০১. টিয়াটাকে বুলি শেখানোর চেষ্টা

হেমন্তের পাখি – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

অগ্রজপ্রতিম লেখক প্রলয় সেন
 ও জয়তী বউদিকে

.

০১.

খাঁচার টিয়াটাকে বুলি শেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল অদিতি। রোজই চালায়, এই দুপুরবেলায়। অদিতির নির্জন সময়ে। পাখি কথা বলবে না, অদিতিও বলাবেই, দু’জনের এ এক ভারী নিভৃত খেলা।

মাসখানেক আগে রাস্তার এক পাখিওয়ালার কাছ থেকে টিয়াটা কিনেছে অদিতি। করকরে আশি টাকায়। পাখিটা খুব বাচ্চা নয়, মোটামুটি বড়ই। পাকা সবুজ রঙ, পরিণত ডানা, গলা জুড়ে বকলসের মতো স্পষ্ট কালো দাগ। বেচার সময়ে লোকটা অনেক ভাল ভাল কথা বলেছিল। সেলসম্যানশিপে সুপ্রতিমকেও বুঝি হার মানায়। নিয়ে নিন বউদি, একদম তৈরি পাখি, সাত দিনে পোষ মেনে যাবে! জাত দেখেছেন, আস্‌লি সিঙ্গাপুরী টিয়া! এ পাখি কথা বলে না, লেকচার দেয়! যা শুনবে তাই আউড়ে যাবে সারাদিন! হাত বাড়াবেন, হাতে চলে আসবে! কাঁধে চড়ে ঘুরবে, ঠিক যেন ঘরের ছেলে! দেখবেন, আপনারই তখন খাঁচায় পুরতে মায়া হবে!

কিন্তু পাখি কথা বলে কই! এক মাস ধরে বিশ্রী একটা কর্কশ ডাক ছাড়া আর কিছুই তো এল না অদিতির কানে। পোষ মানা দূরস্থান, খাঁচা খুলে ছোলা দিতে গেলেও ক্যাঁ ক্যাঁ করে তেড়ে আসে। সুপ্রতিম আর পাপাই তাতাই-এর সামনে অদিতি বেইজ্জতের একশেষ। বাপ আর দুই ছেলে তিনজনই একমত। টিয়াটা বুড়ো। টিয়াটা গোঙা।

অদিতির বিশ্বাস হতে চায় না। এমনও তো হতে পারে টিয়াটা খুব তেজি, প্রখর বুদ্ধিমান। হয়তো ভাবছে অদিতি নিজেই একদিন বিরক্ত হয়ে খাঁচার দরজা খুলে দেবে, ওমনি ও ফুড়ৎ করে উড়ে যাবে আকাশে! অথবা ওর মনে এখনও ফেলে আসা নদী জঙ্গল গাছ আকাশের ছবি অম্লান! সেই স্মৃতি ধুয়ে-মুছে সাফ না হওয়া পর্যন্ত হয়তো কথা বলবে না বলে পণ করে রেখেছে টিয়া।

নাহ্, অদিতির হাল ছাড়লে চলবে না। পাপাইটা ছোটবেলায় অঙ্কে কী কাঁচাই না ছিল, সামান্য গুণ ভাগ করতে দিলে সিঁটিয়ে যেত, চিবিয়ে চিবিয়ে ভুট্টিনাশ করত পেনসিলের। বুঝতে পারছি না মা! হচ্ছে না মা! পারব না মা! সেই ছেলের পিছনে লেগে থেকে থেকে সে এখন অঙ্কে রীতিমতো পালোয়ান। মাধ্যমিকে অঙ্কে সাতানব্বই, উচ্চমাধ্যমিকে একশো নব্বই, ইন্টার স্কুল অঙ্ক কম্পিটিশানেও কুস্তি লড়ে প্রাইজ পেয়েছে কত। এখন পাপাই-এর থার্ড ইয়ারের ক্লাশমেটরা ফিজিক্সের জটিল অঙ্ক নিয়ে পাপাই-এর কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। অঙ্ক ভয় দূর করার থেকেও কি পাখির মুখে বুলি ফোটানো কঠিন?

ব্যালকনির রডে ঝোলানো লোহার খাঁচাটাকে একটু দুলিয়ে দিল অদিতি। নিচু স্বরে বলল,—কিরে, কথা বলবি না?

টিয়া তরতর জাল বেয়ে উল্টোদিকে চলে গেল।

অদিতি দ্রুত ঘুরে গেল সেদিকে। খাঁচার তারে মুখ রেখে নরম করে বলল, —বল সুপ্রতিম। সু-প্র-তি-ম। বল বল।

টিয়ার মোটেই যুক্তাক্ষরে আগ্রহ নেই। একবার ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল অদিতিকে, আবার সরে গেছে।

—বুঝেছি। আমার বরটাকে তোর পছন্দ না। হবেই বা কেন, ও কি তোকে ভালবাসে!

টিয়ার এতটুকু চাঞ্চল্য দেখা গেল না। চুপ, যেন সায় দিচ্ছে।

অদিতি ঠোঁট টিপে হাসল,—বেশ তবে পাপাই তাতাইকে ডাক। বল পাপ্‌পাই। তাত্তাই।

কুৎসিত আওয়াজ করে খাঁচার মেঝেতে বসল টিয়া। বসেই লাফিয়ে উঠেছে। ঝটপট করছে খাঁচা জুড়ে।

—কী অসভ্য রে তুই! দাদাদেরও পছন্দ নয়!

তড়াং করে খাঁচার মাথায় ঝুলে জিমন্যাসটিক দেখাচ্ছে টিয়া।

—আচ্ছা বাবা আচ্ছা। কাউকে ডাকতে হবে না। আমাকেই ডাক। অদিতি। অ-দি-তি।

দাঁড়ে বসেছে টিয়া। দুলছে অস্থির ভাবে। ঘন ঘন চোখ টিপছে।

অদিতি ফিসফিস করে বলল,—অদিতিও কঠিন লাগছে? খুকু বলে ডাকবি? বল খুউকু। খুউকুউ।

অদিতির দুই ছেলেই ছোটবেলায় নাম ধরে ডাকত অদিতিকে। খুকু সুপ্রতিমই শিখিয়েছিল। ছোটর তো অনেক বড় অবধি অভ্যেসটা ছিল। ক্লাশ ফাইভে উঠেও তাতাই মাকে বলত খুকুমা। অদিতি ছেলেকে বকত খুব। এখন কেন যে সেই ডাকটাই শুনতে ইচ্ছে করে অদিতির!

ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে অদিতি বলল,—একবারটি খুকুমা বলে ডাকবি আমাকে? ডাক না। বল খু-কু-মা।

এতক্ষণে টিয়ার মুখে বোল এসেছে, —ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ।

—এই পাজি, চেঁচাচ্ছিস কেন?

—ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ।

—যা, তোর সঙ্গে কথাই বলব না। ওরা তোকে ঠিক চিনেছে। তুই একটা বুড়োর হদ্দ। সাত জংলির এক জংলি!

বিরক্ত হয়ে খাঁচার পাশ থেকে সরে এল অদিতি। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সন্দিগ্ধ চোখে দেখছে পাখিটাকে। সত্যিই কি পাখিওয়ালা তাকে ডাহা ঠকিয়ে গেল? বেশি দাম নিয়ে রদ্দি টিয়া গছিয়ে গেল একটা?

তা অদিতির ঠকা অবশ্য এমন কিছু নতুন কথা নয়। এর আগে একবার কত শখ করে একটা নেপালি ময়না পুষেছিল অদিতি। হাঁ করে খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, এই বুঝি পাখি মানুষের স্বরে কথা বলে ওঠে! হায় কপাল, পাখি শুধু গেলে আর খাঁচা নোংরা করে। শেষে একদিন বাপ-ছেলেদের তুমুল হর্ষধ্বনির মাঝে খাঁচা খোলা পেয়ে পুঁই করে উড়ে পালাল পাখিটা। সবাই বলল, ওটা নাকি গাঙ্শালিখ্ ছিল! অদিতি চিনতে ভুল করেছে! হবেও বা। আর একবার, পাপাই তাতাই তখন বেশ ছোট, দুই ছেলেকে নিয়ে রাসবিহারীর রথের মেলা থেকে চারটে মুনিয়া কিনে এনেছিল অদিতি। সবুজ-হলুদ কালো-বাদামী নীল-খয়েরি কী তাদের রঙের বাহার! দুই ছেলে পিচকিরিতে জল ভরে ক’দিন তাদের স্নান করাতেই বর্ণচোরা মুনিয়ারা ক্যাটকেটে চড়ুই!

সুপ্রতিম সেবার খুব চটেছিল। তিরিশটা টাকা নষ্ট করার জন্য কম খোঁটা দেয়নি অদিতিকে। রোজগার তো করো না, টাকার মর্ম বুঝবে কী! এখন অবশ্য সামান্য আশি টাকা গলে যাওয়াতে সুপ্রতিমের কিছু যায় আসে না। সে তো আর কোম্পানির সেই ছুটন্ত ফেরিওয়ালা নেই, রীতিমতো লোটাস ইন্ডিয়ার দাপুটে এরিয়া ম্যানেজার।

পাখিটার দিকে আরও খানিকক্ষণ কটমট তাকিয়ে থেকে ঘরে ফিরল অদিতি। কাচা জামাকাপড় বিছানায় স্তূপ করে গেছে মলিনার মা, সেগুলোকে নিয়ে পড়ল। পাপাই তাতাই-এর শর্টস টি-শার্ট, সুপ্রতিমের গেঞ্জি পাজামা, নিজের শাড়ি সায়া ব্লাউজ পাট করল আলাদা আলাদা করে। কোনওটা রাখল আলনায়, কোনওটা দিয়ে এল ছেলেদের ঘরে, কোনওটা আলমারিতে তুলল। খাটে শুয়ে গড়াল খানিকক্ষণ। পড়া খবরের কাগজ নতুন করে উল্টোল, সরিয়ে রাখল, আবার শুয়ে রইল চোখ বুজে। ঘুমও ছাই আসে না, আবার এসে গেলেও বিপদ। সারা বিকেল গলা জ্বলবে, সারা সন্ধে টক ঢেকুর। অপারেশনের পর থেকে অম্বলের রোগটা যেন আরও বেড়ে গেল। আবার কি পাখিটাকে নিয়ে পড়বে, নাকি গড়াবে আর একটু? উল কাঁটা নিয়ে বসলে কেমন হয়! ধুস্, কী হবে? ছেলেরা তো আজকাল কেনা শোয়েটার বেশি পছন্দ করে।

অদিতি যে এখন কী করে? কী করে?

হেমন্ত চলছে। শরৎ আর শীতের মাঝে হেমন্ত ঋতুটা যেন কেমনতর। কখন যে একটা পাতলা কুয়াশায় মুখ লুকিয়ে চুপিসাড়ে এসে যায়। তারপর যেন আর কাটতেই চায় না, কাটতেই চায় না। বাতাস শুকনো হয়ে আসে, চামড়ায় টান ধরে, এক হিমঋতুর পদধ্বনি শোনা যায় দূরে। কিন্তু আসে না শীত। তখনও যেন শরতের গন্ধ লেগে থাকে বাতাসে। উচ্ছল শরৎ আর হাড়-কাঁপানো শীত, মাঝের সময়টা বড় নিশ্চেতন। প্রলম্বিত।

ফোন বাজছে। উঠল অদিতি। ছুটল না, অলস পায়ে এল ড্রয়িংস্পেসে। মন্থর হাতে রিসিভার তুলল। সুপ্রতিম।

—কী ব্যাপার, ঘুমোচ্ছিলে নাকি?

—না, এই…একটু…

—পারোও বটে। সুখে আছ।

—এই বলার জন্য ফোন করেছ?

—ঘুম ভাঙালাম বলে চটেছ মনে হচ্ছে?

অদিতি একা একাই ম্লান হাসল,—কী বলবে বলো না।

সুপ্রতিম কি একটু সময় নিল? না বোধ হয়। কাজের কথাটা পেড়েছে,—একটু দ্যাখো তো, শোওয়ার ঘরের টেবিলে কি আমি একটা গোলাপি ফাইল ফেলে এসেছি?

—ধরো, দেখছি। দ্রুত পায়ে শোওয়ার ঘর ঘুরে এল অদিতি, —হ্যাঁ, পড়ে আছে।

—বাঁচালে। আমি ভাবছিলাম শেয়ার ট্যাক্সিতে ফেলে এলাম। একগাদা দরকারি পেপারস আছে ফাইলটায়।

—তুমি আজ ব্রিফকেস নিয়ে বেরোওনি?

—কেন, তুমি দ্যাখোনি আমি ক’দিন ধরে ব্রিফকেস নিয়ে বেরোচ্ছি না!

অদিতি বলতে পারত, খেয়াল করিনি। খেয়াল করার সময়ই বা কোথায় সকালে! পাপাই তাতাই এমন ঘোড়ায় জিন দিয়ে থাকে। ওই একটা সময়ে এখনও তাদের মাকে দরকার। ট্রাউজারটায় একটু ইস্ত্রি চালিয়ে দাও না! শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেছে, চটপট লাগিয়ে দাও তো! ইস্, আমাকে এত ভাত দিয়েছ কেন, ওঠাও ওঠাও! তার মধ্যেও সুপ্রতিমের টাইটা মোজাটা রুমালটা খাটের বাজুতে রেখে আসে অদিতি। শুধু সুপ্রতিমের যাত্রাকালে দরজায় গিয়ে দুগ্‌গা দুগ্‌গাটাই করা হয়ে ওঠে না। বহুকাল যাবৎই।

হালকা ভাবে অদিতি অন্য কথায় গেল,—অতই যদি দরকারি ফাইল, অফিসে যাওয়ার চার ঘণ্টা পরে মনে পড়ল কেন?

চটজলদি জবাব এসে গেল,—অফিস তো আর করলে না, দিব্যি শুয়ে বসে জীবন কেটে গেল। ফার্স্ট আওয়ারে এসেই সেলসের ছেলেদের নিয়ে মিটিং-এ বসেছিলাম, একটু ফাঁক পেতে তবে মনে পড়ল।

—ও। ফস্ করে একটা অবান্তর প্রশ্ন করে বসল অদিতি, —ফিরছ কখন?

—আমি? আজ? সুপ্রতিমও যেন কোনও আজগুবি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে—যেমন ফিরি। সাড়ে ন’টা। দশটা। পাটনার এজেন্ট এসেছে, ওকে নিয়ে সন্ধেবেলা একটু বসতে হবে।

—বেশি গিলো না। প্রেসারটা বেড়েছিল, খেয়াল রেখো।

—জানি। জ্ঞান মারতে হবে না।

—হুঁহ্, তাও যদি বোতল দেখলে জ্ঞান থাকত! বাড়ি ফিরে খাবে তো, না কালকের মতো খাবার নষ্ট হবে?

—অফকোর্স খাব। আমি আজ হোটেলবাজি করতে যাচ্ছি না। রাখছি।

কট। দাম্পত্য আলাপ শেষ। রিসিভারটা হাতে নিয়ে অদিতি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কয়েক সেকেন্ড। নাকি আরও বেশি? সময় যখন কাটে না, কয়েক সেকেন্ডও এত দীর্ঘ হয়ে যায়! মাত্র সাড়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের আসবাব ভরা ফ্ল্যাটটাকেও মনে হয় জনহীন প্রান্তর।

রিসিভার একটানা কুঁ কুঁ কুঁ কুঁ শব্দ করে চলেছে। যেন বলছে রাখ রাখ রাখ রাখ। রিসিভারটাকে আঁচলে ঘষে খানিকটা চকচকে করল অদিতি, রেখে দিল ক্রেডলে। যন্ত্রটার এ বাড়িতে তিন বছর বয়স হল। একমাত্র কাজের কথা ছাড়া আজ পর্যন্ত টেলিফোনে কোনও নরম-সরম কথা বলল না সুপ্রতিম। অদিতি মাঝে মাঝে ভাবে, বিয়ে হয়ে অদিতি যখন শ্বশুরবাড়িতে এল, তখন যদি ও বাড়িতে টেলিফোন থাকত, সুপ্রতিম কি তখনও দুপুরবেলা এরকম নিরস স্বরে ফোন করত অদিতিকে? মনে হয় না। সুপ্রতিমের তখন যথেষ্ট রসকষ ছিল। কী মিষ্টি একটা নামে ডাকত অদিতিকে। ফুল। এখনও ডাকে। ক্কচিৎ কখনও। ফুল ভেবে নয়, বোকা ভেবে।

অন্যমনস্কভাবে সোফাগুলো ঝাড়ছিল অদিতি। মলিনার মা যত্ন করেই ঝাড়াঝুড়ি করে, তবু যেন অদিতির ঠিক তৃপ্তি হয় না। ক্যাবিনেটের গায়ে, সেন্টার টেবিলে, টিভি-র কাচে সর্বত্রই অদৃশ্য ধুলোর কণা দেখতে পায় অদিতি। এগুলোই কি সংসারের মায়া?

কিছুক্ষণ অদিতি ঝুম হয়ে বসে রইল সোফায়। কী ভেবে উঠে টিভি-টা চালিয়ে দিল। আবার বসল। একা একা টিভি দেখতেও ভাল লাগে না অদিতির। পর্দায় চলমান ছবি ভেসে উঠছে, কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ গান গাইছে, কেউ ভালবাসছে কাউকে, কেউ কাউকে মেরে ফেলছে আর অদিতি একা বোকার মতো বসে বসে দেখছে তাদের—সবই কেমন অলীক লাগে অদিতির। পর্দার মানুষগুলোর সঙ্গে কিছুতেই ঠিকঠাক সংযোগ ঘটে না তার। যেন মনে হয় পুতুলের নড়াচড়া দেখছে, সে-ও এক পুতুল। কেউ যদি পাশে বসে অদিতির সঙ্গে দৃশ্যটার রস ভাগাভাগিই না করল, তবে সেই দৃশ্য দেখে অদিতির কীসের আনন্দ? পাপাই তাতাই ক্রিকেট টেনিস চালিয়ে রাখলেও অদিতি সারাদিন বসে দেখতে পারে, কিন্তু একা একা…!

দু’-তিন বছর আগেও অদিতির দুপুরটা অনেক অন্য রকম ছিল। মাধ্যমিকের আগে পর্যন্ত তাতাই-এর ছিল মর্নিং স্কুল, সারা দুপুরই তখন গমগম করত বাড়ি। এই তাতাই দড়াম করে বাথরুমের দরজা বন্ধ করল। এই গান গাইছে গলা ছেড়ে। একবার ফুল ভলিউমে টিভি চালিয়ে দিল, একবার টেপ। সঙ্গে অনবরত হাঁকডাক। মা, আমার ব্রায়ান অ্যাডামস-এর ক্যাসেটটা কোথায় গেল? মা, দাদা আজ আবার আমার টি-শার্ট পরে বেরিয়েছে, তুমি দেখতে পারো না? মা ফ্রিজে দেখছি একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস আছে, খাব? দূর ছাই, ওয়াকম্যানটা কোথায় রাখলাম? ও মা, খুঁজে দাও না। মা মা মা মা মা। অস্থির অস্থির লাগত অদিতির।

এখন চতুর্দিক দমচাপা রকমের ফাঁকা।

তাও তাতাই এখনও কিছুটা ছেলেমানুষ আছে। অদিতিকে জড়িয়ে ধরে এখনও হুমহাম আবদার চালায়। পাপাইটা যেন পুরোপুরি লোক হয়ে গেল। অথচ ওই ছেলেই পাঁচ বছর আগেও কী মা-ঘেঁষাই না ছিল! স্কুল টিউটোরিয়াল খেলার মাঠ বন্ধুবান্ধব, রাজ্যের সব গল্প পুঙ্খানুপুঙ্খ মাকে বলা চাই। অদিতি শুনতে না চাইলেও কানের কাছে বকবক করে যাবে। এখন পাপাই বাড়িতে কথা বলারই সময় পায় না।

অদিতির দুই ছেলেই বৃত্ত পেয়ে যাচ্ছে।

বৃত্ত, না ডানা?

পাপাই তাতাই উড়ে যাচ্ছে ডানা মেলে। মাঝে মাঝে ফিরবে কুলায়। আবার ওড়া। আবার ওড়া। ওদের সামনে এখন সুনীল আকাশ।

আর অদিতির সামনে এই ফ্ল্যাট। সাড়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের এক আদিগন্ত ধুধু মাঠ।

অদিতি নিষ্পলক তাকিয়ে আছে রঙিন পর্দায়। সম্ভবত পুরনো দিনের সিনেমার গান হচ্ছে টিভি-তে। অদিতি দেখছেও না, শুনছেও না। পৌনে তিনটে বাজে। চারটে নাগাদ মলিনার মা বাসন মাজতে আসবে, সাড়ে চারটেয় রান্না করতে সবিতা! ছেলেরা ফিরতেও পারে, নাও ফিরতে পারে। তাদের জন্য জলখাবার করে রেখে লাভ নেই, এলে দেখা যাবে। প্রেশারে খানিকটা মটর সেদ্ধ করা আছে, চটপট ঘুগনি বানিয়ে দেবেখন। সন্ধেবেলা অদিতির একবার দাসপাড়া বাজারে যাওয়া দরকার। কাল সকালে পাপাই-এর স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া আছে, বাজার যেতে পারবে না, রাতেই মাছটা সবজিটা কিনে রাখতে হবে অদিতিকে। টুথপেস্ট ফুরিয়ে এসেছে, গায়ে মাখার সাবানও। ও সব অবশ্য সামনের দোকান থেকেই সওদা করা যায়। সুপ্রতিম জুতোর ফিতের কথা বলছিল, দাসপাড়া বাজারে পাওয়া যাবে কি? পাখির ছোলাও শেষ, আজই কিনে এনে ভিজিয়ে রাখতে হবে রাতে।

পাখির কথা মনে পড়তেই অদিতির বুকটা খচখচ করে উঠল। ডাহা ঠকে গেল পাখিটা কিনে? সামান্য ক’টা টাকার জন্য কেন যে মানুষ মানুষকে ঠকায়! চাইলে তো পাখিওয়ালাকে এমনিই দশ বিশ টাকা দিতে পারত অদিতি! দেয়ও তো। মোড়ের ইস্ত্রিওয়ালাটা বাচ্চার ওষুধ কেনার জন্য এই তো গত মাসে পঞ্চাশটা টাকা নিল, অদিতি কি ফেরত চাইতে গেছে টাকা? যেচে না দিলে অদিতি চাইতেও পারবে না।

যাক গে, ঠকাক গে। অদিতির যে দুপুরের অনেকটাই এখন টিয়াটাকে নিয়ে কাটে, তার দাম কে চায়!

অদিতি একবার উঁকি দিয়ে দেখে এল পাখিটাকে। ঘাড় কাত করে কী যেন শুনছে টিয়া! কী শুনছে? গান? টিভি-র?

তড়াং করে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠেছে অদিতির। পাখিওয়ালা কী যেন বলেছিল! টিভি-টা একটু জোরে ছেড়ে দেবেন বউদি, পাখি গান শুনে শিস শিখে যাবে!

শিস তো অদিতি নিজেই শেখাতে পারে, তার জন্য টিভি-র কি প্রয়োজন? পাপাই তাতাইকে কত শিস দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে অদিতি।

বহুকালের অনভ্যাস, এখন কি আর বাতাস বাজবে!

অদিতি ঠোঁট সরু করে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা বাতাস ঠেলল বুক থেকে। দিব্যি বাজছে! সাইকেল আর সাঁতারের মতো শিসও কি মস্তিষ্কে গেঁথে যায়!

দ্রুত টিভি বন্ধ করে ব্যালকনিতে ফিরেছে অদিতি। এদিক ওদিকের ফ্ল্যাটের দিকে সন্তর্পণে তাকিয়ে নিল। একই কম্পাউন্ডে সামনে পাশে আরও তিনটে ফ্ল্যাটবাড়ি, হেমন্তের দুপুরে সব ফ্ল্যাটই মিঠেকড়া রোদ্র মেখে ঝিমোচ্ছ। কোনও ব্যালকনিতেই কেউ নেই। না, একজন আছে। সামনের ফ্ল্যাটের চারতলায়। শিপ্রার বুড়ি শাশুড়ি। বুড়ি চোখেও দেখে না, কানেও শোনে না, তবু ওই বারান্দাতে বসে আছে সর্বসময়। কী ছাই দেখে কে জানে? হয়তো আলো বাতাসের ঘ্রাণ নেয়!

খাঁচার খুব কাছে গিয়ে ঠোঁট সরু করল অদিতি। ছোট্ট একটা শিস দিল।

টিয়া চমকে তাকিয়েছে।

অদিতি আবার শিস দিল। এবার একটু লম্বা।

টিয়ার ঘাড় কাত সামান্য, শুনছে। লাল টুকটুক ঠোট কি কেঁপে উঠল?

অদিতি মজা পেয়ে গেল। ঘন ঘন শিস দিচ্ছে।

টিয়াটাও চমকিত হয়ে তাকাচ্ছে বার বার।

বুক থেকে বাতাস ঠেলে ঠেলে শিসটাকে সুরে নিয়ে গেল অদিতি। সুন্দর একটা ছন্দে বেঁধে ফেলল। বাহ, বেশ তো বাজছে!

কলেজে পড়ার সময়ে শিস দিয়ে বাজারচলতি গান ভোলা জল-ভাত ছিল অদিতির। ব্রিজ অন দা রিভার কোয়াই-এর মন কাড়া শিসটা ধরা ছিল ঠোঁটে, হানিমুনে সুপ্রতিমকে শুনিয়েছিল। পুরীর সমুদ্রপাড়ে। ঢেউ-এর সামনে বসে আছে দু’জনে, ঢেউ-এর সঙ্গে দুলছে অদিতির শিস। দুলছে শিস, দুলছে সুর। সুপ্রতিম অভিভূত। সুপ্রতিম বিমোহিত। নতুন বউ শিস দিয়ে গান শোনায়! নিজেও সুপ্রতিম চেষ্টা করল বারকয়েক, পারল না, মোটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ফুক ফুক বাতাস বেরিয়ে গেল। অদিতি হেসে কুটিপাটি। হাল ছেড়ে অদিতিকে জড়িয়ে ধরেছে সুপ্রতিম। আর একবার করো, আর একবার করো।

নেশা ধরে গিয়েছিল সুপ্রতিমের। নইলে রাতে হোটেলের নিবিড় শয্যাতে বউকে বলে শিস শোনাও! অদিতির মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপেছিল হঠাৎ স্কুলের এক ফক্কড় বন্ধুর কাছে শেখা লঙ্কা সিটিটা বাজিয়ে দিল শুয়ে শুয়ে। জিভের নীচে দু’আঙুল রেখে। কী তার আওয়াজ! পুঁই পুঁউইইই! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে গেছে সুপ্রতিম। তার হাতের ঝটকায় টেবিলে রাখা কাচের ফুলদানি ভেঙে খান খান। পাশের রুমে ছোট্ট এক মাদ্রাজি পরিবার ছিল, বাবা মা ছেলে মেয়ে। চারজনই পরদিন সকালে জুলজুল চোখে দেখছে সুপ্রতিমকে। হয়তো ভেবেছে এটাই বোধ হয় বাঙালিদের প্রেম করার নতুন রীতি।

আজ একবার সিটিটা বাজিয়ে দেখবে অদিতি? কেউ তো কোত্থাও নেই, কে আর জানছে!

অদিতি শিপ্রার শাশুড়ির দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল। মুখে আঙুল পুরেও থেমে গেছে সহসা। এ কী ছেলেমানুষি! ফ্ল্যাটবাড়িতে কোথায় যে কোন চোখ ঘোরাফেরা করে!

ক’মাস আগে এক খ্যাপামি পেয়ে বসেছিল অদিতিকে। বাড়ি ফাঁকা হলেই অদিতি ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে যেত। যত রাজ্যের পাউডার ক্রিম লিপস্টিক মাখত বসে বসে। মুখ চোখ রঙিন করেই তৃপ্তি হত না, সুপ্রতিমের প্যান্টশার্ট বার করে পরত, তারপর মডেলদের মতো হেঁটে বেড়াত ফ্ল্যাটময়। বেড়ালের মতো হাঁটছে। সিংহের মতো হাঁটছে। ময়ূরীর মতো হাঁটছে। কী একটা শব্দ শুনে একদিন বুঝি উঁকি দিয়েছিল ব্যালকনিতে, ব্যস অমনি ব্যাপারটা রাষ্ট্র হয়ে গেল। বাড়ির লোকদের কৈফিয়ত দিতে দিতে অদিতি জেরবার। যাহ ভুল দেখেছে, যাহ ভুল দেখেছে, বলতে বলতে গলা চিরে গিয়েছিল অদিতির। এখন অদিতির সিটি যদি কেউ শুনে ফেলে, পাপাই তাতাই নির্ঘাত এই পঁয়তাল্লিশ বছরের মা-টাকে রাঁচিতে ছেড়ে দিয়ে আসবে।

রাঁচির রাস্তায় একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে অদিতি, লোকজনকে জিজ্ঞাসা করছে পাগলা-গারদটা কোথায়, মাঝবয়সী পাগলিনীর প্রশ্ন শুনে ছিটকে যাচ্ছে পথচারী, পালাচ্ছে ঊৰ্দ্ধশ্বাসে, তাদের পিছনে ধাওয়া করছে অদিতি… মনশ্চক্ষে দৃশ্যটা দেখে অদিতি নিজের মনে হেসে গড়িয়ে পড়ল। হাসতে হাসতে ফিরল ঘরে।

খাটে শুয়েও হাসছে। চোয়াল ব্যথা হয়ে গেল, পেটও। শেষে আর হাসতে পারছে না অদিতি, তবু তার ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়েই আছে।

হাসি ফুরোতে আবার সেই সমস্যা। সময় থেমে গেল।

সাইড টেবিলের নীচ থেকে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করল অদিতি। পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে, তবু উল্টেপাল্টে ছবি দেখছে। রেখে দিয়ে উঠে ছেলেদের ঘরে এল, টেবিল ঘাঁটল পাপাই-এর। ইয়া মোটা এক ইংরিজি থ্রিলার, সামনের মলাটে অর্ধনগ্ন নারী আর মেশিনগান। পিছন-মলাটে কাহিনীর সংক্ষিপ্তসার। একবার চোখ বুলিয়ে নাক কুঁচকোল অদিতি, রেখে দিল। আবার ফিরে এসে শোকেস থেকে একটা বাংলা বই বার করেছে। ধুস, সবই তো পড়া, এক বই কত বার পড়া যায়! পাড়ায় যদি একটা লাইব্রেরিও থাকত! জামির লেনে অদিতির শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় কী ভাল একটা গ্রন্থাগার ছিল, শ্বশুরমশাই পাল্টে পাল্টে বই নিয়ে আসতেন, ছেলে কোলে নিয়ে গপগপ বই গিলত অদিতি।

ছোট ছোট অগুন্তি কালো পিঁপড়ে লাইন দিয়ে দেওয়াল বেয়ে উঠছে। কী যেন সাদা সাদা গুঁড়ো মুখে করে নিয়ে চলেছে সকলে। ভারী সুশৃঙ্খল এক পদযাত্রা। শীতের প্রস্তুতি। মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত চলে গেছে পিঁপড়ের সারি। ঠিক সরলরেখাও নয়, বক্ররেখাও নয়, যেন এক সাদা ফুটকিঅলা কালো সুতো ঝুলছে দেওয়ালে। কাঁপছে মৃদু মৃদু। সিলিং-এ পৌঁছে ছড়িয়ে পড়ছে পিঁপড়েরা, সে এক অপরূপ জ্যামিতিক নক্শা।

দৃশ্যটা ছিঁড়ে গেল। ডোরবেল বাজছে। মলিনার মা এল বোধ হয়।

দরজা খুলে অদিতি বিস্মিত। এক কুঁজোটে বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে প্যাসেজে। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি, কাঁধে সুতির চাদর, হাতে একটা লম্বা ডাঁটির ছাতা। অদিতির দিকে তাকিয়ে লোকটা হাসছে মিটিমিটি।

চেনা চেনা যেন! কে!

চশমাপরা লম্বাটে তোবড়ানো মুখে রহস্যের হাসি,—কি, চিনতে পারছ না?

কথা বলতেই অদিতি চিনেছে লোকটাকে। ওই গমগমে স্বরেই।

হেমেনমামা না!

.

০২.

রাত্রে খাবার টেবিলে অদিতি বলল, —জানো, আজ একজন এসেছিল বাড়িতে।

ঘুগনির বাটিতে পেঁয়াজকুচি ছড়াচ্ছিল সুপ্রতিম, মুখ না তুলেই প্রশ্ন করল,—কে?

—হেমেনমামা।

—কে মামা? সুপ্রতিম কপাল কুঁচকে ছেলেদের দিকে তাকাল, —এই, তোরা একটু থামবি? খাবার টেবিলে ঝগড়া না করলে কি তোদের রুটি হজম হয় না?

দু’ ভাইতে ক্রিকেট নিয়ে লেগেছে আজ। ভারতীয় ক্রিকেট দল কোথায় যেন বিদেশ সফরে যাবে, খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তাতাই-এর একটুও পছন্দ হয়নি টিমটা। সদ্য কলেজে ঢোকার সুবাদে তাতাই এখন প্রায় সর্বজ্ঞ, অথচ দু’বছরের ছোট ভাইকে নেহাতই নাবালক ভাবে পাপাই, পাত্তাই দিতে চায় না। তর্কের সময়ে সে নিজে কখনও উত্তেজিত হয় না, বরং ছোট ছোট মন্তব্য করে চতুর্গুণ রাগিয়ে দেয় ভাইকে।

বাবার কথা কানে তুলল না তাতাই। গাঁক গাঁক চেঁচাচ্ছে, —স্টুপিডের মতো কথা বলিস না। নিজে কোনও দিন স্কুল টিমেও চান্স পাসনি, এদিকে খেলার ব্যাপারে সব বুঝে গেছিস!

—একটু তো বুঝি। পাপাই গম্ভীর মুখে বাবার দিকে ঘুরল,—শুনলে, আমাকে স্টুপিড বলল?

সুপ্রতিম একটু কড়া গলায় ধমক দিল,—তাতাই, দাদার সঙ্গে যদি ভদ্রভাবে কথা না বলতে পারো, তা হলে এ সব তর্ক করবে না।

তাতাই ফোঁস ফোঁস করছে, —তা বলে ইডিয়টের মতো রিমার্ক করে যাবে? যে চোদ্দোটা টেস্ট খেলে আজ পর্যন্ত নিজেকে শো করতে পারল না…

—এবার ইডিয়ট বলল বাবা। আস্তে করে কথাটা ছুড়ে রুটিতে মন দিল পাপাই।

—কী হচ্ছে তাতাই, চুপ কর না। একটু শান্তিতে কথা বলতে দে। অদিতি মুরগির মাংসের বাটিটা তাতাই-এর দিকে এগিয়ে দিল,—কাদের সঙ্গে মিশিস? মুখের এরকম ভাষা হয়েছে?

তাতাই দাঁতে দাঁত ঘষে থেমে গেল। দাদার মতো কৌশলী ঝগড়টের সঙ্গে সে কোনও দিন পেরে ওঠে না। গাঁক গাঁক চেঁচায় ঠিকই, কিন্তু তাকেই ঢোক গিলতে হয় শেষমেশ। কত দিন যে রাগের মাথায় খাওয়া ছেড়ে উঠে গেছে তাতাই!

আজও তাতাই হাত গুটিয়ে বসেছে। অদিতি ছেলের চুল ঘেঁটে দিল,—খা, খা, খেয়ে নে।

সুপ্রতিম আড়চোখে তাতাইকে দেখে বলল,—থাক, ওকে আর অত আহ্লাদ দিতে হবে না। হ্যাঁ, কার কথা যেন বলছিলে?

সবাইকে খেতে দিয়ে নিজেও বসে গেছে অদিতি। একটু ঘুগনি মুখে তুলে বলল,—হেমেনমামা। আমার ছোটমামার বন্ধু। আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে খুব আসত। লেখক।

পাপাই মুখ তুলেছে,—লেখক? পুরো নাম কী?

অদিতি এক সেকেন্ড ভেবে বলল,—হেমেন্দ্রনারায়ণ মল্লিক।

—ওই নামে কোনও লেখক আছে বলে তো শুনিনি?

তাতাই বেঁজে উঠল,—তুই কি সব লেখকের নামও জেনে বসে আছিস? আমি হেমেন্দ্র কী যেন মল্লিকের তিনটে উপন্যাস পড়েছি।

—তুই! উপন্যাস! বাংলা! মা শুনছ…?

—আহ্ তাতাই। অদিতি ছোট ছেলের গরগরে ভাবটা থামাতে চাইল। সুপ্রতিমের দিকে ঘুরে বলল,—লেখক মানে সেরকম নামকরা কেউ নয়। এক সময়ে খুব লিখতটিখত। কবে যেন ছোটমামার ভবানীপুরের বাড়িতে গেছিল, সেখান থেকে আমার ঠিকানা জোগাড় করে এসেছে।

—হঠাৎ তোমার কাছে কেন?

—এমনিই। তেমন কিছু কারণে নয়। অদিতি কুণ্ঠিত মুখে হাসল, —আমি এক সময়ে লিখতাম-টিখতাম তো, আমাকে খুব স্নেহ করত।

—তুমি লিখতে? রাগ ভুলে তাতাই-এর চোখ বড় বড়।

—হ্যাঁরে হ্যাঁ। স্কুল ম্যাগাজিনে আমার কত কবিতা বেরিয়েছে, কলেজ ম্যাগাজিনে গল্প বেরিয়েছে, কলেজে আমাদের বাংলার টিচার অন্নপূর্ণাদি কী প্রশংসা করেছিল গল্পটার। বিশ্বাস না হয় তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখ।

—আমি! আমি কী করে জানব! সুপ্রতিম যেন আকাশ থেকে পড়ল।

—বাজে কথা বোলো না। আমি নিজে তোমাকে বলেছি। বিয়ের পর পরই। শুধু আমি কেন, মা বলেছে, দাদা বলেছে…

—ও বিয়ের সময়ে মেয়েদের ওরকম অনেক গুণের কথা শোনা যায়, সব কিছু কি সত্যি বলে ধরে নিতে আছে? ছেলেদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল সুপ্রতিম, —তোমার মা তো বিয়ের সময়ে বলেছিল তুমি নাকি দারুণ আমিষ রান্না করো, প্রথম দিন আমাদের বাড়িতে মাংস রাঁধতে গিয়ে কী করেছিলে? নুনেপোড়া! ঘ্যাঁট! নেহাত বাবা নতুন বউ-এর মুখ চেয়ে জলে ধুয়ে ধুয়ে খেয়ে নিয়েছিল।

অদিতি আহত মুখে বলল,—তুমি মাংস রান্নার সঙ্গে গল্প লেখার তুলনা করছ?

—ওই হল। দুটোই মশলা-টশলা দিয়ে পাকাতে হয়। কোনওটা লোকে চিবিয়ে খায়, কোনওটা গেলে।

—তুমি তো বলবেই। একটা বই-এর পাতাও খুলে দেখেছ কখনও? যারা এ-সব নিয়ে চর্চা করে তারা জানে গল্প লেখা কী কঠিন কাজ। জানো, হেমেনমামা আমাকে কি বলছিল আজ? বলছিল তুমি এত ভাল লিখতে… লেখাটা একদম ছেড়েই দিলে?

—অত আফসোস করার কী আছে? লেখো না, কে বারণ করেছে।

—হ্যাঁ মা, একটা আত্মজীবনী লিখে ফেলল। এক গৃহবধুর স্মৃতিকথা। পাপাই ফুট কাটল, —শেষ করতে পারলে ছাপানোর বন্দোবস্ত করা যাবে।।

তাতাই এখনও ঠাণ্ডা হয়নি। চোখ টেরিয়ে তাকাল দাদার দিকে,—কে ছাপিয়ে দেবে? তুই?

—উঁহু। বাবা। মা-র একটা বই ছাপানোর জন্য তুমি আট দশ হাজার টাকা খরচ করতে পারবে না বাবা? মা অবশ্য তোমার নামে বইতে অনেক ভাল ভাল কথা লিখে দেবে।

সুপ্রতিম হো হো হেসে উঠল,—মাত্র আট-দশ হাজার একটা ব্যাপার হল? তোর মা শাড়ির ব্যবসা করতে গিয়ে আমার কত ধসিয়েছে ইমাজিন করতে পারিস? যোলো হাজার। সিক্সটিন থাউজ্যান্ড।

অদিতি ক্ষীণ প্রতিবাদ করল,—আমি তোমায় কিছু ফেরত দিইনি?

মুরগির হাড় থেকে খুঁটে খুঁটে মাংস ছাড়াচ্ছে সুপ্রতিম। বলল,—দিয়েছ বলেই যোল হাজার বললাম, নইলে কুড়ি বলতাম।

অদিতি একদম মিইয়ে গেল। সত্যি, মাঝে কী যে ভূত চেপেছিল মাথায়। সময় কাটে না, ব্যবসা করব। সুপ্রতিমই মূলধন জোগাল। সময় কাটার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে যদি দুটো পয়সা আসে মন্দ কী! ট্যাঙোস ট্যাঙোস করে বড়বাজার থেকে পাইকারি দরে শাড়ি কিনে আনছে অদিতি, দাম ফেলে পরিচিতদের মধ্যে বেচছে। ইনস্টলমেন্টে। কুড়ি পারসেন্ট লাভ। তা ওই ব্যবসা কি অদিতিকে দিয়ে হয়! প্রথমেই ফস করে আসল দাম বেরিয়ে যায় মুখ দিয়ে, ঝুপঝাপ দাম কমিয়ে দেয়, তিনটে ইনস্টলমেন্ট শেষ পর্যন্ত ছ’টা আটটায় গিয়ে দাঁড়ায়। তাও দাম চাইতে লজ্জা করে, নিজেকে কেমন কাবুলিওয়ালা কাবুলিওয়ালা মনে হয়। কিছু কিছু আত্মীয় তো রীতিমতো শাহেনশা। খুকু, তুই কিন্তু অনেক দিন আমাকে পুজোতে শাড়ি দিস না, এটা তোর নাম করে রেখে দিলাম! তুমি যেন কত পাবে বউদি, দেড়শো! সে কী, তিনশো কী করে হয়, গত মাসে আমি দেড়শো দিয়ে এলাম না! একটা একশো টাকার নোট, পাঁচটা দশ টাকার নোট! বছরখানেক পরে বউ-এর ব্যবসার হিসেব কষতে গিয়ে সুপ্রতিমের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। দুঁদে এরিয়া সেলস ম্যানেজারের বউ হয়ে অদিতি স্বামীর সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে! অদিতি বেচারি আর কী করে, কিছু শাড়ি দামে দামে ছেড়ে কিছু নিজেই পরে ব্যবসা গুটোল। এই বিল্ডিং কমপ্লেক্সেই কিছু না হলেও তিন-চার হাজার টাকা পড়ে আছে, সে কি আর উদ্ধার হবে!

অদিতি গুম হয়ে খাওয়া সারল। রাত্রে শোওয়ার আগে চুল বাঁধতে বাঁধতে তুলল কথাটা, —ছেলেদের সামনে আমাকে ওভাবে টাকার খোঁটা দিলে?

সুপ্রতিম ঘরে এসে খবরের কাগজের পাতায় ডুবে ছিল। খবরে নয়, শেয়ারের দরে। তামাম ভারতের স্টক এক্সচেঞ্জ গেলা না হলে রাতে সুপ্রতিমের ঘুম আসে না। কোন শেয়ারের দাম পড়ছে, কোনটা চড়ল, প্রতিদিন তার হিসেব রাখা চাই। নেশা।

অদিতির কথা যেন কানে গেল না সুপ্রতিমের। অদিতি আবার বলল, —ছেলেদের সামনে আমাকে হাস্যকর প্রতিপন্ন করে তোমার কী লাভ হয়?

তরলভাবে এবার উত্তর দিয়েছে সুপ্রতিম, —হলটা কী? গজগজ করছ কেন?

অদিতির চোখে জল এসে গেল, —তুমি আমাকে ছেলেদের সামনে মিথ্যেবাদী পর্যন্ত বললে!

—যাহ্ বাবা, মিথ্যেবাদী কখন বললাম?

—বলোনি? বুকে হাত দিয়ে বলো, আমি তোমাকে আমার লেখার কথা বলিনি কোনওদিন? নিজে তুমি তখন বলেছিলে ও বাড়ি থেকে আমার ম্যাগাজিনগুলো এনে পড়বে..!

—ও, এই জন্য গোঁসা! সুপ্রতিম গাল ছড়িয়ে হাসল। খেপাচ্ছে অদিতিকে, —আমি মোটেই ও কথা বলিনি। খালি বলেছি তুমি যে লিখতে এটা আমার তেমন বিশ্বাস হয়নি।

—সেটাও তো কোনওদিন বলোনি!

—কী বলিনি?

—যে আমার কথা বিশ্বাস হয়নি!

সুপ্রতিম মুচকি হাসল, —নতুন বউকে এ কথা কেউ বলে? তুমি যদি তখন বলতে ঘোড়া চালাতে পারি, পাহাড়ে চড়তে পারি, সে কথারও আমি থোড়াই প্রতিবাদ করতাম।

—তোমার পেটে পেটে এত প্যাঁচ ছিল?

—প্যাঁচ নয়, সেলফ্ ডিফেন্স। কে আর নতুন বউ-এর মুখ ভার দেখতে চায়!

অদিতি কথা বলল না। নাকের পাটা ফুলিয়ে জোর জোর চিরুনি চালাচ্ছে চুলে। এখনও তার চুল বেশ লম্বা, কেশচর্চায় সময় যায় তার। ফিতের এক পাশ দাঁতে চেপে অনেকক্ষণ ধরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চুলের গোড়া বাঁধল। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আলগা চুল বড় পিছলে যায় বালিশে, অদিতির অস্বস্তি হয়।

বিনুনি শেষ হতে হতে অভিমানটা কমে এল অদিতির। তার রাগ ক্ষোভ অভিমান সবই শরতের মেঘের মতো ক্ষণস্থায়ী। এই বৃষ্টি, এই রোদ্দুর।

চিরুনি থেকে চুল ছাড়িয়ে অদিতি উঠে গেল জানলায়। উড়িয়ে দিচ্ছে চুল। জানলা থেকেই বলল, —হেমেনমামার চেহারাটা দেখে আজ খুব মায়া হল।

—খুব মায়াবী চেহারা হয়েছে নাকি?

অদিতি হেসে ফেলল। সুপ্রতিম বড় ফাজিল। পঞ্চাশ বছর বয়স হতে চলল, ফক্কুড়ি কমল না। হাসতে হাসতে বলল, —নাগো, কী ছিল, কী হয়েছে! প্রথম যেদিন ছোটমামার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এল, আমি তো একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কতই বা তখন বয়স হবে? সাঁইত্রিশ আটত্রিশ। আমিই তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কী দেখতে ছিল তখন হেমেনমামা! লম্বা চাবুকের মত শরীর, টকটকে রঙ, খাঁটি গ্রিকদের মতো নাক, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা… লেখক বলতে যে চেহারা মনে আসে ঠিক সেইরকম। এখন একদম ঝিরকুটি মেরে গেছে।

—মন খারাপ লাগছে?

—লাগারই তো কথা। অত সুন্দর চেহারা, ওরকম বুড়োটে মেরে গেলে…

সুপ্রতিম খুচখাচ পেনসিল চালাচ্ছিল কাগজে। গোল করে দাগ টানছিল। থামল। চালশে চশমা খুলে দোলাচ্ছে।

—প্রেমে পড়েছিলে মনে হচ্ছে?

—পড়লে তো ভালই হত। অদিতি ছদ্ম শ্বাস ফেলল, —লোকটার একটা হিল্লে হত।

—মানে? বিয়ে করেননি?

—না। সাহিত্যপাগল লোক, ওই নিয়েই থাকত। কী একটা কাগজ বার করত যেন। ছোটখাটো কাগজ। তারপর হঠাৎ একটা স্কুলে চাকরি নিয়ে আলিপুরদুয়ার চলে গিয়েছিল।

—হাফসোল কেস নাকি? কলকাতা ছেড়ে একেবারে আলিপুরদুয়ার?

—হতে পারে। আমারও তাই ধারণা।

—মেয়েটি কে? তুমি নও তো?

—যাহ্, কী যে বলো না! আমার থেকে কত বড়…। মামার বন্ধু, সে তো মামাই।

—সাউথ ইন্ডিয়াতে মামা-ভাগ্‌নি কিন্তু খুব রোমান্টিক রিলেশান। সুপ্রতিম লম্বা আড়মোড়া ভাঙল, —এমন তো হতে পারে, ভদ্রলোক তোমার নীরব প্রেমিক ছিলেন! না হলে অ্যাদ্দিন পর খুঁজে খুঁজে তোমার কাছে এলেন কেন?

—মোটেই না। বললাম তো আমার লেখা হেমেনমামার খুব ভাল লাগত। অদিতি বিছানায় এসে বসল, —হেমেনমামা কলকাতায় ফিরে আবার কাগজ বার করছে। আমাকে সেখানে লিখতে বলছিল।

—বাহ্, ভালই তো। লেখো। কি লিখবে? কবিতা, না গল্প?

—দূর, এই বয়সে আর লেখা হয় নাকি!

—কেন হবে না? যা পারবে লিখবে, উনি তো ছাপিয়ে দেবেন। সুপ্রতিম সিগারেট ধরিয়েছে। টানছে আয়েশ করে,—নিজেই তো বলো সময় কাটে না। কাটাও সময়। নাকি তাতেও আলস্য? এত কুঁড়ে কেন?

সুপ্রতিমের এই টিপ্পনিটা অদিতিকে বেঁধে খুব। অদিতি কুঁড়ে। বিয়ের পর থেকে কিভাবে দিন কেটেছে অদিতির, সুপ্রতিম কি জানে না? শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করে, দেওর ননদদের কলেজ ইউনিভার্সিটির ভাত জুগিয়ে, দুই দস্যি ছেলের পিছনে চরকি কেটে কতটুকু সময় থাকত অদিতির হাতে? ক্রমে ক্রমে সুপ্রতিমের পদোন্নতি হল, দেওর ভাল চাকরি পেয়ে চলে গেল লখনউ, দুই ননদের একে একে বিয়ে হয়ে গেল, এক বছরের তফাতে শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই গত হলেন, নতুন ফ্ল্যাট কিনে সেলিমপুরে উঠে এল অদিতিরা, তাতেও কি অবসর মিলেছিল? পাপাই তাতাই-এর পড়াশুনো নিয়ে কোনওদিন এতটুকু ভাবতে হয়নি সুপ্রতিমকে, সে শুধু সংসারে টাকা দিয়েই খালাস। আগে অফিসই তার ধ্যানজ্ঞান ছিল, এখনও অফিসই তার কাশী বৃন্দাবন। তফাতের মধ্যে তফাত, তখন ছুটত মালদা মুর্শিদাবাদ শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি, এখন ওড়ে ভুবনেশ্বর, পাটনা, রাঁচি গৌহাটি, কটক। আর মাঝে মাঝেই তার স্বর্গধাম—মুম্বাই হেডঅফিস। এরই মধ্যে দুই ছেলে মাধ্যমিক করল, উচ্চমাধ্যমিক করল, দেখতে দেখতে ঢুকে গেল কলেজে, কোনওটাই এলেবেলে ভাবে নয়, রীতিমত দাপিয়ে-দুপিয়ে, এত কিছু তো আর হাওয়ায় ভেসে ভেসে হয়নি! নিত্যি ছেলেদের স্কুলে ছোটা, এর টিউটোরিয়াল খোঁজা, ওর মাস্টার ঠিক করা, কে কোন সাবজেক্টে পিছিয়ে পড়ছে তার হদিশ রাখা, ভোরে পাপাই-এর ক্রিকেট প্র্যাকটিস তো বিকেলে তাতাই-এর সাঁতার ক্লাব, দুই ছেলের অবিরাম বায়না আবদার—এ-সব তো অদিতি কুঁড়েমি করেই সেরেছে কিনা! পাপাই যদি এ কাঁধ ধরে ঝোলে, তো তাতাই লাফায় অন্য কাঁধে। হিমশিম দশা। এর সঙ্গে বাজারহাট, সংবৎসরের হরেকরকম কেনাকাটা, লোকলৌকিকতা। পায়খানা পরিষ্কার করার অ্যাসিড কেনা থেকে শুরু করে সুপ্রতিমের টাই বাছা, সব একা হাতে করতে হয়েছে অদিতিকে।

আজ সুপ্রতিম বলে অদিতি কুঁড়ে!

হ্যাঁ, এখন অদিতির সময় অঢেল। দুপুর বিকেল সন্ধে অনেকটাই এখন হাতের মুঠোয়। ছেলেরা আর গায়ে লেপটে থাকে না। অদিতির অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশনের পর থেকে দু বেলা রান্নার লোক রাখা হয়েছে। পাপাই অল্পস্বল্প বাজারহাট করে দেয়। আর সুপ্রতিম তো নটার আগে বাড়িই ফেরে না। ফাঁকা ফ্ল্যাটে অদিতির তো এখন সময়ই সময়।

সময় আছে। সময় চলেও গেছে।

যে যায়, সে তো চলেই যায়। নদীর এক জলে কি দ্বিতীয়বার স্নান করতে পারে মানুষ? এই বয়সে লেখার কথা ভেবে লোক হাসিয়ে লাভ কী? তার চেয়ে বোধহয় কুঁড়েমির অপবাদ শোনা ঢের ভাল।

অদিতি ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। রাত্রে গলাটা বার বার শুকিয়ে যায়, ঘরে জল এনে রাখতে হবে।

সুপ্রতিম অ্যাশট্রেতে সিগারেট নেবাচ্ছে। ডাকল অদিতিকে, —এই, টেবিল থেকে আমার ফাইলটা দাও তো।

—তুমি এখন শোবে না? কাজ নিয়ে বসবে?

—না না, দেখব একটু। এই পাঁচ দশ মিনিট।

ফাইল দিয়ে অদিতি রান্নাঘরে এল। গ্যাসের ওপর গরম দুধ রেখে গিয়েছিল, ঠাণ্ডা হয়েছে, এবার ফ্রিজে তুলতে হবে। কম্পাউন্ডে আজকাল প্রায় রাতেই চোর আসছে, পরশুদিনও রেনপাইপ বেয়ে পাশের ফ্ল্যাটে উঠেছিল। চোররা একটু জিপসি ধরনের হয়, এক পাড়ায় তারা বেশিকাল ঘাঁটি গাড়ে না। তবু সাবধানের মার নেই, রান্নাঘরের জানলা ভেতর থেকে ভাল করে দড়ি বেঁধে বন্ধ করল অদিতি। দশ বছর হল ফ্ল্যাটে এসেছে, এর মধ্যে একবার মাত্র কলি ফেরানো হয়েছে, তাও প্রায় চার বছর আগে। রান্নাঘরের দেওয়ালের অবস্থা বেশ খারাপ, এই শীতেই বাড়িটা রঙ করাতে হবে। রান্নাঘরে কি আরও ফুটখানেক টাইলস লাগিয়ে নেবে? নিলে হয়।

বাথরুম সেরে, জলের জগ হাতে ঘরে ফিরছিল অদিতি, অভ্যেসবশে ছেলেদের ঘরে উঁকি দিল একবার। বড় আলো নেবানো, তাতাই নিজের খাটে ঘুমোচ্ছ। রেগে থাকলে বেশি রাত অবধি টিভি দেখে না তাতাই, ফোলা মুখে ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলেমানুষ। টেবিলল্যাম্প জ্বেলে পড়াশুনো করছে পাপাই। দিনের বেলা পাপাই বই ছোঁয় না, রাতই তার পড়ার সময়। জেগে থাকতেও পারে বটে। একটাই শুধু অনুষঙ্গ প্রয়োজন। কফি। হায়ার সেকেন্ডারির সময় থেকে ধরেছে নেশাটা। ছেলে চাইলেও অদিতি অবশ্য এখনও খুব কড়া কফি দেয় না পাপাইকে, বেশি করে দুধ দিয়ে দু আড়াই কাপ মতন ফ্লাস্কে ভরে দেয়। কফি তাও ভাল, ভাগ্যিস তাতাই-এর মতো সিগারেটের নেশা হয়নি! ওইটুকুনি পুচকে তাতাই-এর গা দিয়ে কী ভুক ভুক তামাকের গন্ধ বেরোয়! সুপ্রতিম শুনে বলেছিল, আমি ওই বয়সে বিড়ি খেতাম! হুঁহ্, বাপ কা বেটা।

অদিতি ঘরে এল।

এক ঢোক জল খেয়ে ড্রেসিংটেবিলে জগ রাখল অদিতি, পাখাটা দু পয়েন্ট কমিয়ে দিল। ভোরের দিকে বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে আজকাল, পাখার হাওয়ায় শীত শীত করে। এ ঘরের দুটো জানলাই উত্তরমুখী, তাই শীতলতাও বেশি। ঠাণ্ডার সময় দিনদুপুরে হাড় কাঁপে।

মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়েছে সুপ্রতিম। ঠিক শোয়ওনি, আধশোওয়া, ফাইল পড়ছে।

অদিতি অপ্রসন্ন মুখে বিছানার ভেতরটা দেখল, —আজও তুমি সুজনি দুটো নাওনি?

—সরি। ভুলে গেছি।

—এত ভুলো মন কেন? মশারি টাঙানো, আর বিছানায় বালিশ চাদর নেওয়া, এই দুটোই তো তোমার কাজের মধ্যে কাজ। তাতেও রোজ ভুল?

—বলছি তো সরি। নিয়ে নাও না। সুপ্রতিম চশমা মাথার পিছনে রাখল। ফাইলটাও। হাই তুলতে তুলতে বলল, —আমার অত সুজনি ফুজনি লাগে না। তোমারই শীত বেশি।

—তাইই তো। ভোরবেলা আমিই খকখক কাশি কিনা! বাক্স খাটের গহ্বর খুলে সুজনি বার করল অদিতি, আলতো ঢুকিয়ে দিল বিছানায়।

আশপাশে কোথাও টিভি চলছে, বোধহয় কেবল্ টিভির সিনেমা। শব্দটা চাপা কোলাহলের মতো ভেসে আসছে ঘরে। কোনও ফ্ল্যাটে ঝনঝন বাসন পড়ল, কোথাও কেউ একটা চিৎকার করল হঠাৎ, বাঁকের মুখে এসে শিয়ালদাগামী শেষ লোকাল ট্রেন তীক্ষ্ণ হুইসিল্ বাজাচ্ছে, সমস্ত শব্দই বড় জ্যান্ত লাগে এ সময়ে।

অদিতি বিছানায় এল। মশারির চালে রাখা বেডসুইচ টিপে অন্ধকার করল ঘর।

সুপ্রতিম চিত হয়ে শুয়েছে। বলল, —গোলমালে কথাটা বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম। আমার একটা ভাল নিউজ আছে।

—কী?

—সামনের মাস থেকে আর শেয়ার ট্যাক্সির ধান্দা করতে হবে না, অফিস গাড়ি দিচ্ছে।

—তাই?

—ইয়েস। অবশ্য আমার একার জন্য নয়। যাদবপুরে অ্যাকাউন্ট্স-এর সেন আছে, ও আর আমি যাব। অফিসে গাড়িটা টোটালি আমার কনট্রোলে থাকবে।

—হুঁ।

—হুঁ হুঁ করছ কেন? মানেটা বুঝছ? কোম্পানিতে আমার ইম্পর্টেন্স বাড়ছে। যদ্দূর আমার কাছে খবর আছে মুম্বই অফিস ইজ টেকিং অ্যাকটিভ ইন্টারেস্ট অন সুপ্রতিম মজুমদার। একটা বড় পে-হাইক হতে পারে।

—ভাল তো।

—ভাল, কিন্তু প্রবলেমও আছে। শুনছি জেমসন ইন্ডিয়া নাকি আমাদের সঙ্গে অ্যামালগামেট করে যাবে। নামেই অ্যামালগামেশান, ওদের যা ক্যাপিটাল, গিলেই নেবে আমাদের। এমনি কিছু না, মাইনে পত্তর পার্কস ফার্কস নিয়ে প্রবলেম নেই, তবে মাথার ওপর একগাদা আন্‌নোন্ লোক এসে যাবে… পঁচিশ বছর চাকরি করছি, এখন কি আর উটকো লোকের দাপট ভাল লাগবে? …আমার একটা ওয়ার্কিং প্যাটার্ন আছে, সে সব যদি তাদের পছন্দ না হয়…

এ সব কথা মনোযোগ দিয়েই শোনে অদিতি। তার স্বামী একজন কর্মঠ মানুষ, খেটে খেটে উঁচুতে উঠেছে, ফাঁকিবাজি স্বভাব নেই, কোম্পানিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, চোর জোচ্চোর ঘুষখোর লোভী নয়, এমন লোকের কাজকর্মের গল্পে স্ত্রীর আগ্রহ থাকাটাই তো স্বাভাবিক। সুপ্রতিমের চোখ দিয়ে ভিন্ন স্বাদের বৃহত্তর পৃথিবীর সন্ধান পাওয়া, এই বা কি কম প্রাপ্তি অদিতির?

শুনতে শুনতে অদিতি ডুবতে থাকে সুখের নিদ্রায়। ঘুমপাড়ানিয়া গানের মতো কথা বলে যেতে থাকে সুপ্রতিম। একাই। সেলস লাইনে চাকরি করার সব থেকে বড় সুবিধে তার কথা কেউ শুনছে কি না তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হয় না। কথা বেচেই খাওয়া। কথা বলেই সুখ। কথা শুনিয়েই ঘুম।

আজও ঘুমিয়ে পড়েছিল অদিতি। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। ব্যালকনিতে পাখিটা ভীষণভাবে ডানা ঝাপটাচ্ছে।

অদিতি সুপ্রতিমকে ঠেলল, —এই, কার্নিশে বেড়াল এসেছে বোধহয়। একটু দ্যাখো না।

সুপ্রতিমেরও চোখে তন্দ্রা এসেছিল। বিরক্ত-মুখে বলল, —একটু ঝাপটাক ডানা। আমাদের গ্রিল দিয়ে বেড়াল ঢুকতে পারবে না।

অদিতি আলো জ্বালাল, —নাগো, পাখিটা খুব ভয় পাচ্ছে। যাও না একটু বেড়ালটাকে তাড়িয়ে দিয়ে এসো।

—আমি পারব না। তোমার পাখি, তুমিই যাও।

—প্লিজ যাও। আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না।

—জ্বালালে। দুম দুম করে বিছানা থেকে উঠে গেল সুপ্রতিম। একটু পরেই ফিরে এসেছে। পাখিটাও নীরব।

অদিতি কোমর অবধি সুজনি টেনে নিল, —বেড়াল এসেছিল, না?

—দ্যুৎ, সেই কোন ওদিকের পাঁচিলে বসে আছে… পাখিটা তোমার একেবারে রাম বোকা।

—এখনও আছে বেড়ালটা? তা হলে তো আবার এক্ষুনি ডানা ঝাপটাবে!

—আর ঝাপটাবে না। খাঁচাটাকেই চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। ও ব্যাটা বেড়ালটাকে আর দেখতেই পাবে না।

সুপ্রতিম আলো নিভিয়ে দিল।

.

০৩.

নিস্তরঙ্গ পুকুরে এক কুচি ঢিল পড়লেও তরঙ্গ ওঠে বইকী। তবে সেই তরঙ্গের স্থায়িত্ব আর কতটুকু? দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড, বড় জোর এক মিনিট! এ তরঙ্গ বড় মৃদু, শক্তিহীন। দুর্বল বৃত্তাকার ঢেউ হয়তো একসময়ে কাঁপতে কাঁপতে পাড়ে এসে পৌঁছয়, কিন্তু তখন তার অস্তিত্বই অনুভব করা কঠিন। স্থির পুকুরের দিকে তাকিয়ে কে তখন বলবে, একটু আগে ঢিল পড়েছিত এখানে!

হেমেনমামা নামক মানুষটিরও চকিত আগমন অদিতির কাছে অনেকটা এই গোত্রেরই ঘটনা। ছোট্ট এক সুখস্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে অদিতির মনোজগতে ক্ষীণ আলোড়ন জাগিয়েছিল হেমেনমামা, ক্ষণকাল অদিতির চিত্ত উদ্বেল রইল তাতে, তারপর আবার সব স্বাভাবিক। সংসারের পাড়ে অচিরেই হারিয়ে গেল তরঙ্গ, কোনও অভিঘাতই সৃষ্টি করতে পারল না।

অদিতিও নিশ্চিন্ত। খাঁচার পাখির সঙ্গে সময় কাটছে তার, স্বামী ছেলেদের ভাবনা ভেবে দিন যাচ্ছে তার, সময়কে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার করছে সময়।

অথবা সময় কাটছে না।

তাতেই বা অদিতির কী এল গেল? সময় তো আর সত্যি সত্যি নিশ্চল অনড় এক পাহাড় নয়, যেমন ভাবেই হোক সে ঠিক গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাবে।

যাচ্ছেও তো। সুপ্রতিম গত সপ্তাহে তিনদিনের জন্য গৌহাটি ঘুরে এল, এই শনি রবিবার বন্ধুদের সঙ্গে দীঘায় উইকএন্ড কাটিয়ে এল তাতাই, পড়াশুনা নিয়ে আরও বেশি রাত জাগা শুরু হয়েছে পাপাই-এর। এও তো অদিতির দিন কাটা।

আলমারি খুলে শাড়ি বাছছিল অদিতি। হ্যাঙারে সার সার শাড়ি ঝুলছে, সবই দামি। কাঞ্জিভরম্ ঢাকাই কলাক্ষেত্রম্ বালুচরী বমকাই চান্দেরি। অদিতির পুজোর শাড়ি নিজে পছন্দ করে কেনে সুপ্রতিম, সেই বিয়ের পর থেকেই। বেশিরভাগই চড়া রঙ-এর। ঘোরতর রঙিন না হলে সুপ্রতিমের মনে হয় বুঝি ঠকা হল দামে।

বাসন্তী রঙ কাঞ্জিভরমটা বার করে উল্টেপাল্টে দেখল অদিতি। নাহ্, এটা পরে যাবে না, একটু নোংরা হয়ে আছে। ছোট ননদের দেওরের বিয়েতে শেষ পরেছিল শাড়িটা, শ্রাবণে। তারপর আর কাচানো হয়নি। এত শাড়ির কটাই বা পরা হয় অদিতির! তবু কেনা হয়, তবু ঝোলে। ঘেঁটে ঘেঁটে অদিতি এবার একটা বম্কাই সিল্ক বার করল। এ শাড়িটারও রঙ বেশ চড়া, তুঁতে নীল। ছেলেরা বড় হয়েছে, এত গাঢ় রঙ আর পরতে ভাল লাগে না অদিতির। কিন্তু উপায় নেই। সুপ্রতিম আর অদিতির মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি আছে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ির কোন অনুষ্ঠানে অদিতি নিজের পছন্দমতো শাড়ি পরতে পারে, কিন্তু সুপ্রতিমের বন্ধুবান্ধবের বাড়ি গেলে সুপ্রতিমের পছন্দের শাড়ি পরতে হবে অদিতিকে। থাক, এটাই থাক তবে। এই শাড়িটার রঙ তাও চোখে একটু কম লাগে।

শাড়ি ব্লাউজটায় হালকা ইস্ত্রি চালাতে চালাতে তাতাই-এর গলা পেল অদিতি। বাড়ি ফিরেই হুকুম জারি শুরু করেছে, —সবিতাদি, আমাকে শিগগিরই কিছু খেতে দাও। এক্ষুনি আবার বেরোতে হবে।

অদিতি দরজায় গেল, —এক্ষুনি তো ঢুকলি, এই সন্ধেবেলা আবার কোথায় বেরোবি?

—কাজ আছে মা।

—কী কাজ?

—আছে।

তাতাই হেলেদুলে নিজেদের ঘরে ঢুকছে, অদিতি পিছন পিছন এল, —তোর ব্যাপার কী বল তো? সারাদিনে তো কখনও তোকে বই খুলতে দেখি না?

তাতাই সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাতের চেটোয় মাথা রেখে ফুঃ ফুঃ শব্দ করছে মুখে। মাকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, —কে বলেছে পড়ি না? আমি ভোরবেলা পড়ি।

—বাজে কথা বলিস না। উঠিসই তো সাতটার পর।

—তা হলে তখনই পড়ি।

—ফের বাজে কথা? উঠে তুই কী করিস আমি দেখি না? এক ঘণ্টা ধরে খবরের কাগজ চটকাস, তারপর টুক করে কোথায় বেরিয়ে গেলি, তারপর ফিরে এসেই হুড়ুদ্দুম করে কলেজ। …এর মধ্যে তুই পড়িসটা কখন?

তাতাই উত্তর দিল না। চোখ বুজে রয়েছে।

তাতাইটা চিরকালই এরকম। মহা ফাঁকিবাজ। জোর করে ধরে বেঁধে পড়াতে না বসালে পড়তই না। কম মার খেয়েছে অদিতির হাতে! স্কুল পালিয়ে সিনেমা যেত। টিউটোরিয়ালে ডুব মারত। নজর না রাখলেই বিপত্তি। অথচ আশ্চর্য, তাতাই রেজাল্ট কিন্তু খারাপ করেনি কখনও। পাপাই-এর মতো অত ভাল না হলেও মাধ্যমিকে স্টার, উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশান। উচ্চমাধ্যমিকের পর সায়েন্স ছেড়ে কমার্সে চলে গেল। জেদ করে। গ্র্যাজুয়েশানটাও কি এ-ভাবে পার হবে তাতাই? তারপর?

অদিতি পায়ে পায়ে ছেলের কাছে এল, —হ্যাঁ রে, তোর দাদাকে দেখেও একটু শিখতে ইচ্ছে করে না?

তাতাই তড়াং করে উঠে বসেছে, —প্লিজ মা, কতদিন বলেছি দাদার সঙ্গে আমার তুলনা কোরো না। ও তো একটা বুকওয়ার্ম। পড়া, লাইব্রেরি, নোটস, স্যার এ ছাড়া ওর কোনও জগত আছে? আমি ওর মতো হতে চাই না।

দুই ভাই-এ যে আকাশপাতাল তফাত এ সত্যটা বহুকাল আগেই টের পেয়েছে অদিতি। শুধু পড়াশুনো কেন, কোন্ বিষয়েই বা দুজনের মিল? পাপাই-এর টেবিল বইখাতা জামাকাপড় খাটবিছানা নিখুঁত গোছানো, তাতাই-এর সবই চূড়ান্ত এলোমেলো। আগে আগে অদিতি নিজের হাতে পরিষ্কার করত এ ঘর, এখন অদিতি ছুঁলেই নাকি তাতাই আর দরকারি জিনিস খুঁজে পায় না!

অদিতি ছেলের খাটে বসল, —কার মতো হতে চাস তুই?

সবিতা পরোটা তরকারি দিয়ে গেছে, দ্রুত গিলছে তাতাই। গাল ভরতি খাবার নিয়ে বলল, আমি আমার মতোই হতে চাই মা। দুনিয়ায় এক পিসই তাতাই থাকবে।

—সে তো তুমি এখনই আছ।

তাতাই ঢকঢক জল খেল খানিকটা, —তুমি আজ আমার পেছনে পড়লে কেন বলো তো? তোমার আজ একটা নেমন্তন্ন আছে না?

—কথা ঘোরাস না তাতাই। জীবনের সব পরীক্ষায় স্টেজে বাজিমাৎ হয় না।

অদিতির আঁচলে মুখ মুছে নিল তাতাই, —আজ রূপককাকুর ম্যারেজ অ্যানিভারসারি না? বাবা সেদিন বলছিল গ্যালা টুয়েন্টিফাইভ ইয়ারস…।

ছেলের কায়দায় অন্যদিন হেসে ফেলত অদিতি, আজ একটু রুক্ষই হয়ে গেল, —অনেকদিন আমার হাতে কিন্তু মার খাসনি তাতাই। কোথায় টো-টো করিস দিনরাত? কলেজ টলেজ যাস?

—তোমার খোচড়কে পাঠিয়ে খবর নিয়ে নিয়ো। চোখের ইশারায় দাদার খাটটা দেখাল তাতাই। হাসছে, —বাবা কখন আসবে বলেছে? ছটা? বলেই তাতাই ঘড়ি দেখল একবার—এখন কিন্তু পৌনে সাতটা বাজে। বাবা ঠিক সাড়ে সাতটায় ঢুকবে। এখন থেকে সাজগোজে বসে না গেলে ম্যানেজ করতে পারবে না।

তাতাই উঠে পড়ল। বেরোচ্ছে। অদিতিকে আমল না দিয়েই। ফ্ল্যাটের দরজা অবধি গিয়েও ফিরে এল। দু হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে, —তোমাদের ফ্লাওয়ার বোকে টোকে লাগবে না? টাকা দাও তো এনে দিতে পারি।

—থাক। যেখানে চরতে যাচ্ছ যাও।

তাতাই দাঁড়িয়েই আছে। গাল চুলকোচ্ছে, —তা এমনিই কিছু দাও না। খুব বেশি নয়, গোটা পঞ্চাশ।

অদিতি কঠোর চোখে ছেলের দিকে তাকাল। পরশুই পঞ্চাশ টাকা নিয়েছিল তাতাই, আজ আবার চাইছে, কী করছে টাকা নিয়ে? শুধু সিগারেটে তো এত টাকা লাগে না?

মায়ের চোখ দেখে দু হাত তুলে দিয়েছে তাতাই, —ওকে। লাগবে না। ভুরুটা সোজা করে নাও। নইলে রূপককাকুর বাড়িতে বাবার বদনাম হবে।

তাতাই চলে গেল।

ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসেও তাতাইকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল অদিতির। ছোট ছেলেটার বিপদের দিকে একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে। ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ে সাঁতার শেখার জন্য খুব আবদার জুড়েছিল তাতাই, দুরন্ত ছেলেকে জলে ছাড়তে অদিতি রাজি হয়নি প্রথমে। বলেছিল, তুমিও দাদার সঙ্গে ক্রিকেট প্র্যাকটিসে যাবে। উহু, সাঁতারই শিখবে সে। কদিন মার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করার পর ওইটুকু ছেলে একদিন একা একাই চলে গেছে লেকে। এমন সেয়ানা, বন্ধুকে দিয়ে খবরটা পাঠিয়েও দিয়েছে বাড়িতে। অদিতি হাঁচোড়-পাচোড় করে ছুটে গিয়ে দেখে পাবলিক সুইমিং পুলে হাত পা ছুড়ছে তাতাই। জল খাচ্ছে মাঝে মাঝে, তবু মাকে দেখে কী হাসি! হিড়হিড় করে বাড়ি নিয়ে এসে ছেলেকে খুব পিটিয়েছিল অদিতি, পরদিন ভরতিও করে দিয়েছিল সাঁতার ক্লাবে। একবার তো, এই বছর দু-এক আগে, বন্ধুর দাদার মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে হাত পা ফালা ফালা করে এল। আবার কোনও বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠছে না তো তাতাই?

বলে না। কিছুই বলে না। পাপাই তো বহুদিনই চুপচাপ, তাতাইও এড়িয়ে চলছে! আগে তাও ছেলেদের ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলো বুঝতে পারত অদিতি, এখন ছেলেরা তার চেনা না অচেনা এই নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে অনুক্ষণ। যদি কখনও মানুষ আবিষ্কার করতে থাকে তারই শরীরের অংশ একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, সেই বিচ্ছিন্ন অংশদের হাত পা মুখ গজাচ্ছে ধীরে ধীরে, আলাদাভাবে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে তারা, তখন যে ঠিক কী অনুভূতি হয়!

অন্যমনস্ক মুখে সাজগোজ সারল অদিতি। খুব একটা প্রসাধন সে কোনওদিনই করে না। মুখে একটু হালকা ক্রিম কিংবা ফেসপাউডার, চোখে সামান্য কাজল, ছোট টিপ, আলতো লিপস্টিক, কিছু ছোটখাটো গয়না, এইটুকুই। তার চেহারাটা আগে বেশ ছিপছিপে ছিল, ইদানীং মেদ জমছে শরীরে, অপারেশনের পর থেকে শরীরটা যেন একটু ভারীই হয়ে গেল। তবে তার মুখ থেকে যৌবনের কমনীয়তা পুরোপুরি মুছে যায়নি। এক ঢাল কালো চুলে, ফর্সা ভরাট মুখে অদিতি এখনও দীপ্তিময়ী। সুপ্রতিমের বন্ধুমহলে অদিতির রূপের খ্যাতিতে ভাঁটা পড়েনি এখনও।

সুপ্রতিম এল ঠিক সাড়ে সাতটায়। যেন তাতাই-এর কথা শুনেই। এসেই হাঁক ডাক শুরু করে দিল, যেমনটি এ ধরনের পার্টিতে যাওয়ার আগে সে করেই থাকে। একী, আমার জন্য ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি বার করেছ কেন, এটা নয়, তসরের সেটটা দাও। দেখি দেখি তোমার মুখটা দেখি, টিপটা একটু বড় পরতে পারতে। আমার ইলেকট্রিক রেজারটা পাপাই-এর ঘরে আছে বোধহয়, বসে রইলে কেন, দেখো না। ওফ্, তোমার কোনও সেন্স নেই, এই পাঞ্জাবির সঙ্গে আমি ওই জ্যাকেট পরব! আর একটু লিপস্টিক লাগিয়ে নাও, মুখটা ম্যাড়ম্যাড় করছে। কেমন হয়েছে বোকেটা বললে না তো! নিউমার্কেট থেকে করিয়ে আনলাম! টু থারটি! শালা আমাকে তিনশো বলছিল!

বেরনোর সময়ে মনটা খুঁতখুঁত করছিল অদিতির। সবিতা রান্না করে চলে গেছে, পাপাই ফেরেনি, মিনিট পাঁচ দশ আরও দেখে গেলে হত। কিন্তু সুপ্রতিম যা তাড়া লাগাচ্ছে! কোথাও যাওয়ার থাকলে সুপ্রতিম কখনই সময়ে বাড়ি ফেরে না, কিন্তু একবার বাড়ি এলে এক মিনিটও তর সয় না তার। অগত্যা পাশের ফ্ল্যাটে চাবি রেখেই বেরিয়ে পড়তে হল অদিতিকে।

রূপকদের বাড়ি বেশ দূর। বেহালা চৌরাস্তা পেরিয়ে। ট্যাক্সিতে প্রায় মিনিট কুড়ি লাগে। মহাবীরতলায় এ সময়টায় ট্রাফিক জ্যাম থাকে, আর একটু বেশিও লাগতে পারে।

রাত্রি গাঢ় হচ্ছে। কাল থেকে ঠাণ্ডাও পড়েছে বেশ। মাঝে মাঝে হাওয়া দিচ্ছে একটা, কামড় আছে হাওয়াটায়। মাঝ-অঘ্রানে এই হাল, শীত বোধহয় এবার জাঁকিয়ে আসবে।

ট্যাক্সির একটা কাচ খানিকটা উঠিয়ে দিল অদিতি, গলায় আলতো আঁচল জড়াল। সুপ্রতিম সিটে হেলান দিয়ে বসে, গানের কলি ভাঁজছে গুনগুন।

অদিতি বলল, —কায়দা করে জ্যাকেট না পরে গরম কিছু একটা পরতে পারতে।

—ছাড়ো তো, একি আবার ঠাণ্ডা নাকি? ঠাণ্ডা ছিল গৌহাটিতে। …ফিরবার সময়ে তো গরম হয়েই ফিরব।

অদিতি মুখ ফিরিয়ে নিল। তাতাইটা একটা পাতলা টিশার্ট পরে বেরিয়ে গেল, ঠাণ্ডা না লাগে। বাচ্চাবেলায় খুব সর্দির ধাত ছিল তাতাই-এর, গোটা শীতটা ভুগত। সাঁতার কেটে কমেছিল অনেকটা। মাধ্যমিকের পর থেকে আর সাঁতারে যাচ্ছে না তাতাই, ভোগান্তিও শুরু হয়ে গেছে। সিগারেট কটা করে খায় কে জানে!

আনমনে অদিতি বলল, —কোনওদিন তো সংসারের দিকে দেখলে না, ছোট ছেলেটার দিকে নজর করেছ?

ফুলের তোড়া পাশে রেখে সিগারেট ধরিয়েছে সুপ্রতিম, বলল, —কেন, তার আবার কী হল?

—হবে আবার কী। বড্ড ডোন্ট কেয়ার ভাব এসে গেছে।

—এই বয়সে ওরকম হয়। জোশ্। নতুন পাখনা গজাচ্ছে…। সুপ্রতিম টোকা দিয়ে দেশলাই কাঠি বাইরে ফেলল।

অদিতি একটু ভাবল। ছেলেদের নিয়ে সুপ্রতিমের সঙ্গে সে সচরাচর আলোচনা করে না, এটা তার নিজস্ব এলাকা।

তবু আজ চুপ থাকতে পারল না। বলল,—আমার তাতাই-এর সঙ্গীসাথীদের একটুও পছন্দ নয়।

—ওর তো চিরকালই সব রকম বন্ধু আছে। ভাল। খারাপ।…দু’-চারটে খারাপ বন্ধু থাকা ভাল। তাতে ছেলে বিগড়োয় কম। দ্যাখো না, বড় রোগ আটকাতে শরীরে ছোটখাটো জার্ম ঢোকাতে হয়? নইলে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় না। সুপ্রতিম বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাচ্ছে। দুল্‌কি চালে বলল—আমার সব বন্ধুরাই কি ধোয়া তুলসী পাতা ছিল নাকি? সীতেশ বলে আমার একটি হেভি ইন্টিমেট বন্ধু ছিল, সে পরে গ্যাঙ্‌রেপের কেসে আসামী হয়ে যায়। ওরকম বন্ধু ছিল বলে আমি কি বখে গেছি?

—তা নয়। তবু….

—অত পুতুপুতু কোরো না তো। সবার সঙ্গে না মিশলে ভাল খারাপ চিনবে কী করে? তা ছাড়া সকলেরই কিছু না কিছু সৎ গুণ থাকে। সীতেশ কী সুন্দর কথা বলতে পারত। কাউকে কিছু বোঝাতে হলে দু’ মিনিটে কন্ভিন্স করে ফেলত। আমি তো ওর কাছে কথা বলার টেকনিক শিখেছি। মোদ্দা কথা হল, যে যার কাছ থেকে যা নেয়…

অদিতি অল্প বিমর্ষ হয়ে গেল। সুপ্রতিমের সঙ্গে পাপাই তাতাইকে নিয়ে যদি কখনও আলোচনা করতে যায়ও, সঙ্গে সঙ্গে যেন বিরোধী পক্ষ হয়ে যায় সুপ্রতিম।

গোমড়া মুখে অদিতি বলল—আমি তো বলিনি ওর সঙ্গীসাথীরা বদ, বলেছি ওদের আমার পছন্দ হয় না। কেমন যেন। আপস্টার্ট। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে মনেই হয় না। কেমন বেনিয়া বেনিয়া ভাব। গাড়ি রয়েছে, মোটর সাইকেল রয়েছে…দামি দামি জামাকাপড় পরে…

—তা হলে তো ভাল খবর। ছেলে বেশ তালেবর হয়েছে। ওস্তাদ ওস্তাদ বন্ধু জোগাড় করেছে।

—হুঁহ্, তালেবরই বটে। কী খরচের হাত হয়েছে জানো? পরশু পঞ্চাশ টাকা নিল, আজ আবার টাকা চায়…

—তাই? সিগারেটে শেষ টান দিয়ে জানলার বাইরে ছুড়ল সুপ্রতিম। মুখে হাসিটি ধরে আছে—কাল তো ছোকরা আমার কাছ থেকে একশো টাকা নিল।

—তুমি তো আমাকে বলোনি? অদিতি রুক্ষ হল সামান্য।

—বলার কী আছে? চাইল…। অদিতির মুখ দেখে হুবহু তাতাই-এর মতো হাত তুলেছে সুপ্রতিম—ঠিক আছে, আর দেব না।

অদিতি গুম হয়ে গেল। ছেলেদের এই আগ্‌লা আদর দেখানোর স্বভাবটা আগাগোড়াই আছে সুপ্রতিমের। দুই ভাই এক খাটে শোবে না, শুলেই মারামারি, দুই ছেলের জন্য আলাদা আলাদা খাট এসে গেল। তাতাই দাদার পুরনো প্যান্টজামা পরবে না, পুরনো বই ছোঁবে না, অতএব সেগুলো ফেলে দাও। একই জিনিস ডবল ডবল কিনে আনো। টেবিল চেয়ার আলমারি বুকসেলফ। দাদার যা আছে, ভাইয়েরও অবিকল তাই চাই। একবার অদিতি পাপাইয়ের জন্য একটা বড় ওয়াটার বটল্ এনেছিল, তাতাইয়ের জন্য একটু ছোট, সারাদিন পা ছড়িয়ে বসে কেঁদেছিল তাতাই। অদিতি বলেছিল, যত খুশি কাঁদ, ওই ওয়াটার বটল্ই ব্যবহার করতে হবে তোকে। সুপ্রতিম দু’ দিনের মধ্যে পাপাইয়ের মতো একটা জলের বোতল এনে দিল তাতাইকে। কী খারাপ অভ্যেস! পাপাই অবশ্য মুখে তেমন আব্‌দেরে ছিল না কোনওদিনই, তবু তাকেও কম দিয়েছে সুপ্রতিম! পুজোর বাজারে বেরিয়ে সব থেকে দামি পোশাকটির দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকত পাপাই, নামিয়ে হাত বোলাত, সরাসরি চাইত না। সুপ্রতিম কিন্তু কিনে ফেলেছে সঙ্গে সঙ্গে। পাঁচশো সাতশো কুছ পরোয়া নেই। অত দামি জিনিস কিনে দিতে গা কিচকিচ করত অদিতির, মনে হত দু’ দিন বাদেই তো ছোট হয়ে যাবে, এত অপচয়! সুপ্রতিম নিরুত্তাপ। ফর হুম আই অ্যাম আর্নিং মানি ম্যাডাম! ছেলেদের ভালভাবে মানুষ করার জন্যই তো, নাকি! কী বলবে অদিতি, সে তো শুধু কাজের লোক। হ্যাঁ, গালভরা অনেক নাম আছে বটে! স্ত্রী! মা!

ট্যাক্সি অনেকটা পথ চলে গেছে। নিউআলিপুর পেরিয়ে তারাতলার মোড় ঘুরল। রাস্তাঘাটে পথচারী কমে এসেছে, হয়তো চকিত ঠাণ্ডাটার জন্যই। গাড়িঘোড়ার ভিড় আছে, তবে তাও যেন আজ তেমন বেশি নয়।

সুপ্রতিম কাঁধ ছুঁল অদিতির—কেন এরকম মুড অফ করছ? একটা আনন্দের পরিবেশে যাচ্ছি…। আরে বাবা, তুমি হলে আমার সংসারের স্টিয়ারিং, সবাই আমরা তোমার কন্ট্রোলে থাকি। তোমার যা পছন্দ হবে না, স্ট্রেটকাট বলে দাও। দ্যাখো তোমার কথা কেউ শোনে কিনা।

অদিতি কিচ্ছু বলল না। বড় করে নিশ্বাস নিল একটা। বাতাসটা অনেকক্ষণ জমিয়ে রাখল বুকে। ছাড়ল। হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল মুখে। ফুটল কি?

রূপকদের বাড়িটা দোতলা। নতুন। খুব বড় না, ছোটই। কিন্তু একদম রাস্তার ওপরেই। রূপক দোতলায় ছিল, সুপ্রতিমদের ট্যাক্সির আওয়াজ পেয়ে তরতরিয়ে নেমে এসেছে নীচে—কীরে, তোরা এত দেরি করলি?

—আর বলিস না। সুপ্রতিম টেরচা চোখে বেমালুম দেখিয়ে দিল অদিতিকে—পালিশ চুনকামে এত টাইম লাগাল! এই শাড়ি চলবে না, ওই শাড়ি চলবে না…

অদিতি কটমট করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সুপ্রতিম রূপকের হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে—মেনি হ্যাপি রিটার্নস্‌ অফ দা ডে। শালা, একসঙ্গে পঁচিশটা বছর পার করে দিলি মাইরি!

অদিতির বাড়িয়ে দেওয়া ফুলের তোড়া গদার মতো হাতে ঝুলিয়ে নিল রূপক। গর্বিত মুখে বলল—অফকোর্স। আশা করছি আরও পঁচিশ বছর কাটাতে পারব।

—দ্যাটস্ দা স্পিরিট। বন্ধুর কাঁধে জোর চাপড় মারল সুপ্রতিম, —মাল টাল কী আছে রে?

—যা চাস্। হুইস্কি রাম জিন ভদ্কা ব্র্যান্ডি। শ্যাম্পেনও একটা ছিল। ফ্রেঞ্চ। তোরা দেরি করলি, শেষ হয়ে গেল।

—কুছ পরোয়া নেই। …কে কে এসেছে?

—সব্বাই। সোমন তথাগত অনিরুদ্ধ…শুধু দীপকটা আসতে পারল না। ওর এমন একটা বিশ্রী ফ্যাচাং চলছে! বলতে বলতে আজকের দিনের জন্য ধুতিপাঞ্জাবি পরে নিপাট বাঙালি সেজে থাকা রূপক ঘুরল অদিতির দিকে—এই তুমি ভেতরে যাও না। সীমারা সবাই তোমার জন্য ওয়েট করছে।

পার্টি বহুক্ষণ শুরু হয়েছে। বিয়ের রজত জয়ন্তী বলে কথা, উৎসবটা বেশ ঘটা করেই করছে রূপক। বন্ধুবান্ধব ছাড়া রূপকের আত্মীয়স্বজনও রয়েছে কিছু। শালা শালী ভাই ভাইয়ের বউ বোন ভগ্নিপতি। দোতলার ছোট হলঘর ফুল আর রাংতায় মোড়া। ঘরে হাল্‌কা সবজেটে আলো। দুটো পেল্লাই অ্যামপ্‌লিফায়ারে দ্রুত লয়ে ইংরিজি বাজনা বাজছে। হলঘরের একদিকে কাচঘেরা ব্যালকনি আজকের পানশালা। রূপকের দুই মেয়েও দৌড়ে দৌড়ে পানীয়ের গ্লাস ধরিয়ে দিচ্ছে অভ্যাগতদের। পান চলছে। নাচ চলছে। তালে। বেতালে। শাড়ি সালোয়ার জিনস্ ধুতি কূর্তাপাজামা সবই আজ নাচপোশাক।

অদিতি হলঘরে বসেছিল। সুপ্রতিমের বন্ধুর বউদের সঙ্গে। কস্তুরী সুদীপা গোপা প্রণতি…। সীমা ভারী শরীর নিয়ে প্রজাপতির মতো উড়ে আসছে মাঝে মাঝে, আবার উধাও হয়ে যাচ্ছে অন্য নিমন্ত্রিতদের ভিড়ে। সে আজ সেজেছেও খুব। দারুণ জমকালো সাদা বেনারসি, মাথায় ফুলের মালা, গা ভর্তি গয়না। তবু যেন সীমার চোখে কীসের যেন একটা ক্লান্তি দেখতে পাচ্ছিল অদিতি। আজকের ধকলের ক্লান্তি? না বয়সের?

এ সব পার্টিতে কারও কোনও পৃথক কথা থাকে না। এক ধরনের কথাই গোল হয়ে ঘুরতে থাকে, তার থেকেই ফুল্‌কি ছিটে হঠাৎ হঠাৎ হাসির ফোয়ারা ওঠে। কখনও বা তা নেহাতই বিশ্রম্ভালাপ হয়ে যায়। সোমেনের বউ কস্তুরী আর তথাগতর বউ সুদীপা দু’জনেই ভাল চাকরি করে, এ সব আসরে চাকুরে বউদের কথা একটু বেশি মনোেযোগ দিয়ে শোনে অন্য বউরা। প্রায় একই কথা বলে তারা। সেই শাড়ি গয়না সিনেমা। পরচর্চা। সেই স্বামী ছেলে মেয়ে সংসার। কাজের লোক শাশুড়ি জা। তবু শোনে। হয়তো কোনও হীনমন্যতা থেকেই ওদের খোলা জানলা ভেবে ভ্রম হয়। প্রায় সকলেরই হাতে গ্লাস ঘোরে, সাধ্যমতো নাচেও কেউ কেউ। রেওয়াজ।

অদিতিও ওই সবই করছিল। শুধু পানটাই খুব সীমিত তার। কোনও ছুঁৎমার্গের জন্য নয়, অ্যালকোহল পেটে গেলেই মাথাধরা আর অম্বলের রোগটা তার চাগিয়ে ওঠে। এই ধরনের জমায়েত মন্দ লাগে না তার, কিন্তু কিছুতেই যেন তেমন উচ্ছল হতে পারে না। শোনা দেখাতেই তার সুখ বেশি, ডুবে যাওয়াতে নয়। স্বভাব।

সুপ্রতিম কিন্তু পার্টিতে এলেই টগবগে ঘোড়া। এক দমে গ্লাস নিঃশেষ করে দেরিতে আসা পুষিয়ে নেয়, তিন-চার পেগ গিলেই সে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করে। উচ্চৈঃস্বরে বকে, প্রবল বিক্রমে হাত পা ছুড়ে নাচে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অকারণে। কোনও কোনওদিন গানও শুরু করে, তার কণ্ঠটি যেমন বিশুদ্ধ বেসুরো, গানের কলিও তেমনই ভুলভাল। পার্টিতে এ সবই গা-সওয়া, অনেকেই সুপ্রতিমকে তাতিয়ে দিয়ে মজা লোটে খুব।

অদিতি আজ অত দূর গড়াতে দিল না। ঠেলেঠলে এগারোটার আগেই তুলে ফেলল সুপ্রতিমকে। ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না, এই অজুহাতে।

ফিরছে অদিতি। ট্যাক্সিতে।

সুপ্রতিম সিটে মাথা দিয়ে গড়িয়ে আছে। হঠাৎ বলল—আজ পার্টিটা তেমন জমল না।

অদিতি ঠাট্টা ছুড়ল—কেন, বেশ তো শুরু করেছিলে। জন জানি জনার্দন। রম্ পম্‌ পম্। রম্ পম্‌ পম্। ড্রিঙ্ক করলেই ওরকম হয়ে যাও কেন?

সুপ্রতিম সোজা হয়ে বসল—তুমি তো জানোই সুপ্রতিম মজুমদারকে মদ কখনও মাতাল করতে পারে না। ওটা তো একটু ধুম্কির ভান। একটু রিলিজ করা। বন্ধুবান্ধবদের পার্টিতেও যদি নিজেকে খুলতে না পারি, কোথায় খুলব বলো তো?

—বয়স হচ্ছে এটা তো খেয়াল রাখবে?

—বয়স? বয়স তো একটা মেন্টাল ফিক্সেশান। বয়স-টয়স বলে কিস্যু নেই। চঞ্চল বাতাস উঠেছে একটা, অদিতির কাচটা এ বার সুপ্রতিমই তুলে দিল। তিন-চারটে কাঠি নষ্ট করে সিগারেট ধরাল একটা গম্ভীর মুখে বলল—বয়স যদি ফ্যাক্টরই হবে তবে দীপকের ইন্সিডেন্টটা হয়? অ্যাট দিস্ এজ দে আর রানিং ফর সেপারেশান। শর্মিলা নাকি একটা তিরিশ বছরের ছেলের প্রেমে পড়েছে।

অদিতি মাথা রাখল সিটে—আমি তো উল্টো শুনলাম। দীপকদাই নাকি একটা বুড়ির সঙ্গে লটঘট চালাচ্ছে।

সুপ্রতিম একটু চুপ করে রইল। তারপর হা হা হেসে উঠে বলল, —হতেও পারে। লেট দেম গো টু হেল্। কাম টু দা পয়েন্ট। আমরাও কিন্তু পঁচিশের দিকে এগোচ্ছি, মনে আছে?

অদিতি শুধরে দিল—পঁচিশ নয় স্যার, সামনের জুলাইতে চব্বিশ হবে।

—কথা কেটো না। এই জুলাই না সই, সামনের জুলাইতে তো হবেই। তুড়ি মেরে হাই তাড়াল সুপ্রতিম—রূপক কী করেছে, আমি এর থেকে অনেক গরজাস্ ফাংশান করব। মালাবদল টদল তো হবেই, ভাবছি একটা নহবতখানা বসিয়ে দেব। সকাল থেকে প্যাঁ পোঁ সানাই বাজবে।

—ছিহ্, তোমার কি লজ্জাশরম নেই? অত বড় বড় ছেলে…

—আরে, ওরাই তো হোস্ট্‌ হবে। প্রধান নিমন্ত্রণকর্তা। বাপের বিয়ে কাকে বলে দেখুক ছেলেরা! নিজের বিয়েটা আমার কনট্রোলে ছিল না, এই সেরিমোনিটা পুরো আমার গ্রিপে থাকবে।

অদিতি হেসে ফেলল—সব ব্যাপার নিয়ে ফাজলামি করাটা তোমার আর গেল না।

—ফাজলামি নয়, আমি সিরিয়াস। সুপ্রতিম আচমকা ঘুরে বসল। চোখ ছোট করে দেখছে অদিতিকে। ঘাড় নেড়ে বলল, এই যে পঁচিশ বছর আমরা একসঙ্গে কাটিয়ে দিলাম, এটা কি কম কথা! বিয়ে চাইলে অনেকবার হতে পারে, কিন্তু বিয়ের পঁচিশ বছর জীবনের একটা মাইলস্টোন্। এই পঁচিশ বছরে কনজুগাল লাইফে কী কী অ্যাচিভ করেছি তার একটা ডেমনস্ট্রেশান করব না?

অদিতি আর হাসল না। অ্যাচিভ শব্দটা হঠাৎই ঘণ্টাধ্বনির মতো বেজে উঠেছে বুকে। এই পঁচিশ বছরে অদিতি কী অর্জন করেছে? স্বামী পুত্ৰ সংসার স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তা? নাকি একটু একটু করে একা হয়ে যাওয়া? এক ভাঙা ভাঙা নিঃসঙ্গতা? কী?

.

০৪.

অলকেশ বাস থেকে পিছলে পড়ে পা ভেঙেছে, প্লাস্টার করে শুয়ে আছে বিছানায়। ভাইঝির ফোন পেয়ে দুপুরবেলা আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে গেল অদিতি। দাদাকে দেখতে।

বাপের বাড়িতে অদিতির আজকাল আর তেমন আসা হয় না। মা যতদিন ছিলেন, এ বাড়ির সঙ্গে গ্রন্থিটা অনেক মোটা ছিল, রোজ না হলেও সপ্তাহে এক-আধবার তো আসতই। চার বছর আগে মা মারা গেলেন, তারপর থেকে গ্রন্থি ক্রমশ কৃশ থেকে কৃশতর। বিজয়া, ভাইফোঁটা, ছোটখাটো পারিবারিক অনুষ্ঠান, এরাই এখন সম্পর্কর সুতো। দাদা বউদিও সেভাবে আসা যাওয়া করে কই! একমাত্র দাদার মেয়েটাই যা যোগসূত্র। তুলতুলি যাদবপুরে এম এ পড়ছে, এখনও সে মাঝে মাঝে চলে আসে পিসির কাছে।

অদিতি একটা মোড়া টেনে দাদার সামনে বসল, —কীরে, পড়লি কী করে?

অলকেশ মনমরা হয়ে শুয়েছিল, বোনকে দেখে মুখটা উজ্জ্বল হয়েছে। বলল—আর বলিস না, ভাবলাম লাফ দিয়ে পাদানিটা পেয়ে যাব, পা-টা কিছুতেই উঠল না।

হাত দিয়ে দিয়ে দাদার ডান হাঁটুর প্লাস্টারটা নিরীক্ষণ করল অদিতি—একদম ভেঙেই গেছে, না মচকেছে?

—না, ডিস্‌লোকেশন। সেট হয়ে যাবে। শুধু দেড় মাস শুয়ে থাকতে হবে এই যা।

—তোর ডান হাঁটুটাও কমজোরি হয়ে গেল রে দাদা!

—বাঁ পায়ের কথাটা তোর মনে আছে?

—নেই আবার। পিন্‌কাদা ন্যাড়াদার কাঁধে ভর দিয়ে কোঁকাতে কোঁকাতে মাঠ থেকে ফিরলি তুই। ফিরেই কান্না, এ সিজন্‌টা আর আমার খেলা হবে না! সারা রাত মা জেগে রইল, চুনহলুদ বাটা গরম করে লাগাচ্ছে বার বার! বাবা গজগজ করছে! কেন এই খেলতে যাওয়া! কেন এই খেলতে যাওয়া!

—হ্যাঁ, আমি যখন হাসপাতাল থেকে প্লাস্টার করে ফিরলাম, তুই তো দরজায় দাঁড়িয়ে খুব হাততালি দিয়েছিলি। খোঁড়া ল্যাঙ ল্যাঙ ল্যাঙ, কার বাড়িতে হাঁড়ি খেয়েছিস, কে ভেঙেছে ঠ্যাং!

অলকেশের কথা বলার ভঙ্গিতে ঘরসুদ্ধ লোক হাসছে। অদিতির বউদি ভাইপো ভাইঝি সব্বাই। অদিতিও হাসছিল। তবু মনের মধ্যে কোথায় যেন এক চাপা বিষণ্ণতাও উঁকি ঝুঁকি মারছিল মাঝে মাঝে। এ বাড়িতে এলেই ইদানীং এমনটা হয়। প্রাচীন বাড়িটার এখন আর কোনও ছিরিছাঁদ নেই, মোটা মোটা দেওয়াল স্যাঁতসেতে, নোনাধরা। তবু যেন এই অনুজ্জ্বল বাড়িটাতে পা রাখলেই বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া কৈশোর কোমর জড়িয়ে ধরে আজকাল, অদিতির আঁচল ধরে টানতে থাকে। সামান্যতম অছিলায়। কারণে অকারণে। কেন এমন হয়?

বয়স? মা-র না থাকা? নাকি অদিতি বিয়ের পর থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে সংসারে জড়িয়ে গিয়েছিল বলে পিছন ফিরে তাকানো হয়নি বহুকাল? অথবা দাদার সঙ্গে সম্পর্কটা চিড় খেয়ে যাওয়া?

বড় তুচ্ছ কারণে দাদার সঙ্গে সম্পর্কটা ঢিলে হয়ে গেল অদিতির। মা মারা যাওয়ার পর অদিতিকে দিয়ে গোটা কতক কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিল দাদা। কোন্ কাগজ কীসের কাগজ অদিতি পড়েই দেখেনি। দাদা বলল সই করতে এই না যথেষ্ট। পরে জানল দাদা না-দাবিপত্রে সই করিয়ে নিয়ে গেছে। অদিতি নাকি স্বেচ্ছায় আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ির অধিকার ছেড়ে দিল দাদাকে! শুনে সুপ্রতিমের কী বকুনি! তুমি বাড়ির ভাগ নাও, না নাও, তোমাকে একবার অফার করবে না দাদা! নিদেনপক্ষে কোন্ কাগজে সই করাচ্ছে সেটাও বোনকে বলে নেবে না! তোমারও বলিহারি! লেখাপড়া শিখেছ, দুমদাম না দেখে সই মেরে দিলে!

অদিতির মনেও খোঁচা মেরেছিল কথাটা। দাদা সরকারি অফিসের সামান্য চাকুরে, লোয়ার ডিভিসন ক্লার্ক হয়ে ঢুকেছিল, এখন বড়বাবু, অদিতির মতো তেমন সচ্ছল অবস্থা তার নয়, ছেলের এখনও চাকরি হয়নি, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে—এমন দাদার কাছ থেকে কি বাড়ির ভাগ চাইত অদিতি? কখনওই না। কিন্তু অমন চুপি চুপি সই করিয়ে নিয়ে গেল কেন?

পরে আর-একটা কাগজ সই করাতে এল দাদা। মা-র ফিক্সড ডিপোজিট সংক্রান্ত। অদিতি সেদিন ছেড়ে কথা বলেনি। সোজা বলে দিল—আমাকে কি এটারও ভাগ ছেড়ে দিতে হবে?

ক্ষণকালের জন্য দাদা বিমূঢ়। আমতা আমতা করে বলল—সামান্য তো কটা টাকা। মাত্র দশ হাজার। তুই এর ভাগ নিবি খুকু?

তেতো মুখে অদিতি বলেছিল—দশ হাজার টাকাটা কোনও কথা নয় রে দাদা। আমি যদি বোন না হয়ে তোর ভাই হতাম, তা হলে কি তুই এ ভাবে আমাকে কিছু না জানিয়ে ঝপঝপ করে সব কাগজে সই করিয়ে নিতে পারতিস?

দাদার মুখ ফ্যাকাশে—অত কথার কী আছে, এ টাকার ভাগ আমি তোকে দিয়ে যাব।

বউদি তখন দাদার পাশেই বসে। ফস্ করে বউদি বলে উঠল—তুমি সম্পত্তির ভাগ চাও সেটা আগে বলে দিলেই পারতে। আমাদের ধারণা ছিল তোমার এত আছে, তুমি হয়তো নেবে না।

অদিতি সেদিন কিছুতেই দাদা-বউদিকে বোঝাতে পারেনি ভাগ নেওয়াটা বড় কথা নয়, অদিতির যে একটা অধিকার আছে সেটাকে অবজ্ঞা করাটা অন্যায়। বোনকে অসম্মান করা। টাকাটাও অদিতি নেয়নি, কিন্তু ওই কথাটুকুই মনে লেগে গেল দাদা-বউদির। মা-র বাৎসরিকের আগে পর্যন্ত অদিতির বাড়ির ছায়া মাড়াল না। কালে কালে ক্ষোভ থিতিয়ে এল। তবে সম্পর্ক আর নিখুঁতভাবে জোড়া লাগল না, কোথায় যেন সরু ফাঁক রয়েই গেল একটা।

মা বাবা না থাকলেই কি ভাই-বোনের সম্পর্কে অদৃশ্য ঘূণপোকারা এসে বাসা বাঁধে? ছোটবেলার সমস্ত টান, ভালবাসা, খুনসুটি, মনকেমন করাগুলো নিরর্থক হয়ে যায়?

নাকি কিছু থেকেই যায়? ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি হয়ে? যেমনটি আজ বলছে দাদা?

তিপ্পান্ন বছরের দাদা আর পঁয়তাল্লিশ বছরের বোন শৈশব সেঁচে মণিমুক্তো কুড়োচ্ছে। চা-মিষ্টি হাতে দাঁড়িয়ে আছে বউদি। তুলতুলি রুন্টু টীকাটিপ্পনি কাটছে বাবা পিসিকে নিয়ে। এক অসহ্য সুখের পারিবারিক দৃশ্য।

এর মধ্যেও কাঁটা থাকে!

শীত শহরের দখল নিয়ে নিয়েছে। শেষদুপুরেই ঠাণ্ডা বেশ কড়া। আমহার্স্ট স্ট্রিটের এই বাড়িটা পিছনের প্লটের বাড়ি, প্রায় বদ্ধ, আলোবাতাসহীন। দেওয়াল থেকেও যেন হিমকণা বিচ্ছুরিত হয় এখানে।

অদিতি শালটা ভাল করে জড়িয়ে নিল। হুস হুস চুমুক দিচ্ছে চায়ে। বউদিকে বলল—তুলতুলির আর কোনও সম্বন্ধ এল?

—এসেছিল। ছেলে ইনসিওরেন্সে চাকরি করে। জুনিয়ার অফিসার। তোমার ভাইঝির পছন্দ হল না।

—কেন, দেখতে ভাল নয় বুঝি?

—জানি না বাপু। তোমার ভাইঝিকে জিজ্ঞেস করো। মেয়েমানুষের অত নাক উঁচু হলে চলে?

—সে ভীষণ বেঁটে গো পিসি। তুলতুলি মুখ বেঁকাল—গায়ের রংটাও যা না! পিচরাস্তা।

—তুমি এমন কি অপ্সরী? শিবানীও বেঁজে উঠেছে—সম্বন্ধটা অনেক দূর এগিয়েছিল গো। তোমার ভাইঝিকে ওদের খুব পছন্দ ছিল।

তুলতুলি হাউমাউ করে উঠল—হলেই হল, আমার কোনও মতামত নেই? আমি তো বলেই দিয়েছি আমার জন্য ছেলে দেখতে হবে না। আগে একটা চাকরি-বাকরি পাই, তারপর দেখা যাবে।

—আসল কথা বলো, বাবা মা-র পছন্দে মন উঠবে না। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করবে।

—সেটাই তো ভাল। তোমাদের পরে দুষতে পারবে না। অদিতি হেসে ভুরু নাচাল। তুলতুলিকে বলল—হ্যাঁ রে, ঠিক করা আছে নাকি?

রুন্টু অনেকক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, এবার আর ফুট না কেটে পারল না। বলল—ওদের যাদবপুর তো বৃন্দাবন, না ঠিক থাকাটাই আশ্চর্য।

অদিতি ঠোঁট টিপল—বৃন্দাবন, না নবদ্বীপ রে? তাতাই তো বলে ওখানে নাকি চোখে চোখ মিললেই কণ্ঠীবদল হয়ে যায়। সত্যি?

—বলেছে এ কথা? তুলতুলির গোলগাল মিষ্টি মিষ্টি মুখে রাগের ছল—আমি যাই, নেক্সট দিন গিয়ে ওর কান মুলে দেব।

অলকেশও মিটিমিটি হাসছে। এ ধরনের আলোচনাতে একটু অস্বস্তিও বোধ করছে যেন। পা সামলে বিছানায় উঠে বসে বলল—এই খুকু, পাপাইয়ের পার্ট টু-র প্রিপারেশন কেমন চলছে রে?

—বলছে তো হচ্ছে মোটামুটি।

রুন্টু বলল—পাপাইয়ের ওইরকমই কথা। রেজাল্ট বেরোলে দেখা যাবে ফাটিয়ে দিয়েছে।

অলকেশ বলল—বি এসসি পাশ করে কী করবে কিছু ঠিক করেছে?

—এম এসসি পড়বে। রিসার্চে জয়েন করবে। ওর তো লেখাপড়ার লাইনেই ইন্টারেস্ট, মনে হয় প্রফেসারি-টফেসারির দিকেই যাবে।

—ওকে সিভিল সার্ভিসে বসা না। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কোনও আই এ এস-আই পি এস নেই। ভাগ্নেকে দেখে আমরাও একটু বুক ফোলাই।

অদিতির মনেও সেরকমই একটা সূক্ষ্ম বাসনা ছিল ছেলে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হবে, বিশাল কোয়ার্টার পাবে, অদিতি গিয়ে অবরে-সরে থেকে আসবে সেখানে। ছেলের জিপে চড়ে বেড়াবে এদিক সেদিক। দেখা যাক কী হয়।

রুটু বলল—পাপাইটা বড় লাজুক। ও কড়া অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হতে পারবে না। এ ব্যাপারে তাতাই একদম ফিট্‌।

শিবানী হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলল—তোমার কপালটা খুব ভাল। দুটো ছেলের দুটোই রত্ন। রুণ্টুটার যে কী হবে?

রুণ্টু পলকে গম্ভীর। তুলতুলি ধমকাল মাকে,—আহ্ মা, থামো তো! দাদা কি রোজগার করে না?

অদিতি আড়চোখে দাদাকে দেখছিল। পরিবেশটা কেমন কেটে কেটে যাচ্ছে। এককালে পাউরুটি আলুর দম খেয়ে ফুটবল মাঠে খেপ খেলে বেড়ানো হাট্টাকাট্টা দাদা এখন কেমন বসে আছে জবুথবু! নিষ্পলক। আনমনা। কপালে বুঝি ভাঁজও এসে গেছে এলোমেলো! হয়তো রুন্টুর ভাবনাতেই।

খুব আশা ছিল অদিতির, দাদা হয়তো রুটুর চাকরির জন্য বলবে সুপ্রতিমকে। বি কম করে চার চারটে বছর বসে আছে রুন্টু। ঠিক বসে নেই, প্রচুর টিউশনি করে। নিচু ক্লাশের। একটা ছোটখাটো কম্পিউটার কোর্সও করেছিল। রেজাল্ট খুব ভাল নয়, তবে দাদা একবার মুখ ফুটে সুপ্রতিমকে বললে একটা হিল্লে হয়তো হয়ে যেত। প্রায়ই সেলস লাইনে নতুন নতুন ছেলে নেয় সুপ্রতিমরা। চারদিকে নিজেরও বহু জানাশুনো সুপ্রতিমের। এজেন্ট, ডিস্ট্রিবিউটার, এই পার্টি, ওই পার্টি। সুপ্রতিম তেমন গড়িমসি করলে অদিতিও চাপ দিতে পারত তখন।

দাদা বলে না। বলবেও না। বোনের ওপর অভিমান? না বোনের কাছে আর ছোট করে দেখাতে চায় না নিজেকে? নাকি আশা করে অদিতি সুপ্রতিমই যেচে…! রুণ্টুটাও পিসির বাড়ি যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। হীনমন্যতা?

এ কথা সে কথার পর উঠল অদিতি। বেরনোর আগে জোর জোর নিশ্বাস টানল কয়েকবার। কেমন একটা ভ্যাপসাটে গন্ধ, কোনওমতেই সুঘ্রাণ বলা যায় না, তবু শুঁকল প্রাণভরে। কী যেন মিশে আছে বাতাসটায়! হলুদ শৈশব! গোলাপী কৈশোর! নীলচে যৌবন! কী যেন!

অধিকার চলে যাওয়ার পর থেকেই কি গন্ধটা বেশি করে নাকে এসে লাগে অদিতির!

রাস্তায় নেমে অদিতি বাসে উঠল না। শেষ বিকেলের শীত মাখানো নরম রোদ্র মাড়িয়ে হেঁটে এল শিয়ালদায়। ট্রেনে ফিরবে।

স্টেশনে ঢোকার আগে বাড়ির জন্য কিছু ফল কিনল অদিতি। সুপ্রতিমের জন্য আঙুর, পাপাইয়ের জন্য কমলালেবু, তাতাইয়ের জন্য ন্যাশপাতি। অফিসফেরত যাত্রীদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যখন ঢাকুরিয়া স্টেশনে নামল, তখন অন্ধকার গা বিছিয়েছে চতুর্দিকে।

বাড়ি ফিরেই অদিতি চমকে গেল। আবার হেমেনমামা এসেছে। সোফায় বসে দিব্যি গল্প করছে পাপাইয়ের সঙ্গে। পরনে সেই একই পোশাক। শুধু সুতির চাদর পাল্টে সাদা এক শাল এসেছে গায়ে।

অদিতি কথা বলার আগেই হেমেন গৃহকর্তার ভঙ্গিতে দু’ হাত ছড়িয়েছেন দু’ দিকে—সুস্বাগতম্।

দুপুর থেকে বুড়বুড়ি কেটে চলা চোরা বিষাদের বুদ্‌বুদ্ নিমেষে উধাও। অকৃত্রিম খুশিতে হাসল অদিতি—আপনি কতক্ষণ?

—ঘড়ির হিসেবে বলব? না সময়ের হিসেবে?

—সেটা কীরকম?

—খুবই সরল। ঘড়ি ধরে বললে, আমি ঠিক পঞ্চাশ মিনিট হল এসেছি। সময়ের হিসেব করলে, এই মাত্র। তোমার ছেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে কী করে যে সময়টা চলে গেল!

অদিতি পাপাইয়ের দিকে তাকাল—কি রে দাদুকে চা-টা খাইয়েছিস?

এবারও আগেই হেমেনের উত্তর,—শুধু চা নয়, আরও অনেক কিছু খাইয়েছে। পেস্ট্রি পোট্যাটো চিপস্…। তোমার ছেলে আপ্যায়নে কোনও ত্রুটিই রাখেনি।

সবিতা রান্না করতে এসে গেছে। ডাইনিং টেবিলের বড় কাচের পাত্রে ফলগুলো রেখে সোফায় বসল অদিতি। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল—তাতাই ফেরেনি?

—না তো। পাপাই উঠে পড়েছে—তুমি এবার কথা বলো মা। আমাকে একটু শৌণকদের বাড়ি যেতে হবে।

হেমেন হাঁ হাঁ করে উঠলেন—তোমার সঙ্গে আলোচনাটা তো শেষ হল না! বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের কোথায় বিরোধ সে ব্যাপারে একটা ফয়সালা হওয়া দরকার।

—হবে একদিন। আজ আসি। ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটিয়েই ঘরে ঢুকে গেল পাপাই। পুলওভার চড়িয়ে বেরিয়েও গেল মুহূর্তে।

অদিতি দরজা বন্ধ করে এসে তরল অভিযোগের সুরে বলল—বলেছিলেন শিগ্‌গিরই আসবেন। অ্যাদ্দিনে আপনার সময় হল? এক মাস পর?

—আমি কি আর বসে আছি রে ভাই। বলতে বলতে পাশে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের থলি থেকে একটা চটি মতন বই বার করে এগিয়ে দিলেন হেমেন। বললেন—আমার পত্রিকাটা দ্যাখো। লেটেস্ট ইসু। এর পেছনে কদিন যা খাটুনি গেল।

অদিতি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল কাগজটাকে। নব্বই একশো পাতার বই। কবিতা গল্প প্রবন্ধ সবই আছে। বেশ কয়েকজন কবির নাম তো রীতিমতো পরিচিত। ছাপা, কাগজ, বাঁধাই, সবই ঝকঝকে। পরিপাটি। তুলোট কাগজের মলাট। মলাটে কোনও ছবি নেই, শুধু কাগজটার নাম পাতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে, ঢেউয়ের মতো। বহতা। সম্পাদকের নামও গাঢ় নীল রঙে জ্বলজ্বল। হেমেন্দ্রনারায়ণ মল্লিক।

অদিতি জিজ্ঞাসা করল—আপনি এই কাগজটার কথাই বলছিলেন?

হেমেন কেমনভাবে যেন তাকালেন অদিতির দিকে। বললেন—কাগজ নয়, পত্রিকা বলো।

—হ্যাঁ হ্যাঁ পত্রিকা। অদিতি অপ্রস্তুতভাবে হাসল—আপনি একাই পত্রিকাটা বার করছেন?

হেমেন শব্দ করে হেসে উঠলেন। দরাজ গলায় বললেন—জীবনেই দোকা পেলাম না, পত্রিকায় দোকা পাব কোথ্থেকে? তবে হ্যাঁ, আলিপুরদুয়ারে আমার দু’জন সহযোগী ছিল। দুই ছোকরা। আমারই ছাত্র।

আগের দিন অতশত গা করেনি অদিতি। আজ একটু নড়েচড়ে বসল। বলল—এ তো অনেক খরচের ব্যাপার হেমেনমামা! আপনি একা একা…

—আরে বাবা, রিটায়ারমেন্টের পর কিছু টাকা তো পেয়েছি। সে টাকা কি আমি যক্ষের মতো বসে বসে আগলাব? পুরনো বন্ধুবান্ধব কিছু আছে, তারা কয়েকটা বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে দিল…। গভর্নমেন্টের বিজ্ঞাপনও আসতে শুরু করেছে…। এবার রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা এসে গেলে কোনও প্রবলেম থাকবে না, বুঝেছ?

অদিতির ঠিক ঠিক মাথায় ঢুকছিল না কথাগুলো। নিয়ম রাখার মতো করে বলল—ভালই করেছেন। মানুষকে তো একটা কিছু নিয়ে থাকতে হবে। চা খাবেন আবার?

—বলো। ঠাণ্ডার দিনে চা-টা ভালই লাগে।…তবে আলিপুরদুয়ারের তুলনায় এখানকার শীত কিছুই নয়। সে হচ্ছে যাকে বলে বাঘকাঁপানো ঠাণ্ডা।

অদিতি চেঁচিয়ে চা করতে বলল সবিতাকে। হেমেনমামা আলিপুরদুয়ারের শীতের গল্প শোনাচ্ছে। কবে নাকি একটা বাঘ ডুয়ার্সের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়েছিল, সোজা ঢুকে গিয়েছিল কার কাঠের বাড়িতে, বাড়িঅলার গা থেকে নাকি কম্বল খুলে নিয়েছিল বাঘটা! বলার ভঙ্গি এত সরস যে, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছিল অদিতির। আগের দিন মানুষটা যেন সঙ্কুচিত ছিল সামান্য, আজ কত স্বচ্ছন্দ। খোলামেলা।

হেমেনমামা অনেক বদলে গেছে। অদিতিদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে যখন আসত, তখন কত গম্ভীর ধরনের ছিল। ঠিক যেন গম্ভীরও নয়, মিতবাক, শান্ত এক সৌম্য পুরুষ। হাসতও, কিন্তু মাপা হাসি।

হঠাৎ কথা থামিয়ে হেমেন বললেন—কই, যে জন্য এসেছি সেটা দাও।

অদিতি হোঁচট খেল—কী বলুন তো?

—গল্পটা। নিয়ে এসো, পড়ে দেখি।

অদিতি আকাশ থেকে পড়ল—গল্প! আমি…!

হেমেনও যেন ভীষণ অবাক—কেন, আগের দিন তোমাকে আমি বলে গেলাম না, একটা গল্প লিখে রাখতে? আমার পত্রিকার জন্য?

অদিতি সলজ্জভাবে বলল—বলেছিলেন। তবে…

—কী হবে?

—লেখা-জোখা আর আমাকে দিয়ে হবে না। কবেই ওসব ছেড়ে দিয়েছি।

হেমেনের মুখমণ্ডল পলকে বদলে গেল যেন। গোমড়া মুখে বললেন—আগের দিনও তুমি এই কথাই বলেছিলে। আমি তোমাকে বলেছিলাম চেষ্টা কোরো, নিশ্চয়ই পারবে। তুমি কি চেষ্টা করে দেখেছ?

—না, তা করিনি…

—কেন করোনি? সময় পাওনি?

অদিতি সরাসরি মিথ্যে বলতে পারল না। বলল—তাও ঠিক নয়। এমনিই হয়ে ওঠেনি।

হেমেন কথা বাড়ালেন না আর। চুপ করে বসে আছেন। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মুছলেন কাচ দুটোকে। তারপর প্রায় স্বগতোক্তির মতো বললেন—সবার সব ক্ষমতা থাকে না অদিতি। আবার প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ক্ষমতা থাকে। গুণ থাকে। সেই গুণটার বিকাশ ঘটতে না দেওয়ার মানে হল নিজের জীবনকে নিজেই অপমান করা। এ এক ধরনের আত্মহত্যা। তোমার মধ্যে কিন্তু গুণটা ছিল।

অদিতির অস্বস্তি হচ্ছিল। আবার যেন ভালও লাগছিল শুনতে। মৃদু স্বরে বলল—সে যখন ছিল, তখন ছিল। এই তেইশ বছর ধরে ঘানি টানতে টানতে, ছেলেদের মানুষ করতে করতে…। মেয়েদের অনেক কিছুই ভুলে যেতে হয় হেমেনমামা। আপনি তো ঠিক সংসারি নন, আপনি বুঝবেন না।

—ওগুলো তোমাদের অজুহাত। তোমরা মেয়েরা ওই ধরনের কথা বলে নিজেদেরই সান্ত্বনা দিতে ভালবাসো। লেম্ এক্সকিউজ। যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না? হেমেন রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন—তোমার একটা গল্প পড়েছিলাম। আজও মনে আছে। বোধহয় তোমার কোনও কলেজের ম্যাগাজিনে বেরিয়েছিল। একটা মেয়ে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে কুয়াশার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। চাপ চাপ কুয়াশা। যত সে কুয়াশার মধ্যে ঢুকে পড়ে, ততই সে নতুন নতুন কিছু আবিষ্কার করতে থাকে। নদী পাহাড় জঙ্গল জলপ্রপাত ঝর্না…। যেই কুয়াশাটা মিলিয়ে যায়, ওমনি দেখে তার সামনে কিছুটি নেই। তোমার মনে আছে গল্পটা?

নিস্তরঙ্গ পুকুরের তলদেশে পড়ে থাকা ছোট্ট ঢিলের কুচিটা যেন উঠে আসছে। অদিতি খুব ধীরে মাথা নাড়ল—হুঁ, মনে আছে। গল্পটার নামও ছিল কুয়াশা।

—ওরকম একটা গল্প লেখার পরও তুমি বলতে চাও, তুমি আর লিখতে পারবে না? তোমার কি মনে কোনও কথা জমে নেই? তোমার কি নিজেকে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না? হাতের কাছে কলম আছে, কাগজ আছে, বসে যাও। চেষ্টা করে দ্যাখো না, হয় কিনা। এখন তো তোমার সময় আছে। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে। সংসারের ঘানি টানার অজুহাত এখন আর তোমার খাটে না অদিতি।

অদিতি হেসে ফেলল—তা খাটে না। তবে বয়সও তো একটা ফ্যাক্টর, সেটা তো মানবেন? এই বুড়ো বয়সে ওসব আর আসে?

—না চেষ্টা করলে তুমি জানবে কী করে? হ্যাঁ, এজ একটু তো ম্যাটার করে বটেই। মনের ওপর পলি পড়ে গেছে। অভ্যাস করে, চর্চা করে সেটাকে সরাতে হবে। বাট দা থিং ইজ্ দেয়ার।

সবিতা চা এনেছে। ঘুরে ঘুরে দেখছে উত্তেজিত বৃদ্ধকে। অদিতিকে বলল—আমি কি চলে যাব বউদি? আমার কিন্তু হয়ে গেছে।

—যা। কটা রুটি করেছিস আজ?

—সতেরো আঠেরোটা।

—অতগুলো করলি কেন? সকালে বললাম না, দাদা এবেলা খাবে না! ফিরতে দেরি হবে!

সবিতা জিভ কাটল।

—থাক, যা করেছিস, করেছিস। ক্যাসারোল চেপে বন্ধ করেছিস তো? রুটি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ভাইদের মেজাজ কিন্তু গরম হয়ে যাবে।

—চেপেই বন্ধ করেছি।

—ঠিক আছে, সকালে তাড়াতাড়ি আসিস। অদিতি কথাটুকু শেষ করে হেমেনের দিকে তাকাল—শুনলেন তো? এসবও মাথায় রাখতে হয়।

হেমেন অনেকটা স্থিত হয়েছেন। অল্প হেসে বললেন, রামকৃষ্ণদেবের একটা কথা আছে, জানো তো? কখন ঢেউ আসবে না, তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকলে, সমুদ্রে আর স্নান করাই হবে না।

ঠাণ্ডা বাতাস আসছে একটা। জানলা দরজা সব বন্ধ, তবু কোথা থেকে ঢুকছে বাতাসটা?

হেমেন চায়ে চুমুক দিয়েছেন। আপন মনে বলছেন—শোনো অদিতি, তোমার কথা আমার মাথাতেই ছিল না। আলিপুরদুয়ার থেকে যখন পাকাপাকিভাবে ফিরে এলাম, তখনও মনে পড়েনি। একদিন হঠাৎ বিমলের সঙ্গে দেখা। ডালহাউসিতে। তোমার ছোটমামা বোধহয় পেনশান-টেনশন তুলতে এসেছিল। তারপর একদিন ওর ভবানীপুরের বাড়িতে গেলাম। এ গল্প। সে গল্প। হঠাৎ তোমার কথা উঠল। সেই তোমাদের বাড়িতে যেতাম, তুমি তোমার লেখা দেখিয়েছিলে, সে কথাও হল। বিমল বলল, তুমি নাকি এখন ঘোর সংসারী। কৃতী স্বামী, কৃতী সন্তানদের নিয়ে যাকে বলে একেবারে আপ্লুত হয়ে আছ। শুনে কেমন যেন মনে হল, যাই তোমাকে একটু টোকা দিয়ে আসি। এত ভাল লেখার হাত ছিল তোমার! এত সুন্দর অবজারভেশান! এত সুন্দর ভাষা! তোমার একটা নিজস্ব ইনসাইট আছে। একবার চেষ্টা করতে দোষ কী? আমি আবার মাসখানেক পরে আসব। তখন কি তোমার কাছ থেকে একটা লেখা আশা করতে পারি?

অদিতি ঘাড় নাড়ল কি না, নিজেই বুঝতে পারল না। সম্ভবত নাড়ল। না হলে হেমেনমামার মুখে হাসি ফুটল কেন?

হেমেন চলে গেলেন।

অদিতি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়েই আছে।

পৃথিবী শীতল হচ্ছে ক্রমশ। বায়ুমণ্ডলে পাতলা কুয়াশার পর্দা। কম্পাউন্ডের গেটের সামনেই অত্যুজ্জ্বল রাস্তার বাতি, দূর থেকে তাও যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। চতুর্দিকের দরজা জানলা বন্ধ ইট কাঠের অবয়বগুলোকেও এখন কেমন ভৌতিক লাগে।

পাপাই তাতাই ফিরল না এখনও। সুপ্রতিমও কখন ফিরবে কে জানে! অদিতি গ্রিল থেকে সরে টিয়ার সামনে এলো। সন্তর্পণে হাত রাখল খাঁচার তারে। রেখেই সরিয়ে নিয়েছে হাত। খাঁচাটা কনকনে ঠাণ্ডা, ছ্যাঁকা লাগে।

পাখি ঝিমোচ্ছে। অন্ধকার নামলেই চুপ মেরে যায় টিয়াটা। অথচ সামনে পল্‌কা ছায়া দেখলেও ঠিক টের পায়, চোখ খুলে তাকায় এদিক ওদিক।

অদিতি ফিসফিস করে শুধোল—এই টিয়া, গল্প লিখবি?

ব্যালকনির ছায়া ছায়া আঁধারে স্বরটাকে খুঁজছে টিয়া।

অদিতি ফের শুধোল—কী লিখবি বল তো? আসে কিছু মাথায়?

টিয়া নড়ে বসে।

—সারাদিন তো আফিংখোরের মতো ঢুলিস, আর মাঝে মাঝে ক্যাঁ ক্যাঁ চিৎকার, এর বাইরে তোর আর কিছু করার আছে?

টিয়া চুপ।

—লেখ না যা হোক কিছু। পাগলবুড়োটা এত করে বলে গেল…!

টিয়া একটু চঞ্চল হয়েছে। টিপ টিপ ঘাড় দোলাচ্ছে।

—নিজের কথাই লেখ্‌ না হয়। ধর তোর দাদার পা ভেঙে গেছে। ভাঙেনি, মনে কর চিড় খেয়েছে। তুই তোর দাদাকে খুব ভালবাসতিস, কত স্মৃতি আছে তোর দাদাকে নিয়ে…। তা তুই দাদাকে দেখতে গেছিস। অনেকদিন পর। মাঝে ওই সই করানোর ব্যাপারটা রেখে দে না। দুজনের মনের কথাই লেখ। দাদারও। বোনেরও। তারপর? তারপর? বানা না, বানা। একটা ফিলিং-এ নিয়ে যা গল্পটাকে। একটা সুন্দর রিলেশান চিড় খেয়ে যাওয়ার অনুভূতি।

অদিতি উৎসুক হয়ে ঝুঁকল খাঁচার দিকে—কিরে, পারবি না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *