০৫. পিলপিলে ভিড়ে

অম্বর অবাক কম হয়নি। এই পিলপিলে ভিড়ে পাঁচহাত দূরের চেনা মানুষকে ঠাহর করা মুশকিল, অথচ এই জনারণ্য ভেদ করে আঁচলকেই কিনা চোখে পড়ে গেল অম্বরের! দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই নিজের নিজের কক্ষপথে বিচরণ করছে, তাদের কারওকে কণামাত্র বিচলিত করাটা অম্বরের ধাতে নেই। আজন্মলালিত সেই স্বভাবের বাইরে গিয়ে সে কিনা ডেকেও ফেলল আঁচলকে!

সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আঁচল। পরনে ঢাকাই শাড়ি। সাদা খোলের ওপর কালো সবুজের নকশা করা। একটু বয়স্ক বয়স্ক টাইপ। বোধহয় বড়কাকির। তেমন সাজগোজও করেনি। তবু যথারীতি মারকাটারি দেখাচ্ছে আঁচলকে।

বুকের লাবডুবটা টের পেল অম্বর। ভেতরের অপ্রতিভতা কাটাতেই বুঝি বাড়তি স্মার্টনেস এসে গেল গলায়, “ব্যাপারখানা কী, অ্যাঁ? উদ্ভ্রান্তের মতো চলেছ কোথায়?”

আঁচলও একটু আড়ষ্ট। কেঠো হাসল, “উদ্ভ্রান্ত? আমি?”

“নয়তো কী? পাশ দিয়ে গেলে অথচ দেখতেই পেলে না…!” স্বরে একটা অভিভাবক সুলভ ভাব ফোটাল অম্বর, “রাস্তাঘাটে এত অন্যমনস্ক থাকা ঠিক নয়। অ্যাক্সিডেন্ট ঘটতে পারে।”

খুচরো উপদেশটাকে যেন পাত্তাই দিল না আঁচল। সামান্য ছড়াল হাসিটাকে, “তুমি কোত্থেকে উদয় হলে?”

“উঁহু, উদয় নয়, অস্ত যাচ্ছি।” অম্বর মুচকি হাসল। দেশের বাড়ি থেকে এসে প্রথম প্রথম বেশ কুঁকড়ে থাকত সে, মুখই খুলত না বড় একটা। এখন দিব্যি কথার পিঠে কথা এসে যায়। একেই বোধহয় বলে কলকাতার জলহাওয়ার গুণ। কায়দা করে বলল, “গোধূলিবেলায় এবার নীড়ে ফেরার পালা।”

আঁচলের ভুরুতে পলকা ভাঁজ, “সোজা রানিগড় থেকে আসছ বুঝি?”

“না তো। আমি তো হরিনগর গিয়েছিলাম।” নিজেকে অকিঞ্চিত্কর ভাবে বলেই বোধহয় স্বরে খানিকটা বাড়তি ওজন চাপাল অম্বর, “অফিশিয়াল কাজ ছিল।”

“ও হ্যাঁ…বাপি বলছিল বটে।” বলল বটে আঁচল, কিন্তু এখনও যেন সে একটু আনমনা। দায়সারাভাবে জিজ্ঞেস করল, “তোমার যেন কবে ফেরার কথা ছিল?”

“বেস্পতিবারই।”

“চার দিন দেরি করলে যে বড়?”

কৈফিয়ত চাইছে নাকি? হতেও পারে। ভাইপো হিসেবে সে বড়কাকার বাড়িতে থাকে বটে, কিন্তু আদতে সে তো বড়কাকার কর্মচারী। সুতরাং মালিকের কন্যা হিসেবে আঁচলের এ প্রশ্ন করার হক আছে বই কী।

অম্বর গলা ঝেড়ে বলল, “ফেঁসে গিয়েছিলাম। সেদিন হরিনগর থেকে বেরিয়ে চণ্ডীপুর অবধি এসেছি, হঠাৎ রাস্তা অবরোধ। পুলিশ কোথায় ডান্ডা চালিয়েছে, অমনি পথ আটকে বসে গেছে লোকজন। কী আতান্তরে যে পড়েছিলাম! ওই রাত্তিরবেলা হরিনগর ব্যাক করতে হল। পয়দল। দোকানপাট সব বন্ধ, রাতের খাবার জোগাড় করতে সেদিন যা ভোগান্তি পোয়াতে হয়েছে! মোবাইলে চার্জ ছিল না, খবরও দিতে পারছি না…। পরদিন বুথ থেকে ফোন করলাম, তখন তো বড়কাকাই বলল, আরও দুটো তিনটে দিন ওখানে থেকে, গোটা পরিস্থিতিটা সরেজমিন করে, তবেই যেন ফিরি। সেই ডিউটি করে তবেই না আজ…”

“তা এই রুটে কেন?” অম্বরের দীর্ঘ বর্ণনা থামাতে আঁচল বলে উঠল, “হাওড়া থেকেই তো গড়িয়ার বাস যায়।”

“কফিহাউসে একবার ঢুঁ মেরে গেলাম।” দোনামোনা করে সত্যিটাই বলল অম্বর, “একজনের সঙ্গে দেখা করার ছিল।”

“কবিতা টবিতা দেওয়া নেওয়ার ব্যাপার?”

কথাটা ভুল নয়। কলকাতা আসার পর, কফিহাউসে যাতায়াতের সূত্রে, দু’-চারজন লিটল ম্যাগাজ়িন সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে অল্পস্বল্প। হরিনগরে বসে দু’খানা কবিতা লিখেছে, সে-দুটোকে সম্পাদকদের শ্রীহস্তে সমর্পণ করে আসাই উদ্দেশ্য ছিল আজ।

কিন্তু আঁচলের প্রশ্নের ভাষাটি যথেষ্ট আপত্তিকর। ক্ষুণ্ণ মুখে অম্বর বলল, “কবিতা টবিতা বলছ কেন? শুধু কবিতা বললেই তো হয়।”

অম্বরের আঁতে লাগার ব্যাপারটা বুঝে গেছে আঁচল। ঠাট্টার সুরে বলল, “টবিতা বললে কবিতার মানহানি হয় বুঝি?”

“তোমাকে যদি বলি ইতিহাস টিতিহাস পড়াও, তোমার ভাল লাগবে আঁচল?”

“এই দ্যাখো, খেপে গেলে। তোমরা, কবিরা, এত টাচি কেন বলো তো?”

“গন্ডার কি মহান প্রাণী? চামড়া মোটা হওয়া কি মহৎ গুণ?”

“নাহ, তোমার সঙ্গে কথায় পারব না। বাপি ঠিকই বলে…”

“কী বলে?”

“শুনে কাজ নেই। আরও চটে যাবে।”

“বলোই না।”

“বচনবাগীশ।”

বিশেষণটি অম্বরের একেবারে অপরিচিত নয়। তবু ধক করে লাগল কানে। বোধহয় আঁচলের মুখ থেকে আসার কারণেই। বুঝি বা তার শ্যামলা মুখে ছায়াও পড়ল এক ফালি। পরক্ষণেই অবশ্য গা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। ব্যঙ্গবিদ্রুপ গায়ে মাখলে তার চলে?

ঠোঁট উলটোপালটা ঠাট্টা জুড়ল অম্বর। কৌতুকের সুরে বলল, “বড়কাকা তো ওরকমই বলবে। রসকষ তো নেই।”

“বাপি বেরসিক?”

“অত্যন্ত বেশি মাত্রায়।”

“আজ্ঞে না স্যার। বাপি হচ্ছে পরিশ্রমী। লড়াকু। তোমার মতো সব সময়ে ভাবদরিয়ায় ভেসে বেড়ায় না।”

আঁচলেরও তার সম্পর্কে এই ধারণা? মনে মনে একটু ব্যথাই পেল অম্বর। বাস্তববোধ আছে বলেই না বাস্তবের রূঢ়তাকে সে খানিকটা সহনীয় করে তুলতে চায়, আশ্রয় খোঁজে শব্দের মায়ায়। সারাক্ষণ কেজো লোকের পোশাক গায়ে চাপিয়ে রাখতে হলে তো অম্বর দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। প্রতি মুহূর্তে যদি মনে রাখতে হয়, মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করার সুবাদে হায়ার সেকেন্ডারিতে সায়েন্স নেওয়াটা তার গোক্ষুরি হয়েছিল, জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স না পাওয়াটা তার অপদার্থতারই প্রমাণ, কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে টায়েটুয়ে বি এসসি-টা উতরে সংসারের কোনও ভারই সে লাঘব করতে পারেনি… তা হলে কষ্টটা বাড়ে, না কমে? আঁচল তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, অম্বরের এই মনোকষ্টগুলো কেন যে বোঝে না?

অবশ্য বোঝার তো কোনও দায়ও নেই আঁচলের। এবং তাকে বোঝানোর চেষ্টা করাটা অম্বরের একেবারেই সাজে না। তার চেয়ে বরং নিজের হালকাপুলকা ভাবমূর্তিটা বজায় রাখাই তো শ্রেয়।

মজা করার সুরে অম্বর বলল, “বড়কাকা তো প্র্যাকটিক্যাল বটেই। নইলে কবিকে দিয়ে হালচাষের মতলব ভাঁজে?”

“দাঁড়াও, কথাটা বাপিকে গিয়ে বলছি।”

“অ্যাই প্লিজ…আমার কলকাতার ভাতটা মেরো না।”

“ভাত নিয়ে যেন তোমার খুব ভাবনা আছে?”

“নেই আবার? দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের তাগিদেই না কলকাতায় আসা।”

কথাটার রগুড়ে সুর বোধহয় পছন্দ হয়েছে আঁচলের। হাসছে ঠোঁট টিপে। অম্বরেরও বেশ লাগছিল। আঁচলের সঙ্গে কথা বলতে তার একটু বাড়তি পুলক জাগে বই কী। সামনে দাঁড়ানো এই মেয়েটাকে সে প্রথম দেখেছিল বছর দশেক আগে। দাদুর মৃত্যুর খবর পেয়ে সেবার অনেক বছর পর রানিগড়ে গিয়েছিল বড়কাকা। কাকিমা আর আঁচল অলিকে সঙ্গে নিয়ে। আঁচল তখন বছর পনেরো-ষোলো। সবে টেন-এ উঠেছে। অলি বছর নয়েকের। বড়কাকিমার আগের পক্ষের মেয়েটিকে প্রথম দর্শনেই পলকা শিহরন জেগেছিল অম্বরের। দিঘির মতো টলটলে দু’খানা চোখ, সুন্দরী কিন্তু তাতে কোনও উগ্রতা নেই, বরং একটা পাতলা বিষাদের মসলিন লেপে আছে মুখখানায়। তখন ভারী চুপচাপ থাকত আঁচল, তিনটে প্রশ্ন করলে একটার উত্তর মিলত কি না সন্দেহ। তারপর তো ক্রমে ক্রমে মোটামুটি বন্ধুত্ব হয়ে গেছে দু’জনের। যথেষ্ট ‘অম্বরদা অম্বরদা’ করে আঁচল। গল্প আড্ডা ঠাট্টা ইয়ার্কিও হয় নিয়মিত। তবু সেই প্রথম দেখার রেশটুকু যেন অম্বরকে ছাড়েনি। নইলে সে আঁচলকে এখনও বোন ভাবতে পারে না কেন! আঁচল কি ব্যাপারটা টের পায়? তার মেয়েলি ঘ্রাণশক্তি দিয়ে?

ভাবনাটা মনে আসামাত্র অম্বর সচকিত। ঝটিতি মজারু ভাবটা আনল গলায়। চোখ নাচিয়ে বলল, “কী ভাবছ, অ্যাঁ? বাড়িতে গিয়ে লাগাবে কি না?”

“আমায় কি চুকলিখোর মনে হয়?”

“যাক, ভরসা পেলাম। …তা একটু চা চলবে নাকি?”

আঁচল পলক ভাবল কী যেন। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, “হতে পারে।”

উড়ালপুলের নীচে দোকানটায় ঠাসা ভিড়। চায়ের পাশাপাশি সিঙাড়া-কচুরি-চপ-অমৃতির আয়োজন। বিক্রিও হচ্ছে দেদার। সেদিকে চোখ বুলিয়ে অম্বর জিজ্ঞেস করল, “আসছ তো কলেজ থেকে। খাবে কিছু?”

আঁচল দু’হাত তুলল, “না না, শুধু চা। তোমার খিদে পেয়ে থাকলে তুমি খেতে পারো।”

“আমার পেট তো রাবণের চিতা। সর্বদাই জ্বলছে।” অম্বর হাসল। ঘুরে অর্ডার দিল দোকানিকে, “দুটো চা। ভাঁড়ে।”

পথচলতি লোকের ধাক্কা বাঁচিয়ে দোকানের কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে দু’জনে। ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে অম্বর বলল, “তা ম্যাডাম, তুমি আজ কর্ড লাইনে যে বড়? যাচ্ছ কোথায়?”

“আছে একটা কাজ।” ঠোঁটে ভাঁড় ছুঁইয়ে আঁচল এড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, “একজনের সঙ্গে দেখা করার ছিল।”

অম্বরের জবাবই অম্বরকে ফেরত। তবু কানে লাগল অম্বরের। বুঝি বা তার চেয়ে গভীরেও। তবু রঙ্গ করার সুরে বলল, “অ। আজকাল এসবও হচ্ছে?”

“আজ্ঞে না স্যার। তুমি যা ভাবছ, মোটেই তা নয়।”

“আমার অনুমানটা তুমি জানলে কী করে?”

“ওফ, সেই কথার পিঠে কথা! তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না অম্বরদা।”

“আরে, লজ্জা পাচ্ছ কেন? দোষের কাজ তো নয়। তা ভাগ্যবানটি কে? তোমার পিসি যে সম্বন্ধটা এনেছেন…?”

“না রে বাবা। তাকে তো আমি…”

“ও। সামওয়ান এলস?” অম্বর ঝুঁকল সামান্য। চতুর্দিকের প্রবল কোলাহলের মাঝে দু’জনের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা কারও কানে যাওয়ার কথা নয়, তবু স্বর খানিক নীচে নামাল অম্বর, “আমার কাছে বলতে পারো। কথা দিচ্ছি কাকিমার কাছে চুকলি খাব না।”

আঁচলের মুখমণ্ডলে যেন একটা অস্বস্তির ছাপ। কী একটা বলতে গিয়েও ইতস্তত করছে।

অম্বর বলল, “থাক তবে। তোমার যখন অসুবিধে আছে…”

“বলছি তো তেমন কিছু নয়। একজন ইনভাইট করেছে।…” আঁচল যেন হোঁচট খেল একটা। সামান্য থমকে থেকে বলল, “পার্ক স্ট্রিটে একটা আর্ট এগ্‌জ়িবিশনে যাচ্ছি।”

সহসা এক স্বস্তির অনুভূতি। অকারণে। উচ্ছ্বাসভরা স্বরে অম্বর বলল, “আইব্বাস, তুমি তো ছুপা রুস্তম! পেন্টিংও দ্যাখো? শুধু কবিদেরই যা অবজ্ঞা, অ্যাঁ?”

আঁচল হেসে ফেলে সহজ গলায় বলল, “আচ্ছা বাবা আচ্ছা, এবার থেকে কবিতাও পড়ব। অ্যাট লিস্ট তোমার। খুশি?”

অম্বরের মুখ নির্মল আনন্দে ভরে গেল। পাশে রাখা ড্রামে ভাঁড় ফেলে পার্স বার করছে।

আঁচল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “অ্যাই অম্বরদা, আমি দিচ্ছি।”

“রাখো, রাখো। সামান্য চাটুকু খাওয়াতে পারব না?” অম্বর গুনে গুনে কয়েন বাড়িয়ে দিল দোকানিকে। হেসে বলল, “আমার দেওয়া, তোমার দেওয়া, কী আলাদা?”

“মানে?”

“সরল সত্যিটা বুঝলে না? টাকা তো তোমার বাপির। খরচটা শুধু আমার হাত দিয়ে হল, এই যা।”

“কী যে বলো! তুমি সার্ভিস দাও, তার বিনিময়ে পাও।”

“কেন কাটা ঘায়ে নুন ছেটাচ্ছ আঁচল?” ‘বলব না, বলব না’ করেও অম্বরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “আমার সার্ভিস না পেলে কাকার কাঁচকলা। বরং বর্তে যাবে। দিচ্ছে তো আমার অযোগ্যতার সাবসিডি, সেটা তো বাঁচবে।”

চোখ কুঁচকে তাকাল আঁচল। দেখছে অম্বরকে? ভাবছেটা কী? অম্বরকে নিয়ে তার মা বাপির আলোচনা সে আড়ি পেতে শোনে, কী না? আরে বাবা, এসব শুনতে হয় না। বাড়ির বাতাসেই তো কথাগুলো ভাসে অবিরাম। তা ছাড়া তার যোগ্যতা কতটুকু এবং সেই যোগ্যতার বাজারদর কীরকম, তা কি অম্বরের একেবারেই অজানা? বড়কাকা ব্যবসা ছড়াতে চাইছে, পাশে একটা বিশ্বস্ত লোক প্রয়োজন, সেই ভাবনা থেকেই সম্ভবত অম্বরকে আনা। অম্বর হয়তো জেনেবুঝে কাকাকে ঠকাবেও না। কারণটা অম্বরের সততা নয়। শঠ হতে গেলে মগজটাকে যেভাবে খেলাতে হয়, সেটা অম্বরের আসে না যে। কিন্তু তাকে দিয়ে বড়কাকার সত্যিকারের কোনও কাজ হওয়া মুশকিল, এ অম্বর দিব্যি টের পায়।

অম্বর ফের বলল, “কী, ভুল বললাম কিছু?”

আঁচল হালকা বিদ্রুপের সুরে বলল, “তুমি জ্ঞানপাপী।”

“সে আর বলতে।” মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল কথাটা, কোঁত করে গিলে নিল অম্বর। পরিস্থিতি তরল রাখতে একটা ছদ্ম বিজ্ঞ স্বর ফোটাল গলায়, “তোমার ধারণা একেবারেই ভুল। কবিরা কদাচ জ্ঞানপাপী হয় না। বরং বলতে পারো, তারা নলেজের আকর। তোমরা তাদের মূল্য বোঝো না, এ তোমাদেরই লোকসান। দুনিয়ার যে কোনও সমস্যার আমরা পাঁচ মিনিটে সমাধান করে দিতে পারি। যেমন ধরো, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যা বখেড়া শুরু হয়েছে…”

“প্লিজ অম্বরদা, একদিনের পক্ষে যথেষ্ট দিয়েছ। এরপর আর হজম হবে না। আমি এবার এগোই।” আঁচল আবার ঘড়ি দেখল, “হরিনগরে বাপির ডিউটি করতে করতে তোমারও নিশ্চয়ই ক’দিন খাটাখাটুনি গেল, বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

ঘুরে নিজের পথ ধরল আঁচল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অম্বর একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। হঠাৎই তাকে অবাক করে দিয়ে থমকেছে আঁচল। আবার ফিরে আসছে যে?

অম্বর কয়েক পা এগিয়ে গেল, “কী হল?”

দ্বিধান্বিত স্বরে আঁচল বলল, “তোমায় একটা কথা বলার ছিল। আই মিন, একটা রিকোয়েস্ট।”

অম্বর শশব্যস্ত হয়ে বলল, “কী?”

“আমার সঙ্গে যে দেখা হয়েছে, বাড়িতে কারওকে জানানোর দরকার নেই।”

“কেন?”

“আমি বলছি, তাই। অলিকেও গপ্পো করবে না, বুঝেছ?”

অম্বর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিছুই বুঝল না, তবু ঘাড় নেড়ে দিয়েছে ঝুপ করে।

আঁচল আর দাঁড়াল না। হাঁটছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মিশে গেল জনস্রোতে।

সিগারেট শেষ করে অম্বর ঢুকে পড়ল শেয়ালদায়। মনটা খচখচ করছে। হঠাৎ অম্বরকে অমন অনুরোধ করার কী অর্থ? আঁচল মিথ্যে কথা বলার মেয়ে নয়। যাচ্ছে পার্ক স্ট্রিটের আর্ট এগ্‌জ়িবিশনে, কিন্তু বাড়িতে খবরটা গোপন রাখতে চায়। কেন?

আচমকাই মস্তিষ্কে বিদ্যুতের ঝিলিক। কালই না কাগজে দেখছিল, দিল্লিবাসী চিত্রশিল্পী দেবরাজ সিংহরায়ের প্রর্দশনী শুরু হচ্ছে কলকাতার কোনও এক আর্ট গ্যালারিতে? আঁচল কি তবে সেখানেই গেল? গড়িয়ার বাড়িতে লোকটার নাম উচ্চারণ হয় না বটে, তবে রানিগড়ে মা কাকিমাদের পি-এন-পি-সি থেকে অম্বর ভাসা ভাসা শুনেছে, ভদ্রলোক নাকি মোটেই সুবিধের নয়। সব ধরনের চরিত্রদোষই নাকি আছে তার। আশ্চর্য, আঁচল কি এ সব জানে না? উঁহু, জানে বলেই হয়তো এই চুপি চুপি যাওয়া। পাছে বাড়ির কেউ কিছু মনে করে।

লোকটা কি সত্যিই খুব খারাপ? গড়পড়তা মানুষের চেয়ে শিল্পীদের জীবনযাপনের ধারা অনেকটাই আলাদা। সেই কারণে বহু সময়ে নানা উলটোপালটা গল্প রটে যায়। বড়কাকিমার সঙ্গে লোকটার এককালে বিচ্ছেদ হয়েছিল, হয়তো তার জন্যই একটা ভয়ংকর ছবি আঁকা হয়ে গেছে। সেই ছবি সর্বাংশে সত্য নাও হতে পারে। আর হলেই বা কী? তাতে কি বাবা-মেয়ের সম্পর্ক বদলায়?

যাক গে, মরুক গে, অম্বর এসব ফালতু ভাবনা মাথায় ঢোকাচ্ছে কেন? যার যা প্রাণ চায় করুক না, অম্বরের কী এসে গেল? এখন গড়িয়ার বাড়িটিতে ফিরে, দোতলার গলতায় ঢুকে, শান্তিতে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে পারলেই তো অম্বরের যথেষ্ট।

শহরতলিতে সন্ধে গাঢ় হচ্ছে। ঠান্ডাটাও মন্দ নয় আজ। ছোট ছোট ঝাপটা দিচ্ছে উত্তরের বাতাস। অম্বরের অল্প অল্প শীত করছিল। ঠান্ডার কামড়টা অবশ্য অনেক বেশি ছিল হরিনগরে। সঙ্গে শাল, সোয়েটার, কিছুই না থাকায় ভুগতে হয়েছে বেশ। কলকাতাতেও আর শুধু পাঞ্জাবিতে চলবে না, গায়ে কিছু একটা চাপাতেই হবে। ভাবতে ভাবতে কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করল অম্বর। দু’খানা মাত্র পড়ে, গোটা রাতটা চলবে কী? এক্ষুনি না খেলে অবশ্য চালিয়ে দেওয়া যাবে কোনও মতে। কিন্তু জিভটা বড় শুলোচ্ছে যে। শরীরকে অকারণ অস্থির করে কী লাভ! রাত্রের ভাবনায় আশঙ্কিত হয়ে এই মুহূর্তের বাসনাকে দমন করেই বা কী বাড়তি সুখ মিলবে! ভাঁড়ারে না থাকলে তখন খাবে না, তা হলেই তো চুকে গেল।

অম্বর ধরিয়েই ফেলল সিগারেট। গড়িয়া স্টেশন থেকে কাকার বাড়ি মিনিট সাত-আটের রাস্তা, সুখটান দিতে দিতে পৌঁছে গেছে গেটে। বাড়ির দরজা জানলা সব বন্ধ। আশপাশের বাড়িরও অবস্থা তথৈবচ। লোকজনও দেখা যাচ্ছে না বড় একটা। নেহাত পথবাতিগুলো জ্বলছে, নইলে রানিগড়ের মতোই নিঝুম লাগত পাড়াটা।

বারান্দায় উঠে অম্বর বেল বাজাল। কাকিমা দরজা খুলেছে।

চোরা চোখে কাকিমার মুখখানা দেখল অম্বর। থমথম করছে যেন? অপরাধ তো অম্বর কম করেনি, এক্ষুনি ঝাড় শুরু হবে নাকি?

কী কাণ্ড, মানসী যেন সেভাবে লক্ষই করল না অম্বরকে। নিস্পৃহ মুখে দরজা আটকে গিয়ে বসেছে দূরের সোফাটায়।

সুড়ুত করে দোতলায় চলেই যেতে পারত অম্বর। কিন্তু কেন যেন পা সরল না। অকারণে জিজ্ঞেস করে বসল, “আজ টিভি চালাননি?”

“এমনি। ইচ্ছে করছে না।”

“অলি ফেরেনি এখনও?”

“কবে এই সময়ে ফেরে?”

পালটা প্রশ্নে একটু নাড়া খেয়ে গেল অম্বর। ইস, বেকুবের মতো জিজ্ঞাসার কোনও মানে হয়? টিউশন পড়ে ফিরতে তো অলির রাত আটটা।

নিশ্চুপ মানসীকে আর না ঘাঁটিয়ে কেটে পড়াই শ্রেয় ছিল। কিন্তু ওই নীরবতাই বুঝি একটা চাপ তৈরি করছিল অম্বরের ওপর। আপনা আপনি কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল, “ভেবেছিলাম আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। হরিনগর থেকে বেরিয়েও ছিলাম সকাল সকাল। কিন্তু ট্রেন এমন লেট করল…। পরে মনে হল, সোজা বাসে এলেই ভাল হত…।”

“ঠিক আছে। এমন কিছু দেরি হয়নি।”

“বড়কাকাকে কাল বলেছিলাম, পারলে সোজা ফ্যাক্টরিতে চলে যাব। হয়ে উঠল না। খবরটাও দিতে পারলাম না কাকাকে… মোবাইল চার্জ করতে পারিনি… চার্জারটা ফেলে গেছি…”

“খাবে কিছু এখন?”

আচমকা লোভনীয় প্রস্তাবে অম্বর ঈষৎ থতমত। কোনও মতে বিস্ময়টা সামলে বলল, “অল্প কিছু হলেই চলবে। মুড়ি-টুড়ি গোছের।”

“মুড়ি তো নেই। টোস্ট ওমলেট করে দিই?”

অম্বর ঢক করে ঘাড় নেড়ে দিল। আহ্লাদে পেট গুড়গুড়। ঝাড়ের বদলে আহার! সহ্য হলে হয়।

মানসী উঠে দাঁড়িয়েছে। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “তুমি এখানেই বসবে? না ওপরে দিয়ে আসব?”

“না না, আমি নীচেই আছি।”

মানসী চলে গেল। অম্বর কেমন যেন অস্বচ্ছন্দ বোধ করছিল। টিভিটা চালাতে গিয়েও চালাল না। ভরসা পাচ্ছে না। কাকিমার এই শীতল চেহারাটা তার একেবারেই অচেনা। মহিলা যে সর্বক্ষণ তেতে থাকে, এমন নয়। আড়ালে আবডালে তার সম্পর্কে যা-ই মন্তব্য করুক, সামনাসামনি ব্যবহারটি অবশ্য মন্দ নয়। তবে সুযোগ পেলে বাক্যবাণে বিঁধতে ছাড়ে না, উপদেশেরও কামাই নেই। অলি আঁচলের পিছনেও তো ট্যাঁকট্যাঁক লেগেই আছে। মোদ্দা কথা, কাকিমা মোটেই চুপচাপ বসে থাকার মানুষ নয়। আজ হলটা কী? নো বকবক, নো জ্ঞান দেওয়া…! উলটে শান্ত নিস্তব্ধতার খোলসে গুটিয়ে আছে!

মানসী টোস্ট ওমলেট এনেছে। সঙ্গে চা। ঝটপট খেয়ে ওপরে সরে পড়ল অম্বর। নিজের চাবি দিয়ে ঘর খুলল। তারপর সটান বিছানায়। শবাসনে সারাদিনের শ্রান্তি ঘোচাচ্ছে। একই সঙ্গে ভেবে নিচ্ছে, হরিনগরের হালহকিকত কীভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বলবে কাকাকে।

ভাবতে ভাবতে কখন চোখ জড়িয়ে এসেছিল, একটা বুঝি স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিল, আচমকা ছিঁড়ে গেল তন্দ্রা। নীচে জোর একটা চেঁচামিচি হচ্ছে না?

হ্যাঁ, ঠিক। কাকিমা চেঁচাচ্ছে। অলির ওপর। অলিও গলা ফাটিয়ে তর্ক করে চলেছে। কী নিয়ে বাধল রে বাবা?

অম্বর উঠে বসল। দরজায় কান পাতল।

“অলি চিৎকার করছে,আমার ওপর ঝাল ঝাড়ছ কেন? দিদিভাইকে কিছু বলতে পারো না?”

মানসীরও তীক্ষ্ণ স্বর উড়ে এল, “কাকে কী বলব? তুমি এক পদের, তো সে অন্য পদের। তুমি আমাকে অসভ্যতা দিয়ে জ্বালাচ্ছ, আর সে আমাকে অন্তরটিপুনি দিয়ে মারছে।”

রেগেমেগেই বলছে মানসী, কিন্তু গলায় যেন কেমন অসহায় সুর। অম্বরের কানে ধাক্কা মারল সুরটা। কাকিমা কি জেনে ফেলেছে, আঁচল কোথায় গেছে আজ? অলির মুখ থেকে খবরটা পেল? নাকি আন্দাজ করেছে?

আঁচল বাড়ি ফেরার পর আর এক প্রস্থ ধুন্ধুমার হবে নাকি? সর্বনাশ, আঁচল না অম্বরকেই দায়ী করে বসে!

নাহ, মেয়েকে বিন্দুমাত্র বকেনি মানসী। আঁচল ফিরল প্রায় ন’টা বাজিয়ে, আর পাঁচটা কলেজে যাওয়ার দিনের মতো বিধ্বস্ত হয়ে নয়, বরং বেশ ঝলমল করতে করতে। মানসী তাকে দেরি হওয়ার কারণটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। প্রশ্ন করে লাভ কী? হয় মিথ্যে বলবে, নয় অপ্রিয় সত্য। দুটোর কোনটাই বা শুনতে ভাল লাগে মানুষের?

নৈশাহার পর্ব প্রায় শেষ। অলি, আঁচল টেবিল ছেড়ে উঠে গেছে। অম্বরও। শান্তনু মন দিয়ে কইমাছের কাঁটা বাছছিল। মেয়েরা কেউ রাতে মাছ খায় না, অম্বর- মানসীরও রুটির সঙ্গে নিরামিষ তরকারিই বেশি পছন্দ। রাতের টেবিলে শান্তনুই একমাত্র মত্স্যভোজী। মাছের শিরদাঁড়া পাতের কোণে সরিয়ে রেখে শান্তনু জিজ্ঞেস করল, “কলের মিস্ত্রি এসেছিল আজ?”

মানসী থালা নিয়ে উঠি উঠি করছিল, বসে গেল, “আসার কথা ছিল নাকি?”

“সকালে বেরনোর সময়ে পরেশকে যে বলে গেলাম!” শান্তনু নাক কুঁচকোল, “এদের নিয়ে এই এক জ্বালা। মিস্ত্রি ক্লাসটাকে সতেরো বার তাড়া না দিলে…”

“হুটোপুটির কী আছে? পেছনের কল নয় কয়েকদিন পরেই হল।”

“এই হচ্ছে হবে করতে করতে দু’খানা সিংক বরবাদ হয়ে গেল। বাসনকোসন পেছনের চাতালে নিয়ে মাজলে জিনিসগুলোর আয়ু একটু বাড়ে, নয় কী?”

“স্টিলের সিংক কিনলেই পারতে। বেশি শৌখিনতার কী দরকার!”

“বা রে, নিজের বাড়িতে শখ বিলাসিতা করব না। আর দামি জিনিস থাকলে তার প্রপার যত্নআত্তি হবে না?” শান্তনু গজগজ করছে, “বাথরুমের টাইলসগুলোরও তো বারোটা বাজাচ্ছিল। আছড়ে আছড়ে কাপড় কাচা… কী বিশ্রী প্র্যাকটিস! ভাগ্যিস ওয়াশিং মেশিন কেনা হল।”

ঘরবাড়ির ওপর শান্তনুর ভারী মায়া। কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু। অন্ধ আবেগ। মানসী জানে। এ বাড়ির সিঁড়ি-মেঝে-দরজা-জানলা সবই যেন শান্তনুর হাড়পাঁজর। হবেই তো। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তুলেছে যে। পার্টির লোকাল ছেলেরা মালমশলা সাপ্লাই নিয়ে প্রায় ঘাড়ে চেপে বসেছিল, ঘুসঘাষ দিয়ে কত কষ্টে সামলেছে তাদের। তারপর পাণ্ডুয়া থেকে পছন্দসই বালি নিয়ে এল, নিজে লরিতে চেপে ইট এনেছে বসিরহাটের, কাঠগোলায় বসে পরখ করে করে কাঠ কিনেছে…। বাড়ির যে কোনও দরজা জানলায় হাত দিয়ে শান্তনু বলে দিতে পারে কোনটা শাল, কোনটা শিরীষ, কোনটা গামার। কলকাত্তাইয়া বাবু নয় বলেই বুঝি পারে এসব।

মানুষটার বিষয়বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। সময় বুঝে কেমন কিনে রেখেছিল জমিটা! গড়িয়ার এদিকে, স্টেশনের এত কাছে, এরকম একটা প্লট এখন আঠেরো বিশ লাখ টাকা কাঠা। মেট্রোটা চালু হয়ে গেলে দর হয়তো আরও চড়বে। দারুণ গোছানি সংসারী মানুষ, বিয়ের পরপর কীভাবে যেন জোগাড় করল টাকাপয়সা, ঝুপ করে কিনে ফেলল এই তিন কাঠা পাঁচ ছটাক জমিটা। বাড়িও হয়তো তখনই বানিয়ে ফেলত, চাকরি ছেড়ে সবে ব্যবসায় নেমেছে বলে পেরে উঠল না। কারখানা খানিক দাঁড়াতে একটু একটু করে হাত দিয়েছে। সময় নিয়ে নিয়ে। তিন তিনটে বড় বড় ঘর, দু’খানায় লাগোয়া বাথরুম, বাড়তি আরও একটা কমন, আব্রু বজায় রাখা খাওয়ার জায়গা, আধুনিক কেতার রান্নাঘর… কম টাকার ধাক্কা! সামনের বারান্দাটি তো রীতিমতো লোভনীয়। অর্ধবৃত্তাকার, থাম বসানো, টুকরো বাগান দিয়ে ঘেরা। গ্যারেজে টিনের শেড, সামনে শাটার। দোতলা ঢালাই হয়েছে বছর দুয়েক। ঘর অবশ্য সেখানে আপাতত একটাই। বাকিটা শেষ হয়নি, পড়ে রয়েছে ইটের খাঁচা। বর্তমানে ব্যবসাপাতির হাল তো তেমন সুবিধের নয়, তাই এক্ষুনি এক্ষুনি হাত লাগাচ্ছে না শান্তনু। যাই হোক, যতটা করেছে, সেটাই তো অনেক। শান্তনুর এই বেঁটে পাঁচিল, বাহারি গেট, ছিমছাম বাড়িখানার দিকে পথচলতি মানুষ একঝলক ঘুরে দেখে তো।

হ্যাঁ, শান্তনুর বাড়ি। শুধুই শান্তনুর। মানসীর এরকমই মনে হয় হঠাৎ হঠাৎ। শান্তনুর সঙ্গে টানা একুশ বছর ঘর করার পরও। কেন যে হয়? বিয়ের পর যেদিন প্রথম সাড়ে তিন বছরের মেয়ের হাত ধরে শান্তনুর সেলিমপুরের ভাড়াবাড়িতে গিয়ে উঠেছিল, নিজেকে কেমন আশ্রিত আশ্রিত লেগেছিল মানসীর। এখনও কি তবে হৃদয়ের অতলে সেই অনুভূতির রেশ রয়ে গেছে? নিজের অজান্তেই? অবশ্য না থাকাটাই কি অস্বাভাবিক নয়? সিঙ্কে থালাবাটি নামাতে নামাতে মানসী ভাবল আজ। সেই সাড়ে তিন বছরের মেয়ে এতকাল পরেও যদি এমন উলটোপালটা আচরণ করে, পায়ের তলার শক্ত মাটিটা তখন টলমলে লাগে বই কী।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মানসী দেখল, শান্তনু যাচ্ছে দোতলায়। খাওয়ার সময়ে কথা হয়নি, এখন বুঝি বাতচিত চলবে কাকা ভাইপোয়। অলি আজ টিভি চালায়নি, ঘরে ঢুকে গেছে। ঝাড় খেয়ে সেই তখন থেকে গুম হয়ে আছে মেয়েটা। কেন যে অমন দুমদাম মন্তব্য করে মানসীকে তাতিয়ে দিল? কথা নেই, বার্তা নেই, বাড়ি ঢুকে বেমক্কা বলে দিল, দিদিভাই ফেরেনি বুঝি? তা হলে দ্যাখো, নির্ঘাত এগ্‌জ়িবিশনে দৌড়েছে! যতই ছেলেমানুষি করুক, অলি তো আর কচি নয়, এটাও বোঝে না মা বাবার ক্ষতস্থানে আঘাত দিতে নেই? পুরনো ঘা দিয়ে সর্বদা কি রক্ত ঝরে? কখনও কখনও আগুনও তো ঠিকরোয়!

তবু মেজাজ হারানোটা বোধহয় উচিত হয়নি মানসীর। অলিটা খাওয়ার টেবিলেও প্রায় স্পিকটি নট ছিল আজ। শান্তনু টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছিল মেয়েকে, ভুরুর ইশারায় জানতে চাইছিল হেতু, ঠোঁট উলটে এড়িয়ে গেছে মানসী। এখন অলিকে একটু মলম লাগিয়ে আসবে কি? ভাবতে ভাবতে উঁকি দিল দুই কন্যের দরজায়। বড়জন টেবিলে বসে কী যেন করছে কম্পিউটারে। ছোটটি বিছানায় উপুড়, খুটুর খাটুর করছে মোবাইল নিয়ে।

মানসীর উপস্থিতি টের পেয়েছে অলি। আঙুল স্থির, তবে চোখ তুলছে না মেয়ে। মিনিট খানেক নিথর দাঁড়িয়ে রইল মানসী। যদি মেয়ে নিজে থেকে কিছু বলে। যা হোক কিছু। উঁহু, বাক্যি নেই। ছোট একটা শ্বাস ফেলে মানসী সরে এল। অভিমান তো শুধু মেয়েরই সাজে, মায়ের নয়।

ঘরে এসে নিয়মমাফিক শীতকালীন নৈশ প্রসাধনটুকু সারল মানসী। এবার বিছানা পাতার পালা। বেডকভার সরিয়ে টানটান করছে চাদর, দরজায় বিকট হাঁচি। একটা নয়, পরপর গোটা চারেক।

মানসী ঘুরে দেখল, নাক ঘষছে শান্তনু। মৃদু উষ্মার সুরে মানসী বলল, “বাড়ি ফিরে গায়ে আরও হড়াস হড়াস জল ঢালো!”

শান্তনু নির্বিকার, “আহা দু’বার চান তো আমি বারো মাসই করি।”

“খুব বাহাদুরি, অ্যাঁ? বয়স বাড়ছে? না কমছে?”

“বুড়ো হচ্ছি বলছ?”

“না। খোকা হচ্ছ। অন্তত গিজারটা তো চালিয়ে নিতে পারো।”

“আরে দূর, ও সব গিজার শাওয়ার কি আমার পোষায়! আমি হলাম গাঁয়ের ছেলে। পুকুরে সাঁতারকাটা পার্টি।”

“হাসিও না। কথায় কথায় দেশ গাঁ না কপচিয়ে হাতের কড় গুনে দ্যাখো, জীবনের বেশিটা কোথায় কাটল! কলকাতায়? না রানিগড়ে?”

“তো কী আছে? বডিটা তো আমার ওখানেই তৈরি। আর এ হল রুশি সৈনিকের শরীর, রোদ জল ঝড় সব প্রুফ। তুমি বরং নিজেকে সামলাও।”

“আমার আবার কী হল?”

“এখনও হয়নি, তবে হতে কতক্ষণ? মাথায় রেখো, পরপর দুটো শীতে তুমি কিন্তু বেশ ভুগেছ।”

আজকাল ঠান্ডার সময়টা মানসীর শরীর খানিক বেগড়বাই করছে বটে। গেল বছর তো ভাল মতন সর্দি বসেছিল বুকে। সঙ্গে বিচ্ছিরি শ্বাসকষ্ট। ফি বছর এমনটা চললে রোগটা না শেষে ক্রনিক অ্যাজমায় দাঁড়িয়ে যায়। তাদের বংশে হাঁপানি তো আছেই। শীত-বর্ষায় বাবা কম কষ্ট পেত!

তবে নিজের অসুখ বিসুখের প্রসঙ্গ মানসীর মনঃপূত নয়। ভারী গলায় বলল, “আমারটা আমি বুঝে নেব। তুমি বেশি বীরত্ব ফলিয়ো না। কাল থেকে গিজার চালাবে। নইলে চান বন্‌ধ।”

“জো হুকুম মহারানি।”

শান্তনু ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছে। বাথরুম ঘুরে এসে মানসী বলল, “কী গো, শোবে না?”

শান্তনু আলগাভাবে বলল, “এই যাচ্ছি।”

“রোজ রাতদুপুরে কী এত কাজ?”

“হিসেব করতে হয় মাই ডিয়ার।”

“এত কী হিসেব কষো রোজ রোজ?”

“বেঁচে থাকা মানেই তো অনন্ত হিসেব মানসী। কপাল ভাল থাকলে ঐকিক নিয়ম। সময় মন্দ হলে সিঁড়িভাঙা অঙ্ক।” শান্তনু তেরচা চোখে তাকাল। মুখ টিপে বলল, “সেদিন জিজ্ঞেস করছিলে না, অম্বরকে কেন হরিনগর পাঠাই? কেন ফ্যাক্টরিতে বসাচ্ছি না? নিশ্চয়ই এও ভাবছ, কেন ওকে তিন তিনটে দিন বসিয়ে রাখলাম ওখানে?”

“কিছু একটা প্ল্যান তোমার আছে নিশ্চয়ই।”

“ইয়েস। একটা নতুন প্রোজেক্ট স্টার্ট করব হরিনগরে। একদম ডিফারেন্ট টাইপ।”

“হঠাৎ এমন চিন্তা?”

“হঠাৎ নয় গো। ফ্যাক্টরির হাল রোজই একটু একটু করে খারাপ হচ্ছে যে। বাজার ডাউন, মার্কেটে টাকার ফ্লো নেই, পার্টিরা ক্রেডিটে মাল কিনে ঘাপটি মেরে বসে থাকছে, নতুন অর্ডার কমছে দিন দিন, এদিকে লেবাররা অবিরাম ঝান্ডা নাচাচ্ছে…”

বছরখানেক ধরেই এ ধরনের আশঙ্কার কথা শুনছে মানসী। তামার তার তৈরির ব্যবসায় ইদানীং নাকি বেশ ভাঁটির টান। বিশেষ করে এই রাজ্যে। এক সময়ে এদিকে বিজনেসটার প্রবল রমরমা ছিল। শান্তনুদের প্রধান খদ্দের ফ্যান কোম্পানি, কিংবা গভর্নমেন্ট। অধিকাংশ পাখার কারখানাই এখন ডানা মেলে উড়ে গেছে দক্ষিণ ভারতে, সেখানে তারের কারখানাও গজিয়ে উঠছে অজস্র। পরিণামে শান্তনুদের বাজার মরো মরো। আর সরকারি অর্ডার? ট্রান্সফর্মারের তার কিনবে কী, বিদ্যুৎ পর্ষদ তো ধুঁকছে, তাদের থেকে পেমেন্ট বার করতে জিভ বেরিয়ে যায়। শান্তনু তো তাও চালাচ্ছে কায়ক্লেশে, ছোট বড় কত কারখানায় যে তালা ঝুলে গেল।

মানসী চিন্তান্বিত মুখে বলল, “তো? কী করবে হরিনগরে?”

“ফিশারি। এক্সক্লুসিভলি চিংড়ি। মেনলি বাগদা। সঙ্গে একটা প্রসেসিং প্ল্যান্ট করব। কুলিংয়েরও অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকবে, একেবারে মর্ডান।”

“তুমি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মাছ চাষ করবে?”

“দোষের কী আছে? একটা লাইন আঁকড়ে বসে থেকে পড়ে পড়ে মার খাওয়া তো মূর্খামি। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে বদলাতে হয় বই কী।” ল্যাপটপ বন্ধ করে শান্তনু উঠে দাঁড়াল। ছোট্ট একটা হাই তুলে বলল,অম্বরকে আমি গ্রাউন্ড ওয়ার্কে লাগিয়েছি। ও তো কথাবার্তা ভালই বলতে পারে, আমি চাইছি মাঝে মাঝে গিয়ে লোকাল লোকজনের সঙ্গে অম্বর একটা রিলেশন গড়ে ফেলুক। ওদিকটায় তো এখন বেশ টারময়েল চলছে। কাজ শুরু করতে হলে কাকে কতটা হাতে রাখতে হবে এ সম্পর্কে তো একটা আইডিয়া পাওয়া দরকার।

এই না হলে শান্তনু! মানুষটা দূরদর্শী, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে এগনোর লোক নয়। পুরো পরিকল্পনাটাই ছকে রেখেছে নির্ঘাত। নইলে হঠাৎ পূর্ব মেদিনীপুরের অজ গাঁয়ে আট বিঘে জমি কেনে? তখন অবশ্য বলেছিল, ধরে নাও একটা অ্যাসেট হল, কিংবা বেড়ানোর জায়গা। তলে তলে অন্য ভাবনাটাও ছিল নিশ্চয়ই। কখনওই তো ঝেড়ে কাশে না, মানসী আন্দাজ করবে কীভাবে!

শান্তনু মশারি টাঙানোর তোড়জোড় করছে। মানসী গিয়ে বসল বিছানায়। পলকের জন্য ভাবল, আঁচলের এগ্‌জ়িবিশন যাওয়ার কথাটা বলবে কি না। পরক্ষণেই মত বদলাল। শুনে অবশ্যই কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাবে না শান্তনু। কিন্তু নিরাসক্তির চাদরের আড়ালে একটুও কি অসূয়া অনুভব করবে না মানুষটা?

বরং অন্য প্রসঙ্গটা তোলাই যায়। সামান্য গলা ঝেড়ে মানসী বলল, “জানো, বনানী আজ আবার ফোন করেছিল।”

মশারি গুঁজতে গুঁজতে শান্তনু বলল, “তাই বুঝি? কী বলে?”

“সেই এক কথা। সম্বন্ধটা হাতছাড়া কোরো না… এমনটা আর পাবে না…! বড্ড বোর করছে।”

“একটা কথা বলব?” শান্তনু ঢুকে পড়ল মশারিতে। বালিশে মাথা রেখে বলল, “চটে যাবে না তো?”

“কী এমন কথা?”

“আমার মনে হয়, দেবরাজ কলকাতায় এসেছে বলেই তাড়াহুড়ো করছে বনানী।”

“কেন, দেবরাজের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?”

“বনানী হয়তো চায়, সম্বন্ধটা পাকা হোক, আর দেবরাজও দিল্লি ফেরার আগে সেটা জেনে যাক।”

এমন একটা কথার জন্য মানসী আদৌ প্রস্তুত ছিল না। দু’-এক সেকেন্ড থম থেকে বলল, “তার জানা, না জানায়, কী আসে যায়? আমরা কি তার অনুমতি নিয়ে মেয়ের বিয়ে দেব?”

“তা নয়। তবু জানাতে তো হবেই।”

“আমি কোনও প্রয়োজন দেখি না। তা ছাড়া সম্বন্ধটা নিয়ে আদৌ এগোব কি না, তারই তো ঠিক নেই।”

“সে কী? কেন?”

“কারণ ব্যাপারটা আমার পছন্দ হচ্ছে না, ব্যস।”

“আশ্চর্য, কোয়ালিফায়েড ছেলে, আর ভাই বোন নেই, ভাল চাকরি করে, মা অত বিখ্যাত মহিলা, সল্টলেকে নিজেদের বাড়ি…”

“যা খুশি থাক। আমি লাইক করছি না।”

“কেন? সম্বন্ধটা বনানী এনেছে বলে?”

“ধরে নাও, তাই। বনানীর সিলেকশন বলেই আমার আগ্রহ নেই।”

এটা কিন্তু তোমার ছেলেমানুষি।” শান্তনু হেসে ফেলল, “বনানী আঁচলের পিসি, সে কি তার খারাপ চাইবে?

শান্তনুর মুখে এই ধরনের বাক্য বোধহয় হাজার একবার শুনেছে মানসী। কী অবলীলায় যে উচ্চারণ করে! বেমালুম হজম করে নেয় দেবরাজ আর আঁচলের যোগাযোগ, মানসীর অতীত এসে এই সংসারে ছায়া ফেললেও বিচলিত হয় না, এ কেমন পুরুষ? বনানী যখন বারবার আঁচলকে নিজের বাড়ি নিয়ে গেছে, দেবরাজের সঙ্গে আবার ভাব করিয়ে দিয়েছে মেয়ের, তখন এই শান্তনুই মানসীকে বাধা দিতে দেয়নি। উলটে বুঝিয়েছে, জোর করে আটকালে নাকি বিপরীত প্রতিক্রিয়া হতে পারে মেয়ের! দেবরাজ যে আঁচলের জন্মদাতা, বনানীও যে আঁচলের আপনজন, এ সত্য কি মানসী নিশ্চিহ্ন করতে পারবে? তা হলে কেন নিষেধের গণ্ডি টেনে ক্ষতি করবে আঁচলের? শুধু কী তাই, আঁচলের সিংহরায় পদবিটা পর্যন্ত শান্তনু বদলাতে দিল না। অথচ সে স্বচ্ছন্দে দত্তক নিতে পারত আঁচলকে। দেবরাজ নিশ্চয়ই বাধা দিতে আসত না। তা ছাড়া দেবরাজ তখন কোথায়? সে তো বিদেশে, প্রমত্ত ফুর্তিতে বিভোর! তখন কী যুক্তি ছিল শান্তনুর? না, পিতৃপরিচয় মুছে দিলে সেটা পরে আঁচলের ভাল নাও লাগতে পারে! আঁচলের বাবা হয়ে ওঠার জন্য নিজের পদবিটা জোর করে মেয়ের ঘাড়ে চাপানোটা নাকি এক ধরনের বলপ্রয়োগ! এ কাজ শান্তনু করতে পারবে না।

মানসীর আজকাল ধন্দ জাগে মনে। শান্তনুর এই নিরাবেগ যুক্তিময়তা এক ধরনের ভান নয়তো? নিজেকে মহৎ প্রতিপন্ন করার এক সচেতন কৌশল?

বনানীটাই বা কী? কেন যে এখনও ফেউয়ের মতো লেগে আছে? মানসী ফের বিয়ে করার পর প্রাক্তন ননদটির তো দূরে সরে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। উলটে গায়ে পড়া ভাব যেন বেড়ে গেল আরও। ফোনে খবরাখবর রাখা তো বন্ধ হলই না, অহরহ নিজের ছোড়দার নিন্দে করছে, কারণে অকারণে মানসীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, শান্তনুকেও এমন শান্তনুদা শান্তনুদা শুরু করে দিল…! অলি হওয়ার সময়ে তো সটান নার্সিংহোমে গিয়ে হাজির! এখনও অলির ওপর স্নেহ যেন তার উপচে পড়ে। আঁচলকে বাড়িতে ডাকলে অলিরও নেমন্তন্ন বাঁধা। পুজোয় বড়কে সালোয়ার কামিজ দিল, তো ছোটকেও জিনস-টপ। ঢংগুলো যে কেন করে বনানী? বোঝে না, এতে মানসীর ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়? এত বছর পরেও? উপযাচক হয়ে ঘটকালি করারই বা কী প্রয়োজন? মানসী কি ভুলেও তাকে বলেছে, আঁচলের জন্য পাত্র খুঁজে দাও?

আসলে এসবই বনানীর অধিকার বজায় রাখার চেষ্টা। মানসীকে পদে পদে সমঝে দেওয়া, যেখানে যেভাবেই মানুষ হোক, আঁচল আসলে তাদের বাড়ির মেয়ে।

কনুইয়ে ভর দিয়ে শান্তনু আধশোওয়া হয়েছে বিছানায়। ভুরু তুলে বলল, “কী ভাবছ আকাশ পাতাল?”

মানসী মাথা ঝাঁকাল, “কিচ্ছু না।”

“একটা সহজ ব্যাপারকে কেন অনর্থক জটিল করছ? খোলা মনে ভাবো, বনানী তো শুধু দেবরাজেরই বোন নয়। সে আমাদেরও বন্ধু। অসময়ে সে তোমার পাশে ছিল…। তুমিই তো বলেছ, ক্রাইসিসের সময়ে সে তোমায় সাহস জুগিয়েছে…। নিজে থেকেই ছুটে ছুটে আসে। না ডাকলেও দু’ বোনের জন্মদিনে হাজির হয়…।”

“তো? আঁচলের বিয়ে নিয়ে সে যা ঠিক করবে, সেটাই ফাইনাল?”

“তা কেন। তবে পরিবারের শুভানুধ্যায়ী হিসেবে সে অবশ্যই আঁচলের বিয়ে নিয়ে ভাবতে পারে। আমি তো বলছি না ওখানেই বিয়ে দাও। কিন্তু কথা বলতে কীসের বাধা? এখনও তো এক স্টেপও যাওনি। ওদের আঁচলকে পছন্দ হবে, আঁচল ছেলেটাকে অ্যাপ্রুভ করবে, তার পরে না…”

সেই নিশ্ছিদ্র যুক্তিজাল। সাধে কী লোকটার সঙ্গে কোনওদিন তর্কে এঁটে উঠতে পারে না মানসী! অন্তরের শত উচাটন সত্ত্বেও কত কী মেনে নিতে হয়!

কথা না বাড়িয়ে মানসী শুয়ে পড়ল। বেডসুইচ টিপে টিউব লাইট নিভিয়ে দিল শান্তনু। রাতবাতির ধোঁয়াটে সবুজ আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মশারি ঠিকঠাক গোঁজা হয়েছে কি না। বালিশে আবার মাথা ঠেকানোর আগে মানসীর কাঁধে আলগা চাপ দিল। তরল গলায় বলল, “ব্রেনটাকে কেন মিছিমিছি ট্যাক্স করছ? যো হোগা, দিখা যায়েগা।”

মানসী সাড়াশব্দ করল না।

শান্তনু ফের বলল, “রাত হয়েছে, এবার ঘুমোও।”

বলেই দু’মিনিটের মধ্যে শান্তনু গাঢ় নিদ্রায়। মানসীর মনোকষ্টটা ফিরে আসছিল। বড্ড যাতনা দিচ্ছে আঁচল। আজ যে দেবরাজের কাছে যাবে, মাকে একবার জানাল না পর্যন্ত! ফিরেও কি বলেছে? কী এমন পাপ করেছে মানসী, যে তাকে এমন কষ্ট দেয় আঁচল! নাকি ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে বুঝে ফেলেছে, দেবরাজের প্রতি তার মা’র ঘৃণাটা নিখাদ নয়!

নাহ, মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়াই বুঝি ভাল। চোখের আড়াল হলে হয়তো মানসীর একটু স্বস্তি আসবে।

আবার ল্যান্ডফোনটা বাজছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছাড়তে হল দেবরাজকে। এই সাতসকালে কে জ্বালাচ্ছে রে বাবা?

ঈষৎ টলমল পায়ে দেবরাজ বসার জায়গাটায় এল। কাল রাত্রে পানের মাত্রা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। অসীমকে ধরে এনেছিল রূপরেখা থেকে, দু’জনে বকবক করতে করতে কখন যেন আস্ত বোতলই সাফ। খোঁয়াড়িটা কাটেনি এখনও। রিসিভার তুলে জড়ানো গলায় বলল, “হ্যালো? কে?”

“সক্কাল সক্কাল মদ গিলে পড়ে আছিস নাকি?”

তীক্ষ্ণ বামাকণ্ঠের ঝংকারে ঘুমের ছটকা ছিঁড়ে খানখান। বনো!

সোফায় বসল দেবরাজ, “অ। তুই! তা খবর কী তোর? আছিস কেমন?”

“যাক, গলা চেনার মতো অবস্থায় আছিস তা হলে!”

“আরে দূর, নেশা-টেশা করিনি। জাস্ট ঘুমোচ্ছিলাম।”

“এত বেলা অব্দি? রাতভর মস্তি চলেছে বুঝি? এদিকে কলকাতায় এসে আমাকে একটা ফোন করার সময় পাস না? নাকি সম্পর্ক টম্পর্কগুলো একেবারে শিকেয় তুলে রাখতে চাস?”

বনোর রাগ একদমই অসংগত নয়। সত্যি তো, কলকাতায় চার পাঁচ দিন হয়ে গেল… এখনও…।

বোনের ক্রোধ প্রশমিত করতে দেবরাজ তাড়াতাড়ি বলল, “না রে, বিশ্বাস কর… এমন ব্যস্ত ছিলাম….। কাল এগ্‌জ়িবিশনটা শুরু হল তো…”

“জানি। খবরের কাগজে দেখেছি।” শান্ত স্বরেতেও একটু যেন বিদ্রুপ মিশিয়ে দিল বনানী। গুমগুমে গলায় বলল, “মোবাইল নাম্বারটা পালটে ফেললি কেন? পাছে তোর সঙ্গে যোগাযোগ করি, তাই?”

কাঁহাতক কৈফিয়ত দিতে ভাল লাগে? কথার মোড় ঘোরাল দেবরাজ, “তন্ময়ের কী খবর? ওর ফ্রোজেন শোল্ডার কমেছে? টাবলু পড়াশোনা করছে ঠিকঠাক? জে এন ইউতে অ্যাডমিশন পাওয়া কিন্তু বেশ টাফ।”

বনানী যেন একটু গলেছে। স্বর সামান্য শান্ত হল, “ওরা ঠিকই আছে। কিন্তু…”

“কী কিন্তু?”

“তোর সঙ্গে একটা জরুরি দরকার ছিল রে ছোড়দা। ক’দিন আগেই তো যোগাযোগ করতে আমি লেক গার্ডেন্সেও…”

“হ্যাঁ, দিলীপ বলছিল। কী ব্যাপার বল তো?”

“আছে। সব কথা কি টেলিফোনে হয়? তুই আজ একবার আয় না আমাদের বাড়ি।”

“কিন্তু…আমার তো এগ্‌জ়িবিশন… বিকেলে তো আমাকে ওখানে…”

“এখনই আয়। আমি তা হলে আজ আর অফিস বেরোব না। দুপুরে তুই এখানে খাওয়াদাওয়া করবি…।” বনানীর গলায় মিনতির সুর, “দরকারটা খুব আর্জেন্ট রে ছোড়দা। আয় প্লিজ।”

দেবরাজের মনটা দুলে গেল। বনো জোর করলে সে অনায়াসে কাটিয়ে দিত। কিন্তু এভাবে অনুরোধ করলে তো…। অবশ্য নরম নরম গলায় বনো আবার কী দায়ে যে ফাঁসাবে কে জানে!

দেবরাজ একটু হেসে বলল, “ওকে। আসছি।”

বনানীকে নতুন মোবাইল নাম্বারটা জানিয়ে রিসিভার রেখে দিল দেবরাজ। এবার বড় করে এক কাপ চা দরকার। নিজেই গিয়ে বানিয়ে নিল চটপট। নাহ, গরম লিকারে মাথাটা ছাড়ছে ক্রমশ। বাথরুম ঘুরে এসে ব্রেকফাস্ট বানাতে ডাকল দিলীপকে। ফ্রিজ থেকে সেদ্ধ চিকেন বার করে দিলীপ স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিল। চিবোতে চিবোতে খবরের কাগজে আলগা চোখ বুলিয়ে নিল দেবরাজ। রূপরেখায় তার যে এগ্‌জ়িবিশন চলছে, ছোট্ট হলেও তথ্যটা রয়েছে শিল্পসংস্কৃতির পাতায়। যাক, প্রচারটা ভালই করছে মম্তা।

দুপুরে আজ আর রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই, দিলীপকে ছেড়ে দিল দেবরাজ। স্নানে ঢুকছিল, গালে হাত দিয়ে থমকাল। গালটা খরখর করছে। পরপর দু’দিন কামায়নি, আজ একবার রেজার চালাতেই হবে।

গালে সবে শেভিং ক্রিম লাগিয়েছে, কলিংবেল টিংটং। আবার দিলীপ এল নাকি?

লম্বা লম্বা পায়ে এসে দরজা খুলেই হোঁচট। অসীম! হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে।

অসীমের পরনে ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি। কাঁধে পরিপাটি ভাঁজ করা শাল। পায়ে কোলাপুরি চপ্পল। চোখে ওজনদার কালো ফ্রেমের চশমা। টাক সহ তার নিখুঁত কামানো গোলগাল মুখখানা চকচক করছে। বেঁটেখাটো চেহারাটি থেকে ব্যক্তিত্ব বিচ্ছুরিত হচ্ছে যেন। বোঝার জো নেই, রাতদুপুর অবধি এই ফ্ল্যাটে বসে আকণ্ঠ মদ্যপান করেছে সে।

দেবরাজ অবাক মুখে বলল, “তুই? হঠাৎ?”

“মানে?” অসীম যেন ততোধিক অবাক, তুই রেডি হোসনি যে বড়?”

“কীসের জন্য?”

“বা রে, বেরোবি না? কাল রাত্তিরে অত কথা হল… আমরা চণ্ডীপুর যাব…! প্রথমটায় গাঁইগুঁই করছিলি, পরে রাজি হয়ে গেলি… বলে গেলাম দশটার মধ্যে আসব…”

যাহ, এসব কথা হয়েছে নাকি? কিছুই মনে পড়ছে না। রবিবার রাত্রে তারা বন্ধুবান্ধবরা মিলে হল্লাগুল্লা করার সময়ে অসীম তাকে চণ্ডীপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ঝুলোঝুলি করছিল বটে, কাল রাতেও বোধহয় প্রসঙ্গটা তুলেছিল, কিন্তু দেবরাজ সায় দিয়েছিল কি? সুরার ঘোরে তখন সে কী বলেছে, তা কি স্মরণ করা সম্ভব?

দেবরাজ অপ্রস্তুত স্বরে বলল, “আমায় ছেড়ে দে রে ভাই। আজ আমি পারব না।”

“তা বললে হয় নাকি? নীচে সবাই গাড়িতে তোর জন্য ওয়েট করছে…”

“সবাই মানে? আর কে কে আছে?”

“গেলেই দেখতে পাবি।” অসীম ঘড়ি দেখল, “আমায় ঝুল দিস না বাপ। দাড়িটা কামিয়ে নিয়ে চল।”

এ তো মহা ফাঁপরে পড়া গেল! ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে দেবরাজ বলল, “কিন্তু আমি যে একটা অন্য প্রোগ্রাম করে ফেলেছি। মানিকতলায় যেতে হবে। বনোর বাড়ি।”

“ও, বনানী? কাল ওর বাড়ি যাবি। ফোন করে ওকে বলে দে। আমার সঙ্গে যাচ্ছিস শুনলে ও কিচ্ছু মাইন্ড করবে না।”

“তবু…বিকেলে এগ্‌জ়িবিশন… অদ্দূর যাব..”

“নখড়া করিস না। যেতে আসতে চার ঘণ্টা, ওখানে বড়জোর ঘণ্টা দুই… পাঁচটার মধ্যে তুই মম্‌তার কোলে ফিরে আসবি।” দেবরাজের হাতে মৃদু চাপ দিল অসীম। উপরোধের সুরে বলল, “আমার মানটা রাখ। সবাইকে বললাম, আমার দিল্লিপ্রবাসী শিল্পীবন্ধু দেবরাজ সিংহরায়ও আজ আমাদের সঙ্গী হবে… এখন তুই যদি বাংক করিস…”

“তা আমি গিয়ে সেখানে করবটা কী? কিছুই জানি না, কারওকে চিনি না…”

“গেলেই চেনাজানা হবে। আর তোকে তো বলেইছি, কাজ তেমন কিছু নেই। জাস্ট অসহায় লোকগুলোর অভিযোগ-টভিযোগ শোনা, কী অত্যাচার চলছে তা স্বচক্ষে দেখা, আর মুখের কথা খসিয়ে মানুষগুলোকে একটু ভরসা জোগানো, ব্যস।” অসীম আবার কবজিতে চাপ দিল, “প্লিজ আয়।”

খানিক আগে বনো এই শব্দদুটোই উচ্চারণ করেছিল না? প্রায় তখনকার মতোই নিরুপায় বোধ করল দেবরাজ। অসীমকে নীচে যেতে বলে বাথরুমে এল। ঝটাঝট সেফটি রেজার বোলাল গালে। টুক করে স্নানটা সেরে নেবে ভেবেও মন বদলাল। জিনসের ওপর একটা লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি গলিয়ে বেরিয়ে এল ফ্ল্যাট ছেড়ে।

গেটের সামনে একটা বড়সড় গাড়ি অপেক্ষমাণ। অসীম আর ড্রাইভার ছাড়া আরও তিনজন সেখানে মজুত। দুই পুরুষ, এক মহিলা। অসীমই আলাপ করিয়ে দিল। ঝাঁকড়া চুল বছর পঁয়তাল্লিশের প্রমিত তালুকদার নাকি এক বিশিষ্ট নাট্যকর্মী, কাঁচাপাকা চুল গাট্টাগোট্টা সমীরণ ঘোষ সাহিত্যিক, প্রবীণা সুলেখা নন্দী প্রাক্তন অধ্যাপিকা। আপাতচোখে মানুষগুলোকে মন্দ লাগল না, দেবরাজ হাসিমুখে উঠে পড়েছে গাড়িতে।

বয়ঃকনিষ্ঠ হওয়ার অপরাধে গাড়ির পিছন দিকটায় বসেছে প্রমিত। ড্রাইভার স্টার্ট দিতেই আড়াআড়ি সিটে পা তুলে দিয়ে সে নাটুকে গলায় বলে উঠল, “দুগ্গা, দুগ্গা।”

অসীম সামনের সিটে, ড্রাইভারের পাশে। ঘাড় ঘুরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “শুভযাত্রার সিগন্যাল দিচ্ছ?”

“উঁহু। অক্ষত ফেরত আসার মনোবাসনাটা জ্বালিয়ে রাখলাম।”

দেবরাজ মাঝের সিটে, জানলার ধারে। সামান্য বিস্মিত স্বরে বলল, “কেন, গণ্ডগোলে পড়ার আশঙ্কা আছে নাকি?”

পাশেই উপবিষ্ট সমীরণ বলল, “আরে, না না। প্রমিত কাল্পনিক টেনশন তৈরি করতে ভালবাসে।”

“মোটেই কাল্পনিক নয় সমীরণদা। দেখলেন না, অজেয় আমায় সেদিন কীভাবে থ্রেট করছিল!”

“তুমিও তো ওকে জব্বর দিয়েছ। প্লাস সুলেখাদি এমন পয়েন্ট বাই পয়েন্ট অ্যাটাক করছিলেন…। আমার গিন্নি তো বলছিল, টিভিতে সেদিন অজেয় নো হোয়্যার হয়ে গিয়েছিল।”

“আরে বাবা, সরকারের চামচাবাজি করলেই হবে? স্পেডকে স্পেড বলতে কীসের পরোয়া? দ্বৈপায়নের মতো বেরিয়ে এসো। গলা ওঠাও।”

“সত্যি, দ্বৈপায়নবাবু দেখালেন বটে। সরকার তো ওঁকে কম কিছু দেয়নি। এই অ্যাকাডেমির হর্তাকর্তা, ওই ইউনিভার্সিটির ই-সি মেম্বার…। শুনছিলাম, ওঁকে নাকি যাদবপুরের ভি-সি করা হবে।”

“সে চান্স আর নেই। যা গাল দিয়েছেন গভর্নমেন্টকে! ফলস কেস-টেসে ওঁকে না ঝুলিয়ে দেয়। দেখলেন না, রাহুল মজুমদারের এগেনস্টে কেমন তহবিল তছরুপের খাঁড়া তুলেছে!”

কথোপকথনের কিছুই প্রায় মগজে ঢুকছিল না দেবরাজের। এ রাজ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলছে, এটুকুই যা আন্দাজ করা যায়। তবে নামগুলো তার প্রায় অচেনা। এই যে, অসীম ছাড়া আরও তিনজন চলেছে সঙ্গে, এরাও নিশ্চয়ই এ রাজ্যে মোটামুটি বিখ্যাত। কিন্তু এদেরই কি নাম আগে জানত দেবরাজ? একমাত্র প্রমিতের নামটাই বোধহয় পুরোপুরি অপরিচিত নয়। গত পুজোয় দিল্লিতে নাটক করতে গিয়েছিল সম্ভবত। তখনই বুঝি কানে এসেছে। সে যখন কলকাতায় ছিল, তখনকার সব ইন্টেলেকচুয়ালরা কোথায় এখন? কারা কোন পক্ষে? সরকার? না এগেনস্ট পার্টি? নাকি তারাও দ্বিধাবিভক্ত? তাই হবে হয়তো। একটু উঁচুতে ওঠা বাঙালিরা তো একমত হয় না কখনও।

গাড়ি দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরোচ্ছে। একটু দূরেই বাঁক নিয়েছে গঙ্গা। খিদিরপুর বন্দরের জাহাজের মাস্তুল আবছা আবছা দৃশ্যমান। অনেকটা যেন রেনোয়ার ছবি।

হঠাৎই পিছন থেকে প্রমিতের গলা, “আপনি কি বোর হচ্ছেন দেবরাজদা?”

“না না, আপনাদের গসিপ শুনছি তো।”

“স্রেফ গালগপ্পো মনে হল দাদা? প্রায় আড়াই তিন যুগ ধরে ক্ষমতার পাল্লা এক দিকে হেলে থাকলে কী সর্বনাশ যে হয়, তা যদি টের পেতেন! সর্বত্র শুধু দলবাজি আর গা-জোয়ারি।”

“বিদেশে তো থাকি না, সবই কানে আসে।”

“আপনাদের দিল্লিতেও নিশ্চয়ই এখানকার ব্যাপারস্যাপার নিয়ে খুব তুফান ওঠে?”

“খুব একটা না। বাঙালিদের নিয়ে ওখানে হাসাহাসিই হয় বেশি। ওরা বলে, পসচিম বংগালমে স্রিফ এক হি ওয়ার্ড চলতা হ্যায়। না। নেহি। সব্বাই চার বছর বয়স থেকে ইংরিজি শিখছে, এখানে ইংরিজিতে না। সবাই যখন কম্পিউটার চাইছে, এখানে কম্পিউটারে না। নয়ডা ফরিদাবাদ গাজিয়াবাদে ওয়ার্কাররা লাফিয়ে লাফিয়ে প্রোডাকশান বাড়াচ্ছে। কিন্তু এখানে? ওই, না। মানছি না, মানব না। চলছে না, চলবে না। দিচ্ছি না, দেব না। করছি না, করব না। এটাই হচ্ছে বাঙালির স্ট্যান্ডার্ড কালচার।” বলতে বলতে দেবরাজ হো হো হেসে উঠল, “এই যে দেখুন, গাড়িটা চলছে…। আমাদের ড্রাইভার সাহেব স্পিড তুলতে পারছেন কি?”

“উঁহু। কেন?”

“হয় রাস্তা ভাঙা, নয় হঠাৎ হঠাৎ বাম্প। অর্থাৎ সেই না আঙুল উঁচিয়ে রয়েছে পদে পদে। …অ্যাম আই রং?”

কয়েক সেকেন্ড সকলেই চুপ। তারপর অসীম বলে উঠল, “তুই অনেকটাই ঠিক। তাই না আমরা একটা বদল চাইছি?”

“কীসের?”

“সরকারের। এরা এখন পুরোদস্তুর অপদার্থে পরিণত হয়েছে। গায়ের জোর ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না।”

“শুধু গভর্নমেন্ট চেঞ্জ হলেই হবে? কী জানি!” দেবরাজ ঠোঁট উলটোল, “আমার তো মনে হয়, বাঙালির বেসিক অ্যাটিটিউডটারই পরিবর্তন প্রয়োজন।”

“হবে, হবে, সব হবে। ক’টা দিন যেতে দে, অ্যাসেম্বলি ইলেকশনটা হোক। তারপর রাজ্যটাকে আমরা বিলকুল পালটে দেব।”

“পারলেই ভাল। আমরা তা হলে দিল্লিতে একটু মুখ দেখাতে পারি।” দেবরাজ মিটিমিটি হাসছে, “তবে কী জানিস, তোরা সরকার বদলালেই এ রাজ্যের মানুষগুলো শ্যাম থেকে রাম হয়ে যাবে, এমনটা ভাবা…”

“তুই-ই কিন্তু এবার নেগেটিভ কথা বলছিস!”

“উনি যা-ই বলুন, শুনতে কিন্তু বেশ লাগছে।” প্রতিম ফুট কাটল, “দেবরাজদা, আপনি খুব স্ট্রেট ফরোয়ার্ড। আপনার মিসেস কিন্তু মোটেই আপনার মতো নয়।”

“মিসেস?” দেবরাজ ঘুরে তাকাল, “আমার?”

“হ্যাঁ। পুনম ম্যাডাম। কলকাতার নাট্যোত্সবে এসেছিলেন, আলাপ হয়েছিল। উনি এত নরম ভাবে কথা বলেন!”

“পুনম আমার মিসেস টিসেস নয়। আমরা দু’জনে জাস্ট একসঙ্গে থাকি।”

কথাটার ধাক্কায় প্রতিম পলকের জন্য অপ্রতিভ। পরমুহূর্তে হেসে বলল, “ওই হল। আপনারা দু’জন তো স্বামী-স্ত্রী’র মতোই আছেন।”

“ওই ‘মতো’টুকুই সত্যি। আমাদের মধ্যে কোনও মেটাফিজিকাল ইয়ে টিয়ে নেই। সবটাই ফিজিকাল।”

অসীম ছাড়া দেবরাজের বাকি তিন সহযাত্রী যেন কেঁপে উঠল কথাটায়। সমীরণ অপাঙ্গে দেখল সুলেখাকে। সুলেখার দৃষ্টি ঘুরে গেছে বন্ধ কাচের ওপারে। প্রমিতের চোখজোড়া দেবরাজের দিকে স্থির। তাদের মৃদু চাঞ্চল্যটুকু উপভোগই করছিল দেবরাজ। ন্যাকা ন্যাকা ভাবের কথা তার আসে না। তাতে দেবরাজকে কে কী ভাবল, দেবরাজের বয়েই গেল।

বম্বে রোডে পড়ল গাড়ি। এবার পথ বেশ মসৃণ, চারচাকা ভালই গতি নিয়েছে। দু’ধারে জনপদ, লোকজন যেমন তেমন পারাপার করছে, হঠাৎ হঠাৎ সাইকেল এসে যাচ্ছে সামনে, অমনি ঠোক্কর খাচ্ছে গতি।

তবু মন্দ লাগছিল না দেবরাজের। শহর থেকে বেরিয়ে একটা আউটিং মতো হচ্ছে, এ যেন উপরি পাওনা। সঙ্গে একটা বোতল থাকলে সফরটা জমে যেত। অসীমের ঝোলায় আছে নাকি? জিজ্ঞেস করবে? উঁহু, ব্যাটা আজ যা পূতপবিত্র হয়ে দেশোদ্ধারে বেরিয়েছে, শুনলে হয়তো কানে আঙুল দেবে। তা ছাড়া এই আধচেনা দলটির, বিশেষত অধ্যাপিকা মহিলার পানটানের ব্যাপারে ট্যাবু থাকতে পারে।

বরং যে উদ্দেশ্যে চলেছে, সেটা নিয়েই দু’-চারটে কথা চালানো যাক। দেবরাজ অসীমকে জিজ্ঞেস করল, “চণ্ডীপুরে অত্যাচার টত্যাচার হচ্ছে তো শুনলাম। কিন্তু ওখানকার এগজ্যাক্ট সমস্যাটা কী?”

সুলেখা ঘাড় বেঁকিয়েছে, “সে কী? দুনিয়াসুদ্ধু লোক জানে, আর আপনি জানেন না?”

“আমি একটু আনপড় টাইপ আছি। খবরগুলোর হেডিং দেখি, ভেতরে ঢুকতে পারি না।” দেবরাজ হালকাভাবে বলল, “শুনেছি, কী একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি হবে…”

“উঁহু, একটা নয়। সিরিজ অফ কারখানা।” সমীরণ বিজ্ঞ সুরে বলল, “আজকাল এর নাম হয়েছে কেমিক্যাল হাব। অনেকগুলো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ওখানে আসতে আগ্রহ জানিয়েছে।”

“সে তো ভাল কথা। চণ্ডীপুরের লোকদের সঙ্গে বিরোধ বাধল কেন?”

“ওফ, তোকে কতবার বলব, ওই হাব করার জন্য গভর্নমেন্ট বেশ কয়েকটা গ্রামের লোকজনকে উত্খাত করতে চায়। কিন্তু গ্রামবাসীরা সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে নড়তে নারাজ।” অসীম নড়ে বসেছে, “এই দিয়ে শুরু। গ্রামের মানুষদের প্রতিবাদ মানল না সরকার, গুলি-টুলি চলেছে, বারোজন মারা গেল, তাতেও দমাতে পারেনি বলে পার্টির গুন্ডা লেলিয়ে নানাভাবে টর্চার চালাচ্ছে…”

“শুধু ভিটে বাঁচাতেই এত যুদ্ধ?”

“সেটাই মেইন। তবে… কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে বলেই আরও বেশি আপত্তি।”

“কেন? কেমিক্যাল বানানো কী খারাপ? বিদেশের ওপর নির্ভরতা কমবে, এতে তো দেশেরই লাভ।”

“কত ক্ষতিকর রাসায়নিক ওখানে বানানো হবে আপনি জানেন?” সমীরণ গম্ভীর স্বরে বলল, “হিউম্যান লাইফের পক্ষে ওই সব কেমিক্যাল অত্যন্ত ডেঞ্জারাস। নানান ধরনের অসুখবিসুখ তো হবেই, একটু ভুলচুক ঘটলে হাজারে হাজারে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। সেই ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির মতো।”

“কিন্তু কেমিক্যালসগুলো তো কাজের। কোথাও না কোথাও তো বানাতেই হবে।”

“তা বলে এত ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায়? মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা আছে জেনেও?”

“এ রাজ্যে কোথায় বসতি কম সমীরণবাবু? পাহাড়চূড়ায় যাবে? জঙ্গলে ছুটবে?” দেবরাজ হাত উলটোল, “সেখানেও তো সমস্যা। পরিবেশ নষ্ট হবে।”

“আপনি যে মশাই ওদের মতো কথা বলছেন! আমরা কিন্তু…”

“ওরা আমরা বুঝি না। আমি সমস্যাটার কথা ভাবছি। আফটার অল পিছিয়ে পড়া রাজ্যটার তো উন্নয়ন চাই। কারখানা ফারখানা না হলে…”

সুলেখা বলল, “চোখকান বুজে যেখানে সেখানে ঢাউস ঢাউস কারখানা খুলে দিলে উন্নয়নের রথ গড়গড় চলতে শুরু করে, এই সাবেকি তত্ত্ব আমরা মানি না দেবরাজবাবু। আমরা কি দেখব না, উন্নয়নটা কীভাবে হচ্ছে? এবং কার স্বার্থে? যাদের ভাল করতে চাই, তাদেরই মেরেধরে আউট করে দিলাম, এমন করাটা কি সংগত? যদি বলেন রাজ্য তথা দেশের স্বার্থে তাদের বলি চড়াতে হবে… পরিবেশের সর্বনাশ ঘটলেও কুছপরোয়া নেই… তা হলে তো সেই উন্নয়ন না হওয়াই মঙ্গল।”

মহিলার কথাগুলো ফ্যালনা নয়। জোর গলায় প্রতিবাদ করতে পারল না দেবরাজ। তবু কেন যে তার মনে হচ্ছিল, এখানেও সেই না-এর অভ্যেস কাজ করে যাচ্ছে চুপিসাড়ে। মরুক গে যাক, এত ভাবাভাবির তার দরকারটা কী। অসীমের ডাকে একটা দিন সে বন্ধুকৃত্য করতে চলেছে, ঘুরে বেড়িয়ে কয়েকটা ঘণ্টা পার করে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

দেবরাজ কাচের ওপারে চোখ মেলল। নিসর্গ এখন বেশ খোলতাই, পথের দু’পাশে সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে ব্যস্ত লোকালয়, ছোটখাটো কয়েকটা কারখানাও পড়ল পথে। একটা নদীর ব্রিজে উঠছে গাড়ি। কোলাঘাট আসছে বুঝি? নদীটা কি রূপনারায়ণ?

হ্যাঁ তো। রূপনারায়ণই তো। এ নদী তো তার বহুকালের চেনা। আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে বেশ কিছুদিন তো জোর হুজুগ চলেছিল, তারা চার পাঁচজন বন্ধু মিলে প্রায় ফি রোববার চলে আসত এই কোলাঘাটে। চিরন্তন ছিল ভাব জমানোয় মহা ওস্তাদ, ঘাটের মাঝিদের পটিয়ে পাটিয়ে, কোনও এক মাঝিকে নিয়ে, দিব্যি পাড়ি জমাত নদী বেয়ে। নিসর্গই দেবরাজের আকুলতা। চিরকালই। শিশুর তৃষ্ণা নিয়ে ডানদিকে দৃষ্টি বাড়াল দেবরাজ। মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছে, দু’-দুটো নদী এসে মিশে যাচ্ছে রূপনারায়ণে। একটা তো শিলাই। অন্যটার যেন কী নাম? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মুণ্ডেশ্বরী। নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে অপরূপ সব গ্রাম। একটা চর মতোও ছিল। সেখানেই তো মানসীর সঙ্গে আলাপ। কলেজের বন্ধুরা মিলে পিকনিক করতে এসেছিল ওই চরে। সবে তখন মানসীর ফার্স্ট ইয়ার, কিশোরী কিশোরী ভাবটাও ঘোচেনি। দেবরাজকে স্কেচ করতে দেখে লম্বা বিনুনি বাঁধা শ্যামলা শ্যামলা মেয়েটার দু’চোখে কী কৌতূহল। যেচে এসে পরিচয় করল, প্রশ্নের তার অন্ত নেই…। সেখানেই শেষ নয়, পরের সপ্তাহে মানসী এক বান্ধবীকে নিয়ে আর্ট কলেজে হাজির। তার ভীরু ভীরু মুগ্ধ চোখ দু’খানা কী যে অচেনা সংকেত পাঠাল, দেবরাজও কিনা মজে গেল আচমকাই! ভবিষ্যতের ভাবনা ভুলে, বাড়ির আপত্তি ঠেলে, চোখকান বুজে তার ওপর ভরসা করেছিল মানসী। সম্পর্ক শেষ অবধি টিকল না। হয়তো দেবরাজেরই দোষ। সুশীল বাধ্য স্বামী হওয়াটাই যে ভালবাসার একমাত্র লক্ষণ নয়, মানসীকে তো সে কথা বোঝাতেই পারেনি দেবরাজ।

মানসীর ওপর অবশ্য দেবরাজের কোনও ক্ষোভ নেই। বরং সে মানসীর কাছে কৃতজ্ঞ। আঁচলের মতো একটা মেয়েকে উপহার দিয়েছে বলে। কী সুন্দর যে হয়েছে মেয়েটা, আহা। কাল তো রূপরেখায় আঁচলের উপস্থিতি এগ্‌জ়িবিশনের রংটাই বদলে দিয়েছিল। কতজন যে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। এক সময়ে তো দেবরাজ আঁচলকে বলেই ফেলল, এবার তো তোর একটা পাহারাদার দরকার রে আঁচল! আর দেরি না করে একটা বিয়ে করে ফ্যাল।

শুনেই মেয়ের গলায় ছদ্ম কোপ, “তুমিও তো পিসিমণির মতো শুরু করলে!”

“বনোও তোকে বিয়ের কথা বলছে বুঝি?”

“শুধু বলেই পিসিমণি থামে নাকি? সম্বন্ধ দেখছে, মা’র সঙ্গে ঘোঁট করছে…।”

আঁচলের সংলাপটা মনে পড়তেই দেবরাজের মগজে পলকা টোকা। বনো কি আঁচলের বিয়ের ব্যাপারেই তার সঙ্গে কোনও কথা বলতে চায়? কিন্তু সে কোন হরিদাস পাল? মানসীরা যা ঠিক করবে, তা-ই হবে, ওদের মধ্যে দেবরাজ নাক গলাবেই বা কেন? বনোটার আক্কেল কম, সর্দারি করতে গিয়ে খামোখা না জটিলতা বাঁধায়। আঁচলের মা আর বাপি যদি দেবরাজকে বিয়েতে ডাকে, তা হলেই তো দেবরাজ ধন্য হয়ে যাবে।

ভাবনাটা ছিঁড়ে গেল দেবরাজের। এত উচ্চ স্বরে বাক্যালাপ চলছে অসীম আর প্রমিতের! শেক্সপিয়রের কোন একটা নাটককে মঞ্চস্থ করছে প্রমিতরা, এ রাজ্যের সমসাময়িক ঘটনাগুলোকেও নাকি কায়দা করে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে নাটকে…। এতে নাকি দারুণ জমে গেছে প্লে, দর্শকরা ধন্য ধন্য করছে। অসীমও প্রমিতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দিব্যি সুললিত ভাষায় প্রমিতের তোল্লাই দিয়ে চলেছে। সমীরণ আর সুলেখা তত উচ্চকিত নয়, তবে তারাও যোগ দিয়েছে স্তুতিতে।

দেবরাজের খুব একটা হজম হচ্ছিল না আলোচনাটা। আজকাল এই এক স্টাইল হয়েছে, পুরনো ক্লাসিকগুলোকে নিয়ে যে যেভাবে পারে চটকাচ্ছে। শুধু প্রমিত কেন, পুনমরাও কম যায় না। খোদার ওপর এই খোদকারি করা নিয়ে কতবার যে তর্ক বেঁধেছে পুনমের সঙ্গে। দেবরাজের সাফ কথা, ক্যালি থাকলে অন্যের লেখার ওপর কারিকুরি না করে নিজেরা অরিজিনাল কিছু করো। দয়া করে ওই বকচ্ছপগুলো বানিও না। আজও সেই কথাটাই বলবে নাকি প্রমিতকে? থাক গে, অসীমের এই দঙ্গলটার সঙ্গে কিছুতেই তার মতে মিলছে না, কথায় কথায় তর্ক বেঁধে যাচ্ছে। গোটা রাস্তাটা ঝগড়া করে কাটাতে ভাল লাগে?

প্রাণপণে নিজেকে বধির করে রাখল দেবরাজ। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজেছে। একটু ঘোর ঘোর মতোই এসেছিল, আচমকা জোর ঝাঁকুনি। ঘ্যাচাং ব্রেক কষেছে গাড়ি।

দেবরাজ চমকে তাকাল। গাড়ির সামনে জনা দশেক যুবক পথ আটকে দাঁড়িয়ে। খান কতক মোটকবাইকও আড়াআড়ি রাখা আছে রাস্তায়।

অসীম জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল। উত্তেজিত ভাবে বলল, “হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ?”

জিনস-টিশার্ট পরা এক যুবক এগিয়ে এল। তর্জনী উঁচিয়ে বলল, “কোনও বাকতাল্লা নয়, গাড়ি ঘুরিয়ে নিন।”

“বললেই হল? যাচ্ছি যখন, ফিরব না। দেখি কে রুখতে পারে!” বলেই ড্রাইভারকে নির্দেশ, “স্টার্ট দাও তো।”

“একদম জোর ফলাবেন না। শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী বলে খুব তেল বেড়েছে, অ্যাঁ? অ্যাইসান কেলাব না…!”

“ছি, ও কী ভাষা? এঁরা সব জ্ঞানীগুণী মানুষ… এঁদের সঙ্গে ওভাবে কেউ কথা বলে?” যুবকদের ঠেলে সরিয়ে হঠাৎই এক মধ্যবয়সি, ধুতিপাঞ্জাবি, চশমাধারীর আবির্ভাব। গাড়ির ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিনীত স্বরে অসীমকে বলল, “কেন অশান্তি বাড়াচ্ছেন স্যার? দেখছেন তো, স্থানীয় মানুষ চাইছে না বাইরের লোকজন এসে চণ্ডীপুরে ঝুটঝামেলা বাধাক। এদের সব মাথা গরম হয়ে আছে, কখন কী করে ফেলবে…”

দেবরাজ অবাক হয়ে শুনছিল বাক্য বিনিময়। সভ্যভব্য চেহারার লোকটার ঠান্ডা গলায় ভয় দেখানোটা আচমকা তাতিয়ে দিল তাকে। অদূরে ক্যামেরা কাঁধে কয়েকজন দাঁড়িয়ে, বোধহয় টিভি চ্যানেলের লোকজন। মোটেই সিনক্রিয়েট করার ইচ্ছে ছিল না দেবরাজের, তবু স্থান কাল পাত্র ভুলে ঝটাকসে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। চেঁচিয়ে বলল, “ভেবেছেনটা কী? এ দেশের নাগরিক হিসেবে, চণ্ডীপুর কেন, জাহান্নমেও যাওয়ার আমার অধিকার আছে। আপনি বাধা দেওয়ার কে মশাই?”

লোকটার কোনও হেলদোল নেই। চোখ পিটপিট করে একবার দেখল দেবরাজকে। তারপর ছেলেগুলোর উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল, “অ্যাই, তোরা গাড়ির পাশে ঘুরঘুর করছিস কেন রে? টায়ারের হাওয়া খুলে দিবি? না না, ওসবের দরকার নেই, ওঁরা এমনিই ফিরে যাবেন।”

দেবরাজ কী বলবে ভেবে পেল না। ফুঁসছে রাগে।

লোকটা আবার বলল, “যান, গাড়িতে উঠে পড়ুন। আপনারা মানীগুণী মানুষ… যারা মানুষের ভাল চায় না, সেই প্রতিক্রিয়াশীলদের দাবার বোড়ে কেন হচ্ছেন? চণ্ডীপুরে দেখার কিচ্ছু নেই, সেখানকার মানুষ ভালই আছে। মাঝে গ্রামগুলোতে আঁধার নামানোর চেষ্টা হয়েছিল, আবার সেখানে নতুন সূর্য উঠেছে।”

কাছেই দু’জন পুলিশও হাজির। কাঁধে বন্দুক। দেবরাজ গলা উঁচিয়ে বলল, “এই যে, দাদারা…? আমাদের গাড়িকে ফোর্সফুলি স্টপ করে দেওয়া হয়েছে…”

যুগল বন্দুকধারী যেন শুনতেই পেল না। হাঁটতে হাঁটতে ওদিক পানে সরে গেল। উদাস চোখে প্রকৃতি দেখছে।

প্রমিত ডাকল, “চলে আসুন দেবরাজদা। এরা খুব ডেঞ্জারাস। এক্ষুনি হয়তো হাসতে হাসতে থানইট ছুড়বে।”

অক্ষম ক্রোধে ছটফট করছিল দেবরাজ। অসীম তাকে টেনে ঢুকিয়ে দিল গাড়িতে। তখনও দেবরাজের রগের শিরাদুটো দপদপ করছে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিল ড্রাইভার। ফেরার পথেও দেবরাজের মাথার আগুন যেন নিভছিল না। এ কোন দেশ, যেখানে মানুষের কোথাও একটা যাওয়ার স্বাধীনতা পর্যন্ত নেই? কী ঘটছে, দেখতেও দেবে না? গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরছে এরা, এত বড় দুঃসাহস? নাহ, এর একটা জোরালো প্রতিবাদ করতেই হবে। পুলিশ-প্রশাসন ঠুঁটো করে রাখা এই ধরনের স্বৈরাচারীদের উপড়ে ফেলাটা খুব জরুরি।

পকেটে মোবাইল বাজছে। বের করে কানে চাপতেই বনানীর গলা, “কী রে ছোড়দা, তুই এলি না?”

কোনওক্রমে ভেতরের উত্তেজনা দমন করে দেবরাজ বলল, “হঠাৎ একটা কাজে…”

“কী এমন কাজ রে ছোড়দা? মানুষের প্রাণের চেয়ে বেশি?” বনানীর গলা হঠাৎ কেমন করুণ শোনাল, “কেন তোকে খুঁজছি জানিস? বড়দার জন্য?”

“কী হয়েছে দাদার?”

“খুব খুব খুব খারাপ অসুখ রে। ক্যানসার। দাদা বোধহয় আর বাঁচবে না।”

বনানীর মুখোমুখি বসে ছিল দেবরাজ। ঘাড় ঝুলিয়ে। ফোনে আচমকা দাদার খবরটা পেয়ে তার মতো এক হৃদয়হীন পাষণ্ডরও যে কী হল, কলকাতায় ঢুকে রূপরেখা গ্যালারিতে যেতে ইচ্ছেই করল না আজ। সোজা মানিকতলায় বোনের ফ্ল্যাটে হাজির। এসেও থম। বনো কত কী বলে যাচ্ছে, কিছুই যেন কানে ঢুকছে না। শুধু একটাই প্রশ্ন চরকি খাচ্ছে মাথায়। সাদাসিধে গোবেচারা ভালমানুষ দাদাটার কপালে এমন একটা নিয়তি লেখা ছিল? নিয়তিতে তার কণামাত্র বিশ্বাস নেই, তবু ওই শব্দটাই যে কেন হাতুড়ি মারছে মগজে?

বনানী উত্কণ্ঠিত স্বরে বলল, “কী রে চুপ মেরে গেলি কেন? কী করা যায় বল?”

“ভাবছি।” দেবরাজ সামান্য নড়ে বসল। গলা ঝেড়ে বলল, “ডাক্তারের কী ওপিনিয়ান?”

“খুব একটা আশা দিচ্ছে না।” মধ্যবয়সি পৃথুলা বনানীর গলা ভার ভার শোনাল, “যথেষ্ট অ্যাডভান্সড স্টেজ। ফুসফুসে শুরু হয়ে, এখন নাকি ব্রেনেও ছড়িয়ে গেছে।”

“কবে এগজ়্যাক্টলি ধরা পড়ল?”

“বললাম তো… দিন পনেরো আগে। তখন থেকেই তো তোর সঙ্গে যোগাযোগ করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছি। তোর লেক গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটেও তো…”

“হুঁ। কেয়ারটেকার ছেলেটা বলছিল। তবে আমি তো বুঝতে পারিনি এমন সিরিয়াস একটা ব্যাপার…।” দেবরাজের গলায় অপরাধী অপরাধী সুর এসে গেল। অস্ফুটে বলল, “তা দাদার কী রিঅ্যাকশন? ভেঙে পড়েছে?”

“বড়দা কিছু জানে না। বউদিও না। দু’জনেই যা নার্ভাস পার্টি। বউদি তো মোস্ট ক্যালাস। মাঝে মাঝেই দাদার ঘাড়ে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, আগে কিচ্ছুটি বলেনি। হঠাৎ একদিন ব্যথার চোটে সেন্সলেস হতে তখন আমাদের ডাকাডাকি। রাতদুপুরে আমি আর তন্ময় দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে দাদাকে নার্সিংহোমে ভরতি করলাম। এখন অসুখটার নাম শুনলে বউদি হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে। আর দাদা তো কোলাপসই করে যাবে।”

“কিন্তু… এত টেস্ট-ফেস্ট চলছে… এম-আর-আই, স্ক্যান, বায়োপসি…?”

“তন্ময় সেটা বউদিকে একভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ব্রেনে একটা টিউমার মতো আছে, তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়, চিকিৎসা করালে সেরে যাবে।” বনানী ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, “তবে কদ্দিন আর গোপন রাখা সম্ভব? হসপিটালে তো ভরতি করতেই হবে। রেডিয়েশন চলছে, তারপর কেমোথেরাপি…”

“ভাল প্রাইভেট হসপিটালে যদি দেওয়া যায়? দাদাকে সেভাবে না জানিয়ে যদি ট্রিটমেন্টটা চলে?”

“প্রাইভেটে ভয়ংকর খরচ রে। বড়দার কীই বা সঞ্চয়। সবে তো রিটায়ার করল, এখনও পাওনাগন্ডা কিছু হাতে আসেনি। আর আমাদের অবস্থাও তো তুই জানিস। যেটুকু যা আছে, টাবলুর পড়াশোনার পিছনে ঢালতে হবে।”

দেবরাজের কপালে পলকা ভাঁজ। সত্যি তো, কী বা আছে দাদার? প্রাচীন একটা পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক ছিল দাদা। মাইনেটা সরকারই দিত বটে, তবে তার পরিমাণ মোটেই আহামরি নয়। নেহাত মাথার ওপর বাবার তৈরি ছাদটা ছিল, তাই না কোনও ক্রমে চলে গেছে আপনিকোপনির সংসার। অবসরের পর দাদার যা জুটবে, সেও নিশ্চয়ই বলার মতো কিছু নয়। ওই খুদকুঁড়োটুকু দিয়ে এমন মারণব্যাধির সঙ্গে লড়াই চলে কী? আর বড়দার জন্য বনোর যতই দরদ উথলে উঠুক, সে নিজের সংসার ভুলে কাছাছাড়া হয়ে দাদাকে সাহায্য করবে, এ নিছক দুরাশা। বনানীর সরকারি চাকরি, তন্ময় আছে ব্যাঙ্কে, দু’জনের যৌথ রোজগার নেহাত ফ্যালনা নয়, তবুও। অবশ্য এটাই তো গড়পড়তা গৃহী মানুষদের রীতি। বনানীরাই বা এর ব্যতিক্রম হবে কেন!

খরচের জন্যই কি বনানীর ছোড়দাকে এত খোঁজাখুঁজি? হবেও বা। তবে এই মুহূর্তে ওই চিন্তাকে প্রশ্রয় দিল না দেবরাজ। সহজভাবেই বলল, “টাকাপয়সা নিয়ে ভাবিস না। কোথায় বেস্ট ট্রিটমেন্ট হবে সেটাই আগে দেখা দরকার।”

“তন্ময় বলছিল নিউ টাউনে একটা দারুণ হসপিটাল হয়েছে। ওদের ব্যবস্থাপাতিও খুব মডার্ন।”

“প্রয়োজনে সেখানেই অ্যাডমিট করব। কিন্তু দাদা এখন আছে কেমন? পুরো শয্যাশায়ী?”

“না না, হাঁটাচলা করছে। তবে বড় দুর্বল। এই তো রোববার গিয়েছিলাম, গল্পটল্পও করল। বলছিল, মাথার ভিতরটা নাকি টলটল করে, ভুলে ভুলে যায়। বোধহয় ব্রেনে জল জমার এফেক্ট।”

“হুম। ইডিমাতে এমন হয়।” দেবরাজ ভুরু কুঁচকোল, “আজ একবার দেখা করে আসি।”

“যাবি? এখন? তোর না এগ্‌জ়িবিশন চলছে?”

“গুলি মার। এটা বেশি আরজেন্ট। … তুইও যাবি নাকি?”

“আমি?” বনানী বসার ঘরের দেওয়ালঘড়িটা দেখল, “সাড়ে ছ’টা বাজে, এবার কোচিং থেকে ফিরবে…”

“অ। তুই তা হলে থাক।” দেবরাজ উঠে দাঁড়াল, “তন্ময়কে বলিস রাতে ফোন করব।”

“এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন?” বনানী প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠল, “তোর সঙ্গে আর একটা কথা ছিল যে।”

“কী কথা?”

“আঁচলের বিয়ের ব্যাপারে।”

উদ্বেগের মাঝেও কৌতূহলের হালকা টোকা। আঁচলকে পাত্রস্থ করার তোড়জোড় সত্যিই চলছে তা হলে? ঈষৎ দোনামোনা করে বসেই পড়ল দেবরাজ। কিছুই যেন জানে না এমন ভঙ্গিতে বলল, “আঁচল বুঝি বিয়ে করছে? কবে? কাকে?”

“আহা, করবে কেন। দেওয়া হবে।” বনানী মুচকি হাসল, “আমি ওর পাত্র দেখছি।”

“হোয়াই তুই? ওটা তো মানসীদের দায়িত্ব।”

“একটা ভাল ছেলের সন্ধান পেয়ে গেলাম যে। আমার বড়জায়ের মাসুতুতো দিদির একমাত্র সন্তান। দিদিটি খুব নামজাদা। বিদিশা চৌধুরী।”

“কে সে?”

“সারদা গার্লস কলেজের প্রিন্সিপাল। গভর্নমেন্টের খুব কাছের লোক। নিজেও পার্টির শিক্ষক ফ্রন্টে আছে। শিগগিরই হয়তো কোনও ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলার হয়ে যেতে পারে।”

দেবরাজ তেমন একটা বিমোহিত হল না। আলগাভাবে বলল, “রাজনীতির বাড়িতে কি মেয়ে পাঠানো ভাল?”

“খারাপ কীসের? মহিলার লেখাপড়ার জগতেও খুব নাম। প্লাস, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার, শ্বশুর পর্যন্ত নেই, আঁচল ঝাড়া হাত পা হয়ে রানির হালে থাকবে।”

“শ্বশুর নেই মানে? মারা গেছে?”

“অনেক দিন। তারও বেশ নাম ছিল একসময়ে। কবি হিসেবে।”

“কে বল তো?”

“সজল চৌধুরী।”

নামটা যেন শোনা শোনা! এককালে অনেক কবির সঙ্গে দহরম-মহরম ছিল দেবরাজের। এখন কারও সঙ্গেই আর যোগাযোগ নেই। তাদের কেউ কি? উঁহু, মনে আসছে না।

স্মৃতি হাতড়ানো বন্ধ করে দেবরাজ বলল, “ছেলেটি কী করে?”

“পাবলিক রিলেশন অফিসার। একটা আধা সরকারি সংস্থায়।”

“স্বভাবচরিত্র কেমন?”

“এমন বাপ মার ছেলে, বাজে কেন হবে!”

বাবা মাকে দেখে যে ছেলের চরিত্র অনুমান করা যায় না, দেবরাজই কি তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ নয়? স্কুল মাস্টার অবিনাশ সিংহরায় এবং নিপাট ভালমানুষ সরমা দেবীর কনিষ্ঠ পুত্রটি যে এমন মদ্যপ, বাউন্ডুলে, নারীবিলাসী হবে, তা কি স্বপ্নেও ভাবা সম্ভব ছিল? দেবরাজের চোদ্দো পুরুষে কেউ তুলি ধরেছে বলে জানা নেই, অথচ সে তো দিব্যি এঁকেজুকেই জীবনটা কাটিয়ে দিল। এটাই বা কোন অঙ্কে মেলে?

মনে এলেও দেবরাজ কথাগুলো উচ্চারণ করল না। খামোখা প্রশ্নটা সে করলই বা কেন? চরিত্র নিয়ে কৌতূহল কি তার মুখে শোভা পায়? তা ছাড়া মানানসই সম্বন্ধ না হলে মানসী যে আদৌ এগোবে না, এ তো জানা কথা।

দেবরাজ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ভাল হলেই ভাল। মানসীরা যা ঠিক করবে তাতেই আমার সায় আছে।”

“এ তো এড়ানো কথাবার্তা। যতই হোক, তুই না মেয়ের বাবা? তার ভালমন্দর ব্যাপারে তোর কোনও দায় নেই?”

“আমার?” দেবরাজ হেসে ফেলল, “কীভাবে সেটা পালন করতে হবে শুনি?”

“বিদিশা চৌধুরী জানে, দেবরাজ সিংহরায়ই আঁচলের আসল বাবা। তুই যখন কলকাতায় এসেইছিস, মহিলাকে একবার মিট করে নে না। ছেলেটার সঙ্গেও আলাপ কর। আঁচল কেমন ফ্যামিলিতে যাচ্ছে জানা থাকলে তোরও হয়তো ভাল লাগবে।”

ক্ষণিকের জন্য দেবরাজের মনটা দুলে গেল। যতই দূরে থাকুক, আঁচল তার বড় প্রিয়। তার পাপীতাপী জীবনের একমাত্র পবিত্র দুর্বলতা। ভবিষ্যতে সে অসুখী হবে, ভাবলেই বুকটা চিনচিন করে ওঠে। কেমন ঘরবর পাবে আঁচল, জানতে দেবরাজের লোভ হয় বই কী। কিন্তু আগ বাড়িয়ে ছেলে দেখতে যাওয়াটা কি সংগত? ঘটনাটা কী চোখে দেখবে মানসী? কিংবা মানসীর বর? তাকে ফোপরদালাল ভাবাটাও তো বিচিত্র নয়।

দ্বিধাদ্বন্দ্ব সত্ত্বেও সরাসরি না বলতে পারল না দেবরাজ। বলল, “দেখি, যদি সময়-টময় পাই।”

“সময়ের ছুতো দিস না ছোড়দা। জীবনে কোনও কর্তব্যই তো করলি না। নিজের মেয়েকে স্বেচ্ছায় পর করে রাখলি। অথচ শান্তনুদা পরের মেয়েটাকে কী সুন্দর আপন করে নিল। স্রেফ তোর নেগলিজেন্সের জন্য।

ওফ, ফের সেই পিসিমা পিসিমা ডায়ালগ! বনানীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে পড়ল দেবরাজ। বেরিয়ে এসে রাস্তায় নেমে ট্যাক্সি ধরল একটা। জোর করে আঁচলের প্রসঙ্গ ঝেড়ে ফেলল মন থেকে। দাদার কথাই ভাবছিল। কত দিন যে দেখা হয়নি। গতবার যখন এল, পাইকপাড়ার পথ মাড়ায়নি। তার আগের বারেও না। দাদা বউদির সঙ্গে মোলাকাত করার ব্যাপারটা মনেই হয়নি সেভাবে। বিজয়ার পর একটা ফোন করে ফি বছর, এবার তো সেটাও ভুলে গেল। একে কী বলা যায়? ভুলো মন? উদাসীনতা? না কী দাদাকে সে ছেঁটেই ফেলেছে জীবন থেকে? এতটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছে, যে দাদা বউদি কেমন আছে, কীভাবে তারা দিন কাটায়, জানতেও ইচ্ছে করে না। অথচ দাদা তো কখনও তাকে দূরে ঠেলেনি! দেবরাজের শত বেপরোয়াপনা সত্ত্বেও! বরং ভাই যখন দুম করে লেক গার্ডেন্সে চলে গেল, ভারী দুঃখ পেয়েছিল মানুষটা। বউদিও। পুরনো সেই ছবিটা কোত্থেকে যেন জেগে উঠছে আজ।… ম্যাটাডোরে মালপত্র তুলে দিয়ে দরজায় এসে দাঁড়াল দেবরাজ। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ওকে, আমি তা হলে কাটলাম, তোমরাও মদোমাতালটার হুজ্জোতি থেকে মুক্তি পেলে। দাদার চোখে কেমন যেন দৃষ্টি, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তখনও। বউদি অবশ্য নীরব থাকেনি। ভিজে ভিজে গলায় বলেছিল, হ্যাঁ, তোমারও সুখ এবার উপচে পড়বে। আমরা কাঁটা হয়ে ফুটছিলাম কিনা!

আশ্চর্য, কথাগুলো এখনও নির্ভুল স্মরণে আছে দেবরাজের? ভোলেনি? হৃদয়ের অন্তস্থলে শতসহস্র ঘটনার আড়ালে চাপা পড়েও কত কী যে বেঁচে থাকে!

ভিড় থকথকে সন্ধে। মিহি কুয়াশা, পথঘাটের ধুলো আর গাড়িঘোড়ার ধোঁয়া মিলেমিশে মহানগরীর বাতাসে এখন পাতলা আবছায়ার আস্তরণ। ঘষটে ঘষটে চলছে যানবাহন, ক্লান্ত সরীসৃপের মতো। শ্যামবাজার মোড়ে বিকট জ্যাম, থেমে গেল ট্যাক্সি। থেমেই আছে।

অসহিষ্ণু দেবরাজ তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, পকেটে মোবাইল সরব।

মনিটরে অচেনা নম্বর। কে রে বাবা? দেবরাজ গলা ঝাড়ল, “হ্যালো?”

“আমি কি পেইন্টার দেবরাজ সিংহরায়ের সঙ্গে কথা বলছি?”

পরিশীলিত পুরুষকণ্ঠ। দেবরাজ বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু আপনি…?”

“আমি অনমিত্র বসু। চ্যানেল রাতদিন থেকে বলছি। আপনারা কয়েকজন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী আজ চণ্ডীপুর যাচ্ছিলেন, বাধা পেয়ে ফিরে এসেছেন…”

“এক সেকেন্ড। আমার নাম্বার কোত্থেকে পেলেন?”

“প্রমিত তালুকদার দিয়েছেন। উনিও তো আজ আপনার সহযাত্রী ছিলেন…”

“ও হ্যাঁ।” দেবরাজ পলক থমকাল। চোখে দুলে উঠল দুপুরের দৃশ্যটা। বাইক বাহিনীর চোখ রাঙানি, ধুতিশার্টের হিম হিম স্বরে ভয় দেখানো…। গরগরে গলায় দেবরাজ বলল, “আজ চরম অসভ্যতা হয়েছে আমাদের সঙ্গে। কোনও সভ্য দেশে এভাবে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়… আই জাস্ট কান্ট বিলিভ ইট।”

“আমাদের টিভি চ্যানেল কাল এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা টকশো’র আয়োজন করেছে। যদি কাইন্ডলি অনুষ্ঠানটায় পার্টিসিপেট করে আপনার বক্তব্য রাখেন…”

“আই ডোন্ট মাইন্ড।” বলেই হোঁচট খেল দেবরাজ, “প্রোগ্রামটা কখন?”

“প্রাইম টাইম। সন্ধে সাতটা থেকে আটটা। যাঁরা যাঁরা আজ গিয়েছিলেন, সকলেই থাকবেন।”

“কিন্তু… আমার একটা এগ্‌জ়িবিশন চলছে…”

“জানি স্যার। রূপরেখা আর্ট গ্যালারিতে। যদি বলেন, ওখানেই আমাদের গাড়ি চলে যাবে। সন্ধে ছ’টার মধ্যে।” দেবরাজ একটু ইতস্তত করল এবার। রূপরেখা থেকে বেরনো তেমন সমস্যা নয়। তবে দাদার কাছে যাচ্ছে এখন, গিয়ে কী পরিস্থিতিতে পড়বে জানা নেই। রাতে তন্ময়ের সঙ্গে আলোচনা করে যদি কালই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়… প্লাস, হাসপাতাল ঠিক করা…

দেবরাজ মাথা ঝাঁকাল, “এক্ষুনি কথা দিতে পারছি না। কাল সকালে একবার রিং করুন।”

“নো প্রবলেম। তবে আপনাকে স্যর চাই-ই চাই। আপনার মতো একজন বিখ্যাত শিল্পী দিল্লি থেকে এসে এ রাজ্যের পরিস্থিতি কেমন দেখছেন, সেটাই আমরা…”

“বললাম তো, কাল ফোন করুন। এখন একটা পারসোনাল কাজে যাচ্ছি… রাস্তায় আছি…”

মোবাইল অফ করল দেররাজ। হঠাৎই মন খচখচ। ফালতু ফালতু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে না তো? উঁহু, তা কেন? আজ তাদের সঙ্গে যা হল, সেইটুকুনিরই তো প্রতিক্রিয়া জানাবে সে। নীরবে অপমান গিলে দেবরাজ দিল্লি পালাবে, এ তো হতে পারে না।

পাইকপাড়া এসে গেছে। ভাড়া মিটিয়ে বাসস্ট্যান্ডের মোড়টায় ট্যাক্সি থেকে নামল দেবরাজ। অনেকক্ষণ পর সিগারেট ধরাল একটা। ঢুকছে চেনা পাড়ায়। বছর আষ্টেক পরে এল, পাড়ার ভিতর দিকটায় খুব একটা বদল হয়নি তো এখনও? পুরনো অধিকাংশ বাড়ি এখনও দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। দত্তদের বাড়িটা ভাঙা চলছিল, এখন সেখানে চারতলা ফ্ল্যাট। তেমন জমকালো নয়, নেহাতই মধ্যবিত্ত প্যাটার্নের। বইয়ের দোকানটা নেই, সেখানে এখন মোবাইলের কারবার। পরিচিত মুখ নজরে পড়ল দু’-চারটে। কেমন বুড়োটে মেরে গেছে সব। এই শহরটার মতোই।

সরু গলিটা ধরে দেবরাজ বাড়ির সামনে এসে থামল। শেয়ালদা কোর্টের উকিল অনন্তমোহন সিংহরায় সারাজীবন শ্যামপুকুরের ভাড়াবাড়িতে কাটিয়েছিল বটে, কিন্তু বুদ্ধি করে এই সওয়া চার কাঠা জমি কিনে রেখেছিল পাইকপাড়ায়। দেবরাজের বাবা আর জ্যাঠা নিজেরা ভাগাভাগি করে নিয়েছে সেই জমি। জ্যাঠার অংশে দোতলা উঠে গেছে, দেবরাজদের দিকটা এখনও একতলা। ভাঙাচোরা নয়, তবে যথেষ্ট মলিন।

সদর ভেজানো। কিন্তু বন্ধ নয়। এ বাড়িতে এমনটাই রেওয়াজ। দরজা ঠেলে ঢুকল দেবরাজ। টানা লম্বা প্যাসেজের একধারে পরপর তিনখানা ঘর। বাঁয়েও আছে একখানা। তারপরে উঠোন বাথরুম রান্নাঘর।

প্রথম ঘরটি অন্ধকার। দ্বিতীয়তে আলো জ্বলছে। প্যাসেজের জানলা দিয়ে অন্দর দৃশ্যমান। টিভি চলছে, বিছানায় বসে দেখছে বউদি, খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে দাদাও তাকিয়ে টিভির পরদায়। কী চমৎকার এক নিশ্চিন্ততার ছবি। কে বলবে মারণরোগ ঘাঁটি গেড়েছে এ সংসারে!

চোরা আবেগটুকু নিয়ন্ত্রণে রেখে দেবরাজ দরজা থেকে গলা ওঠাল, “কী গো, তোমরা কর্তাগিন্নি আছ কেমন?”

দেওরের অতর্কিত আবির্ভাবে শুভ্রা জোর চমকেছে। মুহূর্তের জন্য বুঝি বিমূঢ়। তারপর একটা হাসি হাসি ভাব ফুটেছে মুখে। উচ্ছ্বাসমাখা স্বরে বলল, “ওমা, তুমি কোত্থেকে?”

ঘরে এসে হাতলছাড়া চেয়ারটা টেনে বসল দেবরাজ। স্বর লঘু রেখে বলল, “ধরো, সোজা দিল্লি থেকে।”

“মোটেই না। তুমি কলকাতায় এসেছ, আমরা জানি। বনো বলেছে।”

দেবপ্রিয় সোজা হয়ে বসেছে। আহ্লাদিত স্বরে বলল, “কেমন চলছে তোর প্রদর্শনী?”

“ওই আর কী।” প্রসঙ্গটাকে গুরুত্ব দিল না দেবরাজ। ভুরু উঠিয়ে বলল, “তোমার শরীরস্বাস্থ্য কেমন?”

“ভাল নয় রে।” দেবপ্রিয়র শীর্ণ মুখে ফ্যাকাশে হাসি উঁকি দিল, “আমার দিন বোধহয় ফুরিয়ে এল রে রাজু।”

“ফের ওই কথা?” শুভ্রা অল্প ঝেঁঝে উঠল, “ডাক্তার না বলেছে তুমি সেরে যাবে?”

“ডাক্তাররা ওরকম বলে। আমি তো বুঝছি তেল শেষ। এবার ঝুপ করে নিভে যাব।”

শুভ্রা কটমট চোখে একবার তাকাল স্বামীর দিকে। তারপর ঘুরে দেবরাজকে বলল, “বোসো। চা করে আনি।”

“থাক না। এসেছি, দুটো কথাবার্তা বলি…”

“সে তোমরা দু’ভাই বলো না প্রাণের সুখে। আমি যাব, আর আসব।”

এ বাড়িতে কী পদের চা হয়, দেবরাজ জানে। তবু মুখ ফুটে ‘না’ বলতে পারল না। এমন সহজ আন্তরিক সুরে বলল বউদি, যেন আট বছর পরে নয়, রোজই এ বাড়িতে আসে দেবরাজ। এর উত্তরে ‘না’ কি ফোটে মুখে?

বউদি বেরিয়ে যেতেই দাদাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল দেবরাজ। তার চেয়েও লম্বা ছিল দাদা, বরাবরই একটু ঝুঁকে হাঁটত, এখন যেন রীতিমতো কুঁজো। খাড়া লম্বা গ্রিসিয়ান নাক যেন তীক্ষ্ণতর আরও। ফরসা রং এখন আর তামাটেও নয়, যেন কালচে ছোপ পড়েছে চামড়ায়। গাল বিচ্ছিরি রকমের তোবড়ানো, চুল কমে এসেছে, চশমার ওপারে চোখদুটোও কেমন ঘোলাটে। কপালে বলিরেখাও প্রকট। দেবরাজের চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের বড় দাদাটিকে এখন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি ছাড়া আর কিছু ভাবা মুশকিল।

কবে যে দাদা এতটা বুড়িয়ে গেল? অসুখের কারণে হঠাৎ ভেঙেছে শরীর, এমনটা বোধহয় নয়। একটু একটু করে ক্ষয়েছে হয়তো। দেবরাজ তো খোঁজ রাখেনি! শুধু নিজের সুখ আর খেয়ালটুকু ছাড়া কবেই বা অন্য কিছুর খবর রেখেছে দেবরাজ!

আচমকা দেবপ্রিয়র ফ্যাসফেসে স্বর বেজে উঠল, “এবার হঠাৎ এলি যে বড়? বনোর কাছে আমার অসুখের খবর শুনে বুঝি?”

এমন নিখাদ সত্যিকে কি জোর গলায় ওড়ানো যায়? দেবরাজ ঢোক গিলে বলল, “তোর শরীর খারাপ না হলেও এবার আসতাম। বেশ কয়েক দিন থাকতে পারছি তো।”

“ও। শেষের দিনগুলোয় আপনজনদের দেখলে বড় ভাল লাগে রে।”

“আহ, কী বাজে বকছিস! একদম ভাল হয়ে যাবি। হানড্রেড পারসেন্ট ফিট। আমি আছি না!”

“আছিস বুঝি?” দেবপ্রিয়র স্বর যেন সংশয়মাখা। যেন নিজেকেই শোনাচ্ছে, এভাবে বলল, “জীবনটা তো বৃথাই গেল। ভেবেছিলাম রিটায়ারমেন্টের পর একটু অন্যভাবে বাঁচব। ফুটপাথের বাচ্চাদের নিয়ে একটা স্কুল করব। থোক টাকাগুলো হাতে পেলে ওদের মাঝে মাঝে বই-টইও কিনে দেওয়া যেত। এমন কাহিল হয়ে পড়লাম….।”

আশ্চর্য, সেই কবেকার বাসনা এখনও দাদা মনে পুষে রেখেছে! খ্যাপা মানুষ বটে। দাদাটা অবশ্য চিরকালই একটু অন্যকরম। পড়াশোনায় তেমন মন্দ ছিল না, কিন্তু সেভাবে কখনও চাকরির চেষ্টাই করল না কোনওদিন। একটা লাইব্রেরিতে নিতান্ত অকিঞ্চিত্কর কাজ পেয়েই সে সন্তুষ্ট। কেন? না সারাক্ষণ বইপত্রের জগতে থাকতে পারছে। এমনিতে নরম-সরম ধরনের, কিন্তু ওই মানুষটাই শক্ত হয়ে পাশে না দাঁড়ালে আদৌ কি আঁকার জগতে যেতে পারত দেবরাজ? ছোটছেলের আর্ট কলেজে ভরতি হওয়া নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল বাবার। দাদাই না কাকুতি মিনতি করে বাবাকে রাজি করিয়েছিল! শুধু কী তাই, নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে ভাইয়ের আঁকাজোকার সরঞ্জাম কিনে দিত। ভাইয়ের তখন ভাল মতন রেখাজ্ঞান হয়নি, তবু হাবিজাবি যা সে আঁকছে তাতেই দাদা মুগ্ধ। ছেলেপুলে হল না, তাতেও দাদার তেমন দুঃখবোধ দেখেনি দেবরাজ।

কে জানে, হয়তো ভোঁতা ধরনের মানুষরা এরকমই হয়। শোকতাপ, অভাববোধ, কিছুই তাদের বড় একটা ভাবায় না। অতি ক্ষুদ্রকে আঁকড়ে ধরেই এরা দিব্যি বাঁচতে পারে। সেদিক দিয়ে দেখলে, এই নগণ্য মানুষটাকে ঘিরে আবেগ আসাটাও তো অর্থহীন। তবু যে কেন দুর্বল বোধ করছে দেবরাজ?

শুভ্রা চা এনেছে। কাপডিশ হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেবরাজকে বলল, “তোমার মেয়েটা কিন্তু ভারী মিষ্টি হয়েছে। যেমন লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো রূপ, তেমনই সুন্দর ব্যবহার।”

দুধ দিয়ে ফোটানো গুঁড়ো চায়ের মিশ্রণটায় আলতো চুমুক দিয়ে দেবরাজ বলল, “আঁচলের সঙ্গে দেখা হয় নাকি?”

“এমনিতে কোথায় আর…। এবার পুজোর পর বনোর সঙ্গে এসেছিল।” শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে ছোটখাটো গোলগাল চেহারার শুভ্রা ফের বসেছে বিছানায়। চোখ পিটপিট করে বলল, “ওর নাকি শিগগিরই বিয়ে?”

দেবরাজ দায়সারাভাবে বলল, “সেরকম তো শুনছি।”

“হয়ে গেলেই ভাল। মেয়েটা পুরোপুরি নিজের একটা সংসার পায়।”

“আদ্যিকেলে ভাবনা ছাড়ো তো। যেখানে আছে, সেটাও কিছু পরের সংসার নয়।”

দেবরাজের হালকা ধমক খেয়ে শুভ্রা চুপ। বেখাপ্পা, সৃষ্টিছাড়া এই দেওরটিকে শুভ্রা যেন একটু বেশিই সমীহ করে। তবে বেশিক্ষণ মুখ বুজে থাকাও তার ধাতে নেই। ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল, “পুনম কেমন আছে গো?”

বনোর দৌলতে দেবরাজ পুনমের একত্রে বাসের খবর শুভ্রার অজানা থাকার কথা নয়। তবু দেবরাজের মতো দু’ কান কাটাও সামান্য থতমত। সামলে নিয়ে বলল, “ভালই। ঠিকঠাক।”

“ওকে একবার এনো না কলকাতায়। একটু আলাপ-সালাপ হত।”

সরলভাবে বলল শুভ্রা, কিন্তু দেবরাজের একদমই পছন্দ হল না কথাটা। পুনমের সঙ্গে আত্মীয়তা পাতাতে চায় নাকি বউদি? যত্ত সব প্যানপেনে ভ্যাদভেদে চিন্তা।

কড়া গলায় প্রস্তাবটা নাকচ করতে যাচ্ছিল দেবরাজ, তার আগে আবার দেবপ্রিয়র স্বর বেজেছে, “হ্যাঁ রে রাজু, তুই এবার আছিস ক’দিন?”

“দিন সাতেক তো আছিই। এর মধ্যে তোর একটু ডাক্তারবদ্যি করি…”

“মাত্র সাত দিন? তারপর আবার সাত আট বছর? তখন কি আর আমার সঙ্গে…?”

দেবপ্রিয়র অসমাপ্ত বাক্যটা যেন কেমন আর্তির মতো শোনাল। দেবরাজের বুকটা ধক করে উঠেছে। হাত বাড়িয়ে ছুঁল দাদার কবজিখানা। শীর্ণ আঙুলগুলো স্পর্শ করছে দেবরাজকে।

গা’টা শিরশির করছিল দেবরাজের। এই অনুভূতিটা তার একেবারেই অচেনা। নাকি এ অনুভূতি তার ছিল? মনের সংগোপনে? দেবরাজই তা জানত না!

সিনেমাটা একেবারেই ভাল লাগছিল না নির্বাণের। এমন উদ্ভট হাসির ছবি কাঁহাতক সহ্য হয়? অথচ কী কাণ্ড, হলসুদ্ধু লোক উল্লাসধ্বনিতে ফেটে পড়ছে মুহুর্মুহু। এমনকী মহুয়াও। মাঝে মাঝেই শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠছে খিলখিল। এত হাসি আহ্লাদ যে মানুষের কোথা থেকে আসে?

শো শেষ হতে নির্বাণ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। ভিড়ের সঙ্গে বেরোল মাল্টিপ্লেক্স থেকে। অপাঙ্গে দেখল মহুয়াকে। দু’চোখ এখনও জ্বলজ্বল করছে খুশিতে। ঠাট্টার সুরে নির্বাণ বলল, “সিনেমাটা তো দেখবে দেখবে করে লাফাচ্ছিলে। আশ মিটেছে?”

“জমে ক্ষীর।” মহুয়া দু’ আঙুলে মুদ্রা ফোটাল, “সলমন খান হেব্‌বি করেছে, তাই না?”

নির্বাণ জবাব দিল না। পায়ে পায়ে এগোল এসক্যালেটরের দিকে। নিউ টাউনের নতুন শপিং মলটার একতলায় নেমে সামান্য আনমনা হয়ে হাঁটছিল, হঠাৎই খেয়াল হল মহুয়া পাশে নেই। এদিক ওদিক খুঁজতেই অবশ্য নজরে পড়েছে। একটা শো-উইন্ডোর সামনে দাঁড়িয়ে বাহারি পোশাক দেখছে।

একটু তাকিয়ে নিয়ে মহুয়ার পিছনটায় এল নির্বাণ, “কী হল? নেবে নাকি কিছু?”

মহুয়ার চোখ পিটপিট, “ওই পিংক সালোয়ার সুটটা দারুণ না?”

“তোমার চাই?”

“না না, অনেক দাম হবে।”

আপত্তিটা তেমন জোরালো নয়। অর্থাৎ ইচ্ছে আছে। নির্বাণ ছদ্ম ধমকের সুরে বলল, “কত বার বলেছি আমার সঙ্গে বেরিয়ে দামের কথা তুলবে না। যদি পছন্দ হয়, কিনে ফ্যালো, ব্যস।”

মহুয়া ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল নির্বাণকে। আলগা অস্বস্তিমাখা গলায় বলল, “থাক। আলতু-ফালতু তোমার খরচ করানো ঠিক নয়। এমনিতেই তো তুমি আমাদের…”

মহুয়া কথা শেষ না করলেও বাকিটা পড়ে নিতে পারল নির্বাণ। মহুয়াদের পরিবারের পিছনে সে যে অনেক টাকাই ঢালে, সেটাই বুঝি কুণ্ঠিত করছে মহুয়াকে। ইদানীং সংকোচ যেন বেড়েছে। নির্বাণের আচরণে কোনও তারতম্য অনুভব করছে কি? নাকি মেয়েলি ইন্দ্রিয়বলে টের পেয়ে গেছে, নির্বাণের জীবনে একটা বদল আসন্ন?

নির্বাণ গলার স্বর স্বাভাবিকই রাখল, “ফের ওই কথা? জানোই তো, আমি যা করি, ভালবেসে করি। তোমার জন্যই করি। তবু কেন যে আমাকে হার্ট করো!”

“আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। দুঃখ পেতে হবে না। কিনে দাও। তারপর চলো একটু কিছু খাই।”

পোশাকটা কেনার পর মহুয়ার চোখমুখের ঝলমলে ভাবখানা বেড়ে গেছে আরও। ফুড কোর্টে মুখোমুখি চেয়ারে বসে মহুয়াকেই দেখছিল নির্বাণ। শ্যামলা বরণ, বড় বড় চোখ, মোটামুটি সুশ্রী মেয়েটা কি তার জীবনসঙ্গিনী হতে পারত না? কিন্তু তা যে হওয়ার নয়। যা যাঁতাকলে পড়েছে নির্বাণ। বিদিশা চৌধুরীকে আর বোধহয় ঠেকিয়ে রাখা গেল না!

মায়ের নামটা মনে পড়তেই নির্বাণ যেন একটু কেঁপে গেল। নিজের অজান্তেই। পরশু রাত্তিরটা ফের দুলে গেল চোখে। শোওয়ার আগে ঘরের টিভিটা চালিয়ে একটা রিয়্যালিটি শো দেখছিল নির্বাণ। খুব যে একটা উপভোগ করছিল তা নয়। আবার খারাপ লাগছিল, তেমনটাও বলা যায় না। ওই, কিছু একটা সামনে চলছে চলুক। পরদার পাত্রপাত্রীদের কৃত্রিম রঙিন উচ্ছলতায় একটা ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতি জাগল, ব্যস।

তখনই হঠাৎ শ্রীমতী ভয়ংকরীর আবির্ভাব। মাকে দেখলে কেন যে ওই নামটাই কেবল মনে আসে নির্বাণের? শৈশব থেকে মহিলা কী যে আতঙ্ক বুনে দিয়েছে মজ্জায় মজ্জায়। চোখ পাকিয়ে তাকানো ছাড়া আর যে কিছু জোটেনি কখনও। আরও কত যে দুঃসহ স্মৃতি…

ঘরে ঢুকেই মহিলা রীতিমাফিক কড়া গলায় বলল, “অফিস থেকে কখন বেরিয়েছিলে আজ?”

রোজকার মতোই গুটিয়ে গেল নির্বাণ। ঢোক গিলে বলল, “যেমন বেরোই। পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা।”

“মিথ্যে কথা বোলো না। চারটে থেকে তোমার মোবাইল অফ। তোমাদের স্বপনবাবু বললেন, তিনটের পর থেকে তুমি রুমে নেই।”

নির্বাণ কী করে বলে, অফিসে তার একটুও থাকতে ইচ্ছে করে না। সাজানো গোছানো একটা চেম্বারে সে বসে বটে, কিন্তু সত্যি তো তার কোনও কাজ নেই। দুটো-চারটে কমপ্লেন শোনা, কিছু হাবিজাবি চিঠিপত্র দেখা, কিংবা অকাজের মিটিংয়ে গিয়ে বসে বসে ঢোলা। তাকে ছাড়াও তো অফিস দিব্যি চলে যায়, নয় কি? নির্বাণকে বসানোর জন্যই ওই পোস্টটা মা পাক্কা ছ’মাস আটকে রেখেছিল, যতদিন না মাসকমিউনিকেশনের ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট নামক চোথাটি নির্বাণের হাতে আসে। এটা জানার পরও ওই চেয়ারটায় দিনভর সেঁটে বসে থাকতে প্রবৃত্তি জাগে? তবে মা যা গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছে, অফিস পালিয়ে এদিক ওদিক যাওয়ার অভ্যেসটায় বোধহয় লাগাম পরাতে হবে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিল নির্বাণ। তা বিদিশাদেবী তো ছোড়নেওয়ালি নয়, রাশভারী প্রিন্সিপাল সুলভ স্বর ফুটেছিল তার গলায়, “আমার সঙ্গে চালাকির চেষ্টা কোরো না। নিজের যোগ্যতা কতটা তা নিশ্চয়ই তুমি জানো! হায়ার সেকেন্ডারিতে ধেড়ালে, বি-এতে অনার্স টিকিয়ে রাখতে কেঁদে ককিয়ে একসা…। ভাগ্যিস ওপেন ইউনিভার্সিটি খোলা হয়েছে, তাই কোনও ক্রমে এম এ-র একটা ডিগ্রি জুটল…। তারপরও তো ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছিলে।”

কেন যে সুযোগ পেলেই মা তাকে কথাগুলো শোনায়, নির্বাণ জানে। অপদার্থ ছেলেকে নিজের ক্ষমতার জোরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রতিপলে এটা প্রতিপন্ন করতে হবে না? নইলে ছেলে তার পায়ের কাছে অবিরল লেজ নাড়বে কেন! কিন্তু কেন যে ছেলে অযোগ্য হল, তা কী কখনও ভেবেছে ওই আত্মগর্বী মহিলা?

বুকের ভিতর থেকে ঠেলে ওঠা কথাগুলো বুকেই রয়ে গিয়েছিল নির্বাণের। সে রা কাড়েনি।

মা ফের গম্ভীর গলায় বলেছিল, “নিজেকে শুধরোও। আজেবাজে জায়গায় যাওয়া ছাড়ো। আগেই বলেছি, আবার বলছি, কুসঙ্গ ত্যাগ করো।”

চমকে তাকিয়েছিল নির্বাণ। মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নামিয়ে নিয়েছিল চোখ।

তখনই মায়ের গলা নরম, “শোনো, যে কারণে এখন আসা…। রোববার বিকেলে কিন্তু কোথাও বেরনোর তাল কোরো না।”

নির্বাণ মিনমিন গলায় বলেছিল, “কেউ আসবে নাকি?”

“না। তোমায় নিয়ে বেরোব।”

“আমায় নিয়ে?” নির্বাণ হতচকিত, “কোথায়?”

“মেয়ে দেখতে। তোমার জন্য একটা ভাল সম্বন্ধ এসেছে।”

জোর ধাক্কা খেয়েছিল নির্বাণ। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, “তুমি না মেয়ে দেখার ঘোর বিরোধী?”

“উপায় কী! তোমার রুচি তো আমি জানি।” সোনালি ফ্রেম চশমার আড়ালে বিদিশার সার্চলাইটের মতো চোখ জোড়া কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির। তারপর কেটে কেটে বলল, “আমার পুত্রবধূটি এ বাড়ির যোগ্য কিনা সে তো আমাকেই বুঝতে হবে।”

নির্বাণ ক্ষীণ আপত্তির সুরে বলল, “কিন্তু আমি যে এখন…”

“বিয়ে করবে। আমি যা বলছি, তাই হবে।”

ঘোষণাটা এখনও বাজছে কানে। কী যে করে নির্বাণ?

“অ্যাই, কী আনসান ভাবছ?” মহুয়ার স্বর শুনতে পেল নির্বাণ, “দ্যাখো না, খাবারটা হল কি না।”

নির্বাণের চটকা ভাঙল। উঠে কাউন্টারে গিয়ে পিৎজা আর কোল্ড ড্রিংকস সমেত ট্রেটা আনতে আনতে ভাবল, রোববারের কথাটা মহুয়াকে বলে ফেলবে কি না। আগেও নির্বাণের দু’-তিনটে সম্বন্ধ এসেছিল, মা তাকে বলেছিল, তবে তেমন গা দেখায়নি। এবার ভাবগতিক মোটেই সুবিধের নয়, মা যথেষ্ট সিরিয়াস। আজ সকালেও একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে রোববারের ব্যাপারটা। সুতরাং এখনও মহুয়াকে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখাটা বোধহয় অন্যায় হবে।

আচ্ছা, সংবাদটা কীভাবে নেবে মহুয়া? ক্ষিপ্ত হবে? তার দিকে তর্জনী তুলবে? নাকি ভেঙে পড়বে?

দু’খানা প্লেটে পিৎজা ভাগ করে খাওয়া শুরু করেছে মহুয়া। ঠান্ডা পানীয় চুমুক দিচ্ছে আয়েশ করে। সদ্য দেখা সিনেমাটার একটা গান গাইছে গুনগুন। এখনই আঘাত হানবে নির্বাণ? উঁহু, সইয়ে সইয়ে বলাই ভাল। একটু ঘুরপথে। মহুয়ার মেজাজমর্জি বুঝে।

পিৎজা থেকে ছোট একটা টুকরো কেটে নির্বাণ মুখে পুরল। গলায় হালকা সুর ফুটিয়ে বলল, “এভাবে আর ক’দিন চলবে, অ্যাঁ?”

মহুয়া খাবলা করে সস মাখাচ্ছিল পিৎজায়। চোখ তুলে বলল, “মানে?”

“খেয়ে, সিনেমা দেখে, আর মাঝে মাঝে ঘুরতে গিয়ে তো জীবন কাটবে না, এবার তো সিরিয়াস কিছু ভাবতে হয়।”

“কী ভাবব, বলো?”

“আমরা তো বিয়ে করতে পারি, নয় কি? আমিও বেকার নই, তুমিও কল সেন্টারে যা হোক একটা কাজ করছ…”

মহুয়া কেমন হতবাক চোখে তাকাল, “তুমি আমায় বিয়ে করবে? সত্যি?”

“করতেই হবে। নইলে দেখবে মা কোনও দিন ঘেঁটি ধরে আমায় বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছে।” নির্বাণ একটু থামল। তারপর মহুয়ার চোখে চোখ রেখে বলল, “ইন ফ্যাক্ট, চেষ্টাচরিত্র শুরুও করে দিয়েছে।”

মহুয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “তোমার মা আমার কথা জানেন?”

“আমি বলিনি। তবে মায়ের তো অনেক সোর্স… বোধহয় একটু-আধটু…। মানে আন্দাজ-টান্দাজ করে আর কী!” নির্বাণ একটু দম নিল, “অবশ্য বুঝতেই তো পারো, আমার মা একটু অন্য ধরনের… কালচারালি তো তোমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে মায়ের ঠিক মিলবে না…”

“সে তো বটেই। হা-ঘরে বাপ মা, বাবা ছিল কারখানার লেবার.. দাদা গুন্ডা মস্তান… বোমাবাজিতে অক্কা পেয়েছে…। এমন বাড়ির মেয়েকে তোমার মা মানবেন কেন!” বলেই মহুয়ার স্বর হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়েছে, “কিন্তু তুমি কী চাও?”

“আমি কী বলব বলো?” নির্বাণের গলা সামান্য কেঁপে গেল, “আমি তো তোমাকেই চাই।”

একদৃষ্টে নির্বাণকে দেখছে মহুয়া। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। নির্বাণের মনে হল অনন্তকাল। দৃষ্টিটাও যেন বড় বেশি তীব্র, মর্মভেদী।

আচমকাই মহুয়ার গলা আশ্চর্য রকমের নরম, “তোমার কি বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে?”

“না না, বিশ্বাস করো…।”

“একটা কথা বলব?” মহুয়ার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি, “তুমি মায়ের ইচ্ছেমতো বিয়েশাদি করে নাও।”

“কক্ষনও না। তোমায় ছেড়ে আমি থাকতেই পারব না।”

“তাই বুঝি? চলো, কালই তা হলে রেজিস্ট্রি করে নিই।”

প্রস্তাব তো প্রত্যাশিতই, তবু কেন যে প্রবল ঝাঁকুনি খেল নির্বাণ। আমূল কেঁপে উঠল যেন। কথাটা ভাবতে গিয়েই হাঁটুর জোর কমে যাচ্ছে। দপদপ করছে বাসনা, অথচ অসাড় হয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্ক।

কোনও মতে নির্বাণ বলল, “যা, তা কী করে হয়? এত তাড়াহুড়ো করে… বিয়ে বলে কথা… একটু তো ভেবেচিন্তে…”

“এই তো, লাইনে এসো।” মহুয়ার হাসি হাসি মুখখানা যেন করুণ দেখাল। বড় বড় চোখজোড়া নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “আমার মতো সামান্য মেয়ের জন্য কেন মায়ের সঙ্গে বিবাদে যাবে! তুমি তা পারবেও না নির্বাণদা, তোমার সেই জোশ নেই। তার চেয়ে বরং আমায় বাই বাই করে দাও।”

“অসম্ভব। হতেই পারে না।”

“খুব হয়। এখন খাওয়াটা শেষ করো দেখি। আটটা বেজে গেছে, আমাকে তো বাড়ি ফিরতে হবে।”

একটু যেন বেশিই চপল সুরে মহুয়া বলল কথাগুলো। কিন্তু যেন চাপা কান্নার ধ্বনিও শুনতে পেল নির্বাণ। মহুয়া কি তাকে ভুল বুঝল? কী ভাবছে? নির্বাণই কেটে পড়তে চায়?

পরিবেশ সহজ রাখতে নির্বাণও তরল ভাব ফোটাল গলায়, “ছটফট করছ কেন? আটটা কী এমন রাত? চলো, আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি।”

“যাবে? বাবা থাকতে পারে কিন্তু।”

“তো?”

“বাবাকে তুমি ভয় পাও না?”

পরিস্থিতি ভুলে হেসে ফেলল নির্বাণ। হ্যাঁ, মহুয়ার বাবাটিকে সে ডরায় রীতিমতো। যা একখানা চিজ, বাব্বাহ! মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নামকা ওয়াস্তে জমিবাড়ির দালালি করে বটে, মহানগরীর সদ্য গজিয়ে ওঠা এই প্রান্তে ধান্দাটা নেহাত মন্দও নয়, তবে বিমল পালের আদত পেশা উঞ্ছবৃত্তি। দেখা হওয়া মাত্রই এমন অবলীলায় হাত বাড়িয়ে দেয়, নির্বাণ না বলতে পারে না। এই তো গত সপ্তাহেই কী একটা ছুতোয় যেন করকরে হাজার টাকা বাগিয়ে নিল। দুঃখের বিষয়, টাকার বেশির ভাগটাই সংসারের কোনও কম্মে লাগে না। যায় শুঁড়িখানায়, নয়তো তাসের জুয়ায়। সবচেয়ে বড় কথা, টাকাটা নেওয়ার সময়ে এমন একটা ভাব দেখায় বিমল পাল, যেন সে দেনাদারের কাছ থেকে প্রাপ্য বুঝে নিচ্ছে। কিংবা যেন আদায় করছে ট্যাক্স, মহুয়ার সঙ্গে মেলামেশা করার। তবে হ্যাঁ, বিনিময়ে জামাই আদরও করে বই কী। বউকে ধমকায়, এক্ষুনি ছেলেটাকে চা করে দাও…! নিজে গিয়ে মিষ্টি নোনতা কিনে আনে। বাড়তি খাতিরদারি এক একসময়ে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। এমন একটা লোকের সামনাসামনি হতে খানিক সাহস লাগে বই কী।

নির্বাণ হাসতে হাসতে বলল, “কী আছে, আরও নয় কয়েকটা টাকা খসবে।”

“কেন আর আমাদের ইয়ে বাড়াচ্ছ নির্বাণদা? অনেক তো করলে, এবার ক্ষ্যামা দাও। তোমার দয়ার বোঝা আর নয় না-ই বাড়ালে।”

তীক্ষ্ণ শলাকার মতো নির্বাণকে বিঁধল কথাগুলো। এ কি ক্ষোভ? না অভিমান?

নির্বাণ আহত স্বরে বলল, “আমাকে তো কম দিন দেখছ না মহুয়া। তারপরেও এই কথা বলছ?”

“আমি তো পেটেমুখে আলাদা নই নির্বাণদা। মনে যা হল, তাই তো বলব।” মহুয়ার চোখ ছলছল করছে। গুমগুমে গলায় বলল, “তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ আছে, বলো? দাদা যখন বোমা খেয়ে চোখ উলটোল, তুমি তখন স্বর্গ থেকে খসে পড়া দেবদূতের মতো আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলে।”

“আহ মহুয়া, কেন বাজে বকছ? বরুণ আমার বন্ধু ছিল, কলেজে একসঙ্গে পড়েছি। তার বিপদে আমি যদি…”

“বন্ধু তো দাদার আরও অনেক ছিল। তাদের তো টিকি মেলেনি! কত দাদার দলবল, সব ভোঁ ভাঁ। আমাদের খবর নেওয়া দূরস্থান, যারা দাদাকে বোমা মারল, তাদের সঙ্গেই ভিড়ে গেল দাদার স্যাঙাতরা। বিবেক, পল্টন, লালু, ছনু, সব্বাই। আর তুমি প্রায় অচেনা অজানা একজন, হাজির হলে আমাদের দরজায়। এটা কি বেশি পাওয়া নয়, বলো?”

কেন যে সে বরুণের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, কোনওদিন কি কারওকে বলতে পারবে নির্বাণ? কত যে গোপন অপরাধবোধ জমে থাকে বুকে। বুদ্‌বুদের মতো। কখনও ফুলে ফেঁপে ওঠে বুদ্‌বুদটা, চাপ দেয় হৃৎপিণ্ডে, হাঁসফাঁস করে মানুষ। আবার কখনও বা তার অস্তিত্বই টের পাওয়া দায়। তবু সে থাকে। থাকেই।

সেই লুকিয়ে থাকা বুদ্‌বুদই বুঝি ফুলছে আবার। নির্বাণ মাথা ঝাঁকাল, “আহ মহুয়া, থামো।”

“না। আমি বলবই। তুমি না থাকলে কী দশা হত আমাদের? গোটা সংসারটাই তো প্রায় টেনেছ তখন। আমাকে যে মুখে রং মেখে গন্ধা কাজে নামতে হয়নি, সে তো তুমি ছিলে বলেই। চাকরিটাও জুটল তোমার পয়সায় স্পোকেন ইংলিশ শিখে।”

প্রশংসাটা যেন বিদ্রুপের মতো ঠেকল নির্বাণের। মহুয়াদের সাহায্য করে সে নাম কিনেছিল ঠিকই, কিন্তু টাকাটা তো আদতে বিদিশাদেবীর। তার হাতখরচে বেড়ি পরায়নি বলেই না দানবীর সাজতে পেরেছিল নির্বাণ। চাকরিটা সে পেয়েছে বছর দেড়েক, তারপর থেকে মায়ের টাকার ওপর আর নির্ভরতা নেই। কিন্তু ওই চাকরিও তো শ্রীমতী ভয়ংকরীর বদান্যতার রকমফের। যার অন্যায়ের খেসারত গুনতে নির্বাণ ব্যাকুল, তারই ভরসায় নির্বাণের জীবনধারণ, নিয়তির এ যে কী চরম কৌতুক!

নির্বাণের মেজাজটা আরও কষটে মেরে যাচ্ছিল। পিৎজা শেষ হয়নি, কিন্তু আর গলা দিয়ে নামছে না। ঢকঢক কোল্ড ড্রিংকটা শেষ করে বলল, “পুরনো কাসুন্দি থাক। চলো উঠি।”

বাইরে আজ জব্বর ঠান্ডা। বড়দিনে এবার তেমন শীত ছিল না, নতুন বছর পড়ার পর ঝুপ করে নেমে গেছে তাপমাত্রা। উত্তুরে হাওয়াও আজ যথেষ্ট প্রবল। শহরের এদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা, বাতাসও তাই বুঝি হাড় কাঁপানো।

অটো ধরে চলে গেছে মহুয়া। কিছুতেই সঙ্গে যেতে দিল না নির্বাণকে। কী করবে ভেবে না পেয়ে নির্বাণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল দু’-চার মিনিট। তারপর বড়সড় একটা শ্বাস ফেলে বাস ধরল সল্টলেকের।

বাড়ির কাছের মোড়টায় নেমে নির্বাণ জোরে পা চালাচ্ছিল। একটা মাত্র হাফস্লিভ সোয়েটারে ঠান্ডা বাগ মানছে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরের ওমে সেঁধিয়ে যেতে হবে। গেটের মুখে এসে থমকাল। মণিমামা বেরোচ্ছে। পরনে সেই চিরচেনা পোশাক। পাজামা পাঞ্জাবি। আজ অবশ্য মুখখানা মাফলারে মোড়া, গায়ে শাল জড়ানো। তবে কাঁধের ঝোলাব্যাগটি যথারীতি মজুত।

ষাট ছুঁই ছুঁই মণিলালও নির্বাণকে দেখে দাঁড়িয়েছে। হাসি হাসি মুখে বলল, “অফিস থেকে ফিরছ বুঝি?”

নির্বাণ আলগাভাবে বলল, “ওই আর কী।”

“এত রাত হল যে? কোথাও গেছিলে নাকি অফিস থেকে?”

লোকটার এই বাড়তি কৌতূহল নির্বাণের একেবারেই না-পছন্দ। কম দিন তো দেখছে না, বাবা মারা যাওয়ার পর উদয় হয়েছিল বাড়িতে, তারপর থেকে তো নিত্য আসা যাওয়া। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, কখনও মণিলাল সরকারের এ বাড়িতে কামাই নেই। একসময়ে নাকি পার্টি-ফার্টি করত, এখন পারিবারিক ব্যবসা দেখে। কী ছাতার ব্যবসা কে জানে, মায়ের দাসানুদাসটি হয়ে তার সেবা ছাড়া আর কিছু কাজ আছে বলে তো মনে হয় না। তবে সুযোগ পেলেই নির্বাণের ওপর একটু-আধটু গার্জেনি ফলিয়ে নেয়।

নির্বাণ নীরস সুরে বলল, “আপনি বা এত রাতে কী করছেন? বাড়ি যাননি?”

“একটু অপেক্ষা করতে হল যে। তোমার মা প্রুফটা দেখে দিল… সেটা এখন নিয়ে যাচ্ছি।”

“কীসের প্রুফ? মা বই লিখছে নাকি?”

“সে কী, তুমি জানো না? পলিটিকাল সায়েন্সের অনার্সের টেক্সট বই। সব ক’টা পেপার। ভলিউম বাই ভলিউম বেরোবে।”

যাক, এই লাইনটাও মা ধরে ফেলল তা হলে! এবার নিশ্চয়ই কলেজে কলেজে এই বইখানাই পাঠ্য হবে। খুঁটি তো ধরাই আছে, হইয়ে ছাড়বে মা। পার্টির উচ্চমহলে মায়ের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বলতর হবে নির্ঘাত।

নির্বাণ ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে বলল, “সব দিক সামলে কখন যে মা লেখালিখির সময় পায়!”

“কাজের মানুষদের সময়ের অভাব হয় না বান্টি। দ্যাখো না, এই ষোলো ফর্মার পাহাড় মাত্র তিন দিনে নামিয়ে দিল তো।” মণিলাল তারিফের ভঙ্গিতে মাথা দোলাচ্ছে, “মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয়, বিদিশা দশভুজা নয়, শতভুজা।”

ওফ, সেই প্রশস্তির বন্যা। সহ্য হয় না নির্বাণের। কিন্তু মুখোমুখি পড়লে গিলতে হবেই। মাকে এত তেল মেরে মণিমামা যে কী পায়? উঠতে বসতে ধমক ছাড়া? সংসারের কত ফাইফরমাশ খাটে, তবু মায়ের মুখে কখনও তো মণিমামার প্রশংসা শোনেনি কোনও দিন!

নির্বাণ কবজি উলটে ঘড়ি দেখল। ব্যস্ততার ভান করে বলল, “আমার একটু তাড়া ছিল…”

“তাই বুঝি? যাও, যাও।” বলে নিজেও এগোচ্ছিল মণিলাল। হঠাৎ থেমে পিছন ঘুরে বলল, “এই শোনো, মাকে একটা কনগ্র্যাচুলেশন জানিয়ো আজ।”

“কেন?”

“বিদিশা অধ্যক্ষ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কত বড় একটা সাফল্য ভাবো তো।”

মা যে প্রায়শই সফলতার নতুন নতুন কীর্তি স্থাপন করবে, এ তো নির্বাণ জানে। ক্ষমতা করায়ত্ত করার গোপন চাবিকাঠিটি মায়ের কাছে আছে যে। এবং ঠিকঠাক তালায় লাগাতেও পারে।

অন্যদিন সমাচারটা শুনলে নির্বাণ উদাসীন থাকত, আজ কেন যেন তেতো লাগছে। মনমেজাজ এমন বিগড়ে দিয়েছে মহুয়া!

ছোট্ট করে ঘাড় নেড়ে বাহারি লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকে গেল নির্বাণ। স্টাডিতে আলো জ্বলছে, অর্থাৎ মা নিচতলায়। নিঃশব্দ পায়ে নির্বাণ সটান দোতলায় উঠে গেল। নিজের ঘরে এসে পোশাক বদলে সবে বিছানায় একটু বসেছে, দরজায় অনিমা। এ বাড়ির রাতদিনের কাজের লোক।

নির্বাণ ভুরু কুঁচকোল, “কিছু বলবে?”

“তুমি কি এখন খেতে আসবে?”

“এত তাড়াতাড়ি? দশটাও তো বাজেনি!”

“শীতকাল তো…। দিদিও আজ খেয়ে নিল। তাই জিজ্ঞেস করছি।”

“অ। মায়ের ডিনার শেষ বলে আমায় হুড়ো?” নির্বাণ মুখ বেঁকাল, “আমারটা টেবিলে রেখে দাও। সময়মতো খেয়ে নেব।”

“দিদি রাগ করবে। জানোই তো, খাবার বেড়ে রাখা দিদি পছন্দ করে না।”

“জ্বালালে তো।” ঝেঁঝে উঠে অনিমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল নির্বাণ, মোবাইল বেজে উঠেছে। মহুয়া নাকি? ঝটিতি ফোন তুলতেই… উঁহু, মনিটরে দীপন। কলেজে পড়ত একসঙ্গে, যোগাযোগ অতি ক্ষীণ, বছরে সাকুল্যে দুটো ফোন করে কি না সন্দেহ, সে হঠাৎ আজ?

অনিমাকে হাতের ইশারায় ভাগিয়ে দিয়ে ফোন কানে চাপল নির্বাণ, “কী রে, কী মনে করে?”

“একটা দরকার ছিল রে। ভাইটাল।”

“কীরকম?”

“আজ কাগজে তোর মায়ের কলেজের একটা অ্যাড বেরিয়েছে। বেশ কয়েকজন গেস্ট লেকচারার নেবে। তুই যদি আমার নামটা একটু পুশ করে দিস…”

নির্বাণের ভারী মজা লাগল। মায়ের সূত্রে তাকেও কেউ কেউ ক্ষমতাবান ঠাওরাচ্ছে তা হলে? আগেও এরকম এক আধটা অনুরোধ পেয়েছে সে। তাদেরকে যা বলে, সেটাই আউড়ে দিল, “গিয়ে আমার রেফারেন্সটা দিস, আমি বলে রাখব।”

“থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।” দীপনের স্বর বিগলিত, “একদিন আয় না, পুরনো বন্ধুরা জমিয়ে আড্ডা মারি।”

হাস্যকর প্রস্তাব। কলেজে মোটেই তেমন বন্ধু ছিল না দীপন। ভাল ছাত্র ছিল বলে দীপনদের গ্রুপটা পাত্তাই দিত না নির্বাণকে, এখন তার অন্য সুর।

“হুঁ হ্যাঁ” করে নির্বাণ ফোন রেখে দিল। মাকে বলতে তার বয়ে গেছে। উঁহু, তাও নয়। মাকে সে বলতে পারবেই না।

কেন যে সে এত ভয় পায় মাকে? নির্বাণ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। ভয়ানক ঘৃণা। ভীষণ আক্রোশ। অথচ মায়ের সামনে সে কেঁচো। কেন? কেন যে…? মহুয়াও এটা বুঝে ফেলেছে ভালমতো। ধরেই নিয়েছে, নির্বাণের সঙ্গে বিচ্ছেদটা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু… কিন্তু…. মহুয়ার সঙ্গে তার যে ঘনিষ্ঠতা… মেয়েটার শরীর নিয়েও তো নির্বাণ কম খেলেনি… এখন কি আর সরে আসা যায়? এতটা পাপিষ্ঠ কী করে হবে নির্বাণ?

একবার, জীবনে একটি বারও কি নির্বাণ দুঃসাহস দেখাতে পারে না? যদি সে মহুয়াকে রেজিস্ট্রি করেই নেয়? কী করবে মা? মানবে না? তাড়িয়ে দেবে? চাকরি খাবে? আরও বড় কোনও ক্ষতি করবে? তবু… তবু… একবার যদি পাঞ্জা কষে লড়ে নির্বাণ…!

পা-টা ঠান্ডা লাগছে। হিমেল স্রোত যেন উঠে আসছে শিরদাঁড়া বেয়ে। জ্বোরো রোগীর মতো কাঁপছিল নির্বাণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *