০১. ইস্পাতনীল মারুতি

অলীক সুখ

ইস্পাতনীল মারুতির বনেটে হেলান দিয়ে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিল কিংশুক। অসহিষ্ণু মুখে। ওফ্‌, দেবনাথ কুণ্ডু লোকটা তো জ্বালিয়ে দিল! এক্ষুনি আসছি বলে হাওয়া! আসি বলে কাশী গেল নাকি!

পৌনে চারটে বাজে। শীতের বেলা ঝিমিয়ে এলেও আলিপুর আদালতের এখনও দম ফুরোয়নি। গোটা চত্বর জুড়ে তালবেতাল মানুষের ব্যস্ততা। উকিলবাবুরা সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে চরকি খেয়ে চলেছে, ইতস্তত উদ্বিগ্নমুখ মক্কেল, সারিবদ্ধ খাবার দোকানে যত মাছি তত মানুষ, খুপরি চালায় টাইপরাইটারের খুটখুট খটাখট …। এক গণ্ডা আসামীকে কোমরে দড়ি বেঁধে জনগণের মধ্যে দিয়ে মার্চ করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ঘাড় উঁচু করে চলেছে চার বন্দি, যেন ভি আই পিরা নাগরিক সংবর্ধনা নিতে যাচ্ছে। লোহার খাঁচায় খান দশেক চায়ের গ্লাস ঝুলিয়ে হরিণ পায়ে ধাবমান এক কালোকুলো কিশোর, কে যেন কর্কশ স্বরে হাঁক দিল তাকে। অতিকায় শিরীষ গাছের নীচে তর্ক জুড়েছে এক দল লোক, তার মাত্র হাত দুয়েক তফাতে বেমালুম নিদ্রামগ্ন এক শ্মশ্রুগুম্ফধারী। এই হট্টমেলায় মানুষ যে ঘুমোয় কী করে! পাগল টাগল নয় তো? কত কিসিমের চিড়িয়া যে দেখা যায় এখানে! স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকলেই দিব্যি সময় কেটে যায়।

কিন্তু বেফায়দা সময় কাটানোর সময় কোথায় কিংশুকের। ঘোরতর কাজের মানুষ সে, সোম থেকে শনি দিনরাতের প্রতিটি পলই তাকে মেপে জুপে হিসেব করে চলতে হয়। এটা তার অভ্যেসও বটে, আবার জীবনে সফল হওয়ার শর্তও বটে। এই তো আজই পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে এদিকের পাট সেরে তাকে ছুটতে হবে হাজরা রোড, সকালে আশা নার্সিংহোমে একটা হিসটেরেক্‌টোমি করেছে, পেশেন্টের খোঁজখবর নিতে হবে, তারপর পার্ক সার্কাসের কিওর অ্যান্ড কেয়ারে রুটিন ভিজিট, সেখান থেকে মুনলাইট …। আজ আবার সব সামলে সুমলে সাড়ে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফেরা আছে। হয়ে উঠবে কি?

—ডাক্তারসাহেব …? ডক্টর গুহ …?

কিংশুক চমকে তাকাল। যাক, দেখা দিয়েছে দেবনাথ কুণ্ডু। কিন্তু গিয়েছিল তো সামনে, পিছন থেকে এল কী করে? ভোজবাজি জানে নাকি?

দেবনাথ কুণ্ডুর বয়স বছর ষাটেক। দেখে অবশ্য অত মনে হয় না। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, ফোলা ফোলা গাল, মাথার চুল কুচকুচে কালো। লোকটার হাঁটাচলাতেও বেশ একটা যুবক যুবক ভাব আছে।

কাছে এসে হন্তদন্ত স্বরে বলল, আর দেরি করবেন না, চলুন চলুন। আমার হাতে একদম সময় নেই।

যাহ্‌ বাবা! কিংশুক দেরি করিয়ে দিল?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে গাড়ির দরজা খুলে স্টিয়ারিং-এ বসল কিংশুক। মিনি তোরঙ্গ সাইজের ব্রিফকেসখানা অন্দরে চালান করে দিয়েছে দেবনাথ, ধপাস করে শরীর ছেড়ে দিল পাশের সিটে। ভুরু কুঁচকে ঘড়ি দেখছে, আমায় কিন্তু পাঁচটায় ছেড়ে দিতে হবে ডাক্তারসাহেব।

—কেন?

—সাড়ে পাঁচটায় মক্কেলকে টাইম দেওয়া আছে। বাড়িতে।

—আমাকেও তো আপনি তিনটেয় টাইম দিয়েছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে মানুষ কাটাতে কাটাতে ব্যাকগিয়ারে যাচ্ছে কিংশুক। বিরক্তি চেপে হাসল, বাড়ির মক্কেলদের জন্য আপনি বুঝি খুব পাংচুয়াল?

—হুল ফোটাচ্ছেন ডাক্তারসাহেব? হা হা হা। আপনারা মশাই রুগিকে কটায় টাইম দিয়ে কটায় ডাকেন?

কার সঙ্গে কার তুলনা!

কথা না বাড়িয়ে কিংশুক কোর্টের গেট পেরোল। ট্রামরাস্তা ধরে খানিক গিয়ে ডাইনে মোড় নিয়েছে। স্পিড তোলা যাচ্ছে না, ঢেউ তোলা রাস্তায় ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলেছে গাড়ি।

দেবনাথ সিগারেট ধরাল। ধোঁয়াটা ভক করে এসে লাগল কিংশুকের নাকে। ধূমপান তার দু চক্ষের বিষ, তামাকের গন্ধ সে মোটেও সহ্য করতে পারে না, এমনকী বাবাও তার সামনে সিগারেট খেলে সে আজকাল রীতিমতো বিরক্ত হয়। তবে এই অসন্তোষটাও কিংশুক হজম করে নিল। ফ্ল্যাট কেনার হাজারো ঝক্কি ঝামেলা, রেজিস্ট্রেশন না হওয়া পর্যন্ত মুখের ওপর ছাড়া ধোঁয়া গিলতেই হবে। তেমন নামী উকিল নয় বটে, তবে দেবনাথ জমি বাড়ির ব্যাপারটা বোঝে ভাল। প্রোমোটারের খসড়ার ওপর কারিকুরি করে এগ্রিমেন্টটাকে বেশ দাঁড় করিয়েছে। সব আটঘাট বেঁধে। খাঁই অবশ্য লোকটার খুব কম নয়, হরে দরে সেই টু পারসেন্টই নেবে, তবে দেখা হলেই টাকার জন্য ছোঁকছোঁক করে না। তা ছাড়া এই যে আজ এগ্রিমেন্টে সাক্ষী থাকার জন্য এক কথায় রাজি হয়ে গেল, এটাই বা কটা উকিল করে? সুদীপ্তর উকিল শুধু এই সইটুকু করার জন্যই কড়কড়ে দুহাজার নিয়েছিল।

হাত বাড়িয়ে জানলা দিয়ে ছাই ঝাড়ছে দেবনাথ। স্টিম ইঞ্জিনের মতো ভস ভস ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,—আপনি কিন্তু বড্ড তাড়াহুড়ো করলেন ডাক্তারসাহেব।

—করব না? কিংশুক চেতলা ব্রিজ পার হচ্ছে। চোখের কোণ দিয়ে কঙ্কালসার আদিগঙ্গাকে দেখল এক ঝলক, জন্ম থেকে ভাড়াবাড়ির অন্ধকূপে আছি মশাই। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেল, এখনও একটা নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁই চাইব না?

—চাইবেন বইকি। তবে ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে করে জমি বাড়ি হয় না। কোথায় কী টক্কা ফক্কা হয়ে যায়!

—সেই জন্য তো আপনি আছেন।

—আহা, আমি তো দেখব আইনের দিকটা। কিন্তু বাস করবেন তো আপনি। হুট করে দেখলেন, পুট করে পছন্দ করে ফেললেন, দশ দিনের মধ্যে ডিসিশান ফাইনাল… আজকালকার ফ্ল্যাটবাড়ি … কত কী দেখে নিতে হয় … মাল মেটিরিয়াল ঠিকঠাক দিচ্ছে কিনা, ভেন্টিলেশান কেমন রাখবে, বাস্তু মানা হচ্ছে কিনা … শুধু একটা কঙ্কাল দেখেই লাফালাফি শুরু করে দিলেন?

লোকটা বড্ড বকে তো! ভাবল কী করে কিংশুক কোনও পাকা মাথাকে দিয়ে সব চেক আপ করিয়ে নেয়নি? স্কুল মেট সঞ্জয় বোস সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, তাকে রীতিমতো ফিজ দিয়ে প্ল্যান কনস্ট্রাকশন সব বাজিয়ে নিয়েছে কিংশুক। সঞ্জয় সবুজ সংকেত দিল বলেই না কপাল ঠুকে এগিয়ে গেল। পরে কোনও গড়বড় হলে কিংশুক সঞ্জয়ের টুঁটি চেপে ধরবে।

কিংশুক নীরস গলায় বলল,—ও সব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু লিগাল প্রসেডিওরগুলো দেখে দিন, তাহলেই হবে।

—বেশ। ভাবব না। টোকা দিয়ে সিগারেটের শেষাংশটুকু বাইরে ফেলে দিল দেবনাথ। মুচকি হেসে বলল, তবে মশাই, একটা কৌতূহল আমার রয়েই গেল।

—কী কৌতূহল?

—আপনি আজকেই এগ্রিমেন্ট সই করার জন্য এত উতলা হয়ে পড়লেন কেন? সামনে এতগুলো ছুটির দিন ছিল … নেতাজি-সরস্বতী-প্রজাতন্ত্র … আমিও একটু ফাঁকা থাকতাম।

কিংশুক উত্তর দিল না। আলগা হাসল।

দেবনাথ সরু চোখে তাকাল,—আপনি দিন ক্ষণ মানেন নাকি ডাক্তারসাহেব? অশ্লেষা মঘা মাহেন্দ্রক্ষণ …?

কিংশুক এবারও উত্তর দিল না। মনে মনে বলল, আজকের দিনটাকে মানি। মানতে হয়। একুশে জানুয়ারি বছরে একবারই আসে। দিনটাকে কিংশুক এবার স্মরণীয় করে রাখতে চায়। এবারের উপহারটা রুমিকে চমকে দেবে। তাদের ক্রমশ নিস্তরঙ্গ হয়ে আসতে থাকা দাম্পত্যজীবনে এ চমকটার বিশেষ প্রয়োজনও আছে।

রাসবিহারী মোড়ে ট্রাফিক সিগনালে আটকেছিল গাড়ি। ছাড়া পেয়ে কিংশুক ডান দিকে ঘুরল। টালিগঞ্জ থানা পার হয়েছে, পাশে রাখা মোবাইলে সুরেলা ডাক।

বাঁ হাতে ক্ষুদে যন্ত্রটাকে কানে চাপল কিংশুক, ইয়েস?

—মুনলাইট থেকে বলছি স্যার। ও প্রান্তে সিস্টার-ইন-চার্জের গলা, আপনার সিজার পেশেন্টের কিছু প্রবলেম হচ্ছে স্যার।

—কী হল?

—বি পি হঠাৎ ফল করে গেছে স্যার। ফ্লুয়িড চেক করার সময়ে দেখি পেশেন্ট একটু রেস্টলেস। তক্ষুণি প্রেশার নিলাম। হানড্রেড বাই সেভেনটি।

কিংশুকের চোখ উইন্ডস্ক্রিনে, ভুরুতে ঈষৎ ভাঁজ, পালস কত?

—মোর দ্যান হানড্রেড। একশো ছয়, একশো আট …

—সিলটা চেক করেছেন?

—স্টিচ ও কে স্যার।

—ব্লিডিং টিডিং নেই তো?

—না স্যার।

—বেবি ঠিক আছে?

—হ্যাঁ স্যার।

—হুঁম। … আর এম ও কোথায়?

—ডক্টর মুখার্জি একটু বেরিয়েছেন স্যার। এক্ষুনি ফিরবেন।

উফ্‌, আর এম ও হুটহাট চলে যায় কেন? গোটা নার্সিংহোমের ছাব্বিশটা বেডই যার জিম্মায় তার তো অ্যালটেড আওয়ারে কোথথাও নড়া উচিত নয়।

কিংশুকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, হাইলি আনএথিকাল।

—কিছু বললেন স্যার?

—নাহ্‌। প্রেশার কনটিনিউয়াস মনিটার করুন।

—করছি স্যার।

—ফ্লুয়িডটা বাড়িয়ে দিন। ফিফটিন ড্রপ চলছে তো, টোয়েনটি ড্রপ করে দিন। আর পায়ের দিকে একটু উঁচু করে দিন বেডটা।

—ও কে স্যার।

—ডক্টর মুখার্জি এলে আমায় একবার রিং করতে বলবেন। … আমি সন্ধেবেলা যাচ্ছি।

বোতাম টিপে দূরভাষ যন্ত্র বন্ধ করল কিংশুক। হঠাৎ প্রেশার ফল করল কেন? অ্যানেসথেসিয়ার ডোজে গণ্ডগোল? তা কী করে হয়, শ্যামলী সিনহা তো পেশেন্টের ইসিজি টিসিজি ভাল করেই চেক করে নিয়েছিল। পেশেন্ট অ্যানিমিকও নয়। কালই হিমোগ্লোবিন করা হয়েছে, থারটিন পয়েন্ট ওয়ান। অপারেশনের সময়ে লস অফ ব্লাড সামান্য বেশি হয়েছিল, কিন্তু তাও তো …!

—এনি প্রবলেম ডাক্তারসাহেব?।

—আমাদের তো সব সময়েই প্রবলেম। মন গাড়িতে ফেরাল কিংশুক, —প্রতি মুহূর্তে মানুষের জীবন নিয়ে ভাবনা …

—আপনারা জীবন দান করেন, আমরা ভরসা দান করি। হে হে হে। আবার ভাট বকতে শুরু করল লোকটা!

কিংশুষ্ক গম্ভীর স্বরে বলল, এগ্রিমেন্টে পজেশনের ক্লজটা রেকটিফাই করেছেন তো?

—এক্কেবারে যেমনটা আপনি চেয়েছিলেন, তেমনটা করে দিয়েছি। ওয়ান এইটটি ডেজে বেঁধে দিয়েছি। তবে …

—কী তবে?

—লাভ নেই। ওরা যখন পজেশান দেওয়ার তখনই দেবে। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে, কোটের বোতাম এঁটে নিল দেবনাথ, সব টক্কা ফক্কা বিজনেস। দেখুন না, একের পর এক কত বাহানা তোলে। এমন সব ফ্যাকড়া বার করবে আপনারই মনে হবে এগ্রিমেন্টে গোলি মারো, কদিন পরেই যাব।

—হাইলি আনএথিকাল। রয় অ্যান্ড রয় যথেষ্ট রেপুটেড প্রোমোটার, দে শুড নট ডু দিস।

—ভাববেন না, আমি তো আছি। তেমন বুঝলে দেব এমন প্যাঁচ কষে …। দেবনাথ ব্রিফকেস কোলে তুলে আঙুল দিয়ে টরেটক্কা বাজাচ্ছে। থামাল আঙুল, তা আপনার গলফ গার্ডেন জায়গাটা তো বেশ ফাঁকা ফাঁকা, ভবানীপুর থেকে ওখানে গিয়ে মন টিঁকবে তো?

—ফাঁকা বলেই তো যাচ্ছি। নতুন ডেভেলাপ করেছে, জানলা খুললেই গ্রিন পাব… গলফ ক্লাবের মাঠ দেখা যায় …

—গ্রিন ফিন ক্যালেন্ডারেই ভাল মশাই। আশেপাশে লোক থিকথিক না করলে বেঁচে থেকে সুখ আছে? আমায় তো কেউ পঞ্চাশ লাখ দিলেও আমি শেয়ালদার স্কট লেন ছেড়ে বেরোতে পারব না। ব্যাপারীদের হট্টগোল ছাড়া আমার ঘুমই আসে না। দেবনাথ আর একটা সিগারেট ধরাল, ভবানীপুরে আপনারা কদ্দিন আছেন?

—জন্ম থেকেই। ইনফ্যাক্ট আমরা প্রায় ষাট বছরের টেনেন্ট। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময়ে সবাই যখন কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে, বাড়িঅলা প্রায় পায়ে ধরে আমার দাদু, আই মিন ঠাকুরদাকে এনে বসিয়েছিল।

—অ। তার মানে খুব সস্তায় আছেন, অ্যাঁ?

—চল্লিশে শুরু হয়েছিল, এখন আটশো দিই। রেট অফ ইনক্রিজ কি খুব কম?

—বাড়িঅলা হুড়ো দিচ্ছে না?

—দেওয়ার মতো কেউ নেই। আছে এক বুড়ি, অরিজিনাল বাড়িঅলার ছেলের বউ। আর তার এক আধা অ্যাবনরমাল মেয়ে। ছেলে ছিল একটা, মরে গেছে। জমানো টাকার সুদ আর বাড়িভাড়া, এই দিয়েই মা মেয়ের পেট চলে।

—আইব্বাস, এ তো তাহলে সোনার খনি মশাই। কদিন পরে আপনারাই তো মালিক হবেন। অমন বাড়ি ছেড়ে দেবেন?

—ভাবছি।

—ভাবনার কী আছে? ছাড়বেন না। দরকার হলে তালা বন্ধ করে রেখে দেবেন। পজেশান কক্ষনো হ্যান্ডওভার করবেন না।

হুঁহু্‌, এ কথা দেবনাথ কুণ্ডুকে বলে দিতে হবে? এই মুহূর্তে ওই লঝঝরে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া কিংশুকের কাছে খুব জরুরি ঠিকই, ওখানে বন্ধু বান্ধবদের ডাকতে অসুবিধে হয়, পার্টি টার্টি দেওয়া যায় না, চার চারখানা ঘর থাকলেও নিজেদের কোনও প্রাইভেসি নেই, তা বলে ওই রকম একটা জায়গায় গোটা একটা একতলা ছেড়ে দেয় কোন আকাট? তার ওপর আবার সম্প্রতি ওপরে নন্দাজেঠিমার কাছে তার এক ভাইপোর আনাগোনা খুব বেড়েছে, নির্ঘাৎ ভাইপো পিসিকে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট তোলার জন্য জপাচ্ছে। তেমন হলে একখানা ফ্ল্যাট তো কিংশুকদের বাঁধা।

রাণীকুঠি এসে গেছে। বাঁয়ে চওড়া গলিতে বিশ পঞ্চাশ পা এগোলেই রয় অ্যান্ড রয়ের অফিস, এক ঝকঝকে চারতলা বাড়ির একেবারে ওপরতলায়। গোটা একখানা ফ্ল্যাট জুড়ে। সুসজ্জিত, সুবিন্যস্ত, আধুনিক। প্লাস্টিক পেন্ট করা দুধসাদা দেওয়ালে সার সার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। হাউসিং কমপ্লেস। বহুতল। প্রেক্ষাগৃহ। রয় অ্যান্ড রয়ের কর্মকুশলতার নিদর্শন। প্রকাণ্ড এক গণেশের ছবিও আছে, রয় অ্যান্ড রয়ের সিদ্ধিদাতা।

মাঝের বড় হলঘরে জনা পাঁচেক কর্মচারি, কেউ বা ফাইলে ডুবে আছে, কেউ বা আঁকাজোকায় মগ্ন। আধুনিক গৃহসজ্জার উপকরণের মতো কম্পিউটারও আছে একটা, এতে অফিসের আভিজাত্য বাড়ে। কম্পিউটারটি চালাচ্ছে এক সুবেশা তরুণী।

কিংশুক মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়াল, মিস্টার স্বপন রায়ের সঙ্গে আমার আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।

—ও, আপনি এসে গেছেন! মেয়েটি সপ্রতিভ, প্লিজ একটু বসুন। স্যার যাদবপুরের সাইটে গেছেন। এক্ষুনি এসে পড়বেন।

মক্কেলের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সুবিধে অসুবিধে দেখাও যেন তার মহান কর্তব্য এমন ভঙ্গিতে দেবনাথ প্রশ্ন করল, এক্ষুনিটা কতক্ষণ? ঘণ্টা খানেক? জানেন, ডাক্তারসাহেব কত বিজি লোক?

—না, না, দেরি হবে না। এক্ষুনি আসবেন। এনি মোমেন্ট। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল, আসুন, আপনারা স্যারের চেম্বারে বসুন।

স্বপন রায়ের ঘরটিও ঝাঁ চকচকে। বিশাল অর্ধবৃত্তাকার টেবিলে তিন তিনটে টেলিফোন, গদিআঁটা ঘুরনচেয়ার, দেওয়ালে মিশে থাকা কাবার্ড, মেঝেয় পুরু কার্পেট, বাতাসে হালকা সুগন্ধীর আভাস। এবং কম্পিউটার। দেওয়ালে এখানে গণেশ নেই, মা কালী। লোলজিহ্বা করালবদনী দিগবসনা। মা কালীর ছবিতে ঝুলছে জবার মালা, প্লাস্টিকের। সম্ভবত সারা বছর টাটকা থাকে বলে। টেবিলে সুইমিংপুলঅলা এক অট্টালিকার মডেল, দেখে মনে হয় কোথাও কোনও হোটেল মোটেল বানাচ্ছে রয় অ্যান্ড রয়।

মডেলটা নিরীক্ষণ করতে করতে চেয়ারে বসছিল কিংশুক, চলমান টেলিফোনে আবার সুরধ্বনি।

ধাতব বাজনা চুপ করাল কিংশুক, ডক্টর গুহ স্পিকিং।

—কিংশুকদা, আমি প্রতিম বলছি। আপনি কোথায়?

ফের মুনলাইট। কিংশুকের কপাল কুঁচকে গেল, একটা জরুরি কাজে আটকে আছি। আমার পেশেন্ট কেমন?

—রেস্টলেসনেসটা বেড়ে গেছে। অলমোস্ট ফুল কনশাসনেস রিগেন করেছে পেশেন্ট। অ্যাবডোমেনে পেন হচ্ছে বলছে।

প্রাইমারি হেমারেজ? লিগেচার খুলে গেল? খোলার তো কথা নয়। নয় নয় করে ন বছরের ডাক্তারিজীবনে কিংশুক বেশ কয়েকশো সিজারিয়ান সার্জারি করেছে, একটি বারের তরেও তো এমনটা হয়নি!

উদ্বিগ্ন স্বরে কিংশুক বলল, প্রেশার মনিটরিং চলছে?

—বি পি আরও ফল করেছে কিংশুকদা। নাইনটি বাই সিক্সটি।

—পালস্?

—ট্যাকিকার্ডিয়া। একশো চল্লিশ।

—পি ভি ব্লিডিং আছে?

—না।

—রেসপিরেটারি ডিসট্রেস?

—শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

—চেস্ট দেখেছ?

—দেখেছি। কিছু নেই। এয়ার এনট্রি পুওর, অক্সিজেন স্টার্ট করে দিয়েছি।

—গুড। রেসপন্ড করছে অক্সিজেনে?

—বুঝতে পারছি না। … আপনি চলে আসুন কিংশুকদা।

—যাচ্ছি। … তুমি এক কাজ করো। ইতিকৰ্তব্য স্থির করতে কিংশুক সেকেন্ডের জন্য থামল, বি পি যদি আরও নেমে যায় … সিসটোলিক সেভেনটির নীচে হয়ে গেলে ডোপামিন চালিয়ে দিও।

—ঠিক আছে।

—আর হ্যাঁ, শোন। হিমাকসিল দিয়ে দাও। … পেশেন্টের বাড়ির লোকজন আছে?

—আছে। ভিজিটিং আওয়ার তো …।

—পার্টিকে বলল এক্ষুনি হোল ব্লাডের অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে। পেলেই ব্লাড চালু করে দাও। এক হাতে ফ্লুয়িড উইথ ডোপামিন, অন্য হাতে ব্লাড। … আমি দেখছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাচ্ছি।

কিংশুক ফোন কোটের পকেটে ঢোকাল। ঘড়ি দেখছে। পাঁচটা বাজতে পাঁচ। এন্টালি এখান থেকে কতক্ষণ লাগবে? বিশ পঁচিশ মিনিট, কি মেরে কেটে আধঘণ্টা? সাড়ে পাঁচটাতেও এখানকার কাজ চুকে গেলে ছটার মধ্যে মুনলাইট পৌঁছে যাবে। আর এম ও প্রতিম মুখার্জি ছেলেটি চটপটে আছে, নার্ভটাও স্টেডি, ঘণ্টাখানেক কি সামাল দিতে পারবে না?

দেবনাথ ব্রিফকেস খুলে এগ্রিমেন্টটা পড়ছে আর একবার। চোখ না তুলেই বলল, ডাক্তাররাই বিজি বটে। ক্ষণে ক্ষণে শ্যামের বাঁশি!

কিংশুক অস্ফুটে বলল, হুঁ। কেসটা একটু সিরিয়াস। কী করি বলুন তো? প্রোগ্রামটা আজ পোস্টপন করে দেব?

—সে আপনি যা মনে করেন। আমার মক্কেল তো আমাকে ধোয়াবেই। যেমন আপনি ধোয়াচ্ছিলেন।

কিংশুক দোলাচলে। রুমিকে তবে আজ সারপ্রাইজ দেওয়াটা হবে না? পনেরো দিন আগে থেকে এঁচে রেখেছে, রুমিকে সদ্য ঢালাই করা খাঁচাখানা দেখানোর সময়ে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি ওই ফ্ল্যাটটাই এ দিন সে চুড়ান্ত করে ফেলবে। ভেস্তে যাবে প্ল্যানটা?

স্বপন রায় ঢুকে পড়ল। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, সুঠাম স্বাস্থ্য, পরনে দামি উলেন স্যুট, হাতে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট। মুখমণ্ডলে শিক্ষা বিনয় অহংকার হাসি নিষ্ঠুরতা মদ্যপানের ছাপ মিলেমিশে আছে।

ঘুরনচেয়ারে বসতে বসতে বার চারেক ক্ষমা চাইল স্বপন রায়, বেল বাজিয়ে ডাকল বেয়ারাকে, এখনও কিংশুক দেবনাথকে কফি দেওয়া হয়নি বলে ধমকাল কড়া গলায়। হাত বাড়িয়ে চুক্তিপত্রখানা নিয়েছে দেবনাথের কাছ থেকে। পাখির দৃষ্টি বোলাচ্ছে। থামছে হঠাৎ হঠাৎ, গভীর মনোযোগে পড়ছে কিছু কিছু লাইন।

কিংশুক সেলুলার বার করে চটপট সংখ্যা টিপল মুনলাইটের। এনগেজড। মুনলাইটের দ্বিতীয় নাম্বারটা চেষ্টা করল, প্রোপ্রাইটার মিস্টার লালের ব্যক্তিগত লাইন। রিং হয়ে যাচ্ছে, উচ্চকিত ধ্বনি কানে লাগছে খুব। মিস্টার লাল নেই ওখানে? না থাকলে ঘর কি বন্ধ থাকবে? নাকি লাইন খারাপ? এ শহরে কিছুই তো ঠিকঠাক চলে না। আবার একবার প্রথম লাইনটা চেষ্টা করল কিংশুক। এখনও এনগেজড।

স্বপন রায় সিগারেট ধরিয়েছে। স্বপন রায়ের বাড়ানো প্যাকেট থেকে একটা তুলে নিল দেবনাথও। মিউজিকাল লাইটারের সুর নিবিয়ে দিয়ে স্বপন রায় হাসি হাসি মুখে বলল, পজেশনের ক্লজটা তাহলে রাখলেনই?

—অফকোর্স। দেবনাথ কাঁধ ঝাঁকাল, আমার ক্লায়েন্ট তো আপনাকে বলেইছিলেন…

—নো প্রবলেম। … বাই দা বাই, ফাইনাল পেমেন্টের দিনই তো আপনারা রেজিস্ট্রেশান চাইছেন?

—নিশ্চয়ই।

—তার আগে কিন্তু ইনকামট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স বার করে নিতে হবে। আমি পেপার টেপার ইনকামট্যাক্স অফিসে নয় জমা করে দেব, আপনারা কিন্তু লেগে থেকে …

—কেন? ওটা তো আপনার কাজ।

—আহা, বলছি তো আমি টাইমলি জমা করে দেব। তবে নরমাল প্রসেসে হয়তো সময় লাগতে পারে। আমি অত ছোটাছুটি করতে পারব না।

দেবনাথ কিংশুকের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, কী, বলেছিলাম না টক্কা ফক্কা বিজনেস?

স্বপন রায়ের চোখ সরু হল, কিছু বললেন?

রেজিস্ট্রেশানের সময়ে যা হবে দেখা যাবে, এই মুহূর্তে আর কূটকচালি ভাল লাগছিল না কিংশুকের। সামান্য অধৈর্য স্বরেই বলল, —আমার একটু তাড়া আছে, সইসাবুদের কাজগুলো মিটিয়ে ফেললে হয় না?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, এক্ষুনি হবে। স্বপন রায় ব্যস্ত মুখে বলল, তা আপনি আজ দিচ্ছেন কত ডাক্তারবাবু?

—চার।

—সাড়ে চার দেওয়ার কথা ছিল না?

—চেকের অ্যামাউন্ট এক লাখই দিয়েছি। ক্যাশ আজ তিনই রাখুন।

স্বপন দু এক সেকেন্ড থমকে রইল, তারপর উঠে গেল বাইরের হলে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে নিয়ে ফিরে এসেছে, চেকটা তাহলে হ্যান্ডওভার করে দিন ডাক্তারবাবু। এগ্রিমেন্টে চেকের নাম্বারটা তো লিখতে হবে।

ব্রিফকেস খুলে চেকবই-এর পাতা ছিঁড়ল কিংশুক। দেবনাথ হাতে নিয়ে একবার দেখে নিল চেকটা, বাড়িয়ে দিল মেয়েটির দিকে। চেক আর এগ্রিমেন্টের কপিগুলো নিয়ে মেয়েটি চলে গেল।

স্বপনের টেবিলে শৌখিন পোরসিলিনের অ্যাশট্রে। গাঢ় বেগুনি রং রাক্ষসের মুখ। অ্যাশট্রেটা সামনে টেনে বলল, কিছু মনে করবেন না ডাক্তারবাবু, আপনার সঙ্গে কিন্তু টোটাল অ্যামাউন্টের থারটি পারসেন্ট পেমেন্টের কথা হয়েছিল।

দেবনাথ ফুট কাটল, আরে, টাকা তো আপনার পালাচ্ছে না। নব্বই দিনের মধ্যে আপনাকে আরও থারটি পারসেন্ট পেমেন্ট করতে হবে, বিফোর পজেশন ফুল। এবার ক্যাশ পঞ্চাশ হাজার কম পেলেন, ফাইনাল পেমেন্টের সময়ে মেকআপ হয়ে যাবে।

স্বপন দেবনাথের দিকে তাকালই না। পেশায় তেমন সফল না হলে মুখে চোখে ব্যক্তিত্ব ফোটে না, দেবনাথকে কয়েক সেকেন্ড দেখেই ঝানু ব্যবসায়ী স্বপন বুঝে গেছে এ লোকটা মোটেই তেমন দুঁদে উকিল নয়, হলে এত কথায় কথায় ফড় ফড় করত না।

সরাসরি কিংশুকে বলল, ডাক্তাররা কিন্তু জেনারালি কথা ফেল করেন না ডক্টর গুহ।

কিংশুকের মুখ লাল হয়ে গেল। ঈষৎ তপ্ত স্বরে বলল, আমি কি টাকা মেরে দেব মনে হচ্ছে?

—ছি ছি, তা কেন! স্বপন বিনয়ের অবতার হয়ে জিভ কাটল, আসলে আপনাদের পেমেন্টের ওপর ভরসা করেই তো আমি আমার দেওয়া থোয়ার শিডিউল চক আউট করি। বিশেষ করে এই ক্যাশ ট্যাশ। … এই যে এখন যাদবপুরে ছুটেছিলাম … কেন শুনবেন? শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। জানেনই তো, প্রত্যেকটি কনস্ট্রাকশানে লোকাল মাসলম্যানকে প্রসাদ চড়াতে হয়। … পিছনে পার্টির দাদারাও থাকেন … যাক গে, সে থাকুক গিয়ে, সবাই তো করেকন্মে খাবে। আমরা এই নিয়ে কিছু মনে করি না।…কিন্তু এখানে হয়েছে অন্য ফ্যাকড়া। মাসলম্যানের গ্রুপ ভেঙে গেছে। আই মিন আর একটি গ্যাং গজিয়েছে। এখন তারাও নৈবিদ্যি চায়। বলে, ওকে আশি হাজার দিয়েছিলেন, আমায় এক লাখ দিতে হবে। না দিলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। যে কোনও মুহূর্তে আমার ঊর্ধ্বলোকে চলে যাওয়াটাও কিছু অস্বাভাবিক নয়। বলুন কী করব? এ টাকা কোথথেকে জোগাব? আপনাদের ফ্ল্যাটের দাম তো আর বাড়াতে পারব না।

এ সব গাওনা শুনে কিংশুকের কী লাভ? ফ্ল্যাটের দাম না বাড়াক, ফিটিংস চার্জ টিটিংস চার্জ দেখিয়ে ওই টাকা কিংশুকদেরই ঘাড় মটকে বার করে নেবে স্বপন রায়, কিংশুক জানে।

কিংশুক গম্ভীর গলায় বলল, দেখুন, আপনি টাইম টু টাইম যা বলেছেন আমি তাতে এগ্রি করেছি। আমি ব্ল্যাক আর হোয়াইট ফিফটি ফিফটি করতে বলেছিলাম, আপনি কিছুতেই রাজি হলেন না। স্টিক করে রইলেন ফরটি পারসেন্ট ব্ল্যাক, সিক্সটি পারসেন্ট হোয়াইট। বলেছিলেন প্রথম দফায় এক লাখের বেশি হোয়াইটে নেবেন না, আমি তাই দিচ্ছি। যদি আপনি টোটাল থেকে হোয়াইটের পরিমাণ আর একটু কমাতেন…

—হয় না ডাক্তারবাবু, হয় না। আমি অনেকটা ঝুঁকেছি, ছ লাখ পর্যন্ত ক্যাশে আমি এগ্রি করেছি। ন লাখে এই ফ্ল্যাট বিক্রি করছি, ইনকামট্যাক্স এ কথা বিশ্বাস করবে? কখনওই না। অন্যদের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট দেখবেন? সবাই সেভেনটিফাইভ পারসেন্ট হোয়াইট দিচ্ছে। আমার মশাই স্যালারিড পিপলদের নিয়ে কারবার, কালো টালো আমার। বিশেষ পছন্দ নয়।

হুঁহ্‌, সতী সাবিত্রী! বিরক্তিটা প্রায় বেরিয়ে আসছিল মুখ দিয়ে, আবার বুকপকেটে বাজনা বেজে উঠেছে।

কিংশুক চমকে ফোন কানে চাপল। নিচু গলায় বলল, হ্যালো?

—কিংশুকদা, আপনি কোথায়?

—এই তো… বেরোচ্ছি… শিগগিরই…

—এক্ষুনি চলে আসুন। পেশেন্ট শকে চলে যাচ্ছে।

—ইজ ইট?

—হ্যাঁ কিংশুকদা। ডোপামিন ব্লাড কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সিসটোলিক পঞ্চাশে নেমে গেছে। পালস ওয়ান এইটটি। পেশেন্টকে একটু সায়োনোজড লাগছে।

চিড়িক করে বিদ্যুৎ খেলে গেল কিংশুকের মাথায়, অ্যাবডোমেন চেক করেছ?

—সিল ও কে। কিন্তু অ্যাবডোমেন ইজ রিজিড। ভেরি রিজিড।

যা ভেবেছে তাই। প্রাইমারি হেমারেজই। ভেতরে ব্লিডিং হচ্ছে পেশেন্টের। পেরিটোনাইটিস হয়ে গেছে। এক্ষুনি পেট ওপেন করা জরুরি।

উদ্বেগটাকে স্নায়ুর নিয়ন্ত্রণে রেখে কিংশুক বলল, ঠিক আছে, তুমি একটা কাজ করো। ও টি রেডি করতে বলো। অ্যানেসথেটিস্টকে ইমেডিয়েটলি কল পাঠাও। আমি আসছি।

—দেরি করবেন না কিংশুকদা। পেশেন্টের বাড়ির লোকেরা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছে, বার বার আপনার খোঁজ করছে।

—বলে দাও আমি খবর পেয়েছি। আসছি।

মোবাইল অফ করে কিংশুক ছটফট করে উঠল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, —আমায়। এক্ষুনি যেতে হবে। এমারজেন্সি কেস …

—শুধু তো কটা সই। এক সেকেন্ড, আপনি ক্যাশটা রেডি করুন, স্বপন ঝটিতি উঠে বাইরে গেল আবার। মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরে এসেছে, এগ্রিমেন্ট হাতে। টেবিলে কাগজগুলো রেখে বলল, নিন নিন, সইগুলো সারুন।

—কিন্তু আমার যে খুব তাড়া ছিল!… কাল যদি আসি?

—কাল কে দেখতে পায় ডাক্তারবাবু? হু ক্যান সে, কাল আপনার আরও সিরিয়াস কিছু থাকবে না!

দেবনাথ স্বপনের প্যাকেট থেকে আর একটা সিগারেট তুলেছে,—আর তো পাঁচ মিনিটের ব্যাপার…। একটা শুভ কাজ হতে চলেছে, মিছিমিছি আবার কালকের জন্য ফেলে রাখবেন কেন?

—রিয়েলি কেসটা খুব সিরিয়াস মিস্টার কুণ্ডু। এখনই না পৌঁছলে ফ্যাটাল কিছু হয়ে যেতে পারে।

—সে তো আপনি পৌঁছলেও হতে পারে। স্বপন দার্শনিকের স্বরে বলল, জীবন মৃত্যু কিছুই আপনার হাতে নেই ডাক্তারবাবু, সবই মায়ের ইচ্ছে। রাখলে তিনি রাখেন, মারলে তিনি মারেন…

কিংশুক হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে কাগজ টানল, —কোথায় সই করব? কোথায় কোথায়?

—এই হুটোপুটি করলেই তো বিপদ। রিয়েল এস্টেটের ব্যাপার…। দেবনাথ সই করার জায়গাগুলো টিক মেরে মেরে দেখাচ্ছে, ধীরে সুস্থে। মাথা দোলাতে দোলাতে বলল,—আপনারা অল্পবয়সি তো, বুঝতে চান না…

—আহ্‌। কিংশুক প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, স্থানকালপাত্র ভুলে। পরক্ষণে সংযত হয়েছে। ব্রিফকেস খুলল, গুনে গুনে ছটা পাঁচশো টাকার বান্ডিল বাড়িয়ে দিল স্বপনকে।

দেবনাথ সামান্য গোমড়া হয়েছে। ভার গলায় বলল,—প্রত্যেকটা পাতায় ফুল নেম সাইন করবেন। দু কপিতেই।

ওফ্‌, অন্তহীন সই! এগ্রিমেন্টটা কি এত মোটা ছিল?

ঝড়ের গতিতে সই করছে কিংশুক। আড়ে আড়ে কবজির দিকে তাকাচ্ছে। স্বপন রায়, দেবনাথ কুণ্ডুও সই করল। তবে তাদের তেমন ব্যস্ততা নেই। কলকাতার কোথায় কোন এক নার্সিংহোমে কে এক অচেনা মানুষ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তা ভেবে উদ্বেল হলে তো পৃথিবী চলে না।

সওয়া ছটা নাগাদ কিংশুক ছাড়া পেল। ফ্ল্যাট কেনার প্রাথমিক পর্ব শেষ, এগ্রিমেন্টের কপি ব্রিফকেসে ভরে তরতরিয়ে নামছে। গাড়ির দরজা খুলল।

পাশে দেবনাথ, কোন দিকে যাবেন ডাক্তারসাহেব?

—এন্টালি।

—ও, আমার রুটেই। তাহলে তো এক সঙ্গেই যাওয়া যায়।

উত্তেজনাটা ক্রমশ বেলুনের মতো ফুলছে বুকে। চাপ অনুভব করছিল কিংশুক। দেবনাথের সঙ্গ এই মুহূর্তে এতটুকু প্রীতিপ্রদ মনে হচ্ছে না, কিন্তু মুখের ওপর কি না বলা যায়?

অন্ধকার নেমে গেছে। বাতাসে কুয়াশার পাতলা আস্তরণ, পথঘাট কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। ঠাণ্ডা এ বছর ভাল মতন খুঁটি গেড়ে বসে আছে, কামড় দিচ্ছে বাতাস। প্রায় বৃক্ষবিরল পথেও উড়ে আসে পাতা। শুকনো, খড়মড়ে।

গাড়ি পিকআপ নিয়েছে। গতি বাড়াচ্ছিল কিংশুক, শহরের এই যানসংকুল রাস্তায় যতটা সম্ভব। দুপাশের বাড়িঘর দোকানপাট পিছোচ্ছে ক্রমশ, একের পর এক যন্ত্রসরীসৃপ টপকে যাচ্ছে মারুতি।

দেবনাথ ঠান্ডায় জড়োসড়ো। জানলার কাচ অর্ধেক তুলে দিয়েছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ডাক্তারসাহেব একটু বেশি টেনশনে পড়ে গেছেন মনে হচ্ছে? কী কেস? ডেলিভারি?

কিংশুক চুপ করে আছে। এই নির্বোধকে কী বোঝাবে!

দেবনাথ ফের বলল, লেবার পেন উঠেছে বুঝি?

কিংশুক আপন মনে গজগজ করে উঠল, আপনাদের জন্য এত দেরি হয়ে গেল…!

—আমাদের জন্য? যাচ্চলে। আমি বলে আপনার জন্য কাজ ফেলে… ফিজটা পর্যন্ত আপনার কাছে চাইনি…।

ও, তার মানে আজকের জন্যও তাহলে টাকা নেবে! যখন কথা হয়েছিল তখন তো বলেনি!

কিংশুক গম্ভীর গলায় বলল, কাল পৌঁছে দেব।

—ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি আগে ডেলিভারিটা করিয়ে দিন। আমার হাজার টাকা তিন দিন পরে হলেও চলবে।

হাহ্‌, কায়দা করে টাকার অঙ্কটাও শুনিয়ে দিল! যাক গে যাক, একেবারে মাগনায় কিংশুক খাটাবেই বা কেন!

চোয়াল শক্ত করে গাড়ির গতি আরও বাড়াল কিংশুক। হঠাৎ খারাপ লাগছিল ভীষণ, নিজের ওপর বিরক্ত হচ্ছিল। পেশেন্টের লিগেচার ছিঁড়ে গেল? তারই ভুলে কি? না-ও হতে পারে অবশ্য। তবে সিস্টার-ইন-চার্জকে প্রথমেই কি অ্যাবডোমেনটা থরো চেক করতে বলা উচিত ছিল না?

মিন্টো পার্কে এসে গাড়ি নিথর। জ্যাম। মাঝরাস্তায় সরকারি বাস অচল হয়েছে, মুহূর্মুহূ হর্ন বাজাচ্ছে অজস্র যান।

কিংশুক জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল। ট্রাফিক পুলিশ গেল কোথায়? কেউ কি ঠিকঠাক ডিউটি করে না? হাইলি আনএথিকাল।

ফের কোটের পকেটে ধাতব সুর।

—হ্যালো কিংশুকদা, আপনি এখনও এলেন না? পেশেন্ট অ্যাবসোলিউট শকে চলে গেছে। এই মাত্র একটা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল, কোনও মতে রিভাইভ করা গেছে।

—ও নো।…আই অ্যাম অন মাই ওয়ে প্রতিম। জ্যামে আটকে গেছি।…ও টি রেডি?

—অনেকক্ষণ। পেশেন্ট ও টি-তেই আছে। ডক্টর সিনহাও এসে গেছেন। পালস একদমই ফিবল কিংশুকদা, ব্লাডপ্রেশার ননরেকর্ডেবল। ওপারে প্রতিম মুখার্জির গলা দুলে গেল, খুবই ডাউনহিল যাচ্ছে কিংশুকদা, পেশেন্টকে আর বোধহয়…

বলতে বলতে প্রতিম নীরব সহসা। অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য।

কোট সোয়েটার চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঠান্ডা ঢুকে পড়ছে পাঁজরে, কিংশুকের হঠাৎ খুব শীত করছিল। মোবাইল ফোন আস্তে করে পাশে নামিয়ে রাখল কিংশুক।

দুই

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দক্ষিণী রেশম শাড়ির আঁচলখানা প্রসারিত বাহুর ওপর মেলে ধরল রম্যাণি। ভুরুতে আলগা ভাঁজ ফেলে টুকুন নিরীক্ষণ করল নিজেকে। আপন মনে বলে উঠল, বাহ্‌, তোকে তো আজ বেশ দেখাচ্ছে রে।

সাজলে গুজলে রম্যাণিকে তো ভালই লাগে, কিন্তু সে সাজে কই! সেই কোন ছোটবেলায় মা একবার বলেছিল, সাজগোজ একটু কম করিস রুমি, তোর দিদির মনে কষ্ট হতে পারে…। কথাটা রম্যাণির মনে গেঁথে গেছে, এখন ওই না সাজ করাটাই তার অভ্যেস, উমনো ঝুমনো থাকতেই রম্যাণির বেশি ভাল লাগে। বরের সঙ্গে পার্টি টার্টিতে গেলেও অতি সামান্য প্রসাধন করে রম্যাণি, এতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে সে। আর এমনিতে হয়তো শীতে ক্রিম টিম গোছের কিছু মাখল, কি গরমে একটু পাউডার টাউডার, আর রোজ রাতে মুখ পরিষ্কার করে সামান্য লোশান, ব্যস।

তবে আজকের কথা আলাদা। আজ একটা বিশেষ দিন, আজ তো রম্যাণিকে বেশভূষায় একটু বাহার আনতেই হবে। তাই কায়দা করে খোঁপা বেঁধেছে রম্যাণি, হালকা পালিশ বুলিয়েছে ত্বকে, ঠোঁটে রং, ঘন কালো চোখের মণি আরও উদ্ভাসিত করে নয়ন ঘিরে মসিরেখা, কপালে খয়েরি টিপ। কে এখন বলবে এই মেয়ে বত্রিশ? এক বাচ্চার মা?

ঠান্ডাটা আজ একটু বেশির দিকে। হাওয়াও আছে। মকরসংক্রান্তি চলে গেছে গত সপ্তাহে, কিন্তু গঙ্গাসাগরের বাতাস এখনও কলকাতাকে ছাড়েনি। সব জানলাই বন্ধ, তবু রম্যাণির ঘরখানা যেন হিম হয়ে আছে। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে কী ভাবে যে উত্তুরে বাতাস সেঁধিয়ে যায় এই প্রাচীন ঘরটায়!

রম্যাণি আলমারি খুলে নতুন শালখানা বার করল। পালকের মতো হালকা, তুলতুলে, আসলি পশমিনা। পয়লা জানুয়ারির দিন গছিয়ে গেছে শালওলা। খুরশিদ দাম একটু বেশি নেয় বটে, তবে জিনিস ভালই দেয়। শালটায় তেমন দেখনদারি নেই, কিন্তু গরম হয় খুব। আজ ফিরতে রাত হতেই পারে, পশমিনাটাই গায়ে দেওয়া ভাল।

শালখানা জড়াতে গিয়ে রম্যাণি থমকাল একটু। ভেতর বারান্দায় ছ্যাঁকছোঁক শব্দ হচ্ছে না? বাতাসে সহসা গাওয়া ঘিয়ের সুঘ্রাণ! ভাজাভুজি চলছে নাকি কিছু? রান্নাবান্না তো সব সারাই আছে, শাশুড়ির প্রাণে এখন আবার কীসের শখ জাগল?

অন্দরের চওড়া বারান্দাখানা এ বাড়ির রন্ধনশালা। বারান্দার শেষ প্রান্তে ছোট মতন একখানা রান্নাঘর আছে, রম্যাণির শাশুড়ি-মার শাশুড়ি-মা এককালে সেখানেই রান্নাবান্না করতেন, একবার কী করে যেন তাঁর কাপড়ে আগুন ধরে যায়, তারপর থেকেই ঘরখানা পরিত্যক্ত। আপাতত এ বাড়ির ডাম্পিংগ্রাউন্ড।

খসখস শাড়ি বাজিয়ে রম্যাণি ভেতর বারান্দায় এল। গ্যাসের টেবিলের সামনে শাশুড়ি, হাতের ছানচা কড়ায় ডুবছে উঠছে।

পুত্রবধূকে দেখে তাপসীর মুখে একগাল হাসি, তাতানের জন্য কটা লুচি ভাজছি রে।

—হঠাৎ লুচি?

—বাহ্, তোরা বাইরে খেতে যাবি, ও বেচারা শুধু দুধরুটি খায় কেন?

—কেন, আমি তো তাতানের জন্য বিকেলে চিকেন-স্টু বানিয়েছি।

—এহ্, স্টু একটা খাবার হল! ট্যালটেলে, স্বাদ নেই…। লুচিটা তবু বেচারা ভালবেসে খায়।

হুঁহ্, ভালবেসে খায় না হাতি। ওইটুকনি সাড়ে তিন বছরের ছেলে কত যেন খাওয়ার ভাল মন্দ বোঝে! আসলে ঠাকুমারই নাতিকে লুচি গেলানোর বাসনা হয়েছে।

মনে মনে ঈষৎ শঙ্কিত হল রম্যাণি। তাতানের গত সপ্তাহে পেট ছেড়েছিল, গাওয়া ঘি কি হজম করতে পারবে? কিন্তু কে বলতে যাবে এসব কথা! তাপসী নিজে যা উচিত মনে করবে তার ওপর কথা বলার রম্যাণির জো আছে? ফোঁস হয়তো করবে না, কিন্তু রম্যাণির কথা মনোমতো না হলে মুখ তোলো হাঁড়ি করে রাখবে শাশুড়ি। সে তখন এক বিটকেল পরিস্থিতি। রম্যাণির ভাল্লাগে না।

তাপসীর অনেক বাড়াবাড়িই রম্যাণির না-পসন্দ্। তার শাশুড়ি মানুষটি এমনিতে মন্দ নয়, তার সঙ্গে যথেষ্ট সম্ভাবও আছে, আত্মীয় কুটুম্বদের কাছে পুত্রবধূর প্রশংসাও করে তাপসী, কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে মহিলার মাত্রাজ্ঞান এত কম! ছেলে নাতির বেলায় কখনও কখনও যেন তা দৃষ্টিকটুর পর্যায়ে চলে যায়। এই যেমন, কিংশুক সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ে, রম্যাণি এখন আর নববধূটি নেই, নয় নয় করে এ সংসারে তার ছ বছর হয়ে গেল, কিংশুকের জলখাবার রম্যাণিই স্বচ্ছন্দে বানিয়ে দিতে পারে, অথচ সে হাত লাগাতে গেলে শাশুড়ি হাঁ হাঁ করে উঠবে। দখল চলে যাওয়ার ভয়? নাতিকে যে ঠাকুমা মার চেয়ে বেশি ভালবাসে এটা প্রমাণ করা যেন তাপসীর জীবনের ব্রত। এই তো পরশুদিন আইসক্রিমঅলাকে ডেকে চারটে কাপ কিনল তাপসী, রাত্তিরে ঘং ঘং কাশছিল বলে তাতানকে রম্যাণি পুরো কাপ খেতে দিল না, ওমনি ঠাকুমার মুখ এতখানি। সারা সন্ধে গুম, টিভি সিরিয়াল পর্যন্ত দেখল না।

আরও আছে। এই যে লঝ্ঝরে একটা বারান্দাকে রংচং মেরে কিচেন কাম ডাইনিং বানাল, কাঁড়ি কাঁড়ি খরচা করে ভাঙা দেওয়ালে ক্যাবিনেট বসানো হল, চলটাওঠা মেঝেয় শৌখিন খাবারটেবিল বসল, ঝকঝকে বেসিন হল, মিক্‌সি টোস্টার আভেনের জন্য ব্ল্যাক স্টোনের তাক বানানো হল, এ সবের কোনও দরকার ছিল? কবেকার সেই আদ্যিকালের ভাঙা বাড়ি, কোনওভাবেই আর এখানে বাস করা যাচ্ছে না, কিংশুক হন্যে হয়ে পছন্দসই ফ্ল্যাট খুঁজছে, আজ হোক কাল হোক এ বাড়ির মায়া তারা কাটাবেই। এ কথা শাশুড়িও জানে। তার পরও কি এখানে টাকা ঢালা অপচয় নয়? বুঝবে কে? ছেলে রোজগার করছে, মা ওড়াবে না?

যাক গে, যা খুশি করুক। নাতির যদি ফের পেট খারাপ হয়, ঠাকুমাই ম্যাও সামলাবে।

অসন্তোষটা ঝেড়ে ফেলে রম্যাণি ঘরে ফিরছিল, তাপসী ডাকল, এই, তোদের আজ কোথায় পার্টি রে?

সন্ধে থেকে এই নিয়ে তিনবার প্রশ্নটা হল!

রম্যাণি আলগা হাসল, বলেছি তো পার্টি নেই।

—তাহলে এত সেজেছিস যে বড়?

—পার্টি থাকলে আমি বুঝি সাজি?

—সেই জন্যই তো অবাক হচ্ছি। যাচ্ছিসটা কোথায় বলবি তো?

—বেরোব। এমনিই বেরোব।

তাপসী এবার যথেষ্ট বেজার হয়েছে। গ্যাস নিভিয়ে ছোট্ট স্টিলের প্লেট বার করছিল ক্যাবিনেট থেকে, থেমে গেছে হাত।

রম্যাণির হাসি পাচ্ছিল। কৌতূহলে পেট ফুলছে শাশুড়ির। যেখানেই যাক, কোথায় যাচ্ছে শাশুড়িকে বলে যায় রম্যাণি। কিন্তু আজ তার উপায় নেই। দিনটা যে আজ একুশে জানুয়ারি।

এই দিনে রম্যাণির সঙ্গে কিংশুকের প্রথম আলাপ। মেডিকেল কলেজের সোশালে।

এগারো বছর ধরে এই দিনটাকে তারা বিশেষভাবে পালন করে আসছে। বিয়ের পরেও ধারাটা বদলায়নি।

গোয়ায় হানিমুন করতে গিয়ে তারা স্থির করেছিল বিবাহবার্ষিকীর দিন যেমন খুশি সামাজিক অনুষ্ঠান হোক, একুশে জানুয়ারির দিনটা শুধু তাদেরই থাকবে। শুধু নিজেদের।

ফি বছর এই তারিখে কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ে দুজনে। নিয়ম হারা। হিসেব ছাড়া। গত বছর কোলাঘাট গিয়েছিল, তার আগের বছর বকখালি, তার আগের বার ব্যান্ডেল। তার আগের বছর অবশ্য তাতান পেটে ছিল বলে বেশি দূর যাওয়া হয়নি, মধ্যকলকাতার এক হোটেলে রুম ভাড়া করে সারাদিন…।

এই দিনটায় প্রায় বছরই কোনও না কোনও অদ্ভুত কান্ড ঘটে, পরে সেটাই মধুর স্মৃতি হয়ে যায়। গত বার কী হল? কোলাঘাট থেকে ফেরার পথে দুম করে বম্বে রোডের ওপর গাড়ির সেলফ ফেঁসে গেল! দুজনেই পালা করে ঠেলছে গাড়ি, আর কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছে। মিস্ত্রির দেখা মিলল বাগনানে, দুজনেরই তখন কোমর বেঁকে খন্ডৎ ত। বকখালিতে তো আর এক কেচ্ছা। সমুদ্রবক্ষে নৌকাভ্রমণ চলছে, কথা নেই বার্তা নেই কোথথেকে অসময়ে উড়ে এল এক পাগলা মেঘ! উথাল পাথাল হাওয়া শুরু হয়ে গেল, নৌকো প্রায় ডোবে ডোবে, চোখ বুজে ঠকঠক কাঁপছে রম্যাণি, আর কিংশুক শির ফুলিয়ে চেল্লাচ্ছে, ও মাঝিভাই জলদি চালাও! একশো টাকা বেশি দেব! দুশো টাকা বেশি দেব! কে বোঝাবে ঝোড়ো বাতাসে নৌকো আর মাঝির ইচ্ছাধীন থাকে না!

এ বছর দিনটা কেমন চটকে গেল। কিছুতেই আজ নিজেকে ফাঁকা রাখতে পারল না কিংশুক। পারল না? নাকি রাখল না? দুটো চারটে কেস কম নিলে কী হয়? এমন তো নয়, দেশে গায়নোকলজিস্টের আকাল পড়েছে, কিংশুক বিনা চলবে না! মফস্বলে গিয়ে মন বসল না, রম্যাণিকে ছেড়ে থাকতে পারছে না, সরকারি চাকরিও আর করবে না, ঠিক আছে। ফিরে এসে বিয়েটা সেরে ফেলল, এম ডি-তে চান্স পেয়ে গেল, পাশ করে কপাল ঠুকে নেমে পড়ল প্রাইভেট প্র্যাকটিসে, তাও ঠিক আছে। কিন্তু টাকার পিছনে এত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা কেন? ভবানীপুরের চেম্বারেই তো বেশ চলে যাচ্ছিল, তারপর বসা শুরু করল মৌলালি, তারপর যাদবপুর…। তাতেও সন্তুষ্ট নয়, সেদিন বলছিল এবার থেকে টালিগঞ্জের পলিক্লিনিকেও নাকি দু দিন করে বসবে। এর সঙ্গে আবার আধ ডজন নার্সিংহোম। এত দৌড়ে কী লাভ? কী হবে টাকার পাহাড় বানিয়ে?

নাতির জন্য লুচি নিয়ে তাপসী নিজের ঘরে গেছে। রম্যাণি অন্যমনস্ক চোখ কবজিতে নামাল। পৌনে আটটা। এবার বোধহয় কিংশুককে তাড়া লাগানো দরকার। অনেক তো কাজ হল, এবার অন্তত দু এক ঘণ্টা রম্যাণিকে দিক।

মাস আস্টেক হল মোবাইল নিয়েছে কিংশুক। চেম্বার নার্সিংহোম আর রোগিণীদের সঙ্গে সংযোগ রাখার অদৃশ্য তরঙ্গসূত্র। রম্যাণি ঘরে এসে কর্ডলেস তুলে নিল, টকটক সংখ্যা টিপছে। তুৎ, মোবাইল অফ। কিংশুক কি ও টি-তে আছে? কিংবা লেবাররুম? ও টি লেবাররুমে ঢুকলে কিংশুক মোবাইল অচল রাখে, রম্যাণি জানে। সচরাচর সন্ধেবেলা ছুরিকাঁচি ধরে না কিংশুক, তবে তেমন যদি জরুরি কেস কিছু এসে থাকে….। প্রসববেদনা তো আর সময় মেপে ওঠে না। রম্যাণির নিজের বেলায় কী হয়েছিল? দিব্যি সারাদিন ঘুরল ফিরল, সন্ধেবেলা চাউমিন খেতে খেতে…

হঠাৎই রম্যাণির মুখে রক্তচ্ছটা। আবার কেউ একজন আসছে মনে হয়, শরীর তার ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। এ মাসে দশ তারিখে ডেট ছিল, এখনও পিরিয়ড হল না। মাস দুয়েক হল সে পিল খাওয়াও বন্ধ করেছে, সম্ভবত ঘটেই গেছে ঘটনাটা। কিংশুক এখনও জানে না।

আজ কিংশুককে বলতে হবে। কিংশুকের আর একটা বাচ্চার খুব শখ। একটা মেয়ের। মেয়ে হবে কিনা কে জানে, তবে আজ এই বিশেষ দিনে বিশেষ সংবাদটা রম্যাণি কিংশুককে উপহার হিসেবে দিতেই পারে।

ওদিকের ঘরে জোর হল্লা শুরু হয়েছে। আহারপর্ব চলছে তাতানের। লুচিই দিক আর পরমান্নই, খাবার থালা সামনে ধরল্লেই তাতান পাগলা ঘোড়া হয়ে যায়।

রম্যাণি শ্বশুর শাশুড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। যা ভেবেছে তাই, ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে তাতান, পিছন পিছন লুচি হাতে তাপসী। অতীন খপ করে ধরে ফেলল নাতিকে, পিছলে পালাল তাতান। আলমারির কোণে গিয়ে দুয়ো দিচ্ছে ঠাম্মাকে, জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ছে।

রম্যাণি ধমকে উঠল, কী হচ্ছে কী তাতান? ভদ্র সভ্যর মতো এক জায়গায় দাঁড়াও।

—আহা, বকছিস কেন? অতীন হাঁ হাঁ করে উঠল, তোর ছেলে তো এখন ঠাম্মাকে এক্সারসাইজ করাচ্ছে।

—একদম আর আশকারা দিও না তো। দিন দিন অসভ্যর ধাড়ি হচ্ছে। ছেলেকে ঘেঁটি ধরে এনে খাটে বসাল রম্যাণি। শাশুড়ির হাত থেকে লুচি নিয়ে ঠেসে দিল ছেলের মুখে। তাতান মাকে ভয়ই পায়, বাধ্য মুখে লুচি চিবোচ্ছে কচকচ। করুণ চোখে ঠাকুমার কাছে জল চাইল।

রম্যাণি চোখ পাকাল, না। এখন জল পাবে না। আগে মুখেরটা শেষ করো।

—অ্যাই, তুই যা তো। তাপসী নাতির মুখে গ্লাস ধরেছে, আমার কাছে ও ঠিক খেয়ে নেবে।

রম্যাণি নড়ল না। কোমরে হাত রেখে জরিপ করছে তাতানকে। ততানও দেখছে মাকে, চোখাচোখি হলেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে।

অতীন বুঝি নাটকটা উপভোগ করছিল। একটু আগে ফিরেছে পাড়ার ক্লাব থেকে, নাতিতেই মজে ছিল এতক্ষণ, এখনও বাইরের পোশাক বদলানো হয়নি। শাল আলনায় রেখে এন্ডির চাদর গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল, তুই যে একদম রেডি রে! বাবলু ফিরবে কটায়?

—কে জানে! বলেছিল তো সাড়ে সাতটার মধ্যে আসবে।

—তোকে দেখে কী মনে হচ্ছে জানিস? অতীন চোয়াল ছড়িয়ে হাসল, সেজে গুজে রইলাম বসে, বর এল না চোপার দোষে!

রম্যাণি আর গোমড়া থাকতে পারল না। ফিক করে হেসে ফেলেছে, ঠাট্টা কোরো না তো। আমি বলে সেজে গুজে বোর হচ্ছি…!

—সেজে গুজে তোকে কিন্তু বেশ লাগছে আজ।

আশ্চর্য, খানিক আগে নিজের প্রতিবিম্বকে প্রায় এই কথাটাই বলেছিল রম্যাণি। অথচ এখন শ্বশুরের মুখে শুনতে কেমন লজ্জা লাগল। অতীন তাপসী যতই খোলামেলা হোক, তবু তারা শ্বশুর শাশুড়ি, বাবা মা তো নয়।

সুকৌশলে প্রসঙ্গটা চাপা দিল রম্যাণি। খাটে এসে বসল, জানো বাবা, আজ তোমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

—কে বন্ধু?

—ওই যে অমলবাবু না অমরবাবু। তোমার রিটায়ারমেন্টের দিন যিনি তোমার সঙ্গে এসেছিলেন।

—ও, অমর রায়! তাকে তুই পেলি কোথায়?

—বিকেলে আজ বেরোলাম না, তাতানের স্ক্র্যাব বুক কিনতে, তখনই…। ভদ্রলোক আমায় দেখা মাত্র চিনতে পারলেন।

—হুম্, ব্যাটার মেমারিটা খুব শার্প। অতীন সিগারেট দেশলাই বার করল ড্রয়ার থেকে। চেয়ারে বসে বলল, কী বলল অমর?

—জিজ্ঞেস করছিলেন আমরা এখনও এই বাড়িতেই আছি কিনা, তুমি রিটায়ারমেন্টের পর কী করছ, তাস খেলার নেশা বেড়েছে না কমেছে…ব্রিজ কম্পিটিশানে তোমার প্রাইজ পাওয়ার কথাও বলছিলেন।

অতীন মনে মনে কী যেন হিসেব করল, ওরও তো রিটায়ার করে যাওয়ার কথা। আমার থেকে তিন বছরের জুনিয়ার ছিল।

—করেছেন তো। লাস্ট নভেম্বরে। এখন মেয়ের চাকরি নিয়ে খুব আতান্তরে আছেন।

—ও তো অনেক লেটে বিয়ে করেছিল। ওর মেয়ে চাকরির যুগ্যি হয়ে গেল?

—কলেজ সার্ভিস কমিশান থেকে নাকি চাকরি পেয়েছে। তবে পোস্টিং দিয়েছে ধূপগুড়ি।

—ওরেব্বাস, সে তো নর্থ বেঙ্গলে। অতীন সিগারেট ধরাল, তা মেয়ের বিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

—সে কথাও বলছিলেন। কিন্তু মেয়ে নাকি এখন বিয়ে করবে না, চাকরিই করবে। উনি তখন কোন এক নেতাকে যেন ধরতে যাচ্ছিলেন বেলতলায়। যদি কাছাকাছি কোনও কলেজে মেয়ের পোস্টিং ম্যানেজ করা যায়।

—অমর খুব চালাক চতুর। ও ঠিক একটা না একটা চ্যানেল বার করে ফেলবে।

রম্যাণি সরল চোখে তাকাল, এটা কেমন অদ্ভুত, না বাবা? সামান্য একটা চাকরির পোস্টিংও নেতা ছাড়া হবে না!

—যস্মিন দেশে যদাচার। অতীন নির্বিকার, সঠিক লোককে ধরে নিজের কেস থ্রো করতে পারাটাও তো একটা কোয়ালিফিকেশান, না কি?

এ ধরণের কথা রম্যাণির পছন্দ হয় না। সে এ ভাবে ভাবতে শেখেনি। এটা তার গুণ না দোষ, তাও রম্যাণি স্পষ্টভাবে জানে না। তবে এই মুহূর্তে মুখে কিছু বলল না সে। চুপ করে কী যেন ভাবছে।

তাতানের খাওয়া শেষ। তাপসী নাতির মুখ মোছাচ্ছিল, ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, হ্যাঁ রে, বাবলু কখন ফিরবে তো ঠিক নেই, তুই কটা লুচি খাবি? ভেজে দেব?

রম্যাণি গা মোচড়াল, ইচ্ছে করছে না মা।

—সেই কোন দুপুরে খেয়েছিস…বিকেলেও কিছু মুখে তুললি না…

—ভাল্লাগছে না মা। গলার কাছটা কেমন টক টক হয়ে আছে।

—তা হলে বাইরে গিয়ে খাবি কী করে?

রম্যাণি উত্তর দিল না। হাসল আবার। শাশুড়ি ধরেই নিয়েছে দামি হোটেলে ভাল মন্দ খাওয়ার জন্যই আজ বেরোচ্ছে রম্যাণি। তাই ভাবুক। কৌতূহলটা অন্তত নিবৃত্ত হোক।

তাতানকে নিয়ে বসার ঘরে চলে গেছে তাপসী। এখন ঠাম্মা নাতিতে শাল জড়াজড়ি করে বসে টিভি গিলবে। আর কলর কলর চলবে। রম্যাণি কি আর একবার ধরার চেষ্টা করবে কিংশুককে? উঁহু, আর ফোন নয়। আজকের দিনটা কি রম্যাণির একার? কিংশুকের কোনও দায়িত্ব নেই ফেরার?

অতীনের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম।

—কী বাবা?

—বলছিলাম, সর্বাণী কি বিয়ে করবে না বলে পণ করে ফেলেছে?

প্রশ্নটার আকস্মিকতায় রম্যাণি বেশ হকচকিয়ে গেল। এক সময়ে তার দিদির বিয়ের জন্য অনেক চেষ্টা করেছে বাবা মা। চোদ্দো বছর বয়স থেকে সর্বাণীর শরীরে হঠাৎ সাদা চিহ্ন ফুটে উঠতে শুরু করে। শ্বেতী। প্রচুর চিকিৎসা হয়েছে, কিছুতেই কিছু হল না। সাদা দাগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। মুখখানা ভারী ঢলঢলে হওয়া সত্ত্বেও ওই খুঁতের জন্য পাত্রপক্ষ তাকে দেখতেই আসতে চাইত না। যদি বা কেউ এসেছে, তাদের দাবীর ফিরিস্তি শুনে পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যেত সকলের। সেই চোদ্দো বছর বয়স থেকেই মানসিক জটিলতার শিকার সর্বাণী ক্রমশ নিজের ভেতর পুরোপুরি গুটিয়ে নিল নিজেকে। পড়াশুনোয় সে বরাবরই ভাল, এম এ করল, লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে পড়ল, এখন কাঁকুড়গাছির কাছে একটা লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান। পাছে দিদির মনে আঘাত লাগে তাই নিজের বিয়েটাও তিন বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখেছিল রম্যাণি। সর্বাণীর আত্মসম্মানবোধ অতি প্রখর, সে প্রায় জোর করেই রম্যাণিকে বিয়েতে বসিয়েছিল। এখন আর ও বাড়ির কেউই সর্বাণীকে তার বিয়ের কথা বলে না। সে যে আজীবন কুমারী থাকবে এ সিদ্ধান্ত যেন হয়েই গেছে।

রম্যাণি আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ মানে…না মানে…কেন বাবা?

—আজ ক্লাবে তাসের আড্ডায় দ্বিজেন একটি পাত্রের কথা বলছিল। ওরই সম্পর্কিত। শালা। বছর বেয়াল্লিশ বয়স, স্কুলে পড়ায়, খুব উদার মন। পায়ে নাকি সামান্য ডিফেক্ট আছে, তবে সেভাবে বোঝা যায় না।… দ্বিজেন তোর দিদিকে দেখেছে তো, ওই কথাটা তুলল।

নিজের খুঁত আছে বলেই কি খুঁতো মেয়ে বিয়ে করতে চায়?

মনটা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল রম্যাণির।

অতীন প্রশ্ন করল, কী রে, তোর বাবা মা-র সঙ্গে কথা বলব?

—বলতে পারো। রম্যাণি ছোট্ট শ্বাস ফেলল, দিদি রাজি হবে বলে মনে হয় না।

—তুই একটু বোঝা সর্বাণীকে। যদ্দিন বাবা মা মাথার ওপর আছেন, ঠিক আছে। তারপর গোটা জীবনটা একা একা থাকা…। বুড়ো বয়সে মানুষের তো একটা সঙ্গীরও দরকার হয়, না কি?

—হুঁ, তা বটে।

—অত ভাল একটা মেয়ে, কত গুণী, ভাল চাকরি করছে, কী সুন্দর ব্যবহার…আমার ওর জন্য এত খারাপ লাগে। যদি ওর জন্য কিছু একটা করতে পারি…

রম্যাণির বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল। দিদি এই করুণা দেখানোর মনোভাবটাকে সরাসরি অপমানের চেয়েও বেশি অপছন্দ করে। দিদি তো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে, তবু কেন সবাই দিদিকে দয়া করতে চায়?

দিদির প্রতি করুণাটা সূক্ষ্ম অপমান হয়ে রমাণিকেও যেন বিঁধছিল। শুধু সর্বাণীর বোন বলে নয়, মেয়ে হয়ে জন্মানোর সুবাদে সর্বাণীর অপমানে তারও যেন কিছু ভাগ রয়ে গেছে, এ রকমটাই মনে হচ্ছিল রম্যাণির।

একটুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে রম্যাণি নিজের ঘরে চলে এল। আয়নায় ফের দেখছে নিজেকে। বোঝার চেষ্টা করছিল ওই সাদা ছোপগুলো তার মুখমণ্ডলে থাকলে কেমন দেখাত তাকে। কিংশুক কি ভুলেও তার দিকে তাকাত? অথচ সে তো এই রম্যাণিই থাকত, নয় কি?

টেলিফোন। রম্যাণির ক্ষণিক মনখারাপ ছিঁড়ে গেল। লাফিয়ে উঠে তুলেছে হ্যান্ডসেট।

সামান্য অভিমান ভরেই কর্ডলেস অন করেছিল রম্যাণি, ওপ্রান্তে অচেনা স্বর শুনে থমকাল। প্রসাধনচর্চিত মুখ ফ্যাকাসে ক্রমশ। টেলিফোন কেটে যাওয়ার পরও রম্যাণি দাঁড়িয়ে আছে বিমূঢ়। বাইরের ঘরে তাতান খলখল হাসছে, ধ্বনিটা কানে আসছিল রম্যাণির। কানেই আসছিল, মস্তিষ্কে প্রবেশ করছিল না।

ক্ষণ পরে স্খলিত পায়ে রম্যাণি তাপসীদের দরজায়, বাবা, নার্সিংহোম থেকে ফোন এসেছিল।

পুত্রবধূর পাংশু মুখ দেখে বিচলিত হয়েছে অতীন। বিছানায় আধশোওয়া হয়ে খবরের কাগজ খুলেছিল, ধড়মড় উঠে বসেছে। ছুটে এসেছে তাপসীও।

—কী হয়েছে?

—একজন পেশেন্ট মারা গেছে। নার্সিংহোমে ভাঙচুর হচ্ছে। কিংশুককে আটকে রেখেছে লোকজন। হেকল করছে।

—ওমা, সে কী অলুক্ষুণে কথা! কোন নার্সিংহোম? কোথায়?

—এন্টালিতে। মুনলাইট। রম্যাণির গলা বুজে এল, —কী হবে মা?

তাপসীর হতচকিত মুখ অতীনের দিকে। চকিত সংবাদের অভিঘাতে অতীনের বুঝি স্নায়ু বিকল। ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছে।

—কী গো চুপ করে আছ কেন?

অতীন বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ, কিছু তো একটা করতে হয়।

—কী করবে?

—মুনলাইটের নম্বর আছে তোর কাছে? সিচুয়েশানটা আর একবার ভাল করে জেনে নে তো।

—নাম্বার তো আমার কাছে নেই বাবা।

—নেই? তবে ডাইরেক্টরিটা দে।

—আহা, বাবলুর মোবাইলে দ্যাখ না।

—তাই তো। বাবলুকেই তো…। বলতে বলতে অতীন বাইরের ঘরে। ক্রেড্ল থেকে। রিসিভার তুলে নম্বর টিপছে। একটুক্ষণ রিসিভার কানে ধরে হতাশ ভাবে মাথা নাড়ল।

—একটু আগেও অফ ছিল বাবা। আমি চেষ্টা করেছিলাম।

—কী হবে তাহলে?

—কী হবে কী হবে করছ কেন? তাপসী ডুকরে উঠল, নিজে একবার যাও না।

—যাব?…হ্যাঁ, গেলেও হয়। অতীন উদভ্রান্তের মতো শোওয়ার ঘর থেকে পার্স নিয়ে এল। যেন নিজেকেই প্রবোধ দিচ্ছে এমন স্বরে বলল, ঘাবড়িও না তোমরা। আমি দেখছি।

এমন মুহূর্তে বুঝি কারওর ওপরই নির্ভর করতে ভরসা হয় না। রম্যাণিও দৌড়ে ব্যাগ নিয়ে এসেছে, আমিও যাব বাবা।

—তুই…? গণ্ডগোলের মধ্যে…?

—কিছু হবে না বাবা। ঘরে থাকলে আরও টেনশান হবে।

গায়ে একটা শালও জড়াল না রম্যাণি। তাপসীর হতবিহ্বল চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। পিছন পিছন অতীন। গলি পেরিয়ে বাসরাস্তায় পৌঁছনোর আগে ট্যাক্সি পেয়ে গেল। সবে সাড়ে আটটা বাজে, ভবানীপুর শীত মেখেও এখনও জমজমাট। রাস্তায় টুকরো টুকরো জ্যাম। ফুটপাথে স্টলবিহীন হকাররা পশরা সাজিয়ে বসেছে, বেচাকেনা চলছে দিব্যি।।

রম্যাণি কিছুই দেখছিল না। চোরা উদ্বেগে ধকধক কাঁপছে হৃৎপিণ্ড, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অতীন ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়েছে, দেশলাই ঠুকছে, কাঠি জ্বলছে না। অনেক কষ্টে ধরাল।

ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞেস করল, কখন হয়েছে ও সব, কিছু বলল?

দুদিকে মাথা নাড়ল রম্যাণী।

—বাবলুকে আটকে রেখেছে মানে কী? অ্যাসল্ট ফ্যাসল্ট করেছে?

—জানি না বাবা। বুঝতে পারলাম না।

—পেশেন্টটা কি বাবলুরই ছিল?

—বোধহয়। নইলে ওকে কেন…

—তাও তো বটে। অতীন ক্ষণকাল চুপ, পুলিশে খবর দেয়নি?

—দিয়েছে নিশ্চয়ই।

—তারা কী করছে? বাবলুকে রেসকিউ করেনি?

রম্যানি উত্তর খুঁজে পেল না।

অতীন নিজের মনে গজগজ করে চলেছে, কী দেশ! ডাক্তারদের কোনও সিকিউরিটি নেই? একটা নোবল প্রফেশানের লোককে হুলিগানরা হ্যারাস করবে…! যাদের জন্য ছেলেটা সারাদিন মুখের রক্ত তুলে খাটে, তারাই যদি এমন অ্যারোগ্যান্ট হয়…!

অতীন যেন বড্ড বেশি কথা বলছে। রম্যাণির ভাল লাগছিল না। আবার শ্বশুরমশাই ক্ষণিক নীরব হলেও ধাক্কা লাগছে বুকে। মাগো, পথ কেন যে ফুরোয় না!

রম্যাণি দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। একুশে জানুয়ারি এমন ঘটনাও ঘটল!

তিন

ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে মার গলা শুনতে পেল কিংশুক, এই বাবলু… বাবলু? উঠবি না?

শীতকালে কিংশুক আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শোয়। কম্বল সরিয়ে জড়ানো গলায় বলল, কেন, কটা বাজে?

—পৌনে আটটা।

—সেকি! আগে ডাকোনি কেন? কিংশুক ধড়মড়িয়ে উঠে বসল, রুমি কোথায়?

—তাতানকে স্কুলে দিতে গেছে। এই ফিরল বলে। ধূমায়িত চায়ের কাপ ছেলেকে এগিয়ে দিল তাপসী, নে, জুড়িয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নে।

—কোনও মানে হয়? কিংশুক গজগজ করে উঠল, রুমিকে কতবার বলেছি ঠাণ্ডার দিনে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে কষ্ট হয়, একটু আগে আগে তুলে দিতে…

—কাল তোর শুতে অনেক রাত হল তো। তার ওপর অমন একটা ঝড় গেল…তাই হয়তো ও ভেবেছ…

—কী ভেবেছে? সারাদিন বিছানায় গড়াব? কিংশুক সামান্য খেঁকিয়ে উঠল, সাড়ে নটায় একটা ও-টি আছে…

—আজ তুই অপারেশন করবি? একটা দিন জিরিয়ে নিলে হত না?

—আশ্চর্য! জিরোলে চলবে? পেশেন্ট ভর্তি হয়ে গেছে, ও টি বুক করা আছে…

কথাগুলো বেশ জোরের সঙ্গে বলছিল বটে কিংশুক, ভেতরে ভেতরে কেমন গুটিয়েও যাচ্ছিল। আজ ছুরিকাঁচি না ধরতে পারলেই বোধহয় ভাল হত। মাথা অসহ্য ভারী হয়ে আছে, শরীর জুড়ে কী ক্লান্তি। এখনও কানে ঝনঝন বাজছে কালকের খিস্তিগুলো, চোখের পাতায় লেগে আছে ভয়ঙ্কর ছবিটা। মেয়েটার দাদা আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে এল, কলার চেপে ধরেছে, নার্সিংহোমের কেউ ছাড়াতে পারছে না…!

তবু যেতে হবে। একটা দুর্ঘটনা জীবনের ছন্দ বদলে দিতে পারে না।

তাপসী দাঁড়িয়েই আছে। চায়ের কাপের জন্য অপেক্ষা করছে কি?

ভুরু কুঁচকে মাকে দেখল কিংশুক। এই সব বিরস মুহূর্তে কেউ মুখের সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলে এত অস্বস্তি হয়!

তাপসী ভার মুখে বলল, সে তুই যা ভাল বুঝিস কর। মার মন মানে না, তাই বলছিলাম…। তবে…

—কী তবে?

—তোর কিন্তু কাল রুমির ওপর অত মেজাজ করাটা ঠিক হয়নি।

আবার সেই প্রসঙ্গ। শুধু রম্যাণি কেন, মা বাবা কার ওপর না কিংশুক চোটপাট করেছে কাল! কার ওপর সে রেগে ছিল? ওই মারমুখো লোকগুলোর? না নিজেরই ওপর? কিংশুক এখনও বুঝতে পারছে না।

বিছানা ছেড়ে গায়ে পাঞ্জাবি চড়াল কিংশুক। গম্ভীর গলায় বলল, এখনও বলছি মা, রুমিদের কাল ওখানে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না।

—ফের ওই কথা? তাপসীর স্বর আহত, তোর বিপদের খবর পেয়ে বাড়ির লোক হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে?

—খবর দেওয়া হয়েছিল যাতে তোমরা চিন্তা না করো। দল বেঁধে রেসকিউ পার্টি সাজার জন্য নয়।

—কতটা বিপদ বুঝব কী করে? তোর বিপদ শুনে…

—কাল থেকে কী বিপদ বিপদ করছ? বাথরুমের দিকে এগোতে গিয়েও কিংশুক ঘুরে দাঁড়াল। রুক্ষ্ম স্বরে বলল, কীসের বিপদ মা? কী করে বোঝাই তোমাদের, কালকের ইন্সিডেন্টটা সিম্পলি আমার প্রফেশনাল হ্যাজার্ড। এবং আমিই কমপিটেন্ট এনাফ টু ট্যাকল ইট। শুনেছ তো বাবার মুখে, পুলিশ কী ভাবে দুটো বজ্জাতকে ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে গেছে! দেখতেও পেয়েছ, আমি অক্ষত আছি। এবং আজকেও বেরোব, রুগি দেখব, অপারেশন করব, অ্যাবসোলিউটলি নরমাল লাইফ লিড করব।

—তোর বাপু অনেক মনের জোর আছে।… কিন্তু রুমির কথাটাও তো ভাববি। সন্ধে থেকে বেচারা সেজেগুজে বসে…

—তো?

—এখনও মুখ চুন হয়ে আছে বেচারার…। তুই একটু ভাল করে মিষ্টি করে বুঝিয়ে বল না। আমায় যে ভাবে বলছিস।

এটাই মার বদভ্যাস। কোথায় থামতে হয় জানে না। রুমি নিশ্চই মাকে বলেনি, মা তুমি ছেলেকে বলে আমার মানভঞ্জনের ব্যবস্থা করে দাও! স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের প্রাইভেসিটাও মা মানতে চায় না। তবে রুমিরও এটা বড্ড বাড়াবাড়ি। কালকের দিনটা গুবলেট হওয়ার জন্য কিংশুকেরও কি কম খারাপ লেগেছে? অন্তত তেত্রিশ বার সরি বলেছে বিছানায়। তার ওপর রুমি এমন আচরণ করবে কেন যা মা বাবার চোখে লাগে?

তাপসীকে আর আমল না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল কিংশুক। গিজার অন করে ব্রাশে পেস্ট লাগাল, জোরে জোরে দাঁত ঘষছে। মুখে যাই বলুক, সত্যি তো আজকের দিনটা অন্য দিনের মতো নয়। আজ অপারেশানের জন্য প্রচুর মনঃসংযোগ করতে হবে। যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। ওভার। দূর ছাই, মাথাটা ছাড়ে না কেন? ইশ, মেয়েটা মরেই গেল! কিংশুকেরই ভুলে কি? অবহেলায়? সিজারিয়ান সার্জারিতে তার এখন যথেষ্ট পাকা হাত, এমনটা তার আগে কখনও ঘটেছে? ন বছরে কজন ডেলিভারি কেসে মারা গেছে তার হাতে? একজন। সাকুল্যে এক। সেই রঘুনাথপুরে। অবশ্য সেটা সিজারিয়ান ছিল না, নরমাল ডেলিভারি। প্রসবের পর অ্যামনিওটিক ফ্লুয়েড এমবলিজমে মা-টা…। ওই ধ্যাড়ধেড়ে গ্রামে, নাম-কা-ওয়াস্তে হেলথ সেন্টারে ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার কিংশুক গুহর কী-ই বা করার ছিল সেদিন? কিন্তু এখানে…? ছি ছি কিংশুক, বার বার খবর পেয়েও ব্যক্তিগত কাজ ফেলে তুমি এলে না! তুমি বলবে, আসতে পারলে না। ঠিক আছে, নয় তাই হল, ইট মেকস নো ডিফারেন্স। ভালো ভাবো, ঘণ্টাখানেক আগে পৌঁছলেও হয়তো মেয়েটা…

কিংশুক জোরে জোরে জলের ঝাপটা দিল মুখে। জল মোটামুটি উষ্ণ হয়ে গেছে, খানিকটা টাটকা লাগল নিজেকে। আয়নায় দেখছে মুখ। অপরাধী অপরাধী লাগছে কি? কীসের অপরাধ? গালে শেভিং ক্রিম বুলিয়ে রেজার টানল কিংশুক। অপারেশনের পর সিল ঠিক ঠিকই হয়েছিল, তার পরও যদি কারওর লিগেচার ছিঁড়ে যায় কিংশুক তার জন্য দায়ি হবে কেন! শরীর কী, অ্যাঁ? যন্ত্র যন্ত্র। কিংশুক তো নেহাতই মিস্ত্রি। হাজারটা মেশিন মেরামতির কাজে এক-আধটা গড়বড় তো হতেই পারে। আগের ফ্রিজটা সারাতে এসে ব্যাটা মেকানিক কমপ্রেশারটাকে একেবারে ড্যামেজ করে দিয়ে গেল, ওই ফ্রিজ কিংশুকদের ফেলে দিতে হয়নি? মেকানিক কী বলল? কমপ্রেশারের লাইফ শেষ বাবু, ও তো যাবেই। মেয়েটারও যদ্দিন আয়ু ছিল তদ্দিনই তো সে বাঁচবে! কাল ওই মেয়ে মরতই। কিংশুক যথাসময়ে এসে পেট ওপেন করলেও মরত। বিধিলিপি। লিগেচার খুলে গিয়ে প্রাইমারি হেমারেজের কেস আজকাল লাখে একটা ঘটে কিনা সন্দেহ। চান্স ফ্যাক্টরে মেয়েটারই কপাল মন্দ বেরোল। ভগবান তাকে টেনে নিয়েছেন, কিংশুক তো নিমিত্ত মাত্র।

মনে মনে অসার যুক্তিগুলো সাজিয়ে মোটামুটি সমে ফিরেছে কিংশুক। অন্যদিন বাথরুমের কাজ সেরে একটুক্ষণের জন্য বেরোয়, চোখ বোলায় খবরের কাগজে। আজ সময় নেই, সরাসরি স্নান। জোরে শাওয়ার খুলে দিল। ঈষৎ তপ্ত জলকণারা তরতাজা করে দিচ্ছে রোমকূপ। সাবানের ফেনায় মুছে যাচ্ছে ক্লেদ গ্লানি।

তবু একটা চোরা খচখচানি যেন থেকেই যায়। মাত্র একুশ-বাইশ বছর বয়স মেয়েটার। বাচ্চাটাও বেশ হেলদি হয়েছে, প্রায় তিন কেজি, অভাগা জন্মেই মাতৃহারা হল।

বাথরুমের বাইরে এসে কিংশুক টের পেল বাড়িটা হঠাৎ অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ। বাবা এ সময়ে টিভিতে বিভিন্ন খবরের চ্যানেল ধরে, মা অবিরাম শান্তির মার সঙ্গে বকবক করে যায়, আজ সবাই যেন বড় বেশি চুপচাপ। বাড়িতে কি ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে কিংশুক?

নাহ্, নিজের ওপর রাগটা অন্যের ওপর ফলানোর কোনও অর্থই হয় না। রম্যাণি কোনও ঝামেলায় পড়েছে শুনলে কিংশুক কি পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকত? মা বাবারও উতলা হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। যতই সে প্রাপ্তবয়স্ক হোক, সন্তান তো।

রম্যাণি ফিরে এসেছে। বিছানা তুলছিল। কিংশুক আড়চোখে একবার দেখল রম্যাণিকে। আয়নায় চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, কী গো গোবিন্দর মা, আমার ব্রেকফাস্ট কদ্দূর?

রম্যাণি ঘাড় ফেরাল। নিষ্প্রাণ স্বরে বলল, আমাকে বলছ?

—ঘরে আর কেউ আছে নাকি? কিংশুক মুচকি হাসল, যা গাল ফুলিয়েছ, তোমাকে তো গোবিন্দর মা ছাড়া আর কিছু বলা যাচ্ছে না।

রম্যাণির ঠোঁটের কোণে সরু হাসির রেখা ফুটল। ফুটল কি? নাকি কিংশুকের মনে হল?

কিংশুক লঘু স্বরে বলল, গুসসা থুক দো ডার্লিং।

—আমি তো রেগে নেই। রম্যাণির স্বর প্রায় স্বাভাবিক। একটা একটা করে বালিশ বক্সখাটের অন্দরে চালান করছে, রাগ তো দেখাচ্ছিলে তুমি।

—সে তো বলবেই। কিংশুক গায়ে সোয়েটার গলাল। ছদ্ম অভিমানের সুরে বলল, কাল আমার মনের অবস্থা কী ছিল সেটা তো কারওর বোঝার দরকার নেই। কেন রাগ, কেন বকাঝকা, বোঝো?… কাল একে ওই টেনশান চলছে, তার মধ্যে তোমরা..। অ্যাংরি মব যদি তোমাদের অ্যাটাক করত? তোমার যদি কিছু একটা হয়ে যেত, কিংবা বাবার?…বলিহারি যাই, ওই সিচুয়েশানে তুমি মেয়েটার ডেডবডি দেখতে ছুটলে?

তাপসী ভেতরবারান্দা থেকে ডাকছে, বাবলু…তোর খাবার দেওয়া হয়েছে।

—যাই। গলা উঠিয়েই গলা নামাল কিংশুক, কথাগুলো ভেবো। সারাদিন ধরে ভেবো।

অতীনও খাবার টেবিলে। সামনে খবরের কাগজের তাড়া। বড় প্লেটে চিকেন স্যান্ডুইচ সাজিয়ে দিয়েছে তাপসী, চিবোতে চিবোতে গভীর মনোযোগে কাগজ পড়ছে।

কিংশুক এসেও কী ভেবে ঘরে ফিরে গেল। হ্যান্ডসেটে নম্বর টিপছে টকাটক।

—হ্যালো? কিওর অ্যান্ড কেয়ার?

—বলছি। ওপারে বামাকণ্ঠ। রিসেপশনিস্ট এত তাড়াতাড়ি আসেনি, সম্ভবত সিস্টার বা মেট্রন।

—আমি ডক্টর গুহ বলছি।

—গুড মর্নিং স্যার।

—আমার আজ একটা অপারেশান আছে। সাড়ে নটায়।

—হ্যাঁ স্যার। আপনার পেশেন্ট তৈরি।

—আমার যেতে মিনিট পনেরোটাক দেরি হতে পারে, কি আধঘণ্টা। সেই মতো ও টি রেডি রাখুন।

—সব রেডি স্যার। আপনি এলেই…

—ও কে।

মনটাকে আরও প্রস্তুত করার জন্য খাবার টেবিলে এসে হই হই করে উঠল কিংশুক, কী ব্যাপার বাবা? আজ খবরের কাগজের পাহাড় কেন?

অতীন যেন সামান্য অপ্রতিভ, না দেখছিলাম… তোদের নিউজটা কোথাও বেরিয়েছে কিনা।

পলকের জন্য থমকে কিংশুক নিজেকে সামলে নিল, হ্যাহ্‌, ওইটুক একটা মাইনর ইনসিডেন্ট…নিউজপেপারঅলাদের কি খবরের আকাল পড়েছে! ক্রিকেট বেটিং আছে, পলিটিক্স আছে, টেররিস্ট আছে…

—না রে বাবলু, একটা বাংলা কাগজে দিয়েছে।

—ইজ ইট? ..কী বলছে?

—এই তো, দ্যাখ না।

কিংশুক ভুরু কুঁচকে খবরটা পড়ল। ছোট্ট খবর, ফিলারের মতো।…নার্সিংহোমে ভাঙচুর।… বুধবার সন্ধ্যায় এক রোগিণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কিছু লোক এন্টালি এলাকার একটি নার্সিংহোমে হামলা চালায়।…ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি… পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে…

কাগজটা সরিয়ে রাখল কিংশুক। মিস্টার লালের হাত যথেষ্ট লম্বা, তাও খবরটা পুরোপুরি চেপে দিতে পারেনি। তবু মন্দের ভাল, নাম ধাম কিছু বেরোয়নি।

অতীনের কপালে চিন্তার ভাঁজ, হ্যাঁ রে, তোকে আর নতুন করে কোনও ঝামেলায় পড়তে হবে না তো?

—কীসের ঝামেলা?

—কাগজে খবর হয়ে গেল তো।

চিকেন স্যানডুইচে কামড় বসাল কিংশুষ্ক। হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা, তোমরা ভাবছটা কী বলো তো? আমি কি মেয়েটাকে খুন করেছি?

—না না, তা বলছি না। কিন্তু..কাল ওরা তোকে যেভাবে শাসাচ্ছিল…

—ছাড়ো তো। অপারেশানের আগে ওরা বন্ড সই করে দেয়নি? সার্জারিতে কোনও সময়ে যে কোনও রকম জটিলতা অ্যারাইজ করতে পারে। পারে, কি না? কিংশুক একটু বেশি জোরের সঙ্গে বলল কথাটা। হয়তো ভেতরে ততটা জোর পাচ্ছিল না বলেই।

—ঠিক ঠিক। অপারেশানের আগে তো বন্ড সই করতেই হয়। অতীন মাথা দোলাচ্ছে, তাহলে তোকে আর ওরা অ্যাকিউজ করতে পারছে না।

—প্রশ্নই আসে না। কিংশুক একটা সিঙাপুরি কলা হাতে তুলে নিল। খোসা ছাড়াচ্ছে। আর একটু তেজ আনল গলায়, পেশেন্ট মরলেই ডাক্তারদের দোষ, অতএব ডাক্তারকে ধরে ঠ্যাঙাও, এই অ্যাটিচিউডটাই হাইলি আনএথিকাল।

—কোনটা এথিকাল হচ্ছে আজকাল? কারুর এতটুকু ধৈর্য নেই, কেউ যুক্তি মেনে চলে না, কথায় কথায় শুধু ভাঙো ভাঙো ভেঙে ফ্যালো। অতীন তাপসীর দিকে ফিরল, তুমি না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না… নার্সিংহোমটার কী দশাই করেছে! কাচ ভেঙে খানখান, টেবিল আছড়েছে, চেয়ার আছড়েছে, রিসেপশনিস্টের বসার জায়গাটা পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কত টাকার যে লস হল!

—যতটা ভাবছ ততটা অবশ্য কিছু হবে না। কিংশুক চোখ টিপল, মিস্টার লাল যথেষ্ট শাহেনশাহ লোক। ড্যামেজ যদি হয় পঞ্চাশ হাজারের, ক্লেম তুলে নেবে এক লাখ। সুদে আসলে লস উশুল করে নেবে।

তাপসী দুধে চিনি গুলছিল। ছোটবেলা থেকে সকালে দুধ খাওয়ার অভ্যেসটা ছেলেকে তৈরি করে দিয়েছে। চামচে করে এক ফোঁটা দুধ হাতের চেটোয় নিয়ে জিভে ছোঁওয়াল তাপসী, পরখ করে দেখে নিল মিষ্টি ঠিক হয়েছে কিনা।

সন্তুষ্ট হয়ে আপন মনে ঘাড় নাড়ছে। কিংশুকের সামনে গ্লাস রেখে বলল, হ্যাঁ হ্যা, মালিকদের কথা ভাবতে হবে না। ওদের সব ম্যানেজ হয়ে যায়।

—হয়। তবে ভোগান্তিও থাকে। অতীন বিজ্ঞের মতো বলল, মনে আছে, আমাদের ফ্যাক্টরিতে সেবার আগুন লেগেছিল? শেড পুড়ে গেল? দেখেছি তো, ব্যাটারা কেমন চারে খেলায়। সেই শেষপর্যন্ত মাথা মুড়োবে, তার আগে এই খোঁচা, ওই খোঁচা…। গোটা কেসটা তো আমিই হ্যান্ডল করেছিলাম।

মনে মনে না হেসে পারল না কিংশুক। বাবা এক অতি নগণ্য চাকরি করত। গৌরবে যাকে বলা যায় সওদাগরি অফিসের মধ্যম কেরানি। পার্টিদের বিল ভাউচার পেমেন্ট অনেক কিছুই বাবার হাত দিয়ে আনাগোনা করার সুবাদে কিছু প্রাপ্তিযোগ বাবার লেগেই থাকত। ওটা না থাকলে কিংশুকের ডাক্তারি পড়ার খরচ জোগানো কি সহজ ছিল! এখন ছেলে মোটামুটি সফল ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর বাবা নিজের চাকরির পদটাকেও খানিকটা ওপর দিকে নিয়ে গিয়ে তৃপ্তি পায়। বোঝাতে চায় কোম্পানিতে অতীন গুহ একেবারে অকিঞ্চিৎকর নাটবল্টু ছিল না। কমপ্লেক্স? তাই হবে। ছেলের তুলনায় নিজেকে অতি ক্ষুদ্র ভাবতে সব বাবার ভাল নাও লাগতে পারে।

ভেতরের হাসিটা বাইরে টেনে এনে ঠোঁটে ধরে রাখল কিংশুক। মজা করার ঢঙে বলল, ইনশিওরেন্সের লোকদের দোষ কী বাবা? তারাও তো নিজেদের বাঁচিয়ে চলবে। আফটারঅল চাকরি করেই তো খেতে হয়, না কি?

রম্যাণি অনেকক্ষণ টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় ভাবলেশহীন মুখে। হঠাৎ বলে উঠল, একটা ক্ষতি কিন্তু নার্সিংহোমের হয়েই গেল।

তাপসী চোখ ঘোরাল, কী ক্ষতি?

—গুডউইল। এত ভাঙচুর হলে সুনামের হানি হবে না?

কিংশুক হা হা হেসে উঠল, নাহ্‌, তুমি এখনও বড্ড বেশি সরল আছ রুমি। সুনাম বদনামের কী আছে? কোন নার্সিংহোমে এরকম এক-আধটা ঝঞ্ঝাট হয় না? তা ছাড়া পাবলিক মেমারি খুব শর্ট, দেশে পেশেন্টেরও অভাব নেই, কেউ কিস্যু মনে রাখবে না।

রম্যাণি চোখ পিটপিট করছে। কথাটা বুঝি পুরোপুরি হজম করতে পারেনি।

মোবাইল ফোন বেজে উঠল। আশা নার্সিংহোম। কাল তালেগোলে যাওয়াই হয়নি, মেট্রন জানতে চাইছে আজ সে কখন আসবে, পেশেন্টের বাড়ির লোকদের তার সঙ্গে কী যেন জরুরি দরকার। আন্দাজ মতো একটা সময় বাতলে দিয়ে ঘরে এল কিংশুক। ব্রিফকেস গোছাচ্ছে। ফ্ল্যাটের এগ্রিমেন্টখানা বাক্সবন্দিই পড়ে আছে, নিয়ে তুলে রাখল আলমারির কাবার্ডে। কাল তো রম্যাণিকে বলাই হয়নি। এখন ডেকে জানিয়ে দেবে? থাক, এখন বেরোনোর তাড়া আছে।

শ্যু পরছে কিংশুক, তাপসীর আবির্ভাব। গলা নামিয়ে বলল, সাবধানে যাস।

—হুঁ

—দুপুরে আজ ফিরবি?

—দেখি। সাড়ে তিনটে-চারটে নাগাদ এলেও আসতে পারি। আবার ছটায় বেরোতে হবে।

তাপসী আর একটু গলা নামিয়ে বলল, আজ এন্টালির দিকে আর যাস না।

কিংশুক হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল, আচ্ছা বাবা আচ্ছা, যাব না।

তাপসী আঁচলে হাত মুছছে। চেটোয় ঘষছে বুড়ো আঙুল।

কিংশুকের চোখ সরু—আরও কিছু বলবে মনে হচ্ছে?

—হ্যাঁ।…মানে…

—ঝটপট বলো। ঝটপট। নটা বেজে গেছে।

—এই রোববার কি তুই কোথাও বেরোবি?

—কেন?

—তোর গাড়িটা একটু দরকার ছিল যে। সকালবেলা। আটটা-নটায়। দুপুর দুপুরই ফিরে আসব।… মেজদি আদ্যাপীঠ যাওয়ার জন্য খুব ধরেছে। ট্যাক্সিতেই যাবে বলছিল, তা আমি বললাম…

—অর্থাৎ কথা দিয়েই ফেলেছ।

—না না, তোর যদি অসুবিধে থাকে…

গাড়ি কেনার পর থেকে মা বাপেরবাড়ি শ্বশুরবাড়ির লোকদের যেচে মিনি ভ্রমণসুখ উপভোগ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রদর্শনকামিতা? খুবই সম্ভব। মার চিরকালই একটু ছেলেকে জাহির করার স্বভাব আছে। ছেলের সূত্রে নিজের মহিমাও তো বাড়ে!

এই মুহূর্তে মা একটা আলটপকা প্রসঙ্গ তোলায় কিংশুক অবশ্য বেশ স্বচ্ছন্দই বোধ করল। কাজে বেরোনোর আগে যেন এমনই একটা পরিবেশ হালকা করা কথা খুঁজছিল কিংশুষ্ক।

হেসে বলল, দুপুর কেন, হোল ডে ঘোরো। এ রোববারটা আমি পড়ে পড়ে ঘুমোব। তবে হ্যাঁ, গোপালকে আজ-কালের মধ্যে খবর দিয়ে দিও, নইলে ও হয়তো ট্যাক্সি চালাতে বেরিয়ে যাবে।

গেটের কাছে গিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকাল কিংশুক। বুঝি রম্যাণিকে খুঁজল একটু। নেই।

বাথরুম টাথরুমে ঢুকেছে কি? নাকি অভিমান?

নাহ্, রুমি এখনও বড় ছেলেমানুষ।

শীতের সন্ধ্যা গাঢ় হয়েছে অনেকক্ষণ। শহরে এখন হ্যালোজেনের রোশনাই, মোড়ে মোড়ে ভোগ্যপণ্যের চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপন। দিনভর আজ আকাশে মেঘ ছিল অল্প অল্প। আজও হাওয়া বইছে বটে, তবে কালকের চেয়ে কম। ঠাণ্ডাটা বুঝি একটু কমতির দিকে। এবার হয়তো দু-একদিন ছিটেফোঁটা ঝরবে, তারপরই বোধহয় পাততাড়ি গোটাবে শীত।

হাজরা মোড়ে এসে ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়াল কিংশুক। ঘড়ি দেখল। আটটা বাজতে দশ। বাড়ি ফিরে রম্যাণিকে নিয়ে একটু বেরিয়ে পড়াই যায়। মিন্টো পার্কের কাছে একটা চাইনিজ রেস্তোঁরা হয়েছে, পূর্ণেন্দু বলছিল ওখানকার খাবার নাকি দারুণ, রুমিকে আজ তার প্রিয় চাইনিজ খানা খাইয়ে দেওয়াই ভাল। তাতানকেও নিয়ে যাবে? উঁহু, এটা তো কালকের ক্ষতিপূরণ। আজকের দিনটাকেই একুশে জানুয়ারি ভাবতে ক্ষতি কি!

কিংশুকের মন এখন আশ্চর্য রকমের নির্ভার। আজ একটা নয়, দু-দুটো সফল অপারেশান করেছে কিংশুক। দ্বিতীয়টা অবশ্য হিসেবে ছিল না। দুপুরে যাদবপুর মেডিকেল সেন্টারে রুগি দেখছিল, দুম করে জুপিটার থেকে খবর এল তার এক রোগিণীর প্রসববেদনা উঠেছে, ভর্তি হয়েছে নার্সিংহোমে। চটপট চেম্বার সেরে ছুটল জুপিটার। গিয়ে দেখল পেইন থেমে গেছে, কিন্তু বেশ প্যাঁচ খেয়ে গেছে কেসটা। জরায়ুর ঝিল্লি ছিঁড়ে গেছে, গর্ভের তরল বেরিয়ে গেছে অনেকটা। কিংশুক ঝুঁকি নিতে পারল না, সিজার করে দিল সঙ্গে সঙ্গে। একেবারে নিখুঁত অপারেশান। সকালে রুটিন সিজারিয়ান সার্জারিটা করেও তার এতটা তৃপ্তি হয়নি। মাতৃজঠর থেকে নতুন একটা প্রাণকে ধরণীতে এনে সে যখন হাত টাত ধুয়ে নীচের চেম্বারে এসে বসেছিল, তখন কালকের দুর্ঘটনার আর লেশমাত্র নেই মনে।

তবে নিজের কাছে নিজে মিথ্যে বলবে না কিংশুক, সকালে প্রথম অপারেশানটার আগে সে সত্যিই ভেতরে ভেতরে বেশ জড়তা অনুভব করছিল। অবশ্য ছুরি কাঁচি হাতে তুলে নিতেই সে একদম বদলে গেল। অভিজ্ঞতা আর অভ্যেসের মিশেলে হয়ে গেল কাজটা, তাকে তেমন ভাবনাচিন্তা করতে হল না। আর বিকেলের অপারেশানে তো শরীর মন মস্তিষ্ক সব যেন এক ছন্দে বাজছিল, অর্কেস্ট্রার মতো।

এখন কিংশুক অনুভব করছে কালকের সন্ধেটা শুধুই দুঃস্বপ্ন ছিল। এ ব্যাড ড্রিম। এ ব্যাড ড্রিম। এ ব্যাড ড্রিম।।

শুধু একটা কথা ভেবেই খারাপ লাগছে। মুনলাইটের খবরটা বেশ চাউর হয়ে গেছে চারদিকে। কী করে যে এত তাড়াতাড়ি সংবাদ ছড়ায়! বোধহয় তথ্যপ্রযুক্তির যুগ বলেই। লোকজনের কৌতূহলও আছে বটে, জনে জনে এসে খুঁচিয়ে যাচ্ছে, জরিপ করে নিচ্ছে কিংশুককে। এই তো খানিক আগে ব্যাচমেট দীপমাল্যর সঙ্গে দেখা, আশা নার্সিংহোমে। সে তো রীতিমতো গার্জেনি সুরে পিঠ চাপড়ে দিল! বাকআপ ম্যান, কিপ ইট আপ! এরকম দু-চার বার ছড়ে না গেলে তুই তো অ্যাডাল্টই হবি না রে!

হুঁহ্‌, ব্যাটা ভেবেছে কিংশুক ঘাবড়ে গেছে! ছোঃ।

সবুজ বাতি জ্বলেছে। মোড় ঘুরল কিংশুক। কাছেই একটা ফুলের দোকান, নতুন খুলেছে। কী ভেবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দোকানটায় ঢুকল কিংশুক, সুন্দর দেখে একটা বোকে কিনল, আর এক গোছা গোলাপ। এটাও একুশে জানুয়ারির ক্ষতিপূরণ, গোলাপফুল রুমির ভীষণ প্রিয়।

বাইরের ঘরেই ছিল রম্যাণি। শাল মুড়ি দিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখছিল। পাশের ঘরে তাতান আর তাপসীর গলা, লুডো খেলছে নাতি ঠাকুমা। অতীন এখনও ব্রিজের আসর থেকে ফেরেনি।

বাড়ি ঢুকেই কিংশুক বিদেশি কায়দায় বাও করল। রমাণিকে ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল,—উইথ লাভ ম্যাডাম।

রম্যাণি বুঝি টিভিতে একটু বেশিই মগ্ন ছিল। তার মুখে এখনও যেন একটা ম্লান ছায়ার আভাস। ফুল দেখেই বুঝি তার চোখে উজ্জ্বলতা ফিরে এল। সামান্য উচ্ছল স্বরে বলল, ও মা, আজ এত ফুল কেন?

—এ ফুল নয় রুমি, আমার হৃদয়।

—দোকান থেকে কিনে নিয়ে এলে?

—হৃদয় তো কমোডিটিই রুমি।

—বটে! রম্যাণি ভ্রূভঙ্গি করল, প্রাণে দেখি আজ খুব পুলক, অ্যাঁ?

—আরও বাড়বে। চলো, তৈরি হয়ে নাও। বেরোব।

—কোথায়?

—বেরোলেই দেখতে পাবে। হারি আপ, হারি আপ।

একটুক্ষণ কিংশুককে স্থির চোখে দেখল রম্যাণি। কী বুঝল কে জানে, তোড়া থেকে কয়েকটা ফুল বাইরের ঘরের ফুলদানিতে রেখে বাকিটুকু নিয়ে চলে গেল শোওয়ার ঘরে।

তাতান বাবার গলা পেয়ে ছুটে এসেছে। বাপ ছেলেতে খুনসুটি হল খানিক। ও ঘর থেকে ঠাকুমা ঘন ঘন ডাক দিচ্ছে খেলার জন্যে, লাফাতে লাফাতে ফিরে গেল তাতান, ছাগলছানার মতো।

কিংশুকও শোওয়ার ঘরে এসেছে। অপাঙ্গে স্ত্রীকে দেখল, ব্লাউজ বদলাচ্ছে রম্যাণি। রম্যাণির শরীরের বেশিটাই আবৃত, শুধু কোমর আর পিঠের কিছুটা অংশ দেখা যায়। এটুকুতেই যেন সামান্য কাম অনুভব করল কিংশুক। আশ্চর্য, সারাদিন খেটেখুটে আসছে, পেশাগত কারণে নারীদেহ তার কাছে জলভাত, রম্যাণিরও প্রতিটি রোমকূপ তার চেনা, তবু এই বিশেষ শরীরটা কেন যে তাকে এত টানে!

—তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম। রম্যাণি ওয়ার্ড্রোব খুলে শাডি বার করছে, কাল তোমার যা মেজাজের বহর ছিল, তোমার সঙ্গে কথাই বলা গেল না!

—এখন বল। কিংশুক খাটে বসল।

—কাল ওই লোকগুলো চেঁচাচ্ছিল তোমায় নাকি চারটে থেকে কল দেওয়া হয়েছে, আর তুমি পৌঁছেছ সাতটারও পর…। ছিলে কোথায়?

—ছিলাম সামহোয়্যার। শুনলে তুমি লাফিয়ে উঠবে।

—কোথায়?

—রয় অ্যান্ড রয়ে গেছিলাম। ফ্ল্যাট কেনার এগ্রিমেন্ট হয়ে গেল…ওই গলফ গার্ডেনের…যে কনস্ট্রাকশানটা তুমি দেখেছিলে…তোমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল প্ল্যানটা…

—তাই? রম্যাণির চোখ ঈষৎ বিস্ফারিত।

—ইয়েস। করকরে চার লাখ কাল দিয়ে এলাম। ছমাসের মধ্যে পজেশান দিয়ে দেবে। এখনই তুমি নিজেকে ফ্ল্যাটের থার্টি পার্সেন্ট মালকিন ভাবতে পারো।

—ও।…তুমি তাহলে তখন ফ্ল্যাট বুক করছিলে?

—কথাটা পাঁচকান কোরো না। বাবা মাকেও বলতে হবে না এখন।

রম্যাণি অফুটে বলল,—কেন?

—কেন আবার কী! সময়মতো আমিই বলব।

রম্যাণি চুপ। ভাবছে কী যেন।

কিংশুক বলল, কী, খুশি হওনি? ওটাই তোমায় একুশে জানুয়ারির উপহার।

রম্যাণি কোনও উচ্ছ্বাসই দেখাল না। শাড়ি পরছে। কিংশুকের একটু অদ্ভুত লাগছিল। কোনওকালেই রম্যাণির হর্ষ বা বিষাদের উচ্চকিত প্রকাশ নেই, কিন্তু আজ রম্যাণি যেন একটু বেশি শীতল। গালে খুশির ছটাও নেই কেন?

কিংশুক উঠে এসে আলগা জড়িয়ে ধরল স্ত্রীকে, কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ? ফিলিং আনইজি?

উত্তর পাওয়ার আগেই হ্যান্ডসেট বেজে উঠেছে।

বেজার মুখে টেলিফোন অন করল কিংশুক, হ্যালো?

—কে, ডাক্তারবাবু? আমি এন্টালি থানার ওসি বলছি।

কিংশুক বেজায় চমকাল। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গির থেকে একটু জোরেই বলে উঠল, ও, এন্টালি থানা। কী ব্যাপার?

—লোকদুটোকে তো ছেড়ে দিলাম। দাদা আর দাদার সাগরেদটাকে। শোকে একেবারে মূহ্যমান হয়ে ছিল দাদাটা। লকআপে কান্নাকাটি করছিল। হিট অফ দা মোমেন্টে মাথা গরম করে ফেলেছে…যতই হোক আপনজনের শোক…। অবশ্য মুচলেকাও দিয়েছে।

—সে আপনি যা ভাল বুঝেছেন।

—তবু আপনাকে একবার জানিয়ে রাখলাম।…আপনাদের মিস্টার লালকে তো ফোন করে পেলাম না। যাক গে, ওদের কড়কেও দিয়েছি খুব।

—থ্যাঙ্ক ইউ।

—শুধু থ্যাঙ্কসে হবে না ডাক্তারবাবু। দরকার অদরকারে একটু আধটু যাব। আমার শালীর ননদের একটা প্রবলেম হচ্ছে, কিছুতেই বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না…

কিংশুক মনে মনে বলল, শালা।

মুখে বলল, নিয়ে আসবেন। দেখে দেব।

—এদিকে আরও একটা প্রবলেম হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু। মেয়েটির স্বামী আপনার নামে একটি কমপ্লেন ঠুকে দিয়ে গেছে।

—কমপ্লেন? আমার এগেনস্টে?

—হ্যাঁ, গ্রস নেগলিজেন্স অফ ডিউটি ফিউটি বলে…। এই তো একটু আগে এসেছিল।

—তো?…ওসব রাফিয়ানদের কমপ্লেন আপনি এন্টারটেন করছেন?

—উপায় নেই ডাক্তারবাবু। একটা রুটিন ইনভেস্টিগেশান আমায় তো করতেই হবে।

—তদন্ত করবেন? কী তদন্ত?

—ওই আপনার একটা স্টেটমেন্ট ফেটমেন্ট নেব।…থাকবে রেকর্ডে। একদম কিছু না করলে কোথায় কে কীভাবে হুড়কো দিয়ে দেয়…তা আপনি কি একবার আসবেন থানায়? নাকি আমি নার্সিংহোমে গিয়ে আপনার সঙ্গে মিট করব?

—না না, আমিই থানায় যাব। কাল কোনও এক সময়ে…

ফোন অফ করেই কিংশুক টের পেল মাথাটা আবার জ্বালা জ্বালা করছে। ফিরে আসছে ভার ভার ভাবটা। আবার কী ফ্যাসাদে পড়তে হবে কে জানে! কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ!

রম্যাণি আলমারির সামনেই দাঁড়িয়ে। দেখছে কিংশুককে।

কিংশুক সহজ হতে চাইল, —কী হল? তৈরি হয়ে নাও।

রম্যাণির দৃষ্টি স্থির। তীব্র। মর্মভেদী।

চার

বিশ্বজিৎ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শ্রাদ্ধের ফর্দখানা দেখছিল। লম্বা লিস্ট বানিয়েছে পুরুতমশাই। ঘটি, থালা, পিলসুজ, লেডিজ চটি লেডিজ ছাতা কী আছে আর কী নেই! মদন ভট্‌চাজেরই পোয়াবারো। কথায় আছে না কারওর সর্বনাশ, কারওর পৌষমাস!

কবিতা মারা গেছে আজ দশ দিন। শোকে কটা দিন বেভুল মতন ছিল বিশ্বজিৎ। দাঁতে কুটোটি কাটতে ইচ্ছে করত না, ঘুমোতে পারত না, ঘর ছেড়ে দুপা বেরোত না, অষ্টপ্রহর শুধু থম মেরে আছে। কদ্দিনই বা তাদের বিয়ে হয়েছে, এই শ্রাবণে দু বছর পুরত, এর মধ্যেই কবিতা যেন তার পাঁজরের টুকরো হয়ে গিয়েছিল। কী ঢলঢলে ফর্সা পানপাতা কাটিং মুখ, দাঁত ছড়িয়ে হাসলে দিব্যি মাধুরী মাধুরী ভাব আসত একটা। অন্তত বিশ্বজিতের তেমনটাই লাগত। গলা তুলে কথা বলেনি কোনওদিন, মার মতো খিটখিটে শাশুড়িকেও জমিয়ে একেবারে কুলপি বানিয়ে রেখেছিল। প্রাণ ঢেলে সেবা করেছে বেতো শাশুড়ির, চুল বেঁধে দিচ্ছে, মালিশ করে দিচ্ছে, টাইমে টাইমে ভাতের থালা ধরছে সামনে…। বউদির মতো হ্যালহ্যালে ঝ্যালঝ্যালে নয়, চটপটেও ছিল খুব। বরের যখন যা দরকার, টুসকি বাজানোর আগেই হাজির। বিয়ের পর জলটা পর্যন্ত বিশ্বজিৎকে গড়িয়ে খেতে হয়নি। আট মাসের মাথায় বাচ্চা হতে বাপের বাড়ি চলে গেল, তালতলাতে বসেও স্বামীর জন্য কত ভাবনা! হ্যাঁগো, তোমার খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে তো! কে কাচছে তোমার জামাকাপড়! মাথা খাও, মশারি টাঙিয়ে শুয়ো! আমি এখানে পড়ে, তুমি যেন এখন ম্যালেরিয়া ট্যালেরিয়া বাধিয়ো না! দিদিরা পর্যন্ত এসে বলে গেছে এমন লক্ষ্মীমন্ত বউ কপাল করলে পাওয়া যায়। এমন বউকে শ্মশানে রেখে এসে কার না মন পোড়ে!

তবে উথালপাতাল শোকটা এখন অনেক সামলে নিয়েছে বিশ্বজিৎ। অনন্তকাল হাত পা ছড়িয়ে কাঁদলে তো চলবে না, পুরুষমানুষ বলে কথা, শক্ত তাকে হতেই হবে। তাকে দুবলা ভেবে মদন ভট্‌চাজ টুপি পরাবে, এও তো কাজের কথা নয়।

মদন ভট্‌চাজ নাকে নস্যি ঠুসছে। চেটোর উল্টো পিঠে নাক মুছতে মুছতে বলল, শয্যার কথা আর ওখানে লিখিনি বিশু। ও আমি নিয়ে আসব, তুমি মূল্য ধরে দিও।

—সে নয় হল। বিশ্বজিৎ জেরার ঢঙে প্রশ্ন করল, দানসামগ্রী একটু বেশি হয়ে গেল না?

—কোথায় বেশি! তাও তো তোমায় বৃযোৎসর্গ করতে বলিনি। অমন টুকটুকে বউ অকালে চলে গেল, অন্তত ষোড়শটুকু তো করবে।

অজিত ঘরেই আছে। বিকেলে এই সময়ে তার আবার দোকান খোলার কথা, মদন এসে পড়ায় আটকে গেছে। ভাইয়ের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, —লিস্ট মোটামুটি ঠিকই আছে রে বিশু। বাবার সময়ে আরও বেশি লেগেছিল।

সরলাবালা খাটে আধশোওয়া। ছেলের বউ-এর মত্যুসংবাদ পাওয়ার পর থেকে তার মাজার ব্যথা চাগাড় দিয়েছে, শয্যা ছেড়ে নড়ছে না বড় একটা। বিছানা থেকেই উপদেশ ছুড়ল,—এক্কেরে নমো নমো কইরা বউমার কাজ সারবি বাপ? লোকে বদনাম দিব না?

বীণা মদনকে চা দিতে এসেছিল। দুটো বিস্কুট সহ পেয়ালা পিরিচ রাখল টুলে। ছোট জার মৃত্যুতে সেও বেশ মর্মাহত। ধরা ধরা গলায় বলল, আহা রে, বেঘোরে প্রাণ গেল মেয়েটার, বাচ্চাটার মুখ পর্যন্ত দেখা হল না। এখন ক্রিয়াকর্ম ঠিকমতো না হলে তার গতি হবে কেন? বার বার ফিরে আসবে না!

এ তো মহা গেরো! সবাই মিলে এমনভাবে বলছে যেন বিশ্বজিৎ শ্রাদ্ধে ব্যাগড়া দিচ্ছে। দানের লেডিজ চটি পরে কবিতা যদি স্বর্গের বাগানে মাধুরীর মতো নেচে বেড়াত, রঙিন ছাতা মাথায় দিয়ে মনীষা কৈরালার মতো ঘুরে ঘুরে গান গাইত, তাহলে একটা ছেড়ে দশটা চটি ছাতা দিয়ে দিত না বিশ্বজিৎ? কিন্তু ও তো স্রেফ মদন ভট্‌চাজের গব্বায় যাবে। ওই চটি পরে ঘুরবে তো মদনের বউ, ছাতা মাথায় মেয়ে ইস্কুলে যাবে। চাকরিতে দু পয়সা উপরি আছে বলে বিশ্বজিতের অপচয় কি অপচয় নয়? দাদা খুব বড় মুখ করে বলছে বটে বাবার কাজে নাকি এর অনেক বেশি খসেছে! ঢপ, স্রেফ ঢপ। লিস্ট থেকে তখন একটা একটা করে কত কী কাটিয়েছে দাদা, বিশ্বজিৎ বুঝি দেখেনি!

মদন ভট্‌চাজ বুদ্ধি বেচে খায়। তাকে প্রায় বুদ্ধিজীবীই বলা যায়। পুরুতগিরি তার পার্টটাইম জব, একটা অফিসে সিকিউরিটির চাকরি করে, ফাঁকে ফাঁকে জমি বাড়ির দালালি। নীতিকথার শেয়ালের মতো একশোটা বাঁচার রাস্তা ছকে রেখেছে সে, যদিও সে খুব ভালভাবে বেঁচে নেই।

বিশ্বজিতের চাপটা টের পেয়ে মিটিমিটি হাসছে মদন, তাহলে কী ঠিক হল? কেনাকাটাগুলো কি বিশুই করবে? ফর্দ মিলিয়ে মিলিয়ে আনতে হবে কিন্তু।

—আপনিই আনেন। আমার অত সময় নেই। বিশ্বজিতের মুখ বেজার, কত লাগবে বলুন, দিয়ে দিচ্ছি।

—হাজার দুই আড়াই দাও। টেনেটুনে চালিয়ে নেব।

—এত?

—বউমার আত্মার শান্তির জন্য এইটুকু করবা না? মঠ আশ্রমে করতে হলে তো এতেও কুলাত না।

একটু বুঝি ভাবনাতেই পড়ে গেল বিশ্বজিৎ। পর পর অনেক খরচা, ছোট করে হলেও একখানা প্যান্ডেল বাঁধতে হবে, শ্রাদ্ধের দিন অন্তত শ’খানেক লোক খাবে, ব্রাহ্মণভোজন আছে, দক্ষিণা, নিয়মভঙ্গ…। বামুনগুলোর দুইয়ে নেওয়ার কতরকম যে ফিকিরবাজি!

নিমপাতা খাওয়া মুখে ঘর থেকে হাজার দেড়েক টাকা নিয়ে এল বিশ্বজিৎ, এই দিয়ে এখন চালিয়ে নিন। পরে আবার দেখা যাবে।

আঙুলে থুতু মাখিয়ে টাকাটা গুনল মদন, মাত্র এই? এতে তো শ্রাদ্ধের জল গরমও হয় না!

—বললাম তো পরে দেখব।

কোথায় থামতে হয় মদন জানে। আর চাপাচাপি না করে মানে মানে সরে পড়ল। অজিতও ঘড়ি দেখছে,—আমিও তবে বেরোই। ঝাঁপ খুলতে দেরি হয়ে গেল।

—এক সেকেন্ড। আমিও যাব।

সরলাবালা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,—তুই আবার অহন যাবি কোথায়?

—একটু ডেকরেটারের কাছ থেকে ঘুরে আসি।

—সাবধানে যাস মণি। লোহাটারে লগে রাখ, সময়টা তোর ভাল না। হ্যায় কিন্তু অহন আশপাশে ঘুরতাসে।

অজিতের তিন কন্যা ঠাকুমার খাটে বসে গোগ্রাসে বড়দের কথা গিলছিল। আসর ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তারাও গুটি গুটি পায়ে বাইরের উঠোনে। এক্কা দোক্কা খেলছে। বীণা কাঁসিতে মুড়ি মেখে ডাকছে মেয়েদের, ভ্রূক্ষেপ নেই। মেয়েগুলো কবিতার খুব ন্যাওটা ছিল, এক-দুদিন কাকিমার শোকে তাদেরও ভারী মূহ্যমান মনে হয়েছিল। এখন আর তাদের তেমন দুঃখ টুক্‌খো নেই। বরং সামনেই বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান, তাই নিয়ে তারা কিঞ্চিৎ উত্তেজিত।

বিশ্বজিতদের বাড়িটা পুরনোই, নয় নয় করে পঞ্চাশ বছরের। জবরদখল জমি, এককালে ছিটেবেড়ার দেওয়াল ছিল, খোলার চাল। এখন দেওয়াল ছাদ সবই পাকা। ছাদ অবশ্য বছর দুই আগে ঢালাই হয়েছে, বিশ্বজিতের বিয়ের আগে আগে। রোজগার বেশি বলে বিশ্বজিৎই টাকা ঢেলেছিল বেশি, বিনিময়ে মিলেছে বড় ঘরখানা। অজিতেরটা ছোট, মালপত্রে ঠাসা, তার বড় দুই মেয়ে ঠাকুমার ঘরেই শোয়। সরলাবালার ঘরখানা এ বাড়ির বসার জায়গাও বটে। চৌকি আছে, চেয়ার টেবিল, রঙিন টিভি…। যতই অস্বাচ্ছন্দ্য হোক, সরলাবালা এ ব্যবস্থাটা মেনে নিয়েছে। তাও সে খুশি, ছেলেরা এখনও পৃথগন্ন হয়নি।

শার্ট চড়িয়ে দাদার সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে এল বিশ্বজিৎ। সাড়ে পাঁচটা বাজে, বিকেল বড় হচ্ছে, এখনও বেশ আলো আছে। সরস্বতী পুজোর পর থেকে ঝপ করে ঠাণ্ডা কমে গেছে অনেকটা, শাল সোয়েটারের এবার ক্রমে বাক্সবন্দি হওয়ার পালা।

কলোনির পথ ধরে হাঁটছে দুভাই। এককালে চারদিকে জলাজঙ্গল ছিল, এখন সুদৃশ্য দালানবাড়ির সমারোহ, ফ্ল্যাটবাড়িও গজাচ্ছে এখানে সেখানে। দেশভাগের স্মৃতি এসব অঞ্চল থেকে প্রায় মুছে গেছে। এখানকার বাসিন্দারা এখন নিজেদের কলোনির লোক বলতে লজ্জা পায়।

বিশ্বজিৎ অনেকক্ষণ ধরেই মনে মনে একটা কথা ভাবছিল। দোনামোনা করে বলেই ফেলল,—তুই আমায় হাজার দুয়েক টাকা দিবি?

অজিত সতর্ক স্বরে বলল, —কেন?

—জলের মতো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। সামাল দিতে পারছি না। শ্রাদ্ধে মনে হচ্ছে হাজার আষ্টেক চলে যাবে, তার আগে নার্সিংহোম টার্মিংহোম করে…

—সে তুই বড়মানুষি করে নার্সিংহোমে গিয়েছিলি…। তোর বউদির তো তিন-তিনটে বাচ্চা হয়েছে, তিনটেই হাসপাতালে, অসুবিধে হয়েছিল কখনও?

বিশ্বজিৎ চুপ করে গেল। কথাটা দাদা আগেও বলেছে। যবে থেকে কবিতাকে নার্সিংহোমে দেওয়ার কথা হয়েছে তখন থেকেই শোনাচ্ছে। অত টাকা ওড়ানোর কী দরকার! শ্বশুরবাড়ি থেকে চেয়ে নিচ্ছিস না কেন! যে কবিতা মুখের রক্ত তুলে সংসারের জন্য খেটেছে, তার যদি ছোট্ট একটা সাধ থাকে, বিশ্বজিৎ মেটাবে না? আর টাকা সে কোন মুখে শ্বশুরবাড়ির থেকে চাইবে? তার বড় শালীর ছেলে হল নার্সিংহোমে, আদালতের পেশকার ভায়রাভাই একটি পয়সাও দিতে দেয়নি শ্বশুরবাড়িকে। শ্বশুরের টাকা নিলে কবিতার চোখে বিশ্বজিৎ ছোট হয়ে যেত না? হয়তো শ্বশুরকে চাপ দিলে শ্বশুর দিয়েও দিত। পুরুষানুক্রমে স্বর্ণকার তারা, তবে নিজেদের কোনও দোকান নেই। বাপ ছেলে বউবাজারে কারিগরের কাজ করে। কিন্তু বিশ্বজিৎ তাদের কাছ থেকে নেবেই বা কেন? তার রোজগার কি খারাপ? সরকারি অফিসের পিওন সে, ডিপার্টমেন্টে টাকা উড়ছে, দিনে পাঁচটা পার্টির ফাইল এঘর ওঘর করলেই হেসে খেলে হাতে দু-তিনশো। বউকে সে নার্সিংহোমে রাখবে না তো কি জগাভগা রাখবে! নাকি অফিসাররাই শুধু কথায় কথায় নার্সিংহোমে দেখাবে? নেহাত দু হপ্তা ধরে ঠায় বাড়িতে বসে, কোনও আমদানি নেই, শুধু বেরিয়ে যাচ্ছে…।

অজিত গজগজ করছে,—তোর ব্যাপার…তোর টাকার জোর আছে…যা ভাল বুঝেছিস করেছিস।

বিশ্বজিৎ এবার বেশ চটে গেল। দিবি না দিবি না, ঘ্যাজোর ঘ্যাজোর করার কী আছে? এত হিংসে কেন, অ্যাঁ? বিশ্বজিৎ দু পয়সা বেশি কামায় বলে এত জ্বলুনি? বাবা মারা যাওয়ার পর তুই যে ঘড়ির দোকানটার স্বঘোষিত মালিক হয়ে গেলি, বিশু তাই নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়েছে? তুই ঘড়ির কাজ ভালমতো শিখিসনি, কোয়ার্টজ মোয়ার্জের ধাক্কায় তোর খুটুর খুটুর অয়েলিং ক্লিনিং-এর খদ্দের জুটছিল না, সেও কি ভাইয়ের দোষ? আজ যে বিশু একটা পাকা চাকরি করছে, দুটো পয়সার মুখ দেখছে, তাতে তোমার চোখ টাটালে চলবে কেন? প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, এই দাদা ওই দাদা ধরে, লাইনবাজি করে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে কার্ড থ্রু করে, তবেই না…। তুইও তো ঘড়ি বন্ধ করে রঙের দোকান খুললি, ক্যালি থাকলে ব্যবসা বাড়া। যাদবপুর বাসস্ট্যান্ডের বিশ হাত দূরে দোকান, এই পজিশানে তো মানুষ লাল হয়ে যায়। তুমি পারছ না কেন! এখন দিলে চোট আছে বলে বিশু তোমায় কিছু বলল না, অন্য সময় হলে ধুধ্‌ধুড়ি নেড়ে দিত।

গোমড়া গলায় বিশ্বজিৎ বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি টাকার জোগাড় করে নেব।

ভাইয়ের উষ্মা বুঝি টের পেয়েছে অজিত। গলা নামিয়ে বলল, আমি কি টাকা দেব না বলেছি! কবিতা তো আমাদের বাড়িরই বউ। দু-আড়াই পারব না, হাজার খানেক নিয়ে নিস।

অফিসে আসা পার্টিদের মতো দরাদরি করছে! ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করবে বিশ্বজিৎ? কিছু বলল না, আর এগোলও না, দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাসস্ট্যান্ড এখন আরও খানিকটা পথ, অজিত চলে গেল দ্রুত পায়ে।

ডেকরেটারের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে পোদ্দারনগর ছুটল বিশ্বজিৎ। পিসির বাড়ি। পিসি ফোঁচফোঁচ কাঁদল খানিক, বিশ্বজিতের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। বেশিক্ষণ অবশ্য সেখানে বসল না বিশ্বজিৎ, ফিরছে। ধীর পায়ে, উদাস চোখে। কবিতার কথা মনে পড়ছিল। অমন বিবি নাম্বার ওয়ানটা মরেই গেল! বড় কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা, কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছিল, হারামি ডাক্তারটা আরও আগে এলে বাঁচত কি? নাকি ভগবান মৃত্যু লিখেই দিয়েছিল? কে জানে!

বাড়ি ফিরে বিশ্বজিৎ দেখল বড় শালা বড় শালী আর ভায়রাভাই এসেছে। বসে আছে মার ঘরে। খুব উত্তেজিত গলায় কী যেন বলছে ভায়রাভাই, বউদি আর বড় শালী নাক টানছে, বড় শালা কপাল টিপে বসে। মার সারা মুখে পাউডারের মতো দুঃখ, ঘন ঘন চোখ মুছছে মা।

বিশ্বজিতকে দেখেই নিরঞ্জন বলে উঠল,—এই যে, এসে গেছ! তোমার জন্যই ওয়েট করছিলাম।

—কেন! কী হয়েছে?

—পুলিশ তো পুরো পাল্টি খেয়ে গেল।

—মানে?

—তুমি আর আমি যখন কমপ্লেন লিখিয়ে এলাম, তখন দেখেছ তো ওসি-টা কেমন মধুমাখা কথা বলছিল! হাঙ্গামা না করে আপনাদের আগে এটাই করা উচিত ছিল…ডাক্তারগুলোর খুব বাড় বেড়েছে, ওদের আছোলা বাঁশ দেওয়া দরকার…! আজ শালার গলায় একেবারে অন্য গান।

বিশ্বজিতের ভুরু কুঁচকে গেল।

সবিতা বলে উঠল, হ্যাঁ গো। তোমার নিরঞ্জনদা থানায় খোঁজ নিতে গিয়েছিল, পুলিশ ওর ওপর খুব চোটপাট করেছে। বলে কিনা, একটা মানী লোককে আপনারা গুয়ে নামাতে চাইছেন! আপনাদের আস্পর্ধা তো কম নয়!

—বুঝলে ব্যাপারটা? পঙ্কজ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল,—ডাক্তারটার কাছ থেকেও হারামজাদারা মাল্লু খেয়েছে। পুরো গর্তে ঢুকিয়ে দিয়েছে কেসেটা।

থানায় নালিশ জানিয়ে প্রতিকার পাওয়া যাবে, ডাক্তারবাবুকে টানতে টানতে কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে পুলিশ, এমন অলীক বিশ্বাস বিশ্বজিতের ছিল না। নেহাত পরদিন ভায়রাভাই এসে পরামর্শ দিল, তাই না থানায় ছোটা।

শুকনো হেসে বিশ্বজিৎ বলল, তার মানে তদন্ত টদন্ত কিছুই করেনি শালারা? আমাদের কমপ্লেন কুচিয়ে ফেলে দিয়েছে?

—তাই হবে। তবে বলল তো ইনভেস্টিগেশান নাকি করেছে, কমপ্লেনের মেরিট পায়নি। ইংরিজি শব্দগুলো বেশ কায়দা করে উচ্চারণ করে নিরঞ্জন, এ সুবাদে সম্বন্ধী কুটুমরা তাকে মান্যিগন্যি করে। হাত উল্টে বলল, অপারেশানের পর এমন ইন্সিডেন্ট নাকি ঘটতেই পারে। শালা ডাক্তারটা নাকি পথে জ্যামে ফেঁসে গিয়েছিল।

—পট্টি পড়ানোর আর জায়গা পায়নি শালা! পঙ্কজ ফুঁসে উঠল, কলকাতার কোথায় সেদিন তিন ঘণ্টা জ্যামিং ছিল, অ্যাঁ?

সরলাবালা ডুকরে উঠল, সংসারে কোত্থাও বিচার নাই গো! আমার অমন সোনা বউমাটারে মাইর‍্যা ফেলাল…

মিনিট কয়েক নীরব সবাই। সরলাবালাই শুধু সুর তুলে চলেছে।

সুর থামার পর সবিতা চোখে আঁচল চাপল, বাচ্চাটার দিকে তাকানো যায় না। জন্মেই মাকে হারাল, বুকের দুধটুকুও পেল না…

বিশ্বজিতের মধ্যে এখনও তেমন বাবা বাবা ভাব জাগেনি। তবু দায়িত্বশীল গলায় বলল, বেবিফুড আরও লাগলে বোলো দিদি, কিনে দিয়ে আসব।

—তোমাকে এখন ও নিয়ে ভাবতে হবে না ভাই। আমরা সবাই আছি…নমিতা তো তোমার ছেলেকে একেবারে বুকে করে রেখেছে।

সরলাবালা আবার কান্না বাজাল, কত কাল পর ছোট বউমা আমারে একখান নাতি দিল, হ্যার মুখখানাও অহনও দ্যাখলাম না!

বীণার মুখে পলকের জন্য ছায়া। পলকেই বুঝি সামলে নিয়েছে নিজেকে। শাশুড়ির তালে তাল দিয়ে বলল, আহা, কী সুন্দর যে হয়েছে ছেলেটা! একেবারে যেন কবিতার মুখ বসানো!

বাচ্চাটাকে ঘিরেই কথা চলছে। শোক তাপ বিস্ময় খুশি সবই যেন ঘোরাফেরা করছে বাতাসে।

হঠাৎ নিরঞ্জন বলল, ওই চামার ডাক্তারকে তুমি পেলে কোত্থেকে বল তো ভায়া?

—কী করে বুঝব লোকটা ওরকম! বিশ্বজিৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আমার এক কলিগ ওর নাম বলেছিল। আজকাল নাকি প্রচুর কেস করছে…

—ও শালাকে ছাড়া নেই। শিক্ষা একটা দিতেই হবে।

—আর কী শিক্ষা দেবেন? ডাক্তারদের পকেটের জোর অনেক বেশি। দেখলেন তো থানা পুলিশ কেমন মুঠোয় নিয়ে নিল! তবু সান্ত্বনা, যথাসাধ্য করেছিলাম।

—না বিশ্বজিৎ, হাল ছাড়লে চলবে না। পঙ্কজ ঘাড় টেড়া করে আছে, ও শালা আমাদের লকআপে ঢুকিয়েছিল।

—কী করবেন দাদা?

—আছে। উপায় আছে। নিরঞ্জন সোজা হয়ে বসল, আমার বসিরহাট কোর্টের উকিলদের সঙ্গে আমি পরামর্শ করেছি। তারা বলছে কেস ঠুকে দাও।

—কেস?

—হ্যাঁ। এমনি কোর্টে কেস নয়, কনজিউমার কোর্টে। ও ব্যাটা সেখানে জানাক অপারেশানে কী গলতি করেছিল!

পঙ্কজ বলল, শালা অতক্ষণ ধরে কোথায় ফুর্তি মারছিল, তারও জবাব চাই।

—পাঁচ লাখ টাকার কমপেনসেশান ঠুকে দেব। একটা প্রাণ চলে গেল, তার দাম দিক।

—পাঁচ লাখ? বিশ্বজিতের চোখ কপালে।

—চাইতে দোষ কী! খুব বেশি মনে হলে তিন লাখ বলব। কাজকর্ম মিটুক, তারপর দেখছি কী করা যায়।

বিশ্বজিৎ মনে মনে ভাবল মামলা মোকদ্দমা করে কি কিছু হবে? মাঝখান থেকে ফের এক কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ। তা ছাড়া কোর্ট মানেই হাজার হ্যাপা, বার বার দৌড়োও উকিলের পিছনে ঘোরে…নিজের কাজকর্মের বারোটা।

নিরঞ্জন বুঝি ভাবনাটা পড়ে ফেলেছে। বলল, কনজিউমার কোর্টে তোমার খরচখরচাও বেশি নেই ভায়া। প্লেন পেপারে পাঁচ কপি কমপ্লেন ঠুকে দাও, ব্যস। সময়ও বেশি লাগে না, এ সব কেস তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়ে যায়। উল্টে খরচখরচা যা হবে তাও উশুল করে নিতে পারো। তোমার নার্সিংহোমের কাগজপত্র সব ঠিকঠাক আছে তো? ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান, রিপোর্টগুলো…?

—তা আছে।

—তবে আর পিছু হঠো না। লেগে পড়।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা সবাই তোমার সঙ্গে আছি। পঙ্কজের চোয়াল কঠিন, আমার বোনের খুনের বদলা চাই।

বিশ্বজিতের বুকটা হু হু করছিল। আবার কবিতাকে মনে পড়ছে। কবিতাটা হেভি ছমকছল্লু ছিল। পাঁচ লাখ কেন, পঞ্চাশ লাখেও কবিতার দাম উঠবে কি?

মলিন মুখে বিশ্বজিৎ বলল, দ্যাখেন, আপনারা যা বিবেচনা করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *