০১. শুধু নামেই ‘সুশীল’

শুধু নামেই ‘সুশীল’

—আরে, এ যে নেহাতই বাচ্চা! He’s just a child!

—রাইট স্যার, স্টিল মাইনর। কিন্তু তেজ আছে ষোলো আনা। নিষেধ করলেও শুনছিল না। উলটে অফিসারের গায়ে হাত তুলেছে!

—হোয়াট?

—ইয়েস স্যার, ছুটে এসে ধাক্কা দিয়েছে। ঘুসি মেরেছে। সাহসটা ভাবুন একবার! কাস্টডি করে দিই?

—না… জুভেনাইল… কিন্তু হি মাস্ট পে ফর হোয়াট হি হ্যাজ় ডান। Do something, take him downstairs, গুনে গুনে পনেরো ঘা বেত লাগাবেন। Cane him! No less than fifteen times! তারপর ছেড়ে দেবেন।

—রাইট স্যার।

হিড়হিড় করে টানতে টানতে তিনতলা থেকে নীচে নিয়ে যাওয়া হয় একরোখা কিশোরকে। অনুতাপের লেশমাত্র নেই যার চোখেমুখে। বরং ফুঁসছে তখনও।

—এ মেনে নেওয়া যায় না.. কিছুতেই না! একটা বাচ্চা ছেলেকে সবার সামনে ওইভাবে বেত দিয়ে একটার পর একটা..

—হুঁ… মানুষ নয়… নরপশু একটা।

প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বিবৃতি

—সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একে উচিত শিক্ষা না দিতে পারলে আন্দোলনের মেরুদণ্ড বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

—মানছি। কিন্তু শিক্ষাটা কী সেটা তো ভাবতে হবে, আর কে কীভাবে দেবে, সেটাও..

—একটাই শিক্ষা হয় ওই অমানুষের। মৃত্যু! বেঁচে থাকার অধিকার নেই আর।

—একমত। কিন্তু চাইলেই তো হল না। সর্বক্ষণ সান্ত্রি-পেয়াদারা ঘিরে রেখেছে। কাছে যাওয়াই মুশকিল। ওই পাহারার মাঝে ওকে মারতে যাওয়া মানে আত্মহত্যা।

—কিন্তু উপায় তো একটা করতে হবে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব এর পরও?

—কী উপায়?

—আমার একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে মাথায় …

—কী প্ল্যান?

.

পুরনো সেই দিনের কথা। সূত্রপাত এক শতকেরও বেশি আগে, লালবাজার চত্বরে। দেশ তখনও স্বাদ পায়নি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার। ‘ইউনিয়ন জ্যাক’-কে কক্ষচ্যুত করতে ঢের দেরি আছে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার।

বিংশ শতকের প্রথম দশকে বাংলায় স্বদেশি আন্দোলন তখন ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সর্বব্যাপী ক্ষোভ বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করছে অত্যাচারী শাসককে সশস্ত্র আক্রমণে। ‘অনুশীলন সমিতি’ এবং ‘যুগান্তর’-এর মতো গুপ্ত সংগঠনগুলি সক্রিয়তার তুঙ্গে তখন। যে সক্রিয়তায় রাশ টানতে একাধিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে মরিয়া ব্রিটিশ প্রশাসন।

পাশাপাশি ‘বন্দে মাতরম’-এর মতো জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলিতে দেশাত্মবোধক নিবন্ধ এতটাই উদ্দীপনা জাগাচ্ছে জনমানসে, প্রভাবে-প্রসারে এতটাই বিস্তার তার দেশপ্রেমী আবেদনের, লেখক এবং প্রকাশক, উভয়ের উপরই নির্বিচারে নেমে আসছে রাজদণ্ড। শাসকের রাজদণ্ড। যা বেশ কিছুকাল আগে, ‘পোহালে শর্বরী, বণিকের মানদণ্ড’ ছেড়ে দেখা দিয়েছিল অকপট।

এখন যেখানে লালবাজারের অবস্থান, তখন তার একটি অংশে ছিল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। যা একাধিক সাড়া-জাগানো মামলার বিচারপর্বের সাক্ষী। ম্যাজিস্ট্রেটের আসনে সে-সময় Douglas Hollinshed Kingsford। উচ্চশিক্ষিত, ট্রিনিটি কলেজের কৃতী ছাত্র। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) যোগদান ১৮৯৪ সালে। একাধিক জেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার পর ১৯০৫ সালে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হলেন। বঙ্গভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন অল্পদিনেই। সরকারি বাসস্থান শুরুর দিকে ছিল হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে, পরে স্থানান্তরে কিড স্ট্রিটে।

কিংসফোর্ড নিজের মেধা এবং দক্ষতার সিংহভাগ কাজে লাগাতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি নির্মমতায়। ১৯০৭-এর ২৪ জুলাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দের ভাই)-কে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। অপরাধ? ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় দুটি রচনা প্রকাশ করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ বিচারক শাসিত দেশের স্বাধীনতাকামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন না, প্রত্যাশিত। ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা’-র ‘সমান আঘাতে’ কাঁদার প্রশ্ন নেই, স্বাভাবিকই। কিন্তু কিংসফোর্ড সাহেবের ক্রিয়াকলাপ ছিল নিষ্ঠুরতায় মাত্রাহীন।

মামলা হল ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার বিরুদ্ধেও। অভিযোগ একই, শাসকের শোষণের সোচ্চার বিরুদ্ধাচরণ। সেই মামলার বিচার চলাকালীন অনেকে, অধিকাংশই প্রাণোচ্ছল তরুণ, ভিড় করতেন আদালত চত্বরে। বিপিনচন্দ্র পাল যখন পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদান করতে অস্বীকার করলেন, মামলা নাটকীয় মোড় নিল।

শুনানির দিনগুলিতে হাজারে হাজারে মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করলেন বর্তমানের লালবাজার প্রাঙ্গণে। জনস্রোত আর স্বদেশি স্লোগানের যুগলবন্দি সামলাতে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ প্রায়ই নির্দয় লাঠি চালাতে শুরু করল সাধারণের উপর। নির্বিচার এবং মায়া-মমতাবর্জিত।

দমনপীড়ন সহ্যসীমা অতিক্রম করল ১৯০৭-এর ২৬ অগস্ট। মামলার শুনানি চলছে। বাইরে যথারীতি লোকারণ্য এবং পাল্লা দিয়ে ‘বন্দে মাতরম’-এর নির্ঘোষ। জমায়েত ক্রমশ বাড়ছে কলেবরে। আবেগের লাভাস্রোত নিয়ন্ত্রণে অন্য দিনের মতোই পুলিশ লাঠি চালাল ইনস্পেকটর E B Huey-এর নেতৃত্বে। রুখে দাঁড়াল বছর পনেরোর রোগাসোগা চেহারার এক কিশোর। সুশীল সেন। পালটা কয়েক ঘা দিল ইনস্পেকটরকে। অসম যুদ্ধে নতিস্বীকার করতেই হল সুশীলকে। ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে।

কিংসফোর্ড দেখলেন, শুনলেন এবং বললেন, ‘আরে, এ তো নেহাতই বাচ্চা! একে সবার সামনে পনেরো ঘা বেত মেরে ছেড়ে দাও।’ ১৮৯৯-এর ‘Whipping Act’-এ এমন বেত্রাঘাতের বিধিনিয়ম ছিল।

আদেশ পালিত হল। ইতিহাসবিদদের লেখনীতে চিত্রিত রয়েছে সে দৃশ্য। লালবাজার চত্বরে পনেরো বছরের কিশোরের পিঠে একের পর এক বেতের ঘা আছড়ে পড়ছে। আর প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে জোর বাড়ছে সুশীলের স্লোগানের, ‘বন্দে মাতরম!’ প্রহারের পাশবিকতায় নিষ্ফলা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল স্তম্ভিত জনতা। কিংসফোর্ড মনুষ্যত্বকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন অক্লেশে।

এই নৃশংস ঘটনা তীব্র অভিঘাতের সৃষ্টি করল বাংলা জুড়ে। বিপ্লবীরা কিংসফোর্ডের নাম দিলেন ‘কসাই কাজি’। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো তথাকথিত ‘নরমপন্থী’-রাও সোচ্চার হলেন প্রতিবাদে, আর ‘কট্টরপন্থী’-রা সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘এ অপরাধের ক্ষমা নেই!’ কিংসফোর্ড-হত্যার ছক কষা শুরু হল।

—আমার একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে মাথায়।

—কী প্ল্যান?

.

সুশীলের জন্ম শিলং-এ, ১৮৯২ সালে। বাবা কৈলাশচন্দ্র সেন ছিলেন শিলং-এর আইজি (কারা)-র কার্যালয়ে প্রধান করণিক। শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা দেশব্যাপী ব্রিটিশ-বিরোধিতার আবহে। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলেন সুশীল। শিলং-এর গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ডবল প্রোমোশন পেয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে সিলেটের জ্ঞানেন্দ্রনাথ ধরের গুপ্ত সংগঠনে যোগ দিলেন। বিশেষ প্রশিক্ষণ নিলেন বক্সিং আর লাঠিখেলায়। ১৯০৬-এ সিলেটে অনুষ্ঠিত হল সুর্মা ভ্যালি পলিটিক্যাল কনফারেন্স। যেখানে বিপিনচন্দ্র পালের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন ন্যাশনাল স্কুলে। জিমন্যাস্টিক্সের পাঠ নেওয়া শুরু করলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর কাছে।

১৯০৭-এর অগস্টে আদালত প্রাঙ্গণে ঘটল বেত্রাঘাতের ঘটনা। বিপ্লবীদের কাছে রাতারাতি নায়কের মর্যাদায় উন্নীত হলেন সুশীল। সংবর্ধিত হলেন কলেজ স্কোয়ারে। অকুতোভয় কিশোরকে দেখতে উপচে পড়ল ভিড়। এই ঘটনা নিয়ে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ লিখলেন তুমুল জনপ্রিয় হওয়া গান, যা তখন মুখে মুখে ঘুরত বিপ্লবীদের।

(আমার) যায় যাবে জীবন চ’লে আমায়—

বেত মেরে কি ‘মা’ ভোলাবে?

আমি কি মা’র সেই ছেলে?

সুশীল ক্রমে আরও জড়িয়ে পড়লেন বিপ্লবী কার্যকলাপে। অসমসাহসী কিশোরকে শরিক করা হল কিংসফোর্ড-নিধনের চিত্রনাট্যে। দায়িত্ব পড়ল অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেটের বাসস্থানের পারিপার্শ্বিক খুঁটিনাটি সরেজমিনে একাধিকবার দেখে আসার। দেখে তো এলেন, অতঃকিম?

তখন জল্পনা চলছিল প্রশাসনিক মহলে কিছুদিন ধরেই, কলকাতা থেকে বদলি হয়ে যেতে পারেন কিংসফোর্ড। সম্ভাব্য বদলির আগেই শত্রুনিকেশে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবীরা। পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়েছিল প্রভূত সময়ব্যয়ে। প্রয়োগে আর বিলম্ব অনুচিত, সিদ্ধান্ত হল সর্বসম্মত।

.

সরকারি চাকুরের কর্মস্থান স্থানান্তরের সময় যা স্বাভাবিক, তুঙ্গে থাকে ব্যস্ততা তল্পিতল্পা গোটানোর। পরবর্তী কর্মস্থলে নির্দিষ্ট সময়ে যোগদানের সময়সীমা থাকে, যা লঙ্ঘিত হলে ঊর্ধ্বতনের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হওয়া অবধারিত। উপস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যেনতেনপ্রকারেণ গন্তব্যে প্রস্থানই তখন অগ্রাধিকার পায়, বহনযোগ্য গৃহসামগ্রীর সুচারু পারিপাট্য নয়।

কিংসফোর্ড সাহেবের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুজফ্‌ফরপুরে বদলির আদেশ এসেছে। নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। সময়াভাবে রওনা দিয়েছিলেন কোনওমতে লটবহর মালবাহী ট্রাকে গচ্ছিত করে।

.

নাশকতামূলক কাজকর্মে আজকাল আকছার ব্যবহৃত হয় Improvised Explosive Devices (IED)। রেডিয়ো, সাইকেল, টিফিনবক্স, হাতঘড়ি, ল্যাপটপ এবং আরও নানাবিধ দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটানোর উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য। গোপনও কিছু নয়, ইন্টারনেটে মজুত পর্যাপ্ত তথ্যভাণ্ডার।

আলোচ্য ঘটনা একশো বছরেরও বেশি আগের, যখন না ছিল প্রযুক্তির অবাধ আনুকূল্য, না ছিল বহির্জগৎ সম্পর্কে অনায়াস তথ্যস্রোত। সে না-ই বা থাকুক, চিন্তার অভিনবত্ব কবে আর সময়ের আজ্ঞাবহ থেকেছে? বিংশ শতকের প্রথম দশকেই বিপ্লবীরা কিংসফোর্ড হত্যায় প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন IED, তৈরি হয়েছিল বই-বোমা।

কিংসফোর্ডের পুস্তকপ্রীতি সুবিদিত ছিল। বিদায়ী উপহার-উপঢৌকন জমা হবেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কিড স্ট্রিটের বাড়িতে। উপহার হিসাবেই পৌঁছে দেওয়া হবে সুদৃশ্য মোড়কে বই। কিংসফোর্ড খুলবেন, খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরে রাখা বোমা ফাটবে সশব্দ তীব্রতায় এবং ঘটবে কার্যসিদ্ধি, এই ছিল হত্যার নীল নকশা।

নকশা রূপায়ণের দায়িত্ব ন্যস্ত হল মেদিনীপুরের বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাসের উপর। হেমচন্দ্র ১৯০৬ সালের জুলাইয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। বিদেশের বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো এবং তাদের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। নানা ধরনের বোমা তৈরির কৌশল শিখলেন ফ্রান্সে। দেশে ফিরলেন ১৯০৭ –এ। সঙ্গে আনলেন ব্রাউনিং পিস্তল আর বোমা বানানোর ম্যানুয়াল। এবং ফিরেই যোগ দিলেন কলকাতায় বারীন ঘোষের গুপ্ত সমিতিতে। দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পূর্ণ উদ্যমে। এহেন হেমচন্দ্রের উপরই যে ভার পড়বে বই-বোমা তৈরির, আশ্চর্য কী!

হেমচন্দ্র লেগে পড়লেন কাজে। কোন বইয়ের ভিতর রাখা হবে বোমা? এমন কোনও বই হতে হবে, যা হাতে নিলে কিংসফোর্ডের উৎসাহের উদ্রেক হবে অবধারিত। বাধ্য হবেন পাতা উলটোতে। কী হতে পারে সেই বই? অনেক ভেবে বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, কিংসফোর্ড পেশায় বিচারক, পড়াশুনোর নিয়মিত অভ্যেস রয়েছে, আইনের বই পাঠানোই ভাল।

কী বই? Herbert Broom-এর লেখা ‘Commentaries on the Common Law: Designed as its Introductory to its Study’, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১০৭৫। হেমচন্দ্র বইয়ের প্রথম ৮০ পাতা আর শেষের প্রায় ৪০০ পাতায় হাত দিলেন না। বাকি প্রায় ৬০০ পাতার প্রত্যেকটি নিপুণ ভাবে কেটে একটি চৌকো খোপ তৈরি করলেন। খোপ তো হল, এবার আসল কাজ। বোমার রসদ ভরা হল ক্যাডবেরি কোকোর কৌটোয়। বিস্ফোরক বোঝাই সেই কৌটো রাখা হল বইয়ের ভিতরের খোপে। হেমচন্দ্র একটি স্প্রিং দিয়ে জুড়লেন বইটিকে। এমন ভাবে জুড়লেন, যাতে কিংসফোর্ড বইটি খোলা মাত্রই স্প্রিং-এর সাহায্যে বোমার রসদ (পিকরিক অ্যাসিড আর ফালমিনেট অফ মার্কারি) সক্রিয় হবে মুহূর্তে, ঘটবে তীব্র বিস্ফোরণ। এবং অতীত হয়ে যাবেন ‘কসাই কাজি’।

বিপ্লবী পরেশ মৌলিক সরকারি কর্মচারীর পরিচয়ে কিংসফোর্ডের বাড়ির সান্ত্রিদের কাছে পৌঁছে দিলেন প্যাকেট। সাহেবের বদলির পর এমন বিদায়-উপহার অনেকই আসছে, বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করেই প্যাকেট পৌঁছল অন্দরমহলে। সেটা ১৯০৮-এর জানুয়ারি মাস।

কিন্তু বিধি বাম! মাসদুয়েকের মধ্যেই মুজফ্‌ফরপুরে বদলি হয়ে গেলেন কিংসফোর্ড, জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারপতি হিসাবে। গোছগাছের তাড়াহুড়োয় বইয়ের প্যাকেট খোলাই হল না। ট্রাকবন্দি হয়ে বই-বোমা পাড়ি দিল মুজফ্‌ফরপুর।

এবং দুর্ভাগ্য বিপ্লবীদের, নতুন কর্মস্থলে পৌঁছেই তুমুল ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কিংসফোর্ড। বদলির সময় পাওয়া অন্য অনেক উপহারের সঙ্গে বই-বোমাও স্থান পেল বাংলোর আস্তাবলের কাছে একটি গুদামে। কে কী উপহার দিয়েছে, পরে সময়মতো খুলে দেখবেন, এমনটাই ভাবলেন কিংসফোর্ড। আইনের মোটা বইটি পড়ে রইল প্যাকেটসুদ্ধ। খোলা হল না। আয়ুবৃদ্ধি ঘটল সাহেবের।

প্রাথমিকভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়লেও হাল ছাড়লেন না বিপ্লবীরা। মুজফ্‌ফরপুরে গিয়েই হত্যা করা হবে কিংসফোর্ডকে, সিদ্ধান্ত হল। বারীন ঘোষ নির্বাচন করলেন দুই ঘাতককে। সুশীল সেন এবং প্রফুল্ল চাকী। যথাক্রমে ‘দুর্গাদাস সেন’ এবং ‘দীনেশচন্দ্র রায়’ ছদ্মনামে সুশীল-প্রফুল্ল সরেজমিনে ঘুরেও এলেন মুজফ্ফরপুর। দুই দফায় খুঁটিয়ে দেখে এলেন কিংসফোর্ডের বাংলোর অবস্থান। সাহেবের দৈনন্দিন গতিবিধির সম্পর্কে তৈরি করলেন সম্যক ধারণা।

চূড়ান্ত যাত্রার কয়েকদিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন সুশীলের বাবা। সিলেটের বাড়িতে কৈলাশচন্দ্র সেন তখন প্রায় মৃত্যুশয্যায়। একরোখা সুশীল জেদ ধরলেন, কিংসফোর্ড-নিধন সাঙ্গ করে তবেই যাবেন বাবাকে দেখতে। বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র দাস এবং অন্য বিপ্লবীরা বহু চেষ্টায় নিরস্ত করলেন সুশীলকে। পাঠালেন সিলেটে, বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। সুশীলের পরিবর্তে অন্য এক তরুণ মুজফ্‌ফরপুর পাড়ি দিলেন কিংসফোর্ড-হত্যার লক্ষ্যে। নাম? ক্ষুদিরাম বসু।

.

কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীর দুঃসাহসিক অভিযানের দিনলিপি বহুআলোচিত, বহুপঠিত। বিস্তারিত নিষ্প্রয়োজন।

এই লেখার নিরিখে প্রাসঙ্গিক তথ্য এটুকুই, কিংসফোর্ড-হত্যার ব্যর্থ অভিযানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবীদের গোপন ডেরাগুলিতে চিরুনিতল্লাশি চালিয়েছিল পুলিশ। সেই তল্লাশির সূত্রেই গ্রেফতার হয়েছিলেন অরবিন্দ-বারীন ঘোষ সহ অনেকে। উদ্ধার হয়েছিল প্রচুর গুলি-বন্দুক-অস্ত্রশস্ত্র-বোমা। শুরু হয়েছিল আলিপুর বোমা মামলা। এবং এই মামলার তদন্তেই পুলিশ হদিশ পেয়েছিল কিংসফোর্ডের বাংলোর গুদামঘরে একরাশ উপহারসামগ্রীর মধ্যে পড়ে থাকা বই-বোমার। আলিপুর বোমা মামলায় ধৃত এক বিপ্লবীকে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্রে পুলিশ জানতে পেরেছিল ‘কসাই কাজি’-কে হত্যার পরিকল্পনার ইতিবৃত্ত। বছর গড়িয়ে তখন ১৯০৯-এর ফেব্রুয়ারি। বই-বোমা পাঠানোর পর প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত।

ব্রিটিশ সরকারের ‘Sedition Committee’-র রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, ‘A well known revolutionary, when in custody, said that a bomb had been sent to Mr. Kingsford in a parcel. The parcel did not contain a book; but the middle portion of the leaves had been cut away and the volume was thus in effect a box and in the hollow was contained a bomb with spring to cause the explosion if the book was opened.’

বই-বোমার কথা জানামাত্রই কলকাতা পুলিশ তড়িঘড়ি তারবার্তা পাঠিয়েছিল কিংসফোর্ডকে। বোমা বিশেষজ্ঞ Major Muspratt Williams-কে সদলবলে মুজফ্‌ফরপুর পাঠানো হয়েছিল যুদ্ধকালীন দ্রুততায়। বাংলোর গুদাম থেকে যথোচিত সতর্কতায় বই-বোমা আনা হয়েছিল কলকাতায়। নিষ্ক্রিয় করা হয়েছিল তৎকালীন নগরপাল Fredrick Loch Halliday-র কিড স্ট্রিটের বাসভবন সংলগ্ন বাগানে। বোমা নিষ্ক্রিয়করণের পর মেজর উইলিয়ামস ১৯০৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট পেশ করেছিলেন সরকারকে, ‘…I proceeded to Muzaffarpore on the evening of the 22nd, arriving there next morning at 10 AM and was met by Mr. Kingsford, ICS and Mr. Armstrong, Superintendent of Police…. I placed the bomb in my own hand bag, having first wrapped it in cotton wool, and I padded it all round with cotton wool taken out of a cushion. I then caught the afternoon train back to Calcutta on the morning of 24th… I took the bomb to the compound of Mr. F L Halliday, CIE, MVO, Commissioner of Police, and was accompanied by Mr. Denham, who kindly assisted me in conducting operation, as also did Mr. Halliday.’

রিপোর্টে উইলিয়ামস লিখেছিলেন স্পষ্ট, কার্যকারিতায় কী মারাত্মক প্রাণঘাতী হতে পারত ওই বই-বোমা, ‘There is no doubt this would have been a most destructive bomb, had it exploded.’

বই-বোমাটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল সযত্নে। রক্ষিত আছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে আমাদের পুলিশ মিউজিয়ামে, ভারতের ইতিহাসে IED ব্যবহারের সম্ভবত প্রথম নিদর্শন হিসাবে।

.

সুশীল স্বাধীনতা আন্দোলনে আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন পরবর্তী জীবনে। অরবিন্দ ঘোষের প্রেরণায় উচ্চশিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ম্যাট্রিকে চতুর্দশ স্থান, স্নাতক স্তরে রসায়নে স্বর্ণপদক। প্রেসিডেন্সি কলেজে পাঠরত অবস্থায় ইডেন হিন্দু হস্টেলে আলাপ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীনের সঙ্গে, ফের উজ্জীবিত হওয়া দেশকে স্বাধীন করার ব্রতে।

বীরোচিত মৃত্যুবরণ ১৯১৫-য়। নদিয়ায় এক গোপন সশস্ত্র অভিযান চলাকালীন। ব্রিটিশ বাহিনীর চক্রব্যূহে আটকে পড়েছিল ছ’জনের দলটি। নেতৃত্বে ছিলেন সুশীল। মজুত গুলিও প্রায় শেষ। সুশীলের দু’পায়েই গুলি লেগেছিল। চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। পরিস্থিতির বিচারে আপাতদৃষ্টিতে তিনটি রাস্তা খোলা ছিল। এক, পুরো দলটিরই আত্মসমর্পণ। দুই, অসম যুদ্ধ অব্যাহত রেখে মৃত্যুকে সমবেত স্বেচ্ছা-আহ্বান। এবং তিন, গুলিবিদ্ধ সুশীলকে ফেলে রেখে পশ্চাদপসরণ, যা কোনও অবস্থাতেই করতেন না সহযোদ্ধারা।

চতুর্থ রাস্তা দেখিয়েছিলেন সুশীল স্বয়ং। বিভ্রান্ত সহযোদ্ধাদের দ্রুত বোঝাতে পেরেছিলেন, সবাই মিলে শহিদ হলে অভীষ্ট অধরাই থেকে যাবে চিরতরে। একজনের মৃত্যু তবু শ্রেয় দলগত আত্মহননের তুলনায়। লড়াইটা অন্তত আগামীতে জারি রাখবে বাকিরা। সঙ্গীরা অনুরোধ রেখেছিলেন। ব্রিটিশ শাসকের নয়, সতীর্থদের বুলেটেই অবশিষ্ট প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়েছিল তেইশ বছরের সুশীল সেনের। মৃতদেহ খুঁজে পেতে যাতে পুলিশের কালঘাম ছুটে যায়, চিহ্নিতকরণ হয় দুঃসাধ্য, সে পথও মৃত্যুর আগে সঙ্গীদের বাতলে দিয়েছিলেন সুশীল। পরিকল্পনা মতো সুশীলের মৃতদেহ খণ্ডিত করে বিভিন্ন জায়গায় পুঁতে দিয়েছিলেন সতীর্থরা। হদিশই পায়নি পুলিশ।

সুশীল ‘সুশীল’ বালক ছিলেন না। সেই ছেলে ছিলেন না, যাঁকে বেত মেরে মা-ভোলানো যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *