২.১৫ শহরে সন্ধে নেমে গেছে

[পনেরো]

শহরে সন্ধে নেমে গেছে অনেকক্ষণ।

লালবাজার থেকে ফেরার পথে মিতিনদের ঢাকুরিয়া নামিয়ে দিয়ে গেল অর্চিষ্মান। গাড়িতে এতক্ষণ চুপচাপই ছিল পার্থ, বাড়ি ঢুকেই সে উত্তেজিত ভাবে প্রশ্ন করল,— বাপটাকে তুমি বেমালুম ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলে?

মিতিন বড় অবসন্ন বোধ করছিল। মস্তিষ্কের কসরত শেষ, শরীর যেন আর চলছে না, সোফায় নিজেকে ছেড়ে দিতে দিতে অলস গলায় বলল,—হুম।

জুতো খুলে উল্টো দিকের সোফায় বসল পার্থ। বেজার মুখে বলল,—তা হলে তোমার এতদিনের পরিশ্রমের কী অর্থ?

—অর্থ তো আমার ব্যাগেই রয়েছে। করকরে পঞ্চাশ হাজার!

—তা ঠিক। তবু…। পার্থ সিগারেট ধরাল। খুঁতখুঁত গলায় বলল,—এটা কিন্তু সুবিচার হল না। একই অপরাধের জন্য একজন শাস্তি পাবে, অথচ তার সহযোগীর সব দোষ মাপ? দিস ইজ হাইলি আনএথিকাল।

মিতিন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। বুমবুম ডুবে আছে পাজ্লে, ঘরময় অজস্র রঙিন পিজবোর্ডের টুকরো, জুড়ে জুড়ে বাঘ সিংহ হাতি ভাল্লুক বানাচ্ছে অখণ্ড মনোযোগে। এভাবে বসার ঘরের মেঝে নোংরা করার জন্য ছেলেকে বকাবকি করে মিতিন, আজ যেন দেখেও দেখছে না।

একটু পরে খানিকটা আত্মগত ভাবেই বলল,—মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে আর কী লাভ, বলো? বেচারা দিননাথবাবু এমনিতেই অন্তর্দাহে পুড়ছেন। তিনিও তো এক ধরনের ব্ল্যাকমেলিং-এরই শিকার, নয় কি? তাঁর অতীত, তাঁর ভুল তাঁকে তপনের হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছিল।

—কিন্তু অফেন্সটা তো অফেন্সই। তা হলে তপনকেও তোমাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল।

—সে তো এমনিই ছাড়া পেয়ে যাবে। অর্চিষ্মানকে দেখে বুঝলে না, সে এখন প্রাণপণে পারিবারিক কলঙ্ক গোপন করতে চায়? তপনকে নিয়ে বেশি নাড়াঘাঁটা করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে না? বড় জোর এখন তপনের এগেনস্টে নাম-কা-ওয়াস্তে একটা টাকা এক্সটরশনের কেস চলবে। তবে সেই কেসও অর্চিষ্মান আর পারসিউ করবে বলে মনে হয় না। মিতিন বড় করে একটা নিশ্বাস ফেলল,—তপন অনেক দোষ করেছে। বিশেষত অর্ককে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেল্লার কোনও ক্ষমা হয় না। কিন্তু লজিকালি স্পিকিং, গাড়ি চাপা দিয়ে খুন প্রমাণ করা খুব কঠিন। তাও আবার এতদিন পর। তার থেকেও বড় কথা, ঘাতক গাড়িটা যদি আইডেন্টিফায়েড হয়, দিননাথ রুদ্র আবার বিপাকে পড়বেন। কারণ সবাই জানে তিনি তাঁর পুরনো অ্যাম্বাসাডার বেচে দিয়েছিলেন। এটাও যে মিথ্যে, গাড়িটা যে তিনি তপনকে দিয়ে দিয়েছিলেন…। আমি সুভাষকে মোটর ভেহিকল্সে পাঠিয়েছিলাম। দিননাথের সাদা অ্যাম্বাসাডার কার নামে ট্রান্সফারড হয়েছিল জানো? বীথিকা নন্দী। তপনের মা।

বিমলা চা এনেছে। সেন্টার টেবিলে কাপ নামিয়ে বলল,—বিকেলে একটু চিঁড়ের পোলাও বানিয়েছিলাম, খাবে?

—আমি আর এখন কিছু খাব না। তোর দাদা খায় তো দে।

—না, না, আমার পেটে এখনও চিকেন পকোড়া গজগজ করছে। তুমিই বরং একটু…। ওখানে তো কিছুই মুখে দিলে না।

—ইচ্ছে করছে না। একটু পরে একেবারে রাতের খাওয়া খেয়ে নেব। ক’দিন ধরে মাথাটা জ্যাম হয়ে ছিল, আজ একটা লম্বা ঘুম দরকার।

আর বিশেষ কথা হল না। একটুক্ষণ চোখ গোল গোল করে বসে রইল পার্থ, তারপর চা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে গেছে, শাওয়ার খুলে গান ধরেছে সুরেলা গলায়। বুমবুম ক্যাঙারুর দেহে খরগোসের মাথা বসাচ্ছিল, মিতিন হাঁ হাঁ করে বাধা দিল তাকে। নেমে বসেছে মেঝেয়, ছেলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ধাঁধা খেলায়, আধ ঘণ্টার মধ্যেই শরীর মন অনেকটা চনমনে।

আবার বিদিশা-প্রসঙ্গে ফিরল রাত্রে। খাওয়া দাওয়ার পর। বুমবুম ঘুমিয়ে পড়েছে, ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে টান টান করে চুল বাঁধছিল মিতিন, খাটে চিৎপাত পার্থ ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,—আচ্ছা, কেসটা তুমি সল্ভ করলে কী করে বলো তো?

মিতিন হাসি হাসি মুখে বলল,—তুমি কি শুয়ে শুয়ে কেসটার কথাই ভাবছ নাকি?

—ভাবছিই তো। দিননাথ রুদ্রকে তুমি সন্দেহের তালিকায় আনলে কী করে?

—এটা বুঝলে তো তুমিই টিকটিকি হতে, আর আমি আরশোলা। মিতিন হাসতে হাসতে পার্থর পাশে এসে বসল। হাতে নাইটক্রিম, ঘষছে মুখে। পার্থর নাকে একটু ক্রিম লাগিয়ে দিয়ে বলল,—দিননাথকে আমিও প্রথমে গোনায় ধরিনি মশাই। আমার প্রথম সাসপেক্ট কে ছিল তুমি তো জানই!

—হ্যাঁ। অর্চিষ্মান রুদ্র।

—রাইট। অর্চিষ্মানকে সন্দেহ করার কারণও তোমায় বলেছিলাম। আপাতদৃষ্টিতে অনেক কিছুই অর্চিষ্মানের বিরুদ্ধে যায়। দিঘায় তার হঠাৎ অস্বাভাবাবিক আচরণ, দুম করে বিদিশার নামে দশ লাখ টাকার পলিসি করা, সদ্যবিবাহিত স্ত্রী টেনশানে ছটফট করছে, সেদিকে আদৌ লক্ষ না করা, অথচ সেই স্ত্রীর ব্ল্যাকমেলারকে দু-পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়া—এর একটাকেও ঠিক স্বাভাবিক বলা যায় না। এমনকী রবির হাপিশ হয়ে যাওয়াও অর্চিষ্মানের কারসাজি বলে মনে হয়। ঈর্ষায় উন্মাদ মানষ কী না করতে পারে!

—বটেই তো। বউ-এর পেছনে ড্রাইভার লেলিয়ে দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়, বাই চান্স বউ-এর লাভলেটার-বক্স হাতে পেয়ে গিয়ে আরও হিংস্র হয়ে ওঠাও বিচিত্র নয়। পার্থ কনুই-এ ভর দিয়ে আধশোওয়া হল,—আমার কিন্তু প্রেমিকদের দিকেও সন্দেহ গিয়েছিল।

—সে তো তুমি বলেই দিয়েছিলে ওটা অর্কর কাজ।

—তার কারণও ছিল। লোকটা গাড়ির তলায় আধঘণ্টা শুয়ে রইল, অথচ অর্ক তাকে তখন ধরারও চেষ্টা করল না…

—আমি শিওর অর্ক তখন পাজল্‌ড্ হয়ে গিয়েছিল। বেচারা ভাল মানুষ ওরকম পরিস্থিতিতে তো কখনও পড়েনি। যদি ধরতে গিয়ে ফেল করে যায়, যদি প্রেমিকার কোনও নতুন বিপদ হয়…! তা ছাড়া লোকটা, আই মিন তপন, কেন ওভাবে অতক্ষণ শুয়ে রইল, অর্কর হিসেবেই আসছিল না। যেমন তপনেরও হিসেবে আসেনি সত্যি সত্যি বিদিশা অর্ককে সঙ্গে এনেছে। শেষ পর্যন্ত অর্ক যখন মরিয়া ডাইভ দিল, তখনই মুশকিলটা হয়ে গেল। দুজনেই দুজনকে সামনাসামনি দেখে ফেলল। তপন বেজায় ঘাবড়েছিল, তবে সে সময়ে বিদিশা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তপন ভেবেছিল ব্যাপারটা বুঝি ধাপাচাপা পড়ে গেল। কিন্তু অর্ক তক্কে তক্কে ছিল, আকস্মিক ভাবে তপনের সুলুক সন্ধানও পেয়ে গিয়েছিল সে। যখন তপনের সম্পর্কে অর্ক অনেকটা জেনে ফেলেছে, তখনই ব্যাপারটা তপনের নলেজে আসে। খুন হওয়ার আগে তপনের পাড়ায় গিয়েছিল অর্ক, তখনই তপন ঠিক করে অর্ককে সরিয়ে দেবে। অজয় খবর এনে দিয়েছে, সে দিন সকাল থেকেই স্টেডিয়ামের আশেপাশে একটা সাদা অ্যাম্বাসাডার ঘোরাফেরা করছিল। অবশ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা সঠিক বলতে পারেননি সন্ধেবেলা ওই অ্যাম্বাসাডারই অর্ককে হিট করেছে কিনা।…যাই হোক, দুয়ে দুয়ে তো আর পাঁচ হয় না। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি তপনই…। অতি দুঃসাহসী হয়ে তপন সেদিনই বিদিশাকে আবার ফোনও করেছিল।

—হুঁ। পার্থ উঠে বসল। হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করেছে। ধরাল না সিগারেট, ঘোরাচ্ছে আঙুলে।

মিতিন বলল,—শুনুন স্যার। অর্ক কেন, বিদিশার কোনও প্রেমিককেই আমি সন্দেহ করিনি। বিদিশা বার বার ভাস্করের দিকে আঙুল তোলা সত্ত্বেও না।

—তা হলে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে কেন?

—ছাই উড়িয়ে দেখতে চাইছিলাম, মণিমুক্তোর সন্ধান পাই কিনা। ভাস্করকে দেখে বুঝলাম লোকটি একটি অতি পগেয়া মাল। বিদিশাকে সে মন থেকে বহুকাল আগে ঝেঁটিয়ে বিদায় তো করেছেই, সে এখন যে মেয়ে দেখে তার হাত ধরেই টানাটানি করতে চায়। রাজনীতির দৌলতে সে এখন দিব্যি করে কম্মে খাচ্ছে, অর্চিষ্মানের কাছেও তার কিছু ধান্দা আছে, ও সব বাঁকাচোরা ঝামেলায় জড়ানোর বান্দাই নয় সে। মাঝে সে অনেক দিন কলকাতার বাইরে ছিল, এই পয়েন্টটাও তার ফেবারে যায়। কিন্তু মিহিরের কেসটা আলাদা। সে গেরস্ত মানুষ সদ্য বিয়ে-থা করে সুখে আছে…। তবে এর কাছ থেকেই মোক্ষম ইনফরমেশানটা জুটে গেল।

—আর সেই সূত্র ধরেই চিত্রভানু, চিত্রভানুকে ধরে সোনাদা! পার্থ সিগারেটটা ধরাল,—এ তো আমি জানি। কিন্তু দিননাথকে তুমি পিকচারে আনলে কী করে?

—মনের ভেতর অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে মশাই। চিত্রভানুর কাছ থেকে জনৈক সোনাদার সন্ধান পেয়ে চমকে ছিলাম বটে, কিন্তু ব্ল্যাকমেলিং-এর ঘটনার সঙ্গে এই লোকটাকে ঠিক অ্যাসোসিয়েট করতে পারছিলাম না। কারণ তখনও আমার মন জুড়ে আছে অর্চিষ্মান। সোনাকে বছর দুই আগে ছাঁটাই করেছে অর্চিষ্মান, গত বছর জুলাই আগস্টে চিত্রভানুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে সোনার, পুজোর ঠিক পরে কেউ একজন গিয়ে চিত্রভানু সেজে মিহিরের কাছ থেকে বিদিশার প্রেমপত্র নিয়ে এল, তার মাস আড়াই পরে আকস্মিক ভাবে অর্চিষ্মানের সঙ্গে বিয়ের ঠিক হল বিদিশার, ব্ল্যাকমেলিং শুরু হল বিয়ের ছ মাস পরে, ব্ল্যাকমেলিং-এর ফোন আসার আগের দিন অদ্ভুত এক চুরি হয়ে গেল নিলামঘরে, চোর প্রায় কিছুই নিল না, শুধু শুধু কিছু আলমারি ঘেঁটে গেল, তার মধ্যে একটা আবার ভাঙা বাতিল আলমারি—ব্যাপারগুলোকে ঠিক ঠিক লিংকআপ করতে পারছিলাম না। অথচ মনে হচ্ছে প্রতিটি ঘটনার মধ্যেই কোথায় যেন একটা সুতোর যোগ আছে। মিহিরের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে গেছি বিদিশা আর অর্চিষ্মানের বিয়ে হঠাৎ স্থির হয়নি, এটা রীতিমতো পূর্বপরিকল্পিত। প্ল্যানটা কার? অর্চিষ্মানেরই? তা হলে প্রতিহিংসার থিয়োরিটা মিথ্যে হয়ে যায়। ধরে নিলাম, দিননাথ সাদা সরল মানুষ, অর্চিষ্মানই আটঘাট বেঁধে বাবাকে দিয়ে বিয়ের ব্যাপারটা ঠিক করিয়েছিল। সে ক্ষেত্রে কি দিননাথ পরে ঠাট্টার ছলেও কথাটা বিদিশাকে বলতেন না? তা ছাড়া মাত্র দশ লাখ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনায় এমন দীর্ঘমেয়াদি একটা প্ল্যান…? নাহ্, হিসেবটা মিলছে না, হিসেব মিলছে না। ভাবতে ভাবতে সেদিনই অবশ্য চোখ অনেকটা খুলে গেল।

—কী করে?

—ওই শার্ট। অর্চিষ্মান যদি গোটা ব্ল্যাকমেলিং-এর ব্যাপারটা সাজিয়ে থাকে, সে কেন নিজের জাপাকাপড়ের মধ্যে ওই শার্ট রাখতে যাবে? তা হলে রাখল কে? বাড়িরই কেউ! পদ্মপাণি মানদা সুমতি…! কেন তারা রাখবে? অর্থপ্রাপ্তির আশা? কারও নির্দেশ? তখনই মনে পড়ল অৰ্চিষ্মানের জাপাকাপড় ঘাঁটতে দিননাথই বিদিশাকে বলেছিলেন! তবে দিননাথই কি বিদিশাকে বিভ্রান্ত করার জন্য…? আবার আমি তোমার আনা স্টেটমেন্টগুলো নিয়ে বসলাম। কয়েকটা অসঙ্গতি আগেই চোখে পড়েছিল, এবার স্টাডি করে সেগুলো আরও স্পষ্ট হল। সুমতি বলছে, রবি মিসিং হওয়ার আগের দিন চলে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিল। বোনাস নিতে। বোনাস, নাকি দিননাথের সঙ্গে অন্য প্রয়োজন ছিল? মানদার এজাহার অনুযায়ী, রবি বলত বিদিশা এ বাড়ি আসার পর তার কপাল খুলে গেছে! কেন বলত? শুধুই বিদিশার কাছ থেকে বখশিস পেত তাই? উঁহু, ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। পদ্মপাণির বক্তব্য, ইদানীং বড় উদ্ধত হয়ে গিয়েছিল রবি। কোন জোরে? দিননাথের দিকে সন্দেহের তিরটা এবার সরতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝতে পারছি, দ্বিতীয় আর একজন লোকও আছে। যে গাড়ির তলায় শুয়ে ছিল, সাদা অ্যাম্বাসাডার নিয়ে ঘোরে, অর্ককে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে, যার শার্ট এসে গেছে অর্চিষ্মনের দেরাজে…। কাকে আড়াল করতে চাইছেন দিননাথ? সে কি ভাড়া করা লোক? নাকি সে’ই চক্রান্তের হোতা? আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল, চিত্রভানুর সোনাকেও একবার বাজিয়ে দেখা দরকার। পরদিনই নিলামঘরে গিয়ে অর্চিষ্মানের কাছ থেকে ছাঁটাই হওয়া সকলেরই নাম ঠিকানা নিয়ে নিলাম। ওই সময়ে স্ট্যাম্পপেপারের টুকরোটাও পেয়ে যাই। তারপর ছুটলাম বাড়ি বাড়ি। স্বর্ণেন্দু হরিপ্রসাদ হয়ে তপন। বিকেলের মধ্যে ছবি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেল। তপন যে সোনা, সেটাও।…তপনের বাড়িতেই মোস্ট ভাইটাল জিনিসটা চোখে পড়ল। ইনসুলিনের ভাঙা অ্যাম্পিউল। সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা ধাঁধার সমাধান পেয়ে গেলাম।

পার্থর সিগারেট শেষ, আর একটা সিগারেট ধরাল। দু দিকে মাথা নেড়ে বলল,— বুঝলাম না।

—তুমি কী গো? মনে নেই চিত্রভানু কী বলেছিল? সোনাদা মিষ্টি খাওয়ায়, কিন্তু নিজে খায় না। বীথিকা নন্দী বললেন, ইনসুলিন নেয় তার ছেলে। অর্থাৎ তপন অ্যালিয়াস্ সোনা একজন অ্যাকিউট সুগার পেশেন্ট। এই সব রোগীদের হঠাৎ হঠাৎ হাইপোগ্লাইসিমিয়ার অ্যাটাক হয়। বিশেষত টেনশানের মুহূর্তে।

—সেটা কী জিনিস? ওই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া?

—ইয়েস। ব্লাডের সুগার লেভেল সাডেনলি ফল করে সেন্সলেস হয়ে যায় রোগী, এতে আকস্মিক মৃত্যু ঘটাও বিচিত্র নয়। এরা সব সময়ে পকেটে চিনি রাখে। মুখে চিনি দিলেই সঙ্গে সঙ্গে চাঙ্গা। শুধু চাঙ্গা নয়, একশো পারসেন্ট ফিট। তখন এরা হাঁটতে পারে, দৌড়তে পারে, গাড়ি চালাতে পারে…। গাড়ির নীচে তপনের এই অ্যাটাকটাই হয়েছিল। সে তো আর বর্ন ক্রিমিনাল নয়, সুস্থ হওয়ার পরেও কনফিডেন্স পাচ্ছিল না, বেরোতে সময় নিচ্ছিল…

—এটা কিন্তু তোমার স্রেফ আন্দাজ।

—মোটেই না। পরশুদিন বিদিশার বাড়ি গিয়ে তপনের শার্ট আমি পরীক্ষা করেছি। ওতে চিনির দানা লেগেছিল। চোখে দেখা যায় না, চেটে বুঝেছি। দেখলে না, ওই অ্যাটাকই আজ আবার…। মিতিন হাত নেড়ে মুখের সামনে থেকে সিগারেটের ধোঁয়া সরাল,—বিদিশার কাছ থেকে পরশু আরও কয়েকটা খবর পেলাম। দিননাথের উইল করার কথা, মামাবাড়ির সঙ্গে অর্চিষ্মানদের কোনও সম্পর্ক প্রায় না থাকার কথা, ভাই বোন কারও গানের অত ঝোঁক নেই অথচ বাবা গানপাগল—সব মিলিয়ে দিননাথকে নিয়ে মনে মনে গড়ে তোলা কাহিনীটা যেন পুরোপুরি একটা শেপ পাচ্ছিল। ছুটলাম অৰ্চনার বাড়ি। রবি পূষনের দেওয়া লোক, সেই ছুতো ধরে পূষনকে ব্ল্যাকমেলিং-এ জড়িয়ে অর্চনাকে কষে ভয় দেখালাম। ব্যস, চাপের মুখের অর্চনার পেট থেকে কথা বেরিয়ে এল! বাবার অ্যাফেয়ারের কথা, বাবা অবৈধ সন্তানকে সম্পত্তির ভাগ দিতে পারেন, সেই আশঙ্কার কথা…। পুরনো উইলের চিন্তাটাও তখনই মাথায় এসে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কাহিনী কমপ্লিট।

—হুঁ। পার্থ মাথা দোলাচ্ছে, —আচ্ছা, পূষন অর্চনাকে তুমি আদৌ সন্দেহ করলে না, এটা কেন হল?

—কে বলল করিনি? আমার লিস্টে সবাই ছিল। প্রভাকর ভারতী চিত্রভানুরাও। কিন্তু সোনা আর দিননাথকে এত হুড়মুড় করে পেয়ে গেলাম…। মিতিন লম্বা হাই তুলল। আড়মোড়া ভেঙে শুয়ে পড়েছে বিছানায়। বিড়বিড় করে বলল,—বেচারা দিননাথ। বিদিশাকে উনি সত্যি সত্যিই ভালবেসে ফেলেছেন, অথচ এই কুকর্মে তাঁকে সমানে তাল দিয়ে যেতে হয়েছে।…আননেসেসারি কত মিথ্যে বলতে হয়েছে জানো? তোমার দেওয়া স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, রবি মিসিং হওয়ার আগের দিন উনি রবিকে নিয়ে শ্যামবাজারে টেপ সারাতে গিয়েছিলেন। শ্যামবাজার মোড়ে চরকি মেরে সেই দোকানটাও আমি খুঁজে বার করেছি। বহুকাল ধরে সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল নামি অকশনিয়ার দিননাথ রুদ্রর, দোকানদারই বলেছে। সত্যিই ওখানে রেডিও টেপ রেকর্ড প্লেয়ার সারাতেন দিননাথ। কিন্তু ওই বিশেষ দিনটিতে উনি সেখানে যানইনি। আবার বৃহস্পতিবার দিননাথ অবলীলায় বলে দিলেন মঙ্গলবার নজরুল মঞ্চে ফাংশন শুনতে গিয়েছিলেন। আমি ছোট্ট টোপ দিলাম, আমজাদ আলি খাঁর বাজনা? ওঁর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, হ্যাঁ। সেদিন নজরুল মঞ্চে আমদাজ আলি খাঁর প্রোগ্রামই ছিল না। সম্ভবত তিনি আন্দাজই করতে পারেননি আমি একজন গোয়েন্দা।…দিননাথ আসলে যেতেন তপনদের বাড়ি। বীথিকা দেবীকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে তপনকে থামানোর চেষ্টা করতেন। বখে যাওয়া অবৈধ সন্তানটিকেও তিনি বড় ভালবাসতেন যে। আর এই ভালবাসাই তাকে বাধ্য করেছে তপনের শার্টখানা অর্চিষ্মানের দেরাজে রেখে বিদিশাকে পুরোপুরি ঘুলিয়ে দিতে। ভয়েস রেকর্ডার আনা দেখে তিনি ভেতরে ভেতরে বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলেন।

—যাই বলো, বেচারা তো তপনও। পার্থও আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল,—আহা রে, শেষ বাজিটা আর মারতে পারল না। এটা পেয়ে গেলে হয়তো চিরকালের মতো চুপ করে যেত।

—হয়তো। মিতিন চোখ বুজল,—তাই না দু লাখ লাফিয়ে পাঁচ লাখ হয়ে গিয়েছিল…কিন্তু লোভের তো শেষ নেই পার্থ। লোভ লালসা বাসনা কামনা, কোনও কিছু থেকেই মানুষের পালাবার পথ নেই।

খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। অন্ধকার ঘরে শুধু ঘূর্ণায়মান পাখার শব্দ। যেন দীর্ঘশ্বাস বাজছে একটা।

একটু পরে পার্থর গলা শোনা গেল,—ওয়ান লাস্ট কোয়েশ্চেন মিতু। বিদিশাকে তুমি সব কথা জানতে দিলে না কেন? অর্চিষ্মানকেও বারণ করে দিলে..

—যে কারণে বিদিশার সব কথা অর্চিষ্মানকে জানালাম না…। বিদিশার প্রেমিকদের লিস্ট শুনে অর্চিষ্মান কী করবে? শ্বশুরের কীর্তির কথা শুনেই বা কী মোক্ষ লাভ হবে বিদিশার? এতে তো শুধু তিক্ততা আর সন্দেহই বাড়ে।

—তার মানে বলছ স্বামীস্ত্রীর মধ্যে কিছু গোপনীয়তা থাকা ভাল?

—কখনও কখনও ভাল বইকি। অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পর্কটা ভাল করে দানা না বাঁধে। ওরা যদি কখনও গভীর ভাবে পরস্পরকে ভালবাসতে পারে, নিজেরাই পরস্পরকে বলে দেবে সব কথা।

পার্থ হাত বাড়িয়ে ছুঁল মিতিনকে,—আমাদের মধ্যে কি কোনও গোপনীয়তা আছে, মিতু?

মিতিন হেসে ফেলল,—আছে বইকী। এই মুহূর্তে একটা গোপনীয়তা তো আছেই।

—কী?

—কাল যখন অত বার করে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছিলাম, হুঁ হ্যাঁ করে ঘুমিয়ে পড়লে, অথচ আজ সকালেই আমি আলমারিতে একটা খাম পেয়েছি। খামে ট্রেনের টিকিট। পরীর। জার্নি ডেট ফিফটিনথ অক্টোবর। অর্থাৎ একাদশী। তুমি এটা আমার কাছে চেপে গেছ কেন?

—সারপ্রাইজ দেব বলে।

—কবে কেটেছ?

—অ্যাই অ্যাই, নো টিকটিকিপনা। পার্থ মিতিনের ঠোঁটে আঙুল চাপা দিল, তোমাকে আগে থেকে ওয়ার্নিং দিয়ে রাখছি, পুরীতে গিয়ে কিন্তু নো গোয়েন্দাগিরি। কোনও অর্চিষ্মান অর্কর পেছনে দৌড়োনো চলবে না।

—তুমিও কোনও বিদিশার পেছনে ছুটো না, তা হলেই…

কথাটা শেষ করতে পারল না মিতিন। ছেলেকে টপকে চলে এসেছে পার্থ, একেবারে নীরব করে দিয়েছে মিতিনকে।

মাথার ওপর এখন আবার শুধু ঘুরন্ত পাখার শব্দ। তবে দীর্ঘশ্বাসটা নেই আর, কোত্থাও নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *