০৫. নোঈ

০৫. নোঈ

খুব নিচু দিয়ে একটা এরোপ্লেন উড়ে গেল আর নোঈ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল তার কী বিশাল ছায়া পড়ল বাড়িটার গায়ে! ভাস্কর চক্রবর্তীর একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেল ওর!

নোঈ চশমাটা খুলে আলতো করে কপালের ঘাম মুছল। মার্চের শেষ এখন, কিন্তু মনে হচ্ছে ভরা বৈশাখ চলছে। কালবৈশাখী বলে একটা ব্যাপার ছিল ছোটবেলায়, কিন্তু আজকাল সেসব আর হয় না। কে জানে হয়তো অ্যানালগ সময়ের জিনিস বলে এই ডিজিটাল যুগে আর তার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না!

ঘড়িটা দেখল একবার। সওয়া পাঁচটা বাজে। শ্বেতা বলেছিল পাঁচটায় চলে আসবে। কী যে করে না মেয়েটা! এমনিতেই আজ মেজাজটা গরম হয়ে আছে। তার ওপর যদি ও দেরি করে, তা হলে আর কত মাথা ঠিক রাখা যায়!

নন্দনের সামনের রেলিং-এ হেলান দিয়ে মাথাটা নিচু করে দাঁড়াল নোঈ। ক্লান্ত লাগছে। কারও সঙ্গে রুড ব্যবহার করতে খারাপ লাগে ওর। কাউকে অসম্মান করলে মনে হয় সেটা ওর নিজের অসম্মান। কিন্তু ব্যাপারটা এমন একটা পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল যে, আর সহ্য করা যাচ্ছিল না।

প্লেনটা চলে গেলেও তার শব্দটা এখনও যেন চারিদিকে রয়ে গিয়েছে। এত নিচু দিয়ে প্লেন যেতে কোনওদিন দেখেনি নোঈ। ও মাঝে মাঝে ভাবে কোনওদিন যদি কোনও প্লেন ভেঙে পড়ে এই শহরটায়! কী সাংঘাতিক ব্যাপারটাই না হবে!

সাইড-ব্যাগটার ভেতর থেকে একটা জলের বোতল বের করল নোঈ। অর্ধেক জল আছে। কিছুটা খেয়ে আবার ব্যাগে ভরে রাখল বোতলটা। তারপর চারপাশে তাকাল। বিকেলের এই সময়টায় বেশ ভিড় থাকে। আজ আবার কী সব অনুষ্ঠান আছে জীবনানন্দ সভাঘরে। ওই দিকে যাওয়ার যে-গেটটা রয়েছে তার সামনে বড়-বড় পোস্টার পড়েছে! গল্পপাঠ না কী যেন হবে। অন্য দিন হলে হয়তো নোঈ যেত, কিন্তু আজ মেজাজটা ভাল নেই। ব্যাগটাও বড্ড ভারী লাগছে। গীতবিতানটা এত মোটা! এটা নিয়ে সারা দিন ঘুরছে ও। অফিসও করেছে। কী, না শ্বেতা ওটা নেবে। শ্বেতার বইটা কোন এক বান্ধবী নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। কাল শ্বেতার গানের প্রোগ্রাম আছে।

আসলে নোঈর আজ একটুও দাঁড়াতে ভাল লাগছে না। কারও সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে বাড়ি গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে এসিটা চালিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিতে। পরপর যা ঘটছে জীবনে, আর নিতে পারছে না! প্রথমে মা, তারপর জয়, তারপর এই চাকরি। কী যে ঝামেলা! চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করল নোঈ। মায়ের মুখটা ভেসে উঠল সামনে। মায়ের রাগী, গোমড়ামুখ! কী অদ্ভুত! মা কেন এমন করে কে জানে! সবাই বলে ছেলেমানুষি। কিন্তু নোঈ জানে আসলে এটা ইগো, জেদ। মায়ের কথা সবাইকে শুনতে হবে। কেন শুনতে হবে? ভুল বললেও শুনতে হবে! এমন আবদার করার মানে কী? রাগ হয়ে যায় নোঈর। আরে বাবা, তোমার যদি পাত্র অতই পছন্দ হয় তবে তুমি যাও না, বিয়ে করো না! ডাক্তার হলেই তাকে পছন্দ করতে হবে? বিলেতে থাকলেই তার ওপর হামলে পড়তে হবে? আশ্চর্য সাইকোলজি মানুষের! মনের ওপর কি জোর চলে! হয়নি সেই ছেলেটিকে পছন্দ নোঈর। কী করবে? আর ছেলে তো নয়, বড় বড় ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন যেন! আর সারাক্ষণ কত রোজগার করে, কত দামি গাড়ি চড়ে, এসব বলে গেল। এত বাজে লাগছিল নোঈর! নিজের নামটা পর্যন্ত চিবিয়ে মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, “ডিনো।”

বাবা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল নাম শুনে। অবাক হয়ে বলেছিল, “ডিনো মানে?”

“আসলে পুরো নামটা নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির। ম্যারিকায় লোকের ডাকতে সমস্যা হয়! তাই ডিনো করে নিয়েছি আমি।”

পাশ থেকে চশমা পরা শান্ত চোখের মানুষটা এবার প্রথম কথা বলেছিল। আলতো গলায় বলেছিল, “ওর ভাল নাম দীনবন্ধু।”

খুব হাসি পেয়ে গিয়েছিল নোঈর। তবে খুব জোর নিজেকে সামলে নিয়েছিল ও। নোঈর হাসি একবার শুরু হলে আর শেষ হতে চায় না।

বাবা বলেছিল, “কিন্তু এটা তো ভাল নাম। দীনবন্ধু মিত্রের লেখা ‘নীল দর্পণ’ পড়েছ?”

ডিনো আবার কায়দা করে বলেছিল, “ডাক্তারি করতে গেলে বাইরের বই খুব-একটা পড়া হয় না! প্লাস ঠাকুরদা নামটা রেখেছিল। খুব ওল্ড ফ্যাশন। আই ডোন্ট লাইক।”

বাবা সামান্য হেসে নরম গলায় বলেছিল, “বিদেশে থাকো। কিন্তু সেখানকার একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? নাম নিয়ে ওদের অত নতুন-পুরনো বাতিক নেই। যেমন ধরো রিচার্ড নামটা। সেই পুরনো দিনের রাজার নাম। আবার এখনকার হলিউডের অভিনেতার নাম। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে, গৌরনাথ, ঢোলগোবিন্দ, কমলাকান্ত এমন ধারার নামগুলো সব উঠেই গিয়েছে প্রায়!”

ডিনো এর উত্তরে আবার কীসব হাবিজাবি বলছিল। আর নোঈ দেখছিল ওই চশমা পরা শান্ত চোখের মানুষটাকে। ভারী অদ্ভুত নাম মানুষটার। এই ডিনোর জেঠতুতো দাদা এমন, ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল ওর।

মা তারপর খোঁচা দিয়েছিল নোঈকে। চাপা গলায় বলেছিল, “তুই কিছু জিজ্ঞেস করবি না?”

চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলেছিল নোঈ। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনার ডেভিড ফিঞ্চার ভাল লাগে? বা তোরনাতোরে?”

“সে কে?” ডিনো ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল নোঈর দিকে।

আবার পাশ থেকে উত্তর এসেছিল, “ভাই খুব-একটা ফিল্ম দেখে না।”

“আরে নোঈ, তুই এখানে?” আচমকা ডাকে চোখ খুলল নোঈ। সামান্য অবাক হল। সামনে নিশান দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফরসা রংটা যেন একটু পুড়ে গিয়েছে এই ক’দিনে। গালে দাড়িও রাখছে।

“তুই-ই বা এখানে কী করছিস নিশানদা?” নোঈ অবাক হল।

“আমাদের পত্রিকার তরফ থেকে জীবনানন্দ সভাঘরে একটা গল্পপাঠের আয়োজন করা হয়েছে আজ। সাড়ে ছ’টায় শুরু হবে। তাই এসেছি আমরা। ওই দেখতে পাচ্ছিস, প্ল্যাকার্ড আর হোর্ডিং পড়েছে,” নিশান বলল।

নোঈ বিরক্ত হয়ে বলল, “এই সবই কর। তোকে একদিন ফোন করেছিলাম। ধরলি না। তারপর একবার কল ব্যাকও করলি না! তুই কেমন যেন হয়ে গেছিস!”

“আরে, সরি সরি!” নিশান হেসে কান ধরল, “খুব ভুল হয়ে গিয়েছে রে! আসলে সেদিন কেয়াদির পাল্লায় পড়ে সব গুলিয়ে গিয়েছিল।”

কেয়াদি কে, সেটা জানে নোঈ। দেখেছে সোনাঝুরিতে। তবে খুব আলাপ নেই। ওই মুখ-চেনা টাইপ আর কী।

নোঈ আবার ঘড়ি দেখল। শ্বেতার মোবাইলটা কাল বাস থেকে চুরি হয়ে গিয়েছে। তাই ওকে যে ফোন করে তাড়া দেবে, তারও উপায় নেই। খুব বিরক্ত লাগছে নোঈর, কিন্তু কিছু করার নেই। আজ বাড়িতে গিয়ে মা যে কী বলবে, সেটাই দেখার। একে তো বিয়ে করবে না বলে গত পরশু ঘোষণা করার পর থেকে মা রেগে আগুন হয়ে আছে! তার ওপর আজ অফিসের ব্যাপারটা শুনলে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, স্বয়ং ভগবানও জানেন না!

“তোর নাকি বিয়ে?” আচমকা প্রশ্নটা করল নিশান।

“কী?” সামান্য থতমত খেয়ে গেল নোঈ।

“আরে বিয়ে, বিয়ে। তোর। তাই?” নিশান হাসল, “ভাল ডাক্তার নাকি! বিয়ের পর আমেরিকায় চলে যাবি শুনলাম! সত্যি?”

নোঈর মুখটা নিমেষে লাল হয়ে গেল। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন পাল্লা দিয়ে দৌড়ে মাথায় গিয়ে জমা হল। ও চোয়াল শক্ত করে তাকাল।

“যাঃ বাবা, খচে যাচ্ছিস কেন? মাসিমণি তো মাকে বলেছে। ছেলে নাকি বলেছে বছর পাঁচেকের মধ্যে প্লেন কিনবে? তাই?”

“সব তো জানিস, তাও আমার মাথা খাচ্ছিস কেন?” নোঈ এবার চিড়বিড় করে উঠল!

“বাপ রে! প্লেন কেন কিনবে বল তো? রাস্তায় গাড়ি চালাতে ভয় লাগে? আকাশ দিয়ে ফাঁকায় ফাঁকায় যাবে বলে?” নিশান খিকখিক করে হাসল।

“আমি বিয়েটা করছি না,” নোঈ কোনওমতে রাগটাকে গিলে বলল।

“সে কী? কেন?” নিশান চুপ করে গেল এবার।

নোঈ ঠোঁট টিপে মাথা নিচু করল।

“বাদ দে,” নিশান হেসে বলল, “এই বয়সে বিয়ে করবি কী! মাস্টার্স করেছিস। চাকরি করছিস। গ্রেট গোয়িং। আগে নিজের কেরিয়ার সেট কর।”

“কে কাকে বলে দ্যাখো!”

নোঈ দেখল নিশানের পেছনে কেয়াদি উঁকি দিচ্ছে!

কেয়াদি সামনে এসে বিরক্ত মুখে বললেন, “এই নিশান, তোকে তখন থেকে ফোন করছি, কী করছিস তুই?”

“আমায়? ফোন?” পকেট থেকে ফোনটা বের করে জিভ কাটল নিশান, “ওহো, সরি। সাইলেন্ট করা ছিল। কী হয়েছে?”

কেয়াদি বলল, “অনুষ্ঠান শুরু করার আগে কাজ থাকে না? এখানে গপালে হবে? চল।”

নিশান হাসল, “আসলে বোনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তো!”

কেয়াদি নোঈকে দেখল। হাসল সামান্য। কিন্তু নোঈ বুঝল সেটা নিছক ভদ্রতা।

কেয়াদি বলল, “চল নিশান। কোথা থেকে একটা গোঁয়ার-গোবিন্দকে ধরে এনেছিস! প্রতি পদে সবার সঙ্গে ঝগড়া করছে।”

“আরে মণীশ, একটু মাথাগরম ছেলে। ঠিক আছে চলো আসছি।”

“আয় তাড়াতাড়ি,” কেয়াদি দাঁড়াল না আর। আবার চলে গেল সভাঘরের দিকে।

নিশান হাসল নোঈর দিকে তাকিয়ে। তারপর বলল, “মাসিমণি ঝামেলা করছে? শোন, নিজের যা ভাল মনে হবে করবি! মাসিমণিরা অন্য জেনারেশন। আমাদের বুঝবে না। সিকিয়রিটির কনসেপ্টটা আমাদের কাছে যা, ওদের কাছে তা নয়। প্লাস ইগো তো আছেই!”

নোঈ কিছু বলল না। আসলে নোঈ চট করে নিজের কথা কাউকে বলতে পারে না। শ্বেতা ওর খুব ভাল বান্ধবী বলে তাও কিছুটা বলে। যদিও নিশান ওর মাসতুতো দাদা। ভাল ছেলে। কিন্তু সেই কানেকশনটা তো নেই। তাই ওকে আর কী বলবে! মা এমন করে যে, অপমান লাগে নোঈর। মেয়ের কষ্ট হতে পারে, খারাপ লাগতে পারে, সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই! লোকে কী ভাববে! কে কী বলবে! কীসে আরও প্রেস্টিজ বাড়বে এই নিয়ে ভেবে সব সময় মাথা খারাপ করে!

নিশান মাথা নেড়ে এবার বলল, “আমি আসি। এলে পারতিস। ভাল লাগত তোর!”

নিশান চলে যাওয়ার পর ঘড়িটা আবার দেখল নোঈ। আধঘণ্টা হয়ে গেল। শ্বেতা কি আসবে না? তবে কি বাড়ি চলে যাবে? বাড়ি গিয়ে কী বলবে? কাল থেকে আর অফিস নেই! মা তো আরও চেপে ধরবে। বিয়ের জন্য পাগল করে দেবে। ও যে ডিনোকে বিয়ে করতে পারবে না, সেটা মা এখনও ছেলের বাড়িতে জানায়নি! মা আইকাদিদের বলেছে যে, সব মেয়েরাই নাকি ওরকম বলে। কিন্তু মা ঠিক নোঈকে কনভিন্স করে ছাড়বে!

কনভিন্স! কীসের কনভিন্স! এটা কি কেউ ধূপকাঠি বিক্রি করতে এসেছে নাকি? ছেলে জ্বলে অনেকক্ষণ বেশি! ছেলের গন্ধ ভাল! ধোঁয়া ডাইরেক্ট ভগবানের নাকে হিট করে! কনভিন্স! বোকার মতো কথা! নোঈর মাথাগরম কি সাধে হয়!

নোঈ কাজ করতে চায়। আজ কাজটা ছেড়ে এসেছে বটে, কিন্তু তার মানে তো আর ঘরে বসে থাকবে না। আবার কাজ খুঁজবে। সঙ্গে ব্যাঙ্কিং-এর পরীক্ষাও দেবে। কিছু একটা তো ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু কাজ ওকে করতেই হবে।

মনটা খারাপ হয়ে আছে। মাস চারেক হল চাকরিটা করছিল নোঈ। ভালই ছিল প্রথম মাস আড়াই। তারপর শেফালি বলে অ্যাকাউন্টসের হেড এমন পেছনে লাগতে শুরু করল! নোঈর তৈরি করা স্প্রেড শিটে নিজে ইচ্ছে করে ভুল ডেটা বসিয়ে বসের কাছে ঝাড় খাওয়াচ্ছিল। সেই সঙ্গে খারাপ ব্যবহার তো ছিলই! আর নিতে পারছিল না নোঈ। অফিস যাওয়ার নামে আতঙ্ক হয়ে যাচ্ছিল। রাতে ঘুমোতে পারছিল না। শুনছিল, শেফালিদির নিজের কোন এক ক্যান্ডিডেট রয়েছে, তাকে পুশ করার জন্য নোঈকে এমনভাবে হ্যারাস করছে মহিলাটি।

আর, আজ তো চরম জায়গায় পৌঁছেছিল ব্যাপারটা! সকলের সামনে এমন করে বলল শেফালিদি যে, আর নিতে পারেনি নোঈ। ও নাকি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছে! ওর নাকি অন্য মতলব আছে! কীভাবে কেউ এসব বলতে পারে! মানুষ এত নীচে নামতে পারে! কী মিন করেছে শেফালিদি?

“সরি, সরি নোঈ। অনেক লেট হয়ে গিয়েছে,” শ্বেতা হাঁপাতে-হাঁপাতে ওর পেছনের দিক থেকে এসে দাঁড়াল সামনে।

নোঈ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল শ্বেতার দিকে।

শ্বেতা বলল, “আরে, আমার দোষ নেই। মেট্রোয় আসছিলাম। রবীন্দ্র সরোবরে একজন সুইসাইড করেছে। তাই ট্রেন বন্ধ ছিল। এটা কি সত্যি রে যে, ওই স্টেশনে ভূত আছে?”

নোঈ বিরক্ত হয়ে বলল, “ববির সঙ্গে প্রেম করছিলি, না? তোকে কতবার বলেছি, ছেলেটা সুবিধের নয়! শুনবি না তো সেই কথা!”

“মাইরি বলছি,” শ্বেতা হাসল, “ওই জন্য লেট হয়নি। আমি সত্যি মেট্রোয় ছিলাম। তুই বিশ্বাস কর। আচ্ছা যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করিস সুইসাইড হয়েছে কি না। তবে হ্যাঁ, ববি সঙ্গে ছিল।”

নোঈ চোয়াল শক্ত করল। এই ছেলেটাকে ভাল লাগে না নোঈর। চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায়, সোজা পথের নয়। তা ছাড়া হোয়াটস অ্যাপে একদিন নোঈকে প্রোপোজ়ও করেছে। বলেছে, নোঈকে নাকি সারাক্ষণ চোখে হারায়! নোঈ সেদিন ভাল করে ঝেড়েছিল ওকে। শ্বেতা কত ভালবাসে ছেলেটাকে, আর সে কিনা ওকে প্রোপোজ় করছে!

পরে অবশ্য ববি বলেছিল, নেশা করেছিল বলে ভুলভাল বলেছে। আসলে ও কিছুই মিন করেনি। বেশি মদ খেয়ে ফেললে নাকি ও এমন ভুলভাল করে ফেলে।

তারপর থেকে দেখেছে, ওকে দেখলে ববি অদ্ভুতভাবে তাকায়। কিছু একটা বক্তব্য দৃষ্টি দিয়ে পাঠাতে চায়। গোটা ব্যাপারটায় মাথা খুব গরম হয়ে যায় নোঈর। মানুষ মানুষকে কী করে এমন ঠকাতে পারে! শ্বেতাকে যদি ববির পছন্দ না হয়, তবে কেন শুধু শুধু মেয়েটার সঙ্গে ঘোরে? এমনকী, ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। শ্বেতা ববি ছাড়া আর কিছু বোঝে না। কিন্তু ববি শ্বেতা ছাড়া আর সব কিছু বুঝতে চায়।

ববির ওকে প্রোপোজ় করার ব্যাপারটা শ্বেতাকে বলেনি নোঈ। বললে শ্বেতার সঙ্গে ওর সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। কারণ, নোঈ নিশ্চিত ববি এর পরিবর্তে এমন কিছু শ্বেতাকে বলবে যে, পুরো ব্যাপারটাই পালটে যাবে। আর সত্যি বলতে কী, শ্বেতা ওর প্রিয়তম বন্ধু হলেও একটা সীমার পর ওর জীবনে আর ঢোকে না নোঈ। আসলে ছোট থেকেই নোঈ এটা বাবার কাছ থেকে শিখেছে। বাবার মতো এমন চুপচাপ মানুষ ও কোনওদিন দেখেনি! নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কখনও নোঈ দেখেনি মানুষটা অন্যের ব্যাপারে যেচে নাক গলিয়েছে বা কিছু বলেছে। বাবাকে দেখে নির্জন পাহাড়ি নদীর পাড়ের কাঠের বাড়ি মনে হয়! খুব ভাল লাগে ওর। মা তো সারা জীবন বুঝলই না বাবাকে। শুধু রাগ আর অভিমান করে গেল।

“কী রে, কী ভাবছিস?” শ্বেতা সামান্য ঠেলা দিল নোঈকে।

নোঈ বলল, “কিছু না।” তারপর ব্যাগ থেকে গীতবিতানটা বের করে দিয়ে বলল, “এই নে। এটা ধর।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, জানু!” শ্বেতা নোঈকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেল একটা।

নোঈ বলল, “থাক আর ন্যাকামো করতে হবে না। এতক্ষণ ওয়েট করালি বেকার! আমার এমনিতেই আজ মনটা ভাল নেই।”

“কী হয়েছে?” শ্বেতা এবার সিরিয়াস মুখ করে তাকাল।

নোঈ চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুখ মুছল একটু। তারপর সময় নিয়ে ধীরে-ধীরে বলল, “চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি।”

“সে কী রে? পাগল নাকি? এই তো কয়েক মাস হল জয়েন করলি!” শ্বেতা চোখ গোলগোল করে তাকাল ওর দিকে।

“পাগল কেন হব? আর সহ্য করা যাচ্ছিল না,” নোঈ চশমাটা পরে নিল আবার। বলল, “ওই অ্যাটমসফিয়ারে কাজ করা যায় না।”

“কী হয়েছে রে? একদম ছেড়েই দিলি? সত্যি?” শ্বেতা মাথা নাড়ল।

“আরে, আমার স্প্রেড শিটগুলো শেফালিদি ট্যাম্পার করে বসের কাছে সাবমিট করছিল। বারবার করছিল। আজ আমি আর শেফালিদিকে কিছু না বলে সোজা বসকে গিয়ে সাবমিট করেছি আমার কাজগুলো। ব্যস, শেফালিদি কী রেগে গেল! যা খুশি বলতে শুরু করল। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছি নাকি আমি! আমি নাকি অন্য কিছু চাই! আরও কীসব ইঙ্গিত করল। আই জাস্ট ফ্লিপড। ছেড়ে দিয়েছি। দু’মাসের নোটিশ দিতে হয়। দিয়ে এসেছি। বলেছি টাকাপয়সা যেন আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। আমি আর যাচ্ছি না ওই নরকে!”

শ্বেতা মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “ঠিক আছে, আর মাথাগরম করিস না। তুই এত ভাল লেখাপড়ায়। ঠিক অন্য চাকরি পেয়ে যাবি আবার।”

নোঈ মাথা নাড়ল, “অপমানটা ভুলতে পারছি না। অসভ্যতা আমি পছন্দ করি না জানিস তো! শেফালিদির নাকি নিজের কোন এক ক্যান্ডিডেট আছে। ঠিক আছে, এখন তাকে ঢোকাক আমার জায়গায়। আমার অত টাকার দরকার নেই। সব সহ্য করে পড়ে থাকা আমার দ্বারা হবে না।”

শ্বেতা ঘড়ি দেখল। মুখে-চোখে স্পষ্ট যে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

নোঈ বলল, “তোর রিহার্সাল আছে না? তুই তা হলে আয়।”

“কিন্তু তুই এমন করে একা… মানে তোকে এভাবে আমি একা ছেড়ে যাই কী করে?”

“তো কী হয়েছে? আমি এখন বাড়ি যাব। নিড আ শাওয়ার,” নোঈ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

শ্বেতা চট করে ঘড়ি দেখল আবার। তারপর বলল, “ঠিক বলছিস তো? কোনও প্রবলেম নেই তো?”

নোঈ হাসল। অনেকক্ষণ পর হাসল। নিজেরই অবাক লাগল নোঈর। তারপর বলল, “কোনও প্রবলেম নেই। তুই আয়। আমিও যাব।”

শ্বেতা বলল, “কাল তোদের বাড়ি যাব। আর-একটা কথা তোকে বলা হয়নি। আমি কয়েকমাসের জন্য একটা স্কলারশিপ পেয়ে চণ্ডীগড় চলে যাচ্ছি!”

“তাই?” নোঈ অবাক হল।

“হ্যাঁ। আজ এসেছে চিঠিটা। তবে এখন আর এই নিয়ে কিছু বলছি না। পরে ফোনে বলব। আমার দিনটা ভাল আজ। মনটা কী ভাল ছিল! কিন্তু এখন আমার কী খারাপ লাগছে! তোর দিনটা আজ এমন গেল!”

নোঈ জানে শ্বেতার সত্যি খারাপ লাগছে। খুব ভাল মেয়েটা। সত্যি ওর জন্য চিন্তা করে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, ওর মেজাজ খারাপ আছে বলে এখন শ্বেতাকে ওর জন্য বেবি সিটিং করতে হবে।

শ্বেতার সঙ্গে নোঈ নিজেও বেরোল নন্দন চত্বর থেকে। শ্বেতা কবে চণ্ডীগড় যাবে, কোথায় থাকবে, এই নিয়ে টুকটাক কথা হল কিছু। কিন্তু নোঈ বুঝল, ও এসব কথা বললেও মনের ভিতরটা ওর এমন হয়ে আছে যে, কিছুই আসলে ভাল লাগছে না। কোনও কথা ঠিক গাঁথছে না মনে। এই যে শ্বেতা ওর এত বান্ধবী, সে চলে যাবে শুনেও তেমন হেলদোল হচ্ছে না। কেন কে জানে! আচ্ছা, নোঈ কি বড্ড স্বার্থপর!

বড়রাস্তায় গিয়েই বাস পেয়ে গেল শ্বেতা। বাসে উঠে পিছনে ফিরে একবার হাত নাড়ল মেয়েটা। নোঈ হাসল একটু। তারপর বাসটা বেরিয়ে গেলে ও রাস্তা পার হয়ে নিল।

গলাটা আবার শুকিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে জলের বোতল আছে নোঈর, কিন্তু কোল্ড ড্রিঙ্ক খেতে ইচ্ছে করছে ওর। মোড়ের কাছে ডান দিকে একটা দোকান আছে। শ্বেতার সঙ্গে মাঝে মাঝে ওখান থেকে কোল্ড ড্রিঙ্ক খায় নোঈ।

সামনে সামান্য ভিড়। তাদের কাটিয়ে বড় ক্লাবটার সামনে দিয়ে এগোল মোড়ের দিকে। কোল্ড ড্রিঙ্কটা খেয়ে রবীন্দ্রসদন থেকে মেট্রো ধরে নেবে। মার্চের শেষ এখন। গরম পড়েছে বেশ। কুর্তির ভেতর দিয়ে সরু ঘামের রেখা শিরদাঁড়া দিয়ে নামছে। এক-এক ফোঁটা জল। নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন। ওর মতো!

দীর্ঘশ্বাস পড়ল নোঈর। আজ হঠাৎ নিজেকে খুব একা লাগছে ওর। মনে হচ্ছে আসলে ওর কেউ নেই। কেউ কোনওদিন ছিল না। এখন বাড়িতে ঢুকতেও ইচ্ছে করছে না। আবার রাস্তাতেও থাকতে ভাল লাগছে না। কী যে করে নোঈ! ও আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য ডুবে গেলেও তার মনখারাপ করা একটা আলো লেগে রয়েছে মেঘে। যেন আলতা মোছা তুলো ছড়িয়ে আছে আকাশময়! কলকাতার আকাশটা এমন ধূসর কেন কে জানে! নীল রঙের আকাশ শেষ কবে কলকাতায় দেখেছে মনে করতে পারে না নোঈ!

মোড়ের কাছটায় ভিড় হয়ে আছে। লোকজন রাস্তা পার হবে বলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুটো উসকোখুসকো পাগল বসে রয়েছে দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে। তার পাশে ভাজাভুজির দোকান আর একটা পান-কোল্ড ড্রিঙ্কসের দোকান। ফুটপাথটার যেন দমবন্ধ অবস্থা।

নোঈ মাঝে মাঝে ভাবে এই শহরে যে ওদের নানারকম ট্যাক্স দিতে হয় সেটার কতটা লাভ পায় ওরা! অর্ধেকের বেশি ফুটপাথে হয় হকার বসে রয়েছে নয়তো মানুষজন বসবাস করছে! গত পাঁচ-ছ’বছরে ফুটপাথে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা যেন তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে! স্টোভে, উনুনে বা ইট দিয়ে তৈরি উনুনে রান্না, রেলিং-এ মেলে রাখা জামাকাপড়, চাটাই পেতে শুয়ে পড়া, প্লাস্টিকের পুঁটলিতে জড়ো করে রাখা জামাকাপড়, ছড়িয়ে রাখা তরকারির খোসা, ভাতের ফ্যান, টলমল করে হাঁটা ছোট ছোট বাচ্চা, মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা মানুষ! এরা কারা? কোথা থেকে আসে? আগেই-বা ছিল কোথায়? এই নিয়ে আর বেশি ভাবতে চায় না নোঈ। মাথার ভিতরটা কেমন করে!

নোঈ সাইড-ব্যাগটাকে সামনে করে নিয়ে এসে দাঁড়াল দোকানটার সামনে। একজন বয়স্ক বিহারি মানুষ দোকানটা চালান। নোঈর মুখ চেনা। তার পাশে আজ একটা অল্পবয়সি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্ক মানুষটাকে হাতে-হাতে সাহায্য করছে।

নোঈ কোন কোল্ডড্রিঙ্কটা চায়, সেটা বলল।

দোকানে আরও দু’-তিনজন দাঁড়িয়ে ছিল। তারা ঘুরে তাকাল নোঈর দিকে। নোঈ পাত্তা দিল না। ও জানে রাস্তায় বেরোলে লোকজন দ্যাখে ওকে। কেন দ্যাখে সেটাও জানে। শ্বেতা বলে, “তোকে যা দেখতে ইজ়ি সিনেমায় চান্স পেতে পারিস। এমন মাখনের মতো গায়ের রং ভগবান যদি আমায় দিত! কী চাকরি-বাকরি করে জীবনটা নষ্ট করছিস! ববিকে বলব? ওর ফিল্ম লাইনে যোগাযোগ আছে।”

কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতলটা নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল নোঈ! দুশো এমএল-এর ছোট্ট বোতল। তবে খুব ঠান্ডা। দু’হাত দিয়ে বোতলটা প্রাণপণে চেপে তার সমস্ত শীতলতা নিজের শরীর আর মনের মধ্যে শুষে নেওয়ার চেষ্টা করল নোঈ!

খালি বোতলটা নিয়ে এগিয়ে গেল নোঈ। নতুন মেয়েটা হাত বাড়িয়ে নিল বোতলটা। বলল, “দশ রুপায়া।”

নোঈ ব্যাগটা খুলে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিল।

“ছুট্টা নেহি হ্যায়,” মেয়েটা বিরক্ত হল একটু।

“আমার কাছেও নেই,” নোঈ সহজ গলায় বলল।

“আরে, দশ টাকার জিনিস নিয়ে কেউ পঞ্চাশ টাকা দেয়!” মেয়েটার ভাঙা বাংলায় এবার আরও বেশি ঝাঁজ!

“আরে, নেই আমার কাছে!” নোঈও বিরক্ত হল সামান্য।

“ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি,” মেয়েটা গলা বাড়িয়ে হাত দিয়ে নোঈর ব্যাগটা দেখাল, “ওই তো দশটাকার একটা নোট! ঝুট কাহে বোল রহি হো?”

“মানে?” নোঈর মাথাটা আচমকা গরম হয়ে গেল, “লাগবে না ব্যালেন্স।”

নোঈ আর কথা না বলে হাঁটা দিল। আশপাশের লোকজন তাকাচ্ছে। সবাই অবাক। পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে বাকি টাকা ফেরত নিচ্ছে না!

নোঈর মাথা ঝাঁঝাঁ করছে! মেয়েটা বলে, ও মিথ্যেবাদী! এত লোকের সামনে!

“দিদিজি, দিদিজি, সুনিয়ে পিলিজ, দিদিজি…” বয়স্ক মানুষটি কোনওমতে এসে নোঈর পাশে দাঁড়ালেন। নোঈ তাকাল ওঁর দিকে।

“পিলিজ দিদিজি, গুসসা না হোইয়ে। ছোটি লড়কি। বুঝতে পারেনি! আমি দিচ্ছি আপনাকে চেঞ্জ। পিলিজ মাফ কর দিজিয়ে!” বয়স্ক মানুষটি আন্তরিকভাবে বললেন কথাগুলো।

নোঈ দাঁড়িয়ে পড়ল। মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়াল একটু। মাথা নাড়ল অল্প। তারপর বলল, “সরি।”

“নেহি দিদিজি। আপ সরি না বোলিয়ে,” বয়স্ক মানুষটি এবার হাফশার্টের বুকপকেট থেকে দুটো কুড়ি টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিলেন নোঈর দিকে। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেহাতি ভাষায় কিছু একটা বললেন।

নোঈ দেখল মেয়েটা চোয়াল শক্ত করে ওই ভাষাতেই কী একটা উত্তর দিল।

আশপাশের লোকজন আরও একটু ঘিরে এসেছে যেন। যথেষ্ট হয়েছে। নোঈ ভাবল এবার ওর এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। আর সত্যি বলতে কী মেয়েটা তো ভুল কিছু বলেনি! সত্যি তো ওর ব্যাগে একটা দশ টাকার নোট আছে। কিন্তু সেটা তো খরচ করা যায় না! হতে পারে নোটটা দশ টাকার। কিন্তু এর মূল্য তো আর দশ টাকা নয়! এই নোটটা অমূল্য। কারণ জয় ওকে দিয়েছিল এটা। জয় মানে জয়ব্রত ঘোষাল। সেই থার্ড ইয়ারে, হাজরা মোড়ে। সেই পান-কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকানের সামনে। শীতের এক সন্ধেবেলা। নোঈ বলেছিল, কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবে। শীতে কোল্ড ড্রিঙ্ক! জয় বিরক্ত হয়েছিল বেশ! তারপর পকেট থেকে এই দশ টাকার নোটটা বের করে দিয়ে বলেছিল, “এটা দিয়ে কিনে নে। আমার টাইম নেই। আমি আসি।”

জয়ের চলে যাওয়া চুপচাপ ছলছলে চোখে দেখেছিল নোঈ। ও কোল্ড ড্রিঙ্ক খায়নি সেদিন। শুধু নোটটা মুঠো করে ধরে ভিড় ফুটপাথে একা দাঁড়িয়ে ছিল! সেই থেকে এটা ওর কাছে থাকে সারাক্ষণ। আর আজ কী করে এই নোটটা দিয়ে দেবে নোঈ! জয়ের এটুকুই যে শুধু রয়ে গিয়েছে ওর কাছে!

নোঈ বলল, “দেখুন, আমায় যেতে হবে। থ্যাঙ্ক ইউ।”

বয়স্ক লোকটি বললেন, “ওকে ক্ষমা করে দেবেন, দিদিজি!”

নোঈ মাথা নেড়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। মেয়েটার জন্য এবার একটু খারাপ লাগছে ওর। আসলে এটাই হয় নোঈর। রাগের পর কেমন একটা খারাপ লাগা আসে। আসলে মেয়েটার তো দোষ নেই! ও তো ঠিকই দেখেছে নোটটা! কিন্তু এটা তো কোনওদিন দিতে পারবে না ও। কাউকেই দিতে পারবে না।

আচমকা জয়ের মুখটা ভেসে উঠল সামনে। রোগা, ফরসা, চাপদাড়ি আর চশমা। চশমার আড়ালে একজোড়া বাদামি রঙের চোখ। নোঈর দেখলে মনে হত, ওই চোখের ভেতরে কিছু একটা আছে, না হলে কেন এমন ওলট-পালট হয়ে যেত ওর মনটা! শুধুই ওলট-পালট হয়ে যেত! সবটাই কি অতীত এখন? ওই চোখটা মনে পড়লে কি এখনও কিছু হয় না? ভরা কলকাতাটা কি এখনও আচমকা শূন্য হয়ে যায় না?

নোঈ দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবল, না আর অতটা শূন্য হয়ে যায় না। জয়ের ওই শেষ কথাগুলো শোনার পর আর কিছু হয়ে যায় না। আসলে একটা-একটা করে ইট গেঁথে তুলে জয়ের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে নোঈ। যে-কষ্ট আর মানসিক অত্যাচার জয় ওকে করেছে, সেটাতে আর ফিরে যেতে পারবে না ও। তার চেয়ে এমন হয়ে থাকাই ভাল।

রবীন্দ্রসদন মেট্রোয় ঢোকার মুখটায় খুব ভিড়। বিকেল শেষ হচ্ছে, কিন্তু নোঈ লক্ষ করেছে, বিকেল শেষ হওয়ার পর থেকেই কলকাতা যেন নতুন করে জেগে ওঠে। অফিস বা কলেজ ফেরতা মানুষের মধ্যে সুন্দর করে সাজগোজ করে ঘুরতে বেরোনো মানুষও মিশে থাকে। এই শহরে আবহাওয়া আজকাল আর বোঝা যায় না। শুধু যুবক-যুবতীদের পোশাকটাই বলে দেয়, কী ঋতু ফিসফিস করছে বাতাসে!

রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে মেট্রোর সিঁড়িতে পা দিল নোঈ। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারল না।

“নোঈ,” পেছন থেকে আসা ডাকটা থমকে দিল ওকে। ও পেছনে ঘুরল। দি!

নোঈ দাঁড়িয়ে পড়ে এক ধাপ নেমে এল সিঁড়ি থেকে। তারপর পথ না আটকে রাস্তার একপাশে সরে গিয়ে বলল, “দি তুই? এখানে?”

আইকা কপালে এসে পড়া চুলটা ঠিক করে নিয়ে বলল, “বাড়ি যাচ্ছিস?”

“হ্যাঁ,” নোঈ মাথা নাড়ল।

“চল আমার সঙ্গে,” আইকা নোঈর হাত ধরে টান মেরে ওকে রাস্তায় নামিয়ে আনল।

“আরে, আমি বাড়ি যাব। অফিস থেকে আসছি। নিড আ শাওয়ার দি। তুই কি গাড়ি এনেছিস?”

“না, গাড়ি আনিনি আজ। আর আমিও বাড়ি যাব। চল না!” আইকা হাত ধরে টানল, “এই ক্লাবে এসেছিলাম দু’মিনিটের জন্য। একজনকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল। ওই পারে গাড়িতে আমার বন্ধু বসে আছে। ও পৌঁছে দেবে। চল।”

নোঈ ভুরু কোঁচকাল। আইকার বন্ধু তো ও যাবে কেন তার গাড়িতে? চেনে না জানে না! কেন যাবে? বোকা বোকা ব্যাপার!

ও বলল, “না, আমি মেট্রোতেই যাব।”

“আচ্ছা ঢ্যাঁটা মেয়ে!” আইকা কপট রাগে চোখ পাকাল, “হাত ধরে টানছি, এবার না গেলে কান ধরে টানব তোকে। চল। পাকামো সব সময়!”

“তুই যে কী করিস না!” নোঈ হাসল, “ঠিক আছে চল। এইটুকু পথ তাও আবার গাড়িতে!”

আইকা কথার উত্তর না দিয়ে রাস্তার গাড়ির জটের মধ্যে দিয়ে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে নোঈকে নিয়ে পথ পার হয়ে গেল।

রাস্তার এই পারটায় যেন আরও ভিড়। মেট্রো স্টেশনের আড়ালে খাবারের দোকান আছে এদিকে। মানুষ তার উপর যেভাবে ভেঙে পড়েছে, নোঈ ভাবল কলকাতায় কি এতদিন দুর্ভিক্ষ চলছিল?

এই পাশের ফুটপাথ আর রাস্তাটা মোড়ের কাছে বেশ অপরিষ্কার! খাবারের অবশিষ্ট, রোলের ছেঁড়া কাগজ, পচা ফল, পানের পিক! নোংরা দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে নোঈর। ও দেখল আইকা অম্লানবদনে সেই সব টপকে মানুষের ভিড়ের ভিতর দিয়ে তরতর করে এগিয়ে গেল।

এই পারে এসেই নোঈর হাত ছেড়ে দিয়েছিল আইকা। তাই নোঈ পিছিয়ে পড়ল একটু। তারপর সময় নিয়ে নোংরা বাঁচিয়ে এগিয়ে গেল গাঢ় নীল রঙের একটা গাড়ির সামনে দাঁড়ানো আইকার দিকে।

“এত পুতুপুতু কেন তোর?” আইকা ভুরু কোঁচকাল, “এই শহরে বড় হয়েছিস না?”

নোঈ কিছু না বলে হাসল। আসলে সব কিছুর তো উত্তর হয় না! তবে অবাক লাগল দেখে যে, আইকা এমন উচ্ছ্বসিত! সাধারণত আইকা একটু গম্ভীর ধরনের মেয়ে। সে এমন স্কুলের মেয়েদের মতো তড়বড় করছে দেখে, কেমন একটা লাগল নোঈর! কিন্তু কিছু বলল না। আইকাকে ভাল লাগে ওর। খুব ভাল লাগে এমনটা নয়, কিন্তু ভালই লাগে। আসলে আইকার জীবনটা খুব-একটা আনন্দের নয়। তাই ভাল লাগার চেয়ে একটা চাপা সহানুভুতি কাজ করে নোঈর। মনে হয়, মেয়েটা দুঃখী! আর দুঃখী মানুষদের জন্য কোথায় যেন একটা খারাপ-লাগা কাজ করে ওর।

“কী রে! কী ভাবছিস? আজকাল কী হয়েছে তোর? এখন তুই শিয়োর প্রেমে পড়েছিস কারও, না?” আইকা হাসল।

“ধুৎ!” খানিকটা জোর করেই পালটা হেসে উত্তর দিল নোঈ।

মানুষজনের এই ধরনের ইয়ারকিগুলো খুব বোকা বোকা লাগে নোঈর। সামান্য অন্যমনস্ক লাগলেই হয় বলে, কী রে কবিতা লিখবি! নয়তো এই, প্রেমে পড়েছিস! এত স্টিরিয়টাইপ! মানুষ যেন এমনি অন্যমনস্ক হতে পারে না! যেন তার আনমনা হতে এমনি এমনি ইচ্ছে করতে নেই!

“শোন না,” আইকা হাত ধরল ওর, “একটা সারপ্রাইজ় দেব তোকে।”

“আমায়!” নোঈ অবাক হল। তবে সত্যি বলতে কী একটুও আগ্রহ বোধ করল না। আজ চাকরি ছেড়ে এসেছে। অশান্তি হয়েছে অফিসে। ওদিকে বাড়িতেও মায়ের সঙ্গে ঝামেলা চলছে! এখন কি আর ওর এই সব সারপ্রাইজ় দেখে আনন্দে ডগমগ হওয়ার সময় আছে!

“আয়।”

আইকা হাত ধরে ওকে আবার টেনে এনে দাঁড় করাল ওই গাড়িটার পাশে। নোঈ দেখল নীল গাড়িটার কাচটা টিন্টেড। আইকা হাত ঘুরিয়ে গাড়িটার কাচটা নামানোর ইঙ্গিত করল।

সামান্য সময় নিল গাড়ির ভিতরে বসা মানুষটা। তারপর মসৃণভাবে নেমে এল গাড়ির কাচ। শহরের মাথা থেকে প্রায় বিদায় নেওয়া শেষবেলার আলো তার আবছা রং নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল গাড়ির গায়ে, তার ভিতরে। নোঈ দেখল মানুষটাকে। আর খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও মনে হল, ওর পায়ের তলার মাটি একটু কাঁপল!

আবার কি ভূমিকম্প হল? না মনের ভুল! নোঈ একবার তাকিয়েই কেন জানে না চোখটা সরিয়ে নিল মানুষটার দিক থেকে। বুকের ভিতর কেমন একটা অস্বস্তি হল ওর। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। এই আইকার সারপ্রাইজ়? ও যত এইসব এড়াতে চাইছে, তত কেন জীবন এমন সব ঘটনা ও মানুষ এনে সামনে রাখছে ওর! মায়ের সঙ্গে যে জন্য বিবাদ হচ্ছে সেই কারণটাই ওর সামনে! কেন বারবার ঈশ্বর ওকে এমন বিপদে ফেলেন? এমন সংকটের সামনে এনে দাঁড় করান?

“কী রে, খুব চমকে গিয়েছিস, না?” আইকা হাসল, “তোর উড বি হাজ়ব্যান্ডের দাদা। চিনতে পারছিস?”

উড বি হাজ়ব্যান্ড! কথাটা কট করে কানে লাগল নোঈর। এসব কী বলছে আইকা! উড বি হাজ়ব্যান্ড মানে? ও তো সেই ডাক্তার ছেলেটিকে বিয়েই করবে না। তবে! এসব কী বলছে আইকা!

“আঃ দি! কী সব বলছিস তুই!” নোঈ দাঁত চেপে বলল কথাগুলো, “কার বিয়ে? কে উড বি হাজ়ব্যান্ড?”

“তোর রে। ন্যাকা খুকি আমার!” আইকা হইহই করে হেসে গাড়ির ভিতরে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখলি, কেমন লজ্জা পাচ্ছে! এখনও বিয়ে হয়নি, তাতেই এত লজ্জা! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি!”

মানুষটা এবার গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল। নোঈ আজ যেন ভাল করে দেখল মানুষটাকে। গম-রঙা মানুষটার দোহারা চেহারা। পাঁচ ফুট দশ-এগারো ইঞ্চির মতো উচ্চতা। সামান্য ঢেউ খেলানো চুল, গোঁফ। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। মুখে হাসি থাকলেও কোথাও যেন একটা বিষণ্ণতাও আছে। ওই ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে ওকে দেখতে এসেছিল এই মানুষটা। কিন্তু সেদিন ভাল করে তাকায়নি নোঈ। বিরক্তিতে সেদিন ভাল করে মুখই তোলেনি ও। সেদিন সবকিছু আর সকলকে অসহ্য লাগছিল। নিজেকে পথের উপর উপুড় করে বিক্রি করা সবজির মতো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সকলে চোখ দিয়ে টিপে-টুপে ওজন করে দেখছে ও কতটা চলতে পারে। ওকে নিজেদের সংসারে নিলে লাভ হবে না ক্ষতি। কী ভীষণ অপমানজনক আর বর্বর এই প্রথা! আমাদের দেশে যৌনতা নিয়ে এত ছুঁতমার্গ, কিন্তু আসলে গভীরভাবে ভেবে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের নানা রিচুয়াল আর সামাজিক আচার আসলে কোথায় যেন একটা জাতির অবদমিত যৌনতাকেই বড্ড বেশি করে ফুটিয়ে তোলে।

আজ কিন্তু মানুষটাকে দেখে নোঈর অস্বস্তি হলেও তার তলায় কোথায় একটা ভালও লাগছে। কেউ-কেউ থাকে যাদের দেখলে পাহাড়ের কথা মনে পড়ে। সূর্যাস্তের সময় পাহাড়ের নীল রঙের মধ্যে জেগে থাকা নির্জনতার কথা মনে পড়ে। এই মানুষটাকে দেখেও সেটাই মনে হচ্ছে নোঈর। মনে হচ্ছে, এই ভিড়ে হিজিবিজি হওয়া এক্সাইড মোড়েও মানুষটা কেমন যেন একলা, কেমন যেন নির্জন! নোঈর খারাপ লাগল এই ভেবে যে, এই মানুষটার সঙ্গে ওর এমন একটা পরিস্থিতিতে দেখা হল!

“এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে?” আইকা হি হি করে হাসল এবার।

“কী করছিস! উনি হয়তো এমব্যারাসড হচ্ছেন!”

মানুষটার গলাটা হালকা, নরম। নোঈ মুখ তুলে তাকাল। আর আবার কয়েক লক্ষ মাইল দূরের কিছুর টানে পৃথিবী নড়ে উঠল যেন। কী হচ্ছে এসব! নোঈ ধমক দিল নিজেকে।

আইকা বলল, “কেন, তোর ভাইয়ের সঙ্গেই তো বিয়ে হবে ওর, বললে লজ্জা কী!”

মানুষটা হাসল সামান্য। তারপর আইকাকে বলল, “আচ্ছা, তুই থাম,” তারপর নোঈর দিকে তাকিয়ে আলতো গলায় বলল, “সেদিন ভাল করে আলাপ হয়নি। তাই হয়তো আপনি আমার নামটা মিস করে গিয়েছেন। আমার নাম…”

নোঈ মুখ তুলল। দূরের মহাজাগতিক বস্তুটি নড়ছে। তরঙ্গ ভেসে আসছে শূন্যতা ভেদ করে। এ হতে পারে না। এমন অবিবেচক হতে পারে না নোঈ। প্রত্যেকটা শুরুর আগে একটা শুরু থাকে। যেমন থাকে, প্রত্যেকটা শেষের পরে আর-একটা শেষ। তাই সেই শুরুর আগের শুরুটা হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। নোঈ এতটা বোকা, সেন্টিমেন্টাল হতে পারে না। হতে পারে না আর সেইসব কিছু, যেগুলোকে ও নিজেই সারা জীবন হেয় করে এসেছে, ছোট করে এসেছে! ওই কম্পনকে ও সামলে দেবে রূঢ়তা দিয়ে। ভরিয়ে দেবে নিষ্ক্রিয় কিছু শব্দ দিয়ে।

মানুষটার কথা শেষ হওয়ার আগেই নোঈ তাই ঠান্ডা গলায় বলল, “আমি জানি। মনে আছে। আর আমি নোঈ, অ্যাজ় ইউ নো। আর শুনুন, দি জানে না। শি ইজ় মিসইন্টারপ্রেটিং মাই সাইলেন্স। অ্যাকচুয়ালি অল অফ দেম আর! কিন্তু আপনি ভুল কিছু ভেবে নেবেন না। আমি আপনার ভাইকে বিয়ে করছি না। বুঝলেন মিস্টার পুশকিন চক্রবর্তী?”

.

০৬.কাজু

গাছ থেকে পাতাটা ঘুরে-ঘুরে পড়ছে! নদীর দিক থেকে আসা হাওয়া পাতাটাকে আলতো করে ধরে নামিয়ে আনছে মাটির দিকে। বিকেলের রোদ নরম হয়ে আসছে এবার। শীতের ছোট বেলা গুটিয়ে নিচ্ছে পৃথিবী। মনখারাপ রঙের একটা আলো ধীরে-ধীরে নেমে আসছে সোনাঝুরির বুকে! আর কিছু পরেই চটকলে ভোঁ পড়বে। গঙ্গার পাড়ে নৌকোর আনাগোনা বেড়ে যাবে। জলে মেটে সিঁদুর গুলে দিয়ে সূর্য ধীরে-ধীরে তলিয়ে যাবে পাতালে!

এমন সময়টা বুকের ভেতর কেমন যেন করে কাজুর। মনে হয়, কত কিছু যে করার ছিল, কিন্তু কিছুই করা হল না। মনে হয়, হাজার বছর কেটে গিয়েছে, ও এখানেই এমন পাথরের মতো বসে রয়েছে। কত কবিতা লেখা বাকি রইল। কত দেশ দেখা বাকি রইল। কত মানুষের পাশে দাঁড়ানো বাকি রইল। কত কী বাকি রয়ে গেল। ওর বয়স ছাব্বিশ। বন্ধুরা বলে সারা জীবনটা পড়ে রয়েছে সামনে। কিন্তু কাজু জানে পড়ে নেই, সময় নেই ওর হাতে। কেন কে জানে ছোট থেকেই ওর কেবলই মনে হয় ওর সময় কম! যা করতে হবে, তাড়াতাড়ি করতে হবে। যা লিখতে হবে, তাড়াতাড়ি লিখতে হবে। যেখানে-যেখানে যেতে হবে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মনে হয় ওর জীবনও ওই শীতের ঝরে পড়া পাতার মতো। হাওয়ায় ভেসে ধীরে-ধীরে মাটির বুকে নেমে আসছে। একবার ভূমি স্পর্শ করলেই সব স্তব্ধ হয়ে যাবে। তাই এই ভেসে থাকার সময়টুকুই হাতে রয়েছে ওর। যা কিছু করার করে নিতে হবে এই সময়টার মধ্যেই।

ভাল করে গায়ের চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে বসল কাজু। গত রাত থেকে জ্বর এসেছে। ভেবেছিল ওষুধ না খেলেও কমে যাবে। কিন্তু কমছে না। বাবা বলেছে স্বপনডাক্তারকে যেন সন্ধেবেলা গিয়ে দেখিয়ে নেয়।

ডাক্তার দেখাতে বিরক্ত লাগে কাজুর। ওই স্বপন ডাক্তারকে দেখালেই একটা কাচের কর্ক আঁটা বোতলে লাল মিক্সচার দেয়। বোতলের গায়ে আবার কাগজের খাঁজকাঁটা দাগ দেওয়া। এক চামচ পেটে পড়লে মনে হয় ঊর্ধ্বতন দশ পুরুষের মুখ তেতো হয়ে গেল! কাজুর বিরক্ত লাগে।

তার চেয়ে মজুমদার-ডাক্তার ভাল। রোগা-পাতলা। প্রায় বুকের কাছে প্যান্ট পরে। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। একটা নড়বড়ে টেবিলে রাখা হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স, নরম আলোর হারিকেন আর মান্ধাতার আমলের চেয়ারে নিজে বসেন মানুষটা। পাশেই একটা লম্বা বেঞ্চ। রোগী এসে বসে সেখানে।

খুব একটা ভিড় হয় না মজুমদার-ডাক্তারের কাছে। কাজু যাতায়াতের পথে দেখে, মানুষটা একমনে বই পড়ছেন। কবিতার বই!

নয়না এই মজুমদার-ডাক্তারের মেয়ে। বাবার মতো মোটেই শান্তশিষ্ট নয়। বরং খুব দস্যি। নয়নাকে ভয় লাগে কাজুর। পেখমের প্রাণের বন্ধু নয়না। তাই পেখমকে বলতে পারে না যে, নয়না ওর দিকে অন্যভাবে তাকায়। একা দেখা হলেই অদ্ভুত সব কথা বলে। কথা বলতে-বলতে হাত ছোঁয়! হাসে। কাছে এগিয়ে আসে। ভয় লাগে কাজুর। খুব ভয় লাগে। পেখম যদি জানতে পারে! যদি ভুল বোঝে! পেখম ওর কাছ থেকে সরে গেলে ওর যে কী হবে!

নদী থেকে আসা হাওয়ায় শিরশির করে উঠল কাজুর শরীর। আস্তে আস্তে জুটমিল থেকে লোকজন বেরোচ্ছে। সাইকেল বাড়ছে সোনাঝুরির রাস্তায়। এই বড় বাড়িটার সামনের গেট ছুঁয়ে চটকলে যাওয়ার রাস্তা।

কাজু মাঝে মাঝে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে। বিশাল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি। চারটে বড়-বড় ব্লক। আসলে বাড়িটা বহু পুরনো। তখন মাত্র একটা ব্লক ছিল। সে সময় এখানে পর্তুগিজ সারেংরা থাকত। তাদের কাছ থেকেই পরে ব্রিটিশরা এই জায়গা কেনে। জুটমিল বানায়। বাড়িটার একটা ব্লক থেকে চারটে ব্লক করে। তারপর থাকতে শুরু করে। পরে বিশের দশকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই মিল, এই বাড়ি আর আশপাশের জায়গা কিনে নেয় মালিক গ্রুপ। তারপর থেকে তারাই এর অধিকর্তা।

প্রায় দেড়শো বছর বয়স বাড়িটার। এখন গাদাগাদি করে অনেকে থাকে। জুটমিলের বহু হিন্দিভাষী মানুষ থাকে এই বাড়িতে। আরও নানা মানুষজন থাকে। কাজুরাও অনেকে থাকে দুটো ঘর নিয়ে। সবাই মিলে হাঁসফাঁস করে দুটো কামরায়! তাই ছাদের ওপর প্রায় ভেঙে যাওয়া একটা ঘরে কাজু বেশির ভাগ সময় কাটায়। এমনকী, গরমকালে তো সেখানে ঘুমিয়েও পড়ে রাতে।

চারটে বাড়িই তিনতলা। কিন্তু পুরনো দিনের বাড়ি বলে সেটাকে ছ’তলা মনে হয়। ছাদটাও গড়ের মাঠের মতো। তবে সন্ধের পর বিশেষ কেউ যায় না। আর ওই চিলেকোঠায় তো কেউ যায়ই না।

কিন্তু আজ শরীর ভাল নেই, তাই ছাদে আর ওঠেনি কাজু। বরং এই বড় উঠোনটায় এসে বসেছে। আর দেখছে বিকেল কেমন শামুকের মতো এগিয়ে চলেছে আরও গাঢ় বিকেল ছুঁয়ে সন্ধের গুহায়!

কাজু দেখল, ওদের ওই বড় গেট পেরিয়েই মানুষজন আসছে ভেতরে।

“কা বাবুয়া, বুখার আভি উতরা নহি?” যাদবকাকা সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়াল।

সত্যনারায়ণ যাদব ছাপরার মানুষ। চটকলে ফোরম্যানের কাজ করে। ইউনিয়নের নেতাও। ওদের পার্টিরই লোক। প্রৌঢ় মানুষটি বড় ভালবাসে কাজুকে।

কাজু বলল, “না, কমেনি। যাব সন্ধেবেলা মজুমদার-ডাক্তারের কাছে!”

“ও দ্যাট ওল্ড হ্যাগ!” পাশের ইজ়িচেয়ার থেকে সিগারেটে বড় টান দিয়ে কথাগুলো বলল আন্টি বাডু।

যাদবকাকা ঠোঁট টিপে হেসে কাজুর দিকে চোখের ইশারা করল। কাজুও হাসল মুখ টিপে।

কাজুরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান। তবে বাবার দিকে থেকে ওরা বাঙালি হলেও ওর মা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। মায়ের দিকে আর কেউ বেঁচে নেই শুধু এই আন্টি ছাড়া। কাজুর মাকে ছোট থেকে এই আন্টিই মানুষ করেছিল নিজের কাছে রেখে। তাই এখন এই বৃদ্ধ বয়সে আন্টি থাকে ওদের কাছে। আসলে কোথাও যাওয়ার নেই মহিলার!

আন্টির মনটা ভাল হলেও মুখ খুব খড়খড়ে। কাজু এই নিয়ে কিছু বললেই বলে, “হবই তো রাফ! কোন সময় পার করে এসেছি জানিস? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোরা পল্টনদের ক্লাবে ওয়েট্রেস ছিলাম। যদি না মুখ চালাতাম তবে আমায় এখানে দেখতে পেতিস না! কোনও অন্ধকার গলিতে পচে-গলে মরতে হত! মুখের জোর ছিল বলে ওই ছ’বছর বয়সের বনি, মানে তোর মাকে নিয়ে বাঁচতে পেরেছি! অন্ধকার আর তোরা কী দেখলি!”

আন্টির বয়স এখন প্রায় পঁয়ষট্টি। সারাদিন খুটখুট করে সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করে আর মাঝে মাঝে বিকেলে এই ইজ়ি চেয়ারটায় বসে সিগারেট খায়! ওদের মফস্‌সলে মেয়েরা সিগারেট খায় না। তাই নতুন মানুষজন এখনও আন্টিকে ওইভাবে আধশোয়া হয়ে সিগারেট খেতে দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফিসফাস করে। হাওয়ায় ওড়া কথা কানে আসে কাজুর। শোনে, আন্টি নাকি অন্য ধরনের মহিলা!

গোটা ব্যাপারটায় হাসি পেলেও সমাজের মানুষজনের মানসিক অন্ধকারটা বোঝে কাজু! ওদের এই বাড়িতেই কয়েকটা ঘরে রাতের বেলায় অশান্তি হয়। রেল লাইনের পাশের ঝুপড়ি থেকে বাংলা মদ খেয়ে এসে হল্লা করে কেউ! কেউ আবার নিজের স্ত্রীকে পেটায়, অকথ্য গালিগালাজ করে! সেসব নিয়ে কিন্তু কারও মাথাব্যথা নেই! সবাই যে যার ঘরের খিল আটকে থাকে। কাজু কয়েকবার বলতে গিয়েছে বটে এই নিয়ে, কিন্তু বাবা-মা এখন কাজুকে যেতেও দেয় না! বাবা বলে, “তোর ওপর জগতের ভার নেই। সব সমস্যা মেটাতে তুই আসিসনি। তুই মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার নোস যে, ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ বলে বেরিয়ে পড়বি। চেপে বসে থাক।”

নিজের ঘরে বসে কাজুর একটা অসহায় রাগ হয়। মনে হয় কিছুই কি করার নেই ওর? কিছুই কি করতে পারে না?

আন্টি হাতের সিগারেটটা মাটিতে নিবিয়ে টোকা মেরে পাশের একটা জঞ্জাল রাখার জায়গায় ছুড়ে দিয়ে বলল, “তুই কেন যাবি ওই জোচ্চোরটার কাছে! ও ডাক্তার?”

কাজু হাসল, “আন্টি, তুমি এমন বলো কেন? কত ভাল লোক জানো? কবিতা পড়ে!”

“মাই ফুট, কবিতা পড়ে! তা হলে তোদের কফি হাউসে গিয়ে বনের মোষ তাড়াক! এখানে ওরকম ম্যাদামারা চেম্বার খোলার কী আছে!” আন্টি তার বড় শরীরটা নিয়ে কোনওক্রমে সোজা হল। ইজ়ি চেয়ারটাও প্রাণপণে ক্যাঁচকোচ শব্দ করে প্রতিবাদ জানাতে চাইল। কিন্তু আন্টি পাত্তা দিল না একটুও। বরং বলল, “দ্যাট ম্যান ইজ় নাথিং। বলে আমায় সিগারেট ছেড়ে দিতে। না হলে শ্বাসের কষ্ট কমবে না। তবে তোর ওষুধ খাব কেন রে মর্কট! সিগারেট ছাড়লে তো এমনিই ভাল থাকব। তোর ওষুধে জোর নেই তাই ছাড়তে বলিস। ওটার কাছে যাবি না কাজু!”

কাজু বলল, “কিন্তু আমার তো কমে!”

“মোটেই কমে না!” আন্টি এবার কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল, “ওটা প্লাসিবো এফেক্ট। মিছরির দানায় অ্যালকোহল ঢেলে রোগ কমাচ্ছে! তুই স্বপনডাক্তারের কাছে যা।’

আন্টি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলমল পায়ে কিছুটা বেসামাল হল। কাজু উঠে গিয়ে ধরল চট করে। আন্টি নিজেকে সামলাল। তারপর কাজুর হাতটা ধরে তাপ মাপল। কপালেও হাত চেপে দেখল কতটা গরম। তারপর বলল, “এ কী রে! জ্বর তো আছে! এই ঠান্ডা হাওয়ায় বসে কী করছিস? যা ঘরে যা।”

“আমি ঠিক আছি,” কাজু হাসল, “তুমি আস্তে আস্তে যাও। দোতলায় উঠতে পারবে, না আমি ধরব?”

আন্টি পাত্তা না দিয়ে তাকাল যাদবকাকার দিকে। তারপর বলল, “আর তুমি আবার পার্টি-পলিটিক্স খুলে বোসো না। ওকে রেস্ট নিতে দাও।”

যাদবকাকা হাসল। আন্টি বিরক্ত হয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল মূল বাড়ির দিকে।

কাজু আবার বসল বাঁধানো রকটায়। আজ কিচ্ছু ভাল লাগছে না। পেখমকে পড়াতে যাওয়াও নেই। ওরা থাকবে না। কলকাতায় যাবে সবাই মিলে। প্রথম-প্রথম ও গুটিয়ে থাকত, কিন্তু এখন পেখমকে না দেখলে মনখারাপ করে ওর। কেমন সব আবছা লাগে! বুকের ভেতরে যে কষ্টের একটা ছোট্ট চোরাকুঠুরি থাকে, প্রেমে না পড়লে বোধহয় মানুষ জানতে পারে না! কাজু ভাবে কুঠুরিটা থাকলেও কষ্ট, আবার না থাকলেও শূন্যতা। ভাবে, মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী। যা মনে করলে কষ্ট হয়, তাই সে বারবার মনে করে। গলায় কাঁটা ফুটলে যেমন বারবার ঢোঁক গিলতে চায়, ঠিক তেমন। কষ্টের তলায় কি সত্যি পূর্ণতার ফল্গুনদী বয়? কষ্ট পাওয়াটাকে কি আমরা সত্যি মহান কিছু হিসেবে দেখি? আমরা কি কষ্টের আগুনে পুড়ে নিজের ভিতরের খাদগুলো গলিয়ে ফেলতে চাই? বিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টা কি সকলের মনের অবচেতনে কাজ করে?

পেখমকে না দেখলে আজকাল কেমন একটা ভয়ও যেন গ্রাস করে ওকে। কাকিমা, মানে পেখমের মা ওকে পছন্দ করে না। প্রথম দিন থেকেই সেটা ও বোঝে। যদিও কাকু খুব ভাল মানুষ। পুলিশে চাকরি করেন বলে বাড়িতে বিশেষ থাকেন না। আর পেখমের ঠাকুরদা তো খুবই ভাল! এই মানুষটার জন্যই যে ও পেখমের কাছে যেতে পারছে, সেটা পেখমের থেকেই জেনেছে কাজু! কিন্তু ওই বাড়িতে ঢুকলেই ও বোঝে কোথায় যেন দুটো চোখ ওকে সারাক্ষণ লক্ষ রাখছে! খুব অস্বস্তি লাগে! তাই যতক্ষণ থাকে মাথা নিচু করে থাকে। নিজের মতো পড়িয়ে চলে আসে।

তবে পেখমের সঙ্গে ওর দেখা হয় সোনাঝুরির কোনও না-কোনও লুকোনো ভাঁজে। তাও সামান্য সময়ের জন্য। আর প্রতিদিন দেখা করে ফেরার পরে মনের ভিতর তৈরি হওয়া কুয়োটা যেন আরও গভীর হয়ে পড়ে! যেন কুয়োর ভিতর থেকে অতৃপ্ত আত্মারা সব দু’হাত তুলে জল প্রার্থনা করে! প্রতিদিন পেখমের কাছ থেকে সরে আসার সময় শরীরের আর মনের ভিতর কী যেন ছিঁড়ে পড়ে যায়! যন্ত্রণায় ছটফট করে কাজু! ভাবে, কবে পেখমকে সারা জীবনের মতো করে পাবে ও!

“সচমে বুখার ইতনা হ্যায়?” যাদবকাকা সামনে এসে কপালে হাত দিল এবার। তারপর বসে পড়ল পাশে, “আসলে তোর সঙ্গে কিছু কথা ছিল কাজু।”

কাজু সরে বসল একটু। যাদবকাকা সোজা মিল থেকে আসছে। শরীর থেকে ঝাঁজালো ঘামের নোনতা গন্ধের সঙ্গে খইনির গন্ধও আসছে। খারাপ গন্ধ সহ্য করতে পারে না কাজু। আর এখন তো শরীর খারাপ, তাই আরও গা গুলোচ্ছে!

যাদবকাকা এসব ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং আরও ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুই খবর জানিস?”

“কী?” কাজু যতটা সম্ভব কম শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল।

যাদবকাকা বলল, “রাশিয়া থেকে বিরাট অর্ডার পেয়েছি আমরা। প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকার অর্ডার। বুঝলি? কিন্তু সেখানে ইন্সপেকশন ক্লজ় আছে। লেট সাপ্লাইয়ের জন্য পেনাল্টি ক্লজ় আছে। অর্ডার পাওয়ার পর ম্যানেজমেন্ট আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিল। বলেছিল ঠিক সময়ের মধ্যে আমরা যদি মাল ডেলিভারি করে দিতে পারি ফাইভ পারসেন্ট করে ইনটেনসিভ দেবে।”

কাজু বলল, “ইনসেনটিভ!”

“ও একহি বাত হ্যায়,” কথাটাকে মাছির মতো হাত নেড়ে সরাল যাদবকাকা, “কিন্তু প্রোডাকশন ঝাড় খেয়েছে। মালিকের ছেলে দু’নম্বরি পাট দিয়ে বেশ কিছু মাল তৈরি করতে বলেছিল। সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফেঁসে! এখন মালিক বলছে আমাদের নাকি দোষ! বলছে পার্টি যদি টাকা কাটে, তবে আমাদের থেকে মালিকও কেটে নেবে। তার যুক্তি হল, লাভ হলে যদি ফাইভ পারসেন্ট বেশি টাকা আমরা নেব বলে মেনে নিই, তবে লোকসান হলেও তার দায়ের একটা অংশ আমাদের বইতে হবে। ব্যাটা মানছেই না যে, যা হয়েছে ওর লালচি ছেলের জন্য হয়েছে!”

কাজু শুনল চুপ করে। তারপর বলল, “গোপেনদা জানে?”

গোপেন শাসমল এই অঞ্চলের এমএলএ। তা ছাড়া এই জুটমিলটার ব্যাপার-স্যাপারগুলো গোপেনদাই দেখে। যদিও কাজুদের বিরোধী পার্টির লোক গোপেন, কিন্তু কাজুকে বিশেষ স্নেহ করে। মতবিরোধ থাকলেও কাজুর কথার গুরুত্ব দেয়!

“সেই জন্যই তো তোকে বলছি কাজু!” যাদবকাকা দু’হাত দিয়ে ধরল কাজুর হাত। বলল, “তুই একবার বল দাদাকে। আমরা ওর দুশমন তো! আমাদের মিলের ইউনিয়ন ওরা এখনও দখল করতে পারেনি। তাই খুন্নস আছে লোকটার। তুই একবার ওকে বল। তোকে তো অন্যভাবে দেখে। জানিস তো মালিকদের সঙ্গে ওর দহরম-মহরম খুব। ওরা ইউনিয়নে ক্ষমতায় না থাকলেও মালিক ওর কথা ফেলবে না।”

কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হাতটা ছাড়িয়ে নিল। যাদবকাকার হাতটা খরখরে বালি-কাগজের মতো। মুখটা তেতো লাগছে। মাথাটাও ব্যথা করছে বেশ। নদীর দিক থেকে আসা হাওয়ায় শীতটা যেন শিরদাঁড়াতেও অনুভব করতে পারছে। শরীরখারাপের মধ্যে আর এইসব ভাল লাগছে না। কিন্তু ও জানে ভাল না লাগলেও এটা ওকে করতে হবে। যেভাবেই হোক করতে হবে। অনেক মানুষের ন্যায্য পাওনা জড়িয়ে আছে এতে! মরালিটির প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। আসলে টাকা এসে গেলেই ও দেখেছে মরালিটিগুলো কেমন যেন পেছনের দিকে চলে যায়, ভিড়ে হারিয়ে যায়। মানুষ মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলে এই রুপোর ঝনৎকারের সামনে! তাই ভাল না লাগলেও এই নিয়ে গোপেনের সঙ্গে কথা বলতে হবে ওকে। আজ না হলেও দু’-এক দিনের মধ্যেই বলতে হবে। কাজু জানে এতে হয়তো সোনাঝুরিতে ওদের পার্টির মাথা বিমলদা রাগ করবে, কিন্তু বিমলদা এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারবে না। মালিকপক্ষের সঙ্গে বিমলদার সম্পর্কটা আদায়-কাঁচকলায়। যাদবকাকা ঠিকই বলেছে, গোপেনদার দল এখনও ইউনিয়নের দখল নিতে না পারলেও গোপেনদার সঙ্গে মালিকের খাতির খুব! তাই ও জানে, কিছু করতে পারলে গোপেনই পারবে। কাজু বোঝে সব বিষয়ে মাথা গরম করলে হয় না। কিছু জিনিস বুদ্ধি করেও বের করতে হয়।

“আরে, তুই শুনছিস কি?” যাদবকাকা বলল, “জানি, তোর কষ্ট হচ্ছে শরীর খারাপ নিয়ে এসব শুনতে। কিন্তু আজই এই নিয়ে একদফা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। তু জরা দেখ কাজু। ঝামেলা হতে পারে বড়। যদি মাল ইন্সপেকশনে আটকে যায়, বা সেখানে বেরিয়ে গেলেও ডেলিভারির পরে যদি বেশির ভাগ মাল ফেঁসে যায়, তা হলে পার্টি শেষ টোয়েন্টি পারসেন্ট টাকা আটকে দেবে! মালিকরা তো লাভ বের করে নিয়েছে! কিন্তু ওই আটকে যাওয়া টাকার ছুতোয় আমাদের মাইনে আটকে যাবে। বিশাল অসুবিধে হয়ে যাবে। বাবু তু জরা দেখ।”

কাজু তাকাল সামনের দিকে। আলো নরম হয়ে এসেছে। হাওয়ার ভেতরের শীতটাও বাড়ল যেন। ও যাদবকাকার মুখের দিকে তাকাল। লোকটাকে কেমন ভাঙাচোরা লাগছে আজকে। সারাদিন কাজের পর এখন এইসব নিয়ে ভাবছে। না নিজের জন্য শুধু নয়, সকলের জন্য। মালিকের ছেলেটি গন্ডগোলের। সবাই জানে। মালিক নিজেও জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না!

গায়ের চাদরটা ভাল করে আবার জড়িয়ে নিল কাজু। তারপর ধীর গলায় বলল, “আমি দেখব যাদবকাকা। তুমি চিন্তা কোরো না। লক আউট করব বললেই তো করা যায় না। আমি কথা বলব গোপেনকাকার সঙ্গে। আজ সন্ধেবেলা যাব মজুমদার-ডাক্তারের কাছে। ফেরার পথে গোপেনকাকার বাড়ি হয়ে আসব। দেখি, কী বলেন কাকা। কেমন?”

যাদবকাকা উঠল। পকেট থেকে খয়েরি রঙের একটা রুমাল বের করে মুখটা মুছল। তারপর হাসল, “আরে, সুস্থ হয়ে যা আগে। পহলে বুখার তো উতর যায়ে! তারপর দেখিস। আজ যেতে হবে না।”

কাজু নিজেও উঠল। ঘরে যাবে। আর বসবে না। সন্ধে হয়ে যাবে একটু পরে। মশা আসতে শুরু করেছে। এখনই কয়েকটা কানের কাছে পিনপিন করছে। যাদবকাকার মাথার উপর মুকুটের মতো ঘন হয়ে এসেছে কয়েকটা। ও দেখল যাদবকাকা বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে।

বাড়ির চারটে ব্লকের সাউথ ব্লকে থাকে যাদবকাকা। তিন তলায়। আর নর্থ ব্লকের দোতলায় থাকে কাজুরা। তবে এটাকে যদি থাকা বলে!

আগেকার দিনের বাড়ি। কড়িবরগা দেওয়া সিলিং উঁচু হলেও ঘরগুলো খুব একটা বড় নয়। ইয়া মোটা মোটা দেওয়াল। তবে ড্যাম্প ধরা। ঘরে ঢোকার দরজাগুলো বেশ ছোট। ঘরে কুলুঙ্গি আছে দুটো। ইলেকট্রিকের কানেকশান আছে। তবে মরা মানুষের চোখের মতো টিমটিম করে বাল্‌ব। একটা ডিসি পাখা ওই সিলিং থেকে লম্বা রড দিয়ে ঝুলে থাকে। চৌকো বাক্সের মতো রেগুলেটরের খটখটে সুইচ দিয়ে তাকে যতই তাড়া লাগাও না কেন, সে কিছুতেই তার গদাইলশকরি চাল ছেড়ে এগোয় না। এখন শীত তাই রক্ষে। গরমকালে, রাতে এত জনের সঙ্গে এই ঘরটায় শোওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়। কাচের ভাঙা স্কাইলাইটটাও সব গরম হাওয়া বের করতে পারে না। বইয়ে পড়া গ্যাস চেম্বারের কথা মনে পড়ে কাজুর। তাই সেই গরমের রাতগুলোর বেশির ভাগ সময়টা ও চিলেকোঠার ওই আধাখেঁচড়া ঘরটায় ঘুমোয়।

জ্বরটা আছে। গায়ে-হাত-পায়ে বেশ ব্যথাও রয়েছে। বিশেষ করে ঘাড়টা বেশ ব্যথা। সাড়ে ছ’টার আগে মজুমদার-ডাক্তার বসে না। কাজু ভাবল, সতু থাকলে সাইকেল করে নিয়ে যেত। কিন্তু ব্যাটা সেই যে নর্থ বেঙ্গল গিয়েছে তো গিয়েছেই! পার্টির কাজেই গিয়েছে। কবে আসবে কে জানে!

দু’বার চিঠি লিখেছিল কাজু। উত্তর পায়নি। বিমলদা বলেছে, ওখানে লোকজনকে একত্রিত করতে উদয়াস্ত খাটতে হচ্ছে সতুকে। তাই সময় পাচ্ছে না।

সতু ডাকাবুকো ছেলে। ভয়ডর বলে কিছু নেই। ওই চা-বাগানের মতো জায়গায় মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে সংগঠন তৈরি করার কাজ রীতিমতো কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ! তাও সতু নিজেই আগ বাড়িয়ে নিয়েছে কাজটা। কেন কে জানে সতুর মধ্যে একটা মারদাঙ্গা মনোভাব আছে। ও কথায়-কথায় বলে এভাবে ন্যাকা-ন্যাকা ভাবে কিছু হবে না। বাস্তিলের পতনও ন্যাকা ন্যাকা কথায় হয়নি, জারদের উৎখাত করাও ন্যাকা ন্যাকা কথায় হয়নি। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া নাকি এই পচে যাওয়া, নর্দমার মতো পৃথিবীটার মুক্তির উপায় নেই। চারিদিকে পাঁক জমে সবটাই নাকি স্তব্ধ আর নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছে। একে খুঁচিয়ে দূর না করতে পারলে হবে না!

হিংসার পথ ভাল লাগে না কাজুর। মানুষ মারতে হবে সমাজ বাঁচাতে গেলে! মানুষ ছাড়া সমাজ হয় নাকি? খারাপ লোকদের প্রান্তিক মানুষে পরিণত করতে হবে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের মাধ্যমে। মানুষের মনে সুচিন্তার বীজ বুনতে হবে শিক্ষার মাধ্যমে। তা হলে মানুষ নিজেই আবর্জনাদের সরিয়ে দেবে, গুরুত্বহীন করে দেবে। তার জন্য রক্তারক্তি করার কোনও দরকার পড়বে না।

সতু প্রাণের বন্ধু কাজুর। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে দু’জনের মতের মিল হয় না। তবে সতু সেটা নিয়ে কখনও মাথাগরম করে না। বরং বলে, “তুই বুঝবি একদিন। আমার কথার গুরুত্ব বুঝবি। তুই যা বলছিস সেটা থিয়োরি! আসল ক্ষেত্রে কিন্তু এমন সহজ নয় ব্যাপারটা। মানুষকে নিয়ে কাজ। তাদের ইচ্ছে, লোভ, সেয়ানাগিরি, ধান্দাবাজি, ভয়, ইনসিকিয়রিটি, কপটতা, বোকামো এগুলোকে কনসিডার করতে হবে না? এই ফ্যাক্টরগুলোই থিয়রি আর প্র্যাকটিক্যাল পৃথিবীর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়! তবে এটা জানবি, মানুষ কিন্তু তৈরি হচ্ছে তলায়-তলায়। বিপ্লবের দিন ঘনিয়ে আসছে ভাই!”

“কাজুদা,” পিছন থেকে পরিচিত গলার ডাক পেয়ে থমকে গেল কাজু। গলাটা বিজনের। চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে। কিন্তু এখনই পার্টির কাজে ঢুকে পড়েছে! এটা ভাল লাগে না কাজুর। আগে একটু লেখাপড়া করুক, তারপর না হয় ঢুকবে! কিন্তু বিমলদা সেটা মানে না। বলে, “আরে, নতুন অবস্থাতেই ধরতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে আসল ব্যাপারটা কী! এই বয়সে ডেডিকেশান, মরালিটি, ফোর্সফুলনেস বেশি থাকে। করাপ্ট হওয়ার আগেই ওদের বোঝাতে হবে জীবনটা আসলে কী! দেশ ও দশের উন্নতি কীসে হবে!”

ফোর্সফুলনেস জিনিসটা কী, কাজু জানে না। বিমলদার কথার পিঠে কী বলবে বুঝতেও পারে না। বিমলদা কারও কথা শোনার মানুষই নয়! তবে ব্যক্তিগতভাবে বিজনকে সময় পেলেই বোঝায় কাজু। বলে লেখাপড়াটা মন দিয়ে করতে। এসবের জন্য তো সারা জীবন পড়ে রয়েছে! কাজু বোঝে বিজন খুব ভালবাসে ওকে। লোকজন আড়ালে বিজনকে ওর চামচা বলেও ডাকে। কিন্তু সেসব ও পাত্তা দেয় না! বড় বাড়ির ছেলে বিজন। টাকাপয়সার অভাব নেই। কিন্তু এই উঠতি বয়সেও কত সাধারণভাবে থাকে। এসব ছেলে নিজের জন্য আসেনি পৃথিবীতে, কাজু বোঝে। তাই ও চায় আরও পড়ুক ছেলেটা। আরও জানুক। বাকিদের শক্ত মাটিতে তুলতে হলে আগে নিজেকে শক্ত মাটিতে দাঁড় করাক।

কাজু পেছন ফিরল। আর সঙ্গে-সঙ্গে থমকে গেল একটু। বিজনের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে নয়না। চোয়াল শক্ত করল কাজু। মেয়েটা আজও এসেছে! আজকাল ওর আসা যেন বেড়ে গিয়েছে খুব! কথাটা ঘুরিয়ে ও একবার বলেছিল পেখমকে। পেখম পাত্তা দেয়নি। বলেছিল, “ও পাগলি। তা ছাড়া আমায় তো মা যেতে দেয় না তোমার কাছে। লুকিয়ে দেখা করি কী কষ্ট করে জানোই তো! ওই তো তোমার খবর এনে দেয় আমায়। ও আমার সবচেয়ে ভাল বান্ধবী। আসলে বোনই বলতে পারো।”

পেখমের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কাজু! এত বিশ্বাস আর ভালবাসা অন্যের জন্য যার থাকে সে মানুষটা যে কতটা ভাল, কতটা এই পৃথিবীর জন্য প্রয়োজনীয়, সেটা পেখম নিজেই জানে না। নয়না যে সহজ মন নিয়ে আসে না কাজুর কাছে সেটা কিছুতেই স্পষ্টভাবে পেখমকে বলতে পারে না কাজু। ও জানে কিছুতেই কাজুর এই কথাটা বিশ্বাস করবে না পেখম।

কাজু থমকাল একটু। তারপর পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল ওদের দিকে। শাড়ির ওপর একটা পঞ্চো পরে রয়েছে নয়না। টানটান করে বাঁধা চুল। কপালের একপাশে চাঁদের আকারের ছোট্ট একটা কাটা দাগ। ধারালো ছুরির মতো মুখ নয়নার। চিনেমাটির প্লেটের মতো চকচকে মুখের চামড়া। খাঁজ কাটা ওপরের ঠোঁটে চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস!

কাজু সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, নয়নার হাতে একটা কাচের বয়াম।

“তোমার জ্বর কি বাড়ল কাজুদা?” বিজন ছটফটে গলায় জিজ্ঞেস করল।

কাজু বলল, “ওই আর কী। তা তোরা?”

বিজন কিছু বলার আগেই নয়না বলল, “তোমার জ্বর হয়েছে আমায় বিজন বলল। আমায় তো খবর পাঠাতে পারতে একটা!”

কাজু বলল, “এটা কোনও বলার মতো খবর! সোনাঝুরিতে কত লোকের জ্বর হয়, তোকে সবটা সবাই জানাবে?”

নয়নার চোখের দৃষ্টি কড়া হল। ও রাগের গলায় বলল, “সবাই আর তুমি এক? এই বোঝো? আর বাবার কাছে যাওনি কেন?”

কাজু ঢোঁক গিলল সামান্য। নয়নাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। ও বলল, “তোর হাতে কী?”

নয়নার মুখটা সামান্য নরম হল যেন। ও গম্ভীর গলায় বলল, “আমার আজ জন্মদিন। তাই এতে বাড়িতে তৈরি পিঠে আছে। তোমার জন্য মা পাঠাল।”

কাজু হেসে ফেলল, “গত দু’সপ্তাহ আগেও তো তোর জন্মদিন ছিল! আজ আবার জন্মদিন! ভাল তো বেশ!”

নয়না ভুরু কুঁচকে বলল, “তাতে তোমার কী?” তারপর বিজনের দিকে কাচের বয়ামটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কাকিমার হাতে দিয়ে আয় একছুটে। যা।”

বিজন বয়ামটা নিয়ে দৌড়ে গেল।

নয়না তাকাল কাজুর দিকে। কাজুর শিরদাঁড়া দিয়ে কেমন যেন এক ফোঁটা বিদ্যুৎ গড়িয়ে গেল। কাছে না এসেও একটা মেয়ে এমন করে শুধুমাত্র তাকিয়ে কাছে চলে আসতে পারে!

নয়না বলল, “তোমার জন্য আমার রোজ-রোজ জন্মদিন হতে পারে কাজুদা।”

“এসব কী বলছিস?” কাজু চোয়াল শক্ত করল। আজ মেয়েটা এমন খোলাখুলি বলছে কেন? এমন করে পুরো ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলছে কেন?

নয়না বলল, “কেন, কানে শুনতে পাচ্ছ না কী বলছি? এতদিন যা চুপচাপ বোঝাতে চেয়েছি, সেটা তো আর বোঝোনি! এবার তাই স্পষ্ট করে বলছি।”

“এমন বলিস না নয়না। তুই তো জানিস সবটা।”

“কী জানি আমি?” নয়না ফোঁস করে উঠল, “পেখম সুন্দরী, কিন্তু আমিও কি সুন্দরী নই! ও তোমার জন্য সব ছাড়তে পারবে ভেবেছ? ওর মাকে দেখেছ? লেডি হিটলার। তোমায় ঘেন্না করে। মায়ের বিরুদ্ধে যাবে ভেবেছ ও? কোনওদিন না। আর সেখানে আমি সব পারি তোমার জন্য। সব।”

কাজুর বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছে। এসব কেন বলছে নয়না? সুন্দর ব্যাপারটাকে কেন এমন নষ্ট করে দিচ্ছে? ও কি জানে না যে, পেখম ছাড়া আর কেউ কাজুর মনে থাকতে পারে না! পেখম ছাড়া ওর জীবন শূন্য! তা হলে এসব কেন বলছে?

কাজু অসহায়ভাবে তাকাল নয়নার দিকে। কী করে বোঝায় ও মেয়েটাকে!

নয়না বড়-বড় চোখগুলো স্থিরভাবে জ্বেলে রেখেছে কাজুর চোখের সামনে।

কাজু বলল, “প্লিজ় নয়না। এমন করিস না।”

“আমায় ‘তুমি’ করে বলো না কেন কাজুদা?” নয়না চোয়াল শক্ত করল, “আমি কি মেয়ে নই?”

“নয়না, নয়না… তোকে আমি কী করে বোঝাই…” কাজু মাথা নাড়ল।

নয়না বলল, “আমার দিদির সঙ্গে তো তোমার আলাপ আছে কাজুদা। আমার চেয়ে কত বছরের বড় জানো তো! পাঁচ বছরের। আমি যখন সাত বছরের ছিলাম, ওর একটা সুন্দর পুতুল ছিল। আমারও ওটা ভাল লাগত। কিন্তু ওটা আমায় ধরতে দিত না ও। জানো, আমি কী করেছিলাম? আমি…”

“শোন,” কাজু মাঝপথে থামিয়ে দিল নয়নাকে, বলল, “আমি কিন্তু পুতুল নই। মানুষ কিন্তু পুতুল নয়।”

হাসল নয়না। অবজ্ঞার হাসি। তারপর বলল, “এত পড়ে এই জানলে! কাজুদা, আমরা সবাই পুতুল। শুধু নিজেরা বুঝি না। একদিন তুমিও বুঝতে পারবে। একদিন ওই গল্পের শেষটা তোমায় শোনাব। কেমন?”

.

০৭. রাধিয়া

কেরদানি দেখানোটা যে বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে, সেটা এখন খুব বুঝতে পারছে রাধিয়া। মধুদাকে গাড়ি দিয়ে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়াটা যে কী ভীষণ ভুল হয়ে গিয়েছে! এখন কী করবে? চারিদিকে এখন চৈত্র-সেলের ভিড়। মানুষের মাথা মানুষে খাচ্ছে! তার মধ্যে কী করে খুঁজে পাবে ও কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িটা? বাসন্তী দেবী কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে চারিদিকে ফুল স্টপের মতো ছড়ানো মানুষের মাথাগুলোর দিকে টেন্‌সড হয়ে তাকিয়ে রইল রাধিয়া।

মোবাইলটার কি এখনই বন্ধ হওয়ার ছিল! আর কপাল এমন যে, পাওয়ার ব্যাঙ্কটাও আনেনি সঙ্গে করে। কী করবে এখন ও! পলি, জয়তী, বুদা আর রাখি তো বলেইছিল ওদের সঙ্গে যেতে, কিন্তু কী যে মাথায় ভুত চাপল রাধিয়ার? নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করছে ওর! শুনেছে ফার্ন রোড দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে যেন কাঁকুলিয়া রোড যাওয়া যায়। কিন্তু কোথা দিয়ে যাওয়া যায় সেটা ঠিক জানে না।

সুম্পার জন্মদিন আজ। ইউনিভার্সিটির বন্ধু সুম্পা। খুব ঘনিষ্ঠ কিছু নয়। তবে বন্ধু। তাই নেমন্তন্ন করছে। আগে তো আসেনি। তাই কীভাবে যাবে জানতে চাইলে সুম্পা বলেছিল, “তোকে বলে লাভ আছে? গড়িয়াহাট ক্রস করে বিজন সেতুর দিকে এগোলে দেখবি ফার্ন রোডের সিগনাল পড়বে। ওখানে এসে ফোন করবি আমায়। আমি তোদের মধুদাকে বলে দেব! নানা রাস্তায় ওয়ান ওয়ে থাকে। মধুদা বুঝতে পারবে।”

সবই ঠিক ছিল। কিন্তু আজ দিনটাই এমন যে, কী আর বলবে!

ইউনিভার্সিটি বন্ধ আজ। তাই কোথাও যাওয়ার ছিল না সকালে। মা তো বলেছিল এখানেও আসতে হবে না। কিন্তু মায়ের কথা শোনেনি রাধিয়া। মায়ের তো সবকিছুতেই আপত্তি। ওর ইউনিভার্সিটিতে আপত্তি। বন্ধুদের নিয়ে আপত্তি। ওর নিজেকে সাধারণভাবে রাখা নিয়ে আপত্তি। আর কত কিছু শুনবে!

তা ছাড়া আলিপুর থেকে বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছের কাঁকুলিয়া রোড কী আর এমন দূর!

মা তবু জেদ করেছিল। বলেছিল, “বাবা জানলে কিন্তু রাগ করবে! এমন করিস না রাধি।”

“কেন রাগ করবে?” রাধিয়া তর্ক ছাড়েনি, “সেই যে আমি লোকাল ট্রেনে করে সোনাঝুরি গেলাম, তাতে বাবা রাগ করল? তুমিই তো রাগ করছিলে! বাবা মোটেও রাগ করে না। তুমিই শুধু বাবার নামে মিথ্যে মিথ্যে রাগ করার কথা বলো!”

“আমি মিথ্যে বলি?” মা খুব রেগে গিয়েছিল, “আসুক তোর বাবা। আমি বলব তার মেয়ের গুণপনা! ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এই শিখছে! তখনই বলেছিলাম ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিতে। এখানে জংলিদের সঙ্গে থেকে থেকে সব ম্যানার্স নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের স্টেটাসের একটা ফ্যামিলিকে দেখা, যে এভাবে তোর মতো থাকে! তোর বাবা কী নিয়ে এত ব্যস্ত কে জানে যে, এইদিকে নজর দেয় না! মেয়েটা কি আমার একার!”

মা এই বলে, বাবাকে ওর নামে বলবে। এই বলে, বাবা সময় দেয় না। মা যে কী চায়! ওদের বিশাল বড় ব্যাবসা। সেদিকে বাবার সময় না দিলে চলবে? বাবা অনেক সময় নানা টুরে যায়। সেটা তো ব্যাবসার জন্যই না কি? শুধু তো আর সোনাঝুরির জুটমিল নয়, ওদের কাপড়ের ব্যাবসা আছে। রাইস মিল আছে। ফুড প্রোডাক্টের ব্যাবসা আছে। এখন বাবা একটা অন্য ব্যাবসা শুরু করবে। এত কিছু যে-মানুষটা করে, তার কি অন্যদিকে মন দেওয়ার সময় আছে? মা এত তলিয়ে ভাবে না।

রাধিয়া ঘড়ি দেখে বলেছিল, “তুমি আমার ওপর রাগ করে টাইম নষ্ট করছ কেন? তোমায় না পার্লারে যেতে হবে!”

“অ্যাঁ!” মা এবার চমকে উঠে তাকিয়েছিল রাধিয়ার দিকে, “তাই তো! বুজু তো গাড়িটা এখনও বের করল না! কী যে করে না!”

হাসি পেয়ে গিয়েছিল রাধিয়ার। বুজু হল মায়ের রাইটহ্যান্ড। মায়ের সব কাজ বুজু করে দেয়। এমনকী, মায়ের গাড়িটাও বুজুই চালায়। সবাই একটু থমকে যায় বটে মহিলা গাড়িচালক দেখে। কিন্তু বুজুর মজা লাগে! বলে, “জানো রাধি, আমার যা মজা লাগে না! সব বাড়ির ড্রাইভাররা তো পুরুষ। তাই আমায় দেখে সবাই চমকে যায়!”

তবে রাধিয়ার মনে হয় ঠিকই আছে। বুজুর গাড়ি চালানোর হাত খুব ভাল। ওদের চারটে গাড়ি। একটা বাবা চড়ে অফিস যায়। একটা ও ব্যবহার করে। এই এসইউভিটা মা নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে আর একটা ছোট হ্যাচব্যাক আছে সেটা বাড়ির জন্য!

রাধিয়া মায়ের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে বলেছিল, “যাও দ্যাখো, কী হল।”

মা নিজেকে সামলে নিয়েছিল দ্রুত। বাদামি চুলগুলো সামলাতে-সামলাতে বলেছিল, “কথা ঘোরাচ্ছিস! আজকাল কী হচ্ছে তোর! যত্তসব আজেবাজে জায়গায় যাওয়া! আমাদের সঙ্গে ক্লাবে যাওয়ার বেলায় তো আগ্রহ দেখি না! কার মতো হয়েছিস তুই?”

রাধিয়া প্রায় বলে ফেলছিল কার মতো। কিন্তু তারপর সামলে নিয়েছিল নিজেকে। বলেছিল, “বাবা, ঠাকুমা আমায় কিছু বলে না। কিন্তু তুমি এমন করো কেন?”

মা তাকিয়েছিল রাধিয়ার দিকে। তারপর বলেছিল, “কারণ, আমি তোর মা বলে। তোর জন্য চিন্তা হয় না আমার!”

“কীসের চিন্তা মা!” রাধিয়া অবাক হয়েছিল।

“কীসের চিন্তা বুঝিস না! আগে মা হ, তারপর বুঝবি!” মায়ের চোখে জল এসে গিয়েছিল আচমকা।

“মা,” রাধিয়া এসে মায়ের হাতটা ধরেছিল, “কী যে করো না তুমি! এই রাগছ! এই কাঁদছ! কীভাবে এত মুড শিফট হয় তোমার? কোনও মানে আছে এর?”

“ছাড়!” মা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সাবধানে চোখের জলটা চেপে-চেপে মুছেছিল। রাধিয়া দেখেছিল মায়ের বড়, সুন্দর চোখদুটো ছলছল করছে। তবে যত্ন করে করা মেকআপ একটুও নষ্ট হয়নি।

মায়ের বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও দশ বছর কম মনে হয়। রাধিয়ার বান্ধবীরা বলে, “তোর মা বলে কিন্তু বিশ্বাসই হয় না!”

কথাটা ঠিক। কিন্তু বাবাকে সেই তুলনায় বুড়ো লাগে বেশ। যদিও বাবা-মায়ের বয়সের তেমন খুব একটা তফাত নেই।

মা বলে, “প্রথম থেকেই তোর বাবা অমন বুড়োটে। সারাক্ষণ খালি ব্যাবসা আর ব্যাবসা! বাড়ির বাইরে থাকতে পারলেই যেন বেঁচে যায়!”

রাধিয়ার হাসি পায়। মা এমন করে বলে যেন কত অনিচ্ছের সঙ্গে মা বিয়ে করেছিল বাবাকে!

“মা, কী কথা হচ্ছিল আর তুমি কোনদিকে নিয়ে গেলে কথাটা! এর কোনও মানে আছে? আমি যাবই সুম্পার জন্মদিনে… যাবই, ব্যস!” রাধিয়া রাগের গলায় বলেছিল এবার।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়েছিল রাধিয়ার দিকে। তারপর বলেছিল, “ঠিক আছে মধুদাকে নিয়ে যাবি। আর বেশি দেরি করবি না। আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরবি। কেমন?”

মধুদা বাড়ির সবচেয়ে পুরনো ড্রাইভার। বাবার কথায় সবচেয়ে বিশ্বস্ত। তাই বাবা মধুদার ওপর ভার দিয়েছে রাধিয়াকে সব জায়গায় নিয়ে আসা, নিয়ে যাওয়া করার জন্য।

এই বাড়িতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হয়ে গেল মধুদার। একরকম এই বাড়ির লোকের মতোই হয়ে গিয়েছে। গাড়ি চালানো ছাড়াও নানারকম কাজকর্ম করে দেয়। বিশেষ করে ঠাকুরমার সমস্ত কেনাকাটা মধুদাই করে।

বুজু এসে পড়েছিল এরপর। মা বলেছিল, “মধুদাকে ডেকে দে তো। আমি যাওয়ার আগে বলে যাব, রাধিয়াকে যেন ঠিক সময়ে ফিরিয়ে আনে। ওর কোনও কথা যেন না শোনে।”

“মধুদা?” বুজু সামান্য থমকেছিল। ঠোঁট চেটে কী যেন একটা বলবে বলে ইতস্তত করছিল।

“হ্যাঁ। নামটা প্রথম শুনলি?” মা বিরক্ত হয়েছিল এবার।

মায়ের মাথা একটু গরম। চট করে রেগে ওঠে। বুজু খুব ভাল করে জানে সেটা। তাই মায়ের রেগে ওঠায় বুজু আর-একটু থমকে গিয়েছিল।

“কী হল, বল।”

বুজু বলেছিল, “আসলে শুনলাম মধুদার বউয়ের শরীরটা ভাল নেই। আজ বিকেলে ডাক্তার দেখানোর কথা। আজ রাধির কলেজ নেই তো, তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। তাই… মানে…”

“তোকে আমায় মানে বোঝাতে বলেছি!” মা আচমকা চেঁচিয়ে উঠেছিল, “সবাই এখানে কাজ করতে এসেছে না অজুহাত দিতে এসেছে! ডাক মধুদাকে। আমি কথা বলছি।”

বুজু মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল।

“মা, আরে আমি বাচ্চা নাকি! ওলা ধরে চলে যাব। নো প্রবলেম। কেন মধুদাকে ডাকছ!”

মা তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর বলেছিল, “ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি। বাড়িটা আমায় চালাতে হয়। এদের আমায় সামলাতে হয়। মধুদা পুরনো লোক হতে পারে। কিন্তু চাকরি করে। একটা মাইনে পায়। তার এই সময়টা আমরা কিনেছি। বউকে নিয়ে ডাক্তার কবে দেখাবে সেটা ওর বলা উচিত ছিল। নিজের খুশিমতো এমনটা ও করতে পারে না। সেটা ওকে বলে দেওয়া দরকার।”

ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে আবার মাথার ওপরের সুইচটা টিপল রাধিয়া। নাঃ। সেই কালো স্ক্রিন! চোয়াল শক্ত করল রাধিয়া। আজ দিনটাই কেমন যেন। তার ওপর রাসবিহারীর দিকটায় আকাশটা কালো হয়ে এসেছে। প্রথম এপ্রিলের সাংঘাতিক গরম ভেদ করে তবে কি এবার বৃষ্টি আসবে? শহর কি শেষ চৈত্রে এসে প্রথম মাথা পেতে নেবে কালবৈশাখীকে!

রাধিয়া অসহায়ের মতো একবার আকাশ আর একবার সামনে ছড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়টাকে দেখল। এই কি ব্যূহ! এটা ভেদ করে ও যাবে কী করে?

বিকেল সাড়ে পাঁচটার গড়িয়াহাটা মানে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটা। তার মধ্যে সব দোকানদার ‘সেল’ ঝুলিয়ে ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে কার জিনিসপত্র কত সস্তা। কে কত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে। এর মধ্যে কীভাবে সুম্পার বাড়ি পৌঁছবে ও! এর চেয়ে মাঝসমুদ্রে রবারের ডিঙিতে ভাসাও বোধহয় ভাল ছিল।

রাধিয়া ভাবল মধুদার কথা শুনলেই ভাল হত। মধুদা তো বলেছিল ওর অসুবিধে হবে না। মধুদার বউ না হয় ডাক্তারের চেম্বারে একটু অপেক্ষা করবে।

কিন্তু রাধিয়ার একটুও ভাল লাগছিল না। আসলে মা এমন বিচ্ছিরিভাবে মধুদাকে বকাবকি করেছিল যে, রাধিয়ার কেমন যেন অপরাধবোধ হচ্ছিল একটা।

এটা হয় রাধিয়ার। কেউ কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে, ওর নিজের কেমন একটা অপরাধবোধহয়। রাধিয়া কিছু বলেইনি। ও কোনওভাবে হয়তো সেই ঘটনাতে যুক্তও নয়। তবু ওর মনের ভেতরটা কেমন করে! কেমন যে করে সেটা ঠিক নিজের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে করে কিছু একটা। বকুনি খাওয়া, মনখারাপ করে, ম্লান মুখে চলে যাওয়া মানুষগুলোর মন, কিছু একটা করে ভাল করার চেষ্টা করে রাধিয়া। পলি বলে, “বড্ড বাড়াবাড়ি করিস তুই রাধি।”

তা হবেও-বা বাড়াবাড়ি। কিন্তু রাধিয়া কী করবে! ওর তো এমনটাই মনে হয়। জোর করে কিছু করবে কী করে ও!

গাড়িতে উঠে সামনের আয়নায় মধুদার মুখটা অর্ধেক দেখতে পাচ্ছিল রাধিয়া। কেমন একটা ঘষা কাচের মতো চোখ। লম্বাটে ঝুলে পড়া মুখ। কাঁচা-পাকা ভুরুগুলো কেমন যেন কষ্টে কুঁকড়ে গিয়েছে।

আলিপুর জেলের সামনেটা পেরোনোর সময় রাধিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, “ক’টায় শিখামাসির ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট মধুদা?”

“শিখার?” মধুদা মুখ না ফিরিয়েই ক্লান্ত গলায় বলেছিল, “সোয়া ছ’টা।”

“কোথায়?”

“ওই প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ওখানে একটা পলিক্লিনিকে। কেন গো রাধিদিদি?”

রাধিয়া গাড়ির ড্যাশবোর্ডে লাগানো ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলেছিল, “তুমি আমায় রাসবিহারীতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যাও। তারপর সব কাজ মিটিয়ে আমায় আবার পিক আপ করে নেবে কাঁকুলিয়া থেকে।”

“সে কী!” এবার মধুদা একটু সময়ের জন্য পেছনে ফিরে তাকিয়েছিল। তারপর আবার সামনে তাকিয়ে বলেছিল, “এ হয় না রাধিদিদি। ম্যাডাম জানলে রাগ করবে।”

“আরে দূর, জানলে তো করবে!” রাধিয়া এগিয়ে বসে বলেছিল, “মধুদা, আমি যা বলছি শোনো। আমায় নামাও। আমি ঠিক চলে যাব। তুমি কাজ সেরে আবার এসো। কেউ জানতে পারবে না।”

মধুদা বলেছিল, “তুমি চেপে বোসো দেখি। আমি পরে শিখাকে নিয়ে যাব।”

“আঃ,” রাধিয়া বলেছিল, “তোমরা কেউ আমার কথা শোনো না কেন? আমি কি বাচ্চা আছি নাকি এখনও? আমি মোটেও খুকি নই। রাস্তাঘাটে ভিড় বাস বা অটো দেখে মোটেও ভয় পাই না আমি।”

মোবাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে আতঙ্ক নিয়ে রাস্তায় উপচে পড়া বাস আর হেলে পড়া গাড়ির মধ্যে দিয়ে মাথা নিচু করে ছোটা অটোগুলোকে দেখল রাধিয়া! এগুলোয় উঠবে কী করে ও! ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছে রাধিয়ার। ও বুঝল যে, আসলে আমরা অনেক কথাই তাৎক্ষণিকভাবে বলে ফেলি। অনেক কথাই বলি নিজেদের মাপ আর ধারণক্ষমতা না বুঝে। কিছুটা আবেগ আর কিছুটা নিজের মনের মধ্যে অবচেতনায় বহন করা নায়ক বা নায়িকার প্রোজেকশনের পাল্লায় পড়ে আমরা এমন কাজ করে ফেলি। যাতে, পরে নিজেরই মনে হয় এমনটা না করলেই ভাল হত!

মধুদা রাসবিহারীতে ছাড়েনি ওকে। কিন্তু রাধিয়ার দেওয়া চাপে বাসন্তী দেবী কলেজের সামনে ওকে ছেড়ে মধুদা গাড়িটা ডান দিকে টার্ন করে বেরিয়ে গিয়েছে সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের দিকে। বলে গিয়েছে, আটটার মধ্যে ঠিক পৌঁছে যাবে কাঁকুলিয়া রোডে।

কলেজটার সামনের দেওয়াল ঘেঁষে শাড়ির দোকান। উলটোদিকে সার দিয়ে বসে রয়েছে মেহেন্দি এঁকে দেওয়ার ছেলেরা। তবে শুধু ছেলে নয়, কিছু মেয়েকেও দেখল রাধিয়া। তারা কাস্টমারদের হাতে মেহেন্দি পরাচ্ছে।

ভিড়ের চাপে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না ও। কলেজের পাশেই ছোটখাটো একটা মল। সেখান থেকেও গলগল করে মানুষ বেরোচ্ছে!

এ কী বেকায়দায় পড়ল রাধিয়া! এখন ও কী করবে! মোবাইলটা বন্ধ। আর সত্যি বলতে কী সুম্পার নম্বরটাও মুখস্থ নেই। এই হয়েছে এক বিপদ। এখন মোবাইলে সব নাম লেখা থাকে বলে কারও নম্বর মুখস্থ থাকে না। দরকার পড়ে না তো!

“দিদি, পরবেন নাকি? ও দিদি?”

একটা তীক্ষ্ণ মেয়েলি গলার ডাকে সামনে তাকাল রাধিয়া। লাল কুর্তি আর জিন্‌স পরে একটা মেয়ে বসে রয়েছে সামনের মেহেন্দি স্টলটায়। মেয়েটার বয়স ওরই মতো। চোয়াল নড়ছে মেয়েটার। বোঝা যাচ্ছে পানমশলা খাচ্ছে। খয়েরি রঙের চুলগুলো গোছা করে বাঁধা। ওর স্টলের সামনে চারটে সিট। চারটেই ভরতি।

রাধিয়া বলল, “কী বলছেন?”

মেয়েটা খরখরে গলায় বলল, “মেহেন্দি পরবেন?”

“আমি? না তো!” রাধিয়া মাথা নাড়ল।

“তো, বেকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বিজ়নেসের সময়! সরে যান! তখন থেকে জ্যাম করে রেখেছেন সামনেটা!” মেয়েটা ঝাঁজিয়ে উঠল।

রাধিয়া কী বলবে বুঝতে পারল না। ভালমানুষি দেখিয়ে মধুদাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই তো নিজের বিপদ ডেকে এনেছে। সেই সোনাঝুরিতে একা লোকাল ট্রেনে করে যাওয়ার যে-অ্যাডভেঞ্চার ছিল, সেটার তুলনায় এই ভিড় ও মানুষের স্রোত ভেঙে কাঁকুলিয়া রোড পৌঁছনো অনেক কঠিন।

“কী হল? কথা কানে যাচ্ছে না!” মেয়েটা এবার বেশ রেগে উঠল, “দোকানের সামনে থেকে সরুন। এভাবে দাঁড়ালে আমাদের অসুবিধে হচ্ছে!”

রাধিয়া ঘাবড়ে গেল এবার। মেয়েটার গলার তীক্ষ্ণতা বড্ড বেশি। আশপাশের সবাই মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে। সকলের চোখেই বিরক্তি। আসলে সকলেই আজকাল সবসময় বিরক্ত হয়ে থাকে। সকলেই খুব ব্যস্ত। সকলের কার সঙ্গে যেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কারা যেন সকলের জন্য অপেক্ষা করে আছে। সকলেই যেন এক মঞ্চ থেকে নেমে আর-এক মঞ্চে উঠবে। সকলেই সেলেব্রিটি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সকলের পাঁচশো বন্ধু। সকলের ছবিতে শ’য়ে-শ’য়ে লাইক। সকলেই অটোগ্রাফ দেবে বলে উদ্‌গ্রীব, কিন্তু অটোগ্রাফ নেওয়ার লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সকলেই বিরক্ত। যেমন এই মেয়েটি।

রাধিয়া দ্বিধা নিয়ে বলল, “আমি কাঁকুলিয়া রোড যাব কী করে বলতে পারেন?”

মেয়েটা হয়তো আরও খারাপ কিছু বলত এবার, কিন্তু রাধিয়ার কথার ভঙ্গি আর গলার স্বর দেখে থমকে গেল। বুঝল কিছু একটা। তারপর বলল, “এ তো কাছেই। আপনাকে সামনে যেতে হবে। রাস্তায় নেমে দাঁড়ান। একটা অটো ধরুন। গড়িয়াহাটার অটো নয়, বালিগঞ্জের অটো ধরবেন। তারপর ফার্ন রোডের মোড়ে নেমে কাউকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। ভেতর দিয়ে হেঁটে কাছেই। বুঝলেন?”

“থ্যাঙ্ক ইউ,” রাধিয়া নরম করে বলল।

তারপর ব্যাগটাকে সামলে মেহেন্দি পরানোর দুটো স্টলের মাঝখানের জায়গা দিয়ে রাস্তায় নামল। যেতে যখন হবেই তখন সত্যি এরকম ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে তো আর লাভ নেই।

রাস্তায় লোক গিজগিজ করছে। পুজোর আগেও এমন অবস্থা হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কী, রাধিয়া এভাবে ফুটপাথে ঘুরে-ঘুরে বাজার করে না। তাই এই ভিড়টা ওকে ঠেলতে হয় না!

রাধিয়া ডান দিকে তাকাল। বাস, ট্রাম, গাড়ি সব ধেয়ে আসছে। কিন্তু সব ক’টাই তো ভরতি। তবে? রাধিয়া কিছু ভাবার আগেই আচমকা চিৎকার শুনল একটা। খোনা গলা। পুরুষের। সকলের মতো রাধিয়াও চমকে পেছনে তাকাল।

একটা লোক। বেঁটে। কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল। ছাই রঙের হাফহাতা শার্ট আর গোড়ালির ওপর অবধি গোটানো একটা আধময়লা প্যান্ট। কাঁধে পেটমোটা একটা ঝোলা। লোকটার গায়ের রং পুড়ে ইটের মতো হয়ে গিয়েছে। গাল দুটো তোবড়ানো। থুতনিতে সাত দিনের না-কাটা কাঁচাপাকা দাড়ি। শুধু লোকটার বড় কালো চোখ দুটো উজ্জ্বল! লোকটা একটু লেংচে হাঁটছে। তার মধ্যেও মুখে হাসি আর হাতে-ধরা গোছা পাতলা চটি বই। লোকটা বইগুলো হাতপাখার মতো করে নাড়াচ্ছে!

রাধিয়া দেখল লোকটাকে। তারপর শুনল, লোকটা চেঁচিয়ে বলছে, “মানুষ ফুরিয়ে যায় আর থেকে যায় তার কথা। তার নিজের কথা, তার মনের ভেতর জমা হওয়া কথা। ইতিহাস সাক্ষী আছে, মানুষ লিখতে পছন্দ করে। স্টোন ট্যাবলেট, মাটির ট্যাবলেট, মোমের ট্যাবলেট থেকে শুরু করে নীল নদের পাশে পাওয়া প্যাপিরাস ছুঁয়ে, পার্চমেন্ট স্পর্শ করে আধুনিক কাগজ হয়ে এখন ইলেকট্রনিক ট্যাবলেটে মানুষ লিখে যাচ্ছে ক্রমাগত! সারা জীবন ধরে লিখেই যাচ্ছে সে! সেই আদিম ট্যাবলেটকে জড়ো করে রাখা থেকে প্যাপিরাসকে গুটিয়ে স্ক্রোল বানানো থেকে মানুষ চিরকাল চেয়েছে তার নিজের কথাকে যত্ন করে ধরে রাখতে! হেরোডোটাস বলেছেন, ফোনেশিয়ানরা এই প্যাপিরাস আর লেখার প্রক্রিয়া নিয়ে এসেছিল প্রাচীন গ্রিসে। সেই তার জয়যাত্রার সূচনা। প্যাপিরাস হয়ে কাঠের পাতলা ‘ব্যাম্বু বুক’ হয়ে আমাদের তালপাতার পুঁথি ছুঁয়ে, গুটেনবার্গের ছাপাখানা অবধি পৌঁছে এ জিনিস মানুষের সভ্যতা ও তার উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। এ সেই জিনিস, যা মানুষকে বাড়তে দিয়েছে, জানতে দিয়েছে, ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছে! সেই জিনিস, যে মানুষের একলা সময়ের বন্ধু। দূর সফরের সঙ্গী। পালা-পার্বণে উপহার। প্রেমপত্র বহন করার মাধ্যম। সাজিয়ে রাখার অহংকার। সেই জিনিস, যা প্রাচীনকাল থেকে প্রতিটি বিজ্ঞানী আর দার্শনিকের মনের আলো। সেই জিনিস, যা এখনকার পৃথিবীতে আমাদের রোজকার সঙ্গী। আমি আজ এই সেলের বাজারে মানুষের উপকারের জন্য আবার একবার নিয়ে এসেছি তাকে। কমপিউটারের যুগে যা আজও অপরিহার্য। আমাদের সংস্কৃতির যা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি নিয়ে এসেছি সেই জিনিস যা ওল্ড ইংলিশে ‘বক’, স্লাভিক ভাষায় ‘বাকভা’, চিনেভাষায় ‘শু’, আরবিতে ‘কিতাব’, আরমেনিয়ানে ‘গির্ক’, ফরাসিতে ‘লিভ্রা’, স্পেনীয় ভাষায় ‘লিব্রো’ আর আমাদের মাতৃভাষায় বই। সুধীজন, বেজুবান, কদরদান ও ফ্যান অফ শাহরুখ খান। নিয়ে যান, নিয়ে যান, নিয়ে যান। বাচ্চাদের গ্রামার শেখানোর, ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলার জন্য এই সেলের বাজারে আমার বই। শুধু গায়ের পোশাক নয়, নিয়ে যান মনের আশ্রয়। আমার এই চারটে বই একসঙ্গে মাত্র কুড়ি টাকায়। স্পেশ্যাল অফার। কুড়িয়ে নিন কুড়িকে। আর নিজেকে অংশ করে তুলুন মহান হেরোডোটাস থেকে কোপারনিকাস হয়ে ইবনবতুতা, শেক্সপিয়র, মিলটন, কিটস, নিউটন, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, জয়েস, মিলার হয়ে এখনকার হকিং, কামু আর পামুকের। গর্ববোধ করুন তাদের সঙ্গে আপনার মিল থাকার বিন্দুর। গর্ববোধ করুন যে, আপনিও এই সব মহান মানুষের মতোই বই হাতে তুলে নিয়েছেন। আর তাই সেই সু্যোগ হাতছাড়া না করে, নিয়ে নিন আমার আনা স্পেশ্যাল শিক্ষার মাধ্যম। চারটে বই। একসঙ্গে মাত্র কুড়ি! কুড়ি টাকা! খরচা কম, চর্চা বেশি। কাকা কথা হবে না!”

রাধিয়া হাঁ হয়ে গেল। একটানা কথাগুলো বলে লোকটা থমকাল একটু। হাঁপাচ্ছে! রাধিয়া দেখল আশপাশের ভিড়টা কেমন যেন থমকে গিয়েছিল এই সময়টায়। তারপর লোকটা থামতেই কেমন চটরপটর হাততালি আর হাসির ছররা উঠল চারিদিকে। লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করল। তারপর উপস্থিত সকলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল বই বিক্রি করার জন্য।

রাধিয়া এরকম কাউকে কখনও দেখেনি। এভাবে যে কেউ বই বিক্রি করতে পারে ভাবতেও পারেনি। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। বেঁটে, সামান্য-খুঁড়িয়ে-হাঁটা একটা মানুষ। গায়ে ময়লা জামাকাপড়। কাঁধে ঝোলা। হাতে একগোছা বই। বোঝা যাচ্ছে যে, ঝোলাটা বইতে কষ্ট হচ্ছে। তবু হাসিমুখে লোকটা যাচ্ছে সকলের কাছে। অধিকাংশই কিনছে না। কিন্তু লোকটার মুখের হাসিটা অমলিন। এমন করেও বেঁচে থাকে লোকে! এই মিনিটদশেক এখানে দাঁড়িয়েই কত কিছু যেন শিখে গেল রাধিয়া! ‘হ্যাপি প্রিন্স’-এর মতো বাবার ছোটবেলার পরি যেন আজ এই সময়টুকুতেই কিছুটা স্বাদ পেল আসল পৃথিবীর। এই মানুষটারও তো বাড়িতে বউ আছে নিশ্চয়। ছেলেমেয়ে? তাও আছে। তাদের ইচ্ছে, আহ্লাদ আর আনন্দগুলো লোকটা এই সামান্য বই বিক্রি করে মেটাতে পারে। এই চারদিকে উপচে পড়া পণ্যের ভেতরে এইসব মানুষগুলো কীভাবে এমন শান্ত মুখে থাকে! এদের লোভ নেই? ইচ্ছে নেই? এদের বাচ্চাদের জীবনে সেল বা পুজোয় নতুন জামা নেই?

“দাদা,” রাধিয়া লোকটাকে ডাকল।

লোকটা সামান্য খুঁড়িয়ে এগিয়ে এল ওর দিকে।

“আমায় একটা সেট দিন!”

লোকটা ভুরু তুলল। তারপর হেসে বলল, “শিয়োর ম্যাডাম।”

কাঁধে ঝোলানো নীল তাপ্পিমারা ঝোলার ভেতর থেকে বের করে আনল একটা প্লাস্টিক। তারপর তাতে ভরে দিল বইগুলো, “এই যে ম্যাডাম।”

রাধিয়া একটা একশো টাকার নোট দিল লোকটাকে।

লোকটা বলল, “এই রে! খুচরো নেই?”

রাধিয়া বলল, “না তো!”

“আচ্ছা, দাঁড়ান, দেখি ওরা দিতে পারে কি না!” লোকটা ফুটপাথের ধারে এগিয়ে গেল মেহেন্দির দোকানের দিকে।

রাধিয়া পিছিয়ে এল দু’পা। তারপর রাস্তার দিকে তাকাল। একটা অটো এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। পেছনের সিট থেকে নামল দু’জন। কালো, রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া চুলোগুলো হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। অটোচালকটি চিৎকার করছে, “বালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ।”

রাধিয়া দ্রুত এগোল। একজন মোটামতো ভদ্রমহিলাকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল অটোর ভেতরে। ভদ্রমহিলা রাগতস্বরে কিছু একটা বললেন। কিন্তু রাধিয়া পাত্তা দিল না। ও বসামাত্রই ওর পাশে এসে বসে পড়ল একজন বয়স্ক লোক। গাড়ি ভরতি। অটোচালকটি আর দেরি না করে ছেড়ে দিল গাড়ি।

“ম্যাডাম…”

চারদিকের চিৎকার, গাড়ির হর্ন আর অটোর আওয়াজের মধ্যে আবছাভাবে “দিদি!” ডাকটা শুনতে পেল রাধিয়া। ও হাসল শুধু। তারপর সামনের অটোচালকটিকে বলল, “ভাই ফার্ন রোডে নামব। ভাড়া কত?”

ভাড়া বলে অটোচালকটি বলল, “ভাড়া হাতে রাখুন, দিদি…” তারপর সামনের সিটে ওর পাশে বসে থাকা লম্বাচওড়া ছেলেটাকে বলল, “তুই মাইরি নকশা করেই গেলি! দ্যাখ, রিতুদা আমায় অটো কিনে দিল। পারমিট নেই, তাও দাবড়ে বিজ়নেস করছি। কারও বাপ শালা কিছু করতে পারবে না। জানিস তো আমি এটা ভাড়ায় দিই, আবার কখনও-কখনও নিজেও চালাই! মাল্লু আসে কাকা! সেখানে তোকে এত করে বলল, তুই দু’-একদিন গিয়ে আবার বসে গেলি। মাইরি, রিতুদা খচে গেলে কিন্তু বিলা কেস হয়ে যাবে। একটু বোঝ মাহির!”

রাধিয়া দেখল বড়সড় চেহারার ছেলেটা কিছু বলল না। বরং চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

গাড়িটা এসে গড়িয়াহাটার সিগনালে দাঁড়িয়েছে। চালকটি পেছনে ফিরে সকলের কাছ থেকে ভাড়া নিল। তারপর যাকে যার মতো খুচরো ফেরত দিয়ে আবার বড় চেহারার ছেলেটার দিকে তাকাল, “তুই মাইরি ক্যালানে না শয়তান, কে জানে! রিতুদা কালকেও বলল আমায়। বলল, ওকে নিয়ে আয়, কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশনে চান্স করিয়ে দেব। আর তুই…”

“ফার্স্ট ডিভিশনে!” এবার ছেলেটা ঘুরে তাকাল।

সামনে সিগনাল খুলে গিয়েছে! গাড়িটা স্টার্ট করে চালকটি বলল, “তবে তোকে কী বলছি! চল ভাই। আর কতদিন তোদের পতাদার ভুঁড়ি দেখে দিন কাটাবি! চল।”

“ফার্স্ট ডিভিশনে! সত্যি!”

“শালা, আমি কি ঢপ দিচ্ছি? আর রিতুদা কি ঢপ দেয়? চল আজকেই। দাদা হেব্বি খুশি হবে।”

রাধিয়ার ইচ্ছে করছে না এসব শুনতে। বরং ফার্ন রোডে নেমে কীভাবে কাঁকুলিয়া রোডে যাবে সেই নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় আছে!

অটোটাও বাস আর গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফুটপাথের লোক উপচে এসে পড়েছে রাস্তায়। মানুষজন প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে গাড়ির ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা পার হচ্ছে! রাধিয়ার বাঁ দিকের লোকটি বড্ড ঘেঁষে বসেছে রাধিয়ার দিকে। লোকটার শরীর থেকে নোনতা একটা গন্ধ হাওয়ার সঙ্গে এসে ঢুকছে। ওঃ, গা গুলোচ্ছে রাধিয়ার।

“দিদি, ফার্ন রোড,” লাল সিগন্যালের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে অটোটা দাঁড় করাল চালকটি।

রাধিয়া পাশের লোকটিকে বলল, “এক্সকিউজ় মি।”

লোকটা তাকাল রাধিয়ার দিকে। তারপর নেমে দাঁড়াল রাস্তায়। রাধিয়া নিজেকে যতটা পারল সংকুচিত করে নেমে পড়ল। কিন্তু তাও লোকটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নোনতা গন্ধটা আবার নাকে এল। ইস! রাধিয়া বাজে গন্ধ একদম নিতে পারে না। ও কোনওমতে নিজেকে সামলে দাঁড়াল ফুটপাথ ঘেঁষে।

“রাধি!” আচমকা চিৎকারে রাধিয়া চমকে পেছনে তাকাল। আরে, এই তো বুদা আর পলি! ওঃ! প্রচণ্ড ভিড়, গরম আর ঘিঞ্জি কলকাতা ভিজিয়ে যেন বৃষ্টি নামাল রাধিয়ার মনে!

পলি আর বুদা এসে দাঁড়াল ওর সামনে।

“তুই, অটোয়! কোক কি পেপসির ক্যানে বিক্রি হচ্ছে নাকি রে?”

রাধিয়া কিছু না বলে হাসল।

পলি হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু রাধিয়ার পেছনে কাউকে দেখে যেন থমকে গেল। রাধিয়া পেছনে ফিরল। অটোটা সিগনালে দাঁড়িয়ে। পলি তাকিয়ে রয়েছে অটোর সামনের সিটে বসা ছেলেটার দিকে। ছেলেটাও তাকিয়ে দেখছে পলিকে। ছেলেটার মুখে একটা হাসি আসবে কি আসবে না ধরনের দ্বন্দ্ব নিয়ে লুকোচুরি খেলছে।

পলি কিন্তু হাসছে না। রাধিয়া অবাক হল। ছেলেটা এবার হাসল, কিন্তু হাসিটা সম্পূর্ণ হল না। কারণ, সিগনাল পেয়ে অটোটা দ্রুত ছিটকে বেরিয়ে গেল সামনে!

রাধিয়া তাকাল পলির দিকে, “তুই ছেলেটাকে চিনিস?”

পলি নাক টানল। তারপর বলল, “চিনি মানে দু’বার কথা হয়েছে। প্রতাপাদিত্য রোডে রিতুদা বলে এক পার্টি নেতার কাছে গেছি তো কয়েকবার। ওই আমাদের ‘ব্রোঞ্জ ইয়ারস’-এর জন্য একটা বাড়ির তদবির করতে। সেখানে দু’-তিনবার দেখা হয়েছে। তবে বেশি না। জাস্ট কয়েকটা সেনটেন্স। তাও লাস্ট কয়েকবার দেখিনি।”

বুদা বলল, “দেখে তো ভাল বাড়ির মনে হয় না!”

রাধিয়া বলল, “আবার শুরু করলি! মানুষকে ওভাবে চেনা যায়? কী মেয়ে রে তুই! আবার রাজনীতি করিস!”

বুদা হাসল, “তুই শালা এত ফেদার-টাচ টাইপ কেন বল তো? দেখে যা মনে হল বললাম। কী বল পলি?”

পলি রুমাল দিয়ে চেপে ঠোঁটটা মুছল। তারপর কী মনে পড়ায় ডানদিকে হাত দিয়ে ব্লাউজ়ের পাশ দিয়ে হালকা উঁকি দেওয়া ব্রেসিয়ারের স্ট্র্যাপটা ব্লাউজ়ের ভেতরে গুঁজে দিয়ে নিজের মনে সামান্য হাসল। তারপর বলল, “চল তাড়াতাড়ি। সুম্পা রাগ করবে! বাকিরা বোধহয় এসে গেল।”

রাধিয়া বলল, “অনেকটা নাকি রে? মানে অনেকটা হাঁটতে হবে?”

বুদা বলল, “তা তো একটু হবে রূপাঞ্জেল! টাওয়ারে থাকতে-থাকতে তোমার অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছে সোনা। তবে তুই পারবি। এই সেলের ভিড়ের গড়িয়াহাট ঠেলে যখন অটোয় চড়ে এসেছিস, তখন এটুকু হাঁটা তো নস্যি জানেমন!”

রাস্তাটা পার হয়ে ফার্ন রোডে ঢুকল ওরা। রাস্তার ওপর সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গোলপার্কের দিক থেকে আসছে অধিকাংশ গাড়ি। ফুটপাথের ওপরে হকার বসে আর লোকজন থাকতে শুরু করায় এমনিতেই তো হাঁটার জায়গা আর নেই কলকাতায়। তারপর রাস্তাজোড়া গাড়ি! রাধিয়া বারবার পিছিয়ে পড়ছে। ডান দিকে বাঁ দিকে জামা-কাপড়ের দোকানের সঙ্গে রংচটা সোনার দোকান, পুরনো বইয়ের দোকান, স্টেশনারি দোকান। পলি আর বুদা কিছুটা এগিয়ে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ছে আর এগিয়ে আসতে বলছে রাধিয়াকে।

রাধিয়ার অসহায় লাগছে খুব। এত দোকানপাটের মধ্যে ফুটপাথে হাঁটার সরু জায়গা। তার মধ্যে কলকাতার লোকজনের তো বেশ একটা গদাইলশকরি চাল আছেই! তাই তাদের রাস্তা জুড়ে ‘একদিন ঠিক পৌঁছব’ ধরনের হাঁটা ঠেলে এগোতে পারছে না ও।

ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার দেখে বুদা পিছিয়ে এসে হাত ধরল রাধিয়ার। বলল, “শালা, এমন করে হাঁটলে সুম্পার নেক্সট ইয়ার বার্থডে-তে পৌঁছব। ধাক্কা মেরে, খিস্তি করে পথ বের করতে হয় এখানে। এরা সব দুর্যোধন। বিনা রণে সূচ্যগ্র মেদিনীও দেবে না, বুঝলি?”

বলেই রাধিয়ার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে নিয়ে আশপাশের লোকজনকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে, গুঁতিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর গলির আরও ভেতরে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় গিয়ে শ্বাস নিল ওরা।

বুদা হাতটা ছেড়ে বলল, “রাধিয়া, তুই বিদেশে বিয়ে করে চলে যাস। এখানে থাকিস না। নির্ঘাত মারা পড়বি!”

পলি বলল, “দেশটার কী অবস্থা বল তো! কেউ কোনও নিয়ম মানে না। পুলিশ প্রশাসনের লোকজনের কি চোখ নেই?”

বুদা হাসল, “খোঁকি শ্বশুরবাড়ি যাবিস-এর সময় নেই খেন্তিপিসি! সকলের চোখ আছে। তার চেয়েও বেশি আছে মাথা। তুই ভোট দিস? এরা দেয়। এরাই রিয়েল পাওয়ার। এদের চটালে চট নিয়ে বসতে হবে রাস্তায়, সেটা নেতারা জানে। তাই ‘লুটেপুটে যা খুশি করো’-র লাইসেন্স এদের দেওয়া হয়েছে। তুই নালিশ করতে গেলে বলবে, একটু অ্যাডজাস্ট করে নিন না! নিজের জীবনে বেহায়াপনাটা জাস্ট অ্যাড করে নিতে পারলে আর এখন বাঁচতে অসুবিধে হবে না। ফলে কানে তুলো, পিঠে কুলো। বুঝলে খুকুমণি!”

রাধিয়া দেখল, কথাগুলো হাসতে-হাসতে বললেও বুদার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বুদা ইউনিভার্সিটিতে প্রথমদিকে পলিটিক্স করত। এখন আর করে না। কিন্তু একটু র‍্যাডিকাল পলিটিক্সে ওর আগ্রহ আছে। সেটা মাঝে মাঝে কথায় ফুটে বেরোয়।

পলি বলল, “এটা একটা দিক। কিন্তু গরিব মানুষগুলোর কথা ভাববি না? এরা যাবে কোথায়?”

“স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন গেল, কলকাতা কতটুকু বাড়ল রে! আর-একটা সিটি তৈরি হল না কেন, যে কিছুটা এই শহরের ভার নিতে পারবে! রাজারহাটের কথা বলবি না, ওটা এখনও কিছুই করতে পারেনি। শালা হেরিটেজ নষ্ট করে, সারা শহরটায় গিজগিজে লোক বসিয়ে, মোচ্ছব আর পুজো করে গোটা সমাজটা ভোগে গেল! আর সব সেই ভোগ খাবে বলে পাতা হাতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সব সমান! শালা…” দু’ অক্ষরেই থেমে গেল বুদা।

রাধিয়া বুঝল কারণটা। সুম্পাদের বাড়ি এসে গিয়েছে!

বাড়িটা দেখেই ভাল লেগে গেল রাধিয়ার। বেশ পুরনো। আগেকার সেই লাল ইটের তৈরি। আর্চ বসানো, রংবেরঙের কাচের জানলা-দরজা। সামনে একটু বাগান। ছাদে ছোট-ছোট কয়েকটা মূর্তিও দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। বাড়ি মাথায় লেখা আছে ‘বসু ভিলা’।

রাধিয়া দেখল লোহার গেটের ওপরটা একটা তারজালির আর্চ করা আছে। আর তাতে লতিয়ে উঠে একটা ফ্রেমের মতো করে আছে বোগেনভেলিয়া গাছ। তাতে গোলাপি কাগজফুল হাওয়ায় নড়ছে। আকাশের দিকে তাকাল রাধিয়া। রাসবিহারীর দিকের মেঘটা কাঁকুলিয়া অবধি ঢেকে ফেলেছে! হাওয়া দিচ্ছে বেশ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঠান্ডা শিরশিরে ভাব একটা। বোঝা যাচ্ছে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে নিশ্চিত। গরমে ক্লান্ত আর বিরক্ত শহরকে কিছুটা স্বস্তি দিতে আসছে কালবৈশাখী।

বেল বাজাতে হল না। দরজাটা খোলাই ছিল। দরজার গোড়ায় জুতোর সাম্রাজ্য দেখে রাধিয়া বুঝল বেশ কিছু মানুষজন ইতিমধ্যেই এসে পড়েছে। ওর একটু অস্বস্তি হল। সুম্পার সঙ্গেই ওর যা জানাশোনা। ওদের বাড়ির আর কাউকেই তো ও চেনে না!

দরজা দিয়ে ঢুকেই লম্বা টানা বারান্দা। সেখানে জুতো খুলতে-খুলতেই সুম্পা বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ঝিলমিল করে বলে উঠল, “কী রে! তোদের কাণ্ডজ্ঞান নেই? এখন ক’টা বাজে! আসতে বলেছিলাম সেই চারটের সময়! দেখ তো, কত লোকে এসে গিয়েছে! জয়তী আর রাখি তো এখনও এল না। কী যে করিস না তোরা! দেখ, কত গান আর কবিতা হয়ে গেল এর মধ্যে! রাধিয়া, তুই গান গাইবি বলেছিলি। চল।”

রাধিয়া জুতো খুলে ঠিকমতো দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই সুম্পা ওকে হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল।

ঘরটা বড়। না রাধিয়ার বাড়ির তুলনায় নয়, কিন্তু বড়ই। উঁচু সিলিং। বড় তিনটে সোফা ঘরটার কিছুটা ভরে রেখেছে। রাধিয়া দেখল, অন্যান্য আসবাব পেছনে সরিয়ে মেঝেতেই বেশ সাদা ফরাস পেতে দেওয়া হয়েছে। রাধিয়া সকলের দিকে তাকাল। সকলের বয়সই ওর মতো। কিন্তু তার মধ্যেই চোখ আটকে গেল একজনের ওপর। আরে নিশান!

ডিমের কুসুম রঙের পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছে নিশান। রাধিয়ার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মুখে মিটিমিটি হাসি।

রাধিয়া অপ্রস্তুত হল একটু। কেন হল সেটা নিজেই বুঝতে পারল না। সেদিন সোনাঝুরি স্টেশনে এই ছেলেটা নিতে এসেছিল ওকে। তারপর স্টেশন থেকে একটা রিকশায় উঠিয়ে রিকশার পেছন-পেছন ফলসাদের বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েছিল! না, তেমন কথা বলেনি ওর সঙ্গে। শুধু ফলসাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় হেসেছিল একটু। সামান্য হাওয়ায় নিশানের গা থেকে গন্ধ ভেসে এসেছিল খানিক। কী সুন্দর মিষ্টি কর্পূরের গন্ধ! কী পারফিউম ওটা! না, রাধিয়া জিজ্ঞেস করতে পারেনি। ও শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছিল, ফলসাদের বাড়ির সামনের আধো-আলো আধো-অন্ধকার রাস্তা ধরে একটা সাইকেল মিলিয়ে যাচ্ছে আবছা ঝিমঝিম অন্ধকারে।

তারপর কয়েকদিন কখনও সন্ধেবেলা, আবার কখনও রাত্রিবেলা, আচমকাই হাওয়ার সঙ্গে মিশে, হাওয়ায় ভেসে-ভেসে ওর কাছে ফিরে আসছিল গন্ধটা। আর রাধিয়া যেন দেখতে পাচ্ছিল, একটা সাইকেল আধো অন্ধকারে ডুবে, ভেসে মিলিয়ে যাচ্ছে কোথায়! শুধু ছোট্ট প্রজাপতির মতো হাওয়ায় উড়ছে আলতো হলুদ একটা পাঞ্জাবি!

সেদিনের পরে নিশানকে আজ এই দেখল ও। কী বলবে এখন রাধিয়া! প্রায় জনাপঁচিশেক ছেলেমেয়ের মধ্যে পেছনের দিকে বসে রয়েছে নিশান। সোজা তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। ও কেন তাকাচ্ছে অমন করে! আর রাধিয়ারই-বা ওর দিকে কেন বারবার চোখ পড়ে যাচ্ছে!

সুম্পা রাধিয়ার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ফরাসের একদিকে রেখে, সামনে তাকিয়ে বলল, “দিস ইজ় রাধিয়া, পলি অ্যান্ড বুদা…” তারপর হেসে ভিড়ের দিকে হাত দেখিয়ে রাধিয়াদের বলল, “আর শোন, দিস ইজ় এভরিবডি।”

পলি রাধিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “সুম্পার দাদা বিখ্যাত আঁতেল, জানিস তো! এরা বোধহয় ওর সেই কবি-সাহিত্যিক বন্ধুরা।”

“কী রে ফিসফিস করছিস?” সুম্পা পলিকে সামান্য ধাক্কা দিল। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাধিয়া খুব ভাল গান গায়। এখন ও গান গেয়ে শোনাবে। আমায় বলেছিল, আজ ও গান গাইবে।”

“গান?” রাধিয়া একটু চমকে গেল, “আমি কবে বললাম রে?”

সামনের সারি থেকে রোগা, বেঁটে, চশমাপরা একজন বলে উঠল, “কেন, না বললে কি শোনানো যায় না? আমার প্যাঁও তো কিছু না বললেও শোনায়!”

“আবার শুরু করেছিস, স্মরণ!” পাশ থেকে একটা ছেলে বলে উঠল, “সবসময় প্যাঁও! শালা প্যাঁওটা কে রে? একদিনও তো দেখলাম না!”

সুম্পা দ্বিতীয় ছেলেটাকে বলল, “শোন জিৎ, স্মরণের কোনও প্যাঁও নেই। ও ঢপ মারে!”

“প্যাঁও নেই?” স্মরণ সোজা হয়ে বসে একটু উত্তেজিত হল, “আরে, প্যাঁও আমার প্রেমিকা। কতবার বলেছি তোদের! তবে সবার সঙ্গে মেশে না। তোদের সঙ্গে মিশবে না। আর তোর সঙ্গে তো মিশবেই না। যারা বিদেশে থাকে তাদের সঙ্গে মেশে না, তাই আসে না।”

জিৎ বলল, “তোর সঙ্গেও তো মেশে না! তাই ঢপ মারিস!”

ঝগড়াটা বাড়ত। কিন্তু সুম্পা হাত তুলে বলল, “কেক কাটার আগে রাধিয়া গান গাইবে। কেউ ঝগড়া করবে না কেমন!”

“ওরে, তুই এই বুড়ো বয়সে কেকও কাটবি!” স্মরণ মোটা চশমার পেছনে চোখগুলো গোল করল, “তবে আমায় এক পিস এক্সট্রা দিয়ে দিস তো। প্যাঁওকে দেব।”

“আবার শালা…” জিৎ লাফিয়ে উঠতে গিয়েছিল। কিন্তু সুম্পা সামনে এগিয়ে জিৎকে চেপে বসিয়ে বলল, “চুপ সবাই। রাধিয়া গান গাইবে। কেমন?”

রাধিয়া দেখল, ঘরের সবাই তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে! আজ শাড়ি পরে এসেছে রাধিয়া। ও আঁচল দিয়ে ঠোঁটের ওপরের ঘামের ফুলস্টপগুলো মুছল চেপে-চেপে। তারপর তাকাল সবার দিকে। আসলে ঠিক সবাই নয়, একজনের দিকে। নিশানের দিকে। কেন তাকাল! রাধিয়া জানে না। শুধু মনে হল, আবার সেই মিষ্টি কর্পূরের গন্ধটা ফিরে এল।

রাধিয়া চোখ বন্ধ করে সময় নিল একটু। ভিড় থেকে, কোলাহল আর হুল্লোড় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল। দ্রুত শ্বাসকে সংযত করল। শরীরকে নমনীয় করে নিল। তারপর তাকাল। বলল, “গান নয়। আমি একটা কবিতা বলব। আমার ঠাকুরমা মাঝে মাঝে বলে এই কবিতাটা। না, আমায় বলে না। নিজের মনে, একা বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কখনও কখনও বলে, আমি আড়াল থেকে শুনেছি। আমি সেটা বলব।”

পলি আর বুদা বসে পড়েছে ফরাসে। সুম্পা বসেছে একটা সোফার চওড়া হাতলের ওপর। স্মরণ মোটা চশমার ওপার থেকে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। জিৎ পাশের একটা ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে দেখছে ওকে। পেছন থেকে নিশানও অপলকভাবে দেখছে। ঘরের সবাই তাকিয়ে রয়েছে রাধিয়ার দিকে।

রাধিয়া আর-একটু সময় নিল। ঘরের ভেতর ফ্যানের গুঞ্জন ছাড়া আর কিছু নেই!

রাধিয়া এবার সেই গুঞ্জন ভেঙে তুলো-খসে-পড়া আওয়াজে বলল:

“আকাশ জুড়ে জোনাকিদের বাড়ি
বুকের নীচে পাগলা রাজার ঘোড়া
তখন থেকে সবার সঙ্গে আড়ি
তখন থেকে আমার শহর পোড়া!
ধ্বংস ঘেঁটে তোমায় পেলাম মোহর
তোমার আলোয় বাঁচল আমার প্রাণী
কক্ষ থেকে ছিটকে যেত গ্রহ…
উল্কা তোমার কাচের ফুলদানি!
কেমন ছিল সেসব ধুলোখেলা!
কেমন ছিল সাগরপারের রানি!
এই জীবনের নরম বিকেলবেলায়…
আমরা দু’জন, কেবল দু’জন জানি
আমরা দু’জন, মাত্র দু’জন জানি।”

.

০৮.  পুশকিন

কলকাতায় বরফ পড়ে না কেন? সাদা তুলোর মতো, নরম, হালকা বরফ কেন নেমে আসে না কলকাতায়? ভিক্টোরিয়ার পরির পাখনায় বেশ বরফ জমে থাকবে! শহিদ মিনারের মাথায় জমে থাকবে সাদা ফেনার মতো বরফ! মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়েই মানুষজনের পা ডুবে যাবে ফুটপাথের পাশে জমে থাকা বরফে! ট্র্যাফিক পুলিশের হেলমেটের মাথায়, স্কুলফেরতা বাচ্চাদের পিঠের ব্যাগের ওপর, সবুজ-হলুদ অটোর ছাদে বা সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের গাছপালার গায়ে চুড়ো করে জমে থাকবে বরফ! লাল নীল ক্রেয়নের মতো উলের জামাকাপড় পরে মানুষজন জমা হবে রাস্তায়! আর আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করবে ছোট্ট বাচ্চার গালের মতো তুলতুলে বরফকুচি! ইস, কলকাতায় বরফ পড়লে কী ভালই যে হত! কেন যে বরফ পড়ে না! যা-যা হলে ভাল হয়, ভাল হত, কেন যে সেসব কিছু হয় না!

জানলায় দাঁড়িয়ে দূরে আকাশের গায়ে জমতে থাকা পেশিবহুল বাইসনের মতো মেঘগুলো দেখে ছোটবেলার মতো আবার এইসব মনে পড়ল পুশকিনের।

এপ্রিলের শেষ হতে চলল, কলকাতা আলকাতরার মতো ফুটছে। সবাই চাইছে একটা অন্তত কালবৈশাখী আসুক। মাসের প্রথমদিকে একদিন একটু বৃষ্টি হয়েছিল। তারপর আবার সেই এক আগুন! এক যন্ত্রণা!

এত লোকের ডাকেই কিনা কে জানে, আজ পশ্চিম দিকটায় বেশ মেঘ করেছে! জঙ্গল থেকে ছাড়া পেয়ে একপাল বাইসন যেন ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে শহরের দিকে! শেষমেশ কি আসবে তারা? মানুষ কি আজ বৃষ্টি পাবে?

পুশকিন জানলার কাচে নাক ঠেকিয়ে সামনের দিকে তাকাল। এত ওপর থেকে কলকাতার আকাশটাকে অদ্ভুত লাগে। রাজারহাট এমনিতেই বেশ ফাঁকা। আকাশের বিস্তার এখানে বেশি। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতেও আকাশ চোখে পড়ে। তাই এখানে অফিস হওয়ায় মনে মনে বেশ খুশিই পুশকিন। এই ক’মাসে রাজারহাটকে ভালবেসে ফেলেছে ও। কিন্তু আজ যেন একটু বেশি ভালবাসা পাচ্ছে ওর! এমন বাইসন যে এখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবে, আগে বুঝতে পারেনি।

“শালা, কাচের গন্ধ শুঁকছিস নাকি?”

আপনের গলা পেয়ে পেছনে ফিরে তাকাল পুশকিন। দরজাটা অর্ধেক খুলে মাথা বের করে আছে আপন। মুখে একটা সিগারেট। এই ছেলেটা কথা শোনে না। অফিসের মধ্যে স্মোক করা বারণ। কিন্তু ও কিছুতেই শুনবে না। আজ আবার বস আসছে। আপন একটা কেলেঙ্কারি না করে থামবে না!

“কী রে, এমন মুখ করে তাকিয়ে আছিস কেন?” আপন হাসল।

পুশকিন বলল, “তোকে বলেছি না নক না করে ঘরে ঢুকবি না? আর মুখে সিগারেট কেন? তোকে কতবার বলব?”

আপন দাঁত বের করে হাসল। তারপর সিগারেটটা ঠোঁট থেকে হাতে নিয়ে বলল, “টেনশনে সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারছি না। বস আসছে। শালা কোন-কোন অ্যাঙ্গেল থেকে বাঁশ দেবে কে জানে!”

“ভয়ের কী আছে? বস ওরকম নাকি?” পুশকিন জানলার কাছ থেকে সরে এসে চেয়ারে বসে বলল, “প্লাস, কাজ তো ভালই হচ্ছে, অ্যাটলান্টিস সি ফুডের টেক ওভারটা তো মসৃণভাবেই হল। তুই বেকার এত টেনশন করছিস কেন কে জানে!”

“আরে, তুই তো ভালই কাজ করেছিস। কিন্তু আমি সোনাঝুরি নিয়ে কী ঝুলে আছি জানিস না। শালা তারক চক্কোত্তি মাইরি হারামি দ্য গ্রেট! যা ঝোলাচ্ছে না!” আপন হাতের সিগারেটটা একবার টেনে মুখটা বিকৃত করল। তারপর কোথায় ফেলবে বুঝতে না পেরে সটান এসে পুশকিনের চেয়ারের পেছনের জানলাটা এক হ্যাঁচকায় খুলে নীচের দিকে ছুড়ে দিল!

“আরে! কী করলি কী এটা?” পুশকিন চেয়ারে ঘুরে অবাক হয়ে তাকাল।

“বেশ করলাম,” আপন নাক টেনে পুশকিনের উলটো দিকে রাখা দুটো চেয়ারের একটায় বসে বলল, “শালা, আমার নাড়িভুঁড়ি সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে টেনশনে, আর ও আমায় ম্যানার্স শেখাচ্ছে!”

পুশকিন কিছু বলতে গিয়েও বলল না। লাভ নেই। সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকে তো দেখছে ও আপনকে। নিজে যা ভাল বোঝে করে। কারও কথা শোনে না। এমনকী, পুশকিনকেও পাত্তা দেয় না। কিন্তু বিপদে পড়লেই পুশকিনের কাছে আসে। আগেও এমনটাই হত। আসলে কিছু জিনিস সারা জীবনেও পালটায় না।

আপন বলল, “আমায় তাড়িয়ে দেবে না তো! মানে তোর ওই সি ফুড কোম্পানি টেকওভারের পাশে আমার শালা এমন ল্যাজেগোবরে দশাটা আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। প্লাস, বস তোকে তো পছন্দও করে।”

“ব্যাপারটা ওভাবে দেখছিস কেন?” পুশকিন বলল, “এসব ব্যাপারে কি তুলনা চলে? আর পছন্দ করে মানে! তুই সেই সবসময় এমন করে ভাবিস কেন?”

আপন উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ারটা পেছন দিকে ঠেলে বলল, “তোমার আর কী গুরু! ঝাড়া হাত-পা। আমার মতো এক পিস বউ গলায় ঝুললে বুঝতে। সারাক্ষণ তার সারা পৃথিবীর জিনিসপত্তর চাই! আমার তো পেছনে ইংরেজি বাজনা বাজার উপক্রম! শালা, ভালই ছিলাম নয়ডায়। বেশি মাইনে, কলকাতায় থাকব, এসবের লোভে এখানে এসেই ডুবেছি! আমি তো রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি, ভগবান আমার বউ যেন অন্যের প্রেমে পড়ে! শালা বউটাও এক পিস! আমায় ছেড়ে নড়বে না! ভাগ্যবানের বউ পালায় জানিস তো?”

কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

পুশকিন তাকিয়ে রইল আপনের চলে যাওয়ার দিকে। ওর ফেলে রাখা শূন্য চেয়ারটার দিকে। স্মিতা মারা গিয়েছে প্রায় চার বছর! কিন্তু তাও আজও ওর বুকের মাঝখানে, প্রকাণ্ড হলঘরের ভেতর এমন একটা ভাঙা পুতুল কেন বসে থাকে? উসকোখুসকো, জামা ছেঁড়া, রং লেপটে যাওয়া একটা পুতুল আজও কেন বসে থাকে এমন আনমনে? কেন ও পুতুলটাকে মন থেকে বের করে দিতে পারে না? কেন সব কিছু করার পরও ওর মনে হয় হেরে গিয়েছে ও? কেন নিজেকে এমন প্রকাণ্ড ব্যর্থ এক কচ্ছপের মতো লাগে পুশকিনের? কেন পারে না পুরনো পুশকিনটাকে বের করে আনতে? কেন মনে হয়, স্মিতাকে আসলে বুঝতে ভুল হয়েছিল! কেন মনে হয় ওর দোষে আজ স্মিতা নেই! সেই রাতে ও যদি অমন অবস্থায় না থাকত তা হলে… তা হলে যে কী, সেটা আজও বুঝতে পারে না পুশকিন। ওদের সম্পর্কটা কেমন একটা অন্ধ গলিতে ঢুকে গিয়েছিল যেন! থাকার উপায় নেই, পালানোর পথ নেই! যেন ডেড লক! আর সেটা ভেঙে দিতেই যেন এসেছিল মৃত্যু!

স্মিতা যা করেছিল তার পিছনে কি কোনও যুক্তি আছে? জানে না পুশকিন। কী এমন হয়েছিল যে, স্মিতা অমন করল? কাজ না করলে জীবন চলবে কী করে! আর স্মিতাই-বা ওকে নিজের কাছে তা হলে ডেকেছিল কেন?

স্মিতার হয়তো চার মাসের প্রেম ছিল, কিন্তু পুশকিনের তো আর তা নয়। সাড়ে তিন বছর ধরে স্মিতাকে ভালবেসেছিল ও!

এমবিএ করে তখন সবে একটা কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। জীবনের প্রথম চাকরি। মনে মনে খুব সিরিয়াস ছিল পুশকিন। চার মাসের ট্রেনিং-এ ভেবেছিল কোনওদিকে তাকাবে না। জীবনে ভালভাবে দাঁড়াতেই হবে। কাজ শিখতে হবে। ওদের কোম্পানির সল্ট লেক অফিসে ট্রেনিং হত। ক্যান্টিনটা ছিল এক তলায়। লাঞ্চের সময় ওখানেই খেতে যেতে হবে জানত।

কিন্তু সেদিনই ক্যান্টিনে কী একটা ঝামেলা ছিল। তাই অফিস থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী খাবে সেটাই ভাবছিল পুশকিন।

অফিসের সামনে বেশ কয়েকটা দোকান ছিল। কিন্তু তাদের দেখে খুব একটা ভক্তি আসছিল না। খাবার নিয়ে একটা সময় বেশ পিটপিট করত পুশকিন। তাই কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু খিদে বড় বালাই। তাই এদিক-ওদিক দেখে, অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও।

স্যান্ডউইচ! নিজের মনকে মেরে, এক প্লেট স্যান্ডউইচ নিয়ে সকলের কাছ থেকে দূরে একটা বড় গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল পুশকিন।

সেদিন মেঘ ছিল আকাশে। গাছের ছায়া আরও একটু বেশি ছায়াময় ছিল যেন। উলটো ফুটের বিশাল বড় বিল্ডিংটা দেখে সেটাকে রাক্ষস মনে হচ্ছিল পুশকিনের। মনে হচ্ছিল একটু পরেই এটা সামনে ছড়ানো মানুষগুলোকে আবার গিলে নেবে! হাতে ধরা স্যান্ডউইচের প্লেটের দিকে তাকিয়ে পুশকিনের নিজেকেও তেমনই একটা খাবার মনে হয়েছিল।

আর ঠিক তখনই কান্নার শব্দটা ভেসে এসেছিল গাছের অন্যদিক থেকে।

ক্লিংক্লিং করে সামনে রাখা ইন্টারকমটা বেজে উঠল এবার। পুশকিন তাকাল। এখন আবার কার ফোন এল! চশমাটা চোখ থেকে খুলে রেখে রিসিভারটা তুলল পুশকিন, “হ্যালো।”

“স্যার, আপনার সঙ্গে আইকা নামে একজন দেখা করতে এসেছেন। মিসেস আইকা বাসু।”

“আইকা!” অবাক হল পুশকিন। ওর আবার কী দরকার পড়ল!

“হ্যাঁ স্যার। শুড আই সেন্ড হার আপ?”

“না,” পুশকিন বলল, “আমি আসছি। ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলুন।”

ফোনটা রেখে উঠল পুশকিন। আজ বস আসবেন, আর আজকেই মেয়েটা এল! আর আসবি তো আয় এমন সময়! প্লাস, একটা ফোন তো করবে! এমন হুট করে কেউ কাজের জায়গায় আসে!

পুশকিন নিজের ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। করিডর নির্জন। আসলে এই রাজ্যে ওদের এই অফিসটা নতুন। মাসপাঁচেক হয়েছে। এখনও রিক্রুট চলছে। তাই জনাদশেক কর্মী আর দু’জন রিসেপশনিস্ট আছে। আরও কিছু ছেলেমেয়ে দরকার। সি-ফুড কোম্পানিটার মেরামত আর সঙ্গে সেটাকে আবার সচল করতে হলে, বিদেশে মার্কেট ধরতে হলে আরও লোক লাগবে। আর পাশাপাশি তো আরও নানা সেক্টরে কাজ চলছে! তাই লোকজন নিতেই হবে। সেই কাজ নিয়ে আলোচনা করতেই দিল্লি থেকে বস আসছেন।

আপনের ঘরের ঘষা কাচের দরজা বন্ধ। ভালই হয়েছে। ওকে দেখলেই আবার এসে হাবিজাবি কথা শুরু করবে। আপনের সব কথাতেই একটা সূক্ষ্ম হুল টের পায় পুশকিন! কেন কে জানে! পুশকিন ভদ্রতাবশত কিছু বলতে পারে না, কিন্তু মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে! ওর কোথায় যেন পুশকিনকে নিয়ে সমস্যা আছে!

লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে কল-বাটনটা টিপে ঘড়ি দেখল পুশকিন। সাড়ে চারটে বাজে। বস আসবেন পাঁচটা নাগাদ। কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছেন উনি, নিজের কী একটা কাজ সেরে তারপর আসবেন।

টুং শব্দে লিফটের দরজাটা খুলে গেল। বারো তলার ওপরে অফিস ওদের। তবে নীচে একটা রিসেপশন-স্পেস নেওয়া আছে।। সামনের দু’বছরের ভেতরে অফিস স্পেস আরও বাড়াতে হবে।

একতলার বোতামটা টিপে লিফটের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল পুশকিন। লিফটটা ফাঁকা। নরম হলুদ আলোয় ভরতি। এই আলোটাকে কেমন একটা জ্যোৎস্নার মতো লাগে পুশকিনের। মনে হয় এই বুঝি মেঘ এসে মুছে দেবে আলোটুকু!

ছ’তলায় এসে লিফটটা থামল। দরজা খুলতেই স্মরণকে দেখতে পেল পুশকিন। বেঁটে রোগা। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ মতো। ছেলেটা মাসখানেক হল ওদের কোম্পানিতে জয়েন করেছে। অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। তবে বললে নানা চিঠি-চাপাটিও করে দেয়। কোনও কাজে ‘না’ বলে না। আসলে ওর এখনও কোনও নির্দিষ্ট কাজ নেই।

তবে ছেলেটা যেন কেমন। কখনও মাথার চুল আঁচড়াতে দেখল না ছেলেটাকে! জামাটাও কেমন যেন এলোমেলো। হাজারবার বলেও শু পরাতে পারেনি কেউ। সারাক্ষণ একটা সবুজ রঙের স্নিকার পরে থাকে।

লিফটের ভেতরে পুশকিনকে দেখে একটু থমকাল স্মরণ। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে একপাশে দাঁড়াল।

“তুমি ফিফথ ফ্লোরে কী করছ নিজের টেব্‌ল ছেড়ে?” পুশকিন অবাক হয়ে তাকাল।

“স্যার ওই মানে…” স্মরণ মাথা চুলকোল।

“ওই মানে?” পুশকিনের হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করল ও। মাথার চুল এবার পুরো ঘেঁটে গিয়েছে ছেলেটার।

স্মরণ বলল, “স্যার, মানে পারসোনাল একটু।”

পুশকিন কড়া চোখে তাকাল স্মরণের দিকে, “অফিস টাইমে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছ নিজের সিট ছেড়ে! আবার জিজ্ঞেস করলে বলছ পারসোনাল?”

স্মরণ জিভ কেটে বলল, “সরি স্যার। মা কালী বলছি, অন্যায় কিছু করিনি!”

“হোয়াট!” পুশকিন কী বলবে ভেবে পেল না! প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে ওর। কিন্তু কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হয়ে তো আর এভাবে হাসা যায় না!

লিফটটা এসে থামল গ্রাউন্ড ফ্লোরে। পুশকিন বাইরে বেরোল। স্মরণও বেরিয়েছে ওর সঙ্গে।

পুশকিন আবার বলল, “এসব কী বলছ! নিজের সিট ছেড়ে কী করছ তুমি? ফিফথ ফ্লোরে তো অন্য একটা কোম্পানির অফিস। সেখানে কী করছিলে?”

“বললে রাগ করবেন না তো স্যার?” স্মরণের মুখটা কেমন যেন ভয়ে শুকিয়ে গেল।

“আশ্চর্য তো!” পুশকিন ঠোঁট কামড়ে কড়া চোখে তাকাল, “ডু ইউ থিঙ্ক দিস ইজ় ফানি? আজ বস আসছেন, জানো তো! আর সেখানে উনি হিসেব দেখতে চাইলে দেখাতে পারবে? সব আপ টু ডেট আছে তো? না হলে কিন্তু তোমার বিপদ আছে। এখনও পারমানেন্ট হওনি!”

“প্যাঁও, স্যার।”

“হোয়াট?” পুশকিন থমকে গেল, “প্যাঁও মানে?”

“একটা মেয়ে, স্যার। আমার ইয়ে স্যার। ওই ছ’তলার অফিসটায় এসেছিল স্যার।”

পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারল না।

স্মরণ বলল, “স্যার, আসলে আমি কাজ করছিলাম। প্যাঁও এল। তাই আমায় ডাকল আর কী! আর আমি…”

“ওকে, ওকে…” পুশকিন হাত তুলে থামাল স্মরণকে, “আই ডোন্ট ওয়ন্ট এনি ডিটেল অফ ইয়োর পারসোনাল লাইফ! নীচে এসেছ কেন? সিটে যাও।”

“স্যার, একটা কথা স্যার!” স্মরণ এখনও আমতা-আমতা করে যাচ্ছে!

“কী?” পুশকিন জিজ্ঞেস করল।

“সোনাঝুরিতে যে-প্রজেক্টের কাজ হচ্ছে, সেই টিমে আমায় নেবেন স্যার? আমার তো তেমন কাজ নেই। আমি স্যার তার ফাঁকে এখন যেটা করছি সেটাও করে দেব। কাইন্ডলি যদি আমায়…”

“সোনাঝুরির কাজটা তো এখন আপন দেখছে। আমি তো দেখছি না! ওকে বলো।”

“উনি স্যার খ্যাঁকখ্যাঁক করেন!” স্মরণ ব্যাজার মুখে বলল, “কিছু বলতে গেলেই এমন করেন যেন, আমি ওঁর টিফিন চুরি করে খেয়েছি!”

“কী সব বলছ!” পুশকিন হাসল এবার। আস্ত পাগল একটা ছেলে!

“সত্যি স্যার। অন গড!”

“ঠিক আছে। আমি মনে রাখব। এখন নিজের জায়গায় যাও। নীচে এলে কেন?” পুশকিন কথা শেষ করতে চাইল!

“স্যার, একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়েই চলে যাচ্ছি!” স্মরণ আর না দাঁড়িয়ে হনহন করে বিল্ডিং-এর বাইরে হাঁটা লাগাল।

পুশকিনের হাসি পেল। প্যাঁও! এটা কোনও নাম! ছেলেটা ইয়ারকি মারল না তো!

পাশে বড়-বড় কাচের জানলার দিকে তাকাল পুশকিন। আকাশের রং পালটে গিয়েছে আরও! বাইসনরা আরও কাছে চলে এসেছে শহরের! তবে কি আজ সত্যি বৃষ্টি আসবে?

লিফট থেকে নেমে ওদের রিসেপশন স্পেসটা কয়েক পা দূরে। কাছাকাছি পৌঁছতেই পুশকিন দেখল সামনে রাখা চেয়ারে আইকা বসে আছে। দিন এতটা গড়িয়ে গিয়েছে, তাও সাজগোজ এখনও নিখুঁত। ছোট করে কাটা চুল এখনও পাট করে আঁচড়ানো!

মার্বেলের মেঝেতে পুশকিনের জুতোর শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকাল আইকা। তারপর হেসে উঠে দাঁড়াল।

“তুই!” চশমাটা খুলে পকেটে রেখে বলল পুশকিন।

“কেন আসতে নেই?” আইকা হেসে চুলটা অকারণে হাত দিয়ে ঠিক করল।

“হ্যাঁ, মানে…” পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারল না, “আসলে আজ একটু ব্যস্ত আছি। দিল্লি থেকে বস আসছে। তাই সবাই একটু বেশি অ্যালার্ট আর কী!”

“ওহো! তবে তো অসুবিধে করে ফেললাম!” আইকার মুখে কেমন একটা অপরাধীর ছাপ।

খারাপ লাগল পুশকিনের। ও কোনও বিষয়ে কাউকে খুব একটা বারণ করতে পারে না। খবর না দিয়ে চলে আসাতে ওর অসুবিধে হল জেনে আইকা যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে, সেটায় কেন যেন খারাপ লাগল ওর।

ও বলল, “আরে, আধঘণ্টা তো কথা বলাই যেতে পারে!”

আইকা সামান্য হাসল। কিন্তু তাও দ্বিধার ভাবটা কাটছে না ওর।

“চল, ক্যাফেতে যাই। ডোন্ট লুক সো গ্লুমি। ইট ডাজ়ন্ট সুট ইউ!” পুশকিন আলতো করে হাসল।

এই বিল্ডিংটা বেশ বড়। পেছনের দিকে একটা ক্যাফে আছে। চা, কফি ছাড়াও টুকটাক খাবার পাওয়া যায়। পুশকিন নিজে চা বা কফি কিছু খায় না। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে আসে এই ক্যাফেতে। এরা একটা দারুণ আঙুরের শরবত বানায়।

ক্যাফেতে ছোট-ছোট কয়েকটা চেয়ার-টেবিল আছে। তবে এখন তার একটায় মাত্র দু’জন মেয়ে বসে রয়েছে। বাকি চেয়ার-টেবিলগুলো ফাঁকা।

জানলার কাছে একটা চেয়ার দেখে বসে পড়ল পুশকিন। হাতের ব্যাগটা টেবিলের একপাশে রেখে সামনের চেয়ারটা টেনে বসল আইকাও।

“কফি?” পুশকিন জিজ্ঞেস করল।

“তুই তো খাস না। তুই কী খাবি?” আইকা ভুরু তুলে তাকাল পুশকিনের দিকে।

“গ্রেপ জুস। আর তোর কফি বলি?”

আইকা মাথা নাড়ল।

পুশকিন “চাচা” বলে কাউন্টারের লোকটিকে ডেকে একটা গ্রেপ জুস আর কফি দিতে বলে গুছিয়ে বসল এবার।

“বল।”

আইকা নাক টানল, “এই এসেছিলাম কাছের একটা কোম্পানিতে, ‘কোডি স্টিল’। আমরা একটা বড় সেমিনার করছি। তাই এসেছিলাম ওদের জেনারেল ম্যানেজারকে নেমন্তন্ন করতে। মানে, ওঁকে তো আর যাকে-তাকে দিয়ে নেমন্তন্নের কার্ড পাঠানো যায় না! কাজটা শেষ করে ভাবলাম, তুই সেদিন বলেছিলি এখানে আছিস। তাই টুক মাই চান্স। বুঝতে পারিনি তুই বিজ়ি! সরি।”

“আরে, তা নয়,” পুশকিন হাসল, “এই অফিসটা গোটাটাই আমায় আর আপনকে দেখতে হয়। আমরা এই রিজিয়নে নতুন। উই হ্যাভ টু হ্যাভ আ গুড হোল্ড অন দ্য রিজিয়ন। তাই একটা কাজের চাপ আছে। দিল্লির হেড কোয়ার্টার থেকে চাপ দেয়। বাদ দে। তারপর? কী খবর বল।”

আইকা কিছু বলতে গিয়েও থমকাল। কাউন্টারের বয়স্ক মানুষটি এসে ওদের সামনে কফি আর একটা শরবতের গেলাস রেখে গেল।

আইকা ব্যাগ থেকে একটা ওয়াইপ বের করে হাত মুছল। তারপর কাপটা টেনে নিয়ে বলল, “আসলে তোকে এত বছর পরে আচমকা দেখে এত ভাল লাগছে! মাঝে তো পুরো হারিয়ে গিয়েছিলি! তোর সঙ্গে সেই বিকেলের পরে এই দেখা হচ্ছে। মেসেজ করলে রিপ্লাই দিস না কেন রে?”

পুশকিন গেলাসে সামান্য চুমুক দিয়ে শুনল কথাগুলো। আইকা এমন এলোমেলো কথা বলছে কেন! আসলে কী বলতে চাইছে, সেটা ঠিক বুঝতে পারছে না! ও তাকিয়ে রইল।

“আমার এত খারাপ লাগছে! কী বলব তোকে!” আইকা কাপের মুখটায় আঙুল বোলাতে লাগল এবার।

“খারাপ? কেন?” পুশকিনের এক সেকেন্ডের জন্য মনে হল আইকা কি স্কুলের সেই কথাটা তুলছে নাকি!

“খারাপ লাগবে না? কী বলছিস?” আইকা ঠোঁট কামড়ে তাকাল।

পুশকিন ক্যাফের দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা দেখল একবার। আইকা কী শুরু করল এসব!

“কী ব্যাপার বল তো!” পুশকিন গেলাসে লম্বা চুমুক দিয়ে তাকাল আইকার দিকে।

আইকা কিছু বলতে গিয়েও কেমন যেন থমকে গেল। তারপর আচমকা হাত বাড়িয়ে পুশকিনের ঠোঁটের ওপর লেগে থাকা আঙুরের পাল্প মুছে নিল আঙুল দিয়ে। তারপর সেটা মুখে ঢুকিয়ে খেয়ে নিল। বলল, “ইয়াম!”

পুশকিনের ধক করে উঠল বুকটা। এটা কী করল আইকা! এর মানে কী! ও চট করে দেখে নিল আশপাশটা। দূরের টেবলে বসা দুটো মেয়ে কি দেখল এটা!

আইকা হাসল, “কফি না বলে আমিও শরবতটা খেতে পারতাম মনে হচ্ছে।”

পুশকিনের এবার বিরক্তি লাগছে। কী চায় আইকা? ও এল কেন? পাঁচটা বাজে প্রায়। এই আইকার মধ্যে যেন স্কুলের রাগী, অহংকারী সেই মেয়েটা আর নেই।

“তুই কিছু বলবি?” পুশকিন আর থাকতে না পেরে বলল এবার।

“ও হ্যাঁ, মানে… আসলে তোকে দেখতে ইচ্ছে করল!” আইকা তাকাল পুশকিনের দিকে।

পুশকিন হাসল সামান্য। অস্বস্তি হচ্ছে ওর। কিন্তু কী বলবে! আইকা দেখতে খুবই সুন্দরী। রূপচর্চার ফলে সেটা আরও খুলেছে। এমন একটা মেয়ে এসব বললে যে-কোনও ছেলেরই মনে নানা রঙের এলইডি জ্বলতে পারে। কিন্তু পুশকিনের জ্বলল না। এই আইকাকে ও চেনে। স্কুলে এমন কাজ করেছিল যে, এখনও ওর মন তেতো হয়ে আছে। নেহাত অভদ্রতা করতে পারে না তাই কিছু বলছে না!

পুশকিন উঠে দাঁড়াল, “তোর কীসে খারাপ লাগল যখন বললি না, তখন আমি আজ আসি রে। বস যে-কোনও সময় ঢুকবেন।”

হা-হা করে এবার হেসে উঠল আইকা, “ভয় পেয়ে গেলি! এখনও ভিতুই আছিস! কিচ্ছু পালটাসনি তুই পুশকিন।”

পুশকিন হাসল। যদিও এতে হাসির কী আছে বুঝল না। ও হাত তুলে চাচার দিকে ইঙ্গিত করল।

আইকা বলল, “দামটা?”

“আমার খাতা চলে এখানে। ডোন্ট ওয়ারি।”

ক্যাফের বাইরে এসে আইকা ঘড়ি দেখল। বলল, “যা বলছিলাম। আসলে নোঈ যে এমন করে তোর ওই খুড়তুতো ভাইকে বাতিল করে দেবে, আমরা বুঝতে পারিনি। তাই খারাপ লাগছে আমার।”

“এতে খারাপ লাগার কী আছে?” পুশকিন বলল, “ওর জীবন, ও যেটা ভাল বুঝবে সেটাই করবে। প্লাস ডিনো বিদেশে ফিরে গিয়েছে। এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়।”

“আসলে মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তায় আছি আমরা। একটা চাকরি করত। সেটা ছেড়ে দিয়েছে। কাজ খুঁজছে। পাচ্ছে না। ওর মা বিয়ে দেবে বলে উঠে-পড়ে লেগেছে, কিন্তু সেটাও করবে না। কাকু আমায় বলছিল যদি…”

“নোঈ কী পাশ করেছে? মানে কোয়ালিফিকেশন কী! আমাদের এখানে রিক্রুটমেন্ট চলছে। ইফ শি ইজ় ইন্টারেস্টেড, তা হলে…”

পুশকিনকে কথা শেষ করতে দিল না আইকা। প্রায় ছোঁ মেরে ওর মুখ থেকে কথাটা তুলে নিয়ে বলল, “আরে, নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টেড হবে।”

“দেখ, ওকে আগে বল,” পুশকিন সাবধানি গলায় বলল, “নোঈকে আগে বলে দ্যাখ। ইউ ডোন্ট কমিট। প্লাস ভবানীপুর থেকে রাজারহাট আসবে কি না, সেটাও একটা ব্যাপার। আমায় দু’দিনের মধ্যে জানা, তা হলেই হবে,” পুশকিন ঘড়ি দেখল আর দেরি করা যাবে না।

আইকা হাসল, “আমি জানাচ্ছি। খুব ভাল হবে এটা। তোদের বাড়িতে আপত্তি হবে না তো?”

“মানে?” পুশকিন ভুরু তুলল, “বাড়িতে আপত্তি কেন? অফিস আর বাড়ি তো আলাদা। আর বিয়ের কথা মানেই তো বিয়ে নয়। এসব ভাবিস না। যদি ইন্টারেস্টেড হয় আসতে বলিস। কেমন?”

“যদি বলছিস কেন?” আইকা তাও যেন ছাড়ছে না!

“সেদিন গাড়িতে উঠতে বলেছিলি, ও কি উঠল!” হাসল পুশকিন, “দ্যাখ, যদি আসে।”

আইকা বলল, “আজ তবে আসি। আমি আবার আসতে পারি তো?”

“তুই?” পুশকিন সামান্য থমকাল। এর আগের দিন রাস্তায় আচমকা দেখা হয়ে গিয়েছিল বলে লিফট দিয়েছিল গাড়িতে। কিন্তু আবার আসবে? পুশকিন সামান্য ঘাবড়ে গিয়েছিল। দ্বিধা নিয়ে তাকিয়েছিল আইকার দিকে। তারপর কোনওমতে মাথা নেড়ে বলেছিল, “শিয়োর।”

আইকা সামান্য এগিয়ে এল কাছে। তারপর আলতো করে হাতটা ধরল ওর। বলল, “স্কুল অনেকদিন আগে শেষ হয়ে গিয়েছে পুশকিন। সেই আইকাটা আর নেই কিন্তু।”

এই বিল্ডিংটার নীচের তলাটা বেশ ফাঁকা থাকে। বড়-বড় থাম। উঁচু সিলিং! থমথমে লম্বা সাদা দেওয়াল— গোটা জায়গাটাকে যেন আরও নির্জন করে দেয়!

আইকা পায়ের জুতোর আওয়াজ তুলে চলে গেল। আর সেই খটখট আওয়াজ যেন ছোট ছোট ফুটো করে দিল নিস্তব্ধতার আলখাল্লায়!

পুশকিন চুলের ভেতর হাত ডোবাল। বাইরে ছিল ভাল ছিল। কলকাতায় এসেই আবার চুঁইয়ে-চুঁইয়ে অতীত এসে ঢুকছে ওর জীবনে! বাবা ঠিকই বলেছে, “পালিয়ে বাঁচতে পারবি না বাবু।”

বাবার কথা মনে পড়তেই ঘড়ি দেখল পুশকিন। আজ বাবার ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার কথা, গিয়েছে কি!

বাবা রাসবিহারী মোড়ের কাছে ওদের বড় বাড়িতে থাকে ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ওপর রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের কাছে ওর ফ্ল্যাটে থাকে না।

এটা পুশকিনের একটা কষ্টের জায়গা। বাড়ির অমতে স্মিতাকে বিয়ে করেছিল পুশকিন। সবাই বাধা দিয়েছিল। মা তো সাংঘাতিক অসুস্থ হয়েও পড়েছিল। কিন্তু তাও পুশকিন কারও কথা শোনেনি! স্মিতা এমন করে টেনেছিল ওকে! আর সে সময় পুশকিনের মনে হয়েছিল, স্মিতাকে ও কথা দিয়েছে বিয়ে করবে! প্রেমের চেয়েও কথা রাখাটা জরুরি!

কিন্তু বুঝতে পারেনি একটা কথা রাখতে গিয়ে জীবনের অন্যদিকটা নষ্ট হয়ে যাবে! ওর বিয়ের চার মাসের মধ্যে মা মারা গিয়েছিল!

এখনও বিকেলটার কথা মনে আছে পুশকিনের। তখনও প্যারিসে পোস্টিং হয়নি ওর। কলকাতাতেই ছিল। অফিসে বসের ঘরে মিটিং হচ্ছিল সেদিন। নতুন চাকরি। পুশকিন সারাক্ষণ তটস্থ থাকত সেই সময়।

মার্কেটিং চিফ একটা গ্রাফ নিয়ে কথা বলছিলেন, এমন সময় পুশকিনের পকেটের মোবাইলটা তারস্বরে বেজে উঠেছিল। ঘরের সবাই খুব বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছিল পুশকিনের দিকে। পুশকিনের মনে হচ্ছিল ন’তলার ওপর থেকে ঝাঁপ মারে রাস্তায়। ফোনটা বের করে সুইচ অফ করতে গিয়েও থমকে গিয়েছিল একদম! স্ক্রিনে দেখেছিল বাবার মোবাইল থেকে কলটা এসেছে!

নিস্তব্ধ ঘরের মাঝখানে বিরক্ত মুখের বেশ কয়েকজন মানুষকে তোয়াক্কা না করেই খ্যানখ্যান করে বাজছিল ফোনটা! কিন্তু বাবা ফোন করল কেন? পুশকিন ফোনের ‘রিজেক্ট’ বোতামটা টিপতে পারছিল না।

বিয়ের আগে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, তারপর একবারই বাড়িতে গিয়েছিল পুশকিন। কিন্তু কিছুতেই ওকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি ওর ভাই আর কাকারা। বাবা দোতলার বারান্দা থেকে সেদিন দাঁড়িয়ে দেখেছিল সবাই মিলে পুশকিনকে কীভাবে বাড়ির দরজা থেকে দূর করে দিয়েছিল! ভাই যখন ওর কলার ধরে ওকে ধাক্কা মেরে বাড়ির দরজা থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলছিল, বাবা কী অদ্ভুত নিস্পৃহ ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখছিল ওকে! ভাইয়ের সেই ধাক্কা, কাকাদের গালাগালি ওকে কষ্ট দেয়নি! কিন্তু বাবার ওই ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকাটা ভেতরে-ভেতরে একদম মেরে ফেলেছিল ওকে।

সেই বাবা নিজে ফোন করেছে! কেন? হঠাৎ কী হল? ফোনটা হাত-পা ছুড়ে একগুঁয়ে বাচ্চার মতো চিৎকার করে চলছিল!

আচমকা বস শান্ত গলায় বলেছিল, “টেক ইট আউটসাইড। ইট মাস্ট বি ইমপর্ট্যান্ট!”

ঘরের কাচের দরজাটা ঠেলে বাইরে এসে ফোনটা ধরেছিল পুশকিন।

বাবা শান্ত গলায় বলেছিল, “তোমার মা আর নেই। আজ একটু আগে দেহ রেখেছেন। উনি শেষ মুহূর্তেও চাননি তোমায় খবর দিতে। কিন্তু আমি মনে করি, কোনও কিছুই মৃত্যুর চেয়ে বেশি নয়, বড় নয়। যা কিছু মনোমালিন্য তার থেকে মৃত্যুকে দূরে রাখাই ভাল। পারলে কেওড়াতলায় এসো।”

সেদিন অনেক রাতে শ্মশানে একটা সিঁড়িতে একা বসেছিল পুশকিন! ওদের অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিল। কিন্তু কেউই কথা বলছিল না ওর সঙ্গে। বরং এমন একটা ভাব নিয়ে ঘুরছিল যাতে পুশকিনের মনে হচ্ছিল, মায়ের মৃত্যুর জন্য ওই দায়ী!

মায়ের মুখাগ্নিটা পর্যন্ত করেছিল ভাই। দূরে অপরিচিতের মতো দাঁড়িয়ে পুশকিন দেখেছিল মা চলে যাচ্ছে সারা জীবনের মতো! সেই ছোটবেলায় মুখ ধুইয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেওয়া মা। সেই পক্সের সময় সারা রাত জেগে বসে থাকা মা। এক মনখারাপের দুপুরে পাশে এসে মাথায় হাত রাখা মা। চলে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছিল, বাবা, ভাই আর এত আত্মীয়স্বজন কী করে জানবে মা ওর কতটা ছিল! একটা মেয়েকে বাড়ির অমতে বিয়ে করেছে বলে ওকে এমন করে সবাই দাগ কেটে বাইরের লোক করে দিল। মা-ও বুঝল না পুশকিনকে।

সেদিন শেষরাতে বাড়ি ফিরেছিল পুশকিন। স্মিতা জেগে বসেছিল বসার ঘরে। এতক্ষণের কান্নাটা স্মিতাকে দেখে কেমন যেন বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। মাটিতে বসে স্মিতার কোলে মুখ গুঁজে দিয়েছিল পুশকিন। বন্ধ চোখের অন্ধকারে দেখেছিল মা ধীরে-ধীরে মিশে যাচ্ছে আগুনের সঙ্গে!

স্মিতা মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে বলেছিল, “কাঁদে না সোনা। আমি তো আছি।”

কেউ থাকে না। ভাই থাকে না। বন্ধু থাকে না। বাবা থাকে না। মা থাকে না। স্ত্রী থাকে না। প্রেমও থাকে না। নিস্তব্ধতা আর একাকিত্ব তার কালো আলখাল্লা দিয়ে ঢেকে দেয় মাথা-নিচু মানুষের জীবন।

লিফট থেকে বেরিয়ে অফিসে পা রাখল পুশকিন।

“কোথায় ছিলে গুরু? বস এসে গিয়েছে!” আপন হাতে একটা ফাইল নিয়ে এগিয়ে এল সামনের একটা কিউবিকলের ভেতর থেকে।

এই কিউবগুলোর সবটায় লোকজন নেই। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিতে লোকজন বাড়লে এই মৌমাছির খোপগুলো ভরে উঠবে।

পুশকিন কিছু না বলে বসের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ভারী কাচের দরজার বেশির ভাগটাই ফ্রস্টেড। তার ফাঁক দিয়েও বসের ভ্যানিটি ব্যাগটা দেখা যাচ্ছে।

“স্যার,” আচমকা কানের কাছে ফিসফিস করে একটা গলা পেল পুশকিন। সামান্য চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল ও। স্মরণ এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। বেঁটে, রোগা পাতলা ছেলেটার চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে এখনও। সঙ্গে জামাটাও অর্ধেক গোঁজা আর বাকি অর্ধেক বেরিয়ে রয়েছে প্যান্টের বাইরে।

পুশকিনের আবার হাসি পেল। এমন কাকতাড়ুয়া হয়ে আছে কেন ছেলেটা! আর ফিসফিস করেই-বা কথা বলছে কেন?

হাসি চেপে পুশকিন গম্ভীরভাবেই বলল, “কী হয়েছে?”

“স্যার বস, মেয়ে?” স্মরণের চোখগুলো গোলগোল হয়ে আছে।

“হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?”

স্মরণ বলল, “না মানে, হিন্দি সিনেমায়, বাংলা সিনেমায় যে দেখায় বস মানে ছেলে?”

“বস মানে ছেলে? তাই নাকি?” পুশকিন আর না হেসে পারল না!

আপন একটু পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এবার ও বলল, “শালা, এই জ্ঞান বসের সামনে ফলাস না স্মরণ। আর এখন কাট এখান থেকে। ডাকলে আসবি, না হলে আসবি না। বস কিন্তু খুব রাগী।”

স্মরণ কী বুঝল কে জানে! নিজের খোপের দিকে যেতে-যেতে মাথা নেড়ে বলল, “বস শব্দের জেন্ডারটা না জানা গেলেও এটা জানা গেল যে, বস খুব ডেঞ্জার!”

আপন পাশে এসে দাঁড়াল পুশকিনের। বলল, “যা রিক্রুট করেছ না গুরু, জানলে ইন্ডিয়ান ফুটবল টিমের সিলেক্টার বানিয়ে দেবে।”

পুশকিন বলল, “ছেলেটা কাজ করে মন দিয়ে। সিনসিয়ার। অনেস্ট। একটু খ্যাপাটে। কিন্তু তাতে কাজের ক্ষতি তো হচ্ছে না।”

আপন বলল, “শালা, বরাবর দেখছি তোর ট্যান টাইপের জিনিসই বেশি ভাল লাগে। নিজেও তো শালা তার-কাটা!”

পুশকিন হাসল। আপনের কথায় ও কিছু মনে করে না। আপন ওর পুরনো বন্ধু বটে, কিন্তু ও বোঝে আপন সারা জীবন ওর মধ্যে একজন প্রতিদ্বন্দ্বীকেই দেখে এসেছে!

পুশকিনের কারও সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। ওর কেবল এক ক্লান্তি আছে। মনের মধ্যে সহস্র বছরের জমে থাকা এক ঘুম আছে। ওর মাঝে মাঝে মনে হয় একদিন সব ছেড়ে ও দূরে কোনও ঠান্ডা পাহাড়ি শহরে চলে যাবে। সেখানে নির্জন একটি ঘরে বসে দেখবে আকাশ থেকে নেমে আসা ক্যান্ডিফ্লসের মতো তুষারের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে এক ছোট্ট নিশ্চুপ জনপদ।

আচমকা আকাশ ফাটিয়ে কড়কড় করে মেঘ ডেকে উঠল। কাচের বড় জানলাগুলোর দিকে তাকাল পুশকিন। বাইসনের দল এসে গিয়েছে। তাদের খুরের ধুলোয় চারদিক অন্ধকার! কতদিন বৃষ্টি হয় না! আজ কি হবে?

“স্যার, আপনাদের ম্যাডাম ডাকছেন।”

কাচের দরজা ঠেলে হাবু বেরিয়ে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে।

আপন হাত দিয়ে সামনে ঠেলে দিল পুশকিনকে, “এগো, চল। শালা আজ আমার বাম্বু ডট কম হবে শিয়োর।”

কাচের দরজা ঠেলে দু’জনেই অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকল।

বস বড় কাচের টেবিলের অন্য পারে বসে মন দিয়ে সামনে খুলে রাখা কিছু কাগজ দেখছেন। ওদের দিকে না তাকিয়েই হাত নেড়ে বসতে বললেন।

এই ঘরটা বন্ধই থাকে, বস এলেই শুধু ঝাড়পোঁছ করে খোলা হয়। মিসেস মালভিকা আইয়ার কড়া হলেও মানুষ ভাল। সিনসিয়ারিটি না দেখলে যেমন রেগে যান খুব, তেমনই ভাল কাজের প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করেন না কখনও।

গত আড়াই বছর হল এই কোম্পানিতে জয়েন করেছে পুশকিন। সেখানেই কাজের সূত্রে দেখেছে, ঢিলেমি একদম পছন্দ করেন না বস।

এই যে কলকাতায় ওকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে, সেখানেও ওকে বলা হয়েছে যে কোম্পানির কাজ এই অঞ্চলে পুশকিন আর আপনের পারফরম্যান্সের ওপরেই নির্ভর করবে। সেখানে যেন কেউ গাফিলতি না দেখায়!

বসের বয়স চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন। মাথার চুল বড়। কিন্তু কাঁচায় পাকায় মেশানো। পরনের শাড়িটা যে খুব দামি, সেটা আর বলে দিতে হবে না।

“সো জেন্টলমেন, তোমাদের খবর কী?” বস সামনের কাগজটা সরিয়ে ওদের দিকে তাকালেন।

পুশকিন জানে এর উত্তর দিতে নেই। বসের কোনও ইন্টারেস্ট নেই ওদের ব্যাপারে। উনি কেরলের মানুষ হলেও দীর্ঘদিন কলকাতায় লেখাপড়া করেছেন বলে বাংলাটা ভালই বলেন।

আপন হাতে ধরা ফাইলটা টেবিলে রেখে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “ম্যাম, উই হ্যাভ সাম গ্লিচেস ইন দ্যাট সোনাঝুরি প্রজেক্ট। আ পারসন… তারক চক্রবর্তী ইজ ক্রিয়েটিং হ্যাভক ট্রাবল। সো…”

“তুমি এসব তো ই মেলেও জানিয়েছ লাস্ট উইকে। তার পর দশ দিন কেটে গিয়েছে, এখনও একই গল্প দিয়ে যাচ্ছ! নতুন কী প্রগ্রেস হল?”

“ম্যাম, আসলে তারক লোকটি খুব ঝামেলা করছে। কিছুতেই নিজের জায়গা থেকে সরছে না! জুট মিলটা কিছুতেই রিভাইভ করতে দিতে চাইছে না! আর দিলেও ওর ডিম্যান্ড আছে কিছু! আমি মানে…”

বস হাত তুলে আপনকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, “একটা লোকের জন্য তবে কি সবটা আটকে যাবে? জুট মিল টেক ওভার করে সেটাকে চালানো, ওই বড় বাড়িটা নিয়ে সেটাকে রিসর্ট করে তোলা। পাশের নদীতে লাক্সারি ফেরি টুরিজ়ম! সব কি তবে আমরা ডিসকার্ড করে দেব? আপন আই মাস্ট সে ইউ আর নট গুড এনাফ।”

“না ম্যাম, আপনি বিশ্বাস করুন, ব্যাপারটা তা নয়। যে কেউ ওখানে গেলে এমন ফেঁসে যাবে! আমি দেখি তারককে যদি অন্যভাবে কিছু করে বাগে আনা যায়,” আপন হাত মুঠো করে চোখ সরু করে একটা গভীর কিছু করতে চলেছে এমন ভাব দেখাল।

“ডোন্ট মেক ফেসেস। সেভেন্টিজ়ের হিন্দি মুভিজ়ের ভিলেনরা এমন মুখ করত। ওসব ড্রামা বাদ দাও আপন,” বস বিরক্ত হয়ে তাকালেন আপনের দিকে। তারপর পুশকিনকে লক্ষ করে বললেন, “তোমার সি-ফুডের ব্যাপারটা তো ভালই এগিয়েছে। এক কাজ করো, গিভ দ্যাট টু আওয়ার ড্রামাকুইন আপন। তুমি সোনাঝুরির প্রজেক্টটা হাতে নাও। আজ থেকে ওটা তোমার আন্ডারে। ভাল কয়েকজন ছেলেমেয়ে রিক্রুট করো। দেন গো ফর ইট। তারক না কে, তাকে বাইপাস করে টক টু মালিকস। ওদের তো সম্পত্তি! দ্যাখো, ওরা কী বলে। টেল দেম আওয়ার প্ল্যান্‌স। আমরা শুধু বিজ়নেস করি তা নয়, ডেভেলপমেন্টও আমাদের মাধ্যমে হয়। সেটা ওদের বলো। সোনাঝুরি উইল ব্লুম লাইক এনিথিং!”

“আমি পারব ম্যাম!” ঘ্যানঘ্যানে বাচ্চার মতো আপন মাঝখানে লাফিয়ে পড়ে বলল।

“অনেক পেরেছ। আর নয়। পেপার্স পুশকিনকে হ্যান্ডওভার করে দাও। সি ফুডের প্রোডাকশন, সেল্‌স, প্রোমোশনটা তুমি দ্যাখো,” বস কথাটা শেষ করে পুশকিনকে বললেন, “গেট ইট ডান। আমার ওপরও চাপ আছে। ডোন্ট ডিস্যাপয়েন্ট মি। সোনাঝুরির কাজটা ইমপর্ট্যান্ট। রাশিয়া, ইউএস, ব্রিটেন প্লাস ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ এনভায়রনমেন্ট-এর ব্যাপারে খুব কশাস! ওখানে জুট আর জুটের প্রোডাক্ট ইজ় ইন হাই ডিম্যান্ড। প্লাস ওই হেরিটেজ বিল্ডিংটাও আমাদের দরকার। ফ্যান্টাস্টিক রিসর্ট হবে। বিদেশ থেকে কত ডেলিগেটস আসবে জানো? পুশকিন, তুমি শুরু করে দাও।”

পুশকিন কিছু বলার আগে আপন আবার কথার মাঝে ঢুকে পড়ল, “ম্যাম, ওই রাক্ষসের মতো বাড়িটা আমি দেখেছি। ওটাকে সারাতে গেলে অনেক খরচ হয়ে যাবে। তার চেয়ে ওটাকে ভেঙে যদি…”

“শাট আপ!” বস চুপ করিয়ে দিলেন আপনকে। তারপর বললেন, “রাক্ষস-বাড়ি কী কথা! জানো না এভাবে কথা আমি পছন্দ করি না! পুশকিন, তুমি জানো বাড়িটা সম্বন্ধে?”

“জানি ম্যাম। আমি কাল থেকেই পারস্যু করছি ব্যাপারটা!”

“জানিস?” আপন ব্যঙ্গের গলায় বলল, “কী করে জানলি?”

পুশকিন তাকাল আপনের দিকে। তারপর বসের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “ছোটবেলায় আমার বাবা-ঠাকুরদারা সোনাঝুরিতে থাকত। আমিও খুব ছোট বয়সে থাকতাম। গঙ্গার পাশে আমাদের স্কুল ছিল ম্যাম। সোনাঝুরি নার্সারি অ্যান্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুল। যাতায়াতের পথে ওই বিশাল বাড়িটার গেটটা আমরা দেখতাম। বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা বিশাল চারটে বাড়ি! ওখানের লোকজন বলে জোনাক-বাড়ি!”

বস তাকালেন পুশকিনের দিকে। তারপর কেটে-কেটে বললেন, “হ্যাঁ, ওই বাড়িটাই, আমাদের ওই বাড়িটাও চাই। টেক নেসেসারি মেজ়ারস্‌।”

.

০৯. আইকা

বড় আয়নাটায় নিজেকে দেখল আইকা। সামান্য মোটা হয়ে গিয়েছে কি? কোমরের দু’পাশে কি লাভ হ্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে? পেটেও কি চর্বি জমছে? বুকদুটো কি নেমে আসছে নীচে?

হাফ-টার্নে ঘুরে কাঁধের পেছনের দিকটা দেখল আইকা। স্ট্রেচ মার্কস দেখা যাচ্ছে কি? শরীরে সময় তার থাবা বসাবেই। কিন্তু সেটা এতদিন আটকে রাখতে পেরেছিল আইকা। এবার কি তা হলে সেই প্রতিরোধ ভাঙার সময় হল?

গত সপ্তাহে রক্ত পরীক্ষা করিয়েছে আইকা। এমনি সব ঠিক থাকলেও সুগার লেভেল সামান্য বাড়তির দিকে। ডাক্তার বলেছেন, যেন সতর্ক থাকে আইকা। তা থাকে ও। নিজেকে যতটা সম্ভব যত্ন করে। কিন্তু তাও আজ কেন মনে হচ্ছে যে, শরীর ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে? কেন মনে হচ্ছে জীবন পালটে যাচ্ছে ওর?

কোমরে আর বুকের ওপরে দাঁতের দাগ হয়ে গিয়েছে। ঋষি এমন করে কামড়ে দিয়েছে! ব্যথা করছে বেশ! আইকার এসব মারামারি, আঁচড়ানো, কামড়ানো ভাল লাগে না একটুও! আর ঋষি ঠিক উলটো! মারবে, কামড়াবে, হাত-পা বেঁধে রাখবে!

আইকা রাগ করে, বলে, “এত পর্নো দেখো না। ওসব ওদের শুটিং-এ ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে ওসব নোংরামো ভাল লাগে না!”

ঋষি হাসে, বলে, “ডার্টি সেক্স ইজ় দ্য রাইট কাইন্ড অফ সেক্স ডিয়ার!”

বিরক্ত লাগছে আইকার। আজকাল ঋষির ওপর খুব বিরক্ত লাগে। আগে যাও-বা আড্ডা হত, ইদানীং সেটাও হয় না। শুধু কোন কোম্পানির শেয়ার উঠল, কোন কোম্পানির শেয়ার পড়ল! অসহ্য বোরিং সব তথ্য! আর সেটা শেষ হলেই মারামারি করে সেক্স! আইকার মনে হচ্ছে একটা সীমারেখা টানতে হবে এবার। ঋষিকে ঝেড়ে ফেলার সময় এসে গিয়েছে! কিন্তু এখনই এসব মনে হচ্ছে কেন? ঋষি কি সত্যি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে, নাকি ওর মনটা অন্যদিকে টাল খেয়ে যাচ্ছে!

আজ সেক্স করার সময় আবছায়া ঘরে যখনই চোখ বন্ধ করছিল, বারবার ওই মুখটা ভেসে উঠছিল কেন? কেন ওই মুখটাকে মনে করে বারবার ও ঋষিকে আঁকড়ে ধরছিল? কীসের জন্য ওই রাজারহাটের অফিস-ফেরতা বৃষ্টির গন্ধটা স্মৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল?

ঋষির কাছে আসার আগে একটা মজা ছিল, কিন্তু এখন কেমন যেন একটা ঋষির মনরক্ষার দায় হয়ে পড়েছে। তারপর এমন করে আঁচড়ে, কামড়ে ওকে যন্ত্রণা দেওয়াটা আর নিতে পারছে না।

রাজারহাটের এই ফ্ল্যাটের বাথরুমটা বেশ বড়। ফ্রস্টেড কাচের বাক্সের মধ্যে দারুণ সুন্দর শাওয়ার লাগানো আছে। শুধু মাথার ওপর থেকেই নয়, নানা জায়গা থেকে জল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরে।

সাদা বড় শ্বেতপাথরের বাথটাবও রয়েছে এক পাশে। পাথুরে বেসিনের পাশের কাবার্ডে নানারকম বাথসল্ট আর কোলন। ঋষি খুব যত্ন করে সাজিয়েছে বাথরুমটা।

এই বাথরুমে এলেই আইকার মনে পড়ে যায় ওদের সেই যাদবপুরের ভাড়াবাড়ির বাথরুমের কথা! অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ঘর। দুর্বল চল্লিশ পাওয়ারের হলদেটে বাল্‌ব। শ্যাওলা-পড়া মেঝে। এক কোণে রাখা ভাঙা টিনের বালতি। প্লাস্টিকের, তলা সাদা হয়ে যাওয়া মগ। একপাশে টাঙানো একটা নাইলনের দড়ি। বড়জোর একজন মানুষ দাঁড়িয়ে স্নান করতে পারে। আইকার যে কী কষ্ট হত! দেওয়ালের ঝুল, আরশোলার ওড়াউড়ি আর জাল পেতে বসে থাকা ডোরাকাটা মাকড়সা দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত আইকা! শুধু ভাবত জীবনে যদি কোনওদিন ভাল করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তা হলে যে-বাড়িটা করবে সেখানে সুন্দর একটা বাথরুম তৈরি করবে ও।

ভবানীপুরে ওদের বাথরুমটা সুন্দর করে সাজিয়েছে আইকা। কিন্তু ঋষির এই বাথরুমের মতো নয় সেটা।

কাচের ঘরে ঢুকে শাওয়ারটা খুলে দিয়ে আইকা ভাবল, ঋষির সঙ্গে দেখা না হলে ওর কোনও আফশোস থাকবে না, শুধু এই বাথরুমটার জন্য ওর মনখারাপ করবে মাঝে মাঝে!

গায়ে জল পড়ামাত্র কেমন পিঠের চিড়চিড়ে জ্বলুনিটাও আরও বেড়ে গেল যেন! আইকার মাথাটা গরম হয়ে গেল আরও! ঋষিটা একটা জানোয়ার! আইকার অবাক লাগছে, কী করে ও এই দেড়বছর ঋষিকে সহ্য করল!

শাওয়ারের তলায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল আইকা। সারা দিনের কাজের পর এখানে এসে ঋষিকে সহ্য করে এখন শরীরটা কেমন যেন ছেড়ে দিচ্ছে। ঘুম এসে জড়িয়ে যাচ্ছে চোখে। মনে হচ্ছে জলের তলায় দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়ে!

মে মাসের কলকাতা বাইরে জ্বলছে! সন্ধেবেলাতেও কেমন একটা গরম ভাপ যেন! এ বছর একটা মাত্র কালবৈশাখী হয়েছে। তারপরে আর মেঘের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না আকাশে! ধুলোমাখা একটা শহর ক্রমশ আরও ধুলোটে আর আবছায়া হয়ে যাচ্ছে যেন!

সেই সব থেকে দূরে এই জলের তলায় শরীর আস্তে-আস্তে কেমন যেন নিভে আসছে আইকার।

“উই হ্যাভ টু বি ভিজিলেন্ট আইকা,” আজ রুপিন বলছিলেন ওকে, “যেভাবে কমপিটিশন বাড়ছে, উই হ্যাভ টু বি ভিজিলেন্ট। রিয়েল এস্টেট একটা অদ্ভুত ব্যাবসা! মানুষ তার অনেক সাধ আর পরিশ্রম এখানে ইনভেস্ট করে। ইটস নট ওনলি অ্যাবাউট মানি। প্লাস এত রাজনৈতিক ইন্টারফেয়ারেন্স! এভ‌রিবডি ওয়ান্টস হিজ় পিস অফ কেক উইদাউট এনি এফর্ট! লাস্ট ইয়ার আমাদের বিজ়নেস ডিপ করেছে খানিকটা। এমনিতেই রিসেশন আর ডিমনিটাইজ়েশন আমাদের থমকে দিয়েছিল কিছুটা। তাই সামনে উই হ্যাভ আ স্টিপ ক্লাইম্ব! ব্যাবসা বাড়াতেই হবে। নো আদার ওয়ে। ম্যানেজমেন্ট তোমার ওপর ভরসা করছে। এই কাজে নানা ফাইনান্সারও ইন্টারেস্টেড। সোনাঝুরির প্রজেক্টটা কিন্তু হট প্রপার্টি। অনেকের নজর আছে ওতে। ইউ মাস্ট স্টেপ অন দ্য গ্যাস! গঙ্গার পাশে অত সুন্দর জায়গা! ওই বড় বাড়ি প্লাস আশপাশের জমিগুলো নিয়ে নিতে পারলে আমাদের বিজনেস বুস্ট হবে। বুঝলে?”

আইকা এর সবটাই জানে। রুপিন তাও কেন যে এসব বারবার বলেন কে জানে! সোনাঝুরি জায়গাটা গঙ্গার বাঁকের পাশে। সুন্দর ছিমছাম একটা মফস্‌সল। এখানে হাউজ়িং হলে খুব ভাল হবে, সেটা জানে আইকা। কলকাতা থেকে মাত্র চোদ্দো-পনেরো কিলোমিটার দূরত্ব। তার সঙ্গে নদীটাকেও ব্যবহার করার একটা ভাবনা আছে ওদের মাথায়। আমাদের এখানে এত রাস্তা কম। গাড়ি, ট্রেন আর মেট্রোর ওপর এমন বিশাল চাপ! কিন্তু একটা এত বড় নদী পড়ে আছে সেটাকে আমরা কাজে লাগাই না সেভাবে! কেন কে জানে! হ্যাঁ, স্থানীয়ভাবে কিছু লঞ্চ, স্টিমার আর ভটভটি চলে বটে, কিন্তু সেটা দরকারের তুলনায় খুব কম। জলপথে কি অনেকটা জুড়ে ফেরি চালানো যায় না?

রুপিন মানুষটা ভাল। ঠিক টিপিকাল বস নন। বরং অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেন। কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য কখনও বকাবকি করেন না।

আইকা জানে এই প্রজেক্টটা ওর ওপরে ওঠার সিঁড়িও। এটাকে যদি ক্র্যাক করতে পারে, তা হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রজেক্ট-এর জন্য হয়তো ওর নামটা উঠবে।

স্নান সেরে বেরিয়ে আইকা দেখল ঋষি জামাকাপড় পরে নিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল সেট করছে। চুল ঋষির একটা অবসেশন। কতরকমের স্প্রে আর জেল যে লাগায়!

ওকে আয়না দিয়ে দেখে ঋষি ঘুরে দাঁড়াল, “লুকিং হট ইন টাওয়েল!”

আইকা বিরক্ত গলায় বলল, “সারাক্ষণ এসব ভাল লাগে না আমার। তুমি কি ম্যানিয়াক?”

ঋষি থমকে গেল, “তাওয়া গরম হ্যায় কেয়া?”

আইকা নিজের ব্যাগ আর জামাটা তুলে পাশের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “শাট আপ।”

পাশের ঘরটাও বড়। কিন্তু ফ্ল্যাট বেশির ভাগ সময় খালি থাকে বলে এই ঘরে তেমন কিছু আসবাব নেই। শুধু একটা দেওয়ালজোড়া আলমারি আর তাতে লাগানো আয়না রয়েছে।

দ্রুত জামাকাপড় পরে নিল আইকা। তারপর ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে চুলটা আঁচড়ে নিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। একটা লিপস্টিক বের করে হালকা করে বুলিয়ে নিল ঠোঁটের ওপর। নিজেকে সামান্য দেখে নিল, তারপর ঋষির ঘরের দিকে এগোল।

ঋষি বিছানায় বসে গাড়ির চাবিটা ঘোরাচ্ছিল হাতে। ওকে দেখে উঠে দাঁড়াল, “তুমি এতক্ষণ ধরে স্নান করো কেন?”

“আমার ইচ্ছে!” আইকার যেন সহ্য হচ্ছে না ঋষিকে। ওর নিজের এমন রূঢ় ব্যবহার নিজের কাছেই কেমন যেন আশ্চর্য লাগছে।

ঋষি ভুরু কুঁচকে বলল, “কী হয়েছে? আরে, তোমার এই স্নানের জন্য পাপার কাছে আমায় ঝাড় খেতে হল। বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল আগেই। পলকের বাবা-মা আজ আসবে ডিনারে। তারা শালা, এক ঘণ্টা আগেই এসে গিয়েছে। এখন পাপা আমার জান খাচ্ছে! সল্ট লেক থেকে বুয়াদের তুলে নিয়ে যেতে হবে আমায়। আই অ্যাম অলরেডি সো লেট!”

আইকা বলল, “তাতে আমি কী করব! তোমায় আমি বলেছিলাম, আজ এখানে আসব? অফিসের পরে তুমিই তো আমায় জোর করে নিয়ে এলে। আমার গাড়িটা পর্যন্ত আনতে দিলে না! ইফ ইউ কান্ট কন্ট্রোল দ্যাট টাইনি থিং অফ ইয়োর্স, হোয়াট দ্য ফাক ক্যান আই ডু?”

“টাইনি?” ঋষি অবাক হয়ে নিজের প্যান্টের দিকে তাকাল।

“নয়তো কী! আর মুখ খুলিয়ো না,” আইকা বিরক্ত হল, “পলক কি এমনি তোমার সঙ্গে বেড শেয়ার করে না!”

ঋষি থতমত খেয়ে কী বলবে বুঝতে পারল না কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আরে, এসব কথা বলছ কেন? বুঝতে পারছ না, আমার দেরি হয়ে গিয়েছে?”

“ডোন্ট ইয়েল!” আইকার মনে হল হাতের ব্যাগটা ছুড়ে মারে ঋষির মুখে। ও বলল, “চলো এখন।”

ঋষি ঘড়ি দেখল একবার। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগাতে-লাগাতে বলল, “শিট, আই অ্যাম সো লেট। আইকা, আমি তোমায় কিন্তু ভবানীপুরে ড্রপ করতে পারব না। তুমি একটা অ্যাপ-ক্যাব ধরে নাও।”

“মানে?” আইকা ভুরু কুঁচকে তাকাল, “এখন সাড়ে আটটা বাজে। এই সময়ে রাজারহাট থেকে আমি ট্যাক্সি করে বাড়ি যাব?”

“হ্যাঁ, যাবে,” ঋষি বিরক্ত হল, “আরে, আমার বাম্বু হয়ে গিয়েছে পুরো। আমাদের নতুন পেপার মিলে পলকের বাবাও ইনভেস্ট করবে। পাপা চায় আজকেই কথা ফাইনাল করে নিতে। আমায় প্রেজ়েন্ট থাকতে হবে। পলক যদি কিছু ট্রাবল ক্রিয়েট করে, অল উইল বি লস্ট! আমি পারব না তোমায় পৌঁছে দিতে।”

আইকা আর কথা বাড়াল না। লিফটে করে নেমে সোজা বড়রাস্তার দিকে হাঁটা দিল। ঋষি দেখেও কিছু বলল না। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার জন্য উলটো পথে চলে গেল ও।

আইকা বড়রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল একটু। রাগে গা-হাত-পা জ্বলছে! আর কোনওদিন একবার ঋষি আসতে বলুক! বাপের সঙ্গে ওর শ্বশুরেরও বিয়ে দেখিয়ে ছাড়বে!

রাজারহাট এখন অনেক জমজমাট। মোবাইল দিয়ে গাড়ি বুক করতে অসুবিধে হল না ওর। কাছেই ছিল গাড়িটা। এসে পড়ল মিনিটপাঁচেকের মধ্যে। শেয়ারের গাড়ি। পেছনের সিটে দু’জন বসে রয়েছে। গাড়ির ভেতরের অন্ধকারে স্পষ্ট করে মুখ দেখতে পেল না আইকা। কিন্তু বুঝল, খুব কিছু ভাল ঘরের নয়। জানলার দিকে বসে থাকা ছেলেটার মাথায় আবার একটা ব্যান্ড! রোগা-পাতলা চেহারায় ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে ব্যান্ডটা দেখতে কেমন যেন লাগছে! আইকা গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। ওর পাশে বসা ছেলেটার চেহারাটা বেশ বড়সড়। ও বসতেই ছেলেটা যথাসম্ভব সংকুচিত হয়ে বসল।

গাড়ি চলতে শুরু করলে আইকা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। এই দিকটা এখনও মূল শহরের তুলনায় ফাঁকা। তবে বছরপাঁচেকের মধ্যে একদম পালটে যাবে সবকিছু।

গাড়ির এসি চলছে। আইকার কেমন যেন ঘুম-ঘুম পাচ্ছে! সারাদিন অফিসের পরে ওর ঋষির সঙ্গে এখানে আসা ঠিক হয়নি।

আইকা ঘুম কাটাতে মোবাইলটা বের করে দেখল। নোঈকে একটা মেসেজ করেছিল, এখনও ‘সিন’ হয়নি। মেয়েটা গিয়েছিল কি? আজ তো যাওয়ার কথা ছিল। নোঈকে বিশ্বাস নেই। যা জেদি মেয়ে! সামান্য কিছু হলেই গোঁজ হয়ে থাকে মাঝে মাঝে! কী যে করবে বোঝা যায় না।

পুশকিনের কাজ়িনের সঙ্গে বিয়েটা ভেস্তে দিল! কেন দিল কে জানে! প্রেম-টেম যে নোঈর নেই, সেটা জানে আইকা। আগে একটা ছেলে ছিল। কিন্তু ছেলেটা নিজে ওকে ছেড়ে গিয়েছে। নোঈ দীর্ঘদিন এই নিয়ে ডিপ্রেসড ছিল। এখন তাও কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়। আসলে এই ব্যাপারগুলো ঠিক ভাল করে বোঝে না আইকা।

শুভর সঙ্গে ওর বিয়েটা শুভর দিক থেকে প্রেমে পড়ে হলেও, ওর কাছে সেটা ছিল একটা সুরক্ষিত জীবনের হাতছানি। থাকতে-থাকতে একটা মায়া আর ভাললাগা জন্মালেও সেই যে সর্বগ্রাসী প্রেম, সেটা কিন্তু হয়নি। আর আইকা যেমন, ওর প্রেমে গন্ডগোল হলে, তার জন্য মনখারাপ করে না থেকে সেটা কী করে সমাধান করা যায় সেটার দিকেই ওর বেশি ঝোঁক থাকত। এসব লবঙ্গলতিকা হয়ে ফুল স্পিডে ডিপ্রেশন চালিয়ে যাওয়ার মেয়ে ও নয়।

নোঈকে ও পছন্দ করলেও নোঈর এই জিনিসটা ওর ভাল লাগে না! কিছু-কিছু মানুষ আছে প্রেমের জন্য বড্ড হেদায়! জীবনে যেন আর কিছু নেই!

পুশকিনের সঙ্গে কথা বলে আসার সেই দিনেই রাতে নোঈদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল আইকা।

পুটুমাসি টিভি দেখছিল। রাঙামেসো যথারীতি নিজের ঘরে ল্যাপটপে বিদেশি ফিল্ম নিয়ে বসেছিল।

আইকা ঘরে ঢুকেই পুটুমাসিকে বলেছিল, “নোঈ কোথায় গো? ওর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”

পুটুমাসি টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে বলেছিল, “ওর ঘরে আছে, যা না।”

“না, ওকে ডাকো,” আইকা ইচ্ছে করে টিভিটা আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল।

“আরে,” পুটুমাসি ছটফট করে উঠে বলেছিল, “আরে, ঝগড়াটা দেখতে দে ভাল করে, সর!”

“ডাকো নোঈকে,” আইকা বলেছিল, “আর অত ঝগড়া দেখার ইচ্ছে হলে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

নোঈকে ডাকতে হয়নি।

“কী রে দি? কিছু বলবি?” নোঈ হাতে মোবাইলটা নিয়ে নিজেই বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে।

নোঈর চোখে বেশ হাই পাওয়ারের চশমা। আইকা কতবার বলেছে সেটা পালটে কন্ট্যাক্ট করে নিতে, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই নেবে না। এত সুন্দর দেখতে নোঈকে, কিন্তু একটুও সাজে না। শুধু মাঝে মাঝে টিপ পরে। তাও সামান্য ওপরে। এখন আবার এই ফ্যাশনটা ফিরে এসেছে!

শাড়ি পরেছিল নোঈ। আর কপালে একটা অনুস্বরের মতো দেখতে আঁকা টিপ!

“এই ফিরলি নাকি?” জিজ্ঞেস করেছিল আইকা।

নোঈ বলেছিল, “হ্যাঁ, শ্বেতার বাড়িতে একটা নেমন্তন্ন ছিল। ও চণ্ডীগড় থেকে এসেছে সাতদিনের জন্য। কিছু বলবি দি?”

আইকা কিছু বলার আগেই পুটুমাসি বলেছিল, “তোরা আমায় দেখতেই দিলি না সিরিয়ালটা! শাশুড়িটা বউয়ের রান্না করা খাবারে সব লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে দিল লুকিয়ে। এবার কী যে হবে!”

“ধ্যাত্তেরি!” আইকা রিমোট তুলে টিপে বন্ধ করে দিয়েছিল টিভিটা! বলেছিল, “অফিস থেকে এসেছি দরকারি কথা বলতে! সেখানে এসব চালিয়ে রেখেছে!”

নোঈ সোফায় বসে তাকিয়েছিল আইকার দিকে, “কী হয়েছে দি?”

“তোর চাকরির কথা বলতে এসেছি আমি,” আইকা সময় নিয়ে তাকিয়েছিল নোঈর দিকে। মেয়েটা কারও থেকে কিছু নেয় না। এই কথাটায় কী প্রতিক্রিয়া দেবে বুঝতে পারছিল না।

নোঈ কিছু বলেনি। বড়-বড় চোখ করে তাকিয়েছিল আইকার দিকে। পুটুমাসির মুখে বরং আগ্রহ ছিল বেশি।

আইকা বলেছিল, “আমি আজ গিয়েছিলাম পুশকিনদের অফিসে। ওরা বিশাল বড় কোম্পানি! মাল্টিন্যাশনাল জায়ান্ট! রিকো গ্রুপ! কলকাতায় সদ্য অফিস খুলেছে। প্রজেক্টের কাজ করে। রিক্রুট করছে। আমি তোর কথা বলেছি। পুশকিন বলল তোর সিভিটা পাঠাতে।”

“পুশকিন কে?” পুটুমাসি ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল।

আইকা বলেছিল, “তুমি কিছু মনে রাখতে পারো না কেন গো? সেই যে ডিনো না কে এসেছিল না নোঈকে দেখতে, ওর সেই দাদা!”

পুটুমাসি থমকে গিয়েছিল একটু। তারপর ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠেছিল, “না না, একদম নয়। নোঈ ওদের সঙ্গে যা করেছে তাতে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে ওদের সামনে? সম্ভব নয়!”

“আরে,” আইকা বিরক্ত মুখে বলেছিল, “কেন সম্ভব নয়? চাকরি করতে অসুবিধে কোথায়? আর বিয়ের সম্বন্ধ না-ই হতে পারে! তাতে কি জীবন আটকে থাকবে?”

পুটুমাসি বলেছিল, “আমাদের একটা মানসম্মান নেই নাকি? চাকরি দেবে বললেই যেতে হবে?”

“চাকরি দেবে বলেনি। বলেছে যোগাযোগ করতে!” আইকার মাথা গরম হচ্ছিল, “তুমি এসব কেন কমপ্লিকেটেড করছ? কাজ তো রে বাবা!”

“না, ও যাবে না,” পুটুমাসি গোমড়ামুখে বলেছিল, “সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না? আমাদের এতে অসম্মান হবে। নোঈ যাবে না।”

“আরে, যুক্তিটা কী?” আইকা কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

পৃথিবীতে গোঁয়ারতুমির মতো অসুখ কমই আছে! ইগো আর গোঁয়ারতুমির জন্য সারা পৃথিবীর আজ এই অবস্থা!

“আমি বলেছি যাবে না, সেটাই শেষ কথা,” পুটুমাসি বুকের কাছে হাতদুটো আড়াআড়িভাবে জড়ো করে এমন একটা ভঙ্গি করেছিল, যার অর্থ হল এর পর আর কথা চলে না!

“দি আমায় ই-মেল আইডিটা দিস, আমি সিভি পাঠিয়ে দেব,” নোঈ শান্ত গলায় বলেছিল।

“কী?” পুটুমাসি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, “তুই… তুই ওখানে চাকরি করবি? মানে ওদের ওখানে…”

“ওদের ওখানে মানে?” নোঈ ঠান্ডা চোখে তাকিয়েছিল পুটুমাসির দিকে, “অফিসটা কি ওই ডিনোদের নাকি? পুশকিন নিজেও চাকরি করে। আমার করতে অসুবিধে কোথায়!”

পুটুমাসি কিছুক্ষণ নোঈর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের মনে বলেছিল, “ঠিকই তো। আমি আর কে হই? যেমন বাপ তেমন মেয়ে! আমি তো দাসীবাঁদি হয়ে থাকার জন্যই এসেছি এই বাড়িতে! যা পারিস কর, কিন্তু পরে কিছু হলে আমার কাছে কাঁদতে আসবি না!”

আইকা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল পুটুমাসিকে। আর ভাবছিল পরে কী হতে পারে? পুটুমাসি কী হবে বলে ভয় পাচ্ছে?

আইকা ই-মেল আইডি দিয়েছিল নোঈকে। তারপর পুশকিনের মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে বলেছিল, “সিভিটা পাঠিয়ে একটা মেসেজ করে দিবি। ও ইন্টারভিউয়ে ডেকে নেবে।”

পুটুমাসি শেষ চেষ্টা করার মতো করে বলেছিল, “আবার একবার ভেবে দেখ, আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে কিন্তু।”

নোঈ শুধু ছোট্ট করে বলেছিল, “এত দুর্বল ঘাড় হলে তো মুশকিল!”

আচমকা মুঠোর মধ্যে থাকা মোবাইলটা কেঁপে উঠল। আইকা চমকে উঠল। ও কি ঘুমিয়ে পড়েছিল! কতটা এল গাড়ি? সামান্য সোজা হয়ে বসল আইকা। আবছায়া গাড়ির ভেতরে সামান্য একটু সময় আইকার কেমন যেন লাগল। মাথাটা যেন পুরো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে!

ও আলগোছে পাশে তাকাল একবার। ছেলেদুটো নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কথা বলছে। এবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে সায়েন্স সিটি চিনতে পারল আইকা। মানে সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল ও!

ফোনটা এখনও মুঠোর ভেতর কাঁপছে! আইকা দেখল স্ক্রিনটা। অচেনা নাম্বার! এখন কে ফোন করল?

ও ফোনটা ধরে কানের কাছে নিল। আলতো গলায় বলল, “কে বলছেন?”

“আমি তারকবাবুর কাছ থেকে বলছিলাম,” ও পাশের গলাটা খরখরে। সামান্য রূঢ়।

“পার্ডন,” নিজের অজান্তেই আইকার ভুরু কুঁচকে গেল। আজকাল কী যে হয়েছে! বেশির ভাগ মানুষ কেমন একটা বিরক্তি আর রাগ মেশানো গলায় কথা বলে! সবার যেন প্রচুর তাড়া! সবার প্রচুর কাজ! সবাই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে, এমন একটা ভাব। আইকার মনে হয়, আসলে কি সবাই একটা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে? তাই কি বাইরে এমন একটা বর্ম পরে থাকে?

“কী?” লোকটা থমকে গেল এক মুহূর্ত।

আইকা বুঝল ইংরেজিটা বুঝতে পারেনি।

তারপর আবার বলল, “আরে, আমি সোনাঝুরির তারক চক্রবর্তীর অফিস থেকে বলছি। স্যারকে আপনি ফোন করেছিলেন না কাজের ব্যাপারে, তাই স্যার বললেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন,” আইকা এবার নড়েচড়ে বসল। আরে, লোকটা সোনাঝুরি থেকে ফোন করেছে! ওই প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলতে সত্যিই তারক চক্রবর্তীকে কয়েকদিন আগে ফোন করেছিল আইকা। কিন্তু ভদ্রলোক কথা বলতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন, ঠিক সময়ে ডেকে নেওয়া হবে। আইকা বুঝতে পারেনি কতদিনে ঠিক সময় হবে!

এখন ভাবল লোকটা ভুলে যায়নি।

লোকটা বলল, “স্যার বললেন, আপনি পরশুদিন একবার আসবেন। এই সকাল দশটার দিকে।”

“ঠিকানাটা একটু বলবেন?”

“ঠিকানা?” লোকটা হাসল, “আরে, স্টেশনে নেমে যে-কোনও রিকশাওয়ালাকে বলবেন তারক চক্রবর্তীর অফিসে যাব, নিয়ে যাবে। আর গাড়িতে এলে সোনাঝুরি ব্রিজের কাছে এসে একই কথা যে-কাউকে জিজ্ঞেস করবেন। সোনাঝুরিতে থাকতে হলে তারক চক্রবর্তীর অফিসটা চিনতে হয়। বুঝলেন? দেরি করবেন না। স্যারের হেভি কাজ থাকে। নমস্কার।”

ফোনটা কেটে চুপ করে বসে রইল আইকা। গাড়ি জ্যামে থামতে-থামতে এখন বালিগঞ্জ স্টেশন পেরিয়ে গড়ি়য়াহাট মোড়ের দিকে দৌড়োচ্ছে।

রুপিনকে কি একবার ফোন করে জানাবে? রাত হয়ে গিয়েছে। যদিও রুপিন একাই থাকেন। আলিপুরে কোথাও একটা ফ্ল্যাট আছে। কিন্তু তাও এমন সময় কি ফোন করে জানানোটা ঠিক হবে?

নাঃ, কাল অফিসেই জানাবে। মত বদলে বাইরের দিকে তাকাল আইকা। গড়িয়াহাটের সিগন্যালটা আজ খোলা আছে। তাই জ্যাম পেরিয়ে গাড়ি রাসবিহারীর দিকে যাচ্ছে। তবে দ্রুত যেতে পারছে না। সিগনালটা পেরিয়েই অটোস্ট্যান্ড। সেখানে এমন করে গাড়িগুলো জটলা পাকাচ্ছে, বিরক্ত লাগছে আইকার! নিজের গাড়িটা আনলে কত সুবিধে হত! ঋষিটাকে আর জাস্ট নিতে পারছে না ও! আইকা ভবানীপুর যাবে। ছেলেগুলোও নিশ্চয় সামনে কোথাও নামবে।

বাইরের দিকে চোখ থাকলেও এবার ছেলেগুলোর কথা কানে আসতে লাগল ওর।

জানলার দিকে বসা মাথায় ব্যান্ড পরা ছেলেটা চাপা গলা বলল, “তুই শালা গান্ডুই রয়ে গেলি। তোকে রিতুদা বলল একটা মেশিন রাখতে, তুই সতীপনা করতে শুরু করে দিলি। আরে, দাদার কথা শোন, পেলেয়ার কোটায় ভাল জাগায় ঢুকিয়ে দেবে। রিতুদা তোর ওপর ভরসা করে মাহির। এমন উদো হয়ে থাকিস না।”

মাহির বলে ছেলেটা যে আড়চোখে আইকাকে দেখল একবার, সেটা খুব ভাল বুঝতে পারল ও।

মাহির এবার চাপা গলায় বলল, “তোকে বলেছি না, এমন জায়গায় মুখ সামলে কথা বলবি! এত গালাগালি দিস কেন? তোর লজ্জা নেই, আমার আছে। এদিকে আমার মাথাখারাপ হয়ে যাচ্ছে! জানিস তো ভাইটার কী হাল! ডাক্তার বলেছে ডায়ালিসিস করতে হবে। এক-একদিন কত করে টাকা লাগবে বুঝতে পারছিস? আমরা কোথায় যাব বল তো?”

“আঃ,” অন্য ছেলেটা বলল, “সামনে টাকার আলমারি নাচছে, সেখানে ঢ্যামনামো করছিস কেন? তোর ভাই পটল তুললে সতীপনা করিস একা-একা।”

মাহির বলল, “পতাদা বলল, আর-একটা ট্রায়াল আসছে। সেটায় নামকরা সব কোম্পানি আসবে। চাকরি হতেও পারে রে, টিটি।”

“তোর ওই বা…” টিটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “পতাদার পাছায় তিনটে লাথ মারা উচিত। ঢপবাজ বুড়ো। শালা। রিতুদাকে বল মাহির। হাতের লক্ষ্মী বুঝলি! এই যে কাজটায় এলাম। পেমেন্ট নিলাম। এই যে এসি গাড়িতে ফিরছি, সেটা কি রিতুদা না থাকলে হত! শালা বাসে ধাক্কা খেয়ে ঘামের গন্ধ শুঁকে ঢিকিরঢিকির করে ফিরতে হত! বোঝ রে গা…” টিটি আবার নিজেকে সামলে নিল।

“স্যার, আপনারা কোথায় নামবেন?” সামনের দিক থেকে ড্রাইভারটি মুখ না ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“রাসবিহারীর সিগন্যাল তো খোলা আছে, ওই রাইট টার্ন নিয়ে হাজরার দিকে ঘুরিয়ে বাঁ দিক করে নামিয়ে দিন,” টিটি বলল।

ড্রাইভার সিগন্যাল পার করে ওদের নামিয়ে দিল। ওরা নামবে বলে আইকাকেও নেমে দাঁড়াতে হল। আইকা শুনল ওই টিটি বলে ছেলেটা চাপা গলায় বলছে, “কী বলল শুনলি? স্যার! শালা খিস্তি দিয়ে ছাড়া আর কেউ কোনওদিন কিছু বলে ডেকেছে আমাদের? এটাও রিতুদার জন্য।”

ফ্ল্যাটের সামনে যখন পৌঁছল আইকা, সাড়ে ন’টা বেজে গিয়েছে। গেটের কাছে সুশান্ত মাগোকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাগো আইকাকে দেখামাত্র হাত বাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ল! আইকা হেসে কোলে তুলে নিল ওকে।

সুশান্ত বলল, “দিদি, আপনি এই এলেন। ফ্রেশ হয়ে নিন, তারপর ওকে আমি দিয়ে আসব আপনার কাছে!”

আইকা মাগোকে কোলে করে লিফটের দিকে এগোতে-এগোতে বলল, “চড় খাবি বুড়োবয়সে?”

লিফটের মধ্যে আইকা মাগোর সঙ্গে একটু খেলে নিল। মেয়েটা খিলখিল করে খুব হাসে। আইকার কাঁধের ব্যাগের মধ্যে ঝুঁকে পড়ে খোঁজে আজ আইকা কী নিয়ে এসেছে ওর জন্য।

আইকা রোজ মাগোর জন্য কিছু না-কিছু নিয়ে আসে। আজও ট্যাক্সি থেকে নেমে মিল্ক চকোলেট নিয়ে এসেছে। মাগো ব্যাগের চেন খুলতে চেষ্টা করছে দেখে আইকা নিজেই সেটা বের করে দিল। মেয়েটা সেটা নিয়েই হেসে উঠল আবার!

আইকা জানে মাগো এটা একা খাবে না। প্যাকেট খুলে নিজের হাতে আইকাকে খাইয়ে দেবে কিছুটা। ওইটুকু সময়ের জন্য সারাদিন আইকা অপেক্ষা করে। খুব খারাপ কাটা দিনও ওইটুকু সময়ের ছোঁয়ায় কতবার যে ভাল হয়ে উঠেছে!

আইকা নিজের ফ্ল্যাটের দিকে যাওয়ার সময় আচমকা থমকে দাঁড়াল। আরে, পুটুমাসিদের ফ্ল্যাটের দরজা সামান্য খোলা কেন?

পাশের ফ্ল্যাট, সামনে দিয়েই যেতে হয়। আইকা একবার বেলটা বাজিয়ে দরজাটা সম্পূর্ণ ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। দেখল, আজ বসার ঘরে রাঙামেসোও বসে আছে। টিভি বন্ধ। কেমন একটা খুশি-খুশি হাওয়া খেলছে ঘরে।

ওকে দেখেই মেসো হাসল। বলল, “তুই আবার কবে থেকে বেল বাজিয়ে ভেতরে আসতে শিখলি!”

আইকা কী বলবে বুঝতে পারল না। ও অবাক হয়ে দেখল পুটুমাসি আর নোঈর মাঝখানে সোফায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে পুশকিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *