০৫. শ্রাবণ সংক্রান্তি

॥ পাঁচ ॥

বর্ষা যেন এবার বড় তাড়াতাড়ি চলে গেল। শ্রাবণ সংক্রান্তির অনেক আগেই আকাশে ফিরে এসেছে নীল, এক-আধটুকরো ভারী মেঘ দর্শন দেয় ক্কচিৎ কখনও, ঝমাঝম ঝরে খানিক, তারপর আবার সে ঝকঝকে তকতকে। দিনের বেলা সূর্যের তাপ বড্ড চড়া, চব্বিশ ঘণ্টাই এখন ভ্যাপসা গুমোট। এক মুহূর্ত শান্তি নেই, সারাক্ষণ চ্যাটচ্যাট করছে গা হাত পা, ফ্যানের হাওয়া গায়েই লাগে না যেন।

গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে কম্পিউটারে ডাটা ফিড করছিল প্রতীক। পুরনো এক অ্যাসেসির রেকর্ড ভরে রাখছে যন্ত্রগণকে। কাজে উৎসাহ পাচ্ছে না। তার পাঁচতলার চেম্বারে দুটো জানলাই পশ্চিমমুখো, দুপুরের পর থেকে অসম্ভব তেতে যায় ঘরখানা, এই বিকেলের দিকটায় বসে থাকতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। শরীর থেকে নুন বেরিয়ে যাচ্ছে অবিরাম, শ্রান্ত লাগছে খুব। আপন মনে মুখ বিকৃত করল প্রতীক। সরকারের এই এক দোষ, অকাজে হাতি গলে যায় তাতে হুঁশ নেই, কর্মচারীদের কাজকর্মের সুবিধের জন্য সুচটুকু কিনতেও লাখো ফ্যাকড়া। ফান্ড দেখাবে, ফিনান্স দেখাবে, অডিট দেখাবে, রুল দেখাবে…! ঘরে একটা এসি মেশিন থাকলে কত আরামে কাজ করা যায়। প্রতীকরা নয় দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেল, কিন্তু ঘরে যে কম্পিউটারটি রয়েছে তাকে কি এত তাপ খাওয়ানো ভাল? সাধে কি বাবা যন্ত্রগণক মাঝে মাঝেই বিগড়ে বসে। তিনি হ্যাং করে গেলে কাজের তো দফারফা।

চেম্বারে প্রতীকের সঙ্গে বসে আর একজন অফিসারও। যোগব্রত চৌধুরী। প্রতীকের চেয়ে দু’-চার বছরের বড়। যোগব্রতর টেবিলে দু’জন অবাঙালি বসে, তাদের সঙ্গে অনুচ্চ স্বরে কথা বলছিল যোগব্রত, লোকদুটো ফাইলপত্র নিয়ে বেরিয়ে যেতে বড়সড় একটা আড়মোড়া ভাঙল। এবার আঙুল মটকাচ্ছে। দশটা আঙুল গুনে গুনে কুড়ি বার। ডেভিড কপারফিল্ডের নিউম্যান নগ্‌স্‌! টেবিলের ওপর রেখে যাওয়া প্যাকেট খুলে বিদেশি সিগারেট ধরাল একখানা। আয়েস করে ধোঁয়া ছাড়ছে।

প্রতীক বিরক্ত হল বেশ। সিগারেটের গন্ধ তার সহ্য হয় না। যোগব্রত ভালমতোই জানে, তবু ইচ্ছে করে ধরায়। অন্যের অসুবিধে করে কী যে আনন্দ পায়! সরকার কবে থেকে তড়পাচ্ছে অফিসে ধূমপান নিষিদ্ধ করবে, কেন যে আইনটা চালু হচ্ছে না এখনও?

ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে যোগব্ৰত কথা ছুড়ল— কী চ্যাটার্জিসাহেব, কিছু শুনছেন নাকি?

প্রতীক টেরিয়ে তাকাল—কী ব্যাপারে বলুন তো?

—আমাদের অ্যানুয়াল টার্গেট নাকি আবার রিভাইজ হচ্ছে? বাড়িয়ে নাকি ডবল করে দেবে?

—দিতেই পারে। গভর্নমেন্টের ফান্ডের যা দশা।

—একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন? গভর্নমেন্ট যখনই পাঁকে পড়ে, তখনই আমাদের মতো রেভিনিউ আর্নিং ডিপার্টমেন্টগুলোকে ডলা দেওয়া শুরু হয়। কী করে কালেকশান হবে তা নিয়ে ডেফিনিট প্ল্যান প্রোগ্রাম নেই, শুধু মাল্লু এনে দাও, মাল্লু এনে দাও! কাঁহাতক পার্টির ওপর প্রেশার করা যায় বলুন?

প্রতীক মনে মনে বলল, চাপ দিলে আপনার আমার লোকসান তো নেই। নীচের তলা ব্লেড মেরে দেবে, আপনি বসে বসে মুরগির ছাল ছাড়াবেন।

মুখে বলল,—সত্যি, আমাদের হয়েছে যত জ্বালা। কী সব অড সিচুয়েশানই না ফেস করতে হয়!

যোগব্রত চোখ ছোট করে সামান্য নিরীক্ষণ করল প্রতীককে। বুঝি বুঝে নিতে চাইল কথাটায় কোনও টিটকিরি আছে কিনা।

তখনই দরজা ঠেলে ঝোড়ো বাতাসের মতো দেবীপ্রসাদের প্রবেশ। ঢুকেই হইহই করে উঠেছে,—ব্যাপার কী হে প্রতীককুমার? আমার ঘরে ঢুঁ মারছ না কেন?

—আরে ডিপিদা যে! প্রতীক হাসল,—পরশুই গিয়েছিলাম। এরকম সময়ে। আপনি ছিলেন না তখন।

—পরশু?…ও হ্যাঁ, শালীর বাচ্চার মুখ দেখতে গেছিলাম। চেয়ার টেনে বসল দেবীপ্রসাদ,—বউ বাচ্চা পাড়ার সময়ে কাছে থাকতে পারিনি তো, সেটাই পুষিয়ে দিলাম আর কী! জানোই তো, শালী মানে আধি ঘরওয়ালি। হা হা হা।

দেবীপ্রসাদের বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ। টকটকে ফরসা রং, লম্বাটে মুখ, খাড়া নাক, চোখে সবসময়ে খেলা করছে কৌতুক। দেবীপ্রসাদ সেই প্রজাতির মানুষ যার আবির্ভাব মাত্রই যে-কোনও আবহাওয়া লঘু হয়ে যায়।

প্রতীকের সঙ্গে দেবীপ্রসাদের আলাপ শিলিগুড়িতে। প্রতীকের ফার্স্ট পোস্টিংয়ের সময়ে। পদমর্যাদায় তখন তার চেয়ে এক ধাপ ওপরে ছিল দেবীপ্রসাদ। বয়সের অনেকটা ফারাক সত্ত্বেও বছর দু’-আড়াই একত্রে চাকরি করার সুবাদে বেশ গাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল দু’জনে। শিলিগুড়িতে ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকত প্রতীক, প্রায় প্রতি সন্ধেতেই চলে যেত ডিপিদার ফ্ল্যাটে, চলত অনন্ত আড্ডা আর হইহই। প্রতীক খানিকটা মুখচোরা, কথা বলে কম, তাতে কিছু যেত-আসত না দেবীপ্রসাদের। যে-কোনও আসরে সে একাই একশো।

প্রোমোশান হওয়ার পর প্রতীক আর দেবীপ্রসাদ এখন একই ধাপে। অবশ্য শিগগিরই আর একটি প্রোমোশান পেয়ে যাচ্ছে দেবীপ্রসাদ, বর্ধমান থেকে কলকাতায় বদলি হয়ে তারই অপেক্ষায় রয়েছে। সিনিয়রিটি জুনিয়রিটি নিয়ে এখনও তার কণামাত্র ছুঁৎমার্গ নেই, প্রায়শই সে এ-ঘরে হানা দিয়ে পুরনো সম্পর্কটা ঝালিয়ে যায়।

প্রতীক হাসি হাসি মুখে বলল,—তা কেমন দেখলেন শালীর মেয়ে?

—চমৎকার। বিলকুল আমার শালীর ছাঁচে গড়া। তৈরি মেয়ে, জন্মানোর এক ঘণ্টা পর থেকেই চোখ মারছে।

যোগব্রত পাশ থেকে টিপ্পনী কাটল,—আপনার শালী বুঝি খুব চোখ মারে?

—মারে মানে? আই এক্সারসাইজ করতে করতে বেচারি ট্যারা হয়ে গেল। তাই নিয়ে আমার ভায়রার কম আফশোস।… তা আপনার শরীর কেমন এখন? সেই কোমরের ব্যথাটা গেছে?

যোগব্ৰত বিরস মুখে বলল,—কই আর। পেনকিলার খেয়ে খেয়ে চালাচ্ছি।

—শরীরটাকে আর ওষুধে ওষুধে দূষিত করবেন না। আড়াই প্যাঁচের তামা পরুন একটা। কারেন্ট পাস করানো। সঙ্গে গোমেদ ধারণ করুন। আড়াই থেকে তিন রতির।

—আমাকে একজন ম্যাগনেটিক বালার কথা বলছিল…

—দেখতে পারেন। তবে স্টোনের এফেক্ট আরও বেটার।

—বলছেন? যোগব্রত রক্তপ্রবাল আর পোখরাজ শোভিত নিজের আঙুলদুটো দেখাল, —এগুলো থাকবে?

—ক্ষতি নেই। পোখরাজ আপনাকে কে পরতে বলেছে?

—সিদ্ধাই মা। বউবাজারে একটা দোকানে বসেন। খুব ভিড় হয়। আমাকে অবশ্য স্পেশাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন।

—পোখরাজের সঙ্গে একটা চুনি পরলে আরও ভাল কাজ হত।

—বলছেন?

—দেখুন না পরে।

আরও দু’-চার মিনিট পাথর সংক্রান্ত আলোচনা করে উঠে পড়ল যোগব্রত। ধর্মতলায় কী কাজ আছে, ব্রিফকেস গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।

যোগব্রত চলে যাওয়ার পর প্রতীক বলল,—আপনি আজকাল জ্যোতিষ চর্চাও করছেন নাকি ডিপিদা?

—একটু-আধটু। অ্যাপ্রেনটিস বলতে পারো। দেবীপ্রসাদ চেয়ারে হেলান দিল।

—হঠাৎ এ লাইনে আপনার আগ্রহ হল যে?

—আরে ভাই, গভর্নমেন্টের যা হাল, যে-কোনও দিন তো ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দেবীপ্রসাদ মুচকি হেসে চোখ টিপল,—একটা অলটারনেটিভ ফ্রন্ট খুলে রাখা আর কী।

—আপনি তো নিজে পাথর টাথরে তত বিশ্বাস করতেন না?

—আরে বাবা, যাদের বলি তারা তো বিশ্বাস করে। তাহলেই হল।

প্রতীক হেসে ফেলল। ডিপিদা মানুষটাই এরকম। নিজে বিশ্বাস করুক, বা না করুক, অদ্ভুতভাবে অন্যের ভেতরে বিশ্বাসটা চারিয়ে দিতে পারে। চাকরিতে জয়েন করার বছরখানেকের মাথায় বিচ্ছিরি এক গাড্ডায় পড়ে গেছিল প্রতীক। শিলিগুড়ির প্রধান নগরের এক খুদে কারখানার মালিক জোর করে টাকা আদায়ের অভিযোগ এনেছিল প্রতীকের নামে, সাক্ষ্যপ্রমাণও জোগাড় করে ফেলেছিল। তখন প্রতীকের কীই বা বয়স, মেরেকেটে ছাব্বিশ। চাকরিতে মোটেই হাড় পাকেনি তখনও। বাড়তি অর্থোপার্জনের বাহারি প্যাঁচ-পয়জারগুলো তার রপ্ত হয়নি তেমন। জোশের মাথায় চোখ রাঙিয়ে অত বড় একটা বিপদে পড়ে যাবে এ ছিল তার কাছে অভাবনীয়। খোদ কমিশনারের কাছ থেকে শো-কজ খেয়ে তার প্রায় থরহরি কম্পমান দশা। খেতে পারে না, ঘুমোতে পারে না, কীভাবে উদ্ধার পাবে ভেবে ভেবে মাথার চুল ছিঁড়ছে…। ডিপিদাই তখন বলেছিল, তোমার এখন প্রথম কাজ মাথা ঠান্ডা রাখা। স্ট্রেট মায়ের পায়ে পড়ে যাও, সব ভাবনা ছেড়ে দাও তাঁর ওপর, চিত্ত শান্ত থাকবে। তারপর আস্তে আস্তে আত্মরক্ষার জন্য গুটি সাজাও। আশ্চর্য ফল পেয়েছিল ডিপিদার উপদেশে। শান্তাবউদির সঙ্গে রক্ষাকালীর মন্দিরে গিয়ে প্রাণ ভরে ডাকল মাকে, অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল মনটা, ভেতর থেকে একটা অন্য রকম বল পেয়ে গেল যেন। প্রধাননগরে গিয়ে নতমস্তকে হাত মেলাল ব্যবসায়ীটির সঙ্গে, কারণ দর্শানোর চিঠির জবাবে অভিযোগটা সত্য নয় বলে জানিয়ে দিল। ব্যবসায়ীটির সঙ্গে একটা মাখো মাখো সম্পর্কও তৈরি করে নিয়েছিল প্রতীক, লোকটা আর অভিযোগ নিয়ে নাড়াচাড়াই করল না। অবশ্য বছর দুয়েক পর শিলিগুড়ি ছেড়ে মালদা চলে আসার ঠিক আগে আগে ব্যবসায়ীটির নামে প্রতীক একটা জব্বর কেস ঠুকে দিয়ে এসেছিল। সমস্ত আটঘাট বেঁধে। সেই কেসের ধাক্কা সামলাতে পঙ্কজ রায়বর্মনের কারবার লাটে ওঠার জোগাড়। তখন থেকেই প্রতি পদে মা মহামায়া বুদ্ধি জুগিয়েছেন প্রতীককে, তাকে অভয় দিয়েছেন। মাকালীর প্রতি প্রতীকের অচলা ভক্তির সূচনাও সেই তখন থেকেই। মায়ের পায়ে আত্মনিবেদন করে এই বয়সেই এক আশ্চর্য সুখের সন্ধান পেয়ে গেছে প্রতীক। পাপ পুণ্যের বোধ তাকে আর সেভাবে পীড়িত করে না।

কিন্তু যার হাত ধরে প্রতীকের ভক্তিমার্গে প্রবেশ, সেই দেবীপ্রসাদ ঘোষাল আদৌ তেমন ভক্তিমান নয়। তবে ঠাকুর দেবতায় সে অবিশ্বাসও করে না। পথে-ঘাটে মন্দির দেখলে কপালে হাত ঠেকায়, টাকাটা সিকিটা ছোড়ে, কিন্তু ব্যস ওইটুকুই। সারাক্ষণ ঠাকুর ঠাকুর করা তার ধাতে নেই। বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নেও দেবীপ্রসাদ অনেক বেশি বেপরোয়া। প্রতীক জানে।

হাসতে হাসতে প্রতীক বলল, —বুঝেছি। টুপি পরানোতেই আপনার আনন্দ।

—সে তুমি যা খুশি ভাবো। দেবীপ্রসাদও হাসছে মিটিমিটি, —চলো। আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে।

—কোথায়?

—চলোই না। বাড়ি ফেরার তাড়া আছে?

—না মানে…ভাবছিলাম আজ একবার ঠনঠনে যাব…

—বোর কোরো না তো। মাকালীর মন্দিরেই নিয়ে যাব তোমায়। দেখবে, সেখানে ভক্ত গিজগিজ করছে। সব্বাই ডুবে আছে কারণবারিতে।

—আপনি বারে যাচ্ছেন?

—এক ক্লায়েন্ট খুব ধরেছে। জব্বর এক ফাঁড়া থেকে উতরে দিয়েছি, আমাকে সে তুষ্ট করবেই। ব্যাটা গাড়ি লাগিয়ে দিয়েছে নীচে।

—আমি বারে গিয়ে কী করব ডিপিদা?

—তুমি যে বিধবা সে আমি জানি। তুমি কাবাব টাবাব পেঁদাবে। আমি জলে ভাসব, তুমি চরবে ডাঙায়।

—না ডিপিদা, আজ থাক।

—আহা, ফেরার পথে ঠনঠনেতে নেমে একবার নয় কপাল ঠুকে নিয়ো।

—তার জন্য নয়। বাড়িতেও আজ বলা নেই …

—শোনো প্রতীক, আমি মোটেই বলব না তুমি বাড়িতে এক্ষুনি ফোন করে দাও। বউকে লুকিয়ে চুরিয়ে কিছুই যদি না করলে, তা হলে ওপারে গিয়ে কী কৈফিয়ত দেবে, অ্যাঁ? এমনিতেই তো যমরাজ তোমার ওপর হেভি চটে আছে।

—কেন?

—তোমার তো পাপের অন্ত নেই। মাল টানো না, সিগারেট খাও না, বউ ছাড়া আর কিছুই চিনলে না … মরার পর অনন্ত স্বর্গবাসের শাস্তি তোমার কপালে বাঁধা। ওঠো ওঠো, একটু পুণ্য চাখবে চলো!

কোনও ওজর আপত্তি শুনল না দেবীপ্রসাদ, প্রায় ঘেঁটি ধরেই প্রতীককে নামিয়ে আনল নীচে। অফিস প্রাঙ্গণেই অপেক্ষা করছিল দুধসাদা জেন, উর্দি-পরা ড্রাইভার নেমে এসে খটাং স্যালুট ঠুকল, খুলে ধরেছে দরজা। পিছনের নরম সিটে প্রতীক ছড়িয়ে দিল নিজেকে। আঃ, কী আরাম! হিমেল ছোঁয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর।

বন্ধ কাচের ওপারে তাপে ছটফট করছে পৃথিবী, অথচ গাড়ির ভেতরের এই ছোট্ট পৃথিবীটা যেন এক্কেবারে আলাদা। বাইরেটা দেখতে দেখতে কথাটা আলগাভাবে মনে হচ্ছিল প্রতীকের। নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠল, —এরকম একটা গাড়ি কিনে ফেললে হয়।

—ফ্যালো কিনে। দেবীপ্রসাদ সিটে হেলান দিয়েছে। মৃদু হেসে বলল, —আজকাল তো কার লোন দেওয়ার জন্য চারদিকে সব মুখিয়ে আছে। একবার মুখ থেকে কথা খসালেই হল, বাড়ির দরজায় গাড়ি লাগিয়ে দিয়ে যাবে।

—তা দেবে। তবে অন্য ঝামেলাও তো আছে। সবে চার বছর হল ফ্ল্যাট কিনেছি, এক্ষুনি গাড়ি হাঁকালে আর দেখতে হবে না, অফিসে কাঠিবাজি শুরু হয়ে যাবে।

—আরে না রে ভাই। আজকাল সবাই ডালে ডালে চলে, কেউই কাউকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। তা ছাড়া গাড়ি কিনে ঢাক পেটানোর দরকারটাই বা কী? অফিসে এনে শো না করলেই হল।

—তবু …

—অত ভাবার কী আছে? নিজের নামে কিনো না। আমি তো মারুতিটা কিনেছি আমার ছোট শালার নামে। কেউ প্রশ্ন করলে মুখের ওপর কাগজ ফেলে দেব।

—হুম। … আপনার মারুতি এখন সার্ভিস দিচ্ছে কেমন?

—ভালই। মেয়ের কলেজ, শান্তার এদিক-ওদিক ছোটা, মাঝে মাঝে খুচখাচ শর্ট ড্রাইভ … মোটামুটি কাজ চলে যায়। অফিসে পারতপক্ষে আনি না, লোকেরও চোখ করকর করার তেমন চান্স নেই।

—আপনার গাড়িটা তো এসি?

—কেনার সময়ে ছিল না। এখন লাগিয়ে নিয়েছি।

—শালার নামে গাড়ি, শালা যদি কখনও ক্লেম করে বসে?

—শালার মুখ বন্ধ করা আছে। কিসুই তো করতে পারছিল না, ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরছিল, একটা জেরক্স মেশিন কেনার বন্দোবস্ত করে দিলাম। বাড়িতেই গ্যারাজঘরে জেরক্সের দোকান খুলে বসেছে, রোজগারপাতি মন্দ হচ্ছে না। এখন আবার একটা ভিডিও গেমসের মিনি পার্লার করার প্ল্যান করছে।…সে তার দিদি-জামাইবাবুকে নেক্সট টু গড ভাবে।

—তাও যদি কখনও তার মতিভ্রম হয় দাদা?

—হলে হবে। তখন দেখা যাবে। অত দূর অবদি ভাবলে কাছের সুখগুলো বিস্বাদ হয়ে যায় প্রতীক।

এই কারণেই ডিপিদা ইজ ডিপিদা। চিন্তা ভাবনায় কোনও অস্বচ্ছতা নেই, বিবেক পুরোপুরি সাফ, প্রতিটি কর্মের সঙ্গে বাঁধা আছে নিজস্ব যুক্তিজাল। চাকরিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সব্যসাচী হতে পারেনি প্রতীক, বাঁ হাতটা মাস ছয়েক বেশ আড়ষ্টই ছিল। ডিপিদাই কাটিয়ে দিয়েছিল তার মনের সমস্ত দোলাচল। ডিপিদা বলেছিল, লিভ ফর মোমেন্টস্ ব্রাদার। এই মুহূর্তটাকে বয়ে যেতে দিয়ো না। যেটুকু পাচ্ছ চোখ কান বুজে আহরণ করে নাও। যে লোকটা তোমার কাছে আসবে, সে অনেস্ট না ডিজঅনেস্ট তা নিয়ে তোমার তো মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তুমি যে তাকে বিপদে ফেলতে পারো এই ক্ষমতাটুকুকে অনার করার জন্যই তাকে নৈবেদ্য চড়াতে হবে। উৎকোচ গ্রহণে কোনও পাপ নেই ভায়া। স্বয়ং দেবতার কাছ থেকে কাজ বাগাতে গেলেও তাঁর মাথায় ফুল বেলপাতা চড়াতে হয়। হয় না? আর মনে রেখো, তুমি হচ্ছ পাবলিক সারভেন্ট। অর্থাৎ জনগণের চাকর। ভৃত্যের কর্তব্যই তো মনিবের পকেট থেকে পয়সা মারা। নয় কি? আরে ভাই, নিজের বাসনা মতো জীবনটাকে যদি উপভোগই না করতে পারলাম, তবে বেঁচে থেকে কী লাভ!

কী যে বিশ্বরূপ দেখাল ডিপিদা, প্রতীক বদলে গেল দ্রুত। বদল? না রূপান্তর? এই রূপান্তরের সম্ভাবনা কি প্রতীকের মধ্যে আগে থেকেই ছিল? দেবীপ্রসাদের মুখব্যাদান অনুঘটকের কাজ করেছে শুধু? কুরুক্ষেত্রে যেভাবে অর্জুনকে যুদ্ধে প্রণোদিত করেছিল শ্রীকৃষ্ণ? প্রতীকের এখন আর আগের প্রতীককে মনেই পড়ে না। ধুয়ে মুছে গেছে জয়েস, রিলকে, এলিয়ট, ফকনার। কিংবা এখনও আবছাভাবে দেখতে পায়! আচমকা ঘুম ছিঁড়ে যাওয়া কোনও দুঃস্বপ্নে!

গাড়ি পার্ক স্ট্রিট পৌঁছে গেছে। পোলার বেয়ারে অপেক্ষা করছিল শশীকান্ত ভোহরা, জোড়া অফিসারের দর্শন পেয়ে সে একেবারে বিগলিত। হাত কচলাতে কচলাতে বলল, —আমার কী সৌভাগ্য, আমার কী সৌভাগ্য …! বলুন স্যার, কী দিয়ে শুরু করা যায়?

বারে ঢুকেই দেবীপ্রসাদ লাগামছাড়া। গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল, —দেশে অন্নজলের এখন ঘোর অনটন, ধরো হুইস্কি সোডা আর মুরগি মটন …।

—প্রথমে দু’পেগ করে হুইস্কিই বলে দিই স্যার?

—বলুন। আর এই সাহেবের জন্য মুরগি মটন। আঙুল বেঁকিয়ে প্রতীককে দেখাল দেবীপ্রসাদ, —ও ভক্তিরসের কাণ্ডারি, সোমরসে ওর রুচি নাই।

সাফারিস্যুট চড়ানো ভোহরা ঠিক বুঝল না কথাটা। বলল, —আপনি একদমই নেবেন না স্যার?

—বললাম তো, ও অন্য রসের সন্ধান পেয়েছে, এ রসে ওর নেশা হয় না।

চটপট হুইস্কি এসে গেল। সঙ্গে এলাহি খানা, প্রতীকের জন্য। তন্দুরি চিকেন, নান, শাহি কোর্মা, রেজালা …। প্রতীক ছুঁয়ে ধন্য করুক, শেষ না হলে পড়ে থাকবে। নেশাড়ুদের জন্য এসেছে চিপস পকোড়া কাবাব।

খেতে খেতে বার কাম রেস্তোরাঁটায় আলগা চোখ বুলিয়ে নিল প্রতীক। মৃদু আলো, মৃদু সুরভি, মৃদু সংগীত, চামচ কাঁটার মৃদু টুংটাং মদির করে রেখেছে জায়গাটাকে। ঠান্ডাটাই যা চড়া, তবে বেশ লাগছে। বেরিয়েই ফারনেসে পড়বে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। কেন যে এ বছরই শোওয়ার ঘরটা এসি করে নিল না! অন্তত রাত্রিটা তো আরামে কাটে।

টেবিলে ঘন ঘন পরিবেশিত হচ্ছে পানীয়, দ্যাখ না দ্যাখ উড়ে যাচ্ছে পেগের পর পেগ। দেবীপ্রসাদের নেশা চড়ছে ক্রমশ। পেগ ছয়েকের পর সে রীতিমতো বেসামাল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মুখ চলছে অনর্গল। নেশার ঘোরে বলে উঠল, —অ্যাই প্রতীক, এই ভোহরাকে চিনে রাখো। দিশ ভোহরা ইজ আ থিফ। গভর্নমেন্টের কত লাখ টাকা যে শালা ফাঁকি দিয়েছে … কী ভোহরা, ঠিক বলছি?

ঢুলুঢুলু চোখ ভোহরা বিনয়ে অবনত, —হ্যাঁ স্যার। ঠিক স্যার। তবে আমাকে একা দুষছেন কেন স্যার? গোটা দেশটাই তো চোর বনে গেছে।

—ইয়েস। চোর। আর খচ্চোর। দেবীপ্রসাদ ঢক করে আর একটু তরল ঢালল গলায়, —তবু আমরা বলব … কী বলব?

—কী বলব স্যার?

—মেরা দেশ মহান। উই হ্যাভ মেড হার সো। হ্যাঁ, আমরাই দেশটাকে বানিয়েছি। বলেই হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে দেবীপ্রসাদ, —এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি …

আশপাশের টেবিল থেকে ঘুরে ঘুরে দেখছে লোকজন। বেশির ভাগই মাতাল। দেবীপ্রসাদ তাদের ধমকে উঠল, —দেখছেন কী মশাই? ধরুন আমার সঙ্গে। জানেন না, প্যাট্রিয়টিক সং কোরাসে গাইতে হয়?

কী কাণ্ড, সত্যি সত্যি দু’-চারজন গলা মিলিয়েছে! মধুশালা গমগম করে উঠল আর-এক সমবেত সংগীতে, —এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন, এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন …

এক ফোঁটা পান না করে মদ্যপায়ীদের সঙ্গে বসে থাকা বড় কঠিন। প্রতীক ঘড়ি দেখছিল। বলল, —আমি তা হলে উঠি দাদা?

—কেন আমাদের ভজনা তোমার ভাল লাগছে না? মন্দিরের খোলকরতাল টানছে বুঝি? সেখানে গিয়ে গলা মেলাবে?

—নাহ্, আজ সোজা বাড়ি।

—যাও, ঘরে ফেরো। আমি তো এখন আমার কমরেডদের ছেড়ে উঠতে পারব না ভাই। … তোমার বউকে বোলো, ডিপিদা জোর করে নিয়ে গেছিল, তা হলে সে কিচ্ছুটি বলবে না।

—আরে না, সে এমনিতেও কিছু বলে না। এক-আধদিন তো দেরি হতেই পারে। অনন্যা জানে।

—অনন্যা বড় লক্ষ্মী মেয়ে। ভারী পয়মন্ত। যোগ্য সহধর্মিণী। অনন্যা তোমার জীবন আলো করে থাকবে …

নেশার ঝোঁকে গলা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে দেবীপ্রসাদের। প্রতীক টুক করে বেরিয়ে পড়ল। ডিপিদার শেষ কথাগুলো বাজছে কানে। জীবন আলো করে থাকবে বলেই না তুতুলকে ঘরে এনেছে প্রতীক। বরযাত্রী হয়ে মাসতুতো দাদার বিয়েতে গিয়ে যেদিন প্রথম দেখেছিল তুতুলকে, সেদিনই তার মনে হয়েছিল এ মেয়ে শুধু তার। তার জন্যই তৈরি হয়েছে। মানিকদার শাশুড়ির মাধ্যমে দিদি প্রস্তাব পাঠাল তুতুলদের বাড়িতে, তুতুলের বাবা-মা রাজি হয়ে গেল, তুতুলও এক দেখায় পছন্দ করে ফেলল প্রতীককে। গোটা ঘটনাটাই কি বিধিনির্দিষ্ট নয়? তুতুল হাসলে প্রতীকের বুকে জলতরঙ্গ বেজে ওঠে, তুতুলের মুখে ছায়া ঘনালে কেঁপে ওঠে পায়ের তলার মাটি …

আজ বাড়ি গিয়ে তুতুলের কোন মুখটা দেখবে? খুশি খুশি? মলিন? নাকি উদাসিনী?

বাড়ি ফিরে অবশ্য কোনওটাই মিলল না। খুশি অভিমান কিছুই নেই তুতুলের মুখে, সে চোখ বড় বড় করে গিলছে হিন্দি সিরিয়াল। কার্পেটে চম্পা, টিভির পরদায় দৃষ্টি গেঁথে সে দুধরুটির মণ্ড গেলাচ্ছে রুপাইকে।

তুতুলের ধ্যান ভঙ্গ করল না প্রতীক। রুপাই দৌড়ে এসেছিল কাছে, তার মাথায় আলগা হাত বুলিয়ে ঢুকে গেছে ঘরে। জামাকাপড় ছাড়ল, স্নান সারল, শুদ্ধ বসনে ধূপ জ্বালল ঠাকুরের সামনে। শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে ছোট্ট একটা রুপোর সিংহাসন টাঙানো আছে, সেখানে শোভা পাচ্ছে মা কালীর বাঁধানো ছবি। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করল ছবিটাকে। নিত্যকর্ম সমাধা করে তুতুলের পাশে এসে বসেছে।

জিজ্ঞেস করল, —কী সিরিয়াল দেখছ মন দিয়ে?

ঘাড় না ঘুরিয়ে তুতুল বলল, —দিল কি আরমান।

—খুব জমাটি বুঝি?

—মোটামুটি। শুরুটা দারুণ ছিল। মেগা তো, টানতে টানতে একেবারে গেঁজিয়ে দিচ্ছে।

—ও।

প্রতীকও পরদায় চোখ রাখল। একটা বয়স্ক লোক আর এক তরুণ ঝগড়া করছে উচ্চৈঃস্বরে। বোধহয় বাপ ছেলে। এত ভাসা ভাসা ডায়ালগ, কী নিয়ে দ্বন্দ্ব বোঝা যাচ্ছে না। তবে দু’জনে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে যাচ্ছে বারবার। এইসব রাবিশ দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছে সিরিয়ালঅলারা, ভাবা যায়! বিনোদনের নামে এ’ও তো চুরি, নয় কি?

পরদার বাপ ঝাং করে তর্জনী তুলে শাসাল ছেলেকে। শাসিয়েই ফ্রিজ হয়ে গেল। ব্যস, আজকের মতো কহানি খতম।

তুতুল ঘুরে বসেছে। সহজ স্বরে বলল, —এহ্, খানিকটা আগে এলে না, বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত!

—কখন এসেছিলেন?

—কলেজফেরতা। সন্ধের মুখে মুখে।

—হঠাৎ?

—এমনিই। মনমেজাজ ভাল নেই, তাই রুপাইকে দেখে একটু মন ভাল করতে।

—মনমেজাজ খারাপ কেন?

—কেন আবার! মিতুল। হতচ্ছাড়ি সেই জেদ করে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে যাচ্ছে রোজ। … জানো তো, এখন আবার নতুন কথা শোনা যাচ্ছে।

—কী?

—স্কুলটার নাকি স্যাংশানই নেই।

প্রতীক বিশেষ একটা বিচলিত বোধ করল না। আলগাভাবে বলল, —তাই?

—কী আজব ব্যাপার বলো তো! স্কুলের নাম করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার বেরিয়ে গেল, টিচাররা জয়েন করে গেল …

—জয়েন করেছে বোলো না। ওটা নিয়েও কনট্রোভার্সি আছে।

—যাই হোক, ও মাটিকুমড়া গেছে তো। নিয়মিত স্কুলের প্রোপোজড সাইটে হাজিরা দেয় তো। স্কুলবাড়ি নেই সেই শকেই চোখে অন্ধকার দেখছে বেচারারা, তার ওপর যদি শোনে গভর্নমেন্টের রেকর্ডেও স্কুলটার কোনও অস্তিত্ব নেই, তখন কেমন লাগে? কী করে এমন হয়?

—গভর্নমেন্টে সব হয়। আস্ত পুকুর চুরি হয়ে যায়, ব্রিজ চুরি হয়, রাস্তা চুরি হয়, আর একটা স্কুল চুরি হতে পারে না? … স্কুলের অস্তিত্ব আছে। তবে এখন রৌপ্যমুদ্রার তলায় ঢাকা পড়ে আছে। গান্ধীজির ছবি নাচিয়ে ঢাকাটি সরাতে হবে। আই মিন নোট।

—কে টাকা দেবে? কাকে দেবে?

—গভর্নমেন্ট তো কোনও ইন্যানিমেট অবজেক্ট নয়। কখনও তিনি রাজকর্মচারী রূপে উদ্ভাসিত হন, কখনও নেতার বেশে। তোমার বোনের এখন প্রথম কাজ হওয়া উচিত সেই আসল লোকটিকে খুঁজে বের করা। তার হাতের তালু গরম হলেই স্কুলটা ভুস করে জেগে উঠবে।

তুতুল ফ্যালফ্যাল তাকাল। কথাগুলো যেন বেরিয়ে গেল তার মাথার ওপর দিয়ে।

রুপাইয়ের আহার শেষ। মুখ ধুয়ে এসেই ঢাউস খেলনাগাড়িটা নিয়ে মেতেছে ছেলে। ফ্ল্যাটে জায়গা কম, তার মধ্যেই এঁকেবেঁকে চালাচ্ছে গাড়িখানা। চেঁচাচ্ছে মুহুর্মুহু, —ছামনেবালা হাথো, ছামনেবালা হাথো …

ছেলেকে দেখতে দেখতে প্রতীক হঠাৎ নিচু গলায় বলল, — ভাবছি সত্যিকারের একটা গাড়ি কিনব।

মিতুল চমকে তাকিয়েছে। পলকে উজ্জ্বল তার মুখচোখ। অস্ফুটে বলল, —যাহ্, তাই নাকি?

—ইয়েস। তবে কিছু প্রবলেম আছে। নিজের নামে কেনা যাবে না।

—কেন?

—ফ্ল্যাটটা রয়েছে না! অফিশিয়ালি চার লাখ দেখিয়েছিলাম। কিন্তু আদতে এখানে যে সাড়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের এই কোয়ালিটির ফ্ল্যাট ওই দামে মেলে না, তা শিশুও বোঝে। এরপর এক্ষুনি আবার একটা তিন লাখ টাকার অ্যাসেট বানালে …

—তাহলে কার নামে কিনবে? আমার নামে?

—তোমার টাকারই বা সোর্স কোথায়? তোমার টাকা মানে তো আমারই টাকা।

—তাহলে? হবে না কেন?

—আরে বাবা, মুশকিল থাকলে তার আসানও থাকে। ঠান্ডা মাথায় শোনো। প্রতীক একটু থেমে রইল। তারপর বলল, তোমায় একটা কাজ করতে হবে। তোমায় আমি ক্যাশ দু’লাখ দেব, তুমি দিয়ে আসবে তোমার বাবাকে। উনি নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করে আবার ওই টাকাটা তোমার নামে চেক কেটে দিয়ে দেবেন। অ্যাজ ইফ উনিই মেয়েকে গাড়ি গিফট করছেন। গাড়ির বাকি দাম আমি ম্যানেজ করে নেব।

—কিন্তু বাবা …? বাবা টাকাটা কী করে দেখাবে? কোত্থেকে পেল বলবে?

—আরে দূর, ওঁদের অত বলতে টলতে হয় না। তা ছাড়া উনি প্রবীণ মানুষ, আজ বাদে কাল রিটায়ার করবেন … ওঁর দু’লাখ টাকার সোর্স নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাবে না।

—কিন্তু আমি কী করে বাবাকে …?

কথা শেষ হল না, ঘাড়ের কাছে ছায়া, —কখন এলি রে পল্টু? টের পেলাম না তো? বেল মেরেছিলি?

—নয় তো কি এমনি এমনি খুলে গেছে? প্রতীক ভয়ানক রেগে গেল। খেঁকিয়ে উঠল, কাজের কথা বলছি, এর মধ্যে এসে ভ্যাজরং ভ্যাজরং কোরো না তো। যাও, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো গিয়ে।

শেফালির মুখ শুকিয়ে আমসি৷ তিয়াত্তর বছরের শরীরখানা টেনে টেনে ফের ফিরে যাচ্ছে ঘরে।

প্রতীক ঘুরে তাকালই না। এখন তো বাইরের লোক নেই, অনর্থক সে মুখোশ পরে থাকবে কেন!

.

॥ ছয় ॥

অনেকক্ষণ ধরে জেলা পরিদর্শকের সঙ্গে রেখা সেনগুপ্তর কথা চালাচালি শুনছিল মিতুল। রেখাদি নরম করে বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছে, ভদ্রলোকও মোলায়েম সুরে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত কোনও আশার আলো দেখা গেল না।

কাঁহাতক চুপ থাকা যায়? অধৈর্য হয়ে মিতুল বলল, —এ কী বলছেন স্যার? স্কুল সার্ভিস কমিশনের অর্ডারে আমরা কাজে যোগ দিয়েছি, আপনাদের পরামর্শ মতো রেগুলার চাকরির জায়গায় গিয়ে হাজিরা দিচ্ছি। একদিন দু’দিন নয়, টানা পাঁচ সপ্তাহ। তারপরও আমরা মাইনে পাব না কেন?

বছর পঁয়তাল্লিশের সৌম্যদর্শন জেলা পরিদর্শক চোখ ঘুরিয়ে দেখল মিতুলকে। মুখের হাসিটাকে আরও অসহায় করে বলল, —সবই তো বুঝছি। কিন্তু আমি কী করতে পারি বলুন? স্যালারি ডিসবার্স করার তো একটা প্রসেডিয়োর আছে। স্কুল প্রপার ফর্মে মাইনের বিল পাঠাবে, প্রতিটি স্কুলের নামে স্যালারি হেডে ফান্ড অ্যালট করা থাকে, সেই ফান্ড থেকে বিল অনুযায়ী চেক ইস্যু হয় …

রেখা বলল, —বিল তো আমি সাবমিট করেছি। বিলে কি কোনও ভুল আছে?

—ভুলভ্রান্তির কথা উঠছে না ম্যাডাম। ও বিলে হবে না। আপনাদের স্কুলটাই যে গভর্নমেন্ট রেকর্ডে নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত। আর যেহেতু স্কুলের কোনও অ্যাপ্রুভাল নেই, আপনাদের জন্য কোনও ফান্ডও অ্যালটেড হয়নি। তা হলে আমি টাকাটা দেব কোত্থেকে?

—কিন্তু শিক্ষা দপ্তর তো বলছে অ্যাপ্রুভাল ছিল। এতক্ষণে রেখাও কিঞ্চিৎ উত্তেজিত, —তারা তো সাফ জানিয়ে দিল, আমরা কি পাগল, স্যাংশান না হওয়া স্কুলের জন্য টিচার চেয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনে কি চিঠি পাঠাতে পারি!

—তা সেখান থেকে আপনারা অ্যাপ্রুভালের একটা কপি বার করে আনতে পারলেন না?

—তারা তো আপনাদের দেখিয়ে দিল। বলল, ডিস্ট্রিক্ট অফিসে খোঁজ করুন, ওখানে সব আছে।

জেলা পরিদর্শক টুকুন নীরব। মুখের হাসিটি মুছেছে। কাল্পনিক পেপারওয়েট ঘোরানোর ভঙ্গিতে আঙুল ঘোরাচ্ছে টেবিলে। দৃষ্টি টেবিলে স্থির রেখে নীরস স্বরে বলল, —দেখুন, কারেন্ট কেস তো নয়, রেকর্ড থাকলেও খুঁজে বার করতে একটু টাইম লাগবে।

মিতুল ক্ষুব্ধ গলায় বলল,—লাস্ট উইকেও কিন্তু আপনি একই কথা বলেছিলেন স্যার।

—হয়তো নেক্সট উইকেও একই কথা বলব। আমার তো কিছু করার নেই। গভর্নমেন্ট অফিসের হাল তো বোঝেন। জানেনই তো, স্টাফদের দিয়ে কাজ করানো কী কঠিন। বেশি প্রেশার করতে গেলেই ইউনিয়ান হাঁ হাঁ করে ছুটে আসবে। তা ছাড়া মাসের এই সময়টায় সত্যিই কাজের চাপ থাকে, এক্ষুনি এক্ষুনি পুরনো রেকর্ড ঘাঁটার কথা আমি বলতেও পারব না।

—তার মানে আমাদের মাইনের ব্যাপারটা অনির্দিষ্ট কাল ঝুলে রইল?

—কান্ট হেল্প। হাত উলটে দিল জেলা পরিদর্শক। গলা ঈষৎ নামিয়ে বলল, —একটা সাজেশান দেব? আপনারা অফিসস্টাফদের সরাসরি রিকোয়েস্ট করে দেখুন না… যদি তাদের ম্যানেজ ট্যানেজ করে…

বলেই মুখে একটা গাম্ভীর্যের পরদা টেনে দিয়েছে ভদ্রলোক। ফাইল খুলল একখানা। পরিষ্কার ইঙ্গিত, এবার তোমরা এসো।

ডি.-আই-এর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রেখা বলল,—এবার?

মিতুল ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,—চলুন, বড়বাবুর কাছে ধরনা দিই। একটু অয়েল টয়েল মারি।

বড়বাবু যেখানে বসে, সেখানে খান আষ্টেক চেয়ার-টেবিল। পাঁচটায় মানুষ আছে, বাকি তিনটে ফাঁকা। প্রতিটি টেবিলেই ফাইলের স্তূপ। ফাইল এ ঘরের সর্বাঙ্গে। আলমারির মাথায়, কাঠের র‍্যাকে…। কিছু পরিত্যক্ত ফাইল ধুলো মেখে ডাঁই হয়ে আছে মেঝেতেও। ঘরের কোণে ইলেকট্রিক হিটার, চা বানানোর সরঞ্জাম। জনৈক মহিলা কর্মচারী কেটলি বসিয়েছে হিটারে, জল ফুটছে বগবগ।

উলটো কোণে বড়বাবুর টেবিল, সবুজ রেক্সিনে মোড়া। পায়ে পায়ে বড়বাবুর সামনে এল মিতুলরা। বড়বাবুর মুখে যথারীতি সন্তসুলভ নির্বিকল্প ভাব, ঘাড় হেঁট নোটশিটে। চোখ তুলে মিতুলদের দেখল একঝলক, ফের দৃষ্টি ফাইলে।

ঠোঁটে একটা মধুর হাসি টেনে মিতুল বলল,—স্যার, একটু শুনবেন?

স্যার সম্বোধন আর হাসি দুটোই মাঠে মারা গেল। বড়বাবুর কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

মিতুল গলা আরও তুলতুলে করল,—স্যার, আমাদের স্কুলের অ্যাপ্রুভালটা… যদি ওটা পাওয়া যেত…

চশমার ফাঁক দিয়ে অক্ষিযুগল উত্থিত হয়েছে এতক্ষণে।—আমার পকেটে তো নেই।

থাকার তো কথাও নয়। বলতে গিয়েও মিতুল সামলে নিল। গলা নরম রেখেই বলল,—ডি-আই সাহেব বলছিলেন রেকর্ড খুঁজে চিঠিটা বার করতে হবে, তাই…

—সেই মাটিকুমড়া গার্লস স্কুলের কেস? পাশের টেবিলের বছর চল্লিশেকের ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্টটি নাক বাড়িয়ে দিয়েছে,—তা ডি-আইকেই বলুন না, এসে খুঁজে দিয়ে যাক।

কী অসভ্য বাচনভঙ্গি! মিতুল দপ করে জ্বলে উঠছিল, কোনওক্রমে সংযত করল নিজেকে,—বুঝতেই তো পারছেন আমরা কী হেল্পলেস সিচুয়েশানে পড়েছি। স্কুল নেই, মাইনে নেই…

—ধরে নিন চাকরিটাও নেই।

—ধরতে তো পারছি না। চেষ্টা করেও এবার আর ঝাঁঝটাকে চেপে রাখতে পারল না মিতুল,—স্কুল সার্ভিস কমিশনের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে যে।

—ওটাকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখুন। সকাল-সন্ধে ধূপধুনো দেবেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাটা বলে সামনের টেবিলের মধ্যবয়সি মহিলাকে সালিশি মানল লোকটা, —দেখেছেন তো ভারতীদি, স্কুলে ছাত্রী নেই, পড়ানোর কোনও বালাই নেই, শুধু মাইনের ধান্দা!

চা বানানোর মতো জটিল সরকারি কাজে ব্যস্ত অন্য মহিলাটি ফস করে প্রশ্ন ছুড়ল,—আজ যে এখানে এসেছেন, সি-এল নিয়ে এসেছেন?

মিতুল আর থাকতে পারল না, ফেটে পড়েছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, —শুনুন, সি-এল নেব, কি ই-এল নেব, কি পি-এল নেব, তা আপনাদের দেখার বিষয় নয়। আপনারা দয়া করে আপনাদের কাজটুকু করুন।

লোকটা রুক্ষভাবে বলল,—মেজাজ দেখাবেন না, এটা সরকারি অফিস। আমরা আমাদের ডিউটি জানি।

—সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আড়াই বছর আগে স্কুলের স্যাংশান এসেছে, আর আপনারা সেটাকে গাপ করে বসে আছেন।

—মুখ সামলে। মুখ সামলে। ভাষা ঠিক করুন।

—ভাষা আপনার কাছে শিখব?

—স্ক্রু টাইট দিলেই শিখবেন। গলে ন্যাতা হয়ে যাবেন।

মিতুল প্রত্যুত্তরে আরও কড়া কথা শোনাতে যাচ্ছিল, রেখা তাকে প্রায় জোর করে টেনে বাইরে নিয়ে এল। ধমকে উঠেছে, —মিছিমিছি ঝগড়া করতে গেলে কেন? দিলে তো সব গুবলেট করে!

—কী পিত্তি জ্বালানো কমেন্টগুলো করছিল শোনেননি?

—বলুক। বলুক না খুশি। গায়ে না মাখলেই হল।

মিতুল কী করবে, মিতুলের গায়ের চামড়া এখনও অত মোটা হয়নি যে। একটা অক্ষম অসহায় ক্ষোভে ছটফট করছে মিতুল। এই মানুষগুলো সব কী ধাতু দিয়ে গড়া? যারা সামান্য একটু সহায়তা পাওয়ার আশায় এদের কাছে ছুটে আসে, তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই? তাদের সুবিধে অসুবিবে বিপদ আপদ পরিশ্রম সময় সবই কি এদের চোখে নিতান্তই মূল্যহীন? অকারণে মিতুলদের মতো সাধারণ মানুষদের অপমান করে কী সুখ পায় এরা? কেন মানুষগুলো এমন হৃদয়হীন? এরাও তো প্রত্যেকেই কারুর না কারুর বাবা মা ভাই বোন মামা কাকা মাসি পিসি…ঘরেও কি এরা এরকম? নাকি দুটো চেহারা? অফিসের চেয়ারে বসলেই মানবিক অনুভূতিগুলো লোপ পায়! রাষ্ট্রযন্ত্রের অতি সামান্য নাটবল্টু হয়ে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, যন্ত্রটা চালানোর অধিকার পেলে কী ভয়ংকর চেহারা যে হবে তাদের!

রাস্তায় এসেও ঘুরে ঘুরে জেলা অফিসটাকে দেখছিল মিতুল। রাগ রাগ চোখে। দেওয়ালময় পোস্টার আর স্লোগান। ঢং করে লিখেছে, কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে হবে! এই যদি তার নমুনা হয়, জাহান্নম আর কদ্দূর? ইস, মিতুল যে কেন আরও চারটে কথা শুনিয়ে দিয়ে আসতে পারল না! ডিনামাইট দিয়ে যদি উড়িয়ে দেওয়া যেত বাড়িটাকে!

ভেতরের জ্বালাটা অভিমান হয়ে ফুটে বেরোল। হাঁটতে হাঁটতে মিতুল গুমগুমে গলায় বলল,—একটা কথা বলব রেখাদি? কিছু মনে করবেন না?

—কী?

—আপনি বললেন গায়ে না মাখাই ভাল। কিন্তু একদম চুপ থাকাটাও কি উচিত কাজ?

—কোনও কোনও ক্ষেত্রে চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ সুকন্যা। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই রেখা ভারী শরীর নিয়ে হাঁটতে গিয়ে হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। দাঁড়িয়ে পড়ে আঁচলে চশমার কাচ মুছল। ফের চশমাটা পরে নিয়ে বলল,—আমি ইচ্ছে করলে আরও অপ্রিয় কথা বলতে পারতাম। আমি তো ওদের অ্যাটিচিউডটা জানি। ওরা নানান উপায়ে ব্যাপারটাকে ডিলে করার চেষ্টা করছে।

—জানেনই যদি, একটা কথাও কেন বললেন না?

—শোনো সুকন্যা, আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। আমি মনে করি, প্রতিপক্ষের মোকাবিলা অনেক ট্যাক্টফুলি করতে হয়। ওদের চটিয়ে দিয়ে আমাদের কার্যসিদ্ধি হবে না।

—সে তো তেল মেরেও হচ্ছে না রেখাদি।

—ওদের আসল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছ না? স্যাংশান লেটার ওরা বার করে দিচ্ছে না কেন?

—স্রেফ বদমাইসি। অন্যকে যাঁতা দিয়ে ওরা এক ধরনের সুখ পায়।

—শুধু কি তাই? অন্য কারণও আছে। জানো তো, আগে স্কুলে চাকরি পেতে গেলে স্কুলকমিটিকে একলাখ-দেড়লাখ করে দিতে হত। প্রায় নিলাম হত মাস্টারির পোস্ট। যে মূল্য বেশি ধরে দেবে, চাকরি তার।

—যাহ্, অত টাকা?

—যা নয়, হ্যাঁ। সার্ভিস কমিশন হওয়ার পর ছবিটা একটু হয়তো বদলেছে। কোথাও কোনও টাকাপয়সার লেনদেন হয় না তা নয়, তবে লুকিয়ে চুরিয়ে। এই অফিসের লোকরাও হয়তো ভাবছে ফাঁকতালে যদি কিছু আসে…কেন ওরা পুরোপুরি বঞ্চিত হবে! নিউ সেটআপ স্কুল তো, ওরা ভালমতোই জানে আমরা ওদের ওপর কতটা নির্ভর করে আছি। দেখছ তো চারদিকের অবস্থা, যার যেটুকু ক্ষমতা আছে সেটুকু তো তারা ব্যবহার করবেই। আনডিউলি।

—কিন্তু..। মিতুল হালকা প্রতিবাদ করল,—ওরা তো আভাসে ইঙ্গিতেও টাকার কথা কিছু বলছে না?

—হয়তো আমি আছি বলেই ওরা ঠেকে গেছে। ভাবছে দুম করে বলে দিয়ে কোনও বিপদে না পড়ে যায়।

—মানে… আপনার হাজব্যান্ড এম-এল-এ বলে…?

—ঠিক তাই। উনি পুরনো এম-এল-এ। এ অঞ্চলের যথেষ্ট পরিচিত মানুষ। এবং সেখানেই হয়েছে মুশকিল।

—ওভাবে যে অপমান করল, তার জন্য ভয় নেই?

—বলবে, তুমি প্রোভোক করেছিলে। আর এই কারণেই তো বলছি ওদের ঘাঁটিয়ো না। অ্যাভয়েড করে চলো। যতটা সম্ভব। কে জানে, ডি-আইকে ধরে করে যতটা এগিয়েছিলাম ততটাই হয়তো পিছিয়ে গেলাম।

মিতুল একটুক্ষণ গুম। তারপর বলল,—একটা কথা কিন্তু মাথায় ঢুকছে না রেখাদি। ক্ষমতা তো আপনারও আছে, আপনি সেটা ইউটিলাইজ করছেন না কেন?

—ক্ষমতা? আমার?

—নেই? আপনার হাজব্যান্ড চাইলেই তো প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারেন।

রেখা জবাব দিল না। নিশ্চুপ হাঁটছে। নবীন ভাদ্রের চড়া রোদে ঘামছে খুব, রমাল থুপে থুপে মুছল ঘাড় গলা।

মিতুল একটা বড়সড় শ্বাস ফেলল, —বুঝলাম।

ঘুরে তাকাল রেখা, —কী বুঝলে?

—স্কুল হওয়ার কোনও চান্স নেই। আপনি আর দু’-এক মাস দেখে আগের স্কুলে ফিরে যাবেন, আর আমরা পড়েই থাকব ত্রিশঙ্কু দশায়।

—না সুকন্যা। তুমি ঠিক ভাবছ না। মিতুলের পিঠে হাত রাখল রেখা। শুকনো হেসে বলল,—ক’দিন আগেও ফেরার চিন্তাটা মাথায় ছিল। এখন পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলেছি। এখন আমারও রোখ চেপে গেছে। মাটিকুমড়ায় স্কুল নিয়ে কত ধরনের রাজনীতি চলছে, তা তো তুমি জানো। ওই দলাদলির মাঝেও স্কুলটা চালু করা আমার কাছে এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

—সঙ্গে আপনার হাজব্যান্ডকেও একটু ইন্টারফিয়ার করতে বলুন না। তা হলে তো কাজটা সহজ হয়ে যায়।

—সহজ পথটা বেছে নেওয়াই কি সবসময়ে শ্রেয়? দ্যাখো সুকন্যা, আমার স্বামী পলিটিশিয়ান, আমি নই। তাঁকে জড়ানো মানে আবার সেই রাজনীতির গর্তে ঢোকা। আমি তা চাই না।

চার মাথার মোড়ে এসে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াল রেখা। বাস লরি আর রিকশার দাপটে তটস্থ হয়ে আছে জায়গাটা। ধোঁয়ায় ধুলোয় নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে। রেখা একটু ছায়ায় সরে এল৷ বিষণ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল,—কথাগুলো শুনতে খুব অবাক লাগছে, তাই না?

মিতুল চুপ। দেখছে রেখাকে।

রেখা ফের বলল,—আমার আগের স্কুলের চাকরিটা পাওয়ার পেছনে আমার হাজব্যান্ডের যৎকিঞ্চিৎ হাত ছিল। তখন তিনি এম-এল-এ না হলেও বড়সড় পাবলিক ফিগার ছিলেন। চিরটাকাল ওঁর মুখে শুনে আসছি, আমার দৌলতেই তরে গেলে, দিব্যি একটা আয়েসি চাকরি জুটে গেল বাড়ির দরজায়…! ঠাট্টা করেই বলেন, কিন্তু আজকাল কেমন বেঁধে। সত্যিই তো, ওই স্কুলে আমি যতটা না রেখা সেনগুপ্ত, তার চেয়ে বেশি বিজয় সেনগুপ্তের বউ। হেডমিস্ট্রেস পর্যন্ত আমায় তোয়াজ করে চলেন। এ আমার আর ভাল লাগছে না। কতদিন একটা মানুষের ছায়া হয়ে থাকব বলো তো? বিশ্বাস করো, মাটিকুমড়ার চাকরিটা আমি সম্পূর্ণ নিজের জোরে পেয়েছি। ইন্টারভিউ বোর্ডের কেউ আমার স্বামীর কথা জানত না। বাড়ি থেকে মাটিকুমড়া অনেকটাই দূরে, এজন্য আমার স্বামীর প্রথম দিন থেকেই ঘোরতর আপত্তি। তবু আমি জয়েন করেছি। এই বয়সে পৌঁছে দেখতে চাই আমি নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে পারি কিনা।

একসঙ্গে এতগুলো কথা কখনও রেখার মুখে শোনেনি মিতুল। প্রৌঢ়ত্বের দিকে হেলে পড়া এই সাদামাটা চেহারার মহিলার মনে এত ক্ষোভ জমে আছে? ক্ষোভ তা হলে শুধু ভাঙতেই শেখায় না, কখনও কখনও গড়তেও শেখায়?

বাসে উঠে রসুলপুর চলে গেল রেখা। মিতুল রিকশা নিয়েছে। বাসে বড় ক্লান্তি আসে, জেলা অফিসে এলে ট্রেনেই ফেরে।

স্টেশনে পৌঁছে টিকিট কাটছিল মিতুল। কাউন্টারে লম্বা লাইন, এগোচ্ছে শম্বুক গতিতে।

হঠাৎই মিতুলের চোখ লাইনের মাথায়। অতনুদা না?

.

॥ সাত ॥

শেয়ালদার টিকিটখানা কেটে পার্সে রাখছিল অতনু। সেই সঙ্গে মানিব্যাগের স্বাস্থ্যটাও দেখে নিল একবার। বাড়ি ঢোকার আগে বড়সড় একটা ক্যাডবেরি কিনতে হবে। ভাইঝিটার আজ জন্মদিন, কিছু তো অন্তত হাতে করে নিয়ে যাওয়া উচিত। আশি-পঁচাশি টাকা মতন আছে, কুলিয়ে যাবে মনে হয়।

নিশ্চিন্ত অতনু পার্স পকেটে গুঁজে পায়ের কাছে নামিয়ে রাখা ব্রিফকেস হাতে তুলে নিল। তক্ষুনি ধক করে উঠেছে। বুকটা। টিকিটের লাইনে ও কে?

ভুল ভাঙতে এক সেকেন্ডের লক্ষ ভগ্নাংশ সময়ও লাগল না। তুতুল কোথায়, এ তো মিতুল! আশ্চর্য, তুতুলের সঙ্গে কোনও মিল নেই মিতুলের, না মুখশ্রীতে, না গায়ের রঙে, না দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায়। তুতুলের চেয়ে মিতুল লম্বাও। তবু কেন এই বিভ্রম? দু’বোনে কোথাও একটা আবছা সাদৃশ্য আছে কি?

একটু যেন আড়ষ্ট বোধ করছিল অতনু, মিতুলের চোখে চোখ পড়ে যেতে এগিয়ে গেল। মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল,—তুমি এখানে?

মিতুলের ঠোঁটেও চিলতে হাসি,—পেটের ধান্দায়। তুমি?

—সেম কেস। দানাপানির আশায় চরে বেড়াচ্ছি।

—মুখচোখ তো একেবারে কালি মেরে গেছে! খুব রোদ্দুরে ঘুরেছ বুঝি?

প্রশ্নটা ঠং করে কানে বাজল অতনুর। তুতুলের সঙ্গে না হোক দুশো বার দেখা হয়েছে, তুতুল ঠিক এ ধরনের প্রশ্ন কোনওদিন করেনি। এসেই বলত, এই বলো না, আজ আমায় কেমন দেখাচ্ছে!

নিজের ভাবনায় নিজেই বিব্রত অতনু। অদ্ভুত, তুতুলের সঙ্গে কেন তুলনা করছে মিতুলের?

চোরা অস্বচ্ছন্দ ভাবটা কাটানোর জন্য অতনু কাঁধ ঝাঁকাল,—আর বোলো না, সেই কোন ভোরে বেরিয়েছি। ছুটেছিলাম নতুনহাট, স্টকিস্টকে মিট করতে। সেখান থেকে এসে এখানেও দু’জন ডিলারের সঙ্গে বসতে হল। খেচাখেচি, দর কষাকষি, পেমেন্টের তাগাদা…শরীর যে এখনও খাড়া আছে এই না ঢের।

কথায় কথায় কাউন্টারে পৌঁছে গেছে মিতুল। টিকিট কেটে সরে এল লাইন থেকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,—একটু চা খাওয়া যায় না?

—বাইরে খাবে? না ভেতরে গিয়ে?

—প্ল্যাটফর্মেই চলে। কখন আবার ট্রেন এসে যায়।

মিতুল আজ শাড়ি পরেছে। চওড়া পাড় সাদা তাঁতের শাড়ি। শ্যামলা রং ছিপছিপে মেয়েটাকে শাড়িটা মানিয়েছেও বেশ। ভারী স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। তুতুল সাদা রং পরত না। সে ভালবাসত নীল। সাগরনীল, আকাশনীল, তুঁতেনীল, ময়ূরনীল…। লালও পরত খুব।

ধ্যাৎ, আবার উলটোপালটা ভাবনা? এখনও এত তুতুল তুতুল কেন? নাকি মিতুলকে দেখে সেদিনের মতো তুতুলের শোক উথলে উঠছে? অতনু শাসন করল নিজেকে। আজ মিতুলের সামনে একদম তুতুলের প্রসঙ্গ নয়। আগের দিন তুতুলের কথা ওঠায় মিতুল বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছিল।

চায়ের স্টলে এসে দু’-ভাঁড় চা নিল অতনু। মিতুলকে ভাঁড় এগিয়ে দিয়ে বলল, —কিছু খাবে?

—কী খাওয়া যায়?

—কেক নেব?

—ন্‌ন্‌না। ওই লম্বা লম্বা বিস্কুটটা নাও। নোনতা।

নিজেও বিস্কুট নিল অতনু। কামড় দিয়ে বলল,—তুমি এখানে কোথায় চাকরি করছ?

—এমা, আমি তো বলিনি এখানে চাকরি করছি! মিতুল ফিক করে হাসল, —আমি তো বললাম পেটের ধান্দায় এসেছি।

—বুঝলাম না।

—সহজে বোঝাও যাবে না। জটিল ধাঁধাঁ।

—কী রকম?

—আমি চাকরি করছি এমন এক প্রতিষ্ঠানে যার কোনও অস্তিত্ব নেই। এবং যেখানে কোনও মাইনে পাওয়া যায় না। কী বুঝলে?

অতনু দু’-দিকে মাথা নাড়ল।

—তোমায় বলতে পারি, তবে…। মিতুলের চোখে একটা চঞ্চল হাসি খেলা করছে, —না বাবা, তোমায় বলব না। তুমি এক্ষুনি গিয়ে তোমাদের ডিরেক্টারকে গল্প করবে, আর সঙ্গে সঙ্গে আমি হয়ে যাব তোমাদের নেক্সট নাটকের প্লট। ওটি হচ্ছে না।

অতনু চোখ সরু করল,—রহস্যময় চাকরি মনে হচ্ছে?

—রহস্য বলা যাবে কি? বলতে পারো পরাবাস্তব। না না, ওই যে কী বলে আজকাল… জাদুবাস্তব। পরা জাদু সবকিছুর মিশেল আছে আমার চাকরিতে। যদি কথা দাও তোমার ডিরেক্টারকে গল্পটা করবে না, তা হলে শোনাতে পারি।

—নিশ্চিন্তে বলতে পারো। আমরা নতুন যে প্রোডাকশানটা নামাচ্ছি, তার ঠেলা সামলাতে আমাদের ডিরেক্টারের কালঘাম ছুটছে। এখন নতন গল্প শোনাতে গেলে মারতে আসবে।

—উউম্? চা শেষ করে টিনের ড্রামে ভাঁড় ফেলল মিতুল। মুচকি হেসে বলল, —কোত্থেকে শুরু করব? ফ্রম আদি পর্ব?

অতনু আঁতকে ওঠার ভান করল,—সর্বনাশ, মহাভারত নাকি?

—প্রায়। তুমি বামুনঘাটার নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?

—বলে যাও, বলে যাও…। বামুনঘাটায় আমাদের ডিলার আছে। উদয় দেবনাথ। মাসে একবার আমায় ওখানে ঢুঁ মারতে হয়।

—বামুনঘাটা থেকে ফিউ কিলোমিটারস অ্যাওয়ে এই মহাভারতের হস্তিনাপুর। কিংবা ইন্দ্রপ্রস্থ। লোকাল নাম অবশ্য মাটিকুমড়া। বছর পাঁচ-সাত আগে মাটিকুমড়া গ্রামের জনৈক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি শ্রী বিশ্বম্ভর দাস একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। তাঁরই ঠাকুরদার দান করা জমিতে। মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার জন্য তিনি যে বিশেষ ভাবিত ছিলেন তা নয়, তা হলে তো স্কুলটা অনেক আগেই তৈরি হয়ে যেত। কারণ জমিটা তো তাঁর ঠাকুরদা দিয়েছিলেন তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে। আসল কথা, বিশ্বম্ভর দাসের মনে হয়েছিল গার্লস স্কুলের হিড়িকটা তুললে ভোটের বাকসে সোনা ফলবে। সেই মতো তিনি একটি ম্যানেজিং কমিটি করে ফেললেন। দান করা জমি কমিটির তত্ত্বাবধানে চলে এল, এবং অবশ্যই তিনি নিজে হলেন কমিটির সেক্রেটারি। স্কুল হচ্ছে হচ্ছে ধুয়োতেই পঞ্চায়েত ইলেকশান পার হয়ে গেলেন বিশ্বম্ভর। অতীতে বিশ্বম্ভর ছিলেন দক্ষিণপন্থী। হাওয়া বুঝে অনেককাল আগেই ঘুরে গেছিলেন, এবার ভোট জিতলেন বামপন্থী টিকিটে। কিন্তু শুধু জিতে বিশ্বম্ভর তৃপ্ত নন, তখন তাঁর বাসনা জেগেছে পঞ্চায়েতপ্রধান হওয়ার। তবে মজা হল, ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে সেবার লেফ্ট রাইট টাই হয়ে গেছে। তখন যা হয়, শুরু হল দল ভাঙানোর খেলা। অতীতের দক্ষিণপন্থী গন্ধ থাকায় বামপন্থীরা তাকে কিছুতেই প্রধানের আসনটি দেবে না, এটা বোঝামাত্র বিশ্বম্ভর ডিগবাজি খেয়ে চলে গেলেন ডানদিকে।

মুগ্ধ চোখে মিতুলের কথা বলার ভঙ্গিটা দেখছিল অতনু। শুনছিল বর্ণনা। চমৎকার গুছিয়ে গল্প বলতে পারে মেয়েটা। মিতুলের সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটা মনে পড়ছিল অতনুর। তাদের গ্রুপের নাটক দেখতে এসেছিল দিদির সঙ্গে। শো-র পর গ্রিনরুমে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে অতনুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তুতুল। সংকোচহীন কুণ্ঠাহীন মিতুল ঝাড়া আধঘণ্টা লেকচার দিয়েছিল নাটকটা নিয়ে। সমালোচকদের মতো কায়দা মেরে নয়, সাধারণ দর্শক হিসেবে কেমন লেগেছে তাই বলছিল৷ তুতুল বারবার টানছিল বোনকে, এই চল, এত বকবক করার কী আছে! মিতুল শুনছিলই না।

আহ্, কেন যে আবার তুতুলের অনুষঙ্গ এসে যায়?

অতনু মন ফেরাল মিতুলের কাহিনীতে। মজা করা গলায় বলল,—বিশ্বম্ভর দাস তো ওস্তাদ লোক!

—শুধু ওস্তাদ নয়, চ্যাম্পিয়ান ওস্তাদ। মুখের সামনে বসিয়ে রেখে স্পিকটি নট হয়ে থাকে। সামনের লোকটার ওপর সাইকোলজিকাল প্রেশার তৈরি করে। সম্ভবত ওটাই ওর স্নায়ুযুদ্ধ লড়ার নেট প্র্যাকটিস। মিতুল থামল একটু,—হ্যাঁ, কী বলছিলাম যেন?

—ওই যে, বিশ্বম্ভর দাস ডানদিকে ফিরে গেল।

—হুঁ। এবং পঞ্চায়েতপ্রধানও হল।

—করল স্কুল?

—নামকাওয়াস্তে একটা স্টার্ট হল বটে। তবে ওই জমিতে নয়। মাটিকুমড়ার পাশে সোনাদিঘি গ্রাম, সেখানকার চম্পকলাল বিদ্যামন্দিরে। একটা ঘর নিয়ে। ওই ঘর দু’ভাগ করে চালু হল ফাইভ আর সিক্স। নাম দেওয়া হল মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়।

—সোনাদিঘিতে মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়?

—ওই যে বললাম তোমায়। জাদুবাস্তবতা। মিতুল চোখ নাচাল,—তা সেই বিদ্যালয়ে ছাত্রীও পাওয়া গেল কিছু। দেড়শো টাকা অ্যাডমিশান ফি, আর মাস মাস দশ টাকা মাইনে।

—অ্যাই, মেয়েদের স্কুলের এডুকেশান ফ্রি তো!

—সে যেসব স্কুল গভর্নমেন্টের টাকায় চলে, সেই সব স্কুলে। মাটিকুমড়া বিদ্যালয় তো তখনও সরকারি গ্র্যান্ট পায়নি। ইনফ্যাক্ট, গভর্নমেন্টের কাছে তখনও অ্যাফিলিয়েশানের আবেদনই করা হয়নি।… যাই হোক, দু’জন টিচার অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছিল স্কুলে। একজন বিশ্বম্ভরের মাধ্যমিক পাশ মেয়ে। অন্যজন বিশ্বম্ভরের বি-এ না-উতরোনো ভাইপো। ছাত্রীদের টাকা থেকেই তাদের মাইনে হত।

অতনুর চোখ গোল গোল, —বাহ, এ যে দেখি পারিবারিক বন্দোবস্ত!

—পাশে পাশে রাজনীতির খেলাও থেমে নেই। বছর দুয়েকের মাথায় বামেরা ডানদের দু’জন পঞ্চায়েত সদস্যকে পকেটে পুরে ফেলল। ব্যস, পঞ্চায়েত গেল উলটে। বিশ্বম্ভরেরও গদি গন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির অন্য মেম্বাররাও এতদিন তক্কে তক্কে ছিল। যেই বিশ্বম্ভরের গদিটি গেছে, ওমনি তাকে তারা সেক্রেটারির পদ থেকেও হটিয়ে দিল। বিশ্বম্ভরও ছাড়ার পাত্র নয়, সেও একটি মরণকামড় বসাল। পুরনো ম্যানেজিং কমিটির নাম দিয়েই স্কুল অ্যাপ্রুভ করার অ্যাপ্লিকেশান পাঠিয়ে দিল গভর্নমেন্টের কাছে। একই সঙ্গে একটা কেসও ঠুকে দিল নতুন ম্যানেজিং কমিটির নামে। কোর্টে দৌড়োদৌড়ি করে ইনজাংশানও বার করে ফেলল। স্কুলে ম্যানেজিং কমিটির জায়গায় বসল রিসিভার। তা রিসিভারের ভারী দায় পড়েছে স্কুল চালানোর, অচিরেই মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়ের সাঙ্গ হল ভবলীলা।

—আইব্বাস, এ তো যথেষ্ট প্যাঁচালো ব্যাপার। অতনু গাল চুলকোল, —কিন্তু এর সঙ্গে তোমার চাকরির কী সম্পর্ক?

—আমি এখন ওই মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়েরই দিদিমণি। অ্যাপয়েন্টেড বাই স্কুল সার্ভিস কমিশন।

—অ্যাঁ?

—হাঁ-টা বন্ধ করো, মাছি ঢুকে যাবে। মিতুল ফিকফিক হাসছে, —কী, এটা কোন বাস্তব? জাদু? না পরা?

প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছে। কথা বলতে বলতেই ছটফট করে উঠল মিতুল। বলল, —যাবে তো?

ভিড় ট্রেনে উঠতে ইচ্ছে করছিল না অতনুর। বলল, — দাঁড়াও না, একটু পরে তো এখান থেকেই লোকাল ছাড়বে…

—না গো, আমি যাই। বাড়িতে যা সব টেনশান পাবলিক আছে, আমি না-ফেরা পর্যন্ত তাদের নাকি বুক ধুকপুক করে। বলেই দৌড়েছে মিতুল। দৌড়োতে দৌড়োতেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, —গল্পের অনেকটা এখনও বাকি আছে, নেক্সট যে-দিন দেখা হবে বলব।

জনারণ্যে মিশে গেল মিতুল। অতনু হাসল মনে মনে। হয়তো আবার চার মাস পরে দেখা হবে কোথাও, কিংবা চার বছর। হয়তো বা কোনও দিনই আর দেখা হবে না। পথের হঠাৎ দেখা, ক্ষণিকের ভাল লাগা, পথেই মিলিয়ে যাওয়া তো বেশ। খানিকটা সময় তো কাটল ভাল, মনটাও খানিক চাঙা হল। দিনভর কেজো হিসেবি মরুভূমিতে ছোটার মাঝে একটুখানি মরূদ্যানের ছায়া তো মিলল।

আবার টিস্টলে যাচ্ছিল অতনু। চা খাবে আর একবার। অর্ডার দেওয়ার আগেই ফের মিতুলের আবির্ভাব।

অতনু অবাক, —কী হল? গেলে না?

দু’হাতে চুল ঠিক করতে করতে মিতুল বলল, —ওহ্, যা শিব্রামি ভিড়!

—সেটা কী?

—শিবরামের একটা গল্প আছে না, বাসে এত ভিড় যে এক দরজা দিয়ে একটা লোক উঠলে অন্য দরজা দিয়ে আর একটা লোক খসে যায়! ঠিক সেই কেস।… তোমার লোকাল কখন?

—তিনটে চল্লিশে। অতনু ঘড়ি দেখল। মিনিট পনেরো বাকি। আর এক রাউন্ড চা চলবে?

—এবার কিন্তু আমি পয়সা দেব।

বলেই ব্যাগ থেকে একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করেছে মিতুল। চাঅলার হাত থেকে ভাঁড় নিয়ে রাখল স্টলের পাটাতনে। গুনে গুনে চেঞ্জ ভরছে ব্যাগে।

অতনুর ভারী অভিনব ঠেকল দৃশ্যটা। প্রসাধনী বার করা ছাড়া অন্য কোনও কারণে কি কখনও ব্যাগ খুলতে দেখেছে তুতুলকে? মনে পড়ে না। তাদের গ্রুপের মেয়েরা অবশ্য হরবখতই চা’টা বিস্কুটটা খাওয়ায়। মিতুল যেন তাদের মতোই অবলীলায় সম্পর্কটাকে সহজ করে নিতে পারে। একই পরিবারে মানুষ হয়ে দু’বোন কী করে যে এত পৃথক হয়?

ফের তুলনা? নিজেকে ফের ধমকাল অতনু। মনের ওপর কন্ট্রোল নেই কেন, অ্যাঁ?

চায়ে চুমুক দিয়ে অতনু বলল, —এসেই যখন গেলে, তোমার মহাভারতটা শেষ করো।

—শুনবে? ধৈর্য আছে এখনও? মিতুল ঠোঁট টিপল,—হুম, তারপর হল কী…বিশ্বম্ভর দাসের সেই যে অ্যাপ্লিকেশান, তার ধাক্কাতেই সরকারের চাকা আস্তে আস্তে গড়াতে শুরু করল।সম্ভবত বিশ্বম্ভর গিয়ে মাঝে মাঝে পুশ করেও আসত। আর সেই ঠেলাতেই কোনও এক সময়ে পরিদর্শক এসে, বিশ্বম্ভর দাসের ফাঁকা জমিটি দেখে গিয়ে ওপরমহলে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়ের এগজিস্টেন্স আছে। এবং একে অ্যাপ্রুভাল দেওয়াই যায়। বিশ্বম্ভর দাসের বউমা দারুণ কাঁচাগোল্লা বানায়, পরিদর্শকমশাই সম্ভবত পেট পুরে কাঁচাগোল্লা সাঁটিয়েছিলেন। …যাই হোক, এদিকে নতুন ম্যানেজিং কমিটিও বসে নেই। নতুন সেক্রেটারি সনৎ ঘোষ কট্টর বাম, তারও কিছু রাজনৈতিক স্বপ্ন আছে, স্কুল নামক কুমিরছানাটি দেখিয়ে সে আরও বড় ঘাটে নৌকো ভেড়াতে চায়।

—এম-এল-এ হওয়ার ইচ্ছে?

—অতটা নয়। ওই পঞ্চায়েত সমিতি আর কী…। উদ্যোগী হয়ে ছোটাছুটি করে সনৎ ঘোষ কোর্টে কেসটাকে ওঠাল। রিসিভার সরাল। পাকাপাকি ভাবে আসীন হল সেক্রেটারি পদে। কিন্তু তদ্দিনে বিশ্বম্ভরের চাকা বহুদূর গড়িয়ে গেছে। স্কুল চালু হবে বলে টিচারের জন্য লোক চাওয়া হয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশনে, পরীক্ষা নিয়ে টিচার নিয়োগও কমপ্লিট। সেই মাস্টারদের, এক্ষেত্রে দিদিমণিদের, তারা যোগাযোগ করতে বলেছে বিশ্বম্ভর দাসেরই সঙ্গে। সনৎ ঘোষ জেলা অফিসে নতুন ম্যানেজিং কমিটির নামও পাঠিয়েছিল, সেই লিস্টটাই হাপিশ। এবং কোনও এক মোটা দাগের জাগতিক কারণে স্কুল অ্যাপ্রুভালের চিঠিও চাপা পড়ে গেল ফাইলের গাদার নীচে। সুতরাং স্কুল মানে এখনও ফাঁকা মাঠ, সেখানে অবিরাম ঘাস খাচ্ছে গোরুছাগল। এখনও সেক্রেটারি পদের পুরো ফয়সালা হয়নি। বিশ্বম্ভর বলছে আমি সেক্রেটারি, সনৎ বলছে আমি। কপাল পুড়ছে দিদিমণিদের। নো ছাত্রী। নো ক্লাস। নো মাইনে।

মিতুলের মুখে হাসি এখনও লেগে আছে বটে, তবে হাসিতে যেন একটা ছায়াও আছে। অতনুর খারাপ লাগছিল। চিন্তিত স্বরে বলল, —এহ্, তুমি একটা বিশ্রী চক্করে পড়ে গেছ দেখছি!

—চক্কর বোলো না, বলো গাড্ডা। তবে আমার চেয়েও গাড্ডায় পড়েছে আরও দু’জন। তারা প্রচুর ধারকরা করে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাড়ির কাছের স্কুলে পোস্টিং বাগিয়েছিল। এখন দুটিতে খোলামাঠের ধারে বসে হাপুস নয়নে কাঁদে।

—তাহলে এখন কী হবে তোমাদের?

—জানি না। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রতীকদা হলে বলত, প্রাণ ভরে মাকে ডাকো, তিনিই তোমার সব…

মিতুল ঝপ করে থেমে গেল।

অতনু অস্ফুটে বলল, —প্রতীক? মানে তোমার…?

মিতুল মাথা নামিয়ে নিল। ঘাড় দোলাচ্ছে, —জামাইবাবু।

অতনুর মুখ দিয়ে অর্থহীন প্রশ্ন বেরিয়ে এল, —উনি বুঝি খুব ধার্মিক?

মিতুল আবার ঘাড় নাড়ল। অতনুর চোখে আর চোখ রাখছে না। তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক, উদ্দেশ্যহীন ভাবে।

অতনুও আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। আচমকা এক ভ্যাপসা গুমোট যেন ঢুকে গেছে দু’জনের মধ্যিখানে। ট্রেন দিয়েছে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে, নিঃশব্দে ওভারব্রিজ পার হয়ে দু’জনে গিয়ে উঠল ট্রেনে। বসার জায়গা পেয়ে গেছে। কিচিরমিচির করছে যাত্রীরা, বিকট সুরে লজেন্স বিক্রি করছে হকার। ঘটাং করে একটু নড়ে উঠল ট্রেন। ব্রেক টেস্ট।

মিতুলের দৃষ্টি জানলার বাইরে। ভাবতে না চেয়েও তুতুলের কথা মনে পড়ছিল অতনুর। সাড়ে তিন বছর আগের সেই দগদগে ঘা। বারবার অতনু ফোন করছে তুতুলকে, পরে কথা বলব বলে ফোন নামিয়ে রাখছে তুতুল। মরিয়া হয়ে অতনু তুতুলের বাড়ি যেতে চেয়েছিল। নিষেধ করল তুতুল, কেঠো স্বরে। নিজেই শেষে ফোন করে ডাকল অতনুকে। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে লাখো মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অবলীলায় বলে দিল, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তুমি আর যোগাযোগ রাখার চেষ্টা কোরো না!

অতনু মিনতি করেছিল, —ক’টা দিন আর সময় দাও তুতুল। একটা চাকরির কথা চলছে, কিছু একটা হয়ে যাবেই।

—আর তা হয় না। আমি এ বিয়েতে কথা দিয়ে দিয়েছি।

—কেন দিলে?

তুতুল উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। অপরূপ শরীরে ছন্দ তুলে চলে গেল। কী অপমান, কী অপমান! অতনুর মনে হচ্ছিল চারপাশের সব লোক যেন তারই দিকে তাকিয়ে আছে। খলখল হাসছে গোটা দুনিয়া। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেনি অতনু। কত দিন গ্রুপে যায়নি। মাস দুয়েকের জন্য পালিয়েও গিয়েছিল কলকাতা ছেড়ে। লক্ষ্ণৌ পিসির বাড়ি। সারাক্ষণ শুধু একটা প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াত, তুতুল কি তাকে সত্যিই ভালবাসেনি?

এইমুহূর্তে মিতুলের ওপরও রাগ হচ্ছিল অতনুর। কেন যে আবার মিতুলের সঙ্গে দেখা হল? সময়ের পলি পড়ে বেশ তো থিতিয়ে গিয়েছিল ক্ষতটা, মিতুল যেন নতুন করে সব মনে পড়িয়ে দিল। আবার কি ফিরে আসছে সেই বিনিদ্র রজনী?

হঠাৎই মিতুলের ডাকে চমকে উঠেছে অতনু, —অ্যাই অতনুদা, কী ভাবছ?

অতনু হাসার চেষ্টা করল, —তুমিও তো ভাবছ কী যেন!

—আমি আমার পোড়া কপালের কথা ভাবছি।

—ধরে নাও আমিও তাই।

ঝরনার মতো হেসে উঠল মিতুল। চাপা স্বরে বলল, —আমরা ডুয়েট গাইব নাকি? জনমদুখী কপালপোড়া গুরু আমরা দুইজনা…!

অতনু হাসল হা হা। ভারী বাতাস লঘু হয়ে গেছে পলকে। দু’প্যাকেট বাদাম কিনল। দু’জনেই টকাটক বাদাম ছুড়ছে মুখে। ট্রেন ছাড়ল।

মিতুল হালকা সুরে জিজ্ঞেস করল, —তোমরা নতুন নাটক নামাচ্ছ বলছিলে না?

—হ্যাঁ, মরা নদী। মুর্শিদাবাদের আলকাপদের কথা জানো তো? তাদের নিয়ে। আমরা চেষ্টা করছি বাঙালির ওই শিল্পধারাটাকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে। একটা আলকাপ দলের স্ট্রাগল, ফ্রাষ্ট্রেশান, তবু কিছুতেই না দমা, অসম্ভব জেদ… মানে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই আর কী। সেই পঞ্চাশের দশকের পটভুমিকায়।

—আচ্ছা অতনুদা, একটা প্রশ্ন করব? ডোন্ট মাইন্ড…তোমরা যে এই নাটকগুলো করো…গ্রামটামের দর্শক নিশ্চয়ই খুব একটা দেখে না…? শহুরে অডিয়েন্স আলকাপের মাহাত্ম্যে মোহিত হলে সত্যিই কি কোনও লাভ আছে?

—মুশকিলে ফেললে। ফ্রাংকলি বলছি, জানি না। তবু মনে হয়, আলকাপের মতো একটা নিখাদ বাঙালি শিল্প তো প্রায় নিঃসাড়ে লুপ্ত হয়ে গেল…শহরের লোকরা অন্তত এটা জানুক। তা ছাড়া মানুষের লড়াইয়ের গল্প তো কখনও পুরনো হয় না। এই যে তুমি একটা না থাকা স্কুলে চাকরি পেয়ে গাছকোমর বেঁধে ছুটোছুটি করে মরছ, এও তো লড়াই।

—বাপস, আমায় হেভি সার্টিফিকেট দিলে তো! মিতুলের চোখ খুশিতে ঝিকমিক, —তোমাদের নতুন নাটকটা তো তা হলে দেখতেই হয়।

—দেখবে? আসবে? সত্যি?

—কবে শো?

—দেরি আছে। ফার্স্ট শো সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখে অ্যাকাডেমিতে।

—কী বার পড়ছে?

—শনিবার। দুপুরের শো।… তোমাদের ফোন নাম্বার বদলায়নি তো?

—না। কেন?

—শো-এর আগের দিন তোমায় রিং করে মনে করিয়ে দেব।

এলোমেলো কথায় গড়িয়ে যাচ্ছে সময়। নাটক, চাকরি, জ্যাম-জেলি সস আচার বিপণনের প্রক্রিয়া, রেখা অপর্ণা মুনমুন, মহলার টুকিটাকি…। একটার পর একটা স্টেশন পেরোচ্ছে ট্রেন। লোক উঠছে খুব, ভিড়ে হাঁসফাঁস করছে কামরা।

অবরোহণ পর্বে রীতিমতো মেহনত করতে হল মিতুলকে। দমদমে নেমেই অতনুর জানলায় এসেছে মিতুল। হাত নাড়ছে।

চলতে শুরু করল ট্রেন। দ্রুত পিছনে সরে যাচ্ছে মিতুল। মুহূর্তের জন্য মিতুলের চোখে দৃষ্টি আটকাল অতনুর। বুঝতে পেরেছে! বুঝতে পেরেছ! বুঝতে পেরেছে দু’বোনে কোথায় মিল!

দু’বোনের চোখ হুবহু এক। একই রকম টানা টানা। শুধু মিতুলের মণি দুটো যেন আরও বেশি গভীর। আরও বেশি উজ্জ্বল।

.

॥ আট ॥

—দেখেছেন তথাগতবাবু, কী বাজে হয়েছে নতুন রুটিনটা?

—আমাকে বলবেন না ম্যাডাম, আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। একেবারে প্রথমে দুটো ক্লাস, আর সেই লাস্টে দুটো। মাঝের চারটে পিরিয়ড কি আমি ভ্যারান্ডা ভাজব?

—তা কেন, প্রিন্সিপাল তো বলেই দিয়েছেন, লাইব্রেরি গিয়ে বসে থাকতে। নিজেদেরকে আরও ডেভেলাপ করতে হবে! বইপত্র ঘাঁটুন, নতুন কী পদ্ধতিতে পড়ানো যায় তাই নিয়ে ভাবুন।

—তারপর সেই নতুন ভাবনা-চিন্তাগুলো নিয়ে নতুন ফার্স্ট ইয়ার পাসের আড়াইশোটা ছেলেমেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। প্রবল বিক্রমে চেঁচিয়ে যাই পাড়ার কুকুরদের মতো, জোকারদের মতো হাত-পা ছুড়ি…। যদিও নিশ্চিন্ত থাকতে পারি কেউ আমার পড়ানো শুনবে না, তারা নিজেদের মতো করে গল্প করে যাবে, হাসাহাসি করবে…।

—এই দুঃখেই তো আমি ক্লাসে গিয়েই রোল কল শুরু করে দিই। ওতেই মিনিট কুড়ি পার। তারপর ধীরেসুস্থে বোর্ডে গিয়ে কী পড়াব তাই লিখি… ধুয়ো ধরতে না ধরতেই বেল পড়ে যায়।

—ওই টেকনিকটাও বড় বোরিং দেবব্রতদা। এক থেকে আড়াইশো অবদি গোনা, ঘরে ঘরে প্রেজেন্ট অ্যাবসেন্ট বসানো…! তার থেকে নিজের মতো করে বকে যাও, শুনল তো শুনল, না শুনল তো কাঁচকলা। আলটিমেটলি পরীক্ষার খাতায় আমি যা বলছি তার কিছুই তো লিখবি না, উগরে দিবি তো তোর কোচিং আর টিউটরের নোট!

—শুধু নোট নয়, ভুলভাল নোট। আপনি বিশ্বাস করবেন না রুচিরাদি, এবার অনার্সের খাতা দেখতে গিয়ে পর পর চোদ্দোটা স্ক্রিপ্ট পেলাম হুবহু এক লেখা। এবং হুবহু এক ভুল। এসেছে ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশানের বৈশিষ্ট্য, লাইন দিয়ে লিখে গেছে ফরাসি বিপ্লবের ব্যাকগ্রাউন্ড! কেউ কোয়েশ্চেনটা পর্যন্ত ভাল করে পড়ে না!

—ওদের আর দোষ কী অনিমেষ? হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে ট্রিটমেন্ট করালে এর চেয়ে ভাল চিকিৎসা হয় না। ভাল মাস্টাররা ওই আড়াইশোর সমুদ্রে খাবি খাবে, আর চিরটাকাল নোট গিলে আসা কোনও অগাবগার টোলে গিয়ে ছেলেমেয়েরা ওসব জিনিসই শিখবে।

—ফার্স্ট প্রয়োজন স্টুডেন্ট কমানো। বুঝতে হবে হায়ার এডুকেশান সবার জন্য নয়। কোনও দেশে এমন পাইকারি হারে গ্র্যাজুয়েট পোস্টগ্র্যাজুয়েট হয় না।

—জ্ঞান মেরো না মৃগাঙ্ক। হায়ার এডুকেশানের ব্যবসাটা আছে বলে তাও লাখো লোক করেকর্মে খাচ্ছে। তা ছাড়া ছেলেমেয়েগুলোর ভবিষ্যতের জন্য একটা ছাপ্পা চাই।

—কী লাভ? চাকরি পাচ্ছে ক’জন? মেয়েদের তাও হয়তো বিয়ের বাজারে কিছুটা দাম বাড়ে…

—মেয়েদের নিয়ে ওই সব বস্তাপচা রিমার্কগুলো করা ছাড়ুন তো তথাগতবাবু।

—মেয়েরাও আজকাল কেরিয়ারের ধান্দাতেই হায়ার এডুকেশান নেয়।

—হাতাখুন্তির দিন শেষ, চাকরির বাজারে এখন মেয়েরাই এগিয়ে। ছেলেরা এখন টাইট খাচ্ছে।

—ওরেব্বাস, ম্যাডামরা যে একেবারে কোরাসে বেজে উঠলেন! সরি সরি, আই উইথড্র। আমি জাস্ট বলছিলাম এখনও তো প্রচুর মেয়েই শুধু ঘর-বরের আশাতে…

—জেনারালাইজ করবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন, মেয়েদের কাছে বিয়েটাও প্রায় চাকরিই। হোলটাইম ডোমেস্টিক সারভিলিয়েন্স। বাইরে চাকরি করলেও ঘরের দাসীবৃত্তিটি করতেই হয়, আপনারা তো নড়েও বসেন না।

—সর্বনাশ, এ যে ফেমিনিজমের দিকে চলে যাচ্ছেন আস্তে আস্তে!

—হ্যাঁআ, নিষ্ঠুর সত্যিটা বললেই তো ফেমিনিজম মনে হয়।

নতুন রুটিন ঘিরে নানান রকম চাপান উতোর চলছে স্টাফরুমে। মাঝে কয়েক মাস কলেজে ক্লাসের চাপ কম ছিল, সুখের দিন শেষ, সোমবার থেকে এসে পড়বে ফার্স্ট ইয়ার, এ সময়ে খানিকটা চাপের মুখে থাকে সবাই। ছোটখাটো বিস্ফোরণও তাই তেমন বিরল নয়।

আজ অবশ্য হালকা চালেই হচ্ছে কথা। সোমনাথের কানে আসছে বটে, তবে সেভাবে সে শুনছে না। কাল সন্ধে থেকেই খিঁচড়ে আছে মেজাজটা। এ কী আজব এক প্রস্তাব আনল তুতুল? নগদ দু’লাখ টাকা সে সোমনাথের হাতে দেবে, টাকাটা চেক হয়ে আবার ফেরত চলে যাবে মেয়ের নামে? অত টাকা তুতুলের হাতে এল কোত্থেকে? কত মাইনে পায় প্রতীক? ষোলো হাজার? আঠেরো হাজার? মেরেকেটে বিশ? আঠাশ হাজার মাইনে পেয়েও সোমনাথের মুক্তকচ্ছ দশা, আর প্রতীক কিনা অত টাকা জমিয়ে ফেলল? ফ্ল্যাট কেনার পরেও? এবং টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখেনি! প্রতীক মোটেই হাড়কেপ্পন নয়, সংসারে তার প্রচুর খরচা, সোমনাথ তো স্বচক্ষেই দেখছে। নতুন সোফাসেট আসছে, এই সেদিন ঊনত্রিশ ইঞ্চি টিভি ঢুকল ড্রয়িংরুমে, সিলিংয়ে ঝোলাচ্ছে ঝাড়লণ্ঠন…! একটা গাওনা অবশ্য গাইল তুতুল। বহরমপুরে প্রতীকের কী একটা জমি ছিল, সেটা নাকি বেচা হয়েছে, তার থেকে এসেছে টাকা…! শুনেই মনে হচ্ছিল কথাটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ছেলেমেয়ে মিথ্যে বললে বাবা-মা ঠিক টের পায়। সত্যিই টাকাটা সোজা রাস্তায় এলে প্রতীক তা দেখাতে চাইবে না কেন?

প্রতীককে নিয়ে এই কি প্রথম খটকা লাগল সোমনাথের? তা তো নয়। বিয়ের পর থেকেই তুতুলের রইসি চালচলনে ধন্দ তো জাগত। দিশি কসমেটিকস দেখলে নাক সিঁটকোয় মেয়ে, কথায় কথায় দামি শাড়ি কিনছে, হিরেবসানো ব্রেসলেট গড়িয়ে মাকে দেখিয়ে গেল, রুপাইয়ের অন্নপ্রাশনে না হোক উড়িয়ে দিল হাজার চল্লিশ…।

তবু তো চোখ বুজেই ছিল সোমনাথ। মনে প্রশ্ন এলেও নিজেকে শাসন করছে, তোমার আদরের তুতুল যদি একটু সুখে বৈভবে থাকে, তোমার চোখ করকর করে কেন? তবে কাল বড্ড খারাপ লেগেছে। সোমনাথ তুতুলকে গাড়ি যৌতুক দেবে, এই ছলনার আশ্রয় নিতে তুতুলের চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপল না? একবার ভাবল না পর্যন্ত অমন একটা কপট অনুরোধে বাবা কতটা আহত হতে পারে? মৃদুলাই বা কী, দিব্যি কেমন বলে দিল, অত গাঁইগুঁই করছ কেন, যদি তুতুলদের সুবিধে হয় এটুকু করা তো তোমার কর্তব্য! যেন সোমনাথের কী কর্তব্য সোমনাথ জানে না! সারা জীবন ঘাড় গুঁজে তা পালন করেনি! চাকরির শেষ লগ্নে অকারণে ইনকাম ট্যাক্সের ছোবল খেলে সোমনাথের কী দশা হতে পারে এ কথা চিন্তা করা মৃদুলার কর্তব্য নয়? হয়তো কিছুই হবে না, সাতদিনের জন্য সোমনাথের ব্যাঙ্কে কী জমা হল, বেরিয়েও গেল, ইনকামট্যাক্স হয়তো তা জানবেও না, তবু একটা মৃদু ঝুঁকি তো থেকেই যায়। সোমনাথের বিপন্ন হওয়ার এই সম্ভাবনা কণামাত্র উদ্বিগ্ন করল না মৃদুলাকে? উলটে রাত্রে শোওয়ার সময়ে কী গজগজ! প্রতীকের মতো ধর্মপ্রাণ সচ্চরিত্র ছেলেকে তুমি বাঁকা চোখে দ্যাখো, তুমিও তো বাপু খুব সোজা মানুষ নও!

অজান্তেই একটা শ্বাস পড়ল সোমনাথের। আশ্চর্য, তুতুলের হাতে অত কাঁচা টাকা দেখেও মৃদুলার মনে কোনও প্রশ্ন জাগে না? মেয়ের ঐশ্বর্যের আঁচে মন সেঁকে নিয়ে মৃদুলা কি তার কোনও অলব্ধ বাসনাকে পরিতৃপ্ত করতে চায়? সোমনাথ চিরটাকাল সাদাসিধে জীবন যাপন করেছে, বিলাসিতায় ভেসে যাওয়ার মতো পকেট-উপচোনো টাকাপয়সা কোনও কালেই তার হাতে আসেনি, মাঝে যখন টিউশ্যনি করত তখন হয়তো একটু বেশি সচ্ছলতা ছিল, হয়তো ছাত্র পড়ানো ছেড়ে দেওয়ার পর চাপে আছে সামান্য, তা বলে বউ-মেয়েদের তো কখনও অভাবে রাখেনি। মৃদুলা কি এর চেয়ে অনেক বেশি চেয়েছিল?

বেল পড়ল। ক্লাস থেকে ফিরছে অধ্যাপকরা। রুটিন ঘিরে জটলাটাও ছিঁড়ে গেল, কেউ কেউ যাচ্ছে ক্লাস নিতে, কেউ বা নতুন করে গল্প জুড়ছে পাশের চেয়ারের সঙ্গে। হনহনিয়ে স্টাফরুমে ঢুকল নির্মল, অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টারখানা টেবিলে ফেলে ঢুকে গেল টয়লেটে। বেরিয়ে অনুচ্চ স্বরে কথা বলছে দেবব্রতবাবুর সঙ্গে।

নিষ্প্রাণ মুখে সোমনাথ রুটিনের ফোল্ডারখানা কাছে টানল। ডায়েরি বার করে টুকছে প্রাত্যহিক কর্মসূচি। আগেও দেখেছে, তবু আর একবার গুনল ক্লাসের সংখ্যা। পাঁচদিনে মোট উনিশটা। মঙ্গল বৃহস্পতি পাঁচটা করে আছে। ওই দু’দিন জান কয়লা হয়ে যাবে। তার ওপর মঙ্গলবার তো আবার টানা চার পিরিয়ড। কী করে যে টানবে সোমনাথ? রুটিন কমিটির মিটিংয়ে এবার হালকাভাবে বলেছিল সিনিয়ারদের ক্লাসগুলো একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলে ভাল হয়। পুলকেশ আমলই দিল না। এভরিবডি শ্যুড বি ট্রিটেড ইকুয়ালি সোমনাথবাবু, ক্লাসের ব্যাপারে জুনিয়ার সিনিয়ার ভেদ করা চলে না! বরং সিনিয়ারদের তো আরও বেশি দায়িত্ব নেওয়া উচিত। যেন গভর্নমেন্ট বুঝতে পারে বুড়ো হয়ে গিয়ে আপনারা ফিজিক্যাল ফিটনেস বা মেন্টাল অ্যালার্টনেস হারাননি। অর্থাৎ উনষাট বছর বয়সেও সোমনাথকে প্রমাণ দিতে হবে সে একজন তাজা তরুণ! এবং ষাট বছরে পৌঁছোলেই রিটায়ারমেন্টের বেলপাতাটিও শুঁকতে হবে! পুলকেশরা যে ঠিক কী চায়? বোধহয় ওদের কাছে দক্ষতা অভিজ্ঞতা ব্যাপারগুলো তত মূল্যবান নয়, ঠিকমতো জোয়াল টানতে পারছে কিনা সেটা দেখাই একমাত্র উদ্দেশ্য। ভাল। এতে যদি শিক্ষার উন্নতি হয় তো খুবই ভাল।

—স্যার?

রুটিন টোকায় ছেদ পড়ল। দুটো অল্প চেনা মুখ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পিছনে অভিজিৎ। ছাত্র সংসদের সম্পাদক। সোমনাথের ভুরু কুঁচকে গেল। ছেলে দুটোও কি ইউনিয়নের? তাই হবে। সাধারণ ছাত্রছাত্রী হলে স্টাফরুমে ঢুকতে দ্বিধা বোধ করে, অনুমতি চায়।

সোমনাথ জিজ্ঞেস করল,—কী ব্যাপার? কিছু বলবে?

ছেলে দুটোর একজন বলল,—আপনার তো এখন বোধহয় ক্লাস ছিল স্যার। নেবেন না?

সোমনাথ একটু অপ্রস্তুত হল,—তোমাদের ক্লাস? তোমরা কোন ইয়ার?

—সেকেন্ড ইয়ার অনার্স। …মানে নতুন সেকেন্ড ইয়ার।

—ও। …কিন্তু তোমাদের তো ক্লাস হয়ে গেছে! দীনেশবাবু আসেননি বলে পিরিয়ডটা অফ যাচ্ছিল, ছেলেমেয়েরা এসে আমায় টেনে নিয়ে গেল! একটা থেকে একটা পঁয়তাল্লিশ আমার ক্লাসটা নিয়ে এলাম…।

—কিন্তু এ তো আপনি করতে পারেন না স্যার। এতক্ষণে পিছন থেকে অভিজিতের স্বর ফুটছে, —ওরা আপনার ক্লাসের টাইমে এসেছে, এখন তো আপনাকে ক্লাস নিতে হবে।

—তা কী করে হয়? আমার ক্লাসটা তো আমি নিয়ে এসেছি। পঞ্চাশ জনের মধ্যে অ্যাটলিস্ট পঁয়ত্রিশজন প্রেজেন্ট ছিল…

—ওসব শুনিয়ে লাভ নেই স্যার। আপনারা আপনাদের ইচ্ছে মতন সময়ে ক্লাস নেবেন এ আমরা হতে দেব না। অভিজিতের গলা চড়ল, —আমরা মাইনে দিয়ে পড়ি। রুটিন মাফিক টিচারদের ক্লাসে পাওয়াটা আমাদের ন্যায্য অধিকারের মধ্যে পড়ে।

সোমনাথ অসহায় মুখে বলল, —কিন্তু তোমাদের সহপাঠীরাই তো… ওরাই তো এসে বলল, পর পর তিনটে পিরিয়ড গ্যাপ পড়ে যাচ্ছে… আমার ক্লাস সওয়া তিনটেয়… ততক্ষণ ওরা বসে থেকে কী করবে…আমি যদি আগে ক্লাসটা নিয়ে নিই,…

—তাদের সুবিধের জন্য আপনি ক্লাস নিয়েছেন, না আপনার সুবিধের জন্য, তা আমার জানার দরকার নেই। আপনার হুইম্‌সের জন্য অন্য ছাত্ররা সাফার করবে এ মোটেই আমরা মানব না।

অভিজিতের ধমক স্টাফরুমের অনেকেই শুনতে পাচ্ছে। ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে অধ্যাপক অধ্যাপিকারা। তবে কেউই আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে না।

সোমনাথ নার্ভাসভাবে উঠে দাঁড়াল। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, —চলো তাহলে।

হঠাৎই নির্মল এগিয়ে এসেছে। ঋজু স্বরে বলল, —দাঁড়াও। বলেই অভিজিৎকে উপেক্ষা করে সরাসরি ছেলে দুটোকে ধরেছে, —তোমাদের স্যার যখন একটার সময়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন তখন তোমরা কোথায় ছিলে?

দুটো ছেলেই থতমত। মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অভিজিৎই বলে উঠল, —ওরা তখনও আসেনি। ওরা শুধু এস-এমের ক্লাস করবে বলেই দেরি করে এসেছে।

—তার মানে ওরা দীনেশবাবুর ক্লাস করতে ইচ্ছুক ছিল না?

এবার অভিজিৎ থমকেছে।

নির্মল ফের বলল, —তোমার কি ধারণা, কোন স্যারের ক্লাস করবে, কোন স্যারেরটা করবে না, সেটা স্থির করার অধিকার ছাত্রদের আছে?

—আমি তো তা বলিনি। অভিজিৎ সামান্য তেরিয়া হওয়ার চেষ্টা করল।

—তোমার হাবভাব তাই বলছে। নির্মল হাঁক পাড়ল, —রবি, সেকেন্ড ইয়ার পল সায়েন্স অনার্সের অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টারটা নিয়ে আয় তো।

স্টাফরুম পিয়োন দৌড়ে গিয়ে র‍্যাক থেকে নিয়ে এসেছে নীল খাতাটা। রেজিস্টার খুলে নির্মল ছেলে দুটোকে জিজ্ঞেস করল, —নাম বলো? রোল?

দু’জনেই আমতা আমতা করছে, —স্যার এইট্টিন…আর থারটি টু।

নির্মল ঘোষণা করার ঢঙে বলল, —এ বছরে এখনও পর্যন্ত তোমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস হয়েছে সাঁইত্রিশটা। রোল এইট্টিন ক্লাস করেছে চারটে, রোল থারটি-টু দুটো। …অভিজিৎ, মিলিয়ে দ্যাখো তো আমি ভুল বলছি কিনা।

অভিজিতের মুখ পাংশু, —না মানে স্যার…ওরা এসে বলল ওদের ক্লাস ছিল… হচ্ছে না…

—আর ওমনি তুমি টিচার্সরুমে ঢুকে স্যারকে শাসাতে চলে এলে?

— শাসাইনি তো। জাস্ট স্যারকে মনে করিয়ে দিতে এসেছিলাম…

—এই ভাষায়? টাকা দিয়ে পড়ো বটে, তা বলে কি ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কটা বদলে যায়? আমরা মাস্টাররা কি তোমাদের কাছ থেকে আর একটু নম্ভ্র ব্যবহার আশা করতে পারি না? তুমি এ-ঘরে ঢোকার আগে এই ছেলে দুটোকে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলে না এরা আদৌ ক্লাস করে কিনা?

নির্মলের ব্যক্তিত্বের দাপটে রীতিমতো কুঁকড়ে গেছে অভিজিৎ। ঘাড় নামিয়ে বলল, —সরি স্যার।

—শ্যুড বি। ভবিষ্যতে আর এরকম কোরো না। যাও। বলেই ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে নির্মল মিটিমিটি হাসছে, —কী রে, তোদের আজ হঠাৎ ক্লাস করার সাধ জাগল যে? সারা বছর যে আসিস না, তোদের বাবা-মা জানেন?

ওপাশ থেকে মৃগাঙ্ক বলল, —আসবে না কেন, রোজই আসে। পাছে স্যারেরা কিছু হাবিজাবি শিখিয়ে দেয়, সেই ভয়ে ক্লাসে ঢোকে না। ওদের আসল পড়াশুনোর জায়গা আছে, সেখানে যায়। এখানে এতগুলো স্যারের জন্য ওরা মাইনে দেয় ষাট টাকা, আর টিউটোরিয়ালে একজন স্যারই নেন পাঁচশো। অত দামি স্যারকে ছেড়ে কেন ওরা সস্তার ক্লাস করবে?

অভিজিৎ সুড়সুড় করে চলে যাচ্ছিল। নির্মল ডাকল, —শোনো। স্যারদের দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে তোমরা ভাবছ খুব ভাল কথা। অথচ ছেলেমেয়েরা যে ক্লাসে আসছে না তা নিয়ে তো কোনও আন্দোলন করছ না? তোমাদের কি ধারণা দায়িত্ব শুধু একতরফা?

উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল অভিজিৎ। ছেলে দুটোও।

সোমনাথ মুগ্ধ চোখে দেখছিল নির্মলকে। কী চমৎকার সাবলীল ভঙ্গিতে মোকাবিলা করল পরিস্থিতির। জিজ্ঞেস না করে পারল না, —নির্মল, তুমি টের পেলে কী করে ছেলে দুটো ক্লাস করে না?

নির্মল হো হো হাসল, —প্লেন অ্যান্ড সিম্পল। যাদের পড়াশুনা করার ইচ্ছে আছে, তারা কি স্যারকে ডাকার জন্য ইউনিয়নের সেক্রেটারিকে বগলে করে নিয়ে আসে?

মৃগাঙ্ক বলল, —দেখুন সেক্রেটারিই ওদের ধরে এনেছে কিনা। ফ্রেশাররা সব আসবে সোমবার থেকে, তার আগে স্যারদের একটু কড়কে দিতে এসেছিল আর কী। যেন নতুন ছেলেমেয়েরা দেখতে পায় স্যাররা ইউনিয়নের ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকে।

ঘটনাটা নিয়ে গজল্লা চলতে থাকল স্টাফরুমে। নির্মল অবশ্য রইল না, গেছে অফিসে। কী যেন কাজ আছে। সোমনাথ গেল লাইব্রেরি। বই নেবে।

বিকেলে ফেরার পথে নির্মলের পাশে পাশে হাঁটছিল সোমনাথ। দুপুরে হঠাৎ কোত্থেকে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল, ভিজে আছে পথঘাট। তবে খানিকটা জল ঝরিয়ে আকাশ এখন আবার ঘন নীল। ঘুরছে টুকরোটাকরা শুভ্র মেঘ। মন্থর ভঙ্গিতে। রোদ্দুর এখনও যথেষ্ট চড়া, বিকেল চারটেতেও তাত আছে বেশ। তবে শরৎ কিন্তু এসেছে। দিঘির পাড়ে উঁকি দিয়েছে এক জোড়া কাশফুল।

ওই কাশফুল দেখেই বোধহয় পুজোর কথা মনে পড়ল নির্মলের। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, —পুজোয় এবার যাচ্ছ কোথাও?

সোমনাথ বলল, —ইচ্ছে তো ছিল কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসার। ঘাটশিলা কিংবা শিমুলতলা…। মৃদুলা বলছিল।… তবে মনে হচ্ছে হবে না।

—কেন?

—ধুৎ, এত টেনশান নিয়ে বেড়াতে ভাল্লাগে?

—তোমার তো টেনশানই টেনশান। সারাটা জীবন কেঁপে কেঁপেই গেলে। নতুন কী হল?

—আর কী, ছোটমেয়ে। ওর একটা কিছু ফয়সালা হলে বাঁচি।

—সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে কোনও?

—সেক্রেটারি নিয়ে কাজিয়াটা এবার হয়তো মিটলেও মিটতে পারে। ওদের ডি-আই নাকি দুই সেক্রেটারিকেই ডেকে পাঠিয়েছে। দুই মক্কেলকে কাল না পরশু কবে পাশাপাশি বসাবে। দু’জনেরই বক্তব্য শুনে, কাগজপত্র দেখে নিজেই একটা ডিসিশান নিয়ে পাঠিয়ে দেবে হায়ার অথরিটির শ্রীচরণে।

—বাহ্‌, এ তো একটা পজেটিভ সাইন!

—ছাড়ো। না আঁচালে বিশ্বাস নেই। আমি তো মিতুলের চাকরিটা খরচার খাতাতেই ধরে নিয়েছি।

অনেকক্ষণ ধরে পিছনে হর্ন দিচ্ছিল একটা ভ্যানরিকশা, সরে তাকে জায়গা করে দিল সোমনাথ। রাস্তার ধারে গজিয়ে ওঠা নতুন লটারির দোকানটা দেখতে দেখতে বলল, —খারাপটা কী লাগে জানো? একটা ভাল কাজ হচ্ছে, গাঁয়ে একটা মেয়েদের স্কুল হবে, তাকে ঘিরেও রাজনীতির কী নোংরা খেলা!

—রাজনীতি ব্যাপারটাই তো এখন নোংরা রে ভাই। রাজনীতি শব্দটার মানেই তো এখন বদলে গেছে। রাজনীতি এখন রাজত্ব টিকিয়ে রাখার নীতি। রাজ করার নীতি। বুঝতেই পারছ, ক্ষমতায় বহাল থাকতে গেলে ক্ষমতার লড়াইও চলবে। আর সাধু সন্ন্যাসী হয়ে থাকলে তো যুদ্ধ চালানো যায় না, অতএব মারো প্যাঁচ, চালাও ল্যাং, চোখ রাঙাও, ভয় দেখাও…। যেনতেন প্রকারেণ নিজের কব্‌জিটা শক্ত করার চেষ্টা করো। এ তোমার দিল্লির মসনদই বলো, কি বিহার ইউ-পি, কি বাংলার গ্রাম, সর্বত্র এক ছবি। কেউ শানাচ্ছে ধর্মের ত্রিশূল, কেউ বা ধরেছে জাতপাতের অস্ত্র, কারুর হাতিয়ার শুধুই গলাবাজি, কারুর বা বুকে দাস ক্যাপিটালের ঢাল। সকলের টার্গেট কিন্তু একটাই। পাওয়ার। মোর পাওয়ার। অ্যাবসোলিউট পাওয়ার। তারা জানে পাওয়ার ব্রিংস মানি, আর মানি ব্রিংস মোর পাওয়ার। এ এক বিচিত্র অলাত চক্র। সরকার বা অপোজিশান কেউ এর বাইরে নয়। বাঘের রক্ত খাওয়ার মতো যে এই পাওয়ারের স্বাদ পেয়েছে, তার আর অন্য কিছুতেই তৃপ্তি হবে না। সুতরাং তাকে ঢুকতেই হবে চক্রে। এবং তার চারপাশে তৈরিও হবে দুর্নীতির বলয়।

—আর ভুগে মরব আমরা। কমন পিপল্।

—এটাই তো নিয়ম ভাই। কমন পিপল্ মানে তো গড্ডলিকা। এ বান্চ অফ শিপ। হ্যাট হ্যাট করে যেদিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে, সেদিকেই ছুটবে। একটু বেচাল হলেই পিঠে পাচনবাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে বাকি ভেড়াগুলোও সিধে।

—হুম, বড় কঠিন ঠাঁই।

—ভয়ে লেজ গুটিয়ে থাকলে কঠিন, শিং খাড়া রাখলে কঠিন নয়।

কোনও প্রসঙ্গ ছাড়াই আচমকা প্রতীকের মুখটা মনে পড়ল সোমনাথের। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা লাগানো প্রতীক হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে মা কালীর ছবির সামনে। কেন যে মনে পড়ল? এত কথার মাঝেও বুকের ভেতর খচখচানিটা বুঝি রয়েই গেছে।

রাজনীতি প্রতীক ভয় সাহস সবই একসঙ্গে বুক থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল সোমনাথ। কব্জি উলটে ঘড়ি দেখে হাঁটার গতি সামান্য বাড়িয়ে বলল, —যাক গে, ওসব কথা বাদ দাও। তোমরা নিশ্চই এবার পুজোয় ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছ?

—ও শিয়োর। অষ্টমীর দিন স্টার্ট, কালীপুজোর দিন ফেরা। ব্যাটা কেমন একা একা হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাচ্ছে চেখে আসি।

—ছেলের এবার বিয়ে দিয়ে দাও।

—রাঁধুনি খুঁজে দেব বলছ? নির্মল হো হো হেসে উঠল, —শ্যামলী মেয়ে দেখছে। যত্ত সব ঝামেলা। মেয়েগুলো সব সেজেগুজে এসে বসে, কী অকোয়ার্ড যে লাগে! আমার তো কোনও মেয়েকেই তেমন অপছন্দ হয় না। কিন্তু শ্যামলীর তো জানো কেমন নাক উঁচু… ধড়াধধড় বাতিল করছে। কী বিশ্রী ব্যাপার, ছি ছি। আমি বলে দিয়েছি, আমি আর দেখতে যাব না। ছেলেটাও হয়েছে একটা আস্ত ঢ্যাঁড়োশ। এতগুলো বছর তুই কোএডে পড়লি, একটা প্রেমিকা জোটাতে পারলি না? এদিকে মেয়েবন্ধুর তো কমতি নেই। স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গে এখনও রেগুলার ইমেল চালাচালি হয়, খবর পাই।

—প্রেম সবার আসে নাকি? তুমি পেরেছিলে করতে?

—তা ঠিক। যে পারে সে পারে। অনেককেই তো জানি, এদিকে ভাজামাছটি উলটে খেতে পারে না, কিন্তু আসলি জায়গায় ঠিক দিল লড়িয়ে দেয়। ছিপটি ফেলে ঠিক মাছটি গেঁথে তোলে।

সোমনাথ হেসে ফেলল। ইঙ্গিতটা যে তার দিকেই বুঝতে অসুবিধে নেই। তবে সত্যি তো সেভাবে তার সঙ্গে প্রেম হয়নি মৃদুলার। নো হাত ধরাধরি, নো চাঁদ দেখাদেখি, নো ভুল বকাবকি। ওসব করার মতো বুকের পাটা সোমনাথের ছিল কোথায়! যেত মৃদুলার বোনকে পড়াতে, নবীন মুখচোরা অধ্যাপকটিকে দেখে বুঝি ভাল লেগেছিল মৃদুলার মায়ের, আভাসে ইঙ্গিতে প্রস্তাবটা পেড়েছিলেন সোমনাথের কাছে, সোমনাথ তো ঘেমেনেয়ে একসা, সোজা দেখিয়ে দিয়েছিল নিজের মাকে। মা আপত্তি করেনি। করার কারণও ছিল না। ব্যাঙ্ক অফিসারের সুন্দরী মেয়েকে তার পছন্দ হবে নাই বা কেন। তবে মা-ও বোধহয় ধরে নিয়েছিল মৃদুলার সঙ্গে নির্ঘাত একটা নরমসরম সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ছেলের। কী করে সোমনাথ বোঝায়, ফুলশয্যার আগে মৃদুলার সঙ্গে সোমনাথের সেভাবে কোনও কথাই হয়নি। বড় জোর একটু আড়চোখে দেখা, চায়ের কাপ এনে দিলে চোরের মতো একটু হাসা, ব্যস। নির্মল আদ্যোপান্ত গল্পটা জানে, তবু খেপায়। এখনও। সোমনাথের মজাই লাগে। বিয়ের আগেই মৃদুলাকে যে তার ভাল লেগেছিল সেটা তো মিথ্যে নয়।

স্টেশনে এসে কয়েকটা মুসুম্বি কিনল নির্মল। সোমনাথ গোটা ছয়েক কলা। সকালবেলা বিশেষ কিছু মুখে তুলতে চায় না মিতুল, মৃদুলা তাকে জোর করে একটা কলা অন্তত খাওয়াবেই। মিতুল কিছুতেই টিফিনে কলা নেবে না, তার শাস্তি।

দমদমে নেমে খানিকটা হকচকিয়ে গেল সোমনাথ। সান্ধ্য কাগজের হকারকে ঘিরে রীতিমতো এক সরব জটলা। বিকট সুরে চেঁচাচ্ছে ছেলেটা, কী বলছে এক বর্ণ বোঝা দায়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেল নাকি? সামনে গিয়ে দেখল খবরটা তত মারাত্মক নয়। আসন্ন ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবোয়ে যেতে পারবে না সচিন, তাই নিয়ে হইহই, তাই নিয়েই উৎকণ্ঠা। অনেকের মুখেই গেল গেল ভাব। দেশপ্রেম এখন আর কোনও আধার না পেয়ে চাক বেঁধেছে ক্রিকেটমাঠে!

ক্রিকেট নিয়ে তেমন একটা খ্যাপামি নেই সোমনাথের, তবু সেও নিল একটা কাগজ। চোখ বোলাতে বোলাতে এগোচ্ছে সাবওয়ের দিকে। সিঁড়ির মুখে থমকাল। অরুণা।

তুতুলের ননদের হাতে একখানা ক্যারিব্যাগ, মুখে-চোখে ব্যস্ততা। প্রতীকের মতোই অরুণা ফরসা লম্বা, ভাই-বোনের মুখের আদলেও যথেষ্ট মিল। তবে সে মোটেই ভায়ের মতো মিতভাষী নয়, বকতে পারে খুব।

সোমনাথ এক গাল হাসল, —কী খবর?

অরুণা স্মিত মুখে বলল, —চলছে এক রকম। আপনি কেমন আছেন?

—আছি।… হন্তদন্ত হয়ে চললে কোথায়?

—ইছাপুর। দেওরের শাশুড়ি মারা গেছেন, একটু ফল মিষ্টি দিতে যাচ্ছি।

—কবে মারা গেলেন? তুতুল কই বলেনি তো!

কথাটার উত্তর দিল না অরুণা। হালকা অভিযোগের সুরে বলল, —আপনি কিন্তু মেসোমশাই আমার বাড়ি আর এলেন না!

—এইবার যাব। দুম করে একদিন চলে যাব। তোমার মেয়ে তো শুনলাম হায়ার সেকেন্ডারিতে খুব ভাল রেজাল্ট করেছে!

—ওই আর কী। সে তো চলে গেছে খড়্গপুরে।

—বাহ্। …তার মানে এখন তোমরা দুটিতে একা?

—আমি একা। উনি তো অডিট করতে আজ পাটনা ছুটছেন, কাল কটক…। মা আসে মাঝে মাঝে, ওতেই সময়টা কাটে।

—কেন, তুতুল যায় না?

অরুণা। একটুক্ষণ চুপ। তারপর হাসিমুখেই বলল, —সময় পায় না বোধহয়। রুপাইটা খুব গুন্ডা হয়েছে তো, ওকে নিয়েই হয়তো ব্যস্ত থাকে।

সোমনাথ বলতে যাচ্ছিল, তুমিও তো চলে যেতে পারো। বলল না। অরুণাকে দেখে কেমন যেন মনে হচ্ছে ননদ-ভাজের সম্পর্কটা বোধহয় এখন আর তত স্বাভাবিক নেই। প্রতীকও কি ফুরসত পায় না দিদির বাড়ি যাওয়ার?

ব্যাপারটা ভাল লাগল না সোমনাথের। প্রতীককে পছন্দ করার মূলে অনেকটাই অবদান ছিল এই দিদি-জামাইবাবুর। অরুণা কল্যাণের অনাড়ষ্ট পরিশীলিত ব্যবহার সোমনাথকে বেশ মোহিত করেছিল। কী এমন ঘটল, তুতুল-প্রতীকের সঙ্গে সম্পর্কটা ছাড়া ছাড়া হয়ে গেল এদের?

বাড়ি ফিরে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে এই প্রশ্নটাই মৃদুলাকে করছিল সোমনাথ। মৃদুলা সেভাবে পাত্তাই দিল না। বলল, —ফালতু গবেষণা ছাড়ো। কাজের কথা শোনো… দুপুরে তুতুল ফোন করেছিল।

সোমনাথ পলকে টান টান, —কেন?

—পরশু তুতুল টাকাটা নিয়ে আসবে। পরশু তো তোমার অফ-ডে, তোমার সঙ্গে ব্যাঙ্কে যাবে। বলছিল বাবা যা আলাভোলা মানুষ, অত টাকা দিয়ে বাবাকে একলা ছাড়া ঠিক হবে না।

সোমনাথ শুকনো গলায় বলল, —হুম। আর কিছু?

—বলছিল দু’ দিন পরের ডেটে চেক নেবে।

—বলার কী আছে! যেদিনই হুকুম করবে সেদিনই লিখে দেব।

—ও কী কথার ছিরি! মেয়ে গাড়ি কিনছে বলে তুমি যেন খুশি নও?

সত্যিই তো নই। বলতে গিয়েও গিলে নিল সোমনাথ। যে বড়মেয়ে তার নয়নের মণি ছিল, যার বায়না আবদার মেটাতে বহুবার সাধ্যের বাইরে পা বাড়িয়েছে সোমনাথ, আজ তার খুশিতে কেন সোমনাথের বুকে কাঁটা বিঁধছে, একবারও কি তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করবে না মৃদুলা? এ কেমন স্ত্রী? এতকাল ঘর করার পরেও চিনল না সোমনাথকে? দু’জনের কাছে দু’জনে যদি এখনও অচেনা রয়ে গেল, তা হলে এই দাম্পত্যের অর্থ কী?

বুকটা কেমন চিনচিন করছে। বাথরুমে ঢুকল সোমনাথ, মুখেচোখে ভাল করে জল ছেটাল। বেরিয়ে চা জলখাবার খেল চুপচাপ। মিতুল ফিরল মাটিকুমড়া থেকে, কলকল করে শোনাচ্ছে সারাদিনের গল্প। কিছু মাথায় ঢুকছিল সোমনাথের, আবার কিছু ঢুকছিলও না। বুকের চিনচিনে ব্যথাটা রয়েই গেছে। হলটা কী? প্রেশার বাড়ল? নাকি গ্যাসের ধাক্কা? কলেজে আজ লোভে পড়ে ঘুগনি খেয়েছিল, তারই জের? ওষুধ খাবে? বলবে মৃদুলাকে? থাক, সে আবার কী মানে করবে কে জানে!

টিউশ্যনিতে বেরোল মিতুল। মৃদুলা রান্নাঘরে। সোমনাথ ঘরে এসে শুল বিছানায়। চোখের সামনে একটা বই খুলে ব্যথাটাকে ভুলে থাকতে চাইছে। বই পড়তে পড়তে এক সময়ে ঘুমিয়েও পড়ল। মিতুল যখন রাত্তিরে খাওয়ার জন্য ডেকে তুলল, তখন ব্যথাটা অনেকটা কম।

পরদিন সকালে সোমনাথ পুরোপুরি ঝরঝরে। বাজার যাওয়ার আগে খবরের কাগজের পাতা উলটোচ্ছে।

তখনই ভয়ংকর দুঃসংবাদটা এল। সোমনাথই উঠে ধরেছিল টেলিফোনটা, ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়েছে।

মৃদুলা চা আনছিল। কাপ-প্লেট রেখে দৌড়ে এল, —কী হল? কার ফোন ছিল?

গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছিল না সোমনাথের। কোনওক্রমে বলল, —নির্মল…নির্মল…

—নির্মলবাবুর ফোন ছিল? কী হয়েছে? তুমি এত কাঁপছ কেন?

সোমনাথ অস্ফুটে বলল, —নির্মল আর নেই!

—নেই মানে?

—চলে গেল। আজ ভোররাত্তিরে ম্যাসিভ সেরিব্রাল অ্যাটাক। নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, পথেই শেষ।

—সে কী?

—ভাবতে পারছি না। ভাবতে পারছি না। সোমনাথ জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, —কালও সামান্যতম অসুস্থ ছিল না…বিকেলে কত গল্প করতে করতে এলাম…কত কী বলছিল…সেই নির্মল আজ সকালে ডেড?

সোমনাথ বসে আছে মাথা ঝুঁকিয়ে। মিতুল শাড়ি পরছিল, দৌড়ে এসেছে ড্রয়িংরুমে। মৃদুলা কী যেন বলছে মিতুলকে, সোমনাথের কানে কিছুই ঢুকছিল না। সে যেন বধির হয়ে গেছে।

.

॥ নয় ॥

বিশ্বম্ভর দাসের ঠাকুরদা প্রদত্ত জমির ধারে ঝাঁকড়া আমগাছ। কাঁচা রাস্তার লাগোয়া। গ্রামের একেবারে পুব প্রান্তে। জমির পিছন থেকে শুরু হয়েছে ধানখেত, টানা চলে গেছে সেই সোনাদিঘি পর্যন্ত। ধানগাছ এখন গাঢ় সবুজ। হাওয়ায় দোল লাগার মতো না হলেও বেশ খানিক ঝাড়া দিয়েছে চারাগুলো। ওই সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকলে মিতুলের শহুরে চোখের ভারী আরাম হয়।

আজকাল অবশ্য এই মাঠের ধারে এসে বেশিক্ষণ বসে না মিতুলরা। প্রথমদিকে দিন কয়েক এখানেই ঠাঁই হয়েছিল বটে, তবে গ্রামের বেশ কয়েকজন মহিলার সঙ্গে ভাবসাব হয়ে গেছে, তাদের কারুর ঘরে গিয়েই বসে এখন। ভাবী বিদ্যালয়ের বর্তমান দিদিমণিদের তারা খাতিরযত্নও করে। এঘরে ওঘরে গল্প করেই না স্কুলের অনেক পূর্বকাহিনী জেনেছে মিতুলরা। শুধু দুপুরে টিফিন খাওয়ার সময় হলে চার শিক্ষিকা গুটি গুটি চলে আসে এই মাঠে। একান্তে বসে খাওয়া সারে, তারপর যে যার মতো বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়।

আজ রেখা সেনগুপ্ত নেই, মিতুল মুনমুন আর অপর্ণা আমগাছের ছায়ায় বসে টিফিনবাকস খালি করছিল। অপর্ণা ব্যাগে করে প্লাস্টিকের ফোল্ডিং চাটাই আনে একখানা, তাই পেতে বসেছে তিনজনে। মিতুল খাচ্ছে পরোটা আলুচচ্চড়ি, অপর্ণা খিচুড়ি, আর মুনমুন টোম্যাটো সসে মাখামাখি হোমমেড চাউমিন। ছোট্টখাট্টো কৃশাঙ্গী মুনমুনের ওই টিফিনটি দেখে মিতুলের ভারী মজা লাগে। কেন যে প্রায় রোজই ওই একই খাদ্য আনে মুনমুন? ওর বাবা সুবল সর্দার মানুষটি শুধু বুঝি বামপন্থীই নন, কট্টর চিনপন্থীও! গ্রামের মেয়েরা তো মুড়িটুড়িই বেশি ভালবাসে বলে জানত মিতুল, কৃষক নেতার কন্যাটি তাকে চমকে দিয়েছে রীতিমতো।

অন্য দিন মুনমুন ওই রক্তবর্ণ নুডলসের মণ্ড খাওয়ার জন্য একবার অন্তত সাধে মিতুলদের, কিন্তু আজ মেয়েটা যেন সকাল থেকেই কেমন অন্যমনস্ক। খাচ্ছেও এক ভাবে, ঘাড় নিচু করে। অপর্ণাও খিচুড়িতে নিমগ্ন, তার মুখেও বাক্যটি নেই। তা অপর্ণা নয় এমনিতেই কথা বলে কম, মুনমুনের আজ হল কী?

অনেকক্ষণ ধরেই প্রশ্নটা মিতুলের পেটে বুড়বুড়ি কাটছিল। ফস করে বেরিয়ে এল, —এই মুনমুন, তোমার কি শরীরটা খারাপ?

মুনমুন দু’দিকে মাথা নাড়ল, —না তো।

—তা হলে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছ কেন?

উত্তর নেই।

অপর্ণা চাপা স্বরে বলল, —ওর বাড়িতে অশান্তি চলছে।

—কী অশান্তি?

অপর্ণা চুপ। আড়চোখে দেখছে মুনমুনকে।

বেশ কয়েকবার পীড়াপীড়ির পর মুনমুন মুখ খুলল। তবে যা বলল তাতে মিতুলের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। মুনমুনের বিয়ে নাকি সব ঠিকঠাক, সামনের অঘ্রানে দিনক্ষণ পর্যন্ত স্থির হয়ে গেছে। হবু বর সরকারি গেজেটেড অফিসার। তা এখন হঠাৎ পাত্রপক্ষ নাকি বেঁকে বসেছে। পাত্রী স্কুলে চাকরি পেয়েছে বলে তারা নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা পণে রাজি হয়েছিল, মুনমুনের স্কুলের টালমাটাল দশার কথা জানতে পেরে তারা দুম করে পণের বহর বাড়িয়ে দিয়েছে। পুরো এক লাখ।

মিতুল স্তম্ভিত মুখে বলল, —বলো কী? সরকারি অফিসার পণ চাইছে? এমন লোককে তো পুলিশে দেওয়া উচিত।

মুনমুন শ্বাস ফেলল, —ওসব করে কোনও লাভ হবে না ভাই। বিয়েতে তো পণ দেওয়া নেওয়া চলবেই।

—তুমি একজন শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এই কথা বলছ?

—তুমিই তো ভারী আশ্চর্য কথা বলছ। ছেলেপক্ষকে টাকা না দিলে মেয়েদের বিয়ে হয় নাকি?

—না হওয়ার কী আছে? জানো না, ডাউরি নেওয়া গ্রস বেআইনি কাজ?

—ওসব আইন তোমাদের শহরের জন্য। গাঁয়ে ওই আইনটাইন চলে না। একশোটা ঘর থাকলে আশিটা ঘরে টাকা দেওয়াটাই আইন।

মিতুল উত্তেজিত মুখে বলল, —তোমার বাবা তো একজন প্রগতিবাদী মানুষ, তিনিই বা ব্যাপারটা হজম করছেন কেন?

মুনমুন ম্লান মুখে বলল, —বাবাও দেশাচারের বাইরে বেরোতে পারবে না। বাবা নিজেই তো দাদার বিয়েতে টাকা নিয়েছিল। আশি হাজার। তাও তো দাদা আধা সরকারি অফিসে কাজ করে। এল-আই-সি’তে।

মিতুলের মুখ দিয়ে আর কথা সরছিল না। যা শুনছে তা সত্যি? মধ্যযুগীয় প্রথা এখনও রমরমিয়ে চলছে? মুনমুনের মতো লেখাপড়া জানা মেয়েরা তা মেনেও নিচ্ছে মুখ বুজে?

অপর্ণার খিচুড়ি শেষ। কোল্ডড্রিংকসের বোতলে জল এনেছিল, ছিপি খুলে ঢকঢক ঢালছে গলায়। গাছের গুঁড়ির ওপারে গিয়ে কুলকুচি করল। বোতলের মুখ আটকাতে আটকাতে বলল, —তোমাদের শহরে কি দেনাপাওনা একেবারে উঠে গেছে সুকন্যা?

মিতুল ঈষৎ থমকে গেল। সত্যি তো, অপর্ণার কথাও তো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। দানসামগ্রীর নাম করে মেয়ের বাড়ি থেকে যা চায়, সেও তো পাহাড়। খাট আলমারি ড্রেসিংটেবিল ওয়ার্ড্রোব, কোথাও কোথাও টিভি ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিন মাইক্রোওভেন, সঙ্গে মেয়ের শাড়ি গয়না, ছেলের ঘড়ি আংটি বোতাম জামা জুতো, মেয়ের কসমেটিকস, ছেলের কসমেটিকস, প্রণামীর কাপড় ইত্যাদি ইত্যাদি তো আছেই। কায়দা করে বলা হয়, মেয়েকে ভালবেসে দেওয়া হল এসব, কিন্তু দিতে গিয়ে বেশির ভাগ বাবা মায়েরই কি নাভিশ্বাস ওঠে না? দেওয়ার মধ্যে একটা বাধ্যবাধকতাও তো থাকে। বাবা-মাকে অহরহ ভাবতে হয়, প্রতিবেশীরা কী বলবে, আত্মীয়স্বজনরা আড়ালে কী ফিসফাস করবে, শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের মান থাকবে কিনা …। দিদির বিয়ের সময়ে বাবা যে কী কষ্ট করে টাকার জোগাড় করেছিল মিতুল কি তা দেখেনি? নগদ দিতে না হলেও এই দেওয়া থোওয়ার রীতি নগদের চেয়ে কম কীসে?

তবু মিতুল তর্কের খাতিরে ক্যাশের প্রসঙ্গটাই ওঠাতে যাচ্ছিল, তখনই সনৎ ঘোষের সেই লোকটা এসে হাজির। সাইকেল থামিয়ে একটু দূর থেকে দেখছে মিতুলদের।

মিতুল টিফিনবক্স বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল, —কিছু বলবেন?

—সনৎদা আপনাদের ডাকছেন।

—কেন?

—খুব জরুরি দরকার।

তিন সহকর্মী মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। গ্রামে এসে মিতুলরা এর-ওর বাড়ি যায় বটে, তবে পারতপক্ষে সনৎ ঘোষ আর বিশ্বম্ভর দাসকে এড়িয়ে চলে। এতদিনে তারা বুঝে গেছে বিশ্বম্ভর আর সনৎ দু’জনেরই গ্রামে ভালই প্রতাপ, এক পক্ষে সামান্য হেলেও অন্য পক্ষের চক্ষুশূল হওয়া কাজের কথা নয়। কিন্তু তারা তলব পাঠালে তো যেতেই হয়।

মুনমুন আর অপর্ণাকে চোখের ইশারা করল মিতুল। তলপিতলপা গুটিয়ে তিনজনেই উঠে পড়েছে। লোকটার পিছু পিছু এল সনৎ সদনে।

বিশ্বম্ভর দাসের মতো না হলেও সনতের বাড়িও নেহাত ছোট নয়। মূল অংশটা একতলা। পাকা। সামনে টানা লম্বা বারান্দা, পিছনে সার সার ঘর। খড়ে ছাওয়া মাটির বাড়িও আছে একখানা। সঙ্গেই। উঠোনও বেশ বড়সড়ই। মধ্যিখানে তুলসী মঞ্চ, খুদে ঘট বাঁধা আছে তুলসীগাছে। খিড়কি দরজা দিয়ে বেরোলে ছোট্ট পুকুর, গোয়ালঘর, গাছগাছালি। বিশ্বম্ভরের মতো দু’খানা নয়, সনতের ধানের মরাই একটিই। তবে সাইজ মন্দ নয়। বাড়ির লাগোয়া খামারবাড়িও আছে। বিশ্বম্ভরের মতোই। উঠোনের মাথা বেয়ে পাকা বাড়িতে ঢুকে গেছে কেবল্ টিভির মোটা তার।

বারান্দায় জমিদারি ভঙ্গিতে বসে ছিল তালসিড়িঙ্গে প্রৌঢ় সনৎ। পুরনো আমলের হাতলঅলা চেয়ারে দু’হাত ছড়িয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে বছর ত্রিশ-বত্রিশের এক তরুণ, আগে কখনও একে দেখেনি মিতুল। পার্টির ছেলে?

মিতুলদের জন্য বারান্দায় মোড়া এনে দিতে বলল সনৎ। বসেছে মিতুলরা। বসেই টের পেল এদিক-ওদিক থেকে উঁকি দিচ্ছে বাড়ির মহিলারা। মিতুলের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছিটের নাইটি পরা এক কিশোরী সুড়ুৎ সরে গেল।

সনৎ বিশ্বম্ভরের মতো বসিয়ে রেখে চাপে ফেলার তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। ঝলক তিনজনকে দেখে নিয়ে কর্তৃত্বব্যঞ্জক সুরে প্রশ্ন করল, —বড়দিদিমণি আসেন নাই আজ?

অপর্ণা মুনমুন শাড়ির আঁচল পাকাচ্ছে। মিতুলই উত্তর দিল, —রেখাদি আজ কলকাতায় গেছেন। হেড অফিসে।

—আশ্চর্য, কাল তো উনি কিছু বললেন না?

—কাল আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বড়দির?

—আমি কাল ডি-আই অফিসে ছিলাম। সনৎ গলা আরও ওজনদার করল, —যাক গে, কাজের কথা শুনুন। ডি-আই অফিসে কাল সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের নতুন পরিচালন সমিতিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন ডি-আই। এটা অবশ্যই আপনাদের জন্য একটা বড় সুসংবাদ।

মিতুল কৌতূহলী মুখে জিজ্ঞেস করল, —বিশ্বম্ভরবাবুও কি ছিলেন মিটিংয়ে?

—ছিল তো বটেই। ওর সামনেই তো দেখিয়ে দিয়েছি যে সভায় ওকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, কর্মসমিতির সেই সভা বৈধ ছিল কিনা। আদালত থেকে কবে বিদ্যালয়ে তত্ত্বাবধায়ক বসানো হয়েছিল, কবে তত্ত্বাবধায়ক প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, মামলার রায়, নতুন কর্মসমিতি কবে থেকে কার্যভার গ্রহণ করেছে, কোন সভায় আমাকে সম্পাদক পদে বহাল করা হল, কত তারিখে নতুন পরিচালন সমিতির পূর্ণ তালিকা জেলা দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে, সমস্ত প্রমাণপত্রই মুখের ওপর ফেলে দিয়েছি।

মিতুল সামান্য উৎসাহিত হল, —ও। তা হলে আর অনিশ্চয়তা থাকছে না?

—কীসের অনিশ্চয়তা? আপনাদের জন্য অ্যাদ্দিন যে হাঁটাহাঁটি করলাম, সে কি এমনি এমনি? শুনলে আপনাদের ভাল লাগবে, আমাদের আঞ্চলিক কমিটি আপনাদের হয়রানির বৃত্তান্ত জেলা কমিটিকে জানিয়েছিল। জেলা কমিটি আপনাদের প্রতি সহানুভূতিপরবশ হয়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল ভায়া প্রাদেশিক কমিটি। শুনে আপনাদের আরও ভাল লাগবে, মন্ত্রীমহাশয় স্বয়ং এখন বিদ্যালয় স্থাপনে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। তিনিই সম্পাদক সংক্রান্ত বিবাদের আশু মীমাংসার জন্য তাঁর দপ্তরকে নির্দেশ দেন। জেলা পরিদর্শক দপ্তরেরও আর তাই ট্যাঁ ফোঁ করার সাধ্য নাই। বিশ্বম্ভর দাসেরও না।

তা সনৎ ঘোষরা এই কাজ আরও আগে করেনি কেন? দু’মাস ধরে অকারণে মিতুলদের আগুনে সেঁকে জলে ভিজিয়ে কী সুখ পেল সনৎরা? মিতুল অবশ্য উচ্চারণ করল না কথাগুলো। অ্যাদ্দিন পর আশার আলো দেখা গেছে এই না কত!

কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটেছে মিতুলের মুখে, —এবার তা হলে নিশ্চয়ই স্কুলের অ্যাপ্রুভালও চলে আসবে?

—সব হবে। আপনাদের চিন্তা ছাড়া আমার মাথায় এখন আর কিছু নাই। বিদ্যালয় চালু করতে হবে, ছাত্রী ভরতি হবে, পঠনপাঠন শুরু হবে, অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে…। বলতে বলতে চোখের কোণ দিয়ে পাশে দণ্ডায়মান তরুণটিকে দেখাল সনৎ,—একে চেনেন?

—না তো।

—নবীন দাস। বিশ্বম্ভর দাসের ভাইপো। আগে মাটিকুমড়া বিদ্যালয়ে পড়াত। মানে যখন সোনাদিঘিতে বিদ্যালয় বসত, তখন। নবীনের খুব ইচ্ছে আবার পূর্ব পদে নিযুক্ত হওয়ার। কিন্তু সে উপায় তো নাই। পঞ্চম শ্রেণি থেকে পড়াতে গেলে অন্তত স্নাতক তো হওয়া আবশ্যক।

মুখে একটা বোকা বোকা হাসি মাখিয়ে নবীন দাস হাত কচলাচ্ছে। মিতুল অপর্ণা আর মুনমুন তিনজনেরই চোখ একবার দেখে নিল তাকে।

সনৎ বলল, —আমি স্থির করেছি নবীনকে অশিক্ষক পদে বহাল করব। বিদ্যালয়ের কাজকর্ম দেখবে, হিসাবপত্র রাখবে …। বিশ্বম্ভরের মতো আমি তো প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ নই, আমার ক্ষমতা দখলের লিপ্সাও নাই। আমি মনে করি পুরনো শিক্ষক হিসেবে নবীনেরও কাজ পাওয়ার একটা ন্যায্য অধিকার আছে।

যার ক্ষমতার আসক্তি থাকে না সে কি এত আমি আমি করে? যাক গে, যা খুশি হোক, এখন মানে মানে জটটা ছাড়লেই মিতুল বাঁচে।

অপর্ণা আস্তে করে ঠেলছে মিতুলকে। ফিসফিস করে বলল, —জিজ্ঞেস করে দ্যাখো না আমরা এখন কী করব?

সনতের কান সর্ব অর্থেই খাড়া। ঠিক শুনতে পেয়ে গেছে। নড়ে বসে বলল, —আপনাদের কী কী করণীয় তা আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি। নতুন করে আপনাদের চাকরিতে যোগদান করতে হবে। আমার কাছে। সেটা আপনারা আজও করতে পারেন, আপনাদের বড়দিদিমণির সঙ্গে পরামর্শ করে কালও করতে পারেন, অথবা সংশোধিত সরকারি আদেশনামা আসা অবধি অপেক্ষাও করতে পারেন। তবে দেরি করলে আপনাদেরই ক্ষতি। যেদিন যোগদান করবেন, সরকার ধরে নেবে সেই দিন থেকেই আপনাদের চাকরি শুরু হল। বুঝতে পারলেন তো কী বলছি?

না, বুঝতে পারেনি মিতুল। তাকাচ্ছে অপর্ণা মুনমুনের দিকে। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে বলল,—আমাদের আগের জয়েনিংটা ধরা হবে না?

—প্রথমদিনই তো আপনাদের সাবধান করে দিয়েছিলাম, আপনারা শোনেননি। সনতের গলায় ধমকের সুর, —ঠিক আছে, দেখব কী করা যায়। আশা করি ওটারও ফয়সালা হয়ে যাবে। আগের চিঠির প্রতিলিপি নিশ্চয়ই রেখে দিয়েছেন?

—হ্যাঁ।

—ওটি হারাবেন না। পরে কাজে লাগলেও লাগতে পারে। আর হ্যাঁ, মাঠের ধারে বসে থাকাটা এবার বন্ধ করুন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানোও আর চলবে না। মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়ের এতে সম্মানহানি হয়।

—কিন্তু বসবটা কোথায়? জায়গা তো নেই?

—প্রথম থেকে আমার বাড়িতে এসে বসে থাকলেই ভাল করতেন। কিন্তু আপনারা তো আমাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। এবার থেকে অবশ্যই আসবেন। আশা করছি শিগগিরই বিদ্যালয়টি সাময়িক ভাবে কোথাও একটা চালু করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে বড়দিদিমণির সঙ্গেও কাল আলোচনা হয়েছে। সনৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, —আজ আপনারা আসতে পারেন।

সনৎ ঘোষ আচমকা কথায় ইতি টেনে দেওয়ায় থতমত খেয়েছে মিতুল। তবু দাঁড়িয়ে পড়ে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, —ধন্যবাদ সনৎবাবু। আজ আপনি আমাদের অনেকটাই ভরসা দিলেন।

সনৎ যেতে গিয়েও থেমে গেল। ভুরুতে গোটা দশেক ভাঁজ ফেলে দেখছে মিতুলকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভাঁজগুলো বিলীন করে দিয়ে বলল, —আপনাদের দোষ দিই না। নতুন চাকরি তো, কিছু নীতি নিয়ম এখনও আপনাদের রপ্ত হয় নাই। বিদ্যালয়ের সম্পাদক মহাশয়কে শিক্ষক শিক্ষিকারা সার বলে সম্বোধন করেন। এটিই প্রথা। আশা করব আপনারাও প্রথাটা মান্য করবেন।

মহা দাম্ভিক লোক তো! তেজে মটমট করছে! তবে মিতুলের পেট গুলিয়ে হাসিও আসছিল। স্যার শব্দটা উচ্চারণের গুণে কেমন ষাঁড় ষাঁড় শোনাল না? থাক বাবা, মশকরা করে কাজ নেই। বিশ্বম্ভরের মতো প্যাঁচালো না হলেও সনতের সত্যি শিং আছে, গুঁতিয়ে দিলেও দিতে পারে।

বাইরে এসে এতক্ষণ বোবা হয়ে থাকা মুনমুনের মুখে খই ফুটছে। চোখ ঘুরিয়ে বলল, —জানো তো, সনৎ ঘোষ যতই ক্রেডিট নিক, আমার বাবাও কিন্তু কলকাঠি নেড়েছিল। জেলা কমিটির সেক্রেটারিকে বাবা কতবার বলেছে জানো?

অপর্ণা ঠোঁট উলটে বলল, —আমার কাকাও তো মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানকে দিয়ে বলিয়েছে। আমাকে তো একদিন ডেকেছিলেন চেয়ারম্যান, ডিটেলে শুনলেন সব। আমার সামনেই তো উনি ফোন করেছিলেন কলকাতায়।

—যে ভাবেই হোক বাবা, ফাঁড়াটা তো কেটেছে। বিপত্তারিণীর থানে আমার মানত করা আছে প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই পাঁচশো এক টাকার পুজো দেব।

—তোমার তো আরও বেশি দেওয়া উচিত ভাই। এক লাখ টাকা আবার পঞ্চাশ হাজারে নেমে যাবে।

—দেখি কী হয়। একটা খিঁচ বেঁধেছে তো, বাবা হয়তে ওখানে আর না-ও এগোতে পারে।

—গলায় দুঃখী দুঃখী সুর কেন, অ্যাঁ? গেজেটেড অফিসারকে খুব মনে ধরেছে?

—ত্যাৎ, কী যে বলো না!

—নাম কী অফিসারবাবুর?

—সমীরণ নস্কর।

—দারুণ রোম্যান্টিক নাম তো! ছুঁলেই মনে হবে গায়ে ফুরফুরে বাতাস লাগছে।

—আমাকে নিয়ে পড়লে কেন? তোমারও তো নিশ্চয়ই সম্বন্ধ আসছে, তাদের কথা বলো না!

—আমার এখন কোনও সুযোগ নেই। অপর্ণার হাসি কেমন মিয়োনো মিয়োনো, —সব কথা তো হুট করে সবাইকে বলা যায় না, আমার মাথায় এখন অনেক দায়িত্ব। মা ভাই বোন মিলে কদ্দিন কাকাদের ঘাড়ে বসে খাব?

—কেন? তোমাদের তো ফ্যামিলি বিজনেস?

—নামেই ফ্যামিলি বিজনেস, দেখার লোক নেই। বাবা যদ্দিন ছিল বাবাই চালাত। এখন মেজোকাকা আর সেজোকাকা কোনওক্রমে হাল ধরে আছে। বড়কাকা তো পার্টি নিয়েই মেতে থাকে, ছোটকাকাও চাকরি নিয়ে বাইরে এখন। নেহাত যৌথ পরিবার বলে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায়। ভাইটা সবে কলেজে ঢুকল, দু’বোন নাইন আর সিক্স, এখন চাকরির কথা না ভেবে বিয়ের চিন্তা করলে আমার চলবে? কাকারা যতই বলুক আমরা আছি, বড় মেয়ে হিসেবে আমার তো একটা কর্তব্য আছে, না কী?

মিতুল হাঁটতে হাঁটতে দু’জনের কথাই শুনছিল। অপর্ণা আর মুনমুন কেন যে সবসময়ে ভয়ে ভয়ে থাকে আন্দাজ করতে পারছে কিছুটা। দু’জনের কাছেই চাকরিটা যেন নিশ্চিন্ত জীবনের হাতছানি। একজন মা ভাই বোন নিয়ে কাকাদের সংসারে মাথা উঁচু করে থাকতে চায়, অন্যজনের স্বপ্ন ভাল বর। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য, তাই না?

গল্পে কথায় এসে গেছে বাসরাস্তা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাসও। এ লাইনের কনডাক্টর চিনে গেছে নতুন দিদিমণিদের, বাচ্চাকাচ্চাদের ঠেলেঠুলে বসার জায়গাও করে দিল। অপর্ণার গন্তব্যস্থল চন্দ্ৰপল্লি, এই বাসেই সোজা চলে যাবে সে। মুনমুন বামুনঘাটা থেকে ধরবে শেয়ারের ভ্যানরিকশা। মিতুলের পথই এখন সবচেয়ে লম্বা। ভাদ্রের গরমে পচতে পচতে না হোক আরও ঘণ্টাতিনেক।

আজ অবশ্য অতটা সময় লাগল না। বামুনঘাটায় এসেই মিলে গেছে বাস, সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই মিতুল পৌঁছে গেছে বাড়ি।

মৃদুলা টেলিফোনে কথা বলছিল, মিতুলকে দরজা খুলে দিয়েই আবার ফিরে গেছে রিসিভারে। চোখ নাচিয়ে বলল, —তোর দিদি।

ক্লান্ত মিতুল সোফায় গা ছেড়ে দিয়েছে। চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, —বাবা ফেরেনি?

—দেরি হবে আজ। নির্মলবাবুদের বাড়ি যাবে।

—ও।

—তুতুল তোকে কী বলতে চাইছে।

—কীই?

—ধর না এসে ফোনটা।

মিতুলের মোটেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তবু গিয়ে ধরল ফোন, —কী বলছিস?

—তোর জন্য একটা দারুণ কাঁথাস্টিচের শাড়ি রেখেছি। প্রতীকের অফিসের ডিপিদা আছেন না, ডিপিদার মিসেস পাঠিয়েছিলেন একটা লোককে। শান্তিনিকেতনের তাঁতি। আমার জন্য একটা মেরুন রেখেছি, তোর জন্যে গোল্ডেন। পিয়োর সিল্কের ওপর দুর্দান্ত কাজ।

—আমার জন্য আবার শাড়ি রাখতে গেলি কেন?

—তুই তো আজকাল খুব শাড়ি পরছিস।

—সে তো স্কুলে। উপায় নেই বলে। জানিস তো আমার শাড়ি পরতে ভাল্লাগে না। মিছিমিছি এক কাঁড়ি দাম দিয়ে …

—দাম নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। পরতে হলে পরবি, নইলে বিয়ের জন্য তুলে রাখবি। মা’র জন্যেও রেখেছি একখানা। তসরের ওপর অলওভার ছোট ছোট মোটিফ।

তুতুলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, এটা কি বাবাকে দিয়ে কালো টাকা সাদা করানোর ঘুষ? বলল না। থাক, কী দরকার! অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল মিতুল। রুপাইয়ের কথায়।

এলোমেলো সংলাপের মাঝে আচমকাই মনে পড়ল কথাটা। অতনুদার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার ঘটনাটা বলা হয়নি দিদিকে। আজ বলবে কি?

থাক। কী দরকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *