1 of 2

৩.১৫ বাংলার নবজাগরণ ও আজকের সংকট

৩.১৫ বাংলার নবজাগরণ ও আজকের সংকট

আচারশাসিত সমাজে রামমোহন যুক্তিধর্মিতার একটি প্রবাহ সৃষ্টি করেছিলেন। সেই স্রোত সমাজের বেশী গভীরে প্রবেশ করেনি। সে কথা ভিন্ন। তার কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। কিন্তু ভট্টাচার্যের সহিত বিচারে যে রামমোহনকে আমরা পাই, তৎকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির পটভূমিকায় নির্ভীক যুক্তিধর্মিতাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর দেশবাসীর জন্য এমন একটি ঊর্ধ্বলোকে জাগরণ প্রার্থনা করেন, যেখানে চিত্ত ভয়শূন্য, জ্ঞান মুক্ত এবং যেখানে “বিচারের স্রোতঃপথ অবলুপ্ত নয় “আচারের মরুবালিরাশিতে তখন কবির সেই চিন্তার পিছনে আমরা যেন রামমোহনের একটি মূর্তি প্রত্যক্ষ করি। রামমোহন ধর্ম ত্যাগ করেননি। ধর্মের উত্তরাধিকার নিয়ে তাঁর জন্ম; সেই ধর্মকে যুক্তি দিয়ে বিচার ও পরিশুদ্ধ করে তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন।

আচারের শাসন থেকে বিচারের মুক্তিতে আরোহণই যেমন রামমোহনের বৈশিষ্ট্য, যুক্তিবাদ থেকে অধ্যাত্মবাদে উত্তরণ তেমনই দেবেন্দ্রনাথের চৈতন্যের বিবর্তনে প্রধান ঘটনা। দেবেন্দ্রনাথ গ্রাম্য পরিবেশে শৈশব অতিবাহিত করেননি। পশ্চিমী যুক্তিবাদকে তিনি সহজ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মতনই লাভ করেছিলেন। সেই যুক্তিবাদ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানে বিশ্বাসী এবং জগতের সামগ্রীকে উপকরণ হিসেবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এই চিন্তা দেবেন্দ্রনাথকে শাস্তি দিতে পারেনি।

আত্মজীবনীতে দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন “আমি য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্র বিস্তর পড়িয়াছিলাম। কিন্তু এত করিয়াও মনের যে অভাব, সেই অভাব! তাহা কিছুতেই ঘুচাইতে পারিলাম না। …ভাবিলাম, প্রকৃতির অধীনতাই কি মনুষ্যের সর্বস্ব? তবে তো গিয়াছি! ইহার নিকট নতশিরে থাকাই যদি চরম কথা হয় তবে তো গিয়াছি। আমাদের আশা কৈ, ভরসা কে?” (শ্ৰীমন্মমহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, তৃতীয় সংস্করণ, পৃঃ ৪৯) যে অধ্যাত্মচিন্তায় দেবেন্দ্রনাথ অবশেষে শান্তি লাভ করেন তার বিশদ আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। সেই চিন্তার একটি মূল কথা এই মানুষ উপকরণ সংগ্রহ করে ও প্রয়োজন মতো তার পুনর্বিন্যাস করে, একে বলা যায় রচনা। রচনা এবং সৃষ্টি এক নয়। মানুষ রচনা করে, ভগবান সৃষ্টি করেন। সেই সৃষ্টির রহস্য মানুষের অজ্ঞাত। সৃষ্টির রহস্যে বিশ্ব অনন্ত বিস্ময়কর। দেবেন্দ্রনাথের ভাষায়। “আমরা, সকল উপকরণ সংগ্রহ করিয়া রচনা করি; তিনি, তাঁহার ইচ্ছায় সকল উপকরণ। সৃষ্টি করিয়া রচনা করেন। তিনি জগতের কেবল রচনা কতা নহেন…তিনি ইহার সৃষ্টিকর্তা। ..আবার আমি একাগ্র মনে অগণ্য গ্রহনক্ষত্র খচিত এই অনন্ত আকাশের উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম, এবং অনন্তদেবকে দেখিলাম। এছাড়া ভগবানের স্বরূপ নির্ণয়ের। জন্য দেবেন্দ্রনাথ আরও কিছু যুক্তি ব্যবহার করেন, যেসব বহু পরিমাণে পশ্চিমী দর্শনশাস্ত্র। থেকে গৃহীত, যার উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন।

দেবেন্দ্রনাথের অধ্যাত্মচিন্তার কিছুটা যে আভাস দেওয়া গেল তার একটা কারণ। আছে। রামমোহন ও দেবেন্দ্রনাথের অধ্যাত্মচিন্তার আস্বাদ ঠিক এক নয়। সাধারণের সমক্ষে শাস্ত্রের পর্যালোচনা ও যুক্তিতর্কের সাহায্যে রামমোহন সকল মানুষের গ্রাহ্য একটি সাধারণ ধর্মমতে পৌঁছতে চেষ্টা করেছিলেন। রামমোহনের স্বরচিত ব্রহ্মসঙ্গীতেও যেন। তত্ত্বের আধিক্য। তুলনায় দেবেন্দ্রনাথের ভিতর রহস্যাভূতি ও ব্যক্তিগত উপলব্ধির প্রাধান্য, যদিও উপনিষদের প্রতি তিনিও শ্রদ্ধাবান। এই পার্থক্য পরবর্তীকালে গুরুত্ব অর্জন করে।

বিপিনচন্দ্র পাল এই পার্থক্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখেন “রাজা রামমোহন রায়) একান্তভাবে শাস্ত্র প্রামাণ্য বর্জন করেন নাই। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ..শুদ্ধ ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির উপরে ঐকান্তিকভাবে সত্যাসত্য ও ধর্মাধর্ম মীমাংসার ভার অর্পণ করেন। …কিন্তু এই স্বানুভূতি প্রতিষ্ঠিত ধর্মকে তিনি উপনিষদের শ্রুতির আশ্রয়ে স্থাপন করিতে যাইয়া একপ্রকারের শাস্ত্রপ্রামাণ্যও প্রদান করেন। “ মূল প্রশ্নটি এই ধর্ম বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিলে সেই সংশয়ের নিরাকরণ করবেন কে, কী ভাবে? ইউরোপে রেনেসাঁসের যুগে এই প্রশ্ন উঠেছিল এ দেশেও অনিবার্যভাবে একই প্রশ্ন দেখা দিল। দুই বিপরীতমুখী উত্তরও পাওয়া গেল। একদল ধর্মকে “শাস্ত্র প্রামাণ্যর ওপর স্থাপন করতে চাইলেন, এ নয় তো সমাজে ঐক্যবন্ধন বলে কিছু থাকবে না। যুগ যুগ সঞ্চিত শাস্ত্রার্জিত জ্ঞানই নির্ভরযোগ্য। আবার কেউ কেউ বললেন যে “স্বানুভূতিই বিশ্বাসের ভিত্তি, নয় তো ওটা যথার্থ বিশ্বাসই নয়, অন্যসাধারণের অন্ধ অনুকরণ মাত্র। রবীন্দ্রনাথ এই দ্বিতীয় মতের মানুষ ছিলেন, অন্তত সেদিকেই ছিল তাঁর ঝোঁক। তাই তিনি লিখেছিলেন “আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শিল্পসাহিত্যে যেমন ধর্মমতেও তেমনি, যা গোষ্ঠীগত তার মূল্য সামান্যই। প্রকৃতপক্ষে এটা পরস্পর অনুকরণের সংক্রামতা ছাড়া আর কিছু নয়।”

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, প্রথম মতটিই আমাদের সমাজে প্রাধান্য পেয়েছে। যাঁরা মনে মনে দ্বিতীয় মতে বিশ্বাসী তাঁরাও বাইরের আচরণে রক্ষণশীল থেকে গেছেন প্রধানত। দেবেন্দ্রনাথ নিজেই এ ব্যাপারে উদাহরণস্বরূপ। পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ পিতা সম্বন্ধে Frezca “My father, though an uncompromising enemy of idolatrous worship, was essentially conservative in his instincts.” (The Autobiography of Maharshi Debendranath Tagore, tr. by Satyendranath Tagore and Indira Devi, Macmillan, London, p. 16)

ধর্মের তাত্ত্বিক প্রশ্নে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন “চরমপন্থী” পৌত্তলিকতা বা মূর্তিপুজোর ব্যাপারে তাঁর বিরোধিতা ছিল অখণ্ড এবং সংশয়হীন। কিন্তু হিন্দুসমাজের প্রচলিত বর্ণভেদপ্রথার সঙ্গে আপোস করতে তাঁর অসম্মতি ছিল না; বরং এ-বিষয়ে কেশব সেনের অনমনীয় মনোভাবটাই তাঁর কাছে আপত্তিজনক মনে হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ জানতেন যে, জাতিভেদপ্রথার ওপর আঘাত হিন্দুসমাজ সহ্য করবে না। এ ব্যাপারে হিন্দুসমাজের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করাই তিনি সমীচীন মনে করলেন।

আমাদের ইতিহাসে এই রকম বারবারই হয়েছে। বেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছে। বুদ্ধ থেকে মার্ক্স অবধি অনেকের ডাকেই মানুষ সাড়া দিয়েছে। তারপর বিশাল সমাজের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে বিরোধীরা ধীরে ধীরে নেমে এসেছেন নবলব্ধ সত্যের ঊর্ধ্বলোক থেকে প্রচলিত আচারের কঠিন মাটিতে। বিদ্রোহী মন্ত্র অথবা আওয়াজ ত্যাগ না করেও তাঁরা জীবনের আচরণে আপোস করে নিয়েছেন রক্ষণশীল সমাজের সঙ্গে।

.

যে-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অবলম্বন করে গত শতকের নবজাগরণ দেখা দিয়েছিল, সেই শ্রেণীটি সম্বন্ধে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবু দুএকটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন।

উনিশ শতকে যে-ইংরেজী শিক্ষাপদ্ধতি এদেশের কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবর্তিত হয়, বলা হয়েছে যে, কেরানী সৃষ্টি করাই ছিল ঐ শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। অজস্রবার উচ্চারণের গুণে কথাটা এখন আমাদের কাছে একটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওটাকে শুধু অর্ধ সত্য বলেই স্বীকার করা সম্ভব, তাও কেরানী’ শব্দটিকে অনেকটা ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে হবে। আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো পাঠক্রম ও পুস্তকের তালিকা দ্রুত দেখে নিলেও বোঝা যায় যে, শুধু কেরানী তৈরি করবার জন্য অত সব প্রয়োজন ছিল না। বরং বলা যেতে পারে যে, ইংরেজী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল উকীল ও ডেপুটি তৈরি করা। অনিবার্যভাবেই অধ্যাপকও হয়েছে। সেই সঙ্গে সামান্য কিছু ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার।

শাসনযন্ত্রের উচ্চতম পদে সেদিন অধিষ্ঠিত ছিলেন ইংরেজরা। ভারতীয়েরা সেখানে কদাচিৎ প্রবেশ করতে পেরেছেন। বহুদিন অবধি এদেশীয় ইংরেজী শিক্ষিত উচ্চাভিলাষীরা জীবনের শেষে ডেপুটির পদটিই কামনা করেছেন।

ডেপুটির সঙ্গে যোগ হল উকীল। নতুন শিক্ষাব্যবস্থার এঁরা উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণীর অংশ হিসেবেও এঁরা সমান উল্লেখযোগ্য। উকীল অথবা আইনজীবী সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানসিকতা বোঝা যাবে না। একই সঙ্গে ইংরেজ শাসনযন্ত্র এবং নতুন জমিদারী প্রথার অত্যাবশ্যক অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালেন উকীল। ভূমিস্বত্ব আইনের জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবীর গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেল। রাজধানীর বাইরেও জেলায় জেলায় প্রধান শহরে আইনজীবীদের আবির্ভাব ঘটল।

একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি জীবন্ত করে তোলা যাবে। জলপাইগুড়ির বিশিষ্ট নাগরিক চারুচন্দ্র সান্যাল মহাশয় ১৯৩২ সালে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন “বল দেখি তোমরা কে? কোথা থেকে এসেছ? …প্রায় ৫০/৬০ বৎসর আগে এখানে ইংরেজ গভর্নমেন্ট এসে একটা আচ্ছা করলেন, একটা শহর তৈরীর মতলবে। এখানে বসলো আফিস, আদালত, পোস্টাফিস, থানা, আরো কত কি? সঙ্গে সঙ্গে এলো ডেপুটি, মুন্সেফ, উকিল, মোক্তার, কেরানী প্রভৃতি। …এরা এসেই এদেশী লোকের কাছ থেকে কিছু জমি কিনে বা পত্তন নিয়ে বসলো। ধীরে ধীরে এদেশের লোক মামলা মোকদ্দমা করতে শিখলো আর তাদের টাকায় উকিল, মোক্তার মোটা হতে লাগলো।” নতুন মধ্যবিত্তের বিবর্তনের একটি দিক অল্প কথায় এখানে পরিষ্কার চিত্রিত হয়েছে।

আইনজীবীর ভূমিকার আরও একটি গভীরতর দিক আছে। আধুনিক অর্থে আমরা যাকে আইনের শাসন বলি, সেটা এদেশে গড়ে উঠেছে ইংরেজ শাসনের সঙ্গে সঙ্গে। এই আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র অথবা নাগরিক স্বাধীনতা অসম্ভব। আইনের শাসনই যথেষ্ট নয়, কিন্তু নাগরিক স্বাধীনতার জন্য ওটা আবশ্যক। কাজীর বিচার আচারশাসিত সমাজের অঙ্গ। ইংরেজ আমলে আইনজীবী সম্প্রদায় এদেশে এক নতুন ঐতিহ্যের ভিত্তি স্থাপন। করলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে আমাদের বরেণ্য নেতাদের অনেকেই এসেছেন এই আইনজীবীদের ভিতর থেকেই।

এদেশের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানসিকতায় এবং বাস্তব ভিত্তিতে যেটা অভাবের দিক, অদ্ভুত বিচক্ষণ পর্যবেক্ষকদের চোখে সে-দিকটা গত শতক থেকেই মোটামুটি স্পষ্টভাবে। ধরা পড়েছিল।

ম্যাকলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল না জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোেলা। কেরী এবং মার্শম্যান কিন্তু উনিশ শতকের গোড়াতেই জোর দিয়েছিলেন জনশিক্ষার ওপর। মাতৃভাষাকে ওঁরা জনশিক্ষার মাধ্যম করে তুলতে চেয়েছিলেন। ওঁরা দৃষ্টি ফেরাতে চেষ্টা করেছিলেন বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে, অর্থাৎ জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব ওঁদের চিন্তায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। নগর থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানকে ওঁরা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেশের নানা প্রান্তে। কিন্তু শিক্ষার এই নতুন আদর্শ সরকারী নীতিতে স্বীকৃত হয়নি।

ফলে উনিশ শতকের নবজাগরণ নগরভিত্তিক রয়ে গেল। নগর ও গ্রামের ভিতর ব্যবধান আরও দুস্তর হল। দেশের কৃষি ও শিল্পের উন্নতির জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যবহারে নতুন মধ্যবিত্ত অগ্রণী হল না। উনিশ শতকের গোড়ায় শিক্ষিত বাঙ্গালীর ব্যবসায় বাণিজ্যে একটা ভূমিকা ছিল। ক্রমে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে গেল। সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করল যে অবাঙ্গালী সম্প্রদায়, অন্য যে গুণই তার থাক না কেন, নবজাগরণ অথবা নতুন যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ তার ছিল না। উনিশ শতকের নবজাগরণ ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ফলবান হতে পারল না। এর কারণ বিশ্লেষণ এখানে সম্ভব নয়; কিন্তু ফলাফল হিসেবে আমরা পেয়েছি আজকের সংকট।

ইয়োরোপে নবজাগরণের একটা প্রধান কথা ছিল, বৈষয়িক ক্ষেত্রে মানুষের আত্মবিশ্বাস। শ্রম ও বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর মানুষ তার নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে, সে নিজের ইতিহাস নিজে সৃষ্টি করছে। এইখানে মানুষের বৈশিষ্ট্য, এইখানে তার গৌরব। এই ছিল পশ্চিমী নবজাগরণের বাণী। কৃষি ও শিল্পের ক্ষেত্রে একটা সম্ভাব্য সৃজনশীল ভূমিকা থেকে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত যতই পিছিয়ে এলো ততই ভিতরে ভিতরে তার আত্মবিশ্বাস ভাঙতে লাগল। তুলনায় পাঞ্জাবী ও গুজরাতীর আত্মবিশ্বাস বেশী। তবু বাঙ্গালীর ভিতর যেটা প্রকট, ভারতের মধ্যবিত্তের বৃহত্তর অংশে সেটাই কম বেশী বর্তমান। বাঙ্গালীর সংকট ভারতেরও সংকট। চেতনায় ও বাস্তবে আমরা সবাই একই উপমহাদেশের অধিবাসী।

মধ্যবিত্তকে আশ্রয় করেই যুক্তিধর্মিতার জন্ম ও প্রসার ঘটে। আমাদের মধ্যবিত্তের যুক্তিধর্মিত ওকালতিবুদ্ধি এবং ডেপুটির সাবধানী মনোবৃত্তিতে পর্যবসিত হল। এর সঙ্গে প্রয়োগধর্মী বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির বলিষ্ঠ যোগ স্থাপিত হল না! কর্মভিত্তিক নীতিবোধও। এদেশের নগরসমাজে গড়ে উঠল না। আমাদের মধ্যবিত্তের উচ্চাশার চূড়া সরকারী শাসনযন্ত্রে, অর্থাৎ আমলাতন্ত্রে, একটি বড় চাকুরি। সৃজনের সুযোগ সেখানে না থাকুক, নিরাপত্তা এবং মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্য আছে; সেটাই আমাদের বৈষয়িক বৃন্দাবন। এতে করে। ভিতরে ভিতরে নিজের প্রতি একটা অবজ্ঞাবোধ অবশ্য আটকানো গেল না। কাজেই আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিক্ত এবং বিপ্লবাত্মক ধ্বনি উচ্চারণও আমরা সরল বিশ্বাসে আমাদের অভ্যস্ত মন্ত্রতন্ত্রের অঙ্গ করে নিয়েছি।

এই সব লক্ষণ মধ্যবিত্তের সকল অংশের ভিতরই দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে মধ্যবিত্তের একটি প্রধান অংশ, অধ্যাপক সম্প্রদায়কে, ধরা যাক। আজকের অধ্যাপক নিজ বৃত্তিতে বিশ্বাস হারাতে বসেছেন, অর্থাৎ যে জ্ঞান তিনি পরিবেশন করছেন তার মূল্য সম্বন্ধে অধিকাংশ অধ্যাপক গভীরভাবে সন্দিহান। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা তুলনায় কম, কলা বিভাগে স্বাভাবিক কারণেই এই সংশয়বাদী মনোভাবের বিশেষ প্রাবল্য এই সংশয়বাদিতা অধ্যাপকদের নতুন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে এগিয়ে যাবার শক্তি দিচ্ছে না, বরঞ্চ নিজ কর্তব্যে অবহেলার সপক্ষে একটি দুর্বল যুক্তি যোগাচ্ছে মাত্র।

যে অধ্যাপকেরা সৎ এবং পরিশ্রমী, তাঁরা অন্যের উপহাসের পাত্র হয়ে উঠছেন। কর্মভিত্তিক নীতিবোধ অধ্যাপক সম্প্রদায় নিজ চেষ্টায় গড়ে তুলবেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলবেন, এমন সম্ভাবনা আজ সুদূর পরাহত। শুধু একটি দাবীতে অধ্যাপক সম্প্রদায়ের ভিতর উৎসাহ এবং অবিচলতা দেখা গেছে। আমলাতন্ত্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যে বেতন পান অধ্যাপকদেরও সেই হারে বেতন দিতে হবে, এটাই তাঁদের বহুদিনের দাবী মধ্যবিত্তের অন্যান্য অংশের মতোই অধ্যাপকেরাও আমলাতন্ত্রের উচ্চপদের প্রতি দৃষ্টি রেখে সেইখানে নিজেদের উচ্চাশার পরিমাপ খুঁজেছেন। অথচ আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্যবধান, সঙ্গত কারণেই, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক আক্রমণের লক্ষ্য। সমালোচনার এই অধিকার নিঃসন্দেহে রক্ষা করা আবশ্যক। কিন্তু এ বিষয়েও সন্দেহ নেই যে, অধ্যাপকেরা আমাদের চাকুরীজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রধান প্রধান সমস্ত রোগেই আক্রান্ত। কথাটা বিশেষভাবে বলতে হল এই জন্যেই যে, তরুণদের কাছে এঁরাই দৃষ্টান্ত! অন্তত চিন্তার ক্ষেত্রে, বিগত শতকের নবজাগরণের প্রধান উত্তরাধিকারী আজকের অধ্যাপক সম্প্রদায়। নতুন চিন্তার আন্দোলন এঁদের কাছ থেকেই প্রত্যাশিত। আত্মসমালোচনা ছাড়া সেই আন্দোলনকে সমাজের কাছে বিশ্বাস্য করে। তুলবার আজ আর অন্য পথ নেই।

.

আমাদের মধ্যবিত্তের চেতনায় ওকালতী বুদ্ধির প্রাবল্যের কথা উল্লেখ করেছি। ঐ জাতীয় বুদ্ধির প্রতি কটাক্ষ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং এর প্রয়োজন স্বীকার্য। তবে, ‘ওকালতী বুদ্ধির সঙ্গে বিজ্ঞা সচেতনতা এবং কর্মভিত্তিক নীতিবোধ যোগ হলে তবেই যুক্তিধর্মিত নিজ স্তরে একটা সম্পূর্ণতা লাভ করে। এই যোগাযোগের অভাবে, যে। জিনিসটা সম্পর্ণের অংশ হিসেবে একটা বিশেষ মূল্য পেতে পারত, সেটাই আবার বিকৃত হয়ে ওঠে। ওকালতী বুদ্ধির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আইন সম্বন্ধে সচেতনতা আমাদের একটা নৈব্যক্তিক ন্যায়বোধের দিকে এগিয়ে দেয়নি। পরিবারের বাইরে, বৃহত্তর জীবনের নানা কাজে, স্বজন ও অন্যজনকে সমান চোখে দেখবার প্রয়োজন ঘটে। সেই সমদৃষ্টি আমাদের সমাজে বিরল, স্বজনপোষণই প্রচলিত। আইন বিষয়ে সচেতনতা শুধু আমাদের কলহপরায়ণতাকে উৎসাহিত করেছে। এটাই ওকালতী বুদ্ধির বিকৃতি।

আমরা সাম্যবাদ অথবা সমাজতন্ত্রের কথা বলি। কিন্তু এক্ষেত্রেও একই কারণে সেই বিকৃতিই আবার দেখা দিয়েছে। আমরা সমাজকে যা দিই এবং সমাজের কাছ থেকে যা নিই, এ দুয়ের ভিতর একটা সাম্য থাকা উচিত। আমি যা পাচ্ছি তার পরিবর্তে সমমূল্যের কিছু দিচ্ছি কি না, এ প্রশ্নটা জরুরী। এ দেশের মধ্যবিত্ত কিন্তু নিজেকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে অভ্যস্ত নয়। নীরদ চৌধুরী, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ অতিরঞ্জিত ভাষায় লিখেছিলেন যে, কিছু না করে মাইনে পাবার অধিকার, এ দেশের সংবিধানে অলিখিত কিন্তু সর্বস্বীকৃত অধিকার। অতিরঞ্জনের অংশটা বাদ দিলে কথাটায় তবু কিছু সত্য অস্বীকার করা যায়। অথচ আমরা সাম্যবাদী। বলা বাহুল্য, আমি এখানে সাম্যবাদী তত্ত্বের কথা বলছি; মধ্যবিত্ত চেতনার অপূর্ণতার কথাই বলছি।

আমরা সবাই কিছু না-দিয়ে কিছু পেতে চাই এবং এটাকেই সরকারী সমর্থনে একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করে তুলতে চাই; কিন্তু সেটা হয় না। মনের একটা অংশে আমরা জানি যে, সেটা হতে পারে না। অন্যের ভিতর, বিশেষত নিজ গোষ্ঠীর বাইরে কারো মধ্যে, এটা না দেখলে আমরা কখনও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি। কিন্তু এই সমালোচনা সাধারণীকৃত হয়ে আত্মসমালোচনায় পরিণত হয় না। আত্মপ্রতারণাকে কেউ কেউ তত্ত্বকথা দিয়ে সাজান। তাঁদের কাঙিক্ষত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না-হওয়া অবধি অন্য কিছু আশা করাটাই ভুল। আগে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, তারপর তাঁরা কাজে মনোযোগী হবেন। কর্মভিত্তিক নীতিবোধের অভাবে শুধু ওকালতী বুদ্ধিরই নয়, তত্ত্বেরও বিকৃতি রোধ করা যায় না।

আপৎকালীন ব্যবস্থায় আজকের সংকট একটা বিশেষ রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত সংকটের মুহূর্তটিকে যখন নাটকীয়ভাবে বেছে নিলেন জরুরী অবস্থা জারি করবার জন্য, তখন উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে উঠল। তবু মনে রাখা ভালো যে, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যের বিশ্লেষণে ইতিহাসের তাৎপর্য ধরা পড়ে না। সেই তাৎপর্যের আলোচনাই যুগের দৃষ্টিতে বেশী জরুরী। আপৎকালীন অবস্থায় একটি প্রবন্ধে যা লিখেছিলাম, আলোচনার সুবিধার জন্য তারই একটি অংশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি :

“With the proclamation of a special state of emergency in India in June 1975, India has come to the end of her liberal cra, at least temporarily. The fundamental rights of the citizen now stand suspended. The press in India has been gripped by a fear unknown in recent history … There is an essential difference between the kind of discipline that is necded in offices and factories and other places of work for material production and the freedom required for the creative work of writers and artists. Such distinctions are casily overlooked when the problem is sought to be solved by political means and administrative fiats. Those in authority have to be extraordinarily discriminating and forbearing or they cannot avoid gross citors of judgement in such matters… In the perspective of history, the emergency is a passing phenomenon. Through it and beyond it loom those larger discords which belong to a whole age and wait patiently to be resolved.”

আপৎকালীন, ব্যবস্থাকে একদিন, অনুশাসন পর্ব, আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। জোর পড়েছিল শৃঙ্খলাবোধের ওপর; ‘কথা কম, কাজ বেশী এই রকম একটা বুলি চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে সরকার শুধু রাজনীতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরই জেলে পাঠাননি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলেন, বিবেকবান বহু লেখকের কণ্ঠরোধ করেছিলেন। অর্থাৎ, আমাদের জাতীয় জীবনে কমভিত্তিক নীতিবোধের যে-অভাব অনস্বীকার্য, তাকেই সেদিন ব্যবহার করা হয়েছিল আতিশয্য ও জবরদস্তির সপক্ষে মৌলিক যুক্তি হিসেবে।

জরুরী অবস্থার জবরদস্তি আজ শেষ হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন শেষ হয়নি। রামমোহন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তিনি বিচারের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। প্রতিটি সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে এই স্বাধীনতার মূল্য ও মূল শর্তগুলি আমাদের নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, কারণ এর অভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অনুচ্চারিত থাকে, আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দল ভুল পথে বহু দূর চলে না-যাওয়া পর্যন্ত ভুল বলে কিছু তার চোখে ধরাই পড়ে না। এতে সকলেরই অমঙ্গল। মত প্রকাশের স্বাধীনতা মূল্যবান, কেন না চতুর্দিকে একটা আতংকের পরিমণ্ডল সৃষ্টি না করে এই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া সম্ভব নয়। মানুষের মনুষ্যত্বেরই ওপর এটা আঘাত। যুক্তি ও বিচারের স্বাধীনতা চাই, কারণ মানুষের ভিতর চৈতন্যের একটা সৃজনশীল দ্বন্দ্ব ক্রমাগত চলছে, যার ভিতর দিয়ে সে এক স্তর থেকে পথ হাতড়ে অন্য স্তরের দিকে পা বাড়ায়। সেই দ্বন্দ্বকে অস্বাভাবিকভাবে অস্বীকার করার চেয়ে বড় ভ্রান্তি কমই আছে। মানুষের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব কোনো বাঁধা সরকারী রাস্তায় কখনও চলে না। নবজাগরণের কোনো বড় শিক্ষা থাকে তবে এই স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করবার শিক্ষা অন্যতম।

এই স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেও সমাজে কর্মভিত্তিক নীতিবোধ কি করে জাগিয়ে তোলা যায়, এটাই মূল প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিকেই সাম্প্রতিক ইতিহাস আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরেছে। স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, এটা সহজ প্রশ্ন নয়। তবু এর একটা সমাধান চাই। কারণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে সমাধানের পথ যদি আমরা খুঁজে বের করতে না পারি, তবে গণতন্ত্র আবারও বিপন্ন হবে, অন্য কোনো নামে অন্য কোনো রূপে। কিন্তু নামরূপে কি এসে যায়!

জরুরী ব্যবস্থাকালীন দ্বিতীয় বহু বিজ্ঞাপিত বিষয় ছিল, ‘বিশদফা কার্যক্রম, অন্তহীন পুনরুক্তির গুণে যেটা অন্তঃসারশূন্য ধ্বনিতে পর্যবসিত হয়েছিল। কিন্তু এর পিছনেও অপরিচ্ছন্নভাবে একটা মূল ভাব ছিল, যেটা মূল্যবান। সেটা হল, নগর ও পল্লীর ভিতর বৈষম্য হ্রাসের চিন্তা।

এ নিয়েও শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন এবং চিন্তার প্রয়োজন থাকবে। পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এর উত্তর খুঁজে নিতে হবে। উনিশ শতকের নবজাগরণ নগরে সীমাবদ্ধ ছিল। সে জন্য তাকে মূল্যহীন মনে করা অবশ্য ভুল। ইতালীর রেনেসাঁসও ছিল নগরভিত্তিক; তাই বলে তার মূল্য আমরা অস্বীকার করি না। আমাদের নবজাগরণের নেতারা নমস্য। কিন্তু সেটাই একমাত্র কথা নয়। প্রধান কথা এই যে, নগর ও পল্লীর ভিতর আর্থিক ও সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন না হলে নবজাগরণের মূল্যবোধগুলি আজ আর রক্ষা পাবে না। একথা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে গভীর ও পরিচ্ছন্নভাবে আর কেউ জানতেন না। তাই মহানগরীর ঐ শ্রেষ্ঠ সন্তানটি পল্লীতে তাঁর সাধনার কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। কুসংস্কার যেখানে সব চেয়ে অটল, দৈন্য যেখানে সব চেয়ে গভীর, বিজ্ঞান ও যুক্তিধর্মিতাকে সেখানেই আহ্বান করতে হবে, তার প্রয়োগধর্মী রূপে। ভগবানকেই শুধু নয়, বিজ্ঞানকেও গরীবের ঘরে দর্শন দিতে হয় রুটি এবং স্বাস্থ্য হাতে করে। শিক্ষা চাই, ভূমি সংস্কার চাই, চাই গ্রামে গ্রামে ব্যাংক ও বীমার ব্যবস্থা। আর এ সবই চাই বিজ্ঞানের প্রয়োগের পথ সহজ করে তুলবার জন্য। এ শুধু পল্লীকে বাঁচাবার পথ নয়। এছাড়া নাগরিক সংস্কৃতিকেও মুক্ত এবং সার্থক করবার আর কোনো উপায় নেই। পল্লীকে মুক্ত করে তবেই নগর আজ মুক্ত হতে পারে।

এ যদি না হয় তবে মধ্যবিত্তের যুক্তিধর্মিতা দুর্বল, ভঙ্গুর এবং অপূর্ণই থেকে যাবে। আর এই অপূর্ণ যুক্তিধর্মিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত যে-অধ্যাত্মচিন্তা, তাও অপূর্ণ। অপরিশুদ্ধ বলেই অপূর্ণ। আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে জাতি, বর্ণ, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে যে ভেদাভেদ ও জটিলতা, তার কিছুই এই অপরিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতায় দূর করা যাবে না। আজকের সমাজকে বেঁধে রাখা যাবে না শুধু শাস্ত্র প্রামাণ্য দিয়ে সেজন্য চাই গঠন ও সংগঠন, চাই শ্রম ও বিজ্ঞান। আজকের অধ্যাত্মচিন্তাকে সেই সেতু রচনা করতে হবে, যার এক প্রান্তে বিজ্ঞান আর অন্য প্রান্তে ‘স্বানুভূতি’। উপজাতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির উর্ধ্বে। স্বাধীন মানুষের ঐক্যের যে প্রতিষ্ঠাভূমি নবজাগরণের কাম্য ছিল, তাকে লাভ করবার এই পথ।

ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (১৯৭৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *