1 of 2

৩.১৬ উনিশশতকী বাংলা নবজাগরণের গৌরব ও অপূর্ণতা

৩.১৬ উনিশশতকী বাংলা নবজাগরণের গৌরব ও অপূর্ণতা

মধ্যযুগীয় সমাজ ও চেতনার সঙ্গে তুলনায় আধুনিক যুগকে যুক্তিধর্মিতায় অগ্রসর বলা হয়েছে।

কিন্তু যুক্তিরও ক্ষেত্রভেদ ও প্রকারভেদ আছে। যুক্তিকে অখণ্ড ও অবিভাজ্য মনে করলে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে অসুবিধা দেখা দিতে পারে।

আইনপ্রণয়নে অথবা আধুনিক আমলাতন্ত্রিক সংগঠনে যুক্তির একটা বিশেষ বিকাশ লক্ষ করা যায়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে জন্ম ও জাতিগত মর্যাদার বড় স্থান ছিল। আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের নৈর্ব্যক্তিক পদাধিকার সেই তুলনায় অধিকতর যুক্তিধর্মী–যেমন জেলার প্রশাসক ব্রাহ্মণই হন অথবা নীচুজাতই হন, তাঁর পদাধিকারের তাতে ইতর বিশেষ হয় না। নৈর্ব্যক্তিক বুদ্ধির বিচারে এটা প্রগতির একটা ধাপ। বাণিজ্যে অথবা ব্যবসায়িক। প্রতিষ্ঠানে দেখি যুক্তির অপর এক প্রকাশ। আর্থিক লাভক্ষতির গণনায় একপ্রকার যুক্তি আছে একথা স্বীকার্য। আবার বিজ্ঞানে অথবা প্রকৃতিপাঠেও লক্ষণীয় যুক্তির উল্লেখযোগ্য। জয়যাত্রা।

এই যে বিভিন্ন রকমের যুক্তিপ্রবণতা, এদের ভিতর ঐতিহাসিক সূত্রে কোনো দৃঢ় এবং অচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুমান করে নেওয়া অনুচিত। বৃহৎ সাম্রাজ্যপ্রতিষ্ঠান ও আইনপ্রণয়নে। যে-জাতীয় যুক্তিধর্মিতা আছে তার একটা বড় রকমের বিকাশ ঘটেছিল প্রাচীন রোমক যুগে। অথচ বিজ্ঞানচর্চায় সে-যুগের কীর্তি তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। বরং পূর্ববর্তী গ্রীক যুগ গণিতে ও বিজ্ঞানে এবং দর্শনে ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে অধিকতর ভাস্বর। এটাও দেখানো কঠিন নয় যে, প্রশাসনিক যুক্তি এবং ব্যবসায়িক যুক্তির ভিতর কোনো অঙ্গাঙ্গি যোগ নেই। কোনো যুগে অথবা কোনো সম্প্রদায়ে নিয়মন্ত্রী বুদ্ধির প্রাবল্য দেখা দিলেই যে মানুষের এক অবিভাজ্য যুক্তিপ্রবণতা সেই যুগমানসকে ব্যবসায়ী অথবা প্রযুক্তিসন্ধানী বুদ্ধির দিকে এগিয়ে দেবেই, এমন কথা বলা যায় না।

শাস্ত্রের ভয় ও বাঁধাধরার বন্ধন মানুষের চেতনায় যে অসাড়তার সৃষ্টি করে তাকে অতিক্রম করে সুখের অথবা আনন্দের সন্ধানে যুক্তির একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। মানুষের ভিতর যে-শক্তি তাকে চেতনার স্তর থেকে শুরান্তরে নিয়ে যায় সেই শক্তিকে পরিপূর্ণত যুক্তি নাম দেওয়া চলে কিনা সেটা অবশ্য ভিন্ন ও গভীরতর প্রশ্ন। তবে যুক্তিকে অস্বীকার করলে প্রাচীনের বন্ধনমোচন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যুক্তির আলোর প্রয়োজন আছে আনন্দের সন্ধানেও। এই যুক্তি কখনও ধর্মসমালোচনার রূপ নেয়, কখনও নতুন অধ্যাত্মচিন্তার পথ খুলে দেয়।

ব্যবসায়ে অথবা নিয়মতন্ত্রে যে-যুক্তিকে আমরা পাই তার সঙ্গে বিশুদ্ধ আনন্দসন্ধানী বুদ্ধির কোনো অচ্ছেদ্য ঐক্য নেই। বরং এদের ভিতর যুগবিশেষে বিরোধী সম্পর্কও লক্ষ করা যায়। আনন্দসন্ধানী বুদ্ধিকেই যিনি উত্তম বলে জানেন তিনি অবশ্য বলবেন যে, যুক্তির অপরাপর যে-সব রূপ ও পরিচয় আমরা পাই সে সবই মেকী। এ কথাটাকে হয়তো বিশেষ কোনো দর্শনের জোরে দাঁড় করানো যায়, কিন্তু ইতিহাসের বিশ্লেষণে এতে কাজ চলে না।

ইতিহাসে যুক্তি দেখা দেয় নানা খণ্ডিত ও বিচিত্র রূপে। যে-মানুষ সমাজের মাঝে দাঁড়িয়ে পথ খুঁজে নিতে চায়, একটা গঠিত জীবনযাত্রা এবং ইতিহাসের ভিতর থেকেই তার পরিপার্শ্বকে সে বিচার করে। অতএব সেই অতীতকে যখন সে অতিক্রম করতে চায়। তখনও ভবিষ্যতের ওপর অতীতের ছায়া এসে পড়ে। ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে কোনো গোষ্ঠী অথবা সম্প্রদায় যে-খণ্ডিত যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়, তাতে একই সঙ্গে থাকে বর্তমানের প্রান্তস্পশী পশ্চাকালের অন্তরঙ্গ পরিচয়, আবার সম্মুখের কর্মকাণ্ড তথা নতুন সমস্যার আভাস।

এইভাবে প্রতিযুগই নিজের দ্বারা নিজে অন্তত কিছু পরিমাণে সীমাবদ্ধ। আবার প্রতিযুগকেই সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। ব্যবসায়িক যুক্তি ও নিয়মতন্ত্রী যুক্তি, বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও আনন্দসন্ধানী বুদ্ধি, এসবের ভিতর একটা সামঞ্জস্য সমাজ ও জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য প্রয়োজন। কাঙ্খিত সামঞ্জস্যের প্রকৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে চলে। বাস্তবে একে কখনও পুরোপুরি লাভ করা যায় না। যুক্তির প্রতিটি কাঠামোর একটা নিজস্ব জাড্যগুণ আছে; তা থেকে ভেঙ্গে বেরোবার জন্য একটা বিশেষ শক্তির প্রয়োজন হয়। কোনো একদিকে আতিশয্য, অন্য কোনো দিকে অপূর্ণতা, প্রতিযুগের নিজস্ব পরিচয় বহন করে। এরই ভিতর দিয়ে যুগের বিচার হয়, ভবিষ্যতের নতুন লক্ষ্য আকার ধারণ করে।

মুখবন্ধে এই ক’টি তাত্ত্বিক কথার উপস্থাপন করা গেল। এবার বাংলার উনিশশতকী রেনেসাঁস অথবা নবজাগরণের আর্থিক ও সামাজিক পটভূমিকার দুয়েকটি বৈশিষ্ট্যের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আসা যাক।

বাঙালী হিন্দুসমাজে উঁচু জাত বলতে আমরা ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থকেই বুঝি। নবশাখ ও বণিক এই সমাজে উঁচু জাতের ভিতর গণ্য হয় না। ভারতের সর্বত্র জাতিবিচার একপ্রকার নয়। এই তারতম্যের সামাজিক ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা থাকাই স্বাভাবিক। সে সবের ভিতর যাওয়া এখানে নিষ্প্রয়োজন।

বাঙালী, বিশেষত কলকাতাবাসী, উচ্চজাতের হিন্দুসমাজ থেকে উনিশশতকী নবজাগরণের উদ্ভব। ঐ স্তরের কিছু লোক আঠার শতকের দ্বিতীয় ভাগে ইংরেজের সঙ্গে অল্পবেশী যুক্ত হয়। অধ্যাপক নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ প্রমুখ ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে আমরা দেখি যে, সেই সময়ে ব্যবসায়িক জগতে, কিছুকালের জন্য হলেও, এরা অনেকটা প্রাগ্রসর স্থান লাভ করে। কিন্তু অবস্থার শীঘ্রই পরিবর্তন ঘটে। উনিশ শতকে দেখি বাঙালী। উঁচুজাতের হিন্দুর ব্যবসায়ে সেই স্থান আর নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, উঁচুজাতের বাঙালী হিন্দুরা ব্যবসায় ত্যাগ করলেন কেন আর ত্যাগ করে গেলেন কোথায়?

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাণিজ্যের জন্য এদেশে আসে, তারপর আঠার শতকের শেষ ভাগে ভূমির রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার লাভ করে এবং উনিশ শতকে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত ও সম্প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আসে নতুন ধরনের আইন আদালত, বৃদ্ধিলাভ করে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা, গড়ে ওঠে নতুন প্রশাসনযন্ত্র। এইসঙ্গে উঁচুজাতের হিন্দু বাঙালীর সামনে উন্নতির নতুন পথ ও সুযোগ দেখা যায়। জমিদারি থেকে অর্থাগমের একটা পথ খুলে গিয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে। তার সঙ্গে উচ্চবর্ণের হিন্দু যোগ করতে চেয়েছে কলকাতায় ও অন্যত্র নাগরিক একটা বিশেষ প্রতিষ্ঠা। এই নাগরিক প্রতিষ্ঠা দুই ভিন্ন পথে হওয়া সম্ভব এক, ব্যবসায়ের মাধ্যমে আর দ্বিতীয়ত, সরকারী আইন আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন ব্যবস্থায় চাকুরীর পথে। এই দ্বিতীয় পথটাই উঁচুজাতের হিন্দুর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। এর নানা কারণ ছিল।

ভারতের পূর্বপ্রান্তে যে-সব শিল্প উনিশ শতকে প্রধান হয়ে উঠেছিল, যেমন চা অথবা পাট, তার নির্ভর ছিল বৈদেশিক বাজারের ওপর। ফলে, এইসব শিল্পে কর্তৃত্বলাভ বিদেশী বণিকের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। পশ্চিম দিকে, বোম্বাইকে কেন্দ্র করে, কাপড়ের কলে অবস্থাটা ছিল ভিন্ন। সেখানে বাজার অনেক পরিমাণে স্বদেশী। ফলে ভারতীয় পুঁজি নিয়োগের ওখানে সুবিধা ছিল বেশী। গুজরাতী পারসীরা সেখানে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে।

উঁচুজাতের হিন্দুরা মুসলমান আমলেও প্রশাসনে একটা বড় স্থান অধিকার করেছিল। এক সাম্রাজ্য ভাঙা এবং অন্য সাম্রাজ্য গড়ার মধ্যকালীন সময়ে যদিও কিছুদিনের জন্য ইংরেজ বণিকদের অংশীদার হয়ে তারা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়, তবু তাদের জীবনযাত্রা ও মানসিক প্রবণতা বেশীদিন সেখানে তাদের থাকতে দেয়নি। জমিদারী মেজাজ আর শিল্পপতির প্রয়োজনের ভিতর কিছু কিছু বড় পার্থক্য থাকে। বিশেষত গোড়ার যুগের শিল্পপতিদের শুধু ভোগী এবং বিদ্যোৎসাহী হলেই চলে না। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভিতর নতুন পথে এগোবার আর বড় কাজ হাতে নেবার মতো শক্তি ও কল্পনা ছিল প্রচুর। কিন্তু তিনি ছিলেন আদতে রাজসিক ও ভোগী। একদিকে যেমন তিনি বড় ব্যবসায় গড়ে তোলেন অন্য দিকে তেমনি মৃত্যুর সময় বিপুল দেনা রেখে যান, যার ভার বহন করতে হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথকে।

বাণিজ্যের উত্থানপতন, নিত্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অনিশ্চয়তার চেয়ে প্রশাসনিক পদের স্থায়িত্ব অথবা আইনজীবী ও শিক্ষাবিদের নিরুপদ্রব মর্যাদা ও সংস্কৃত জীবনযাত্রা উচ্চবর্ণের হিন্দুর কাছে অনেক বেশী বাঞ্ছনীয় মনে হয়েছে। প্রসন্নকুমার একসময়ে ব্যবসায়ে বিপদের সম্মুখীন হন। যেহেতু ইংরেজী ভাষা ও আইনশাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর বিলক্ষণ পরিচয় ছিল কাজেই তাঁর সামনে একটি বিকল্প পথ খোলা ছিল। ব্যবসায় থেকে সরে গিয়ে তিনি অর্থ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন আইনের ক্ষেত্রে। পরবর্তীকালে জমিদারির সঙ্গে আইনচচা অথবা প্রশাসনিক চাকুরীর সংযোগটাই জীবিকার সুগম পথ হিসেবে উচ্চাকাঙ্খী বাঙালীরা নিজেদের ও পুত্রদের জন্য গোড়া থেকেই বেছে নিতেন সচরাচর। ইংরেজী। শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শুধু কলকাতা ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই নয়, বিহার থেকে সুদূর পঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বাঙালীরা নতুন শিক্ষাধারার অগ্রদূত হিসেবে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন।

জীবিকার এই সব পথ বহুদিন পর্যন্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছে একরকম বন্ধ ছিল বলা চলে। এর প্রধান কারণ সাংস্কৃতিক বা শিক্ষাগত। হিসেবে দেখা যায় যে, ১৮৮৩-৮৪ সালে, অর্থাৎ রামমোহনের মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরেও, বাংলাদেশের কলেজসমূহে মোট ছাত্রসংখ্যার শতকরা পঁচানব্বই ভাগই ছিল হিন্দু আর এই হিন্দু ছাত্রদের ভিতর শতকরা পঁচাশি ভাগই ছিল উচ্চবর্ণের এর পর তৎকালে সরকারী চাকুরীতে মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুর সংখ্যাল্পতায় আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

উচ্চবর্ণের হিন্দুরা উনিশ শতকে, এমন কি বিশ শতকের গোড়াতেও, কেন শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে অগ্রসর হয়নি, এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণে জমির মালিকানাই অপেক্ষাকৃত লাভজনক ছিল। কিন্তু এই উত্তরটা সম্ভবত যথেষ্ট নয়। প্রশ্নটা এই নয় যে, বাঙালী নব্য মধ্যবিত্তগণ জমিদারির প্রতি আকৃষ্ট হল কেন। জমিদারির সঙ্গে শিল্প অথবা ব্যবসায় যোগ করা যায়, যেমন যোগ করা যায় ওকালতি অথবা সরকারী চাকুরী। প্রশ্নটা এই যে, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এই দ্বিতীয় সংযোগটাই বেছে নিল কেন? জনসংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জমির ভাগবণ্টনের ফলে উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের জমি থেকে আয়ের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কমতে থাকে। কিন্তু চাকুরীকে আঁকড়ে ধরার প্রবৃত্তি অথবা অভ্যাস ততদিনে দুর্মর হয়ে উঠেছে। অথচ কিছু অবাঙালী তো বটেই, নিম্নবর্ণের বাঙালী হিন্দুদের ভিতরও কোনো কোনো সম্প্রদায় ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নিজেদের জীবিকার উপায় করেছে। তাদের সামনে অন্যপথ বড় বেশী ছিল না। উনিশ শতকের গোড়ায়, পথ বেছে নেবার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে, উচ্চবর্ণের হিন্দুর সামনে শহরে সরকারী চাকুরীর অন্যপথ খুলে গিয়েছিল। যদি তা না হত, যদি কোনো কারণে ঐ পথটি হিন্দুর কাছে বন্ধ এবং মুসলমানের কাছেই উন্মুক্ত হত, তবে সেই কল্পিত ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে উচ্চবর্ণের হিন্দুকেও সম্ভবত ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেই আরও উদ্যোগী দেখা যেত। বাঙালী মুসলমান যে সেইদিকে অগ্রসর হয়নি তার অন্তত আংশিক কারণ তৎকালীন মুসলমান সমাজে মধ্যবিত্তশ্রেণীর অভাব। যাই হোক কল্পিত ইতিহাস নিয়ে অনুমানের চেষ্টা বেশীদূর না। করাই ভালো। বাস্তব পরিস্থিতিতে উচ্চবর্ণের হিন্দু যে-পথ বেছে নিয়েছে, যে-যুক্তির অনুসরণ করেছে, সেটাই আলোচ্য। এই পথনির্বাচন বিশুদ্ধ আর্থিক গণনা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ হিন্দুর বংশানুক্রমিক যে-ঐতিহ্য, বিভিন্ন বৃত্তি ও পদের। সামাজিক মর্যাদা সম্বন্ধে তাদের যা ধারণা, সেদিনের ইতিহাসে তাদের সাংস্কৃতিক যে-অভিলাষ বা দিগন্তবোধ, এই সব মিলেই তাদের চলবার পথও নির্দিষ্ট হয়েছিল।

যে-নাগরিক সম্প্রদায়ে উনিশশতকী নবজাগরণের উদ্ভব তার আর্থিক ও সামাজিক পটভূমিকা সম্বন্ধে সংক্ষেপে দুয়েকটি কথা বলা গেল। এবার সেই নবজাগরণের বৌদ্ধিক। ও সাংস্কৃতিক চরিত্র নিয়ে আলোচনা আবশ্যক।

.

হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মের নবমূল্যায়ন উনিশশতকী নবজাগরণের প্রথম পর্বের একটা মূল বৈশিষ্ট্য। ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে ভিতর থেকে একটা প্রতিবাদ, অথবা ধর্মের সত্যকে নব উপলব্ধির দ্বারা নতুন রূপে আবিষ্কারের প্রচেষ্টা, অবশ্য পূর্বেও ঘটেছে। বর্ণভেদ ও আচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বারবার দেখা দিয়েছে। বুদ্ধ এবং চৈতন্যের মতো প্রচারকেরা সম্যক জ্ঞান এবং ভক্তি অথবা প্রীতিকে ধর্মের সারবস্তু বলে চিনেছেন ও চিনিয়েছেন।

তবু উনিশশতকী নবজাগরণে ধর্মের নবমূল্যায়নের যে-প্রচেষ্টা তার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। বিদেশী বণিক ও ধর্মর্যাজক যখন এদেশের মাটিতে দলে দলে উপস্থিত হল তখন বিশ্বজগৎ এবং অপরাপর ধর্মমত ও ধর্মসমালোচনা আমাদের চৈতন্যের কাছে। এমন একটা চমক এমন কি আঘাত পৌঁছে দিল যাতে ঐতিহাসিক নতুনত্ব ছিল। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা পাই রামমোহনের মত চিন্তার নেতাদের কাছ থেকে ধর্মের যুক্তিবাদী পর্যালোচনা। রামমোহন বিভিন্ন ধর্ম যত্নের সঙ্গে পাঠ করে দেখলেন যে, বিভিন্ন ধর্মের ভিতর কিছু বৈসাদৃশ্য আছে আবার সাদৃশ্যও আছে। তিনি বললেন যে, ধর্মের যেটা মূল সত্য, যেটা সর্বমানবের, সেখানেই বিভিন্ন ধর্মের ভিতর সাদৃশ্য; আর ধর্মের যে-অংশটা আচার ও অন্ধবিশ্বাসকে নিয়ে, সেখানেই দেখা যায় পরস্পর বিরোধ। এই যে নানা দেশের মানুষ ও তার সংস্কৃতি সম্বন্ধে সজাগ চেতনা ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ববিচার আর সেই সঙ্গে যুক্তির ভিত্তিতে একটা সর্বমানবীয় সত্যের দিকে অগ্রসর হবার আকাঙ্খ, এতে আধুনিক যুগের একটা বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথ ও কেশব সেনের ধর্মচিন্তার অবশ্য অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। আধুনিক বিজ্ঞান যতই মানুষকে জড় প্রকৃতির অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করে ততই মানুষের আধ্যাত্মিক প্রশ্ন একটা নতুন রূপে উপস্থিত হয়। প্রকৃতির নিয়মবদ্ধতা আর মানুষের আন্তরিক মুক্তির কামনা এদুয়ের ভিতর কি করে সামঞ্জস্য স্থাপন করা যায়, এই অনুসন্ধান দেবেন্দ্রনাথের ভিতর একটা ব্যক্তিগত আকুলতা নিয়ে দেখা দেয়।

উনিশশতকী নবজাগরণে ধর্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে সমাজসংস্কারের যোগ হয়। দুটি মূল প্রশ্ন। অনেকখানি আলোড়ন সৃষ্টি করে প্রথমটি নারীর স্বাধীনতা নিয়ে, দ্বিতীয়টি ব্রাহ্মণের অগ্রাধিকার ও জাতিভেদসংক্রান্ত। সতীদাহনিবারণ ও বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতির ভূমিকা সবাই জানেন। নারীর শিক্ষালাভের অধিকার সাধারণভাবে শুধু উদারপন্থীরাই নয় রক্ষণশীলদের ভিতরও অনেকে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ঘরের বাইরে যে বৃহৎ ও বিচিত্র জগৎ সেখানে নারী স্বাধীনভাবে নিজের স্থান বেছে। নিতে পারবে কি না, এটা ছিল বিতর্কিত বিষয়। ব্রাহ্ম আন্দোলনের ভিতরও এ ব্যাপারে মতের গভীর ও তীব্র পার্থক্য ছিল, পিতাপুত্র দেবেন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের ভিতর যার প্রতিফলন সুপরিচিত। এ কথা স্বীকার্য যে, নারীর এই স্বাধীনতার অধিকার বৃহত্তর সমাজ মেনে নিতে পারেনি। জাতিভেদের ক্ষেত্রেও রক্ষণশীলেরাই দলে ভারী ছিল। কিন্তু এই প্রশ্ন নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা ও বিতর্ক, উনিশশতকী নবজাগরণের কাছে এইজন্য আমরা ঋণী।

এক শতকের ভিতর বাংলাসাহিত্যে যে বহুমুখী পরিবর্তন দেখা যায় সেটা চমকপ্রদ। ধর্ম ও সমাজসংস্কার নিয়ে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের যুগে যে বিতর্ক তারই ভিতর দিয়ে আধুনিক বাংলা গদ্য ও প্রবন্ধসাহিত্যের সূত্রপাত। এ জাতীয় জিনিস পূর্বে বাংলা সাহিত্যে ছিল না। সেই সঙ্গে দেখা দেয় তৎকালীন সমাজ ও সংস্কৃতিকে একটু দূরত্ব রেখে। সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখবার বিশেষ মানসিকতা এবং সাহিত্যে তার প্রতিফলন। প্রবন্ধে, প্রহসনে, নাটকে পাওয়া যায় এই দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ। দেবদেবীর স্তুতি ও মাহাত্মকীর্তনের একটা আবরণ অন্তত রক্ষা করতে এতদিন অভ্যস্ত ছিল বাংলা সাহিত্য, তা নইলে কাব্যে মঙ্গল কোথায়, স্থায়িত্ব কোথায়? এবার সেই আবরণ পরিত্যক্ত হল, মানুষ ও সমাজকে আপন মর্যাদায় সাহিত্যের বিষয়বস্তুরূপে সরাসরি গ্রহণ করা হল, বাংলা উপন্যাসের জন্ম হল। পুরাণ ও মহাকাব্যের চরিত্রগুলি ফিরে এলো নতুন যুগ ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রেক্ষিতে আধুনিক অর্থ ও ব্যঞ্জনা বহন করে, মধুসূদনের কাব্যে যার উদাহরণ। এই সবের ভিতর দিয়ে আরও দৃঢ় একটি পরিবর্তন সাহিত্যে লক্ষ করা যায়। পুরনো ঐতিহ্যে বিশেষ বিশেষ অঙ্গ ও পরিস্থিতির বর্ণনার জন্য কিছু গৃহীত উপমা ও বাক্যাংশ। ছিল, যার যথাযথ ব্যবহার লেখকের কারিগরিতে প্রধান হয়ে উঠত। যেহেতু নতুন যুগের সার্থক লেখকের উদ্দেশ্য শুধু ঐতিহ্যকে ভাষা দেওয়াই নয় বরং একটা ভিন্ন ও বহুপরিমাণে ব্যক্তিগত ভাবনাকে মৃর্তিদান করা, অতএব নতুন শব্দ ও রচনাশৈলীর সচেতন

সাধনা কাব্য ও সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হয়ে উঠল। ব্যক্তির মূল্য, অথবা রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন, ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিকের চিত্রাঙ্কনে ও অনুভূতিতে একটা বিশেষ মূল্যলাভ করল। মধুসূদন বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, বিশেষত নারীর চরিত্রচিত্রণে, এটা পরিস্ফুট। সাহিত্যে নবজাগরণের আর একটি সার কথা এই যে, বাংলাসাহিত্য এবার বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হল। বিশ্বসাহিত্যের দিকে মনের একটা জানালা খোলা রাখা, বাইরের সেই প্রভাবকে নিজের মনে গ্রহণ করে তাকে ক্রমাগত নতুন শিল্পবস্তুতে পরিণত করা, সাহিত্যিকের স্বধর্মের অঙ্গ বলে স্বীকৃত হল।

উনিশ শতকের প্রথম ভাগের সঙ্গে শেষভাগের সুরের একটা অমিল অবশ্য অনেকেই লক্ষ করেছেন। রামমোহন ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে পুনরাবিষ্কৃত করেন উপনিষদের যুগের আলোতে। পরে গীতা প্রাধান্য লাভ করে, শিবাজী ও রাণা প্রতাপ কাব্যে ও রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশ করেন। স্বাদেশিকতার অভ্যুত্থান ও শক্তিবৃদ্ধির ফলে সমাজসমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে স্বজাতিস্তুতিও লেখক ও বুদ্ধিজীবীর কর্তব্যের অংশ হয়ে পড়ে। বিদ্যাসাগর সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। দেশের মানুষের প্রতি যথার্থ প্রেমেরও তাঁর সীমা ছিল না। সাহসে ও সহানুভূতিতে তাঁর স্বাদেশিকতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু প্রাচীন ধর্ম অথবা শাস্ত্রের মাহাত্মপ্রচার তিনি আবশ্যক মনে করেননি। বরং ইংরেজী সাহিত্য এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় লাভ করে দেশীয় পণ্ডিত ও চিন্তকেরা মুক্তমনে এদেশের প্রাচীন শাস্ত্রের সমালোচনা করবেন, দেশের উন্নতির জন্য এই রকমই প্রয়োজন বলে তিনি মনে করতেন। যতদিনে আমরা বিবেকানন্দের যুগে এসে পৌঁছই। ততদিনে দেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবীর চিত্তপ্রবৃত্তি দুয়েরই অনেকখানি পরিবর্তন ঘটে। গেছে। কিন্তু যে যুক্তিধর্মিতাকে নিয়ে উনিশশতকী নবজাগরণের শুরু তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্রের মাহাত্ম্য দেখিয়েছেন। কিন্তু তার সঙ্গে পুরানো যুগের কৃষ্ণমাহাত্মকীর্তনের কত তফাৎ! বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধসাহিত্য যুক্তিধর্মী রচনাশৈলীর উজ্জ্বল উদাহরণ। কঁৎ ও সেই যুগের বাস্তবাশ্রয়ী চিন্তাধারা বঙ্কিমমানসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তৎকালীন প্রাগ্রসর দর্শনকে অস্বীকার করে নয়, বরং একপ্রকারে তাকে আত্মসাৎ করেই, বঙ্কিম তাঁর অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল চিন্তাভাবনাকে সাজাতে চেষ্টা করেছেন। বিবেকানন্দের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সংযোগ প্রশ্নাতীত। তবে মানুষের চেতনার বিবর্তনে অবিশ্বাসেরও যে একটা বিশেষ স্থান আছে, একথা তিনি জানতেন। তিনিও আধুনিক চিন্তার সঙ্গে পরিচিত। স্বাজাত্যের সঙ্গে মিশিয়ে মানবতাবাদকে তিনি পরালেন অন্য এক বেশ, দরিদ্রনারায়ণের সেবা।

উনিশশতকী নবজাগরণ একদিন ধর্ম ও সমাজসংস্কার, শিল্প ও সাহিত্য, সবকিছুকে ব্যাপ্ত করে শুরু হয়েছিল। ধর্ম ও সমাজসংস্কারে তার প্রভাব তেমন গম্ভীর হয়নি, তবে ভারতের অন্যান্য বহু অংশের তুলনায় জাতিভেদ ও ধর্মান্ধতা এখনও বাঙ্গালীদের ভিতর তেমন কট্টর ও প্রবল নয়। অবশ্য অন্য কারণও আছে। নবজাগরণের স্থায়ী প্রভাব পড়েছিল বাঙ্গালীর সাহিত্যে। এবং মূল্যবোধে, বুদ্ধিমুক্তির মূল্য সম্বন্ধে একটা সচেতনতায়। এই মূল্যবোধও আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ পরাজিত হয়নি। বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন এই শতকের প্রথমভাগে পূর্ববাংলার মুসলমান চিন্তানায়কদের একাংশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই আন্দোলনের একটি ধারা সংকটের ভিতর দিয়ে আজও, বিশেষত কবি লেখকদের ভিতর দিয়ে, বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।

.

অর্থাৎ, উনিশশতকী নবজাগরণ প্রধানত চাকুরীজীবী মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে উদ্ভুত হলেও, সেই সামাজিক সীমার দ্বারা বহু পরিমাণে খণ্ডিত ও বিকৃত হলেও, তার ভিতর একটা মূল্যায়িত ও অসামান্যতা ছিল। বাঙালীর যদি আজ কোনো বিশেষ পরিচয় থাকে তো উনিশশতকী নবজাগরণকে অনুক্ত রেখে সেই পরিচয় উচ্চারণ করা যায় না।

তবু যে বাঙালী মধ্যবিত্তের একাংশ সেই নবজাগরণকে অবজ্ঞা করতে চাইছে, তার অবমূল্যায়নের চেষ্টা করছে, তারও নিশ্চয়ই কারণ আছে। মোটাভাবে বলতে গেলে কারণটা সম্ভবত এই রকম। নবজাগরণ সত্ত্বেও বাংলার দুরবস্থা ঘোচেনি, আর্থিক সংকট থেকেই গেছে। বাংলার কৃষক দারিদ্র্য ও অত্যাচারে পীড়িত; শিক্ষিত যুবকদের ভিতর বেকারী ব্যাপক; বাংলার অর্থনীতি দ্রুত উন্নয়নের গতি লাভ করেনি এসব কথা স্বীকার্য। কিন্তু প্রশ্ন তবু থেকে যায়।

আরও কয়েক শতাব্দী আগে, অর্থাৎ পনের শতকে, ইতালীর বিখ্যাত রেনেসাঁসের কথা আমরা জানি। সেই রেনেসাঁসের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করা হয়ে থাকে। মনে রাখা ভালো, ইতালীর আর্থিক সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান সেদিন হয়নি। বরং বিশ শতকের গোড়াতেও ইতালী আর্থিক দৃষ্টিতে ইয়োরোপের পশ্চাৎপদ দেশের ভিতরই গণ্য ছিল। পনের শতকের নবজাগরণও শহরকেন্দ্রিক ছিল। ইতালীর দরিদ্র চাষী তারপরও দরিদ্রই থেকে গেছে। তবু যে সেই নবজাগরণের একটা মূল্য স্বীকার করা হয়েছে তারও তো একটা কারণ আছে।

আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে রেনেসাঁস একটা নতুন চেতনা যোগ করেছিল। মানুষ যে সমাজে কোনো একটি পূর্বনির্দিষ্ট স্থান নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, ব্যক্তি-মানুষ যে বিচিত্র সম্ভাবনাকে বহন করে আনে এবং নানা অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে একটি নিজস্বতা ও অনন্যতা লাভ করে, এই অনন্যতার যে একটি বিশেষ মূল্য আছে, মানুষের সৃজনীশক্তি ও স্বাধীনতার অর্থ উদঘাটনে এই মূল্যবোধ যে একান্ত প্রয়োজন, আবার প্রতিটি ব্যক্তি এই অর্থে বিশেষ হয়েও যে বিশ্বমানবের সঙ্গে। মানুষের অধিকারে যুক্ত, এই রকম কয়েকটি কথা রেনেসাঁসের মূল বাণী হয়ে আছে। সমাজ ও চেতনার অভিব্যক্তির কোনো একটি স্তরে এই কথাগুলি স্পষ্টভাবে উচ্চারিত না। হলে একটা বড় অভাব থেকে যায়। সমাজের সমস্ত সমস্যার এতে সমাধান হয় না, বরং বহু সমস্যা এরপরও থেকে যায়। তবু নবজাগরণের আধারে বিধৃত এই বিশেষ মূল্যবোধের একটা স্বতন্ত্র সার্থকতা আছে, কারণ এছাড়া বিশ্বমানবের সংস্কৃতি অসম্পূর্ণ। এ ব্যাপারে আমাদের মনে একটা শ্রদ্ধা রাখাই ভালো। কোনো সমাজের আর্থিক অভাব পূর্ণ হলেই তার সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে ওঠে না। সে জন্য একটা বিশেষ ঐতিহ্য চাই। রেনেসাঁস সেই ঐতিহ্যের নির্মাণে মহান সহায়ক, অতএব শ্রদ্ধেয়। তার কাছ থেকে কতটা আশা করা যায় আর কতটা যায় না, এ বিষয়ে সজাগ থেকেও তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রক্ষা করা সম্ভব। ইতালীয় রেনেসাঁস ও বাংলার নবজাগরণের ভিতর, বলা বাহুল্য, দেশকালের ব্যবধানে নানা পার্থক্য আছে। কিন্তু আধুনিক বাংলার বিবর্তমান ঐতিহ্যে রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র ও মধুদূদন, দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র এবং আরও অনেকে মানবতাবোধ ও বুদ্ধিমুক্তির সমন্বিত যে আদর্শ যোগ করে গেছেন তাকে মূল্য না দিলে অকারণে আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে দরিদ্র করা হবে।

ইয়োরোপে পনের শতকের নবজাগরণের পর এসেছিল পিউরিটান আন্দোলন। মেজাজে সেটাকে বলা যেতে পারে রেনেসাঁসের অনেকটা বিপরীত। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সেটা বিপদ ঘটায়। কিন্তু এ রকম খণ্ড খণ্ড করে দেখলেও বিচার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মধুর জিনিসটা ভালো, তবু লবণ ও কিছুটা তিক্তৈরও প্রয়োজন আছে, যদিও মনে হতে পারে শেষের দুটি প্রথমটির বিপরীত। মাত্রা রক্ষা করাটাই প্রধান কথা। ইয়োরোপের নাগরিক জীবন ঐ আপাত বিপরীতের প্রভাবেই গঠিত হয়েছিল। বাংলার উনিশশতকী নবজাগরণের ইতিহাসেও এর খানিকটা প্রতিতুলনা পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথ যে-ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করেন তাতে ‘পিউরিটান’ ভাবধারার বিশেষ স্থান ছিল। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এমন কি রবীন্দ্রনাথের জীবনেও কিছু পরিমাণে এর প্রভাব দেখা যায়, যদিও রবীন্দ্রনাথ মূলত অন্যভাবের ভাবুক। দ্বারকানাথের জীবনে ভোগের যে আতিশয্য ছিল অথবা দীনবন্ধু মিত্রের লেখায় উনিশশতকী কলকাতার যে সামাজিক চিত্র পাওয়া যায়, তার বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিরোধ প্রত্যাশিত। দেবেন্দ্রনাথ জোর দিয়েছিলেন নিরলস অধ্যবসায় ও আত্মসংযমের ওপর। তবে যে-বাস্তব অবস্থার সঙ্গে যোগাযোগে এই শিক্ষা বড় আকারে ফলপ্রসূ হতে পারত সেই অবস্থা সেদিন দেশে ছিল না।

সামাজিক যে আধারে উনিশশতকী বাঙলা নবজাগরণের জন্ম ও বৃদ্ধি তার অপর একটি পরিণাম এই সঙ্গে উল্লেখ্য। ভারতের পশ্চিম উপকূলে নবজাগরণের যাঁরা নেতা তাঁদের ভিতর অনেকেই একটি কথার ওপর জোর দিয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক অথবা বৌদ্ধিক আন্দোলনের সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন ও গঠনমূলক কাজের একটা সমম্বয় ও পরিপূরকতা থাকা প্রয়োজন। বঙ্গদেশে অন্যান্য সব কিছু ছাড়িয়ে রাজনীতিটাই ক্রমশ বড় হয়ে উঠল। এই পলিটিক্স-প্রমত্ততার বিপদ রবীন্দ্রনাথকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছিল। তিনি দেখেছিলেন যে বাংলার নবজাগরণ তার কল্যাণবুদ্ধি হারিয়ে ক্রমে দলাদলি ও উত্তেজনার শিকার হয়ে পড়ছে।

নবজাগরণের আরো একটি দুর্বলতা রবীন্দ্রনাথ যেমনভাবে বুঝেছিলেন এদেশের স্মরণীয়দের ভিতর তার তুলনা পাওয়া কঠিন। তিনি বুঝেছিলেন যে, গ্রামবাংলায় যদি না নতুন জীবন সৃষ্টি করা যায় তবে বাংলার সার্থক নবজীবন সম্ভব নয়। অতএব কলকাতার। নাগরিক নিবাস ত্যাগ করে বীরভূমের পল্লী অঞ্চলে তিনি তাঁর কর্মকেন্দ্র বেছে নেন। নবজাগরণের উৎপত্তি অনিবার্যভাবে নগরে। কিন্তু নগর থেকে পল্লীতে যদি তার ব্যাপ্তি না ঘটে তবে তার ক্ষয় অনিবার্য।

কথাটা উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। রেনেসাঁসের যুক্তি ও প্রাণবস্তু মূলত আনন্দধর্মী। উনিশ শতকের বাংলায় এই আনন্দধর্মী জীবনদর্শনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল চাকুরীজীবী মধ্যবিত্তের বুদ্ধি। এই যোগাযোগে সামাজিক সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান ছিল না। ইংরেজী শিক্ষা যতদিন স্বল্পলোকের ভিতর সীমাবদ্ধ ছিল ততদিন। বড় কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। উনিশ শতকের শেষভাগে মুসলমানদের ভিতরও ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন হল। ক্ৰমে বাঙ্গালী অবাঙ্গালী, হিন্দু মুসলমান ইংরেজী শিক্ষিতদের সংখ্যাবৃদ্ধি হয়ে চলল। ফলে সরকারী চাকুরী নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা বৃদ্ধি পেল। সীমাবদ্ধ শহুরে চাকুরীর জন্য এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমশ সামাজিক জীবনকে তিক্ত ও বিষাক্ত করে তুলল। এরই অন্যতম পরিণাম, নাগরিক মধ্যবিত্তদের ভিতর বিশ শতকের গোড়ায় চরমপন্থী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাদুর্ভাব। প্রাগ্রসর ও অনগ্রসর গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ভিতর চাকুরী নিয়ে কাড়াকাড়ি, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব, আমাদের সমাজে সেই থেকে একটি দুষ্ট ক্ষতের মতো আজও জেগে আছে।

রবীন্দ্রনাথ রেনেসাঁসের সন্তান। তাঁর অন্তরতম প্রেরণাটি আনন্দধর্মী! কিন্তু তিনি এটা স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন যে, এই আনন্দধর্মী বুদ্ধিকে রক্ষা করা যাবে না একান্ত নাগরিক সীমানায়, সরকারী চাকুরীজীবীদের নিয়মন্ত্রী কোলাহলে আর হতাশ তরুণদের পথভ্রষ্ট সন্ত্রাসবাদের সন্দিগ্ধ পরিবেশে। পল্লীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সংস্কৃতি ও অর্থনীতির এক নতুন সমন্বয় এ জন্য প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে নবজাগরণের বাণী গ্রামবাংলায় কিছু পরিমাণে সার্থক করে তুলতে হলেও গ্রামীণ অর্থনীতির মৌল পরিবর্তন ও পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন।

উনিশশতকী নবজাগরণ যদিও শ্রদ্ধেয় তবু নিজেকে রক্ষা করবার শক্তি তার নিজের ভিতর ছিল না। তাকে রক্ষা করবার জন্যই তার অপূর্ণতা স্বীকার করে নিতে হয়। নবজাগরণের ধারাকে ব্যাপ্ত করতে না পারলে তাকে রক্ষা করাও যাবে না। তাকে ব্যাপ্ত করা যাবে না গ্রাম ও শহরের বিন্যাস ও পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন ছাড়া। এটা বড় কাজ। এই কাজটা সামনে রেখে চিন্তা করলে অনেক প্রশ্নই অন্যভাবে দেখা দেয়। কর্মের পরিধির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নবজাগরণের চরিত্রেরও পরিবর্তন অনিবার্য। রেনেসাঁসচিন্তাকে নতুন ভাবে ভাবিত হতে হবে। আনন্দিনী বুদ্ধি আর ব্যবসায়িকী বুদ্ধির একটা নতুন সমম্বয়ের সময় এসেছে। যুগের এই প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের নতুন করে চিনে নিতে হবে। প্রতিযুগই পূর্বপুরুষদের ও পূর্বঐতিহ্যকে পুনরাবিষ্কার করে তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে।

আমাদের আগামী দিনের ইতিহাস উন্মুক্ত হবে না কোনো অতিক্রান্ত আন্দোলনের অনুসরণে। একথা পুনরায় বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, রেনেসাঁস ও নবজাগরণ এক। বস্তু নয়। ইয়োরোপের ইতিহাসে রেনেসাঁস এনে দিয়েছিল ব্যক্তিত্ব–অথবা, ব্যক্তির অদ্বিতীয়তা–এবং মনুষ্যত্ব–কিংবা, মানুষের সাধারণ ধর্ম–এ দুয়ের ভিতর একটা সামঞ্জস্যের সন্ধান প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের অন্যতম ফল সেই অনলসতা ও নিয়মনিষ্ঠা, পশ্চিমী সমাজের জাগতিক উন্নতিতে যেটা সহায়ক হয়েছিল। আঠারশতকের যুক্তির যুগের বাণী এই যে, যুক্তি ও বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ শতাব্দীর অন্ধতার বন্ধন কাটিয়ে প্রগতির অন্তহীন পথ খুলে দিতে পারে। এই তিন আন্দোলনের ফল যেন আমরা বাংলার উনিশশতকী নবজাগরণের কাছ থেকে একই সূঙ্গে আশা করেছি। সেই আশা পূর্ণ হওয়া সম্ভব ছিল না, সম্ভব নয়। আর্থিক ও সামাজিক উন্নতির নতুন পথ আজ রচিত হবে না পূর্বতন কোনো শিল্পোন্নয়নের অনুসরণে। যুক্তি ও মুক্তির ধারণারও ক্রমাভিব্যক্তি আছে। মানুষ তার মনুষ্যত্বকে আবিষ্কার করবে নব নব রূপে। তবু অতীতের কিছু জিজ্ঞাসা, কোনো কোনো মূল্যবোধ, আশা করা যায় সহায়ক হবে ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নিতে। নবজাগরণের সদর্থ সেইখানে।

গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *