২৫. কাজু

২৫. কাজু

ঘুমের শেষে কী লেগে থাকে? অন্ধকার? আর অন্ধকারের শেষে? অন্ধকারের শেষেই কি হাহাকার লেগে থাকে? আকাশ-পাতাল গ্রাস করে নেওয়া হাহাকার!

আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই কথাটাই মনে এল কাজুর। নিজেকে কেমন যেন ভিখিরি মনে হল। মনে হল এভাবে কাউকে কাছে টেনে তারপর দূরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায়! ও বেশি রোজগার করে না বলেই কি আজ এই ভাবে ওকে দূরে সরিয়ে দিতে পারল পেখম! যতই ওদের সমাজ আলাদা হোক না কেন, আজ যদি সুদর্শন মালিকের মতো বাবা থাকত ওর, যদি সম্পত্তি থাকত, তা হলে কি ওর সঙ্গে এমন করতে পারত পেখম বা ওর বাড়ির লোকেরা?

চোখটা জ্বালা করছে কাজুর। ও সহজে কাঁদে না, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে জাহাজ উলটে গেছে! আর চারদিক থেকে জলের তোড় এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে!

জোনাক-বাড়ির বড় গেটের পাশের ভেঙে যাওয়া ছোট কংক্রিটের পিলারটায় একটু ভর দিয়ে দাঁড়াল কাজু। মন ঠিক না থাকলে কিছুই ঠিক থাকে না! এই রাতের অন্ধকারে সবটাই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ওর!

আজ সন্ধে থেকে হাওয়া দিচ্ছে খুব। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কে জানে বৃষ্টি হবে কি না!

চ্যাটার্জিপাড়ায় আজ টিউশন ছিল কাজুর। ক্লাস টেনের দুটো ছেলে পড়ে ওর কাছে। পড়াতে বসেই শুনছিল বাজ পড়ছে। জানলা দিয়ে দেখেছিল বিদ্যুতে-বিদ্যুতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে আকাশ! বৃষ্টি হবে কি? ও ভেবেছিল ছাতা সঙ্গে নেই, ফেরার পথে ভিজে যাবে একেবারে। কিন্তু বৃষ্টি আসেনি এখনও।

কাজু আবার আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ করে আছে মাথার ওপরে। তারাদের দেখা যাচ্ছে না! এত হাওয়া যে, চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ভাল লাগছে, কিন্তু শুধু শরীরে আটকে যাচ্ছে ভাললাগাটুকু। মনের কাছে পৌঁছতে পারছে না সেটা। এখনও চোখের সামনে ভাসছে ছোট গলি জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দামি গাড়িটা। আজ তবে পেখমদের বাড়িতে এসেছিল মালিকরা। কথা কি ঠিক হয়ে গেল? কবে ঠিক হল দিন? ওর মৃত্যুদিন?

“কী রে, শরীর খারাপ?” যাদবকাকা এসে পেছন থেকে হাত দিল কাজুর পিঠে।

কাজু পেছনে ফিরল। আধো অন্ধকারে যাদবকাকাকে কেমন ভুতুড়ে লাগছে! জোনাক-বাড়ির গেটের সামনে একটা লাইটপোস্ট আছে। সেখানে খুব দুর্বল আলো জ্বলে একটা। আলোর মাথায় কালচে একটা শেড। হাওয়ায় আলোটা পেন্ডুলামের মতো দুলছে!

“কী রে কাজু!” যাদবকাকা এবার সামনে এসে দাঁড়াল।

কাজু ঝাঁজালো গন্ধ পেল ঘামের। সারা দিন মিল-এ কাজ করে যাদবকাকা। বিমলদা বলে, এই যে-গন্ধ আমাদের খারাপ লাগে, আসলে তা পরিশ্রমের গন্ধ। গরিবদের মধ্যে কাজ করতে হলে অনেক কিছু মেনে নিতে হবে। বুঝতে হবে যে, জীবনের আসল গন্ধ আর স্পর্শগুলো এমনই হয়। আমরা মেকি জিনিসপত্র দিয়ে ঢেকে রাখি সব। আসলে জীবনের গন্ধ এমনই। ঝাঁজালো, কটু। ঠিক এই গরিব অসহায় মানুষগুলোর রোজকার বেঁচে থাকার মতো!

কাজু নিজেকে ঠিক করল। ওর ইচ্ছে করছে না কারও সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু ও শিখেছে যে, নিজের ইচ্ছের চেয়ে বৃহত্তর মানুষের স্বার্থ বড়। নিজের ইচ্ছেকে অমানুষ ছাড়া আর কেউ বড় করে দেখে না!

“বলো যাদবকাকা,” কাজু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সামনে তাকাল।

“আমাদের ব্যাপারটা দেখলি কিছু? আর তো সময় নেই! মালের লাস্ট ব্যাচ তৈরি হচ্ছে। আর দিনদশেকের মধ্যে সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। তুই জ়রা দেখ বাবু। তুঝে পতা হ্যায় না হামলোগোকা ক্যায়া হোগা! শুনলাম তুই গিয়েছিলিস মালিকের সঙ্গে কথা করতে। কিছু পজ়িটিভ হল?”

কাজু ঠোঁট কামড়ে মাটির দিকে তাকাল। মনে পড়ে গেল ক্লাবের সেই সন্ধেটার কথা।

সুদর্শন মালিক লোকটা কেমন ঠান্ডা চোখে তাকিয়েছিল ওর দিকে। মুখে লেগেছিল পাতলা চিক কাগজের মতো একটা হাসি।

“বলো কাজুবাবু, তোমার কী আর্জি?”

আর্জি! কথাটা কানে কট করে লেগেছিল কাজুর। আর্জি মানে? ও কি রাজার দরবারে এসেছে নাকি? ওর মনে হয়েছিল, পা থেকে চটি খুলে লাগিয়ে দেয় লোকটার মুখে! কোনও-কোনও মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জিনিস পেয়ে গেলে এমন জানোয়ার হয়ে যায়! তার ছোট-ছোট কথার মধ্যে দিয়ে উপচে ওঠে পশুত্ব! সবাইকে নিজের অধীনে ভাবা বা সবাই তার কাছে কিছু প্রার্থনা করতে আসে, এরকম ভাবা তো একরকম পশুত্বই বটে!

“আর্জি মানে?” কাজু ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

সুদর্শন সামনে রাখা গেলাস থেকে হালকা সরষের তেলের রঙের মদে চুমুক দিয়ে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। সামান্য হেসে বলেছিল, “আরে মিস্টার ট্রেড ইউনিয়ন! এমন রাগ করলে চলে! নাও, কাজু খাও,” সামনে রাখা তিন-চার রকমের খাবার থেকে কাজুর প্লেটটা ওর দিকে ঠেলে এগিয়ে দিয়েছিল সুদর্শন।

“আমি আপনার সঙ্গে দরকারি কথা বলতে এসেছি। আপনার ফ্যাক্টরি নিয়ে।”

“সন্ধেবেলা বসে একটু রিল্যাক্স করব, সেটাও করতে দেবে না! সারাক্ষণ কি কাজের কথা ভাল লাগে!” সুদর্শন মাথা নেড়েছিল। বোঝাতে চাইছিল যে, বিরক্ত হচ্ছে।

“এটা ভাললাগা বা মন্দলাগা নয়। এটা অনেক মানুষের জীবন। আপনি নাকি বলেছেন মালের কোয়ালিটি খারাপ হলে, পার্টি যদি পেনাল্টি করে, তা হলে সেই টাকার একটা ভাগ আপনি শ্রমিকদের কাছ থেকে কেটে নেবেন!”

“আমার ফ্যাক্টরির ব্যাপার তোমায় কেন বলব?” সুদর্শন এবার গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।

“কারণ, আমায় না বললে আপনার ফ্যাক্টরিতে গন্ডগোল হবে! বুঝলেন?” লোকটার ঔদ্ধত্য দেখে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি কাজু, “শ্রমিকের ঘাম আর রক্ত পিষে আপনার পকেট ভরে, তারা যদি উঠে দাঁড়ায় কী হবে জানেন?”

“আরে! তাই! ওভাবে আমার পকেট ভরে!” সুদর্শন হেসেছিল শব্দ করে, “এমন হট হেড নিয়ে তুমি প্রেম করো কী করে? তবে শুনেছি তুমিই আমার বউমার পেছনে ঘোরো। ও তোমায় পাত্তা দেয় না। সত্যি?”

কাজু চোয়াল শক্ত করে সামলেছিল নিজেকে। তারপর বলেছিল, “আমি যেটা বলছি সেটা বলুন। আপনি কি জানেন যে, আপনার ছেলে সুজিত ইনফিরিয়র কোয়ালিটির র-মেটিরিয়াল দিয়ে জিনিস বানাচ্ছে! সেটা ফেল করার চান্স নাইনটি পারসেন্ট! আপনাদের বাজে জিনিসের দায় শ্রমিকরা নেবে কেন?”

সুদর্শন হেসেছিল। কিন্তু হাসির পেছনে যে বিষ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি কাজুর।

সুদর্শন বলেছিল, “আমার ছেলে! আমার ফ্যাক্টরি! তুমিই বলছ যে সবটা আমার, আর তারপর এটা বলতে চাইছ যে, আমি কিছু জানি না! তুমি কে হে ছোকরা? টিপে ধরলে মরে যাবে! বয়স কত? আমায় জ্ঞান দিতে এসেছ? তোমাদের বিমল জানে যে, তুমি এসেছ আমার কাছে? গোপেন জানে? শোনো, আমার ফ্যাক্টরি এটা। আমার বাপ-ঠাকুরদার রক্ত-জল-করা পরিশ্রম আছে এতে! সেটা নিয়ে তোমার মতো নো ওয়ান-এর জ্ঞান আমি শুনব না। দাড়ি রাখলেই বুঝি ইন্টেলেকচুয়াল হয়ে ঢপের জ্ঞান দেওয়া যায়! শ্রমিক স্বার্থ! কোনওদিন এক পয়সা রোজগার করে দেখেছ? বিদেশ থেকে কাজ আনতে কী করতে হয় জানো? এতগুলো লোকের মাস মাইনে কোথা থেকে আসে জানো? সবাই কাজে ঢোকার সময় তাদের কন্ট্র্যাক্ট লেটার দেখে নিয়েছিল কি না জানো? আমি কি কাউকে পায়ে দড়ি দিয়ে রেখেছি? ইচ্ছে না হলে চাকরি ছেড়ে দিক! শালা, খালি বক্তৃতা! বাতেলাবাজি! আর চটি পরে এই ক্লাবে ঢুকেছ? ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার আগে কেটে পড়ো। আর-একটা কথা, দীপমালার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে হবে। সুজিত যা চায় আমি ওকে সেটা দিই। দীপমালাকে ও চেয়েছে। আমার ফ্যাক্টরি বা দীপমালা দুটোর পেছনেই ঘুরঘুর করা বন্ধ করো। না হলে তোমাদের গোটা গুষ্টিকে পাছায় লাথি মেরে বের করে দেব জোনাক-বাড়ি থেকে। আর বিশেষ করে তোমায় খুঁজে পাওয়া যাবে না! মনে থাকবে?”

গোটা কথাটা চোয়াল শক্ত করে শুনেছিল কাজু। তারপর বলেছিল, “যা করতে পারেন করে নিন! কিন্তু জানবেন যদি স্ট্রাইক হয়, তা হলে মালও কিন্তু ডেলিভারি হবে না। পড়ে থাকবে ফ্যাক্টরিতে। ডেলিভারি না হলে পয়সাও পাবেন না। মাসের পর মাস টাকা ঝুলে থাকবে। লেট ক্লজ়ে পড়ে বড় পেনাল্টি খাবেন। আর পড়ে থাকতে থাকতে ব্যাচ খারাপ হয়ে যাবে। তা হলে পার্টি তো আর সেই খারাপ মাল নেবে না। তখন পুরো লস! আর মনে রাখবেন, আমরা এও জানি যে, পার্টির এই মাল আর্জেন্টলি দরকার বলে অন্য কোনও অজুহাত বা ক্যালামিটি ক্লজ় অর্ডারে নেই বা তারা মানবেও না। ফলে সাবধান। ভাববেন না আমায় ভয় দেখিয়ে চুপ করানো যাবে!”

“তুই যাবি না ঘাড় ধরে তোকে বের করব শুয়োরের বাচ্চা!” আচমকা টেবিল থাবড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল সুদর্শন।

কাজু দেখেছিল আশপাশে যারা যা কাজ করছিল, সব থামিয়ে চুপ করে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

কাজুও উঠে দাঁড়িয়েছিল এবার। তারপর বলেছিল, “জাত চিনিয়ে দিলেন তো নিজের! যা বললাম মাথায় থাকে যেন। শ্রমিকদের কোনও ক্ষতি হবে না সেটা ইন রাইটিং দেবেন আপনি সাত দিনের মধ্যে। না হলে শ্রমিকদের রক্ত জল করে বের করা পয়সায় ফুটানি করা বের করে দেব।”

“কাজু, কী রে, কী কথা হল? বললি না?” যাদবকাকার মুখটা এই আলো-আঁধারিতে কেমন অদ্ভুত লাগছে! আলোটা নড়ছে হাওয়ায়। মুখের ওপরে পড়া ছায়াটাও কেমন নড়ছে!

কাজু বলল, “আমি আলটিমেটাম দিয়ে এসেছি। সাত দিন। তিন দিন কেটে গেছে। আরও চার দিন বাকি। তারপর আমরা স্ট্রাইকে যাব।”

“স্ট্রাইক!” যাদবকাকা কেমন যেন ঘাবড়ে গেল, “এ বাবু, ইয়ে তো গড়বড় হয়ে যাবে!”

“কিছু গড়বড় হবে না। ডেলিভারি ডেটের দু’মাস পরে আর মাল নেবে না পার্টি। আমি ইউনিয়ন রুমে অর্ডারের ডুপ্লিকেট কপি দেখেছি। কারণ, পার্টিকেও তো ব্যাবসা চালাতে হবে! কতদিন আর ওরা বসে থাকবে মাল ডেলিভারি না পেয়ে! শোনো, তোমরা ভয় পাবে না। দু’মাস ধরে রাখবে স্ট্রাইক। মালিক কী, মালিকের ঘাড় মাথা নোয়াবে! এত টাকার অর্ডার! ও শুধু লিখে দেবে যে, মালের ডিফেক্টের জন্য যদি পেনাল্টি কাটে, তা হলে তোমাদের মাইনে বা ওভারটাইমে হাত পড়বে না। ব্যস! চাকরির প্রাথমিক শর্ত তো এটাই ছিল। সেটাই ওরা মানছে না। তাই দাওয়াই হিসেবে স্ট্রাইক। দু’মাস শুধু ধরে রেখো। এক মাসের মধ্যে দেখবে লেজ গুটিয়ে সুদর্শন মালিক আসছে সমঝোতা করতে। মাল ক্যানসেল হয়ে গেলে বাজার থেকে যে-টাকা উঠিয়েছে, সেটা দেবে কী করে? তোমরা একদম ভয় পাবে না।”

যাদবকাকা এবার যেন বুঝল। নিজের মনে কিছু ভেবে নিয়ে বলল, “কিন্তু বিমলদা যদি আপত্তি করে?”

“বিমলদা তোমাদের টাকা দেবে? সংসার চালাবে? তোমাদের যা সমস্যা সেটা মেটাতে কি লোকটা কিছু করছে! আমার তো মনে হয় সুদর্শন ওকেও খাইয়ে রেখেছে। তুমি কাল বা পরশু মিটিং ডাকো। আমি কথা বলব। তুমিও তো ওদের নেতা, না কি? বিমলদা দু’পাতা বই পড়েছে। ইংরেজি জানে। তার মানে এই নয় যে, শ্রমিক স্বার্থ তোমার চেয়ে বেশি দেখবে। তুমি চাকরি করো মিলে। তোমার ফ্যামিলি আছে। ওর সেই সব আছে কিছু? আর আমায় কিছু বললে? আমি ভয় পাই না যাদবকাকা। আমার হারানোর কিছু নেই। তুমি একটা মিটিং ডাকো।”

“কী যে বলছিস!” যাদবকাকা পিঠে হাত দিল ওর, “ঘরমে সবহি তো হ্যায়।”

কাজু চোয়াল শক্ত করল। চোখ জ্বালা করছে ওর। বুকের ভেতর জাহাজ উলটে গেছে আজ। চারিদিক থেকে জলের চাপ বাড়ছে। আধো আবছায়া গলিজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিদেশি গাড়িটা ওকে যেতে দিচ্ছে না! পৃথিবীতে কেউ কোনওদিন বুঝতে পারবে না, সব থেকেও কখন মানুষের কিছু থাকে না!

যাদবকাকা বুঝল কিছু একটা হয়েছে। বলল, “তু ঠান্ডা রাখ বাবু। আমি দেখছি। পরশু গেটে মিটিং ডাকছি একটা। এখন তুই ঘর যা। মৌসম খুব খারাপ। ঘর যা।”

যাদবকাকা চলে যাওয়ার সামান্য পরে কাজুও এগোল। মনটা এমন খারাপ করছে যে, কিচ্ছু ভাল লাগছে না। ভেবেছিল পার্টি অফিসে যাবে, কিন্তু ওই গাড়িটা পেখমদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে দেখার পর থেকে সবকিছু অর্থহীন লাগছে ওর!

সুজিত কি এসেছে পেখমের সঙ্গে দেখা করতে? ওরা কি কথা বলছে এখন? কী কথা বলছে? দৃশ্যটা মনে করতেই বুকের মধ্যে কে যেন মাটি খুঁড়ে পারদ ঢেলে দিল! আর মাইলের পর মাইল মরে যেতে লাগল গাছ। নষ্ট হয়ে যেতে লাগল মাটি। বিষ এসে মিশে যেতে লাগল জলে।

কাজু শুনেছে, আজকাল নাকি পেখম কলেজেও যাচ্ছে না। বিজন বলছিল সেদিন। ও পেখমদের বাড়িতে গিয়েছিল। পেখমের মা আর কাকিমা বিজনকে দেখাই করতে দেয়নি! বলেছে, ক’দিন দেখা করা যাবে না।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজেদের ঘরের দরজায় দাঁড়াল কাজু। কিন্তু ভেতরে ঢুকল না। বাড়িতে ও পারতপক্ষে ঢোকে না আজকাল। রাতে খেতে আর শুতেই আসে। অসুস্থ বাবা ওকে দেখলেই খিটখিট করে! শুধু আন্টি বাডু যা ওর হয়ে কথা বলে। তা ছাড়া মা, ভাই, বোন। ভাল করে বসারই জায়গা হয় না!

ও দেখল, ছোটভাইটা পড়ছে মাটিতে বসে। বোন চৌকিতে বসে রয়েছে। ভেতরের ঘর থেকে আন্টি বাডু ছাড়াও কার যেন গলার আওয়াজ আসছে। কাজুর মনে হল এখন ওকে একা থাকতে হবে। ঘরে ঢুকতে পারবে না কিছুতেই।

বাড়িতে কারও সঙ্গেই যেন কথা বলার নেই! ও যেন অতিথি! সংসারে টিউশনের টাকা দেওয়াটা ওর কাজ। ব্যস, ওইটুকুই যেন সম্পর্ক! আগে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তাও কথা হত। পড়াশোনায় খুব ভাল ছেলেটা। গাছ বলতে পাগল। সারাক্ষণ ওই নিয়েই কথা বলে যেত। কিন্তু আজকাল তাও হয় না। নিজের বুকের ভেতর বিষের একটা নদী তৈরি হয়েছে কাজুর। সেই ঘূর্ণিতেই ডুবে মরেছে ও! আর মৃত মানুষের সঙ্গে কার আর কথা হয়! যোগাযোগ হয়!

ও পেছন ফিরে সিঁড়ির দিকে এগোল। ছাদে যাবে। ওই একটাই জায়গা আছে, যেখানে ও ছাড়া আর বিশেষ কেউ যায় না। ওই নির্জনতাটা খুব ভাল লাগে কাজুর! ছাদ থেকে পেছনের বড় বাগানটা দেখা যায়। আর বাগান ছাড়িয়ে দেখা যায় সামান্য দূরের গঙ্গা!

ছাদে পা দিতেই হাওয়া যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল ওকে। একটা ঘর আছে ছাদে। ভাঙা জিনিসে ভরতি! ও মাঝে মাঝে যায় সেখানে। কিন্তু আজ ভাল লাগছে না।

ও পায়ে-পায়ে ছাদের পেছনের দিকে গেল। এই জায়গা থেকেই বাগান দেখা যায়।

ছাদের পাঁচিলটা বেশ চওড়া। নিচু। ইচ্ছে করলে বসাও যায়। কিছুটা দূরে-দূরে পাঁচিলের ওপর সিমেন্টের ঘটের মতো ডিজ়াইন করা। বাড়িটা অনেক পুরনো, তাই বেশ কিছু ঘট ভেঙে গেছে। রাতের অন্ধকারে ওই ঘটগুলোকে কেমন যেন ভাঙাচোরা মুখের মানুষ মনে হচ্ছে!

কাজু পাঁচিলে বসে চারিদিকে তাকাল। দূরে ছড়িয়ে থাকা আরও তিনটে ব্লক দেখা যাচ্ছে। সব কেমন নিঝুম। শুধু নীচের বড় বাগানটায় সবুজ-হলুদ আলো জ্বেলে পিটপিট করে জেগে আছে জোনাকিরা।

কাজুর মনে হল, আজ থেকে অনেকদিন পরে একদিন এইসব বাগান, বাড়ি কিছুই থাকবে না। এইসব বিক্রি হয়ে যাবে। এখানে হয়তো নতুন বাড়ি উঠবে। কেউ আর হয়তো মনেও রাখবে না কাজুকে। পেখম চলে যাবে কোথায়। ও-ও কি আর মনে রাখবে এসব? মনে রাখবে, একটা ছেলে ছিল, যে সবটা দিয়ে ভালবেসেছিল ওকে। মনে রাখবে অন্ধকারে জোনাকিদের এই বাড়িটাকে। মনে রাখবে সেইসব জ্যোৎস্না। সেইসব বিকেলের মাঠ। নদীর ধার। সেইসব মুহূর্ত, যা ছিল শুধু ওদের। যা শুধু ওরা দু’জন জানত।

সব হারিয়ে যায়। ভালবাসা হারিয়ে যায়। বিশ্বাস হারিয়ে যায়। কথা হারিয়ে যায়। সময়ের দুর্লঙ্ঘ্য খাদে তলিয়ে যায় স্মৃতি। সোনাঝুরির এই হাওয়ায়, এই আলোয়, এই অন্ধকারে অমোঘ নিয়মে একদিন হারিয়ে যাবে কাজুও। কেউ ওকে মনে রাখবে না। পেখম ওকে মনে রাখবে না আর।

জীবনের অনিত্যতার চেয়েও এই শেষের কথাটুকু, ‘পেখম ওকে আর মনে রাখবে না’, এটা মনে হতেই কী যেন একটা হয়ে গেল কাজুর! আর বহুক্ষণ উলটে থাকা জাহাজটার কাঠামো ফাটিয়ে হু হু করে ঢুকে এল জল! আর সেই জলের তোড়ে এই সন্ধের অন্ধকারে, হাওয়ায় কোথায় যেন ভেসে, তলিয়ে গেল কাজু! মনে হল ওর ভেতর থেকে কে যেন সত্যিকারের কাজুকে ছিঁড়ে, খুলে নিয়ে গেছে! আর যেন কোনও জোর নেই ওর। শরীরে কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই। কাজু বিহ্বল হয়ে একবার নিঃশেষ অন্ধকারের দিকে তাকাল, তারপর হাঁটু ভাঁজ করে সিমেন্টের মেঝেতে মুখে গুঁজে শব্দ করে কেঁদে উঠল।

হাওয়া যেন আরও জোরে বইছে। আকাশ ফেটে যাচ্ছে বিদ্যুতে। কিন্তু কাজুর হুঁশ নেই কোনও। আসলে আমাদের কষ্টগুলো একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। যেন ছোট্ট আলমারিতে ঠেসে ভরে রাখা জিনিসপত্র। আলমারি খুলে একটা বের করতে গেলেই হুড়মুড় করে সব নেমে আসে।

কাজুরও সব কিছু এই সন্ধেতেই যেন মনে পড়তে লাগল। ও কিছুতেই আটকাতে পারছে না নিজেকে। ছাদের মেঝেতে যেন কেউ ওকে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে। কয়েকহাজার বছরের আটকে থাকা জল যেন আজ দখল নিয়েছে ওর। কাজুর মাথা থেকে সবকিছু মুছে যাচ্ছে সেই জলের স্রোতে।

“কাজুদা!” নরম একটা হাত এসে কাজুর মাথায় আলতো করে স্পর্শ করল হঠাৎ।

কাজুর যেন মনে হল কেউ একটা এসেছে। কেউ একটা ওকে ডাকছে। কিন্তু জলের তলায় ডুবে যাওয়া মানুষের মতো বুঝতে পারল না কোথা থেকে এই শব্দ আসছে। কেউ কি সত্যি ডাকছে? নাকি আসলে কেউ ডাকছে না! কেউ আসেইনি! সবটাই ওর ভ্রম! কারণ, এই পৃথিবী তো নিজের দরকারেই কাজুকে ব্যবহার করে গেছে। দরকার যখন শেষ, তখন কেন কেউ আসবে ওর কাছে!

“কাজুদা, কী হল? ওঠো! উঠে বোসো!” দুটো হাত এবার কাজুকে শক্ত করে ধরে ছাদের মেঝেতে বসিয়ে দিল!

কে এল? কে এটা? কাজু আবছা চোখে তাকাল সামনে। জলের পরদা ভেদ করে দৃষ্টি যেতে পারছে না। সব কেমন লেপটে যাচ্ছে। আবার বিদ্যুৎ চমকাল আকাশ ফাটিয়ে। আর তার আলোয় জলের ওপার থেকে মুখটা এবার বুঝতে পারল কাজু। নয়না!

নয়না এখানে এখন কী করছে? কাজু নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারছে না। নিজের শরীরের ওপর, মনের ওপর যেন নিজেরই জোর নেই ওর!

“কী হয়েছে কাজুদা, কী হয়েছে? আমি নীচে ছিলাম আন্টির কাছে। জানলাম এসেছ। তাই আমি ছাদে এলাম… তুমি কাঁদছ কেন?”

কাজু কথা বলতে পারছে না। মাটিতে বসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছে পাহাড়ি ঝোরার মতো!

নয়না এগিয়ে এসে আচমকা কাজুকে টেনে নিল বুকের কাছে। জোরে ধরে রাখল। কাজুর কী হল কে জানে, একটা আশ্রয় পেয়েই বোধহয় দু’হাত দিয়ে ও নিজেও পেঁচিয়ে ধরল নয়নার কোমর।

“কী হয়েছে কাজুদা!” নয়নার গলা ভারী হয়ে এল। কাজুকে যেন আরও শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।

কাজুর কান্না কমে এসেছে। কিন্তু তার দমক মাঝে মাঝে তরঙ্গ ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা শরীরে! ও বুঝল নয়না ওকে জড়িয়ে ধরেছে শক্ত করে আর নিজের বুক দুটো ঘষছে কাজুর বুকের সঙ্গে! ওর গলায়, ঘাড়ে মুখ ঘষছে নিজের।

“কাজুদা!” নয়নার গলায় অদ্ভুত এক শ্বাস এসে জড়িয়ে দিচ্ছে কথাগুলো। কাজুর চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে কাজুর মুখটাকে আঁকড়ে ধরছে নিজের বুকের কাছে। শাড়ি সরে যাচ্ছে। ছোট ছোট ঢেউ-এর মধ্যে যেন কাজুকে ডুবিয়ে মারতে চাইছে ও।

কাজু নিজেকে ছাড়ানোর কথা ভাবল একবার। কিন্তু তারপর বুঝল নয়নার শরীরের স্পর্শে ও নিজেও কেমন শক্ত হয়ে উঠছে! এটা কী হচ্ছে! এমন হচ্ছে কেন! কীভাবে এ সম্ভব! কিছু বোঝার আগেই এবার নয়না এই আধো-অন্ধকারে, এই মন্থনের মধ্যে আচমকা হাত দিয়ে স্পর্শ করল ওর কাঠিন্য!

কাজু মুখ তুলে তাকাল নয়নার দিকে। নয়না দ্বিধাহীনভাবে কামড়ে ধরল কাজুর ঠোঁট। ওর জিভ কাজুর জিভ স্পর্শ করেছে। জিভ কামড়ে ধরেছে। কাজু বাধা দিচ্ছে না। বরং নয়নার জিভকে যেন খুঁজতে দিচ্ছে কিছু। যেন নয়নার সঙ্গে ও নিজেও খুঁজছে নিজেকে। চোখের জলের নুনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ঘাম, লালা। নয়না সবুজ শক্ত লতার মতো ক্রমশ দখল নিয়ে নিচ্ছে কাজুর। ওর শাড়ি সরে যাচ্ছে! ব্লাউজ় নেমে যাচ্ছে! কাজু যেন তলিয়ে যাচ্ছে গোলকধাঁধায়! নয়নার জিভে নারকেলের স্বাদ। ও কাজুর একটা হাত নিয়ে নিজের খোলা বুকের ওপর চেপে ধরেছে! মুখটা চেপে ধরছে কঠিন হয়ে ওঠা বৃন্তে! কাজুর চারিদিকে কেমন ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। নয়না ক্রমশ উঠে আসছে ওর শরীরের ওপর। ওর প্যান্টের হুক খুলে দিচ্ছে। বোতাম টান মেরে ছিঁড়ে দিচ্ছে! আর অস্ফুটে বলছে, “তুমি আমার কাজুদা! তুমি শুধু আমার!”

কাজু কার? নয়নার? পেখমের? নাকি কাজু নিজের? কিছুই বুঝতে পারছে না ও। শুধু এক প্রবল স্রোত ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বিষাদ থেকে গোলকধাঁধায়। কাজু বুঝতে পারছে এটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু আটকাতেও পারছে না নিজেকে। নয়না ওর কোলের ওপর বসে পড়েছে। শাড়ি উঠে গেছে ঊরু অবধি। দুটো পা দিয়ে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরেছে ওকে। ব্লাউজ়ের সামনেটা সম্পূর্ণ খুলে ফেলেছে কখন। কাজুর মুখটা চেপে ধরছে শরীরে। কাজু বুঝল ওর প্রতিরোধ শেষ হয়ে আসছে। মনে হল, কেনই-বা প্রতিরোধ করবে? কীসের জন্য করবে? কে আছে ওর? সেই মেয়েটা কি একবারও ভাবল ওর কথা? অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা বড় গাড়ি যখন ওর পথ বন্ধ করে দিয়েইছে, তখন অন্য পথে যেতে কে আটকাবে ওকে!

আবছা চোখে নয়নার দিকে তাকাল কাজু। বুঝল, মেয়েটা আর নিজের মধ্যে নেই। পাগলের মতো ওকে নিজের সঙ্গে বেঁধে ফেলতে চাইছে। নয়নার ভেতরের আদিম নারী তার পুরুষকে খুঁজে চলেছে যেন। সমস্ত ভালবাসা আর আকুতি যেন এসে জ্বলে উঠেছে আজ নয়নার মধ্যে।

কাজু ছিন্নভিন্ন আকাশ থেকে নেমে আসা সাদা-গোলাপি আলোয় নয়নাকে দেখল। তীক্ষ্ণ কাচের মতো মুখ। কপালে কাটা দাগ। বড়-বড় চোখ! মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘামের ফোঁটা। কাজুকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিয়ে এখন থরথর করে কাঁপছে! মনে হচ্ছে যে-কোনও সময় ভেঙে যাবে মেয়েটা!

কাজু নিজেও ভাঙতে চায় আজ। এই কাজুটাকে ভেঙে বের করে আনতে চায় অন্য একটা কাজুকে। যে-কাজু ভালবাসে না। যে-কাজু কষ্ট পায় না। যে-কাজু শুধু শরীর বোঝে। যে-কাজু জানে, বিষ বুকে নিয়েও কীভাবে বেঁচে থাকা যায়।

ও নিজেকে আর আটকাল না। নয়নাকে আঁকড়ে ধরে কামড়ে ধরল ওর ঠোঁট! তারপর কোলে উঠিয়ে শুইয়ে দিল মেঝেতে। আর বর্শার মতো, বল্লমের মতো নিজে নেমে আসতে লাগল নয়নার শরীরে! আসতেই লাগল ক্রমাগত!

আর ওই ছাদ থেকে নীচে দূরের বাগানে জ্বলে-নিভে-জ্বলে, আলো আর অন্ধকারকে, ঠিক আর ভুলকে, প্রেম আর অপ্রেমকে, আলো আর পতঙ্গকে একাকার করে দিতে লাগল আলোকবিন্দুর মতো জোনাকিরা!

.

২৬. আইকা

যেন পিঁপড়ে! যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাঙা খেলনা! যেন ছিঁড়ে গড়িয়ে যাওয়া পুঁতির মালা! ওপর থেকে রাস্তার মানুষজনকে অদ্ভুত দেখতে লাগছে! স্কুল ছুটি হয়েছে। দুটো বড় বাস ততটাও বড় নয়, তাও গলিতে ব্যাক করাতে গিয়ে কেমন একটা ছত্রভঙ্গ অবস্থার সৃষ্টি করেছে চারিদিকে! লোকজনের মধ্যে কাজ শেষের মন্থরতা। পুজোর ছুটির পরের আলস্য। অনিচ্ছে। সামনের দিকে তাকাল এবার ও। কেমন একটা রক্তহীন আকাশ এই সব কিছুর মাথায় টাঙানো আছে যেন। যেন কাচের, নির্লিপ্ত চোখ নিয়ে এই শহর তাকিয়ে আছে অগণন মানুষের দিকে। আচ্ছা, এই শহরটা কি ক্রমে-ক্রমে শেষ হয়ে যাচ্ছে! মারা যাচ্ছে!

ছ’তলার ওপর থেকে শহরটার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা মায়া হল আইকার। আজ সকাল থেকেই মেঘ করে ছিল। আর এখন এই বিকেলের দিকে সেটা যেন জাঁকিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ঘন প্যাস্টেল ঘষে আকাশের রংটাকে আরও গাঢ় করে দিচ্ছে!

আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে আইকা। মাকে চোখের ডাক্তার দেখানোর ছিল। বাবার একজন পুরনো বন্ধু আছে। ফিরোজকাকু। আই স্পেশ্যালিস্ট। বরাবর মা তাকেই দেখায়। ওদের বিপদের সময় যে দু’-একজন ওদের সামান্য হলেও সাহায্য করেছে তাদের মধ্যে ফিরোজকাকু অন্যতম।

ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে বসে ফিরোজকাকু। ছ’তলার ওপর চেম্বার। ভিড় হয় বেশ। সবাইকে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হয়। কিন্তু আইকাদের সেসব করতে হয় না।

গত কয়েকদিন ধরেই মায়ের চোখে জল পড়ছিল। মাথাব্যথা করছিল। আইকা বারবার বলছিল, যেন ডাক্তার দেখিয়ে নেয়। মা যথারীতি পাত্তা দেয়নি। কিন্তু কাল রাতে ব্যথাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, তাই আজ আসতেই হয়েছে।

সকালে মা নিজেই বলেছিল, “ফিরোজদাকে একবার ফোন কর বুড়ি, আজ একবার যাব।”

সপ্তাহের মাঝখানে এমন হুট করে বললেই কি অফিস থেকে ছুটি করতে পারবে? মনে মনে খানিকটা বিরক্ত হয়েছিল আইকা। সেই কবে থেকে বলে যাচ্ছে মাকে, ডাক্তার দেখাও। কিন্তু মা শুনলে তো! আর এখন যখন শিরে সংক্রান্তি, ডাক্তার দেখাতে হবে এখনই!

আইকা বিরক্তি না-লুকিয়ে বলেছিল, “আমি তো আগেই বলেছিলাম, দেখিয়ে নাও। শুনলে না তো! আজ বুধবার। প্লাস অক্টোবর মাসের শেষ হতে চলল। এই সময় কী করে অফিস কামাই করব! জানো না, মাসের শেষে অফিস থেকে টাইম ম্যানেজ করতে আমার মুশকিল হয়!”

মা টোস্টারে পাঁউরুটি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “তোর আজকাল সবেতেই এমন বিরক্তি কেন রে? এত রাগ কীসের তোর? সারাক্ষণ সবাইকে মুখ নেড়ে যাচ্ছিস! আর, শরীর খারাপ কি মাসের শুরু, সপ্তাহের ছুটির দিন দেখে হবে?”

আইকা স্নান করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল সে সময়। মায়ের কথা শুনে চিরুনি হাতে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল খাওয়ার ঘরের দরজায়। বলেছিল, “কতদিন ধরে তোমায় আমি বলছি ডাক্তার দেখাও! শুনছ আমার কথা? তুমি নিজের দোষটা দ্যাখো না কখনও!”

“এতদিন তো আমার খুব-একটা অসুবিধে হয়নি। শুধু-শুধু টাকা খরচ করে কী হবে? এখন হল তাই বললাম।”

মায়ের কিছু-কিছু যুক্তি কিছুতেই বুঝতে পারে না আইকা। মায়ের মনের কোনও একটা অংশে এখনও সেই যাদবপুর কলোনির বাড়িটা আটকে আছে! সারাক্ষণ এত টাকার চিন্তা করে কী করে কে জানে! মাকে কতবার বলেছে আইকা যে, এখন আর এসব ভাবার দরকার নেই। কিন্তু কে কার কথা শোনে! সারাক্ষণ পাই-পয়সার হিসেব করে যাচ্ছে!

আইকা বলেছিল, “আবার শুরু করলে তো! কতদিন বলেছি যে, এমন করে কথা বলবে না! আমাদের অভাব আছে কিছু? নিজে তো ভগবানে বিশ্বাস করো, জানো না, সারাক্ষণ নেই-নেই করে গলা শুকোলে ভগবান এক সময়ে সব কিছু কেড়ে নেয়!”

“গলা কোথায় শুকোচ্ছি?” মা বিরক্ত হয়ে পাঁউরুটিতে জ্যাম লাগাতে-লাগাতে বলেছিল, “বাস্তব কথা বলছি। তুই ভুলে গিয়েছিস, আমি যাইনি। পুরনো দিন ভুলে যেতে নেই। মাটিতে পা রেখে চলতে হয় আমাদের, বুঝেছিস!”

“মা!” আইকার মনে হচ্ছিল দেওয়ালে মাথা ঠোকে নিজের। মাকে কিছু বলা মানে নিজের মেজাজ খারাপ করা। ও ড্রেসিং ইউনিটের সামনে চিরুনিটা রেখে, খাওয়ার ঘরের বেসিনে হাত ধুয়েছিল। তারপর টেবিলে বসে জ্যাম-টোস্ট খেতে-খেতে ফোনটা নিয়ে কল করেছিল ফিরোজকাকুকে। চারটের সময় আসতে বলেছিল ফিরোজকাকু। আইকা চেষ্টা করেছিল ওটা ছ’টা করার। কিন্তু ফিরোজকাকু বলেছিল, ছ’টায় তো সল্ট লেকে চেম্বার আছে।

ফোনটা রেখে চুপচাপ খাবার খাচ্ছিল আইকা। মনে মনে বিরক্ত লাগছিল এত! কিন্তু বুঝতে পারছিল মাকে নিয়ে যেতেই হবে। গতকাল রাতে মা কষ্ট পেয়েছে খুব।

টোস্ট শেষ করে ডিমের পোচটা টেনে নিয়ে ও বলেছিল, “তুমি সাড়ে তিনটের সময় রেডি হয়ে থেকো।”

“তোকে আসতে হবে না, আমি একাই যেতে পারব!” মা মুখ গোঁজ করে বসে ছিল সামনের চেয়ারে!

আইকা বলেছিল, “আচ্ছা মা, একটা কথা বলো তো, সব কিছুতেই এত এফর্ট দিতে হয় কেন আমাকে? যাই করতে যাই, কেউ না-কেউ কিছু না-কিছু একটা ফ্যাকড়া বের করে ফেলে! সারাক্ষণ কি আমি লোকজনকে কনভিন্স করে যাব নাকি এটা করে দাও, ওটা করে দাও! আমার নিজেরও তো একটা ভাল লাগা খারাপ লাগা আছে না কি? কোনও কাজ সহজে হয় না কেন! সবাই সব কিছুতে এত ব্যাগড়া দেয় কেন!”

“আমি ব্যাগড়া দিচ্ছি?” মায়ের ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল, “তুই এভাবে কথা বলিস কেন আমার সঙ্গে? তোকে নিয়ে যেতে হবে না! আমি একা যেতে পারব না ভেবেছিস?”

আইকার মনে হচ্ছিল খাবার ছেড়ে উঠে যায়! মা সকাল-সকাল কী শুরু করেছে!

মা বলেছিল, “শোন, আমার জন্য তোকে কিছু করতে হবে না। সত্যি, এই তো ছিল আমার কপালে। যাকে বুক দিয়ে আগলে বড় করলাম এখন তার লাথি-ঝ্যাঁটা খেতে হবে!”

“মা,” আইকা কী বলবে বুঝতে পারছিল না, “কীসব বলছ! তোমাকে বলেছি না ওই সিরিয়ালগুলো দেখা বন্ধ করো! একদম ওদের মতো বিহেভ করছ তুমি!”

“বেশ করেছি, তোকে চিন্তা করতে হবে না!” মা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।

খাবার শেষ করে উঠে মুখ ধুয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়েছিল আইকা। মাকে ভাল করে চেনে ও। জানে, এমন সময়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে লাভ হয় না। মা একদম বাচ্চাদের মতো!

ও মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, “ঠিক আছে, আর রাগ করতে হবে না। সাড়ে তিনটের সময়ে রেডি থেকো।”

“না, তোকে কিছু করতে হবে না আমার জন্য!”

মায়ের গলা শুনে আইকা বুঝেছিল এই কাঁদল বলে! ও আলতো করে ঝুঁকে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, “এমন কোরে না মা। আমি আসব ঠিক সময়ে। তোমার এত অভিমান কেন! আমি কি নিয়ে যাব না বলেছি?”

মা আর কিছু না বলে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। শব্দ শুনে বুঝেছিল মা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে!

সময় দিয়েছিল আইকা। ও জানে মাকে এমন সময় আটকালে বিপদ। তাতে হিতে বিপরীত হবে! আইকা শুধু মাকে ধরে দাঁড়িয়েছিল চুপ করে। কিছুক্ষণ পরে মা চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, “তুই অফিসে যা। দেরি হয়ে যাবে। পরে আবার বলবি আমার জন্য দেরি হয়েছে!”

আইকা অসহায়ভাবে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। বুঝতে পারছিল কিছু-কিছু খেলায় ওর হার অনিবার্য!

অফিস যাওয়ার ড্রেস করে, ব্যাগটা নিয়ে বেরোনোর আগে তাও একবার শেষ চেষ্টা করেছিল ও। মা বসার ঘরে বসে খবরের কাগজটা উলটোচ্ছিল! ও বলেছিল, “মা, এখন রাগ করছ করো, আমি কিন্তু আসব ঠিক সাড়ে তিনটের সময়! রেডি হয়ে থাকবে বলে দিলাম।”

মা তাকিয়েছিল খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে, তারপর বলেছিল, “আমি বুঝতে পারছি, তুই এমন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিস কেন!”

“মানে?” আইকা বুঝতে পারছিল না মা আবার নতুন কী থিয়োরি বের করছে। ও দরজার কাছে গিয়ে থমকে গিয়েছিল।

মা খবরের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে বলেছিল, “তোর একটা বিয়ে দিতে হবে এবার। তোর একটা সঙ্গী দরকার। বুঝতে পারছি, এই জন্য তুই এমন খিটখিটে হয়ে গিয়েছিস!”

বিয়ে! সঙ্গী! কী বলবে বুঝতে পারছিল না আইকা! ও খিটখিটে হয়ে গেছে। আর সত্যি যদি হয়েও যায়, তার মানে কি ওকে বিয়ে দিতে হবে? এটা কোনও সমাধান নাকি? কেউ খিটখিট করলে তাকে বিয়ে দিতে হবে? সেই যুক্তিতে তো মাকেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত!

মা বলেছিল, “বিয়ে হলে তোর ঢ্যাঁটামো ঠিক হয়ে যাবে! তখন দেখব কোথায় থাকে তোর এত গুমর!”

আইকা চুপ করে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। ভাবছিল, মা ঠিক কেন ওকে বিয়ে দিতে চাইছে! ওর একজন সঙ্গী হবে বলে, নাকি ওকে শাস্তি দেবে বলে! ওর তথাকথিত গুমর ভাঙবে বলে!

মা বলেছিল, “আমি দেখছি কী করা যায়।”

আইকা আর কথা বাড়ায়নি! দরজাটা টেনে বেরিয়ে এসেছিল। কিছু বললে বিপদ বাড়ত। মা যে মুডে ছিল তাতে বলা যায় না তখনই হয়তো পাত্র দেখতে বেরিয়ে যেত!

অফিসের দিকে যেতে-যেতে আইকার হাসি পেয়েছিল মায়ের কথা ভেবে! মধ্যবিত্ত বাঙালিদের একটা মজা আছে। কিছু হলেই দুটো অপশন দিয়ে দেয়। হয় বলে, কোথাও থেকে ঘুরে আয়! নয়তো বলে, একটা বিয়ে করে নে! আইকার মনে হয় এখন সারা বিশ্বের যা অবস্থা, তাতে এদের হাতে ক্ষমতা দিলে এরা সারা পৃথিবীকে হয় ঘুরতে পাঠিয়ে দিত, নয়তো বিয়ে দিয়ে দিত!

ঘড়ি দেখল আইকা। পাঁচটা বাজতে যায় প্রায়। মা কী করছে ভেতরে কে জানে। যতক্ষণ চোখ দেখানো হচ্ছিল আইকা ভেতরেই ছিল। কী ড্রপ দিতে হবে, কী টেস্ট করাতে হবে সব ও জেনে নিয়েছে। কিন্তু তারপরেই মা বলেছিল, “বুড়ি, তুই বাইরে যা তো, ফিরোজদার সঙ্গে আমার কথা আছে!”

বাইরে! অবাক হয়ে গিয়েছিল আইকা। বাইরে যাবে কেন ও! মা আবার কী বলবে ফিরোজকাকুকে! ও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।

মা চোখ বড় করে ইশারা করেছিল। যার মানে, কথা শোন, বাইরে যা!

সেই বাইরে এসেও প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। চেম্বারে আরও জনাপাঁচেক পেশেন্ট বসে রয়েছে। তারাও উসখুস করছে। আইকার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে! ওর কী যে বাজে লাগছে! তাই তো চেম্বার ছেড়ে বাইরে এই করিডরটায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই বিল্ডিংটার একদিকের দেওয়াল পুরো কাচের। তাই রাস্তা দেখা যায়। উঁচু জায়গা থেকে রাস্তা দেখতে বেশ মজা লাগে আইকার! অফিসেও নিজের ডেস্ক থেকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। ছোটবেলায় ওরা ঝুলন সাজাত। উঁচু থেকে কলকাতার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় তেমনই কোন এক ঝুলনের শহরে এসে পড়েছে! পার্থক্য একটাই যে, এরা সব সচল!

“কী রে, তুই এখানে! সরি আসতে দেরি হয়ে গেল!”

দূর্বার গলা পেয়ে পেছনের দিকে ফিরল আইকা। একটা জিন্‌স আর ডেনিমের শার্ট পরেছে আজ দূর্বা। মাথার চুলগুলো খোলা। মুখে সারাক্ষণের মতো এখনও হাসি।

আইকা হাসল। লেট করাটা দূর্বার কাছে কোনও ব্যাপার নয়! আইকা এতে অভ্যস্ত। ও দেখল পাশে গোলগাল ফরসা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চিনতে পারল ও। ব্রতীন।

দূর্বা আজ অফিসে আসেনি। আইকা জানত ও আসবে না। সামনেই বিয়ে ওদের। নভেম্বরের আঠারো তারিখ। তাই আজ শপিং-এ বেরিয়েছে। আইকার সঙ্গে ব্রতীনের আগে দেখা হয়নি। শুধু ছবিতে দেখেছে!

দূর্বা আজ একটা কাজের ব্যাপারে অফিসে ওকে ফোন করেছিল। কিন্তু যেই জেনেছিল যে, ও মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে দেখাতে যাবে, সঙ্গে-সঙ্গে বলেছিল, “আমি যাব তোর সঙ্গে দেখা করতে। আমরা আজ গড়িয়াহাটেই যাব শপিং করার জন্য। তুই ক’টায় কোথায় থাকবি বল, আমি দেখা করতে যাব!”

আইকা অবাক হয়েছিল। বলেছিল, “আরে, আমরা তো ডাক্তার দেখাতে আসব।”

“তাও,” দূর্বা জেদ করেছিল, “আমরা যাব। অফিশিয়ালি তো যাবই তোর বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে, কিন্তু তার আগে এমনিও যাব আজ। পাঁচ মিনিট। প্লিজ়!”

দূর্বাটা পাগলি আছে। ওকে আটকানো যায় না। অগত্যা আইকা রাজি হয়ে গিয়েছিল।

আইকা ব্রতীনকে দেখল। ফরসা গোলগাল ছেলেটার মুখ লাল হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দূর্বা ঘুরিয়ে মেরেছে বেচারাকে।

দূর্বা বলল, “এই হল ব্রতীন।”

“হাই,” ব্রতীন হাত বাড়াল।

আইকা আলতো করে ব্রতীনের বাড়ানো হাতটা ধরল। হাসল একটু।

ব্রতীন বলল, “এভাবে এখানে দেখা করাটা একটু অকোয়ার্ড। আমরা একদিন কোথাও আড্ডা মারব, কেমন!”

আইকা মাথা নেড়ে হাসল। কিন্তু সম্পূর্ণ মনটা এখানেও দিতে পারছে না। মা কী করছে এখনও চেম্বারে! একটা করে মিনিট কাটছে আর ওর অস্বস্তি বাড়ছে!

দূর্বা এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে বলল, “অফিসে নাকি তুই আজ ঝামেলা করেছিস! আমায় রাণুদি ফোন করে বলল। এটাই নাকি আজকের হট টপিক! কেন রে? ঝগড়া করেছিস কেন?”

আইকা মাথা নাড়ল। রানুদি ওদের পারচেজ় দেখে। কিন্তু আসলে অফিসের রিপোর্টার! কিছু হল কী, চারদিকে ফোন করে খবর দিতে শুরু করবে! আজ দূর্বা অফিসে আসেনি— ওকে ফোন করে এসব বলার কী মানে!

এতক্ষণ অফিসের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল না আইকা। মন থেকে একরকম জোর করেই সরিয়ে রেখেছিল। আবার দূর্বা সেটা মনে করিয়ে দিল!

আজ সকালে অফিসে যেতেই তারক চক্রবর্তীর কাছ থেকে মোতি নামে লোকটি ফোন করেছিল। আইকা নিজে তখন ঠিকমতো বসেওনি চেয়ারে। লোকটি মোবাইলে ফোন করে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিল।

আইকা বাধা দিয়েছিল। এভাবে হুট করে কথা হয় নাকি! ওর সকালে একটু কাজ ছিল। ভেবেছিল সেটা সেরে ফোন করবে! তাই ফোনটা ধরে বলেছিল, “আমি আপনাকে মিনিটদশেক পরে ফোন করছি। আমি জাস্ট অফিসে ঢুকলাম।”

“মিনিট দশেক!” মোতি লোকটি খিকখিক করে হেসেছিল, “আরে ম্যাডাম, এক মিনিটের জন্য মানুষের জীবনে কত কী ঘটে যায়! এক সেকেন্ডের জন্য কত কী ঘটে যায়! সেখানে দশ মিনিট! তারকদাকে কী পেয়েছেন? উনি আপনার জন্য দশ মিনিট ওয়েট করবেন ভাবছেন?”

আইকা অবাক হয়েছিল, “উনি কথা বলতে চান?”

এবার ফোনে তারকের গলাই পেয়েছিল আইকা।

লোকটা ফোনের মধ্যেই অসভ্যের মতো একটা বিশাল ঢেকুর তুলে বলেছিল, “কী ম্যাডাম, সব ভুলে গেলেন যে! শুনলাম আপনাদের জিএম মালিকদের সঙ্গে ডাইরেক্ট যোগাযোগ করছেন! তা করুন, কিন্তু আমায় টপকে কিছু হবে না। জানবেন মালিকরাই আমায় বলেছে এতে নাক গলাতে। কারণ, এখানে অলরেডি আপনাদের এই সব কিছু কিনে ভেঙে ফেলে বাড়িঘর তৈরি করার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে! ফলে ঘোড়া টপকে ঘাস খেতে যাবেন না! পেছনে বাঁশ হয়ে যাবে!”

আইকা থমকে গিয়েছিল সামান্য। ব্যাপারটা কী? ও তারকের প্রস্তাব রুপিনকে জানিয়ে দিয়েছে মাসদুয়েক আগে। কিন্তু এর মধ্যে আর এই নিয়ে তেমন কোনও কথা হয়নি। আইকাকেও বালির দিকে একটা প্রজেক্টের ফিজ়িবিলিটি রিপোর্ট তৈরি করার কাজ দেওয়া হয়েছে! তারকের কথায় আবার নড়েচড়ে বসেছিল আইকা। এর মধ্যে মালিকদের সঙ্গে রুপিন কথা বলেছেন! সেটা তো ও জানে না!

তারক আবার ঢেকুর তুলেছিল একটা। তারপর জল খেয়েছিল। লোকটার এটিকেট বা ভদ্রতা বোধটাই নেই! সবই কেমন একটা হাটুরে রংবাজি যেন! সারাক্ষণ অন্যকে মাটিতে পিষে, তার মাথায় পা তুলে দিয়ে কথা বলা।

আইকা বলেছিল, “আমি আসলে অন্য কাজে ছিলাম, আমি খবর নিয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছি!”

“অন্য কাজ!” খ্যাকখ্যাক করে হেসেছিল তারক, “মাইরি! আমি প্রথম থেকেই জানি মেয়েছেলে দিয়ে কোনও কাজ হয় না!”

“মানে?” আইকা নিজেকে আর সামলাতে পারেনি! এটা কেমন ধরনের অসভ্যতা!

“মানে, মেয়েছেলে দিয়ে দু’-চাররকম কাজের বাইরে আর কোনও কাজ হয় না। আপনি দেখুন, কতদিন ধরে এই কাজটা নিয়ে ল্যাদ চালাচ্ছেন! আমায় তো মালিকরা বলল এসব ঢ্যামনা কোম্পানি দিয়ে হবে না। অন্য পার্টি দেখতে। শালা, আজকাল সব আমাদেরই করে দিতে হয়!”

“প্লিজ় এভাবে কথা বলবেন না,” আইকা শক্ত গলায় বলেছিল “আমি খবর নিয়ে জানাব বললাম তো!”

“ম্যাডাম, আমার মুখ আমি যেমন খুশি বলব! কোটি-কোটি টাকার ব্যাপার। ছেলেখেলা নয় এটা। প্রপার্টির সব কাগজ তো আপনারা সার্চ করে দেখেইছেন যে, সব ওকে আছে। তবে! এত লেট কীসের!”

“দেখুন, এত কোটি টাকা বলেই সব কিছু ভেবে কাজ করতে হয় আমাদের,” আইকা নিজের মেজাজটাকে খুব কষ্ট করে সামলে রেখেছিল।

তারক বলেছিল, “আমি আপনাকে স্পেশ্যাল পছন্দ করি বলে জানিয়ে রাখলাম এসব। আর বেশি কিন্তু লেট করবেন না। কেমন! মটকা আবার তাতছে আমার! রাখছি! আমি আর ফোনও করব না।”

ফোনটা কেটে মাথা নিচু করে বসেছিল আইকা। লোকটা কী সাংঘাতিক অসভ্য সেটাই ভাবছিল! ওকে কোন সাহসে বলে যে, ‘স্পেশ্যাল পছন্দ করে!’ আর মেয়েছেলে! এভাবে কেউ কোনওদিন ওর সঙ্গে কথা বলেনি! লোকটার স্পর্ধা দেখে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল ওর।

আইকা আর অপেক্ষা না করে উঠে সোজা রুপিনের ঘরের দিকে গিয়েছিল।

সবার আগে রুপিন অফিসে আসেন। এমনকী, ব্রেকফাস্টটাও অফিসেই করেন মানুষটা।

করিডর পেরিয়ে সোজা দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল আইকা। তারপর হাতল ধরে ঘুরিয়ে দরজা ঠেলে খুলে বলেছিল, “মে আই কাম ইন!” স্যার কথাটা ইচ্ছে করেই বাদ রেখেছিল আইকা।

রুপিন মাথা নিচু করে কিছু একটা পড়ছিলেন। ওর কথায় মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন। তারপর সামান্য হেসে বলেছিলেন, “কাম কাম। প্লিজ় হ্যাভ আ সিট। আমি তোমাকেই ডাকব ভাবছিলাম। আই নিড আনাদার ফেভার!”

আইকা কিছু শোনার মতো অবস্থায় ছিল না! ও সোজা গিয়ে টেবিলে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল।

রুপিন বুঝেছিলেন কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। বইটা ভাঁজ করে রেখে তাকিয়েছিলেন আইকার দিকে, “কী হয়েছে?”

“আমি স্যার চাকরি ছেড়ে দেব, আই ওয়ান্ট টু রিজ়াইন!” কোনও ভণিতা না করে আইকা সরাসরি বলেছিল কথাটা।

“আরে!” রুপিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, “হোয়াট হ্যাপেন্ড! এসব কী বলছ?”

“আমি স্যার অসম্মান নিয়ে চাকরি করতে পারব না। আমার যা প্রোফাইল, জব পেতে আমার অসুবিধে হবে না। আমি আর এখানে কাজ করতে পারব না।”

রুপিনের চেম্বারের এসিটা কুড়িতে করা থাকে। বেশ ঠান্ডাই লাগে অন্য সময়। কিন্তু আজ আইকার ঘাম দিচ্ছিল। মাথায় আসছিল না কিছু। শুধু পিন আটকে যাওয়া গ্রামোফোনের মতো ঘসঘস করে তারকের কথাগুলোই ঘুরেফিরে বাজছিল কানে। বুঝতে পারছিল না, ও চেঁচিয়ে কথা বলছে!

রুপিন চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে উঠে এসেছিলেন আইকার পাশে। তারপর আইকার সামনে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বলেছিলেন, “প্লিজ়, মাথা ঠান্ডা করো! এভাবে চিৎকার কোরো না। কী হয়েছে আমায় বলো।”

“আস্ক মি হোয়াট ডিডন্‌ট হ্যাপেন! আমি স্যার চাকরি করি বলে কেউ খারাপ কথা বলবে, সেটা আমায় সহ্য করতে হবে? যে-প্রজেক্টে আমি কাজ করছি সেখানে কী হচ্ছে, তার ইনফো আমার থেকে উইথহেল্ড করে রাখা হবে? এটা কেমন ওয়ার্ক কালচার! আমায় তারক চক্রবর্তী ফোনে ইনসাল্টিং কথাবার্তা বলছে কেন! আমি জানি না, কিন্তু রিসেন্টলি নাকি আপনি মালিকদের সঙ্গে গিয়ে নিজে কথা বলেছেন। আমায় প্রজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেখানে, আমি জানি না এসব হচ্ছে। একটা লুম্পেনের কাছ থেকে আমায় জানতে হচ্ছে! তার টিটকিরি শুনতে হচ্ছে! আই ওয়ান্ট টু কুইট।”

রুপিন নিজে সামনের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়েছিলেন এবার। তারপর আর-একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়েছিলেন আইকার দিকে।

“সিট।”

আইকা কথাগুলো এমন তোড়ের সঙ্গে বলেছিল যে, নিজেই হাঁপিয়ে গিয়েছিল। ও কথা না বাড়িয়ে চেয়ারটা টেনে বসে পড়েছিল।

রুপিন শান্ত গলায় বলেছিলেন, “আমি তোমার সিনিয়র। এভাবে কেউ সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলে! একে ইনসাবরডিনেশন বলে, জানো তো?”

“সরি স্যার, কিন্তু আমায় ফিল্ডে নেমে কাজ করতে হয়। আপনি জানেন, তারক চক্রবর্তীদের মতো গুনস‌্‌দের সঙ্গে কীভাবে কাজ করি? তারা আমায় বাজে কথা বলছে। তার কাছ থেকে জানছি, আপনি মালিকদের সঙ্গে একা কথা বলে এসেছেন।”

রুপিন মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কারণ, আই ওয়াজ় টোল্ড টু। আমাকেও ডাইরেক্টরদের জবাব দিতে হয়। আর তুমি তো বালির প্রজেক্টটা দেখছ আপাতত।”

“সোনাঝুরি আমার প্রজেক্ট। সেখান থেকে আমায় কি সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কেন আমায় জানানো হচ্ছে না? আমায় সাইড লাইন কেন করা হচ্ছে? এটা আমার কেরিয়ারকে সাবোটাজ করা নয়?”

“হোয়াট আর ইউ সেয়িং!” রুপিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন আইকার দিকে, “ডু ইউ বিলিভ আই, অফ অল পারসন, উইল ডু দ্যাট! সিরিয়াসলি!”

আইকা থমকে গিয়েছিল এবার।

রুপিন মাথা নিচু করে বসেছিলেন সামান্য সময়, তারপর বলেছিলেন, “সারা অফিস শুনল যে, ইউ আর শাউটিং অ্যাট মি!”

আইকা কিছু না বলে ভুরু কুঁচকে বসেছিল। তারকের কথাগুলো তখনও কানের মধ্যে ঘুরেফিরে বাজছিল ওর।

রুপিন বলেছিলেন, “এতদিন হয়ে গেল এই কাজে কোনও প্রগ্রেস নেই। আমাদের ফাইনান্সাররা ইন্টারেস্ট হারাচ্ছেন। চারদিকেই বিজ়নেসের অবস্থা ভাল নয়। সোনাঝুরি যাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে যে-ফ্লাইওভারটা করার কথা ছিল, সেটা ঝুলে আছে। হাফ ডান হয়ে পড়ে আছে। কবে হবে ঠিক নেই। এখানে এত দামি ফ্ল্যাট যে কিনবে, সে কি ওই ভাঙা রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করবে! লোকজনের ইন্টারেস্ট কমছে। তাই আমরা আবার রি-থিঙ্ক করছি। বাড়িঘর বানালেই তো হল না! তারপর ভূতের শহরের মতো ওটা পড়ে থাকবে। কেউ কিনবে না। সেটা কি ভাল হবে? বিজ়নেস ইজ় লাইক পলিটিক্স। এখানে কোনও ইন্টারেস্টই পারমানেন্ট নয়। সবটাই ক্রমাগত ইভ্যালুয়েট করতে হয়। ডায়নামিক্স পালটায় উইথ ইচ ডে। তার চেয়ে বালির দিকে আমাদের কাজটা হচ্ছে। কোন্নগরেও গঙ্গার ধারে আমরা অনেকটা জমি পেয়েছি। তাই আমরা ভাবছি।”

আইকা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, “এসব আমায় বলেননি কেন? আমার গোটা চেষ্টাটাই তো বৃথা হয়ে গেল! আমি তো এমনও বন্দোবস্ত করেছিলাম যে, অন্য কোম্পানি কী টাকা দিয়ে জায়গা কিনবে, মানে কত কোট করবে সেটাও জেনে নেব।”

“লিস্‌ন আইকা, লিস্‌ন, আমাদের ম্যানেজমেন্টে চেঞ্জ এসেছে, এটা তো জানো। আমি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম আমরা যে মিলটা ডেমলিশ করে বাড়ি করব, সেটা ওদের ভাল লাগছে না। প্লাস এখানকার পার্টির এক মাথা আমার সঙ্গে কথা বলেছে। রিতু না কী যেন নাম। আমাকে বলা হয়েছে, সরকার চায় না জুটমিল বন্ধ হয়ে যাক। সামনে ভোট আসছে। তাই গোটা ইকোয়েশনটাই পালটে গেছে। তারক যদি…”

কিন্তু এবার রুপিনকে থামিয়ে দিয়েছিল আইকা, “আপনি জানেন কী ভাষায় লোকটা কথা বলেছে! বলেছে, আমায় নাকি ওর পছন্দ তাই আমায় এসব বলছে! হি ইভন ইউজ়ড স্ল্যাং ওয়ার্ডস!”

“স্ল্যাং!” রুপিন মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন।

“আমি, আমি…” আইকার আচমকা জল এসে গিয়েছিল চোখে! তারকের বলা কথাগুলো সময়ের সঙ্গে যেন আরও কঠিন আর তীক্ষ্ণ হয়ে ফিরে এসেছিল ওর মনে। আইকা নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিল, ও কেন এমন কেঁদে ফেলল রুপিনের সামনে!

আইকা মাথা নিচু করে বসেছিল। কোলের ওপর টপটপ করে জল পড়ছিল ওর চোখ থেকে!

“আরে, কাঁদছ!” রুপিন কী করবেন যেন বুঝতে পারছিলেন না! তারপর নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আইকা সেটা না নিয়ে হাত দিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল, “সরি স্যার! আই লস্ট কন্ট্রোল। কিন্তু আপনি যদি চান, আমি রিজ়াইন করতে পারি!”

রুপিন বলেছিলেন, “তুমি নিজের ডেস্কে যাও। বালির কাজটা শেষ করো। আমি সোনাঝুরি নিয়ে হেড অফিসে কথা বলছি। দেখি, তারা শেষমেশ কী ডিসিশন নেয়। তবে একটাই কথা, যা পরিস্থিতি তাতে অন্য যারাই এতে ইনভেস্ট করবে, তাদের প্রফিট বের করতে মুশকিল হবে খুব! আর ওয়াশ ইয়োর আইজ়! কোহল স্মাজ করে গেছে!”

ঘর থেকে বেরিয়ে আইকা দেখেছিল, সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর এত লজ্জা লেগেছিল! মনে হচ্ছিল একটুও পালটায়নি ও। স্কুলেও এমন দুমদাম কাণ্ড করত!

আইকা নিজের সিটে না ফিরে লু-তে গিয়েছিল। আর হঠাৎ কোনও কারণ ছাড়াই মনে পড়েছিল স্কুলের ওই ঘটনাটায় পুশকিন কেমন কষ্ট পেয়েছিল!

পুশকিন! নামটা মনে পড়তেই কেমন একটা লেগেছিল আইকার! ওদের রিকো গ্রুপ-ও তো ওই প্রজেক্টে আছে! কিন্তু ওদের প্রপোজ়াল আলাদা। তবে এই নিয়ে পুশকিন বা নোঈর সঙ্গে কোনও কথা বলেনি আইকা। কারণ, সেটা তো এথিকাল নয়। কাজ কাজের জায়গায় আর নিজের সম্পর্ক নিজের জায়গায়।

“স্যারের ঘরে চিৎকার করলি, স্যার কিছু বলেননি?” দূর্বা তাকাল ওর দিকে।

আইকার অপ্রস্তুত লাগল। এর কী জবাব দেবে? ও যেটা করেছে সেটা ঠিক নয়। কিন্তু তখন এমন মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল! সকালে মায়ের সঙ্গে ঝামেলার পরে ও এমনিতেই খুব উত্তেজিত হয়েছিল, তাই তারকের কথাটা আর নিতে পারেনি। রুপিনের ঘরে গিয়ে অমন একটা সিন ক্রিয়েট করে ফেলেছে।

আইকা জানে রুপিন কিছুই বলেননি ওকে। বরং বোঝার চেষ্টা করেছেন কেন আইকা এমন করল। কিন্তু সেটা তো আর অন্য কলিগরা বুঝবে না! বরং সেটা জানলে নানা জলঘোলা হবে। রুপিনের অথরিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সেটা আইকা হতে দিতে পারে না।

ও বলল, “না, আমায় শো কজ় করেছেন। আসলে আমারই ভুল। তাই…”

দূর্বা চোখ বড়-বড় করে শুনল কথাটা। তারপর বলল, “দূর, তোকে কিছু বলবেন না।”

“কেন?” অবাক হয়ে তাকাল আইকা।

“ন্যাকা খুকু আমার! জানে না!” দূর্বা চোখ টিপে বলল, “মালটা তোর প্রেমে পড়ছে তো!”

“মাইরি… তুই না…” আইকা হেসে পাশে দাঁড়ানো ব্রতীনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এর সঙ্গে প্রেম করছ কী করে? আর বিয়েও করবে! মানুষ পায়ে কুড়ুল মারে! তুমি যে কুড়ুলে পা মেরে বসেছ!”

“এই, আমার বিয়েতে ভাংচি দিচ্ছিস কেন রে?” দূর্বা আলতো করে চিমটি কাটল আইকার হাতে।

আইকা আরও কিছু বলত, কিন্তু তার আগেই দেখল বড় কাচের দরজা ঠেলে মা বেরিয়ে এল এবার।

“কাকিমা!” দূর্বা এমন করে মায়ের দিকে দৌড়ে গেল, যেন কতদিন পরে হারানো কিছু ফিরে পেয়েছে!

আইকা দেখল ব্যাপারটা। আসলে এসব বোঝে ও। কেউ যখন খুব খুশি থাকে, তখন সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি রি-অ্যাকশন দিয়ে ফেলে।

মায়ের সামনে গিয়ে দূর্বা হাত ধরে টানল ব্রতীনকে। তারপর বলল, “কাকিমা, এই যে ব্রতীন। ওর সঙ্গেই…”

শূন্যস্থান বলে তো পৃথিবীতে কিছু থাকে না। তাই এটাও থাকল না। মা ঠিক বুঝে নিয়ে হাসল। ব্রতীন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে মা “থাক, থাক,” বলেও প্রণামটা নিল। তারপর মুখ তুলে তাকাল আইকার দিকে।

আইকা মায়ের তাকানোটা বোঝে। এটাও বুঝল। আর তখনই ওর মনে হল, ফিরোজকাকুর সঙ্গে কী নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করেছে মা।

মা দূর্বার সঙ্গে কথা বলল সামান্য। আইকার মনে হল মা খুব একটা কথা বলতে চাইছে না। অন্যের মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আইকা একা রয়ে গেল, সেটা কোথাও মাকে মনে মনে খারাপ লাগা দিচ্ছে।

দূর্বা কী বুঝল কে জানে। বলল, “ঠিক আছে রে, আমরা আসি। আসলে ভাবলাম, এখানেই যখন আছিস একবার ব্রতীনকে দেখিয়ে নিয়ে যাই। তাই তোকে ফোন করেছিলাম। আমি নেক্সট উইক নাগাদ তোদের ফ্ল্যাটে যাব নেমন্তন্ন করতে, কেমন!”

আইকা দেখল ব্রতীন বিশেষ কথাই বলল না। সারাক্ষণ দূর্বার পেছনে-পেছনে ঘুরে গেল। এমনকী, যাওয়ার সময়ও গুড বয়ের মতো দূর্বার পেছন-পেছন লিফটে করে নেমে গেল।

আইকা ভেবেছিল ওরাও একসঙ্গে যাবে, কিন্তু দেখল মা এগোচ্ছে না। অর্থাৎ মা ওদের সঙ্গে এক লিফটে নামতে চায় না।

“এবার চল,” মা এগিয়ে এসে দাঁড়াল আইকার সামনে।

“কী হয়েছে তোমার?” আইকা জিজ্ঞেস করল।

মা লিফটের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “হাঁটুর বয়সি ছেলেকে বিয়ে করছে! সেটা আবার নেচে-নেচে সবাইকে দেখাচ্ছে! বেহায়াপনার কোনও মানে হয়?”

“মা!” আইকা বিরক্ত হল। এসব কী বলছে মা!

মা কিছু না বলে লিফটের কল বাটনটা টিপল।

অক্টোবরের শেষ এখন। গরম খুব। আজকাল শহরে এত গরম পড়ে! আসলে এটাই স্বাভাবিক। এত পলিউশন! এত মানুষ! গরমের আর দোষ কী!

লবিতে বেশ গরম লাগছে। আইকা বুঝতে পারছে শরীরের ভাঁজে ঘাম জমা হচ্ছে। নীচে গিয়ে একটা গাড়ি ধরতে পারলে এখন বাঁচে। গাড়িটা আজ আনেনি। এখানে একটা বড় স্কুল আছে। ভিড় থাকে বেশ রাস্তায়। গাড়ি পার্ক করা খুব ঝামেলা।

লিফট দিয়ে নামতে-নামতে মা বলল, “তবে এলেম আছে মেয়েটার। তোর তো তাও নেই! কিন্তু তোকে ওর চেয়ে কত ভাল দেখতে! সেখানে তুই কিছুই করতে পারলি না। আজকাল বিধবাদের বিয়ে হয় যখন-তখন। সেখানে তুই গাধাই রয়ে গেলি।”

“মা, কী বলছ তুমি!”

মা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, “কেবলি একটা। একটা কিছু যদি পারিস!”

আইকা জানে কথাটা ঠিক নয়। বহু পুরুষ ওকে পছন্দ করে, ওর দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দেয় না। ঋষিকে যা একটু পাত্তা দিয়েছিল। কিন্তু এখন সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে।

বহুদিন পরে পুশকিনকে দেখে মনে একটা নরম ভাব এসেছিল ওর। কিন্তু ক্রমশ বুঝেছে যে, পুশকিন ওর সামনে এলেই কেমন আড়ষ্ট হয়ে যায়। কেমন যেন পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। ব্যাপারটায় বেশ অপমান হয়েছে আইকার। তাই আজকাল পুশকিনের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখে ও। আইকার কাছে সম্মানের চেয়ে বড় কিছু হয় না।

আইকা মোবাইলের অ্যাপ থেকে একটা গাড়ি ডেকে নিয়েছিল লিফট থেকে নামতে-নামতেই। নীচে নেমে গাড়িকে ফোন করে আইকা বলল ওরা কোথায় আছে।

রাস্তায় বেশ ভিড়। স্টুডেন্ট আর তাদের বাবা-মায়েরা ছানা কাটার মতো ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। কিন্তু বড় বাস দুটো আর নেই। বেরিয়ে গিয়েছে নিজের-নিজের স্টুডেন্ট তুলে নিয়ে।

মা কেমন একটা রাগী মুখ করে আছে। দূর্বাকে দেখার পর থেকেই মা কেমন যেন হয়ে গেছে। আইকা কথা বাড়াল না। আজ দিনটা ভাল নয়। সবার সঙ্গে ওর ঝামেলা লাগছে!

আইকা অ্যাপে দেখল, গাড়িটা প্রায় এসে গেছে দেখাচ্ছে। ও ডান দিকে তাকাল। আর দেখতে পেল গাড়িটাকে। সাদা একটা হাচব্যাক। গাড়িটা কাছে আসতেই হাত তুলে সেটাকে থামাল আইকা। তারপর দরজা খুলে মাকে উঠতে বলল। মা গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের পেছনে বসল। আইকা কাঁধের ব্যাগটাকে সিটের ওপর রেখে নিজেও এবার উঠতে গেল। কিন্তু আচমকা কী একটা চোখে পড়ায় থমকে গেল ও।

নোঈ না? আইকা একটু দূরে উলটো দিকের ফুটপাথে তাকাল। সত্যি তো! ওই তো নোঈ! লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। কী করছে ও? তারপর সামান্য দৃষ্টি ঘুরিয়ে গাড়িটা দেখতে পেল আইকা। নীল রঙের হাচব্যাক। টিন্টেড গ্লাস। দেখল, গাড়িটা পার্ক করে সেটা থেকে নামল পুশকিন। এখানে কাজে এসেছে ওরা।

আইকা থামল এক মুহূর্ত। নোঈরা ওকে দেখতে পাচ্ছে না। এদিকে ওদের খেয়ালই নেই। ও দেখল, নোঈ হাসছে খুব। পুশকিন কিছু বলছে আর নোঈ হাসছে। সামনে একটা রেস্তরাঁ। সেইদিকে এগোল ওরা দু’জনে। কিন্তু ঢুকল না। পুশকিন দাঁড়িয়ে গেল রেস্তরাঁর দরজার সামনে। আর নোঈ আচমকা এগিয়ে গিয়ে পুশকিনের গাল থেকে লেগে থাকা কিছু একটা সরিয়ে দিল!

এক মুহূর্ত। নোঈ আর পুশকিন কাছে এল এক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু ওইটুকু সময়ের জন্যই কী যে হল, বুঝতে পারল না আইকা। মনে হল সামান্য কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ তৈরি হল। আর তা ওই পার থেকে ছিটকে এসে গেঁথে ফেলল আইকাকে।

এভাবে পুশকিনের গালে হাত দিল কেন নোঈ? পুশকিন না ওর বস? তার সঙ্গে কী করে এমন করে নোঈ? আর পুশকিন সেটা হতে দিল? কেন? নোঈ কি ভুলে গেছে পুশকিনের সঙ্গে ওর কী করে আলাপ? ভুলে গেছে পুশকিন ওর চেয়ে কত বড়। চোয়াল শক্ত করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল আইকা। তারপর কেন কে জানে ওর হঠাৎ কষ্ট হল খুব। মনে হল মা ঠিক বলেছে। ও একটা কেবলি! ওর কেউ নেই। নিজের বলতে কিছু নেই। আইকার আচমকা মনে পড়ে গেল সকালের একটা কথা। আচ্ছা, রুপিন ওকে কেন খুঁজছিলেন? কীসের দরকার ছিল ওর সঙ্গে! ওর মনে হল রুপিনের কাছ থেকে ওর জানাই হল না রুপিন কী ব্যাপারে ওর সাহায্য চাইছিলেন। আচমকা রুপিনের মুখটা সামনে ভেসে উঠল আইকার। মনে হল জর্জ ক্লুনি তাকিয়ে রয়েছেন ওর দিকে! মনে পড়ল দূর্বার রুপিনকে নিয়ে বলা কথাটা। সত্যি আর মিথ্যেগুলো কেমন যেন গুলিয়ে গেল ওর। যেন বুঝতেই পারছে না কোনটা বিশ্বাস করবে আর কোনটা বিশ্বাস করবে না। গাড়ির কাচে নিজের মুখের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল আইকা। বিকেলের নরম হয়ে আসা আলোয় মনে হল, এই মেয়েটাকে ও আর চেনে না!

.

২৭. নিশান

নার্সিং হোমটা চার তলা, বড়। বেশ সাজানো-গোছানো। খুব আধুনিক দেখতে। নিশান গেটের সামনে এসে একটু থমকে দাঁড়াল। বিকেল চারটে থেকে ছ’টা অবধি ভিজ়িটিং আওয়ার্স। ও দেখল নীচের লবিতে বেশ ভিড়। আজ রবিবার। এই দিন বাচ্চাদেরও নিয়ে আসা যায়। কিছু কুচোকাঁচা নার্সিং হোমের লবিকে হোটেলের লবি ভেবে দৌড়োদৌড়ি করছে।

নিশান এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর দেখতে পেল মেয়েটাকে। ওই তো ফলসা বসে রয়েছে। কেয়াদির মেয়ে ফলসা। এখন বেঙ্গালুরুতে থাকে। মায়ের অপারেশন হয়েছে বলে এসেছে।

কেয়াদির দু’বার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দুটোই ভেঙে গেছে। প্রথম বিয়ে থেকে কোনও সন্তান হয়নি। ফলসা কেয়াদির দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে। ফলসার বাবার সঙ্গে সেভাবে আর যোগাযোগ নেই কেয়াদির। ভদ্রলোক এখন ফ্রান্সে থাকেন। সেখানে একজন আলজিরিয়ান মহিলাকে বিয়ে করেছেন।

ফলসাকে ভাল করেই চেনে নিশান। এখন নিয়মিত আর যোগাযোগ নেই। কিন্তু তাও দেখা হলে ভালই কথাবার্তা হয়।

নার্সিং হোমের লবিটার একটা দিক কাচের দেওয়াল দেওয়া। সেখানে কিছু সিট লাইন দিয়ে বসানো আছে। কোণের দিকে টবে রাখা একটা বড় পাতাবাহার গাছ। তার পাশের সিটে বসে রয়েছে ফলসা।

সামনে ছড়ানো মানুষদের কাটিয়ে ফলসার সামনে গিয়ে দাঁড়াল নিশান। মেয়েটা গত চারদিন আগে এসেছে এখানে। গত দু’দিন আগে কেয়াদির অপারেশন ছিল। ইউটেরাস বাদ গেছে। কেন, কী হয়েছে সেসব আর ডিটেলে শোনেনি নিশান। মেয়েদের ব্যাপার এসব, ও কী আর শুনবে!

“বাব্বা, এই তোর আসার সময় হল?” ফলসা চোখ বড় করে উঠে দাঁড়াল।

নিশান হাসল। বলল, “কেন, দেখা করার সময় তো এখনই।”

“সেটা মাকে গিয়ে বলিস। সকাল থেকে বলছে নিশান কই! ডাক্তার বলছেন বেশি কথা বলবেন না, কিন্তু জানিস তো মা কারও কথা শোনার পাত্রী নয়। সে ডাক্তারকেই ধমক-চমক দিয়ে একশা করে রাখছে! নার্সরা মায়ের জ্বালায় অস্থির হয়ে গেছে!”

নিশান হাসল। কেয়াদি কেমন সে ভাল করেই জানে। ওকেই কি কম বকুনি দেয়? দেখা হলেই শাসন!

ও জিজ্ঞেস করল, “এখন তো সাড়ে চারটে বাজে। তুই নীচে কেন?”

ফলসা হাসল। সামান্য লজ্জাও পেল যেন। বলল, “না মানে, আমার হবু শ্বশুর আর শাশুড়ি গেছেন ওপরে। মায়ের কাছে আছেন ওঁরা। প্লাস তুই আসবি। তাই আমি তোকে রিসিভ করতে নীচে আছি।”

“আমায় রিসিভ করতে?” নিশান হাসল, “মাইরি! তুই শিয়োর যে, তুই কেয়াদির মেয়ে!”

“মারব শালা! ওপরে চল,” ফলসা হাতের মুঠো পাকিয়ে বলল।

“দ্যাটস মোর লাইক ইট! তা, কতজন দেখা করতে পারে একসঙ্গে?”

“সেভাবে কিছু রেসট্রিকশন এখানে নেই। প্লাস কেবিন নেওয়া হয়েছে। তুই চল না!”

নিশান ঘড়ি দেখল। তারপর দরজার দিকে তাকাল। এখনও এল না তো! বলেছিল চলে আসবে। দেরি হচ্ছে কেন? একবার কি ফোন করবে? নাঃ, সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। নিজে থেকে এতটা উতলা হওয়া ওর মানায় না।

“আরে, আসবে আসবে, অত ভাবছিস কেন? আমাকেও ফোন করেছিল রাধিয়া। বলেছে আসতে একটু লেট হবে। কিন্তু আসবে। হাঁপিয়ে মরে যাস না!” ফলসা চোখ টিপল।

নিশান ভুরু কুঁচকে বলল, “তোর মা কিন্তু এখানে ভরতি। শরীর খারাপ। একটু সিরিয়াস হ ফলসা।”

“ইস, জ্ঞান দিচ্ছে! নিজে হেদিয়ে মরছে! আমি জানি না ভেবেছিস?”

“আমরা ভাল বন্ধু,” নিশান গম্ভীর গলায় বলল।

“ওইসব ঢপবাজি কাকু ‘সেভ সোনাঝুরি’-র লোকেদের দেবেন! আমরা ভাল বন্ধু!” ফলসা ওকে নকল করে বলল, “যেন বিরাট কোহলি! শালা মারব কানের গোড়ায়!”

“আরে! আর কনফিউশন নেই!” নিশান আশপাশে দেখল, “মা-মেয়ে পুরো সমান। বেঙ্গালুরুতে থাকিস কী করে! সেখানে থেকে তো একটুও উন্নতি হয়নি দেখছি তোর!”

“উনি আমার বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করবেন আর আমরা কিছু বললেই দোষ!” ফলসা আলতো করে মারল নিশানের হাতে।

নিশান হাসল। দেখল, আশপাশ থেকে কয়েকজন তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কেউ সামান্য হাসছে আবার কেউ খুব বিরক্ত মুখ করে বোঝাতে চাইছে এইসব করার জায়গা এটা নয়!

ফলসা কনুই দিয়ে আলতো করে মারল নিশানকে, “প্রপোজ় করেছিস?”

“ভাগ!” নিশান সামান্য লাল হয়ে গেল নিজের অজান্তেই। সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর! নিজেরই অবাক লাগল।

“এখনও বলিসনি? আমায় তো রাধিয়া বলে তোর কথা। তুই কত ভাল। কত হেল্‌পফুল! প্রথম থেকেই নাকি ওর মনে হয়েছে, তোকে সব কথা বলা যায়! এটসেট্রা এটসেট্রা। তাও তুই প্রপোজ় করিসনি? কেন?”

“আচ্ছা, আমি কেয়াদিকে দেখতে এসেছি। এখানে এসব কথা না বললেই নয়? কেয়াদি এমন অসুস্থ! সেখানে তুই কী শুরু করলি!” নিশান এবার সিরিয়াস গলায় বলল।

“মা অসুস্থ ছিল, আর নেই। অপারেশন ভাল হয়েছে। সেটা হিল হতে যা সময় নেবে। ব্যস, আর কিছু নয়। বুঝলি? এখন উত্তর দে।”

সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় দাঁড়াল নিশানরা। করিডর চলে গেছে দু’দিকে। সামনে একটা কাউন্টার। দু’জন নার্স বসে রয়েছে। পাশের লম্বা বেঞ্চে দু’জন ওয়ার্ড বয় বসে মোবাইল নিয়ে কীসব গুজগুজ করছে।

নিশান এদিক-ওদিক তাকাল। কোনদিকে যেতে হবে!

ফলসা নাছোড়বান্দা গলায় বলল, “কী রে বল! তারপর যাব। আগে বল, তুই এখনও কিছু বলিসনি কেন?”

নিশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভুলে গেছি বলতে! খুশি!”

“মারব এবার, বল!” ফলসা ঠোঁট কামড়ে হাত মুঠো করে ঘুসি পাকাল আবার!

নিশান বলল, “আমি বাস্তবের পৃথিবীতে থাকি ফলসা। ও মালিক গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র মেয়ে। আর আমি? আমার জীবন কেমন তুই জানিস না? আমাদের খাওয়া পরার অভাব নেই। কিন্তু আমরা তো মধ্যবিত্ত। সেখানে ওরা… এটা তো সিনেমা নয় রে বাবা! প্লাস আমার জীবন কেমন সেটা আমি জানি। ধরাবাঁধা কাজে আমি থাকি না। জানি আমাকে আমাদের ব্যাবসা দেখতে হবে একসময়। কিন্তু পাশাপাশি আমি মানুষের জন্য যে-কাজ করি, সেটাও তো করতে চাই। ওকে আমি কী বলব বল?”

“ওকে তোর ভাল লাগে সেটা বলবি!”

“পাগল নাকি! তারপর না করে দিক! তখন তো যোগাযোগটাও যাবে!”

“ও না করবে না,” ফলসা এমন করে বলল, নিশানের মনে হল গড়িয়াহাটে বোধহয় জ্যোতিষের চেম্বার খুলেছে মেয়েটা।

“তোকে বলেছে?” নিশান হাসল।

“সব কিছু বলতে হয় না। আমি নিজে মেয়ে না? আমি বুঝি!”

নিশান ভুরু কুঁচকে বলল, “তুই মেয়ে? শিয়োর জানিস?”

“শালা, চল!” ফলসা এবার নিশানকে ধাক্কা দিয়ে ডান দিকের করিডরে এগিয়ে গেল নিজে।

মোটামুটি চওড়া করিডর। দু’পাশে ঘর। মাথার ওপর নরম আলো। মেঝেও ঝকঝক করছে। নরম মাখনরঙা দেওয়াল। এদিকটা যে কেবিন, বুঝতে পারল নিশান। ফলসা গিয়ে থামল একদম শেষের ঘরটায়। করিডরটা সেখান থেকে ডান দিকে বেঁকে গেছে। অপারেশন থিয়েটার ওইদিকে। সামনে ঝোলানো সাইনবোর্ড দেখে বুঝল নিশান।

কেবিনের ভেতরে সোজা ঢুকে গেল ফলসা। কিন্তু নিশান একটু ইতস্তত করল। ভেতরে দু’জন বয়স্ক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, এবার তাঁরা বেরিয়ে যাবেন। নিশানের মনে হল, এটা কেয়াদিদের খুব ব্যক্তিগত একটা মুহূর্ত। ওর বোধহয় একটু বাইরেই থাকা উচিত!

“তুই ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? কাছে আয়!”

কেয়াদির গলাটা ক্লান্ত লাগলেও দাপট যে একই রকম আছে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না নিশানের। ও হেসে এবার ঘরে ঢুকল।

ঘরটা বেশ বড়। একপাশের দেওয়ালের গোটাটা জুড়েই জানলা। তাতে লম্বা ব্লাইন্ডস লাগানো। জানলা থেকে বিছানার মাঝখানেও বেশ কিছুটা ফাঁক। সেখানে চার জন বসতে পারে এমন সোফা রাখা আছে। বিছানার এদিকেও দুটো চামড়ায় বাঁধানো টুল রয়েছে। নিশান গিয়ে সোফায় বসল।

কেয়াদি বয়স্ক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “ও খুব ভাল ছেলে। এই সময়ে সবাই যখন নিজের কেরিয়ার আর নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, তখন নিজের কথা না ভেবে ও মানুষের জন্য কাজ করে।”

ভদ্রলোক কী বুঝলেন কে জানে। খুব গদগদ হয়ে এসে নিশানের হাত ধরে ঝাঁকালেন! বললেন, “আমার ছেলেও তো তাই করে। মানুষের হয়ে কাজ করে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার!”

নিশান কী বলবে বুঝতে পারল না।

ভদ্রলোক এবার কেয়াদির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা তা হলে আসি। আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। কেমন?”

কেয়াদি মাথা নাড়ল শুধু। ভদ্রমহিলা ফলসার মাথায় হাত বুলিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর দু’জনে একসঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

নিশান বলল, “ফলসা, তুই গেলি না ওঁদের সঙ্গে? একটু এগিয়ে দিতিস।”

ফলসা বলল, “কেন? আমার বাড়িতে এসেছিল নাকি ওরা? মাকে দেখতে এসেছে। নিজেরাই ঠিক বেরিয়ে যাবে।”

কেয়াদির খাটটা ভেঙে আধশোয়া করা আছে। কেয়াদিকে সারাক্ষণ মেক আপ করা অবস্থায় দেখেছে নিশান। এখন কেমন যেন লাগছে। বয়সটা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে!

কেয়াদি বলল, “তুই কী দেখে এই ফ্যামিলির ছেলেকে বিয়ে করবি ভাবলি রে ফলসা! এসে থেকে সারাক্ষণ টাকার কথা বলে গেল। যেন আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে! এত টাকার গরম কেন! এসব তো ছোটলোক আর হাড়হাভাতেদের থাকে!”

ফলসা বলল, “মা, প্রণীত এমন নয়। তুমি ওকে দেখলে বুঝতে পারতে। সিঙ্গাপুর থেকে নেক্সট মান্থে তো আসছে। দেখবে।”

কেয়াদি মাথা নেড়ে নিশানের দিকে তাকাল, “তুই আজ এলি! আগে এলি না কেন রে? অপারেশন টেবিলে যদি মরে যেতাম তা হলে? আর তো দেখা হত না। আজ এসেছিস কেন?”

“কেয়াদি তুমি এমন কথা বোলো না! আসলে কাল আমাদের একটা ডেমনস্ট্রেশন ছিল। মিছিল। অবস্থান। সেই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম!”

কেয়াদি ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, “ও বাবা, তুই সত্যি এসব করছিস এখনও!”

নিশান সোজা হয়ে বসল, “হ্যাঁ, কেয়াদি। তুমি-আমি মিলেই তো সব শুরু করেছিলাম। তুমি শরীর খারাপের জন্য সরে গেলে। কিন্তু আমাকে তো করতেই হবে। উপায় কী বলো? গরিব লোকগুলোর হয়ে কে কথা বলবে? ওদের বাড়ি, দোকান সব ভেঙে দেবে। মিল বন্ধ করে দেবে। ওরা যাবে কোথায়? কলকাতার ফুটপাথে? যেখানে অলরেডি কয়েকহাজার লোক এসে বসে পড়েছে! ওদের কথা কে বলবে কেয়াদি?”

কেয়াদি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। বিকেলের নরম, সুখী কলকাতা। শীত আসার আগের অভিমানী কলকাতা। নিশান দেখল, হঠাৎ যেন কেয়াদি নেই এখানে! যেন চলে গেছে অন্য কোথাও!

নিশান অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, “কী হল কেয়াদি?”

কেয়াদি কেমন একটা আবছা গলায় বলল, “আমি তখন অনেক ছোট, জানিস। এত কিছু বুঝি না। কিন্তু বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম ফ্যাক্টরি গেটে। এমনি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কাজুদা কথা বলছিল বলে বাবা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আমি সাইকেলের সামনে বসে শুনছিলাম। এরকমই বলত কাজুদা। আর সবাই শুনত। কী সুন্দর দেখতে ছিল! মাথাভরতি কোঁকড়া চুল। হালকা দাড়ি। আমার শরীরে তখনও নারীভাব আসেনি, কিন্তু তাও কেমন একটা ভাললাগা আসত!”

“কাজুদা কে কেয়াদি? অনেকে নাম বলে। কিন্তু আর কিছু বলে না!” নিশান অবাক হল।

কেয়াদি আচমকা আবার ফিরে এল এই নার্সিং হোমের কেবিনে। বলল, “তা, মালিকদের সঙ্গে কথা হল? পেখমদির ছেলের সঙ্গে?”

নিশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর মনে পড়ে গেল সেই বৃষ্টির দিনের কথা। মণীশের কথা শুনে ঠিক পৌঁছে গিয়েছিল নিশান।

তারকের সঙ্গে কথা বলে সুপ্রতীক সবে নিজের গাড়িতে উঠেছিল। তুখোড় বৃষ্টির ভেতরেও দূর থেকে সেটা দেখেছিল নিশান। এবড়োখেবড়ো রাস্তার পরোয়া না করে ও সাইকেল চালিয়ে দিয়েছিল জোরে। তারপর একদম বড় গাড়িটার সামনে তেরছা করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সাইকেলটা।

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করেও থতমত খেয়ে আবার বন্ধ করে দিয়েছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সুপ্রতীক জানলার কাচ নামিয়ে চিৎকার করে বলেছিল, “মরার ইচ্ছে হয়েছে? গাধা!”

সাইকেলটা কোনওমতে স্ট্যান্ড করিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল নিশান। তারপর মুখের জল হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে বলেছিল, “আমার আপনার সঙ্গে খুব জরুরি দরকার আছে!”

“আমার সঙ্গে?” সুপ্রতীক অবাক হয়ে গিয়েছিল এবার।

নিশান বলেছিল, “আমি ‘সেভ সোনাঝুরি’ থেকে আসছি। আপনারা এভাবে সব কিছু বিক্রি করে সোনাঝুরিকে ধ্বংস করতে পারেন না! এটা অন্যায়! হাজার-হাজার মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে এতে। আপনাদের মূলধন আছে বটে, কিন্তু এত মানুষের সহযোগিতা ছাড়া আজ আপনারা এই জায়গায় পৌঁছতে পারতেন না। সেখানে তাদের সব কিছু এভাবে শেষ করে দিচ্ছেন কোন অধিকারে?”

“বাপ রে!” সুপ্রতীক হেসেছিল নিশানের কথা শুনে, “এই বৃষ্টিতে এভাবে কেউ আসে? এটা কি ভাই সিনেমা নাকি? সাউথের ফিল্ম দ্যাখো বুঝি খুব! এটা কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেটানোর কাজ? ঠিক আছে। আমি কথা শুনব। মিট মি। একদিন এসো আমাদের কাছে, অফিসে। সোনাঝুরি আমারও খুব প্রিয়। আমার মা এখানকারই মেয়ে। তুমি এসো। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজো না। ঠান্ডা লেগে যাবে। কেমন?”

নিশান রাগ করতে চাইছিল। কিন্তু সুপ্রতীক এমন করে কথা বলছিল যে, বুঝতে পারছিল না কী করবে। রাধিয়ার কথার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না মানুষটাকে।

সুপ্রতীক বলেছিল, “আমিও এভাবে বিক্রির বিপক্ষে। কিন্তু… যাক গে। তুমি এসো একদিন। আমার কার্ড রাখো। অফিসে এসে বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাও। কেমন?”

নিশান ভেজা কার্ড হাতে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়েছিল। কী ভেবে এসেছিল আর কী হল! লোকটাকে খুব করে বলবে বলে যে সারাটা পথ রিহার্সাল দিয়ে এল তার সবটাই মাঠে মারা গেল যে!

কিন্তু সেই ঘটনার পরে বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। দু’বার ওদের অফিসে গিয়েছে নিশান। কিন্তু সেখানে সুপ্রতীকের দেখা পায়নি। বারবার ওকে ফিরে আসতে হয়েছে।

“কী রে, চুপ করে কেন, কী হয়েছে বল!” কেয়াদি জিজ্ঞেস করল।

নিশান বলল, “তোমায় তো বলেছিলাম আগে। ভুলে গেছ? আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাজের কথা হয়নি। তাই আমি আর ওয়েট করছি না। গতকাল থেকে ফুল ফ্লেজেড ডেমনস্ট্রেশন শুরু করেছি। আর রেয়াত নেই!”

কেয়াদি হাত বাড়াল। পাশেই একটা বে়ডসাইড টেবিল। সেখানে একটা ক্রিম রাখা আছে।

ফলসা এগিয়ে গিয়ে ক্রিমটা নিল। তারপর কেয়াদির মুখে মাখিয়ে দিল সময় নিয়ে।

বাঁ হাতে স্যালাইন চলছে। হাতটা বেশ ফুলে আছে। কেয়াদির যে কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে নিশান। কিন্তু তাও কেয়াদি কথা বলেই চলেছে।

কেয়াদি বলল, “যা করবি, বুঝে করবি। কেমন? আন্দোলন মানুষের কাজের জন্য। নিজের রোম্যান্স ফুলফিল করার জন্য নয়।”

নিশান ভাবল বলে আন্দোলন ওর কাছে নিছক রোম্যান্স নয়। কিন্তু তার আগেই পকেটের মোবাইলটা নড়ে উঠল। নার্সিং হোমে এসেছে বলে ও রিংটোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল!

“হ্যালো, বলো। হ্যাঁ, উপরে চলে এসো। করিডর… হ্যাঁ, ডান দিকের… লাস্ট কেবিন। এসো।”

“কে আসছে রে?” কেয়াদি ভুরু কুঁচকে তাকাল।

“আসছে একজন!” নিশান মুচকি হাসল।

“রাধিয়া?” ফলসা ভুরু নাচিয়ে হাসল।

“তোর এক ভাঙা রেকর্ড! দেখ না কে আসছে।”

নিশানের কথা শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরে দরজায় শব্দ হল একটা।

“এসো,” নিশান যেহেতু দরজার দিকে তাকিয়ে বসেছিল, ও দেখতে পেল মানুষটাকে। ফলসা পেছনে ফিরল আর কেয়াদি বাঁ দিকে তাকাল। আর তাকিয়েই কেয়াদি কেমন যেন স্থির হয়ে গেল।

নিশান হেসে উঠে গিয়ে হাত ধরল মানুষটার। বলল, “এসো বিজনদা।”

বিজনদা খুব সংকুচিত হয়ে দাঁড়াল একপাশে। একমুখ দাড়ি। ঢোলা পাজামা। রংচটা কুসুমরঙের পাঞ্জাবি। পায়ে রাবারের একটা চটি। পাকা চুলগুলো এলোমেলো!

ফলসা বুঝতে পারল না কে লোকটা। ও তাকিয়ে রইল।

কেয়াদি নিজের অবাক হয়ে যাওয়া ভাবটা কাটিয়ে এবার কড়া গলায় বলল, “এ কী! তুমি? এখানে কী করছ?”

বিজনদা হাসল। তারপর স্বভাবগত দ্বিধা নিয়ে বলল, “না মানে, নিশানের কাছে শুনলাম তোমার অপারেশন হয়েছে। তাই…”

“আমি কি চিড়িয়াখানার জিনিস নাকি?” কেয়াদি রাগে গরগর করছে একদম।

বিজনদাকে একটা টুল এগিয়ে দিল ফলসা। ও বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে!

কেয়াদি বলল, “খবরদার বসবে না তুমি। বেরিয়ে যাও।”

বিজনদা হাসল, “আরে, সে তো যাব। কিন্তু আছ কেমন?”

“তাতে তোমার কী?” কেয়াদি চোখ পাকাল।

বিজনদা এবার ফলসার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমার মায়ের পুরনো শত্রু। তাই আমায় দেখে এমন করছে। তা, তোমার মা নিয়ম মানছে তো?”

ফলসা হাসল, “নিয়ম? মা কি কারও কথা শোনে?”

বিজন এবার এগিয়ে গেল কেয়াদির দিকে। তারপর পকেট থেকে একটা ছোট বই বের করে রাখল সামনে। বলল, “এই যে বিনয় মজুমদারের কবিতার বই। তুমি পড়তে ভালবাসতে। আর কী আনব বুঝতে পারলাম না।”

কেয়াদি মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। নিশান দেখল কেয়াদির মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। ও বুঝল এখানে আর ওর বা ফলসার থাকা ঠিক হবে না!

নিশান উঠে দাঁড়িয়ে ফলসাকে বলল, “চল তো বাইরে একটু। কেয়াদিরা কথা বলুক।”

ফলসা বুঝল যে, কিছু একটা ব্যাপার আছে। ও আর দ্বিধা করল না। অবাক হয়ে একবার দেখল দু’জনকে, তারপর বেরিয়ে এল।

নিশান ঘরের বাইরে যেতে যেতে শুনল কেয়াদি বলছে, “সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসতে পারছ না!”

বিজনদা বলল, “তুমি যে বেরিয়ে যেতে বললে!”

“আমি কিছু বললেই সেটা শুনতে হবে? তোমার নিজের বিবেচনা নেই? সারা জীবন এমন থাকবে? আমি একবার না করেছিলাম বলেই…”

ঘরের বাইরে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল নিশান।

ফলসা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নিশানের দিকে। তারপর ওর মুখে আস্তে-আস্তে ফুটে উঠল হাসি। বলল, “ও আচ্ছা। এই বিজন… মায়ের ফরেস্ট গাম্প!”

নিশান হাসল। কী বলবে বুঝতে পারল না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে ভাল লাগল যে, ফলসা ব্যাপারটা স্পোর্টিংলি নিয়েছে। এই নিয়ে কোনও বাঁকা কথা বলেনি। বিজনদাকে দেখলে তো আর কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। কিন্তু কেয়াদি ওইটুকু সময়ের মধ্যে এমন করল যে, ফলসা বুঝতে পেরে গিয়েছে।

নিশান বলল, “প্রেম বেকার জিনিস রে ফলসা। তুইও কেন যে প্রেমে পড়লি!”

“ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার গুরু, না পড়ে উপায় আছে?” ফলসা হাসল।

নিশান চোখ বড়-বড় করল।

ফলসা বলল, “দেখ ভাই, আমার সোজা কথা। শুধু প্রেম মারিয়ে জীবন যাবে না। মাল্লু চাই মাল্লু। ম্যাক্সিমাম মেয়েরই তাই। দেখবি, এমনি সাধারণ ভাল ভদ্র ছেলেদের মেয়েরা দয়ার পাত্রর মতো ট্রিট করে। কিন্তু অনেক টাকা, ভাল চাকরি, বড় গাড়ি থাক, মেয়েরা ঠিক সব ঝামেলা সহ্য করে নিয়ে তার সঙ্গে মানিয়ে চলবে!”

“ভাগ, কী বাজে কথা! একটা মেয়ে হয়ে এসব বলছিস তুই?” নিশান অবাক হল।

“আমি জানি তাই বললাম। সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনে দেখবি। ম্যাক্সিমাম মেয়েরা এমন। সবাই নয়। কিন্তু ম্যাক্সিমাম। ভাল ভদ্র ছেলে হলে হবে না। আরও চাই আমাদের। সবাই আমরা মনে মনে এলিজাবেথ বেনেট। ডারসিকে দেখে লিজি যতটা না প্রেমে পড়েছিল, সেই প্রেম আরও দশগুণ হয়ে উঠেছিল পেম্বারলির সেই সম্পত্তি দেখে! সেই নাইটিন্থ সেঞ্চুরিতে লিখে গিয়েছিলেন জেন অস্টেন, অবস্থা কিচ্ছু পালটায়নি খোকা!” ফলসা হি হি করে হাসল, “মা এই বিজন লোকটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিল কেন? বিশাল রেস্তদার বাপের ছেলে হলে তাড়াত? তাড়াত না! এখন অভিমান দেখাচ্ছে! হাউ কনভিনিয়েন্ট! আর দেখবি, তোর বিজনদাও সেটা গিলে নেবে। গলে যাবে। শোন, আমরা মেয়েরা অনেক প্র্যাকটিক্যাল। তোদের মতো অমন মূর্খ নই। আমরা চাইল্ড বিয়ার করি! আমাদের সফটওয়্যারটাই এমন হয় যে, মেটকে সব দিক থেকে এব্‌ল হতে হবে। না হলে বেবি সামলাবে কী করে? শুধু প্রেমের খঞ্জনি বাজালেই হবে? জীবন কি হাওয়ায় চলবে?”

নিশান মাথা নেড়ে বলল, “পরের বার ‘সেভ সোনাঝুরি’-র যে-মিটিংটা আছে সেটাতে তুই কিছু বলবি?”

কিছু বলার আগেই এবার ফলসার মোবাইলটা বাজল। মোবাইলটা বের করে নামটা দেখে সেটা নিশানের দিকে ফেরাল ফলসা। তারপর ভুরু নাচিয়ে হাসল। নিশান দেখল কলারের নাম। রাধিয়া!

“হ্যাঁ রে, বল। ও আচ্ছা। না, না, ঠিক আছে, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি… না, না, ইটস ওকে। আরে বাবা, ঠিক আছে! কোনও প্রবলেম নেই। রাখলাম রে,” ফোনটা কেটে ফলসা ভুরু কুঁচকে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

“কী হল রে?” নিশান অবাক হল।

“তোকে রাধিয়া নীচে ডাকছে। গলাটা বেশ টেনস‌্‌ড লাগছে ওর। বলল, আজ আসতে পারবে না। কীসব কাজ আছে। খুব জরুরি। তোকে একবার নীচে ডেকেছে। গাড়িতে ওয়েট করছে ও। পাঁচ মিনিটের জন্য ডেকেছে। যা দেখা করে আয়।”

নিশানের অবাক লাগল খুব। এ আবার কেমনতরো কথা! এখানে আসার কথা ছিল কিন্তু আসবে না! নীচে এসেও গাড়ি থেকে নামবে না! কী হয়েছে? বিপদ হল নাকি কিছু?

নিশান আর সময় নষ্ট না করে নীচে নেমে এল।

রোদ নেই আর এখন। বরং একটা মনমরা আলো ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। নীচের লবিতে ভিড় বেড়েছে আরও। বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখে মনে হচ্ছে কোনও স্কুলের অনুষ্ঠান হচ্ছে!

ও যতটা সম্ভব দ্রুত মানুষজন কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আর বেরিয়েই থমকে গেল একদম। আরে, সেই বড় গাড়িটা! সুপ্রতীক মালিকের গাড়ি! রাধিয়া কি আজ এটা করে এসেছে?

ও দ্বিধার সঙ্গে গাড়ির দিকে এগোল। দেখল, ওকে দেখেই হয়তো রাধিয়া গাড়ির দরজা খুলে নামল। অন্যদিন রাধিয়া ওকে দেখে হাসে। আজ কিন্তু মুখটা বেশ সিরিয়াস। কিছুটা ভীতও!

নিশান এগিয়ে গিয়ে রাধিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গেল। কিন্তু তার আগেই রাধিয়া চোখের ইশারায় গাড়ির মধ্যে দেখাল। নিশান তাকাল। কে আছে গাড়িতে। ও সামান্য ঝুঁকে গাড়ির ভেতরটা দেখল এবার। আর চমকে উঠল সঙ্গে-সঙ্গে। দেখল, গাড়ির মধ্যে বসে রয়েছে সুপ্রতীক মালিক!

“কাম কাম! কাম ইনসাইড! সামনের সিটে বোসো…” সুপ্রতীক নিশানকে হাত দিয়ে দেখাল।

নিশান ঘুরে গিয়ে সামনের সিটে উঠল। দেখল, ও ওঠামাত্র ড্রাইভারটি নেমে গেল গাড়ি থেকে। বুঝল, এদের সব কিছু বলা থাকে! রাধিয়াও পেছনের সিটে নিজের বাবার পাশে গিয়ে বসেছে।

সুপ্রতীক হাসল নিশানকে দেখে। তারপর রাধিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আই ওয়াজ় আমেজ়ড টু নো দ্যাট ইউ টু আর ফ্রেন্ডস! দারুণ ব্যাপার! আমি আজ আচমকা জানলাম ব্যাপারটা। তুমি আগে বলোনি কেন যে, আমার মেয়েকে চেনো!”

নিশান ভাল করে দেখল সুপ্রতীকের মুখটা। কী বলতে চাইছে মানুষটা? এইসব কথার পেছনে অভিসন্ধি কী? ও দেখল, রাধিয়া মাথা নামিয়ে বসে রয়েছে!

সুপ্রতিক হাসল, “যাক, ভালই হল এটা। রাধির ফ্রেন্ড মানে সে আমার কাছেও স্পেশ্যাল!”

নিশান হাসার চেষ্টা করল। রাধিয়া এই লোকটা সম্বন্ধে ওকে বলেছিল কিছু কথা। নিশান নিজে বলেছিল খবর নিয়ে জানাবে। কিন্তু ও যা জেনেছে, সেটা এখনও রাধিয়াকে বলতে পারেনি। কীভাবে যে বলবে, সেটাই বুঝতে পারছে না। আর আজ সেই লোকটার সামনেই এসে পড়েছে।

সুপ্রতীক বলল, “সেদিন তো অনেক কথা বলছিলে, আজ এত চুপ কেন? তুমি তো আমার কাছে এলে না!”

নিশান নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করল মনে মনে। বলল, “আমি কিন্তু গিয়েছিলাম। একবার না, দু’বার। কিন্তু আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। আমাকে বলা হয়েছিল, আপনি নাকি দেখা করতে চাননি!”

“আমি? চাইনি?” সুপ্রতীক আকাশ থেকে পড়ল যেন। একবার রাধিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল, “কী বলছে রে! আমার অফিস থেকে এমন বলল! স্ট্রেঞ্জ!”

নিশান কিছু না বলে সামান্য হাসল।

সুপ্রতীক বলল, “আর সেই রাগে তুমি কাল মিছিল-মিটিং করলে!”

নিশান অবাক হল না। এটা তো জানবেই সুপ্রতীক। কাল জমায়েত হয়েছিল ভাল। সোনাঝুরির মানুষজন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই যোগ দিয়েছিল মিছিলে। খবরটা যে সুপ্রতীকের কানে পৌঁছবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সুপ্রতীক আবার বলল, “আচ্ছা, যা হয়েছে ভুলে যাও। তারক আমায় বলল, তোমায় নাকি শিক্ষা দেবে। কিন্তু আমি ওকে বলে দেব তোমায় যেন কিছু না করে। আমার মেয়ের বন্ধু তুমি। আমার বাড়ির লোকই তো হলে প্রায়। তাই আমি যেমন তোমার দিকটা দেখছি, তুমিও আমার কাছের লোক হিসেবে আমার দিকটা দেখবে নিশ্চয়! দ্যাখো, এইসব মিটিং, মিছিল, ডেমনস্ট্রেশন ব্যাড প্রেস অ্যাট্রাক্ট করে। আমরা একটা বিরাট ভেঞ্চার নিচ্ছি। সেখানে প্রেস নেগেটিভ লিখলে কেউ কি আর আসবে এখানে? তাই আমি তোমায় বলছি, এসব কোরো না। আমার মেয়ের বন্ধু তুমি। আমার একটা দায়িত্ব আছে তোমার প্রতি। তাই তুমি এসব থামিয়ে দাও। আমি তোমায় দেখব। ভালভাবে দেখব। কেমন?”

নিশান কী বলবে বুঝতে পারল না। ওকে দেখবে মানে?

সুপ্রতীক আবার বলল, “আমাদের বাড়িতে এসো। রাধিয়া হ্যাজ় সো লিট্‌ল ফ্রেন্ডস। জীবনে বন্ধু খুব দরকার মাই ডিয়ার! আমাকেও বন্ধু করে নাও, দেখবে দারুণ হবে! শুধু আমার ব্যাপারটা একটু ভাবো। ওভাবে লোক জুটিয়ে হুজ্জুতি কোরো না। কেমন?”

নিশান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে থাকল। দেখল, রাধিয়া মুখ নামিয়ে বসে আছে। ফরসা মেয়েটা লাল হয়ে গেছে লজ্জায়!

“তো, সেই কথাই রইল। তোমার পাওনা তুমি পেয়ে যাবে। কেমন? আর, একদিন লাঞ্চ করো আমাদের সঙ্গে। ওকে! ঠিক আছে? এখন এসো। আমাদের যেতে হবে!” সুপ্রতীক ঝুঁকে পড়ে গাড়ির দরজাটা খুলে দিল।

নিশান নেমে গেল গাড়ি থেকে। ড্রাইভারটি গাড়িতে উঠে পড়ল আবার। স্টার্টও দিয়ে দিল। নিশান কী বলবে বুঝতে পারল না। সারা শরীরের রক্ত যেন ফুটছে ওর! ওকে কিনতে চাইছে লোকটা! এত টাকার গরম হয়ে গিয়েছে! মানুষকে আর মানুষই মনে করছে না! ওর মনে হল রাস্তা থেকে একটা আধলা ইট তুলে গাড়িটার পেছনের কাচে ছুড়ে মারে!

কিন্তু কিছু না করে নিশান গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। দেখল, গাড়িটা গড়িয়ে চলে যাচ্ছে সামনের দিকে। আর জানলার কাচ নামিয়ে মাথা বের করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে রাধিয়া। নিশান দেখল, বিকেলের শেষ আলোর মধ্যে মোমবাতির শিখার মতো রাধিয়ার মুখে টলটল করছে লজ্জা আর কষ্ট।

.

২৮. পেখম

আর দু’সপ্তাহ, মাত্র দু’সপ্তাহ! তার মধ্যেই বিয়ে হয়ে যাবে ওর! এই ঘর, এই বাড়ি, বাড়ির সামনের রাস্তা, বড় পুকুর, বাঁশবন, আর পেছনের ওই ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জোনাকিদের ছেড়ে ওকে চলে যেতে হবে। কেন হবে? কীসের জন্য হবে? কে এই সুজিত মালিক? কবে দেখল ওকে? কোথা থেকে দেখল? এই কি রাহুর দৃষ্টি? ওর গোটা জীবনকে কেন গ্রাস করে নিল এইভাবে? কী অপরাধ করেছে ও?

ঘুমোতে পারে না পেখম! খেতে পারে না! এক অদ্ভুত বিষাদ ঘন মেঘের মতো ঝুলে থাকে মনের ওপরে! কিছু ভাল লাগে না ওর। কেউ সাহায্য করার নেই ওকে। মা নয়, ঠাকুরদা নয়, এমনকী বাবাও নয়।

বাবাও কেমন যেন চুপ করে গেছে আজকাল। বাবাকে সবচেয়ে ভালবাসে পেখম। কিন্তু সেই মানুষটা যে এমন চুপ করে যাবে, সেটা ভাবতে পারেনি ও।

শাড়ির আঁচলটাকে চেপে ধরে সামনের দিকে এগোতে লাগল পেখম। সন্ধে নেমেছে সবে। তবে হাওয়া দিচ্ছে খুব। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সারাক্ষণ। যেন আজ সব কিছু এলোমেলো করে দেবে এই হাওয়া!

পাড়ার ভেতরের রাস্তাটা ইটের। মাঝে মাঝে ভাঙা। তাড়াতাড়ি হাঁটা খুব অসুবিধের। কিন্তু তাও যতটা সম্ভব দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করল পেখম। ন’টার আগে বাড়ি ফিরতে হবে ওকে। মা আজ মিতুকাকিমার সঙ্গে পাঠ শুনতে গিয়েছে। বাবাকে অনেক করে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে নয়নার কাছে যাবে বলে। ন’টার মধ্যে না ফিরতে পারলে মা আস্ত রাখবে না। বাবা বারবার এটাই বলছিল ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়।

পেখম আহত হয়ে তাকিয়েছিল বাবার দিকে। এভাবে কেন বাবা গুটিয়ে যাচ্ছে মায়ের সামনে? যে-বাবা ওকে আগলে রাখত, সে কী করে সরে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে!

পেখম বলেছিল, “বাবা, তুমি এমন করে বলছ? আমায় আর একটুও ভালবাসো না, না?”

বাবা চেয়ারে বসে একটা কাগজ দেখছিল। ওর কথায় অসহায়ের মতো মুখ করে তাকিয়েছিল। বলেছিল, “কেন রে মা? এমন বলছিস কেন?”

পেখম তাকিয়েছিল বাবার দিকে। ঘরের বাল্‌ব জ্বলছিল। তার আলোয় বাবাকে কেমন তামাটে আর ভেঙে পড়া লাগছিল। যেন বাবা আর পারছে না এই জীবন বইতে!

পেখম বলেছিল, “আমার সঙ্গে যা হচ্ছে, তা তুমি মেনে নিচ্ছ কী করে বাবা?”

বাবা বলেছিল, “কী হচ্ছে মা? আমি সাধারণ একজন কর্মচারী। কত টাকাই-বা পাই বল! সেখানে এমন বাড়ি থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে, আমি না বলব কোন সাহসে? আমি কি এত ভাল ঘরে তোর বিয়ে দিতে পারব কোনওদিন?”

“আমি তো তা চাইনি বাবা,” পেখমের গলায় অভিমান জমা হয়ে উঠছিল, “আমি কি বলেছি কোনওদিন আমায় বড়লোক বাড়িতে বিয়ে দাও?”

“কিন্তু আমি তো জানি রে মা,” বাবা মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল, “সারা জীবন তুই কিছু চাসনি বলেই তো আমার আরও খারাপ লেগেছে। আমি তো কিছুই করতে পারিনি, পারি না। সবাই কত কিছু করে নিজের সন্তানদের জন্য! আমার কি ইচ্ছে করে না আমার মেয়ে ভাল করে থাকুক? জীবনে আরও অনেকটা পথ যাবি তুই, তখন বুঝবি টাকার গুরুত্ব কতটা!”

“টাকাটাই সব বাবা?” পেখমের গলা দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছিল যেন। এতদিন ধরে চেপে থাকা সব কষ্ট আর যন্ত্রণা আজ মায়ের অনুপস্থিতিতে বেরিয়ে এসেছিল বাবার সামনে।

“সব না হলেও অনেকটা, অনেক-অনেকটা রে মা!” বাবা যেন নুইয়ে পড়েছিল আরও। বাবাকে আরও বৃদ্ধ দেখাচ্ছিল। কেমন একটা খয়াটে লাগছিল যেন। যেন এইসব কথা আসলে বাবার মনের কথা নয়। কেউ যেন জোর করে বলিয়ে নিচ্ছিল বাবাকে দিয়ে!

বাবা বলেছিল, “আমি যা কোনওদিনও দিতে পারিনি তোকে, সেই সব কিছু তুই পাবি এখানে রে মা।”

“আমি তা চাইনি বাবা, আমি মরে যাব এখানে বিয়ে হলে!” পেখম অসহায়ের মতো তাকিয়েছিল বাবার দিকে।

বাবা উঠে এসেছিল এবার। ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “তুই এভাবে বলিস না। জানিস, তোর যখন ছ’বছর বয়স, একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলি তুই। ডাক্তাররা কিছুই করতে পারছিল না। শেষে মানিকতলার এক ডাক্তার, অনেক বয়স তার, সে সারিয়ে তুলেছিল তোকে। টানা দু’মাস ভুগেছিলি। আমার যে কী গেছিল, সে আমিই জানি। আমার যে কতটা কষ্ট হয় তোর জন্য, কতটা অসহায় লাগে তোর বিপদ হলে তুই জানবি না! তোকে আমরা হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিচ্ছি না! মালিকরা নিজে এসেছে। সেদিন দেখলি তো সুজিতের মা আর সুজিত দু’জনেই এল। কত কিছু নিয়ে এল। তোকে পাশে বসিয়ে কত আদর করল ওর মা। তোর আজ যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে, সেটা কিন্তু কাল আর থাকবে না। এমন করে ভাবিস না।”

“কিন্তু আমি যে ভাল থাকব না বাবা! এটা কেন তোমরা বুঝছ না?” পেখম শেষ চেষ্টার মতো করে বলেছিল, “আমার মন বলে কিছু নেই? জোর করে আমার ওপর এসব চাপিয়ে দিচ্ছ কেন তোমরা?”

বাবা বলেছিল, “কারণ, তুই এখনও নিজের ভাল বুঝতে শিখিসনি মা। আর এসব বলেই সময় নষ্ট করবি? বললি যে বেরোবি!”

পেখম বুঝতে পারছিল, বাবা কথা এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই নিজেই ওকে বাইরে যাওয়ার কথা বলছে। ও বুঝতে পারছিল, আসলে মায়ের কথা বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাবা যাবে না। বাবা যেতে পারবে না। বাবা মাকে এতটাই ভালবাসে যে, সেখানে পেখমও তুচ্ছ!

ও আর কথা বাড়ায়নি। শুধু এটা বুঝেছিল, যা করতে হবে ওকে নিজেকেই করতে হবে। কেউ কিছু করে দেবে না ওর জন্য!

হাতঘড়িটা দেখল পেখম। ছোট ঘড়ি। নতুন। ডায়ালে অক্ষরগুলো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। সুজিতের মা এটা দিয়ে গেছেন। ওঁরা এসেছিলেন কিছুদিন আগে। বিশাল বড় গাড়িটা ওদের ছোট পাড়ায় যেন আঁটছিল না। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়েছিল গাড়িটা।

সবার মাঝে পুতুলের মতো বসেছিল পেখম। ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বসেছিলেন সুজিতের মা। তখনই এই ঘড়িটা পরিয়ে দিয়েছিলেন উনি।

আজকের আগে এই ঘড়িটা পেখম হাতে দেয়নি। কিন্তু আজ উপায় ছিল না। ও যে ঘড়িটা পরত সেটা মা কাজের দিদিকে দিয়ে দিয়েছে। পেখম আপত্তি করলেও শোনেনি। পেখম বুঝতে পেরেছিল, মা জোর করে এসব করছে! নানাভাবে পেখমকে কোণঠাসা করে ঠেলে দিচ্ছে মালিকদের দিকে।

পৌনে সাতটা বাজে এখন। এখান থেকে চ্যাটার্জিপাড়া হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মতো লাগবে। বিজনদের বাড়িতে আজ কেউ নেই। সেখানে আজ দেখা করবে ও কাজুর সঙ্গে।

কাজু প্রথমে রাজি হয়নি। বিজনকে বলেছিল দেখা করতে পারবে না। কিন্তু বিজন খুব জোর করেছে।

বিজনকে মা ঢুকতে দেয় না আর বাড়িতে। তাই ঠাকুরদার দোকানে বিজনকে একদিন ধরেছিল পেখম। একমাত্র ওইখানে গেলেই মা কিছু বলে না।

পেখম বলেছিল, “তোকে যে করেই হোক একবার কাজুদাকে রাজি করাতেই হবে বিজু। আমার জীবন-মরণ সমস্যা। তুই একটু দেখ ভাই। এটা খুব দরকারি।”

বিজন সেই কাজটা করেছে। দোকানেই গতকাল পেখমের সঙ্গে দেখা করে বলে গেছে আজ সন্ধেবেলা ওদের বাড়িতে আসবে কাজুদা। বাড়িতে কেউ নেই। সবাই রাত দশটা নাগাদ ফিরবে। তার মধ্যে যেন দেখা করে নেয় ওরা।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে খুব। রাস্তাটাও নির্জন। সামান্য ভয়-ভয় করছে পেখমের, কিন্তু তাও ও যাচ্ছে। ফেরার পথে না হয় বড়রাস্তা ঘুরে রিকশা করে চলে আসবে।

কিন্তু হাঁটার পক্ষে পাড়ার ভেতরের রাস্তাটাই সবচেয়ে ভাল।

কাজু কি আসবে? এই যে চারদিকে মিথ্যে বলে এতটা ঝুঁকি নিয়ে এল, সেটা কি ঠিক করল? কাজু তো কথাই বলতে চাইছে না ওর সঙ্গে। আর ছোটকার কাছে এও শুনেছে যে, কিছুদিন আগে ফ্যাক্টরি গেটে নাকি বিশাল মিটিং হয়েছে। কাজু নাকি ফ্যাক্টরি স্ট্রাইক করার কথা বলছে!

সবাই মিলে রাতের খাবার খাচ্ছিল একসঙ্গে। ছোটকা তখনই কথাটা তোলে। আগে ছোটকা জুট মিলের ফোরম্যান ছিল। কিন্তু গত একমাস হল, ছোটকার প্রোমোশন হয়েছে। মালিকরা ছোটকাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোডাকশন ম্যানেজার করে দিয়েছে। এসব যে কেন হচ্ছে, সেটা ভালই বুঝতে পারছে পেখম। এমনকী, এটাও শুনছে, মালিকদের হাত নাকি এতটাই লম্বা যে, ওরা বাবাকে এই থানার বড়বাবু করার জন্যও সরকারের কাছে কলকাঠি নাড়ছে! কোন কথা কতটা সত্যি পেখম জানে না। কিন্তু এটা বোঝে যে, ওদের গোটা পরিবারকে গ্রাস করে ফেলছে মালিকরা!

ছোটকা বলেছিল, “জানো বউদি, ওই কাজু সেদিন ফ্যাক্টরি গেটে মিটিং করেছে। সবাইকে উসকাচ্ছে, যাতে সবাই স্ট্রাইক করে। আমাদের বিপাকে ফেলতে চাইছে, জানো! কী বদ ছেলে ভাবতে পারছ? নিজে তো করিস টিউশনি। রোজগার করার মুরোদ তো নেই একফোঁটা। সেখানে তুই অন্যদের ভাত মারবি? মালিকদের একটা ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে কিছু যাবে-আসবে না। ওদের অনেক ফ্যাক্টরি আছে, ব্যাবসা আছে। কিন্তু এখানে গরিব লোকগুলোর কী হবে ভাবতে পেরেছে?”

মা রুটি দিচ্ছিল বাবাকে। সেটা মাঝপথে থামিয়ে বলেছিল, “তবেই বোঝো কেমন জানোয়ার ছেলে! আর একেই কিনা বাড়িতে ঢুকিয়েছিলে তুমি! আমার মেয়ের মাথা খেতে চেয়েছিল! ভাবতে পারো! কী ভাগ্যে আপদ নেমেছে ঘাড় থেকে!”

ছোটকা মাথা নেড়ে বলেছিল, “আমি বুঝতে পারিনি যে, শয়তানটা এতদূর যাবে। আমাদের মিলের ক্ষতি করতে চায়। কীসের রাগ এত সেটা কি আর জানি না! দাড়ি রাখলেই ভাবে সব চে গেভারা হয়ে যাবে!”

পেখম অবাক হয়ে যাচ্ছিল। এসব কী বলছে ওরা! কাজু এমন নয় সেটা ওর চেয়ে ভাল আর কে জানে! আর এই ছোটকাই তো কয়েকমাস আগে মালিকদের গালাগালি করত। বলত মাইনে ভাল নয়। ওভারটাইম নিয়ে কারচুপি করে। লোকজনদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। তারা আজ ভাল হয়ে গেল! এই মিল এখন ছোটকার ‘আমাদের মিল’ হয়ে গেল!

মানুষ এতটা লোভী আর নীচ হতে পারে! এই বাড়িতে জন্মেছিল বলে ওর আজকাল ঘেন্না হয়। ঠাকুরদাও কেমন যেন হয়ে গেছেন। সব কিছু থেকে যেন দূরে থাকেন আজকাল। বাড়িটা যেন আর পেখমের বাড়ি নেই। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, ব্লেড চালিয়ে নিজের মুখটা ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। এই রূপ দেখেই তো সুজিত ভুলেছিল। এই রূপের জন্যই তো এত কিছু। তা হলে এটাকে শেষ করে দিলেই তো আপদ চুকে যায়।

আবার চমকে উঠল বিদ্যুৎ। সামনে ভটচাজ গলির মোড়। আর-একটু গেলেই চ্যাটার্জিপাড়া। বিজনদের বাড়ি। সত্যি আসবে তো কাজু? কতদিন দেখেনি! ওর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল আচমকা। চোখে জল এসে গেল। কাজুর মুখটা মনে পড়লেই ওর বুকের মধ্যে কেমন একটা করে। মনে হয় সব ছেড়ে চলে যায় কাজুর কাছে। ওদের ওই দু’কামরার ঘরেই ও থাকবে। মাটিতে শোবে। আধপেটা খেয়ে থাকবে। কাজু যেভাবে রাখবে, সেভাবে থাকবে। নিজেও দরকার হলে কাজ করবে। কিন্তু কাজুকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারবে না। ও আকাশের দিকে তাকাল। লালচে আকাশে কালো-কালো ছায়ার মতো গাছেরা মাথা নাড়াচ্ছে। সামনের বড় বটগাছটাও আজ এই হাওয়ার রাতে সব ভুলে যেন পাগল হয়ে উঠেছে! এমন রাতে কি কাজু আসবে না? কাজু কি এতটা ভুল বুঝল ওকে? এতটা পর করে দিল! জানে না কি যে, ওর বাড়ির লোকজন কেমন! কীভাবে সবাই মিলে ওকে আটকে রাখে! কষ্ট দেয়! এতটা ভুল কী করে বুঝল কাজু!

“আরে পেখম, তুই?”

পেখম চমকে গেল খুব। আবছায়ায় আচমকা এভাবে ডেকে ওঠায় প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি কে এটা। তারপর দেখল ফুলুদাদু। ফুলুদাদুরা ওদের বাড়ির পাশে থাকে। ঠাকুরদার খুব বন্ধু। সেই ছোটবেলার বন্ধু যাকে বলে। এক সঙ্গেই দু’জনের পরিবার পার্টিশানের পরে এসেছিল এই সোনাঝুরিতে। ফুলুদাদুদের এখনও কিছু আত্মীয়স্বজন রয়ে গিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। ফুলুদাদু সেখানেই গিয়েছিল।

পেখম কী বলবে বুঝতে পারল না। ফুলুদাদু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছে।

ফুলুদাদু বলল, “তুই এখন কোথায় যাচ্ছিস?”

পেখম ইতস্তত করে বলল, “এক বান্ধবীর বাড়ি যাচ্ছি। কিছু বই দরকার।”

ফুলুদাদু সহজ-সরল মানুষ, বেশি প্যাঁচঘোঁচ বোঝে না! বলল, “ও, ঠিক আছে। আমি বগলার কাছে যাচ্ছি এখন। তোদের দোকানে যাব।”

পেখম বলল, “ঠিক আছে, কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে বোলো না। মাকে তো জানো! জানলে… সামনে বিয়ে তো আমার!”

“তাই নাকি? বিয়ে?” ফুলুদাদু হাসল, “দারুণ খবর তো! ঠিক আছে তুই এখন যা, আমি কাউকে কিছু বলছি না…” ফুলুদাদু মাথায় হাত রাখল ওর।

পেখম হাসল। তারপর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। তবে ফুলুদাদু ভাল মানুষ, কিছু বলবে না।

পেখম ঘড়ি দেখল আবার। কাজু আসবে সাতটার সময়ে। বিজনদের বাড়িটা ঠিক চেনে না পেখম। বিজন বলেছে ও চ্যাটার্জিপাড়ার মোড়ে এসে সেখান থেকে নিয়ে যাবে পেখমকে। বলেছিল, “তুমি ভেবো না পেখমদি। আমি চলে আসব। তবে একটা কথা, তুমি নয়নাদিকে কিন্তু এসব কিছু বোলো না।”

“মানে?” পেখম বুঝতে পারেনি কী বলতে চাইছে বিজন।

“মানেটা খুব সহজ, নয়নাদিকে আমার ভরসা হয় না আজকাল। কেয়া সেদিন বলছিল, নয়নাদির কাছে নাকি ও কাজুদার ছবি দেখেছে!”

কেয়াকে চেনে পেখম। বিজনের স্যারের মেয়ে। ন’-দশ বছর বয়স। ছোট্ট একরত্তি একদম। কিন্তু কী পাকা, কী পাকা! সারাক্ষণ বিজনের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। ওদের সঙ্গে আবার নয়নার খুব ভাল সম্পর্ক!

“কাজুদার ছবি দেখেছে, তো? তাতে কী হল? তুই জানিস না, আজকাল নয়না সারাক্ষণ ছবি তুলে বেড়ায়! তাতে কী হল?” পেখম আমল দেয়নি কথাটার।

বিজন ঠাকুরদার দোকানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। পেখমের প্রশ্নে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ও সরে এসেছিল এক কোণে। তারপর বলেছিল, “আরে, কেয়া বলে, নয়না নাকি কাজুদার লাভে পড়েছে!”

“মারব এক চড়!” পেখমের রাগ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ, “ওইটুকু মেয়ে! এসব কে বলেছে ওকে? এত পাকা কী করে হয় ও?”

বিজন ঘাবড়ে গিয়েছিল সামান্য। রক্ষণাত্মক হয়ে বলেছিল, “না, না, রাগ কোরো না পেখমদি। আমি যা শুনেছি বললাম। তুমি কিছু মনে কোরো না।”

নয়না পেখমের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। এইসব বিজনের মতো পাকা ছেলেগুলো কী করে বলে এমন কথা? নয়নাকে ও বলে না, এমন কথা নেই। সেখানে বিজন এসব বলে কী করে?

নয়নার কাছ থেকে কিছু লুকোয় না পেখম। আজও কিছু লুকোয়নি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও সোজা গিয়েছিল নয়নার কাছে।

নয়নাদের বাড়িটা সামান্য দূরে। চারিদিকে বাগান দিয়ে ঘেরা। ওর বাবা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। বাড়ির সামনে ডিসপেন্সারি। পেখম দেখেছিল আজ নয়নার বাবার কাছে ভিড় বেশ। অন্যদিনের মতো ফাঁকা নেই দোকান। পেখম ওই দিকে না গিয়ে সোজা দরজার কড়া নেড়েছিল।

সামান্য সময় পরে নয়না নিজেই এসে দরজা খুলে দিয়েছিল। পেখম দেখেছিল নয়না চুল বাঁধছে ফিতে দিয়ে। ওকে দেখে বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিল। চোখ বড়-বড় করে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুই এখানে? কাকু-কাকিমা জানে? তোর না বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ?”

পেখম এদিক-ওদিক দেখে নয়নাকে হাত ধরে টেনে বের করে এনেছিল ঘরের বাইরে। তারপর সতর্ক গলায় বলেছিল, “শোন না, আমি কাজুদার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। বাড়িতে বলেছি তোর কাছে এসেছি। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সেটাই বলিস কিন্তু।”

“কিন্তু তোর তো বিয়ে! সেখানে এখন কাজুদার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস কেন? দেখ, ঝামেলা হয়ে যাবে কিন্তু জানাজানি হলে। কাজুদাকে গুলি মার। সামনে কত ভাল জীবন তোর। এসব করিস না পেখম।”

পেখম আহত হয়ে তাকিয়েছিল নয়নার দিকে, “তুইও ওদের মতো কথা বলছিস! তুই জানিস না আমার আর কাজুদার প্রেম কতটা খাঁটি। তা হলে? তোকে যা বললাম, সেটা শুধু মাথায় রাখিস!”

নয়না খপ করে হাত ধরেছিল পেখমের। তারপর সোজা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমি তোকে খুব ভালবাসি পেখম। কিন্তু কিছু জিনিস আছে যেগুলো ভালবাসার চেয়েও জরুরি। তুই যা করছিস তাতে কারও ভাল হবে না।”

“আমি জানি আমি কী করছি। তোকে যেটা বললাম সেটা বুঝেছিস তো?” পেখম নয়নার হাতটা আঁকড়ে ধরে বলেছিল, “একটু সাহায্য কর নয়না। আমার যে আর কেউ নেই… কাকে আমি বলব বল!”

আবছা হয়ে আসা আলোয় নয়না তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর ধীরে-ধীরে কেটে-কেটে বলেছিল, “কাজুদা তোর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হল? আর, কোথায় যাচ্ছিস তুই দেখা করতে?”

“বিজনদের বাড়ি। চ্যাটার্জিপাড়ায়। বাড়ি আজ ফাঁকা ওদের। যাব আর আসব। তুই প্লিজ় আমার কথাটা রাখিস!”

কথা শেষ করে আর দাঁড়ায়নি পেখম। আসলে ওর আর দাঁড়ানোর সময় ছিল না।

“আমার বাড়িটা সামনেই, তাড়াতাড়ি চলো। কাজুদা এসে গেছে।” চ্যাটার্জিপাড়ার মোড়েই দাঁড়িয়েছিল বিজন। পেখমকে দেখে নিজেই এগিয়ে এল।

বিজনদের বাড়িটা সত্যি মোড়ের কাছে। বাড়িটা বেশ বড়। ইটের। মাথায় টিন দেওয়া। বাড়ির সামনে একটা উঠোন। তুলসী-মঞ্চ। আর বাড়ির চারদিকে প্রচুর গাছপালা। বিজনদের টাকাপয়সা থাকলেও সেটা কিন্তু বাহ্যিক আড়ম্বরে দেখা যায় না। বোঝাও যায় না।

বিজন বলল, “বাড়ির পেছনের দিকে চলে যাও। ওখানে একটা বাগান আছে। কাজুদা আছে ওখানে দাঁড়িয়ে। আমি বাড়ির সামনে আছি। মানে, ঘরগুলো বন্ধ করে দিয়ে গেছে তো… আমি পাশে মামার বাড়িতে দুপুরে খেয়েছি। তাই…”

পেখম আর শুনল না। অত শোনার মতো মনের অবস্থা ওর নেই। হাত-পা কাঁপছে ওর। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কতদিন পরে কাজুর সামনে দাঁড়াবে গিয়ে! কী বলবে কাজু! কথা বলবে তো নাকি…

কাজু দাঁড়িয়েছিল একা। চারদিকে ঘন গাছপালার মধ্যে কেমন একা আর দুঃখী লাগছিল কাজুকে। আবছায়া হলেও পেখমের মনে হল কাজু বেশ রোগা হয়ে গেছে।

পেখম এগিয়ে গেল এবার। পা কাঁপছে ওর! বুকের মধ্যে যেন চটকলের ভোঁ পড়েছে! কতদিন পর কাজুর কাছে ও এল! এভাবে সম্পূর্ণ নির্জনে কতদিন পরে দেখা করল দু’জন!

ওর পায়ের আওয়াজ পেয়ে কাজু মুখ তুলে তাকাল এবার। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেন ডেকেছ?”

“কাজুদা, আমি… আমায় জোর করে…” পেখমের গলা আচমকা ডুবে গেল জলের তলায়। কোন এক অজানা সমুদ্র থেকে চোরাস্রোত এসে হঠাৎই যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল পেখমকে। কষ্টের সঙ্গে এক চূড়ান্ত অভিমান এসে দখল নিল ওর মনের! এত ভালবাসার পরেও ওকে বলতে হবে কেন ডেকেছে? কেন দেখা করতে চাইছে? কাজু কি একদম ভুলে গেল ওকে? সবটাই ভুলে গেল এই কদিনে! পেখম আর কোনও কথা না বলে মুখ নামিয়ে নিল।

কাজু চোয়াল শক্ত করে বলল, “জোর করে কাউকে কিছু করানো যায় না। এটা নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নয়!”

পেখমের ইচ্ছে হল বলে, এটা তার চেয়েও বেশি। এখানে শরীরে মারে না, মনে মারে। এই ক্যাম্পে মনে মেরে শেষ করে দেওয়া হয় মানুষকে।

কাজু এগিয়ে এল এবার সামান্য। বলল, “এভাবে কান্নাকাটি করার কিছু নেই। বিয়ে করো। সুখী থাকো। আর কী বলব! তবে তোমার হয়তো মনে নেই এই সম্পর্কটা তুমি নিজেই শুরু করেছিলে। আমি প্রথম থেকেই বলেছিলাম, এতে অসুবিধে হবে। তুমি শোনোনি কিছু। আর দ্যাখো, আজ তোমার কথা না শোনার খেসারত দিতে হচ্ছে আমায়। ভালবেসে আমার কী হল দ্যাখো পেখম। আমার আর তোমার কী সম্পর্ক সেটা তো কেবল আমরা জানতাম। সেটা কতটা গভীর সেটা তো আমরা বুঝতাম কেবল। আর, সেখানে তুমি এমন করলে! আমার সব কিছু তো নষ্ট হয়েই গিয়েছে। আর কেন ডাকলে আমায়? কী বলতে চাও আর?”

কাজুর গলার হাহাকার যেন আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে মেঘ ডেকে উঠল যেন তার উত্তরে! ডাইনির চুলের মতো আঁকাবাঁকা বিদ্যুৎরেখা নিমেষে ছড়িয়ে গেল আকাশময়! পেখম মুখ তুলে সেই আলোয় দেখল কাজুকে। দেখল, কাজুর চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কাঁদছে!

পেখম আর নিজেকে আটকাতে পারল না। কীসের এই টান ও নিজেও বুঝতে পারল না। শুধু দেখল, এক অমোঘ আকর্ষণ ওকে যেন টেনে এনে ছুড়ে ফেলল কাজুর বুকের ওপরে।

পেখম সমস্ত শক্তি দিয়ে কাজুকে জড়িয়ে ধরল। ওর মনে হল লতানো গাছের মতো ওর মন আর শরীর থেকে অসংখ্য আকর্ষ যেন বেরিয়ে এসে কাজুকে মিশিয়ে দিতে শুরু করেছে ওর সঙ্গে!

“পেখম আমি… আমি ভাল নই পেখম… আমি এর মধ্যে… আমি…” ওই বন্ধনের মধ্যেও কাজু যেন কিছু বলতে চাইল।

কিন্তু কাজুকে আর কিছু বলতে দিল না পেখম। মুখ তুলে কাজুর ঠোঁটদুটো কামড়ে ধরল ও। কাজুও যেন সামান্য দ্বিধা করল প্রথমে, তারপর ওর নিজেরও সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল এবার। নরম পাখির মতো পেখমকে প্রায় তুলে নিল মাটি থেকে। তারপর নিজের সমস্ত না পাওয়া দিয়ে পেখমের ভালবাসা শুষে নিতে লাগল ও।

আকাশে মেঘ ডাকল আবারও। হাওয়ার জোর বাড়ল। ক্ষণে-ক্ষণে ছিটকে উঠল বিদ্যুৎ। পেখম আর কাজু ক্রমশ তলিয়ে যেতে লাগল এক নরম অন্ধকারে। পৃথিবীর সমস্ত হিংসা, লোভ আর বিচ্ছেদ থেকে দু’জনকে আড়াল করে দিতে শুরু করল এই বাগান, এই গাছপালা, এই অন্ধকার। পেখম বুঝল আজকে, এতদিনে ও সম্পূর্ণ কাজুর হয়ে গেল। বুঝল সারা জীবনের মতো কাজুর সুবাস জমা হয়ে গেল ওর শরীরে। জমা হয়ে গেল ভালবাসা আর নির্ভরতা। পেখম বুঝল, এই বন্ধন থেকে ওর আর মুক্তি নেই। এই বন্ধন ওকে সারা জীবন বাঁচিয়ে রাখবে।

.

২৯. রাধিয়া

এই গাড়িটায় সান রুফ আছে। গাড়ির মাথার একটা চৌকোমতো অংশ কাটা। তাতে কাচ লাগানো রয়েছে। ব্যাপারটা খুব ভাল লাগে রাধিয়ার। ও পেছনের সিটে বসে মাঝে মাঝে মাথাটা ওপর দিকে তুলে ওই চৌকো জানলাটা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের গাড়ির ওই কাচটা ফোটোক্রোম্যাটিক। দিনে যেমন গভীর কালো রং হয়ে যায়, তেমনই রাতে আবার স্বচ্ছ সাদা হয়ে যায়। ফলে গাড়ির মধ্যে বসেই আকাশ দেখতে পারে ও।

আজও আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভাল লাগছে খুব। নভেম্বরের শেষ, তাই আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই। শহর হলেও সামান্য কিছু জেদি নক্ষত্র দূষণের মাস্তানির ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে। বাইরে গরম হলেও গাড়ির ভেতরটা বেশ ঠান্ডা। ছোটবেলায় ঠাকুরমার সঙ্গে টেরাসে বসে আকাশ দেখত ও। ঠাকুরমা গল্প বলত ওকে। রূপকথার গল্প। রাজা, রানি, রাজকুমার, রাজকুমারী আর দুষ্টু ড্রাগনের গল্প। আর সেই গল্প শুনতে-শুনতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাধিয়ার মনে হত আকাশ থেকেও কি এমন কোনও ড্রাগন হাঁ করে ওকে গিলে নিতে নেমে আসবে নীচে? এখন মনে পড়লে হাসি পায় রাধিয়ার। ছোটবেলার অনেক কিছুই, দেখেছে, বড় হলে আর পাওয়া যায় না!

মধুদা গাড়ি চালাচ্ছে। বিবেকানন্দ পার্কের পাশের গলিতে একটা রেস্তরাঁয় যাচ্ছে রাধিয়া। নেমন্তন্ন আছে আজ। পলি নেমন্তন্ন করছে! ও যে ওল্ড এজ হোমটা চালায়, সেটা নাকি বড় একটা গ্র্যান্ট পেয়েছে। সেই জন্য ও আজ বন্ধুদের খাওয়াবে!

পলি মেয়েটা অদ্ভুত। খুব বড় মনের! রাধিয়া জানে যে এই ওল্ড এজ হোমটার হয়ে কাজ করার জন্য পলি নিজে কোনও টাকা পায় না। এই যে গ্র্যান্টটা পেয়েছে সেটা থেকে এক কানাকড়িও ও পাবে না। তাও মেয়েটা কী খুশি!

রাধিয়ারও এমন হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারে না। কীসের যে এক ভয় ওকে চেপে ধরে কে জানে! কিছুতেই নিজের মন খুলে ও কিছু করতে পারে না। সারাক্ষণ কেমন যেন মাথা নিচু করে থাকে! অন্যায্য কেউ কিছু বললেও প্রতিবাদ করতে পারে না। উচিত কথা বলে দিতে পারে না। শুধু রাগ হয়, চাপা একটা কষ্ট হয় মনে মনে। বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপ অনুভব করে ও। উলটো দিকে একটা ভয় এসে আঁকড়ে ধরে ওকে। ভাবে, উচিত কথা বললে যদি খুব অশান্তি হয়! তার চেয়ে বাবা এই চুপ করে থাকাই ভাল!

এই তো আজকেই বেরোনোর আগে মা রাগ করছিল।

মা বলছিল, “এখন কোথায় যাচ্ছিস তুই? আবার সেই ভুলভাল বন্ধুদের কাছে যাচ্ছিস? তোর কি একটুও স্টেটাস-জ্ঞান নেই! আমি আর তোর বাবা কোথায় যাই, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করি! আর তুই! কতবার বলেছি আমাদের সঙ্গে পার্টিতে চল, ক্লাবে চল। সেখানে কত ব্রাইট ছেলেমেয়েরা আসে। তাদের সঙ্গে ঘোর। না, সেসব তো করবি না! সারাক্ষণ পেটি কিছু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মাখামাখি। আমি তোর বাবাকে তখনই বলেছিলাম মেয়েকে লন্ডনে পাঠিয়ে দাও। কিন্তু তার কি আমার কথা শোনার সময় আছে! একদম ঠাকুমার রক্ত পেয়েছিস তুই! যত ছোটলোকদের সঙ্গে মেলামেশা!”

ছোটলোক! রাধিয়ার রাগ হয়ে গিয়েছিল। ও বলেছিল, “ওরা খুব ভাল মা!”

“কীসের ভাল? আমি দেখিনি! যেমন ড্রেসিং সেন্স, তেমন চেহারা সব! কী করে তুই ওদের টলারেট করিস?”

রাধিয়া কিছু না বলে পার্স খুলে দেখছিল কত টাকা আছে ব্যাগে। কার্ডগুলো সব ঠিক আছে কি না।

মা বুজুকে ডেকে বলেছিল, “বুজু আমি বেরোব। ক্লাবে যাব। সুপ্রতীকও চলে যাবে ওখানে। আমার ড্রেস রেডি কর!” তারপর রাধিয়ার দিকে ফিরেছিল, “আমাদের সঙ্গেও তো যেতে পারতিস। ইউ ক্যান মিট নিউ ফ্রেন্ডস দেয়ার। সুশীল নিয়োগীর ছেলে এসেছে স্টেটস থেকে। আমি ছবি দেখেছি। একদম রণবীর কপূরের মতো দেখতে! ও তোর সঙ্গে মিট করতে চায়। ফেসবুকে তোকে দেখেছে। সুশীলের ওয়াইফ নীতা আমায় বলছিল। সেখানে না গিয়ে কোন না কোন পলি কী এক হোম চালায়, তার সঙ্গে কোন একটা বাজে রেস্তরাঁয় খেতে যাবি! সত্যি!”

রাধিয়া কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল। মায়ের আগে এমন মনোভাব ছিল না। কিন্তু ইদানীং কী হয়েছে মায়ের কে জানে! সারাক্ষণ এসব বলে চলেছে!

গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে সিগন্যালে। পরের সিগনালটাই ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক। সেখান থেকে ডান দিকে বাঁক নিতে হবে।

রাধিয়া পাশে তাকাল। একটা বড় হাসপাতাল। সামনে অনেক মানুষ। পাশে একটা মন্দিরও রয়েছে। সেখানে একটা লোককে দেখে সোজা হয়ে বসল রাধিয়া। আরে, সেই বইওয়ালাটা না! ও ভাল করে তাকাল। ফুটপাথে আজকাল এত দোকানপাট হয়ে গেছে যে, ভাল করে কিছু দেখার উপায় নেই। তবু পথচলতি মানুষ আর দোকানের ফাঁক দিয়ে লোকটাকে দেখল রাধিয়া। হ্যাঁ, ঠিক, সেই বইওয়ালাটাই। তবে হাতে বই নেই। তার বদলে খেলনা বিক্রি করছে! আর তার সামনে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মুখটা স্পষ্ট হচ্ছে না! ছেলেটাকে খুব চেনা লাগছে রাধিয়ার। ওর মনে হল গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায়। লোকটা খেলনা বিক্রি করছে যখন, সেখানেও নিশ্চয় অমন কিছুটা একটা স্পিচ দেবে! মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল রাধিয়ার। কত অদ্ভুত মানুষ যে আছে! রাধিয়ার এমন মানুষজন দেখতে খুব মজা লাগে। ও সমাজের যে-স্তরে থাকে সেখানে সব কিছু বড়ই সাজানো-গোছানো। মাটির অনেকটা ওপরে। ফলে নানা ধরনের লোকের সঙ্গে সেখানে দেখা হওয়ার সুযোগ হয় না। সেখানে সব কিছুই কেমন যেন স্কেল দিয়ে মাপা। কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া। রাধিয়া ভাবতেই পারে না, ওর বাবা রাস্তায় বসা লোকের কাছ থেকে কুলের আচার কিনবে ওর জন্য। ভাবতেই পারে না ট্রামে করে ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। স্টেশনে ফটাস জল খাবে। এসব গল্প যখন বন্ধুদের থেকে শোনে, রাধিয়ার লোভ হয় খুব। মনে হয়, এমনটা কেন ওর সঙ্গে হল না!

ঠাকুরমা বলে, ভাবতে নেই। কী হল না, ভাবতে নেই। কী হল সেটা দেখলে জীবন অনেক ভাল হয়ে যায়। এই যে ওদের টাকার অভাব নেই, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা নেই, এই যে ও যা চায় কিনতে পারে, খেতে পারে, বিদেশে হলিডে কাটাতে যেতে পারে, সেসব ক’টা লোকের কপালে জোটে! যে-লোকটা লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে ওঠার আগে সারা দিনের ক্লান্তি আর তেষ্টা কমাতে ওই স্টেশনের ফটাস জল খায়, সে তো মনে মনে রাধিয়ার মতো এমন একটা জীবনই চায়। ঠাকুরমা বলে, “আমার বাবা বলতেন নিরাপত্তা খুব দরকারি। তুই সেটা পেয়েছিস রাধি।”

রাধিয়ার জানতে ইচ্ছে করে, ঠাকুরমাও তো নিরাপত্তা পেয়েছে, তা হলে ঠাকুরমা এমন গম্ভীর আর চুপচাপ কেন? কেন ঠাকুরমাকে দেখলে মনে হয় এখানে থেকেও মানুষটা এখানে নেই! সব আছে কিন্তু আসলে যেন কিছুই নেই! নিরাপত্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ঠাকুরমার বাবা বলেছিলেন, কিন্তু রাধিয়ার জানতে ইচ্ছে করে ঠাকুরমার নিজের এই নিয়ে কী মত!

রাধিয়া ভাবল, একবার মধুদাকে বলে যে, ও গাড়ি থেকে নামতে চায়। কিন্তু তার আগেই একটা বাস এসে গাড়িটার বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মধুদাও ঠিক তখনই সামনের সিগন্যালটা খোলা পেয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল।

রাধিয়া একবার পেছনের দিকে তাকাল। না, দেখা যাচ্ছে না কিছু! নিজের মনে মাথা নেড়ে হাতঘড়িটা দেখল রাধিয়া। প্রায় আটটা বাজে। ডিনারের নেমন্তন্ন আজ। কারও নেমন্তন্নে খালি হাতে যায় না রাধিয়া। পলির জন্য একটা পার্স কিনেছে।

মনের মধ্যে সামান্য হলেও একটা কাঁটা ফুটে আছে ওর। বুদা আসবে। সেই যে বুদা ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল, তারপর থেকে আর ওদের কথা হয়নি। ইউনিভার্সিটিতে বুদা আসছে না মাসখানেক। জয়তীর কাছে ও শুনেছে, বুদা নাকি কোথাও একটা গেছে। কেউ ঠিক বলতে পারছে না বুদার কী হল। তবে সেই জন্য কেউ বুদার বাড়িতে যায়নি খবর নিতে। কেউ যদি যোগাযোগ না রাখতে চায়, তা হলে কেন কেউ তাকে বিরক্ত করবে!

কিন্তু বুদা যোগাযোগ করেছে। গতকাল পলি ফোন করেছিল রাধিয়াকে আজ রেস্তরাঁয় আসতে বলার জন্য। তখনই বলেছে যে, বুদা ফোন করে পলির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।

রাধিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, “কেমন আছে বুদা? কী খবর ওর?”

পলি বলেছিল, “কী জানি কী খবর! তবে বলল আমাদের সবার সঙ্গে ওর দরকার আছে কী একটা, তাই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি আর কথা বাড়াইনি বুঝলি। আজকে নেমন্তন্ন করে ডেকেছি। বলেছি সবাই আসবে, তুইও আয়।”

“আসবে?” রাধিয়া জিজ্ঞেস করেছিল।

“বলল তো আসবে,” পলি বলেছিল, “দেখ, আমাদের তো ওকে নিয়ে কোনও প্রবলেম হয়নি। ও নিজেই আচমকা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই আমি আসতে বলব না কেন! ঠিক না?”

“ঠিকই তো,” সামান্য হেসেছিল রাধিয়া। তবে বাইরে হাসলেও মনের মধ্যে সামান্য একটা কাঁটা ফুটেছিল ওর। বুদা এসে আবার কী বলবে কে জানে!

পলি ফোন রাখার আগে বলেছিল, “আটটার মধ্যে চলে আসবি পজ়িটিভলি! যদি দেরি করেছ না…”

এই রাস্তাটার নাম পণ্ডিতিয়া রোড এক্সটেনশন। রাস্তাটা বেশ সরু। তার মধ্যে একদিকে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের বড় গাড়িটা নিয়ে মধুদা বেশ নাকাল হচ্ছে!

সামনেই একটা নতুন তৈরি হওয়া বাড়ি। তার আগেই বাঁ হাতে একটা রাস্তা ঢুকে গিয়েছে! মধুদা গাড়িটাকে সামনে ফুটপাথের পাশ ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে বলল, “গাড়িটা ওই রাস্তায় ঢুকবে না। তাই…”

রাধিয়া বলল, “ঠিক আছে মধুদা। তুমি এখানেই দাঁড়াও। আর এটা রাখো। বিকেলে কিছু যে খাওনি সেটা আমি জানি।”

একটা একশো টাকার নোট মধুদার দিকে বাড়িয়ে দিল রাধিয়া। মধুদা দ্বিধার সঙ্গে টাকাটা নিল। আজ মধুদার কী হয়েছে কে জানে! কেমন একটা মনমরা ভাব। অন্যদিন কত কথা বলে! আজ কেমন যেন নুয়ে আছে!

গাড়ি থেকে বেরিয়ে জানলায় ঝুঁকে দাঁড়াল রাধিয়া, “তোমার কী হয়েছে মধুদা? শরীর খারাপ?”

“না, না” মধুদা জোর করে মাথা নাড়ল।

“বাড়িতে সব ঠিক আছে? শিখামাসি ঠিক আছে?”

“সবাই ঠিক আছে,” মধুদা আবার জোর করে হাসল।

রাধিয়া আর কথা বাড়াল না। বুঝতে পারছে মধুদা বলতে চাইছে না। মানুষের ব্যক্তিগত কথা থাকতেই পারে। ও গলিতে ঢুকে গেল।

খুব গরম আর এখন নেই। রাতের দিকটায় সামান্য চিনচিনে ঠান্ডা পড়ে। মুখে পিপারমিন্ট লজেন্স রাখার মতো একটা ঠান্ডা। এইদিকের রাস্তায় বড়-বড় হলুদ সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প লাগানো রয়েছে। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় আলোর গায়ে লাগানো কাচের ঢাকনায় অসংখ্য মৃত পোকা জমে কালো হয়ে আছে! ফলে আলোর মধ্যেও কেমন যেন একটা বাদামি আভা! রাস্তাগুলোয় কেমন একটা ছমছমে রং!

অনেক ফুল পড়ে আছে পথে। চারপাশে বেশ গাছ। লোকজনও কম। দক্ষিণ কলকাতাটা বেশ সুন্দর। বিশেষ করে লেকের আশপাশটা। একা-একা হাঁটতে ইচ্ছে করে রাধিয়ার।

রেস্তরাঁটা গলির ওই মাথায়। ডান হাতে। রাস্তা থেকে এক ধাপ উঠে। রাধিয়া দেখল, সামনে দিয়ে একটা ড্রেন গেছে। তার ওপর চেকার্ড প্লেট পাতা। সেখানে পা দিয়ে উঠে গেল রাধিয়া। রেস্তরাঁটার সামনে সরু বাঁশের কাজ করা একটা ডিজ়াইন রয়েছে। পাশেই কাচের পাল্লাওয়ালা দরজা। একজন গেটকিপার দাঁড়িয়েছিল। রাধিয়াকে দেখে সে মাথা ঝুঁকিয়ে “গুড ইভনিং!” বলে পাল্লাটা খুলে ধরল।

রাধিয়া ভেতরে ঢুকে একটু থমকে গেল! রেস্তরাঁটা ছোট। দেখেই বোঝা যায় পুরনো বাড়ির নীচের তলাটা নিয়ে সেটাকে ঠিকঠাক করে এটা করা হয়েছে।

গোটা রেস্তরাঁটা লাল আর কালো রং দিয়ে সাজানো। অল্প আলোয় সবটাই বেশ মায়াময় লাগছে। আজ সপ্তাহের মাঝখান বলেই কি না কে জানে, এখানে ভিড় নেই একদম।

একজন ওয়েটার এগিয়ে এল এবার। ছেলেটা ইয়ং। রোগা। মুখে হাসি লেগে রয়েছে। রাধিয়া ছোট করে বলল ও কেন এসেছে। ছেলেটা রাধিয়াকে সামনের দিকে আসতে বলল।

এদিকটায় দুটো ভাগে চেয়ার-টেবিল সাজানো আছে। ছেলেটা রাধিয়াকে নিয়ে এই জায়গাটা পেরিয়ে ডান দিকে ঘুরল। আর তখনই দেখল সবাইকে। রাধিয়া নিমেষের জন্য থমকে গেল।

এদিকে একটা বড় জায়গা। সেখানে তিনটে টেবিলকে জোড়া দিয়ে রাখা আছে। আর সেগুলো গোল করে ঘিরে বসে রয়েছে সবাই। কিন্তু সবার মধ্যে রাধিয়ার চোখ পড়ল নিশানের দিকে। ওকেও বলেছে পলি! এটা জানত না তো! কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ওর মন পালটা প্রশ্ন করল, জানলে কী করত? আসত না? নাকি আসত? ওর মনে পড়ে গেল নিশানের সঙ্গে সেদিন ওই নার্সিং হোমে কী হয়েছিল! মনে মনে সংকুচিত হয়ে গেল হঠাৎ। আর নিজেরই রাগ হল নিজের এই দুর্বলতার জন্য!

কেয়াআন্টিকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল সেদিন। ফলসা এসেছিল বেঙ্গালুরু থেকে। রাধিয়া জানত যে, নিশান যাবে। ও তাই যেতে চেয়েছিল। যত দিন যাচ্ছে, নিশানের কাছাকাছি থাকতে, ওর কথা শুনতে ইচ্ছে করছে রাধিয়ার। এটা কতটা সিরিয়াস ও জানে না। কিন্তু বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, এমন ইচ্ছেটা বেড়েই চলেছে। নিশানই এমন একজন যাকে, কেন ও জানে না, ওর মনের সবচেয়ে অস্বস্তিজনক কথাটা জানাতে পেরেছে! নিশান বলেছিল, বাবার ব্যাপারটার খবর নেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেটা আশা করে না রাধিয়া। ওর নিশানকে ভাল লাগে মানেই নিশানেরও যে ভাল লাগবে, তা তো নয়। ভাললাগা ব্যাপারটার মজা বা সাজা হল এই যে, কখনওই তা দু’জনের মধ্যে একই বেগে কাজ করে না! ফলে নিশান যে ওকে ওই কথাটা বলেছিল, সেটা ও ধরেনি। সেদিন খুব মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আর ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল রাধিয়া, তাই হয়তো বলে ফেলেছিল ওই কথাটা। আর ওর মনে হয় নিশানও ওকে সান্ত্বনা দিতেই ওরকম একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

কিন্তু পরে, মাথা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরে নিজের কাজের জন্য ওর কেমন একটা লেগেছে! নিশানকে বলতে পারার মধ্যে যেমন একটা আপনজনের ভাব আছে, তেমন এই ঘটনাটার মধ্যে ওর নিজের চারিত্রিক ইমব্যালেন্স আর দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে!

তাও নিশান আসবে শুনে ওর মনে হয়েছিল একবার যায়। নিশানের সঙ্গে একবার দেখা করে!

তেমন ভেবে রেডি হয়ে নিয়েছিল। মধুদাকে বলেছিল গাড়ি বের করতে। কিন্তু তারপর বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়েও মনে পড়েছিল, আরে, মোবাইলটা তো ফেলে এসেছে বসার ঘরে।

আর এটাতেই বিপদটা হয়েছিল। মোবাইলটা নিতে গিয়ে দেখেছিল বাবা ওর মোবাইল খুলে দেখছে!

“কী রে! তুই দাঁড়িয়ে পড়লি যে, আয়!” পলি ওকে হাত তুলে ডাকল।

রাধিয়া অপ্রস্তুতের মতো হেসে এগিয়ে গেল। বাকিদেরও দেখল এবার। পলির পাশে একটা ছেলে বসে রয়েছে। বসে থাকলেও বোঝা যাচ্ছে ছেলেটার চেহারা ভাল। ছেলেটাকে চেনা মনে হল ওর। আর বুদাও এসেছে। এ কী! বুদার এ কী হয়েছে! আর বুদার পাশে এটা কে!

সুম্পা বসেছিল নিশানের পাশে। রাধিয়াকে দেখে উঠে গিয়ে জয়তীর পাশে বসল।

বলল, “নে, তোর জায়গা ছেড়ে দিলাম। বোস।”

রাধিয়া দেখল সবাই হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ছে যেন! রাধিয়া কী করবে বুঝতে না পেরে বসল নিশানের পাশেই। এই নিয়ে কথা বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না।

ও দেখল আজও নিশান সেই কুসুম রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে। পাশে বসতেই খুব সুন্দর একটা গন্ধ পেল ও। কিন্তু নিশানের দিকে তাকাতে পারছে না! সেদিন গাড়ির মধ্যের ঘটনাটা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে!

পলি বলল, “তোকে আলাপ করিয়ে দিই। ও হল মাহির। আমাদের ওল্ড এজ হোমের যে-ফান্ড আমরা পেয়েছি সেটা ওর জন্য। রিতুদা নামে একজন পলিটিক্যাল লিডার আছে। এমপি। মাহির সেই রিতুদাকে বলে এটা করিয়ে দিয়েছে। আর মাহির, ও হল রাধিয়া। তোমায় তো ওর কথা বলেইছি!”

রাধিয়া হেসে মাথা নাড়াল। মাহিরকে দেখল এবার ভাল করে। ছেলেটাকে চেনা লাগছে ওর। বোঝা যাচ্ছে যে, ছেলেটার আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। এখানে এসে খুব একটা শান্তিতে নেই। কিন্তু হাসিটা সুন্দর। বাচ্চাদের মতো! একটা ডিসআর্মিং ব্যাপার আছে!

“আর, বুদার ব্যাপারটা শুনেছিস তো?” জয়তী এবার মাঝখান থেকে কথা বলল।

রাধিয়া কী বলবে বুঝতে পারল না। বুদা ঠিকমতো তাকাচ্ছে না ওর দিকে। ওর মাথায় সিঁদুর দেখে বেশ ঘাবড়েই গেছে রাধিয়া! বিয়েটা করল কখন ও? আর ওদের একবারও জানাল না? এটা কেমন ব্যাপার!

বুদা তাকাল সকলের দিকে। তারপর বলল, “তোরা এমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন? আমি বললাম তো, এভাবে বিয়ে করতে আমি বাধ্য হয়েছি!”

জয়তী বলল, “ঠিক আছে। আমরা কি কিছু বলেছি? বলিনি।”

বুদা আবার বলল, “তোরাও তো খবর নিসনি আমার! নিয়েছিস? কী রে রাধি, নিয়েছিস?”

“আরে! তুই রাধিকে বলছিস কেন?” জয়তী বিরক্ত হল এবার, “ওর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছিলি ভুলে গিয়েছিস? আর আমরা সবাই তোকে ফোন করেছি। মেসেজ করেছি! একটারও কিন্তু রিপ্লাই দিসনি। তোর কী হয়েছে? এমন বিটার হয়ে আছিস কেন?”

এবার ওর পাশে বসা ছেলেটা কথা বলল, “আসলে বাড়িতে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে টেনশন ছিল খুব। এখনও আছে। তাই হয়তো বুদা একটু অ্যাজিটেটেড হয়ে আছে!”

“কেন, কীসের টেনশন! বুদা যে প্রেম করত, আমরা তাই তো জানি না!” পলি অবাক হয়ে তাকাল।

“প্লিজ়,” নিশান আচমকা কথা বলে উঠল মাঝে, “আমি ঠিক তোমাদের গ্রুপের তো নই। সুম্পার দাদার বন্ধু। প্লাস ওই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ছিলাম। তাই আমার সামনে তোমরা এসব না বললেই বোধহয় ভাল। বুদা মে ফিল ডিসকমফর্ট!”

“না, না” বুদা উত্তেজিত হয়ে উঠল সামান্য, “আমি কিছু অন্যায় করিনি যে, ওরকম ফিল করব। আমি বলছি সায়ন।”

সায়ন! ছেলেটার নাম তা হলে সায়ন! রাধিয়া বুঝতে পারছে না ওর সামনে কী হচ্ছে! বুদা কাউকে না বলে বিয়ে করেছে। সেটা বুদার ডিসিশন। সেটা নিয়ে এমন করছে কেন ও!

সায়ন বলল, “প্লিজ় বুদা, আজ আমরা এসেছি সেলিব্রেট করতে! ডোন্ট স্পয়েল ইট!”

“তুই চুপ কর,” সায়নকে ধমকে বুদা এবার তাকাল ওদের দিকে, “কেন তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি জানিস? কারণ… কারণ, আমি সায়নকে যে বিয়ে করেছি, ও আমার দূর সম্পর্কের হলেও মাসতুতো দাদা! বুঝেছিস? আমার বাবা-মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমরা এখন নাকতলার কাছে একটা বাড়িতে আছি। একটা রুম। ইউনিভার্সিটিতে আর যাব না। সায়ন বেহালা বাজায়। ক্লাবে। তাও রোজ কাজ পায় না। আমি টিউশনি করি! আমাদের বাড়ির কেউ আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। বুঝলি এবার কেন যোগাযোগ রাখিনি কারও সঙ্গে? বুঝলি?”

কথা শেষ করে আচমকা বুদা টেবিলে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে! রাধিয়া ঘাবড়ে গেল। আর শুধু রাধিয়াই নয়, সবাই থতমত খেয়ে গেল। সায়ন বুদার পিঠে হাত রাখল আলতো করে। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “সরি।”

“কী হয়েছে?” পেছন দিক থেকে একটা প্রশ্ন এল এবার।

রাধিয়া তাকিয়ে দেখল স্মরণ। আর ঠিক তখনই চিনতে পারল। আরে, সেই ফুটপাথে এই ছেলেটাই তো দাঁড়িয়ে ছিল ওই খেলনাওয়ালার সঙ্গে! এই তো সেই শার্ট! তাই দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা চেনা লাগছিল।

রাধিয়া দেখল, স্মরণ অবাক মুখ করে বুদাকে দেখছে।

“কিছু না,” জয়তী বুদার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “পাগলি একটা! চুপ কর। মাথা তোল। এত ওয়ার্কড আপ হয়ে থাকিস কেন? আমরা তোর বন্ধু না? আমরা কেন তোকে জাজ করতে যাব? এসব করিস না। পাগলি নাকি তুই! মুখ তোল।”

জয়তীর কথায় বুদা মুখ তুলল। পলি নিজের ব্যাগ থেকে একটা টিসু বের করে গিয়ে দিল বুদার দিকে। বুদা সেটা নিয়ে চোখ মুছল। তারপর সামান্য সময় নিল। সামনে রাখা গেলাসটা থেকে জল খেল একটু। তারপর ভেজা গলায় বলল, “সবাই আমাদের বয়কট করেছে! আমি ভাবলাম তোরাও… সরি রাধি। আমি তোর সঙ্গে খুব খারাপ বিহেভ করেছি। আই ওয়াজ সো টেন্‌সড!”

স্মরণ এসে বসল রাধিয়ার পাশে। তারপর কাঁধের ঝোলা থেকে প্রায় আট-দশটা নানা রকমের খেলনা বের করে রাখল সামনে। সবই খুব সাধারণ, সস্তা খেলনা। ভেঁপু, গাড়ি, খেলনা মোবাইল ধরনের। সবাই অবাক হয়ে তাকাল ওর দিকে।

স্মরণ সামনে চলা কান্নাকাটি পাত্তা না দিয়ে বলল, “একটা লোক খেলনা বিক্রি করছিল। যা স্পিচ দিল না, শাহরুখ খান ফেল! তাই কিনে নিলাম। যে যেটা খুশি নিয়ে নাও। শুধু এটা আমি নেব!” বলে একটা ছোট পুতুল তুলে নিল। বলল, “আমি এটা প্যাঁওকে দেব।”

পলি ছড়ানো খেলনা থেকে প্লাস্টিকের মোবাইলটা তুলে নিয়ে বলল, “এই যে স্মরণ, এখানে নিশানও আছে কিন্তু। তোমাদের এগেনস্টে প্রোটেস্ট করছে ও। কিন্তু সেই নিয়ে এখানে কোনও কথা হবে না। বুঝেছ?”

স্মরণ হাত তুলে বলল, “আমি কেন বলতে যাব। যে যার কাজ করছে। শুধু এটাই বলব যে, নিশানভাই, আমরা কিন্তু মিলটা চালাতে চাই। জোনাক-বাড়ি ভাঙতে চাই না। কিন্তু সেই নিয়ে আমি কিছু বলবই না!”

নিশান হাসল, “সবাই ওই বলেই ঢোকে তারপর আসল রং দেখায়।”

“কিন্তু আমরা তা নই। আমাদের আসল নকল, সবটাই একটা রং। কিন্তু আমি তো এই নিয়ে কিছু বলবই না!” স্মরণ এমন করে বলল কথাটা যে, হেসে ফেলল সবাই।

রাধিয়া দেখল, স্মরণ কথা বলার সময় সামান্য হাসল মাহিরের দিকে তাকিয়ে। আর মাহিরও ফিরিয়ে দিল সেই হাসি। কী হল! রাধিয়া কি ভুল দেখল? দু’জন দু’জনকে চেনে কি? তা হলে কেন এখানে সেটা লুকিয়ে গেল!

টেবিল ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলো এবার ধীরে-ধীরে সহজ হয়ে এল। পলিই দায়িত্ব নিয়ে খাবারের আর ড্রিঙ্কের অর্ডার করে দিল। আস্তে-আস্তে সবাই ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে কথাও শুরু করে দিল।

রাধিয়া চোয়াল শক্ত করল। পাশে বসে থাকলেও নিশান এখনও কথা বলেনি ওর সঙ্গে। রাধিয়ার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু যা হয়েছে, সেটা তো ওর জন্যই হয়েছে!

রাধিয়া সবার কান আর দৃষ্টি বাঁচিয়ে নিচু গলায় বলল, “আমি সরি!”

নিশান হাসল সামান্য, “কেন?”

রাধিয়া বলল, “ইউ নো ইট। তাই জন্য তো তুমি আর আমায় মেসেজ বা ফোন কিছুই করো না!”

নিশান হাসল, “সেই জন্য নয়।”

রাধিয়া সামান্য অভিমানী গলায় বলল, “তবে কী জন্য?”

নিশান হাসল শুধু, কিছু বলল না।

রাধিয়া আবার বলল, “সেদিন বাবা আমার মোবাইলে তোমার কিছু মেসেজ দেখে আমায় চেপে ধরেছিল। আমি তো মোবাইলে কোনও সিকিয়রিটি রাখি না! বাবা এমন করে বলেছিল যে, আমি বাধ্য হয়ে বলেছিলাম তোমার কথা। বাবা সব শুনেছিল মন দিয়ে। তারপর বলল, তোমায় চেনে। যখন আমার বন্ধু হও, তা হলে যেন মিট করাই। আমি তখন বললাম যে, আজই তো দেখা হবে। তখন বাবা ইনসিস্ট করল, আমি যেন তখনই তোমার সঙ্গে দেখা করাই। খুব নাকি দরকার তোমার সঙ্গে! আমার বাবা খুব পারসুয়েসিভ। আমি খুব ভয় পাই বাবাকে। তাই আমি না করতে পারিনি। আই ওয়াজ় সো টেন্‌সড। ফলসার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে পারলাম না! কেয়াআন্টির নার্সিং হোমের সামনে দিয়ে ঘুরে গেলাম। আয়াম সো কাওয়ার্ড! কিন্তু বিশ্বাস করো আমি বুঝতে পারিনি বাবা এমনটা করবে। তোমায় যে এভাবে অপমান করবে, আই সোয়্যার, আমি বুঝতে পারিনি। পারলে আমি এমন করতাম না। নিয়ে যেতাম না বাবাকে!”

“কী রে, তোরা এমন নিচু গলায় কী কথা বলছিস?” সুম্পা টেবিলের অন্যদিক থেকে খিকখিক করে হাসল।

রাধিয়া লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল।

নিশান বলল, “প্রাইভেট কথা। তোমাদের শুনতে হবে না!”

“তবে তো আমি শুনবই। আমিও শিখে নিয়ে প্যাঁওকে বলব! প্যাঁও খালি বলে আমি নাকি কোনও প্রাইভেট কথাই বলতে পারি না। সব কিছু নাকি পাবলিক হয়ে যায়! বাই দ্য ওয়ে পলি, প্যাঁওয়ের জন্য একটা খাবার প্যাক করে দেবে। ও চাইনিজ় খুব ভালবাসে। দেবে?”

পলি ভুরু কুঁচকে বলল, “ইস, কী করে বলছে দ্যাখো! আচ্ছা, সত্যি প্যাঁও বলে কেউ আছে?”

“কী বলে!” স্মরণ এমন করে বলল যেন আগ্রায় তাজমহল আছে কি না সেই নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ও বলল, “প্যাঁও দারুণ মেয়ে! ছোট্ট মুকুট কপাল। মুক্তোর মতো দাঁত। হাত-পা যা সুন্দর না! থুতনিতে সামান্য একটা টোল আছে। নাকে দু’পাশে দুটো ছোট্ট-ছোট্ট তিল। আর রঙ্গন ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁট! যা দেখতে না! তবে হ্যাঁ। খুব রাগী। সারাক্ষণ রেগে থাকে আমার ওপর। একটু এদিক-ওদিক হয়েছে কী ঝাড় দেয় আমায়! বলে, ‘স্মরণ সরকার, বেশি বাড় বাড়বি না!’ আমিও তাই বাড়ি না বেশি। দেখছিস না আমার হাইটটাও কেমন কম করে রেখেছি! প্যাঁও-এর কথা আমি অমান্য করি না কখনও। ও যখন বলে, ‘দূরে থাক, দূরে থাক।’ আমি দূরে থাকি। যা বলে তাই করি। বুঝলি। আই লাভ হার এনাফ টু লেট হার গো। বুঝেছ!”

রাধিয়া দেখল ওর সঙ্গে টেবিলের সবাই চুপ করে গেছে। ওর হাসি পেল খুব।

“খালি হাবিজাবি…” নিস্তব্ধতা ভেঙে পলিই প্রথম কথা বলল। কিন্তু শেষ করতে পারল না বাক্যটা।

“রাধি!” বলে একটা চেনা গলার চিৎকার চাবুকের মতো সপাং করে আছড়ে পড়ল সবার মাঝে!

রাধিয়ার হাতে একটা ফ্রেশ লাইমের গেলাস ছিল। ও এত ঘাবড়ে গেল যে, হাত থেকে কিছুটা পানীয় চলকে ওর জামায় পড়ে গেল। ও দ্রুত ঘুরল। আর সঙ্গে-সঙ্গে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল ওর! বাবা! এখানে বাবা কী করছে!

বাবা হনহন করে এসে রাধিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কী করছ এখানে তুমি? হাউ ক্যান ইউ মিঙ্গল উইথ পিপ্‌ল লাইক দিজ়! কাম, কাম উইথ মি!”

“বাবা,” রাধিয়া উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল।

“শাট আপ!” বাবা ফেটে পড়ল যেন, “চলো! আর কোনওদিন যদি এই প্যারাসাইটটার সঙ্গে আমি তোমায় দেখেছি তবে দেখো কী করি!”

বাবা যে নিশানকে বলছে, সেটা বুঝতে কারও বাকি রইল না।

নিশান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কী বললেন?”

“ইউ স্লাইমি ফাক, কে বলেছে তোমায় কথা বলতে!” বাবা ঘুরে দাঁড়াল নিশানের দিকে, “আমি ভাল করে গাড়িতে ডেকে কথা বলেছিলাম, ভাল লাগেনি, না? আজও তুই মিছিল করেছিস? তোর হুলিগানরা ফ্যাক্টরি গেটে ইট ছুড়েছে! আমি দেখাচ্ছি মজা! তারপর আবার আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিস! ইউ আর ব্লাডি ফিনিশড!”

নিশান বলল, “ভদ্রভাবে কথা বলুন।”

রাধিয়ার হাত-পা কাঁপছে। ওর মনে হচ্ছে, যে-কোন সময়ে ও পড়ে যাবে মাটিতে। রেস্তরাঁর লোকজন এগিয়ে এসেছে।

ম্যানেজার গোছের লোকটি বলল, “স্যার, প্লিজ় ডোন্ট ক্রিয়েট আ সিন।”

“শাট দ্য ফাক আপ ইউ বাস্টার্ড!” বাবা এবার লোকটির দিকে ঘুরল, “তোদের এই রেস্তরাঁ আমি এখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কিনব। রাধিয়া চলো। চলো!”

বাবা আর না দাঁড়িয়ে রাধিয়াকে টানতে-টানতে এগোতে লাগল। রাধিয়া তাকাল নিশানের দিকে। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। নিশান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে এখনও।

বাবা বলল, “ভাগ্যিস, মধু আমায় খবর দিল যে, জানোয়ারটা এখানে আছে! আই টোল্ড হিম টু কিপ অ্যান আই অন ইউ।”

রাধিয়া টলতে-টলতে বাবার সঙ্গে এগোতে লাগল। ওর চোখের সামনে সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে! মধুদা বাবাকে খবর দিয়েছে! মধুদা এমন করল! তাই আজ মধুদা… কিছু আর ভাবতে পারছে না রাধিয়া।

ও দেখল নিশানও এগিয়ে আসছে।

বাবা শেষবারের মতো পিছনে ঘুরল। বলল, “তোকে দেখ জানোয়ার কী করি আমি! দেখ! জাস্ট ফাকিং ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ!”

নিশানও গলা তুলল এবার। তারপর রাধিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই জন্য। এই জন্য আমি ফোন করিনি তোমায়! আমি জানতাম তোমার বাবা কী ধরনের মানুষ! বুঝলে!”

রাস্তায় হলুদ আলোর মধ্যে আরও বেশি করে বাদামি ছোপ পড়েছে যেন। সব কিছু কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছে চারদিকে। চাপ-চাপ অন্ধকার ক্রমে মুড়ে নিচ্ছে চারিদিক। মাটিতে পড়ে থাকা ফুলগুলোর গায়ে যেন জমে উঠছে বীভৎস পোকা! পচা গলা টিকটিকি আর ইঁদুর যেন ছড়িয়ে আছে চারিদিকে! সামনের বাড়িগুলোর গায়ে অজস্র ফাটল। রাক্ষসের মুখের মতো হাঁ করে সব দাঁড়িয়ে রয়েছে সার-সার! জলের ওপর থেকে ভেসে আসা হাওয়ায় যেন সোরা আর গন্ধকের ঘ্রাণ। রাস্তার পিচ যেন হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরছে ওর পা। এ আর কোনও সুন্দর শহর নয়। এ যেন এক মৃত্যু উপত্যকা!

রাধিয়া টলমলে পায়ে গাড়ির দিকে এগোল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, গাড়িটা নেই ওর সামনে। বরং বিশাল বড় একটা ড্রাগন যেন ওকে গিলে নেবে বলে মুখ খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে! সে তার অস্থির ডানা ঝাপটাচ্ছে! লেজের আছড়ানিতে ফাটিয়ে দিচ্ছে মাটি! চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে তার! রাধিয়া বুঝল ছোটবেলার কিছু জিনিস অন্যভাবে হলেও ঠিক বেঁচে থাকে বড়দের এই পৃথিবীতে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *