১৩. ঘোড়েপর হাওদা

ঘোড়েপর হাওদা

কাশীতে দশাশ্বমেধ ঘাট সবার জানা। গঙ্গার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানদিকে বাঙালিটোলার সরু গলি। গলির মুখ থেকে অল্প হাঁটলেই চৈত সিংয়ের প্রাসাদ। বাড়ির পিছন দিক থেকেও আসা যায়। তখন নৌকা ভরসা। ইংরাজ সৈন্যরা আক্রমণ করলে রাজা চৈত সিং নৌকা করে পালিয়েছিলেন। কী করে তাঁর এরকম বিপদ হল সেই কথা বলছি।

চৈত সিংয়ের ঠাকুর্দার নাম ছিল মনসারাম। ইনি অনেক টাকা জমিয়েছিলেন ও জমি-জমাও করেছিলেন। তিনি ছিলেন জমিদার, তাঁর ছেলে বলবন্ত সিংকে সবাই রাজা বলত। তাঁর জমিদারি তাঁর বাবার চেয়ে অনেক বড় ছিল। তিনি অযোধ্যা নবাবের অধীন ছিলেন। ১৭৭৫ সালে প্রভু বদল হল। সন্ধির ফলে চৈত সিংয়ের জমিদারি ইংরাজদের অধীনে চলে এল। ঠিক হল চৈত সিং এখন থেকে কর জমা দেবেন পাটনায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খাতাঞ্চি-খানায়। করের পরিমাণ ২২,৫০,০০০ টাকার কাছাকাছি। ঠিক হল চৈত সিংয়ের জমিদারিতে কোম্পানি কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবেন না। কোম্পানির পক্ষ থেকে আরও বলা হল চৈত সিং দু-হাজার অশ্বারোহী রাখবেন। সেটা তাঁর ইচ্ছা হলে তবে। তিনি রাখতে বাধ্য নন। চৈত সিং অশ্বারোহী রাখবেন বলে কোনো অঙ্গীকারও করেননি। কোম্পানির যদি এই অশ্বারোহীর সাহায্যের দরকার হয় তাহলে তার জন্য চৈত সিংকে খরচপত্রের টাকা দেওয়া হবে। এই অশ্বারোহীর দল রাখা না রাখা চৈত সিং-এর মর্জির উপর নির্ভর করবে। এজন্য ইংরাজরা কোনোরকম জোর করবেন না।

১৭৭২ সালে হেস্টিংস গভর্নর-জেনারেল হলেন। তখন কোম্পানির টাকা-পয়সার টানাটানি। মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে অনেক টাকা খরচ হল। ১৭৭৮ সালের মাঝামাঝি কলকাতায় খবর এসে পৌঁছল যে, ইউরোপে ফরাসিদের সঙ্গে ইংরাজদের যুদ্ধ বেধেছে। যুদ্ধ হলেই টাকার খুব দরকার হয়। চৈত সিংকে বলা হল যে যুদ্ধের খরচ মেটাবার জন্য তাঁর কিছু করা উচিত। সেইজন্য তাঁকে তিন ব্যাটেলিয়ান সৈন্যের খরচ দিতে হবে। এক ব্যাটেলিয়ানে হাজার লোকের কিছু কম থাকে। কয়েকটি ব্যাটেলিয়ান একসঙ্গে করে ব্রিগেড তৈরি হয়। ব্রিগেড়ে হাজার দশেক সৈন্য থাকে। চৈত সিং দেখলেন তাঁর উপর অনেক টাকার দায়িত্ব এল। তিনি ইংরাজদের বললেন: এত খরচ করা তাঁর সাধ্যের বাইরে। আরও টাকা দেবার কথা হয়েছিল। চৈত সিং-এর দূত জানালেন: অসম্ভব। শেষে ইংরাজের ধমক খেয়ে দূত স্বীকার করলেন, তাঁর মনিব পাঁচ লাখ টাকা দিতে রাজি আছেন। কিন্তু এই অঙ্গীকার শুধু এক বছরের জন্য। হেস্টিংস বললেন, তা হবে না। যতদিন ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ চলবে ততদিন বছরে পাঁচ লাখ টাকা চাই।

হেস্টিংসের ধারণা হল যে, চৈত সিং গোলমাল করবার চেষ্টায় আছেন। কোম্পানির সৈন্যদের চৈত সিংয়ের রাজ্যের মধ্যে ঢুকবার হুকুম দেওয়া হল। এতে কোম্পানির যে বাড়তি খরচ হবে, হেস্টিংস জানালেন—তাও চৈত সিংকে দিতে হবে।

বছর-দুয়েক এরকম ভাবে চলল। চৈত সিং তারপর হেস্টিংসকে জানালেন যে, তিনি তাঁর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন তার জন্য তিনি অনুতপ্ত। সেই সঙ্গে হেস্টিংসকে দু-লাখ টাকা পাঠালেন। এটা ঘুষ। তখনকার দিনে বড়-বড় সাহেবদের এরকম ঘুষ দেওয়া অজানা ছিল না। হেস্টিংস একটু ইতস্তত করে টাকাটা নিলেন। কিন্তু এই টাকা নিজের তহবিলে জমা করলেন না। মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধে খরচ করবার জন্যে তুলে রাখলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে চৈত সিংয়ের কাছে জানতে চাইলেন—আরও টাকা তাঁর দেবার কথা ছিল তার কী হল? দু-হাজার অশ্বারোহী রাখবার কথা ছিল, তার কী ব্যবস্থা হয়েছে? আগেই বলেছি, দু-হাজার অশ্বারোহী যে রাখতেই হবে এমন কথা হয়নি।

ইংরাজরা দু-হাজার অশ্বারোহী থেকে আস্তে-আস্তে দেড় হাজারে নামলেন, তারপর এক হাজারে। চৈত সিং বললেন, এক হাজার অশ্বারোহীর মাইনে দেবার মতো টাকাও তাঁর নেই। তার বদলে তিনি পাঁচশো অশ্বারোহীর একটি দল তৈরি করলেন আর পাঁচশো পদাতিক যোগাড় করলেন। তারপর হেস্টিংসকে খবর দিলেন। হেস্টিংস চৈত সিংয়ের এই চিঠির উত্তর দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করলেন না—বরং ভাবলেন যে, চৈত সিংকে উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। গভর্নর-জেনারেলের কথা না শুনবার ফল কী হতে পারে তাঁকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

১৭৮১ সালের জুলাই মাসে ওয়ারেন হেস্টিংস বক্সারে এসে পৌঁছলেন। বক্সার চৈত সিংয়ের জমিদারির পূর্ব-সীমান্ত। অলিখিত নিয়ম হচ্ছে যে, সীমান্তে এরকম গণ্যমান্য অতিথি এলে সেই জায়গায় গিয়ে অতিথির অভ্যর্থনা করতে হয়। চৈত সিং বক্সারে এলেন। সঙ্গে একটি বড় নৌবাহিনী এল, তার নাবিক ও সৈন্যদের সংখ্যা দু-হাজার হবে। এত লোকজন নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে আসা উচিত হয়নি। হেস্টিংসের মেজাজ আরও খারাপ হল। চৈত সিং এইবার ভয় পেলেন। তিনি তাঁর পাগড়ি মাথা থেকে খুলে হেস্টিংসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। পাগড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার অর্থ বশ্যতা স্বীকার করা। হেস্টিংসের তখন এত রাগ হয়েছিল যে, তিনি সেই পাগড়ি গ্রহণ করলেন না। সোজা বারাণসী রওনা হয়ে গেলেন। সেখানেও হেস্টিংস চৈত সিংকে তাঁর সামনে আসতে দিলেন না—তাঁর কাছে কোম্পানির কী-কী দাবি লিখে জানালেন। চিঠিতে এমন কথাও ছিল যে চৈত সিং রাজ্যশাসন করবার অনুপযুক্ত। রাজ্যে চুরি-ডাকাতি লেগেই আছে।

চৈত সিং খুব বিনীত উত্তর দিলেন। বললেন, তাঁর শত্রুরা তাঁর যাতে সর্বনাশ হয় এমন কথা রটিয়ে বেড়াচ্ছে। চিঠির শেষে ছিল—‘আমি আপনার দাস… আপনার দিন-দিন শ্রীবৃদ্ধি হোক।’

এই চিঠি পেয়েও হেস্টিংসের রাগ কমল না। পরে তিনি তাঁর কাউন্সিলের সদস্যদের বলেছিলেন: চিঠির ভাষা দেখলেন আপনারা? এ তো নিজের সাফাই নয়, আমার বিরুদ্ধে কথা। কাশীর রেসিডেন্ট উইলিয়াম মার্কাম্কে হুকুম দিলেন, তিনি যেন পরদিন ভোরে সৈন্য নিয়ে চৈত সিংকে গ্রেপ্তার করেন। চৈত সিং যদি কোনোরকম বাধা দিতে চান তাহলে যেন মেজর পপামের সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়।

রাজাকে গ্রেফতার করা হলে পরবর্তী হুকুম না আসা পর্যন্ত মার্কাম যেন তাঁকে নিজের কাছে বন্দী করে রেখে দেন। চৈত সিং কোনো বাধা দেননি। বন্দী হবার পর হেস্টিংসকে একটি চিঠি লিখলেন। তার একটি অংশ এইরকম: আমি তো পূর্বেই আপনার নৌকায় উঠে বলেছিলাম যে, আমি কোম্পানির সেবক। মন-প্রাণ দিয়ে কোম্পানির সেবা করব। আমাকে যা করতে ইচ্ছা হয় আপনি নিজের হাতে করুন। আমি আপনার দাস। সান্ত্রীর কি কোনো দরকার আছে? রেসিডেন্ট মার্কামও ওয়ারেন হেস্টিংসকে সেই কথাই লিখেছিলন। চৈত সিং গ্রেফতার হওয়ার সময় কোনো বাধা দেননি। তিনি বলেছিলেন, তাঁর একটি মাত্র প্রার্থনা—তাঁর যেন গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা থাকে। তাঁর জমিদারি তাঁর দুর্গ, তাঁর ধনরত্ন এমনকি তাঁর নিজের জীবনও তিনি হেস্টিংসের পায়ে রাখছেন। হেস্টিংস এইবার চৈত সিংকে লিখলেন: ভয়ের কোনো কারণ নেই। মার্কামসাহেব তাঁর সঙ্গে দেখা করে সব কথা জানাবেন।

চৈত সিং লিখলেন: আপনি আমার রক্ষাকর্তা, আপনি তো আমাকে আপনার স্নেহের ছায়ায় আবৃত করে রেখেছেন। আমি এখন সব দুশ্চিন্তা ও ভয় থেকে মুক্ত। আপনিই আমার প্রভু। আপনি যা বলবেন আমি তাই ঠিক মনে করব।

হেস্টিংস যা চেয়েছিলেন এ-পর্যন্ত তাই হচ্ছিল। রাজাকে বন্দী করার খবর পেয়ে কিন্তু ঘটনা এইবার অন্য দিকে মোড় নিল। রামনগর থেকে দলেদলে সশস্ত্র লোক নদী পার হয়ে চৈত সিংয়ের প্রাসাদের দিকে আসতে লাগল। চৈত সিংয়ের প্রাসাদে যে-সব ইংরাজ সৈন্য মোতায়েন ছিল তারা হঠাৎ আবিষ্কার করল যে, তাদের সঙ্গে বন্দুক আছে কিন্তু ভুল করে গুলি আনা হয়নি। মেজর পপা্ম বিপদ বুঝতে পেরে বাইরে থেকে অন্য সৈন্যদের খবর দিয়ে ডেকে পাঠালেন। তারা যখন এসে পড়ল তখন প্রাসাদের চারপাশে চৈত সিংয়ের এত প্রজাদের ভিড় যে, ভিতরে প্রবেশ করা অসম্ভব। সরু গলির ভিতরে ইংরাজ সৈন্যরা সুবিধা করতে পারল না। চৈত সিংয়ের লোকরা শেষপর্যন্ত ইংরাজ সৈন্যদের উপর গুলি ছুঁড়তে লাগল। চৈত সিং বুঝতে পারলেন যে, ঘটনা যে দিকে যাচ্ছে তাতে তাঁর সর্বনাশ হবে। তিনি একটি ছোট দরজা দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন। জল সেখান থেকে অনেক নীচে। তিনি নিজের পাগড়ি বারান্দার সঙ্গে বেঁধে তাই ধরে নীচে নেমে গেলেন। সেখানে আগে থেকেই নৌকো রাখা ছিল। সেই নৌকোয় করে তিনি ওপারে রামনগরে পৌঁছে গেলেন।

চৈত সিংয়ের লোেকরা যখন প্রাসাদে ইংরাজ সৈন্যদের আক্রমণ করল তখন তাদের কিছু করার সাধ্য ছিল না। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের আর কেউ বাকি রইল না। তিনদিন পরে ওয়ারেন হেস্টিংস এক বড় সৈন্যদল রামনগরে পাঠিয়েছিলেন। রামনগরেও ইংরাজদের সুবিধা হল না। সেখানেও সঙ্কীর্ণ পথ, গলির মধ্যে ইংরাজদের বিপদ হতে লাগল। দুদিকে যদি বড় বাড়ি থাকে তাহলে সেখান থেকে আক্রমণ এলে তাকে প্রতিরোধ করা কঠিন। একজন ইংরাজ কর্মচারী তাঁর সৈন্য নিয়ে বিবেচনা না করে একটি গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন, সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেননি। ইংরাজ সৈন্যদের এই দ্বিতীয়বার বিপত্তি ঘটল। গুজব রটল যে, এইবার ওয়ারেন হেস্টিংসকেও আক্রমণ করা হবে। সমস্ত এলাকা জুড়ে ইংরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেষ্টা হচ্ছে। হেস্টিংস জায়গা নিরাপদ না দেখে চুনারে পালিয়ে গেলেন। এই ঘটনাকে নিয়ে একটি ছড়া তৈরি হয়েছিল—

ঘোড়েপর হাওদা, হাথি পর জিন,

জল্দি ভাগ গয়া ওয়ারেন হেস্টিন্।

হাওদা তো হাতির পিঠে লাগানো হয় কিন্তু ভুল করে তা ঘোড়ার পিঠে লাগাবার চেষ্টা হয়েছিল। এমন গোলমালে বিদ্রোহ খুব তাড়াতাড়ি বারাণসী থেকে ফৈজাবাদ ও তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হল না। জোয়ারের ঢেউয়ের মতো যা কোম্পানির শাসনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল তা আবার ভাটার জলের মতো তাড়াতাড়ি সরেও গেল। উত্তেজনা কমে আসবার পরে হেস্টিংস নতুন ব্যবস্থা নিলেন।

চৈত সিংয়ের পরিবারের একজন, মোহিপনারায়ণকে চৈত সিংয়ের জায়গায় বসানো হল। তাঁর হাতে বেশি ক্ষমতা রইল না। তাঁর বাবা দিগ্বিজয় সিংকে নায়েব করে দেওয়া হল, তাঁর হাতেই ছিল প্রকৃত ক্ষমতা। তাও আবার অনেক ছেঁটে দেওয়া হল। দিগ্বিজয় সিংয়ের বিচার-ব্যবস্থা বা টাঁকশালের উপর কোনো কর্তৃত্ব রইল না। খাজনার হার ওয়ারেন হেস্টিংস প্রায় দ্বিগুণ করে দিলেন। এখন থেকে বছরে চল্লিশ লাখ টাকা।

চৈত সিং ইতিহাস থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত এই নিয়ে অনেক আলোচনা চলেছিল। হেস্টিংসের সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, হেস্টিংসের এই কাজ কি উচিত হয়েছিল? চৈত সিং তো সাধারণ জমিদার ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রাজা। তাঁর সঙ্গে এরকম ব্যবহার কি উচিত হয়েছিল? হেস্টিংসের কি চৈত সিংয়ের উপর কোনো রাগ ছিল? এই উপলক্ষে তিনি কি শোধ তুলতে চেয়েছিলেন? অন্যদিকে হেস্টিংসের বন্ধুরা বলেছেন যে, হেস্টিংস কোথাও নিয়মের বাইরে কাজ করেননি। ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তিনি যে বাড়তি সাহায্য চেয়েছিলেন তাতে তাঁর অধিকার ছিল। তাছাড়া চৈত সিংয়ের শাসনও খারাপ ছিল। দেশে চুরি-ডাকাতির অন্ত ছিল না। হেস্টিংস যা করেছেন তার ফল ভালই হয়েছে।

শেষ কথা বলা কঠিন। ইংরাজরা বারেবারে বলেছিলেন যে, সমস্ত দেশ জুড়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেষ্টা চলেছিল। সত্যিই কি তাই হয়েছিল? হয়ে থাকলেও তাতে চৈত সিংয়ের কতটা হাত ছিল! এসব কথার কিন্তু উত্তর দেওয়া এখন আর সম্ভব নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *