০১. আজ বাড়ি ফেরা হবে না

রাতে যে আজ বাড়ি ফেরা হবে না, হিসেবে ছিল না তন্নিষ্ঠার। সকলে মিলে এমন জোরাজুরি শুরু করে দিল! মালবিকা হাত ধরে বলছে তনু প্লিজ, বন্ধুরা টানাটানি করছে, রাতভর চলবে অনন্ত হা হা হি হি—এসব ফেলে চলে যেতেও কি মন চায়! এমনিই তো কলেজ ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ এখন, মালবিকার বিয়ে উপলক্ষে তাও অনেক দিন পর কজন একসঙ্গে মিলল, আবার তারা কবে একত্র হবে তার ঠিক কী!

সাড়ে এগারোটা বাজে। সুসজ্জিত বিশাল হলঘরের কোণে রাখা ঢাউস বক্সদুটো সন্ধে থেকে নিচু গ্রামে সানাই-এর বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছিল, থেমেছে এইমাত্র। খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ, কেটারারের লোকজন বাসন গোছাচ্ছে। উজ্জ্বল আলোকিত ঘরে যত্রতত্র ভ্রাম্যমাণ গুটিকয়েক পুলক-ক্লান্ত নিকটাত্মীয়, লম্বা লম্বা সোফায় এদিক ওদিক ঘুমন্ত বাচ্চা, এলোমেলো ছড়ানো চেয়ার, পায়ে পায়ে মলিন হয়ে আসা শ্বেতশুভ্র চাদরে রঙিন কাগজের টুকরো, গড়াগড়ি খাওয়া শূন্য কোল্ড ড্রিংকসের বোতল, পিষে যাওয়া ফুল, ছেঁড়া মালা, বাতাসে চাপা আঁশটে গন্ধ—বিয়েবাড়ি এখন ভাঙা হাট।

অনেকক্ষণ আগেই ভেলভেটের সিংহাসন থেকে নেমে পড়েছিল মালবিকা সুপ্রিয়, তারা এখন রাজা রানির মতো বন্ধুদের মাঝে আসীন। জোর গজল্লা চলছে। উদ্দেশ্যহীন সংলাপের সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে হাসি। বিচিত্র বিভঙ্গে। কেউ লুটোপুটি খায়, কেউ পাশের জনকে কিল মারে, কেউ বা পাগলের মতো মাথা ঝাঁকায়, কেউ দাঁত বার করে শুধু ফিঁচ ফিঁচ।

তার মধ্যেই মালবিকার ছোটমাসি কোত্থেকে যেন উড়ে এল। হাতে কাচের প্লেট, তাতে ইয়া বড় বড় রাজভোগ। সুপ্রিয়কে বলল,—হাঁ করো, মালা তোমাকে এটা খাইয়ে দিক।

ব্যাঙ্ক-অফিসার সুপ্রিয় বেশ রগুড়ে ধরনের ছেলে, এতক্ষণ মাঝে মাঝে টুকরো টাকরা জোক শোনাচ্ছিল, রাজভোগের সাইজ দেখে সে প্রায় আঁতকে উঠল—ওই জিনিস আমায় গিলতে হবে?

—বারে, বউ মিষ্টিমুখ করাবে না? নাও নাও, হাঁ করো। এই মালা, তোল না একটা।

—ওই মিষ্টি গিলতে যে আমায় জলহস্তীর হাঁ করতে হবে মাসি!

—করবে। জলহস্তী না হলেও তুমি আজ গণ্ডার তো বটে। সব সহ্য করতে হবে।

সুপ্রিয়র দুই বন্ধুও থেকে গেছে রাতে। প্রত্যুষ আর অভিমন্যু। প্রত্যুষ একটু বাচাল ধরনের, হাস্যরোলের মাঝে ফস করে বলে উঠল,—রাজভোগ কেন? মালবিকা অন্যভাবে মিষ্টিমুখ করাক।

—সে তো করাবেই। তাড়া কীসের? মালবিকার মাসিও তুখোড় মহিলা, ঝপ করে ঘুরে তাকিয়েছে প্রত্যুষের দিকে,—অ্যাই ছেলে, তোমার বিয়ে হয়েছে?

—কই আর। ওই আশায় আশায় তো এখানে আসা। যদি একটা কোনও খেঁদিবুঁচি জুটে যায়!

—খুব বুলি, অ্যাঁ? পিট পিট চোখ ঘোরাল মালবিকার মাসি,—এই তন্নিষ্ঠা, এই কোয়েল, এই পর্ণা, তোরা বাসর করছিস না? এটাকে ভাল করে রগড়াস তো।

ঈপ্সিতা সবার আগে বলে উঠল,—ও ফাইন। অফকোর্স উই ক্যান হ্যাভ এ বাসর। টু হ্যাভ সাম মজা। আইডিয়াটা হোয়াই ডিডনট কাম আগে?

শেখর পাশ থেকে আলগা চাঁটি মারল ঈপ্সিতাকে,—অ্যাই, ল্যাংগোয়েজটা ঠিক কর।

—কেন, আমি কী ভুল বলেছি?

বিচিত্র উচ্চারণে বাংলা বলে ঈপ্সিতা। সুপ্রিয়ও মুখ টিপে টিপে হাসছে। তবে বাসরের প্রস্তাবটা ধরে গেছে। আজকাল বেশির ভাগ পরিবারেই শালা-শালির সংখ্যা অপ্রতুল, বাসর জাগতে বন্ধুরাই ভরসা।

হলের লাগোয়া বড়সড় ঘর আছে একখানা। হইহই করে সকলে এগোচ্ছিল সেদিকে, তন্নিষ্ঠা দু পায়ে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল,—তোরা যা, আমি একটু নীচ থেকে আসছি।

মালবিকা উৎকণ্ঠিত চোখে তাকাল,—কেন, নীচে কী আছে?

—একটা ফোন করতে হবে বাড়িতে। পাশে এস টি ডি বুথ আছে না?

—কী দরকার এত রাতে ঝামেলা করার? মাসিমা মেসোমশাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওঁরা জানেন আমার বিয়েতে এসে তোকে থেকে যেতে হবে।

সুপ্রিয় আজ থেকে একজন বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরুষ। মুখে চোখে সে ভারিক্কি ভাব আনল,—না না, ফোন করে দিয়ে আসাই তো ভাল। তাঁরা যদি অনর্থক টেনশান করেন, সে ভারী বিশ্রী ব্যাপার হবে।

প্রত্যুষ গলা বাড়াল,—আমি কি সঙ্গে যাব?

তন্নিষ্ঠা মুচকি হাসল,—লাভ কী? আমি তো খেঁদিবুঁচি নই।

প্রত্যুষ পাল্টা জবাব ছোড়ার আগে তন্নিষ্ঠা হরিণপায়ে সিঁড়িতে। আজ তার তরতরিয়ে নামার উপায় নেই। একে শাড়ি পরার অভ্যাস, তায় পরনে বেজায় ভারী মার ব্রোকেড বেনারসি। জুতোর হিলটাও কদিন ধরে গড়বড় করছে, বেঁকে বেঁকে যায়।

ভাড়া করা বিয়েবাড়ির গেটে রোগা কনস্টেবলটা এখন টুলে বসে ঢুলছে। মালবিকার বিয়ের সেপাই! খুব সাঁটিয়েছে লোকটা, পাতে ফিশফ্রাই উপচে পড়ছিল, তন্নিষ্ঠা স্বচক্ষে দেখেছে। লোকটাকে টপকে ফুটপাথে এসে তন্নিষ্ঠা বড় করে একটা শ্বাস টানল। ওপরে আনন্দ হল্লা সবই মোহনীয়, তবে খোলা হাওয়ার স্বাদই আলাদা। কী চমৎকার এক মলয় বইছে, আহা। নাহ্, এই মধুমাসেই বিয়ে করা সার্থক। মালবিকাটা জিতে গেল।

চারদিক সুনসান, সমস্ত দোকাপনাটের ঝাঁপ বন্ধ, লোকজন প্রায় চোখেই পড়ে না। গলিতে গোটা তিন চার টানারিকশা নিথর, চালকরা ধারেকাছে কেউ নেই। ফাঁকা রাস্তায় সিংহের মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা ক্ষয়াটে নেড়ি কুকুর। ফুটপাথবাসীরা ধার ঘেঁষে শয্যা পেতেছে, ডুবে গেছে গাঢ় নিদ্রায়। বড় রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। সামনের বৃত্তাকার পার্ক ঘিরে পর পর টিউবলাইট, বহমান রাজপথের ধারে শ্রেণীবদ্ধ হ্যালোজেন রোশনাই। আলোময় এই শহর কেমন যেন রহস্যময় এখন।

তন্নিষ্ঠা তেমন একটা গয়না পরেনি। গলায় সরু নেকলেস, কানে ঝুমকো, হাতে চওড়া বাউটি, ব্যস। তবু আঁচলটা ভাল করে জড়িয়ে নিল গায়ে, রাস্তা পার হয়ে ওপাশের এস টি ডি বুথে গেল।

শাটার অর্ধেক নামানো, ভেতরে এক মাঝবয়সী লোক টিফিন-কেরিয়ার খুলে যাচ্ছে। রুটি, আলু ভেণ্ডির সবজি, কাঁচা পেঁয়াজ।

তন্নিষ্ঠা গলা খাঁকারি দিল,—দাদা, একটা ফোন করা যাবে?

খেয়ে চলেছে লোকটা, চোখ তুলল না। বিরস স্বরে বলল,—সেই জন্যই তো খোলা আছে। লোকাল, না বাইরে?

—লোকাল।

অবহেলা ভরে কাউন্টারের ওপরে রাখা টেলিফোন এগিয়ে দিয়েছে লোকটা। তন্নিষ্ঠা ভেবেছিল বাবা ফোন ধরবে। অনেক রাত্রি অবধি জেগে থাকে বাবা। বইপড়ার নেশা। কিন্তু ওপারে মা।

তন্নিষ্ঠার কথা পুরো শোনার আগেই নন্দিতা কড়া গলায় বলল,— তুমি কিন্তু খুব ইরেসপনসিবল হয়ে যাচ্ছ তিন্নি। অনেক আগে তোমার ফোন করা উচিত ছিল।

—সরি মা। তন্নিষ্ঠা সামান্য কুঁকড়ে গেল,—অনেকক্ষণ ধরেই করব করব ভাবছি। কিছুতেই…হইচই-এর মাঝে বেরনো যায়!

—বুঝেছি। সব ভাল মতো চুকেছে?

—হ্যাঁ।

—ওখানে শোয়ার কোনও প্রবলেম হবে না?

—শোয়া হবেই না। এখনই বাসর শুরু হবে।

—ও। সকালে দেরি কোরো না। কাল আমি একটু তাড়াতাড়ি অফিস বেরোব, তার আগে দয়া করে চলে এসো।

মা আজ একটু গরম মনে হচ্ছে? বাবার সঙ্গে কিছু হল নাকি আবার?

তন্নিষ্ঠা কথা বাড়াল না। শুধু বলল,—আমি আটটার মধ্যে পৌঁছে যাব।

আহার পর্ব শেষ, লোকটা কাউন্টারের ওপারে মাদুর চাদর বিছিয়ে ফেলেছে, এবার শোবে বোধহয়। পয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে এল তন্নিষ্ঠা।

হলঘরে ঢুকতে গিয়ে তন্নিষ্ঠা থমকাল একটু। বিশাল কক্ষে এখন মাত্র দুজন মানুষ। মালবিকার বাবা কেটারারের সঙ্গে বসে হিসেবনিকেশ করছেন। কী যেন বলছে কেটারার ভদ্রলোক, দুদিকে জোরে জোরে মাথা নাড়ছেন মালবিকার বাবা। মৃদু তর্কাতর্কি হচ্ছে যেন? অনুষ্ঠান চুকলেও কত যে ঝঞ্ঝাট থাকে!

তন্নিষ্ঠা সরে এল। বাসর জমজমাট, পর্ণা গান গাইছে খোলা গলায়। নজরুলগীতি। সই, ভাল করে বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে…! রীতিমতো রেওয়াজ করা গলা পর্ণার, চোখ বুজে শুনলে ফিরোজা বেগম বলে ভুল হয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে সকলে। শুধু প্রত্যুষ নামের ওই বকবক ষষ্ঠীটা ভুল তালে মাথা দুলিয়ে চলেছে। পারেও! জোকার। তুলনায় সুপ্রিয়র অন্য বন্ধুটা, অভিমন্যু না কী যেন নাম, অনেক পদের। সোবার। দেখতেও মন্দ নয়। চেহারা লম্বার দিকে, চওড়া কাঁধ, গালে সযত্নলালিত দাড়ি, চোখে হাইপাওয়ারের চশমা। বাদামি মুখমণ্ডলে একটা কাঠিন্যের ছাপ আছে। চোখ বুজে বসে আছে এখন, ভঙ্গিটি ধ্যানী সাধকের। কায়দা মেরে ঘুমোচ্ছে না তো?

পর্ণার গান শেষ, সঙ্গে সঙ্গে তুমুল হাততালি। প্রত্যুষ মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করল,—মহাশয়ার নাম জানতে পারি?

—পর্ণা।

—কী?

—পর্ণা। আমি পর্ণা মুখার্জি।

—কী পর্ণা? ঋতু শ্রী সু মধু বিদ্যুৎ কিছু একটা তো আছে সঙ্গে?

—কিছু নেই। আমি শুধুই পর্ণা। আপত্তি আছে?

—বিন্দুমাত্র না। আমি পছন্দসই কিছু একটা জুড়ে নেব। প্রত্যুষ ফিচেল হাসল,—আমি কি মহাশয়ার কাছে আমার ক্যান্ডিডেচার পেশ করতে পারি?

মালবিকা খিলখিল হেসে উঠল, —ও অলরেডি বুকড্। ওর উড বি এখন ব্যাঙ্গালোরে। সামনের জুলাইতে আসছে, পক্ষীরাজে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে।

—ওফ্, হাফসোল্। কৃত্রিম বেদনায় বুকে হাত চাপল প্রত্যুষ। মালবিকার দিকে ফিরে বলল,—ঝোপে ঝাড়ে কুড়ল চালিয়ে লাভ নেই। গোড়াতেই ক্লিয়ার করে দাও তোমার বন্ধুদের মধ্যে কে কে ফ্রি আছে।

—চিন্তায় ফেললেন। মালবিকার ভুরুতে নকল ভাঁজ, —কোয়েলকে দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ওর সিগনাল পড়ে গেছে। ওর বর তথা বর্বর ওই শেখর, আপনার পাশেই বসে৷ সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে লটঘট, গত বছর পিঁড়িতে বসেছে।… আঁখি এখন গলাজলে, এক পেঁপে চোর থুড়ি প্রফেসার ওকে নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছে।… আর ওই যে দেখছেন পেছনে ঘাপটি মেরে বসে, তন্নিষ্ঠা, ওরও সব ঠিকঠাক। কী কারণে যেন তোদের বিয়েটা পিছিয়ে গেল রে তনু?

হট্টমেলায় নিজের প্রসঙ্গ এসে পড়ায় অস্বস্তি বোধ করল তন্নিষ্ঠা। তবু সপ্রতিভ ভাবেই বলল, —শৌনকের দাদু মারা গেছেন, তাই…। কালাশৌচ।

—দাদু মারা গেলে এসব হয় নাকি? দাদু তো অন্য গোত্র! সুপ্রিয় বিজ্ঞের মতো বলল।

—দাদু মানে বাবার বাবা। ঠাকুরদা।

—ও, তাই বলো। তা প্রায়শ্চিত্ত করে নিলেই তো হয়।

অনেকক্ষণ পর, এই প্রথম, অভিমন্যু কথা বলে উঠল,—কালাশৌচ টৌচ আজকাল আবার কেউ মানে নাকি?

শেখর লঘু গলায় বলল,—যে মানে, সে মানতেই পারে। একটু আধটু দেশি কাস্টম তো আমাদের মানাই উচিত।

—সিলি কাস্টম। অপ্রয়োজনীয় রীতিনীতি।

—কোনও রীতিনীতিই আকাশ থেকে পড়ে না, সব আমাদের জন্য তৈরি। সবেরই কিছু প্লাস পয়েন্ট আছে। শেখর তর্ক জুড়েছে, —পরিবারের একজন মারা গেছে, তাকে সম্মান জানাতে হবে না?

—সরি। মানতে পারলাম না। কালাশৌচ বলে কোন আমোদ প্রমোদটা আজকাল বন্ধ থাকে শুনি? বাড়িতে একটা বিয়ে হলে মৃত মানুষকে বুঝি অসম্মান করা হয়?

—এগজ্যাক্টলি। ঈপ্সিতা মাথা দোলাল,—সম্মান কামস্ ফ্রম হৃদয়। সোশাল ফাংশান স্টপ করে দেওয়াটা বোগাস ব্যাপার।

—আচ্ছা, কালাশৌচ চলতে চলতে যদি আর একজন মারা যায়, তনুর বিয়ে আবার এক বছর পিছোবে? আঁখি চোখ টিপল,—এই করতে করতে দেখা যাবে তনুর বিয়েটাই হয়তো আর হল না?

—আমার কী মনে হয় জানেন? অভিমন্যু গলা ঝাড়ল,—ওই সব বস্তাপচা নিয়মকানুনগুলো টান মেরে নর্দমায় ফেলে দেওয়া উচিত। যত্ত সব প্রাগৈতিহাসিক রিচুয়াল।

শেখর হাত ওল্টালো, —সেভাবে ধরতে গেলে তো মন্ত্র পড়ে বিয়েরও কোনও মানে হয় না।

—হয় না-ই তো। যে লোকটা আওড়ায় সেও অর্থ বোঝে না, যারা শোনে তারাও না। মন্ত্রগুলো আমাদের কাছে অং বং চং ছাড়া আর কী? এই যে সুপ্রিয় এতক্ষণ নিষ্ঠাভরে মুখ ব্যথা করল, ওকে জিজ্ঞেস করুন ও কটা শব্দের মানে জানে?

মালবিকা মিনমিন করে বলল, —তবু শাস্ত্রে যা আছে, তা তো একটু আধটু পালন করতেই হবে।

—শাস্ত্র? হোয়াট ইজ শাস্ত্র? আজ থেকে হাজার দুহাজার বছর আগের মানুষজন নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি মতো যে সব নিয়ম বিধান তৈরি করে গেছে, তাকে অন্ধ ভাবে অনুসরণ করার নাম শাস্ত্ৰপালন? সময় কি এগোয়নি? মানুষ কি এখনও ঠুলি পরে থাকবে? খতিয়ে দেখবে না ওগুলোর এখন আর কোনও ইউটিলিটি আছে কি না? অভিমন্যু হঠাৎই বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে, —ওই শাস্ত্রই আমাদের মাথা খেল। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে এমন কতকগুলো জোলো সংস্কার এখনও অনড় হয়ে বাসা বেঁধে আছে! সাধে কি আজকাল ধর্মব্যবসায়ীদের এত রমরমা?

—ও, আপনি এথিষ্ট! শেখরের ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি।

—আমি কী, সেটা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু শাস্ত্র ধর্ম, এগুলো কী সে তো আমাদের জানা দরকার। যত্ত সব মানুষকে সুড়সুড়ি দেওয়ার চাবিকাঠি!

প্রত্যুষ এতক্ষণ পেণ্ডুলামের মতো এদিক ওদিক ঘাড় দোলাচ্ছিল। হঠাৎ কটমট করে অভিমন্যুর দিকে তাকিয়েছে, —অ্যাই অভি, এটা তোর বিজ্ঞান মঞ্চ নয়। অনেক হয়েছে, আর নো জ্ঞান মারা। বলেই নাটুকে ভঙ্গিতে মালবিকার দিকে ফিরেছে,—কীসের থেকে কী হইল, মোহন পলাইয়া গেল! লেকচারের গুঁতোয় আমার কেসটাই ভোগে?

পায়রা ওড়ানো হাসি উঠল আবার। পলকে বাসর স্বাভাবিক ছন্দে। মালবিকা স্মিত মুখে বলল, —না স্যার, ভুলিনি।… তন্নিষ্ঠা তো ফস্‌কে গেল। হাতে পড়ে রইল পেন্‌সিল। মানে ঈপ্সিতা।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, ঈপ্সিতা খালি আছে।

—ওরেব্বাস, আমি বাংরেজি বলতে পারব না।

ঈপ্সিতা মুখ বেঁকাল, —আমার বয়েই গেছে।

—বাহ্, এই তো বেশ বাংলা বলে!

—আই ক্যান স্পিক বাংলা বেটার দ্যান ইউ। বলি না, আই ডোন্ট ফিল লাইক, তাই।

—আহা রে, আমার বাংলা মায়ের অ্যাংলো মেয়ে!

চোখে আগুন হেনে ঈপ্সিতা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কোয়েল প্রায় মুখ চেপে থামাল তাকে। মোটাসোটা গোলগাল চেহারার ঈপ্সিতা ধনীর দুলালী, বাবার নাকি তিনটে টিগার্ডেন, বাড়িতে তাদের নিখুঁত বিলিতি ঠাটবাট। তবে মুখের ভাষা যেমনই হোক, মনটা তার ভারী সাদামাঠা। ইউনিভার্সিটি গিয়ে সে দিব্যি এসব মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে, খুচরো ঠাট্টা-তামাশা উপেক্ষা করেই। এমন আনন্দের মুহূর্তে সে চটেমটে একটা সিন ক্রিয়েট করুক, কোনও বন্ধুরই তা অভিপ্রেত নয়।

আবার হাসিমস্করা চালু। ক্ষণপূর্বের মিতভাষী রাগী যুবক অভিমন্যুও এবার টুকটাক ফুট কাটছে। তাঁরই ফাঁকে ফাঁকে চলছে মালবিকা আর সুপ্রিয়র চোরা শুকসারি-সংলাপ। দুটিতে বেশ ভাব হয়ে গেছে। মালবিকার চন্দনশোভিত মুখে গভীর তৃপ্তির ছাপ। দেখে ভাল লাগছিল তন্নিষ্ঠার। সম্বন্ধ করে বিয়ে, মালবিকা মনে হয় সুখীই হবে।

পুরনো কথা উঁকি দিয়ে গেল তন্নিষ্ঠার মনে। বড়সড় একটা ল্যাং খেয়েছিল মালবিকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়। অনিন্দ্য বজ্জাতটার সঙ্গে বেশ একটা মাখো মাখো ব্যাপার ঘটেছিল মালবিকার। ক্যান্টিন কফিহাউস গঙ্গার পাড় সিনেমা হল নন্দনচত্বর, সর্বত্রই মালবিকা আর অনিন্দ্য। বলা নেই কওয়া নেই, অনিন্দ্য দুম করে কেটে পড়ল অস্ট্রেলিয়ায়। মাঝে এক দু-বার এসেছিল, মালবিকার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কিছু নিশ্চয়ই হয়েছিল, মালবিকা মুখ ফুটে বলে না। মাঝে কেমন যেন বিষাদপ্রতিমা হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। সুপ্রিয় নিশ্চয়ই মালবিকার মন থেকে অনিন্দ্যকে মুছে দিতে পারবে।

পর্ণা আবার গান ধরেছে। সমবেত দাবিতে হিন্দি। ফিল্মি গান, তবে ছন্দটি ভারী সুরেলা। আলাপচারিতাও চলছে, নিচু পর্দায়। শেখর এম এ করার পর প্রাইভেটে ম্যানেজমেন্টের কোর্স করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে সফ্‌টওয়্যার ট্রেনিংও, চাকরি পেয়েছে নামী ফিনান্স কোম্পানিতে। অফিস তার ধ্যানজ্ঞান, এই বাসরেও সে অফিসের সমস্যা সাতকাহন করে শোনাচ্ছে সুপ্রিয়কে। বুঝদারের মতো মাথা নাড়ছে সুপ্রিয়, বোধহয় পরামর্শও দিচ্ছে। কোয়েল সম্প্রতি ঢুকেছে এক কুরিয়ার সার্ভিসে, ফিসফিস করে আঁখিকে স্যালারির অঙ্ক শোনাল, তেমন একটা বিশাল কিছু নয়, তবু মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল আঁখির। স্বাভাবিক। আঁখি অনেক বেটার স্টুডেন্ট ছিল, এখন বেহালার দিকে এক কলেজের পার্টটাইম লেকচারার। হাতে যা পায় শুনলে ঠিকে ঝিরাও হাসবে।

তন্নিষ্ঠার ছোট্ট শ্বাস পড়ল। তার তাই বা জুটছে কই! এম এ হল, বি এড হল, তবু…। গতবার নেট স্লেট দুটোতেই বসেছিল, কোয়ালিফাই করতে পারেনি। এ বছর যদি লেগে যায়…!

রাত বাড়ছে। এবার শুরু হয়েছে ঝিমুনির পালা। উচ্ছ্বাস অনেক কমে এসেছে ঘরে, প্রত্যুষ পর্যন্ত হেলান দিয়েছে তাকিয়ায়, বেশ বোঝা যায় জোর করে চোখ খুলে রেখেছে। মালবিকার ঘাড় হেলে গেছে সুপ্রিয়র কাঁধে। ঈপ্সিতা চোখ কচলাচ্ছে, ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন। শেখর আর অভিমন্যুই শুধু জাগ্রত। হাত পা নেড়ে কথা বলছে কুটুর কুটুর। ওই সব ধর্ম আর শাস্ত্র নিয়ে গম্ভীর আলোচনা বোধহয়। আঁখি আর কোয়েল গুটিসুটি মেরে শুয়েই পড়ল।

তন্নিষ্ঠারও চোখ লেগে আসছিল। ঘুম তাড়াতে উঠে গেল হল পেরিয়ে ব্যালকনিতে। বড় বড় হাই তুলল কয়েকটা, আড়মোড়া ভাঙল। বিয়েবাড়িতে এই সময়টাই খুব বিশ্রী। এই বাড়িতে আরও একটা ঘর আছে, সেখানে আত্মীয়স্বজনরা ঠাসাঠাসি করে শুয়েছে। কোথায় যে এখন যায় তন্নিষ্ঠা! ধুৎ, বাড়ি ফিরে গেলেই হত।

বাসর থেকে বেরিয়ে এসেছে ঈপ্সিতা। সঙ্গে কোয়েল শেখর। ঈপ্সিতা চেঁচিয়ে ডাকল,—এই তনু, উই আর লিভিং ইয়ার।

—এত রাতে?

—বাড়িতে বলে রেখেছি, লেটনাইটেও ফিরতে পারি। শেখরদের ড্রপ করে দেব। ইফ ইউ লাইক আই ক্যান ড্রপ ইউ অলসো অ্যাট ইওর বাড়ি।

লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু না, ঝঞ্জাট অনেক। তাদের ফ্ল্যাটবাড়ির কম্পাউন্ডের গেটে তালা পড়ে গেছে, দারোয়ানকে জাগাতে জান নিকলে যাবে। তারপর আবার বাড়ি গিয়ে বেল বাজাও, ঘুম থেকে তোলো…।

তন্নিষ্ঠা মাথা ঝাঁকাল,—না রে, আমি পর্ণা আঁখিদের সঙ্গে ম্যানেজ করে নিচ্ছি। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ব।

শেখর কোয়েল হাত নাড়ল,—কাল আসছিস তুই? বাসি বিয়েতে?

—দেখি।

—আমাদের তো হচ্ছে না।….পরশু তাহলে দেখা হবে। বাই।

ঈপ্সিতাদের পদশব্দ মিলিয়ে যেতেই পায়ে পায়ে হলঘরের সোফায় এল তন্নিষ্ঠা। পাখার হাওয়ার ঠাণ্ডা লাগছে অল্প অল্প, শাড়িটা ভাল করে সাপটে নিল গায়ে। পা ওঠাল সোফায়, হাঁটুতে মুখ গুঁজেছে।

সবে ঘোর মতো এসেছে, দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ! তন্নিষ্ঠা চমকে তাকাল। অভিমন্যু। সিগারেট ধরাচ্ছে। পোড়া কাঠি কোথায় ফেলবে ভেবে পাচ্ছে না, পকেটে পুরে ফেলল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তন্নিষ্ঠার চোখে চোখ পড়েছে অভিমন্যুর। অপ্রস্তুত মুখে হাসল—এখানে কেন? ঘরে গিয়ে শোও না।

বেশ পাকা আছে তো ছেলেটা! সামান্য চেনাতেই অবলীলায় তুমি তুমি!

তন্নিষ্ঠাও ইচ্ছে করে তুমি বলল,—ওটা তোমাদের ঘর। গেস্ট রুম। আমি এখানেই ভাল আছি।

—তোমার বন্ধুরা কিন্তু ওখানেই লুটিয়ে পড়েছে।

—ওরা পারে। অপরিচিত লোকের মাঝখানে আমার ঘুম হয় না।

অভিমন্যু কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসল,—আমারও সেম কেস। আমিও তো ওই জন্যে….

হলঘরে আরও বেশ কয়েকটা ফাঁকা সোফা। সেদিকে ইঙ্গিতপূর্ণ চোখে তাকাল তন্নিষ্ঠা। বুঝিবা বলতে চাইল, আমি কিছু মনে করব না, তুমি স্বচ্ছন্দে কোথাও একটা বডি ফেলতে পার।

ইশারা-টিশারা বোঝার ধার দিয়েই গেল না অভিমন্যু। সামনে এগিয়ে এসেছে,—প্রত্যুষটা আজ খুব জ্বালাল তোমাদের, তাই না?

—একটুও না। তন্নিষ্ঠা পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসল,—ওরকম কেউ না থাকলে বিয়েবাড়ি জমেই না।

—হ্যাঁ, ও একটু ফানি আছে।

—ভাল তো। হুঁকোমুখো হ্যাংলা নয়।

অভিমন্যু যেন কথাটা ঠিক সহজভাবে নিতে পারল না। কাঁচুমাচু মুখে বলল,—কেন, আমিও তো হাসি।

—আমি তো তোমাকে মিন করিনি। ইন জেনারেল বলছি।

—ও, তাই বলল। আমি ভাবলাম….। কয়েক সেকেন্ড কী যেন চিন্তা করল অভিমন্যু। তারপর বলল,—তখন কালাশৌচের এগেন্‌স্টে বললাম বলে তুমি কিছু মাইন্ড করোনি তো? আসলে আমি বলতে চাইছিলাম আমরা মুখেই আধুনিক, এদিকে মনে মনে পড়ে আছি সেই মান্ধাতার আমলে। শিক্ষিত লোকের এরকম ডুয়েল চেহারা আমার সহ্য হয় না।

সহ্য তো তন্নিষ্ঠারও হয় না। কিন্তু উপায় কী? শৌনকের বাবা সব রকম আচার বিচার মানেন যে। এই করলে অযাত্রা, ওই দেখলে বাধা, অমুক মাসে তমুক জিনিস ছুঁতে নেই….। নিজে ডাক্তার তো, সঙ্গে সঙ্গে একটা করে বৈজ্ঞানিক যুক্তিও খাড়া করে দেন। তন্নিষ্ঠার আশীর্বাদের দিন কী হল? পাত্রপক্ষের আসার কথা বিকেলে, ভরদুপুরে ভদ্রলোক সদলবলে হাজির। কেন? না, একটা বিয়াল্লিশের পরে নাকি আর শুভ কাজে বেরনোর যোগ নেই। শৌনকের দাদু মারা যাওয়ার পর বাবা গিয়েছিল। ফিরে এসে সে কী হাসাহাসি! মৃতের জন্য শোক নেই এতটুকু, শৌনকের বাবা নাকি খালি হম্বিতম্বিই করে চলেছেন! ডেডবডির মাথার তলায় আগে গীতা দাও, পশ্চিমে মাথা করে শুইয়ো না….! ভদ্রলোক নাকি পূজা আহ্নিক না করে চেম্বারে বসেন না, ফি শনিবার কালীবাড়ি ছোটেন। শৌনক আবার গর্ব করে বলে, আমার পিতৃদেব ডাক্তার সুকুমার রায়চৌধুরী কিন্তু অত্যন্ত গোঁড়া মানুষ, তুমি তার সঙ্গে ঠিকমতো মানিয়ে চলতে পারবে তো!

তন্নিষ্ঠা অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল,—কী করা যাবে, আমাদের বেশিরভাগ মানুষ তো এ রকমই।

—তুমিও কি বেশির ভাগেরই দলে?

—ভেবে দেখিনি। তন্নিষ্ঠা হেসে ফেলল,—দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোসা।

বসল অভিমন্যু। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে আবার এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে।

তন্নিষ্ঠা বলল,—পকেটে রেখে দাও। তবে স্বচ্ছন্দে মেঝেতেও ফেলতে পার, গোটা ঘরটাই অ্যাশট্রে হয়ে আছে।

অভিমন্যু হেসে ফেলল। মেঝেয় ফেলে চেপে চেপে নেভাচ্ছে সিগারেটটা। জোরে শ্বাস নিল একটা, আরও কয়েকটা পর পর। নাক কুঁচকে শোঁকার ভঙ্গি করছে,—তোমার পারফিউমের গন্ধটা তো দারুণ! অনেকটা ব্রুট ঘেঁষা।…কিন্তু এ তো ব্রুট নয়!

তন্নিষ্ঠা টেরচা চোখে তাকাল,—তুমি মনে হচ্ছে গন্ধবিশারদ? পারফিউমের শখ আছে বুঝি?

—নাহ্‌, ওই পেশার খাতিরে যেটুকু….

—পারফিউম ব্যাচো?

—বেচি তো বটেই। অভিমন্যু চোখ ছোট করে মুখ টিপে হাসছে। ভঙ্গিটি বিচিত্র। বলল,—অল্পস্বল্প বানাইও।

ঈষৎ চমকাল তন্নিষ্ঠা,—তোমার পারফিউমের ফ্যাক্টরি আছে?

—হ্যাঁ, তাও বলতে পার। যেন বাচ্চা মেয়েকে বোঝাচ্ছে, এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে ছেলেটা,—কারখানা একটা আছে। বারো বাই বারো একটা ঘর, তিনজন কর্মচারী, দুটো মেশিন….

—চলে তোমার পারফিউম? মার্কেটে দেখেছি?

—সম্ভবত না। তোমরা তো সব ফরেন পারফিউম মাখো, আমার দিশি ব্যাপার। বাজার বলতে মফস্‌সল। অভিমন্যু আবার নাক টানল,—তোমার গন্ধটা বেশ লাগছে। ভাবছি চুরি করব।

—গন্ধ চুরি?

—মামলা করতে পারবে না। কী নাম তোমার পারফিউমটার?

—কী জানি, অত দেখিনি। মার ড্রয়ারে ছিল, মেখে নিয়েছি।…. তোমার সত্যিই ভাল লাগছে? বিদেশি ফুলের গন্ধ, তাই না?

—উহুঁ, এটা ফ্লোরাল নয়। পারফিউমের অনেক টাইপ আছে। যেমন ধরো….। একটা দীর্ঘ লেকচার শুরু করতে যাচ্ছিল অভিমন্যু, থেমে গেল অকস্মাৎ। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,—যাকগে, তুমি তো পরশু বউভাতে আসছই, নামটা কাইন্ডলি দেখে এসো। তোমার গন্ধটা আমায় খুব হন্ট্‌ করছে।

বিটকেল ছেলে তো! বাক্যটা প্রায় বেরিয়েই আসছিল তন্নিষ্ঠার মুখ থেকে, হঠাৎ ঝুপ করে লোডশেডিং। আলোকিত হলঘর নিমেষে মিশমিশে কালো।

কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, পাশের ছেলেটাকেও না।

কটা মাত্র সেকেন্ড গেছে, মনে হচ্ছে অনন্ত সময়। একটু একটু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল তন্নিষ্ঠা। দু ফুট দূরের সদ্য চেনা পুরুষ যদি ঝপ করে অদৃশ্য হয়ে যায়, কেমন লাগে? বিয়েবাড়ি হিসেবে যখন ভাড়া দেয়, নিশ্চয়ই এখানে জেনারেটর আছে! চালাচ্ছে না কেন! দারোয়ান নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে? এ ঘর ও ঘরে কেউ জাগছেও না তো! উঠে যাবে তন্নিষ্ঠা? বিশ্রী দেখায়। ছেলেটা নির্ঘাৎ ভাববে তন্নিষ্ঠা তাকে বাঘ ভাল্লুক ঠাউরেছে। ছেলেটা তার দিকে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে নেই তো? কিন্তু ওই বা দেখবে কী করে! যাক, নিশ্চিন্ত। আজ কি অমাবস্যা? বাইরেও একফোঁটা আলো নেই কেন? অমাবস্যায় কি বিয়ে হয়?

ভাবনাটুকু যেন পড়ে ফেলেছে অভিমন্যু, ফস করে দেশলাই জ্বালাল। পকেট থেকে সিগারেট বার করতে গিয়েও করল না, জ্বলন্ত কাঠি হাতেই ধরে আছে। নিবে গেল কাঠি, আবার একটা ধরাল। আবার নিবল, আবার জ্বালিয়েছে।

আধো আলোয় তাকে দ্যাখে নাকি অভিমনু?

আরও একটা কাঠি নেভার পর তন্নিষ্ঠা বলে উঠল,—থাক না, কাঠি নষ্ট করছ কেন?

আবার অন্ধকার। আবার নৈঃশব্দ্য। আবার চোরা অস্বস্তি।

অভিমন্যই বরফ ভাঙল। যেন কথা বলার জন্যই কথা বলছে, যেন কথা খুঁজে নিয়ে কথা বলছে, এমন স্বরে বলল,—কোন মাসে তোমার বিয়ের ঠিক হয়েছিল?

—এই তো, অঘ্রানে।

—মানে নেক্সট অঘ্রান অবধি তোমায় প্রতীক্ষা করতে হবে?

—অগত্যা।

—তোমার বরের নামটা কিন্তু বেশ। শৌনক কে ছিল জানো?

একবার শুনেই শৌনক নামটা মনে রেখেছে তো!

তন্নিষ্ঠা আলগাভাবে বলল,—হবে কোনও দেবতা। বা অসুর।

অভিমন্যু গমগম হেসে উঠল,—আরে না না, রামায়ণের ক্যারেক্টার। মানুষ। জনকের ছেলে। ধরতে গেলে সীতার ভাই, রামের শালা। বলা হয়, শৌনকই নাকি গোত্র ধর্মের প্রবর্তনকারী ঋষি।

ফান্ডা লড়াচ্ছে! অন্ধকারে মুখ টিপে হাসল তন্নিষ্ঠা। কত ভাবেই যে ছেলেরা মেয়েদের ইম্‌প্রেস্‌ করার চেষ্টা করে!

অভিমন্যু ফের বলল,—শৌনকবাবু করেন কী?

—ইঞ্জিনিয়ার। জেফার্সানে আছে।

—সে তো বিশাল কোম্পানি! হেড অফিস কি কলকাতায়?

—না, নয়ডাতে। দিল্লি।

ভটভট শব্দ বেজে উঠেছে। আলোগুলো জ্বলে উঠল। অজান্তেই একটা স্বস্তিমাখা শ্বাস বেরিয়ে এল তন্নিষ্ঠার বুক থেকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে,—যাই, ওরা জেগেছে কি না দেখি।

নাহ্‌, সারাদিনের হুল্লোড়ের পর সকলেই শ্রান্ত, কয়েক মিনিটের বিদ্যুৎহীনতায় কারুরই চোখ খোলেনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে আঁখি-রা, প্রত্যুষের মুখ হাঁ, মালবিকা সুপ্রিয়র মাথা এক তাকিয়ায়।

অভিমন্যুর ভ্যাজর ভ্যাজরে ঘুম ছিঁড়ে গেছে। পর্ণার পাশে একটুক্ষণ শুয়েও উঠে পড়ল তন্নিষ্ঠা। সে একটু শয্যাবিলাসী, নিজের বিছানা ছাড়া ঘুম তার আসবেই না।

অভিমন্যু ব্যালকনিতে। একটা চেয়ারে বসেছে, অন্য চেয়ারে পা, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট, মাথা খাটো রেলিঙে হেলানো।

হাল্কা মেজাজে অভিমন্যুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল তন্নিষ্ঠা। এখনও কারেন্ট আসেনি, পথবাতিগুলো এখনও নিবে আছে, বাইরে ছমছম অন্ধকার।

তন্নিষ্ঠা কৌতুকের স্বরে বলল,—এত সিগারেট খাচ্ছ কেন? ঘুম তাড়াচ্ছ?

আলগা একবার তন্নিষ্ঠাকে দেখে নিয়েই অভিমন্যুর চোখ আবার বাইরে। দূরমনস্কের মতো বলল,—রাস্তাটাকে খুব স্ট্রেঞ্জ লাগছে, তাই না?

—তাই কি? তন্নিষ্ঠা রেলিঙ ধরে ঝুঁকল।

—মনে হচ্ছে না ওটা একটা নদী? পিচডার্ক! বয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে?

তন্নিষ্ঠার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। গন্ধবিদ কি কবিতাও লেখে!

.

২.

বেশ কয়েক মাস ধরেই আশঙ্কাটা ঘনীভূত হচ্ছিল, চরমপত্র মিলল আজ। অফিস ছুটির মিনিট কুড়ি আগে। মুম্বই-এর সদর দপ্তর থেকে পাঠানো সাদা জানলা-খামগুলো টেবিলে টেবিলে বিলি করে গেল লক্ষ্মণ।

খাম খোলার সময়েও শুভেন্দু পুরোপুরি আন্দাজ করতে পারেনি। পড়তে পড়তে শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। চোস্ত বয়ান, ধানাই পানাই নেই, যা বলতে চায় চাঁছাছোলা ভাষায় চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে কোম্পানি। …পূর্বাঞ্চলে ক্রমাগত লোকসানের দরুন এবং এদিকে আর ব্যবসা বাড়ার আশু সম্ভাবনা না থাকায় কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলী কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এক, কলকাতাস্থিত পূর্বাঞ্চলীয় দপ্তরটি আর পূর্বাবস্থায় থাকবে না, এখানকার কর্মিসংখ্যা আটত্রিশ থেকে বারোয় নামিয়ে আনা হল। দুই, যে সব কর্মচারীর বয়স পঞ্চাশের উপরে, অথবা যাঁরা কুড়ি বছরের বেশি চাকরি করছেন কোম্পানি তাঁদের আগামী নব্বই দিনের মধ্যে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। কোম্পানিতে তাঁদের দীর্ঘ অবদানের কথা মাথায় রেখে এবং তাঁদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড গ্র্যাচুয়িটি ও অন্যান্য আইন মোতাবেক সুবিধা ছাড়াও এককালীন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের জন্য কোম্পানি অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছে। অর্থের পরিমাণ কী ভাবে স্থির হবে, পত্রের শেষে তার উল্লেখ করা আছে। তিন, যাঁদের বয়স পঞ্চাশের নীচে, অথবা যাঁরা কুড়ি বছরের কম চাকরি করছেন, এমন দশ জনকে পূর্বাঞ্চলীয় শাখাতেই রাখা হবে। এই দশজন নির্বাচিত হবেন চাকরিজীবনে সিনিয়রিটি এবং কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে। চার, পিয়ন ব্যতীত এই শাখার বাকি কর্মচারীদের মুম্বই সদর দপ্তর এবং হায়দ্রাবাদ শাখায় বদলি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। কে কোথায় যোগ দিতে ইচ্ছুক তা পনেরো দিনের মধ্যে মুম্বই সদর দপ্তরে জানানো আবশ্যিক। পাঁচ, পূর্বাঞ্চলীয় দপ্তরের শাখা-প্রধানকে আপাতত ওই দপ্তরেই কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

এর পর দু লাইনের শুকনো ভদ্রতা… উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলির জন্য কোনও কর্মচারীর যদি অসুবিধা ঘটে, কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলী তার জন্য আন্তরিক দুঃখিত। প্লিজ বেয়ার উইথ আস।

শেষ বাক্যটাকে মনে মনে অনুবাদ করতে পারল না শুভেন্দু। আমাদের মতো করে কষ্ট সহ্য করুন? আমাদের সঙ্গে কষ্ট সহ্য করুন? নাকি আমাদের সহ্য করুন? উঁহু, কোনওটাই হচ্ছে না। একমাত্র বুঝি সাহেবরাই শব্দগুলোর মর্ম বোঝে। অথবা দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা। ক্ষমতা হাতে থাকলেই বুঝি কথাগুলো বলা যায়।

রিডিং গ্লাস খুলে কপালের রগ টিপে ধরল শুভেন্দু, বসে আছে নিঝুম। মাথা বেবাক ফাঁকা, যেন মহাশূন্য। শেষ পর্যন্ত ছুটি তাহলে হয়েই গেল? মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সেই শুভেন্দু দাশগুপ্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক! একজন মিস্টার এক্স! পুরো অফিস নিস্তব্ধ, আলপিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। তড়িৎ শ্যামল দীপঙ্কররা এই একটু আগেও আগামী কালের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে গলা ফাটাচ্ছিল, তারা সহসা নির্বাক। বিহ্বল। অফিসের একমাত্র মেয়েটি, শমিতা পাইন, টাইপ মেসিনে হাত রেখে স্ট্যাচু। পিল্লাই আর সদাশিব ব্যানার্জিরও চোখ নিস্পলক। হঠাৎ দেখলে মনে হয় গোটা অফিসটাই একটা ফ্রিজ শট।

মিনিট দশেক পর গুঞ্জন উঠল। সদাশিব অনুচ্চ স্বরে কী যেন বলল বিজন রায়কে, বিজন আরও নিচু গলায় অশ্লীল একটা খিস্তি করল।

তড়িৎ ফুঁসে উঠল,—মামদোবাজি পায়া? হুকুম করলেই মুম্বই হায়দ্রাবাদ ছুটতে হবে? কেস ঠুকে দেব আমি।

শ্যামল নীরস স্বরে বলল,—লড়ার পয়সা আসবে কোত্থেকে? চাকরিই তো থাকবে না।

—চাকরি খাওয়া অত সোজা? এই চিঠিটাকেই আমি বেআইনি প্রমাণ করব।

—করিস’খন। এখন আগে ভাব, কোথায় যাওয়ার অপশন পাঠাবি।

দীপঙ্কর মলিন হাসছে,—উত্তেজিত হয়ে লাভ কী? এ তো জানাই ছিল সাম ডে অর আদার…

শুভেন্দু মাথা ঝাঁকাল আপনমনে। সাম ডে অর আদার এবং দা ভেরি ডে, দুটোর মধ্যে গভীর পার্থক্য আছে, এ কথা কি বোঝে না দীপঙ্কর? বিপদের সম্ভাবনা আর বিপদ কি এক হল?

মণিশঙ্কর পিল্লাই টেবিল থেকে উঠে পড়েছে। কেমন যেন টলতে টলতে টয়লেটের দিকে চলে গেল। মিনিট খানেকের মধ্যেই ফিরেছে, চোখে মুখে জল ছিটিয়ে। সিট অবধি গেল না, শুভেন্দুর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভাঙাচোরা হাসি খেলছে মুখে। রুমালে হাসি আর জল মুছতে মুছতে বলল,—সো দাশগুপ্তা, আওয়ার গেম ইজ ওভার!

শুভেন্দু কেঠো হাসল,—ও শিওর। একদিন না একদিন খেলা তো শেষ হতই। দু দিন আগে, নয় দু দিন পরে…

—নো নো, নট দু দিন। আরও নো বছোর আমার চাকরি ছিল। সার্ভিস আমায় বাই করে দিল।

—বাই বলছ কেন? উই ক্যান স্টার্ট অ্যাফ্রেশ। শুভেন্দুর স্বরে ঠিক প্রত্যয় ফুটল না, তবু বলল, —এখনও তো আমরা খাটতে পারি, কী বলে?

—কোথায় খাটব?

—হ্যাভ অ্যানাদার জব। তুমি পেয়ে যাবে, তোমার যা অ্যাকাউন্টসে ব্রেন আছে…

—বোগাস। হিউম্যান ব্রেন এখন টোটালি ইন্‌এফেক্টিভ, কস্টিং-এ আসে না। কম্পিউটারে ডাটা ফিড করলে সে আমাদের চেয়ে অনেক ভাল অ্যাকাউন্টস করে দেবে। … আর লোক নিলেই বা আমার চান্স কোথায়? থাউজেন্ডস অ্যান্ড থাউজেন্ডস অব ছেলে বেকার…। আমার ছেলে তো বি কম করে সিম্পলি লয়টারিং, সেদিন একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এল, ওনলি ফোরটিন হানড্রেড অফার করেছে। কম্পিউটার ট্রেনিং আছে, তাও। পিল্লাইয়ের ছোটখাটো চেহারাটা গুটিয়ে গেছে যেন। জোরে জোরে মাথা দোলাচ্ছে,—ক্যালকাটা এখন টোটালি ড্রাই। নাথিং ইজ লেফট্‌ ইন ক্যালকাটা, এক্সক্লডিং দা লেফটস।

এত উদ্বেগের মধ্যেও শুভেন্দু হেসে ফেলল, —ওয়েল সেড। তোমার তো তা হলে কোট্টায়ামে পালিয়েও লাভ নেই, লেফট্‌ তোমার পিছু ছাড়বে না।

—কোট্টায়ামে যাব কেন? লাস্ট থারটিফোর ইয়ারস আমি ক্যালকাটায় আছি, ইটস্ মাই হোম নাউ। এখন কেরালায় নিজেকে ফিটই করতে পারব না। মোরওভার, ওখানেও তো আমি একজন ফিফ্‌টি প্লাস ম্যান…। সামনের চেয়ারে বসে পড়ল পিল্লাই, হাই মাইনাস পাওয়ার চশমার আড়ালে অক্ষিগোলক কেমন অস্বচ্ছ লাগে। বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল,—বিলিভ মি, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক হবে বুঝেছিলাম, কিন্তু…

—গোল্ডেন নয় গোল্ডেন নয়, আয়রন। সদাশিব পাশের টেবিল থেকে কথা শুনছিল, বলে উঠল,—দেওয়া থোওয়াগুলো স্টাডি করে দেখেছেন? তিন লাখের বেশি কমপেনসেশান জুটবে না।

—দ্যাট মিনস্‌, পিএফ টিএফ নিয়ে অ্যারাউন্ড…

—আমার একটি মেয়ের বিয়ে দিতে দু লাখের ওপর গেছে। সদাশিবের গলা নিমতেতো, এখনও দুটো বাকি।

শুভেন্দু বলে ফেলল,—এ খরচা অবশ্য আপনার চাকরি থাকলেও ছিল ব্যানার্জি!

—দুটো কি এক? সার্ভিস থাকলে লোন করা সহজ, সেই লোনের একটা ক্রেডিবিলিটি থাকে, সিকিউরিটি থাকে…. এখন আমায় কে ধার দেবে?

শুভেন্দু মনে মনে বলল, লাইন দিয়ে মেয়ে পয়দা করার সময় এগুলো ভাবা উচিত ছিল। মুখে বলল,—মেয়ের বিয়ে বিয়ে করে উতলা হয়ে লাভ নেই ব্যানার্জি। কষ্ট করে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, ওরা চাকরি বাকরি করবে, নিজেদের ম্যাচ নিজেরা খুঁজে নেবে।

—আপনার পক্ষে এসব বলে দেওয়া সোজা দাশগুপ্ত। নিজের মেয়ের একটি সলিড পাত্র ঠিক করে ফেলেছেন, মিসেস চাকরি করে… মোটা কামাই…. মিসেসের লোনে ফ্ল্যাট হয়ে গেল, ওয়েলসেটলড্‌ লাইফ…। দিব্যি পায়ের ওপর পা ছড়িয়ে থাকবেন, নাটক থিয়েটার করে বেড়াবেন…। একা সংসারের জাঁতা পেষা যে কী জিনিস, তা তো কোনওদিন টের পেলেন না!

কথাগুলো বর্ণে বর্ণে সত্যি। আবার সত্যি নয়। স্ত্রীর যদি স্বামীর চেয়ে রোজগার বেশি হয়, আর সেই স্ত্রী যদি নন্দিতার মতো দাপুটে হয়, তাহলে স্বামীকে সারাজীবন কী পিষতে হয়, তা শুধু শুভেন্দুই জানে। নিজের ভেতরটা কি সে কখনও উপড়ে দেখাতে পেরেছে কাউকে? এ এক অসহ্য ক্ষরণ। রক্তহীন, কিন্তু সর্বক্ষণ রক্তাক্ত হয়ে থাকে হৃদয়।

সামনে দিয়ে স্টোরের সুকমল ঘোষ আর অনিল সাহা যাচ্ছে। কেজো পায়ে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ঘরে ঢুকল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখল পিল্লাই। মুখ বিকৃত করে বলল,—শালারা ধার দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর দু তিনটে বছর বেশি হলেই…

সদাশিব বলল,—ঘোষের অনেক বয়স কমানো আছে। আমি জানি। ওর হায়ার সেকেন্ডারির সার্টিফিকেটটা দেখেছেন? সাড়ে চোদ্দোয় নাকি পাশ করেছে! … আমার বাপটাই শালা গান্ডু ছিল।

—শালারা এখন খুব তেল মারবে মজুমদারকে।

—লাভ নেই। কোম্পানি একবার যখন বেলপাতা শোঁকানো শুরু করেছে, ও শালারাও স্পেয়ারড্‌ হবে না।

ক্রমশ তীক্ষ্ণতর হচ্ছে ভাষা, শুরু হয়ে গেছে ব্যক্তিগত আক্রমণ। এ এখন রোজই চলবে, টের পাচ্ছিল শুভেন্দু। এইটুকুনি তো অফিস তাদের, ইউনিয়ন নেই, অ্যাসোসিয়েশন নেই, পরস্পর পরস্পরের এত ঘনিষ্ঠ, এতদিন প্রায় এক পরিবারের মতো ছিল, সূক্ষ্ম রেষারেষি সত্ত্বেও, আর বোধ হয় সম্পর্কটা আগের মতো রইল না। তলিয়ে ভাবতে গেলে পিল্লাই সদাশিবদের আক্রোশও অর্থহীন। কোম্পানি আরও ক’ বছর আগে সিদ্ধান্তটা নিলে মধুসূদনবাবু সমরেন্দ্রদা, এরাও হয়তো শুভেন্দুদের সম্পর্কে এই উক্তিগুলোই করত। আর তেল মারায় কম যায় কে? সে বছর যখন দুম করে শুভেন্দুর ইনক্রিমেন্ট স্টপ করে দিল কোম্পানি, তখনকার ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ঘরে ফাটাফাটি করতে ঢুকেছিল শুভেন্দু, পিল্লাই মুচকি মুচকি হাসছিল সেদিন। বিজন তো নির্লজ্জের মতো লোকটার হয়ে সাফাই গেয়েছিল। সদাশিব ব্যানার্জিই বা কী? কদিন আগেই মজুমদারের শাশুড়ির জন্য টিকিট কাটতে ট্রেনের বুকিং কাউন্টারে লাইন দেয়নি?

পিল্লাই সিটে ফিরে যাওয়ার পর শুভেন্দু ব্যাগ কাঁধে উঠে পড়ল। ছুটি হয়ে গেছে, তবু অফিস আজ ভরপুর। এখানে সেখানে জটলা চলছে। নিখিল দাস চেঁচিয়ে ডাকলও শুভেন্দুকে, দাঁড়াল না শুভেন্দু। আর ভাল্লাগছে না।

বাইরে এক মায়াবী বিকেল। সূর্য প্রায় ডুবডুব, তার শেষ আভা মেখে সামনের ময়দান এখন স্বপ্নের দেশ। পশ্চিমে মেঘের কুচি রঙের খেলা দেখাচ্ছে। মাঝ আকাশে এক সরু লম্বা সাদা রেখা, একটু আগে কোনও জেটপ্লেন উড়ে গেছে বোধ হয়। ছুটিভাঙা মানুষ, ব্যস্ত যানবাহন, দূরের গাছগাছালি, প্রতিফলিত রশ্মিতে উজ্জ্বল স্কাইস্ক্র্যাপারের সারি— ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো লাগে যেন। হাওয়া বইছে মৃদুমন্দ, শুকনো হাওয়া। এমন দিনে বুঝি ইচ্ছে করলেও মন খারাপ করে থাকা কঠিন।

ফুটপাথে দাঁড়িয়ে শুভেন্দু একটা সিগারেট ধরাল। প্যাকেটটা দেখে নিল একবার, আর পাঁচটা আছে। দিনে মোটামুটি এক প্যাকেট তার বরাদ্দ, আজ রিহার্সাল নেই, মোটামুটি কুলিয়ে যাবে। এখন কি যাবে একবার গ্রুপে? বাড়ি ফিরে গেলেও হয়। দারিও ফোর নাটকটার অনুবাদের কাজ কিছু দূর এগিয়ে থেমে আছে, আবার উদ্যোগ নিয়ে বসা দরকার। আজ থেকেই না হয়…। কাজই শ্রেষ্ঠ ওষুধ, মনের চাপ কম থাকে। নাহ্, আজ হবে না। তিন্নি আজ সন্ধেবেলা বাড়ি থাকবে না, নন্দিতা যদি ফিরে দেখে শুভেন্দু নাটক নিয়ে বসেছে, ওমনি চটাস চটাস মন্তব্য শুরু হয়ে যাবে, শুভেন্দুও মেজাজ ঠিক রাখতে পারবে না আজ। আজই কি নন্দিতাকে জানাবে ভলান্টারি রিটায়ারমেন্টের কথাটা?

ভাবতে ভাবতে শুভেন্দু ময়দান মেট্রো স্টেশনে। এলোমেলো পায়চারি করছে প্ল্যাটফর্মে। ভিড় আছে বেশ, বেশির ভাগই অফিসযাত্রী। কলেজ পড়ুয়া তরুণ তরুণীও আছে কিছু। এরা কোত্থেকে আসে অফিসপাড়ায়? এই সময়ে? ময়দানে ঘোরাঘুরি করে বুঝি? নীল সালোয়ার কামিজ পরা একটি মেয়ের সঙ্গে তিন্নির মুখের খুব মিল। স্থির চোখে মেয়েটাকে দেখছিল শুভেন্দু, চোখাচোখি হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার বয়সী পুরুষের দৃষ্টি তরুণীরা উপভোগ করে না। তাকে কি প্রৌঢ় বলা যায়? প্রৌঢ়! প্রৌঢ়! শব্দটা মুখে বেশ কয়েক বার বিড়বিড় করল শুভেন্দু। শব্দটাতেও কেমন যেন ন্যুব্জ ভাব আছে। কিন্তু সে তো কুঁজো নয়! মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল শুভেন্দু, দু হাত ছড়াল দু পাশে। ফোলাচ্ছে ফুসফুস। চোখ ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করল চামড়া, হাতে হাত বোলাল। মসৃণ, এখনও মসৃণ। চাইলে এক্ষুনি সে দৌড়ে প্ল্যাটফর্ম এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে, একটুও হাঁপাবে না। তা হলে?

আবার শূন্যতাটা দখল নিচ্ছে বুকের। ট্রেন ঢুকে গেছে, ভার মুখে কামরায় উঠল শুভেন্দু। মিনিট কুড়ির মধ্যেই শ্যামবাজার। অন্য দিন দুটো করে সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে, আজ এসক্যালেটার ধরল। সচেতন ভাবে। সিঁড়ি নয়, আজ থেকে তার জন্য ওই অনায়াস চলমান সোপানেরই নিদান দেওয়া হয়েছে।

শুভেন্দুদের গ্রুপ থিয়েটারের ঘরটা শিকদার বাগানে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা দিয়েই যাওয়া যায়, তবু গলিখুঁজিই ধরল শুভেন্দু। এই অঞ্চলে তার দীর্ঘকালের বাস ছিল, সবে বছর সাতেক হল গেছে রানিকুঠি, এখনও পুরনো পাড়ার মায়া পুরোপুরি কাটাতে পারেনি। পথেঘাটে প্রায়ই দু চারজন পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, দু দশটা কথা হয়, ফুরফুরে লাগে মেজাজটা। আজ দিন খারাপ, কাউকেই চোখে পড়ল না। নিজেদের আগের বাড়ির গলির মুখ পেরিয়ে মোড় ঘুরতেই চোখে পড়ল দত্তবাটীর রোয়াকে তিন বৃদ্ধ বসে। পাশাপাশি। সামনেই রাস্তার কলে কাজের মেয়েরা উচ্চৈঃস্বরে ঝগড়া করছে, মুখের ভাষার কোনও লাগাম নেই, তিন বৃদ্ধ জুলজুল চোখে উপভোগ করছেন কলহ। এমন দৃশ্য জীবনে বহু বার হয়তো দেখেছে শুভেন্দু, কিন্তু আজ হঠাৎ বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কী অদ্ভুত দৃষ্টি তিন বৃদ্ধের চোখে! যেন ওইটুকু দেখার জন্যই বেঁচে থাকা! শুভেন্দু কি আজ থেকে ওঁদের দলে? মাস পয়লায় ব্যাঙ্কে গিয়ে লাইনে দাঁড়াবে, সঞ্চিত টাকার সুদের চেক জমা দেবে, সেভিংসের পাসবই খুলে তীর্থের কাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কাউন্টারে?

উফ্‌, কী অসহ্য বিবমিষা যে ভাবনাটায়!

সমিধের ঘরে জনা তিনেক এসেছে আজ। সুজিত নির্মল আর প্রণবেশ। কী যেন একটা মজার গল্প বলছে প্রণবেশ, সুজিত নির্মল হা হা হাসছে। ঘরে ছড়ানো ছেটানো চেয়ার টুল মোড়া, একটা চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিল শুভেন্দু। তেষ্টা পাচ্ছে খুব, উঠে আর কুঁজো থেকে গড়িয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না। হাই তুলল একটা। ফাঁকা চোখে দেখল বন্ধুদের।

কথার মাঝেই নির্মলের চোখ শুভেন্দুর দিকে,—কী সাহেব? এত গোমড়া দেখাচ্ছে কেন?

শুভেন্দু চোয়াল ফাঁক করল,—এইই … এই আর কী… প্রণবেশ দাঁত বার করল, —সাহেব কি তার সাহেবের কাছে ঝাড় খেয়েছে?

শুভেন্দুর টকটকে রঙের জন্য তার সাহেব নামটা চালু আছে বহুকাল। এই ‘সমিধ’ যখন তৈরি হল, প্রায় বাইশ বছর আগে, তখন অনেকেই বলত সাহেবদের দল। এক সময়ে ডাকটা শুনে বেশ রোমাঞ্চ বোধ করত শুভেন্দু, এখন ওই সাহেব ডাকটাকেই খোকন বাবলু গোছের কিছু মনে হয়।

শুভেন্দু আলতো হাসল,—সাহেবরা তো ঝাড় দেওয়ার জন্যই জন্মেছে।

—স্বর যেন আজ একটু অন্য রকম? সিরিয়াস কিছু হয়েছে?

—ওই যেমন চলে। …ভি-আর-এস্ টি-আর-এস নিয়ে…

—তোমাদের এসে গেল নাকি?

হ্যাঁ বলাই যেত। নির্মল জানেও অনেকটা। তবু গলা দিয়ে সত্যিটা বেরোল না শুভেন্দুর। বলল, কথা তো চলছেই। যে কোনও দিনই…

—বিচ্ছিরি ব্যাপার। …আমার ভায়রার তো আরও অ্যাকিউট প্রবলেম। চাকরি করে যাচ্ছে, মাইনে পাচ্ছে না। এই তো কদিন আগে নভেম্বরের স্যালারি মিলল। তাও ইনস্টলমেন্টে। হাঁড়ির হাল হয়েছে বেচারার। ফ্ল্যাট ট্যাট কিনে একেবারে লেজেগোবরে।

সুজিত সিগারেট ধরিয়েছে। বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বয়স, শুভেন্দুদের থেকে ঢের জুনিয়ার। সাত বছর হল জয়েন করেছে গ্রুপে। পর পর দুটো প্রোডাকশানেই মেন রোল। ইদানীং তার কথাবার্তায় চাপা ঔদ্ধত্যের সুর শোনা যায়। টিভি-সিরিয়ালেও কাজ করেছে কিছু, রাস্তাঘাটে দর্শকরা তাকে চিনতে পারে, হয়তো সেটাও কারণ।

এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে সুজিত বলল,—সাহেবদার ভাবনা কী? বউদি আছেন, সব সামলে নেবেন।

নির্মল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছে, —সংসার চলাটাই কি সব? সাহেবের মতো একজন ভাইটাল মানুষ, ম্যান অফ অ্যাকটিভ হ্যাবিটস্‌, দুম করে বসে যাবে?

—বসে যাবেন কেন? গ্রুপের জন্য আরও বেশি করে টাইম দেবেন।

—ওতে কি সারাটা দিন কাটে? প্লাস নিজের আর্নিংয়ের তো একটা ব্যাপার আছে।

—তাহলে ছোট পর্দায় লড়ে যান। সাহেবদার ফিগার এখনও দারুণ, পুলিশ অফিসার টপিসারের রোলে সাহেবদাকে লুফে নেবে। আরে দাদা, আমরা গ্রুপ থিয়েটাররাই তো এখন টিভির দখল নিচ্ছি।

—ডেপোমি কোরো না তো হে ছোকরা। সকাল থেকে সন্ধে অব্দি সঙের মতো বসে থেকে, অশিক্ষিত ডিরেক্টরগুলোর সামনে হাত কচলে, জোটে তো মাত্র দু পাঁচশো। তার জন্য ছুটবে আমাদের সাহেব? আর ইউ ম্যাড?

—না উনি আর্নিংয়ের কথা বলছিলেন তো…। যার যা ট্যালেন্ট আছে, তাই ভাঙিয়ে রোজগার করুক। একটু নাম হয়ে গেলে তো সাহেবদাকে সেধে নিয়ে যাবে।… তখন কিন্তু রোজগার খুব মন্দ নয়। রথীনদার এখন কত আর্নিং জানেন? দু দুখানা মেগা সিরিয়াল টেনে দিচ্ছে।… দধীচিতে এর একশো ভাগের এক ভাগ পয়সা কখনও চোখে দেখেছে রথীনদা?

—শোনো সুজিত, তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলি। নাটক করতে আমরা ভালবাসি। অভিনয়ও। এটা আমাদের প্যাশান। প্যাশান বেচে পেট চালাব, আমরা সেই স্কুল অব থটের মানুষ নই। ভবিষ্যতে কক্ষনও তুমি এরকম কথা আমাদের সামনে উচ্চারণ করবে না।

নির্মলের আকস্মিক কড়া কথায় হকচকিয়ে গেছে সুজিত। আমতা আমতা করে বলল,—এটা কিন্তু আপনাদের বাড়াবাড়ি। অভিনয় ইজ অভিনয়। সে স্টেজেই হোক, কী পর্দায়।

—বললাম তো, আমরা তোমার পাঠশালায় পড়ি না।

সুজিত তবু গোঁয়ারের মতো বলল,—আপনারা বাসবেন্দ্ৰদাকে এ কথা বলতে পারবেন?

একটু থমকাল নির্মল। বাসবেন্দ্র বসুরায় তাদের সমিধের পরিচালক। কর্ণধার। সম্প্রতি ছোট পর্দায় এক আধটা অভিনয় করছে বাসবেন্দ্র। বড় পর্দাতেও।

স্পর্শকাতর প্রসঙ্গটা বুদ্ধি করে এড়াল নির্মল। বলল, —আমাদের গ্রুপের লোকের তো অন্য কোথাও অভিনয় করতে বাধা নেই। কারুরই না। তেমনি, কোথাও কোথাও না অভিনয় করার স্বাধীনতাও আমাদের আছে, তার সপক্ষে যুক্তিও আছে। সেটাকে অন্তত তুমি সম্মান করার চেষ্টা করো।

সুজিত গুম হয়ে গেল। প্রণবেশ একখানা ম্যাগাজিন বার বার পড়ছে, মাথা গলাচ্ছে না। ঢোকার সময়ে পাশের চায়ের দোকানটাতে হাত নেড়ে এসেছিল শুভেন্দু, বাচ্চাটা কেটলি হাতে ঢুকেছে। প্রত্যেকের হাতে গরম ভাঁড় ধরিয়ে দিল।

শব্দ না করে ভাঁড়ে চুমুক দিল শুভেন্দু। মনে মনে নির্মলের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করছিল। নির্মল ঠিক বুঝতে পেরেছে হঠাৎ বেকার হলে কোন জায়গাটায় বিঁধবে শুভেন্দুর। নন্দিতার রোজগারের প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিয়েও ভাল কাজ করেছে। সেই কবে কলেজে পড়ার সময়ে কফিহাউসে নির্মলের সঙ্গে পরিচয়। নিজের লিটল্‌ ম্যাগাজিনে তখন বুঁদ হয়ে থাকত নির্মল, চমৎকার কবিতা লিখত, শুভেন্দুও তখন হাত মক্‌শো করছে—বন্ধুত্ব গাঢ় হতে সময় লাগেনি। নন্দিতার সঙ্গে আলাপ জোড় গৎ ঝালা, সবেরই সাক্ষী এই নির্মল। ভাঙতে ভাঙতেও নন্দিতার সঙ্গে সম্পকৰ্টা কেন টিকে গেছে, তাও নির্মলের জানা।

কোণের ভাঙা প্যাকিং বাক্সে শূন্য চায়ের ভাঁড় ছুড়ে দিল নির্মল, —চলি আজ।

শুভেন্দু বলল,—এত তাড়াতাড়ি উঠছ যে?

—বাড়িতে একটা ফোন আসবে। সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে।

—বাসবেন্দ্র আজ আসবে না?

—না। ওর একটা বিয়ে বাড়ি আছে। প্রণবেশ চোখ তুলল।

—তাহলে আমিও উঠি…. প্রণবেশ, তোমরা তা হলে বোসো…

বেরিয়ে এসে শুভেন্দু সিগারেট ধরাল, একটা নির্মলকেও দিল। হাল্‌কা গলায় বলল, —তুমি হঠাৎ সুজিতের ওপর অত খেপে গেলে কেন?

—ওকে একটু কড়কানোর দরকার ছিল। বড় ছোট জ্ঞান নেই…

—ও কিন্তু বাসবেন্দ্রর খুব পেয়ারের। সব রিপোর্ট করবে।

—সো ব্লাডি হোয়াট? বাসবেন্দ্র ওকে মাথায় তুলেছে বলেই তো আমার ওকে ঝাড়ার ইচ্ছে হল। বাসবেন্দ্র বুঝুক, আমরা ওর স্ট্যান্ডগুলো লাইক করছি না। মনে আছে, সুপ্রিয়াকেও কেমন মাথায় তুলেছিল? আল্টিমেট্‌লি হোয়াট ডিড সমিধ গেইন? সে এখন মধুক্ষরার হয়ে স্টেজ কাঁপাচ্ছে, আর সর্বত্র সমিধের কুচ্ছো গেয়ে বেড়াচ্ছে।

—হুঁ, বাসবেন্দ্র অনেক বদলে গেছে।

—তুমি আজ একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? প্রণবেশ ওয়াজ টোটালি সাইলেন্ট? অথচ তার আগে খুব হ্যা হ্যা করছিল…

—নিজেও সিরিয়াল টিরিয়াল করে তো, তাই…

—নাহ্‌। ওর মধ্যে একটা সাইকোফ্যান্সি গ্রো করেছে। বাসবেন্দ্র হচ্ছে এখন ওর ডেমি গড। বাসবেন্দ্রর প্রিয়পাত্রকে আঘাত করা মানে… বুঝতেই পারছ! অথচ আমাদেরও মুখের ওপর কিছু বলতে পারছে না…। শব্দ করে হাসল নির্মল, পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেল,—এই অ্যাটিটিউডটা আমার ভাল লাগছে না সাহেব। যদ্দিন গ্রুপ ছোট ছিল, ঠিক ছিল। নাউ উই আর নট দ্যাট স্মল। এখন আমাদের গ্রুপের পলিসি, মটো, সব রিভিউ করা দরকার। তোমার কী মনে হয়?

—হুম। শুভেন্দু মাথা নাড়ল,—একদিন টোটাল গ্রুপ নিয়ে বসতে হবে।

টাউন স্কুলের উল্টো দিকে এসে দাঁড়িয়ে গেল দুই বন্ধু। নির্মল ঘড়ি দেখল একবার। জিজ্ঞেস করল,—তুমি কি এখন স্ট্রেট বাড়ি?

—কোথায় আর যাব! খোঁটা বাঁধা আছে না!

—চলো না আমার ওখানে। একটু আড্ডা ফাল্ডা মারি। মঞ্জরী সেদিনও বলছিল, সাহেবদা আমাদের ভুলেই গেছে।

—তোমার তো আবার কী সব ফোন টোন আসবে?

—আরে ধুত, আমার এক কলেজকলিগ করবে। কলেজের একটা ফালতু ইসু নিয়ে…। চলো চলো।

একটু ইতস্তত করে শুভেন্দু রাজিই হয়ে গেল। সত্যি বলতে কী, তাড়াতাড়ি ফিরে একা আজ নন্দিতার মুখোমুখি হওয়ার কোনও মানেই হয় না।

সময় কাটল বেশ। মঞ্জরী দারুণ খুশি, ছাড়তেই চায় না, ছাড়তেই চায় না, শুভেন্দু বেরোল রাত সাড়ে নটায়। বাড়ি ফিরে দেখল লিভিংরুমের বড় আলো নেবানো, স্ট্যান্ডল্যাম্প জ্বলছে, আলো আঁধারের আবছায়া মেখে সোফায় বসে আছে নন্দিতা, টিভিতে নিমগ্ন।

বাড়ি ঢোকার সময়েই চাপটা ফিরে এসেছিল আবার, নন্দিতাকে দেখে হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল শুভেন্দুর। কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব অচঞ্চল রেখে শুভেন্দু জিজ্ঞাসা করল,—তিন্নি ফিরেছে?

—হুঁ। সোফার আবছায়া সামান্য কাঁপল।

—কখন ফিরল?

—তোমার আগে। টাইম দেখিনি।

শুভেন্দুর গলা পেয়েই ঘরের দরজায় উঁকি দিয়েছে তন্নিষ্ঠা। হাতের ইশারায় ডাকল শুভেন্দুকে।

মেয়ের ঘরে এসে বাঁচল শুভেন্দু, কী রে?

—আমার ড্রেসটা কেমন হয়েছিল দ্যাখো! তন্নিষ্ঠা হাতে আঁচল ছড়িয়ে দিল,—বলো, কেমন লাগছিল?

গাঢ় দৃষ্টিতে মেয়েকে নিরীক্ষণ করল শুভেন্দু। ঘন নীল কাঞ্জিভরম পরেছে তিন্নি, গলায় মুক্তোর নেকলেস্‌, কানে মুক্তো, হাতে মুক্তো, খোঁপায় জুঁইমালা, কপালে ছোট্ট টিপ। মুখে গোলাপি আভা ফুটছে তিন্নির, এ নিশ্চয়ই মেকআপের নয়? তিন্নির চোখের মণি কি এত কাজলকালো?

শুভেন্দুর বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠল। শাড়ি পরলে মেয়েটাকে এমন নন্দিতা নন্দিতা লাগে কেন?

তন্নিষ্ঠা অধৈর্য ভাবে বলল,—কী, বলো?

—মার্ভেলাস। পারফেক্ট। মুক্তোটা দারুণ লাগছে।

তন্নিষ্ঠা ঠেটি ফোলাল,—মা বলল মুক্তোটা নাকি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচই করেনি।

—মার কথা বাদ দে। মেয়েদের ড্রেসের আসল সমঝদার হল পুরুষরা, এ তোর মা জানেই না।

কথাটা মনে ধরেছে তন্নিষ্ঠার। ঝলমলে মুখে বলল,—অভিমন্যুও খুব প্রশংসা করছিল।

—সে কে?

—ও একটা পাগলা পাগলা ছেলে। মালবিকার বরের বন্ধু। গন্ধের কারিগর।

—সেটা কী জিনিস?

—পারউিউম তৈরি করে। নিজের ফ্যাক্টরি আছে। কেমিস্ট্রিতে এম এসসি, একটা ল্যাবরেটরিতে কাজ করত, কী সব ঝগড়া টগড়া করে ছেড়ে দিয়ে…। আমাকে আজ পারফিউম প্রেজেন্ট করেছে একটা। দেখবে?

বলেই তন্নিষ্ঠা ড্রেসিংটেবিল থেকে একটা শিশি তুলে বাড়িয়ে দিয়েছে।

শুভেন্দু দেখল শিশিটা। বিশেষত্বহীন চেহারা, ভেতরের তরলটা একটু বেশি হলুদ। নামটা মন্দ নয়, ডিউ ড্রপ। মুন ড্রপ থেকে ঝেড়েছে বোধহয়। নাকের কাছে এনে শুঁকল একটু, —এহ্‌, গন্ধটা তো খুব চড়া রে!

—হ্যাঁ, গ্রামবাংলায় ব্যাচে তো। শিশিটা নিয়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দিল তন্নিষ্ঠা, —গন্ধটা আমারও ভাল লাগেনি। হাতে করে দিল, রিফিউজও করা যায় না।

শুভেন্দু বলল,—তোর মালবিকার বিয়ে-এপিসোড তাহলে ওভার?

—ভেরি মাচ ওভার। ওরা কালই হানিমুনে বেরিয়ে যাচ্ছে। লোলেগাঁও।

—সামনের বছর তুমিও এই সময়ে যেও। শুভেন্দু মেয়ের গালে ছোট্ট টোকা দিল, —জায়গা চুজ করে রেখেছিস?

—শৌনকের ইচ্ছে সুইজারল্যান্ড! আমার ইচ্ছে ডায়মন্ডহারবার। তন্নিষ্ঠা ফিকফিক হাসছে, দেখি মাঝামাঝি কোথায় রফা হয়।

দরজায় নন্দিতার ছায়া,—বাপ মেয়ের আহ্লাদীপনাই চলবে? নাকি বাপের কিছু মুখে তোলা হবে?

শুভেন্দু সিঁটিয়ে গেল সামান্য। বলল, —দাও, আমি আসছি।

—দয়া করে এসো। সকালে আমার অফিস কাছারি থাকে, রাত করে শুলে আমার অসুবিধা হয়।

শুভেন্দুর ফুসফুসে যেটুকু খুশির বাতাস জমেছিল বেরিয়ে গেছে। নন্দিতা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল, কী ভেবে ফিরে এল। হঠাৎ মেয়ের মুখের সামনে দুটো আঙুল নাচাতে শুরু করেছে,—এই তিন্নি, ধর তো একটা।

তন্নিষ্ঠা বিস্মিত ভাবে বলল, —কেন? কী হবে?

—আহ্, ধর না।

শুভেন্দুর দিকে তাকাতে তাকাতে খপ করে মধ্যমাটা চেপে ধরেছে তন্নিষ্ঠা। মুহূর্তে শুভেন্দুর মুখ খুশিতে ভরে গেল,—বাঁচালি।

—মানে?

—তোর মাকে আজ বলতে হবে না।

—কী?

—আছে একটা কথা। ভাবছিলাম আজ জানাব, না পরে জানাব!

—কী কথা? হেঁয়ালি কোরো না, বলো না।

শুভেন্দু গলা নামাল,—অফিসে আজ আমার গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ফতোয়া এসেছে। তিন মাসের মধ্যেই ছুট্টি।

পলকে তন্নিষ্ঠার মুখখানা শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেল। প্রায় আর্তস্বর ছিটকে এসেছে,—মানে তোমাকে বসিয়ে দিচ্ছে?

—আহ্, চুপ চুপ। মেয়ের মুখে হাত চাপা দিল শুভেন্দু,—চেঁচাচ্ছিস কেন? এই মাত্র ডিসিশান হয়েছে না, তোর মা আজ জানবে না?

তন্নিষ্ঠা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে।

শুভেন্দু মুখ ঘুরিয়ে নিল। মেয়েকে চোখের জল না দেখানোই ভাল।

.

০৩.

অভিমন্যু হনহন হাঁটছিল। দেরি হয়ে গেছে খুব। সমীরণকে পাক্কা নটায় কারখানায় আসতে বলেছিল, এখন নটা চল্লিশ। সেলুনের ছেলেটা সামান্য দাড়ি ট্রিম করতে এত সময় লাগিয়ে দিল! কান এফ-এম্‌ চ্যানেলের গানে, মুখে অবিরাম পাড়ার ঘোঁট, হাতের কাঁচি চলবে কী করে! সমীরণটা যা উড়ুউড়ু টাইপ, ফস করে না কোনও কাজের ছুতোয় পালিয়ে যায়! গোবিন্দ মালতীরা যদি বুদ্ধি করে ছেলেটাকে আটকে রাখে তো মঙ্গল।

—এই অভিদা, অভিদা…?

উল্টো ফুটে ভোলা। ল্যাম্পপোস্টে ঠেসান দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হাঁক পাড়ছে।

অভিমন্যু বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল, —কী বলছিস?

—তোমায় ননীদা কাল থেকে খুব খুঁজছে।

—কেন, কী দরকার?

—বলতে পারব না। তবে মনে হয় হেব্‌বি আজ্‌জেন্ট। ননীদা পার্টি অফিসে আছে, একবার দেখা করে যাও।

কথার ভঙ্গিটায় সামান্য হুকুম মেশা। স্বাভাবিক। ননী সেন এ অঞ্চলের খুদে রাজনৈতিক নেতা। তার দাপটে কুকুর বেড়ালে এক ডাস্টবিনের খাবার খায়। অভিমন্যু অবশ্য ননী সেনকে ডরায় না। তবে ননীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কও খারাপ নয়, মোটামুটি একটা পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা আছে, দায়ে অদায়ে ননী তাদের পাশেও দাঁড়িয়েছে অনেক বার। বাড়িউলির সঙ্গে ঝামেলায়, দাদার অসুখের সময়…। চামচার কথাবার্তার ঢং যেমনই হোক, ননী সেনের মনটা ভালই।

অভিমন্যু ভুরু কুঁচকোল। সে রাজনীতির সাতে পাঁচে থাকে না, পার্টি অফিসে ঢোকায় তার একটু আড়ষ্টতা আছে। তা ছাড়া এই তাড়াহুড়োর সময়ে…

সামান্য দোনামোনা করে পার্টি অফিসেই এল অভিমন্যু। সুন্দর সাজানো গোছানো ঘর। কাচ লাগানো সেক্রেটারিয়েট টেবিল, আট দশখানা চেয়ার, কয়েকটা ফাইবার গ্লাসের লাল টুকটুকে টুল, দুখানা স্টিলআলমারি, গদিমোড়া বেঞ্চি, সবই পরিপাটি ভাবে বিন্যস্ত। দেওয়ালের ছবিগুলোও ঝকঝক করছে, দেখে বোঝা যায় রোজ মোছা হয়। ঘরখানার এককালে বেশ ভগ্ন দশা ছিল। টিনের চাল, ফাটাফাটা মেঝে, মলিন আসবাব…! এখনও অবশ্য তার স্মৃতি আছে এক আধটা। যেমন ওই কোণে পড়ে থাকা ভাঙা শোকেসখানা।

ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনা আট দশ লোক। যুবকই বেশি, বয়স্কও আছে এক আধজন। কেজো আলাপ চলছে।

ননী সেনের চোখ খবরের কাগজে। পাশ থেকে এক যুবক তার কানে কী যেন বিনবিন করে চলেছে, পড়তে পড়তেই মাথা দুলিয়ে চলেছে ননী। যুবকটির মুখ আধচেনা মতো লাগল অভিমন্যুর, বাজার টাজারে দেখেছে বোধহয়।

গলা খাঁকারি দিল অভিমন্যু,—কী ননীদা, আমায় হঠাৎ তলব কেন?

বছর পঁয়তাল্লিশের ননী মুখ তুলে একগাল হাসল,—আয় আয়…

—জলদি জলদি বলো, আমার তাড়া আছে।

—তুই মিনি ইন্‌ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের মতো কথা বলছিস দেখি? পন্টু, দুটো লিকার-চা বলে দে তো।…তারপর বল্‌, তোর কারখানা চলছে কেমন?

ওফ্‌ খাজুরা শুরু হল! অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল অভিমন্যু। হেসে ফেলল,—আমাদের মতো সুপার স্মল স্কেলরা যেমন চলে, তেমনই চলছে। লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে যায়, আমরা কারখানার মালিক হয়েছি এই আনন্দে ঘরে বসে আঙুল চুষি।

—কেন? তোর মাল চলছে না?

—ধরছে আস্তে আস্তে। টাইম লাগবে। গাঁ গঞ্জের বাজার, লোকে আলু পেঁয়াজ কিনবে, না সেন্ট মাখবে?

—লোকাল দোকান ফোকানে দিস না?

—চেনা জায়গায় মার্কেটিং করার বহুত হ্যাপা। সাধাসাধি করলে হয়তো একটা দুটো রাখল, তবে দাম দেওয়ার সময়ে রোজই বলে কাল এসো, পরশু এসো…। বিক্রি হয়ে গেলেও। কাঁহাতক ঝগড়া করি বলো তো?

—হুম্‌, সর্বত্রই প্রবলেম! দোকানদার দোকানদারের মতো করে ভাবে, তোরা তোদের মতো করে দেখিস। আমাকে দিস্ তো কয়েকটা, বনমালীকে বলব রাখতে। আমি দিলে ও তোর পেমেন্ট মারতে পারবে না।

হ্যাঁহ্‌, তারপর চারদিকে কায়দা করে শোনাও তুমিই ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে দিলে! মনে মনে আওড়াল অভিমন্যু, মুখে কিছু বলল না। জিভটা উশখুশ করছে একটা সিগারেটের জন্য। ধরাবে এখানে? পথেঘাটে সে ননী সেনের সামনেই সিগারেট খায়, কিন্তু এখন যেন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। ননীর গুহায় বসে আছে বলে? চিন্তাটাতে যেন সামান্য দাসত্ব রয়ে গেছে? অভিমন্যু পকেট থেকে সিগারেট দেশলাই বারই করে ফেলল। ধরাল একটা, প্যাকেটটা ননী সেনকে বাড়াল না। থাক, ননীদা হয়তো অপমানিত বোধ করতে পারেন।

ননীর মুখে ভাবান্তর নেই। যেন অভিমন্যুর সিগারেট ধরানোটা খেয়ালই করেনি। সহজ সুরে বলল,—তারপর, তোর বিজ্ঞানমঞ্চ চলছে কেমন?

—চলতা হ্যায়। শো হচ্ছে মাঝে মাঝে। দু তিনটে নতুন ছেলেমেয়ে এসেছে, কলেজের ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার…দারুণ জিল্‌ আছে। আবার ঘড়ি দেখল অভিমন্যু,—কী বলবে বলছিলে, বললে না?

—এই কথাটাই। এই তোর বিজ্ঞানমঞ্চ। তোকে একটা শো করতে হবে।

—কবে? কোথায়?

—একটা কলেজে। সাউথেই। এপ্রিলের ফাস্ট রোববার। চার তারিখ।

—হুঁউ, করা যেতে পারে। অভিমন্যু একটু উদ্দীপিত বোধ করল,—কী ধরনের প্রোগ্রাম চাই?

—ওই, সব কিছু একটু মিলিয়ে মিশিয়ে। গ্লাসে কালো চা এসে গেছে, অভিমন্যুকে গ্লাস এগিয়ে দিল ননী,—আমার ভাইঝি পড়ে ওই কলেজে। একটু ইউনিয়ন টিউনিয়নও করে। এবার ওদের কলেজের সিলভার জুবিলি। অনেক ফাংশান টাংশান হবে, ইউনিয়নের ইচ্ছে একটা এগ্‌জিবিশানও হোক।…সেখানেই যদি জেনারেল অ্যাওয়্যারনেসের জন্য কিছু একটা করিস্‌…। এই ধর, তোদের স্লাইড্‌শো, কিছু হাল্‌কা ডেমন্‌স্ট্রেশান, সঙ্গে তোদের ওই যে কী সব ভণ্ডামি বুজরুকি ধরার টেস্ট ফেস্ট আছে না…!

—বুঝেছি। খিচুড়ি প্রোগ্রাম…। তা মালপত্র সব নিয়ে যাব, ট্যাক্সি ভাড়া টাড়া দেবে তো?

—নিশ্চয়ই দেবে। ইউনিয়ন যখন অ্যারেঞ্জ করছে…। জগন্নাথদা ওই কলেজের প্রেসিডেন্ট। উনি নিজে সব দেখভাল করছেন। ওঁর পারসোনাল ইচ্ছে এই ধরনের কিছু একটা হোক। বেশির ভাগ কালচারাল প্রোগ্রাম তো এখন অপসংস্কৃতি, তার মধ্যে কিছু সুস্থ চিন্তাভাবনাও থাকুক।

অভিমন্যুর কপালে ভাঁজ পড়ল,—প্রোগ্রামটা তোমাদের পার্টির ক্যাম্পেন নয় তো?

—আরে না না। হচ্ছে রজতজয়ন্তী উৎসব, সেখানে আবার ক্যাম্পেন কী? ননী শব্দ করে গ্লাসে চুমুক দিল। হাসতে হাসতেই বলল,—তোর এত ছুতমার্গ কীসের রে? তোরা তোদের মতো শো করবি, পাবলিক দেখবে, শুনবে, জানবে…কারা অ্যারেঞ্জ করছে তাই নিয়ে তোর কীসের মাথাব্যথা? কী আসে যায় তোর?

—আমার আসে যায় ননীদা। অভিমন্যুও হাসি ধরে রাখল ঠোঁটে। মৃদু শ্লেষের সুরে বলল,—তোমাদের কৃপায় তো কিছুই আর রাজনীতির বাইরে রাখার উপায় নেই, অনেক কষ্টে আমাদের ইউনিটটা এখনও অ্যাপলিটিকাল রেখেছি। আমি চাই সেরকমই থাকুক।

ননীর হাসি ঈষৎ শীতল হল,—তুই কী মিন করতে চাইছিস, তুইই জানিস।…তোদের ডেকে এসব অনুষ্ঠান করা কি খারাপ কাজ?

—কোনও কাজই নিখাদ খারাপ ভাল হয় না ননীদা। কাজটা কী উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, সেটাই ভাল মন্দ মাপার একমাত্র মাপকাঠি। অভিমন্যু উঠে পড়ল।

—প্রোগ্রামটা তাহলে করবি না?

—নাহ্, তোমার ভাইঝি আছে যখন, করে দেব। এক কাজ করো, তোমার ভাইঝিকে বলো আমার সঙ্গে কন্‌ট্যাক্ট করতে। টাইম ফাইমগুলো ওর সঙ্গে ডিস্‌কাস্‌ করে নেব।

বেরিয়ে এসে আর একটা সিগারেট ধরাল অভিমন্যু। মনটা একটু খচখচ করছে। রাজি না হলেই কি ভাল হত? থাক গে, ননীদাকে এটা অন্তত তো বোঝানো গেছে, সে হুকুম করলেই ল্যালল্যাল করে ছুটবে না অভিমন্যু। সরাসরি ননীদার মুখের ওপর না বলে দেওয়াটাও বোধহয় অকৃতজ্ঞতা হত।

রোদ বেশ চড়া আজ। দশটা বাজতে না বাজতেই তেতে গেছে পৃথিবী। ধুলো উড়ছে। চৈত্র মাস আসার আগেই ছোট ছোট ঘূর্ণি তৈরি করতে শুরু করেছে বাতাস।

অভিমন্যুর কারখানা দু মিনিটের পথ। একটা দোতলা বাড়ির একতলায়। পিছন দিকে। দরজায় সাইনবোর্ড ‘মনামি কেমিক্যালস।’ ঢুকে সরু ফালি প্লাইউড ঘেরা জায়গা। অফিস। লাগোয়া ঘরখানা প্রোডাকশান রুম। ঘরের একদিকে জার বিকার শিশি বোতল অ্যাটোমাইজার স্তূপ, পারফিউম বক্স, অন্য দিকে দুখানা ক্যাপ সিলিং মেশিন। ছোট ঢাকা উঠোনও আছে একটা, সেখানে প্যাকিং বক্সের ডাঁই, ভাঙা শিশি, ছেঁড়া পিজবোর্ড, দুটো চারটে বস্তাও।

কারখানার বাইরে থেকেই সমীরণের গলা পেল অভিমন্যু। আছে এখনও। জোর জেরা করছে গোবিন্দকে, —ডিভাইনের গন্ধটা সাস্‌টেন করার জন্য কী মেশাচ্ছ বলো তো?

অভিমন্যু দাঁড়িয়ে পড়ল। গোবিন্দ মিনমিন করে কী যেন বলছে।

আবার সমীরণের স্বর, —না না, ওসব পাতি জিনিস মেলালে হবে না, ফরেন কেমিক্যালস্ কিছু মেশাচ্ছ কি?

—কোনটা ফরেন, কোনটা অ-ফরেন আমরা কী করে জানব? দাদা যেভাবে যা বলেন, আমরা করে যাই।

—হ্যাহ্‌, দাদা! দাদাকে তো আর রেগুলার পাবলিক ফেস্ করতে হয় না…। জামাকাপড়ে সেন্টের দাগ লেগে থাকছে কেন শুনি? বেস্‌টা কী দাও? অয়েল?

—না, আমরা তো জল ব্যবহার করি।

—জল? আমি জল মেশানো মাল ফিরি করে বেড়াই? তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছে সমীরণ, তাই এত কমপ্লেন! নাহ্, দাদাকে বলতে হবে, এসব জালি জিনিস চলবে না।

অভিমন্যু নিঃসাড়ে ঢুকে অফিসের চেয়ারে বসল। আপন মনে হেসে নিল একটু। নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যালকোহলে নির্দিষ্ট পরিমাণ জল মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করা হয়, তারই বাজারচলতি নাম জল। মাস তিনেক হল সমীরণ চাকরিতে ঢুকেছে এখানে, আগে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাটলারি সেট, হাতা খুন্তি, ইস্ত্রি, এসব বেচত। এখনও গন্ধ-ব্যবসার সন্ধ্যাভাষা তার রপ্ত হয়নি।

হাসি চেপে গলা ওঠাল,—সমীরণ, ওটা তোমার এরিয়া নয়। ওদের শান্তিতে কাজ করতে দাও, তুমি এখানে এসো।

সমীরণ গটগটিয়ে চলে এল। বসেছে চেয়ারে। এক গাল হেসে বলল,—দাদা আজ এত লেট করলেন? আমার এক মাসি থাকে বেহালা চৌরাস্তায়, মাসিকে একটা জমির খবর দেওয়ার ছিল, ভাবছিলাম ঘুরে আসি….

—ভাগ্যিস যাওনি। একবার কেটে পড়লে তো তোমার টিকি পাওয়া যেত না।

—যাহ্‌। কী যে বলেন দাদা! বারোটার মধ্যেই চলে আসতাম।

—ঠিক আছে। এবার তোমার রিপোর্ট টিপোর্টগুলো দাও। শোনাও তোমার নদিয়া ভ্রমণের বার্তা।

সমীরণ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে ব্রিফকেস খুলল। কাগজপত্র বার করছে। তার বয়স চব্বিশ পঁচিশের বেশি নয়, ডিগডিগে লম্বা, রং ফর্সার দিকে, খাড়া নাক, মুখে একটা চোয়াড়ে চোয়াড়ে ভাব আছে। চোখের মণি সতত সঞ্চরণশীল, চড়ুইপাখির মতো। সর্বদাই টিপটপ থাকে সমীরণ, এই গরমেও তার শার্টের হাতা কব্‌জি অবধি নামানো।

অর্ডার ফর্মের প্যাডগুলো অভিমন্যুকে দিল সমীরণ। দেখছে অভিমন্যু, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সপ্রশংস উক্তি বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে। ভালই অর্ডার এনেছে তো সমীরণ! বেথুয়াডহরি পলাশি নবদ্বীপ কৃষ্ণনগর শান্তিপুর রানাঘাট চাকদা—অনেক জায়গা চষেছে। এমন কয়েকটা ডিস্ট্রিবিউটারের অর্ডার আছে, যাদের কাছে অভিমন্যু নিজে গিয়েও দাঁত ফোটাতে পারেনি। নাহ্, ছেলেটার এলেম আছে, এ একটু আধটু চাঁট মারতেই পারে।

হাত বাড়িয়ে হোয়াট-নট থেকে একটা গার্ডফাইল টানল অভিমন্যু, অর্ডারগুলো সাজাচ্ছে একে একে। কাগজ টেনে যোগ শুরু করল। অর্ডার আর অ্যাডভান্সের পরিমাণ।

সমীরণ সোজা হয়ে বসেছে,—দাদা, এবার কিন্তু লোকনাথ এজেন্সি খুব কথা শুনিয়েছে।

—কী বলছে?

—আপনি ওদের মালের সঙ্গে গিফট্‌ দেবেন বলেছিলেন, অথচ লাস্ট লটেও কিচ্ছু যায়নি….

—হুম্‌, পাঠানো হয়নি।…কী গিফট্‌ দিই বলো তো?

—একটা করে চামচ দিতে পারেন?

—চামচ! অভিমন্যু হিসেব থেকে চোখ তুলল,—আমি কি কাশির সিরাপ বেচছি, যে সঙ্গে চামচ দেব?

—সস্তা হত। বড়বাজার থেকে লটে কিনলে পঁচাত্তর পয়সা।

দিনকাল কী পড়েছে! কাস্টমার মালের সঙ্গে যা হোক একটা কিছু ফ্রি পেলেই খুশি! কীসের সঙ্গে কী ম্যাচ করে তাই নিয়ে কে মাথা ঘামায়!

অনেক ডিস্ট্রিবিউটারই এবার অগ্রিম টাকা পাঠিয়েছে, অর্থের পরিমাণ নেহাত কম নয়, সমীরণের কাছ থেকে টাকা চেক সব বুঝে নিল অভিমন্যু। বকেয়া পেমেন্টও বেশ কিছু এসেছে, সেটাও। এখন কয়েক মাস বাজার মন্দ যাবে না, টাকাপয়সা বড় একটা পড়ে থাকবে না মার্কেটে। গ্রীষ্ম আসছে। গরমকালের একটা অন্তত সুফল আছে, গায়ে বগলে ঘাম জমে খুব, লোকে সময় অসময়ে সুগন্ধী হাতড়ায়। পুজোর পর থেকে আবার শীতলতা, তখন এই সব ডিস্ট্রিবিউটাররাই দাঁত নখ নিয়ে স্বমূর্তিতে বিকশিত হবে। পঞ্চাশটা টাকা পেমেন্ট পেতেও তখন যে কী যন্ত্রণা! তিন বছর আগে, যখন নতুন ব্যবসায় নেমেছিল অভিমন্যু, এক একদিন কান্না পেয়ে যেত। সেই কোন দূরে পেমেন্ট কালেকশানে গেছে, ভোরবেলা বেরিয়ে সন্ধে পর্যন্ত হাট মাঠ চষেছে, ফেরার সময়ে ট্রেনে বসে দেখছে পকেটে মোটে এক টাকা নব্বই! কানে বাজছে ডিস্ট্রিবিউটারদের বুকনি, সাত দিন হল কারবার খুলে পেমেন্ট নিয়ে পাগল করে দিচ্ছেন! পাবেন পাবেন, আমরা কারুর টাকা মারি না! এই শুনে শুনে কত হাজার টাকা গর্তে ঢুকে গেল, কতজন যে আর উপুড়হস্ত করল না! বাবার পি এফের কতটাই যে জলে গেছে! এখনও কি সামলেছে পুরোপুরি? ভাবতে ভয় হয়, প্রতি মুহূর্তে মনে হয় পায়ের নীচে যেন চোরাবালি।

একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অভিমন্যু, সমীরণের ডাকে সম্বিত ফিরল,—দাদা, একটা কথা ছিল!

—বলো।

—লাস্ট লটের মালে কিন্তু কিছু কমপ্লেনও আছে।

—শোনা হয়ে গেছে। অভিমন্যু আলগা হাসল,—গন্ধটা কেন অনন্তকাল থাকছে না, জামাকাপড়ে কেন দাগ লাগছে, তাই তো?

চোখেমুখে কথা বলা ছেলেটা লজ্জা পেয়ে গেল,—হ্যাঁ, মানে….

—শোনো। যে দামে আমরা মাল দিই তাতে কি ফরাসি পারফিউম হবে? তাও তো আমি নিজে খেটে খেটে গন্ধগুলো ইনভেন্ট করছি, কমন কোনও সুগন্ধের সঙ্গে এগুলো মিলবে না….এর বেশি আমি কী করতে পারি বলো? আর হ্যাঁ, লাস্ট লটটা আমি একটু অন্য ভাবে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম, ফাইনাল টেস্টটা হয়ে ওঠেনি, তার জন্যই হয়তো দাগ টাগ…। তুমি ওদের বোলো কমপ্লেন-আসা মালগুলো পাঠিয়ে দিতে, আমি চেঞ্জ করে দেব। ঠিক হ্যায়?

ঢক করে ঘাড় নাড়ল সমীরণ। ব্রিফকেস খুলে আর এক তাড়া কাগজ বার করে বাড়িয়ে দিয়েছে। গলা নামিয়ে বলল,—এবার কিন্তু একটু টি.এ বেশি আছে দাদা।

—কত?

—চোদ্দশো ষাট।

চমকাল অভিমন্যু,—এত?

—হবে না? কতগুলো জায়গায় ঘুরেছি, ছ’টা নাইট স্টে আছে….ট্রেনভাড়া বাসভাড়া কিছুই তো আর কম নেই দাদা! কৃষ্ণনগরের ডিস্ট্রিবিউটরকে একদিন আবার খাওয়াতে টাওয়াতে হল…

অভিমন্যু টি.এ বিলগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিল। নিখুঁত হিসেব সাজানো, তবে স্বচ্ছন্দে গোজামিলগুলো ধরে ফেলা যায়। এই সব প্রত্যেকটি জায়গাই তার চষা, কোথায় কেমন হোটেল খরচা লাগতে পারে মোটামুটি জানে সে। সমীরণ থাকেও ব্যারাকপুরে, কদিন কোথায় রাত্রিবাস করেছে তাতেও সন্দেহ আছে।

সমীরণকে কোনও কূট প্রশ্ন করল না অভিমন্যু। জামাকাপড়ে যতই কেতাদুরস্ত হোক ছেলেটা অভাবী, বাপ মারা যাওয়ার পর বি কমটা পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি, মা আর তিন ভাইবোনের সংসার প্রায় একাই টানছে। কত আর মাইনে দিতে পারে অভিমন্যু? পনেরো শো টাকায় কী হয় আজকের দিনে? নয় দু চারশো টাকা বেশি নিলই। খাটছে তো।

ক্যাশবক্স থেকে টাকা বার করতে করতে অভিমন্যু জিজ্ঞাসা করল,—তোমার মা কেমন আছেন?

—চোখের প্রবলেমটা খুব ভোগাচ্ছে মাকে। ডাক্তার বলছে একটা অপারেশন করতে হবে।

—করিয়ে নাও।…..দরকার হলে কিছু অ্যাডভান্স নিও, মাসে মাসে কাটিয়ে দেবে।

—দেখি। টাকা ব্রিফকেসে ঢোকাল সমীরণ। ডালা আটকাতে আটকাতে বলল, দাদা, আমার আরও একটা কথা ছিল।

—কী?

—সামনের মাসে আমি দিন সাতেকের ছুটি নেব। তখন কিছু অ্যাডভান্সও লাগবে কিন্তু, শ পাঁচেক।

—কেন?

—শুশুনিয়া যাব।

—বেড়াতে?

সমীরণ হেসে ফেলল,—না। আমার একটা বদ নেশা আছে। মাউন্টেনিয়ারিং। সামনে মাসে আমার ট্রেনিং ক্যাম্প।

—এ নেশা জোটালে কোত্থেকে?

—ছোটবেলা থেকে পাহাড় আমায় ভীষণ টানে দাদা। আর ওই স্পোর্টটা…..মানে….খুব অ্যাডভেঞ্চারাস তো। টাকা জমিয়ে এর আগেও আমি একবার ট্রেনিং নিয়ে এসেছি।…..আমার ভীষণ ইচ্ছে করে, একবার মাউন্ট এভারেস্টে উঠব।

বুকের ভেতরটা শিরশির করে উঠল অভিমন্যুর। ঝলক দেখল সমীরণকে। আহারে এমন স্বপ্ন নিয়েই তো বাঁচে মানুষ। স্বপ্নটা আছে বলেই বোধহয় এরকম চরকির মতো ঘুরতে পারে ছেলেটা, ওই ল্যাগবেগে চেহারায় অসুরের মতো পরিশ্রম করতে পারে। দীনহীন প্রাত্যহিক জীবনটাও হয়তো ওর সহনীয় হয়ে উঠেছে এই স্বপ্নের কল্যাণে। সে নিজেও যে এই সুগন্ধীর ব্যবসা করছে, সবটাই কি পেশা?

অভিমন্যু হাত নেড়ে বলল,—সব হবে, সব হবে। আগে তুমি একবার বর্ধমান ডিস্ট্রিক্টটা ট্যাপ করে এসো তো। রাজরানি জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে মাল তোলেনি, শ্রীদুর্গার তিনটে পেমেন্ট ডিউ হয়েছে, তোমার প্রিডিসেসর তো মাল দিয়ে চলে গেল, আমার যে চুল পেকে যাচ্ছে! আসানসোল মার্কেটেও বাসব ব্রেক থ্রু করতে পারেনি, দ্যাখো তুমি যদি…..

—কবে নাগাদ বেরোতে হবে?

—এ উইকটা রেস্ট নিয়ে নাও। তোমার নর্থ চব্বিশ পরগনার ডিস্ট্রিবিউটারদের সঙ্গে দেখা টেখাগুলো সারো….! কটা মাস যাক তোমাকে আমি খানিকটা হালকা করে দেব, আরও দুজন সেল্‌সম্যান…

—আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না কিন্তু।

—তা বলে তুমি একাই গোটা বেঙ্গল টানবে নাকি? শিলিগুড়ি বেল্টটা তো ছোঁয়াই হয়নি কোনওদিন।

আরও দু চারটে কাজের কথা বলে চলে গেল সমীরণ।

অভিমন্যু পাশের ঘরে এল। গোবিন্দ আর মালতী কাজ করছে মন দিয়ে। মেজারিং সিলিন্ডারে মেপে মেপে অতি সন্তর্পণে শিশিতে সুগন্ধী ভরছে মালতী, গোবিন্দ একটা একটা করে অ্যাটোমাইজার লাগিয়ে সিলিং মেশিনে চাপাচ্ছে। গোবিন্দর বয়স বছর পঁচিশ, পাড়ারই ছেলে। মালতী আসে করুণাময়ী থেকে, বিবাহিত, বাচ্চা কাচ্চা আছে, স্বামীর কারখানা লকআউট, সে’ই এখন সংসারের হাল। চব্বিশ পরগনা নদিয়া হাওড়া হুগলি বর্ধমান মিলিয়ে গোটা চল্লিশেক জায়গায় এখন অভিমন্যুর মাল যায় বটে, তবে কোথাওই একবারে ছ আট ডজনের বেশি নয়, এই দুজনেই এখনও পর্যন্ত কাজ উঠে যাচ্ছে। এতেই টার্নওভার মন্দ নয়, মাসে মোটামুটি পঁচাত্তর হাজার, সক্কলকে দিয়ে থুয়েও হাতে হাজার সাতেক। ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে ব্যবসাটা আর একটু বাড়ানোর কথা বলছে বাবা, অভিমন্যুর ভয় করে ব্যবসাটাই যদি তাকে শেষে গিলে খেয়ে নেয়!

বড় জারে বেশ কিছুটা তরল। বর্ণহীন। ঢাকা খুলে শুঁকল অভিমন্যু, গোবিন্দকে বলল,—এটা কবে বট্‌লিং করতে হবে মনে আছে তো?

—কাল। সাড়ে এগারোটার পর।

—হ্যাঁ। মনে করে আজ পাঁচ সিসি অ্যাসিটোফেনন মিশিয়ে দিস তো। অভিমন্যু কবজি উল্টে সময় দেখল,—এই ধর, অ্যারাউন্ড তিনটে। আমি যদি এসে পড়ি তো আমিই দেব।

—আচ্ছা।

—সিলিং হয়ে গেলে পারফিউম বক্সগুলো তৈরি করে ফেলিস। খুব সাবধানে, হ্যাঁ?

বলে অফিসে ফিরে এল অভিমন্যু। খাতাপত্রের কাজ করল কিছুক্ষণ। অ্যাকাউন্ট্‌সের কাজও সে নিজেই করে, শুধু বছরের শেষে সুপ্রিয়কে দিয়ে একবার পরীক্ষা করিয়ে নেয়। এবার একবার যাওয়া দরকার, ইয়ার এন্ডিং তো ঘনিয়ে এল। সুপ্রিয়রা যেন কবে ফিরছে হানিমুন থেকে?

চড়াং করে মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই পারফিউমটার কথা। নাকি সেই সুগন্ধী মেয়েটার কথা? সুপ্রিয়র বউভাতের দিন পারফিউমের নাম এনে দিয়েছিল তন্নিষ্ঠা। ফ্যান্সি মার্কেট থেকে কিনেও এনেছে অভিমন্যু। নামটা পিকিউলিয়ার। ডেড্‌লি। শুনলেই একটা ঘাতকের অনুভূতি আসে। কিন্তু ঘাতক কে? পারফিউমটা? না যে পারফিউমটা মেখেছিল, সে?

নিজের ভাবনায় নিজেই মজা পেল অভিমন্যু। তন্নিষ্ঠা কি সম্মোহিত করে দিল তাকে? ওরে নির্বোধ মায়া কাটা, দেরি হয়ে গেছে।

বেঁটে আলমারিটা খুলে অভিমন্যু পারফিউমের শিশিটা বের করল। মণিবন্ধে স্প্রে করল সুরভি। ঘ্রাণ নিচ্ছে। আশ্চর্য, গন্ধ তো সেদিনের মতো লাগে না!

কী কী আছে এতে? বের্গামট্‌ অয়েল বোঝাই যাচ্ছে, হালকা ইউক্যালিপটাসও টের পাওয়া যায়…..আর কী আছে? একটা ফুল ফুল গন্ধ আসে কেন? অচেনা ফুল? জুঁই ল্যাভেন্ডার গোলাপ বা রজনীগন্ধা নয়, তবে কি ইলাং-ইলাং? মাদাগাস্কারের ফুল ব্যবহার করেছে? ফিক্সেটিভ কী আছে? সিভেটোন কেন মনে হয় আজ? তাহলে তো এটা ফ্লোরাল! সেদিন কেন মনে হয়নি? কেন একটা অদ্ভুত পাতার গন্ধ পাচ্ছিল সে? কচি পাতা, একটু বুনো বুনো ধরনের! তার নাক এত ভুল করল সেদিন?

তন্নিষ্ঠারই কি নিজস্ব গন্ধ আছে কোনও?

আবার অভিমন্যু ধমকাল নিজেকে। ওরে নির্বোধ মায়া কাটা, তোর দেরি হয়ে গেছে।

একটা বাজল, সিলিং মেশিন বন্ধ হয়েছে। গোবিন্দ আর মালতী এবার টিফিন করবে।

অভিমন্যু উঠল। এ সময়টায় সে বাড়ি যায়। মা আজকাল আর তাড়াহুড়ো করে রান্না করতে পারে না, তাই দুপুরে বাড়ি এসে স্নানাহার সারে অভিমন্যু।

আজ আবিষ্টের মতো বাড়ি ফিরেছিল। বাথরুমে ঢুকেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল। কলে জল নেই, চৌবাচ্চাতেও তলানি মতন পড়ে আছে।

অভিমন্য গলা ওঠাল,—মা, জল নেই কেন?

উত্তর নেই।

—ওপরে বলে দাও পাম্প চালাতে।

এবারও উত্তর নেই।

অভিমন্যু ধন্দে পড়ে গেল। মা’ই তো দরজা খুলে দিল, গেল কোথায়? আর হাঁকডাক না করে তলানি কাচিয়ে কাচিয়ে কাকস্নান সারল অভিমন্যু। বেরিয়ে দেখল মা খাবার টেবিলেই বসে।

মার মুখে এত আঁধার কেন?

অভিমন্যু জিজ্ঞেস করল,—কী হয়েছে? শরীর খারাপ? সুপ্তোত্থিতের মতো নড়ে চড়ে উঠল সুরমা,—অ্যাঁ?

—বাথরুম একদম নির্জলা কেন আজ? আজও কি পাম্প গন্‌?

—হ্যাঁ।

ওফ, কী যে বাহানা শুরু করেছে বাড়িওলি! কত ভাবেই না জ্বালাচ্ছে! ওপর থেকে ময়লা ফেলছে, যখন তখন কটুকাটব্য করছে, ওঠানোর জন্য একেবারে মরিয়া। বিশ বছর অভিমন্যুরা আছে এ বাড়িতে, আড়াইশো টাকায় ঢুকেছিল, এখন সাড়ে বারোশো, তবুও আশ মেটে না। নতুন ভাড়াটে এলে দশ বিশ হাজার থোক মিলে যাবে, শুধু এই আশায়…..! গত বছর কী কাণ্ডটাই না করল! বাথরুমের অকহতব্য দশা, বাবা নিজে খরচা করে মিস্ত্রি লাগিয়েছে, ওমনি সবিতা মুখার্জি থানায়! তার বাড়ি নাকি ভাড়াটেরা ভেঙে ফেলছে! পুলিশ এল, পার্টির ছেলেরা হাজির—বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার। কেউ অবশ্য সেদিন ওই মহিলার পক্ষে যায়নি। ননীদা তো ভাল মতন ঝাড় দিয়েছিল সবিতা মুখার্জিকে। সম্প্রতি সবিতাদেবী নতুন ট্যাকটিকস নিয়েছেন। যখন তখন পাম্প বিকল! আরে, সারানোর পয়সা না থাকলে আমাদের বল্‌, নতুন কিনে লাগিয়ে দিচ্ছি। এতেই বুঝি সুখ! নিজে ভারী ডেকে জল নেব সেও ভি আচ্ছা, ভাড়াটেকে তো টাইট দেওয়া গেল!

ঘর থেকে চুল আঁচড়ে এসে অভিমন্যু দেখল তখনও সুরমা একই ভঙ্গিতে বসে। অভিমন্যু চোখ সরু করল,—কেসটা কী? ওপরের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে?

—না। সুরমার স্বর ঘড় ঘড় করে উঠল।

মার চোখ দুটো সামান্য ঘোলাটে লাগল অভিমন্যুর। কপালে হাত ছোঁওয়াল। নাহ্, টেম্পারেচার নরমাল। কী যেন সন্দেহ হল অভিমন্যুর, প্রশ্ন করল,—দাদার ওখান থেকে চিঠি এসেছে নাকি?

সুরমার মাথা অল্প দুলল,—হ্যাঁ।

ও, সেই কেস। মেন্টাল হোম তিন মাস অন্তর অন্তর রুটিন চিঠি পাঠায় বাড়িতে, দাদার অবস্থাটা জানিয়ে। চিঠিটা এলেই মার এই অবসাদ রোগ চাড়া দেয়। আগেও হত, তবে এতটা প্রকট ছিল না। এবার বোধহয় ডাক্তার দেখাতেই হবে।

অনেক বছর তো হয়ে গেল, এখনও যে কেন সইয়ে নিতে পারল না মা?

সুরমাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় স্বরে আদুরে ভাব আনল অভিমন্যু,—আমায় খেতে দেবে না মা? পেট জ্বলে যাচ্ছে।

—দিই।

—কী মেনু আজ?

সুরমা যেন কথাটা শুনতেই পেল না। খাবার রান্নাঘরে বাড়াই ছিল, এনে টেবিলে রেখে দিল। বড়ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল, অভিমন্যু পিছু ডাকল, —বাবাকে দেখছি না? শুয়েছে?

—না।

—বেরিয়েছে নাকি? কোথায় গেল এই রোদ্দুরে?

সুরমা হ্যাঁ না কিছুই বলল না, ঢুকে গেছে ঘরে।

খেতে খেতে ভাবছিল অভিমন্যু। বাবা কি আবার ডি আই অফিসে ছুটেছে আজ? নিশ্চয়ই তাই। মিনিংলেস। যতই নিজেকে শক্তপোক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করুক, সাতষট্টি বছর বয়স হয়েছে, সেটা তো একবার ভাববে? পেনশানের কাগজপত্র তৈরি হয়নি, সার্ভিসবুকে গণ্ডগোল আছে…..বুঝিয়ে দিলে অভিমন্যুই তো ছোটাছুটি করতে পারে। কে শোনে কার কথা! অভিমন্যুর দ্বারা নাকি এসব হবে না! বাবা এখনও তাকে ছোটছেলেটিই ভাবে। ঝানু অঙ্কের মাস্টার অহীন্দ্র মজুমদারের গণনায় নেই তার এই ছেলে এখন তিরিশ পুরে গেছে।

বেরনোর মুখে মার ঘরে একবার উঁকি দিল অভিমন্যু। শুয়ে আছে মা, দৃষ্টি কড়িকাঠে, নিষ্পলক। বাবার থেকে মা বছর দশেকের ছোট, এর মধ্যেই কী ভীষণ বুড়িয়ে গেল! চুল সাদা, কপালে বলিরেখা, গালের মাংসপেশি কুঁচকে গেছে, গলার চামড়া শিথিল…..!

একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এল অভিমন্যুর বুক থেকে। দাদা এ বাড়ির সকলের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে। অভিমন্যুরও।

.

০৪.

—ওমা, ছোড়দি তুমি?

—চলে এলাম। নন্দিতা দরজা থেকেই ফ্ল্যাটের দেওয়ালে চোখ বোলালো,—তোদের রঙের কাজ কমপ্লিট?

—রান্নাঘর এখনও বাকি। শর্মিলা চকচকে চোখে ননদের দিকে তাকাল,—লিভিং রুমটা কেমন লাগছে গো? বেশি চড়া হয়ে গেছে কি?

—ভালই তো দেখাচ্ছে। …এই পিংকটা প্রথম প্রথম একটু ডিপ থাকে, কটা দিন পরে নরম হয়ে যায়।

—কথাটা তোমার ভাইকে একটু বোলো তো। সারাক্ষণ চেঁচিয়ে যাচ্ছে ক্যাড ক্যাড ক্যাড…

নন্দিতা মুচকি হাসল। রন্টুর প্রিয় রং নীল, আর সব রংই তার চোখে বিশ্রী। সেই ছোটবেলা থেকেই। কতগুলো যে নীল জামা-প্যান্ট আছে রন্টুর! ডার্ক-ব্লু স্কাই-ব্লু রয়াল-ব্লু পিকক-ব্লু নেভি ব্লু টারকুইজ ব্লু…। দিদি বিয়ে হয়ে জামশেদপুর চলে যাওয়ার পর দিদির বাতিল একটা তুঁতে রং প্রিন্টেড শাড়ি কেটে রন্টু পাঞ্জাবি পর্যন্ত বানিয়েছিল। খ্যাপা নাম্বার ওয়ান।

চটি খুলতে খুলতে স্মিত মুখে নন্দিতা জিজ্ঞেস করল, —মা কোথায় রে?

—ঘরে। মেগায় বসেছে।

হুঁউ, মার ঘর থেকে টিভির আওয়াজ আসছে বটে। চোখা চোখা সংলাপ! ওই সিরিয়ালটা চলছে বোধহয়। পিতামাতা।

নন্দিতা নরম সোফায় শরীর ছেড়ে দিল,—তাহলে তো এখন ও ঘরে নো এনট্রি!

—চা করি ছোড়দি?

—কর। বেশ কড়া করে। অফিসে মিটিং ছিল, ভ্যাজোর ভ্যাজোরে মাথা ধরে গেছে।

—সঙ্গে কী খাবে?

—কী খাওয়াবি?

শর্মিলা মাথা চুলকোল,—তুমি যদি ফোন করে দিতে আসবে, পিৎজা আনিয়ে রাখতাম। …টুকুসটাও এই মাত্র কোচিং-এ বেরিয়ে গেল…

নন্দিতা মুখ টিপে হাসল, —ফরম্যালিটি করছিস কেন? ঘরে যা আছে তাই দে না।

—এহ্, খাটাখাট্‌নি করে আসা, শুধু রুটি চচ্চড়ি খাবে? রুটি একটু বাদাম তেলে ভেজে দিই?

বলেই রান্নাঘরে ছুটেছে শর্মিলা। ঘরে বসে থেকে খেয়ে শুয়ে ভালই মুটিয়েছে, তবে এই আটত্রিশেও বেশ তুরতুরিটি। একটু যেন বেশি আহ্লাদী আহ্লাদীও!

ঢাউস ভ্যানিটি ব্যাগখানা সোফায় রাখল নন্দিতা। লিভিংরুমটা বেশ অগোছালো আজ। সোফাগুলো স্বস্থানে নেই, বেতের গ্লাসটপ সেন্টার টেবিল টিভির ক্যাবিনেটের দিকে ঠেলা, শোকেসও বেঁকে-চুরে আছে, কোণের স্ট্যান্ডল্যাম্প প্রায় মধ্যিখানে, মোজাইক মেঝেয় ইতস্তত রঙের কুচি জমাট। দেখেই বোঝা যায় রাজসূয় যজ্ঞ চলছে ফ্ল্যাটে। প্রায় আড়াই বছর হল সেলিমপুরের এই ফ্ল্যাটে এসেছে রন্টুরা, বাবা মারা যাওয়ার মাস ছয় পর। বাবার খুব নিজস্ব বাড়িঘরের শখ ছিল, কিন্তু দেখে যেতে পারল না। এই দুঃখে ফ্ল্যাটে এসে ভারী বিমর্ষ ছিল রন্টু, প্রোমোটারের করে দেওয়া প্লাস্টার অফ প্যারিসের ওপর আর হাত লাগায়নি, রং করল এতদিন পর।

ভাবতে গিয়ে নন্দিতার বুকটা সামান্য ভারী হয়ে গেল। আজ রন্টুর এই রং ঝলমল ফ্ল্যাটখানা দেখলে কী খুশিই যে হত বাবা! নন্দিতাই যখন রানিকুঠিতে ফ্ল্যাট কিনল, বাবা কম আনন্দ পেয়েছিল! যাক, নিজে পারেনি, মেয়ে তো করল!

—কী রে, তুই কতক্ষণ?

আসছেন চিন্ময়ী। সত্তরে পৌঁছেও তাঁর হাঁটাচলা এখনও সাবলীল।

নন্দিতা হাল্‌কা হওয়ার চেষ্টা করল। ছদ্ম গাম্ভীর্য আনল গলায়,—বহুক্ষণ এসেছি, প্রায় ঘণ্টা খানেক। এবার চলে যাব।

পলকের জন্য যেন থমকালেন চিন্ময়ী। পরক্ষণে মেয়ের ঠাট্টাটা বুঝতে পেরেছেন,—যাহ্, মিথ্যে কথা বলিস না। আমি তো এইমাত্র এ ঘর থেকে গেলাম. …আমার ঘরে যাসনি কেন?

—গিয়ে কী লাভ? মুখে তো কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হত।

—যাহ্, তা কেন? টিভি দেখলে কি আমি কথা বলি না? চিন্ময়ী মেয়ের পাশটিতে এসে বসলেন, দুঃখমাখা খুশি-খুশি গলায় বললেন,—যাই বল্‌, আজকেরটা কিন্তু জমেছিল খুব। লোকটা কী বজ্জাত কী বজ্জাত, বউকে কী কষ্টটাই না দিচ্ছে! ওই পাজির পাঝাড়াটাকে কেন যে পুলিশে ধরছে না!

—বোধহয় তোমার মেগা শেষ হয়ে যাবে, সেই ভয়ে। নন্দিতা আবার পল্‌কা টিপ্পনী কাটল। লঘু গলাতেই বলল, —তুমি ওই আদ্যিকালের সাদাকালোটায় দ্যাখো কেন? রন্টু এত বড় একটা কালার টিভি কিনল…

—না বাবা, আমার সাদাকালোই ভাল। ওসব রঙিন-টঙিন তোমাদের জন্য। শর্মিলা খাবার নিয়ে এসেছে। প্লেট রাখতে রাখতে বলল, —সত্যি কথাটা বলুন না মা, নাতির সঙ্গে রোজ আপনার লড়াই বাধছিল, তাই…! জানো তো ছোড়দি, টুকুস বাংলা দেখবে না, মাও বাংলা ছাড়া দেখবেন না, এই নিয়ে জোর কাজিয়া। মা রেগেমেগে রঙিনটা বয়কট করেছেন।

—হ্যাঁ বাপু হ্যাঁ, আমার সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।

শর্মিলা হাসতে হাসতে চা আনতে চলে গেল।

নন্দিতা প্লেট টানল। রুটি নয়, পরোটা ভেজে দিয়েছে শর্মিলা। ছিঁড়ে মুখে দিতে গিয়েও নন্দিতা থেমেছে। শর্মিলা ফিরে আসার আগেই কাজের কথাটা সেরে নেওয়া ভাল।

চিন্ময়ীর পাশে একটু সরে গিয়ে চাপা গলায় নন্দিতা বলল, —তোমার সেই নেকলেসটা কোথায় মা? সেই কাঠি কাঠি?

—ও তো আমি শর্মিলাকে দিয়ে দিয়েছি। চিন্ময়ীর নির্লিপ্ত জবাব।

—দিয়েই দিয়েছ?

—হ্যাঁ, ও বলছিল ওর খুব পছন্দ…। কেন রে?

নন্দিতা মনে মনে একটু দমে গেল। ক্ষীণ আশা ছিল, হারটা তিন্নিকে দেবে মা…। শর্মিলা কি আন্দাজ করেই ভালমানুষ মাকে জপিয়ে জাপিয়ে অত সুন্দর নেকলেসটা বাগিয়ে নিল?

নীরস গলায় নন্দিতা বলল, —না, ভাবছিলাম ওটা ক’দিনের জন্য একটু নিয়ে যাব।

শর্মিলা চা নিয়ে পৌঁছে গেছে। জিজ্ঞেস করল, —কী নিয়ে যাবে গো ছোড়দি?

—ওই মা’র কাঠি কাঠি হারটা।

—কেন গো?

নেকু! নন্দিতা বিরক্তি চেপে হাসল, —ডিজাইনটা তিন্নির খুব পছন্দ, ভাবছিলাম স্যাকরাকে দেখিয়ে অবিকল ওরকম একটা গড়িয়ে নেব।

—খুব মানাবে তিন্নিকে। শর্মিলা গুছিয়ে বসল, —তোমার আর সব গয়না গড়ানো কমপ্লিট?

—কই আর! বানাতে দিচ্ছিলাম, তখনই তো শৌনকের দাদু…। ভালই হয়েছে, এক বছর সময় পেলাম, ধীরেসুস্থে করতে পারছি।

—তিন্নির কপালটা খুব ভাল। ওরকম একটা ছেলে আজকালকার দিনে…ইঞ্জিনিয়ার এম বি এ একসঙ্গে। তিরিশ পুরতে না-পুরতে বিশ হাজার টাকা মাইনে…ভাবা যায়!

চিন্ময়ী বলে উঠলেন, —পরিবারটার কথাও বলো। বাবা অত বড় ডাক্তার, কিন্তু এতটুকু অহঙ্কার নেই। মা’টিরও কী মধুর ব্যবহার! প্রথম আলাপেই দুটিতে আমায় ঢিপঢিপ প্রণাম করল।

নন্দিতার নেকলেসের শোক স্তিমিত হয়ে এল। খাচ্ছে। আলুচচ্চড়ি থেকে কাঁচালঙ্কা বার করে কুটুস কামড় দিল। যে কথা লক্ষ বার বলেও তৃপ্তি হয় না, সেই কথাই শুরু করেছে আবার। গরবিনী মুখে বলল, —এরকম একটা কোহিনূর কে ঢুঁড়ে বার করেছে সেটা বলো? এসেছে তো কত সম্বন্ধ, কত লোক তো এনেছিল, দৌড় তো এই ব্যাঙ্কের ক্লার্ক, কি গভর্নমেন্টের অফিসার, মেরে কেটে প্রফেসর। ভাগ্যিস আমি ঠিক করে রেখেছিলাম খুব ব্রাইট ফিউচার না হলে কিছুতেই সেখানে এগোব না!

কথাটায় চোরা ঠেস আছে। শর্মিলার মা একবার একটা সম্বন্ধর কথা বলেছিলেন। পাত্র অধ্যাপক।

শর্মিলার মুখে হালকা ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। হাসিটা ধরে রেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে, —তোমরা মা মেয়ে তাহলে কথা বলো ছোড়দি, আমি ততক্ষণ বালিশের ওয়াড়গুলো পরিয়ে ফেলি।…যাওয়ার সময়ে কিন্তু মনে করে আমার নেকলেসটা নিয়ে যেও।

নন্দিতা একটু গোমড়া হয়ে গেল।

ননদ-ভাজের সূক্ষ্ম লুকোচুরি খেলাটা চিন্ময়ী ধরতেই পারেননি। হাসি হাসি মুখে বললেন, —হ্যাঁ রে, শৌনকের সঙ্গে তিন্নির দেখা হয়?

—খুব হয়। নন্দিতা ঝলক তাকিয়ে নিল শর্মিলার গমনপথের দিকে। বলল, —দুজনে কী ভাব! এই তো শৌনক কবে যেন ফোন করল, সেজেগুজে নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল তিন্নি, ফিরল সেই রাত দশটায়। সিনেমা দেখে, বাইরে খেয়ে…শৌনকই পৌঁছে দিয়ে গেল। মোটরবাইকে।

—বাহ্ বাহ্। চিন্ময়ীর গোলগাল মুখখানা হাসিতে ভরে গেছে। ভুরু নাচিয়ে বললেন, —আর তোরা? তোরা তোদের কর্তব্য করছিস তো। হবু বেয়াই-বেয়ানের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখছিস?

—আমার একার পক্ষে যতটা সম্ভব। প্রায় রোজই একবার বীথিকাদির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি, অফিসফেরতা ওবাড়িতে গেছিও দু-একদিন। লাস্ট বুধবার শৌনকের দাদুর যান্মাসিক কাজ ছিল…তোমার জামাই-এর তো কর্তব্যজ্ঞানও নেই, দায়িত্ববোধও নেই…জন্মের মধ্যে কর্ম, একবারই তিনি গিয়েছিলেন, সেই শৌনকের দাদু মারা যাওয়ার দিন…! মনের ক্ষোভ দমকে দমকে বেরিয়ে এল নন্দিতার, —অগত্যা আমিই ওদিন অফিস কামাই করে ছুটলাম।

—ওরকম করে বলছিস কেন? নিশ্চয়ই শুভেন্দুর কোনও কাজ ছিল।

—হ্যাঁ, তিনি তো পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষ। এত ব্যস্ত যে কোনও দায়িত্বই পালন করার তার সময় হয় না। মেয়েকে আলগা সোহাগ দেখানো পর্যন্ত ঠিক আছে। তিন্নিকে বড় করার সমস্ত ঝক্কিটা পোহাল কে? নন্দিতা ঝেঁঝে উঠল, —মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করা, কলেজের অ্যাডমিশান, মাস্টার খোঁজা…! এই, বিয়ের গোটা মার্কেটিং তুলছে কে? বাজারহাট করো, সেও আমি, ফার্নিচার পছন্দ করো, সেও আমি, নেমন্তন্ন লিস্টটাও আমাকেই একা বসে করতে হবে,…। তিনি বসে বসে ল্যাজ নাড়বেন।

—ও কী ভাষা নন্দু? চিন্ময়ী প্রতিবাদ করে উঠলেন, —সেও তো করে। এই তো কবে যেন ফোনে কথা হচ্ছিল, ও বলল কোন এক বন্ধুকে বলে রেখেছে…তারা নাকি খুব বড় ক্যাটারার…। তুই বাপু শুভেন্দুর একটু বেশিই নিন্দে করিস।

নন্দিতার ঝাং করে মাথা গরম হয়ে গেল। সামান্য একটা কাজ মাথায় নিয়েছে কি নেয়নি, আদৌ কী করবে জানা নেই, সাত-আট মাস আগে থেকে ঢেঁড়া পেটানো শুরু করে দিয়েছে! মা’ও যেন কেমন হয়ে গেছে আজকাল, শুভেন্দুর নামে কিছু বললেই গায়ে এমন ফোস্‌কা পড়ে। অথচ এই মা নিজের চোখে দেখেছে এক সময়ে ওই মানুষটাকে নিয়ে অহর্নিশি কী মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছে নন্দিতা। তখন তো মা শুভেন্দুর ওপর খড়্গহস্ত ছিল, বাবা জামাই-এর হয়ে একটি কথা বললেও মা’র কী বিরক্তি। পরে যখন মোটামুটি মিটমাট হয়ে গেল, মুখে মা এসো বোসো করত বটে, কিন্তু কোনওদিনই জামাই তার তেমন পেয়ারের হয়ে ওঠেনি। বাবা মারা যাওয়ার আগে কদিন লোকদেখানো ডাক্তার হাসপাতাল করল, অমনই চিন্ময়ীদেবী গলে জল! ওফ্‌, নাটুকে লোকটা অভিনয় জানেও বটে, ঠিক বুঝেছে কোন সিনে ক্ল্যাপ পাবে।

চিন্ময়ীকে মুখে কিছু বলল না নন্দিতা, এই বয়সে পৌঁছে আর ভালওলাগে না। তবু একবার মনে হল মাকে নতুন খবরটা শুনিয়ে দেয়। শুভেন্দু অফিস থেকে বাতিল এখন, বোঝা আরও দ্বিগুণ হচ্ছে নন্দিতার! কে জানে তাতে মা’র দরদ হয়তো উথলে উঠবে, মেজাজ ঠিক রাখা আরও কঠিন তখন।

রন্টু টুকুসের জন্য আর অপেক্ষা করল না নন্দিতা, দুটো চারটে কথা বলে মিনিট দশেক পর উঠে পড়েছে। সেলিমপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে ট্যাক্সি ধরল একটা। জানলা দিয়ে ঢুকছে ফুরফুর করে হাওয়া, চৈত্রের শুরুতে সান্ধ্য বাতাস এখন ভারী মোলায়েম, এতক্ষণ পর শ্রান্তি যেন দখল নিচ্ছে শরীরের, চোখ বুজে এল। মার কথাগুলো বাজছে কানে, অবিরাম নেহাই পড়ছে বুকে।

……তুই বাপু শুভেন্দুর একটু বেশিই নিন্দে করিস….

নিন্দে? ওই মানুষ কি নিন্দেমন্দর যোগ্য?

কত ছবি, কত টুকরো টুকরো ছবি….। কোনওটা বিবর্ণ, কোনওটা ঝাপসা, কোনওটা বা চোখ ঝলসে দেয়। আবার কোনও ছবি গুহাচিত্রের মতো হৃদয়ে প্রোথিত, কোটি বছর পরেও বুঝি তা মুছবে না।

নাহ্‌, একটা ছবিও নন্দিতা মনে আনবে না। কেন সেধে সেধে কষ্ট পাবে?

একটা মাত্র ভুল গোটা জীবনটাকে ছারখার করে দিল? কী দেখে নন্দিতা লোকটার প্রেমে পড়েছিল? রূপ? সুন্দর কথা বলার ক্ষমতা? নাটকসর্বস্ব মানুষটার নাটকে ভুলেছিল? এক আদ্যন্ত উচ্চাশাহীন পুরুষ, আঠাশ বছর আগে অ্যাকাউন্টস্‌ ক্লার্ক হয়ে জীবন শুরু, কেরানি অবস্থাতেই পূর্ণচ্ছেদ। অফিসে বসে নাটক লিখছে, দুমদাম অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, এতদিন মালিক সহ্য করেছে। এই না ঢের। অথচ ইচ্ছে থাকলে কি উন্নতি করতে পারত না? নন্দিতার মতো লেখাপড়ায় অতি সাধারণ একটা মেয়ে যদি শুধু পরিশ্রমের জোরে তিন ধাপ উঁচুতে উঠতে পারে, আজ নয় নয় করেও তার মাইনে তেরো হাজার নশো তেতাল্লিশ, সেখানে শুভেন্দুর মতো চালাকচতুর লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট ছেলে কোথায় না পৌঁছতে পারত! নাটকই বা কী দিল শুভেন্দুকে? না যশ, না অর্থ। সেখানেও তো সে এক কেরানিই, বাসবেন্দ্র বসুরায়ের স্যাটেলাইট। একটা সামান্য ফ্ল্যাট করবে, মাথা গোজার ঠাঁই, তাতেও ওই লোকটা কখনও….? গর্ব করা হয়তো ভাল নয়, তবু এ কথা তো নিখাদ সত্যি, সংসারে যেটুকু স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, সবই নন্দিতার পয়সায়। নন্দিতার রক্ত জল করা খাটুনির বিনিময়ে। ফ্ল্যাট ফ্রিজ টিভি ওয়াশিংমেশিন দামি দামি আসবাব—কে কিনেছে? তার পরও শুনতে হয় তুই বাপু শুভেন্দুর একটু বেশিই নিন্দে করিস!

বিয়েটা টিকিয়ে রাখাই কি ভুল হয়েছিল? বিয়ে ভেঙে চলে এলে হয়তো এই আফসোসটা থাকত না! অহরহ হুল বিঁধত না বুকে!

অবশ্য সম্পর্কের আর আছেই বা কী? এক বিছানায় পাশাপাশি দুটো কফিন হয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া? হয় বরফ, নয় আগুন, এ ছাড়া আর কী টিকে আছে তাদের মধ্যে?

তুষের আগুন বুকে নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বাজিয়েছিল নন্দিতা, ভেতরে ঢুকেই হৃদয় জুড়িয়ে গেল। সোফায় কে ও, শৌনক না!

বিগলিত গলায় নন্দিতা বলল, —তুমি কতক্ষণ?

—এই তো, অফিস থেকে।

—তিন্নি, ওকে খাইয়েছিস কিছু?

—সব হয়ে গেছে, আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না।

নন্দিতা কয়েক পা এগিয়ে এল। এত কাছে নয়, যে শৌনক তাকে বেশি গায়ে পড়া ভাবে। আবার এত দূরেও নয়, যাতে গলা তুলে কথা বলতে হয়। বিয়ের আগে থেকেই শাশুড়ি সম্পর্কে শৌনকের যেন একটা সম্ভ্রম জাগে।

স্বরে স্নিগ্ধতা এনে বলল, —তোমরা দুজনে ঘরে বসে আছ কেন? এমন সুন্দর সন্ধে, বাইরে চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে….

—আমি তো কখন থেকে এই কথাটাই বলছি তন্নিষ্ঠাকে। শৌনক কথাটা টেনে নিল, —বললাম, চলো গঙ্গার পাড়ে একটা রাইড দিয়ে আসি, কতদিন স্কুপে আইসক্রিম খাইনি….

—সত্যিই তো। যাচ্ছিস না কেন?

তন্নিষ্ঠা শরীর মুচড়োল, —আমার ভাল্লাগছে না মা। এমন দিনে ঘরেই বা খারাপ কী?

—যা খুশি কর বাবা।

নন্দিতা ভেতরে এল। তাদের এই ফ্ল্যাটের ড্রয়িং ডাইনিংয়ের জায়গাটা মোটামুটি মন্দ নয়। এল্‌ টাইপ। এই শেপই নন্দিতার পছন্দ, এতে খাওয়ার জায়গার প্রাইভেসিটা বজায় থাকে। শোওয়ার ঘর দুটোও মোটামুটি চলনসই। দুটো বাথরুম আছে ফ্ল্যাটটায়, একটা মনোরম পুবমুখো ব্যালকনি। সব মিলিয়ে ফ্ল্যাটটা নন্দিতার পরিবারের জন্য যথেষ্ট। নন্দিতার অবশ্য একটা সূক্ষ্ম বেদনা আছে। এই ফ্ল্যাটটা আটশো দশ স্কোয়্যার ফিট, রন্টুদেরটা আটশো চল্লিশ, শর্মিলা বলে সাড়ে আটশো। এইটুকু তফাতে কিছুই আসে যায় না তবু….।

ঘরে ঢুকে নন্দিতার কপাল কুঁচকে গেল। শুভেন্দু চেয়ার টেবিলে বসে কী সব ছাইপাঁশ লিখছে। মগ্ন ভঙ্গি, হাতে সিগারেট। পাশে দুখানা মোটা মোটা ডিকশনারি।

একদম টেবিলের কাছটিতে এসে নন্দিতা বলল, —তুমি এখানে বসে? ছেলেটাকে একটু অ্যাটেন্ড্‌ করছ না?

শুভেন্দু মাথা না তুলেই বলল, —ওরা দুজনে কথা বলছে, ওখানে আমি গিয়ে কী করব?

—সে বুদ্ধি ঘটে থাকলে তুমি তো তুমি হতে না।…ছেলেটাকে কী খাইয়েছ শুনি?

—কী খাওয়াব? ও ছেলে তো চা কফি কিছুই খায় না। তাও আমি তো জোর করে সিঙাড়া রসগোল্লা নিয়ে এলাম।

নন্দিতা মরমে মরে গেল, —সিঙাড়া! তুমি ওকে শুধু সিঙাড়া খাইয়েছ?

—সঙ্গে রসগোল্লাও দিয়েছি। শুভেন্দু নিরুত্তাপ, —তোমার সিঙাড়া রসগোল্লা টেবিলে রাখা আছে।

—নিকুচি করেছে। উত্তরোত্তর মেজাজ চড়ছিল নন্দিতার, অনেক কষ্টে স্বর নামিয়ে রাখছে, —রোল প্যাটিস্ কিছু এনে দিতে পারোনি?

—প্যাটিস ফিনিশড্‌। আর ঝন্টুর দোকানের রোল ইচ্ছে করেই আনিনি, ব্যাটা কীসের না কীসের মাংস দেয়! শুভেন্দু লেখা থামিয়ে নন্দিতার দিকে তাকিয়েছে। একটু হেসে বলল, —অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? ও তো আজ বাদে কাল বাড়ির লোকই হয়ে যাচ্ছে….। আমি তো ওকে সিগারেটও অফার করতাম, সেটাও তো খায় না!

ঠিকঠাক জবাব আসছিল না নন্দিতার ঠোঁটে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, —সবাই তো আর তোমার মতো নেশাড়ু নয়। সিগারেট চা, শ্রাদ্ধের নাটক….

—আবার নাটক নিয়ে পড়লে কেন? শুভেন্দুর স্বরে কৌতুকের ভাব উবে গেছে, —যাও না, ও ঘরে তোমার জামাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকো।

এই হচ্ছে ভাষা! টেপ করে রাখলে নন্দিতা গোটা বিশ্বকে শুনিয়ে দিতে পারে শুভেন্দু কত সুসভ্য ভদ্রলোক! মুখোশটাই দেখে সবাই, মুখটা চেনে না।

আহত ফণিনীর মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ শ্বাস ফেলল নন্দিতা, তারপর বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। ঈষৎ ফাঁক হয়ে যাওয়া পর্দা সুচারুভাবে টান করে দিল। চেষ্টাকৃত মন্থর পায়ে ড্রয়িংরুমে এসেছে। অফিসের কী এক গল্প করছে শৌনক, বলতে বলতে হাসছে, ভ্রূভঙ্গি করে শুনছে তন্নিষ্ঠা।

কাহিনী শেষ করে শৌনক নন্দিতার দিকে ফিরল। সহজ গলায় বলল, —আপনাকে আজ খুব টায়ার্ড লাগছে?

—হ্যাঁ, ইয়ার এন্ডিংয়ের মুখ….। নন্দিতা মাথা দোলাল, —বীথিকাদির কী খবর?

—মা তোফা আছে। খুব ডিউটি করে বেড়াচ্ছে।

—সেই ওল্ডএজ হোম? বীথিকাদির সোশাল ওয়ার্ক?

—হ্যাঁ, সোশাল ওয়ার্ক বলতে পারেন। শৌনক কাঁধ নাচাল, —ওল্ডএজ হোম বললেও কিছু ভুল হয় না….

এই হচ্ছে অন্তঃকরণ। অর্থবান ডাক্তারগৃহিণী হয়েও কাজের মধ্যে ডুবে থাকে বীথিকাদি, কাজ খুঁজে নিয়ে ডুবে থাকে। শর্মিলাদের মতো শুধু বরেরটি খেয়ে শুয়ে বসে মোটায় না।

সপ্রশংস চোখে নন্দিতা বলল, —বীথিকাদিকে দেখে আমার ভারী শ্রদ্ধা হয়। আজ কোন হোমে গেছেন বীথিকাদি?

—মাসি মেসোর হোম।

নন্দিতার বোধগম্য হল না, —সেটা কোথায়?

—সল্ট লেকে। মাসি মেসো মানে আমার মা’র মাসি মেসো। মেসো, আই মিন আমার দাদু হাইকোর্টের জাজ্‌ ছিলেন। নামও বোধহয় শুনে থাকবেন। জাস্টিস দেবেন্দ্রবিজয় গুহ।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেছি যেন। নন্দিতা ঝপ করে মাথা নেড়ে দিল।

—দাদুর এখন একটু ডাউন ফেজ্‌। গত মাসে ছোট একটা স্ট্রোক হয়েছিল, এখন সামলেছেন মোটামুটি, তবে তাঁর দেখভাল করা….। আমার মাসিদিদু আবার অ্যাকিউট হাঁপানির পেশেন্ট….

—ছেলেমেয়েরা কোথায়?

—ছেলে একটিই। রমেন মামা। তিনি আছেন ভ্যাঙ্কুভারে। ওখানেই সেটলড্‌।

—আহা রে, দাদু দিদার তো তাহলে এখন খুব কষ্ট?

—কষ্ট বলে কষ্ট? সাফারিংস্ ডিউ টু ওল্ড এজ। থাউজেন্ডস্‌ অব কম্‌প্লিকেশানস্‌। শরীর চলে তো মন অচল, মন তাজা থাকলে শরীর বিগড়োয়। বেচারাদের কেউ নেই দেখাশুনো করার। মার মনটা একটু বেশি সফ্‌ট, তাই মা’ই ছুটছে।

তন্নিষ্ঠা ফস করে প্রশ্ন করে বসল, —অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট ইওর রমেন মামা? তিনি বাবা মার জন্য কী করছেন?

—টেলিফোনে খবর নেয়। রেগুলার ডলার পাঠায়। দাদুমেসোও অবশ্য সলিড পার্টি….

—শুধু ডলার আর টাকাতেই কি বার্ধক্যের একাকিত্ব ঘোচে?

—হোয়াট এলস্ হি ক্যান ডু? এটা নিশ্চয়ই আশা করা লজিকাল হবে না, তিনি অ্যাট হিজ প্রাইম এজ অব ফরটিসিক্স তাঁর এসট্যাব্‌লিশড্‌ ক্যারিয়ার ছুড়ে ফেলে পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরে আসবেন? দ্যাট টুউ, সেই বাবা মার জন্য, যাঁরা আর কদিন বাঁচবেন তার সার্টেন্‌টি নেই?

পলকের জন্য নন্দিতার বুক হিম। কল্পচোখে নিজের বার্ধক্য দেখতে পেল যেন! পরক্ষণেই অনাগত ভবিষ্যতের উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলেছে। ঠিকই তো, কেরিয়ার গড়তে গেলে মানুষকে কিছুটা নিরাবেগ তো হতেই হয়। হয়তো বা নিষ্ঠুরও। দেশে থেকেই বা কটা ছেলেমেয়ে বাবা মাকে দেখে? সন্তানকে মানুষ করে দিয়েছি বলে সন্তানও বাবা-মার কাছে চিরতরে দায়বদ্ধ হয়ে গেল, ও ভাবনারও বোধহয় কোনও মানে হয় না।

তন্নিষ্ঠাটা তবু তর্ক করে চলেছে, —আমি তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না শৌনক। আমার মনে হয় প্রতিটি ছেলেমেয়ের, বাবা মা, বা বলতে পারো তার প্রতিপালকদের প্রতি একটা কর্তব্য থাকা উচিত। অন্তত হোয়েন দে আর ইন ওল্‌ড এজ। মানে অসহায়।

—এটা ডিবেটেবল্‌ সাবজেক্ট। বুড়ো হলেই মানুষ নিজেকে অসহায় ভাববে কেন? মনের একাকিত্ব ঘোচানোর এক হাজার একটা রাস্তা আছে। চিনে তো বুড়োরা নিজেদের এনগেজড্‌ রাখার জন্য কমিউনিটি সার্ভিস করে। নিজেকে বুড়ো না ভাবলেই ল্যাটা চুকে যায়। এখন, সেকেন্ড পয়েন্ট আসছে, ফিজিকাল অসহায়তা। হ্যাঁ, এই প্রবলেমটা আসতেই পারে ….. শরীরের নরমাল ওয়্যার অ্যান্ড টেয়ার।…..এবং ছেলেমেয়েদের তখন ফাংশানটা কী? নিতান্ত অমানবিক না হলে তারা অবশ্যই ভাববে, করবে, বাট উইদিন দেয়ার ওউন লিমিটেশানস্‌। পৃথিবীটা যেমন তার বাবা মার, তেমনি তারও তো বটে। সেখানে তার কিছু হোপস্ অ্যান্ড ড্রিমস্‌ আছে। তার কিছু প্রমাণ করার আছে, অ্যাচিভ করার আছে, এগুলো ভুলে গেলে চলবে কেন? জীবনের তিনটে স্টেজ আছে। আমি বড় হচ্ছি, আমি অ্যাচিভ করছি, আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি। আমার বাবা মা ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে আমি চাকরি বাকরি সব ছেড়ে সারাক্ষণ তাদের পাশে গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম, এতে কি পৃথিবী এক চুল এগোবে?

—অর্থাৎ পৃথিবীকে এগোনোর জন্য সেন্টিমেন্ট ইমোশানস্‌ সব মুছে ফ্যালো। তাই তো? তন্নিষ্ঠা তবু বেঁকে আছে।

—ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে ভালবাসবে না, তাদের সেন্টিমেন্ট ইমোশানস্‌ থাকবে না, এ কথা আমি কখন বললাম? ফর এগ্‌জামপ্‌ল্‌ বলি, আমার বাবার প্রেশার আছে, জানোই বোধহয় মার সুগার লেভেলও একটু হাই। কিন্তু তা বলে আমি যদি আজ কলকাতার বাইরে একটা অফার পাই, বাবা মার কী হবে ভেবে আমায় সেটা স্যাক্রিফাইস করতে হবে? আর যদি যাই, তাহলেই কি ধরে নেওয়া হবে আমি বাবা মাকে ভালবাসি না?

শৌনকের যুক্তিজালে ক্রমশ আচ্ছন্ন নন্দিতা। তার বিতর্ক প্রতিভা দেখে বিমুগ্ধও। তার মধ্যেও শৌনকের কথায় কী যেন ইঙ্গিত পেয়ে গেছে।

জিজ্ঞাসা করল, —তুমি বাইরে কি কোনও অফার পেয়েছ?

—নট টিল নাউ। অ্যাপ্লাই করেছি অনেক, অল্প স্বল্প রেসপনস্‌ আসতে শুরু করেছে।

—কোন সাইডে তোমার যাওয়ার ইচ্ছে?

—চয়েস নেই। ওয়েস্ট নর্থ সাউথ যে কোনও সাইড। এখানেও যদি বেটার চান্স পাই, এখানেও থেকে যেতে পারি। শৌনক নরম করে হাসল,—যেখানে আমি বেশি দাম পাব, আই শ্যাল বিলঙ্‌ টু দ্যাট প্লেস।

—অর্থাৎ ইউ ওয়ান্ট টু বি সোল্‌ড্‌!

—হোয়াই নট …….

শৌনক আর তন্নিষ্ঠায় আবার তর্ক বেধেছে। চলছে। আর একটুক্ষণ বসে থেকে ঘরে এল নন্দিতা, অ্যাটাচড্‌ বাথরুমে ঢুকেছে। শাওয়ার খুলে স্নান করল ভাল করে। বেরিয়ে দেখল গভীর মনোযোগে অভিধান উল্টোচ্ছে শুভেন্দু। ফর ফর ফর ফর করে অনেকগুলো পাতা উল্টে গেল। শব্দ খুঁজছে। নাটকের অনুবাদ চলছে নির্ঘাত। খেটে খুটে করে দেবে, বাসবেন্দ্র বসুরায় সেটি লুফে নিয়ে মঞ্চস্থ করবে, এক পয়সা পারিশ্রমিক জুটবে না ….. একেই বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। হুঁহ্‌।

শৌনক কখন যেন চলে গেছে। তন্নিষ্ঠাও মনে হয় নিজের ঘরে। নন্দিতা অন্ধকার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। কম্পাউন্ডের গেটের ধারে রাধাচূড়া গাছটা ছেয়ে গেছে ফুলে, তিনতলা থেকে দেখছে নন্দিতা। তিন্নি আর শৌনক মিলবে বেশ, দুজনেই খুব তর্কবাগীশ। তবে সব সময়ে তর্ক করাটাও ভাল নয়, শেখাতে হবে তিন্নিকে।

—মা?

মেয়ের ডাকে ফিরে তাকাল নন্দিতা। কখন যেন চুপিসাড়ে তন্নিষ্ঠা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে কেমন মেঘের আভাস, এই বসন্তেও।

নন্দিতা কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করল, —কী রে তিন্নি?

—আমি বিয়ে করব না মা।

—সে কী রে? কেন?

—আমার তোমাদের ছেড়ে থাকতে ভাল লাগবে না।

—দূর পাগলি, বিয়ের পর দেখবি উল্টো হয়ে গেছে। আমাদের কাছে এসে দুদিন থাকলেই তখন হাঁপিয়ে উঠবি।

—আমায় ছেড়ে তোমরা থাকতে পারবে তো মা? তুমি? বাবা?

হঠাৎ কথাটা যেন অন্য রকম ভাবে প্রবেশ করল নন্দিতার কানে। যেন নন্দিতা শুনল, আমি ছাড়া তোমরা থাকতে পারবে তো মা?

সত্যি তো, মেয়ে চলে গেলে তার আর শুভেন্দুর মাঝের সেতুটাও তো মিলিয়ে যাবে। তখন তারা পাশাপাশি থাকবে কী করে?

নন্দিতা ভেতর থেকে কেঁপে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *