৩৫. রাধিয়া

৩৫. রাধিয়া

পরিটা ঘোরে না। কতদিন ঘোরে না এই পরি? জানে না রাধিয়া। শুধু এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে, মেঘের দিকে তাকিয়ে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে পরি! ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় রোদ এসে লেগেছে এখন। কমলালেবু রঙের সূর্য শীতের কলকাতার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার আগে নিজের শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেলোফেনের মতো আলো লেগে রয়েছে মেমোরিয়ালের চূড়ায়, ক্যাথিড্রালের গথিক থামে, ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়ানো উঁচু বাড়িটির গালে। পরির ডানাও ভিজে আছে সেই রোদে। পরিটার জন্য কষ্ট হয় রাধিয়ার। ও জানে পরি হয়ে থাকার যন্ত্রণা।

ছোটবেলায় বাবা পরি বলে ডাকত ওকে! সাদা ফ্রিল দেওয়া ফ্রক, মাথায় সাদা হেয়ার ব্যান্ড পরা ছবি যে ওর কত আছে। বাবার কোলে রাধিয়া। বাবার কাঁধে রাধিয়া। বাবা খুব খুশি হয়ে হাসছে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে।

এইসব ছবি এখন ডিজিটাল ফ্রেমে ট্রান্সফার করানো হয়েছে। রাতে, একা-একা সেই ছবি দেখে ও। বাবার সঙ্গে লেপটে থাকার সেই বয়সটার কথা ভাবে। ভাবে সেই মেয়েটা কোথায় গেল! ঠিক কোন দিন থেকে মেয়েটার হাত ছেড়ে দিল বাবা। রাধিয়ার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কষ্ট হয়। ওদের বিশাল বড় বাড়িটা কেমন দৈত্যের কেল্লা মনে হয়। মনে হয় এই গোলকধাঁধায় আটকে গেছে, হারিয়ে গেছে ও। ওই পরির মতো নিরুপায় হয়ে থেমে আছে। মানুষ হয়ে বেঁচে ওঠা যেন আর হল না রাধিয়ার।

রাধিয়া জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে দেখল। ভাড়া করা গাড়িতে বসে আছে ও। চৌরঙ্গি আর ক্যাথিড্রাল রোডের ক্রসিংটায় আছে ওর গাড়ি। নন্দন চত্বরে যাবে ও। নিশান আসবে। নিশানের সঙ্গে দেখা করাটা খুব দরকার। সেদিনের পর থেকে আর নিশানের সঙ্গে দেখা হয়নি। পরপর দু’দিন যা অসভ্যতা করল বাবা! কীভাবে যে নিশানের কাছ থেকে ক্ষমা চাইবে বুঝতে পারছে না।

আজ বড়দিন! ইউনিভার্সিটি ছুটি। তাও বেরিয়েছিল রাধিয়া। জয়তীর বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল ওর। আসলে ঠিক নেমন্তন্ন নয়। জয়তীকে ও বলেছিল, মাকে যেন ফোন করে জয়তী। বলে, নেমন্তন্ন আছে। সেদিনের পরে ওকে সারাক্ষণ চোখে-চোখে রাখা হয়েছে! ইউনিভার্সিটি যাওয়া আর আসা। তাও গাড়িতে মধুদার সঙ্গে বুজুকেও পাঠানো হয়। মাঝে মাঝে এত দম বন্ধ লাগে! বাবা এমন বাড়াবাড়ি করছে কেন, কে জানে!

মাকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল রাধিয়া। বলেছিল, “এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? এমন কতদিন চলবে মা? আমি তো মানুষ না কি!”

মা রাগ দেখিয়ে বলেছিল, “যতদিন না সোনাঝুরির কাজটার কিছু ব্যবস্থা হয় ততদিন! আর কোন মুখে কথা বলিস তুই? লজ্জা করে না! অমন একটা ছেলের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসেছিলি! ছিঃ ছিঃ! এভাবেই থাকতে হবে তোকে। তোর বাবাকে এইজন্য আমি বলেছিলাম, মেয়েকে এখানে রেখো না। বিদেশে পাঠিয়ে দাও। কিন্তু আমার কথা আর তোর বাবা শুনেছে কবে! মেয়ে যা বলবে, সেটাই যেন সব! নাও এখন ভোগো! তোকে বলে দিলাম, এভাবে অসভ্যতা আমরা সহ্য করব না। এটা মাথায় থাকে যেন।”

রাধিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল অবাক হয়ে। মা এভাবে বলতে পারে কী করে? বাবা যে কী করে বেড়াচ্ছে, সেটা যদি একবার জানতে পারে, তখন ও দেখবে মায়ের এই সব কথা কোথায় যায়! কিন্তু রাধিয়া এখনও স্পষ্ট করে জানে না বাবা ঠিক কী করছে। ওদের ব্যাবসার কাজে বাইরে যাচ্ছে বলে আসলে কোথায় যাচ্ছে। নিশানের সঙ্গে এই নিয়ে আর কথাই হয়নি সেভাবে। আসলে সেদিন ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেছিল ওই সব কথা। কিন্তু তারপর থেকে নিশান এই নিয়ে ওকে কিছু বলেনি। আর রাধিয়াও স্বভাবগত লজ্জা আর দ্বিধায় ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি।

জয়তী ওর শেখানো কথামতো মাকে ফোন করেছিল গতকাল। মা প্রথমে গাঁইগুঁই করেছিল বটে, কিন্তু মুখের ওপর না করতে পারেনি। মায়ের এই ব্যাপারটা জানে রাধিয়া। মায়ের রাগ-টাগগুলো সব ঘরের ভেতরে, ওর সামনে। বাইরের লোকের সামনে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। তাই জয়তীকে দু’-একবার না করেও শেষে হ্যাঁ করে দিয়েছিল।

মা আজ রাধিয়াকে বলেছিল, “আমাদের সঙ্গে রাতে ক্লাবে যাবি না বলেই কি বান্ধবীকে দিয়ে এমন একটা ফোন করালি?”

রাধিয়া গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “এসব আমায় না জিজ্ঞেস করে জয়তীকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতে! ঠিক আছে জয়তীর মায়ের সঙ্গে না হয় আবার ফোন করে কথা বলো।”

মা আর কথা বাড়ায়নি। শুধু বলেছিল, “কিন্তু আজ তো মধুদা ছুটি নিয়েছে। আর বুজু আমায় নিয়ে পার্লারে যাবে। ঠিক আছে, ছোট হ্যাচব্যাকটা নিয়ে তপনকে না হয় বলব তোকে পৌঁছে দিতে।”

“আমি গাড়ি বুক করে নেব মোবাইল থেকে। আমায় কী ভাবো মা? কী ভাবো আমায়?” রাগে ছটফট করে উঠেছিল রাধিয়া, “একটা দিন। আমি নিশানের সঙ্গে দেখা করব না, হয়েছে? এমন কোরো না সবাই মিলে! আমি মরে যাব এবার!”

মা আর কথা বাড়ায়নি। শুধু বলেছিল, “তোর বাবা এখন নেই। আজ সন্ধেবেলা ফিরবে। তারপর আমরা ক্লাবে যাব। তার আগে ঢুকে পড়বি কিন্তু!”

বাবা গতপরশু আবার বাইরে গিয়েছে। বাবা বাইরে গেলেই কেমন একটা লাগে রাধিয়ার। কেমন একটা মনখারাপ হয়। কষ্ট হয় বুকের মধ্যে। মায়ের জন্য খারাপও লাগে। মনে হয় মায়ের কাছে গোটা ব্যাপারটা লুকিয়ে ও খুব খারাপ কাজ করছে। কিন্তু আসল কথাটা যতক্ষণ না ও নিজে ঠিকঠাকমতো জানতে পারছে, ততক্ষণ তো কিছু বলতেও পারছে না। এখন এমনি বললে মা পাত্তাই দেবে না। মা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে বাবাকে। কিন্তু তাও ওর অপরাধবোধ হয়। মনে হয়, বাবা যে ওদের মিথ্যে বলছে সেটা ওর লুকিয়ে রাখা উচিত হচ্ছে না।

জয়তীর বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে রাধিয়া। মাকে বললেও, আসলে ও নিশানের সঙ্গেই দেখা করতে চায়। যে-ছেলেটাকে ওর এত ভাল লাগে, আর ছেলেটাও যা ইঙ্গিত দিয়েছে, তাতে বুঝেছে নিশানেরও ওর ওপর দুর্বলতা আছে। সে কী করে একবারও ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে না! ওর ফোন তো কেড়ে নেয়নি কেউ! নিশানের মনের ভাব পড়তে কি তা হলে ভুল হয়েছিল! সব এমন ছন্নছাড়া কেন ওর জীবনে! কিছুই কি রাধিয়া গুছিয়ে করতে পারে না! অনেকটা রাগ আর জেদ থেকে আজ সকালে নিশানকে মেসেজ করেছিল রাধিয়া। লিখেছিল, ‘আমি দেখা করতে চাই।’

সামান্য সময় পরে নিশান উত্তরে লিখেছিল, ‘একা? না বাবা সমেত!’

রাগে গা জ্বলে গিয়েছিল রাধিয়ার। কী সাহস! ওকে চিমটি কেটে কথা বলছে! ও লিখে পাঠিয়েছিল, ‘একা। একাই। পাঁচটা, নন্দন।’

নিশান একটা ছোট্ট ‘ওকে,’ লিখে পাঠিয়েছিল শুধু!

জয়তীদের বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় একবার মনে হয়েছিল নিশানকে ফোন করে কনফার্ম করবে কি না। কিন্তু শেষে করেনি। কথার দাম নিশ্চয় আছে ছেলেটার। আর যদি না থাকে তা হলে তো হয়েই গেল। কেন কে জানে সেদিনের পর থেকে নিশানের ওপর কেমন যেন একটা অভিমান জমেছে ওর মনে। সবার সামনে থেকে বাবা ওরকম করে ওকে নিয়ে গেল, সেখানে নিশান কিছু বললই না প্রায়! আর শেষে বলল কিনা, বাবা এরকম বলে ওকে ফোন করে না। বাবা-মা কেমন হবে তার ওপর কি সন্তানের হাত থাকে? তা হলে সেই কথা বলে ওকে অপমান করার কী মানে! আজ তাই তো ডেকেছে ওকে। আর কবে সময় পাবে জানে না। কিন্তু আজ নিশানকে জিজ্ঞেস করবেই ওর ওইসব কথার মানে। কেন নিশান এমন! সব জেনেও কেন এমন করেছে ওর সঙ্গে! ও কাউকে কিছু বলে না বলে সবাই ওকে ভিতু আর টেক্‌ন ফর গ্র্যান্টেড করে নিয়েছে! এটা আর যেন আজকাল সহ্য হয় না। সেদিন যেভাবে বাবা ওকে টানতে-টানতে নিয়ে এল, নিশান তো তারপর একবারও কিছু জিজ্ঞেস করল না যে, ও কেমন আছে! এমন একটা ছেলেকে দেখে ক্ষণিকের দুর্বলতায় রাধিয়া বাবার ব্যাপারটা বলে দিল? তবে কি ও ভুল করেছে! আজ নিশানের সঙ্গে দেখা করে এটাই নিজের কাছে পরিষ্কার করে নেবে ও। তাই মনে মনে তৈরি হওয়া অভিমান আর রাগটাকে রাধিয়া বাঁচিয়ে রাখছে। এটা কাজে লাগবে পরে।

বেরোনোর মুখে জয়তী বলেছিল, “নিশানের সঙ্গে দেখা করছিস, বাড়িতে জানলে কিন্তু বিশাল ঝামেলা হবে আবার!”

রাধিয়া হেসেছিল সামান্য, “হলে হবে। কিন্তু জানার উপায় নেই।”

জয়তী হেসেছিল। তারপর ওর হাতটা ধরে বলেছিল, “প্রেমে পড়েছিস না, ছেলেটার?”

“ভাগ!” রাধিয়া নিজের অজান্তেই লাল হয়ে উঠেছিল।

“ইঃ! খালি ঢপ! মুখ সঙ্গে-সঙ্গে লাল হয়ে উঠল, আর বলে কিনা পড়েনি! কিন্তু যা করবি ভেবে করবি।”

রাধিয়া তাকিয়েছিল জয়তীর দিকে। মেয়েটা খুব ভাল। ওকে খুব ভালবাসে। এই যে মিথ্যে করে নেমন্তন্নের কথাটা বলল, তাতে জয়তী সত্যি ওকে বাড়িতে ডেকে দুপুরে খাইয়েছে। ওর বাবা, মা, বোন কত গল্প করেছে। গান করেছে। এত ভাল লেগেছে রাধিয়ার। ওর তো নিজের বাড়িতে যেতেই ইচ্ছে করছিল না। কী সুন্দর ওদের বাড়িটা। পুরনো দিনের উঁচু সিলিং। মোটা ভারিক্কি দেওয়াল। লাল মেঝে। বিশাল বড় সেগুন কাঠের দরজা। লম্বা পেতলের ছিটকিনি। কাচের স্কাইলাইট। চওড়া বারান্দা। নিচু ধাপের সিঁড়ি। কেমন একটা পুরনো সুন্দর কলকাতা যেন থমকে আছে জয়তীদের বাড়িতে। বাইরের, রাস্তার সব পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন চৌকো কলকাতা তৈরির চেষ্টাটা এখানে ঢুকতে পারেনি এখনও। এর তুলনায় ওদের বাড়িটা কেমন যেন গোমড়া আর মনখারাপ রঙের! ওদের বিত্তের তো অভাব নেই, কিন্তু চিত্তের অভাব বড় প্রকট।

রাধিয়া বলেছিল, “আমি কিছু করব না রে। আমি একটা-দুটো প্রশ্ন করব। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তো বিশ্বাসের আর ভরসার। সেটাই জিজ্ঞেস করব।”

জয়তী বলেছিল, “দেখ রাধি, তোদের অনেক টাকা। সেটা একটা যেমন সুবিধে তেমন অসুবিধেও। তুই অন্য বড়লোক বাড়ির মেয়ের মতো নোস। তুই খুব ডাউন টু আর্থ! খুব সাধারণভাবে থাকিস, জীবন কাটাস। কিন্তু তোকে যারা দেখছে, তারা সেভাবে সবাই দেখবে না ব্যাপারটা। তাই তাদের রিজ়ার্ভেশন থাকা স্বাভাবিক। একটা সামান্য কথা বলতে গেলে তাদের দশবার ভাবাটা স্বাভাবিক, তাই না? তাই বলছি নিশান চাইলেও নানা ফ্যাক্টর আছে কিন্তু এর মধ্যে! সবসময় মানুষ যা বলতে চায়, তা কিন্তু বলে উঠতে পারে না। এটা মাথায় রাখিস।”

সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে ওই ওপরে দরজার কাছে দাঁড়ানো জয়তীকে দেখে খুব ভাল লাগছিল ওর। কতদিন পরে কেউ ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলল! ওর পাশে দাঁড়াল!

মনটা কেমন যেন নরম হয়ে আসছিল। মোবাইলে গাড়ি বুক করে নিয়েছিল জয়তীদের বাড়িতে থাকতেই। কিন্তু গাড়িতে উঠেও জয়তীদের বাড়িতে থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল! কী আর হবে— ভেবে নিজেকে আবার কেমন যেন গুটিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু তারপরেই আবার সচেতন হয়ে নিজেকে ঠিক করেছিল রাধিয়া। ওর এই নরম হয়ে যাওয়াটাই লোকে ভুল ভাবে নেয়। ওকে দুর্বল ভাবে। নিশানকে আজ ছাড়বে না ও কিছুতেই। মানুষের ভরসা নিয়ে, ইমোশন খেলা করাটা আজকাল যেন একটা ফ্যাশন হয়ে গিয়েছে সবার। এটাকে ওর সঙ্গে হতে দেবে না আর।

ক্যাথিড্রাল রোড দিয়ে গাড়িটা এগোচ্ছে। ডান দিকে ভিক্টোরিয়ার ইস্ট গেট। বাঁ দিকে বড় ক্যাথিড্রাল। আজ বড়দিন। রাস্তায় লোক থিকথিক করছে। ক্যাথিড্রালের সামনে গেট করা হয়েছে। আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে সুন্দর করে। মানুষজনের সারি-সারি হাসি মুখ! এটা ভাল লাগে রাধিয়ার। পৃথিবীতে এত কিছু ভয়াবহ আর কষ্টের ব্যাপার ঘটে চলছে, তাও মানুষ কিন্তু সামান্য সুযোগ পেলেই সব ভুলে আনন্দ করতে চায়। এটাই বোধহয় মানুষের সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রবণতা। তা হলে মানুষ এমন কাজ কেন করে, যাতে তার আর আশপাশের সবার কষ্ট বাড়তেই থাকে! নাকি মানুষ নিজের আনন্দটাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যের কথা ভুলে যায়! তা হলে কি আনন্দ আর কষ্ট আলাদা কিছু নয়! দুটোর মধ্যের বিভাজন রেখা কি তবে অস্পষ্ট! একটা কি আর-একটার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত!

রাধিয়ার প্রশ্ন প্রচুর, কিন্তু উত্তরগুলো যেন সব স্পষ্ট নয়। ঠাকুরমার কাছে মাঝে মাঝে এইসব নিয়ে প্রশ্ন করে রাধিয়া। ঠাকুরমা সাধ্যমতো উত্তর দেয়। কিন্তু সোনাঝুরির ওই জুট মিল, জায়গা আর বাড়ি বিক্রি নিয়ে ঠাকুরমা কয়েকমাস যাবৎ খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছে। চাপাগলায় দু’-একবার বাবার সঙ্গে ঠাকুরমার এই নিয়ে অশান্তি হতেও শুনেছে ও। তবে কী কথা হয়েছে, শোনেনি। রাধিয়ার সামনে বাবা, ঠাকুরমার সঙ্গে এই নিয়ে কিছু বলে না। ঠাকুরমাও, ও দেখেছে বাবার ব্যাপারে মাথা গলায় না। ছেলে বড় হয়ে গেছে বলে বাবার সংসারের কিছুতেই থাকে না।

শুধু সেদিন রেস্তরাঁ থেকে ফেরার পরে বাবা যখন খুব চিৎকার করছিল, ঠাকুরমা ওপর থেকে নেমে এসে বলেছিল, “রাধি, আমার কাছে চলে আয়!”

সেদিন রাতে ঠাকুরমার কাছেই ছিল রাধি। চিরকাল ঠাকুরমাকে গম্ভীর, কম-কথা-বলা মানুষ হিসেবে দেখেছে রাধিয়া। মাঝে মাঝে অফিস যাওয়া ছাড়া অধিকাংশ সময় বাড়িতে, নিজের মনেই থাকতে দেখেছে। শুধু সেদিন দেখেছিল অনেক রাত অবধি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল ঠাকুরমা। নরম গলায় বলেছিল, “যার জন্য এমন কষ্ট পাচ্ছিস, সে কি জানে?”

ঠাকুরমার ছোটবেলার কথা কিছু জানে না রাধিয়া। ঠাকুরমাই বলে না। জিজ্ঞেস করলে বলে, “আমি আর অতীত নিয়ে ভাবি না।”

তবে মাঝে মাঝে নিজের বাবার কথা বলে। ঠাকুরমার বাবা পুলিশ ছিল। সেটা জানে ও। খুব শান্ত আর নরম মনের মানুষ ছিল। ঠাকুরমার ঘরে ছবি দেখেছে রাধিয়া। আর কারও কোনও ছবি ও দেখেনি। বাবা ছাড়া আর কারও কথা ঠাকুরমা বলে না। শুধু শুনেছে, কানাডায় ঠাকুরমার এক ভাই থাকে। ঠাকুরমা বলে, “খুব ভাল ছেলে ছিল টেটু!”

কেউ জানে না কারও কথা! এই পৃথিবী এক ‘সলিটারি প্রিজ়ন’! ও শুধু বলেছিল, “তুমি বুঝবে না ঠাকুমা! ইটস কমপ্লিকেটেড! যদি কাউকে ভালবাসতে, তা হলে বুঝতে!”

ঠাকুরমা তাকিয়েছিল ওর দিকে। নরম হলুদ টেব্‌ল ল্যাম্প জ্বলছিল ঘরে। তার ওপরে ঢাকা দেওয়া ঝালরকাটা নকশার আলোছায়া ছড়িয়ে ছিল দেওয়ালে। রাধিয়া দেখেছিল, ওর কথা শুনে ঠাকুরমা যেন কিছু বলতে গিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর বলেনি। রাধিয়া মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি কী বলতে চাইছিলে?”

ঠাকুরমা বলেছিল, “কিছু না রে। আমার আর কিছু বলার নেই!”

আজও পরিটাকে যতক্ষণ পারা যায় দেখল রাধিয়া। রোদে ভিজে আছে বলেই কি ওই ডানা নিয়ে উড়ে যেতে পারে না! ওর মনে হল, আচ্ছা পরিটা কি ওকে দেখতে পেল?

নন্দনের সামনে গাড়িটাকে ভাড়া মিটিয়ে ছেড়ে দিল রাধিয়া। বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এখানেও ভিড় খুব। ও ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোল। লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে রয়েছে! এখানে এলে কতরকমের যে মানুষ দেখা যায়! তার ওপর আজ উৎসবের দিন বলে লোকজন আরও বেশি। সিনেমা হলের সামনে বেশ ভিড়। গাছের গোড়ার বাঁধানো বসার জায়গায় বসে আছে ছেলেমেয়েরা। এই ভিড়ে কীভাবে খুঁজবে নিশানকে! রাগের মাথায় টেক্সট তো করে দিয়েছে, কিন্তু এটা বলেনি কোথায় দাঁড়াবে।

হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একটা চেনা মুখ দেখতে পেল রাধিয়া। আরে, সেই মেয়েটা না! সেই সুন্দর দেখতে, চশমা পরা মেয়েটা! কপালে অনুস্বরের মতো করে টিপ পরে। ঝকঝকে হাসি। সেই পাগল-পাগল স্মরণ বলে ছেলেটা থাকে সঙ্গে। কলেজ স্ট্রিটে দেখা হয়েছিল। মেয়েটাকে দেখে এক মুহূর্ত কেমন যেন থমকে গেল রাধিয়া। কী হয়েছে মেয়েটার? এমন গোমড়ামুখ কেন? সামনে দাঁড়ানো একটা ছেলে। চাপ দাড়ি। ছেলেটা কিছু বলছে। আর মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। দেখেই রাধিয়া বুঝল যে, কিছু একটা হয়েছে। রাধিয়া তাই আর সামনে এগোল না। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে ঢোকা ঠিক নয়। তাও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রাধিয়া। মেয়েটার নাম যেন কী… ও, নোঈ! মেয়েটার মুখটা এমন গম্ভীর কেন? ছেলেটাকে আবার ভাল করে দেখল রাধিয়া। প্রাণপণে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে ছেলেটা। মাঝে মাঝে হাতজোড় করে কিছু বলার চেষ্টাও করছে। কিন্তু নোঈ মাথা নামিয়ে গম্ভীর হয়ে আছে। কী যে ব্যাপার বুঝল না রাধিয়া।

“হাই!” পাশ থেকে নিশানের গলা পেল এবার। রাধিয়া ঘুরে তাকাল।

নিশান ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল নোঈকে। তারপর চোখের ইশারায় রাধিয়াকে সরে আসতে বলল।

রাধিয়া ওর সঙ্গে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল। নিশান দেখল একবার। না, এখান থেকে আর নোঈকে দেখা যাচ্ছে না। রাধিয়া অবাক হল। ওর মাসতুতো না কী যেন বোন হয় না?

নিশান বোধহয় বুঝতে পারল রাধিয়ার মনের কথা। বলল, “নোঈর এক্স বয়ফ্রেন্ড ওই ছেলেটা। আজ দেখা করতে এসেছে। জয় নাম। ওদের সামনে তাই আর গেলাম না। আগে আমার দেখা হয়েছে ওর সঙ্গে। আমাদের ওর সামনে যাওয়া উচিত নয়।”

“উচিত নয়?” রাধিয়া তাকাল নিশানের দিকে।

নিশান পাশের একটা গাছের গায়ে হাত দিয়ে পা-টা ক্রস করে দাঁড়াল। নীল পাঞ্জাবির ওপর হাতকাটা সাদা রঙের জহরকোট পরে এসেছে আজ নিশান। গালের দাড়িটাও সুন্দর করে কাটা। অদ্ভুত ঠান্ডা আর মিষ্টি গন্ধের একটা পারফিউমও মেখেছে। পায়ের জুতোটাও নতুন। এমন সাজগোজ করতে নিশানকে ও দেখেনি কোনওদিন। কাটা-কাটা চোখমুখে একটা শান্ত ভাব। রাধিয়া দেখেছে আশপাশের কয়েকটা মেয়ে ঘুরে-ঘুরে দেখছে নিশানকে। বিরক্ত লাগছে রাধিয়ার। কী অসভ্য সব মেয়েগুলো! এভাবে দেখার কী আছে! বুকের ভেতর ওর পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে যেন। কিন্তু নিশানের হাসি-হাসি মুখ দেখে তো বোঝা যাচ্ছে যে, ও ব্যাপারটায় মজা পাচ্ছে বেশ। ছেলেরা কি এমনই হয়? নির্লজ্জ? ফ্লার্ট করেই তাদের আনন্দ! মেয়েদের মতো ভাল কেন বাসতে পারে না ছেলেরা! শুধু নিজেদের দর যাচাই করাই কি ওদের কাজ! নিশান ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে কেন? রাধিয়ার মনে হল নিশানের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দেয়। এই ছেলের নিশ্চয় অনেক মেয়েবন্ধু। ফলসা তো বলেছে নিশানের নাকি হেভি ডিমান্ড। ডিমান্ড! ছিঃ, কেমন চিপ লাগে শুনলে। কিন্তু নিশানের নিশ্চয় খুব আরাম হয় এসব শুনে। ডিমান্ড! পেট্রল নাকি? মানুষ কত সহজে নিজেকে কমোডিটি করে দিতে পারে! কেন এসেছে ও এখানে নিশানের সঙ্গে কথা বলতে! এমন ছেলে ওর খবর নেয় না বলে কেন হেদিয়ে মরছে ও! মায়ের কাছে মিথ্যে বলে, জয়তীকে অনুরোধ করে কীসের জন্য রাস্তায় বেরিয়েছে! কীসের জন্য দাঁড়িয়েছে এখানে! বাবা সাতটার মধ্যে ফিরবে। তার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে। না হলে আবার অশান্তি হবে। কেন এসব অশান্তি নেবে ও! কার জন্য! এই সামনের ছেলেটার জন্য! যে ও মরল কি বাঁচল তার খবর রাখে না!

আচমকা মনের ভেতরটা কেমন হয়ে গেল রাধিয়ার। ও বলল, “ওকে বাই। আমি আসছি!”

নিশান সোজা হয়ে দাঁড়াল, “আরে!”

রাধিয়া চোয়াল শক্ত করে বলল, “হ্যাঁ, আমি বাড়ি যাব।”

নিশান এগিয়ে এল এক পা। তারপর আচমকা হাতটা ধরল ওর, “কী হয়েছে রাধি… ইয়ে রাধিয়া!”

রাধিয়া মুখ নামিয়ে নিল। কোনও কারণ ছাড়াই আচমকা চোখে জল এসে গেল ওর। নিশানের হাতটা গরম। ওর ঠান্ডা আঙুলগুলোর যেন ইচ্ছে হল সেই উত্তাপের সমস্তটাই শুষে নেয় শরীরের মধ্যে।

নিশান নরম গলায় বলল, “তোমার জ্বর হয়েছিল কয়েকদিন আগে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটাও কেটে গিয়েছিল। এর মাঝে দুটো গল্পের বই তুমি পড়েছ। দু’রাত না খেয়ে থেকেছ। আর… আর… আর তোমার মায়ের জন্মদিন ছিল চারদিন আগে। ঠিক না?”

রাধিয়া চমকে উঠে তাকিয়ে রইল নিশানের দিকে। ভুলে গেল চোখের কোণে এখনও জল চিকচিক করছে। কী করে এসব জানল নিশান! এসব তো ওর জানার কথা নয়। সেদিনের পর থেকে তো আর যোগাযোগই নেই! তা হলে! কী বলবে বুঝে পেল না রাধিয়া।

নিশান পকেট থেকে রুমাল বের করল একটা। তারপর আরও কাছে সরে এসে আলতো হাতে চেপে-চেপে চোখটা মুছিয়ে দিল রাধিয়ার। রাধিয়া ভুলে গেল আশপাশে লোকজন আছে। ভুলে গেল, তারা ওকে দেখছে। ও নিশানের হাতটা চেপে ধরল ওর গালে। অস্ফুটে শুধু বলল, “কেন? কেন?”

নিশান হাসল। তারপর নরম গলায় ফিসফিস করে বলল, “ভালবাসি তো, তাই…”

“মিথ্যে কথা!” ভাল লাগায়, অভিমানে গলা ভারী হয়ে এল রাধিয়ার, “সব মিথ্যে। আমার খবর নাওনি তুমি। আমি মরে গেছি কি বেঁচে আছি, জানতে চাওনি। যা বলেছে বাবা বলেছে। আমি কি বলেছি? আমি তো তোমার কাছে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি… তুমি চেয়েছ আমার ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি কি জানি না? আমি জানি। আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে তুমি। ঠাকুমা তো যার-তার সঙ্গে দেখা করে না। সোনাঝুরির আন্দোলন নিয়ে তুমি দেখা করতে গিয়েছিলে। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছ ওখানে পৌঁছতে। আমার জন্য মোটেও নয়। কোনওদিনও নয়… আমি জানি…”

“তাই? তা হলে জয়তীর কাছ থেকে আমি নিয়মিত কেন খবর রাখতাম তোমার? কেন জানতে চেয়েছি তুমি কী করছ? কেমন আছ?”

“জয়তী!” রাধিয়া অবাক হয়ে মুখ তুলল। দেখল, ঠান্ডা হাওয়ায় নিশানের মাথার চুলগুলো উড়ছে অদ্ভুতভাবে!

“না হলে এসব জানলাম কী করে! ওকে আমি বলতে বারণ করেছিলাম, আজ যে ওদের বাড়ি গিয়েছিলে তাও আমি জানি,” নিশান হাসল।

রাধিয়া তাও বলল, “মিথ্যে কথা… আমার ঠাকুরমার জন্য, ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য…”

“না রাধি,” নিশান রাধিয়ার হাতটা চেপে ধরল জোরে, “আমি তোমায় ভালবাসি। তাই তো যাইনি ওঁর কাছে। অফিসে পিটিশন জমা দিয়েছি। কিন্তু নিজে যাইনি। গেলে তো তুমি ভাবতে তোমায় ব্যবহার করছি। আমরা সোনাঝুরিকে বাঁচাব। বেলাগাম বাড়িঘর করে সব ধ্বংস করতে দেব না। কিন্তু তার মানে এই নয়, তার জন্য তোমায় ব্যবহার করব!”

রাধিয়া তাকাল এবার। দেখল, নিশানও তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

নিশান বলল, “আমি তোমাকে ভালবাসি, তাই কষ্ট দিতে চাই না। আমি যোগাযোগ করলে তোমার বাড়িতে অশান্তি হয়। প্লাস আমাদের স্টেটাসে অনেক অমিল। তোমার বাবা আমায় সহ্য করতে পারেন না। আমার জন্য তোমায় কষ্টই পেতে হবে। তাই আমি…”

“তোমায় কে ভাবতে বলেছে এত কথা! কেন ভাবছ? আমার তোমায় ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়। সেটা ভাবলে না! যেটা আসল সেটা না ভেবে এসব কী বাজে কথা নিয়ে পড়ে আছ তুমি!”

“বাজে নয়,” নিশান সিরিয়াস মুখ করে তাকাল এবার। বলল, “আমি চাই না তোমায় কষ্ট দিতে। চাই না তোমার মনখারাপ হোক! প্লিজ় আন্ডারস্ট্যান্ড! তাই তো… তাই তো…” নিশান যেন নিজেকে অনেক কষ্টে আটকাল।

রাধিয়া তাকাল নিশানের দিকে, “তাই আমার বাবার সম্বন্ধে খবর পেয়েও আমায় দাওনি, তাই না!”

নিশান মাথা নামিয়ে নিল। রাধিয়া নিশানের থুতনিটা ধরে মুখটা তুলল। কাটা-কাটা স্বরে বলল, “আমায় বলো! আমার জানা দরকার। আমায় যদি সত্যি ভালবাসো, তা হলে আমায় বলো তুমি!”

পরির গায়ে হাজার দাগের ফাটল। ডানা খুলে পড়ে যাচ্ছে। পায়ের তলার মাটি আলগা খুব। বাবার সেই ছোট্টবেলার পরি আজ টলমল করছে।

কোনওমতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল রাধিয়া। নন্দন থেকে গাড়িতে করে বাড়ির সামনে অবধি নিশান এসেছিল। তাই হয়তো আসতে পেরেছে ও। না হলে আসতে পারত না! এটা কী শুনল ও! এও সম্ভব! বাবা এমন! কিন্তু ওরা আগে কেউ জানতে পারেনি! মা-ও জানতে পারেনি! কিন্তু মায়ের তো জানা উচিত! ও আর ভাবতে পারছে না! নিজের বাবা-মাকে নিয়ে কেউ এসব ভাবতে পারে!

নিশান ওকে বাড়ির গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, “জোর করে এসব না শুনলেই পারতে। কী হবে শুনে! আমাদের বাবা-মায়েরাও তো মানুষ। তাদেরও নিজের জীবন আর ইচ্ছে থাকে। সন্তান হওয়া মানেই তো দাসখত লিখে দেয়নি কেউ। তাই না!”

নিশান হয়তো ঠিকই বলছিল, কিন্তু রাধিয়ার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। এখনও ঢুকছে না। এই বাড়ি-ঘর সব কেমন যেন লাগছে ওর! ও নিজের ঘরে যাবে বলে কোনওমতে বসার ঘরের পাশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে গেল। এখন কারও সঙ্গে কথা বলবে না ও, কথা বলতে পারবে না। আলো নিভিয়ে শুয়ে থাকবে শুধু।

“রাধি!” আচমকা চিৎকার করে বাবা বেরিয়ে এল বসার ঘরের দরজা দিয়ে। তারপর কোনও কথা না বলে রাধিয়ার হাত ধরে এক টানে ওকে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে। রাধিয়া থতমত খেয়ে গেল। শরীর এমনিতেই দুর্বল লাগছে। তাই টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল একটা সোফার ওপর।

“হাউ ডেয়ার ইউ! তুই ওই শুয়োরটার সঙ্গে এসেছিস বাড়ি অবধি! আমি কলকাতায় ছিলাম না ভেবে যা খুশি তাই করবি? জানোয়ার! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! আমি তোকে বলেছিলাম না, যাবি না। মিশবি না। জানিস না, ও একটা লিচ! একটা প্যারাসাইট! আমাদের কাজকে সাবোটাজ করছে! তা হলে! কেন গেছিলি! ইউ ডার্টি হোর! খুব রস হয়েছে! এই বয়সেই ছেলে চাই! আজ তোকে…” বাবা আচমকা কোমর থেকে বেল্ট খুলে নিল। চিৎকার করে বলল, “আজ তোকে দেখাব আমার কথা না শোনার ফল! আজ…”

বাবা পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল সামনে!

“বুম্বা!” পেছন থেকে আসা ঠাকুরমার গলার স্বরে বাবা থমকে গেল, “কী করছিস কী তুই! এত বড় মেয়েকে এভাবে কেউ মারতে যায়! কী করছিস কী? আর বউমা, তুমি দাঁড়িয়ে দেখছ! মেয়েটাকে মেরে ফেলবে, চাও!”

ঠাকুরমা এসে দাঁড়াল রাধিয়া আর বাবার মাঝখানে, “অমানুষ হয়ে গেছিস!”

বাবা রাগে লাল হয়ে গিয়েছে। হাতের বেল্টটা পাশে রাখা একটা চেয়ারে আছড়ে বলল, “শি ইজ় আ বিচ! আ ডার্টি হোর! ওর নোংরা ছেলে পছন্দ! আমাদের শত্রুর সঙ্গে পিরিত করছে! বাইরে বেরোতে তোকে বারণ করেছিলাম না! আজ তোকে শেষ করে ফেলব আমি… আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! আজ…”

বাবা ঠাকুরমাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে এল এবার! ভয়ের চোটে কুঁকড়ে গেল রাধিয়া। বাবা বেল্টটা চালাল! সপাং করে রাধিয়ার কোমরের কাছে এসে লাগল ওটা। চড়াৎ করে শব্দ হল একটা। শাড়ির ওপর দিয়ে লাগলেও রাধিয়ার মনে হল শরীরের চামড়া ফেটে গেল একদম। একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা ওর এতক্ষণের নিস্তব্ধতাকে এক ধাক্কায় টুকরো-টুকরো করে দিল। শরীরের আগেও মনের যন্ত্রণাটা এবার বোমার মতো ফেটে পড়ল যেন।

রাধিয়া চিৎকার করে উঠল, “বাবা!”

বাবা এই চিৎকারে থমকে গেল এবার!

রাধিয়া শরীরের সব জড়তা কাটিয়ে উঠে দাঁড়াল এবার। আচমকা একটা রাগ দলা পাকাচ্ছে ওর শরীরে। মনে হচ্ছে এবার ফেটে পড়বে বোমার মতো। ও বুঝতে পারছে পরির খোলস ভেঙে পড়ছে। ডানা খসে গেছে। বুঝতে পারছে পায়ের তলার বাঁধন আরও আলগা এখন।

রাধিয়া সোজা তাকাল বাবার দিকে। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “তুমি কেন আমাদের মিথ্যে বলো যে, অফিসের ট্যুরে যাচ্ছ? আসলে তো বাচ্চা ছেলেদের সঙ্গে রাত কাটাতে যাও! একজন মহিলা আছে। শানায়া দত্তা। সে তোমায় আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে সাপ্লাই করে! তাদের নিয়ে তো তুমি… তুমি… ছিঃ বাবা, ছিঃ!”

বাবা কী বলবে বুঝতে পারল না হাতের বেল্টটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল!

রাধিয়া এগিয়ে গেল বাবার দিকে এবার। চোয়াল শক্ত করে বলল, “এবারও গিয়েছিলে। শঙ্করপুরে ছিলে দু’রাত। সঙ্গে দুটো ছেলে ছিল। একজনের নাম প্রাণেশ আর-একজনের নাম মোহিত। দু’জনেই ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কোথায় থাকে সেটাও কি বলব!”

রাধিয়া এবার মায়ের দিকে তাকাল। দেখল, মা পাথরের মূর্তি যেন। কিছুই যেন বুঝতে পারছে না, কী ঘটছে সামনে। ঠাকুরমা বসে আছে চেয়ারে। মাথা নিচু।

রাধিয়া এগিয়ে গিয়ে বাবার হাত থেকে সহজেই বেল্টটা নিয়ে নিল। তারপর বলল, “বেল্ট হাতে নিলেই সব সত্যি হয়ে যায় না। নিশান খারাপ, কেননা তোমার স্বার্থে লাগছে বলে, তাই তো! কিন্তু সে তো অনেক মানুষের কথা ভাবছে। আর তুমি নিজে কী? নিজেকে মানুষ বলে মনে হয় তোমার? আমার সঙ্গে তুমি এমন করতে পারলে? আমায় ছোটবেলায় পরি বলতে না? তাই কি আমায় চূড়ায় তুলে মূর্তির মতো করে রেখেছিলে? অচল, অপদার্থ ধরনের মানুষ করে রেখেছিলে?”

রাধিয়া ফুঁসছে! আচমকা কোথা থেকে পরি ভেঙে সারা জীবন খুঁজে যাওয়া মানুষটা বেরিয়ে এসেছে যেন! ও যেন দেখতে পাচ্ছে ওর পায়ের তলায় টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে পরি। ছড়িয়ে আছে তার ডানা। রাধিয়া বুঝতে পারছে, আর ওকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না এই রোদ-জল-কাদার নোংরা পৃথিবীতে! মানুষ যতদূর যায়, পরিরা যেতে পারে না ততদূর!

রাধিয়া দেখল, বাবা হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে মাটিতে। মা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে। ঠাকুরমা শুধু তাকিয়ে আছে ওর দিকে!

রাধিয়া বলল, “আমায় আজ মারলে বাবা! নোংরা গালি দিলে! কেন? কারণ, তোমার কথা শুনিনি বলে? তোমার স্বার্থে লেগেছে বলে! এতদিন তা হলে মা’র সঙ্গে, আমার সঙ্গে যা করলে, তার কী শাস্তি হবে বাবা? লিচটা কে? প্যারাসাইটটা কে? কে অন্যের ভালবাসা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে? তাদের শুষে বেঁচে থাকে?”

“প্লিজ়…” বাবা হাতজোড় করে তাকাল রাধিয়ার দিকে, “প্লিজ় রাধি… আমি… প্লিজ়…”

রাধিয়া তাকাল বাবার দিকে। তারপর বলল, “মাকে বলো। আমাকে নয়। মায়ের সঙ্গে যা করেছ, তার ক্ষমা হয় কি না, সেটা মা ঠিক করবে। আমায় এসব বোলো না। মানুষ হওয়ার ইচ্ছে থাকলে জীবনের যে-কোনও অবস্থা থেকে সেই চেষ্টা শুরু করা যায়। কিন্তু তুমি মানুষ হতে পারবে কি? হাতে বেল্ট আর মনে ঘৃণা নিয়ে সেটা হওয়া কিন্তু মুশকিল!”

বাবা মাটিতে মুখ গুঁজে দিয়েছে এবার। রাধিয়া মায়ের দিকে তাকাল। দেখল, মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ছে টপটপ করে।

রাধিয়া মাথা নাড়ল, হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই আমাদের বাড়ি! আমাদের সংসার! সত্যি!”

কথা শেষ করে রাধিয়া হালকা পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আসলে ঠিক ঘর নয়, এই জেলখানার মতো বাড়িটা থেকে আজ যেন বেরিয়ে এল ও। নিজেকে হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে কত বছরের পুরনো পাথর যেন সরে গিয়েছে। যেন খুলে গিয়েছে কত বন্ধমুখ নদী। আজ আকাশে ভেসে যেতে পারে ও। স্রোত হতে পারে নদীতে। জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বনটা খুঁজে পেয়েছে ও। রাধিয়া বুঝল আসলে মানুষও পরির মতো উড়তে পারে। যেখানে খুশি হারিয়ে যেতে পারে। ছুঁয়ে দিতে পারে আকাশের সর্বোচ্চ বিন্দু। তবে তার জন্য ডানার দরকার হয় না। যেটা দরকার হয়, সেটাই ও খুঁজে পেয়েছে আজ। আজ রাধিয়া খুঁজে পেয়েছে আত্মবিশ্বাস। সত্যি কথা বলার, সত্যিকে সামনে থেকে দেখার সাহস!

ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে একবার পেছনে ঘুরল রাধিয়া। দেখল, মায়ের সামনে নতজানু হয়ে বসে রয়েছে সুপ্রতীক মালিক! ওর বাবা!

.

৩৬. আইকা

I will be home for Christmas
You can plan on me
Please have snow and mistletoe
And presents on the tree
Christmas Eve will find me
Where the love light gleams
I’ll be home for Christmas
If only in my dreams…

গানটা বাজছে। নিচু স্বরে ভরাট গলায় গানটা বেজেই চলেছে। বড়দিনের রাত গভীর হচ্ছে ক্রমশ। ওদের পাড়াটা নিঝুম হয়ে আসছে। দূরে টিভি চলছে কোথাও। মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক ছিটকে আসছে এখান-ওখান থেকে। জানলার পাশে বসে সামনের শূন্য রাস্তা আর দু’পাশের নির্জন পাতাহীন গাছেদের দেখছে আইকা!

শীত এক অদ্ভুত সময়। সব কিছু ঝরিয়ে, হারিয়ে পৃথিবীকে শূন্য করে দেওয়ার সময়। শীত মানুষকে বোঝায় কোনও কিছুই স্থায়ী নয়। যা তোমার আছে, তা ক্ষণিকের জন্য আছে। হাতের মুঠো শক্ত করে রাখলেও তুমি তাকে কিছুতেই চিরদিন ধরে রাখতে পারবে না। সে ছেড়ে যাবেই। চলে যাবেই। শূন্য হবেই সব। এ খেলা ভাঙবেই একদিন। শীত খেলা ভাঙার সময়। মানুষকে একা করে দেওয়ার সময়!

আজ ঠান্ডা পড়েছে বেশ। ঠান্ডায় আইকার কষ্ট হয়। ছোট থেকেই শীতকাতুরে ও। সেই যাদবপুরের বাড়ির কথা আজ আবার মনে পড়ছে আইকার। সেই ছোট ড্যাম্প ঘর। চৌকি। ফাটল মেঝে দিয়ে বেরিয়ে আসা বিছে। শীত খুব ভয়ের সময় ছিল ওর কাছে। পাশেই পুকুর ছিল একটা। ভাঙা জানলার পাল্লা দিয়ে রাতে ঠান্ডা ভেজা হাওয়া আসত। মা খবরের কাগজ কেটে আটকে রাখত সেই ভাঙা জানলার গায়ে। মা নিজে শুত সেই জানলার দিকটায়। আর কম্বলের তলায় মায়ের গায়ের ওম নিয়ে শুয়ে থাকত আইকা। মনে হত পৃথিবীতে এর চেয়ে সুরক্ষিত জায়গা আর নেই।

এই ফ্ল্যাটটা বড়। মায়ের নিজের ঘর আছে এখানে। সে ঘরে বিছানার পাশে কাচের জানলা। সামনে ঝোলানো বড় ভারী পরদা। মোটা লেপ। মা ওখানে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু আইকার আজ ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে শুতে। আবার সেই ছোটবেলার মতো মায়ের কোল ঘেঁষে, মায়ের ওম নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।

আইকা সামনে রাখা ডিজিটাল টেব্‌ল ক্লকটা দেখল। রাত সাড়ে দশটা বাজে। মা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। ঘুমের ওষুধ খায় একটা করে, তাই আইকাই বলে দেরি না করতে। কিন্তু আইকার ঘুম আসে না। এমনিতেই আজ বড়দিন। তারপর কাল রবিবার। তবে এখন থেকে তো ওর সবটাই রবিবার। কারণ, আর তো অফিস নেই ওর। গতকাল ই-মেলে রেজ়িগনেশন পাঠিয়ে দিয়েছে।

রুপিন নেই, গুজরাত গিয়েছেন নিজের বাড়িতে। আবার নিউ ইয়ারে ফিরবেন। কিন্তু ততদিন অবধি আর অপেক্ষা করেনি আইকা। গত পরশু রুপিন বেরিয়ে গেছিলেন আর গতকালই নিজের কাজ ছাড়ার কথা ও ই-মেলে জানিয়ে দিয়েছে রুপিনকে। রুপিন নিশ্চয় পেয়েছেন চিঠিটা। কিন্তু এখনও কোনও রিপ্লাই করেননি। ফোন করেননি। আইকাকে জিজ্ঞেস করেননি কিছু। রুপিন নিশ্চয় রেগে আছেন। সোমবার দিনই হয়তো রেজ়িগনেশন লেটার যে অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়া হয়েছে, সেটা জানিয়ে দেওয়া হবে। রুপিনের সামনে হয়তো আর যেতে হবে না আইকাকে।

আইকা চোয়াল শক্ত করল। ছেলেরা সব একরকম হয়। নিজেদের ইচ্ছে ছাড়া, মতলব ছাড়া আর কিছু বোঝে না। ও আজও কেমন বোকা রয়ে গেল। আজও মানুষকে চিনতে পারল না। আজও সব কথাই ও ফেসভ্যালুতে নেয়। নিজের বোকামির জন্য নিজের গালেই থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে আইকার। কী করে এমন ভুলটা করল ও!

মাকে সেই চোখের ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার কিছুদিন পরে রুপিন এক বিকেলে, ছুটির পরে আইকাকে ডেকেছিলেন নিজের ঘরে। আইকা তখন বেরিয়ে যাচ্ছিল অফিস থেকে। এমন সময় ডাক পেয়ে কিছুটা অবাকই হয়েছিল আইকা! আর সত্যি বলতে কী, মনে মনে একটু বিরক্তও হয়েছিল। তাও গিয়েছিল ঘরে।

রুপিন দাঁড়িয়ে ছিলেন জানলার কাছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আইকা নক করে ঘরে ঢোকার পরে রুপিন বসতে বলেছিলেন ওকে। তারপর হেসে বলেছিলেন, “তোমার শো কজ়ের রিপ্লাই আমি পেয়েছি!”

“এই জন্য ডাকলেন!”

“না, না,” হেসেছিলেন রুপিন, “আমি কিছুদিন আগে বলেছিলাম না যে, আই নিড আ হেল্‌প! সেই জন্য ডেকেছি।”

হ্যাঁ, তাই তো! আইকার মনে পড়েছিল। সেই যেদিন ও অফিসে রাগারাগি করল, সেদিন রুপিন তো বলেছিলেন, কী একটা হেল্‌প লাগবে।

আইকা বলেছিল, “ও হ্যাঁ। আই রিমেমবার।”

রুপিন সময় নিয়েছিলেন একটু। তারপর বলেছিলেন, “আমরা তিন ভাই। আয়্যাম দ্য এল্ডেস্ট। আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে, রেণুকা, এই ডিসেম্বরের সাতাশ তারিখ এক বছরে পড়বে। আমি ওকে কিছু দিতে চাই, লাইক গোল্ড। বাট আই ডোন্ট নো এনিথিং আবাউট গোল্ড অর অরনামেন্টস। আমি জানি, আয়্যাম আস্কিং টু মাচ। বাট কুড ইউ হেল্‌প মি ওয়ান লাস্ট টাইম! প্লিজ়!”

আইকার হাসি পেয়েছিল রুপিনকে দেখে। অন্য বসেরা হুকুম করে নিজেদের কাজকর্ম করিয়ে নেয় অধস্তনদের দিয়ে। সেখানে রুপিন এমন করে বলেন যেন আইকা উলটে বকুনি দেবে!

আইকা হেসে বলেছিল, “হ্যাঁ, শিয়োর। এতে না করার কী আছে! কবে যাবেন?”

“নেক্সট সানডে! আর…” রুপিন আবার থমকেছিলেন। কিছু একটা যে বলতে চাইছিলেন সেটা বুঝতে পারছিল আইকা।

ও বলেছিল, “বলুন।”

রুপিন হেসে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, “নাঃ, সানডে বলব। সানডে। আবাউট ফোর ইন দ্য আফটারনুন! ঠিক হবে তো? কোথায় সেটা আমি জানাব তোমায়।”

রবিবার ঠিক চারটের সময় বালিগঞ্জ ফাঁড়ির আগে একটা বড় সোনার দোকানের সামনে পৌঁছে গেছিল আইকা। সেদিন সকালেই রুপিন জানিয়ে দিয়েছিলেন কোথায় দেখা করতে হবে।

দোকানটা বড়। সামনের দিকটা ঘষা কাচের। সেখানেই দরজা ঠেলে ঢুকেছিল ওরা।

আইকা কিছু বলার আগেই রুপিন বলেছিলেন, “আমার বাজেট ধরো এক লাখ। মানে, এর কমে তো আর ভাল কিছু হয় না। এতেও হয়তো হয় না। কিন্তু তাও…”

বেশি সময় নেয়নি আইকা। মিনিট পনেরোর মধ্যেই একটা হার পছন্দ করে দিয়েছিল। বলেছিল, “এক বছরের বাচ্চা তো, কিন্তু এটা সারা জীবন রাখতে পারবে। তাই না?”

হারটা খুব পছন্দ হয়েছিল রুপিনের। বলেছিলেন, “এই জন্য তোমায় বলি। ইউ আর ফ্যান্টাসটিক!”

দোকানের বাইরে এসে আইকা নিজের গাড়ির কাছে গিয়েছিল। রুপিন পেছন-পেছন গিয়েছিলেন ওর। বলেছিলেন, “আই নিড টু টক টু ইউ! একটা রেস্টুরেন্টে বসি? আমার গাড়িটা থাক এখানে। আমি কি তোমার গাড়িতে আসতে পারি!”

আইকা অবাক হয়েছিল। রুপিন এমন তো আগে বলেননি! কিছু কি সমস্যা হয়েছে! ও গাড়িতে উঠে পাশের দরজাটা খুলে দিয়েছিল। রুপিন যে রেস্তরাঁর কথা বলেছিলেন, সেটা কাছেই।

গাড়িটা রেস্তরাঁর পাশে রেখে ওরা ঢুকেছিল ভেতরে। সার দেওয়া চেয়ার-টেবল। অধিকাংশই ফাঁকা। একপাশে বার। দেখেই বোঝা যায় পুরনো কলকাতার ছাপ এখানে রয়ে গেছে। রুপিন সবার কাছ থেকে সরে একটা কোণের দিকে বসেছিলেন।

আইকার খাবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু বাধ্য হয়ে সামান্য স্ন্যাক্স বলেছিল। রুপিনকে দেখে বেশ অবাক লাগছিল ওর। কান লাল হয়ে আছে মানুষটার। বারবার মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁচাপাকা চুলগুলো ঠিক করছিলেন! জর্জ ক্লুনি এত চিন্তিত কেন, সেটা বুঝতে পারছিল না আইকা!

আইকা একচুমুক জল খেয়ে সামনে রাখা টিসু দিয়ে চেপে-চেপে ঠোঁটটা মুছে বলেছিল, “বলুন স্যার!”

“রুপিন, ইউ মে কল মি রুপিন। আমরা অফিসে নেই। প্রোটোকল মেনটেন করতে হবে না।”

আইকা এমন এলোমেলো অবস্থায় কোনওদিন দেখেনি রুপিনকে। ওর মনে হয়েছিল কিছু একটা হয়েছে নির্ঘাত।

“কী হয়েছে আপনার?” আইকা তাকিয়েছিল রুপিনের দিকে।

রুপিন সময় নিয়েছিলেন একটু। তারপর বলেছিলেন, “আইকা, আমার কলেজ লাইফ থেকে প্রায় অনেকটা সময় কাটে ইংল্যান্ডে। সেখানে সোনম নামে একটা পঞ্জাবি মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছিল। উই ওয়্যার ইন লাভ। কিন্তু আমার বাড়ি মানেনি। ওর বাড়িও মানেনি! সোনমও আমার সঙ্গে ইলোপ করতে চায়নি। আই ওয়জ় ডিভাস্টেটেড! আমি কাজ ছেড়ে দেশে ফিরে আসি! আমার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে পড়ে। ইট টুক মি টু ইয়ার্স টু রিকভার! রেজ়াল্ট ভাল ছিল। বিদেশে জব এক্সপিরিয়েন্স ছিল, আমার চাকরি পেতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু আর বিয়ে করিনি। আমার দুই ভাই বিয়ে করেছে। দে আর সেটলড! এখন এই বয়সে সবাই আমার বিয়ে দিতে চায়। আই অ্যাম অলমোস্ট ফিফটি। কিন্তু কেউ কথা শুনছে না।”

আইকা বলেছিল, “ফিফটি তো কী হয়েছে? এখন এসব কেউ মানে?”

“আসলে তা নয়, আমি বিয়ে করতে চাইলে…” রুপিন থমকে গিয়েছিলেন একটু, “তোমায় চাইব। আমি তোমায় পছন্দ করি। তোমায় বিয়ে করতে চাই! ওঃ! আই হ্যাভ সেড দ্যাট!”

আইকা ঘাবড়ে গিয়েছিল। রুপিনকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনও বিশাল কঠিন কাজ করে ফেলেছেন! মানুষটার মুখ-চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল একদম!

আইকা নিজেও কী বলবে বুঝতে পারছিল না। রুপিন! ওকে বিয়ে করতে চায়! কিন্তু কেন! এটা কী করে সম্ভব!

আইকা আমতা-আমতা করে বলেছিল, “আমায়? কেন?”

“কারণ, আই লাইক ইউ আ লট! আমি জানি আমার বয়স বেশি। তোমার ‘হ্যাঁ’ বলার চান্স কম। কিন্তু তাও আমার যা মনে হয় বললাম। আমি সিরিয়াস এই ব্যাপারে। না, এখনই কিছু বলতে হবে না। আমি জোরও করব না। তুমি যদি ‘না’ বলো, আমি মেনে নেব। আই টোটালি আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়োর সিচুয়েশন। তাই ডোন্ট সোয়েট অন ইট। টেক ইয়োর টাইম, তারপর জানিয়ো।”

সে দিনের পর রুপিন এই নিয়ে একবারও কিছু বলেননি। আইকাও কিছু উত্তর দেয়নি। কী বলবে ও! কাকে বলবে! দূর্বাকে বলার প্রশ্ন নেই, কারণ এক অফিস। মাকে বলারও মানে হয় না। মা শুনে যে কী প্রতিক্রিয়া দেবে সেটা মা নিজেও জানে না। তাই কিছু বুঝতে না পেরে ও ভেবেছিল পুশকিনের কাছে একবার যাবে!

পুশকিন। সেই স্কুলজীবনের লাজুক মনমরা পুশকিন। ক্লাস ইলেভেনে নতুন স্কুলে ভরতি হয়ে প্রথম পুশকিনকে দেখেছিল আইকা। সেই আইকা অনেক গম্ভীর, চাপা আর রাগী ছিল। এমন একটা বলয় দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখত যে, কাউকে কাছে আসতে দিত না! কিন্তু নিজের অজান্তেই সেই ঘেরাটোপ ভেঙে কী করে যেন পুশকিনকে ভাল লাগতে শুরু করেছিল ওর!

ওদের সঙ্গে রিয়া বলে একটা মেয়ে পড়ত। একটু গায়ে-পড়া ধরনের ছিল মেয়েটা। ছেলেদের সঙ্গে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াত। কথায়-কথায় পুশকিনের গায়ে হাত দিত। ঢলে পড়ত। দেখে কী যে রাগ হত আইকার! কিন্তু কিছু বলতে পারত না।

এমন করে ক্লাস টুয়েলভে একদিন সেই রিয়া একটা চিঠি দেখিয়েছিল। ফোর্থ পিরিয়ডের ইংরেজি ক্লাসের পরে টিফিন ছিল। সেই সময় রিয়া চিঠি বের করে দেখিয়েছিল সবাইকে। বলেছিল, “দেখ। লাভ লেটার! কে লিখেছে বল তো?”

সেটা মোবাইলের সময় ছিল না। তখনও টাকায় চারটে ফুচকা পাওয়া যেত, নীল-হলুদ কাগজে চিঠি আসত! কালো ঢাউস টেলিফোন যে সব বাড়িতে থাকত, তাদের বড়লোক বলা হত। সে সময় ছেলে আর মেয়েদের মাঝে একটা অদৃশ্য রেখা ভেসে থাকত সারাক্ষণ। সে সময় সেই রেখা টপকে মাঝে মাঝে কিছু কাগজ উড়ে আসত, যাকে উত্তেজিত টিনএজরা বলত, ‘লাভ লেটার!’

“তোকে অফার করেছে? কে রে?” রিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল পাশে বসা সুদীপা।

সেই সময় প্রোপোজ করাকে বলা হত ‘অফার’ করা!

রিয়া সবার সামনে লটারির ফার্স্ট প্রাইজ় দেখানোর মতো করে দেখিয়েছিল সেই চিঠিটা, তারপর বলেছিল, “তলায় নাম নেই তো কী হয়েছে? হাতের লেখা দেখে চিনতে পারছিস না? এত সুন্দর হাতের লেখা আমাদের ক্লাসে কার আছে?”

“পুশকিন!” সমবেতভাবে গুঞ্জন উঠেছিল। আর আইকার মনে হয়েছিল, কে যেন ওর বুকে ছুরি বসিয়ে দিল! পুশকিন! পুশকিন রিয়াকে ‘অফার’ করেছে! লাভ লেটার দিয়েছে! এত সাহস! এত বাজে ছেলে! আইকার মনে হয়েছিল কে যেন শিরার ভেতর বিষ ভরে দিয়েছিল ওর! যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠেছিল ও। দাঁতে দাঁত চেপে মনে হয়েছিল, পুশকিনকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।

টিফিনের পরের ক্লাস ছিল হেডস্যারের! আইকা আর সময় নষ্ট করেনি, রিয়ার ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে সোজা স্যারের টেবিলে গিয়ে বলেছিল, “স্যার, পুশকিন মেয়েদের এই সব লিখছে! নাম নেই তলায়, কিন্তু হাতের লেখা মিলিয়ে নেবেন!”

সারা ক্লাস স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল! রিয়া কী বলবে বুঝতে না পেরে বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়েছিল। আর সেকেন্ড বেঞ্চে বসা পুশকিন ফ্যালফ্যাল করে দেখেছিল আইকা ওর দিকে বিরক্তি আর ঘেন্না নিয়ে তাকিয়ে আছে!

দু’সপ্তাহ সাসপেন্ড ছিল পুশকিন। বাবাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সারা স্কুলে ঢিঢি পড়ে গিয়েছিল। সবাই বলেছিল, আইকার সাহস আছে! এসব নোংরামোর একটা শেষ হওয়া দরকার!

শুধু রিয়া একদিন স্কুল ছুটির পরে ওর কাছে এসে বলেছিল, “এটা কী করেছিস তুই! চিঠিটা পুশকিন লিখলেও নিজের জন্য লেখেনি। শোভনের জন্য লিখে দিয়েছিল! শোভন ভালবাসে আমাকে। ও বলেছে আমায়। আর তুই সবটা না জেনে… এটা কী করলি তুই!”

আইকার অবাক লেগেছিল! পুশকিন তা হলে এটা বলেনি কেন! শোভনের নাম তো বলতেই পারত! কিন্তু তাও বলেনি! কেন? বন্ধুকে বাঁচাতে! লয়ালটি!

বুকের ভেতর কেমন একটা কষ্ট হয়েছিল আইকার! বুঝতে পেরেছিল হিংসের চোটে বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে ওর! পুশকিনের দিকে দূর থেকে তাকিয়ে থাকত আইকা! দেখত কেমন একা হয়ে গিয়েছে ছেলেটা! রাতে শুয়ে পুশকিনের মুখটা মনে পড়লে কান্না পেত আইকার! এত কষ্ট হত যে মনে হত, এর থেকে কী করে নিস্তার পাবে! কে বাঁচাবে ওকে এই খারাপ লাগা থেকে! যাকে ও ভালবাসল তার ক্ষতি করে দিল! কেমন মানুষ ও!

এক বৃষ্টির দিনে লাইব্রেরির পাশের দেবদারু গাছের নীচে পুশকিনকে ধরেছিল আইকা! একটা সিমেন্টের বেঞ্চে বসেছিল পুশকিন। মাথায় ছাউনি ছিল বলে বৃষ্টি লাগছিল না ওর গায়ে! সামান্য হেঁটে, সামান্য ছুটে পুশকিনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল আইকা। পুশকিন মুখ তুলে ওকে দেখে কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল! কী করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল!

আইকা সময় নিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, “আমি সরি পুশকিন। আমি বুঝতে পারিনি। আসলে আমি…”

পুশকিন হাত তুলে থামিয়েছিল ওকে। তারপর বলেছিল, “কিন্তু কেন? কেন এমন করলি তুই! আমি রিয়াকে পছন্দ করি না! আমি তো… আমি… তুই এমনটা করতে পারলি! আমার জীবনে কত বড় দাগ পড়ে গেল বল তো!”

আইকাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে সেই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে চলে গেছিল পুশকিন! আর কোনওদিন কথা বলেনি ওর সঙ্গে!

তারপর কতবার ভেবেছে আইকা, পুশকিন কী বলতে গিয়ে বলল না! ওর কাকে পছন্দ ছিল! অসমাপ্ত বাক্যের শেষে কে দাঁড়িয়েছিল!

পুশকিনের রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, সেই রাতে পুরনো সব কথা এক নিমেষে মনে পড়ে গিয়েছিল! সেই পুশকিন ওর সামনে দাঁড়িয়ে! কফি করছে! আজও পুশকিনের কথা ভাবলে ওর মনের মধ্যে কী একটা যেন হয়! কিন্তু আইকা সেই বয়সে পৌঁছে গিয়েছে যেখানে ও বুঝতে পারে, সব হওয়াগুলোর পরিণতি নেই! কিছু মনে হওয়া একলা, নির্জন! তাদের কোনও বন্ধু নেই!

রুপিনের কথাটা সেই রাতে পুশকিনকে বলেছিল আইকা। বলেছিল, “আমি এখনও কিছু বলিনি জানিস! কী করব বুঝতে পারছি না!”

পুশকিন বলেছিল, “লোকটা ভাল হলে হ্যাঁ করে দে। কিন্তু কী কেস বল তো? আমার নোঈকে পছন্দ, তোর বসের তোকে পছন্দ! ব্যাপারটা কী? দেখবি, যখন তোর সঙ্গে অদ্ভুত কিছু ঘটবে, তখনই আশপাশে সিমিলার ইনসিডেন্টস চোখে পড়বে তোর! এটা অদ্ভুত একটা কোইন্সিডেন্স! তাই না?”

“কিন্তু কী করব বল!” আইকা জিজ্ঞেস করেছিল পুশকিনকে।

পুশকিন হেসে বলেছিল, “তোকে কে ভালবাসে জানবি, সেটাই বেশি ইমপর্ট্যান্ট। লোকটা তোকে ভালবাসলে গো ফর ইট। তোর একটা কম্প্যানিয়ান তো হবে। ওটাও খুব দরকার।”

আইকা হেসেছিল। তারপর আর বেশিক্ষণ বসেনি। শুধু চলে আসার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “পুশকিন, তোর সেই দেবদারু গাছের তলায় বৃষ্টির দিনটা মনে আছে?”

পুশকিন থমকে গিয়েছিল। কিছু না বলে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

আইকা সামান্য হেসে বলেছিল, “আমার মনে আছে। আচ্ছা, সেদিন একটা সেনটেন্স শুরু করেও শেষ করিসনি। রিয়াকে তোর পছন্দ ছিল না তুই বলেছিলি। কিন্তু কাকে পছন্দ ছিল তবে? সেটা বলতে গিয়েও বলিসনি।”

পুশকিন হেসে বলেছিল, “আর মনে নেই। কতদিন আগের কথা। প্লাস সেদিন এত বৃষ্টি হয়েছিল যে, সব ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে। সেই পুশকিনটা ধুয়েমুছে পৃথিবী থেকে মিলিয়ে গেছে রে আইকা! সে বা তার ইচ্ছেগুলোও আর নেই!”

নিঃশব্দে সামনে রাখা মোবাইলটা কড়কড় করে নড়ে উঠল। এখন কে ফোন করল, রুপিন? আচমকা রুপিনের নামটা মনে আসতেই নিজের লজ্জা লাগল আইকার। ও কি মনে মনে আশা করছে যে, ওর ই-মেল পেয়ে রুপিন ওকে ফোন করবেন? কেন করবেন? রুপিনকে ও উত্তর দেয়নি কিছু। একরকম ইগনোরই করেছে! তারপর রুপিনের অনুপস্থিতিতে ই-মেলে রেজিগনেশন পাঠিয়েছে! ও নিজেও তো রুপিনকে ফোন করতে পারত। ওর রাগের কথা, কষ্টের কথা বলতে পারত। তা তো করেনি! তা হলে রুপিন কেন ফোন করবেন? কিন্তু যদি করতেন? আইকার মনটা আবার না-মেলা অঙ্কের মতো হয়ে গেল। ও ফোনটা তুলল। আরে নোঈ! এখন! মেয়েটা তো ওর সঙ্গে কথা বলছে না! ওর ওপর রেগে আছে! তা হলে এমন সময় ফোন করল কেন!

আইকা চিন্তা করল একটু। তারপর ফোনটা ধরল, “বল।”

“দরজা খোল দি। আমার তোর সঙ্গে কথা আছে। বেল বাজালাম না। কারণ, মাসির ঘুম ভেঙে যাবে। খোল।”

আইকা ফোনটা রেখে দিল। বুঝতে পারল না ব্যাপারটা কী! হঠাৎ নোঈ কী বলতে চায়!

আইকার মনে পড়ল কিছুদিন আগে নোঈ আচমকা ওকে লিফটের সামনে ধরেছিল! ওদের অফিসের টাইমিং-এর জন্য আজকাল খুব একটা দেখা হয় না। তাই নোঈকে দেখে ভাল লেগেছিল আইকার।

বলেছিল, “কী রে? কেমন আছিস? পাত্তাই নেই তোর!”

নোঈ গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “কেমন আছি জানিস না দি? মায়ের কাছে যখন গিয়ে লাগিয়েছিস আমি আর পুশকিনদা কোনও রেস্তরাঁয় ঢুকছি, তখন জানিস না মা কেমন রাখতে পারে আমায়!”

“মানে?” নোঈর এমন ব্যবহারে খুব ঘাবড়ে গেছিল আইকা! নোঈ এমনিতে চুপচাপ থাকে। ব্যবহার খুব ভাল। সে এমন করে ওর সঙ্গে কথা বলছে কেন! ওর মনে হয়েছিল পুশকিন কি ওই রাতে ওর কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা বলেছে নোঈকে? কিন্তু পুশকিন সেটা বলার মতো ছেলে নয়! আর পুটুমাসির সঙ্গে তো নোঈকে নিয়ে কোনও কথাই হয়নি! তা হলে! পুটুমাসি কী বলেছে! নোঈ এমন করে কথা বলছে কেন!

নোঈ বলেছিল, “যা বলার আমাকে বললেই পারতিস! মায়ের কাছে গিয়ে এসব বলার কী ছিল! আর, আমি তো বড় হয়েছি। কার সঙ্গে কোথায় যাব সেটা কেউ ঠিক করে দেবে কেন?”

“কী বলছিস তুই নোঈ?” আইকা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

নোঈ আর লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে সিঁড়ির দিকে যেতে-যেতে বলেছিল, “এভাবে কারও পেছনে স্পাইয়ের মতো নজর রাখার কোনও মানে হয় না। এতটা চিপ তো তুই ছিলি না দি! আই পিটি ইউ।”

আইকার খারাপ লেগেছিল খুব। নোঈ এমন করে বলল! ও স্পাইগিরি করেছে! ওর নামে পুটুমাসির কাছে লাগিয়েছে! এসব কী করে বলল ও? পুটুমাসি কি এসব বলেছে ওকে? কষ্টে আর অপমানে আইকার ভেতরটা কেমন গুটিয়ে গিয়েছিল। নোঈকে কত ভালবাসে ও! ওর জন্য পুশকিনের কাছে গিয়েছে বলতে যে, পুশকিন কী ভাবছে। নোঈ যেন কোনও কষ্ট পুশকিনের কাছ থেকে না পায়। আর সেখানে নোঈ ওর সঙ্গে এমন করল! আইকার একবার মনে হয়েছিল পুটুমাসির কাছে যায়। কিন্তু মত পালটেছিল। কেন যাবে? ও যা করেনি, সেটা ওকে কেন গিয়ে প্রমাণ করতে হবে? না, ও যাবে না। তার জন্য যদি ওর সঙ্গে কেউ কথা না বলে, না বলুক! নোঈ কোনওদিন যদি ভুল বুঝতে পারে, তা হলে কথা হবে, না হলে হবে না। ওর আর সেই বয়স নেই যে, জনে-জনে গিয়ে ওকে লোকের ভুল ভাঙাতে হবে।

কিন্তু আজ নোঈ কী বলতে চায়! আরও খারাপ কিছু বলবে নাকি?

আইকা চেয়ার থেকে উঠে চটিটা গলাল পায়ে। বেশ ঠান্ডা আজ। কট্‌সউলের ওভারকোট পরেও ঠান্ডা লাগছে!

ও দরজার সামনে গিয়ে ‘কি-হোল’-এ চোখ রাখল। দেখল, নোঈ দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। চোখে চশমা।

দরজাটা খুলে আইকা দাঁড়াল। নোঈ কী বলতে চায়?

নোঈ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আইকার দিকে। তারপর আচমকা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আইকাকে!

ঘটনার আকস্মিকতায় আইকা আর-একটু হলে পড়ে যাচ্ছিল! কিন্তু দরজার ফ্রেমটা ধরে নিজেকে সামলাল।

ও বুঝল নোঈ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে কাঁদছে! নোঈর শরীরটা কাঁপছে থরথর করে!

“কী হল? নোঈ? আরে নোঈ… কী হয়েছে তোর? এই দ্যাখো পাগলামি করে! কী হয়েছে বলবি তো?” আইকা নোঈকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল। তারপর কোনওরকমে দরজাটা বন্ধ করল। নোঈ কিছুতেই ছাড়ছে না ওকে। কেমন বাচ্চাদের মতো আঁকড়ে ধরে আছে!

ও এবার জোর করে নোঈকে ছাড়াল। সোজা করে দাঁড় করাল। নোঈর চশমা বেঁকে গেছে। সারা মুখ লেপটে আছে কান্নায়। নোঈ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে!

আইকা জোর করে থুতনিটা ধরে মুখ তুলল ওর, “কী হয়েছে?”

নোঈ কাঁপছে। হেঁচকি তুলছে। তার মধ্যেও বলল, “আমি… সরি দি… আমি না জেনে… আসলে মাসি বলেছে মাকে… আমাকে আর পুশকিনদাকে… মানে…”

আইকা বুঝল এবার। সেদিন নোঈ আর পুশকিনকে রেস্তরাঁয় ঢুকতে শুধু ও নিজেই দেখেনি। মা-ও দেখেছিল। আর মা সেই ঘটনাটা পুটুমাসিকে বলেছে। কোনও মানে আছে! মা আইকাকে পুরো ব্যাপারটাই চেপে গিয়েছে। জানে, আইকা জানলে বকবে।

আইকার হাসি পেল হঠাৎ। নোঈটা খুব ছেলেমানুষ। এই রাগ করছে! এই কাঁদছে! কী যে করছে ঠিক নেই। পুটুমাসিও পারে! নিশ্চয় খুব আজেবাজে কথা বলেছে!

আইকা নোঈকে দু’হাতে ধরে বলল, “ও! এখন কান্নাকাটি করে ম্যানেজ করা হচ্ছে? এবার যদি আমি বকি? কান মুলে দিই তা হলে? তখন কী হবে?”

নোঈ আইকার হাতটা ধরে নিজের গালে থাপ্পড় মারার চেষ্টা করল। বলল, “আমায় মার তুই, আমায় মার…”

“আবার এসব করে!” আইকা হাসি চেপে নিজের গলাটা কড়া করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। হেসেই ফেলল, “পাগলি একটা! এমন কেউ করে? আরে, তোর ভুল হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছিস, এনাফ। আর কিছু বলতে হবে না!”

নোঈ চশমা খুলে জামার হাতায় চোখ আর গাল মুছল। এখনও মেয়েটা হেঁচকি তুলছে অল্প। আইকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সত্যি কী বলে ক্ষমা চাইব জানি না। আজ দিনটা আমার কাছে খুব ইমপর্ট্যান্ট, জানিস দি। আজ আমায় ডিসাইড করতে হবে আমি জীবনে কোন দিকে, কার দিকে যাব। আর আজ মায়ের কাছে এটাও জানলাম যে, তুই কিছু বলিসনি। আমি যে কী খারাপ বিহেভ করেছি তোর সঙ্গে!”

“আমার সঙ্গেই তো করেছিস। আমায় নিজের ভাবিস বলেই তো করেছিস। তা হলে! এখন এসব রাখ।”

নোঈ চোখ মুছে বলল, “মা বলল, তুই নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস কাল। সত্যি?”

আইকা হাসল। খবরটা ঠিক পেয়ে গিয়েছে! মায়ের পেটে যদি কিছু খবর থাকে! ও বলল, “হ্যাঁ রে। ভাল লাগছিল না। ম্যানেজমেন্ট এমন একটা ডিসিশন নিল!”

“কেন?” নোঈ চোখ মুছল। কথার ভেতর এখনও একটা হালকা কাঁপন আছে কান্নার।

“আরে, ওই সোনাঝুরির প্রজেক্টটা আর আমরা করছি না। আমায় আবার ফিল্ড থেকে সরিয়ে গোডাউনে দিয়ে দিয়েছে। মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু ভাবটা এই যে, আমার জন্য প্রজেক্টটা হয়নি। আরে, মালিকরাই ডিসাইড করতে পারছে না তো আমি কী করতে পারি! কিন্তু ওরা কথাই শোনেনি। এটা তো ইনসাল্ট! আমি তাই ছেড়ে দিয়েছি। আমার কাছে দু’-একটা অফার আছে। দেখি।”

“কিন্তু একটা কাজ পেয়ে ছাড়লে হত না! আর এভাবে হঠাৎ…”

আইকা বলল, “তুইও তো হঠাৎ ছেড়েছিলি, মনে আছে? কিছু জিনিস ইমপালসে করতে হয়! না হলে…”

আইকা কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই আচমকা ডোরবেলটা টিংটং টিংটং করে কয়েকবার বেজে উঠল। শুনেই বোঝা যাচ্ছে কারও খুব তাড়া আছে।

আইকা বিরক্ত হল। কে এমন করে বেল বাজাচ্ছে! ভেতরের ঘরে মা ঘুমোচ্ছে, উঠে পড়লে মায়ের শরীর খারাপ করবে।

ও নোঈকে ছেড়ে দ্রুত গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দেখল, ভীত-সন্ত্রস্ত মুখে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফ্ল্যাটের দারোয়ান সুশান্তর স্ত্রী, মালতী।

আইকার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। মাগোর কিছু হয়েছে কি? সুশান্ত পা ভেঙে বসে আছে। তাই মালতী হয়তো ওর কাছে এসেছে।

“কী হয়েছে রে?” আইকার গলা কেঁপে গেল।

“বিটিয়ার, মাথা… মাথা ফেটে গেছে…” মালতি কেঁদে ফেলল কথা বলতে গিয়ে।

“সে কী!” আইকা চিৎকার করে উঠল। তারপর বুঝল এখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন-উত্তর খেলে লাভ নেই। ও দ্রুত ঘরের ভেতরে গিয়ে মোবাইল আর টাকার ব্যাগটা নিল। তারপর গাড়ির চাবিটা নিতে গিয়ে থমকে গেল। আরে, গাড়িটা তো দু’দিন আগে গ্যারাজে দিয়েছে ঠিক করতে। ক্লাচটা কাজ করছিল না বলে। এখন কী হবে?

নোঈ নিজেকে সামলে নিয়েছে এসবের মধ্যে। ও বলল, “একটা অ্যাপ ক্যাব ডেকে নেব। নীচে চল তুই।”

আইকা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল। মাকে জাগানোর মানে হয় না। ঘুমোক। ও ঘরের চাবিটা দরজার পাশের টেবিলটা থেকে তুলে বাইরে পরার জুতোটা গলিয়ে নিল পায়ে। জামাকাপড় পালটানোর সময় আর নেই।

আইকা আর নোঈ দরজাটা টেনে দ্রুত বেরোল। মালতী আগেই লিফটের কল-সুইচ টিপে লিফটটাকে ওপরে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল।

আইকা লিফটে উঠে নোঈর দিকে নিজের মোবাইলটা বাড়িয়ে দিল, “দ্রুত একটা গাড়ি বুক কর।”

লিফট নীচে নামতেই আইকা ছিটকে বেরোল।

সুশান্ত বসে ছিল মেয়েকে ধরে। মাগো কাঁদছে। সুশান্ত মাথার কাছে একটা গামছা চেপে ধরেছে। লাল হয়ে গেছে সবুজ গামছা!

আইকার শরীরটা কেমন করে উঠল। মাগো ছটফট করছে। ওকে দেখে জল এসে গেল আইকার চোখে। ও কী করবে বুঝতে পারল না।

“দি, একটাও গাড়ি নেই। আজ বড়দিন না! কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না! শেয়ারও বলছে পনেরো মিনিট লাগবে!” নোঈ টেন্‌সড গলায় বলল।

“তা হলে?” আইকার কেমন লাগল শরীরটা। এবার কী করবে ও। কাছের যে পলিক্লিনিক আছে সেটা প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এখন এই ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ও যাবে কী করে?

এমনিতেই আইকা রক্ত দেখতে পারে না। সেখানে এখন কী হবে? ফ্ল্যাটের অন্য কারও হেল্‌প নেবে? কিন্তু তারা কি এখন হেল্‌প করবে?

আচমকা ফ্ল্যাটের মেন দরজার কাছে একটা গাড়ির হর্ন শুনতে পেল আইকা। এত রাতে কে এল? যেই হোক গাড়িটা যদি পাওয়া যায়?

আইকা দ্রুত সুশান্তর ছোট ঘরটা থেকে বেরিয়ে মূল ফটকের কাছে এল আর এসেই থমকে গেল একদম! দেখল, সাদা একটা ভাড়া করা সেডান থেকে নামছেন রুপিন!

আইকা কী বলবে বুঝতে পারল না। ও থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রুপিন! এখানে! এখন! কেন?

“স্যার প্লিজ়, গাড়িটা ছাড়বেন না!” নোঈ পাশ থেকে দৌড়ে গেল রুপিনের দিকে।

রুপিন, আইকা আর ওর পাশে নোঈকে দেখেই বুঝেছেন যে, কিছু একটা হয়েছে! সঙ্গে-সঙ্গে গাড়িওয়ালাকে জানলা দিয়ে বললেন, গাড়িটা লাগবে আরও।

আইকা দেখল, নোঈ ওই অবস্থায় মাগোকে নিয়ে এল। মালতীও এসেছে সঙ্গে। সুশান্ত খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। আইকা নিজেকে ঠিক করল।

মালতী উঠেছে গাড়িতে। মাগোকে ওর কোলে দিল নোঈ।

“তুই থাক এখানে। আর, এই নে আমার ফ্ল্যাটের চাবি, আমরা যাচ্ছি!” আইকা চাবিটা নোঈর হাতে দিয়ে মালতীর পাশে উঠে বসল।

নোঈ একবার দেখল রুপিনকে। ও অবাক হয়ে তাকাল। স্বাভাবিক। ও তো বুঝতে পারছে না কে লোকটা। কেন এভাবে এলেন! কেন কিছু না জেনে গাড়িটাকে দাঁড়াতে বললেন!

আইকা নোঈর দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলল, “আমার বস!”

রুপিন সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশে বসতে-বসতে আইকার মতো একই সুরে বললেন, “এক্স বস!”

মাগো ঘুমোচ্ছে এখন। বাচ্চাদের ওয়ার্ডে মাগো আর মালতীকে রাখা হয়েছে আজ রাতের মতো। মাথায় লেগেছে, তাই একটু অবজ়ার্ভ না করে তো আর ছাড়তে পারে না!

আইকা দেখে এসেছে মাগোকে। চারটে সেলাই পড়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে। মালতীও ওর পাশেই শুয়ে।

রিসেপশনে এসে দাঁড়াল আইকা। কাচের রিসেপশন। দেখা যাচ্ছে বাইরেটা। সামনে বড় রাস্তা শুনশান। রিসেপশনেও একজন বসে ঝিমোচ্ছে। ও মোবাইলটা দেখল। আড়াইটে বাজে।

রুপিন কোথায়! এখানেই তো ছিলেন। গেলেন কোথায়! এদিক-ওদিক তাকাল আইকা। আর তখনই দেখতে পেল রুপিনকে। রাস্তার ওপার থেকে আসছেন মানুষটা। কী করছে কী লোকটা! আইকা রিসেপশনের কাচের দরজা খুলে বেরোল রাস্তায়। দেখল, রুপিন হাতে দুটো মাটির খুরি নিয়ে আসছেন!

আইকা এগিয়ে গেল কাছে। রুপিনের সঙ্গে কথাই বলা হয়নি একটুও। সময়ই পায়নি। ও বলল, “স্যার, আপনি! এখানে এভাবে! সরি, এতক্ষণ কথাই বলতে পারিনি!”

রুপিন হাসলেন। আইকার হাতে একটা চায়ের খুরি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “আর স্যার কেন? তুমি তো রিজ়াইন করেছ। ওরা হয়তো রেজিগনেশন নিয়েও নেবে। ফলে টেকনিকালি আমি তোমার স্যার নই আর।”

“তা হলে এখানে কেন?”

রুপিন চায়ে চুমুক দিলেন একটা, নাক কুঁচকে বললেন, “মিষ্টি বেশি! কিন্তু এত রাতে যে পেলাম এই অনেক! তাই না!”

আইকা দেখল রুপিন হাসছেন।

“কী হল?” আইকা বিরক্ত হল এবার, “কী জিজ্ঞেস করছি?”

“সোনম বলত আমার উদ্যোগের অভাব আছে, জানো! তাই আমার দ্বারা কিছু হবে না! তাই ভাবলাম অনেক হয়েছে। যার জন্য মনখারাপ করছে সে কেন রিজ়াইন করল, একবার জেনে আসি।”

“মনখারাপ!” আইকা অবাক হল, “আর, ফোনও তো করা যেত। তাই না!”

রুপিন বললেন, “ফোন করলে মজা কই! প্লাস তোমার মাগোর কী হত! আর…”

“আর?” আইকা তাকাল এবার রুপিনের দিকে।

“আর, আমার কী হত আইকা! আমার যে খুব মনখারাপ করছিল তোমার জন্য। চাকরি ছেড়ে দিলে তো আর দেখতে পাব না তোমায়! তাই… ভাবলাম… শেষবার একবার দেখে আসি। আমি জানি আমার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। এসব ছেলেমানুষি করার আর বয়স নেই। কিন্তু তুমি বলো তো, আমরা কি সত্যি কোনওদিন বড় হই! এখনও তো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, স্কুলে যাওয়ার আগে মা আমার ভাত মেখে দিচ্ছে। এখনও তো পাহাড় দেখলে সেই কুড়ি বছর বয়সের মতো মনের মধ্যেটা কেমন করে। এখনও তোমার কথা মনে পড়লে আর সব কিছু বেকার, ফালতু মনে হয়। মনে হয় সদ্য কলেজে ওঠা আমিটা আবার কষ্ট পাচ্ছে। আমরা কি সত্যি কোনওদিনও বড় হই! বড় হওয়ার অভিনয় করতে করতে আমরা শেষমেশ সেটাকেই বিশ্বাস করতে শুরু করি মাত্র! আসলে আমরা বড় হই না। আমি জানি তুমি হয়তো বিরক্ত হচ্ছ। কিন্তু তাও আমায় ফিরিয়ে দিলেও এটা তো মনে রাখবে যে, একটা লোক এসেছিল তোমার জন্য সারা ভারতবর্ষ টপকে!”

আইকা কী বলবে বুঝতে পারল না। স্ট্রিট বাল্‌বের আলো এসে পড়েছে রুপিনের সাদা-কালো চুলে! ফরসা চামড়ায় আলো পিছলে যাচ্ছে! রুপিন হাসছেন ওকে দেখে। আর পুশকিনের কথা মনে পড়ছে আইকার— আমাদের যারা ভালবাসে, তাদেরও একবার সুযোগ দিতে হয়! তাদেরও একবার বলতে হয়, ‘রাজি!’

আইকা ঠোঁট কামড়ে তাকাল রাস্তার দিকে, শীতে, কুয়াশার তলায় কুঁকড়ে যাওয়া কলকাতার দিকে। শীত সত্যি কি শুধু সব কিছু নষ্টই করে দেয়? সব কিছু শেষ করে একা চণ্ডালের মতো জেগে থাকে ধ্বংসের মাঝে? নাকি শীত গত সময়ের ব্যবহৃত আবর্জনা সরিয়ে পৃথিবীকে নতুন করে বাঁচার জায়গা করে দেয়? আসলে শীত সেই জীবন তৈরি করে দেয়, যেখানে নতুন স্কুলের জামায় আবার ধুলো-মাটি লাগে। নতুন ব্ল্যাকবোর্ডে আবার শুরু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অঙ্ক, বিজ্ঞান আর নতুন দিনের বেঁচে থাকা। শীত আসলে সেই টবের মাটি তৈরি করে দেয় যাতে, আবার আগামী গ্রীষ্মের সন্ধের আবছায়ায় জেগে ওঠে বেলফুলের সুবাস। শীত মানুষকে নতুন শুরুর কথা বলে। পৃথিবীর দুর্লভ ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ আবার সামনে এনে দেয়। সুযোগ দেয় আগের ভুল শুধরে নেওয়ার, আবার নতুন করে ভাল থাকার। শীত সব বাধা আর খসে-পড়া গত পৃথিবীর অতিরিক্ত যা কিছু সমস্ত সরিয়ে মানুষকে দেয় আর-একবার চেষ্টা করার সুযোগ। জীবনে ফিরে আসার সু্যোগ।

আইকা দেখল, রুপিন তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। মুখে সামান্য হাসি। হয়তো হেরে যাওয়ার হাসি। রুপিন কি হেরে যাবেন? আইকার মনে হল তা হলে তো সেই মানুষগুলোও হেরে যাবে যারা কষ্ট পেয়েও, সব ভুলে আবার বিশ্বাস করেছিল। আবার হাত বাড়িয়েছিল। আবার চেষ্টা করেছিল। আইকা ভাবল রুপিন হেরে গেলে ও নিজেও তো হেরে যাবে।

আইকা এগিয়ে গেল এবার। রুপিনের চায়ের খুরিটা নিয়ে ফেলে দিয়ে হাত ধরল ওঁর। তারপর নরম গলায় বলল, “এসব খেতে হবে না। আর ভেতরে চলুন। ঠান্ডা লেগে যাবে। এই শীতটা ভাল নয়।”

রুপিনও আইকার হাতটা চেপে ধরলেন এবার। সামান্য হাসলেন। তারপর বললেন, “শীতের চেয়ে আর ভাল কিছু হতেই পারে না আইকা! ইট ব্রিংস পিপল হোম!”

.

৩৭. কাজু

প্রথম বোমাটা কে মেরেছিল সেটা ঠিক বুঝতে পারেনি কাজু। ফ্যাক্টরি গেটের সামনের কাঁঠালচাঁপা গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে মাইকে কথা বলছিল সতু। সামনে প্রায় হাজারদেড়েক লোক জটলা করছিল। সব শ্রমিক আসেনি। কিন্তু যা এসেছিল তাই অনেক। শেষ বিকেলের দিকে কথা ছিল কাজুও কিছু বলবে। কিন্তু ঠিক তখনই প্রথম বোমাটা পড়েছিল।

বোমার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কাজু দেখেছিল, ওর সামনের দুটো লোক হঠাৎ কেমন যেন দম শেষ হওয়া পুতুলের মতো টলে পড়ে গেল মাটিতে। মানুষজন দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিয়েছিল। চিৎকার, পুলিশের লাঠিচার্জ আর যন্ত্রণায় কাতরানো মানুষের ভিড়ে কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন দিশাহারা লাগছিল কাজুর। এই ভিড়ে তো বিজনও আছে। ওকে বারণ করা সত্ত্বেও তো এসেছিল। কাজুর মনে হয়েছিল বিজন কই! কোথায় গেল ছেলেটা! ওর যদি কিছু হয়ে যায়! বোমা পড়ছিল আরও। মানুষের আতঙ্ক বাড়ছিল সঙ্গে সঙ্গে। পুলিশ লাঠি নিয়ে নেমে পড়েছিল। কারা বোমা মারছে? কেন মারছে? ওরা তো শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত করছিল। ওদের অসহায়তা আর দাবির কথা বলছিল। সুদর্শন মালিক তো ওদের কোনও কথাই শুনছে না। তাই তো ওরা বাধ্য হয়ে জমায়েত করেছিল। সেখানে হঠাৎ বোমা পড়ল কেন! কারা ফাটাল? এইভাবে কি আন্দোলন ভেস্তে দেওয়া যাবে! না দেওয়া যায়?

কাজু ভিড় থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়েছিল। কোথায় গেল বিজন! এই ভিড়ের মধ্যে দৌড়োদৌড়ির চাপে পড়ে বিজনের কিছু হয়ে গেলে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।

আর ঠিক তখনই দূরে একটা বটগাছের আড়ালে বিজনকে দেখেছিল ও। সতু ছিল কাজুর পাশে।

কাজু সতুকে বলেছিল, “তুই যাদবকাকা আর বাকিদের মিলের গলির পাশ দিয়ে বের করে দে। আমি বিজনকে নিয়ে যাচ্ছি!”

“পালা কাজু!” সতুর গলা কাঁপছিল উত্তেজনায়, “ওরা তোকে পেলে কিন্তু বিপদ হবে। তুই পালা!”

আলো কমে সন্ধে হয়ে আসছিল। মানুষের অস্থিরতা বাড়ছিল আরও। আর বোমা পড়ছিল। কাজু দেখেছিল ফ্যাক্টরির পাঁচিল টপকে বোমাগুলো এসে পড়ছিল এদিকে। এ কী! মালিকরা তবে বোমা ফেলছে! ওদের পোষা গুন্ডারা এসব করছে! আর সেখানে পুলিশ তা হলে নিরীহ শ্রমিকদের ওপর লাঠি চালাচ্ছিল কেন? কাজুর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল। ও বুঝতে পারছিল ব্যাপারটা কী হচ্ছে! আস্তে-আস্তে পুলিশ বাড়ছিল সংখ্যায়। এরপর বিজনকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

আচমকা ফ্যাক্টরির গেট খুলে গিয়েছিল এবার। আর কাজু সন্ত্রস্ত হয়ে দেখেছিল, দশ-বারোজন লোক বেরিয়ে আসছে। হাতে রড, চপার আর সাইকেলের চেন! পরিস্থিতি যে কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা আঁচ করে কাজু আর দাঁড়ায়নি। ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে, মানুষজন পার হয়ে দৌড়েছিল বটগাছটা লক্ষ করে। আর তখনই বৃষ্টি নেমেছিল ফোঁটা-ফোঁটা। কাজু প্রাণপণে দৌড়েছিল বিজনের দিকে।

বটগাছের কাছে পৌঁছে কাজু দেখেছিল গেট থেকে বেরিয়ে আসা গুন্ডারা এদিকেই ধেয়ে আসছে! ওদের লক্ষ্য স্পষ্ট!

“কাজুদা, সাইকেল!” বিজন কাজুর হাত টেনে নিয়ে এসেছিল পাশের ঝোপটার দিকে। বলেছিল, “সতুদা বলেছিল সাইকেলটা এখানে লুকিয়ে রাখতে। বলেছিল এমন ঝামেলা হতে পারে। তুমি, তুমি চলো কাজুদা। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

সতু কোথায় গেল! যাদবদাদের নিয়ে ঠিকমতো পালাতে পারল তো! বিমলদা বলেছিল আসবে কিন্তু এল না তো!

আর-একটা বোমা এসে পড়েছিল কাছাকাছি। স্প্লিন্টার এসে লেগেছিল পাশের গাছে! হতভম্ব ভাবটা কিছুটা কেটেছিল।

“কাজুদা, ওরা তোমায় মারবে… পালাও!” বিজন ওর হাত ধরে টান মেরেছিল জোরে।

আর অপেক্ষা করেনি কাজু। দ্রুত সাইকেলটা টেনে নিয়ে উঠে পড়েছিল! বিজন লাফিয়ে পেছনের ক্যারিয়ারে বসেছিল। কাজু প্রাণপণে চালিয়ে দিয়েছিল সাইকেল!

পেছনে তেড়ে আসছিল লোকজন। বোমার শব্দ আসছিল। চিৎকার, গালিগালাজ আরও কী সব যে ভেসে আসছিল! কাজু কোনও দিকে না তাকিয়ে সাইকেল চালিয়ে দিয়েছিল গঙ্গার দিকে। নিজের জন্য খারাপ লাগছিল। এভাবে পালিয়ে এল ও! এভাবে চলে এল! সবাইকে ফেলে রেখে পালিয়ে এল! ওর ডাকেই তো আজকের গেট মিটিং হয়েছিল। বিমলদা তো করতে চায়নি। রাগ করেছিল। বলেছিল, “আবার তুই পাকামো শুরু করেছিস?”

পার্টি অফিসে বসে কথা বলছিল বিমলদা। সামনে রাখা চা-টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হুঁশ ছিল না বিমলদার। খুব রেগে গিয়েছিল, “তোকে কে বলেছে এসব করতে? আমি বারণ করিনি? মালিকরা যদি বন্ধ করে দেয় কারখানা, তা হলে শ্রমিকদের কী হবে? গোপেনরা বলবে, আমরা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি, বলবে আমরা শ্রমিক স্বার্থ দেখি না। সামনে ইউনিয়নের ভোট। সেখানে এসব বলে গোপেনরা প্রচার চালাবে। আমাদের অসুবিধে দেখবি না? তোকে আগেও একবার বলেছিলাম না?”

কাজু শুধু বলেছিল, “আমি শ্রমিকদের কথা ভেবেই এটা করেছি। যাদবকাকারাও আমাদের সঙ্গে আছে। আর আমরা তো স্ট্রাইক করছি না। জানাচ্ছি আমাদের কথা। সেটা আমাদের অধিকার বিমলদা। এটা কেউ কাড়তে পারবে না। আপনিও না। আমরা খারাপ বা ঋণাত্মক কিছু করছি না কিন্তু। আমি চাই আপনিও আসুন মিটিং-এ। আমরা ওদের পাশে আছি জানলে ওদের মনোবল বাড়বে। আর আপনি খালি ভোট নিয়ে চিন্তিত, সেটাও সফল হবে।”

পার্টি-অফিস তো আর চায়ের দোকান নয়। সেখানে বিমলদার একটা ইমেজ আছে। আর কাজুকে ভালবাসে এমন কর্মীর সংখ্যাও কম নয়!

বিমলদা কাজুর কথাটা গিলে নিয়েছিল যেন! তেতো গলায় বলেছিল, “ঠিক আছে, যাব না হয়। কিন্তু স্ট্রাইক বা কাজ বন্ধ করার কথা বলে উসকাবি না কাউকে! এটা যেন মনে থাকে!”

“মানুষের কথা বলা, তাদের অধিকার পাইয়ে দেওয়াটা কি উসকানো বিমলদা? আপনি দলের মাথা হয়ে এসব কী বলছেন?” কাজুর অবাক লেগেছিল খুব।

বিমলদা তাকিয়ে দেখেছিল কাজুর দিকে। তারপর চিবিয়ে-চিবিয়ে নিচু স্বরে, আশপাশের কেউ যেন শুনতে না পায় এমনভাবে বলেছিল, “শুয়োর, আমার অফিসে দাঁড়িয়ে আমায় জ্ঞান! তোর ব্যবস্থা হচ্ছে!”

কাজু হেসেছিল। তারপর সবাই যাতে শুনতে পায় এমন গলায় বলেছিল, “আপনার অফিস? সে কী! আপনি তাই ভাবেন নাকি? আর আমাদের কী ভাবেন, আপনার কর্মচারী? এটা পার্টির অফিস। আপনি কর্মী, আমরাও কর্মী। আপনি সিনিয়র। সম্মান সেটুকুই। তার বেশি নয়। আর যাতে আমরা আপনাকে সম্মান করতে পারি সেটা দেখার দায়িত্বও আপনার। জানবেন, আমরা বয়সে নবীন। আগামী পৃথিবী কিন্তু আমাদেরই হাতে।”

“কাজুদা, ক’টা বাজে!” বিজনের গলায় এখনও সতর্কতা!

কাজু ঘড়িটা দেখল। এখানটা বেশ অন্ধকার। তাও ঘড়ির কাঁটা জ্বলজ্বল করছে! সওয়া আটটা বাজে।

কাজু বলল, “চল, আমরা যাই। অনেকক্ষণ হল। মনে হয় সব ঠান্ডা হয়েছে।”

বিজন মাথা নাড়ল, “না, না, পাগল হয়েছ তুমি? পুলিশ তোমায় পেলেই ধরবে! জানো না এটা? আমি বাচ্চা ছেলে হয়েও জানি! আর তুমি বলছ, চল?”

কাজু চুপ করে গেল। পেখমের কাছে কি এই খবরটা পৌঁছেছে? নিশ্চয় পৌঁছেছে। ওর ছোটকা তো এখন জুটমিলের ম্যানেজার। আগে কাজুকে কী পছন্দ করতেন, কিন্তু এখন দেখা হলে এমন মুখ করেন! তা ছাড়া সবুজকাকু তো এসেছিলেন ফোর্স নিয়ে। আচ্ছা পেখমদের কী বলছে ওরা কাজুর নামে? কাজু গোলমাল পাকিয়েছে! কাজুর জন্যই এই গোলমাল হয়েছে! মিলের ভেতর থেকে যে বোমা মারা হয়েছে, সেটা কি ওরা জানে? মিলের ভেতর থেকে যে গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে ওদের ওপর, সেটাও কি জানে? কাজু জানে, পেখম কিছুই বিশ্বাস করবে না।

কাজু মনে মনে এমনিতেই মরে আছে। নয়নার সঙ্গে সেই রাতে কী যে হয়েছিল! পেখমের বিশ্বাসই তো ভেঙেছে। কিন্তু সেটা বলতে আর পারল কই পেখমকে! ও তো বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা শুনতেই চাইল না। কী করে যে এর প্রায়শ্চিত্ত করবে কাজু! কতদিন এই অপরাধ সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকবে ওর বুকের ওপর! কিন্তু তাই বলে তো পেখমকে ও ছেড়ে দিতে পারে না! মানুষের জীবনের না-বলা কথা হয়েই না হয় থেকে যাবে এই ঘটনাটা। অমীমাংসিত অপরাধের মতো।

ও আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টি আর হচ্ছে না। তবে আকাশ লাল হয়ে আছে। চৌধুরীদের পোড়োবাড়ির ঝোপে ওরা বসে রয়েছে এখন। গঙ্গার বাঁধের পাড়ে এই বিশাল খণ্ডহর ধরনের বাড়িটা দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত। কেউ আসে না এদিকে। সাপখোপের ভয় থাকলেও তাই এদিকে এসেছে কাজু!

বিজন বলল, “কাল তোমার যাওয়া আছে, মনে আছে তো!”

কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে তো আছে। কিন্তু আজ ব্যাপারটা এমন হয়ে যাবে, সেটা বুঝতে পারেনি। ওর প্ল্যান ছিল আজকে গেট মিটিংটা করে দিয়ে ও বাকি ব্যাপারটা সতুকে বুঝিয়ে দেবে। তারপর কাল বেরিয়ে যাবে পেখমের সঙ্গে। হাজারিবাগের কাছে আন্টিবাডুর এক বান্ধবী থাকে। সেখানেই যাবে আপাতত। এই যে ওরা চলে যাচ্ছে, সেটা বাড়িতে জানিয়েছে কাজু। বাবা, মা আর আন্টিকে জানিয়েছে। বাবা-মা আপত্তি করলেও আন্টি বলেছে, “ঠিক আছে। তোর লাইফ। ইউ হ্যাভ এভরি রাইট টু ডিসাইড। আমাদের কিছু বললে আমরা দেখে নেব। বলব আমরা জানি না।”

মা যদিও ভয় পাচ্ছে খুব, কিন্তু কাজু বুঝিয়েছে। বাবাও সব ভেবে শেষমেশ বলেছে, “ওর যাতে আনন্দ, সেটাই ও করুক!”

কিন্তু মুশকিল হল এখানে এভাবে যে সব গন্ডগোল হয়ে যাবে, সেটা বুঝতে পারেনি কাজু। এখানে কতক্ষণ বসে থাকবে ও? খবরও পাচ্ছে না কী হয়েছে!

এই বাড়ির সীমানা পার হয়ে বাঁধের ওপরের কাঁচা পথ। তারপরেই নদী। সেদিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে।

কাজু কাঁধের ঝোলাটার ভেতর হাত ঢোকাল। ডায়েরিটা আছে। সঙ্গে পেখমের দেওয়া কার-বাঁধা রুপোর লকেটটাও। সেটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরল ও।

বিজন বলল, “সতুদা কি জানে তুমি আর পেখমদি কাল…”

“না, জানে না। ওকে আমি বলেছি বাড়ির কাজে আমি কয়েকদিনের জন্য মেদিনীপুর যাচ্ছি। বাইরের লোকেদের মধ্যে তুই জানিস শুধু।”

আসলে মুক্তার সিংহের ট্যাক্সিটা বিজনই ঠিক করে রেখেছে। সেটা করেই ওরা হাওড়া চলে যাবে। মুক্তার অল্পবয়সি ছেলে। একুশ-বাইশ বছর বয়স। কলকাতায় ট্যাক্সি চালায়। বিজনের সঙ্গে ভাল ভাব আছে।

বিজনের বয়স হয়তো অল্প, কিন্তু এই বয়সেই খুব কাজের ছেলে। কত লোকের সঙ্গে যে আলাপ! সবার দায়ে-দফায় গিয়ে হাজির হয়। তাই সবাই ভালওবাসে। কাজু জানে, ভবিষ্যতে বিজন অনেক বড় হবে।

কাজু বলল, “তুই এবার আয় বিজন। আর থাকিস না এখানে। তোর বাড়িতেও লোকজন চিন্তা করবে!”

বিজন কী একটা ভাবল। বলল, “ঠিক বলেছ। আমি বেরোচ্ছি। সাইকেলটা নিয়ে যাচ্ছি। বাইরের পরিস্থিতি কী একবার দেখি। ঘণ্টাখানেক পরে আমি আসছি আবার। খবর নিয়ে আসছি। তুমি কিন্তু এখান থেকে নড়বে না, আমি খবর নিয়ে এসে যদি সব ঠিক আছে দেখি, তা হলে বেরোবে। আর তেমন হলে সতুদা, যাদবকাকাকে বলব আজ রাতের মতো তোমায় কোথাও থাকার জায়গা করে দিতে!”

কাজু আবছায়ায় বিজনের দিকে তাকাল। ছেলেটা অনেক করছে ওর জন্য। বলল, “সাবধানে যাবি। আর রিস্ক নিবি না। কেমন? বাইরে কী পরিস্থিতি কেউ জানে না। আর নিজে না এসে সতুকেও আসতে বলতে পারিস। আর পারলে পেখমকে একটা খবর দিস যে, আমি ঠিক আছি। আচ্ছা আয় এবার।”

আবছায়া অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে কাজুর। ও দেখল, বিজন ওর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। তারপর সামনে রাখা সাইকেলটা নিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। চারিদিকে ঝিঁঝি আর রাতপাখির আচমকা চিৎকারের মাঝে কিটকিট করে সাইকেলের চেনের শব্দ আর ঘাসপাতার ওপর বিজনের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল কিছুক্ষণ। তারপর আবার সবকিছু যেন কেউ ঢেকে দিল স্তব্ধতার কালো নরম কাপড় দিয়ে।

আকাশের দিকে তাকাল কাজু। লালচে রং ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। মেঘলা হয়ে আছে। কেমন একটা স্যাঁতসেঁতে বিষণ্ণতা। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। এবার ঘাড় ঘোরাল কাজু। একটু দূরে জোনাক-বাড়ির পেছনের দিকে বড়-বড় গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে। চৌধুরীদের এই জায়গার কোনাকুনি গেলে জোনাক-বাড়ির পেছন দিকের একটা অংশ পড়ে। কিন্তু জায়গাটা এতটাই জঙ্গলে ঢাকা যে, যাওয়া সম্ভব নয় কারও পক্ষে।

কাজু জানে এখন কিছু করার নেই। বাড়িতে যে যাবে, সেটাও সুরক্ষিত নয়। সত্যি যদি ওকে পুলিশ খোঁজে, তা হলে বাড়িতেও ওরা হানা দেবে। আর, একবার ধরা পড়লে খুব মুশকিল। পেখমের সঙ্গে যাওয়াটাই আর হবে না। পেখম যে অন্য কারও হয়ে যাবে, এটা ভাবতেই পারে না কাজু। এটা মনে করলেই কেমন একটা করে শরীরে! মনে হয় এক্ষুনি সাংঘাতিক কিছু একটা হয়ে যাবে। কেমন কান্না পায়। পেখম এই পৃথিবীতে থাকবে আর ওর হবে না, এটা হয় নাকি! তাই কোনও ঝুঁকি ও নেবে না। বিজন বা সতু এসে বাইরের ‘সব ঠিক আছে’ ধরনের খবর দিলে তবে বেরোবে।

সামনে তাকিয়ে রইল কাজু। দেখল, জোনাকি উড়ছে। ঝিরঝির আলো জ্বালিয়ে জোনাকিরা উড়ছে। কী সুন্দর দেখতে লাগছে! মনে মনে গুনল কাজু। প্রায় কুড়িটা জোনাকি। ও ভাবল, ওদের জোনাক-বাড়িতে তো আরও আছে! এমন ঠান্ডা সুন্দর আলো আর কোথাও দেখেনি ও। হঠাৎ নয়নার কথা মনে পড়ল কাজুর!

অদ্ভুত মেয়ে নয়না। সেদিন সন্ধেবেলা একটা কাচের বোতল নিয়ে এসেছিল ওদের বাড়িতে। কী আবদার, না জোনাকি ধরবে!

কাজুর সেদিন পড়ানো ছিল না। ভেবেছিল, একবার পার্টি-অফিসে যাবে। সেই মতো মুড়ি-চানাচুর খেয়ে বেরিয়েছিল। কিন্তু যেতে পারেনি। গেটের কাছে দেখা হয়েছিল নয়নার সঙ্গে!

নয়না! সেই ছাদের ওপর আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনাটার পরে নয়নার কথা ভাবলেই কেমন একটা অপরাধবোধ এসে ঘিরে ধরে কাজুকে। মনে হয়, পেখমের ওপর রাগটা এভাবে বেরোল ওর মধ্য দিয়ে। কেন ওভাবে নয়নাকে ধরল ও। এটা তো পেখমকে ঠকানো হল। ব্যাপারটা যতটা সম্ভব মন থেকে ভুলে যেতে চায় কাজু। কিন্তু নয়না মাঝে মাঝে ওর কাছে এসে কিছুতেই ভুলতে দেয় না ওকে কিছু।

সেদিনও জোনাক-বাড়ির গেটের কাছে নয়না এসে পথ আটকেছিল কাজুর। এই সময়টা তেমন লোকজন থাকে না ওখানে। নয়না সোজা এসে কাজুর জামার কলারটা ধরে টেনে ঠোঁট রেখেছিল ঠোঁটে! কাজু ঘাবড়ে গেছিল। কী করছে কী মেয়েটা! কেউ দেখে ফেললে! এখানে কেউ নেই ঠিক আছে, কিন্তু বাড়ির জানলায় তো কেউ থাকতেই পারে।

নয়নাকে ও ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল।

নয়না হেসে বলেছিল, “কী হল? লজ্জা লাগছে? কেউ দেখে ফেলবে? সেদিন যেভাবে বুকে কামড়ে দিলে মনে আছে? এখনও নীল হয়ে আছে! জানো?”

“তুই চুপ কর। ওটা ভুল হয়ে গেছে আমার। আর হবে না। প্লিজ়, ওটা ভুলে যা,” কাজু কাতর স্বরে বলেছিল।

“ভুল! অতক্ষণ ধরে ভুল!” নয়না চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, “ও, পেখম সেদিন তোমার সঙ্গে দেখা করার পরে এসব এখন ভুল লাগছে তোমার?”

কাজু কী বলবে বুঝতে পারছিল না। নয়না কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না। কাম আর প্রেম তো এক নয়। ওটা একটা দুর্ঘটনা। ওটা কাজুর কাছে জীবন নয়।

নয়না ওর হাতে ধরা কাচের বোতলটা দেখিয়ে বলেছিল, “এতে জোনাকি ধরব বলে এসেছিলাম কাজুদা। কিন্তু এখন দেখছি তোমায় ধরতে হবে। সেই তোমায় একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?”

“কোন কথা?” কাজু অবাক হয়েছিল।

নয়না তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। তারপর বলেছিল, “তুমি আমার সব কথা ভুলে যাও, না কাজুদা?”

কাজু কী বলবে বুঝতে পারেনি। আসলে ওর মাথার ওপর অনেক চাপ। এসব মনে রাখবে কী করে! আর নয়নার সঙ্গে যা হয়েছে, তাতে মরমে মরে গেছে ও। তাই সচেতনভাবে ও নয়নার কথা মনে আনতে চায় না।

নয়না বলেছিল, “আমার দিদির একটা পুতুল ছিল। খুব সুন্দর। সেটা আমায় ধরতে দিত না। তখন সাত বছর বয়স আমার। আমি বলতাম একবার শুধু ধরব। কোলে নেব। কিন্তু কিছুতেই দিদি আমার কথা শুনত না। একদিন লুকিয়ে কোলে নিয়েছিলাম বলে দিদি আমায় মেরেছিল খুব। মায়ের কাছে মিথ্যে নালিশ করিয়ে আমায় মারও খাইয়েছিল। মা খুব ভালবাসে দিদিকে।”

কাজু কী করবে বুঝতে পারছিল না। নয়না কেন এসব বলছে ওকে? কী বলতে চায় আসলে?

নয়না বলেছিল, “একদিন বিকেলে দিদি ছিল না বাড়িতে। আমি সেই সুযোগে পুতুলটাকে মায়ের উনুনে গুঁজে দিয়েছিলাম। উনুনটা আঁচে বসিয়েছিল মা। আমি পুতুলটা নিয়ে সোজা গুঁজে দিয়েছিলাম উনুনের তলায়। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল সব। দিদি এসে খুব কেঁদেছিল। মা এমন মেরেছিল আমায় যে, মাথা কেটে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই দাগ আজও আছে। কিন্তু জানো কাজুদা, আমি খুব কিছু কাঁদিনি। রাতে শুয়ে দেখেছিলাম, মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মায়ের চোখে জল। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘দিদি আবার এমন করলে আমিও কিন্তু এমনই করব!’ কাজুদা বুঝলে কিছু? আমি কিন্তু এমনই করব। মনে থাকে যেন।”

কাজু কী বলবে বুঝতে পারছিল না। হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল সব। নয়নার চুল উড়ছিল। আধো-অন্ধকারে কেমন লাগছিল নয়নাকে।

“আমার বুকে মুখ দিয়েছ তুমি কাজুদা। তুমি আমার। পেখমের নও। দাগ আছে এখনও। চিহ্ন। তুমি যে আমার, তার চিহ্ন!” নয়না কথাটা বলে হেসে হাত ধরেছিল কাজুর, “চলো, জোনাকি ধরে দেবে আমায়। আমি আমার কাছে রাখব তোমার জোনাকিদের।”

কাজু বলেছিল, “যা তোর নয়, তা কিছুতেই তোর নয়। এটা মনে রাখিস নয়না। জোর করে এসব হয় না। আমার জোনাকি তোর নয়। পেখমের।”

জোনাকিরা উড়ছে সামনে। কুড়িটা জোনাকি। কাজুর অদ্ভুত লাগছে। বিন্দু-বিন্দু তারা যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে! মা ছোটবেলায় বলত, জোনাকিরা নাকি পরি! ছোট-ছোট পরি। ওদের কাছে ভাল মনে কিছু চাইলে ওরা ঠিক দেয়।

এখন মনে পড়লে হাসি পায় কাজুর। পরি! পরি বলে কিছু হয় না পৃথিবীতে। কিন্তু তাও মায়ের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে ওর। মনে হচ্ছে বলে, ওর জীবনের সব কষ্ট দূর করে দেয় যেন পরিরা। সব বাধা কাটিয়ে পেখম যেন আসে ওর জীবনে। কাজুর মাঝে মাঝে মনে হয়, বড় হওয়ার সবচেয়ে মুশকিল হল লজিক তৈরি হওয়া। এই জল-কাদা, মনখারাপ-করা আধো-অন্ধকার পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে বাচ্চাদের মতো সরল মনের বিশ্বাসের খুব দরকার। রূপকথার খুব দরকার।

আচমকা সামনের দিকে কীসের একটা শব্দ হল। কীসের শব্দ এটা! কাজু সচকিত হয়ে নড়েচড়ে বসল। ঘড়ি দেখল একবার। বিজন গিয়েছে আধঘণ্টার মতো হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল ও!

“কাজু, কাজু! তু হ্যায় কেয়া!”

সামনে থেকে যাদবকাকার গলার স্বর শোনা গেল।

কাজু হাঁপ ছাড়ল। যাক যাদবকাকা। ও নিজের জায়গা থেকে উঠে শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে গেল কিছুটা। লালচে মেঘ থেকে ছিটকে আসা আবছায়া আলোয় দেখতে পেল ও মানুষটাকে। যাদবকাকার হাতে একটা টর্চ।

“এই যে আমি!” কাজু সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“ওঃ!” যাদবকাকা আশ্বস্ত হল, “আরে, মেরেকো ডর লগ রাহা থা! বিজনের কাছ থেকে শুনলাম তুই এখানে আছিস। যাক। তু চল অব।”

কাজু জিজ্ঞেস করল, “কোথায়?”

“আরে, বাওয়াল হয়ে গেছে! বোমায় দু’জন স্পট ডেড। পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি এখনও। তুই যেহেতু মিটিং ডেকেছিলি তোকেও খুঁজছে। তাই এখানে থাকা সেফ নয়।”

“যাবটা কোথায়?” কাজুর গলা কেঁপে গেল। দু’জন মারা গেছে। পুলিশ খুঁজছে। এবার কী হবে? কাল যে ওর পেখমের সঙ্গে যাওয়ার কথা!

“আরে, সে নিয়ে চিন্তা করিস না। আজ রাতটা গা-ঢাকা দিয়ে থাক। কাল গোপেনদা আর বিমলদাকে বলে একটা রফা করা যাবে। কিন্তু আজ বাইরে আসিস না। মেথরপট্টির পেছনে পবনের বাড়িতে আজ থাকবি। এখান থেকে এখন চল। মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া হবেই। তব অর এক মুসিবত। চল।”

কাজু কাঁধের ব্যাগটাকে সামলে নিয়ে যাদবকাকার সঙ্গে বেরিয়ে এল চৌধুরীদের জায়গা থেকে। চারপাশে অন্ধকার। পথ দেখাচ্ছে ওই ছোট্ট একরত্তি একটা টর্চ। যাদবকাকা হনহন করে হাঁটছে। কাজুও যাচ্ছে, কিন্তু হাওয়াই চটিটা বিকেলে দৌড়োনোর সময় কিছুটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তাই খুব একটা জোরে হাঁটতে পারছে না।

“যাদবকাকা, আস্তে!” কাজু বলল।

ওরা বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটছে। সামনে পথের বাঁক দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে যাদবকাকা। কাজু যতটা সম্ভব জোরে সেই বাঁকের দিকে এগোল। ওই তো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সামনে বড় একটা গাছ আবছায়ার মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ডাল বেশ নিচু। কাজু মাথা ঝুঁকিয়ে গাছের ডালটা এড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল।

থাড করে একটা ভোঁতা শব্দ হল হঠাৎ! কাজু থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। তারপর মনে হল ওর মাথার ভেতরে যেন বোমা ফাটল! ও বুঝল মাথার ডান দিক দিয়ে গরম কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে। সামনের দৃশ্য আবছায়া হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কাজু কথা বলতে পারছে না। মাথার ব্যথাটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। হাত কাঁপছে ওর। পা অবশ হয়ে আসছে। গরম স্রোত ক্রমশ ভিজিয়ে দিচ্ছে জামা। কী হল এটা? কেউ কি মারল? নাকি মাথায় গাছের ডালটা লাগল? এটা কী? কাজু মাথায় হাত দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে আবার থাড করে আর-একবার বোমা ফাটল ওর মুখের ওপর! কাজু ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে!

নাকটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে! মুখে নোনতা স্বাদের রক্ত! সামনের দৃশ্য প্রায় আবছা! একটা চোখ দিয়ে কিছুটা দেখা যাচ্ছে আর অন্য চোখের সামনে শুধু মেঘ!

তবু সেই আধখোলা চোখ দিয়ে কাজু দেখতে পেল পাঁচ-ছ’টা আলোর রেখা। টর্চ। কয়েকজোড়া পা।

শুনল কে যেন বলছে, “শাবাস যাদবসাহাব! একদম পারফেক্ট আছে!”

যাদবকাকা! কাজুর মাথা নিভে আসছে দ্রুত! তবু জোর করে নিজেকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে ও। যাদবকাকা ওকে এভাবে… দৃশ্য গুলিয়ে যাচ্ছে। পাগুলো ঘিরে ধরছে ওকে। টর্চের আলো এসে পড়ছে ওর ওপর।

কার একটা গলা, “শেষ করে দে এবার! শালার পুড়কি ছিল খুব! মার বাঞ্চোতকে!”

কাজু হাত তুলল। কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু এবার ধারালো কিছু এসে লাগল ওর কাঁধে! মনে হল, শরীর ছিঁড়ে গেল একদম! আঃ, কী যন্ত্রণা! এবার গোটা শরীর নিভে আসছে দ্রুত!

কাজু অস্ফুটে বলল, “মা… মা… পেখম…”

“শুয়োর! আমার বউয়ের নাম নিচ্ছে! শালাকে…”

কথা শেষ হওয়ার আগে আর-একটা কিছু এসে পিঠ থেকে কাজুর শরীর ভেদ করে ওকে গেঁথে দিল মাটির সঙ্গে। কাজু একবার ওপরের দিকে তাকাল। সারা শরীরে আর কিছু নেই! শুধু মাথাটা যেন নড়ছে! আবছাভাবে একবার সামনে তাকাল ও।

“শেষ হয়েছে?” চেনা একটা গলা কানে এল কাজুর। ও কোনওমতে তাকাল। টর্চের আলো এসে পড়েছে লোকটার মুখের একপাশে। আলোছায়ায় লোকটা তাকিয়ে আছে কাজুর দিকে। কাজু স্থির হয়ে গেল একেবারে! এ কাকে দেখল ও! তারপর অবসন্নভাবে মুখ গুঁজল মাটিতে। আবছাভাবে একটা ধাতব শব্দ পেল ও। তারপর আর-একটা শব্দ এল…

আর জোনাকিরা উড়ছে। সব অন্ধকার চিরে বেরিয়ে আসছে অনেক-অনেক জোনাকি! ওদের ছোট্ট মফস্‌সলের মাথার ওপর উড়ছে তারা। আর সেই আলোয় মাকে দেখতে পেল কাজু। দেখল, ছোট ভাইটা গাছ লাগাচ্ছে। আন্টিবাডু ইজিচেয়ারে বসে হেসে কথা বলছে কোন একটা ছেলের সঙ্গে যেন। আর সে মুখ ফেরাতেই চিনতে পারল। বিজন! তুই এখানে! কে যেন হাসল এর উত্তরে। আর পেছন ফিরল কাজু। দেখল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে পেখম। আজ আবার জোনাকিদের আলো জ্যোৎস্নার মতো ভাসিয়ে নিচ্ছে চরাচর। কাঠালচাঁপার গন্ধ চৌধুরীদের লম্বা পাঁচিল টপকে, ঝুমাদিদের কলতলা ঘুরে, হেমন্তকাকুর সাইকেলের কেরিয়ারে বসে চলে আসছে এই এত দূরে! চ্যাটার্জিপাড়ার জলট্যাঙ্কির পেছন থেকে হাওয়া ভেসে আসছে আজ। হাওয়া ডুবিয়ে দিচ্ছে এই ছোট্ট মফস্‌সলটাকে। কাজু দেখছে পেখমকে। পেখম হাসছে। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর দিকে। আর এই অন্ধকার নদীবাঁধে শুয়ে কাজু শেষবারের মতো সেই স্পর্শ অনুভব করল। শেষ জোনাকিটা নিভে যাওয়ার আগে সেই ছোঁয়াচটুকু ধরে রইল কাজু। অস্ফুট হাওয়ার স্বরে এই নদী, এই হাওয়া, এই রাত্রি আর পৃথিবীর নিভে-যাওয়া সমস্ত জোনাকিদের কানে কানে বলল, “আমরা দু’জন, মাত্র দু’জন…”

.

৩৮. নোঈ

ডিসেম্বরেও এমন মেঘ করে! মনে হচ্ছে কলকাতা যেন বাইসনের পেটের তলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে! জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল নোঈ।

ডিসেম্বরের প্রায় শেষ এখন। নতুন বছর চলে এল প্রায়। শহরের চারিদিকে ছুটির আমেজ। তার ওপর রবিবারের দুপুর। শীত, মেঘ আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এমন দিনে গল্পের বই নিয়ে লেপের তলায় শুয়ে থাকার চেয়ে আর কী ভাল হতে পারে! গতবছর শীতের নোঈ হলে সেটাই করত ও! কিন্তু এই শীতের নোঈ অন্য, আলাদা।

ও নিজেকে একবার দেখে নিল আয়নায়। আজ জিনস আর উলেন টপ পরেছে। সঙ্গে মাফলার। নোঈর ঠান্ডা কম। মা বলে, আগের জন্মে নাকি ও পেঙ্গুইন ছিল! হতেও পারে। কিন্তু ঠান্ডা ব্যাপারটা খুব ভাল লাগে নোঈর।

শুধু বৃষ্টিটাই যা গোলমাল পাকাল আজ।

মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল নোঈ। মা বসে রয়েছে বাইরের ঘরে। টিভিতে কী একটা সিরিয়াল দেখছে! বাবা যে নিজের ঘরে সেটা আর বলে দিতে হবে না।

মা তাকাল নোঈর দিকে। মুখটা হাসি-হাসি! বলল, “যাক, রেডি তা হলে? গাড়ি বুক করেছিস তো? আর এ কী! এভাবে কেউ হবু শাশুড়ির সামনে যায়!”

“প্লিজ় মা!” নোঈ মাথা নাড়ল, “কে হবু শাশুড়ি?”

মা উঠে এসে ওর জামাটা টেনে ঠিক করতে করতে বলল, “অবশ্য এখনকার ব্যাপারই আলাদা। আর যা বাজে ওয়েদার! অন্য কেউ হলে আমি যেতে না বলতাম। হ্যাঁরে, ও কবে যেন আমেরিকা যাচ্ছে?”

“জানুয়ারির দশ তারিখ,” নোঈ মায়ের হাতটা সরিয়ে দিল।

মা সামান্য বিরক্ত হল, “কী হল, এমন করছিস কেন! উলের টপটা একটু ঠিক করে দিচ্ছি। পেছনের দিকটা কেমন হয়ে আছে। শোন, টেরাবাঁকা উত্তর দিবি না। আর, একটা জিনিস জিজ্ঞেস করবি, আমরা কবে যাব ওদের বাড়ি?”

“তোমরা?” নোঈ অবাক হল, “পারো বটে বাবা!”

“কত ভাল ছেলে!” মা নোঈর মাথায় হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করার চেষ্টা করল, “যখন তুই নিজে মা হবি, তখন বুঝতে পারবি কী জ্বালা আর চিন্তা।”

নোঈ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে এখনই আমি বুঝতে পারছি।”

মা ছোট্ট করে একটা চড় মারল নোঈর হাতে। হেসে বলল, “খালি আজেবাজে কথা! আমার খুব নিশ্চিন্ত লাগছে আজ জানিস। আমি আইকাদেরও বলেছি। ওরা তো খুব খুশি শুনে। শুধু আইকা কেমন যেন অবাক হল! যাক বাবা, ওই লোকটার ভূত যে তোর মাথা থেকে নেমেছে এই অনেক! আমার যা চিন্তা হচ্ছিল! আমি তোর বাবাকে বলেছি, আমার মেয়ে যখন, তখন ও কোনও ভুল করতে পারে না। তোর দিদিরা আছে আমেরিকায়। তুইও যাবি! ভালই হবে, কাছাকাছি থাকবি দু’জনে। আমরা আর ক’দিন বল! নিজেদের লোকই কাজে আসে জীবনে।”

মা এত কেন কথা বলে কে জানে! নোঈ মায়ের কাছ থেকে সরে গেল একটু।

মা বলল, “টিপ পরলি না? তোকে টিপ পরলে এত সুন্দর দেখায়! পর না!”

“মা,” নোঈ মাথা নাড়ল, “আমি ঠিক আছি। প্লিজ় এবার আমি যাই? দেড়টা বাজে। ওরা বলেছিল দুটোর মধ্যে যেতে!”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আর, লজ্জা করে খাবি না। সকালে মাত্র দুটো টোস্ট আর জুস খেয়েছিস একটু। আচ্ছা, ওরা কবে বিয়ের ডেট ঠিক করতে চায় বলে তোর মনে হয়? জানুয়ারিতে যদি ছেলে আমেরিকা যায়, ছ’মাসের মধ্যে আসতে পারবে বলে তো মনে হয় না, না? নেক্সট ইয়ারের শেষে কি তবে ওরা ভাবছে? নাকি শ্রাবণ মাসে?” মা চিন্তিতভাবে তাকাল নোঈর দিকে!

নোঈ আর কথা বাড়াল না। মায়ের মনোলগ চলতেই থাকবে। ও বেশ বুঝতে পারছে, মা পারলে ওর সঙ্গে যায়।

পায়ে এতক্ষণ ঘরের চটি ছিল। সেটা কার্পেটের পাশে খুলে রাখল নোঈ। স্নিকারটা মা বের করে রেখেছে আগেই। ও সোফায় বসে মোজা আর জুতো পরে নিল।

মা এবার বড় ঢাউস ছাতাটা বের করে দিল, “এটা নিয়ে যা। ওই ফ্যান্সি ছোট ছাতা নিতে হবে না। ভিজে যাবি।”

এটা ছাতা না পোল ভল্টের পোল, সেটা বুঝতে পারে না নোঈ। ইয়া বড়। সামলানোই দায়। খুব ঝড়ের ভেতর এই ছাতা নিয়ে হাঁটলে আকাশে উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল!

নোঈ বলল, “এটা নিয়ে যেতে হবে? এটা আমার চেয়ে বড়। এটা নিয়ে অসুবিধে হবে।”

মা বলল, “না, এটা নিয়ে যা। ভিজলে জ্বর আসবে। কথা শোন। সব কিছুতে তর্ক করবি না। সব কিছু নিয়ে তর্ক করতে নেই। আমরা কোনওদিন বাবা-মায়ের মুখের ওপর কোনও কথা বলিনি আর তোদের কী চোপা, কী চোপা!”

নোঈ মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল। ওর আটপৌরে, রাগী, জেদি আর ছেলেমানুষ মা। সারাক্ষণ সংসারের জন্য ভাবে। কাজ করে। সবাইকে নিজের মতো করে ঠিক রাখতে চায়। সারা জীবন এর বাইরে আর কিছু ভাবলই না। মায়ের দিকে তাকিয়ে আচমকা কেমন একটা কষ্ট হল ওর। মনে হল মা গোটা জীবন তো দিয়ে দিল ওদের জন্য। নিজে তো কিছুই করল না। মা ভাল গান জানত। ভাল নাচতে পারত। ফিজ়িক্সে অনার্স নিয়ে ভাল নম্বর পেয়েছিল। চাকরি করতে পারত অনায়াসে। কিন্তু করল না। অনেকে মাকে হাউস ওয়াইফ বলে মনে মনে একটু খাটো করে দেখে। কিন্তু সারা জীবন একদিনও তো নিজের কাজ থেকে ছুটি নিল না মা। সারা জীবন সারাক্ষণ এই মানুষটা অন্যের জন্য করে গেল।

নোঈ আচমকা এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে। তারপর গালে জোরে চুমু খেল একটা।

মা ঘাবড়ে গেল সামান্য, “কী হল হঠাৎ?”

নোঈ হাসল, বলল, “এমনি। আগেকার দিনে তোমরা বাবা-মাকে প্রণাম করতে না? এখন আমরা তার বদলে চুমু খাই, বুঝলে?”

মা ভুরু কুঁচকে তাকাতে গিয়েও হাসল। ওর হাতে একটা দু’হাজার টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলল, “ভাল মিষ্টি কিনে নিবি লেক মার্কেটের ওই নতুন বড় দোকানটা থেকে।”

“আরে!” নোঈ অবাক হল, “টাকা দিচ্ছ কেন?”

মা বলল, “এটা দিতে হয়। নে। ব্যাগে ঢোকা!”

নোঈ টাকাটা ব্যাগে ভরে বলল, “মা তুমি আমায় খুব ভালবাসো, না?”

“তোর কী মনে হয়?”

“আমি যাতে ভাল থাকব সেটা তুমি চাও?”

মা অবাক হল, “এসব বলছিস কেন?”

নোঈ বলল, “এমনি বলছি। আমি আসি এখন।”

নোঈ আর অপেক্ষা না করে বাবার ঘরে উঁকি মারল, “আমি আসছি বাবা।”

বাবা তাকাল। হেসে মাথা নাড়ল শুধু। মা দরজা অবধি এগিয়ে এল ওর সঙ্গে! বলল, “পাগলামি করবি না কিন্তু। সাবধানে যাস।”

লিফটে নামতে-নামতে মোবাইলে গাড়িটা বুক করে নিল নোঈ। কাছেই আছে। দু’মিনিট দেখাচ্ছে।

নোঈ একবার সুশান্তর ঘরের দিকে এগোল। একবার দেখে যাবে মাগোকে। সেদিন রাতে যা হয়েছিল! নোঈর তো হাত-পা কাঁপছিল থরথর করে। ভাগ্যিস আইকাদির বস এসে গেছিলেন।

নোঈ গিয়ে দরজায় দাঁড়াল। মালতী বসে আছে মাটিতে। রান্না করছে কিছু একটা। সুশান্ত বিছানায় বসে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আছে। মাগোর মাথায় ব্যান্ডেজ। কিন্তু মুখে হাসি। সুশান্তর গলার লকেটটা ধরে খেলছে!

“সুশান্তদা, কেমন আছে মাগো?”

সুশান্ত তাকাল। মালতীও ঘুরে তাকাল নোঈর দিকে। মাগো নোঈর গলা চেনে। ও চারটে দাঁত দেখিয়ে খিলখিল করে হেসে, ঠেলে আসতে চাইল ওর কাছে।

নোঈ চোখ বড়-বড় করে মাগোর দিকে তাকিয়ে বলল, “খালি দুষ্টুমি! চুপ করে থাকো। আমি ফিরে এসে কোলে নেব।”

সুশান্তদা হাসল। মাগোকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল, “এখন ভাল আছে দিদি।”

“গুড,” নোঈ হাসল, “আমি আসি।”

রাস্তায় বেরিয়ে এক মিনিট দাঁড়াতে হল নোঈকে। গাড়ি এসে গেল তার মধ্যেই।

রাস্তা ভিজে আছে বেশ। ছিপছিপে বৃষ্টি হচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে না নোঈর। শুধু একটা অস্বস্তি হচ্ছে। এই যে ও যাচ্ছে, এটা কি ঠিক হচ্ছে! শ্বেতার সঙ্গে কথা বলার সময় গোটা ব্যাপারটা কাটিয়ে দিলে পারত না!

কিছুদিন আগে অফিস থেকে ফেরার সময় শ্বেতাকে দেখেছিল, দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাড়ির গলির মুখে। কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল নোঈ। এ কী চেহারা হয়েছে মেয়েটার! সেই যে শেষ কথা হয়েছিল তারপর আর শ্বেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি নোঈ। কেন ও গাল বাড়িয়ে চড় খেতে যাবে? তাই বিয়েতেও যায়নি।

নোঈ শ্বেতাকে দেখে থমকে গিয়েছিল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। শ্বেতাও থমকে গিয়েছিল প্রথমে। তারপর প্রায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিল নোঈকে।

নোঈ বুঝতে পারছিল কিছু একটা হয়েছে। ও বলেছিল, “কী হয়েছে তোর! এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঘরে চল!”

সেদিন বাবা আর মা ছিল না। একটা অনুষ্ঠানে বেরিয়েছিল। বাড়ি ফাঁকাই ছিল। ঘরে ঢুকে জুতো খুলতে-খুলতেই নোঈকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল শ্বেতা। নোঈ কিছু বলেনি। কাঁদতে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে মনের ময়লা দূর করতে হলে কান্নাটা দরকার।

কিছু পরে শ্বেতা সামলেছিল নিজেকে। নোঈর আনা জল খেয়ে ধাতস্থ হয়েছিল।

নোঈ শান্ত গলায় বলেছিল, “কী হয়েছে তোর?”

শ্বেতা বলেছিল, “আমায় ক্ষমা করে দে নোঈ। আমি তোকে খুব বাজে কথা বলেছিলাম। আমি বুঝিনি যে, ববি একটা জানোয়ার! আমি… আমি…”

“আরে, আবার কাঁদছিস?” নোঈ শক্ত করে ধরেছিল শ্বেতাকে।

শ্বেতা অনেক কষ্টে আটকেছিল নিজেকে। বলেছিল, “বিয়ের সাত দিনের মধ্যে ঝামেলা শুরু করেছিল জানিস! আর গতকাল আমি ছিলাম না। বাড়ি ফিরে দেখি অন্য মেয়ে নিয়ে শুয়ে আছে! আর সেটা বলেছি বলে আমায়… আমায় লাথি মেরেছে! আমি… আমার জীবনটা…”

নোঈ তাকিয়েছিল শ্বেতার দিকে। কষ্ট হয়েছিল ওর। মেয়েটা যেন টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে! নোঈ ভেবেছিল, কেন এমন হয়? শ্বেতা তো ভালইবেসেছিল। তা হলে এমন করে কষ্ট পাচ্ছে কেন! অধিকাংশ মানুষ আসলে ভালবাসতে চায়, কিন্তু সেটার জন্য যে-একাগ্রতা, ডেডিকেশন আর সততার দরকার হয় সেটা তাদের থাকে না। দু’মিনিটের চাউমিন খেতে খেতে সব কিছুই আসলে দু’মিনিটের কনসেপ্টের মতো হয়ে গেছে।

“তুই ঠিক বলেছিলি নোঈ। আমি ওকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি! আমি আর থাকব না ওর সঙ্গে। আগে তো সম্মান। তারপর প্রেম ভালবাসা!”

নোঈ কিছু না বলে চুপ করে তাকিয়েছিল শ্বেতার দিকে।

শ্বেতা আবার বলেছিল, “তবে জয় খুব হেল্‌প করেছে আমায়! আজ গেছিলাম ওর কাছে। আমার চাকরি দরকার। তাই ওর কথা মনে হয়েছিল।”

জয়! নোঈ চমকে উঠেছিল আবার ওর কথা কেন!

“জয় খুব ভাল ছেলে!” শ্বেতা বলেছিল, “ও বলেছে আমায় কাজ দেখে দেবে। তবে ওর একটা ফেভার চাই। বন্ধুর কাছ থেকে বন্ধুর মতো। তাই আমি তোর কাছে এসেছি।”

“আমার কাছে!” অবাক হয়েছিল নোঈ। কেমন একটা ভয়ও করছিল।

শ্বেতা বলেছিল, “জয় তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়। একবার দেখা কর। প্লিজ়। বড়দিনের বিকেলে নন্দনে। আমাদের ইউজ়ুয়াল জায়গায়। প্লিজ়।”

নোঈ অবাক হয়ে গিয়েছিল, “আমার সঙ্গে? কেন?”

শ্বেতা বলেছিল, “আমি ডিটেল জানি না। আই গেস হি ইজ় রিপেন্টেড। তুই প্লিজ় একবার যাস। এটা আমার জন্য করিস। আমার কাজটা খুব দরকার। আমি আর ববির সঙ্গে থাকতে পারব না।”

নোঈ চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করেছিল, “শ্বেতা, তোকে কি জয় বলেছে যে, এটা না করে দিলে তোর কাজ হবে না? মানে সাম কাইন্ড অব বার্টার?”

শ্বেতা থমকে গেছিল, “না, মানে তা ঠিক নয়। কিন্তু হি ইজ হেল্‌পিং মি আউট! আমিও কিছু করতে চাই। প্লাস তুই ওকে ভালবাসিস। আমি জানি সেটা। তাই প্লিজ়।”

নোঈ বলেছিল, “প্রেমের চেয়ে সম্মান বড়, কথাটা তুই একটু আগে বললি না?”

শ্বেতা বলেছিল, “প্লিজ় জানু। প্লিজ়। আমার জন্য। আমার জীবনটা তো শেষ। আমি যে সময় নিয়ে কিছু কাজ খুঁজব তার উপায় নেই। আমি… আমি প্রেগন্যান্ট!”

“ফাক!” নোঈ নিজের অজান্তেই বলে ফেলেছিল, “আর ইউ নাটস? কী করেছিস?”

“আমার চাকরিটা খুব দরকার। আমি জেদ করে বিয়ে করেছিলাম ববিকে। বাড়িতেও তাই কিছু বলতে পারছি না। জয় আমার ইমিডিয়েট হোপ! প্লিজ়।”

আবার সেই জয়! আবার সেই টেনশন! টানাপোড়েন! কান্নাকাটি! মনখারাপ! নোঈ শ্বেতাকে দেখছিল।

শ্বেতা আশা নিয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে। মানুষ কী অদ্ভুত! এই শ্বেতা সেদিন ওকে খারাপ কথা বলছিল আর আজ যেই নিজের দরকার পড়েছে সঙ্গে-সঙ্গে এসে প্রায় পায়ে ধরছে! এরা কি বন্ধু! বন্ধু বলে কি আদৌ কিছু হয়?

নোঈ বলেছিল, “ঠিক আছে। যাব।”

শ্বেতা আবার জড়িয়ে ধরেছিল ওকে, “মাই বেস্টেস্ট জানু!”

হাজরা মোড় বেশ ফাঁকা আজ। বৃষ্টির বিকেলে সবাই কেমন একটা নেতিয়ে গেছে। কেমন একটা আড়মোড়া ভাঙা ভাব সবার মধ্যে। নোঈ ঘাড় ঘুরিয়ে সেই দোকানটা দেখার চেষ্টা করল। পান, কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকান। এখানেই জয় ওকে দশ টাকার নোটটা দিয়েছিল না! অন্য সময় এটা দেখলে বুকের ভেতরে কেমন একটা মোচড় মেরে উঠত। কিন্তু আজ যেন কিছুই হল না। নোঈ ইচ্ছে করে দেখছিল দোকানটাকে। যদি কিছু মনে হয়! কিন্তু না। আর-পাঁচটা দোকানের মতোই লাগল! বৃষ্টি ভেজা, নীল প্লাস্টিক টাঙানো, কোল্ড ড্রিঙ্কের ফ্রিজ দাঁড় করানো যে-কোনও একটা দোকান যেন!

নোঈর মনে পড়ল, সেদিন জয়কে নন্দন চত্বরে দেখেও ঠিক এমনটাই মনে হয়েছিল। ঠান্ডা, নিঃসাড় আর সাধারণ।

জয় এসেছিল ঠিক সময়ে। দেরি করেনি। এমনিতেই উৎসবের দিন ছিল সেটা। চারিদিকে লোকের ভিড়ও ছিল খুব। তার মধ্যে ওদের দেখা করার জায়গা, সেই বড় গাছটার নীচে দাঁড়িয়েছিল নোঈ। জয়কে দেখতে পেয়েছিল দূর থেকে।

আর-একজনকেও দেখেছিল। নিশান। নীল পাঞ্জাবির ওপরে হাতকাটা সাদা কোট পরেছিল নিশান। এমন সাজগোজ করতে সেভাবে নিশানকে দেখেনি ও। নিশান কাছে আসেনি। দূর থেকে হাত দেখিয়ে হেসে এগিয়ে গিয়েছিল অন্যদিকে। নোঈ কিছু বলেনি। ওর বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না।

“হাই!” জয় এসে হাসিমুখে তাকিয়েছিল নোঈর দিকে। জয়কে স্মার্ট লাগছিল। যত্ন করে রাখা দাড়িতে সাজানো মুখে একটা চকচকে ভাব ছিল, “শুড উই সিট সামহোয়্যার? কাছেই ওই ময়দানের দিকে যেতে একটা ওল্ড ক্যালকাটা টাইপ চাইনিজ় রেস্তরাঁ আছে। বেশ গ্রিজ়ি ফরবিডন টাইপ অফ ফুড পাওয়া যায়। ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম। যাবে?”

জয় এত কথা কেন বলছিল বুঝতে পারছিল না নোঈ। ও বলেছিল, “কী বলবে বলো। আমার তাড়া আছে।”

নোঈর স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে, জয় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। ও বলেছিল, “না মানে… আমি আসলে তোমার সঙ্গে খুব রুড বিহেভ করেছিলাম। তাই… মা বলছে বিয়ের কথা। আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি নেক্সট জ্যান-এ। তাই… মানে, মাকে বলেছি নোঈ বলে একটা মেয়ে আছে। আমায় খুব ভালবাসে। আমার জন্য পাগল। মা তো জানোই খুব রাগী। অর্থোডক্স! কিন্তু আমি যেহেতু চলে যাচ্ছি, তাই এবার একটু নরম হয়েছে। বলছে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করবে। নেক্সট সানডে বাইরে আমরা তিন জনে লাঞ্চ করি চলো।”

নোঈ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তারপর বলেছিল, “লাস্ট টাইম কী বলেছিলে তোমাদের অফিসে মনে আছে? মনে আছে কী ভাবে তাড়িয়েছিলে! আর এখন তোমার মা ডাকছেন!”

জয় হাত জোড় করে ঝুঁকে পড়েছিল, “প্লিজ় নোঈ! আয়্যাম সরি! প্লিজ়। আমি বুঝতে পেরেছি আমারও তোমাকেই পছন্দ। আমার তোমার কথাই মনে পড়ে। প্লিজ় আন্ডারস্ট্যান্ড! আমি মাকেও বলেছি নোঈ খুব ভাল মেয়ে। একবার দেখা করো। আমি বলেছি নোঈ আমার কথা ফেলবে না। প্লিজ়।”

নোঈ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করেছিল। সবাই ‘সরি’! সারাক্ষণ সবাই কিছু করে ফেলেই বলে ‘সরি’! আরে বাবা, ‘সরি’ বলতে হবে এমন কাজ করা কেন? শ্বেতা সরি! জয় সরি! আর কে কে সরি কে জানে!

“প্লিইইইজ়!” জয় বলেছিল, “এবার না বললে কিন্তু আমি মাটিতে বসে পড়ব হাঁটু গেড়ে! সামনের রবিবার। প্লিজ়।”

জয়ের দিকে তাকিয়েছিল নোঈ। ওর কিছু মনে হচ্ছিল না। মৃত সম্পর্ক যেন। জয় আরও কিছু বলছিল। কিন্তু কানে ঢুকছিল না কোনও কথা। বরং আচমকা ওর পুশকিনের মুখটা মনে পড়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল দূর থেকে পুশকিন যেন তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

“ঠিক আছে, যাব,” নোঈ আর কথা বাড়ায়নি। ও ভাবছিল জয়ের সামনে থেকে ওকে সরে যেতে হবে এক্ষুনি!

জয় খুশিতে হাত ধরতে চেয়েছিল ওর। নোঈ সরে গিয়েছিল। বলেছিল, “জানিয়ে দিয়ো কোথায়, কখন।” ওর শরীরের ভেতরে আগুন জ্বলছিল যেন! মনে হচ্ছিল জয়কে ছিঁড়ে রুটির টুকরোর মতো ছড়িয়ে দেয় পথে! মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছিল নোঈ। পরের রবিবারের জন্য।

রাতে খেতে বসে নোঈ জয়ের কথা গুছিয়ে বলেছিল মা আর বাবাকে। মা শুনে প্রথমে কোনও কথা বলেনি। তারপর কী যে নাচানাচি শুরু করেছিল! বলেছিল, “একদম ঠিক করেছিস। অবশ্যই যাবি রবিবার। যাক বাবা, ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন আমার দিকে। পুশিদি আমাকে যেদিন থেকে বলেছিল যে, তোকে আর ওই লোকটাকে একসঙ্গে দেখেছে, আমার তো রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। আমি ঠাকুরের কাছে খুব কাঁদতাম। তোর যেন মতি ফেরে। যাক, ঠাকুর মুখ তুলে তাকিয়েছেন!”

পুশিদি! মানে আইকাদির মা,ওই ম্যান্ডেভিলার রেস্তরাঁর কথা বলেছিল মাকে। আর ও কিনা সেই নিয়ে আইকাকে আজেবাজে কথা বলেছে! লজ্জা আর খারাপ লাগায় নোঈ চুপসে গিয়েছিল একদম। শুধু মনে হচ্ছিল এবার কী করবে ও? কীভাবে আইকাকে বলবে?

নোঈ মায়ের কথা শেষ করার হওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করেনি। সোজা মেসেজ করেছিল আইকাকে। ওর নিজের ‘সরি’ বলার সময়ও যে এসেছে বুঝতে পারছিল।

লেক মার্কেটে গাড়ি দাঁড় করায়নি নোঈ। সোজা নজরুল মঞ্চের উলটোদিকের বড় রেস্তরাঁর সামনে গিয়ে গাড়ি থেকে নামল। এটার কথাই জানিয়েছিল জয়। ও চোয়াল শক্ত করে ঠিক করেছিল নিজেকে। জয় দিনের পর দিন ওকে কষ্ট দিয়েছে। এখন সেই জয় কী বলে ও দেখবে।

রেস্তরাঁটা যে বড়, বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চওড়া ফুটপাথের সামনে একটা বেঞ্চ রাখা। আর ঢোকার দরজার পাশে ডেস্ক নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে।

নোঈ সামনে যাওয়ামাত্র লোকটা এগিয়ে এসে দরজা খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করল। নোঈ ভেতরে ঢুকল। ঝলমল করছে চারিদিক। ঢুকেই বাঁ দিকে রিসেপশন। সেখান থেকে ওকে সবাই স্বাগত জানাতে শুরু করেছে। এতজন একসঙ্গে স্বাগত জানাচ্ছে! নোঈর মজা লাগল। খুব ঝকঝকে করে সাজানো জায়গাটা। সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সিলিং-এ হলুদ আলো। দেওয়ালে বিটন উড প্যানেল। কোণে কোণে গাছ রাখা। সিঁড়ির প্রথম ল্যান্ডিং-এর পাশে একটা বসার জায়গা। নোঈ ওর সামনে দাঁড়ানো একজন হস্টেসকে বলল, “আই হ্যাভ বিন ইনভাইটেড। আ ইয়ং ম্যান উইথ…”

নোঈকে সবটা বলতেও হল না। একটি মেয়ে “দিস ওয়ে ম্যাম,” বলে ওকে ওপরের দিকে নিয়ে গেল।

ওপরে বসার জায়গাটা আরও বড়। দু’পাশে মাখন রঙের সোফা। গ্লাস টপ টেবিল।

“হিয়ার!” দূর থেকে জয় হাত তুলে ডাকল নোঈকে।

আর ঠিক তখনই আবার পুশকিনের কথা মনে পড়ল ওর। কেন মনে পড়ল? এই রাস্তার ওপরেই সামান্য দূরে পুশকিনের ফ্ল্যাট। তাই কি মনে পড়ল? এখানে যে আসবে সেটা পুশকিনকে জানায়নি ও। কেন জানায়নি? জয়ের কথা পুশকিন জানে, কিন্তু আজ যে জয়ের সঙ্গে ও দেখা করছে, এখানে আসছে, এসব জানে না।

আজও সকালে পুশকিনকে ফোন করেছিল নোঈ। জেনেছে আজ আর বাবার কাছে যাবে না পুশকিন। নিজের ফ্ল্যাটেই থাকবে। অফিসের অন্য একটা প্রজেক্টের কাজ আছে। তারই ইভ্যালুয়েশন করতে হবে।

নোঈ কথা বাড়ায়নি আর। কারণ, কেন যেন মনে হচ্ছিল, আর-একটু কথা বললেই আজকের এই ব্যাপারটা ও বলে ফেলবে!

পুশকিনের ওপর যে খুব চাপ যাচ্ছে সেটা ও জানে। বস খুব ভরসা করেন পুশকিনকে। সোনাঝুরির কাজটাও যেন একটা সুতোয় ঝুলছে। বিজনবাবু রাজি হয়েছেন দীপমালাদেবীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে। কিন্তু দীপমালাদেবী এখনও সময় দেননি। অফিস থেকে ওরা জেনেছে, ওঁর ছেলে সুপ্রতীকের নাকি শরীর ভাল নেই। দীপমালাদেবী সেই নিয়ে ব্যস্ত।

পুশকিনের ব্যাপারটা বোঝে না নোঈ। এই চাপেও কেমন যেন ছাড়া-ছাড়া থাকে। সারাক্ষণ, দেখলে মনে হয়, লোকটা যেন এই পৃথিবীতে ছুটি কাটাতে এসেছে। কোথাও যাওয়ার নেই। কোনও তাড়া নেই। সারাক্ষণ ইজ়ি।

সেদিন বিজনবাবু পুশকিনকে দেখে কী যে খুশি হয়েছিলেন! কত গল্প করেছিলেন পুশকিনের বাবার আর ওঁর নিজের ছেলেবেলার। সেই পুরনো সোনাঝুরি। পুরনো জোনাক-বাড়ি। সতুদা। বিমলদা। অজানা কত নাম। কত স্মৃতি।

সব শুনে পুশকিন বলেছিল, “কাকু, আমি এসেছি আপনার হেল্‌প নিতে। বাবা বলেছে আমাদের সমস্যার সমাধান একমাত্র আপনি করতে পারবেন।”

বিজন বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, “আমি? মানে?”

“মানে, দীপমালাদেবীর সঙ্গে আপনাকে একবার কথা বলতে হবে।”

“পেখমদি!” বিজন যেন চমকে উঠেছিলেন, “ওরে বাবা, আমি! পেখমদির তো মনে হয় আমাকে মনেও নেই! চিনতেও পারবে না!”

“প্লিজ় কাকু। আপনাকে একবার কথা বলতেই হবে। বাবা বলল, পারলে আপনি ওঁকে জোনাক-বাড়ি বিক্রি করতে বলতে পারবেন।”

বিজন মাথা নিচু করে নিয়েছিলেন। নোঈর মনে হয়েছিল, লোকটা হঠাৎ যেন এখান থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! যেন এখানে নেই!

“কাকু, প্লিজ়…”

পুশকিন সবিস্তারে বলেছিল ওদের প্ল্যানের কথা। কী-কী ওরা করতে চায়, ওদের লক্ষ্য কী, ওদের লাভের পাশাপাশি সোনাঝুরিরও কী লাভ হবে, সব বলেছিল বিজনকে। এমনকী এটাও বলেছিল যে, একটা প্রফেশন্যাল ব্যাপার নিয়ে দীপমালাদেবী ছেলেমানুষের মতো করছেন। কী প্রশ্ন, কী উত্তর এসব বলছেন।

পুশকিন বলেছিল, “বাবা বলল, আপনি দীপমালাদেবীকে চিনতেন। আপনাকে নাকি খুব স্নেহও করতেন। তাই আপনি একটু যদি বলেন। প্লিজ়!”

বিজন মাথা নিচু করে বসেছিলেন বেশ কিছুটা সময়। তারপর তাকিয়েছিলেন পুশকিনের দিকে। বলেছিলেন, “ঠিক আছে! কিন্তু কী জানো, সেই সময়টা অন্যরকম ছিল। মানুষগুলো, তাদের মূল্যবোধ সব অন্যরকম ছিল। এখনকার দৃষ্টিতে তাদের দেখলে হবে না। তোমাদের মতে যা প্রফেশনাল, তাই হয়তো অন্যের কাছে পারসোনাল,” সামান্য থেমেছিলেন বিজন। তারপর কিছুটা যেন স্বগতোক্তির মতো করে বলেছিলেন, “তা ছাড়া আমিও ক্লান্ত। শরীর ভাল নেই। ক’দিন আর থাকব কে জানে! তাই আমিও বলে দিতে চাই কিছু। আমি আর বইতে পারছি না।”

“মানে?” পুশকিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

স্মরণ বলেছিল, “কী বইতে পারছেন না জেঠু? কার কথা বলছেন আপনি? সেই…”

বিজন স্মরণকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, “তোমরা যোগাযোগ করো। আমি যাব। কথা বলব। পেখমদিরও তো একটা অধিকার আছে।”

নোঈ বসার পরে জয় হাসল শব্দ করে। নোঈ একঝলকে দেখে নিল চারপাশ। চেয়ার-টেবিল ছাড়াও কাচের জানলা দিয়ে বাইরের মেঘলা বৃষ্টির শহরটা দেখা যাচ্ছে।

জয় নিজের হাসির রেশ ধরে বলল, “মা বলছিল, তুমি আসবে না। আমি বললাম আসবেই। নোঈ আমার কথা ফেলতে পারে না। ঠিক কি না?”

নোঈ হাসল।

জয় আবার বলল, “ফর্মালি কি আলাপ করাব?”

নোঈ মাথা নাড়ল, “কাকিমা, আমি নোঈ। জয় বলেছিল বলে আজ এলাম। আপনি নাকি দেখা করতে চেয়েছিলেন!”

কাকিমা গম্ভীর মুখে তাকালেন। তারপর কোনওরকম ভূমিকা না করে সরাসরি বললেন, “তুমি জয়কে পছন্দ করো? খুব ফলো করতে শুনলাম। কান্নাকাটি করতে নাকি! জয় বলছিল, নোঈ ওকে খুব ভালবাসে। তাই?”

নোঈ চোয়াল শক্ত করে জয়ের দিকে তাকাল। এসব বলেছে জয়! ওর সম্বন্ধে এসব কথা বাড়িতে বলেছে!

জয় সামান্য অপ্রস্তুত হলেও দ্রুত সেটাকে সামলে নিল। বলল, “মা ওসব ছাড়ো। পুরনো কথা আর ভেবে কী হবে! লেটস অর্ডার সাম ফুড!”

কাকিমা হাত তুলে চুপ করতে বললেন জয়কে। তারপর নোঈর দিকে তাকিয়ে বললেন, “জানো বোধহয় তোমার পরেও জয়ের একটা রিলেশন ছিল। একজন ডিভোর্সি মহিলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। তার মেয়েও আছে। মহিলা তো খুব চেপে ধরেছিল ওকে বিয়ে করবে বলে। আমরা ব্যাপারটাকে সামলাই। আর ঠিক করি ওর বিয়ে দিয়ে দেব। তখন জয় বলল, তোমার কথা!”

“হ্যাঁ, স্বাভাবিক তো,” জয় হাসল, “তাকেই বিয়ে করা উচিত যে তোমায় ভালবাসে! তুমি তাকে ভালবাসো কি না, সেটা ইমপর্ট্যান্ট নয়। তাই না!”

কাকিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমায় দেখতে তো ঠিকঠাক। এখন তোমার বাড়ির লোকেরা কেমন সেটাও দেখতে হবে। বিয়ে তো আর প্রেম নয় যে, লেকে বসে গুজুরগুজুর করে এলাম দু’ঘণ্টা!”

“মা,” জয় কাকিমাকে থামাল, “আরে, নোঈ তো আছে। তুমি এসব কথা পরে বোলো! এখন কিছু অর্ডার করি।”

“প্লিজ়,” নোঈ হাত তুলে থামাল জয়কে। এবার আর নিতে পারছে না। সেই নন্দনের বিকেলটা থেকে নিজে সামলে রেখেছিল, আর জাস্ট পারছে না। ও বলল, “আমি কিন্তু এখানে খেতে আসিনি। আমি এসেছি তোমার মায়ের সামনে তোমাকে কিছু কথা বলতে!”

“মানে?” অবাক হয়ে জয় তাকাল ওর দিকে।

নোঈ বলল, “মানে, আমি তোমায় বিয়ে করব এটা ভাবলে কী করে? আমি ভালবাসতাম তোমায় একসময়। কিন্তু তুমি এমন ব্যবহার করেছ যে, আমার মধ্যে আর ভালবাসার কিছু অবশিষ্ট নেই!”

“কী বলছ?” জয় তাকাল ওর দিকে।

“মানেটা তো সহজ। আমি এটাই বলতে এসেছিলাম। আর তো কোনও কারণে আসিনি। লাঞ্চ আমি এখানে করব না।”

জয় থতমত খেয়ে গেল একদম, “কী বলছ কী? আরে, মাকে আনলাম, মা বলল…”

নোঈ বলল, “নিজেকে অত বড় কিছু ভাবার কী আছে! আমি তোমার জন্য মরতাম! তোমার জন্য আমি মরিনি। দিব্যি আছি। কাকিমা সরি। কিন্তু ও আমাকে যে কী অপমান করেছে সেটা আপনি জানেন না! যখন ইচ্ছে দূরে ঠেলবে যখন ইচ্ছে কাছে টানবে, আমি কি পুতুল কাকিমা? সেটা তো ঠিক নয়। সেটাই বলতে এলাম আজকে। জয়ের মানসিক সমস্যা আছে কি না আমি জানি না। কিন্তু আচমকা ওর এমন কেন যে মনে হল, ওই জানে! আমার কিন্তু এসব মনে হচ্ছে না। আমি আসি। জয়, হ্যাভ আ নাইস লাইফ।”

রেস্তরাঁর বাইরে বেরিয়ে নোঈ হাঁপ ছাড়ল। সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে! নিজেকে এতক্ষণ কী করে যে ও সংযত রেখেছিল ও-ই জানে! সকাল থেকে এই সময়টা নিয়ে ও টেনশনে ছিল। মাকেও কিছু বলেনি। কাউকেই কিছু বলেনি। ওর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল যে, একবার যদি সু্যোগমতো পেত, তা হলে জয়কে ঠিক মজা দেখিয়ে ছাড়ত। ও ভাবতেই পারেনি এমনটা হতে পারে। এভাবে সুযোগটা আসতে পারে ওর সামনে। জয় বারবার ওকে দূরে ছুড়ে ফেলেছে! একবার করলে মানা যায়, মানুষ ভুল করল। কিন্তু বারবার যদি কেউ করে, তা হলে তো সেটা সে জেনেবুঝে করছে বলেই ধরতে হবে! আর জেনেবুঝে কেউ ওর সঙ্গে এমন করে যাবে, আর নোঈ তাকে ছেড়ে দেবে! আগে জয়ের দেওয়া দশ টাকাটা চিকলেট কিনে খরচ করেছিল, আর আজ গোটা জয়কেই জীবন থেকে খরচ করে ফেলে দিল। ­

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এখনও। টিপটিপ করে পড়েই চলেছে। কিন্তু ছাতা খুলতে একটুও ইচ্ছে করছে না। বরং আজ ভিজতে ইচ্ছে করছে। মন খুলে সেই ছোটবেলার মতো করে ভিজতে ইচ্ছে করছে। আর ইচ্ছে করছে পুশকিনকে দেখতে। সেই সকাল থেকে মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটা এখন যেন আরও ফুটে বেরোচ্ছে। যেন আর কিছুতেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছে না নোঈ। এখান থেকে সামান্য কিছু দূরত্বে নিজের ফ্ল্যাটে এখন বসে আছে পুশকিন। আর কী এক অদৃশ্য টান সেখানে নিয়ে যেতে চাইছে নোঈকে!

বহুদিনের চাপা রাগ আর অপমান আজ সরে গেল ওর বুক থেকে। মায়ের সামনে নিজের স্বরূপ প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার পর জয় যেভাবে তাকিয়েছিল ওর দিকে, সেটা মনে পড়তেই আনন্দটা বেশি হচ্ছে। জয়ের ভেতরের ফাঁপা মানুষটা আজ বেরিয়ে এসেছে!

নোঈ হাত বাড়িয়ে একটা হলুদ ট্যাক্সিকে দাঁড় করাল। গাড়িটা দাঁড়াতেই দরজা খুলে উঠে পড়ল ও। বলল, “রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের কাছে।”

“আরে, এটুকু কেউ যায় নাকি?” বয়স্ক লোকটা অবাক হয়ে তাকাল নোঈর দিকে।

নোঈ আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বলল, “এবার চলুন!”

ট্যাক্সিওয়ালা বৃদ্ধ মানুষ। নোঈর হাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হেসে বলল, “মা, আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আমার বয়স এখন প্রায় ষাট। এই পঞ্চাশ টাকাটা না হলেও আমার চলবে। যা ভাড়া তাই দিয়ো। কেমন?”

নোঈ বলল, “সরি কাকু। আমি সেটা মিন করিনি। আমি খুব তাড়ায় আছি। খুব।”

লোকটা হেসে গাড়ি স্টার্ট করল।

ডোরবেলটা বাজিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিল না নোঈ। বহু বছরের অপমানের জবাব আজ দিতে পেরেছে। বাবা বলে, যেমন গাছ লাগাবে, তেমন ফল পাবে। আজ জয় বুঝতে পারছে এর মানে। পুশকিনকে না দেখলে ও বুঝতে পারত না, আসলে মানুষ কেমন হয়। সত্যিকারের ভালমানুষ কেমন হয়।

দরজটা খুলে পুশকিন অবাক হয়ে তাকাল নোঈর দিকে। নোঈ আর অপেক্ষা না করে হাতের ছাতাটা মাটিতে ফেলে দিয়ে প্রায় লাফিয়ে জড়িয়ে ধরল পুশকিনকে।

“আরে!” পুশকিন থমকে গেল।

নোঈ পুশকিনকে কথা বলতে দিল না একটুও। নিজের ঠোঁট চেপে ধরল ঠোঁটে! হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল ওর পিঠ!

শ্বাস নেওয়ার জন্য প্রায় মিনিটখানেক পর নোঈ ছাড়ল পুশকিনকে!

পুশকিন মাটি থেকে ছাতাটা তুলল। এদিক-ওদিক একবার দেখল। তারপর বন্ধ করে দিল দরজাটা। ছাতাটা হেলিয়ে রাখল এক পাশে।

নোঈ উজ্জ্বলভাবে হেসে পুশকিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আজ জয়কে যা দিয়েছি না!”

“নোঈ!” পুশকিন হাত তুলে পিছিয়ে এল।

নোঈ থমকে গেল। পুশকিনের মুখচোখ এমন কেন? কী হয়েছে? বাইরের সমস্ত মেঘ যেন এসে জমেছে পুশকিনের ভেতরে!

“কী হয়েছে? আপনি এমন করে সরে যাচ্ছেন কেন? আপনি আমায় পছন্দ করেন না? ভালবাসেন না?” নোঈ তাকাল পুশকিনের দিকে! আচমকা চোখ জ্বালা করছে ওর! পুশকিন এমন করছে কেন?

পুশকিন তাকাল নোঈর দিকে। তারপর বলল, “তোমায় একটা খবর বলার ছিল।”

“কী?” প্রশ্ন করতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল নোঈর।

পুশকিন সময় নিল। তারপর বলল, “আমায় বুদাপেস্ট চলে যেতে হচ্ছে। জানুয়ারির ছ’তারিখ।”

“কী?” নোঈ কী বলবে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল।

পুশকিন বলল, “প্রজেক্টটা থ্রু হয়ে গিয়েছে! তাই…”

পুশকিন বলে চলল আরও কথা। কিন্তু কিছুই যেন ঢুকছে না কানে! সব পার করে পুশকিনের দিকে তাকিয়েই রইল নোঈ। মেঘ আরও ঘনিয়ে এল কলকাতায়! বৃষ্টির জোরও বাড়ল কি? নোঈ জানতে পারল না কিছু। শুধু ধীরে-ধীরে আবছা হয়ে গেল এই ঘর, এই দুপুর, আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুশকিন! মনে হল সব কিছু কেমন যেন নষ্ট হয়ে গেল! শেষ হয়ে গেল! আর কিছুই যেন অবশিষ্ট রইল না নোঈর জীবনে!

ভালবেসেছে ও পুশকিনকে। নিজের ভেবেছে। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়েছে। স্পর্শের মধ্য দিয়েই কি তবে পুশকিনের ভেতরের মেঘ এসে বৃষ্টি হয়ে নামল নোঈর চোখে? ভালবাসলে কি এভাবেই পরস্পরের রোদ আর ছায়াগুলো জড়িয়ে যায়? মাটি আর শিকড় জড়িয়ে যায়? এভাবেই কি মেঘ আর বৃষ্টি বদল হয়ে যায় পরস্পর? নোঈ জানে না। শুধু জানে আজ ঘোর বৃষ্টির দিন! নোঈর এক জীবন থেকে অন্য জীবন শুরু হওয়ার দিন!

নোঈ চশমা খুলে চোখ মুছল এবার। তারপর তাকাল সোজা। এগিয়ে গিয়ে বলল, “বারবার তুমি পালিয়ে যেতে, সরে যেতে পারো না। ভালবাসলে তার দায়িত্বও নিতে হবে তোমায়। জানবে, মেয়েদেরও ইচ্ছে আর চাওয়ার দাম আছে পুশকিনদা। অধিকার আছে। আমি সেটাই চাইছি। আজ তুমি তোমার নিজেকে আমায় দাও। তোমার সবটা আমায় দাও।”

ঘষা কাচে বৃষ্টি এসে টোকা মারছে। বাইরে গাছেরা মাথা নাড়ছে হাওয়ায়। মেঘ নেমে আসছে শহরের দিকে। নোঈ এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে পড়ল পুশকিনের সঙ্গে। আর এই আবছা মনেও বুঝল, আজ আবার সেই আফটার শেভটা মেখেছে পুশকিন!

.

৩৯. নিশান

আলো-আলো অন্ধকার। অন্ধকার-অন্ধকার আলো। ঝাপসা চৌকো আলো। সরে-সরে যাচ্ছে… মাথার ওপর দিয়ে সরে যাচ্ছে মেঘলা একটা করিডরের ছাদ। ঠান্ডা! আর কী গরম! অন্ধকার অন্ধকার যন্ত্রণা! অবশ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি! কোথায় যাচ্ছে নিশান? কোথায় এখন ও? চোখ বুজে আসছে। মাথা ফাঁকা! শুধু দূর আকাশে যেন চিল উড়ছে একটা। আকাশ-আকাশ আলো। কারা ঝুঁকে পড়ছে সেই আকাশ থেকে? কাদের মুখ এগুলো? ফোঁটা ফোঁটা মুখ। চেনা লাগছে। তাও মনে পড়ছে না। চোখ বুজে আসছে নিশানের। ক্লান্ত লাগছে। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে যেন। ডাকছে, সিঁড়িগুলো ডাকছে নিশানকে। ওকে যেতে হবে। দূরে যেতে হবে। একা। নিশান সিঁড়িতে পা রাখল এবার। আর, কে যেন ডাকল পেছনে! মুখ তুলে দেখল নিশান। মা! মা এসে দাঁড়িয়েছে! অন্ধকারে ছোট্ট আলোর মতো মা! কী বলছ তুমি, মা?

“নিশান আজ তোকে বেরোতেই হবে? এই ঠান্ডায়, এমন বৃষ্টিতে… বেরোতেই হবে?”

নিশান সোয়েটারটা পরে নিল। তারপর আলনার পাশে ঝোলানো রেনকোটটা তুলে নিয়ে গায়ে চাপাল। বলল, “মা, বিজনদা ডেকেছে। সেই সকালে যেতে বলেছিল। কিন্তু যেতে পারিনি। আর, ক’টা বাজে এখন? সবে রাত ন’টা। কিছুই রাত হয়নি।”

মা মুখ ভার করে বলল, “আমার কথা একদিন শুনলে কী হয়! আজ তোর বাবার জন্মদিন। আমি বিরিয়ানি বানিয়েছি। তোর বেরোনো মানে তো মাঝরাতের আগে ঢুকবি না! ততক্ষণে তো ঠান্ডা হয়ে যাবে সব!”

নিশান রেনকোটের চেনটা গলা অবধি টেনে বলল, “মা, তুমি বড্ড ভেবে নাও। আমি তাড়াতাড়ি ফিরব। ডোন্ট ওয়ারি।”

“তা হলে বাড়িতে এলি কেন?” মা রাগের বলায় জিজ্ঞেস করল।

নিশান হাসল। বলল, “আরে, কলকাতায় গিয়েছিলাম পত্রিকার আর্টওয়ার্কটা নিয়ে আসতে। সেটা নিয়ে এই বৃষ্টিতে ঘুরব নাকি? তাই তো রাখতে এলাম। আমি চলে আসব ঠিক সময়ে। ডোন্ট ওয়ারি!” নিশান মায়ের গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে হেসে বারান্দায় এল। সাইকেল আর নেবে না। বড়রাস্তা থেকে একটা রিকশা নিয়ে নেবে। কেন বিজনদা ওকে ডাকল কে জানে!

মা বলল, “মাথাটা ভাল করে ঢাকা দে। পরে আবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ করবি!”

রাস্তাটা পিছল বেশ। পাড়ার ভেতরের রাস্তাগুলো কংক্রিট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার মাঝে মাঝে কিছু-কিছু জায়গা ভাঙা। জল জমে আছে। নিশান খুব সাবধানে হাঁটতে লাগল।

দূরের লাইটপোস্টের হলুদ আলো কেমন একটা সেপিয়া রং লেপে দিয়েছে সব কিছুর ওপর। ওদের পাড়াটা একটু পুরনো। বাড়িঘরগুলো কেমন বয়স্ক আর থমথমে। এই শীতের বৃষ্টিতে গোটা তল্লাটটাই কেমন কুঁকড়ে রয়েছে যেন।

নিশান সরু রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে বড়রাস্তায় উঠল। এটা স্টেশন রোড। এই আবহাওয়ার জন্য আজ এই রাস্তাটাও ফাঁকা। ও এদিক-ওদিক তাকাল। কিছু নেই। সাধারণত রিকশা থাকেই। কিন্তু আজ নেই। তবে কি হাঁটবে? অনেকটা পথ! আর এখন বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়াও দিচ্ছে! কাছেই গঙ্গা, তাই জলের ওপর থেকে ভেসে আসা হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা। হাড় অবধি পৌঁছে যাচ্ছে! নিশানের একটু শীত বেশি। তাই ওর কষ্ট হচ্ছে বেশ। ও হাত দুটো ঘষে মুখের কাছে এনে গরম ভাপ দিল। বিজনদা কী বলবে? হঠাৎ এভাবে ডাকল কেন?

পকেটে আচমকা নড়ে উঠল ফোনটা। এখন আবার কে ফোন করল! এই বৃষ্টিতে কথা বলবে কী করে! নিশান একটা শেডের তলায় সরে গিয়ে ফোনটা বের করল। স্ক্রিনে দেখল নামটা। আরে রাধিয়া! নিশান হাসল নিজের মনে। এই ফোনটা আবহাওয়া নিরপেক্ষ।

“হ্যাঁ রাধি!” নিশান কানে লাগাল ফোনটা।

“বাড়ি পৌঁছে গেছ?” রাধিয়ার গলায় সামান্য উদ্বেগ।

“হ্যাঁ, পৌঁছে আবার বেরিয়ে পড়েছি। কেন?”

“কেন মানে?” রাধিয়ার গলায় রাগ টের পেল নিশান, “বলেছি না বাড়ি ঢুকে আমায় একবার মেসেজ করে দেবে!”

তা ঠিক। আজকেও রাধিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিল নিশান। চলে আসার আগে মেয়েটা বলেছিল এই কথাটা!

কলেজ স্ট্রিট থেকে আর্টওয়ার্কটা নিয়ে রবীন্দ্র সরোবর লেকে গিয়েছিল নিশান। রাধিয়া বলেছিল দেখা করতে চায় ও। সেই বড়দিনের পরে আর দেখা হয়নি।

লেকে আজ ভিড় ছিল না। বেশ ফাঁকাই ছিল। পদ্মপুকুরটা পার হয়ে মাথায় ছাউনিওয়ালা একটা সিটে বসেছিল দু’জন! রাধিয়া একদম নিশানের গায়ের সঙ্গে লেগে বসেছিল। নিশানের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে জড়িয়েছিল লতানো গাছের মতো।

রাধিয়ার শরীর থেকে কী অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ যে আসছিল! নিশানের মনে হচ্ছিল সবটাই কেমন যেন অবাস্তব! রাজকুমারী আর রাখালের গল্প! এই মেয়েটা কেন ওকে ভালবাসল? কতদিন ভালবাসতে পারবে? যদি পরে ওকে ছেড়ে চলে যায়, তা হলে নিশান কী করবে?

রাধিয়াকে ও জিজ্ঞেস করেছিল, “বলো, কী বলবে?”

“কিছু না তো!” রাধিয়া সামনে, জলের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল!

“মানে?” নিশান হেসেছিল, “কিছু বলবে না তো ডাকলে কেন?”

“এমনি, ইচ্ছে হল!” রাধিয়া ওর কাঁধে মাথা রেখেছিল, “দেখতে ইচ্ছে করছিল। তোমায় ধরতে ইচ্ছে করছিল।”

“তাই?” নিশান হেসেছিল। আসলে ওর এত ভাল লাগছিল যে, বিশ্বাস হচ্ছিল না রাধিয়ার মতো মেয়ে ওকে ভালবাসে!

“খুব ভাও খাচ্ছ না?” রাধিয়া কুট করে চিমটি কেটেছিল নিশানের হাতে, “মেয়েদের কী মনে হয়!”

“যাঃ” হেসেছিল নিশান, “কিছুই মনে হয় না! কী আবার মনে হবে?”

রাধিয়া সোজা হয়ে বসেছিল, “কিছু মনে হয় না মানে? শভিনিস্ট পিগ নাকি তুমি?”

নিশান সামান্য ঘুরে বসেছিল, “ও এবার বুঝেছি! পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে ডেকেছ! আমি ঝগড়া করতে পারি না!”

“নাঃ, পারে না!” রাধিয়া মুখ বেঁকিয়েছিল সামান্য, “আমাদের কোম্পানির সঙ্গে ঝগড়া করছ না! ওইসব আন্দোলন অ্যান্ড অল।”

“আচ্ছা আচ্ছা!” হাত তুলে দিয়েছিল নিশান।

রাধিয়া বলেছিল, “আমিও পারি! আমার এখন সাহস বেড়ে গিয়েছে। কাউকেই ছাড়ি না উচিত কথা বলতে!”

নিশান চুপ করে ছিল। আসলে ও জানে রাধিয়ার বাড়িতে কী হয়েছে। ঘটনার দিন রাতে রাধিয়াই ওকে ফোন করে জানিয়েছিল সব কিছু। নিশানের মনে এই নিয়ে একটা খারাপ লাগা আছে। আসলে ও বলতে চায়নি ব্যাপারটা। কিন্তু বাধ্য হয়েছিল বলতে। সেদিন রাধিয়া এমন করে ওকে চেপে ধরেছিল যে, ও বাধ্য হয়েছিল। আর শুধু তাই নয়। ওর মনে হয়েছিল, একটা লোক বাড়িতে তার স্ত্রী ও মেয়েকে কিছুতেই ঠকাতে পারে না। তার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন যা খুশি হতেই পারে। ওটা মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ ও অপছন্দ, কিন্তু সে কখনওই নিজের স্ত্রী বা মেয়েকে ধোঁকা দিতে পারে না। আসলে একটা জিনিস আজকাল খুব দেখতে পায় নিশান। মানুষের মধ্যে লয়ালটি আর ডিভোশন কমে যাচ্ছে। এই সব সোশ্যাল সাইটের জন্যই হোক বা কমিউনিকেশনের বাড়বাড়ন্তর জন্যই হোক, মানুষকে সে অপশন ভেবে ফেলছে! লোকের একটা রিলেশনে টিকছে না বেশিদিন! সারাক্ষণ তাদের ‘কী নেই কী নেই’-টা যেন বেড়ে গেছে। প্রেম ব্যাপারটা চলে গিয়ে কেমন যেন ইগো মাসাজ, লোকের মনোযোগ পাওয়া, এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সবাই যেন নায়ক হবে, নায়িকা হবে! সবাইকে ঘিরে গ্রহ-তারা ঘুরতে হবে! উল্কাপাত হতে হবে! নিজের ইচ্ছেটাই যেন বড়! অন্যের যে খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে, সে ব্যাপারে কারও কোনও হুঁশ নেই!

সুপ্রতীকের সম্বন্ধে মণীশ খবরটা নিয়ে এসেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করেনি নিশান। কিন্তু তারপর মণীশ এমন-এমন ঘনিষ্ঠ ছবি দেখিয়েছে যে, আর কিছু বলতে পারেনি নিশান।

রাধিয়া কথাটা শুনে প্রথমে কেমন যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল! বলেছিল, “কী বলছ তুমি?”

নিশান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিল রাধিয়ার দিকে। তারপর মোবাইল খুলে দেখিয়েছিল ছবিগুলো।

রাধিয়া প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। ভাল করে কথাও বলতে পারছিল না। শুধু কোনওমতে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী করে পেলে ছবিগুলো?”

নিশান বলেছিল, “মণীশ। এই দুটো ছেলের একজনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে এগুলো নিয়ে এনেছে তার থেকে।”

রাধিয়াকে সেদিন একা ছাড়েনি নিশান। পৌঁছে দিয়ে এসেছিল ওদের বাড়ি অবধি।

“ছবিগুলো কি আছে না ডিলিট করে দিয়েছ!” রাধিয়া জিজ্ঞেস করেছিল দ্বিধার সঙ্গে!

“নেই, দ্যাখো!” নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিয়েছিল নিশান।

রাধিয়া নিয়ে ইতঃস্তত করেছিল সামান্য।

নিশান বলেছিল, “আমার মোবাইলে কিছু নেই। আমার গোপন কিছু নেই রাধি। তুমি দ্যাখো।”

“না থাক, আই বিলিভ ইউ,” রাধিয়া ফেরত দিয়ে দিয়েছিল মোবাইলটা!

নিশান মোবাইলটা খুলে ওকে দেখিয়েছিল। বলেছিল, “আমি চাই তুমি দ্যাখো।”

নিশানকে জড়িয়ে ধরেছিল রাধিয়া। কিছু বলেনি। শুধু জড়িয়ে ধরে রেখেছিল অনেকক্ষণ। তারপর মুখ তুলে বলেছিল, “আমায় ছেড়ে যাবে না তো!”

নিশান পালটা বলেছিল, “তুমি হয়তো চলে যাবে!”

রাধিয়া বড় করে তাকিয়েছিল নিশানের দিকে। তারপর বলেছিল, “গিয়ে দ্যাখো, মেরে ফেলব! সেই পরিটা নেই আর। এখন আমি রক্তমাংসের রাগী, বাজে কথা বলা, পালটা মার দেওয়া মানুষ! মনে থাকে যেন!”

বৃষ্টিটা বাড়ল আরও। গায়ে জলের ছিটে এসে লাগছে।

নিশান বলল, “এই ফোন করব ভাবছিলাম। আসলে খুব দরকারি একটা কাজে বেরিয়েছি! আমি রাতে ফিরে ফোন করি?”

রাধিয়া বলল, “এত তাড়া কীসের? কার কাছে যাচ্ছ যে, এত তাড়া?”

“আরে!” নিশান শব্দ করে হাসল, “কী যে বলো না! বিজনদার কাছে যাচ্ছি। খুব বৃষ্টি পড়ছে। কী এক ডিপ্রেশন হয়েছে কে জানে!”

“ঠিক আছে,” রাধিয়া হাসল সামান্য, “ফিরে রাতে মিস্‌ড কল দিয়ো। কথা হবে।”

নিশানও হেসে বলল, “এই রাখাল ছেলে ফোনের খরচ চালাতে পারে রাজকুমারী! ফোনই করব!”

“দাঁড়াও কাছে পাই, তারপর দেখছি তোমায়!” রাধিয়া গরগর করল রাগে।

কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল নিশান। একটাও রিকশা নেই। তা হলে কি হেঁটেই যাবে! সারা শরীর যদিও রেনকোটে ঢাকা, তাও, হাঁটা বেশ মুশকিল এমন বৃষ্টিতে!

আচমকা একটা গাড়ি শব্দ করে, জল ছিটিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল। সামান্য ঘাবড়ে গেল নিশান! পিছিয়ে এল দু’পা! তারপরেই বড় এসইউভি গাড়িটাকে চিনতে পারল ও। তারক চক্রবর্তীর গাড়ি।

তারক সামনে, ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিল। কাচটা নামিয়ে বলল, “কী রে, এখানে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কোথায় যাবি?”

নিশান ইতস্তত করল। এটা কি বলা ঠিক হবে? কিন্তু তারপর ভাবল ও তো কোনও ভুল করছে না। বলবে না-ই বা কেন!

বলল, “বিজনদার কাছে যাব!”

“অ! ভীমরতির কাছে! চলে আয়, নামিয়ে দিয়ে যাব। আমার বাড়ির রাস্তাতেই পড়বে।”

নিশান ভাবল এক মুহূর্ত। যাবে? এই লোকটাকে সহ্য করতে পারে না! কিন্তু এখন উপায়ই-বা কী! নিশান এগিয়ে গিয়ে গাড়ির মাঝের দরজা খুলে উঠে পড়ল।

তারক বলল, “শালা, রেনকোটের জল সব ভাসিয়ে নিল। মোতি, কাল আর গাড়ি ধুতে হবে না বুঝলি!”

মোতি বসেছিল সবার পেছনে! এই কথার জবাবে শুধু হাসল।

গাড়ি চলছে আবার। রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। এত বড় গাড়ি, তাও দুলছে নৌকোর মতো! গাড়ির ভেতরে বেশ সুন্দর একটা গন্ধ। খুব লো ভলিউমে গান বাজছে। গাড়িতে তারক, ড্রাইভার আর মোতি ছাড়া শুধু নিশান বসে রয়েছে।

তারক সামনের দিকে তাকিয়েই বলল, “শালা, তুই আমাদের ব্যাবসা গোটাবি মনে হচ্ছে! তোকে বললাম, ওই সব না করতে। গেল তো একটা পার্টি পালিয়ে! আইকা বলে একটা মেয়ে আসত। শালা জ্বলতি জওয়ানি টাইপ! সেও কাটল! তুই গান্ডু আমার অনেক টাকার লোকসান করালি! মেয়েটাকে যে পটাব, সেটাও হতে দিলি না! আমার সঙ্গে তোর কোন জন্মের শত্রুতা আছে বল তো!” কথাটা শেষ করে হা হা করে হাসল তারক।

নিশান চোয়াল শক্ত করে বসে রইল। মনে মনে বলল, প্রতিটা জন্মের!

ও বৃষ্টি-ঘষা জানলা দিয়ে দেখল গাড়ি মল্লিকবাজার পেরোচ্ছে। এর পরে মজদুর ইউনিয়নের গলি, তারপরে ভাঙা রেললাইন। ব্যস, ওই ভাঙা লাইন ধরে ডান দিকে একটু গেলেই গেলেই ওদের পার্টি অফিসের পাশে বিজনদার আস্তানা।

বিজনদাদের বেশ বড় বাড়ি আছে চ্যাটার্জিপাড়ায়। কিন্তু সব ছেড়ে লোকটা কেন যে এইখানে থাকে!

তারক বলল, “শোন নিশান। দাড়ি রাখলেই কেউ বিপ্লবী হয় না! পেছনে অন্য দম লাগে। লেকে বসে মাগিবাজি করবি, আবার গেটে দাঁড়িয়ে বিপ্লব মারাবি! হয় না! শুনলাম দু’দিন পরে আবার তোদের ওই ঢ্যামনামি আছে! এসব করিস না বাবু। ভাল কথায় বলছি। কাজ হতে দে। তুইও কেকের ভাগ পাবি। প্লাস মালিকের মেয়ের সঙ্গে তো লটঘট শুরুই করেছিস! কেন বেকার উঙ্গলি করছিস! চেপে যা!”

নিশান দেখল আর চুপ করে থাকা যায় না! ও বলল, “আমার পারসোনাল লাইফে আমি কী করছি, সেটা আপনাদের দেখার কথা নয়! আর কেউ গোটা সোনাঝুরিকে নিজের সম্পত্তি বলে বিক্রি করে দেবে, সেটা হয় নাকি? খারাপ কাজ হলে প্রতিবাদ হবে!”

তারক কেমন যেন হঠাৎ চুপ করে গেল। আর বাকি পথটা কিছু বলল না। নিশান বুঝল ওর কথাটা একদম মোক্ষম জায়গায় গিয়ে লেগেছে!

গাড়িটা ওকে নামিয়ে দিল ভাঙা রেললাইনের কাছে। এদিকটা আরও নির্জন। কেমন একটা ছমছমে ভাব আছে। লাইনটা দিয়ে অনেক আগে জুটমিলে কাঁচা মাল নিয়ে আসত গুডস ট্রেন। কিন্তু দীর্ঘদিন আর মালগাড়ি না চলায় ভেঙে গেছে জায়গায় জায়গায়। লাইনের পাশে সরু রাস্তা। সামান্য নোংরা। ঝোপঝাড় পাশ থেকে এসে রাস্তাটাকে আরও সরু করে দিয়েছে।

পার্টি অফিসে ঢোকার সামনে বড় চওড়া রাস্তা আছে। কিন্তু বিজনদার বাড়িটা যেহেতু পার্টি অফিসের পেছন দিকে, তাই এই পথেই যেতে হয়।

রাস্তাটা চেনা নিশানের। তাই অন্ধকার হলেও খুব কিছু অসুবিধে হল না। সামান্য দূরে বিজনদার বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে।

দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল নিশান। একটু সময় নিয়ে বিজনদা দরজা খুলে দিল। নিশান ঘরের সামনের বারান্দায় ঢুকে একপাশে সরে দাঁড়াল। সারা শরীর দিয়ে জল ঝরছে। ও দ্রুত রেনকোটটা খুলে বারান্দার পাশের তারে ঝুলিয়ে দিল। দেখল, বিজনদা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে ফোনে। তারই মধ্যে ওকে হাত দিয়ে ঘরে আসতে ইশারা করল বিজনদা।

নিশান ঘরে ঢুকে একটা টুলে বসল। রেনকোট থাকলেও সামান্য জল চুঁইয়ে ঢুকেছে ভেতরে। প্যান্টের নীচ আর কলারের কাছটা ভিজেছে একটু। বিজনদা এসে বসল সামনে চৌকিতে। শুনল ফোনে বলছে, “হ্যাঁ, গলায় মাফলার আছে। পায়ে মোজাও পরেছি। না, না, চোখের ওষুধ ফুরোয়নি, আছে এখনও। আর তেলেভাজা রোজ খাচ্ছি না বাবা! আরে, বিরক্ত হলাম কোথায়! কী বলে! না, না, বিরক্ত হইনি। কী মুশকিল… এমনি মানে… আরে, এত রাগ করো কেন! শরীর এখনও উইক কিন্তু। এভাবে কেউ ফোনে চেঁচায়! মানে… চেঁচায়! মানে কথা বলে! সব উলটো ধরো কেন? আর রাতে রুটি আর ফুলকপির তরকারি করেছি। না, না, তোমায় পাঠাতে হবে না কিছু! মাঝে মাঝেই তো পাঠাও। কী বিপদ! আমি সত্যি বলছি! আর শোনো, নিশান এসেছে। একটু কাজ আছে ওর সঙ্গে। পরে তোমায় আবার কল করব। মানে, হ্যাঁ, তুমিই তো করো, আমি তো বিশেষ কল করি না… ঠিক আছে বাবা, তুমিই কোরো। এখন রাখি। কেমন?”

ছোট্ট ফোনটা কেটে সামনে থাকা বালিশের তলায় রেখে মাথা নাড়ল বিজনদা। হাসল নিজের মনে, “পাগলি!”

“কেয়াদি?” নিশানও হাসল।

“আর কে! এখনও একই রকম আছে! কে বলবে বয়স হয়েছে!” বিজনদা হাসল।

নিশান মাথা নাড়ল নিজের মনে। দেখল, বিজনদার গলায় মাফলার নেই, পায়েও মোজা নেই।

বিজনদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সারা জীবন পাগলামি করে গেল। আমায় ভালবাসত। কিন্তু সব ছেড়ে আমায় ওকে নিয়ে নাকি বিদেশে যেতে হবে! সেটা করলাম না বলে রাগে দুম করে অন্যকে বিয়ে করে নিল! নিজের জীবনটা নিয়ে কীসব করল! ও পাগলি, ওকে কেউ বুঝতে পারবে ও ভেবেছিল? সেদিন নার্সিং হোমে ও কাঁদছিল। তোরা তো কেউ ছিলি না। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখি কান্না বেড়ে গেল আরও! আমার এত কষ্ট লাগছিল!”

নিশান তাকাল বিজনদার দিকে। তারপর চোখ বুলিয়ে ঘরটাকে দেখল। খুব ছিমছাম ঘর। একটা আলমারি। একটা আলনা। কাঠের একটা চেয়ার-টেবিল আর এই চৌকি। ব্যস।

ও জিজ্ঞেস করল, “এই জন্য তুমি বিয়ে করলে না বিজনদা?”

বিজন হাসল, “আমায় কে বিয়ে করবে! আমার চালচুলো নেই! পার্টি করি সারাক্ষণ। দূর! তবে কী জানিস, কেয়াকে দেখার পরে আর কাউকে ভালও লাগেনি।”

নিশান হেসে বলল, “স্বাভাবিক তো। পাগল আর পাগলি! ভাল হত কিন্তু।”

বিজনদা হাসল। বলল, “তবে রে। আমি তোর জ্যাঠার বয়সি! আমায় দাদা বলিস ঠিক আছে। কিন্তু এসব কী কথা?”

নিশান হেসে বলল, “খুব খারাপ লাগছে কি! তোমরা এই বয়সে কিন্তু কাঁপিয়ে দিচ্ছ! আবার পুরনো দিন আসবে ফিরে।”

বিজনদা এবার হাসল। তবে বিষণ্ণভাবে। বলল, “না রে নিশান, যা যায় তা আর আসে না। আমাদের সেই সময়টা অদ্ভুত ছিল। পরিতোষ, আমি, পেখমদি, কাজুদা। সে এক অন্য সময়।”

নিশান কী বলবে বুঝতে পারল না।

বিজনদা বালিশের ওপর রাখা ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল একটু। তারপর মাথা নাড়ল, “সব কেমন হয়ে গেল রে! কেমন যেন হয়ে গেল!”

“তুমি আমায় কিছু বলতে?” নিশান জিজ্ঞেস করল, “আসলে বাড়িতে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি! তাই…”

“তুই চাস সোনাঝুরি আবার আগের মতো হোক? চাস?” বিজনদা ফোনটা রেখে প্রশ্ন করল।

নিশান অবাক হয়ে তাকাল বিজনদার দিকে, “হ্যাঁ চাই। কিন্তু পুঁজিপতিদের…”

“বাজে কথা রাখ! জুট মিলের অবস্থা জানিস? যে-কোনও দিন বন্ধ হয়ে যাবে। জোনাক-বাড়িটা দেখেছিস? কেমন হয়ে গেছে। তুই চাস না এগুলোর সংস্কার হোক? চাস না? কেন ঝামেলা করছিস?” বিজনদা মাথা নাড়ল, “এমন করিস না বাবু। তুই তো বুঝদার ছেলে। কী হয়েছে তোর? কে বলেছে তোকে সব ভেঙে বাড়ি হয়ে যাবে? শোন, সেই কোম্পানিটা আর এই কাজে নেই। ওরা সরে গিয়েছে। রিকো গ্রুপের প্ল্যান এমন নয়। আমি জানি সবটা। ওরা এসেছিল আমার কাছে।”

নিশান বলল, “আর তুমি বিশ্বাস করলে? ওরা যে সবকিছু নেওয়ার পরে অন্য কিছু করবে না সেটা হতে পারে তো!”

“না, হবে না,” বিজনদা বলল, “ওরা একটা অ্যাডভাইসরি বোর্ড তৈরি করবে। আমায় থাকতে বলেছে। আমি বলেছি তোকেও রাখতে। আমরা দেখব ওরা যা প্ল্যান এখন বলছে, সেটাই যেন ইমপ্লিমেন্টেড হয়। ওদের ব্রোশার-লিফলেট সব তৈরি। তুই একটু ব্যাপারটা ভাব। পরে যদি ভুলভাল কিছু করতে যায়, সে না হয় আমরা তখন কাজ করতে দেব না! কিন্তু এভাবে তুই উন্নয়নকে আটকাতে যাস না। মিলটা বড় হবে। জোনাক-বাড়িতে ভাল হোটেল আর পার্ক হবে। সোনাঝুরির অর্থনৈতিক লেভেলটা বাড়বে। তুই একটু ভাব।”

“কিন্তু যদি না হয়?” নিশান ভুরু কুঁচকে বলল।

“এটা তোর যুক্তি তো? আচ্ছা, কয়েকদিন পরে আমি যাব মালিকদের ওখানে। তুইও চল। নিজে দেখে বুঝে নে। কিন্তু গোঁয়ারতুমি করিস না! সব কিছু পালটায় নিশান। আজ ধর ওরা চলে গেল। তারপর যদি সামনের বছর মিল বন্ধ হয়ে যায়, দেখবি আজ তোর কথায় যারা নাচছে, তারাই তখন তোকে গালি দেবে! এটা একবার ভাব। রাজনীতি মানে কিন্তু এখনকার কথা নয় শুধু, ভবিষ্যৎ দেখতে না শিখলে কিছু হবে না।”

নিশান মাথা হেঁট করে বসে রইল।

বিজনদা চৌকি থেকে উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়াল, “আমি জানি এতদিন পরে হঠাৎ যদি তুই উলটো কথা বলিস ওরা ভাববে, তোর কোনও ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আছে। তাই বলছি ওদের মধ্য থেকেও কেউ-কেউ চলুক। আমি যেটা তোকে বললাম, তুই সেটা বল ওদের। সব খোলাখুলি হোক। আমি কি তারক নাকি যে, টাকা খাব এই জন্য!”

“না না, তা বলিনি বিজনদা!” নিশান বিজনদার হাতটা ধরল।

“শোন তোকে হ্যাঁ-না করতে হবে না, তুই একবার চল আমার সঙ্গে। তোর সঙ্গে যারা আছে তাদেরও কেউ যাক। ব্যাপারটা বোঝ। জেদ করে থাকিস না।”

নিশান উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “আমি একটু ভাবি বিজনদা। মানে, সত্যি ভাবি। যারা আছে তাদেরও বলি। দেখা যাক তারা কী বলে।”

বিজনদা বলল, “দরকার হলে তাদের আমার কাছে নিয়ে আসবি। কিন্তু এভাবে সব বন্ধ করে দিস না। দরজা-জানলা খোলা রাখবি নিশান। ওটা ইমপর্ট্যান্ট। বুঝলি!”

নিশান হাসল। বিজনদার কথাগুলো খারাপ লাগছে না ওর। কিন্তু এটাও সত্যি যে, ও একার হাতে কিছু করতে পারবে না। দেখা যাক, কী হয়!

বারান্দায় এসে ও রেনকোটটা পরল আবার। তারপর খুব শিগগিরি জানাবে বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।

বৃষ্টি কমেছে। কিন্তু একেবারে থেমে যায়নি। আবার বড়রাস্তার দিকে হাঁটা দিল নিশান। সাড়ে দশটা বাজে প্রায়। রাস্তায় লোক দেখতে পাচ্ছে না। পাশে ভাঙা রেল লাইনের মাঝে বেশ জল জমে গিয়েছে। ও সরু রাস্তা দিয়ে এগোতে লাগল। মা খুব রাগ করছে নিশ্চয়। বাবাও এসে গেছে এতক্ষণে। হঠাৎ বাবা-মায়ের জন্য খারাপ লাগল নিশানের। সত্যি ও বাড়িতে সময় দেয় না। এটা ঠিক নয়। বিজনদার কথাটা শুনে বুঝল যে, এটা কাল সকালে শুনলেও চলত। আসলে বিজনদার বয়স হয়েছে, তাই হয়তো আজকাল সবকিছুতেই একটা তাড়া লাগায়। বয়স হলে কি মানুষ এমন হয়ে যায়? আচ্ছা, নিশানও কি এমন হয়ে যাবে? রাধিয়া কেমন হবে?

রাধিয়ার কথা মাথায় আসতেই মনটা ভাল হয়ে গেল নিশানের। মেয়েটা সত্যি ভালবাসে ওকে! সত্যি…

“নিশান!” পেছন থেকে কে যেন ডাকল।

নিশান দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে তাকাল পেছনে। চেনা গলা। কে ডাকছে এই অন্ধকারে!

“নিশান!”

লোকটা কাছে আসতে বুঝতে পারল নিশান। আরে বাদল! ও এখন এখানে কী করছে?

“তুই!” নিশান অবাক হল।

“হ্যাঁ রে আমি!”

নিশানের নাক কুঁচকে গেল। বাদলের মুখ থেকে তীব্র মদের গন্ধ বেরোচ্ছে!

“কী বল? কী হয়েছে তোর?” নিশান অবাক হল।

বাদল এসে দাঁড়াল সামনে। আর ঠিক তখনই বৃষ্টিটা জোরে নামল আবার। নিশান আকাশের দিকে তাকাল। নিকষ কালো একটা অন্ধকার কড়াই যেন উলটে আছে মাথার ওপরে!

বাদল জড়ানো গলায় বলল, “আজ তোদের দেখলাম। তোকে আর মালিকের মেয়েকে। হেভি মাল তুলেছিস! ব্যাপক! তা লাগিয়েছিস নাকি এর মধ্যে?”

“কী বলছিস তুই?” নিশান চোয়াল শক্ত করল।

“আমি বললে দোষ হয়ে গেল?” বাদল আর-একটু কাছে এল, “তারকদা বলেছিল, মালটাকে নজরে রাখবি। দেখলাম, শালা লক্কা পায়রা হয়ে আকাশে লাট খাচ্ছে! আর… আর মাঝখান থেকে আমার বোনটাকে… শুয়োরের বাচ্চা…”

“কী বললি? মেঘলাকে আমি কী?” নিশানের মাথায় আগুন লেগে গেল।

“শালা, আমার বোনকে ধরিসনি তুই? চুমু খাসনি? হারামি মাগিবাজ শালা!”

“তবে রে…” নিশান আর মাথার ঠিক রাখতে পারল না। আচমকা এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল বাদলের গালে।

“আমার গায়ে হাত দিলি! আমার বোনকে খেয়ে এখন… শালা, তারকদা ঠিক বলেছে। তোর শালা বাঁচার অধিকার নেই! সব তোর বাপের সম্পত্তি, না? আজ তুই গেছিস!” আচমকা দু’পা পিছিয়ে গেল বাদল। তারপর কোমর থেকে কালোমতো কী একটা বের করল। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ায় এবার জিনিসটা দেখতে পেল নিশান। একটা ওয়ান শটার পিস্তল!

“কী করছিস বাদল! ওটা ঢোকা!” নিশান চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ভারী বৃষ্টির তলায় চাপা পড়ে গেল ওর গলার আওয়াজ।

“আমার বোন কেঁদেছে! তোর জন্য কেঁদেছে! তারকদা ঠিক বলেছে, দে শালাকে ঠুকে! শালা, আজ তুই গেলি! আজ…”

কথা শেষ করতে পারল না বাদল, আচমকা পেছন থেকে একটা ভারী পায়ের শব্দ এল দ্রুত। বাদল ঘাবড়ে গেল বেশ। ও পেছনে ফেরার আগেই অন্ধকার থেকে কেউ একটা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপরে! আচমকা ধাক্কায় পড়ে যেতে-যেতে শেষমুহূর্তে বাদল ওয়ান শটারের ট্রিগারটা টিপে দিল।

চাপা, টায়ার ফাটার মতো শব্দ হল একটা। আর কেমন যেন ধাক্কা লাগল নিশানের। ও টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। লোহার রেল লাইনের একটা কোণ ভোঁতা শব্দ করে লাগল মাথার পাশে। নিশানের মনে হল কেউ যেন দু’হাত দিয়ে টেনে ওর মাথা আর শরীরটা আলাদা করে দিতে চাইল! ও চোখ মেলে দেখতে চাইল। কিন্তু পারল না। পেটে কী অসহ্য যন্ত্রণা!

বৃষ্টি নেমে আসছে দ্রুত। সামনে আবছায়ায় কারা যেন ধস্তাধস্তি করছে! যন্ত্রণাটা বাড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। আর শরীর নিভে আসছে ক্রমশ। অন্ধকার নেমে আসছে… কাছে কীসের যেন শব্দ। কে যেন চিৎকার করল… ধাতুতে ঘষা খেল ধাতু। আর সব কিছু নিভে এল ক্রমশ। শুধু বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়তে লাগল। একাকী বিরামহীন বৃষ্টি।

তারপর আবার চোখ মেলল নিশান। কোথায় ও! কতক্ষণ কেটে গেছে!

আলো-আলো অন্ধকার। অন্ধকার-অন্ধকার আলো। ঝাপসা চৌকো আলো। সরে-সরে যাচ্ছে… মাথার ওপর দিয়ে সরে যাচ্ছে মেঘলা একটা করিডরের ছাদ। ঠান্ডা। আর কী গরম! অন্ধকার অন্ধকার যন্ত্রণা। অবশ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি। কোথায় যাচ্ছে নিশান! কোথায় এখন ও! চোখ বুজে আসছে। মাথা ফাঁকা। শুধু দূর আকাশে যেন চিল উড়ছে একটা। আকাশ-আকাশ আলো। কারা ঝুঁকে পড়ছে সেই আকাশ থেকে? কাদের মুখ এগুলো? ফোঁটা ফোঁটা মুখ। চেনা লাগছে। তাও মনে পড়ছে না। চোখ বুজে আসছে নিশানের। ক্লান্ত লাগছে। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে যেন। ডাকছে, সিঁড়িগুলো ডাকছে নিশানকে। ওকে যেতে হবে। দূরে যেতে হবে। একা। নিশান সিঁড়িতে পা রাখল এবার। আর, কে যেন ডাকল পেছনে! মুখ তুলে দেখল নিশান। মা! মা এসে দাঁড়িয়েছে! অন্ধকারে ছোট্ট আলোর মতো মা! কী বলছ তুমি, মা?

“বাবু, বাবু!” মা ডাকছে? ছোটবেলা থেকে মা ডাকছে ওকে? উঠোনের পেয়ারা গাছের পাশে এসে পড়েছে কত রোদ! আর নিশান ঘুরছে সেই রোদে। ছোট্ট লাল সাইকেল। ও ঘুরছে। আর মা আচারের বয়াম দিচ্ছে রোদে। ওদের ছোট্ট কুকুরটা ঘুরছে সাইকেলের পেছনে। আর মা ডাকছে ওকে। খেতে ডাকছে। দূরে গান বাজছে একটা। কিশোর কুমারের গান। ভগবান নাপিত এসে বসে পড়েছে দাদুর চুল কাটতে। আর বাবা বাজার হাতে ঢুকছে। কোথায় বাবা? তুমি কোথায় ছিলে? আর মা? কই মা? রোদের বয়াম পড়ে আছে। পেয়ারা গাছের পাশে কুচি-কুচি রোদ পড়ে আছে। আর তুমি মা, তুমি কোথায় গেলে? মা… সাইকেল থেকে উঠে পড়ছে নিশান…

আর কারা যেন হাত ধরল ওর। শুইয়ে দিল। আলো-আলো অন্ধকার। মাথার ওপর চৌকো আলোর কাটাকুটি। কোথায় এসেছে ও? এখানে মা আছে? মা… আবার সেই সব কিছু মুড়ে দিল অন্ধকার!

“বাবু, বাবু,” নিশান চোখ খুলল এবার। কে ডাকছে? আলো এসে লাগছে চোখে। কে এসে দাঁড়িয়েছে? চোখ কুঁচকে তাকাল নিশান। আঃ, মাথায় লাগছে। চোখে লাগছে খুব। নিশান চোখ বন্ধ করে নিল আবার।

কে যেন হাত দিল মাথায়। এবার আস্তে-আস্তে চোখ খুলল নিশান। সকালের রোদ এসে পড়ছে ঘরে। মানুষের মাথার ধূসর সোনালি আউট লাইন দেখা যাচ্ছে। এবার ভাল করে দেখল। ও নার্সিং হোমে। মা দাঁড়িয়ে আছে মাথার কাছে। বাবাও আছে পাশে। আর… আর ওই তো বিজনদা, কেয়াদি। আরে মণীশ, নোঈও এসেছে! পাশে কে? সেই অদ্ভুত চুলের স্মরণ না? আর সেই লম্বা ছেলেটা! সেও! সে কী করে এখানে এল! কী যেন নাম! কোথায় যেন দেখেছিল… সেই… সেই রেস্তরাঁ! মাহির!

আর ও… ও কোথায়? নিশান মুখ ঘোরাল। আর দেখল মায়ের পেছনে চেয়ারে বসে রয়েছে রাধিয়া। চুল অবিন্যস্ত। চোখ লাল।

নিশান হাসার চেষ্টা করল। পারল না। মাথায় লাগছে! পেটেও কী ব্যথা! যন্ত্রণা! ঘুম আসছে ওর। ক্লান্ত লাগছে। ও মাথা ঘোরাল। দেখল বাবা গিয়ে মাথায় হাত দিয়েছে রাধিয়ার! মা ধরে আছে রাধিয়ার একটা হাত! এসব কার জীবন? কার সংসার? ওর? এরা ওর লোক! চোখ বুজে আসছে নিশানের। মাথা নিভে আসছে আবার। কিন্তু অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছে ওর। এসব কি সত্যি? ওরা কি সত্যি এসেছে? নাকি স্বপ্ন দেখছে! নিশান আবার চোখ খোলার চেষ্টা করল। কী আলো! ব্যথা লাগছে চোখে! বাবা? বাবা কই! এই তো ছিল রাধিয়ার পাশে! কিন্তু এখন? এখন কই? তবে কি স্বপ্ন দেখছে নিশান! ভাল একটা পৃথিবীর স্বপ্ন! সবাই মিলে বেঁচে থাকার পৃথিবীর একটা স্বপ্ন!

নিশান চোখ বন্ধ করে মাথাটা পাশ ফেরাল আবার। তারপর ঘুমের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল অনেক দূরের একটা উঠোনে। দেখল, পেয়ারা গাছের পাশে রোদ এসে পড়েছে আবার। আবার মা আচারের বয়াম রাখছে রোদে। বাবা এই বাজার নিয়ে ঢুকল। আর ভীষণ ট্যারা ভগবান নাপিত দাদুর চুল কাটছে বসে। ঘুমের মধ্যে সামান্য হাসল নিশান। তারপর এগিয়ে গেল মায়ের কাছে।

মা ঘুমন্ত নিশানের দিকে তাকিয়ে আলতো গলায় সবাইকে বলল, “তোমরা চলো এখন। ও ঘুমোক। রাধিয়া, তুমি এখানে থাকো শুধু। কেমন?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *