1 of 2

৩.০৩ পঞ্চপ্রীতি

৩.৩ পঞ্চপ্রীতি

চীনের কম্যুনিস্ট নেতারা যখন দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের শেষে দেশ গড়বার কাজে অগ্রসর হলেন তখন তাঁরা চারটি বিষয়ে প্রীতির কথা বলেছিলেন। স্বদেশপ্রীতি, শ্রমের প্রতি প্রীতি, বিজ্ঞানপ্রীতি ও জাতীয় সম্পদের প্রতি প্রীতি, এই চারটিকে সেদিন তাঁরা সবাচ্চ স্থান Frauecoa (“Love for the fatherland and the people, love of labour, love of science, and taking care of public property shall be promoted as the public spirit of all the nationals of the Chinese People’s Republic.”)

কম্যুনিস্ট চীনের চিন্তার এই অংশটি বিশেষ প্রশংসনীয়। এদেশের জাতীয়তাবাদীরাও এটিকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেন। পঞ্চশীলের শোচনীয় পরিণিত সত্ত্বেও চীনের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

আধুনিক শিল্পপ্রধান সমাজের ভিত্তিতে আছে শ্রম ও বিজ্ঞান। স্বদেশপ্রীতি যদি আমাদের চিত্তকে শ্রম ও বিজ্ঞানের দিকে চালিত না করে তো এযুগে স্বদেশপ্রেমও নিষ্ফল। আবার বহুলোকের শ্রমে যে সম্পদ সৃষ্টি হয় তাকে রক্ষা করবার জন্য প্রয়োজন জাতীয় সম্পদের প্রতি মমতা। উদ্ধৃত বাক্যটিতে তাই শ্রম ও বিজ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠাকে। মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে এবং তার দুই প্রান্তে প্রহরীরূপে স্থাপিত হয়েছে স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয় সম্পদের প্রতি মমতা।

এই মূল্যবান সত্যটি এদেশে আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছে বলে মনে হয় না। আমাদের ভিতর যাঁরা নিজেকে বিপ্লবী বলে পরিচয় দেন তাঁরাও ব্যক্তিগত জীবনে জাগতিক ফলোভের জন্য শতপ্রকার দৈবশক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করেন। তাঁদের আচার বিচার সকলক্ষেত্রে বিজ্ঞানপ্রীতি দ্বারা আলোকিত নয়। হরিনাম উচ্চারণ মাত্র সমস্ত পাপ কাটে কি না জানি না। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে বৈপ্লবিক ধ্বনিবিশেষ উচ্চারণ দ্বারা মনের অন্ধ তামসিকতা কাটে না।

এদেশের মানুষ পাশ্চাত্ত্য সমাজে অনেক দোষ দেখেন। কিন্তু এইসব দোষ জাগতিক উন্নতির পথে তেমন বাধা নয়। অপরপক্ষে পাশ্চাত্ত্য দেশের দুটি গুণ উল্লেখযোগ্য, কঠিন শ্রমের অভ্যাস ও বিজ্ঞানের প্রচণ্ড শক্তিতে বিশ্বাস। এই দুটি গুণ বাদে প্রগতিশীলতার বিচার অর্থহীন।

এদেশে সঙ্ঘশক্তি সম্বন্ধেও একই প্রকার বিচার প্রয়োজন। যে আন্দোলনের ফলে শ্রমের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি পায় অথবা বিজ্ঞানবুদ্ধি প্রসারিত হয় তাকেই প্রগতিশীল আখ্যা দেওয়া যুক্তিসঙ্গত। জাতিভেদের প্রভাবে আমরা কর্মের নানা ছোট ছোট ভেদকে মিথ্যা মর্যাদার প্রশ্ন করে তুলেছি। আবার এদেশের জলবায়ুর গুণে একটা আলস্যভাব আমাদের অনেকেরই স্বভাবসিদ্ধ। এই আলস্যপ্রিয়তাকে যদি আমরা সঙ্ঘশক্তি দ্বারা একটা মৌলিক অধিকারে পরিণত করতে উদ্যত হই তবে সেই সঙ্ঘশক্তিও দেশের উন্নতির সহায়ক হয় না।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দুটি ধরন আছে। আমরা যখন নিজের কর্তব্যে হেলা করি এবং সেই অবহেলাকে নিজের বিবেকের কাছে মার্জনীয় ও অপরের দৃষ্টি থেকে আড়াল করার জন্য চারিদিকে অন্য সকলের বাস্তব ও কল্পিত অন্যায় সম্বন্ধে অত্যন্ত মুখর হয়ে উঠি, তখন সেই পরনিন্দামুখরতা একপ্রকার আলস্যবিলাসের মুখোস মাত্র হয়ে। ওঠে। আমরা যখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য যথাসম্ভব পালন করে তবেই অপরের সমালোচনা করি, তখন সেই সমালোচনা প্রশংসার যোগ্য হয়।

আমাদের মধ্যবিত্তের জীবন সাধারণভাবে ঔদাসীন্য ও সাময়িক উত্তেজনার ভিতর আবর্তিত। পারিবারিক ও দলীয় কলহ আমাদের মাঝে মাঝে চঞ্চল করে তোলে, নয় তো। আমরা ঝিমিয়ে চলি। বৃহত্তর জাতীয় প্রশ্নের আলোচনাতেও আমাদের মনের এই ধর্ম লক্ষ করা যায়। বিশেষ কোনো শিল্পে অথবা প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রের পরিচালনা প্রবর্তন করা বাঞ্ছনীয় কি না এই প্রশ্নটা আমরা যেমন উত্তেজনার সঙ্গে আলোচনা করি রাষ্ট্রীয়করণের পরে সেখানে কর্মের গতি দ্রুত হল কিনা তাতে আমাদের তেমন উৎসাহ দেখা যায় না। অথচ দেশের উন্নতি অথবা অধোগতির পক্ষে এই দ্বিতীয় প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরী।

এদেশে শ্রম-ও-বিজ্ঞানবিমুখতাকে অনেকে অন্যায় সমাজব্যবস্থার ফল হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। এই ব্যাখ্যা অংশত সত্য। কিন্তু সমাজব্যবস্থা প্রথমে সকল প্রকার অন্যায় থেকে মুক্ত হবে তারপর দেশের মানুষ শ্রম ও বিজ্ঞানে উন্মুখ হবে এমন হয় না। আধুনিক জাপান উনিশ শতকের শেষভাগে স্বদেশের শক্তি বৃদ্ধির জন্য শ্রম ও বিজ্ঞানে অনুরক্ত হয়ে ওঠে, যদিও সেই সমাজে সেদিন অন্যায়ের অভাব ছিল না। যদি উন্নতি চাই তবে এমনিষ্ঠা, বিজ্ঞানের বিকাশ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন একই সঙ্গে আবশ্যক। যে-জাতি ওঠে, সে এইভাবেই ওঠে।

স্বদেশপ্রীতিও কখনও বিদেশের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমাত্র হয়ে ওঠে। প্রীতিরও বিকার ঘটে যখন একটি বৃহত্তর বিদ্বেষের বিষে সে জর্জরিত হয়। শ্রম ও বিজ্ঞান তখন হিংসার দাসে পরিণত হয়। আদর্শনিষ্ঠা ও ক্ষমতালিপ্সা তখন একাকার হয়ে যায়। আধুনিক জাপানের ইতিহাসে এর উদাহরণ আছে। আজকের চীনও এ দোষ থেকে মুক্ত নয়। অসহিষ্ণুতায় আমাদের দৃষ্টি একপ্রকার ভ্রান্ত স্বচ্ছতা লাভ করে। এই অন্ধ স্বচ্ছতার চেয়ে দ্বিধা ও সন্দেহের কুয়াশাও ভালো।

এই বিকারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে হলে অপর চারটি খণ্ডপ্রীতিকে একটি বৃহত্তর প্রীতির সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন। এই বৃহত্তর প্রীতির সংজ্ঞা নির্দেশ করা কঠিন। সমাজ ও রাজনীতিতে এর প্রকাশ মানবতা ও গণতন্ত্রের প্রতি গভীর অনুরাগে।

এই পঞ্চপ্রীতির আশ্রয় ছাড়া আমাদের স্বাধীনতাকে সার্থক করে তুলবার কোনো আশা নেই। আজ যখন বিদ্বেষের রাজনীতি বিপুল আকার ধারণ করেছে তখন এই আড়ম্বরহীন মৌল সত্যটি আমাদের বিশেষভাবে স্মরণ করা কর্তব্য।

সমাজ ও ইতিহাস (১৯৭০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *