১২. গোলাম কাদিরের কাণ্ড

গোলাম কাদিরের কাণ্ড

বাদশা আওরঙ্গজেবপ্রথম আলমগির ১৭০৭ সালে দাক্ষিণাত্যে মারা গেলেন। আগেই বোঝা গিয়েছিল যে, তাঁর স্থান নিতে পারেন, তাঁর বংশধরদের মধ্যে এমন কেউ নেই। বাহান্ন বছর পরে আলি গহর, দ্বিতীয় শাহ আলম, অনেকদিন রাজত্ব করেছিলেন, প্রায় ৪৭ বছর। সাম্রাজ্য বলতে তখন আর বিশেষ কিছু ছিল না। প্রথম জীবনে তিনি দিল্লি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এক সময় তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মিরকাশিমের সঙ্গে মিলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধে তাঁদের বড় রকমের হার হল। শাহ আলম তারপর বহুদিন পর্যন্ত এলাহাবাদে ইংরেজদের আশ্রয়ে থাকতেন। অবশেষে সাত-আট বছর পরে তিনি দিল্লি ফিরে গিয়ে মারাঠাদের আশ্রয়ে থাকেন। শাহ আলমের পিতৃপুরুষের সিংহাসনে বসবার আগ্রহ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরিণাম তাঁর পক্ষে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে সে কথা বোঝা যায়নি। শাহ আলমের আয়ু দীর্ঘ ছিল, দীর্ঘ আয়ু না হলে তিনি হয়তো অত কষ্ট পেতেন না।

মোগল সাম্রাজ্য যখন ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছিল তখন আফগানরা রোহিলখণ্ডে তাঁদের নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁদের নেতা জবিতা খানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে গোলাম কাদির ক্ষমতায় এলেন। গোলাম কাদিরের ইচ্ছা ছিল তিনি সম্রাটের মির বকশি অর্থাৎ সেনাদলের অধিনায়ক হবেন, সব ক্ষমতা তাঁর হাতে আসবে। তিনি দিল্লির দিকে অগ্রসর হয়ে গেলেন এবং সম্রাট শাহ আলমের দর্শন চাইলেন। তখন পর্যন্ত দিল্লিতে মহাদজি সিন্ধিয়ার কিছু আধিপত্য ছিল, কিন্তু তিনি তখন খুব বিব্রত। গোলাম কাদিরকে বাধা দিতে পারেননি। তিনি বুঝেছিলেন গোলাম কাদির দিল্লিতে এলে মারাঠাদের আর ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু বাদশার নাজির মনজুর আলি গোলাম কাদিরকে নিয়ে আসবার জন্য খুব আগ্রহী ছিলেন। তখন পুরো বর্ষাকাল, যমুনার জল স্ফীত হয়েছে। অন্তত কিছুদিনের জন্য গোলাম কাদিরকে বাধা দেওয়া শক্ত হত না। সামান্য কয়েকজন মারাঠা সৈন্য যমুনার পূর্বতীরে শাহদরার কাছে গোলাম কাদিরকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের সে-চেষ্টা সফল হয়নি। গোলাম কাদির যমুনা পার হয়ে দিল্লি এলেন। শাহ আলমের নাজির মনজুর আলির সঙ্গে মারাঠাদের শত্রুতা ছিল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এইভাবে মারাঠাদের ক্ষমতা ধ্বংস করা যাবে। ১৭৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দু-হাজার রোহিলা সৈন্য নিয়ে গোলাম কাদির দিল্লি শহরে ঢুকলেন। বৃদ্ধ শাহ আলমের অন্য কোনো উপায় ছিল না। তিনি গোলাম কাদিরকে খুব উঁচু পদ দিলেন। সম্রাট নিজে অবশ্য পছন্দ করেননি। তিনি ভেবেছিলেন রোহিলারা এতে খুশি হয়ে দিল্লি ছেড়ে চলে যেতে পারে।

শাহ আলম যা আশা করেছিলেন তা হয়নি। গোলাম কাদির ভেবেছিলেন যে, তিনি বিনা ঝঞ্ঝাটে সম্রাটের সব ক্ষমতা নিয়ে নেবেন, তাও হয়নি। বেগম সমরু তাঁর গোলন্দাজ সৈন্য নিয়ে সম্রাটকে রক্ষা করবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। গোলাম কাদির তখনকার মতো যমুনা পার হয়ে ফিরে গেলেন। বেগম সমরুর বাধা তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। এই শান্তি খুব অল্পদিনের। গোলাম কাদির শক্তি সংগ্রহ করে যমুনার পূর্ব দিক থেকে দিল্লির কেল্লার দিকে কামান দাগতে আরম্ভ করলেন। বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য শাহ আলম সিন্ধিয়ার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। সিন্ধিয়ার তখন নিজেরই অবস্থা ভাল নয়, কোনো ফল হল না।

দিল্লিতে শাহ আলমের শত্রুর অভাব ছিল না। দিল্লিতে মহম্মদ শাহর বেগম মালিকা-ই-জামানি শাহ আলমের পুরনো শত্রু। তিনি গোলাম কাদিরকে বারো লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাইলেন। শর্ত হল শাহ আলমের শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। গোলাম কাদিরের যে বন্ধুত্বের মুখোশ এতদিন ছিল সেটা এইবার খসে পড়ল। তিনি খোলাখুলি দিল্লির প্রজাদের উপর অত্যাচার আরম্ভ করলেন। এর আগেও দিল্লি অনেকবার লুঠ করা হয়েছে। গোলাম কাদিরের ধারণা হল যে, সম্রাটের কাছ থেকে তিনি যত টাকা আদায় করতে পারবেন ভেবেছিলেন, তা হচ্ছে না। ১৭৮৮ সালের আগস্ট মাসের প্রথমে দিল্লি শহর গোলাম কাদিরের হাতে চলে এল। শাহ আলমের বাদশাহি তখনকার মতো শেষ। আহমেদ শাহর পুত্র কেদার বখতের পুত্রকে সম্রাট বলে ঘোষণা করা হল। শাহ আলম এবং তাঁর ছেলেরা বন্দী হলেন। ততক্ষণে দিল্লি শহরে রোহিলা সৈন্যদের লুঠপাট আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। গোলাম কাদিরের অর্থলোভের সীমা ছিল না। তাঁর তাগাদায় উত্ত্যক্ত হয়ে শাহ আলম বারবার বলতে লাগলেন যে, তাঁর যা কিছু সম্পদ ছিল সে সবই তিনি দিয়েছেন। “টাকা কি আমি পেটের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি?” এই কথায় গোলাম কাদিরের রাগ আরও বেড়ে গেল। গোলাম কাদির বললেন, “দরকার হলে তোমার পেট চিরে দেখব সত্যি টাকা লুকনো আছে কি না।” তারপর গোলাম কাদিরের হু্‌কুমে শাহ আলমের চোখ অন্ধ করে দেওয়া হল। তখনও শেষ হয়নি। গোলাম কাদিরের আদেশে একজন চিত্রকর এসে একটি ছবি আঁকল। শাহ আলম চিত হয়ে শুয়ে আছেন, তাঁর বুকের উপর বসে গোলাম কাদির ছুরি দিয়ে তাঁর চোখ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করে নিচ্ছে।

কয়েকদিন শাহ আলমকে ঐ অবস্থায় রেখে দেওয়া হল, একফোঁটা জলও তিনি পেলেন না। বাদশাহের অন্দরমহল লুঠ করা হল। এর আগেও দিল্লিতে লুটপাট হয়েছে। কিন্তু তখনও অন্দরমহল লুট করার জন্য কেউ হাত বাড়ায়নি। অত্যাচারের যে-সব গল্প লোকের মুখে শোনা যাচ্ছিল, তাই শুনে একজন বেগম ভয়েই মারা গেলেন। হারেমে বেগমদের উপর অত্যাচারের সীমা ছিল না। সব শেষ হলে নাজির মনজুর আলির পালা। গোলাম কাদির তাকে বললেন, “কেল্লার দাসদাসীরাও জানে কোথায় ধনসম্পত্তি লুকনো আছে, তোমার তো আরও বেশি জানা উচিত।” গোলাম কাদিরের লোকেরা মনজুর আলিকে আচ্ছা করে প্রহার করল, তার বাড়ি লুট করা হল। মনজুর আলির বাড়িতে পাওয়া গেল চল্লিশ হাজার টাকা, পাঁচ হাজার মোহর, তাছাড়া সোনা-রুপোর বাসনপত্র। গোলাম কাদিরের মনে হল এগুলো তেমন বেশি কিছু নয়। আরও অনেক পাওয়া যেতে পারত।

গোলাম কাদিরেরও দিন ঘনিয়ে এসেছিল। মহাদজি সিন্ধিয়া অবশেষে তাঁর সেনাপতি রানা খানের অধীনে বড় একদল সৈন্য পাঠিয়ে দিলেন দিল্লি অধিকার করতে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষে মারাঠা সৈন্যরা দিল্লি এসে পৌঁছল। গোলাম কাদির ভাবলেন, এইবার দিল্লি ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তিনি পালিয়ে গেলেন। মারাঠারা আবার দিল্লির কর্তা হল।

সম্রাটের পরিবারের তখন এমন অবস্থা যে, অনেকদিন কারও খাওয়া হয়নি। মারাঠারা তাদের রান্নাকরা খাবার পাঠাতে লাগল। ইতিমধ্যে গোলাম কাদিরের সর্বনাশ আরম্ভ হয়েছে। যে-সব সম্পদ দিল্লি লুট করে তিনি জমা করেছিলেন, তার একটা বড় অংশ রাস্তায় লুট হয়ে গিয়েছে। মারাঠা সৈন্যদের হাতে পড়ে গোলাম কাদিরের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আক্রমণের সময় গোলাম কাদির লুকিয়ে ছিলেন। অবশেষে ঘোড়ার একটি পা জখম হয়ে গেল। সেই ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে গোলাম কাদির পায়ে হেঁটে পালাতে লাগলেন। এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে তিনি ভাবলেন নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে। গোলাম কাদিরকে দেখে ব্রাহ্মণের সন্দেহ হয়েছিল। কাছেই একজন মারাঠি সেনাপতির শিবির পড়েছিল। তাঁকে খবর পাঠানো হল। কয়েকজন সৈন্য এসে গোলাম কাদিরকে বন্দী করে নিয়ে গেল। প্রথমে তাঁকে মথুরায় নিয়ে যাওয়া হল। সেখান থেকে দিল্লির পথে তাঁকে পিটিয়ে মারা হল। গোলাম কাদিরের চোখ খুবলে নেওয়া হয়েছিল, ঠিক যেমন শাহ আলমকে করা হয়েছিল। কথা ছিল তাঁর মৃতদেহ দিল্লি নিয়ে যাওয়া হবে। সম্ভব হল না।

সেই সময়কার একজন লেখক বলেছেন, পথে তাঁর মৃতদেহ গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। একটি কালো কুকুর, দেখতে অদ্ভুত, তার দু’চোখের চারদিকে সাদা দাগ। কুকুরটি দু’দিন সেই মৃতদেহকে পাহারা দিল। গোলাম কাদিরের মৃতদেহ থেকে যে রক্ত পড়ত, কুকুরটা তা চেটে খেত। দু’দিন পরে দেখা গেল গোলাম কাদিরের মৃতদেহ অদৃশ্য হয়েছে, কুকুরটিও নেই। কেউ কেউ বিশ্বাস করত, কুকুরটি আসলে নরক থেকে এসেছিল গোলাম কাদিরকে যথাস্থানে নিয়ে যেতে।

এই গল্পে একটু ফাঁক আছে। দু’দিন ধরে মৃতদেহ থেকে কি রক্ত পড়তে পারে? সে-কথা অবশ্য এখন তুলে লাভ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *