০৪. প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন

চতুর্থ অধ্যায় – প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন

প্রাকৃতিক নির্বাচনের তুলনায় এর ক্ষমতা–তুচ্ছ গুরুত্বের বৈশিষ্ট্যগুলির উপর এর প্রভাব–সমস্ত বয়সে উভয় লিঙ্গে এর ক্ষমতা–যৌন নির্বাচন–একই প্রজাতির এককদের মধ্যে আন্তঃ-সঙ্করণের সর্বজনীনতা–প্রাকৃতিক নির্বাচনের পরিণতিতে অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্থাসমূহ, যথা আন্তঃ-সঙ্করণ, অন্তরণ, এককদের মন্থর প্রক্রিয়া–প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সংঘটিত বিলুপ্তি–যে কোন ছোট অঞ্চলের অধিবাসীদের বিচিত্রতায় এবং অভিযোজন সম্পর্কিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি–একটি সাধারণ পিতামাতা থেকে বংশধরদের ওপর বৈশিষ্ট্য ও বিলুপ্তির অপসারণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া–সমস্ত জীবজগতের শ্রেণীবিন্যাসের ব্যাখ্যা–সংগঠনের অগ্রগতি–নিম্ন আকাররা সংরক্ষিত–চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিসৃতি–প্রজাতির অনির্দিষ্ট সংখ্যাবৃদ্ধি– সারাংশ।

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে সংক্ষেপে আলোচিত অস্তিত্বের সংগ্রাম পরিবৃত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে কিরূপে কাজ করে? মানুষের হাতে এত শক্তিশালী নির্বাচন পদ্ধতিটি কি প্রকৃতিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে? এর পর আমরা দেখব এটি অতিশয় ফলপ্রদভাবে কাজ করতে পারে। আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনে সংঘটিত অল্প পরিবৃত্তি ও এককীয় পার্থক্যের সীমাহীন সংখ্যা এবং এগুলি অল্পতর মাত্রায় প্রকৃতিতে ঘটে, এটা আমাদের স্মরণে রাখা উচিত; এবং সঙ্গে সঙ্গে বংশানুক্রমিক প্রবণতার ক্ষমতাটিও। এটি সত্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে গৃহপালনাধীন অবস্থায় সমগ্র জৈব সংগঠন কিছু মাত্রায় নমনীয়। কিন্তু যেমন হুঁকার ও আসা গ্রে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে বিভিন্নতাটি প্রত্যক্ষভাবে মানুষের দ্বারা উৎপাদিত হয় না, যা আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলিতে আমরা প্রায় সার্বজনীনভাবে দেখি, সে ভ্যারাইটিদের উদ্ভব ঘটাতে পারে না অথবা এটির সংঘটনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না, যা ঘটে তা হচ্ছে যে এটি কেবল সংরক্ষণ ও পুঞ্জীভবন করতে পারে। সে অনিচ্ছাকৃতভাবে জীবগুলিকে নূতন ও পরিবর্তনশীল পরিবেশে প্রভাবাধীন করে এবং এর ফলে বিভিন্নতা বা পরিবৃত্তির উদ্ভব ঘটে; কিন্তু পরিবেশের একইরূপ পরিবর্তন প্রাকৃতিক অবস্থাতেও ঘটতে পারত এবং ঘটে। এটিও স্মরণে রাখা উচিত যে সমস্ত জীবের পরস্পরের ও এদের জীবনের ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কগুলি কি-রকম জটিল ও অন্তরঙ্গ হয়; ফলস্বরূপ দেহগঠনের অসংখ্য বহুবিচিত্র বৈচিত্ৰসমূহ জীবনের পরিবর্তনশীল পরিবেশে প্রত্যেক জীবের কী প্রয়োজনে লাগতে পারত? মানুষের পক্ষে উপকারী পরিবৃত্তিগুলির সন্দেহাতীতভাবে উদ্ভব ঘটেছে এবং বিরাট ও জটিল জীবন-সংগ্রামে প্রত্যেক জীবের পক্ষে উপকারী পরিবৃত্তিগুলি অনেক বংশপরম্পরায় ঘটতে থাকবে, এসব দেখে এটি অসম্ভব বলে চিন্তা করা যেতে পারে কি? যদি এরূপ ঘটে, অন্যদের তুলনায় যত অল্পই হোক, কোন বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভকারী এককদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকবে এবং নিজের মত সন্তান উৎপাদন করবে, এ ব্যাপারে আমরা কি সন্দেহ করতে পারি (বেঁচে থাকার তুলনায় আরও অনেক এককদের জন্ম হয় এটি স্মরণ করে? পক্ষান্তরে, আমরা স্থিরনিশ্চিত হতে পারি যে অল্পতম মাত্রায় ক্ষতিকর যে কোন পরিবৃত্তি ভয়ানকভাবে ধ্বংস হবে। অনুকূল এককীয় পার্থক্য এবং পরিবৃত্তিদের এই সংরক্ষণ এবং ক্ষতিকারকগুলির ধ্বংসসাধনকে আমি প্রাকৃতিক নির্বাচন বা যোগ্যতমের উদ্বর্তন বলেছি। অনুপকারী বা ক্ষতিকারক নয় এমন পরিবৃত্তিগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা প্রভাবিত হবে না, এবং হয় এটি অস্থিরতামূলক উপাদান হিসেবে পরিত্যক্ত হবে, যেমনটা আমরা কোন কোন বহুরূপক প্রজাতিদের ক্ষেত্রে দেখি, অথবা জৈবসংগঠন ও পরিবেশের প্রকৃতি অনুযায়ী অবশেষে স্থায়ী হবে।

কয়েকজন লেখক প্রাকৃতিক নির্বাচন পদটি সম্পর্কে অহেতুক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অথবা বিরোধিতা করেছেন। এমনকি কেউ কেউ কল্পনা করেছেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচন পরিবৃত্তি ঘটাতে প্ররোচিত করে, পক্ষান্তরে জীবের জীবনাবস্থায় উপকারী ও উদ্ভূত পরিবৃত্তিদের কেবল সংরক্ষণই এটির অর্থ প্রকাশ করে। নির্বাচনে মানুষের বিশেষ ক্ষমতা আছে একথা যে সব কৃষিবিদরা বলেন, তারা কেউ এটির বিরোধিতা করেন না। এবং এক্ষেত্রে প্রকৃতিপ্রদত্ত এককীয় পার্থক্যগুলি অনিবার্যরূপে ঘটে, যাদের মানুষ কোন কোন কারণে নির্বাচন করে। অন্যরা বিরোধিতা করেছেন এভাবে যে রূপান্তরিত প্রাণীদের। সচেতন মনোনয়নই নির্বাচন পদটির অর্থ প্রকাশ করে, এবং এমনকি এ-ও বলার চেষ্টা হয় যে যেহেতু উদ্ভিদদের কোন ইচ্ছা নেই, সেহেতু প্রাকৃতিক নির্বাচন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কোন সন্দেহ নেই আক্ষরিক অর্থে প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি ভুল পদ, কিন্তু বিভিন্ন মৌল পদার্থদের ঐচ্ছিক সম্বন্ধতা সম্পর্কে বলেন, এমন রসায়নবিদদের কেউ কি। কখনও বিরোধিতা করেছেন? এবং তথাপি সঠিকভাবে বলতে গেলে অম্ল ক্ষারকে নির্বাচন করতে পারে না, যার সঙ্গে এর যুক্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। বলা হয়েছে যে একটি সক্রিয় শক্তি অথবা ঈশ্বররূপে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা বলেছি আমি; কিন্তু কে সেই লেখকের বিরোধিতা করে যিনি গ্রহদের গতির কারণ অভিকর্ষজ আকর্ষণ বলে প্রচার করেন? প্রত্যেকেই জানে এরূপ রূপক মিশ্রিত প্রকাশের অর্থ ও ইঙ্গিত কী; সংক্ষিপ্ততার জন্য এগুলির খুবই প্রয়োজন। অতএব প্রকৃতি শব্দটিতে ব্যক্তিত্ব আরোপ পরিহার করা অতিশয় কষ্টকর। কিন্তু কেবলমাত্র অনেক প্রাকৃতিক নিয়মের সামগ্রিক ক্রিয়া ও তজাত ফল, এবং আমাদের দ্বারা নির্ধারিত ঘটনার ক্রমবিন্যাসের নিয়ম দ্বারা প্রকৃতি সম্পর্কে আমি অর্থ প্রকাশ করি। অল্পজ্ঞানসম্পন্ন ভাসা-ভাসা বিরোধিতাগুলি ভুলে যেতে হবে।

কিন্তু অল্প ভৌত পরিবর্তন হচ্ছে এমন একটি দেশের কোন ঘটনা ধরলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সম্ভাব্য গতি সম্পর্কে ভালভাবে জানতে পারব আমরা। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ুর কথা বলা যেতে পারে। দেশটির অধিবাসীদের আনুপাতিক সংখ্যা প্রায় তৎক্ষণাৎ পরিবর্তিত হবে এবং কতিপয় প্রজাতি সম্ভবতঃ বিলুপ্ত হবে। প্রত্যেক দেশের অধিবাসীরা যে অন্তরঙ্গ ও জটিলভাবে একত্রে আবদ্ধ থাকে, তা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত। করতে পারি যে জলবায়ুর পরিবর্তন নিরপেক্ষভাবে অধিবাসীদের সংখ্যাসূচক অনুপাতের যে কোন পরিবর্তন অন্যদের গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে। কোন দেশের সীমান্ত যদি খোলা থাকে, তাহলে নতুন আকারগুলি নিশ্চয় অনুপ্রবেশ করবে এবং এটি এভাবে পূর্বের কয়েকটির সম্পর্ককে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করবে। স্মরণ রাখা উচিত, একটি প্রবর্তিত বৃক্ষ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর কত ক্ষমতা দেখানো হয়েছে। কিন্তু একটি দ্বীপ অথবা প্রতিবন্ধক দ্বারা বেষ্টিত একটি দেশের ক্ষেত্রে, যেখানে নতুন ও সু-অভিযোজিত আকারগুলি অবাধে প্রবেশ করতে পারে না, যদি আদিম অধিবাসীদের কয়েকটি কোনভাবে রূপান্তরিত হয়ে থাকত, তাহলে প্রকৃতিতে তখন অনেক অঞ্চল রয়ে থাকবে যা নিশ্চিতভাবে পরিপূর্ণ হবে। কারণ মুক্ত অঞ্চলটি অনুপ্রবেশের জন্য খুলে দিলে অনুপ্রবেশকারীরা এইসব অঞ্চল দখল নিত। এসব ক্ষেত্রে, পরিবর্তিত পরিবেশে ভালভাবে অভিযোজিত হওয়ার মাধ্যমে যে কোন ভাবে যে কোন প্রজাতির এককদের আনুকূল্য করে অল্প রূপান্তরগুলি সংরক্ষিত হওয়ার প্রবণতাসম্পন্ন হবে এবং আরও উন্নতিসাধনের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচনের অবাধ সুযোগ থাকবে।

আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে জীবন পরিবেশের পরিবর্তন পরিবৃত্তির বৃদ্ধি করতে জীবকে প্রবণ করে তোলে, যেমনটা প্রথম অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে; এবং পূর্ববর্তী ক্ষেত্রগুলিতে জীবন-পরিবেশে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ফলদায়ক পরিবৃত্তি ঘটানোর একটি ভাল সম্ভাবনা প্রদান করে এটি স্পষ্টতঃ প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনুকূল হবে। এগুলি না ঘটলে প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছুই করতে পারে না। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ‘পরিবৃত্তি’ পদটির মধ্যে কেবল এককীয় পার্থক্যসমূহ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মানুষ যেমন এককীয় পার্থক্যগুলিকে বিশেষ দিকে বৃদ্ধি করিয়ে গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে ভাল ফল লাভ করতে পারে, প্রক্রিয়াটির জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি সময় নিয়ে আরও সহজভাবে সেইরূপ প্রাকৃতিক নির্বাচনও করতে পারে। অথবা আমি বিশ্বাস করি না যে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করতে যে কোন বিরাট বিরাট ভৌত পরিবর্তন, যেমন জলবায়ু বা যে কোন অস্বাভাবিক পরিমাণের অন্তরণের প্রয়োজন এই জন্য হয় যে পরিবর্তনশীল অধিবাসীদের কয়েকটিকে উন্নত কোরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য পূর্ণ করতে নূতন ও অদখলীকৃত স্থান পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। কারণ যেহেতু প্রত্যেক দেশের অধিবাসীরা সুষম শক্তিগুলির সঙ্গে একত্রে সংগ্রাম করছে, সেহেতু একটি প্রজাতির দেহগঠন ও স্বভাবের অত্যল্প রূপান্তরসমূহ সুফলটিকে ততদিন পর্যন্ত প্রায়শই আরও বর্ধিত করবে, যতদিন পর্যন্ত প্রজাতিটি জীবনের একই পরিবেশে অবস্থান করবে এবং জীবনধারণ ও আত্মরক্ষার একইরূপ উপায়গুলির দ্বারা সুফল লাভ করবে। এমন একটিও দেশের নাম করা যেতে পারে না যেখানে সমস্ত স্থানীয় অধিবাসীরা এখন এত নিখুঁতভাবে পরস্পরের সঙ্গে এবং বেঁচে থাকার উপযুক্ত ভৌত অবস্থার সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছে যে তাদের মধ্যে কেউই আরও নিখুঁতভাবে অভিযোজন ও উন্নতিসাধন করতে পারত না; কারণ সব দেশেই ভিন্ন পরিবেশে অভিযোজিতরা দেশজদের এতটা পরাজিত করেছে যে দেশজরা কতিপয় বিদেশিদের জমির অধিকার ছেড়ে দিয়েছে। এবং এভাবে প্রত্যেক দেশে বিদেশিরা দেশজদের পরাজিত করেছে বলে আমরা নিরাপদে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে প্রাধান্যের জন্য দেশজদের রূপান্তর ঘটে থাকতে পারে, যাতে করে তারা অনুপ্রবেশকারীদের ভালভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।

মানুষ যেহেতু নিয়মানুগ ও অচেতন নির্বাচন পদ্ধতির দ্বারা বিরাট ফল উৎপাদন করতে পারে এবং নিশ্চয়ই করেছে, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন কি তা করতে পারে না? বহিঃস্থ ও দৃষ্টিগোচর বৈশিষ্ট্যদের ওপরই মানুষ কেবল কাজ করতে পারে; প্রাকৃতিক সংরক্ষণে অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তনকে নরত্ব আরোপ করতে আমাকে যদি অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে বলা যায় জীবের ক্ষেত্রে যতখানি উপযোগী হবে এমনগুলি ছাড়া প্রকৃতি বাহ্যরূপকে গ্রাহ্য করে না। অন্তঃস্থ অঙ্গের প্রত্যেকটির, জৈবসংগঠনীয় পার্থক্যের প্রত্যেক বৈচিত্র্যের, জীবনের সমগ্র তন্ত্রটির ওপর সে কাজ করতে পারে। মানুষ শুধুমাত্র নিজের ভালর জন্যই নির্বাচন করে, প্রকৃতি শুধুমাত্র জীবের সেইটির ওপর কাজ করে যাকে সে কোন লক্ষ্যে চালিত করে। প্রত্যেক নির্বাচিত বৈশিষ্ট্যকে সে পুরোপুরি কাজে লাগায়, যেটি এদের নির্বাচনের ঘটনার দ্বারা আভাসে-ইঙ্গিতে বোঝা যায়। মানুষ একই দেশে বহু ধরনের জলবায়ুতে অভ্যস্ত দেশজদের প্রতিপালন করে; প্রত্যেক নির্বাচিত বৈশিষ্ট্যকে কদাচিৎ সে কোন বিশেষ ও উপযুক্ত প্রথায় ব্যবহার করে; লম্বা ও ছোট চঞ্চুওয়ালা পায়রাকে সে একই খাবার খাওয়ায়; সে কোন বিশেষ পদ্ধতিতে লম্বা পৃষ্ঠদেশ বা লম্বা পাওয়ালা চতুষ্পদকে কাজে লাগায় না; লম্বা ও ছোট উল সমেত ভেড়াদের একই আবহাওয়ার মধ্যে রাখে। স্ত্রীদের জন্য সংগ্রাম করতে অতি শক্তিশালী পুরুষদের অনুমতি দেয় না সে। নিকৃষ্ট প্রাণীদের সে নির্বিচারে হত্যা করে না, বরং প্রত্যেক পরিবর্তনশীল ঋতুতে সে তার ক্ষমতানুসারে তার সমস্ত উৎপাদনকে রক্ষা করে। কোন অর্ধ অঙ্গবিকৃতিমূলক আকারের অথবা অন্ততঃ চোখে দেখা যায় এমন যথেষ্ট লক্ষণীয় কিছু রূপান্তরের অথবা সরলভাবে তার উপকারে লাগে এমন সব ক্ষেত্রে সে প্রায়শই তার নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রাকৃতিক অবস্থায় দেহগঠন ও বিন্যাসের অল্পতম পার্থক্য জীবন-সংগ্রামে সুষম মানদণ্ডকে ঘুরিয়ে দিতে পারে এবং সেইজন্যই সংরক্ষিত হয়। মানুষের ইচ্ছা ও চেষ্টা কত ক্ষণস্থায়ী! কত অল্প তার সময়! এবং ফলস্বরূপ সমগ্র ভূতাত্ত্বিক যুগ ধরে প্রকৃতি দ্বারা সঞ্চিত ঐ সব ফলগুলির তুলনায় তার কার্যকাল কতই সামান্য! আমরা কি এই ভেবে বিস্ময় বোধ করতে পারি যে মানুষের উৎপাদনগুলির তুলনায় প্রকৃতির উৎপাদনগুলি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অনেক সঠিকতর’ হবে, বা তারা সবচেয়ে জটিল জীবন-পরিবেশে সীমাহীনভাবে অভিযোজিত হবে বা সরলভাবে উচ্চতর দক্ষতার ছাপ বহন করবে?

রূপক হিসেবে বলা যেতে পারে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন সমগ্র পৃথিবীব্যাপী অল্পতম পরিবৃত্তিগুলিকে প্রতিদিন ও প্রতিঘণ্টায় খুঁটিয়ে বা সযত্নে পরীক্ষা করছে, খারাপগুলিকে বাতিল করছে, ভালগুলিকে সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করছে; এর জৈবিক ও অজৈবিক জীবনাবস্থাদের সম্পর্কে প্রত্যেক জীবের উন্নতিসাধনে যখন ও যেখানেই সুযোগ উপস্থিত হয়, নীরবে ও অচেতনভাবে কাজ করছে সে। দীর্ঘসময় অতিবাহিত না-হওয়া পর্যন্ত অগ্রগমনের এইসব মন্থর পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই না, এবং তারপর দীর্ঘসময় পূর্বে অতিবাহিত ভূতাত্ত্বিক যুগগুলি সম্বন্ধে আমাদের পর্যবেক্ষণ এত ত্রুটিপূর্ণ যে পূর্বের অবস্থার তুলনায় জীবনাকারগুলি এখন অনেক ভিন্ন, এটিই আমরা দেখি।

একটি প্রজাতির যে কোন বিরাট পরিমাণ রূপান্তর হতে গেলে, একসময়ে সৃষ্ট একটি ভ্যারাইটি দীর্ঘসময় ব্যবধানে পুনরায় নিশ্চয় পরিবর্তিত হবে বা পূর্বের মত অনুকূল প্রকৃতির এককীয় পার্থক্যগুলো উপস্থিত করবে; এবং এগুলি নিশ্চয় পুনরায় সংরক্ষিত হবে এবং ধাপে ধাপে অগ্রসর হবে। একই প্রকার এককীয় পার্থক্য পুনঃ পুনঃ ঘটতে দেখে একটি অনধিকার ধৃষ্টতা হিসেবে এটিকে কদাচিৎ বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এটি সত্য কিনা, প্রকল্পটি কতখানি প্রকৃতির সাধারণ ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কেমন ব্যাখ্যা উপস্থিত করে, তা দেখেই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি। বিপরীতক্রমে, সাধারণ বিশ্বাস হচ্ছে যে সম্ভবপর পরিবৃত্তির পরিমাণ কঠোরভাবে সীমায়িত। এটিও একটি সরল ধারণা।

প্রাকৃতিক নির্বাচন যদিও প্রত্যেক জীবের ভিতর দিয়ে ও মঙ্গলের জন্যই কেবল কাজ করতে পারে, তথাপি আমাদের বিবেচনায় অতি তুচ্ছ গুরুত্বের বৈশিষ্ট্য ও দেহগঠনের ওপরও ক্রিয়াশীল হতে পারে। আমরা যখন লক্ষ্য করি পাতা-ভক্ষণকারী পতঙ্গরা সবুজ, গাছের ছাল-ভক্ষণকারীরা বহুবর্ণে চিহ্নিত ধূসর, শীতে উচ্চ গিরিশৃঙ্গের টারমাইগানরা সাদা, লাল-গ্রাউসের রং হেদার গুল্মের মতো, তখন আমাদের নিশ্চয় বিশ্বাস করা উচিত যে এইসব রং ঐ সব পাখিদের ও পতঙ্গদের বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে। জীবনের কোন পর্যায়ে এদের যদি ধ্বংস করা না হয়, তাহলে গ্রাউসরা (এক ধরনের বুনো হাঁস) সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পাবে। এরা সাধারণত শিকারি পাখি দ্বারা বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এটা জানা গেছে; বাজপাখিরা দৃষ্টিশক্তির কারণে শিকারের সন্ধান পায়-মহাদেশের মানুষদের সাদা পায়রা না পোষার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়, কারণ এরা সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযোগ্য। অতএব প্রত্যেক প্রকার/ধরনের গ্রাউসকে সঠিক রং প্রদানের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হবে এবং একবার অর্জন করার পর রংটিকে সঠিক ও স্থায়ী রাখতেও প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হবে। অথবা আমাদের এমন চিন্তা করা উচিত হবে না যে কোন বিশেষ রঙের একটি প্রাণীর আকস্মিক ধ্বংসসাধন অল্প ফল উৎপাদন করবে: আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে এক পাল ভেড়ার মধ্যে যদি একটি শিশু ভেড়ার রং কালো হয় তাহলে তাকে নষ্ট করা কত প্রয়োজনীয়। আমরা দেখেছি ভার্জিনিয়াতে ‘রং-করা শিকড় খাওয়ানো হয় এমন শূকরদের শরীরের রং তাদের বাঁচা-মরা নির্ধারণ করে। উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে, ফলের নরম রোম ও শাঁসের রংকে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা অতি তুচ্ছ গুরুত্বের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করেন: তথাপি বিখ্যাত উদ্যানবিদ্ ডাউনিং-এর কাছ থেকে আমরা শুনি যে ইউনাইটেড স্টেট-এ নরম রোমযুক্ত ফলগুলির তুলনায় মসৃণ চামড়াযুক্ত ফলগুলি কারকিউলিও নামে গুবরে পোকার দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; আরও শুনি যে হলদে প্লামের তুলনায় বেগুনি প্লামগুলি কোন বিশেষ রোগের দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কিন্তু পক্ষান্তরে, অন্য রঙের শাঁসসমেত পিচফলগুলির তুলনায় হলদে শাঁসের পিচফলগুলিকে অন্য ধরনের রোগ আক্রমণ করে। যাবতীয় দক্ষতার সঙ্গে কতিপয় ভ্যারাইটিকে চাষ করতে গিয়ে যদি এইসব অল্প পার্থক্য একটি বিরাট পার্থক্যে পরিণত হয়, তবে সেখানে বৃক্ষের ও অন্য অনেক শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়, প্রাকৃতিক অবস্থায় মসৃণ বা সূক্ষ্ম রোমযুক্ত, হলদে বা বেগুনি শাঁসযুক্ত ফলের যে কোন ভ্যারাইটি কৃতকার্য হবে কিনা তার ওপর এইরূপ পার্থক্যের ব্যাপারটির সফল সমাধান হবে।

প্রজাতিদের মধ্যে আপাতভাবে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় অনেক ছোট ছোট পার্থক্যের বিষয় লক্ষ্য করে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে জলবায়ু, খাদ্য ইত্যাদি নিঃসন্দেহেই কিছু প্রত্যক্ষ ফল উৎপাদন করেছে। এটিও স্মরণে রাখা উচিত যে যখন একটি অঙ্গ পরিবর্তিত হয় এবং পরিবর্তনগুলি যখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সঞ্চিত হয়, তখন পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়মানুযায়ী অন্য রূপান্তরসমূহ প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই আবির্ভূত হবে।

আমরা লক্ষ্য করি যে পরিবৃত্তগুলি গৃহপালিত অবস্থায় জীবনের কোন বিশেষ বয়সে আবির্ভূত হয়। বংশধরের একই বয়সে ঐগুলির পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা থাকে। যেমন, আমাদের রন্ধন ও চাষযোগ্য উদ্ভিদের অসংখ্য ভ্যারাইটিদের বীজগুলির আকার, আয়তন ও স্বাদগন্ধে; রেশম কীটের ভ্যারাইটিদের গুটি ও শুয়োপোকার বিভিন্ন ধাপে বা স্তরে; পক্ষিশালার ডিমগুলিতে ও তাদের ছানার পালকের রঙে; আমাদের প্রায় পূর্ণবয়স্ক ঘোড়া ও গোমহিষাদির শিঙে। অতএব প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাকৃতিক নির্বাচন ঐ একই বয়সে ফলদায়ক পরিবৃত্তিগুলিকে সঞ্চয়ের মাধ্যমে এবং সমরূপ বয়সে এদের বংশধরে প্রেরণের মাধ্যমে যে কোন বয়সে জীবকে পরিবর্তিত ও জীবের ওপর ক্রিয়া করতে সমর্থ হবে। যদি কোন গাছের বীজগুলি বায়ুর দ্বারা ব্যাপকভাবে বিস্তারে লাভবান হয়, তাহলে নির্বাচনের মাধ্যমে তার তুলগাছের গুঁটির রোমগুলির উন্নতি ও বৃদ্ধি করতে তুলাচাষীর অবদানের তুলনায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এটি সম্পাদন করায় আমি কোন অসুবিধা দেখি না। একটি পতঙ্গের লার্ভাকে রূপান্তরিত ও অভিযোজিত করতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের বহু সম্ভাবনা থাকতে পারে, যা আবার পূর্ণবয়স্ক পতঙ্গের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ভিন্ন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়মের মাধ্যমে রূপান্তরগুলি লার্ভার গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে। বিপরীতক্রমে এভাবে বয়স্কদের রূপান্তরগুলি লার্ভার গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে এরা ক্ষতিকর হবে না তা প্রাকৃতিক নির্বাচনই নিশ্চিত করবে, কারণ তা না হলে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হবে।

পিতামাতা সম্পর্কে প্রাকৃতিক নির্বাচন তরুণদের গঠন রূপান্তরিত করবে এবং তরুণদের সম্পর্কে পিতামাতাদেরও। সামাজিক প্রাণীদের ক্ষেত্রে, যদি নির্বাচিত পরিবর্তনটির দ্বারা সম্প্রদায় লাভবান হয়, প্রাকৃতিক নির্বাচন সমগ্র সম্প্রদায়ের উপকারের জন্য প্রত্যেক এককের গঠনকে অভিযোজিত করবে। প্রাকৃতিক নির্বাচন যা করতে পারে না তা হচ্ছে অন্য প্রজাতির ভালর জন্য কোন সুবিধা প্রদান না করে একটি প্রজাতির গঠনকে রূপান্তরিত করা। প্রাকৃতিক ইতিহাসের গবেষণায় এই সংক্রান্ত বক্তব্য দেখা যেতে পারে, আমি একটিও উদাহরণ দেখতে পাইনি যা পরীক্ষার যোগ্য। একটি প্রাণীর জীবনে কেবল একবার ব্যবহৃত একটি গঠন যদি তার পক্ষে অতিশয় প্রয়োজনীয় হয়, তাহলে গঠনটি প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা যে কোন পর্যায় পর্যন্ত রূপান্তরিত হয়ে থাকবে; উদাহরণস্বরূপ, কোন কোন পতঙ্গের বিরাট চোয়াল গুটি খুলতে কেবল ব্যবহৃত হয় অথবা পাখিদের ঠোঁটের শক্ত অগ্রভাগ ডিম ভাঙ্গতে ব্যবহৃত হয়। জোরের সঙ্গে বলা হয় যে ডিম ফুটে বেরোনোর পূর্বেই সর্বোত্তম অসংখ্য হ্রসচক্ষুবিশিষ্ট লোটন পায়রা ডিমেই নষ্ট হয়; সেইজন্য পাখিরসিক বা প্রেমিকরা ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করতে সাহায্য করে। এখন যদি প্রকৃতি পাখির সুবিধার জন্য পূর্ণবয়স্ক পায়রার ঠোঁট অতিশয় ছোট করত, তাহলে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি অতিশয় মন্থর হবে এবং ডিমের মধ্যে অতিশয় শক্তিশালী ও খুব শক্ত ঠোঁটওয়ালা সমস্ত তরুণ পাখিদের যুগপৎ কঠোর নির্বাচন হবে, ফলে দুর্বল ঠোঁটওয়ালারা সকলে অনিবার্যভাবে ধ্বংস হবে; অথবা আরও নরম ও সহজেই ভাঙ্গা যায় এমন খোলকরা নির্বাচিত হয়ে থাকবে–জানা গেছে যে খোলকের পুরুত্ব অন্য প্রত্যেক গঠনের মতোই পরিবর্তিত হয়।

এখানে বলে নেওয়া ভাল যে আকস্মিকভাবে সমস্ত জীবের ব্যাপক বিনাশ হতে পারে, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অল্প প্রভাব ফেলে অথবা আদৌ কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, অসংখ্য ডিম ও বীজ প্রতিবছর খেয়ে ফেলা হয়, যেগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে রূপান্তরিত হতে পারত একমাত্র তখনই যখন এরা এমনভাবে পরিবর্তিত হত যাতে করে শত্রুদের হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। তবুও যারা বেঁচে আছে তাদের যে কোনটির তুলনায়, ধ্বংস না হলে, এইসব ডিম ও বীজদের অনেকেই জীবন-পরিবেশে ভালভাবে অভিযোজিত, এককদের বোধহয় উৎপাদন করে থাকবে। এভাবে জীবন-পরিবেশে খুব ভালভাবে অভিযোজিত হোক আর না-ই হোক, বিরাট সংখ্যক প্রাণী ও উদ্ভিদ আকস্মিক কারণের জন্য প্রতিবছর নিশ্চয় ধ্বংস হবে, প্রজাতির পক্ষে উপকারী হবে এমন দেহকাঠামো ও জৈবসংগঠনে কোন পরিবর্তনের মাধ্যমে এদের তীব্রতা হ্রাস হবে না। কিন্তু ধরা যাক বয়স্কদের ধ্বংসসাধন কখনও খুব বেশি হয়, যে কোন জেলায় অবস্থানরত সংখ্যাটি যদি এরূপ কারণগুলির দ্বারা সামগ্রিকভাবে সংযত না রাখা হয়, অথবা ধরা যাক বীজ ও ডিমগুলির ধ্বংসসাধন এক বিরাট হয় যে কেবল শতাংশ বা সহস্রাংশ বেড়ে ওঠে–সেক্ষেত্রেও যারা বেঁচে থাকে, অনুকূল দিকে যে কোন বিভিন্নতা/পরিবর্তনশীলতা রয়েছে এটি মনে করে, এদের মধ্যে সবচেয়ে ভালভাবে অভিযোজিত এককরা সাধারণভাবে অভিযোজিতদের তুলনায় অধিক সংখ্যায় নিজেদের বংশধর উৎপাদন করতে প্রবণ হবে। এইমাত্র উল্লিখিত কারণের দ্বারা সংখ্যাটি সামগ্রিকভাবে সংযত রাখা হলে, যা প্রায়ই ঘটে থাকে, প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন এক হিতকর দিকে কাজ করতে ক্ষমতাহীন হবে; কিন্তু অন্য সময়ে ও অন্য দিকে এরা দক্ষতা সম্পর্কে এটি কোন যুক্তিসংগত আপত্তি নয়, কারণ অনেক প্রজাতি একই সময়ে একই অঞ্চলে কখনও রূপান্তরিত হয় ও উন্নত হয় এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই।

যৌন নির্বাচন।

যে কারণে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি গৃহপালনাবস্থায় একটি লিঙ্গে প্রায়শই আবির্ভূত হয় ও ঐ লিঙ্গেই বংশানুক্রমিক হয়, সেইরূপে নিঃসন্দেহে প্রকৃতিতেও এটি ঘটে। জীবনের বিভিন্ন স্বভাব সম্পর্কে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে দুটি লিঙ্গের রূপান্তর হওয়া এভাবে সম্ভবপর হয়, যেটি কখনও কখনও ঘটে; অথবা অন্য লিঙ্গের সম্পর্কে একটি লিঙ্গের রূপান্তর যেমন সাধারণভাবে ঘটে। এটিই আমাকে কয়েকটি কথা বলতে প্রভাবিত করেছে, যাকে আমি যৌন নির্বাচন বলেছি। অন্য জীবদের বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে অস্তিত্বের সংগ্রামের ওপর এটি নির্ভর করে না, কিন্তু অন্য লিঙ্গকে অধিকার করার জন্য একটি লিঙ্গের, সাধারণতঃ পুরুষদের, এককদের মধ্যে সংগ্রামের ওপর এটি নির্ভর করে। পরিণামে অকৃতকার্য প্রতিযোগীর মৃত্যু হয় না, বরং অল্প কয়েকটি বংশধর উৎপন্ন হয় অথবা একেবারেই হয় না। অতএব প্রাকৃতিক নির্বাচনের তুলনায় যৌন নির্বাচন কম কঠোর। প্রকৃতিতে ভালভাবে মানিয়ে নিয়েছে এমন সবল পুরুষরাই সাধারণতঃ বেশি বংশধর উৎপাদন করবে। অনেক ক্ষেত্রে জয়লাভ কিন্তু সাধারণ সবলতার ওপর নির্ভর করে না। সেটা সাধারণ অস্ত্র হিসেবে পুরুষদেরই থাকে। একটি শিংহীন হরিণ বা স্পারহীন মোরগের অসংখ্য বংশধর উৎপাদন করার কম সম্ভাবনা থাকে। সেরা মোরগদের যে পদ্ধতিতে নির্বাচন করে নিষ্ঠুর মোরগ-লড়িয়েরা, অনেকটা সেভাবেই সর্বদা বিজয়ীদের বংশবিস্তারের সুযোগ দিয়ে স্পার সমেত পায়ে আঘাত করতে যৌন নির্বাচন অদম্য সাহস, স্পারের (কাটা) দৈর্ঘ্য ও ডানার বল নিশ্চয় প্রদান করতে পারত। প্রকৃতির মানদণ্ড অনুযায়ী সংগ্রামের নিয়মটি কত নিম্নগামী হয় তা আমি জানি না। পুরুষ অ্যালিগেটরদের (চীন ও আমেরিকার কুমীর) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে রেডইন্ডিয়ানদের যুদ্ধনৃত্যের মতই স্ত্রীদের অধিকার করার জন্য এরা লড়াই-গর্জন করতে করতে স্ত্রীদের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়; দেখা গেছে পুরুষ স্যালমনরা সারাদিন লড়াই করে; পুরুষ স্ট্যাগ বিটলরা অন্য পুরুষদের বিরাট পার্শ্বীয় চোয়াল দ্বারা কোন কোন সময় আহত হয়; অননুকরণীয় পর্যবেক্ষক এম.ফেবার প্রায়শই লক্ষ্য করেছেন যে কোন কোন হাইমেনপ্টে রা পতঙ্গরা একটি বিশেষ স্ত্রীর জন্য সংগ্রাম করছে, ঐ স্ত্রীটি সংগ্রাম সম্পর্কে নির্বিকার থাকে এবং বিজয়ীর সঙ্গে প্রস্থান করে। বহুগামী প্রাণীদের ক্ষেত্রে সংগ্রামটি বোধ হয় কঠোর হয় এবং প্রায়শই এরা বিশেষ হাতিয়ার দ্বারা সজ্জিত হয়। মাংসাশী প্রাণীদের পুরুষরা সর্বদাই হাতিয়ার দ্বারা সজ্জিত। যৌন নির্বাচনের পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে এদের ও অন্যদের আত্মরক্ষার বিশেষ উপায় প্রদান করা যেতে পারে; যেমন সিংহের কেশর, পুরুষ স্যালমনদের হুঁকাকার চোয়াল–কারণ যুদ্ধজয়ের জন্য তরবারি অথবা বর্শার মতো ঢালেরও প্রয়োজন হতে পারে।

পাখিদের মধ্যে লড়াই প্রায়শই আরও শান্তিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের হয়। এ বিষয়ে যাঁরা মনোনিবেশ করেছেন তাঁরা সকলেই বিশ্বাস করেন যে সঙ্গীতের দ্বারা স্ত্রীদের আকর্ষণ করার জন্য অনেক প্রজাতির পুরুষদের মধ্যে ভয়ানক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। গিয়ানার পাহাড়ি গ্রাস, স্বর্গ উদ্যানের পাখিরা এবং অন্যরা একত্রে জড়ো হয় এবং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ও সবচেয়ে ভালভাবে পর্যায়ক্রমে পুরুষরা তাদের চমৎকার পালকসমূহ প্রদর্শন করে; এভাবে তারা দর্শক হিসাবে উপস্থিত স্ত্রীদের সম্মুখে বিচিত্র সঙের অভিনয় প্রদর্শন করে এবং অবশেষে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সঙ্গিনীকে পছন্দ করে। আটক অবস্থায় পাখিদের যাঁরা পুত্থানুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করেছেন তারা জানেন যে এদেরও নিজস্ব পছন্দ ও অপছন্দ থাকে। কেমন করে একটি চিত্রবিচিত্র ময়ূর তার সকল ময়ূরীদের নিকট আকর্ষণীয় হয়েছিল স্যার আর. হিরণ তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। আমি এখানে বিশদ বিবরণ দিতে পারছি না, কিন্তু তার নিজস্ব সৌন্দর্য্যের মান অনুযায়ী মানুষ যদি তার গৃহপালিত। লড়িয়ে মোরগদের স্বল্প সময়ে সৌন্দর্য্য ও সুন্দরভাবে দাঁড়ানোর ভঙ্গি প্রদান করতে পারে, তাহলে আমি সন্দেহ করার উপযুক্ত যুক্তি খুঁজে পাই না যে স্ত্রী পাখিরা তাদের সৌন্দর্য্যের মান অনুযায়ী কয়েক সহস্র বংশ ধরে সবচেয়ে সুরেলা কণ্ঠস্বরবিশিষ্ট ও সুন্দর পুরুষদের নির্বাচন করে উল্লেখযোগ্য ফল উৎপাদন করে থাকবে। তরুণদের পালকদের তুলনায় পুরুষ ও স্ত্রী পাখিদের পালকের বিষয়ে সুপরিচিত কয়েকটি নিয়মকে বিভিন্ন বয়সে সংঘটিত পরিবৃত্তির ওপর যৌন নির্বাচনের কর্মশীলতার মাধ্যমে অংশত ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, এবং ঐ পরিবৃত্তিগুলি কেবল পুরুষদের অথবা উভয় লিঙ্গের সমরূপ বয়সে বংশগতভাবে প্রেরিত হয়; কিন্তু স্থানাভাবে এখানে আমি এ বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাব না।

আমি বিশ্বাস করি বিষয়টি এমন হয় যে যখন কোন প্রাণীর পুরুষ ও স্ত্রীদের জীবনের সাধারণ স্বভাবসমূহ একই থাকে, কিন্তু দেহকাঠামো, রঙ ও অলংকরণ ভিন্ন হয়, তখন এ সব পার্থক্য প্রধানতঃ যৌন নির্বাচন দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ কোন পুরুষ বংশধরে বংশগতভাবে প্রেরিত এদের হাতিয়ারে, আত্মরক্ষায় উপায়ে বা আকর্ষণ করার ক্ষমতায় একক পুরুষদের পর্যায়ক্রমিক বংশে অন্য পুরুষদের ওপর অল্প সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার দরুণ এটি ঘটে। তথাপি সকল যৌন পার্থক্যই যে এর মাধ্যমে ঘটে, তা আমি বলতে চাই না, কারণ আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের লক্ষ্য করলে আমরা দেখি যে বৈশিষ্ট্যগুলি পুরুষ লিঙ্গে উদ্ধৃত হয় ও সংশ্লিষ্ট হয়, যা আবার আপাততঃ মানুষের নির্বাচনের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় না। বন্য টার্কি মোরগের স্তনের লোমগুচ্ছ কোন কাজে লাগে না এবং এটি সন্দেহজনক যে স্ত্রী পাখির চোখে সৌন্দৰ্য্যবর্ধনের জন্য এটি সৃষ্টি হয়েছে কিনা। বাস্তবিকপক্ষে এই লোমগুচ্ছ গৃহপালনাধীন অবস্থায় আবির্ভূত হলে একে অঙ্গবিকৃতি বলা যেতে পারত।

প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বা যোগ্যতমের উদ্বর্তনের উদাহরণসহ ব্যাখ্যা

আমার বিশ্বাস মত কেমন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হয়, তা পরিষ্কার করে বলার জন্য একটি বা দুটি কল্পনামূলক উদাহরণ দেওয়ার অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি আমি। নেকড়ে বাঘের কথাই ধরুন। এরা বিভিন্ন প্রাণীদের শিকার করে-কেউ চাতুর্যের দ্বারা, কেউ ক্ষমতা বা শক্তির দ্বারা, কেউ দ্রুতগামীতার দ্বারা; এবং ধরুন আমরা মনে করি যে দেশটির কোন পরিবর্তনের ফলেই দ্রুতগামী শিকার, উদাহরণস্বরূপ, হরিণের সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল বা অন্য শিকারের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। বছরটি ঐ ঋতুতে নেকড়েদের খাদ্যের যখন ভয়ানক প্রয়োজন, সেরূপ অবস্থায় সবচেয়ে দ্রুতগামী ও কৃশকায় নেকড়েরা বেঁচে থাকার ভাল সুযোগ পাবে এবং এইরূপে সংরক্ষিত বা নির্বাচিত হয়ে থাকবে–সর্বদা যদি বছরের একই সময়ে বা অন্য কোন সময়ে এরা শিকার করার শক্তি বজায় রাখত তাহলে এরা অন্য প্রাণীদের শিকার করতে বাধ্য হত। যত্ন সহকারে ও নিয়মানুগ নির্বাচনের দ্বারা অথবা জাতটির রূপান্তরের কোন চিন্তা ছাড়াই প্রত্যেক মানুষের সেরা কুকুর রাখার চেষ্টাপ্রসূত ঐ ধরনের অচেতন নির্বাচন দ্বারা মানুষ তার গ্রে হাউন্ড কুকুরের দ্রুতগামীতার উন্নতিসাধন করায়, তখন আমি সন্দেহ করার আর কোন যুক্তি দেখি না যে এটিই হবে তার ফল। আমি যোগ করতে পারি যে ইউনাইটেড স্টেটস-এর ক্যাটস্কিল পর্বতমালায় দুই ধরনের নেকড়ে বসবাস করে, একটির ধরন হচ্ছে গ্রে হাউন্ডের মত যারা শিকারের জন্য হরিণকে অনুসরণ করে এবং অন্যটি হচ্ছে আরও স্থূলকায়, যারা প্রায়শই মেষপালকের মেষের পালকে আক্রমণ করে।

লক্ষ্য করা উচিত এই উদাহরণে আমি সবচেয়ে কৃশকায় নেকড়ের কথা বলেছি, সংরক্ষিত হয়েছে এমন কোন স্পষ্টচিহ্নিত পরিবৃত্তির কথা বলিনি। এই বইটির পূর্বতন সংস্কারগুলিতে কোন কোন সময় আমি বলেছিলাম যে পরের বিকল্পটি বারংবার সংঘটিত হয়েছিল। এককীয় পার্থক্যদের বিরাট গুরুত্বের বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছিলাম। মানুষের দ্বারা অচেতন নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে এটি আমাকে প্ররোচিত করেছে, অচেতন নির্বাচন কমবেশি সব মূল্যবান এককদের সংরক্ষণের ও নিকৃষ্টদের ধ্বংসের ওপর নির্ভর করে। আমি এ-ও লক্ষ্য করেছিলাম যে প্রাকৃতিক অবস্থায় দেহকাঠামোর কোন আকস্মিক বিচ্যুতি, যথা একটি অঙ্গবিকৃতি, বিরল ঘটনা হবে; আরও লক্ষ্য করেছিলাম যে প্রথমেই যদি এটি সংরক্ষিত হয়, তাহলে সাধারণ এককদের সঙ্গে পরবর্তী আন্তঃসঙ্করণের মাধ্যমে এটি হারিয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও নর্থ ব্রিটিশ রিভিউ’ পত্রিকায় (১৮৬৭) একটি মূল্যবান প্রবন্ধ না পড়া পর্যন্ত আমি উপলব্ধি করিনি যে যতই অল্প ও স্পষ্টচিহ্নিত হোক না কেন, কেমন করে একটিমাত্র পরিবৃত্তি ক্কচিৎ চিরস্থায়ী হয়ে থাকতে পারত। উক্ত লেখক এক জোড়া প্রাণীর বিষয় নিয়েছেন। এরা এদের সমগ্র জীবৎকালে দুই শত বংশধর উৎপাদন করেছে, যার মধ্যে, বিভিন্ন কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর, গড়ে কেবলমাত্র দুটি নিজের মত সন্তান উৎপাদনের জন্য বেঁচে থাকে। বরং উচ্চতর প্রাণীদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটি একটি চূড়ান্ত হিসেব, কিন্তু নিম্নতর জীবদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটি কোন মতেই প্রযোজ্য নয়। এর পর তিনি দেখিয়েছেন যে যদি কেবলমাত্র একটি এককের জন্ম হত, যা কোনভাবে পরিবর্তিত হত, অন্য এককদের তুলনায় যদি এর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দুগুণ হত, তথাপি বেঁচে থাকার বিরুদ্ধ-সম্ভাবনাগুলি প্রবল হবে। মনে করা যাক যে এরা বেঁচে থাকে ও সন্তান উৎপাদন করে এবং এর অর্ধসংখ্যক তরুণরা অনুকূল পরিবৃত্তি। বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়েছে, তবুও পূর্বের আলোচনাকারী দেখিয়েছেন যে তরুণের বেঁচে থাকার ও সন্তান উৎপাদন করার কেবল অল্প সম্ভাবনা থাকবে এবং এই সম্ভাবনা পরবর্তী বংশপরম্পরায় ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকবে। আমি মনে করি এইসব মন্তব্যের নায্যতা খণ্ডন করা যেতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, কোন এক ধরনের একটি পাখি যদি ঠোঁট বাঁকিয়ে সহজভাবে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারত এবং ভয়ানকভাবে বাঁকা ঠোঁট নিয়ে যদি কেউ জন্মাত এবং ফলস্বরূপ সতেজে বেড়ে উঠত, তা সত্ত্বেও সাধারণ আকারকে বর্জন করে এই একটি এককের নিজের রূপ চিরস্থায়ী করার সম্ভাবনা খুব অল্প হবে; গৃহপালন অবস্থায় যা ঘটে তা দেখে এটির বিচার-বিশ্লেষণ করে কিন্তু কোন সন্দেহ থাকতে পারে না যে খুব শক্ত ঠোঁটওয়ালা বিরাট সংখ্যক এককদের বহু বংশ ধরে সংরক্ষণ ও আরও বিরাট সংখ্যক সোজা ঠোঁটওয়ালাদের ধ্বংসসাধন থেকে এই ফলাফল ঘটবে।

তবে এটি উপেক্ষা করা ঠিক হবে না যে একই রকম জৈব সংগঠনের ওপর একইভাবে কাজ করার জন্য কোন কোন স্পষ্টচিহ্নিত পরিবৃত্তি, যাদের কেউ কেবলমাত্র এককীয় পার্থক্য হিসাবে গণ্য করবে না, প্রায়শই পুনঃ পুনঃ ঘটতে থাকবে–আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির ক্ষেত্রে যাদের অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল এককটি যদি তার বংশধরে নূতনভাবে অর্জিত বৈশিষ্ট্যটি প্রকৃতই বংশগতভাবে প্রেরণ না করত, যতদিন বিদ্যমান জীবন-পরিবেশ একইরূপ থাকে, সন্দেহাতীতভাবে এটি একইভাবে পরিবর্তিত হওয়ার আরও প্রবলতর প্রবণতা বংশগতভাবে প্রেরণ করবে। এখানেও অল্প সন্দেহ থাকতে পারে যে একই উপায়ে পরিবর্তিত হওয়ার প্রবণতা প্রায়শই এত প্রবল হয় যে একই প্রজাতির সকল একক কোন প্রকার নির্বাচনের সাহায্য ছাড়াই একইভাবে রূপান্তরিত হয়। অথবা এককদের কেবল তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম বা দশম অংশ এভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকবে, যার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। গ্র্যাবা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে ফারো দ্বীপপুঞ্জের গিলমট পাখিদের প্রায় এক পঞ্চমাংশই হচ্ছে একটি এত স্পষ্টচিহ্নিত ভ্যারাইটি যে পূর্বে এটিকে ইউরিয়া ল্যাক্রিম্যান্স নামে একটি ভিন্ন প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা হত। এসব ক্ষেত্রে, পরিবৃত্তিটি যদি উপকারী প্রকৃতির হয়, প্রাথমিক আকারটি যোগ্যতমের উদ্বর্তনের মাধ্যমে শীঘ্রই রূপান্তরিত আকারটির দ্বারা স্থানচ্যুত হবে।

সমস্ত প্রকার পরিবৃত্তি অপসারণ করতে এই অর্থে আন্তঃসঙ্করণ সম্পর্কে আমার আরও কিছু বলা উচিত। কিন্তু এখানে বলা যেতে পারে যে অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদরা। তাদের উপযুক্ত বাসস্থানে বসবাস করে এবং তারা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ঘুরে বেড়ায় না; এমনকি যাযাবর পাখিদের ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ্য করি যে এরা প্রায় সর্বদাই পূর্ব বাসস্থানে ফিরে আসে। ফলস্বরূপ নূতন সৃষ্ট প্রত্যেকটি ভ্যারাইটি সাধারণতঃ প্রথমে স্থানীয় হবে, যাকে প্রাকৃতিক অবস্থায় ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম বলে মনে হয়। অতএব একইরূপে রূপান্তরিত এককরা শীঘ্রই ছোট ছোট দলবদ্ধভাবে একত্রে অবস্থান করবে, প্রায়শই একত্রে সন্তান উৎপাদন করবে। নূতন প্রকারটি যদি জীবনসংগ্রামে কৃতকার্য হত, তাহলে একটি ক্রমাগত বৃদ্ধিশীল চক্রের কিনারায় অবস্থিত অপরিবর্তিত এককদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং জয় করে এটি একটি কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করত।

প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার অন্য আরও জটিল একটি উদাহরণ দেওয়া সময়োপযোগী হতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে প্রাণরস থেকে ক্ষতিকর কোন কিছু অপসারণের জন্য কোন কোন উদ্ভিদ মিষ্টরস নিঃসরণ করে; কোন কোন শুটি জাতীয় উদ্ভিদের উপপত্রের গোড়ায় ও সাধারণ লরেল জাতীয় উদ্ভিদের পাতার পৃষ্ঠদেশে এই ধরনের নিঃসরণ গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড থাকে। পরিমাণে অতি অল্প হলেও এই রস পতঙ্গদের নিকট অতি লোভনীয়; কিন্তু এদের পরিদর্শন উদ্ভিদের কোন উপকারে আসে না। এখন মনে করা যাক যে রস বা মধু যে কোন প্রজাতির কিছু সংখ্যক উদ্ভিদের ফুলের অভ্যন্তর থেকে নিঃসৃত হয়েছিল। মধুর খোঁজে এসে কীটপতঙ্গরা পরাগরেণু দ্বারা আবিষ্ট হবে এবং প্রায়শই একটি ফুল থেকে অন্য ফুলে বহন করবে। একই প্রজতির দুটি ভিন্ন এককের ফুলগুলি এভাবে সঙ্করিত হবে; এবং সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে যে সঙ্করণ প্রক্রিয়া সবল চারাগাছের জন্ম দেয়, ফলস্বরূপ এদের প্রচুর পরিমাণে জন্মানোর ও বেঁচে থাকার উত্তম সম্ভাবনা থাকবে। বৃহত্তম নিঃসারক গ্রন্থি ও মধুগ্রন্থি সমেত ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদগুলিতে প্রায়শই কীটপতঙ্গরা আসবে এবং প্রায়শই সঙ্করিত হবে; এবং এভাবে পরিণামে কর্তৃত্ব লাভ করবে ও একটি স্থানীয় ভ্যারাইটি সৃষ্টি করবে। পরাগরেণুর পরিবহনের জন্য কিছু সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ পতঙ্গটির আকার ও স্বভাব সম্পর্কে পুংকেশর ও গর্ভকেশরের বিশেষ অবস্থান সম্বলিত ফুলগুলি পতঙ্গদের বিষয়টি আমাদের গ্রহণ করা উচিত ছিল। কেবলমাত্র নিষেকের জন্য পরাগরেণু সৃষ্ট হয় বলে এর বিনাশ সম্ভবতঃ উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর; তথাপি যদি পরাগরেণু ভক্ষণকারী পতঙ্গদের দ্বারা প্রথমে আকস্মিকভাবে ও তারপর স্বভাবগতভাবে ফুল থেকে ফুলে অল্প বাহিত হত ও এভাবে সঙ্করিত হত, যদিও পরাগরেণুর দশভাগের নয়ভাগ নষ্ট হয়ে থাকে, উদ্ভিদটির পক্ষে এটি বিরাট লাভ হয়ে থাকবে; এবং বেশি বেশি করে পরাগরেণু উৎপাদনকারী ও বড় পরাগধানী সম্বলিত এককরা নির্বাচিত হবে।

উপরোক্ত প্রক্রিয়া চলার পর, যখন আমাদের উদ্ভিদটি পতঙ্গদের কাছে আকর্ষণীয় হয়, তখন এরা অনিচ্ছাকৃতভাবে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে নিয়মিতভাবে. পরাগরেণু বহন করে এবং এরা এটি সার্থকভাবে করে। উল্লেখযোগ্য তথ্যের সাহায্যে বিষয়টি আমি। সহজেই দেখতে পারতাম। আমি কেবল একটি উদাহরণ দেব, যা এভাবে উদ্ভিদের লিঙ্গগুলির পৃথকীকরণের একটি ধাপকে ব্যাখ্যা করে। হোলি নামে এক প্রকার চিরসবুজ গুল্মে কেবল পুং-ফুল হয়, যাদের অল্প পরিমাণ পরাগরেণু উৎপাদনকারী চারটি পুংকেশর থাকে ও একটি অবর্ধিত গর্ভকেশরও থাকে; অন্য হোলি গুল্মে কেবল স্ত্রীফুল হয়; এদের পূর্ণ আকারের গর্ভকেশর ও কুঞ্চিত পরাগধানী সমেত চারটি পুংকেশর থাকে, যাতে পরাগরেণুর একটিও রেণু খুঁজে বার করা যায় না। একটি পুরুষ গাছের ঠিক ষাট গজ দূরে একটি স্ত্রী গাছ দেখে তার বিভিন্ন শাখা থেকে কুড়িটি ফুল সংগ্রহ করেছিলাম আমি ও এদের গর্ভমুণ্ডগুলি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখেছিলাম যে ব্যতিক্রমহীনভাবে সবগুলিতেই অল্প কয়েকটি পরাগরেণু এবং অন্য কয়েকটিতে প্রচুর পরাগরেণু ছিল। কয়েকদিন ধরে স্ত্রী গাছের দিক থেকে পুরুষ গাছের দিকে বায়ুর প্রবাহ। থাকা সত্ত্বেও পরাগরেণু বাহিত হয়নি। আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা ও প্রচণ্ড ছিল, অতএব মৌমাছিদের পক্ষে এটি সুবিধাজনক ছিল না, তা সত্ত্বেও আমার পরীক্ষিত প্রত্যেক স্ত্রীফুল মৌমাছিদের দ্বারা কার্যকরভাবে নিষিক্ত হয়েছিল, যারা মধুর খোঁজে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে বেড়াত। বরং আমাদের কল্পিত বিষয়ে ফিরে আসা যাক: নিয়মিতভাবে পরাগরেণু এক ফুল থেকে অন্য ফুলে বহনের জন্য যে মুহূর্তে উদ্ভিদটি পতঙ্গদের নিকট এত আকর্ষণীয় হয়েছিল যাতে করে অন্য একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে থাকবে। কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী সুবিধাটি সম্পর্কে সন্দেহ করে না যাকে “শ্রমের শারীরবৃত্তিয় বিভাজন” বলা হয়েছে; সুতরাং আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে একটি উদ্ভিদের পক্ষে এটি সুবিধাজনক হবে এবং অন্য ফুলে অথবা অন্য গাছে কেবলমাত্র গর্ভকেশরগুলির উদ্ভব ঘটাতে সুবিধাজনক হবে। চাষের জন্য ব্যবহৃত ও নূতন পরিবেশে স্থাপিত উদ্ভিদগুলিতে, কোন কোন সময় পুরুষ ও কোন কোন সময় স্ত্রী অঙ্গগুলি কম অথবা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়; এখন যদি আমরা মনে করি প্রাকৃতিক অবস্থায় এটি অল্পমাত্রায় হলেও ঘটে, এর পর যেহেতু আমাদের উদ্ভিদের লিঙ্গগুলির আরও সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ শ্রমের বিভাজনের নীতি অনুসারে সুবিধাজনক হবে, আরও বেশি বেশি করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই প্রবণতা সমেত এককরা অনবরত মনোনীত ও নির্বাচিত হবে, যতক্ষণ না লিঙ্গদের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ কার্যকরী হয়ে থাকবে। দ্বিরূপতা ও অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমের বিভিন্ন ধাপগুলি দেখাতে অনেক জায়গা লাগবে, যার দ্বারা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদে লিঙ্গগুলির পৃথকীকরণ আপাতত এখন ঘটে চলেছে। কিন্তু এখানে আমি বলতে পারি যে আশা গ্রে-র মতে দক্ষিণ আমেরিকার হোলি উদ্ভিদের কয়েকটি প্রজাতি ঠিক মধ্যবর্তী অবস্থার হয়, যাকে তিনি ভিন্নবাসী-মিশ্রবাসী উদ্ভিদ আখ্যা দিয়েছেন।

এখন মধুভক্ষণকারী পতঙ্গদের বিষয়ে আসা যাক। আমরা ধরে নিতে পারি উদ্ভিদটি একটি সাধারণ বা সুলভ উদ্ভিদ, অনবরত নির্বাচনের মাধ্যমে যার মধু আমরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করেছি এবং কোন কোন পতঙ্গ খাদ্যের জন্য এই মধুর ওপর নির্ভর করে। অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে আমি দেখাতে পারতাম যে মৌমাছিরা সময় বাঁচাতে ব্যর্থ হয়: উদাহরণস্বরূপ, কোন ফুলের গোড়ায় গর্ত তৈরি ও মধুশোষণ করার স্বভাবের জন্য এরা মুখের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। এ সব ব্যাপার মনে রেখে বিশ্বাস করা যেতে পারে যে কোন কোন পরিস্থিতিতে শুড়ের দৈর্ঘ্য বা বক্রতা এবং অন্য অনেক ব্যাপারে ধর্তব্যের মধ্যে নয় এমন অতি অল্প এককীয় পার্থক্য মৌমাছি বা অন্য পতঙ্গদের উপকারে লাগতে পারে, যাতে করে অন্যদের তুলনায় কোন কোন একক তাড়াতাড়ি তাদের খাদ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হবে; এবং এভাবে এদের অন্তর্ভুক্ত সম্প্রদায়গুলি প্রবলভাবে বেড়ে উঠবে এবং ঝক সৃষ্টি করবে যারা একই বৈশিষ্ট্য বংশগতভাবে লাভ করবে। সাধারণ লাল ও ইনকারনোট ক্লোভার উদ্ভিদদের (ট্রাইফোলিয়াম প্যাটেন্স ও ট্রাইফোলিয়াম কানেক্টাম) ফুলের দলমণ্ডলের নলগুলিকে একনজরে দেখলেও দৈর্ঘ্যে ভিন্ন হয় বলে মনে হয় না; তথাপি মধু-মৌমাছি ইনকারনেট ক্লোভারের মধু সহজেই শুষে নিতে পারে, কিন্তু লাল ক্লোভার ফুলগুলির মধু শুষে নিতে পারে না, সেখানে কেবল ভ্রমর-মৌমাছিরা (হাম্বল-বি) আসে; অতএব লাল ক্লোভারের। সমগ্র খেত মধুমৌমাছিদের মূল্যবান মধুর প্রচুর যোগান দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। এটা নিশ্চিত যে মধুমৌমাছিরা এই মধু খুবই পছন্দ করে; কারণ কেবল শরৎকালে আমি বারংবার দেখেছি যে নলের গোড়ায় ভ্রমর-মৌমাছিদের দ্বারা তৈরি গর্ত থেকে মধুমৌমাছিরা মধু শোষণ করছে। দু’ধরনের ক্লোভারের দলমণ্ডলের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য অতিশয় তুচ্ছ হয়, যা আবার মধুমৌমাছির পরিদর্শন নির্ধারণ করে; কারণ আমাকে নিশ্চিতরূপে জানানো হয়েছে যে লাল ক্লোভারদের কেটে ফেলার পর দ্বিতীয়বারের ফুলগুলি কিছুটা ছোট হয় এবং তখন অনেক মধুমৌমাছি এদের পরিদর্শন করতে আসে। এই বক্তব্যটি সঠিক কিনা জানি না, অথবা অন্য একটি প্রকাশিত বক্তব্যে বিশ্বাস করা যেতে পারে কিনা তা-ও আমার জানা নেই। সেটি হচ্ছে–মধুমৌমাছির সাধারণভাবে বিবেচিত একটি ভ্যারাইটি এবং যার সঙ্গে অবাধে সঙ্করিত হয় এমন লিগুরিয়ান মৌমাছিরা লাল ক্লোভারে পৌঁছাতে ও মধু শোষণ করতে সমর্থ হয়। অতএব যে দেশে এই জাতীয় ক্লোভার প্রচুর জন্মায়, সেখানে অল্প দীর্ঘতর বা ভিন্নভাবে গঠিত একটি শুড় মধুমৌমাছির পক্ষে প্রভূত সুবিধাজনক হয়ে থাকবে। বিপরীতক্রমে, যেহেতু এই। ক্লোভারের উর্বরতা ফুলগুলিতে আসা মৌমাছিদের ওপর নির্ভর করে, সেহেতু কোন দেশে মধুমৌমাছিরা বিরল হলে একটি খবর ও গভীরভাবে বিভক্ত দলমণ্ডল থাকা উদ্ভিদটির পক্ষে বিরাট সুবিধা হয়ে থাকবে যাতে করে মধু মৌমাছিরা এর ফুলগুলিকে শোষণ করতে সমর্থ হবে। অতএব আমি বুঝতে পারি কেমন করে একটি ফুল ও একটি মৌমাছি পরস্পরের নিকট অনুকূল দেহকাঠামোর অল্প বিচ্যুতিগুলি সৃষ্টিকারী সমস্ত এককদের হয় যুগপৎ নয়তো একের পর এক ভাবে অনবরত সংরক্ষণের দ্বারা সবচেয়ে নিখুঁত উপায়ে পরস্পরের সঙ্গে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত এবং অভিযোজিত হয়ে থাকবে।

আমি সম্পূর্ণভাবে অবগত যে ওপরের কল্পিত উদাহরণের দ্বারা ব্যাখ্যাত প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই তত্ত্বটি যে ধরনের আপত্তির সম্মুখীন হয়, সেইরকম ভূবিদ্যা দ্বারা ব্যাখ্যামূলক পৃথিবীর আধুনিক পরিবর্তনগুলির ওপর স্যার চার্লস লিয়েলের মহৎ মতবাদের বিরুদ্ধেও প্রথমে আপত্তি তোলা হয়েছিল; কিন্তু আমরা এখন মাধ্যমগুলি সম্পর্কে কদাচিৎ শুনি, যেগুলি এখনও কাজ করে চলেছে এবং যাদের অতি তুচ্ছ বা অকিঞ্চিৎকর বলা হয়। গভীরতম উপত্যকাদের খননকার্য বা আন্তর্দেশীয় পাহাড়দের গঠন ব্যাখ্যা করতে এই মাধ্যমগুলি ব্যবহৃত হয়। প্রত্যেক সংরক্ষিত জীবের পক্ষে উপকারী ছোট ছোট আনুবংশিক রূপান্তরগুলির সংরক্ষণ ও সঞ্চয়নের দ্বারা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হয়; এবং যেমন আধুনিক ভূবিদ্যা একমাত্র একটি প্লাবন তরঙ্গের মাধ্যমে একটি বিরাট উপত্যকা সৃষ্টির মতবাদকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত করেছে, তেমনি প্রাকৃতিক নির্বাচন নূতন জীব ও এদের দেহকাঠামোর যে কোন বিরাট ও আকস্মিক রূপান্তরের অনবরত সৃষ্টির বিশ্বাসটিকে নির্বাসিত করবে।

এককদের আন্তঃসঙ্করণ

এখানে আমি একটি ছোট্ট অসাম্প্রদায়িক বিষয় উত্থাপন করব। ভিন্ন লিঙ্গসমূহ সম্বলিত প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্ট যে প্রত্যেক জন্মের জন্য দুটি একক নিশ্চয় সর্বদা মিলিত হবে (অপুংজনির অদ্ভুত ও অজানা বিষয়গুলি ছাড়া); কিন্তু উভলিঙ্গীদের ক্ষেত্রে এটি মোটেই স্পষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও বিশ্বাস করার কারণ আছে যে সমস্ত উভলিঙ্গীদের ক্ষেত্রে দুটি একক হয় আকস্মিকভাবে নয়তো স্বভাবগতভাবে নিজেদের মত সন্তান উৎপাদনের জন্য মিলিত হয়। অনেক আগে এই মতবাদের পক্ষে প্রেনজেল, নাইট ও কোয়েলরয়টার সন্দেহজনকভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বর্তমানে এটির প্রয়োজনীয়তা আমরা দেখব। কিন্তু বিষয়টি অতিসংক্ষেপে আমি নিশ্চিয় আলোচনা করব, যদিও বিস্তৃত আলোচনার জন্য আমার কাছে যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীরা, সকল পতঙ্গরা এবং অন্য সব বড় গোষ্ঠীর প্রাণীরা প্রত্যেকে সন্তান উৎপাদনের জন্য মিলিত হয়। আধুনিক গবেষণা কল্পিত উভলিঙ্গীদের সংখ্যা ও প্রকৃত উভলিঙ্গীদের বিরাট সংখ্যক জোড়ার বিরাটভাবে হ্রাস করেছে; অর্থাৎ দুটি একক সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়মিত মিলিত হয়, এগুলি আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে। কিন্তু এখনও অনেক উভলিঙ্গী প্রাণী আছে যারা নিশ্চয়ই স্বাভাবিকভাবে মিলিত হয় না এবং বিরাট সংখ্যক উদ্ভিদরা উভলিঙ্গী। প্রশ্ন উঠতে পারে, এইসব ক্ষেত্রে মনে করার কি যুক্তি রয়েছে যে দুটি একক সন্তান উৎপাদনের জন্য কখনও মিলিত হয়? বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাওয়া অসম্ভব বলে আমি কেবল কয়েকটি সাধারণ বিবেচনার ওপরেই আস্থা রাখব।

প্রথমেই বলে রাখি, আমি এত বিপুল সংখ্যক তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং এত সংখ্যক। পরীক্ষা করেছি যা প্রজননকারীদের প্রায় সার্বজনীন বিশ্বাস অনুসারে দেখায় যে প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, ভিন্ন ভিন্ন ভ্যারাইটির অথবা একই ভ্যারাইটির কিন্তু অন্য জাতের। এককদের মধ্যে একটি সঙ্করণ তাদের বংশধরকে সবলতা ও উর্বরতা প্রদান করে; এবং বিপরীতক্রমে নিকট আন্তঃপ্রজনন সবলতা ও উর্বরতা হ্রাস করে; এসব তথ্য থেকে। মনে হয় এটি প্রকৃতির একটি সাধারণ নিয়ম যে কোন জীব বংশবিস্তারের জন্য নিজেই নিষিক্ত হয় না; কিন্তু অন্য এককের সঙ্গে একবার সঙ্করণ, সম্ভবতঃ বিরাট সময়ের ব্যবধানে, সাধারণভাবে অপরিহার্য।

এটিকে প্রকৃতির একটি নিয়ম বলে ধরে নিলে নিচে বর্ণিত কয়েকটির মত অসংখ্য তথ্যকে বুঝতে পারি আমরা, যা অন্য কোন মতের দ্বারা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। প্রত্যেক সংকরায়ণকারী জানে একটি ফুলের নিষেকের পক্ষে আর্দ্রতা কত প্রতিকূল হয়, তা সত্ত্বেও অসংখ্য ফুলের পরাগধানী ও গর্ভমুণ্ড আবহাওয়ায় সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত থাকে। প্রয়োজনভিত্তিক সংকরণ অপরিহার্য হলেও উদ্ভিদের নিজস্ব পরাগধানী ও গর্ভকেশর স্ব নিষেক সুনিশ্চিত করার জন্য পরস্পরের এত কাছে অবস্থিত যে অন্য একক থেকে পরাগরেণু প্রবেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অঙ্গদের উন্মুক্ততার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে। বিপরীতক্রমে, অনেক ফুলে নিষেকের অঙ্গগুলি গুপ্তভাবে পরিবেষ্টিত থাকে, যেমন দেখা যায় প্যাপিলিয়োনেসি বা মটর গোত্রে; কিন্তু পতঙ্গদের পরিদর্শনের জন্য এদের সুন্দর  ও অদ্ভুত অভিযোজন প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবেই উপস্থিত থাকে। অনেক প্যাপিলিয়োন্যাসিয়াস ফুলে মৌমাছিদের ভ্রমণ এত প্রয়োজন যে এদের আগমন যদি বাধাপ্রাপ্ত হলে এই ফুলেদের উর্বরতা ভীষণভাবে হ্রাস পায়। এখন উদ্ভিদটির মঙ্গলের জন্য পতঙ্গদের ফুল থেকে ফুলে উড়ে আসা এবং একটি থেকে অন্যটিতে পরাগরেণু বহন না করা মোটেই সম্ভবপর নয়। পতঙ্গরা একটি ক্যামেল হেয়ার পেন্সিলের মত কাজ করে এবং নিষেক নিশ্চিত করার জন্য একটি ফুলের পরাগধানী ও তার পর অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ড একই ব্রাস দ্বারা ঠিকভাবে স্পর্শ করাই যথেষ্ট; কিন্তু এটা মনে করা উচিত নয় যে মৌমাছিরা এভাবে ভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য সংকর সৃষ্টি করবে। গার্টনার দেখিয়েছেন যে যদি একটি উদ্ভিদের নিজস্ব পরাগরেণু এবং অন্য প্রজাতির পরাগরেণু একই গর্ভমুণ্ডে স্থাপন করা হয়, তাহলে পূর্বেরটি এত শক্তিশালী হবে যে এটি অনিবার্যভাবে ও সম্পূর্ণভাবে বহিরাগত পরাগরেণুর প্রভাবকে ধ্বংস করবে।

একটি ফুলের পুংকেশররা যখন গর্ভকেশরের দিকে হঠাৎ আবির্ভূত হয়, বা ধীরে ধীরে একের পর এক তার দিকে অগ্রসর হয়, তখনই মনে হয় যে কেবলমাত্র স্ব-নিষেক নিশ্চিত করার জন্যই কৌশলটি অভিযোজিত হয়েছে; এবং নিঃসন্দেহেই এটি এই উদ্দেশ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। যেমন বারবেরির ক্ষেত্রে কোয়েলরয়টার দেখিয়েছেন যে পুংকেশরদের সামনের দিকে আবির্ভাব ঘটাতে পতঙ্গদের সাহায্য প্রায়শই প্রয়োজন হয়, স্ব-নিষেকের জন্য বিশেষ কৌশলবিশিষ্ট এই গণটির ক্ষেত্রে এটি সুপরিচিত যে, নিকট সম্পর্কীয় আকার ও ভ্যারাইটিদের পরস্পরের নিকটে বসানো হলে বিশুদ্ধ চারাগাছ জন্মানো কদাচিৎ সম্ভবপর হয়, স্বাভাবিকভাবে সংকরায়নের ফলে যা বিরাটভাবে ঘটে। অন্যান্য অসংখ্য ক্ষেত্রে, স্পেনজেল ও অন্যদের গবেষণামূলক কাজ থেকে এবং আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ থেকে আমি দেখাতে পারতাম যে স্ব-নিষেককে উৎসাহ দেওয়ার পরিবর্তে এমন অসংখ্য কৌশল থাকে যা নিজের ফুলের পরাগরেণু পেতে গর্ভমুণ্ডকে কার্যকরভাবে বাধা দেয়। যেমন, লোবেলিয়া ফুলজেন্স-এ প্রকৃতই সুন্দর ও বিশদ কলাকৌশল থাকে যার দ্বারা এটি নিজস্ব ফুলের গর্ভমুণ্ড পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার পূর্বে অসংখ্য পরাগরেণু প্রত্যেক ফুলের সংযুক্ত পরাগধানী থেকে দ্রুতবেগে ধাবিত হয়; এবং যেহেতু এই ফুলে পতঙ্গরা কখনই আসে না, অন্ততঃ আমার বাগানে, তাই এরা কখনই বীজ উৎপাদন করে না, যদিও এক ফুলের পরাগ অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে ছড়িয়ে অংসখ্য চারাগাছের জন্ম দিয়েছি আমি। লোবেলিয়ার অন্য একটি প্রজাতি আমার বাগানে অবাধে বীজ উৎপাদন করে, যাতে আবার মৌমাছিরাও আসে। আরও অনেক ক্ষেত্রে, যদিও একই ফুল থেকে পরাগ গ্রহণের জন্য গর্ভমুণ্ডকে বাধা দেওয়ার কোন বিশেষ কলাকৌশল নেই, তথাপি স্প্রেনজেল এবং আরও সম্প্রতি হিলডেব্র্যান্ড ও অন্যরা দেখিয়েছেন, যা আমি সত্য বলে স্বীকার করি, যে হয় নিষেকের জন্য গর্ভমুণ্ড প্রস্তুত হওয়ার আগেই পরাগধানী বিস্ফোরিত হয়, নয়তো ঐ ফুলের পরাগ প্রস্তুত হওয়ার আগেই গর্ভমুণ্ড প্রস্তুত হয়, সেই জন্যই অসম বা বিষম পরিণত উদ্ভিদ নামে খ্যাত এইসব উদ্ভিদে পৃথক লিঙ্গ থাকে এবং এরা স্বাভাবিকভাবে সংকরিত হয়। পূর্বে উল্লিখিত পারস্পরিক দ্বিরূপক ও ত্রিরূপক উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এরূপ হয়। এইসব তথ্য কতই না বিচিত্র! কত অদ্ভুত যে স্ব-নিষেকের জন্য অতি নিকটে অবস্থিত একই ফুলের পরাগ, গর্ভমুণ্ডের পৃষ্ঠদেশ অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়। একটি ভিন্ন এককের সঙ্গে আকস্মিক সংকরণ সুবিধাজনক ও অপরিহার্য, এই মত সম্বন্ধে এইসব তথ্য কত সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

বাঁধাকপি, মূলো, পিঁয়াজ ও অন্যান্য উদ্ভিদের কয়েকটি ভ্যারাইটিকে যদি পরস্পরের অতি নিকটে বীজ উৎপাদন করতে দেওয়া হয়, তাহলে আমার দেখা এভাবে উৎপন্ন চারাগাছগুলি সকলেই বর্ণসংকর হয়। পরস্পরের নিকটে জন্মানো বিভিন্ন ভ্যারাইটিদের কয়েকটি গাছের ২৩৩টি চারা বাঁধাকপি গাছ তুলেছিলাম আমি এবং লক্ষ্য করেছিলাম, এদের মধ্যে কেবলমাত্র ৭৮টি আসল বা প্রকৃতই ছিল, এবং এমনকি এদের কয়েকটি নিখুঁতভাবে আসল ছিল না। তথাপি প্রত্যেক বাঁধাকপির ফুলের গর্ভকেশরটি শুধু তার নিজস্ব ছয়টি পুংকেশর দ্বারাই পরিবেষ্টিত নয়, বরং একই গাছের অন্য অনেক ফুলের পুংকেশর দ্বারাও পরিবেষ্টিত; এবং কীটপতঙ্গদের সাহায্য ছাড়াই প্রত্যেক ফুলের পরাগ তার নিজস্ব গর্ভমুণ্ডে সহজেই যায়, কারণ যত্নসহকারে পতঙ্গদের হাত থেকে সুরক্ষিত উদ্ভিদরা যে অসংখ্য শুটি উৎপাদন করে তা আমি লক্ষ্য করেছি। তা হলে অসংখ্য চারাগাছ বর্ণসংকর সদৃশ হয় কী করে? এর অর্থ এই যে ফুলের নিজস্ব পরাগের ওপর একটি ভিন্ন ভ্যারাইটির পরাগের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে, এবং একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন এককদের আন্তঃসঙ্করণের মাধ্যমে ভাল জীব উৎপন্ন হয়–এই সাধারণ নিয়মের একটি অংশ এটি। ভিন্ন প্রজাতিরা সংকরিত হলে ফলটি উল্টো হয়, কারণ একটি গাছের নিজস্ব পরাগ বহিরাগত পরাগের চেয়ে প্রায় সর্বদাই শক্তিশালী হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আলোচনা করব আমি।

অসংখ্য ফুল সম্বলিত একটি বিরাট বৃক্ষের ক্ষেত্রে আপত্তি করে বলা যেতে পারে যে বৃক্ষ থেকে কদাচিৎ পরাগ বাহিত হয়, এবং অন্ততপক্ষে একই বৃক্ষের ফুল থেকে ফুলে এটি ঘটতে পারে। এবং কেবল সীমাবদ্ধ অর্থে একই বৃক্ষের ফুলগুলি ভিন্ন ভিন্ন একক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই আপত্তিটি সঠিক বলেই বিশ্বাস করি আমি, কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রকৃতি পৃথক লিঙ্গ সমেত অসংখ্য ফুল উৎপাদন করতে বৃক্ষকে প্রবল প্রবণতা প্রদান করে। লিঙ্গগুলি যখন পৃথক হয়, যদিও পুং অথবা স্ত্রীফুল একই বৃক্ষে উৎপন্ন হতে পারে, পরাগ নিশ্চয়ই ফুল থেকে ফুলে নিয়মিতভাবে বাহিত হবে এবং গাছ থেকে গাছে মাঝেমাঝে পরাগ বহনের ভাল সম্ভাবনা প্রদান করবে। এই দেশে আমি দেখেছি যে সমস্ত বর্গের অন্তর্ভুক্ত বৃক্ষদের লিঙ্গগুলি অন্য উদ্ভিদের তুলনায় প্রায়শই ভিন্ন হয়। আমার অনুরোধে ডঃ হুঁকার নিউজিল্যান্ডের এবং ডঃ আসা গ্রে ইউনাইটেড স্টেট্রক্স এর বৃক্ষদের তালিকা তৈরি করেছিলেন, এবং আমি যেভাবে আশা করেছিলাম এটি তারই ফলশ্রুতি। বিপরীতক্রমে, ডঃ হুঁকার আমাকে জানান যে নিয়মটি অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে খাটে না, তবে অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত বৃক্ষগুলি অসমপরিণত হলে একই ফল হবে, যেন এরা পৃথকীকৃত লিঙ্গ সুমেত ফুল উৎপাদন করে। এ বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য বৃক্ষদের সম্বন্ধে কেবল কয়েকটি কথা বলেছি আমি।

প্রাণীদের দিকে সংক্ষেপে দৃষ্টি দেওয়া যাক। বিভিন্ন স্থলচর প্রজাতির উভলিঙ্গের হয়, যেমন স্থলচর শম্বুক বা কম্বোজজাতীয় প্রাণী ও কেঁচো; কিন্তু এরা সকলে যুগলে মিলিত হয়। আমি এখনও পর্যন্ত একটিও স্থলচর প্রাণী দেখিনি যে নিজেই নিষিক্ত হয়। এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি স্থলচর উদ্ভিদদের তুলনায় প্রবল বৈসাদৃশ্য প্রদান করে। একটি আকস্মিক মিলন অপরিহার্য, এই মত স্বীকার করলে এটি বোধগম্য হয়। কারণ গর্ভনিষেক উপাদানের স্বভাবের জন্য প্রত্যঙ্গদের ক্রিয়া প্রক্রিয়া ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে বায়ুসদৃশ কোন উপায় নেই যার দ্বারা দুটি এককের মিলন ব্যতিরেকে ভূচর প্রাণীদের একটি আকস্মিক সংকরণ ঘটানো যেতে পারে। জলচর প্রাণীদের মধ্যে অসংখ্য স্ব নিষেককারী উভলিঙ্গী আছে, কিন্তু এখানে আকস্মিক মিলন ঘটাতে জলপ্রবাহ নিশ্চয় একটি বিশেষ উপায়। ফুলের বিষয়ের মত, সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞদের অন্যতম একজন প্রফেসর হাক্সলের সঙ্গে আলোচনার পর, আমি এখনও পর্যন্ত একটিও উভলিঙ্গী প্রাণী আবিস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছি, তাদের জনন-অঙ্গগুলি এমন নিখুঁতভাবে পরিবেষ্টিত যে শূন্য থেকে প্রবেশ এবং একটি ভিন্ন এককের আকস্মিক প্রভাব বাস্তবিকপক্ষে দেখানো অসম্ভব। এই মতের পক্ষে সিরিপেডদের ঘটনা দেখানো অতিশয় কষ্টকর বলে আমার দীর্ঘদিন মনে হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমি প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছি যে দুটি একক কোন কোন সময় গর্ভধারণের জন্য মিলিত হয়, যদিও উভয়েই স্ব-নিষেককারী উভলিঙ্গী।

এই অদ্ভুত ব্যতিক্রম নিশ্চয় অধিকাংশ প্রকৃতিবিদদের বিমুগ্ধ করে যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উভয় ক্ষেত্রে সামগ্রিক জৈব সংগঠনে পরস্পরের সঙ্গে অধিকভাবে সদৃশ একই গোত্রের ও এমনকি একই গণের কিছু প্রজাতি উভলিঙ্গী ও কিছু একলিঙ্গী হলেও প্রকৃতপক্ষে সমস্ত উভলিঙ্গীরা মাঝেমধ্যে আন্তঃসঙ্করিত হয়। কার্যকলাপের ক্ষেত্রে যতদূর বিবেচনা করা যায়, এদের ও উভলিঙ্গী প্রজাতিদের মধ্যে পার্থক্য অতি অল্প।

এইসব বিচার-বিশ্লেষণ ও আমার সংগৃহীত অসংখ্য বিশেষ তথ্য (যা আমি এখানে। উপস্থিত করতে পারছি না) থেকে মনে হয় যে প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন এককদের মধ্যে একটি সময়োচিত আন্তঃসঙ্করণ প্রকৃতির একটি অতি সাধারণ নিয়ম, যদি সার্বজনীন না-ও হয়।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন আকারের উদ্ভব ঘটানোর জন্য অনুকূল অবস্থাসমূহ

এটি একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। যে পদটির মধ্যে এককীয় পার্থক্য সর্বদা অন্তর্ভুক্ত হয় এমন প্রচুর পরিমাণ প্রকারণ বা বিভিন্নতা স্পষ্টতঃ অনুকূল হবে। যে কোন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লাভজনক বিভিন্নতা বা পরিবৃত্তির আগমন বা আবির্ভাবের জন্য ভাল। সম্ভাবনা প্রদান করে এককদের বিরাট সংখ্যা প্রত্যেক এককের অল্পতর পরিমাণ বিভিন্নতার ক্ষতিপূরণ করবে, এবং আমি বিশ্বাস করি কৃতকার্য হওয়ার পক্ষে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজের জন্য প্রকৃতি দীর্ঘ সময় দেয় না, সে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষাও করে না। কারণ যেহেতু সমস্ত জীবকূল। প্রকৃতিমণ্ডলে নিজস্ব স্থান অধিকার করার চেষ্টা করছে, তাই কোন প্রজাতি তার প্রতিযোগীদের তুলনায় সমমাত্রায় উন্নত ও রূপান্তরিত না হলে প্রজাতিটি নিশ্চিহ্ন হবে। অনুকূল পরিবৃত্তির কয়েকটি অন্ততঃ বংশধরে যতক্ষণ না প্রেরিত হচ্ছে, ততক্ষণ প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হতে পারে না। পূর্বানুবৃত্তির প্রবণতা প্রায়শই নিয়ন্ত্রণ করে অথবা বাধা দেয়; কিন্তু এই প্রবণতা নির্বাচনের মাধ্যমে অসংখ্য গৃহপালিত জাত সৃষ্টি করতে মানুষকে নিবৃত্ত করেনি, কাজেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিরুদ্ধে কেন এটি প্রভাব বিস্তার করবে।

নিয়মানুগ নির্বাচনের ক্ষেত্রে, একজন প্রজননকারী কিছু বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্বাচন করে, এবং এককদের অবাধে আন্তঃসঙ্করণের সুযোগ দেওয়া হলে তার কাজ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। কিন্তু যখন জাতটিকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ছাড়া অনেক মানুষের উৎকর্ষতার প্রায় একটি সাধারণ মান থাকে, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীদের সংগ্রহ ও প্রজনন করতে সকলে চেষ্টা করে, তখন নির্বাচিত এককদের বিচ্ছিন্নতা না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনের এই অচেতন প্রক্রিয়া থেকে নিশ্চিতভাবে ধীরে ধীরে উন্নতি ঘটে। এভাবে এটি প্রকৃতির মধ্যেও ঘটে, কারণ প্রকৃতির রাজ্যে সম্পূর্ণভাবে অনধিকৃত কোন স্থান সমেত একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চলে, সঠিক দিকে, যদিও বিভিন্ন মাত্রায়, পরিবর্তনশীল সমস্ত একক সংরক্ষিত হতে চেষ্টা করবে। কিন্তু অঞ্চলটি বিরাট হলে তার কয়েকটি জেলায় জীবন-পরিবেশ নিশ্চয় ভিন্ন হবে, এবং তখন একই প্রজাতি যদি ভিন্ন জেলায় রূপান্তরিত হয়, তাহলে নূতন সৃষ্ট ভ্যারাইটিরা নিজস্ব সীমার মধ্যে আন্তঃসংকরিত হবে। কিন্তু ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমরা দেখব যে মধ্যবর্তী জেলাগুলিতে বসবাসকারী মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা পার্শ্ববর্তী ভ্যারাইটিদের একটি দ্বারা অবশেষে স্থানচ্যুত হবে। অন্তঃসঙ্করণ মূলতঃ সেই সব প্রাণীদের প্রভাবিত করবে যারা প্রত্যেকটি জন্মের জন্য মিলিত হয়, অতিশয় ঘুরে বেড়ায় এবং অত্যধিক দ্রুতহারে প্রজনন করে না। অতএব এই প্রকৃতির প্রাণীদের যথা পাখিদের ক্ষেত্রে, ভ্যারাইটিরা ভিন্ন ভিন্ন দেশে সীমাবদ্ধ থাকবে; এবং এটিই হয় বলে আমি লক্ষ্য করেছি। উভলিঙ্গী প্রাণীদের ক্ষেত্রে যারা মাঝেমধ্যে সংকরিত হয় এবং এভাবে প্রাণীদের ক্ষেত্রে যারা প্রত্যেকটি জন্মের জন্য মিলিত হয়, যারা অল্প ঘুরে বেড়ায় এবং দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেতে পারে, সেসব ক্ষেত্রে একটি নূতন ও উন্নত ভ্যারাইটি যে কোন স্থানে দ্রুত সৃষ্টি হয়ে থাকবে, সেখানে একত্রে লালিতপালিত হয়ে থাকবে এবং পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত হয়ে থাকবে, ফলে নূতন ভ্যারাইটির এককরা মূলতঃ সংকরিত হবে। এই পদ্ধতি অনুসারে বাগানমালীরা বিরাট সংখ্যক উদ্ভিদ থেকে বীজ সংরক্ষণ পছন্দ করে, কেননা এতে আন্তঃসঙ্করণের সম্ভাবনা এভাবে হ্রাস পায়।

এমনকি প্রাণীদের ক্ষেত্রে যারা প্রত্যেকটি জন্মের জন্য মিলিত হয় ও দ্রুতহারে বংশবৃদ্ধি করে না, তাদের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয় মেনে নেব না যে অবাধ আন্তঃসঙ্করণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবকে সর্বদা অপসারিত করবে; কারণ অসংখ্য তথ্য দ্বারা আমি দেখাতে পারি যে একই অঞ্চলে একই প্রাণীর দুটি ভ্যারাইটি বিভিন্ন স্থানে বারংবার। যাতায়াত করে, অল্প ভিন্ন মরশুমে বংশবৃদ্ধি করে, অথবা প্রত্যেক ভ্যারাইটির এককদের একত্রে মিলিত হওয়ার প্রবণতা থেকেও, দীর্ঘদিন গুণগতভাবে ভিন্ন থাকতে পারে।

প্রকৃতিতে একই প্রজাতি বা একই ভ্যারাইটির এককদের বৈশিষ্ট্যে বিশুদ্ধ ও একইরূপে রাখতে আন্তঃসঙ্করণ অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একবার জন্মদানের জন্য মিলিত হয় এমন সব প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটি এভাবে স্পষ্টতঃ আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি, আমাদের বিশ্বাস করার যুক্তি আছে যে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে আন্তঃসংকরণ ঘটে থাকে। এমন কি যদি এগুলি কেবল দীর্ঘ সময় অন্তর অন্তর ঘটে থাকে, তাহলে এভাবে উৎপন্ন তরুণটি দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা স্ব-নিষেকের ফলে উৎপন্ন বংশধরের তুলনায় এত জীবনীশক্তি ও উর্বরতা লাভ করবে যে বাঁচার ও নিজের মত বংশবৃদ্ধির ভাল সম্ভাবনা তার থাকবে এবং এভাবে অবশেষে তার পরিণামে সংকরণগুলির প্রভাব বিরাট হবে, এমনকি বিরল বিরতির পরেও। যারা যৌন দিক থেকে বংশবৃদ্ধি করে না অথবা যাদের যুগ্ম প্রজনন হয় না এবং যারা সম্ভবতঃ আন্তঃসংকরিত হতে পারে না, এমন সব নিম্নস্তরের জীবদের ক্ষেত্রে, কেবল বংশগতির নিয়মের মাধ্যমে এবং প্রকৃত রূপ থেকে বিচ্যুত যে কোন এককদের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একই জীবন-পরিবেশে বৈশিষ্ট্যের সমরূপতা বজায় রাখতে পারে। যদি জীবন-পরিবেশ পরিবর্তিত হয় এবং আকারটি রূপান্তরিত হয়, তাহলে সদৃশ অনুকূল পরিবৃত্তিগুলিকে সংরক্ষণ করে শুধুই প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা বৈশিষ্ট্যের সমরূপতা রূপান্তরিত বংশধরে প্রেরিত হতে পারে।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অন্তরণও একটি প্রধান উপাদান। অতি বিরাট না হলে একটি সীমাবদ্ধ বা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে জৈব ও অজৈব পরিবেশ সাধারণতঃ প্রায়ই একইরকম থাকবে, যাতে করে প্রাকৃতিক নির্বাচন একই প্রজাতির সমস্ত পরিবর্তনশীল এককদের একইভাবে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করবে। পাশ্ববর্তী জেলাসমূহের অধিবাসীদের সঙ্গে আন্তঃসংকরণও এভাবে বাধাপ্রাপ্ত হবে। মরিজ ওয়াগনার এ বিষয়ের ওপর সম্প্রতি একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে নূতন সৃষ্ট ভ্যারাইটিদের মধ্যে সংকরণকে বাধা দিতে অন্তরণের কার্যকারিতা, এমনকি আমার অনুমানের তুলনায় সম্ভবতঃ আরও অধিকতর হয়। কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে ইতিমধ্যে উল্লিখিত কারণসমূহ থেকে আমি এই প্রকৃতিবিদদের সঙ্গে কোন মতেই একমত হতে পারি না যে স্থানান্তরগমন ও অন্তরণ নূতন প্রজাতির উদ্ভবে প্রয়োজনীয় উপাদান। ভৌত অবস্থাসমূহের কোন ভৌতিক পরিবর্তনের পরে, যেমন আবহাওয়া, ভূমির উত্থান ইত্যাদি, ভালভাবে অভিযোজিত জীবদের অভিবাসন (immigration) প্রতিরোধ করতে অন্তরণের প্রয়োজনীয়তা এভাবে বিরাট হয়; এবং এভাবে জেলার প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের নূতন জায়গাগুলো বয়স্ক অধিবাসীদের রূপান্তরের দ্বারা পূর্ণ করতে খুলে দেওয়া হবে। শেষতঃ, অন্তরণ একটি নূতন ভ্যারাইটিকে ধীরে ধীরে উন্নত করতে যথেষ্ট সময় নেবে, এবং এটি কোন কোন সময় অতি প্রয়োজনীয়ও হতে পারে। তবে প্রতিবন্ধক দ্বারা পরিবেষ্টিত বা অদ্ভুত ভৌত পরিবেশ সম্বলিত একটি অঞ্চল যদি খুব ছোট হয়, তাহলে অধিবাসীদের সামগ্রিক সংখ্যা অল্প হবে; এটি অনুকূল পরিবর্তনগুলির উদ্ভবের সম্ভবনা হ্রাস করে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন প্রজাতির সৃষ্টিকে এভাবে হ্রাস করবে।

কেবলমাত্র সময়ের ব্যবধান প্রাকৃতিক নির্বাচনের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন কিছুই করে না। আমি এটা বলছি এই কারণে যে ভুলবশতঃ বলা হয় আমি যেন বলেছি সময় উপাদানটি প্রজাতির রূপান্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেন জীবনের সব আকার কোন সহজাত নিয়মের মাধ্যমে মূলতঃ রূপান্তরিত হচ্ছে। সময়ের অতিবাহন কেবল ততদূর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও এ ব্যাপারে এর প্রয়োজনীয়তাও বিরাট হয় যে উপকারী পরিবৃত্তিগুলির উদ্ভব ঘটাবে ও এদের নির্বাচিত, সঞ্চিত ও স্থায়ী করতে এটি একটি ভাল সম্ভাবনা প্রদান করে। প্রত্যেক জীবের দেহগঠন সম্পর্কে জীবনের ভৌতিক পরিবেশসমূহের প্রত্যক্ষ বৃদ্ধি করতে এটি এভাবে সহায়তা করে।

এইসব বক্তব্যের সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য আমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই এবং যে কোন একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল, যেমন একটি মহাসামুদ্রিক দ্বীপকে লক্ষ্য করি, যদিও এখানে বসবাসকারী প্রজাতির সংখ্যা অল্প হয়, তথাপি এসব প্রজাতিদের মধ্যে অধিকাংশই স্থানীয়–অর্থাৎ সেখানেই সৃষ্ট হয়েছে এবং পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। বিষয়টি আমরা ভৌগলিক বিস্তারের ওপর আমার অধ্যায়ে দেখব। অতএব প্রথম দর্শনে এটি মনে হয় যে একটি মহাসামুদ্রিক দ্বীপ নূতন প্রজাতির সৃষ্টিতে অনুকূল। কিন্তু এভাবে আমরা নিজেদের প্রতারিত করতে পারি, কারণ একটি ছোট্ট বিচ্ছিন্ন অঞ্চল অথবা একটি মহাদেশের মত বিরাট মুক্ত অঞ্চল নূতন জৈবিক আকার সৃষ্টির জন্য। অনুকূল হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করতে সমান সময়ের মধ্যে আমাদের তুলনা করা উচিত, এবং তা করতে আমরা অসমর্থ।

নূতন প্রজাতি সৃষ্টিতে অন্তরণ অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সামগ্রিকভাবে আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য যে একটি অঞ্চলের বিরাটত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে প্রজাতির সৃষ্টির জন্য, যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়ায় সক্ষম এটি প্রমাণ করবে। বিরাট ও উন্মুক্ত অঞ্চলের সর্বত্র একই প্রজাতির অসংখ্য একক থেকে উদ্ভুত অনুকূল পরিবৃত্তিগুলির কেবল ভাল সম্ভাবনা থাকবে না, বরং ইতিমধ্যে অবস্থিত বিরাট সংখ্যক প্রজাতির জন্য জীবনের পরিবেশ আরও জটিলতর হবে; এবং অসংখ্য প্রজাতির কয়েকটি যদি রূপান্তরিত ও উন্নত হয়, তবে অন্যগুলিও অনুরূপ মাত্রায় উন্নত হবে অথবা বিলুপ্ত হবে। প্রত্যেক নূতন আকারটি যে মুহূর্তে আরও বেশি উন্নত হয়, উন্মুক্ত ও নিরবচ্ছিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে সেটি সমর্থ হবে এবং এভাবে অন্য আকারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। অধিকন্তু ভূমিতলের আগেকার স্পন্দনগুলির জন্য এখন বিচ্ছিন্ন, বিরাট অঞ্চল প্রায়শই ভঙ্গিলাবস্থায় অবস্থান করবে, সেইজন্য অন্তরণের ভাল ফল কিছু পরিমাণে সাধারণতঃ একত্রে সঙঘটিত হবে। অবশেষে আমি সিদ্ধান্ত করি যে যদিও ছোট বিচ্ছিন্ন অঞ্চলসমূহ কোন কোন বিষয়ে নূতন প্রজাতির উদ্ভাবনে অতিশয় অনুকূল হয়েছে, তথাপি বিরাট অঞ্চলগুলিতে রূপান্তরের গতি সাধারণতঃ আরও দ্রুততর হবে; এবং যা আরও গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে।—বিরাট অঞ্চলগুলিতে সৃষ্ট নূতন আকারগুলি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবে, যারা ইতিমধ্যে অসংখ্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছে, এবং বিরাট সংখ্যক নূতন আকার ও প্রজাতি সৃষ্টি করবে। এভাবে এরা জৈবজগতের ইতিহাস পরিবর্তনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এই মতানুসারে আমরা বোধ হয় কিছু বিষয় বুঝতে পারি, যেগুলি আমাদের ভৌগোলিক বিস্তারের অধ্যায়ে পুনরায় পরোক্ষভাবে উল্লিখিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার মত ছোট মহাদেশের উৎপাদনগুলির নিকট ইউরোপ এশিয়ার বৃহত্তর অঞ্চলের উৎপাদনসমূহের এখন হার স্বীকারের বিষয়টি। মহাদেশীয় উৎপাদনগুলি দ্বীপসমূহের সর্বত্র এভাবে বহুলাংশে অভিযোজিত হয়েছে। একটি ছোট্ট দ্বীপে জীবনসংগ্রাম কম কঠোর হয়ে থাকবে এবং সেখানে কম রূপান্তর ও বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে থাকবে। অতএব আমরা বুঝতে পারি কেমন করে ম্যাডেইরার উদ্ভিদকুলটি অসওয়াল হিয়ারের মতানুসারে ইউরোপের টার্শিয়ারী যুগের বিলুপ্ত উদ্ভিদকুলটির সঙ্গে কিছু পরিমাণে সদৃশ হয়। মিঠাজলের সমস্ত অববাহিকা একত্রে সমুদ্র ও স্থলভাগের অববাহিকার তুলনায় একটি ছোট অঞ্চল সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ, স্বাদুজলের উৎপাদনগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা অন্য জায়গার তুলনায় কম কঠোর হয়ে থাকবে, নূতন আকারগুলো আরও ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়ে থাকবে এবং পুরানো আকারগুলো আরও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে। এবং এই স্বাদুজলের অববাহিকাসমূহে আমরা গ্যানয়েড মাছেদের সাতটি গণ দেখতে পাই, যেগুলো একটি বহুবিস্তৃত বর্গের অবশিষ্টাংশ। এবং স্বাদুজলে আমরা কিছু কিছু ব্যতিক্রমী আকারদের দেখি যারা বর্তমানে সারা পৃথিবীতে অর্নিথোরিনকাস ও লেপিডোসাইরেন হিসেবে পরিচিত, এরা আবার জীবাশ্মদের মত প্রকৃতিমণ্ডলে বর্তমানে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন বর্গগুলিকে কিছু পরিমাণে সংযুক্ত করে। এইসব ব্যক্ৰিমী আকারদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলা যেতে পারে। এরা একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চলে বসবাস করে ও কম বিচিত্র এবং অতএব কম কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত টিকে আছে।

বিষয়টি যতই জটিল হোক না কেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন প্রজাতির সৃষ্টির জন্য অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশের বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করে আমি সিদ্ধান্ত করেছি যে স্থলচর উৎপাদনগুলির জন্য আনুভূমিক তল অনেকবার আন্দোলিত হওয়া, একটি বৃহৎ মহাদেশীয় অঞ্চল দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়া অনেক নূতন জীবনাকার সৃষ্টিতে অতিশয় অনুকূল হয়ে থাকবে। যখন অঞ্চলটি একটি মহাদেশ হিসেবে অবস্থিত ছিল, তখন একক ও ভ্যারাইটি সমেত অধিবাসীরা অসংখ্য হয়ে থাকবে এবং তারা কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে থাকবে। অবনমনের ফলে যখন বিরাট ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের সৃষ্টি হয়, তখনও প্রত্যেক দ্বীপে একই প্রজাতির অসংখ্য একক রয়ে থাকবে, যে কোন প্রকার ভৌত পরিবর্তনের পর অভিবাসন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকবে, যাতে করে প্রত্যেক দ্বীপে সমগ্র অঞ্চলের নূতন জায়গাগুলি বয়স্ক অধিবাসীদের রূপান্তরের দ্বারা পূর্ণ হয়ে থাকবে; এবং প্রত্যেক দ্বীপে ভ্যারাইটিদের ভালভাবে রূপান্তরিত ও নিখুঁত হওয়ার জন্য সময় পেয়ে থাকবে। পুনরুত্থানের পর, যখন দ্বীপগুলি একটি মহাদেশীয় অঞ্চলের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হয়, সেখানে পুনরায় কঠোর প্রতিযোগিতা হয়ে থাকবে-সবচেয়ে আনুকূল্যপ্রাপ্ত বা উন্নত ভ্যারাইটিরা ছড়িয়ে পড়তে সমর্থ হয়ে থাকবে, কম উন্নত আকাররা ভয়ানকভাবে বিলুপ্ত হয়ে থাকবে এবং সংযুক্ত মহাদেশটির বিভিন্ন অধিবাসীরদের আপেক্ষিক আনুপাতিক সংখ্যা পুনরায় পরিবর্তিত হয়ে থাকবে; এবং আবার অধিবাসীদের আরও উন্নতি করতে ও এভাবে নূতন প্রজাতি সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য ভাল ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে থাকবে।

আমি সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করি যে প্রাকৃতিক নির্বাচন অতি মন্থরভাবে কাজ করে। এটি তখনই কাজ করতে পারে যখন একটি অঞ্চলের প্রকৃতিমণ্ডলের কিছু জায়গায় বিদ্যমান অধিবাসীদের কয়েকটির রূপান্তরিত আকারের মাধ্যমে ভালভাবে অধিকৃত হয়ে থাকে। এ সব জায়গার অবস্থান প্রায়শই ভৌতিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে, যা আবার অতি মন্থরভাবে ঘটে, এবং ভালভাবে অভিযোজিত আকারদের অভিবাসনকে প্রতিরোধ করার ওপর সেটি আবার নির্ভর করে। যেহেতু বয়স্ক অধিবাসীদের সামান্য কয়েকটিই রূপান্তরিত হয়, তাই অন্যদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলিও প্রায়শই নষ্ট হবে এবং ভালভাবে অভিযোজিত আকারদের দ্বারা পূর্ণ করতে এটি নূতন নূতন জায়গা সৃষ্টি করবে। একই প্রজাতির সমস্ত একক পরস্পরের থেকে অতি অল্প মাত্রায় ভিন্ন হলেও, দেহের বিভিন্ন অঙ্গের সঠিক প্রকৃতির পার্থক্য ঘটতে দীর্ঘ সময় লাগবে। অবাধ আন্তঃকরণের দ্বারা পরিণামটি প্রায়শই বিরাটভাবে হ্রাস পাবে। অনেক বিস্ময়ের সঙ্গে বলবে যে এ সব কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষমতাকে খর্ব করতে যথেষ্ট। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে কেবল দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ও একই অঞ্চলের অধিবাসীদের কেবল কয়েকটির ওপর এটি সাধারণতঃ মন্থরভাবে কাজ করবে। আমি আরও বিশ্বাস করি যে পৃথিবীর অধিবাসীদের পরিবর্তনের হার ও পদ্ধতি সম্পর্কে ভূবিদ্যা আমাদের যা বলে, এইসব মন্থর, সবিরাম পরিণামগুলি তার সঙ্গে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।

নির্বাচনের পদ্ধতিটি হতে পারে মন্থর, দুর্বল মানুষ কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে যদি অনেক কিছু করতে পারে, পরস্পরের ও নিজেদের জীবনের ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে, সমস্ত জীবের মধ্যে সহ-অভিযোজনগুলির সৌন্দর্যে ও জটিলতায় আমি পরিবর্তনের পরিমাণের কোন সীমা দেখতে পাইনি, যা প্রকৃতির নির্বাচনের ক্ষমতার মাধ্যমে অর্থাৎ যোগ্যতমের উদ্বর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে কার্যকরী হয়ে থাকতে পারে।

প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সংঘটিত বিলুপ্তি

আমাদের ভূতত্ত্ব সংক্রান্ত অধ্যায়ে এই বিষয়টি আরও বিশদভাবে আলোচিত হবে। তবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সঙ্গে এটি গভীরভাবে সম্পর্কিত বলে এ বিষয়ে কিছু কথা এখানে বলা দরকার। কোন-না-কোনভাবে সুবিধাজনক পরিবৃত্তিগুলির সংরক্ষণের মাধ্যমেই প্রাকৃতিক নির্বাচন ক্রিয়া করে, যে সুবিধাগুলি শেষ পর্যন্ত স্থায়ী রূপ নেয়। সমস্ত জীবের বৃদ্ধির উচ্চ গুণোত্তরীয় হার থাকার জন্য প্রত্যেক অঞ্চল ইতিমধ্যে অধিবাসীদের দ্বারা পূর্ণ হয়েছে; এবং এর থেকে অনুধাবন করা যায় যে যেহেতু আনুকূল্যপ্রাপ্ত আকাররা সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়, সেহেতু কম আনুকূল্যপ্রাপ্তরা সংখ্যায় হ্রাস। পায় ও বিরল হয়। ভূবিদ্যা আমাদের শেখায় বিরলতা হচ্ছে বিলুপ্তির পূর্বাভাস, কিন্তু। আমরা দেখতে পাই মরশুমের প্রকৃতির বিরাট পরিবর্তনের জন্য অথবা এদের শত্রুদের সাময়িক সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অল্প কয়েকটি একক সম্বলিত আকারের সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমরা আরও অগ্রসর হতে পারি; কারণ যেহেতু নূতন আকাররা সৃষ্ট হয়েছে, যতক্ষণ না আমরা স্বীকার করছি যে বিশেষ আকাররা অনির্দিষ্ট সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে পারে, অনেক বয়স্ক আকার নিশ্চয় বিলুপ্ত হবে। ভূতত্ত্ব আমাদের শেখায় যে বিশেষ আকাররা অনির্দিষ্টভাবে সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় না। এখন আমরা দেখার চেষ্টা করব সমগ্র পৃথিবীতে প্রজাতির সংখ্যা কেন বিলুপ্ত হয় না।

আমরা দেখেছি যে কোন নির্দিষ্ট সময়পর্বে অধিক সংখ্যক একক সম্বলিত প্রজাতিদের অনুকূল/উপযুক্ত পরিবৃত্তি উদ্ভাবনের ভাল সম্ভাবনা থাকে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে উল্লিখিত তথ্যসমূহে এর সাক্ষ্যপ্রমাণাদি আমাদের কাছে আছে, সেখানে দেখানো হয়েছে যে সুলভ ও পরিব্যাপ্ত এবং প্রভাবশালী প্রজাতিরা অধিক সংখ্যক নথিভুক্ত ভ্যারাইটি সৃষ্টি করে। অতএব, যে কোন নির্দিষ্ট সময়পর্বে প্রজাতিরা কম মন্থরভাবে রূপান্তরিত ও উন্নত হবে, পরিণামে তারা জীবনসংগ্রামে সুলভ প্রজাতিদের রূপান্তরিত ও উন্নত বংশধরদের দ্বারা পরাজিত হবে।

এইসব বিচার-বিশ্লেষণ থেকে আমি মনে করি এটি অনিবার্যরূপে ঘটে যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সময়ের ব্যবধানে নূতন প্রজাতিরা সৃষ্ট হয় বলে অন্যরা তখন বিরল থেকে বিরলতর হবে ও অবশেষে বিলুপ্ত হবে। রূপান্তরিত ও উন্নত হচ্ছে এমনগুলির সঙ্গে আকাররা কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়, সাধারণতঃ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং অস্তিত্বের সংগ্রাম সংক্রান্ত অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে সবচেয়ে নিকট সম্পর্কীয় আকারদের মধ্যেই এটি ঘটে–একই প্রজাতির ভ্যারাইটি ও একই গণের এবং সম্পর্কিত গণগুলির প্রজাতিরা, যাদের অবয়ব, দেহগঠন ও স্বভাব প্রায় একইরকম, তারাই সাধারণভাবে পরস্পরের সঙ্গে কঠোর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, ফলস্বরূপ উদ্ভব প্রক্রিয়া চলতে থাকার সময় প্রত্যেক নূতন ভ্যারাইটি বা প্রজাতি সাধারণতঃ নিকটতম আত্মীয়কে প্রচণ্ড চাপ দেয় এবং তাদের বিনাশের দিকে চালিত করে। মানুষের দ্বারা উন্নত আকারদের নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির মধ্যে আমরা একইরকম ধ্বংসসাধন প্রক্রিয়া লক্ষ্য করি। অনেক বিচিত্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যা দেখায় কত শীঘ্র গো-মহিষাদি, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণীদের নূতন জাত ও ফুলের ভ্যারাইটিরা প্রবীণতর ও নিকৃষ্টতরদের স্থান গ্রহণ করে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে প্রাচীন কৃষ্ণকায় গো-মহিষাদিরা লম্বা শিংওয়ালাদের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়েছিল এবং এরা “ছোট শিংওয়ালাদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হয়েছিল” (একজন কৃষিবিদের লেখা উল্লেখ করলাম), “যেন কোন ঘাতক মহামারী রোগের দ্বারা।”

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি

যে বিষয়টিকে আমি এই পদটির আখ্যা দিয়েছি, সেই পদ্ধতিটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ও আমার বিশ্বাস মতো কয়েকটি বিষয় ব্যাখ্যা করে। প্রথমে, ভ্যারাইটিরা, এমনকি স্পষ্টচিহ্নিতগুলিও, যদিও প্রজাতির কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়, তবুও বিশুদ্ধ ও ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিদের তুলনায় পরস্পরের থেকে নিশ্চয় আরও কম ভিন্ন হয়, যেমন অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহের চোখে দেখানো হয়েছে যে কেমন করে এদের শ্রেণীভুক্ত করা হবে। তা সত্ত্বেও আমার মতানুসারে সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ভ্যারাইটিরা হচ্ছে প্রজাতি, অথবা আমি যেমন বলি–জায়মান প্রজাতি। তা হলে ভ্যারাইটিদের মধ্যে কম পার্থক্য কেমন করে প্রজাতিদের মধ্যে বেশি পার্থক্যকে বর্ধিত করে? সমগ্র প্রকৃতিমণ্ডলে অংসখ্য প্রজাতির অধিকাংশই সুচিহ্নিত পার্থক্যসমূহ উপস্থিত করে। এ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে এটা স্বাভাবিকভাবেই ঘটে। পক্ষান্তরে, ভবিষ্যতের সুচিহ্নিত প্রজাতিদের অনুমতি আদিরূপ ও পিতামাতা এরূপ ভ্যারাইটিরা অল্প ও সংজ্ঞা নিরূপণের অসাধ্য পার্থক্যসমূহ উপস্থিত করে। আমরা বলতে পারি কেবল অপ্রত্যাশিতভাবে একটি ভ্যারাইটি তার পিতামাতার কিছু বৈশিষ্ট্য থেকে ভিন্ন হতে পারত, কিন্তু একই গণের। প্রজাতিদের মধ্যে স্বাভাবিক ও বিরাট পরিমাণ পার্থক্যের মতো এটি কখনই ঘটবে না।

নিজস্ব অভ্যাস মতো এ বিষয়ে আমি আমাদের গৃহপালিত উৎপাদিত উৎপাদনগুলির ওপর আলোকপাত করতে চেষ্টা করেছি। আমরা এখানে অনুরূপ কিছু দেখব। এটি স্বীকার করতে হবে যে ছোট শিংওয়ালা ও হেয়ারফোর্ড গো-মহিষাদিদের, ঘোড়দৌড়ের ও ভারবাহী ঘোড়াদের, পায়রাদের কয়েকটি জাতের মতো এত পার্থক্যজনিত জাতসমূহের উৎপাদন অসংখ্য ধারাবাহিক বংশ ধরে সমরূপ পরিবৃত্তিদের কেবল অপ্রত্যাশিত সঞ্চয়নের দ্বারা কখনই কার্যকরী হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, বাস্তবে একজন পাখিপ্রেমী বা পাখিরসিক খুব ছোট্ট ঠোঁটওয়ালা একটি পায়রাকে দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়; এবং স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসারে ‘প্রেমী বা রসিকরা মাধ্যমিক মানকে পছন্দ করে না ও করবে না, বরং চরমগুলিকে পছন্দ করে, এবং এরা উভয়েই (লোটন পায়রার উপ জাতগুলির ক্ষেত্রে যেমন সচরাচর ঘটে) ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ঠোঁটওয়ালা পাখিদের পছন্দ ও প্রজনন করতে থাকবে। আবার আমরা মনে করতে পারি যে ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে একটি দেশ বা জেলার মানুষদের দ্রুতগামী ঘোড়ার প্রয়োজন হতো, বলবান ও স্থূলকায় ঘোড়ার। প্রাথমিক পর্যায়ে পার্থক্যগুলি অতি অল্প হবে; কিন্তু কালক্রমে, একটি ক্ষেত্রে দ্রুতগামী, অন্য ক্ষেত্রে বলবান ঘোড়াদের নিরবচ্ছিন্ন নির্বাচন দ্বারা পার্থক্যগুলি বিরাটতর হবে এবং লক্ষ্য করা যাবে যে দুটি উপজাত সৃষ্টি হয়েছে। অবশেষে, কয়েক শতাব্দী পরে এই উপজাতগুলি দুটি ভিন্ন ও সুপ্রতিষ্ঠিত জাতে রূপান্তরিত হবে। পার্থক্যগুলি বিরাট হয় বলে মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য সমেত নিকৃষ্ট প্রাণীরা, যারা দ্রুতগামীও নয় বা বলবানও নয়, প্রজননে ব্যবহৃত হবে না। এবং এভাবে তারা বিলুপ্ত হতে থাকবে। এখানে আমরা মানুষের উৎপাদনগুলিতে এমন একটি ঘটনা দেখি যাকে আমরা অপসৃতির পদ্ধতি বলতে পারি এবং যা পার্থক্যগুলি ঘটায়, প্রথমে অতি অল্পভাবে, তার পর ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় এবং অবশেষে পরস্পরের থেকে এবং নিজেদের সাধারণ পিতামাতার থেকে ভিন্নমুখী বৈশিষ্ট্যের জাতগুলির উদ্ভব ঘটায়।

কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে কোন অনুরূপ পদ্ধতি কেমন করে প্রকৃতিতে প্রয়োগ হতে পারে? আমি মনে করি এটি অতিশয় কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায় ও যেতে পারে (কেমন করে এটি হয় তা অনুধাবন করতে অবশ্য অনেক সময় লেগেছিল)। সরল ঘটনা থেকে জানা যায় যে কোন একটি প্রজাতির বংশধররা অবয়বে, জৈবসংগঠনে ও স্বভাবে যত বেশি ভিন্নমুখী হয়; তত বেশি করে তারা প্রকৃতিমণ্ডলের অসংখ্য ও ব্যাপকভাবে বিচিত্র অঞ্চলসমূহ অধিকার করতে সমর্থ হয়, এবং এভাবে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে সক্ষম হয়।

সরল স্বভাবের প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটি আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। মাংসাশী চতুষ্পদ প্রাণীদের বিষয়টি ধরা যাক, যে কোন দেশে যার সংখ্যা বহু পূর্বে গড়সংখ্যার পূর্ণতায় পৌঁছে গেছে। এদের বৃদ্ধির স্বাভাবিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেওয়া হলে অন্য প্রাণীদের দ্বারা বর্তমানে অধিকৃত স্থানগুলি এদের পরিবর্তনশীল বংশধরদের দ্বারা অধিকার করার মাধ্যমে এরা কেবল বৃদ্ধি পেতে সমর্থ হতে পারে (দেশটির কোন ভৌতিক পরিবর্তন হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, এদের মধ্যে কয়েকটি মৃত অথবা জীবিত নূতন ধরনের শিকার ধরে খেতে সমর্থ হয়; কিছু প্রাণী নূতন জায়গায় বসবাস করতে শুরু করে, গাছে ওঠে, জলে ঘুরে বেড়ায় এবং কিছু বোধহয় কম মাংসাশী হয়। আমাদের মাংসাশী প্রাণীদের বংশধরদের দেহগঠন ও স্বভাব যত বেশি বিচিত্র হবে, এরা তত বেশি অঞ্চল অধিকার করতে সমর্থ হবে। যা একটি প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা সবসময় সমস্ত প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে–অর্থাৎ যদি এরা পরিবর্তিত হয়, কারণ অন্যথায় প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হতে পারে না। এভাবে উদ্ভিদদের ক্ষেত্রেও এটি ঘটবে। পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে জমির একটি প্লটে যদি ঘাসের একটি প্রজাতির চাষ করা হয় এবং অনুরূপ প্লটে ঘাসের কয়েকটি ভিন্ন গণের প্রজাতির যদি চাষ করা হয় এবং অনুরূপ প্লটে ঘাসের কয়েকটি ভিন্ন গণের প্রজাতির যদি চাষ করা হয়, তাহলে পূর্বেরটির তুলনায় পরেরটির ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক ঘাস ও বেশি ওজনের শুকনো খড় উৎপাদন করা যেতে পারে। একই ঘটনা ঘটে গমের একটি ভ্যারাইটি ও কয়েকটি মিশ্র ভ্যারাইটিকে জমির সমান পরিমাণ প্লটে চাষ করা হলে। অতএব ঘাসের একটি প্রজাতিকে পরিবর্তিত হতে দেওয়া হলে এবং ভ্যারাইটিদের অনবরত নির্বাচন করা হলে, যারা পরস্পরের থেকে যদিও অতি অল্প মাত্রায় একইভাবে ভিন্ন হয়, যেমন প্রজাতি ও গণগুলির ক্ষেত্রে হয়, এদের রূপান্তরিত বংশধরগুলি-সমেত প্রজাতির বিরাট সংখ্যক এককরা জমির একই প্লটে বেঁচে থাকতে সমর্থ হবে। এবং আমরা জানি যে ঘাসের প্রত্যেক প্রজাতি ও প্রত্যেক ভ্যারাইটি প্রতি বছর অসংখ্য বীজ জমিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং এভাবে এরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ফলস্বরূপ কালক্রমে, শত সহস্র বছর পরে, ঘাসের যে কোন একটি প্রজাতির সবচেয়ে ভিন্ন ভ্যারাইটিদের কৃতকার্য হওয়ার ও সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ার এবং এভাবে কম ভিন্ন ভ্যারাইটিদের স্থানচ্যুত করার সম্ভাবনা বেশি থাকবে; এবং যখন পরস্পরের থেকে আরও বেশি ভিন্ন হয়, তখন ভ্যারাইটিরা প্রজাতি পদে উন্নীত হয়।

দেহকাঠামোর বিপুল বৈচিত্র্যের ওপর জীবনের সংখ্যার পরিমাণ নির্ভর করে, এই নীতিটির সত্যতা অনেক প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। একটি ছোট এলাকা বিশেষভাবে যদি পরদেশীদের জন্য মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং সেখানে এককের সঙ্গে এককের সংগ্রাম কঠোর হয়, তাহলে আমরা সেখানের অধিবাসীদের মধ্যে বিপুল বৈচিত্র্য লক্ষ্য করি। উদাহরণস্বরূপ, একই অবস্থায় পড়ে থাকা তৃণাচ্ছাদিত তিন ফুট চওড়া ও চার ফুট লম্বা আয়তনের এক খণ্ড ঘাসের চাপড়া আমি দেখেছিলাম এবং সেখানে আটটি বর্গের আঠারোটি গণের অন্তর্গত কুড়িটি প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল। এই সংখ্যা থেকে বোঝা যায় এইসব উদ্ভিদরা পরস্পরের থেকে কত পৃথক। ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপে প্রাণী ও পতঙ্গদের ক্ষেত্রেও এরূপ ঘটে। স্বাদুজলের পুকুরগুলিতেও এরূপ ঘটে। কৃষকরা লক্ষ্য করে যে সবচেয়ে বেশি হতে পারে। প্রকৃতিও এটি অনুসরণ করে থাকে যাকে বলা যেতে পারে যুগপৎ চক্রগতি বা পর্যায়ক্রম। এক খণ্ড জমিতে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবাসকারী অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদরা এখানে বাস করতে থাকবে (এদের প্রকৃতি কোনভাবেই স্বাতন্ত্র্যসূচক নয় মনে করে) এবং বলা যেতে পারে যে ‘বাঁচার জন্য তীব্র চেষ্টা করছে এরা। কিন্তু দেখা যায় এরা যখন তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়, এদের স্বভাব ও জৈবিকগঠনের পার্থক্য সমেত দেহের বৈচিত্র্যের সুবিধাগুলি নির্ধারণ করে যে পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় নামা অধিবাসীরা, একটি সাধারণ নিয়মানুযায়ী যাদের আমরা বিভিন্ন গণ ও বর্গ বলি, তার অন্তর্ভুক্ত হবে।

মানুষের হস্তক্ষেপ দ্বারা উদ্ভিদের বিদেশের মাটিতে স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারেও একই পদ্ধতি দেখা যায়। এটি আশা করা যেতে পারত যে যে-কোন দেশে পরিবেশানুগ হতে সমর্থ উদ্ভিদরা সাধারণতঃ দেশীয়দের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়, কারণ সাধারণভাবে লক্ষ্য করা যায় যে এরা নিজের দেশে বিশেষভাবে সৃষ্ট ও অভিযোজিত হয়েছে। বোধ হয় আরও আশা করা যেতে পারত যে পরিবেশানুগ উদ্ভিদরা এদের নূতন বাসস্থানের কোন কোন জায়গায় আরও বিশেষভাবে অভিযোজিত কয়েকটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবে। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই অন্যরকম। আলফোন্সে ডি ক্যান্ডেলে তার সুবৃহৎ ও প্রশংসনীয় গ্রন্থে সুন্দরভাবে মন্তব্য করেছেন যে উদ্ভিদকুলগুলি দেশীয় গণ ও প্রজাতিদের সংখ্যার অনুপাতে নূতন প্রজাতির তুলনায় নূতন গণের আরও বেশি দেশীয়করণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়। কেবল একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ডঃ আসা গ্রে-র ‘ম্যানুয়্যাল অফ দ্য ফ্লোরা অফ নর্দান ইউনাইটেড স্টেটস্’ গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণ ২৬০টি পরিবেশানুগ উদ্ভিদের তালিকা দেওয়া হয়েছে এবং এরা ১৬২টি গণের অন্তর্গত। এভাবে আমরা লক্ষ্য করি যে এইসব পরিবেশানুগ উদ্ভিদরা অতিশয় বৈচিত্র্যপূর্ণ; অধিকন্তু দেশীয়দের তুলনায় এরা বহুল পরিমাণে ভিন্ন হয়, কারণ ১৬২টি পরিবেশানুগ গণের মধ্যে কম করেও ১০০টির মতো গণ দেশীয় নয়, এবং এভাবে ইউনাইটেড স্টেটস-এ বর্তমানে অবস্থিত গণগুলির সঙ্গে বিরাট সংখ্যক গণ যুক্ত হয়েছে।

দেশীয়দের সঙ্গে সফলভাবে সংগ্রাম করে সেই দেশের পরিবেশানুগ হয়েছে এমন উদ্ভিদ বা প্রাণীদের প্রকৃতি বিচার করে আমরা কিছু ধারণা লাভ করতে পারি যে সহযোদ্ধাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের জন্য কিভাবে রূপান্তরিত হতে হবে; এবং আমরা অন্ততঃ সিদ্ধান্ত করতে পারি যে অবয়বের নূতন গণীয় পার্থক্যের সমতুল বৈচিত্র্য। এদের পক্ষে লাভজনক হবে।

একই অঞ্চলের অধিবাসীদের অবয়বের বৈচিত্র্যের উপযোগিতা, বাস্তবিকপক্ষে এককদের শরীরের অঙ্গগুলির শ্রমের শারীরবৃত্তীয় কাজের মতো একই হয়–এই বিষয়টি মিলনে এডওয়ার্ডস বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কোন শারীরতত্ত্ববিদ সন্দেহ করেন না যে কেবল শাকসজী, অথবা কেবল হজমের পক্ষে উপযোগী একটি পাকস্থলী এইসব বস্তু থেকে সবচেয়ে পুষ্টিকর বস্তু গ্রহণ করে। অতএব যে কোন দেশের সাধারণ পরিমণ্ডলে প্রাণী ও উদ্ভিদরা ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবের জন্য যত বেশি ব্যাপকভাবে ও নিখুঁতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়, তত বেশি সংখ্যক এককরা বেঁচে থাকতে সমর্থ হবে। অল্প বৈচিত্র্যপূর্ণ জৈবসংগঠন সম্বলিত একদল প্রাণী জৈবসংগঠনে আরও নিখুঁতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ আর একদল প্রাণীর সঙ্গে কদাচিৎ প্রতিযোগিতা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মিঃ ওয়াটারহাউস ও অন্যদের মন্তব্য অনুসারে, পরস্পরের থেকে ভিন্ন বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারুরা আমাদের মাংসাশী, রোমন্থক, দন্তুর স্তন্যপায়ীদের সঙ্গে সফলতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারত কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। অস্ট্রেলিয়ার স্তন্যপায়ীদের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি, বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়াটি বিকাশের আদিম ও অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

একজন সাধারণ পূর্বপুরুষের বংশধরদের ওপর বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি এবং বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য প্রভাবসমূহ

অতি সংক্ষেপে উপরোক্ত আলোচনার পর আমরা ধরে নিতে পারি, যে কোন একটি প্রজাতির রূপান্তরিত বংশধররা অবয়বে যত বেশি ভিন্ন হবে তত বেশি ভালভাবে সাফল্য লাভ করবে এবং অন্যের অধিকৃত স্থানসমূহ অধিকার করতে সমর্থ হবে। এখন দেখা যাক প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বিলুপ্তির পদ্ধতিগুলির সঙ্গে যুক্ত বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি থেকে উদ্ভূত উপকারের এই পদ্ধতিটি কেমন করে কার্যকরী হয়।

এখানে প্রদত্ত রেখাচিত্রটি (৮৭-৮৮ পৃষ্টায় দ্রষ্টব্য) এই জটিল বিষয়টি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। নিজ দেশের একটি বিরাট গণের প্রজাতিদের A থেকে L অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা যাক। মনে করা যাক এই প্রজাতিরা পরস্পরের সঙ্গে অসমান মাত্রায় সদৃশ, যেমন সাধারণতঃ প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘটে, এবং যেমন রেখাচিত্রে অসমান দূরত্বে অবস্থিত অক্ষরগুলি দ্বারা উপস্থাপিত করা হয়েছে। আমি একটি বিরাট গণের বিষয় উল্লেখ করেছি, কারণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছিলাম যে ছোট গণগুলির তুলনায় বড় গণগুলির গড়ে আরও বেশি প্রজাতি পরিবর্তিত হয় এবং বড় গণের পরিবর্তনশীল প্রজাতিরা আরও বেশি সংখ্যক ভ্যারাইটি উৎপাদন করে। আমরা আরও দেখেছি যে সবচেয়ে সুলভতম এবং ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত প্রজাতিরা বিরল ও সীমাবদ্ধ প্রজাতিদের তুলনায় বেশি পরিবর্তিত হয়। নিজ দেশের একটি বড় গণের অন্তর্গত, ধরা যাক (A) একটি সুলভ, ব্যাপকভাবে পরিবর্তনশীল প্রজাতি। (A) থেকে। উদ্ভূত অসমান দৈর্ঘ্যের শাখাবিভক্ত ও অপসারণশীল বিন্দুখচিত রেখাগুলি তার পরিবর্তনশীল বংশধরদের সূচিত করতে পারে। পরিবর্তনগুলিকে মনে করা হয় অত্যল্প, কিন্তু অতি বিচিত্র প্রকৃতির; মনে হয় এরা সকলে যুগপৎ আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রায়শই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আবির্ভূত হয়েছে; অথবা মনে হয় না যে এরা সকলে সমান। সমান কালব্যাপী স্থায়ী হয়। কোন-না-কোনভাবে লাভজনক কেবল ঐ সব পরিবৃত্তিরাই সংরক্ষিত অথবা স্বাভাবিকভাবে নির্বাচিত হবে। এবং বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি থেকে উদ্ভূত সুফলের মূল নীতির প্রয়োজনীয়তা এখানে উপস্থিত হয়, কারণ এটি সবচেয়ে ভিন্ন অথবা অপসারী পরিবৃত্তিদের (বাইরের বিন্দুখচিত রেখাগুলি দ্বারা সূচিত) প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সংরক্ষিত ও পুঞ্জীভূত হতে সাধারণতঃ প্রণোদিত বা পথপ্রদর্শন করবে। যখন একটি বিন্দুখচিত রেখা সমান্তরাল রেখাগুলির একটিতে পৌঁছায় এবং সেখানে সংখ্যা সম্বলিত একটি ছোট অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত হয়, তখন স্পষ্টভাবে সুচিহ্নিত একটি ভ্যারাইটি সৃষ্টি করতে যথেষ্ট পরিমাণ পরিবৃত্তি সঞ্চিত হয়েছে বলে মনে হয়। এটি একটি সিস্টেমেটিক গবেষণার কাজে লিপিবদ্ধ হওয়ার যোগ্য হিসেবে মনে করা উচিত হবে।

রেখাচিত্রের সমান্তরাল রেখাদের মধ্যের জায়গাগুলি প্রত্যেকে এক হাজার বা আরও বেশি বংশ সূচিত করতে পারে। এক হাজার বংশের পর প্রজাতি (A) ধরে নেওয়া যাক দুটি অতি স্পষ্টচিহ্নিত ভ্যারাইটি উৎপাদন করেছে, যথা a1 ও m1। যে। জীবন-পরিবেশ এদের পিতামাতাদের পরিবর্তনশীল করেছিল, এই দুটি ভ্যারাইটি সাধারণতঃ তখনও সেই একই জীবন-পরিবেশের প্রভাবাধীন হবে এবং পরিবর্তনশীলতার প্রবণতাও বংশগত হবে; ফলস্বরূপ যেভাবে এদের পিতামাতারা পরিবর্তিত হয়েছিল, প্রায়, সেভাবেই এরাও পরিবর্তনপ্রবণ হবে। অধিকন্তু, এই দুটি ভ্যারাইটি, যারা কেবলমাত্র অল্প রূপান্তরিত আকার, ঐ সব সুফলগুলিতে বংশগতভাবে প্রেরণ করতে চেষ্টা করবে, ঐ সুফলগুলি একই দেশের অধিবাসীদের অধিকাংশের তুলনায় এদের পিতামাতাদের (A) আরও সংখ্যাবহুল করেছিল; এরা ঐ সব আরও সাধারণ সুফলগুলিরও অধিকারী হবে। ঐ সুফলগুলি পিতামাতা প্রজাতিটির অন্তর্গত গণটিকে এর নিজের দেশে বিরাট গণে পরিণত করেছিল। এই সকল পরিবেশ নূতন ভ্যারাইটি সৃষ্টিতে অনুকূল হয়।

এখন এই দুটি ভ্যারাইটি যদি পরিবর্তনশীল হয়, তাহলে এদের মধ্যে সবচেয়ে অপসারী বা ভিন্নমুখী পরিবর্তনগুলি পরবর্তী হাজার পুরুষ ধরে সাধারণতঃ সংরক্ষিত হবে। এই সময়ান্তরের মধ্যে a1 ভ্যারাইটি রেখাচিত্রে a2 ভ্যারাইটি সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়, যা অপসৃতির নিয়ম অনুযায়ী a1 ভ্যারাইটির তুলনায় (A) থেকে বেশি ভিন্ন হবে। ধরা যাক m1 ভ্যারাইটিটি দুটি ভ্যারাইটি সৃষ্টি করেছে, যথা m2 ও s2, এরা পরস্পরের থেকে ও আরও বিশেষভাবে এদের সাধারণ পিতামাতার (A) থেকে ভিন্ন হয়। যে। কোন সময় ধরে আমরা একইরূপ ধাপগুলি দ্বারা প্রক্রিয়াটিকে চালিয়ে যেতে পারি; ভ্যারাইটিদের কয়েকটি প্রত্যেক হাজার বংশ পরে কেবলমাত্র একটি ভ্যারাইটি উৎপাদন করে, কিন্তু আরও বেশি রূপান্তরিত হওয়ার ফলে কয়েকটি ভ্যারাইটি দুটি বা তিনটি ভ্যারাইটি উৎপাদন করে এবং কয়েকটি একটিও সৃষ্টি করে না। এভাবে পিতামাতার (A) ভ্যারাইটিরা বা রূপান্তরিত বংশধররা সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে এবং সাধারণত বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী হতে থাকবে। রেখাচিত্রটিতে প্রক্রিয়াটি দশ হাজার বংশ এবং একটি সংক্ষিপ্ত ও সরলাকারে চোদ্দ হাজার বংশ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।

কিন্তু এখানে আমি নিশ্চয় বলবো যে প্রক্রিয়াটি সর্বদা এত নিয়মিতভাবে চলে বলে আমি মনে করি না, যেমন রেখাচিত্রটিতে দেখানো হয়েছে, যদিও এটি অনিয়মিতভাবে অঙ্কিত হয়েছিল, অথবা আমি এ-ও মনে করি না যে এটি অবিচ্ছিন্নভাবে চলে না। এটি আরও বেশি সম্ভবপর যে প্রত্যেক আকার দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে এবং তারপর পুনরায় রূপান্তরিত হতে শুরু করে। অথবা আমি মনে করি না যে অতিশয় অপসারী/ভিন্নমুখী ভ্যারাইটিরা অনিবার্যভাবে রূপান্তরিত হয়; একটি মধ্যম আকার প্রায়শই দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে এবং একাধিক রূপান্তরিত বংশধর সৃষ্টি করতে পারে বা পারে না, কারণ জীব দ্বারা হয় অনধিকৃত বা সম্পূর্ণরূপে অধিকৃত নয় এমন স্থানসমূহের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রাকৃতিক নির্বাচন সর্বদা ক্রিয়া করবে এবং তা অনির্দিষ্ট জটিল সম্পর্কগুলির ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু একটি সাধারণ নিয়মানুসারে যে কোন একটি প্রজাতির বংশধরদের দেহ যত বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ হবে, তত বেশি অঞ্চল দখল করতে সমর্থ হবে এরা, এবং তত বেশি এদের বংশধরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অনুক্রমিক আকারদের চিহ্নিত করে ছোট সংখ্যার অক্ষরগুলি দ্বারা নিয়মিত ব্যবধানে আমাদের রেখাচিত্রটিতে পরম্পরার রেখাঁটি ভাঙ্গা দেখানো হয়েছে, ঐসব আকাররা ভ্যারাইটি হিসেবে লিপিবদ্ধ হতে যথেষ্ট ভিন্ন হয়েছে। কিন্তু এই বিযুক্তিগুলি কল্পিত এবং যথেষ্ট সময়ের ব্যবধানে বেশ কিছু পরিমাণ অপসারী/ভিন্নমুখী পরিবর্তনের পুঞ্জীভবনের সুযোগ দিয়ে বিযুক্তিগুলিকে যে কোন জায়গায় সন্নিবেশিত করা যেতে পারত।

একটি বিরাট গণের অন্তর্গত একটি সুলভ ও ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত প্রজাতির সমস্ত রূপান্তরিত বংশধররা সেই একই রকম সুযোগসুবিধাগুলি নিতে চেষ্টা করবে যেগুলি তাদের পিতামাতাদের কৃতকার্য হতে সাহায্য করেছিল, এবং এরা সাধারণত সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে ও বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী হতে থাকবে: এটি (A) থেকে উদ্ভূত কয়েকটি ভিন্নমুখী বা অপসারী শাখার দ্বারা রেখাচিত্রটিতে দেখানো হয়েছে। পূর্ববর্তীটির থেকে রূপান্তরিত বংশধর এবং বংশরেখাগুলির আরও উন্নত শাখারা, সম্ভবতঃ পূর্বের কম উন্নত শাখাদের স্থান প্রায়শই গ্রহণ করবে এবং এভাবে ধ্বংস করবে: উপরের সমান্তরাল রেখাগুলিতে না-পৌঁছানো নিচের কয়েকটি শাখার দ্বারা এটি রেখাচিত্রে দেখানো হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহেই রূপান্তরিত প্রক্রিয়াটি একটি একক বংশরেখায় সীমাবদ্ধ থাকবে এবং রূপান্তরিত বংশধরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না, যদিও ভিন্নমুখী/অপসারী রূপান্তরের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। রেখাচিত্রটিতে এই বিষয়টি দেখানো যেতে পারে a1 থেকে a10 পর্যন্ত রেখাগুলি ছাড়া (A) থেকে উদ্ভূত রেখাগুলি মুছে ফেলা হলে। এভাবে ইংলিশ ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া ও ইংলিশ পয়েন্টার কুকুর উভয়েই কোন নূতন শাখা বা জাত সৃষ্টি না করে, এদের আদিম কুল থেকে বৈশিষ্ট্যে ধীরে ধীরে ভিন্নমুখী হয়েছে।

দশহাজার বংশের পর, ধরা যাক প্রজাতি (A) তিনটি আকার a10, f10, m10 সৃষ্টি করেছে, যারা পর্যায়ক্রমিক বংশগুলিতে বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী/অপসারী হয়ে পরস্পরের থেকে ও নিজেদের সাধারণ পিতামাতার থেকে, সম্ভবতঃ অসমানভাবে প্রভূত পরিমাণে ভিন্ন হয়ে থাকবে। আমরা যদি মনে করি যে আমাদের রেখাচিত্রের প্রত্যেক সমান্তরাল রেখার মধ্যে পরিবর্তনের পরিমাণ অতি অল্প হয়, এই তিনটি আকার তখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র সুচিহ্নিত ভ্যারাইটি হতে পারে; কিন্তু এই তিনটি আকার সন্দেহজনক বা অন্ততঃ সু-সংজ্ঞায়িত প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে রূপান্তর প্রক্রিয়ার ধাপগুলি আরও অসংখ্য ও বিরাট পরিমাণ হতে হবে, এটা আমাদের মনে করতে হবে। এভাবে রেখাচিত্রটি ধাপগুলির উদাহরণস্বরূপ ব্যাখ্যা উপস্থিত করে, যার দ্বারা ভ্যারাইটিদের প্রভেদকারী অল্প পার্থক্যসমূহ প্রজাতিদের প্রভেদকারী বড় ধরণের পার্থক্যে বৃদ্ধি পায়। বিরাট সংখ্যক বংশ ধরে প্রক্রিয়াটি চলার পর (সংক্ষিপ্ত ও সরলভাবে যেমন রেখাচিত্রটিতে দেখানো হয়েছে) আমরা আটটি প্রজাতি পাই, যারা a14 ও m14-এর মধ্যবর্তী অক্ষরগুলি দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে এবং এরা সকলেই (A) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আমার বিশ্বাস মতো, এভাবে প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও গণগুলি সৃষ্ট হয়।

একটি বড় গণে এটি সম্ভবপর যে একাধিক প্রজাতি পরিবর্তিত হবে। রেখাচিত্রটিতে আমি ধরে নিয়েছি যে দ্বিতীয় একটি প্রজাতি (I) দশ হাজার বংশের পর, সমান্তরাল রেখাদের মধ্যে কল্পিত পরিবর্তনের পরিমাণানুসারে অনুরূপ ধাপগুলির দ্বারা হয় দুটি সুচিহ্নিত ভ্যারাইটি (w10 এবং z10) বা দুটি প্রজাতি সৃষ্টি করেছে। চৌদ্দ হাজার বংশের পর, মনে হয় n14 থেকে z14 অক্ষরগুলি দ্বারা চিহ্নিত ছয়টি নূতন প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে। যে কোন গণের প্রজাতিরা, যারা বৈশিষ্ট্যে পরস্পরের থেকে ইতিমধ্যে অতিশয় ভিন্ন হয়েছে, সাধারণতঃ বিরাট সংখ্যক রূপান্তরিত বংশধর সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে; কারণ প্রকৃতিমণ্ডলে নূতন ও ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন স্থানগুলি অধিকার করার ভাল সুযোগ থাকবে! অতএব রেখাচিত্রটিতে আমি প্রান্তবর্তী প্রজাতি (A) এবং প্রায়-প্রান্তবর্তী প্রজাতি (I)-কে মনোনীত করেছি, যারা বিপুলভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং নূতন ভ্যারাইটি ও প্রজাতি সৃষ্টি করেছে। আমাদের আদি প্রথম গণের অন্য নয়টি প্রজাতি (বড় অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত) দীর্ঘ এবং অসমান সময় ধরে অপরিবর্তিত বংশধরদের উৎপাদন করে থাকতে পারে। এটি রেখাচিত্রের ওপরদিকে অসমানভাবে প্রসারিত বিন্দুখচিত রেখাদের দ্বারা দেখানো হয়েছে।

রেখাচিত্রটির মাধ্যমে উপস্থাপিত রূপান্তর প্রক্রিয়া চলার সময়, আমাদের অন্য একটি মূলতত্ত্ব অর্থাৎ বিলুপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকবে। প্রত্যেক পরিপূর্ণ দেশে জীবনসংগ্রামে অন্য আকারের ওপর অল্প প্রাধান্য বিস্তারকারী নির্বাচিত আকারদের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন যেহেতু স্বাভাবিকভাবে কাজ করে, তাই যে কোন একটি প্রজাতির উন্নত বংশধরদের উদ্ভবের প্রতিটি ধাপে এদের পূর্বপুরুষ ও জন্মদাতাদের অনবরত ধ্বংস ও স্বভাবচ্যুত করার প্রবণতা থাকবে। কারণ স্মরণ রাখা উচিত যে স্বভাবে, দেহগঠনে, অবয়বে পরস্পরের সঙ্গে প্রায় সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কিত এইসব আকারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সাধারণতঃ অতিশয় কঠোর হবে। অতএব পূর্বের ও পরবর্তী অবস্থার মধ্যে সমস্ত মধ্যবর্তী আকারদের, অর্থাৎ একই প্রজাতির কম ও বেশি উন্নত আকারদের এবং আদি পিতামাতা প্রজাতিরও বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সুতরাং এটি অনেক সমগ্র সমপার্শ্বিক বংশরেখার ক্ষেত্রেও হবে, যারা পরবর্তী সময়ে ও উন্নত রেখাদের দ্বারা বিজিত হবে। তবে একটি প্রজাতির রূপান্তরিত বংশধর যদি কোন ভিন্ন দেশে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়, অথবা সম্পূর্ণ নূতন জায়গায় তাড়াতাড়ি অভিযোজিত হয়, তাহলে সেখানে বংশধর ও জন্মদাতার মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা থাকে না, উভয়েই একসঙ্গে অবস্থান করতে পারে।

যদি আমাদের রেখাচিত্রটি রূপান্তর প্রক্রিয়াকে কিছু পরিমাণে উপস্থাপিত করে বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে প্রজাতি (A) ও পূর্বের ভ্যারাইটিরা বিলুপ্ত হয়ে থাকবে, এরা আটটি নূতন প্রজাতি (a14 থেকে m14) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে থাকবে; এবং প্রজাতি (I) ছয়টি (n14 থেকে z14) নূতন প্রজাতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।

কিন্তু আমরা এর চেয়ে আরও বেশি দূর এগোতে পারি। প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আমাদের গণের মূল/আদি প্রজাতিরা পরস্পরের মধ্যে অসমমাত্রায় সদৃশ বলে মনে করা হয়েছিল; অন্য প্রজাতিদের তুলনায় প্রজাতি (A) B, C ও D প্রজাতিদের সঙ্গে আরও বেশি সম্পর্কযুক্ত; এবং অন্যদের তুলনায় প্রজাতি (I) G, H, K, L প্রজাতিদের সঙ্গে আরও বেশি সম্পর্কযুক্ত। (A) এবং (I) এই দুই প্রজাতিকে অতিশয় সুলভ ও ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত বলে ধরা হয়েছিল, কেন না এরা গণটির অন্য অধিকাংশ প্রজাতিদের ওপর প্রথমের দিকে কিছু প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এদের রূপান্তরিত বংশধরগণ, চৌদ্দ হাজারতম বংশে সংখ্যায় চোদ্দটি, একই সুফলগুলোর কয়েকটি সম্ভবতঃ বংশগতভাবে প্রাপ্ত হবে : উদ্ভবের প্রতিটি ধাপে এরা বিভিন্নরূপে উন্নত ও রূপান্তরিত হয়েছে, যাতে করে এরা এদের দেশের প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের অনেক সম্পর্কিত এলাকায় অভিযোজিত হয়ে থাকবে। অতএব এটি খুবই সম্ভবপর বলে মনে হয় যে এরা শুধুমাত্র এদের পিতামাতা (A) এবং (I) নয়, বরং এদের পিতামাতাদের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কিত এরূপ মূল/আদি প্রজাতির কয়েকটির স্থান গ্রহণ করে থাকবে এবং এরূপে ধ্বংস করে থাকবে। অতএব মূল/ আদি প্রজাতি অল্প কয়েকটি চৌদ্দ হাজারতম বংশে বংশধর প্রেরণ করে থাকবে। আমরা অনুমান করতে পারি যে অন্য নয়টি প্রজাতির সঙ্গে কম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত দুটি প্রজাতির (E এবং F) মধ্যে কেবল একটি (F) উদ্ভবের শেষ ধাপে বংশধরদের প্রেরণ করেছে।

আমাদের রেখাচিত্রটিতে মূল এগারটি প্রজাতি থেকে উদ্ভূত নূতন প্রজাতিদের সংখ্যা এখন পনেরটি হবে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের অপসারী/বহির্মুখী প্রবণতার জন্য প্রজাতি al4 এবং zl4-এর মধ্যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের চূড়ান্ত পরিমাণ মূল এগারটি প্রজাতির সবচেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের তুলনায় আরও অনেক বেশি হবে। পরন্তু প্রজাতিরা ব্যাপকভাবে ও বিভিন্নভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবে। (A) থেকে উদ্ভূত আটটি বংশধরের মধ্যে a14, p14, q14 চিহ্নিত তিনটি a10 থেকে সম্প্রতি শাখাবিস্তার করে সম্পর্কযুক্ত হবে; অনেক আগে a5 থেকে শাখাবিস্তার করে b14 ও f14 তিনটি প্রথম নাম দেওয়া প্রজাতি থেকে কিছু মাত্রায় ভিন্ন হবে এবং সবশেষে, o14, e14 এবং m14 পরস্পরের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কযুক্ত হবে, কিন্তু রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রথম আরম্ভের জায়গা থেকে উদ্ভূত হয়ে অন্য পাঁচটি প্রজাতি থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন হবে এবং একটি উপ গণ অথবা একটি পৃথক গণ সৃষ্টি করতে পারে।

(I) থেকে উদ্ভূত ছয়টি বংশধর দুটি উপ-গণ অথবা গণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু যেহেতু মূল প্রজাতি (I) মূল গণটির প্রায় চূড়ান্ত প্রান্তে অবস্থিত (A) থেকে বহুলাংশে ভিন্ন, তাই (I) থেকে উদ্ভূত ছয়টি বংশধর, কেবল বংশানুসৃতির জন্য (A) থেকে উদ্ভূত আটটি বংশধরের তুলনায় আরও বিশেষভাবে ভিন্ন হবে; অধিকন্তু দুটি গোষ্ঠী সম্ভবতঃ বিভিন্ন দিকে বহিমুখী বা অপসারী হতে থাকবে। মধ্যবর্তী প্রজাতিরাও (এবং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়), যারা মূল প্রজাতি (A) এবং (I)-কে সংযুক্ত করেছিল, (F) ছাড়া সকলে বিলুপ্ত হয়েছে এবং কোন বংশধর রেখে যায়নি। অতএব (I) থেকে উদ্ভূত ছয়টি নূতন প্রজাতিকে (A) থেকে উদ্ভূত আটটি নূতন প্রজাতিকে অতিশয় ভিন্ন ভিন্ন গণ হিসেবে অথবা এমনকি ভিন্ন ভিন্ন উপ-গোত্র হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করতে হবে।

আমার বিশ্বাস মতো এটি এভাবে হয় যে একই গণের দুই বা ততোধিক প্রজাতি থেকে রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের মাধ্যমে দুই বা ততোধিক গণ সৃষ্টি হয়েছে। এবং দুটি বা ততোধিক পিতামাতা প্রজাতি আগেকার একটি গণের যে কোন একটি প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়। আমাদের রেখাচিত্র বড় অক্ষরগুলির নিচে ভঙ্গিল রেখাদের দ্বারা এর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এবং ঐ রেখাগুলি নিচের দিকের উপ-শাখার একটি বিন্দুতে মিলিত হয়; এই বিন্দুটি প্রজাতির প্রতীক, যা আমাদের কয়েকটি উপ-গণ। ও গণসমূহের কল্পিত জন্মদাতা।

নূতন প্রজাতি F14-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর কিছু আলোচনা সময়োপযোগী, মনে হয় যেটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে খুব একটা ভিন্নমুখী হয় না, বরং হয় অপরিবর্তিত অথবা অতি অল্পমাত্রায় পরিবর্তিত হয়ে (F)-এর আকার বজায় রেখেছে। এ ক্ষেত্রে অন্য চৌদ্দটি নূতন প্রজাতির সঙ্গে এর সম্বন্ধ অদ্ভুত ও ঘোরালো প্রকৃতির হবে। পিতামাতা প্রজাতি (A) এবং (I)-এর মধ্যবর্তী একটি আকার থেকে, যা অজানা ও বিলুপ্ত হয়েছে। বলে মনে হয়, উদ্ভূত হবার পর এটি এই দুই প্রজাতি থেকে উদ্ভূত দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে বৈশিষ্ট্যে কিছুমাত্রায় মধ্যবর্তী হবে। কিন্তু যেহেতু এই দুটি গোষ্ঠী এদের পিতামাতার টাইপ থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী হয়ে থাকে, তাই নূতন প্রজাতিটি (F14) প্রত্যক্ষভাবে এদের মধ্যবর্তী হবে না, বরং দুই গোষ্ঠীর টাইপের মধ্যবর্তী হবে; এবং এই ঘটনাগুলি সম্পর্কে প্রত্যেক প্রকৃতিবিদ মনে মনে প্রশ্ন তুলতে সমর্থ হবেন।

এখানে কল্পনা করা হয় যে রেখাচিত্রের প্রত্যেক সমান্তরাল রেখা এক হাজার বংশ সূচিত করে, কিন্তু প্রত্যেকে দশ লক্ষ বা আরও বেশি বংশ সূচিত করতে পারে; এটি দেহাবশেষ সমেত পৃথিবীপৃষ্ঠের পর্যায়ক্রমিক স্তরগুলির একটিকেও সূচিত করতে পারে; যখন আমরা ভূতত্ত্বের অধ্যায়ে আসব তখন পুনরায় এ বিষয়ে উল্লেখ করব, এবং তখন। আমরা দেখব যে রেখাচিত্রটি বিলুপ্ত জীবদের বংশগত মিলের ওপর আলোকপাত করে, যদিও এরা এখন জীবিতদের সঙ্গে একই বর্গ, গোত্র বা গণগুলির সাধারণতঃ অন্তর্ভুক্ত হয়, তবুও এরা প্রায়শই কিছুমাত্রায় বর্তমানের গোষ্ঠীদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যবর্তী হয়; এবং আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি, কারণ বিলুপ্ত প্রজাতিরা সূদূর অতীতের বিভিন্ন যুগে বেঁচেছিল, যখন উদ্ভবের শাখারেখাগুলি কম ভিন্নমুখী হয়েছিল।

এখনকার ব্যাখ্যামতো কেবল গণগুলি সৃষ্টি করতে রূপান্তর প্রক্রিয়ার সীমারেখা নির্ধারণ করার কোন যুক্তি আমি খুঁজে পাই না। রেখাচিত্রটিতে, আমরা যদি কল্পনা করি যে অপসারণশীল বিন্দুখচিত রেখাদের প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক গোষ্ঠী দ্বারা সূচিত পরিবর্তনের পরিমাণ বিরাট হয়, তাহলে a14 থেকে p14, b14 ও f14 এবং o14 থেকে m14 চিহ্নিত আকাররা তিনটি অতিশয় ভিন্ন গণ সৃষ্টি করবে। আমরা (A)-এর বংশধরদের থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন (I) থেকে উদ্ভূত দুটি ভিন্ন গণ দেখে থাকব। গণেদের এই দুটি গোষ্ঠী রেখাচিত্রে সূচিত অপসারী রূপান্তরের পরিমাণ অনুযায়ী এভাবে দুটি ভিন্ন গোত্র বা বর্ণ গঠন করবে। এবং দুটি নূতন গোত্র বা বর্গ মূল গণের দুটি প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং এরা আরও প্রাচীন ও অজ্ঞাত কোন আকার থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়।

আমরা দেখেছি যে প্রত্যেক দেশে বৃহত্তর গণগুলির অন্তর্গত প্রজাতিরাই প্রায়শ ভ্যারাইটি অথবা জায়মান প্রজাতিদের সৃষ্টি করে। বাস্তবিকপক্ষে এটিই অবশ্য করা যায়, কারণ অস্তিত্বের সংগ্রামে অন্য আকারদের ওপর কিছু পরিমাণ প্রাধান্য বিস্তারকারী একটি আকারের ওপর প্রাকৃতিক নির্বাচন যেহেতু ক্রিয়াশীল হয়, সেহেতু এটি সেইগুলির ওপরেই মূলতঃ ক্রিয়া করে যেগুলি ইতিমধ্যেই কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এবং যে কোন গোষ্ঠীর বিরাটত্ব থেকে বোঝা যায় যে তার অন্তর্গত প্রজাতিগুলি একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে কিছু সাধারণ উন্নতির সুফল বংশগতভাবে পেয়েছে। অতএব নূতন ও রূপান্তরিত বংশধরদের উদ্ভব বা সৃষ্টির সংগ্রাম মূলতঃ বৃহত্তর গোষ্ঠীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, যারা সকলে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে চেষ্টা করছে। একটি বিরাট গোষ্ঠী ধীরে ধীরে অন্য বিরাট গোষ্ঠীকে জয় করবে, তার সংখ্যা হ্রাস করবে এবং এভাবে তাদের আরও পরিবর্তন ও উন্নতির সম্ভাবনা হ্রাস করবে। একটি বিরাট গোষ্ঠীর মধ্যে, পরের ও আরও নিখুঁত উপ-গোষ্ঠীরা শাখায় বিভক্ত হয়ে, প্রকৃতিমণ্ডলের অনেক নূতন স্থান দখল করে, অনবরত পূর্বেকার ও কম উন্নত উপ-গোষ্ঠাদের স্থানচ্যুত করতে ও ধ্বংস করতে চেষ্টা করবে। ছোট ও ভঙ্গিল গোষ্ঠী এবং উপ-গোষ্ঠীরা অবশেষে বিলুপ্ত হবে। ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে যারা এখন বিরাট ও বিজয়ী এবং যারা সামান্যতমও ভেঙ্গে যায়নি, অর্থাৎ যাদের বিলুপ্তির সম্ভাবনা কম জীবজগতের এমন গোষ্ঠীরা দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কিন্তু কোন্ কোন্ গোষ্ঠী অবশেষে প্রাধান্য বিস্তার করবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়, কারণ আমরা জানি যে পূর্বের অতি-উন্নত অনেক গোষ্ঠী এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও দূরের ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে বৃহত্তর। গোষ্ঠীদের নিরবচ্ছিন্ন ও নিয়মিত বৃদ্ধির জন্য অসংখ্য ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠী সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে এবং কোন রূপান্তরিত বংশধর রেখে যাবে না; ফলস্বরূপ, যে কোন যুগে জীবিত প্রজাতিদের মধ্যে অল্প কয়েকটি অদূর ভবিষ্যতে বংশধর রেখে যাবে। শ্রেণী বিভাগ অধ্যায়ে এ বিষয়ে আমাকে ফিরে আসতে হবে, কিন্তু এখানে আমি আরও বলতে পারি যে এই মতানুসারে যেহেতু আরও আদিম প্রজাতিদের অতি অল্প কয়েকটি বর্তমান। কাল পর্যন্ত বংশগতভাবে বংশধর প্রেরণ করেছে এবং যেহেতু একই প্রজাতির সমস্ত বংশধররা একটা শ্রেণী সৃষ্টি করে, তাই আমরা বুঝতে পারি কেমন করে এটি হয় যে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের প্রত্যেক প্রধান বিভাগে এত অল্প কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে। আদিম প্রজাতিদের কয়েকটি যদিও রূপান্তরিত বংশধর রেখে গেছে, তথাপি ভূতাত্ত্বিক যুগের বহু অতীতে সমগ্র পৃথিবী বর্তমান সময়ের মত অসংখ্য গণ, গোত্র, বর্গ ও শ্ৰেণীদের . প্রজাতি দ্বারা প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকতে পারে।

জৈবসংগঠনের উন্নতির প্রবণতার মাত্রা

প্রত্যেক জীব সারা জীবন ধরে জৈব ও অজৈব পরিবেশের প্রভাবাধীন থাকার ফলে উপকারী পরিবৃত্তিগুলির সংরক্ষণ ও সঞ্চয়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে। সর্বশেষ ফলটি এই হয় যে প্রত্যেক জীব তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আরও বেশি বেশি করে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করে। সারা পৃথিবী জুড়ে বিরাট সংখ্যক জীবের দেহগঠনের ক্রমশঃ উন্নতি ঘটাতে অনিবার্যরূপে প্রভাবিত করে। কিন্তু আমরা এখানে একটি অতি জটিল বিষয়ে প্রবেশ করেছি, কারণ দেহগঠন বা জৈব সংগঠনের অগ্রগতির অর্থ কী, সে বিষয়ে প্রকৃতিবিদরা পরস্পরের সন্তুষ্টির জন্য কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেননি। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে বোধশক্তির মাত্রা ও দেহগঠন মানুষের নিকটবর্তী হওয়াটা স্পষ্টতঃ একটি ভূমিকা পালন করে। ভাবা যেতে পারত যে ভূণাবস্থা থেকে পূর্ণাবস্থায় এদের ক্রমবিকাশের জন্য বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পরির্তনের পরিমাণই তুলনামূলক বিচারের একটি পর্যাপ্ত মান হবে। কিন্তু কোন কোন পরজীবী খোলকী প্রাণীদের সম্পর্কে কয়েকটি ঘটনা রয়েছে, এদের দেহের কয়েকটি প্রত্যঙ্গ এত অসম্পূর্ণ যে পূর্ণবয়স্ক প্রাণীটিকে তার লার্ভার তুলনায় উচ্চ পর্যায়ের বলা যেতে পারে না। ভন বেয়ারের মানদণ্ডটিই সম্ভবতঃ সবচেয়ে ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য ও সর্বোৎকৃষ্ট, সেটি হচ্ছে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় একই জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রভেদের পরিমাণ এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ার জন্য তাদের বিশিষ্টতা; অথবা মিলনে এডওয়ার্ড যেমন বলেন সেটি হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় শ্রমবিভাগের সম্পূর্ণতা। কিন্তু আমরা দেখব এই বিষয়টি কতটা অস্পষ্ট। যেমন হয় মাছগুলিকে লক্ষ্য করলে। এদের মধ্যে কিছুকে কয়েকজন প্রকৃতিবিদ উচ্চস্তরের বলে অভিমত ব্যক্ত করেন, এরা আবার হাঙ্গরের মতো উভচরদের কাছাকাছি; অন্যদিকে অন্য প্রকৃতিবিদরা সাধারণ অস্থিময় অথবা টেলিয়োস্টিয়ান মাছেদের উচ্চ শ্রেণীভুক্ত করেছেন, কারণ এরা অতি সঠিকভাবে মাছের মতো ও অন্য মেরুদণ্ডী শ্রেণীদের থেকে অতিশয় ভিন্ন। উদ্ভিদদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই বিষয়টির অস্পষ্টতা আরও বেশি। এদের বুদ্ধির মান নিশ্চয় সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়েছে এবং কয়েকজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী সেই সব উদ্ভিদদের উচ্চ পর্যায়ভুক্ত করেছেন, যাদের প্রত্যেক ফুলের প্রত্যেক অঙ্গ, যেমন বৃত্যাংশ, পাপড়ি, পুংকেশর, স্ত্রীকেশর সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে; অন্যদিকে অন্য উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা, সম্ভবতঃ যাঁরা আরও সঠিক, সেই সব উদ্ভিদদের উচ্চ শ্রেণীভুক্ত করেছেন যাদের অঙ্গ অতিশয় রূপান্তরিত হয়েছে ও সংখ্যায় হ্রাস পেয়েছে।

প্রত্যেক পূর্ণবয়স্ক জীবের কয়েকটি অঙ্গের বিশিষ্টতা এবং পৃথকীকরণের পরিমাণকে উচ্চ সংগঠনের মানদণ্ড হিসাবে যদি আমরা ধরি (এবং এটি বুদ্ধিমত্তার জন্য মস্তিষ্কের অগ্রগমনকে অন্তর্ভুক্ত করে), তাহলে দেখবো এই মানদণ্ডের দিকে প্রাকৃতিক নির্বাচন স্পষ্টতই চালনা করে; কারণ সমস্ত শারীরতত্ত্ববিদ স্বীকার করেন যে এদের প্রক্রিয়াটিকে ভালভাবে সম্পন্ন করার জন্য অঙ্গগুলির বিশিষ্টতা প্রত্যেক জীবের পক্ষে লাভজনক; এবং সেহেতু বিশিষ্টতার দিকে পরিচালিত পরিবৃত্তিদের সঞ্চয়ন প্রাকৃতিক নির্বাচনের কর্মের পরিধির মধ্যে আসে। অন্যদিকে, সমস্ত জীব উচ্চহারে বৃদ্ধি ও প্রকৃতিমণ্ডলের অনধিকৃত বা কম অধিকৃত অঞ্চল অধিকারের জন্য চেষ্টা করছে–এই বিষয়টি মনে রাখলে এটাও সম্ভবপর মনে হয় যে প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি জীবকে যে কোন অবস্থা মানিয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত করে তোলে, যাতে করে কয়েকটি অঙ্গ অনাবশ্যক বা অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে সংগঠনের মাত্রায় প্রত্যাগতি ঘটবে। ভূতাত্ত্বিক যুগের বহু পূর্ব থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে সংগঠনের প্রকৃতই কোন অগ্রগমন হয়েছে কিনা তা আমাদের ভূতাত্ত্বিক পর্যায়ক্রম সংক্রান্ত অধ্যায়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে যদি সমস্ত জীব উপযুক্ত মানে উন্নত হতে চেষ্টা করে, তবে কেমন করে এটি হয় যে সমগ্র পৃথিবীতে সর্বনিম্ন আকাররা বিশাল সংখ্যায় এখনও বর্তমান আছে? এবং কেমন করে এটি হয় যে প্রত্যেক বিরাট শ্রেণীতে অন্যদের তুলনায় কম উন্নত আকাররা রয়েছে? অতি উন্নত আকাররা কেন সর্বত্র নিম্নবতী আকারদের স্থানচ্যুত ও ধ্বংস করে না? লামার্ক বিশ্বাস করতেন যে সম্পূর্ণ নিখুঁত হওয়ার দিকে সমস্ত জীবের একটি সহজাত ও অনিবার্য প্রবণতা রয়েছে এবং তিনি এই অসুবিধাটি রীতিমতো গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন বলেই বোধ হয় মনে করতে বা হয়েছিলেন যে নূতন ও সরল আকারগুলি স্বতঃপ্রজননের মাধ্যমে অনবরত সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে যা-ই আবিষ্কার হোক না কেন, বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত এই বিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। আমাদের তত্ত্ব অনুযায়ী নিম্নবর্তী জীবদের ধারাবাহিকভাবে টিকে থাকাটা কোন অসুবিধা সৃষ্টি করে না; কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন প্রগতিমূলক বিকাশকে আবশ্যক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে না।–এটি কেকল এর জটিল জীবন সম্পর্কে প্রত্যেক জীবের ভাবে এবং উপকারী এইসব পরিবৃত্তিদের সুযোগ গ্রহণ করে। প্রশ্ন করা যেতে পারে-অগ্রগতির পক্ষে কোন্ সুবিধাটি, যতদূর আমরা দেখতে পাই, ইনফুসোরিয়ান অ্যানিম্যাল-অন্ত্রে বসবাসকারী একটি কৃমি, অথবা একটি কেঁচোর ক্ষেত্রে উচ্চহারে সংগঠিত হবে? যদি এর অগ্রগমনের কোন সুবিধা না থাকত, তাহলে যে সব আকার প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা অনুন্নত তা কম উন্নত অবস্থায় পরিত্যক্ত হবে এবং বর্তমানের নিম্ন অবস্থায় মতো অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত রয়ে থাকবে; এবং ভূতত্ত্ব আমাদের বলে যে ইনফুসোরিয়া ও রাইজোপড়ের মতো সর্বনিম্ন আকারদের মধ্যে কয়েকটি সুদীর্ঘ কাল ধরে প্রায় বর্তমান অবস্থার মতোই রয়েছে। কিন্তু এখন জীবিত অসংখ্য নিম্নবর্তী আকারদের অধিকাংশই জীবনের প্রথম প্রভাত থেকে অন্ততঃ অগ্রগতি করেনি বলে মনে করা অত্যন্ত হঠকারী সিদ্ধান্ত হবে; কারণ সাংগঠনিকভাবে নিম্নবর্তী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি জীবের শবব্যবচ্ছেদ করেছেন এমন প্রত্যেক প্রকৃতিবিদ নিশ্চয় এদের প্রকৃত সুন্দর ও আশ্চর্যজনক সংগঠন দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়েছেন।

একই বিরাট গোষ্ঠীর মধ্যে সংগঠনের বিভিন্ন ক্রমগুলি যদি আমরা লক্ষ্য করি, সেখানেও একই অভিমত প্রযোজ্য হয়। যেমন, মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণী ও মাছের সহবস্থান, স্তন্যপায়ীদের মধ্যে মানুষ ও অর্নিথোরিনচাঁদের সহাবস্থান, মাছেদের মধ্যে হাঙ্গর ও ল্যান্সলেট (অ্যাফিয়কসাস)-দের সহবস্থান, শেষের মাছটি তার দেহগঠনের অতিশয় সরলতার জন্য অমেরুদণ্ডী শ্ৰেণীদের নিকটবর্তী হয়। কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণী ও মাছেদের পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা কদাচিৎ ঘটে; স্তন্যপায়ীদের সমগ্র শ্রেণীর বা এই শ্রেণীর কোন কোন সদস্যের উচ্চতম ধাপে উন্নতি মাছেদের স্থান গ্রহণ করতে প্রভাবিত করবে না। শারীরতত্ত্ববিদরা মনে করেন মস্তিষ্ককে অতিশয় সক্রিয় করতে উষ্ণ রক্তের প্রয়োজন এবং তার জন্য বায়বীয় শ্বসন দরকার; সেই জন্য অসুবিধাজনক অবস্থায় জলে বাস করতে অভ্যস্ত উষ্ণরক্তবিশিষ্ট স্তন্যপায়ীদের অনবরত জলের ওপর স্তরে উঠে আসতে হয়। মাছেদের ক্ষেত্রে, হাঙ্গর গোত্রের সদস্যরা ল্যান্সলেটদের স্থানচ্যুত করতে উৎসাহিত হবে না; কারণ আমি ফ্রিজ মূলারের কাছ থেকে শুনেছি ল্যান্সলেটের একমাত্র সঙ্গী ও প্রতিযোগী হচ্ছে দক্ষিণ ব্রাজিলের উষ্ণ বালুময় সমুদ্রসৈকতের একটি ব্যতিক্রমী অ্যানেলিড। স্তন্যপায়ীদের তিনটি নিম্নতম বর্গ, যথা মাসুপিয়াল, এডেন্টটা এবং রোডেন্টরা দক্ষিণ আমেরিকার একই অঞ্চলে অসংখ্য বানরদের সঙ্গে সহাবস্থান করে এবং পরস্পরের সঙ্গে সম্ভবতঃ অল্প সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যদিও সামগ্রিকভাবে সমগ্র পৃথিবীতে জৈবসংগঠনের উন্নতি ঘটে থাকতে পারে এবং এখনও ঘটছে, তথাপি মানদণ্ডটি সর্বদা অতিশয় নিখুঁত পর্যায়ে যেতে চেষ্টা করবে; কারণ কোন কোন সমগ্র শ্রেণীর বা প্রত্যেক শ্রেণীর কোন কোন সদস্যদের অতিশয় উন্নতি ঐ সব গোষ্ঠীদের কোনমতেই বিলুপ্তি ঘটায় না, যাদের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায়– অংশগ্রহণ করে এরা। আমরা এর পর দেখব কয়েকটি ক্ষেত্রে নিম্ন আকাররা বর্তমান কাল পর্যন্ত সংরক্ষিত রয়েছে বলে মনে হয়, যারা সীমাবদ্ধ বা বিশেষ অঞ্চলে বসবাস। করে, যেখানে তারা কম তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে থাকে এবং যেখানে তাদের কম সদস্যসংখ্যা অনুকূল পরিবৃত্তিদের উদ্ভবের সম্ভাবনাকে রদ করে।

অবশেষে, আমি বিশ্বাস করি যে অনেক নিম্নস্তরের আকার সারা পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন কারণে বেঁচে আছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে, অনুকূল প্রকৃতির পরিবৃত্তিগুলি বা এককীয় পার্থক্যসমূহ প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার এবং সঞ্চয়নের জন্য কখনও উদ্ভূত হতে পারে na, সম্ভবতঃ কোন ক্ষেত্রেই সম্ভবপর সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য সময় যথেষ্ট নয়। যাকে আমাদের বলা উচিত জৈব সংগঠনের অধঃপতন, অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে। বরং প্রধান কারণটি এই ঘটনায় নিহিত আছে যে অতি সরল জীবন-পরিবেশে উচ্চ জৈব সংগঠন কোন উপকারে আসবে না, যেহেতু তাদের প্রকৃতি অতি নমনীয় এবং যেহেতু ধ্বংস হওয়া ও আহত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের বেশি থাকে, সম্ভবতঃ সেই হেতু এটি কাজে লাগবে না।

জীবনের প্রথম উন্মেষের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সমস্ত জীবের দেহগঠন তখন সরলতম আকারের ছিল। তা হলে প্রশ্ন করা যেতে পারে–অঙ্গগুলির উন্নতি ও পৃথকীকরণের প্রথম ধাপগুলি কিভাবে উদ্ভূত হয়েছিল? মিঃ হার্বার্ট স্পেন্সার সম্ভবতঃ উত্তর দেবেন–যে মুহূর্তে এককোষী জীব বৃদ্ধি বা বিভাজনের দ্বারা কোষসমষ্টিতে পরিণত হয়েছিল অথবা কোন অবলম্বনে আসঞ্জিত হয়ছিল, সেই মুহূর্তেই তার নিয়ম অর্থাৎ “প্রাসঙ্গিক শক্তিগুলি যেমন পৃথক হয়, তার সম্পর্কে ও অনুপাতে যে কোন বর্গের অনুরূপ এককগুলিও তেমনি পৃথক হয়”–এই সূত্রটি কাজ করতে আরম্ভ করবে। কিন্তু যেহেতু পথপ্রদর্শক কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই, সেহেতু এ বিষয়ে দূরকল্পনা সবসময়ই অর্থহীন। তবে এটি মনে করা ভুল যে যতক্ষণ পর্যন্ত না অনেক আকার সৃষ্টি হয়, অস্তিত্বের সংগ্রাম ও ফলস্বরূপ প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটবে না : একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী একমাত্র একটি প্রজাতির পরিবৃত্তিসমূহ উপকারী হতে পারত এবং এভাবে সব এককরা রূপান্তরিত হয়ে থাকত অথবা দুটি ভিন্ন আকারের উদ্ভব হতে পারত। কিন্তু যেমন আমি ভূমিকার শেষে বলেছিলাম যে আরও অতীতে ও বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বসবাসকারী সমস্ত এককদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে যদি আমরা আমাদের গভীর অজ্ঞতা স্বীকার করি, তাহলে প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা না পাওয়ার জন্য কারুর আশ্চর্যান্বিত হওয়া উচিত নয়।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিসৃতি

মিঃ এইচ. সি. ওয়াটসন মনে করেন যে আমি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসৃতির প্রয়োজনীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি (যাতে তিনি আপাতত বিশ্বাস করেন) এবং বলা। যেতে পারে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিসৃতি এভাবে একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। ভিন্ন অথচ সম্পর্কিত দুটি গণের অন্তর্গত প্রজাতি উভয়েই যদি নতুন ও অপসারী বা ভিন্নমুখী অসংখ্য আকার সৃষ্টি করত, তাহলে এরা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে এত কাছাকাছি সম্পর্কযুক্ত হত যে এদের সকলকে একই গণের মধ্যে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারত; এবং এভাবে দুটি ভিন্ন গণের বংশধররা একটিতে মিলিত হবে। কিন্তু ব্যাপকভাবে ভিন্ন আকারদের রূপান্তরিত বংশধরদের দেহগঠনের একটি ঘনিষ্ট ও সাধারণ সাদৃশ্যকে অভিসৃতি হিসেবে চিহ্নিত করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিশয় হঠকারী। কাজ হবে। একটি কেলাসের আকার কেবলমাত্র আণবিক শক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়, এবং এটি বিস্ময়কর নয় যে অসদৃশ পদার্থরা কোন কোন সময় একই আকার ধারণ করবে। কিন্তু জীবজগতের ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে প্রত্যেকের আকার অনির্দিষ্ট জটিল সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে, যথা উদ্ভূত পরিবৃত্তিসমূহ, এগুলি এত জটিল কারণের জন্য হয় যে একে অনুধাবন করা দুঃসাধ্য-সংরক্ষিত ও নির্বাচিত পরিবৃত্তিদের প্রকৃতি, যা পারিপার্শ্বিক ভৌতিক অবস্থাসমূহের ওপর নির্ভর করে এবং আরও উচ্চ মাত্রায় পারিপার্শ্বিক জীবগুলির উপর, যাদের সঙ্গে এদের প্রতিযোগিতা করতে হয়, এবং অবশেষে অসংখ্য জন্মদাতা পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত বংশানুসৃতির (যা প্রকৃতিগতভাবে একটি অস্থির উপাদান) ওপর এদের সকলের আকার সমভাবে জটিল সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। এটি অবিশ্বাস্য যে প্রথমে স্পষ্টভাবে পৃথক দুটি জীবের বংশধররা। পরবর্তী সময়ে কখনও এমন ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হবে যে সমগ্র জৈবসংগঠন প্রায় একইরূপ হবে। এটি ঘটলে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভূতাত্ত্বিক গঠন-স্তরগুলিতে জৈবিক সম্পর্ক নিরপেক্ষভাবে একই আকারের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত, কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণাদি যা পাওয়া যায় তা এই মতের বিরোধিতা করে।

মিঃ ওয়াটসন আরও আপত্তি করেছেন যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসৃতির সঙ্গে প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনবরত বিক্রিয়া অনির্দিষ্ট সংখ্যক বিশেষ আকার সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে। যতদূর সম্ভব অজৈব পরিবেশগুলির কথা বিবেচনা করলে মনে হতে পারে যে যথেষ্ট সংখ্যক প্রজাতি তাপ, আদ্রর্তা ইত্যাদির নানাবিধ বৈচিত্র্যে শীঘ্র অতিযোজিত হবে; কিন্তু আমি সম্পূর্ণভবে স্বীকার করি যে সমস্ত জীবের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও গুরুত্বপূর্ণ; এবং যে কোন দেশে প্রজাতিদের সংখ্যা জীবের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও গুরুত্বপূর্ণ; এবং যে কোন দেশে প্রজাতিদের সংখ্যা অনবরত বৃদ্ধি পেতে থাকে বলে জীবনের জৈব পরিবেশ আরও বেশি বেশি করে জটিল হবে। ফলস্বরূপ প্রথম দর্শনে মনে হয় যে দেহগঠনের সুবিধাজনক বৈচিত্র্যগুলির কোন সীমা নেই, অতএব উদ্ভূত প্রজাতিদের সংখ্যারও কোন সীমা থাকবে না। এমনকি অতিশয় উর্বর অঞ্চল বিশেষ আকারদের দ্বারা পরিপূর্ণ কিনা তা-ও আমরা জানি না : বিস্ময়কর সংখ্যক প্রজাতিতে পরিপূর্ণ উত্তমাশা অন্তরীপ ও অস্ট্রেলিয়াতে অনেক ইউরোপীয় উদ্ভিদ ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ভূতত্ত্ব আমাদের দেখায় যে টার্শিয়ারী পর্বের গোড়ার দিকে খোলকী প্রাণীর প্রজাতিদের সংখ্যা এবং ঐ যুগের মধ্যবর্তী সময়ে স্তন্যপায়ীদের সংখ্যা বিরাটভাবে বাড়েনি বা আদৌ বৃদ্ধি পায়নি। প্রজাতিদের সংখ্যার অনির্দিষ্ট সংখ্যার নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটা তাহলে কী? বিশেষভাবে বহুলাংশে ভৌত পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল একটি অঞ্চলের জীবনের মোট পরিমাণ বা সমষ্টির একটা সীমা নিশ্চয়। থাকবে; অতএব, একটি অঞ্চলে অধিক সংখ্যক প্রজাতি বাস করলে, প্রত্যেক বা প্রায়। প্রত্যেক প্রজাতির অল্প সংখ্যক একক থাকবে; এবং হঠাৎ মরশুমের প্রকৃতি পরিবর্তন ও শত্রুদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এভাবে প্রজাতিদের ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এ সব ক্ষেত্রে ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি দ্রুতহারে ঘটবে, অথচ নূতন প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে মন্থর গতিতে। একটি চরম অবস্থার কথা কল্পনা করুন। ইংল্যান্ডে যত প্রজাতি আছে তত। এককও রয়েছে, এবং প্রথম প্রচণ্ড শীত বা অতি শুষ্ক গ্রীষ্মকাল হাজার হাজার প্রজাতিকে ধ্বংস করবে; বিরল প্রজাতিরা এবং যে কোন দেশে প্রজাতিদের সংখ্যা অনির্দিষ্টভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন বিরল হওয়া প্রত্যেক প্রজাতি প্রায়শই ইতিমধ্যে ব্যাখ্যাত পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অল্প অনুকূল পরিবৃত্তির উদ্ভব ঘটাবে; ফলে নূতন বিশিষ্ট আকারের জন্মদান প্রক্রিয়ার গতি এভাবে হ্রাস পাবে। কোন প্রজাতি বিরল হয়ে এলে, নিকট আত্মীয়দের আন্তঃপ্রজনন তার ধ্বংসসাধনে সাহায্য করবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে লিথুয়ানিয়াতে আউরকদের, স্কটল্যান্ডে লাল হরিণদের, নরওয়েতে ভল্লুকদের সংখ্যা কমে যাওয়ার ব্যাপারে এটি একটি ভূমিকা পালন করেছে। অবশেষে আমি মনে করতে বাধ্য হচ্ছি যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হচ্ছে তার নিজের দেশে বহু প্রতিযোগীকে ইতিমধ্যেই পরাজিত করেছে এমন প্রাধান্য বিস্তারকারী প্রজাতি, সে বিস্তার লাভ করার জন্য এবং অনেককে স্থানচ্যুত করার জন্য সচেষ্ট হবে। আলফোনসে ডি ক্যান্ডেলে দেখিয়েছেন যে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত প্রজাতিরা সাধারণতঃ আরও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে সচেষ্ট হয়; ফলে এরা কয়েকটি অঞ্চলের কয়েকটি প্রজাতিকে স্থানচ্যুত ও ধ্বংস করতে চেষ্টা করবে, এবং এভাবে সারা পৃথিবীতে বিশেষ আকারদের অবাধ বৃদ্ধি প্রতিরোধ করবে। ডঃ হুঁকার সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে স্পষ্টতঃ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য অনুপ্রবেশকারী প্রবেশ করেছে, যার ফলে অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় প্রজাতিদের সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। এইসব বিচার বিবেচনাতে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, দুঃসাহসী হয়ে সে ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারি না; কিন্তু এগুলি একত্রে প্রত্যেক দেশে বিশেষ আকারদের অনির্দিষ্ট বৃদ্ধির প্রবণতাকে নিশ্চয় রোধ করবে।

সারাংশ

জীবনের পরিবর্তনশীল পরিবেশে জীবেরা তাদের প্রায় প্রতি অঙ্গে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য উপস্থিত করে, এ বিষয়টি খণ্ডন করা যেতে পারে না; বৃদ্ধির গুণোত্তরীয় হারের দরুন যদি কোন বয়সে, ঋতুতে বা বছরে কঠোর জীবন-সংগ্রাম হয়, তাহলে সে বিষয়েও কোন বিতর্ক করা যেতে পারে না; জীবদের দেহকাঠামো, জৈবসংগঠন ও স্বভাবসমূহের পক্ষে লাভজনক বা উপকারী অসংখ্য বৈচিত্র্য ঘটানোর জন্য দায়ী সমস্ত জীবের পরস্পরের সঙ্গে ও নিজেদের জীবন-পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কসমূহের সীমাহীন জটিলতা বিবেচনা করলে, মানুষের পক্ষে উপকারী পরিবর্তন ঘটার মতো প্রত্যেকের কল্যাণের জন্য উপকারী পরিবৃত্তিগুলি যদি না ঘটে, তবে সেটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা হবে। কিন্তু যে কোন জীবের পক্ষে উপকারী পরিবৃত্তিগুলি যদি কখনও ঘটে, তাহলে এভাবে অর্জিত বৈশিষ্ট্য সমেত এককদের জীবন-সংগ্রামে বেঁচে থাকার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে এবং বংশগতির কঠোর নিয়মের জন্য এরা এভাবে অর্জিত বৈশিষ্ট্য সমেত বংশধর উৎপাদন করতে সচেষ্ট হবে। সংরক্ষণের এই পদ্ধতিটিকে বা যোগ্যতমের উদ্বর্তনকে আমি প্রাকৃতিক নির্বাচন বলেছি। জৈব ও অজৈব জীবন-পরিবেশ সম্পর্কে এটি প্রত্যেক জীবের উন্নতি ঘটায় এবং ফলস্বরূপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি সংগঠনের অগ্রগতি হিসাবে নিশ্চয় বিবেচিত হবে। তা সত্ত্বেও, সরলতম জীবন-পরিবেশ মানানসই হলে, নিম্ন ও সরল আকাররা দীর্ঘস্থায়ী হবে।

অনুরূপ বয়সে চারিত্রিক গুণগুলি আনুবংশিক হওয়ার নীতি বা পদ্ধতি অনুসারে, প্রাকৃতিক নির্বাচন বয়স্কদের মতো সহজেই ডিম, বীজ অথবা তরুণদের রূপান্তরিত করতে পারে। অসংখ্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে, সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল ও অভিযোজিত পুরুষদের অধিক সংখ্যক বংশধর উৎপাদন সুনিশ্চিত করে যৌন নির্বাচন প্রাকৃতিক নির্বাচনকে সাহায্য করতে থাকবে। অন্য পুরুষদের সঙ্গে বিরোধ ও সংগ্রামে যৌন নির্বাচন কেবল পুরুষদেরই উপকারী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করবে; এবং প্রচলিত বংশগতির প্রকৃতি অনুযায়ী এ সব বৈশিষ্ট্য একই লিঙ্গে বা উভয় লিঙ্গে বংশগতভাবে প্রেরিত হবে।

বিভিন্ন ধরনের জীবন-পরিবেশে ও অবস্থানস্থলে বিভিন্ন জীবনাকারদের অভিযোজিত করতে প্রাকৃতিক নির্বাচন সত্যসত্যই কাজ করছে কিনা, পরবর্তী অধ্যায়ে প্রদত্ত সাধারণ স্বাভাবিক অর্থে ও সাক্ষ্যপ্রমাণাদি দ্বারা তা বিচার-বিবেচনা করা হবে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি কেমন করে এটি অবলুপ্তির কারণ হয়; এবং পৃথিবীর ইতিহাসে কেমন করে জীবকূলের অবলুপ্তি ঘটেছে ভূতত্ত্ব সাধারণভাবে তা আমাদের দেখিয়েছে; প্রাকৃতিক নির্বাচন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপসারণ ঘটাতে প্রণোদিত করে, কারণ জীবকূল অবয়বে, স্বভাবে ও জৈব সংগঠনে যত বেশি অপসরণশীল হয়, তত বেশি সংখ্যক অঞ্চলে অবস্থান করতে পারে–যে কোন ছোট অঞ্চলের অধিবাসীদের ও বিদেশভূমিতে অভিযোজিত উৎপাদনসমূহ লক্ষ্য করার মাধ্যমে আমরা যার প্রমাণ দেখি। অতএব যে কোন একটি প্রজাতির বংশধরদের রূপান্তরের ও সমস্ত প্রজাতির সংখ্যায় বৃদ্ধির জন্য অবিরাম সংগ্রামের সময়কালে বংশধররা যত বেশি অপসরণশীল হবে, জীবনসংগ্রামে। তাদের সাফল্যের সম্ভাবনাও তত বেশি হবে। এভাবে একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের পৃথক করতে পার্থক্য বা প্রভেদসমূহ তত সময় পর্যন্ত নিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে, যত সময় পর্যন্ত না এরা একই গণের বা এমনকি ভিন্ন গণগুলির প্রজাতিদের মধ্যেকার বড় বড় পার্থক্যগুলির সমান হয়।

প্রত্যেক শ্রেণীর বৃহত্তর গণগুলির ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত ও বিস্তৃত প্রজাতিরা যে সবচেয়ে পরিবর্তিত হয়, এই সাধারণ ঘটনাটি আমরা লক্ষ্য করেছি; এবং এই বিপুলতাকে এদের রূপান্তরিত বংশধরে বংশগতভাবে প্রেরণ করতে এরা সচেষ্ট হয় যা এখন নিজ নিজ দেশে প্রাধান্য বিস্তার করতে সাহায্য করে এদের। আগেই বলা হয়েছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি ঘটায় এবং জীবের কম উন্নত ও মধ্যবর্তী আকারগুলির বিলুপ্তি ঘটায়। এই নীতি অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রত্যেক শ্রেণীর অসংখ্য জীবের মধ্যে আত্মীয়তার প্রকৃতি ও সাধারণত সুনির্দিষ্ট পার্থক্যগুলি ব্যাখ্যা করা যেতে পরে। এটি প্রকৃতই একটি বিস্ময়কর বিষয়–যা সাধারণত আমাদের নজর এড়িয়ে যায়–সমস্ত দেশে ও সমস্ত কালে যাবতীয় প্রাণী ও উদ্ভিদরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিত্তিতে এবং এই গোষ্ঠীগুলির অধীনে পরস্পরের সঙ্গে তাদের কতটা পরিমাণে সম্পর্কিত হওয়া উচিত তা আমরা সর্বত্র লক্ষ্য করি–যেমন, একই প্রজাতির ভ্যারাইটিরা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, একই গণের প্রজাতিরা কম ঘনিষ্ঠভাবে ও অসমানভাবে সম্পর্কিত। যারা গোষ্ঠী ও উপগণ সৃষ্টি করে, ন্নি ভিন্ন গণের প্রজাতিরা কম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, এবং বিভিন্ন মাত্রায় সম্পর্কিত গণগুলি উপ-গোত্র, গোত্র, বর্গ উপশ্রেণী ও শ্ৰেণীদের সৃষ্টি করে। যে কোন শ্রেণীর কতিপয় অধীনস্থ গোষ্ঠীকে পরের পর কেবলমাত্র একটি সারিতে সাজানো যেতে পারে না, বরং মনে হয় এরা বিন্দুদের চারিদিকে গুচ্ছবদ্ধ, এগুলি আবার অন্য বিন্দুদের চারিদিকে গুচ্ছবদ্ধ হয় এবং এভাবে সীমাহীন চক্রে এটি চলতে থাকে। প্রজাতিরা যদি স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে এই প্রকার শ্রেণীবিভাগের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভবপর হবে না; কিন্তু বৈশিষ্ট্যের অপসৃতি ও বিলুপ্তির জন্য আবশ্যক বংশানুসৃতি ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এর ব্যাখ্যা করা যায়, যেমনটা রেখাচিত্রে দেখানো হয়েছে।

একই শ্রেণীর সমস্ত জীবের গঠনগত বা আকৃতিগত সৌসাদৃশ্যকে একটি বিরাট বৃক্ষের দ্বারা কোন কোন সময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই উপমা অনেকাংশে প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটন করে বলে আমি বিশ্বাস করি। সবুজ ও কুঁড়ি সমেত পল্লবরা এখানকার প্রজাতিদের সূচিত করতে পারে এবং পূর্ববর্তী বছরগুলিতে সৃষ্ট বা বিলুপ্ত প্রজাতিদের দীর্ঘ পরস্পরা সূচিত করতে পারে। বৃদ্ধির প্রত্যেক পর্যায়ে সমস্ত বর্ধনশীল পল্লবরা সমস্ত দিকে শাখাবিস্তার করতে এবং পাশের পল্লবদের ছাড়িয়ে যেতে ও বিনষ্ট করতে যে উপায়ে চেষ্টা করেছে, সেই একই উপায়ে প্রজাতি ও প্রজাতি গোষ্ঠীরা বিরাট জীবনসংগ্রামে সব সময় অন্য প্রজাতিদের উপর প্রাধান্যবিস্তার করেছে। বিরাট শাখায় বিভক্ত শাখাঙ্গরা এবং এদের আরও ছোট ছোট শাখাগুলি বৃক্ষটির তরুণাবস্থায় নিজেরাই তখন কুঁড়িসমেত পল্লব ছিল এবং শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হওয়ার মাধ্যমে পূর্বের ও বর্তমানের কুঁড়িদের এই সংযোগ বা সংযুক্তি সমস্ত বিলুপ্ত ও জীবন্ত প্রজাতির গোষ্ঠীদের অধীনে গোষ্ঠীগুলিতে শ্রেণীবিভাগ সূচিত করতে পারে। গুল্মবস্থায় বৃক্ষটির বহু শাখার মধ্যে এখন বিরাট শাখায় পরিণত কেবল দুটি বা তিনটি শাখা এখনও বাঁচে ও অন্য শাখা উৎপাদন করে। এভাবে প্রজাতিদের ক্ষেত্রে ভূতাত্ত্বিক যুগের অনেক কাল পর্যন্ত বেঁচে ছিল এমন অল্প কয়েকটি প্রজাতি জীবন্ত ও রূপান্তরিত বংশধর রেখে গেছে। বৃক্ষটির প্রথম বৃদ্ধির সময় থেকে অনেক শাখাঙ্গ ও শাখা বিনষ্ট হয়েছে ও খসে পড়েছে: এবং বিভিন্ন আকারের এইসব পতিত শাখারা সেই সব বর্ণ, গোত্র ও গণকে সূচিত করতে পারে যারা কোন জীবন্ত প্রতিনিধি রেখে যায়নি এবং যেগুলি কেবল জীবাশ্ম হিসেবে আমাদের নিকট পরিচিত। যেমন আমরা এখানে-সেখানে দেখি যে একটি বৃক্ষের একটি সন্ধিস্থল থেকে বের হয়ে একটি সরু ও ছড়িয়ে-পড়া শাখা ঝুলে থাকে এবং কোন না কোন ভাবে আনুকূল্যপ্রাপ্ত হয় ও তখনও এর শীর্ষে বেঁচে থাকে, সেভাবে অর্নিথোরিনচাস বা লেপিডোসাইরেনের মতো একটি প্রাণীকে মাঝেমাঝে লক্ষ্য করি, যারা আকৃতিগত বা গঠনগত সৌসাদৃশ্যের দ্বারা জীবনের দুটি বিরাট শাখাকে অল্পমাত্রায় সংযুক্ত করে এবং যারা একটি সংরক্ষিত অঞ্চলে বসবাস করে সর্বনাশা প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। যেমন কুঁড়ির বৃদ্ধির দ্বারা নূতন নূতন কুঁড়ির উদ্ভব হয় এবং সবল হলে সেগুলি চারিদিকে শাখা-বিস্তার করে ও দুর্বল শাখাকে সমস্ত দিক দিয়ে ঢেকে দেয়, আমি বিশ্বাস করি সেইভাবেই এরা বংশপরম্পরায় জীবনের একটি বিরাট বৃক্ষে পরিণত হয়, যা এর মৃত ও ভাঙা শাখাদের দ্বারা পৃথিবীর ভূত্বককে পূর্ণ করে এবং পৃথিবীর উপরিতলকে অনবরত শাখায় বিভক্ত হওয়া সুন্দর শাখাপ্রশাখা দ্বারা পরিপূর্ণ করে তোলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *