০৫. লেখা আছে অশ্রুজলে

লেখা আছে অশ্রুজলে

—এটা ঠিক করছিস না… এটা আত্মহত্যা।

শয্যাশায়ী যুবক শোনেন এবং প্রত্যুত্তরে হাসতে চেষ্টা করেন।

—তোরা বারবার এক কথা বলছিস কেন? বলেছি তো, দেখাব না ডাক্তার।

—দেখাব না বললেই হল? তুই এভাবে সুইসাইড করবি আর সেটা আমাদের দেখতে হবে? এত ইমোশনাল হলে লড়াইটা জারি থাকবে কী করে?

শরীরে দৃশ্যতই যন্ত্রণার অনায়াস আধিপত্য, তবু সিদ্ধান্তে অনড়ই থাকেন যুবক।

—দয়ার দান নেওয়ার থেকে মৃত্যু ভাল। দাক্ষিণ্য চাই না ওদের। কুকুর-ছাগলের মতো ব্যবহার করার আগে এরপর ওদের ভাবতে হবে… এটাও তো লড়াই-ই…

—কিচ্ছু ভাববে না ওরা… মেডিক্যাল রিপোর্টে লিখে রাখবে তুই রিফিউজ় করেছিস চিকিৎসা। আমরা আইনি পথে কিছুই করতে পারব না।

—লিখুক যা খুশি, তোরা জোর করিস না আমাকে আর…

যন্ত্রণায় ফের কুঁকড়ে যায় যুবকের শরীর। ঘিরে থাকা বন্ধুদলকে অসহায় দেখায়। অবশ্যম্ভাবী পরিণতির প্রহর গোনা ছাড়া উপায়?

.

অধস্তন সহকর্মীর গলায় উত্তেজনার আঁচ সচকিত করে উর্দিধারী অফিসারকে।

—স্যার, ডানদিকে দেখুন…

—কী?

—ওই যে…

অফিসার ঝটিতি দৃষ্টিপথ ঘোরান ডানদিকে। এবং দেখেই তড়িতাহত প্রায়। যুগপৎ বিস্ময়ে এবং অভাবিত প্রাপ্তির পুলকে। এ তো মেঘ না চাইতেই জল! কালবিলম্ব করা নির্বুদ্ধিতা হবে বুঝে সতর্ক করেন দেহরক্ষীকে।

—বনবিহারী, সাবধানে। একে ধরতেই হবে। Prize catch, ব্যাটা প্রচুর জ্বালিয়েছে। আমি গিয়ে সোজা মাথায় রিভলভার ঠেকাব, তুমি কভার দেবে পিছন থেকে।

—ওকে স্যার।

—ছেলেটা কিন্তু মহা বিচ্ছু। ডেঞ্জারাস। গোলমাল দেখলেই গুলি চালাবে। অর্ডারের অপেক্ষা করার কোনও দরকার নেই। ক্লিয়ার?

—রাইট স্যার।

—আর শিউপ্রসাদ… তুমি ঠিক আমার কয়েক পা পিছনে থাকবে…

—জি সাব।

উত্তর কলকাতার হেদুয়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যমনস্ক যুবকের কয়েক পা দূরত্বে ক্ষিপ্র পদচারণায় পৌঁছন উর্দিধারী। কোমরের হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করার আগেই বিপত্তি। এমনটা যে হতে চলেছে, কল্পনার অতীত ছিল লালবাজারের ডাকসাইটে অফিসারের।

কল্পনাতীত ছিল পথচলতি কতিপয় এলাকাবাসীরও। কলকাতা সাক্ষী থাকবে এহেন শিহরণ-জাগানো দৃশ্যের, কে ভেবেছিল?

শীতের নিরপরাধ সকাল। ঘড়িতে সাড়ে ছ’টা। শহর সবে পাশ ফিরে শুচ্ছে। আড়মোড়া ভাঙতেও দেরি আছে কিছু।

.

—থোড়া জলদি সর্দারজি…

শিখ ট্যাক্সিচালককে তাড়া দেন আরোহীদের একজন। কিঞ্চিৎ বিরক্ত চালক অ্যাকসিলেটরে চাপ বাড়ান পায়ের। গাড়িতে ওঠা ইস্তক মিনিটে মিনিটে শুনতে হচ্ছে, ‘জলদি চলিয়ে!’ এদের এত তাড়া কীসের? দু’-পাঁচ মিনিট এদিক-ওদিক হলে কী এসে যাবে?

গার্ডেনরিচ ক্রসিংয়ের কাছে আসতেই চাপা স্বরে বলে ওঠেন এক আরোহী, ‘রোখ দিজিয়ে ইয়াহাঁ।’

উলটোদিক থেকে একটা ছ্যাকড়া গাড়ি আসছে দুলকি চালে ঢিকিরঢিকির। দেখতে পেয়েই গাড়ির আরোহীরা সহসা উত্তেজিত, ‘রোখ দিজিয়ে সর্দারজি!’

কিন্তু এখানে থামাতে বলছে কেন? কৌতূহল চেপে রাখতে পারেন না চালক।

—ইয়াহাঁ? আপ লোগ তো অউর দূর যানেওয়ালে থে না?

উত্তরে কড়া ধমক শুনতে হয় চালককে।

—সওয়াল মত কিজিয়ে… ওহ গাড়ি কে সামনে লাগাইয়ে ট্যাক্সি… জলদি…

সন্দেহ হলেও কিছু করার ছিল না আর। আরোহীদের কোমরে গোঁজা পিস্তল ততক্ষণে উঠে এসেছে হাতে। ধাতব আগ্নেয়াস্ত্র নজরে পড়ে ট্যাক্সিচালকের, সভয়ে নির্দেশ পালন করেন বিনা বাক্যব্যয়ে।

.

১৯১৫ সালের প্রথমার্ধ। বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ অনুভূত হচ্ছে বাংলার বিপ্লবী ক্রিয়াকর্মের গতিপ্রকৃতিতেও। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবল পরাক্রান্ত জার্মানির সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন বাঘা যতীনের নেতৃত্বে সমমনোভাবাপন্ন বিপ্লবীকুল। সাম্প্রতিক অতীতে ১৯১৪ সালের অগস্টে ডালহৌসির অদূরে অবস্থিত R B Rodda Co.-এর অস্ত্র লুঠের সফল অভিযানে বিপ্লবীরা উদ্দীপিত যেমন, দমনপীড়ন নীতির দৃঢ়তর প্রয়োগে তেমনই স্থিরসংকল্প পুলিশ প্রশাসন। ধরপাকড়-তল্লাশি অব্যাহত পূর্ণ মাত্রায়। গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয়তা তুঙ্গে। মহানগরীতে বিপ্লবীদের এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে রাজি নয় ‘যুদ্ধং দেহি’ লালবাজার।

ক্ষমতাধর রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে স্রেফ আবেগনির্ভর লড়াই ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য, সম্যক উপলব্ধি করলেন বাঘা যতীন-বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী-রাসবিহারী বসু এবং অন্য নেতৃবর্গ। প্রয়োজন সাংগঠনিক শক্তির প্রসারের, প্রয়োজন অস্ত্রের নিয়মিত জোগানের। এবং এই দ্বৈত চাহিদা মেটাতেই সর্বোপরি প্রয়োজন অর্থের।

সশস্ত্র অভ্যুত্থানে বিশ্বাসী বঙ্গজ বিপ্লবীদের যিনি তখন অলিখিত সর্বাধিনায়ক, সেই বাঘা যতীন একাধিক গোপন বৈঠক করলেন। বার্তা দিলেন দ্ব্যর্থহীন, রাজশক্তিতে বলীয়ান প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুঝতে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এবং পরিস্থিতির সার্বিক বিচারে অগ্রাধিকারের শীর্ষে রাখতে হবে যে-কোনও মূল্যে দ্রুত অর্থাগমকে।

সে না হয় হল, কিন্তু কী উপায়ে হবে অর্থাগম?

.

১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫। বেলা দ্বিপ্রহর। মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ ছ্যাকড়া গাড়ি ঢিমেতালে এগোচ্ছে গার্ডেনরিচের দিকে। আরোহী বলতে Messrs Bird & Co-র এক নিচুতলার কর্মচারী এবং দুই দারোয়ান।

বার্ড কোম্পানির টাকাভর্তি দশটি পাটের বস্তা রয়েছে গাড়িতে। গন্তব্য বদরতলার South Union Mill, উদ্দেশ্য পাটকলের কর্মচারীদের মাসিক বেতন পৌঁছে দেওয়া। শম্বুকগতির গাড়ির দুলুনির সঙ্গে সঙ্গত দিচ্ছে শীতের দুপুররোদ। ঝিমুনির আয়েশি আমেজ গ্রাস করেছে আরোহীদের।

ঝিমুনিতে ছেদ পড়ল গার্ডেনরিচ মোড়ের কাছাকাছি আসতেই। পথরোধ করে দাঁড়াল একটি ট্যাক্সি, যার চালকের আসনে ভয়ার্ত চেহারার এক মধ্যবয়সি শিখ। যিনি একটু আগেই তীব্র ধমক শুনেছেন—

—সওয়াল মত কিজিয়ে… ওহ গাড়ি কে সামনে লাগাইয়ে ট্যাক্সি… জলদি…

ট্যাক্সি থেকে লাফিয়ে নামেন চারজন যুবক। প্রত্যেকের হাতে উদ্যত পিস্তল। আরও জনাতিনেক ভোজবাজির মতো আবির্ভূত আগ্নেয়াস্ত্র হাতে, অকুস্থলের আশেপাশেই যাঁরা অপেক্ষমাণ ছিলেন এতক্ষণ। ঘোড়ার গাড়ি থেমে গেল বাধ্যত। পরের মিনিটদশেকের মধ্যে কর্মচারী ও দারোয়ানদের মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে গাড়ি থেকে নামানো, টাকাভর্তি থলিগুলি ট্যাক্সিতে ওঠানো, চালককে বলপূর্বক নামিয়ে দিয়ে সাতজনের দলের ট্যাক্সি নিয়ে চম্পট দেওয়া।

লুঠ করা থলিগুলির ওজন নেহাত কম ছিল না। ৩৪০০ টাকা ৩৪০টি নোটে, চাঁদির এক টাকা হিসাবে ১৩,৩০০ টাকা, আধুলি ৯৪০ টাকার। বাকি সব চার-আনা, দু-আনা এবং খুচরো পয়সা। সব মিলিয়ে ১৮,০০০ টাকা।

ট্যাক্সি চলতে শুরু করল দক্ষিণ শহরতলির বারুইপুরের দিকে। মধ্যপথে রাজপুরের কাছে একটি টায়ার অকেজো হয়ে গেল, সেই অবস্থাতেই সুবুদ্ধিপুর অবধি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হল মোটরগাড়ি। বারুইপুরের একটি দোকান থেকে দুটি তোরঙ্গ কিনে ভরা হল টাকাপয়সা।

ট্যাক্সি পড়ে রইল স্থানীয় একজনের জিম্মায়। যাঁকে বলা হল, কলকাতা থেকে মেরামতির যন্ত্রপাতি নিয়ে ফিরবেন আরোহীরা। বারুইপুর স্টেশন থেকে দুটি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে তুলে দেওয়া হল টাকাভর্তি ট্রাঙ্ক। পথবদল করে যাত্রা এরপর উত্তরে, সুন্দরবন অভিমুখে। নৌকাযাত্রায় পেচুয়াখালি পৌঁছে দিনদুয়েকের আত্মগোপন, অতঃপর টাকীতে সদলে উপস্থিত হওয়া ১৫ ফেব্রুয়ারির সকাল এগারোটায়।

আরও দুটি ট্রাঙ্ক কিনে সমানভাবে ভর্তি করা হল টাকাপয়সা। বিবিধ ঘুরপথ ব্যবহার করে সাতজনের দল পাতিপুকুর স্টেশনে পৌঁছল রাত আটটা নাগাদ। সেখান থেকে তিনটি গাড়ি ভাড়া করে ২০ নম্বর ফকিরচাঁদ মিত্র স্ট্রিটের গোপন ডেরায়। পরবর্তী কাজ ছিল লুঠের টাকা বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাছে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেওয়া বাঘা যতীনের নির্দেশমাফিক।

গার্ডেনরিচের ডাকাতির আকস্মিকতায় হতচকিত পুলিশের ঘোর কাটতে না কাটতেই দশদিনের মাথায় ফের হানা দিল ডাকাতদল। এবারও মোটরগাড়িতে সওয়ার হয়ে, টার্গেট বেলেঘাটার চাউলপট্টি রোডের বর্ধিষ্ণু চালকল মালিক ললিতমোহন বৃন্দাবন শাহ। যিনি ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী বলে পরিচিত। ছ’-সাতজনের দলটি পিস্তল হাতে ২২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ চড়াও হল ললিতমোহনের বাড়ি। সংলগ্ন অফিসঘরে আসীন ক্যাশিয়ার চাবি দিতে অস্বীকার করলেন ক্যাশবাক্সের এবং তৎক্ষণাৎ কোমরের নীচে গুলিবিদ্ধ হলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ললিতমোহনের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ২২,০০০ টাকা লুঠ হয়ে গেল মিনিটপাঁচেকের মধ্যে।

গার্ডেনরিচের ডাকাতিতে জড়িত বিপ্লবীদলের নেতৃত্বে ছিলেন বাঘা যতীনের অত্যন্ত বিশ্বস্ত অনুগামী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যিনি পরবর্তীকালে এম এন রায় হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। পরিকল্পনা এবং রূপায়ণের নানা পর্যায়ে সঙ্গী ছিলেন অতুলকৃষ্ণ ঘোষ, সরোজভূষণ দাস, ফণীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিমানচন্দ্র ঘোষ, রজনীকান্ত বসু, প্রকাশচন্দ্র বসু, বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ, গোপালচন্দ্র দত্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন দাশগুপ্ত প্রমুখ। বেলেঘাটার ঘটনাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ফণীন্দ্রনাথ-মনোরঞ্জন-নীরেন ছাড়াও চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী এবং বাঘা যতীনের অনুগত একাধিক বিপ্লবীর।

বিড়ম্বিত লালবাজার পূর্ণশক্তিতে প্রত্যাঘাত করবে, প্রত্যাশিতই ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের ফড়িয়াপুকুরের কাছে সাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হানা দিল ২০ ফকিরচাঁদ মিত্র স্ট্রিটের সেই বাড়িটিতে, যেখানে টাকাভর্তি ট্রাঙ্ক নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারির রাতে উঠেছিলেন বিপ্লবীরা। রডা কোম্পানির লুঠ হওয়া একটি মাউজার পিস্তল এবং কিছু কার্তুজ ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হল। গ্রেফতার হলেন চার বিপ্লবী, হীরালাল বিশ্বাস, নিরঞ্জন দাস, পতিতপাবন ঘোষ এবং রাধাচরণ প্রামাণিক।

দুটি অভিযানেরই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাব-ইনস্পেকটর সুরেশচন্দ্র মুখার্জী, যিনি তখন লালবাজারের কর্তাদের বিশেষ আস্থাভাজন। দুর্দান্ত সাহসী সুরেশের গোপন চরের সংখ্যা ছিল ঈর্ষণীয়। শহরে বিপ্লবীদমন অভিযানগুলিতে তাঁর উপস্থিতি ছিল একরকম আবশ্যিকই। কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রেফতারের পর বিপ্লবীদের চরম নির্যাতনের ব্যাপারেও। নরেন্দ্রনাথ এবং অন্য সঙ্গীদের গ্রেফতারির পর বাঘা যতীন সিদ্ধান্ত নিলেন, সুরেশকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। রচিত হল নিধনের চিত্রনাট্য। যা অভিনীত হল কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে, হেদুয়া পার্কের ঢিলছোড়া দূরত্বে।

২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫।

দিনকয়েক পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব, স্বয়ং ভাইসরয়ের উপস্থিতিতে। অনুষ্ঠানের মহড়ার তদারকিতে কাকভোরেই বেরিয়েছেন সাব-ইনস্পেকটর সুরেশচন্দ্র মুখার্জী। সঙ্গী সাব-ইনস্পেকটর বনবিহারী মুখার্জী এবং দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত দেহরক্ষী শিউপ্রসাদ। খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছেন ভাইসরয়ের যাত্রাপথ। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে পৌঁছনোর পর হঠাৎই চাপা স্বরে বনবিহারী দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সুরেশের।

—স্যার, ডানদিকে দেখুন…

—কী?

সুরেশের দৃষ্টিপথ ধাবিত হয় ডানদিকে, স্নায়ু সজাগ হয়ে ওঠে চকিতে। অন্যমনস্কভাবে ওই যে যুবক দাঁড়িয়ে আছে, তাকে তো হন্যে হয়ে খুঁজছেন গত কয়েক মাস ধরে। চিত্তপ্রিয়! চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, বাঘা যতীনের ছায়াসঙ্গী অনুচরদের অন্যতম। এ তো মেঘ না চাইতেই জল!

—একে ধরতেই হবে। Prize catch, ব্যাটা প্রচুর জ্বালিয়েছে। আমি গিয়ে সোজা মাথায় রিভলভার ঠেকাব, তুমি কভার দেবে পিছন থেকে।

—রাইট স্যার।

দ্রুত পদক্ষেপে সঙ্গীদের নিয়ে চিত্তপ্রিয়র সামনে পৌঁছলেন সুরেশ, চেপে ধরলেন শার্টের কলার। এবং পরমুহূর্তেই কোমরে গোঁজা রিভলভার বের করে গুলি চালালেন চিত্তপ্রিয়। কপালের ফের, গুলি ছুটল না। মিসফায়ার!

আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন সঙ্গী বিপ্লবীরা, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন দাশগুপ্ত, নরেন ঘোষচৌধুরী। লক্ষ রাখছিলেন ঘটনাপ্রবাহের উপর । বিপদ বুঝে দৌড়ে এলেন ত্রয়ী, নরেন পিছন থেকে গুলি চালালেন সুরেশকে লক্ষ্য করে। নির্ভুল নিশানা, সুরেশ ভূপতিত হলেন। পথমধ্যে শায়িত অফিসারের শরীরে বিপ্লবীদের বুলেট বিঁধল একাধিক।

ব্যর্থ হল সুরেশের সঙ্গীদের প্রতিরোধও। শিউপ্রসাদের ঊরুতে গুলি লাগল। বনবিহারীকে লক্ষ করে ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল অল্পের জন্য। প্রাতঃভ্রমণে বেরনো মুষ্টিমেয় পথচারীদের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে শূন্যে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালালেন বিপ্লবীরা। অপারেশন সফল।

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হল সুরেশের। যিনি জানতেন না, বিপ্লবীদের পরিকল্পনাই ছিল সেই সকালে ইচ্ছাকৃত ভাবে সুরেশের দৃষ্টিগোচর করা চিত্তপ্রিয়কে। পুলিশের ‘সন্ধান চাই’-এর তালিকার শীর্ষস্তরে থাকা বিপ্লবী নজরে এলে সুরেশ গ্রেফতারের চেষ্টা করবেনই, চলে আসবেনই ক্লোজ় রেঞ্জে এবং তখনই করা হবে অতর্কিত আক্রমণ। আত্মরক্ষার ন্যূনতম সুযোগ দেওয়া হবে না অত্যাচারী অফিসারকে।

.

মোটরগাড়িতে আরোহীর বেশে সওয়ার হয়ে ডাকাতি। কলকাতায় এই অভিনব পদ্ধতিতে ডাকাতি কখনও ঘটেনি ইতিপূর্বে। উপর্যুপরি দু’বার। দশদিনের ব্যবধানে। রেশ কাটতে না কাটতেই প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ-হত্যা। এরপর কী? কোথায়-কবে-কখন?

লালবাজারের শীর্ষমহলে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল বললে হয়তো অতিশয়োক্তি হবে, কিন্তু এটুকু লেখাই যায় দ্বিধাহীন, জোড়া ডাকাতি এবং পুলিশ অফিসার খুনের যৌথ অভিঘাতে ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতা পুলিশের সোর্স নেটওয়ার্ক এবং অপরাধদমনে দক্ষতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল অস্বস্তিকর প্রশ্নচিহ্ন। সরকারের কাছে কর্তাদের বিস্তর জবাবদিহি করতে হয়েছিল পুলিশি ব্যর্থতার।

নগরপালের নেতৃত্বে উচ্চপদস্থ অফিসারদের একাধিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল নজরদারি ব্যবস্থা ঢেলে সাজার। ফলত, ‘Taxi Dacoities’ বা ‘Motor Dacoities’ রুখতে কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে সেই প্রথম চালু হল প্রধান সড়কগুলিতে লোহার বা বাঁশের ড্রপগেট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি করার বিধিনিয়ম। যাকে বর্তমান পুলিশি পরিভাষায় ‘নাকাবন্দি’ বলা হয়।

আমূল পরিবর্তন ঘটল টহলদারির প্রচলিত ব্যবস্থায়ও। বিশেষ গাড়িতে যথেষ্টসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশকর্মী মোতায়েন করে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, শুরু হল ‘Armoured Car’ এবং ‘Flying Squad’-এর ‘Round-the-clock patrolling’। শহরে ঢোকার এবং বেরনোর রাস্তাগুলিতে সশস্ত্র প্রহরা চালু হল। নজরদারিতে প্রাধান্য পেল উত্তর এবং পূর্ব কলকাতা। শহরের মূলত যে অংশে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানার সংখ্যাধিক্য। চিৎপুর, টালা, বেলগাছিয়া, মানিকতলা, নারকেলডাঙা এবং হাওড়া ব্রিজে যখন-তখন যাকে-তাকে ধরে এবং যে-কোনও গাড়িকে থামিয়ে শুরু হল খানাতল্লাশি। থানায় থানায় বসল সাইরেন।

১৯১৫-র বার্ষিক পুলিশ প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ রয়েছে তৎকালীন নজরদারি ব্যবস্থার ভোলবদলে জোড়া ডাকাতি এবং হেদুয়ার খুনের গুরুত্ব।

Political Crime.—The present year has been marked by an outbreak of serious political crime of a new form, namely motor-car dacoities, and in addition here have been three cases of murder by the anarchist party, two of the victims being police officers. Special preventive measures in the shapes of patrols, alarms and traffic barriers were taken to deal with this particular form of crime, and the activities of the anarchist party have been checked by arrests in Calcutta and the neighbourhood under the defence of India Act.

The Special Branch assisted the local police in the investigation of 17 cases during the year. Details of the most important are given below:-

Garden Reach Taxi Dacoity Case. — On the 12th February 1915 at 2 P.M. a sircar and two durwans of Messrs. Bird & Co., Calcutta, were conveying Rs. 18,000 in cash in a ticca gharri to the South Union Mill when their gharry was stopped in Garden Reach by four armed Bengalis in a taxi. The occupants of the gharry were compelled to make over their cash under threats of being shot and the dacoits then decamped in the taxi throwing out the chauffeur as they drove off. They were eventually traced through the Sundarbans back to Calcutta and four of them were arrested in the Northern Town, one with a loaded mauser pistol but no property was recovered. Two of the accused were subsequently put on trial, one being convicted and sentenced to seven years’ rigorous imprisonment and the other acquitted. The chauffeur, a Sikh employe of the Indian Taxi Company, was an accomplice and has since been interned in jail.

Belliaghatta Motor Dacoity. — On the 22nd February 1915 at about 09.30 P.M. a band of 15 Bengali youths armed with pistols attacked the counting house of Lalit Mohan Brindabun Shah at 25, Chaulpatti Road, Belliaghalla, in motor cars and looted Rs. 19,000 in Government Currency notes. The cashier was wounded by a revolver shot and taxi driver shot dead by the dacoits. The numbers of the stolen notes could not be correctly given by the complainant and he and his servants declared their inability to identify any of the dacoits, so it was impossible to get evidence to prosecute. The taxi used, together with a mauser pistol and ammunition was found subsequent to the dacoity in a lane near Circular Road and latter enquiries have given a clue to the gang who committed this crime, 5 of whom have been interned.

Cornwallis Street Murder case. — On the 28th February at 06.30 A.M. Sub-Inspector Suresh Chandra Mukherjee of the Special Branch was shot dead his orderly was severely wounded in Cornwallis Street by three Bengali youths, Chittapriya Roy Chaudhury, Narendra Das and Manoranjan Sen. The Sub-Inspector had just arrested the first–named who was being sought for. All the accused absconded after the commission of the crime and were not traced until November when they were captured by the Balasore Police.

.

বিচারপর্ব শুরু হল গার্ডেনরিচ এবং বেলেঘাটার ঘটনায় ধৃতদের। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্ত হয়ে ফেরার হয়ে গেলেন। নাগাল পেল না লালবাজার। ফকিরচাঁদ মিত্র স্ট্রিট থেকে ধৃত চারজনের বিরুদ্ধে প্রথমে অস্ত্র আইনে মামলা করেছিল পুলিশ। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যাঁদের দু’জনকে গার্ডেনরিচ ডাকাতির মামলায়ও জড়িয়ে দেওয়া হল। যাঁরা আদতে অংশই নেননি ওই ডাকাতিতে। পতিতপাবন ঘোষ এবং রাধাচরণ প্রামাণিক।

অস্ত্র আইনের মামলায় জামিনে মুক্ত ছিলেন পতিতপাবন। ডাকাতির মামলায় ফের গ্রেফতার হলেন। যে গ্রেফতারি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল বাঘা যতীন সহ নেতৃস্থানীয়দের। পতিতপাবন ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয় বিপ্লবী। ভবিষ্যতের সশস্ত্র অভিযানগুলিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা। তাঁর কারাবাস পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটাবে। পতিতপাবনের মুক্ত থাকা একান্ত জরুরি। এখন উপায়?

উপায় বাতলালেন বিবাদী পক্ষের আইনজীবী। যিনি বাদী পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে দফায় দফায় আপস-আলোচনার পর জানালেন, পতিতপাবনের মুক্তির উপায় একটিই। অন্য অভিযুক্ত, অর্থাৎ রাধাচরণ, যদি ডাকাতির ঘটনায় আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন, তবেই মামলা থেকে পতিতপাবন অব্যাহতি পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে অবশ্য রাধাচরণের দণ্ডাদেশের মেয়াদ দু’ বছর (অস্ত্র আইনে দোষীদের সাজার মেয়াদ) থেকে বেড়ে দাঁড়াবে সাত বছরের সশ্রম কারাবাসে।

দেশমুক্তির ব্রতে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবীরা আর কবে শাস্তির লঘু-গুরুর তোয়াক্কা করেছেন? রাধাচরণ সানন্দে রাজি হলেন দোষ কবুল করতে, দণ্ডিত হলেন সাত বছরের হাজতবাসে। পতিতপাবন মুক্তি পেলেন।

রাধাচরণ প্রামাণিকের (১৮৮৫-১৯১৭) জন্ম মাদারীপুরে (ফরিদপুর)। ছাত্রাবস্থায়, ১৯১১ সালে, বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাসের (যাঁর নামে দক্ষিণ কলকাতার পূর্ণদাস রোড) প্রেরণায় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান এবং ক্রমে বাঘা যতীনের ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর একনিষ্ঠ সদস্য হয়ে ওঠা।

রাধাচরণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কারাবাসের দ্বিতীয় বছরে। চোখ আক্রান্ত হল সংক্রমণে, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীয়মাণ হতে শুরু করল।

জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দণ্ডিতের প্রাপ্য চিকিৎসার আবেদন করলেন রাধাচরণ। এবং ইংরেজ জেলর প্রাথমিক মৌখিক প্রতিক্রিয়ায় সটান প্রত্যাখ্যান করলেন আর্জি। মন্তব্যে ঝরে পড়ল চূড়ান্ত তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা, ‘কীসের চিকিৎসা? অমন খুনে ডাকাতের অন্ধ হয়ে যাওয়াই ভাল।’ সেই মুহূর্তেই রাধাচরণ সিদ্ধান্ত নিলেন, দণ্ডাদেশ পালনকালে জেল কর্তৃপক্ষের থেকে কোনও অবস্থাতেই কোনওরকম চিকিৎসা গ্রহণ করবেন না।

চোখের অবস্থার ক্রমাবনতি তো ঘটলই, সপ্তাহকয়েক পর গুরুতর পেটের অসুখে আক্রান্ত হলেন রাধাচরণ। কিন্তু অটুট থাকলেন ধনুর্ভাঙা পণে, বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়পরিজনদের শত উপরোধেও রাজি হলেন না জেল হাসপাতালের চিকিৎসা গ্রহণে। শারীরিক অবস্থা যখন ক্রমে আরও সংকটজনক রাধাচরণের, টনক নড়ল জেল কর্তৃপক্ষের। একরকম চক্ষুলজ্জার খাতিরেই অনুরোধ করলেন ওষুধবিষুধ খেতে। কর্ণপাত করলেন না বত্রিশ বছরের তরুণ বিপ্লবী। উপরন্তু স্বেচ্ছায় চিকিৎসা-প্রত্যাখ্যানের মুচলেকা লিখে দিলেন। আসলে মুচলেকা নয়, নিজের মৃত্যু-পরোয়ানাই।

—দয়ার দান নেওয়ার থেকে মৃত্যু ভাল। দাক্ষিণ্য চাই না ওদের। এটাও তো লড়াই।

লড়াই-ই, তবে দ্বিমুখী। একটি ব্যাধির বিরুদ্ধে, অন্যটি মর্যাদারক্ষার। প্রথমটিতে রাধাচরণ পরাভূত হয়েছিলেন অনিবার্য, দ্বিতীয়টিতে শহিদোচিত জয়লাভ।

এমন কত যে লড়াই, কত যে ত্যাগ, অজানা-অচেনাদের নিঃস্বার্থ আত্মবলিদানের কত যে অশ্রুত-অকথিত-অপঠিত আখ্যান অগ্নিযুগের বঙ্গদেশে।

লেখা আছে অশ্রুজলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *