০৫. লাটসাহেবের বাড়ি হল

লাটসাহেবের বাড়ি হল

গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি সাহেব তো ঠিক করলেন যে, এভাবে আর চলছে না, লাটসাহেবের নিজের বাড়ি দরকার। কিন্তু কী করে হবে সে বিষয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে গেল। বাংলা-বিহার-ওড়িশা প্রায় পঞ্চাশ বছর হল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতে এসেছে। দেশে অনেক দুর্বল রাজ্য আছে বটে, কিন্তু তারা তখনও ইংরেজের মুঠোর মধ্যে আসেনি। বড় রাজ্যদের মধ্যে অবশ্য নিজামের কথা বলা যায়। কিন্তু ক্ষমতা বলতে বিশেষ কিছু নেই। গত একশো বছর ধরে নিজাম অনেক যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু প্রায় কোনো যুদ্ধেই জিততে পারেননি। তা ছাড়া অবশ্য পশ্চিমে মারাঠারা রয়েছে, দক্ষিণে টিপু সুলতান। এদের সঙ্গে একহাত লড়াই হয়ে গিয়েছে। ইংরেজদের তাতে সুবিধাই হয়েছে বলতে হবে। কিন্তু ভবিষ্যতের বড় লড়াই তখনও বাকি। তাতে অনেক টাকা খরচ হবে নিশ্চয়ই। বিলেতে কোম্পানির কর্তারা অর্থাৎ ডিরেক্টররা লড়াই করবার কথা শুনলে খুশি হতেন না। হারলে সবনাশ, জিতলে লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে যাবে এত খরচ। আর বড় বাড়ি করবার খরচ চাইলেই কি কোম্পানির কর্তাদের কাছে পাওয়া যেত? ওয়েলেসলি অবশ্য অতশত ভাবলেন না। বিলেতের কর্তাদের সব কথা জানাতে হবে, এই চিন্তা তাঁর মনে ঠাঁই পেল না।

বাড়ি করা তো ঠিক হল, কিন্তু কী ধরনের বাড়ি? ভারতবর্ষে তো বিভিন্ন রকমের প্রাসাদ তৈরি হয়ে এসেছে। মোগল সম্রাটরা হিন্দু মুসলমান দু-রকম স্থাপত্যকে মিলিয়ে স্থাপত্যে নতুন চেহারা আনবার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের সময়ের আঁকা ছবিতেও এই চেষ্টা ধরা পড়ে। কিন্তু দেশীয় রীতি পছন্দ হল না। কী পছন্দ হল বলছি। লাটসাহেবের বাড়ি তৈরি হবার একশো বছর পর লর্ড কার্জন এদেশের বড়লাট হয়ে এসেছিলেন। তাঁর ঠাকুরদার ঠাকুরদার সময়ে ইংলণ্ডের ডার্বিশায়ার অঞ্চলে তাঁরা বসতবাড়ি বানিয়েছিলেন। তখনকার একজন বিখ্যাত স্থপতি রবার্ট অ্যাডম্ সাহেব এর প্ল্যান তৈরি করেছিলেন। সেই নকশা অনুসারে সরকারের একজন ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন ওয়াট ও ক্যাপ্টেন টিরেটোকে প্ল্যান তৈরি করতে বলা হল। টিরেটোর তখন খুব নামডাক। এখন কলকাতার টেরিটিবাজার অঞ্চল তাঁরই সম্পত্তি ছিল। টিরেটোর প্ল্যান শেষপর্যন্ত পছন্দ হল না। কত টাকা লাগবে হিসেব করে দেখা গেল পাঁচ লাখ ঊনত্রিশ হাজার সিক্কা টাকা। সিক্কা টাকার বাজারদর সাধারণ টাকার চেয়ে একটু বেশি ছিল। এটা মনে হয় শুধু বাড়ি তেরির খরচ।

বাড়ির যখন ভিত্তি স্থাপন করা হল, লর্ড ওয়েলেসলি নিজে কিন্তু তখন উপস্থিত থাকতে পারলেন না। দক্ষিণে যুদ্ধের বাজনা বেজে উঠল। বড়লাট কলকাতা থেকে কুচ আরম্ভ করলেন। টিমথি হিকি নামে একজন ইঞ্জিনিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। তিনি যে বিখ্যাত লোক ছিলেন তা নয়, তবে তাঁর এক আত্মীয় নামকরা ছবি-আঁকিয়ে ছিলেন। লর্ড ওয়েলেসলিও তাঁকে দিয়ে তাঁর নিজের প্রতিকৃতি আঁকিয়েছিলেন।

১৭৯৮ সালের মে মাসে বাড়ির কাজ আরম্ভ হয়েছিল। ১৮০২ সালের প্রথম দিকে বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেল। ছোটবড় খানার ব্যবস্থা হতে লাগল লাটসাহেবের বাড়িতে। এই যে এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল কলকাতায়, সে-খবর বড়লাট প্রকৃতপক্ষে ইংলণ্ডের কর্তাদের জানাননি। ওয়েলেসলি বলতেন, তিনি তো দুটি চিঠি লিখেছিলেন। একটি হল ১৭৯৮ সালে, আর একটির তারিখ এপ্রিল ১৮০১। তাতে সব জিনিস পরিষ্কার করে বলা হয়েছিল। তা ঠিক নয়, কাগজপত্র ঠিকমতন কি পাঠানো হয়েছিল? সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বিলেতে খোঁজ করে সে-ধরনের কোনো চিঠির হদিস পাওয়া যায়নি। ওয়েলেসলি অবশ্য জানিয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষ এমন পোড়া দেশ যে, এখানে পুরনো বাড়ি মেরামত করার চেয়ে নতুন বাড়ি তৈরি করার খরচ কম। পরে অবশ্য দেখা গেল খরচ অনেক বেশি পড়েছে। বাড়ি তৈরি করতে সাত লাখ টাকার উপর, আশেপাশের জমি ও বাড়ি কিনতে আরও পাঁচ লাখ একাত্তর টাকা, আর নতুন নতুন রাস্তা বানাতে সাতাশ হাজার টাকা খরচ পড়েছে। সবসুদ্ধ ১৩,০১,২৮৬ সিক্কা টাকা। অনুমতিও চাওয়া হয়নি, এবং বাড়ি যে আরম্ভ হয়েছে সে-কথাও জানানো হয়নি। বরং কার্জন পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন, যে মোটা বাঁধানো খাতায় এই সব চিঠি থাকলেও থাকতে পারত, তার পাতা কে যেন ছুরি দিয়ে কেটে নিয়েছে, এইসব থেকে আসল ব্যাপার বুঝতে কি কারুর বাকি থাকে!

একটি কথা মনে হতে পারে। কলকাতায় বড়লাটসাহেবের বাড়ি তৈরি হচ্ছে একথা লণ্ডনে ঘুণাক্ষরেও কি কেউ জানত না? বিশ্বাস করা কঠিন। তখন ইউরোপের সঙ্গে চিঠিপত্র যাতায়াতে অনেক সময় নিত। ছ’ সাত মাস তো বটেই, কখনও কখনও বছর পেরিয়ে যেত। সেজন্য সাহেব-বিবিরা দেশে খুব বড়-বড় চিঠি লিখতেন। তাতে সবরকম খবর থাকত। পাশের বাড়ির মেমসাহেব ইউরোপ থেকে কীরকম নতুন ফ্যাশানের গাউন আনিয়েছেন, ও বাড়ির বাবুর্চি গেল মানে পার্টির দিন কী রকম ভাল হাঁসের রোস্ট করেছিল, এইসব কথা। তাঁরা কি কেউই গল্প করেননি যে, কলকাতায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। বড়লাটসাহেবের বাড়ি? ইংলণ্ডের লোকেরা বিলেতে বসেই এদেশ সম্পর্কে অনেক খবর পেতেন। তাঁরা কি এ খবর কখনও শোনেননি?

এই প্রশ্নের উত্তর কার্জন নিজেই দেবার চেষ্টা করেছেন। ভাসাভাসা খবর সম্ভবত বিলাতে পৌঁছেছিল, কিন্তু কী করা যেতে পারত। প্রত্যেক জাহাজেই ওয়েলেসলির যুদ্ধজয়ের খবর আসছে, আর শোনা যাচ্ছে কীভাবে ক্রমাগত তিনি কোম্পানির রাজত্বের সীমা বাড়িয়ে চলেছেন। ডিরেক্টররা যাই মনে করুন না কেন, এই গভর্নর জেনারেল যদিও অবাধ্য, তবু তাঁকে প্রথমে ঘাঁটাতে সাহস পেলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করলে দেশের লোক কি খুশি হত? তখন বিলেতের উইলিয়ম পিট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারাও তাঁর বন্ধু। তাছাড়া এ-কথাও প্রমাণ করা শক্ত হত যে, বিলেতের বড়কর্তারা আদপেই কিছু জানতেন না। ডিরেক্টরদের কিল খেয়ে কিল চুরি করার মতো অবস্থা হল। তাঁরা শেষ পর্যন্ত একটি বড় চিঠিতে গভর্নর জেনারেল কী কী অবাধ্যতা করেছেন তার ফিরিস্তি লিখে পাঠালেন। সবাই যে ওয়েলেসলির ব্যবহারে খুশি ছিলেন তা নয়, কিন্তু মোটের উপর ওয়েলেসলির দিকেই পাল্লা ভারী ছিল।

লাটপ্রাসাদের যেদিন ঘটা করে দ্বার উন্মোচন হল, সেদিন লর্ড জর্জ ভ্যালেনসিয়া নামে একজন ভ্রমণকারী কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে লিখেছেন, লাটসাহেবের বাড়ি তৈরি করতে অনেক খরচ হয়েছে তো কী হয়েছে? বড়লাটবাহাদুর কি কুঁড়েঘরে থাকবেন? মোগলরা যে ভারতবর্ষে এত খরচ করে বাড়িঘর করেছিল, ঠিক করেছিল। আসল কথা, বিলেতে ডিরেক্টররা ব্যবসায়ী ছাড়া কিছু নয়, তারা শুধু মসলিন কাপড় মাপতে জানে আর জিনিস ওজন করতে জানে, এসবের কদর বুঝবার ক্ষমতা তাদের নেই।

যে যাই বলুন না কেন, তখন অনেক ইংরেজও এই কথা ভাবতেন। যে গভর্নর জেনারেল কোম্পানির শত্রুদের অল্প কয়েক বছরের মধ্যে শেষ করে দিলেন, তাঁকে ‘কেন তিনি বাড়িঘর তৈরি করতে এত খরচ করেছেন’, ‘কেন তিনি আগে অনুমতি নেননি’, এই সব প্রশ্ন করা কি মানায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *