০৩. অস্তিত্বের সংগ্রাম

তৃতীয় অধ্যায় – অস্তিত্বের সংগ্রাম

প্রাকৃতিক নির্বাচনের ওপর এর প্রভাব ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত পদটি– বৃদ্ধির গুণোত্তরীয় অনুপাত–অভিযোজিত প্রাণী ও উদ্ভিদের দ্রুত বৃদ্ধি–বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের ধরন–বিশ্বজনীন প্রতিযোগিতা–জলবায়ুর প্রভাব এককগুলির সংখ্যা থেকে সংরক্ষণ–প্রাকৃতিক জগতে প্রাণী ও উদ্ভিদের জটিল সম্পর্ক–একই প্রজাতির একক এবং ভ্যারাইটিদের মধ্যে জীবনসংগ্রামের তীব্রতা–একই গণের প্রজাতিদের মধ্যে এই জীবনসংগ্রাম কঠোর–জীবের সঙ্গে জীবের সম্পর্কটি সমস্ত সম্পর্কগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

এই অধ্যায়ে বিষয়টির ওপর বিশদ আলোচনার আগে, কেমন করে অস্তিত্বের সংগ্রাম প্রাকৃতিক নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে আমার কিছু বলা উচিত। আগের অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে যে প্রাকৃতিক অবস্থায় জীবগুলির মধ্যে কিছু এককীয় বিভিন্নতা দেখা যায়: বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে কখনও কোন প্রশ্ন তোলা হয়েছিল কিনা এ ব্যাপারে সত্যিই আমার কিছু জানা নেই। অসংখ্য সন্দেহজনক আকারদের প্রজাতি বা উপজাতি বা ভ্যারাইটি বলা যাবে কিনা তা আমাদের কাছে গুরুত্বহীন। যেমন, যদি কোন সুচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের অবস্থান স্বীকার করা হয়, তবে ব্রিটিশ উদ্ভিদদের দুই বা তিনশত আকারদের কী পদ হবে? যদিও এই গবেষণার ভিত্তি হিসেবে এটি প্রয়োজনীয়, কিন্তু এককীয় বিভিন্নতার ও কিছু সুচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের কেবল অবস্থান, কেমন করে প্রকৃতিতে প্রজাতিরা উদ্ভূত হয় এ বিষয়ে আমাদের বুঝতে অল্পই সাহায্য করে। জীবদেহের একটি অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের, এবং জীবনাবস্থার ও একটি জীবের সঙ্গে অন্য জীবের এইসব সূক্ষ্ম অভিযোজন কেমন করে নিখুঁত হয়েছে? সাধারণভাবে কাঠঠোকরা পাখি ও মিল্লটো উদ্ভিদে, চতুষ্পদ প্রাণীর লোমে বা পাখির পালকে আটকে থাকা নিচুস্তরের পরজীবীতে, জলে ডুব দেওয়া বিটল পতঙ্গের দেহগঠনে, মৃদুমন্দ বাতাসে তাড়িত হওয়া পালক সম্বলিত বীজে আমরা এইসব চমৎকার অভিযোজনগুলি দেখি। এককথায়, সর্বত্র ও জীবজগতের প্রতিটি অংশেই এইসব চমৎকার অভিযোজনগুলি দেখি আমরা।

এটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে যে যাদের আমরা জায়মান প্রজাতি বলেছি এমন ভ্যারাইটিরা কেমন করে অবশেষে ভাল ও ভিন্ন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের তুলনায় স্পষ্টতঃ আরও বেশি ভিন্ন হয়? যারা স্বতন্ত্র গণ সৃষ্টি করে এবং একই গণের প্রজাতিদের তুলনায় পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয়, প্রজাতিদের সেইসব গোষ্ঠীর কেমন করে উদ্ভব হয়? অস্তিত্বের সংগ্রামের পরিণতিতেই এইসব ফলাফল, যা পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা পরিপূর্ণভাবে দেখব। অন্য জীব ও এদের ভৌতিক পরিবেশের অশেষ সম্পর্কগুলির ব্যাপারে যদি একটি প্রজাতির এককদের ক্ষেত্রে কোন মাত্রায় লাভজনক হয়, তাহলে এই সংগ্রামের জন্য যত অল্প এবং যে কারণেই হোক না কেন, পরিবৃত্তিগুলি ঐ সব এককদের সংরক্ষণ করার প্রবণতাযুক্ত হবে এবং সাধারণতঃ তা বংশধরে প্রেরিত হবে। এভাবে বংশধরটির বেঁচে থাকার ভাল সম্ভাবনা থাকবে, কারণ যে কোন প্রজাতির পর্যায়ক্রমিকভাবে জন্মানো অনেক এককের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকটিই বাঁচে। যদি উপকারী হয় তবে প্রত্যেক অল্প পরিবৃত্তি সংরক্ষিত হয়। এই পদ্ধতিটিকে আমি প্রাকৃতিক নির্বাচন নামে অভিহিত করেছি, এবং নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের শক্তির সঙ্গে এটির? সম্পর্ক চিহ্নিত করতে এই পদটি ব্যবহার করেছি। কিন্তু যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ মিঃ। হাবার্ট স্পেনসারের এই অভিব্যক্তিটি আরও সঠিক এবং কোন কোন সময় বেশি। সুবিধাজনক। আমরা দেখেছি নির্বাচনের দ্বারা মানুষ প্রভূত ফল লাভ করতে পারে এবং প্রকৃতি-প্রদত্ত অল্প অথচ উপকারী পরিবৃত্তিগুলির সঞ্চয়নের মাধ্যমে মানুষ তার নিজের ব্যবহারের জন্য জীবদের উপযোগী করে নিতে পারে। কিন্তু এর পর আমরা দেখব যে প্রাকৃতিক নির্বাচন হচ্ছে কর্মপ্রক্রিয়ার জন্য নিয়ত প্রস্তুত একটি শক্তি, এবং শিল্পকলার কাজের তুলনায় প্রকৃতির কাজকর্মের মত মানুষের ক্ষীণ প্রচেষ্টার তুলনায় এটি। তসবিমেয়ভাবে উৎকৃষ্টতর।

অস্তিত্বের সংগ্রাম বিষয়টি নিয়ে এখন আমরা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব। ভবিষ্যতে আমার গবেষণার জন্য এটি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হবে, কারণ এটি আলোচনার উপযুক্ত। অগ্রজ ডি ক্যান্ডেলে ও লিয়েল বিস্তৃতভাবে ও দর্শনগতভাবে দেখিয়েছেন যে সমস্ত জীবই কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। উদ্ভিদদের সম্পর্কে, উদ্যানসংক্রান্ত বিষয়ে বিপুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, ম্যানচেস্টারের ডিন ডব্লিউ. হার্কটের তুলনায় কেউই অধিকতর দক্ষতা ও উৎসাহের সঙ্গে বিষয়টি পর্যালোচনা করেননি। সার্বজনীন অস্তিত্বের সংগ্রামের সত্যতা ভাষায় স্বীকার করা ছাড়া কোন কিছুই সহজতর নয়, অথবা, অন্ততঃ আমি যেমন দেখি, এই সিদ্ধান্ত অনবরত স্মরণে রাখার তুলনায় কোন কিছুই আরও কষ্টকর নয়। তথাপি, বিস্তার, বিরলতা, প্রাচুর্য, বিলুপ্তি ও পরিবৃত্তি সমেত প্রত্যেকটি বিষয়ে সমগ্র প্রাকৃতিক জগৎকে অস্পষ্টভাবে দেখা হবে অথবা ভুল বোঝা হবে, যতক্ষণ না এটি মনের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে প্রোথিত হচ্ছে। প্রকৃতির উজ্জ্বল মুখমণ্ডল আমরা আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করি, যাদের অতিপ্রাচুর্য প্রায়শই আমরা লক্ষ্য। করি; আমরা লক্ষ্য করি বা ভুলে যাই যে আমাদের চারিদিকে অনাবশ্যকভাবে গান করে বেড়ানো পাখিদের অধিকাংশই কীটপতঙ্গ অথবা বীজ খেয়ে বেঁচে থাকে এবং এভাবে প্রতিনিয়ত জীবন ধ্বংস করছে তারা; অথবা আমরা ভুলে যাই কেমন করে এইসব গায়ক পাখি, এদের ডিম ও বাসাগুলি পাখি ও শিকারী পশুদের দ্বারা বহুলাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যদি খাদ্য এখন অতি সুলভ হয়, প্রতি বৎসর প্রতি ঋতুতে এরূপ হয় না এটি আমরা সর্বদা মনে রাখি না।

অস্তিত্বের সংগ্রাম পদটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত

আমার গোড়ায় উল্লেখ করা উচিত যে একটির ওপর অন্যটির নির্ভরশীলতা এবং শুধু এককটির জীবন নয় বরং বংশধর উৎপাদনে সক্ষম এই দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপক ও আলংকারিক অর্থে এই পদটি ব্যবহার করেছি আমি। সঠিকভাবে বলা যেতে পারে যে অভাবের সময় দুটি কুকুরসদৃশ প্রাণী খাদ্য ও বাঁচার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে। মরুভূমির প্রান্তে একটি উদ্ভিদ খরার বিরুদ্ধে বাঁচার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে বলা হয়, কিন্তু সঠিকভাবে বললে বলা উচিত যে এরা আর্দ্রতার উপর নির্ভরশীল। একটি উদ্ভিদ প্রতি বছর হাজার হাজার বীজ উৎপাদন করে, এদের মধ্যে গড়ে কেবলমাত্র একটিই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। আরও সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে যে এরা একই ধরনের ও অন্য ধরনের উদ্ভিদদের সঙ্গে সংগ্রাম করে, যারা ইতিমধ্যে জমিকে পূর্ণ করে রেখেছে। মিটো উদ্ভিদ আপেল ও অন্য অল্প কয়েকটি গাছের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু কষ্টকল্পিতভাবে বলা যেতে পারে যে এরা এইসব বৃক্ষের সঙ্গে সংগ্রাম। করে। আসল কারণ হচ্ছে এইসব পরজীবীরা যদি অসংখ্যভাবে একই বৃক্ষের সঙ্গে সংগ্রাম করে। আসল কারণ হচ্ছে এইসব পরজীবীরা যদি অসংখ্যভাবে একই বৃক্ষের ওপর জন্মায়, তবে এরা নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। কিন্তু আরও সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে যে একই শাখায় কাছাকাছি একত্রে জন্মানো কয়েকটি চারা মিটো উদ্ভিদ পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে। যেহেতু পাখিরা মিটো উদ্ভিদের বীজ ইতস্ততঃ ছড়িয়ে দেয়, সেহেতু এর অস্তিত্ব পাখিদের ওপর নির্ভর করে। এবং নিয়মানুসারে বলা যেতে পারে যে এরা অন্য ফল-উৎপাদক উদ্ভিদের সঙ্গে সংগ্রাম করে, ফল গিলে খাওয়ার জন্য পাখিদের প্রলোভিত করে এবং এভাবে এরা ইতস্ততঃ ছড়িয়ে পড়ে। পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এই রকম কয়েকটি অর্থে সুবিধার জন্য অস্তিত্বের সংগ্রামের সাধারণ পদটি ব্যবহার করেছি আমি।

বৃদ্ধির গুণোত্তরীয় অনুপাত

সমস্ত জীবনের উচ্চ হারে বৃদ্ধির প্রবণতা থেকেই অস্তিত্বের সংগ্রাম গড়ে ওঠে। নিজেদের সাধারণ জীবৎকালে কয়েকটি ডিম বীজ উৎপাদন করে এমন প্রত্যেকটি জীব তার জীবনের কোন পর্যায়ে ও কোন ঋতুতে অথবা আকস্মিক কোন বছরে নিশ্চয় ধ্বংসের সম্মুখীন হয়, পক্ষান্তরে গুণোত্তরীয় বৃদ্ধির নিয়মানুসারে এদের সংখ্যা শীঘ্রই এত অত্যধিক বৃদ্ধি পাবে যে কোন দেশ উৎপাদনগুলিকে প্রতিপালন করতে পারবে না। অতএব যেহেতু বেঁচে থাকার তুলনায় আরও অনেক বেশি এককদের জন্ম হয়, সেহেতু হয় একই প্রজাতির একটি এককের সঙ্গে অন্যটির, না হয় ভিন্ন প্রজাতির এককদের সঙ্গে, অথবা জীবনের ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিশ্চয় বাঁচার সংগ্রাম চলবে। এটাই হচ্ছে ম্যালথাসের তত্ত্ব যা সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতে প্রচণ্ড জোরের সঙ্গে প্রয়োগ করা হয়, কারণ এক্ষেত্রে খাদ্যের কোন কৃত্রিম বৃদ্ধি হতে পারে না এবং কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি বিবাহ করা থেকে নিবৃত্ত হতে পারে না। যদিও এখন কয়েকটি প্রজাতি কিছুটা দ্রুতহারে সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সকলে এরূপ করতে পারে না, কারণ পৃথিবী এদের ধারণ করতে পারবে না।

নিয়মটির কোন ব্যতিক্রম নেই যে প্রত্যেক জীব স্বাভাবিকভাবে এত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায় যে যদি না তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে পৃথিবী এক জোড়া বংশধর দ্বারা শীঘ্রই পূর্ণ হবে। এমনকি মন্থরভাবে প্রজননক্ষম মানুষ পঁচিশ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, এবং এক হাজার বছরের কম সময়ের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে এই হারে এদের বংশধরদের দাঁড়াবার কোন জায়গা থাকবে না। লিনিয়াস গণনা করেছেন যে একটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ যদি কেবলমাত্র দুটি বীজ উৎপাদন করে–এভাবে এত অনুর্বর উদ্ভিদ যদি না থাকে–এবং যদি এদের চারাগাছগুলি পরের বছর দুটি উৎপাদন করে এবং যদি এইভাবে চলে, তবে কুড়ি বছরে দশ লক্ষ উদ্ভিদ জন্মাবে। সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে হাতি হচ্ছে সবচেয়ে কম প্রজননক্ষম, এবং এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সম্ভবপর সর্বনিম্ন হার আমি কষ্ট করে হিসেব করেছি। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে হাতিরা ত্রিশ বছরের হলে সন্তান উৎপাদনক্ষম হয় এবং নব্বই বছর পন্ত বেঁচে থাকে। যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে : ৭৪০ থেকে ৭৫০ বছরপরে প্রায় এক শত নব্বই লক্ষ হাতি বেঁচে থাকবে, যারা প্রথম। জোড়ার বংশধর।

কিন্তু গেবল তত্ত্বগত গণনার তুলনায় এ বিষয়ে আমাদের কাছে ভাল সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। যেমন, পরপর দুই বা তিনটি ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূল হয়, তখন প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন প্রাণীদের আশ্চর্যজনকভাবে দ্রুত বৃদ্ধির অসংখ্য নথিভুক্ত ঘটনা রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া অনেক ধরনের গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে অধিকতর চিত্তাকর্ষক সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকায় এবং পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় মন্থর প্রজননক্ষম গোমহিষাদি ও ঘোড়াদের বৃদ্ধির হারের বক্তব্যগুলি সত্য বলে যদি প্রমাণিত না হয়, তবে এটি অবিশ্বাস্য হবে। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এমন হয়। প্রবর্তিত উদ্ভিদের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যারা সমগ্র দ্বীপের সর্বত্র দশ বছরের কম সময়ের মধ্যে সহজলভ্য হয়েছে। উদ্ভিদদের মধ্যে কয়েকটি, যেমন কার্টুন ও লম্বা থিসল, ইউরোপ থেকে লা-প্লাটায় প্রবর্তিত হয়েছিল, যারা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ এখন সেখানে সহজলভ্য হয়েছে এবং অন্য প্রত্যেক উদ্ভিদকে বিতাড়িত করে কয়েক বর্গমাইল এলাকা দখল করেছে। ডঃ ফ্যালকনারের কাছ থেকে আমি শুনেছি আমেরিকা থেকে আমদানীকৃত কিছু উদ্ভিদ ভারতের কন্যাকুমারী থেকে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কেউ মনে করে না যে প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রজননক্ষমতা যুক্তিগ্রাহ্য পরিমাণে হঠাৎ এবং সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হচ্ছে-জীবন-পরিবেশ অতিশয় অনুকূল হয়েছে এবং ফলে নবীন ও প্রবীণদের কম বিনাশ হয়েছে এবং প্রায় সকল নবীনরা সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। নূতন বাসস্থানে অস্বাভাবিক দ্রুত বৃদ্ধি ও ব্যাপকভাবে ব্যাপ্তির বিষয়টি এদের গুণোত্তরীয় হার থেকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যার ফলাফল কখনও ব্যর্থ হয় না।

প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রায় প্রত্যেক পরিণত উদ্ভিদ বছরে একবার বীজ উৎপাদন করে, এবং প্রাণীদের মধ্যে অতি অল্প কয়েকটি বছরে একবার সন্তান উৎপাদন করে না। অতএব আমরা নিশ্চিতভাবে দাবী করতে পারি, যে সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীরা গুণোত্তরীয় অনুপাতে বৃদ্ধির দিকে প্রবণতাযুক্ত হচ্ছে–যে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন সেই অঞ্চলটিকে পূর্ণ করতে চেষ্টা করবে–যে জীবনের যে কোন সময়ে বিনাশের দ্বারা বৃদ্ধির এই গুণোত্তরীয় প্রবণতা নিশ্চয় নিয়ন্ত্রিত হবে। আমার মনে হয় গৃহপালিত প্রাণীদের সঙ্গে পরিচিতি আমাদের বিপথে পরিচালিত করতে উদ্যত হয়: এদের ব্যাপকভাবে বিনাশ আমরা লক্ষ্য করি না, অন্যদিকে এ-ও লক্ষ্য করি না যে খাদ্যের জন্য প্রতি বছর হাজারে-হাজারে এদের হত্যা করা হয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশেও সমসংখ্যক প্রাণী কোন না কোন প্রকারে শেষ হয়ে থাকে।

বছরে একবার হাজারে-হাজারে এবং অতি অল্প বীজ বা ডিম উৎপাদনকারী জীবদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্যটি হচ্ছে অনুকূল পরিবেশে, যত বড়ই হোক না কেন, একটি জেলাকে পরিপূর্ণ করতে ধীরগতিতে বংশবৃদ্ধিকারীদের আরও কয়েক বছরের প্রয়োজন হবে। দক্ষিণ আমেরিকার বিশালাকায় শকুনরা কয়েক জোড়া ডিম পাড়ে ও উটপাখি এককুড়ি ডিম পাড়ে, তা সত্ত্বেও একই দেশে দুটির মধ্যে প্রথমোক্তটির সংখ্যা আরও বেশি হয়, ফুলমার পেট্রেল পাখিটি মাত্র একটি ডিম পাড়ে, তথাপি এটিকে পৃথিবীতে সবচেয়ে সংখ্যাবহুল পাখি বলে বলা হয়। একটি মক্ষিকা কয়েকশত ডিম পাড়ে, হিপ্নেবস্কার মত অন্য একটি কেবলমাত্র একটি ডিম পাড়ে; কিন্তু দুটি প্রজাতির কতগুলি একক এক জেলায় থাকতে পারবে, এই পার্থক্যটি তা নির্ধারণ করে না। অনিশ্চিত পরিমাণ খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হয় বলে এইসব প্রজাতিদের অত্যধিক সংখ্যক ডিমের এত প্রয়োজন, কারণ এটি এদের দ্রুতহারে বৃদ্ধি ঘটায়। কিন্তু জীবনের কোন পর্যায়ে অত্যধিক বিনাশের ক্ষতিপূরণের জন্য অসংখ্য ডিম ও বীজের প্রকৃতই প্রয়োজন; এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি হয় জীবনের প্রাথমিক বয়সে। কোন প্রাণী যদি তার নিজের ডিম ও বাচ্চাদের রক্ষা করতে পারে, তাহলে অল্প সংখ্যায় এরা উৎপন্ন হতে পারে, এবং তা সত্ত্বেও গড় কুল সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ থাকবে। কিন্তু যদি বহু ডিম বা বাচ্চাগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে নিশ্চয় অসংখ্য উৎপন্ন হবে বা প্রজাতিটি বিলুপ্ত হবে। গড়ে এক হাজার বছর বাঁচে এমন একটি বৃক্ষের পূর্ণসংখ্যা বজায় রাখার পক্ষে এটি যথেষ্ট হবে যদি এক হাজার বছরে কেবল একটি বীজ উৎপন্ন হত এবং এটি কখনও নষ্ট না হত ও উপযুক্ত স্থানে অঙ্কুরিত হত। অতএব, এইসব ক্ষেত্রে ডিম ও বীজগুলির গড় সংখ্যার ওপর যে কোন প্রাণী ও উদ্ভিদের গড় সংখ্যা নির্ভর করে।

প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য করার সময় আগেকার আলোচনাগুলি মনে রাখা প্রয়োজন কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে প্রত্যেক জীব তার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রচণ্ড চেষ্টা করে বলে বলা হয়, প্রত্যেকে জীবনের কোন পর্যায়ে সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকে, এবং হয় শৈশবে নয়তো পরিণত অবস্থায় প্রত্যেক বংশে বা মধ্যবর্তী যে কোন সময়ে ব্যাপক বিনাশ অনিবার্যরূপে ঘটে। প্রতিবন্ধকগুলিকে লঘুতর করলে, যত অল্পই হোক ধ্বংসের তীব্রতা হ্রাস করলে, প্রজাতির সংখ্যা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যে কোন পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।

বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের ধরণ

প্রত্যেক প্রজাতির বৃদ্ধির সাধারণ প্রবণতা দমনের কারণগুলি খুবই অস্পষ্ট। সবচেয়ে সবল প্রজাতিদের দিকে লক্ষ্য করুন, এরা সংখ্যায় যতই বৃদ্ধি পায়, ততধিক বৃদ্ধি পেতে প্রবণ হয়ে ওঠে। এমন কি একটি মাত্র উদাহরণে নিয়ন্ত্রণগুলি কী কী তা সঠিকভাবে আমরা জানি না। অথবা এটি কাউকেই আশ্চর্যান্বিত করবে না যিনি স্মরণ করেন এ বষয়ে আমরা কত অজ্ঞ, এমন কি মানুষ জাতি সম্পর্কেও, যদিও তুলনামূলকভাবে অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় বেশি পরিচিত। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সম্পর্কে দক্ষতার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এবং আমি আশা করি ভবিষ্যতের গবেষণায় এটি সুদীর্ঘভাবে আলোচনা করবো, আরও বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার বন্য প্রাণীদের সম্পর্কে। কয়েকটি প্রধান বিষয় পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এখানে আমি কয়েকটা কথা বলব। ডিম অথবা অতিশয় শিশু প্রাণীরাই সম্ভবতঃ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু এটি অপরিহার্য নয়। উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে বীজগুলি অতিমাত্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু আমার কয়েকটি পর্যবেক্ষণ থেকে মনে হয় অন্যান্য উদ্ভিদ দ্বারা পরিপূর্ণ ভূমিতে অঙ্কুরোদগমের সময় চারাগাছগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন শত্রুদের আক্রমণে চারাগাছগুলি অধিক সংখ্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তিন ফুট লম্বা ও দু ফুট চওড়া একটি জায়গার মাটি খনন ও পরিষ্কার করার পর এবং যেখানে অন্য উদ্ভিদদের জন্মাতে দেওয়া হয়নি সেখানে জন্মানোর পর আমাদের দেশের দেশীয় আগাছাদের চারাগাছগুলিকে চিহ্নিত করেছিলাম আমি, এবং লক্ষ্য করেছিলাম ৩৫৭টির মধ্যে কম করেও ২৯৫টি চারাগাছ প্রধানতঃ স্থলচর শামুক ও অন্যান্য পতঙ্গদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। ঘাসগুলি কেটে দেওয়া হলে বা কোন চতুষ্পদ প্রাণীর দ্বারা খাওয়ালেও এমন ঘাসের চাপড়া যদি বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে অধিক সকল উদ্ভিদরা পূর্ণবয়স্ক উদ্ভিদ হলেও কম সকল উদ্ভিদদের ক্রমশঃ হত্যা করে; এভাবে কাটা ঘাস চাপড়ার ছোট প্লটে (তিন ফুট x চার ফুট) জন্মানো কুড়িটি প্রজাতির মধ্যে নয়টি প্রজাতি ধ্বংস হয়েছিল এবং অন্য প্রজাতিদের স্বাধীনভাবে বাড়তে দেওয়া হয়েছিল।

খাদ্যের পরিমাণ নিশ্চয়ই প্রত্যেক প্রজাতির বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা নির্ধারণ করে দেয় যার মধ্যে তারা বৃদ্ধি পেতে পারে; কিন্তু এটি প্রায়শই খাদ্য প্রাপ্তির জন্য হয় না, বরং অন্য প্রাণীদের শিকারের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেটি আবার একটি প্রজাতির গড় সংখ্যা নির্ধারণ করে। সন্দেহ করার অবকাশ নেই যে, যে কোন বড় এস্টেটে তিতির ও গ্রাউস পাখি এবং শশকদের কুল মূলত কীটমূষিকাদির ধ্বংসের উপর নির্ভর করে। পরবর্তী কুড়ি বছরে ইংল্যান্ডে যদি একটিও প্রাণীকে হত্যা করা না হয় এবং এই সময়ে যদি কোন। পোকামাকড় ধ্বংস না হয়, তাহলে বর্তমানের তুলনায় খুব সম্ভবতঃ শিকারযোগ্য প্রাণী কম থাকবে, যদিও এখন শত সহস্র শিকারি পশুরা হাতিকে ধ্বংস করতে পারে না, কারণ এমনকি ভারতবর্ষেও বাঘেরা বাচ্চা হাতিদের আক্রমণ করার সাহস দেখায় এমন ঘটনা প্রায় বিরল।

কোন প্রজাতির গড় সংখ্যা নির্ধারণ করতে জলবায়ু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং ভয়ানক ঠাণ্ডা ও খরার পর্যায়ক্রমিক ঋতুপরিবর্তন সম্ভবতঃ সমস্ত নিয়ন্ত্রকগুলির মধ্যে সবচেয়ে ফলপ্রদ। আমি হিসেব করেছিলাম (বসন্তকালে মূলতঃ পাখির বাসার ক্রমহ্রাসমান সংখ্যা থেকে) যে ১৮৫৪-৫৫ সালের শীতকাল আমার, নিজের জমির পাখিদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশকে ধ্বংস করেছে; এবং এই ধ্বংসকার্য ভয়ানক, যখন আমরা স্মরণ করি যে মানুষের ক্ষেত্রে মহামারী হলে দশ শতাংশ মৃত্যুই ভয়ানক। জলবায়ুর প্রক্রিয়াকে প্রথম দর্শনে অস্তিত্বের সংগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বলে মনে হয়। কিন্তু জলবায়ুর প্রক্রিয়া যতখানি খাদ্য উৎপাদন হ্রাস করে, তখন একই সময়ে যারা একই ধরনের খাদ্যে জীবনধারণ করে, একই বা ভিন্ন প্রজাতির এককদের কঠোর সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করে এই প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, এমন কি যখন জলবায়ু অত্যধিক ঠাণ্ডা হয় তখন যদি এটি প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হয়, তাহলে কম সবল অথবা শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে যারা কম পরিমাণ খাদ্য খায় এমন এককরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যখন দক্ষিণ থেকে উত্তরে বা আর্দ্র থেকে শুষ্ক অঞ্চলে ভ্রমণ করি, তখন কিছু প্রজাতি ক্রমশঃ বিরল থেকে বিরলতর এবং অবশেষে অদৃশ্য হয় এটা আমরা অনিবার্যরূপে লক্ষ্য করি; এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন এত স্পষ্ট যে সমগ্র ফলাফলটিকে তারই প্রত্যক্ষ কাজ বলে চিহ্নিত করতে প্রলোভিত হই আমরা। কিন্তু এটি ঠিক নয়। আমরা ভুলে যাই যে প্রত্যেক প্রজাতি, এমনকি অতি সুলভ প্রজাতিও একই খাদ্য ও স্থানের জন্য শত্রু ও প্রতিযোগীদের দ্বারা জীবনের যে কোন পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে; আবহাওয়ার কোন অল্প পরিবর্তনের জন্য এই শত্রু ও। প্রতিযোগীরা যদি সামান্য মাত্রায় প্রভাবিত হয়, তাহলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে; এবং যেহেতু প্রত্যেক অঞ্চল ইতিমধ্যে অধিবাসীদের দ্বারা পরিপূর্ণ, সেহেতু অন্য প্রজাতিরা নিশ্চয় হ্রাস পাবে। আমরা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলে লক্ষ্য করি একটি প্রজাতি সংখ্যায়। ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে; আমরা নিশ্চয় অনুভব করতে পারি এর মূল কারণটি হচ্ছে সেই প্রজাতিরা আনুকূল্য পায়, যেমন এক্ষেত্রে অন্য একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাপারটা একইরূপ হয় যখন আমরা উত্তর দিকে অগ্রসর হই, কিন্তু কিছুটা কম মাত্রায়, কারণ সমস্ত ধরনের প্রজাতিদের সংখ্যা এবং প্রতিযোগীদের সংখ্যাও উত্তর দিকে হ্রাস পায়, অতএব উত্তরদিকে অগ্রসর হওয়া বা পর্বতে ওঠার সময় জলবায়ুর প্রত্যক্ষ ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার জন্য আমরা প্রায়শই খর্বাকৃতি আকারের সাক্ষাৎ পাই, যেটা আমরা দক্ষিণদিকে যাওয়া বা পর্বত থেকে নামার সময় দেখি না। আমরা যখন মেরুঅঞ্চলে বা বরফাচ্ছাদিত পর্বতশীর্ষে কিংবা প্রকৃত মরুভূমিতে যাই, তখন দেখি কেবল উপাদানগুলির সঙ্গে প্রায়শই অস্তিত্বের সংগ্রাম ঘটছে।

অন্য প্রজাতিদের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করে জলবায়ু যে অপ্রত্যক্ষভাবে কাজ করে, তা আমরা বাগানের অসংখ্য উদ্ভিদের ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে দেখি। আমাদের বাগানের উদ্ভিদরা আমাদের জলবায়ুকে দক্ষতার সঙ্গে সহ্য করতে পারে, কিন্তু এরা কখনও পরিবেশানুগ (ন্যাচারালাইজ) হয় না, কারণ এরা আমাদের দেশজ উদ্ভিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না বা আমাদের দেশীয় প্রাণীদের দ্বারা বিনাশপ্রাপ্ত হওয়াকে প্রতিরোধ করতে পারে না।

অতিশয় অনুকূল পরিবেশের জন্য যখন একটি প্রজাতি একটি ছোট এলাকায় অবাধে, সংখ্যাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়, তখন মহামারী দেখা দেয়–অন্ততঃ শিকারি প্রাণীদের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে দেখা যায়; এবং এখানে অস্তিত্বের সংগ্রাম নিরপেক্ষ সীমিত নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু তথাপি এই তথাকথিত মহামারী পরজীবী কৃমির জন্য হয় বলে মনে হয়, যেখানে সম্ভবতঃ অংশত দলবদ্ধ প্রাণীদের মধ্যে ব্যাপ্তির সুবিধা থেকে কিছু কারণের জন্য সামঞ্জস্যহীনভাবে আনুকূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে: এবং পরজীবী ও তার শিকারির মধ্যে কিছু পরিমাণ সংগ্রাম এখানে পরিলক্ষিত হয়।

পক্ষান্তরে, অনেক ক্ষেত্রে সংরক্ষণের জন্য শত্রুদের সংখ্যার আপেক্ষিক অনুপাতে একই প্রজাতির এককদের বিরাট সংখ্যা প্রয়োজন হয়। এইরূপে আমরা আমাদের জমিতে অনায়াসে প্রচুর শস্য ও রেপসিড ইত্যাদি উৎপাদন করতে পারি, কারণ পাখিদের সংখ্যার তুলনায় পাখিদের খাদ্যবীজের পরিমাণ অনেক বেশি; অথবা এক ঋতুতে অত্যধিক পরিমাণ খাদ্যের যোগান থাকা সত্ত্বেও বীজ সরবরাহের অনুপাতে পাখিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে না, কারণ এদের সংখ্যা শীতকালে নিয়ন্ত্রিত হয়; কিন্তু যিনি এ ব্যাপারে চেষ্টা করেছেন তিনি জানেন যে একটি বাগানে কিছু গম ও এরূপ অন্য গাছ থেকে বীজ পাওয়া কতখানি কষ্টসাধ্য কাজ : এক্ষেত্রে আমি প্রত্যেক বীজ নষ্ট করেছি। সংরক্ষণের জন্য একই প্রজাতির এককদের বিরাট সংখ্যার প্রয়োজনীয়তার এই ধারণাটি প্রকৃতির কিছু অদ্ভুত বিষয়কে ব্যাখ্যা করে, যেমন কিছু জায়গায় অবস্থিত অতি বিরল উদ্ভিদ কোন কোন সময় সংখ্যায় প্রচুর হয় এবং কয়েকটি সামাজিক উদ্ভিদ এমন কি তাদের বিস্তারের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সামাজিক থাকে অর্থাৎ এককগুলি সংখ্যায় প্রচুর হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে একটি উদ্ভিদ কেবল সেখানেই অবস্থান করতে পারে যেখানে জীবনধারণের উপাদানসমূহ এত অনুকূল যে অনেক সংখ্যায় একত্রে অবস্থান করতে পারে এবং এভাবে প্রজাতিটিকে চরম বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এখানে আমার আরও বলা উচিত যে আন্তঃসঙ্করণের ভাল ফল ও নিকট আন্তঃপ্রজননের খারাপ ফল নিঃসন্দেহে এ-সবের অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এখানে আমি বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করছি না।

অস্তিত্বের সংগ্রামে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের পরস্পরের মধ্যে জটিল সম্পর্ক

এমন অনেক ঘটনা নথিভুক্ত আছে যা থেকে দেখা যায় যে একই দেশের একত্রে সংগ্রামরত জীবদের মধ্যে সম্পর্ক ও নিয়ন্ত্রণগুলি কত জটিল ও অপ্রত্যাশিত। আমি একটিমাত্র সরল উদাহরণ দেব যা আমাকে উৎসাহিত করেছে। স্ট্যাফোর্ডশায়ারে আমার এক আত্মীয়ের একটা এস্টেটে একটি বিরাট ও অতিশয় উষর প্রান্তর ছিল, যেখানে কখনও মানুষের স্পর্শ লাগেনি এবং যেখানে আমার পর্যবেক্ষণের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। কিন্তু পঁচিশ বছর আগে একই ধরনের কয়েকশ একর জমিকে বেড়া দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে স্কচ ফার গাছ লাগানো হয়েছিল। উষর প্রান্তরের গাছ লাগানো অংশের স্থানীয় গাছপালার পরিবর্তনটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, সম্পূর্ণ ভিন্ন জমি থেকে অন্য জমি অতিক্রম করার সময় এটি সাধারণতঃ বেশি পরিলক্ষিত হত। উষর প্রান্তরের উদ্ভিদের আনুপাতিক সংখ্যা শুধুমাত্র সামগ্রিকভাবে পরিবর্তিত হয় নি, বরং উদ্ভিদের বারটি প্রজাতি (ঘাস ও ক্যারিসদের গণনা করা হয়নি) বাগিচায় প্রচুর পরিমাণে জন্মেছিল, যেগুলি আবার উষর প্রান্তরে দেখা যায়নি। কীটপতঙ্গের ওপর প্রভাব তখনও বেশি হয়ে থাকবে, কারণ বাগিচাগুলিতে ছয়টি কীটপতঙ্গভোজী পাখি সচরাচর দেখা যেত, যেগুলি উষর প্রান্তরে দেখা যায়নি; এবং উষর প্রান্তরে দুই বা তিনটি ভিন্ন কীটভোজী পাখি প্রায়শই আসত। অতএব আমরা লক্ষ্য করি একটিমাত্র বৃক্ষের প্রবর্তন কত শক্তিশালী; গবাদি পশুরা যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য জমিটা ঘিরে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছুই করা হয়নি। আমি সারের ফার্নহ্যামের নিকটে স্পষ্ট লক্ষ্য করেছিলাম বেড়া দেওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দূরবর্তী পাহাড়শীর্ষে স্কচ ফার গাছের কয়েকটি ঝাড় সমেত বিস্তৃত উষর প্রান্তর রয়েছে: গত দশ বছরের মধ্যে বিরাট অঞ্চল ঘিরে দেওয়া হয়েছে এবং এখন ফার গাছগুলি আপনা থেকেই এত নিকটে একত্রে অসংখ্যভাবে জন্মাচ্ছে যে এরা সকলে বাঁচতে পারে না। যখন আমি নিশ্চিত হই যে এই নূতন গাছগুলি লাগানো বা বসানো হয়নি, তখন এদের সংখ্যা দেখে আশ্চর্যান্বিত হই, কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখতে বাধ্য হই, এবং না-ঘেরা প্রান্তরের কয়েক শত একর জমি পরীক্ষা করি এবং সত্যি সত্যি পুরানো বসানো ঝাড় ছাড়া একটিও স্কচ ফার গাছ দেখিনি। কিন্তু ঐ প্রান্তরের গাছগুলির কাণ্ড ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর আমি অসংখ্য চারা এবং ছোট গাছ দেখি যেগুলিকে গবাদি পশুরা ঘন ঘন খেয়েছে। পুরানো ঝাড়গুলির একটির থেকে শত গজ দূরে অবস্থিত এক বর্গগজের মধ্যে বত্রিশটি ছোট গাছ গণনা করেছিলাম আমি। এদের মধ্যে ছাব্বিশটি বলয় সমেত একটি গাছ অনেক বছর ধরে উষর প্রান্তরের কাণ্ডদের চেয়ে মাথা তুলতে পেরেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল। এটি মোটেই আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে, যে মুহূর্তে জমিটি ঘিরে দেওয়া হয়েছিল, তখন থেকেই এটি দ্রুত বৃদ্ধিশীল শিশু গাছগুলি দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। তথাপি প্রান্তরটি এতই অনুর্বর ও বিস্তৃত ছিল যে কেউ কখনও কল্পনাও করবে না যে এখানে গবাদি পশুরা নিবিড় ও সার্থকভাবে খাদ্যের সন্ধান করে থাকবে।

এখানে আমরা লক্ষ্য করি যে গবাদি পশুরা স্কচ ফার গাছের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে নির্ধারণ করে; কিন্তু পৃথিবীর কয়েকটি অঞ্চলে কীটপতঙ্গরা গবাদি পশুর অস্তিত্ব নির্ধারণ করে। সম্ভবতঃ প্যারাগুয়েই এ বিষয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত উদাহরণ, কারণ এখানে গবাদি পশু কিংবা ঘোড়া অথবা কুকুররা যথেচ্ছভাবে বেড়ে ওঠে না, যদিও এরা দলবদ্ধভাবে দক্ষিণ ও উত্তরদিকে চলাফেরা করে; এবং আজারা ও রেংগার দেখিয়েছেন যে প্যারাগুয়েতে বিপুল সংখ্যক কোন এক মাছিদের জন্যই এটি ঘটেছে, এই মাছিরা এইসব প্রাণীদের নাভিতে ডিম পাড়ে যখন এই প্রাণীরা প্রথম জন্মায়। এই মাছিদের অসংখ্য বৃদ্ধি কোন উপায় দ্বারা, সম্ভবতঃ অন্য কোন কীটপতঙ্গ দ্বারা, নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। অতএব প্যারাগুয়েতে কোন পতঙ্গভোজী পাখিদের সংখ্যা যদি কমে যায়, তখন পরজীবী কীটপতঙ্গদের সংখ্যা সম্ভবতঃ বৃদ্ধি পাবে; এবং এটি গবাদি পশুর নাভিতে ঘন ঘন আগমনকারী কীটপতঙ্গদের সংখ্যা কমাবে এবং তখন গবাদি পশু ও ঘোড়ারা অপোষ্য হবে এবং এটি নিশ্চয়ই বনানীর বিপুল পরিবর্তন ঘটাবে (প্রকৃতপক্ষে যেমনটা আমি দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি অঞ্চলে দেখেছি)। এটি পুনরায় ব্যাপকভাবে পতঙ্গদের ওপর প্রভাব ফেলবে; এবং স্ট্যাফোর্ডশায়ারের পতঙ্গভুক পাখিদের ক্ষেত্রে যেমন আমরা আগেই দেখেছি, এবং এভাবে জটিলতার ক্রমবর্ধমান চক্র চলতে থাকবে। এটি এই নয় যে প্রকৃতিতে এই সম্পর্কগুলি কখনও এইভাবে এত সরল হবে। ভিন্ন ভিন্ন সফলতার সঙ্গে সংগ্রামের পর সংগ্রাম অনবরত চলতেই থাকবে। এবং তথাপি পরিমাণে শক্তিগুলি এত সুন্দরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় যে প্রকৃতির রূপটি দীর্ঘ সময় ধরে একই থাকে, যদিও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তুচ্ছ সংগ্রাম একটি জীবের ওপর অন্য জীবের বিজয় এনে দেবে। তা সত্ত্বেও আমাদের অজ্ঞতা এত গভীর ও আমাদের অনুমান এত প্রবল যে কোন জীবের অবলুপ্তির কথা শুনলে আমরা বিস্মিত হই এবং আমরা কারণটি লক্ষ্য করি না বলে পৃথিবীকে নির্জন করার জন্য বিধ্বংসী প্লাবনের প্রার্থনা করি অথবা জীবনাকারগুলির স্থায়িত্বের নিয়ম আবিষ্কার করি।

আর একটি উদাহরণ দেওয়ার জন্য আমি প্রলুব্ধ হচ্ছি, যা দেখায় প্রকৃতির মানদণ্ডে যথেষ্ট ব্যবধানবিশিষ্ট উদ্ভিদ ও প্রাণীরা জটিল সম্পর্কের জালে কেমন করে আবদ্ধ থাকে। এর পর আমি দেখানোর সুযোগ পাব যে কীটপতঙ্গরা কখনই আমার বাগানে আসে না যেখানে লোবিয়েলা ফুজেস গাছ আছে, এবং ফলস্বরূপ এর অদ্ভুত গঠন থাকা সত্ত্বেও কখনও এর বীজ হয় না। এদের পরাগপুঞ্জ অপসারণের জন্য আমাদের প্রায় সমস্ত অর্কিড জাতীয় উদ্ভিদগুলিতে কীটপতঙ্গের পরিদর্শন একান্ত দরকার এবং এর ফলে এরা নিষিক্ত হয়। পরীক্ষার মাধ্যমে আমি আবিষ্কার করেছি যে হার্টসিজ উদ্ভিদদের (ভায়োলা ট্রাইকালার) নিষিক্তকরণের জন্য ভ্রমর-মৌমাছিদের একান্ত প্রয়োজন, কারণ অন্য মৌমাছিরা এই ফুল পরিদর্শন করে না। আমি আরও লক্ষ করেছি যে কোন কোন ক্লোভার উদ্ভিদ নিষিক্তকরণের জন্য মৌমাছিদের আসা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ডাচ ক্লোভারের (ট্রাইফোলিয়াম রিপেন্স) ২০টি পুষ্পমঞ্জরী ২২৯০টি বীজ উৎপাদন করেছিল, কিন্তু মৌমাছিদের থেকে সংরক্ষিত অন্য ২০টি পুষ্পমঞ্জরী একটিও বীজ উৎপাদন করেনি। তা ছাড়া লাল ক্লোভারের (ট্রাইফোলিয়াম প্যাটেন্স) ১০০টি পুষ্পমঞ্জরী ২৭০০টি বীজ উৎপাদন করেছিল, কিন্তু সমসংখ্যক সংরক্ষিত পুষ্পমঞ্জরী একটিও বীজ উৎপাদন করেনি। কেবল ভ্রমর-মৌমাছিরাই লাল ক্লোভার উদ্ভিদে আসে, কারণ অন্য মৌমাছিরা এর মধু সংগ্রহ করতে পারে না। মনে করা হয় যে মথ পতঙ্গরা ক্লোভার ফুলগুলিকে নিষিক্ত করতে পারে; কিন্তু লাল ক্লোভারের ক্ষেত্রে এরা এইরূপ করতে পারে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে, কারণ এদের ভর যথেষ্ট নয় যা ফুলের পক্ষযুক্ত পাপড়িগুলিকে চাপ দিয়ে নত করতে পারে। অতএব যতদূর সম্ভব আমরা। সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে যদি ভ্রমর-মৌমাছির সমগ্র গণটি ইংল্যান্ডে অবলুপ্ত বা অতিশয় বিরল হয়, তাহলে হার্টসিজ ও লাল ক্লোভার উদ্ভিদরা অতিশয় বিরল ও সামগ্রিকভাবে অদৃশ্য হবে। যে কোন জেলায় ভ্রমর-মৌমাছির সংখ্যা মেঠো ইঁদুরের। সংখ্যার উপর দারুণভাবে নির্ভর করে, কারণ এরা এই মৌমাছিদের জাল ও বাসা নষ্ট করে ফেলে, এবং “সমগ্র ইংল্যান্ডে এদের দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক এভাবে ধ্বংস হয়েছে”-এই অভিমত ব্যক্ত করেন কর্ণেল নিউম্যান, যিনি ভ্রমর-মৌমাছিদের স্বভাব সম্বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করেছেন। প্রায় সকলেই জানে যে বিড়ালদের সংখ্যার উপর ইঁদুরের সংখ্যা বহুলাংশে নর্ভর করে; এবং কর্ণেল নিউম্যান অভিমত ব্যক্ত করেন, “অন্য জায়গার তুলনায় গ্রাম ও ছোট শহরে ভ্রমর-মৌমাছিদের আরও বেশি সংখ্যক বাসা আমি দেখেছি, বিড়ালদের সংখ্যার জন্য এটি হয় বলেই মনে করি আমি; কারণ এরা ইঁদুর ধ্বংস করে।” অতএব এটি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য যে একটি জেলায় একটি বিড়াল জাতীয় প্রাণীর বিরাট সংখ্যায় উপস্থিতি ঐ জেলায় প্রথমে ইঁদুর ও তারপর মৌমাছিদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কোন কোন উদ্ভিদের বারংবার ফুল ফোঁটা নির্ধারণ করে থাকবে।

প্রত্যেক প্রজাতির ক্ষেত্রে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বিভিন্ন ঋতুতে ও বছরে ক্রিয়াশীল হয়ে অনেক ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সম্ভবতঃ কার্যকরী হয়; কেউ নিয়ন্ত্রণ করে অল্প, কেউ-বা সাধারণতঃ খুব শক্তিশালী হয়; কিন্তু প্রজাতিদের গড় সংখ্যা বা এমনকি তাদের অবস্থান নির্ধারণ করতে সকলেই একমত হবে। কতিপয় ক্ষেত্রে এটি দেখানো যেতে পারে যে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ বিভিন্ন জেলায় একই প্রজাতির ওপর কার্যকরী হয়। ঘেরা জায়গায় উদ্ভিদ ও ঝোঁপগুলি যখন আমরা লক্ষ্য করি, তখন এদের আনুপাতিক সংখ্যা ও ধরনগুলি হঠাৎ ঘটে বলে অভিহিত করতে প্রলোভিত হই। কিন্তু এই মতবাদটি একেবারেই ভুল: প্রত্যেকে শুনেছে যে আমেরিকার অরণ্য কেটে ফেলার পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ধরনের বনানী আবির্ভূত হয়; কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে যে দক্ষিণ ইউনাইটেড স্টেটস-এর প্রাচীন ইন্ডিয়ান ধ্বংসাবশেষের জায়গায় যেখানে বৃক্ষরাজি কেটে ফেলা হয়েছিল, সেখানে এখন পার্শ্ববর্তী স্বাভাবিক আদিম অরণ্যের মত একই রকম মনোরম বৈচিত্র্যে ভরা অরণ্যের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিবছর হাজারে হাজারে বীজ উৎপাদনকারী কয়েক ধরনের বৃক্ষের মধ্যে বহু শতাব্দী ধরে কি তীব্র সংগ্রামই হয়ে। থাকবে। কীটপতঙ্গের মধ্যে সংগ্রাম, কীটপতঙ্গ, শামুক ও অন্য প্রাণীদের সঙ্গে পাখি এবং শিকারি পশু-পাখিদের মধ্যে সংগ্রাম-সকলের একটাই চেষ্টা, সেটা হচ্ছে বৃদ্ধি। সকলে পরস্পরকে খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করে, অথবা বৃক্ষ, তাদের বীজ ও চারাগুলিকে খায় অথবা অন্য উদ্ভিদগুলিকে খায়, যারা প্রথম ভূমিকে পূর্ণ করেছিল এবং এইভাবে গাছের বৃদ্ধি রোধ করেছিল। কিছু পালক উড়িয়ে দিন, দেখবেন সকলে নির্দিষ্ট নিয়মে মাটিতে পড়ে। কিন্তু সমস্যাটি কত সরল, যেখানে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্রিয়া ও প্রক্রিয়ায় ঐগুলির তুলনায় প্রত্যেকে পতিত হবে, যারা কয়েক শতাব্দী ধরে পুরনো ইন্ডিয়ান ধ্বংসাবশেষের ওপর এমন বাড়ন্ত বৃক্ষদের আনুপাতিক সংখ্যা ও ধরন নির্ধারণ করেছে।

পরজীবীরা যেমন তাদের শিকারের ওপর বেঁচে থাকে, তেমনি একটি জীবও অন্য জীবের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে এবং এই নির্ভরশীলতা সাধারণতঃ প্রকৃতির। মানদণ্ডে যথেষ্ট ব্যবধানবিশিষ্ট জীবদের মধ্যেই গড়ে ওঠে। কোন কোন সময় এটি সেই ঘটনার মত হয়, যাকে সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে বাঁচার জন্য পরস্পরের মধ্যে সংগ্রাম, যেমন পঙ্গপাল ও তৃণভোজী চতুম্পদ প্রাণীদের ক্ষেত্রে ঘটে। কিন্তু একই প্রজাতির এককগুলির মধ্যে সংগ্রাম প্রায় অনিবার্যভাবে কঠোর হবে, কারণ এরা একই জেলায় নিয়মিত জন্মায়, এদের একই খাদ্যের প্রয়োজন হয়, এরা একই বিপদের সম্মুখীন হয়। একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রে সংগ্রাম সাধারণতঃ প্রায় সমভাবে কঠোর হবে এবং কোন কোন সময় আমরা লক্ষ্য করি সংগ্রামটি মীমাংসিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গমের কয়েক ধরনের ভ্যারাইটিকে যদি একত্রে বোনা হয় এবং মিশ্রিত বীজ যদি আবার বোনা হয়, তাহলে মাটি ও আবহাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত বা স্বভাবতই সবচেয়ে উর্বর এমন ভ্যারাইটিদের কয়েকটি অন্যদের পরাজিত করবে ও আরও বীজ উৎপাদন করবে এবং পরিণতিতে কয়েক বছরের মধ্যে অন্য ভ্যারাইটিদের স্থানচ্যুত করবে। বিভিন্ন রঙের মিষ্টি মটরের মত, এমন কি অতি নিকটতর ভ্যারাইটিদের মিশ্রিত কুল সংরক্ষিত করে রাখতে প্রত্যেক বছর এদের আলাদা করে চাষ করা উচিত এবং তারপর বীজদের সঠিক অনুপাতে মেশানো উচিত, অন্যথায় দুর্বলতর আকারগুলি নিয়মিতভাবে সংখ্যায় হ্রাস পাবে এবং অদৃশ্য হবে। ভেড়াদের ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রেও এইরূপ হয়। জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে যে কোন কোন পর্বতবাসী ভ্যারাইটি অন্য পর্বতবাসী ভ্যারাইটিদের অনশনে রাখবে, সেইজন্য এদের একত্রে রাখা যেতে পারে না। ভেষজ জোঁকের বিভিন্ন ভ্যারাইটিদের একত্রে রাখলেও একই ফল পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে একইভাবে যদি এদের সংগ্রাম করতে দেওয়া হত এবং বীজ বা শিশুদের যদি সঠিক অনুপাতে প্রতিবছর সংরক্ষণ না করা হত, তাহলে আমাদের গৃহপালিত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের যে কোনটির ভ্যারাইটিদের একই ক্ষমতা, স্বভাব ও জৈবিক সংগঠন যথাযথভাবে বজায় থাকতো কিনা যাতে করে আধ ডজন বংশপর্যায় পর্যন্ত একটি মিশ্রিত কুলের (যাদের সংকরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে) আদি অনুপাত বজায় রাখা যেতে পারে, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে।

একই প্রজাতির একক ও ভ্যারাইটিদের মধ্যে জীবন-সংগ্রামের তীব্রতা

যেহেতু একই গণের প্রজাতিরা–যদিও আদৌ অপরিবর্তনীয় নয়–স্বভাবে ও গঠনবিন্যাসে এবং দেহকাঠামোয় সর্বদা সদৃশকার হয়, যদি এরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করে, তাহলে ভিন্ন গণগুলির প্রজাতিদের মধ্যেকার সংগ্রামের তুলনায় এদের মধ্যে সংগ্রাম মূলতঃ আরও তীব্র হবে। ইউনাইটেড স্টেটস-এর বিভিন্ন অংশে সাম্প্রতিককালে সোয়ালো পাখির একটি প্রজাতির বিস্তার আমরা লক্ষ্য করি, যা আবার অন্য একটি প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গায়ক গ্লাস পাখির সংখ্যা হ্রাস করেছে। আমরা প্রায়শই শুনি কেমন করে ইঁদুরের একটি প্রজাতি ভিন্ন আবহাওয়ায় অন্য প্রজাতির স্থান দখল করেছে। রাশিয়াতে এশীয় আরশোলারা তাদের সমগোত্রীয়দের সর্বত্র বিতাড়িত করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় বহিরাগত মধুমৌমাছি ছোট কাটাহুলহীন স্থানীয় মৌমাছিদের দ্রুত ধ্বংস করেছে। জানা গেছে যে চার্লকের একটি প্রজাতি অন্য প্রজাতিদের স্থানচ্যুত করে; এবং অন্য সব ক্ষেত্রেও এরূপ হয়। কেন সমগোত্রীয় আকারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অতিশয় তীব্র হলে আমরা তা অস্পষ্টভাবে দেখতে পারি, যারা আবার প্রাকৃতিক সংগঠনের একই স্থান পূর্ণ করে। কিন্তু সম্ভবতঃ কোন একটি ক্ষেত্রেও আমরা যথাযথভাবে বলতে পারি না বিরাট জীবনসংগ্রামে কেন একটি প্রজাতি অন্য একটি প্রজাতির ওপর বিজয়ী হয়।

উপরোক্ত মন্তব্যগুলি থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুসিদ্ধান্ত করা যেতে পারে, যথা–প্রত্যেক জীবের দেহকাঠামো অন্য সব জীবের দেহকাঠামোর সঙ্গে অপরিহার্যভাবে বা গুপ্তভাবে সম্পর্কযুক্ত, খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য সে যাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে, অথবা যাদের হাত থেকে পালাতে চায়, অথবা যাদেরকে সে শিকার করে। বাঘের দাঁত, পা ও নখগুলির বক্রাকার গঠনে এটি স্পষ্ট; বাঘের শরীরের লোমে আটকে থাকা পরজীবীদের ক্ষেত্রেও এটি স্পষ্ট। কিন্তু ড্যানডেলিওন উদ্ভিদের সুন্দর পালক সমেত বীজের এবং জল-বিটলের চেপ্টা ও লোমাবৃত পায়ের সম্পর্কটি প্রথমে মনে হয় বায়ু ও জলের সঙ্গে সম্পর্কিত। তথাপি পালক সমেত বীজের সুবিধাটি অন্য উদ্ভিদ দ্বারা পরিপূর্ণ জমির সঙ্গে নিঃসন্দেহেই গভীরভাবে সম্পর্কিত, যাতে করে বীজগুলি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করতে পারে ও ফাঁকা জমিতে পড়তে পারে। জল-বিটলের পায়ের গঠন সাঁতারের জন্য এত নিখুঁতভাবে অভিযোজিত যে নিজের শিকার খোঁজার জন্য ও অন্য প্রাণীর হাত থেকে পালানোর জন্য অন্য জলজ কীটপতঙ্গদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে এরা।

অনেক উদ্ভিদের বীজের মধ্যে রক্ষিত পুষ্টিকর খাদ্যের ভাণ্ডারের সঙ্গে প্রথমে মনে। হয় অন্যান্য উদ্ভিদের কোন সম্পর্ক নেই। যখন মটর ও বিনের বীজ লম্বা ঘাসের মধ্যে বপন করা হয়, তখন বীজগুলি থেকে উৎপন্ন নতুন চারাগাছের বিপুল বৃদ্ধি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে বীজের মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রধান ব্যবহার হচ্ছে। চারাগাছগুলিকে বাড়তে সাহায্য করা, তার পাশাপাশি যখন চতুর্দিকে বিপুলভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অন্যান্য উদ্ভিদের সঙ্গে এদের সংগ্রাম করতে হয়।

একটি উদ্ভিদের বিস্তার লক্ষ্য করুন, কেন এরা দ্বিগুণ বা চতুগুণ হয় না? আমরা জানি এরা আর একটু বেশি তাপ, শৈত, আদ্রর্তা অথবা শুষ্কতা ভালভাবে সহ্য করতে পারে, সেইজন্য অন্য কোথাও এরা অল্প বেশি তাপ অথবা ঠাণ্ডা, আদ্রর্তা অথবা শুষ্কতা সম্বলিত জেলাগুলিতে বিস্তৃত হয়। এক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পারি যে যদি আমরা এদের সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষমতা প্রদান করার কল্পনা করতে ইচ্ছা করি, তবে প্রতিযোগীদের বা এদের ভক্ষণকারী প্রাণীদের থেকে এদের কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া উচিত। এদের ভৌগোলিক বিস্তারের মধ্যে, আবহাওয়ার জন্য গঠনবিন্যাসের একটি পরিবর্তন আমাদের উদ্ভিদটির পক্ষে স্পষ্টত লাভজনক হবে; কিন্তু বিশ্বাস করার সঙ্গ ত কারণ আছে যে কেবল কতিপয় উদ্ভিদ বা প্রাণী এতদূর বিস্তৃত হয় যে কেবল আবহাওয়ার তীব্রতার জন্যই ধ্বংস হয়। মেরু অঞ্চল এবং মরুভূমির প্রান্তদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এমন জীবন আমরা দেখি না যেখানে প্রতিযোগিতা স্তব্ধ। দেশটি অতিশয় ঠাণ্ডা অথবা শুষ্ক হলেও উষ্ণতম বা অতিশয় আর্দ্রস্থানের জন্য কতিপয় প্রজাতি অথবা একই প্রজাতির এককদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা হয়।

অতএব আমরা লক্ষ্য করতে পারি যখন একটি উদ্ভিদ বা প্রাণী নূতন দেশ ও নূতন প্রতিযোগীদের মধ্যে এসে পড়ে, তখন আবহাওয়া প্রাক্তন বাসস্থানের মত একইরূপ থাকলেও এদের জীবন-পরিবেশ সাধারণতঃ প্রয়োজনানুগভাবে পরিবর্তিত হবে। নূতন বাসস্থানে যদি এদের গড় সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হয়, তাহলে নিজ দেশে যেমনভাবে এদের রূপান্তর ঘটেছে, নূতন বাসস্থানে এদের ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে রূপান্তরিত হওয়া উচিত; কারণ ভিন্ন প্রকার প্রতিযোগী ও শত্রুদের ওপর এদের কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত।

একটি প্রজাতিকে অন্য প্রজাতির তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টার কল্পনা করার ফল ভাল হয়। কী করা উচিত এ বিষয়ে সম্ভবতঃ একটিও উদাহরণ আমরা জানি না। সমস্ত জীবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতার বিষয়ে আরও বেশি দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাতে সাহায্য করে। এই দৃঢ় প্রত্যয় যেমন প্রয়োজন, এটি অর্জন করাও তেমনি কষ্টকর। আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে দৃঢ়ভাবে মনের মধ্যে রাখা যে প্রত্যেক জীব গুণোত্তরীয় অনুপাতে বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। জীবনের যে কোন পর্যায়ে, বছরের যে কোন ঋতুতে, প্রত্যেক বংশে বা মধ্যবর্তী সময়ে, প্রত্যেক জীবকে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করতে হয় এবং ধ্বংসেরও সম্মুখীন হতে হয়। এই সংগ্রাম সম্বন্ধে যখন আমরা স্মরণ করি, তখন পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারি যে প্রকৃতির সংগ্রাম অবিরাম নয়, কোন আশঙ্কা অনুভূত হয় না, মৃত্যু সাধারণত সক্রিয় এবং সবল, স্বাস্থ্যবান ও সুখীরা বেঁচে থাকে ও সংখ্যাবৃদ্ধি করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *