১. শ্যামলদা, ভাল আছেন?

শ্যামলদা, ভাল আছেন?

—শালা পুরো পৈতে করে দিয়েছি বডিটাকে।

—মানে?

—আবে…পৈতে বুঝিস না? আড়াআড়ি নামিয়ে দিয়েছি। চিরে গেছে পুরো। ঘাড় থেকে কোমর অবধি। ওই যে রে, যেভাবে পৈতে থাকে বামুনদের। আর মালটাকে কুপিয়েছি ওর মায়ের সামনে। বুড়ি তো রক্ত দেখে বেহুঁশই হয়ে গেল…

—মায়ের সামনে মারলে এভাবে?

—দরকার ছিল। ইচ্ছে করেই করেছি। মালটা পুলিশের খোঁচড়গিরি করছিল বড্ড। মহেশতলার ঠেকে গত হপ্তার রেইডটা ওই-ই করিয়েছিল। পাকা খবর আছে আমার কাছে। তাই ঘরে ঢুকে মারলাম। মায়ের সামনে পৈতে করে দিলাম। এই যে লুড়কে গেল… আর কারও হিম্মত হবে না মাথা তোলার…কই বে…ঢাল একটা মোটা করে… মাথাটা ছাড়ুক একটু…

—এই নাও দাদা… এইট্টি এমএল… তিনটে ঢকাঢক নামিয়ে দিলেই দেখবে মদটা চলকাচ্ছে ভেতরে…

—ধুর… ওসব এইট্টি ফেইট্টিতে থোড়ি চলকায় আমার! কিসে চলকায় জানিস? মার্ডারের পর। গরম রক্তটা যখন ছিটকে এসে মুখে লাগে না… কী আর বলি তোদের… বুঝবি না তোরা…গরমাগরম রক্ত স্ট্রেট ছিটকে এসে মুখে… আঃ… বিন্দাস… ও নেশার কাছে মদ-ফদ মায়া…

‘দাদা’-র ব্যাখ্যা স্তব্ধ করে দেয় গোল হয়ে ঘিরে বসে থাকা শ্রোতাদের। ‘দাদা’। বন্ধুদের কাছে ‘শ্যামল’। জুনিয়রদের কাছে ‘শ্যামলদা’। বা স্রেফ ‘দাদা’। বাকিদের কাছে, প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের কাছে, পুলিশের কাছে পরিচয় অন্য নামে। যে নামে রিষড়া-কোন্নগর অঞ্চলে বাঘ, গোরু এবং অন্যান্য যা যা প্রাণী আছে, সব এক ঘাটে জল খায়।

হুব্বা। হুব্বা শ্যামল।

.

ডাক্তার আর পুলিশ। নানাধরনের মৃতদেহ দেখতে হয় এই দুই পেশার লোকদের। সাধারণ লোকের গা গুলিয়ে উঠবে দেখলে, এমন থ্যাঁতলানো-দোমড়ানো-পচাগলা ক্ষতবিক্ষত ‘বডি’ খুঁটিয়ে দেখাটা ডাক্তার বা পুলিশের রুটিন কাজের মধ্যেই পড়ে। অভ্যেস হয়ে যায়। বিকৃত মৃতদেহ আলাদা করে কোনও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় না সচরাচর।

এই লাশটা ব্যতিক্রম। পড়ে ছিল রিষড়া রেলগেটের কাছে। বহু ডেডবডি দেখার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রিষড়া থানার ওসি-ও প্রথম দেখায় চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। মৃতের বয়স পঁচিশ-তিরিশের বেশি নয়। শরীরের উপরের অংশ আড়াআড়িভাবে কোপানো। ডানদিকের কাঁধ থেকে বাঁদিকের কোমর অবধি। বেলাগাম বেরিয়ে পড়েছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ছড়িয়েছে-ছিটিয়েছে রাস্তায়। ধারালো অস্ত্রের কোপ পড়েছে গলাতেও। এক নয়, একাধিক। এ খুনের বর্ণনায় ‘নৃশংস’ নেহাতই নরম বিশেষণ।

খবর পেয়ে স্পটে চলে এসেছেন এসডিপিও (সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার), শ্রীরামপুর। যিনি লাশে একঝলক চোখ বুলিয়ে দৃশ্যতই সামান্য বিচলিত হয়ে পড়েছেন, এবং আপ্রাণ চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক থাকার। ওসি তাকান এসডিপিও-র মুখের দিকে। আন্দাজ করার চেষ্টা করেন তরুণ আইপিএস অফিসারের অস্বস্তির কারণ, ‘স্যার, বডি আইডেন্টিফাই হয়নি এখনও। চেনেন নাকি একে?’

মানুষটাই যখন নেই আর, পরিচয় গোপন করাটা প্রহসন। এসডিপিও উত্তর দেন শান্ত গলায়, ‘সোর্স ছিল আমার। উত্তরপাড়ার ছেলে। কেউ জানত না যে ও সোর্স। খুব রিলায়েবল ছিল। অসম্ভব সাহস… দুর্দান্ত নেটওয়ার্ক…পিনপয়েন্ট খবর দিত… দিন দশেক আগের মহেশতলার রেইডটার ইনপুটগুলো ওরই ছিল…’

চুপ করে থাকেন ওসি। তিনি নিজেও মহেশতলার ওই রেইডে ছিলেন। মহেশতলা থানা থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে একটা তেমাথা মোড়। মোড়ের মাথায় একটা পানবিড়ির দোকান। যার থেকে বাঁ হাতে কয়েকশো মিটার হেঁটে গেলে দোতলা বাড়ি একটা। দোতলাটা ভাল করে ঢালাই হওয়া বাকি এখনও। এসডিপিও সাহেবের কাছে খবর ছিল, একতলায় পালের গোদা সহ ফুল টিম-কে পাওয়া যাবে রাত সাড়ে বারোটার পর। মদ-মাংস-মোচ্ছবের ঢালাও আয়োজন থাকবে মধ্যরাতের ‘ঠেক’-এ।

কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়, বাদ সেধেছিল সন্ধে থেকে অঝোর বৃষ্টি। ‘মুভমেন্ট’ যতটা গোপন রাখা উচিত, ততটা রাখা যায়নি। ওই আকাশ-ভাঙা বৃষ্টির মধ্যেও বাড়িটাকে ‘কর্ডন’ করা হয়েছিল সোয়া একটা নাগাদ। কাউকে পাওয়া যায়নি। যাদের ধরতে যাওয়া, তারা যে কোনওভাবেই হোক, রেইডের আঁচ পেয়ে গিয়েছিল। সোর্সের সেদিনের খবর যে একশো শতাংশ ঠিক ছিল, সে তো এই ছিন্নভিন্ন লাশই জানান দিচ্ছে। বাংলা হিসেব, পুলিশের ‘সোর্স’ হওয়ার চরম মাশুল দিতে হয়েছে এই যুবককে।

বডি পোস্টমর্টেমে পাঠানোর ব্যবস্থা করে গাড়িতে ওঠেন এসডিপিও। রহস্যের ‘র’-ও নেই এখানে। তদন্তেরও ‘ত’ নেই। খুনটা কে করেছে, কেন করেছে, সে নিয়ে ভাবারও কিছু নেই।রিষড়া রেলগেটের লেভেল ক্রসিংটাও জানে।

হুব্বা। হুব্বা শ্যামল।

.

সন্ধে নেমেছে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শেষ মুহূর্তের ব্রিফিং সেরে নিচ্ছেন ডিআইজি সিআইডি (অপারেশনস), যাঁকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অফিসাররা। মন দিয়ে শুনছেন প্রতিটা শব্দ।

—আর্মস থাকবে না ওদের কাছে, এটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়োর! সুতরাং ক্রসফায়ার আউট অফ কোয়েশ্চেন। যদি পালানোর চেষ্টা করে, কেউ ফায়ার করবে না। জানি, প্রাইজ ক্যাচ, কিন্তু ফায়ারিং আন্ডার নো সার্কামস্ট্যান্সেস…আই রিপিট… আন্ডার নো সার্কামস্ট্যান্সেস। ভিড়ের মধ্যে পাবলিকের কোনও ইনজুরি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে… প্লিজ় কিপ দিস ইন মাইন্ড। তেমন হলে জাস্ট দৌড়ে চেজ় করবে… নাথিং মোর। দৌড়ে কোথায় যাবে, কতদূর পালাবে? ধরা পড়বেই। গাড়িদুটো কোথায় থাকবে সেটা আরেকবার বুঝে নাও ভাল করে। পেয়ে গেলে সোজা এনে গাড়িতে তুলব আমরা। আর বেশি সময় নেই হাতে… জাস্ট অ্যাবাউট হাফ অ্যান আওয়ার…কোনও ডাউট আছে কারও? এনি কোয়েশ্চেনস?

উত্তর আসে সমস্বরে, ‘নো স্যার!’

.

‘ডন’। শব্দটা ইদানীং অপাত্রে দান করে মিডিয়া। মাঝারি মাপের কোনও স্থানীয় গুন্ডা-মস্তানের নামের আগেও ‘ডন’ বা ‘গ্যাংস্টার’ বসিয়ে দেওয়াটা আজকাল নেহাতই সাধারণ ঘটনা।

এ কাহিনি তেমন কোনও রাম-শ্যাম-যদু গোত্রের মস্তানকে নিয়ে নয়। খুচরো গুন্ডামি আর টুকরো মস্তানির সীমানা ছাড়িয়ে কীভাবে আক্ষরিক অর্থেই ‘ডন’ হয়ে উঠেছিল হতদরিদ্র পরিবারের এক অশিক্ষিত যুবক, পুলিশকে প্রায় দুই দশক ধরে নাকানিচোবানি খাইয়ে অপরাধ-দুনিয়ায় কীভাবে কায়েম করেছিল একাধিপত্য, তার কিছুটা ধরা থাকল এ কাহিনিতে। ধরা থাকল পুলিশের সঙ্গে ধারাবাহিক টক্করের ইতিবৃত্ত। এবং পরিণতি।

শ্যামল দাস। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বাবা শ্রমিক, হুগলির শ্রীদুর্গা কটন মিলে। কোন্নগরের ধর্মডাঙায় একটা বাড়িতে কোনওমতে সপরিবার দিন গুজরান। পাড়ার স্কুলে বাবা ভরতি করিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেদের। কিন্তু ক্লাস থ্রি-র বেশি আর পড়াশুনো এগোয়নি শ্যামলের। মা-বাবার হাজার বাবা-বাছা সত্ত্বেও যেতই না স্কুলে। আর গেলেও পালিয়ে আসত একটা-দুটো ক্লাসের পরেই। রিষড়া রেলগেটের কাছে গিয়ে মালগাড়ির আসা-যাওয়া দেখত। ভাবত, মালগাড়ি বলে কেন? কী ‘মাল’ থাকে ওই ইয়া ইয়া বগিগুলোর ভিতরে? কারা পাঠায়? কোথায় পাঠায়?

স্কুলের পাট চুকে যাওয়ার পর কিশোর শ্যামলের দিন কাটত ঘুঁটে দিতে মা-কে সাহায্য করে। আর রাতটা কাটত বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। দোসর ছিল ঠিক উপরের দাদা বাচ্চু। স্কুলের মায়া সে ক্লাস ফাইভেই কাটিয়ে দিয়েছিল। আটের দশকের শুরুর দিক তখন। দুই ভাই মিলে খুঁজে বেড়াত টাকা রোজগারের সহজ উপায়। চোদ্দো বছর বয়েসেই বিড়ি আর ‘বাংলা’-য় বউনি। নেশার খরচটা তো অন্তত তুলতে হবে। বাবা একদিন খুব বকাঝকা করলেন শ্যামল-বাচ্চুকে। বাচ্চু চুপ করে থাকল। শ্যামল অবশ্য চুপ করে বকুনি হজম করার বান্দা নয়। বাবার মুখের উপর সরাসরি বলে দিল, ‘তোমার মতো মজুরগিরি আমি করব না। তার চেয়ে ওয়াগন ভাঙলে অনেক বেশি টাকা। আমি নিজেরটা নিজে বুঝে নেব।’ বাবা কাঞ্জিলাল দাস বুঝে গেলেন, এ ছেলে পোষ মানার নয়। এই বয়সে নিজেরটা নিজেই বুঝে নেবে বলছে। ঠিকই বলছে বোধহয়। না হলে চোদ্দো বছর বয়সে বুঝে যায় ওয়াগন ভাঙার হিসেব! মুখের উপর তেড়িয়া মেজাজে বলে দেয়, ‘মজুরগিরি করব না!’

‘ওয়াগন ব্রেকিং’-এ শ্যামলের হাতেখড়ি অবশ্য বছরদুয়েক পরে। ক্রিমিনাল কেরিয়ারের শুরু তারও আগে, স্থানীয় আইসিআই ফ্যাক্টরির মালপত্র চুরি করা দিয়ে। যে ফ্যাক্টরির স্থানীয় নাম ‘অ্যালকালি’। রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা মালপত্র বেচে যা আসত, তাতে আর কতটুকু হত? মাসে দুটোর বেশি সিনেমা দেখা যেত না। সপ্তাহে একদিনের বেশি ‘ইংলিশ’ খাওয়া যেত না। পকেটে পয়সা না থাকায় মাঝপথে জুয়ার বোর্ড ছেড়ে উঠে যেতে হত। অ্যালকালি ফ্যাক্টরির পাশের মাঠে বসে শ্যামল ক্ষোভ উগরে দিত বন্ধুদের কাছে, ‘ধুর, এভাবে বাঁচা তো সেই মিল মজদুরের বাঁচাই হল।’

আরও একটু ভালভাবে বাঁচতে অগত্যা ওয়াগন ভাঙা আর টুকটাক ছিনতাই। ‘টুকটাক’-এর গণ্ডি অবশ্য দ্রুতই পেরল বছর আঠারোর শ্যামল। কোন্নগরের একটা ফ্যাক্টরির টাকা নিয়ে সংস্থার এক কর্মী সাইকেলে করে সন্ধেবেলা ফিরছিলেন। শ্যামল আটকাল কোন্নগর আন্ডারপাসের মুখে, ‘টাকার ব্যাগটা দে!’ ওই কর্মী প্রতিবাদ করলেন, ‘এটা আমার টাকা নয়। কোম্পানির টাকা। তা ছাড়া যারই টাকা হোক, তোকে দেব কেন? তুই কে? কোন হরিদাস?’ বলামাত্রই শ্যামল সোজা ছুরি ঢুকিয়ে দিল পেটে। এবং টাকার ব্যাগ নিয়ে চম্পট।

ওটাই প্রথম খুন। পুলিশের খাতায় ছিঁচকে ছিনতাইবাজ থেকে দাগি দুষ্কৃতীতে উত্তরণের ওটাই প্রথম ধাপ। সেই প্রথম পুলিশের তাড়ায় সাময়িক পালিয়ে যাওয়া এলাকা থেকে। থানায় থানায় ‘রাফ রেজিস্টার’ বলে একটা খাতা থাকে। যাতে নথিবদ্ধ রাখা হয় এলাকার দুষ্কৃতীদের নাম। সেখানে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে সেই প্রথম জায়গা পেল শ্যামল। চেহারার বর্ণনায় (পুলিশি ভাষায়, ‘ডেস্ক্রিপটিভ রোল’) লেখা হল, বেঁটে, হাইট পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি। গায়ের রং চাপা। ছিপছিপে চেহারা।

অপরাধী হিসেবে ‘গুরুত্ব’ যে ক্রমশ বাড়বে আরও, প্রথম খুনের মাসদুয়েকের মধ্যেই সেটা জানান দিল শ্যামল। কোন্নগর-নবগ্রাম এলাকায় পরপর কয়েকটা ডাকাতি করে। দাদা বাচ্চু এবং কিছু উঠতি চ্যাংড়াকে সঙ্গে নিয়ে মাঝরাতে গৃহস্থবাড়িতে ঢুকে বেপরোয়া লুঠপাট। কেউ প্রতিরোধ করলে এলোপাথাড়ি মারধর।

লোহাচুরি-টুরি অনেকেই করে। কিন্তু এই আঠারো-উনিশ বছরের ছেলেটা তো নিজের পাড়ার আশেপাশেই ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে! স্থানীয় মানুষ উত্তরপাড়া থানায় ডেপুটেশন দিলেন। প্রতিদিন অন্তত দু’বার করে শ্যামলের ধর্মডাঙার বাড়িতে শুরু হল পুলিশি রেইড। প্রতিটা ঘরের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তল্লাশি। শ্যামলের বাবা-মাকে পুলিশ স্পষ্ট বলে এল, ‘ছেলেকে বলুন সারেন্ডার করতে। না হলে রোজ এভাবে বাড়িতে পুলিশ আসবে যখন-তখন, লাইফ হেল হয়ে যাবে আপনাদের।’

বাড়ির চাপ। পুলিশের চাপ। এলাকার মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সামাজিক চাপ। পাড়াছাড়া হতে বাধ্য হল শ্যামল। সেটা আটের দশকের শেষ ভাগ, ’৮৬-৮৭। মা-বাবা-ভাইদের প্রতি কোনও পিছুটান ছিল শ্যামলের, এমন অভিযোগ কখনও কেউ করতে পারেনি। প্রবল পিছুটান বরং ছিল অন্যত্র। পাড়ারই এক কিশোরীর সঙ্গে প্রেম গত কয়েক বছর ধরে। নাম তাপসী। যার পরিবারের ঘোর আপত্তি ছিল একজন সমাজবিরোধীর সঙ্গে মেয়ের মেলামেশায়। পাড়াছাড়া হওয়ার পর এক বন্ধু মারফত ক্লাস এইটের তাপসীকে বার্তা পাঠাল শ্যামল, ‘কয়েকটা বছর শুধু ধৈর্য ধরে থাকো…।’ কথা রেখেছিল শ্যামল। বছরদুয়েকের মধ্যেই এক রাতে ঝটিতি অভিযানে দলবল নিয়ে ঢুকেছিল পাড়ায়। তাপসীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেছিল পরের দিনই।

সমাজবিরোধী তো অনেকই থাকে। কিন্তু গুন্ডামি-মস্তানির প্রচলিত সীমানা পেরিয়ে যদি কোনও সমাজবিরোধীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ‘বাহুবলী’ হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি থাকে, পৃষ্ঠপোষকের বড় একটা অভাব হয় না আমাদের সমাজে। ছাতা একটা জুটেই যায় ঠিক। জুটে গেল শ্যামলেরও। দক্ষিণ শহরতলির এক রাজনৈতিক নেতার বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে উঠল। ঘাঁটি গাড়ল মহেশতলায়।

পরের ছ’-সাত বছর হুগলিতে পাকাপাকিভাবে ঢুকতে না পারলে কী হবে, রাজ্যের অন্যত্র এবং কখনও কখনও রাজ্যের বাইরেও একটার পর একটা ক্রাইম করে বেড়িয়েছিল শ্যামল। কী নেই অপরাধের সেই দশকর্ম ভাণ্ডারে? হাওড়ার বন্ধ কারখানার লোহার ছাঁট পাচার। দূরপাল্লার ট্রেনে প্যাসেঞ্জার সেজে উঠে গভীর রাতে ডাকসাইটে ডাকাতি। বেপরোয়া বোমাবাজি করে এলাকা দখল কোনও রাজনৈতিক দাদার অঙ্গুলিহেলনে। মোটা টাকার বিনিময়ে ‘সুপারি-কিলিং’।

এমনই এক সুপারি-কিলিং করতে গিয়ে নয়ের দশকের শুরুতে মুঘলসরাইয়ে রেলপুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল শ্যামল। মাসখানেকের জেলযাত্রার পর বেরিয়ে এসে ফের নতুন উদ্যমে শুরু করেছিল দাদাগিরি। চেহারাটাও বদলে গেছিল এই কয়েক বছরে। ছিপছিপে ছিল না আর। শরীরে জমছিল সমৃদ্ধির মেদ। এই শ্যামলের ‘ডেস্ক্রিপটিভ রোল’ লিখতে হলে ‘ছিপছিপে’ বদলে গিয়ে হত ‘গাট্টাগোট্টা, সামান্য মোটার দিকে’।

‘গ্যাং’ থাকলে তবেই না গ্যাংস্টার! শ্যামল একটু একটু করে গড়ে তুলেছিল নিজস্ব গ্যাং। হাওড়ার কুখ্যাত সাট্টা-কারবারি রাম অবতারের কাছে সাট্টার প্যাড লেখার কাজ করত রমেশ মাহাতো। কিন্তু স্বপ্ন দেখত ‘বড়’ মাঠে খেলার। প্যাড লেখে তো পাতি পাবলিক, ক’পয়সাই বা হয়? বালি-বেলুড়ের মাঝামাঝি জায়গায় একটা জুয়ার ঠেকে শ্যামল-রমেশের আলাপ। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব, এবং সেই বন্ধুত্ব গভীরতর হয়ে শ্যামলের গ্যাংয়ের অলিখিত নাম্বার টু হয়ে ওঠা রমেশ মাহাতোর।

নাম্বার থ্রি? ‘বেনারসি বাপি’। আসলে বাঙালি। নাম, বাপি খাস্তগির। বেনারসে জন্ম এবং বড় হওয়া বলে নাম ‘বেনারসি’। শ্যামলের সঙ্গে প্রথম দেখা লিলুয়ার বিজলি কোয়ার্টারে, যেখানে দুষ্কৃতীদের নিত্য যাতায়াত। লম্বায় ছ’ফুট, নির্মেদ শরীরের বাপিকে দলে নিতে একটুও ভাবতে হয়নি শ্যামলকে। গ্যাংয়ের অন্যদের অনেকেরই নাম করা যায়। লম্বা লিস্ট। তবে ‘কোর গ্ৰুপ’ বলতে মন্টু, সত্য, পুতন, চিকুয়া, জিতেন্দর, নেপু…।

শেষ নামটা অন্যদের তুলনায় কিছু বাড়তি শব্দ দাবি করে। নেপু— নেপু গিরি। কিছু লোকের বোধহয় জন্মই হয় অপরাধ-লগ্নে। নেপু যেমন। ‘বর্ন ক্রিমিনাল’ গোত্রের । শুধু বলার অপেক্ষা, ‘নামিয়ে দিয়ে আয় তো নেপু।’ কোনও প্রশ্ন না করে যাকে ‘নামানোর’ নির্দেশ এসেছে, তাকে খুন করে আসবে নির্মম নির্বিকার। এমন পেশাদার খুনির দরকার ছিল শ্যামলের।

‘খুন’ ব্যাপারটা অবশ্য নেপুর থেকেও ঢের বেশি মজ্জাগত ছিল শ্যামলের। অপরাধ-বিজ্ঞানের খটোমটো পরিভাষায় বললে, শ্যামল ছিল ‘প্যাথলজিকাল কিলার’। আনন্দ পেত খুন করে। হয়তো প্রাণে মেরে ফেলার দরকারই নেই কাউকে, স্রেফ ধমকধামকই যথেষ্ট, তবু শ্যামল বিজাতীয় তৃপ্তি পেত ‘লাশ ফেলে দিয়ে’। মদের সঙ্গে গাঁজার নেশা জমে উঠলে বাবু হয়ে বসে থাকত স্থির। বদলে যেত চোখের দৃষ্টি। কথা প্রায় বলতই না। এমন একটা বোমভোলা চেহারা হত যে, সঙ্গীরাই বলত, ‘দ্যাখ… দাদা পুরো হুব্বা হয়ে গেছে!’

সেই থেকেই নামকরণ। হুব্বা। হুব্বা শ্যামল। নেশার ঘোরে থম মেরে ‘হুব্বা’ হয়ে থাকার সময়টাতেই শ্যামল ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক। তখনই মাথাচাড়া দিত কারণে-অকারণে রক্ত দেখার তাড়না, লাশ দেখার স্পৃহা—‘ধুর… এসব মদ-ফদ মায়া… আমার কিসে চলকায় জানিস… মার্ডারের পর যখন গরম রক্তটা মুখে ছিটকে এসে লাগে না… আঃ… বুঝবি না তোরা…!’ রমেশ-বাপি-মন্টুর মতো ঘনিষ্ঠরা শ্যামলের এই রক্ত দেখার রাত্রিকালীন ছটফটানিটা জানত। বছরের পর বছর ধরে সঙ্গে থাকার ফলে আঁচ করতে পারত, ওইসময় আশেপাশে বিরোধী গ্ৰুপের ছেলে পেলে তো কথাই নেই, এমনকী নিজের গ্ৰুপের ছেলেছোকরাদের উপরও যখন-তখন চড়াও হয়ে যেতে পারে শ্যামল। রমেশ টিমের জুনিয়রদের বলেই রেখেছিল, ‘শ্যামল যদি কোনওদিন রাত সাড়ে দশটার পর ডাকে, আসবি না। না এলে দাদা রাগ করবে, এই ভয়ে দুম করে চলে আসবি না কিন্তু। বেশি রাতে ডাকলে আসবি না, ব্যস। দাদা রাগ করলে করবে। সেটা আমি সকালে বুঝে নেব।’

হাতে যথেষ্ট টাকা। দুর্ধর্ষ গ্যাং-ও তৈরি এই ক’বছরে। শ্যামল সিদ্ধান্ত নিল, ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার এটাই সেরা সময়। কোন্নগর-ধৰ্মডাঙায় শ্যামলের, সরি, হুব্বা শ্যামলের সদলবল পুনঃপ্রবেশ ঘটল এলাকাছাড়া হওয়ার প্রায় এক দশক পরে। ৯৫-’৯৬-এ, নয়ের দশকের মাঝামাঝি। লক্ষ্য মূলত দুটো। প্রথম, রিষড়ায় সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া বিন্দাল ফ্যাক্টরিতে পড়ে থাকা লক্ষ লক্ষ টাকার মাল পাচার। দ্বিতীয়, হুগলি-হাওড়ার অপরাধ দুনিয়ায় ‘বেতাজ বাদশা’ হয়ে ওঠা।

প্রথম লক্ষ্যপূরণে অভিনব পন্থা নিল শ্যামল। নিজে বা নিজের টিমের ছেলেপুলেদের দিয়ে ফ্যাক্টরির মাল চুরি আর পাচার আর নয়। ওসব কেরিয়ারের শুরুর দিকে অনেক হয়েছে। এবার চুরিটা অন্যরা করুক, কিন্তু নিজের টিমের নজরদারিতে।

কীরকম? শ্যামল নিয়ম বেঁধে দিল। জটিল কিছু নয়। বিন্দাল ফ্যাক্টরির মাল যে কেউ চুরি করতে পারে। অবারিত দ্বার। কিন্তু চুরির পর বেচতে হবে শ্যামলের কাছেই। এবং বাজারদরের থেকে অর্ধেক দামে। এক কেজি ছাঁটের বাজারদর যদি তিনশো টাকা হয়, ফ্যাক্টরি থেকে সরানো সেই এক কেজি শ্যামলকে বেচতে হবে দেড়শো টাকায়। অর্ধেক দামে কিনে নেওয়া সেই মাল এবার শ্যামল বাজারে বেচত চলতি দরে।

এই সিস্টেমের প্রতিবাদ করার মানে পৃথিবী থেকেই ‘খরচা’ হয়ে যাওয়া, জানত সবাই। জানত, শ্যামলের সঙ্গে এই কেজি প্রতি দেড়শো টাকাটা অন্তত দুশো করতে চেয়ে একজন তর্কাতর্কি করেছিল। পরিণতি ভাল হয়নি। বুকে সোজা পিস্তল ঠেকিয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় শ্যামল বলেছিল, ‘পাঙ্গা নেওয়ার আগে তোর একটা জিনিস মনে রাখা উচিত ছিল। গাড়িটা তুই চালাচ্ছিস না। আমি চালাচ্ছি।’ এরপর দুটো গুলি খরচ করেছিল শ্যামল। ‘পাঙ্গা’-নেওয়া লোকটির ‘বডি’ খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশের খাতায় ‘মিসিং’। জনশ্রুতি, লাশটা রেললাইনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

হাজার হাজার টনের অরক্ষিত এবং পরিত্যক্ত মাল এভাবে বেচে খুব দ্রুত টাকার পাহাড়ে পা রাখল শ্যামল। অতঃপর দ্বিতীয় লক্ষ্য। এলাকায় নিজের নিরঙ্কুশ আধিপত্যে শিলমোহর দেওয়া।

খুব সোজা হল না ব্যাপারটা। অপরাধ জগতে শূন্যস্থান ‘শূন্য’ থাকে না বেশিদিন। এলাকায় প্রায় এক দশক ধরে শ্যামলের অনুপস্থিতির সুযোগে তৈরি হয়ে গিয়েছিল একাধিক ছোট-বড় গ্যাং। যাদের মধ্যে শ্যামলের দিকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো বুকের পাটা একজনেরই ছিল। বাঘা। ভাল নাম, ভোলানাথ দাশ। যে একসময় ছিল শ্যামলেরই টিমে। বখরা নিয়ে ঝামেলায় দল ছেড়েছিল। কোন্নগর পেরিয়ে কানাইপুরে ঢুকলেই বাঘার এলাকা শুরু।

’৯৭-৯৯, এই সময়টায় শ্রীরামপুর মহকুমার পুলিশ প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল শ্যামল-বাঘার টক্কর, এলাকা দখলের লড়াই, খুন-পালটা খুন, বোমাবাজি, রক্তপাত। খুনোখুনি কখনও কখনও এতটাই মাত্রা ছাড়াত যে ঘটনার আঁচ মহকুমা বা জেলা পেরিয়ে পৌঁছে যেত কলকাতাতেও। জায়গা করে নিত শহরের বাংলা-ইংরেজি খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। একবার যেমন হল। শ্যামলের গ্ৰুপের দুটো ছেলেকে রাতের দিকে একলা পেয়ে কুপিয়ে মেরে দিল বাঘার ছেলেরা। পরের রাতেই বদলা নিল শ্যামল। বাঘার পাড়াতে দলবল নিয়ে ঢুকে চূড়ান্ত তাণ্ডব করল। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিল বাঘার বাড়ি। বাঘা কোনওমতে জনাদুয়েক সঙ্গীকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচল। পালাতে পারেনি চারজন। তারা বাঁচল না। তাদের কুপিয়ে পিস পিস করে কেটে স্থানীয় পুকুরপাড়ে ফেলে রেখে গেল শ্যামল।

দু’দিনের মধ্যে দুষ্কৃতীদের গোষ্ঠী-সংঘর্ষে আধডজন খুন হলে পুলিশি প্রতিক্রিয়া যেমন হওয়ার, তেমনই হল। জেলার সমস্ত থানা থেকে অফিসার-ফোর্স এনে শ্যামল আর বাঘা, দু’জনের গ্ৰুপের ছেলেদের সবার বাড়িতে রাতভর তল্লাশি-অভিযান। সোর্সের খবর অনুযায়ী একাধিক গোপন ঠেকে একযোগে হানা। মোড়ে মোড়ে পুলিশ পিকেট। গাড়ি থামিয়ে নাকা-চেকিং। চব্বিশ ঘণ্টাই সাদা পোশাকে নজরদারি তিন শিফটে। ধরাও পড়ল বেশ কয়েকজন। কিন্তু মূলত যাকে ধরার জন্য এত আয়োজন, সেই শ্যামল বেপাত্তা। ভ্যানিশ।

শ্যামলের ঘনিষ্ঠ বলয়ে ছিল যারা, সেই রমেশ-বাপি-মন্টু-পুতন-নেপু-চিকুয়া-রা সবাই কখনও না কখনও ধরা পড়েছিল নয়ের দশকের এই শেষের বছরগুলোয়। শ্যামলই শুধু ‘অড ম্যান আউট’। ধরা পড়েনি কখনও। কোনও গুন্ডা-মস্তান কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় কিছুদিন দাদাগিরি করে বেড়িয়েছে, মস্তানিতে কাঁপিয়ে দিয়েছে, এমন উদাহরণ খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু শ্যামলের ব্যাপারটা আলাদা। এত খুন-জখম-লুঠপাট করেও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বছরের পর বছর অধরা থাকাটা শ্যামলকে শুধু হুগলিতে নয়, সারা রাজ্যেরই অপরাধ-মানচিত্রে ‘মিথ’-এর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর যে ধরা পড়ে পড়ুক, শ্যামলকে ধরতে পারবে না পুলিশ, এই ধারণাটা একটা দীর্ঘসময় ধরে জলবাতাস পেয়েছিল। শ্যামল নিজেও ‘ডন’ ছবিতে বচ্চনের কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া ডায়লগটা সামান্য পালটে নিয়ে বলত রাতের আড্ডায়, ‘শ্যামলকো পকড়না মুশকিল হি নহি… না-মুমকিন হ্যায়।’

কেন মুশকিল? কেন না-মুমকিন? কোন জাদুমন্ত্রে নিজের রাজ্যপাট দিব্যি কায়েম রেখেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকত পুলিশের? পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মী-অফিসার, যাঁরা নব্বই-এর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে পরের দশ বছরের কোনও না কোনও সময় কাজ করেছেন শ্রীরামপুর মহকুমায় বা হুগলি জেলার অন্যত্র, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে একাধিক কারণ বেরিয়ে আসে।

এক, শ্যামলের অত্যাশ্চর্য ইনফর্মার-নেটওয়ার্ক। যাঁরা রিষড়া-কোন্নগর অঞ্চলের বাসিন্দা বা নিয়মিত যাতায়াত আছে ওই এলাকায়, তাঁরা জানবেন স্থানীয় ভূগোল। যাঁরা যাননি কখনও, ধারণা নেই তেমন, তাঁদের জন্য বলা, রিষড়া-কোন্নগর অঞ্চলের বিভিন্ন বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরির বিস্তীর্ণ এলাকার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল শ্যামলের বিচরণভূমি। অ্যালকালি… জেকে স্টিল… বিন্দাল… ইউনাইটেড ভেজিটেবলস…। পাশাপাশি ছিল স্থানীয় ক্লাব ‘সেবক সংঘ’-র মাঠ.. ধর্মডাঙা… বারুজীবী কলোনি…।

শেষ যে জায়গার নামটা লিখলাম, কৌশলগত কারণে সেটাই ছিল শ্যামলের পক্ষে নিরাপদতম। বারুজীবী কলোনি। রাতে এখানেই থাকত বেশিরভাগ সময়। কেন? এই জায়গাটায় তিনদিক দিয়ে ঢোকা যেত। রিষড়া রেলগেট দিয়ে। কোন্নগর আন্ডারপাস দিয়ে। কিংবা দিল্লি রোড দিয়ে ডানকুনি হয়ে। ডানকুনি হয়ে পুলিশের গাড়ি ঢুকলে দেখা যেত অনেক দূর থেকে। কিন্তু রিষড়া রেলগেট বা কোন্নগর আন্ডারপাস দিয়ে পুলিশের পক্ষে দ্রুত ঢুকে যাওয়া সম্ভব ছিল বারুজীবী কলোনিতে। ডিফেন্সকে মজবুত করতে তাই রেলগেট আর আন্ডারপাসের মুখে সন্ধে থেকে ভোর অবধি ‘ডিউটি’ করত শ্যামলের বাহিনী। নজরে রাখত প্রতিটা গাড়ি, প্রতিটা বাইককে। সাদা পোশাকে পুলিশ ঢুকছে, এ নিয়ে সামান্যতম সন্দেহ হলেও নিমেষের মধ্যে মোবাইলে খবর চলে যেত শ্যামলের কাছে।

এ তো গেল রাত। নজরদারি বজায় থাকত দিনের বেলায়ও। এলাকার প্রতিটা গলিতে, প্রতিটা মোড়ে ছড়িয়ে থাকত ইনফর্মাররা। যাদের সবাইকে মাসে মাসে ভদ্রস্থ অঙ্কের টাকা দিত শ্যামল। দিয়ে রাখত মোবাইল ফোন। ওসি থেকে শুরু করে এসডিপিও বা জেলার এসপি স্বয়ং…বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অফিসার কম চেষ্টা তো করেননি শ্যামলকে ধরতে। রিকশা করে, অটো করে, বাইকে করে, নানারকম ছদ্মবেশে প্রাণপ্রাত চেষ্টা হয়েছে, যাতে পুলিশের গতিবিধি আন্দাজ করতে না পারে শ্যামলের লোকেরা। কিন্তু লাভ হয়নি। ‘খবর’ হয়ে গেছে মোক্ষম সময়ে। পাখি উড়ে গেছে।

শ্যামল যে সময়ে ক্রমে ত্রাস হয়ে উঠছে রিষড়া-কোন্নগর-উত্তরপাড়া এলাকায়, তখন ওই এলাকায় কাজ করেছেন এমন এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য তুলে দিচ্ছি হুবহু, …‘ডিমওয়ালা, সবজিওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, ইস্ত্রিওয়ালা, পাড়ার চায়ের দোকান, মুদির দোকান, সর্বত্র সোর্স ছিল শ্যামলের। এটা রেইড-এর সময় আমরা ফিল করতে পারতাম। ধরুন রিষড়া রেলগেট পেরলাম সিভিল ড্রেসে। রিকশা করে। বা পায়ে হেঁটে। অদৃশ্য নজরদারি যে একটা চলছে, সেটা সেন্স করতে পারতাম স্থানীয় মানুষের চোখের ইশারায় বা ফিসফিসানিতে। শ্যামলের চ্যালাচামুন্ডাদের মুখে শুনেছি, নানারকম কোডনেম ছিল খবর দেওয়ার। ‘‘ছোটপাখি’’ মানে ওসি। ‘‘মেজোপাখি’’ মানে সিআই বা সার্কেল ইনস্পেকটর। আর ‘‘বড়পাখি’’ মানে এসডিপিও। রেইড হত, কিন্তু ফিরতাম খালি হাতে। এক একসময় এত হতাশ লাগত যে কী বলব! মনে হত এলাকার গাছগুলোও বোধহয় শ্যামলের সোর্স। না হলে এতটা সিক্রেসি মেইনটেইন করার পরেও প্রত্যেকবার খবর পেয়ে যায় কী করে?’

এই ‘কী-করে’-র উত্তরেই উঠে আসে দ্বিতীয় কারণ। সোর্সের মধ্যেই ভূত। পুলিশেরই একাংশ মনে করেন, ফোর্সের মধ্যেও বিভিন্ন স্তরে নিজের লোক ‘ফিট’ করেছিল শ্যামল। অন্তর্ঘাত না হলে বারবার ‘অপারেশন’ ফেল করতে পারে না। আর রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কথা তো আগে লিখেইছি। বড়সড় কোনও ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়ার পর ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ের অভাব হত না শ্যামলের। কখনও কখনও আবার পুলিশের ‘রেডার’-এর সম্পূর্ণ বাইরে চলে যেত দু’-একজন বিশ্বস্ত সঙ্গীকে নিয়ে। মণিপুর, মেঘালয় বা মিজোরাম। এলাকা ঠান্ডা হলে ফিরে আসত কয়েক মাস পরে।

তিন নম্বর কারণ, এলাকায় নিজের একটা ‘রবিনহুড’ ইমেজ গড়ে তোলা। পাড়ার কোনও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ের বিয়েতে হয়তো টাকা জোগাড় হচ্ছে না লোক খাওয়ানোর। মেয়ের বাবা শ্যামলকে এসে ধরলেন। এলাকার কোনও ক্যাটারারকে ডেকে শ্যামল নিজস্ব ভঙ্গিতে হুকুম জারি করল, ‘ভাল মেনু করবি। মাছ-মাংস রাখিস। আর যা বিল হবে, তার থার্টি পারসেন্টের বেশি নিবি না। কিন্তু তা বলে খাবারের কোয়ালিটি যদি খারাপ হয়েছে শুনি…।’ কথা শেষ করার প্রয়োজনই হত না, বিয়ের ভোজ মিটে যেত নামমাত্র টাকায়। পাড়ার কোনও মেধাবী ছাত্রের কলকাতার ভাল কলেজে অ্যাডমিশনের টাকা জোগাড় হচ্ছে না। শ্যামলের দরবারে গিয়ে আর্জি জানালে মুশকিল আসান। স্থানীয় কোনও ব্যবসায়ীকে ফোন করে সামান্য চমকালেই কাজ হয়ে যেত। টাকা পৌঁছে যেত ছাত্রের পরিবারে। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে কেউ ঝগড়া করে না। কোন্নগরে বাস করে কেউ শ্যামলের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়াত না।

একটা পরিত্রাতা ইমেজ তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তা বলে এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই যে শ্যামল আদতে দয়ালু প্রকৃতির এবং গরিবের দুঃখে বুক ফেটে যেত। নিজের রোজগার ছিল অঢেল। কিন্তু যা যা ‘পরোপকার’ করে পাড়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার জন্য একটা পয়সাও নিজের পকেট থেকে খরচ করত না। খোলাখুলিই বলত, ‘লোকে জানছে, শ্যামলদার জন্য কাজটা হল। আমার ওটুকুই দরকার। আমার মাল খসছে কী অন্যের, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।’

স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কার ছিল। স্থানীয় মানুষের কিছু উপকার করে কৃতজ্ঞতা কিনতে থাকো এলাকায়, যাতে ‘শ্যামলদা’-র বিপদে-আপদে লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘বিপদ-আপদ’ মানে পুলিশের ‘রেইড’, ‘ঝাঁপিয়ে পড়া’ মানে চোখকান খোলা রেখে পুলিশের গতিবিধির ব্যাপারে ‘দাদা’-কে খবর দেওয়া। খবরের বিনিময়ে অনেককে মাসোহারা দিত শ্যামল, আগেই লিখেছি। কিন্তু এমনও অনেকে ছিল, যারা বিনে পয়সাতেই ‘ইনফর্মার’-এর কাজ করত। পরোপকারে বিনিয়োগের ফসল সুদে-আসলে এভাবেই তুলেছিল শ্যামল।

কারণ নম্বর চার, নিজেকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস না করার প্রবণতা। যতই নেশার ঘোরে ‘হুব্বা’ হয়ে যাক, জুয়ার বোর্ডে যতই উপচে পড়ুক টাকার বান্ডিল, রাতটা কোথায়, কোন ঠেকে বা কার বাড়িতে কাটাবে, কেউ জানত না। কাউকে বলত না। দিনের বেলায়ও কোথাও যদি যাওয়ার থাকত কখনও, সময়টা নির্দিষ্ট করে জানাত না কোনও অবস্থাতেই। বলত, বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে যাব। বা চারটে থেকে ছ’টার মধ্যে। এবং ওই সময়টায় হয়তো যেতই না আদৌ। যেত ওই সময়সীমার আগে-পরে।

সময়ের এই সামান্য হেরফেরেই পাকা খবর থাকা সত্ত্বেও মহেশতলার রেইডটায় এসডিপিও-র নাগাল থেকে বেরিয়ে গেছিল শ্যামল। শুরুতে বলেছি সেই ব্যর্থ রেইডের কথা। লিখেছি, খবরটা যে দিয়েছিল, এসডিপিও-র সেই সোর্সের দেহ দিনদশেক পর পাওয়া গিয়েছিল রিষড়া স্টেশনের কাছে। বাড়িতে ঢুকে মায়ের সামনে কুপিয়ে শ্যামল ভয়ংকরতম বদলা নিয়েছিল পুলিশকে খবর দেওয়ার। এবং রাতে মদের ঠেকে রসিয়ে রসিয়ে বিবরণ দিয়েছিল খুনের, ‘আড়াআড়ি নামিয়ে দিয়েছি। চিরে গেছে পুরো। ঘাড় থেকে কোমর অবধি। আর মালটাকে কুপিয়েছি ওর মায়ের সামনে। পুরো পৈতে করে দিয়েছি বডিটাকে।’

কখনও ‘পৈতে’। কখনও ‘ফুটবল মাঠ’। কখনও ‘বোটি কাবাব’। এক একরকম খুনের বর্ণনায় এক একরকম বিশেষণ ব্যবহার করত শ্যামল। টুকরো টুকরো করে কাটলে সেটা ‘বোটি কাবাব’। পেট চিরে দিয়ে ভিতরে নুড়িপাথর আর ঘাস ভরে দিলে সেটা ‘ফুটবল মাঠ’। মোট কত খুন করেছিল শ্যামল? সরকারি হিসেবই যদি ধরি শুধু, ১৯৯৬-২০০০-এর মধ্যেই অন্তত কুড়িটা খুনের ঘটনায় সরাসরি যুক্ত ছিল। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আটের দশকের শেষ থেকে ধরলে, তা নিয়ে জল্পনাই করা যেতে পারে শুধু। তিরিশ? চল্লিশ? নাকি আরও অনেক বেশি?

পুলিশের নাগালের বাইরে থাকার নেপথ্যে পঞ্চম এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, শ্যামলের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, দুরন্ত উপস্থিত বুদ্ধি এবং চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। বিভিন্ন সময়ে শ্যামলের টিমের যে ছেলেপুলেরা ধরা পড়ত, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ পুলিশকে বুঝিয়ে দিত, অন্যদের থেকে ঠিক কোথায় আলাদা ক্লাস থ্রি অবধি বিদ্যের ‘অশিক্ষিত’ শ্যামল।

টুকরো কিছু ঘটনার উল্লেখ থাক। সেবক সংঘের মাঠে ঠেক বসেছে। তখন শ্যামল কুড়ি-বাইশ। চাঁদনি রাত। এক সঙ্গী একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল দু’-তিন পেগ পেটে পড়ার পর, ‘কী অ্যাটমোসফেয়ার মাইরি। মনেই হচ্ছে না এটা রিষড়া! তাজমহলে বসে মাল খাচ্ছি মনে হচ্ছে, বল?’ শ্যামল শুনে সরলভাবেই প্রশ্ন করল, ‘তাজমহল? এই বারটা আবার কোথায়? নতুন হল নাকি?’ সঙ্গীরা হাসিতে ফেটে পড়ত, ‘তাজমহলের নাম শুনিসনি? আরে বার নয় রে !’ অপ্রতিভ দেখাত শ্যামলকে।

অথচ তাজমহলেরও নাম-না-শোনা এই শ্যামলই তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষিত বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দিত যখন-তখন। ওই সেবক সংঘ মাঠেরই একটা ঘটনায় যেমন। বেশ কয়েকটা হারিকেনের আলোয় চলছে খানাপিনা। হঠাৎই শ্যামল বলে উঠল, ‘এই, আলো বন্ধ কর, পুলিশ আসছে!’ অন্যরা অবাক। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। কিচ্ছু নেই। কী করে বুঝল পুলিশ আসছে? আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। আর তার ঠিক মিনিট দেড়েক পরে মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে গেল একটা। চলে যাওয়ার পর আবার যখন চালু হল মদ-মাংস, বাকিরা শ্যামলকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে বুঝলি?’

শ্যামল হাসল, ‘এই জন্যই আমি আমার জায়গায়, আর তোরা তোদের জায়গায়। থানার জিপগুলো বেশিরভাগই দেখবি লজ্‌ঝড়ে। যত্ন নেই। তার উপর হেবি রাফ চালায়। তাই দেখবি হেডলাইটের পজিশন ঠিক থাকে না। উঁচুনিচু হয়ে যায়। অন্য গাড়িতে আলো সোজা রাস্তায় পড়ে। পুলিশের গাড়িতে দেখবি হেডলাইটের আলোটা একটু উপরে পড়ে। ইলেকট্রিকের তারে ঝিলিক মারে। আমি তারে ওই আলোর ঝিলিকটা দেখলাম। মানে পুলিশ।’

মোবাইলের যুগে যে টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে অবস্থান জেনে নেওয়া যায়, বছরের পর বছর চোর-পুলিশ খেলতে খেলতে জেনে গিয়েছিল শ্যামল। জেনে গিয়েছিল, পুলিশ ফোনে আড়িও পাততে পারে নম্বর জানা থাকলেই। সেই প্রযুক্তি এসে গেছে। চূড়ান্ত সতর্ক থাকত ফোন নিয়ে। অন্তত হাফ ডজন মোবাইল সঙ্গে থাকত অষ্টপ্রহর। নিজের কাছে দুটো। বাকিগুলো সর্বক্ষণের সঙ্গীদের কাছে। পালটে পালটে ব্যবহার করত প্রত্যেকটা ফোন। একটা ফোন টানা দু’ঘণ্টার বেশি চালু রাখত না কখনওই। কোন ফোনটা যে কখন চলবে, কোনটা যে কখন বন্ধ হবে হঠাৎ, কখন যে ফের চালু হবে, কেউ জানত না। সবসময় মাথায় রাখত, হয়তো নম্বরগুলো জেনে গেছে পুলিশ। হয়তো প্ল্যান করছে রেইড-এর। হয়তো আড়ি পেতে শুনছে কথাবার্তা। শ্যামল তাই ফোনে কথা বলতও কম। আর বলার সময়ও এমন কিছু কথা ভাসিয়ে দিত ইচ্ছে করে, যাতে পুলিশ বিভ্রান্ত হয়। হয়তো আছে কোন্নগরে, রাতে কোনও একটা ‘অপারেশন’ করার কথা আছে রিষড়ায়। একটা ফোনে কাউকে বলল, ‘রাতে হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির সামনে চলে আয়। বাকি কথা ওখানে হবে।’ সঙ্গীরা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালে ক্রুর হাসত শ্যামল, ‘একটু চুক্কি দিলাম আর কী! পুলিশ জাতটাকে বিশ্বাস নেই। যা বলছি, শুনছে হয়তো। শুনলে শোন না… যা ঘুরে মর হাওড়ায়। আমি এদিকে কাজটা সেরে নিই। নো রিক্স।’

রিস্ক নিত না, এমন নয়। নিত, কিন্তু ভেবেচিন্তে। বাঘার সঙ্গে যখন সেয়ানে-সেয়ানে চলছে কোন্নগর-কানাইপুরে, একদিন দুপুরবেলা শ্যামল একা বাইক চালিয়ে বারুজীবী কলোনিতে ঢুকল। ঢুকল কানাইপুরের দিক থেকে। যেটা বাঘার এলাকা। রমেশ জিজ্ঞেস করল, ‘এই রাস্তা দিয়ে এলি যে? এই ঝুঁকি নেয় কেউ? আর রাস্তা ছিল না? বাঘার এরিয়া দিয়েই আসতে হল? যদি বাঘার ছেলেরা দেখতে পেয়ে যেত? যদি ঘিরে নিত?’

শ্যামলের উত্তর সোজাসাপ্টা, ‘আরে তোরাও যেমন! বাঘার পাড়া দিয়ে ঢোকাই তো সবচেয়ে সেফ রে! ওরা যদি আমাকে দেখেও ফেলত, ভাবতেও পারত না যে আমি একা ঢুকেছি। ভাবত, আশেপাশে ছেলে আছে অনেক। অ্যাটাক করতে এসেছি বোধহয়। ভয় পেয়ে যেত। বাঘাকে খবর দিত। গুলি-বোমা নিয়ে রেডি হতে ওদের সময় লাগত কিছুটা। তার মধ্যে এই দ্যাখ আমি আরামসে নিজের মহল্লায়। যাতায়াতের সময় রুট বদলাবি মাঝে মাঝে। একই রুটে গেলে ডেঞ্জার বেশি। নে নে… ঢাল একটা…।’

ফোনই শুধু ঘনঘন বদলাত না, বদলাত চেহারাও। কখনও শুধুই গোঁফ রাখত। কখনও গোঁফের সঙ্গে একমুখ দাড়ি। এবং তার উপর পাগড়ি চড়িয়ে পাক্কা পাঞ্জাবি। কখনও আবার গোঁফদাড়ি উড়িয়ে দিয়ে পরিপাটি ক্লিনশেভন। দূরপাল্লার ট্রেনে প্যাসেঞ্জার সেজে উঠে রেলডাকাতি করত যখন কেরিয়ারের শুরুর দিকে, তখন থেকেই ছদ্মবেশ ধরায় পটু। কখনও বিহারি সাজত, কখনও পাঞ্জাবি। সেই অনুযায়ী পোশাক-আশাক। চেহারার ছিরিছাঁদ পালটানোর এই অভ্যেস আগাগোড়া বজায় রেখেছিল শ্যামল। ঠিক এই মুহূর্তের মুখের চেহারাটা কেমন, রেইড করার সময় জানত না পুলিশ। দীর্ঘদিন অ্যারেস্ট না হওয়ায় সাম্প্রতিক কোনও ছবি ছিল না শ্যামলের। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া সঙ্গীদের থেকে চেহারার বিবরণ শুনে এবং সোর্সদের সঙ্গে কথা বলে একটা ধারণাই তৈরি ছিল শুধু।

নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনার চেষ্টা করত সবসময়। বাইক চালাত দুর্দান্ত। কেউ কখনও অন্যের বাইকের পিছনে বসতে দেখেনি। সে যতই নেশা হোক, ‘পিলিয়ন রাইডিং’ কখনও নয়। বলত, ‘অন্য কেউ শালা কোথায় কখন গাড়ি ভিড়িয়ে দেবে, ঠিক আছে কোনও?’

গুলি-বোমার ব্যাপারেও একই নীতি। এক শাগরেদের ভাষায়, শ্যামল লোহা আর ছিলামে দানা নিজে ভরত। হজমোলা নিজেই বানাত। ডেটলেও অন্য কাউকে হাত দিতে দিত না। বলত, ‘নিজের মাল নিজে রেডি করব। অন্যের বানানো মাল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজেই যদি ফুটে যাই?’

অন্ধকার জগতের ভাষা এগুলো। ‘লোহা’ মানে দেশি পিস্তল। মুঙ্গেরে বানানো পিস্তল, যার ম্যাগাজিন আছে গুলি ভরার, তার নাম ‘ছিলাম’। ‘দানা’ কী, পাঠক হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন। গুলি। ‘ডেটল’ মানে বোম বানাতে যে নাইট্রোগ্লিসারিন লাগে। আর ‘হজমোলা’? শিশি বোমার কোডনেম।

সব বিষয়ে অবশ্য শ্যামল এতটা স্বাবলম্বী ছিল না। ব্যাঙ্কের চেকবইয়ে সই করা যেমন। শ্যামলের একেবারে ছোটবেলার এক বন্ধুর কথায়, ‘যখন প্রথম ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলল, সে এক কাণ্ড! ইংরেজি অক্ষর লিখতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যাওয়ার অবস্থা। ‘এস’ আর ‘এইচ’ লিখতেই আধঘণ্টা কাটিয়ে দিল। শেষে বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, এর থেকে তো ক্ষুর দিয়ে লেখা সোজা ছিল। ঘণ্টাদেড়েকের কসরতের পর কোনওভাবে সই করল চেকে। আর মকশোর কাগজটা রেখে দিল ওয়ালেটে। ওটা সবসময় সঙ্গে রাখত। বলত, ‘না দেখে নিজের নাম ইংরেজিতে লেখা? পারবই না!’

.

এলাকা দখলে। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ফুলে ঢোল। পুলিশি রেইড থেকে বাঁচার নিরাপত্তা বলয় আরও নিশ্ছিদ্র। এর পরের ধাপে যা হয়ে থাকে সাধারণত, সেটাই ঘটল শ্যামলের ক্ষেত্রেও। প্রোমোটারির অন্দরমহলে পা রাখা। বালি-উত্তরপাড়া-রিষড়া-কোন্নগরে প্রচুর আবাসন তৈরি হচ্ছে তখন। যেখানে যা জমি খালি পড়ে ছিল, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। টাকা উড়ছে, শুধু লুফে নিতে হবে। শ্যামল ঠিক করল, খুনখারাপি-ঝামেলা অনেক হয়েছে। এবার ‘ডন’ থেকে ‘ব্যবসায়ী’ হওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে লাখ পেরিয়ে কোটিতে খেলার।

প্রথম জমিটা দখল নেওয়ার সময় ‘দাদাগিরি’ অবশ্য করতেই হল। একটা প্লট পছন্দ হয়েছিল শ্যামল-রমেশের। কিনে ফ্ল্যাট বানিয়ে চড়া দরে বেচলে প্রচুর মুনাফা। কিন্তু যে দর ‘অফার’ করল শ্যামল, তাতে রাজি হচ্ছিলেন না জমির মালিক। বললেন, ‘তোমরা জলের দরে চাইছ জমিটা। এ হয় না। আমি এর চেয়ে অনেক বেশি দাম পাব কাগজে বিজ্ঞাপন দিলে।’ শ্যামল সোজা পিস্তল বের করে পেটে ঠেকিয়ে দিল, ‘বেঁচে থাকলে তবে তো কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন। হয় জমিটা দিন, নয়তো মরে যান। আপনার চয়েস।’ বেঁচে থাকাকেই বেছে নিলেন জমির মালিক। শ্যামলের প্রথম প্রজেক্টে ইট-বালি-সিমেন্ট পড়তে শুরু করল।

সেই শুরু, এবং বছরখানেকের মধ্যেই এলাকার প্রোমোটিংয়ে মৌরসিপাট্টা কায়েম করে নেওয়া। এখানেও নিয়ম বাঁধা। কোনও একটা জমিতে হয়তো কেউ ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। প্রতি স্কোয়ারফুট পিছু ৫০ থেকে ৭০ টাকা বরাদ্দ থাকবে শ্যামলের জন্য। কারও দখলে হয়তো কোনও জমি আছে, কিন্তু জি প্লাস থ্রি বানানোর পয়সা নেই। শ্যামল টাকার জোগান দিত। শর্ত, মাসে তিন শতাংশ সুদ। লোকেশন যদি খুব ভাল হয়, সুদের হার বেড়ে পাঁচ শতাংশ। এর উপর স্কোয়ারফুট পিছু ৫০ থেকে ৭০ টাকা তো রইলই।

আরও ছিল। ফ্ল্যাট কেউ শ্যামলের দেওয়া টাকাতেই বানাক বা নিজের পয়সায়, ইট-বালি-সিমেন্ট কিনতে হবে শ্যামলের এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দোকান থেকে। যার ইমারতি সামগ্রীর ব্যবসা। স্কোয়ারফুটের মাপজোক যাতে ঠিকঠাক হয়, তার জন্য মাসমাইনের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করেছিল শ্যামল। ইঞ্জিনিয়ার সাইটে গিয়ে সব দেখেটেখে এসে রিপোর্ট দিলে তবেই শুরু হত টাকাপয়সার গল্প। হিসেবপত্রের জন্য অবশ্য মাইনে দিয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখার দরকার পড়েনি। শ্যামল নিজেই রাখত প্রতিটা পাইপয়সার হিসেব। একটা খাতায় যেভাবে লিখে রাখত পাওনাগন্ডার খুঁটিনাটি, দেখলে কে বলবে ক্লাস থ্রি-তেই পড়াশোনায় ফুলস্টপ!

টাকা আসতে লাগল বন্যার স্রোতের মতো। খুব নিম্নবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা কোনও সমাজবিরোধী যখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে পড়ে, চোখে ঝিলমিল লেগে যায়। সমাজের উচ্চকোটির জীবনযাত্রাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেখে দেখার একটা মোহ তৈরি হয়। শ্যামল ব্যতিক্রম ছিল না। বিলাসবহুল গাড়িতে যাতায়াত বাড়ল শহরে। একাধিক ফ্ল্যাট ভাড়া নিল কলকাতায়। ভাড়া অবশ্য নিত খুব অল্পদিনের জন্য। তারপর ছেড়ে দিয়ে ফের অন্য এলাকায় অন্য ফ্ল্যাট। খুব ঘনিষ্ঠ দু’-একজন ছাড়া কেউ জানত না ফ্ল্যাটগুলোর ঠিকানা । যেখানে মাঝেমাঝে খানাপিনা নাচাগানার আসর বসাত শ্যামল। এক রাতের সুর আর সুরার আয়োজনে উড়ে যেত লক্ষ লক্ষ টাকা!

লাইফস্টাইলে আমূল পরিবর্তন হল। সেরা ব্র্যান্ডের পোশাক-আশাক গায়ে উঠতে লাগল রোজ। নিজের কুর্তা-পাজামা অর্ডার দিয়ে বানাতে শুরু করল কলকাতার সেরা ডিজ়াইনারদের দিয়ে। সঙ্গে যোগ হল যথেচ্ছ নারীসংসর্গের অভ্যেস, যেটা আগে ছিল না। প্রচুর টাকার বিনিময়ে টলিউড এমনকী বলিউডের নায়িকাদের সঙ্গে সময় কাটানো যায় কিনা, সেই খোঁজ করার জন্য মোটা টাকা দিয়ে এজেন্ট লাগিয়েছিল। বড়াই করে বন্ধুদের বলত, ‘আমার পড়াশুনো হয়নি বলে তোরা ঠাট্টা করিস… তোরা তো কেউ বারো ক্লাস, কেউ গ্র্যাজুয়েট, পারবি টপ হিরোইনের সঙ্গে পাঁচতারা হোটেলে সময় কাটাতে?’

দুই মেয়ে ছিল শ্যামলের। যাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসত। মেয়েদের ভরতি করেছিল কলকাতার অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। বলত, ‘আমার তো বাওয়াল করেই লাইফটা খরচা হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েগুলো ইংলিশে কথা বলবে, ফরেন যাবে পড়তে, মিলিয়ে নিবি।’ পাশাপাশি আক্ষেপও করত, ‘মেয়েদুটোর তো বিয়ে হয়ে যাবে। শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। আমার টাকাপয়সা আর ব্যবসার দেখভাল কে করবে? একটা যদি ছেলে থাকত!’ ছেলের আশাতেই শ্যামল দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। মিতালি নামের এক তরুণীকে। তবে প্রথম স্ত্রী তাপসীর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরেনি বিশেষ।

চিড় বরং ধরেছিল শ্যামল-রমেশের সমীকরণে। নাম্বার ওয়ান আর নাম্বার টু-র মতবিরোধে গ্যাংয়ের মধ্যে চাপা টেনশন জন্ম নিচ্ছিল। শ্যামলের মনোভাব ছিল, অনেক তো হল। এবার পুরো ফোকাসটা সিন্ডিকেট ব্যবসায় দেওয়া যাক। ‘চমকানো-ধমকানো’র মেশিনারি তো আছেই, থাকবেও। কিন্তু নিতান্ত প্রয়োজন না হলে আর নিজেরা সরাসরি ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই। এমনিতেই পুলিশের অনেক কেসে নাম ঝুলছে। আর বাড়িয়ে কী লাভ? বরং বুদ্ধিমানের কাজ হল, একটা আপাত-ভদ্র ‘ইমেজ’ তৈরি করা। যাতে পরের বার মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে দাঁড়ানো যায়। রাজনীতির একটা মোড়ক থাকলে কিছুটা সুবিধে তো পাওয়াই যায়।

রমেশ সহমত ছিল না এই গাঁধীগিরির তত্ত্বে। বরং বক্তব্য ছিল, সিন্ডিকেট আছে, থাকুক। যেমন চলছে চলুক। কিন্তু প্রোমোটিংয়ের কাজে যে কোনও সময় বাজারে মন্দা আসতেই পারে। তাই সিন্ডিকেটের পাশাপাশি হাওড়া-হুগলিতে লোহার ছাঁটের ব্যবসাটাও চালানো উচিত সমান তালে। তোলাবাজির পরিধিও আরও বাড়ানো দরকার। আর সেটা করতে হলে নিয়মিত ‘অ্যাকশন’ করতে হবে। এবং নিজেদেরও মাঝেমধ্যে সামনে থাকতে হবে। না হলে গ্যাং বা ব্যবসা, দুটোর উপর থেকেই নিয়ন্ত্রণের রাশ আলগা হবে ক্রমশ। কারণ, দুটোই যথেষ্ট বেড়েছে কলেবরে। এখন হঠাৎ করে পুরোপুরি ‘ভদ্রলোক’ সেজে গিয়ে লাভ নেই। আর রাজনীতিতে যোগ দিলেই তো আর একঝটকায় অতীত কীর্তি সব মুছে যাবে না। পুলিশও পিছু ছাড়বে না।

পিছু ছাড়ার প্রশ্নই ছিল না। সেই যে ’৯১-এ শ্যামল ধরা পড়েছিল মুঘলসরাইয়ে জিআরপি-র হাতে, তারপর আর ধরা যায়নি। দীর্ঘ ব্যর্থতায় হতাশা আসেই। শ্যামলের ক্ষেত্রেও হতাশা বারবার গ্রাস করেছিল পুলিশকে। চেষ্টা কিন্তু তা বলে থেমে থাকেনি। জেলা পুলিশ এবং সিআইডি, দু’তরফেই। সিআইডি-র ‘মনিটরিং সেলে’ বিশেষ টিম তৈরি হয়েছিল শ্যামলের ‘ট্র্যাকিংয়ে’। পুলিশ যে হাল ছাড়েনি, শ্যামল জানত বিলক্ষণ। তাই চালিয়ে যেত অহরহ সিম বদলানোর খেলা। নির্দিষ্টভাবে হদিশ পাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হত পুলিশের পক্ষে। তবু লেগে থাকতে হত। কথা আছে না, সুন্দর মুখের জয় সর্বত্ৰ। তদন্তের ক্ষেত্রে অন্য। ধৈর্যের জয় সর্বত্র। সবুর করো এবং মেওয়া ফলার অপেক্ষায় থাকো।

সরাসরি খুনখারাপিতে ২০০২-০৩-এর পর থেকে আর জড়াতে চাইত না শ্যামল। জড়াতে বাধ্য হল ২০০৫-এর ডিসেম্বরে। একটা সাইটের প্রজেক্ট প্ল্যান নিয়ে শ্যামলের সঙ্গে মতের মিল হচ্ছিল না প্রোমোটারের। উপরমহলে কিছু যোগাযোগ ছিল এই প্রোমোটারের। অন্যায় দাবির কাছে অন্যদের মতো গলবস্ত্র হয়ে নতজানু হওয়া দূরে থাক, উলটে শ্যামলের লোকদের শাসিয়েছিলেন, ‘তোদের দাদাকে বলে দিস, যা ইচ্ছে ডিমান্ড করবে আর আমি মেনে নেব, সেটা হবে না। চমকে লাভ নেই। তেমন হলে ফেলে রাখব জমিটা। প্রজেক্ট হবে না।’

একেবারে সরাসরি বিদ্রোহ খোদ হুব্বা শ্যামলের বিরুদ্ধে! পালটা চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেওয়া একরকম— ‘যা পারিস করে নে… তোর জোরজুলুম মানব না।’ মস্তানি আর তোলাবাজির দুনিয়ায় সবচেয়ে জরুরি বিনিয়োগ হল ‘ভয়’। ‘ভয়’ পেয়েই অন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া। ‘ভয়’ পেয়েই নিঃশর্ত নতিস্বীকার। ‘ভয়’-এর চাষ করেই মুনাফার ফসল তোলা। তা সেই ‘ভয়’-ই যদি চলে যায়, যদি কেউ শ্যামলকে চোখ রাঙিয়েও পার পেয়ে যায়, তা হলে শ্যামলের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। বিদ্রোহের নিশান তোলার মাশুল দিতে হল ওই প্রোমোটারকে। শ্যামল নিজে অ্যাকশনে নামল। ২০০৫-এর ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রজেক্টের সাইট ম্যানেজারকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারল। এবং প্রকাশ্য হুমকি দিয়ে গেল কয়েকদিনের মধ্যে প্রোমোটারের পুরো ফ্যামিলি উজাড় করে দেওয়ার।

এই হুমকিটা যে ফাঁকা আওয়াজ নয়, সত্যিই যে হাওড়া-নিবাসী প্রোমোটারের বাড়িতে ভয়ানক কোনও অ্যাকশনের প্ল্যান করছে শ্যামল, তার আঁচ পেল সিআইডি-র মনিটরিং সেল। কল-ইন্টারসেপশনে ধরা পড়ল শ্যামলের সঙ্গে এক সহযোগীর মিনিটদেড়েকের কথোপকথন। শ্যামলকে বলতে শোনা গেল, ‘শালার বড্ড পুড়কি হয়েছে! দ্যাখ না কী করি! এক হপ্তার মধ্যে বাড়ির হাফ থেকে ফুল হাওয়া করে দেব পুরো।’ বাড়ির ‘হাফ থেকে ফুল’? এটা ‘ডিকোড’ করা কোনও সমস্যা নয়। ‘হাফ থেকে ফুল’, অর্থাৎ ছোট থেকে বড়, সবাইকে মেরে দেওয়ার প্ল্যান করছে!

একটা খুন হয়ে যাওয়ার পর তদন্তে নেমে অপরাধীকে খুঁজে বের করা এক জিনিস। রুটিন কাজ। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি এক বা একাধিক খুন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, এটা জেনে যাওয়ার পর খুনগুলোকে প্রতিহত করা আরেক। রুটিন নয়। ঢের বেশি কঠিন, ঢের বেশি উদ্বেগের।

জরুরি বৈঠকে বসলেন ডিআইজি, সিআইডি (অপারেশনস), ‘ক্রাইম ওয়ার্ক’-এ যাঁর তর্কাতীত দক্ষতা শুধু রাজ্যে নয়, দেশের পুলিশ মহলেও বহুচর্চিত। শ্যামলের মোবাইলের তিনটে সিমের কথা জানা ছিল অফিসারদের। কিন্তু আগে যেমন লিখেছি, কখন কোনটা অ্যাকটিভ থাকবে, কখন কোনটা ব্যবহার করবে, সেটা আন্দাজ করা ছিল শিবের অসাধ্য। কোনটা হয়তো সকাল ন’টায় চালু হল। সোয়া ন’টায় খুচরো দুটো ফোনের পর বন্ধ সারাদিনের জন্য। কোনটা আবার সারাদিন খোলা, কিন্তু অ্যাকটিভিটি নেই। কোনওটায় ফোন এলে শ্যামল নয়, তুলছে অন্য কেউ। পাশ থেকে হয়তো শ্যামলের গলা শোনা যাচ্ছে। টাওয়ার লোকেশন (টিএল) বদলাচ্ছে দিনে কম করে হলেও পাঁচবার। কখনও বেলুড়, কখনও বালি, কখনও ব্যান্ডেল, কখনও শ্রীরামপুর, কখনও আবার মধ্য কলকাতা। কোনও কোনওদিন আবার তিনটে ফোনই সারাদিন বন্ধ। কিন্তু মোবাইল ছাড়া কাটাচ্ছে কী করে? হতেই পারে, চতুর্থ কোনও সিমও আছে, যা অজানা এখনও পর্যন্ত।

চারটে কাজ করার আছে আপাতত। সোর্সদের নতুন করে অ্যাকটিভেট করা। এসপি হুগলিকে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে রাখা। এসপি হাওড়াকে বলে ওই প্রোমোটারের বাড়ির আশেপাশে সাদা পোশাকের নজরদারির ব্যবস্থা করা। এবং শ্যামলের যে নম্বরগুলো জানা আছে, সেগুলো ‘রাউন্ড দ্য ক্লক’ মনিটর করা।

২১ ডিসেম্বরের বিকেলে ‘কল মনিটরিং সেল’ থেকে ফোন এল ডিআইজি-র কাছে।

—স্যার, একটা দেড় মিনিটের কনভার্সেশন হল মিনিটদশেক আগে।

—কী?

—বলছে, কাল বাগুইআটি যাবে। বলল, ‘পাগলি’ ফিট করে রাখিস…

—কখন যাবে বলেছে?

—বলল, সেকেন্ড হাফে।

—এখন টিএল?

—বেলুড়।

—যার সঙ্গে কথা হল, তার সাবস্ক্রাইবার ডিটেলস নিয়েছ?

—ইয়েস স্যার। তন্ময় বলে একজনের নাম দেখাচ্ছে। অ্যাড্রেস গুপ্তিপাড়া।

—নম্বরটা ট্র্যাক করেছ?

—হ্যাঁ স্যার, কনভার্সেশনের সময়ের লোকেশন ব্যান্ডেল। ওই ফোনটার পরেই সুইচড অফ। ট্র্যাক রাখছি স্যার।

—গুপ্তিপাড়ার ঠিকানাটা টেক্সট করো। রাইট নাউ।

গুপ্তিপাড়ার ওই ঠিকানায় যে তন্ময় বলে কেউ থাকে না, সেটা এসপি হুগলি খোঁজখবর নিয়ে ডিআইজি-কে জানিয়ে দিলেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। ভুল নাম দিয়ে, ভুল ঠিকানা দিয়ে সিমটা নেওয়া হয়েছে। ফোন আবার চালু হওয়া অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।

দেড় মিনিটের কথা-চালাচালি থেকে কী জানা যাচ্ছে? আগামীকাল বাগুইআটি যেতে পারে। বলছে, সেকেন্ড হাফে যাবে। মানে, বিকেলে, সন্ধে বা রাতে। ‘পাগলি’ ফিট করে রাখতে বলেছে। এটাও অপরাধ দুনিয়ার ভাষা। ‘পাগলি’ অর্থাৎ মহিলা। যা দাঁড়াচ্ছে, কোনও মহিলার সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য কাল বাগুইআটি যেতে পারে। অবশ্য শ্যামলের যা মারাত্মক ধূর্ত স্বভাব, কে বলতে পারে, ‘বাগুইআটি’-ও হয়তো কোডনেম! আসলে হয়তো যাবে অন্য কোথাও। ফোনে ইচ্ছে করে ‘মিসলিড’ করছে। যদি তা-ও হয়, ইনপুট যেখানে কয়েকদিনের মধ্যে একাধিক খুনের, চান্স নিতেই হবে। ধরে নিতে হবে, বাগুইআটিই।

বাছাই করা কিছু সোর্সকে জরুরি তলব করা হল সন্ধেতেই। কথা হল বিস্তারিত। কেষ্টপুর আর বাগুইআটির মাঝামাঝি একটা জায়গায় ঠেকের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এক প্রোমোটারের বাড়ি। গত বছর একটা সময় শ্যামলের নিয়মিত যাতায়াত ছিল এখানে। ফুর্তিটুর্তি হত রাতবিরেতে। বাগুইআটি যদি হয়, এখানেই যাওয়ার সম্ভাবনা নিরানব্বই শতাংশ।

বাড়িটা ‘আইডেন্টিফাই’ করা যাবে? সোর্সের উত্তর ইতিবাচক। ঠিক হল, সকাল থেকে শুরু হবে ‘অপারেশন শ্যামল’। ভোরের দিকেই সোর্সকে নিয়ে একটা টিম দেখে আসবে ফ্ল্যাটটা। সাদা পোশাকের ফোর্স কীভাবে ছড়িয়ে থাকবে চারপাশে, সেই ‘ডিপ্লয়মেন্ট প্ল্যান’ করে রাখতে হবে।

‘অপারেশন’ কাল। কিন্তু রাত থেকেই ‘টাওয়ার লোকেশন’ মিনিটে মিনিটে মনিটর করতে হবে। ফিল্ডে চারটে টিম থাকবে সকাল থেকে। নেতৃত্বে থাকবেন ডিআইজি (অপারেশনস) স্বয়ং। সঙ্গে থাকবেন সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ। যিনি এসএস( সিআইডি) বলে পরিচিত রাজ্য পুলিশে। একটা টিম থাকবে উল্টোডাঙায়। একটা কেষ্টপুরে। বাগুইআটিতে স্ট্যাটিক টিম একটা। ডিআইজি থাকবেন এয়ারপোর্টের কাছে। দুটো গাড়ি নিয়ে। শ্যামলের ফোনের টিএল যেমন যেমন জানা যাবে, সেভাবে ‘মুভ’ করবে ফিল্ডে থাকা ইউনিট। মনিটরিং সেল প্রতি দশ মিনিট অন্তর যাদের জানাতে থাকবে শ্যামলের ফোন-অবস্থান।

২২ ডিসেম্বর, ২০০৫। সকাল থেকে শ্যামলের তিনটে সিমই বন্ধ। একটা চালু হল সোয়া দশটা নাগাদ। যাতে একটা ফোন এল সাড়ে দশটার সামান্য পরে। বালি এলাকার কোনও এক প্রোমোটারের ফোন। নিছক কাজের কথাই হল। সিমেন্ট-বালির ডেলিভারি সংক্রান্ত। ফোনটা অবশ্য শ্যামল ধরল না। ধরল অন্য একজন। যে ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা প্রোমোটারকে শুরুতেই বলল, ‘দাদাকে এখন দেওয়া যাবে না। ঘুমচ্ছে। যা বলার আমাকে বলুন।’ পাশ থেকে একটা জড়ানো গলা শোনা গেল, ‘কার ফোন রে?’ এতদিনের ট্র্যাকিংয়ের অভিজ্ঞতায় গলাটা মনিটরিং সেলের সবার চেনা। শ্যামল।

টাওয়ার লোকেশন? ডানলপ সংলগ্ন এলাকা। সঙ্গে সঙ্গে সোর্সদের চট করে বাজিয়ে নেওয়া হল একবার। ডানলপ এলাকায় কোনও নতুন ডেরার সন্ধান জানা আছে? কোনও নতুন কাজে হাত দিয়েছে ওই অঞ্চলে? যতটুকু জানা গেল, মাসছয়েক আগে সিঁথিতে একটা সাইটে কিছু টাকা ঢেলেছিল শ্যামল। তখন যাওয়া-আসা ছিল মাসে দু’-একবার। কিন্তু ‘ঠেক’ বলতে যা বোঝায়, তেমন কিছুর খোঁজ নেই।

একটা ব্যাপারে সন্দেহ নেই আপাতত। শ্যামল এখন ডানলপ এলাকায় আছে। বাকি দুটো ফোন অবশ্য এখনও বন্ধ। টাওয়ারের অবস্থান ‘স্ট্যাটিক’ থাকল দুপুর প্রায় দুটো অবধি। সেই সাড়ে দশটার পর থেকে ফোন এসেছে তিনটে। কথোপকথনে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। ব্যবসাপাতির ফোন। যার মধ্যে শেষ ফোনটা শ্যামল নিজেই ধরেছে। এবং ছাড়ার আগে বলেছে, ‘পরে কথা হবে, এখন বেরচ্ছি একটু।’

বেরল যে, সেটা বোঝা গেল আড়াইটের পর, যখন ‘টাওয়ার লোকেশন’ বদলাতে শুরু করল ফোনের। বেলঘরিয়া পেরিয়ে বরানগর। বরানগর পেরিয়ে টালা। ফোনের বদলাতে থাকা অবস্থান বুঝিয়ে দিল, হুব্বা শ্যামল এখন দক্ষিণমুখী। নাকি ভুল ভাবা হচ্ছে? শ্যামল আদৌ নয়, শ্যামলের কোনও সঙ্গী? ধন্দের কারণ, ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে দ্বিতীয় ফোনটা, যার অবস্থান দেখাচ্ছে ডানলপ সেক্টর। দুটো ফোনের কোনওটাতেই কথোপকথন হচ্ছে না কিছু।

দুটো সম্ভাবনা। এক, শ্যামল এখনও ডানলপ এলাকাতেই কোথাও আছে। দ্বিতীয় সিমটা ব্যবহার করছে। কোনও সঙ্গীর কাছে এখন প্রথম চালু হওয়া ফোনটা আছে, যে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছে। দুই, শ্যামল ডানলপ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রথম ফোনটা নিয়ে। এবং নর্থ টু সাউথ যাচ্ছে। আর দ্বিতীয় সিমটা ব্যবহার করছে কোনও সঙ্গী, যে তখনও ডানলপেই রয়েছে। বেরয়নি শ্যামলের সঙ্গে।

বিভ্রান্তি দূর হল সোয়া তিনটে নাগাদ। যখন দ্বিতীয় ফোনের সিমও স্থিতাবস্থা কাটিয়ে বদলাতে শুরু করল পজিশন। এবং দক্ষিণে নয়, টিএল ক্রমে সরতে থাকল দক্ষিণেশ্বর পেরিয়ে বালির দিকে। দ্বিতীয় ফোনে একটা ইনকামিং কল এল। ফোনটা ধরে যে হ্যালো বলল, সে শ্যামল নয়। এ সেই লোক, যে সকালের ফোনে বলেছিল, ‘দাদা এখন ঘুমচ্ছে।’ যিনি ফোন করেছেন, তিনি বললেন, ‘শ্যামলের সঙ্গে কথা ছিল।’ উত্তর এল, ‘দাদা একটু ব্যস্ত এখন। আপনার সঙ্গে পরে কথা বলিয়ে দেব।’ ফোনটা ডিসকানেক্ট হওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই দ্বিতীয় ফোন থেকে প্রথম ফোনে কল গেল।

—দাদা, ‘পার্টি’-র ফোন ছিল, কথা বলতে চায়।

—পরশু সাইটে আসতে বল বারোটা নাগাদ।

ধন্দের জায়গা নেই আর। শ্যামল প্রথম ফোনটা ব্যবহার করছে। যে ফোনের টিএল জানাচ্ছে, শ্যামলের অবস্থান এখন মধ্যমগ্রামের কাছাকাছি। গত মিনিট পনেরো ধরে স্ট্যাটিক। বাগুইআটিতে থাকা টিমকে অ্যালার্ট করা হল।

মধ্যমগ্রামের কাছাকাছি কোথায় আছে? স্ট্যাটিক আছে কেন পনেরো মিনিট? গাড়িতে তেল ভরছে? কোনও ঠেক আছে ওই এরিয়ায়? নাকি লাঞ্চ করছে কোনও রেস্তোরাঁ বা ধাবায়? ডিআইজি নিজে এসএস সিআইডি-র সঙ্গে ছিলেন এয়ারপোর্টের কাছাকাছি। পিছনের গাড়িতে ছিলেন ইনস্পেকটর হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আরও তিনজন অফিসার।

দুটো গাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে মধ্যমগ্রাম অবধি চক্কর দিল পরের আধঘণ্টা। পেট্রল পাম্পগুলো দেখা হল। ঢুঁ মারা হল যশোর রোডের বিখ্যাত ধাবা ‘শের-ই-পাঞ্জাব’-এও। যদি ভাগ্য ভাল হয়, যদি বাই চান্স চোখে পড়ে যায়। পড়ল না চোখে।

গাড়ির নম্বর জানা নেই। কী ধরনের গাড়িতে আছে, জানা নেই। সম্ভাব্য গন্তব্য সম্পর্কে একটা আন্দাজ আছে মাত্র। শুধু ‘টাওয়ার লোকেশন’ ফলো করে শ্যামলের মতো অত্যন্ত ধূর্ত ক্রিমিনালকে ধরা যে প্রায় দুঃসাধ্যের পর্যায়ে পড়ে, বেশ বুঝতে পারছিলেন ডিআইজি এবং তাঁর টিমের সদস্যরা। বাগুইআটির ওই ফ্ল্যাটে যদি আজ সত্যিই যায়, ধরা যাবে নিশ্চিত। কিন্তু যদি না যায়? এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ফোনের অবস্থান ‘ফলো’ করে করে সম্ভব কখনও?

সোয়া চারটে নাগাদ ফের বদলাতে শুরু করল ফোন-গতিবিধি। মাইকেলনগর পেরিয়ে ঢুকল এয়ারপোর্ট সেক্টরে। এবার কি তা হলে বাগুইআটির ফ্ল্যাট? কিন্তু এটা কী হল? ভিআইপি রোড ধরে উত্তরের দিকে যেতে যেতে ‘টাওয়ার লোকেশন’ হঠাৎই পূর্বমুখী। রাজারহাটের দিকে যাচ্ছে। সোজা ভিআইপি রোড না ধরে রাজারহাটের ভিতর দিয়ে বাগুইআটি যাবে? ডিআইজি-র গাড়িও ঢুকল রাজারহাটের রাস্তায়। হল্ট করল চিনার পার্কের কাছাকাছি।

বাগুইআটির ধারেকাছেও যে আপাতত যাওয়ার পরিকল্পনা নেই শ্যামলের, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ফোন-অবস্থান জানিয়ে দিল, শ্যামল রাজারহাট-নিউটাউনের রাস্তা ধরে যাচ্ছে সল্টলেকের দিকে। এ তো মহা মুশকিল হল। বাগুইআটিতে যাওয়াটা ঝুঁকির হয়ে যাবে আজ, কোনওভাবে আন্দাজ করেছে? দুপুর-বিকেল-সন্ধে-রাত, কোনও না কোনও সময় বাগুইআটিতে আসবে, এই ধারণা নিয়েই ‘অপারেশন’-টা প্ল্যান করা। অথচ সন্ধে হয়ে এল, ওদিকে যাওয়ার কোনও নামগন্ধ নেই।

সিআইডি-র গাড়ি যখন সল্টলেকের দিকে এগোচ্ছে, স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট জিজ্ঞেস করেই ফেললেন ডিআইজি-কে, ‘স্যার, এভাবে আর কতক্ষণ? শ্যামল যা সেয়ানা জিনিস, হয়তো কোনও হিন্ট পেয়েছে কোথাও থেকে। তাই বাগুইআটির দিকটা মাড়াচ্ছেই না।’

—আর ঘণ্টাখানেক দেখব। তারপর ব্যাক। ধরো যদি বাগুইআটিতে রাতের দিকে যায়, টিম তো থাকছেই।

সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের কাছে যখন গাড়ি থামালেন ডিআইজি, তখন ঘড়িতে সোয়া পাঁচটা। শ্যামলের ফোনের টিএল সল্টলেকে স্ট্যাটিক পাঁচটা থেকে। ঠিক পৌনে ছ’টায় একটা ইনকামিং কল এল শ্যামলের মোবাইলে। ফোনটা ধরল শ্যামলই।। ধরেই ‘পরে করিস’ বলে কেটে দিল ফোনটা। ফোনের অন্যদিকে যে-ই থাকুক, সুযোগই পেল না কিছু বলার।

সাড়ে ছ’টা বাজতে চলল। টিএল বদলাচ্ছে না। প্রায় দেড়ঘণ্টা হয়ে গেল সল্টলেকেই থিতু। কোথায় আছে? এখানে কোনও ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে, যেমন করে থাকে মাঝেমধ্যে? যে মহিলার সঙ্গে সময় কাটানোর কথা বাগুইআটিতে, তাঁকে কোনওভাবে খবর পাঠিয়েছে সেই ফ্ল্যাটে আসতে? ফোনটা যেরকম অধৈর্যভাবে রেখে দিল, তাতে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, যেখানেই থাকুক, যা-ই করুক এখন, কোনও ডিস্টার্বেন্স চাইছে না।

কোথায় থাকতে পারে… কোথায় থাকতে পারে… ভাবতে ভাবতেই আচমকা একটা ‘ব্রেনওয়েভ’ ঝটকা দিল হিমাদ্রিকে। দেড়ঘণ্টা নট নড়নচড়ন, ফোন এলে কেটে দিচ্ছে… ফ্ল্যাট ছাড়া অন্য জায়গাও তো হতে পারে। সিটি সেন্টার তো বেশি দূরে নয়। তা হলে কি…? উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেন না হিমাদ্রি, ‘স্যার, লোকেশন স্ট্যাটিক এতক্ষণ, সিনেমা দেখছে না তো?’

ডিআইজি চকিতে তাকান হিমাদ্রির দিকে। মুখ খোলেন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর, ‘পসিবল, কোয়ায়েট পসিবল। হতেই পারে। আর যদি না-ও হয়, ট্রাই নিতে ক্ষতি নেই। লেটস গিভ ইট আ শট।’

দুটো গাড়ি মিনিট তিনেকের মধ্যে ব্রেক কষল সিটি সেন্টারের ক্রসিং থেকে সামান্য দূরে। হিমাদ্রি এবং আরেকজন অফিসার পায়ে হেঁটে এগোলেন সিটি সেন্টারের দিকে। এবং যা জানার ছিল, জেনে নিয়ে ফিরে এলেন মিনিটদশেকের মধ্যে।

তিনটে শো শুরু হয়েছে পাঁচটার আশেপাশে। একটা বাংলা ছবি। ঘরোয়া, পারিবারিক। ইংরেজি ছবিও চলছে একটা। পোস্টার দেখে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, সায়েন্স ফিকশন জাতীয়। তিন নম্বর ছবিটা হিন্দি। নাম ‘KALYUG’। পোস্টারের ছবিই বলে দিচ্ছে, নাচগান-মারদাঙ্গা এবং সেক্সের ভরপুর সুড়সুড়ি সংবলিত বলিউডি মশলা ছবি। শ্যামল যদি সিনেমা দেখতে এসেই থাকে, ঘরোয়া পারিবারিক বা কল্পবিজ্ঞানের ছবি দেখে নিশ্চয়ই সময় ‘নষ্ট’ করছে না। দেখলে নির্ঘাত ওই ‘কলিযুগ’-ই দেখছে!

—শো শেষ হবে ক’টায়?

—স্যার, হিন্দি ছবিটার ডিউরেশন দেখলাম দুই ঘণ্টা ছয় মিনিট। শুরু হয়েছে পাঁচটা দশে। অ্যাড-ট্যাড আর ইন্টারভ্যাল মিলিয়ে আরও পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরুন। সাড়ে সাতটার আশেপাশে ‘কলিযুগ’-এর শো ভাঙবে। তার একটু আগে ইংরেজি ছবিটা শেষ হবে। আর বাংলাটা শেষ হবে ওই হিন্দিটার কাছাকাছি সময়েই। এখন পৌনে সাতটা। কিছুটা সময় আছে হাতে।

ডিআইজি ছক কষে নেন দ্রুত। যদি আইনক্সেই থাকে, আন-আর্মড অবস্থায় আছে। মাল্টিপ্লেক্সের সিনেমাহলে একটা দেশলাইকাঠিও অ্যালাও হয় না। আর যে ছবিই দেখুক না কেন, দোতলার হল থেকে বেরিয়ে নীচে নামার একটাই সিঁড়ি। ঠিক হল, সিঁড়ির শেষ ধাপের মুখে থাকবেন ডিআইজি স্বয়ং, এসএস সিআইডি, হিমাদ্রি এবং আরও দু’জন অফিসার। আরেকটা টিম থাকবে সিটি সেন্টারের মেন এন্ট্রির ঠিক বাইরে। যারা গাড়িতে অপেক্ষা করবে, ওয়ারলেসে কল পেলে দৌড়ে আসবে, যদি প্রয়োজন হয়। সোয়া সাতটার মধ্যে ‘টেক পোস্ট’, অর্থাৎ প্ল্যানমাফিক নিজের নিজের পজিশন নিয়ে নেওয়া।

শেষ মুহূর্তের ব্রিফিং সেরে নিলেন ডিআইজি, ‘যদি পালানোর চেষ্টা করে, কেউ ফায়ার করবে না। জানি, প্রাইজ ক্যাচ, কিন্তু ফায়ারিং আন্ডার নো সার্কামস্ট্যান্সেস… আই রিপিট… আন্ডার নো সার্কামস্ট্যান্সেস… ভিড়ের মধ্যে পাবলিকের কোনও ইনজুরি হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে…।’

আর আটচল্লিশ ঘণ্টা পরেই বড়দিন। সান্টা ক্লজের লাল-সাদা কাটআউটে ভরে গেছে সিটি সেন্টার চত্বর। ভিড়ে ভিড়াক্কার শপিং মলে খুশির ফুলকি উড়ছে।

আইনক্সের ইভনিং শো ভেঙেছে। লোকজন নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। ওইভাবে সার দিয়ে নেমে আসা এত লোকের মাঝে একটা নির্দিষ্ট লোককে খুঁজে বের করা মুশকিল। মুখগুলোর উপর দ্রুত চোখ বুলোচ্ছিলেন হিমাদ্রি আর ডিআইজি।

মাঝবয়সি, বেঁটে, গাট্টাগোট্টা চেহারার জনাদশেক লোক নেমেছে গত দু’-তিন মিনিটে। যাদের দেখে সন্দেহ করার মতো কিছু পাওয়া যায়নি, যাদের মুখের সঙ্গে ন্যূনতম মিলও নেই শ্যামলের। লোক নেমে আসছে ননস্টপ। নামছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে ভিড়ে। একটা অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের গ্রুপ ওই নামছে হইহই করতে করতে। ওদের ঠিক পিছনের ধাপে দাঁড়ানো বেঁটে লোকটার উপর চোখ আটকে যায় হিমাদ্রির। বেঁটে… স্বাস্থ্যবান… কালো ফুলস্লিভ শার্ট…মাথায় টুপি। টুপিটা অনেকটা নামানো বলে মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। লোকটার পাশেপাশেই নেমে আসছে লম্বা চেহারার আরেকজন। এর মাথাতেও টুপি।

বেঁটে লোকটা সিঁড়ির শেষ ধাপে প্রায়। সোর্সরা যা বলে শ্যামলের ইদানীংকার চেহারার ব্যাপারে, তার সঙ্গে তো অনেকটাই মিলছে। একটু মোটা। ফোলাফোলা মুখ। কিন্তু সোর্সরা তো এটাও বলে যে শ্যামলের পুরুষ্টু গোঁফ আছে। এর তো গোঁফ নেই। তা হলে?

শিয়োর হওয়া যাচ্ছে না। কী করবেন এখন? সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেন হিমাদ্রি। লোকটা মাটিতে পা রাখামাত্র হিমাদ্রি একটু চেঁচিয়েই বলে ওঠেন, ‘কী শ্যামলদা, ভাল আছেন?’ সঙ্গে সঙ্গে টুপি-পরা বেঁটে লোকটা রিফ্লেক্স অ্যাকশনে মুখ ফেরায়, ‘কে?’ পাশে থাকা ছিপছিপে লোকটাও থমকে যায় হঠাৎ।

ব্যস, ওই ‘কে’-টাই যথেষ্ট ছিল। ডিআইজি সিআইডি নিমেষে হাত চেপে ধরেছেন লোকটার। হিমাদ্রি একটানে মাথা থেকে খুলে নিয়েছেন টুপি। চেহারা পরিষ্কার এবার। গোঁফ থাকুক না থাকুক, এ শ্যামল। প্রায় দেড় দশক ধরে পুলিশকে নাকের জলে-চোখের জলে করে দেওয়া হুব্বা শ্যামল। সঙ্গীটিও অচেনা নয়। বাপি, বেনারসি বাপি। ‘কলিযুগ’ দেখেই বেরচ্ছিল।

ওয়ারলেসে ‘কল’ পেয়ে চটজলদি দৌড়ে এসেছে বাইরে থাকা টিম । ডিআইজি পিস্তল ঠেকিয়ে দিয়েছেন শ্যামলের গলায়। হিমাদ্রিও কোমরে গোঁজা আগ্নেয়াস্ত্র বার করে সোজা তাক করেছেন বাপির দিকে। কলার ধরে টানতে টানতে যখন দু’জনকে বাইরে নিয়ে আসছে সিআইডি-র টিম, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সিটি সেন্টারে। কী ঘটছে এটা? সিঁড়ি থেকে নামার পর দুটো লোককে ঘিরে ধরল কয়েকজন। তারপর রিভলভার ঠেকিয়ে ঘাড় ধরে বাইরে নিয়ে এসে গাড়িতে তুলছে। চোখের সামনে কিডন্যাপিং? শ্যামল আর তার সঙ্গীকে তুলে দুটো গাড়ি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে হুউশ, ততক্ষণে হইচই শুনে ছুটে এসেছেন সিকিউরিটি ম্যানেজার। মোবাইলে ডায়াল করছেন বিধাননগর (দক্ষিণ) থানার নম্বর।

‘কিডন্যাপিং’-এর বার্তা পেয়ে থানার টহলদারি গাড়ি এসে পৌঁছনোর আগেই ডিআইজি ফোন করে জানিয়ে দিলেন উত্তর ২৪ পরগনার এসপি-কে, ‘উই হ্যাভ জাস্ট পিকড আপ হুব্বা শ্যামল ফ্রম সিটি সেন্টার। ওখানে একটু প্যানিক হতে পারে, দেখে নাও তাড়াতাড়ি।’ এসপি সঙ্গে সঙ্গেই ফোনে জানালেন ওসি বিধাননগর (দক্ষিণ)-কে। আতঙ্কের পরিবেশ কাটাতে সিটি সেন্টারের ‘পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম’ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোষণা শুরু হল, ‘অযথা আতঙ্কিত হবেন না। কোনও কিডন্যাপিং এখানে হয়নি। সিআইডি রেইড করে দু’জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গেছে।’

দ্রুত খবর ছড়াল, ‘সল্টলেকে সিনেমা দেখতে এসে সিআইডি-র জালে হুগলির ত্রাস হুব্বা শ্যামল।’ পরের দিন সব কাগজে প্রথম পাতায় জায়গা পেল ‘অপারেশন হুব্বা’। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর কলকাতা সংস্করণে শ্যামল-গ্রেফতারের খবরের হেডিংটা তুলে দেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন, ‘ ‘‘Dawood Ibrahim of Hooghly’’ arrested by CID’.

পুরনো মামলা অনেক ঝুলছিল শ্যামলের নামে। তবু এক বছরের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হল না শ্যামলের কারাবাস। জামিনে বেরিয়ে গেল। কী করে? বেশিরভাগই ছিল খুনের মামলা। কোনও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিল না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আর থাকলেও কারও ঘাড়ে মাথা ছিল না শ্যামলের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে মুখ খোলার। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু সাক্ষী তবু জোগাড় করা গিয়েছিল কয়েকটা মামলায়। চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল শ্যামলকে ‘ফেরার’ দেখিয়ে। কিন্তু বিচারপর্ব যখন শুরু হল, সাক্ষীরা ‘hostile’ হয়ে গেল। পুলিশের কাছে দেওয়া আগের বয়ান অস্বীকার করল (আইনি পরিভাষায় বিরূপ সাক্ষ্যদান)। কেন করল, অনুমেয় অনায়াসে। ‘হুব্বা শ্যামল’— এই পাঁচ অক্ষরের রোষে পড়ার ভয়ে। কে আর সাধ করে হাঁড়িকাঠে মাথা দিতে চায়? শ্যামল না হয় ধরা পড়েছে। কিন্তু গ্যাংয়ের বাকিরা তো বাইরে আছে। কেউ ‘দাদা’-র বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে জানলে ছেড়ে দেবে তারা?

কোনও মামলায় ‘বিরূপ সাক্ষ্য, কোনওটায় সাক্ষীরই অভাব, আবার কোনওটায় ‘শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া’ (Test Identification Parade)-য় অভিযুক্তকে চিনতে সাক্ষীর অস্বীকার করা। দোষী সাব্যস্ত করা দুরূহ হচ্ছিল ক্রমশ। নামীদামি আইনজীবীদের পিছনে শ্যামল টাকাও খরচ করছিল দেদার। পুলিশের ব্যর্থতাই, আটকে রাখা গেল না বেশিদিন। জামিনে মুক্ত হয়ে ফের হুগলির মাটিতে পা রাখল শ্যামল। টিমের ছেলেদের বলল, ‘ভালই হল। একেবারে ফ্রেশ হয়ে এলাম। এবার বাওয়াল কম, ব্যবসা বেশি।’

কী বেশি, কী কম, সেটা পরের ব্যাপার। তারও আগে শ্যামল আবিষ্কার করল, জেলে থাকার এই এক বছরে ব্যবসার অঙ্ক বদলে গেছে অনেক। শ্যামলের অনুপস্থিতির সুযোগে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নিজের দখলে নিয়ে ফেলেছে রমেশ। শ্যামল লক্ষ করছিল, বছরখানেক আগেও টিমের যারা ‘শ্যামলদা’ অন্ত প্রাণ ছিল, তাদের অনেকেই জার্সিবদল করেছে। যাদের কাছে এখন রমেশই শেষ কথা।

গ্যাং ভাগ হয়ে যায়নি। শ্যামল-রমেশ কাজ করছিল একসঙ্গেই। কিন্তু কোথাও একটা তাল কেটে গিয়েছিল। ২০০৭-১০, এই সময়টায় সম্পর্কের ফাটল নানা মতবিরোধে ক্রমশ আরও চওড়া হয়েছিল। আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদটাই যা হয়নি। তবে মনকষাকষি যতই হোক, শ্যামলের একটা ন্যূনতম বিশ্বাসের জায়গা অটুট ছিল রমেশের প্রতি। বলত, ‘এখনও যদি বলি, এই প্রজেক্টটায় হাত দেওয়া ঠিক হবে না, রমেশ মেনে নেবে। অমত থাকলেও মেনে নেবে। মুখের উপর না বলার হিম্মত হবে না।’

এই ‘বিশ্বাস’-টাই কাল হয়েছিল শ্যামলের। সময়টা ২০১১-র জুন। শ্রীরামপুরের কাছে একটা জমি দেখতে গিয়েছিল শ্যামল-রমেশ। জমি জরিপের পর্ব মিটে যাওয়ার পর রমেশ বলেছিল শ্যামলকে, ‘দুপুরের খাওয়াটা আমার ওখানে খেয়ে যা।’ রিষড়ার দাসপাড়ায় রমেশের ফ্ল্যাট ছিল একটা। রমেশেরই গাড়িতে চড়ে দু’জনে রওনা দেয় দাসপাড়ায়। শ্যামলের সঙ্গীরা বলেছিল, ‘দাদা, আমরাও যাই সঙ্গে?’

নিজের বিপদ-আপদ সম্পর্কে সদাসতর্ক থাকা শ্যামল সেদিন আত্মঘাতী আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে ফেলেছিল। বারণ করেছিল সঙ্গীদের, ‘ধুর, যাচ্ছি তো রমেশের বাড়িতে। তোরা চলে যা। কী আর হবে? ম্যাক্সিমাম মেরে দেবে।’ তারপর বহু বছরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী রমেশের দিকে তাকিয়ে চোখ মেরেছিল। ইয়ারকির ঢংয়ে বলেছিল, ‘কী রে রমেশ, মেরে দিবি নাকি একা পেয়ে?’ উত্তরে রমেশও হেসে উঠেছিল হো হো করে। বলেছিল, ‘হ্যাঁ, ম্যাক্সিমাম মেরে দেব। কী আর হবে?’

কী যে হবে, সেটার আঁচ রমেশের ফ্ল্যাটে পা রাখা মাত্রই পেয়েছিল শ্যামল। একসময়ের বিশ্বস্ততম সঙ্গীরা হাতে ছুরি-পিস্তল নিয়ে বসে। নেপু, জিতেন্দর, চিকুয়া… আরও কয়েকজন। শ্যামল ঢুকতেই যারা নিমেষের মধ্যে ঘিরে নিয়েছিল। কোমরে যে নাইন এমএম-টা গোঁজা থাকত সবসময়, সেটা ছোঁয়ারই সুযোগ পায়নি শ্যামল। রমেশ বলেছিল, ‘দ্যাখ শ্যামল, যে ভাবে চলছে, একসঙ্গে ব্যবসা চালানো আর সম্ভব নয়। আলাদা হয়ে গেলে হয় তুই আমাকে ফুটিয়ে দিবি, নয়তো আমি তোকে খালাস করে দেব। তাই ভাবলাম…।’ বাক্যটা শেষ করেনি রমেশ। ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পাঁচটা শব্দ খরচ করেছিল নেপুর উদ্দেশে, ‘আমি বেরলাম… তোরা দেখে নে।’

নির্দেশ পালন করেছিল নেপু-জিতেন্দররা। ‘দেখে নিয়েছিল’, যা দেখার। তিনদিন নিখোঁজ থাকার পর বৈদ্যবাটি খালে ভেসে উঠেছিল হুব্বা শ্যামলের দেহ।

শ্যামলের যদি বিচার হত আদালতে, দোষী সাব্যস্ত হলে কী হতে পারত সম্ভাব্য পরিণতি? যাবজ্জীবন কারাবাস বা ফাঁসি। টাকার তো অভাব ছিল না। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করতই। উচ্চ থেকে উচ্চতর কোর্ট অবধি গড়াত মামলা। গড়িয়ে যেত বছরের পর বছর।

সব অন্যায়ের শাস্তিবিধান বাস্তবের আদালতে নির্ধারিত হয় না। কিছু অপরাধের, কিছু অপরাধীর বিচার হয় হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট পেরিয়ে ‘সর্বোচ্চ’ আদালতে। কর্মফলের হিসেবনিকেশ সুদে-আসলে মিটিয়ে দেওয়া হয় সেখানে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডিভাইন জাস্টিস’। হুব্বা শ্যামলের মৃত্যু যেমন। বৈদ্যবাটি খাল থেকে দেহ উদ্ধার হয়েছিল, লিখেছি। কী অবস্থায় উদ্ধার, বলা হয়নি। বডির কাঁধ থেকে কোমর, আড়াআড়ি চেরা ছিল ধারালো অস্ত্রের টানে।

পৈতে করে দিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *