২.০১ বাজার থেকে ফিরে

দ্বিতীয় পর্ব

[এক]

বাজার থেকে ফিরেই অভ্যাসমতো খবরের কাগজ নিয়ে বসে পড়েছিল পার্থ। হাতে পেনসিল, ঘন ঘন আঙুল ঠুকছে কপালে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,—ইউরেকা! ইউরেকা!

মিতিন শোওয়ার ঘরে। বুমবুমকে স্কুলের জন্য তৈরি করছে। ছেলের ঘেঁটি চেপে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গলা ওঠাল, —কী হল চেল্লাচ্ছ কেন?

—পেয়ে গেছি। চশমখোর।

ও, শব্দজব্দ! আপন মনে ভ্রূভঙ্গি করল মিতিন। ইদানীং এই খেলাটা নিয়ে খুব মেতেছে পার্থ, সারা সকাল ধরে চলে শব্দ খোঁজার পালা। ঠেলে ঠেলে ওঠানো যায় না, কাজে পাঠানো যায় না, কী ঝকমারি! বললেই ওমনি বাবুর গোঁসা হবে, কেন আমি কি কাজ করি না!

হ্যাঁ, কাজ পার্থ করে বটে! এগারোটা নাগাদ হেলে দুলে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে টানা দেড় মিনিট হেঁটে ঢাকুরিয়া স্টেশন, অন্তত খান দুই ট্রেন ছেড়ে তৃতীয় ট্রেনে আরোহণ, শেয়ালদা নেমে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে শ আড়াই গজ দূরে নিজস্ব প্রেসে পদার্পণ, কর্মস্থলে পৌঁছেই স্ট্যান্ডফ্যানের সামনে জামাটি ঝুলিয়ে দিয়ে তুড়ি মেরে হাই তোলা, কম্পোজিটার মেশিনম্যানকে আলগা নির্দেশ বিতরণ, এবং পাঁচটা বাজলেই শখের প্রাণ গড়ের মাঠ, তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাবু চললেন নাটকের রিহার্সালে—সব কটাই তো কাজ! এমন ঢিকিস ঢিকিস বরটাকে যে কী করে শোধরায় মিতিন!

বুমবুম নিজে নিজেই জুতো পরছে। বয়স চারও ছোঁয়নি, এর মধ্যেই সে ঘোরতর স্বাধীনচেতা। মা চুল আঁচড়ে দিয়েছে বলে এখনও এক রাশ বিরক্তি তার কপালে। ছেলে ব্যাগ পিঠে ঝোলানোর আগে মিতিন টুক করে টিফিনবাক্সটা খুলে দেখে নিল একবার। আঙুর ডিমসেদ্ধ বিস্কুট সন্দেশ। নাহ, বিমলা ঠিকই গুছিয়ে দিয়েছে। দানবীর ছেলে আঙুর আর সন্দেশ বিলোবেই, অন্তত বাকি দুটো যদি মুখে তোলে!

পার্থ আবার চেঁচাচ্ছে,—আচ্ছা, যার দাড়ি জন্মায়নি, এক কথায় কী হবে গো?

বুমবুম গটগট বেরোচ্ছে ঘর থেকে, পিছন পিছন এল মিতিন। স্বামীকে আলগা দেখে নিয়ে বলল,—এও জানো না? মাকুন্দ।

—আহ্, তিন অক্ষর নয়, ছ অক্ষর।

বিমলা সেন্টারটেবিলে চা নামাচ্ছে। তার হাতে ছেলেকে জিম্মা করে দিয়ে মিতিন বসল সোফায়। কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল,—অজাতব্যঞ্জন হতে পারে।

—কী ব্যঞ্জন?

—অজাত। অর্থাৎ যার ব্যঞ্জনা জন্মায়নি। ব্যঞ্জনা অর্থ গোঁফদাড়িও হয়।

সন্দিগ্ধ চোখে স্ত্রীকে একবার দেখল পার্থ। দাড়ি চুলকে পূর্ণ করল ছক। পরক্ষণেই প্রশ্ন,—মহাভারতের শয়তান, যাকে বায়ু ছোঁয়…? তিন অক্ষর।

—কীচক।

—আর যার হাত বেঁকা? এটাও তিন।

—শুরু কী দিয়ে?

—খ।

—খটক।

—যাক, এটা কমপ্লিট। পেনসিল নামিয়ে চায়ের কাপ টানল পার্থ,— তুমি রিয়েলি জিনিয়াস। এমন পটাপট বলে দিতে পারো…!

—মন দিয়ে লেখাপড়াটা করেছিলাম স্যার। তোমার মতো মেয়েদের পেছনে ঘুরে ঘুরে সময় কাটাইনি।

পার্থ চোখ পাকিয়ে তাকাল,—ডোন্ট ফরগেট, মেয়েটা কিন্তু তুমিই।

—আরও কোথায় কোথায় ছোঁক ছোঁক করে বেড়াতে…আমি কি তোমাকে পাহারা দিতে গেছি!

—এবার কিন্তু মিথ্যে বললে। আমাকে পাহারা দিতে দিতেই তুমি মেয়েটিকটিকি হয়েছ।

মিতিন হেসে ফেলল। পার্থর রসিকতায় কণামাত্র হলেও সত্যি আছে বইকি। কলেজে দু দুবার আলাদা আলাদা বান্ধবী নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিল পার্থ, তাকে না জানিয়ে। নির্দোষ প্রমোদ। দু বারই ধরে ফেলেছিল মিতিন। বান্ধবীরা যে ফিল্‌মের গল্প বলে, পার্থর মুখেও সেই ফিল্‌মের কথা—ব্যস এইটুকু থেকেই জেরা শুরু, এবং আত্মসমর্পণ।

হাসতে হাসতেই মিতিন বলল,—তুমি কিন্তু একটা অফেনসিভ কথা বললে। আমি টিকটিকি?

—পাড়াপড়শিরা তো তাই বলে।

—আর তোমাকে কী বলে?

—কী আর…! টিকটিকির আরশোলা।

কথাটা নেহাতই রঙ্গ করে বলা। তবু মিতিনের হাসি চুপসে গেল। ভার ভার গলায় বলল,—তোমার আজকাল কমপ্লেক্স আসছে মনে হচ্ছে?

—আমার! পার্থ হো হো হেসে উঠল,—এমন টিকটিকি পেয়ে আমার আরশোলা জনম সার্থক হয়ে গেছে। কটা লোকের বউ-এর মাথায় এত বুদ্ধি থাকে।

—থাক, আর ঠাট্টা করতে হবে না। মিতিন উঠতে গিয়েও কী ভেবে বসল আবার। ইতস্তত করে বলল, —দুপুরে আজ একটা কাজ করে দিতে পারবে?

নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল পার্থ,—আজ্ঞা করো দেবী…

—ফের ফাজলামি? সিরিয়াসলি শোনো। একজনকে টেইল করতে হবে।

—কেন, তোমার শাগরেদরা কোথায়?

—অজয়কে আমি আজ ইনসিওরেন্স অফিসে পাঠাচ্ছি। সুভাষ যাবে মধ্যমগ্রাম। গয়না চুরির কেসটার টুকিটাকি কয়েকটা ইনফরমেশান দরকার।

—অ। সোফার ওপর বাবু হয়ে বসল পার্থ। সিগারেট ধরাল একটা, —বলো, কার পেছনে লাগতে হবে?

—একজন বিজনেসম্যানের। দীপক ভাল্লা।

—ব্যাটাছেলে?

—কেন, মেয়েছেলে হলে বুঝি খুশি হতে?

—মিথ্যে বলব না, হতাম। তবে মেয়েদের পিছু নেওয়ার অবশ্য একটা প্রবলেমও আছে। মেয়েরা সিমপলি আনটেইলেবল। মনে আছে তোমার মিসেস নীলিমা সিনহা আমায় কেমন ভুগিয়েছিল? পার্লারে ঢুকল তো ঢুকলই, বেরোল সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর। কী সব চুনকাম করেছে, হেয়ারস্টাইল বদলে ফেলেছে, বয়স কমিয়ে ফেলে…। আমি তো চিনতেই পারতাম না, ভাগ্যিস শাড়ির কালার মনে ছিল!

মিতিন ঠোঁট টিপে হাসল,—দীপক ভাল্লাকে নিয়ে তোমার সে সমস্যা নেই। আমি ওর ছবি আর অ্যাড্রেসটা তোমায় দিয়ে দিচ্ছি, ঠিক দুটোর সময় ওর অফিসের গেটে চলে যাবে। সওয়া দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে লোকটা অফিস থেকে বেরোবে, এবং পসিব্‌লি ধর্মতলার এক বারে যাবে। ওখানে দুজন লোক দেখা করতে আসবে ভাল্লার সঙ্গে, তুমি কাছাকাছি বসে ওদের কথাবার্তাগুলো শোনার চেষ্টা করবে। পারলে ভাল, না পারলে এটুকুনি শুধু নোট করবে, কথার মাঝে কোনও ঝগড়াঝাঁটি হয় কিনা। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে অফিস ফেরা পর্যন্ত দীপক কী কী করে তার ডিটেলটা আমার চাই।

—হু ইজ দিস ব্লাডি ভাল্লা? পার্থ সিগারেট নেবাল।

—ভাল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তিন মালিকের ছোট মালিক। অর্থাৎ বাবা ভাল্লার কনিষ্ঠ পুত্র। পিতৃদেবের সন্দেহ কোম্পানি থেকে টাকা সরাচ্ছে ছোট ছেলে, এবং কোনও আনহোলি বিজনেসে নেমেছে। পারহ্যাপস স্মাগলিং। আমার যা ফাইন্ডিং, তাতে বাবা ইজ হাফ ট্রু। ছেলেটা ফেঁসে গেছে। বিগড়েছিল, কিন্তু এখন নিজেকে শুধরে নিতে চায়। লোকগুলো টাইপ অফ ব্ল্যাকমেলিং করছে ওকে। টোটাল রিপোর্টটা বাবাকে দিয়ে আমি জলদি জলদি হাত ধুয়ে ফেলতে চাই। বুঝলে কিছু?

—বুঝলাম। ভাল্লা ওই ব্ল্যাকমেলারগুলোর সঙ্গে আজ মিট করছে।

—গুড। তুমি তো বেশ ইমপ্রুভ করছ দিন দিন! মিতিন আদর করে পার্থর থুতনি নেড়ে দিল,—একটা কথা বলে রাখছি মশাই! বারে গিয়ে নিজেই যেন সেঁটে যেয়ো না।

দু হাত জোড় করে মাথা ঝোঁকাল পার্থ,—নিশ্চিন্ত রহো দেবী, এ দাসের সুরায় রুচি নাই।

কথাটা খাঁটি, তবু পুরোপুরি আশ্বস্ত হল না মিতিন। বারে শুধু সুরাই পাওয়া যায় না, অভিরুচিমতো সুখাদ্যও জোটে। পার্থ অত্যন্ত ভোজনবিলাসী, প্রিয় খাবার সামনে থাকলে তাকে নড়ানো কঠিন। সেবার এক প্রেমিক প্রেমিকাকে ফলো করে রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিল পার্থ, কপোতকপোতী কখন হাওয়া, পার্থ বসে বসে কবিরাজি সাঁটাচ্ছে! মিতিনের বকাবকিতে এখন অবশ্য খানিক পরিবর্তন হয়েছে পার্থর, ওরকম পরিস্থিতিতে অর্ধভুক্ত খাবার পকেটে পুরে নিয়ে ধাওয়া করে টার্গেটকে। আজ যদি চাওমিন বা স্যুপ অর্ডার দিয়ে বসে, তা হলে কী ঘটবে বলা মুশকিল। তাও ঝুঁকিটা নিতেই হচ্ছে মিতিনকে। হাতে কাজ জমেছে অনেক, এই সব ছুটকো ছাটকা কেস ঝটপট ঘাড় থেকে নামানো দরকার।

কেস এখন মিতিনের হাতে আসছেও বটে। সাত বছর আগে তৃতীয় নয়ন নাম দিয়ে যখন ডিটেকটিভ এজেন্সিটা খুলেছিল, তখন সারাদিন মাছি তাড়াত বসে বসে। যতই এখন নিন্দেমন্দ করুক, আর পার্থর ওপর চোটপাট করুক, ওই প্রেসই তখন ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছে সংসারের। প্রথম কেস এল একটি মেয়ে, স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অভিযোগ, প্রমাণ জোগাড় করে দিতে হবে। খেটেখুটে করল কাজটা, তারপর আবার বসে রইল টানা দু মাস। বাবা এসেছে, মেয়ে লটঘট করছে, মেয়ের প্রেমিকের চরিত্র সম্পর্কে বাবা যথেষ্ট সন্দিহান, তার নাড়িনক্ষত্র জানতে চায়…। এ ভাবেই গড়িয়ে গড়িয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছিল তৃতীয় নয়ন। কিন্তু মেয়েমানুষের শতেক বাধা। এজেন্সি পিক-আপ নেওয়ার আগে বুমবুম এসে গেল পেটে, ব্যস তৃতীয় নয়ন বছর দেড়েকের জন্য পুরোপুরি অন্ধ। তারপর আবার গা ঝাড়া দিল মিতিন, লেগে পড়ল নতুন উদ্যমে। গত বছর থেকে কারবার দিব্যি জমে উঠেছে, ফেব্রুয়ারিতে এক পাঞ্জাবি দম্পতির বাচ্চা চুরির রহস্য সল্ভ করে পুলিশ মহলেও মিতিন এখন রীতিমতো পরিচিত। তিন চারটে কেস তো হাতে থাকছেই সব সময়, কখনও কখনও বেশিও।

কত বিচিত্র কেসই যে আসে! বাবা ছেলের গোপন খবর জানতে চায়, ছেলে মায়ের, মা মেয়ের, মেয়ে শাশুড়ির…! আর স্বামীস্ত্রীর পরস্পরকে অবিশ্বাস করা তো আছেই। যুগের হাওয়া! সম্প্রতি ইনসিওরেন্সের কেসও জুটছে কিছু, ক্লেমের সত্যিমিথ্যে নিরূপণ করতে হয় মিতিনকে। দিনে দিনে কত কিছু শিখছে মিতিন, কত কিছু যে জানছে!

বুমবুমকে পৌঁছে বিমলা ফিরেছে। রান্নাঘরে গিয়ে তাকে কিছু সাংসারিক নির্দেশ দিল মিতিন, তারপর স্টাডিরুমে এসে বসল। তাদের এই দু কামরার ভাড়াবাড়িতে একটা চওড়া বারান্দা আছে। পিছন দিকটায়। বারান্দাটাকে ঘিরে নিয়েছে মিতিন, নিজস্ব কাজকর্মের জন্য। খুপরি জায়গাটুকুতে অনেক কিছুই আছে, মিতিনের চেয়ার টেবিল, ছোট সোফা, একখানা ফাইল ক্যাবিনেট, বেঁটে একটা স্টিল আলমারি, বইপত্র। গোপন নথিপত্রও থাকে আলমারিতে, নিজের পেশার প্রয়োজনীয় জিনিসও।

ক্যাবিনেট থেকে গয়না চুরির ফাইলটা পাড়ল মিতিন। বাড়ির সকলের জবানবন্দি রয়েছে, পড়ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কর্তা আর গিন্নির স্টেটমেন্টে কোথায় যেন একটা ফাঁক আছে, মনে হচ্ছিল মিতিনের। কর্তা বলছেন স্লিপিং পিল খেয়েছিলেন নৈশাহারের ঠিক আগে, গিন্নির বক্তব্য সাড়ে দশটার সময়ে ট্যাবলেট খাওয়ার জল দিয়েছিলেন কর্তাকে। কাজের লোকের জবানবন্দি অনুযায়ী সাড়ে নটা থেকে দশটার মধ্যে বাড়ির লোকের খাওয়া দাওয়া সব চুকে যায়, কর্তা খুব টাইমের মানুষ, কোনও রকমেই বেনিয়ম পছন্দ করেন না…। সেদিন কি কোনও কারণে দেরি হয়েছিল? কেউ উল্লেখ করেনি তো! কর্তা গিন্নির মধ্যে কেউ একজন মিথ্যে বলছে। অথবা ভুল। কিন্তু কেন?

ফাইল বন্ধ করে মিতিন চোখ বুজল। ভাবছিল। তার থট প্রসেস রীতিমতো এক শারীরিক ক্রিয়া। গভীর চিন্তার সময়ে মিতিন অনবরত নাক মুখ কুঁচকোয়, কখনও মিটিমিটি হাসে, কখনও অসম্ভব গম্ভীর। যে কেউ এখন বছর বত্রিশের এই শ্যামলরঙ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার রমণীটিকে দেখলে পাগল বলে ভুল করবে।

টেলিফোন বেজে উঠল। মূল ফোন ড্রয়িংরুমে, এখানে এক্সটেনশান লাইন। চোখ বুজেই মিতিন রিসিভার তুলেছে,—প্রজ্ঞাপারমিতা বলছি।

—আমি অনিশ্চয় তালুকদার। ডিসি ডিডি।…ম্যাডাম কী খুব বিজি নাকি?

মিতিনের মুখমণ্ডল হাসিতে ভরে গেল। ভদ্রলোকের সঙ্গে বছর দুয়েকের পরিচয়, হৃদ্যতাও আছে বেশ, তবু এখনও লোকটা ফোনে নামের সঙ্গে পোস্টের উল্লেখ করে। করবেই।

হাসিমুখে মিতিন বলল,—ওই আর কি। ফেঁসে আছি বলতে পারেন।

—তার মানে খুব কামাচ্ছেন, অ্যা?

—আপনাদের আশীর্বাদ দাদা।

—হুম।…তা কর্তাটি কোথায়? তিনিও কামাই-এ বিজি?

—আজ্ঞে না। তিনি এখন অক্ষরের ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছেন।

—সেটা কী কেস?

—ক্রসওয়ার্ড পাজল। বাংলায়।

—আছেন বেশ দুটিতে, হেঁ হেঁ হেঁ। কর্তার নাটকের পাস কিন্তু এখনও পেলাম না।

—ওদের গ্রুপের তো মাঝে মাঝেই শো হচ্ছে। আকাদেমিতে। চলে যান না যেদিন খুশি। আগে একটা রিং করে দেবেন, ও কাউন্টারে বলে রাখবে। মিতিন একটু থেমে গলাটাকে সামান্য আদুরে করল,—দাদা, আমার কাজটার কী হল?

—আরে, সেই জন্যই তো…। আপনি পরশু বিকেলে যখন ছবি আর ফিঙ্গারপ্রিন্টটা পাঠালেন, তখনই আমার নাকটা খুব শুলোচ্ছিল। বাড়ি ফিরেই কাত, কাল আর অফিস যেতে পারলাম না..

—ওমা, সেকী! জ্বর হয়েছে নাকি?

—ঠিক জ্বর নয়, জ্বর জ্বর। মনে হচ্ছে এই এল, কিন্তু টেম্পারেচার উঠছে না।

—তার মানে কাজটা হয়নি। তাই তো?

—ঠিক ধরেছেন, হেঁ হেঁ হেঁ…।

সাধে কি আর লোকে পুলিশকে ছেড়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাছে ছোটে? মিতিন গলা ঈষৎ ভারী করল,—ইনফরমেশানটা আমার কিন্তু খুব আরজেন্ট ছিল দাদা। কাজের লোকটা এখনও পুলিশ কাস্টডিতে, পাস্ট রেকর্ডটা পেয়ে গেলে ওর সম্পর্কে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।

—আরে দূর, বৃথা খাটছেন। ওই কাজের লোকটাই চোর। আপনারা গোয়েন্দারা অনর্থক সোজা ব্যাপার জটিল করেন। আর দুটো দিন কাটুক, রুলের গুঁতোয় ব্যাটা সব ব্যাকব্যাক করে বলে দেবে।

তর্কে গেল না মিতিন। কেজো স্বরে বলল,—আজ কি ওগুলো পাব দাদা?

—আজ যদি অফিস যাই, তো আজই পেয়ে যাবেন।

—যদি কেন দাদা?

—মানে যদি সব ঠিকঠাক চলে আর কী। যদি জ্বরটা না আসে, যদি অন্য কোনও ঝাটে না আটকে যাই…

কথাতে এত ‘যদি’! পিতৃদত্ত নাম সার্থক লোকটার। মিতিন টেলিফোন রেখে কয়েক মিনিট ঝুম হয়ে বসে রইল। সব গুলিয়ে দিল লোকটা, কোনও মানে হয়? তাদের পেশাটা এমনই, প্রতি পদে পুলিশের সাহায্য লাগবেই। আবার তাদের ওপর ভরসা করতে গেলেও বছর গড়াতে আঠেরো মাস লেগে যায়।

এ বাড়িতে বাংলা ইংরিজি মিলিয়ে অনেকগুলো খবরের কাগজ আসে। আন্দাজ মতো বিভিন্ন দরকারি খবরের কাটিং রাখতে হয় মিতিনকে। এখন আর একটা বাংলা কাগজ নিয়ে পড়েছে পার্থ, শব্দ হাতড়াতে হুশ হুশ সিগারেট টানছে। বিমলার মাছ কোটা সারা, মশলা বাটছে শিলে। মিতিন রান্নাঘরে এল, কড়া বসাল গ্যাসে। মাছের ঝোলটা নিজেই রাঁধবে। খুন্তি নাড়তে নাড়তে মিতিনের মাথাটা খোলে ভাল।

সবে কড়ায় মাছ ছেড়েছে, দরজায় বেলের ঝংকার। পার্থর নড়ার লক্ষণ নেই, মিতিন ঝামরে উঠল,—দ্যাখো না কে এসেছে!

—জ্বালালে। পার্থ বিরক্ত মুখে উঠে দরজা খুলছে। সামনেই এক সুবেশ ভদ্রলোক। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, গাট্টাগোট্টা চেহারা, নিখুঁত কামানো গালে নীলচে আভা।

পার্থ কায়দা করে তাকাল,—কাকে চাইছেন?

—আমি কি একটু পি মুখার্জির সঙ্গে দেখা করতে পারি?

—আমিই পি মুখার্জি। বলুন।

—না মানে…প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়…

—ও আচ্ছা। আসুন। …আপনার নামটা জানতে পারি কী?

লোকটা পকেট থেকে কার্ড বার করে বাড়িয়ে দিল। পার্থ কার্ডে চোখ বোলানোর আগে নিজেই বলে উঠল,—আমার নাম অর্চিষ্মান রুদ্র। আমি সল্টলেক থেকে আসছি।

[দুই]

বড় সোফায় আড়ষ্ট ভাবে বসেছে অর্চিষ্মান। আলগা চোখ চালিয়ে দেখে নিচ্ছে চারদিক। আড়চোখে ঘুরন্ত ফ্যানটাকে দেখল একবার। ঘামছে অল্প অল্প, নাকের ডগায় জমেছে স্বেদবিন্দু। একটু বুঝি বা অন্যমনস্ক মুখে রুমাল বের করল পকেট থেকে, মুখ মুছছে।

মিতিনও ঝলক পর্যবেক্ষণ করে নিল লোকটাকে। জুতো ছেড়ে ঘরে ঢোকেনি, অর্থাৎ সহবত বোধ কম। অথবা বিদেশি আবহাওয়ায় মানুষ। শার্টপ্যান্ট জুতো হালকা ডিওডোরেন্টের গন্ধ বলে দিচ্ছে লোকটা বেশ ধনাঢ্য। সোফায় খবরের কাগজ ছড়িয়ে রেখেছে পার্থ, সেদিকে মাঝে মাঝেই অস্বস্তিভরা চোখে তাকাচ্ছে লোকটা। খুব টিপটিপ থাকা পছন্দ করে কি?

কাগজগুলো গুছিয়ে তুলে সেন্টার টেবিলের নীচে চালান করে দিল মিতিন। স্মিত মুখে জিজ্ঞাসা করল,—আপনি চা কফি কিছু খাবেন মিস্টার রুদ্র?

—নো থ্যাঙ্কস। অর্চিষ্মান যেন সামান্য সহজ হল।

পার্থ উল্টো দিকের সোফায় বসেছে। ঝুঁকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল,— চলবে?

—সরি, আমি স্মোক করি না।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেই একটা সিগারেট ধরাল পার্থ। বলল,—বেশ, তা হলে আমরা কাজের কথাই শুরু করি।

—হুম। অর্চিষ্মান একবার পার্থকে দেখল, একবার মিতিনকে,—কথাটা কিন্তু খুব কনফিডেনশিয়াল।

—আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন মিস্টার রুদ্র। পার্থ লম্বা করে ধোঁয়া ছাড়ল,— আমাদের এখানে শুধু কনফিডেনশিয়াল কথাই হয়।

মিতিন চোখের ইশারায় চুপ করালো পার্থকে। হাসি হাসি মুখেই তাকাল অর্চিষ্মানের দিকে,—আপনি কি একান্তে কথা বলতে চান?…ইনি আমার স্বামী, পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়। আমরা একসঙ্গেই কাজ করি।

অন্যমনস্ক মুখে মাথা নাড়ল অর্চিষ্মান,—আমি খুব বিপদে পড়ে এসেছি…বিপদটা ঠিক আমার নয়, আমার স্ত্রীর।

—কীরকম?

—কেউ একজন তাকে ভয় দেখাচ্ছে। আই মিন ব্ল্যাকমেল করছে।

—কারণ?

—বিকজ…বিকজ..। অর্চিষ্মান আবার রুমালে মুখ মুছল,—বিয়ের আগে শি হ্যাড অ্যান অ্যাফেয়ার। কেউ একজন উড়ো কল করে আমার স্ত্রীকে ভয় দেখাত, টাকা না দিলে সে আমাদের কাছে ওই অ্যাফেয়ারের কথা ফাঁস করে দেবে। ন্যাচারালি, পরিবারে নিজের সুনাম রক্ষার জন্যই হোক, লোকলজ্জার ভয়েই হোক, সে একবার পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছে। কিন্তু এখন সেই লোকটা আরও বেশি টাকা দাবি করছে। দু লাখ। আমার স্ত্রী একদম ভেঙে পড়েছে। যাকে বলে টোটাল নার্ভাস ব্রেকডাউন।

—স্ট্রেঞ্জ! পার্থ সিগারেট নিবিয়ে সোফার পিঠে হাত ছড়িয়ে দিল,—আপনাকে লুকোনোর জন্যই তো তিনি টাকাটা দিয়েছিলেন, এখন যখন আপনি জেনেই গেছেন, তখন আর ব্ল্যাকমেলিং-এর কোনও মূল্যই নেই। আপনার স্ত্রী তো এখন স্বচ্ছন্দে ইগনোর করতে পারেন।

—আপাতদৃষ্টিতে আপনার কথাই ঠিক। বাট ম্যাটার ইজ মোর সিরিয়াস নাউ। অর্চিষ্মান কয়েক সেকেন্ড থেমে বড় করে নিশ্বাস নিল,—ওর মধ্যে এখন একটা মৃত্যু ঢুকে পড়েছে।

—মৃত্যু! মিতিনের গলা দিয়ে শব্দ ছিটকে এল।

—ইয়েস। পরশু হয়তো কাগজে দেখেছেন, রোড অ্যাক্সিডেন্টে সল্টলেকে একজন অ্যাথলিট মারা গেছে?

—দেখেছি তো। পার্থ বলে উঠল,—অর্ক রায়। স্প্রিন্টার। এবার বোধহয় ন্যাশনাল মিটে যাওয়ারও কথা ছিল ছেলেটার।

অর্চিষ্মান মাথা নামাল,—ওই অর্ক রায়ই আমার স্ত্রীর…মানে ওর সঙ্গেই আমার স্ত্রীর অ্যাফেয়ার ছিল।

এতক্ষণে চোখ সরু হয়েছে মিতিনের,—আপনি বলতে চান ওই অর্ক রায়ের মৃত্যুটা নিছক অ্যাক্সিডেন্ট নয়?

—আমি নয়, আমার স্ত্রীর সেরকমই ধারণা। তাকে নাকি ব্ল্যাকমেলারটা শাসিয়েছে আবার। বলেছে, দু লাখ টাকা না দিলে তার দশা নাকি অর্ক রায়ের চেয়েও খারাপ হবে।

—অর্থাৎ প্রকারান্তরে ব্ল্যাকমেলার বলছে সেই অর্ক রায়কে খুন করেছে। তাই তো?

—ঠিক তাই। বিদিশা…আই মিন আমার স্ত্রী তাই বিশ্বাস করে।

—কিন্তু অর্ক রায়কে মেরে ব্ল্যাকমেলারের কী লাভ?

—লাভ আছে। আমার স্ত্রী যখন ব্ল্যাকমেলারকে টাকা দিতে যায়, অর্ক রায় তখন নাকি সঙ্গে ছিল। সম্ভবত সে সময়ে অর্ক রায় দেখে ফেলেছিল লোকটাকে। পরে আবার পথেঘাটে তাকে চিনতে পেরে…। সেই খবরটা দিতেই বিদিশাকে, মানে আমার স্ত্রীকে সে দেখা করতে বলেছিল।

—এবং তার আগেই ছেলেটি মারা যায়?

—না। অ্যাট দ্যাট ভেরি ডে, ঠিক দেখা করার সময়ে, এগজ্যাক্ট দেখা করার জায়গাতেই অর্ক রায় ওয়াজ রান ওভার। পুওর সোল।

একটুক্ষণের জন্য গোটা ঘর নিঝুম। বিমলা সেন্টার টেবিলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল রেখে গেছে, অর্চিষ্মান বড় চুমুকে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিল খানিকটা। নতমস্তকে বসে আছে।

মিতিনই বরফ ভাঙল, আপনি এত সব কথা জানলেন কোত্থেকে?

অর্চিষ্মান মুখ তুলল,—ওই অ্যাক্সিডেন্টের দিন, মানে রোববার, আমি বিজনেসম্যান, রোববারও আমার কাজ থাকে। আমি একটু দেরি করেই ফিরেছিলাম, এই ধরুন সাড়ে নটা নাগাদ। ফিরে দেখি আমার স্ত্রী কেমন জবুথবু মেরে বসে আছে বিছানায়। নড়ছে না চড়ছে না, ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না…। ঘাবড়ে গিয়ে একটু ঝাঁকুনি দিয়েছিলাম স্ত্রীকে, সঙ্গে সঙ্গে আছাড়ি পিছাড়ি কান্না শুরু হয়ে গেল। তার পরই ও আমাকে সব…

—হুঁ। আপনি ঘটনার বিন্দুবিসর্গও জানতেন না?

—প্রশ্নই আসে না। সেদিনই প্রথম…।

—ওই অ্যাফেয়ারের কথাটা কি আপনার জানা ছিল?

—নাহ্।

—চিনতেন অর্ক রায়কে?

—নাহ্।

মিতিন আবার চেখ সরু করল,—আপনি পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না কেন?

—ওই যে বললাম, ব্যাপারটা কনফিডেনশিয়াল রাখতে চাই। চাই না ব্যাপারটা পাঁচকান হোক।..আমার বাবা বৃদ্ধ মানুষ, তিনিই বিদিশাকে পছন্দ করে এনেছেন, বউমা বলতে অজ্ঞান। এ সব শুনলেই তিনি ভয়ঙ্কর শক্ড্ হবেন। হার্ট অ্যাটাকও হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। বোঝেনই তো, পুলিশ কিছুই গোপন রাখবে না, শোরগোল তুলে এমন একটা কাণ্ড বাধাবে..

—বুঝলাম। মিতিন মাথা দোলাল,—কিন্তু আমার সন্ধান আপনি পেলেন কী করে?

—আমার এল আই সি এজেন্ট আপনার কথা বলছিল।

—কী নাম বলুন তো?

—সবিতাবাবু। সবিতাবরণ বাপুলি।

—ও হ্যাঁ, একটা কেসে ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল।…তাঁকে আপনি বলেছেন নাকি সব কিছু?

—না না। জাস্ট কথায় কথায়…আমি একজন পেশাদার গোয়েন্দার সন্ধান করছিলাম, তখনই উনি…। আমাদের পরিচিত একজন পুলিশে আছেন। ডি সি। দীপঙ্কর মুস্তাফি। তিনিও আপনাকে চেনেন দেখলাম…।

—চেনে মানে? পার্থ অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর কথা বলে উঠেছে,—জাপানি কনস্যুলেট থেকে কতগুলো ডকুমেন্ট চুরি হয়ে গিয়েছিল, কেসটা সল্ভ করার জন্য দীপঙ্করবাবু মিতিনেরই…। মুস্তাফিসাহেবের প্রেস্টিজ বাঁচিয়ে দিয়েছিল মিতিন।

মিতিন যেন সামান্য লজ্জা পেল। কথা ঘুরিয়ে বলল,—আমি এবার আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি?

—করুন।

—আপনার বাবা তো আছেন শুনলাম। তিনি ছাড়া আর কে কে আছেন বাড়িতে?

—আমার মা আমার খুব ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। দিদির অনেক দিন বিয়ে হয়ে গেছে, এখন বাড়িতে আমি, আমার স্ত্রী, আর বাবা।

—আপনাদের কোনও ইস্যু নেই?

—আমাদের বেশি দিন বিয়ে হয়নি। এই মাস আষ্টেক।

—ও। …আপনার কার্ডে দেখছি অক্শনিয়ার লেখা, আপনার নিলামঘরটা কোথায়?

—পার্ক স্ট্রিটে। নাম সম্ভবত শুনেও থাকবেন। ইম্পিরিয়াল এক্সচেঞ্জ। কলিন মিলার নামে এক সাহেবের ছিল অকশন হাউসটা, তিনি ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে বাবাকে নামমাত্র দামে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

পার্থ তড়বড় করে বলে উঠল,—ইম্পিরিয়াল এক্সচেঞ্জ তো আমি চিনি। মনে নেই তোমার, সুব্রতর অ্যানিভার্সারিতে আমরা একটা কার্টলারি সেট প্রেজেন্ট করেছিলাম?…ওটা তো ওই নিলামঘর থেকেই কেনা! বলেই অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়েছে,—আপনিই ইম্পিরায়াল এক্সচেঞ্জের মালিক? তাই আপনার মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছিল! আপনার দোকানের গায়েই একটা বার আছে না?

—ইম্পিরিয়াল বার। আমারই।

মিতিন কথোপকথন শুনছিল। ঝপ করে বলল,—আমার আরও কয়েকটা প্রশ্ন আছে মিস্টার রুদ্র।

অর্চিষ্মান ঘুরে তাকাল।

—এক নম্বর, আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন? মানে আপনার চেনাজানা কেউ আছে এমন, যে এই কুকাজ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

—কাকে সন্দেহ করব?…নাহ্।

—দু নম্বর, আপনার স্ত্রী কবে প্রথম ব্ল্যাকমেলারের ফোন পেয়েছিলেন?

—নিখুঁত বলতে পারব না। মাস দেড় দুই হবে। দিঘায় আমরা একটা আউটিং-এ গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই ফিরেই নাকি…

—এই দেড় দু মাসে আপনার স্ত্রীর মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখেছিলেন?

—আমি খুব বিজি মানুষ প্রজ্ঞাপারমিতাদেবী। দুটো ব্যবসা আমি একা চালাই, রোজই বাড়ি ফিরে এক্সট্রিমলি টায়ার্ড থাকি।

—অর্থাৎ লক্ষ করেননি?

—সেভাবে নজরে পড়েনি। হয়তো কোনওদিন একটু মুখভার থাকত, কি একটু উদাস…। সে তো নানা কারণেই হতে পারে। নয় কি?

—লাস্ট প্রশ্ন।…আপনি ঠিক কী চান? আমার কাছে কী জন্য এসেছেন?

—আমি সেই ব্ল্যাকমেলারটাকে চাবকাতে চাই। অর্চিষ্মান চাপা স্বরে গর্জে উঠল,— সে আমার মেন্টাল পিস নষ্ট করে দিয়েছে।

—শুধু এটুকুই কারণ?

—আপনি আমার স্ত্রীর অবস্থা দেখেননি! …সব সময়ে থরথর করে কাঁপছে, বিছানা থেকে উঠতে পারছে না…এরকম চললে যে কোনও দিন সে এমনিই মারা যেতে পারে।

পার্থ পুট করে বলে উঠল,—বউকে ডাক্তার দেখিয়েছেন?

—না…মানে এখনও…। অর্চিষ্মান আমতা আমতা করল,—বললাম না, ব্যাপারটা জানাজানি হতে দিতে চাই না! আমি নিজেই তাকে কনসোল করার চেষ্টা করছি।

—আর ওই টাকাটা দেওয়ার ব্যাপারে কী ভাবছেন?

—কোন টাকা? ওই দু লাখ?…যদি লোকটাকে ধরার কোনও বন্দোবস্ত না হয়, আমার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আই অ্যাম ফোর্সড্ টু পে। এত বড় শয়তান, সে আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলারও ভয় দেখিয়েছে! আমার স্ত্রীর প্রাণ আমার কাছে অবশ্যই আগে।

—কবে দিতে হবে টাকাটা?

—বলেনি এখনও। আজও ফোন আসতে পারে…। অর্চিষ্মান স্পষ্টতই বিচলিত। হঠাৎ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,—বদমাইশটাকে আপনি ট্রেস করে দিন প্রজ্ঞাপারমিতাদেবী। বিফোর এনি মোর সিরিয়াস মিসহ্যাপ। আই শ্যাল পে ইউ ফিফটি থাউজেন্ড ফর দ্য জব।

মিতিন তক্ষুনি কিছু উত্তর দিল না।

অর্চিষ্মান আবার বলল,—আপনাকে এখনই কি কিছু অ্যাডভান্স করে যাব? চেকবই আমি সঙ্গে এনেছি।

—না থাক। মিতিন সেন্টারটেবিলে পড়ে থাকা অর্চিষ্মানের কার্ডটা তুলে নিল। কার্ডে চোখ রেখেই বলল,—যদি কেসটা নিই, আমি আপনাকে জানিয়ে দেব।

—আপনি কেসটা নেবেন না? অর্চিষ্মানের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল,—খুব আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। আমি শিওর ছিলাম, মহিলা হয়ে আপনি আর একটি মেয়ের প্রবলেম ঠিক ফিল করতে পারবেন।

—ফিল করছি না, এ কথা কিন্তু এখনও বলিনি মিস্টার রুদ্র। মিতিন আলতো হাসল,—আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আমি আগে একবার কথা বলতে চাই। তার পরে নেব কি নেব না, সেটা ভাবব।

—তাই হবে। অর্চিষ্মান ঘাড় নাড়ল,—কবে দেখা করতে চান বলুন?

—আজ হবে না। কাল…

—কখন যাবেন বলুন? আমি আপনাকে নিতে আসব…

—তার কোনও দরকার নেই। আপনার অ্যাড্রেস তো কার্ডে আছে, আমি চলে যাব। মিতিন সোজাসুজি অর্চিষ্মানে চোখের দিকে তাকাল,—আমি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে নিভৃতে কথা বলতে চাই, আপনিও সেখানে না থাকলে ভাল হয়। শুধু স্ত্রীকে জানিয়ে দেবেন, আমি অ্যারাউন্ড ইলেভেন তার কাছে যাচ্ছি।…বাই দা বাই, আপনার বাবাও তো ওখানে থাকেন, তাঁর কাছে নিশ্চয়ই আমার পরিচয় দেওয়া চলবে না?

অর্চিষ্মান অসহায় মুখে বলল,—না দিলেই তো ভাল। নয় কি?

—ঠিক আছে।

অর্চিষ্মান উঠে পড়ল। সে চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে এসে পার্থ বলল,—তুমি কী গো? কড়কড়ে চেক দিয়ে যাচ্ছিল, ছেড়ে দিলে? ব্যাটা হেভি চালু, ব্ল্যাকমেলারকে দু লাখের বদলে তোমায় দিতে চায় পঞ্চাশ! নিট দেড় লাখ মুনাফা!

মিতিন কথাটা যেন শুনতেই পেল না। চিন্তিত মুখে বলল,—লোকটাকে তোমার কেমন মনে হল বলো তো?

—বড়লোকরা যেমন হয়। টাকার গরম আছে, টনটনে প্রেস্টিজান আছে, চিপ্পুসও আছে। জোর করেই চেকটা দিয়ে যেতে পারত! …একটা জেন হাঁকিয়ে এসেছিল, যাওয়ার সময়ে দেখলাম।

—সে তো বুঝলাম। কিন্তু লোকটা কেমন? মানে মানুষ হিসেবে কেমন?

—এই তো মুশকিলে ফেললে। পার্থ মাথা চুলকোল,—ভালই তো মনে হয়। বউকে ভালবাসে, ফ্যামিলির সুনাম নিয়ে চিন্তা করে…

—সত্যিই কি ভালবাসে?..বউকে একটা ব্ল্যাকমেলার ভয় দেখাচ্ছিল, বউ প্রেমিকের সঙ্গে গিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকাও নাকি দিয়ে এসেছে…! তুমি খেয়াল করেছ, লোকটা প্রেমিক শব্দটা একবারও উচ্চারণ করছিল না, বার বার বলছিল অ্যাফেয়ার…! বউয়ের অ্যাফেয়ার নিয়ে কোনও কমেন্টও করল না! জেলাসি? না বউয়ের প্রতি উদাসীন? বউটা ব্ল্যাকমেলারের ফোন পেয়ে নিশ্চয়ই আনন্দে নাচছিল না? মাত্র আট মাস বিয়ে হয়েছে, অলমোস্ট নিউলি ম্যারেড, বউ যে ডিসটার্বড্ রয়েছে, সে কিছুই আঁচ করতে পারেনি?

—হতে পারে বউটা খুব ঘুঘু মাল। ভাল অ্যাক্টিং জানে।

—তার মানে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা খুব গভীর নয়।

—হুম।…তুমি তা হলে কি কেসটা নেবে না?

—ভাবছি। এরকম ব্ল্যাকমেলিংয়ের কেস তো আগে করিনি। সঙ্গে আবার একটা খুন মতনও আছে। বলেই পার্থকে ঠেলতে শুরু করেছে মিতিন,—ওঠো ওঠো, বিমলার রান্না হয়ে গেছে, চান খাওয়া করে বেরিয়ে পড়ো।

—আজ আর প্রেসে যাব না। ধর্মতলার দিকে দুটো পেমেন্ট কালেকশান আছে, অফিস দুটোতে ঢুঁ মেরে তোমার কাজে নেমে পড়ব।

—প্রেসেই যাবে না? তোমার কর্মচারীরা ফাঁকি মারবে না?

—আমি থাকলেই ওদের কাজের ডিসটার্ব হয়। হে হে করে হাসল পার্থ। ভুরু নাচিয়ে বলল,—তোমার ডিউটিতে যাচ্ছি, টিএ ফিএ দেবে তো?

—ফিরে এসো, দেব।

—রাত্তিরে?

—ফাজলামি হচ্চে?

কথা বলতে বলতেই রিসিভার কানে তুলেছে মিতিন। ডায়াল করছে টক টক।

ও প্রান্তে নারীকণ্ঠ। মিতিন জিজ্ঞাসা করল, —সবিতাবাবু বাড়ি আছেন?

—না তো। কিছু দরকার ছিল?

—আমি প্রজ্ঞাপারমিতা বলছি। উনি এলেই আমাকে একটা ফোন করতে বলবেন। আরজেন্ট।

ফোন রেখে দিয়ে কাগজ কলম নিয়ে বসল মিতিন। প্রশ্ন সাজাচ্ছে। বিদিশাকে ঘিরে।

[তিন]

প্রেসের দরজায় এসে থমকে গেল মিতিন। সামনে কী বিরল দৃশ্য! গভীর মনোযোগে কাজ করছে পার্থ! ঘুপচি ঘরখানার টেবিলে হুমড়ি খেয়ে, জোরালো বাতি জ্বালিয়ে! প্রুফ দেখছে মনে হয়। মাত্র তিন হাত দূরে মিতিন, এতই নিমগ্ন পার্থ যে মিতিনকে খেয়ালই করছে না!

মিতিন দু চোখ ভরে পার্থকে দেখল একটুক্ষণ। পার্থর এই ডুবে থাকা রূপটা তার ভারী প্রিয়। হয়তো ক্ষণস্থায়ী বলেই।

একটু পরে গলা ঝাড়ল মিতিন। বারেক তাকিয়েই পার্থ আবার মাথা নামাচ্ছিল, হঠাৎ যেন সম্বিতে ফিরেছে,—আরে প্রজ্ঞাদেবী যে! অসময়ে দেবী কেন দীনের দপ্তরে?

—অ্যাই, নো যাত্রা। মিতিন হেসে চেয়ার টেনে বসল,—আর প্রজ্ঞা প্রজ্ঞা আবার কী? কত দিন না বলেছি, ওই ডাকটা শুনতে আমার একটুও ভাল লাগে না।

—কী বলব তবে? পারু পারো?

—ছিঃ, তুমি কি দেবদাস নাকি?

—উহুঁ দেবীদাস। কলম টেবিলে ফেলে কাগজের তাড়া সরাল পার্থ। আড়মোড়া ভাঙল,—তারপর বলল, দেখা হল সেই বিদিশাদেবীর সঙ্গে?

—হল।

—কথাবার্তা?

—হয়েছে।

—কী বুঝলে?

—বলছি। আগে এক গ্লাস জল খাওয়াও তো। মিতিন আঁচল তুলে মুখ মুছল! কাঁধের ঝোল্লা ব্যাগখানা রাখল টেবিলে,—উফ, যা গরম আজ! সল্টলেক থেকে আসতেই ভাজা ভাজা হয়ে গেলাম। কে বলবে আশ্বিন মাস!

পাশের বড় ঘরে ঘটাং ঘট মেশিন চলছে। পার্থর হাঁক শুনে ছুটে এল রঘু। বছর তিরিশ বয়স, কম্পোজিটার।

পার্থ চোখ টেরচা করে তাকাল,—কী রে অ্যাঁ, চাকরি বাকরি করার ইচ্ছে আছে, না কী?

রঘু মিচকে হাসল,—বউদিকে দেখেই আমি কালো চায়ের অর্ডার দিয়ে এসেছি।

—গুড। তোর বোনাস কে আটকায়! আদত জায়গায় লাইন করা শিখে গেছিস।…যা, এক গ্লাস জল নিয়ে আয়।

পলকে হুকুম তামিল করেছে রঘু। ছেলেটাকে একটা হাসি উপহার দিয়ে মিতিন ঢকঢক জল শেষ করল। আবার আঁচলে মুখ মুছছে। ধীরেসুস্থে।

পার্থ অসহিষ্ণু ভাবে বলল,—এবার বলো, কেমন দেখলে বিদিশাদেবীকে?

—রিয়েল রূপসী। দু আঙুলে মুদ্রা করল মিতিন,—যাকে বলে ডানাকাটা পরী।

—অ্যাহ্, মিস হয়ে গেল!

—আফসোস হচ্ছে? সঙ্গে গেলে পারতে।

—নিয়ে গেলে কই! আহা, কত দিন সুন্দরী মেয়ে দেখিনি!

—উঁ? মিতিন কড়া গলায় বলল,—আমি বুঝি সুন্দরী নই?

—তুমি সুন্দর কোত্থেকে হবে? তুমি তো বউ।

—দাঁড়আও, তোমার আজ হবে।

বলতে বলতে চট করে বাড়িতে একটা ফোন সেরে নিল মিতিন। নাহ্, বুমবুম ঠিকই আছে, ঘুমোচ্ছে। ছেলে ঘুম থেকে উঠলে তাকে জোর করে লেবুর রস খাওয়ানোর নির্দেশ দিল বিমলাকে, বিকেলবেলাতেও ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে বলল। রিসিভার রেখে খুলল ঝোল্লা ব্যাগ, অর্চিষ্মানের কার্ড বের করে রাখল সামনে। আবার ডায়াল করছে।

—হ্যালো, মিস্টার রুদ্র আছেন?

—স্পিকিং।

—শুনুন, আমি প্রজ্ঞাপারমিতা বলছি। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার…

—জানি। বিদিশা আমায় একটু আগে ফোন করেছিল।

—আমি কেসটা নিচ্ছি।

—সো কাউন্ড অফ ইউ। আমি জানতাম আপনি বিদিশাকে দেখলে আর না করতে পারবেন না।

—শুনুন, আপনার সঙ্গে আমার আরও কিছু কথা আছে। অ্যাক্রস দা ফোন হবে না, আমি আপনাকে মিট করতে চাই।

—বেশ তো।…যদি বলেন, সন্ধেবেলা আপনার বাড়ি চলে আসতে পারি।

—তার দরকার নেই। আমি আপনার শোরুমে যাব।

—মোস্ট ওয়েলকাম। কটায়?

—এই ধরুন, অ্যারাউন্ড পাঁচটা। একটু লেটও হতে পারে।

—নো প্রবলেম। আমি আটটা অব্দি আছি।

পার্থ জুলজুল চোখে মিতিনের ফোনালাপ শুনছিল। মিতিন রিসিভার রাখতেই কৌতূহলী মুখে বলল,—কেসটা তা হলে নিয়েই নিলে?

—ইন্টারেস্টিং খুব, বুঝলে। অনেকগুলো গিঁট আছে…

—কীরকম?

—বলছি।…আগে কিছু খাওয়াও তো। পেট জ্বলে যাচ্ছে।

—কী আনাব?

—এখানে নয়, বাইরে চলো। অনেকদিন তুমি আমায় রেস্টুরেন্টে খাওয়াওনি।

—আমারই ঘাড় ভাঙবে? এটা তো তোমার কোম্পানি এক্সপেন্সে হওয়া উচিত।

মিতিন চোখ পাকাল। সংসার খরচের জন্য দুজনেই তারা মোটামুটি সমান টাকা দেয়, তার বাইরে হাতখরচ যার যার তার তার। যেহেতু ইদানীং মিতিনের রোজগার বেশি, পার্থ সহজে হাত উল্টোতে চায় না, এই নিয়ে স্বামীস্ত্রীতে খুনসুটিও চলে জোর।

আজ মিতিনের কুপিত দৃষ্টি দেখে সঙ্গে সঙ্গেই শ্বেতপতাকা তুলে দিল পার্থ। চা এসে গেছে, দু চুমুকে ভাঁড় শেষ, উঠে পড়েছে স্বামীস্ত্রী। প্রেসে এখন কাজ আছে বিস্তর, ছোট ছোট দুটো পত্রিকার পুজোসংখ্যা ছাপা চলছে, খান তিনেক স্যুভেনিরও। মেশিনম্যান কম্পোজিটারদের সঙ্গে টুকিটাকি দু চারটে দরকারি কথা সারল পার্থ, তারপরই মিতিনকে নিয়ে বড় রাস্তায়। পুজো এখন হপ্তা তিনেক দূর, শারদীয়া কেনাকেটা শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে, ভিড় ঠেলে দুজনে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল। অর্ডারও দিয়েছে চটপট। রুটি মাংস। খিদের মুখে কোনও শৌখিন খানা মিতিনের পছন্দ নয়।

ঘোর দুপুরেও রেস্তোরাঁ জমজমাট। ঠক ঠক দুটো জলের গ্লাস টেবিলে বসিয়ে দিয়ে গেল বেয়ারা। পার্থ পথেই সিগারেট ধরিয়েছিল, অ্যাশট্রে টেনে নেবাল সিগারেট।

জলে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল,—লোকটার কাছে পাঁচটায় যাবে বললে কেন?

—এখান থেকে একবার লালবাজার যাব। তারপর…মিতিন সামান্য দূরমনস্ক,—মেয়েটা যেন কেমন কেমন, বুঝলে…! শকটা ওর জেনুইনই মনে হল। কিন্তু কী যেন একটা গোপন করছে!

—মাঝখান থেকে বোলো না, গোড়া থেকে শুরু করো। পৌঁছলে কখন?

—সওয়া এগারোটা। সল্টলেকে বাড়ি খুঁজে পাওয়া…!

—বাড়িটা কেমন? খুব পয়সাওলা, না?

—সে তো বটেই। একতলার ড্রয়িংরুমখানা দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যা অ্যান্টিকের কালেকশান!

—নিলামঘরখানা দেখলে আরও চোখ ধাঁধাবে। ভেতরে পুরো একটা ক্রিকেট প্র্যাকটিস করার জায়গা আছে। এখনকার বাজারে ওই দোকানের ভ্যালুয়েশান কোটি টাকার কম হবে না।

—বাপ রুদ্রর সঙ্গে আলাপ হল?

—হয়েছে। কোথায় যেন বেরোচ্ছিলেন ভদ্রলোক

—খানদানি রইস, না?

—নিশ্চয়ই তাই। তবে দেখে বোঝা যায় না। কথাবার্তায় খুব অ্যাফেকশান আছে।

—তুমি তাকে কী পরিচয় দিলে?

—সে বেশ মজা হয়েছে। চাকরটা তো প্রথমেই আমায় হাঁকিয়ে দিচ্ছিল, বউদির শরীর খারাপ, দেখা হবে না…! ভদ্রলোক ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। আমি ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বললাম, আমি বিদিশার বন্ধু মেসোমশাই, বিদিশার বিয়ের দিন আপনাকে দেখেছিলাম…। ব্যস, ওমনি চাকরটাকে কী দাবড়ানি! তোর এত বড় সাহস, বউদিমণির বন্ধুকে ফেরত পাঠাচ্ছিস…! উনিই আমায় সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। সরবত মিষ্টিও দিয়ে যেতে বললেন ঘরে।

—মহিলা তোমায় দেখে চমকায়নি?

—মহিলা কী গো! মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে। হার্ডলি চব্বিশ পঁচিশ। আমার থেকে অন্তত সাত আট বছরের ছোট। বরের সঙ্গে বেশ ভালই বয়সের তফাত আছে।…তবে সে মেয়ে চমকানোর পাত্রী নয়। বর তো বলে রেখেছিলই, তিনিও অভিনয়ে দিব্যি পটু। শ্বশুরমশায়ের সামনে এমন ভাব করল যেন আমি সাত জন্মের সখী!

—শ্বশুরমশায়ের সন্দেহ হয়নি? তোমার মতো একটা দামড়া মেয়েকে সখী বলে মেনে নিল?

—পুরুষরা মেয়েদের বয়স বোঝে না। মিতিন খিলখিল হাসল,—আর আমিও এমন কিছু বুড়ি নই।

কথাটা অস্বীকার করার অবশ্য উপায় নেই পার্থর। এক ছেলের মা হয়েও মিতিনের শরীর বেতসলতার মতো ছিপছিপে। এক কণা মেদ নেই কোত্থাও। নিয়মিত ভোরবেলা যোগাভ্যাস করে মিতিন। কলেজে পড়ার সময়ে ভাল মতো ক্যারাটে শিখেছিল, যদিও ব্ল্যাকবেল্ট পাওয়া অবধি এগোনো হয়নি। এখন পাড়ার ক্লাবে সপ্তাহে দু দিন বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ক্যারাটে শেখায় মিতিন। চর্চাটাও থাকে, ব্যায়ামও হয়। মুখে একটা কিশোরীর লাবণ্য আছে মিতিনের, এই উত্তরতিরিশেও।

রুটি মাংস এসে গেছে। ক্ষুধার্ত মিতিনের আগে পার্থর হাতই চলতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে কথাও চলছে। বউকে একটু তোষামোদ করে নিয়ে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনছে বিদিশা উপাখ্যান।

খেতে খেতেই মিতিন বলল,—মোদ্দা কথা যা বুঝলাম, মেয়েটা একেবারেই সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির। বাপ সওদাগরি অফিসের হরিপদ কেরানি, দাদাটা কাঠবেকার, শুধু মাত্র রূপের জোরে বড়লোকের বাড়ির বউ হয়েছে। অর্ক বলে ছেলেটার সঙ্গে এক সময়ে চুটিয়ে প্রেম করত। হয়তো এমনও হতে পারে ব্ল্যাকমেলারটা অর্কই, সেই এইভাবে ঘটনাকে সাজিয়েছিল! যুক্তিটার সপক্ষে একটা বড় পয়েন্টও আছে। বিয়ের পর দিঘাতেই প্রথম অর্কর সঙ্গে দেখা হয় বিদিশার, এবং তার পরেই ফোনটা আসে। হয়তো গাড়ির তলায় শুয়ে থাকা লোকটাও অর্করই লোক!

—তা হলে অর্ক মরল কেন?

—হতে পারে অর্কর সঙ্গীটি খুব খতরনাক ছিল। হয়তো টাকা ঠিক পায়নি তাই

—মেরেই দেবে?

—অর্ককে মেরেই দেওয়া হয়েছে কিনা এ ব্যাপারেও আমি শিওর নই। ওটা একটা মিয়ার অ্যাক্সিডেন্টও হতে পারে। মিতিন ন্যাপকিনে মুখ মুছল,—তবে অর্কর ফেবারে একটা পয়েন্ট আছে। অর্ক তো বিদিশার গয়নাই পেয়ে গিয়েছিল, সেটা নিয়েই কেটে পড়ল না কেন? তা না করে গয়না বেচে বিদিশাকে টাকা এনে দিতে গেল কেন? গয়না নিয়ে পালিয়ে গেলে বিদিশা কিল খেয়ে কিল হজম করত, কাউকেই কিছু বলতে পারত না…! অর্থাৎ অর্কই যদি ব্ল্যাকমেলার হয়, তার এত ঘুরপথে যাওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?

—এটা প্রেমিকদের সাইকোলজি, তুমি বুঝবে না। পার্থ বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল,—মে বি, অর্ক হয়তো চেয়েছিল বিদিশার চোখে মহান হয়ে থাকতে। প্লাস, সোনার ডিম পাড়া হাঁসটা হাতে রইল! মাঝে মাঝে গলা টিপে ধরলেই কঁক করে একটা ডিম পেড়ে দেবে। তুমি যে বললে বিদিশার সামনে অর্ক সব চিঠি পুড়িয়ে দিয়েছিল, ওটাও হয়তো একটা ফলস শো! চিঠিগুলোর ফটোকপি সে রেখে দিতেই পারে।

—হুম। মিতিন তবু যেন সামান্য চিন্তিত।

—আর ভাবতে হবে না যাও। ওই অর্কটাই কালপ্রিট।…কেস সল্ভ করে দিলাম, কোল্ড ড্রিঙ্কসের অর্ডার দাও, আর রেস্টুরেন্টের বিলটাও পে করে দেবে।

—নিশ্চয়ই মিটিয়ে দেব। মিতিন সোজা হয়ে বসল,—আগে বলো, বিদিশা এখন যে দু লাখ টাকাটা দেবে, কাকে দেবে?

—ধুস, সব গুলিয়ে দিলে। সত্যিই তো, অর্ক যখন আউটই হয়ে গেছে, তখন দ্বিতীয় বার টাকাটা চাইল কে? পার্থ সিগারেট ধরাল,—আচ্ছা, অর্কর সেই শাগরেদটা হতে পারে না?

—পারে। কিন্তু তাকে বিদিশা অর্চিষ্মান এখন পাত্তা দেবে কেন? অর্কর ব্ল্যাকমেলিং-এর হাতিয়ারগুলো ধরে নিলাম এখন তারই জিম্মায় আছে, কিন্তু তাতেই বা বিদিশাদের কী এল গেল? অর্চিষ্মানের কাছে তো এখন সব কিছুই ওপেন!

—বা রে, কারণটা কাল অর্চিষ্মানই তো বলল! মৃত্যুর ভয়। বউকে সে বাঁচাতে চায়। শয়তানটাকেও খুঁজে বার করে চাবকাতে চায়!

—আমারও ব্যাপারটা কাল এরকমই জলবৎ তরলং মনে হয়েছিল। কিন্তু…। মিতিন আপন মনে দুদিকে মাথা দোলাচ্ছে,—আমি অন্য দু একটা পয়েন্টও পেয়েছি। সেগুলোও ক্লিয়ার হওয়া দরকার।

—কী পয়েন্ট?

—বলব। মিতিন হাত উল্টে ঘড়ি দেখল,—এখন আর সময় নেই।…তোমার কি আজ রিহার্সাল আছে?

—কেন?

—না থাকলে প্রেস থেকে সোজা বাড়ি ফিরে যাবে। ছেলেটা একা আছে…। আর হ্যাঁ, চারটে নাগাদ একবার ফোন কোরো তো বাড়িতে। বিমলা বোসবাবুর ড্রাইভারটার সঙ্গে প্রেম করছে, বুমবুমকে আটকে রেখে বেরিয়েও যেতে পারে।

পার্থ হেসে ফেলল,—রিয়েলি, গিন্নিমা যদি টিকটিকি হয়, সে বাড়ির কাজের লোকদের জীবন দুর্বিসহ! বেচারা।

মিতিনও হাসল ফিক করে,—থাক, আর কাজের লোকের দুঃখে দুঃখী হতে হবে না। বিল মিটিয়ে বেরোও এখান থেকে।

রাস্তায় এসে একটা ট্রাম ধরে নিল মিতিন। সূর্য পশ্চিমে হেলেছে কিছুটা, তবে এখনও তার তেজ প্রখর। আকাশে উদাসী মেঘের কোনও চিহ্নই নেই। হাওয়া বইছে, প্রায় না বওয়ারই মতো। শম্বুক গতিতে চলছে ট্রাম, থামছে ঘন ঘন। মিতিন ঘামছিল।

লালবাজারে পৌঁছে মিতিন হতাশ। অনিশ্চয় তালুকদার রুমে নেই। লোকটা তাকে ভোগাচ্ছে, এখনও ছবি আর ফিঙ্গারপ্রিন্টের রিপোর্ট দিল না। আজ মিতিন ছাড়ছে না, দেখা করেই যাবে।

অপেক্ষা করতে করতে মিতিন ব্যাগ খুলে পকেটবুকটা বার করল। অর্কর ঠিকানা টুকে নিয়েছে, ছেলেটার মাসির সঙ্গে দেখা করতে হবে। নিজেই যাবে। অর্কর মৃত্যুর জায়গাটাও একবার দেখে আসা দরকার। সুভাষকেই না হয়…। টুকরো টুকরো চিন্তা আসছে মাথায়। বিদিশাদের বাড়ি, বিদিশা, তার শ্বশুরমশাই, কাজের লোকজন…। একের পর এক মুখ ভেসে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন ছবি আসছে চোখে। চাকরটার কী যেন অদ্ভুত নাম? পদ্মনাভ…না না না, পদ্মমণি। কাজের লোকদেরও এমন কায়দার নাম হয়…

চারটে নাগাদ অনিশ্চয় তালুকদারের দর্শন মিলল। মিটিং সারছিলেন। কাজ শেষ পর্যন্ত হল বটে, তবে সময়ও গেল অনেক। অনর্গল কথা বলে অনিশ্চয়, বেশির ভাগই নিজের কথা এবং বাহ্বাস্ফোট। প্রথম একটুক্ষণ মজা লাগে, তারপর বিরক্তি এসে যায়। লালবাজার থেকে মিতিন যখন বেরোল, তখন ছটা কুড়ি।

আশ্বিনের সন্ধ্যা বেশ ঘন হয়ে গেছে। অর্চিষ্মানের কাছে আর যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতে পার্ক স্ট্রিটে নেমেই পড়ল মিতিন। সান্ধ্য পার্ক স্ট্রিট যথারীতি আলোয় আলোয় ঝলমল, গাড়িতে মানুষে শব্দময়।

ইম্পিরিয়াল এক্সচেঞ্জের সামনে এসে মিতিন দেখল কোলাপ্‌সিবল গেট প্রায় পুরোটাই টানা, ভেতরে আলো প্রায় নেইই। চলে গেছে অর্চিষ্মান?

গেট ধরে উঁকি দিচ্ছে মিতিন, এক দারোয়ান এগিয়ে এল, —আপনি কি সাহেবের কাছে এসেছেন?

—হ্যাঁ।

—সাহেব পাশেই বারে গেছেন। সসম্মানে দরজা খুলে দিল দিল লোকটা,—আপনি বসুন একটু, ডাকছি সাহেবকে।

ভেতরে পা রেখে গা ছমছম করে উঠল মিতিনের। প্রকাণ্ড নিলামঘরে মাত্র দুটো কি তিনটে বাতি জ্বলছে। কোথাও ফার্নিচার, কোথাও বা মূর্তি, কোথাও অসংখ্য কাচের সরঞ্জাম, ঝাড়বাতি। আবছায়ায় সব কেমন আধিভৌতিক লাগে! প্রাচীন আর নবীনের কী অলৌকিক সমন্বয় চারদিকে!

আচ্ছন্নের মতো হাঁটছিল মিতিন। জায়গাটা ভারী রহস্যময় তো!

[চার]

বিশাল নিলামঘরের একেবারে শেষপ্রান্তে অর্চিষ্মানের অফিস। কাচঘেরা জায়গাটি আয়তনে নেহাত ছোট নয়, আসবাবপত্রও আছে বেশ। মাঝারি সাইজের একখানা সেক্রেটারিয়েট টেবিল, হালকা গদিআঁটা ঘুরনচেয়ার, খান তিনেক হাতলঅলা কাঠের কুর্সি, দুটি স্টিল আলমারি, দেওয়ালে গাঁথা প্রাচীন সিন্দুক, টাইপিস্টের বসার ছোট্ট খোপ, চেস্ট অফ ড্রয়ার—সবই মোটামুটি ছিমছাম সাজানো। নিলামঘরের বাকি কর্মচারীদের বসার স্থান অন্যত্র, মালিকের কাচঘেরা ঘরের বাইরে।

এসি অন করে ঘুরনচেয়ারে বসেছে অর্চিষ্মান। দারোয়ানকে ডেকে দুটো কফির অর্ডার দিল। মৃদু হেসে মিতিনকে জিজ্ঞাসা করল, —আপনার জন্য কি কিছু স্ন্যাকস আনাতে পারি ম্যাডাম?

—নো, থ্যাঙ্কস। উল্টো দিকের চেয়ারে গুছিয়ে বসল মিতিন। অফিসঘরে নিয়নের চড়া আলো। বাইরে নিলামখানার ছায়া ছায়া অন্ধকার এখান থেকে গাঢ়তর লাগে। মিতিনের চোখ ওই আবছায়াতে ঘুরে গেল। খানিকটা স্বগতোক্তির ঢঙে বলে উঠল, —জায়গাটার বেশ একটা ক্যারেক্টার আছে। ঢুকলেই প্রাচীন কলকাতার গন্ধ পাওয়া যায়।

—পুরনো আমলের জিনিসপত্রও তো কম নেই এখানে। বাইরে একখানা প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি আছে, প্রায় সওয়া শো বছরের পুরনো। কুইন ভিক্টোরিয়ার। বিক্রির জন্য এসেছিল, ভাল দাম ওঠেনি বলে আমরাই রেখে দিয়েছি।

—হুঁ, দেখলাম।…আপনাদের দোকানটার বয়স কত হল?

—একদম শুরু থেকে ধরলে সত্তর বছর। আমার বাবাই তো কিনেছেন প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেল।

—কী রকম দামে কিনেছিলেন?

—প্রায় জলের দরে। মাত্র আশি হাজার।

—সেও তো খুব কম নয়। আপনাদের কি পূর্বপুরুষের টাকা ছিল?

—ছিল মোটামুটি। একটু বুঝি ইস্ততত করল অর্চিষ্মান, তারপর বলল,—খুলেই বলি। আমার ঠাকুরদার ছিল মানিলেন্ডিং বিজনেস। হুন্ডিতে টাকা খাটাতেন, গয়নাপত্র বাঁধা রেখেও ধারকর্জ দিতেন। যুদ্ধের, আই মিন সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের আগে, ব্যবসাটা বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। খুব বেশিদিন বাঁচেননি তিনি, বাবার যখন একুশ বছর বয়স তখন হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে…। বাবা ওই বিজনেস আর চালাতে পারেননি। প্রথমত অল্প বয়স দেখে অনেকে বাবাকে টাকা ফাঁকি দিয়েছিল, তা ছাড়া লোকের গলায় গামছা দিয়ে টাকা আদায় করতেও বাবা খুব দড় ছিলেন না। ওই ব্যবসাটা ছেড়ে দেবেন দেবেন করছেন, তখনই এই নিলামঘরটার অফার এল। সাহেবকে বেশ কয়েক বার বিপদে আপদে টাকা ধার দিয়েছিলেন ঠাকুরদা, কিছুটা সেই কৃতজ্ঞতাতেই বাবাকে সস্তায়…।

—আপনি ক বছর হল চালাচ্ছেন?

—দোকানে আসছি অনেক দিন। সেই বি.কম. পাশ করার পর থেকেই। বাবাকে বিশ্রাম দিয়েছি বছর আড়াই।

—হঠাৎ বাবাকে বিশ্রাম দিলেন কেন? তাঁকে তো এখনও যথেষ্ট ফিট দেখলাম!

অর্চিষ্মান হেসে ফেলল,—এসব প্রশ্নের সঙ্গে কি আপনার কেসের কোনও সম্পর্ক আছে ম্যাডাম?

—হয়তো নেই। তবু যাদের কেস করছি তাদের ফ্যামিলি-হিস্ট্রি একটু জানব না?

—ও. কে। অর্চিষ্মান কাঁধ ঝাঁকাল,—বাবাকে শুধু বয়সের জন্য বসিয়ে দিয়েছি, এটা পুরোপুরি ট্রু নয়। একটা সময় গেছে যখন বাবা এই ব্যবসাটাকে চড়চড় করে তুলেছিলেন। সাহেবরা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে, দিশি সাহেবরা হুড়মুড়িয়ে তাদের মাল কিনছে…। তারপর সিচুয়েশান ক্রমশ বদলে গেল। আমি যখন থেকে আসছি, এই ধরুন তেরো চোদ্দ বছর, তখন আর ব্যবসার সেই রমরমা অবস্থা নেই। তারপর কাজকর্ম করতে গিয়ে দেখছিলাম হিসেবপত্রে প্রচুর ডিসক্রিপেনসি আছে, পুরনো লোকজনেরা চুরি করে করে ফাঁক করে দিচ্ছে, বাবা কাউকে তেমন ভাবে বকাঝকাও করতে পারেন না…দেখে দেখে প্রায় জোর করেই একদিন এই ডিসিশনটা নিয়ে নিলাম। নিলামঘরেরই একটা পোরশান আলাদা করে ওই বার কাম রেস্তোঁরাটা খুললাম।…বাবা মাথার ওপর থাকলে হয়তো এটাও সম্ভব হত না।

—আর আপনাদের বাড়িটার বয়স কত?

—ছাব্বিশ বছর।

—তার আগে কোথায় থাকতেন আপনারা?

—দর্জিপাড়া।

—নিজেদেরই বাড়ি ছিল নিশ্চয়ই?

—হ্যাঁ, মোটামুটি বড় বাড়িই ছিল। মা মারা যাওয়ার পরেই ও বাড়ি থেকে বাবার মন উঠে গিয়েছিল। সল্টলেকে সস্তায় জমি কিনেছিলেন, বছর পাঁচেক পর পছন্দসই বাড়ি করে ওখানেই…

—মা কবে মারা গেছেন?

—আমি তখন বছর চারেকের। কলেরা বা ফুডপয়জনিং মতো কিছু হয়েছিল। এক রাতেই ডিহাইড্রেশান হয়ে…। মার কথা আমার খুব পরিষ্কার মনে নেই।

কফি এসে গেছে। ধূমায়িত কাপে চুমুক দিল মিতিন। কথার ফাঁকে ফাঁকে জরিপ করছে অৰ্চিষ্মানকে। কাল লোকটার মধ্যে বেশ নার্ভাস ভাব ছিল, আজ কথাবার্তায় কোনও জড়তা নেই। বরং একটু বেশিই সপ্রতিভ। যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ও আছে বলে মনে হয়। হেলান দিয়ে বসেছে চেয়ারে, মাঝে মাঝে ডাইনে বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে আসনটাকে।

হঠাৎই উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ল অর্চিষ্মান,—আপনি আসল কথা তো কিছু ডিসকাস করছেন না ম্যাডাম? বিদিশার সঙ্গে কথা বলে কী আইডিয়া হল?

মিতিন টেবিলে কাপ নামাল। অর্চিষ্মানের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল,—আপনি কিন্তু দুটো ইনফরমেশান আমায় দেননি মিস্টার রুদ্র!

—আমি! কী ইনফরমেশান?

—দুটো চুরির ইন্সিডেন্ট। একটা আপনার দোকানের, আর একটা আপনার স্ত্রীর গয়নার বাক্স…

মুহূর্তের জন্য থমকে গেল অর্চিষ্মান। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,—হ্যাঁ, গয়নার বাক্সের কথা আমার বলা উচিত ছিল। একদমই মনে ছিল না। কিন্তু ওই চুরির সঙ্গে ব্ল্যাকমেলিংয়ের কী সম্পর্ক? ওটা তো সিম্‌পলি একটা কেপমারি!

—আছে, সম্পর্কে আছে। আপনি আগে বলুন, আপনার এই দোকানের চুরিটা কবে হয়েছিল?

অর্চিষ্মান খাড়া হয়ে বসল, —ওটার সঙ্গেও ব্ল্যাকমেলিংয়ের কো-রিলেশান খুঁজছেন? স্ট্রেঞ্জ!

—কিছুই খুঁজছি না মিস্টার রুদ্র, জাস্ট জানতে চাইছি।

—আমরা দিঘা বেড়িয়ে আসার পরে এগজ্যাক্ট ডেটটা…দাঁড়ান, এক সেকেন্ড। অর্চিষ্মান উঠে আলমারি খুলে একটা ফাইল বার করল। দ্রুত কাগজ ওল্টাচ্ছে। থামল,— ডেটটা হল টেনথ অগাস্ট। ইট ওয়াজ আ ফ্রাইডে।

—আপনার স্ত্রীকে ব্ল্যাকমেলার প্রথম কবে ফোন করেছিল জানেন?

—কবে?

—ইলেভেনথ অগাস্ট।

—ইজ ইট? পলকের জন্য অর্চিষ্মান আলমারি বন্ধ করতে ভুলে গেল। পায়ে পায়ে এসে বসেছে ঘুরনচেয়ারে। চোখ পিটপিট করল একটু। ঠোঁট কামড়ে বলল,—তাতেই বা কী এল গেল? ওটা তো একটা সিম্‌পল কো-ইন্সিডেন্সও হতে পারে।

—হওয়াই সম্ভব। তবু একটু নেড়েচড়ে দেখতে দোষ কি! মিতিন আলগা হাসল,—আপনার দোকানের চুরিটাও তো খুব নরমাল ছিল না। কী, ঠিক বলছি?

—হ্যাঁ, বেশ পিকিউলিয়ার ঘটনা ঘটেছিল! কিছুই খোয়া যায়নি, অথচ এক কাঁড়ি আলমারি ভাঙল…! সিন্দুকটাকেও ড্যামেজ করে দিয়েছিল। তবে টাকাপয়সা তেমন…। বলতে বলতে দুম করে যেন সামান্য সতর্ক হয়ে গেল অর্চিষ্মান। গলা ঝেড়ে বলল,— হাজার বিশেক মতো গেছে তাও। অথচ চোর কিন্তু অবলীলায় লাখ টাকার মাল সরিয়ে ফেলতে পারত।

—পুলিশ তো কিছুই করে উঠতে পারেনি, না?

—আমি এক্সপেক্টও করিনি। তবে সেদিনের দারোয়ানগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছি। একজন মাত্র পুরনো আছে, বাকি সব এখন প্রফেশনাল সিকিউরিটি।

—ভালই করেছেন। …বাই দা বাই, কোন আলমারিগুলো চোর ভেঙেছিল?

—এই তো, এই স্টিলের দুটো। আর বাথরুমের ধারে একটা পড়ে আছে লঝ্ঝর…। ওটা যে কেন ভাঙল! বহুকালের রিজেক্টেড মাল..

মন দিয়ে কথাগুলো শুনল মিতিন, কোনও মন্তব্য করল না। অর্চিষ্মানকে একটু ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য পুরনো প্রসঙ্গে ফিরল,—আপনার স্ত্রীর সেই গয়নার বাক্সে কী ছিল জানেন?

—জানি। ইমিটেশান কীসব।

—একটা জেনুইন জিনিসও ছিল। অর্কর চিঠি।

প্রতিক্রিয়াটা বেশ জোরই হল। হাঁ হয়ে আছে অর্চিষ্মানের মুখ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিস্ফোরিত হল,—এ কথা তো আমায় বলেনি বিদিশা! আশ্চর্য, কেন বলেনি?

—সম্ভবত ভুলে গেছে।

—এত বড় ভুল! আপনাকে বলার সময়ে মনে পড়ল, আর আমাকে…! নো, দিস ইজ আনপার্ডনেবল্।

শেষ শব্দটা ভয়ঙ্কর কঠিন ভাবে উচ্চারণ করল অৰ্চিষ্মান, যেন কোনও দণ্ড ঘোষণা করল।

মিতিন তাড়াতাড়ি বলে উঠল,—আপনি কেন এত উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন মিস্টার রুদ্র? আপনি একজন মহান মানুষ, উদার স্বামী, স্ত্রীর এত কিছু জেনেও তাকে মেনে নিতে পারছেন, আর সামান্য একটা ভুল…! এমনিতেই মিসেস রুদ্র মরমে মরে আছেন, আপনার কাছে তাঁর অপরাধের সীমা নেই…

অর্চিষ্মান কিছুক্ষণ গুম। কী যেন ভাবছে।

মিতিন সামনের পেপারওয়েটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল,—শুনুন মিস্টার রুদ্র, এখন আমাদের সামনে একটাই কাজ। ব্ল্যাকমেলারটাকে পাকড়াও করা। এ সময়ে আপনি ইমোশনাল হলে কিন্তু কাজে খুব অসুবিধে হবে।

অৰ্চিষ্মানের, মুখ তবু থমথমে। কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,—না না, আমি ঠিক আছি। আপনার যদি আর কিছু প্রশ্ন থাকে, করে ফেলুন।

মিতিন মনে মনে হাসল। মুখে যাই বলুক, লোকটা এখনও স্ত্রীর দেওয়া জ্বালাতে ভেতরে ভেতরে জ্বলছে। যে কোনও পুরুষের পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক।

সামান্য গলা ঝেড়ে বলল,—ওই বাক্স চুরির ডিটেলটা কি আপনার মনে আছে?

—আছে। অন্তত যেটুকু আমায় বলা হয়েছে সেদিন।

—আপনার ড্রাইভারই তো মার্কেটে ঢুকে আপনার স্ত্রীকে ডেকেছিল, তাই না?

—হ্যাঁ, সেরকমই শুনেছি।

—আপনার ড্রাইভারটি কি বিশ্বস্ত?

—তাই তো জানতাম। অনেক সময়ে আমার অনেক টাকা নিয়ে ও যাতায়াত করে, কখনও এক পয়সা এদিক ওদিক করেনি।

—আপনি এটা বিশ্বাস করেন যে ব্ল্যাকমেলার সেদিন আপনার ড্রাইভারকে ধোঁকা দিয়েছিল?

—এতদিন তো তাই ভেবেছি। এখন আপনি যখন বলছেন, তখন নতুন করে ভাবতে হবে।

—ঝোঁকের মাথায় কিছু করবেন না মিস্টার রুদ্র। আমিই আপনার ড্রাইভারকে বাজিয়ে দেখব।…এবার আপনাকে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?

—কীরকম?

—কিছু মনে করবেন না, আপনি একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। কারণটা জানতে পারি?

—তেমন স্পেসিফিক কোনও কারণ নেই। বিজনেসে এমন ডিপ্‌লি ইনভল্ভড্ ছিলাম, বিয়ের চিন্তা মাথায় আসেনি।

—এখনই বা এল কেন?

—বলতে পারেন কিছুটা বাবার জোরাজুরিতে। আমিও ভেবে দেখলাম বাবাও রিটায়ার্ড লাইফ লিড করছেন, সারাদিন বাড়িতে একা, সেকেন্ড একজন কেউ এলে বাবার ভাল লাগবে।

—শুধু এই কারণেই বাবার পছন্দ করা পাত্রীকে আদৌ না দেখে আপনি বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লেন?

—বাবার পছন্দে আমার আস্থা ছিল।

—স্ত্রীর কথা বাদ দিন, শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে আপনি স্যাটিসফায়েড?

এবার অর্চিষ্মানকে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত মনে হল,—এ প্রশ্নের উত্তর কি খুব জরুরি?

—প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, আমার কিন্তু জানা দরকার।

এক মুহূর্ত সময় নিয়ে অর্চিষ্মান বলল,—শ্বশুরবাড়িতে আমি খুব কমই যাই। প্রথমত, সময় পাই না। দ্বিতীয়ত, ও বাড়ির অ্যাটমসফিয়ার আমার ভাল লাগে না।

—কেন? তারা আপনাদের থেকে অনেক গরিব বলে?

এতক্ষণে অল্প হাসল অর্চিষ্মান,—দেখুন ম্যাডাম, দারিদ্র্যকে তারাই ঘৃণা করে যারা সদ্য গরিব থেকে বড়লোক হয়েছে, অথবা একেবারেই বড়লোকদের এয়ারটাইট কম্পার্টমেন্টে বাস করে। আমি এর কোনওটাই নই। আমি সাধারণ স্কুলকলেজে পড়েছি, সাধারণ ঘরের প্রচুর বন্ধুবান্ধব আমার ছিল। ইনফ্যাক্ট কেউ কেউ এখনও আছে।

—তা হলে?

—বিদিশাদের বাড়ি একটু ডিফারেন্ট। শ্বশুরমশাই বড্ড বড়বড় কথা বলেন। কবে কোথায় তাঁদের জমিদারি ছিল প্রজারা তাঁদের দেখে কী ভাবে সেলাম করত…। অথচ আমি জানি, মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে তিনি কাবলিঅলার কাছ থেকে টাকা ধার করেছেন। যার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। আমার বাবা তাঁদের এক বস্ত্রে মেয়ে দিতে বলেছিলেন।

—আপনি এত সব কথা জানলেন কোত্থেকে? বিদিশা বলেছেন?

—এই প্রশ্নটা কিন্তু ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল ম্যাডাম। বিদিশা ছাড়াও তো কত ভাবে আমি জানতে পারি। আমার কলেজেরই এক বন্ধু শ্বশুরমশায়ের অফিসে চাকরি করে, আসে মাঝে মাঝে এখানে। আমি অবশ্য কথাটা আমার বাবা বা স্ত্রী কাউকেই কোনওদিন বলিনি।

—ও। তার মানে শ্বশুরকে অপছন্দ করাই আপনার শ্বশুরবাড়ি না যাওয়ার কারণ?

—শুধু তিনি নন, আমার শ্যালকটিও সুবিধের নয়। কুসংসর্গে পড়েছে, নেশাভাঙ করে, কাজকর্ম কিস্যু করে না, মুখের ভাষাও ভাল নয়, মানীর সম্মান রেখে কথা বলতে জানে না।…শাশুড়ি ঠাকরুণ নির্বিরোধী, কিন্তু গেলেই এত বেশি বাবা বাছা করেন, আমার খুব অস্বস্তি হয়।

—বুঝলাম।…এবার একটু আপনার বাড়ির সম্পর্কে প্রশ্ন করি। আপনার দিদি জামাইবাবুর সঙ্গে আপনার রিলেশন কী রকম?

—ওদের কথাও বিদিশার কাছ থেকে শোনা হয়ে গেছে? অর্চিষ্মান আবার হাসল,— ঠিকই আছে সম্পর্ক। ওরাও আসে, আমরাও যাই।

—জামাইবাবুর তো ব্যবসা আছে শুনলাম, কীসের বিজনেস?

—ঢালাইঘর। হাওড়ায়। তবে জানেনই তো, বর্তমানে ঢালাইঘরগুলোর অবস্থা খুব কাহিল। পূষনদা, আই মিন আমার জামাইবাবু, ইদানীং তান্য বিজনেসের কথাও চিন্তা করছেন।

—ও। শেষ প্রশ্ন।…আপনার বাড়ির কাজের লোকগুলো কেমন? বেশ বিশ্বাসী?

অর্চিষ্মান উত্তর দিতে গিয়েও চুপ করে গেল। সিকিউরিটি গার্ডরা এসে গেছে, তাদের দুজন কাচের ওপার থেকে সেলাম ঠুকছে। অর্চিষ্মান হাত তুলল সামান্য, চলে গেল লোকগুলো, পিছনের কোলাপসিবল গেটের দিকে।

আবার কথায় ফিরল অর্চিষ্মান,—কাজের লোক তো আমাদের তিন জন। পদ্মপাণি, সুমতি, মানদা। পদ্মপাণি পুরনো লোক। চোদ্দ পনেরো বছর বয়সে এসেছিল আমাদের বাড়িতে, সেই দর্জিপাড়ায় থাকার সময়ে, তখন থেকেই আছে। বলতে পারেন, এখন মোটামুটি ঘরেরই লোক মানদা সুমতি খুব পুরনো নয়। সুমতি আছে বছর দুয়েক, মানদা আর একটু বেশি। বাড়িতেই থাকে দুজনে, এখনও তাদের অবিশ্বাস করার মতো কোনও কারণ খুঁজে পাইনি। মালী একজন আছে, পার্ট টাইম। সপ্তাহে দু তিন দিন আসে।…আর কিছু জানার আছে আপনার?

মিতিন হেসে ফেলল,—আজকের মতো এই যথেষ্ট।

—এবার আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

—বলুন।

—আপনি কি এদের মধ্যে কাউকে সন্দেহ করছেন ম্যাডাম? মানে এতক্ষণ যাদের কথা জিজ্ঞেস করলেন?

—না না, সেরকম কিছু নয়। এসব হল রুটিন প্রশ্ন। কাজ শুরু করার আগে জেনে নিতে হয়। মিতিন উঠে দাঁড়াল,—আজ তা হলে চলি।

—এক মিনিট বসুন। অ্যাডভান্সের চেকটা দিয়ে দিই।

—এখন থাক, আমি একবারেই নেব।

—চলুন, তা হলে অন্তত আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি!

—থ্যাঙ্কস, এখন আমার একা যেতেই ভালই লাগবে। মিতিন দরজায় গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল,—আর একটা কথা। আপনি যে আমায় অ্যাপয়েন্ট করেছেন, সেটা আপনি আর আপনার স্ত্রী ছাড়া তৃতীয় কেউ যেন না জানেন। অন্তত এক্ষুনি।

অর্চিষ্মান মাথা নাড়ল,—অবশ্যই। আমি তো আগেই বলেছি পাঁচ কান করতে চাই না।

পথে নেমে একটা ট্যাক্সি ধরে নিল মিতিন। দিনভর প্রখর উত্তাপের পর কোমল বাতাস বইছে এখন। ক্লান্ত চোখ জড়িয়ে আসছিল মিতিনের। সারাদিন ধরে আহরণ করা টুকরো টুকরো তথ্যগুলো গাঁথছে মনে মনে, ঝাড়াই বাছাই করছে। একটা কথা পরিষ্কার, ব্ল্যাকমেলার বিদিশার পরিচিত কেউ। অর্ক ছাড়াও আর কে কে হতে পারে? বিদিশাই বা কী গোপন করল মিতিনের কাছে? মিতিন যা আন্দাজ করছে সেটাই কি ঠিক?

মিতিনের চোয়াল শক্ত হল। অঙ্কটা মেলাতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *