০. ঐতিহাসিক রূপরেখা / ভূমিকা

প্রসঙ্গ ও বাংলা অনুবাদ

বেশি দিনের কথা নয়, একজনকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে তুলে দিতে সকালবেলা হাওড়া স্টেশনে যেতে হয়েছিল। ট্রেনের সময়ের বেশ খানিকটা পূর্বেই উপস্থিত হওয়ায় আজকাল বসবার জন্য গোল করে চেয়ার পেতে তৈরি দ্বীপের দুটি চেয়ারে আমরা। দুজনে বসে কথা বলছিলাম। আমি যাকে তুলে দিতে গেছিলাম, তিনি তার সপ্তাহ। খানেক আগেই বেশ কিছুদিন মস্কো, আজকের রাশিয়ায় ঘুরে এসেছেন। তার কাছে প্রশ্ন করছিলাম দেশটাকে কেমন দেখলেন, সাধারণ মানুষের অবস্থা, তাদের মনোভাব কেমন বুঝলেন, পুরাতন সোবিয়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের এখনকার মনোভাব কেমন, এই সব আর কি।

তার উত্তরের প্রধান কথাই ছিল, “আমি ত পুরাতন সোবিয়েত দেখিনি, তাই তুলনার কোন প্রশ্নই আমার কাছে ছিল না। সব থেকে বড় বাধা ছিল ভাষা। কোথাও কেউ রুশ ভাষা ছাড়া কথা বলে না, বা অন্য ভাষা, যেমন ইংরাজি, জার্মান, ফরাসি, বাংলা, হিন্দি কোন ভাষাই কেউ বোঝে না। তাই সর্বত্র প্রচণ্ড অসুবিধা।” তবু ওনার আত্মীয়রা বিগত ৩০ বছরেরও বেশি ও-দেশে থাকায় ও সকলেই রুশ ভাষায় যথেষ্ট পারঙ্গম হওয়ায় তারা কেউ সঙ্গে থাকলে তবেই কথা বলা বা তাদের কথা বোঝা সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় একেবারেই জম্বৎ চলাফেরা। তবে বিদেশিদের, বিশেষ করে ভারতীয়দের প্রতি একটা হৃদ্যতা ও কথা বলার চেষ্টা, একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ইচ্ছা বয়স্ক পুরুষ মহিলাদের মধ্যে বেশ লক্ষণীয়। আমরা এই সব কথা যখন আলোচনা করছিলাম, তখন আমাদের পাশেই বসে থাকা আর একটি পরিবারের প্রৌঢ় মহিলা বোধ হয় আমাদের কথা একটু মন দিয়েই শুনছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, “কেন, ওরা ইংরাজি জানে না বা বোঝে না?” উত্তরে না শুনে চোখেমুখে যত না বিস্ময়, তার অপেক্ষা অবিশ্বাসের ছাপটাই যেন ধরা পড়ে বেশি। ইংরাজি ভাষা সম্পর্কিত প্রভাবে এঁরা এতই প্রভাবিত ও বিশ্ব সম্পর্কে এঁদের জ্ঞানের বহর এতদূর যে এঁরা মনে করেন যে পৃথিবীর সব দেশেই সবাই না হলেও লেখাপড়া জানারা ইংরাজি জানেন বা বোঝেন আর উচ্চশিক্ষার। অর্থই ইংরাজি। ফলস্বরূপ স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ শক্তিশালী বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভাষা থাকা সত্ত্বেও ইংরাজি ছাড়া উচ্চশিক্ষার দরজা আমাদের কাছে বন্ধ। কারণ জিজ্ঞাসা করলে একটাই উত্তর–নানা বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বই কোথায়? কথাটি অসত্য নয়। কিন্তু কেন এই অবস্থা? আমাদের অধিকাংশ পণ্ডিত, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা মাতৃভাষার পুস্তক রচনা করতে চান না। কারণ তারা মনে করেন ইংরাজিতে না লিখলে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ তাদের কম বিদ্বান বলে মনে করবে। অথচ এশিয়া, আফ্রিকার পূর্বের ঔপনিবেশিক দেশগুলির প্রভুরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার প্রয়োজনে যেমন নিজেদের উন্নত মানুষ হিসাবে জাহির করেছে, তেমনি নিজেদের ভাষাকে শ্রেষ্ঠতর ভাষা হিসাবে ব্যবহার করে এখানেও স্থানীয় শ্রেষ্ঠতর মানুষ সৃষ্টি করে তাদের দিয়েই নিচের তলার মানুষকে শাসন-শোষণের পাকা বন্দোবস্ত করেছিল। সেই ট্রাডিশন আজও সমানে চলেছে।

আমাদের মতো দাসসুলভ মানসিকতার দেশ ছাড়া যাদের সবল-সরস মাতৃভাষা বর্তমান, সেখানে তারা জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সবকিছুই নিজেদের মাতৃভাষা রচনা করেন। অন্য দেশে প্রকাশিত প্রয়োজনীয় বইপত্র, সে বিজ্ঞানই হোক আর সাহিত্যই হোক, নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে আত্মস্থ করেন।

আমাদের দেশে সম্প্রতিকালে নানা বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ কিছু কিছু হলেও তার সংখ্যা এত নগণ্য যে আগামী একশ বছরেও আমাদের প্রয়োজন মিটবার কোন সম্ভাবনা দেখতে পাই না। এই কাজের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই অনেক হয়েছে। কিন্তু প্রচার যত কাজ যে তুলনায় অতি নগণ্য।

বাস্তব এই অবস্থার মধ্যে উচ্চশিক্ষা ও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখার যুগান্তকারী জ্ঞানপাত্রের কানায় অন্ততঃ এই অনুদিত বইটির মাধ্যমে মুখ ছোঁয়াতে পারে। চার্লস ডারউইনের ‘Origin of Species’-এর অনুবাদ প্রকাশ করে অনুবাদক শ্রী শান্তিরঞ্জন ঘোষ ও প্রকাশক দীপায়ন উভয়েই আমাদের বিশেষভাবে অভিনন্দনযোগ্য হয়েছেন। প্রথমত এই ধরনের বিজ্ঞানগ্রন্থের যথার্থতা বজায় রেখে সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ খুবই দুরূহ। এই কাজটিই আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধা করার জন্য অসীম ধৈৰ্য্য সহকারে যে অমানুষিক পরিশ্রম শান্তিরঞ্জন ঘোষ করেছেন সে কথা আমার অজানা নয়। এই কাজটি করার জন্য, আমি নিঃসন্দেহ যে, কেবলমাত্র জীববিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের সব বিভাগের ছাত্র, শিক্ষক ও বিজ্ঞানপ্রিয় সব মানুষেরই কৃতজ্ঞতা-ভাজন হবেন তিনি। প্রকাশককেও আমাদের সহস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখলাম। আজকের দিনে মাতৃভাষাকে অপমানিত করার জন্য হঠাৎ কেঁপে ওঠা একদল পরশ্রমভোজী মধ্যবিত্ত যাঁরা কাঞ্চনকৌলিন্য ব্যতিরেকে আর সব কিছুকেই নস্যাকরণে উঠে-পড়ে লেগেছেন এবং সেই সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানের বইয়ের কেনা ও পড়ার দিকে ও প্রকাশে বেশ বড় রকমের ভাটা লক্ষণীয়। এমনি এক অবস্থায় আর্থিক লাভালাভের বিষয়টি গৌণ করে বইখানি প্রকাশে যে ঝুঁকি প্রকাশক নিলেন তার জন্য অবশ্যই তিনি আমাদের ধন্যবাদার্হ। সেই সঙ্গে আমরা আশা করব এই বই কিনে পড়বার যথেষ্ট পাঠক, লাইব্রেরি প্রকাশক পাবেন, যার ফলে এই ধরনের প্রকাশের কাজে তিনি আরও উৎসাহিত হবেন।

এ তো গেল প্রারম্ভিক কিছু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা। এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বলার চেষ্টা করছি। হয়ত অনেকের কাছে আমার এই বক্তব্য অনধিকার চর্চা মনে হতে পারে, কারণ বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করার কোন ছাপ আমার গায়ে নেই। তথাপি আলোচনা করছি তার প্রধান কারণ–আমি আমার সীমিত ক্ষমতানুসারে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করে থাকি এবং এই সমাজ পরিবর্তনের যে বৈপ্লবিক চিন্তার প্রয়োজন, চালর্স ডারউইন সেই জগতে বেশ জবরদস্ত জায়গা করে নিয়েছেন। এই সূত্র ধরেই কিছু কথা বলা দরকার মনে হওয়ায় কিছু লিখবার স্পর্ধা দেখালাম।

.

প্রসঙ্গ : চার্লস ডারউইন

অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে ইরাসমাস ডারউইন একটি বিশেষ পরিচিত নাম। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, উদ্ভাবক, লেখক, অনুবাদক। নিজের লেখা ‘জুনোমিয়া’ নামে একটি বইতে এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন যে সব প্রাণীর রক্ত গরম তারা সবাই একই সূত্র থেকে এসেছে–এই ধারণাটা যে খুবই সাহসী ও নূতন। চিন্তার খোরাক যোগাবে, তাতে কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। এই ঠাকুরদার নাতিই হলেন চার্লস ডারউইন। পিতার নাম রবার্ট ডারউইন। মাতার নাম সুসানা ওয়েউড। পেশায় রবার্ট ডারউইন ছিলেন চিকিৎসক। কাজ করতেন সপশায়ারের শিউসবেরিতে। রবার্ট-সুসানার ছয় সন্তানের পঞ্চম সন্তান ছিলেন চার্লস ডারউইন। জন্ম ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি। পরিবারটি ছিল ধর্মভীরু গোঁড়া খ্রিস্টান। এই আবহাওয়াতেই গড়ে ওঠেন ডারউইন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পিতৃভক্ত। চার্লস ডারউইনের জীবনী বলার কোন প্রয়োজনে এই কথার উল্লেখ করছি না। বলার উদ্দেশ্য একটিই, তা হল–যে খ্রিস্টীয় সৃষ্টিতত্তের বিশ্বাসের আওতায় তাকে মানুষ হতে হয়েছিল, তাঁর সারা জীবনের গবেষণা কর্মকাণ্ড সেই বিশ্বাসকেই সমূলে উৎপাটিত করেছে।

ডারউইনের বাবা চেয়েছিলেন পুত্র ডাক্তার হোক, সেই আশা ফলবতী না হওয়ায় চাইলেন অন্তত যাজক হোক। চার্লস ডারউইন তা-ও হননি, হলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানী। ছোটবেলা থেকেই বাঁধাধরা লেখাপড়া ভাল লাগত না তার। ভাল লাগত প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। সাবেক কালের বাঁধাধরা পড়াশোনা তাঁকে আকর্ষণ করতে পারত না। তার ঝোঁক ছিল নানা ধরনের নুড়িপাথর, মুদ্রা, নামলেখা মোহর, গাছপালা, লতাপাতা, পোকামাকড়, পাখির ডিম সংগ্রহ করে চিহ্নিত করে রাখার কাজে। এছাড়া রসায়নশাস্ত্রের প্রতি ছিল তার এক সহজাত আকর্ষণ। সাহিত্যের প্রতিও তার আকর্ষণ লক্ষণীয়। কেব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইষ্ট কলেজের যাজক হওয়ার ক্লাস করতে গিয়ে যাজক হওয়া তার হয়নি। কিন্তু এই সময়েই চলত তার দল বেঁধে শিকার করা, সেই সঙ্গে পোকামাকড় সংগ্রহ করে চিহ্নিত করার কাজ। এখানেই তিনি পরিচিত হন উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক জন সিভেন্স হেনস্লো-র সঙ্গে। তিনি হয়ে ওঠেন চার্লস ডারউইনের প্রেরণাদাতা। ঠাকুরদার লেখা ‘জুনোমিয়া’ বইটি আবার ভাল করে পড়লেন। পড়লেন লামার্কের লেখা। পড়লেন হাম্বোল্ড-এর ‘পার্সোন্যাল ন্যারেটিভ’, হারসেল-এর ‘ইনট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অফ ন্যাচারাল ফিলজফি’। ডারউইনের নিজের ভাষায়, ‘প্রকৃতিবিজ্ঞান’ পঠনে এই দুটি লেখার অবদান আমাকে তখন উৎসাহ-উদ্দীপনার তুঙ্গে তুলে দিয়েছিল। অধ্যাপক হেনস্লো তাকে ভূতত্ত্ব পড়তে উৎসাহ যোগান।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ। ভবিষ্যতের চার্লস ডারউইন তখন ২২ বছরের যুবক। হেশ্লোর। সুপারিশেই প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে এইচ. এম. বিল্ল’ জাহাজের দীর্ঘ অভিযানের শরিক হন তিনি। ১৮৩১-এর ২৭শে ডিসেম্বর তারিখে প্লিমাউথ বন্দর থেকে বিলের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার নানা দেশ, আন্দিজ পর্বতাঞ্চল, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ-সহ নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া পরিভ্রমণ করে, কেপটাউন, সেন্ট হেলেনা হয়ে, ১৮৩৬-এর ২রা অক্টোবর ফলমাউথ বন্দরে ফিরে আসে বিল। বিল্ল জাহাজের অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলভাগের মানচিত্র তৈরির কাজে সাহায্য করা, সেই সঙ্গে সঠিকভাবে দ্রাঘিমারেখা নির্ধারণ করা।

কিন্তু প্রকৃতিবিজ্ঞানী ডারউইন পৃথিবীর গহনতম এই সব অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করলেন প্রচুর উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, মথ, প্রজাপতি, শামুক, পাথর, জীবাশ্ম, সেই সঙ্গে বিপুল অভিজ্ঞতা। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচুর জীবাশ্ম এবং গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের বহু বিচিত্র প্রজাতিগুলিকেই ডারউইনের যাবতীয় চিন্তাভাবনার মূল উৎস হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।

গ্যালাপাগোসের মতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জে বিরল সমস্ত প্রজাতির বিস্তারণ (Distribution) লক্ষ্য করেই তিনি ভেবেছিলেন, ঐসব প্রজাতি একদা মূল ভূখণ্ডের পূর্বপুরুষদের মধ্য থেকেই এসেছিল এবং পরে কোন কারণে অন্যরকম হয়ে উঠেছে–কিন্তু কেমন করে এবং কেন? এমন কি হতে পারে যে জীবনযাত্রার পরিস্থিতির সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক রয়েছে–যা, সম্ভবত কতকগুলি বৈশিষ্ট্যেরই অনুকূল, অন্যগুলির নয়? তিনি তৎকালীন ইংল্যান্ডের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ধ্যানধারণার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ভাবলেন, মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে প্রতিযোগিতার যে পরিস্থিতি বিদ্যমান তা হয়ত জীবজগতেও ক্রিয়াশীল, আর পুঁজিতান্ত্রিক শোষণকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য যাজক ম্যালথাস-এর তত্ত্ব তো হাতের কাছেই ছিল। যাজক ম্যালথাসের মতে জীবন একটা যুদ্ধ, সে যুদ্ধে কেবল যোগ্যতমরাই জয়লাভ করে, সে যুদ্ধে নৈতিক উৎকর্ষের পুরস্কার হিসাবে জোটে সম্পদ ও সন্মান। জনসংখ্যার চাপ যাতে খাদ্যের যোগানকে ছাপিয়ে না ওঠে তারই জন্য যুদ্ধ, মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ডারউইন ভাবতে লাগলেন প্রাণীসমাজেও যদি তাই ঘটে? তা যদি হয় তাহলে পরিবেশের পক্ষে আরো উপযোগী হয়ে ওঠার পথে যারা নিজেদের এতটুকুও বদলে নিতে পারল তারা সেই সুবিধাটুকু তাদের উত্তরপুরুষের মধ্যে সঞ্চার করে দেবে, এই ভাবে ধীরে ধীরে প্রজাতির বর্তমান চেহারার উদ্ভব হবে। এই চিন্তা ডারউইনের আগেই করা চলছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক ছিল লামার্কের (১৭৪৪-১৮২৯) বক্তব্য। ফরাসী এই উদ্ভিদবিদ ১৮০৯ সালে সাহসের সঙ্গে এক তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন যে পরিবেশের সঙ্গে আরও মানিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেয় যোগ্য হয়ে ওঠার এক প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পূর্ববর্তীকালের প্রজাতি থেকে ক্রমে আজকের প্রজাতির উদ্ভব। উঁচু গাছের পাতা খাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেয় যোগ্য হয়ে ওঠার এক প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পূর্ববর্তীকালের প্রজাতি থেকে ক্রমে আজকের প্রজাতির উদ্ভব। উঁচু গাছের পাতা খাবার আকাঙ্ক্ষায় জিরাফ তার গলা বাড়িয়েছিল, সেই গলা-বাড়ানোর উত্তরাধিকার বর্তায় তার পরবর্তী প্রজন্মের উপর। এই ভাবনাকে মনে হয়েছিল দূরকল্পিত, সমর্থনের অযোগ্য। কিন্তু ইতিমধ্যে জমতে শুরু করেছিল সাক্ষ্যপ্রমাণ–কেবল জীবিত প্রাণী সম্পর্কিত চর্চার ফলেই নয়, জীবাশ্ম সম্পর্কিত চর্চার ফলও এর সঙ্গে যুক্ত হল। আর এই কাজটি অতি সাফল্যের সঙ্গেই সমাধা করেন চার্লস ডারউইন। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের ক্ষেত্রে ১৮৪০-এর বিশ্বব্যাপী বুভুক্ষু দশক ছিল এরকম একটা পর্যবেক্ষণের পক্ষে একান্তই উপযোগী সময়।

‘Origin of Species & Natural Selection’ সংক্রান্ত যে চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তে। ডারউইন পৌঁছন, তার ২০ বছর পর পুস্তকাকারে তার আবিষ্কার ও সিদ্ধান্ত ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হল। এই সময়ের মধ্যে বহু ঘটনার সমাবেশ, যার উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি না।

পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে সংযোজিত হল এক ঐতিহাসিক সম্পদ–অরিজিন অফ স্পিসিস। প্রজাতির বিবর্তন, তার ইতিহাস, রূপান্তর–সব কিছুর প্রধান উৎস হিসাবে চিহ্নিত হল প্রাকৃতিক নির্বাচন। কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর সময় থেকে ঊনবিংশ শতকের ষাটের। দশকে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে খানিকটা অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও তার ধ্যানধারণা এক তুমুল দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের জন্ম দিল। এ বিবাদ ছিল মূলত ধর্মতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক প্রশ্নকে ঘিরে, বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে ঘিরে নয়। কেবলমাত্র জীববিদ্যা সংক্রান্ত বিজ্ঞানে নয়, এ তত্ত্ব কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর তত্ত্বেরই সমগ্র সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে পরিবর্তন করে দেওয়ার প্রতীকরূপে গৃহীত হতে পারে। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন সারা দেশের ধর্মগুরুরা। এই তত্ত্ব বাইবেলোক্ত সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী–এই বলে আক্রমণ করা হল ডারউইন-তত্ত্বকে। শুধু সভা-সমিতিতে নয়, কার্যক্ষেত্রে নানা ভাবে ডারউইনকে হেয় করার চেষ্টা হল। মানুষকে বানরের মতো করে কার্টুন আঁকা হল, Monkey law-র নামে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ডারউইন-তত্ত্ব পড়ানো নিষিদ্ধ হল। শুধু সেইসময়ে কেন, মাত্র কয়েকমাস আগেও আমেরিকার কানসাস প্রদেশে ডারউইন-তত্ত্ব পড়ানোর উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর কারণ কী?

ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে তীব্র ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া যদি মাথাচাড়া না দিত, তাহলে এমন কি ডারউইন-তত্ত্বের প্রকাশের পূর্বে উনিশ শতকের গোড়াতেই সকল প্রজাতির উদ্ভব যে এক সাধারণ উৎস থেকে, এই ধারণাটা সহজেই স্বীকৃত হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। বরং সতেরো শতকের Counter-Reformation-এর দিনগুলির চেয়েও প্রবল উৎসাহে বাইবেল-বর্ণিত নির্দিষ্ট দিনে প্রজাতি, প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্মকাহিনীকে আক্ষরিক সত্য বলে প্রচার করাটা উনিশ শতকের গোড়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে অনেক বেশি জরুরী হয়ে পড়েছিল। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই রহস্যবাদী ধারা উনিশ শতকের গোড়ায় গুরুতরভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উনিশ শতকের গোড়ায় জার্মানির নাটুরফিলসফি (Naturphilosophie) ধারণা ছিল এর প্রতিভূ। হের্ডর ও শেলিং-এর মতো দার্শনিক, গয়টের মতো কবির প্রেরণায় এঁরা মগ্ন ছিলেন ঐশ্বরিক পরিকল্পনার মাঝে প্রকৃতির পরম ভাবের সন্ধানে। এই সন্ধানের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ছিল জার্মান জাতির পুনর্জাগরণ ও ‘ঘৃণিত’ ফরাসী গাণিতিক জড়বাদকে নির্মূল করার প্রয়াস। কাজেই পঞ্চাশ বছর ধরে অধিকাংশ প্রকৃতিবিদ অণুবীক্ষণে যে-চোখ লাগালেন, কার্যত তা ছিল অন্ধ। তারা প্রকৃতির অৎপর্য নিয়ে ভাবতে রাজী ছিলেন না।

এইখানেই ডারউইন-তত্ত্বের ঐতিহাসিক ও অপরিসীম গুরুত্ব। ১৮৫৯ সালে ‘অরিজিন। অফ স্পিসিস’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই পুস্তক গভীরভাবে অধ্যয়ন করলেন। ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস। পরের বছর কার্ল মার্কস এই বইটি অধ্যয়ন করে ১৮৬০ সালের ১৯ ডিসেম্বর এঙ্গেলসকে লিখলেন, “আমাদের ধারণার প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক বনিয়াদ সৃষ্টি করে দিয়েছে এই বইটি। ডারউইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকারের উদ্দেশ্যে ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থটি ডারউইনের নামেই উৎসর্গ করেছিলেন মার্কস। এঙ্গেলস তাঁর ডায়লেকটিস্ অফ নেচার’ পুস্তকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের জগতে তিনটি ঘটনাকে চূড়ান্ত গুরুত্ব দিয়েছেন-জীবকোষের আবিষ্কার, শক্তির সংরক্ষণ ও তার রূপান্তরের নিয়ম আবিষ্কার আর ডারউইনের আবিষ্কার। মার্কস-এঙ্গেলসের চোখে চার্লস ডারউইনের আবিষ্কার ছিল এক প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পাশাপাশি এঙ্গেলস তার ‘ডায়লেকটিস্ অফ নেচার’-এ ডারউইন-তত্ত্বের কিছু সমালোচনাও করেছেন। অবশ্য অরিজিন অফ স্পিসিস-এর সঙ্গে ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ গ্রন্থেরও সাহায্য নিয়েছেন তিনি। যে সমস্ত প্রশ্নগুলি এঙ্গেলস তুলেছে, সংক্ষেপে তা উল্লেখ করছি। অস্তিত্বরক্ষার জন্য সংগ্রামের ওপর একপেশেভাবে অতিরিক্ত জোর দিয়েছেন ডারউইন, যা এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক বলে মনে হয়নি। প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্বন্ধেও এঙ্গেলসের মতামত কিছুটা ভিন্ন, যথা একই প্রাণীগোষ্ঠীতে সদস্যসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে যে প্রতিযোগিতা দেখা দেয়, তাতে সব থেকে শক্তিশালীরাই প্রধানত টিকে থাকলেও অন্য অনেক দিকের বিচারে দুর্বলতমরাও টিকে থাকতে পারে। তিনি আরও বলেছেন যে অজৈব প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুগুলির মধ্যে শুধুমাত্র সংঘাতই থাকে না, সামঞ্জস্যও থাকে; জৈব প্রকৃতির বস্তুগুলির মধ্যে সচেতন ও অসচেতন সংগ্রামের পাশাপাশি সচেতন ও অসচেতন সহযোগিতাও অবস্থান করে। আর তাই এমন কি প্রকৃতির ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র সংগ্রাম’ লিখে রাখাটা তার মতে নেহাতই একপেশে ধারণা। বিভিন্ন প্রজাতির পরিবর্তনশীলতার কারণ, পরিবেশের ভূমিকা, বিপাক ক্রিয়ার ভূমিকা–এ সব বিষয়েও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন এঙ্গে লস। প্রশ্ন তুলেছেন ম্যালথাসের তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও। এই সব সমালোচনার পাশাপাশি মানবদেহের শারীরস্থানবিদ্যা, তুলনামূলক শারীরস্থানবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা–সবকিছুর ভিত্তি হিসাবে এঙ্গেলস প্রজাতি তত্ত্বকেই চিহ্নিত করেছেন, অকৃত্রিম স্বাগত জানিয়েছেন ডারউইনের আবিষ্কারকে।

ডারউইন-তত্ত্বের অনেককিছুই আজ আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চায় পরিত্যক্ত, সংশোধিত হচ্ছে। কিছু কিছু প্রশ্ন নিয়ে চলেছে গবেষণা, বিতর্ক। এটাই স্বাভাবিক, কারণ বিজ্ঞান এগিয়ে চলে নানা জনের নানা প্রয়াসের সমষ্ঠির রূপ নিয়ে, যদিও ডারউইনের মতো দিকপালদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে ডারউইন ও তাঁর বিবর্তন তত্ত্বের মৃত্যু নেই।

পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই, “সংস্কৃতির কোন ক্ষেত্রেই দিকপাল মানুষরা স্বয়ম্ভর নন, বিজ্ঞানে তো ননই। কেননা বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কারের পশ্চাতে থাকে গৌণ ও কল্পনা-দীন শতশত বিজ্ঞানীর প্রস্তুতিমূলক কাজ। এই সব বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সঞ্চয় করে চলেন। বেশিরভাগ সময়েই না বুঝে সঞ্চিত সেই তথ্য-ভাণ্ডার নিয়েই দিকপাল বিজ্ঞানী তার কর্ম সমাধা করেন।”

“মানুষের মনের গঠন যে কত রকমের হয় তার ইয়ত্তা নেই। বিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রাখার সম্ভাবনা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই থাকে যদিও অতীতের তুলনায় আজ অনেক বেশি মানুষ সে সুযোগ পাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি লোক তা পাবেন। যাঁরা বিজ্ঞানের কাজ করার জন্য নির্বাচিত হন বা নিজেদের নির্বাচিত করেন, তাঁদের মধ্যেও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছাড়া আর সব ব্যাপারে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। এর ফলে বিজ্ঞানে যেমন বিপুল বৈচিত্র্যের সঞ্চার ঘটে, তেমনি সমাজ আরোপিত নিয়ন্ত্রণের মারফৎ প্রয়োজনীয় একটি ঐক্যও সাধিত হয়। সে নিয়ন্ত্রণ সচেতনভাবে অথবা অচেতনভাবে আরোপিত হতে পারে। সমাজ-আরোপিত এই ঐক্যের সুবাদেই বিজ্ঞান মানুষের পরিবেশকে অনুধাবন করে তাকে বদলানোর এক সমবায়িকা যৌথ প্রয়াসকে উপলব্ধি করে যে সব দিকপাল বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আলোকে সমাজের অগ্রগমনের পথকে আলোকিত করছেন, চার্লস ডারউইন তাঁদেরই অন্যতম এক অগ্রণীপুরুষ বলেই আত্মজীবনীতে বলতে পেরেছেন, “আমি জানি, ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হবে–মানুষের উদ্ভব আর মানবজাতির ইতিহাসের উপর এসে পড়বে আরও উজ্জ্বল আলোকরশ্মি।”

পরিশেষে, আবার আমাদের ধন্যবাদ পুস্তকটির অনুবাদক ও প্রকাশককে।

হীরেন দাশগুপ্ত
কে. জি. দাস রোড
বারুইপুর
দঃ ২৪ পরগণা

.

পুস্তকটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধীয় মতামতের অগ্রগতির একটি সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক রূপরেখা

.

আমি এখানে প্রথমেই প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামতের অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেব। সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত অধিকাংশ প্রকৃতিবিজ্ঞানীর বিশ্বাস ছিল যে প্রজাতির এক অপরিবর্তনীয় উৎপাদন এবং এরা সৃষ্টি হয়েছিল পৃথক পৃথক ভাবে। অনেক প্রবক্তা এই মতকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেন। অন্যদিকে কোন কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে প্রজাতিরা রূপান্তরিত হয় এবং জীবের বর্তমান আকারগুলি পূর্বে অবস্থিত আকারগুলির বংশধরদের বিশুদ্ধ উৎপাদন। এ বিষয়ে ধ্রুপদী লেখকদের কথা বাদ দিলেও, বর্তমানে যিনি প্রথম এ বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলার চেষ্টা করেছেন তিনি হলেন বুফন(১)। কিন্তু তাঁর মতামত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছিল এবং যেহেতু তিনি প্রজাতির রূপান্তরের কারণ ও উপায়গুলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেননি, তাই আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না।

লামার্কই হলেন প্রথম প্রকৃতিবিদ যাঁর এই বিষয়ের সিদ্ধান্তগুলি গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এই প্রখ্যাত প্রকৃতিবিজ্ঞানী ১৮০১ সালে সর্বপ্রথম তার মতামত প্রকাশ করেন এবং ১৮০৯ সালে তার ফিলসফি জুলোজিক এবং ১৮১৫ সালে হিস্ট্রি ন্যাচারালিস ডেস অ্যানিম্যাক্স স্যান্স ভার্টেব্রেস’-এর ভূমিকায় নিজের মতামত আরও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন তিনি। মানুষ-সহ সমস্ত প্রজাতি অন্যান্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে এই মতবাদ তিনি তার এই সমস্ত লেখায় সমর্থন করেছিলেন। জৈব ও অজৈব জগতের সমস্ত পরিবর্তন কিছু নিয়মানুসারে হয়, কোন অলৌকিক হস্তক্ষেপ দ্বারা নয়–এই কথা বলে সকলের দৃষ্টিআকর্ষণের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন তিনি।

প্রজাতি ও প্রকারগুলির মধ্যে পার্থক্য করতে সমর্থ হয়ে, কয়েকটি গোষ্ঠীতে আকারদের প্রায় নিখুঁত ক্রমবিন্যাস এবং গৃহপালিত উৎপাদনের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করেই সম্ভবত লামার্ক প্রজাতির ক্রমিক পরিবর্তন সম্পর্কে তার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। রূপান্তরের উপায়গুলি সম্পর্কে, জীবনের ভৌত অবস্থায় প্রত্যক্ষ ক্রিয়াকলাপে ও বর্তমান আকারগুলির মধ্যে সঙ্করণে কিছু এবং বেশির ভাগই ব্যবহার এবং অব্যবহারে অর্থাৎ অভ্যাসের প্রভাবের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রকৃতিতে সুসম অভিযোজনের জন্য তিনি শেষের মাধ্যমটির উপর সম্ভবত বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন–যেমন জিরাফের লম্বা গলার কারণ হচ্ছে উঁচু গাছের ডালপালা খেতে পারা। কিন্তু একইভাবে তিনি প্রগতিমূলক বিকাশের নিয়মেও বিশ্বাস করতেন। এবং যেহেতু বর্তমান কালের সরল উৎপাদনগুলির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে জীবনের সমস্ত ধরণগুলি ক্রমাগত উন্নত হয়েছে, সেহেতু তিনি বলেছিলেন যে আকারগুলি বর্তমানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়(২)। তাঁর পুত্রের লেখা জীবনীতে উল্লিখিত হয়েছে যে ১৭৯৫ সালের প্রায় প্রারম্ভে জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারে মনে করতেন যে আমরা যাকে প্রজাতি বলি তা আসলে একই টাইপের বিভিন্ন অধঃপতিত রূপ। ১৮২৮ সাল অবধি তিনি তার মতামত দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেননি যে সমস্ত বস্তুর উৎপত্তির সময় থেকেই একই আকারগুলি চিরস্থায়ী হয়নি। সম্ভবত জিওফ্রয় জীবনের পরিবেশ বা ‘মনডে অ্যাম্বিয়ান্ট’-কে পরিবর্তনের কারণ বলে। মূলতঃ বিশ্বাস করতেন। কোন সিদ্ধান্তে আসার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন তিনি এবং বিশ্বাস করতেন না যে বর্তমান প্রজাতিরা রূপান্তরিত হচ্ছে, এবং যেমন তাঁর পুত্র বলেছেন, “যে কোন প্রজাতিকে সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষণ করাটাই একটা গভীর সমস্যা, কেননা সব প্রজাতিই ভবিষ্যতে অসম্ভবরূপে পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলেছে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ডঃ ডব্লিউ. সি. ওয়েলস রয়াল সোসাইটির সম্মুখে “জনৈক শ্বেতকায় মহিলার চর্মের কিছু অংশ নিগ্রোসদৃশ” নামে একটি গবেষণাপত্র পাঠ করেন;

কিন্তু ১৮১৮ সালে তাঁর “ডিউ এ্যাণ্ড সিঙ্গল ভিশন সংক্রান্ত দুটি প্রবন্ধ” প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্বের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়নি। এই গবেষণাপত্রে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের নীতিকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেন, এবং এটিকে প্রথম স্বীকৃতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু একে তিনি কেবলমাত্র মানবজাতির ক্ষেত্রে এবং কয়েকটি চরিত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। নিগ্রো ও মূলাটোরা কয়েকটি ক্রান্তীয় রোগের সংক্রমণ থেকে মুক্ত, এ-কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমতঃ, সমস্ত প্রাণীরাই কোন-না কোন মাত্রায় পরিবর্তনপ্রবণ হয়, এবং দ্বিতীয়তঃ, কৃষিবিদরা নির্বাচন দ্বারা তাদের গৃহপালিত প্রাণীদের উন্নত করেন, সেই কাজটি প্রকৃতিতে কিছুটা মন্থরগতিতে হলেও সমান দক্ষতায় সম্পন্ন হয়েছে–হয়েছে কোন নির্দিষ্ট দেশে বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত মনুষ্যসৃষ্টির প্রক্রিয়ায়। মানুষের আকস্মিক ভ্যারাইটিদের মধ্যে, যা আফ্রিকার মধ্যভাগে বিচ্ছিন্ন অধিবাসীদের মধ্যে প্রথমে ঘটেছে, সেইসব দেশের বিভিন্ন অসুখ সহ্য করার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় কোন একটি জাত অধিকতর উপযুক্ত হবে। পরিণামে সেই জাতটি সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে, যখন অন্যরা সংখ্যায় হাস পাবে। এই হ্রাস পাওয়ার কারণ কেবলমাত্র রোগাক্রমণ থেকে বাঁচার অক্ষমতাই নয়, সুস্থ-সবল প্রতিবেশীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম না হতে পারাও তার কারণ হিসেবে কাজ করে। ইতিমধ্যে যা বলা হয়েছে তা থেকে আমি বিনা বিচারেই স্বীকার করে নিচ্ছি যে এই সবল জাতিটির বর্ণ হবে কালো। কিন্তু ভ্যারাইটি সৃষ্টির এই প্রবণতা বিদ্যমান থাকলে কালক্রমে কৃষ্ণ থেকে কৃতর জাতির উদ্ভব ঘটবে, এবং যেহেতু কৃষ্ণতমরা আবহাওয়াটিতে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত হবে, সেহেতু সেই বিশেষ দেশটিতে তারা একমাত্র জাত না হলেও কালক্রমে সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতে পরিণত হবে। তিনি তারপর শীতল আবহাওয়ার শ্বেতকায় অধিবাসীদের ক্ষেত্রে এই একই মতামত ব্যক্ত করেছেন। মিঃ ব্রেসের মাধ্যমে ডঃ ওয়েলসের গ্রন্থের উপরিউক্ত রচনাংশটি সম্বন্ধে আমার দৃষ্টিআকর্ষণ করার জন্য আমি ইউনাইটেড স্টেট~এর মিঃ রোলের নিকট কৃতজ্ঞ।

মাননীয় রেভারেণ্ড ডব্লিউ. হার্বাট, পরবর্তীকালে যিনি ম্যানচেস্টারের ডিন হন, ১৮২২ সালে প্রকাশিত তাঁর হর্টিকালচারাল ট্রানজাকশনস’ গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডে এবং ‘অ্যামারিলিভেসি’র ওপর তার গবেষণামূলক রচনায় (১৮২৭, পৃঃ ১৯, ৩৩৯) ঘোষণা করেন, “উৎপাদন সংক্রান্ত পরীক্ষা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে যে উদ্ভিদ প্রজাতিসমূহ কেবলমাত্র একটি উচ্চতর এবং স্থায়ী ভ্যারাইটি। প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই মত প্রকাশ করেন তিনি। ডিন মহাশয় বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেক গণের একটি প্রজাতি প্রথমে অতি নমনীয় অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলি প্রধানতঃ আন্তঃসঙ্করণ দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে, বর্তমানে আমাদের সমস্ত প্রজাতিদের বিভিন্নতা এই ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে।

স্পঞ্জিলার ওপর তার বিখ্যাত গবেষণাপত্রের (‘এডিনবার্গ ফিলোসফিক্যাল জার্নাল’, খণ্ড ১৪, পৃঃ ২৮৩) উপসংহার অনুচ্ছেদে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে অন্য প্রজাতি থেকেই একটি প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে এবং রূপান্তরের ফলে এরা উন্নত হয়েছে! ১৮৩৪ সালে প্রকাশিত ‘ল্যান্সেট’-এ তাঁর ৫৫তম বক্তৃতার এই একই মতামত প্রকাশ করেন তিনি।

১৮৩১ সালে মিঃ প্যাট্রিক ম্যাথিউ ‘নাভাল টির অ্যাণ্ড আর্বোরিকালচার’-এর ওপর তাঁর গবেষণামূলক রচনাটি প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে একই মত পোষণ করেন, যেমনটা ( এখানে উল্লিখিত হবে) মিঃ ওয়ালেস এবং আমি লিনিয়ান জার্নাল’-এ প্রস্তাব করেছি এবং বর্তমান খণ্ডে পরিবর্ধিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ একটি ভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণামূলক কাজের পরিশিষ্টের কয়েকটি। বিক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে মিঃ ম্যাথিউ মতবাদটি প্রকাশ করেছিলেন, ফলে এটি অনেকদিন পর্যন্ত অলক্ষিত অবস্থায় থেকে গিয়েছিল। অবশেষে মিঃ ম্যাথিউ নিজেই ১৮৬০ সালের ৭ই এপ্রিল তারিখের ‘গার্ডেন ক্রনিকল’ পত্রিকায় এ বিষয়ে সকলের দৃষ্টিআকর্ষণ করেন। আমার সঙ্গে ম্যাথিউ-র মতের পার্থক্য খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। মনে হয় তিনি বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবী পর্যায়ক্রমে প্রায় জনশূন্য হয়ে যেত এবং পরে আবার পূর্ণ হত; এবং তিনি বিপরীত ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে নূতন আকারসমূহ “পূর্বের পুঞ্জীভূত কোন মোল্ড বা জার্মের উপস্থিতি ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে। কয়েকটি অনুচ্ছেদের সারমর্ম আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি, তবে মনে হয় তিনি জীবনের পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ক্রিয়ার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তবে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বিপুল ক্ষমতা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করেছিলেন তিনি।

প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী ভন বাখ “ক্যানারী: দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক গঠনের বর্ণনা” (১৮৩৬, পৃঃ ১৪৭) শীর্ষক চমৎকার রচনাটিতে তার বিশ্বাস পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেন যে ভ্যারাইটিরা ধীরে ধীরে স্থায়ী প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়, যা আন্তঃসঙ্করণে আর সমর্থ হয় না।

১৮৩৬ সালে প্রকাশিত “নিউ ফ্লোরা অফ নর্থ আমেরিকা” গ্রন্থে রাফিনেস্ক লেখেন (পৃঃ ৬): “সমস্ত প্রজাতি এক সময় ভ্যারাইটি হলেও হতে পারত, এবং অনেক ভ্যারাইটি স্থায়ী ও নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে ক্রমশ প্রজাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু পরে তিনি উল্লেখ করেন (পৃঃ১৮) “গণের আদিম রূপ বা পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে এ-ঘটনা ঘটেনি।”

অধ্যাপক হেল্ডমান ১৮৪৩-৪৪ সালে (“বোস্টন জার্নাল অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি, ইউনাইটেড স্টেটস, খণ্ড ৪, পৃঃ ৪৬৮) প্রজাতিদের ক্রমবিকাশ ও রূপান্তর সম্পর্কিত প্রকল্পসমূহের বিপক্ষে এবং স্বপক্ষে দক্ষতার সঙ্গে অনেক যুক্তি দেখিয়েছেন। সম্ভবত পরিবর্তনের দিকে তার ঝোঁক বেশি।

‘ভেস্টিজেস অফ ক্রিয়েশন’ গ্রন্থটি ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত হয়; গ্রন্থটির দশম ও পরিমার্জিত সংস্করণে (১৮৫৩) অনামী লেখক বলেন (পৃঃ ১৫৫): “অনেক বিবেচনার পর এই সিদ্ধান্ত আসা গেছে যে জীবন্ত জীবের সরল ও আদিমতম অবস্থা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের সর্বোচ্চ রূপ পর্যন্ত দীর্ঘ ক্রমমালা হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছাপ্রসূত ফলে, প্রথমতঃ, জীবের আকারগুলিতে প্রদত্ত একটি উদ্দীপনা এদের বংশপরম্পরায় উন্নত করেছে যা জীব সংগঠনের বিভিন্ন ক্রমের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদে ও মেরুদণ্ডী প্রাণীতে পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এই ক্রমবিন্যাস সংখ্যায় অল্প এবং জৈব বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য দ্বারা চিহ্নিত, এদের মধ্যেকার সম্পর্ক নিরূপণ করতে আমাদের বাস্তব অসুবিধা অনুভব করার সম্মুখীন হতে হয়; দ্বিতীয়তঃ, জীবনীশক্তির সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য উদ্দীপক যা বংশানুক্রমে বহিরাবস্থানুসারে জৈবিক কাঠামোগুলিতে রূপান্তরিত করতে প্ররোচিত করে। যেমন, খাদ্য, আবাসস্থলের প্রকৃতি ও মহাকাশীয় উন্নপিণ্ডজাতীয় মাধ্যমগুলি, এগুলি হচ্ছে প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ববিদের ‘অভিযোজন’।” লেখক স্পষ্টতঃ বিশ্বাস করেন যে আকস্মিক উল্লম্ফন দ্বারা জীব সংগঠনের অগ্রগমন হয়, কিন্তু জীবের। পরিবেশ দ্বারা সৃষ্ট প্রভাব ক্রমান্বয়ী হয়। তিনি জোরের সঙ্গে মত প্রকাশ করেন যে প্রজাতিরা অপরিবর্তনীয় নয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না কেমন করে অসংখ্য ও সুন্দর সহ-অভিযোজনের জন্য, যা আমরা প্রকৃতির সর্বত্র দেখি, দুটি কল্পিত ‘তাড়না’ বৈজ্ঞানিক অর্থে বিবেচিত হয়। আমি বুঝতে পারি না যে এইভাবে আমরা কোন্ জ্ঞান। লাভ করেছি, উদাহরণস্বরূপ–কেমন করে একটি কাঠঠোকরা পাখি অদ্ভুত স্বভাবে অভিযোজিত হয়েছে। শক্তিশালী ও অত্যুৎকৃষ্ট উপায়ে লেখা হলেও লেখাটি, যদিও এটির পূর্ববর্তী সংস্করণে যথাযথ জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক সতর্কতার বিরাট অভাব ছিল, তৎক্ষণাৎ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। আমার মতে এটি আমাদের দেশে এ বিষয়ে দৃষ্টিআকর্ষণ করতে, সংস্কারমুক্ত করতে এবং সঠিক মতামত গ্রহণের জন্য পটভূমি তৈরি করতে চমৎকার কাজ করেছে।

১৮৪৬ সালে অভিজ্ঞ ভূ-বিজ্ঞানী এম. জে. ডি’ ওমালিয়াস ডি’ হালয় তার চমৎকার অথচ সংক্ষিপ্ত গবেষণাপত্রে (বুলেটিনস ডে লাকাদ, রয়, ব্রাক্সেলেস্ টম. ১৩, পৃঃ ৫৪১) মতামত প্রকাশ করেন যে পৃথক ভাবে সৃষ্টির তুলনায় পরিবর্তনের পথ বেয়ে। নূতন প্রজাতিদের উদ্ভব ঘটাই অধিকতর সম্ভবপর। লেখক এই মতবাদ সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে প্রচার করেছিলেন।

১৮৪৯ সালে (নেচার অফ লিম্ব, পৃঃ ৮৬) অধ্যাপক ওয়েন নিচের অংশটি লেখেন: “এই গ্রন্থে সমস্ত প্রাণী প্রজাতিদের অবস্থানের বহু পূর্বে, বিচিত্র এইরূপ রূপান্তরের মধ্যে প্রাণীদের আদিরূপের ধারণা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছিল। কোন্ প্রাকৃতিক নিয়ম এবং গৌণ কারণানুসারে এইরূপ জৈব ঘটনার সুশৃঙ্খল অনুগমন ও গ্রগতি ঘটে থাকতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা এখনও অজ্ঞ।” ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে অভিভাষণে, তিনি “সৃজনশীল ক্ষমতার অবিচ্ছিন্ন ক্রিয়াকলাপের স্বতঃসিদ্ধ সত্যতার অথবা জীবন্ত দেহের নির্দেশমতো আবির্ভাবের কথা বলেন। ভৌগলিক বিস্তার উল্লেখ করে, তিনি আরও যোগ করেন, “এই সব ঘটনা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসকে নাড়া দেয় যে নিউজিল্যাণ্ডের অ্যাপ্টেরিক্স এবং ইংল্যান্ডের লাল জংলি হাঁসেরা যথাক্রমে ঐ সব দ্বীপগুলির জন্যই পৃথকভাবে সৃষ্টি হয়েছিল। সর্বদা মনে রাখা দরকার যে সৃষ্টি’ শব্দটির দ্বারা এই প্রাণীবিজ্ঞানী বোঝাতে চেয়েছেন একটি প্রক্রিয়া যা তার অজানা। তিনি তার এই ধারণা ব্যাখ্যা করেন এটি যোগ করে যে লাল জংলি হাঁসের মত এই সব ঘটনা “এই দ্বীপগুলির মধ্যে পাখিটির স্বতন্ত্র সৃষ্টির সাক্ষ্য হিসাবে প্রাণীবিজ্ঞানীদের দ্বারা পরপর উল্লিখিত হয়েছে, তারা মূলতঃ বলতে চেয়েছেন যে কেমন করে লাল জংলি হাঁসেরা সেখানে এবং কেবলমাত্র সেখানেই এসেছিল তা তারা জানেন না; উল্লেখযোগ্য যে তাঁদের এরূপ অজ্ঞতার প্রকাশ তাঁদের এই বিশ্বাসই ব্যক্ত করে যে পাখিটি এবং দ্বীপগুলি উভয়েই একটি প্রথম সৃজনশীল কারণ অর্থাৎ ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল।” একই অভিভাষণে প্রদত্ত এই সমস্ত বাক্যগুলো যদি আমরা একের পর এক ব্যাখ্যা করি, তাহলে মনে হয় তার দৃঢ় বিশ্বাসে নাড়া লেগেছিল, তিনি ১৮৫৮ সালে অনুভব করেছিলেন যে অ্যাপ্টেরিক্স ও লাল জংলি হাঁসেরা সর্বপ্রথম তাদের নিজেদের দেশে আবির্ভূত হয়েছিল, “তিনি জানতেন না কেমন করে বা কোন্ পদ্ধতির দ্বারা “সেটাও অজানা”।

এখানে উল্লিখিত প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে মিঃ ওয়ালেস এবং আমার গবেষণাপত্র লিনিয়ান সোসাইটিতে পড়ার পর এই বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছিল। যখন এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল, তখন “সৃজনশীল ক্ষমতার নিরবচ্ছিন্ন কার্যপ্রণালী র মতো কথাগুলিতে অন্য অনেকের মতো আমিও এত প্রতারিত হয়েছিলাম যে আমি অধ্যাপক ওয়েনকে অন্যান্য জীবাশ্মবিদদের অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম, যাঁরা প্রজাতির অপরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাসী, কিন্তু এটি (অ্যানাট, অফ ভার্টেব্রটস’, খণ্ড ৩, পৃঃ ৭৯৬) আমার পক্ষে অস্বাভাবিক ভুল বলে প্রতীয়মান হয়। এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে “নিঃসন্দেহে টাইপ-আকারটি’ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা শুরু একটি অনুচ্ছেদ (ঐ, খণ্ড ১, পৃঃ ৩৫) থেকে আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম এবং সিদ্ধান্তটি এখনও আমার সঠিক বলেই মনে হয়, যে অধ্যাপক ওয়েন স্বীকার করেছিলেন যে একটি নূতন প্রজাতির উৎপত্তিতে প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছু ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে; কিন্তু দেখা যায় (ঐ, খণ্ড ৩, পৃঃ ৭৯৮) এটি ভুল এবং প্রমাণহীন। আমি লন্ডন রিভিউ-এর সম্পাদক এবং অধ্যাপক ওয়েনের মধ্যে পত্রবিনিময় থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, যা থেকে সম্পাদক ও আমরা নিকট এটি স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয় যে অধ্যাপক ওয়েন আমার. পূর্বে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব প্রচারের দাবীদার। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত পুস্তকের অনুচ্ছেদগুলো থেকে যেটুকু বোঝা যায় (ঐ, খণ্ড ৩, পৃঃ ৭৯৮), তাতে মনে হয় আমি অংশতঃ অথবা সামগ্রিকভাবে আবার ভুল করেছি। এটি আমার পক্ষে সান্ত্বনাদায়ক যে অন্যান্যরা অধ্যাপক ওয়েনের বিতর্কিত লেখাগুলো বুঝতে ও মীমাংসা করতে আমার মতোই। অসমর্থ। কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতির ঘোষণা বিষয়ে যতদূর বলা যায়, এটি সম্পূর্ণ অনাবশ্যক যে অধ্যাপক ওয়েন আমার পূর্ববর্তী ছিলেন কি ছিলেন না, কারণ আমাদের উভয়ের বহু পূর্বে ডঃ ওয়েলস্ এবং মি. ম্যাথিউ যে কথা বলেছিলেন তা এই ঐতিহাসিক রূপরেখায় বর্ণিত হয়েছে।

এম. ইসিডোরে জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারে তার ১৮৫০ সালের বক্তৃতায় (যার সারসংকলন ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের ‘রিভিউ এট ম্যাগ, ডে জুলজ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল) বলেছেন যে “প্রতিটি প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুবই দৃঢ় থাকে সেই পরিবেশের মধ্যে, যে পরিবেশের মধ্যে সে তার জীবনকে গড়ে তুলতে পেরেছে। কিন্তু যদি তাদের জীবদ্দশায় তাদের পরিবেশের মধ্যে কোনরকম পরিবর্তন আসে, তবেই তারা নিজেদের পরিবর্তন করে থাকে। পর্যবেক্ষণ করে যা দেখা গেছে তা সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কিছু প্রজাতির পশুরা যথারীতি নিজেদের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এইসব পর্যবেক্ষকদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখা গেছে যে বন্য পশুকে গৃহপালিত পশু বা পোষমানানো পশুতে রূপান্তরিত করা যায়, অন্যদিকে পোষ মানানো পশুকে পুনরায় বন্য পশু বা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া যায়। এই একই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে প্রমাণিত হয় যে বিভিন্ন গণগত বৈশিষ্ট্য প্রজাতিদের মধ্যে কোন অপরিবর্তনীয় স্বতন্ত্রতা গড়ে তোলে না।” তিনি তার হিস্ট, ন্যাচ. জেনারেল (খণ্ড ২, পৃঃ ৪৩০, ১৮৫৯) গ্রন্থে সদৃশ সিদ্ধান্তসমূহ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন।

দেরীতে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে ১৮৫১ সালে ডঃ ফ্ৰেক (ডাবলিন মেডিক্যাল প্রেস, পৃঃ ৩২২) একটি তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন যে একটি আদিম প্রকার থেকে সমস্ত জীবের উদ্ভব হয়েছে। তার বিশ্বাসের কারণ ও বিষয়টির বর্ণনা আমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; কিন্তু যেহেতু ডঃ ফ্রেক ‘ জৈবিক সাদৃশ্য দ্বারা প্রজাতির উৎপত্তি’ নামে একটি রচনা এখন (১৮৬১) প্রকাশ করেছেন, তাই তার মতবাদের উপর কোন ধারণা দেওয়ার কষ্টকর চেষ্টা আমার পক্ষে নিষ্প্রয়োজন।

মিঃ হার্বার্ট স্পেনসার একটি প্রবন্ধে ( প্রথমে ১৮৫২ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত “লিডার পত্রিকায় এবং ১৮৫৮ সালে তাঁর রচনাবলীতে পুনঃপ্রকাশিত) জীবের সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশের তত্ত্বসমূহ সম্বন্ধে অত্যন্ত দক্ষতা ও ক্ষমতার সঙ্গে বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। গৃহপালিত উৎপাদনের উপমা, অসংখ্য প্রজাতির সূণের পরিবর্তন, প্রজাতি ও ভ্যারাইটিদের পার্থক্য করার অসুবিধা এবং সাধারণ ক্রমোন্নতির সূত্র থেকে তিনি যুক্তি দেখান যে প্রজাতিরা রূপান্তরিত হয়েছে; এবং তিনি বলেন রূপান্তরগুলি পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য হয়েছে। ক্রমবিন্যাসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মানবিক ক্ষমতা ও সামর্থ্য অর্জনের নীতির উপর ভিত্তি করে মনোবিজ্ঞান আলোচনা করেছেন তিনি।

বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম. নডিন ১৮৫২ সালে প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি চমৎকার গবেষণাপত্রে (রিভিউ হর্টিকোলে, পৃঃ ১৩২; তারপর ‘নউভেলেস আর্কাইভস ডু মিউজিয়াম, খণ্ড ১, পৃঃ ১৭১-এ অংশতঃ পুনঃপ্রকাশিত) স্পষ্টভাবে তার বিশ্বাস ব্যক্ত করেন যে গৃহপালনাধীনে ভ্যারাইটিরা যেভাবে সৃষ্ট হয়, সেই একই উপায়ে প্রজাতিগুলি সৃষ্ট হয়। পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের নির্বাচনী ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। প্রকৃতিতে কেমন করে নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল হয় তা তিনি উল্লেখ করেন নি। ডিন হার্বার্টের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন যে বর্তমানের তুলনায় জায়মান অবস্থায় প্রজাতিরা আরও নমনীয় ছিল। তার কথিত পরিণামের নীতির উপর অতিশয় গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি, “ একটি রহস্যময় শক্তি, যা তাদের অলক্ষ্য ও নিয়তি, এই প্রকৃতি তাদের দিয়ে সেইসব কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে করিয়ে নিচ্ছে যা তাদের জন্য নির্ধারিত। কোন্ পরিবেশে তারা বেড়ে উঠবে, কোন্ পরিবেশ তাদের পক্ষে উপযুক্ত, সে সবই নির্ধারণ করে থাকে প্রকৃতি। প্রকৃতির এই লীলাখেলাকে অনুসরণ করেই তাদের বেড়ে উঠতে হয়। প্রকৃতির এই রহস্যময়তার মধ্যেই তাদের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সাদৃশ্যজনিত আকারে বেড়ে ওঠে। যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির দ্বারা তাদের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। প্রকৃতির এই রহস্যময় ঘূর্ণাবর্তে সাধারণ জীবকূলের সমস্ত রকম ক্রিয়া সম্পাদিত হয়ে থাকে এবং সেই একই কার্য তাদের শাবকদের উপরেও প্রযুক্ত হয়।” (৩)

১৮৫৩ সালে কাউন্ট কেইসারলিং নামে একজন ভূবিজ্ঞানী (বুলেটিন ডে লা সোস, জিয়ে!লাজ’, ২য় ক্রম, খণ্ড ১০, পৃঃ ৩৫৭) প্রস্তাব করেন যে যেমন নূতন রোগসমূহ, যা পৃতিবাপ দ্বারা সংঘটিত হয় বলে মনে হয়, উদ্ভূত হয়েছে এবং সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত হয়েছে, সেইভাবে কোন যুগে বর্তমান প্রজাতিদের জীবাণু একটি বিশেষ পরিবেষ্টক অণুদের দ্বারা রাসায়নিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে এবং নূতন আকার ধারণ করতে পারে।

ঐ একই বৎসরে, ১৮৫৩ সালে, ডঃ শ্যাফহাউসেন একটি চমৎকার পুস্তিকা প্রকাশ করেন, (ভারহ্যান্ড, ডেস ন্যাচারিস্ট ভেরেইনস্ ডার প্রিউস. রাইনল্যান্ডস, ইত্যাদি) যাতে তিনি পৃথিবীতে জৈব আকারগুলোর ক্রমবিকাশ উল্লেখ করেন। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে অনেক প্রজাতি দীর্ঘদিনব্যাপী বিশুদ্ধ থাকে, পক্ষান্তরে কিছু প্রজাতি রূপান্তরিত হয়। মধ্যবর্তী ক্রমিক আকারগুলির ধ্বংসসাধন দ্বারা প্রজাতির পার্থক্য ব্যাখ্যা করেন তিনি। “এইভাবে নূতন সৃষ্টির দ্বারা অধুনালুপ্তদের থেকে জীবন্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীরা পৃথক হয় না, কিন্তু এদেরকে অনবরত জননের মধ্য দিয়ে তাদেরই বংশধর হিসেবে গণ্য করা দরকার।”

সুপরিচিত ফরাসী উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম. লেকক ১৮৫৪ সালে লেখেন (এটুডেস সুর জিয়োগ্রাফ.বট’, খণ্ড ১, পৃঃ ২৫০), “কিছু প্রজাতির পশুদের পরস্পরের মধ্যে যে স্বতন্ত্রতা থাকে তা তাদের মন বা ধারণার স্বতন্ত্রতার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে– এই ধারণা আমরা দুই বিখ্যাত মণীষী জিওফ্রয় সেন্ট হিলারে ও গেটের গবেষণা থেকে যথারীতি লাভ করেছি।” এম. লেখকের বিশাল গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি অনুচ্ছেদে প্রজাতির রূপান্তর সম্বন্ধে তাঁর মতবাদ কিছু সন্দেহ জাগায়।

১৮৫৫ সালে প্রকাশিত “জগতের ঐক্যসংক্রান্ত প্রবন্ধসমূহ’-তে রেভারেণ্ড ব্যাডেন পাওয়েল সৃষ্টির দর্শন’ অতি সুনিপুণভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। নতুন প্রজাতির প্রবর্তন “একটি নিয়মিত অথচ আকস্মিক ঘটনা নয়” এটি তিনি যেভাবে দেখিয়েছেন তার তুলনায় আর কোন কিছুই অধিকতর চিত্তাকর্ষক হতে পারে না।

‘লিনিয়ান সোসাইটির জার্নাল’-এর তৃতীয় খণ্ডে মিঃ ওয়ালেস ও আমার রচিত এবং ১৮৫৮ সালের ১লা জুলাই তারিখে পঠিত গবেষণাপত্রে, যা এই খণ্ডের ভূমিকায় বলা হয়েছে, মি. ওয়ালেস প্রশংসনীয় দক্ষতায় এবং স্পষ্টভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব উপস্থাপিত করেছেন।

ভন বেয়ার, যার প্রতি সমস্ত প্রাণীবিজ্ঞানীরা অগাধ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, ১৮৫৯ সালে (দ্রষ্টব্য, অধ্যাপক রুডলফ ওয়াগনার ‘জুলজিশ্চ-অ্যানথ্রপলজিশ্চ উণ্টারসুচাঙ্গেন’, ১৮৬১, পৃঃ ৫১) মূলতঃ ভৌগলিক শ্রেণীবিভাগের নিয়মাবলীর উপর ভিত্তি করে দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করেছিলেন যে নিখুঁতভাবে পৃথক বর্তমান আকারগুলি একটি পিতামাতা আকার থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

১৮৫৯ সালের জুন মাসে অধ্যাপক হালে ‘প্রাণীজীবনের স্থায়ী নমুনা’-র উপর রয়্যাল ইনস্টিউশনে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। এই সব ঘটনার উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেন, “এ সবের মতো এইরূপ বিষয়গুলির অর্থ বোঝা কষ্টকর যদি আমরা মনে করি প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতি অথবা প্রতিটি জৈবসংগঠন দীর্ঘকালের ব্যবধানে পৃথিবীপৃষ্ঠে সৃজনশীল ক্ষমতার একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট ও প্রবর্তিত হয়েছিল; এবং স্মরণ করা ভাল যে এরকম একটি ধারণা ঐতিহ্য বা প্রত্যাদেশ দ্বারা অসমর্থিত, যেহেতু এটি, প্রকৃতির সাধারণ উপমার বিরোধ। অন্যদিকে, যদি ঐ প্রকল্প সম্বন্ধীয় স্থায়ী নমুনাদের আমরা পর্যবেক্ষণ করি, যেটির মতে যে কোন সময়ে জীবিত প্রজাতিরা পূর্বে অবস্থিত প্রজাতিদের ক্রমিক রূপান্তরের পরিণাম, প্রকল্পটি যদিও অপ্রমাণিত ও এর কিছু সমর্থকের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত, তবুও কেবলমাত্র এটিই শারীরতত্ত্বের দ্বারা সমর্থিত হয়; এদের অবস্থান সম্ভবত দেখায় যে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগে সংঘটিত জীবন্ত জীবের রূপান্তরের পরিমাণ সমগ্র পরিবর্তনের তুলনায় অত্যন্ত কম।

১৮৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ডঃ হুঁকার ‘অস্ট্রেলিয়ার ফ্লোরার ভূমিকা’ প্রকাশ করেন। এই বিরাট গ্রন্থের প্রথমাংশে তিনি প্রজাতির উদ্ভব ও রূপান্তর স্বীকার করেছেন এবং অনেক মৌলিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা এই তত্ত্ব সমর্থন করেছেন।

.

ভূমিকা

আমি যখন এইচ. এম. এস. ‘বিগ্‌ল’ জাহাজে চড়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে পরিভ্রমণ করেছিলাম, তখন দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাসকারী জীবগুলির বিস্তার এবং ঐ মহাদেশে বর্তমান ও অতীতে বসবাসকারী জীবদের ভূতাত্ত্বিক সম্পর্ক লক্ষ্য করে কয়েকটি ঘটনায় রীতিমতো অভিভূত হয়েছিলাম। এই সব তথ্য, এই গ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে দেখা। যাবে, মনে হয়েছিল প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কেও কিছু আলোকপাত করবে–যেমন আমাদের বিখ্যাত দার্শনিকদের মধ্যে একজন বলেছেন, রহস্যের মধ্যে রহস্য। ১৮৩৭ সালে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পরে আমার মনে হয়েছিল, সমস্ত সংগৃহীত তথ্য গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এগুলি প্রশ্নটি সম্বন্ধে হয়তো কিছু আলোকপাত করতে পারে। পাঁচ বছর গবেষণার পর আমি বিষয়টির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্বন্ধে অনুমান করতে শুরু করেছিলাম এবং ছোট ছোট টীকার খসড়া তৈরি করেছিলাম, যা তখন। আমার নিকট সম্ভবপর বলে মনে হয়েছিল। সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি একই বিষয় অবিচলভাবে অন্বেষণ করেছি। আশা করি এই সমস্ত ব্যক্তিগত বর্ণনার জন্য আমাকে ক্ষমা করা যেতে পারে, কারণ এই সিদ্ধান্ত আসার জন্য আমি হঠকারী হইনি।

আমার গবেষণা এখন (১৮৫৯) প্রায় শেষ। কিন্তু যেহেতু এটি শেষ করতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে এবং আমার স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়, তাই এই সারসংগ্রহ প্রকাশ করাতে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে। আমি বিশেষভবে এটি প্রস্তুত করতে প্রবৃত্ত হয়েছি, যেহেতু মিঃ ওয়ালেস, যিনি এখন মালয় দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক ইতিহাস অনুশীলন করছেন, প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে আমার সিদ্ধান্তের মতো প্রায় একই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন। ১৮৫৮ সালে এই বিষয়ের উপর তিনি আমাকে একটি স্মারক বিবরণ পাঠিয়েছিলেন এবং অনুরোধ করেছিলেন যেন আমি সেটি চার্লস লিয়েলের নিকট পাঠাই। তিনি সেটি লিনিয়ান সোসাইটিতে পাঠান এবং বিবরণটি ঐ সোসাইটির জার্নালের তৃতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। স্যার সি. লিয়েল ও ডঃ হুঁকার উভয়েই আমার গবেষণা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন-শেষের জন ১৮৪৪ সালে আমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পড়েছিলেন–এবং তারা মি. ওয়ালেসের উৎকৃষ্ট স্মারক বিবরণের সঙ্গে আমার পাণ্ডুলিপির কয়েকটি সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি প্রকাশ করার কথা চিন্তা করে আমাকে সন্মানিত করেন।

বর্তমানে আমি যে সারসংগ্রহ প্রকাশ করছি তা অবশ্যই অসম্পূর্ণ। আমার কয়েকটি বক্তব্যের জন্য প্রামাণ্য গ্রন্থাদির বিশেষ অংশ ও বিশেষজ্ঞদের নাম উল্লেখ করতে আমি অক্ষম। আশা করি পাঠকরা আমার নিখুঁততায় আস্থা স্থাপন করবেন। ভুল অবশ্য হতেই। পারে, যদিও সর্বদাই আমি শুধুমাত্র বিচক্ষণ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যকেই গুরুত্ব দিয়েছি। ব্যাখ্যা সমেত কয়েকটি উদাহরণের সঙ্গে উপনীত আমার কিছু সাধারণ সিদ্ধান্তই শুধু উল্লেখ করতে পারি, তবে আমি আশা করি সেগুলোই যথেষ্ট। পূর্বসূত্রের উল্লেখ সমেত, সমস্ত তথ্যের পূর্ণ বর্ণনা, যেগুলো আমার সিদ্ধান্তের ভিত্তি, সেগুলো প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা আমার থেকে কেউই বেশি অনুভব করছেন না। আশা করি ভবিষ্যতে আমি এ কাজটি করব। কারণ আমি ভালভাবেই অবগত আছি যে এই গ্রন্থে এমন একটি বিষয়ও আলোচিত হয়নি যার কোন প্রমাণ উল্লেখ করা যেতে পারে না, যার থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যা আমার উপনীত সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধী। প্রত্যেক প্রশ্নের উভয় দিকের তথ্য ও যুক্তিগুলির পূর্ণ বর্ণনা এবং সমতা রক্ষার দ্বারা ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এখানে তা অসম্ভব।

আমি অতিশয় দুঃখিত যে, যে সমস্ত প্রকৃতিবিদের কাছ থেকে উদার সাহায্য লাভ করেছি স্থানাভাবে তাদের কাছে আমার ঋণস্বীকার সম্ভব হচ্ছে না, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে আমার অপরিচিত। ডঃ হুঁকার, যিনি গত পঞ্চাশ বছর ধরে তার অগাধ জ্ঞানভাণ্ডার ও অপূর্ব বিচারশক্তির দ্বারা আমাকে সর্ববিধ সাহায্য করেছেন, তাঁর প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের এই সুযোগ আমি হারাতে পারি না।

প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে সবকিছু বিবেচনা করে, এটি সম্পূর্ণ বোধগম্য হয় যে একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী জীবদের পারস্পরিক সম্বন্ধ, ভূণ সম্বন্ধীয় সম্পর্ক, তাদের ভূ বিস্তারণ, ভূতাত্ত্বিক পর্যায় এবং অন্য সব তথ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন যে প্রজাতিরা স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয় নি, বরং ভ্যারাইটিদের মতো অন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এরূপ একটি সিদ্ধান্ত সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও অসন্তোষজনক হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখানো যায় যে এই পৃথিবীতে বসবাসকারী অসংখ্য প্রজাতি রূপান্তরিত হয়ে থাকবে, এটি অর্জন করার জন্য যে গঠনের উৎকর্ষতা এবং সহ অভিযোজন প্রয়োজন তা সঙ্গতভাবেই আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা অনবরত পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কথা উল্লেখ করেন, যথা আবহাওয়া, খাদ্য ইত্যাদি যেগুলি পরিবৃত্তির সম্ভাব্য একমাত্র কারণ। একটি সীমিত অর্থে যা আমরা এখন থেকে পর্যবেক্ষণ করব তা সত্য হতে পারে; কিন্তু, উদাহরণস্বরূপ, গাছের ছালে পোকামাকড় ধরার জন্য পায়ের পাতা, লেজ, ঠোঁট ও জিভ সমেত কাঠঠোকরার দেহগঠন এত সুন্দরভাবে অভিযোজিত যে তার কারণ কেবলমাত্র পারিপার্শ্বিক অবস্থায় আরোপ করা ভ্রমাত্মক হবে। মিলটো পরাশ্রয়ী গুল্মগাছের ক্ষেত্রে, যা অন্য গাছের থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে, তার একটি ফুল থেকে অন্য ফুলে পরাগ বহন করার জন্য কোন কোন পতঙ্গ কে মাধ্যম হিসাবে অবশ্যই প্রয়োজন হয়; পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবের দ্বারা, বা স্বভাবের, বা উদ্ভিদের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা কয়েকটি স্বতন্ত্র জীবের সম্পর্ক সমেত এই পরজীবীর দেহগঠনকে বিচার করা একইরকম ভ্রমাত্মক।

অতএব রূপান্তরের উপায়গুলি এবং সহ-অভিযোজনের মর্ম উপলব্ধি করা একান্তই প্রয়োজন। আমার পর্যবেক্ষণের প্রারম্ভে এটি সম্ভবপর বলে মনে হয়েছিল যে গৃহপালিত প্রাণী ও আবাদী উদ্ভিদদের যত্নপূর্বক পর্যবেক্ষণ এই দুর্বোধ্য সমস্যার সমাধানে ভাল ফল প্রদান করবে। তাতে আমি হতাশও হইনি; এক্ষেত্রে এবং অন্যান্য সমস্ত জটিল ক্ষেত্রে আমি নিয়তই দেখেছি যে আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ হলেও গৃহপালনাধীন অবস্থায় পরিবৃত্তি (variation) সম্পর্কে আমাদের সর্বোত্তম ও নিরাপদ সূত্র প্রদান করেছে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণের প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করার সাহস আমি রাখি, যদিও প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের কাছে এগুলো সাধারণভাবে অবজ্ঞাতই রয়েছে।

এগুলো বিচার-বিবেচনা করেই, এই সংক্ষিপ্ত বিবরণের প্রথম অধ্যায়ে গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তির উপর মনোনিবেশ করব আমি। এইরূপে আমরা দেখব যে বহুপরিমাণে বংশগত রূপান্তর সম্ভবপর এবং সমভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল আনুক্রমিক অল্প অল্প পরিবৃত্তিসমূহকে নির্বাচন দ্বারা সঞ্চয় করার ব্যাপারে মানুষের প্রচণ্ড ক্ষমতা। এরপর প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রজাতিদের পরিবৃত্তি সম্পর্কে মনোনিবেশ করব আমি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি এই বিষয়টি সংক্ষেপে বিবেচনা করতে বাধ্য হব, যদিও তথ্যসমূহের দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেই এগুলোর সত্যতা অনুধাবন করা সম্ভব। তবে পরিবৃত্তির পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল অবস্থাটা কী, তা আমরা আলোচনা করতে সমর্থ হব।

পরবর্তী অধ্যায়ে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সমস্ত জীবের মধ্যে জীবনসংগ্রাম প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে, যা এদের বৃদ্ধির উচ্চ জ্যামিতিক হার থেকে অনিবার্যভাবে অনুসৃত হয়। সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতে আরোপিত এটাই হচ্ছে ম্যালথাস তত্ত্ব। বেঁচে থাকার সম্ভাবনার তুলনায় প্রত্যেক প্রজাতির আরও অসংখ্য একক জন্মায়, এবং পরিণতিতে বাঁচার জন্য প্রায়শঃই পৌনঃপুনিক সংগ্রাম চলে। এর অর্থ হল–জীবনের জটিল ও কোন কোন সময় পরিবর্তিত জীবন-অবস্থায় যে কোন জীবের অল্প পরিবর্তন হলেও যদি তা লাভজনক হয়, তাহলে সেটির বেঁচে থাকার অধিকতর সম্ভাবনা থাকবে এবং এভাবে প্রকৃতিগতভাবে নির্বাচিত হবে। বংশানুসৃতির কঠোর নিয়মানুসারে, যে কোন নির্বচিত প্রকার তার নূতন ও রূপন্তরিত আকারে বংশবিস্তার করতে সমর্থ হবে।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই মৌলিক বিষয়টি চতুর্থ অধ্যায়ে সবিস্তারে আলোচিত হবে। তখন আমরা দেখব প্রাকৃতিক নির্বাচন কেমন করে জীবনের কম উন্নত আকারদের অথবা জাতদের প্রায় অনিবার্যভাবে বিলুপ্তি ঘটায় এবং সেইদিকে প্ররোচিত করে, যাকে আমি বৈশিষ্ট্যের কেন্দ্ৰাপসারণ বলি। পরবর্তী অধ্যায়ে পরিবৃত্তির জটিল ও অল্পজ্ঞাত নিয়মগুলো আলোচনা করব। পরবর্তী পাঁচটি অধ্যায়ে তত্ত্বটিকে স্বীকার করার পক্ষে সবথেকে স্পষ্ট ও জটিল সমস্যাগুলো আলোচিত হবে: যথা, প্রথমতঃ, অবস্থান্তরের অসুবিধাসমূহ, অথবা একটি সরল জীব এবং একটি সরল অঙ্গ কেমন করে একটি উচ্চ বিকশিত জীবে অথবা সুগঠিত অঙ্গে পরিবর্তিত অথবা নিখুঁত হতে পারে; দ্বিতীয়তঃ, সহজাত প্রবৃত্তির বিষয়টি অথবা প্রাণীদের মানসিক ক্ষমতা; তৃতীয়তঃ, সঙ্করণ অথবা আন্তঃসঙ্করণের পর প্রজাতিদের অনুর্বরতা ও প্রকারদের উর্বরতা; চতুর্থতঃ, ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডের অসম্পূর্ণতা। পরবর্তী অধ্যায়ে সর্বকালের জীবের ভূতাত্ত্বিক অনুগমন বিবেচনা  করা হবে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অধ্যায়ে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী এদের ভৌগলিক বিস্তার; চতুর্দশ অধ্যায়ে এদের শ্রেণীবিভাগ বা পরিণত ও ভূণাবস্থায় এদের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহ; সর্বশেষ অধ্যায়ে সমগ্র গবেষণার সারসংক্ষেপ ও কয়েকটি উপসংহারমূলক মন্তব্য উপস্থিত করব আমি।

প্রজাতি ও ভ্যারাইটিদের উৎপত্তি সম্বন্ধে এমন অনেক কিছুই অব্যাখ্যাত রয়েছে যে তার জন্য কারুর আশ্চর্যান্বিত হওয়া উচিত হবে না, যদি তিনি আমাদের চতুষ্পার্শ্বের জীবদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের গভীর অজ্ঞতা স্বীকার করেন। কেন। একটি প্রজাতি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ও সংখ্যাধিক হয়, এবং কেন সম্বন্ধযুক্ত অন্য প্রজাতির বিস্তার সংকীর্ণ ও বিরল হয়, কে তা ব্যাখ্যা করতে পারে? তথাপি এই সম্পর্কগুলো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমার বিশ্বাস এই পৃথিবীর প্রত্যেক অধিবাসীর বর্তমান কল্যাণ ও ভবিষ্যৎ সাফল্য এবং তার রূপান্তর এরাই নির্ধারণ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিগত বহু ভূতাত্ত্বিক যুগের সময় এই গ্রহে বসবাসকারী অসংখ্য অধিবাসীদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে এখনও আমরা যথেষ্ট কম জানি। যদিও অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়েছে এবং দীর্ঘদিন অস্পষ্ট থাকবে, তবু সবিশেষ অনুশীলন এবং পক্ষপাতহীন বিচার-বিশ্লেষণের পর আমি এই মত পোষণ করতে পারি যে মতবাদটি, যা সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অধিকাংশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী পোষণ করেন এবং যা আমি পূর্বে পোষণ করতাম–যথা, প্রত্যেক প্রজাতি স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়েছে–তা ভ্রমাত্মক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রজাতিরা অপরিবর্তনশীল নয়; আরও বিশ্বাস করি যে একই গণের অন্তর্গত প্রজাতিরা অন্য কোন এবং সাধারণতঃ বিলুপ্ত প্রজাতির বংশধর, একইভাবে যে কোন একটি প্রজাতির স্বীকৃত ভ্যারাইটিরা ঐ প্রজাতিটির বংশধর। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রাকৃতিক নির্বাচনই হচ্ছে রূপান্তরের পদ্ধতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একমাত্র পদ্ধতি নয়।

————-

১। অ্যারিস্টটল তার ‘Physicae Auscultationes (lib2.cap.8.s.2) গ্রন্থে শস্য ফলবার জন্য বৃষ্টি হয় না, এই মন্তব্য করে জীবের ক্ষেত্রে একই যুক্তি প্রয়োগ করেন; এবং বলেন (যেমন মিঃ ব্লেয়ার গ্রেসে অনুবাদ করেছিলেন, এবং যিনি রচনাংশটি সম্পর্কে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন), “প্রকৃতিতে (শরীরের) বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ গুলির আকস্মিক সম্পর্ক থাকার বাধা কোথায়? যেমন দাঁতগুলি প্রয়োজনের জন্য বিকশিত হয়, সামনেরগুলি তীক্ষ্ণ ও ছেদনের জন্য অভিযোজিত এবং পেষকগুলি চেপ্টা ও খাবার চেবানোর উপযোগী; এই সব কাজের জন্য এদের সৃষ্টি হয়নি, বরং এটা দৈবক্রমে ঘটেছিল। অন্য প্রত্যঙ্গগুলি সম্পর্কেও এই নিয়ম প্রযোজ্য, এবং পরিশেষে অভিযোজনের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয়। যে কোন স্থানেই হোক না কেন, সমস্ত জিনিসগুলি (একটি সমগ্রের বিভিন্ন অংশগুলি) একত্রে ঘটেছিল যেন এরা কোন কিছুর জন্য সৃষ্টি হয়েছিল, আভ্যন্তরীণ স্বতঃপ্রবৃত্ততার দ্বারা যথোচিতভাবে স্থাপিত হয়ে এগুলি সংরক্ষিত হয়েছিল; এবং যেকোন স্থানেই হোক না কেন, জিনিসগুলি এইরূপে স্থাপিত না হওয়ার জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে এবং হচ্ছে।” এখানে প্রাকৃতিক নির্বাচন সূত্রটি অদৃশ্যভাবে অনুসৃত হয়েছিল দেখেছি। হাতের গঠনের ওপর তার মন্তব্য থেকে এই বিষয়ে অ্যারিস্টটলের ধারণা কত সীমিত ছিল তা বোঝা যায়।

২। ইসিডোর জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারের (হিস্ট্রি ন্যাচ, জেনারালে’, খণ্ড ২, পৃঃ ৪০৫, ১৮৫৯) এই বিষয়ের ওপর মতবাদগুলির চমৎকার ইতিহাস থেকে আমি নামাৰ্কের রচনার প্রথম প্রকাশের তারিখটি গ্রহণ করেছি। এই বিষয়ের ওপর বুফনের সিদ্ধান্তসমূহের একটি পূর্ণ তালিকা এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে। এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে কেমন করে আমার পিতামহ ডঃ ইরাসমাস ডারউইন ১৭৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘জুনোমিয়া’ (খণ্ড ১, পৃঃ ৫০০-৫১০)-তে লামার্কের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতসমূহের ভ্রমাতৃক যুক্তিগুলি পূর্বেই বহুলাংশে উপলব্ধি করেছিলেন। ইসিডোর জিওফ্রয়-এর মতানুসারে, গেটে নিঃসন্দেহে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গির অতিশয় অনুগামী ছিলেন, যেমনটা ১৭৯৪ ও ১৭৯৫ সালে লিখিত কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপ্রকাশিত, তার বই এর ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি স্পষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন (গেটে আলস্ নেচারফস্টার, ভন ডঃ কার্ল মেডিং, এস ৩৪) যে প্রকৃতিবিদদের কাছে ভবিষ্যতের প্রশ্নটি হবে, উদাহরণস্বরূপ, কেমন করে গো-মহিষাদিরা তাদের শিঙের অধিকারী হয়, কীভাবে তা ব্যহহৃত হয় সে প্রশ্ন নয়। এটি বরং একটি উপায়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ যাতে অনুরূপ মতবাদ প্রায় একই সময়ে উদ্ভব হয়, যে জার্মানিতে গেটে, ইংল্যান্ডে ডঃ ডারউইন এবং ফ্রান্সে জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারে (যেমন আমরা এখন দেখব) প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ১৭৯৪-১৭৯৫ সালে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

৩। ব্রনের ‘আন্টারসূচন জেন ইউবার ডাই এণ্টউকেলাঙ্গস-গেজেটজে উল্লেখ থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রসিদ্ধ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও জীবাশ্মবিদ উনগার ১৮৫২ সালে বলেছিলেন যে প্রজাতিরা ক্ৰমবিকশিত ও রূপান্তরিত হয়। এইরূপে ডাল্টন, জীবাশ্ম শ্লথের উপর প্যাণ্ডার এবং ডাল্টনের ১৮২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে একটি বিশ্বাস উপস্থাপিত হয়েছিল। সকলেই জানেন, ওকেন তার রহস্যময় ‘নেচার ফিলসফি’ গ্রন্থে একই মত ব্যক্ত করেছিলেন, গড্রনের সুর এল’ এসপেসে’ গ্রন্থের উল্লেখ থেকে মনে হয় রবিসেণ্ট ভিনসেন্ট, বুড্যাক, পয়রেট এবং ফ্রাইস সকলেই স্বীকার করেছেন যে নূতন প্রজাতি অনবরত সৃষ্টি হচ্ছে। আমি যোগ করতে পারি যে এই ঐতিহাসিক রূপরেখায় উল্লিখিত ৩৪ জন লেখকের মধ্যে, যাঁরা প্রজাতির রূপান্তরে বিশ্বাস করেন বা অন্ততঃ সৃষ্টির পৃথক প্রক্রিয়া অবিশ্বাস করেন, ২৭ জন প্রাকৃতিক ইতিহাস অথবা ভূবিদ্যার বিশেষ শাখাগুলির উপর লিখেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *