০৫. মুন্ডু ঘুরিয়ে দেওয়া চমক

০৫.

চমক একটা দিল বটে রাজা। একেবারে মুন্ডু ঘুরিয়ে দেওয়া চমক। পরদিনই সকালে সশরীরে কলকাতায় হাজির।

আর পাঁচটা রবিবারের মতোই দিনটা শুরু হয়েছিল পারমিতার। উঠেছিল সামান্য দেরিতে, যেমন ওঠে। মুখ টুখ ধুয়ে সকালের চা বানিয়ে ফেলল, যেমন বানায়। তারপর তাতারকে ঘুম থেকে তোলা, দাঁত ব্রাশ, দুধ খাওয়ানোর পর্ব সেরে লেগে পড়েছিল রবিবাসরীয় জলখাবারের আয়োজনে। শুভেন্দুর এখন গোটা সপ্তাহটাই রবিবার, তার সঙ্গে সঙ্গে মানসীরও। তবু সত্যিকারের রবিবারটা যেন একটু অন্যরকম। শুভেন্দুর অফিসজীবনের রীতিটাই এখনও বহাল আছে এ বাড়িতে, এদিন প্রাতরাশ খানিক জবরদস্ত হবেই। গরম গরম লুচি, কিংবা আলুপরোটা, অথবা ফ্রেঞ্চটোস্ট…। এক এক সপ্তাহে এক এক রকম।

আজ ছিল লুচির দিন। সঙ্গে কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়ে সাদা সাদা আলুচচ্চড়ি। মানসীও হাত লাগিয়েছিল কাজে। লেচি কেটে বেলে দিচ্ছিল। যেমনটা দেয়। শুভেন্দু মর্নিংওয়াক সেরে বাজার নিয়ে ফিরল প্রায় ন’টা নাগাদ। বসে গেল দু’খানা খবরের কাগজ নিয়ে, যেমন বসে। রবিবারে অন্তত ঘণ্টাখানেকের আগে কাগজ গেলার পালা চোকে না শুভেন্দুর। তাতারকে প্লে হোম পৌঁছোনোর তাড়া নেই, এদিন তার অনন্ত অবকাশ। সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রের গল্পটা পর্যন্ত পড়ে ফেলে।

তারই ফাঁকে পারমিতা জলখাবার দিয়ে গেল। মুখ থেকে কাগজ সরিয়ে টেরিয়ে দেখল শুভেন্দু, যেমন দেখে। অভ্যাস মতো লুচির সংখ্যা গুনে বলল,— আজ একখানা কম মনে হচ্ছে?

পারমিতা ফিক করে হাসল,— মা আপনাকে পাঁচখানাই দিয়েছেন।

সব কিছুতে রেশান করলে বাঁচি কী করে বলো তো? গত দিনও তো ছ’খানা দিয়েছিলে।

লুচির বেলায় স্মৃতিশক্তি যেন উথলে ওঠে! মানসীর গলা উড়ে এল। কাল মাতৃগৃহে না যেতে পারার ক্ষোভটুকু তার ঘোচেনি যেন, সকালেও ভার হয়ে আছে মুখখানা। কথাও বলছে কম। যেটুকু বা বলছে, তাতেও বুঝি পলকা ঝাঁঝ। গুমগুমে গলায় বলল,— স্মরণে আছে কি, আগের দিন আলুর তরকারি হয়নি?

বেগুনভাজা তো ছিল। তেল চুপচুপে বেগুনভাজাতে কি আলুর চেয়ে ক্যালরি কম?

অত আমি জানি না। আজ থেকে পাঁচখানার বেশি তুমি পাবে না, ব্যস।

শুভেন্দু মিইয়ে এতটুকু। করুণ চোখে পারমিতার দিকে তাকাল। পারমিতা ছেলের আহারপর্ব শুরু করেছিল। লুচি ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিনি সুদ্ধু দিচ্ছিল ছেলের মুখে। এই খাদ্যটি তাতারের মোটামুটি পছন্দসই, বেশি ঘ্যানাতে হয় না, খেয়ে নেয় চটপট। তাকে খাওয়াতে খাওয়াতে চোখে পড়েছে শুভেন্দুর অনুনয়। মুচকি হেসে ইশারায় শ্বশুরকে বলল, দাঁড়ান আমি ম্যানেজ করছি…

তখনই কলিংবেল ডিং ডং। অণিমা এল ভেবে পারমিতা দরজা খুলতে গিয়েছিল। এবং খুলেই স্তম্ভিত। এ কাকে দেখছে সে?

ল্যাপটপের ঝোলা কাঁধে মিটিমিটি হাসছে রাজা,— কী, কেমন দিলাম?

বিশ্বাস হচ্ছে না। পারমিতার দৃষ্টি বিস্ফারিত। হৃৎপিণ্ড তড়াক তড়াক লাফাচ্ছে। রাজা নিউ জার্সি থেকে ফেরার দিনও এমনটা হয়নি। এ যেন নিছক আনন্দ নয়, অপ্রত্যাশিত বলে তার চেয়েও বেশি কিছু। পারমিতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,— বাবা, দেখুন কে এসেছে!

মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশটাই বদলে গেল। একটু যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গড়াচ্ছিল, হঠাৎই উচ্ছলতায় থইথই। শুভেন্দুর সঙ্গে মানসীও ছুটে এসেছে। গদগদ স্বরে মানসী বলল,— লুচি বেলতে বেলতে তোর কথাই ভাবছিলাম রে রাজা। খালি মনে হচ্ছিল, তুই এত ভালবাসিস…

গন্ধে গন্ধেই তো উড়ে এলাম। স্নিকার ছেড়ে রাজা সোফায় বসেছে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,— সঙ্গে সেই ফেমাস আলুচচ্চড়ি আছে তো? চটপট লাগাও। হেভি খিদে পেয়েছে।

কেন রে, ফ্লাইটে কিছু খাসনি?

সরকারি এয়ার লাইনস ছিল মা। বিমান সেবিকারা পেঁচার মতো মুখ করে যা দেয়, তা কি গলা দিয়ে নামে?

তাতারের খাওয়া মাথায়। বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। জ্বলজ্বলে চোখে বলল,— বাবা, চিনি দিয়ে লুচি খাবে?

তাও চলতে পারে। ছেলের নাক নেড়ে দিল রাজা,— এনিথিং হোমমেড ইজ ওয়েলকাম।

শুভেন্দু বসেছে রাজার মুখোমুখি। জিজ্ঞেস করল,— ক’টায় ল্যান্ড করেছে রে ফ্লাইট?

আটটা কুড়ি। রাস্তা ফাঁকা ছিল, সাঁই সাঁই পৌঁছে গেলাম।

ওখান থেকে অনেক সকালে বেরিয়েছিস বল?

সকাল কী গো! প্রায় ভোর রাত। যখন গেস্টহাউস থেকে ট্যাক্সিতে উঠলাম, তখন সওয়া চারটে। আকাশে তারা ফটফট।

ও। তুই তা হলে একটু রেস্ট নে।

হ্যাঁ, ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হ। মানসী সায় দিয়ে বলল,— আমি ততক্ষণ লুচি ভাজছি।

উঠে এগোচ্ছিল রাজা, দু’ পা গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মানসীকে জিজ্ঞেস করল,— তোমার ছোট ছেলের কি এখন মাঝরাত?

এবার বোধহয় জাগবেন। কাল তো তাড়াতাড়িই শুয়েছিল। …ডাকব?

একদম না। প্রাণ ভরে ঘুমিয়ে নিক। যে ক’টা দিন পারে। এরপর তো বাবুর জাগরণই জাগরণ।

মানসীর মাথায় ঢোকেনি কথাটা। ভুরুতে যেন প্রশ্নচিহ্ন। ইঙ্গিত হেনে রাজাকে প্রসঙ্গটা চেপে যেতে বলল পারমিতা। রাজা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঢুকে গেল ঘরে। শার্টটা খুলে রেখেছে বিছানায়।

পারমিতাও এসেছে পিছন পিছন। ছাড়া জামাখানা নেটের বালতিতে চালান করে বলল,— তুমি আচ্ছা লোক তো! কাল রাত্তিরেও কিছু ভাঙলে না!

এসে অসুবিধে ঘটালাম বুঝি? বলো তো চলে যেতে পারি।

ফাজলামি হচ্ছে? পারমিতা রাজার সামনে এসে দাঁড়াল। চোখ তুলে বলল,— এখন এক-দু’ দিন থাকছ নিশ্চয়ই?

উঁহু। কালই ফেরা। মর্নিং ফ্লাইটে।

যাহ্ বাবা! এমন আসার দরকারটা কী ছিল?

না এসে পারলাম না যে। পারমিতার দু’কাঁধে হাত রেখেছে রাজা। গাঢ় স্বরে বলল,— বড্ড মন কেমন করছিল।

পারমিতা বিহ্বল। হৃৎপিণ্ডে শিরশিরে অনুভূতি। সরু একটা নদী যেন বয়ে যাচ্ছে নেচে নেচে। রাজার বুকে মুখ রেখে বলল,— তুমি কিন্তু একটু পাগল আছ।

একটুক্ষণ পারমিতাকে জড়িয়ে রইল রাজা। যেন ওম নিচ্ছে শরীরের। তারপর কপালে চুমু খেয়ে বলল,— ঝটপট একটা শাওয়ার নিয়ে আসি, কী বলো?

স্নান করাটা রাজার প্রিয় ব্যসন। গরমকালে দিনে দু’বার তো বটেই, ছুটিছাটায় তিনবার, চারবার…। এমনকী শীতেও গিজার চালিয়ে রাতের বেলা দাঁড়ায় শাওয়ারের নীচে। নইলে নাকি দেহ আনচান করে।

পারমিতা ওয়ার্ড্রোব থেকে পাজামা বার করল রাজার। ধরিয়ে দিয়ে বলল,— যাও। …তোমার খাবারটা কি ঘরে আনব?

না, না, টেবিলেই আসছি।

রাজা বাথরুমে ঢুকেছে। তার ঘরে পরার স্লিপারখানা বাথরুমের দরজায় রেখে পারমিতা বাইরে এল। নিজের কাজ নিজেই করতে পারে রাজা, মোটেই ঠুঁটো জগন্নাথ টাইপ আয়েশি বর নয়, তবু হাতের কাছে গুছিয়ে দিলে ভারী খুশি হয়।

বাড়িতে একটা সাজো সাজো রব। শুভেন্দু হাফপাঞ্জাবি চড়িয়ে চলেছে বাজারে, ছেলের জন্য ইলিশ মাছ আনবে। রাজার লুচিভাজা শেষ করে মানসী ব্যস্ত রান্নাবান্নায়, আনাজপাতি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছে আর কী বিশেষ পদ বানানো যায়। অণিমা এসে পড়ল, তাকে মশলা বাটতে বসাল মানসী। বাজার থেকে শুভেন্দু রুই মাছ এনেছিল, ওটা রাঁধবে না, সেদ্ধ করে কাঁটা ছাড়িয়ে দিতে বলল অণিমাকে। আজ মাছের চপ হবে।

কী আজব ব্যাপার স্যাপার, তাই না? হেতুটা কত সামান্য…! ক’দিনই বা গেছে রাজা, দু’মাসও তো পেরোয়নি, তার চকিত আগমনে এই আহ্লাদ তো প্রায় বাড়াবাড়িরই সামিল। তবু পারমিতার বেশ লাগছিল। আসলে কাজেকর্মে কোথাও গমন, আর স্থায়ীভাবে ঠাঁইনাড়া হওয়া, দুটোতে বুঝি বিস্তর প্রভেদ। রানা পর্যন্ত জলখাবারের টেবিলে গল্প জুড়েছে দাদার সঙ্গে। আর তাতার যেন বাবার লেজ। কস্মিনকালে বাবা বাবা আদিখ্যেতা ছিল না, আজ সুযোগ পেলেই গায়ে সেঁটে যাচ্ছে। গ্যারেজে ঢুকল রাজা, তাতার পাশে। গাড়ি নিয়ে এক প্রস্ত চক্কর মেরে এল, তাতারই সঙ্গী। ফোন এল রাজার, মেঘলা উঠোনে ব্ল্যাকবেরি কানে পায়চারি করছে রাজা, বাবাকে নকল করে খেলনাফোন নিয়ে একই ভঙ্গিতে হাঁটছে তাতার। সে এক দৃশ্য! পারমিতা তো বটেই, শুভেন্দু-মানসী-রানা, এমনকী অণিমাও হেসে কুটিপাটি।

দুপুরের ভুরিভোজ সেরে রাজা লম্বা হল বিছানায়। এসি চালিয়ে। পারমিতার তখনও হাতজোড়া। সরস্বতী গতকালই গা গুলোনোর ধুয়ো তুলেছিল, আজ ডুব, সিঙ্কে থালাবাসনের ডাঁই…মাজছিল ঘষে ঘষে। ভারী বাসনগুলো অন্তত সরস্বতীর জন্য রেখে দিতে বলছিল মানসী, ভরসা পেল না পারমিতা। যদি কালও সরস্বতী নাগা করে! ভোরবেলা রাজার বেরোনোর প্রস্তুতি, তাতারকে তৈরি করা, ন’টা-সওয়া ন’টার মধ্যে নিজের কলেজ রওনা…সময় মিলবে কি? সেই হয়তো শাশুড়ির ঘাড়েই পড়ে যাবে। তার চেয়ে পারমিতা এখনই না হয়…

বাসনপত্র ধুয়ে যথাস্থানে রাখতে রাখতে কে জানে কেন হঠাৎ রঞ্জাবতীকে মনে পড়ল পারমিতার। ওই হাইফাই মেয়ে এ বাড়ি এসে কি মাজবে এত বাসন? বলা যায় না, মেয়ে তো, সংসার করতে গেলে কী না পারে! পারমিতা যখন কুমারীবেলায় জিন্স চড়িয়ে, চোখে সানগ্লাস এঁটে, বন্ধুদের সঙ্গে হাহা হিহি করত, তখন কি স্বপ্নেও ভেবেছিল বিয়ের পর তাকে…! এখনও ল্যাবরেটরিতে যখন ছেলেমেয়েদের প্র্যাক্টিকাল করায়, ক্লাস-টাস নেয়, বকাঝকা করে, তখনও তো ওই পারমিতার কাছে এই পারমিতা এক অলীক মানবী। অথচ মোটেই অলীক নয়, সংসারে এই পারমিতাও এক জ্যান্ত বাস্তব। নয় কি?

ফ্রিজ খুলে ঢকঢক খানিক ঠান্ডা জল খেল পারমিতা। শিথিল পায়ে ঘরে এসে দেখল রাজা নাক ডাকাচ্ছে। খাটে বসতে গিয়েও রাজার পানে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। দু’হাত ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে রাজা, চিত হয়ে। মুখের রং ঈষৎ তামাটে মেরে গেলেও বুক-পেট বেশ ফরসা ফরসা। চেহারাটা রাজার চিরকালই কষা ধরনের, রীতিমতো শক্তপোক্ত। ইদানীং কিঞ্চিৎ মেদ জমেছে গায়ে। বাড়তি চর্বিটুকু যেন কমিয়ে দিয়েছে মুখমণ্ডলের তীক্ষ্নতা । বহিরঙ্গের ওই সামান্য বদলটুকু ছাড়া আর কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি রাজার? উঁহু, এখনও তো পারমিতাকে চোখে হারাচ্ছে। অল্প ক’দিনের অদর্শনে কতটা উতলা হলে একটা ছেলে মাত্র একদিনের জন্য বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতা পাড়ি দিতে পারে!

বিয়ের আগের সেই সব দিনগুলো মনে পড়ছিল পারমিতার। তেমন পুরনো হয়তো নয়, তবে মাঝে সাত-আট বছর তো কাটল। তখনও এক দিন দেখা না হলে কী ছেলেমানুষি যে করত! এক-দু’ঘণ্টা ছাড়া ছাড়া ফোন, ক্ষণে ক্ষণে এস-এম-এস…মাঝরাতেও মোবাইলে টুং টুং। এখনও এই সদা ব্যস্ত, নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় আকণ্ঠ ডুবে থেকেও কোথায় যেন সেই অস্থির প্রেমিকটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে রাজা। ভাবলে পারমিতার একটা আলাদা গর্ব হয় বই কী। সে এমনই এক বিশেষ নারী, যার অমোঘ টানে বাঁধা পড়ে আছে রাজা। শুধু শরীর নয়, রাজা নিশ্চয়ই আরও কিছু পায় পারমিতার কাছ থেকে!

পারমিতাও কি পায় না? এক মায়াবী জাদু, এক অজানা রসায়ন…! এমনি এমনি কি শত কাজের মাঝেও হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে ওই মুখখানা? ওমনি একটা মিষ্টি মিষ্টি বিষাদে ছেয়ে যায় বুক! এক একটা রাতে তো ঘুমই আসতে চায় না পারমিতার। বালিশে মাথা রাখলেই অজস্র সোনালি মুহূর্ত দুলতে থাকে চোখের পাতায়। কী অপূর্ব শিহরন যে জাগে তখন! মনে হয় এক্ষুনি চলে যাই তার কাছে, সেই পুরুষের কাছে, বালিহাঁসের মতো ডানা মেলে পেরিয়ে যাই হাজারটা মাইল…!

পারমিতা শুয়ে পড়ল রাজার পাশে। ঘুম তার আসে না দুপুরে। শ্রান্ত থাকলেও না। আলগাভাবে ছুঁয়ে আছে রাজার ছড়িয়ে থাকা হাত। স্পর্শটুকুই বুঝি অনেকখানি। হিমেল ঘরে এ যেন এক নরম সুখ।

বিকেলে আজ কী করা যায়? চোখ বুজে ছকছিল পারমিতা। এমন একটা পড়ে পাওয়া মণিমুক্তোর মতো দিন তো নষ্ট হতে দেওয়া যায় না! প্রতিটি মুহূর্ত তারিয়ে তারিয়ে চাখতে হবে। গঙ্গার ধারে যাবে দু’জনে? তাতারও নয় রইল সঙ্গে। খানিকক্ষণ হয়তো নৌকো চড়ল, হেঁটে বেড়াল নদীর ধারে, তারপর ফুচকা-ভেলপুরি-আইসক্রিম, যার যা প্রাণ চায়…। শেষে পার্ক স্ট্রিটে কোথাও চাইনিজ সাঁটিয়ে একেবারে ফিরবে রাতে। একটা সিনেমাও যেতে পারে। কাল তো রঞ্জাবতীর কলকলানিতে ছবিটা মন দিয়ে দেখাই গেল না…। কোথায় যেন একটা থ্রি-ডি মুভি চলছে, পরদা থেকে লোকজন জীবজন্তু হুশ করে সামনে চলে আসে। ভারী মজা পায় তাতার! রাজাও। যাবে কি? সিনেমার পর টো-টো করবে শপিংমলটায়।…যাদবপুরে ঘুরে এলেই বা কেমন হয়? বেঙ্গালুরু যাওয়ার আগে রাজা তো শেষমেশ ও বাড়ি গিয়ে উঠতে পারল না…। আচমকা জামাইকে দেখে মা তো আহ্লাদে চৌষট্টিখানা হবেই, বাবারও ভাল লাগবে নিশ্চয়ই। শ্বশুরের শারীরিক উন্নতিটুকুও সরেজমিন করে আসুক রাজা। পারমিতা যে এত দিনের পরিশ্রমের ফল পাচ্ছে, দেখে রাজারও কি আনন্দ হবে না!

শেষ পরিকল্পনাটাই বেশি মনে ধরল পারমিতার। ভেবেছিল রাজা জেগে উঠলেই পাড়বে প্রস্তাবটা, কিন্তু আচমকা ঘুঁটি কেঁচে গেল।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ দ্বারে মৃদু করাঘাত। মানসীর গলা,— মিতা, তোমরা কি জেগে?

পারমিতা দৌড়ে দরজা খুলেছে। মানসীর হাতে চায়ের ট্রে। পারমিতা তাড়াতাড়ি বলল,— এমা, আপনি করতে গেলেন কেন? আমি তো যাচ্ছিলাম।

ভাবলাম তুমি জিরোচ্ছ। আজ অত বাসন মাজামাজি গেল…

হায় রে, ওইটুকুতেই পারমিতার শ্রান্তি! শুধু ওইটুকুর জন্যই বিশ্রাম চাই পারমিতার!

চা এনেছ নাকি? রাজার জড়ানো গলা শোনা গেল। উঠে বসেছে বিছানায়। হাই তুলতে তুলতে বলল,— দাও। ঘুমটা এবার ছাড়ুক।

মানসী ঢুকে বেড-সাইড টেবিলে রাখল ট্রেখানা। যেতে গিয়েও কী ভেবে ঘুরেছে। খাটে বসে জিজ্ঞেস করল,— কিছু করছিস বিকেলে?

কী আর করার আছে? একটু আয়েশ করব, গল্প আড্ডা…

চল না, তোর দিদাকে একবার দেখে আসবি! মা’র শরীরটা ভাল যাচ্ছে না…বয়স হয়েছে, কবে আছে, কবে নেই…এত তোর কথা বলে…রানা তো কিছুতেই ও পথ মাড়াবে না…

রাজা অপাঙ্গে পারমিতাকে দেখল। যেন জানতে চায় পারমিতার অভিমত। কিন্তু আর কি বাপের বাড়ির কথা তুলতে পারে পারমিতা? বিশেষ করে কাল যখন একটা মান-অভিমানের পালা হয়ে গেছে?

পারমিতা ঢক করে ঘাড় নেড়ে দিল। রাজাও কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে,— চলো তবে। বুড়িকে দর্শন করে আসি।

প্রফুল্ল বদনে ঘর ছাড়ল মানসী। সূক্ষ্ম জয়ের সুখ? চা শেষ করে পারমিতাও তৈরি হচ্ছে। মনটা যেন ভার ভার। অদৃশ্য যুদ্ধে হেরে গেল বলেই কি? ওয়ার্ড্রোব খুলে একটা তাঁত-ঢাকাই বার করেও রেখে দিল পারমিতা। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি শাড়ি পরে গেলেই শাশুড়ি খুশি হয়, আজ সে সালোয়ার-কামিজ পরবে।

রাজার মাতুলালয়টি ভবানীপুরের চক্রবেড়িয়ায়। ছোট দোতলা বাড়ি। প্রাচীন, তবে জীর্ণ নয়। একটা সাবেকিয়ানা আছে। রাজার দুই মামার বড়জন হৃদরোগে গত হয়েছে বছর সাতেক, তার একমাত্র পুত্র এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। কলকাতা থেকে বউ নিয়ে গিয়ে সে সিডনিতে থিতু, সম্প্রতি মাকেও নিয়ে গেছে ও দেশে। ছোটমামার চাকরিজীবন এখনও শেষ হয়নি, তবে মেয়ের বিয়ে দিয়ে সে অনেকটা যেন ঝাড়া-হাত-পা। তার ছেলেটিও দাঁড়িয়ে যাব যাব করছে। এবার বাবুয়ার ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ফাইনাল ইয়ার। এদের নিয়েই ছিয়াশি বছরের সাধনার এখন ছড়ানো-ছেটানো সংসার।

সদলবলে দিদির আবির্ভাবে চিন্ময় যথেষ্ট পুলকিত। হেসে বলল, জামাইবাবুকেও ধরে আনলে পারতিস।

তার আজ ব্রিজ কম্পিটিশান। সন্ধেবেলা ক্লাব ছেড়ে সে নড়বেই না। বলতে বলতে অন্দরের প্যাসেজে পা রেখেছে মানসী। জিজ্ঞেস করল,— কেমন আছে রে মা এখন?

মন্দের ভাল। কাশিটা কম, কিন্তু বুকে সাঁ সাঁ এখনও যায়নি।

রাজা বিজ্ঞ বিজ্ঞ সুরে বলল,— ডাক্তার কী দিয়েছে? অ্যান্টিবায়োটিক্স?

তা ছাড়া আর কী! এখনকার ডাক্তারদের ওটাই তো হাতিয়ার। গড়বড় দেখলেই একটা কোর্স ঠুকে দেয়।… যা না ওপরে, দেখে আয়।

সাধনা দোতলার বড় ঘরে। পালঙ্কের বাজুতে ঠেসান দিয়ে বসে। পরনে ঢোলা নাইটি, চোখে চশমা, সাদা ধবধবে চুল লিকলিকে বিনুনিতে বাঁধা। বিছানায় একটি লাঠি শোওয়ানো। এবং একটি বাংলা উপন্যাস। মহিলাকে বই ছাড়া কখনও দেখেনি পারমিতা।

রাজা দরজা থেকেই হাত তুলল,— হাই ডার্লিং! কী সব পাকিয়েছ শুনলাম?

সাধনা হাঁপাচ্ছিল অল্প অল্প। রাজার ডাক শুনে ফোলা ফোলা মুখখানা হাসিতে ভরে গেছে,— ওমা, তুই কোত্থেকে? আয় আয়।…ও বাবা, তোর বউও এসেছে? পুচকে বিচ্ছুটাও…? অ্যাই অ্যাই ছেলে, লুকোচ্ছিস কেন? দেখি দেখি তোদের চাঁদমুখগুলো!

কারও বাড়ি গেলে তাতার কেমন ভেবলে যায়। কিছুতেই এগোচ্ছে না। পারমিতা গিয়ে প্রণাম করল দিদিশাশুড়িকে। ঢাউস পেস্ট্রির বাক্সখানা দিদাকে অর্পণ করল রাজা।

সাধনা ডগমগ স্বরে বলল,— আমাকে কেন, তোর মামির হাতে দে।

আগে তুমি একটু ছুঁয়ে দাও। তারপর তো মামি…

ঠোঁটে মাপা হাসি টেনে অঞ্জলি পাশেই দাঁড়িয়ে। বাক্সখানা নিয়ে বাড়িয়ে দিল রাতদিনের কাজের মেয়েটিকে। অভ্যস্ত নিরাবেগ স্বরে মানসীকে বলল,— তুমি আজ মাকে একটু বোকো।

কেন গো?

কত বলছি খাট থেকে নামার আগে কাউকে একটা ডাকবেন। সবিতাকে তো ওঁর জন্যই রাখা। নইলে চব্বিশ ঘণ্টার লোক আমার কী কাজে লাগে! কিন্তু মা তো নিজের নিয়মেই চলছেন। সেই লাঠি ঠুকঠুক করে একাই বাথরুম, এ ঘর, ও ঘর…। কিছু একটা ঘটলে লোকে তো তখন আমাদেরই দুষবে।

মামিশাশুড়ির এই আত্মরক্ষার সুরটা পারমিতার ভাল লাগে না। যেন বদনাম থেকে বাঁচার জন্যই বৃদ্ধার দেখভাল করে!

সাধনারও মুখ অপ্রসন্ন। বলল,— পারোও বটে। ঢুকতে না ঢুকতেই নালিশ! আগে ওদের একটু জলটল দাও।

অঞ্জলি বুঝি সেই আয়োজনেই গেল, ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে। বড় ধীর লয়ে হাঁটে মহিলা, কোনও কাজেই যেন তাড়া নেই। তাতারকে নিয়ে রাজাও সুড়ুৎ। বোধহয় নীচে টিভি চালিয়ে খেলা টেলা দেখবে।

মানসী বসেছে বেতের আরামচেয়ারে। পারমিতা বিছানার ধারটিতে, আদুরে গলায় বলল,— সত্যি, আপনার কিন্তু একা চলা-ফেরা একদম উচিত নয় দিদা।

একেবারেই পরনির্ভর হয়ে যাব রে? কষ্টেসৃষ্টে এখনও যখন হাত-পা চলছে, সেটাকে অযথা বিকল করি কেন?

কিন্তু এই বয়সে যদি একবার আছাড় খান…

নারীজন্ম তো খালি আছাড় খাওয়ার জন্যই রে। একটু সোজা হয়ে হাঁটতে গেলেই ধপাস। এতরকম ফেনায় পিছল থাকে জীবনটা!

তোমার কেতাবি বাক্যিগুলো থামাও তো মা। মানসী মৃদু ধমক দিল,— পাঁচজনে যা বলছে, একটু শুনে চলো। বয়সটাকে তো মান্য করবে!

করি তো। তাই তো লাঠি নিয়েছি।

পারমিতা হেসে ফেলল, দেহে জরা ধরেছে বটে দিদিশাশুড়ির, কিন্তু মগজ দিব্যি সাফ। যুক্তিতে এঁটে ওঠা মুশকিল। এই বয়সে এমনটা কমই দেখা যায়। মানসীর মুখে শুনেছে, দিদার নাকি চিরদিনই খুব দাপট। বিয়ের পর বরকে জাপিয়ে জাপিয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে, কলেজে ভরতি হয়েছিল। তার মধ্যেই প্রেগন্যান্ট, তবু দমেনি, একটা বছর নষ্ট হলেও ছেলে কোলে গ্র্যাজুয়েশান করেছে। স্কুলে পড়ানোর নাকি ইচ্ছে ছিল, পর পর আরও দুটো বাচ্চা এসে সেই মনোবাঞ্ছা আর পূর্ণ হয়নি, সংসারেই বাঁধা পড়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। অবশ্য জ্ঞানপিপাসা তাতে মরেনি, হাতের কাছে যা পায় তাই পড়ে ফেলে। এখনও। বাহাদুর বটে মহিলা।

হাসিমাখা মুখে পারমিতা বলল,— শুধু একটা কাষ্ঠদণ্ডেই কি সব শক্তি পাওয়া যায় দিদা?

তা বটে। আগে তো লাগে মনের জোর, তারপর লাঠি। পারমিতার একটা হাত টেনে নিল সাধনা। ঈষৎ তপ্ত আঙুল বোলাচ্ছে পারমিতার হাতে। স্মিত মুখে বলল,— হ্যাঁরে, তোরা শাশুড়ি-বউ কি আমায় শুধু শাসন করতে এসেছিস? অন্য কথা বল।… তোর বাবা এখন কেমন?

একটু ভাল। ফিজিয়োথেরাপিতে রেসপন্স করছে।

সুস্থ হলেই মঙ্গল। শয্যায় যে পড়ে, তার তো অশেষ যন্ত্রণা। পাশে যারা থাকে, তাদেরও কি কম জ্বালা? তোর মা’র যা যাচ্ছে…

মিতারও প্রাণান্ত। মানসী বলে উঠল,— কলেজ ঠেঙিয়ে হুড়মুড়িয়ে যাদবপুর…তাও একদিন দু’দিন নয়, মাসের পর মাস…আমি তো বাবা পারতাম না। পারমিতা একদম ছেলের মতো করছে।

উপমাটা কি শোভন হল মানু? বাবা-মা’র ওপর ছেলেমেয়েদের টানের ধরন কি আলাদা আলাদা? নাকি কর্তব্যটা সমান সমান নয়?

একটু তো তরবেতর থাকেই মা। বিয়ে হলে মেয়েদের একটা ভিন্ন জগতে যেতে হয়। একটা অন্য সংসার, যেখানে স্বামী থাকে, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওর-ননদ…সেই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে ছেলেদের মতো করে বাপ-মা’র দায়িত্ব নেওয়া কি মেয়েদের পক্ষে সম্ভব? পেরে ওঠে তারা? আমি কি চিনু বা দাদার মতো তোমার সেবাযত্ন করতে পেরেছি? ওরা না থাকলেও কি পুরো ভারটা নিতে পারতাম?

সেটা তোর সমস্যা। কিংবা অক্ষমতা। তা বলে আমার নাতবউয়ের গলায় একটা ভুলভাল সার্টিফিকেট ঝোলাস কেন? মুখে কেন আসে না, ও সন্তানের যোগ্য কাজই করছে?

এটা তো পারমিতারও অন্তরের কথা। সাধে কি এ বাড়ি এলে দিদিশাশুড়ির সান্নিধ্যটুকুই তার কাছে বেশি প্রিয়?

মানসী অবশ্য বিশেষ প্রীত হয়নি। আঁতে লাগল কি? নাকি কোনও প্রচ্ছন্ন অনুযোগ আছে পারমিতাকে নিয়ে? একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল,— যাক গে, অন্য খবরটবর বলো। তোমার নাতির ফোন কি এল?

অবশেষে। কাল বিকেলে করেছিল। শুনলাম কম্পিউটারে নাকি বাচ্চার রাশি রাশি ছবি পাঠিয়েছে, আমার অবশ্য এখনও দেখা হয়নি।

সেই মেয়ে নাকি খুব গাবলুগুবলু হয়েছে?

ঝিনি তো তাই বলছিল।

ওমা, ঝিনি এসেছিল নাকি?

এই তো পরশু ঘুরে গেল। নাতজামাইকে নিয়ে।

অঞ্জলি ফিরেছে। সঙ্গে সবিতা, হাতে শরবতের ট্রে। একটা গ্লাস নিয়ে মানসী যেন অঞ্জলিকে শুনিয়েই বলল,— ইস, কবে থেকে ঝিনি আর ঝিনির বরকে খেতে ডাকব ভাবছি, হয়েই উঠছে না।

তাড়া কীসের? তোমার ভাইঝি-জামাই তো অস্ট্রেলিয়া পালাচ্ছে না। অঞ্জলিও উত্তরটুকু ভাসিয়ে দিয়েছে,— তোমরা এখন কী খাবে বলো? নোনতা কিছু আনাই?

না গো, কিছু না। আমরা অনেক বেলায় খেয়েছি। মানসী ফের সাধনাকে প্রশ্ন করল,— তা ঋজুর সঙ্গে তোমার কথা হল? কী বলল?

খোশমেজাজেই আছে সিডনিতে। মেয়ের জন্য চমৎকার একটা আয়া পেয়ে গেছে…না না, আজকাল কী যেন বলে…বেবিসিটার!

মানসীর উচ্ছ্বাস থমকেছে। সন্দিগ্ধ স্বরে বলল,— তুমি কি বউদির কথা বলছ?

নয় তো আর কে! অঞ্জলির চকিত মন্তব্য,— মা’র কথা তো ওরকমই ধারা। ঋজু কত ভালবেসে তার মাকে ডাকল…দিদিও কত আনন্দ করতে করতে গেল… নাতনিকে নিয়ে তার এখন সুন্দর সময় কাটছে… অথচ মা’র যত বাঁকা টিপ্পনী।

সোজা-বাঁকা আমি বুঝি না ছোটবউমা। সাদাকে সাদাই বলি, কালোকে কালো। ঋজু আমাদের খুব গুণের ছেলে, এ কি আমি কখনও অস্বীকার করেছি? কিন্তু কবেই তো সে বিদেশ গেছে, আগে একবারও মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়েনি কেন? যেই বউয়ের পেটে বাচ্চা এল, ওমনি ম্যা ম্যা ডাক! ডলার তো বাঁচছেই। মাকে বাচ্চার পাহারাদারিতে রেখে দুটিতে অফিসও করতে পারছে নিশ্চিন্তে।

উফ মা, তুমি সত্যিই বড় নেগেটিভ। মানসী অঞ্জলিরই পক্ষ নিয়েছে,— বউদি দিব্যি ছেলে ছেলের বউয়ের কাছে থাকছে, উপরি পাওনা একটা ফুটফুটে নাতনি…

ওসবের মোহেই তো মেয়েরা মরে। তাদের শেকলে বাঁধতে সুবিধে হয়।

উত্তেজনায় জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে সাধনা। মুখ লাল, একটা ফ্যাঁসোর ফ্যাঁসোর আওয়াজ উঠছে বুক থেকে। মানসী বুঝি তাই আর তর্ক বাড়াল না। নিজের নাতির মুখ মনে পড়ল কি? দিনভর তাতারকে সামলানো…? অঞ্জলিও সরে গেছে প্রসঙ্গ থেকে। টুকিটাকি গল্পগাছা হচ্ছে সাংসারিক। চিন্ময় বেরিয়ে একগাদা মোগলাই পরোটা এনেছিল, পারমিতাদের কারওই তেমন আহারে রুচি নেই, তবু গিলতে হল উপরোধে। বেরোনোর ঠিক মুখে মুখে বাবুয়ার প্রবেশ, আরও খানিকক্ষণ বসতে হল সকলকে। শেষে যখন গাড়িতে উঠল, তাতার রীতিমতো ঢুলছে।

রাত্তিরে গজগজ করছিল রাজা। অভ্যাস মাফিক ল্যাপটপে মেল চেক করতে করতে বলল,— ধুস, বিকেলটা আজ পুরো চৌপাট!

রাজার জন্য ছোট একখানা সুটকেস গোছাচ্ছিল পারমিতা। নিজের অনেক জামাকাপড়ই নিয়ে গেছে রাজা, এবার আরও ক’টা যাক সঙ্গে। শ্যাওলা রং চিনোজটা ভরতে ভরতে পারমিতা বলল,— কেন গো? তুমি তো ভালই আড্ডায় মেতেছিলে?

ঘোড়ার মাথা। শুধু বসে বসে বাকতাল্যা হজম করা! ছোটমামার গুল মারার হ্যাবিটটা আর গেল না। কী বলে জানো? বাবুয়া নাকি ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চারখানা ঘ্যাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছে!

পেতেই পারে।

ছাড়ো তো। বাবুয়ার মেরিট আমি জানি না? হায়ার সেকেন্ডারিতে তো কেঁদে-ককিয়ে ফার্স্ট ডিভিশান। এখন যেখানে পড়ছে, সেটাও তো একটা সেকেন্ড গ্রেড ইনস্টিটিউট। সেখানেও এন্ট্রি পাওয়ার মুরোদ ছিল না, ছোটমামাকে প্রচুর গ্যাঁটের কড়ি ঢালতে হয়েছে। মা-ই তো বলে, লোকে মেয়ে পার করতে সর্বস্বান্ত হয়, ছেলেকে খাম্বা ধরাতে চিনুর ভিখিরি বনার দশা…। বাবুয়ারও বোলচাল শুনছিলে? অসহ্য।

তুতো ভাইবোনদের সম্পর্কে রাজার এক ধরনের তুচ্ছতাচ্ছিল্য আছে, পারমিতা জানে। বিশেষত মেধার ব্যাপারে সে যে তাদের চেয়ে বহু ওপরে, এ বিষয়ে যেন সদা সচেতন। সমকক্ষতার আভাস দেখলেও সে অখুশি হয়। শাশুড়ি বলে, কোনও বছর স্কুলে যদি রানা দাদার চেয়ে অঙ্কে একটু বেশি নম্বর পেল, ওমনি দাদা গোঁজ! অথচ ভাইকে সে কম ভালবাসে তাও তো নয়। এমনকী বাবুয়াও যদি আজ রাজার সাহায্যপ্রার্থী হয়, তার জন্য যথাসাধ্য করবে রাজা। এও জানে পারমিতা। রাজার এটাই স্বভাব। অহংটা একটু বেশি। কী আর করা, দোষেগুণেই তো মানুষ।

ডালা বন্ধ করে দেওয়ালের ধারে সুটকেস রাখল পারমিতা। বৃষ্টি হয়নি আজ, তবে বাতাসে বড্ড জোলো ভাব, ঘর তাই ঠান্ডা হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি। পারমিতা এসি সামান্য কমিয়ে দিল। বিছানায় বসেছে। নিচু স্বরে বলল,— এবার ল্যাপটপ বন্ধ হোক।

এক সেকেন্ড। রাজা চোখ তুলে একবার হাসল। ফের মনিটরে দৃষ্টি রেখে বলল,— মা এমন ফাঁসিয়ে দিল! …এর চেয়ে গঙ্গার হাওয়া খেতে যাওয়া ঢের ভাল ছিল।

পারমিতার বেদনাটুকু উথলে উঠছিল প্রায়। কিছু না বলে ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল শুধু। দু’জনারই একই বাসনা, অথচ ঠিক সময়ে মনের দরজা না খুলতে পেরে দু’জনেই অতৃপ্ত, এটা ভাগ্যদেবীর ঠাট্টা ছাড়া আর কী!

রাজাই আবার বলল,— গাড়িটায় আজ একটা শব্দ হচ্ছিল, খেয়াল করেছ?

কই, না তো।

কী যে চড়ো তোমরা! সাউন্ডটা বোধহয় গিয়ার থেকে আসছে। বাবাকে বোলো তো, একবার যেন মেকানিক এনে দেখায়।

গাড়িটা তুমি নিয়ে গেলেই তো পারো।

অফিস একটা দিয়েছে ওখানে। এটা থাক। তোমরা ইউজ করো।

কে করবে? মা তো চড়তে চান না, বাবার প্রশ্নই ওঠে না, রানাও…

তুমি চড়ো। কাল যেমন বেরিয়েছিলে। ছুটিছাটায় হয়তো শপিং টপিং-এ গেলে, কিংবা যাদবপুর…। ও বাড়িতে বাবা তো অনেক বেটার…এখন মাকে নিয়ে একটু এদিক ওদিক…

দৃশ্যটা কল্পনা করে পারমিতা শিউরে উঠল যেন। সে হুশ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, এদিকে শাশুড়ি বাড়িতে…মুখে কিছু না বললেও শাশুড়ি কি মানতে পারবেন মনে মনে? তা ছাড়া খারাপও তো দেখায়।

পারমিতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,— না না, তুমি নিয়েই যাও। এখানে পড়ে পড়ে নষ্ট হবে।

বলছ? ল্যাপটপ সাইড টেবিলে সরিয়ে পারমিতাকে কাছে টানল রাজা। গলায় মুখ ঘষে বলল,— দেখি, কী করা যায়!

এই ক্ষণটুকুরই যেন প্রতীক্ষায় ছিল পারমিতা। মুহূর্তে জেগে উঠেছে শরীর। তাদের কথা ভেবেই বুঝি তাতারকে আজ নিজেদের ঘরে শুইয়েছে মানসী, আর তাতার নেই বলেই বুঝি দু’জনে পলকে উদ্দাম।

রমণ শেষে দু’জনে শুয়ে আছে পাশাপাশি। অন্ধকার ঘরে ভাসছে একটা বুনো ফুলের গন্ধ। রাজা জোরে শ্বাস টানল। যেন নিচ্ছে ঘ্রাণটা। ফিসফিসে স্বরে বলল,— অ্যাই…?

উঁ?

আমি তো সারপ্রাইজ দিলাম। এবার কিন্তু তোমার পালা। আমি আটতলার ফ্ল্যাটটা নিচ্ছি। পনেরোই অগস্টের সময়ে তো আর একটা কী যেন ছুটি আছে। প্লাস, শনি-রবি…

পারমিতাও একই কথা ভাবছিল। এবার যেতে হবে বেঙ্গালুরু। সাজিয়ে রেখে আসতে হবে ফ্ল্যাটখানা।

.

০৬.

কত কিছু তো পরিকল্পনা করে মানুষ, সব কি আর ঘটে সেই মতো? কখন যে কোত্থেকে এক উটকো বাতাস এসে ভেস্তে দেয় সাজানো ছক। হয়তো এটাই জীবনের নিয়ম।

রাজা ফিরে যাওয়ার পর পরই বেঙ্গালুরু ঘুরে আসার বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল পারমিতা। স্বাধীনতা দিবস আর জন্মাষ্টমীর মাঝে একটা শুধু ক্যাজুয়াল লিভ, ব্যস তা হলেই টানা পাঁচদিনের অবকাশ। ওই সময়ে তাতারকে নিয়ে ক’টা দিন যথাসম্ভব সঙ্গ দিয়ে আসবে রাজাকে। বেচারা একদম একা একা আছে, নতুন ফ্ল্যাট নিল…যাওয়াটা পারমিতার কর্তব্যও তো বটে। প্ল্যানমাফিক প্লেনের টিকিট হয়ে গেল, টুটান আর সোনালিকে পারমিতা বলেও দিল তারা যেন ক’টা দিন বাবা-মা’র খোঁজখবর রাখে…।

ওদিকে রাজাও বেজায় খুশি। রোজ পারমিতাকে শোনাচ্ছে কবে কোথায় বেড়াবে, কোন কোন শপিং মল ঘুরে কেনাকাটা করবে নতুন গৃহস্থালির টুকিটাকি, কখন কোন রেস্তোরাঁয় খাবে…। তার উৎসাহ দেখে এক্ষুনি একবার বেঙ্গালুরু ছুঁয়ে আসা আরও যেন বেশি জরুরি মনে হচ্ছিল পারমিতার। সে গিয়ে ক’দিন থেকে এলে যদি কলকাতা ত্যাগের ঝটকাটা রাজার কাছে খানিক সহনীয় হয়ে ওঠে, তার চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে!

যাত্রার ঠিক আগে আগে আচমকা বিভ্রাট। সেদিন কলকাতায় জোর ঝড়বৃষ্টি, দাদু-ঠাকুমার চোখ এড়িয়ে ছাদে উঠে প্রাণের সুখে ভিজেছিল তাতার, রাত থেকেই তার ধুম জ্বর। অনেকটা প্রায় তড়কার মতো। দুমদাম টেম্পারেচার চড়ে যাচ্ছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে ছেলে, ভুলভাল বকছে…রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দেওয়া ব্যাপার। তড়িঘড়ি ডাক্তার ডাকা হল, ওষুধও পড়ল। চড়চড়িয়ে জ্বর বাড়লে প্যারাসিটামলে নেমে আসে বটে, কিন্তু দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যে আবার একশো তিন, একশো চার! ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছিল তাতার, দেখে তো বাড়িসুদ্ধু সকলের হাত-পা ছেড়ে যাওয়ার জোগাড়। রাজা তো ঘনঘন ফোন করছেই, রানার পর্যন্ত কপালে চিন্তার রেখা, দরজায় এসে খোঁজ নেয় বারবার। ডাক্তারবাবু অবশ্য বলেছিলেন ভয়ের কিছু নেই। বছর চারেক বয়স অবধি শিশুদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকাটা নাকি মোটেই অস্বাভাবিক নয়। অ্যান্টিবায়োটিক চলুক, তাতার ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে।

হলও তাই। কিন্তু তার আগেই তো বেঙ্গালুরু যাত্রা বাতিল। ছেলে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই, ছেলেকে নিয়েই বা পারমিতা যায় কোন সাহসে। সুতরাং পাকা ঘুঁটি কাঁচিয়ে ঘরেই আটকে থাকো চুপচাপ।

তাতার অবশ্য এখনও পুরোপুরি তরতাজা নয়। ছোটাছুটি করছে ঠিকই, তবে ঘংঘঙে কাশিটা আছে। সঙ্গে ভয়ানক অরুচি। তাকে যে কীভাবে কী খাওয়ানো যায়, ভেবে ভেবে মা-ঠাকুমা জেরবার। যেমন আজই সকালে নাতিকে ফ্রেঞ্চ টোস্ট ভেজে দিয়েছে মানসী। টম্যাটো সস মাখিয়ে কত বাবা-বাছা করছে। তা তাতার মুখে তুললে তো।

পারমিতার আজ ছেলের দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। তড়িঘড়ি আহার সেরে তৈরি হচ্ছিল দ্রুত। সপ্তাহের এই দিনটায় বড্ড চাপ থাকে কলেজে। ক্লাস, ক্লাস, অন্তহীন ক্লাস। প্রথমেই প্র্যাক্টিকাল, তারপর একের পর এক থিয়োরির পিরিয়ড…শরীর যেন ঝিমিয়ে আসে। আজ তো আবার মাথার ওপর বাড়তি বোঝা। দুপুর বারোটায় বসতে হবে ইন্টারভিউ বোর্ডে। সপ্তাহ খানেক হল স্কুল সার্ভিস কমিশনের ফল বেরিয়েছে, পারমিতাদের রসায়ন বিভাগের তিন-তিনজন অতিথি অধ্যাপক চাকরি পাচ্ছে স্কুলে, তাদের জায়গায় এক্ষুনি নতুন মুখ দরকার। অনিমেষের রিটায়ারমেন্টের আর বারো দিন বাকি, সে এখন একেবারেই পাল ছেঁড়া নৌকো, অগত্যা অস্থায়ী শিক্ষক নির্বাচনের গোটা ঝক্কি এখন পারমিতার। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিনিধি আসবে, বোর্ডে পরিচালন সমিতিরও থাকবে কেউ না কেউ, নিয়োগপত্রও দেবেন প্রিন্সিপাল, কিন্তু মূল কাজটা তো পারমিতারই। আবেদনকারীদের মোটামুটি বাজিয়ে দেখা, তাদের মার্কশিট চেকিং, ইন্টারভিউ বোর্ডের সকলের অভিমত একসঙ্গে গাঁথা, তারপর তথ্যপঞ্জি সমেত একখানা তালিকা বানানো…। এই প্রথম স্বাধীন ভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি চালাবে পারমিতা, ভেতরে ভেতরে একটা চোরা উত্তেজনাও বুঝি রয়েছে তাই। কাজটা ঠিকঠাক উতরোলে হয়। কোনও ঝুটঝঞ্ঝাট ছাড়াই।

মোবাইলখানা ব্যাগে ভরে পারমিতা ঝটিতি একবার চোখ চালাল আয়নায়। নিছকই অভ্যেস মাফিক। অভ্যেস মতোই গোড়ালি দিয়ে টেনে শাড়ির প্রান্ত নামাল সামান্য, গালে আলতো আঙুল বোলাল, কপালের টিপখানা চাপল আর একবার। ছাতা নিয়েছে, এবার জলের বোতলটা নিলে প্রস্তুতি শেষ। গড়িয়া থেকে ন’টা দশের ট্রেনটা পেয়ে গেলে নিশ্চিন্ত, আরামসে ওদিকের ব্যারাকপুর লোকাল ধরতে পারবে।

সরস্বতী পরদা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ব্যাগ কাঁধে তুলে পারমিতা জিজ্ঞেস করল,— কিছু বলবে?

একটা দরকারি কথা ছিল গো বউদি।

এখন…? চটপট, চটপট।

ভারী মুশকিলে পড়েছি গো। সরস্বতী ভেতরে এল, একটু যেন আড়ষ্ট পায়ে। সংকুচিত স্বরে বলল,— তুমি যদি একটা বুদ্ধি দাও…

সরস্বতীকে ঝলক দেখে পারমিতা পড়ে ফেলল সমস্যাটা। বেশ কয়েক দিন ধরেই সরস্বতী দেবীর হাবেভাবে সন্দেহটা দানা বাঁধছিল, প্রশ্নটা অবশ্য করা হয়ে ওঠেনি।

ভুরু কুঁচকে পারমিতা বলল,— টেস্ট করিয়েছ?

সরস্বতী ঘাড় ঝোঁকাল,— হ্যাঁ।

কত দিন হয়েছে?

দু’ মাস মতন। সরস্বতীর মুখ এবার কাঁদোকাঁদো,— কী করি বলো তো বউদি? দুটো বাচ্চার পেট ভরাতে প্রাণ যায়, এর পর যদি ফের একটা আসে…

সেটা তো আগে ভাবা উচিত ছিল। তোমার ছোট ছেলেটা যখন হল, তখনই তো বলেছিলাম অপারেশান করিয়ে নাও।

বর রাজি হল না যে, সে বলে, ওতে নাকি মেয়েমানুষের শরীরের ক্ষতি হয়। জোশ কমে যায়।

যত্ত সব পিত্তি জ্বালানো কথাবার্তা। কী যে কুযুক্তি মাথায় ঢুকে আছে! বরটার কর্তালিরও বলিহারি। ওই তো তার মুরোদের ছিরি! নাম কা ওয়াস্তে কাজ করে জোগাড়ের। সকালবেলা যাদবপুরে গিয়ে বসে থাকে দল বেঁধে, প্রায় দাসশ্রমিকের মতো। চেহারাপত্র দেখে কোনও ঠিকাদারের পছন্দ হল তো ভাল, সেদিনের মতো কাজ জুটল। না মিললেই বা কী, বাড়ি ফিরে ভাতপান্তা খেয়ে ঘুমোবে ভোঁস ভোঁস। আর কাজ পেলেও যেটুকু যা আসে, তার চেয়ে মৌজমস্তি, চুল্লুর ঠেক, মোবাইলে চলে যায় ঢের বেশি। সেই অকম্মা বর বিধান ঝেড়ে খালাস, আর এদিকে এই মেয়েটা, বয়স তো মেরেকেটে পঁচিশ, এরই মধ্যে জীবনের সব সাধআহ্লাদ খতম, উদয়াস্ত শুধু জোয়াল টানছে। এরপর আবার যদি একটা বাচ্চা হয়, তার অন্ন সংস্থানও করতে হবে এই সরস্বতীকেই। তিনি হাত উলটে থাকবেন, নইলে স্রেফ ভেগে যাবেন। তাও বরের সিদ্ধান্তই মেয়েটার কাছে বেদবাক্য! কোনও ভাবেই ওই বরের ওপর নির্ভরশীল নয় সরস্বতী, তবুও।

পারমিতা মুখ বেঁকিয়ে বলল,— তা এখন তার কী মত? বাচ্চা রাখা হবে? না নষ্ট করবে?

সে তো বলছে, তুমি যা ভাল বোঝো করো।

তুমি কী ঠিক করেছ?

আমি চাই না।

তোমার বর মানবে?

আপত্তি করবে না।

তা হলে একদম দেরি নয়। এবং ভুলেও কোনও হাতুড়ে টাতুড়ের পাল্লায় পোড়ো না যেন।

না না, ভাল জায়গাতেই যাব। বাঘাযতীন হাসপাতালে আমার ননদাইয়ের চেনাজানা আছে। একটুক্ষণ থেমে রইল সরস্বতী। তারপর মৃদু স্বরে বলল,— কিন্তু কিছু টাকা লাগবে যে।

কাল নিয়োখ’ন।

দু’-তিন দিন বোধহয় কামাইও হবে। তুমি একটু মাসিমাকে বুঝিয়ে বোলো…

আইনত ছুটিটা সরস্বতীর প্রাপ্য। কিন্তু তিন দিন ধরে ঘর ঝাড়পোঁছ, বাসন মাজা…!

পারমিতা সরু চোখে বলল,— বদলি কাউকে দাও তা হলে।

ঢক করে ঘাড় নেড়ে দিল সরস্বতী। কিন্তু পারমিতা খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারল কি? যদি সরস্বতী বদলি লোক না দেয়, কী করার আছে? তখন ক’টা দিন যা চরম বিশৃঙ্খলা চলবে… ঘরদোর একহাঁটু…মানসীর মুখ হাঁড়ি।…ওফ্, ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়।

যাক গে যাক, পরের ভাবনা পরে। এখন একটাই টারগেট। ন’টা দশের ট্রেন। মনে হতেই পারমিতা প্রায় ছিটকে বেরোল ঘর থেকে। তাতার এখনও ডাইনিং টেবিলে, সামনে ফ্রেঞ্চ টোস্টের প্লেট, পাশে মানসী। রান্নাঘর থেকে জলের বোতলটা নিয়ে এসে ছেলের কপালে একবার হাত ছোঁয়াল পারমিতা। নাহ্, তাপ নেই। ভোরবেলা একটু যেন গা গরম গরম ঠেকছিল, ওটা তবে মনেরই ভুল, জ্বরটা সত্যিই গেছে।

আলগা হাতে ছেলের চুল ঘেঁটে দিয়ে পারমিতা বলল,— আমি তা হলে আসি সোনা?

ওমনি তাতার খপ করে হাত চেপে ধরেছে। মিনতির সুরে বলল,— আজ যেয়ো না মা। প্লিজ।

ওরকম করে না বেটা। আজ আমার অনেক কাজ।

উঁউঁউঁ…প্লিজ…দুপুরে আমরা লুডো খেলব…

এমন একটা ব্যস্ত মুহূর্তেও পারমিতার জোর হাসি পেয়ে গেল। যেন কল্পচোখে দেখতে পেল গ্রাম্ভারি সভায় ইন্টারভিউ নেওয়ার বদলে আয়েশ করে সে ছক্কা-পাঞ্জা চালছে লুডোর বোর্ডে! দৃশ্যটা শুধু অলীক নয়, যেন পরাবাস্তবকেও হার মানায়।

মাথাটা সামান্য ঝাঁকিয়ে নিয়ে পারমিতা নরম গলায় বলল,— আজ নয় সোনা। তুমি লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকো, আমি শিগগির শিগগির চলে আসব।

তবু তাতার হাত ছাড়ে না। পারমিতা একটু অসহায় বোধ করছিল এবার। করুণ চোখে তাকাল মানসীর দিকে।

নাতির মুখে এক টুকরো ডিম-পাঁউরুটি গুঁজে দিয়ে মানসী বলল,— তুমি রওনা দাও তো। ও তোমাকে সামনে দেখলে একটু বেশি ঘ্যানঘ্যান করে। চোখের আড়াল হলে তো তখন দিব্যি থাকে। এই তো এক্ষুনি টিভি চালিয়ে দেব…

শুভেন্দু সোফায়। চুপচাপ দেখছিল দৃশ্যটা। হঠাৎই বলে উঠল,— হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি বেরিয়ে পড়ো। আমি তাতারবাবুর সঙ্গে লুডো খেলব। এখনই বসছি।

কৃতজ্ঞ চোখে শ্বশুর-শাশুড়িকে একবার দেখল পারমিতা। তারপর জুতোর র‍্যাকের সামনে গিয়ে চটি গলাচ্ছে।

শুভেন্দুর কী যেন মনে পড়েছে। পারমিতাকে জিজ্ঞেস করল,— তুমি কি ও বেলা যাদবপুর ঘুরে আসবে?

হ্যাঁ…মানে না…ক’দিন তো যাওয়া হয়নি…যদি সম্ভব হয়…

গেলে একটা কাজ কোরো। তোমার মা’র সার্ভিস বুকের ডুপ্লিকেট কপি আর পেনশান অর্ডারটা নিয়ে এসো তো। বেয়ান আমাকে বলছিলেন, অ্যাকচুয়াল পেনশানটা কত হওয়া উচিত তার একটা হিসেব করে দিতে। কথাবার্তা শুনে যা মনে হল, উনি অনেকটাই লস করছেন।

ঠিক আছে বাবা। যদি যাই তা হলে…

ভুলো না যেন। গভর্নমেন্টের ঘরে টাকা ফেলে রাখা মোটেই কাজের কথা নয়। একটু উদ্যোগী হতে হবে, বুঝলে। দ্যাখো না, পেনশান-গ্র্যাচুইটি ঠিকঠাক ক্লিয়ার হয়ে যাক, তারপর অ্যাইসান উকিল ফিট করে দেব, গভর্নমেন্টের কান মুলে ইন্টারেস্টটা পর্যন্ত আদায় করে আনবে। হকের টাকা যদ্দিন ইচ্ছে আটকে রাখবে, এ কি মামদোবাজি নাকি? গুঁতো না দিলে…

তাড়াহুড়োর সময়ে এসব বকবকানি পোষায়? গটগটিয়ে বেরিয়ে যাওয়াও তো অশোভন। বাবা-মা হলে তাও বলা যেত, এখন খ্যামা দাও। কিন্তু শ্বশুরকে কি তা বলা সম্ভব?

তবু মরিয়া হয়ে ইচ্ছে করে একবার ঘড়ি দেখল পারমিতা। ফল হয়েছে, খেয়াল করেছে শুভেন্দু। থমকে তাকিয়ে বলল,— খুব তাড়া আছে বুঝি?

হ্যাঁ বাবা। এগারোটার মধ্যে কলেজে ঢুকতে হবে।

কেন, তোমাদের তো অফিসবাবুদের মতো ঘড়ি ধরে হাজিরা দেওয়ার বালাই নেই।

তা ঠিক। তবে…প্রথমেই আজ ফার্স্ট ইয়ার অনার্সের প্র্যাক্টিক্যাল… সবে ভরতি হয়েছে তো ছেলেমেয়েগুলো, ল্যাবে গিয়ে স্যার ম্যাডাম কারওকে না পেলে কেমন দিশেহারা মতন হয়ে যায়।

অ। তা হলে আর কী, ছোটো।

ছোট্ট বাক্যবন্ধটিতে কি কোনও ব্যঙ্গের আভাস? হয়তো নেই, হয়তো কল্পনা, তবু বলার ভঙ্গিতে ওইরকমটাই লাগে যেন। বাড়ির মেয়ে-বউরা, বিশেষত বউ, যে চাকরিই করুক, যত উঁচু পদেই থাকুক, তার কাজটাকে কি যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হয় আজও? রিকশায় স্টেশন যেতে যেতে কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল পারমিতার মাথায়। এ কি এক ধরনের অবুঝপনা? না সংস্কার? নাকি দুটোই? আর এই বিষয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বাবা-মা’র কী-ই বা এমন প্রভেদ? পারমিতার মা’র চোখেও কি জামাইয়ের কর্মজগৎ বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়? সেই মা, যে কিনা নিজেও চাকরি করেছে এতকাল! নাহ্, আদ্যিকালের ধ্যানধারণাগুলো এখনও ঘুচল না। মনের কোন গভীরে যে গেড়ে আছে শিকড়টা? আরও কত বছর যে লাগবে পুরোপুরি উপড়োতে?

রিকশাভাড়া মিটিয়ে ছুটতে ছুটতে প্ল্যাটফর্মে উঠল পারমিতা। ন’টা দশের ট্রেন নিখুঁত সময়ে বেরিয়ে গেছে এবং পরবর্তী গাড়ি ঝোলাচ্ছে যথারীতি। শেষে এল টইটম্বুর হয়ে। লেডিজ কামরাতেও প্রায় ছুঁচ গলার ঠাঁই নেই। তারই মধ্যে ঠেসেঠুসে ওঠা, গলদঘর্ম হয়ে নামা, ফের হাঁপাতে হাঁপাতে আর একটা প্ল্যাটফর্মে দৌড়…। কপালজোরে ব্যারাকপুর লোকালটা কান ঘেঁষে মিলেছে, এটুকুই যা স্বস্তি অবশেষে।

কলেজ পৌঁছে আজ স্টাফরুম নয়, সরাসরি নিজেদের ডিপার্টমেন্ট। প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা করিডরে জটলা করছিল, তাদের পারমিতা ডেকে নিল পরীক্ষাগারে। প্র্যাক্টিক্যাল করার পদ্ধতি নিয়ে আগে কিছু নির্দেশ দেওয়ার ছিল, ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছে একে একে। ধৈর্য ধরে বুঝিয়েও দিচ্ছে কোন সলিউশান কতক্ষণ গরম করলে কী রং আসবে, অ্যাসিড ব্যবহারে কী কী সতর্কতা প্রয়োজন, মূল দ্রবণ থেকে অধঃক্ষেপ কেমন ভাবে পৃথক করবে, বিক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ কী করে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে হয়…। পরীক্ষা নিরীক্ষার খুঁটিনাটি বর্ণনা করতে বেশ লাগে পারমিতার। যেন অধীত বিদ্যা ঝালাই করছে। অথবা নিজেই যেন নতুন করে শেখাচ্ছে নিজেকে। যখন ছাত্রছাত্রীরা আলটপকা প্রশ্ন জোড়ে, মগজ হাতড়ে সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়ায় তখন কী যে রোমাঞ্চ। এই অনুভূতির বুঝি কোনও সংজ্ঞা নেই।

কাজ শুরু করিয়ে দিয়ে পারমিতা বসল চেয়ারে। ছেলেমেয়েরা এখন যে যার টেবিলে। ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সজল ঘোষ আর বিমলেন্দু নস্করের নজরদারিতে চলছে তাদের কাজকর্ম। পারমিতা চারদিকে চোখ চালিয়ে নিয়ে প্র্যাক্টিক্যাল বই খুলল। মিনিট পনেরোও কাটেনি, প্রিন্সিপালের পিয়ন রমেশ হালদার হাজির। এত্তেলা নিয়ে। ইন্টারভিউয়ের কাল সমাগত, প্রস্তুতি সারতে পারমিতাকে এখনই যেতে হবে সেমিনার কক্ষে।

বিমলেন্দুর জিম্মায় ছাত্রছাত্রীদের সঁপে দিয়ে পারমিতা উঠল। বড়সড় হলঘরটায় এসে দেখল পরিচালন সমিতির প্রতিনিধিটি পৌঁছে গেছে। ভদ্রলোককে চেনে পারমিতা। নাম রাখাল নাথ। বয়স বছর পঞ্চাশ। নোয়াপাড়া কলেজের কমার্সের টিচার। ব্যারাকপুরেরই বাসিন্দা, মাঝে সাঝেই অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাসের ঘরে দেখা যায় তাকে। একই রাজনৈতিক দলের লোক তো, তাই দু’জনে গুজুর গুজুর চলে খুব। এবং পারমিতারা কেউ স্বপনের চেম্বারে ঢুকলে কুলুপ আঁটে ঠোঁটে।

পারমিতাকে দেখে একগাল হাসল রাখাল,— ও, আপনি আজ টিম লিডার? খুব ভাল, খুব ভাল।

পারমিতা ঈষৎ কুণ্ঠিত মুখে বলল,— আসলে অনিমেষ স্যার এখন নিয়মিত আসছেন না তো, তাই আমি…

আরে, আপনিই তো এখন কেমিস্ট্রির মাথা। রাখালের হাসি চওড়া হল,— একদম ঘাবড়াবেন না। ডক্টর বিশ্বাস ঠিক আপনাকে গাইড করে করে ডিপার্টমেন্ট চালিয়ে নেবেন।

একটু যেন আঁতে লাগল পারমিতার। সে কি এতই অযোগ্য, যে প্রতি পদে অধ্যক্ষের ওপর তাকে নির্ভর করতে হবে? নাকি পারমিতা মেয়ে বলেই এমন একটা ধারণা পোষণ করে রাখাল নাথ?

বাড়তি কথায় না গিয়ে পারমিতা ফাইল খুলল। পরপর আবেদনপত্রগুলো সাজাচ্ছে। রাখাল খানিক উসখুস করছে। জিজ্ঞেস করল,— মোট ক’টা অ্যাপ্লিকেশান এল?

সাতটা।

এই কলেজের এক্স স্টুডেন্ট আছে কেউ?

পাঁচটা মেয়ে দরখাস্ত দিয়েছে। পাঁচজনই আমাদের কলেজের। ছেলে দুটো শুধু বাইরের।

পারলে মেয়েদেরই নেবেন, বুঝলেন। পড়ানোর কাজটাই প্রমীলাকুলের আসে ভাল। ঘরে বাইরে সর্বত্রই তো আপনারা দিদিমণি, ঠিক কি না? নিজের গ্রাম্য রসিকতায় নিজেই হ্যা হ্যা হাসছে রাখাল। হঠাৎই হাসি থামিয়ে বলল,— আচ্ছা দেখুন তো, বিদিশা চৌধুরী বলে কোনও ক্যান্ডিডেট আছে কিনা?

পারমিতা নীরস স্বরে বলল,— আছে।

মেয়েটা খুব ভাল, বুঝলেন। একটা ফ্যামিলি প্রবলেমে পড়ে এম-এসসির রেজাল্টটা খারাপ হয়ে গেছে।…একটু দেখবেন তো। ও কিন্তু খুব সিরিয়াসলি পড়াবে।

অনুরোধ? সুপারিশ? নাকি নির্দেশ? পারমিতা ঠিক বুঝতে পারল না। ঠান্ডা গলাতেই বলল,— সিলেকশান তো শুধু আমার একলার ওপর নির্ভর করবে না। ইউনিভার্সিটির এক্সপার্ট আছেন, তারপর আপনি, সবাই মিলে তো…

কথা শেষ হল না, নাম করতে না করতেই রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের জয়ন্ত মজুমদার উপস্থিত। বয়স চল্লিশের আশেপাশে, রোগাসোগা চেহারা, মাথাভরা কোঁকড়া চুল। সঙ্গে অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাস। মাস্টার ডিগ্রি করার সময়ে জয়ন্ত মজুমদারকে দেখেনি পারমিতা, পরে জয়েন করেছে বোধহয়।

চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করে বেরিয়ে গেল স্বপন বিশ্বাস। কালাতিপাত না করে শুরু হল ইন্টারভিউ। নির্বাচন পর্ব চুকতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগল। কোনও প্রার্থীই তেমন জুতের ছিল না, তবু তার মধ্যেই ঝাড়াই বাছাই। কলেজের প্রাক্তনীদেরই শীর্ষে রেখে তৈরি হল তালিকা। চেষ্টা করেও বিদিশাকে তিন নম্বরে তুলতে পারল না পারমিতা। একটু যেন ক্ষুণ্ণ হয়েছে রাখাল, তবে সোজাসুজি বলল না কিছু, সই করে দিল চুপচাপ। জয়ন্তরও স্বাক্ষর দান শেষ, এবার অধ্যক্ষের হাতে লিস্ট তুলে দিলে পারমিতার দায়িত্ব সম্পূর্ণ হয়।

ফাইলটা নিয়ে স্বপন বিশ্বাসের কাছেই যাচ্ছিল পারমিতা, করিডরে থামল হঠাৎ। পৌনে দুটো বাজে, শাশুড়িকে তো এখনও ফোন করা হল না? তাতারটা বেশি জ্বালাতন করছে কিনা কে জানে! বেরোনোর সময় এমন একটা সিন করল…!

কথাটা মনে হওয়ামাত্রই ব্যাগ থেকে মোবাইল তুলেছে পারমিতা। সঙ্গে সঙ্গে চমক। মনিটরে তিন-তিনটে মিস্ড কল। মা। এত কী দরকার পড়ল হঠাৎ? কোনও খারাপ খবর নয় তো?

দুরুদুরু বুকে মা’র নম্বরটাই আগে টিপল পারমিতা। বাজছে, বাজছে, বেজেই যাচ্ছে। অবশেষে সুমিতার ঘুম ঘুম কণ্ঠ। অর্থাৎ তেমন কিছু ঘটেনি।

পারমিতা একটু বিরক্তই হল,— কী ব্যাপার? এতবার কল কেন?

তুই কি ক্লাস নিচ্ছিলি? বারবার বেজে যাচ্ছিল…

ফোন সাইলেন্ট মোডে ছিল মা। আমি কাজ করছিলাম।…বলো কী বলবে?

না মানে…আসলে মনটা কেমন কেমন করছিল। ভাবলাম তাতারের একটা খবর নিই…

তার জন্য আমায় ডাকাডাকির দরকার হল? পারমিতার স্বরে অসন্তোষ বাড়ল, বাড়িতে ফোন করলেই তো জানা যায়।

রেগে যাচ্ছিস কেন?

কাজের সময়ে খাজুরা ভাল লাগে না মা।

সুমিতা চুপ। বুঝি আহত হয়েছে। ক্ষণ পরে ভার ভার গলায় বলল,— অন্য আলোচনাও ছিল কিছু। শোনার সময় হবে কি তোর?

বলো। শুনছি।

তুই তো ক’দিন আসতে পারছিস না…তাতারকে নিয়ে আতান্তরে ছিলি বলে প্রসঙ্গটা তুলিওনি… গত রোববার নীলু এসেছিল।

হঠাৎ?

সন্তোষপুরে কোনও এক কলিগের মা’র শ্রাদ্ধ ছিল…

ও। তাই খেয়েদেয়ে ফেরার পথে মামা-মামিকে একবার দর্শন দিয়ে গেল, তাই তো?

অনেকটা সেরকমই। তবে নীলু একটা কথা বলছিল। তোর বাবার নাকি এবার একটা ব্রেন স্ক্যান করানো উচিত।

কেন? বাবা তো দিব্যি ইমপ্রুভ করছে।

সেই জন্যই নাকি দরকার। বলছিল, মামার যখন এত উন্নতি হচ্ছে, তা হলে হয়তো মাথায় আর কোনও ক্লট টট নেই। যদি স্ক্যান করে ব্যাপারটা শিয়োর হওয়া যায়, তা হলে হয়তো ট্রিটমেন্টের ধারাটাও বদলে যেতে পারে।

কেন ফালতু কথায় কান দাও মা? ডক্টর মুখার্জি তো কবেই বলেছেন, কোথাও রক্ত আর জমাট বেঁধে নেই। থাকলে প্যারালিটিক কন্ডিশান দিনকে দিন বাড়ত। দেখেছ তো, বাবার ওষুধও কত কম এখন। শুধু ফিজিয়োথেরাপিতেই…

কী জানি, আমি তো অত বুঝি টুঝি না। নীলু বলল…আমারও মনে হল একবার পরীক্ষা করাতে তো দোষের কিছু নেই…বরং মনে মনে নিশ্চিন্ত হওয়া…

ঠিক আছে। ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করব। পারমিতা এক সেকেন্ড ভাবল, মাকে সার্ভিস বুকের কথাটা এক্ষুনি বলবে কিনা। পরক্ষণে মত বদলেছে। এমন কিছু সাংঘাতিক জরুরি নয়, সামনাসামনি গিয়ে বললেও চলে। পারমিতা গলা ঝাড়ল, তা হলে এখন ছাড়ি?

এক সেকেন্ড। ওপারে সুমিতার দ্বিধামাখা স্বর,— আর একটা কথা…

কী?

তোর বাবাকে তো তাতারের অসুখের কথাটা জানাইনি…সে রোজ ইশারায় তোর আর তাতারের খোঁজ করছে। ফোনে ফের নীরবতা। ফের সুমিতা বলল,— তুই কি আজ একবার…আসবি?

দেখছি। না পারলে কাল যাবই।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোর সুবিধেমতোই আয়।

ফোন অফ করে পারমিতা ঈষৎ বিমনা। নীলুদার নাম দিয়ে চালাল বটে, তবে বাবার ব্রেন স্ক্যান করানোর বাসনাটা সম্ভবত মা’র নিজেরই। একটু যেন দুঃখ পেল পারমিতা। বাবাকে নিয়ে তার কি দুশ্চিন্তা কম? কেন যে মা বোঝে না, ফের স্ক্যানিং-এর প্রয়োজন বোধ করলে পারমিতা কবেই তা করিয়ে নিত। অবশ্য মা’র দৃষ্টিকোণ দিয়ে ভাবলে তার এই অভিমান একান্তই অর্থহীন। কার মনের উচাটন কীসে কমে, তা কি অন্য কেউ স্থির করে দিতে পারে?

ঘণ্টা বাজছে। ফোর্থ পিরিয়ড শেষ। এতক্ষণ কলেজ ছিল ভরা হাট, এবার ছাত্রছাত্রীদের কেটে পড়ার পালা শুরু হবে। ক্লাসরুম থেকে বেরোচ্ছে টিচাররা, বেরোচ্ছে ছেলেমেয়ের দল। কোলাহল অনেকটাই নিচু গ্রামে ছিল, হঠাৎই পরদা চড়ে চতুর্দিক গমগম। দু’-চারটে ঝাঁক কিচিরমিচির করতে করতে চলে গেল গেট পেরিয়ে। কেউ বা প্রাইভেট টিউটরের ঠেকে, কেউ বা স্রেফ বাঙ্ক। সামনের মাঠে থোকা থোকা জটলা। ছোটবড় আড্ডায় হাহা-হিহি চলছে জোর। কিছু কিছু পড়ুয়া মুখও দেখা যায় এদিক ওদিক। হন্তদন্ত পায়ে চলেছে লাইব্রেরিতে অথবা স্টাফরুমের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।

পারমিতা দ্রুত পা চালাল। এখন থার্ড ইয়ার অনার্সের ক্লাস, টানা দু’পিরিয়ড। প্রিন্সিপালকে ফাইলটা দিয়েই ছুটতে হবে দোতলায়। প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসটা আধাখেঁচড়া হল আজ, থিয়োরির সময়টা নষ্ট করা উচিত হবে না।

টেলিফোনে যেন কার সঙ্গে কথা বলছিল স্বপন বিশ্বাস, ইশারায় বসতে বলল পারমিতাকে। আরও মিনিট কয়েক বাক্যালাপ সেরে ফাইল হাতে নিয়ে বলল,— ঠিকঠাক বানিয়েছ তো প্যানেলটা?

হ্যাঁ স্যার। তবে ফিজিকাল কেমিস্ট্রির তেমন ক্যান্ডিডেট তো পেলাম না।

তাই বুঝি? ফাইল খুলে লিস্টে চোখ বোলাল স্বপন। দৃষ্টি না তুলেই বলল,— বিদিশা চৌধুরী ফিজিকালের মেয়ে নয়?

হ্যাঁ। ওকে রেখেছি প্যানেলে, তবে…

আর একটু ওপরে উঠিয়ে দিতে পারতে। তোমারই সমস্যার লাঘব হত। স্বপন ক্ষণকাল ভেবে নিয়ে বলল,— অল রাইট, আমি টপ ফাইভকেই নিয়ে নিচ্ছি।

তা হলে তো ভালই হয় স্যার। অনিমেষ স্যার চলে গেলে আবার তো নতুন করে লোক নিতে হত, এতে কাজটা বরং এগিয়েই রইল।

মুখে বলল বটে পারমিতা, তবে মনে মনে বুঝে গেল, যে-কোনও ভাবেই হোক বিদিশা চৌধুরীকে নেওয়া হবে। মেয়েটি কলেজের প্রাক্তনী হলেও পারমিতার অচেনা। সে আসার আগেই পাশ করেছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে একটু যেন উদ্ধত লাগছিল মেয়েটিকে, সম্ভবত খুঁটির কারণেই। পরেও ভোগাবে নির্ঘাত। আগে একবার প্রেসিডেন্টের ভাইপোকে নেওয়া হয়েছিল। যথেষ্ট টেঁটিয়া ছিল ছেলেটা। অনিমেষ দত্তর মতো মানুষ তাকে বাগে আনতে হিমশিম। শেষে ছোকরা স্কুলে চাকরি পেয়ে যেতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। তবে অনিমেষ দত্ত আর পারমিতা মজুমদারকে তো এক মাপকাঠিতে দেখা হবে না, মেয়েটিকে সামলাতে না পারলে সেটা হয়তো পারমিতার মহিলা সুলভ অক্ষমতা বা মেয়েদের পারস্পরিক রেষারেষি বলে ধরা হবে। কী মুশকিল! কী যে জ্বালা!

চোয়াল সামান্য শক্ত করে পারমিতা উঠে যাচ্ছিল, স্বপন হাত নেড়ে বলল,— দাঁড়াও, দাঁড়াও। আরও কিছু কথা আছে।

বলুন?

তোমার ডিপার্টমেন্টের ব্যাপারে একটা স্কিম দিতে হবে তো। তাড়াতাড়ি রেডি করে ফেলো।

কীসের স্কিম স্যার?

অ, তুমি তো সেদিন মিটিং-এ ছিলে না। ছেলের অসুখ না কী যেন অজুহাতে ওই দিন ডুব মারলে। স্বপন সামান্য ঝুঁকল,— শুনেছ নিশ্চয়ই, নেক্সট ফেব্রুয়ারিতে কলেজে ইউ জি সি-র টিম আসছে?

হ্যাঁ। ন্যাকের পক্ষ থেকে…

কারেক্ট। তারই প্রস্তুতির জন্য ডিটেল আলোচনা হল সেদিন। টিচার্স কাউন্সিলে। সেখানে ডিশিসান হয়েছে, প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্ট ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত তিনটে স্পেশাল লেকচার অ্যারেঞ্জ করবে। যে যার ফিল্ডের বিশিষ্ট অধ্যাপকদের আমন্ত্রণ করে এনে। প্লাস, প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব ম্যাগাজিন চাই। নিজেরাও তাতে কন্ট্রিবিউট করবে, স্টুডেন্টদের দিয়েও লেখাবে। গোটা ব্যাপারটা মিলিয়ে আমায় একটা কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান বানিয়ে দাও। এক মাসের মধ্যে।

কিন্তু স্যার…আমি তো সেপ্টেম্বরের গোড়ায় রিফ্রেশার কোর্সে যাচ্ছি। তিন সপ্তাহ থাকব না।

সে কী? এরকম একটা ভাইটাল সময়ে রিফ্রেশার কোর্স করতে চলে যাবে? স্বপন জোরে জোরে মাথা নাড়ল,— ইম্পসিবল। হতেই পারে না।

আপনিই তো স্যার অনুমতি দিয়েছিলেন। সামনের বছর আমার প্রোমোশান, তার আগে যদি কোর্সটা না করি তো…

উপায় নেই। সেপ্টেম্বরে আমি ছাড়তে পারব না। অনিমেষবাবু চলে গেলে রিকুইজিশান পাঠাচ্ছি, ডিসেম্বরের মধ্যে পার্মানেন্ট টিচার একজন আমি আনবই, তারপর তুমি যেতে পারো।

কিন্তু স্যার…আমার প্রোমোশান…

সব হবে। তা বলে ডিপার্টমেন্ট ফাঁকা করে যেতে আমি দেব না। অ্যান্ড দিস ইজ ফাইনাল।

পারমিতার মাথা দপদপ করে উঠল। ছকে রাখা কত প্ল্যান যে কতভাবে আপসেট হয়! শুকনো মুখে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তিতকুটে মেজাজ নিয়ে গেল ক্লাসে। কী যে পড়াল কে জানে, মনই বসছে না আজ। শ্রোয়েডিংজারের সমীকরণ আজ যেন জটিল ধাঁধার মতো লাগছে। বস্তু আর তরঙ্গ মগজে মিলেমিশে একাকার। এরপর আবার সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস টানতে হবে, ভাবলেই গলা শুকিয়ে আসে…

দুপুরের দিকে শাশুড়িকে ফোন করার বাঁধা রুটিনটাও আজ বিলকুল মুছে গেল মস্তিষ্ক থেকে। এই প্রথম।

.

০৭.

কী ম্যাডাম, খুব গড়িয়ে গড়িয়ে কাটাচ্ছ তো শনিবারের সকালটা?

আজ্ঞে না স্যার। কবে আমি অফ ডে-তে শুয়ে-বসে থাকি?

সরি, সরি। করছটা কী?

তোমার ছেলের ফরমাশ খাটছি।

আজ তার কী বায়না?

ধোসা চাই। অবিকল দোকানের মতো। পাতলা পাতলা। মুচমুচে। সঙ্গে সম্বর, নারকোলের চাটনি…। আজ বাড়িতে ওটাই ব্রেকফাস্ট।

বাবাও সাউথ ইন্ডিয়ান খাবে? এ তো প্রায় বিপ্লব!

ইয়েস স্যার। আশা করছি খুব একটা অপছন্দও করবেন না।

দ্যাটস গুড। হাতটা পাকিয়ে ফেলো। তারপর যদি কপালে থাকে, তোমার তৈরি ধোসা আমারও কোনও না কোনও দিন জুটবে নিশ্চয়ই।

একটু আক্ষেপোক্তির মতো শোনাল কি? নাকি নিছকই ঠাট্টা? রাজা এখন অফিসের পথে। গাড়িতে এই সময়টুকু গল্পগাছার জন্য বরাদ্দ রাখে রাজা। বিশেষত পারমিতার অফ ডে-র সকালটায়। পারমিতা জানে।

ডেকচিতে সম্বরডাল ফুটছে। কানে মোবাইল চেপে গ্যাসের আঁচ কমাল পারমিতা। তরল সুরে বলল,— তুমি এত ধোসাভক্ত জানা ছিল না তো!

ধরো, হয়েছি। ধোসার দেশে আছি যে।

তোমার কলাবতীকে তা হলে বলো, মাঝেসাঝে বানিয়ে দেবে।

উঁহু। জলখাবার বানানো ওর ডিউটি লিস্টে নেই। যা হোক দুটো রেঁধে যায়, এই না কত।

কলাবতীকে জোগাড় করে দিয়েছে রাজার আবাসনেরই এক নিরাপত্তাকর্মী। কন্নড় মেয়েটি নাকি আশেপাশেই থাকে, এদিক ওদিক আরও কয়েকটা ফ্ল্যাটে কাজ করে, হিন্দিও জানে মোটামুটি। এবং নাকি বিশ্বাসী। সিকিউরিটি রুমে একটা চাবি রেখে যায় রাজা, মেয়েটি সময় মতো এসে কাজকর্ম সারে। ঘনঘন কামাই করে বলে কলাবতীকে নিয়ে প্রায়শই গজগজ করে রাজা, তবু ওই কলাবতীই আপাতত রাজার ভরসা।

পারমিতা রঙ্গ করে বলল,— আহা, একদিন বলেই দেখো না। মাছ-ডিম-মাংস ভাল না রাঁধুক, ধোসা ওর হাতে চমৎকার খুলবে।

সরি। রাজার স্বর যেন সহসা গম্ভীর,— আমি কারও কাছ থেকে আনডিউ অ্যাডভান্টেজ নিই না।

‘আনডিউ’ শব্দটায় কি বাড়তি জোর দিল রাজা? প্রাপ্য সুবিধেটুকু তার জুটছে না, এটাই কি বোঝাল ঠারেঠোরে?

একটু বুঝি গুটিয়েই গেল পারমিতা। তবু স্বর যথাসম্ভব লঘুই রাখল,— কী জলখাবার খেলে আজ?

কাল যা খেয়েছি। কিংবা পরশু। বা তার আগের দিন। পাঁউরুটি-কলা-ডিমসেদ্ধ। সঙ্গে ফ্রুট জুশ।

এক-আধদিন পিৎজা ট্রাই করতে পারো। আগের দিন কিনে রাখবে, খাওয়ার সময়ে মাইক্রোতে গরম করে নেবে।

আই হেট বাসি পিৎজা। ছাড়ো, ভাল্লাগে না। …তাতার আছে সামনে?

হ্যাঁ। এই তো…ছিল…

দাও, ওর সঙ্গে একটু কথা বলি।

ডাক পেয়েই তাতার লাফাতে লাফাতে হাজির। ভারী বিজ্ঞ ভঙ্গিতে শুরু করল আলাপচারিতা। বাড়িময় ঘুরে ঘুরে ফোনালাপ চলছে। একটুক্ষণ সেদিকে স্থির তাকিয়ে থেকে পারমিতা কাজে হাত লাগাল। ধোসা-ঘোল পাত্রে ঢেলে ফেটিয়ে নিচ্ছে। ননস্টিক তাওয়ায় হাতাভরতি মিশ্রণ ছড়িয়ে ভেজে ফেলছে ধোসা, একের পর এক। সর্ষে-কারিপাতার ফোড়ন দিয়ে নারকোল-চাটনি আগেই প্রস্তুত। এবার প্লেট-বাটিতে সাজিয়ে ডাইনিং টেবিলে রেখে এলেই হয়।

শুরু হয়েছে প্রাতরাশ। শুভেন্দু ভাবলেশহীন মুখে ধোসা ছিঁড়ছিল। ছোট একটা টুকরো সম্বরে ডুবিয়ে মুখে পুরে বলল,— রাজা আজ অনেকক্ষণ ছেলের সঙ্গে গল্প করল তো!

মানসী যথারীতি তাতারকে খাওয়ানোয় ব্যস্ত। ঈষৎ উদাস মুখে বলল,— ছেলে ছেড়ে থাকে, মন কেমন তো করে।

কথাগুলোর একটা নিঃশব্দ ব্যঞ্জনা আছে। পারমিতা কেমন যেন অস্বচ্ছন্দ বোধ করছিল। ফস করে প্রশ্ন জুড়ল, খাবারটা কেমন লাগছে বাবা? খুব খারাপ?

চলতা হ্যায়।

আপনার ছেলে কিন্তু বলছিল আপনি ধোসা ছোঁবেনই না।

তা কেন, তুমি যত্ন নিয়ে বানালে…একটু মুখবদলও হল। শুভেন্দু তিলেক থামল। চোখ তুলে বলল,— রাজাকে কাজের কথাটা বলেছ?

কী বাবা?

কাল গাড়িখানা সারানো হয়েছে…

এমা, একদম মনে ছিল না। পারমিতা জিভ কাটল,— রাতে ফোন করলে জানিয়ে দেব।

হ্যাঁ, বোলো কিন্তু। …আর একটা কথা। গাড়িতে আর আওয়াজ হচ্ছে কি না সেটাও তো পরখ করা দরকার।

আপনিই তো দেখে নিয়েছেন।

তাও…বেশ খানিকক্ষণ না চললে হাল পুরোপুরি মালুম হয় না। তুমি বরং ড্রাইভার ডেকে বিকেলে একটা চরকি মেরে এসো। যদি দেখো আওয়াজটা আছে, তবে ফের নিমাইকে ডাকছি। ব্যাটাকে এখনও পুরো পয়সা দিইনি…

পারমিতা একবার ভাবল, আজ ও বাড়ি ঘুরে এলে হয়। পরপর তিন দিন যেতে পারেনি, মনটা খচখচ করছে। বুধবার গেল অনিমেষ স্যারের ফেয়ারওয়েল, অনুষ্ঠান চুকতে প্রায় সন্ধে। জনে জনে গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা, তারপর বিদায়লগ্নে হঠাৎ আবেগে আপ্লুত হয়ে অনিমেষ দত্তর স্মৃতিরোমন্থন, শেষে কলেজের রীতিমাফিক গাড়ি করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা, সেখানেও সৌজন্য দেখিয়ে থাকতে হল একটুক্ষণ…বাড়ি পৌঁছোতে কত রাত সেদিন। কাল আর পরশু তো কাটল নতুন অতিথি অধ্যাপকদের নিয়ে। ছুটির পর মেয়েগুলোর সঙ্গে বসে পাঠক্রম বণ্টন, প্রত্যেকের সময় সুবিধা অনুযায়ী রুটিনটাকে খানিক বদলানো-সাজানো, বিভাগীয় পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে আলোচনা…। এত কিছুর পর যাদবপুর নামার আর দম থাকে? কিংবা সময়? আজ ও বাড়ি গেলে তাতারের সঙ্গেও মোলাকাত হয় বাবা-মা’র। গত রবিবার অবশ্য তাতারকে নিয়ে গিয়েছিল, তবু…। নাতিকে পেলে বাবা-মা যা পুলকিত হয়। বিশেষত বাবা। দস্যিটার দর্শনে বাবার মস্তিষ্ক যেন অনেক বেশি সচল হয়ে ওঠে আজকাল।

কিন্তু এদিকে কাজটার কী হবে? আগামী বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার একটা অনার্স পেপারের প্রশ্নপত্র তৈরির দায়িত্ব পেয়েছে পারমিতা। এই প্রথম। হাতে আর সময় নেই, সামনের মঙ্গলবার জমা দেওয়ার শেষ দিন। আজই বসতে হবে কাজটা নিয়ে, কালকের জন্য ফেলে রাখাটা ঠিক নয়। কাল কী ঘটবে, কে বলতে পারে? হয়তো দুম করে কোনও আত্মীয়স্বজন এসে পড়ল…।

অতএব না বেরোনোটাই শ্রেয়। মুখে একটা হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে পারমিতা বলল,— আজ আমার নড়ার উপায় নেই বাবা। দুপুর থেকে এমন এক ঝঞ্ঝাটিয়া ডিউটিতে বসতে হবে…

কীরকম?

পেপার সেটিং। এখন নিয়ম হয়েছে, কোয়েশ্চেনের সঙ্গে মডেল আনসারও চাই। অতএব বুঝতেই পারছেন একগাদা সময়ের ব্যাপার।

ও। শুভেন্দু আড়চোখে এবার মানসীকে দেখল,— তা হলে তোমার শাশুড়িকেই বলো। উনি যদি দয়া করে কোথাও একটা ট্রায়াল রান দিয়ে আসেন…

হ্যাঁ হ্যাঁ, মা তো যেতেই পারেন। পারমিতা শাশুড়িকে উসকোল,— তাতারকে নিয়ে ভবানীপুর ঢুঁ মেরে আসুন না মা। ওরও বিকেলে একটু বেড়ানো হয়।

আর তুমিও তা হলে নিরিবিলিতে কাজ সারতে পারো, তাই তো?

স্মিত মুখে বলল মানসী, তবু একটা যেন কাঁটা মিশে আছে বাক্যে। যেন ধরে ফেলেছে, নিজের সুবিধে হবে বলেই তাতারকে তার ট্যাঁকে গুঁজে দিতে চাইছে পারমিতা।

অপ্রস্তুত মুখে পারমিতা বলল,— না না, তেমন কোনও ব্যাপার নেই মা। তাতার থাকলেই বা আমার কী প্রবলেম? চাইলে আপনি একাও বেরোতে পারেন।

নাহ্, তাতারকে নিয়েই যাব। মানসীর তেরচা চোখ এবার শুভেন্দুতে,— তবে তোমার ছেলের গাড়ির আওয়াজ টাওয়াজ বোঝা কিন্তু আমার কম্মো নয়।

শাশুড়ি-বউয়ের গোপন খেলাটুকু শুভেন্দু খেয়াল করেনি। আহ্লাদিত মুখে বলল,— আরে দূর, ওটা বোঝার জন্য তো ড্রাইভার আছে। তুমি শুধু গ্যাঁটসে বসে থাকবে।

বেশ, তোমরা যখন বলছ…। চারটে নাগাদ বেরোব।

তা হলে প্রবলেম সলভড। এবার জম্পেশ করে এক কাপ কফি হয়ে যাক।

খুব আহ্লাদ, অ্যাঁ? একেবারে কফি?

ধোসার সঙ্গে কফিপানই বিধেয়। শাস্ত্রে লেখা আছে।

মানসী মুখ বেঁকাল। পারমিতা ঠোঁট টিপে হেসে সিধে রান্নাঘরে। মেপে মেপে কেটলিতে জল চড়াচ্ছে। রানার জন্যও নেবে কি? থাক। কাল রানাবাবুর নাইট ছিল, এগারোটার আগে থোড়াই সে গাত্রোত্থান করবে।

কাপে দুধ-চিনি-কফি দিল পারমিতা। প্রতীক্ষা করছে জল ফোটার। আচমকা রাজাকে মনে পড়ল। হঠাৎ কেমন অভিমান হল বাবুর, পারমিতার সঙ্গে আর কথাই বলল না। যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ আছে কি? একা একা থাকতে হবে, খেতে হবে, শুতে হবে…এসব কি বেঙ্গালুরু যাওয়ার আগে বোঝেনি রাজা? এখন তবে গোঁসা কেন? জানে না, এতে পারমিতার ওপর একটা বাড়তি চাপ তৈরি হয়?

শ্বশুর-শাশুড়ির টুকরো টাকরা সংলাপ উড়ে আসছে। পারমিতার ভাবনা ছিঁড়ে গেল। তাকে নিয়েই আলাপ চলছে যেন? হ্যাঁ তো। দুজনেরই স্বর অনুচ্চ, তবে কান পাতলে শোনা যায় দিব্যি।

শুভেন্দু বলল,— যতই যা বলো, তোমার বউভাগ্য কিন্তু যথেষ্ট ভাল।

মানসী বলল,— তা তো বটেই। কত গুণের মেয়ে…

অবশ্যই। কী পরিমাণ খাটতেও পারে, ভাবো তো? সপ্তাহভর ছুটছে, সেই সকাল থেকে রাত্তির। হাজার দায়িত্ব মাথায়। তারপরও কেমন আগ বাড়িয়ে এটা ওটা রাঁধছে… আজ কেমন একা হাতে জলখাবারটা বানিয়ে ফেলল…

হুম। শৌখিন মজদুরিগুলোই মানুষের চোখে পড়ে। আর যে কিনা সারাটা জীবন সংসারটা বইল, এখনও বোঝাটা টেনে চলেছে, তার শ্রমের তো কোনও মূল্য নেই।

তুলনা করো কেন? সে তার মতো। তুমি তোমার মতো।

বুঝলাম। আদিখ্যেতায় দোষ নেই, তুলনাতেই দোষ!

পারমিতার একটা শ্বাস পড়ল। তার যেচে সংসারের কাজে অংশগ্রহণ কি নিছক দেখানেপনা? হাত গুটিয়ে থাকলেই কি খুশি হত শাশুড়িমা? সে তো কর্তব্যবোধ থেকেই করে, তবু কী যে তার ব্যাখ্যা হয়!

নাহ্, মানুষের মন বোঝা বড় কঠিন। মন পাওয়াও।

পরবর্তী শ্বাসটা গোপন রেখে কফির ট্রে হাতে ফিরল পারমিতা। শ্বশুর-শাশুড়িকে পেয়ালা বাড়িয়ে দিয়ে বসল চেয়ারে। নিঃশব্দে।

শুভেন্দু চুমুক দিচ্ছে কফিতে। সামনে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলতে গিয়েও রেখে দিল। মানসীকে পলক দেখে নিয়ে পারমিতাকে বলল,— ও হ্যাঁ, একটা কথা তোমায় বলা হয়নি। তোমার মা’র সার্ভিসবুকের প্রবলেমটা কিন্তু ধরে ফেলেছি।

হয়ে গেল? গত সপ্তাহেই তো পারমিতা ডুপ্লিকেট কপিটা এনে দিল, এর মধ্যেই…? কাজপাগল লোক বটে! এ কি পরোপকারের নেশা? নাকি নেহাতই হিসেব কষার আকর্ষণ?

পারমিতা মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল,— কী ভুল ছিল?

সে ভারী ভজকট ব্যাপার। আঠারো বছর আগে একটা ফিক্সেশানে গড়বড়। তারপর থেকে গলতিটা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। এত দিন বাদে পুরোটা নির্ভুলভাবে শুধরোনো…। যাই হোক, মোটামুটি একটা দাঁড় করিয়েছি। এবার একটা চিঠি লিখে দেব, এজি বেঙ্গলে আমার এক পরিচিতের হাতে দিয়ে আসতে হবে। বেয়ান কি পারবেন?

না পারার কী আছে? বাবাকে আয়ার জিম্মায় রেখে মাকে তো বেরোতে হয়ই মাঝে মাঝে। তেমন দরকার হলে আমিই না হয়…

ঘরে মোবাইলের ঝংকার। শুনেই খাবার ফেলে ছুট্টে ফোন আনতে যাচ্ছিল তাতার, ছেলেকে চোখ পাকিয়ে পারমিতা নিজেই উঠল। মনিটরে অচেনা নম্বর। কে রে বাবা?

ফোন কানে চাপতেই ওপারে চেনা চেনা গলা,— কেমন আছ গো দিদি?

পারমিতা যন্ত্রের মতো বলল,— ভাল।

আমি কে বলো তো?

পারমিতা থতমত। স্মৃতি হাতড়াচ্ছে।

বুঝেছি। আমার নাম্বার সেভ করা নেই। ওপারের স্বর ঈষৎ আহত,— আমি রঞ্জা। রঞ্জাবতী। মনে নেই?

এবার বেশ অস্বস্তিতে পড়ল পারমিতা। নম্বরটা রাখা উচিত ছিল বই কী। মাথাতেই আসেনি। স্বয়ং হিরোই আর প্রেমিকার প্রসঙ্গ তোলে না যে! সেই কবে বলেছিল এক মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রি করছে, তারপর তো আর নো উচ্চবাচ্য। যেচে জিজ্ঞেস করতেও কেমন কেমন লাগে। হয়তো বা নিজেই এড়াতে চায়। হয়তো রাজার নিষেধবাণী মনে পড়ে।

আত্মরক্ষার সুরে পারমিতা বলল,— তুমিও তো আমায় ফোন করতে পারতে। তা হলেই নাম্বারটা…। যাক গে, আছ কেমন?

মোটামুটি গো। অফিস গলায় দড়ি বেঁধে খাটাচ্ছে। সারাক্ষণ টার্গেট, মার্কেট, আর নইলে বাস্কেট।

প্রথম দুটো তো বুঝলাম। শেষেরটা কী?

কাজে ফেল করলে যেখানে পাঠানো হয়। বাতিলের ঝুড়ি।… তোমার কলেজের কী নিউজ?

চলছে। যেমন চলে।

তোমাকে একটা কথা বলার ছিল গো দিদি। এখন কি ফ্রি আছ?

স্বরটা যেন এবার অন্যরকম ঠেকল পারমিতার। একেবারেই রঞ্জাবতী সুলভ নয় যেন। তবে চট করে কোনও অনুমানে গেল না। সতর্ক স্বরে বলল,— হ্যাঁ, খানিকটা সময় আছে এখন। কী বলবে?

দেবের কেসটা কী বলো তো? আমায় অ্যাভয়েড করছে কেন?

করছে নাকি? আমি তো কিছুই জানি না। কোনও ঝগড়া হয়েছিল নাকি তোমাদের?

তেমন কিছু তো নয়। নিজেই বলেছিল অগস্টের গোড়ায় রেজিস্ট্রি করবে, আমি বাবা-মাকে জানিয়েও দিলাম, তারপর নিজেই হঠাৎ ডেট পিছিয়ে দিল। তারপর থেকে শুধুই গড়িমসি। একবার খালি বলেছিলাম, এভাবে ঝোলাচ্ছ কেন, বাড়িতে তো আমি অকোয়ার্ড সিচুয়েশানে পড়ে যাচ্ছি…ব্যস, সেদিন থেকে ও ট্রেসলেস। যোগাযোগ করছে না, ফোন করলেও ধরছে না, এস-এম-এসেরও নো রিপ্লাই।

ও। স্ট্রেঞ্জ তো!

তুমি দেবকে একবার জিজ্ঞেস করবে, প্লিজ? যা বলার খোলাখুলি বলুক। আমি ইনডিসিসিভ ছেলে পছন্দ করি না।

ঠিক আছে, দেখছি।

বলতে আমার খারাপ লাগছে…তবু তুমি তো মেয়ে, তুমি বুঝবে এই ধরনের ব্যবহার মেয়েদের কতটা হার্ট করে।

পারমিতা চুপ। ফোন ছাড়ার পরেও ঝুম বসে আছে বিছানায়। রানা ভারী আজব তো! মেয়েটার সামনে সেদিন অত গদগদ ভাব, হঠাৎই প্রেম উবে ফরসা? নাকি ওই মেয়েকে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে এখন? তা দ্বিধাই যদি জাগে, আগেভাগে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া কেন?

তুৎ, পারমিতা কেন ভাবছে বসে বসে? যাদের ব্যাপার তারাই বুঝুক গে যাক। রানাকেও কিছু বলার দরকার নেই।

কিন্তু রঞ্জাবতী যদি আবার ফোন করে? একটা কোনও উত্তর তো দিতে হবে তখন। তা ছাড়া মেয়েটা যেমন ধারারই হোক, মেয়ে তো। চুপচাপ তাকে অপমানিত হতে দেখাটা কি সংগত?

খানিক দোনামোনা ভাব নিয়েই রানাকে ধরল পারমিতা। সরাসরি নয়, সামান্য ঘুরিয়ে। রানা তখন সবে শয্যা ছেড়ে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসেছে সোফায়। টিভি খোলা, কালকের কোনও এক ক্রিকেটম্যাচের পুনঃপ্রচার চলছে। মানসী ধারে কাছে নেই, অণিমাকে রান্না বুঝিয়ে সে এখন স্নানে।

রানার পাশে বসে পারমিতা নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করল,— তোমার সেই রঞ্জাবতীর কী সমাচার গো?

রানার নির্লিপ্ত জবাব,— আছে।

আর তার কথা কিছু বলো না তো?

তুমি তো জানতে চাও না।

এই তো, আজ চাইছি।… তোমাদের সেই রেজিস্ট্রির কী হল?

হচ্ছে না।

সে কী? কেন?

জেনে কী করবে ম্যাডাম?

রঞ্জাবতীকে জানাব। সে আমাকে ফোন করেছিল কিনা। বলেই রানার প্রতিক্রিয়াটা নিরীক্ষণ করল পারমিতা। কেটে কেটে বলল,— তুমি নাকি তার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ?

ধুস্ পালাব কেন? পারমিতাকে চমকে দিয়ে রানা হঠাৎ হাহা হেসে উঠেছে। হাসি থামিয়ে বলল,— শোনো, ওকে আমার টার্মসে চলতে হবে, আমি ওর ইচ্ছেয় চলব না। এ কথা তো সাফ জানিয়ে দিয়েছি। সে এগ্রি করেনি, সুতরাং কাট্টি। এবং তার পরেও যদি ঘ্যানঘ্যান করে, আমি নাচার।

তোমার টার্মসটা কী? রঞ্জাই বা কী চায়?

তার বহুৎ ফ্যাচাং। আলাদা গিয়ে তার সঙ্গে থাকতে হবে, তার লাইফ স্টাইলে ইনট্রুড করা চলবে না…

অযৌক্তিক দাবি তো নয়। তাকে একদিন দেখে যা মনে হয়েছে, এরকমটা সে চাইতেই পারে। তা ছাড়া এ বাড়িতে বউ হয়ে থাকলে, বাবা-মা’র সঙ্গে তার পটবে কি?

ওকে নিয়ে আলাদা থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কেন?

আছে সমস্যা। ওটা ছেলেদের ব্যাপার, তুমি বুঝবে না।

বোঝাও।

ওর এত চাকরির গরম, সর্বক্ষণ হাইফাই টক…একসঙ্গে থাকলে দু’ দিনে আমার লাইফ হেল হয়ে যাবে।

প্রেমে পড়ার সময়ে কথাটা মনে আসেনি? নাকি আদৌ প্রেমেই পড়োনি?

কী জানি। তাই হবে হয়তো। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, ওকে আমি সেভাবে মিসও করি না।

বুঝলাম। আর তোমার টার্মস কী ছিল?

খুবই মিনিমাম। আমি ফ্যামিলির সঙ্গে থাকব। ওকে মানিয়ে গুনিয়ে চলতে হবে।

কী অবলীলায় বলছে রানা। পারমিতা ভেতরে ভেতরে তেতে গেল। বাঁকা সুরে বলল,— পরিবারের ওপর তোমার এত টান, টের পাইনি তো? বাড়ির কোন ব্যাপারে থাকো তুমি? আর মেয়েটা তো তার নেচার গোপন করে তোমার সঙ্গে মেশেনি। বরং তুমি সব জেনেবুঝেও তাকে বিয়ে করার কথা ভেবেছিলে!

তো?

তারপর এভাবে ব্যাক আউট করা যায়? মেয়েটার খারাপ লাগবে না?

কিন্তু বিয়েটা করলে যে আমার খারাপ লাগবে। তার চেয়ে এটাই তো ভাল। ক’দিন মেলামেশা হল, দেন বাই বাই।

তা হলে রঞ্জাবতীকে অন্তত সেটুকুও জানিয়ে দাও।

আমার নীরবতাই কি যথেষ্ট মেসেজ নয়? রঞ্জার তো মগজে গ্রে ম্যাটার খানিকটা আছে, এত দিনে আমার মনোভাব বুঝে ফেলা উচিত ছিল। রানা সেন্টারটেবিলে পা তুলে দিল। টিভির আওয়াজ অল্প বাড়িয়ে বলল,— টপিকটা এবার বন্ধ করা যায় না? খাবার দাবার আছে কিছু? পাব?

পারমিতা স্তম্ভিত। রঞ্জাবতীকে তার এ বাড়ির পক্ষে মানানসই মনে হয়নি, রানা ওই মেয়েকে বিয়ে করলে অনেক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হত, তবু রানার এমন আচরণ হজম করা কঠিন। একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেও ভেঙে গেল, অথচ তার জন্য রানার কণামাত্র বিচলন নেই? এত আবেগশূন্য হওয়া কি মানসিক সুস্থতার লক্ষণ? রানার ভালবাসাটা ঠিক কী ধরনের ছিল? শুধুই জৈবিক আকষর্ণ? শুধু ফস্টিনস্টি? নাকি সাময়িক বোধবুদ্ধি লোপ পাওয়া এক বিভ্রান্তি? রঞ্জাবতীর সঙ্গে আলাপের দিন পারমিতা ভেবেছিল, কী এক ভয়ংকরীর পাল্লাতেই না পড়েছে রানা! আজ মনে হচ্ছে, মেয়েটাই বুঝি বেঁচে গেল।

একটা ধোসা ভেজে, পারমিতা আর এল না, অণিমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। চোখ চালিয়ে দেখছিল রান্নার আয়োজন। ইলিশমাছ হচ্ছে। কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা দিয়ে পাতলা ঝোল আর কাঁটাচচ্চড়ি। ইস, দই ইলিশ হলে বেশ হত। শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে বানিয়ে ফেলবে নাকি? ধুস, কী দরকার? কোন কাজের কী মানে দাঁড়াবে তার ঠিক আছে? নিজের পছন্দ অপছন্দ না হয় না-ই জাহির করল।

ঘরে ফিরে এবার একটু ঝাড়াঝুড়িতে মন দিল পারমিতা। সারা সপ্তাহ সময় কই, শনিবার-রবিবারটাই পড়তে হয় ঘরদোর নিয়ে। আসবাবপত্র ঝাড়ো রে, তাতারের খেলনাপত্র স্বস্থানে সাজিয়ে রাখো রে, নিজের আলমারি গোছাও, ক’টা জামাকাপড় ইস্ত্রি করো…। হাতের কাজ সারতে সারতেই একটা ফোন করে নিল যাদবপুরে। মা যথারীতি অনুযোগের ঝাঁপি খুলেছে। দিন দশেক হল বিমলা আসছে না, দেশগাঁয়ে তার শাশুড়ির নাকি এখন-তখন অবস্থা, তাকে যেতেই হয়েছে। বদলি আয়াটি বেশ মুখরা, আজ সকালেই নাকি ছ্যারছ্যার ঝেড়েছে মাকে। পারমিতা আলগাভাবে শুনে গেল কথাগুলো, খুব একটা গায়ে মাখল না। যাদের দিয়ে কাজ চালাতে হয়, তারা প্রত্যেকেই যে মনোমতো হবে এমন আশা করাও তো বাতুলতা। তা ছাড়া মা’র পিটপিটানিটাও বেড়েছে। বিমলাতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে তো, এখন রমা মেয়েটির কোনও কাজই পছন্দ হয় না। অবশ্য এটাও ঠিক, যে-কোনও অভ্যেসেরই বদল হলে মনের ওপর একটা চাপ পড়ে। পড়বেই। এই যে রাজা, নয় নয় করে প্রায় তিন মাস পাশে নেই, এখনও তার অনুপস্থিতি কি পুরোপুরি মেনে নিতে পারে পারমিতা? চোরা একটা অস্থিরতা কি অনুভব করে না হঠাৎ হঠাৎ? কিন্তু কিছু তো করারও নেই। এই সব চাপ নিয়েই তো জীবন।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বইপত্র কাগজকলম নিয়ে বসল পারমিতা। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরম, পাখার হাওয়া যেন গায়ে লাগে না, চালিয়ে দিল এসি মেশিন। পড়াশোনার সময়ে অন্তত ঘাম থেকে মুক্তি মিলুক। ছেলেকেও এনে চেপেচুপে শুইয়েছিল বিছানায়, পারমিতা কাজে ডুবতেই সে কখন হাওয়া। আর তাকে ধরা দায়।

অনেক লড়ালড়ির পর একটা খসড়া খাড়া করল পারমিতা। পড়ল এক-দু’বার। মোটামুটি ঠিক আছে, তবে অজস্র কাটাকুটি। ফেয়ার করতে হবে। অতঃপর বাংলায় অনুবাদ আর উত্তরপত্র তৈরির পালা।

পারমিতা প্রশ্নপত্রের অঙ্ক দুটো কষে দেখে নিচ্ছিল, চা-সহ মানসীর প্রবেশ। হাসিমাখা মুখে বলল,— ড্রাইভার গাড়ি বার করছে। আমি তা হলে আসি?

বুকে বালিশ চেপে বিছানায় উপুড় ছিল পারমিতা, ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে। কাপটা নিয়ে ঝলক দেখল শাশুড়িকে। দিব্যি মাঞ্জা দিয়েছে তো! হাজার বুটি তাঁত, স্লিভলেস ব্লাউজ, ঘাড়ে গোল খোঁপা, কানে গত বিবাহবার্ষিকীতে রাজা-পারমিতার দেওয়া হিরের দুল, কপালে খয়েরি টিপ, গালে পাউডারের প্রলেপ, গলায় লম্বা চেন…। এবং পারফিউমের সুঘ্রাণ। মাতৃগৃহে যাওয়ার মৌতাতই আলাদা!

মুচকি হেসে পারমিতা বলল,— আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে মা।

দূর, এই বয়সে আবার সুন্দর অসুন্দর! মানসী লজ্জা পেয়েছে। বুঝি কথা ঘোরাতেই বলল,— তোমার শ্বশুরমশাই সাড়ে পাঁচটায় ক্লাবে ছুটবে, তার আগে একটু চা দিয়ো।

ও আপনাকে ভাবতে হবে না। পারমিতা কাপে চুমুক দিল,— তাতার কোথায়? সে ড্রেস করবে না?

আমাদের ঘরে এক সেট ভাল জামাপ্যান্ট ছিল, পরিয়ে দিয়েছি।…ও হ্যাঁ, সরস্বতী তো এখনও বাসন মাজতে এল না…ওকে বোলো তো থালাগুলো যেন দুবার করে ধোয়। দাগ থেকে যাচ্ছে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, করিয়ে নেবখ’ন। আপনি নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়ুন।

মানসী রওনা দেওয়ার পর পারমিতা ফের ঝুঁকেছে কাগজপত্রে। টানা কাজ করার জো নেই, বারবার এত বাধা! সরস্বতী এল; খানিক দুঃখের কাহিনি গিলতে হল। শুভেন্দুকে চা দিল; তার সঙ্গে বকবক করতে হল একটুক্ষণ। অণিমা রুটি করতে হাজির, সেখানেও সময় গেল কিছুটা। রানা বেরিয়েছিল চরকি খেতে, ফিরল সন্ধের মুখে মুখে, তাকেও এক প্রস্থ চা বানিয়ে দাও, তার নৈশাহারের বন্দোবস্ত করো…। তা এত কিছু সামলে শেষে আটটা নাগাদ সমাপ্ত হল প্রশ্নপত্র রচনা। এতক্ষণ মাথাটা যেন ভার হয়ে ছিল পারমিতার, ল্যাটা চুকতেই আচমকা ফুরফুরে। আনন্দে একখানা ফোন লাগাল রাজাকে। বাবুর মন ভাল হল কিনা কে জানে! দুৎ, লাইন এনগেজড। আবার ফোন। আবার এনগেজড। এবার তা হলে কী করা যায়? টিভি? ফেসবুক? নাকি চিতপাত হয়ে শুয়ে থাকা?

হঠাৎই মোবাইলে ঝংকার। মনিটরে শুধুই নম্বর। পারমিতার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। আবার রঞ্জাবতী নয় তো?

বোতাম টিপে সাবধানী গলায় হ্যালো বলতেই ওপারে নারীকণ্ঠ,— কী রে মিতু, কেমন আছিস? আমি এণাক্ষীদি বলছি রে।

মগজ হাতড়ে নামটাকে চিনতে দু’-এক পল সময় লাগল পারমিতার। স্কুলের বন্ধু মীনাক্ষীর দিদি? তাদের চেয়ে চার বছরের সিনিয়র ছিল এণাক্ষীদি। নাকি পাঁচ?

সামান্য উচ্ছল স্বরে পারমিতা বলল,— ওমা, তুমি? আমার নাম্বার পেলে কোত্থেকে?

মীনুই দিল। তোর সঙ্গে নাকি ফেসবুকে ওর যোগাযোগ আছে…

হ্যাঁ তো। কিন্তু মীনাক্ষী তো এখন দুবাইতে!

তো? নম্বর দিতে তো অসুবিধে নেই। যাক গে, যে কারণে তোকে আজ ধরা…। আমাদের স্কুলের এবারে প্ল্যাটিনাম জুবিলি, জানিস নিশ্চয়ই?

শুনেছি।

শুধু শুনলে হবে না। পার্টিসিপেট করতে হবে। আমরা প্রাক্তনীরা একটা গ্যালা কালচারাল পারফর্মেন্স করব ভেবেছি। তুইও তাতে থাকবি।

এ বাবা, আমি কী করব?

ঢং করিস না। তুই ভাল গান গাইতিস, আমার মনে আছে। এগজ্যাক্টলি কী রোলে তোকে লাগাব, কাল ঠিক হবে। কাল আমরা অনেকে মিট করছি। বিকেলে পাঁচটায়। স্কুলেই। ইউ মাস্ট কাম।

শুনেই যেন প্রাণ নেচে ওঠে! আবার সেই স্কুল, সবাই মিলে নাচ গান হইহল্লা…! কিন্তু কাল তো বিকেলে তাতারকে নিয়ে যাদবপুরে যাওয়ার কথা। মাকে তখন জানিয়ে দিল। বাবা নিশ্চয়ই আশা করে থাকবে…। কাল না পারলে সেই পরের শনি-রবি। তা ছাড়া টুটানরাও কাল যাদবপুরে আসবে…

আমতা আমতা করে পারমিতা বলল,— দেখি, যদি পারি…

অ্যাই, ভাও বাড়াস না তো। কলেজে পড়াস বলে কি হাতির পাঁচ-পা দেখেছিস? কাল এলে মালুম পাবি আমাদের স্কুলের কত মেয়ে কতভাবে শাইন করেছে।

জানি গো, জানি। অনেকেই ফেসবুকে আসে। পারমিতা সামান্য তোষামোদের সুরে বলল,— তোমার খবরও রাখি। তুমি ডাক্তার, তোমার বর ডাক্তার…

আমার বর বেশি ডাক্তার। আমি কম কম।

মানে?

মানে সে খুব বিজি। আমি হিজিবিজি।

বুঝলাম না। তুমি তো এম-বি-বি-এসে ফাটাফাটি রেজাল্ট করেছিলে!

ইয়েস। বরের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলাম।

তা হলে?

সব ফক্কা পারমিতারানি। সংসারের পরীক্ষা বড় কঠিন। সেখানে বেশি মার্কস পেতে গেলে বরের চেয়ে একটু পিছিয়ে পিছিয়ে থাকতে হয়। বলেই কেমন যেন কৃত্রিম হাসছে এণাক্ষী,— দু’জনেই সমান তালে হসপিটাল-নার্সিংহোম করে বেড়ালে চলবে? সংসার কে দেখবে? ছেলেমেয়ে?

বা রে, মা বাইরের জগতে বেরোলে কি ছেলেমেয়েরা মানুষ হয় না?

তা নয়। তবে এখনও ফ্যামিলি কোড অনুযায়ী মায়েরই তো দায়িত্ব বেশি। ছেলেরা বউ-বাচ্চা ভুলে কাজে ডুবে থাকতে পারে। সেটা তাদের গুণ। আর মেয়েরা তেমনটা করলে তারা হয় সৃষ্টিছাড়া। অতএব কেরিয়ারটা মেয়েদেরই স্যাক্রিফাইস করতে হবে। এণাক্ষী আবার যেন জোর করে হাসল,— এতে আর একটা সুবিধে। বউয়ের হাইট বরের চেয়ে সর্বদা খানিকটা কম থাকে। সমান হয়ে গেলেই তো মুশকিল, তাই না?

যাহ্, কী যে তুমি বলো না!

খাঁটি কথাটাই বলছি রে। আপ্ত বাক্যটা জানিস তো, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে! তাই একটু কম কম ডাক্তারি করছি। আর বেশি বেশি সংসার। এণাক্ষী গলা ঝাড়ল,— তোর বর যেন কী করে?

কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। এখন বাঙ্গালোরে।

তোর তো একটাই ছেলে?

হ্যাঁ, এবার তিন পুরে চারে পড়ল।

কোন স্কুলে দিলি?

এখনও তো প্লে হোমে যায়। সামনের সেশান থেকে কোথাও একটা…

খোঁজ শুরু কর। খোঁজ শুরু কর। পুজোর আগেই কিন্তু অনেক স্কুল ফর্ম দিয়ে দেয়।… কাল তা হলে আসছিস তো?

খুব চেষ্টা করব গো।

একবার অন্তত মুখ দেখিয়ে যাস লক্ষ্মীটি। তোদের ভরসাতেই তো ফাংশনটা করা।

ফোন ছাড়ার পর পারমিতার মনে হল, এণাক্ষীদি বেশ মনোকষ্টে আছে। হয়তো সেই জন্যই মেতেছে স্কুল টুল নিয়ে। কিন্তু তাতারের ভরতির চিন্তাটাও মাথায় ঢুকিয়ে দিল যে। নামী স্কুলগুলোর ওয়েবসাইট একবার ঘেঁটে দেখবে নাকি এক্ষুনি?

সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার চালু। নেটে ঢুকে অনুসন্ধান চালাল ঝটাঝট। নাহ্, আশঙ্কার কারণ নেই, নভেম্বরের আগে কেউ ফর্ম দিচ্ছে না। এখনও সময় আছে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা করে ধীরেসুস্থে এগোতে হবে।

এবার তা হলে নিশ্চিন্তে ফেসবুক। কিন্তু রিফ্রেশার কোর্সের ব্যাপারটা কী হবে? সেপ্টেম্বরের যাওয়াটা তো প্রিন্সিপাল চটকে দিল। পরে আবার কবে কোথায় কোর্সটা জয়েন করা সম্ভব, ইন্টারনেটে দেখে নেবে নাকি?

মাউস ক্লিক করে পারমিতা হানা দিল সাইটে। বিষয় ধরে বিভিন্ন কোর্সের দিনক্ষণ দেওয়া আছে। হঠাৎই চোখ আটকাল। কী কাণ্ড, যাদবপুরেই তো রয়েছে একটা! এবং এই অক্টোবরেই! লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে আরম্ভ হয়ে তিন সপ্তাহ! শেষের ক’দিন বাদ দিলে গোটাটাই তো কলেজ ছুটি। স্বপন বিশ্বাস মোটেই এটাতে বাগড়া দিতে পারবে না। সোমবারই অ্যাপ্লিকেশান ঠুকে দেবে?

সঙ্গে সঙ্গে আর একটা চিন্তাও টোকা দিয়েছে মস্তিষ্কে। কোর্স তো করা হল না, সেপ্টেম্বর মাসটা বৃথা যাবে? একবার তো…দু-তিন দিনের জন্য…!

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পারমিতা। পায়চারি করছে। ক্রমশ চোখমুখ উজ্জ্বল। ফের বসেছে কম্পিউটারে। ক্রেডিট কার্ড বার করে সামনে রাখল। টিকিট কাটছে প্লেনের।

.

০৮.

উড়ান ছিল সওয়া চারটেয়। পারমিতা কলেজ থেকেই সরাসরি পাড়ি জমিয়েছিল দমদম। শেষ বিকেলে বেঙ্গালুরুতে পা রেখে পারমিতা টের পেল, এবারও না এলে সে দারুণ কিছু হারাত।

কী খুশিই যে হয়েছে রাজা! এমন করছে যেন কত যুগ পর পেল পারমিতাকে! যেন তার এই আগমনের প্রতীক্ষাতেই দিন গুনছিল!

এয়ারপোর্টেই উচ্ছ্বাসের শুরু। প্রথমেই এক দফা আপ্যায়ন। বাইরের প্রশস্ত চত্বরে এসে ক্যাপুচিনা কফি, পকোড়া। পারমিতা যত বলে ফ্লাইটে স্যান্ডুইচ খেয়েছে, কে শোনে কার কথা! রাজার জয়নগরের আবাসনটি নাকি নতুন বিমানবন্দর থেকে বিস্তর দূরে, পথে পারমিতার খিদে পেয়ে যেতে পারে! তারপর হিমশীতল গাড়িতে পাশাপাশি বসে রাজার মুখে যেন খই ফুটছে অবিশ্রান্ত। তার নাকি আজ অফিস থেকে জলদি ছাড়া পাওয়ার কথাই নেই, কী এক জরুরি মিটিং চলছে, তার মাঝেই কেমন সুড়ুৎ বেরিয়ে পড়েছে। শুধু পারমিতারই জন্য। কম্পিউট্রনিক্সে কেমন জটিল রাজনীতি চলছে, সহকর্মীরা কে তার প্রতি কত ঈর্ষাকাতর, তাও শোনাল সাগ্রহে। যেন অফিসের ওই সব সমাচার পারমিতাকে শোনাবে বলেই জমিয়ে রেখেছিল। যেন পারমিতাও শুনে ভারী আমোদিত হবে। কথার ফাঁকে টুক করে গড়িয়ায় একটা ফোন করে দিল। ফের অফিসের ঘোঁট চালু।

গাড়ি মূল শহরে ঢুকতে প্রসঙ্গ পালটাল রাজা। এবার শুধুই বেঙ্গালুরু উপাখ্যান। কীভাবে শহরটা রোজ বদলাচ্ছে, ক’খানা ফ্লাইওভার তৈরি হল, কতগুলো নতুন শপিং মল গজিয়েছে, ট্রাফিক কেমন বাড়ছে নিত্যদিন, দামি দামি বিদেশি গাড়িতে ছেয়ে যাচ্ছে পথঘাট, নতুন কোন কোন রেস্টুরেন্টের চেন এল বেঙ্গালুরুতে…। বেচারার খেয়ালই নেই, এসব গল্প ফোনে হয়ে গেছে বহুবার।

পারমিতা অবশ্য বাধা দিচ্ছিল না। ইচ্ছে করেই। রাজার চোখে ওই আনন্দের বিচ্ছুরণ তারও ভাল লাগছিল যে।

ফ্ল্যাটে ঢুকেও চনমন করছে রাজা। বাদশাহি মেজাজে খাবারের অর্ডার দিল টেলিফোনে। আধা ঘণ্টায় খানা হাজির। বাটার নান, রোগনজুশ, চিকেন রেশমি কাবাব, আর স্যালাড। শিস দিতে দিতে ঝটাপট টেবিল সাজিয়ে ফেলল রাজা। শসা চিবোতে চিবোতে হাঁক পাড়ল,— আ যা পারো, ডিনার তৈয়ার।

পারমিতা তখন বাথরুমে। সেই কোন সকাল ন’টায় বেরিয়েছে বাড়ি থেকে, তারপর সারাদিন ছোটাছুটি, গা-হাত-পা কেমন কিচকিচ করছিল, গিজার চালিয়ে স্নান সেরে নিচ্ছিল ছোট একটা। রাতপোশাক গলিয়ে এসেছে ডাইনিং টেবিলে। বসতে বসতে বলল,— আহ্, এতক্ষণে একটু আরাম লাগছে।

রাজা নান্ তুলে দিল পারমিতার প্লেটে। হালকা উপদেশের সুরে বলল,— যতই যা হোক, জার্নির তো একটা ধকল আছে। কলেজটা আজ বাঙ্ক করলেই পারতে।

উপায় ছিল না গো। থার্ড ইয়ারের ছেলেমেয়েগুলো ক’টা মাসই বা ক্লাস পায়…এত প্রকাণ্ড সিলেবাস…ভাবলাম দুটো পিরিয়ড করেই বেরোই…

ছাড়ো তো। ওরা তোমার আশায় থাকে নাকি? সবাই এখন প্রাইভেট টিউটরের নোট গেলে।

না গো। দু’-চারজন ক্লাস-লেকচারের ওপর ডিপেন্ড করে বই কী। অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের পাত্র থেকে কাবাব নিল পারমিতা, রাজাকেও দিল। হেসে বলল,— যারা পড়তে চায় তাদের পড়িয়ে খুব তৃপ্তি আসে গো মশাই।

যাক, দিদিমণিগিরিতেও স্যাটিসফ্যাকশান আছে তা হলে! রাজা ঠোঁট উলটোল। চোখ নাচিয়ে বলল,— তা আমার ফ্ল্যাটটা কেমন দেখছ বললে না তো?

পারমিতা বলতে যাচ্ছিল, ছবিতে যত জমকালো লাগে ততটা নয়। বলল না। আজকের সুন্দর সুরটা যদি কেটে যায়! দু’আঙুলে একটা তারিফের মুদ্রা ফোটাল শুধু।

ওমনি রাজা কলার ওঠাচ্ছে,— আমার চয়েস সর্বদা এ ক্লাস হয় ম্যাডাম।

বটে?

নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারো না?

থাক। নো মস্‌কা। পারমিতার চোখে ছদ্ম উষ্মা,— পছন্দটুকুই করতে জানো, তবে যত্নের বালাই নেই। ফার্নিচারে কত ধুলো জমেছে, হাত বুলিয়ে দেখেছ কি?

কাজের মেয়েটা ফাঁকি মারলে আমি কী করব!

নিজে হাত লাগাবে। এমন কিছু হাতিঘোড়া কাজ তো নয়। কিচেনটাও তো ছ্যাতাপ্যাতা। স্ল্যাবে বাসন ছড়ানো, ফ্রিজের মাথায় প্যাকেটের স্তূপ…

অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি যায় ডিয়ার। বহুৎ টায়ার্ড থাকি। কোনও দিকে তাকাতে পারি না।

আমরা কিন্তু পারি।

তোমাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা? তোমরা হলে গিয়ে শক্তির আধার। ঘরগৃহস্থালি তো তোমাদের রক্তে…।

আর তোমাদের রক্তে কী? খালি হুকুম জারি? আর বিছানায় গড়াগড়ি?

তাই বা হচ্ছে কোথায়! হুকুমটা ঝাড়ব কাকে? একা একা গড়াগড়িই বা কত খাব? রাজা চোখ টিপে একটা চটুল ইশারা করল,— ওতে কি মজা আসে?

পারমিতা হেসে ফেলল। পালটা ইঙ্গিত হেনে বলল,— দাঁড়াও, কাল তোমার কলাবতীকে ধরছি। বাবুর দেখভাল করছে না, এ তো ভাল কথা নয়!

হাসিমশকরা চালাতে চালাতেই আহার সারা। প্লেট সিঙ্কে নামিয়ে উদ্বৃত্ত খাবার ফ্রিজে ঢোকাল পারমিতা। ভেতরে কী যেন একটা রান্না করা আছে, দেখল ঢাকনা খুলে। আলুর দম। কুচকুচে কালো। সভয়ে ফের ঢাকা দিয়ে ফ্রিজের দরজা বন্ধ করল। নাহ্, রাজার সত্যিই বড় করুণ দশা, কাল পরশু বেশি করে রেঁধে রাখতে হবে।

লঘু হাতে রান্নাঘরখানাও একটু গুছিয়ে ফেলল পারমিতা। জৈবিক অভ্যাসের মতো। রান্নাঘর থেকেই শুনতে পেল ড্রয়িং হলে তার মোবাইলটা বাজছে। তাতার কি? এখনও ঘুমোয়নি? মা’র সঙ্গে কথা বলবে বলে বায়না জুড়েছে নাকি?

পারমিতা গিয়ে ধরার আগেই রাজা এনে দিয়েছে সেলফোনটা। চাপা গলায় বলল,— ম্যাডামকে চাইছে। বোধহয় তোমার কোনও স্টুডেন্ট।

ভুরু কুঁচকে পারমিতা ফোন কানে চাপল,— কে বলছেন?

ম্যাডাম, আমি অরিজিৎ। সেকেন্ড ইয়ার অনার্স। রোল নাম্বার ফাইভ।

ও, সেই পাগলাটে ছেলেটা। যার মাথায় আজব আজব প্রশ্নের ভূত চাপে হঠাৎ হঠাৎ।

পারমিতা গম্ভীর গলায় বলল,— এখন ফোন? কী ব্যাপার?

কলেজে আপনাকে খুঁজছিলাম ম্যাডাম। শুনলাম আপনি চলে গেছেন…

হ্যাঁ। একটা কাজ ছিল।

কাল আপনি আসছেন তো ম্যাডাম?

না। কাল আমার অফ-ডে। সোমবার যাব।

ও। একটা জিনিস জানার ছিল। বিদিশা ম্যাডামকে বললাম, উনি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন…

কী?

থার্মোডায়নামিক্সের প্রবলেম। পারপেচুয়াল মোশানকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে কেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।

এভাবে প্রশ্নটা তো কোনওদিন মনে আসেনি! বাঁধা গতেই তো পড়ে আর পড়িয়ে এসেছে চিরকাল। পারমিতা একটু চিন্তা করে উত্তরটা বলার চেষ্টা করল। ওদিক থেকে অরিজিৎও মতামত দিয়ে চলেছে টুকটাক। নিজের মতো করে। আলোচনা করতে করতে একটা সমাধান পাওয়া গেল যেন। তবু পারমিতা বুঝি সন্তুষ্ট হতে পারল না। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,— ফোনে তো এত বোঝানো যায় না, সোমবার যাই, তখন ব্যাপারটা নিয়ে বসব।

আমার দু’খানা প্র্যাক্টিকাল সই করানোর ছিল ম্যাডাম। সোমবার করে দেবেন তো?

না। প্র্যাক্টিকাল ক্লাসেই শুধু প্র্যাক্টিকাল সই হবে। এখন তা হলে রাখছি।

কথা বলতে বলতে কখন যেন লিভিং হলে চলে এসেছিল পারমিতা। মোবাইল অফ করে দেখল সোফায় বাবু হয়ে বসে মিটিমিটি হাসছে রাজা।

বোকা বোকা মুখে পারমিতা বলল,— বড্ড জ্বালায়। সময় অসময় জ্ঞান নেই।

বুঝেছি। স্টুডেন্টরা ম্যাডামকে চোখে হারায়।

না গো। আসলে ডিপার্টমেন্টে আমি এখন একাই তো ফুলটাইমার, আর গেস্ট লেকচারারদের ওপর ছেলেমেয়েদের আস্থা কম, তাই যার যা জিজ্ঞাস্য সব আমাকেই…। আমি তো ইনঅরগ্যানিকের, অথচ অরগ্যানিক, ফিজিকাল, সব আমায় দেখতে হবে। এদিকে আনসার খুঁজতে আমার তো প্রাণ জেরবার।

বাড়তি লোড নাও বলেই ঘাড়ে চাপে। সাফ বলে দিতে পারো না, ইনঅরগ্যানিকের বাইরে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না?

যাহ্, তা হয় নাকি?

কেন হয় না?

টিচারদের কাছে স্টুডেন্টদের একটা আলাদা এক্সপেক্টেশান থাকে স্যার। ওদের ধারণা আমরা সর্বজ্ঞ, বুঝলে।

তা হলে আর কী, খাও খাও গ্যাস খাও। হাত বাড়িয়ে খপ করে পারমিতাকে ধরল রাজা। এক টানে বসিয়ে নিয়েছে কোলে। কাঁধে মুখ ঘষছে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল,— অ্যাই, আর নো কলেজ, নো স্টুডেন্ট। এখন শুধু আমি। আমারও তো একটা এক্সপেক্টেশান আছে, না কি?

জানি তো। পারমিতা বরের গলা বেড় দিয়ে আদুরে স্বরে বলল,— আমিও কি এখানে এমনি এমনি এসেছি?

ব্যস, আর সংলাপের কী প্রয়োজন! উন্মত্ত চুম্বনে নারী-পুরুষ তপ্ত ক্রমশ। পারমিতা যেন পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে, রাজা তাকে পাঁজকোলা করে নিয়ে গেল শয্যায়। খসে পড়ল আবরণ। মেতে উঠল শরীর।

রতিক্রিয়া সাঙ্গ করে পাশাপাশি শুয়ে আছে দু’জনে। পরস্পরকে ছুঁয়ে। অসম্ভব এক ভাল লাগা যেন ছেয়ে যাচ্ছিল পারমিতাকে। মন ফুরফুরে, আশ্বিনের আকাশের মতো।

হঠাৎ আপন মনে বলে উঠল,— এমা, একটা ভুল হয়ে গেল তো!

রাজা অলস গলায় বলল,— কী?

মাকে একটা ফোন করা উচিত ছিল।

কেন? কোনও দরকার ছিল বুঝি?

না, তা নয়… জাস্ট বাবার একটা খবর নেওয়া…

চিন্তা করছ কেন? উনি তো এখন ভাল আছেন।

তবু…এত দূরে চলে এলাম…টেনশান হয় গো।

দূর পাগলি! কাল বাদে পরশু তো ফিরে যাবে, এর মধ্যে কারও কিচ্ছু হবে না। রাজা পারমিতার চুলে বিলি কেটে দিল,— সকালে উঠেই যাদবপুরে ফোন কোরো। আমি কথা বলব।

রাজার আশ্বাসে পারমিতার চিত্তচাঞ্চল্য কমল কি? হয়তো বা। তবু একটু কাঁটা যেন রয়েই যায়। বরের কাছে আসার উল্লাসে বাবার খবর নিতে বেমালুম ভুলে যাওয়াটা কি অবহেলারই নামান্তর নয়? যাদবপুরে না গেলেও ফোন একটা তো করেই!

রাজা পাশ ফিরেছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা ওঠাল সামান্য। প্রায় ফিসফিস করে বলল,— অ্যাই পাগলি, কী ভাবছ?

কিচ্ছু না।

একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করছে।

কী?

একটুক্ষণ ভেবে রাজা বলল,— নাহ্, থাক।

আহা, থাকবে কেন? বলো না?

মিথ্যে মন রাখা জবাব দেবে না তো?

ভণিতা করছ কেন?

না ভাবছিলাম…আমরা তো প্রায় পার্মানেন্টলি দূরে দূরে আছি…এতদিন পরপর মিট হয়…তোমার খারাপ লাগে না? অসুবিধে হয় না?

পারমিতা একটু যেন কেঁপে উঠল। রাজার বিরহে তার দেহ কি অভ্যস্ত হয়েছে? বেশির ভাগ দিন এতই ক্লান্ত থাকে, বিছানায় গিয়ে কিছু মনেই পড়ে না। তখন তো শরীরের একটাই চাহিদা। বিশ্রাম। নির্ভেজাল ঘুম। কিন্তু কোনও কোনও রাতে কষ্টও তো হয়। চেনা পুরুষের স্পর্শ পেতে আকুল হয় দেহমন। দুটো অনুভূতিই তো সত্যি। দুটোই বলবে রাজাকে? জবাবটা কীভাবে নেবে রাজা?

সত্যিমিথ্যে এড়িয়ে পারমিতা আলগোছে বলল,— মিছিমিছি ওসব ভেবে লাভ কী বলো? জীবন যখন যেভাবে চলে…তাকে মেনে নিতে হয়।

কিন্তু জীবনের চলার অনেকটাই তো তোমার আমার হাতে। নয় কি?

কী জানি। আমি আর অত ভাবতে পারি না। মাথা ঝিমঝিম করে।

রাজা কেমন যেন কাঠ কাঠ মতন হয়ে গেল। একটুক্ষণ স্থির পারমিতাকে দেখে আবার শুয়েছে চিত হয়ে। মাথার ওপর ফ্যান চলছে ধীর লয়ে। বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে ঘরের বাতাস। পারমিতার শীত শীত করছিল।

উঠে পাখাটা বন্ধ করবে কিনা ভাবছিল পারমিতা, তখনই ফের রাজার স্বর। প্রায় অস্ফুটে বলল,— একটা প্ল্যান মাথায় খুব ঘুরছে…

কী?

দেওয়ালির সময়টায় কয়েকটা দিন ছুটি নিতে পারব। তোমরা তো পুজোয় আসছই… মা-বাবারও বাঙ্গালোর দেখার খুব ইচ্ছে…ওরাও যদি আসে…সবাই মিলে উটি বেড়িয়ে এলে কেমন হয়?

এমন লোভনীয় প্রস্তাবটা যেন সেলের মতো বিঁধল পারমিতাকে। রাজার তরফ থেকে ভ্রমণের প্রস্তাব কদাচিৎ আসে। অফিস নাকি তাকে ছাড়েই না। সত্যি, রাজা চমকে দিচ্ছে বটে! আজ একটাও কনফারেন্স কল হল না এখনও, এটাও কি কম বিস্ময়ের? নিশ্চয়ই পারমিতার খাতিরেই যাবতীয় কাজ রাজা আজ মুলতুবি রেখেছে। এবং অবশ্যই পারমিতার ভাল লাগবে বলেই ওই বেড়ানোর পরিকল্পনা!

পারমিতা কাঁপা কাঁপা গলায় বলেই ফেলল,— আমি তো প্রোগ্রামটায় জয়েন করতে পারব না রাজা। তখন যে আমায় কলকাতায় থাকতেই হবে।

সে কী? কেন?

লক্ষ্মীপুজোর পরদিন থেকে আমার রিফ্রেশার কোর্স। যাদবপুরে। টানা একুশ দিন।

অ। রাজা খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,— পুজোর ছুটিতেই করতে হবে? পরে করলে হয় না?

উপায় নেই গো, বিশ্বাস করো। সামনের ফেব্রুয়ারিতে আমার প্রোমোশান ডিউ। এর মধ্যে সেকেন্ড রিফ্রেশার কোর্সটা না করতে পারলে সব আটকে যাবে। এদিকে এই অ্যাকাডেমিক সেশানে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ছাড়া কোথাও কোর্সটা নেই। পারমিতা পাশ ফিরে রাজার বুকে হাত রাখল,— জানো, তন্নতন্ন করে নেট ঘেঁটেছি। ভেবেছিলাম যদি, ইন দা মিন টাইম, বাঙ্গালোরেই কোর্সটা পেয়ে যাই, তা হলে তো সোনায় সোহাগা। তিনটে সপ্তাহ টানা এখানে থাকতে পারব। কপাল খারাপ, এখানেও কিছু নেই।

হাহ্, কার যে কপাল খারাপ…! রাজার গলায় প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ। গোমড়া স্বরে বলল,— যা তোমার মর্জি, করো। আই হ্যাভ নাথিং টু সে।

অ্যাই, রাগ কোরো না প্লিজ। পারমিতা পলক ভেবে নিয়ে কিঞ্চিৎ উদ্দীপিত ভাবে বলল,— একটা ব্যবস্থা কিন্তু হয়ে যায়। উটির প্রোগ্রামটা যদি এগিয়ে আনো…এনি টাইম বিটুইন ষষ্ঠী আর লক্ষ্মীপুজো…আমি বেড়িয়ে ফিরে যাব, বাবা-মা নয় তাতারকে নিয়ে আরও কিছুদিন রয়ে গেলেন!

সরি। আমার অফিস তো তোমার সুবিধে মেপে আমায় ছুটি দেবে না। দুর্গাপুজোর টাইমে ইউ-এস থেকে একটা ডেলিগেশান আসছে, আমি তখন ভীষণ বিজি।

কেন যে দু’জনের তার একই ছন্দে বাজে না? সন্ধে থেকে বেশ তো একটা সুরে বাঁধা ছিল, এখন বারবার কেটে যাচ্ছে। রাজাকে যে কী করে আবার সমে ফেরায় পারমিতা?

নিজেকে খানিক বিন্যস্ত করে পারমিতা বাথরুম ঘুরে এল। কাচের দরজা ঠেলে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে লাগোয়া ব্যালকনিতে। অন্দরের চেয়ে বাইরেটা এখন অনেক বেশি শীতল। মিহি বাতাস বইছে একটা, সামান্য এলোমেলো। হাওয়াটা যেন কাঁপন ধরায়।

পারমিতা কুঁকড়ে গেল সামান্য। বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে দৃষ্টি মেলে দিয়েছে। আটতলার এই বারান্দা থেকে বহু দূর অবধি দৃশ্যমান। গাছগাছালির অন্ধকার, উঁচু উঁচু বাড়ি, নাগরিক দীপমালা…। আলোর দ্যুতি যেন আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। গড়ানে আকাশের গাঢ় নীল কেমন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে। তারা ফুটে আছে, তবে নগরের প্রভায় তাদেরও কেমন মলিন দেখায়। পারমিতার ঠিক নীচের পৃথিবীটাও যেন আবছায়া মাখা। আধ চেনা বাস্তবের মতো।

মনটা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল পারমিতার। বেশ তো গড়াচ্ছিল জীবনটা। কলকাতাতে তারা দু’জন তো দিব্যি সুখে ছিল। কেন যে রাজা প্রোমোশানটা পেল? মাঝখান থেকে যত সব টুকরো টাকরা সমস্যা, ভুল বোঝাবুঝি, অহেতুক টেনশান…কোনও মানে হয়? আবার রাজাও চিরকাল একটা গণ্ডিতে আটকে থাকবে, এও তো এক স্বার্থপর চিন্তা। কী যে হবে…?

ছোট একটা শ্বাস ফেলে পারমিতা ঘরে ফিরল। রাজার মুখ দেওয়ালের দিকে। ঘুমিয়ে পড়ল কি? নাকি জেগে শুয়ে সেও মন খারাপ করছে? পারমিতা বুঝতে পারল না। তবে আর ডাকল না রাজাকে। গুটিসুটি মেরে পাশে শুয়ে পড়েছে।

পরদিন সকালে অবশ্য মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। রাজা একদম স্বাভাবিক। একটু দেরি করে তার ঘুম ভাঙল, বিছানাতেই চা পেয়ে ভীষণ খুশি, পরমুহূর্তে ঘড়ি দেখে হুটোপাটি শুরু। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় সে অফিস বেরোবে, তার আগে দাড়ি কামানো, স্নান, ফিটফাট হওয়া, প্রাতরাশ…এ যেন কলকাতার সেই চেনা রাজা, সকালে যে ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে ছোটে।

পারমিতাও নির্ভার। ঢুকেছে রান্নাঘরে। ডিপ ফ্রিজে বোনলেস মুরগি ছিল, সেদ্ধ করে স্যান্ডউইচ বানাল চটপট। গরম গরম কফিও রেডি। দুধ বেশি দিয়ে। ঠিক যেমনটা রাজা ভালবাসে।

রাজা গপাগপ খাচ্ছিল। একদৃষ্টে তাকে দেখছিল পারমিতা। জিজ্ঞেস করল,— কী গো, ব্রেকফাস্ট মনোমতো হয়েছে?

ফার্স্ট ক্লাস। অনেক দিন পর বাড়িতে গ্রিলড স্যান্ডউইচ খাচ্ছি।

রাত্তিরে কী খাবে? আমি রেঁধে রাখব।

কী করে? বাড়িতে তো কিছু আনা নেই?

দেখেছি। শুধু ডিম আলু পেঁয়াজ…। পারমিতা হাসল,— চিন্তা কোরো না, বাজার করে আনছি।

পারবে?

একেবারে গাঁওয়ার তো নই। পারমিতা চোখ ঘোরাল,— এই শহরে ঘোরাফেরার প্রসেস আমি জানি স্যার। ভুলে যেয়ো না, বাঙ্গালোরে আমি আগেও এসেছি।

সে তো বহুকাল…। তখন তাতার হয়নি। রাজা কফিতে লম্বা চুমুক দিল,— যাক গে, আজ রাতের রান্না নিয়ে নো টেনশান। ও বেলায় আমাদের নেমন্তন্ন।

কোথায়?

সৌম্যদের বাড়ি।

সৌম্য নামটা পারমিতার হাজারো বার শোনা। রাজার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহপাঠী, স্টেটস-এ বছর তিনেক কাটিয়ে সেও এখন বেঙ্গালুরুবাসী। কলকাতায় থাকার সময়ে তেমন যোগাযোগ ছিল না, হালফিল স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই রাজার বিশেষ বন্ধু।

পারমিতা জিজ্ঞেস করল,— তুমি বুঝি জানিয়েছ আমি এসেছি?

এরকম একটা মেগা ইভেন্ট গোপন রাখা যায়! পরে শুনলে ওরা গাল মেরে গুষ্টি উদ্ধার করে দেবে না! রাজা ন্যাপকিনে মুখ মুছল,— তানিয়া তো তোমার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। দেখো, সন্ধেটা হেব্বি কাটবে।

উৎসাহভরে বলল রাজা, কিন্তু পারমিতা তেমন পুলকিত বোধ করল কি? বাড়তি কয়েকটা ঘণ্টা শুধু রাজার সান্নিধ্য পেলেই বুঝি তার বেশি আনন্দ হত।

ড্রাইভার এসে গেছে। তাড়াতাড়ি জুতো-মোজা পরে বেরিয়ে পড়ল রাজা। সে চোখের আড়াল হতেই পারমিতার স্মরণে এল, মা’র সঙ্গে রাজার কথা বলানো হল না তো! সকালে রাজাকে ফের খোসমেজাজে পেয়ে এত বেভুল হয়ে গেল?

দ্রুত যাদবপুরে ফোনটা সেরে নিল পারমিতা। কোনও সমস্যা নেই। ফিজিয়োথেরাপিস্ট, আয়া, সবাই এসেছে। এবং কেউ না ধরতেই বাবা নাকি একা উঠে বসেছিল কাল! গড়িয়াতেও পারমিতা ফোন করল একটা। তাতারের সঙ্গে একটু কথা বলল, ছেলে খানিক ম্যা ম্যা করল বটে, তবে মা’র অভাবে অতিশয় কাতর বলে মনে হল না। স্বাভাবিক, দাদু-ঠাকুমা যেভাবে সারাক্ষণ ঘিরে থাকে!

তা এবার তো পারমিতাকে কাজে নামতে হয়। কলাবতী নাকি বেলায় আসে, তার আগে বাজারটা সেরে ফেলবে? পুচকে ট্রলিব্যাগখানা খুলে এক সেট সালোয়ার-কামিজ বার করল পারমিতা। পাঁচ মিনিটেই রেডি, লিফ্ট ধরে একতলায়। আবাসনের গেটে অটো মজুত, চেপে সপ্রতিভ নির্দেশ, জয়নগর মার্কেট চলো…

তিন রকমের মাছ, একটা বড়সড় মুরগি, আর কিছু আনাজপাতি কিনে পারমিতা ফিরল সাড়ে দশটা নাগাদ। টুকুন জিরিয়ে নিয়ে রান্না স্টার্ট। মিক্সিতে মশলা বেটে সবে ভেটকি মাছটা বসিয়েছে, কলাবতী দরজায়। শ্যামলা বরণ যুবতী, পরনে সালোয়ার-কামিজ, বেণিতে ফুলের মালা, হাত ভরতি কাচের চুড়ি, পায়ে ঝুমুর ঝুমুর রুপোর মল।

পারমিতাকে দেখে দু’গাল ছড়িয়ে হাসল কলাবতী। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল,— আপ বিবিজি? সাবনে বোলা থা…

সরল হাস্যমুখ কলাবতীকে মনে ধরে গেল পারমিতার। বেশ তুরতুরে আছে মেয়েটা, তুরন্ত্‌ নেমে পড়ল সহকারীর ভূমিকায়। এটা ওটা কেটেকুটে দিচ্ছে, সঙ্গে মুখও চলছে অবিরাম। সরস্বতী-কলাবতীদের সর্বত্রই এক হাল। কলাবতীর বরও মদ খায়, জুয়া খেলে, আর নিয়ম করে বউ পেটায়। রাজাকে কী কী রেঁধে দেয় কলাবতী, কেমন তার রন্ধনপ্রণালী, ওই বিষকালো আলুর দমটায় কোন মশলা দিয়েছিল, পারমিতা জানল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কলাবতীর হিন্দি পারমিতার চেয়েও খারাপ, দক্ষিণী টানে যা বলে তার মর্মোদ্ধার দুঃসাধ্য। তা ছাড়া জবাব দেবে কী, মেয়েটা এত হাসে কথায় কথায়। তাও ভাববিনিময় তো হচ্ছিল একটা!

কলাবতীকে দিয়ে গোটা ফ্ল্যাট ঝাড়পোঁছও করিয়ে নিল পারমিতা। মোছাল প্রতিটি আসবাব, ধোয়াল রান্নাঘর-বাথরুম। এবার থেকে আর যেন ফাঁকি না মারে, সেই অনুরোধও জানাল বারবার।

রান্নাবান্না শেষ। কলাবতী বিদায় নিয়েছে বহুক্ষণ। স্নান-খাওয়া সেরে পারমিতা টিভি চালিয়ে বসল একটু। ইংরিজি চ্যানেল করা আছে, রাজা বোধহয় সিনেমা টিনেমা দেখে। রিমোট টিপে পারমিতা একটা বাংলা চ্যানেলে গেল। খবর হচ্ছে। দু’-চার মিনিট শুনে অন্য চ্যানেল। মেগা সিরিয়াল। শাশুড়ি-বউয়ের কূটকচালির কাহিনি। এখানেও ধৈর্য রইল না, ধ্যাত্তেরি বলে উঠে পড়েছে। ঘুরছে এ ঘর, ও ঘর।

তখনই এক বিচিত্র অনুভূতি। হোক না ভাড়ার ফ্ল্যাট, এটা তো এখন রাজার অধিকারে। সেই সূত্রেই পারমিতারও। কিন্তু মোটেই নিজের ডেরা বলে মনে হচ্ছে না কেন? কেমন হোটেল হোটেল লাগে! কিংবা গেস্ট হাউস। একেবারেই অস্থায়ী আগমন পারমিতার, তাই কি আত্মিক যোগ তৈরি হচ্ছে না?

অ্যাই, খবরদার! নিজেকে শাসন করল পারমিতা। মুখ ফসকেও যেন ভাবনাটা রাজার সামনে প্রকাশ না পায়। বেচারা খুব দুঃখ পাবে।

রাজা এল সন্ধের মুখে মুখে। দিব্যি ফুর্তির মেজাজে আছে। ঢুকেই এক প্রস্থ আদর, তারপর গিয়ে অভ্যাস মতো ঠান্ডা জল খেতে ফ্রিজ খুলেছে। তাকে তাকে সাজানো পাত্র দেখে পলকে চোখ বড় বড়। দুটো-চারটে ঢাকা খুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,— অ্যাই, কী করেছ এসব?

পারমিতা ঠোঁট টিপে হাসছে,— বা রে, খরচাপাতি করে এক-দু’দিনের জন্য এলাম, বাবুকে একটু সার্ভিস না দিয়ে গেলে চলে?

এটা বুঝি একটু? এ তো আমার মাসখানেকের খোরাক!

আজ্ঞে না স্যার। প্রত্যেকটি তোমার ফেভারিট আইটেম। তিন দিনে উড়ে যাবে।

কিন্তু তার পর? ফ্রিজ ভেজিয়ে রাজা কাছে এল। পারমিতার কাঁধে হাত রেখে গাঢ় চোখে বলল,— হ্যাবিট নষ্ট করে দিয়ে যাচ্ছ কেন? এরপর তো কলাবতীর রান্না খেতে কান্না পাবে।

কথাটায় বুঝি শুধু স্তুতি নয়, গোপন অনুযোগও আছে। সঙ্গে একটা অব্যক্ত অনুরোধ। মুখে হাসি টেনে রেখে পারমিতা বলল,— থাক থাক। অত ফ্ল্যাটারি আমার সইবে না। এবার চলো তো… কোথায় যাবে…

হ্যাঁ। রাজা সংবিতে ফিরেছে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,— ড্রেস করে নাও। আমি ততক্ষণ একটা স্নান মেরে আসি।

আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়েছে দু’জনে। বাইরে এক মনোরম সন্ধে। দিনের তাপ মরে শিরশিরে বাতাস বইছে। কাঁপছে গাছের পাতারা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে বসে অবশ্য ওসব টের পাওয়ার উপায় নেই, চেয়ে চেয়ে আলোকিত পথঘাট দেখাই সার।

সৌম্যদের ইন্দিরা নগরের বাড়িতে পৌঁছোতে খানিক সময় লাগল। দূর তো একটু আছেই, তার ওপর ট্রাফিক জ্যাম। শনিবারের সন্ধেটা উপভোগ করতে বেঙ্গালুরুর পথঘাট গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ।

সৌম্য আর তানিয়া রাজাদের অপেক্ষাতেই ছিল। দরজা খুলে কোরাসে আহ্বান জানাল,— ওয়েলকাম, ওয়েলকাম।

এগারো তলার ফ্ল্যাটখানায় ঢুকে পারমিতার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মেঝেতে কাঠের প্যানেলিং, সুদৃশ্য ঝাড়বাতি ঝুলছে সিলিং থেকে, দেওয়ালে দামি দামি পেন্টিং, আফ্রিকান মুখোশ… কত সুন্দর সুন্দর শো-পিসও যে রয়েছে ছড়ানো ছেটানো। সোফা-ডিভানে বিদেশি বাহার।

সৌম্যই আতিথেয়তা শুরু করেছে। পারমিতাকে জিজ্ঞেস করল,— কী নেবে বলো? হার্ড ড্রিঙ্কস? না সফ্ট?

সুরাতে যে সাংঘাতিক ছুঁৎমার্গ আছে পারমিতার, তা নয়। তবে খায় না বড় একটা। ক্বচিৎ কখনও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে হয়তো চাখল একটু আধটু। তা বলে এই অচেনা পরিবেশে সদ্য পরিচিত দম্পতির সামনে…!

স্মিত মুখে পারমিতা বলল,— আমি সফ্টই নিই? জাস্ট ঠান্ডা একটা কিছু…?

অ্যাজ ইউ উইশ।

সঙ্গে সঙ্গে তানিয়াও বলে উঠেছে,— আমিও পারমিতার দলে। তোমরা বসে বসে হুইস্কি গেলো।

শিয়োর। সুরাই তো সন্ধেকে রঙিন করে।

লিভিংরুমের একপাশে সাজানো ছোট্ট সেলার থেকে শিভাস রিগালের বোতল নিয়ে এল সৌম্য। তানিয়া এনেছে কোল্ড ড্রিঙ্কস, জলের বোতল, পাতলা পাতলা কাচের গ্লাস। আর ট্রে উপচোনো চিংড়িভাজা, চিকেন ভাজা।

ব্যস, গুলতানি শুরু। বেঙ্গালুরুর আবহাওয়া, কলকাতার হালচাল, এখানকার জীবন কত গতিময়, কলকাতা কীভাবে স্থবির হয়ে পড়ছে দিনদিন, তানিয়ার চাকরি, পারমিতার কলেজ, তানিয়ার ছেলে গোগোল, পারমিতার তাতার, তাদের দুরন্তপনা, সৌম্য-তানিয়ার আমেরিকা বাস…সবই আসছে ঘুরেফিরে। ফাঁক বুঝে রাজা আর সৌম্য যে যার অফিস নিয়ে বকল খানিক। তাদের গ্লাস শূন্য হচ্ছে দ্রুত, ভরেও যাচ্ছে। পারমিতার বাবার খবরও তানিয়াদের অজানা নয়। প্রণব এখন কতটা সুস্থ, সৌম্য জানতে চাইল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ।

এরই মাঝে হঠাৎ গোগোলের উদয়। নীচের তলার ফ্ল্যাটে বন্ধুর জন্মদিনে গিয়েছিল, ফিরেছে লাফাতে লাফাতে। রিটার্ন গিফ্ট দেখাচ্ছে বাবাকে।

তানিয়া ছেলেকে বলল,— এই আন্টিটাকে চেনো?

গোগোল ঘাড় নাড়ল দু’দিকে। ঠোঁট উলটোচ্ছে।

পারমিতা আন্টি। স্কুলটুল নয়, আরও উঁচুতে পড়ায়। কলেজে। কেমিস্ট্রি।

গোগোলের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। সে সদ্য ঘুরে আসা অনুষ্ঠানের বর্ণনা শোনাতে বেশি ব্যাকুল।

তানিয়া লঘু ধমকের সুরে বলল,— বোর কোরো না গোগোল। বুঝেছি, তুমি আজ খুব এনজয় করেছ। এবার যাও, নাইট ড্রেস পরে শুয়ে পড়ো।

এখন তো সবে নাইন থার্টি। কাল তো স্কুল নেই, একটু গেমস খেলি না…

ফিফটিন মিনিটস। তারপর কিন্তু বন্ধ করবে। নিজে থেকে। আমাকে যেন উঠতে না হয়।

নাচতে নাচতে গোগোল নিজের ঘরে। পারমিতা হেসে বলল,— সব বাচ্চার আজকাল গেমস খেলার নেশা। তাতার তো চান্স পেলেই আমার মোবাইলটা নিয়ে বসে পড়ে।

তোমার ছেলে গোগোলের চেয়ে একটু ছোট, তাই না? গোগোল তো পাঁচ…

তাতার থ্রি প্লাস। এখনও প্লে হোমে যাচ্ছে। এবার স্কুলে দেব।

সৌম্য তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিচ্ছিল গ্লাসে। বলল,— এমন একটা স্কুলে দিয়ো, যেখান থেকে টানা পাশ করে বেরিয়ে যেতে পারবে।

আমারও তাই ইচ্ছে। পুজোর পরে কয়েকটা ভাল স্কুল থেকে ফর্ম তুলব।

দেখো, ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের আন্ডারে যেয়ো না কিন্তু। পরে বাঙ্গালোরে এলে অ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধে হবে। সৌম্য রাজাকে সালিশি মানল,— কী রে, ঠিক বলেছি তো?

আমি জানি না রে ভাই। রাজা ঢকাস করে অনেকটা তরল ঢেলে নিল গলায়। কিঞ্চিৎ জড়ানো স্বরে বলল,— আমার ছেলের ভরতির যে তোড়জোড় চলছে, সেটাই তো এই প্রথম শুনলাম।

বলিনি বুঝি তোমায়? পারমিতা জিভ কাটল,— সরি, সরি।

হোয়াই সরি ডিয়ার? তাতারের ফিউচার তো তুমিই ডিসাইড করবে! আমি হ্যাঁ না বলার কে?

পারমিতার কপালে পল্‌কা ভাঁজ। রাজার নেশা হয়ে গেল নাকি? বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ করছে গ্লাস। এবারেরটা তো জল ছাড়াই নিল!

চোখ কুঁচকে পারমিতা বলল,— এভাবে বলছ কেন?

তো কীভাবে বলব?…যদি বলি, আমি যখন এখানে থাকছি, তাতার এখানেই পড়াশোনা করবে, তুমি মেনে নেবে?

আপত্তি কেন করব? পাঠিয়ে দিতেই পারি। অফিস টফিস ছেড়ে ছেলে সামলাও।

অ। আর তুমি কলকাতাতেই পড়ে থাকবে, তাই তো?

পারমিতা ধক করে একটা ধাক্কা খেল। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে একটু তীক্ষ্ন স্বরেই বলল,— তুমি কী চাইছ বলো তো? সব ছেড়েছুড়ে এখানে চলে আসি?

কিছুই বলছি না। আমার ইচ্ছের যখন ভ্যালুই নেই, তখন আমার মতামতেই বা কী আসে যায়?

অ্যাই, অ্যাই, তোরা হঠাৎ ঝগড়া বাধালি কেন? কুল। কুল। সৌম্য রাজার পিঠে আলগা চাপড় মারল। তানিয়াকে বলল,— এবার ডিনার লাগিয়ে ফেলো তো। ব্যাটা হাই হয়ে গেছে।

না রে, তোরা জানিস না, ও আমার কথা ভাবেই না।

পারমিতা স্তম্ভিত। সবে আজই আলাপ হল সৌম্যদের সঙ্গে…সেখানে এরকম একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি…! এ তো পারমিতাকে ছোট করা! রাজা কি জেনেবুঝে করছে?

টেবিল সাজিয়ে ডাকল তানিয়া। আড়ষ্ট পায়ে পারমিতা চেয়ারে গিয়ে বসেছে। উলটো দিকে সৌম্য আর রাজা। পাশে তানিয়া।

খেতে হাত উঠছিল না পারমিতার। তানিয়া প্লেটে পোলাও তুলে দিল। সঙ্গে ফিশফ্রাই। নিজেও নিয়েছে। রাজাকে একবার দেখে নিয়ে বলল— মাল খেলে অনেকেই ভাট বকে। একদম পাত্তা দিয়ো না। সৌম্যই যা করে এক একদিন…

পারমিতা ফ্যাকাশে হাসল।

তানিয়া ঝুঁকল একটু। গলা খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করল,— তুমি কি সত্যিই বাঙ্গালোরে আসতে চাও না?

কী করে সম্ভব বলো? বাবার ওই সিচুয়েশান…। প্লাস, চাকরিও একটা ফ্যাক্টর…

হ্যাঁ, মেসোমশাইয়ের ব্যাপারটা তো খুবই প্র্যাক্টিকাল প্রবলেম। তার ওপর তুমি যখন একটামাত্র মেয়ে…। কিন্তু তোমাদেরও তো একটা লাইফ আছে। কথাটাকে খারাপ সেন্সে নিয়ো না…ধরো মেসোমশাই যদি ওভাবে দশ বছর বাঁচেন, কি পনেরো বছর… আজকাল মেডিকেল সায়েন্স যা ইমপ্রুভ করছে, কিছুই অসম্ভব নয়… তখন তুমি কী করবে? কনজুগাল লাইফটাকে ভুলে জীবনের প্রাইম টাইম এভাবে স্টাক-আপ হয়ে কাটিয়ে দেবে?

দুর্ভাবনাটা তো পারমিতাকেও কুরে কুরে খায়। কিন্তু এর কি সমাধান আছে কোনও? যুক্তির দিক দিয়ে তানিয়া হয়তো সঠিক, কিন্তু পারমিতার হৃদয় কী বলে? হৃদয়? না আবেগ? হৃদয়? না বিবেক? পারমিতা জানে না।

তানিয়া ফের নিচু স্বরে বলল,— একটা অল্টারনেট কিছু ভাবো। এখানে থেকেও কনট্যাক্ট রাখতে তো কোনও প্রবলেম নেই। মাসে দু’মাসে ঘুরেও আসতে পারো। মাসিমা ওখানে রয়েছেন, সমস্যা হলে তোমায় ডাকবেন… যেতে কতক্ষণই বা লাগে, বলো? ট্রেনে দুর্গাপুর-আসানসোল থেকে আসাও বোধহয় এর চেয়ে বেশি টাইম নেয়।…আর চাকরি তো তুমি এখানেও করতে পারো। স্কুল টুলে তো পাবেই। তুমি যা ব্রিলিয়ান্ট, ইজিলি রিসার্চে চান্স মিলবে। হয়তো আরও ব্রাইট প্রসপেক্ট…

কাকে কী বোঝাচ্ছ তানিয়া? হঠাৎই রাজার নেশাতুর স্বর ধেয়ে এসেছে,— শি ইজ ভেরি অ্যাডামেন্ট। নিজে যা চায়, সেখান থেকে একচুল নড়বে না।…কলেজ দেখায় আমায়? কলেজ? হুঁহ। ওই কলেজের মাইনেটা আমি ওকে হাতখরচা দিতে পারি।

ঘরের বাতাস সহসা স্থির। তানিয়া অপ্রস্তুত। সৌম্য নিশ্চুপ।

পারমিতার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল।

ফেরার পথে গাড়িতে গুম হয়ে বসে ছিল পারমিতা। মনে এত গরল পুষে রেখেছে, ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি রাজা? রোজ এত ফোন, হাসি, গল্প, পারমিতাকে দেখে গদগদ ভাব, মৌখিক ঔদার্য…অথচ তারই আড়ালে ক্ষোভের এই প্রমত্ত তুফান? মদের ঘোরে উঠে এল কি? নাকি নেশার অছিলায় মনটাকে বেআবরু করল রাজা?

ঊরুতে রাজার হাত। হঠাৎই।

পারমিতা সচকিত। নীরস স্বরে বলল,— কী হল?

তুমি কী খুব হার্ট হয়েছ? সরি। ভেরি সরি।

থাক। তোমার ভেতরটা তো জানা গেল…

বিলিভ মি, ওভাবে বলতে চাইনি। আমি কি তোমার সমস্যাটা বুঝি না? তবু… কেমন যেন গড়বড় হয়ে গেল। সব্বাই শালা কেমন বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘরসংসার করছে…সৌম্যদেরই তো কী চমৎকার হ্যাপি ফ্যামিলি…। একা আমিই শুধু…। রাজার গলাটা ভেজা ভেজা শোনাল,— আমারও কি ইচ্ছে করে না, বলো?

পাঁজরটা চিনচিন করছিল পারমিতার। কী অসহায় আর্তি! প্রতিটি শব্দ যেন পেরেক ঠুকছে হৃৎপিণ্ডে। এই মানুষের ওপর রেগে থাকতেও তো কষ্ট হয়।

পরদিন কলকাতা ফিরছিল পারমিতা। বিকেলবেলায়। রাজা পৌঁছে দিয়ে গেছে এয়ারপোর্টে। একটু আগে আকাশে উড়ল বিমান। পড়ন্ত সূর্য দর্শন দিয়েছিল ক্ষণিকের জন্য, তারপর কোথায় যে হারিয়ে গেছে। জানলার ওপারে এখন শুধুই পুঞ্জীভূত মেঘ।

পারমিতা আলতো ভাবে চোখের কোলটা মুছল। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে ভেবেছিল না এলে বুঝি মহামূল্য কিছু হারাত। হায় রে, এলেও যে কত কী হারায়!

.

০৯.

বৃষ্টি পড়ছিল ঝিরঝির। ক্যালেন্ডারের হিসেবে এখন পূর্ণ শরৎ, আশ্বিন পড়ে গেছে, তবে আকাশ দেখে তা বোঝা কঠিন। নীলের দেখা প্রায় মেলেই না। রোজই রাশি রাশি মেঘ, রোজ বর্ষণ। আজও সকাল থেকে মুখ ভার ছিল আকাশের, তারপর ঘণ্টাখানেক ধরে এই চলছে। একটানা।

পারমিতা ইউনিট টেস্টের খাতা দেখছিল। একটু আগে থার্ড ইয়ারের প্র্যাক্টিকাল শেষ হল, আজ আর থিয়োরির ক্লাস নেই, তাই বসেছে উত্তরপত্রের বান্ডিল নিয়ে। বয়ে নিয়ে যাওয়া পোষায় না, কলেজের কাজ যথাসম্ভব কলেজেই সেরে ফেলে। বাড়িতে তা হলে বইটই ঘাঁটার বাড়তি সময় মেলে খানিক।

কী রে, কী এত রাজকার্য করছিস?

পরিচিত কণ্ঠস্বরে পারমিতা ঘুরে তাকাল। দরজায় শর্বরীদি।

পারমিতা হেসে বলল,— ওমা, তুমি না লিভে ছিলে? কবে জয়েন করলে?

এই তো আজই। বলতে বলতে পারমিতার পাশের চেয়ারটিতে এসে বসল প্রাণীবিদ্যার শর্বরী। ব্যাগ টেবিলে রেখে বলল,— ক’দিন জোর ভুগলাম রে।

কী হয়েছিল গো? ভাইরাল ফিভার?

না রে, লাং কনজেশান। আমার ধাত আছে তো। অ্যান্টিবায়োটিকের লম্বা কোর্স করতে হল। এখনও শরীর বেশ দুর্বল।

আর ক’দিন রেস্ট নিলে পারতে।

মেডিকেল লিভ আর বেশি নেই রে হাতে। এখনও চার বছর চাকরি বাকি, কিছু জমিয়ে না রাখলে চলে! শর্বরী চেয়ারে হেলান দিল,— তোর কী খবর?

চলছে।

বাবা কেমন?

বলতে নেই… মাচ বেটার। ডান সাইডের সেন্সেশানটা ফিরছে। ডাক্তারবাবু তো ফিজিয়োথেরাপি এখন একবেলা করে দিলেন।

খুব ভাল। বিছানায় পড়ে থাকার চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু নেই।… আর তোর বরের কী সমাচার?

সে আছে তার মতো। আমি গেলাম, সেও গত শনি-রবি ঘুরে গেল…

তোর বরটা কিন্তু ভাল। আজকালকার ছেলে তো… অনেক বুঝদার। আমাদের বরদের মতো ঢ্যাঁটা নয়। তারা তো সব এক একটা ইগোর ট্যাবলেট।

রাজা কি সত্যিই আলাদা রকম? অত সরি টরি বলার পরেও তো মনে ক্ষোভটা ধিকিধিকি জ্বলছে। আর কেউ না বুঝুক, যতই তার সঙ্গে রাজা স্বাভাবিক ব্যবহার করুক, পারমিতা ঠিক টের পায়। চকিত আগুনের ফুলকি, হঠাৎ হঠাৎ গোমড়া হয়ে যাওয়া, রাজাকে কি চিনিয়ে দেয় না?

শ্বাস গোপন রেখে পারমিতা বলল,— সত্যিই কি ছেলেরা বদলেছে শর্বরীদি? নাকি বদলে যাওয়ার ভান করে? আচার-আচরণে জাস্ট একটা পালিশ পড়েছে?

তোর মুখে হঠাৎ এ হেন কমেন্ট? উঁহু, এ তো ভাল কথা নয়। বিষ্মিত শর্বরীর চোখ সরু হয়েছে,— কী ব্যাপার, অ্যাঁ?

না না, তেমন কিছু নয়।

বললেই হবে? তোর মুখ দেখে বুঝতে পারছি…। শর্বরীর দৃষ্টি তীক্ষ্নতর,— রাজর্ষি কি কোনও প্রবলেম করছে?

না গো। সে তো কখনই মুখে কিছু বলে না…। বাক্যটা উচ্চারণ করেও বেঙ্গালুরুতে সৌম্যদের ফ্ল্যাটের সেই রাতটা মনে পড়ে গেল পারমিতার। ঢোক গিলে বলল,— তবে কী জানো, একটা চাপ তো থাকেই।

কীসের চাপ? তোর বাবার এই অবস্থায়…

রাজর্ষির সেই ফিলিংটা আছে। পারমিতা সামান্য দ্বিধা নিয়ে বলল,— তবে … মাঝে মাঝে শোনায়, একা একা থাকতে হচ্ছে, খুব লোনলি লাগে… কনজুগাল লাইফ নেই…

হুম। সাইলেন্ট প্রেশার। এটাও একটা ট্যাকটিক্স। ইনিয়ে বিনিয়ে এমন করবে, যাতে তাদের মর্জিটাই স্ট্যান্ড করে। আর তাতেই তো বেশির ভাগ মেয়ে গলে যায়। শর্বরী হঠাৎ যেন জ্বলে উঠল,— তোরা এখনকার মেয়েরাও যদি একটু শক্ত হতে না পারিস…

কী করব বলো? কী করা উচিত?

সেটা তো তোমাকেই স্থির করতে হবে বাছা। নিজের গেমটা নিজেকেই খেলতে হয়। খেলার পদ্ধতিটাও অন্য কেউ বাতলাতে পারে না। শর্বরী শুকনো হাসল,— আমি শুধু বলতে পারি, আমাকে প্রচুর সাফার করতে হয়েছে, তবু আমি নিজের প্রিন্সিপলে স্টিক করে থেকেছি।

শর্বরীর অতীত মোটামুটি জানে পারমিতা। বনিবনা হয়নি বলে মেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছিল। ব্যারাকপুরে ঘরভাড়া নিয়ে বাস করছে বহুকাল। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, এখন শর্বরী একেবারেই একা। বর নাকি আসে মাঝে মাঝে, শর্বরীও কালেভদ্রে যায় শ্বশুরবাড়ি, কিন্তু এখনও দু’পক্ষে নাকি তেমন সদ্ভাব নেই।

পারমিতা অনুচ্চস্বরে বলল,— তোমাকে তো শ্বশুরবাড়ির টরচারে…

তারা তো নিমিত্তমাত্র। আসলে তো আমার বরই…। শর্বরীর ঠোঁট সামান্য বেঁকে গেল। একটু যেন দূরমনস্ক ভাবে বলল,— আমি আর আমার হাজব্যান্ড, দু’জনেই স্কুলে পড়াতাম। সে ইংরিজি, আমি বায়ো-সায়েন্স। কলেজ সার্ভিস কমিশানে অ্যাপ্লাই করে, পরীক্ষা টরিক্ষা দিয়ে এই চাকরিটা আমি পেয়ে গেলাম। প্রথমে কিছু বলেনি, কিন্তু লেকচারারশিপ পেতেই গোঁ ধরল, বেশ তো সংসার সামলে ঘরের দুয়ারে স্কুল করছ, ক’টা বাড়তি টাকার জন্যে বসিরহাট থেকে ব্যারাকপুর ছুটবে কেন! বোঝো আবদার, কলেজে চান্স পেয়েও স্কুলেই পড়ে থাকব! বারণ শুনলাম না, জয়েন করে গেলাম। তবে প্রতিদিন বসিরহাট ব্যারাকপুর… বছরখানেক পর আর ধকলটা সইছিল না। ব্রঙ্কিয়াল প্রবলেমটাও তখন থেকে শুরু। অগত্যা বরকে বললাম, চলো না বারাসতে গিয়ে থাকি। তোমার স্কুল আমার কলেজ দুটোই রিচের মধ্যে পড়বে। সে কিছুতেই রাজি হল না।

কেন? সলিউশানটা তো ভালই ছিল।

বললেই হবে? একেই স্কুলটিচারের অধ্যাপিকা বউ, তাতেই তার মান খোওয়া গেছে। তার ওপর সেই বউয়েরই সুবিধার্থে বাড়ি ছাড়তে হবে? মুখে অবশ্য যুক্তি দিল, বাড়িতে মা অসুস্থ, মাকে ফেলে যেতে পারব না। তা তার মা’র কী অসুখ? আর্থ্রারাইটিস। তিনি কিন্তু সেই রোগব্যাধি সমেত আশি পেরিয়ে এখনও বহাল তবিয়তে বর্তমান। তা ছাড়া বাড়িতে আমার বরের ভাই রয়েছে, বোনেরও শ্বশুরবাড়ি বসিরহাট টাউনে, সপ্তাহে না হোক তিনবার তখন যাতায়াত করত বাপের বাড়ি…। তাও আমার হাজব্যান্ড ওই অছিলাতেই অনড়। অটল। বুঝলাম, ভীষণভাবে চাইছে আমি যেন কলেজটা ছাড়তে বাধ্য হই।… আমিও তখন দিলাম টাইট। মাম্পিকে নিয়ে সোজা হাঁটা দিলাম ব্যারাকপুর। থাকো তুমি তোমার মা-ভাই নিয়ে।

তারপর?

পরে সে বহুবার সাধ্যসাধনা করেছে, আমি আর ব্যাক করিনি। করবও না। তুই ভাবতে পারবি না পারমিতা, যে শাশুড়ি একদিন আমার পিছনে আদাজল খেয়ে লেগেছিল… কলেজ থেকে ফিরে দেখতাম আমাকে দিয়ে মাজাবে বলেই বাসনকোসন ফেলে রেখেছে… পয়সা দিয়ে লোক রাখলেও ছাড়িয়ে দিত… এখন সেই মহিলাই কী মধুরভাষিণী! গেলে কী আদর, পাড়াপড়শিদের কাছে কত প্রশংসা…! বাড়ির দোতলা উঠছে, বউ সেখানে টাকা দিচ্ছে…! শর্বরীর বাঁকা হাসি চওড়া হল,— নীতিবাক্যটা বুঝলি?

পারমিতা ধন্দমাখা মুখে বলল,— কী বলো তো?

শেষপর্যন্ত মেয়েরা যদি লড়াই করে করে কোথাও একটা পৌঁছোতে পারে, তখন সবাই তাকে কুর্নিশ করবে। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত বাধা দেবে প্রাণপণ। …মনে আছে, বোধিলাভের আগে বুদ্ধকে কেমন ঘিরে রেখেছিল মারেরা? আমাদের, মেয়েদের, ওই মারের উপদ্রবটা সইতে হয়। খুব যন্ত্রণা হয় রে। আমাকেই তো বর ছাড়া একটা আধাখেচড়া সংসারে জীবনের আসল সময়টা কাটাতে হল। মেয়েটাও সেভাবে তার বাবাকে পেল না। কলেজেও কতরকম রসালো গল্প তৈরি হয়েছে। কোনও পুরুষ কলিগের সঙ্গে একান্তে দু’মিনিট কথা বললেও অন্যরা আড়ে আড়ে তাকাত। খারাপ লাগত, তবে ঝেড়েও ফেলেছি। আমি তো জানি আমি কী, সো হোয়াই শুড আই বদার?

কিন্তু…। পারমিতা না বলে পারল না,— ওই জেদ দেখিয়ে তুমি পেলেটা কী?

মেটিরিয়ালি দেখতে গেলে প্রায় কিছুই না। তবে হ্যাঁ, জীবনটা তো নিজের টার্মসে কাটাতে পেরেছি। একটা মেয়ের পক্ষে এই পারাটা কি একটা অ্যাচিভমেন্ট নয়?

তার জন্য ঝুঁকিও কম নাওনি। বরের সঙ্গে সম্পর্কটা তোমার ভেঙেও যেতে পারত।

হ্যাঁ, সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। তবু কী করে যেন রয়ে গেল। হয়তো আমার ওপর তার টান আছে। হয়তো আমিও তাকে ভালবাসি। নইলে তার অসুখ বিসুখের খবরে ছুটে ছুটে গেছি কেন? সেই বা কেন চলে এসেছে হঠাৎ হঠাৎ? নিজের অহং সেও জয় করতে পারেনি। আমিও না। বলেই ফিকফিক হাসছে শর্বরী,— তাতেই বোধহয় কাটাকুটি হয়ে গেছে।

অর্থাৎ তোমরা বেশ কাঠে কাঠে?

বলতে পারিস। কেউ আমরা কারওকে জমি ছাড়িনি, বুঝলি। ব্যাগ থেকে ইনহেলার বার করে ফসফস স্প্রে নিল শর্বরী। দু’-এক সেকেন্ড চোখ বুজে থেকে বাইরে তাকিয়েছে। বিড়বিড় করে বলল,— বৃষ্টিটা মনে হচ্ছে ধরল…। তুই কি উঠবি এখন?

বসে থেকেই বা কী করব? পারমিতা হাসছে,— খাতা দেখা তো আজকের মতো চৌপাট। চলো বেরিয়েই পড়ি।

ব্যারাকপুর লোকালে ফিরতে ফিরতে শর্বরীকে নিয়েই ভাবছিল পারমিতা। ওভাবেও তো জীবন কাটে স্বামী-স্ত্রীর। কিন্তু সেটা কি খুব সুখের? কেমন অস্বাভাবিক লাগে না? পারমিতা হলে কি এভাবে থাকতে পারত? আবার ধরাবাঁধা গার্হস্থ্য জীবনেও যে স্বামী-স্ত্রী সর্বদা সুখের সাগরে ভাসে, তেমনটাও তো নয়। এই তো, দিদিশাশুড়িই সেদিন বলছিল, সংসারের মূল রসায়ন হল বোঝাপড়া। আর সেটা হয় সমানে সমানে। সেখানে দু’পক্ষকেই কিছুটা করে ছাড়তে হয়। তা না হলে সম্পর্কটাই তো এবড়োখেবড়ো। দিদার নিজের বেলাতে নাকি এমনটাই ঘটেছিল। বরকে ব্যক্তিত্বে কাবু করে কলেজে পড়তে গিয়েছিল দিদা, পাঁচ বছরে তিন বার গর্ভধারণ করিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল সেই বর। এক ছাদের নীচে, এক বিছানায় শুয়েও, তাদের নাকি নীরব যুদ্ধ চলেছে আজীবন। সংসারের প্রতিটি কর্তব্যই করেছে দিদা, কিন্তু স্বামীকে কখনও মনেপ্রাণে ভালবাসতে পারেনি। এভাবেও তো চলে জীবন, নয় কি?

এতাল বেতাল চিন্তার মাঝেই ট্রেন শেয়ালদা ঢুকেছে। মহিলা কামরাতেও রক্ষা নেই, নামতে প্রাণান্ত। বাড়ি ফেরার জন্য মরিয়া মেয়েরা এমন কুৎসিত ধাক্কাধাক্কি করছে! প্ল্যাটফর্মটাও জলকাদায় প্যাচপেচে, জোরে পা চালাতে গেলেই আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা। শাড়ি সামান্য তুলে সন্তর্পণে হাঁটছিল পারমিতা। ব্যাগ-ছাতা সামলে। জনস্রোত কাটিয়ে কাটিয়ে। সাউথ স্টেশনে ক্যানিং লোকালের সিগনাল হয়ে গেছে, দৌড়ে গিয়ে কোনওক্রমে পা রাখল শেষ বগিতে। পুজোর কেনাকাটা সেরে ফিরছে অনেকে, ঠেসাঠেসি যেন তাই আরও বেশি, ঠেলেঠুলেও অন্দরে ঢোকা মুশকিল। তার ওপর এত নোংরা কীটপতঙ্গ কিলবিল করছে গায়ের কাছে… ওফ, নরকযন্ত্রণা! একটা গাড়ি ছেড়ে পরবর্তী ট্রেনের লেডিজ কম্পার্টমেন্টে চাপলেই ভাল হত।

যাদবপুরে নেমে পারমিতা বুক ভরে শ্বাস নিল। এদিকে বৃষ্টি বুঝি তেমন হয়নি, পথঘাট প্রায় শুকনো। রিকশায় যেতে যেতে পারমিতা দেখছিল দোকানপাট। এদিকেও পুরোদমে চলছে শারদীয় বিকিকিনি। মহালয়া এসে গেল, এবার পারমিতাকেও সেরে ফেলতে হবে পুজোর বাজার।

মোড়ের দোকান থেকে এক ভাঁড় রসমালাই কিনে নিল পারমিতা। এই মিষ্টিটা বাবা বেশি পছন্দ করছে ইদানীং। চপ-শিঙাড়াও নিল অল্প, মা’র জন্যে। মুখে যতই না না করুক, ভাজাভুজিটাই মা’র প্রিয় আইটেম।

দোতলার ফ্ল্যাটে বেল বাজাতেই ছোট্ট খুশির ঝলক। দরজা খুলেছে টুটান।

পারমিতা হরষিত মুখে বলল,— কী রে, তুই? কতক্ষণ?

এই তো, একটু আগে। এ-জি বেঙ্গলের খবরটা দিতে এসেছিলাম।

শুভেন্দুর প্রাক্তন সহকর্মীর কাছে গিয়েছিল সুমিতা। কয়েক দিন পর খোঁজ নিতে বলেছিল ভদ্রলোক। তা সুমিতার পক্ষে তো বারবার ছোটাছুটি সম্ভব নয়, টুটানই নিয়েছে দায়িত্বটা। ডালহাউসিতে টুটানের অফিস, টুপ করে সে হানা দিতে পারে।

চটি ছাড়তে ছাড়তে পারমিতা জিজ্ঞেস করল,— কী অবস্থা দেখলি রে? ক’ইঞ্চি এগোল?

তোর শ্বশুরের সুপারিশের ওজন আছে রে মিতুদি। ফাইল নেচে নেচে অফিসারের ঘরে ঢুকেছে। মনে হচ্ছে মালটা এবার নেমে যাবে।

গুড। ভেরি গুড। এমন একটা নিউজের জন্য তোকে তো মিষ্টিমুখ করাতে হয়। পারমিতা অনাবিল হাসল,— রসমালাই চলবে? সঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ নোনতা?

পারমিতার হাতের প্লাস্টিক ঝোলাটায় নজর আটকেছে টুটানের। চোখ বড় বড় করে বলল,— এনেছিস বুঝি?

সামান্য কিছু। পারমিতা গলা ওঠাল,— মা, ঠোঙা থেকে এগুলো ঢালো তো।

সুমিতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে। বলল,— এ হে হে, আমি তো টুটানের জন্য টোস্ট-ওমলেট বানিয়ে ফেলেছি!

তো কী? দু’রকমই হোক। ফেজ বাই ফেজ। প্রথমে মিতুদিরটাই আসুক।

প্লেটে চপ-শিঙাড়া সাজাচ্ছিল সুমিতা। ব্যাগ নামিয়ে পারমিতা বাবার কাছে এল। এ ঘরটায় একটু যেন অসুখ অসুখ গন্ধ থাকে সারাক্ষণ, তবু এখানে পা রাখলেই কেমন অন্যরকম হয়ে যায় মন। সারাদিনের খাটাখাটুনি, কলেজের খুচরোখাচরা টেনশান, নিজস্ব দুর্ভাবনা, পথশ্রমের ক্লান্তি, সব যেন পলকে উধাও। বাবাকে দেখামাত্র কী যে ভাললাগায় বুকটা ভরে ওঠে!

প্রণব আজ বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে। চোখ দরজায়, যেন শোনার চেষ্টা করছিল বাইরের কথাবার্তা। খাটের পাশে গিয়ে পারমিতা বলল,— কী গো, আজ কেমন?

লাগোয়া বাথরুমে কী যেন ধুচ্ছিল বিমলা। মুখ বাড়িয়ে বলল,— বাবুর আজ খুব আনন্দ।

শুধু বিমলাকে নয়, যেন প্রণবকেও জিজ্ঞেস করল পারমিতা,— কেন গো? ভাইপো এসেছে বলে?

সে তো আছেই। বাড়িতে যে কেউ এলেই বাবু বড্ড খুশি হয়। তার ওপর ওই দাদা আজ বাবুর জন্য নতুন পাঞ্জাবি এনেছে…

ওমা, তাই? পারমিতা বিছানায় বসল,— পুজোর জামা? তোমার পছন্দ হয়েছে?

শিশুর মতো ঘাড় হেলাল প্রণব। কী যেন বলারও চেষ্টা করল, পারল না। ধ্বনিটুকু বেরোল মাত্র।

পারমিতা বাবার হাতে হাত রাখল,— পাঞ্জাবিটা পুজোয় পরবে তো?

আবার ঢক করে নড়ল ঘাড়। উচ্ছ্বাসে খানিকটা লালা গড়িয়ে পড়ল কষ বেয়ে। খাটের বাজুতে রাখা তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছিয়ে পারমিতা বলল,— আমি কিন্তু পুজোয় তোমায় একটা অন্য জিনিস দেব। হুইল চেয়ার। তাতে চড়ে, নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, তুমি এবার ঠাকুর দেখতে যাবে।

প্রস্তাবটায় প্রণব বুঝি ভারী উত্তেজিত। মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠেছে। চিত্তচাঞ্চল্যের কারণে শ্বাস চলছে জোরে জোরে।

পারমিতা বাবার বুকটা আলতো ঘষে দিতে দিতে বলল,— ঠিক আছে, ঠিক আছে, শান্ত হও। …তোমার ফেভারিট মিষ্টি এনেছি, খাবে এখন?

দু’দিকে মাথা দুলছে প্রণবের। চোখ কী যেন ইশারা করছে। পারমিতা বলল,— বুঝেছি। এখন পেটভরতি, রাত্তিরে খাবে, তাই তো?

গলা বেয়ে ফের দুর্বোধ্য আওয়াজ। পারমিতা ঘুরে বিমলাকে জিজ্ঞেস করল,— বাবাকে বিকেলে কী দেওয়া হয়েছে?

দুধমুড়ি। অনেকটা খেয়েছেন।

গ্যাস ট্যাস হচ্ছে না তো?

না বোধহয়।

খেয়াল রেখো। …ডান হাতের ব্যায়ামটা করাচ্ছ তো রোজ?

হ্যাঁ গো দিদি, হ্যাঁ। আমার কাজে কখনও ফাঁকি দেখেছ?

হেসে ফেলতে গিয়েও সামলে নিল পারমিতা। চা-খাবার নিয়ে সুমিতা ডাকাডাকি করছে, বাবাকে ছেড়ে বাইরে এল।

টুটানের চপ-শিঙাড়া পর্ব শেষ। জমিয়ে টোস্ট-ওমলেট সাঁটাচ্ছে। চোখ নাচিয়ে পারমিতাকে বলল,— খা রে মিতুদি। তোর শিঙাড়া তো আধমরা হয়ে গেল।

হুঁ। পারমিতা সোফায় বসল,— বাবাকে কেমন দেখছিস?

ফাইন। শুধু কাকার স্পিচটা যদি এসে যেত…

হ্যাঁ রে, ওটাই তো ভাবাচ্ছে। সব অঙ্গেরই তো সাড় ফিরছে, শুধু ওটারই কোনও…

একটা মুষ্টিযোগ ট্রাই করতে পারিস। হিন্দি ফিল্মে দেখায় না… বছরের পর বছর বাক্‌রোধ হয়ে আছে, হঠাৎ একটা জোর শক খেল, ওমনি ঝটাকসে…

যাহ্, ফাজলামি করিস না। কী করলে সত্যি সত্যি চাঙা করা যায়, সাজেশান দে তো।

কাকা তো ধরে ধরে হাঁটে। ডাক্তারবাবুর অ্যাডভাইস নিয়ে একটা ওয়াকার ট্রাই কর। ওতে পেশেন্টেরও নিজের ওপর কনফিডেন্স বাড়ে।

ওতে নয় দেহের বল বাড়ল। কিন্তু মস্তিষ্ক…? স্পিচ…?

আমি তো তোকে বললাম, একটা স্ক্যান দরকার। সুমিতা ফস করে বলে উঠেছে,— একবার ডাক্তারবাবুকে বলে দ্যাখ না।

হবে, হবে। এর মধ্যেই হবে। হয়েছে কথা ডাক্তারবাবুর সঙ্গে। পারমিতা চা টানল। টুটানকে বলল,— হ্যাঁরে, তুই একদিন ছুটি নিতে পারবি?

স্ক্যানিং-এর দিন?

হুঁ। এমনি গাড়িতে নিতে না পারলে হয়তো অ্যাম্বুল্যান্স ডাকতে হবে। যদি কেউ একজন সঙ্গে থাকে…

নো প্রবলেম। জাস্ট একদিন আগে জানিয়ে দিস।

বেশ।

আরও একটুক্ষণ গল্প করে, বাবাকে আর একবার দেখে, বেরিয়ে পড়ল পারমিতা। টুটানের সঙ্গে। বাইরে আকাশ গাঢ় লাল, এদিকে বুঝি ঢালবে এবার। হাওয়া নেই এতটুকু, গরম লাগছে রীতিমতো। পারমিতা শঙ্কিতবোধ করল, গড়িয়া পৌঁছোনর আগেই না ঝমঝম নেমে যায়।

রাস্তায় এসে টুটান সিগারেট ধরিয়েছে। ধোঁয়া ছেড়ে বলল,— পুজোতে তুই নাকি কলকাতাতেই থাকছিস?

হ্যাঁ রে। একটা ঝামেলার কাজ পড়ে গেল।

কাকি বলছিল কী একটা কোর্স করবি বলে তুই নাকি রাজাদার কাছে যাচ্ছিস না?

ও, এসব গল্পো করা হয়ে গেছে মা’র! পারমিতা বিরক্তি চেপে বলল,— খুবই জরুরি ব্যাপার রে। না করলেই নয়।

রাজাদা কাঁইকাঁই জোড়েনি?

না তো। পারমিতা স্বর অচঞ্চল রেখে বলল,— সে নিশ্চয়ই সিচুয়েশানটা বোঝে।

বহুৎ কনসিডারেট কিন্তু তোর বর। আমি হলে চিল্লিয়ে ফাটিয়ে দিতাম। টুটান হ্যা হ্যা হাসছে,— আমার বউ অবশ্য খুব বাধ্য। বিয়ের আগেই বেড়াল মেরে রেখেছি কিনা। সাফ বলে দিয়েছিলাম, চাকরি টাকরি যা ইচ্ছে করো, তবে আমায় অবহেলা আমি বরদাস্ত করব না।

তুই তো দেখছি মহা এম-সি-পি?

যা খুশি বলতে পারিস। তবে সংসার একজনেরই কন্ট্রোলে থাকা উচিত। সেটা হাজব্যান্ডরাই বেটার পারে। চোখের কোণ দিয়ে টুটান দেখল পারমিতাকে। তারপর তরল সুরে বলল,— যাক গে, ফালতু বাত ছোড়। তোদের স্কুলের তো সেদিন বড় অ্যাড দেখলাম রে পেপারে!

হুম। পঁচাত্তর বছর হচ্ছে তো… তাই একটু ঘটা করে…

তোকে ডাকেনি?

গিয়েছিলাম একদিন। দেখলাম, বহুৎ দলাদলি। কেটে এসেছি।

বেশ করেছিস। ঝুটঝঞ্ঝাটে না থাকাই ভাল। সিগারেট শেষ করে পায়ে চেপে নেভাল টুটান। বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঘড়ি দেখে বলল,— চলি রে। স্ক্যান করার ডেটটা পেলে আমায় জানিয়ে দিস।

রাস্তা পেরিয়ে উলটো পারে এল পারমিতা। বরাত ভাল, মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটা অটোয় জায়গা মিলেছে। সামনে অল্প অল্প জ্যাম, হোঁচট খেতে খেতে চলেছে তেচাকা। বাঘাযতীনের মোড়ে পৌঁছে আর নো নড়নচড়ন। চারদিকে শুধু প্যাঁপো, ক্যাচোরম্যাচোর… কানে তালা লাগার জোগাড়। তারই মধ্যে আবছা ভাবে টের পেল ব্যাগে ফোন বাজছে। রাজার জন্য সংরক্ষিত বিশেষ রিংটোন। চটপট মোবাইল বার করল পারমিতা, কিন্তু ততক্ষণে কল শেষ। সেলফোনখানা পারমিতা হাতেই রাখল, ফের যদি বাজে…!

বাজল না। গড়িয়ায় নেমে নিজেই ফোন করল রাজাকে। নাহ, ব্যস্ত নয়, রিং হচ্ছে। রাজার গলা শোনা গেল,— ট্রেনে ছিলে বুঝি?

নাহ। যাদবপুর থেকে ফিরছি।

অ। কাজের কথা শোনো। বাবা মা আর তাতারের টিকিট তোমায় মেল করে দিয়েছি। ডাউনলোড করে নিয়ো।

সেই অপ্রিয় প্রসঙ্গ!

পারমিতা স্বর সহজ রেখে জিজ্ঞেস করল,— কবেকার টিকিট হল?

কলকাতা থেকে দ্বাদশীর দিন। ব্যাক, নভেম্বরের টেন্থ।

পারমিতা ঝটপট হিসেব করে দেখল। নভেম্বরের ছ’ তারিখ দেওয়ালি… অর্থাৎ উটির প্রোগ্রামটা হচ্ছেই! তাও কেন যে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,— বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলে নিয়েছ?

কী ব্যাপারে?

ওই সময়ে ভাইফোঁটা… মা তো প্রতি বছর…

এবার মা ভাইফোঁটা দেবে না। আমার রিকোয়েস্টটা রেখেছে মা।

ও।

ছাড়ছি তা হলে?

কী অদ্ভুত ভাবলেশহীন কণ্ঠস্বর! রাজার বলে চেনাই যায় না। একটুক্ষণ ঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পারমিতা। তারপর হাঁটছে ধীর পায়ে। নিজের জেদটাই তা হলে বজায় রাখল রাজা? এবার যখন রাজা এল, পারমিতা কত করে বলেছিল উটিভ্রমণ স্থগিত থাক এখন, বড়দিনে যাবে সবাই মিলে…। রাজা অনুরোধটা গ্রাহ্যই করল না? যেন তর্জনী তুলে বুঝিয়ে দিল পারমিতার খাতিরে সে কখনই সিদ্ধান্ত বদলাবে না! কী করা যাবে, রাজা যদি জেনেবুঝে অবুঝ হয়, পারমিতাও নিরুপায়!

নাহ্, বদলে যাচ্ছে রাজা, বদলে যাচ্ছে। রাতেও তো আজকাল ফোন করে না রোজ। যদি বা করে, যেন রুটিনের মতো। বাঁধা গতের সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতা। পারমিতাই বরং উপযাচক হয়ে প্রশ্ন করে নানারকম। রাজার অফিস নিয়ে, রাজার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে, রাজার খাওয়া দাওয়া নিয়ে…। কখনই রূঢ়ভাবে কথা বলে না রাজা, তবে জবাব কাঠকাঠই থাকে।

বুকটা ভার হয়ে যাচ্ছিল পারমিতার। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে চুপচাপ বসে রইল খানিকক্ষণ। কী যে করে এখন? কী করবে? রিফ্রেশার কোর্সটা ছেড়ে দিলে কি প্রশমিত হবে রাজার ক্ষোভ? তারপর? বাবাকে ফেলে পারমিতাকে বেঙ্গালুরু থাকার জন্য জবরদস্তি করবে, রাজা মোটেই এতটা নিষ্ঠুর নয়। পারমিতা জানে। তার চেয়ে এখন যেমন চলছে… রাজা কখনও এল, সেও গেল নিয়ম করে, ছুটিছাটায় ক’টা দিন বেশি কাটিয়ে এল… এভাবেই যদি তুইয়ে-বুইয়ে চলা যায়… যদি সম্ভব হয়…!

তাতার গুটিগুটি ঘরে ঢুকেছে। পিটপিট চোখে দেখছে মাকে। পারমিতা পাতলা হেসে বলল,— কী রে? বলবি কিছু?

ছুট্টে এসে মাকে জড়িয়ে ধরেছে তাতার। কৌতূহলী গলায় বলল,— তুমি বসে আছ কেন মা?

এমনিই…। ছেলের স্পর্শে একটু বুঝি সঞ্জীবিত হয়েছে পারমিতা। তাতারকে কোলে টেনে বলল,— আজ সারাদিন আমার তাতারসোনা কী কী দুষ্টুমি করেছে?

তাতার ঘটঘট মাথা নাড়ল,— কিচ্ছু না।

বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি?

না তো।

দাদুকে নিশ্চয়ই জ্বালিয়েছিস. তাস ঘেঁটেছিস দাদুর?

তাতার প্রবলভাবে মাথা দোলাল,— একবারও না।

ঠাম্মা টিভি দেখতে পেরেছে?

হ্যাঁ অ্যা অ্যা।

তা হলে দিনভর করলিটা কী?

ফুটবল খেলেছি। কার্টুন চ্যানেল দেখেছি। ড্রয়িং-এ কালার করেছি।

ওরে ব্বাবা, এত লক্ষ্মী ছেলে! পারমিতা তাতারের গাল টিপে দিল,— আর রং ভুল করছিস না তো?

উঁহু। ট্রি হল গ্রিন। সান ইয়েলো। স্কাই ব্লু।

ভেরি গুড। আজ তোকে একটা স্টোরি শোনাব।

কোনটা। লালকমল, নীলকমল? না ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী?

এটা একদম নতুন। তোকে বলিইনি। পারমিতা ছেলের গালে গাল ঘষল। তাতারের উষ্ণ ছোঁয়ায় মন স্থিত হয়েছে খানিক। বুঝি বা এটাও এক ধরনের আশ্রয়। হৃদয়পীড়ার উপশম। মধুর হেসে বলল,— চল, আর দেরি নয়, খেতে খেতে গল্প শুনবি।

এমা, আমার খাওয়া তো হয়ে গেছে!

তাই নাকি? কখন?

এই তো, একটু আগে। ঠাম্মা বলল, তোর মা’র ফেরার কি কোনও ঠিক-ঠিকানা থাকে! রোজ রোজ তার অপেক্ষায় বসে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই!

পারমিতা দুম করে তেতে গেল। একটা বাচ্চার সামনে এ কী ধরনের কথাবার্তা? এমন কী রাত করেছে সে আজ? সবে তো আটটা চল্লিশ! এক এক দিন তো তাতার এই সময়ে খেতে বসে!

অভ্যেস মতো রাগটা গিলেও নিল পারমিতা। ঝগড়াঝাঁটি তার ধাতে নেই, শাশুড়িকে গিয়ে বলল না কিছু, তবে তাতারকে আর ছাড়ল না। প্রায় চেপে ধরে শুইয়ে দিয়েছে। চট করে পোশাক বদলে নিজেও এল ছেলের পাশে। শোনাচ্ছে গল্প। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার। তাতারকে নিয়ে একটাই সুবিধে, পুরো কাহিনি তাকে বলতে হয় না, তার আগেই সে পৌঁছে যায় ঘুমের দেশে।

নিদ্রিত তাতারের মাথা বালিশে তুলে দিয়ে পারমিতা বিছানা ছেড়ে উঠল। অন্তরের কোন অন্তঃস্থলে এখনও যেন তুষের আগুন জ্বলছে সংগোপনে। চোয়ালে চোয়াল কষে পারমিতা বসল কম্পিউটারে। মেলবক্স খুলে বার করেছে টিকিট। ছেপে নিল প্রিন্টারে। তারপর কাগজখানা হাতে গেছে মানসীদের ঘরে।

মানসী আলমারি খুলে কী যেন করছিল। শুভেন্দু নোটবুকে দিনের হিসেব লিখছে। ঘুরে তাকিয়ে মানসী বলল,— কী গো, কিছু বলবে?

পারমিতা নিরুত্তাপ স্বরে বলল,— মা, এই প্রিন্ট-আউটটা আপনাদের কাছে রাখুন।

কী ওটা?

আপনার, বাবার আর তাতারের প্লেনের টিকিট। কেটে কেটে বলল পারমিতা, রাজা পাঠিয়েছে।

ও। মানসী একবার টেরিয়ে দেখল শুভেন্দুকে। বিরস মুখে পারমিতাকে বলল,— তা হলে আমরা তিনজনই যাচ্ছি শেষপর্যন্ত?

সেইরকমই তো স্থির হয়েছিল।

তোমার গোঁ থেকে তুমি তা হলে নড়লে না?

ও কথা উঠছে কেন? পারমিতার গলায় ঝাঁঝ এসেই গেল,— আপনি তো জানেন কেন আমি যাচ্ছি না। যেতে পারছি না। আপনার ছেলেকেও সেটা বলেছি। সে মেনেও নিয়েছে।

হুঁহ, না মেনে তার উপায় আছে! তার ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে তুমি থোড়াই মান্য করো।

ন্যায্য হলে নিশ্চয়ই করি মা। আমার সুবিধে-অসুবিধেগুলোও তো তাকে বুঝতে হবে।

তুমি তার সুবিধে-অসুবিধে বোঝো? বোঝার চেষ্টা করেছ কখনও? বরং তোমাকেই তো সে শুধু সুতো ছেড়ে যাচ্ছে। সবটাই তো একতরফা।

আমি তর্ক করতে চাই না মা। টিকিটটা রইল, রেখে দিন।

বলে পারমিতা বেরিয়ে আসছিল, ফের মানসীর কণ্ঠ উড়ে এসেছে,— কাজটা কিন্তু ভাল করলে না। চাকরির বাহানা দেখিয়ে মেয়েমানুষের এই ধরনের একগুঁয়েমি শোভা পায় না।

ছাড়ো না মানসী। কেন কথা বাড়াচ্ছ? শুভেন্দু চোখ কুঁচকে তাকিয়েছে,— তার যদি বরের কাছে যেতে ইচ্ছে না করে, তুমি তো ঘেঁটি ধরে নিয়ে যেতে পারো না!

সেটাই উচিত। আমার ছেলেটা নরম সরম বলে পার পেয়ে যাচ্ছে। অন্য কোনও বর হলে…

ছিটকে নিজের ঘরে চলে এল পারমিতা। হাঁপাচ্ছে। শ্বশুর-শাশুড়ির মন্তব্যগুলো যেন চিপে ধরছে ফুসফুস। এক-দু’দিন নয়, প্রায় পাঁচ বছর ধরে পারমিতাকে দেখছে রাজার বাবা-মা, তার পরেও পুত্রবধূ সম্পর্কে এই ধারণা? এত শ্রম দান, মন জুগিয়ে চলা… সবই তা হলে নিষ্ফলা? যুক্তি দিয়ে কেউ কিছু বিচার করবে না? পারমিতার অবস্থাটা ভাববে না?

মোবাইল বাজছে। ওফ, এখনই বাজতে হল? অভ্যস্ত ধ্বনি কী উচ্চকিত হয়ে আঘাত করছে কানের পরদায়!

পারমিতা ঝাং করে সেলফোন তুলল। মনিটরে মা। তীক্ষ্ন স্বরে পারমিতা বলল,— কী হল? হঠাৎ?

অ্যাই, তখন কথায় কথায় বলতে ভুলে গেলাম… টুটান তো আমাকেও একটা শাড়ি দিয়েছে রে।

তো?

তোর জেঠিমাকেও তো তা হলে একটা শাড়ি দেওয়া উচিত। ঠিক কি না? তাই ভাবছিলাম, আমি যদি বেরিয়ে কিনে আনি, কিংবা তুই…। জানিসই তো, সে লাল বাদে হালকা হালকা রং পরে…

আহ, মা! পারমিতা ঝামটা দিয়ে উঠল,— আলোচনাটা কি এতই জরুরি যে এক্ষুনি করতে হবে? একটু শান্তি দাও না মা। জ্বালিয়ো না তো সব সময়ে।

মোবাইল বিছানায় আছড়ে ফেলল পারমিতা। ফুলছে নাকের পাটা। দপদপ করছে কপালের শিরা। ক্ষণ পরে হুঁশ ফিরেছে। ছি ছি, এ কী আচরণ করল সে মা’র সঙ্গে? নিজের সমস্যার ঝাল মা’র ওপর মেটাচ্ছে? কেন সে বশে রাখতে পারছে না স্নায়ু? খারাপ, খারাপ। খুব খারাপ।

বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। মুষলধারে। বারিধারার শব্দটা যেন নিজের ভেতরেও শুনতে পাচ্ছিল পারমিতা।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *