০১. গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তি

প্রথম অধ্যায় – গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তি

পরিবৃত্তির কারণ–স্বভাবের প্রভাব এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার অথবা অব্যবহার–পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তি বংশানুসৃতি–গৃহপালিত নানা প্রকার ভ্যারাইটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য–নানা প্রকার ভ্যারাইটি ও প্রজাতিদের মধ্যে বিভিন্নতা নির্দিষ্ট করার অসুবিধা–এক বা একাধিক প্রজাতি থেকে গৃহপালিত বিভিন্ন ভ্যারাইটির–উৎপত্তি গৃহপালিত পায়রা, এদের পার্থক্য ও উৎপত্তি– প্রাচীন যুগ থেকে অনুসৃত নির্বাচন পদ্ধতি, এদের ফলাফল–নিয়মানুযায়ী এবং অচেতন নির্বাচন–আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির অজানা উৎপত্তিরসূত্র—মানুষের নির্বাচন শক্তির অনুকূল পরিবেশ।

.

পরিবৃত্তির কারণসমূহ

আমাদের কর্ষিত (আবাদী) উদ্ভিদ ও গৃহপালিত প্রাণীদের একই ভ্যারাইটি অথবা। উপ-ভ্যারাইটিদের এককগুলোর তুলনা করার সময় প্রথম যে বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে প্রাকৃতিক অবস্থায় স্থিত যে কোন প্রজাতি অথবা ভ্যারাইটির এককগুলোর তুলনায় এরা পরস্পরের থেকে অধিকতর পৃথক। অতিশয় ভিন্ন আবহাওয়া ও পরিবেশে সমস্ত যুগ জুড়ে পরিবর্তিত হওয়া কৰ্ষিত ও গৃহপালিত উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের বৈচিত্র্যসমূহ বিবেচনা করলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হই যে এই অতি প্রকারণ বা বিভিন্নতা প্রাকৃতিক অবস্থায় অবস্থান রত পিতামাতা প্রজাতির তুলনায় পৃথক ও ভিন্ন অসমরূপ পরিবেশে উদ্ভূত আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনসমূহের জন্য হয়। অ্যাণ্ডু নাইটের মতে, এই প্রকারণ বা বিভিন্নতা অংশতঃ অধিক খাদ্য গ্রহণের জন্য হতে পারে। স্পষ্টতঃ মনে হয় যে পরিবৃত্তির যে কোন বিরাট পরিমাণ ঘটাতে গেলে কয়েক বংশপরম্পরায় নূতন পরিবেশে জীবদের অবশ্যই রাখতে হবে। এবং যখন জীবরা পরিবর্তিত হতে শুরু করে, তখন এই পরিবর্তন সাধারণতঃ বংশপরম্পরায় ঘটতে থাকে। পরিবর্তনশীল জীবের গৃহপালনাধীন অবস্থায় পরিবর্তন বন্ধ হয়েছে এমন কোন রেকর্ড নেই। আমাদের প্রাচীনতম আবাদী উদ্ভিদের মধ্যে গমের ক্ষেত্রে এখনও নূতন ভ্যারাইটি বা জাত সৃষ্টি হয়ে চলেছে। আমাদের গৃহপালিত প্রাণীরাও দ্রুত উৎকর্ষলাভ অথবা রূপান্তরে এখনও সমর্থ।

দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি সম্পর্কে অনুশীলনের পর আমার মনে হয়েছে এই জীবনাবস্থা দু-ভাবে কাজ করে–প্রত্যক্ষভাবে সমগ্র জীব সংগঠনের ওপর অথবা কেবল কোন প্রত্যঙ্গের ওপর এবং অপত্যক্ষভাবে জননেন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করে। প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা নিশ্চয় মনে রাখব যে প্রত্যেক ক্ষেত্রে দুটি উপাদান রয়েছে, যেমন অধ্যাপক ভাইসম্যান ইদানিং দৃঢ়তা সহকারে বলেছেন এবং আমি যেমন ‘গৃহপালনাধীন পরিবৃত্তি’ নামক গবেষণামূলক কাজে প্রাথমিকভাবে দেখিয়েছি। উপাদান দুটি হচ্ছে জীবের প্রকৃতি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য। পূর্বেরটি সম্ভবতঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যতদূর আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি তাতে মনে হয় অসদৃশ পরিবেশে কোন কোন সময় সদৃশ পরিবৃত্তির উদ্ভব ঘটে এবং বিপরীতক্রমে প্রায়-সদৃশ বলে মনে হয় এমন পরিবেশে অসদৃশ পরিবৃত্তির উদ্ভব হয়, বংশধরদের ওপর এর প্রভাব কখনও নির্দিষ্ট, কখনওবা অনির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট হিসেবে এটি বিবেচিত হতে পারে যখন কয়েক বংশপরম্পায় কোন নির্দিষ্ট পরিবেশের প্রভাবাধীন এককদের সব বা প্রায় সব বংশধররা একইভাবে রূপান্তরিত হয়। এরূপে নির্দিষ্টভাবে প্রবর্তিত পরিবর্তনের সীমা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অত্যন্ত কষ্টকর। তবে, অনেক অল্প পরিবর্তন সম্বন্ধে খুব একটা সন্দেহ থাকত না, যেমন খাদ্যের পরিমাণ থেকে আকার, খাদ্যের বৈশিষ্ট্য থেকে বর্ণ, আবহাওয়া বা জলবায়ু থেকে চামড়া ও রোমের বেধ ইত্যাদি। মোরগ-মুরগীদের পালকগুলোকেও আমাদের দেখা সীমাহীন প্রকারণগুলোর প্রত্যেকটি কোন না কোন উপযুক্ত কারণের জন্য হয়ে থাকবে; এবং অনেক এককের ওপর দীর্ঘ বংশপরম্পায় একই কারণ ক্রিয়াশীল হলে সকলে সম্ভবতঃ সমরূপেই রূপান্তরিত হত। গল (gall) সৃষ্টিকারী একটি কীটের দ্বারা বিন্দুর আকারে বিষ প্রবেশ করানোর সাহায্যে উৎপন্ন জটিল ও অসাধারণ উপবৃদ্ধিগুলো সমেত এরূপ তথ্য আমাদের দেখায়-উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে প্রাণরসের বৈশিষ্ট্যে একটি রাসায়নিক পরিবর্তন থেকে কী অনন্য রূপান্তর ঘটে থাকে।

নির্দিষ্ট পরিবৃত্তির তুলনায় পরিবর্তিত পরিবেশে অনির্দিষ্ট পরিবৃত্তি আরও অনেক বেশি ফলদায়ক এবং সম্ভবতঃ আমাদের জাতগুলো সৃষ্টিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা সীমাহীন অল্প অল্প বৈশিষ্ট্যগুলোতে সুনির্দিষ্ট পরিবৃত্তি দেখি, যা একই প্রজাতির এককদের পৃথক করে এবং যাকে উভয় পিতামাতার যে কোন একটি অথবা আরও দূরবর্তী কোন পূর্বপুরুষের থেকে বংশানুসৃতির দ্বারা বিচার করা যাবে না। এমনকি সুচিহ্নিত পার্থক্যগুলো একই বংশধরের শাবকে এবং একই বীজাধার থেকে চারাগাছে হঠাৎ আবির্ভূত হয়। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে, একই দেশে লালিত-পালিত ও একই ধরনের খাদ্য খাওয়ানোর ফলে লক্ষ লক্ষ এককে দেহগঠনের বিচ্যুতি এত ব্যাপক ও সুস্পষ্ট যে এদের অঙ্গবিকৃতি হয়েছে বলে মনে করা হয়। স্বল্পতর পরিবৃত্তি থেকে অঙ্গবিকৃতিগুলোকে কোন স্বতন্ত্র রেখার দ্বারা পৃথক করা যায় না। অতি অল্প বা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত দেহগঠনের এইসব পরিবৃত্তি, যা একত্রে বসবাসকারী অনেক এককে আবির্ভূত হয়, প্রত্যেক একক জীবের ওপর জীবন-পরিবেশের অনির্দিষ্ট প্রভাব হিসেবে বিচার করা যেতে পারে। প্রায় একই পদ্ধতিতে দেহের গঠনবিন্যাস বা ধাত অনুসারে বিভিন্ন মানুষকে অনির্দিষ্টভাবে শৈত্য প্রভাবিত করে, যার ফলে ঠাণ্ডা লাগে সর্দি ও বাতরোগ হয় এবং বিভিন্ন অঙ্গের প্রদাহ ঘটে।

পরিবর্তিত পরিবেশের অপ্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি যা বলেছি অর্থাৎ জননতন্ত্র প্রভাবিত হওয়ার মধ্য দিয়ে, তা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে অংশতঃ প্রকারণ এভাবে ঘটে, অংশতঃ পরিবেশের যে কোন পরিবর্তনে এই তন্ত্রের অতি সংবেদনশাল হওয়া থেকে এবং অংশতঃ, যেমন কোয়েলরয়টার ও অন্যরা বলেছেন, প্রকারণের মধ্যে সদৃশতা থেকে, যা স্বতন্ত্র প্রজাতির সঙ্করণের ফলে ঘটে এবং নতুন বা অস্বাভাবিক পরিবেশে লালিত-পালিত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্ষেত্রে যা দেখা যেতে পারে। অনেক তথ্য স্পষ্ট করে দেখায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের অতি অল্প পরিবর্তনে জননতন্ত্র কত বিপুলভাবে সংবেদনশীল হয়। একটি প্রাণীকে পোষ মানানোর থেকে সোজা আর কিছুই নয় এবং আটক অবস্থায় অবাবে সন্তান উৎপাদন করানোর থেকে কঠিন আর কিছুই নয়, এমনকি যখন স্ত্রী-পুরুষ মিলিত হয় তখনও। স্বদেশে মুক্তাবস্থায় রাখা সত্ত্বেও বহু সংখ্যক প্রাণী আছে যারা সন্তানসন্ততি উৎপাদন করতে পারে না! এটিকে সাধারণতঃ, কিন্তু ভুলবশতঃ, ত্রুটিপূর্ণ সহজাত প্রবৃত্তির ওপর আরোপ করা হয়। অনেক আবাদী উদ্ভিদ অত্যন্ত তেজিয়ান হয় এবং তথাপি বিরলভাবে অথবা কখনওই বীজ উৎপাদন করে বা করে না। কয়েকটি ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হয়েছে যে অতি তুচ্ছ পরিবর্তন, যেমন ধরুন বৃদ্ধির কোন বিশেষ সময়ে অল্প বা বেশি জল, একটি উদ্ভিদে বীজ হবে কি হবে না তা নির্ধারণ করে। এই অদ্ভুত বিষয়টি সম্পর্কে আমি যা তথ্য সংগ্রহ করেছি। এবং অন্যত্র প্রকাশ করেছি, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এখানে দিতে পারছি না; কিন্তু যে নিয়মগুলো আটক অবস্থায় প্রাণীদের প্রজনন নির্ধারণ করে, সেগুলোর অনন্যতা দেখানোর জন্য আমি উল্লেখ করতে পারি যে এমন কি ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আনীত মাংসাশী প্রাণীরাও এই দেশে আটক অবস্থায় মোটামুটি অবাধেই সন্তান উৎপাদন করে, কেবল প্ল্যান্টিগ্রেড অথবা ভল্লুক গোত্র ছাড়া যারা কদাচিৎ সন্তান উৎপাদন করে; পক্ষান্তরে, বিরলতম ব্যতিক্রম ছাড়া মাংসাশী পাখিরা কদাচিৎ উর্বর ডিম পাড়ে। এই অবস্থায় অতিশয় বন্ধ্যা সঙ্করগুলোর মত অনেক বিদেশি উদ্ভিদের পরাগরেণু নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর হয়। একদিকে আমরা দেখি গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদরা দুর্বল ও অসুস্থ হলেও আটক অবস্থায় অবাধে সন্তান উৎপাদন করে, অন্যদিকে আমরা দেখি প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগৃহীত শাবকের এককগুলোকে সঠিকভাবে পোষ মানানো গেলে তারা দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্যবান হয় (যার অসংখ্য উদাহরণ আমি দিতে পারি), তথাপি এদের জননতন্ত্র কোন অজ্ঞাত কারণের দ্বারা এত গুরুতরভাবে প্রভাবিত হয় যে এটি কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এই কার্যপদ্ধতিতে আমাদের বিস্মিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ এটি অনিয়মিতভাবে কাজ করে এবং এদের পিতামাতার কিছু ভিন্ন প্রকৃতির বংশধর উৎপাদন করে, আটক অবস্থায় কার্য সম্পাদন করে। আমি আরও বলতে পারি, যেহেতু কিছু জীবের অস্বাভাবিক অবস্থায় (যেমন খরগোশ ও খাঁচায় রাখা নকুল জাতীয় প্রাণী) অবাধে সন্তান উৎপাদন করার দ্বারা বোঝা যায় যে এদের জননাঙ্গ সহজে প্রভাবিত হয়, সেহেতু কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদ গৃহপালন অথবা চাষকরণ প্রতিরোধ করবে এবং অতি অল্প পরিবর্তিত হবে–বোধ হয় প্রাকৃতিক অবস্থার তুলনায় কদাচিৎ বেশি।

কিছু প্রকৃতিবিজ্ঞানী বলেছেন যে সব প্রকারণই যৌন জনন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এটা অবশ্যই ভুল, কারণ অন্য একটি গবেষণামূলক কাজে আমি বাগানের মালীদের দেওয়া নাম ‘কৌতুককর উদ্ভিদের’ একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়েছি; অর্থাৎ সেইসব উদ্ভিদ যেখানে একই গাছে অন্য কুঁড়ির তুলনায় একটি নতুন ও ব্যাপকভাবে পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভিন্ন কুঁড়ি সহসা জন্মায়। জোড় কলম, শাখা কলম ইত্যাদি এবং কোন কোন সময় বীজের দ্বারা এইসব পরিবৃত্তির বংশবিস্তার ঘটানো যেতে পারে এবং এদের ভিন্ন ভিন্ন নাম রাখা যেতে পারে–যা প্রাকৃতিক পরিবেশে কদাচিৎ ঘটে, কিন্তু চাষের ক্ষেত্রে এটি বিরল নয়। একই পরিবেশে একই গাছে বছরের পর বছর জন্মানো কয়েক হাজার কুঁড়ির মধ্যে একটি ভিন্ন কুঁড়ি হঠাৎ নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং ভিন্ন পরিবেশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গাছের কুঁড়িগুলো কোন কোন সময় একই ভ্যারাইটি উৎপাদন করে–যেমন, পীচ গাছের মধু-উৎপাদনকারী কুঁড়ি এবং মস-গোলাপ উৎপাদনকারী সাধারণ গোলাপের কুঁড়িরা। এইসব ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টভাবে দেখি যে প্রত্যেক বিশেষ ধরনের পরিবৃত্তি নির্ধারণ করতে জীবটির বৈশিষ্ট্যের তুলনায় পরিবেশের বৈশিষ্ট্য গৌণ মূল্যের হয়; বোধ হয় যার দ্বারা দাহ্যবস্তু প্রজ্জ্বলিত হয় সেই স্ফুলিঙ্গের বৈশিষ্ট্যের তুলনায় শিখার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় না।

স্বভাবের প্রভাব এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার অথবা অব্যবহারের
ফলাফল; পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তি; বংশানুসৃতি

এক আবহাওয়া থেকে অন্য আবহাওয়ায় পরিবাহিত উদ্ভিদদের ফুল ফোঁটার ক্ষেত্রে যেমন হয়, পরিবর্তিত স্বভাব বংশানুক্রমিক ফলাফল সৃষ্টি করে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রত্যঙ্গগুলোর বেশি বেশি ব্যবহার বা অব্যবহারের আরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। বন্য পাতিহাঁসের একই হাড়গুলোর তুলনায় সমগ্র কঙ্কালের অনুপাতে ডানার হাড় কম ওজনের হয় এবং পায়ের হাড়গুলোর ওজন বেশি হয়, এটা আমি গৃহপালিত পাতিহাঁসের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি। বন্য পিতামাতার তুলনায় গৃহপালিত হাঁসরা অতি অল্প ওড়ে এবং বেশি হেঁটে বেড়ায়, তার ফলেই এই পরিবর্তন। অন্য দেশে গরু ও ছাগলের বাঁট-স্তনের তুলনায় নিয়মিত দুগ্ধদোহন করা হয় এমন দেশের গরু ও ছাগলের বাঁট স্তনের বিরাট ও বংশানুক্রমিক বিকাশ অনেক বেশি, যা সম্ভবতঃ ব্যবহারের ফলাফলের আর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের দেশের গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে একটিরও নাম করা যেতে পারে না, অন্য কোন দেশে যাদের ঝুলন্ত কান নেই। কানের মাংসপেশী অব্যবহারের জন্যই কান ঝুলন্ত হয়, কারণ এই প্রাণীদের সতর্ক হওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না–এই মতটি যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয়।

অনেক নিয়ম পরিবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে, যেগুলোর কয়েকটিকে অস্পষ্টভাবে দেখা যেতে পারে এবং এখানে এগুলো সংক্ষেপে আলোচিত হবে। আমি এখানে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তি বিষয়ে উল্লেখ করব। ভুণে ও শূককীটে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সম্ভবতঃ বয়স্ক প্রাণীদের পরিবর্তন ঘটাবে। বিকৃতাঙ্গ জীবের সম্পূর্ণ পৃথক প্রত্যঙ্গদের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ অত্যন্ত অদ্ভুত প্রকৃতির; ইসিডোরে জিওফ্রয় সেন্ট হিলারের বিরাট গ্রন্থে এ বিষয়ে অনেক উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। প্রজননকারীরা বিশ্বাস করেন যে লম্বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো প্রায় সর্বদাই লম্বাটে মস্তকের সঙ্গে সহবর্তমান। পারস্পরিক সম্বন্ধের কয়েকটি উদাহরণ খাপছাড়া ধরনের, যেমন সম্পূর্ণ সাদা ও নীলবর্ণের চোখওয়ালা বিড়ালেরা সাধারণত বধির হয়; কিন্তু মিঃ টেট সম্প্রতি বলেছেন যে এটি কেবল পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বর্ণ ও দেহগত বিন্যাসের বিশেষত্বগুলো একই সঙ্গে চলে, প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে এ সম্বন্ধে অনেক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারত। হিউসিনজারের সংগৃহীত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে সাদা ভেড়া ও শূকররা কয়েকটি উদ্ভিদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু কৃষঃবর্ণের এককগুলো নিষ্কৃতি পায়। অধ্যাপক উইম্যান এ বিষয়ে একটি ভাল উদাহরণ সম্প্রতি আমাকে জানিয়েছেন। ভার্জিনিয়ার কয়েকজন কৃষককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তাদের শূকররা কেন কৃষ্ণবর্ণের হয়। উত্তরে তারা তাকে জানিয়েছিল যে তাদের শূকররা রঙ্গিন শিকড় (ল্যাকনানথেস) খেয়ে থাকে, যা এদের হাড়কে পাটল বর্ণ করে দেয়, এবং কালো রঙের ভ্যারাইটিগুলো ছাড়া অন্য সকলের পায়ের ক্ষুর লোপ পায়; এবং দন্তী মানুষদের (অর্থাৎ ভার্জিনিয়া স্কোয়াটার্স) মধ্যে একজন বলেন, “শাবকদের মধ্যে কালোগুলোকে আমরা নির্বাচিত করি কেবলমাত্র এদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি বলে।” লোমহীন কুকুরদের দাঁত অসম্পূর্ণ হয়; মোটা লোমযুক্ত প্রাণীদের লম্বা অথবা অনেক শিং থাকে; পালকওয়ালা পায়ের পাতা সমেত পায়রাদের পায়ের পাতায় বাইরের আঙ্গুলগুলোর মধ্যে চামড়া থাকে; ছোট ঠোঁটযুক্ত পায়রার পা ছোট হয় এবং লম্বা ঠোঁটওয়ালাদের পা বড় হয়। অতএব মানুষ যদি কোন বৈশিষ্ট্যকে নির্বাচিত করতে থাকে এবং তার বৃদ্ধি ঘটাতে থাকে, তাহলে পারস্পরিক সম্পর্কের রহস্যময় নিয়মগুলির দরুন সে প্রায় নিশ্চিতভাবেই দেহের অন্য প্রত্যঙ্গগুলোকে অনিচ্ছাকৃতভাবে রূপান্তরিত করবে।

পরিবৃত্তির বিভিন্ন, অজ্ঞাত অথবা অস্পষ্টভাবে জানা নিয়মগুলোর ফলাফল অত্যন্ত জটিল ও বিচিত্র। প্রাচীন যুগ থেকে আবাদী কয়েকটি উদ্ভিদ, যেমন হায়াসিন্থ, আলু, এমনকি ডালিয়া প্রভৃতি সম্বন্ধে লেখা কয়েকটি প্রবন্ধ যত্নসহকারে অধ্যায়ন করা খুবই প্রয়োজনীয়; এবং দেহকাঠামো ও দেহগত বিন্যাসের অনন্ত বিষয়সমূহ লক্ষ্য করা অতিশয় বিস্ময়কর, কারণ ভ্যারাইটি ও উপভ্যারাইটিদের মধ্যে পার্থক্য অতি অল্প। সমগ্র জৈব সংগঠনটি সম্ভবতঃ নমনীয় হয়েছে এবং পিতামাতা বৈশিষ্ট্যগুলোর থেকে অল্প। মাত্রায় ব্যতিক্রম ঘটেছে।

বংশানুক্রমিক নয় এমন পরিবৃত্তি আমাদের কাছে গুরত্বহীন। কিন্তু দেহগঠনের বংশগত বিচ্যুতি সংখ্যা ও বিচিত্রতা, যারা অল্প এবং যাদের শরীরবৃত্তীয় বিশেষ গুরুত্ব থাকে, তা অনন্ত। বিষয়টির ওপর ডঃ প্রসপার লুকাসের লেখা দুটি বিরাট গ্রন্থ সর্বোত্তম এবং সম্পূর্ণ। কোন প্রজননকারীই সন্দেহ করে না বংশানুসৃতিতে প্রবণতা কত প্রবল। সদৃশ প্রাণী সদৃশ প্রাণীরাই জন্ম দেয়, এটাই হচ্ছে তাদের মৌলিক বিশ্বাস; তাত্ত্বিক লেখকরাই কেবল এই সূত্র সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন। দেহগঠনের কোন বিচ্যুতি যখন প্রায়শই আবির্ভূত হয় এবং আমরা সেটি পিতা ও শিশুর মধ্যে দেখি, তখন আমরা বলতে পারি না একই কারণ উভয়ের ওপর কার্যকরী হয় কিনা। কিন্তু যখন পরিবেশের কয়েকটি অস্বাভাবিক জোটের জন্য আপাততভাবে একই পরিবেশের প্রভাবাধীন এককগুলোর মধ্যে যে কোন অতি বিরল বিচ্যুতি পিতামাতায় আবির্ভূত হয়–ধরুন কয়েক লক্ষ এককের মধ্যে একবার–এবং এটি শিশুটির মধ্যে পুনরাবির্ভূত হয়, তখন এটির পুনরাবির্ভাবের সম্ভাব্যতার একমাত্র কারণকে বংশানুসৃতির ওপর আরোপ করতে অনেকাংশে বাধ্য হই আমরা। একই গোত্রের সদস্যদের শরীরে ধবলতা, কাঁটাময় চামড়া, লোমাবৃত শরীর ইত্যাদি বিষয়ের কথা নিশ্চয় প্রত্যেকে শুনে থাকবেন। যদি দেহের অদ্ভুত ও বিরল বিচ্যুতিগুলো আনুবংশিক হয়, তাহলে কম অদ্ভুত ও সাধারণ বিচ্যুতিগুলোকে বংশগত বলে অনায়াসেই স্বীকার করা যেতে পারে। সমগ্র বিষয়টি লক্ষ্য। করার সঠিক উপায় হচ্ছে–নিয়ম যাই হোক না কেন, প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যকে বংশগত হিসেবে দেখা এবং বংশগত নয় এমন বৈশিষ্ট্যকে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা।

বংশগতি নিয়ন্ত্রণের নিয়মগুলো অধিকাংশ সময় অজ্ঞাত। কেউ বলতে পারে না। কেন একই প্রজাতির অথবা ভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন এককগুলোতে একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কোন কোন সময় আনুবংশিক হয় কোন কোন সময় হয় না; কেন শিশুর মধ্যে পিতামহ অথবা মাতামহীর অথবা আরও দূরবর্তী পূর্বপুরুষের কিছু কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রায়শই পুনরাবির্ভূত হয়; কেন একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এক লিঙ্গ থেকে উভয় লিঙ্গে, অথবা কেবল একটি লিঙ্গে, আরও বিশেষভাবে কোন সদৃশ লিঙ্গে নয়, প্রায়শই পরিবাহিত হয়। এটি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোর পুরুষ লিঙ্গে আবির্ভূত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয় স্বতন্ত্রভাবে অথবা আরও বেশি মাত্রায় কেবলমাত্র পুরুষদের মধ্যে প্রায়শই বংশগতভাবে পরিবাহিত হয়। আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি, যা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়, সেটি হচ্ছে জীবনের কোন বিশেষ বয়সে একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রথমে আবির্ভূত হয়, বংশধরের অনুরূপ বয়সে এটি পুনরাবির্ভূত হতে চেষ্টা করে, যদিও কোন কোন সময় আরও আগেও তা দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এটি অন্যরূপে হয় না। এইরূপে গো-মহিযাদির শিংগুলোতে বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ কেবল পরিণত বয়সেই বংশধরে আবির্ভূত হতে পারে; রেশমকীটের বৈশিষ্ট্যগুলো শুয়োপোকা অথবা রেশমগুটির সমরূপ দশায় আবির্ভূত হয় বলে জানা গেছে। কিন্তু বংশগত রোগ এবং অন্য কয়েকটি বিষয় আমাকে বিশ্বাস করায় যে নিয়মটির ব্যাপক বিস্তৃতি আছে, এবং কেন একটি বৈশিষ্ট্য কোন বিশেষ বয়সে আবির্ভূত হবে তার আপাত কোন কারণ না থাকলেও পিতামাতার মধ্যে প্রথম যে বয়সে এই পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল, বংশধরের মধ্যেও সেই বয়সেই দেখা যায়। ভূণবিদ্যার নিয়মসমূহ ব্যাখ্যা করতে এই নিয়মটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমি বিশ্বাস করি। এই মন্তব্যগুলো নিশ্চয়ই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রথম আবির্ভাবের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ এবং প্রাথমিক কারণে নয় যা ডিম্বক অথবা পুরুষ-উপাদানের ওপর কার্যকরী হয়ে থাকতে পারে; প্রায় একইভাবে একটি লম্বা শিংওয়ালা ষাঁড়ের ছোট শিংওয়ালা গাভী থেকে উৎপন্ন বংশধরের শিঙের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দৈর্ঘ্য স্পষ্টতই পুরুষ-উপাদানের জন্য হয়, যদিও তা বেশি বয়সে আবির্ভূত হয়।

পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন বিষয়টি প্রসঙ্গে আমি এখানে প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের একটি উক্তি উল্লেখ করতে পারি–আমাদের গৃহপালিত ভ্যারাইটিরা যখন বন্যাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে, তখন তাদের মধ্যে আদিম বংশের বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমশঃ কিন্তু অনিবার্যভাবে ফিরে আসে। অতএব যুক্তি দেখানো হয় যে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রজাতিদের সঙ্গে জাতসমূহের সম্পর্ক থেকে কোন সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে না। কোন্ চূড়ান্ত তথ্যের ভিত্তিতে উপরোক্ত বক্তব্যটি প্রায়শই এবং জোরের সঙ্গে বলা হয়, তা আবিষ্কার করার নিল চেষ্টা করেছি আমি। এটির সত্যতা নিরূপণ করা অত্যন্ত কষ্টকর। আমরা নিরাপদে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে সুচিহ্নিত গৃহপালিত ভ্যারাইটিরা অধিকাংশই বন্যাবস্থায় সম্ভবতঃ বাস করতে পারত না। বহু ক্ষেত্রে আদিম বংশটি কী ছিল আমরা জানি না এবং সে জন্য নিখুঁত প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল কিনা আমরা বলতে পারি না। আন্তঃ সঙ্করণের প্রভাব প্রতিরোধ করতে এটি প্রয়োজন হবে যে কেবল একটি একক নূতন বাসস্থানে বন্ধনমুক্ত হয়ে থাকবে। তা সত্ত্বেও, যেহেতু আমাদের গৃহপালিত ভ্যারাইটিদের কয়েকটি বশিষ্ট্য পূর্বপুরুষীয় আকারে নিশ্চয় হঠাৎ প্রত্যাবর্তন করে, তাই এটি অসম্ভব নয় বলে মনে হয় যে আমরা যদি অনুর্বর মাটিতে (তবে এক্ষেত্রে অনুর্বর মাটির জন্য কিছু ফলাফল আরোপ করা যেতে পারে), ধরা যাক, বাঁধাকপির কয়েকটি জাতকে কয়েক বংশ জুড়ে ভিন্ন পরিবেশের উপযোগী করতে সমর্থ হতাম অথবা চাষ করতে পারতাম, তাহলে এরা অনেকাংশে বা এমনকি সামগ্রিকভাবে বন্য আদিম বংশে প্রত্যাবর্তন করত। পরীক্ষাটি সফল হবে কি হবে না তা আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বের নয়, কারণ পরীক্ষা দ্বারাই জীবন-পরিবেশ পরিবর্তিত হয়। যদি দেখানো যেতে পারত যে আমাদের গৃহপালিত ভ্যারাইটিরা পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনে অত্যন্ত প্রবণ হয়, অর্থাৎ একই পরিবেশে এবং বিশেষ সংখ্যায় রাখা হলে এরা এদের আহৃত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো হারাতে চায়, যাতে একত্রে মিলনের দ্বারা অবাধ আন্তঃসঙ্করণ এদের গঠনের যে কোন অল্প বিচ্যুতিকে রোধ করতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে প্রজাতি সম্পর্কে গৃহপালিত ভ্যারাইটিদের থেকে কোন সিদ্ধান্ত আমি করতে পারিনি। কিন্তু এই মতের অনুকূল সাক্ষ্যপ্রমাণের কোন চিহ্ন নেহ : অনন্ত বংশপরম্পরা ধরে আমাদের মালবাহী ও ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া, লম্বা ও ছোট শিংওয়ালা গো-মহিযাদি এবং বিভিন্ন জাতের কুকুটাদি গৃহপালিত পাখি ও খাদ্য-উপযোগী সবজি প্রজনন করতে পারতাম না, এটা দাবী করা সমস্ত অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে যাবে।

গৃহপালিত নানা প্রকার ভ্যারাইটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য; নানাপ্রকার ভ্যারাইটি ও প্রজাতিদের মধ্যে বিভিন্নতা নির্দিষ্ট করার অসুবিধা; এক বা একাধিক প্রজাতি থেকে বিভিন্ন ভ্যারাইটির উৎপত্তি।

আমরা যখন গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদের বংশধর ভ্যারাইটি বা জাতগুলোর দিকে লক্ষ্য করি এবং নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতিদের সঙ্গে এদের তুলনা করি, তখন প্রত্যেক গৃহপালিত জাতে প্রকৃত প্রজাতির তুলনায় কম একরূপত্ব আমরা সাধারণতঃ দেখতে পাই, যা ইতিমধ্যে উল্লিখিত হয়েছে। গৃহপালিত জাতগুলো প্রায়শই কিছুটা অস্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে; যার দ্বারা আমি এই অর্থ করি যে যদিও কয়েকটি তুচ্ছ বৈশিষ্ট্যে এরা পরস্পরের থেকে এবং একই গণের অন্য প্রজাতির থেকে পৃথক হয়, পরস্পরের সঙ্গে এবং বিশেষত প্রাকৃতিক পরিবেশের নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এরা উভয়ে প্রায়শই যে কোন একটি অঙ্গে চূড়ান্ত মাত্রায় পৃথক। হয়। এগুলো ব্যতীত (সঙ্করিত হওয়ার পর ভ্যারাইটিদের সম্পূর্ণ উর্বরতা–বিষয়টি পরে আলোচিত হবে) একই প্রজাতির গৃহপালিত জাতগুলো পরস্পরের থেকে একই পদ্ধতিতে পৃথক হয়, যে পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে একই গণের নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতিরা পৃথক হয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার্থক্যগুলো কম মাত্রায় হয়। এটি অবশ্য সত্য বলে স্বীকার করা উচিত, কারণ কয়েকজন দক্ষ বিচারক প্রাণী ও উদ্ভিদের গৃহপালিত জাতগুলোকে আদিম স্বতন্ত্র প্রজাতির বংশধর হিসেবে গণ্য করেছেন এবং অন্য দক্ষ বিচারকরা এদের কেবলমাত্র ভ্যারাইটি হিসেবে গণ্য করেন। যদি একটি গৃহপালিত জাত এবং একটি প্রজাতির মধ্যে কোন সুচিহ্নিত পার্থক্য থাকে, সন্দেহের এই উৎসটি এভাবে চিরস্থায়ী রূপে আর পুনরায় ঘটবে না। প্রায়শই বলা হয় যে গণীয় মূল্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে গৃহপালিত জাতসমূহ পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয় না। দেখানো যেতে পারে যে বক্তব্যটি সঠিক নয়; কিন্তু গণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ধারণ করতে প্রকৃতিবিদদের মধ্যে নানাবিধ মতভেদ হয়; এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মূল্য নির্ধারণ বর্তমানে পরীক্ষাধীন। কেমন করে গণগুলি প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভূত হয় তা ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে যে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোতে পার্থক্যের গণীয় চারিত্রিক পরিমাণ আবিষ্কার করার আশা করার কোন অধিকার আমাদের নেই।

সম্বন্ধযুক্ত গৃহপালিত জাতগুলোর মধ্যে গঠনগত পার্থক্যের পরিমাণ নির্ধারণ করার চেষ্টায়, এরা এক বা একাধিক পিতামাতা প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা জেনে তৎক্ষণাৎ সন্দেহ করতে শুরু করি আমরা। বিষয়টি পরীক্ষিত হলে, কৌতূহলোদ্দীপক হবে। যেমন, যদি দেখানো যেতে পারত যে গ্ৰেহাউণ্ড, ব্লাডহাউণ্ড, টেরিয়ার, স্প্যানিয়েল এবং বুলডগ কুকুররা যে কোন একটি স্বতন্ত্র প্রজাতির বংশধর ছিল, আমরা জানি এরা এদের সদৃশ বংশধর জন্ম দেয়, তাহলে এইসব তথ্য অসংখ্য নিকট সম্বন্ধীয় প্রাকৃতিক প্রজাতির অপরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ উদ্রেক করতে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকবে-যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী অসংখ্য শিয়াল সম্পর্কে খাটে। আমি বিশ্বাস করি না যে–যেটি আমরা এখানে দেখবো-কুকুরদের কয়েকটি জাতের মধ্যেকার সমস্ত পার্থক্য গৃহপালনাধীন অবস্থায় উদ্ভূত হয়েছে; স্বল্প পার্থক্য স্বতন্ত্র প্রজাতি থেকে উদ্ভবের জন্য দায়ী, এটা আমি বিশ্বাস করি। অন্য কয়েকটি গৃহপালিত প্রজাতির স্পষ্টচিহ্নিত, জাতগুলোর ক্ষেত্রে, অনুমিত অথবা এমনকি জোরাল সাক্ষ্যপ্রমানাদি রয়েছে যে সকলে একটি স্বতন্ত্র বন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

অনেকে মনে করেন যে মানুষ গৃহপালনের জন্য এমন সব প্রাণী ও উদ্ভিদ নির্বাচন করে যাদের পরিবর্তনের জন্যে সহজাত প্রবণতা রয়েছে এবং যারা বিচিত্র জলবায়ু সহ্য করতে সমর্থ। আমি ভিন্নমত পোষণ করি না যে এই সামর্থগুলো আমাদের অধিকাংশ গৃহপালিত উৎপাদনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু যখন একজন বন্য মানুষ একটি প্রাণীকে প্রথম পোষ মানিয়েছিল, তখন কেমন করে সে জানত সেটি পরবর্তী বংশপরম্পরায় পরিবর্তিত হবে কিনা এবং অন্য জলবায়ু সহ্য করতে পারবে কিনা? গাধা ও রাজহাঁসের অল্প পরিবৃত্তি অথবা বন্না হরিণের গরম সহ্য করার বা সাধারণ উটের ঠাণ্ডা সহ্য করার অল্প ক্ষমতা এদের গৃহপালনে বাধা সৃষ্টি করেছে কি? আমি সন্দেহ পোষণ করি না যে যদি আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলোর সমান সংখ্যায় এবং সমভাবে বিভিন্ন শ্রেণী ও দেশের অন্তর্গত অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে গ্রহণ করা হত এবং গৃহপালনাধীন অবস্থায় এরা সমসংখ্যক বংশপরম্পরায় বংশবিস্তার করত, তাহলে এরা বর্তমানে গৃহপালিত জাতগুলোর পিতামাতা প্রজাতিদের মতো গড়ে একইরূপে পরিবর্তিত হত।

আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকাংশের প্রসঙ্গে বলা যায় যে এরা এক বা কয়েকটি বন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা অসম্ভব। গৃহপালিত প্রাণীদের বহুবিধ উৎপত্তিতে বিশ্বাসী লোকেদের প্রধান যুক্তি হচ্ছে যে ইজিপ্টের স্মৃতিসৌধে এবং সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীদের মধ্যে অতি প্রাচীনকালের জাতগুলোর ক্ষেত্রে বিপুল বিভিন্নতা লক্ষ্য করি আমরা, এবং প্রাচীন জাতগুলোর কয়েকটি বর্তমান জাতগুলোর সদৃশ বা এমনকি সমরূপ হয়। কিন্তু এটি সভ্যতার ইতিহাসকে অনেক পিছনে টেনে নিয়ে যায় এবং আজ পর্যন্ত যা মনে করা হয় তার চেয়ে বহু পূর্বেই প্রাণীদের গৃহপালিত করা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের হ্রদ অধিবাসীরা কয়েক ধরনের গম এবং বার্লি, ছোলা, তেলের জন্য আফিম ও তিসির চাষ করত এবং কয়েকটি প্রাণীকেও পোষ মানিয়েছিল। অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও করত তারা। হিয়ারের মন্তব্যানুসারে এ সব তথ্য স্পষ্ট করে দেখায় যে এরা সভ্যতার গোড়ার দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছিল; এবং এটি আবার কম উন্নত সভ্যতার পূর্ববর্তী দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়ের ইঙ্গিত দেয়, যখন বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর পোষ মানানো গৃহপালিত প্রাণীরা পরিবর্তিত হয়ে থাকবে এবং স্বতন্ত্র জাত উদ্ভূত হয়ে থাকবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠে চকমকি পাথরের হাতিয়ার আবিষ্কার থেকে সব ভূবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে বহু বহু বছর পূর্বে বর্বর মানুষরা বসবাস করত; এবং আমরা জানি যে অন্তত কুকুরকে পোষ মানাতে পারে না এ-রকম বর্বর গোষ্ঠী বর্তমানে একটিও নেই।

আমাদের অধিকাংশ গৃহপালিত প্রাণীদের উৎপত্তির বিষয়টি চিরকালের মত অস্পষ্ট থাকবে। সারা পৃথিবীর গৃহপালিত কুকুরদের লক্ষ্য করে আমি কিন্তু এখানে বলতে পারি যে সমস্ত জানা তথ্য কঠোর পরিশ্রম সহকারে সংগ্রহ করে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে কুকুর গোত্রের বন্য প্রজাতিকে পোষ মানানো হয়েছে এবং এদের রক্ত কয়েকটি ক্ষেত্রে একত্রে মিশ্রিত হয়ে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোর শিরায় প্রবাহিত হয়ে আসছে। ভেড়া ও ছাগলের ক্ষেত্রে আমি কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। কুঁজওয়ালা। ভারতীয় গবাদি পশুদের স্বভাব, কণ্ঠস্বর, দেহগঠন ও অবয়ব সম্বন্ধে মিঃ ব্লিথ প্রেরিত তথ্যসমূহ থেকে নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে এরা আমাদের ইউরোপিয় গবাদি পশুদের থেকে ভিন্ন একটি আদিম কুল (বংশ) থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং কয়েকজন দক্ষ বিচারক বিশ্বাস করেন যে ইউরোপিয় গবাদি পশুদের দুটি বা তিনটি বন্য পূর্বপুরুষ ছিল–এদের প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা যুক্তিযুক্ত হবে কিনা তা পরের কথা। এই সিদ্ধান্তটি এবং কুঁজওয়ালা ও সাধারণ গবাদি পশুদের বিশেষ পার্থক্যের বিষয়টি অধ্যাপক রুটিমেয়ারের প্রশংনীয় গবেষণামূলক কাজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ঘোড়াদের ক্ষেত্রে, কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামতের বিরুদ্ধে, আমি মনে করি সমস্ত জাত একই প্রজাতির অন্তর্গত, যার কারণগুলো আমি এখানে দিতে পারছি না। মুরগীদের প্রায় সমস্ত ইংলিশ জাতগুলোকে জীবিত রেখে, এদের প্রজনন করে সঙ্করণ ঘটিয়ে এবং এদের কঙ্কাল পরীক্ষা করে আমার কাছে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয়েছে যে গ্যালাস ব্যাঙ্কিভা নামক ভারতীয় বন্য মুরগী থেকেই এরা উদ্ভূত হয়েছে; এবং মিঃ ব্লিথ ও অন্য যাঁরা এই পাখিটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন, এটা তাদেরই সিদ্ধান্ত। পাতিহাঁস ও খরগোশদের ক্ষেত্রে, যাদের কয়েকটি জাত পরস্পরের থেকে ভীষণভাবে ভিন্ন হয়, সাক্ষ্য প্রমাণাদি থেকে এটা পরিষ্কার যে এরা সকলে সাধারণ বন্য পাতিহাঁস এবং খরগোশ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।

কয়েকটি আদিম বংশ (কুল) থেকে কয়েকটি গৃহপালিত জাতের উৎপত্তি তত্ত্বকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অযৌক্তিক সীমায় নিয়ে গিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেক জাতের, যারা অকৃত্রিম বংশধর উৎপাদন করে এবং যাদের পার্থক্যমূলক বৈশিষ্ট্য যতই অল্প হোক না কেন, বন্য আদিরূপ ছিল। এই অনুপাতে কেবলমাত্র ইউরোপেই কম করেও এক কুড়ি বন্য গবাদি পশুর প্রজাতি, সমসংখ্যক ভেড়া, কিছু ছাগল নিশ্চয়ই থেকে থাকবে, এমনকি গ্রেট ব্রিটেনেও কয়েকটি। একজন বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে। কেবল গ্রেট ব্রিটেনেই পূর্বে ভেড়ার এগারটি বন্য প্রজাতি ছিল! আমরা যখন স্মরণে রাখি যে এখন গ্রেট ব্রিটেনের নিজস্ব কোন স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই, এবং জার্মানির তুলনায় স্বতন্ত্র কয়েকটি ফ্রান্সে এবং এরূপে হাঙ্গেরি, স্পেন প্রভৃতি দেশেও নেই, তথাপি এসব দেশগুলোর প্রত্যেকটিতে গবাদি পশু, ভেড়া প্রভৃতির কয়েকটি নিজস্ব জাত রয়েছে, তখন আমাদের নিশ্চয় স্বীকার করা উচিত যে সারা ইউরোপে অনেক গৃহপালিত জাত উদ্ভূত হয়ে থাকবে, কারণ তা না হলে কোথা থেকে উদ্ভূত হয়েছে এরা? ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমন কি সারা পৃথিবীর গৃহপালিত কুকুরদের জাতগুলোর ক্ষেত্রে–আমি স্বীকার করি যে এরা কয়েকটি বন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে– নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এদের মধ্যে বিরাট পরিমাণে বংশগত পরিবর্তন ঘটেছে; কারণ কে বিশ্বাস করবে যে ইতালির গ্ৰেহাউণ্ড, ব্লাডহাউণ্ড, বুলডগ, পাগ-ডগ বা ব্লেনহিম স্প্যানিয়েল প্রভৃতি ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ প্রাণীরা, যারা সমস্ত বন্য কুকুর গোত্রীয়দের থেকে এত পৃথক, তারা কখনও প্রাকৃতিক পরিবেশে বর্তমান ছিল? প্রায়শই হালকাভাবে বলা হয় যে কয়েকটি আদিম প্রজাতির মধ্যে সঙ্করণের মাধ্যমে কুকুরদের সমস্ত জাতের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু সঙ্করণ প্রক্রিয়া দ্বারা এদের পিতামাতাদের কেবলমাত্র কিছু মাত্রায় মধ্যবর্তী আকারই পেতে পারি আমরা; এবং এই পদ্ধতির দ্বারা আমরা যদি আমাদের গৃহপালিত জাতগুলো সম্বন্ধে বিচার-বিবেচনা করি, তাহলে ইতালির গ্ৰেহাউণ্ড, ব্লাডহাউণ্ড, বুলডগ ইত্যাদির অতিশয় চরম আকারদের বন্যাবস্থায় পূর্ব অবস্থান আমাদের। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অধিকন্তু সঙ্করণ প্রক্রিয়ার দ্বারা স্বতন্ত্র জাত সৃষ্টির সম্ভাবনার বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। অনেক লিপিবদ্ধ ঘটনা থেকে জানা যায় যে আকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য সমেত এককদের যত্নসহকারে নির্বাচন করা হলে আকস্মিক সঙ্করণ পদ্ধতির দ্বারা একটি জাত রূপান্তরিত হতে পারে, কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। জাতের মধ্যবর্তী একটি জাতের উদ্ভব ঘটানো অত্যন্ত কষ্টকর। স্যার জে. সেবরাইট এই উদ্দেশ্যে বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন এবং ব্যর্থ হয়েছিলেন। দুটি বিশুদ্ধ জাতের মধ্যে প্রথম সঙ্করণ থেকে উৎপন্ন বংশধররা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সহনীয় ও কোন কোন সময় (যেমন আমি পায়রাদের ক্ষেত্রে দেখেছি) সম্পূর্ণ একইরূপ হয়, এবং এর থেকে মনে হয় সবকিছুই যথেষ্ট সরল; কিন্তু যখন কয়েক বংশ ধরে এই বর্ণসঙ্কররা পরস্পরের সঙ্গে সঙ্করিত হয়, তখন কদাচিৎ এদের দুটি হুবহু একই রকম হয়, এবং তখন করণীয় কাজের অসুবিধাটি স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয়।

গৃহপালিত পায়রাদের জাত, এদের পার্থক্য ও উৎপত্তি

কয়েকটি বিশেষ গোষ্ঠী সম্বন্ধে অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ করা সর্বদাই উপকারী, এটা বিশ্বাস করে ও বিশেষভাবে বিবেচনা করে গৃহপালিত পায়রাদের বিষয়টি অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের জন্য গ্রহণ করেছি আমি। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে ভারতবর্ষ থেকে, মাননীয় ডব্লিউ, ইলিয়ট ও পারস্য থেকে মাননীয় সি. মুর প্রেরিত চামড়াগুলো সমেত আমার ক্রীত ও প্রাপ্ত প্রত্যেক জাত আমি সংগ্রহ করে রেখেছি। পায়রা সম্বন্ধে অনেক গ্রন্থ ও নিবন্ধ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এদের মধ্যে কয়েকটি বহু প্রাচীন ও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। আমি কয়েকজন পশুপাখিরসিক ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করেছি এবং লন্ডনের দুটি পায়রা ক্লাবের সদস্য হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে আমাকে। জাতগুলোর বিচিত্রতা অতি বিস্ময়কর। ইংলিশ গিরাবাজ (কেরিয়ার) ও ছোট মুখওয়ালা লোটন পায়রাদের (টাম্বলার) তুলনা করুন এবং ফলস্বরূপ এদের করোটির অনুরূপ পার্থক্য সমেত ঠোঁটের বিস্ময়কর পার্থক্যগুলো লক্ষ্য করুন। গিরাবাজ পায়রাদের, বিশেষত পুরুষ-পাখিটির মাথায় আব সমেত চামড়ার অপূর্ব বৃদ্ধি লক্ষণীয়; এবং একই সময়ে বর্তমান থাকে বেশ লম্বাটে চোখের পাতা, নাসারন্ধ্রের বেশ বড় বাইরের রন্ধ্র মুখের বিরাট ফাঁক। ছোট মুখওয়ালা লোটন পায়রার ঠোঁটের বহিরাকৃতি প্রায় ফিন পাখির ঠোঁটের মত। দল বেঁধে আকাশে অধিক উচ্চতায় ওড়ার ব্যাপারে সাধারণ পায়রাদের অসাধারণ বংশগত স্বভাব রয়েছে। আকাশে এরা গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে ডিগবাজি খায়। রান্ট পায়রা বিরাটাকারের একটি পাখী, এদের লম্বা প্রকান্ড ঠোঁট ও বড় পায়ের পাতা থাকে; রান্ট পায়রার কিছু উপজাতের লম্বা গলা, কিছু উপজাতের অতিশয় লম্বা ডানা ও লেজ, আবার অন্য কিছু উপজাতের অস্বাভাবিক খর্ব। লেজ থাকে। গোলা পায়রারা (বাব) গিরাবাজ পায়রাদের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। কিন্তু লম্বা ঠোঁটের পরিবর্তে এদের ঠোঁট খুব ছোট ও প্রশস্ত। পাউটার পায়রাদের শরীর, ডানা ও পা লম্বাটে হয়; এরা এদের বিকশিত গলার থলি ফোলাতে গর্ব অনুভব করে। এদের এই কার্যকলাপ বিস্ময়, এমনকি হাসির উদ্রেক করতে পারে। টাবিট পায়রাদের খর্ব শঙ্কু আকৃতি ঠোঁট থাকে এবং বুকের নিচ বরাবর উল্টানো পালকের একটি সারি থাকে, অন্ননালীর ওপরের অংশ অনবরত ও অল্পভাবে ফোলানো এদের স্বভাব। জ্যাকবিন পায়রাদের পালকগুলো গলার পিছন দিক বরাবর এমনভাবে উল্টানো থাকে যে এরা একটি হুড তৈরি করে; এদের দেহের অনুপাতে লম্বাটে ডানা ও লেজের পালক থাকে। নামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ট্রামপেটার ও লফার পায়রারা অন্য জাত থেকে অতিশয় পৃথক বকবকম আওয়াজ করতে পারে। বিরাট পায়রা গোত্রের সকল সদস্যদের লেজে সাধারণত বারো অথবা চোদ্দটি পালক থাকে, কিন্তু লক্কা পায়রাদের লেজে ত্রিশ অথবা চল্লিশটি পালক থাকে। এই পালকগুলি এরা ফুলিয়ে রাখে ও খাড়াভাবে এমনভাবে বহন করে যে ভাল পায়রাদের মাথা ও লেজ পরস্পরকে স্পর্শ করে, তেলগ্রন্থি লুপ্ত হয়। কম ভিন্ন জাতগুলোর কয়েকটি সম্বন্ধে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার।

কয়েকটি জাতের কঙ্কালে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বক্রতায় মুখমণ্ডলের হাড়গুলির বৃদ্ধি বহুলাংশে ভিন্ন হয়। নিচের চোয়ালের হাড়ে শাখার (র্যামাসের) আকার, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থও লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন হয়। পুচ্ছ ও নিতম্ব কশেরুকা সংখ্যায় ভিন্ন হয়, যেমন ভিন্ন হয় পঞ্জরাস্থির সংখ্যা, এর সঙ্গে এদের আপেক্ষিক প্রস্থের উদগত উপাঙ্গগুলির উপস্থিতি। বক্ষাস্থির রন্ধ্রগুলির আকার ও আয়তন ভয়ানক পরিবর্তনশীল; সেই রকম ফারকিউলার দুই বাহুর আপেক্ষিক আয়তন ও কেন্দ্ৰাপসারণের পরিমাণ; মুখগহ্বরের ফাঁকের আনুপাতিক বিস্তার; চোখের পাতা, নাকের রন্ধ্র ও জিহ্বার আনুপাতিক দৈর্ঘ্য (ঠোঁটের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে সব সময় সঠিক সম্বন্ধযুক্ত হয় না), পাকস্থলী ও অন্ননালীর উপরাংশের আকার; তেলগ্রন্থির বৃদ্ধি ও বিলুপ্তি; মুখ্যডানা ও পুচ্ছের পালকদের সংখ্যা; পরস্পরের সঙ্গে ও শরীরের সঙ্গে ডানা ও লেজের আপেক্ষিক দৈর্ঘ্য; পা ও পায়ের পাতার আপেক্ষিক দৈর্ঘ্য; পদাঙ্গুলির স্কুটেলার সংখ্যা, পদাঙ্গুলির মধ্যেকার চামড়ার বৃদ্ধি, দেহগঠনের এইসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি পরিবর্তনশীল; নিখুঁত পালকসমূহের আবির্ভাবের সময়কাল ভিন্ন হয়, ডিম ফুটে বের হওয়া বাচ্চা পায়রাদের নরম পালকগুলো যেমন ভিন্ন হয়, ডিমের আকার ও আয়তন ভিন্ন হয়, উড্ডয়ন পদ্ধতি এবং কয়েকটি জাতের কণ্ঠস্বর ও স্বভাব লক্ষণীয়ভাবে পৃথক। সর্বশেষ কয়েকটি জাতের পুরুষ ও স্ত্রীরা পরস্পরের থেকে সামান্য ভিন্ন হয়।, সামগ্রিকভাবে অন্ততঃ এক কুড়ি পায়রাকে মনোনীত করে যদি একজন পক্ষীবিশারদকে দেখানো হয় এবং বলা হয় যে এরা সকলে বন্য পাখি, তাহলে তিনি নিশ্চয় এদের স্পষ্টচিহ্নিত প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত করবেন। অধিকন্তু আমি বিশ্বাস করি

যে এইসব ক্ষেত্রে কোন পক্ষীবিশারদ ইংলিশ গিরাবাজ, খবমুখওয়ালা লোটন, রান্ট, গোলা, পাউটার এবং লক্কা পায়রাদের একই গণের অন্তর্ভুক্ত করবেন; আরও বিশেষভাবে এইসব জাতগুলোর প্রত্যেকটির কয়েকটি প্রকৃত বংশধর উপ-জাত অথবা প্রজাতি তাকে দেখানো যেতে পারত যাদের তিনি প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করবেন।

পায়রাদের জাতগুলির মধ্যেকার পার্থক্যসমূহ যতই বিরাট হোক না কেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রকৃতিবিদদের সাধারণ অভিমত নির্ভূল। যথা, পাহাড়ি পায়রাদের (কলম্বিয়া লিভিয়া) থেকেই কিছু ভৌগোলিক জাত অথবা উপপ্রজাতি সমেত সকলের উদ্ভব ঘটেছে, যারা পরস্পরের থেকে অতি তুচ্ছ কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন হয়। যুক্তিগুলোর কয়েকটি যা আমাকে বিশ্বাস করতে অনুপ্রাণিত করেছে ও যেগুলো অন্য ক্ষেত্রে কিছু মাত্রায় প্রযোজ্য হয়, তা আমি এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করব। যদি কয়েকটি জাত ভ্যারাইটি (প্রকার) না হয় এবং পাহাড়ি পায়রা থেকে উদ্ভূত না হয়ে থাকে, তাহলে এরা নিশ্চয় অন্ততঃ সাত বা আটটি আদিম বংশ (স্টক) থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকবে, কারণ যে কোন কম সংখ্যক সঙ্করণের মাধ্যমে বর্তমান গৃহপালিত জাতগুলির। সৃষ্টি অসম্ভব : উদাহরণস্বরূপ, কোন একটি পিতামাতার বংশে বিরাট পাকস্থলী না থাকলে, কেমন করে দুটি সঙ্করণের দ্বারা একটি পাউটার পায়রা সৃষ্টি করা যেতে পারে? তথাকথিত আদিম বংশগুলো সকলে নিশ্চয় পাহাড়ি পায়রা হয়ে থাকবে, অর্থাৎ এরা বংশবৃদ্ধি করেনি বা স্বেচ্ছায় গাছে এসে বসে না। কিন্তু কয়েকটি উপপ্রজাতি সমেত কলম্বিয়া লিভিয়া ছাড়া পাহাড়ি পায়রাদের কেবল দুটি বা তিনটি প্রজাতি আছে বলে জানা গেছে এবং এদের মধ্যে গৃহপালিত জাতসমূহের কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয় না। অতএব তথাকথিত আদিম বংশগুলি সেইসব দেশে এখনও নিশ্চয় আছে। যেখানে এদের প্রথমে গৃহপালিত করা হয়েছিল, তথাপি এটি পক্ষীবিশারদদের নিকট অজ্ঞাত রয়েছে; এবং এদের আকার, স্বভাব, লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলি বিবেচনা করলে মনে হয় এটি অসম্ভব; অথবা বন্যাবস্থায় এরা বিলুপ্ত হয়ে থাকবে। কিন্তু পাহাড়ের ঢালু জায়গায় ডিম পাড়তে ও ভালভাবে উড়ে পালাতে পারায় অভ্যস্ত পাখিদের নিশ্চিহ্ন হওয়া অসম্ভব, এবং ছোট ছোট কয়েকটি ব্রিটিশ দ্বীপে বা ভূমধ্যসাগরের উপকূলে গৃহপালিত জাতগুলোর স্বভাব সম্বলিত সাধারণ পাহাড়ি পায়রারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। অতএব পাহাড়ি পায়রাদের সদৃশ স্বভাব সম্বলিত অসংখ্য প্রজাতির তথাকথিত নিশ্চিহ্ন হওয়ার বক্তব্যটি সম্ভবতঃ একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। এ ছাড়াও উপরোক্ত গৃহপালিত জাতগুলোর কয়েকটি পৃথিবীর সকল অংশে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এদের মধ্যে কয়েকটি নিশ্চয় এদের নিজের দেশেও পুনরায় স্থানান্তরিত হয়েছে; কিন্তু একটিও বন্য। অথবা অপোষ্য হয়নি, যদিও অল্প পার্থক্যযুক্ত পাহাড়ি ডোভেকট পায়রাটি কয়েকটি জায়গায় অপোষ্য হয়েছে। যাবতীয় সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখায় যে বন্যপ্রাণীদের গৃহপালনাধীনে অবাধে বংশবিস্তার করানো অতিশয় কষ্টকর; তথাপি আমাদের পায়রাদের বহুবিধ উৎপত্তির প্রকল্প অনুসারে নিশ্চয় অনুমান করা উচিত যে প্রাচীনকালে অর্ধসভ্য মানুষদের দ্বারা অন্ততঃ সাত বা আটটি প্রজাতি এত সম্পূর্ণরূপে গৃহপালিত হয়েছিল যে আটক অবস্থাতেও এরা বহু সন্তান উৎপাদনক্ষম হয়েছিল।

অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং অত্যন্ত জোরালো একটি যুক্তি হচ্ছে যে উপরোক্ত জাতগুলো, যদিও দেহগঠনে, স্বভাবে, কণ্ঠস্বরে, বর্ণে এবং এদের দেহের অধিকাংশ প্রত্যঙ্গে পাহাড়ি পায়রাদের সঙ্গে সাধারণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তথাপি অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নিশ্চয় অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক হয়; ইংলিশ গিরাবাজ অথবা। হ্রস্বমুখওয়ালা লোটন বা গোলা পায়রার ঠোঁটের মতো একটি ঠোঁট, জ্যাকোবিনদের মতো উল্টানো পালক, পাউটারের মত গলার থলি, লক্কা পায়রাদের মত লেজ পালক কলুকিম্বডির মত বিরাট গোত্রে খুঁজতে বৃথাই চেষ্টা করি আমরা। অতএব নিশ্চয় মনে করা উচিত যে অর্ধসভ্য মানুষরা কেবল কয়েকটি প্রজাতিকে গৃহপালিত করতে সমর্থ হয়নি, বরং তারা ইচ্ছাকৃত বা আকস্মিকভাবে অসাধারণ অস্বাভাবিক প্রজাতিদের বেছে নিয়েছিল; এবং আরও বলা যায় যে এইসব আসল প্রজাতিরা তখন থেকেই সকলে লুপ্ত হয়েছে অথবা অজ্ঞাত রয়েছে। এত সব অদ্ভুত অনিশ্চিত সম্ভাবনা অতিমাত্রায় অসম্ভাব্য।

পায়রাদের বর্ণ সংক্রান্ত কিছু তথ্য বিবেচনার যোগ্য। পাহাড়ি পায়রারা শ্লেট পাথরের মত নীলাভ, যার কটিদেশ শ্বেত বর্ণের; কিন্তু ভারতীয় উপপ্রজাতি স্ট্রিকল্যান্ডের কলম্বিয়া ইন্টারমিডিয়া পায়রার এই অংশটি ঈষৎ নীলাভ, লেজের শীর্ষভাগে কালো ডোরা দাগ থাকে, বাইরের পালকের নিচের দিকের ধার সাদা রঙের হয়। ডানাতে দুটি কালো ডোরা দাগ থাকে। কয়েকটি অর্ধগৃহপালিত এবং প্রকৃত বন্য জাতের দুটি কালো ডোরা দাগ ছাড়া ডানাগুলি কালো রঙের ছোপ দিয়ে নকশা কাটা। সমগ্র গোত্রের যে কোন প্রজাতিতে এইসব চিহ্ন একত্রে থাকে না। এমতাবস্থায় সম্পূর্ণরূপে বংশবৃদ্ধিপ্রাপ্তদের ধরে নিয়ে গৃহপালিত জাতসমূহের প্রত্যেকটিতে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি, এমনকি লেজের বাইরের পালকের সাদা ধারও কোন কোন সময় একত্রে নিখুঁতভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে। এছাড়াও, যখন দুই বা ততোধিক ভিন্ন জাতের অন্তর্গত। পাখিরা সঙ্করিত হয়, তখন এদের কোনটাই নীল রঙের হয় না অথবা এরা উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যমূলক চিহ্নের অধিকারী হয় না, বর্ণসঙ্কর বংশধরে এইসব বৈশিষ্ট্য হঠাৎ-হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে আমি যা লক্ষ্য করেছি তা হচ্ছে : কয়েকটি সাদা লক্কা পায়রার সঙ্গে, যারা অনুরূপ বংশধরের জন্ম দেয়, কয়েকটি কালো গোলা। পায়রার প্রজনন ঘটাই আমি; ফলস্বরূপ দেখা গেল যে গোলা পায়রার নীল জাতটি এত, বিরল হল যার একটিও উদাহরণ ইংল্যান্ডে আমি কখনও শুনি নি; এবং বর্ণসঙ্কররা কালো, বাদামী ও বহু বর্ণের হয়েছিল। একটি গোলা পায়রার সঙ্গে একটি ছোপ-ছোপ দাগওয়ালা পায়রার সঙ্করণ ঘটিয়েছিলাম, দাগওয়ালা সাদা পায়রাটির লেজ লাল ও কপালে লাল দাগ ছিল এবং সকলেই জানে যে এরা সদৃশ বংশধর উৎপাদন করে। বর্ণসঙ্কররা হয়েছিল ইষৎ লালচে রঙের এবং নানা বর্ণের ছোপযুক্ত। এরপর আমি গোলা-লক্কা পায়রার বর্ণসঙ্করদের একটির সঙ্গে গোলা ও ছোপ-ছোপ দাগওয়ালা পায়রার বর্ণসঙ্করদের একটির সঙ্করণ ঘটাই, এবং তার ফলে কোমর সাদা, ডানায় জোড়া কালো ডোরা দাগ ও মোটা ডোরা দাগ এবং লেজের পালকের ধারে ডোরা দাগ সম্বলিত যে কোন বন্য পাহাড়ী পায়রার মত একটি অতি সুন্দর নীল বর্ণের পাখি উৎপাদন করেছিল এরা! যদি সমস্ত গৃহপালিত জাতগুলি পাহাড়ি পায়রা থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে, তাহলে পৈতৃক বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের সুপরিচিত নীতির ওপর ভিত্তি করে আমরা এ সব বিষয় বুঝতে পারি। কিন্তু যদি আমরা এটি অস্বীকার করি, তাহলে নিচের দুটি অসম্ভব কল্পনা আমাদের অবশ্যই করতে হবে। প্রথমতঃ হয় সমস্ত কল্পিত আদিম বংশগুলো পাহাড়ি পায়রার মত বর্ণময় ও ছোপচিহ্নিত ছিল, যদিও বর্তমানের কোন প্রজাতি এইরূপ বর্ণময় ও চিহ্নিত নয়, যাতে করে প্রত্যেক পৃথক জাতে সেই একই বর্ণ ও চিহ্নের প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা থাকতে পারত। দ্বিতীয়তঃ, নয়তো বিশুদ্ধতম জাতটি সমেত প্রত্যেক জাত বারো অথবা অন্ততঃ এক কুড়ি বংশের মধ্যে এমন একটিও বংশের উদাহরণ জানা নেই যেখানে সঙ্করিত বংশধররা বেশি সংখ্যক বংশ বাদ দিয়ে অনাত্মীয় রক্তের পূর্বপুরুষে প্রত্যাবর্তন করেছে। কেবলমাত্র একবার সঙ্করিত হওয়া জাতে এই সঙ্করণের ফলে উদ্ভূত যে কোন বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা স্বভাবতই অল্প থেকে অল্পতর হবে, কারণ প্রত্যেক পরবর্তী বংশে অনাত্মীয় (বিদেশি) রক্ত কমতে থাকবে; কিন্তু যখন কোন সঙ্করণ হয় না এবং একটি জাতে পূর্বের কোন কোন বংশে লুপ্ত হওয়া একটি বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা থাকে, তখন আমরা দেখি অনির্দিষ্ট সংখ্যক বংশ ধরে এই প্রবণতা অপরিবর্তিতভাবে পরিবাহিত হতে পারে। প্রত্যাবর্তনের এই দুটি ভিন্ন ঘটনা প্রায়শই তারা একত্রে মিশিয়ে ফেলেন, যাঁরা বংশগতি সম্বন্ধে লিখেছেন।

পরিশেষে, পায়রাদের সকল জাতের সঙ্কর ও বর্ণসঙ্কররা যে জননশক্তি সম্পন্ন হয়, সবচেয়ে স্বতন্ত্র জাতগুলির উপর আমি যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম তার উপর ভিত্তি করে তা আমি নিশ্চিতরূপে বলতে পারি। বর্তমানে প্রাণীদের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির সঙ্কররা সম্পূর্ণরূপে উর্বর হয়, এমন কোন ঘটনার কথা কদাচিৎ নিশ্চিতরূপে জানা যায়। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে দীর্ঘদিন গৃহপালনাধীনে থাকার ফলে প্রজাতির বন্ধ্যা হওয়ার এই শক্তিশালী প্রবণতা অপসারিত হয়। কুকুর এবং অন্য কয়েকটি গৃহপালিত প্রাণীর ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় যে এই সিদ্ধান্ত নিকট সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে সম্ভবতঃ সম্পূর্ণ সঠিকই হবে। এখনকার গিরাবাজ, লোটন, পাউটার এবং লক্কা পায়রাদের থেকে উৎসগতভাবে স্বতন্ত্র প্রজাতিরা। সম্পূর্ণ উর্বর বংশধর উৎপাদন করে, এটা তর্কের খাতিরে স্বীকার করা চরম হঠকারিতা।

এইসব কারণগুলির কয়েকটি, যথা, পায়রাদের সাত বা আটটি কল্পিত প্রজাতির গৃহপালনাধীনে অবাধে প্রজনন করানোর ব্যাপারে মানুষের অক্ষমতা; এইসব কল্পিত প্রজাতিদের বন্যাবস্থায় অবস্থানের বিষয়টি সম্পূর্ণ অজানা এবং গৃহপালনাধীন বন্দীদশা। থেকে মুক্ত হয়ে কোথাও বন্য অবস্থায় ফিরে যাওয়া; কলাম্বিডি গোত্রের অন্য সব প্রজাতির তুলনায় এইসব প্রজাতিদের অতি অস্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করা, যদিও এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাহাড়ি পায়রাদের সদৃশ হয়; উভয়কেই যখন বিশুদ্ধ অবস্থায় রাখা হয় ও যখন সঙ্করিত হয় তখন সব জাতে নীল রঙ ও বিভিন্ন কালো দাগগুলির হঠাৎ পুনরাবির্ভাব হওয়া, এবং পরিশেষে বর্ণসঙ্কর বংশধরদের সম্পূর্ণ উর্বর হওয়া–এইসব কারণগুলোকে একত্র করে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে আমাদের সমস্ত গৃহপালিত জাতগুলি পাহাড়ি পায়রা অথবা তার ভৌগোলিক উপ-প্রজাতি সমেত কলাম্বিয়া লিভিয়া থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

এই মতবাদের সমর্থনে আমি আরও কিছু যোগ করতে পারি। প্রথমতঃ, বন্য। কলাম্বিয়া লিভিয়া পায়রাটি ইউরোপে ও ভারতবর্ষে পোষ মানতে সমর্থ বলে দেখা গেছে, এবং এরা স্বভাবে ও শরীরগঠনের অনেক বিষয়ে সমস্ত গৃহপালিত জাতের সঙ্গে। মিলে যায়। দ্বিতীয়তঃ, যদিও একটি ইংলিশ গিরাবাজ বা একটি ছোট মুখওয়ালা লোটন পায়রা পাহাড়ি পায়রাদের থেকে কোন কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ভীষণভাবে ভিন্ন হয়, তবুও এই দুটি জাতের কয়েকটি উপজাত, বিশেষ করে দূরবর্তী দেশগুলিতে আনীত উপ-জাতগুলির তুলনা করে পাহাড়ি পায়রা ও এদের মধ্যে প্রায় নিখুঁত একটি শ্রেণী আমরা তৈরি করতে পারি; এভাবে অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রেও, অবশ্য সব জাতগুলির ক্ষেত্রে নয়, এরূপ শ্রেণী তৈরি করতে পারি আমরা। তৃতীয়তঃ, প্রত্যেক জাতে প্রধানত স্বাতন্ত্র-নির্দেশক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতিটিই বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল, যেমন গিরাবাজ পায়রার মাথার ঝুঁটি ও ঠোঁটের দৈর্ঘ্য, লোটন পায়রার ঝুঁটি ও ঠোঁটের হ্রস্বতা এবং লক্কা পায়রার লেজের পালকের সংখ্যা; নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনার সময় এই বিষয়টি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা হবে। চতুর্থতঃ, অনেক মানুষ অতি যত্ন সহকারে ও মনোযোগ দিয়ে পায়রাদের পর্যবেক্ষণ ও পালন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক হাজার বছর ধরে গৃহপালিত হয়েছে এরা; পায়রার সবচেয়ে পুরানো রেকর্ড হচ্ছে প্রায় ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ইজিপ্টের পঞ্চম রাজবংশের রাজত্বকালে, যেটি অধ্যাপক লেপসিয়াস আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; কিন্তু মিঃ বাৰ্চ, আমাকে অবহিত করেছেন যে পূর্ববর্তী রাজবংশের রাজত্বকালে পায়রাদের যাতায়াতের জন্য ভাড়া দেওয়া হত। যেমন আমরা প্লিনির লেখা থেকে জানতে পারি যে রোমানদের রাজত্বের সময় পায়রাদের জন্য অর্থ ব্যয় করা হত; “শুধু তাই নয়, এটি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এরা এদের কুলজি ও জাত বিচার করতে পারে।” ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতবর্ষের আকবর খান। পায়রাদের অত্যন্ত মূল্য দিতেন, তাঁর রাজসভায় কখনও ২০০০-এর কম পায়রা রাখা হত না। “ইরান ও তুরানের সম্রাটরা তাঁকে কয়েকটি বিরল জাতের পায়রা পাঠিয়েছিলেন, এবং রাজসভার ঐতিহাসিকরা আরও বলেন, “জাতগুলির মধ্যে সঙ্করণের দ্বারা সম্রাট এদের বিস্ময়করভাবে উন্নত করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে পায়রাদের সম্বন্ধে প্রাচীন রোমানদের মত ওলন্দাজরাও খুব আগ্রহী ছিল। পায়রাদের প্রচণ্ড পরিমাণ পরিবৃত্তি ব্যাখ্যা করতে এগুলো বিবেচনার গুরুত্ব স্পষ্টতর হবে যখন আমরা নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনা করব। তখন আমরা এ-ও দেখব যে কেমন করে কয়েকটি জাত প্রায়শই কিছু পরিমাণ বিকৃত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ভিন্ন জাত সৃষ্টির পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল অবস্থাটি হচ্ছে যাতে করে সহজেই বংশধর উৎপাদনের জন্য পুরুষ ও স্ত্রী পায়রারা মিলিত হতে পারে; এবং সেইজন্য বিভিন্ন জাতগুলোকে একত্রে একই পক্ষীশালায় রাখা যেতে পারে।

গৃহপালিত পায়রাদের সম্ভবপর উৎপত্তি সম্বন্ধে আমি কিছুটা অপর্যাপ্তভাবে আলোচনা করেছি; কারণ কেমন করে এরা সদৃশ বংশধর উৎপাদন করে তা ভালভাবে অবগত হয়ে আমি যখন প্রথম এদের পালন ও কয়েক প্রকার জাতকে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম, তখন আমি বিশ্বাস করতে অতিশয় অসুবিধা বোধ করেছিলাম যে যেহেতু এরা গৃহপালিত হয়েছিল, সেজন্য এরা একটি সাধারণ পিতামাতা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিঞ্চ পাখির অনেক প্রজাতি বা অন্য গোষ্ঠীর পাখিদের সম্পর্কে যে কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাত। একটি ঘটনা আমাকে অতিশয় আশ্চর্যান্বিত করেছে, যথা, যাদের সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি বা যাদের লেখা আমি পড়েছি এমন বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীর প্রায় সব প্রজননকারী ও কৃষকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কয়েকটি জাত অনেক আদিম ভিন্ন প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। যেমন, আমি যদি একজন বিখ্যাত হেরেফোর্ড গো-মহিষাদি প্রজননকারীকে জিজ্ঞাসা করি, যে তার গো-মহিষাদি লম্বা শিংওয়ালা গো-মহিষাদি থেকে বা উভয়েই সাধারণ পিতামাতা বংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা, তাহলে সে আপনার-আমার কথায় অবজ্ঞা সহকারে হেসে উঠবে। পায়রা বা গৃহপালিত পাখি ও হাঁস বা খরগোশ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আমি এমন একজনেরও সাক্ষাৎ পাইনি যিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন না যে প্রত্যেক প্রধান জাত একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ভ্যান মন্স ন্যাসপাতি ও আপেল সম্বন্ধে তার লেখা গ্রন্থরাজিতে দেখান কত চূড়ান্তভাবে তিনি অবিশ্বাস করেন যে রিবস্টোন-পিপ্পিন ও কডলিন-আপেলের মতো কয়েক জাতের আপেল একই গাছের বীজ থেকে উৎপন্ন হয়। অন্য অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারত। আমি মনে করি ব্যাখ্যাটি সরল : দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধানের পর কয়েকটি জাতের পার্থক্যগুলো সম্পর্কে তারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছে; এবং যদিও তারা ভালভাবে পরিচিত যে প্রত্যেক জাত খুব অল্প ভিন্ন হয়, সেজন্য তারা এই অল্প পার্থক্যযুক্ত জাতগুলোকে নির্বাচন করে, পুরস্কার লাভ করে, তথাপি তারা সমস্ত সাধারণ যুক্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করে এবং বহু বংশপরম্পরা ধরে অল্প পার্থক্যগুলো সঞ্চিত হয়েছে। এই ধারণাকে মনে স্থান দিতে অস্বীকার করে। আবার যখন প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি প্রজাতিকে অন্য প্রজাতির বংশধর হিসেবে ভাবার ধারণাকে উপহাস– করেন, তখনই এইসব প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা প্রজননকারীর তুলনায় বংশগতির নিয়মাবলী অতি অল্প ও দীর্ঘ বংশধারার মধ্যবর্তী অবস্থা সম্বন্ধে একেবারে কিছু না জানলেও স্বীকার করেন যে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলি একই পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

প্রাচীন যুগ থেকে অনুসৃত নির্বাচন পদ্ধতি, তাদের ফলাফল

এক-এক করে ধাপগুলো আমাদের এখন সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার, যাদের দ্বারা আমাদের গৃহপালিত জাতগুলো হয় একটি অথবা কয়েকটি সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কিছু ফল জীবনের বহিঃপরিবেশের প্রত্যক্ষ ও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া দ্বারা ঘটতে পারে, আবার কিছু ফল স্বভাবের জন্যও ঘটতে পারে। তা হলে তিনি একজন সাহসী লোক হবেন যিনি একটি ভারী ঠেলাগাড়ি-টানা ঘোড়া ও ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া, একটি গ্ৰেহাউণ্ড ও ব্লাডহাউণ্ড, একটি গিরাবাজ ও লোটন পায়রার মধ্যে পার্থক্যের জন্য এইসব মাধ্যমকে গুরুত্ব দেবেন। আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের অভিযোজন, যেটি ঘটে প্রকৃতপক্ষে প্রাণী বা উদ্ভিদের মঙ্গলের জন্য নয়, বরং মানুষের ব্যবহার ও পছন্দের জন্য। তার কাছে উপকারী কিছু পরিবৃত্তি সম্ভবতঃ হঠাৎ উদ্ভূত হয়, অথবা একটি ধাপের দ্বারা, যেমন, অনেক উদ্ভিদবিজ্ঞানী। বিশ্বাস করেন যে অঙ্কুশ সমেত ফুলারের টিশেল কেবল বন্য ডিস্যাকাসের একটি ভ্যারাইটি, যার কোন যান্ত্রিক কৌশলের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না, এই পরিমাণ পরিবৃত্তি হঠাৎ চারাগাছে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে। এভাবে খর্ব পাওয়ালা কুকুরের ক্ষেত্রেও এটি ঘটে থাকতে পারে; এবং এটি অতি খর্ব পাওয়ালা ভেড়ার ক্ষেত্রে ঘটে বলে অনেকেই জানে। কিন্তু যখন আমরা ভারী-ঠেলাগাড়ি-টানা ঘোড়া ও ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া, এক কুঁজওয়ালা উট ও সাধারণ উট এবং ভেড়ার বিভিন্ন জাতের তুলনা করি, যে ভেড়া হয় কৃষি জমি বা পাহাড়ি চারণভূমির জন্য উপযুক্ত, এবং যাদের একটি জাতের পশম এক উদ্দেশ্যে ও অন্যটির অন্য উদ্দেশ্যের জন্য উপযুক্ত; মানুষের কাছে বিভিন্ন জাতের কুকুর বিভিন্নভাবে উপকারী এমন কুকুরের জাতগুলো তুলনা করি; একগুঁয়ে লড়াকু মোরগের সঙ্গে অল্প কলহপ্রিয় মোরগ, এক জায়গায় বসতে চায় না এমন অনবরত ডিম পাড়া মুরগী, এবং ছোট্ট অথচ সুশ্রী ব্যানট্যাম জাতীয় লড়িয়ে গৃহপালিত মোরগের যখন আমরা তুলনা করি, যারা বিভিন্ন ঋতুতে ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে মানুষের এত প্রয়োজনীয় ও মানুষের চোখে এত মনোমুগ্ধকর; আমি মনে করি কেবল পরিবৃত্তি ছাড়াও অন্য কিছুও আমাদের লক্ষ্য করা উচিত। এখনকার মতো নিখুঁত ও উপকারী সমস্ত জাত হঠাৎ উদ্ভূত হয়েছিল কিনা তা আমরা কল্পনা করতে পারি না; অনেক ক্ষেত্রে আমরা জানি যে যথার্থই এটি এদের ইতিহাস নয়। চাবিকাঠিটি হচ্ছে সঞ্চয়ী নির্বাচনে মানুষের ক্ষমতা। প্রকৃতি আনুক্রমিক পরিবৃত্তিগুলি উৎপাদন করে; নিজের উপকার হয়। এমনদিকে মানুষ এদের সংযোজিত করে। এ অর্থে বলা যেতে পারে মানুষ নিজের প্রয়োজনে উপকারী জাত সৃষ্টি করে।

নির্বাচনের এই পদ্ধতিটির বিরাট ক্ষমতা অনুমানভিত্তিক নয়। এটা নিশ্চিত যে আমাদের সময়ের কয়েকজন প্রজননকারী তাদের নিজস্ব জীবনকালের মধ্যে গো-মহিষাদি ও ভেড়ার জাতগুলোকে বহুল পরিমাণে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁরা কী কী করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য বিষয়টি সম্বন্ধে লিখিত কয়েকটি বই পড়া ও প্রাণীদের সযত্নে নিরীক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। প্রজননকারীরা অভ্যাসবশতঃ বলেন যে প্রাণীদের জৈবিককঠন বেশ নমনীয়, যেমন খুশি তেমনভাবে এদের পরিবর্তিত করতে পারেন। যদি এখানে জায়গা থাকত, আমি অতিশয় দক্ষ বিশেষজ্ঞদের লেখা থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি দিতে পারতাম। ইউয়াট, যিনি অন্য যে কোন ব্যক্তির তুলনায় কৃষিবিজ্ঞানীদের লেখা ও কাজ সম্বন্ধে সম্ভবতঃ বেশি অবহিত ছিলেন এবং নিজেও প্রাণী সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, নির্বাচনের পদ্ধতিটি সম্পর্কে বলেন, “এটি শুধু গো-মহিষাদির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর ঘটায় তাই নয়, সম্পূর্ণরূপে এদের রূপান্তর ঘটাতে কৃষিবিজ্ঞানীদের ক্ষমতাও প্রদান করে। এটি যদুকরের যাদুদণ্ডের মতো যার দ্বারা তিনি জীবনের যে কোন আকার দিতে পারেন ও পছন্দমতো রূপদান করতে পারেন।” ভেড়ার ক্ষেত্রে প্রজননকারীরা কী করেছেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লর্ড সমারভিল বলেন, “মনে হবে যেন আপনা থেকে নিখুঁত একটি আকৃতি এরা দেওয়ালে এঁকেছে ও পরে সেটিকে বাস্তব রূপ দিয়েছে।” স্যানিতে মেরিনো ভেড়া সম্পর্কে নির্বাচনের পদ্ধতিটির গুরুত্ব পুরোপুরি স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে এটিকে মানুষ একটি ব্যবসা বলে গণ্য করে। যেমন একজন রসজ্ঞ ব্যক্তি একটি ছবির কদর করে, তেমনিভাবে ভেড়াদের একটি টেবিলের উপর রাখা হয় ও পর্যবেক্ষণ করা হয়; একমাস অন্তর-অন্তর এটি তিন বার করা হয় এবং প্রত্যেকবার ভেড়াদের চিহ্নিত শ্রেণীভুক্ত করা হয়, যাতে করে সর্বোত্তমটিকে প্রজননের জন্য নির্বাচিত করা যায়।

ইংরেজ প্রজননকারীরা আসলে কী ফল পেয়েছে, ভাল বংশতালিকা সমেত প্রাণীদের উচ্চ মূল্যই তা প্রমাণ করে; এবং এরা পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশে রপ্তানি হয়েছে। বিভিন্ন জাতের সঙ্করণের দ্বারা কোন মতেই সাধারণতঃ উৎকর্ষসাধন হয়নি। কোন কোন সময় নিকট সম্বন্ধীয় উপ-জাত ছাড়া সেরা প্রজননকারীরা এই প্রথার দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে। এবং যখন সঙ্করণ ঘটানো হয়, এমনকি সাধারণ ঘটনা ছাড়াও নিকটতম নির্বাচন আরও বেশি অপরিহার্য। যদি নির্বাচনের অর্থ কয়েকটি অতিশয় ভিন্ন। ভ্যারাইটির পৃথকীকরণ হয় এবং এর থেকে প্রজনন করা হয়, পদ্ধতিটি (নীতিটি) এতই স্পষ্ট হবে যা কদাচিৎ চোখে পড়ার যোগ্য; বরং পার্থক্যগুলির বংশপরম্পরায় একই দিকে পুঞ্জীভবনের দ্বারা উৎপন্ন বিরাট ফলাফলেই রয়েছে এটির গুরুত্ব, যেটি একজন। অশিক্ষিত লোকের চোখে ধরা পড়ে না–পার্থক্যগুলি ধরতে আমি একবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। একজন দক্ষ প্রজননকারী হওয়ার গুণ নিপুণ বিচার ক্ষমতা ও নিখুঁত চোখ যা এক হাজার জনের মধ্যে একজনেরও থাকে না। এইসব গুণ দ্বারা যদি ভূষিত হন। এবং যদি অনেক বছর ধরে পড়াশুনা করেন ও অদম্য ধৈর্য্যের সঙ্গে সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেন, তবে তিনি কৃতকার্য হবেন এবং বিরাট অগ্রগতি করতে পারবেন; এইসব গুণাবলী যে কোন একটি যদি তিনি চান, তাহলে নিশ্চিতভাবে অকৃতকার্য হবেন। এমনকি একজন দক্ষ পায়রা বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা ও স্বাভাবিক সামর্থ্যকে শুধু অল্প কয়েকজন সহজেই বিশ্বাস করবে।

উদ্যানবিদরাও একই নীতি বা পদ্ধতি অনুসরণ করেন; কিন্তু এখানে প্রকারণগুলি প্রায়শই আকস্মিক হয়। কেউই মনে করে না যে আমাদের উৎকৃষ্টতম উৎপাদনসমূহ আদিম বংশ (কুল) থেকে শুধুমাত্র একটি প্রকারণ দ্বারা উৎপাদিত হয়েছে। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে যে কয়েকটি ক্ষেত্রে এরূপ হয় না, যার লিখিত বিবরণ রয়েছে। এভাবে একটি তুচ্ছ উদাহরণ দিতে সাধারণ গুজবেরি অনবরত আকার বৃদ্ধির উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিশ বা ত্রিশ বছর আগে আঁকা ছবির সঙ্গে বর্তমানের ফুলের যখন তুলনা করা হয়, তখন অনেক ফুলচাষীর দ্বারা বিস্ময়কর উন্নতিসাধন আমরা লক্ষ্য করি। উদ্ভিদের একটি জাত যখন সুপুষ্ট হয়, বীজ-সংগ্রহকারী উৎকৃষ্ট গাছটি তোলে না, বরং সে এদের বীজতলা পরিদর্শন করে ও নিকৃষ্টগুলিকে তুলে ফেলে, তারা বলে যে এরা সঠিক মান থেকে বিচ্যুত হয়েছে। প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি একইভাবে অনুসরণ করা হয়, কারণ নিকৃষ্ট প্রাণীর প্রজনন ঘটাতে কোন লোক কদাচিৎ এত অসতর্ক হয়।

উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে নির্বাচন পদ্ধতির সঞ্চিত ফলাফল লক্ষ্য করার উপায় হচ্ছে–যথা, ফুলের বাগানে একই প্রজাতির বিভিন্ন ভ্যারাইটির ফুলের বৈচিত্র্য; একই ভ্যারাইটির ফুলের তুলনায় বাসগৃহ সংলগ্ন তরিতরকারীর বাগানের পাতা, শুটি বা কল অথবা প্রয়োজনীয় অংশগুলির বৈচিত্র্য; এবং ভ্যারাইটিদের একই গোষ্ঠীর পাতা ও ফুলের তুলনায় ফলের বাগানে একই প্রজাতির ফলের বৈচিত্র্য ইত্যাদির তুলনা করা। বাঁধাকপির পাতা কত বিভিন্ন ধরনের হয় ও ফুলগুলি একই ধরনের হয় তা লক্ষ্য করুন; হার্টসিজের ফুলগুলি কত অসদৃশ ও পাতাগুলি কত সদৃশ, গুজবেরি বিভিন্ন প্রকারের ফলের আকার, বর্ণ, আকৃতি ও রোম কত ভিন্ন ধরনের, তা সত্ত্বেও ফুলগুলি কত অল্প ভিন্ন। এটি এই নয় যে ভ্যারাইটিরা কোন একটি বৈশিষ্ট্যে বহুলাংশে ভিন্ন হয়, অন্য বৈশিষ্ট্যগুলিতে মোটেই ভিন্ন হয় না; এটি কদাচিৎ কখনও দেখা যায়–সতর্ক পর্যবেক্ষণের পর আমি বলছি, ঘটনাটি বোধহয় কখনও ঘটে না। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তির নিয়ম, যার গুরুত্ব কখনও উপেক্ষা করা উচিত নয়, কিছু কিছু বিভিন্ন তার বিষয়ে আলোকপাত করবে। কিন্তু একটি সাধারণ নিয়মানুসারে, এটি সন্দেহ করা যায় না যে হয় পাতায়, ফুলে অথবা ফলে স্বল্পমাত্রায় পরিবৃত্তিগুলির ক্রমাগত নির্বাচন পরস্পরের থেকে এইসব বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন জাতগুলোকে সৃষ্টি করবে।

বলা যেতে পারে যে নির্বাচন পদ্ধতিটিকে বড়জোর এক শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশের কিছুটা বেশি কাল ধরে নিয়মনিষ্ঠ চর্চায় রূপান্তরিত করা হয়েছে শেষের বছরগুলিতে বিষয়টি সম্পর্কে বেশি বেশি করে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে এবং বিষয়টি সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যার ফলাফল অনুরূপ মাত্রায় অতি দ্রুত ও গুরুত্বপূর্ণ। পদ্ধতিটি (নীতিটি) কিন্তু বর্তমান যুগের আবিষ্কার নয়। বিষয়টির উল্লেখ আছে এমন অতি প্রাচীন গ্রন্থ থেকে কয়েকটা উদ্ধৃতি দিতে পারতাম, যেখানে এই পদ্ধতিটির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে। অসভ্য ও বর্বর যুগের ইংল্যান্ডের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে সেখানে পছন্দমতো প্রাণীদের আমদানী করা হত এবং এদের রপ্তানীর বিরুদ্ধে আইন পাশ করা হয়েছিল। কোন কোন জাতের ঘোড়াকে হত্যা করার হুকুম জারী হয়েছিল এবং ফুলের বাগানে “নিকৃষ্ট” গাছগুলিকে মেরে ফেলার সঙ্গে এটির তুলনা করা যেতে পারে। আমি দেখেছি একটি প্রাচীন চীনা বিশ্বকোষে নির্বাচন পদ্ধতিটি স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। কয়েকজন প্রাচীন রোমান লেখকের লেখায় বিষয়টি সম্পর্কে নিয়মাবলী স্পষ্টভাষায় লেখা আছে। জেনেসিস’-এর অনুচ্ছেদগুলি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে আদিম যুগে গৃহপালিত প্রাণীদের শরীরের রঙের উপর মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। এখন অসভ্য মানুষরা কোন কোন সময় তাদের কুকুরদের জাতের উন্নতি ঘটাতে কুকুরসদৃশ প্রাণীদের সঙ্গে এদের সঙ্করণ ঘটায় এবং পূর্বেও তারা এটি করত, এ বিষয়টি প্লিনির লেখা গ্রন্থের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছে। আফ্রিকার অসভ্য মানুষরা তাদের ভারবাহী পশুদের শরীরের রঙ দেখে খুঁজে বার করে, এক্সিমোরাও এভাবে কুকুরদের খুঁজে বার করে। লিভিংস্টোন উল্লেখ করেছেন যে ইউরোপীয়দের সঙ্গে অপরিচিত মধ্য আফ্রিকার নিগ্রোরা উৎকৃষ্ট গৃহপালিত জাতদের ভাল দাম দেয়। এইসব তথ্যের কয়েকটি প্রকৃত নির্বাচনের ব্যাপারটি দেখায় না, বরং এটি দেখায় যে প্রাচীন যুগে গৃহপালিত প্রাণীদের প্রজনন বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হত, যেমন নিম্নতম অসভ্য মানুষরা এখনও মনোযোগ দেয়। যদি প্রজনন বিষয়ে মনোযোগ না দেওয়া হত, তা হলে এটি একটি অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে থাকত, কারণ ভাল ও মন্দ বৈশিষ্ট্য বংশানুসৃতির ফলে ঘটে বলেই এটি এত সুস্পষ্ট।

অচেতন নির্বাচন

বর্তমানে দক্ষ প্রজননকারীরা নিয়মানুগ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিশেষ দিকে লক্ষ্য রেখে দেশের প্রাপ্ত যে কোন জাতের তুলনায় একটি নূতন স্ট্রেন বা উপজাত সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু এখানে আমাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আর এক-প্রকার নির্বাচন অতি গুরত্বপূর্ণ, যেটিকে অচেতন নির্বাচন বলা যেতে পারে এবং যেটি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রাণী সংগ্রহ করা এবং তার থেকে ভাল জাত সৃষ্টির ব্যাপার অনেক মানুষের চেষ্টার ফল। ‘পয়েন্টার কুকুর’ পোষার জন্য একজন মানুষ সাধারণতঃ সবচেয়ে ভাল কুকুর পাওয়ার চেষ্টা করে, এবং পরে স্থায়ীভাবে জাতটিকে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা বা আশা না করেও নিজস্ব সর্বোত্তম কুকুরগুলি থেকে নূতন জাত সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও আমরা এই ধারণায় উপনীত হতে পারি যে কয়েক শতাব্দী ধরে অনুসৃত এই প্রক্রিয়াটি যে কোন জাতকে উন্নত ও রূপান্তরিত করবে, যেমন একই উপায়ে বেকওয়েল কলিন্স প্রমুখরা একই পদ্ধতির দ্বারা কেবল আরও বেশি নিয়মানুগভাবে তাদের জীবকালের মধ্যে তাদের গো-মহিষাদির আকার ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে দারুণভাবে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। বহু পূর্বে উল্লিখিত জাতগুলির তুলনা করার জন্য প্রকৃত পরিমাপ ও যত্নসহকারে ছবি আঁকা না হলে মন্থর ও অচেতন পরিবর্তনকে কখনও শনাক্ত করা যেতে পারে না, তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে একই জাতের অপরিবর্তিত বা অল্প পরিবর্তিত এককগুলি অনুন্নত জেলায় থাকে। বিশ্বাস করার যুক্তি আছে যে সম্রাট চার্লসের রাজত্বের সময় থেকে স্প্যানিয়েল কুকুররা অজ্ঞাতসারে বহুল পরিমাণে রূপান্তরিত হয়েছে। কয়েকজন অতিদক্ষ বিশেষজ্ঞ নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন যে গোয়েন্দা কুকুররা স্প্যানিয়েল কুকুর থেকেই প্রত্যক্ষভাবে উদ্ভূত হয়েছে এবং সম্ভবতঃ পরিবর্তনটি ধীরে ধীরে ঘটেছে। আমরা জানি যে ইংলিশ নির্দেশক কুকুররা গত শতাব্দীতেই দারুণভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং এটি বিশ্বাস করা হয় যে পরিবর্তনটি ফল্স হাউণ্ড কুকুরের সঙ্গে সঙ্করণের ফলেই মূলতঃ ঘটেছে; কিন্তু যেটি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তা হচ্ছে পরিবর্তনটি অজ্ঞাতসারে ও পর্যায়ক্রমে ঘটেছে, তথাপি এত অভীষ্ট ফলদায়করূপে ঘটেছে যে প্রাচীন স্প্যানিশ নির্দেশক কুকুররা নিশ্চিতভাবে স্পেন দেশ থেকে এসে থাকলেও মিঃ বরোর কাছ থেকে জেনেছি যে তিনি আমাদের পয়েন্টার কুকুরের মতো কোন স্থানীয় কুকুর স্পেনে দেখেন নি।

নির্বাচনের এরূপ প্রক্রিয়া ও শিক্ষার মাধ্যমে ইংলিশ ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ারা তাদের আরবীয় পিতা-মাতাদের দ্রুতগামীতায় ও আকারে ছাড়িয়ে যায়। আরব ঘোড়াদের আইন মারফত মালবহনক্ষম গুডহুড দৌড়ের জন্য বাছাই করা হয়। লর্ড স্পেনসার ও অন্যান্যরা দেখিয়েছেন কেমন করে ইংল্যান্ডের গো-মহিষাদির ওজন বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঐ দেশের আগেকার কুলগুলির তুলনায় বেড়েছে। ব্রিটেন, ভারতবর্ষ ও পারস্যদেশের গিরাবাজ ও লোটন পায়রাদের অতীত ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থাদিতে প্রদত্ত বিবরণের তুলনা করে আমরা সেই ধাপগুলির খোঁজ করতে পারি, যার মধ্য দিয়ে এরা ধাপে ধাপে এগিয়েছে ও পাহাড়ি পায়রাদের থেকে এত ভিন্ন হয়েছে।

ইউয়াট নির্বাচন প্রক্রিয়ার ফলাফলের একটি সুন্দর উদাহরণ উপস্থিত করেছেন যেটিকে অচেতন নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যতদূর পর্যন্ত বলা যায় যে প্রজননকারীরা পরিণামস্বরূপ ফল উৎপাদন করার আশা অথবা ইচ্ছা প্রকাশ না করে থাকতে পারে- যেমন দুটি স্বতন্ত্র স্ট্রেনের উৎপাদন। ইউয়াটের বক্তব্য থেকে জানা যায়, “মিঃ বাকলে ও মিঃ বার্জেস-এর পোষা লাইচেস্টার ভেড়ার দুটি পালকে” পঞ্চাশ বছরেরও অধিক কাল ধরে মিঃ বেকওয়েলের পোষা আদিম বংশ থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রজনন করা হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত এমন কারও মনে এতটুকুও সন্দেহ নেই যে উভয়ের মধ্যে যে কোন মালিক মিঃ বেকওয়েলের পোষা পালটির বিশুদ্ধ রক্ত থেকে যে কোন বিষয়ে বিচ্যুত হয়েছে, এবং তা সত্ত্বেও এই দুজন ভদ্রলোকের পালিত ভেড়াদের পার্থক্য এত বিরাট যে এরা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভ্যারাইটির আকার ধারণ করেছে।”

যদি বর্বরদের মতো বন্য মানুষরা থাকত যারা কখনই তাদের গৃহপালিত প্রাণীদের বংশধরের বংশগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা চিন্তা করে না, তথাপি বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য তাদের কাছে বিশেষভাবে উপকারী যে কোন একটি প্রাণী প্রায়শই ঘটা দুর্ভিক্ষ ও, অন্যান্য দুর্ঘটনার সময় যত্ন সহকারে সংরক্ষিত হবে এবং এরূপ বাছাই করা প্রাণীরা নিকৃষ্টদের তুলনায় এভাবে সাধারণতঃ আরও বেশি বংশধর উৎপাদন করবে; যার। ফলে এ ক্ষেত্রে এক প্রকার অচেতন নির্বাচন হয়ে থাকবে। আমরা লক্ষ্য করি যে অভাবের সময় নিজেদের বৃদ্ধ স্ত্রীলোকদের হত্যা করা ও মাংস খাওয়ায় অভ্যস্ত এমনকি তিয়েরা দেল ফুয়েগোর বর্বররাও তাদের কুকুরদের তুলনায় প্রাণীদের কম মূল্য দেয়।

প্রথম আবির্ভাবে গুণগতভাবে ভিন্ন ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করতে যথেষ্ট ভিন্ন হোক বা না হোক এবং দুই অথবা ততোধিক প্রজাতি বা জাত সঙ্করণের মাধ্যমে মিশ্রিত হোক বা না হোক, উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট এককদের মাঝে মাঝে সংরক্ষণ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আকার ও সৌন্দর্যের ক্রমোন্নতির একই প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা যেতে পারে, যেগুলি আগেকার ভ্যারাইটি বা পিতামাতা বংশের তুলনায় আমরা হার্টসিজ, গোলাপ, পেলাগোনিয়াম, ডালিয়া ও অন্যান্য উদ্ভিদের ভ্যারাইটিগুলোতে আমরা লক্ষ্য করি। একটি বন্য উদ্ভিদের বীজ থেকে শ্রেষ্ঠ হার্টসিজ বা ডালিয়া পাওয়ার আশা কারও করা উচিত নয়। বন্য ন্যাসপাতির বীজ থেকে একটি সবচেয়ে নরম ন্যাসপাতির উদ্ভব ঘটানোর আশা কেউই করে না, যদিও বন্য অবস্থায় জন্মানো একটি দুর্বল গাছ থেকে এটি ঘটাতে তিনি সফল হবেন যদি এটি বাগানকুল থেকে নেওয়া হয়। প্লিনির বর্ণনা থেকে জানা যায় ন্যাসপাতি অতি নিকৃষ্ট ধরনের একটি ফল যা প্রাচীনকালেও চাষ হত। নিকৃষ্ট উপাদান থেকে উচ্চমানের ফলাফল সৃষ্টি করতে বাগানবিদদের অসাধারণ দক্ষতা সম্বন্ধে বাগানসম্বন্ধীয় রচনাবলীতে পরম আশ্চর্য প্রকাশ হতে আমি দেখেছি। কিন্তু ব্যবহারিক বিদ্যাটি সরল এবং সর্বশেষ পরিণামের কথা চিন্তা করলে মনে হয় বিদ্যাটি প্রায় অচেতনভাবে অনুসৃত হয়েছে। বিদ্যাটি হচ্ছে সুপরিচিত ভ্যারাইটি (প্রকার) চাষ করা, এর বীজ বপণ করা এবং সবচেয়ে ভাল ভ্যারাইটি যখন হঠাৎ আবির্ভূত হয় তখন এটিকে নির্বাচিত করা এবং এভাবে চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু প্রাচীন যুগের বাগানবিদরা কখনও ভাবেনি কি উৎকৃষ্ট ফল আমরা খাব, যারা তাদের সংগৃহীত সর্বোত্তম ন্যাসপাতি চাষ করত; যদিও উৎকৃষ্ট ফলটির জন্য তাদের কাছে আমরা কিছু মাত্রায় ঋণী, কারণ তারা যেখানেই পেত সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ভ্যারাইটিকে নির্বাচন ও সংরক্ষণ করত।

আমি বিশ্বাস করি এভাবে মন্থর ও অচেতনভাবে পুঞ্জীভূত বিরাট পরিবর্তন স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে যে অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভিদের বন্য পিতামাতা বংশ আমরা চিনতে পারি না অর্থাৎ জানি না, যেগুলি আমাদের ফুলের ও গৃহসংলগ্ন বাগানে দীর্ঘদিন ধরে চাষ হয়ে আসছে। মানুষের কাছে উপকারিতার বর্তমান মানে পৌঁছাতে আমাদের অধিকাংশ উদ্ভিদদের উন্নত ও রূপান্তর ঘটাতে যদি শত সহস্র বছর লেগে যায়, তা হলে আমরা বুঝতে পারি কেন অস্ট্রেলিয়া, উত্তমাশা অন্তরীপ ও সম্পূর্ণ অসভ্য মানুষের বাস এমন যে কোন অঞ্চল চাষযোগ্য একটিও উদ্ভিদ আমাদের দেয়নি। এটি এই নয় যে উদ্ভিদ প্রজাতিতে পরিপূর্ণ এইসব দেশগুলিতে যে কোন উপকারী প্রজাতিদের আদিম বংশের উদ্ভিদ নেই, বরং প্রাচীন সুসভ্য দেশগুলিতে উদ্ভিদদের অর্জিত নিখুঁত মানে, পৌঁছানোর তুলনায় স্থানীয় উদ্ভিদের নিরবচ্ছিন্ন নির্বাচনের দ্বারা ঐ মানে উন্নত করা যায়নি।

অসভ্য মানুষের পোষা গৃহপালিত প্রাণীদের সম্পর্কে এটি উপেক্ষা করা উচিত নয় যে অন্ততঃ কোন কোন মরসুমে এদের খাদ্যের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এবং ভিন্ন পরিবেশের দুটি দেশে, জৈবিক গঠন ও কাঠামোয় অল্প পার্থক্যযুক্ত একই প্রজাতির এককগুলি অন্যটির তুলনায় একটি দেশে প্রায়শই সফলতা লাভ করবে এবং এইরূপে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়াটি দ্বারা দুটি উপজাত সৃষ্টি হয়ে থাকবে, যে বিষয়ে পরে ভালভাবে আলোচনা করা হবে। বোধ হয় এটি অংশতঃ ব্যাখ্যা করে কেন অসভ্য মানুষদের পোষা ভ্যারাইটিগুলি সভ্য দেশে পোষা ভ্যারাইটিদের তুলনায় বিশুদ্ধ প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বেশির ভাগের অধিকারী হয়, যেটি অনেক বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন।

মানুষের দ্বারা নির্বাচন প্রক্রিয়াটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখানে প্রদত্ত এই মতবাদটি অনুসারে এটি তৎক্ষণাৎ স্পষ্ট হয় যে কেন মানুষের প্রয়োজন ও শখের জন্য আমাদের গৃহপালিত জাতগুলো স্বভাবে ও দেহগঠনে অভিযোজিত হয়। আমি মনে করি গৃহপালিত জাতগুলির প্রায়শই উদ্ভূত অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধারণ সম্পর্কে আমরা বুঝতে পারি এবং এভাবেও বাইরের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য এত বিরাট ও ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এটি আপেক্ষিকভাবে কত অল্প তা-ও বুঝতে পারি। প্রত্যক্ষভাবে দৃষ্টিগোচর হয় এমন বিচ্যুতি ছাড়া জৈবিক গঠনের কোন বিচ্যুতি মানুষ কদাচিৎ নির্বাচন করে বা কেবল কষ্টসাধ্যভাবে নির্বাচন করে। বাস্তবিকপক্ষে ভিতরের গঠনের দিকে সে কদাচিৎ মন দেয়। অল্পমাত্রায় প্রাকৃতিক অবস্থায় উৎপন্ন পরিবৃত্তিগুলি ছাড়া সে কখনও নির্বাচনের কাজটি করতে পারে না। অস্বাভাবিকভাবে অল্পমাত্রায় বর্ধিত লেজ সমেত অথবা অস্বাভাবিক আকারের গলার থলি সমেত পায়রাদের না দেখে কোন মানুষ লক্কা বা পাউটার পায়রা সৃষ্টির কোন চেষ্টাই করবে না; এবং প্রথম আবির্ভাবে কোন বৈশিষ্ট্য যত বেশি অস্বাভাবিক বা অনিয়মিত হয়, তত বেশি এটি তার মনোযোগ আকর্ষণ করবে। কিন্তু একটি লক্কা পায়রা সৃষ্টিতে যে মত প্রকাশ করা হয়, কোন সন্দেহ নেই। সেটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে ত্রুটিপূর্ণ। একজন মানুষ যখন অল্প বড় লেজওয়ালা একটি পায়রা নির্বাচন করে, তখন ঐ পায়রাটির বংশধররা অংশতঃ অচেতন ও অংশতঃ নিয়মানুগ অবিরাম নির্বাচনের মাধ্যমে হয়েছিল কি না সে কখনও এই অলীক কল্পনা করেনি। বর্তমানের জাভা দেশীয় লক্কা পায়রা বা অন্য এবং ভিন্ন জাতের এককদের মতো, যাদের কম করেও সতেরোটি লেজের পালক গণনা করা হয়েছে, বোধ হয় সব লক্কা পায়রাদের পিতামাতা পাখিটির কেবল চোদ্দটি কিছু পরিমাণ প্রসারিত লেজ পালক ছিল। বর্তমানের টারবিট পায়রারা যেভাবে তাদের অন্ননালীর উপরের অংশ ফোলায় তার তুলনায় বোধ হয় প্রথম সৃষ্ট পাউটার পায়রাটি তার গলার থলি আরও বেশি ফোলাতো না–এই স্বভাবটিকে সব পাখিরসিকরা অবজ্ঞা করে, কারণ নূতন জাত সৃষ্টির পক্ষে এটি কোন প্রয়োজনীয় বিষয় নয়।

ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে দেহগঠনের কোন বিরাট বিচ্যুতি পাখিপ্রেমিকদের চোখে লাগার জন্য প্রয়োজন হবে : সে অতি অল্প পার্থক্যকেও চিনতে পারে এবং মানুষের প্রবৃত্তি হল যত অল্পই হোক যে কোন নূতনত্বকে মূল্য দেওয়া। একই প্রজাতির এককদের অল্প পার্থক্যকে পূর্বে যে মূল্য দেওয়া হতো, কয়েকটি জাতের সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই মূল্য দেওয়া নিশ্চয় বিচারযোগ্য নয়। অনেকেরই জানা আছে। যে পায়রাদের মধ্যে অনেক অল্প পরিবৃত্তি অনিয়মিতভাবে আবির্ভূত হয়, কিন্তু এগুলি প্রত্যেক জাতের  নিখুঁততার মান থেকে বিচ্যুত বা অসম্পূর্ণ বলে বাতিল করা হয়। সাধারণ রাজহাঁস বা কোন স্পষ্ট চিহ্নিত ভ্যারাইটি উৎপাদন করে না; এই কারণে টাউলাউস ও সাধারণ জাতটি সাম্প্রতিক কালে গৃহপালিত পাখিদের প্রদর্শনীতে স্বতন্ত্র পাখি হিসেবে প্রদর্শিত হয়, যা কেবল সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী বৈশিষ্ট্য বর্ণের দ্বারা পৃথক করা হয়।

এইসব মতবাদ বোধ হয় স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে যে আমাদের যে কোন গৃহপালিত জাতগুলোর উৎপত্তি ও ইতিহাস সম্বন্ধে আমরা কদাচিৎ কিছু জানি। কিন্তু, আসলে কোন ভাষার একটি উপভাষার মতো একটি জাতের উৎপত্তিও স্বতন্ত্রভাবে হয়েছে, এটি কদাচিৎ বলা যেতে পারে। দেহগঠনের অল্প বিচ্যুতি সমেত একটি একককে মানুষ সংরক্ষণ করে ও তার বংশবৃদ্ধি ঘটায় বা তার সর্বোত্তম প্রাণীদের খুঁজে বের করতে প্রচলিত পন্থার চেয়ে বেশি যত্ন নেয়, এবং এভাবে তাদের উন্নত করে এবং উন্নত প্রাণীরা সন্নিহিত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত এদের কোন স্বতন্ত্র নাম কদাচিৎ হয়ে থাকবে, এবং এদের অল্প উপযোগিতার মূল্য না দিয়ে এদের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা হয়ে থাকবে। একই মন্থর ও ক্রমিক প্রক্রিয়া দ্বারা আরও উন্নত। হলে এদের আরও ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটবে, এবং ভিন্ন ও মূল্যবান জাত হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম একটি প্রাদেশিক নাম পেয়ে থাকবে। অল্প অবাধ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে এমন অর্ধসভ্য দেশগুলিতে একটি নূতন উপ-জাতের বিস্তার মন্থর গতিতে ঘটবে। উপযোগিতার প্রশ্নটি যে মুহূর্তে স্বীকৃতি লাভ করে, যেটিকে আমি বলি অচেতন নির্বাচন, প্রক্রিয়াটি–যেহেতু জাতটির বৈশিষ্ট্যে উত্থান ও পতন হয়, বোধ হয় অন্য পর্যায়ের তুলনায় এক পর্যায়ে আর বেশিভাবে অধিবাসীদের সভ্যতা অনুসারে, সম্ভবতঃ অন্য জেলায় আরও বেশি ভাবে–যদি জাতটিতে নূতন বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে যোগ করে, তাহলে প্রক্রিয়াটি সর্বদাই চালিত হবে। কিন্তু এরূপ মন্থর, ভিন্ন প্রকার, অচেতন পরিবর্তনগুলির সংরক্ষণের সম্ভাবনা নিতান্তই নগণ্য।

মানুষের নির্বাচন শক্তির অনুকূল পরিবেশ

মানুষের নির্বাচন শক্তির অনুকূল বা প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে আমি কয়েকটি কথা বলব। অধিক পরিবৃত্তি স্পষ্টতঃই অনুকূল হয়, কারণ এটি নির্বাচনের জন্য উপাদান অবাধে প্রদান করে। আকাঙ্খিত যে কোন দিকে বিপুল পরিমাণ রূপান্তরের পুঞ্জীভবনের জন্য এককীয় পার্থক্যসমূহ যথেষ্ট নয়। কিন্তু যেহেতু মানুষের কাছে উপকারী ও মানুষকে সন্তুষ্টকারী পরিবৃত্তিগুলি কেবল অনিয়মিতভাবে আবির্ভূত হয়, সেহেতু অসংখ্য একক রাখলে এদের আবির্ভাবের সম্ভাবনা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। অতএব সংখ্যাই হচ্ছে সাফল্যের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতিটির উপর ভিত্তি করে ইয়র্কশায়ারের কোন অঞ্চলের ভেড়াদের সম্পর্কে মার্শাল মন্তব্য করেছিলেন, “যেহেতু এরা দরিদ্র মানুষের অধিকারভুক্ত ও সংখ্যায় অল্প, তাই কখনও এদের উন্নত করা যেতে পারে না।” অন্যদিকে, একই উদ্ভিদের বিরাট সংখ্যক এককদের রক্ষণাবেক্ষণ করে মালীরা সাধারণতঃ অপেশাদারদের তুলনায় নূতন ও মূল্যবান ভ্যারাইটির উদ্ভব ঘটাতে আরও বেশি সাফল্য লাভ করে। একটি প্রাণী ও উদ্ভিদের বিরাট সংখ্যক এককদের লালনপালন করা যেতে পারে কেবলমাত্র সেখানেই, যেখানে বংশবৃদ্ধির পরিবেশ অনুকূল। যখন এককগুলি অপ্রচুর, তখন এদের বংশবৃদ্ধি ঘটতে দিলে, এদের বৈশিষ্ট্যমূলক গুণ যা-ই হোক, এরা সার্থকভাবে নির্বাচন প্রতিরোধ করবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হচ্ছে উদ্ভিদ বা প্রাণীদের এত উচ্চ মূল্য দেবার জন্য মানুষ তাদের গুণ বা দেহের অল্পতম বিচ্যুতির প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। যদি এভাবে মনোযোগ না দেওয়া হয়, কোন কিছুই ঘটানো যেতে পারে না। গুরুগম্ভীরভাবে বলতে শুনেছি যে স্ট্রবেরী গাছ পরিবর্তিত হতে শুরু করে তখনই যখন বাগানবিদরা গাছটির দিকে নজর দেয়। সন্দেহ। নেই যে স্ট্রবেরী গাছের চাষ শুরুর সময় থেকেই সর্বদা পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল, কিন্তু অল্পতম ভ্যারাইটিগুলিকে অবহেলা করা হয়েছিল। তবে যখনই বাগানবিদরা অল্প বড় আকারে, ভাল ফল সমেত এই উদ্ভিদগুলিকে তোলেন, এদের থেকে চারাগাছ তৈরী করেন এবং পুনরায় উৎকৃষ্টতম চারাগাছ তোলেন, এদের বংশবৃদ্ধি (স্বতন্ত্র প্রজাতির সঙ্গে সঙ্করণের সাহায্যে) ঘটান, তখন থেকেই স্ট্রবেরী গাছের ঐ সব বিস্ময়কর ভ্যারাইটিদের উদ্ভব হয়েছিল যা গত অর্ধশতাব্দীতেই ঘটেছে।

প্রাণীদের ক্ষেত্রে, নূতন জাত সৃষ্টিতে সঙ্করণ প্রতিরোধ করাই হচ্ছে একটি প্রধান উপাদান–অন্ততঃ একটি দেশে যেখানে অন্যান্য জাত অধিক সংখ্যায় পরিপূর্ণ, এ ব্যাপারে কোন অঞ্চলের সীমাবেষ্টনী একটি ভূমিকা পালন করে। আদিম অসভ্য ও মুক্ত সমতলের অধিবাসীদের কাছে একটি প্রজাতির একটি জাতের বেশি জাত কদাচিৎ থাকে। পায়রাদের মিলন ঘটানো যেতে পারে, এবং এটি পাখিরসিকদের পক্ষে খুব সুবিধাজনক, কারণ একই পক্ষিশালায় মিশ্রিত থাকে এমন অনেক জাতকে উন্নত ও বিশুদ্ধ অবস্থায় রাখা যেতে পারে; এবং এই পরিবেশ নূতন জাত সৃষ্টিতে নিশ্চয়ই অনুকূল হয়ে থাকবে। আমি যোগ করতে পারি যে পায়রাদের অধিক সংখ্যায় এবং দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং নিকৃষ্টদের সহজেই বাতিল করা যেতে পারে ও হত্যার পর এদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে, বিড়ালদের ক্ষেত্রে, যাদের মতো রাত্রিতে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসবিশিষ্ট জুড়ি খুঁজে বার করা যায় না এবং যাদের মহিলা ও শিশুরা খুব পছন্দ করে, একটি স্বতন্ত্র জাত দীর্ঘদিন ধরে টিকে রয়েছে এমনটা আমরা কদাচিৎ লক্ষ্য করি। আমরা অনেক সময় দেখি যে এইসব জাত অন্য দেশ থেকে আমদানী করা হয়েছে। যদিও আমি সন্দেহ করি না যে কয়েকটি গৃহপালিত প্রাণী অন্যদের তুলনায় কম হারে পরিবর্তিত হয়, তথাপি বিড়াল, গাধা, ময়ূর, রাজহাঁস প্রভৃতির স্বতন্ত্র জাতদের বিরলতা বা অনুপস্থিতির জন্য বলা যেতে পারে যে নির্বাচন পদ্ধতিটি বহুলাংশে তার ভূমিকা পালন করে না; বিড়ালদের ক্ষেত্রে এদের মিলন ঘটানোর অসুবিধা; গাধাদের ক্ষেত্রে, দরিদ্র মানুষরা কয়েকটিকে পোষে ও তাদের বংশবৃদ্ধিতে কদাচিৎ মনোযোগ দেয়; সম্প্রতিকালে স্পেন ও ইউনাইটেড স্টেক্স-এর কোন কোন অঞ্চলে যত্নসহকারে নির্বাচন দ্বারা এই প্রাণীটি বিস্ময়করভাবে রূপান্তরিত ও উন্নত হয়েছে; ময়ূরদের ক্ষেত্রে, এদের সহজেই পালন করা যায় না ও অধিক সংখ্যায় বৃদ্ধি করা যায় না; রাজহাঁসরা কেবলমাত্র দুটি বিষয় অর্থাৎ খাদ্য ও পালকের জন্য মূল্যবান এবং বিশেষ করে স্বতন্ত্র জাতগুলি প্রদর্শন করিয়েও কোন আনন্দানুভূতি উদ্রেক করে না; কিন্তু গৃহপালনাধীন পরিবেশে রাজহংসীদের দেহগঠন অদ্ভুতভাবে অনমনীয়, তা সত্ত্বেও আমি অন্যত্র বর্ণনা করেছি যে এরা অল্পমাত্রায় পরিবর্তিত হয়।

কয়েকজন লেখক দৃঢ়ভাবে মত পোষণ করেন যে আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনসমূহে পরিবৃত্তির পরিমাণ শেষ সীমায় পৌঁছেছে এবং এগুলি কখনই এই সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে না। নিশ্চিত করে বললে বেশি হঠকারিতা হবে যে, যে কোন একটি ক্ষেত্রে শেষ সীমায় পৌঁছানো গিয়েছে; কারণ আমাদের সব প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকাংশই সম্প্রতিকালে অনেক বিষয়ে দারুণভাবে উন্নত হয়েছে এবং এটি পরিবৃত্তির ইঙ্গিত দেয়। আরও নিশ্চিতভাবে বললে একইরকম হঠকারিতা হবে যে প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছানো বর্তমানে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলি, অনেক শতাব্দী ধরে স্থির থাকার পর জীবনের নূতন পরিবেশে পুনরায় পরিবর্তিত হতে পারত না। মিঃ ওয়ালেসের মতানুসারে–যাঁর মতের যথেষ্ট সত্যতা আছে–কোন সন্দেহ নেই যে অন্ততঃ একটি সীমায় পৌঁছানো যাবে। উদাহরণস্বরূপ যে কোন স্থলচর প্রাণীর দ্রুতগামিতার বৈশিষ্ট্য নিশ্চয় থাকবে, কারণ ঘর্ষণকে কাটিয়ে ওঠা, শরীরের ভার বহনের ক্ষমতা ও মাংসপেশীর সংকোচনের দ্বারা এটি নির্ধারিত হবে, কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের ভাবিত করে তা হচ্ছে–একই প্রজাতির গৃহপালিত ভ্যারাইটিগুলি একই গণের ভিন্ন প্রজাতিদের তুলনায় প্রায় সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরস্পরের থেকে আরও বেশি ভিন্ন হয়, যে বৈশিষ্ট্যগুলোতে মানুষ বেশি মনোযোগ দেয় ও নির্বাচিত করে। ইসিডোরে জিওফ্রয় সেন্ট হিলারে আকার, বর্ণ, সম্ভবতঃ লোমের ক্ষেত্রেও এটি প্রমাণ করেছেন। দ্রুতগামিতার ক্ষেত্রে বলা যায় এটি অনেক শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভরশীল, কারণ। অতিশয় দ্রুতগামী এবং একই গণের অন্তর্গত যে কোন দুটি প্রাকৃতিক প্রজাতির তুলনায় ভারী ঠেলাগাড়ি-টানা ঘোড়া তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, বিন অথবা ভূট্টার বিভিন্ন ভ্যারাইটিদের বীজগুলি একই দুটি গোত্রের যে কোন একটি গণের ভিন্ন প্রজাতিদের বীজগুলির তুলনায় আকারে সম্ভবতঃ আরও বেশি ভিন্ন হয়। এটি কুলগাছের কয়েকটি ভ্যারাইটির ফল সম্পর্কেও খাটে, এবং তরমুজ জাতীয় গাছের ক্ষেত্রে আরও বেশিভাবে এবং সদৃশ অনেক ক্ষেত্রেও ঘটে।

প্রাণী ও উদ্ভিদের জাতগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে সংক্ষেপে মূল কথা হল–জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশ জীবদেহে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে এবং অপ্রত্যক্ষভাবে জননতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, উভয় উপায়েই পরিবৃত্তি ঘটাতে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে প্ৰকারণ সকল অবস্থায় একটি সহজাত ও প্রয়োজনীয় আকস্মিক উপাদান। বংশগতি ও পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের কম বা বেশি ক্ষমতা পরিবৃত্তিসমূহ স্থায়ী হবে কিনা নির্ধারণ করে। পরিবর্তনশীলতা (প্রকারণ) অনেক অজানা নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যার মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত ক্রমিকবৃদ্ধি সম্ভবতঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের পরিবেশের নির্দিষ্ট প্রভাবের উপর কিছুটা আরোপ করা যেতে পারে, কিন্তু কতখানি তা আমরা জানি না। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যবহার বা অব্যবহারেরও কিছু প্রভাব থাকে, সম্ভবতঃ বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবই থাকে, এটি বলা যেতে পারে। সর্বশেষ ফলাফল অত্যন্ত জটিল। কয়েকটি ক্ষেত্রে, আমাদের জাতগুলি সৃষ্টি করতে আদিম ভিন্ন প্রজাতিদের আন্তঃসঙ্করণ বোধ হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যখন কয়েকটি জাত একবার কোন দেশে উদ্ভূত হয়, তখন নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের আকস্মিক আন্তঃসঙ্করণ নিঃসন্দেহেই নূতন উপজাত সৃষ্টিতে বহুলাংশে সাহায্য করেছে; কিন্তু প্রাণী ও বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি করা উদ্ভিদের উভয় ক্ষেত্রে সঙ্করণের প্রয়োজনীয়তাকে অতিশয় অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। সাময়িকভাবে কর্তিত অংশ, কুঁড়ি ইত্যাদি দ্বারা বংশবৃদ্ধি করতে অত্যন্ত উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে সঙ্করণের প্রয়োজনীয়তা অসীম; কারণ চাষীরা সঙ্কর, বর্ণসঙ্কর উভয়েরই অত্যধিক পরিবর্তনশীলতা (প্রকারণ)-কে এবং সঙ্করদের বন্ধ্যাত্বকে এখানে অবজ্ঞা করে; বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি করে না এমন উদ্ভিদগুলি আমাদের কাছে অল্প গুরুত্বের, কারণ এদের স্থায়িত্বকাল ক্ষণস্থায়ী। পরিবর্তনের এইসব কারণগুলির মধ্যে নিয়মানুগভাবে এবং দ্রুতহারে প্রয়োগ হোক বা না হোক, অথবা অচেতনভাবে ও মন্থরভাবে কিন্তু আরও দক্ষতার সঙ্গে নির্বাচনের সঞ্চয়কারক প্রক্রিয়াটি সম্ভবতঃ সর্বাধিক শক্তিমান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *