১.০৯ মধ্যরাতের কিড স্ট্রিটে

মধ্যরাতের কিড স্ট্রিটে

[রমজান আলি হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার মহম্মদ আক্রম]

কোথায় : লালবাজার কন্ট্রোল রুম।

কবে : ২০ ডিসেম্বর, ১৯৯৪।

কখন : রাত পৌনে দুটো।

ফোন বাজল ঝনঝন। রাতের শিফটের অফিসার তুললেন।

—দেরি হচ্ছে কেন? ওসি পার্ক স্ট্রিট বলছি। ফোর্স পাঠান।

—বেরিয়ে গেছে একটু আগে। পৌঁছে যাবে।

—লোকেশন নিন। ফোর্স দরকার। অ্যাজ় আর্লি অ্যাজ় পসিবল। না হলে সামলানো যাচ্ছে না।

—রজার।

নড়েচড়ে বসে কন্ট্রোল রুম। শিফট ইনচার্জ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আন্দাজ করেন, আজ রাতটা ঝামেলার হতে যাচ্ছে। ওয়াকিটকি হাতে নিতে যেটুকু সময়। ধাতব শব্দ ছিটকে আসে পরমুহূর্তে, ‘কন্ট্রোল রুম কলিং। হেভি রেডিয়ো ফ্লাইং স্কোয়াড টেন, লোকেশন প্লিজ়?’

—রিপ্লায়িং, অ্যাপ্রোচিং ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম।

—পৌঁছে ওসি-র কাছে রিপোর্ট করুন। ডিসি সাউথ অন ওয়ে।

সে-রাতে জমাট ঠান্ডা শহরে। এখনকার মতো চটজলদি কুড়ি-বিশের ক্রিকেটে বিশ্বাসী ছিল না তখনকার পৌষ-মাঘ। ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরের ওম সহজে ক্রিজ় ছাড়ত না সে-সময়। রাস্তায় বেরলে ফুল সোয়েটার বা শাল না হলেই নয়।

বাড়তি ফোর্স যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছল, গলদঘর্ম স্থানীয় পুলিশ। শ’তিনেক লোকের কৌতূহলী দঙ্গল গেটের বাইরে। ঢুকতে চায় ভিতরে। আটকাচ্ছে পুলিশ, কী করে ওভাবে আমজনতাকে ঢুকতে দেওয়া যায় ভিআইপি এলাকায়? খুনের ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছে কিছুক্ষণ হল, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা আসছেন, কলকাতা পুলিশের একাধিক আইপিএস অফিসার পৌঁছে গিয়েছেন। তাবড় তাবড় রাজনৈতিক নেতাদেরও গাড়ি ঢুকছে একের পর এক। লাল বাতির ছড়াছড়ি।

ভাগ্যিস গুচ্ছের টিভি চ্যানেল ছিল না তখন। থাকলে অবস্থা আরও সঙ্গিন হত। ক্যামেরা আর বুমের দাপটে নতুন সমস্যা তৈরি হত, স্পট থেকে মিনিটে-সেকেন্ডে-মাইক্রোসেকেন্ডে ‘ব্রেকিং নিউজ়’ আর এক্সক্লুসিভের ইঁদুরদৌড় সামলাতে ঘাম ছুটে যেত পুলিশের। তবু, সেই মূলত দূরদর্শন-শাসিত সময়েও সাংবাদিকদের জটলা নেহাত কম নয় রাতবিরেতে।

কোনওভাবে ভিড়ভাট্টা সামলে বছর পঁয়ত্রিশের শোকস্তব্ধ সদ্য-স্বামীহারাকে যখন ধরে ধরে গেটের দিকে আনছেন পরিচিত-পরিজনেরা, ঘড়ির কাঁটা তিনটের চৌকাঠ পেরিয়ে গিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় নির্বাক মহিলা তখন প্রায় চলচ্ছক্তিহীন।

পুলিশের তখন অনেক কাজ বাকি। ঘটনাস্থলের পুঙ্খানুপুঙ্খ স্কেচ ম্যাপ বানানো, কাদের রাতেই জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন তার তালিকা তৈরি করা, ফরেনসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যত দ্রুত সম্ভব, সিজ়ার লিস্টের লেখালেখি, মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো সকাল হলেই, যাতে পরীক্ষার পর সম্ভাব্য রিপোর্টের প্রাথমিক আন্দাজ পাওয়া যায় সন্ধের আগেই। এবং, স্বামীহত্যার সাক্ষী থাকা স্ত্রীর বয়ান নিয়ে FIR নথিভুক্ত করা।

সাংবাদিকদের ব্যস্ততাও কম নয় তখন। লেট সিটির এডিশনে খবরটা ধরাতেই হবে, যে করে হোক। ফ্রন্ট পেজ় নিউজ়, নিশ্চিত।

পার্ক স্ট্রিট থানার ওসি-র চেম্বারে বসানো হয়েছে মহিলাকে। পৌনে চারটে বাজে প্রায়, একটু পরেই রাত হাঁটা দেবে ভোরের দিকে। যথাসাধ্য সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন মহিলা পুলিশকর্মীরা। ডিসি ডিডি স্বয়ং থানায় উপস্থিত। অনেক সাধ্যসাধনার পর দুটি বাক্য বেরল দৃশ্যতই বিধ্বস্ত মহিলার মুখ থেকে, ‘ম্যায় তো বিলকুল আকেলি হো গয়ি… লাইফ বরবাদ হো গয়া…’ কেঁদে ফেললেন বলতে বলতেই।

—শান্ত হন ম্যাডাম, বলুন প্লিজ়, ঠিক কী হয়েছিল।

একটু ধাতস্থ হয়ে বলতে শুরু করেন তালাত সুলতানা। উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখর থেকে নির্বাচিত ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক রমজান আলির স্ত্রী।

“কলকাতায় এলে কিড স্ট্রিটের এমএলএ হস্টেলেই উঠি আমরা। ১৩ ডিসেম্বর রমজান সাহেবের সঙ্গেই এসেছিলাম। ওঁর চিকিৎসার প্রয়োজনে। উঠেছিলাম চারতলার রুম নম্বর ৩/১০-এ। গতকাল দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ সুব্বাদিদি (রেণুলীনা সুব্বা, অল ইন্ডিয়া গোরখা লিগের প্রাক্তন বিধায়ক) এল। বলল, ‘কোনও রুম খালি নেই, তোদের ঘরে রাতটা থাকতে দিবি?’ আমি সুব্বাদিদিকে চিনতাম। আর রমজান সাহেবের সঙ্গে তো দীর্ঘদিনের পরিচয়। বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আমাদের সঙ্গেই থেকে যান।’

লাগেজ আমাদের ঘরে রেখে সুব্বাদিদি বেরল। ফিরল ছ’টা নাগাদ। রাত সোয়া ন’টায় আবার বেরল ওষুধ কিনতে। ফেরার পর আমরা তিনজন খাওয়াদাওয়া করলাম। সুব্বাদিদি দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি আর রমজান সাহেব সোয়া দশটা–সাড়ে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনলাম, রাত সাড়ে এগারোটা হবে তখন। আমার আর রমজান সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। সুব্বাদিদির খুব গাঢ় ঘুম, জাগেনি। রমজান সাহেব বললেন, ‘বোধহয় মতিন, খুলে দাও। কিছু দরকার আছে হয়তো।’

মতিন ফরওয়ার্ড ব্লকের সর্বক্ষণের কর্মী। ও আর আলম রুম নম্বর ১/৮ –এ ছিল। খুলে দিলাম দরজা। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, কই, কেউ তো নেই করিডরে! তা হলে কি ঘুমের ঘোরে ভুল শুনলাম আমরা? রমজান সাহেব বললেন, ‘দরজাটা খুলেই রাখ। মতিনই হবে। পার্টির কাজ নিয়ে কিছু আলোচনা ছিল। সে জন্যই এসেছিল নিশ্চয়ই। দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় চলে গিয়েছে। ভেবেছে, ঘুমিয়ে পড়েছি।’

দরজা খুলে রেখেই আমি ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গেলাম। ভাবলাম, উঠেই যখন পড়েছি, বাসনকোসনগুলো ধুয়ে রাখি। বাসন গুছোচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন মুখ চেপে ধরল। দেখি, দু’জন লোক, হাতে পিস্তল। গলায় ওটা ঠেকিয়ে কম্বল দিয়ে মুখচাপা দিয়ে হাত-পা বাঁধল কাপড় দিয়ে। টানতে টানতে নিয়ে গেল ভিতরে। দেখলাম আরও দু’জন ঢুকে পড়েছে ঘরে। আমি তখন ভয়ে প্রায় আধমরা। সুব্বাদিদি ততক্ষণে জেগে গিয়েছে টানাহ্যাঁচড়ার শব্দে। রমজান সাহেবও। ওরা সুব্বাদিদিরও মুখ-হাত-পা বাঁধল। ভয় দেখাল, শব্দ করলে জানে মেরে দেবে।

আলনায় থাকা আমার হলুদ শাড়ি দিয়ে রমজান সাহেবের গলায় পেঁচিয়ে ধরল একজন। আমি বাধা দিতে গেলে একজন সজোরে লাথি মারল পেটে, গালি দিল অকথ্য ভাষায়, ‘শালি হারামজাদি।’ রমজান সাহেব যখন ছটফট করছিলেন, ওরা বলছিল, ‘১০ তারিখে মিটিং, না? মজা দেখাব।’

আমাকে একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘টাকা কই?’ তারপর সুটকেসের উপর রাখা মানিব্যাগ থেকে যা টাকাপয়সা ছিল, নিয়ে নিল। ওরা আধঘণ্টা মতো ছিল। বারবার ভয় দেখাচ্ছিল, গুলি করে মেরে দেওয়ার।

ওরা চলে যাওয়ার পর ঘষটে ঘষটে আমি আর সুব্বাদিদি ইন্টারকমের কাছে গেলাম। রমজান সাহেবের কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। নিথর হয়ে পড়ে ছিলেন। খুব ভয় করছিল আমার।

কোনওভাবে আমি আর সুব্বাদিদি অনেক চেষ্টা করে আমার হাতের বাঁধনটা খুলতে পারলাম। ফোন করলাম মতিনের ঘরে। মতিন আর আলম দৌড়ে এল। আমাদের বাঁধন খুলে দিল। রমজান সাহেবের তখনও কোনও সাড়াশব্দ নেই। মতিন ওঁর গলার ফাঁস খুলে দিল। নাড়ি টিপে দেখল কিছুক্ষণ, নাকের কাছে হাত রাখল। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছিল তখন। মতিন ছলছল চোখে বলল, ‘রমজান ভাই আর নেই!’

পুরো ব্যাপারটা আমার চোখের সামনে ঘটল স্যার… ওদের দেখলে চিনতে পারব, খুঁজে বের করে শাস্তি দিন…..।”

ফের কেঁদে ফেললেন তালাত।

একটানা এতক্ষণ কথা বলে হাঁপাচ্ছেন তখন। তালাতকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন ডিসি ডিডি, ‘নিন ম্যাডাম, আপনার একটু বিশ্রাম দরকার। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব খুনিদের ধরতে, কথা দিচ্ছি।’

এ মামলার কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। জওহরলাল নেহরু রোড ধরে দক্ষিণ দিকে এগোলে পার্ক স্ট্রিটের একটু আগেই বাঁ হাতে কিড স্ট্রিট। রাস্তা ধরে সামান্য হাঁটলেই ডান দিকে এমএলএ হস্টেল। গ্রিলের উঁচু গেট, সামনে সর্বক্ষণের পুলিশি প্রহরা। ‘বিধানসভা সদস্য আবাস বিভাগ’-এর গ্লো সাইনবোর্ড চোখ এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

নিরাপত্তা যেখানে নিশ্ছিদ্র থাকার কথা, সেখানেই মাঝরাতে খুন হয়ে গেলেন এক বিধায়ক। তুমুল হইচই হওয়ার কথা। হলও। পুলিশের বাপবাপান্ত করার এমন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা মিডিয়া হাতছাড়া করে না সাধারণত। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো-র কটাক্ষ নানা রকমফেরে আক্রান্ত করল আমাদের। উত্তাপ যথানিয়মে বাড়ল রাজ্য-রাজনীতিরও।

খুনিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার না হলে বাংলা বন্‌ধের হুমকি দিল ফরওয়ার্ড ব্লক। লালবাজারে গঠিত হল দুটি বিশেষ দল। সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকলেন উচ্চপদস্থ কর্তারা। ঘটনার দু’দিনের মধ্যেই মামলার তদন্তভার প্রত্যাশিতভাবেই বর্তাল গোয়েন্দা বিভাগের উপর। তদন্তকারী অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হলেন হোমিসাইড শাখার তৎকালীন ইনস্পেকটর মহম্মদ আক্রম, যিনি চাকরিজীবনের শেষে অবসর নিয়েছিলেন কলকাতা সশস্ত্র পুলিশের অষ্টম ব্যাটালিয়নের ডেপুটি কমিশনার হিসেবে।

বিধানসভা সদস্য আবাস

মহম্মদ রমজান আলি হত্যা মামলা। পার্ক স্ট্রিট থানা, কেস নম্বর ৮২৫, তারিখ ২০/১২/৯৪। ধারা ৩০২/৩৪/৩৯৪/৩৯৭ আইপিসি। খুন, একই উদ্দেশ্যে একাধিকের সম্মিলিত পরিকল্পনা, লুঠের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে খুন বা গুরুতর আঘাতের চেষ্টা।

তদন্ত শুরু হল প্রথাগত বিধিনিয়মে। ময়নাতদন্তে কী পাওয়া যাবে, জানাই ছিল। শ্বাসরোধ করে খুন, ‘manual strangulation’।

রুম নম্বর ৩/১০-এ ঢুকেই একটা দশ ফুট বাই আট ফুট মতো জায়গা। মোটা পরদা টাঙানো রয়েছে সামনে। যা পেরলে মূল ঘর। পরদার ভিতর থেকে বাইরেটা দেখা যায় না, বাইরে থেকে ভিতরটাও।

যে ঘরে রমজান আলিকে হত্যা করা হয়েছিল

তন্নতন্ন করে খুঁজেও মিলল না ‘ডেভেলপ’ করার যোগ্য হাত বা পায়ের ছাপ। বেশ কিছু টুকিটাকি জিনিস বাজেয়াপ্ত করা হল বটে, কিন্তু সেসব নিয়মরক্ষার। ঘেঁটেঘুঁটেও নির্ণায়ক কিছু পাওয়া গেল না। তালাত বলেছিলেন, খুনিদের দেখে চিনতে পারবেন। ছবি আঁকানো হল বর্ণনা অনুযায়ী। ছড়িয়ে দেওয়া হল সোর্সদের মধ্যে, বিভিন্ন থানায়। লাভ হল না।

সূত্র, সে যতই তুচ্ছ হোক, পেলে তবেই না পরের ধাপ! হস্টেলের কর্মী-আবাসিক বা সেদিনের ‘ভিজিটর’-দের বিস্তারিত জেরা করেও অধরাই থাকল তদন্তের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ।

জটিল কেসে আমাদের প্ৰচলিত পদ্ধতি, তদন্তের অগ্রগতির কাটাছেঁড়া হয় নিয়মিত। গুরুত্বের বিচারে কখনও দু’-তিন দিন অন্তর, কখনও সকাল-বিকেল-সন্ধে। এ মামলা ছিল দ্বিতীয় গোত্রের, আক্ষরিক অর্থেই ঘুম ছুটে গিয়েছিল পুলিশের।

এমনই এক রিভিউ-বৈঠকের আগে তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে তাঁর সহযোগীর কথোপকথন। ঘটনার দিনতিনেক পরের কথা লিখছি।

—স্যার, তালাত সুলতানার বয়ান নিয়ে খটকা লাগছে।

—সে তো আমারও লাগছে, প্রথম দিন থেকেই।

—রাইট স্যার। রমজান দরজা খুলে রাখতে বলবেন কেন? মতিন আসেনি, জানার পরও?

তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, মতিন তো বলছে সে ফোন পেয়েছে রাত একটার পর…

—আর খুনটা হয়েছে, তালাতের বয়ান অনুযায়ী রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে। পোস্টমর্টেমও তা-ই বলছে |

—কারেক্ট! এতক্ষণ কী করছিলেন উনি?

—বলছেন তো, অনেক চেষ্টা করে হাতের বাঁধন খুলেছিলেন বলে দেরি হয়েছিল। তারপর ফোন করেছেন।

—হুঁ… ক্রিমিনাল গ্যাং হলে ফোনের লাইন কেটে দিয়ে যেত।

—হয়তো মিস করে গেছে তাড়াহুড়োয়।

—তুমিও আসল ব্যাপারটা মিস করে যাচ্ছ। বাইরে পুলিশ। নিতান্ত পরিচিতের সঙ্গে কেউ ঢুকলে তবেই রেজিস্টারে লেখা হয় না। চার জন অপরিচিত ঢুকে পড়বে এমএলএ হস্টেলে, কেউ খেয়াল করবে না? আর যদি এক এক করে ঢুকেও পড়ে কোনওভাবে, পুলিশ, রিসেপশন, সবার চোখ এড়িয়ে গেল?

—হয়তো সেন্ট্রি কনস্টেবলের ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। শীতের রাত, সেই সুযোগে টুক করে…

—তালাত বলেছেন, সাড়ে এগারোটায় দরজায় টোকা। অন্তত তার পৌনে এক ঘণ্টা আগে সেন্ট্রি চেঞ্জ হয়। ডিউটি ধরেই কেউ ঝিমোবে না। রাত দুটো-আড়াইটা হলে তবু মানা যায়…

—মহিলা বলছেন, লোকগুলোকে দেখলে চিনতে পারবেন। স্পেশিফিক ডিটেলস দিচ্ছেন চেহারার। অথচ লাইট অফ ছিল। কী করে দেখলেন এত?

—হুঁ… ওটা তো সবচেয়ে বড় কন্ট্রাডিকশন…

—তালাতকে অ্যারেস্ট করলে হয় না? শিয়োর কিছু লুকোচ্ছেন। আর রেণুলীনাও কিছু দেখলেন না, এটাও কেমন যেন…

—গ্রেফতার করা যায়… কিন্তু রিস্‌ক আছে। প্রমাণ ছাড়া কমপ্লেনান্টকে ওভাবে.. অবশ্য আর একবার ইন্টারোগেট করাই যায়। ডিসি-কে বলব ভাবছি আজ।

—বলুন স্যার, এই প্রেশার আর নেওয়া যাচ্ছে না। পলিটিক্যাল মার্ডার বলে বাজার গরম করছে কাগজগুলো। আর তালাত তো ফিরে গেছেন কিষাণগঞ্জে গতকাল।

—এভাবে পলিটিক্যাল মার্ডার হয়? কত জায়গা আছে মার্ডার করার। এমএলএ ছিলেন উনি। জনসংযোগ করতে হত, মিটিং-মিছিল করতে হত। রাজনৈতিক খুন করতে এমএলএ হস্টেলের মতো সিকিয়োর জায়গায় চারজন দল বেঁধে আসবে মার্ডার করতে? হয় কখনও?

—ওই জন্যই তো আরও সন্দেহ। ডেলিবারেটলি মিসলিড করছেন তালাত। আর ভেবে লাভ নেই স্যার, ডিসি-কে বলুন।

বলা হল, আলোচনা হল বিস্তর। প্রমাণ ছাড়া আটক করাতেও সমালোচনার ঝুঁকি প্রচুর। কিন্তু তালাতের বয়ানে অসংগতির আধিক্য এতটাই, হিসেবে গরমিল এতটাই, ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। আদালত থেকে ওয়ারেন্ট বের করা হল তালাতের নামে। ডিসি ডিডি-র নেতৃত্বে ২৪ ডিসেম্বর বিহার রওনা দিল দল। কিষাণগঞ্জের বাহাদুরপুরের বাড়ি থেকে তালাতকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হল ২৬ ডিসেম্বর।

প্রশ্নমালা তৈরিই ছিল। অথচ কাজেই লাগল না তেমন। মিনিট দশেক জেরার পর তালাত নিজেই বললেন, ‘মিথ্যে বলেছিলাম। খুনটা রবি করেছিল। রমজান সাহেবের কনফিডেন্সিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

—করল কেন?

—সেটা আদালতে বলব। আপনাদের নয়।

—আদালতে স্বীকারোক্তি দেবেন?

—অবশ্যই, ওখানেই দেব। আপনারা ব্যবস্থা করুন।

—সে না হয় করব। কিন্তু শুরুতে মিথ্যে বলেছিলেন কেন? রবির সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?

—বললাম তো, যা বলার আদালতেই বলব। রবি আমাকে দিদি বলে ডাকত। খুনের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

নির্দিষ্ট দিনে তালাত আদালতে স্বীকারোক্তি দিলেন। ‘যাহা বলিব সত্যি বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না’-র পর কী সেই স্বীকারোক্তি? তুলে দিলাম হুবহু।

“আমার এই খুনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। আমি সাধারণ গৃহবধূ। দুই মেয়ে, এক ছেলে। গত মে মাসের পনেরো তারিখে পুরসভা নির্বাচন ছিল উত্তর দিনাজপুরে। তার আগের রাতে, ১৪ মে, ইসলামপুরের হোগলবাড়িতে একটা রাজনৈতিক মারামারি হয়। রমজান সাহেব আহত হন। রবি ছিল ওঁর পিএ। সবসময় সঙ্গে সঙ্গে থাকত। রমজান সাহেবকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়, ভরতি করা হয় ক্যালকাটা হসপিটালে। সেখানে এবং তারপর এমএলএ হস্টেলে আমি প্রাণপণ শুশ্রূষা করি স্বামীর। রবিও সাহায্য করেছিল খুব। ওই সময় রবির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়, অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি আমরা। রমজান সাহেব আমার প্রতি উদাসীন ছিলেন, ভাল ব্যবহার করতেন না।

আমরা কিষাণগঞ্জের বাড়িতে তখন। ফিরে গিয়েছি চিকিৎসার পর। একদিন আমাকে আর রবিকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেন আমার স্বামী। রবির সামনেই অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন আমাকে। রবিকে ছাড়িয়ে দেন কাজ থেকে। সেই থেকেই রবির আক্রোশ রমজান সাহেবের উপর। আমি অবশ্য ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। কোনও সম্পর্ক সেই থেকে রাখিনি রবির সঙ্গে।

আবার বলছি, আমি খুন করিনি। কোনও সম্পর্ক নেই খুনের সঙ্গে। খুন রবি করেছে।

২০ তারিখ রাতে সাড়ে দশটা নাগাদ আমি, সুব্বাদিদি আর এমএলএ সাহেব ঘরে ছিলাম। সুব্বাদিদি ঘুমিয়ে পড়েছিল। রমজান সাহেবের চোখে ড্রপ দেওয়ার পর আমি মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে শুয়েছিলাম। দুটো আলাদা খাটে আমার স্বামী আর সুব্বাদিদি শুয়ে ছিল। ঘরের লাইট অফ করা ছিল। দরজা খোলা ছিল।

হঠাৎ রবি দরজা ঠেলে পরদা সরিয়ে ঢুকল ঘরে। বলল, ‘কাকুর (এই নামেই ডাকত ও রমজান সাহেবকে) শরীর কেমন দেখতে এসেছি।’ রবিকে দেখেই ভীষণ রেগে গেলেন রমজান সাহেব। খুব গালাগালি করলেন আমাকে, বললেন, ‘তোমার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতেই এসেছে হারামজাদা।’ রবিও ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘আপনি দিদির জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছেন।’ বলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রমজান সাহেবের উপর। আমি আটকানোর চেষ্টা করলাম, হাতেপায়ে ধরলাম। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল রবি। আমি জ্ঞান হারালাম।

কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখি, আমি সুব্বাদিদির খাটে শুয়ে। রমজান সাহেবের শার্ট আর গেঞ্জি দিয়ে আমার মুখ বাঁধা। সুব্বাদিদির মুখ বাঁধা ওঁর লাল শাল দিয়ে। এমএলএ সাহেব নিজের খাটে। গলায় শাড়ির ফাঁস দেওয়া। এর বেশি কিছু জানি না।

আমার হার্টের সমস্যা আছে। কিন্তু রমজান সাহেব কখনও আমার অসুখের ব্যাপারে যত্ন নেননি। তবু আমি ওঁর সেবাযত্নে কোনওদিন ত্রুটি রাখিনি। এবারও কলকাতায় আসা ওঁর চিকিৎসার জন্যই।”

ম্যাজিস্ট্রেট সব শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পুলিশের কাছে মিথ্যে বলেছিলেন কেন?’

তালাত সোজাসাপটা উত্তর দিলেন, ‘ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া রবি শাস্তি পাক, এটা চাইনি। ওকে ভালবেসেছিলাম আমি। পরে মনে হল, সত্যিটা না বললে অন্যায় হবে।’

যাক, তা হলে কিনারা তো হল শেষমেশ! — এমনই প্রতিক্রিয়া সাধারণত আমাদের হয় আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিতে অভিযুক্ত রাজি হলে। এ যাত্রায়ও প্রাথমিকভাবে তেমনটাই ভেবেছিল পুলিশ। সত্যিটা অন্তত এবার জানা যাবে।

ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় নথিবদ্ধ হওয়া স্বীকারোক্তির (Judicial Confession) কপি যখন হাতে এল, মাথায় হাত গোয়েন্দাদের। স্বস্তি তো দূরের কথা, বরং আরও অস্বস্তির গ্রাসে। এটা কীরকম হল?

FIR–এ যা তালাত বলেছিলেন, তার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই। এবং এই অমিলের থেকেও বড় কথা, আদালতে দেওয়া বয়ানেও অজস্র অসংগতি। রাত এগারোটায় কেন দরজা খুলে রাখলেন? ব্যাখ্যা নেই। এতদিন পরে রবি হঠাৎ কেন ‘কাকু’–র শরীরের খোঁজ নিতে প্রায় মাঝরাতে এমএলএ হস্টেলে চলে এল? মতিনের উল্লেখ কোথায় নয়া স্বীকারোক্তিতে? নেই। তালাত বলছেন, পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। ঘটনার পরদিন প্রাথমিক চিকিৎসার সময় শরীরের কোথাও দৃশ্যমান আঘাত ছিল না, মাথাতেও নয়। একমত হলেন গোয়েন্দারা, ইনি কঠিন মহিলা। হয় মিথ্যে, নয় অর্ধসত্য বলছেন।

সিদ্ধান্ত হল, রবিকে তো আগে ধরা হোক। জেরা করলেই ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ হয়ে যাবে। রবি শিকদার, বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। ধরা হল নদিয়ার বাড়ি থেকে, নিয়ে আসা হল কলকাতায়।

এরপর যা ঘটল, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না পোড়খাওয়া গোয়েন্দারাও। জানা গেল, রবি কিছুদিন গাড়ি চালিয়েছিলেন রমজানের। কাজ করেছিলেন ব্যক্তিগত সহায়ক হিসেবেও। বেশ কয়েক মাস আগে অন্য চালক নিয়োগ করেন রমজান। সেই থেকে নদিয়ার বাড়িতেই থাকেন, জমিজমা দেখাশোনা করেন। চাকরি যাওয়ার পর তালাতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, দেখাও হয়নি কখনও। রবি স্পষ্ট বললেন, তালাতকে ‘দিদি’ বলে ডাকতেন, প্রশ্ন নেই দূরতম কোনও অবৈধ সম্পর্কের। আরও জানালেন জোর গলায়, কলকাতায় শেষ এসেছেন মাসছয়েক আগে। ঘটনার দিন তিনি নদিয়াতেই ছিলেন।

রবিকে নিয়ে পুলিশের বিশেষ টিম রওনা হয়ে গেল নদিয়ায়। খোঁজখবর-জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ নিশ্চিত হল, রবি সত্যি বলছেন। ঘটনার দিন নিজের গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। অসংখ্য সাক্ষী রয়েছে। আদালতে রবির জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করল না পুলিশ। রেহাই পেলেন নির্দোষ যুবক।

এদিকে কাগজে ফলাও করে প্রচার হয়েছে রবি ধরা পড়ার পর থেকে, চর্চা হয়েছে তালাতের স্বীকারোক্তি নিয়ে। ‘স্ত্রীর প্রাক্তন প্রেমিকের রোষেই খুন রমজান’ শীর্ষক খবর বেরিয়েছে সর্বত্র। রবির জামিনের পর আর-এক প্রস্থ নিন্দেমন্দ সহ্য করতে হল আমাদের।

অতঃকিম? লালবাজার ঠিক করল, শূন্য থেকে শুরু করা ছাড়া উপায় নেই। মূলত তিনটে সিদ্ধান্ত হল।

এক, আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সেই রাতে হস্টেলে থাকা সমস্ত আবাসিক-কর্মীদের, ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যে সমস্ত দোকানপাটের কর্মচারীদেরও। কেউ কিছু যদি মনে করতে পারেন, যা খেয়াল করেননি প্রথম বারের জেরায়।

দুই, এলাকার দু’-তিন কিলোমিটারের মধ্যে সমস্ত পিসিও বুথ চষে ফেলতে হবে। ঘটনার অন্তত কুড়ি দিন আগে থেকে খুনের দিন পর্যন্ত ফোনের রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এমএলএ হস্টেলে বাইরে থেকে কী কী ফোন এসেছিল কখন, রুম নম্বর ৩/১০-এ তো বটেই, অন্য সব রুমেও, জানতে হবে।

তিন, টিম পাঠানো হবে উত্তর দিনাজপুরে এবং কিষাণগঞ্জে। পার্টিকর্মীদের নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও মুখ খুলছেন না কেউ। স্থানীয় স্তরে সোর্স লাগিয়ে খোঁজখবর নিতে হবে রমজানের পারিবারিক ব্যাপারে। বিষয়সম্পত্তি নিয়ে কোনও বিবাদ ছিল কি না, মৃত্যুতে রাজনৈতিক ভাবে কেউ লাভবান হতে পারত কি না, রমজান-তালাতের সম্পর্কে কতটা টানাপোড়েন ছিল ইত্যাদি।

ত্রিমুখী স্ট্র্যাটেজিতে সর্বাত্মক ঝাঁপাল লালবাজার। ফলও মিলল পরিশ্রমের, ধৈর্যের, অধ্যবসায়ের।

তদন্তকারী অফিসার মহম্মদ আক্রম রোজ নিয়ম করে দশ-বারোটা পিসিও বুথে ঘুরে ঘুরে কললিস্ট ঘাঁটতে শুরু করলেন। প্রথম কিনারাসূত্র এল সেখান থেকেই।

সেদিন সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। জানুয়ারির শেষাশেষি। সারাদিন টো টো করে ঘুরেছেন আক্রম। শরীরে-মনে ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’-র রিংটোন বাজতে শুরু করেছে। ঠিক করলেন, আর গোটা তিনেক বুথ ঘুরে আজকের মতো দাঁড়ি টানবেন।

৩সি চৌরঙ্গি লেন। ছোট পিসিও বুথ, মালিক রঞ্জিত দাস। আদর-আপ্যায়ন করে বসালেন আক্রমকে, চা এল। কললিস্ট খুঁজতে খুঁজতেই খুচরো এ-কথা সে-কথার মাঝে রঞ্জিত বললেন, ‘স্যার, আপনারা তো সব ক’টা বুথ ঘুরছেন ক’দিন ধরে। ওই এমএলএ মার্ডারের ব্যাপারে, না?’

—হুঁ!

—স্যার, অভয় দেন তো একটা কথা বলি?

আক্রম চোখ তুলে তাকালেন। দৃষ্টিতে খুব একটা কৌতূহল আছে, এমনটা বলা যায় না।

গলার স্বর প্রায় খাদে নামিয়ে আনেন রঞ্জিত।

—স্যার, ম্যাডাম আমার বুথে প্রায়ই আসতেন ফোন করতে। ভাল আলাপ আছে আমার সঙ্গে।

—কোন ম্যাডাম?

—এমএলএ সাহেবের মিসেস।

আক্রম আবার চোখ তুললেন ফোন নম্বরের তালিকা থেকে। দৃষ্টি বদলে গিয়েছে এখন, উঠে পড়েছেন চেয়ার ছেড়ে। ক্লান্তি- শ্রান্তি উধাও।

—কোথায় করতেন ফোন?

—এসটিডি কল স্যার। দিল্লিতে।

—কোন নম্বর? শেষ কবে করেছেন?

—দশ মিনিট বসুন স্যার, বের করে দিচ্ছি। শেষ এসেছিলেন বোধহয় মাসখানেক আগে। স্পষ্ট মনে আছে। আর একবার চা বলি স্যার?

চা কেন, স্বর্গের অমৃতসুধা এনে দিলেও তাতে তখন আর রুচি নেই আক্রমের। সম্ভাব্য সূত্রের আভাস পেলে তদন্তকারী অফিসারের যা হয়, মনের তখন সেই অবস্থা। শিরা-ধমনীতে একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা-ঔৎসুক্য।

২০ অক্টোবর থেকে ১৫ ডিসেম্বর, বারোবার তালাত ফোন করেছিলেন দিল্লিতে। নম্বর ০১১-৭৩৮৬২৪। কথোপকথনের সময়সীমা কখনও তিন-চার মিনিট, কখনও আট-দশ। ওই বুথ থেকেই ফোন ঘোরালেন আক্রম। নম্বরটা দিল্লির একটা ব্যবসায়িক সংস্থার, নাম ‘Mumbai Trading & Co’। মালিকের নাম কলিম খান। যাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল কর্মচারীদের ব্যাপারে। বাংলা বা বিহারের কেউ আছে? এমন কি কেউ আছে যে কুড়ি তারিখ কাজে আসেনি?

—হাঁ, বাঙ্গাল সে এক হ্যায়। নুরুল, নুরুল ইসলাম। ষোলা তারিখ সে ছুট্টি লিয়া থা। লওট কে নেহি আয়া। কোই গড়বড় হ্যায় কেয়া?

এক মুহূর্ত দেরি করলেন না আক্রম। গাড়ি ছোটালেন লালবাজারে। ঝটিতি মিটিং সারলেন ডিসি ডিডি। সেই রাতেরই ট্রেন ধরতে রওনা হয়ে গেলেন অফিসারদের একটি দল। গন্তব্য দিল্লি।

পাশাপাশি ঠিক হল, যদি নুরুলই খুনি হয়, আর দিল্লি থেকে এসেই যদি খুনটা করে থাকে, আশেপাশের হোটেলে ওঠার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। আজ রাতেই হানা দিতে হবে দক্ষিণ ও মধ্য কলকাতার সমস্ত হোটেল-ধর্মশালায়। নুরুল ইসলাম বা অন্য কোনও নামে ১৬/১৭ তারিখ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে কেউ উঠেছিল কি না, খোঁজ নিতে হবে।

বেশি পরিশ্রমের দরকার পড়ল না। ঘণ্টা তিনেকের ছোটাছুটির পরই এমএলএ হস্টেল থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বের খাজা হাবিব হোটেলের রেজিস্টারে পাওয়া গেল নুরুল ইসলামের নাম। উঠেছিলেন ১৯ তারিখ সকালে, লিখেছিলেন ২২ তারিখ অবধি থাকবেন। কিন্তু ২০ তারিখ রাতেই টাকাপয়সা মিটিয়ে দিয়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে যান।

পরদিন সকালেই আরও প্রমাণ মিলল। সে-রাতে হস্টেলের ভিজিটার্স রেজিস্টারে যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় আর একটি দল জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছিল বেশ কয়েকদিন ধরে। জেরায় মনজুর আলম বলে একজন অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন, যেটা প্রথমবার বলেননি।

“রমজান সাহেব আমাদের এলাকার বিধায়ক। আমার বাড়ি চাকুলিয়া থানা এলাকায়। রমজান সাহেবের আদি বাড়ি কিষাণগঞ্জে, কিন্তু ওঁর আমাদের গ্রামের কাছেও একটা বাড়ি ছিল। রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের সঙ্গে আমাদের একটা জমিজমা সংক্রান্ত মামলা চলছিল অনেকদিন ধরে। সেই ব্যাপারে সাহায্য চাইতে বেশ কয়েকবার গিয়েছি এমএলএ সাহেবের বাড়ি। ওখানে নুরুলকে দেখেছি। রমজান সাহেবের ব্যক্তিগত সহায়ক ছিল নুরুল। ওর বাড়ি চাকুলিয়া থানারই বড়ডিহা গ্রামে। আলাপ ছিল আমার সঙ্গে।

২০ তারিখে কলকাতায় এসেছিলাম কাজে। উঠেছিলাম বেকার হস্টেলে এক বন্ধুর রুমে। রাত ১০টা নাগাদ করণদিঘির বিধায়ক সাজাদ আলির সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল এমএলএ হস্টেলে। ব্যবসায়িক সমস্যার ব্যাপারে। গিয়ে দেখি, সাজাদ সাহেবের রুম (২/৭) তালাবন্ধ।

আধঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। সাজাদ ভাই এলেন না। ভাবলাম, রমজান ভাইয়ের রুম থেকে ঘুরে আসি একবার। জানতাম, উনি কলকাতায় এসেছেন। হস্টেলে রুম ৩/১০-এই উঠতেন চিরকাল। সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় উঠলাম। রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম, ভিতর থেকে বন্ধ। আলো জ্বলছে না। ভাবলাম, ঘুমিয়ে পড়েছেন। অসুস্থ মানুষ, ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না।

যখন লিফটের দিকে ফিরে আসছি, নুরুলকে করিডরের উলটোদিক থেকে আসতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ভাই, এখানে এত রাতে?’ নুরুল বলল, রমজান সাহেবের সঙ্গে একটা দরকার আছে।”

গোয়েন্দারা মনজুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, এসব আগে বলেননি কেন?

—স্যার, পরের দিন যখন শুনলাম, রমজানভাই খুন হয়ে গিয়েছেন, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সব বলতে গিয়ে যদি ঝামেলায় পড়ি, কোর্টকাছারি করতে হয়, কী দরকার?

ওদিকে রহস্যজাল পরতে পরতে খুলতে শুরু করেছে কিষাণগঞ্জের বাড়িতেও। যেখানে রমজানের পরিবারের খুঁটিনাটি তথ্যতালাশ চালাচ্ছিলেন গোয়েন্দারা। জেলার অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিবার, কঠিন হচ্ছিল আত্মীয়-পরিজন, পাড়াপ্রতিবেশী-পার্টিসদস্যদের মুখ খোলানো। কিন্তু খবর বের করাটাই তো কাজ আমাদের। যেন তেন প্রকারেণ।

কী-কখন-কেন-কীভাবের উত্তর ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এল প্রকাশ্যে।

১৯৮৯ থেকে ’৯৩, চার বছর রমজান আলির ব্যক্তিগত সহায়ক হিসেবে কাজ করেছিল নুরুল ইসলাম। ’৯১ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন রমজান। ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, ক্ষয়রোগও বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল শরীরে। চিকিৎসার জন্য দিল্লি গেলেন, সঙ্গে তালাত আর নুরুল। রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকলেন রমজান এবং ক্রমে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল তালাত-নুরুলের।

রমজান তখন পঞ্চাশোর্ধ্ব, নানা রোগভোগে জীর্ণ। তালাত সবে তিরিশ পেরিয়েছেন, নুরুলও সমবয়সি প্রায়। ঘি এবং আগুনের সহাবস্থানে যা হওয়ার, তাই হল। গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন দু’জনে। মানসিক, শারীরিকও। চিকিৎসার পর কিষাণগঞ্জে ফিরলেন রমজান। কিছুদিনের মধ্যেই আঁচ করতে পারলেন তালাত আর নুরুলের ব্যাপারটা। একদিন দু’জনকে ধরে ফেললেন ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। গালাগাল-মারধোর করে তাড়িয়ে দিলেন নুরুলকে। লেখার অযোগ্য শব্দ ব্যবহার করলেন তালাতের উদ্দেশে।

নুরুল দিল্লি চলে গেলেন, চাকরি নিলেন Mumbai Trading & Co–তে। রমজান ভাবলেন, আপদ গেল। কিন্তু সম্পর্ক ততদিনে গড়িয়েছে অনেকদূর। ভৌগোলিক দূরত্বের সাধ্য ছিল না আর তাতে ইতি টানার। নিয়মিত চিঠির আদানপ্রদান চলতে থাকল তালাত-নুরুলের। সপ্তাহে অন্তত দু’বার ফোনেও প্রেমালাপ।

ভাই হাফিজ আলম সৈরানি এবং খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছে তালাতের ব্যাপারে বিষোদ্গার করতেন এমএলএ সাহেব। রমজান-তালাতের পারস্পরিক অবিশ্বাস আর তিক্ততা কোন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা বোঝা যায় দুটি নথি থেকে। প্রথমটা রমজানের ডায়েরির পাতা, যা উদ্ধার হয়েছিল কিষাণগঞ্জের বাড়ি থেকে। কিছু অংশ তুলে দিলাম।

‘আজ, ১৩/৪/৯২, বড় দুঃখের সাথে লিখছি। ভালবাসার ধারণাটাই বদলে গিয়েছে আমার।

লুকিয়ে লাভ নেই, আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে নিজের শারীরিক চাহিদা মেটাতে আমার স্ত্রী এমন একজনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, যার সঙ্গে মাত্র কয়েক বছরের আলাপ। এই অনাচার আমাকে সহ্য করতে হচ্ছে। দিনের পর দিন। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, যখন এই সেদিন ও আমাকে বলল, প্রয়োজনে আবার বিয়ে করবে!’

দ্বিতীয়টা নুরুলকে লেখা তালাত সুলতানার একটি চিঠি, যেটা তিনি পোস্ট করেননি। এটিও উদ্ধার হয়েছিল ওই কিষাণগঞ্জের বাড়ি থেকেই। উর্দু চিঠির অংশবিশেষ রইল বঙ্গানুবাদে।

‘ডিয়ার,

আদাব।

চিঠি পেয়েছি।

এত দুঃখ পাচ্ছি এখানে যে ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে দেখা করে সব দুঃখ হালকা করে নিই। লোকে ঠিকই বলে। অভীষ্টের খোঁজে আমরা এমন জায়গায় পৌঁছে যাই, যখন মনে হয় খুঁজতে খুঁজতে সব হারিয়ে ফেলেছি। ভয় হয়, তোমাকেও হারিয়ে ফেলব না তো? আমার জীবন বলতে তো তুমিই।’

ঘটনার পর আর দিল্লি ফেরেনি নুরুল। পালিয়েছিল বিহারে। জানুয়ারির শেষ থেকে পুলিশ বিহারের আনাচকানাচ চষে ফেলেছিল নুরুলের খোঁজে। একটা দল ঘাঁটি গেড়েছিল উত্তর দিনাজপুরে, অন্যটা বিহারে। মাসখানেক চোর-পুলিশ খেলার পর নুরুল ধরা পড়েছিল ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখে, রায়গঞ্জের শিলিগুড়ি মোড় থেকে।

জেরাতে নুরুল স্বীকার করেনি কিছু, গোয়েন্দারা অকাট্য পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হাজির করা সত্ত্বেও। অনড় থেকেছে নিজেকে নির্দোষ ঘোষণায়, যুক্তি-তর্ক কিছুই ধোপে টিকছে না দেখেও।

রেণুলীনা সুব্বার সাক্ষ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু কে জানে কেন, উনি FIR–এ তালাতের প্রাথমিক বক্তব্যকেই ঘুরিয়েফিরিয়ে সমর্থন করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। পুলিশ বুঝেছিল, সত্য গোপন করছেন। রেণুলীনা নিজেও জানতেন নিশ্চিত, আসলে কী ঘটেছিল। কিন্তু বলেননি, হাজার প্রশ্নবাণের মুখেও নড়েননি একটুও। তালাতকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, পরিষ্কার। কিন্তু কেন? উত্তর পাইনি আমরা। সব কিছু জানা যায় না।

দ্রুত চার্জশিট পেশের পর দীর্ঘ বিচারপর্ব চলেছিল। তীব্র বাদানুবাদের সাক্ষী থেকেছিল আদালত। তালাত-নুরুলের আইনজীবী দাবি করেছিলেন, এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। যে যুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ খুঁজে পায়নি আদালত। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ঠাসবুনোট বুনিয়াদ তৈরি করেছিলেন তদন্তকারী অফিসার।

খাজা হাবিব হোটেলের রেজিস্টারে খুনের আগের দিন নুরুলের হাতের লেখার সঙ্গে পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন সংগৃহীত ‘handwriting specimen’–এর মিলে যাওয়া। পিসিও বুথের কলকাতা-দিল্লি ফোনের খতিয়ান, বুথমালিকের শনাক্তকরণ তালাতকে। মনজুর আলমের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে নুরুলের এমএলএ হস্টেলে ঘটনার রাতে উপস্থিতি প্রমাণ হওয়া। তালাত, তদন্তে জানা গিয়েছিল, বেশ কয়েকবার নিউ মার্কেটের সাব-পোস্ট অফিস থেকে মানিঅর্ডারে টাকা পাঠিয়েছিলেন নুরুলকে। তার রসিদের প্রতিলিপি উভয়ের সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতে আদালতে পেশ হওয়া। উত্তর দিনাজপুরে জয়শ্রী কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্টিলাইজারের

সাব-ডিস্ট্রিবিউটরশিপ গোপনে নিয়েছিলেন তালাত-নুরুল। সংশ্লিষ্ট প্রমাণ হাজির করা সেই ব্যবসায়িক অংশীদারির। এবং সর্বোপরি রমজানের ডায়েরির পাতার আক্ষেপ আর তালাতের পোস্ট-না-করা প্রেমপত্র।

নিম্ন আদালত তালাত-নুরুলকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা শুনিয়েছিল। হাইকোর্ট যা বহাল রেখেছিল। দু’জনেই এখনও সংশোধনাগারে।

ঠিক কী ঘটেছিল সে-রাতে? নুরুল-তালাত স্বীকার করেননি, রেণুলীনা কৌশলে এড়িয়েছেন। কিন্তু এঁদের তিনজনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করে, সব দিক বিচার করে তদন্তকারী দলের যা নিশ্চিতভাবে মনে হয়েছিল, তা এরকম।

নুরুল কলকাতায় এসেছিলেন তালাতের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু বাইরে দেখা করায় ঝুঁকি ছিল অনেক। দু’জনে ঠিক করেছিলেন, রাতে রমজান ঘুমিয়ে পড়লে নুরুল হস্টেলের ঘরে আসবেন। রেণুলীনার রাত্রিবাসটা হিসেবের বাইরে ছিল। রাত্রি সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা নাগাদ গেটের বাইরের ‘সেন্ট্রি চেঞ্জ’ হচ্ছিল। পাহারা বদলের সময় নজরদারি একটু ঢিলেঢালা থাকেই। সেই সুযোগেই চাদরমুড়ি দিয়ে ঢুকেছিল নুরুল। ‘ভিজিটার্স রেজিস্টার’-এর দায়িত্বে যিনি ছিলেন রিসেপশনে, তাঁরও নজর এড়িয়ে গিয়েছিল।

তালাত দরজা খুলে রেখেছিলেন পৌনে এগারোটার পর। রমজান আর রেণুলীনা তার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বেন, নিশ্চিত ছিলেন। ঘুমিয়ে পড়েওছিলেন ওঁরা। এগারোটা নাগাদ সন্তর্পণে ঢুকলেন নুরুল। পরদা ঘেরা জায়গায় একান্তে দু’জনে সময় কাটানোই ছিল উদ্দেশ্য।

বাদ সাধল ফিসফিস কথার আওয়াজে রমজানের ঘুম ভেঙে যাওয়ায়। উঠে পড়লেন, গলা ছেড়ে আওয়াজ দিলেন। রমজান বুঝে ফেলেছিলেন, নুরুল এসেছে। এবং নুরুল জানত, যেখানেই পালান, পার পাবেন না। রমজান ক্ষমতাশালী লোক, ধনেপ্রাণে অতিষ্ঠ করে দেবেন জীবন। এরপর রমজানের গলায় ফাঁস দেওয়া নুরুলের। রেণুলীনার সঙ্গে তালাতকেও বেঁধে ফেলার নাট্যরূপ। নুরুল বেরিয়ে গিয়েছিল মেন গেট দিয়েই। প্রহরায় থাকা পুলিশ সন্দেহ করেনি। ভেবেছিল, ঢুকেছে যখন, বৈধভাবেই ঢুকেছে। বৈধ অতিথিকে আটকানোর কথাও নয় বেরনোর সময়।

রমজানের মৃতদেহ, গলায় ফাঁস লাগানো

রাজনীতির কোনও প্যাঁচপয়জার ছিল না রমজান-হত্যায়। খুন, কিন্তু ছক কষে নয়। সে তালাতই হন বা নুরুল, দাগি আসামি তো আর ছিলেন না। খুন-পরবর্তী-চিত্রনাট্যে ফাঁকফোকর থেকে গিয়েছিল বিস্তর। আবেগ আর আক্রোশের তাৎক্ষণিক তাড়নাই ছিল চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেপথ্যে, পোড়খাওয়া অপরাধীর স্থিরমস্তিষ্ক নয়।

সত্যের অন্বেষণই তদন্তের মূল কথা, “to ascertain the truth”। তবে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী যে বিলাসিতা দেখাতে পারতেন, তা আমাদের, বাস্তবের সত্যসন্ধানীদের থাকে না। এক এবং অদ্বিতীয় ব্যোমকেশ উৎসাহী ছিলেন অপরাধীর মনস্তত্ত্বে, সত্য উদ্‌ঘাটনে। শাস্তিবিধানে তাঁর নিবিড় মনোনিবেশ বড় একটা দেখি না আমরা। অপরাধীর বাধ্যবাধকতা বিচার করে কখনও কখনও অব্যাহতি দেন সত্যিটা জানা হয়ে যাওয়ার পর, স্বজ্ঞানে মুক্তি দেন পুলিশের হাত থেকে। বিবেকের শাসনে জীবনভর যন্ত্রণা পাওয়াকেই যথেষ্ট শাস্তি মনে করেন।

বাস্তবের গোয়েন্দা রক্তমাংসের, আইনের চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার অধিকার তাঁর নেই। তাঁকে বাধ্যত নিরাবেগ হতে হয়। অভিযুক্তকে ধরা, সাক্ষ্যপ্রমাণ একত্রিত করা এবং আদালতে চার্জশিট দাখিল করা শাস্তিবিধান চেয়ে। অনেক অপরাধই ঘটে যায় বিচিত্র পরিস্থিতির জাঁতাকলে। তদন্তকারী অফিসার যতই নৈর্ব্যক্তিক মানসিকতায় রহস্যভেদ করুন, কখনও কখনও সহানুভূতি বা সম-অনুভূতি মননে প্রভাব ফেলেই। সেই প্রভাবের ছোঁয়াচ কাটিয়ে নির্মোহ তদন্ত কোনও কোনও ঘটনায় নেহাত সহজসাধ্য নয়।

আক্রম সাহেব কি কখনও আক্রান্ত হয়েছিলেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে, যখন তদন্ত চলছিল মামলার, যখন একটু একটু করে পরদা উঠছিল রহস্যের? ভেবেছিলেন, কোন পরিস্থিতিতে, কোন মনস্তাপে তালাত এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন? কুড়ি বছর সংসারযাপনের পর, তিন সন্তানের জন্মদাত্রী হয়েও? কে জানে?

জল্পনায় লাভও নেই বোধহয়। কথাই তো আছে, “the more you know, the more you know you don’t know.”

যত বেশি জানবে, ততই বেশি জানবে, জানা হয়নি বিশেষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *