1 of 2

৩.০৪ ধর্ম, যুক্তিবাদ ও স্বাধীন সমাজ

৩.৪ ধর্ম, যুক্তিবাদ ও স্বাধীন সমাজ

বিজ্ঞানের প্রগতির পথে ধর্ম প্রতিবন্ধক, এমন একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। কথাটার সপক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণও আছে। গ্যালিলিওকে ধমর্যাজকদের হাতে নিগ্রহ স্বীকার করতে হয়েছিল। জীব হিসাবে মানুষের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে ডারউইনের মত খৃষ্টধর্ম সহজে মানতে চায়নি। নতুন সত্যের পথে কুসংস্কার বারবারই বাধা হয়েছে। এ সবই স্বীকার্য। তবু ধর্মের প্রতিবন্ধকতাকে খুব বড় করে দেখাবার আগে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের অন্য দিকটার প্রতিও একটু নজর দেওয়া উচিত। মধ্যযুগের শেষভাগে বিজ্ঞানচর্চা ইয়োরোপে নতুন করে শুরু হয় ধর্মের ছায়াতে ধর্ম প্রতিষ্ঠানের ধার ঘেঁষে এই নতুন প্রয়াস বেড়ে ওঠে। চার্চের আওতা থেকেই খৃষ্টীয় তের শতকে রোজার বেকন গণিত ও জ্যোতিষ, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার মহত্ত্ব ঘোষণা করেন। সেই থেকে আজ। অবধি বহু বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন অর্থে ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ধার্মিক বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন ঈশ্বরের নিজের হাতে লেখা বই,তাই এর সূত্রোদ্ধার মহৎ কাজ।

ধর্মকে কেন্দ্র করে বহু কুসংস্কার জমে ওঠে। বিজ্ঞানের প্রগতির পথে তারা বাধা হয়। সে বাধা অতিক্রম করেও বিজ্ঞান এগিয়ে চলে। আর কুসংস্কারকে ছাড়িয়েও ধর্মের বাণীর কিছু অর্থ হয় তো অবশিষ্ট থাকে। থাকে কিনা সে কথা পরে বিবেচ্য। তার আগে অন্য একটি প্রসঙ্গ সেরে নেওয়া আবশ্যক।

বিজ্ঞানের প্রগতি অন্ধবিশ্বাসে বাধা পেয়েছে, এটাই ধর্মান্ধতার একমাত্র বিপদ নয়। তার চেয়েও বড় বিপদ দেখা দিয়েছে অন্য পথে। ধর্মান্ধতার তিক্ততম ফল সাম্প্রদায়িক বিরোধ।

উদাহরণ দিয়ে কথাটা বোঝান সহজ। ষোড়শ শতকে জার্মানী ছিল শিল্পেবাণিজ্যে-সংস্কৃতিতে ইয়োরোপের অগ্রগণ্য দেশগুলির অন্যতম। তদানীন্তন ইংল্যাণ্ডের তুলনায় জামানীকেই অপেক্ষাকৃত অগ্রসর দেশ বলে ঐতিহাসিক স্বীকার করবেন। অথচ আরও এক শতাব্দী পরে জামানী ইয়োরোপের একটি পিছিয়ে-পড়া দেশ। এর প্রধান কারণটি লক্ষ করবার মত। সতের শতকে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের ভিতর যে রক্তাক্ত সংগ্রাম শুরু হয় তারই সাংঘাতিক পরিণতি হিসেবে জার্মানী বহুকালের জন্য কি-রাজনীতি, কি-অর্থনীতি, কি-সংস্কৃতি, জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এর বিষময় ফল পৃথিবীকে বিশ শতক পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছে।

সতের শতকে অবশ্য শুধু জার্মানীতেই নয়, ইয়োরোপের অধিকাংশ দেশেই সমাজজীবন সাম্প্রদায়িক বিরোধে আলোড়িত হয়ে ওঠে, আর বহু দেশই এর ফলে অল্পবেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু রক্তক্ষয়ের ভিতর দিয়ে একথাটা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পরধর্মসহিষ্ণুতা ছাড়া সুস্থ সমাজজীবন সম্ভব নয়। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। কথাটা আর-একভাবে ধরা যাক। শোনা যায় মানুষ বাস্তব স্বার্থ দিয়ে পরিচালিত। স্বার্থসিদ্ধির কিন্তু দুটো পথ আছে; একটাকে বলা যায় বিরোধ অথবা দস্যুবৃত্তির পথ, অর্থাৎ পরপহরণ বা অপরের ক্ষতি সাধন করে নিজের লাভ; অন্যটি সহযোগিতার পথ, অর্থাৎ সহযোগিতায় সকলের উন্নতি। বিরোধ ও সহযোগিতার ভিতর কোন পথটা মানুষ বেছে নেবে সেটা শুধু বাস্তব অবস্থা দিয়েই নির্ধারিত হয় না; ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মানসিকতার উপরও সেটা নির্ভর করে। সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিতে যখন আমরা উন্মত্ত হয়ে উঠি তখন বিরোধের পথকেই একমাত্র পথ বলে মনে হয়। হিন্দু-আমি ভাবি মুসলমানকে নিধন করেই আমার জয় সম্ভব; মুসলমান-আমি ভাবি হিন্দুকে বধ করে আমার জয়। হিন্দু মুসলমানে যুক্ত প্রয়াসের ভিতর দিয়ে যে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরই স্বার্থসিদ্ধির আরও একটা পথ খোলা আছে সাময়িকভাবে সে কথাটা আমরা বিস্মৃত হই। দেশ বিভক্ত হয়।

সম্প্রদায়বিশেষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে অস্বীকার করে আধুনিক যুক্তিবাদের উদ্ভব। যুক্তিবাদী নীতির বিচারে এটাই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। ব্যক্তির চরম আনুগত্য কোনো গোষ্ঠিবিশেষের প্রতি নয়, বরং নিজের প্রতি; এবং যেহেতু মানুষে মানুষে সহযোগিতার ভিতর দিয়েই ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধি সম্ভব অতএব সামাজিক সহযোগিতা যুক্তিবাদীর কাম্য। সামাজিক সহযোগিতার অন্বেষণে যুক্তিবাদীর দৃষ্টি কোনো জাতি অথবা সম্প্রদায়বিশেষের পরিধিতে আবদ্ধ নয় বরং নানাভাবে নানা পথে মানুষের সহযোগিতার ক্ষেত্রকে বিস্তৃততর করাই তাঁর লক্ষ্য। আঠার-উনিশ শতকের বহু যুক্তিবাদী তাই নিজেদের পরিচয় দিতেন “মানবতার বন্ধু” বলে। যথাসম্ভব বেশী লোকের যথাসম্ভব বেশী সুখই কাম্য, বেন্থামের এই উক্তিতে সেদিনকার যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় মেলে।

সম্প্রদায়সর্বস্ব ব্যক্তি বলবেন, সম্প্রদায়ের জন্য মৃত্যু বরণও শ্রেয়। যুক্তিবাদী এতে শংকিত বোধ করবেন। তাঁর মতে এ ধরনের আত্মত্যাগী মনোভাব বিপজ্জনক। ধর্মরোষ অথবা আদর্শবাদী উৎসাহের আতিশয্য নিয়ে সুস্থ সমাজ চলে না। বরং সাধারণ মানুষ। স্বার্থান্বেষণ করবে লাভক্ষতি গণনা করে, যুক্তিবিচারের সাহায্যে, এটাই সমাজজীবনের পক্ষে অধিক নিরাপদ। বিচার-বিবেচনা করে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষ মানুষের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্কে আবদ্ধ হবে, এতেই সকলের মঙ্গল। ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করে নয়, বরং স্বার্থকে আশ্রয় করে যে সহযোগিতা, মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের কঠিন মাটিতে যার মূল, সেই সহযোগিতাই নির্ভরযোগ্য।

এ ধরনের যুক্তিবাদী দর্শনের লাভক্ষতির অর্থটাও একই সুরে বাঁধা। অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতিটা ধর্মীয় উৎসাহে কেউ শ্রেয় বিবেচনা করতে পারেন। কিন্তু শ্রেয়ের এমন সংজ্ঞা নিয়ে দুই বিরোধী দল কাজে নামলে সাধারণ জীবন বিপর্যস্ত হবারই সম্ভাবনা। যা-কিছুতে জীবনে আরাম বাড়ে সহজ দৃষ্টিতে তাতেই লাভ; যাতে ক্লেশ বৃদ্ধি পায় তাতে ক্ষতি। এই আটপৌরে সংজ্ঞাটাই বেন্থামী যুক্তিবাদীরা মেনে নিলেন। স্বার্থান্বেষণ মানেই হল আরামের অন্বেষণ। রাষ্ট্র, জাতি বা ধর্মের জন্য আত্মত্যাগে আকুল না হয়ে মানুষ যদি বুদ্ধি বিবেচনার সঙ্গে সুখের অন্বেষণ করে তা হলেই সুস্থ সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা বেশী। সমাজজীবনের ছোট বড় সব সমস্যার আলোচনাতে এই দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রয়োজন। করের বোঝা গরীবের চেয়ে ধনীর উপরই বেশী পড়বে কিনা, বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার স্বীকার্য কিনা এবং কোন্ অবস্থায় স্বীকার্য, মৃত্যুদণ্ড উঠিয়ে দেওয়া উচিত কিনা, এইসব প্রশ্নের সমাধানে একমাত্র বিবেচ্য এতে মোটের উপর সমাজে সুখের ভাগটা বাড়বে,

অসুখের ভাগটা। সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা ও ধর্মান্ধতার স্থানে এমনি করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, যুক্তিপন্থী, সুখবাদ এলো গণতান্ত্রিক জীবনের ভিত্তি রচনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।

.

কিন্তু সুখবাদী দর্শনে জীবন চলে না।

নিরাসক্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালে জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের ভাগটাই বড় মনে হতে পারে–গৌতম বুদ্ধ থেকে আরম্ভ করে বহুলোকেরই তাই মনে হয়েছে; অতএব যুক্তিবাদী দর্শন অনুযায়ী আত্মহত্যাই কেন শ্রেয় হবে না? আসক্তিহীন মন নিয়ে গণনা করলে সন্তান প্রসব ও পালনে ক্লেশের ভাগটা এতোই বড় যে, কোনো যুক্তিবাদী রমণীর পক্ষে জননী। হতে চাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। সন্তানকে জননী ভালোবাসেন বলেই সন্তান পালনের। ক্লেশও রমণীয়। এখানে সুখ অসুখের হিসাবটা আগে নয়, ভালোবাসাটাই আগে। এই অযৌক্তিক ভালোবাসার প্রভাবেই সাধারণ দৃষ্টিতে যা ক্লেশ তাও সুখদায়ক হয়ে ওঠে। যা কিছু কঠিন সাধনায় লভ্য তার বেলাতেই এই একই কথা সত্য। আহার-নিদ্রার মত সুখকর বস্তু ত্যাগ করে পণ্ডিত কেন পুঁথি নিয়ে পড়ে থাকেন তা পণ্ডিতের মূর্খ ভৃত্যের কেন, পত্নীরও প্রায়ই বোধগম্য হয় না। এবং অনুগত পুরাতন ভৃত্য পণ্ডিতের সেবায় কেন ক্লেশ স্বীকার করে তা যুক্তিবাদী পণ্ডিতের বোধগম্য হবার কথা নয়। সুখ-অসুখের হিসাব মিলিয়ে যিনি জীবনযাপন করতে চাইবেন জীবনধারণ তার কাছে শীঘ্রই একটা বিড়ম্বনা স্বরূপ দেখা দেবে।

নৈতিক মূল্যবোধকেও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুখবাদের ভিত্তিতে দাঁড় করান কঠিন। সত্য কথা বলা কর্তব্য কিন্তু কেন? সুখবাদী বলবেন, সকলে মিথ্যাভাষণে অভ্যস্ত হলে সমাজজীবন অসম্ভব হয়ে ওঠে, এতে সকলেরই ক্ষতি কাজেই প্রত্যেকের সুখ-সুবিধার জন্য সকলেরই সত্য কথা বলা কর্তব্য। কিন্তু যুক্তিবাদী ব্যক্তিবিশেষ ভাবতে পারেন, অন্য সকলে সত্য বলুন, আর প্রয়োজনমত আমি পরম সাবধানে মিথ্যা বলি; এতেই আমার সবাধিক সুখ। কর্তব্যপালনের সকল ক্ষেত্রেই এই একই কথা। কর্তব্যের খাতিরেই কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব যদি স্বীকৃত না হয় তবে অপরের কর্তব্যচ্যুতিতে তারস্বরে প্রতিবাদ এবং নিজের কর্তব্যগুতি যথাসম্ভব গোপন করার চেষ্টাই বুদ্ধিমানের কাজ হয়ে ওঠে।

সুখবাদী দর্শনে তাই সমাজে নীতিবোধ জাগিয়ে রাখা কঠিন। সামাজিক ভাঙ্গাগড়ার যুগে এ বিপদ বিশেষ বড় আকারে দেখা দেয়। আজকের বাংলা দেশের দিকে তাকালে বিপদটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। শিল্পোন্নয়নের যুগে বহু প্রাচীন অবস্থাপন্ন পরিবার তলিয়ে যায়, আবার বহু তলাকার মানুষ ওপরে ওঠে। বিত্ত বণ্টনের এই ওলটপালটে বহু লোকই নিজেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত বোধ করে। প্রাচীন সমাজের অসাম্য প্রাচীনত্বের মহিমায় যদি-বা সহনীয় নতুন বিত্তবানদের অধিকাংশের চোখেই অসহনীয়। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সামাজিক অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে। যেখানে গোষ্ঠী অথবা সম্প্রদায়-বিশেষের যোগ্যতর ব্যক্তির জন্যও উন্নতির দ্বার রাজনীতিক বা সামাজিক কারণে রুদ্ধ সেখানে সংঘর্ষও তিক্ততর কিন্তু সংঘর্ষ সম্পূর্ণ এড়ানো যায় না, অসন্তোষ অনিবার্য। ইতিহাসে এমন কোনো দেশের নজীর আজও নেই যেখানে সামাজিক ও আর্থিক রূপান্তরের যুগে অশান্তি ও অবিচারবোধ পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি। এই অবিচারবোধের সঙ্গে প্রায়শ যোগ হয় সব কিছুতে একটা অশ্রদ্ধার ভাব। যাদের আমরা মনে মনে অবজ্ঞা করি তাদেরই কৃপার উপর যখন নির্ভর করতে হয়, পিতা ও পুত্রের মূল্যবোধে যখন প্রভেদ দুস্তর হয়ে ওঠে, জীবনযাত্রার বহুমুখী পরিবর্তনের ধারায় নব নব অভাববোধ যখন অথাগমের চেয়ে দ্রুত বেড়ে চলে, তখন অসন্তোষ ও অশ্রদ্ধা ব্যাপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক।

এই সুদূরপ্রসারী অসন্তোষ ও শ্রদ্ধাহীনতার ভিতর ব্যক্তির মনে কর্তব্যবোধ জাগিয়ে রাখা কঠিন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুখবাদ এ অবস্থায় সমাজ সংগঠনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। নিজের। কর্তব্য করে তবেই আমরা অপরকে সমালোচনা করবার অধিকারী হই, একথা শুধু সুখবাদকে আশ্রয় করে জোরের সঙ্গে বলা যায় না অথচ এ কথাটা একেবারে উপেক্ষা। করেও সমাজসংগঠন সম্ভব নয়। ইংল্যাণ্ডে শিল্পোন্নয়নের প্রথম যুগের মানসমণ্ডল তাই গঠিত হয়নি শুধু বেন্থামী সুখবাদে; তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাপক আদর্শবাদী ধর্ম আন্দোলন। এই ধর্ম আন্দোলনে দুটি বস্তুর উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছিল; পরমতসহিষ্ণুতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা। ইংল্যান্ডের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের ইতিহাসে এই আন্দোলনের অবদান অল্প নয়। (১)

সামাজিক ভাঙ্গাগড়ার যুগে সমাজসংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার অপর এক পথও চোখে পড়ে। সুখবাদে হতাশ হয়ে সমাজসংগঠনের দৃঢ়তর ভিত্তির সন্ধানে উৎকণ্ঠিত দেশ ঝুঁকে পড়ে উগ্রজাতীয়তাবাদ আর রাষ্ট্রপূজার দিকে। যুক্তিবাদী জীবনদর্শনের দুর্বল বাধা উপেক্ষার। সঙ্গে সরিয়ে দিয়ে মধ্যযুগের ঈশ্বরের আসনে এসে বসেন নতুন যুগের রাষ্ট্রধর্মান্ধতার আর এক ভয়াবহ নতুন সংস্করণ।

.

গোড়াকার প্রশ্নে আবার ফিরে আসা যাক। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে কার্যকরী এমন কি কথা আছে যা যুক্তি বা বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রমাণ (বা খণ্ডন) করা সম্ভব নয়, যাকে কুসংস্কার বলেও ত্যাগ করা চলে না, বরং জীবনকে যা ধারণ করে আর স্বাধীন সমাজ সংগঠনের ভিত্তিতে যাকে স্থান দিতে হয়? কিছু কি আছে?

জীব হিসাবে সুখ আমাদের কাম্য, দুঃখ অনভিপ্রেত। এই জৈবিক প্রেরণাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। এই প্রেরণা জীবন থেকে লুপ্ত হলে সাধারণ মানুষের কর্মে। উদ্দীপনা থাকবে না। কিন্তু সুখ দুঃখের গণনা করেও বাঁচবার কোনো তীব্র বাসনা অবশিষ্ট থাকে না। সাধারণ মানুষ এমন কোনো গণনা করতে বসে না বলেই বহু দুঃখের ভিতরও সে বাঁচবার জন্য সংগ্রাম করে যায়। যুক্তিকে অতিক্রম করেও জীবনের প্রতি আমাদের একটা দুর্বার আকর্ষণ আছে। এই অন্ধ আকর্ষণের জায়গায় সুখদুঃখের যুক্তিবাদী গণনামাত্রকে অধিষ্ঠিত করলে ছিন্নমূল বৃক্ষের মতই জীবন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। মানুষের চেতনার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন যুক্তিনির্ভরতা বাড়ে অন্যদিকে তেমনই প্রয়োজন হয় জীবনের প্রতি আদিম অন্ধ আকর্ষণকে যুক্তির অতীত এক অহেতুক জীবনপ্রেমে পরিণত করবার। এই অহেতুক প্রেমের দৃষ্টিতে সুখ দুঃখ সমান রমণীয় সাহিত্য পাঠকের নির্লিপ্ত অথচ দরদী দৃষ্টিতে যেমন মিলন ও বিরহ উভয়ই মধুর। ভক্তের ভাষায়, সবই তাঁর লীলা। ভাষা নিয়ে কলহ সম্ভব। কিন্তু জীবনের প্রয়োজন বিচিত্র! আমরা সুখ চাই, দুঃখ চাই না; আবার সুখে-দুঃখে মিলিয়ে জীবনকে অকারণে শিশুর মত ভালোবাসতে চাই–তা যদি না পারি তো সমস্ত জীবনই তিক্ত হয়ে ওঠে। আপাত বিপরীতের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ এই সত্যটাকে সুখবাদী দর্শনে স্থান দিতে হলে সুখের অর্থ পালটে যায়।

কর্তব্যের বিচারেও ধরা পড়ে স্বার্থ ও পরার্থের একটা অনুরূপ দ্বৈতাদ্বৈত বিচিত্র সমন্বয়।

জৈব প্রকৃতিতে স্বজাতির সঙ্গে একটি সহজাত বন্ধনবোধ আছে। বুদ্ধির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আমরা স্বতন্ত্র মানুষ বলে ক্রমশ আবিষ্কার করি, আত্মসচেতন হই। এখানেই একটা নতুন দ্বন্দ্বের শুরু। পরার্থ যতদিন শুধুই পরার্থ ততদিন পরার্থে আত্মত্যাগ অর্থহীন। যুক্তিবাদী বোঝাতে চেষ্টা করেন, তুমি অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলে তবেই অপরে তোমার জন্য ত্যাগ স্বীকার করবে; অতএব স্বার্থসিদ্ধির জন্যই পরার্থে কর্ম প্রয়োজন। কিন্তু এমনতর যুক্তিতে কাজ ভালো এগোয় না। মনে মনে সারাক্ষণই সন্দেহ থেকে যায় যে, অপরে আমার জন্য তেমন কিছুই করছে না, আমিই অপরের জন্য খেটে মরছি। সমাজ আমার কাছ থেকে কাজটি আদায় করে, মূল্যটি পুরো দিচ্ছে না। আমাদের কর্তব্যবুদ্ধির পিছনে এই যুক্তিবাদী স্বার্থবুদ্ধিরও প্রয়োজন আছে। তা নইলে ব্যক্তিত্বের বিকাশ অসম্পূর্ণ থাকে, আর প্রবঞ্চিত হবার সম্ভাবনাটাও মিথ্যা নয়। কিন্তু স্বার্থবুদ্ধিকে যে অতিক্রম করতে পারেনি কর্তব্যমাত্রই তার কাছে ক্লেশ; আর দিনানুদৈনিক প্রতিটি কর্তব্য যার কাছে অবাঞ্ছিত বোঝা মাত্র, স্বার্থবুদ্ধির মারে জীবনের স্বাদ থেকেই সে বঞ্চিত। আবারও আমাদের যুক্তিবাদকে অতিক্রম করতে হয়।

এই সমন্বয়পন্থী ত্রিভঙ্গী দর্শন আদর্শবাদী মনে হতে পারে, সাধারণ লাভক্ষতি হিসেবের পথ ধরে এখানে পৌঁছা কঠিন। কিন্তু একবার যখন আমরা এখানে পৌঁচেছি তখনই। একথাও স্পষ্ট জেনেছি যে, জীবনে এর প্রয়োজন জীবনেরই দায়ে অস্তিত্বকে সহনীয় করবার জন্য। আর তাই কোনো সুদূর স্বর্গলোকে নয়, দূর ভবিষ্যতে কোনো সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজে নয়, আজকের এই অসম্পূর্ণ, অসুন্দর, অবিচারপীড়িত পৃথিবীতেই আমাদের চেষ্টা করতে হয় যেন সুখের অন্বেষণে আশা হতাশার মাঝখানে সুখে-দুঃখে মণ্ডিত জীবনকে অকারণে ভালোবাসতে পারি; যেন কর্তব্যসাধনের পথে সংসারের সঙ্গে আমাদের কর্মের যোগ আনন্দের সঙ্গে অনুভব করতে পারি। কঠিন এ প্রয়াস, কঠিনতম সিদ্ধি; কিন্তু এ ভিন্ন জীবন বিস্বাদ, বির। হিংসার মত্ততায় অথবা পরলোকের মিথ্যা আশ্বাসে এই বিরসতাকে সাময়িকভাবে ভুলে থাকা যায়। সভ্যতার রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে ফ্রয়েড বলেছিলেন যে, যুক্তি ও নীতির ধমকে হিংসা বাইরের বিশ্ব থেকে পিছিয়ে এসে অন্তর্মুখী হয়; আত্মনিপীড়নই সভ্যতার ব্যাধি। কিন্তু ব্যাপারটা বোধ হয় আরও জটিল। বাইরের শত্রুকে নিয়ে আমাদের মাতামাতি যখন মস্থর হয়ে আসে তখন আমাদের সামনে যে প্রশ্নটা মৃত্যুর সমান মুখব্যাদান করে দাঁড়ায় তা হল এই, জীবনের অর্থ কি? অগত্যা স্বীকার করতে হয়, জীবনের অর্থ অর্থহীন জীবনপ্রেমে। সে প্রেম যুক্তিতে ধৃত নয়, যুক্তিবিরোধীও নয়। ১৩৭৩। আবু সয়ীদ আইয়ুবের হীরক স্তী প্রভাবিত গ্রন্থের জন্য লিখিত।

গণযুগ ও গণতন্ত্র (১৯৬৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *