০১. স্নানে ঢুকেছিল দোলা

চার দেওয়াল – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

চিত্রা লাহিড়ী-কে

.

০১.

আজ খেয়ে উঠে স্নানে ঢুকেছিল দোলা। চার দিন শ্যাম্পু করা হয়নি, অনেকক্ষণ ধরে মাথা ঘষেছে আজ। এ পাড়ার জলটা খুব খারাপ, নিয়মিত তেলসাবানের যত্ন না নিলে হুহু করে চুল ওঠে।

তেতলার পুঁচকে ব্যালকনিটায় তোয়ালে মেলতে এসে দোলা টের পেল, রোদ্দুরের আজ বড় তাত। কী যে ছাই হচ্ছে, আবহাওয়ার কোনও ছিরিছাঁদ নেই। এ বছর শীত তো তেমন পড়লই না। এদিকে মাঘ না ফুরোতেই দুপদাপিয়ে এসে গেছে গরম। এখনই যেন দুপুরবেলাটায় গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গোটা পৃথিবীরই নাকি উষ্ণতা বাড়ছে ক্রমশ। টিভিতে সে দিন দেখাচ্ছিল, নানান হাবিজাবি গ্যাসের দাপটে বায়ুমণ্ডলের কী সব স্তর নাকি ফেটেফুটে গেছে, এই তাপবৃদ্ধি নাকি তারই পরিণাম। পাহাড়-পর্বতে শতসহস্র বছর ধরে জমে থাকা হিমবাহ পর্যন্ত গলে যাচ্ছে দ্রুত। এমন ধারা চলতে থাকলে শীত গ্রীষ্মের মাঝে বসন্ত ঋতুটা কি আর থাকবে?

অবশ্য কংক্রিটের জঙ্গলে বসন্তকে তো টের পাওয়াই ভার। তেলে-ধুলোয় মলিন গাছে দু’-চারটে ফুল ফোটে বটে, ব্যস ওই পর্যন্তই। বছর পাঁচেক আগেও দোলারা যখন এ পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে এল, সবুজের ছিটেফোঁটা ছিল এদিক ওদিক। পিছনের জমিটাতেই তো গাছ-আগাছার মাঝে একটা কৃষ্ণচূড়া লকলক বেড়ে উঠছিল। কচি গাছ, তাও চৈত্রমাসে লালে লাল। কোথায় সেই কৃষ্ণচূড়া, এখন সেখানে দামড়া ফ্ল্যাট। বাইপাসের দিকটাতে তো ধড়াধড় হাইরাইজ উঠছে। দখিনা বাতাস যদি বা আসে এ দিকে, ঠেকে ঠেকে। হটলোহায় ঠোক্কর খেতে খেতে।

গেটে ট্যাক্সি থামল একটা। পাশের ব্লকের দোতলার গার্গী ছেলে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরল। বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে গার্গীর, কী এক কস্‌মেটিক্স কোম্পানির এজেন্সি নিয়ে ছেলেটাকে একাই মানুষ করছে। ইদানীং মা-ও এসে থাকছে বুঝি। পাশের ফ্ল্যাটের মন্দিরা বলে, ওই এজেন্সি ফেজেন্সি নাকি কামোফ্লেজ, গার্গী নাকি ধান্দায় নেমে গেছে। কে জানে বাবা কী, তবে শুনতেও তো খারাপ লাগে। কী যে ছাই হচ্ছে আজকাল!

টুকটাক ভাবনার মাঝেই টেলিফোনের ঝংকার। কান পেতে দোলা শুনল দু’-এক সেকেন্ড। কার ফোন? দিদি? এই দুপুরবেলাটাই তো দিদির গল্পগাছার সময়। এ কথা সে কথার পর ঘুরেফিরে সেই বাবান। মেলবোর্ন থেকে বাবান ফোনে কী কী বলল, বাবানের বউ সেখানে এখন কোন কোন রান্নায় পোক্ত হয়েছে, উইকএন্ডে তারা ছুটিতে কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল…। কাছে যখন ছিল সারাক্ষণ ছেলে ছেলে করেছে, দূরে গিয়েও এখনও বাবানই দিদির টাইমপাস। বাবানের কথা ভেবেই না ই-মেল করা পর্যন্ত শিখে নিল! অবশ্য দ্বিপ্রাহরিক টেলিফোন মাতৃদেবীর হওয়াও বিচিত্র নয়। ভাইয়া-ঝুমা অফিসে, নাতনি স্কুলে, এই অবসরেই না মেয়েদের কাছে বধূনিন্দার পাটটুকু চুকিয়ে নেয় মা।

শোওয়ার ঘর ভেদ করে দোলা লিভিং হলে এল। হল বলাটা অবশ্য ব্যজস্তুতি। তিতানের ভাষায় খড়মের হাফসোল। মাত্র আটশো নব্বই স্কোয়্যার ফিটে তিন তিনখানা ঘর, দুটো টয়লেট, কিচেন ব্যালকনি পুরে দিলে হল আর বেরোবে কোথ্‌থেকে! আদতে এক ফালি এল শেপের জায়গা, যার এক দিকে খাওয়া, অন্য দিকে বসা। ঠেসেঠুসে। চেপেচুপে।

টেলিফোন থাকে বসার জায়গায়। বেঁটে মতন চৌকো টেবিলে। অলস হাতে রিসিভার তুলে দোলা একটু নাড়া খেয়ে গেল। মা নয়, দিদি নয়, অংশুদা!

কী খবর দোলনচাঁপা? কেমন আছ?

পরিশীলিত চর্চিত ওই কণ্ঠস্বর এক ধাক্কায় দোলার উনপঞ্চাশ বছর বয়সটাকে যেন কয়েক ধাপ কমিয়ে দেয়। নাটুকে ভঙ্গিতে দোলা বলে উঠল,—হঠাৎ অভাগিনীকে স্মরণ এল যে বড়?

তোমায় ভুলব কেন ভদ্রে? আমার কি স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে?

তা হলে এত দিন সাড়াশব্দ নেই কেন?

অ্যাই মেয়ে, তুমি বছরে ক’বার ফোন করো? আমি নয় সাত কাজে থাকি, তুমি তো ঘরেই বসে…। মাসে দু’মাসে একটা রিং করলে কি বরের বেশি পয়সা খরচা হয়?

পলকের জন্য দোলার মনে পড়ল, গত মাসেই টেলিফোনের বিল দেখে খ্যাচখ্যাচ করছিল তুহিন। ফোনে আড্ডা মারার সময়ে টাইমটার দিকেও একটু নজর রেখো! বকবক করেই চলেছ, করেই চলেছ…! অথচ মেয়ে যে ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেটে বসে, চ্যাট চলছে, গেমস চলছে… সে কথা বাবুর মাথায় থাকে না। কিংবা হয়তো থাকে। মেয়েকে সরাসরি বলতে পারে না, দোলার ওপর চোটপাট।

ক্ষণিকের তিক্ততা সরিয়ে রেখে দোলা একটা আহ্লাদি আহ্লাদি ভাব ফোটাল গলায়,—আচ্ছা বাবা আচ্ছা, সব দোষ আমার।… আপনাদের খবর বলুন। রানিবউদি কেমন আছেন?

আরে সে তো এক জবরদস্ত কেলো করেছিল। দিল্লিতে কল-শো করতে গিয়ে, ঠান্ডা-ফান্ডা লাগিয়ে, লাস্ট মোমেন্টে তার স্বরযন্ত্র বিকল। গলা দিয়ে হড়হাঁসের মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে।

তার পর? কী করলেন?

একটা শো শর্মিষ্ঠাকে দিয়ে ম্যানেজ করলাম। বাকি দুটোয় রানি জোর করে নামল। আমাদের অপযশ হল খানিকটা।

কী যে বলেন! রানিবউদির স্টেজ অ্যাপিয়ারেন্সের মূল্যই আলাদা।

সে তো তোমাদের কাছে। যারা গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে আমাদের নিয়ে গেছে, তারা তো হানড্রেড পারসেন্টই চাইবে।… আমাদের শর্মিষ্ঠাও যদি ঠিকঠাক ম্যাচিওর করে যেত, তা হলে এই প্রবলেমগুলো আর হয় না।

শর্মিষ্ঠা কি এখনও স্টেজ-শাই আছে?

তা হয়তো নেই। তবে একটা বড় রোল ক্যারি করার ক্ষমতাও তো নেই। আর আমাদেরও কপাল, একটা ভাল মেয়ে পাচ্ছি না। তুমি যখন আসতে… ভেবেছিলাম যাক, গ্রুপে তাও একটা ফিমেল বাড়ল। তা তুমিও তো সংসারের ছুতো দেখিয়ে কেটে পড়লে।

ছুতো নয়, অসুবিধে তো দোলার সত্যিই হচ্ছিল। ঘরের লোক যদি রোজ রোজ অসন্তোষ প্রকাশ করে, কারণে অকারণে তার নাটকের প্রতি আগ্রহকে কটাক্ষ হানে, কাঁহাতক ভাল লাগে! অশালীন মন্তব্যও তুহিন কম করেনি। ওই অশান্তি বুকে নিয়ে গ্রুপে যাওয়া…! তার চেয়ে বরং জানলাটা বন্ধই থাক। সংসারে সুখের চেয়ে স্বস্তিই তো শ্রেয়, নয় কি?

জোর করে চপল হল দোলা। খিলখিল হাসছে,—কী যে বলেন…! আমায় দিয়ে থোড়াই আপনাদের কাজ চলত! দেখেননি, রিহার্সালে প্রক্সি দিতে গিয়েই কেমন ঠকঠক কাঁপতাম!

সে নয় একটু গড়েপিটে নেওয়া যেত। অন্তত একটা ফিমেল তো বাড়ত।

দ্বিতীয় বার উচ্চারিত বাক্যটি টুং করে বাজল দোলার কানে। একটা ফিমেল তো বাড়ত…! বটেই তো, সে তো শুধুই একটা সংখ্যা। ফিমেল ক্যারেক্টার। ঘরেও। বাইরেও। অংশুদাও তাকে তার বেশি কিছু ভাবে না।

এবারও হালকা বিষাদটাকে ছুঁতে দিল না দোলা। হাসতে হাসতেই বলল,—আমার কথা থাক। গ্রুপের সবাই কে কেমন আছে? পলাশ? বিষাণ? সৌমাল্য?

বিষাণ তো বেরিয়ে গেছে। বাকিদের নিয়ে টুকটুক করে চালাচ্ছি আর কী। আমার পুত্রটি তো কিছুতেই গ্রুপে এল না।

কেন?

তার গানে ইন্টারেস্ট। বাংলা ব্যান্ড করছে। আমি অবশ্য ওটাকে গান বলি না। জন্মে কোনওদিন চর্চা নেই, গিটার নিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে শিল্পী বনে গেল?… আমি যে নাটকে অল্পস্বল্প গান গাই, তার জন্যও আমায় রীতিমতো অনুশীলন করতে হয়। অথচ এরা রেওয়াজের নামে গাঁক গাঁক চেঁচাচ্ছে, আর পাড়ার লোকের কান ঝালাপালা করছে।

কী করবেন বলুন, এটাই তো যুগের হাওয়া। বয়সের ধর্ম।

হুম, চটজলদি খ্যাতির বাজার। এখন তো প্রতিভা যাচাই হয় এস-এম-এস পোলে। অংশুর গলা গমগম বাজল,—তোমার ছেলে এবার কলেজে ঢুকেছে না?

হ্যাঁ। বি-কম পড়ছে।

তারও কি মাথায় এখনকার ভূত চেপেছে?

ভূত কিনা জানি না অংশুদা। তবে খুব পলিটিক্স নিয়ে মেতেছে। কলেজে ইউনিয়ন করছে।

দেখো, পলিটিক্স বড় সাংঘাতিক নেশা। বয়সটা তো ভাল নয়, ইমোশনের মাথায় কোথায় কী ঘটিয়ে ফেলে…! এখন রাজনীতি ব্যাপারটাও তো খুব সুস্থ ভাবে চলে না।

বলি তো। শোনে কই?

এটাও বয়সের ধর্ম। দরাজ গলায় হেসে উঠল অংশু,—যাক গে, অনেক প্রিল্যুড হল, এবার কাজের কথায় আসি। আমাদের নতুন নাটক নামছে। ছন্নছাড়া। ফার্স্ট শো মার্চের ছাব্বিশ। অ্যাকাডেমিতে। দেরি আছে, তবু আগাম বলে রাখলাম।

এ কী অংশুদা, ভাল খবরটা এতক্ষণ চেপে রেখেছেন?

ওই যে বললাম… প্যাঁ-পোঁটা বাজিয়ে নিয়ে তার পর…

নিশ্চয়ই আপনার লেখা?

না। এবার অন্যের একটা উপন্যাস ধরে করছি। নতুন ধরনের থিম। কী ভাবে একটা মানুষ এই বাজারি দুনিয়ায় ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে…। তুমি আসছ তো?

সে আর বলতে। অবশ্যই।

তারিখটা মনে রেখো। পারলে সে দিন তুহিনকেও ধরে এনো।

তুহিন যাবে নাটক দেখতে? ভাবাটাই একটু বাড়াবাড়ি নয় কি? অংশু রায়ের পীড়াপীড়িতে একবারই মাত্র গিয়েছিল, বছর আষ্টেক আগে। ফিরে এসে কী বিরক্তি! ও সব আঁতলামির মধ্যে আর টানবে না বলে দিলাম! আমার পোষায় না! বটেই তো। তুহিন মিত্রর জগৎটাই তো আলাদা।

পলকা শ্বাস ফেলে দোলা বলল,—তুহিনকে বাদ দিন। জানেনই তো কেমন ব্যস্ত মানুষ। এখনও তো মাসের মধ্যে পনেরো দিন ট্যুরে ছুটছে… অফিস থেকেও কখন ফেরে না ফেরে ঠিক নেই…

বেশ। তবে একাই এসো। অংশু একটুক্ষণ চুপ। তারপর ফের গলা বেজেছে,—এর মধ্যে একদিন তোমার মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলেছে?

কই, না তো!

বোধহয় ভুলে গেছে। মোবাইলে কথা বলতে বলতে থিয়েটার রোড ধরে হনহন হাঁটছিল। আমার সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগার জোগাড়। অনেক কাল দেখিনি তো, প্রথমটা চিনতে পারিনি। ক্রস করে যাওয়ার পর মনে হল, আরে এ তো দোলনচাঁপার মেয়ে! সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ধরেছি।

চিনল আপনাকে? কথা হল?

প্রথমটা একটু থমকেছিল। তারপর ওই…হাই, হ্যালো…! খুব তাড়ায় ছিল মনে হয়।

হুঁ, ওর সারাক্ষণই তাড়া।

দারুণ স্মার্ট হয়েছে কিন্তু মেয়েটা। তোমার মতো সেই ঢলঢলে লাবণ্যটা হয়তো নেই, তবে যথেষ্ট চার্মিং।

স্তুতিটা যেন সেভাবে উপভোগ করতে পারল না দোলা। তার লাবণ্য আছে কি নেই, আদৌ কি অংশুদা লক্ষ করেছে কখনও? অন্তত যে বয়সটাতে মেয়েরা আশা করে? হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগে অংশু রায় বছরখানেক ইংরিজি পড়িয়েছিল দোলাকে! মাসতুতো দাদার বন্ধু, ইংরিজিতে এম-এ করছে, দোলাকে পড়ানোর জন্য রন্টুদাই তাকে ঠিক করে দিয়েছিল। কী আবেগ দিয়ে যে পড়াত অংশুদা! শেলি, কিট্স, ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠত। মার্চেন্ট অব ভেনিসের একটা অংশ পাঠ্য ছিল দোলাদের। ব্যাসানিও আর পোরশিয়ার সংলাপ তো প্রায় অভিনয় করে দেখাত। পড়া নয়, হাঁ করে অংশুদাকেই যেন গিলত দোলা। পালটা কোনও মুগ্ধতা কি দেখেছে অংশুদার চোখে? সেভাবে পাত্তাই দিল না কখনও। আজ হঠাৎ দোলার রূপের প্রশংসা তো নির্মম রসিকতা।

দোলা আলগাভাবে বলল,—আজকালকার মেয়েরা সবাই ওরকম স্মার্ট হয় অংশুদা। আমাদের সময়ের মতো কেউ আর বোকাহাবা নেই।

তা যা বলেছ। আবার গলা খেলিয়ে হাসল অংশু,—যুগটা খুব ফাস্ট বদলে গেল…

টেলিফোন ছাড়ার পর দোলা নিঝুম দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। অংশুদার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে, আবার মনটা কেমন খারাপও হয়ে যায়। পাল্লাটা যে কোন দিকে বেশি ঝোঁকে বোঝা কঠিন। একই অতীত কীভাবে যে মনকে দু’ভাবে দুলিয়ে দেয়! কী এমন ক্ষতি হত, অংশুদাদের গ্রুপে সে একটু জড়িয়ে থাকলে? সপ্তাহে তো মাত্র দুটো-তিনটে দিন, তাও বিকেল-সন্ধেগুলো…! সৃষ্টি ছেড়ে দিয়েই বা দোলার সংসার কী এমন শিখরে উঠল? ছেলেমেয়ে দুটো তো যা হওয়ার তাই হল। তাদের বাবা-মা এমন কিছু পণ্ডিত দিগ্‌গজ নয়, তারাই বা সাংঘাতিক মেধাবী হবে কোথ্থেকে? দোলা তাদের ঘাড়ে দিনরাত চেপে থাকলেও কি তারা নিউটন, আইনস্টাইন বনত?

তবু তিয়ার ব্যাপারে একটু মন-খচখচ আছে দোলার। বি এ-তে রেজাল্ট খারাপ ছিল না তিয়ার, স্বচ্ছন্দে এম এ-টা পড়তে পারত। ও পথে মেয়ে হাঁটলই না। হাজারে হাজারে পল্-সায়েন্সে এম এ নাকি ফ্যা ফ্যা ঘুরছে, সংখ্যা বাড়ানোর তার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই। বরং সে একটা কোর্স-টোর্স কিছু করবে, যাতে আখেরে লাভ হয়। এককাঁড়ি টাকা খরচা করে নিজের ইচ্ছেমতো ম্যানেজমেন্টের একটা কোর্স শুরু করল, এখন তো পরীক্ষাটরিক্ষা দিয়ে ডিপ্লোমাও জুটিয়ে ফেলেছে। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো, ক্লাস-টাসের বালাই নেই, মেয়ে একই সঙ্গে চাকরিও করে যাচ্ছিল পুরো দমে। নিজেই জোগাড়যন্ত্র করে ক্রেডিট কার্ড বেচা শুরু করল। সেটা ছেড়ে মাঝে কিছু দিন রইল এক টেলি-সার্ভিসে। মোবাইলের গ্রাহক ধরিয়ে দিয়ে কমিশন। হালফিল ঢুকেছে এক গাড়ি ডিস্ট্রিবিউটারের শো-রুমে। সল্স অফিসার। এই চাকরিরও মেয়াদ ক’দিন কে জানে! বললে উলটে শুনিয়ে দেয়, এ ভাবেই নাকি উঠতে হয় এখন। ধরবে ছাড়বে, ছাড়বে ধরবে, এটাই নাকি এখনকার দস্তুর।

হবেও বা। থিতু না হওয়াটাই হয়তো উন্নতির সোপান। কিন্তু তিয়াকে কেন যেন বড় বেশি অস্থিরমতি মনে হয় দোলার। বড্ড খরখরে কথাবার্তা বলে এক এক সময়ে। আগে আগে ভাবত, এ বুঝি বয়ঃসন্ধির স্বাভাবিক ঔদ্ধত্য, এখন বুঝেছে এটাই তিয়ার স্বভাব। নিজের খেয়ালখুশিতে চলা, মাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা…

বাবাকেও কি বিশেষ আমল দেয় মেয়ে? তুহিন তো মাঝে মাঝেই গার্জেনি ফলাতে যায়, এঁটে উঠতে পারে কি? তিয়ার ওপর তুহিনের একটা আলগা দুর্বলতাও বুঝি আছে। হাজার হোক, মেয়ে তো। নইলে যে বাবার কথা এ বাড়িতে আইন, অবলীলায় তার গজগজানি এ কান দিয়ে ঢুকিয়ে ও কান দিয়ে বার করে দিতে পারে তিয়া?

কী যে হবে ওই মেয়ের! বিয়ে-টিয়েও তো এক্ষুনি দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না। প্রসঙ্গ তুললে তিয়া মুখের ওপর বলে দেয়, কেন ফাটা রেকর্ড বাজাচ্ছ মা? আমার ভাবনা আমাকেই ভাবতে দাও না। বাবানের বিয়ের পর তো হাসতে হাসতে বলে দিল, চেনা নেই, জানা নেই, এমন একটা মেয়ের সঙ্গে কী করে যে বাবানদা দরজা আটকে শুয়ে পড়তে রাজি হয়ে গেল? ছি ছি, আমি তো ভাবতেও পারি না। ওই সব ভাষার পর বিয়ের ব্যাপারে আর এগোনো যায়?

যাক গে, মরুক গে, যার যা প্রাণ চায় করুক। মেয়ে তার মর্জি মতো চলুক, ছেলে ইউনিয়নবাজি করে বেড়াক… দোলা আর সংসার নিয়ে ভাববেই না। কেন ভাববে? সংসার তার কথা কতটুকু ভেবেছে?

কষটে মেজাজে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল দোলা। অংশুদার ওপর হঠাৎ কেমন রাগ হচ্ছে। হয় মাঝে মাঝে। বেশ তো সে চোখকান বুজে ঘরসংসার করে যাচ্ছিল, অংশুদার ফের আবির্ভাবের কী প্রয়োজন ছিল? নিজেকে অসুখী ভাবার বদ রোগটা তো দোলার তা হলে গজাত না।

অবশ্য অংশুকে দোষ দিয়ে কী লাভ, খাল কেটে কুমির তো দোলাই এনেছিল।

দিনটা এখনও স্পষ্ট দেখতে পায় দোলা। উঁহুঁ, দিন নয়, সন্ধে। তারা তখন লেক গার্ডেন্সের ভাড়াবাড়িতে। ছেলের স্কুলের প্রজেক্টের জন্য চার্টপেপার কিনতে বেরিয়েছে দোলা, মোড়ের মাথায় আচমকা অংশুদা! প্রায় দু’যুগ পর। হায়ার সেকেন্ডারির পরে সেই প্রথম।

অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিল অংশু। দোলা ডেকে উঠেছিল,— অংশুদা না?

প্রাক্তন ছাত্রীকে চিনতে দু’-এক সেকেন্ড বুঝি সময় লাগল অংশুর। পরক্ষণে একগাল হাসি,— আরে, দোলনচাঁপা যে? তুমি এখানে কোথথেকে?

কত বছর পর নিজের পুরো নামটা শুনল দোলা। ওই নামে এখন আর কেই বা ডাকে তাকে! উনচল্লিশের দোলা পলকে শিহরিত। বুঝি বা পুরনো মুগ্ধতায় আচ্ছন্নও কিছুটা। পুলকিত স্বরে বলেছিল,— আমি তো এ পাড়াতেই থাকি। আপনি এখানে?

আমার গ্রুপের একটা ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দেখতে এসেছিলাম।

গ্রুপ? দোলার মাথায় ঢোকেনি,— কীসের গ্রুপ?

নাটকের। তুমি সৃষ্টির নাম শোনোনি?

সৃষ্টি কেন, দুটো-চারটে বড় নাটকের দল ছাড়া কারও নাম কি জানত দোলা? খবরের কাগজে থিয়েটারের বিজ্ঞাপনেই বা চোখ বোলাত কই! স্বামী, সংসার, ছেলেমেয়েতেই তো হাবুডুবু তখন। মাঝে ঝড়ঝাপটাও তো কম গেল না। তুহিনদের রবার ইন্ডিয়ার টালমাটাল দশা, সরকারি ছেড়ে বেসরকারি সংস্থায় যোগ দিল তুহিন, শাশুড়ি মারা গেলেন…। তবু তার মধ্যেই ফাঁক বুঝে কচিৎ কখনও সিনেমা, কিংবা এর ওর বাড়ি, ব্যস এইটুকুই তো পৃথিবী। দোলাকে একদা মোহিত করে দেওয়া প্রাইভেট টিউটরটি যে একটা নাটকের দল গড়েছে, এ খবর কি তখন দোলার পক্ষে রাখা সম্ভব? যার কাছ থেকে জানলেও জানা যেত, সেই রন্টুদাও এখন চণ্ডীগড়প্রবাসী। দেখাসাক্ষাৎ নেইই প্রায়।

নিজের অজ্ঞতাটা অবশ্য মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারেনি দোলা। ঢোঁক গিলে বলেছিল,— হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার তো এখন খুব নাম।

নামফাম কিছু নেই। লড়ে যাচ্ছি।… যাক, তোমার সমাচার শোনাও।

চলছে। বর এখন ভেনাস রবারে। এক মেয়ে, এক ছেলে। মেয়ে ক্লাস এইট, ছেলে ফোর।… চলুন না, কাছেই আমার বাড়ি।

কত ছোট ছোট ঘটনা জীবনের অভিমুখই বদলে দেয়। শুধু অভিমুখ নয়, ভারসাম্যও। সেদিন সন্ধেবেলায় দোলা যদি চার্টপেপার কিনতে না বেরোত, যদি তিয়া বা তিতানকে পাঠাত দোকানে, তা হলে পরের দু’-তিনটে বছর তো অন্য রকম হত না। না হলেই বা কী এসে যেত? হয়তো জীবনটা আর একটু বোদা হত, কিন্তু দোলা আদৌ টের পেত কি?

ধুওোর ছাই, দোলা তো সমঝোতা করেই নিয়েছে, কেন মিছিমিছি টোকো ভাবনায় পীড়িত হওয়া! ঘাড় ঘুরিয়ে দোলা দেওয়ালঘড়ি দেখল। তিনটে দশ। চারটে নাগাদ সাবিত্রী আসবে, তার আগে দুধের ডেকচিটায় জল ঢেলে রাখা দরকার। ভেজানো না থাকলে মাজতে অসুবিধে হয় সাবিত্রীর, ট্যাকট্যাক করে।

রান্নাঘর ঘুরে দোলা বসার জায়গায় এল। টিভি চালিয়েছে। এই সময় আগের রাতে প্রচারিত হিন্দি ধারাবাহিকগুলো আবার দেখায়। সন্ধেটা বাংলার জন্য বরাদ্দ, দুপুর বিকেলে এক-আধটা মেগা সিরিয়াল দেখে দোলা। গল্পের মাথামুণ্ডু নেই, অনন্তকাল ধরে চলছে কাহিনি, চড়া নাটকে মাঝে মাঝে হাসি পেয়ে যায়। তবু যেন দোলার খানিকটা নেশা ধরে গেছে। তার ঠাকুমা দুপুর সন্ধেয় আফিম খেয়ে ঝিমোত, এ যেন তারই সমগোত্রীয়। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনির পর জীবন আবার থেমে গেছে তো, নেশাটা ভাল কাজ দেয়।

আজ গল্প ক্লাইম্যাক্সে। বাড়ির ছোটবউকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে প্রাক্তন প্রেমিক, মেয়েটা চিৎকার করছে…। মেয়েটির দ্বিতীয় বর, হবি তো হ’, ওই পথেই আসছে গাড়ি নিয়ে… যাহ্, টায়ার পাংচার হয়ে গেল! কোথথেকে এক প্রকাণ্ড ট্রাক ধেয়ে আসছে… পিষে ফেলবে নাকি বরটাকে?

জানার আগেই বিজ্ঞাপনের বিরতি। ঝকঝকে গাড়ি… মন মাতানো রং… তন্বী মোবাইল… চটকদার প্রসাধনী… মিহি গুঁড়োমশলা…

ছোট্ট একটা হাই তুলে রিমোটে এ-চ্যানেল ও-চ্যানেল ঘুরতে লাগল দোলা। হঠাৎই একটা বাংলা সংবাদে এসে থেমে গেছে আঙুল। কী খবর দেখায় ওটা? ছাত্র সংসদের নির্বাচন ঘিরে তিতানদের কলেজে গন্ডগোল? বোমা পড়েছে? মারামারি চলছে?

তিতানদের কলেজের গেটটা দেখাল ঝলক। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ভরে গেছে, তার মধ্যেই এলোপাথাড়ি ছুটছে ছেলেমেয়েরা…!

দোলার মুখ পলকে পাংশু। তিতান কোথায়? সে ঠিক আছে তো? একটু আগেই অংশুদা বলছিল, বয়সটা ভাল নয়… ইমোশনের মাথায় কখন কী ঘটিয়ে বসে…!

ক্ষণপূর্বেও সংসার সম্পর্কে উদাসীন হতে চাওয়া দোলার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ সহসা। কী করবে সে এখন? কী করবে?

.

০২.

আর কতক্ষণ বসে থাকব স্যার? এবার বাড়ি যাই?

মোবাইলটা অন্তত ফেরত দিন। বাড়িতে খবরটবর দিই।

আপনি কিন্তু অকারণে আটকে রেখেছেন। আসল কালপ্রিটদের পতা করতে পারলেন না, কাজ দেখাতে আমাদের নিয়ে টানাটানি! দেখলেন তো, আমরা টিটি খেলছিলাম।

আপনাদের থানাটা কিন্তু বড্ড স্টাফি। অক্সিজেন সাপ্লাই কম। মাথা ধরে যাচ্ছে।

আমার তো ঘুম পেয়ে গেল। একটা সিগারেট খেতে পারি স্যার?

মধ্যবয়সি সেকেন্ড অফিসারটি মাথা নামিয়ে কী যেন লেখালিখি করছিল। চোখ তুলে ধারালো দৃষ্টি হানল একখানা। হাত পাঁচ-ছয় দূরে, তিন কমরেডের সঙ্গে, টানা লম্বা বেঞ্চিতে বসে থাকা তিতান একটু যেন কেঁপে গেল। থানায় সে কস্মিনকালে ঢোকেনি, পুলিশ সম্পর্কে তার একটা স্বাভাবিক আড়ষ্টতা আছে। ধরে আনার পর থেকে তার বেশ ভয় ভয়ই করছিল। অবশ্য গায়ে হাত দূরে থাক, কেউ এখনও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। ঠায় বসিয়ে রেখেছে, এই যা। তবে ভ্যানে তোলার আগে জোর দাবড়াচ্ছিল সেকেন্ড অফিসার। এখনও যেন সেই হুংকার তিতানের কানে লেগে। কেন যে তিতান আগেভাগে কেটে পড়েনি!

অশান্তির শুরু বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ। আজ ছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। সংসদ টানা ষোলো বছর তিতানদের পার্টির দখলে। গত সাত-আট বছর তো ইলেকশনের পাটই নেই, বিপক্ষ দল তো মনোনয়নপত্র দাখিলের সুযোগই পায় না। কলেজের একশো হাতের মধ্যে মিছিলটিছিল নিয়ে ঘেঁষার চেষ্টা করলেই রে রে করে তেড়ে যায় কমরেডরা, ছত্রভঙ্গ হয়ে পালায় প্রতিপক্ষ। এবারও সে রকমটাই হবে ধারণা ছিল তিতানদের। অন্তত খবর তো সে রকমই ছিল। কিন্তু এবার অন্য রণকৌশল নিয়েছিল পালটা দল। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে কলেজে এসে হঠাৎই একজোট হয়ে স্লোগান শুরু করে দিল। অফিসে মনোনয়নপত্র জমা নিচ্ছিলেন এক অধ্যাপক, হুড়মুড় করে সেখানেও হাজির। ক্ষণিকের জন্য হকচকিয়ে গেলেও তিতানদের দল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়েছিল প্রতিরোধে। মারপিট, ধস্তাধস্তি করে হঠিয়েও দিল ছেলেগুলোকে। পার্টির স্থানীয় অফিসে খবরও গেল নিয়মমাফিক। ঘন্টাখানেকের মধ্যে যথারীতি জঙ্গি ক্যাডাররা হাজির। বিশুদ্ধ মার্ক্সীয় খিস্তি ছুড়তে ছুড়তে গোটা দুয়েক বামপন্থী বোমা টপকে দিল কলেজ গেটে। তিতানরাও ভাবল, সমস্যার বুঝি ইতি, এবারের মতো ঝঞ্ঝাট চুকেবুকে গেল। কিন্তু গুন্ডাবাজিতে বিপক্ষ দলও তো কম দড় নয়। তাদেরও দাদা দিদি আছে। পেশি আছে। বোমা পিস্তল আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা, তারা বেশ মরিয়া ছিল এবার। সুতরাং আড়াইটে নাগাদ আবার তারা আসরে। এবার দু’-চারটে দক্ষিণপন্থী বোমা। হল্লা। খিস্তিখেউড়। তবে এবারও পরাজয়। উলটে তিতানরা তাদের একজনকে পাকড়াও করে, চড় থাপ্পড় কষিয়ে, আটকে রাখল ইউনিয়ন রুমে। ব্যস, ওই দলও ওমনি ছুটল থানায়। বন্দে মাতরম ধ্বনিতে কাঁপিয়ে দিল পুলিশচৌকি।

তা ছাত্রদের ঝামেলায় পুলিশ আজকাল সহজে নাক গলাতে চায় না। কোথায় কোন ছাত্রর গায়ে বেকায়দায় হাত পড়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য জুড়ে ছাত্র ধর্মঘট…। তার ওপর শাসক দলের ছাত্রফ্রন্টকে তারা একটু সমঝে-বুঝেই চলে। এটাই রীতি। অলিখিত আইন। কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে একটু তো নড়াচড়া করতেই হয়। তা ছাড়া এই সেকেন্ড অফিসারটিও কিঞ্চিৎ টেঁটিয়া টাইপ। সম্ভবত এখনও নিজেকে আইনের রক্ষক মনে করে। সটান ইউনিয়ন রুমে এসে ছেলেটিকে উদ্ধার তো করলই, হাতের কাছে যে চার জনকে পেল তুলে আনল থানায়। টেবিল টেনিস খেলার দোহাইকে পাত্তাই দিল না।

কী যে লোকটার মতিগতি, ঠাহর করতে পারছিল না তিতান। সেই চারটে থেকে ধরে এনে বসিয়ে রেখেছে, কখন যে ছাড়বে? মুচলেকা টুচলেকা লেখাতে চায়? থানা একটু ফাঁকা হলে হাতের সুখ করবে না তো? একটাই যা ভরসা, তিন-চার ঘন্টা বসে থেকে তিতান টের পাচ্ছে, থানা এমনই এক জায়গা যা কখনওই নির্জন হয় না। চোর গুন্ডা পাতাখোর পকেটমার বাড়িওয়ালা ভাড়াটে, হরেক কিসিমের চিড়িয়া আসছে তো আসছেই। খানিক আগে বরের নামে ডায়েরি লিখিয়ে গেল এক মাঝবয়সি মহিলা। দেখে দেখে প্রাথমিক শঙ্কাটা কেটেছে খানিক, তবু চোরা ধুকপুকুনি একটা রয়েই গেছে। শ্ৰীমন্ত, বরুণরা অনেক বেশি পোড়খাওয়া, বরুণ তো ইউনিয়ন করার জন্যই গত বছর পার্ট ওয়ান ড্রপ দিল, তিতানের এখনও ততটা হাড় পাকেনি।

তা বলে কমরেডদের সামনে তিতান কি মানসিক দুর্বলতা দেখাতে পারে? সাহস করে সেও তাই ফুট কাটছে মাঝে মাঝে। সে যে ক্রমশ হেক্কড় হয়ে উঠছে, প্রমাণ করার এটাই তো রাস্তা।

তিতান কনুই দিয়ে আস্তে ঠেলল বরুণকে। ঝুঁকে পল্লবকে কী যেন বলছিল বরুণ, ঘুরে তাকিয়েছে,— কিছু বলছিস?

তিতান গ্রাম্ভারি ভাব আনল গলায়,— এবার তো কিছু একটা করতে হয়। তুমি যে বললে পল্টুদা এসে যাবে?

তাই তো ভাবছি রে। মিটিং-টিটিংয়ে আটকে পড়ল নাকি?

পল্লব বলল,— কিন্তু এভাবে তো আটকে রাখার কথা নয়…

শালা দারোগাটা বহুত হারামি। শ্ৰীমন্ত দাঁত কিড়মিড় করল,— আমাদের খেলাচ্ছে।… প্রতিক্রিয়াশীল গান্ডুটাকে নর্থ বেঙ্গল পাঠানো দরকার। পল্টুদাকে বলব, জোনাল কমিটির মিটিংয়ে কথাটা তুলতে।

সেকেন্ড অফিসারের বুঝি কুত্তার কান। দুম করে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে। ভুরু নাচিয়ে শ্ৰীমন্তকে বলল,— কী বললি রে তুই? আর একবার বল।

শ্ৰীমন্ত কাঁধ ঝাঁকাল,— কিছু না তো।

কায়দা মারবি না। খপ করে শ্রীমন্তর কাঁধ খামচে ধরেছে অফিসার। কড়া গলায় বলল,— অনেকক্ষণ ধরে তোদের কপচানি হজম করছি। এবার কিন্তু লিমিট পেরিয়ে যাচ্ছিস।

খারাপ কথা কী বললাম?

ভাল খারাপের বোধ তোদের আছে? শ্ৰীমন্তকে ছেড়ে লোকটার চোখ বাকি তিন জনে ঘুরল একবার। দৃষ্টি তো নয়, যেন ছাগল জবাইয়ের আগে কসাই ছুরি শানাচ্ছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,— পোশাক-আশাকে তো ভদ্রবাড়ির ছেলে বলেই মনে হয়। ভাষা এমন ইতরের মতো কেন?

আমি তো আপনাকে কিছু বলিনি।

চোপ। নাক টিপলে দুধ বেরোয়, মুখে মুখে তর্ক! বাপ-মা পয়সা খরচ করে কলেজে পাঠিয়েছে কি গুন্ডামি মস্তানি করতে?

আমরা গুন্ডামি করিনি। খেলছিলাম।

খেলা আমি ছুটিয়ে দেব। একটা কথা মাথায় রাখবি… আমি যত দিন এই থানায় আছি… ফের যদি কোনও কমপ্লেন পাই… তোদের পল্টুদা বিল্টুদা কেউ এসে ছাড়াতে পারবে না। এক রাত হাজতে থাকলে বুঝবি কত ধানে কত চাল!

শ্ৰীমন্তর জোশ খতম। মিনমিনে গলায় বলল,— আপনি শুধু আমাদের দোষ দেখছেন। ওরা যে হামলা করল, অথচ ওদের আপনি…

সে কৈফিয়ত তোকে দেব নাকি? যা ভাগ। আমার মুড আরও খারাপ হওয়ার আগে কেটে পড়।

টেবিলের দেরাজ খুলে চার জনের চারখানা মোবাইল বার করে দিল অফিসার। তিতানকে ফোনটা হাতে দিয়ে চোখ পিটপিট করছে,— অ্যাই, তোর নাম কী রে?

তিতান ঢোঁক গিলে বলল,— কেন?

বলতে আপত্তি আছে?

না, না। আমি সায়র। মিত্র।

কোন ইয়ার?

ফার্স্ট ইয়ার বি-কম। অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স।

হুম। সায়র মানে জানিস?

তিতান ঢক করে ঘাড় নাড়ল,— দিঘি।

তা হলে নালানর্দমায় ঘুরছিস কেন? পার্টিবাজি ছেড়ে মন দিয়ে পড়াশুনা কর গে যা।

বাইরে বেরিয়ে তিতান যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। শ্ৰীমন্ত পল্লবদেরও রোঁয়া ফুলেছে। পল্লব দাঁত বার করে বলল,— ব্যাটা আমাদের ছেড়ে দিল কেন বল তো?

কেন?

পন্টুদার নাম শুনে কানে জল গেছে। মুখে যতই তড়পাক, চাকরির ভয় আছে তো।

তাই কি? তিতানের তো বেশ দাপুটেই মনে হল লোকটাকে। শ্ৰীমন্তর মতো ওস্তাদকেও কেমন পেড়ে ফেলেছিল! ভাবতে ভাবতে মোবাইল চালু করল তিতান। কী কাণ্ড, পরের পর মিসড কল অ্যালার্ট! বাড়ি থেকে অগুনতি, বাবার মোবাইল থেকে চার বার। আশ্চর্য, সাড়ে তিনটের সময়ে মা’র সঙ্গে কথা হল, তখন পইপই করে তিতান বলে দিল, কলেজের গন্ডগোল নিয়ে মাকে উতলা হতে হবে না, সব চুকেবুকে গেছে… তার পরেও এত বার ফোন? তিতানের ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে চিন্তা? কীই বা এমন রাত হয়েছে, সবে তো আটটা চল্লিশ…! আজব নার্ভাস পাবলিক বটে মা! বাবাকেও নির্ঘাত ব্যতিব্যস্ত করে দিয়েছে!

চটপট বাড়ির লাইনটা ধরতে গিয়েও তিতান নিরস্ত হল। থাক, ভাবতে চাইছে ভাবুক। ভুগুক আর একটু। অকারণ টেনশন করার জন্যে মা’র একটু শাস্তি পাওয়া প্রয়োজন। তিতান যে আর কচি খোকা নেই, কেন বুঝবে না মা?

বরুণ মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা সারছে। ফোন অফ করে বলল,— পল্টুদা জ্যামে ফেঁসে আছে। আমরা বেরিয়ে পড়েছি জেনে নিশ্চিন্ত হল।

শ্ৰীমন্ত উৎসুক স্বরে বলল,— দারোগাটার কথা বললি? কেমন বোর করেছে আমাদের?

বোর নয়, ইনসাল্ট। বরুণ গম্ভীর,— দাঁড়া না, কাল পার্টি অফিসে গিয়ে ডিটেলে জানাব।

শ্ৰীমন্ত বলল,— আমি শুধু বিশ্বজিৎদের হিম্মতের কথাটা ভাবছি। জানে আমাদের কলেজে লাইফে এনট্রি পাবে না, তবু কেন যে ক্যাচাল পাকাতে এসেছিল!

বটেই তো, কী সাহস! নমিনেশন ফাইল করতে আসে!

নমিনেশন পেপার ওরা পেল কোথথেকে বল তো? কবে তুলে নিয়ে গেল?

সম্ভবত আজকের মতোই ট্যাকটিক্স নিয়েছিল। আলাদা আলাদা এসে…

কিন্তু পায় কী করে?… শালা এ-কে-এসটা জালি করেনি তো? মুখে হয়তো গদগদ ভাব দেখায়, তলে তলে…। শালা মাস্টারগুলোর তো কোনও রঙের ঠিক নেই। কখন লাল, কখন গেরুয়া… তুই বুঝতেও পারবি না। কেমিস্ট্রির পি-এমকে দেখেছিস তো, সারাক্ষণ প্রিন্সিপালের গায়ে মক্ষীর মতো সেঁটে থাকে। পল্টুদাকে দেখলে ঢলে ঢলে পড়ে। অথচ ও মাল নিজের পাড়ায় কিন্তু তেরঙ্গা।

তোকে কে বলল।

জানি, জানি। আমাদের নেটওয়ার্কে সব ধরা পড়ে।

বিশ্বজিৎ শুভেন্দুদের কেসটা এবার ছানবিন করতে হবে। জানা দরকার, ঠিক কে ওদের মদত দিল। ভেতর থেকেই কেউ? নাকি যতীন রায় কলেজটা ক্যাপচার করতে পেরে পুড়কি বেড়েছে শালাদের?… আরে ভাই, ওখানে তোদের অ্যাকশন স্কোয়াড স্ট্রং বলে এখানেও খাপ খুলবি? শালা এমন মাউস টিপে দেব… রক্ত আমাশা হাগবি রে।

তিতান চুপচাপ বন্ধুদের আস্ফালন শুনছিল। দুপুর থেকে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। ফস করে বলে বসল,— আচ্ছা, ওরা নমিনেশন ফাইল করলে আমাদের কী এমন ক্ষতি হত?

ঢ্যাঙা বরুণ লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,— মানে?

মানে… লড়ালড়ি হলে কি আমরা জিততাম না? স্টুডেন্টদের ওপর কি আমাদের যথেষ্ট কনফিডেন্স নেই? হোল্ড নেই?

বাচ্চা ছেলের মতো কথা বলিস না তো! খামোখা ঝুঁকি আমরা নেব কেন? ওদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে কেউ যদি পালটি খেয়ে গিয়ে থাকে…

কিন্তু এভাবে তো আমরা নিজেদের রিয়েল স্ট্রেংথ বুঝতেও পারব না। স্টুডেন্টরা সত্যি সত্যি আমাদের চায় কিনা…

আবার বাচ্চাদের মতো কথা! বরুণ হো হো হেসে উঠল,— অন্য কাউকে চাওয়ার রাইট ওদের কেন থাকবে? আমরা তো জানি, আমরাই স্টুডেন্টদের ভাল করছি। তারা আমাদের জন্য থাকলে, আমরাও তাদের দেখভাল করব। বেফালতু কারও চাওয়া চাওয়িতে যাওয়ার দরকার কী?

জবাবটা তিতানের ঠিক মনঃপূত হল না যেন। এ কথা সত্যি, বিরোধী পক্ষ দুর্বল হওয়ায় তাদের কলেজে মোটামুটি একটা শৃঙ্খলা বজায় আছে। ক্লাস-টাস যেমনই হোক, যতীন রায় কলেজের মতো রোজ রোজ তুলকালাম হয় না। আবার এটাও তো মানতে হবে, এক-আধ বার অন্তত ভোটাভুটিটা হতে দিয়ে নিজেদের অবস্থা যাচাই করে নেওয়া উচিত। যাক গে যাক, তিতানের এত মাথাব্যথার প্রয়োজনটাই বা কী! ইউনিয়ন করার সুবাদে সে এখন পাদপ্রদীপের আলোয় রয়েছে, এটাই তো তার কাছে অনেকখানি। মাত্র আট মাস কলেজে ঢুকেছে, এখনই কত ছেলেমেয়ে চেনে তাকে। পল্টুদা যে পল্টুদা… পার্টির জোনাল কমিটির মেম্বার, কলেজের গভর্নিং বডিতেও আছে… সে পর্যন্ত দেখা হলে কত খাতির করে কথা বলে। তোমরাই তো পার্টির ভবিষ্যৎ, তোমরাই পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে…

সামনে তেমাথার মোড়। বরুণ আর শ্ৰীমন্ত সোজা চলে গেল। এই অঞ্চলেই থাকে তারা, হাঁটাপথের দূরত্বে। পল্লব আর তিতান ঘুরল বাঁয়ে। বাস ধরবে।

বাসস্টপ ফাঁকা ফাঁকা। বাতাসে অল্প শিরশিরে ভাব। ডেনিম জ্যাকেটের বোতাম আটকে তিতান হাতে হাত ঘষল। পল্লব একখানা সিগারেট ধরিয়েছে, দেখে মুচকি হাসল তিতান। কৌতুকের সুরে বলল,— অ্যাই, তুই এতক্ষণ প্যাকেটটা বার করিসনি কেন রে?

পল্লব হেসে ফেলল,— জানিসই তো, শালা বরুণদাটা দেখলেই…। শালা মহা চিপ্পুস! জম্মে কখনও কিনবে না, অন্য কেউ ধরালেই লগা বাড়াবে! এবং দুটো-চারটে যা আছে, দ্যাখ না দ্যাখ ফিনিশ।

বরুণদার ফ্যামিলি কন্ডিশন খুব ভাল নয়, তাই না?

ঠিক জানি না। বাপের বোধহয় দোকান-টোকান আছে। গ্রসারি শপ। লম্বা ধোঁয়া বুকে টানল পল্লব। হঠাৎই খ্যাঁক খ্যাঁক হাসছে,— অ্যাই, তোর কেসটা কী বল তো?

কী কেস?

দারোগা ব্যাটা অচানক তোর ওপর সফ্ট হয়ে পড়ল কেন রে?

আমি কী করে জানব?

সিম্পল। পল্লব চোখ টিপল,— ও ব্যাটা নির্ঘাত হোমো। তোর লালটু লালটু চেহারাটা দেখে শালার রুল উসখুস করছিল।

যাহ, কী যে বলিস!

শরমিও না বস। যা একখানা মেয়ে-পটানো ফেস তোমার… বালিকারা তো ফটাফট ফিদা হচ্ছে।

অ্যাই, আওয়াজ মারবি না।

আপঅন গড। এই তো পরশু সাইকোলজির মেয়েটা… কী যেন নাম… শ্রেয়া…। বলছিল, তোকে দেখলেই নাকি ওর হার্টবিট বেড়ে যায়।

তিতান ঈষৎ রোমাঞ্চিত বোধ করল। তবু একটা উদাসীন ভাব ফুটিয়েছে মুখে,— কোন মেয়েটা বল তো? আমি চিনি?

খুব চেনো। স্মরজিতের সঙ্গে প্রায়ই আসে ইউনিয়ন রুমে। ব্যাপক খিল্লি খায়।

নিখুঁত মনে করতে পারল না তিতান। একটা শ্যামলা রং, চোখ বড় বড় মেয়ে মাঝে মাঝে ইউনিয়ন রুমে হাসির তুফান তোলে। তার নামই কি শ্রেয়া? মেয়েটা ইউনিয়নের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত নয়। তবে কি তিতানের টানেই আসে?

পল্লব পেটে খোঁচা মারল,— কী বস, ধ্যানে ডুবলে নাকি? তোমার লাইফে এরকম বহুত আসবে, দু’-চার পিস আমাদেরও পাস কোরো।

তিতান ভুরু বেঁকাল,— অ্যাই, তোর তো আছে!

ও হেভি সেয়ানা। গায়ে হাতফাত দিতে দেয় না, শুধু ডায়ালগ মারতে হয়।

তা কলেজের মেয়েদের নিয়ে যা খুশি করা যায় বুঝি?

একটু আধটু কোনও ব্যাপারই নয়। ওরাও চায়, বুঝলি। জাস্ট তক্কে তক্কে থাকতে হয় আর কী। পল্লব আবার চোখ টিপল,— শ্রেয়ার সঙ্গে ট্রাই নিয়ে দ্যাখ না। মনে তো হয় লেগে যাবে। তখন ফার্স্ট কিসটা আমার নামে উৎসর্গ করে দিস।

পল্লবের পিঠে চটাস এক থাপ্পড় কষাল তিতান। ছিটকে সরে গেছে পল্লব। হ্যা হ্যা হাসছে। তাদের দেখে এখন কে বলবে মাত্র মিনিট কুড়ি আগে তারা ছাড়া পেয়েছে থানা থেকে!

মোড় ঘুরে একটা মিনিবাস থামল স্টপেজে। একেবারেই ভিড় নেই, একদম পিছনের সিটে গিয়ে বসল তিতান। পাশে পল্লব।

তিতান জিজ্ঞেস করল,— তুই বাঘা যতীনেই নামবি তো?

আর এখন যাব কোথায়! সন্ধে তো গন।

কিছু একটা ছিল বুঝি সন্ধেবেলা?

রুমির আজ যাদবপুরে পড়তে আসার কথা। ইকো স্যারের খোঁয়াড়ে। ভেবেছিলাম, পড়ে বেরোলে আজ একবার…

তুই কিন্তু রুমির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিসনি!

খেপেছ বস! তুমি স্ক্রিনে এলে ও-পার্টি আর আমার দিকে তাকাবে! বলেই পল্লব দু’সেকেন্ড চুপ। চোখ পিটপিট করছে। কপালে ভঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,— হ্যাঁরে, কলেজের অ্যাকশনটা কি সত্যিই নিউজে দেখিয়েছে?

আমার মা তো খবরটা টিভি থেকেই পেয়েছিল।

শালা টিভি চ্যানেলগুলো জিনা হারাম করে দেবে মাইরি! বাড়িতে যদি দেখে থাকে… বহুত বাওয়াল হবে।

চিন্তাটা তিতানের মাথাতেও উঁকি দিচ্ছে বটে। একা মা হলে পট্টি পরানো যেত। মা একটু নাদান টাইপ। কিন্তু বাবা…? ব্যাপক হল্লা জুড়ে কানের পোকা বার করে দেয়। দিদির সঙ্গে সুবিধে করতে পারে না তো, তাই ছেলেকেই পেষো! অবশ্য মা-ও পেষানিটা খায়। তা সে নয় বরের ঝাড় ভালবাসে, কিন্তু তিতান কেন..? ধুস, ভাল্লাগে না।

এসে গেল বাঘা যতীন। পল্লব উঠে পড়েছে। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, কাল বরুণদার সঙ্গে যাচ্ছিস নাকি? পার্টি অফিসে?

আগে কলেজ তো যাই।

আমি কিন্তু কাল বাঙ্ক। এক পিসি-পিসেমশাই এসেছে কানাডা থেকে। কাল দুপুরে বাড়িতে খাবে।

তুই সেখানে কী করবি?

একটু মাখনটাখন লাগাব। যদি গ্যাস-ট্যাস খেয়ে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে হেলপ করে। এমনিতে তো হবে না…

কনডাক্টর টিকিট চাইছে। বুড়ো আঙুলে বন্ধুকে দেখিয়ে দিয়ে ফের একবার চোখ টিপে নেমে গেল পল্লব। আপন মনে হাসল তিতান। একমাত্র এই বন্ধুটির সঙ্গই তার বেশ লাগে। ওয়েভলেংথে মেলে মোটামুটি। পার্টি করে বটে পল্লব, তবে ছাড়া ছাড়া। আছে, আবার নেইও। তিতানকেও ওরকমই থাকতে হবে। ভেসে ভেসে। পল্লবের মগজ বেশ সাফ, এখন থেকেই বিদেশ যাওয়ার ছক কষছে। বরুণদারা যতই বুলি কপচাক, এই পোড়া দেশে থেকে কী লাভ? এত মানুষের গাদাগাদি, পিলপিল করছে বেকার…! বাবানদা এসেছিল পুজোয়, কত গল্প শুনিয়ে গেল মেলবোর্নের। আহা, সে নাকি এক অতি মনোরম শহর। ধুলোবালি নেই, ভিড়ভাট্টা নেই, আকাশ ঝকঝকে নীল, বাতাসে কিলো কিলো অক্সিজেন…। অলিবউদি তো আহ্লাদে ডগমগ। এমন শান্ত মসৃণ জীবন, দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতো কেটে যায়। মেলবোর্নের ট্রামও নাকি দেখার মতো। এখানকার মতো লঝঝড়ে রংচটা নয়, ঝকঝক করছে। তরতরিয়ে ছোটে লাইন বেয়ে…

ইস, তিতানের কখনও ওসব ট্রামে চড়া হবে না। তার কেরিয়ারটাই এমন বিচ্ছিরি ভাবে ঘেঁটে গেল। মাধ্যমিকে টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশনের পরও মরিয়া হয়ে, স্কুল বদলে, সায়েন্স নিয়েছিল। শেষ অবধি সামাল দিতে পারল কই! এমন কঠিন কোর্স, এত প্রকাণ্ড সিলেবাস…! টিউটোরিয়াল মিউটোরিয়াল ধরেও শেষমেশ দু’দাঁড়ি। রেজাল্ট পদের হলে তাও ফিজিক্স ম্যাথস নিয়ে কোথাও একটা ঢুকে এ বছরটা পুরো জয়েন্টের জন্য জান লড়িয়ে দিত। ধুস, আর সায়েন্স! বাবার ঠেলায় কমার্সে এসে অনার্সও একটা মিলেছে, কিন্তু ভাল লাগছে না তিতানের। ডেবিট ক্রেডিট মার্কেট শেয়ার ডিম্যান্ড সাপ্লাই… ধুস, পোষায় নাকি? বাবার হয়তো আশা, ছেলে সি-এ হবে। পাগল? তিতানের মুরোদ কতটা, তিতান কি জানে না?

নাহ, তিতানের কিস্যু হবে না। এই পার্টি ফাটির সঙ্গেই সেঁটে থাকতে হবে তিতানকে। যদি তাতে অন্তত করেকন্মে খাওয়ার মতো একটা ভবিষ্যৎ তৈরি হয়। কাল চলেই যাবে পার্টি অফিসে? শুধু পল্টুদা কেন, বাকি মুখগুলোকেও তো চেনা দরকার।

ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনা নিয়ে বাস থেকে নামল তিতান। হাঁটছে দুলে দুলে। হঠাৎই টের পেল খিদেয় চনচন করছে পেট। দুপুরে ক্যান্টিনে এক প্লেট ঘুগনি খেয়েছিল, তারপর তো বাওয়াল, পুলিশভ্যান…। মনে হচ্ছে পাকস্থলীতে বহু যুগ দানাপানি পড়েনি। বাড়ি গিয়ে আগে খাবার, না খিস্তি কোনটা জুটবে কে জানে!

বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না তিতানের। কিন্তু বাড়ি ছাড়া আর গতিই বা কী! রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরোয় সপাটে লাথি কাল তিতান। ধুস, ভাল্লাগে না।

.

০৩.

তোমার কি খুব একা লাগছে? জীবনে নতুন উত্তেজনা চাও? নীচের নম্বরে ডায়াল করো, মন ঝরঝরে হয়ে যাবে। কলচার্জ প্রতি মিনিটে মাত্র ছ’টাকা।

চুলে ব্রাশ চালাতে চালাতে মোবাইলে সদ্যপ্রাপ্ত সংক্ষিপ্ত ইংরিজি বার্তাটি পড়ল তিয়া। সেলফোনে প্রায়ই আসে এরকম আহ্বান। প্রথম প্রথম কৌতূহলের বশে তিয়া টিপেছে নম্বরটা। নাম দাও, বয়স দাও, মেয়ে না ছেলে জানাও, এরকম সাতসতেরো ফ্যাকড়া পার হয়ে শোনা যাবে কোনও সম্ভাব্য পুরুষবন্ধুর কণ্ঠস্বর। দু’-পাঁচ মিনিট কথা বলে দেখেছে তিয়া, কারও সঙ্গেই পটে না। বেশির ভাগই কেমন মেকি, ফোনালাপের চেয়ে সরাসরি সাক্ষাতেই তারা বেশি আগ্রহী। সোনালি বলে, ওপারের কণ্ঠটি ছাব্বিশের না হয়ে বাষট্টিরও হতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলে অবশ্য। এবং সোনালির তাতে বয়েই গেল। সাতাশের জায়গায় তিপ্পান্ন এল, কি তিরিশের বদলে পঁয়তাল্লিশ, কারও একটা ঘাড় ভেঙে মস্তি করতে পারলেই সোনালি খুশি। কিন্তু তিয়া কি তা পারবে? নৈতিকতা ফৈতিকতা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না তিয়া, তবু কোথায় যেন বাধে। সংস্কার? উঁহুঁ, তাও নয়। হয়তো বা রুচি। নাম বয়স না ভাঁড়ালেই বা কী, প্রায় অপরিচিত একজনের সঙ্গে ক্লাব হোটেলে গিয়ে উদ্দাম হইহই, নাচাগানা কিংবা গাড়ি মোটরবাইকে চেপে যত্রতত্র খানিক পাড়ি জমানো…! খারাপ কি ভাল, মন্তব্য করবে না তিয়া। তবে এসব তার ধাতে নেই। কেন তা হলে ফালতু মজা চাখতে গিয়ে মোবাইলের ব্যালেন্সটাকে ফক্কা বানানো!

তিয়া টুপুস করে বারতাটিকে মুছে দিল। খুব হালকা করে ঠোঁটে লিপস্টিক বুলিয়ে আয়নার তিয়াকে দেখল ভাল করে। নীল জিনসের সঙ্গে কালো টপটা যাচ্ছে তো? নাকি সাদা এমব্রয়ডারি করাটা পরবে? থাক গে, আর সময় নেই, পৌনে দশটার মধ্যে কসবায় পৌঁছোতে হবে। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গেলেই কেলো, কাজটা মার খেয়ে যাবে আজ।

নিরাভরণ নিটোল হাতে ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে তিয়া হাঁক পাড়ল, —মা, তোমার কদ্দূর?

সঙ্গে সঙ্গে দোলার স্বর উড়ে এসেছে, — আয় না, খাবার তো রেখে দিয়েছি।

আর একবার আয়নায় নিজেকে দেখল তিয়া। তারপর কাঁধছোঁয়া স্টেপকাট চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বেরিয়ে এল। ডাইনিং টেবিলে বসেই নাক কুঁচকেছে, —আজও টোস্ট পোচ?

দোলা রান্নাঘরে ফিরছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, —তোর তো সকালে ভাজাভুজি পছন্দ হয় না। নইলে আজ ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানাব ভেবেছিলাম।

স্যান্ডুইচ দিতে পারতে।

পরশুই তো তুই স্যান্ডুইচ নিয়ে হল্লা জুড়েছিলি!।

উঁহুঁ, পরশু নয়। তার আগের দিন। তিয়া হালকা হাসল, —মাঝে দুটো দিন কেটে গেছে মা।

কী জানি বাবা, কখন তোমার কী খেতে ভাল লাগে। দোলা হাত উলটোল, —আজ ফলের রসে আপত্তি নেই তো?

মা যে কী না! বড্ড বেশি ছকে বাঁধা। ভাল লাগা, মন্দ লাগাটাও যেন একটা বাঁধা নিয়মের গণ্ডিতে আটকানো। একদিন তিয়া কোনও খাবার অপছন্দ করল, তো ওমনি সেটা ঢুকে পড়ল বাতিলের তালিকায়। আকাশ দিনের মধ্যে চোদ্দো বার রং বদলাতে পারে, তিয়ার ইচ্ছে অনিচ্ছে পালটাতে পারে না? এসব বোঝার মতো মনই নেই মা’র।

তিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, —কথা না বাড়িয়ে দাও যা প্রাণ চায়। ঝটপট।

আজ তোর এত কীসের তাড়া?

কাজ আছে। এক জায়গায় ঘুরে তার পর অফিস যাব।

কারও সঙ্গে দেখা করবি বুঝি?

ইয়েস।

তোর অফিসের কাজের ব্যাপারে?

টোস্টে কামড় দিয়ে চোখ তুলল তিয়া, —আমি কি এখন খেলাধুলো করতে বেরোচ্ছি মনে হয়?

অমন বাঁকাভাবে বলছিস কেন? দোলা যেন সামান্য আহত।

কারণ সোজা কথা তুমি বোঝো না! তিয়া একবারে গোটা পোচটা মুখে পুরে দিল। একমুখ খাবার নিয়ে বলল, —বাবা কোনওদিন তাড়াতাড়ি বেরোলে তাকে এত প্রশ্ন করো?

প্রশ্ন করার দরকার হয় না। সে নিজেই বলে।

সে তো দায়ে পড়ে। হয় তোমায় জলদি জলদি ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে, নয় কাকভোরে উঠে সুটকেস গুছোতে হবে…

দোলা গুম হয়ে গেল। ঢুকে গেছে রান্নাঘরে। মা’র শুকনো মুখখানা দেখে একটু বুঝি খারাপই লাগল তিয়ার। কতবার ভেবেছে, মাকে এসব আর বলবে না। কেন যে মুখ ফসকে অপ্রিয় সত্যগুলো বেরিয়ে যায়! মা তো দিব্যি নিজেকে সংসারের একটা প্রয়োজনীয় আসবাব ভেবেই তৃপ্ত, তিয়া যে কেন মানতে পারে না! মায়ের হয়ে গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়াও তো করল না কখনও, উলটে মায়ের ওপরই ঝাল ঝাড়ে। এটা কি এক ধরনের হিপোক্রেসি নয়?

দোলা ফলের রস এনেছে। ভাবনা নিয়ে নাড়াচাড়া করার আর সময় নেই তিয়ার, এক চুমুকে গ্লাস সাফ। দৌড়েছে ব্যাগ আনতে। একঝলক উঁকি দিল ভাইয়ের ঘরে। বাবু হাত পা ছড়িয়ে নিদ্রামগ্ন। বাবা অফিস বেরোনোর আগে ভাইয়া উঠে দাঁত মাজছিল না? আবার গিয়ে শুয়েছে? অনেক রাত অবধি জাগছে নাকি? করেটা কী? পড়াশুনো? ছোট সোফায় বসে হাইহিলের স্ট্র্যাপ বাঁধতে বাঁধতে তিয়ার হঠাৎই মনে হল, তিতানের গায়ের চামড়াটা ইদানীং বড্ড পুরু হয়ে গেছে। সে দিন কলেজে গন্ডগোল, রাত করে বাড়ি ফিরে বেদম ঝাড় খেল বাবার। অথচ পর দিন সকালেই বিন্দাস। মোবাইলে টাকা ভরার জন্য মাকে জপাচ্ছে। মা হাত উলটে দিতেই ওমনি দিদি। কোনও লজ্জা নেই, মান অপমান নেই…। তিয়া হলে তো সাতদিন বাড়িতে কারও সঙ্গে কথা বলত না।

দু’দিকে মাথা দোলাতে দোলাতে তিয়া দরজা খুলতে যাচ্ছিল, পিছনে মা।

তুই আজ ফিরছিস কখন?

কেন?

পারলে একটু তাড়াতাড়ি আসিস।

কেন?

কাল ভোরে তোর বাবা জামশেদপুর যাচ্ছে…

তো?

পালটা প্রশ্নটা অর্ধসমাপ্ত রেখে তিয়া স্থাণু কয়েক সেকেন্ড। বাবার তো মাসে দশ বার ট্যুর, তার জন্য আজ হঠাৎ তিয়াকে কেন চটপট ফিরতে হবে? নাহ, তিয়ার মাথায় ঢুকছে না। এক এক সময়ে মা যে কী অর্থহীন কথা বলে! কাল হয়তো আবদার জুড়বে, তোর বাবা নেই, আজ বেশি দেরি করিস না কিন্তু! ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বাবার ছুতো না দেখিয়ে সরাসরি তো বলতে পারে, রোজ সন্ধে সন্ধে ঘরে ঢুকে যাস তিয়া, তুই না ফেরা পর্যন্ত আমার বুক কাঁপে…! তিয়াও তা হলে সাফ সাফ জানিয়ে দিতে পারে, সম্ভব নয় মা। শো-রুমই বন্ধ হয় সাড়ে সাতটায়, তার পরেও অফিসে অজস্র কাজ। মেয়ে বলেই ঝটপট পালিয়ে আসব? বরং মেয়ে বলেই না কর্মক্ষেত্রে তাকে প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করতে হয় সে অযোগ্য নয়! আর সেই চাপ বইতে গিয়েও তো খাটুনির মাত্রা বাড়ে খানিকটা। অবশ্য এক আধদিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প-আড্ডাও চলে বই কী। তাতেও দেরি হয় মাঝেমধ্যে। তা চাকরি করছে বলে তিয়ার জীবন তো মরুভূমি হয়ে যায়নি! শুধু অফিস বাড়ি, বাড়ি অফিসই করে যাবে সে, ব্যস? ভাবেটা কী মা?

আবাসনের গেট পেরোতেই চিন্তাগুলো অবশ্য কর্পূরের মতো উধাও। দ্রুত পা চলছে তিয়ার। বড় রাস্তায় পৌঁছে হাত দেখিয়ে একটা অটো থামাল। পিছনে জায়গা নেই, ড্রাইভারের পাশে বসতে হবে। আইনে যদিও তিন জনের বেশি যাত্রী নেওয়ার কথা নয়, তবু এভাবেই চলছে অটোগুলো। এ শহরে বেআইনই আইন। পুলিশ আছে, পার্টি আছে, ভাবনা কী অটোওয়ালাদের!

অফিসটাইমে পরবর্তী অটোতেও একই হাল থাকবে ধরে নিয়ে ঝটিতি উঠে পড়ল তিয়া। বাঁ হাতে মাথার রডখানা পাকড়েছে।

তখনই মোবাইলে টুং টাং। এস-এম-এস। ডান হাতে কোনওক্রমে তিয়া বার করল যন্ত্রখানা। বার্তা দেখে ঠোঁটে চিলতে হাসি। মোবাইলেই টাইমটা দেখল। কাঁটায় কাঁটায় ন’টা পনেরো। রোজ ঠিক এই সময়ে একটা করে মেসেজ আসে সূর্যর। দিনটা ভাল কাটুক, অথবা আজ মুরগি ফাঁসবেই, কিংবা সকালটা আজ বড্ড সুন্দর…! রোমান হরফে বাংলা শব্দগুলো তিয়ার মেজাজকে বেশ তরতাজা করে দেয়। আজ লিখেছে, বউনিটা ভাল হোক। পারেও। ফাজিল নাম্বার ওয়ান। তিয়া বুঝি কথায় কথায় বলেছিল, সকালে আজ ক্লায়েন্ট মিট করতে যাবে… শোনামাত্র মেমারিতে পুরে নিয়েছে।

মোবাইল মুঠোয় রেখে তিয়া বাইরে তাকাল। ঝকঝকে দিন। কর্মব্যস্ত শহর ছুটছে নিজের গতিতে। হলুদ রোদ আর নরম বাতাস মেখে। বসন্ত কি এসে গেল? সূর্য শুভেচ্ছা জানাল বটে, কিন্তু কাজটা আদৌ হবে তো? খুব চেনাজানা না হলে অফিসের কাজে কারও বাড়িতে যায় না তিয়া। পাঁচ মাসের এই চাকরিতে এটা মাত্র দ্বিতীয় বার। আগের কেসটা ছিল দেবলীনার দিদি-জামাইবাবুর। ডিলটা পাকল না শেষ পর্যন্ত, পিছলে অন্য কোম্পানির গাড়িতে চলে গেল তারা। কে কোথ্‌থেকে বুঝিয়েছে, তিয়ারা যে মোটর কোম্পানির ডিলার, তাদের গাড়ির এসি নাকি যথেষ্ট আরামদায়ক নয়। ব্যস, ওমনি পাল্টি। কতবার বোঝাল তিয়া, তোমরা অন্য কোনও মডেল দ্যাখো, ডিসকাউন্ট আরও বাড়িয়ে দেব, কিছুতেই রাজি হল না। আজ ঋতব্রতর কাকা-কাকিমাও না ঝোলায়!

গড়িয়াহাটে এসে অটো বদলে মিনি। তিয়া কসবা পৌঁছোল পাক্কা ন’টা চল্লিশে। ঠিকানা খুঁজে পেতে অসুবিধে নেই, বাড়িটা মেন রোডের ওপরেই। জরাজীর্ণ এক ত্রিতল অট্টালিকার লাগোয়া জমিতে উঠেছে ফ্ল্যাট। প্রাচীনের গায়ে নবীন, চমৎকার বৈসাদৃশ্য!

ঋতব্রতর কাকা-কাকিমার ফ্ল্যাট দোতলায়। সূর্যর শুভকামনার প্রথম ধাপটা ফলেছে, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বাড়িতে মজুত। কাকিমাই খুলেছে দরজা। তিয়া তাদের একেবারে অপরিচিত নয়, ঋতব্রতর দিদির বিয়েতে দেখেছে তিয়াকে। বেশ আন্তরিক ভাবেই অভ্যর্থনা জানাল মহিলা। জিজ্ঞেস করল, —চা কফি কিছু খাবে?

তিয়া নরম গলায় বলল, —না কাকিমা, এক্ষুনি খেয়ে বেরিয়েছি। …আপনারা দু’জনেই ব্যস্ত মানুষ, বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করব না…

আরে না, এক্ষুনি কোনও তাড়া নেই। তুমি আসবে বলে আমি আজ কলেজ ছুটি নিয়েছি। আর তোমার কাকুর তো আজ অফ-ডে।

ও। তিয়া মৃদু হাসল বটে, তবে ঋতব্রতর ওপর চটল মনে মনে। সব সময়ে অর্ধেক কথা বলে ছেলেটা। কর্তাগিন্নি কলেজ যাবে না জানলে আর একটু দেরিতে বেরোনো যেত। যাক গে যাক, শুভস্য শীঘ্রম। তিয়া ফটাফট ব্যাগ থেকে কাগজের তাড়া বার করে ফেলল। গাড়ির ছবিওয়ালা পাতলা পুস্তিকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, —আপনারা এই মডেলটাই চাইছিলেন তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কী কী কালার পাওয়া যাবে?

চারটে কালার থাকে, কিন্তু এক্ষুনি দুটো অ্যাভেলেবল। স্টিল-গ্রে, আর হোয়াইট।

আমি সাদা ভালবাসি। তোমাদের কাকুর তো আবার…

আহা, রংটং পরে। লম্বা সোফায় দু’হাত ছড়িয়ে বসেছে ঋতব্রতর কাকা। সম্রাটের ভঙ্গিতে বলল, —আগে মূল্য তো স্থির হোক।

তিয়ার মনে পড়ে গেল, ভদ্রলোক কলেজে ইকনমিক্স পড়ায়। এবং ঋতব্রতর টিপস, যে-কোনও জিনিসের দরদাম করা কাকার নেশা। সে ফ্রিজ-টিভি কিনুক, কি কাঁচালঙ্কা। এই ধরনের খদ্দেরদের খেলিয়েই তো মজা।

সপ্রতিভ মুখে তিয়া বলল, —দাম তো কাকু আপনারা জানেনই। নিউজ পেপারেই থাকে। আর এখন যা স্কিম চলছে, তাতে আপনার ইনশিয়োরেন্সটা ফ্রি। তাতেই ধরুন ষোলো হাজার কমে গেল।

সে তো কোম্পানি দিচ্ছে। তোমরা ডিলাররা কত দেবে?

ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনি ঋতব্রতর কাকা… ম্যাক্সিমাম যতটা সম্ভব, নিশ্চয়ই কমিয়ে দেব।

অ্যামাউন্টটা শুনি?

সর্বোচ্চ ছাড়ের সীমা বাঁধা। সেলস ম্যানেজার বলেও দিয়েছে অঙ্কটা। প্রথম দফায় তিয়া তার চেয়ে হাজার পাঁচেক কমিয়েই বলল, —তা ধরুন… কোম্পানি প্রাইসের টু পারসেন্ট।

বলো কী? পাল মোটরস তো ফাইভ পারসেন্ট অফার করছে।

ঋতব্রতর কাকাটা তো মহা ঢপবাজ! কাস্টমারকে পাঁচ পারসেন্ট ছাড়লে পাল মোটরসে কবে লাল বাতি জ্বলে যেত!

তিয়া হেসে সুতো ছাড়ল, —অত কী করে পারবে কাকু? একটা গাড়ি বেচে ডিলারই তো ফাইভ পারসেন্ট পায় না।

পায় কত?

অম্লান বদনে তিয়া পরবর্তী গুলটা মারল। খেলিয়ে খেলিয়ে। গলা খাদে নামিয়ে বলল, —ফ্র্যাঙ্কলি বলব কাকু? এটা কিন্তু স্ট্রিক্টলি কনফিডেন্সিয়াল। কাস্টমারের জানার কথা নয়। …তবে আপনি ঋতব্রতর কাকা…। আমরা পাই সওয়া তিন। প্লাস একটা ইনসেনটিভ। বছরে যত গাড়ি বিক্রি হয়, তার ওপর।

হুম। সম্রাটের মাথা দুলছে। বিড়বিড় করে হিসেব করল কী যেন। সযত্ন লালিত কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, —তাও তোমরা আর একটু ছাড়তে পারো। অন্তত হাজার চারেক।

ওরে বাবা, তা হলে আমাদের ঘরে ক’পয়সা যাবে?

একটা গাড়িতে লাভ নয় কমই রইল। কাকাও যথেষ্ট খেলোয়াড়। ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসি ঝুলিয়ে বলল, —তুমি ঋতব্রতর বন্ধু… ঘরের মেয়ে … এটুকু করতে পারবে না?

যাক, কেসটা বোধহয় লেগে গেল। মালহোত্রা অটোমোবাইলস তো আরও হাজার পাঁচেক ছাড়ার অনুমতি দিয়েই রেখেছে তিয়াকে। ভদ্রলোক চাইছে চার। কিন্তু ঝটাকসে রাজি হওয়াও ঠিক হবে না। পার্টি পেয়ে বসে, হরেক বায়না জোড়ে। একবার সেল্‌স ম্যানেজারকে ফোন করে নেবে? অতনুদা খানিকটা গাইডলাইনও দিতে পারে, পার্টিও বোঝে তিয়া তাদের হয়ে খুব লড়ালড়ি করছে।

তিয়া আঙুল তুলে বলল, —এক মিনিট। আমি তা হলে বসকে একটু কনভিন্স করার চেষ্টা করতে পারি। আপনাদের জন্য যতটা সম্ভব…

উঁহু, যতটা নয়। আমি যা বলছি, ততটাই।

টকাটক মোবাইলের বোতাম টিপল তিয়া। সচেতন ভাবে গলা নামিয়ে বলল, —অতনুদা, পার্টি তো মোট চোদ্দো হাজার ডিসকাউন্ট চাইছেন।

অতনু ইঙ্গিত বুঝে গেছে। বলল, —তুমি কি এখন পার্টির সামনে?

হ্যাঁ

ও কে। এগোও। যতটা পারো অ্যাক্সেসারিজ ভেড়াও।

এবার তিয়া গলা উঠিয়েছে, —কিন্তু সব মিলিয়ে চোদ্দো হাজার ডিসকাউন্ট দিতেই হবে। এঁরা আমার খুব পরিচিত। প্রায় রিলেটিভ। অত্যন্ত রেসপেক্টেবল কাস্টমার। বলতে বলতে অপাঙ্গে দেখল বন্ধুর কাকাটিকে। বেশ একটা ওজনদার ভঙ্গিতে সিগারেট ধরিয়েছে ভদ্রলোক। মনে মনে মুচকি হেসে তিয়া বলল, —আমি কিন্তু এঁদের না বলতে পারব না অতনুদা।

হয়েছে, হয়েছে। পারলে এক্সটেন্ডেড ওয়ারেন্টিটাও পুশ করো। পেপার্স টেপার্সগুলোও ঠিকঠাক কালেক্ট করে নাও।

থ্যাঙ্ক ইউ অতনুদা। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।

ফোন সুইচ অফ করে মুখে চওড়া হাসি ফুটিয়েছে তিয়া। ঋতব্রতর কাকিমা এতক্ষণ নীরব শ্রোতা ছিল, এবার উজ্জ্বল মুখে জিজ্ঞেস করল, —হয়ে গেছে?

না হইয়ে ছাড়ব নাকি? ঋতব্রত কি তা হলে আমায় আস্ত রাখবে? তিয়ার স্বর আহ্লাদি আহ্লাদি, —তবে কাকিমা, আমার একটা রিকোয়েস্ট কিন্তু রাখতে হবে। এক্সট্রা চার হাজারের হাফ দেব আমরা ক্যাশ ডিসকাউন্ট, বাকি অর্ধেক অ্যাক্সেসরিজ।

সেগুলো কী কী?

ফুল ম্যাটিং, প্লাস ফ্লোর ম্যাট, প্লাস স্টিয়ারিং কভার, তারপর ধরুন মাডগার্ড ফ্ল্যাপ…

আর একটা পারফিউম?

বেশ। একটা এম্বিপিয়োর দিয়ে দেব। আর কাকুর জন্য কার-অ্যাশট্রে।

দূর দূর, অ্যাশট্রে কী হবে?

না না, দরকার। ভদ্রলোক নড়ে বসেছে,— এখনকার মারুতি ভ্যানটায় বারবার বাইরে হাত বাড়িয়ে ছাই ঝাড়তে হয়। ডিসগাস্টিং।

কিনছ তো এসি গাড়ি। কাচ তোলা থাকবে। বদ্ধ গাড়িতে তুমি স্মোক করবে?

কাচ নামিয়ে খাব। গাড়িতে বেশিক্ষণ সিগারেট না খেয়ে আমি থাকতে পারি না।

যত্ত সব বদ অভ্যাস। ভাল লাগে না।

স্বামী-স্ত্রী-র খুনসুটি চলছে। তিয়া উপভোগ করছিল। মোক্ষম হয়েছে ছাইদানির চালটা। ঋতব্রতর হিসেবি কাকা এখন খেয়ালই করবে না, দু’হাজার টাকার ক্যাশ ডিসকাউন্টের বদলে কয়েকটা টুকিটাকি জিনিসপত্র ঠেকালে মালহোত্রা অটোমোবাইলসের লাভ একটু বেশিই। ওর থেকে অন্তত আটশো হাজার ফেরত আসবে কোম্পানির ঘরে। হয়তো তেমন কিছু নয়, তবু কম কী? এভরি ফার্দিং কাউন্টস।

পেশাদারি দক্ষতায় কাগজপত্রের কাজগুলো ঝটাপট সেরে ফেলল তিয়া। ঋতব্রতর কাকা ব্যাঙ্ক লোন নেবে, পুরো টাকা পেতে দিন কয়েক সময় লাগবে, অগ্রিম বাবদ একখানা এক লাখ টাকার চেকও হস্তগত করল দ্রুত। মালহোত্রা অটোমোবাইলস ঋণের বন্দোবস্ত করলে আরও কিছু আসত, তবে তা নিয়ে আর চাপাচাপিতে গেল না। ইদানীং মধ্যবিত্তরা পটাপট গাড়ি কিনছে। ক্রেতা হিসেবে তারা সর্বদাই সন্দিগ্ধ এবং স্পর্শকাতর। কেবলই ভাবে, গাড়ি বেচনেওয়ালারা এই বুঝি তাদের ঠকিয়ে দিল। অতএব জোরাজুরিতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মতি বদলের আগে অগ্রিমটা এখন ক্যাশ করে নিতে পারলেই তিয়া নিশ্চিন্ত।

ব্যাগ গুছিয়ে তিয়া উঠব উঠব করছে, হঠাৎই ভদ্রমহিলা বলল, —অ্যাই মেয়ে, তুমি আমাদের আর একটা কাজ করে দেবে?

বলুন?

আমাদের এখনকার গাড়িটা বেচে দাও না।

ওমা, আগে বলবেন তো! ঋতব্রত তো বলছিল আপনারা ওটাও রেখে দেবেন!

সেরকমই ইচ্ছে ছিল। ভেবেছিলাম, কোনও রেন্টাল এজেন্সিতে দেব। যা আসবে, তাই দিয়ে ব্যাঙ্ক লোনের খানিকটা শোধ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন চার দিকে যা দেখছি, শুনছি… কোথায় কে গাড়ি ভাড়া নিয়ে কোন দুষ্কর্ম করল… আমরাও পড়ব ফ্যাসাদে…। তা ছাড়া রেন্টাল এজেন্সিগুলোও নাকি টাকার ব্যাপারে বড় ঘোরায়।

তিয়ার চোখ চকচক করে উঠল। পুরনো গাড়ি কেনাবেচার এজেন্ট হাতেই আছে। শিশির দস্তিদারকে ফোন লাগালেই এক্ষুনি এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু তিয়ার আসবে কত?

মোলায়েম স্বরে তিয়া জিজ্ঞেস করল, —আপনাদের তো মারুতি ভ্যান। কোন সালের মডেল?

একটু পুরনো। এই ধরো ন’-দশ বছর।

কী রকম দাম আশা করছেন?

খেলোয়াড় আবার মাঠে নেমেছে, —ষাট-পঁয়ষট্ট…

এবার তিয়ার দরাদরির পালা। তবে এক্ষুনি সে পথে গেল না তিয়া। ভুরু কুঁচকে দু’-এক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে টকাটক শিশিরকে ফোন। লাইন এনগেজড। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা, আবার ফোন। নাহ্, পাওয়া যাচ্ছে না। তৃতীয় চেষ্টাতে বিফল হয়ে তিয়া রীতিমতো বিরক্ত। দরকারের সময়ে কখনওই লোকটাকে ধরা যায় না। অথচ তিয়াদের অফিসে এসে তাগাদার পর তাগাদা, পুরনো গাড়ির খবর আছে নাকি!

তিয়া চুল ঝাঁকিয়ে সোজা হয়ে বসল, —চিন্তা করবেন না, লোক আমি পাঠিয়ে দেব। তবে পঞ্চাশের বেশি পাবেন বলে মনে হচ্ছে না।

কেন? খুব ভাল কন্ডিশনে আছে…

সেকেন্ড হ্যান্ডের মার্কেট বড় ডাল যাচ্ছে কাকু। সবাই নতুনই কিনছে কিনা। দেখছেন না, প্রাইস ঝপঝপ পড়ে যাচ্ছে! তবু দেখি, ম্যাক্সিমাম কত আপনাদের পাইয়ে দিতে পারি…

ঋতব্রতর কাকা-কাকিমার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে, আর বাস মিনিবাস নয়, তিয়া সটান ট্যাক্সিতে। আহ্‌, স্বস্তি। বউনি সত্যিই ভাল হল আজ। কথাটা মনে হতেই হাতে মোবাইল, বার্তা পাঠাচ্ছে সূর্যকে। শুধু একটাই শব্দ, সাকসেস। তারপর সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজেছে। ফেব্রুয়ারি মাসটা যাচ্ছে ভাল। সবে আজ আঠেরো, এর মধ্যেই দু’-দুটো গাড়ি বেচে ফেলল। অর্থাৎ মাসিক কোটার ডবল, তাদের চার জনের টিমে কেউই এক পেরিয়ে দুয়ে পৌঁছোয়নি। দীপন বেচারার তো এ মাসে খাতাই খুলল না। পুওর সোল। …এ মাসে বাড়তি কত আসতে পারে তিয়ার? সাত হাজার? আট? উঁহুঁ, আটের বেশি হবে না। বোধহয় আজ যদি সিটকভার, টেপ ফেপ গছানো যেত, অঙ্কটা একটু ভারী হত। যাক গে, চেনা পরিচিতর মধ্যে বেশি লোভ করতে নেই। বরং ওই কাকা-কাকিমাদের জপিয়ে আরও দুটো একটা কাস্টমার ধরতে পারলে তিয়ার আখেরে লাভ। কলেজের মাস্টাররা আজকাল খুব গাড়ি কিনছে। পরশুই তো এক অধ্যাপক তাদের শো-রুমে ঘুরে ঘুরে মডেলগুলো দেখছিল। দেদার টিউশনির পয়সা, খরচ তো করতে হবে। করো বাবা, করো। শুধু বড়লোকরাই গাড়ি চড়বে কেন, এখন তোমরাও আমাদের লক্ষ্মী। আহা রে, পেট্রোলের দামটা যদি ঝপ করে পড়ে যেত, গাড়ি বিক্রি বেড়ে যেত হুহু করে। এবং তিয়ার ইনসেনটিভ। কুড়ি… পঁচিশ… তিরিশ…! তিয়াই তখন একটা কিনে নিতে পারে। নিজেদেরই শো- রুম থেকে। নিজেই চালিয়ে আসবে, পার্ক করবে শো-রুমের পিছনটায়, কাস্টমার কলে বেরিয়ে যাবে চার চাকা নিয়ে…। খুব আওয়াজ দেবে সূর্য। মোটরবাইকের ধাপ পেরোতে পারেনি তো, হিংসেয় জ্বলবে নির্ঘাত। জ্বলুক, তিয়ার তাতে কাঁচকলা! তিন-চারটে বড় জায়গায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অর্ডার পেয়ে ইদানীং একটা কী হনু, কী হনু, ভাব এসেছে সূর্যর। নাকে একটু ঝামা ঘষে দিতে পারলে বেশ হয়।

অলস কল্পনার কাল শেষ। শো-রুম এসে গেছে। ঢুকেই কাজের আবর্তে ঘুরপাক খেতে লাগল তিয়া। অতনু সেনকে রিপোর্ট দিল, কম্পিউটারে ঢোকাল বিক্রি সংক্রান্ত তথ্যাবলি, টিমের বাকি তিন জনের মতোই শো-রুমে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন গাড়ির মডেল দেখাল সম্ভাব্য খরিদ্দারদের…। ফোনও আসছে মুহুর্মুহু। মিটিং চলছে। টিম মিটিং, জি-এস-এমের চেম্বারে সাপ্তাহিক মিটিং…। মাঝে কোনওক্রমে টিফিন গেলা ছাড়া সন্ধে সাতটার আগে ফুরসত মেলা ভার। অবশ্য আজ আর কোনও এনকোয়ারিতে বাইরে ছুটতে হল না, এই যা রক্ষে।

সন্ধে গাঢ় ক্রমশ। শো-রুমের ব্যস্ততা কমেছে। দোতলায় নিজস্ব চেয়ারটেবিলে তিয়া থিতু এখন। তৈরি করছে সারা দিনের কাজের বিবরণী। বাকি সহকর্মীরা এ দিক ও দিক ছড়িয়ে। চিনোজ আর স্প্যাগেটি-টপ সোনালি হরিণ পায়ে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। তিয়াকে একটা ‘হাই’ ছুড়ে দিয়ে বসেছে নিজের জায়গায়। খানিক বাদে একটা স্ট্র্যাটেজি মিটিং আছে আজ, তারপর ছুটি।

তিয়ার মনোযোগে বাধা পড়ল। মোবাইলে ‘কাল হো না হো’ বাজছে। ভুরু কুঁচকে নম্বরটা দেখল তিয়া। অচেনা। শেষবেলায় কোন মক্কেল রে ভাই?

কানে যন্ত্র চাপল তিয়া,— ইয়েস প্লিজ।

ম্যাডাম, আমি ইন্দ্রজিৎ রায় বলছি।

তিয়া স্মরণ করতে পারল না নামটা। তবু বলল,— ইয়েস, বলুন?

লাস্ট উইকে আমি এক বন্ধুর সঙ্গে আপনাদের শো-রুমে গেছিলাম। বন্ধু গাড়ি দেখছিল, তখন আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা হল…

ও, সেই জিন্‌স পাঞ্জাবি? কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা? তিয়া তাড়াতাড়ি বলল,—হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। বলুন কী ব্যাপার?

আপনি বলেছিলেন আপনাদের কাছে মাঝে মাঝে পুরনো গাড়ির খবর আসে…। আমাকে একটা কিনতে হবে… বলেছিলেন টাইম টু টাইম খবর নিতে…

একেই বুঝি বলে যোগাযোগ! ইন্দ্রজিৎ রায় আজই গাড়ির জন্য ফোন করছে, আর আজই তিয়ার কাছে…? সামান্য সময় নিয়ে তিয়া বলল,— একটা খবর আছে। মারুতি ভ্যান। গুড কন্ডিশন। চলবে?

দৌড়োবে। খুব পুরনো নয় তো?

ন’-দশ বছরের। পঞ্চাশ-পঞ্চান্নয় হয়তো দিয়ে দেবে।

নাহ, তা হলে হল না। আমি চল্লিশের বেশি উঠতে পারব না। মেরেকেটে… আর দু’-পাঁচ হাজার।

তিয়া ভাবল আবার। ঋতব্রতর কাকা ষাট-পঁয়ষট্টি বলেছে, কিছু কমবে। হাতের ডটপেন ঠুকতে ঠুকতে বলল, —ঠিক আছে, কথা বলে জানাচ্ছি। তবে মনে হয় পঞ্চান্নর নীচে নামবে না।

খুব টাফ হয়ে যাবে।

দেখুন। ভাবুন। আপনি গ্রিন সিগন্যাল দিলে…

না, না, আপনি কথা বলুন। আসলে আমার প্রয়োজনটা খুব জরুরি… দালাল টালাল ধরলে তারা আবার দাম বাড়িয়ে বলবে…

তিয়া ফস করে বলে ফেলল, —কমিশন কিন্তু আমাকেও দিতে হবে। চার পার্সেন্ট।

ইন্দ্রজিতের স্বর আচমকাই চুপ। তারপর ফের ফুটেছে, —ওয়েল… দেব। আপনিও দেখুন, যতটা কমাতে পারেন…। আমার রিসোর্স কিন্তু সত্যিই লিমিটেড ম্যাডাম। প্লিজ, ব্যাপারটা একটু ভাববেন।

স্বরটা যেন করুণ শোনাল। সত্যি? নাকি অভিনয়? এই ধান্দাবাজ শহরে মানুষকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন। হয়তো বেচারা পার্টি হাতে রেখে সস্তায় কিনতে চায়! হয়তো শিশির দস্তিদারের লাইনেই নেমেছে সম্প্রতি, জিন্‌স-পাঞ্জাবি-শান্তিনিকেতনি ঝোলা নতুন কায়দার ইউনিফর্ম!

তবু স্বরে যেন কী একটা আছে। দিনভর কম কেজো কণ্ঠ তো শোনে না তিয়া, কিন্তু এ যেন একটু আলাদা। অক্ষমতা ঢাকতে কোনও চালবাজি নেই।

তিয়া নরম করেই বলল, —ও কে। দেখছি। আপনি ঘন্টাখানেক বাদে রিং করুন।

ঋতব্রতর কাকাকে ডায়াল করার আগে তিয়া একটুক্ষণ বসে রইল চুপচাপ। আস্তে আস্তে মুখে একটা হাসি জেগেছে। পঞ্চাশে যদি রাজি হয়, তিয়ার ভাগে দুই। নট ব্যাড। নট ব্যাড। আমদানিটা আজ মন্দ হচ্ছে না। গত এপ্রিলে কেনা মোবাইলটা কি এবার বদলে ফেলবে?

উঁহুঁ, না, না, না। তিয়া নিজেকে ধমকাল। মার্কেটিংয়ের কোর্স পড়ার সময়ে বাবার কাছ থেকে চল্লিশ হাজার নিয়েছিল। খুব গাঁইগুঁই করেছিল বাবা। তিয়া বলেছিল, ধার হিসেবে দাও, চাকরি পেলে শোধ করে দেব। ব্যাঙ্কে হাজার পনেরো মতন জমেছে। তার সঙ্গে মিলিয়ে আরও দশ হাজার টাকা থোক যদি দিয়ে দিতে পারে….

তিয়া বেশি করে বাতাস ভরল ফুসফুসে। হ্যাঁ, কথার দাম রাখাটাই বেশি জরুরি।

.

০৪.

তুহিন দূরের পাহাড় দেখছিল। তুহিন ডুবন্ত সূর্য দেখছিল। আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে দিনশেষের বর্ণচ্ছটা দেখছিল তুহিন।

তা ওই দেখাই সার। কিছুই যেন গভীরে ঢোকে না সে ভাবে। চোখের লেন্স দুটো যেন অস্বচ্ছ হয়ে এসেছে। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য নেহাতই ম্যাড়মেড়ে। এত ক্লান্তি… এত ক্লান্তি…!

দিনটা আজ গেল বটে। তুহিন বরাবরই দেখেছে, ট্যুরের তৃতীয় দিনটা শরীরের সব শক্তি নিংড়ে নেয়। প্রথম দিন তো ঝামেলা প্রায় থাকেই না। নেমে, হোটেলে চেক-ইন করে, একটু জিরিয়ে টিরিয়ে, যাও বাবুদের প্ল্যান্টের অফিসে, রথী মহারথীদের গিয়ে মুখটা দেখাও, যদি নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন থাকে তো সেরে ফেলো বিকেল বিকেল, তারপর সন্ধেবেলা গুটিগুটি অফিসার্স ক্লাবে হাজির হয়ে নিজের আসাটাকে একটু পোক্ত করে নাও…। দ্বিতীয় দিন তো কাটে কোম্পানির হাঁড়ির খবর নিতে নিতে। কবে নাগাদ নতুন টেন্ডার বেরোচ্ছে, কোন কোন ডিপার্টমেন্টে রদবদলের সম্ভাবনা, আনকোরা কেউ আসছে কিনা, নতুন কী প্রোজেক্ট শুরু হতে পারে…। আরও একটা আছে। খোঁজখবর করে দেখো আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী বাজারে এল কিনা, কিংবা পুরনোর ভেনাস রবারের নামে কী কী নতুন চুকলি খেয়ে গেল…। এই কাজগুলো অবশ্য এখন তুহিনের নয়। এসবের জন্য সেলস অফিসাররা আছে, এবং তারা ঘনঘন চরকিও খেয়ে বেড়ায়। তবু তুহিন পুরনো অভ্যেসটা ছাড়তে পারেনি। এতে অবশ্য দু’তরফা লাভ। প্রথমত, সরাসরি ওয়াকিবহাল থাকা। দ্বিতীয়ত, অধস্তনেরা কে কত টুপিটাপা দিচ্ছে যাচাই করে নেওয়া। তা ছাড়া ভেনাস রবারের আঞ্চলিক অধিকর্তা স্বয়ং এসে কোম্পানির মাঝের তলা, নীচের তলায় কথা বলছে, এর একটা আলাদা মূল্যও আছে। ভারী তুষ্ট হয় লোকগুলো, ব্যাকব্যাক করে অনেক গুপ্ত সমাচার শুনিয়ে দেয়। আর ওগুলোই তো তুহিনের তুরুপের তাস। অফিস মিটিংয়ে ছাড়ে মাঝে মাঝে, সেল্‌স অফিসারগুলো কেঁপে কেঁপে ওঠে। এরপর তো সন্ধেবেলা নিয়মমাফিক পার্টি। ভেনাস বরারের পয়সায় কেনারামদের কাঁড়ি কাঁড়ি মদ গেলানো। কাবাব বিরিয়ানির নয়ছয়। কিন্তু তৃতীয় দিনটিতেই আসল কাজ। প্ল্যান্ট ভিজিট। ভেনাসের মাল নিয়ে কোনও নালিশ আছে কিনা দেখতে হয় সরেজমিনে। ফ্যানবেল্ট, ভি-বেল্টে কী কী খুঁত বেরোল, কনভেয়ার বেল্টের পুরনো সমস্যাটা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে না তো, অথবা কী কী বদল ঘটালে ভাল হয়, নোট নেয় ঘুরে ঘুরে। কী যে ধকল!

ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে তুহিন হোটেলের কোলবারান্দা থেকে সরে এল। বসেছে ফোমে মোড়া দোলচেয়ারে। আর কত দিন যে এভাবে টানতে পারবে সে? এই তো সেদিন চাকরিজীবন শুরু করল, এর মধ্যে কেটে গেল তি-রি-শটা বছর? কোথা দিয়ে যে গেল? কবে যে তার শরীর যৌবন পেরিয়ে পা রাখল এই প্রৌঢ়বেলায়?

আগে এসব ভাবত না তুহিন। একটাই তো মন্ত্র ছিল জীবনে— চরৈবেতি, চরৈবেতি। এখন একা হলেই পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে। কেমন ছিল রাস্তাটা? চলতে চলতে, পথেপ্রান্তরে, কোথায় কী ফেলে এল সে? কী-ই বা কুড়িয়ে পেল?

অজস্র ভাঙাচোরা ছবি। অগুনতি ছেঁড়াখোঁড়া দৃশ্য। একটা অক্ষম, বদরাগী বাবা। একটা সিঁটিয়ে থাকা মা। একটা স্বার্থপর ভাই। একটা আধাশীতল বউ। একটা মাথামোটা ছেলে। একটা জিদ্দি মেয়ে। আর চাকরি? সে তো আজীবন টেনশন টেনশন…। সারাক্ষণ সরু সুতোর ওপর ব্যালেন্স করে করে হাঁটা। এসব নিয়েই তো চুয়ান্ন বছর বয়সে পৌঁছে গেল তুহিন। আর কী, এবার তো মানে মানে কেটে পড়লেই হয়।

এই মৃত্যুচিন্তাটা নতুন। ইদানীং হানা দিচ্ছে মাঝে মাঝে। তুহিন আমল দিতে চায় না, তবু কোন ফাঁকফোকর দিয়ে যে ঢুকে পড়ে মগজে! এখনও কত কাজ বাকি। ছেলেটা দাঁড়ায়নি, মেয়ের বিয়ে দেওয়া হল না, ফ্ল্যাটের লোন চলছে, এমন কিছু সঞ্চয় নেই যাতে দোলার বাকি জীবনটা কেটে যেতে পারে… এখনই কি মরার কথা ভাবতে আছে? বাবাকে দেখে কিছুই কি শেখেনি তুহিন?

তুহিনের বাবা মারা গিয়েছিল মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে। সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস। তুহিন তখনও পার্ট-ওয়ান পরীক্ষায় বসেনি। একটি অতি ক্ষুদ্র প্রাইভেট কোম্পানির, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ করা কেরানি ছিল রথীন মিত্তির। পাঁচ পয়সা সঞ্চয়ও ছিল না সংসারে, অফিস থেকে প্রায় কিছুই জোটেনি, নির্মলা চুড়ি বালা বেচে কোনওক্রমে কলেজের গণ্ডিটুকু পার করিয়ে দিয়েছিল বড় ছেলেকে। তার পর থেকেই তো ঘানি টানা। বলদ ঘুরছে… বলদ ঘুরছে…। আজ তুহিন মরে গেলে হয়তো অতটা অথই জলে পড়বে না দোলারা, তবু ভোগান্তি তো আছেই। তিয়ার ঘাড়েই হয়তো এসে পড়ল চাপ। ওফ্‌, সেই চাপটা যে কী মারাত্মক, তুহিন হাড়ে হাড়ে জানে। বাপ হয়ে সে কি তা চাইতে পারে?

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল তুহিন। উঠে জগ থেকে জল খেল একটু। গলার শুকনো ভাব কাটল সামান্য। অম্বল হয়ে আছে কি? একটুক্ষণ কী যেন ভেবে বেল বাজিয়ে ডাকল বেয়ারাকে।

চেনা হোটেল। পরিচিত বেয়ারা। আদিবাসী ছেলেটা এসে ঘাড় ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়েছে। তুহিনের হাবভাবে কোনও অফিসারসুলভ ভারিক্কিপনা নেই। আগেও ছিল না, গজাতেও দেয়নি। সহজ সুরেই বলল,— কী রে সনাতন, সন্ধেবেলা আমায় উপোস করিয়ে রাখবি?

বলুন স্যার, কী খাবেন? ভেজ পকোড়া, এগ পকোড়া, চিকেন পকোড়া, চিকেন কাটলেট, পনির চপ…?

এক সময়ে এই প্রতিটি গুরুপাক খাদ্যই প্রিয় ছিল তুহিনের। এখন আর টানে না। ঠোঁট ছুঁচোল করে বলল,— টোস্ট ফোস্ট হবে না?

এখন টোস্ট? সনাতন মাথা চুলকোচ্ছে।

তা হলে বিস্কুট নিয়ে আয়। ক্রিম ক্র্যাকার। আর এক কাপ লিকার চা।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চা-বিস্কুট হাজির। কাপে সবে প্রথম চুমুকটা দিয়েছে, দরজায় টকটক।

কাম ইন।

রাজেশ ঢুকল। রাজেশ দুবে, ভেনাস রবারের জামশেদপুরের এজেন্ট। রাজেশের মাধ্যমেই এখানকার ব্যাবসা চলে তুহিনদের। কমিশন ভিত্তিতে।

অ্যাথলিট চেহারার, বছর পঁয়তাল্লিশের রাজেশ ঘরে ঢুকে চোখ বড় বড় করল, —এ কী স্যার আপনার কি শরীর খারাপ?

কই, না তো!

তা হলে ইভনিংয়ে রুমে বসে চা বিস্কুট খাচ্ছেন?

মেঘলা মেজাজটা পলকে বদলে ফেলেছে তুহিন। হেসে বলল, —টেস্ট করে দেখছি, এই সময়ে চা কেমন লাগে!

মুখ বদল? হা হা হা। রাজেশ চেয়ার টেনে বসল,— তা স্যার… যাবেন তো ক্লাবে?

যাব?

চলুন। গাড়ি এনেছি।

একটা বিস্কুট রাজেশের হাতে ধরিয়ে দিল তুহিন। আলগা হেসে বলল, — আজ থাক না।

সে কী স্যার? শুক্লা-সাব, চ্যাটার্জি-সাব, মিস্টার জরিওয়ালা, সব্বাই থাকবেন, মৌজটৌজ হবে…

কাল তো হল একচোট। আজ আর ইচ্ছে করছে না।

চলুন না স্যার। আজ দুবে এন্টারপ্রাইসকে একটু আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন।

একই সংলাপ শুনে শুনে কান পচে গেছে। সে কী-বা রাউরকেল্লা, কী-বা চন্দ্রপুরা, কিংবা ধানবাদ রাঁচি বোকারো সিন্ধ্রি ঝরিয়া, সর্বত্র এজেন্টদের উদ্দেশ্য একটাই। আপনারা খুশি থাকুন, আমাদেরও খুশিতে থাকার বনেদটাকে শক্ত করে দিন। দু’তরফের মধ্যিখানে আছে তো, সর্বদাই আশঙ্কা এই বুঝি এক পক্ষের কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হল। বোঝে না রাজেশরা যতটা চাপে, তুহিনরাও ঠিক ততটাই চাপে। এবং কেনারাম অফিসারগুলোও। এ এক অভিনব ত্রিভুজ, যার প্রতিটি শীর্ষবিন্দু অবিরাম নিজের ঘাঁটি আগলাচ্ছে।

তুহিন ফের বলল,— নাহ্‌, আজ বাদই দিন।

রাজেশ ঈষৎ থতমত। তার পরেই চোয়াল বিকশিত করেছে,— সন্ধেটা তা হলে একেবারে শুখা যাবে স্যার? রুমেই কিছু আনাই? ব্ল্যাক ডগ, জনি ওয়াকার, পিটার স্কট…?

সুরার নাম শুনেও কেন যেন তেমন উদ্দীপিত বোধ করল না তুহিন। তবু অভ্যাসবশে বলল, —দিন যা হোক কিছু বলে।

গ্লাস, বোতল, ফিঙ্গার চিপস, শসা, পেঁয়াজ, মাছভাজা এসে গেল পলকে। চা শেষ করেই হুইস্কিতে চুমুক দেবে কিনা তা নিয়ে সামান্য খুঁতখুত ছিল তুহিনের। সোনালি পানীয়ের দর্শন মিলতেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব হাপিস। গ্লাস ছুঁইয়েছে ঠোঁটে। কষটে স্বাদটা চারিয়ে দিল রক্তে।

রাজেশেরও হাতে সুরা। শসা দাঁতে কেটে বলল, —আজ কিন্তু ক্লাবে একবার যেতে পারতেন স্যার। মিস্টার জরিওয়ালার সঙ্গে আপনার আগের বার মোলাকাত হয়নি।

কাল তো আর একবার ঢুঁ মারব। তখনই…

আপনি অনেক বদলে গেছেন স্যার।

তাই বুঝি? …বয়স তো বাড়ছে।

শুধু বয়স কেন স্যার, আপনার ওজনও তো বাড়ছে। রাজেশের চোখে হাসি খেলে গেল,— আপনি তো চিফ সেল্‌স ম্যানেজার বনে যাচ্ছেন, তাই না?

কে দিল খবরটা? আমাদের সান্যাল?

না স্যার। সান্যাল-সাব এসে তো শুধু কাজ নিয়ে থাকেন। ফালতু বাত করেন না। বহুত পাক্কা আদমি।

তা হলে?

আপনাদের হেড অফিসে আমারও তো কিছু জান পহেচান আছে…

সে কি আমি জানি না? আপনার হাত ব্ৰহ্মদত্যির থেকেও লম্বা।

রাজেশ আবার হা হা হাসল,— তা স্যার, সি-এস-এম হলে তো আপনার আসা অনেক কমে যাবে!

হয়তো।

পাওয়ার ভি তো অনেক বেড়ে যাবে!

ক্ষমতা বাড়বে কিনা জানি না, তবে টেনশন চার গুণ বাড়বে। ফেরিওয়ালাদের সর্দার হওয়ার হ্যাপা নেই? এম-ডি আরও বেশি করে ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলবে। টার্গেটের দিকে তাকিয়ে চুল ছিঁড়তে হবে। মাল বেচার নতুন নতুন কায়দা উদ্ভাবন করতে হবে প্রতিদিন!

আপনার মতো মানুষের স্যার আরও আগেই এই পোস্টে যাওয়া উচিত ছিল।

রাজেশ হালকা চালেই বলেছে কথাটা। কিংবা তেল মারতে। তবু কোথায় যেন বাজল তুহিনের! সত্যি তো, চুয়ান্ন বছর বয়সে এই পদে পৌঁছোনোয় খুব একটা গৌরব কি আছে। কী করা, মাঝপথে কেঁচে গণ্ডূষ করতে হল যে। ভেনাস রবারে সে তো এই সেদিন এসেছে, বড়জোর বছর পনেরো। আসতে বাধ্য হয়েছে। তার আগের কোম্পানি রবার ইন্ডিয়া এখন টিকে থাকলে, তুহিন অ্যাদ্দিনে কোথায় উঠে যেত!

কপাল, সবই কপাল। কী চমৎকার চলছিল রবার ইন্ডিয়া, তুহিনও দিব্যি পা রেখেছিল মইতে। ঘুরতে হত ঠিকই, তবে এতটা টেনশন ছিল না। সরকারি হওয়ার সুবাদেই তুতো-ভাইদের মাল বেচতে অনেক সুযোগসুবিধে তখন। আর পাঁচটা দিশি কোম্পানির চেয়ে দর কম না হলেও কুছ পরোয়া নেই, রবার ইন্ডিয়ার ফ্যানবেল্টই কিনতে হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে। তাদের সারা বছরের কেনাকাটার একটা মোটা অংশ রবার ইন্ডিয়ার জন্য তো বাঁধা। কী যে বিশ্বায়নের হুজুগ এল, দিল্লির উদারীকরণ নীতির ঝাপটায় রবার ইন্ডিয়ার জোশ খতম। সরকার সোজা বলে দিল, যাও, খোলা বাজারে লড়ে খাও! সস্তা এবং সেরা দুটো গুণই না থাকলে বসে বসে আঙুল চোষো! এতকাল ভারী আনন্দে, প্রায় ফাঁকা মাঠে, ছড়ি ঘুরিয়েছিল রবার ইন্ডিয়া, বাজারে হঠাৎ জাঁদরেল জাঁদরেল দিশি বিদেশি বেচনেওয়ালা এসে যাওয়ায় তুহিনদের সাড়ে সর্বনাশ। কারখানায় পাহাড়ের মতো মাল জমছে, জমছে…। আগে যেখান থেকে টুসকি বাজিয়ে অর্ডার মিলত, তারা সটান দেখিয়ে দিচ্ছে দরজা।

কী যে দিন গেছে তখন! বুঝতে পারছে তুহিন, মাঝদরিয়ায় একটা ফুটো নৌকোয় বসে আছে, পালানোর রাস্তা পাচ্ছে না…! অহরহ চিন্তা, এই বুঝি কারখানায় তালা ঝুলল! তার পর কী করবে তুহিন? চল্লিশ বছর বয়সে সে কোথায় চাকরি পাবে? কে নেবে তাকে? কেন নেবে? যে দেশে লাখ লাখ টগবগে জোয়ান চাকরির জন্য মাথা খুঁড়ে মরছে, তার মতো আধবুড়োকে সেখানে কে পুঁছবে? জমানো টাকা-পয়সা কিছু আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে কদ্দিন..? সংসারের খরচ অসম্ভব বেড়ে গেছে। লেক গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটটার ভাড়াই তো আড়াই হাজার। মেয়ে ক্লাস সিক্স, ছেলে টু… তাদের পড়াশুনো চালানো তো হাতি পোষা! খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে একটা মান তৈরি হয়ে গেছে, তার থেকেই বা আচমকা নামা যায় কী করে?

ভাগ্যিস তখনই ভেনাস রবারে পা রাখার একটা জায়গা মিলেছিল! হোক না দিশি কোম্পানি, না হয় এক ধাপ নিচু থেকে শুরু করছে, মাইনেকড়িও সামান্য কমল… তবু বেঁচে গেল তো!

নাহ্, উন্নতি অবনতি নিয়ে তুহিনের আফশোস নেই। রবার ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সহকর্মীদের এক একজনের যা হাল দেখে এখন। কেউ অর্ডার সাপ্লাইয়ের বিজনেস করছে, কেউ বা ইনশিয়োরেন্সের এজেন্ট…। ঘোষ তো কী এক চিটফান্ড খুলে ফোর টোয়েন্টি কেসে ধরা পড়ল। তুহিন কি তাদের চেয়ে ঢের ঢের ভাল নেই?

তুহিন গ্লাসটাকে দু’হাতের মাঝে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, —আই বিলিভ ইন ডেসটিনি দুবেজি। যেখানে যখন পৌঁছোনোর, তখনই তো পৌঁছোব। সে ওপরেই হোক, কি নীচে।

উয়ো তো সচ্ বাত্। রাজেশ ঢকঢক ঘাড় নাড়ল,—পৌঁছানেওয়ালা তো উপরে বসে আছেন।

ভগবান টগবান বুঝি না ভাই। তুহিন হেসে একটা ফিল্মি ডায়ালগ ছাড়ল, —যব যব যো যো হোনা হ্যায়, তব তব সো সো হোতা হ্যায়।

হা হা হা। বড়িয়া বলেছেন। রাজেশ তুহিনের শূন্য গ্লাসে ফের পানীয় ঢালল। গ্লাস টেবিলে রেখে এক মুঠো ফিঙ্গার চিপস তুলেছে হাতে। চোখ টেরচা করে বলল,— কিন্তু স্যার, আমার কথাও একটু ভাবুন।

আপনার আবার কী হল?

কদ্দিন আর এক জায়গায় আটকে থাকব? হাফ পারসেন্ট অন্তত বাড়ান।

ওরে বাবা, এখন খরচ কমাও অভিযান চলছে। চার জনকে ভি-আর ধরানো হল। এখন আপনার কথা তুললে এম-ডি আমায় বাঁশপেটা করবে।

এই বললে চলে স্যার? সব কিছুর ভাও বাড়ছে। কোম্পানির সাহেবদেরও রেট চড়ে গেছে।

মালকড়িগুলো জায়গা মতন ঠিকঠাক দ্যান তো?

দু’কান চেপে জিভ কাটল রাজেশ, —মা কসম। ভেনাস রবারের সঙ্গে আমি বেইমানি করি না স্যার।

কিন্তু আমার কাছে যে একটু অন্য খবর আছে!

কী স্যার?

আপনি নাকি ইন্ডিয়ান রবার প্রোডাক্টসের হয়েও দরবার শুরু করেছেন?

ঝুট, ঝুট। বিলকুল ঝুট। কোন শালা বলেছে নাম বলুন, আমি তার জিভ ছিঁড়ে নেব।

রাজেশের উত্তেজনা বলছে, সে বেশ নার্ভাস। অর্থাৎ তুহিন যে খবরটা পেয়েছে, ভুল নাও হতে পারে। মনে মনে তুহিন স্থির করে ফেলল, রাজেশের ওপর কড়া নজরদারি রাখতে হবে। সান্যাল ব্যাপারগুলোর গন্ধ পায়, ওকেই লেলিয়ে দেবে এবার। পারচেজ-ডিপার্টমেন্ট শুঁকে শুঁকে ঠিক বের করে ফেলবে, কী করে ইন্ডিয়ান রবার প্রোডাক্টস আগের লটে দু’গুণ অর্ডার পেল।

মুখের হাসি অবশ্য নিবতে দেয়নি তুহিন। হাসিটা আরও বাড়িয়ে বলে উঠল,— আরে, চটেন কেন? পুরনো ইয়ারদোস্তের সঙ্গে মশকরা করতে পারব না?

তাই বলুন। রাজেশ শান্ত হয়েছে। তবু একটু ভার মুখে বলল,— জানেন তো স্যার, বিসওয়াসটাই দুনিয়ায় সবচেয়ে দামি চিজ।

হুম।…কিন্তু মেলে কোথায়?

এও আপনি সহি বাত বলেছেন। …দেখুন না, ভাইটাকে পড়িয়ে লিখিয়ে মানুষ করলাম… আমার বিজনেসেও লাগিয়েছিলাম… বহুত রুপিয়া চোট দিয়ে ভেগে গেল।

কে? দীপেশ? সে আর আপনার সঙ্গে নেই?

আর বোলেন কেন! রাঁচিতে অলগ্‌ ধান্দা শুরু করেছে। ট্রান্সপোর্টের। চার চারখানা ট্রাক কিনে ফেলল। শুনছি এবার হোটেল বানাবে।

ভাই যে কী চিড়িয়া হয়, তা কি তুহিন জানে না! প্রায় দোরে দোরে ফেরিওয়ালার চাকরি করে তুষারকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছিল তুহিন। ভাইয়ের অবশ্য মাথাও ছিল। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বনে মহেশতলার এক কারখানায় চাকরি করল কিছুদিন। সেখান থেকে ঢুকে পড়ল ব্যাঙ্কে। টেকনিক্যাল অফিসার। উন্নতির সুবিধে হবে বলে প্রথম সুযোগেই বদলি নিয়ে চলে গেল দিল্লি। বিয়ে-থা করল, মেয়ে এখন ক্লাস টেন, কালকাজিতে সুন্দর সাজানো গোছানো সংসার। কিন্তু তুহিনের কাছে একান্তই অর্থহীন।

কথাটা মনে পড়লেই তুহিনের বুকটা চিনচিন করে। মা’র অসুখের সময়ে তুষার এসেছিল কলকাতায়। তখনই তুহিনের অফিস ডুবছে। দোলাকে পুরোটা না জানাক, ভাইকে তুহিন খুলে বলেছিল প্রকৃত অবস্থাটা। ঠাট্টার সুরে বলেছিল, এরপর বোধহয় তোর ঘাড়ে গিয়েই চাপতে হবে রে! সদলবলে দিল্লি পাড়ি দিলে কেমন হয়! তোর ওখানেই নয় ডেরা বেঁধে নতুন কাজের ধান্দা করব!

শুনেই তুষারের মুখ শুকিয়ে আমসি।

না, আর কোনও ছবি মনে পড়ে না তুহিনের। ছোটবেলার কোনও স্মৃতিও না। শুধু ভাইয়ের ওই মুখটা…! ক্ষণিকের ওই পাংশু মুখটি তুহিনকে বুঝিয়ে দিয়েছে, বিপদের দিনে তুষার তার পাশে নেই। যতই সে নিখুঁত সময়ে বিজয়ার প্রণাম জানাক, মাসে দু’-চার বার ফোন করুক, কিংবা বছরে দু’বছরে ঘুরে যাক কলকাতা…। সবই তো ওপর ওপর, নয় কি? হাজার মাইল দূরে থাকে ভাই, এটা বড় কথা নয়। মন থেকে সে লক্ষ মাইল সরে গেছে।

তুহিন এক ঢোকে গ্লাস শেষ করল। ঈষৎ জড়ানো গলায় বলল,— দুঃখ করবেন না, দুবেজি। প্রার্থনা করুন, সে যেন সুখে থাকে।

তাই তো করি স্যার। দুনিয়ার সব্বাই হ্যাপি থাকুক, রাজেশের স্বরেও সামান্য দুলুনি,— আপনারাও দেখুন আমি যেন ভাল থাকি। বেশি নয়, ওই হাফ পারসেন্ট।

ভবি তো ভোলবার নয়! তুহিন নিজেই অনেকটা সুরা ঢালল গ্লাসে। অল্প জল মেশাল। গ্লাস হাতে হেলান দিয়েছে দোলচেয়ারে। জিজ্ঞেস করল,— আপনার ছেলের কী খবর?

ঠিকঠাক। কলেজে পড়ছে। দিল্লাগি করছে। মোটরবাইক নিয়ে টাউনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে।

ওকে আপনার বিজনেসে আনবেন না?

দেখি। আগে শাদিবিয়াটা দিই।

এখনই?

টোয়েন্টি ওয়ান হয়ে গেছে স্যার। অনেক সম্বন্ধ্‌ আসছে। তবে আমি ঠিক করেছি এমন ঘরে দেব, যেখানে একটাই মেয়ে, বাপের ভি বিজনেস আছে। দুটো বেওসা জুড়ে যাবে, ছেলের ফিউচার ভি ফার্স্ট ক্লাস।

এমন সরল পদ্ধতি যদি তিতানের জন্য ভাবা যেত! কী যে করল ছেলেটা! স্কুল মাস্টারিতে আজকাল পার্টির লোক নাকি নিচ্ছে খুব, ওই লাইনটাই বোধহয় ওর কপালে নাচছে। কমার্সে না দিয়ে ওকে বাংলা, ইতিহাস পড়ালে কি ভাল হত? তিয়ার মতো ড্যাশি পুশি নয় তিতান, পার্টির ফেস্টুন ধরে থেকে হয়তো বুদ্ধিমানের কাজই করছে। তবে ও যা ছেলে, ভরসা হয় না। হয়তো সাঙ্গোপাঙ্গরাই এগিয়ে গেল, ও লাঠি হাতে পড়ে রইল! কত ভাল একটা টিউটোরিয়ালে দেওয়া হয়েছিল, ওখানকার বন্ধুরা তো সব স্টার লেটার নিয়ে আচ্ছা আচ্ছা জায়গায় পড়ছে, আর তিতান…!

আসলে ওর ভিতটাই কাঁচা রয়ে গেছে। তুহিন নিজে যদি ছেলেকে নিয়ে একটু বসতে পারত! এত চাপ, এত কাজ, এত ঘোরা তখন। দোলা তো বোধহয় প্রতিজ্ঞাই করে ফেলেছিল, ছেলেমেয়ের পড়াশুনো নিয়ে সে মাথা ঘামাবে না। নাটক নিয়ে তুহিন ধেইধেই নাচতে দেয়নি তো, তার প্রতিশোধ। নাটকের টানে ছুটত? না অংশুদার? এত কীসের উচ্ছ্বাস ওই লোকটাকে নিয়ে? বিছানায় বরের কাছে এলে তুমি কাঠের মতো পড়ে থাকো, অথচ অংশু রায়ের নামে তোমার চোখ জ্বলজ্বল কেন?

রাজেশ ঘড়ি দেখছে। বলল,— আজ উঠি স্যার। একটা অন্য জায়গায় যেতে হবে।

তুহিন হাত ওঠাল,— যাবেন? যান।

কাল বিকেলে আমার গাড়ি আপনাকে স্টেশনে ছেড়ে আসবে।

ঠিক হ্যায়। থ্যাঙ্কস।

আমার ব্যাপারটা একটু খেয়াল রাখবেন স্যার। রাজেশ দরজায় গিয়েও দাঁড়িয়েছে,— ওই হাফ পারসেন্ট।

হাহ্‌, ওই হাফ পারসেন্ট নিয়েই তো দুনিয়ায় যত গোলমাল। দোলার কাছে ওই বাড়তি আধ পারসেন্ট যদি পেত তুহিন!

গ্লাসে তরল টলটল করছে। তুহিন চুমুক দিল। স্খলিত হাতে। শিথিল ঠোঁটে। অসাড় জিহ্বায়। আপন মনে বিড়বিড় করে উঠল, আমি সব বুঝি দোলা, সব বুঝি। একটা ইশ্‌ক-মহব্বত তোমাদের ছিল। এখনও হয়তো আছে। তুহিন তো বাড়িতে পাহারা বসায়নি! হয়তো এখনও দুপুরবেলায়…

তুহিনের ঢুলুঢুলু চোখ স্পষ্ট দেখতে পেল তাদের ফ্ল্যাটে বেল বেজেছে, দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল দোলা। ওপারে অংশু। দোলা তাকে টেনে নিল অন্দরে, বন্ধ করল দরজা। অংশু জড়িয়ে ধরেছে দোলাকে। ঝুঁকল। মিশে যাচ্ছে ঠোঁটে ঠোঁট। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অদ্ভুত চপল বিভঙ্গে ভেঙে পড়েছে দোলা। এখনকার দোলা নয়, দশ বছর আগের দোলা। অংশু রায়কে যে ধরে এনেছিল বাড়িতে। উচ্ছল সেই দোলা অংশুর সঙ্গে শোওয়ার ঘরে এল। বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে দু’জনে। অংশু দু’হাতে খুলছে দোলার আবরণ…

তুহিনের নিশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। শ্বাস তো নয়, হলকা। দু’কান দিয়ে আগুন ছুটছে। তুহিন টের পেল, শরীর জেগে উঠছে সহসা। ঘোর ঘোর নেশা ছিঁড়ে খানখান। এক্ষুনি একটা মেয়েমানুষ চাই। এক্ষুনি।

দোলচেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল তুহিন। ঈষৎ বেপথু পা চলেছে সুইচবোর্ডের দিকে। কলিংবেল টিপল। টিপেই আছে।

সনাতন দৌড়ে এসেছে,— খানা আনব স্যার?

চোপ। তর্জনী ওঠাল তুহিন,— যা, মেয়েটাকে ডেকে আন।

কোন মেয়েটা স্যার?

ওই যে, কী যেন নাম? আগের বার যেটা এসেছিল। দুগ্‌গা…লক্ষ্মী…সরস্বতী…! যা যা, জলদি যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *