১.০১ অর্কর সঙ্গে হঠাৎ দেখা

পালাবার পথ নেই – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

অর্জুন চক্রবর্তী
নীলাঞ্জনা চক্রবর্তী
স্নেহাস্পদেষু

.

প্রথম পর্ব

[এক]

অর্কর সঙ্গে হঠাৎ এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি বিদিশা। তাও আবার এখানে, এই দিঘায়!

গতকালই দুপুরে দিঘায় এসেছে বিদিশা, অর্চিষ্মান। বিয়ের পর এই তাদের দ্বিতীয় সফর। প্রথম বারটা ছিল হানিমুন, মাস সাতেক আগে। জানুয়ারির রক্তজমানো শীতে ডালহাউসি চাম্বা ধরমশালা। তখন ছিল এক ঘোরের সময়, অর্চিষ্মানকে আবিষ্কারের নেশায় তখন তন্ময় ছিল বিদিশা। তবু তার মধ্যেও একটা খুঁতখুঁতে ভাব মনে লেগে থাকত সারাক্ষণ। ধুস, পাহাড়পর্বতে আসার কোনও মানে হয়! বিশ্রী ঠাণ্ডা, দিনের বেলাতেও ফায়ার প্লেসের সামনে কুঁকড়ে মুড়ে বসে থাকো, প্রাণের সুখে হেঁটে চলে বেড়ানোর উপায় নেই, চড়াই উৎরাই করতে করতে হাঁপ ধরে যায়…এর চেয়ে সমুদ্র ঢের ঢের ভাল। একের পর এক ঢেউ কাছে ছুটে আসছে, সাদা ফেনা লুটিয়ে পড়ছে পায়ে, কানে বাজে অবিরাম চাপা গুমগুম ধ্বনি, চোখে মুখে নোনতা বাষ্পের মাখামাখি—এর সঙ্গে পাহাড়ের তুলনা হয়! ওই অন্তহীন জলরাশির দিকে শুধু তাকিয়ে থাকাতেই যে কী আবেশ!

সেই আবেশের টানেই এবার দিঘা। না, পুরী ওয়ালটেয়ার চাঁদিপুর কিংবা গোয়া আন্দামান নয়, ওসব জায়গায় যেতে গেলে বেশ কয়েকটা দিন হাতে নিয়ে বেরোতে হয়। অন্তত সাত দিন। অর্চিষ্মান অত দিন ব্যবসা ফেলে নড়বেই না। অগত্যা দিঘা। দু দিনের জন্য। মঙ্গলবার ভোরে বেরিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ফেরা। অনেকটা উইকএন্ড করার মতো। মিড উইকই অর্চিষ্মানের উইকএন্ড। মঙ্গল বুধ তার নিলামঘর বন্ধ থাকে। আর বার-কাম রেস্তোরাঁটা দুটো দিন নয় ম্যানেজারই সামলে নেবে।

বিদিশারা উঠেছে পুরনো টাউনশিপের দিকটায়। সমুদ্রের একদম পাড়েই, নতুন এক বিশাল হোটেলের তিনতলায়। ভারী সুন্দর নাম হোটেলটার। ব্লু হোয়েল। নীল তিমি। একটু কষ্টকল্পিত নাম বটে, তবে শুনলেই মনে হয় অ্যাটলান্টিক প্যাসিফিকের পাড়ে এসে গেছি। এখানে ব্যালকনিতে সমুদ্র, জানলায় সমুদ্র, চোখ মেললে সমুদ্র, চোখ বুজলে সমুদ্র, শয্যায় রমণের সময়েও ঢেউ-এর ফসফরাস বুঝি লেগে থাকে গায়ে।

নীল তিমি কেতাদুরস্তও খুব। ইউরোপিয়ান স্টাইলের ঝকঝকে সুইট, মেঝেয় নরম কার্পেট, পা রাখলে গোড়ালি ডুবে যায়, নীচে মাদক আলোয় মোড়া পানশালা, মখমলসবুজ লন, এখানে সেখানে বাহারি টেবিলচেয়ারের মাথায় রঙিন বিশ্রামছাতা, মোমমসৃণ ডাইনিং হল, প্যাসেজে সার সার এরিকা পাম, সুইচ টিপলেই উর্দিপরা বেয়ারা হামেহাল হাজির, জেনারেটারের গুণে অবধারিত লোডশেডিং টের পাওয়া যায় না…। এমন হোটেলে বাস বিয়ের আগে বিদিশার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল।

মতো কেন, স্বপ্নই। অথবা স্বপ্নাতীত।

দিঘায় এখন ভিড়ও নেই তেমন। একে বর্ষাকাল, যখন তখন ঝমঝম ঝমঝম, তায় আবার সপ্তাহের মাঝখান, হোটেল রাস্তাঘাট সবই এখন ফাঁকা ফাঁকা। এমন একটা কুড়িয়ে পাওয়া নির্জনতায় বিদিশার খুশি বুঝি আর ধরে না। অর্চিষ্মানও বদলে গেছে। কলকাতায় সে এক প্রবল পুরুষ, মিতবাক পুরুষ, স্থিতধী, ঘড়ির কাঁটার তালে তাল মিলিয়ে চলা আদ্যন্ত কাজমাতাল এক মানুষ। এখানে পা রেখেই সে রুটিনছাড়া। রাত বারোটার সময়ে কাল বিচে চলে গেল, ভোর হতেই বেরিয়ে পড়ল ক্যামেরা কাঁধে। পটাপট ছবি তুলে চলেছে, গুনগুন গান গাইছে, চুটকি রসিকতা করছে, আকাশ দেখছে, সমুদ্র দেখছে, ঝাউবনে ছুটছে বাঁই বাঁই।

এই তো সকালেই ব্রেকফাস্ট সেরে বিদিশাকে টানতে টানতে সমুদ্রে নিয়ে গেল। হাত ধরে দু’জনে একটার পর একটা ঢেউ টপকাচ্ছে। একেবারে বিদিশার থুতনিজলে এসে দুম করে হাত ছেড়ে দিল।

বিদিশা হাউমাউ আঁকড়ে ধরেছে অর্চিষ্মানকে,—অ্যাই, ডুবে যাব, ডুবে যাব…

অর্চিষ্মান হা হা হেসে উঠল,—কাউকে না ধরে একটু নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো ম্যাডাম।

—কী করে দাঁড়াব? বিদিশা অর্চিষ্মানকে খামচে ধরেছে, নীচ থেকে বালি সরে যাচ্ছে যে।

—ও তো যাবেই। আন্ডার কারেন্ট।

—আমার কেমন গা শিরশির করছে। এই প্লিজ, আমি পাড়ে যাব।

বলতে বলতেই সামনে ঢেউ। প্রকাণ্ড। ওমনি ডুব, দু’জনে একসঙ্গে। মাথা তুলে হাঁপাচ্ছে বিদিশা। থু থু করছে নুনজল,—এই প্লিজ চলো, আর নয়। সমুদ্র আজ বড় টানছে গো।

অর্চিষ্মান নির্বিকার। হাসছে,—ভিতুর ডিম কোথাকার। বালি সরে যেতেই এত ভয়? পায়ের তলার মাটি সরে গেলে কী করবে?

—মরে যাব। একদম মরে যাব।

—বললেই হল? মরতে তোমায় দিচ্ছে কে?

অর্চিষ্মান পলকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল বিদিশাকে। জল ভেঙে ভেঙে পাড়ে ফিরছে। বিদিশা দু হাতে অর্চিষ্মানের গলা জড়িয়ে ধরল। চোখ বুজে ফেলেছে। উফ, প্রিয় পুরুষের শরীরে লেপটে থাকায় কী যে অবিমিশ্র সুখ! সে যেন এক রক্তগোলাপ, কামনার ছোঁয়ায় একটু একটু করে ফুটে উঠছে।

গোলাপে কাঁটা থাকে। সুখেও।

না হলে অর্কর সঙ্গে তার দেখা হবে কেন!

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরেই অর্চিষ্মান ঘুমিয়ে কাদা। পাশে শুয়ে বিদিশারও চোখ জড়িয়ে এসেছিল, উঠে পড়ল সাড়ে চারটে নাগাদ। বাইরে তখন এক মলিন বিকেল। শ্রাবণের আকাশ ঘন হয়ে নীচে নেমে এসেছে, নামতে নামতে মিশে গেছে দিগন্তরেখায়, ছুঁয়ে আছে সমুদ্রকে। মেঘের গন্ধ পেয়ে ফুঁসছে ঢেউ, গর্জন তুলে ছুটে আসছে পাড়ের দিকে। বাতাস ভারী গুমসুম, যেন মেঘ তাকে ধমকে থামিয়ে রেখেছে।

বিদিশার মন আনচান করে উঠল। এমন বিকেলে হোটেলে কেউ বসে থাকে!

অর্চিষ্মানকে ঠেলল বিদিশা,—এই ওঠো, বেরোবে না?

অর্চিষ্মান উম্‌ আম্ করে পাশ ফিরল।

বিদিশা সুড়সুড়ি দিল পায়ে। কানেও। কেঁপে কেঁপে উঠছে অর্চিষ্মান, সরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু জাগার লক্ষণ নেই।

—উঠবে না? আমি কিন্তু তাহলে একাই বেরিয়ে যাব।

জড়ানো গলায় অর্চিষ্মান বলল,—যাও।

তবু একটুক্ষণ অপেক্ষা করল বিদিশা। বেয়ারাকে ডেকে চা খেল, আয়নার সামনে বসে সাজল মন দিয়ে। অসামান্য রূপসী সে, ছোট্ট একটা টিপ লাগালেই তাকে কল্পলোকের রাজকন্যা বলে বিভ্রম জাগে। তবু চোখে একটু কাজল টানল বিদিশা, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, শঙ্খ হেন ত্বকে ক্রিমের প্রলেপ। নাইটি ছেড়ে গাঢ় নীল সালোয়ার কামিজ পরে নিল, বুকে বিছিয়ে দিল সাদা ওড়না। এখন তাকে দেখলে রম্ভা মেনকা উর্বশীরাও হিংসেয় মটমট করবে।

সন্তর্পণে দরজা খুলে একাই বেরিয়ে পড়ল বিদিশা। লনে ছাতার নীচে এক জোড়া বিদেশি তরুণ, কথা থামিয়ে বিদিশাকে নিষ্পলক দেখছে। বিদিশা রাজহংসীর মতো গ্রীবা উঁচু করে তাদের পার হয়ে গেল।

পায়ে পায়ে একেবারে বেলাভূমিতে। ভাঁটার টানে সমুদ্র পিছিয়ে গেছে খানিকটা, ভেজা বালি মাড়িয়ে জলের কাছে এল। গড়ানে ঢেউ এসে পা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে, বিদিশা অনুভব করছিল স্পর্শসুখ। মেঘধ্বনি হচ্ছে গুমগুম। বিদিশা শুনছিল।

তখনই পিছনে চেনা স্বর,—দিশা?

বিদিশা ভীষণ জোর চমকেছে,—তুমি! তুমি এখানে?

পলকের জন্য বুঝি থমকাল অর্ক। তার চেহারা পাক্কা অ্যাথলেটিক। হাইট পাঁচ এগারো। দেহের সেই ঋজু কাঠামো একটু বুঝি নুয়ে পড়েছে এখন। ছায়ামাখা মুখে বলল,—আজই এসেছি। হঠাৎ তোমাকে দেখতে পেয়ে…

বিদিশার স্নায়ু টানটান। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,—কেন এসেছ?

অর্ক আরও মিইয়ে গেল,—কেন, আমার কি দিঘা আসতে নেই?

—তা কেন, দিঘা তো কারুর কেনা নয়, ইচ্ছে হলে আসতেই পারো। অস্বস্তি ঢাকতে বিদিশা সামান্য ঝেঁঝে উঠল। দ্রুত এদিক ওদিক চোখ চালিয়ে নিয়ে বলল,—একা?

—না, আমরা তিন জন এসেছি। কন্টাইতে স্টেট মিট ছিল। আজ সকালে আমাদের ইভেন্টটা হয়ে গেল, ভাবলাম একটু দিঘা ঘুরে যাই।

—ও। এখনও তাহলে দৌড়ে বেড়াচ্ছ?

—আর কিছু তো আমি পারি না দিশা।

—চাকরি টাকরি জুটল?

পূর্ণ চোখে বিদিশার দিকে তাকাল অর্ক। তীক্ষ্ণ, মর্মভেদী দৃষ্টি। বিদিশা দৃষ্টিটা পড়তে পারছিল। যেন বলছে, জেনে তোমার কী লাভ! তুমি তো আমায় সময় দাওনি।

অজান্তেই কেঁপে উঠল বিদিশা। হয়তো বা সামুদ্রিক বাতাসে। হয়তো বা ওই চোখ মনে পড়িয়ে দিল, কী অবলীলায় ওই শ্যামলা মায়াবি-মুখ ছেলেটাকে প্রতারণা করেছে বিদিশা। টানা দেড় বছরের সম্পর্ক এক লহমায় ছিঁড়ে ফেলেছে। কোনও প্রস্তুতির অবকাশ না দিয়েই। কারণ অর্চিষ্মানের সঙ্গে তার তখন বিয়ে পাকা, এবং অর্ককে সে পোকামাকড়ের মতো ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। অর্কর চাকরি পাওয়া অবধি কি অপেক্ষা করতে পারত না বিদিশা? সে রুখে দাঁড়ালে বাবা কি জোর করে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পারত?

লোভ, লোভই তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল।

মনকে কষে ধমকাল বিদিশা। লোভ কেন, সে তো যুক্তি মেনেই কাজ করেছে। শুধু চুমু খেয়ে কি পেট ভরে? সংসার করতে গেলে অন্য কিছুও লাগে। যা লাগে তা অর্কর তখনও ছিল না, এখনও নেই।

অর্ক তাকিয়েই আছে নির্নিমেষ। অফুটে বলল,—তুমি আরও সুন্দর হয়েছ দিশা।

অভ্যস্ত স্তুতিতে বিদিশা গলল না। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,—বিয়ের জল গায়ে পড়লে মেয়েরা সুন্দরই হয়।

—তা অবশ্য ঠিক।…উঠেছ কোথায়?

পিছনেই ব্লু হোয়েল। ঠিক পিছনে নয়, বিদিশা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে একটু কোনাকুনি, উত্তর পুবে। হোটেলের সব কটা ব্যালকনি এখান থেকে দৃশ্যমান নয়, ঝাউবনের আড়াল আছে একটা। তিনতলার কোন সুইটটায় যেন আছে বিদিশা? বাঁ দিক থেকে উঠে পাঁচ নম্বর। তার পরে আর কটা ব্যালকনি? বিদিশা ঠিক ঠিক হিসেব করতে পারল না। আন্দাজে আঙুল তুলতে গিয়েও সামলে নিল। ওরে মুখ্যু, অর্ক যদি গিয়ে হাজির হয়?

বিদিশা আলগা ভাবে হাত ঘুরিয়ে দিল,—ওই ওদিকের একটা হোটেলে।

ছলনাটা কি ধরে ফেলল অর্ক? ঠোঁটের ফাঁকে বাঁকা হাসি কেন?

হাসিটুকু ঠোঁটে রেখেই অর্ক বলল,—একা এভাবে ঘুরছ যে বড়? তোমার হাজব্যান্ড কই?

অকারণে মিথ্যে বলল বিদিশা। কিংবা হয়তো অর্ককে শোনানোর জন্যই বলল— আমাদের জেন গাড়িটা গড়বড় করছে খুব। লোকাল গ্যারেজে দেখাতে নিয়ে গেছে।

অর্ক বুঝি ঈষৎ ম্লান,—গাড়ি নিয়ে এসেছ?

বিদিশা মাথা নাড়ল,—হুম্। অর্চিষ্মান লং ড্রাইভে নতুন গাড়িটা টেস্ট করে দেখতে চাইল। আমারও হাইওয়েতে খানিকটা প্র্যাকটিস হয়ে গেল।

—তুমি গাড়ি চালাচ্ছ?

—বিয়ের পর শিখে নিলাম। ড্রাইভার-টাইভারের ওপর বেশি ভরসা করা অৰ্চিষ্মান পছন্দ করে না।

অর্ক একটুক্ষণ চুপ। তারপর বলল,—তোমার বরের নামটা ভারী আনকমন। অর্চিষ্মান।

—মানুষটাও আনকমন। কাজের লোক। অকাজের খই ভেজে বেড়ায় না।

অর্ক শ্লেষটা গায়ে মাখল না। নাকি মাখল। বিদিশাকে বুঝতে দিল না। বলল,— তোমার বরের কীসের যেন বিজনেস?

—জেনে তোমার লাভ? বিদিশা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, চাকরি টাকরি চেয়ে বোসো না। আমি বলতে পারব না।

অর্ক হো হো করে হেসে উঠল,—আরে আরে, তোমার স্বামীর চাকর না হয়েও আমার পেট চলে যাবে। বরং আমিই তোমার স্বামীকে কিছু দান করতে পারি।

বিদিশা ভুরু কুঁচকে তাকাল।

—প্রেমপত্রগুলোর কথা মনে পড়ে? মোট সাঁইত্রিশটা আছে। বনেদি বাড়ির গিন্নির প্রেমিককে লেখা রগরগে চিঠিগুলো তার স্বামীকে প্রেজেন্ট করলে কেমন হয়? তোমাদের বিয়েতে তো কোনও উপহারও দেওয়া হয়নি।

বিদিশার মুখ কালো হয়ে গেল,—তুমি…তুমি…!

—ঘাবড়ে গেলে তো? অর্ক আরও জোরে হেসে উঠল,—আরে না না, তোমার চিঠিগুলোই তো এখন আমার সম্বল। স্মৃতি। ওগুলো কি আমি হাতছাড়া করতে পারি? বলতে বলতে হাত রেখেছে বিদিশার কাঁধে। নাটুকে ভঙ্গিতে বলল,—সুখী হও। আমি রব চিরকাল বঞ্চিতের দলে…। বাট মাইন্ড ইট, ডোন্ট টিজ মি এগেন। নেভার।

বড় বড় পা ফেলে অর্ক মিলিয়ে গেল। বিদিশা স্থানু। টিপটিপ বৃষ্টি নেমেছে। মোটা মোটা ফোঁটাগুলো বিঁধছে গায়ে। অর্কর কথাগুলোর মতো।

মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থেকে ফিরল বিদিশা। জোরে পা চালিয়ে। হোটেলে ঢোকার মুখে এ পাশ ও পাশ দেখে নিল ভাল করে। বিশ্বাস নেই, অর্ক যদি কাছাকাছি কোথাও…!

স্যুইটে ঢুকে বিদিশা অবাক। অর্চিষ্মান বসে আছে সোফায়, চোখ কেবল টিভির ইংরিজি সিনেমায়, হাতে সোনালি পানীয়।

বিদিশা সোফার পাশে এসে দাঁড়াল,—এমন অসময়ে ড্রিঙ্ক করছ যে?

—এমনিই। গা’টা ম্যাজম্যাজ করছে। অর্চিষ্মান ঘুরে তাকাল,—তোমার বেড়ান হল?

—দুৎ, একা একা কোথায় যাব? এই একটু সামনে গিয়ে…।

—মার্কেটিং সেরে আসতে পারতে। কীসব কিনবে বলছিলে…

—একা আমার দোকানে যেতে ভাল লাগে না।

—কলকাতায় তো একাই যাও।

—এটা কলকাতা নয়। এখানে আমি বেড়াতে এসেছি। বেড়াতে এসে মোটেই আমি একা একা ঘুরব না।

অর্চিষ্মানের যেন কানেই গেল না কথাটা। চোখ আবার ঘুরে গেছে টিভিতে। গ্লাসে চুমুক দিল।

বিদিশা স্বামীর গা ঘেঁষে বসল,—এই চলো না, একটু নিউ দিঘা ঘুরে আসি। তুমি কিন্তু নিয়ে যাবে বলেছিলে।

—চলো তাহলে।

অর্চিষ্মান কাঁধ ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল। এক চুমুকে গ্লাস শেষ, মুহূর্তে টিভি বন্ধ, দু মিনিটে অর্চিষ্মান রেডি। বিদিশাকে পাশে নিয়ে যখন গাড়িতে স্টার্ট দিল, তখনও দিনের আলো পুরোপুরি মরেনি।

ফেরার পথে তুমুল বৃষ্টি। উইন্ড স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে গেছে, ওয়াইপার চালিয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না, ধীর গতিতে চলছে গাড়ি।

হঠাৎ অর্চিষ্মান স্টিয়ারিং-এ বসে গজগজ করে উঠল,—ফালতু এই ঝড়বৃষ্টিতে বেরোলাম। হোটেলে বসে সিনেমাটা দেখলে ভাল হত। তোমার জন্য আমার শেষটা দেখা হল না।

বিদিশা বলল,—সরি।

—শুড বি। সিনেমাটার শেষটা দেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিল।

—কী সিনেমা?

রাস্তায় একটা গোরু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। তাকে পাশ কাটিয়ে অর্চিষ্মান বলল,— ডায়াল এম ফর মার্ডার। হিচককের।

—ও তো আমার দেখা বই। শেষটা আমি তোমায় বলে দিতে পারি। বিদিশা ঠোঁট টিপে হাসল,—বজ্জাত স্বামীটা শেষ পর্যন্ত বউকে মারতে পারবে না। এক্স লাভারই মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দেবে। চাবি নিয়ে বেশ একটা ইন্টারেস্টিং পাজল আছে।

ঝপ করে ঘাড় ঘুরিয়ে বিদিশাকে দেখল অর্চিষ্মান। বিড়বিড় করে বলল,—আমিও তাই অনুমান করেছিলাম। গল্পে হাজব্যান্ডরাই যত দুষ্কর্মের নায়ক হয়, আর পূর্ব প্রেমিকরা ত্রাণকর্তা। হাইলি আনরিয়েল আইডিয়া।

—কেন? আনরিয়েল কেন?

—ও, তোমার বুঝি রিয়েল মনে হয়? অর্থাৎ আমি যদি হিচককের ওই স্বামীটা হই, তুমি তোমার প্রেমিকের কাছে শেল্টার নেবে?

বিদিশা হেসে ফেলল। শরীর হেলিয়ে অর্চিষ্মানের কাঁধে মাথা রাখল। মৃদু স্বরে বলল,—উঁহু। আমায় মারতে হলেও তুমি মারবে, রাখতে হলেও তুমি রাখবে। আমি তো গল্পের নায়িকা নই, সুতরাং আমার প্রেমিক টেমিকও নেই।

—তাই বুঝি?

শব্দ দুটো ঠং করে বাজল বিদিশার কানে। অর্চিষ্মানের স্বর হঠাৎ এমন হিমশীতল কেন? অর্ককে কি দেখে ফেলেছে অর্চিষ্মান?

[দুই]

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ভারতী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মেয়েকে দেখেই চোখে খুশির ঝিলিক,—ওমা, বুলু তুই! কখন এলি?

—অনেকক্ষণ। বিদিশা ঠোঁট টিপে হাসল,—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তুমি কতক্ষণে টের পাও।

—সদর খোলা ছিল বুঝি?

—ছিল মানে? একেবারে হাট।

—সে কী! ভানু নেই?

—কোথায় দাদা! ও ঘর তো ফাঁকা।

—আশ্চর্য, এই তো ছিল! তোর বাবা অফিস বেরোনর সময়েই তক্তপোষে শুয়ে কাগজ পেনসিল নিয়ে কী সব করছিল।…কোথায় যায়, কখন যায়, কিছু বলেও যায় না…

—ভাল ভাল। বিদিশা ভুরু বেঁকাল—যেদিন সর্বস্ব চুরি হয়ে যাবে, সেদিন টের পাবে।

দরজার কাছে গিয়ে বাইরেটায় ইতিউতি উঁকিঝুঁকি দিলেন ভারতী। ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে আলগা নিশ্বাস ফেললেন—আমাদের আর আছেটা কী, যে নেবে।

কথাটা নিখাদ সত্যি। এ বাড়িতে দুটো মাত্র ঘর, দুটোই শ্রীহীন। খাট চৌকি আলমারি, কাঁড়িখানেক আদ্যিকালের ট্রাঙ্ক স্যুটকেস, সবেরই বেশ লঝ্ঝরে দশা। ছোট মতন প্যাসেজ আছে একটা, নামকা-ওয়াস্তে চিলতে বসার জায়গাও। সর্বত্র এলোমেলো জিনিসপত্র। মামুলি। রংচটা টেবিল, নড়বড়ে চেয়ার, মান্ধাতা আমলের সাদাকালো টিভি, সাবেকি পুতুলে সাজানো ধুলোয় ঢাকা শোকেস, পাথরের ভাঙা ফুলদানি, পুরনো রেডিও, বিকল সেলাইমেশিন…। আজকালকার চোরদের যথেষ্ট আত্মসম্মানজ্ঞান আছে, এ বাড়িতে ঢুকে মোটেই তারা হাত গন্ধ করবে না।

মার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিদিশা ভেতরের ঘরে এসে বসল। হাতের বিগ শপার নামাল বিছানায়, গরমে হাঁসফাঁস করছে। ভারতী ফ্যান চালিয়ে দিলেন, ঘুরন্ত বাতাস একটু বুঝি স্বস্তি ছড়াল দমচাপা ঘরটায়।

মেয়ের সামনে বসেছেন ভারতী,—হ্যাঁ রে, তোরা দিঘা গিয়েছিলি না?

—এই তো পরশু ফিরলাম। কালই আসতাম, যা বৃষ্টি…

—এবার যেন বর্ষা একটু বেশিই হচ্ছে। রাত নেই, দিন নেই…দিঘায় বৃষ্টি পেয়েছিলি?

—মাঝে মাঝে হচ্ছিল। বিদিশা ব্যাগ থেকে এক রাশ ঝিনুকের পর্দা বার করল,— কী, পছন্দ হয়?

—বাহ্, সুন্দর!…কত পড়ল রে?

—দাম জেনে কী হবে! তোমার জন্য এনেছি, ঘর সাজাবে, ব্যস চুকে গেল।

একের পর এক জিনিস বার করছে বিদিশা। যেন বিগ শপার নয়, রত্নগুহা। শঙ্খের ধূপদানি, সিগারেট হোন্ডার, ইয়া বড় কাজুবাদামের প্যাকেট, পাঞ্জাবিতে লাগানোর ঝিনুক বোতাম, আপেল বিচির ভ্যানিটি ব্যাগ, এমনকী একটা দক্ষিণাবর্ত শাঁখও বেরোল ঝোলা থেকে।

ভারতীর চোখ বড় বড়,—এত কিছু এনেছিস বুলু? এত?

—তাও তো মার্কেটিং করার সময়ই পেলাম না। আসার দিন সকালবেলা যা একটু…। বিদিশা গর্বিত মোরগের মতো ঘাড় ফোলাল,—তোমাদের জন্য একটা ফোল্ডিং মাদুরও আনার ইচ্ছা ছিল। অফসিজন তো, তেমন ভাল স্টক নেই।

ক্ষণপূর্বের ঈষৎ আড়ষ্ট ভারতী কিশোরীর মতো চপল সহসা। কোন জিনিস যে কোথায় রাখেন! একবার বসার জায়গায় ছুটছেন, তো একবার ছেলের ঘরে, ঘটাং ঘটাং আলমারি খুলছেন…। তারই মধ্যে ছুটলেন রান্নাঘরে, চচ্চড়ি নামাতে।

মার দৌড়োদৌড়ি দেখে বিদিশার বেশ মজা লাগছিল। ফুরফুরে মেজাজে আলগা চোখ বোলাচ্ছে ঘরে। আরও মলিন হয়েছে বাড়িটা, সর্বাঙ্গে দারিদ্র বড় প্রকট লাগে। পলেস্তারা ওঠা দেওয়াল, সিলিংয়ে চাবড়া ঝুলছে, যে কোনও মুহূর্তে খসে পড়বে, বিবর্ণ দরজা জানলা—প্রতি বারই এলে মনে হয় আগের বারের চেয়ে হীনতর দশা। কী করে যে এই হতশ্রী বাড়িতে সে চব্বিশটা বছর কাটিয়েছিল!

রান্নাঘর থেকে ভারতীর গলা উড়ে এল,—চা খাবি তো? বসিয়েছি।

—শুধু চা কিন্তু। আমার পেট একদম ভর্তি।

ঝটিতি দু হাতে ধূমায়িত পেয়ালা নিয়ে মেয়ের পাশে এসে বসলেন ভারতী,—হ্যাঁ রে, জামাই কি তোকে নামিয়ে দিয়ে গেল?

—না, সে অনেকক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। সেই আটটায়।

—তোদের নিলামঘর অত সকালে খোলে নাকি?

—খোলে না, আবার খোলেও। বিদিশা শাড়ি গুছিয়ে বাবু হয়ে বসল। ছোট্ট চুমুক দিল কাপে,—দু তিনটে দিন বেড়িয়ে কাটাল তো, এখন সে টাইমটাও কাজ করে উশুল করবে।

—ওভাবে বলছিস কেন? কাজের মানুষ হওয়া তো ভাল। ভারতী ভ্রূকুটি করলেন— তুই আবার এই নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করিস না তো?

—বয়ে গেছে। দিব্যি খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমোচ্ছি, পার্লার যাচ্ছি, মার্কেট যাচ্ছি, তোফা আছি।

গদগদ চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন ভারতী। মেয়ের এই উপচে পড়া সুখ দেখে বুক ভরে যায় তাঁর। রূপ যৌবন তো অনেক মেয়ের থাকে, এমন কপাল হয় ক’জনের? বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিল মেয়ে, ঘাচাং করে এক গাড়ি এসে পাশে থামল, রূপো বাঁধানো ছড়ি হাতে নেমে এলেন বেয়াইমশাই! নাম কি তোমার মা? থাকো কোথায়? সতেরোর দুই মহিম হালদার লেন? ভবানীপুর? পূর্ণ সিনেমার কাছে? রোববার সকালে তোমার বাবা বাড়ি থাকবেন? মাত্র কুড়ি দিনের মধ্যে সানাই বাজল। এক পয়সা দেনাপাওনা নেই, ঘুরিয়ে পেঁচিয়েও সামান্যতম দাবিদাওয়া নেই, শুধু আপনাদের মেয়েটিকে চাই। ব্যস্‌ ঘুঁটেকুড়ুনির মেয়ে রাতারাতি রাজরানি বনে গেল। সল্টলেকে কী বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়ি! গেট ঠেলে ঢুকতে গেলে গা ছমছম করে। ভারতীর অবশ্য প্রথম দিকে একটু মন খুঁতখুঁত ছিল। ছেলের সঙ্গে মেয়ের অনেকটাই বয়সের তফাত, প্রায় বারো বছর। স্বামী, ছেলে, এমনকী মেয়ের পর্যন্ত আপত্তি নেই দেখে মুখ ফুটে কিছু আর বলেননি। এখন মনে হয় ভালই হয়েছে। শুধু ভাল কেন, তার থেকে অনেক অনেক বেশি কিছু। শাশুড়ি গত হয়েছেন বহুকাল, একটা মাত্র ননদের কবেই বিয়ে হয়ে গেছে, অমন বড়লোক শ্বশুর তবু কী দম্ভহীন, আর জামাই তো একেবারে হিরের টুকরো—সাত জন্ম তপস্যা করলে এমন ঘর পাওয়া যায়। এ যেন গল্পকথা। না না না, রূপকথা। রূপকথাই।

ভারতী মেয়ের গায়ে আলতো হাত বোলালেন। আঙুল খেলা করছে মেয়ের চুড়ি বালায়। হঠাৎ কী যেমন মনে পড়ে গেল। প্রশ্ন করলেন—তা হ্যাঁরে বুলু, জামাই নামিয়ে দিয়ে যায়নি, তো তুই এলি কীসে?

—যাতে আসি। বাড়ির গাড়িতে। নেভি ব্লু মারুতিটায়।

—কই, বাইরে গাড়ি দেখলাম না তো?

—মোড়ের ও পাশে পার্ক করা আছে।

একটু যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন ভারতী,—এমা, ঘরে তো মিষ্টিমাস্টা কিছু নেই। কাকে দিয়ে আনানো যায়?

—মিষ্টি কী হবে? আমি মিষ্টিফিষ্টি খাব না।

—আহ্, তোর জন্য বলছি নাকি? তোদের ড্রাইভারকে দিতে হবে না?

বিদিশা মুচকি হাসল,—ড্রাইভার কোথায়, গাড়ি তো আমি চালিয়ে এনেছি। ব্যাক করতে অসুবিধে হবে বলে বড় রাস্তায় রেখে দিয়েছি।

—সব্বোনাশ! তুই আজকাল এত দূর গাড়ি চালাচ্ছিস নাকি?

—আমায় কী ভাবো বলো তো মা? আমার হাত এখন পুরো সেট। ভোরবেলা যা সাঁই সাঁই সল্টলেকে চক্কর মারি না…

—তাও এতটা রাস্তা তোমার একা একা আসা উচিত হয়নি।

—তাহলে আজও আসা হত না। রবি আজ ডুব মেরেছে। …শ্বশুরমশাইই তো বললেন, কদ্দিন আর সল্টলেকে পাক খাবি? যা, আজ ভিড়ভাট্টায় হাত টেস্ট করে আয়। অ্যাক্সিডেন্ট করলে থানা থেকে খবর দিস, ছাড়িয়ে আনব।

ভারতী হেসে ফেললেন,—শ্বশুরও পেয়েছ বটে। যেমন উদার, তেমন রসিক। লাই দিয়ে দিয়ে তোমায় মাথায় তুলছেন।

—ওমা জানো না, এই নিয়ে দিদির সঙ্গে বাবার কত খুনসুটি হয়। বিদিশা হেসে লুটিয়ে পড়ল,—দিদি তো কথায় কথায় গাল ফোলায়। হ্যাঁ, আমি হচ্ছি তোমার ডাস্টবিন থেকে কুড়নো মেয়ে, বিদিশাই হল গিয়ে যাকে বলে কন্যা। বাবাও বলেন, ঠিকই তো, ঠিকই তো। ডাস্টবিন থেকে না হোক, হাসপাতাল থেকে তোকে এনেছিলাম তো বটেই।

—তোর ননদ আসে মাঝে মাঝে?

—ননদাই আসে খুব, দিদি আসে বড় জোর মাসে দু একবার।

—তোকে ভালবাসে?

—হাবে ভাবে তো মনে হয়। মনের ভেতরে কী আছে, কী করে বলব! এই তো পুজোর পরে দিল্লি রাজস্থান যাচ্ছে, আমাকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল।

—ভাল। ঘুরে আয়।

—ধুস, ওদের সঙ্গে কে যাবে। পূষনদাকে আমার একটুও পছন্দ হয় না। শুধু চালবাজি মার্কা কথা বলবে, মুখে রাজা উজির মারবে…ওদিকে জানো তো, ব্যবসার অবস্থা ঢু ঢু। অর্ডার নেই, কিচ্ছু নেই, ফ্যাক্টরির এখন আজ উঠে যায় কাল উঠে যায় দশা।

—কেন, তার ব্যবসা তো বেশ চালু ছিল।

—উঁহু, অনেক দিন ধরেই ফোঁপরা। চেপে চুপে রাখত, এখন প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বিদিশা চোখ ঘোরাল,—প্রেমের বিয়ে তো, বাবাও আগে অত কিছু খবর নেননি।

—প্রেমের বিয়ে? আগে বলিসনি তো?

—আমিও কি ছাই জানতাম। শ্বশুরমশাই আমায় সব মনের প্রাণের কথা বলেন তো, একদিন দুঃখ করছিলেন, তখনই…

—শ্বশুরমশাই বলেছেন? জামাই বলেনি?

—তোমার জামাই বাপের ঠিক উল্টো। পেটে একবার কোনও কথা ঢুকল, তো জমে বরফ হয়ে গেল।

পলকের জন্য দিঘার বৃষ্টিভেজা সন্ধেয় গাড়ির চালকের আসনে বসা অর্চিষ্মানের মুখটা মনে পড়ল বিদিশার। পুট করে একটা কথা ছুড়ে দিল অর্চিষ্মান, তার পরই চুপ। হোটেলে ফিরে আর ওই প্রসঙ্গেই গেল না, আবার বোতল খুলে বসে পড়ল। এত খাচ্ছ কেন, দিনে দু পেগ না তোমার লিমিট? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, আজ দিনটা অন্য রকম, আজ সুরা না হলে চলে! কীসে অন্যরকম? বৃষ্টির রাত, না অর্ক…জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয়নি বিদিশার। অর্চিষ্মান ঘুমিয়ে পড়ার পর অনেক রাতে একা একা দাঁড়িয়ে ছিল ব্যালকনিতে। বৃষ্টি থেমে গেছে, তবু চরাচরে কী নিবিড় অন্ধকার! সমুদ্রকে ভাল দেখা যাচ্ছে না, শুধু তার গর্জন শোনা যায়। জোয়ার এসে ডুবিয়ে দিয়েছে বেলাভূমি, ঠিক কোনখানটায় অর্কর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কী করে বুঝবে বিদিশা!

ধুস, যত সব ফালতু ভাবনা। অর্চিষ্মান তো পরদিন স্বাভাবিকই ছিল। ফেরার পথে গাড়ি চালাতে চালাতে কী হেঁড়ে গলায় গান ধরল অর্চিষ্মান। ভুল সুর, ভুল কথা…মনে রেখো শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর… পাঁচজনেতে কথা কবে, তুমি রবে নিরুত্তর…! কী গিটকিরি ছাড়ছিল মাঝে মাঝে! হিহি।

ভারতী কাপ ডিশ রেখে ফিরে এলেন। সঙ্কুচিতভাবে বললেন,—বুলু, দুটো ভাত খেয়ে যাবি নাকি? আজ অবশ্য মাছ নেই, ডিমের ঝোল!

বিদিশা ঘড়ি দেখে তড়াং করে লাফিয়ে উঠল,—উরেব্বাস, এগারোটা বেজে গেছে। আজ বারোটায় ব্যাংক বন্ধ না?

—ব্যাংকে আবার তোর কী কাজ?

—এই চুড়ি ক’টা লকারে ঢুকিয়ে দিয়ে আসতে হবে।

—তুই লকার নিয়েছিস? কবে?

—ওমা, বলিনি তোমায়? ও, তার পরে আর কবেই বা এলাম। বিদিশা এক সেকেন্ড হিসেব করে বলল,—তা ধরো, হপ্তা তিনেক হবে। তোমার জামাই জোর করে করিয়ে দিল। বাড়িতে গয়না রাখা ও একটুও পছন্দ করে না। ওই হাতে দু-চার গাছা চুড়ি রইল, এক জোড়া বালা, একটা হয়তো পাতলা নেকলেস, ব্যস। বাকি সব ব্যাঙ্কের লকারে।

—আলাদা লকার করার কী দরকার ছিল? আগে তো সব শ্বশুরের লকারেই থাকত।

—শ্বশুরের মানে শ্বশুর আর শ্বশুরের ছেলের জয়েন্ট লকার। ওখানে তোমার জামাইও আর রাখতে চায় না, বাবাও না। যত দিন শাশুড়ির গয়না ছিল, তদ্দিন নয় ওখানে ছিল, এখন তো ওগুলো আমার! সুতরাং…। রাজেন্দ্রাণীর মতো হাসল বিদিশা। মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল,—তোমায় একদিন দেখাব সব। অজ্ঞান হয়ে যাবে। কত ভরি যে সোনা তার ঠিকঠিকানা নেই। তার সঙ্গে হিরে মুক্তো পান্না চুনি, কত রকম যে স্টোন…আমি সব কটার নামও জানি না।

—থাক, ওসব আর সাতকাহন করে বলতে হবে না।

বিদিশা মাকে জড়িয়ে ধরল,—তুমি মা এখনও…আরে বাবা, তোমার মেয়ে এখন রিচ লেডি। সে তার হকের ধনের কথা বিশ্বসুদ্ধ লোককে চেঁচিয়ে বলবে, তাতে কার বাপের কী?

—ওভাবে বলতে নেই রে। যা নিয়ে মানুষ গর্ব করে, তাই থেকেই মানুষের বিপদ আসে। হারিও না, ছড়িও না, যত্ন করে রেখো…

—সে তোমায় বলতে হবে না মা। ওসব হওয়ার জো নেই। তোমার জামাই হল গিয়ে ব্যবসাদার চূড়ামণি। হিসেবের গুরুঠাকুর। লকারের প্রতিটি গয়নার ফর্দ একেবারে তার কাছে মজুত। এই যে বারো গাছা চুড়ি রাখতে যাব, এও তার লিস্টে আছে।

কথা বলতে বলতে বলতে বিদিশা দরজায় এল। ভারতীও এসেছেন পিছন পিছন। অনুযোগের স্বরে বললেন—আজ নয় ব্যাঙ্কে নাই যেতিস। কদ্দিন পর এলি… খেয়েদেয়ে একটি গড়িয়ে নিলে তোর বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। আজ তো হাফডে, আজ ও তাড়াতাড়িই ফিরবে।

—উপায় নেই মা। দিনের দিন কথামতো কাজ না করলে তোমার জামাই চটে ফায়ার হয়ে যায়। আমি নয় নেক্সট উইকে একদিন আসবখন…সন্ধের দিকে…

আরেক বার কবজিঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিদিশা। কাল রাতেও প্রচুর ঢেলেছে আকাশ, মহিম হালদার লেনের এঁদো গলিতে জমাট জলকাদা। পিওর সিল্কের শাড়ি সামান্য উঠিয়ে নিয়ে সাবধানে হাঁটছে, দামি বিদেশি হাইহিলে কাদার ছোঁয়া বাঁচিয়ে। আশপাশের বাড়ির জানলায় বেশ কয়েকটা চোখ, বিদিশা টের পাচ্ছিল। কীটপতঙ্গের দল সব, ঈর্ষাকাতর প্রতিবেশী! দু একজন কি কেমন আছ গোছের আলাপও ছুড়ল, কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাদের পেরিয়ে এল বিদিশা।

মোড়ে এসে গাড়ির লক খুলতে গিয়ে থমকেছে। দাদা। দাঁত বার করে হাসতে হাসতে চায়ের দোকান থেকে উঠে আসছে।

—কী রে লেডি ডায়না, এসেই চললি যে?

—তুই আমাকে আসতে দেখেছিলি?

—উহুঁ, গাড়ি দেখে বুঝলাম।

চিত্রভানু একদম কাছে এসে দাঁড়াল। ধারাল উজ্জ্বল চেহারা। বেঁটেই বলা চলে, তবে গঠন চমৎকার। গায়ের রং লালচে ফর্সা, বোনেরই মতন। পরনে তাপ্পি মারা জিনস, গাঢ় হলুদ টি শার্ট। শ্যাম্পু করা ফাঁপানো চুল উড়ছে হাওয়ায়।

চাপা গলায় বলল,—কিছু মাল্লু না ছেড়েই কেটে পড়ছিস?

বিদিশা দরজা খুলে স্টিয়ারিং-এ বসল। ঘাড় হেলিয়ে বলল,—মাল্লু কীসের? এলেই তোকে নজরানা দিতে হবে নাকি?

—নয় দিলিই। তার জন্য তোর বাকিংহাম প্যালেস ভিখিরি হয়ে যাবে না।

যত্ত সব পিত্তি জ্বালানো কথাবার্তা। বাক্য ব্যয় না করে বিদিশা ভ্যানিটি ব্যাগ খুলল,—কত?

—দে যা পারিস, পাঁচশো হাজার…

বিদিশা চটেও চটল না। ভাবলেশহীন মুখে বলল,—কী করবি?

—বিজনেসে ইনভেস্ট করব।

—কী বিজনেস?

—আছে একটা। হাই প্রফিট। কুইক রিটার্ন।

—ফোট, দেব না। বিদিশা গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল,—তোর হাই প্রফিট কুইক রিটার্ন মানে তো সাট্টা, নয় তাসের জুয়া।

—নারে, এবার সিরিয়াস কেস। গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ গলাল চিত্রভানু,— সত্যিকারের বিজনেস। হাজার দশ বারো হলেই ভাল হত। মিনিমাম থাউজেন্ড তো এখন লাগবেই। কিছু দে, বাকিটা অন্য কোথাও থেকে দেখছি।

চিত্রভানুর বাচনভঙ্গি এতই অকপট যে সত্যি মিথ্যে যাচাই করা অসম্ভব। কিন্তু নিজের এই পিঠোপিঠি দাদাটিকে হাড়ে হাড়ে চেনে বিদিশা। জানে, টাকাটা কোন খাদে বিলীন হয়ে যাবে। তবু একটু কোমল হল। ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বার করে বলল,—এই দিয়েই কাজ চালিয়ে নে।

বিদিশার ভ্যানিটি ব্যাগ কয়েক মুহূর্তের জন্য খোলা ছিল, বাজপাখির চোখে অন্দরটা দেখছিল চিত্রভানু। ব্যাগ বন্ধ হওয়ার আগেই শিকারি মাছরাঙার মতো খপ করে দু আঙুলে আরও কটা নোট তুলে নিয়েছে।

বিদিশা আগুন হয়ে গেল। রাস্তার মধ্যিখানে চেঁচাতেও পারছে না। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল,—তুই একই রকম নির্লজ্জ রয়ে গেলি। দু পয়সা রোজগারের ক্ষমতা নেই, বোনের টাকা থেকে খামচা মারিস…

—খামচা মারাটাও রোজগার। তুই তোর বরের থেকে খামচা মারিস, আমি তোর থেকে খামচা মারছি। তোর মতো মেয়ে রাজবাড়ির সুখ ভোগ করছে, দাদাকে একটু ট্যাক্স দেবে না?

শুধু দৃষ্টি দিয়েই যদি মানুষকে ভষ্ম করে দেওয়া যেত! বিদিশা রাগে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে বলল,—বোনকেও তুই হিংসে করিস? তুই এত নীচে নেমে গেছিস? বাবা একা মুখের রক্ত তুলে খাটছে, তার কোনও সাহায্যে আসিস না, উল্টে ফুর্তির টাকার জন্য…

—চোপ। একটা কথা নয়। তুই বাবার কী সুসারটা করেছিস, শুনি? গেছিস তো বাবাকে ধসিয়ে দিয়ে। চিত্রভানুর কমনীয় মুখ বিকৃত হয়ে গেল,—জানিস তোর বিয়ের সময়ে বাবাকে কাবলিঅলার কাছ থেকে ধার করতে হয়েছে! কম নয়, পঞ্চাশ হাজার! পাঁচের পিঠে চারটে শূন্য। এখন আগা সাহেব সুদ নেওয়ার জন্য মাসপয়লায় বাবার অফিসে গিয়ে হানা দেয়। বাবার জন্য দরদ দেখাচ্ছিস তুই। হুঁহ্।

শ্বশুরমশাই তো শাঁখাসিঁদুরে মেয়ে নিতে চেয়েছিলেন, কে বাবাকে দেড় দু লাখ টাকা খরচ করার জন্য মাথায় দিব্যি দিয়েছিল? কেন বিশ ভরি সোনা দিয়েছে বাবা? কেন পাত পেড়ে সাড়ে তিনশো লোক খাইয়েছে? বিদিশা বলেছিল? হ্যাঁ, বিদিশার বাবা প্রভাকর দত্ত সেই বিরল প্রজাতির মানুষ, যারা সারা জীবন হতদরিদ্র অবস্থায় কাটিয়েও হঠাৎ হঠাৎ লুপ্ত বংশগরিমার দাপটে অন্ধ হয়ে যায়। এতে বিদিশা কী করবে? তাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা ধার করাটাও এমন কিছু নতুন ঘটনা নয়। তবে হ্যাঁ, কাবলিঅলাটা একটু বাড়াবাড়ি। বাবার সতর্ক থাকা উচিত ছিল।

চিত্রভানু এখনও গজরাচ্ছে,—আমি ফুর্তি মেরে বেড়াই, অ্যাঁ? আয়নায় নিজের মুখ দেখেছিস? রাজবাড়ির পালঙ্কে শুয়ে খুব পায়াভারী হয়েছে, অ্যাঁ? যখন বলব, তখনই টাকা ফেলবি। টুসকি বাজালেই টাকা ফেলবি। বুয়েচিস?

দাদার দিকে হিংস্র চোখে তাকাল বিদিশা। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,—আমি আর কোনও দিন একটা পয়সাও দেব না।

—দেখব তোর কলজের জোর। আমার নামও চিত্রভানু, মনে রাখিস।

বিস্বাদ মুখে গাড়ি স্টার্ট করল বিদিশা। আকাশ একেবারে ঝুলকালি মাখা, এখনই বোধহয় কান্না শুরু করবে। আর ব্যাংকে যেতে ইচ্ছে করছে না। কাঁকুড়গাছিতে ব্যাংক, সে পথে গেলই না বিদিশা। বাইপাস ধরে সোজা সল্টলেক।

বাড়ির গেটে গাড়ি ঢোকানোর মুখে আকস্মিক বিপত্তি। একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে বেরোচ্ছিল, লোকটা একেবারে বিদিশার গাড়ির সামনে পড়ে গেছে।

প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষল বিদিশা। চোখ বুজে ফেলল।

[তিন]

পলকের জন্য নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিদিশার। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলতেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। ঈশ্বরের অপার করুণা, চাকার তলায় পড়েনি লোকটা, জোর বেঁচে গেছে। লোকটার ঠিক ইঞ্চি ছয়েক আগে থমকেছে বিদিশার মারুতি।

ঘাবড়ে গিয়েছে লোকটাও। তার দু হাত বনেটে, আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে। হাঁপাচ্ছে বেচারা। বিশেষত্বহীন চেহারা, পোশাক আশাকে তেমন জৌলুস নেই। বয়সও খুব একটা বেশি নয়, জোর তিরিশ। মুখটা যেন কেমন চেনা চেনা! আগে কি দেখেছে বিদিশা?

স্টিয়ারিং-এ বসে বিদিশার এখনও হাত কাঁপছিল। হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস। চোট ফোট লাগেনি তো? একটু স্থিত হয়ে বিদিশা গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিল, তার আগে লোকটা সরে গেল। কোনও বিরক্তি নেই মুখে, অভিযোগও না, বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যাচ্ছে গেটের বাইরে।

ছি ছি, আর একটু হলে কী বিশ্রি কাণ্ডই না ঘটে যেত! একঝলক দোতলার দিকে তাকিয়ে নিল বিদিশা। শ্বশুরমশাই দেখে ফেলেননি তো? তাহলে একেবারে ঠাট্টায় ঠাট্টায় জেরবার করে ছাড়বেন। আজই প্রথম গাড়ি নিয়ে অদ্দূর বেরোল, আর আজই কিনা…! অর্চিষ্মানের কাছেও ঘটনাটা চেপে যেতে হবে। শুনে সে মোটেও আহ্লাদিত হবে না।

নাহ, এখনও হাত পা চোখ কানের মেলবন্ধন ঘটেনি। আরও প্র্যাকটিস করতে হবে বিদিশাকে, আরও। সন্তর্পণে গাড়ি গ্যারেজ করল বিদিশা। আঙুলে চাবি দোলাতে দোলাতে এগোল বাড়ির দিকে।

অর্চিষ্মানদের বাড়িটা সত্যিই বিশাল। সল্টলেকের একেবারে প্রথম দিককার বাড়ি, অনেকটা জায়গা জুড়ে। ঘেরা কম্পাউন্ড, সামনে সবুজ মসৃণ লন, এক দিকে ছোট্ট মতন বাগান আছে, মালী এসে নিয়মিত পরিচর্যা করে যায়। চার পাঁচটা বড়সড় ফুলগাছও আছে। চাঁপা বকুল গন্ধরাজ অমলতাস…। বাড়ির মালিকরা থাকে দোতলায়, তাদের খাওয়া থেকে শুরু করে সবই হয় ওপরে। একতলায় বৈঠকখানা রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর, কাজের লোকদের থাকার জায়গা, গোটা তিনেক গেস্টরুম, আর সামনে পিছনে দু’খানা পেল্লাই টানা বারান্দা। বৈঠকখানাটিও প্রকাণ্ড, একটু সাবেকি ঢঙে সাজানো। ইয়া ইয়া সোফা, কার্পেট, সুদৃশ্য ঝাড়বাতি, বাহারি স্ট্যান্ডল্যাম্প, কারুকাজ করা আবলুশ কাঠের টেবিল, কাচের শো কেসে দুষ্প্রাপ্য চিনে মাটির পুতুল, লাইফসাইজ হরিণ… সবই বাড়ির বিশালত্বের সঙ্গে মানানসই।

বৈঠকখানায় আলগা উঁকি দিয়ে বিদিশা সিঁড়ির পথে, সামনে পদ্মপাণি। বিদিশাকে দেখে পদ্মপাণি এক গাল হাসল,—এত দেরি করলে বউদি? কর্তাবাবু না খেয়ে তোমার জন্য বসে আছেন…

মাঝবয়সি পদ্মপাণি এ বাড়ির পুরনো কাজের লোক। নামেই কাজের লোক, খবরদারিতে মালিকদেরও ছাপিয়ে যায়।

বিদিশা বিশেষ আমল না দিয়ে বলল,—বাবা জানেন আমার দেরি হবে।

সিঁড়িতে পা রেখেও কী মনে করে থামল বিদিশা,—পদ্মা, লোকটা কে গো?

—কোন লোকটা?

—এই যে এই মাত্র বেরিয়ে গেল?

পদ্মপাণি টাক চুলকোল,—তপনবাবু?

—তপন…?

—হ্যাঁ, তপনই তো। …ওই তো, আগে নিলামঘরে কাজ করত।

—এখন করে না?

—না। ছাঁটাই হয়ে গেছে।

—ও।

বিদিশা নিজের মনে মাথা দোলাল। এই জন্যই বুঝি চেনা চেনা লাগছিল! বছর দুয়েক হল দোকান রিমডেলিং করার সময়ে অনেক লোকজনকে বসিয়ে দিয়েছে অর্চিষ্মান, শুনেছে বিদিশা। ও তবে তাদেরই একজন। মাঝে মধ্যে এদের কেউ কেউ শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। কেন আসে এরা? টাকাপয়সার ধান্দায়? তাইই হবে? শ্বশুরমশায়ের যা দরাজ দিল, নিশ্চয়ই খালি হাতে ফেরান না।

ঊর্ধ্বগামী বিদিশা হুকুম ছুড়ে দিল,—সুমতিকে ঝটপট খাবার লাগাতে বলো। আমি বাবাকে ডাকছি।

—তুমি চান করবে না বউদি?

ওফ, আবার বাড়তি কথা! বিদিশা মৃদু ধমক দিল,—যা বলছি তাই করো তো। আমার চান আমি বুঝব।

ওপরতলাটা দো-মহলা। অৰ্চিষ্মানরা থাকে উত্তর দিকে, দক্ষিণে দিননাথ। দক্ষিণের অর্ধবৃত্তাকার বারান্দাটি দিননাথের ভারী প্রিয়।

দোতলায় এসে ত্বরিত পায়ে আগে নিজের ঘরে গেল বিদিশা। হাতের ছয়-ছয় বারো গাছা চুড়ি চালান করল আলমারির অন্তঃপুরে, পরে নিল এক জোড়া বালা। শাড়িটা বদলাবে বদলাবে করেও বদলাল না, বাথরুম ঘুরে এসেছে দক্ষিণ মহলে।

দিননাথ যথারীতি বারান্দায়, ইজিচেয়ারে। চোখ দুটি বোজা, বুকের ওপর ইংরিজি কাগজ, খোলা ডটপেন। ক্রসওয়ার্ড পাজল করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন?

বিদিশা কোমল স্বরে ডাকল,—বাবা?

দিননাথ চমকে তাকালেন,—ও তুই! এসে গেছিস?

—এখনও খাওনি কেন বাবা? তোমায় না বলে গেলাম আমার জন্য ওয়েট করবে না!

দিননাথ চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে দাঁড়ালেন। সস্নেহে বললেন,—ভাবলাম এসেই তো পড়বি, বাপ বেটিতে এক সঙ্গেই না হয়…

—এটা কিন্তু মোটেই ঠিক কাজ নয় বাবা। তোমার কি অনিয়ম করা উচিত? বয়স হচ্ছে না?

—অ্যাই মেয়ে, বেশি শাসন করবি না তো। তুই ধমকাবি, তোর বর ধমকাবে, এত বকুনি আমার সহ্য হবে না।

বিদিশা হেসে ফেলল,—ইস, তোমার ছেলের বদনাম করছ কেন? কখন বকে তোমায়?

—বকে না? ওর তাকানোটাই তো ফাউল। সেই কথায় আছে না…হুঁকোমুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা, মুখে তার হাসি নেই দেখেছ…

—সে তুমি তোমার ছেলেকে যেমন গড়েছ। বিদিশা পায়ে পায়ে ডাইনিং হলের দিকে এগোল।

—মোটেই না। ছেলে আমার মোটেই আগে এরকম ছিল না। দিননাথও চলেছেন সঙ্গে সঙ্গে,—তুই আমার ছেলেটাকে গোমড়ামুখো করে দিলি।

দিননাথের কথা বলার ধরনটাই এরকম। অন্তত বিদিশার সঙ্গে। কে বলবে শ্বশুর বউমার বাক্যালাপ চলছে! বিয়ের পর প্রথম প্রথম ভারী আড়ষ্ট ছিল বিদিশা, শ্বশুরের সঙ্গে তাল মেলাতে পারত না, ঠাট্টা তামাশার উত্তরে লাজুক লাজুক হাসত। এখন সেও দিব্যি সড়গড় হয়ে গেছে। দিননাথই মনের আড় ভেঙে দিয়েছেন। বিদিশাও বেশ বুঝে গেছে এই ভাবে কথা বলাটাই দিননাথ বেশি উপভোগ করেন। মায়া পড়ে গেছে মানুষটার ওপর। আহা, বড্ড একা। সেই কোন কালে বউ মারা গেছে, অর্চিষ্মান তখন নাকি মাত্র চার বছরের। সংসারে নারীর ছোঁয়া না থাকলে পুরুষমানুষ বড় কাঙাল হয়ে যায়। তাও দিদি যদ্দিন ছিল… তারও তো বিয়ে হয়ে গেছে অনেক কাল, ষোলো বছর। মাঝে নাকি বেশ খিটখিটে হয়ে গিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই, ওই পদ্মপাণিই গল্প করে। হয়তো বা বিদিশাকে এনে নিজেই আবার এভাবে সংসারে প্রাণ জাগাতে চাইছেন। নাহলে কোন শ্বশুর বলে, বউমা পরিচয়টা একদম ভুলে যা! বেটি বনে যা, স্রেফ বেটি!

সুমতি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। ইলিশ মাছের ডিমভাজা, ইলিশের তেল, দই-ইলিশ, কাঁটা চচ্চড়ি… যাকে বলে ইলিশের একেবারে হদ্দমুদ্দ। সঙ্গে চাটনি আর বেনারসের ল্যাংড়া।

বেসিনে হাত ধুয়ে এসে চেয়ারে বসেছেন দিননাথ। ভাত ভাঙতে ভাঙতে বললেন,—হ্যাঁ রে, তোর কাজ হল আজ?

বিদিশা দু দিকে মাথা নাড়ল,—কই আর হল। মার ওখানে যা দেরি হয়ে গেল…

দিননাথকে অল্প চিন্তিত দেখাল,—বাবলু রাগ করবে না?

—জানবে কী করে! বিদিশা মুখ টিপে হাসল,—চুড়িগুলো তুলে রেখেছি। সোমবার টুক করে গিয়ে লকারে দিয়ে আসব।

—বাবলু ঠিক টের পেয়ে যাবে।

—কী করে?

—তুইই বলে দিবি। মেয়েরা খুব পেটপাতলা হয়।

—আমার পেট থেকে সহজে কথা বেরোয় না।

দিননাথ আর কিছু বললেন না। বিদিশা লক্ষ করল শ্বশুরমশাই হঠাৎ যেন একটু অন্যমনস্ক। ইলিশের চওড়া পেটি খুঁটছেন, সেভাবে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছেন না।

হলটা কী শ্বশুরমশায়ের? শরীর গড়বড়? উঁহু, দেখে তো মনে হচ্ছে না। আধিব্যাধি তো কাছেই ঘেঁষে না মানুষটার। কী স্বাস্থ্য, বাবার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড়, কিন্তু একটুও বুড়োননি! নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন, চামড়া এখনও টান টান, পেশি সবল, গাল ভরাট, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মজবুত দেহকাণ্ড একেবারে পামগাছের মতো ঋজু। চুল পর্যন্ত পাকেনি, এখনও স্বচ্ছন্দে পঞ্চান্ন-ছাপান্ন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। আহারেও মানুষটা রীতিমত রাজসিক। খান কম, কিন্তু বেছে বেছে সেরা জিনিসটি খান, রসিয়ে রসিয়ে। সকালে তো নিজেই ভাল ইলিশ আনার জন্য পদ্মপাণিকে নির্দেশ ছুড়ছিলেন, পাতে বসে বীতস্পৃহ কেন?

বিদিশা জিজ্ঞাসা করল,—কী ভাবছ বাবা?

—কই, কিছু না তো!

—বললেই হল? এত ভাল টেস্টফুল ইলিশ… তুমি খাচ্ছ কই?

—আজ তেমন খিদে হয়নি রে।

—সে কী? কেন?

—সারাক্ষণ শুয়ে বসে আছি, কাজকর্ম নেই… আজ সকালে এক্সারসাইজটাও বাদ পড়ে গেল…

কেমন যেন দুঃখী দুঃখী গলা! বিদিশার বুক মমতায় ভরে গেল। এত শক্তসমর্থ মানুষ কাজ ছাড়া থাকলে বুঝি এমনটাই হয়। অর্চিষ্মানটা যেন কী! বাবাকে তো নিলামঘরের দায়িত্বটা দিয়ে রাখলেই পারে। দেবে না। তার এক কথা, বাবা সারা জীবন অনেক পরিশ্রম করেছে, নাউ হি নিডস এ হ্যাপি ডিসেন্ট রিটায়ার্ড লাইফ! ঘুরুক, ফিরুক, যেমন ভাবে খুশি লাইফটাকে এনজয় করুক। নো মোর খাটুনি। নো মোর টেনশান! আর নিলামঘরে তো বসাবই না! বাবা হল ওল্ড ভ্যালুজের মানুষ, দয়ার প্রাণ, হাসিমুখে বাবা বাছা করে কাজ ওঠাতে চায়, ওই বিজনেস ট্যাকটিকস অর্চিষ্মান রুদ্রর পোষাবে না! আশ্চর্য, শ্বশুরমশাই বিনা প্রতিবাদে মেনেও নিয়েছেন ব্যবস্থাটা, ছেলের হাতে ব্যবসা তুলে দিয়ে দিব্যি হাত উল্টে বসে আছেন! ছেলেকে জোর করেন না কেন?

থাক বাবা, বেশি দরদ দেখিয়ে কাজ কী! মানুষকে কিছু বিশ্বাস নেই, হয়তো উনিই ভেবে বসবেন সাধের বউমা আবার শ্বশুরকে যাঁতাকলে ফেলার মতলব করছে! পুরুষদের জগতে অনুপ্রবেশ না করাই ভাল।

বিদিশা পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইল। মুখে দিদিমণি দিদিমণি ভাব ফুটিয়ে বলল,—কেন ব্যায়ামটা বাদ পড়ল আজ জানতে পারি?

দিননাথ হাসলেন,—উঠতে দেরি হয়ে গেল যে।

—কেন দেরি হল?

—কাল ফিরতে অনেক রাত হল না…।

—কেন রাত হল?

দিননাথ হঠাৎ চোখ পাকালেন,—অ্যাই, তুই জানিস তো…

—জানি তো আমি সবই। তোমার ক্লাসিকাল ফাংশন। অমন ফাংশন না শুনলে কী হয়, যার জন্য শরীরের ওপর অত্যাচার হচ্ছে?

দিননাথ নাটুকে ভঙ্গিতে বললেন,—ওরে বেটি, তোর প্রাণে কি দয়ামায়া নেই? একটাই তো মাত্র নেশা, তাও তুই কেড়ে নিতে চাস?

—শুধু নেশা নয়, বলো যমনেশা। বিদিশা চোখ পাকাল,—মনে আছে, গত মাসে কী কাণ্ডটা করেছিলে?

—কী বল তো?

—সেই যে শ্রীরামপুরে কোন বন্ধুর বাড়ি গান শুনতে গেলে, সারারাত দেখা নেই, কী তুমুল বৃষ্টি, আমরা ভেবে ভেবে মরছি…

—ওহো, সেই দিন! দিননাথ ছোট্ট এক টুকরো আম মুখে পুরলেন,—সেদিন কী বিশাল আয়োজন! রশিদ খাঁ এসেছেন, পণ্ডিতজি এসেছেন, মল্হারের তান চলছে, সঙ্গে বৃষ্টির রিমঝিম… তুই থাকলে তুইও নড়তে পারতিস না।

সত্যি, খ্যাপা লোক বটে! কী যে মজা পান ওই সব গিটকিরিতে! বিদিশাকে লাখ টাকা দিলেও সে ওই আসরে গিয়ে বসবে না।

তারে না না করতে করতে আহার পর্ব শেষ। দিননাথ শুতে গেছেন, ঘরে এসে স্নানে ঢুকল বিদিশা। আজ বৃষ্টি নেই বটে, কিন্তু গুমোট খুব, গা একেবারে ঘেমে প্যাচপেচে। বাথটবে সুগন্ধি ছড়িয়ে বিদিশা জলে শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। হাত পা ডলল, শ্যাম্পু করল, ফেনা নিয়ে খেলল…। ইটালিয়ান মার্বেল মোড়া এই ঘরটায় ঢুকলে আর যেন বেরোতেই ইচ্ছে করে না! মহিম হালদার লেনের বাড়িতে কী এঁদো একটা কলঘরে ছ্যাকরা ছ্যাকরা করে গায়ে জল ঢেলে স্নান করত বিদিশা! উফ, দুঃস্বপ্ন!

বাথরুম থেকে বিদিশা বেরোল প্রায় চারটেয়। গা পুরোপুরি মোছেনি, এতে বেশ আরাম হয়। ঢোল্লা একটা কাফতান চড়িয়ে নিল গায়ে, আয়নার সামনে বসে ড্রায়ারে চুল শুকোচ্ছে। ফরফর করছে হাওয়া, উড়ছে চুল, এও সুখ। হঠাৎই দাদার কথা মনে পড়ল। সত্যিই কি কাবুলিঅলার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছে বাবা? দাদার ঢপও তো হতে পারে।

ঝট করে ড্রেসিংটেবিল থেকে কর্ডলেসটা তুলল বিদিশা। টিপ টিপ করে ডায়াল টিপছে। রিং হয়েই যাচ্ছে বাবার অফিসে, কেউ ধরে না কেন? ধুৎ, আজ শনিবার তো, ছুটি হয়ে গেছে।

বিদিশা দু চার সেকেন্ড থম। তারপর নিজের মনে ঠোঁট উল্টোল। ফোনে বাবাকে পেলেই বা হতটা কি? বাবা থোড়াই স্বীকার করত। মরুক গে যাক, নিলে নিয়েছে। মেয়ের জন্যই তো নিয়েছে। কিন্তু দাদাকে আর একটি পয়সাও নয়। প্রমিস প্রমিস প্রমিস।

তৃপ্ত মুখে উত্তরের বারান্দায় এল বিদিশা! বেতের দোলনায় দুলছে মৃদু মৃদু। মেঘেরা আবার দখল নিয়েছে আকাশের, বৃষ্টি পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। পিছন দিকের চাঁপা গাছ থেকে গন্ধ ভেসে আসছে। মিষ্টি, উগ্র সুরভি। নেশা নেশা লাগছে, বিদিশার চোখ জড়িয়ে এল।

তখনই কোলের কর্ডলেস টেলিফোনটা বেজে উঠেছে। সহসা।

ধড়মড়িয়ে চোখ খুলল বিদিশা। রিসিভার কানে চাপল,—হ্যালো?

ক্ষণিক নৈঃশব্দ্য। তারপরই ও প্রান্তে একটা হিম হিম গলা—সুখে আছ, বিদিশা?

[চার]

বিদিশার ঘুম ঘুম ভাব ছিঁড়ে গেল, কে রে বাবা?

টেলিফোনে আবার স্বর বাজল,—চিনতে পারলে না?

—না! কে আপনি?

—আপনি নয়, তুমি। আমরা একদিন পরস্পরকে তুমিই বলতাম।

বিদিশার কপালে ভাঁজ। অর্কর গলা কি? একবার বিদিশার দর্শন পেয়েই…? জ্বালাতন!

নির্লিপ্ত স্বরে বিদিশা বলল,—হতে পারে। আমি বুঝতে পারছি না।

—ভুলেই গেলে? খোঁড়ো, খোঁড়ো নিজেকে।

বেশ কায়দা করে কথা বলে দেখি! উঁহু, এ তো অর্ক নয়। দু’ দিন আগেই যার সঙ্গে অত কথা হল, সে এমন হেঁয়ালি করতে যাবে কেন? টেলিফোনে অবশ্য অর্কর কণ্ঠ কখনও শোনেনি বিদিশা। অর্কর স্বরও ভারী বটে, কিন্তু যে এ যেন একটু অন্য রকম! বড় বেশি ধাতব! তাছাড়া অর্ক তার নাম্বার পাবেই বা কোত্থেকে? যদি নাম্বার থাকত, তা হলে তো আগেই…!

অস্বস্তি কাটাতে এবার সামান্য ঝেঁঝে উঠল বিদিশা,—দ্যাখো, আমার অত ফালতু সময় নেই। নাম বলতে হয় বল, নইলে রাখছি।

—নাম? নামে কী হবে বিদিশা?

—তা হলে থাক।

বিদিশা কট করে ফোন কেটে দিল। চোখ বন্ধ করে ভাবল কয়েক সেকেন্ড। উড়ো ফোন? কোনও ত্যাঁদোড় লোকের বজ্জাতি? আন্দাজে আন্দাজে একটা নম্বর ঘুরিয়ে মেয়ের গলা পেয়ে ফাজলামি করছে? উঁহু, বিদিশার নাম জানবে কী করে? তাহলে আর কে হতে পারে? মিহির…? ভাস্কর…? ধুৎ, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তো কবেই চুকে বুকে গেছে।

আবার ফোন বেজে উঠল।

অজান্তেই গাটা ছমছম করে উঠল বিদিশার। আড়ষ্টভাবে রিসিভার কানে চেপেছে।

—পরিচয় না দিলে আমি কথা বলব না।

—হুঁউ?…ধরে নাও তোমার একশো আটটা প্রেমিকের একজন।

—মানে?

—মানে বলতে হবে? বিয়ের আগে কোথায় কী কী কীর্তি করেছ মনে নেই?

—একদম আজেবাজে কথা বলবেন না।

—বাহ বাহ, বিয়ের পর খুব সতী বনে গেছ দেখছি। কী করছ এখন, অ্যাঁ? এসি চালিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বরের ধ্যান করছ?

—যাই করি না কেন, আপনার কী? বিদিশা অসহিষ্ণু হল,—আপনি আমায় ডিস্টার্ব করছেন কেন?

—আমার একটা কথা ছিল।

—কী কথা?

—বিয়ের আগে এতগুলো ছেলেকে যে ল্যাঙ মারলে, তার খেসারত দিতে হবে না?

—কী খেসারত? বিদিশার গলা দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল কথাটা।

—আপাতত পঞ্চাশ হাজার!

—টাকা?

—নয় তো কী, চুমু? ও তোমার বরের জন্যই তোলা থাক। আমি টাকা পেলেই খুশি। লোকটা খ্যাক খ্যাক হাসল।

বিদিশার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। চেঁচিয়ে উঠল প্রায়,—ভেবেছেন কী, মগের মুলুক? উল্টোপাল্টা বলে ভয় দেখাচ্ছেন?

—ধরে নাও তাই। আই ওয়ান্ট দ্যাট মানি। ওই ক’টা টাকা তো এখন তোমার হাতের ময়লা!

—চোপ।

বিদিশা আবার লাইন কেটে দিল। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। সুস্থিতভাবে চিন্তা শুরু করার আগেই আবার সরব হয়েছে কর্ডলেস।

সঙ্গে সঙ্গে বোতামটা টিপল না বিদিশা। হাতে ধরা রিসিভারের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। একবার বাজল, দু বার বাজল, তিন বার রাজছে, চার বার…উফ, এত জোরে বাজে কেন? বেশ কয়েক বার বাজার পর থেমে গেল, আবার বাজছে।

অতিষ্ঠ হয়ে ফোন তুলল বিদিশা। কড়া গলায় ধমকাতে যাচ্ছিল, তার আগেই ও প্রান্তের স্বর ঝাপটে এল,—তোমার সাহস তো কম নয়! বার বার লাইন কেটে দিচ্ছ কেন?

বিদিশার গলা কেঁপে গেল,—কেন এরকম করছেন বলুন তো?

ভারী গলা হঠাৎ বরফের মতো শীতল,—বললাম তো, টাকা চাই।

—কেন টাকা দেব আপনাকে? মিছিমিছি চাইলেই হল?

—আমি কিন্তু সব কথা ফাঁস করে দিতে পারি। আমার কাছে সমস্ত প্রমাণ আছে।

—কী প্রমাণ?

—সে তোমার বরের হাতেই তুলে দেব। নাকি তোমার ভালমানুষ শ্বশুরের হাতে দেব, যিনি তোমায় আহ্লাদ করে বউ করে নিয়ে গেছেন? কোনটা বেশি ভাল হবে?

—আপনি আমায় ভয় দেখাচ্ছেন? জানেন আমি পুলিশে খবর দিতে পারি?

—দাও। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোবে। দু এক সেকেন্ড থেমে থেকে আবার স্বর ফুটল,—একদম বাড়াবাড়ি কোরো না। নিজের ভাল যদি চাও তো সুড়সুড় করে টাকাটা দিয়ে দেবে। কখন কীভাবে দেবে, আমি তোমায় জানিয়ে দেব।

এবার ওদিক থেকেই কেটে গেছে ফোন। রিসিভারে একটানা ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। অসাড় হাতে টেলিফোন কোলে নামিয়ে রাখল বিদিশা। তাকাতেও সাহস হচ্ছে না, মনে হচ্ছে বুঝি বেজে উঠবে এক্ষুনি। হয়তো আরও কিছু ভয়ঙ্কর কথা বলবে, হয়তো আরও ঠাণ্ডা স্বরে শাসাবে। বিদিশা দোলনা থেকে নামার চেষ্টা করল। পা টলে গেল, হাঁটুর জোর যেন কমে গেছে হঠাৎ। কে তার এই অবিমিশ্র সুখের জীবনে আগুন লাগাতে চাইছে? কী জানে সে? কতটা জানে?

টেলিফোনের প্রতিটি বাক্যবন্ধকে মনে করার চেষ্টা করল বিদিশা।… কী কীর্তি করে বেড়িয়েছ, জানি না!…সব ফাঁস করে দেব!…ভাষা ভাষা কথা না সব? কেউ কি টোকা দিয়ে বাজিয়ে দেখতে চাইছে তাকে? যদি ভুলেও কারুর নাম করে ফেলত বিদিশা, তা হলে তাই নিয়ে…? কেউ প্র্যাক্টিকাল জোক করছিল না তো? অর্চিষ্মানের জামাইবাবুর চাষাড়ে রসিকতা করার শখ আছে, সে’ই মজা করছিল না তো বিদিশার সঙ্গে? চান্স কম। পূষনদা কি জানে না, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে কী বিশ্রী কাণ্ড হবে? অর্চিষ্মানের সঙ্গে পূষনদার মোটেই সুসম্পর্ক নেই, এমন গাড়োয়ানি রংতামাশা অর্চিষ্মান মোটেই বরদাস্ত করবে না।

আর কে হতে পারে? দাদা? শাসিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের বোনকে এভাবে…! দাদা সব পারে, কোনও গুণেরই ঘাট নেই তার। নেশা ভাঙ মদ জুয়ার জন্য ঘরের জিনিস পর্যন্ত বেচে দিয়ে আসে, সঙ্গীসাথিগুলো লোফারস্য লোফার…তবু যেন বিশ্বাস করতে মন চায় না। মুখে দশ বারো হাজারের আওয়াজ তুললেও দাদার চাহিদা পাঁচশো হাজারের বেশি নয়, পঞ্চাশ হাজার উচ্চারণ করতেই দাদা ভিরমি খাবে।

তবে কি অর্কই? কিন্তু গলাটা যে মিলছে না। রিসিভারের মুখে রুমাল চাপা দিয়ে কথা বললে গলা নাকি অন্য রকম শোনায়। দিঘাতেই অর্ককে যথেষ্ট আহত মনে হয়েছিল, ফিরে এসেই কি তার প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠল? কথায় কথায় বলেছিল না, অর্চিষ্মানকে প্রেমপত্রগুলো উপহার দেবে? ফোন নাম্বার পেল কী করে? ডিরেক্টরি দেখে? সে অবশ্য নিলামঘর থেকেই জোগাড় করতে পারে। অর্চিষ্মানের কার্ডে এ বাড়ির দুটো নম্বরই ছাপা আছে। শ্বশুরমশায়ের ঘরে কি ফোন করেছিল আগে? তারপর বুঝে গিয়ে এখানে…! চাকরি বাকরি জুটছে না বলে একবারে মোটা কোপ মারতে চায় অর্ক?

দরজায় ছায়া।

বিদিশা চমকে তাকাল,—কে?

—আমি বউদি। সুমতি।

—ও।…কী চাই?

—চা হয়ে গেছে। এখানেই কি দিয়ে যাব, না হলঘরে যাবে?

সরু চোখে সুমতিকে দেখল বিদিশা। কতক্ষণ এসেছে দরজায়? এত নিঃসাড়ে দাঁড়িয়েছিল কেন? কিছু শোনেনি তো?

প্রাণপণে বিদিশা গলা স্বাভাবিক বলল,—বাবা উঠে পড়েছেন?

—হ্যাঁ। উনিই তোমায় ডাকতে পাঠালেন।

—যাচ্ছি। যাও।

দ্রুত ঘরে এল বিদিশা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আলগা চিরুনি চালাল চুলে, কাঁপা কাঁপা হাতে। এখনও তার নাড়ির গতি স্বাভাবিক হয়নি। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে নিজের হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি। লাবডুব। লাবডুব। বড় করে নিশ্বাস ভরে নিল ফুসফুসে, ছাড়ছে ধীরে ধীরে। আবার নিল, আবার ছাড়ল। কর্ডলেস ফোনটা হাতে নিয়েই হলঘরে এসেছে।

দিননাথ টেবিলে বসে, হাতে ধূমায়িত কাপ। বিদিশাকে দেখে হাসলেন,—কীরে, টেলিফোন হাতে নিয়েই ঘুরছিস যে? কারুর সঙ্গে কথা বলবি বুঝি?

বিদিশা হকচকিয়ে যন্ত্রটা রাখল টেবিলে,—না…এমনিই…

—ঘুমোচ্ছিলি নাকি? তোর টিভির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল না তো?

—চালাইনি আজ।

—মুখটা শুকনো লাগছে কেন? শরীর খারাপ?

—তেমন কিছু নয়। বিদিশা ঠোঁটে হাসি আনল,—মাথাটা একটু ধরেছে।

—ওষুধ খেয়েছিস?

—লাগবে না। বিদিশা সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল,—বিকেলে আজ তোমার কী প্রোগ্রাম?

—আমার তো বাঁধা গৎ। স্টেডিয়াম অবধি হাঁটতে হাঁটতে যাব, ফেরার পথে একবার কর্নেল লাহিড়ির বাড়ি ঢুঁ মারব, খেলব এক দু দান, ব্যাক।

কর্নেল লাহিড়ির গল্প অনেক শুনেছে বিদিশা। দিননাথের সমবয়সী, বছর দুয়েক হল স্ত্রী মারা গেছেন, একমাত্র ছেলে আমেরিকায় থাকে, বেশ বড়সড় এক বাড়িতে এখন ভারী নিঃসঙ্গ জীবন কাটান ভদ্রলোক। বিশেষ একটা বেরোন না, সঙ্গী না জুটলে একা একাই দু দিকে গুটি সাজিয়ে দাবা খেলেন। দিননাথ গেলে খুব খুশি হন, দাবার বোর্ড ছেড়ে দিননাথকে উঠতেই দিতে চান না।

মাঝেমধ্যেই দুই বৃদ্ধের দাবা খেলার গল্প নিয়ে টিপ্পনি কাটে বিদিশা, আজ কথাটা খেয়ালই করল না, অন্যমনস্ক ভাবে বলল,—বৃষ্টি পড়ছিল, ছাতা নিয়ে বেরিয়ো।

—হ্যাঁ রে বেটি, সে খেয়াল আমার আছে। তুই বেরবি কোথাও?

—কোথায় যাব?

—কেন, যেখানে ফি শনিবার যাস। তোর বিউটি পার্লার?

—আজ যাব না।

বাইরে চেনা হর্নের শব্দ। দুজনেই উৎকর্ণ সহসা। সুমতি হলঘরেই দাঁড়িয়েছিল, ছুটে গেছে জানলায়,—ওমা, দাদাবাবু ফিরলেন যে!

কথায় কথায় বিদিশার বুকের কাঁপন সামান্য কমেছিল, ধক ধক করে উঠল। আজই কেন তাড়াতাড়ি ফিরল অর্চিষ্মান? এ কি কোনও অমঙ্গলের পুর্বাভাস?

হাশ্ পাপিজ্ জুতোয় মশ মশ শব্দ তুলে অর্চিষ্মান উঠে আসছে। দিননাথ প্রশ্ন ছুড়লেন,—কী রে বাবলু, তোরও আজ মাথা ধরল নাকি?

কপালে ভাঁজ ফেলে অর্চিষ্মান চেয়ার টেনে বসল,—সত্যিই মাথা ধরেছে। এক কাপ চা দাও তো।

বিদিশা হাতে টিপট তুলল,—কিছু খাবে?

—নাহ।

দিননাথ ছেলেকে দেখছিলেন। বললেন,—মুখ এত কালো কেন বাবলু? এনি প্রবলেম?

—প্রবলেম তো বটেই। অর্চিষ্মান রুক্ষস্বরে বলল,—নিলামঘরে চুরি হয়ে গেছে।

—সে কী? কখন?

—প্রোব্যাবলি কাল রাত্তিরে। পেছনের কোল্যাপসিবল গেটটা ভেঙে…

—পুলিশে খবর দিয়েছিস?

—তাদের পেছনেই তো সারাটা দিন গেল আজ। তিনবার করে এল দোকানে, এটা দেখছে, ওটা দেখছে…কাজের কাজ কিছু নেই, অল রাবিশ!

—গেছে কী কী?

—তেমন কিছু অবশ্য যায়নি। মালপত্র সব ঠিক আছে। বড় আলমারিটা ভেঙেছে, সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ারগুলো, ক্যাশের সিন্দুকটা আর একদম পেছনের একটা আলমারি।…ওটা অবশ্য বাতিল অবস্থায় পড়ে ছিল।

—কত টাকা ছিল, সিন্দুকে?

—বেশি নয় হাজার দেড়েক মতন। আর আলমারিতে হাজার খানেক। ভাগ্যিস আমি দোকানে হার্ড ক্যাশ রাখি না।

দিননাথ উত্তেজিত মুখে বললেন,—দারোয়ানগুলো ছিল কোথায়?

—গড নোজ। হয়তো নেশা করে ঘুমোচ্ছিল। হয়তো দোকানে ছিলই না, সারা রাত কোথাও ফুর্তি করতে গেছিল। অর্চিষ্মান গজগজ করে উঠল,—এত অপদার্থ যে বার্গলারি ডিটেক্ট করার পরও বাবুদের আমায় ফোন করার হুঁশ হয়নি! কী, না কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ক্যান ইউ ইমাজিন দিস সর্ট অব নেগলিজেন্স? সব কটাকে ঘাড় ধরে তাড়াব আমি।

দিননাথ একটুক্ষণ চুপ। তারপর বললেন,—তোকে আমি কত দিন ধরে বলছি, দিনকাল ভাল নয়, প্রাইভেট সিকিউরিটি অ্যাপয়েন্ট কর…

—এবার তাই করতে হবে।

—পুলিশ দারোয়ানদের জেরা করেনি?

—করেছে। রুটিন জেরা। তারাও রুটিনমাফিক জবাব দিয়েছে।

—ইনসিওরেন্সে জানিয়েছিস?

—হ্যাঁ। ইন্সপেক্ট করে গেছে।

—আমি কি লালবাজারে একটা ফোন করব? মুস্তাফিকে বোধহয় এখনও পেতে পারি।

—থাক। তেমন কিছু তো যায়নি, ডিসিকে আর উত্যক্ত করে লাভ কী!

—যা ভাল বোঝ। দিননাথ উঠে পড়লেন,—আমি সাঁইত্রিশ বছর ওই দোকান চালিয়েছি। একটা মাত্র চুরির ইন্সিডেন্ট ঘটেছিল। তাও শীতের সময়ে। তখন ওই পেছনে কোলাপসিবল্‌ গেটের সিস্টেমটা করেছিলাম।

—প্লিজ স্টপ দ্যাট ওল্ট স্টোরি বাবা। আমার ভাল লাগছে না।

অর্চিষ্মান চা শেষ করেই ঘরে চলে গেল। পিছন পিছন এসেছে বিদিশাও, প্রায় ছুটতে ছুটতে। অর্চিষ্মানের এখন মেজাজ গরম, প্রতিটি জিনিস হাতের কাছে জুগিয়ে যেতে হবে।

সন্ধের পর ভাল মতোই বৃষ্টি নামল। ঝমঝম শব্দ হচ্ছে একটানা। একঘেয়ে। দিননাথ আর বেরোননি, ঘরে বসে টিভি দেখছেন। অর্চিষ্মান বাইরের পোশাক ছেড়ে ফেলে পাজামা পাঞ্জাবিতে বদলে নিয়েছে নিজেকে, খানিকক্ষণ গিয়ে বসে রইল বারান্দার দোলনায়, দুম করে উঠে পর পর নিজস্ব সেলুলারে কটা ফোন করল, ব্রিফকেস খুলে কী সব কাগজপত্র ঘাঁটল কিছুক্ষণ, তার পরই গ্লাস বোতল নিয়ে বসে পড়েছে। এমন অস্থির অর্চিষ্মানের সঙ্গে কথা বলার সাহস হয় না বিদিশার। তার ওপর দুপুরের ফোনটা গায়ে কাদার মতো লেগে রয়েছে। আজ ফোনও আসছে ঘন ঘন, ধরতে ভরসা পাচ্ছে না বিদিশা। একটুক্ষণ অর্চিত্মানের কাছাকাছি থেকে সুড়ুৎ করে নীচে রান্নাঘরে চলে গেল।

রাত্রে খাওয়াদাওয়াও তাড়াতাড়ি হয়ে গেল আজ। দিননাথ এসি ঘরে শোন না, তাঁর ঘরে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে এল বিদিশা। নিজের মহলে ফিরল যখন, আবার বোতল খুলে বসেছে অর্চিষ্মান। সে বড় মাপা মানুষ, রোজ দু পেগ বরাদ্দ। চিত্তবিক্ষেপ ঘটেছে আজ, বেশিই খাবে। তাকে না ঘাঁটিয়ে বিদিশা বিছানায় চলে এল।

চোখ বুজে ফোনটার কথাই ভাবছিল বিদিশা। অর্চিষ্মানের গলা শুনতে পেল,— ঘুমিয়ে পড়লে?

বিদিশা স্বামীর দিকে ফিরল,—না। কেন?

—কেসটা কী বল তো?

—কী কেস? বিদিশা আমূল কেঁপে উঠল।

—অর্চিষ্মান চুলে আঙুল চালাল—দোকানে চুরিটা ভারী অদ্ভূত হয়েছে। কত দামি দামি মাল ছিল, কিছু নেয়নি। টাকাপয়সাও না। শুধু সব তছনছ করে দিয়ে গেল।…

—আশ্চর্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *