০৭. নিকোলাও মানুচির গল্প

নিকোলাও মানুচির গল্প

১৬৫৩ সাল, নভেম্বর মাস। ইটালির ভেনিস বন্দরে একটি ছোট জাহাজ অপেক্ষা করছিল। এক-মাস্তুলের জাহাজ, বড় সমুদ্রে পাড়ি দেবার জন্য তৈরি হয়নি। এই জাহাজে সেদিন এক সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক ছদ্মনামে দূরদেশে পালাবার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর নাম লর্ড বেলমন্ট। ইংল্যাণ্ডে তখন বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। অলিভার ক্রমওয়েল দেশের শাসক। ইংল্যাণ্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। যাঁরা তাঁর বন্ধু ছিলেন, তাঁদের বিপদ হতে পারে এই মনে করে লর্ড বেলমেন্ট ভারতবর্ষের দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। জাহাজ ছাড়বার একদিন পরে শোরগোল শোনা গেল। চোদ্দ বছরের একটি ছেলে জাহাজ ছাড়বার আগের দিন এসে লুকিয়ে ছিল। পরের দিন খিদের কষ্ট সইতে না পেরে জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে ধরা দিয়েছে। ছেলেটির নাম নিকোলাও মানুচি। অনেকদিন থেকে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। পৃথিবী ঘুরে দেখবে। বাবার কড়া নজর ছিল, এইবার সে বাবার চোখ এড়িয়ে জাহাজে এসে লুকিয়ে ছিল। লর্ড বেলমেন্টের একটি ছোকরা চাকরের দরকার ছিল, যে তার কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখবে, দেখাশোনা করবে। মানুচিকে তাঁর পছন্দ হয়ে গেল। মানুচিকে তিনি কাজে বহাল করলেন।

জাহাজের প্রথম গন্তব্য স্মার্না। স্মার্না তুরস্ক দেশের একটি বন্দর। সাতদিন স্মর্নায় থাকবার পরে জাহাজ আবার চলতে লাগল। এ সব জাহাজ জোরে যেতে পারে না। পরের বছর সেপ্টেম্বর মাসে তাঁরা পারস্য দেশের সিরাজ শহর হয়ে বন্দর আব্বাসে পৌঁছলেন। খোলা সমুদ্রে পাড়ি দেবার জন্য বড় জাহাজ দরকার। মানুচি ও তার প্রভু ‘সি হর্স’ জাহাজে জায়গা পেয়ে ১৬৫৬ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে সুরাট বন্দরে এসে পৌঁছলেন।

সুরাট সমুদ্রতীরে নয়। মাইল দশেক ভেতরে একটি নদীর ওপরে। সেখান থেকে হাঁটাপথে বুরহানপুর, গোয়ালিয়র, ঢোলপুর হয়ে শেষে আগ্রা। মোগল সম্রাট কিন্তু তখন দিল্লিতে ছিলেন। মথুরা হয়ে দিল্লি যাবার পথ, কিন্তু সেখানে পৌঁছবার আগেই মানুচির মনিব হঠাৎ মারা গেলেন। মানুচি একা দিল্লি এসে পৌঁছলেন। তখন সম্রাট শাজাহানের বয়স হয়েছে। তাঁর চার ছেলেদের মধ্যে শত্রুতা আরম্ভ হবে বোঝা যাচ্ছিল। মানুচি শাজাহানের বড় ছেলে দারার সৈন্যদলে গোলন্দাজের পদ পেলেন। সে সময় ইউরোপ থেকে কোনো বিদেশী এলে দুটি চাকরি সব সময় পাওয়া যেত। হয় সৈন্যদলের চাকরি, নয় ডাক্তারের কাজ। তাঁরা এইসব বিদ্যা সত্যি জানেন কি না কেউ জিজ্ঞাসা করত না। মানুচিরও সেইজন্য কাজ পেতে অসুবিধা হয়নি। অল্পদিনের মধ্যে দারা ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল।

আগ্রার কাছে সমুগড়ের যুদ্ধে দারার বড় রকমের হার হল। যুদ্ধের পরে মানুচি সমুগড় থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে আবার তিনি সৈন্যদলে ভর্তি হলেন। এবার আওরঙ্গজেবের দলে। আওরঙ্গজেবের সৈন্যদলেও তিনি বেশিদিন ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে আওরঙ্গজেবকে তাঁর পছন্দ হত না। তাঁর সৈন্যদল ছেড়ে দিয়ে মানুচি পুবদিকে পালিয়ে গেলেন। পাটনা পৌঁছে নৌকো করে রাজমহল এসেছিলেন। সেখান থেকে পূর্ববঙ্গে ঢাকা। আবার সুন্দরবনে ঘুরে হুগলি, হুগলি থেকে কাশিমবাজার, সেখান থেকে সবশেষে আগ্রা। সেনাদলে নাম লেখাবার ইচ্ছা ছিল না। আগ্রায় এসে তিনি ডাক্তার হয়ে ব্যবসা আরম্ভ করলেন। অন্য বিদ্যার মতো ডাক্তারি-বিদ্যা শিখতেও সময় লাগে। কোথা থেকে মানুচি ডাক্তারি শিখেছিলেন জানি না। ডাক্তারিতে তাঁর কিছু পসারও হয়েছিল। সাহেব-ডাক্তারদের চাহিদা ছিল। বাত কিংবা রক্তচাপের রোগীদের চিকিৎসাই ছিল শরীর থেকে খানিকটা রক্ত বের করে দেওয়া। এই কাজ ইউরোপীয়রা ভাল করতেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি ডাক্তারও রইলেন না। অম্বরের রাজা জয়সিংহের ছেলে কিরাতসিংহ তাঁকে আবার গোলন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি করে নিয়ে এলেন। মাইনে ঠিক হল দিনে দশ টাকা। তখনকার দিনের হিসাবে বেশ ভাল।

রাজপুত সৈন্যদের সঙ্গে তিনি দক্ষিণ ভারতবর্ষে এলেন। তখন ১৬৬৪ সালের মাঝামাঝি। তখন বিদেশীরা অনেক সময় ভারতীয়দের মতো পোশাক পরতেন, মানুচিও তাই। তিনি দাড়ি কামিয়ে ফেলে রাজপুতদের মতো গোঁফ রাখতেন। রাজপুতরা কানে গয়না পরতেন, তিনি পরতেন না। আচকান পরতেন, তার বোতাম আটকাতেন মুসলমানদের মতো করে। তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে জিজ্ঞেস করত, “মানুচি, তুমি হিন্দু না মুসলমান?”

মানুচি বলতেন, “আমি কিছুই নয়, আমি খ্রিস্টান।”

তারা বলত, “সে তো আমরা জানি, কিন্তু তুমি বলো—তুমি হিন্দু-খ্রিস্টান, না মুসলমান-খ্রিস্টান।”

মানুচি খুব রেগে গিয়ে বলতেন, “এদেশের লোক খ্রিস্টান ধর্ম সম্বন্ধে এত কম জানে যে, সে আর বলবার নয়।” সুবিধা পেলে খ্রিস্টান ধর্ম সম্বন্ধে উপদেশ দিতেন। দক্ষিণ ভারতে তখন শিবাজির আধিপত্য। মানুচি একবার শিবাজিকে দেখেছিলেন। সৈন্যদলে আর থাকতে ভাল লাগছিল না তাঁর। মানুচি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বোম্বাইয়ের কাছে বেসিনে চলে এলেন। এটা পর্তুগিজদের এলাকা। কিছুদিন পরে মানুচি আবার বেসিন ছেড়ে লাহোরে ডাক্তার হয়ে বসলেন। ছ-সাত বছর ডাক্তারি করলেন কিন্তু মানুচির টাকা-পয়সার একটু টানাটানি হয়েছিল। ব্যবসায় টাকা খাটাবার চেষ্টা করেছিলেন, তার ফল ভাল হয়নি। তিনি আবার দিল্লি ফিরে গিয়ে ডাক্তারি আরম্ভ করলেন। আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহ আলমের বেগমের কানের চিকিৎসা করে তাঁর নাম হয়েছিল। মানুচি বলেছেন যে, তাঁর এত নাম-ডাক আর পসার হয়েছিল যে, দিল্লির ডাক্তাররা তাঁকে দেখতে পারত না। একদিন তিনি রোগী দেখছিলেন, ঘরে রোগীদের ভিড় হয়েছে। এমন সময় কয়েকজন গুণ্ডার মতো লোক এসে গোলমাল করতে আরম্ভ করল, যাতে রোগীরা ভয় পেয়ে অন্য কোথাও চলে যায়।

মানুচি বুঝতে পারলেন যে, এ-সব সাজানো ব্যাপার। অন্য ডাক্তাররা গণ্ডগোল বাধাবার চেষ্টা করছে। তিনি তাঁর লোকদের বললেন, “ধরো ওদের।”

সবাই পালিয়ে গেল তাড়া খেয়ে, কিন্তু একজনকে ধরা গেল। তার হাত-পা বেঁধে ফেলা হল। মানুচি তাকে বললেন, “তোমার ব্যবহারে বোঝাই যাচ্ছে যে, অনেক বদ রক্ত ঢুকেছে, তা বের করে না দিলে নয়।” এই বলে তার শরীর থেকে অনেকটা রক্ত বার করে নিলেন। লোকটি খুব চেঁচাতে লাগল। তারপর বলল, এর শোধ নেবে সে। মানুচি বললেন, “আগে তো বাঁচো, বদ রক্ত বের করে দিই।” এই বলে তার শরীর থেকে অনেক রক্ত মিছিমিছি বার করে নিলেন। তারপর লোকটিকে বললেন, “ভাগ্যিস আজ এসেছিলে, খুব বেঁচে গেলে।”

অত রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছিল বলে লোকটি বোধহয় একটু দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় সে ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিয়ে গেল। বলল, তাঁর জন্যই তার প্রাণ রক্ষা হয়েছে।

মানুচিকে বোধহয় আর কখনও এরকম বিপদে পড়তে হয়নি। শাজাহানকে যখন তাজমহলে কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনকার ব্যাপার নিয়ে মানুচি একটি গল্প লিখে শুনিয়েছেন।

শাজাহানের মৃতদেহ তাজমহলে নিয়ে আসা হল। সঙ্গে শাজাহানের প্রিয় হাতি ছিল। হাতিটি বাইরে বাঁধা, কিন্তু লক্ষ করছিল কী একটা শোরগোল হচ্ছে, কেন সে বুঝতে পারছে না। এমন সময় মাহুত কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওরে তোর আজ দুর্দিন। সম্রাট আর নেই। কে তোর পিঠে চড়বে, তুই তো আর এরকম প্রভু পাবি না?”

হাতি সব কথা বুঝতে পারল। সে শুঁড় দিয়ে ধুলো এনে নিজের দেহে ছড়িয়ে কান্নাকাটি করতে লাগল। তারপর হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ল, আর উঠল না। ঘটনাটি বোধহয় সত্যি। মানুচি এরকম অনেক গল্প লিখে গিয়েছেন। দু-চারটি গল্প পরে শোনানো যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *