1 of 2

৩.০১ বিজ্ঞান ও প্রগতির পথ

তৃতীয় অধ্যায় – সমাজদর্শন

৩.১ বিজ্ঞান ও প্রগতির পথ

আমরা তার্কিক। অথচ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এদেশের মাটিতে এখনও শিকড় গাড়তে পারল না। কেন?

পুরনো কথা দিয়ে শুরু করি। বৈদিকযুগের শেষ দিকে আচার-অনুষ্ঠান, বিশেষত যাগযজ্ঞ, ধর্মের প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠলো। ব্রহ্মের ব্যক্তসত্তা এই বিশ্ব নিয়ত নিজেকে। আহুতি দিচ্ছে অব্যক্ত ব্রহ্মের কাছে। যজ্ঞ ও মন্ত্রকে কেন্দ্র করে সমাজে ব্রাহ্মণ্য শ্রেণীর বিশেষ স্থান নির্দিষ্ট হলো। সেই সঙ্গে বর্ণভেদ প্রতিষ্ঠিত হলো। পুরুষসূক্তে শুধু একটি চরাচরময় আহূতিই কীর্তিত হয়নি, চতুর্বর্ণের অলৌকিক ভিত্তিও কল্পিত হয়েছে।

আচার ও উচ্চবর্ণের এই কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিতে দেরি হয়নি। বিদ্রোহ নানা রূপ নিয়েছে। রামায়ণে দেখতে পাই আত্মবিদ্যা ও আত্মীক্ষিকীর ভিতর বিভেদের সূচনা। আম্বীক্ষিকী তর্কে ও বিচারে বিশ্বাসী। মহাকাব্যে অভিযোগ শুনতে পাই যে তার্কিকদের তর্কে প্রাচীন বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে; আচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বিচার।

শুধু চাবাকই বেদকে অস্বীকার করেননি; জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মেও বেদ অস্বীকৃত। ভগবান সম্বন্ধে বুদ্ধ মৌন ছিলেন। মানুষের দুঃখ কি করে দূর করা যায় এটাই তাঁর প্রধান চিন্তা ছিল। বুদ্ধ কার্যকারণ সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছেন। দুঃখ-বিষয়ক চিন্তায়ও সেই একই কথা প্রথমে দুঃখের মূল কারণ আবিষ্কার করা আবশ্যক, তারপর সেই কারণ দূর করে তবেই দুঃখপ্ত প্রাণীদের আর্তিনাশ সম্ভব। ধর্মীয় জীবনে বুদ্ধ ব্রাহ্মণের একাধিপত্য অস্বীকার করলেন নিম্নবর্ণকেও তিনি ধর্মের সাধনায় উচ্চস্থান দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বুদ্ধ ছিলেন জ্ঞানের পথের যাত্রী। তাঁর কাছে যাগযঞ্জের চেয়ে সৎচিন্তা বড়। তিনি চিত্তকে সজাগ রাখতে বলেছিলেন মৃত্যুর আগে রোরুদ্যমান শিষ্যদের জন্য বুদ্ধ বাণী দিয়ে গেলেন অন্তরের আলোতেই নিজের পথ চিনে নিও, অন্য পথপ্রদর্শক নেই।

কিন্তু এই বিচারের ধারা ব্যবহারিক জীবনে খুব বেশী উন্নতি এনে দিতে পারেনি। ফলিত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা খানিকটা এগিয়ে থেমে গেছি। পঞ্চেন্দ্রিয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা পঞ্চভূতের কথা ভেবেছি এবং বস্তুর গঠন ও উপাদান সম্বন্ধে জল্পনা-কল্পনা করেছি; লৌহ প্রস্তুত করতে শিখেছি; অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে দ্রব্যগুণ সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞানলাভ করেছি; ইত্যাদি। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে বৈজ্ঞানিক নিয়মের উপর এই জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করা প্রায়ই সম্ভব হয়নি। প্রাচীন ভারতের প্রতি অতিভক্তি হেতু আমরা অবশ্য অনেক সময় দাবি করে বসি যে, অদ্যাবধি বিশ্বের বৈজ্ঞানিকেরা যা কিছু জেনেছেন এবং আবিষ্কার করেছেন তা সবই আমাদের ঋষি ও পণ্ডিতদের জ্ঞাত ছিল। কথাটা বিচারে টেকে না। ঋষিদের আত্মবিদ্যা নিয়ে এখানে প্রশ্ন তুলছি না। বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারিক জ্ঞানের কথাই আপাতত আলোচনা করছি। এই জ্ঞানের ফলে প্রকৃতির উপর মানুষের অধিকার বাড়ে; পার্থিব শক্তি বৃদ্ধি পায়। প্রাচীন ভারত যদি এই বিজ্ঞানপ্রদত্ত জ্ঞান ও শক্তিতে সত্যি অতুলনীয় হতো তা হলে বহিঃশত্রুর কাছে সে বারবার পরাজিত হতো না। এমন কোনো অতুলনীয় জ্ঞানলাভ যে আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, এটা লজ্জার কথা নয় ইতিহাসের সেই পর্যায়ে সেটাই স্বাভাবিক। তবে ঐ সত্যটাকে আজ স্বীকার করে নেওয়া ভালো। বিজ্ঞানের অতি আধুনিকতত্ত্ব দূরের কথা, প্রাচীন ভারতের পন্ডিতেরা মাধ্যাকর্ষণতত্ত্বও আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। অনেকে অবশ্য এ প্রসঙ্গে ভাস্করাচার্যের নাম উল্লেখ করেন। বিজ্ঞানাচার্য মেঘনাদ সাহা এ বিষয়ে লিখেছেন “এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। কিন্তু এই সমস্ত “অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী” শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চারিদিকে বৃত্তাভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন না। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোনো হিন্দু, গ্রীক বা আরবী পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহু পূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়।” (মেঘনাদ রচনা সংকলন, পৃ ১৬১)। অতীতের মুগ্ধপ্রেমে ঐতিহাসিক বিচারবুদ্ধি বিসর্জন দেওয়া বিবেচকের কাজ নয়।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের তার্কিকেরা তর্কবিদ্যায় নিঃসন্দেহে কুশলী ছিলেন। তাঁদের যে-ধীশক্তি বাহ্য জগৎকে জয় করতে পারেনি, অর্থাৎ ব্যবহারিক সত্যের ক্ষেত্রে একান্ত নিষ্ঠায় নিযুক্ত হয়ে বৃহৎ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, সেই বিশ্লেষণী শক্তিদ্বারাই আবার তাঁরা জগৎকে মিথ্যা প্রমাণ করে গেছেন। শঙ্করাচার্য বা নাগার্জুনের চেয়ে বড় তার্কিক কে? অবশ্য ন্যায়দর্শনে জগৎকে মিথ্যা বলা হয়নি। কিন্তু বেদান্ত বা বৌদ্ধ দর্শনেরই প্রভাব ও প্রতিপত্তি বেশি। জগৎ সম্বন্ধে চিন্তার ভিত্তি হিসাবে যে আদি প্রত্যয়গুলি আমরা অনিবার্যভাবে গ্রহণ করি সমালোচনায় সেগুলিকেই ‘মিথ্যা, অর্থাৎ আত্মবিরোধে চিহ্নিত, মনে হতে পারে। বুদ্ধি দিয়ে জগৎসৃষ্টি বোঝা যায় না। সৃষ্টির আগে কী ছিল? সৃষ্টির আগে তো কিছু থাকা সম্ভব নয়; অথচ শূন্য থেকেও কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। সৃষ্টি যদি রহস্যাবৃত হয় পরিবর্তনও কি তেমনই রহস্যময় নয়? ক থেকে খ-এর উদ্ভব; কিন্তু ক-এর ভিতরই কি খ নিহিত ছিল? তবে দুয়ের ভিতর পার্থক্য কি? ক-এর ভিতর কি খ নিহিত ছিল না। তবে খ এল কোথা থেকে? জগৎকে অথবা পরিবর্তনকে সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু সত্য বলে প্রমাণ করা কঠিন।

অথবা বলা যায় যে, জগৎ সত্যাসত্যের সমন্বয়; অর্থাৎ, এক দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য, অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে মিথ্যা। জগৎ সত্য কি মিথ্যা এই তর্কে বুদ্ধিকে আমরা ক্লান্ত করতে পারি, কিন্তু জগৎ সম্বন্ধে ব্যবহারিক জ্ঞান তাতে বাড়ে না। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি, জগৎ সম্বন্ধে ব্যবহারিক জ্ঞান নিয়েই তার কারবার। সেকালের পণ্ডিতেরা। অধীতব্য বস্তুকে নানাভাবে সাজাতে পারদর্শী ছিলেন; তর্কজাল বিস্তারেও মধ্যযুগীয় মনের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। কিন্তু সেই তার্কিক বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এক বস্তু নয়। আমরা আজও যতখানি তার্কিক ততখানি বৈজ্ঞানিক নই। এদেশের মন থেকে মধ্যযুগ এখনও বিদায় নেয়নি।

.

উনিশ শতকের গোড়ায় আশা জেগেছিল যে, নতুন পাশ্চাত্ত্য চিন্তার প্রভাবে দেশের মন থেকে মধ্যযুগীয় জড়ত্ব দূর করা যাবে। বাংলার নবজাগরণের নেতারা এই চিন্তা থেকেই ইংরেজী শিক্ষাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। রামমোহন এদেশের প্রাচীন চিন্তার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন এবং উপনিষদের চিন্তায় তিনি তাঁর নতুন ধর্মের উপাদান খুঁজেছেন। কিন্তু আমাদের পুরাতন দর্শন ও ভাবধারার সাহায্যে ব্যবহারিক জীবনকে নতুন করে গড়া যাবে না, এই প্রত্যয় তাঁকে ইংরেজী শিক্ষা ও পাশ্চাত্ত্য বিজ্ঞানের দিকে আকর্ষণ করেছিল। ১৮২৩ সালে সরকার যখন একটি নতুন সংস্কৃত শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ-মঞ্জুর করেন তখন রামমোহন প্রতিবাদ জানিয়ে বড়লাটকে লিখেছিলেন।

“This seminary (similar in character to those which existed in Europe before the time of Lord Bacon) can only be expected to load the minds of youth with grammatical niceties and metaphysical distinctions of little or no practical use.’’

সংস্কৃত টোলে ব্যাকরণের নিয়ম শিক্ষায় ও প্রাচীন দর্শনের আলোচনায় আর যাই লাভ হোক, পৃথিবীকে নতুন করে গড়া সম্ভব হবে না যেমন সম্ভব হয়নি বেকনের পূর্ববর্তী ইউরোপের মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায়।

রামমোহনের উক্তিতে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক উপযোগিতার উপর গুরুত্ব আরোপ ও সেই সঙ্গে বেকনের নামোল্লেখ তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিষয়ে খানিকটা অলোচনা প্রয়োজন।

রেনেসাঁসের যুগে ইউরোপের মন প্রাচীন গ্রীক চিন্তা ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৩২৬) কিন্তু কৈশোর থেকেই প্ল্যাটো এবং বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের প্রতি বিরূপ হলেন। এই বিরূপতার কারণটি উল্লেখযোগ্য। বেকনের জীবনীকার ডঃ উইলিয়ম রলি (William Rawley) লিখেছেন।

“Whilst he was commorant in the university, about sixteen years of age, he first fell into dislike of the philosophy of Aristotle; not for the worthlessness of the author, but for the unfruitfulness of the way; being a philosophy (as his lordship used to say) only strong for disputations and contentions, but barren of the production of works for the benefit of the life of man.”

অ্যারিস্টটল ও সেই সঙ্গে ইউরোপের মধ্যযুগীয় পাণ্ডিত্যকে বেকন ত্যাগ করলেন, কারণ তাতে তর্ক বাড়ে, কিন্তু মানুষের পার্থিব অবস্থার উন্নতির উপযোগী জ্ঞান বাড়ে না। বিজ্ঞানকে বেকন চেয়েছিলেন জাগতিক উন্নতির সহায় হিসাবে।

বিজ্ঞানের মূল্য তার ব্যবহারে। এই মতবাদের অবশ্য অপব্যাখ্যা সম্ভব। মিথ্যাকেও ‘বিজ্ঞানসম্মত মনে হতে পারে। নিতান্ত ব্যবহারিক প্রয়োজনে মিথ্যা প্রচার যুদ্ধে ও রাজনীতিতে বিরল নয়। যে-অসত্য সাময়িকভাবে লাভজনক হতে পারে তার তুলনায় যে-সত্যু বিশ্বমানবের সম্পদ হতে পারে তার একটি বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃতি না হলে পরস্পরবিরোধী মিথ্যার আধিপত্যে মানুষের অগ্রগতি বিপন্ন হওয়া সম্ভব। তবে বেকনের বক্তব্যের উদ্দেশ্য ও পটভূমিকা ছিল ভিন্ন। তিনি চেয়েছিলেন নৈয়ায়িকদের তর্কের স্থানে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চাকে অধিষ্ঠিত করতে যাতে মানুষের বৈষয়িক উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়।

বেকন ধর্মবিরোধী ছিলেন না। বরং তাঁর জীবনদর্শনকে তিনি বাইবেলের উপরই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। বাইবেলে কথিত আছে যে, ভগবান প্রথম মানুষকে আশীবাদ করে বলেছিলেন।

“Be fruitful, and multiply, and replenish the earth, and subdue it.”

তিনি বলেছিলেন, এই পৃথিবীর উপর তোমাদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হোক, তোমরা ধনবান হও, তোমাদের বৃদ্ধি হোক। পরে ভগবানের নিষেধ অমান্য করার ফলে মানুষের পতন ঘটে। কিন্তু মানুষের জীবনের পরম লক্ষ্য সেই প্রথম দিনেই স্থির হয়ে গেছে। ভগবানের অভিশাপে মানুষ তার নিষ্পাপ সারল্য হারিয়েছে; সেই সঙ্গে প্রকৃতির উপর তার কর্তৃত্ব স্থাপনের পথও ঐ অভিশাপেই কঠিন পরিশ্রম সাপেক্ষ হয়েছে। বেকন বলেছেন যে, ধর্ম ও বিজ্ঞান দুই-ই আমাদের চাই। ধর্মকে চাই সেই নিষ্পাপ সারল্য পুনরুদ্ধারের জন্য, আর বিজ্ঞান দেবে আমাদের প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব ও পার্থিব সম্পদ। বেকনের সেই বিখ্যাত উক্তি এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে।

“For Man through the Fall lost both his state of innocence and his lordship over the created world. Both these losses can, even in this life, be partially repaired; the former by Religion and Faith, the latter by Arts and Sciences.” (Novum Organon).

ইতিহাসে মানুষের প্রগতি সম্বন্ধে বেকনের চিন্তায় এক নতুন দিগন্ত উদঘাটিত হলো। বেকন বললেন যে, বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে সমাজ, সভ্যতা ও ইতিহাসে যে বিরাট পরিবর্তন এনে দেয় দিগবিজয়ী বীর ও সাম্প্রদায়িক গুরুদের শক্তি সে তুলনায় সামান্য। সম্রাটপূজায় অভ্যস্ত ইউরোপে, সাম্প্রদায়িক কলহে রক্তাক্ত ইউরোপে, বেকনের কণ্ঠধ্বনি মানুষকে আহ্বান করল শিল্প ও বিজ্ঞানের সাধনায়, গঠনমূলক কর্মের পথে।

সেই আহ্বান উনিশ শতকের গোড়ায় ভারতে এসে পৌঁছেছিল। রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের চিন্তায় তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।

রামমোহন এদেশে সংস্কৃত শিক্ষার আধিপত্য কমাতে চেয়েছিলেন যাতে নতুন চিন্তার স্রোত দেশে সহজে প্রবাহিত হতে পারে। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শিক্ষাকেই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন চিন্তার বিপ্লবকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। এ বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর ধারণা অতি পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বিনয় ঘোষ মহাশয়ের গবেষণার গুণে সেই পরিকল্পনার সঙ্গে আমরা অনেকেই আজ পরিচিত।

বেকন যেমন প্ল্যাটো ও অ্যারিস্টটলের দর্শন বর্জন করেছিলেন বিদ্যাসাগরও তেমনই সাংখ্য বেদান্তকে ভ্রান্ত বলেছিলেন। কিন্তু প্রাচীন দর্শন ভ্রান্ত হলেও সমাজ সংস্কারকের সে-বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন এমন কিছু তরুণ পণ্ডিত তৈরি করতে যাঁরা একদিকে যেমন ইংরেজী ভাষা ও আধুনিক দর্শনবিজ্ঞানের সঙ্গে সুপরিচিত হবেন অন্যদিকে তেমনই সংস্কৃত ও প্রাচীন শাস্ত্র ভালোভাবে জানবেন। তা ছাড়া আধুনিক ভারতীয় ভাষায় জনসাধারণের জন্য নিজের মতামত প্রকাশ করবার দক্ষত্রও এঁদের অর্জন করতে হবে। সংস্কৃত কলেজের শিদের জন্য এই ছিল বিদ্যাসাগরের পরিকল্পনা। তিনি লিখেছিলেন।

“Youngmen thus educated will better able to ___ the errors of ancient Hindu philosophy than if they were to ____ knowledge edge of philosophy  simply from European sources.”

শুধু ইংরেজীতেই যাঁদের বিদ্যা সীমায়িত তাঁদের ধ্যানধারণা দেশের মনে পৌঁছবে না। বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সমালোচনায় অভ্যস্ত ও পাশ্চাত্ত্য চিন্তার সঙ্গে পরিচিত এমন এক নবীন শিক্ষিত সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে যাঁরা দেশের মনে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। আজকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে তাকিয়ে মনে হয় না যে, ঈশ্বরচন্দ্রের সেই আশা পূর্ণ হয়েছে।

.

এদেশে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা প্রবর্তনের পর শতাধিক বৎসর পূর্ণ হয়ে গেছে। বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাত্রায় একেবারেই ফলপ্রসূ হয়নি একথা বলা যায় না বিদ্যাসাগরের জীবনের প্রথমভাগে এদেশে রেলগাড়ী ছিল না। বাষ্পীয় যানের প্রবর্তন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। নুইয়র্ক ডেইলী ট্রিবুন’-এর পৃষ্ঠায় মার্ক্স সেদিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

“The railway system will become in India truly the forerunner of modern industry.”

কয়েকটি আধুনিক শিল্প যে তারপর এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি এমন নয়। বাষ্পীয় শকটের যুগ ছাড়িয়ে আমরা বিমানপথের যাত্রীও হয়েছি। কিন্তু শতবর্ষ পরে মার্ক্সের ভবিষ্যদ্ববাণীর ঐ ক্রিয়াবিশেষণটি (“truly’) এখনও যেন আমাদের সমানে তিরষ্কারবাণী হয়ে আছে।

আবারও বলতে হয় যে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এদেশের মাটিতে এখনও শিকড় গাড়তে পারেনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়, আর্থিক জীবনে, রাজনীতিতে সর্বত্র এটা প্রকট।

কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর প্রচলন হয়েছে; পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় আধুনিক লেখকদের নামও খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু যে-মন নিয়ে আমরা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করি, তাকে আধুনিক মন বলা যায় না। সেকালে সংস্কৃত টোলের ছাত্র ব্যাকরণ, সাহিত্য। ও নানা শাস্ত্র কণ্ঠস্থ করত; আজকের ছেলে পাঠ্যপুস্তক বিষয়ক ব্যাখ্যাপুস্তক মুখস্থ করছে। আমরা মুখে বলি যে, বিদ্যার্থীকে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হবে, নিজের মতো করে উত্তর লিখতে হবে। বিদ্যার্থী কিন্তু কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষা কক্ষে যায়, ধরাবাঁধা প্রশ্নের ভিতর উত্তরের সুবিধা না থাকলে পরীক্ষাকেন্দ্র ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে। এদিক থেকে টোলের শিক্ষাব্যবস্থাই অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল।

বিজ্ঞানের যুগে জ্ঞান ক্রমশ বেড়ে চলেছে, শিল্পে অবিরত উন্নতি ঘটছে, প্রচলিত ধারণার বহু পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা এমন ছাত্র চাই যারা প্রশ্ন করতে শিখবে, নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে নিজ বুদ্ধিবৃত্তি চালনা করতে জানবে। ধরাবাঁধা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থের ভিতর। দিয়ে পরিবর্তনশীল জীবনের জন্য এই প্রস্তুতি অথবা বুদ্ধির এই বিকাশ সম্ভব নয়। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক যুগের উপযোগী মানুষ তৈরি করতে অক্ষম। সংস্কারের কোনো আন্তরিক চেষ্টাও অনুপস্থিত। কিছুদিন আগে সংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ের একজন অধ্যাপক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকদের মতামত সংগ্রহ করেন। পরীক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের নামে অনেকেই চাইছেন যে, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের হাতে প্রধান প্রধান পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করবার ভার বেশি করে তুলে দেওয়া হোক। যেন পঠিতব্য বিষয়গুলিও ইতিমধ্যে অবসর গ্রহণ করে থেমে আছে! রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে আমাদের শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থাকে আজও জুড়ে বসে আছে এক মধ্যযুগীয় মন।

বিজ্ঞান পৃথিবীকে নতুন করে গড়তে পারে, আমাদের বৈজ্ঞানিকরাও এই বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত নন। অতএব তাঁরা ব্যক্তিগত উন্নতির প্রচেষ্টায় পারিষদনীতিতেই ব্যস্ত। তার। উপর আবার এদেশের গবেষণাগারে বিজ্ঞানচর্চা যতটুকু হয় তার সঙ্গে আমাদের উৎপাদনব্যবস্থার, কৃষি ও শিল্পের, যোগাযোগ ক্ষীণ। এদেশে আধুনিক কৃষিগবেষণার। সূচনা হয়েছে শতাব্দীর বাঁকে জাপানেও প্রায় একই সময়ে ঐ জাতীয় কাজ শুরু হয়। কিন্তু জাপান শুধু গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেই সন্তুষ্ট থাকেনি গ্রামে গ্রামে সমস্ত চাষীকে শিক্ষিত করে তুলেছে এবং কৃষি ব্যবস্থার বহু উন্নতি সাধন করেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও ওদেশে কৃষিকাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছে। আর এদেশে অধিকাংশ চাষী আজও নিরক্ষর। এদেশের মাটিকে সুজলাসুফলাশস্যশ্যামলা করবার জন্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ উদ্যোগী হয়নি। এর নানা কারণ আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই কারণগুলি দূর করবার জন্য আমরা যথেষ্ট সচেষ্ট নই। এই কৃষিপ্রধান দেশে বিজ্ঞানের সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের বিচ্ছেদ মাঠে মাঠে মহৎ সম্ভাবনার ব্যর্থতায় প্রকট।

যেখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভিতর গঠনমূলক প্রচেষ্টা অনুপস্থিত, সেখানে সেই নিশ্চেষ্টতার একটা বৈপ্লবিক কৈফিয়ত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এ দেশে শিক্ষিতদের ভিতর এ কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, ছোট ছোট ক্ষেতে উন্নত ধরনের চাষ সম্ভব নয়; সেইজন্য চাই বৃহৎ যৌথ কৃষিক্ষেত্র। যৌথ চাষ যতদিন না চালু হচ্ছে, ততদিন বৈজ্ঞানিক কৃষিব্যবস্থা আশা করা যায় না। বৈজ্ঞানিক কৃষির নাম শ্রবণ মাত্র আমরা মুখস্থ শ্লোক উচ্চারণের মতো করে বলি “ট্রাক্টর”। যেন ঐ একটি বস্তুতেই বৈজ্ঞানিক কৃষি নামক অবয়বহীন একটি ভাব মূর্তি লাভ করেছে। এই ধারণার পরিবর্তন প্রয়োজন। ট্রাক্টরের ব্যবহারে অপেক্ষাকৃত অল্প লোকের সাহায্যে চাষ সম্ভব যে দেশে জনশক্তির অপ্রাচুর্য সেখানে এই বিশেষ যন্ত্রটির ব্যবহার প্রয়োজনীয়। কিন্তু জমির উৎপাদিকাশক্তি বাড়াবার জন্য ট্রাক্টর অপরিহার্য নয়। বরং প্রয়োজন উৎকৃষ্ট বীজ বপন, জল ও সারের ব্যহার, কীটাদিনাশের জন্য বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন। জাপানে কৃষিজাত উৎপাদন বৃদ্ধির মূল কারণ অপর্যাপ্ত সার ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ। এইসব উপায়ে ছোট ক্ষেতেও উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। অবশ্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারকে কৃষিকাজে টানতে হলে অপেক্ষাকৃত বড় জোত প্রয়োজন। বাংলা দেশের জমির মালিকানায় পঁচিশ একরের একটি ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই পঁচিশ একর জমিও ছোট ছোট বহু খণ্ডে বিভক্ত। মধ্যবিত্ত পরিবার সাধারণত এই খণ্ড খণ্ড জমি বর্গাদার বা ভাগচাষীর হাতে তুলে দেন। পঁচিশ একর জমি একটি অবিভক্ত ক্ষেত্র হিসাবে লাভ করলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও নিজস্ব পরিচালনায় কৃষিকর্মকে জীবিকা উপার্জনের পথ হিসাবে গ্রহণ করা সহজ হবে। কৃষির উন্নতিতে মধ্যবিত্ত মানুষ যেখানে নিজে মনোযোগী নয়, সেখানে জমির মালিকানায় তার অধিকার সঙ্কুচিত করাই ভালো। যৌথ চাষ না হলেও চলে। কিন্তু বগাদারী ব্যবস্থার পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। এটা এমন কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয়। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবিষয়ে উৎসাহিত হলে এই পরিবর্তনটুকু সম্পন্ন করা দুঃসাধ্য হবে না। দুঃখের বিষয়, এ দেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যদিও বেড়েছে, এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্রদের বিজ্ঞানস্পৃহা নির্জীব ফলিত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের চেয়ে রাজধানীর অফিসঘর ও রাজনীতির উত্তেজনা তাঁদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়।

আমাদের রাজনীতির সঙ্গে বিজ্ঞানের মিত্ৰতা নেই। এর কোনো দীর্ঘ বিশ্লেষণ এখানে। সম্ভব নয়। দুয়েকটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্যেই বক্তব্য শেষ করতে হবে।

প্রাচীন ও আধুনিক যুগের ভিতর আমাদের মন দ্বিধায় দোদুল্যমান। ইংরেজ ও মুসলমানের প্রতি বিরূপতায় রক্ষণশীল হিন্দুয়ানীর সমর্থকদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে। ইংরেজী হটাবার তোড়জোড়ে ও গো-হত্যা নিবারণী আন্দোলনে এই দৃষ্টির সংকীর্ণতা তীক্ষ্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার কাম্য, এর সপক্ষে যুক্তি আছে। কিন্তু এই যুক্তি যাঁরা মেনে নিয়েছেন, তাঁরাও স্বীকার করবেন যে, উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ভাষাকে যুক্ত করা প্রয়োজন, তা নইলে আমরা মনে ও বুদ্ধিতে প্রাদেশিক হয়ে পড়ব। এ দেশে আমরা যদি বিজ্ঞান চিন্তাকে সবল রাখতে চাই তো মাতৃভাষার পাশে এই দ্বিতীয় স্থানটি দিতে হবে ইংরেজীকে। উচ্চশিক্ষায় বাংলা ও হিন্দীকে আবশ্যিক করার চেয়ে, হিন্দীভাষীর পক্ষে হিন্দী ও ইংরেজী এবং বাঙালীর জন্য বাংলা ও ইংরেজীর দ্বৈতবন্ধনই যে শ্রেয়, এবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। মাতৃভাষা ও ইংরেজীর পর অপর একটি ভারতীয় ভাষা যদি শিক্ষণীয় হয় তোত সংস্কৃতের দাবিটাই আগে বিবেচ্য। এবিষয়ে বিদ্যাসাগরের মতামত সমর্থনযোগ্য। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের কাছে আমাদের বিজ্ঞানবুদ্ধি পরাস্ত হতে চলেছে।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে গো-হত্যা নিবারণী আন্দোলনে। গো-রক্ষার সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে গান্ধীজীর ভূতপূর্ব সচিব ১৯৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি তারিখে স্টেটসম্যান কাগজে প্রকাশিত একটি পত্রে লিখেছেন।

“We go against the principle of cow protection when we use leather goods made from the skins of the slaughtered animal; we condemn the cow and its progeny to death by slow starvation or under the butcher’s knife when we throw them out of work by using the tractor for ploughing, the electric pump for inrigation, the diesel engine for oil pressing, crushing sugar cane, grinding corn or husking rice, the truck for transfer of farm products, and chemical fertilizers in the place of composted manure… Let those who support the demand for stopping cow slaughter, therefore, if they mean business, launch a movement to restore to the cow and its progeny its due place in our econony.”

যে-সমাজে গরুর মূল্য শুধু তার দুগ্ধে নয়, বরং কৃষি, শিল্প ও পরিবহণব্যবস্থায় গো-শক্তিই প্রধান চালক শক্তি, সেখানেই গো-হত্যা নিবারণী আন্দোলন ব্যবহারিক দৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত মনে হতে পারে। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গরুর দুগ্ধ, মাংস ও চর্মের ব্যবহারই প্রাধান্য লাভ করে; শক্তির উৎস হিসাবে ধেনুর চেয়ে বিদ্যুৎই বড় হয়ে ওঠে। এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই যে, জাপানে শিল্প বিপ্লবের আগে উচ্চশ্রেণীর লোকেরা গো-মাংস ভক্ষণ করতেন না, কিন্তু এখন করেন। তাছাড়া, গো-মাংস রপ্তানির প্রশ্নও আছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী বিসর্জন দিয়ে গরুকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করলেই বিপদ। এই যুক্তিহীন রাজনীতিতে গো-মাতা রক্ষা পান না; সমাজের সংহতি ও প্রগতি

বিপন্ন হয়।

দুঃখের বিষয়, এ দেশে মার্ক্সবাদও শেষ অবধি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সহায়ক হয়নি। মার্ক্স স্বয়ং বিজ্ঞানে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর চিন্তায় মানবতাবাদী ঐতিহ্যের ধারাও মিশেছে। ফয়েরবাখ খ্রীষ্টধর্মের একটি মানবতাবাদী ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন। ধর্ম বলেছে যে, ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করলে সমাজকে শাস্তি ভোগ করতে হয়, আর ঈশ্বরের অন্য নাম প্রেম। ফয়েরবাখ অর্থ করলেন, মানবপ্রেমেই সমাজের ভিত্তি। ঈশ্বর মানুষ থেকে অন্তরিত মনুষ্যত্ববোধ।

মার্ক্স চেয়েছিলেন, বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে, মনুষ্যত্বে বিধৃত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু ইতিহাসকে তিনি ব্যাখ্যা করলেন শ্রেণীসংগ্রামের সূত্র ধরে। শ্রেণীতে শ্রেণীতে স্বার্থের দ্বন্দ্বই মনুষ্যত্বের অভিব্যক্তির পথে বড় বাধা। এই দ্বন্দ্বের মূলে আছে উৎপাদনের। মূল উপকরণে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার। শ্রেণীসংগ্রামের ভিতর দিয়েই শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের অবসান ঘটতে পারে। শ্রেণীসংগ্রামের পথেই শুধু মনুষ্যত্বের জয়লাভ সম্ভব মার্ক্সবাদের এটা মূলকথা।

শ্রেণী সচেতনতা থেকে যে-ঐক্যবোধ, তাকে মনুষ্যত্ব বলা চলে না; মানুষ হিসাবে যে-স্বাজাত্যবোধ, তারই নাম মনুষ্যত্ব। ইতিহাস থেকে এই মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে। ইতিহাসের অন্তে তাকে খুঁজে পাওয়া অনেকের কাছে অতিনাটকীয় মনে হয়েছে। তার চেয়ে বিশ্বাস করা ভালো যে, ইতিহাসের ধাপে ধাপে মনুষ্যত্বের ক্রমশ বিকাশ ঘটছে, অর্থাৎ ইতিহাসের প্রতি পর্যায়ে দ্বন্দ্ব ও মানবিক সহযোগিতা দুই-ই উপস্থিত। ইতিহাস সহযোগিতারও ইতিহাস। মনুষ্যত্বের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে সমাজ এক মুহূর্তও টিকতে পারে না। ভগবানকে যেমন শুধু সৃষ্টির আদিতে অথবা অন্তে কল্পনা করা অর্থহীন, মানবিক সহযোগিতা ও মানুষের আন্তরিক ঐক্যবোধকেও তেমনই ইতিহাসের আদিতে ও অন্তে মাত্র প্রতিষ্ঠা করলে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যায়।

মার্ক্সের আদর্শ ছিল মনুষ্যত্বের আদর্শ। কিন্তু যে-পরিমাণে শ্ৰেণীযুদ্ধের ঐকান্তিক ধারণা মার্ক্সবাদীর চেতনাকে অধিকার করেছে সে-পরিমাণে একটি নতুন বিপদও সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞানবুদ্ধি পরাস্ত হতে বসেছে জঙ্গীবুদ্ধির কাছে। তাই উত্তেজক বক্তৃতায় এঁদের যতটা উৎসাহ দেখা যায়, লোকশিক্ষায় ততটা নয়। গো-রক্ষা নিবারণী আন্দোলন উপলক্ষে বামপন্থীরা “দক্ষিণ-পন্থী চক্রান্তের কথা বলেছেন, কিন্তু এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রচারে সক্রিয় হননি। পরিবার নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনায়ও এঁরা “সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত দেখতে পান। মার্ক্সবাদীর মন যে-সুরে বাঁধা হয়ে গেছে তাতে যুদ্ধের সুর যত অনায়াসে বাজে, যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা তেমন আসে না। স্বয়ং নেহরু তাই একবার বলেছিলেন যে, এঁদের শান্তি আন্দোলনের ইস্তাহারও কেমন যেন যুদ্ধনিনাদের মতো শোনায়।

মনুষ্যত্বের নীতি আর যুদ্ধের নীতি এক নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদী যেমন তার যুদ্ধং দেহি ডাকে সমাজে বিপদ ডেকে আনেন, শ্রেণীসংগ্রামের ধ্বজাধারীও তেমনই দ্বন্দ্ববোধের তীব্রতায় সমাজকে বিপদের পথে ঠেলে দিতে পারেন। যুদ্ধের একটা উন্মাদনা আছে–সেটা ধর্মের নামেই হোক আর শ্রেণীর নামেই হোক। সেই উন্মাদনায় অবশেষে। মনুষ্যত্ব আচ্ছন্ন হয়। মার্ক্সবাদ এই বিপদ থেকে মুক্ত নয়। মাওবাদে এটা প্রত্যক্ষ। সোভিয়েত লেখক ফেদোসিয়েভ লিখেছেন “সমাজ যতদিন শ্রেণীবিভক্ত, ততদিন তার সমগ্র ইতিহাসই শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস, এই মার্ক্সীয় তত্ত্বের স্থলে মাও সেতুঙ ইতিহাসকে যুদ্ধের ইতিহাস বলে তাঁর সমরবাদী ইতিহাসতন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। মাও। সে-তুঙ-এর বিচারে শ্রেণীসংগ্রামের নিয়মনীতি নয়, যুদ্ধের নিয়মনীতিই রাজনীতির পথ নির্ধারণ করবে।” (মার্ক্সবাদ ও মাওবাদ, সোভিয়েত সমীক্ষা, ২৫ মে ১৯৬৭)। এই পরিণতি আকস্মিক নয়, মার্ক্সবাদেই এর বীজ নিহিত ছিল। অবশ্য চীনের বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিও এজন্য অংশত দায়ী।

এদেশে অতিবৈপ্লবিক পদ্ধতিতে কম্যুনিজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বরং এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে উগ্র দক্ষিণপন্থীরাই দিল্লীতে ক্ষমতায় আসবেন। আর বাংলা দেশে এতে অরাজকতা স্থায়ী হবে। শিল্পে ও আর্থিক উন্নয়নে আমরা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে যাব। এই দুর্গতি ও আশাভঙ্গের ফলে আমাদের বৈপ্লবিক উন্মাদনাটাই যদি আরও বাড়ে, তাতে কারোরই মঙ্গল হবে না। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে আমাদেরই।

যে-প্রাণশক্তি নিয়ে বাংলা দেশ বৈপ্লবিক মার্ক্সবাদের দিকে ঝুঁকেছে, তার ভগ্নাংশ নিয়েও যদি শিক্ষিত বাঙালী গঠনমূলক কাজে, লোকশিক্ষার প্রসারে, শিক্ষার সংস্কারে, বিজ্ঞানচর্চায় ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রচারে, এবং কৃষি ও শিল্পে তার প্রয়োগে আত্মনিয়োগ করত, তা হলে ভারতের প্রগতির ইতিহাসে বাংলা দেশ আবারও একটি গৌরবে উজ্জ্বল অধ্যায় যোগ করতে পারত। কিন্তু সে আশা আজ সুদূরপরাহত। রামমোহন-বিদ্যাসাগরের ধারা এই বাংলায় জয়ী হবে, এ সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে চলেছে।

.

বেকন বলেছিলেন, জ্ঞানই শক্তি। কথাটা নানাভাবে সত্য। যে-অন্ন ক্ষুধার্তের দেবতা, বিজ্ঞানই শুধু সেই অন্ন জনে জনে বিতরণ করতে সমর্থ। বিজ্ঞানই পারে গ্রামে গ্রামে প্রদীপ জ্বালাতে। প্রকৃতির শক্তিকে বিজ্ঞান করে মানুষের ভৃত্য, মানুষকে সে করে প্রাণীজগতের অধিপতি। পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের বাত বিজ্ঞান এক নিমেষে অলৌকিক ডাকহরকার মতো আমাদের ঘরে পৌঁছে দেয়, যেন এই বিপুলা পৃথ্বী ছোট একটি পল্লীমাত্র। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য শিল্প ও বিজ্ঞান অপরিহার্য। আবার পরমাণুবোমার ভয়ঙ্কর শক্তি মানুষের হাতে তুলে দিয়ে বিজ্ঞান মানুষকে বলে, এক হও, নয়তো ধ্বংস হও। বিজ্ঞানই আমাদের আজকের রাজনীতিকে গ্রাম্য রাজনীতি বলে। চিনিয়ে দেবে। এবং বিজ্ঞানই অবশেষে এ যুগের একটি “বৈজ্ঞানিক আশাকেও ভ্রান্ত বলে চেনাবে। বিজ্ঞানের বলে সমৃদ্ধিময় যে নতুন জগৎ আমরা সৃষ্টি করবার আশা রাখি, স্বয়ং বুদ্ধেরও তা কল্পনার অতীত ছিল। তবু সে সমৃদ্ধি যেদিন আমরা লাভ করব, জীবন। থেকে দুঃখ সেদিনও দূর হবে না। মৃত যদি থাকে তো ভয়ও থাকবে; পরিবর্তন যতদিন আছে, আশংকা ততদিন দূর হবে না। বিজ্ঞান আমাদের জাগতিক সমৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠিত করে সুখের অলীক আশা থেকে মুক্তি দেবে। বিজ্ঞান ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *