১০. পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে

১০.

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে বিকেলের ঝকঝকে আকাশটাকে কেমন পাঁশুটে লাগছিল লাল্টুর। প্রথম সেমেস্টারের পালা চুকল, সামনে টানা এক সপ্তাহ ছুটি, তবু প্রাণে এতটুকু আনন্দ নেই যেন। শেষ পরীক্ষাটা কী খারাপ যে হল আজ। সহজ প্রবলেম ভুল করল, মুখস্থ থিয়োরি খাতায় উগরোতে গিয়ে গুলিয়ে গেল মাঝপথে, এতটাই সময় নষ্ট হল যে আস্ত একখানা ব্রড কোয়েশ্চেন ছেড়ে দিতে হল শেষমেষ। সিক্সটি পারসেন্ট তো দূরস্থান, ব্যাক না পেয়ে যায় পেপারটায়।

প্রস্তুতির ত্রুটি? লাল্টু দেদার ফাঁকি দিয়েছে? তাও তো নয়। সেদিন তোয়া যা বাণী দিল, তারপর থেকে তো লাল্টু যথেষ্ট মন বসিয়েছে পড়াশোনায়। তাও যে কেন এমন হল?

ক’দিন আগে কলেজ থেকে ফিরে লাল্টু দাঁড়িয়েছিল ব্যালকনিতে। একটু আগে ফোন এসেছিল কৃষ্ণনগর থেকে, বড়মামা জানতে চাইছিল টাকার কথাটা লাল্টু বাবাকে বলেছে কি না। প্রথম নয়, পুজোর ছুটির পর এই নিয়ে বোধহয় বার চারেক ফোন করল বড়মামা। অন্য দিনের মতো সেদিনও এটা সেটা বলে কাটিয়ে দিয়েছে লাল্টু, কিন্তু ভাবছিল কী করে বড়মামার এই উৎপাতটা পাকাপাকিভাবে বন্ধ করা যায়।

তখনই হঠাৎ তোয়ার আগমন। পাশে দাঁড়িয়ে বলল, জানো একটা কাণ্ড হয়েছে।

কী?

মা পরশুদিন বাবাকে দেখতে গিয়েছিল।

তাই? খবরটার ধাক্কায় মুহূর্ত আগের ভাবনাটা সরে গেছে লাল্টুর। বিস্মিত স্বরে বলল, তোমার মা’র কি ও বাড়িতে যাতায়াত আছে?

মোটেই না। থাকলে তো বাবা বলত। বাবার অত লুকোছাপা নেই। তোয়ার ঠোঁট বেঁকে গেল, কেন যে হঠাৎ দরদ উথলে উঠল!

ওভাবে বলছ কেন? তোমার বাবার দুর্ঘটনায় উনি তো সত্যিই চিন্তিত। মাঝে মাঝেই তো তোমাকে জিজ্ঞেস করেন।

ও তো স্রেফ ঢং। জানার ইচ্ছে থাকলে তো বাবাকে ফোনই করতে পারে। গড়িয়ায় যাওয়ারই বা কী দরকার ছিল, অ্যাঁ?

দরকারটা তুমি এখনই কী করে বুঝবে! লাল্টু ঠাট্টা জুড়েছিল, আগে আরও বড় হও, প্রেম ভালবাসাটাসা হোক।

বোকো না। প্রেমভালবাসা কী জিনিস আমার বোঝা হয়ে গেছে। দুনিয়ায় নিজের ধান্দার বাইরে আর কিস্যু নেই, বুঝলে।

তুমি এত কিছু বুঝে গেছ?

ইয়েস। তাই এই সব স্টান্টবাজি আমি হেট করি। তোয়া গুমগুমে গলায় বলল, আজব পাবলিক! যাকে ডিভোর্স করে দিয়েছে তার বাড়ি যেতে লজ্জা করল না, উলটে কিনা আমায় গুঁতোয়!

কেন? কী বলেছেন তোমায়?

তোমার আমার ও বাড়ি যাওয়া নিয়ে একগাদা কথা শোনাল। লেখাপড়া না করে আমরা নাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গিয়ে আড্ডা মারছি… তোমার সামনে এগজাম, আমি নাকি তোমার সময় নষ্ট করে দিচ্ছি…। বলতে বলতে তোয়া থমকেছে, তোমার ফার্স্ট সেমেস্টার কবে থেকে শুরু হচ্ছে?

এই তো…সামনের সোমবার…

তা হলে তো এসে গেল। কেমন হয়েছে প্রিপারেশান?

তুৎ, মনই বসে না। আমি তো তোমায় বলেছি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আমার পোষাচ্ছে না।

তা বললে চলে? তা হলে এত খরচা করে ভরতি হলে কেন?

আমি কি স্বেচ্ছায় পড়ছি? বাবা তো জোর করে…। আমার পিছনে অত টাকা ঢালা হয়েছে বলে কী পরিমাণ মরমে মরে থাকি, তুমি জানো না?

স্ট্রেঞ্জ! টাকা খরচ হয়েছে বলে তোমার মানে লাগে, অথচ পড়াশোনা না করলে বাপির টাকাটা যে পুরো জলে চলে যাবে, সেটা তুমি ভাবো না?

গুম হয়ে গিয়েছিল লাল্টু। গম্ভীর মুখে বলেছিল, তা হলে আমার কী করা উচিত? বাধ্য ছেলেটি হয়ে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বনে, বাবার সঙ্গে বিজনেসে নেমে পড়ব? বাবা যেমনটি চায়?

ফিউচারে কী করবে, না করবে, সেটা তোমার ব্যাপার। এখন তো একটু প্র্যাক্টিকাল হও। জানি, বাপির ওপর তোমার খুব অভিমান আছে, তুমি তার শ্যাডো হতে চাও না…কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগটা নষ্ট করবে কেন? আমি তো ঠিক করে রেখেছি, স্কুল কলেজ দুটোই ভাল ভাবে পার করে, যেমন ভাবে হোক একটা চাকরি বাকরি জোগাড় করে, মা আর বাপি দু’জনকেই বাই বাই বলব। যতদিন সেটা না পারছি, বাপি আর মা’র থেকে সব নেব আমি। কিছু ছাড়ব না। কারণ এগুলো আমার হকের পাওনা। বড়রা নিজেদের ইচ্ছে মতো লাইফ অ্যাডজাস্ট করতে চাইলে করুক, বাট দে হ্যাভ টু পে প্রাইস ফর ইট। তোমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোটাও সেই প্রাইস, বুঝেছ কি?

একেবারেই বোঝে না যে লাল্টু, তা নয়। কিন্তু রূঢ় সত্যটা যে এভাবে কেউ ঘোষণা করবে, এতটা সে ভেবে উঠতে পারেনি। আর বলছে কিনা সেই মেয়ে, যাকে কিনা সে ক’দিন আগেও আত্মমুখী নাদান বলে ভাবত।

লাল্টু তবু মৃদু গলায় বলেছিল, কিন্তু আমার যে নিতে ইচ্ছে করে না তোয়া।

দাঁতে দাঁত চেপে গিলে নাও। চোয়ালে চোয়াল ঘষে কয়েকটা বছর লড়ে যাও। তারপর ডানায় জোর এলে ফুড়ুত করে উড়ে পালাও সাজানো পাখির বাসা থেকে।

কথাগুলো স্মরণে আসতেই আরও মনটা খারাপ হয়ে গেল লাল্টুর। প্রথম দফার পরীক্ষার এই যদি নমুনা হয়, তা হলে কি ডানা কোনওদিন পোক্ত হবে? বাবার লেজুড় হয়ে একটা পরজীবীর জীবনই কি তার ভবিতব্য?

দলবল জুটিয়ে এদিকে আসছে দেবাঞ্জন। মেঘনা বিষাণ তো বটেই, আছে ক্লাসের আরও বেশ কয়েকজন। সকলেরই চোখেমুখে খুশির ঝলক। আরও কুঁকড়ে গেল লাল্টু। তার বিষণ্ণতায় এদের আনন্দ ছানা কেটে যাবে না তো?

দেবাঞ্জন কাছে এসে বলল, তোর ব্যাপারখানা কী রে? আমরা তোর খোঁজে কলেজ তোলপাড় করছি, আর তুই কিনা করিডরের কোনায় ঘাপটি মেরে আছিস?

লাল্টু জোর করে হাসল, আমি তো তোদের জন্যই ওয়েট করছি।

মেঘনা চোখ কুঁচকে বলল, আজ ধেড়িয়েছিস মনে হচ্ছে?

সব দিন কি সমান হয়?

বিষাণ বলল, আজ পেপারটাও ডিফিকাল্ট ছিল। এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কোয়েশ্চেন করেছে…

এক একটা পেপার সেটার আছে এরকম তিকড়ম। কোয়েশ্চেন করতে গিয়ে নিজেদের ফান্ডা দেখায়।

ছাড় ছাড়। যো হো গিয়া, সো বিত গয়া। দেবাঞ্জন মাছি ওড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, চল চল, নতুন বছরের আগে তো আর দেখা হবে না, এখন একটু ক্যান্টিন গরম করে আসি।

করিডর থেকে নেমে ছোট মাঠ। ন্যাড়া ন্যাড়া। তার ওপারে সার দিয়ে ছেলেদের মেয়েদের কমনরুম। একেবারে শেষে মিনি ভোজনালয়। নতুন তৈরি বলে এখনও চেহারাটা বেশ ঝাঁ চকচকে। ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন আর কাচের শোকেস শোভিত। খাবার দাবার অবশ্য বাঁধা গতের। টোস্ট-অমলেট, পুরি-সবজি, চপ-শিঙাড়া, কেক-বিস্কুট, চা-কফি। ক্যান্টিন মালিকের মর্জি হলে ঘুগনি আলুর দম বানায় কোনও কোনও দিন। চাউমিন, ফ্রায়েড রাইসেরও দর্শন মেলে মাঝেমধ্যে। যে দ্রব্যটি বিক্রি করার নিয়ম নয়, শুধু সেইটিই পাওয়া যায় অফুরন্ত। সিগারেট।

লাল্টুদের ক্লাসের মিনি দঙ্গলটি গিয়ে বসল টেবিলে। প্লাস্টিকের চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে লাল্টুর মনে পড়ল, মোবাইলটা সুইচ অফ করা আছে এখনও। তার পরীক্ষা নিয়ে তোয়ার বেজায় কৌতূহল, এখন একটা ফোন এলেও আসতে পারে।

নিথর মোবাইলের প্রাণ ফেরাতেই চমক। তিন তিনটে মিসড কল। তিনটেই তাপসের। পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপনের তাগাদা? মেলা তো ওখানে শুরু হয়ে গেছে, লাল্টুর বিজ্ঞাপনের জন্য নিশ্চয়ই লৌকিকের বইমেলা সংখ্যা আটকে নেই! তবে তাপস যা খলিফা ছেলে, স্পেস ডোনেটেড বলে পত্রিকার একটা পাতা খালি রেখে পরে টাকা দাবি করতে পারে। একটা পালটা ফোন করবে তাপসকে? নাকি চেপে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে? কিন্তু বাল্যবন্ধু তিনবার কল করার পরেও নীরব থাকাটা কি অভদ্রতা হবে না?

সামান্য দোনামোনার পর ফোনটা করেই ফেলল লাল্টু। মোবাইল কানে চেপে উঠে গেছে ক্যান্টিনের দরজায়।

ওপারে পরিচিত গলা, অবশেষে তোর সাড়া মিলল তা হলে?

এগজ়াম চলছিল রে। মোবাইল বন্ধ রাখতে হয়েছিল।

আরে, ঠিক আছে। দশবার রিং করলে একবার জবাব দিস, তা হলেই যথেষ্ট। বুঝতে পারব একেবারে ভুলে যাসনি।

যাহ্, কী যে বলিস না! লাল্টু ফোনটা আর একটু চাপল কানে, মাইকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি…তুই কি এখন বইমেলায়?

তোর তা হলে স্মরণে আছে, কৃষ্ণনগরে এই সময়ে একটা বইমেলা হয়?

কেন টিজ করছিস? লাল্টু সামান্য চুপ থেকে বলল, লৌকিক বেরিয়েছে?

তোর কী মনে হয়?

আবার একটু চুপ থেকে লাল্টু বলল, আই অ্যাম সরি তাপস। বিশ্বাস কর, আমি বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন চাইতে পারি না।

সে না হয় নাই দিলি।… যে জন্য ফোন করা…। উনত্রিশ তারিখ তো মেলা শেষ, তার আগের দিন কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমাদের লৌকিকেরই উদ্যোগে। গজাদা চাইছে তুইও সেখানে কবিতা পড়িস।

আহ্বানটা ধক করে বাজল লাল্টুর বুকে। পাঁচ মাসের ওপর কলকাতায় এসেছে সে, এর মধ্যে একটাও কবিতা লিখতে পারেনি। সময়ের অভাব ছিল না, ঘরোয়া কাজকর্মেরও চাপ নেই কণামাত্র, তবু লিখে উঠতে পারেনি। আসেইনি কবিতা। মগজ কেমন যেন ভোঁতা মেরে গেছে। এখানে চাপ চাপ কুয়াশা ছাড়া আর যেন কিচ্ছু নেই।

তাপসের গলা বাজছে, কী রে, চুপ মেরে গেলি যে? আসবি তো? আমরা সবাই মিলে খুব হুল্লোড় করব।

দেখি…। যদি যাই…।

যদি বলছিস কেন? তোদের নিশ্চয়ই কাল থেকে বড়দিনের ছুটি পড়ছে? অবশ্য এখানে কলকাতার মতো অত প্রমোদ বিনোদন নেই…। তবু তোকে খুব এক্সপেক্ট করব।

ফোন অফ করে লাল্টু পলকের জন্য উদাস। বড়দিনের কৃষ্ণনগর কম মধুর নয় তার কাছে। আলোয় আলোয় সাজবে প্রাচীন গির্জাটা, ঘন্টাধ্বনি বাজবে, অন্দর থেকে ভেসে আসবে প্রার্থনার আওয়াজ…। সঙ্গে ঘরে ঘরে কেক খাওয়া-খাওয়ি তা আছেই।

যাবে কি কৃষ্ণনগর? গেলে হয়। দিদাকেও দেখে আসা হবে একবার।

হালকা আমেজ নিয়ে লাল্টু টেবলে ফিরল। সেখানে এখন প্রমত্ত হুড়োহুড়ি। ক্রিসমাস ইভ উপলক্ষে সবাইকে শিঙাড়া খাওয়াচ্ছে দেবাঞ্জন। প্লেট থেকে একখানা শিঙাড়া তুলে নিল মেঘনা। জবজবে সস মাখিয়ে তুলে ধরল মাথার ওপর। বলল, মেরি ক্রিসমাস।

উজ্জ্বল মুখ বেঁকাচ্ছে, দূর দূর, কেক পেস্ট্রি হলে তাও কথা ছিল। এতে তো যিশুর অমর্যাদা হচ্ছে।

বিষাণ বলল, ওসব খেতে চাইলে তো পার্ক স্ট্রিট যেতে হয় রে।…ওপাড়ায় একটা ঢুঁ মারবি নাকি?

আমি যেতে পারব না। দেবাঞ্জন হাত তুলে দিল, বাড়িতে পার্টি আছে, দিদি বলে দিয়েছে আটটার মধ্যে বাড়ি ঢুকতেই হবে।

পার্টি তো দিচ্ছে তোর দিদি জামাইবাবু। আসবে তাদের বন্ধুবান্ধবরা। ওই দামড়াদের ভিড়ে তুই কী করবি?

বা রে, খাবার দাবার সার্ভ করার লোক লাগবে না! দেবাই তো আজ পার্টির হেড ওয়েটার।

আজ্ঞে না স্যর। নিলয়দা আজ আমাকে মাল খাওয়াবে বলেছে। হুইস্কি ভদকা রাম, যা আমি চাইব তাই।

কথোপকথনের মাঝে হঠাৎই লাল্টুর কোমরে খোঁচা। মেঘনা। চাপা গলায় লাল্টুকে বলল, ওপাশের সানগ্লাস মাথায় ছেলেটাকে লক্ষ কর।

কেন? লাল্টু নিচু গলায় বলল, কী হয়েছে?

আহ্, দ্যাখ্ না। তারপরে বলছি।

চোখ তুলে ছেলেটাকে নজর করল লাল্টু। বেশ লক্কা মার্কা চেহারা। পরনে জিনসের জ্যাকেট, কানে দুল, হাতে বালা, একটা চেনও যেন ঝুলছে গলায়। আরও দুটো প্রায় একই কিসিমের চেহারা রয়েছে টেবিলে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সানগ্লাসওয়ালার মুন্ডু যেন এদিক পানেই স্থির।

লাল্টু গলা খাদে নামিয়ে বলল, ছেলেটা কে?

মেঘনা ফিসফিস করে বলল, বন্ধুরা চিনো বলে ডাকে। অরিজিনাল নামটা বোধহয় চিন্ময়। থার্ড ইয়ার মেকানিক্যাল। বহুৎ পয়সা। ম্যানেজমেন্ট কোটায় ঢুকেছে। একটা হন্ডা সিটি নিয়ে আসে। সারাক্ষণ মেয়েবাজি করে বেড়ায়।

তো?

রিসেন্টলি আমাকে টার্গেট করেছে। লাস্ট উইকে লাইব্রেরি থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গিয়েছিল…কলেজ তখন প্রায় ফাঁকা…হারামজাদা তখন আমায় ধরেছিল গেটের মুখটায়। গাড়িতে উঠতে ডাকছিল।

বলিস কী? তুই কী করলি?

না শোনার ভান করে হাঁটার স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। তারপর দৌড়ে রাস্তার ওপারে। আর একটা দিন করুক, স্ট্রেট প্রিন্সিপালকে গিয়ে বলে দেব। প্রিন্সিপাল যদি স্টেপ না নেয়, এমন হল্লা মাচাব…

অ্যাই, তোরা দু’জনে কী গুজগুজ করছিস রে? দেবাঞ্জন হেঁকে উঠল, প্রাইভেট টক হচ্ছে, অ্যাঁ?

সব কথা পাবলিক করা যায় নাকি? মেঘনা শব্দ করে হেসে উঠল। চোখ টিপে বলল, কিছু কিছু তো গোপনও রাখতে হয়, না রে সোহম?

লাল্টু এক চিলতে হাসি ফোটাল ঠোঁটে।

দেবাঞ্জন দুজনকে জরিপ করে নিয়ে বলল, যা খুশি কর।…এবার একটা কাজের কথা শোন। সাতদিনের ছুটিটা কি একদম বৃথা যাবে?

মেঘনা কপাল কুঁচকোল, মানে?

চল না, ছোট্ট করে একটা ট্রিপ মেরে আসি।

কোথায় যাবি?

কাছেপিঠে। দিঘা, শঙ্করপুর, কি মন্দারমণি…। একদিন যাব, নেক্সট দিনটা থাকব, পরদিন ব্যাক।

বিষাণ বলল, এখন খুব ভিড় হবে না?

সো হোয়াট? নিলয়দার হেভি সোর্স আছে, ঠিক কোথাও না কোথাও বুক করে দেবে।…মন্দারমণিটা নাকি দারুণ করেছে। বিশাল চওড়া বিচ, সমুদ্রটাও নাকি ঠান্ডা ঠান্ডা, যত খুশি স্নান করো…

মাল্লু কী রকম পড়বে?

কত আর। তিনদিনে ধর তিন হাজার। ম্যাক্সিমাম।

ওরে বাবা! হাজার খানেক হলে বাড়ি থেকে ম্যানেজ করতে পারি।

আরে চল না। সবাই মিলে একসঙ্গে দল বেঁধে…হয়ে যাবে।

মন্দারমণি নামটা শুনে লাল্টুর খুব ইচ্ছে জাগছিল যাওয়ার। সমুদ্রে সে সাকুল্যে গেছে একবার। পুরীতে। দিদার খুব সাধ হয়েছিল, মামার বাড়ির সবাই মিলে…। সেও তো প্রায় ছ’-সাত বছর আগে। কিন্তু ওদিকে তাপসও যে ডাকছে কৃষ্ণনগরে। তা ছাড়া বাবার টাকায় ফূর্তি করতে যাওয়া…

লাল্টু দুদিকে মাথা নাড়ল, না রে, আমাকে বাদ দে। আমার অসুবিধে আছে।

আমারও হবে না রে। মেঘনা বলল, এতগুলো ছেলের সঙ্গে একা মেয়ে যাচ্ছি শুনলে বাড়িতে হার্টফেল করবে।

আর এক পিস জুটিয়ে নে। হেব্‌বি মস্তি হবে।

ধুস, কাকে বলব সঙ্গে যেতে!

কথাবার্তার মাঝেই লাল্টুর পকেটে মোবাইলের ঝংকার। নিশ্চয়ই তোয়া। তাড়াতাড়ি সেটটা বার করল লাল্টু।

মনিটরে দৃষ্টি রাখতেই হালকা চমক। বাবা।

আবার একটু সরে গিয়ে লাল্টু ধরল ফোনটা, হ্যাঁ, বলো।

পরীক্ষা কেমন হল রে?

খুব খারাপ। বলতে গিয়েও বাধল লাল্টুর। ঢোক গিলে বলল, মোটামুটি।

এই সেমেস্টার তো শেষ হল?

হুঁ।

ক্রিসমাসের উইকটায় তুই তো কলকাতাতেই থাকছিস, তাই না?

ভাবছি। কৃষ্ণনগরও ঘুরে আসতে পারি।

এমা, আমি যে হেমন্তকে বলে দিলাম, ছুটিটা এবার এখানেই আছিস!

বড়মামা ফোন করেছিল বুঝি?

হ্যাঁ। এইমাত্র। …আরও জিজ্ঞেস করছিল, তোর নাকি আমাকে কী সব বলার আছে…তুই আমায় বলেছিস কি না…! কী ব্যাপার রে?

এ কী বজ্জাতি শুরু করল বড়মামা? লাল্টুকে চাপে ফেলতে চাইছে?

লাল্টু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, কই তেমন কিছু তো নয়।

উঁহু। কিছু একটা তো বটেই। হেমন্তর ভয়েসটা খুব সিরিয়াস শোনাচ্ছিল।… টাকাপয়সা সংক্রান্ত কিছু?

কী বলবে লাল্টু ভেবে পেল না। চুপ করে আছে।

সিদ্ধার্থ ফের বলল, ডোন্ট হেজ়িটেট। তুই আমাকে স্বচ্ছন্দে জানাতে পারিস।

লাল্টুর স্বর এবার যথেষ্ট বিরস, বলার মতো কিছু থাকলে আমি নিশ্চয়ই বলতাম। বড়মামার কথাকে তুমি আমল দিয়ো না।

হুম। সিদ্ধার্থ ক্ষণিক নীরব। তারপর আওয়াজ ফুটেছে, বাড়ি ফিরেছিস?

না। কলেজে। এবার বেরোব।

আচ্ছা। ছাড়ছি।

সবে একটু সমে ফিরছিল লাল্টু, ফোনটা পেয়ে মেজাজ আবার হাকুচ তেতো। নাহ্, কৃষ্ণনগর যাওয়ার উপায় নেই, লাল্টুকে পেলে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দেবে বড়মামা। একমাত্র দিদার অসুখ বিসুখ ছাড়া ও পথ আর সে মাড়াবেই না এখন।

এদিকে দেবাঞ্জনেরও বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাও চৌপাট। লাল্টু মেঘনার পর বিষাণও হাত তুলে দিয়েছে, উজ্জ্বলরাও বাহানা তুলছে একের পর এক। অগত্যা দেবাঞ্জনকে রণে ভঙ্গ দিতেই হয়। চা-শিঙাড়ার দাম মিটিয়ে ক্যান্টিন ছাড়ছে বেজার মুখে।

সওয়া পাঁচটা বাজে। বড়দিনের আগের ছোট্ট বিকেলটা কখন যে ফুড়ুত। পৌষের সন্ধে এখন রীতিমত গাঢ়। হাওয়া বইছে ঠান্ডা ঠান্ডা। হিমালয়ের গন্ধ মাখা।

সদলবলে গেটের দিকে যাচ্ছিল লাল্টুরা। মেঘনা বলল, তোরা এগো, আমি একটু টয়লেট ঘুরে আসছি।

কলেজের বাইরেটায় এসে লাল্টুরা দাঁড়িয়ে পড়ল। এবার যে যার রাস্তা ধরবে। দেবাঞ্জন এখনও গজগজ করে চলেছে, ছুটিটায় নাকি সে ভীষণ বোর হবে, বিষাণ তাকে বেলডাঙা যাওয়ার পরামর্শ দিতে সে প্রায় খেঁকিয়ে উঠল, তার চটিতং মূর্তি দেখে আরও তাকে খেপাচ্ছে সবাই। হাসতে হাসতেই তারা চলে যাচ্ছে একে একে।

হঠাৎ দেবাঞ্জন বলল, মেঘনাটার এত দেরি হচ্ছে কেন?

লাল্টু বলল, হুঁ। অনেকক্ষণ তো হল। এগিয়ে দেখব?

পটি করছে নাকি? না কাউকে পাকড়াও করে ফের গপ্পো জমাল?

ধুস, কাকে পাবে! কলেজ তো শুনশান।

দেশবন্ধু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এখন সত্যিই নির্জন। পেল্লাই পেল্লাই দু’খানা তিনতলা বিল্ডিং-এর করিডরে টিউব জ্বলছে সার দিয়ে। ওই ফ্যাটফেটে আলোয় আরও যেন জনশূন্য লাগে পরিবেশ। প্রিন্সিপাল আর গুটিকতক কর্মচারী ছাড়া কেউই বুঝি আর কলেজে নেই।

আরও একটুক্ষণ অপেক্ষা করে লাল্টু ঢুকেই পড়ল ভেতরে। পিছন পিছন দেবাঞ্জনও। যাচ্ছিল মেয়েদের কমন রুমের দিকে, দু’জোড়া পা স্থাণু সহসা।

ওই তো মেঘনা। তাকে ঘিরে ক্যান্টিনের সেই ছেলে তিনটে না? আঙুল উঁচিয়ে মেঘনা ওদের কী বলছে?

লাল্টু সামনে দৌড়ে গেল। তাকে দেখেই মেঘনা হাউমাউ করে উঠেছে, অ্যাই দ্যাখ না, এরা আমায় কীরকম উত্ত্যক্ত করছে।

লাল্টু গম্ভীর স্বরে বলল, হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? কলেজের মধ্যেই একটা মেয়েকে ডিস্টার্ব করছ, তোমাদের সাহস তো কম নয়!

চিনো নামের ছেলেটা ঘুরে তাকাল। লাল্টুকে একবার দেখে নিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, পাতলা হও, পাতলা হও। ফোটো এখান থেকে।

মেঘনা তেজি স্বরে বলল, না, ওরা যাবে না। আমি ওদের সঙ্গে ফিরব।

কাম অন বেবি। কেন খুকিপনা করছ? লেট্‌স হ্যাভ ফান টুনাইট। একটু নাচাগানা করব, মৌজমস্তি হবে, দেন আই উইল ড্রপ ইউ টু ইয়োর হাউস।

ফের ওই কথা? মেঘনা চেঁচিয়ে উঠল, বললাম তো আমি তোমাদের সঙ্গে কোত্থাও যাব না। প্রিন্সিপাল এখনও আছেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি কিন্তু…

বেশি রোয়াব মারিস না, পুরো ভিত্তাল হয়ে যাবি। চিনোর এক সঙ্গী বলে উঠল, জাস্ট কিছুক্ষণ মজা করব, তাতে এত কীসের আপত্তি?

লাল্টুর মেজাজের তিরিক্ষি ভাবটা আরও বেড়ে গেল। শাসানির সুরে বলল, ভাল কথা বলছি, চলে যাও এখান থেকে। ডোন্ট ইরিটেট হার।

তুই কে রে হরিদাস পাল? নাক টিপলে দুধ বেরোয়…

আবার বলছি, ওকে ছেড়ে দাও।

ওকে নিয়ে একটু ফূর্তি করতে যাব, তাতে তোর কী? চিনো হিন্দি ফিলমের হিরোদের কায়দায় কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে। ভুরু নাচিয়ে বলল, তুই কি ওর ইজ্জৎ বাঁচানোর ঠেকা নিয়েছিস?

ধরে নাও, তাই?

কিঁউ রে? হঠাৎ লাল্টুর থুতনি নেড়ে দিল ছেলেটা, ও তেরি মা লাগতি হ্যায় কেয়া?

বলেই শরীর কাঁপিয়ে হাসছে চিনো। বাকি দু’জন বিশ্রী ভঙ্গিতে হ্যা হ্যা করছে।

‘মা’ শব্দটা লাল্টুকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। চোখের সামনে একটা মুখ ঝলসে উঠল। নিস্তেজ এক মহিলা কী করুণ চোখে তাকিয়ে আছে লাল্টুর পানে। প্রাণহীন দৃষ্টি… নেমে আসছে একটা রক্তস্রোত…

আহত বাঘের মতো চিনোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল লাল্টু। তারপর যে কী হল লাল্টুর আর মনে নেই। শুধু আবছা শুনতে পাচ্ছিল, কোথায় যেন একটা জোর চেঁচামেচি হচ্ছে। কারা যেন টানছে তাকে। চিনোর টুঁটি চিপে ধরা হাত দু’খানা সরাতে চাইছে প্রাণপণে। পারছে না।

কোত্থেকে যে এত শক্তি এল লাল্টুর দেহে!

.

১১.

বড়দিনের আগের সন্ধেটা একটু অন্যভাবে কাটায় সিদ্ধার্থ। কোনও কালেই সে তেমন মিশুকে নয়, নিতান্ত দায়ে না পড়লে পার্টি টার্টিতে যায় না বড় একটা, বন্ধু-বান্ধবদেরও এড়িয়ে এড়িয়ে চলে বরাবর। তবে এই দিনটায় ব্যত্যয় ঘটে তার নিয়মে। কলেজের চার-পাঁচজন সহপাঠীর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ ছাড়েনি, তারা সবাই মিলে কোথাও একটা জড়ো হয়, তারপর চলে দেদার পানভোজন আর স্মৃতি রোমন্থন। এই একটা দিন লাগামছাড়া হওয়াটা বেশ উপভোগই করে সিদ্ধার্থ।

আজ তাদের লেক ক্লাবে বসার কথা। দুপুর থেকেই ডাক আসছে। প্রথমে আবীর, তারপরে নীলিমেশ…। তখন থেকেই সিদ্ধার্থর আর মন বসছিল না কাজে। বিকেলের দিকে তো রীতিমতো ছটফট করছিল। তখনই ফোন এল লাল্টুর বড়মামার। কী সব হেঁয়ালি করছিল হেমন্ত, তাই লাল্টুর সঙ্গে একটু বাতচিত করতে হল। তারপর একেবারে শেষ লগ্নে তো বিভাস এসে হাজির। সে আর ওঠেই না, ওঠেই না, নিজের সমস্যার কথা শোনায় সাতকাহন করে। সবে গত সপ্তাহে বিভাসের মাধ্যমে নরেন্দ্রপুরের ডিল ফাইনাল হয়েছে, মোট সাড়ে ন’কোটিতে রেজিস্ট্রেশনও কমপ্লিট, এখন বিভাসকে ভাগিয়ে দেওয়াটাও তো অভদ্রতা। অগত্যা তার ব্যাজব্যাজানি গিলতেই হয়। খানিক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মূল প্রসঙ্গে এল বিভাস। পঁচিশ হাজার টাকা চাই। এক্ষুনি। বিরক্তই হল সিদ্ধার্থ। কাজটার জন্য বিভাস পুরো পাঁচ লাখ দাবি করেছিল, হাফ পারসেন্টের হিসেবে চার পঁচাত্তরে রফা হয়, সিদ্ধার্থ সেই টাকা মিটিয়েও দিয়েছে। ফালতু আবদার সে শুনবে কেন। একটু কথা কাটাকাটি হয়ে গেল বিভাসের সঙ্গে, কিন্তু উপুড়হস্ত করল না সিদ্ধার্থ। সে তো দানসত্র খোলেনি।

বিভাসকে বিদায় করে সিদ্ধার্থ ওঠার তোড়জোড় করছে, দরজায় সুনীত। ল্যাপটপ ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?

হ্যাঁ স্যার। একটা রিকোয়েস্ট ছিল।

কী?

অফিসের সবাই বলছিল পয়লা জানুয়ারি যদি একটা পিকনিক মতো করা যায়…

অর্থাৎ সেদিনটা ছুটি চাই। সিদ্ধার্থ একঝলক দেখল সুনীতকে। ছেলেটি পরিশ্রমী, নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাও আছে। একা সুমিতই নয় অবশ্য, বাকিরাও খাটে খুব, ঘড়ির দিকে চোখ না রেখে অনেক দরকারি কাজ তুলে দেয়। বাড়তি একটা ছুটি মানে টাকার হিসেবে নেহাত কম নয়, তবু এটুকু বোধহয় দেওয়া যেতেই পারে। মালিকের সদাশয় ভাবমূর্তি নির্মাণেরও তো একটা খরচ আছে। তা ছাড়া ওই দিনটাতে সে নিজেও অফিসে আসবে না…

সিদ্ধার্থ হেসে বলল, ও.কে। লিভ গ্রান্টেড। করো পিকনিক।

আপনি থাকবেন তো স্যর?

পেরে উঠব না। আমার সেদিন একটা অন্য কাজ আছে। পারিবারিক।

ও।…আর একটা অনুরোধ ছিল স্যার…

আবার কী? চটপট বলো। আমার তাড়া আছে।

আপনি নরেন্দ্রপুরে যে ল্যান্ডটা নিলেন… সেখানে তো অনেক গাছপালা …যদি পিকনিকটা ওখানেই করি…

ইংরিজি নববর্ষের দিনটায় নরেন্দ্রপুরেই যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে সিদ্ধার্থ। বাড়ির সবাইকে নিয়ে। সেই দিনই অফিসের লোকজন ওখানে গিয়ে হইচই করবে…!

সিদ্ধার্থ নরম গলাতেই বলল, সরি সুনীত। ওখানে একটু অসুবিধে আছে। তোমরা অন্য কোনও জায়গা চুজ করো।

ও.কে স্যার। নো প্রবলেম।

সুনীত চলে যাওয়ার পর পলকের জন্য সিদ্ধার্থর মনে হল, সপরিবারে তো যাবে নরেন্দ্রপুর, পরিবারের মধ্যে লাল্টু আছে তো? নিজেকে কি পরিবারের একজন ভাবে সে? তা ছাড়া তোয়াও কি সম্মত হবে? বাপি-মা’র সঙ্গে সে তো আজকাল কোথাওই বেরোতে চায় না। আচ্ছা, যদি সিদ্ধার্থ তোয়াকে জোর করে, লাল্টুকেও বলে একত্রিশ তারিখের মধ্যে কৃষ্ণনগর থেকে ফিরে আসতেই হবে, ওরা শুনবে কি? তাদেরই তো ছেলেমেয়ে, তবু কেন যে নিশ্চিত হতে পারে না সিদ্ধার্থ? পরিবারের এই ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবটাই বা জোড়া লাগবে কোন মন্ত্রবলে? কে জানে!

ল্যাপটপ হাতে ঝুলিয়ে সিদ্ধার্থ অফিস ছাড়ল। পার্কিং লটে গিয়ে গেট খুলল গাড়ির। ড্রাইভিং সিটে বসে বেল্ট বাধঁছে, মোবাইল সরব। ফের কোনও বন্ধুর তাড়া? এবার কি প্রবাল?

উঁহু, মনিটরে দুর্গাপুর। বাবা? নাকি মা?

সিদ্ধার্থ বলল, হ্যালো?

কে? খোকন তো? আমি বাবা বলছি। কী খবর তোদের?

ঠিকই আছে।…মা’র শরীর কেমন?

কেন জিজ্ঞেস করিস? সত্যিকারের উদ্বেগ থাকলে তো মাঝে মাঝে আসতিস দেখতে।

জানোই তো, সময় পাই না…। বিজনেস করার জ্বালা তো কম নয়।

সে তো বটেই। ফুরসত পাস না বলে বিজয়ার পরও এবার এলি না, ছেলেটাকেও একবার দেখিয়ে গেলি না…

ওফ, সেই এক অনুযোগ। ভাল্লাগে না। ধানাই পানাই করে আর কতকাল পাস কাটাবে সিদ্ধার্থ? মুখের ওপর বলে দিলেই তো হয়, লাল্টুকে দেখার তোমাদের কোনও অধিকারই নেই!

গোমড়া গলায় সিদ্ধার্থ বলল, দেখি, কবে পারি…। আর কিছু বলবে?

হ্যাঁ। যে জন্য ফোন করা…। আমি একটা উইল করতে চাই।

জানি। বাচ্চু বলেছে। তা করে ফেলো।

তোমাকে যে একবার আসতে হবে।

আমার কী ভূমিকা আছে? বাচ্চু থাকছে, একটা উকিল ডাকো, তোমার বন্ধু ডাক্তার লাহিড়ীকে প্রেজেন্ট রাখতে পারো…। তা ছাড়া আমি তো বলেই দিয়েছি, দুর্গাপুরের বাড়িতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। ওটা বাচ্চুকে দিয়ে দিলেও আমি কিছু মাইন্ড করব না।

সেটা তো তোমার ব্যাপার। আমাকে আমার ডিউটিটা তো করতে দাও। আমরা বুড়োবুড়ি মরে গেলে নিজের ভাগটা নয় ভাইকে দানপত্র করে দিয়ো। আর যদি মত বদলাও, তোমার ভাগটা নয় তোমার ছেলের থাকবে। ও প্রান্তে স্বর যেন ধরাধরা শোনাল, কিছুই তো তাকে দিতে পারিনি। যদি ওইটুকু সে আমাদের কাছ থেকে পায়…

এ যেন কিছু একটা ধরে দিয়ে প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা। বুঝেও সিদ্ধার্থ বিশেষ একটা আমল দিল না বাবাকে। অবহেলার সুরে বলল, করো যা প্রাণ চায়। তবে আমার অপেক্ষায় থেকো না।

তুই তা হলে আসছিস না?

এক-দু’মাসের মধ্যে পারব না। তারপর ভেবে দেখব। …আর কিছু বলার নেই তো?

না।

তা হলে ছাড়ছি।

মোবাইল পাশে রেখে গাড়ি স্টার্ট দিল সিদ্ধার্থ। এক মাসও হয়নি কিনেছে গাড়িটা, চলনটা ভারী মসৃণ, শহরের এবড়ো খেবড়ো রাস্তা টেরই পাওয়া যায় না। চালাতে চালাতে ভেতরের অপ্রসন্ন ভাবটা কেটে যাচ্ছিল সিদ্ধার্থর। রিমোট টিপে এফ-এম রেডিয়ো চালিয়ে দিল। গান শুনছে।

আবার মোবাইল বেজে উঠল। হাতে নিয়ে সিদ্ধার্থর ভুরুতে পলকা ভাঁজ। সম্পূর্ণ অচেনা নম্বর। গাড়ি চালানোর সময়ে সাধারণত মোবাইল ধরে না সিদ্ধার্থ, সামান্য দোনামোনা করে সাড়া দিয়ে ফেলল, হ্যালো?

ওপারে এক ওজনদার গলা, আমি কি মিস্টার সিদ্ধার্থ দত্তর সঙ্গে কথা বলছি?

ইয়েস। স্পিকিং।

আমি প্রভাত চৌধুরী। দেশবন্ধু ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির প্রিন্সিপাল। আপনার ছেলে সোহম দত্ত আমাদের কলেজে পড়ে, তাই তো?

হ্যাঁ। সিভিলে। কী হয়েছে সোহমের?

হি হ্যাজ ডান সামথিং সিরিয়াস। ভেরি সিরিয়াস।

কেন? সিদ্ধার্থর গলা কেঁপে গেল, কী করেছে?

নিজে আসুন। শুনুন। আমি আপনার জন্য ওয়েট করছি।

এখন?

এক্ষুনি। আমি আপনার ছেলেকে ডিটেইন করে রেখেছি।

ফোনটা কেটে গেল। সিদ্ধার্থ বিমূঢ়। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে ধড়াস ধড়াস।

প্রিন্সিপালের চেম্বারে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল সিদ্ধার্থ। যা শুনল, তা কি সত্যি? লাল্টু নাকি নৃশংসভাবে পিটিয়েছে একটা ছেলেকে! কলেজের এক কর্মচারীর বর্ণনা অনুযায়ী সে নাকি প্রায় খুনই করে ফেলছিল, বরাতজোরে ছেলেটা বেঁচে গেছে। তবে জখমের মাত্রা ভালই, নাকমুখ নাকি বিশ্রীভাবে ফেটে গেছে, সে এখন হাসপাতালে।

টেবিলের ওপারে অধ্যক্ষ প্রভাত চৌধুরী। মধ্যবয়সি সুটধারী মানুষটির মুখমণ্ডল থমথমে। গম্ভীর স্বরে প্রভাত বলল, আপনার ছেলে যে ব্যাপারে প্রতিবাদ করেছে, সেটাকে আমি অন্যায় বলছি না। সেটা তো খুবই জাস্টিফায়েড। তার সহপাঠিনীকে… শুধু সহপাঠী কেন, পথেঘাটে যে-কোনও মেয়েকে কেউ জ্বালাতন করলে তার এই রুখে দাঁড়ানোটা আমি অ্যাডমায়ার করি। অ্যান্ড আই মাস্ট কনগ্র্যাচুলেট হিম ফর দ্যাট কারেজ। এক্ষুনি তো কিছু করার উপায় নেই, তবে চিন্ময় নামে ছেলেটার বিরুদ্ধে আমি কড়া স্টেপই নেব। ওর সঙ্গে আরও যে দু’জন ছিল, তারাও ছাড়া পাবে না। তিনজনেরই আইডেনটিটি কার্ড আমি জমা রেখেছি। কিন্তু সোহম যে পদ্ধতিতে চিন্ময়কে হ্যান্ডেল করেছে, সেটাও মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।

কলেজের কর্মচারীটি দাঁড়িয়ে ছিল দরজায়। ফস করে বলে উঠল, আমরা তো ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। তিন-চারজন মিলে চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছি না। এমন পাগলের মতো হাত-পা চালাচ্ছিল… মনে হচ্ছিল ওর ওপর কিছু যেন ভর করেছে। জোরজার করে ওকে সরালাম, ছেলেটার মুখ রক্তে মাখামাখি, পুরো নেতিয়ে পড়েছে। যে অবস্থায় নিয়ে গেল… অন্তত পাঁচ-ছ’খানা স্টিচ তো হবেই।

শুনুন মিস্টার দত্ত, শুনুন। আবার প্রভাত চৌধুরীর গলা বাজল, যদি একটা মিসহ্যাপ ঘটে যেত, তা হলে এক্সটেন্ট অফ ড্যামেজটা আপনি ভাবতে পারছেন?

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। সিদ্ধার্থ বিড়বিড় করে বলল, ছেলেটা আমার এত শান্ত, এত নিরীহ, কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলে না।

এটাই তো সমস্যা মিস্টার দত্ত। সব গার্জেনই ভাবে তার ছেলের মতো ছেলে হয় না। আদতে যে তারা কী, বাবা-মা’রা খোঁজই রাখে না। প্রভাতের স্বরে বিদ্রূপ। চোখ সরু করে বলল, ডোন্ট মাইন্ড, আপনার প্রফেশানটা কী, জানতে পারি?

আমি একজন আর্কিটেক্ট। যাদবপুর থেকে পাশ করেছিলাম। নিজস্ব একটা ফার্ম আছে।

আর সোহমের মা…?

সত্যিটা কেন যে মুখ দিয়ে বেরোল না সিদ্ধার্থর? ঢোক গিলে বলল, আমার মিসেস চাকরি করে। একটা নাম করা এন-জি-ও’তে।

তা হলেই দেখুন, হি ইজ কামিং ফ্রম আ ডিসেন্ট ফ্যামিলি। তারপরেও কী করে যে এমন স্ট্রিট ফাইটারদের মতো আচরণ করে! এতটা ভায়োলেন্ট হয়ে যাওয়াটা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক নয়। প্রভাত ভুরু কুঁচকোল, নিশ্চয়ই কোনও মেন্টাল প্রবলেম আছে।

তাই কি? সিদ্ধার্থ অস্ফুটে বলল, তেমন তো দেখিনি কোনওদিন।

তা হলে তো আরও চিন্তার কথা। ছেলেকে ক্লোজ ওয়াচে রাখুন। রাস্তায় ঘাটে কখন কী ঘটিয়ে ফেলবে, কোমরে দড়ি পড়ে যাবে। সেটা নিশ্চয়ই আপনার পক্ষে খুব প্লেজেন্ট এক্সপিরিয়েন্স নয়!

হুঁ। সিদ্ধার্থ মাথা নাড়ল। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, সোহম এখন কোথায়?

পাশের ঘরে। ভেবেছিলাম আপনাকে দিয়ে একটা মুচলেকা লিখিয়ে নেব। …আমার ছেলে আবার এরকম কাণ্ড ঘটালে আমি পারসোনালি দায়ী থাকব…। এনিওয়ে, তার আর দরকার নেই, ছেলেকে আপনি নিয়ে যান। অ্যান্ড ফর গডস্ সেক, অ্যাক্ট অ্যাজ এ রেসপন্সিবল ফাদার। অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক, ভেরি গুড। কিন্তু দেখবেন, জোশের মাথায় খুনখারাপি না করে বসে।

অপমানে দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল সিদ্ধার্থর। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। অপেক্ষা করতে হল না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লাল্টুকে নিয়ে এসেছে কর্মচারীটি, সমর্পণ করল সিদ্ধার্থর জিম্মায়। লাল্টু ঘাড় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে। মুখই তুলছে না। ছেলেকে একবার দেখে নিয়ে সিদ্ধার্থ হাঁটা শুরু করল। লাল্টু আসছে পিছন পিছন।

গাড়িতে উঠে সিদ্ধার্থ ক্ষোভে ফেটে পড়ল, ছি ছি, কী একটা কাণ্ড বাধালি বল তো? তোর জন্যে প্রিন্সিপাল আমায় যা নয় তাই শুনিয়ে দিল!

লাল্টুর ঠোঁট সামান্য নড়ল, সরি।

তুই তো সরি বলেই খালাস। আমার সম্মানটা তো ধুলোয় মিশল।

লাল্টু চুপ।

বান্ধবীর সামনে হিরো সাজাটা কি এতই জরুরি ছিল?

লাল্টু নিরুত্তর।

তা সেই বান্ধবীটিকে তো দেখলাম না! তোকে ফেলে দিব্যি কেটে পড়েছে, অ্যাঁ?

ওরা থাকতে চেয়েছিল। আমিই চলে যেতে বললাম।

অ।… তা হঠাৎ অত মাথা গরম করলি কেন? একেবারে ফেরোশাস হয়ে গেলি? বিকেলেও যখন তোর সঙ্গে কথা হল, তখন তো মোটেই এক্সাইটেড ছিলি না?

জবাব নেই।

তোর এমন চণ্ডালের মতো রাগ আছে, জানতাম না তো! কথাটা বলেই প্রিন্সিপালের উক্তিটা মনে পড়ল সিদ্ধার্থর। গলা খানিক নরম করে জিজ্ঞেস করল, তোর কি এরকম হঠাৎ হঠাৎ হয়? মানে মাথায় কোনও ইয়ে টিয়ে নেই তো?

রা কাড়ল না লাল্টু। বসে আছে নিশ্চুপ।

সিদ্ধার্থর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল। একটু জোরেই বলে উঠল, চুপ মেরে আছিস কেন? হ্যাঁ না কিছু একটা তো বল।

লাল্টুর কোনও হেলদোল নেই। একইরকম নির্বাক।

এ তো মহা ফ্যাসাদ হল! সিদ্ধার্থ আপনমনে গজগজ করছে, সাধে কি লোকে বলে যেচে কারও ভাল করতে যেয়ো না! কৃষ্ণনগরে ছিলি, বেশ ছিলি। তোকে এখানে আনাটাই আমার মূর্খামি হয়েছে। তোয়ার মা যখন জানবে… সে তো তোর কাণ্ডকারখানা শুনে অসম্ভব প্যানিকি হয়ে পড়বে।

সিদ্ধার্থ বলল বটে, তবে একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ঘটনাটা পুরো চেপেই যাবে বাড়িতে। এ পক্ষের কথা ও পক্ষের না জানাই তো ভাল। হ্যাঁ, বাড়িতে তো এখন দুটো শিবির। আগেও হয়তো ছিল, সিদ্ধার্থ সেভাবে নজর করেনি। লাল্টু আসার পর বিভাজনটা যেন ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। মোটামুটি একটা স্বস্তি বজায় ছিল, সংসারটা একটা ছন্দে চলছিল, লাল্টুর জন্য সেটা বুঝি আর থাকবে না। লাল্টু তার সঙ্গে একটার বেশি দুটো কথা বলে না, অথচ নাচতে নাচতে তোয়ার বাবার কাছে গিয়ে আড্ডা জমায়— এরই বা কী অর্থ? এটা কি একভাবে সিদ্ধার্থকে অপমান করা নয়? বর্ণালি কি প্রতিশোধ নিচ্ছে? ভায়া লাল্টু?

উইন্ডস্ক্রিনে দৃষ্টি রেখে সিদ্ধার্থ ফের বলল, আমাকে অকোয়ার্ড সিচুয়েশানে ফেলে তুই খুব আনন্দ পেয়েছিস, তাই না রে লাল্টু?

এবার যেন লাল্টুর সামান্য ভাবান্তর ঘটল। নিচুগলায় বলল, না বাবা। আমার সেরকম কোনও ইন্টেনশান ছিল না।

থাক। আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। তোর মা এমন একটা কাজ করল, চিরকাল আমি দোষী হয়ে রইলাম। এখন তুইও…। গলাটা বুজে আসছিল সিদ্ধার্থর, কোনওক্রমে আবেগটাকে গিলে ফেলল। ফুসফুসে খানিকটা শুকনো বাতাস ভরে নিয়ে বলল, যাক গে, আমাকে তো আমার ক্রস বইতেই হবে। …তুই কি কাল কৃষ্ণনগর যাচ্ছিস?

লাল্টু অস্ফুটে বলল, ভাবছি।

ঘুরেই আয়। মাথাটা একটু ঠান্ডা হোক। একত্রিশ তারিখের রাতে কিন্তু ফিরে আসিস। অনেকক্ষণ পর মুখখানা একটু হাসিহাসি করল সিদ্ধার্থ, নিউ ইয়ারটা এবার আমরা দারুণ সেলিব্রেট করব।

লাল্টু ঘাড় নাড়ল কি? বোঝা গেল না।

স্বপনপুরী আসছে। এক্ষুনি কি বাড়ি ঢুকবে সিদ্ধার্থ? মনের যা হাল, গিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করবে না। হয় হাঁড়িমুখ করে বসে থাকো, নয় চুপচাপ শুয়ে থাকো বিছানায়। আজকের আসরে না যাওয়া নিয়ে তৃষিতা প্রশ্ন জুড়বেই, তাকে মিথ্যে বলতে হবে খানিক। মিথ্যের মধ্যেই তো বাস, তবু আর ভাল লাগে না। তারচেয়ে বরং লেক ক্লাবে চলে গেলেই তো হয়। মধ্যরাতে আজ না হয় বেহেড হয়েই ফিরবে সিদ্ধার্থ।

বড় রাস্তাতেই সিদ্ধার্থ গাড়ি দাঁড় করল। লাল্টুকে বলল, তুই চলে যা। আমার আজ ফিরতে দেরি হবে।

দরজা খুলে লাল্টু নামতে যাচ্ছিল, সিদ্ধার্থ ফের ডাকল ছেলেকে। স্বর নামিয়ে বলল, আজকের ইন্সিডেন্টটা বাড়ির কাউকে গল্প করিস না। তোয়াকেও নয়।

লাল্টু স্থিরচোখে তাকাল। সেই দৃষ্টি, যেটা একেবারে চেনে না সিদ্ধার্থ। আজ যেন আরও তীব্র। লেজ়ার রশ্মির মতো। এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে বুকের ভেতরটা।

সিদ্ধার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে নিল।

আকাশে অল্প অল্প মেঘ জমেছিল, কেটে গেছে মাঝরাতে। তারপরেই যেন হুশ করে বেড়ে গেল ঠান্ডাটা। হাওয়া চলছে জোর। শহরময় কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে উত্তুরে বাতাস। জানলা দরজা বন্ধ করেও বুঝি নিস্তার নেই, কোন পথে যে হিমকণা ঢুকে পড়ে অন্দরে।

স্বপনপুরীর আটতলার দক্ষিণের ফ্ল্যাট লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে তখন। শুধু স্টাডিরুমই যা বিনিদ্র। শেষ রাতে আলো জ্বলল ঘরটায়, নিভেও গেল। নিজের কিটসব্যাগখানা কাঁধে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল লাল্টু। নিঃসাড়ে। কাউকে জানান না দিয়ে।

ভোর ফুটছে। কুয়াশা ভেদ করে হাঁটছিল লাল্টু। এক সময়ে মিলিয়েও গেল কুয়াশায়।

.

১২.

এক একটা দিন বুঝি এরকমও হয়। আকাশ ঝকঝকে নীল, মিঠেকড়া সোনা রং রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী, চতুর্দিক খুশিতে ঝলমল, অথচ তোয়ার মন একটুও ভাল নেই। নতুন একটা বছর এল, তোয়ার যেন তাতে কিছুই যায় আসে না। সকাল থেকে সে ঘরবন্দি, নড়ছেই না। বাপি আর মা এত করে সাধল, তবু সে গেল না নরেন্দ্রপুর। বন্ধুরা আসবে, এই অজুহাতে কাটিয়ে দিল কোনওমতে। সিদ্ধার্থ আর তৃষিতা দত্তর সঙ্গে দুপুর-বিকেলটা নেচেকুঁদে বেড়ানোর কণামাত্র বাসনা নেই তোয়া বিশ্বাসের। নববর্ষের উইশ জানিয়ে বন্ধুদের মেসেজ আসছে সকাল থেকে। বাবাও ফোন করল, তার লেজুড় হয়ে শর্বরী আন্টিও। তবু তোয়া যে মনমরা, সেই মনমরা।

বিকেলবেলা সত্যি সত্যি এল বন্ধুরা। কাছেই শপিংমলটায় পায়েল দিব্যারা দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে। প্রচুর টানাটানি করল, তবু বেরোল না তোয়া। আজ তার কোনও মজাতেই মজবার স্পৃহা নেই।

সোহম নেই বলেই কি তোয়ার মনখারাপ? তা সোহম তো গত এক সপ্তাহ ধরেই নেই। তা ছাড়া সোহমের জন্য মনখারাপ করতে তোয়ার বয়েই গেছে। সাত সাতটা দিন যে একবারও তোয়াকে ফোন করল না, মোবাইলটাও টানা সুইচ অফ করে রেখেছে, থোড়াই তার কথা ভেবে দিনটা নষ্ট করছে তোয়া! মনটা তার ভাল নেই, মন ভাল না থাকার এটাই কি যথেষ্ট কারণ নয়?

সিদ্ধার্থ আর তৃষিতা ফিরল সন্ধে নামার পর। নীচে তখন স্বপনপুরীর নিউ ইয়ার্স স্পেশাল বিচিত্রানুষ্ঠান শুরু হচ্ছে। গান ছাপিয়ে মা’র গলা শুনতে পাচ্ছিল তোয়া। পুলকে ডগমগ করছে যেন। নরেন্দ্রপুরে জংলা জংলা পরিবেশে বাপি একটা বাংলো বানালে ধরায় যেন স্বর্গসুখ নেমে আসবে, এমনটাই মনে হচ্ছে মা’র কথাবার্তায়।

হঠাৎ তৃষিতা হাঁকাহাঁকি শুরু করেছে, তোয়া? তোয়া…?

বেজার মুখে তোয়া বেরিয়ে এল, কী হয়েছে?

তোর বন্ধুরা কি এসেছিল?

সবিতামাসিকে জিজ্ঞেস করো।

ওদের কেক টেক খাইয়েছিস?

খেল না। তাড়া ছিল, চলে গেল।

আর তুই কিনা তাদের জন্য সারাদিন বাড়ি বসে রইলি! তৃষিতা আফশোসের সুরে বলল, আজ কিন্তু তুই খুব মিস করলি। গেলে মোহিত হয়ে যেতিস।

সে কী হারিয়েছে, কেন মুগ্ধ হত, জানার মোটেই ইচ্ছে নেই তোয়ার। গলায় শ্লেষ এনে বলল, তোমরা এনজয় করেছ তো?

ভীষণ। ভীষণ। তোর বাপিকে জিজ্ঞেস কর। সে তো দশ বছরের খোকা হয়ে গিয়েছিল। ফলের গাছগুলোকে যে কতভাবে কতদিক দিয়ে চরকি মারল।

সিদ্ধার্থ প্রায় সম্রাটের ভঙ্গিতে সোফায় বসে। পরনে জিন্‌স, পুলওভার, দু’হাত দু’দিকে ছড়ানো। পা দু’খানা সেন্টারটেবিলে তুলে দিয়ে রাজকীয় মেজাজে বলল, লাল্টুটাও ঝুল দিল। কেন যে এল না?

ছেলেমেয়েদের মর্জি বোঝা কি তোমার আমার কর্ম! তৃষিতা হালকাভাবে বলল, দ্যাখো সে হয়তো নিজের মতো করে সেখানে নিউ ইয়ার করছে।

কিন্তু মোবাইলটা বন্ধ রেখেছে কেন?

খেয়াল।…ওর কলেজ তো কালই খুলছে, তাই না?

হুম।…ও বোধহয় আজ রাতে ফিরবে।

একেবারে কাল কলেজ করেও আসতে পারে। মাঝে একবার তো তাই করেছিল। তবে কী, তার প্ল্যান প্রোগ্রাম জানা থাকলে বাড়ির লোকের একটু সুবিধে হয়।

লাল্টুর সঙ্গে তো কন্ট্যাক্টই করা যাচ্ছে না।

আর একবার ট্রাই নাও। নইলে সোহমের কোনও মামাকে ফোন লাগাও।

এটা তো মন্দ বলোনি! সিদ্ধার্থ সোজা হল। মোবাইল হাতে তুলে বলল, দাঁড়াও, হেমন্তকে ধরি।

পটপট নম্বর টিপছে সিদ্ধার্থ। কানে চেপে হাই হ্যালো করল একটু। তারপরেই গলায় বিস্ময়সূচক ধ্বনি। ফোনটা কেটে দিয়ে ঝুম। চোখ পিটপিট করছে।

তৃষিতা উদ্বিগ্ন মুখে বলল, কী হল?

সিদ্ধার্থ বিড়বিড় করল, নেই।

কী নেই?

লাল্টু।

মানে?

লাল্টু নাকি কৃষ্ণনগরে যায়নি।

কোথায় গেল তবে?

জানি না। লাল্টু কি আমার ওপর অভিমান করে…

সিদ্ধার্থর গলাটা কেমন হাহাকারের মতো শোনাল। তোয়ার গা ছমছম করে উঠেছে। এক ছুটে চলে গেছে সোহমের ঘরে। একটুক্ষণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ঘাঁটছে টেবিল, টানল ড্রয়ার, নাড়াচাড়া করছে ট্রলি সুটকেসখানা। কী খুঁজছে? তোয়া নিজেও কি জানে? অস্থিরভাবে ওয়ার্ড্রোব খুলল। হাতড়াচ্ছে তাকগুলো।

হঠাৎই শ্বাস বন্ধ। হৃৎপিণ্ডের লাবডুব নিশ্চল সহসা।

সোহমের মোবাইল, ফ্ল্যাটের চাবি সাজানো আছে পাশাপাশি। নাহ, মাউথ অরগ্যানটা নেই।

সোহম আর ফেরেনি। থানা-পুলিশ, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন, টিভিতে ছবি দেখানো, কোনও দিক দিয়েই চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি সিদ্ধার্থ। কিন্তু সোহমের কোনও সন্ধানই মিলল না। মর্গে মর্গে ঘুরে অজস্র মৃতদেহও দেখতে হল সিদ্ধার্থকে, সোহম তাদের মধ্যেও নেই। কোথায় যে উবে গেল ছেলেটা?

তা সময় তার নিজের গতিতেই চলে, পিছন পানে সে ফিরেও তাকায় না। সে চির উদাসীন। কিন্তু মানুষ তো তা নয়। তৃষিতা নিয়ম মতোই অফিস যাচ্ছে, সংসার করছে, তবু তার মাঝেও কখনও কখনও যেন একটা পিঁপড়ের কামড় টের পায়। কে যেন কানে ফিসফিস করে বলে, ছেলেটাকে ভালবেসে রেখো, ছলনা কোরো না…! সিদ্ধার্থ বিশাল বিশাল কাজ করছে, করেই চলেছে। তবু জানলায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকালে কেন যে আকাশ আবছা হয়ে যায়!

আর তোয়া? স্কুল থেকে ফেরার সময়ে স্বপনপুরীর গেটে এসে থমকে দাঁড়ায় হঠাৎ হঠাৎ। অদূরে চায়ের দোকানটায় কয়েক মুহূর্ত গেঁথে থাকে তার দৃষ্টি। তারপর সিদ্ধার্থ দত্তর আটতলার ফ্ল্যাটে ঢুকে স্টাডিরুমের দরজায় একবার উঁকি দেয় তোয়া বিশ্বাস। একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাসও পড়ে তার।

ওই দুঃখী ছেলেটাকে তখন বুঝি মনে মনে একটু হিংসেই করে তোয়া। সে যেখানেই থাকুক, যে অবস্থাতেই থাকুক, তার অন্তত একটা মাউথঅরগ্যান আছে। তোয়ার তো সেটুকুও নেই।

———

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *