১.০৫ লাশই নেই, খুন কীসের?

লাশই নেই, খুন কীসের?

[অনুরাগ আগরওয়াল হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার দুলাল চক্রবর্তী]

—আবার বলছি মিস্টার আগরওয়াল, পুলিশকে কিছু জানাবেন না। জানালে পস্তাতে হবে। নাতিকে আর দেখতে পাবেন না কখনও।

—জানাব না। ওকে কিছু করবেন না মিস্টার গুপ্ত, প্লিজ়! বলছি তো, টাকা দেব। যা বলবেন, করব।

—বসুশ্রী সিনেমা চেনেন?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, হাজরা মোড়…

—রাইট। সন্ধে ৭টা ২০ নাগাদ গাড়ি নিয়ে আসবেন। বসুশ্রীর কাছে দাঁড় করাবেন। টাকা ব্রাউন পেপারে মুড়ে একটা চওড়া লাল রিবন দিয়ে বাঁধবেন। দেখে যাতে চেনা যায়।

—আচ্ছা… আমার এক কলিগ যাবে…দীনদয়াল উপাধ্যায়।

—ওঁকে বলবেন, গাড়ি থেকে নেমে টাকার প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মিনিটখানেক দাঁড়াতে। তারপর আবার গাড়িতে গিয়ে বসতে বলবেন। আমার লোক যাবে গাড়ির কাছে। তাঁকে প্যাকেটটা দিয়ে দিতে বলবেন।

—কিন্তু আমার নাতি…মালতু..

—টাকা পাই, নাতি কাল আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। পুরো আশিই আনছেন তো?

—হ্যাঁ, কিন্তু… একবার যদি ওর সঙ্গে কথা বলা যায়…

—ওকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ঘুমোচ্ছে।

—কিন্তু…

—কোনও কিন্তু নেই। আপনার সন্দেহ হচ্ছে তো, নাতি সত্যিই আমাদের কাছে কি না। টাকা নেওয়ার সময় আমার লোক আপনার নাতির রিস্টওয়াচটা দিয়ে দেবে আপনার লোকের হাতে।

—আচ্ছা আচ্ছা…

—তা হলে ওই কথাই রইল। পুলিশকে জানালে কিন্তু জেনে যাব, মনে থাকে যেন। সাতটা কুড়ি, বসুশ্রী। ঠিক আছে?

গুলমোহন ম্যানসন, ৬০ মিডলটন স্ট্রিট। ফ্ল্যাট নম্বর ৪৩, পাঁচতলায়। এখানেই দীর্ঘদিনের বাস আগরওয়াল পরিবারের। তেষট্টি বছর বয়সি দেবীলাল পরিবারের মাথা, French Motors-এর চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে কর্মরত। আগরওয়ালদের আদি বাড়ি উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরে। দুই ছেলে দেবীলালের। শৈলেন্দ্র আর মুরারিলাল। যাঁরা গোরখপুরেই থাকেন, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতির পারিবারিক ব্যাবসা দেখাশোনা করেন।

শৈলেন্দ্রর দুই মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েরা থাকে গোরখপুরেই, বাবা-মায়ের সঙ্গে। ছেলে অনুরাগ সবচেয়ে ছোট, ডাকনাম মালতু | কলকাতায় দাদু-ঠাকুমার কাছে থেকে পড়াশোনা করে। বয়স চোদ্দো, এলগিন রোডের জুলিয়ান ডে স্কুলে ক্লাস সিক্স, সেকশন ই। দেবীলালের ছেলেরা সপরিবারে মাঝে মাঝে আসেন কলকাতায়, সময় কাটিয়ে যান মা-বাবার সঙ্গে।

দাদু-ঠাকুমার নয়নের মণি অনুরাগ, বিশেষ করে দাদুর। চোখে হারান নাতিকে। মালতুও অসম্ভব ন্যাওটা দাদুর। যত রাগ-অভিমান-বায়না-আবদার ওই দাদুর কাছেই। বাবা-মা অনেকবার চেয়েছেন গোরখপুরে নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে, ওখানের স্কুলে ভরতি করে দিতে। অনুরাগ রাজি হয়নি | দেবীলাল মুখে কিছু বলেননি, কিন্তু নাতির ইচ্ছায় মনে মনে আহ্লাদিত হয়েছেন খুব।

সালটা ১৯৮৮। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে তীর্থযাত্রায় বেরলেন দেবীলাল। স্ত্রী অসুস্থ, একাই গেলেন। গোরখপুর থেকে সস্ত্রীক শৈলেন্দ্র চলে এলেন কলকাতায়, বড়মেয়ে সংগীতাকে সঙ্গে নিয়ে। বাবা যে ক’দিন বাইরে, মায়ের দেখাশোনার প্রয়োজন। তার উপর অনুরাগ রয়েছে।

অনুরাগের তখন পুজোর ছুটি চলছে। দুপুর-বিকেলে কাছেপিঠে প্রায় রোজই বন্ধুদের সঙ্গে এদিক-সেদিক ঘুরতে যেত। কখনও চিড়িয়াখানা, কখনও ভিক্টোরিয়া, কখনও জাদুঘর। ফিরে আসত সন্ধে নামার আগেই।

১২ অক্টোবর দুপুরে দিদি সংগীতা হঠাৎ খেয়াল করলেন, ভাই নিজের ঘরে নেই। কোথায় গেল? মা-কে জানালেন| খোঁজ খোঁজ। বহুতলের দারোয়ানের থেকে জানা গেল, অনুরাগকে দেখেছেন দুপুর একটা নাগাদ কাঁধে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে বেরতে| মা আর দিদি ভাবলেন, বন্ধুদের সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করতে গিয়েছে কোথাও। না জানিয়ে বেরনোর জন্য বাড়ি ফিরলে বকাবকি করবেন, ভেবে রাখলেন দু’জনেই।

কিন্তু ফিরলে তো? বিকেল পেরিয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত। ফিরল না অনুরাগ। স্কুলের বন্ধুদের বাড়িতে ফোন করা হল, শৈলেন্দ্র প্রতিবেশীদের নিয়ে চষে ফেললেন পার্ক স্ট্রিট-ভিক্টোরিয়া-চিড়িয়াখানা চত্বর-প্রিন্সেপ ঘাট-ইডেন গার্ডেন। নেই, কোত্থাও নেই। বিনিদ্র রাত কাটল আগরওয়াল পরিবারের।

পরের দিন সকালে দেবীলাল ফোন করলেন কলকাতার বাড়িতে, বাইরে গেলে রোজ যেমন করে থাকেন। শুনলেন দুঃসংবাদ, ছেলেকে বললেন অবিলম্বে পুলিশে মিসিং ডায়েরি করতে। এবং পত্রপাঠ রওনা দিলেন কলকাতায়। পার্ক স্ট্রিট থানায় ১৩ অক্টোবর জমা পড়ল অনুরাগের ছবি, ডায়েরির পর প্রাথমিক খোঁজখবর শুরু করল পুলিশ। আজ থানায় ছবি পাঠানো, কোথাও কোনও দুর্ঘটনা হয়েছে কি না ইত্যাদি।

১৪ অক্টোবর, সকাল ১০টা। দেবীলাল ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন গোরখপুরে। কলকাতার ট্রেন ধরবেন | হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকতে ঢুকতে রাত সাড়ে এগারোটা হবে। গোরখপুর স্টেশন থেকেই ফোন করলেন বাড়িতে। এবং খবর শুনে মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। গলা কাঁপছে শৈলেন্দ্রর, জানালেন, এক ঘণ্টা আগে ‘মিস্টার গুপ্ত’ নামে একজন ফোন করে জানিয়েছেন, অনুরাগকে তাঁরা কিডন্যাপ করেছেন। মুক্তির বিনিময়ে দাবি এক লাখ টাকা। পুলিশকে কিছু জানালে মালতুকে প্রাণে মেরে ফেলবে বলে হুমকিও দিয়েছেন |

ফের ফোন এলে একদিন সময় চেয়ে নিতে বললেন দেবীলাল| পরামর্শ দিলেন পুলিশকে এখনই কিছু না জানাতে| আরও বললেন, ব্যাংক থেকে তিরিশ হাজার টাকা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুলে নিতে। বন্ধুবান্ধবদের থেকে বাকিটাও জোগাড় করে রাখতে।

১৪ তারিখই ফোন এল আরও কয়েকবার। হুমকি, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে টাকা না পেলে মেরে ফেলা হবে অনুরাগকে। সঙ্গে রুটিন সতর্কবার্তা, পুলিশকে জানালে পরিণতি মারাত্মক হবে। শৈলেন্দ্র বললেন, বাবা বাইরে আছেন। একটু সময় চাই।

দেবীলাল বাড়িতে ঢুকলেন মাঝরাতে। অফিসের সহকর্মী আর আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভরতি। আশঙ্কা আর আতঙ্কে পুরো পরিবার প্রায় আচ্ছন্ন তখন। French Motors-এর সহকর্মীরা যে যত পেরেছেন, টাকা নিয়ে এসেছেন, শৈলেন্দ্র টাকা তুলেছেন ব্যাংক থেকে। দেখা গেল, আশি হাজার জোগাড় হয়ে গিয়েছে।

পরের দিনের সকাল, ১৫ অক্টোবর। ঠিক ন’টায় ফোন বাজল। অন্যদিকে মিস্টার গুপ্ত |

—কী ঠিক করলেন? বেশি সময় নেই আমাদের হাতে।

—আপাতত আশি হাজার দিচ্ছি। বাকিটা দু’-একদিনের মধ্যে দিয়ে দেব।

—হুঁ, টাকা রেডি রাখুন, কখন কীভাবে কোথায় দেবেন, সন্ধেবেলা জানিয়ে দেব।

—কিন্তু মালতুর সঙ্গে একবার…

—বলছি তো, টাকা পেলে পরশু দিন বিকেলে বাড়ি পৌঁছে যাবে।

কেউ কেউ বললেন, পুলিশে জানিয়ে রাখা যাক। রাতভর আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, টাকা দেওয়া হোক। মালতু আগে বাড়ি ফিরুক, তারপর পুলিশে জানানোর কথা ভাবা হবে। ঘরের ছেলের প্রাণ আগে, না অপরাধীর ধরা পড়া আগে? না কি টাকা আগে? আগে মালতু ফিরুক।

অপহরণের মামলায় এই এক মুশকিল। একবার নয়, বারবার দেখেছি আমরা। জানাজানি হয়ে গেলে, মিডিয়ায় প্রচারিত হয়ে গেলে অন্য কথা। কিন্তু যদি সেটা না হয়, জানতে না পারে কেউ পরিবার-পরিজন ছাড়া? মুক্তিপণ চেয়ে ফোন এলে, পুলিশকে জানালে অপহৃতকে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখালে, স্বাভাবিক দোলাচলে ভুগতে থাকে পরিবার। পুলিশকে জানাব কি জানাব না?

সত্যি বলতে, দোষও দেওয়া যায় না ভুক্তভোগী পরিবারকে| এ তো চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-শ্লীলতাহানি নয় যে অভিযোগ করে দিলাম, এবার পুলিশ যা করার করুক। প্রিয়জন জীবিত অবস্থায় অন্যের হেফাজতে বন্দি| এবং যে বা যাদের হাতে বন্দি, জানা নেই তারা কতটা বিপজ্জনক, কতটা মরিয়া। এমন অবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক স্তরে পুলিশে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকতেই পছন্দ করে অপহৃতের পরিবার, অভিজ্ঞতা আমাদের। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে প্রিয়জন বাড়ি ফেরার পরই পুলিশকে জানান, কেউ কেউ আদৌ জানানই না।

এক্ষেত্রেও ভয় পেয়েছিলেন আগরওয়াল পরিবার। পুলিশে জানালে পাছে ক্ষতি হয়ে যায় অনুরাগের, সেই আশঙ্কায় মুক্তিপণের টাকা দিয়েছিলেন। যখন জানালেন, তখন চূড়ান্ত ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, যা পূরণ হওয়ার নয়।

পুলিশের দিকটাও বলা দরকার। অভিযোগ যদি সাহস করে কেউ করেও ফেলেন অপহরণের, সাবধানে, খুব সাবধানে পা ফেলতে হয় পুলিশকে। মাথায় রাখতে হয়, অপরাধী তো ধরতে হবেই, কিন্তু নিরপরাধ প্রাণের মূল্যে নয়। অপহৃত ফিরে আসুক নিরাপদে, তারপর ঝাঁপানো যাবে, এই ভাবনা কাজ করেই। রক্ষণ মজবুত করে তবেই আক্রমণে যাওয়া। গ্রেফতার, মুক্তিপণের টাকা উদ্ধার, এসব পরেও হতে পারে, বিলক্ষণ সম্ভব। কিন্তু অপহৃতের প্রাণহানির ন্যূনতম ঝুঁকি থাকতে পারে, এমন কিছু করার আগে হাজারবার ভাবি আমরা|

ঠিক হল,বাড়ির বিশ্বস্ত ড্রাইভার ভবন শর্মাকে নিয়ে দেবীলালের দীর্ঘদিনের সহকর্মী দীনদয়াল উপাধ্যায় টাকা নিয়ে যাবেন। ফোন এল সাড়ে ছ’টায়| যা কথোপকথন হল, কাহিনির শুরুতে পড়েছেন। হাজরা মোড়ে রওনা হলেন দীনদয়াল উপাধ্যায়। যেমনটা নির্দেশ এসেছিল, অক্ষরে অক্ষরে মেনে। কতটুকুই বা দূরত্ব মিডলটন স্ট্রিট থেকে হাজরার? দীনদয়াল যখন পৌঁছলেন বসুশ্রীর সামনে, ঘড়িতে সাতটা দশ। মানে এখনও হাতে মিনিট দশেক। নেমে দাঁড়ালেন, হাতে প্যাকেট। ব্রাউন পেপারের, লাল রিবন দিয়ে বাঁধা। ভিতরে আশি হাজার নগদ| গাড়িতে গিয়ে বসলেন কয়েক মিনিট পর। ঘড়ির কাঁটা সোয়া সাতটা ছুঁয়ে ফেলেছে তখন।

দোকানবাজারের হইহল্লা, গাড়িঘোড়ার ভিড়ভাট্টা, অফিসফিরতি জনতা পিলপিল। ভরসন্ধের হাজরা মোড় গমগম করছে তখন, যেমন করে আজ-কাল-পরশু। কাঁটায় কাঁটায় সাতটা কুড়িতে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বছর দশেকের একটি ছেলে। খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন দীনদয়াল। নাহ্, চেহারায় বিশেষত্ব বলতে কিছু নেই। নোংরা শার্ট, ঢিলেঢালা হাফপ্যান্ট, পায়ে চটিও নেই। নেহাতই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, বুঝতে বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন নেই।

হাফপ্যান্টের পকেট থেকে একটা রিস্টওয়াচ বার করল ছেলেটি। দীনদয়াল হাতে নিয়ে দেখালেন ড্রাইভার ভবনকে| দেখেই ঘাড় নাড়ল ভবন, মালতু ভাইয়া কি হি হ্যায়। শুনে আর একটা কথাও খরচ করলেন না দীনদয়াল। হাতবদল হয়ে গেল ব্রাউন পেপারের প্যাকেট। যেটা নিয়েই দৌড় দিল ছেলেটি, মিশে গেল থিকথিকে ভিড়ে।

পৌনে আটটা নাগাদ মিডলটন স্ট্রিটে ফিরলেন দীনদয়াল। রিস্টওয়াচ দেখে আর এক প্রস্থ কান্নাকাটি শুরু হল। Citizen Quartz white dial, এ ঘড়ি মালতুরই। নিউ মার্কেট থেকে নাতিকে কিনে দিয়েছিলেন দাদুই| মা-দিদি-ঠাকুমার অঝোর কান্না থামালেন শৈলেন্দ্র, টাকা দেওয়া হয়েছে। মালতু কালই ফিরে আসবে। জানতেন না, ওই আশ্বাসবাণী কত ঠুনকো শোনাবে মাত্র এক ঘণ্টা পরে!

আগরওয়ালদের বাড়িতে ফোন বাজল রাত ন’টায়। তুললেন দেবীলাল, অন্যপ্রান্তে পরিচিত গলা। মিস্টার গুপ্ত।

—কী হল মিস্টার আগরওয়াল! টাকা তো পেলাম না।

—মানে? পেলেন না মানে? উপাধ্যায় প্যাকেট দিয়েছে একটা বাচ্চা ছেলের হাতে। ছেলেটা মালতুর ঘড়িও দিয়েছে।

—ছেলেটাকে আর খুঁজে পাচ্ছি না | চালাকি করবেন না আমাদের সঙ্গে।

—কী বলছেন আপনি? দিস ইজ় অ্যাবসোলুটলি ফলস। আপনি কথা দিয়েছিলেন, মালতুকে ছেড়ে দেবেন টাকা পেলে।

—টাকা পেলে দেব বলেছিলাম। টাকাই তো পাইনি!

ফোন কেটে দেওয়ার শব্দ পান দেবীলাল, বসে পড়েন মাথায় হাত দিয়ে|

এবার? কী করণীয়? ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল পরিবার। পুলিশকে জানাতেই হবে, রাস্তা নেই এ ছাড়া| মামলা দায়ের হল পার্ক স্ট্রিট থানায়। তদন্তের দায়িত্ব পড়ল গোয়েন্দা দফতরের তৎকালীন সাব-ইনস্পেকটর দুলাল চক্রবর্তীর উপর। যিনি সফল কর্মজীবনের শেষে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন।

অনুরাগ আগরওয়াল অপহরণ ও হত্যা মামলা। পার্ক স্ট্রিট থানা, কেস নম্বর ৬৩১, তারিখ ১৭ অক্টোবর, ১৯৮৮। ১২০ বি/৩৬৮/৩৮৪/৩০২/২০১ আইপিসি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, খুন এবং প্রমাণ লোপাট। এই মামলা, বহুব্যবহারে মরচে পড়ে যাওয়া তুলনাতেই বলি, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের টুপিতে উজ্জ্বল পালক। যে মামলা প্রসঙ্গে মাননীয় কলকাতা হাইকোর্ট মন্তব্য করেছিলেন, “The prosecution case as aptly observed by the learned Trial Judge reminds us of a story taken from a thriller.”

অনুরাগ আগরওয়াল

ঘটনা আটের দশকের শেষাশেষির। যাঁরা এখন চল্লিশের কোঠায়, তাঁরা নিশ্চয় ফিরে দেখতে পাবেন সময়টা, অনায়াসে। আজকের মতো হাজার খানেক টিভি চ্যানেল ছিল না তখন। ছিল না ২৪ x ৭ শুধু সিরিয়াল-সিনেমার জন্যই নির্দিষ্ট গোটা পঞ্চাশ বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি চ্যানেল। খেলা বা খবরের জন্যও বরাদ্দ থাকত হাতে গোনা গুটিকয়েক। সপ্তাহে একদিন হাপিত্যেশ করে বসে থাকা ‘চিত্রহার’-এর অপেক্ষায়। হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় গানের অনুষ্ঠান। শেষ হয়ে গেলে আক্ষেপ, মাত্র চার-পাঁচটা গান দেয়, এত বিজ্ঞাপনের কী দরকার? স্কুল-কলেজ-পাড়ায় আলোচনা অবধারিত পরের দিন, এ বারেরটা জমল না তেমন, বা শেষ গানটায় পয়সা উসুল!

তখন সিরিয়াল বলতে ’৮৪-র ‘হামলোগ’, ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাসে প্রথম সোপ অপেরা। যা আবির্ভাবেই তুমুল জনপ্রিয়। প্রতি এপিসোডের শেষে অশোককুমারের কয়েক মিনিটের ভাষ্য আর অননুকরণীয় ‘হামলোগ’ দিয়ে শেষ করা। বছর দুয়েক পরে বোকাবাক্সের পরদা দখল করবে ‘বুনিয়াদ’, দেশ ভাগের পটভূমিতে তৈরি সিরিয়াল | অলোকনাথ আর অনিতা কানওয়ারের হাত ধরে ‘মাস্টারজি’ আর ‘লাজোজি’ ঢুকে পড়বেন আম ভারতীয় পরিবারের হেঁসেলে। সোপ অপেরার সৌজন্যে হাট করে খুলে যাবে বহুদিনের বন্ধ থাকা একটা দরজা। যার জেরে পরের কয়েক দশকে ভারতীয় টেলিভিশনে আছড়ে পড়বে সিরিয়াল-সুনামি।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, উপরের দুটো অনুচ্ছেদ বাড়তি মনে হতে পারে। কিন্তু প্রেক্ষিতের স্বার্থে প্রয়োজন ছিল। অনুরাগের কথায় ফিরি। জন্ম ’৭৪-এ। বেঁচে থাকলে বয়স হত মাঝচল্লিশ। সিরিয়াল-সিনেমার আকর্ষণ কৈশোরে অনেকেরই থাকে। অনুরাগেরও ছিল, কিন্তু অস্বাভাবিক বেশি মাত্রায়। টিভির পোকা বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। সিরিয়াল-সিনেমা দেখা অনুরাগের কাছে ছিল সাধনার মতো। ডায়লগ মুখস্থ করত, ঘরে অভিনয় করত আয়নার সামনে, পড়াশোনা–খেলাধুলোর মতো নেহাতই ‘তুচ্ছ’ জাগতিক বিষয়ে মাথা ঘামাতে তীব্র অনীহা ছিল বছর চোদ্দোর কিশোরের। আশা-আকাঙ্ক্ষা-সাধ-আহ্লাদ বলতে একটাই, রুপোলি পরদায় মুখ দেখানো। সেটাই কাল হবে, কে ভেবেছিল?

কারা করেছিল অপহরণ? কীভাবে? কাহিনি পিছিয়ে যাক কয়েক মাস আগে, কিডন্যাপ-কাণ্ডের পান্ডাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

দেবাশিস ব্যানার্জি, বয়স তখন তিরিশ ছাড়িয়েছে| বাড়ি তিলজলার সি এন রায় রোডে। জীবিকা বলতে ছোটখাটো অর্ডার সাপ্লাই। বাবা মারা গিয়েছেন, মা কিছু টাকা পেনশন পান ‘পলিটিক্যাল সাফারার’ হিসেবে। মধ্যবিত্ত পরিবার, সচ্ছল নয় একেবারেই। যাদবপুরে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন দেবাশিস। সেখানেই ’৮৬ -তে আলাপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কাবেরীর সঙ্গে। আলাপ গড়াল প্রেমে, ’৮৮–র জানুয়ারিতে দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল বিয়ের।

বিয়ের খরচাপাতির ব্যবস্থা করতে গিয়ে টাকাপয়সার সমস্যা দেখা দিল। কিন্তু সব পাকাপাকি হয়ে গিয়েছে, দিন আর পিছনো যায় না। বিয়েতে ধারদেনা হল কিছু। যা ক্রমে বাড়তে থাকল বিয়ের পর, লোকলৌকিকতা ইত্যাদিতে। ব্যবসাতেও মন্দা চলছে তখন। সংসার চালাতে দেবাশিসের নাভিশ্বাস উঠল মাসছয়েকের মধ্যেই। মেজোশ্যালক রেলে কনট্র্যাক্টর ছিলেন, চেষ্টা করলেন দেবাশিসকে কিছু অর্ডার পাইয়ে দেওয়ার। সুবিধে হল না তেমন। শ্যালকের থেকে দেবাশিস ধারও নিলেন হাজার বিশেক, শোধ করতে পারলেন না। কাবেরী প্রায়ই দুঃখ করতেন, দাদার টাকাটা ফেরত দিয়ে দাও, বাপের বাড়িতে লজ্জায় মাথা কাটা যায় আমার।

কসবার মসজিদবাড়ি লেনে থাকতেন দেবাশিসের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিজন বড়ুয়া, বিজ্ঞানের স্নাতক। প্রাইভেট টিউশন এবং একটি ওষুধের দোকানে টুকটাক কাজ করেই যাঁর দিনগুজরান। অবিবাহিত, একাই থাকেন। আর্থিক অবস্থা করুণ বিজনেরও। ধারদেনা তাঁরও বিস্তর।

দুই বন্ধু সান্ধ্য আড্ডায় প্রায়ই ভাবতেন, এভাবে তো আর চলে না, দেনার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে কতদিন আর টানা যাবে এভাবে? টাকার দরকার, কিন্তু কে দেবে? রাতারাতি লটারি লেগে যাবে, এমন সম্ভাবনা নেই। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই পোষাবে না। তা হলে? কথায় কথায় একদিন মাথায় এল, কিডন্যাপিং করলে কেমন হয়? চটজলদি বড়লোক হওয়ার আর তো কোনও উপায় দেখা যাচ্ছে না।

ছক কষা শুরু করলেন দুই বন্ধু। কয়েকটা ব্যাপার ঠিক করে নিলেন প্রথমেই। এক, বিশাল ধনী কোনও পরিবারের ছেলেকে টার্গেট করা ঝুঁকির হয়ে যাবে। কাগজে বেরবে, জানাজানি হবে, পুলিশ ঝাঁপাবে। তার চেয়ে ভাল, মোটামুটি সম্পন্ন পরিবারের কাউকে কিডন্যাপ করা। টাটা–বিড়লা জাতীয় নয়, কিন্তু মুক্তিপণ দেওয়ার মতো টাকা আছে, এমন। দুই, যা করতে হবে, ভুলিয়েভালিয়ে। জোরজার করে নয়। তিন, অপহৃতকে রাখার জায়গা চাই। দেবাশিস বললেন বিজনের বাড়িতে রাখার কথা। বিজন শুরুতে গররাজি হলেও মেনে নিলেন শেষ পর্যন্ত| চার, কিছু সরঞ্জাম চাই। মুখ বাঁধার জন্য লিউকোপ্লাস্ট কিনলেন দেবাশিস, বাগরি মার্কেট থেকে air purifier mask। ভাবনা, কিডন্যাপ করার পর এই ঢাকনা মুখে পরিয়ে দিয়ে উপরে ফোঁটা ফোঁটা ক্লোরোফর্ম ঢালবেন, যা অপহৃতের নাকে ঢুকবে। তাতে ব্যাপারটা নিরাপদ থাকবে। কতটা দিতে হবে জানা নেই, ডোজ় বেশি হয়ে গেলে যদি ঘুমই না ভাঙে? বিজন জোগাড় করলেন pethidine ইঞ্জেকশন আর ক্লোরোফর্ম। পাঁচ, সম্ভাব্য শিকার খুঁজবে কে? টিউশনির ফাঁকে সময় বের করা মুশকিল বিজনের, খোঁজার ভার নিলেন দেবাশিস।

শিকারের সন্ধানে পরের সপ্তাহদুয়েক এসপ্ল্যানেড, নিউমার্কেট, পার্ক স্ট্রিট, বালিগঞ্জ, আলিপুরে দিনভর ঘুরে বেড়াতেন দেবাশিস। বড়লোকরা তো এসব জায়গাতেই থাকে অধিকাংশ। কিন্ত ওভাবে কি হয়? অনেক ঘুরেফিরেও সুবিধে হচ্ছিল না। টার্গেট চিহ্নিত করছেন হয়তো, কিন্তু আলাপ জমাতে পারছেন না। প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মুখে যখন, এক সন্ধ্যায় আচমকাই সন্ধান পেলেন সম্ভাব্য শিকারের।

২ অক্টোবর। বিকেল-সন্ধের মাঝামাঝি তখন। এসপ্ল্যানেড থেকে যতীন দাস পার্কের টিকিট কেটে দেবাশিস প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছেন। দেখলেন, একটু দূরেই দাঁড়িয়ে দুটি ছেলে | দু’জনেরই বয়স তেরো-চোদ্দো হবে। ধোপদুরস্ত জামাকাপড়। দেবাশিস কান পাতলেন। দু’জনেই সিনেমা আর সিরিয়ালের গল্পে মগ্ন। ট্রেন এল। দুই কিশোরের পিছুপিছুই ট্রেনে উঠলেন। বসলেন ওদের পাশেই। গল্প তখনও লাগাতার চলছে সিনেমার।

“পরবর্তী স্টেশন পার্ক স্ট্রিট, আগলা স্টেশন পার্ক স্ট্রিট, দ্য নেক্সট স্টেশন ইজ় পার্ক স্ট্রিট।” ঘোষণা হতেই উঠে দাঁড়াল দু’জন। উঠে পড়লেন দেবাশিসও, ওদের সঙ্গেই নামলেন পার্ক স্ট্রিটে। প্ল্যাটফর্মেই আলাপ জমালেন দেবাশিস।

—এক্সকিউজ় মি, তোমাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

—বলুন।

—আমি এইচ কে গুপ্ত। টিভি সিরিয়াল বানাই। একটু কথা বলতাম। তার আগে তোমাদের নামটা জানা দরকার।

—আমি অনুরাগ, অনুরাগ আগরওয়াল। আর ও সমীর প্যাটেল। সিরিয়ালের ব্যাপারে কী বলছিলেন…

—আসলে আমি একটা সিরিয়াল বানাচ্ছি। ‘সফেদ ধাগে’। একজন টিন-এজারের গল্প। অ্যাক্টর খুঁজছি, পাচ্ছি না। তোমাকে দেখে মনে হল, রোলটায় ভাল মানাবে। অবশ্য তুমি যদি রাজি থাকো, তবেই…

—কী বলছেন? আমরা রাজি, আর কে কে আছে সিরিয়ালে?

দেবাশিস বুঝতে পারেন, শিকার টোপ গিলেছে, এখন শুধু প্ল্যানমাফিক বঁড়শিতে গাঁথার অপেক্ষা।

—সব বলব, কিন্তু দু’জনকে তো নিতে পারব না। অনুরাগ এই ছবিটার জন্য পারফেক্ট। সমীর, তোমারটা পরের ছবিতে ভাবব। কিন্তু তোমার বাড়ির লোকজন রাজি হবেন তো অনুরাগ?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, হবে। শুরুতে বলব না, সিরিয়াল টেলিকাস্টের আগে সারপ্রাইজ় দেব।

—আসলে শুটিংয়ে কী হয় জানো, টাইমের ঠিক থাকে না কোনও। যখন-তখন ‘কল টাইম’ থাকে। তোমার বাড়িতে অ্যালাও করবে কি?

—ও আমি ম্যানেজ করে নেব আঙ্কল। সিরিয়াল কবে থেকে দেখাবে টিভিতে?

দেবাশিস হাসেন, পিঠে হাত রাখেন অনুরাগের।

—হবে হবে। তোমার পুজোর ছুটির মধ্যেই শুটিং সেরে ফেলব। এখন বাড়ির কাউকে কিছু না বলাই ভাল।

—বলব না আঙ্কল, নিশ্চিন্তে থাকুন।

অনুরাগের বাড়ি কোথায়, কে কে আছেন, কে কী করেন, টেলিফোন নম্বর কী, সব কথার মাঝে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন দেবাশিস। বললেন, ফোনে যোগাযোগ করবেন। সঙ্গে যোগ করলেন, বাড়ির অন্য কেউ ফোন ধরলে কিন্তু কেটে দেবেন। অনুরাগের গলা পেলে তবেই কথা বলবেন। না হলে বাড়ির লোক জেনে যাবে, আর জেনে গেলে অভিনয়ের অনুমতি না-ও দিতে পারেন। সকাল দশটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে করবেন আঙ্কল, আমিই ধরব, আশ্বস্ত করল অনুরাগ|

সন্ধেবেলা বিজনের বাড়িতে বসে প্ল্যান হল, কাজটা পরের দিনই সেরে ফেলতে হবে। ৩ অক্টোবর বেলা এগারোটা নাগাদ রাসেল স্ট্রিটের পোস্ট অফিস থেকে ফোন গেল অনুরাগের বাড়ি। দুটো নাগাদ ময়দান স্টেশনে আসতে বলা হল অনুরাগকে, তড়িঘড়ি চলেও এল অভিনয়ের স্বপ্নে বিভোর কিশোর।

দেবাশিস বললেন, ‘তোমার ‘লুক টেস্ট’ হবে আজ, ক্যামেরাম্যানের বাড়ি যাই চল।’ নিয়ে গেলেন বিজনের বাড়ি, এদিক–ওদিক চক্কর কেটে ঘুরপথে, যাতে চট করে আবার কখনও চিনে আসতে না পারে। বিজনের পরিচয় দিলেন ক্যামেরাম্যান হিসাবে, নাম মিস্টার রায়।

‘সফেদ ধাগে’ সিরিয়ালের বানানো গল্প শোনানো হল অনুরাগকে। বিজন ক্যামেরা নিয়ে নানা পোজ়ে ছবি তুললেন কিশোরের। আসল ‘কাজ’টা কিন্তু দেবাশিস-বিজন করে উঠতে পারলেন না সেদিন। সাহসে কুলোল না। পৌনে পাঁচটা নাগাদ অনুরাগ বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, মা-বাবা চিন্তা করবে এবার। দেবাশিস কালীঘাট স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ময়দান স্টেশনের টিকিট কেটে দিলেন।

পরের সাক্ষাতের দিন ঠিক হল ফোনমারফত। ৪ অক্টোবর, কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে। দুপুর একটায়। ফের বিজনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল অনুরাগকে। ঘটনাচক্রে সেদিন কোনও প্রতিবেশীর বাড়িতে সামাজিক অনুষ্ঠান, দিনভর আনাগোনা লোকজনের, হইচই | সেদিনও হল না, ফিরে গেল অনুরাগ, কিছু কাল্পনিক দৃশ্য অভিনয় করে দেখানোর পর।

সে-রাতে বিজন বললেন দেবাশিসকে, এভাবে ছেলেটাকে বারবার বাড়িতে আনা ঝুঁকির হয়ে যাচ্ছে। পাড়ার কিছু লোকজনের চোখে তো পড়ছেই। যা করার, খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর দেরি করাটা মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে যাবে।

ঠিক হল, ৬ তারিখ দুপুরে ফের ডাকা হবে অনুরাগকে। আর সেদিনই এসপার-ওসপার।

৬ অক্টোবর, দুপুর দেড়টা। কথা হয়েছিল ফোনে আগেই। অনুরাগকে নিয়ে দেবাশিস কসবায় পৌঁছতেই বিজন বললেন, ‘শুটিং শুরু পরের সপ্তাহে, আজকে তো ফাইনাল ‘লুক টেস্ট’। কিন্তু তোমার মুখটা তো একদম রোদে পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। এতে তো চলবে না ভাই।’

অনুরাগ শুনেই ভীষণ মুষড়ে পড়ল। সাজানো চিত্রনাট্যে দেবাশিস-বিজনের পরের সংলাপ হল এরকম।

—মিস্টার রায়, চেহারায় ‘গ্লেজ়’ ফিরিয়ে আনার ওই ইঞ্জেকশনটা দিলে হয় না?

—মন্দ বলেননি, কিন্তু ঘুম পাবে তো একটু। অবশ্য ঘণ্টাখানেক মাত্র। তারপর উঠে পড়বে, মুখে ‘গ্লেজ়’ ফিরে আসবে। ফ্রেশ লাগবে অনেক।

অনুরাগ লাফিয়ে উঠল।

—দিন আঙ্কল, দিন। ইঞ্জেকশনটা দিন প্লিজ়।

Pethidine ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। ডিসপোজ়েবল সিরিঞ্জ দেবাশিস কিনে রেখেছিলেন। ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ কাটল | কিন্তু যাকে বলে ‘Deep Sleep’, তাতে তলিয়ে গেল না অনুরাগ। ঘুমঘুম আচ্ছন্ন ভাব, কিন্তু জেগে। ঘণ্টাখানেক পর উঠেই বসল অনুরাগ।

—আঙ্কল, ছবি তুলে নিন এবার।

ছবি তোলা হল। ততক্ষণে সন্ধে নেমেছে প্রায়। পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াদের একজন পাড়ার কালীপুজোর ব্যাপারে কথাও বলতে এসেছেন। কাজ হাসিল সেদিনও হল না। অনুরাগকে মেট্রোতে ছেড়ে দিতে গেলেন দেবাশিস। রাসবিহারী মোড়ের PCO থেকে বাড়িতে মা-কে ফোন করল অনুরাগ, ‘একটু দেরি হচ্ছে। চিড়িয়াখানা গিয়েছিলাম। সমীরদের গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গিয়েছিল। চিন্তা কোরো না। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।’

‘অপারেশন কিডন্যাপ’ বারবার তিনবার ফেল। সেই রাতে বিজন পরিষ্কার জানালেন দেবাশিসকে, তাঁর বাড়িতে আর সম্ভব নয়। ছেলেটাকে অনেকে দেখেছে, চিনে ফেলেছে। কৌতূহল বাড়ছে পাড়াপ্রতিবেশীর। কিডন্যাপের পর রাখার অন্য জায়গা খোঁজা দরকার।

হাওড়ার বালিতে দেবাশিসের এক পরিচিত ছিল। নাম পল্লব মুখার্জি ওরফে পলু। কাজকর্ম বলতে টুকটাক জমির দালালি, বাকি সময় এলাকায় দাদাগিরি। পরের দিনই বালি গিয়ে প্ল্যান খুলে বলা হল পলুকে। সব শুনেটুনে পলু বলল, ‘জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে পারে ঘাসবাগানের অশোক রাই ওরফে ভোদা | তোমরা ১১ তারিখ এসো একবার, তার মধ্যে আমি কথা বলে রাখছি। হাওড়া স্টেশনের কফি কর্নারে বেলা এগারোটা নাগাদ দেখা হবে।’

১১ অক্টোবর। পলুর সঙ্গে কফি কর্নারে অপেক্ষা করছিল আর একটি ছেলে। এর নাম গোপাল, গোপাল সরকার | একে সঙ্গে রাখলে কাজের সুবিধে হবে— আলাপ করিয়ে দিল পলু | চারজনে মিলে ঘাসবাগানে যাওয়া হল ভোদার সঙ্গে দেখা করতে। বহু গলিঘুঁজি পেরিয়ে ভোদার বাড়ি। কথা হল। দেবাশিস-বিজন অল্পক্ষণেই বুঝলেন, ভোদা অপরাধের দুনিয়ায় জলের মাছের মতোই স্বচ্ছন্দ। হাওড়ার নটরাজ হোটেলের কাছে গম বিক্রি করে। এহ বাহ্য | আসলে এলাকার নামকরা মস্তান, দুর্দান্ত দাপট আছে |

টাকাপয়সার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে কথা হল। কিডন্যাপের পর অপহৃতকে রাখার জায়গা দেখাতে নিয়ে চলল ভোদা। কাছেই একটি নুনের গোলা, বিশাল এলাকা জুড়ে | পরিত্যক্ত, নির্জন। অনেক ঘর, এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার জন্য আঁকাবাঁকা গলিপথ | ভুলভুলাইয়ার সঙ্গে টক্করে জিততে না পারলেও লড়াই দেবে | ভোদা বিড়ি ধরিয়ে বলল, ‘এটাই ফিট জায়গা। কেউ টের পাবে না। রাতে কোনও পাহারা থাকে না। এখানে রাখতে গেলে তোমাদের দু’জনকেই পালা করে পাহারা দিতে হবে। আমার লোক পাহারা দেবে না।’

বিজন-দেবাশিস শত হলেও দাগি আসামি তো নন, একটু ঘাবড়ে গেলেন। বিজন বললেন, এই হানাবাড়িতে রাতভর একা পাহারা? অসম্ভব! দেবাশিস সায় দিলেন, অন্য জায়গা হলে ভাল হয়।

ভোদা ফ্রন্টফুটের প্লেয়ার। ব্যাকফুটের কোনও অস্তিত্বই নেই চিন্তাভাবনায় | হেসে আরেকটা বিড়ি ধরাল। বোঝা গেল, জায়গার অভাবটা কোনও সমস্যাই নয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সদলবলে পৌঁছল কাছেই Dikshit Transport Company-র গোডাউনে। কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে মাসছয়েক আগে। একজন দারোয়ান আছে, নাম ভগবতী| ভরদুপুরেই যার মুখ থেকে মদের গন্ধ ছিটকে বেরচ্ছে ভকভক| পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি চোলাই মদ বেচা শুরু করেছে ইদানীং।

ভগবতী চাবি দিয়ে দিল এক কথায়। গুদামঘরটা বেশ বড়। নানা মাপের কাঠের প্যাকিং বক্স রাখা। বেশ পছন্দ হয়ে গেল দেবাশিস-বিজনের। হ্যাঁ, এটা চলবে।

এই সেই গুদামঘর

দু’জনে রওনা হয়ে গেলেন কলকাতায়। পরের দিন সকাল দশটায় অনুরাগের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বলা হল দুপুর দেড়টা নাগাদ কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে আসতে। দিনটা ১২ অক্টোবর। নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি থেকে কাউকে না জানিয়ে বেরল অনুরাগ| ‘হিরো’ হওয়ার স্বপ্নে মাতোয়ারা কিশোর, দূরতম কল্পনাতেও ভাবেনি, আর ফেরা হবে না।

অনুরাগকে নিয়ে দু’জনে প্রথমে গেলেন চাঁদপাল ঘাট, তারপর লঞ্চে গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়ায়। অনুরাগকে বললেন, হাওড়ায় একটা গোডাউনে শুটিং-এর লোকেশন। গোপাল ওপারের ঘাটে অপেক্ষা করছিল। দূর থেকে দেখেই রওনা হয়ে গেল পলু আর ভোদাকে খবর দিতে। বেলা তখন সাড়ে তিনটের কাছাকাছি।

দেবাশিস-বিজন যখন অনুরাগকে নিয়ে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির গুদামের রাস্তায়, গোপাল পথ আটকাল। দেবাশিসদের আলাদা ডেকে বলল, সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দিনের আলোয় গোডাউনে ঢোকা যাবে না। লঞ্চঘাটে ফিরে অপেক্ষা করতে লাগলেন দেবাশিস-বিজন-গোপাল। এবং অনুরাগ। যে এতক্ষণে একটু অস্থির হয়ে পড়েছে, বলছে, বাড়িতে সন্ধের মধ্যে ফিরব বলে এসেছি। মা-বাবা খুব চিন্তা করবে। দেবাশিস আশ্বস্ত করলেন, টেকনিক্যাল সমস্যার জন্য দেরি হচ্ছে। কোনও চিন্তা নেই, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব আমরা। মা-বাবাকে বুঝিয়ে বলব।

দিন তো গেল, সন্ধে হল | অনুরাগকে নিয়ে তিনজন ফের রওনা দিল গোডাউনে। পলু ও ভোদা ভিতরে অপেক্ষা করছিল। ঢুকেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অনুরাগ। এ কোথায় এলাম? এখানে শুটিং হবে? ক্যামেরা কই, আলো কই, টেকনিশিয়ানরা কই? আর ওই দু’জন কারা? লুঙ্গি পরে বসে আছে, সামনে গ্লাস, বিশ্রী গন্ধ বেরচ্ছে মুখ থেকে? একটা প্যাকিং বক্স উঁচু করে রাখা একধারে। উপরে চট ও চাদর পাতা। একটা ছোট ল্যাম্প জ্বলছে টিমটিম। বিজনরা ঢুকতেই ভোদা দরজা বন্ধ করে দিল গোডাউনের, চাবি দিয়ে দিল ভিতর থেকে। দারোয়ান ভগবতী তখন বাইরে, চোলাইয়ের খদ্দেররা আসতে শুরু করেছে।

এই গুদামঘরে অনুরাগকে মারা হয়েছিল

ব্যাপারস্যাপার দেখে ভয় পেয়ে গেল অনুরাগ। কেঁদেই ফেলল দেবাশিসের হাত জড়িয়ে ধরে, ‘আঙ্কল, বাড়ি যাব | আমাকে প্লিজ় নিয়ে চলুন এখান থেকে। আমি অভিনয় করতে চাই না।’

দেবাশিস-বিজন তখন কিছুটা বিভ্রান্ত। ঠিক কীভাবে এগোবেন, বুঝতে পারছেন না। ভোদা ব্যাপারটা বুঝে দায়িত্ব নিয়ে নিল, এরপর চিল্লামিল্লি করবে, বেঁধে ফেল।

পাঁচজনে ঘিরে ধরে মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দেওয়া হল অনুরাগের, বেঁধে ফেলা হল হাত-পা। প্যাকিং বক্সের উপর শুইয়ে দিয়ে air purifier mask-এর মধ্যে কয়েক ফোঁটা ক্লোরোফর্ম দিয়ে নাকের কাছে ধরা হল। একটা ঝিমুনি ভাব এল ঠিকই, কিন্তু অচৈতন্য নয়।

সে-রাতে পাহারায় থাকল বিজন। ঠিক হল, ভোদা আর পলু রাতে মাঝেমাঝে এসে দেখে যাবে, কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না। দেবাশিস কলকাতায় চলে এলেন সে-রাতে। পরের দিন, ১৩ অক্টোবর, ফিরে এলেন সন্ধেবেলায়। বিজন বললেন, ‘কোনও কাজ হয়নি ক্লোরোফর্মে, সারারাত ছটফট করেছে অনুরাগ।’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘ফোন করেছ আগরওয়ালদের?’ দেবাশিস বললেন, ‘করব, কাল।’

বিজন এবার ফিরে গেলেন কলকাতায়। সে-রাতে পাহারার পালা দেবাশিসের। সন্ধেবেলা গুদামঘরে তখন গোপাল-পলু-ভোদা-দেবাশিস। ভোদা বখরার টাকার দাবি করল। এখনও জোগাড় হয়নি শুনে খেপে গিয়ে বলল, ‘এমন তো কথা ছিল না! আমি আগে টাকা না নিয়ে কোনও কাজে হাত দিই না। পলু বলেছিল বলে করেছিলাম। ২/৩ দিন ওয়েট করব, তার মধ্যে টাকা না পেলে…।’ কথা শেষ করল না ভোদা, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে রক্ত হিম হয়ে গেল দেবাশিসের।

রাত বাড়ল। ভোদা একটা দোকানে নিয়ে গেল বাকি তিনজনকে। ডিনারে মশলা ধোসা, শেষ পাতে কুলফি। দেবাশিস পয়সা দিতে গেলেন, ভোদা থামিয়ে দিল, ‘আমার কাছে পয়সা চাওয়ার হিম্মত এ তল্লাটে কারও নেই। কেউ কথা বলে না আমার উপর।’

ফেরা হল গুদামে | তখন প্রবল ছটফট করছে অনুরাগ, কাঁদছে। মুখ বাঁধা থাকায় আওয়াজ বেরচ্ছে না, কিন্তু জল পড়েই চলেছে চোখ দিয়ে। পলু বলল, ‘ব্যাপারটা কিন্তু খারাপ দিকে যাচ্ছে। কলকাতার ছেলে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। টাকা যদি পেয়েও যাই, একে ছেড়ে দিলে সব বলে দেবে। মুখ তো চিনেই ফেলেছে। ধরা পড়লে লাইফ বরবাদ হয়ে যাবে।’

ভোদা সায় দিল, ‘সবার আগে দেবাশিস তোমরা ফাঁসবে। আনাড়ি মালের সঙ্গে কাজ করার এই মুশকিল। আমার জেলখাটা অভ্যেস আছে। ও ঠিক বেরিয়ে আসব কয়েক মাসের মধ্যে। তুমি আর বিজন সারা জীবনের মতো ভোগে।’

পলু বলল, ‘ভোদা ঠিক বলছে, একে বাঁচিয়ে রাখলে বিপদ।’

দেবাশিস এসব শুনে দিশেহারা তখন। অনুরাগের ছটফটানি, ভোদা-পলুর ভয় দেখানো, সব মিলিয়ে পাগল-পাগল অবস্থা। ঠিক, বাঁচিয়ে রেখে আর লাভ নেই, বলে দেবাশিসই প্রথমে চড়ে বসলেন অনুরাগের বুকের উপর। ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকিরাও। গলায় গামছা দিয়ে ফাঁস দিল ভোদা, পা চেপে ধরল পলু-গোপাল। ছটফটানি থেমে গেল অনুরাগের, অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই।

এবার? অনুরাগ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সাদা স্ট্রাইপড শার্ট আর খয়েরি ট্রাউজ়ার পরে। পায়ে ছিল চটি। হাতে সোনার আংটি ছিল, গলায় সোনার চেন | সঙ্গে নিয়ে ছিল একটা ব্যাগ। যাতে ক্রিম রংয়ের শার্ট আর ট্রাউজ়ার ছিল, শুটিং-এ ইস্ত্রি করা ভাল জামাকাপড় পরবে, সম্ভবত এই ভেবেই। কালো সানগ্লাস ছিল, ছিল একটা ক্যামেরাও। হলুদ রঙের টুপি ছিল ব্যাগে, একটা খাতা-পেনসিলও নিয়েছিল। যদি ডায়লগ টুকে রাখতে হয়, এমনটাই ভেবে ছিল হয়তো। একটা মানিব্যাগ ছিল পকেটে, ভিতরে একটা কুড়ি টাকার নোট। আর ছিল একপাতা ভিটামিন ক্যাপসুল, যা দাদুর কথায় খেত রুটিন মাফিক।

যা পরে ছিল অনুরাগ, জ্বালিয়ে দেওয়া হল সব। ব্যাগের শার্টপ্যান্ট নিলেন দেবাশিস, পরের দিন রেখে এলেন বিজনের বাড়িতে| ক্যামেরাটাও দেবাশিসই নিয়েছিলেন, বেচে দিয়েছিলেন পরে। বিক্রির টাকা ভাগ করে নিয়েছিলেন পল্লব আর বিজনের সঙ্গে। গোপাল নিল সানগ্লাস। ওষুধের পাতাটা পল্লব রেখে দিল পকেটে।

ভোদাই ব্যবস্থা করল দেহ লোপাটের। বস্তায় অনুরাগের দেহ ভরে বেঁধে ফেলল দড়ি দিয়ে। রাত গভীর হলে সবাই রওনা হল গঙ্গার ঘাটে, গলির গলি তস্য গলি দিয়ে, নুনগোলার পাঁচিল টপকে। ভোদাই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পায়ে চোট লাগল দেবাশিসের।

বস্তাবন্দি দেহ নিয়ে পলু ও গোপাল গঙ্গায় নামল। সাঁতরে কিছু দূর গিয়ে ভাসিয়ে দিল জলে। সেদিন ছিল চতুর্থী। দেবীর বোধনের আগেই পুজোর মরশুমে গঙ্গায় ভাসান হয়ে গেল নিরপরাধ এক কিশোরের, যে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল দেবাশিস-বিজনকে।

পুলিশের কাছে তো বটেই, আদালতেও দেবাশিস–বিজন বারবার বলেছিলেন, অপহরণের পর হত্যার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না তাঁদের। অনভিজ্ঞতা এবং ভয়ের যোগফলে ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু অনুরাগ জীবিতই নেই আর, এটা জেনেও এরপর ওঁরা দু’জন যা করেছিলেন, ক্ষমাহীন।

১৪ অক্টোবর, লিখেছি আগে, প্রথম ফোন গিয়েছিল আগরওয়ালদের বাড়িতে। ১৫ অক্টোবর সন্ধে সাতটা কুড়িতে টাকা হাতবদল হল। পাঁচ টাকার বিনিময়ে একটি স্থানীয় বাচ্চা ছেলেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন দু’জনে, বসুশ্রীর সামনে দাঁড় করানো গাড়ি থেকে টাকা নিতে। টাকা এল, ভাগাভাগি হল। এবং দু’জনে ঠিক করলেন, ভোদা-পলু-গোপালকে বলবেন, টাকা আদৌ পাওয়াই যায়নি। ওদের ভাগ দেওয়ার দরকার নেই। ভোদা-বাহিনী অবশ্য অত সহজে মেনে নেওয়ার পাত্র ছিল না। সরাসরি হুমকি দিল, ওসব গালগল্প শুনিয়ে লাভ নেই। কালীপুজোর মধ্যে টাকা না পেলে দেবাশিস-বিজনের লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনুরাগের মতো দশা হবে।

ক্রমাগত হুমকিতে ভয়ই পেয়ে গেলেন দু’জন। ঠিক করলেন, আবার ফোন করবেন আগরওয়ালদের। ১৭ অক্টোবর থেকে ফোন করা শুরু হল। ততক্ষণে তদন্তে নেমে পড়েছে গোয়েন্দা দফতর। আগরওয়াল পরিবারও আঁচ পেয়ে গিয়েছে, বড়সড় গোলমাল আছে কোনও।

মোবাইল ফোন তখনও আসেনি এদেশে। এলে, এবং অভিযুক্তরা ব্যবহার করলে কিনারা করা অনেক সহজ হত। আগরওয়ালদের ল্যান্ডলাইনে আড়ি পাতা হল। ‘মিস্টার গুপ্তের’ ফোন তিন-চারদিন অন্তর আসতেই থাকল টাকার দাবি জানিয়ে। বক্তব্য, আশি হাজার পাইনি। কিন্তু আর আপনাদের বাড়ির ছেলেকে রাখতে চাই না। হাজার বিশেক দিলেই ছেড়ে দেব। দেবীলাল-শৈলেন্দ্র প্রতিবারই কথা বলতে চাইতেন অনুরাগের সঙ্গে। উলটোদিকের বাঁধাধরা উত্তর ছিল, টাকা পাওয়ার আগে কথা বলানো যাবে না। না পুলিশ, না আগরওয়াল পরিবার, কেউই তখনও জানে না, অনুরাগ আর বেঁচে নেই।

দাবি করা টাকার অঙ্ক কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কুড়ি থেকে নেমে এল পাঁচ হাজারে। পুলিশের পরামর্শ অনুযায়ী ফাঁদ পাতা হল। দেবীলাল জানালেন, তিনি রাজি। ফোনে নির্দেশ এল, ৩ নভেম্বর কালীঘাট মন্দিরের কাছে একটা ডাস্টবিনে কাগজের প্যাকেটে টাকাটা রেখে দিতে। ছেঁড়া কাগজে ভরতি প্যাকেট নিয়ে সকাল দশটায় ডাস্টবিনে প্যাকেট রেখে দিলেন শৈলেন্দ্র। সোয়া দশটায় দেবাশিস ডাস্টবিনের কাছাকাছি এলেন, তাকাচ্ছিলেন এদিক-ওদিক। সাদা পোশাকের পুলিশ কলার চেপে ধরল।

—আপনি মিস্টার গুপ্ত?

—না, মানে…

—অনুরাগ কোথায়?

—কে অনুরাগ?

একটি জোরদার থাপ্পড়ের প্রয়োজন হল, যা গালে পড়লে মিনিটতিনেক কানমাথা ভোঁ ভোঁ করার কথা। ওটুকুই যথেষ্ট ছিল।

—স্যার, আমি দেবাশিস ব্যানার্জি। অনুরাগকে মেরে ফেলেছি আমরা। আমি একা ছিলাম না।

বাকি যারা ছিল, বিজন-পল্লব-ভোদা-গোপাল, ধরা পড়ল কয়েকদিনের মধ্যেই। জেরায় সব স্বীকার করল অভিযুক্তরা। কিন্তু একটাই সমস্যা, অনুরাগের দেহ পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। দেহ না পেলে মৃত্যু প্রমাণ করা দুরূহ | অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসা করা হল, একই স্বীকারোক্তি কি আদালতে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত? সবার আগে রাজি হলেন দেবাশিস।

এখানে একটু আইনের ব্যাখ্যা জরুরি। তফাতটা বোঝানো জরুরি, পুলিশের কাছে করা স্বীকারোক্তি আর আদালতে বিচারকের এজলাসে করা স্বীকারোক্তির। গ্রেফতারের পর পুলিশ ধৃতের মৌখিক স্বীকারোক্তির বয়ান লিপিবদ্ধ করতে পারে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬১ ধারায়। কিন্তু এই স্বীকারোক্তি প্রামাণ্য হিসেবে গ্রাহ্য নয় আদালতে, যতক্ষণ না তা অন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। পরিভাষায়, corroborative evidence, সহায়ক প্রমাণ মাত্র, স্বতঃসিদ্ধ নয়। হতেই পারে, মেরেধরে ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে পুলিশ। তাই এই আইনি রক্ষাকবচ।

আদালতে বিচারকের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তির (judicial confession, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারা) প্রমাণমূল্য ঢের বেশি, এ প্রমাণমূল্য অকাট্য (substantive evidence), যদি সেটা হয় সত্যি এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। এবং যদি তার সাধারণ সমর্থন মেলে অন্য সাক্ষ্যপ্রমাণে, সে সরাসরিই (direct evidence) হোক বা পারিপার্শ্বিক (circumstantial), শাস্তি একরকম অনিবার্যই |

কী করে বোঝা যাবে, আদালতে স্বীকারোক্তি পুলিশের চাপে কি না? সে বিধানও আছে আইনে। প্রাক্-স্বীকারোক্তি পালনীয় নিয়ম রয়েছে। যা মানতে হয় বিচারককে। প্রথামাফিক, পুলিশ পেশ করে আর্জি। জানায়, আদালতে স্বীকারোক্তিতে রাজি হয়েছে অভিযুক্ত। আবেদন গৃহীত হলে দিন স্থির হয় স্বীকারোক্তির। আদালতে অভিযুক্ত হাজির হলে কিছু বাঁধাধরা প্রশ্ন করেন বিচারক। নমুনা দেওয়া যাক।

‘আপনি কি অমুক মামলায় দোষ স্বীকার করতে চান? করলে, কেন চান?

আমি ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের লোক নই। আপনি কিন্তু আইনত দোষ স্বীকার করতে বাধ্য নন আসামি হিসেবে। তবু যদি স্বীকার করেন, বিচারপর্বে সেই স্বীকারোক্তি আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। এটা জানেন তো?

পুলিশ কি আপনাকে বলেছে যে দোষ স্বীকার করলে মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন বা সাজা কম হবে?

আপনি কি পুলিশের নির্দেশে বা চাপে পড়ে দোষ স্বীকার করতে এসেছেন? নির্ভয়ে বলুন।

আপনি এই মামলায় পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন আপনার প্রতি কি কোনও দৈহিক বা মানসিক অত্যাচার হয়েছে? দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন থাকলে দেখাতে পারেন।

আপনি দোষ স্বীকারে বাধ্য নন, আবার বলছি। তবু যদি চান স্বীকার করতে, চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি আবার ভেবে দেখার। তারপরও যদি স্বীকারোক্তি দিতে চান, লিপিবদ্ধ করব।

দেখতেই পাচ্ছেন, এজলাসে পুলিশ নেই। অনুরোধ, যা বলবেন, সত্যি বলবেন এবং স্বেচ্ছায় বলবেন। যদি স্বীকারোক্তির ব্যাপারে মত পরিবর্তন করেন, জানাবেন কাল, চব্বিশ ঘণ্টা ভেবে দেখার পর। আপনার মতই গ্রাহ্য হবে।’

উপরে যা যা পড়লেন, সবই দেবাশিসকে জিজ্ঞাসা করলেন বিচারক। দেবাশিস অনড় থাকলেন স্বীকারোক্তিতে। “কেন দোষ স্বীকার করছেন”— এর উত্তরে যা বললেন, হুবহু তুলে দিচ্ছি।

—পরিস্থিতি এমন হয়ে গেছে যে আমি যা করেছি তাতে বাইরের জগতে সবাই আমাকে ঘৃণা করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি সাজা না পাই, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কিছুতেই শান্তি পাব না। যখন আমাকে অ্যারেস্ট করে আমার বাড়ি নিয়ে যায়, তখন আমার মা বলেছিলেন, এর থেকে যদি মরার খবর শুনতাম তা হলে খুশি হতাম। আমি যা অন্যায় করেছি তার সাজা আমি পেতে চাই।

দেবাশিস শুধু নন, গোপাল এবং ভোদাও স্বীকারোক্তি দিল আদালতে।

তদন্তকারী অফিসার দুলালবাবু তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কাজটা করলেন অসামান্য। ঘটনাপ্রবাহ নিখুঁত উঠে এল চার্জশিটে। বিরল মামলা, শুরুতে লিখেছি। অপহরণ এবং হত্যার কেস অনেক হয়েছে এদেশে। আলোচ্য মামলা বিরল, কারণ দেহই পাওয়া যায়নি খুন হওয়া অপহৃতের। পুলিশি পরিভাষায়, ‘corpus delicti’, অর্থাৎ ‘body of crime’-ই মেলেনি। লাতিন শব্দবন্ধ, সোজা বাংলায়, অপরাধ যে আদৌ ঘটেছে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ। একজন নিখোঁজ হয়ে গেল এবং আর খুঁজে পাওয়া গেল না। দেহ না পাওয়া পর্যন্ত কী করে প্রমাণ হবে যে নিখোঁজ নিহত হয়েছে?

এই যুক্তিতেই তর্ক সাজালেন অভিযুক্তদের আইনজীবী।

‘Corpus Delicti’ ছাড়াই খুনের ঘটনা প্রমাণ এবং অপরাধীদের শাস্তিদানের নজির আছে অতীতে। খুব অল্পসংখ্যক মামলায়। তদন্তকারী অফিসারের পক্ষে কাজটা ছিল অসম্ভব কঠিন, অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই দুর্গম পাহাড়ে চড়ার মতোই। আদালতে দেবাশিস-ভোদা-গোপালের দেওয়া জবানবন্দি ছিল, কিন্তু শুধু তার ভিত্তিতে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করতে প্রয়োজন ছিল ওই জবানবন্দির প্রতিটি দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ( circumstantial evidence) মাধ্যমে নিখুঁত উপস্থাপনার। যাতে ঘটনার শুরু থেকে শেষ, ফাঁক না থাকে কোনও, বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় তর্কাতীত।

অনুরাগের ব্যাগ থেকে যা যা নিয়েছিল যে যে, উদ্ধার হল সব। ঘটনার দিন হাওড়ার লঞ্চঘাটে দেবাশিস ও বিজন যে এক কিশোরকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বেশ কিছুক্ষণ, তার সমর্থন পাওয়া গেল এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। তিনজনের ছবি জেটির সমস্ত কর্মীদের বারবার দেখানোর পর। বস্তাবন্দি দেহ নিয়ে চারজন যখন গঙ্গার পথে সে-রাতে, মাঝরাস্তায় দেখে ফেলেছিলেন একটি স্থানীয় গ্যারেজের দুই কর্মী। যাঁরা গাড়ি সারাচ্ছিলেন ল্যাম্পপোস্টের আলোয়। যাঁদের কৌতূহলী দৃষ্টি নজরে পড়ায় ভোদা ধমকেছিল, ‘মুখ বাড়িয়ে দেখা বার করে দেব হারামজাদা! বেশি চালাক, না?’ সেই দুই কর্মী বয়ান দিলেন।

বয়ান দিলেন দারোয়ান ভগবতীও, ধরে আনা হল বিহারের বাড়ি থেকে| যাকে ঘটনার পর ভোদা বলেছিল, ‘তুনে বহুত কুছ দেখ লিয়া| ভাগ যা ইহাঁসে, নেহি তো খালাস কর দেঙ্গে।’

গুদামের ভিতর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল বেশ কিছু পায়ের ছাপ, যার অধিকাংশই ‘ডেভেলপ’ করা যায়নি| কিছু অবশ্য ‘ডেভেলপ’ করা গিয়েছিল, যা মিলে গিয়েছিল দেবাশিসের পায়ের ছাপের সঙ্গে।

শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াও চলল বিচারপর্বে, আইনের ভাষার ‘Test Identification Parade’। যাতে অংশ নিল অনুরাগের বন্ধু সমীর প্যাটেল, চিনিয়ে দিল মেট্রো স্টেশনে আলাপ হওয়া দেবাশিসকে। যে দোকানগুলি থেকে কেনা হয়েছিল লিউকোপ্লাস্ট, Pethidine এবং air purifier mask, তার কর্মচারীরাও শনাক্ত করলেন দেবাশিস-বিজনকে।

সিটি সেশনস কোর্টের বিচারক ৭৭ জন সাক্ষীর বয়ান নথিবদ্ধ করলেন। দেবাশিস-গোপাল-অশোকের আদালতে স্বীকারোক্তি এবং সমস্ত তথ্যপ্রমাণ বিবেচনা করে ’৯১-এর ১৪ ডিসেম্বর রায় দিলেন। পাঁচ অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা ঘোষণা হল যাবজ্জীবন কারাবাসের। আবেদন দাখিল হল হাইকোর্টে। শুনানি চলাকালীনই, এগারো বছর কারাবাসের পর নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়েছিল বিজন বড়ুয়া বাদে বাকি চারজন। সে জামিন নাকচ করে দিল হাইকোর্ট। যাবজ্জীবন কারাবাসের রায় বহাল রেখে আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ জারি হল জামিনে মুক্ত চারজনের উপর।

রায়ে বিচারপতিরা লিখলেন, “We are of the considered view that prosecution successfully established a complete chain of circumstances from its oral and documentary evidence which taken as a whole unerringly established the guilt of each and every appellant.”

Robert Louis Stevenson তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস ‘Kidnapped’-এ লিখছেন, “I have seen wicked men and fools, a great many of both; and I believe they both get paid in the end; but fools first.” (দু’ধরনের লোকই দেখেছি আমি। শয়তান আর বোকা, দুই-ই দেখেছি অনেক| উভয়কেই মূল্য চোকাতে হয়। তবে আগে বোকাদের)|

ঠিকই। অপরাধীরা শয়তানের প্রতিরূপ তো ছিলই, না হলে তরতাজা এক কিশোরকে ওভাবে খুন করে ভাসিয়ে দেওয়া যায় গঙ্গাবক্ষে? তবে তার চেয়েও বেশি বোকা ছিলেন দেবাশিস-বিজন| যদি প্রথম বারের মুক্তিপণের টাকায় সন্তুষ্ট থাকতেন, আশি হাজার পাওয়ার পরও বেসামাল লোভে যদি আর ফোন না করতেন আগরওয়াল পরিবারে, ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল শূন্য। কে ধরত, কীভাবে ধরত, সূত্র পেত কোথায়? খুনের চিত্রনাট্য-সংলাপ-পরিচালনা অজানাই থেকে যেত, পুলিশও একটা সময় উৎসাহ হারিয়ে ফেলত কূলকিনারা না পেয়ে, অদৃষ্টকে শাপশাপান্ত করা ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকত অনুরাগের আত্মীয়-পরিজনের, আর দিব্যি ঘুরে বেড়াত খুনিরা। নিরাপদে, নিরুপদ্রবে।

এমনই হয়। কখনও অতিচালাকি, কখনও অতিলোভ কাল হয়ে দাঁড়ায় অপরাধীর।

ধর্মের কল। বাতাসে তো নড়বেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *