২০. আইকা

২০. আইকা

সিগনাল থেকে বাঁ দিকে ঘুরতেই হু হু করে হাওয়া ঢুকে এল ট্যাক্সির জানলা দিয়ে। আইকার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেল নিমেষে। আরামে চোখও বুজে এল! যা ভ্যাপসা গরম পড়েছে! ভাদ্র মাসের এই এক সমস্যা! বৃষ্টি বন্ধ হলেই চারদিক থেকে যেন কেউ গরম বাষ্প ছাড়তে শুরু করে! ঘাম হলে খুব কষ্ট হয় আইকার। ঘাম জিনিসটা কিছুতেই নিতে পারে না! আর আজকাল এসি-তে থাকতে-থাকতে অভ্যেসটাই খারাপ হয়ে গেছে! কিছুতেই সামান্য গরমও সহ্য হয় না! এই যে হলুদ ট্যাক্সিতে বসে আছে, এতেও খুব কষ্ট হচ্ছে ওর!

আজ নিজে ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছিল না। ভেবেছিল ভাড়া করে নেবে গাড়ি। তাই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ও দেখছিল কোনও অ্যাপ ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে কি না। কিন্তু কোনও গাড়ি নেই। আজকাল ছুটি হলেই দেখেছে গোটা শহরটা কেমন যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে রাস্তায় আর শপিং মলে। আজকাল শপিং করাটাও একটা এন্টারটেনমেন্ট! সারাক্ষণ কিছুতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চায় যেন মানুষ! এসব কি একাকিত্বের লক্ষণ? কিন্তু আজকাল তো চারিদিকে এত রকমের যোগাযোগের উপায়! আইকার মনে হয়, এই বাড়াবাড়িটাই বিপদের কারণ। দরকারের চেয়ে বেশি জিনিস কোনওদিনও ভাল নয়। বেশি যোগাযোগের ভিড়ে সত্যিকারের সম্পর্ক হারিয়ে যাচ্ছে। কথা হারিয়ে যাচ্ছে। নানারকমের হলুদ গোল্লাওয়ালা মুখ জানিয়ে দেবার চেষ্টা করছে হাসি, কষ্ট আর মনখারাপ! বুড়ো আঙুলের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে! আইকার মাঝে মাঝে মনে হয় এমন চলতে থাকলে কয়েকহাজার বছর পরে কি আস্তে-আস্তে মানুষের হাতের বাকি আঙুল সব লুপ্তপ্রায় হয়ে যাবে!

“দিদি সামনে নামবেন কি? না, এইখানে রাখব?”

ট্যাক্সিওয়ালার ডাকে হুঁশ ফিরল আইকার। ও তাকাল সামনে। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে গাড়িটা মলের মূল ফটকের উলটো ফুটপাথে দাঁড়িয়েছে।

“ব্যস এখানেই,” আইকা টাকার ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, “কত হয়েছে?”

ভাড়া মিটিয়ে রাস্তায় নেমে এদিক-ওদিক তাকাল আইকা। গাড়ির স্রোত চলেছে। ও ঘড়ি দেখল। ছ’টা বাজে। আকাশে আলো আছে এখনও। ও ওপরের দিকে তাকাল। পাখিদের একটা রেখা ওই ওপর দিয়ে উড়তে-উড়তে বেরিয়ে যাচ্ছে!

রুপিন কি এসে পড়েছেন! আইকা এপার থেকেই ওপারের মলের সামনের বড় বাঁধানো জায়গাটা দেখল। কোথায়! চোখে তো পড়ছে না! এদিকে পৌনে সাতটা নাগাদ এখানেই আর-একটা কাজ আছে। তারক চক্রবর্তী আসবে দেখা করতে!

আজ শনিবার বলে ছুটি ছিল আইকার। ভেবেছিল বাড়িতেই থাকবে। নিজের আলমারিটা একটু গোছাবে। তারপর পার্লারে যাবে। বেশ কিছুদিন হল পার্লারে যাওয়া হয়নি। আইব্রো করাটা খুব জরুরি। তা ছাড়া চুলটাও কাটবে। কিন্তু তারক চক্রবর্তী যে এমন করে দেখা করতে চাইবে, সেটা বুঝতে পারেনি।

গতকাল বিকেলে লোকটা নিজে ফোন করেছিল আইকাকে। আসলে এর আগে আইকা গিয়ে দু’বার দেখা করে এসেছে সোনাঝুরিতে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, কাজের কাজ কিছু হয়নি! তারক শুধু কথা দিয়ে মেপে গেছে ওকে। এমনকী এমনও ইঙ্গিত করেছে যে, আইকা মেয়ে হয়ে কেন এমন ঝামেলার কাজে ঢুকছে!

লোকটা যে অশিক্ষিত আর নোংরা, সেটা কথা আর চোখমুখ দেখেই বুঝেছে! কথা বলার সময় সমানে আইকার বুকের দিকে তাকাচ্ছিল ও। এটা নতুন কিছু নয়। অনেক ছেলেই এমন করে। তবে সেটা অসতর্ক ভাবে বা লুকিয়ে-চুরিয়ে। কিন্তু এই লোকটা এমন করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল যে, আইকা শেষমেশ বড় ব্যাগটাকে কোলের ওপর নিয়ে বুকটা আড়াল করে বসতে বাধ্য হয়েছিল! তাতে তারক বলেছিল, “আরে, শীত করছে নাকি! তবে এসিটা বন্ধ করে দিই!”

আইকার বিরক্তি আর ফ্রাস্ট্রেশন বাড়ছিল। ভাবছিল, দু’-দু’বার দেখা হয়ে গেল, কিন্তু লোকটা কিছুই বলছে না! যেন অপেক্ষা করছে! যেন দেখছে, আরও কেউ খেলায় নামবে কি না! যত বেশি পার্টি এই সোনাঝুরির জমি, বাড়ি আর জুট মিলের দিকে হাত বাড়াবে তত বেশি করে তারকের লাভ! দরকষাকষিটা আরও ভাল হবে আর কী!

সেই দুটো দিন আইকার বেকার গিয়েছে! ওই ভীষণ খারাপ রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে অতটা যাওয়ার কোনও ফলই হয়নি! ও বুঝতে পারছিল তারক ওকে লেজে খেলাচ্ছে মাত্র!

তারক শুধু ওকে বলেছিল, “আপনি আসছেন, কথা বলছেন আমার খারাপ লাগছে না! সুন্দরীদের সান্নিধ্য কে না চায়! কিন্তু আমায় একটু হিন্ট দিন তো, আমার জন্য কী ভেবেছেন? মানে, আমায় কতটা যোগ্য মনে করছেন, সেটা আমায় জানতে হবে তো!”

অফিস থেকে বলে দেওয়া একটা ডিল তারককে অফার করে এসেছে আইকা। তারক কিছু বলেনি, শুধু হেসেছে!

জুট মিল, পাশের বিস্তীর্ণ জায়গা আর জোনাক-বাড়ি গোটাটাই মালিক গ্রুপের। ওদের সঙ্গেও কথা বলছে আইকা। এমনকী রুপিন নিজেও বলছে। মুশকিলটা হল, কিছুতেই আসল মানুষটার নাগাল পাচ্ছে না ওরা। ডিরেক্টররা বলেছেন যে, চেয়ারপার্সনই কিন্তু শেষ ‘কল’-টা নেবেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই দেখা করছেন না! আইকা জানে ব্যাপারটা সহজ নয়। কারণ, এ এক বিরাট কর্মকাণ্ড। বোর্ডের লোকজন তো বলছেন, মিলের অবস্থা ভাল নয়। তাই তাঁরা সবটাই ছেড়ে দিতে চান! কিন্তু আসল জায়গা থেকে এখনও নাকি কিছু সেভাবে বলা হয়নি! চেয়ারপার্সন এখনও নাকি কোনও সিদ্ধান্ত নেননি!

আইকার অবাক লেগেছিল। একটা কোম্পানি, তারা তাদের জায়গা বিক্রি করে দেবে, তাতে তারক চক্রবর্তীকে কেন যোগাযোগ করতে হবে! রুপিনকে সেই কথাটা জিজ্ঞেসও করেছিল আইকা!

রুপিন সব শুনে হেসেছিলেন খুব। বলেছিলেন, “তুমি এমন বাচ্চা কেন আইকা! আমরা একটা মিল কিনে সেটা বন্ধ করে দেব। কত লোকের চাকরি যাবে বলো তো? তা ছাড়া ওই জমিতে জবরদখল করে হলেও বেশ কিছু লোক দোকান, বাড়ি করে রয়েছে! মাস ইভাকুয়েশন হলে তার একটা ব্যাকল্যাশ আসবে না? সেটা সামলাবে কে? প্লাস আরও নানা ঝামেলা আছে! পলিটিক্যাল পার্টির হেল্‌প তো লাগবেই! অ্যান্ড হিয়ার তারক চক্রবর্তী কাম্‌স ইনটু প্লে!”

সেই তারক চক্রবর্তী আচমকা গতকাল ফোন করেছিল।

সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে স্নান সেরে সবে মাগোকে নিয়ে বসেছিল আইকা। মাগোর জন্য একটা জামা কিনে এনেছিল। সেটাই পরিয়ে দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু তখনই ফোনটা এসেছিল।

বিরক্তই হয়েছিল আইকা। সারাদিন অফিসে নানা ঝামেলা থাকে। তারপর কাজের শেষে আবার ফোন এলে খুব রাগ হয়!

ফোনটা তুলে নম্বরটা দেখেছিল। চিনতে পারেনি আইকা। একটা ল্যান্ড লাইনের নম্বর! সামান্য দ্বিধা নিয়ে ধরেছিল কলটা।

“ম্যাডাম, আমি তারক বলছি।”

আইকা থমকে গিয়েছিল। লোকটা নিজে ফোন করল! কেন? ব্যাপার কী?

“বলুন?” আইকা যথাসম্ভব স্বাভাবিক ও অনাগ্রহী গলায় বলেছিল।

তারক সময় নিয়েছিল সামান্য। তারপর বলেছিল, “কাল একবার কথা বা দেখা হতে পারে?”

“কথা না দেখা?”

সামান্য ভেবে তারক বলেছিল, “দেখা। মুখ না দেখলে আমি আবার কথা বলতে পারি না! এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, আমার অস্বস্তি হচ্ছে! কারণ, আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।”

লোকটার কথার সঙ্গে একটা শোঁ শোঁ শ্বাসের শব্দ পাচ্ছিল ও। কেমন যেন বিরক্ত লাগছিল। ও বলেছিল, “কাল আমার ছুটি। আমি সোমবার দেখা করব?”

“আরে, আপনাকে দেখা করতে আসতে হবে না আমার কাছে। আমিই যাব আপনাদের ওদিকে! দেখুন, এখানে আমায় সবাই চেনে। কে এল, কে গেল সবাই নজর করে। বন্ধু আর অনুগত সেজে সবাই ঘুরে বেড়ায় আমার চারিদিকে। কিন্তু তাই বলে কেউ তো আর বন্ধু নয়। আমায় পদে-পদে সব দেখে চলতে হয়। তাই আমিই যাব কাল। এই ধরুন বারোটা নাগাদ! পার্টির দপ্তরে কাজ আছে আমার। সেটা চুকিয়ে যাব। কোথায় বসবেন, আপনি ঠিক করবেন। আমি পৌঁছে যাব। আর আমি কিন্তু নেমন্তন্ন করলাম। আশা করি আমায় না করবেন না!”

মাগো অস্থির হচ্ছিল আইকার কোলে। বারবার মোবাইলটা ধরে টানাটানি করছিল। নিজের ভাষায় কীসব ইকির-মিকির বলে যাচ্ছিল!

আইকা ছোট কথায় কাজ সারতে চাইছিল। ও বলেছিল, “ঠিক আছে। সকালে আমি আপনাকে ফোন করে নেব। আমায় আমার বসের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে!”

“আরে, আপনার বেবি আছে? কথা শুনছি?” তারক অবাক হয়েছিল যেন!

“মানে?” চমকে গিয়েছিল আইকা!

“ওই যে শুনছি!” হেসেছিল তারক, “আপনাকে দেখলে কিন্তু ইয়ে বোঝা যায় না যে… মানে এমন ফি… মানে নিজেকে ধরে রেখেছেন!”

আইকা আর উত্তর না দিয়ে বলেছিল, “কাল সকালে আমি আপনাকে জানাচ্ছি। গুড নাইট।”

তারক গুড নাইট বলার আগেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল আইকা। কেমন গা ঘিনঘিন করছিল! লোকটার চোখে কেমন একটা আঠা আছে! ফোনে কথা বললেও লোকটার দৃষ্টি যেন ওকে নোংরা করছিল!

আইকা কথার কথা হিসেবে বলেছিল যে, বসকে ফোন করবে! কিন্তু আসলে তার তো দরকারই নেই! রুপিন আইকাকে একটা পর্যায় অবধি ছাড় দিয়েই রেখেছেন। এসব সিদ্ধান্তর জন্য ওকে কারও সঙ্গে কথা বলতে হবে না।

সকালে আলমারি গোছানো, পার্লার যাওয়া সব বাতিল করে দিয়েছিল আইকা। তারপর তারককে ফোন করেছিল। কিন্তু তারক ফোন ধরেনি! অবাক হয়ে গিয়েছিল আইকা! নিজেই তো বলল দেখা করার কথা। আর এখন রিং হয়ে যাচ্ছে! তাও ফোন ধরছে না! এ কেমন অসভ্যতা!

সারা দুপুর কেটে গিয়েছিল। শেষে আইকা খেয়ে নিয়েছিল। তারপর বেলা সাড়ে তিনটের সময় এসেছিল তারকের ফোনটা! খুব দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিল, পার্টি অফিসে এমন কাজে আটকে পড়েছিল যে, ফোনটা ধরতে পারেনি। সন্ধে ছ’টার পরেই একমাত্র ও দেখা করতে পারবে।

আইকা কথা বাড়ায়নি! ও বলেছিল সন্ধে সাড়ে ছ’টার সময় রাজডাঙার কাছের মলটায় দেখা করতে পারবে ও! তারক এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল!

কিন্তু রুপিন কই? আইকা দু’দিক দেখল। গাড়ি এসেই যাচ্ছে ক্রমাগত! রাস্তা যে পার হবে তার উপায় নেই! আজকাল দূরের জিনিস দেখতে একটু সমস্যা হচ্ছে ওর! পাওয়ার বাড়ল নাকি? ও একবার মোবাইলটা দেখল। রুপিনকে কি একবার ফোন করবে? তারপরই মত পালটাল! ছ’টায় দেখা করার কথা। একটু দেখে নিয়ে তারপর ফোন করবে। এত সামান্যতে অধৈর্য হলে হবে না।

এই মলটা নতুন হয়েছে। বেশ বড়। আইকার ভালই লাগে এইসব জায়গায় আসতে। শপিং করতে খুব ভালবাসে ও। ছোটবেলার না পাওয়া সব কিছু এখন মনে হয় কেনে। মনে হয়, জীবন যা-যা করতে দেয়নি ওকে, সেইসব করে! শুভ ওকে কোনও কিছু করতে বারণ করেনি কোনওদিন। কিছু কিনতে, কোথাও যেতে বারণ করেনি। কিন্তু নিজেই যে অমন চট করে চলে যাবে, সেটা বুঝতে পারেনি আইকা! শুভ বারণ না করলেও ও বেহিসেবি কাজ বা খরচ করত না! কিন্তু শুভ মারা যাওয়ার পর, আইকার মধ্যে থেকে যেন আর-একটা আইকা বেরিয়ে এসেছে। শুভ মারা গিয়ে যেন ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই জীবন কতটা ভঙ্গুর! কতটা অনিশ্চিত! ওই ঘটনাটা যেন ওকে শিখিয়েছে যা আছে, যতটুকু আছে, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার মানে হয় না। জীবনকে কৃপণের মতো খরচ করা আর জীবনকে বাজে খরচ করার মধ্যে কোনও তফাত নেই। মনের সামান্য ইচ্ছেগুলোকে মেরে ফেলার কোনও মানে হয় না। আগের চেয়ে আইকা তাই নিজেকে মেলে ধরেছে অনেকখানি! শুভ যে বলত, কার্পে ডিয়েম, সেটার মানে বুঝতে পেরেছে এখন।

সামনের রাস্তায় গাড়ি একটু কমে এসেছে এবার। সিগনালটা বন্ধ হয়েছে নিশ্চয়! এই সুযোগে সামান্য হেঁটে আর দৌড়ে রাস্তা পার হল আইকা।

মলের সামনেটা কালো পাথর দিয়ে বাঁধানো। সেখানেও লোকজন দাঁড়িয়ে গল্প করছে। এখানে হাওয়া আরও বেশি! হাওয়ায় সব যেন লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে! আইকা মাথার চুলগুলোকে সামলে সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠে লম্বা বাঁধানো চত্বরে দাঁড়াল।

আকাশের নীল কমে এসেছে আরও। আশপাশটা আলোয় ঝলমল করছে। আইকা আবার দেখল চারদিকে। আর এবার দেখতে পেল রুপিনকে। একটা মেরুন টি-শার্ট আর নীল জিন্‌স পরে গাড়ি থেকে নামছেন। গায়ের ফরসা রঙের সঙ্গে অমন টি-শার্টটা যেন সবার মধ্যে আরও বেশি করে চোখে পড়ছে! রুপিনকে কোনওদিন এমন ইনফরমাল জামা কাপড়ে দেখেনি আইকা। তাই অদ্ভুত লাগল। আর যেন এই প্রথম খেয়াল করল রুপিনকে দেখতে বেশ ভাল! অনেকটা জর্জ ক্লুনির মতো।

রাস্তা থেকেই রুপিন হাত তুললেন। হাসলেন আইকাকে দেখে! আইকাও হাসল। আসলে ওর একটু অস্বস্তি হচ্ছে। রুপিনের সঙ্গে এভাবে আগে কখনও তো বাইরে দেখা করেনি! তাই কেমন একটা লাগছে!

আজ ওই সাড়ে তিনটের সময় তারকের সঙ্গে কথা বলার পর রুপিনকে ফোন করেছিল আইকা। না করলেও হত, কিন্তু তাও মনে হয়েছিল রুপিনকে একটু জানিয়ে রাখা ভাল!

দু’বার রিং হতেই ফোনটা ধরেছিলেন রুপিন।

“স্যার, আমি এক মিনিট কথা বলতে পারি?” আইকা দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।

“শিয়োর, বলো,” রুপিন নরম গলায় বলেছিলেন।

আইকা সময় নিয়ে ধীরে-ধীরে তারকের সঙ্গে হওয়া কথার মূল বিষয়টা বলেছিল।

রুপিন সবটা শুনে সময় নিয়েছিলেন একটু। তারপর বলেছিলেন, “নিশ্চয় দেখা করবে। আর ও যখন নিজে থেকে যোগাযোগ করছে, নিশ্চয় কিছু বক্তব্য আছে। জাস্ট ডোন্ট কমিট এনিথিং। তুমি শুধু শুনবে! কেমন?”

“থ্যাঙ্কস স্যার,” আইকা ভেবেছিল রেখে দেবে।

“আইকা,” রুপিনের গলায় সামান্য দ্বিধা শুনেছিল ও।

“স্যার?”

“মে আই টেক সাম অফ ইয়োর টাইম! মানে, ইটস ইমপর্ট্যান্ট। আই নিড সাম হেল্‌প,” রুপিনের প্রতিটা কথায় দ্বিধা ঝরে পড়ছিল।

“স্যার, ডোন্ট হেজ়িটেট, প্লিজ় বলুন,” আইকা যতটা সম্ভব আশ্বস্ত করেছিল রুপিনকে।

রুপিন সামান্য লাজুক গলায় বলেছিলেন, “আসলে আমার বোনের কাল টোয়েন্টি ফিফ্‌থ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি! আই নিড টু পিক আপ সাম গিফট ফর হার! মানে জুয়েলারি নয়। সাম নাইস ওয়ান্স। বাট আই কান্ট জ়িরো-ইন টু সামথিং স্পেসিফিক। তাই আজ মানে… ইফ ইউ লেন্ড মি সাম অফ ইয়োর টাইম… দেন… তোমার কনভিনিয়েন্ট টাইম বোলো, আই উইল বি দেয়ার!”

“স্যার, কোনও অসুবিধেই নেই,” রুপিনের এমন ইতস্তত ভাব দেখে খুব হাসি পেয়ে গিয়েছিল আইকার, “আমি তো ওই মলে যাবই। তো আপনি যদি ছ’টার সময় আসতে পারেন। তা হলে মনে হয় কেনা হয়ে যাবে।”

“সো কাইন্ড অফ ইউ,” রুপিন যেন স্বস্তি পেয়েছিলেন, “প্লিজ় ডোন্ট মাইন্ড। আসলে আমি এসব করিনি তো কোনওদিন।”

আইকা যেন মনে মনে দেখতে পাচ্ছিল রুপিনের ফরসা মুখটা কেমন যেন লাল হয়ে উঠছে!

“হাই আইকা!” রুপিন সামনে এসে দাঁড়ালেন, “আয়াম সরি, ইউ হ্যাড টু ওয়েট! স্যাটারডে করে আজকাল চারদিকে এত জ্যাম হয়! সরি।”

“স্যার প্লিজ়!” আইকা হাসল।

“ইউ ক্যান কল মি রুপিন! আমরা তো অফিসে নেই আর! আই ডোন্ট লাইক প্রোটোকলস!”

আইকার লজ্জা লাগল হঠাৎ। এমন করে রুপিন বললেন, যেন নাম ধরে ডাকাটা কোনও ব্যাপার নয়!

ও পাশ কাটিয়ে বলল, “চলুন স্যার। ভেতরে যাওয়া যাক!”

রুপিন শুনে হাসলেন একটু। নিজের মনে মাথা নাড়ালেন। তারপর মলের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

আইকাও রুপিনের পেছনে-পেছনে এগোতে গেল। কিন্তু চোখের কোণ দিয়ে কাকে যেন দেখে একটু থমকে গেল। ও মুখ ফেরাল। একটা ছেলে। বেশ লম্বা। ভাল চেহারা। একটা জিন্‌স আর টি-শার্ট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্যদিকে তাকিয়ে।

আইকার কেমন যেন লাগল। ছেলেটা এখন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর মনে হল, ছেলেটা একটু আগে ওকেই দেখছিল! খুব চেনা লাগল ছেলেটাকে। কিন্তু মনে করতে পারল না। কে এটা? মনের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে ওর!

“আর ইউ কামিং?” রুপিন পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন।

আইকা হেসে এগিয়ে গেল।

মলের ভেতরে ঢুকে ভাল লাগল আইকার। ঠান্ডা! চারিদিকে লোকজন থাকলেও তাতে খুব কিছু অসুবিধে হচ্ছে না! বরং ভালই লাগছে। এই মলগুলো কেমন ঝকঝক করে! কিন্তু যে-মানুষগুলো এই মলে আসে তারাই কলকাতার অবস্থা কী খারাপ করে রেখেছে! যেন দুটো আলাদা ডাইমেনশন! নয়তো যেন মানসিক রোগে ভুগছে সবাই। একের মধ্যে দু’রকম বিপরীত মানুষ ঢুকে বসে আছে!

“স্যার, আপনি কী কিনতে চান?” আইকা তাকাল রুপিনের দিকে।

রুপিন অসহায়ের মতো তাকালেন আইকার দিকে। মাথা নেড়ে হাত ছড়িয়ে বললেন, “নো ক্লু! আমি জানি না বোন কী পছন্দ করে! আর শুধু বোন নয়, আমার বোনাইয়ের জন্যও কিছু কিনতে চাই। পারফিউম দেব না। কারণ, আই অ্যাম আ বিট সুপারস্টিশাস! আদার দ্যান দ্যাট ইউ চুজ়।”

আইকা ইতস্তত করল। রুপিন বলছেন বটে, কিন্তু কত বাজেট সেটা বলছেন না! তা হলে কী করে কিনবে ও?

ও রুপিনের দিকে তাকিয়ে হাসল। রুপিন যেন বুঝতে পারলেন কিছু! বললেন, “অ্যারাউন্ড ফিফটি থাউজ়্যান্ড ইজ় মাই লিমিট টুডে।”

বাপ রে! আইকা মনে মনে চমকে উঠল! পঞ্চাশ হাজার টাকার গিফট! সোনা দেবেন না এদিকে!

ও ঠোঁট কামড়ে তাকাল রুপিনের দিকে। তারপর বলল, “রিস্ট ওয়াচ!”

“গ্রেট চয়েস!” সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নাড়লেন রুপিন, “রিস্ট ওয়াচ জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি একটা অ্যান্টিক ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে! এটা ভাল বলেছ! লেটস্‌ বাই দেন!”

এসকালেটার বেয়ে ওরা ওপরে উঠে গেল। ঘড়ির দোকানটা আলোয় ঝলমল করছে! আইকা ভাবল এরা কত টাকা ইলেকট্রিক বিল দেয়! তারপরেই হাসি পেয়ে গেল। এখনও মাঝে মাঝে ওর মনের ভেতরে যাদবপুরের কলোনির একটা ঘরে বড় হওয়া মেয়েটা বেরিয়ে পড়ে। মেঘ করে আসা বর্ষাকালে লেখাপড়া করবে বলে দিনের বেলায় একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্‌ব জ্বালানোর জন্যও যাকে বাড়িওয়ালি জেঠিমার কাছে গালাগালি খেতে হত!

ওরা দোকানে ঢুকতেই খুব সাজগোজ করা একটা মেয়ে এগিয়ে এল ওদের দিকে। মেয়েটা একটা টপ আর স্কার্ট পরে আছে। মুখে আচ্ছা করে রং লেপেছে! গায়ের রং যে কারও এমন অদ্ভুত কমলা হতে পারে না, সেটা মেকআপ করার সময় মেয়েটার মনে ছিল না!

আইকা দেখল মেয়েটার ডান হাতের অনামিকায় একটা রুপোয় বাঁধানো পলার আংটি। আর বাঁ হাতের বাহুতে টপের ফাঁক দিয়ে লাল কারে বাঁধা শিকড় উঁকি মারছে!

মেয়েটা কায়দা করে ইংরেজি বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু উচ্চারণের জন্য সেটা আমেরিকান ইংরিজি না হয়ে অদ্ভুত একটা উচ্চারণ হচ্ছে!

আইকার কষ্ট হল মেয়েটাকে দেখে। কোন বাড়ির মেয়ে! কত বয়স হবে? এই বাইশ-তেইশ। নিজেকে ছাপিয়ে ও স্মার্ট আর ঝকঝকে হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এমন কষ্টের সঙ্গে ও নিজেও পরিচিত।

আইকা বাংলায় বলল, “আমরা ঘড়ি দেখতে এসেছি। ফর কাপ্‌ল। মাঝবয়সি কাপ্‌লদের জন্য!”

বাংলা শুনে মেয়েটাও যেন স্বস্তি পেল একটু। হাসল। তারপর এগিয়ে নিয়ে গেল কাউন্টারের দিকে!

ঘড়ি পছন্দ করতে আইকার মিনিট কুড়ি সময় লাগল। রুপিন যেটা দেখছিলেন সেটাই খুব ভাল বলে কিনতে চাইছিলেন। কিন্তু আইকা সেটা হতে দেয়নি! বরং দু’বার তো একটু বকেইছে রুপিনকে। বলেছে, “স্যার, প্লিজ় ইউ স্টে আউট অফ দিস!”

আইকা দেখেছে যে, এতে রুপিন রাগ তো করেনইনি, বরং হেসেছেন খুব! দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে পিছিয়ে গিয়েছেন!

দুটো ঘড়ি ছাপ্পান্ন হাজার টাকা! আইকা মনে মনে আবার চমকাল! সময় দামি জানত! কিন্তু এমন দামি না হলেও বোধহয় চলত!

রুপিন নিজেই এগিয়ে গেলেন ক্যাশের দিকে। আইকা এই সময়ের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে আরও কয়েকটা ঘড়ি দেখল। বেশ ঘড়িগুলো। কিন্তু বড্ড দাম! আইকা নিজে ঘড়ি পরে না আর। মোবাইলেই তো দেখা হয়ে যায় সময়।

“লেটস গো,” রুপিন হাতে প্যাকেট নিয়ে এসে দাঁড়ালেন পাশে।

দোকানের বাইরে এসে দাঁড়তেই পিংপিং করে আইকার মোবাইলটা বেজে উঠল। ওই বোধহয় এসে পড়েছে!

আইকা দেখল মোবাইলটা। ঠিক ধরেছে। ও রুপিনের দিকে তাকাল। তারপর ফোনটা ধরে বলল, “ইয়েস। ও, এসে গিয়েছেন? কোথায়? ও আচ্ছা। আমি আসছি তা হলে। ফাইভ মিনিটস।”

ফোনটা কেটে রুপিনের দিকে তাকাল আইকা। বলল, “স্যার, আই নিড টু লিভ। তারক চক্রবর্তী এসে গিয়েছেন।”

রুপিন মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যাব তোমার সঙ্গে?”

“না স্যার, আই ক্যান ম্যানেজ। আপনাকে দেখলে হি উইল বিকাম মোর গ্রিডি। মানে আই থিঙ্ক হি ইজ় হিয়ার টু ইনটিমেট হিজ় প্রাইস টুডে।”

রুপিন চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “ওকে। শিয়োর!”

“আমি আসছি স্যার। আই উইল লেট ইউ নো!”

আইকা পা বাড়াতে গেল। কিন্তু পারল না। রুপিন হাত তুলে আটকালেন ওকে। তারপর হাতের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে ওর হাতে দিয়ে বললেন, “দিস ইজ় ফর ইউ। আর একদম আরগু করবে না। টেক দিস অ্যান্ড প্রসিড টুওয়ার্ডস দ্য মিটিং! বাই।”

গোটা ব্যাপারটা এমন করে ঘটে গেল যে, আইকা কী বলবে বুঝতে পারল না। ও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে দেখল, রুপিন দ্রুত হেঁটে এসকালেটর বেয়ে নেমে গেলেন নীচে।

একটা ঘড়ির বাক্স! এটা কখন কিনলেন রুপিন! ও যখন অন্যমনস্ক হয়ে ঘড়ি দেখছিল তখন? ও কী করবে? ঘড়ি তো পরে না! কিন্তু ফেরত দেওয়াটাও তো ভাল দেখাবে না! তা হলে? আইকা মাথা নাড়ল নিজের মনে। লজ্জা করছে খুব। অপ্রস্তুত লাগছে খুব! এটা কী হল? এভাবে গিফট করলেন কেন রুপিন? আইকা তো এটা চায়নি! আশাও করেনি! এভাবে ধন্যবাদ জানানোর কী দরকার ছিল! আইকার তো ভালই লাগছিল এই শপিংটা করতে। কিন্তু আর কিছু করার নেই। কাঁধের বড় ব্যাগে বাক্সটা ভরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল আইকা।

এসকালেটার দিয়ে উঠে খাবারের জায়গা। একপাশে বাচ্চাদের খেলাধুলোর দোকান। কফি শপ। আইসক্রিমের কাউন্টার। সিনেমা হলও আছে। কিন্তু সেই দিকে না গিয়ে অন্যদিকে এগোল আইকা। সামনে ঝলমলে একটা জায়গা। এই রেস্তরাঁর কথাই বলেছে তারক।

কাচের দরজার সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। আইকা যেতেই মাথা নেড়ে ওকে অভিবাদন করল। তারপর খুব ভদ্রভাবে বলল, “উই আর কমপ্লিটলি অকুপায়েড ম্যাম। প্লিজ় রাইট ডাউন ইয়োর নেম। উই উইল কল ইউ!”

আইকা বলল, “কিন্তু আমি যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, সে ভেতরে আছে!”

“সরি ম্যাম,” মেয়েটি সামান্য হেসে বলল, “ইউ হ্যাভ টু ওয়েট…”

“আরে!” আইকা বলল, “ব্যাপারটা বুঝুন। একজন এসেছেন! আমি দেখা করতে এসেছি তাঁর সঙ্গে!”

“সরি ম্যাম, ইউ হ্যাভ টু ওয়েট!” হাসি-হাসি মুখ থাকলেও মেয়েটার গলায় জেদ।

“কী বে?” আচমকা রেস্তরাঁর ভেতর থেকে তারক বেরিয়ে এল।

মেয়েটি ঘাবড়ে গেল বেশ। তারকের অমন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। কপালে কমলা রঙের তিলক। গলায় উত্তরীয়। পায়ে সাদা স্নিকার্স। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে লোকটি কী করে বা কীসের সঙ্গে যুক্ত।

আইকা দেখল, বাইরে থেকেও তিন-চারজন ছেলে এগিয়ে এল। চোয়াড়ে ধরনের চেহারা তাদের। মুখ দেখলেই বোঝা যায় নেতাদের পেছনের চামচা এগুলো। তারক ভেতরে থাকলেও এরা বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আইকার বিরক্ত লাগে এই শ্রেণির লোকজনকে দেখলে। একা কিছু করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা নেই! নেতাদের আড়ালে দাঁড়িয়ে গুন্ডামি আর ধমক-ধামক দেওয়া শুধু! আইকা মাঝে মাঝে ভাবে আসলে কিছুই পালটায়নি। আগে বর্গিরা যুদ্ধের সময় ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করত আর বাকি সময় লুঠতরাজ করত, এখনও এরা ভোটের সময় পার্টিগুলোর হয়ে ‘খাটাখাটনি’ করে, তারপর নানাভাবে তোলাবাজি আর গুন্ডামি করে বেড়ায়! ইতিহাসে, জামাকাপড় আর মুকুটের রংই পালটায় শুধু, মানুষগুলো একইরকম থেকে যায়।

তারক গলার উত্তরীয়টা মাফলারের মতো করে গলায় পেঁচিয়ে বলল, “ওকে আটকাচ্ছ কেন? আমার গেস্ট না?”

মেয়েটি শুকনো মুখে বলল, “আমি স্যার ওঁকে বলছিলাম… একটা তো রুল আছে!”

এবার রেস্তরাঁর ভেতর থেকে একজন ম্যানেজার গোছের লোক বেরিয়ে এল হন্তদন্ত হয়ে। তারকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “হোয়াটস দ্য ইনকনভিনিয়েন্স স্যার?”

“বাঞ্চোত!” তারক ঠোঁট কামড়ে লোকটার দিকে তাকাল, “বাঙালির পো হয়ে ইংরেজি মারাচ্ছ? রুল? রুলের গুঁতো খেয়েছ? তোদের গোটা হোটেল পেছনে দিয়ে দেব শুয়োরের বাচ্চা! ম্যাডাম আমার গেস্ট। বলে কিনা ঢুকতে দেবে না! নিয়ম দেখাচ্ছে! আমার মটকা তেতে গেলে না কেলিয়ে দাঁত খুলে নেব!”

ম্যানেজারটি হাসছিল। কিন্তু দাঁত খুলে নেওয়ার আশঙ্কাতেই কি না কে জানে, দ্রুত বেরিয়ে থাকা দাঁতগুলো ঢুকিয়ে নিল!

তারক দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আমায় চেনো না চাঁদু! পোঙাপাকামো করেছ কী, পোঙা ভেঙে বাড়ির দেওয়ালে ডেকরেশন করে দেব! আসুন ম্যাডাম।”

আইকা দেখল ম্যানেজারটি মাথা ঝুঁকিয়ে আইকাকে ভেতরে যাওয়ার জন্য বিগলিত হয়ে হাত দেখাল।

তারক কটমট করে তাকাল ম্যানেজারটির দিকে। তারপর বলল, “আর ঢ্যামনামো করতে হবে না! আমার জন্য একটা নিট পাঠা!”

রেস্তরাঁর ভেতরে সবাই গন্ডগোলে থমকে ছিল। এবার ওরা ঢুকতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল!

তারক নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে পাশের টেবিলে বসা একটা ইয়া মোটা, ফরসা লোকের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী কাকা, ভাল টাইট দিয়েছি না? শালা ইংরেজি মারাচ্ছে! বাড়িতে উবু হয়ে বসে হাগে, আবার ইংরেজি মারায়! বেশি ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করলেই পোঙা ভেঙে বাড়ির দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেব। কেমন? তুমি খাও।”

লোকটা দ্রুত তারকের মধুর বাক্যে সম্মতি জানিয়ে গোগ্রাসে নিজের খাবার শেষ করতে লাগল। আইকা বুঝল লোকটা আর পাশের টেবলে বসে থাকার কোনওরকম রিস্ক নিতে চাইছে না!

তারকের টেবিলে একটা বিয়ারের মাগ। সামনে চিকেনের দু’-তিন রকম প্লেট। লোকটা যে ড্রিঙ্ক করে আছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল!

“ম্যাডাম, আপনি কী নেবেন? আমি খাওয়াব!”

আইকা দেখল, এ এমন অবস্থায় আছে যে, এর সঙ্গে বেশি কথা বাড়ানো মুশকিল! ও বলল, “আজ আমার উপোস! তাই খাব না কিছু!”

“উ…” তারকের চোখ গোল হয়ে গেল, “আপনারা উপোস করেন!”

“কেন?” আইকা তাকাল অবাক হয়ে!

তারক ফিক করে হাসল! লোকটার নেশা হয়ে গেছে কি! কেমন একটা ব্যবহার করছে!

তারক সামনে রাখা বিয়ারের মাগটা তুলে লম্বা চুমুক দিয়ে শব্দ করে ঢেকুর তুলল! পাশের টেবলের সেই মোটা লোকটি সামান্য অসন্তুষ্ট হয়ে তাকাল।

তারক আবার ঘুরল লোকটার দিকে, “কী হল, কাকা? তুমি ঢেকুর তোলো না? দেখে তো মনে হচ্ছে ঢেকুর ছাড়াও নানা শব্দ বের করো শরীর থেকে! অমন তাকিয়ো না, মটকা তাতছে কিন্তু!”

“প্লিজ়,” আইকা এবার না বলে পারল না, “একটু কন্ট্রোল করুন। এমন করবেন না। আমার এমব্যারাসিং লাগছে!”

তারক থমকে গেল এবার। তারপর হাসল। বলল, “আচ্ছা, বাদ দিন। আসলে আপনাদের মতো মোমপালিশ করা মেয়েরা এমন উপোস করে, আমি জানতাম না!”

মোমপালিশ! কথাটা কট করে কানে লাগল আইকার। কিন্তু ও কিছু বলল না। তারক যে পুরো নেশাগ্রস্ত, সেটা বোঝাই যাচ্ছে!

আইকা জিজ্ঞেস করল, “আপনি ডাকলেন কেন? যদি কাইন্ডলি বলেন! আমার একটা কাজ আছে!”

“ইয়েস!” তারক একটা চিকেন তুলে মুখে দিয়ে তাকাল আইকার দিকে। তারপর বলল, “আপনাদের সোনাঝুরির জায়গা, মিল, জোনাক-বাড়ি চাই। ওখানে অনেক লোক থাকে। আপনারা সব নিয়ে সেই লোকগুলোকে উৎখাত করবেন! বিশাল প্রজেক্ট বানাবেন! ভাল। কিন্তু সেটা করতে গেলে বহু গরিবের বহুত কষ্ট হবে। তাই না?”

আইকা তাকিয়ে রইল।

তারক বলল, “আপনারা চান যাতে ঝামেলা না হয়। চান, যাতে কেউ প্রতিবাদ না করে! তাই তো? সেটার জন্যই তো আমার কাছে গিয়েছিলেন! ঠিক আছে। জানেন তো আরও একটা পার্টি ঘুরঘুর করছে। পুশকিন চক্রবর্তী। সেও দেখা করতে চাইছে। অফিস থেকে একটা ছেলেকেও পাঠিয়েছে কয়েকবার। জানেন তো?”

এসব জানে আইকা। কিন্তু এটাই তো স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিজের জায়গায়। কিন্তু কাজটা কাজই। এটা ও জানে যে, পুশকিনদের কোম্পানি ‘রিকো গ্রুপ’-ও এই একই লক্ষ্যে এগোচ্ছে!

আইকা বলল, “আপনি কেন ডেকেছেন যদি বলেন।”

তারক বলল, “আমার দুটো মেয়ে! বউ নেই। বহু আগে এক ছোঁড়ার সঙ্গে পালিয়েছিল! আমি জানেন, বউকে খোঁজার চেষ্টা করিনি। যে নিজের ইচ্ছেয় চলে যায় তাকে জোর করে লাভ নেই! আমার বউয়ের যদি অন্য কাউকে পছন্দ হয়, তবে আর কী করা যাবে! কিন্তু একটা জিনিস হয়েছে তারপর থেকে। আমি আমার মেয়েদের ব্যাপারে খুব ইনসিকিয়র্ড হয়ে পড়েছি! ওদের ভবিষ্যৎও তো আমাকেই দেখতে হবে। তাই চারটে থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাট, প্রেফারেবলি নদীর পাশে। আর দেড় কোটি টাকা! আমার মেয়েদের জন্য এটাই এনাফ হবে।”

আইকা ভেতরে-ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে দেখাল না। বলল, “ঠিক আছে মিস্টার চক্রবর্তী। আমি অফিসে জানিয়ে দেব। তারপর জানাব কী করতে পারছি!”

তারক তাকিয়ে হাসল। বলল, “জানাবেন! পুশকিন কিন্তু আরও বেশি দিতে রাজি! কিন্তু আপনি এসেছেন আগে। দু’বার দেখা করেছেন। তাই আপনার চান্স আগে! আমি লোভী নই। প্র্যাকটিকাল। আসুন!”

তারক আর কথা না বাড়িয়ে হাতজোড় করে হাসল।

আইকা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। এত টাকা! চারটে ফ্ল্যাট! নদীর পাশে! পাগল নাকি?

ও চারিদিকে তাকাল। লোকজন এখনও তারককে দেখছে! নিজেদের মধ্যে কীসব বলাবলি করছে! কিন্তু তারকের কিছু খারাপ লাগছে বলে তো মনে হচ্ছে না! পাত্তাই দিচ্ছে না!

আইকা এগিয়ে গেল দরজার দিকে। কিন্তু হঠাৎ কী একটা মনে হল ওর! ওটা কে?

আইকা দ্রুত মাথা তুলল। রেস্তরাঁর দেওয়ালটা পুরো কাচের। বাইরের সব দেখা যাচ্ছে! আর সেখানেই ছেলেটাকে দেখল ও। আবার!

সেই লম্বামতো। বড় চেহারা। জিন্‌স আর সস্তার টি-শার্ট পরা! ছেলেটা স্থিরভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে! বেশ কিছুটা দূরে হলেও আইকার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না!

শরীরের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল ওর। ছেলেটা কি ওকে ফলো করছে? কেন করছে? কে ছেলেটা? কী চায়?

আচমকা মনে পড়ে গেল ওর। আরে, এ তো সেই ছেলে! ঋষির বাড়ি থেকে একদিন শেয়ার গাড়িতে করে ফেরার সময়ে দেখেছিল। সঙ্গে একটা রোগা করে ছেলেও ছিল! ছেলেটা কী করছে এখানে! কী চায়? ওকেই কি ফলো করছে? নাকি এমনি এসেছে! বুঝতে পারছে না আইকা। কিন্তু কেন কে জানে গোটা ব্যাপারটা ভালও লাগছে না! খালি মনে হচ্ছে সামনে কোনও বিপদ আসতে চলেছে! যাদবপুর কলোনির সেই ভিতু মেয়েটা যেন আবার গুটিগুটি করে এসে মনের দখল নিচ্ছে ওর।

.

২১. কাজু

আজ হাওয়া দিচ্ছে খুব। গঙ্গার দিক থেকে অদ্ভুত একটা হাওয়া এসে যেন পাউডারের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে সোনাঝুরির আকাশে বাতাসে! এই অন্ধকারে বসে হাওয়ায় ডুবে যেতে যেতে কী ভাল যে লাগছে কাজুর! উঠতে ইচ্ছে করছে না।

জোনাক-বাড়ির এই বাগানের দিকটা অন্ধকার থাকে। বিশাল কম্পাউন্ডের এই দিকটায় বিশেষ কেউ আসে-টাসে না। চারটে বিশাল বড়-বড় বাড়ির ব্লকের পরে একটা রাস্তা কিছুটা এসেছে এই বাগানের মধ্যে। তবে নামে বাগান হলেও পরিচর্যার অভাবে এটা এখন কেমন একটা জঙ্গলের আকার নিয়েছে। সামনেই বাউন্ডারি ওয়াল। তবে তার কিছুটা বেশ ভাঙা। কিন্তু যেহেতু এদিকে কেউ আসে না, তাই এটা সারানোও হয় না। তবে সারাবেই-বা কে?

আসলে জোনাক-বাড়িতে যারা থাকে, তারা কেউই এটা সারাবে না। ইচ্ছে থাকলেও তাদের সেই সামর্থ্য নেই। আর এই বাড়িটা সুদর্শন মালিকদের। যারা থাকে তাদের অধিকাংশ লোকই জুটমিলে কাজ করে। বাকিরা ভাড়া দিয়ে থাকে। তবে সেটাও খুব বেশি নয়। তাই মালিকরাও কেউ এটা সারানোর গরজ করে না।

“কী ভাবছিস কী?” সতু কনুই দিয়ে খোঁচা দিল।

কাজু মাথা নাড়ল। তারপর সামান্য শব্দ করে হাসল, “না, এই বাড়িটার কথা ভাবছিলাম! ভাগের মা গঙ্গা পায় না অবস্থা বাড়ির! অনেক জায়গা রিপেয়ার করা দরকার!”

“ছাড় তো!” সতু হাসল, “কী সব ভাবিস! তার চেয়ে সামনে দেখ! কী সুন্দর না!”

কাজু কথা না বলে তাকিয়ে রইল। সামনে অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু জোনাকি জ্বলছে। অনেক জোনাকি। বাড়িটার চারিদিকে এত জোনাকি জ্বলে থাকে যে, অদ্ভুত লাগে কাজুর! মনে হল আকাশ থেকে হাজার-হাজার তারা নেমে এসেছে মাটিতে!

ছোটবেলায় ও কাচের বয়ামে জোনাকিদের ধরে রাখত। সারাদিন বয়ামটাকে ও ঢেকে রাখত কাপড় দিয়ে। তারপর ছাদের ওপরের ভাঙা ঘরে গিয়ে সন্ধের অন্ধকারে বয়ামটার কাপড় সরিয়ে দিত! আর দেখত, অপার্থিব এক সবুজ-হলুদ আলো! ঘরের দেওয়ালে কেমন জলের মতো সেই আলোর ঢেউ খেলত! ওর মনে হত কোনও দূর আর অজানা সমুদ্রের তলায় যেন বসে রয়েছে ও! বয়ামের চারপাশে হাত ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখত ও। হাতে আলোর টুকরো ছড়িয়ে থাকত! কিন্তু ধরা যেত না! বাবাও মাঝে মাঝে ওর পাশে বসে দেখত এই সব আলোর জাদু! আর বলত, “মানুষের কিছু-কিছু ইচ্ছেরা এমন হয় জানিস! এই জোনাকিদের আলোর মতো। দেখা যায়, কিন্তু হাতের মুঠোয় ধরা যায় না! তাদের শুধু দূর থেকে দেখেই যেতে হয়!”

তখন বাবা কী বলছে না-বুঝলেও আজ বড় হওয়ার পরে এই সব কিছু বুঝতে পারে কাজু। বুঝতে পারে কোন কষ্ট আর হতাশা থেকে বাবা ওকে এইসব কথা বলত!

“তোদের এই বাড়িটাকে জোনাক-বাড়ি বলে, কিছু খারাপ বলে না। শালা ভারতের সমস্ত জোনাকি কি এখানেই এসে জমেছে?” সতু চিনেবাদামের ঠোঙার মুখটা খুলে হাতে ঢালল।

কাজু কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু।

সতু বলল, “শালা, সারাক্ষণ এমন করে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়বি, কিন্তু তাও পেখমের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিবি না! শালা, তোকে বোঝা ভার। ভালই যদি বাসিস তা হলে এমন করছিস কেন বে?”

কাজু চোয়াল শক্ত করল। ও চাইছিল না এই প্রসঙ্গটা উঠুক। কিন্তু এই সতুব্যাটা ভুল সময়ে ভুল কথা তুলবেই!

ও বলল, “এই নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগছে না!”

“কেন?” সতু ছাড়ল না, “সেদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল পেখমের পাঁচ মিনিটের জন্য। মেয়েটার মুখ-চোখ বসে গিয়েছে! কেমন অসুস্থ লাগল। আমি কথা বললাম। ও শুধু হুঁ হাঁ করে গেল গোটা সময়। শেষে আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম যে, কাজুর সঙ্গে দেখা হয়? তাতে মেয়েটা সবার সামনে যা কাঁদল! তুই শালা মানুষ!”

কাজু সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চে এবার ঘুরে বসল, “এটা আগে বলিসনি তো!”

“কী বলব?” সতু পাশ ফিরে তাকাল।

“এই যে পেখমের সঙ্গে তোর দেখা হয়েছিল, এটা বলিসনি তো!”

“বললে কী করতিস? সেদিন মেয়েটা নিজে তোর সঙ্গে কথা বলতে এল, তুই কথা বললি? বললি না। সাইকেলে উঠে চলে গেলি! তারপর মেয়েটার সঙ্গে সব কথা, সম্পর্ক শেষ করে দিলি! আর বলছিস আমি তোকে বলিনি কেন!”

কাজু চোয়াল শক্ত করল। বুকের ভেতরে কেমন একটা দমচাপা কষ্ট হচ্ছে ওর। পেখমের কথা উঠলেই এমনটা হয়!

কেবলই মনে হয়, মেয়েটা এই পৃথিবীতে থাকবে কিন্তু ওর হবে না! ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না! অন্যের হয়ে যাবে মেয়েটা! অন্যের জন্য চিন্তা করবে! অন্যের সঙ্গে সময় কাটাবে! অন্যের সন্তান ধারণ করবে! অন্যের শরীরের গন্ধ মিশে থাকবে ওর শ্বাসে! যাকে কাজু সব দিয়ে ভালবাসল, সে এটা কী করে করতে পারল ওর সঙ্গে?

“কী হয়েছে তোর কাজু! আমার সঙ্গে কিচ্ছু দেখা হয়নি পেখমের! আমি জাস্ট দেখলাম তোর রিঅ্যাকশন!” সতু আলতো ঠেলল ওকে, “দেখ ভাই আমি ধর তক্তা মার পেরেক টাইপের ছেলে! রাজনীতি নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু এটুকু আমিও বুঝি যে, মেয়েটা তোকে পাগলের মতো ভালবাসে! আর তুই নিজেই বলেছিস একদিন মেয়েটা এসেছিল তোর কাছে, তুই ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিস! তারপর সেদিন সন্ধেবেলা তোর কাছে আবার এল, তুই ওকে দেখতে পাসনি এমন ভাব করে চলে গেলি! তোর দাবিটা কী? মেয়েটা কী করেছে?”

“ও বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছে,” কাজু ছোট করে বলল।

ছোট একটা বাক্য। কিন্তু বলতে গিয়ে কাজুর মনে হল বুক থেকে জিভ অবধি সবটা পুড়ে গিয়েছে ওর! কেমন একটা শূন্যতা টের পাচ্ছে যেন ও! কাজু বুঝল, কিছু বলে দেওয়া আর মনে মনে বিশ্বাস করার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক আছে।

“বিয়ে?” সতু আকাশ থেকে পড়ল যেন, “সে কী রে? এটা তো জানি না! কার সঙ্গে বিয়ে? কে বলল তোকে?”

“কার সঙ্গে বিয়ে?” নামটা মুখে আনতেও কেমন যেন মনে হল ভেতরে-ভেতরে একটা বিস্ফোরণে শেষ হয়ে যাবে কাজু।

ও ঢোঁক গিলে নিজেকে সামলাল। গলার কাছে তীব্র একটা ব্যথা হচ্ছে।

কাজু মিথ্যে করে বলল, “জানি না। তবে হচ্ছে জানি। এটা আমায় অন্যের মুখ থেকে শুনতে হল সতু! যাকে সব দিয়ে ভালবাসলাম সে একবারও বলল না!”

“কে বলেছে তোকে? তুই শিয়োর?” সতুর গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, ও এটা বিশ্বাস করতে পারছে না!

“বাদ দে,” কাজু আবার সামনের দিকে তাকাল, “এসব আর বলিস না। প্লিজ়!”

সতু আরও কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। সত্যি, কিছু সময় কথা বলা যায় না!

কাজু সামনের অন্ধকারে জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে রইল। গাছে, ঝোপে যেন অসংখ্য আলোর বিন্দু জ্বলে আছে। যেন দূর থেকে দেখা আলো-জ্বলা বাড়ির জানলা! যেন প্রতিটা আলোর পেছনে কোনও না-কোনও গল্প লুকিয়ে আছে!

সতু এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল, “বাদ দে। তা, গোপেনদার সঙ্গে তোর কথা হল? বিমলদা তো ঝাড় দিল খুব। গোপেনদা কিছু বলল?

কাজু মাথা নাড়ল, “কেউ কিছু করবে না রে। গোপেনদা তো দেখাই করছে না আর! ওদিকে বিমলদা ওইসব বলল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম গোপেনদা ঠিক হেল্‌প করবে। কিন্তু সব শালা এক!”

“কেন করবে?” সতু বাদামটা শেষ করে এবার পকেট থেকে বিড়ি বের করল একটা, “তুই শালা সত্যযুগে পড়ে আছিস, কিন্তু এখন কলিযুগ ভাই। গোপেনদা যেই বুঝেছে যে, ফ্যাক্টরিতে গোলমাল হলে ওদের লাভ, সঙ্গে-সঙ্গে কাটাচ্ছে তোকে। গাছে ফল পাকতে দিচ্ছে। বিমলদা যেই শ্রমিক স্বার্থ দেখতে ব্যর্থ হবে, গোপেনদা টুক করে খেয়ে নেবে ফলটা!”

“আমি বুঝতে পারছি সতু,” কাজু মাথা নাড়ল, “অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু তা বলে তো আমি বসে থাকতে পারি না! যাদবকাকাদের সঙ্গে আজও সকালে কথা হল মিলের ইউনিয়ন রুমে। সবাই খুব আপসেট। আর ভয়ও পেয়ে গিয়েছে। এমনিতেই মিল থেকে মাইনে ইরেগুলার হয়ে গিয়েছে! এখন যদি অন্যভাবেও ন্যায্য পারিশ্রমিকে হাত পড়ে, তবে তো লোকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে রাস্তায় বসবে! ওদিকে মালের শিপমেন্ট এগিয়ে আসছে। আর যা কোয়ালিটি দিয়েছে মালিকের ছেলে, তাতে মাল রিজেক্ট হওয়ার চান্স বেশি। সেই ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নাকি টাকা কেটে নেবে! এটা কোন দেশি কথা? এর একটা বিহিত করতে হবে না?”

সতু এতক্ষণ বিড়ি ধরায়নি। এবার দাঁত দিয়ে বিড়িটা চেপে ফস করে দেশলাই জ্বালাল। কাজুর নাক কুঁচকে গেল। এই গন্ধটা কী যে খারাপ লাগে ওর!

সতু বিড়ি টেনে কিছুক্ষণ ধোঁয়াটা ধরে রাখল বুকের ভেতর। তারপর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নীলচে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “কী করে বিহিত করবি?”

কাজু মাথা নাড়ল। তারপর কবজি উলটে ঘড়ি দেখল। অন্ধকারে ঘড়ির কাঁটার সবুজ ফসফরাস চকচক করছে! ও বলল, “যে-কোনও সময় বিজন এসে পড়বে। ও খবরটা আনবে লোকটা কখন অফিসার্স ক্লাবে আসে। খবরটা পেলেই আমি গিয়ে দেখা করব আজ।”

“অফিসার্স ক্লাব? মানে?” সতু অবাক হয়ে তাকাল, “কার সঙ্গে দেখা করবি তুই?”

কাজু চোয়াল শক্ত করল। আবার বুক থেকে জিভ অবধি পুড়ে যাচ্ছে ওর! কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে পাঁজরগুলো গুঁড়িয়ে যাবে!

“কী হল বল!” সতু ঠেলল ওকে।

“বলছি, কিন্তু কাউকে বলবি না।”

“শালা, আমি তোর কোন কথাটা কাকে বলতে গিয়েছি রে? ফালতু কথা বলছিস!” সতু রেগে গেল সামান্য। হাতের বিড়িটা মাটিতে ফেলে হাওয়াই চটি দিয়ে পিষে দিল। যেন বিড়িটা নয়, কাজুকেই পিষল!

কাজু দম নিল একটু। তারপর বলল, “গোড়া ঘরের সঙ্গে দেখা করব আজ, খোদ মালিকের সঙ্গে দেখা করব। সুদর্শন মালিক! বুঝলি?”

“শালা…” সতু হাঁ করে তাকিয়ে রইল কাজুর দিকে। কী বলবে বুঝতে পারল না!

“শোন, বিমলদা, গোপেনদা, সবাই সাইড করছে। এভাবে কিছু হওয়ার নয়। সবাই যে যার ইগো আর ধান্দা নিয়ে ব্যস্ত! তা হলে আর ইউনিয়ন করে শ্রমিক স্বার্থ দেখব বলে ঢ্যামনামো করা কেন? আমি সতু, নিজের আখের গোছানোর জন্য রাজনীতি করি না। জানি সব জায়গায় আজকাল নিজের আখেরটাই ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে! কিন্তু আমি নিজে যেটা কনডেম করি, সেটাই আবার নিজে কী করে করি! আর করবই-বা কেন? সৎ কাজ করার জন্য যখন দেখবি লোকজন বাহবা দিচ্ছে বা সাবধান করে দিচ্ছে, জানবি তখন সমাজ আর দেশের ঘোর দুর্দিন!”

সতু সময় নিল একটু। তারপর বলল, “এখন যা সিচুয়েশন তোর ব্যক্তিগত লাইফে, সেখানে এই সুদর্শন মালিকের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারটাকে পারসোনালি নিয়ে নিস না। মানে ওর ছেলের সঙ্গে তো…”

সতু জানত। তবে ওকে জিজ্ঞেস করল কেন? কিন্তু এটা নিয়ে আর কথা বাড়াতে ভাল লাগছে না ওর। ওই নামটাই আর শুনতে ইচ্ছে করছে না। কাজু সামনের দিকে তাকাল। অন্ধকারে জোনাকিরা আলো জ্বালিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ছোট-ছোট প্রদীপ যেন। অদ্ভুত এক আভা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু অন্ধকার কি তাও কাটছে!

ও বলল, “সবটাই পার্সোনাল সতু। জানবি, জীবনে প্রফেশনাল বলে কিছু নেই। পারসোনালি লোকটা কেমন, সেটাই ইমপর্ট্যান্ট।”

“কিন্তু…”

সতু আরও কিছু বলত, তবে তার আগেই, পেছনে একটা শব্দ শোনা গেল। কারও একটা হেঁটে আসার শব্দ! কাজু উঠে ঘুরে দাঁড়াল।

অন্ধকার হলেও আবছায়ায় মানুষটার অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ও বুঝল বিজন আসছে!

“কাজুদা,” বিজন সামনে এসে দাঁড়াল। সামান্য হাঁপাচ্ছে ছেলেটা।

“কী রে এসেছে?”

“এসেছে, এই মিনিটদশেক হল… আমি ঢুকতে দেখেই তোমার কাছে এসেছি, সাইকেল আছে আমার, চলো…” বিজন নিজের শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে বলল।

“চল,” কাজু এবার সতুর দিকে ঘুরল, “তুই যাবি?”

সতু মাথা নাড়ল, “না, আমার কাজ আছে অন্য। আর তুইও যাস না। শোন, একটা জিনিস ভাব। সুদর্শনের ছেলে যা করছে, সেটা কি লোকটা নিজে জানে না মনে হয়? যাদবকাকা না কে, তার কথায় অত গুরুত্ব দিস না। তুই যে ডাইরেক্ট এসব করছিস, জানলে কিন্তু বিমলদা খচে যাবে! আমাদের রেজিমেন্টেড পার্টি। ঘোড়া টপকে ঘাস খেতে যাস না! বিপদে পড়বি কিন্তু কাজু।”

কাজু বলল, “এই তোর বিপ্লব! ভাগ শালা। চল বিজন।”

সাইকেলটা দাঁড় করানো ছিল জোনাক-বাড়ির মেন গেটের পাশে।

কাজু দেখল পরিতোষ সাইকেল পাহারা দিচ্ছে। কাজু বিরক্ত হল। ছেলেটা কথা শোনে না তো!

ও বলল, “তুই কী করছিস এখানে? তোকে বলেছি না যে, এমন করবি না? তুই ভাল ছেলে। পড়াশোনা কর। এসব করছিস কেন এখন? সবাই এক কাজ করলে মুশকিল! যে যেটা পারে, তার সেটাই করা উচিত! বিজনটা আর কিছু করবে না বলে ঠিক করে নিয়েছে। ওকে বললেও শোনে না। কিন্তু তুই এসবে আসিস না পরিতোষ। বাড়ি যা।”

পরিতোষ কী বলবে বুঝতে পারল না। বিজনের দিকে তাকাল।

“যা বলছি!” এবার জোরে ধমক দিল কাজু। তারপর সাইকেলে উঠে বিজনকে বলল, “তুইও কাট।”

বিজন মাথা নাড়ল জোরে, “আমি যাব তোমার সঙ্গে। একা যাবে কেন তুমি? আর এমন হাওয়াই চটি পরে তোমায় ওই ক্লাবে ঢুকতে দেবে?”

কাজু আর উত্তর দিল না কথার। সাইকেল চালিয়ে দিল। এই বয়সি ছেলেগুলো খুব ডেঁপো হয়! ঢুকতে দেবে কি দেবে না সেটা ওর ব্যাপার! সব কিছু না জেনেই কি ও আর এভাবে দেখা করার কথা ভেবেছে!

সোনাঝুরির মেন রোডে আলো লাগানো হয়েছে। সোজা রাস্তাটা একটা ব্রিজ থেকে নেমে দু’কিলোমিটারের মতো গিয়ে সোনাঝুরি বয়েজ় স্কুলে শেষ হয়েছে।

রাস্তাটা নির্জন। দু’পাশে বড়-বড় গাছ। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, রেন-ট্রি আর পাম গাছ! তার মাঝখানে ছড়ানো মাঠের মধ্যে জুটমিলের কোয়ার্টার, সিনেমা হল, পাম্প হাউজ়, মেস আর ক্যান্টিন!

যদিও রাস্তার আলো ওই মাঠের দূর অবধি পৌঁছয় না, তাই সবটাই কেমন যেন ধোঁয়াটে, অন্ধকার! রহস্যকাহিনির মতো। সাইকেল চালাতে-চালাতে আচমকা কাজুর মনে হল, এই যে এসব করছে ও, তাতে কি সত্যি কিছু হবে! নাকি কিছু হতে পারে! কোনও কিছুর জন্য পরিশ্রম করলেই কি সেটা মানুষ পায়! তা হলে তো সেই হিসেবে দেখলে, পেখমকেও ওর পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা কি হল?

নয়না যখন বলল যে, পেখমের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে, পেখম খুব খুশি, তখন তো এই কথাটাই মনে হয়েছিল ওর। মনে হয়েছিল, এই জীবনে সৎভাবে কিছু পাওয়া যায় না! মন দিয়ে চাইলেও কিছু পাওয়া যায় না। ও ভেবেছিল, আজ যদি ও ভাল চাকরি করত, অনেক টাকা রোজগার করত, তা হলে কি এভাবে ওকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারত পেখম! ও তো কোনওদিন লুকোয়নি যে, ও কী! জীবনে কী চায়! তখন তো পেখমের এসবই ভাল লাগত। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে সে সবই খেলাচ্ছল। তাই তো সেদিন পেখম যখন ওকে ডাকছিল ও শোনেনি। কী শুনবে? একরাশ বানানো কথা? নিজেকে অসহায় দেখানোর একপ্রস্থ নাটক! ও নিজে তো যায়নি পেখমের কাছে! পেখমই তো আগ্রহ দেখিয়েছিল! আর এখন…

আঃ, এসব কী ভাবছে! আজকাল সব কথাই কেন এমন করে বাঁক নিয়ে পেখমের কথায় এসে মেশে! সব কিছুই কেন এসে মেশে এমন একটা হাহাকারে! কাজু তো এমন নয়। ওর তো সামনে কত কিছু করার আছে। সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কত কী করার আছে। তা হলে এমন কেন করছে? কে না কে একটা মেয়ে, তার জন্য এমন করছে কেন? বেশি গল্পের বই পড়ার ফল কি? এসব ন্যাকামো তো ওর ছিল না কোনওদিন! তা হলে? নিজের ওপর ঘেন্না হল ওর। এতেই এত হতচকিত হয়ে গেল ও! একটা অল্পবয়সি মেয়ের পুতুলখেলা নিয়ে এতটা কষ্ট পেয়ে গেল! তা হলে ও জীবনে যে-পথ বেছেছে সেখানে কী করবে? সেখানে তো পদে-পদে বিপদ আর কষ্ট! সামনে আধো আলো আর আধো অন্ধকার ঢাকা পথের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করল কাজু। আর এসব নিয়ে কোনওদিন ভাববে না। পেখমের কথা মনে এলে জোর করে মনটা ঘুরিয়ে দেবে অন্য দিকে। ও ভুলে যাবে এমন কোনও একটা মেয়ে এসেছিল ওর জীবনে।

অফিসার্স ক্লাবটা নদীর একপাশে। বেশ বড় আর পুরনো ক্লাব। ব্রিটিশদের তৈরি করা। ঢোকার মুখে বড় গেট। বাগান। তারপর কাঠ আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা ক্লাব। অনেকটা প্যাগোডার আকৃতি। পেছনে একটা লম্বা জেটির মতো আছে, যেটা গঙ্গা অবধি টানা চলে গিয়েছে।

সাইকেলটা গেটের একপাশে রেখে দিল কাজু। গেটে আজ কেউ নেই। তবে গেট দিয়ে ঢুকেই ডান দিকের গুমটি ঘরে দু’জন দারোয়ান বসে রয়েছে। বাল্‌ব জ্বলছে। মাধবকাকাকে দেখা যাচ্ছে। এই ক্লাবের সিনিয়র গেটকিপার। খুব ভাল করে চেনে কাজু। মাধবকাকার দুই নাতনিকে ও এক সময় পড়িয়েছে!

“মাধবকাকা!” গেট দিয়ে ঢুকে সামান্য গলা তুলে ডাকল কাজু।

মাধবকাকা বেরিয়ে এল গুমটি থেকে। সামান্য সময়ের জন্য থমকে গেলেও তারপর খুশি হয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল কাজুকে!

“আরে মাস্টার তুমি? এখানে? কী ব্যাপার?”

কাজু হাসল, “একটু ভেতরে যাব। একজনের সঙ্গে দরকার আছে। কিন্তু…” বলে নিজের জামাকাপড় আর পায়ের দিকে দেখাল।

মাধবকাকা দেখল সেটা, তারপর মাথা নেড়ে হাসল, “আর্জেন্ট মনে হচ্ছে!”

কাজু কিছু না বলে হাসল।

“যাও, কিছু হবে না, আজ ক্লাব ফাঁকা আছে…” মাধবকাকা হাসল।

কাজু মাথা নেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

মোরামের বাঁকা রাস্তা। দু’পাশে পুরনো ধাঁচের বাতিস্তম্ভ। সবেতেই কলোনিয়াল ছাপ স্পষ্ট। রাস্তাটা গিয়ে শেষ হয়েছে কাঠের রেলিং দেওয়া বড় বারান্দায়। সেখানে কয়েকজন মানুষ বসে মদ্যপান করছে।

সুদর্শন মালিককে কয়েকবার দেখেছে কাজু। ও চেনে মানুষটকে। মোটা চেহারা। খুব ফরসা। আর দু’কানে বড়-বড় লোম আছে!

কাজুকে খুঁজতে হল না। সুদর্শনকে বারান্দার এককোণেই পেয়ে গেল কাজু। একাই বসে রয়েছে মানুষটা। সামনের টেবলে কাচের গেলাস। সঙ্গে মাংসজাতীয় খাবার।

কাজু একটু ইতস্তত করল। তারপর মনটা শক্ত করে এগিয়ে গেল সামনে।

“মিস্টার মালিক?”

সুদর্শন গে‌লাসটা তুলে চুমুক দিতে যাচ্ছিল। আচমকা ডাকে থমকে গেল। তারপর তাকাল।

এবার কাছ থেকে ভাল করে মানুষটাকে দেখল কাজু। আয়েশি চেহারা। চোখের কোলে ছোট-ছোট থলি। মাথায় পাতলা চুল। জোড়া ভুরু। আর কানের লোমগুলো শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে আছে। লোকটা জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে।

কাজু বলল, “আমার আপনার সঙ্গে একটু দরকার আছে। ইমপর্ট্যান্ট দরকার। কথা বলা যাবে?”

সুদর্শন চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখল সামনে। তারপর হাসল। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক মুছে বলল, “তোমরা আমাকে একটুও একা ছাড়বে না, না?”

“দেখুন,” কাজু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল। ও জানে, ওর বয়সটা একটা সমস্যা। কেউ তেমন সিরিয়াসভাবে ওকে নেয় না! তাই ও নিজের গলাটা ভারিক্কি করার চেষ্টা করল, “আমি যে-কাজে এসেছি, তাতে অনেক মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তাই বলছি, আমার কথাটা শুনুন।”

সুদর্শন হাসল এবার। একটা মাংসের টুকরো মুখে পুরে চিবোতে-চিবোতে বলল, “ঠিক আছে। বোসো কাজুবাবু। কথাটা শুনি।”

কাজু থমকে গেল একদম! কাজুবাবু! মানে সুদর্শন ওর নাম জানে! ওকে চেনে? কিন্তু ও তো কোনওদিন সুদর্শনের সামনে যায়নি। প্রথাগতভাবে আলাপ করেনি! তা হলে?

“অত ঘাবড়ানোর কিছু হয়নি!” সুদর্শন এবার খিকখিক করে হাসল, “আমার পেছনে যে আছোলা বাঁশ দেওয়ার জন্য ঘুরছে, তাকে আমি চিনব না! তা ছাড়া, আমার বাড়ির হবু বউমার লাভারকেই-বা না চিনে থাকি কী করে?”

কাজুর পা দুটো দুর্বল লাগল আচমকা! লোকটা ওর সম্বন্ধে এত কিছু জানে! কিন্তু কী করে? ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ওর ঘাম দিচ্ছে বেশ। বুঝল, মনের মধ্যে জমিয়ে তোলা সাহসটা কোন এক অদৃশ্য ফুটো দিয়ে গলে যাচ্ছে! কাজুর মনে হল লোকটা ওকে কথা শুরুর আগেই দু’গোল দিয়ে দিয়েছে!

ও চোয়াল শক্ত করে নিজেকে গোছানোর চেষ্টা করল। তারপর চেয়ারটা টেনে বসল সামনে। খেলা শুরুর আগে হার মানার কোনও মানে নেই।

.

২২. নোঈ

ভাঙা গাড়িটার মাথায় এমন করে ফুলগুলো ছড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে কে যেন নরম সবুজ রং মাখিয়ে দিয়েছে। কী ফুল এটা! কেমন একটা অদ্ভুত মিষ্টি ঝিমধরা গন্ধ! নোঈর মনে হল ওর শরীরের সমস্ত রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে গন্ধটা। বিকেল-শেষের বৃষ্টির পরে, সোঁদা গন্ধের সঙ্গে মিশে ফুলের গন্ধটা অন্য একটা আলো পেয়েছে!

নোঈ দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাল করে দেখল গাড়িটাকে। ভাঙা, পুরনো একটা গাড়ি। সামনের লাইট নেই। জং ধরা দরজা। বনেটের সামনেটা কেমন একটু তুবড়েও আছে! তার ওপর ছড়িয়ে থাকা ফুলগুলো দেখে কী অদ্ভুত লাগল নোঈর! নিঝুম পাড়া। বড় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা একলা গাড়ি। মাথায় গুঁড়োফুল। ওর মনেই হচ্ছে না এটা কলকাতা।

“খুব সুরিয়াল একটা ব্যাপার না?” পাশ থেকে স্মরণ নরম গলায় বলল।

নোঈ সেই কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী ফুল?”

“এটা?” স্মরণ সামনে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির বনেটের ওপর থেকে একমুঠো ফুল তুলে নিয়ে ওর হাতে রেখে বলল, “ছাতিম! এই বড় গাছটা দ্যাখো। ছাতিম গাছ! কেমন মেলে রাখা একটা ছাতার মতো, না? এই ফুলের গন্ধ খুব স্ট্রং হয়।”

নোঈ ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল। সত্যি, অদ্ভুত দেখতে একটা গাছ! ও গাছপালা খুব একটা চেনে না। কলকাতা শহরের দক্ষিণে গাছপালা উত্তরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে কোনওদিন এই নিয়ে নোঈ ভাবেনি। কিন্তু আজ এই ফুলগুলো দেখে ওর মনে হল, গাছপালা সম্বন্ধে ও কত কম জানে!

স্মরণ বলল, “ভাবো একবার, এই শহরের দক্ষিণে একসময় ঘন জঙ্গল ছিল! দেখবে মাঝে মাঝে বড় আর বুড়ো কিছু গাছ তুমি দেখতে পাবে কলকাতায়! যেমন ধরো, টালিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের সামনের যে-ক্রসিং। যেখান থেকে একটা রাস্তা লেক হয়ে গোলপার্কের দিকে বেঁকে গেছে, সেখানে একটা বটগাছ আছে! তারপর গল্‌ফ গ্রিনের কাছে আছে। লেকেও আছে। কত পুরনো আর বড় সব গাছ! দেখলেই আমার গা ছমছম করে! চোখ বন্ধ করে আমি ভাবি বহু পুরনো সময়ে এই দিকের কলকাতাটা কেমন ছিল! তুমি ভাবো না?”

নোঈ হাসল। মাথা নাড়ল।

স্মরণ চোখ বড় করল। বলল, “প্যাঁও-ও ভাবে না! কেন কে জানে!”

নোঈ হাতের মুঠোয় ধরা ফুলগুলো নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ শুঁকল। কী অদ্ভুত গন্ধ! ঝিম হয়ে আসে শরীর!

স্মরণ বলল, “এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? আমার বাড়ি যাবে না?”

নোঈ হাসল। কথাটা ঠিক। স্মরণের বাড়ি যাবে বলেই ও এসেছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম রবিবার আজ। কিন্তু ওর ছুটি ছিল না। অফিসের কাজে সোনাঝুরি গিয়েছিল। হেড অফিস থেকে বেশ একটা কড়া করে চিঠি এসেছে অফিসে। এতদিন হয়ে গেল, তাও কেন কোনও প্রগ্রেস হয়নি?

কিন্তু নোঈ জানে এতে পুশকিনের কোনও দোষ নেই। আসলে কারও দোষ নেই। মালিক গ্রুপের সম্পত্তি। গোটাটা নিয়ে তারাই ঢিমেতালে এগোচ্ছে। ওদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, আপাতত শুধু মিল ও তার আশপাশের জায়গা বিক্রি করা হবে। জোনাক-বাড়ি এখন বিক্রি করা হবে না।

কিন্তু ওদের কোম্পানির কাছে, জোনাক-বাড়ি ছাড়া জায়গাটার তেমন মূল্য নেই। সোনাঝুরির সবচেয়ে ভাল আর সুন্দর জায়গায় ওই বড় বাড়িটা রয়েছে! ওদের কোম্পানির উদ্দেশ্য তো শুধু ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রি করা নয়। মিলটাকে বাঁচিয়ে আরও ভালভাবে ব্যাবসা করতে চায় ওরা! আগামীর পৃথিবীতে প্যাকিং-এ ইকো ফ্রেন্ডলি প্যাকেজ হিসেবে জুট খুব প্রয়োজনীয় একটা ভূমিকা পালন করবে। প্লাস্টিকের চেয়ে জুট প্যাকিং-এর দাম বেশি হলেও, জুটের প্যাকিং অনেক টেকসই ও বহুবার ব্যবহার করা যায়। তার সঙ্গে এটা অরগ্যানিক, তাই বায়োডিগ্রেডেবল। সামনের দূষণমুক্ত পৃথিবীতে তাই জুট খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস।

এইসব দিক ভেবেই এই ফ্যাক্টরিকে আবার ভালভাবে চাঙ্গা করে তুলতে চায় ওদের কোম্পানি। কিন্তু সেটা করলেই শুধু হবে না। বিদেশ থেকে লোকজন এসে যাতে ভালভাবে থাকতে পারে এখানে, সেটাও দেখতে হবে। সেই সঙ্গে একটা ট্যুরিজ়মও ডেভেলপ করা যাবে জোনাক-বাড়ি আর ওর পাশের নদীকে কেন্দ্র করে। শুধু মিলটা নিলে তা হবে না।

নোঈর অবাক লেগেছিল। আইকাদিদের কোম্পানি কিন্তু সব কিনে, ভেঙে ফেলে তাতে বাড়িই করবে। তা হলে ওদের ‘রিকো গ্রুপ’-ই বা সেটা করবে না কেন?

কথাটা একদিন অফিসের পরে ও জিজ্ঞেস করেছিল পুশকিনকে। পুশকিন হেসেছিল কথাটা শুনে। তারপর বলেছিল, “জলসাঘর দেখেছ? সত্যজিৎ রায়ের সেই ছবি?”

“হ্যাঁ, কেন?” নোঈ বুঝতে পারেনি হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন কেন?

পুশকিন বলেছিল, “আমাদের কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল। আমাদের ভিশনটা কিন্তু শুধু পয়সা রোজগার করা নয়! সঙ্গে নানা কিছু ডেভেলপ করা। মিলটা রিভাইভ করলে শ্রমিকদের সুরাহা হবে। জোনাক-বাড়িটাকে ফাইভ স্টার হোটেল করে তার পাশের বিশাল বড় জায়গায় থিম পার্ক করে সেখানে ট্যুরিজ়ম ডেভেলপ করলে, সোনাঝুরির অন্য লোকজনও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। আমাদের কোম্পানির প্রেস্টিজ কিন্তু শুধু লাভ করে তৈরি হয়নি। মানুষের ওয়েলফেয়ারটাও আমাদের ভিশনের একটা লক্ষ্য।”

“কিন্তু জলসাঘর কেন বললেন বুঝলাম না।”

পুশকিন হেসে বলেছিল, “ছবি বিশ্বাসের সেই ক্যারেকটারটা, মানে সেই পড়তি জমিদার কী বলেছিল মনে আছে? ওরা পারবে না, কারণ জানো? রক্ত! অনেক মানুষ আছে যারা ওঁচা টাইপ! সারাক্ষণ হাত পেতে থাকে, কাঁদুনি গেয়ে বেড়ায়। কিছু পাওয়ার জন্য ছোঁক ছোঁক করে সব সময়! তেমন কিছু কোম্পানিও আছে এরকম! তাদের কাছে টাকা রোজগারটাই আসল। ক্লাস নয়! এটাই সেই রক্ত! এখনকার ভাষায় ডিএনএ! কারও-কারও রক্তে অমন থাকে। আমাদের কোম্পানির ডিএনএ-টা অমন ছোটলোকদের মতো নয়! বুঝলে? তাই হোমওয়ার্ড-এর লোকজন যা করবে আমরা তা পারব না। আমাদের ইন্টারন্যাশনাল রেপুটেশন আছে। ইউএন-এ আমাদের কথা ওঠে! আমরা ওঁচা কাজ করতে পারি না!”

“কী হল?” স্মরণ নোঈর ব্যাগটা ধরে টানল।

নোঈ লক্ষ করেছে, স্মরণ কখনও ওর গায়ে হাত দেয় না। ও মাঝে মাঝে স্মরণের পিঠে থাপ্পড় মারে, চিমটি কাটে, কান ধরে টানে। কিন্তু স্মরণ কখনও ওর গায়ে হাত দেয় না!

কোলিগ হলেও স্মরণ ওর বন্ধুর মতোই হয়ে গেছে। ও জানে ওর এমন মারধরে স্মরণ কিছু মনে করে না।

নোঈ বলল, “যাচ্ছি। আসলে এমন ফুল আমি আগে দেখিনি। তাই…”

স্মরণ বলল, “আজ তারক চক্কোত্তির কথায় কি তুমি একটু আপসেট?”

নোঈ হাসল। মাথা নেড়ে বলল, “কেন এমন মনে হল?”

স্মরণ বলল, “পুশকিনস্যার যে কেন লোকটার সঙ্গে নিজে দেখা করছে না সেটা বুঝতে পারছি না!”

নোঈ ভাবল, বলে রক্ত, রক্ত, কিন্তু বলল না। বরং হাসল।

স্মরণ নিজেই উত্তর দিল নিজের প্রশ্নের। বলল, “আসলে গোড়া ঘরই যখন ঠিক করতে পারছে না কী করবে, জোনাক-বাড়ি বিক্রি করবে কি করবে না, সেখানে বেকার তারক চক্কোত্তিকে ভাও দিয়ে কী হবে, তাই না?”

নোঈ কিছু বলার আগেই ফোনটা বেজে উঠল ওর। ও ব্যাগ থেকে বের করল মোবাইলটা। আরে, শ্বেতা ফোন করেছে! মেয়েটার বাড়িতে সেই যে নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছিল, তারপর থেকে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চণ্ডীগড় গিয়ে কেমন যেন ভুলে গিয়েছে। সেই মেয়ে হঠাৎ ফোন করল! তাও আবার কলকাতার নাম্বার থেকে? কেন? কী ব্যাপার! ও কি ফিরে এসেছে?

ফোনটা ধরল নোঈ, “আরে, কী খবর তোর?”

শ্বেতা ওদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফোনের মধ্যে দিয়ে। বলল, “আমার কী খবর! বাজে মেয়ে। আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড সেটা ভুলে গিয়েছিস, না?”

নোঈ বলতেই পারত যে, ও বেশ কয়েকবার হোয়াটসঅ্যাপে ওকে পিং করেছে। ই-মেল করেছে। কিন্তু শ্বেতাই ওকে কোনওরকম পাত্তা দেয়নি! উত্তর দেয়নি। কিন্তু এখন সেটা বলল না। ও একটা জিনিস বুঝতে পারছে। জীবনে একটা সময়ের পরে বন্ধুত্বগুলো সব পালটে-পালটে যায়। সেটা নিয়ে সেন্টিমেন্টাল হওয়ার বা মনখারাপ করার কোনও কারণ ও দেখে না। আর সত্যি বলতে কী, এই চাকরিতে জয়েন করে কাজের মধ্যে ডুবে ও ভাল আছে! পুরনো জীবনটা ওকে যে-কষ্ট দিয়েছিল, সেটা আর সহ্য করতে হচ্ছে না!

নোঈ শব্দ করে হাসল। তর্কে যেতে ইচ্ছে করছে না। শ্বেতা নিজের দায়টা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যদি খুশি হয় হোক!

“শোন,” শ্বেতা বলল, “আমার সামনে বিয়ে। সেই জন্য নেমন্তন্ন করতে এসেছিলাম তোদের বাড়িতে। শুনলাম তুই অফিসের কাজে বেরিয়েছিস! আমি নেমন্তন্ন করে বেরিয়ে এসেছি। বাব্বা সানডেতেও কাজ! কী করছিস রে!”

শ্বেতার বিয়ে! সেটা ও এখন জানতে পারছে! ওকে কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করতে এসেছে মেয়েটা! এসব কী! ওর সঙ্গে এমন সম্পর্ক তো ছিল না! নোঈর খারাপ লাগল বেশ। কিন্তু সেটা ও প্রকাশ করল না। কারণ, ও শ্বেতার গলা শুনে বুঝতে পারছে ওর খারাপ লাগল কি ভাল লাগল, তাতে শ্বেতার কিছু যায় আসে না!

“দারুণ!” নোঈ হাসল, “কার সঙ্গে?”

“কেন তুই জানিস না?” শ্বেতার গলাটা কেমন যেন পালটে গেল এবার।

“মানে… ওই ববি?” নোঈ সাবধানে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ,” শ্বেতা সামান্য থামল, তারপর বাঁকা গলায় বলল, “তোর গা জ্বলে গেল, তাই না?”

“মানে?” নোঈ শ্বেতার গলায় শ্লেষ শুনে কেমন যেন থমকে গেল।

শ্বেতা বলল, “তুই আমার সঙ্গে যা করেছিস, তারপর আমার উচিত ছিল তোকে নেমন্তন্ন না করা!”

“মানে?” নোঈ ঘাবড়ে গেল, “কী বলছিস তুই?”

শ্বেতা বলল, “আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে তুই এটা করতে পেরেছিলি? কেন তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি ভেবে দেখেছিস কখনও? জয় বেঁচে গেছে তোকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে!”

“তুই কী বলছিস?” নোঈ স্থান কাল ভুলে চিৎকার করে উঠল। দেখল, স্মরণ হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে ওকে!

শ্বেতা বলল, “ববি বলেছে আমায়, তুই ওর পেছনে পড়েছিলি!”

“কী!” নোঈ বিহ্বল হয়ে গেল। এটা কী বলছে শ্বেতা!

শ্বেতা বলল, “ববি বলেছে আমায়! ছিঃ। আমি আজ আসতেও চাইনি। ববিই আমায় আসতে বলেছে তোদের বাড়ি। নেমন্তন্ন করতে বলেছে।”

নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না। হাত-পা কাঁপছে ওর, চোখ জ্বালা করছে। ববি এসব বলেছে! এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাত! এমনও হয়! এতদিন দেখা নেই, যোগাযোগ নেই, সেটা এই কারণে! ববি এমন করে মন বিষিয়ে দিয়েছে শ্বেতার! ববি ওকে কী বলেছিল, শ্বেতা কষ্ট পাবে বলেই শ্বেতার সামনে নোঈ তা কোনওদিন বলেনি। সেখানে ববি এমনটা করতে পারল! কেন করল এমন!

নোঈ বলল, “যা বললি, ভুল বললি। এটাই শুধু বলব। আর একটা কথাও আমি বলব না এ বিষয়ে। আমায় ছোট থেকে এই চিনলি! আর কিছু বলার নেই। আমার হোয়াট্সঅ্যাপে এখনও কিন্তু ববির মেসেজ সেভ করা আছে। চাইলে স্ক্রিন শট পাঠাতে পারি। বাট ক্যান ইউ হ্যান্ডেল দ্যাট? বাই।”

ফোনটা কেটে চোয়াল শক্ত করল নোঈ। চোখের জ্বালাভাবটা আর নেই। বদলে একটা রাগ মাথার ভেতরে পাক খাচ্ছে! স্মরণ ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমার বাড়ি যাবে তা হলে?”

“কেন যাব না?” ফুঁসে উঠল নোঈ, “তোমরা কী ভাবো আমাকে?”

“আমরা?” স্মরণ কী বলবে বুঝতে পারল না।

“নয়তো কী? কেন মনে হল যাব না? কীসের জন্য মনে হল? আমি কি বলেছি যাব না? আমার কথার দাম নেই?” নোঈ ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে থামল।

স্মরণ সময় নিল একটু। তারপর আচমকা ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, “ঘ্যামা লাগছিল কিন্তু! খচে গেলে মাইরি, ডোন্ট মাইন্ড, দারুণ লাগে তোমায়! যে-মেয়েটা ফোন করেছিল তাকে যা ঝাড়লে… সামনে থাকলে বোধহয় কেলিয়েই দিতে, না? এমন একটা ব্র্যান্ডের ঝাঁটা আর ঝাড়ন মার্কেটে আনলে হয় না? ‘নোঈ ঝাড়ন’!”

নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না। ছেলেটা এমন করে বলল যে, এত রাগের মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল ওর। ও মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “শ্বেতা আমার ছোটবেলার বন্ধু। তারপরও ও এমন কথা বলে কী করে? আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমায় এমন করে বলল? বলে ওর বয়ফ্রেন্ডকে আমি নাকি ভাঙিয়ে নিতে চেয়েছি! ভাবতে পারো?”

স্মরণ ভাঙা গাড়িটার গায়ে হেলান দিল এবার। আর-এক মুঠো ফুল হাতে তুলে নিয়ে বলল, “এই দ্যাখো, ঝরা ফুল। গাছ কি আর একে নিজের ফুল ভাবে? ভাবে না! তুমিও ওকে বন্ধু ভেবো না। মানুষের সম্পর্কগুলো এমনই হয়। তারা আসে ঝরে পড়ার জন্যই। এমন করে মনখারাপ করার মানে নেই নোঈ।”

“তোমার সঙ্গে হলে তুমি এমন ফিলজ়ফিকাল হতে পারতে?” নোঈ সোজা তাকাল স্মরণের দিকে।

স্মরণ হাসল। বলল, “আচ্ছা, আমার কথা বাদ দাও। আমি বেশি বকবক করি। প্যাঁও তো তাই রেগে যায় আমার ওপর। শোনো, একটা কথা বলি, মায়ের সামনে কিন্তু প্যাঁও-এর কথা বোলো না। মা এসব জানে না কিন্তু।”

নোঈ রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল, “তুই একটা… সরি… মানে তুমি একটা পাগল।”

“তুইটাই তো ভাল!” স্মরণ হাসল, “আমিও তুই বলি। চল, বাড়ি চল।”

পাড়াটা ছোট। ফাঁকা। পুরনো বাড়িঘর চারিদিকে। কেমন একটা রংচটা ধরনের। কেমন যেন ছোট, মাথা নিচু আর লাজুক! দেখলেই মায়া হয়, এমন।

রাস্তার দু’পাশে বেশ বড়-বড় গাছ। ফুল হয়ে আছে। বড়রাস্তা থেকে বেশ ভেতর দিকে পাড়াটা।

স্মরণ হাঁটতে-হাঁটতে আশপাশের গাছগুলো দেখাচ্ছে আর বলছে কোন গাছটার কী নাম। নোঈ এসব জেনে কী করবে, কে জানে! কিন্তু স্মরণের উৎসাহ দেখে ভাল লাগছে।

ও আশপাশের বাড়ি-ঘরগুলো দেখতে-দেখতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এত গাছ চেনো কী করে?”

স্মরণ বলল, “আরে, আমার বাবা বোটানিস্ট ছিল। সারাক্ষণ গাছপালা নিয়ে থাকত। আমাদের বাড়িটা একতলা, ছোট। কিন্তু দেখবে কতরকমের গাছপালা আছে। বাবার লাগানো সব। এখন যদিও খুব একটা যত্ন করা হয় না। জঙ্গল মতো হয়ে গেছে। তাও মা কাটতে দেয় না।”

নোঈ তাকাল স্মরণের দিকে। ছেলেটা হাসিমুখেই কথা বলছে। কিন্তু তাও কথাগুলোর তলায় একটা চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে!

স্মরণদের বাড়িটা সত্যি ছোট। একটা মুঠোর মধ্যে যেন ধরা যায়। কিন্তু কী মিষ্টি লাগল নোঈর। পাহাড়ি এলাকায় কাঠের ছোট বাড়ি যেমন হয় অনেকটা সেই ধাঁচের বাড়ি, কিন্তু ইট-সিমেন্টের! আর সামনে কত গাছপালা!

স্মরণ বলল, “বাবা কিনেছিল জায়গাটা। নিজেরা ছোটবেলায় চিরকাল খুব ঘিঞ্জি, পুরনো বাড়িতে কষ্ট করে ছিল বলে, নিজে জায়গা কিনে বাড়ি করতে চেয়েছিল! তাই ছোট্ট এই বাড়ি তৈরি করে বাকি জায়গায় গাছ লাগিয়েছিল। ছোট থেকেই বাবা গাছ খুব ভালবাসে! পরিবেশটা ভাল না? তোমায় এই যে জোর করে নিয়ে এলাম, ভাল লাগল না এটা? এখানে একদিন তোমায় জোনাকি দেখাব! দেখবে আমাদের শহরেও কত জোনাকি আছে!”

জোনাকি? এখানে! স্মরণটা পাগল নাকি? নোঈ হাসল।

সোনাঝুরি থেকে এসে নোঈ ভেবেছিল বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু স্মরণই ওকে বলেছিল ওর বাড়িতে আসতে। কেন বাড়িতে আসতে বলেছিল, সেটা বলেনি। কিন্তু জোর করেছিল একরকম। নোঈ প্রথমে একটু আপত্তি করলেও পরে মেনে নিয়েছিল। সবে বিকেল। কী করবে এখন বাড়ি গিয়ে! আজকাল বাড়িতে মা সারাক্ষণ বলে, “বিয়ে কর, বিয়ে কর!” আর আজ তো শ্বেতা এসে ওর বিয়ের কার্ড দিয়ে গেছে। সঙ্গে আরও কী-কী বলে গেছে ভগবান জানে! শ্বেতা যেরকম মুডে ছিল, কিছু বলে গেছে তো নিশ্চিত। তাই ও ভালই করেছে বাড়ি না গিয়ে।

আজ দিনটাই ভাল নয়। একটু আগে শ্বেতার সঙ্গে ঝামেলা হয়ে গেল। তার আগে সোনাঝুরিতে গিয়ে তারক চক্রবর্তীর অসভ্যতার সামনে পড়তে হয়েছিল। এক-একটা দিন যায় যাতে কিছুই ঠিকঠাক হয় না। নিজেকেই চড় মারতে ইচ্ছে করছে নোঈর। ওকে তো বারণ করেছিল পুশকিন ওখানে যেতে। কিন্তু ও নিজেই জোর করে গিয়েছিল। পুশকিনের কথা শুনলেই হত।

হেডঅফিস থেকে ওইরকম কড়া চিঠি পাওয়ার পরে পুশকিন বেশ চিন্তিত ছিল ক’দিন। সেটা দেখে ভাল লাগেনি নোঈর। পুশকিন ওকে এই চাকরিটা পেতে সাহায্য করেছে, সেটা ভাল করেই ও জানে। সেখানে লোকটাকে হেডঅফিস থেকে একরকম শোকজ় করা হয়েছে দেখে ওর খারাপ লাগছিল।

গত পরশু নিজের চেম্বারে বসে ছিল পুশকিন। তখন দরজা নক করে ঘরে ঢুকেছিল নোঈ।

“কিছু বলবে?” পুশকিন তাকিয়েছিল ওর দিকে। সামনে একগাদা কাগজ খোলা ছিল। পুশকিনকে কেমন এলোমেলো লাগছিল নোঈর। মনে হচ্ছিল গালটা ধরে চুল আঁচড়ে দেয়!

“একটা কথা ছিল, স্যার,” নোঈ সাবধানে বলেছিল কথাটা।

এলোমেলো হলেও পুশকিনকে অন্যদিনের চেয়ে বেশ গম্ভীর লাগছিল! একটা পেপারওয়েট নিয়ে নিজের মনে আস্তে-আস্তে ঘোরাচ্ছিল পুশকিন। “বলো, বসে বলো…” সামনের চেয়ারের দিকে হাত তুলে দেখিয়েছিল পুশকিন।

নোঈ বসে ঠোঁটটা চেটে তাকিয়েছিল পুশকিনের দিকে। এলোমেলো চুল, আলগা টাই! ও খেয়াল করেছিল সন্ধেবেলায় পুশকিনের গালটা কেমন গাঢ় নীল হয়ে যায় দাড়ির জন্য! নোঈ দেখেছে পুশকিনের দাড়ি বেশ ঘন।

“ইয়েস!”

“আসলে স্যার, আমি ভাবছিলাম সানডে আমি সোনাঝুরি যাব। তারক চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলতে। স্মরণ গিয়ে সেই যে খবর নিয়ে এসেছিল তারপর তো আমরা আর সেভাবে ফলো আপ করিনি। তাই ভাবছিলাম আমি যাব।”

“গিয়ে?”

“গিয়ে লোকটাকে বোঝাব যে, আমরাও ইন্টারেস্টেড। আইকাদিরাই শুধু ইন্টারেস্টেড, সেকথা ভাবা তো ঠিক নয়!” নোঈ চশমাটা ঠিক করেছিল।

পুশকিন বলেছিল, “লোকটা ঘুষ চায়। জানো, ঘুষ দেওয়া কতটা বিপজ্জনক! না আমি মরালিটির কথা বলছি না। বলছি প্র্যাকটিকাল ব্যাপার। লোকটা ক্যাশ চাইবে। সঙ্গে ফ্ল্যাটও চাইবে। কিন্তু আমরা সেটা দেব কী করে? ট্যাক্সে দেখাব কী করে এত টাকা! আর লোকটাকে সেটা দিলেই যে কাজ হবে, এমনটাও তো নয়! প্লাস আর-একটা সমস্যা আছে!”

“কী সমস্যা?”

“যার জিনিস সেই তো বিক্রি করবে না! তা হলে?”

“তাও স্যার। আমাদের দিক থেকে একটা রিপ্রেজ়েন্টেশন হয়ে থাকা ভাল,” নোঈ সোজা তাকিয়েছিল, “আপনি আমার জন্য এত করেছেন, আমি এটুকু চেষ্টা করব না!”

“আরে!” এবার পুশকিন সোজা হয়ে বসেছিল। হেসেওছিল সামান্য, “বাচ্চা মেয়ের মতো হয়ে গেল না কথাটা? আমি কী করেছি? কিচ্ছু না! তুমি নিজের যোগ্যতায় কাজ পেয়েছ! আর এটা কর্পোরেট সেক্টর! ডোন্ট মেক ইট পারসোনাল।”

নোঈ একগুঁয়ে বাচ্চার মতো বলেছিল, “আমি যাব স্যার, প্লিজ় হ্যাঁ বলুন!”

“আচ্ছা মেয়ে তো! আমি অন্য প্ল্যান ভাবছি।”

“প্লিজ়!” নোঈ তাকিয়েছিল পুশকিনের দিকে।

একটা জিনিস নোঈ বোঝে, পুশকিন ওকে পছন্দ করে। না, এটা ও ভাবতে চায় না। কিন্তু তাও ভেবে ফেলে মাঝে মাঝে। মেয়ে হিসেবে নিজের ইনস্টিংক্টটাকে তো আর অস্বীকার করতে পারে না!

পুশকিনের ওর দিকে তাকানো, হাসি, ওকে ইন্ডাল্‌জ করা, সবেতেই একটা ভাললাগা মিশে আছে, সেটা বুঝতে পারে নোঈ। আর এটাও বোঝে, পুশকিন সেটা লুকোনোর চেষ্টা করে। অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করে!

নোঈর খারাপ লাগে না, বা সত্যি করে বললে বলা উচিত ভাল লাগে ব্যাপারটা। আর দিনে-দিনে সুড়ঙ্গ কাটার মতো ভাললাগাটা যেন আরও গভীর হচ্ছে! নিজেকে এই নিয়ে বুঝিয়েছে নোঈ। বলেছে এসব ঠিক নয়। কত বড় ওর চেয়ে পুশকিন! একবার বিয়ে হয়ে গেছে! বাড়িতে সবাই অন্যভাবে ওকে চেনে।

কিন্তু মনের আর-একটা দিক ছোট্ট খোঁচা মেরে বলেছে, এসব তো মিডল ক্লাস মেন্টালিটি। কাউকে ভাল লাগলে বয়সের কী কাজ সেখানে! নোঈ বোঝে আমাদের মনের মধ্যে এমন একটা কিছু আছে, যা আমাদের জটিলতার দিকেই টানে! ও বোঝে জটিলতার একটা আলাদা মাধ্যাকর্ষণ আছে! একটা অদ্ভুত চোরা নেশা আছে! যা কিছু ‘ফ্রাউন্ড আপন’, মানুষ সেটার দিকেই কেন কে জানে বেঁকে যায়! ও নিজেও সেই বাঁকের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। টান টের পাচ্ছে! আর অনেকটা সেই টানই ওকে পুশকিনের ঘরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বলে ওর চোরা মনটা বুঝতে পারছিল!

পুশকিন বলেছিল, “স্মরণকে নিয়ে যেয়ো। একা যেয়ো না। আর ডোন্ট এক্সপেক্ট এনি ওভারটাইম। কেমন?”

নোঈ ঘর থেকে বেরোনোর আগে চশমাটা ঠিক করে তাকিয়েছিল পুশকিনের দিকে, তারপর কেটে-কেটে বলেছিল, “আই অ্যাম নট এক্সপেক্টিং এনিথিং।”

“তুমি… মানে তুই এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি?” স্মরণ আবার ব্যাগ ধরে টানল ওকে।

নোঈ বলল, “যাচ্ছি, যাচ্ছি, দাঁড়া। আগে বাগানটা দেখি ভাল করে।”

স্মরণ চোখ গোল করে বলল, “দূর, বাগান আর নেই। জঙ্গল হয়ে গেছে। দেখছিস না কী হয়ে আছে? আমি আর সময় পাই না পরিষ্কার করার। আগে এক মালিকাকু আসত। কিন্তু মাসে তিন হাজার টাকা আর অ্যাফোর্ড করতে পারি না রে। প্লাস ওই যে বললাম, মা কিছু কাটতেও দেয় না!”

ঘন সবুজের একটা গন্ধ থাকে। এই গাছপালার মধ্যে দাঁড়িয়ে সেটা পেল নোঈ। আর কেন কে জানে হঠাৎ পুশকিনের কথা মনে পড়ল। পুশকিন এমনই একটা পারফিউম ব্যবহার করে। কেমন একটা ঘন জঙ্গল মাখা গন্ধ! আজকাল মাঝে মাঝে এই গন্ধটা পায় নোঈ। রাতে নিজের ঘরে বসে, স্নান সেরে বেরোনোর পরে বা আচমকা বৃষ্টি এলে কী করে যেন এই গন্ধটা পায় ও। কেমন একটা করে ওর শরীর। কাঁটা দিয়ে ওঠে! বুকের কাছটা কেমন একটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। ও ভাবে এটা কী করে হল! জয় চলে যাওয়ার পরে তো ভেবেছিল আর কোনওদিন কারও জন্য এমন কিছু মনে হবে না ওর। কিন্তু সেখানে এমন হল কী করে? কোন ফাঁক দিয়ে এমন ছোট্ট এই গাছটা বেরোল মাটি ভেদ করে! ওর এও মনে হয়, এটা কোনও রিবাউন্ড নয় তো!

আসলে পুশকিন খুব শান্ত, চুপচাপ ধরনের। রাগ করে না। ভাল করে কথা বলে। আর কেমন একটা একা-একলা মানুষ যেন! পুশকিনকে দেখলে মনে হয়, সব কিছু করছে, কিন্তু তাও যেন কিছু করছে না! সব কিছুতে আছে, কিন্তু যেন কোনও কিছুতেই নেই! এমন একটা মানুষের দিকে কেন টান অনুভব করছে নোঈ! আজকাল পুশকিনের সামনে গেলে ও সচেতন হয়ে পড়ে। মানুষটা কিছুতেই যেন ওর মনের ভাব বুঝতে না পারে!

বাগানের মধ্যে দিয়ে ছোট নুড়ি ফেলা রাস্তা চলে গেছে বাড়ির দিকে। সেই পথে এগোল নোঈ।

বিকেল শেষ হয়ে আসছে। মেঘও করছে আবার। বৃষ্টি নামবে মনে হয়! নুড়িপথ থেকে দু’ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে বারান্দায়। নোঈ বারান্দায় উঠে দেখল দুটো বেতের মোড়া রাখা আছে। সবটাই কেমন একটা ঘন সবুজ ছায়া দিয়ে ঢাকা! বারান্দায় একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে ঝোলানো টবের অর্কিডগুলো নাড়াচাড়া করছিলেন।

“মা, এই যে নোঈ!” স্মরণ বলল।

“আরে, এসো,” ভদ্রমহিলা পেছন ফিরে হেসে এগিয়ে এলেন।

নোঈ এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করল, “কাকিমা, আমি নোঈ!”

“আরে, প্রণাম করতে হবে না!” কাকিমা হাসলেন। নোঈর থুতনি ধরে আলতো করে চুমু খেলেন। বললেন, “বাব্বা, কী সুন্দর দেখতে তোমায়!”

নোঈ লজ্জা পেয়ে গেল। এভাবে কেউ বললে লজ্জা তো করবেই! ও বলল, “সেটা ইমপর্ট্যান্ট নয় কাকিমা… এসব তো আর কারও হাতে থাকে না!”

স্মরণ বলল, “ঘরে চলো। নোঈর মেজাজ আজ হেভি খারাপ! দুটো ঝামেলা করে এসেছে! বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে আরও রেগে যাবে!”

“ভ্যাট,” নোঈ আলতো করে একটা চড় মারল স্মরণকে, “খালি বাজে কথা!”

স্মরণ চোখ বড় বড় করে বলল, “দেখছ তো, এখনই মারধর শুরু করেছে আমায়। এবার তোমাকেও মারবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে!”

“তবে রে,” নোঈ ব্যাগটা তুলল, “সারাক্ষণ খালি বাজে কথা!”

কাকিমা নোঈর হাত ধরে বললেন, “চলো, ঘরে চলো। আমাদের ছোট বাড়ি। একটু অসুবিধে হবে!”

স্মরণ বারান্দা থেকে ঘরে ঢোকার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কেন অসুবিধে হবে? আমাদের এখানে কি ও থাকতে আসছে নাকি! কথা বলো একটা এমন!”

নোঈ হাসল। কিন্তু শহরের মধ্যে এমন একটা বাগানঘেরা বাড়িতে থাকতে পারলে ওর খারাপ লাগত না! ওদের ভবানীপুরের ফ্ল্যাট যেন কেমন কাটাকুটি খেলার ঘরের মতো!

ঘরে ঢুকেই বসার জায়গা। মাটিতে পাতা মোটা গদি। কুশন দিয়ে সাজানো! বারান্দাতেই জুতো খুলে রেখেছিল নোঈ। এবার গদিতে বসে পড়ল। দেখল, স্মরণ ওইখানে ওর পাশে না বসে সামনের একটা ছোট চৌকোমতো গদিতে বসল।

নোঈ মাথা ঘুরিয়ে দেখল ঘরটা। চারিদিকে শুধু বই রাখা! আর নানান মাপের ছোটবড় গাড়ির মডেল সাজানো!

নোঈ জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কার গাড়ি?”

“কেন? আমার!” স্মরণ এমন করে বলল, যেন নোঈ বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছে!

“এই বয়সে গাড়ি? কী করিস? খেলিস?”

“খেলব কেন? জমাই! ভিন্টেজ কার্‌স। দারুণ। সব স্কেল ডাউন ডাই কাস্ট মডেল। পুরো অরিজিনালের মতো!”

নোঈ হাসল, “পাগল কি গাছে ফলে?”

স্মরণ পালটা বলল, “না, ভবানীপুরে ফলে!”

“কেন, আমি কী করলাম?” নোঈ অবাক হল।

“অন্যের অফিসে গিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদে, আবার জিজ্ঞেস করছিস!”

“ভাল হবে না কিন্তু স্মরণ!” নোঈ আবার ব্যাগ তুলল।

“আঃ, বাবু তুই চুপ করবি! নোঈ, তুমি কিছু মনে কোরো না ওর কথায়! আর এমন গাড়ি কিনে কত টাকা যে নষ্ট করে!” কাকিমা মাথা নাড়লেন, “যাই হোক, তোমরা কথা বলো। আমি খাবার নিয়ে আসি।”

“খাবার!” নোঈ অপ্রস্তুত হল, “খাবার কেন?”

“আরে, খাবার কেন মানে? তারক চক্কোত্তি তোমার… ইয়ে তোর মাথা ঘেঁটে দিয়েছে নাকি? নাকি ওই বান্ধবী দিল!” স্মরণ হইহই করে উঠল, “তুমি আনো তো মা!”

কাকিমা চলে যেতেই নোঈ চাপা গলায় বলল, “এভাবে খাওয়া-দাওয়া কেন? আর খালি তারক চক্রবর্তীর কথা তুলছিস কেন?”

“কারণ,” স্মরণ এবার সিরিয়াস গলায় বলল, “লোকটাকে আমি মাথা থেকে বের করতে পারছি না! কেমন করে তাকাচ্ছিল মনে আছে? জানোয়ার পুরো!”

নোঈ চোয়াল শক্ত করল। স্মরণ ঠিক বলেছে! লোকটার যে বাজে দৃষ্টি, লোকটাকে দেখেই তা বোঝা যাচ্ছিল! এই সব লোকগুলো কেমন একটা ধাঁচের হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন!

লোকটার সামনে বসতেই নোঈর অস্বস্তি লেগেছিল। লোকটা সোজা ওর বুকের দিকে তাকিয়েছিল। আজ জিন্‌স আর একটা নীল সাদার ডোরাকাটা গোল গলার টিশার্ট পরেছে নোঈ!

ও ব্যাগটাকে বুকে জড়িয়ে বসেছিল।

তারক লোকটার বড়সড় চেহারা। মাথায় বিশাল টাক। কপালে তিলক কাটা। একটা স্টিলের বইয়ের মতো দেখতে কৌটো খুলে জরদা খেয়েছিল সময় নিয়ে। কিন্তু গোটা সময়টা চোখ সরায়নি নোঈর দিক থেকে!

জরদা মুখে পুরে হাতটা চেয়ারের হাতলে রাখা একটা তোয়ালেতে মুছে তারক বলেছিল, “আপনি চাকরি করেন কেন? আপনার তো ফিল্মে নামা উচিত! নিদেনপক্ষে সিরিয়াল! বলেন তো, আমি বলে দিই কাউকে। আমার চেনাজানা আছে।”

স্মরণ মাঝখান থেকে বলেছিল, “আসলে আমরা এসেছিলাম ওই জুট মিল আর…”

“জানি, জানি,” খেঁকিয়ে উঠেছিল তারক, “দেখছ কথা বলছি, অত নাক গলানোর কী আছে!”

নোঈ চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, “আমরা ওই কাজেই এসেছিলাম তারকবাবু, পুরো কাজটা…”

তারক এবার হেলান দিয়ে বসেছিল, “ও আপনার বুঝি ফিল্মে নামার ইচ্ছে নেই! ঠিক আছে, তা হলে আর কী বলি?”

“ওই মিলের আর জোনাক-বাড়ির ব্যাপারটা…” নোঈ চেষ্টা করেছিল আবার।

এবার আর আপনি নয়, সোজা তুমিতে নেমে এসেছিল তারক। ঝুঁকে পড়ে বলেছিল, “তোমাদের মতো বাচ্চাদের সঙ্গে আমি এই নিয়ে কথা বলব? তোমাদের ওই পুশকিনবাবু কই? আমি খবর রাখি না ভেবেছ? অন্য যারা কাজ নেবে তারা রেসপন্‌সিবল লোকজনদের পাঠাচ্ছে! আর তোমাদের অফিস এসব নভিসদের পাঠাচ্ছে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে! আমার মান-সম্মান নেই?”

স্মরণ বলেছিল, “আমি আগেই এসেছিলাম। মোতিবাবুর সঙ্গে কথা বলে গিয়েছি। কিন্তু, মানে একটা গাইডলাইন না পেলে…”

“কীসের গাইডলাইন!” তারক বলেছিল, “গান্ডু নাকি তুমি? এখানে রেট বাঁধা! বুঝেছ? আর সেটা না জেনে এলে আমি কী করতে পারি। প্লাস বড় কাউকে পাঠাও! তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে কলেজ থেকে রিইউনিয়নের চাঁদা চাইতে এসেছ!”

“আপনি একবার কথাটা শুনুন,” নোঈ বলার চেষ্টা করেছিল।

“তুমি তো পার্ট করবে না সিনেমায়, তবে আর কী শুনব। এমন চেহারা নিয়ে এসব বাজে কোম্পানিতে কাজ করছ! কোনও মানে হয়?”

“প্লিজ়, মিস্টার চক্রবর্তী এভাবে বলবেন না,” নোঈ উঠে দাঁড়িয়েছিল।

“তবে কীভাবে বলব? আমার একটা সম্মান নেই? যার-তার সঙ্গে আমি কথা বলব বলে মনে হয়?” তারক চোয়াল শক্ত করেছিল, “সামনের উইকের মধ্যে তোমাদের অফিসের বড় কেউ এসে যোগাযোগ না করলে দেখব তোমরা কী করে এখানে কাজ করো! নাও, এখন কাটো! শালা…”

অপমানে নোঈর মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। এতটা ইতর কেউ কী করে হতে পারে! স্মরণ কিছু বলতে গিয়েছিল। কিন্তু নোঈ স্মরণের হাত ধরে টেনে ওকে ঘর থেকে বের করে এনেছিল! এসব মানুষের সামনে কিছু বলার মানে হয় না! রাগে কষ্টে জল এসে গিয়েছিল ওর চোখে!

স্মরণ বাইরে বেরিয়ে বলেছিল, “কাঁদছ কেন? এভাবে কাঁদতে নেই! বড়রা কাঁদে না!”

“কী হল? এখনও মুড অফ!” স্মরণ সাবধানে জিজ্ঞেস করল!

নোঈ বলল, “জানিস তো আমার এক কাজ়িন দাদা ওখানেই থাকে। নিশান। ও সোনাঝুরিতে পলিটিক্যালি অ্যাক্টিভ। কিন্তু ওকে আমি কিছু বলি না, কারণ ও নিজে এইসব আবাসনের বিরুদ্ধে! কীসব নাকি কমিটি করছে সোনাঝুরিকে বাঁচাবে বলে! তাই ওকে বলেও লাভ হবে না। বরং হিতে বিপরীত হবে!”

স্মরণ বলল, “আমি চিনি ওকে! ম্যাগাজ়িন সূত্রে আলাপ। আর শোন, কাউকে বলার দরকার নেই! নিশান যদিও আমাদের ভুল বুঝছে, তাও এখনই কিছু বলার দরকার নেই। আমরা তো আর সব কিছু ধ্বংস করতে চাইছি না হোমওয়ার্ড বাউন্ডের মতো! আমাদের ভিশনটা আলাদা। তবে নিশান কিছু শুনবে না জানি। ডোন্ট মাইন্ড। ও ভাল ছেলে, কিন্তু হেভি গোঁয়ার! যাকগে। এখন আর মাথা খারাপ করিস না। যা হবে দেখা যাবে। এখন তো লুচি খা! মা যা আলুর দম বানায় না! আর নারকেলের মিষ্টিও বানিয়েছে। ঘ্যামা!”

নোঈ হাসল সামান্য। মাথা নাড়ল, “আর লুচি! আসলে কী জানিস, এক-একটা দিন এমন যায়! আজ আমার খারাপ লাগার দিন!”

স্মরণ দ্রুত একবার রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, “প্যাঁও-ও এমন বলে। সত্যি এমন এক-একটা দিন যায়।”

“প্যাঁওকে বাড়িতে আনিসনি এখনও?” নোঈ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল।

“বাড়িতে?” স্মরণ হেসে বলল, “সবকিছু অত সহজ নয়! আসলে…”

কিন্তু কথাটা শেষ করার আগেই টিং টং শব্দে ডোরবেলটা বেজে উঠল! স্মরণ চমকে উঠল একটু, “এখন আবার কে!”

নোঈ দেখল কাকিমাও রান্নাঘর থেকে মুখ বের করে উঁকি মারছেন।

স্মরণ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। নোঈ বসেই দেখতে পেল লোকটাকে।

আসলে লোক নয়, একটা ছেলে। বেশ লম্বা। ভাল চেহারা! একটা জিন্‌স আর টি-শার্ট পরা। পায়ে সাধারণ একটা চটি।

স্মরণ চশমাটা ঠিক করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাকে চাইছেন?”

ছেলেটা নরম গলায় বলল, “আপনাদেরই চাইছি।”

“আমাদের? মানে?” স্মরণ যে সামান্য ঘাবড়ে গেছে, সেটা ওর গলার স্বরেই বুঝতে পারল।

ছেলেটা বলল, “আমি আপনাদের কাছে বলতে পারেন একজনের হয়ে এসেছি। সোনাঝুরির কাজের ব্যাপারে এসেছি!”

“সোনাঝুরি?” নোঈ এবার উঠে গিয়ে দাঁড়াল স্মরণের পাশে!

ছেলেটা বলল, “হ্যাঁ। দরকারি কাজ। একটু যদি শোনেন আপনাদের ক্ষতি হবে না।”

নোঈ অবাক হল, “কোথা থেকে আসছেন? কে আপনি?”

ছেলেটা সময় নিল একটু। তারপর নরম স্বরে বলল, “আমি রিতুদার কাছ থেকে আসছি। আমার নাম মাহির।”

.

২৩. নিশান

বৃষ্টিতে আজ চারিদিক আবছা হয়ে আছে। পাঁচ হাত দূরের জিনিসও এখন দেখা যাচ্ছে না! তাও সাইকেল চালাতে বেশ মজা লাগছে নিশানের।

বর্ষাকাল খুব পছন্দ ওর! কেমন একটা ঘন রং হয়ে যায় সব কিছুর। জল যেন সমস্ত পৃথিবীর ভেতর থেকে একটা ডার্কার শেড বের করে আনে।

বাঁধের রাস্তাটায় উঠে সাইকেল চালানোই দায় হয়ে উঠছে। ও গায়ে মোটা বর্ষাতি পরে থাকলেও মুখটা তো খোলা। মুখ বেয়ে গলার কাছ অবধি জল চলে যাচ্ছে। বারবার চোখ আর ভুরুর ওপর থেকে জল সরাতে হচ্ছে। অন্য কেউ হলে এই বৃষ্টিতে নিশান আসত না, কিন্তু মেঘলার জন্মদিন আজ! না এলে পাগলিটা খুব রাগ করবে। কষ্টও পাবে! মেঘলার প্রতি একটা অদ্ভুত মায়া আছে নিশানের।

নিশান সাইকেল থেকে নেমে পড়ল এবার। বৃষ্টির আলপিন তেরছাভাবে এসে মুখে ফুটছে। এভাবে সাইকেল চালানো যায় না!

সাইকেল হাঁটিয়ে-হাঁটিয়ে নিশান এগোতে লাগল সামনের দিকে। বর্ষাতির তলায় পিঠে ব্যাগ আছে ওর। মেঘলার জন্য উপহার আছে ওতে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা বারণ করছিল আসতে। কিন্তু নিশান শোনেনি। আসলে নিশান কারও কথাই খুব একটা শোনে না। আজকাল বাবাও তাই কথা বলা একরকম বন্ধ করে দিয়েছে। খুব দরকার না পড়লে বাবা আর নিশান দু’জন দু’জনকে এড়িয়েই চলে। কারণ, কথা হলেই ঝগড়া হয়। এই যেমন গতকাল রাতেই খেতে বসে হয়েছে একচোট।

অন্য দিন বাবা দশটার মধ্যে খেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। কিন্তু গতকাল রাতে বাড়ি ফিরে নিশান দেখেছিল খাওয়ার ঘরে মায়ের সঙ্গে বাবাও বসে রয়েছে!

নিশানের এমনিতে বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা হয়। কিন্তু গতকাল আরও রাত হয়ে গিয়েছিল। ওরা যে একটা মঞ্চ তৈরি করেছে, ‘সেভ সোনাঝুরি’, তার কিছু লিফলেট আর ব্যানার তৈরির কাজ ছিল। বাড়িতে ঢুকে অত রাতে বাবাকে বসে থাকতে দেখে ও অবাকই হয়েছিল।

ও ঘরে ঢুকতেই মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “এইমাত্র এল ছেলেটা, এখনই কিছু বোলো না।”

“এখন বলব না?” বাবা যে খুব রেগে আছে, সেটা গলার আওয়াজ শুনেই বুঝে গিয়েছিল নিশান।

ও আর নিজের ঘরের দিকে না গিয়ে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে তাকিয়েছিল বাবার দিকে। যা শোনার এখনই শুনে নেওয়া ভাল!

নিশান শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার হার্টের সমস্যা, এই রাত বারোটার সময় জেগে আছ কেন?”

বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর বলেছিল, “আমি মরি কি বাঁচি, তাতে তোর আগ্রহ আছে?”

“কী হয়েছে?” নিশান টেবিলে আঙুল দিয়ে দাগ কাটতে-কাটতে বলেছিল, “এমন করে বলছ কেন?”

বাবা উত্তেজিত গলায় বলেছিল, “তুই কী পেয়েছিস? এভাবে কি তোর জীবন যাবে? আমার ব্যাবসাটা কার জন্য করেছি? আর কতদিন এভাবে সমাজসেবা চলবে?”

“কী হয়েছে বলবে তো?” নিশান বুঝতে পারছিল ব্যাপারটা শুধু ওর নিজেদের ব্যাবসায় মন না দেওয়ায় আটকে নেই। অন্য কিছু ঘটেছে!

বাবা উঠে দাঁড়িয়েছিল এবার, “সোনাঝুরি কি তোর একার জায়গা! যে যা করছে করুক, তুই কেন তার মধ্যে নাক গলাচ্ছিস? যাদের জুটমিল, যাদের জোনাক-বাড়ি তাদের ভাবতে দে না। তুই কেন এর মধ্যে থাকছিস? নিজের বড়মামার রক্তটা পেয়েছিস?”

“আরে, কী হল!” নিশান অবাক হয়ে গিয়েছিল। বড়মামা মানে সত্যেন মিত্র। নকশালের সময় খুন হয়ে গিয়েছিলেন। সোনাঝুরিতে সতু বললে একসময় সবাই চিনত। সতুমামার গল্পই শুধু ও শুনেছে। কারণ, চার ভাই আর দু’বোনের মধ্যে মা সবচেয়ে ছোট। সতুমামা যখন মারা যান তখন মা অনেক ছোট ছিল! কিন্তু পরিবারের মধ্যে এখনও সতুমামার কথা আলোচনা হয়। বলা হয়, কীভাবে সতু রাজনীতিতে ঢুকে নিজের জীবন নষ্ট করে ফেলেছিল!

কিন্তু সেই সতুমামার কথা বাবা তুলল কেন? নিশান এবার সামান্য শক্ত গলায় বলেছিল, “কী হয়েছে বলো তো! কেউ কিছু বলেছে তোমায়?”

“কেন, বললে কী করবি? তাদের গলা কাটবি?” বাবা পায়চারি করতে-করতে তাকিয়েছিল নিশানের দিকে।

“কে কী বলেছে তোমায়? আমি কী করব, সেটা কি অন্য লোকে ঠিক করে দেবে?”

“মরতে চাস তুই?” বাবা সামনে এসে আচমকা চিৎকার করে উঠেছিল।

“বাবা আস্তে!” নিশান চাপা গলায় বলেছিল, “অনেক রাত হয়েছে। আশপাশের লোকজন শুনতে পাবে। কী হয়েছে তোমার?”

“তুই ওই তারক গুন্ডার সঙ্গে লাগতে গিয়েছিস? তোকে তো মেরে পুঁতে দেবে! আমায় আজ শয়তানটা ধরেছিল রাস্তায়। নিজের গাড়ি থেকে নেমে এসেছিল আমায় দেখে। বলে, নিজের ছেলেকে সামলান। উন্নয়নে বাধা দিলে ওকে কিন্তু আর খুঁজে পাওয়া যাবে না! কে বলেছে তোকে উন্নয়নে বাধা দিতে? নিজেকে কী ভাবিস তুই?

নিশান তাকিয়েছিল বাবার দিকে। ফরসা মানুষ, লাল হয়ে গিয়েছে! কাঁপছে থরথর করে। ও বুঝতে পারছিল খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে বাবা! ওরও ভয় হয়েছিল। বাবার না আবার শরীর খারাপ করে!

নিশান বলেছিল, “তুমি ভয় পেয়ো না বাবা। কিছু হবে না। এভাবে কেউ এসে আমাদের হেরিটেজ নষ্ট করবে! মিল বন্ধ করে দিয়ে যাবে! এটা হতে পারে না। এতগুলো লোকের কী হবে? আর তার ওপর লোকটা তো দালালি করে মোটা টাকা কামাবে। এতগুলো মানুষকে শেষ করে ও নিজে টাকা রোজগার করবে? জানোয়ার ছাড়া এমন কেউ করে? এটা আমার সামনে দিয়ে হবে, আর আমি কিছু বলব না?”

“না, বলবি না! কে বলতে বলেছে তোকে এসব কথা!” বাবা গলা নামায়নি একটুও, “আমি চাই না তুই এসব করিস। আজ তারক এভাবে বলছে। কাল যদি কিছু করে? রাতবিরেতে বাড়ি ফিরিস তুই। কিছু হলে আমার আর তোর মায়ের কী হবে? নিজের কথাটাই শুধু ভাবছিস?”

নিশান সোজা তাকিয়েছিল বাবার দিকে। তারপর বলেছিল, “আর, মানুষগুলোর কী হবে? কঠিন সময়ে সবাই যদি পালায় তবে দাঁড়াবেটা কে? কেন সবকিছু আমাদের মুখ বুজে মেনে নিতে হবে? উন্নয়নের নামে কেউ যদি মানুষের ক্ষতি করে! নিজের পকেট ভরে! সেসব মেনে নিতে হবে? কেউ কিছু না বললে তো এবার বাকি সোনাঝুরিটাও নিলাম করে দেবে এই লোকগুলো! কারখানা বন্ধ করে হাউজ়িং হচ্ছে! বড় লোকেদের ইনভেস্টমেন্টের জায়গা এইসব ফ্ল্যাট। ক’জন থাকবে এখানে এসে? সব কিনে ফেলে রাখবে। বছরে কয়েকদিন আসবে মাত্র। আর ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা কী করবে? কোন কাজ করবে? মাঠের ঘাস কাটবে? দরোয়ানের পোশাক পরে সামান্য মাইনে নেবে? আর নিজের কথা কি সত্যি আমিই শুধু ভাবছি বাবা?”

“তুই… তুই… আমায় জ্ঞান দিচ্ছিস? তুই…” বাবা কথা খুঁজে না পেয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। তারপর মাকে উদ্দেশ করে বলেছিল, “তোমার ছেলেকে এসব করতে বারণ করে দাও। আমি কিন্তু এসব বরদাস্ত করব না। কেউ রাস্তায় সবার সামনে আমায় অপমান করবে, এসব কিন্তু আমি মেনে নেব না বলে দিলাম!”

বাবা দুদ্দাড় করে পা দাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল। নিশান কী বলবে বুঝতে পারছিল না। নিঝুম রাত যেন আরও চেপে বসছিল চারিদিকে। দূরে ঝিঁঝি ডাকছিল। পাশের পুকুর থেকে কোলাব্যাঙের আওয়াজ রাতটাকে আরও যেন নিশুত করে দিচ্ছিল!

মা বলেছিল, “তুই এমন কেন? আমাদের কথা একবারও তোর মনে পড়ে না!”

নিশান বলেছিল, “কেন, বাবা তো বলেই গেল। সতুমামার রক্ত! মা, আর ভাল লাগছে না। খিদে পেয়েছে। বিজনদার সঙ্গে সেই মুড়ি আর তেলেভাজা খেয়েছিলাম কখন। খেতে দেবে?”

মা খেতে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সারাটা সময় গজগজ করে গিয়েছিল!

আজও সারাক্ষণ মা, বাবার কথাগুলোকেই নানাভাবে বলে যাচ্ছিল। নিশান খুব-একটা গা করেনি। বরং নিজের ঘরে বসে রাধিয়ার সঙ্গে মেসেজে কথা বলছিল!

মা ভেবেছিল গতকালের বকুনির পরে হয়তো নিশানের সুমতি হয়েছে, তাই বেরোয়নি সকালে। কিন্তু বুঝতে পারেনি যে, দুপুরে এই বাদলার মধ্যে বেরিয়ে যাবে ও!

রাধিয়াও ওকে বারণ করছিল এই ঝড়বৃষ্টিতে বেরোতে, কিন্তু আজ রাধিয়ার কথাও শোনেনি! রাধিয়া কি তাতে রেগে গেছে! কে জানে! রাধিয়া ওকে ভুল বুঝলে বা রেগে গেলে খুব খারাপ লাগবে নিশানের।

বাঁধের ওপর থেকে রাস্তাটা নেমে গেছে ঢালু হয়ে। রাস্তার দু’দিকে ঘন ঝোপঝাড়! তার মধ্য দিয়ে মেঘলাদের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে নিশান।

সাইকেলটা ঠেলতে-ঠেলতে ও বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছড়ানো উঠোনে জল থইথই করছে! জায়গা দেখে, সামনের বড় চাঁপাগাছের পাশে সাইকেলটাকে স্ট্যান্ড করিয়ে বারান্দায় উঠল ও।

“কে?” মেঘলার গলা পেল নিশান।

“আমি রে!” নিশান গায়ের বর্ষাতিটা খুলে জল ঝেড়ে বারান্দার পাশে একটা কাঠের ছোট আংটায় ঝুলিয়ে দিল। তারপর হাত দিয়ে মাথা আর গায়ের সামান্য জলের কুচি সরিয়ে দিয়ে দাঁড়াল ঘরের সামনে! পাপোশটা সরে গেছে। সেটা পা দিয়ে টেনে তাতে পা মুছে ও ঘরে ঢুকল। সামান্য ঠান্ডা লাগছে!

“কী রে, কাকিমা নেই?”

“আমি আছি, এতে হবে না?” মেঘলার গলায় রাগ।

“আরে!” নিশান হাসল। পিঠ থেকে ব্যাগটা খুলে রাখল বিছানায়। তারপর বসল মেঘলার পাশে।

“কী আরে!” মেঘলা অভিমানী গলায় বলল, “খালি এর কথা, ওর কথা! আজকাল তো আসোও না! কেন এমন হয়ে গেলে তুমি নিশানদা!”

“আমি আবার কী হলাম!” নিশান ব্যাগের চেন খুলে একটা বড় প্যাকেট বের করল। তারপর ব্যাগটা নামিয়ে রাখল মাটিতে।

রাধিয়ার সঙ্গে গিয়ে কিনেছে এটা। একটা জামা আছে এতে। সঙ্গে ভাল একটা মিউজিক সিস্টেম!

“এই যে আর আসো না! আমি কেমন আছি আর জানতে চাও না। আজ মা জোর করে নেমন্তন্ন করল বলেই তো এলে, তাই না? না হলে কি আসতে?”

“কী হয়েছে তোর মেঘলা?” নিশান ওর দিকে ঘুরে বসল, “কী বলছিস? আজ তোর জন্মদিন না! এমন মনখারাপের কথা কেউ বলে? এমন করিস না। এই দ্যাখ তো, আমি যদি তোর কথা না ভাবি, তা হলে এই ওয়েদারে কেন আসব জল-কাদা ভেঙে? এই দেখ কী এনেছি তোর জন্য!”

“লাগবে না যাও, কিচ্ছু লাগবে না আমার! তুমি ভিক্ষে দিতে এসেছ?” মেঘলা আচমকা ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে গেল দরজার দিকে। কিন্তু ওর পায়ের কাছে রাখা নিশানের রাখা ব্যাগটায় বাধা পেয়ে নিজে টাল সামলাতে পারল না।

নিশান দ্রুত প্যাকেটটা বিছানায় রেখে ধরে ফেলল মেঘলাকে। মেয়েটা আর-একটু হলেই পড়ে যেত মাটিতে!

মেঘলা ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গেল একটু। নিশান ওকে নিজের বুকের কাছে ধরে রেখেছে। ও-ও নিশানের পাঞ্জাবির বুকের কাছটা ধরে রয়েছে খামচে।

নিশান দেখল মেঘলার চোখে জল।

“আরে, তুই কাঁদছিস?”

নিশান হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করতে গেল। কিন্তু আচমকা মেঘলা সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর দু’হাতে নিশানকে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে নিল নিজের দিকে। আর নিখুঁত আন্দাজে নিশানের ঠোঁটটায় চেপে ধরল ওর ঠোঁট!

নিশান হতভম্ব হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য! এটা কী হচ্ছে? মেঘলা হঠাৎ এটা কী করছে? তারপরেই ওর হুঁশ ফিরল। মেঘলাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল জোরে। কিন্তু পারল না। বরং মেঘলা যেন আরও ঘন হয়ে, আরও জোরে চেপে ধরল ওকে!

মেঘলার গরম জিভ ওর ঠোঁট ফাঁক করে মুখের ভেতরে ঢুকতে চাইছে! মেঘলা দুটো হাত দিয়ে নিজের সঙ্গে পিষে ফেলতে চাইছে নিশানকে! নিশান কী করবে বুঝতে পারল না। মেঘলা যেন নিশানের সমস্ত সত্তাকে নিজের ঠোঁট দিয়ে শুষে নিতে চাইছে নিজের মধ্যে। কামড়ে ধরছে ওর ঠোঁট! নিজের বুক দুটো চেপে ঘষছে নিশানের বুকের সঙ্গে!

“আঃ!” ব্যথায় চিৎকার করে এবার নিশান গায়ের জোরে মেঘলাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মেঘলা সরল বটে, কিন্তু তাতে খুব একটা দূরে ছিটকে গেল না। বরং আবার সামনে ঝুঁকে দু’বারের চেষ্টায় চেপে ধরল নিশানের হাত। তারপর সটান নিজের বুকের ওপর চেপে ধরে বলল, “আমি কি কিছু কম? নিশানদা, আমি চোখে দেখি না বলে আমার কি কিছু নেই! আমি কি কিছু দিতে পারি না তোমায়?”

নিশান এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ছিটকে গেল পেছনে। বলল, “কী করছিস তুই? পাগল হয়ে গেলি নাকি?”

“কেন, পাগল কেন? বাড়িতে মা নেই। দাদাও না। আমার ইচ্ছে করে না তোমায় আদর করতে! তুমি বোঝো না! আমিও তো মানুষ না কি! আমার চোখ নেই বলে কি ইচ্ছে থাকতে নেই!” মেঘলার গলার স্বর রাগ থেকে আচমকা কান্নায় ডুবে গেল এবার। ও দু’হাতে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল বিছানায়!

নিশান কী করবে বুঝতে পারল না। মেয়েটা বিছানায় শুয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে। ফুলে-ফুলে উঠছে পিঠটা। ওর কী করা উচিত? পাশে বসে মাথায় হাত দেবে? তাতে যদি আবার রাগ করে? বা যদি আবার ওরকম করে?

নিশানের ঠোঁটটা এখনও ব্যথা হয়ে আছে! মনটা কেমন খাদে-পড়ে-যাওয়া বাসের মতো উলটে আছে! মনে হচ্ছে দৌড়ে পালিয়ে যায় এখান থেকে! কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়, বুঝতে পারছে। মেয়েটা এমন করল কেন!

এই জটিল প্রেম-ভালবাসা-যৌনতাগুলো সব কিছু নষ্ট করে দেয়। যার সঙ্গে মনের সম্পর্ক আছে তাকে আদর করতে নিশানের অসুবিধে হয় না। কিন্তু এভাবে যাকে ওই চোখে কোনওদিনও দেখেনি, যাকে ওইভাবে ভাবেনি, তার সঙ্গে কী করে ও এমন একটা সম্পর্কে জড়ায়! ও জানে এমন মানুষজন আছে যারা মন-টন বোঝে না! শরীর হলেই তাদের হয়। কিন্তু নিশান সে দলে পড়ে না। বরং ওর এখন খুব কষ্টও হচ্ছে! ও মনে মনে রাধিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। সেখানে অন্য একটা মেয়ে ওকে এভাবে ধরে ফেলল! ঠোঁটে কামড়ে ধরল! এতে কোথাও কি রাধিয়ার বিশ্বাসটা ভাঙল ও!

নিশান জানে এভাবে হয়তো এখনকার ছেলেমেয়েরা কেউ ভাবে না। কিন্তু ও কী করবে! সবার ভ্যালু সিস্টেম তো একরকম নয়! ওর এইসব ব্যাপারে খুব একটা পিউরিটান মনোভাব আছে। কেন আছে জানে না। এখন ওর বারবার রাধিয়ার মুখটা মনে পড়ছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, রাধিয়াকেও তো কিছু বলেনি ও। এখনও ওর মনের ইচ্ছেটা, ফিলিংসটা নিয়ে কিছু বলেনি! শুধু বন্ধুত্বটুকু হয়ে আছে! তাও নিজের মনের কাছে কী করে মিথ্যে বলে নিশান!

নিশান নিজের মনকে শক্ত করল। তারপর ধীরে-ধীরে বসল বিছানার একপাশে। বলল, “এমন করতে নেই মেঘলা। এভাবে বলতে নেই!”

“কেন?” মেঘলা উঠে বসল এবার। পাথরের মতো চোখ দুটো থিরথির করে কাঁপছে, “কেন হয় না নিশানদা? আমি অন্ধ বলে?”

“না রে পাগলি না,” মেঘলার গলায় এমন একটা অসহায়তা ছিল যে, নিশানের চোখে জল এসে গেল, “আমি তোকে ওভাবে দেখি না রে! তোকে সেই ছোট থেকে দেখছি। আর তুই… তুই এমন কেন করলি?”

“আমি তোমায় ভালবাসি নিশানদা। বোঝো না কেন তুমি? আমি তোমায়… সব দিতে চাই নিশানদা…”

“কী বলছিস তুই?” নিশান মেঘলার গলার ওপর গলা তুলে ওকে চুপ করিয়ে দিতে চাইল।

মেঘলা নিজেকে সংযত করল এবার। তারপর বলল, “আমি জানি আমার এই অবস্থার জন্য কোনওদিন তুমি আমায় ভালবাসতে পারবে না। ছেলেরা মুখেই বড়-বড় কথা বলে, কিন্তু আসলে সবাই বিজ্ঞাপনের মডেলের মতো বউ আর প্রেমিকা চায়! তোমারও নিশ্চয়ই তেমন কোনও প্রেমিকা আছে! তাই না? কিন্তু আমি তো তোমায় ভালবাসি, আমি থাকব তোমার জন্য। কখনও যদি তোমার মনে হয়, তুমি এসো। আমি আমার সবটা তোমায় দেব। না, পরিবর্তে কিছু চাই না।”

নিশান কী বলবে বুঝতে পারল না। আসলে কিছু বলার নেই ওর। মেঘলা মনে মনে এমন একটা জায়গায় চলে গিয়েছে যে, ওকে কিছু বলার কোনও মানে নেই এখন। যে সত্যিকারের প্রেমে পড়ে তার কাছে জীবনের, বাস্তবের, ঠিক-ভুলের পারসেপশনগুলো বদলে যায়। তার যুক্তি, বুদ্ধি, তথাকথিত রোজকার পৃথিবীর যুক্তি, বুদ্ধির সঙ্গে খাপ খায় না আর!

“কী চাস না রে?”

আচমকা পেছন থেকে কাকিমার গলা পেয়ে নিশান চমকে উঠল। ওর মনে হল হৃৎপিণ্ডটা বোধহয় এবার মুখ দিয়ে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসবে।

“কী রে! কী বলছিস তুই?” কাকিমা ঘরে ঢুকল। নিশান দেখল কাকিমার সঙ্গে বাদলও এসে ঘরে ঢুকেছে!

মেঘলা চোখ মুছে বলল, “বলছি, আমার কিছু চাই না নিশানদার কাছ থেকে। নিজে আসে না, আর আজ এসেছে গিফট নিয়ে! মানুষের চেয়ে জিনিস দামি নাকি? তাই বলেছি এসব যেন নিয়ে যায়!”

“আরে…” নিশান অপ্রস্তুতভাবে হাসল। মেয়েটা কথাটা ঠিক ঘুরিয়ে দিল তো! ও বলল, “তাই কি হয় নাকি? ওভাবে হয় না। আমি নিয়ে এসেছি, তোকে নিতেই হবে! আমি তোকে ভালবেসে…”

“ছাড়ো তো!” মেঘলা রাগে গরগর করে উঠল, “ভালবেসে… বাজে কথা যত!”

“আহা, তুই ওকে অমন করে কথা বলছিস কেন?” কাকিমা শাসনের গলায় বলল, “চল ও ঘরে। স্নান করে নিবি, চল।”

মেঘলা উঠল বিছানা থেকে, তারপর আর কথা না বাড়িয়ে ধীরে-ধীরে চলে গেল পাশের ঘরে।

নিশান যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণ যা হল সেটা কি সত্যি হয়েছিল? মেঘলা এমন করবে বুঝতে পারেনি! এরপর থেকে এখানে আসার আগে ওকে ভেবে দেখতে হবে!

“কী এনেছিস এটা?” বাদল ঝুঁকে বিছানায় রাখা গিফটের প্যাকেটটা তুলে নিল হাতে।

“ওই আর কী…” নিশান হাসার চেষ্টা করল, “তা কোথায় গিয়েছিলি তোরা?”

“কাছেই। পাড়ার এক দাদু। আচমকা হার্ট অ্যাটাক হল। আমায় ডাকল। শুনে মা-ও গেল। মা, কাকাবাবু বলে ডাকত। আরে দেখ না, অ্যাম্বুলেন্স আসতে চাইছিল না। আমাকে তাই ডেকেছিল।”

“তোকে? কেন?” নিশান অবাক হল।

বাদল হাসল, “আরে, তুই জানিস না? তুই তো আর কিছু কাজ দেখে দিলি না। তাই আমি গিয়ে ধরলাম তারকদাকে। আমি এখন তারকদার সঙ্গে আছি। সেই কারণেই ডেকেছিল আমায়। তো, দাদুর ওখানে গিয়ে আমি নিজেই ফোন করলাম তারকদার ওই রাইট হ্যান্ড মোতিদাকে। ব্যস, অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হয়ে গেল। তা, তুই খেয়ে যাবি তো? একটু বোস, আমি আসছি।”

নিশানের উত্তর না শুনেই বেরিয়ে গেল বাদল। নিশান ঘড়ি দেখল। দেড়টা বাজে। একটা ফোন আসার কথা আছে। মণীশটা ঠিকমতো কাজটা করছে তো! চিন্তা হল ওর। ছেলেটাকে ব্যাপারটা বলে কোনও ভুল করেনি তো! নিশান নিজেকে ঠিক করতে চোখ বন্ধ করল। আর সঙ্গে-সঙ্গে মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা।

সেদিন ঝড় উঠেছিল খুব। নন্দন চত্বরে হাওয়ায় কুটো উড়ছিল ভীষণ! একটা ঝড়ের কুটো এসে লেপটে গিয়েছিল রাধিয়ার গালে। এমন তো করে না নিশান! কিন্তু সেদিন কী যে হয়েছিল ওর! আচমকা হাত বাড়িয়ে রাধিয়ার গালে লেপটে থাকা ঝড়ের কুটো সরিয়ে দিয়েছিল ও। আর অবাক হয়ে দেখেছিল রাধিয়া মাথা নামিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে!

“আরে, কী হল?” নিশান আর-একটু কাছে এগিয়ে গিয়েছিল।

রাধিয়া সময় নিয়েছিল। আর সেই সু্যোগে ঝড়টাও যেন আছড়ে পড়েছিল কলকাতায়। সবাই এদিক-ওদিক দৌড়োচ্ছিল মাথা বাঁচাতে। নিশানও রাধিয়ার হাতটা ধরে সামান্য দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা ছাউনির তলায়।

“কী হয়েছে তোমার?” নিশান যেন কীসের এক অদৃশ্য জোরে তুমি করে বলে ফেলেছিল কথাটা।

“আমার… আমার…” রাধিয়া কথা বলতে পারছিল না ভাল করে। হাওয়া এসে উড়িয়ে নিচ্ছিল ওর চুল। জলের ছিটে এসে হিরের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিচ্ছিল ওর চুলে, মুখে।

“আমি কিছু হেল্‌প করতে পারি?” নিশানের ঠোঁট শুকিয়ে আসছিল। বুকের ভেতর কেমন যেন এক ঘূর্ণি শুরু হয়েছিল। ওর মনে হচ্ছিল রাধিয়াকে জড়িয়ে ধরে, সবার কাছ থেকে, সব কিছু থেকে লুকিয়ে রাখে!

রাধিয়া নিজেকে সামলেছিল এরপর। হাতে ধরা রুমালটা দিয়ে চোখ আর নাক মুছেছিল আলতো করে। তারপর বলেছিল, “আই অ্যাম সরি।”

“কিছু হয়েছে কি? আমায় বলতে পারো,” আশ্বাসের গলায় বলেছিল নিশান।

“পারি?” দ্বিধা নিয়ে তাকিয়েছিল রাধিয়া, “আসলে… মানে…”

“তবে থাক। ব্যক্তিগত কিছু হলে লেট ইট বি,” নিশান হেসে পরিস্থিতি সহজ করার চেষ্টা করেছিল।

“আসলে,” রাধিয়া ঠোঁট কামড়ে ভেবেছিল একটু, “আমার কাউকে এই ব্যাপারটা নিয়ে বলার নেই। কিন্তু… আমি কি তোমায় বিশ্বাস করতে পারি?”

নিশান এবার চওড়া করে হেসেছিল, “শোনো, বিশ্বাস ব্যাপারটা সেই ছবি বিশ্বাসের আমলেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই ওটা ভেবো না। আমি এমন কিছু করব না যাতে তোমার ক্ষতি হয়। ইচ্ছে হলে বলতে পারো আমায়।”

নিশান কথা বলার সময় রাধিয়ার চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছিল না একটুও। দেখছিল ওর ‘তুমি’ বলাটা রাধিয়া ভালভাবেই নিয়েছে। আর নিজেও ‘তুমি’ করেই কথা বলছে!

“আমার বাবা… মানে কী করে বলি,” রাধিয়া ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলেছিল, “আমি এটা কী করে তোমায় বলতে পারছি, জানি না। কিন্তু ইচ্ছে করছে বলতে…”

নিশান কিছু না বলে এবার আলতো করে রাধিয়ার হাতটা ধরে সামান্য চাপ দিয়েছিল। নিজের ব্যবহারে ও নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিল। এসব কী করে করছে ও! একটা অর্ধেক চেনা মেয়ের হাত ধরছে ও!

রাধিয়া বলেছিল, “বাবা আমাদের না বলে আজকাল কোথায় যেন যায়! মানে… আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। বিজ়নেসের কাজে কলকাতার বাইরে যাবে বলে কলকাতার মধ্যেই ঘোরাফেরা করে! কেন জানি না। কিন্তু আমার খুব ভয় করে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। মাকে বা ঠাকুমাকে বলা যাবে না!”

নিশান বলেছিল, “আমি কি খোঁজখবর করব?”

“তুমি?” রাধিয়া কেঁপে গিয়েছিল সামান্য, “কিন্তু…”

“না, কিছু ফেভার আমি চাইব না। তোমার ঠাকুমার সঙ্গে আমার দেখা করা দরকার। কিন্তু সেটাও আমি তোমায় করিয়ে দিতে বলব না। তুমি চাইলে আমি খবর নিতে পারি।”

রাধিয়া মাথা নামিয়ে নিয়েছিল, “ছিঃ! ছিঃ! আমি কী বললাম!”

“ডোন্ট ওয়ারি, কেউ জানবে না। আই প্রমিস। আমি খবর নেব।”

রাধিয়া এবার নিশানের হাতটা ধরেছিল। বলেছিল, “আমি ভুলব না, তুমি আমার জন্য কী করলে!”

“এখনও তো কিছু করিনি! আগে করি!” নিশান হেসেছিল।

রাধিয়া বলেছিল, “এই যে কিছু করবে বললে এটাই বা কে বলে? আই অ্যাম গ্রেটফুল।”

“প্লিজ়, এভাবে বোলো না। তোমার জন্য কিছু করতে পারলে আমার ভাল লাগবে!”

“কেন?” রাধিয়া প্রশ্নটা করে তাকিয়েছিল নিশানের দিকে।

নিশান হেসেছিল শুধু। তারপর শান্ত গলায় বলেছিল, “ঝড় থেমে গেছে, দ্যাখো!”

“না, আমার উত্তর চাই,” রাধিয়া চোখ সরায়নি, “কেন?”

নিশান মাথা নেড়ে হেসেছিল নিজের মনে, তারপর বলেছিল, “বলব একদিন, কেমন?”

“তুমি শালা নিজে ক্যাল খাবে! আমাকেও ক্যাল খাওয়াবে!” কথাটা শুনে চিড়বিড় করে উঠেছিল মণীশ।

“আরে, তুই জাস্ট একটু খবর নিবি!” নিশান কথাটা বলে হেসেছিল।

সোনাঝুরির বটতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। সেদিনের অনুষ্ঠানের পরে সোনাঝুরিতে ফিরে মণীশের সঙ্গে দরকারি কথা আছে বলে নিশান ওকে দাঁড় করিয়েছিল বটতলায়!

“মাইরি, সুপ্রতীক মালিক কি বাচ্চা ছেলে নাকি যে, আমি খবর নেব? শালা, গাড়ি করে বেড়ায় সারাক্ষণ। আমি কী করে পারব?” ছায়া-ছায়া অন্ধকারে মণীশকে কেমন ছটফটে লাগছিল।

“না, না, পারবি। তোর তো বিশাল জানাশোনা। একটু দেখ না, কোথায় যায় লোকটা। বুঝতে পারছিস না আমাদের আন্দোলনের জন্য এটা দরকার। লোকটা কার সঙ্গে মেলামেশা করছে, সেটা জানা দরকার আমার।”

“আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়া একটা বাচ্চা ছেলে, আমায় তুমি এসব বলছ?” কথাটা শেষ করে হেসেছিল মণীশ।

“শালা, তিনবার ফেল করে তো এবার স্কুল ছেড়ে দিলি! আবার বাচ্চা ছেলে কী রে? দেখ না ভাই, প্লিজ়!” নিশান হাত ধরেছিল ওর।

আসলে নিশানের নিজের তো সময় হবে না। তাই মণীশকে বলেছিল। ও জানে মণীশ ছেলেটা করিতকর্মা। তা ছাড়া নিশানের কথা শোনে মণীশ। আর ওকে তো আসল কথা বলেনি। বলেছে এই সোনাঝুরির ব্যাপারে সুপ্রতীক মালিক কী করছে সেটা জানা দরকার। আর মণীশ ব্যাপারটা খেয়েও গেছে!

মণীশ শুধু বলেছিল, “তুমি কি মালটার সঙ্গে দেখা করতে চাও নাকি?”

সময় নিয়েছিল নিশান। তারপর বলেছিল, “হ্যাঁ চাই। দেখা করতে চাই আমি। শুধু গতিবিধিটা একটু দেখিস, কেমন!”

“শালা, তোমার যত্তসব আনতাবড়ি কাজ! খবর নিয়ে কী ছিঁড়বে কে জানে! বেকার সব! ঠিক আছে আমি জানাব,” মণীশ আর দাঁড়ায়নি। বটতলার পাতলা অন্ধকার ফুটো করে চলে গিয়েছিল বাড়ির দিকে।

আর, তারপর খবর পেয়েছে নিশান। মণীশ ঠিক খবর জোগাড় করে এনেছে। আর সেটা খুব একটা সুখবর নয়। ও জানে না ব্যাপারটা কী করে বলবে রাধিয়াকে!

“কী রে, একা-একা বসে কী করছিস? আমি ভাবলাম মায়ের সঙ্গে কথা বলবি,” বাদল ঘরে ঢুকে হাসল।

নিশানও হাসল বাদলের দিকে তাকিয়ে। বলল, “না এমনি।”

বাদল চট করে একবার অন্য ঘরের দিকে দেখল। তারপর একটা মোড়া টেনে এনে ওর পাশে বসে বলল, “তোকে একটা কথা বলার ছিল। আর্জেন্ট।”

নিশান অবাক হল। বাদলের চেহারায় পুরনো চাকচিক্য ফিরে এসেছে। ঘরবাড়িতেও একটা শ্রী এসেছে। বোঝা যাচ্ছে যে, তারক চক্রবর্তীর কাছ থেকে খারাপ কিছু পাচ্ছে না ও। কিন্তু এই লোকটার সঙ্গে কেন কাজ করছে বাদল? ওর বাদলের জন্য চিন্তা হচ্ছে।

“বল,” নিশান ছোট করে বলল।

বাদল ওর হাতটা ধরল। তারপর নিচু গলায় বলল, “তুই কথাটা কিন্তু ভুলভাবে ধরবি না নিশান। তুই আমার বন্ধু, আমি চাই না তোর কোনও ক্ষতি হোক। তাই বলছি। তুই এই ‘সেভ সোনাঝুরি’ না কী একটা অর্গানাইজ়েশন করেছিস, সেটা বন্ধ কর। শুনছি সামনে তোদের নানা প্রোগ্রাম আছে? মিছিল, ধরনা, আরও কীসব! করিস না ভাই এসব। বন্ধ কর। না হলে বিপদ হবে!”

“তারকদা বলেছে এসব তোকে আমায় বলতে?” নিশান শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।

“না রে পাগল!” বাদল বলল, “আমি শুনেছি। মানে, কানে এসেছে আমার। তোর ওপর কিন্তু খার আছে তারকদার। ভাই, তুই এসব করিস না। বিপদ হয়ে যাবে! আমার উপায় নেই, আমায় রোজগার করতে হবে। কিন্তু তুই এমন করিস না। তারকদা ভাল লোক নয়। জানিস তো এই প্রোজেক্টে কয়েক কোটি টাকা কামাবে ও। সেটাতে কেউ বাধা দিলে কী হবে বুঝতে পারছিস? পার্টির কথাও নাকি লোকটা শুনছে না! মোতিদা সেদিন বলছিল আমায়। তুই একটু রয়ে-সয়ে থাকিস।”

নিশান কিছু বলার আগেই পকেটের ফোনটা বেজে উঠল ওর। এখন আবার কে? ও পকেট থেকে বের করল মোবাইলটা। মণীশ! এখন মণীশ কল করছে কেন?

“বল,” মোবাইলটা কানে লাগাল নিশান।

“তুমি কোথায়?” মণীশ দ্রুত জিজ্ঞেস করল।

“কেন? আমি বাদলের বাড়িতে। কী হয়েছে?”

“আধঘণ্টার মধ্যে তারকদার বাড়ির সামনে আসতে পারবে? খুব জরুরি দরকার।”

মণীশের গলা শুনে নিশান বুঝল কিছু একটা হয়েছে।

“কেন? আমি নেমন্তন্নে এসেছি…”

“সুপ্রতীক মালিক এসেছে একা। তারকদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে! তুমি বলেছিলে না, লোকটার সঙ্গে কথা বলবে! আজ চান্স। চলে এসো। একাই লোকটা গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছে। এই ওয়েদারে সবার চোখের আড়ালে আসতে পারবে বলেই বোধহয় এসেছে। জানি না কী কেস! কিন্তু কিছু কেলো তো আছে গুরু। চলে এসো। আমি এখানেই আছি।”

কথাটা বলে ফোনটা কেটে দিল মণীশ। নিশান বুঝতে পারল না কী করবে! এখানে দুপুরে খাবে। কাকিমা সারাদিন ধরে রান্না করেছে। এখন চলে গেলে বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে!

“খুব আর্জেন্ট দরকার নাকি?” বাদল তাকাল ওর দিকে।

নিশান মাথা নাড়ল। বাদলকে বলা যাবে না কী ব্যাপার। কারণ, ওর যা প্ল্যান সেটা তারকের ভাল লাগবে না জানলে।

নিশান বলল, “হ্যাঁ রে, খুব আর্জেন্ট। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছতে হবে।”

বাদল মুখ নিচু করে চিন্তা করল। তারপর বলল, “এক ঘণ্টার মধ্যে আসতে পারবি? আমি মাকে ম্যানেজ করে নিচ্ছি। তুই ঘুরে আয়!”

“কিন্তু…” নিশান ইতস্তত করল।

বাদল হাসল, “আরে, কাজ আগে। প্লাস এমন হুড়োহুড়ি করে কেউ নেমন্তন্ন খায়! তুই সেরে আয় কাজটা। আমি মা আর মেঘলাকে সামলে নেব। শুধু মাথায় রাখিস, তুই না এলে কিন্তু আমরা কেউ খাব না! কেমন? বোনটা আমার কষ্ট পাবে!”

নিশান হাসল। বলল, “ব্যাগটা থাক। আমি ঘুরে আসছি তা হলে চট করে।”

আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় টাঙানো বর্ষাতিটা তুলে নিয়ে সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেল। উঠোনে জল আরও বাড়ছে। চাঁপাগাছের ওপরের ডালপালা কেমন ঝাপসা হয়ে এসেছে!

বাইরে বেরিয়ে নিশানের মনে হল বৃষ্টিটা বোধহয় আরও ঝেঁপে নামল ওকে দেখে! বাধা, সবেতেই যেন বাধা পাচ্ছে! কেন কে জানে, নিশানের মনে হল, সামনেও খুব কিছু সহজ দিন আসছে না!

.

২৪. পুশকিন

আজ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। দূর পাহাড়ের ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে খুব। ফাঁকা মাঠের মাঝে একলা সিঁথির মতো রাস্তা পড়ে রয়েছে। আর সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা লোক। পরনে হাতকাটা ফতুয়া আর ধুতি। লোকটা বাঁশি বাজাতে-বাজাতে হেঁটে যাচ্ছে দূর পাহাড়ের দিকে। আশপাশে কেউ নেই। শুধু দূরে একটা বাড়ি, তার জানলায় বসে রয়েছে কেউ। আর সে দেখছে এই পথিককে। হাওয়ায় চুল উড়ছে মানুষটির। ফতুয়ার কোণ উড়ছে। আর সে একাকী হেঁটে যাচ্ছে নির্জন এই পথে, দূর পাহাড়ের দিকে। বাঁশির সুরটা স্পষ্ট। আর কী ভীষণ চেনা! রাতের হাওয়ায় ভেসে সেই সুর ছড়িয়ে পড়ছে। আর ছুঁয়ে দিচ্ছে দূর সেই বাড়ির জানলায় বসে থাকা ছেলেটিকে। পাশে প্রদীপের মৃদু আলো। ছেলেটি বসে দেখছে দূর রাত্রির বুক দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক একলা মানুষকে।

“বাবু,” ছেলেটিকে কে যেন ডাকল এবার। ছেলেটি পাশ ফিরল। আর চোখ মেলে তাকাল পুশকিন!

“বাবু, ঘুমিয়ে পড়েছিস?” বাবা ডাকছে! পুশকিন বুঝতে পারল না প্রথমে! কোথায় ও! সেই সাদা সিঁথির মতো একলা রাস্তাটা কোথায়! পথিক! সেই পথিকই-বা কই!

“কী রে, শুনছিস?” বাবা সামান্য ঠেলল এবার ওকে!

পুশকিন যেন প্যারাসুটে চেপে ধীরে-ধীরে নেমে এল মাটিতে!

ও এবার ভাল করে দেখল। বাবা দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথার কাছে। সিল্কের লুঙ্গি আর গায়ে একটা ফতুয়া। ও ধীরে-ধীরে উঠে বসল। আজ কী দিন? কী বার! গুলিয়ে যাচ্ছে যেন সব!

“কী রে, শরীর খারাপ করছে এখনও?” বাবার মুখে উদ্বেগ!

পুশকিন মাথাটা ঝাঁকাল। চোখটা লেগে আসছে। ক্লান্ত লাগছে। বালিশের দিকে তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ার লোভ হচ্ছে!

ক’টা বাজে? দেওয়ালে পুরনো দিনের একটা ঘড়ি টাঙানো আছে। দেখল, সাড়ে সাতটা বাজে। সন্ধে হয়ে গেছে তবে? কতক্ষণ ঘুমোল ও?

“কী রে, শরীর খারাপ নাকি?” বাবা আবার জিজ্ঞেস করল।

“না, না,” পুশকিন আশ্বস্ত করল বাবাকে, “আসলে দু’রাত ঘুমোইনি তো… তাই…”

বাবা মাথা নাড়ল, “কী লাভ এমন কাজ করে! ক্রীতদাস প্রথা চলছে নাকি! যাকগে, তুই রেডি হয়ে নে, লোকজন আসতে শুরু করবে!”

এবার মাথাটা পরিষ্কার হল পুশকিনের। তাই তো! আজ তো রাতে বাড়িতে লোকজন খায়। বাবা অনেককে নেমন্তন্ন করে। আজ অষ্টমী যে! দুর্গাষ্টমী!

গত দু’রাত ঘুমোয়নি পুশকিন। অফিসের একটা বিশেষ কাজে খুব ব্যস্ত ছিল। ওদের দিল্লি হেড কোয়ার্টার থেকে পুশকিনকে একটা কাজ দেওয়া হয়েছিল। হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে একটা নতুন ফ্যাক্টরি হচ্ছে। তার কিছু টেকনিকাল ইভ্যালুয়েশন ছিল। পুশকিনের কাছে সেইসব পেপার পাঠানো হয়েছিল দেখে দেওয়ার জন্য। প্রায় সাড়ে ছ’শো পাতার পিডিএফ ফাইল। দুটো দিন আর দুটো রাত লেগে গিয়েছে পুশকিনের।

পুজো বলে এখানে অফিস ছুটি। কিন্তু ও একা এই দু’দিন অফিসে গেছে। অফিস করেছে! কাজটা খুব জরুরি ছিল। যে-কোম্পানি এই প্রোজেক্টে ইনভেস্ট করছে রিকো গ্রুপের সঙ্গে, তাদের প্রতিনিধিরা কাল আসবে বুদাপেস্টে। মিটিং আছে রিকো গ্রুপের লোকজনদের সঙ্গে। ব্যাপারটা খুবই জরুরি বলে বস দিল্লি থেকে ওকে নিজে ফোন করে বলেছিলেন কাজটা করে দিতে। পুশকিন আপত্তি করেনি। পুজো-টুজো নিয়ে ওর কোনও মাথাব্যথা নেই।

টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা কাজ করে আজ সকালে অফিস থেকে বেরোনোর সময় ওর মাথা টলছিল। মনে হচ্ছিল যে-কোনও সময় পড়ে যাবে মাটিতে। কীভাবে যে তাও গাড়ি চালিয়ে এখানে এসেছে, এখন ভাবতেও অবাক লাগছে ওর!

বাবা আগেই বলে দিয়েছিল, পুজোর চারটে দিন ও যেন নিজের ফ্ল্যাটে না থেকে বাড়িতে এসে ওঠে! তাই আজ অফিস থেকে সোজা বাড়িতেই এসেছে পুশকিন।

ও বুঝতে পারছে আস্তে-আস্তে বাড়ির সঙ্গে ওর যোগাযোগ আবার সহজ হয়ে আসছে। বুঝতে পারছে, বাবা চাইছে ও আবার এখানে ফিরে আসুক।

পুশকিন বাবাকে বলল, “আমি ঠিক আছি। একটু ফ্রেশ হয়ে নিই।”

বাবা বিরক্ত মুখে তাকাল ওর দিকে! বলল, “সেই দেড়টার সময় ঘুমিয়েছিস! না ডাকলে তো এখনও উঠতিস না! কী হবে এমন কাজ করে যেখানে এভাবে গোরুর মতো খাটতে হয়!”

পুশকিন হাসল। বাবাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।

বাবা আবার বলল, “তুই ফ্রেশ হয়ে নে। লোকজন এসে পড়বে! আর ওই মেয়েটা, নোঈ, ওকে একবার ফোন করে মনে করিয়ে দে যেন আসে।”

“মানে!” পুশকিন অবাক হল! এই কথাটায় ঘুমের যে সামান্য কুঁচিকাচা পড়েছিল চোখের কোণে, এক ধাক্কায় উধাও হয়ে গেল! ও বলল, “নোঈ মানে? ওকে তুমি আসতে বলেছ নাকি?”

“হ্যাঁ, আমি ফোন করেছিলাম মহালয়ার দিন। বলল তো নিশ্চয় আসবে। আর আমি স্পেশ্যালি বলেছিলাম, তোকে যেন না বলে!”

পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারল না। বাবা মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে! কে বলেছে বাবাকে এটা করতে? যত বয়স বাড়ছে, ছেলেমানুষিগুলোও যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে!

ও বলল, “তুমি ওকে বলেছ কেন? আরে, ও আমার অফিসে চাকরি করে! একটা প্রোটোকল বলেও তো ব্যাপার আছে, নাকি? বললেই হল এভাবে বাড়িতে আসতে!”

বাবা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর বলল, “আমার বাড়ি, আমি যাকে খুশি ডাকব, তাতে তোর কী!”

পুশকিন মাথা নাড়ল। বাবা আগে এমন ছিল না। দিন কে দিন কী যে হয়ে যাচ্ছে!

বাবা আবার বলল, “ফ্রেশ হ,’ ওই বুঝি কেউ এল!”

কলিং বেলটা পুশকিনও শুনতে পেয়েছিল। ও আর কিছু বলল না। বাবা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে!

ওর মনে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। বাবা আবার নোঈকে কেন ডাকতে গেল! মেয়েটার সামনে গেলে আজকাল কেমন একটা লাগে ওর! কেমন একটা মনখারাপ আর মন ভাল নামের দুটো রং যেন মিলেমিশে যায় একসঙ্গে! মনে হয় পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে, পাইন আর দেবদারু গাছের জঙ্গল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একলা এক মনমরা টয় ট্রেন উঠে যাচ্ছে মেঘেদের ছাড়িয়ে! উঠে যাচ্ছে নাম-না-জানা কোনও নির্জন কাঠের স্টেশনের দিকে!

কী করে যে এর থেকে পালাবে, কিছুতেই বুঝতে পারে না ও। ও শুধু নিজেকে বোঝায় মেয়েটা, ওর চেয়ে অনেক ছোট। মেয়েটার একটা জীবন আছে! কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছে মেয়েটা। বোঝায়, এসব অপ্রীতিকর চিন্তাভাবনা যেন কিছুতেই ওর মনে আর জায়গা না করতে পারে।

এমনিতেই অফিসের কারণে বেশ চাপে আছে পুশকিন। সোনাঝুরির কাজটা কেমন যেন আটকে আছে! কিছুতেই কিছু হচ্ছে না! শুধু মিল কেনার কথা ওরা ভাবছে না। জোনাক-বাড়ি না পেলে শুধু মিল ওরা কিনতে চায় না। এখন ম্যানেজমেন্ট চাইছে পুশকিন যে করেই হোক ওই বাড়ির ব্যাপারটা যেন মিটিয়ে দেয়। মালিকদের বলে যে করেই হোক জোনাক-বাড়িটা জোগাড় করে। বিদেশে নাকি এই গোটা প্রজেক্টের জন্য নানা ইনভেস্টরের কাছ থেকে কোম্পানি টাকা তুলতে শুরু করেছে। সেখানে এখন কাজ না হলে যে-পরিমাণ পেনাল্টি রিকো গ্রুপকে দিতে হবে, সেটা কোম্পানির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই যে করেই হোক জুট মিল, জমি আর গোটা জোনাক-বাড়ি, সবটাই চাই ওদের। সেই কারণেই চতুর্থীর দিন সোজা গিয়ে দীপমালা দেবীর সঙ্গে দেখা করেছিল ও।

মাথাটা টিপটিপ করছে পুশকিনের। আরও ঘুম দরকার ছিল। বাবা কেন যে ঘুমটা ভাঙাল! লোকজন এলে আসবে, তাতে ও কী করবে? ওর লোকজন ভাল লাগে না! দেখা হলেই সব এমন-এমন প্রশ্ন করে! বিশেষ করে স্মিতার সঙ্গে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে লোকজন এখনও এমন সব প্রশ্ন করে যে, মাথা ঠিক রাখা যায় না! পৃথিবীতে আত্মীয়স্বজনদের কাজই বোধহয় মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলা, তাদের মুখ ম্লান করে দেওয়া!

স্মিতার মুখটা মনে পড়তেই কেমন একটা লাগল। আবার মনে পড়ে গেল সেই রাতটা। প্রেম করেই তো বিয়ে করেছিল ওরা। কিন্তু কোথায় ফাঁক থাকল! কী করে ফাঁকটা তৈরি হল? স্মিতা কী করে করতে পারল অমনটা! আর সেটা করেছিল বলেই কি সেই রাতে পুশকিন…

মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ঠিক করল পুশকিন। অতীত এক অতলান্ত খাদের মতো ওকে সারাক্ষণ টানে। একবার সেই দিকে ঝুঁকে পড়লে ও গড়িয়ে, তলিয়ে যাবে সেই খাদে!

ও চোখ বন্ধ করল একবার। ঘুমের আঠা ফিরে আসছে আবার! চোখের পাতা আটকে যেতে চাইছে। ও দেখল এক দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। একলা এক পথিক বাঁশি বাজাতে বাজাতে আপনমনে হেঁটে চলেছে! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল পুশকিনের। এই স্বপ্নটা কী অদ্ভুত!

ছোটবেলায় একটা কবিতা পড়েছিল পুশকিন। রবি ঠাকুরের ‘ফাল্গুন’! শুধু শেষের কয়েকটা লাইন মাথার মধ্যে সারাক্ষণ আজকাল পাক খায়। নিজের মনেই কখনও কখনও ও গুনগুন করে, “খেয়াঘাটে ওঠে গান / অশ্বত্থতলে, / পান্থ বাজায়ে বাঁশি / আনমনে চলে। / ধায় সে বংশীরব / বহুদূর গাঁয়, / জনহীন প্রান্তর / পার হয়ে যায়। / দূরে কোন শয্যায় একা কোন ছেলে / বংশীর ধ্বনি শুনে / ভাবে চোখ মেলে— / যেন কোন যাত্রী সে, / রাত্রি অগাধ, / জ্যোৎস্নাসমুদ্রের/ তরী যেন চাঁদ। / চলে যায় চাঁদে চ’ড়ে / সারা রাত ধরি, / মেঘেদের ঘাটে ঘাটে/ ছুঁয়ে যায় তরী।”

আজ স্বপ্নে এটাই যেন ফিরে এসেছিল। ছোটবেলায় এই কবিতাটার পাশে একটা ছবি ছিল। বাচ্চা একটা ছেলে, আধশোয়া হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর দূরে, বহু দূরে এক পথিক বাঁশি বাজাতে-বাজাতে চলেছে মাঠের মধ্যে দিয়ে! আর সবকিছুর ওপর নিটোল চাঁদ তার জ্যোৎস্নার ওড়না মেলে বসে রয়েছে!

আজ স্বপ্নে সেই ছবিটাই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল! খুব অবাক লাগছে পুশকিনের! সেই কবেকার ছোটবেলায় সাত-আট বছর বয়সের পুশকিন যে-ছবিটা দেখেছিল, আজ সেটাই জীবন্ত হয়ে উঠল! বুকের মধ্যে কেমন একটা ‘পেয়ে হারালাম’ ধরনের শূন্যতা টের পাচ্ছে আজ। সেই কবিতাটা পড়ার সময় মা, ঠাকুরদা, পিসেমশাই, পিসি আরও কত-কত মানুষ ঘিরে থাকত ওর জীবন। পুশকিনের নিজেকে মনে হত ওই বাচ্চা ছেলেটার মতো। মনে হত, ও নিজেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে জ্যোৎস্নার রাত্রে ফাঁকা মাঠ দিয়ে দূরে কোনও এক বাঁশিওয়ালা আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে! তার মনখারাপ করা সুর ভেসে আছে আকাশে! আর আজ এত বছর পরে, এতটা পথ হেঁটে আসতে-আসতে মনে হয় কখন যেন সেই বাচ্চা ছেলেটা থেকে ও একলা, নির্জন পথে হেঁটে যাওয়া সেই বাঁশিওয়ালায় পরিণত হয়েছে। জীবন এক অদ্ভুত জাদুকর! নিজের অজান্তেই সে মানুষকে পালটে দেয়। তার অবস্থান বদলে দেয়।

নাঃ, মাথাটা কেমন করছে! একে ভাল করে ঘুম হয়নি, তারপর এসব চিন্তাভাবনা! পুশকিন আর দেরি করল না। উঠে পড়ল। নোঈ কি সত্যি আসবে নাকি? বুকের মধ্যে আবার খচ করে উঠল! বাবা যে কী করে!

বাথরুমে গিয়ে সময় নিয়ে চোখেমুখে জল দিল পুশকিন। তারপর কী মনে হওয়ায় স্নান করল ভাল করে।

স্নান সেরে তোয়ালে পরে ঘরে এল পুশকিন। পাজামা-পাঞ্জাবি আছে আলমারিতে। ও বের করল সেটা। ডিমের কুসুম রঙের পাঞ্জাবির সঙ্গে সাদা পাজামা পরে নিল। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পারফিউমটা তুলে নিল। নীল রঙের বোতল। ঠান্ডা জলের মতো আরামদায়ক।

“জেজে, আমায় লাগিয়ে দেবে না!”

কোমরের কাছ থেকে শব্দটা এল। পুশকিন তাকাল। কুটু এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। কুটু ভাইয়ের ছেলে। বছরচারেক বয়স। একমাথা গোল্লা পাকানো চুল। ছোট্ট লাল ঠোঁট আর বড়-বড় চোখ!

পুশকিন দেখল বাইরে বেরোনোর জামাকাপড় পরে কুটু তৈরি! বুঝল, ভাইরা ঘুরতে বেরোবে। ঠাকুর দেখতে বেরোবে। বাবা এই নিয়ে একটু রাগ করছিল, কিন্তু ভাইকে বাবা জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। ভাই সাফ বলে দিয়েছে যে, লোকজন আসবে আসুক, ওরা একটু ঘুরে দশটার মধ্যে বাড়ি চলে আসবে!

কথাটা সত্যি। অষ্টমীর দিন মানুষ ঘুরবে না তো কি লোকের বাড়িতে এসে রাতে খাবে? বাবাকে কে বোঝাবে! বললেই বলবে, “আগে তো সবাই আসত। এত বায়নাক্কা দেখাত না। এখন তোরা কেমন সব হয়ে গেছিস!”

আরে, আগেকার দিনে মানুষ অন্যরকম ছিল। এখন আর-এক রকম হয়ে গেছে। সব পালটাচ্ছে, মানুষ পালটাবে না! চারিদিকে জনসংখ্যা কী হারে বাড়ছে! মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য আরও আক্রমণাত্মক হতে হচ্ছে এখন! নিজের ইচ্ছেটাই সেখানে সার্ভাইভাল ইনস্টিংক্টের জন্য প্রাধান্য পাচ্ছে। মনের ধাঁচটাই যে পালটে গিয়েছে! সেই মনটা কি আর আগের মতো কাজ করবে! তার প্রভাব তো অন্য কাজেও পড়বে!

“এই নে, হাত তোল…” পুশকিন কুটুর দিকে ঝুঁকল।

“হ্যান্ডস আপ?” কুটু চোখ বড়-বড় করে হাত তুলল মাথার ওপরে!

পারফিউম লাগিয়ে দিয়ে নিজের গায়েও স্প্রে করল পুশকিন।

“জেজে, তুমি আমাদের সঙ্গে চলো না! মা বলছিল তোমায় বলতে। যাবে? আজ সাউথের ঠাকুর দেখব।”

“না কুটুবাবু, আজ তো যেতে পারব না। বাড়িতে লোকজন আসবে! সবাই চলে গেলে লোকজন রাগ করবে তো। কাল যাব, কেমন?” পুশকিন হাসল।

কুটু গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করল, “লোক রাগ করবে, না জন রাগবে?”

হাসল পুশকিন, বলল, “দু’জনেই রাগ করবে! তাই আমাকে থাকতে হবে বাড়িতে!”

কুটু বলল, “দাদু বলল, আন্টি এসে গেছে, তোমায় যেন বলি!”

“আন্টি! মানে?”

কুটু হাসল। সব বুঝে গেছে এমন করে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “ওই যে বিউটিফুল বিউটিফুল আন্টি! আমায় চকোলেট দিল একটা ইয়াব্বড় প্যাকেটে।”

পুশকিন বলল, “বেশি খেয়ো না! দাঁতে পোকা হবে!”

কুটু বলল, “ভালবেসে কেউ দিলে নিতে হয়। আর পোকা! সে না হয় একটু হোক!”

পুশকিন ড্রেসিং ইউনিটের সামনে রাখা ঘড়িটা তুলে হাতে পরল। তারপর মোবাইলটা পকেটে নিয়ে কুটুর হাত ধরে ঘরের বাইরে বেরোল। আন্টি মানে নিশ্চয়ই নোঈ!

ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখল ভাইরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কুটু পুশকিনের হাত ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে ওর মায়ের হাত ধরল।

ভাই বলল, “এলাম দাদা। চলে আসব তাড়াতাড়ি। বাবাকে বলিস যেন এই নিয়ে রাগ না করে!”

পুশকিন হাসল। রাগ! নাঃ, বাবার রাগ কমে গেছে!

ভাইরা বেরিয়ে গেলে ও ভাবল বসার ঘরে যাবে। নোঈ যদি সত্যি এসে থাকে তবে ওর যাওয়া দরকার! কিন্তু ঠিক তখনই পকেটের ফোনটা বাজল। ও বের করে দেখল। স্মরণ। এ সময় ছেলেটা ফোন করল!

“বলো!” পুশকিন ফোনটা কানে লাগাল।

“স্যার, সরি স্যার, এমন সময় ফোন করার জন্য, কিন্তু ওই মাহির বলে ছেলেটা আবার ফোন করেছিল!”

পুশকিন বলল, “তুমি বলো পুজো কেটে যাক, আমি ব্যাপারটা দেখছি!”

“আমি বলেছি স্যার। ও বলছে একাদশীর দিন ফিক্স করবে মিটিং? রিতুবাবু নাকি একটু ইমপেশেন্ট হয়ে পড়েছেন!”

“লক্ষ্মীপুজোর পরে করতে বলো। তার আগে হবে না। অফিসের একটা অন্য কাজ নিয়ে আমি একটু ব্যস্ত আছি!”

“ওকে স্যার। সরি, এমন সময় ফোন করলাম! আমি রাখছি।”

পুশকিন হেসে বলল, “তুমি ঘুরতে বেরোওনি?”

“বেরিয়েছি স্যার! প্যাঁওয়ের সঙ্গে বেরিয়েছি। আমি রাখছি তা হলে। হ্যাপি পূজা স্যার।”

ফোনটা কেটে সিলিং-এর দিকে তাকাল পুশকিন। সোনাঝুরির ব্যাপারটায় এটা একটা নতুন দিক। কী চায় রিতু বলে লোকটি? পলিটিকাল পার্টির লোক। কী ধান্দা আছে বুঝতে পারছে না। কিন্তু লোকটার সঙ্গে দেখা করতে হবে। কারণ, চারিদিক দিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যা থেকে মনে হচ্ছে কাজটা বোধহয় ফসকে যাবে এবার! সেদিন দীপমালাদেবীর সঙ্গে দেখা করেও তো কোনও পথ খুলতে পারেনি!

কলকাতায় ক্যামাক স্ট্রিটে মালিক গ্রুপের বড় অফিস। সেখানে মাসে একদিন দীপমালাদেবী আসেন। এই খবরটা মালিক গ্রুপের ভেতর থেকেই বের করেছিল পুশকিন। সেই মতো একজনকে ম্যানেজ করে দীপমালাদেবীর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল পুশকিন। লোকটি বলেছিল, ম্যাডাম এক ঘণ্টার মতো থাকেন। ও যেন দেরি না করে!

ঠিক বিকেল চারটের সময় পৌঁছে গিয়েছিল পুশকিন।

দীপমালাদেবীর ঘরটা বেশ বড়। কাঠের প্যানেল দেওয়া। পুশকিন ঢুকতেই উনি থমকে গিয়েছিলেন সামান্য। তারপর সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বলেছিলেন। পুশকিন অবাক হয়ে দেখেছিল, এই বয়সেও কী সুন্দরী আছেন উনি!

“বলুন,” দীপমালাদেবী সোজা পুশকিনের দিকে তাকিয়েছিলেন। কোনও ভণিতা করেননি।

পুশকিন বসে আর সময় নষ্ট করেনি। বলেছিল, “আমি ম্যাম কী কারণে এসেছি সেটা সরাসরি বলি?”

দীপমালাদেবী বলেছিলেন, “জুটমিল আর জমি আমি বিক্রি করতে রাজি। কিন্তু ওই জোনাক-বাড়ি আমি বিক্রি করব না।”

“ম্যাম, আপনি আমাদের প্রোপোজ়ালটা যদি কাইন্ডলি পড়ে দেখতেন! অন্যরা সব কিছু ডেমলিশ করে সেখানে হাউজ়িং করবে। আমরা ম্যাম জুটমিলটাকে রিভাইভ করব। জোনাক-বাড়িটাকে রেস্টোর করে সেখানে ফাইভ স্টার হোটেল বানাব। একটা ট্যুরিজ়ম পার্ক হবে! সামনে গঙ্গাটাকেও ইউজ় করব। জোনাক-বাড়িটা পিভটাল ফর আওয়ার প্ল্যান!”

“মিস্টার চক্রবর্তী, আমি সব শুনলাম, কিন্তু আমি পারব না ওটা দিতে। এটা টাকাপয়সার ব্যাপার নয়, আমার পারসোনাল ব্যাপার! প্লিজ়, আমায় আর রিকোয়েস্ট করবেন না! থ্যাঙ্ক ইউ।”

“কোনও উপায় নেই ম্যাম? মানে, কোনও উপায়?” পুশকিন মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করেছিল।

দীপমালাদেবী হেসেছিলেন শুধু।

ছোট্ট একটা হাসি। কিন্তু দীপমালাদেবীর হাসির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যাতে করে পুশকিনের বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এই ভদ্রমহিলাকে কনভিন্স করা কারও কম্ম নয়! ও হাল ছেড়ে দিয়ে, “সরি ম্যাম!” বলে সামান্য হেসে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল।

“মিস্টার চক্রবর্তী, আমি জানি আপনাদের প্ল্যানটা ভাল। কিন্তু জানবেন সব কিছু তো আর বিজ়নেস নয়। আপনি জানতে চাইলেন না, কোনও উপায় আছে কি না? আছে, একটা উপায়! আমি একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। সেটা আমায় এনে দিন। ওই বাড়িও আমি দিয়ে দেব।”

“কী প্রশ্ন ম্যাম?” পুশকিন সামান্য আলো দেখতে পেয়েছিল যেন!

দীপমালাদেবী বিষণ্ণভাবে হেসে বলেছিলেন, “সেটা আপনাকেই জানতে হবে। প্রশ্ন আর উত্তর দুটোই আপনাকে জানতে হবে। কেমন? খুঁজে পেলে, আসবেন।”

এ কেমন ধাঁধা? প্রশ্ন জানলে তবে তো উত্তর খোঁজা যায়! কিন্তু এখানে তো প্রশ্নটাও জানতে হবে!

সেদিন থেকে এই একটা ব্যাপারই পুশকিনকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে সারাক্ষণ। প্রশ্নটা কী!

পুশকিন ভাবল, এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই। ও নিজের মনে মাথা নেড়ে বসার ঘরের দিকে গেল। বাইরের প্যাসেজে কয়েকজোড়া জুতো দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে তিনটে মেয়েদের।

ও বসার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ঘন নীল পরদা উড়ছে। তার আড়ালে দাঁড়িয়ে পুশকিন শুনল গান ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে। পরদাটা সামান্য সরিয়ে ও দেখল, কয়েকজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে বসে চোখ বন্ধ করে, ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’ গাইছে নোঈ! থমকে গেল পুশকিন। আজ শাড়ি পড়েছে নোঈ! খুব সুন্দর সাতরঙের শাড়ি একটা। কপালে অনুস্বরের মতো নীল টিপ। চোখ বন্ধ ওর। আর গানের তালে মাথা নাড়ানোর সঙ্গে অল্প-অল্প করে কানের সামান্য ঝোলা দুলটা নড়ছে। পুশকিনের গলা শুকিয়ে গেল! আবার বুকের ভেতরে একটা ছোট্ট টয় ট্রেন যেন পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করেছে! কোথায় যাচ্ছে এই টয় ট্রেন? মেঘ পার হয়ে কোথায় গিয়ে থামবে এটা? ছোট্ট কাঠের স্টেশনে?

বাবা আর বাবার দুই বন্ধু ও তাঁদের স্ত্রী বসে রয়েছেন নোঈকে ঘিরে। গানের সঙ্গে তাঁরাও মাথা নাড়ছেন।

পুশকিনের মনে হল, ও ফিরে যায় নিজের ঘরে। এই দৃশ্যে কেন কে জানে হঠাৎ ওর নিজেকে বড্ড বেমানান লাগছে।

কিন্তু নড়তে পারল না পুশকিন। ওই পরদার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল গোটা গানটার সুর ধরে-ধরে। মনে হল, গানটা যেন না থামে। টয়-ট্রেনের স্টেশন যেন না আসে কোনওদিন!

“আরে, তুই ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?” গান থামার পরে বাবা গলা তুলে বলল কথাটা!

পুশকিন লজ্জা পেয়ে গেল। বাবা এমন করে বলে সবার সামনে! ও অপ্রস্তুত হয়ে হেসে ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। ও ঘরে ঢোকামাত্র নোঈ উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু পুশকিন দেখল বাবা নোঈকে হাত ধরে চেপে বসিয়ে দিল, উঠতে দিল না!

বাবা বলল, “ও কী, উঠছ কেন? কোন গুরুঠাকুর ও? নাকি তোমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল? বসে থাকো!”

সবাই সোফায় বসেছিল। ও এসে সবার থেকে একটু দূরত্ব রেখে একটা চেয়ারে বসল।

বাবা বলল, “শুনলি কেমন গাইল? তোর মা গাইত এই গানটা। মনে পড়ে তোর?”

পুশকিন হাসল। হ্যাঁ, মনে পড়ে ওর। সবটাই মনে পড়ে। কিন্তু মনে করতে চায় না আর। ওর অতীতটা কেমন যেন রং লেপটে যাওয়া ছবির মতো! সবই আছে, কিন্তু যেন কিছুই নেই!

“আমি তোকে বলেছিলাম না, নোঈকে ফোন করে ডাকতে, কিন্তু ডাকতে হয়নি। শি ইজ় মাই গুড গার্ল! দেখ, নিজেই চলে এসেছে! আর কী এনেছে দেখ!” বাবা টেবলের ওপর রাখা একটা প্যাকেটের দিকে আঙুল দেখাল।

পুশকিন এতক্ষণ লক্ষ করেনি। এবার দেখল। একটা বড় প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর থেকে একটা ক্যাসেরোল উঁকি দিচ্ছে।

বাবা সেটা বের করল এবার। বেশ বড় একটা ক্যাসেরোল। প্যাঁচ ঘুরিয়ে খুলে ফেলল ঢাকনাটা। আর সঙ্গে-সঙ্গে মাছের গন্ধ পেল পুশকিন। দেখল ক্যাসেরোল ভর্তি ফিশ-ফ্রাই!

নিজে থেকেই ভুরু কুঁচকে গেল ওর।

বাবা সেটা দেখে বলল, “তুই ভুরু কোঁচকাচ্ছিস কেন? আমার জন্য এনেছে! নিজে ভেজেছে। বুঝলি!”

আশপাশের সবাই মাথা নেড়ে প্রশংসা করা শুরু করল। দু’জন তো হাত বাড়িয়ে তুলে নিল দুটো!

পুশকিন দেখল নোঈ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। বাবা আরও কিছু বলত, কিন্তু পরদা সরিয়ে এবার একসঙ্গে প্রায় দশজন ঢুকে এল ঘরে! পুশকিন প্রমাদ গুনল। কোন্নগর থেকে মায়ের মামারা এসে পড়েছে। এবার চিৎকার আর হইচই হবে! কানুদা নিশ্চয় দরজা আজ খুলেই রেখেছে, তাই কলিং বেল শোনা যায়নি!

বাবা সবার সঙ্গে নোঈর পরিচয় করিয়ে দিল। সামান্য দু’-চারটে কথার পরে পুশকিন উঠে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোল। এখানে আর বসে থাকা সম্ভব নয় ওর পক্ষে!

“শুনছেন!” বাইরের বড় করিডরটায় এসে পেছন থেকে ডাক শুনে থমকে গেল পুশকিন। ঘুরে দেখল নোঈ এসে দাঁড়িয়েছে।

“আপনি কোথায় যাচ্ছেন আমায় ফেলে?” নোঈ মুখ ভার করে জিজ্ঞেস করল।

“তোমায় ফেলে?” পুশকিন অবাক হল।

“নয়তো কী! আমি কি আপনাদের বাড়ির লোকেদের চিনি? আপনি আমায় ফেলে হুট করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কেন? আপনি ওখানে বসতে পারলেন না? আপনার ওই বড়মামা কী মজার গল্প বলছেন। আপনি বসলেন না কেন! আর আমায় এভাবে ফেলে চলে এলেন কেন?

পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারল না। কথা খুঁজে পাচ্ছে না যেন। নোঈকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন? ও যে ভাল করে তাকাতেও পারছে না। তাকালেই মনে হচ্ছে নোঈ সবকিছু বুঝে যাবে।

ও মাথা নামিয়ে বলল, “আমি আসলে এখন নিজের ঘরে যাচ্ছি। একটু টায়ার্ড।”

“আমি আসব আপনার সঙ্গে? আমি তো কাউকে চিনি না!” নোঈ অসহায় মুখ করে তাকাল।

পুশকিন হাসল শুধু।

পুশকিনের ঘরের দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল নোঈ। তারপর একটু সময় নিয়ে চারিদিকে ঘুরে-ঘুরে দেখল সবকিছু। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানেই ছোটবেলা কাটিয়েছেন?”

পুশকিন হাসল আবার।

“আপনি কি রাগ করেছেন, আমি এসেছি বলে?” নোঈ এসে বিছানায় পুশকিনের পাশে বসে পড়ল। পুশকিন একটু কেঁপে গেল। বসার দুটো চেয়ার কি নোঈ মিস করল!

পুশকিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকাল নোঈর দিকে। কী বলবে একে? কী বলতে পারে ও। এক হাতের মধ্যে মেয়েটা বসে রয়েছে। ঘরের আলো যেন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ! কী অদ্ভুত একটা সুগন্ধ প্রজাপতির মতো ছোট-ছোট ডানা মেলে উড়ছে চারিদিকে! কষ্ট হচ্ছে পুশকিনের। মনে হচ্ছে, দৌড়ে পালিয়ে যায়। মনে হচ্ছে কুটুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে চলে গেলেই ভাল হত।

“কী হল? আমি কি চলে যাব?” নোঈ আচমকা উঠে দাঁড়াল।

“আরে!” পুশকিন অবাক হয়ে গেল।

“ঠিক আছে। আমারই ভুল হয়েছিল। আমি আসছি…” নোঈ দরজার দিকে এগোতে গেল।

পুশকিন কিছু না ভেবেই নোঈ যাতে না যায় সেই জন্য হাতটা ধরে টানল ওকে। নোঈ আর না চলে গিয়ে ওর দিকে ঘুরে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। পুশকিন দেখল নোঈর চশমার কাচে এক ফোঁটা, দু’ফোঁটা করে জল জমছে! কাঁদছে! পুশকিন মাথা ঝুঁকিয়ে ওর মুখটা দেখল।

চশমার আড়ালে নোঈর চোখ দুটো ছলছল করছে। পুশকিনের কী যে হল হঠাৎ ও নিজেও বুঝতে পারল না। কীসের যে টান ওকে কুহকের মতো ডাকল, ধরতেই পারল না। অনেকটা যেন নিজের অজান্তেই ও বাঁ হাত দিয়ে নোঈর কোমরটা জড়িয়ে ধরল আচমকা। ডান হাত দিয়ে খুলে নিল ওর চশমা! তারপর নোঈকে নিজের আরও কাছে টেনে ওর ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল নিজের ঠোঁট!

ছোট্ট ট্রেন চলেছে পাহাড়ের কারনিশ ঘেঁষে! পাইন বনের পাশ দিয়ে, লাল-নীল ফুল সাজানো বাড়ির উঠোন ছুঁয়ে ট্রেন এগিয়ে চলেছে ওপরের দিকে। মেঘ এসে জড়িয়ে যাচ্ছে তার চিমনিতে। জানলা দিয়ে ঢুকে এসে মেঘ থেমে থাকছে কাচের গায়ে। লাইনের পাশের জংলি গোলাপ নাড়িয়ে, সাদা ঘাস ফুল ঘেঁটে, হলুদ টোপর ফুলের শিশির ছিটকে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। ওই দূরে বরফের পাহাড়ে সূর্য এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আর পরমুহূর্তে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে! মেঘের রহস্য এসে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে পথের নির্জন বাঁক! লাল-কমলা-সবুজ-নীল মাফলার জড়িয়ে হেঁটে যাওয়া বাচ্চাদের ছাড়িয়ে, শীর্ণ লাজুক পাহাড়ি ঝোরাকে টপকে, লেপচা গ্রামের এলাচের গন্ধ বুকের মধ্যে নিয়ে ওই চলে যাচ্ছে ট্রেন। ছোট্ট টয় ট্রেন। এই জীবনের সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা আর মনখারাপ থেকে দূরে, অনেক দূরে সে নিয়ে যাচ্ছে পুশকিনকে।

নোঈকে ছেড়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল পুশকিন। ওর শরীর কাঁপছে থরথর করে! এটা কী করে ফেলল ও! ও কি পাগল হয়ে গিয়েছে নাকি? এমন কেউ করে? নোঈ ওর সাব-অর্ডিনেট। এটা তো সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট! এটা কী করল ও! নোঈ কী ভাবছে ওকে? কতটা ছোটলোক ভাবল? ছিঃ ছিঃ! নিজের গায়ে থুতু দিচ্ছে ইচ্ছে করল পুশকিনের। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না ও।

পুশকিন চোখ বন্ধ করেই ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। মাথা নিচু করে রাখল।

নোঈ সময় নিল একটু। তারপর পুশকিনের পাশে বসে নিজের চশমাটা নিয়ে চোখে দিয়ে বলল, “কী হল? এমন করছেন কেন পুশকিনদা?”

“আমি… আমি খুব সরি…” পুশকিন কীভাবে বলবে বুঝতে পারল না! লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে ও। মাঝে মাঝে মানুষকে ভূতে পায়! ও দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।

নোঈ আলতো করে পিঠে হাত দিল পুশকিনের। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, “আমি খারাপ কিছু মনে করিনি, পুশকিনদা। এই আপনাকে ছুঁয়ে বলছি।”

পুশকিন মাথা তুলতে পারল না। কিন্তু বুঝল নোঈর একটা হাত ওর পিঠে আর অন্য হাতটা আলতো করে ধরে রেখেছে ওর আঙুল।

পুশকিনের আবার ইচ্ছে করল নোঈকে চুমু খেতে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে ধমক দিল ও। এসব কী ভাবছে ও! কেন ভাবছে! ছিঃ, ছিঃ! অমানুষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ!

নোঈ আবার বলল, “আমার দিকে তাকান। তাকান!”

পুশকিন চোয়াল শক্ত করে মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে। দেখল, নোঈ সোজা তাকিয়ে রয়েছে ওর চোখের দিকে।

পুশকিন বলল, “আমি জানি না, আমার কী হয়েছে। আমি সরি নোঈ! তুমি আমার বিরুদ্ধে কোনও স্টেপ নিতে চাইলে নিতে পারো!”

“পাগল আপনি?” নোঈ হাসল এবার, “স্মরণের চেয়েও আপনি বেশি পাগল। বললাম তো আমি কিছু মনে করিনি। শুধু একটা প্রশ্ন।”

“কী?” পুশকিন টালুমালু চোখে তাকিয়ে রইল নোঈর দিকে।

নোঈ ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে রইল একটু, তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী আফটার শেভ ইউজ় করেন আপনি?”

“বাবু…”

পুশকিন কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে বাবার গলা পেল। ও নোঈর পাশ থেকে ছিটকে উঠে গিয়ে একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, ওর এমন করে সরে যাওয়া দেখে নোঈ মুখে হাত দিয়ে হাসছে। পুশকিন ইঙ্গিতে ওকে চুপ করতে বলল। নোঈ চোখ বড় করল একটু, তারপর ইশারায় দেখাল পুশকিনের ঠোঁটে কিছু লেগে আছে।

বাবা পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। পুশকিন দ্রুত পাশে রাখা ড্রেসিং ইউনিটের আয়নার দিকে ঘুরল। দেখল নিজেকে। নোঈ ঠিক বলেছে। ওপরের ঠোঁটে একটু লিপস্টিকের দাগ লেগে রয়েছে! ও দ্রুত পাঞ্জাবির হাতায় সেটা মুছে নিল।

বাবা বলল, “কী করছিস এখানে? আমি সবাইকে বললাম নোঈ কী দারুণ গান গাইল! সবাই শুনতে চাইছে ওর গান। আর তুই ওকে এখানে নিয়ে বসে অফিসের কথা বলছিস নাকি?”

পুশকিন কিছু বলার আগেই নোঈ বলল, “হ্যাঁ তো। সোনাঝুরির ওই প্রোজেক্টটা নিয়ে পুশকিনদা খুব বিব্রত। সেই নিয়েই বলছিলেন। জুটমিলের সঙ্গে জোনাক-বাড়ি কেনার জন্য তো দীপমালা মালিকের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন কিছুদিন আগে। কিন্তু…”

“দীপমালা!”

পুশকিন দেখল বাবা কেমন যেন হয়ে গেল হঠাৎ।

“হ্যাঁ,” পুশকিন নিজেকে গোছানোর চেষ্টা করল, “উনি বললেন, ওই বাড়ির সঙ্গে কী একটা প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। সেটার উত্তর দিতে পারলে বাড়িটা দেবেন। না হলে নয়। ভাবুন, বিজ়নেস ডিল এটা। তার মধ্যে কেউ এমন করে? এটা কি খেলা নাকি?”

বাবা বসে পড়ল চেয়ারে। বাবাকে কেমন যেন হতভম্ব লাগছে।

“কী হয়েছে তোমার?” পুশকিন অবাক হল এবার, “আমি ছোটবেলায় সোনাঝুরিতে থাকতাম। কিন্তু অত ছোট ছিলাম তো! সেভাবে মনে নেই সব ঠিকমতো। আচ্ছা বাবা, তুমি তো ছোটবেলায় সোনাঝুরিতে থাকতে। জোনাক-বাড়ির কি কোনও গল্প আছে?”

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “তুই পেখমদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিস, আমায় বলিসনি তো!”

পুশকিন অবাক হল। অফিসের কথা ও কাউকেই বলে না। বাবাকেই বা বলবে কেন?

“পেখম কে?” নোঈ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল!

বাবা কেমন বিষণ্ণ গলায় বলল, “দীপমালা হল পেখমদির ভাল নাম। আর জোনাক-বাড়ি! হ্যাঁ, তাতে তো প্রশ্ন আছেই! কিন্তু আমি সেটা বলতে পারব না। বাবু, তুই সোনাঝুরিতে যা।”

“গিয়ে?” পুশকিন অবাক হল।

বাবা স্থির চোখে তাকাল পুশকিনের দিকে। তারপর বলল, “গিয়ে বিজনের সঙ্গে দেখা কর। বিজন সরখেল। জোনাক-বাড়ি সম্বন্ধে কিছু জানতে হলে ওই লোকটাই পারবে বলতে। পেখমদির গল্পটা বিজনই সবচেয়ে ভাল জানে!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *