৯. দেশবাসীর প্রতি

৯. দেশবাসীর প্রতি

Where the mind is without fear and
the head is held high
Where knowledge is free Where the world has not been broken up in to fragments…

My father let my Country awake.

-Rabindranath Tagore

সমগ্র বইটিতে আমি ইচ্ছা শক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এটি সৃজনশীল কাজের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং এটিই আমাদের জীবনের খুব প্রয়োজনীয় অংশ; এর একত্রিত শক্তি আমাদের আকাংখার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এই শক্তিই বিজয়ী এবং বিজেতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আমি আগামী বিশ বছরের মধ্যে ভারতকে শিক্ষিত এবং দারিদ্র্যমুক্ত জাতি হিসেবে দেখতে চাই। আমি আদর্শ নেতাদের পরিচালিত ভারতের স্বপ্ন দেখি। আমি এমন এক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি যেখানে বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদের কর্মকান্ড পরিচালিত হবে সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে। কিভাবে এই স্বপ্ন সত্যি হবে?

আমাদের অনুধাবন করা দরকার যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মিশন কোন সংগঠনের চেয়ে অনেক বড়, যেমন একটা সংগঠন তার পরিচালকের চেয়ে বড়। কোন মিশন পরিচালনার জন্য দরকার উদ্যম এবং তা আমাদেরকে সরবরাহ করে মন। ভেবে দেখুন, কোন বিভাগ বা মন্ত্রণালয় কি মানুষকে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে সেখানে বসতি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে? ২ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন কি তাপশক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, পারমাণবিক শক্তি এবং অনিয়মতান্ত্রিক ক্ষেত্রগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম ছাড়া সম্ভব? কৃষি বিজ্ঞানী, জীব প্রযুক্তিবিদ এবং সেচ বিশেষজ্ঞদের একত্রিত কর্মকান্ডের সমন্বয় ছাড়া কি দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব সম্ভব?

আমাদের ক্লিনিকগুলোতে সঠিক ডায়াগনোসিস সুবিধা এবং সাধারণের ক্রয়যোগ্য ওষুধ না রাখতে পারলে এই জৈব প্রযুক্তির গবেষণাগার আর মেডিকেল কাউন্সিল গঠন করে কোন লাভ নেই। এসব নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই হল সর্বাধুনিক চিকিৎসা সেবার আবিষ্কার এবং ন্যুনতম অর্থের বিনিময়ে সে সেবা রোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

আমার অভিজ্ঞতার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি সচেতন থেকেছি। ভবিষ্যত লক্ষ্য স্থির করে সামনে চলার শক্তি আমার মধ্যে এক প্রবল আশাব্যঞ্জক তেজ সৃষ্টি করেছে। এ এমনই এক শক্তি যা তোমার ভেতর থেকে জ্বলে ওঠে। স্বাধীনতার সময় এই শক্তিকে আমরা জ্বলে উঠতে দেখেছিলাম। যখনই কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই তখনই স্বাধীনতার সেই সময়ের শক্তিকে আমি ধারণ করি।

আজকের ভারতের পুনর্জাগরণের জন্য স্বাধীনতার সময়কালীন সেই তেজদীপ্ততার আজ বড় প্রয়োজন।

জামশেদজি নুসরাবানজি টাটা ভারতে প্রথম ইস্পাত শিল্পের সূচনা করেছিলেন, যদিও ব্রিটিশ সরকার তার এ আইডিয়া সমর্থন করেনি। আচার্য পি. সি. রায় ভারতের কেমিকেল ও ফার্মাসিউটিক্যালস্ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচর্যা করেছিলেন। এসব মহাত্মাদের হাতেই আমরা ভারতের ভুবন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো সৃষ্টি হতে দেখেছি। জে. এন. টাটা ব্যাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতীয় বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। পন্ডিত মদনমোহন মালবী বানারসে গড়ে তুলেছিলেন বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।

বরোদার মত বিভিন্ন স্থানেও কিছু কিছু প্রগতিশীল মহারাজারাও বহু বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছেন। এমন বহু দৃষ্টান্ত বহু স্থানে ছড়িয়ে আছে। এসব কাজের পেছনে তাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল সেটা হল ভারতের জাগরণ। বিশ্বে ভারতের উত্থান নিশ্চিত করা। বিশ্বে অন্যদের মত ভারতও সব কিছু করতে পারে- এটাই তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।

আমরা কি তাদের সেই আদর্শের অবস্থানে এখনও আছি? তাদের সেই তেজোদীপ্ত আকাঙখা সফল করার বাসনা কি আমরা লালন করতে পেরেছি? আমরা কি এ দৃশ্য দেখে যেতে পারব না যে ভারতের তৈরী গাড়িগুলো ফ্রাঙ্কফুর্ট অথবা সিউলের রাজপথে আমাদের সাফল্য গাঁথা এঁকে দিয়ে যাচ্ছে?

অথবা আমরা কি কোনদিন দেখতে পারব না যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান অথবা চীনে ভারত পাওয়ার স্টেশন নির্মাণ করে দিচ্ছে? যদি আমাদের উচ্চাশাগুলোকে নিম্নগামী করে রাখি তাহলে সে সম্ভাবনা অনেক দূরবর্তী হয়ে পড়বে।

তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আজকে ভারতের সফটওয়ার সেক্টর খুব ভাল অবস্থানে চলে এসেছে, কিন্তু হার্ডওয়ার যন্ত্রপাতির প্রায় সবকিছুই আনতে হচ্ছে বিদেশ থেকে।

আমরা কি এই অনগ্রসরতা কাটিয়ে উঠতে পারব না? ভারত কি এমন কোন অপারেটিং সিস্টেমের ডিজাইন আবিষ্কার করতে পারবে না যা বিশ্বের কম্পিউটার মার্কেটে একচ্ছত্র আধিপত্য চালাতে পারে? আমাদের রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচা লোহা ও অ্যালুমিনিয়ামের মত জিনিস যার মূল্য বিশ্ববাজারের অন্যান্য দ্রব্যের তুলনায় খুবই কম। আমরা এই কাঁচামালগুলোকে সদূর প্রসারী ও ব্যাপক চাহিদাভিত্তিক পণ্য সামগ্রীতে কি রূপান্তর করতে পারি না যা বিশ্ববাজারে আধিপত্য গড়ে তুলতে পারে?

আমাদের কয়েকশ প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনকারী ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। তারপরও ভারত কেন মেইন ব্যাটল ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, এয়ারক্র্যাফট, বন্দুক ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৈরী করে বিশ্ব বাজারে ছাড়তে পারছে না?

আমাদের মেধাবী ও কর্মঠ জনশক্তি ও মৌলিক ভৌত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা তা পারছি না? আমাদের মূল অভাবটা কীসের?

আসুন, আমরা সবাই ভেবে দেখি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কী কী বিষয় আমাদের অনগ্রসর করে তুলছে? কোন ব্যক্তি স্বার্থ নয়, কোন একক শিল্প প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের স্বার্থে নয়, সকলের সম্মিলিত স্বার্থে এবং সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় অগ্রগতির কথা মাথায় রেখে অগ্রসর হলে ভারতের উন্নয়ন সম্ভব। আমাদের মূল শক্তিকে উত্থিত হতে হবে দেশপ্রেম থেকে। আমাদের এমন একটি ভিশন থাকতে হবে যার সংগে সমগ্র জাতীয় স্বার্থ জড়িত।

উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে কোন কোন প্রদেশ অন্যান্য প্রদেশ অপেক্ষা ভাল করছে। জাতীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তরুণরা বেশ সাফল্য অর্জন করছে। ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, মুম্বাই, দিল্লি এবং হায়দ্রাবাদ বাণিজ্যিক কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছে। কিন্তু তথাপি দেশের সামগ্রিক তথ্য-প্রযুক্তির বিচারে এ উন্নয়ন এখনও অপ্রতুল। আপনি যদি তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে মিশন হিসেবে নিতে চান তাহলে প্রথমেই দরকার জনশক্তি। এই সর্বোচ্চ মেধার ক্ষেত্রে কাজ করতে হলে ওই শহরগুলোয় আরও বেশী শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো–ত্রিপুরা, আসাম ও ঝাড়খণ্ড সফর করে সেখানে অজস্র প্রাকৃতিক সম্পদ উপযোগীতা সৃষ্টির অভাবে নষ্ট হতে দেখেছি। বাঁশ ও বাঁশজাতীয় পণ্যসহ বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করেই ত্রিপুরার অর্থনীতি চলছে। এখানে প্রাকৃতিক গ্যাসসহ নানা ধরনের খনিজ সম্পদ রয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এ রাজ্যে ভ্রমণ, যোগাযোগ ভিত্তিক ব্যবসা করা খুবই কঠিন। রাজ্যটি একরকমের এক ঘরে অবস্থায় রয়েছে। ঝাড়খন্ডেও খনিজ ও বনজ সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। কিন্তু সে সম্পদের সঠিক উপযোগীতা এখনও তৈরী করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। স্থানীয় সম্পদ সঠিকভাবে পণ্য সামগ্রীতে রূপান্তর করে রাজ্যটি সংস্কার করা জরুরী।

আসামে কোন সম্পদের ঘাটতি নেই এবং সেখানে বেশ মজবুত শিক্ষা অবকাঠামো রয়েছে। উন্নত দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও জনশক্তি থাকার পরও সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সহিংস কার্যক্রমের জন্য অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। সবার যৌথ উদ্যোগ আসামের মানুষকে এক ছাতার নিচে আনতে পারে।

তামিল নাড়, অন্ধ্র প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং কর্নাটকের আজকের এই উন্নয়নমুখী অগ্রগতির পেছনে রাজ্যের সার্বিক ও সমন্বিত পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে তারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে এ রাজ্যগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনগুলো, রাজনৈতিক প্লটফর্ম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চেম্বার অব কমার্স একের পর এক সভা সেমিনার, আলোচনা, বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে আলোচনার নামে আসলে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি আর গলাবাজিই হচ্ছে বেশী। অবিরাম সেখানে তত্ত্ব, মহাতত্ত্ব, থিওরি নিয়ে আলোচনা করেও অগ্রগতি হচ্ছে খুবই সামান্য।

আমার বক্তব্য হল বোর্ড রুম আর প্রযুক্তি সম্মেলনে উন্নত ভারত গঠনের আলোচনা, বিতর্ক ও থিওরি কপচালে চলবে না। এ আলোচনা হতে হবে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে, সংগঠনে, পরিবারে এমন কি ব্যক্তি পর্যায়েও। সমাজের প্রত্যেকটি পর্যায়কে দেশের ভালমন্দের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। দেশের জন্য কোনটা ভাল কোনটা খারাপ সমাজের প্রত্যেককেই তা বুঝতে হবে।

আমি সমগ্র বইয়ে একটা বিষয়ই তুলে ধরতে চেয়েছি। সেটা হল আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে আর নিজেদেরকে উন্নত ভারতের নাগরিক হিসেবে ভাবতে শিখতে হবে। আমরা একটা বিশাল উন্নত সভ্যতার মধ্যে জন্ম নিয়েছি আর এই সভ্যতার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমাদের পূর্ণবিশ্বাসী হওয়া দরকার। আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে উন্নত বিশ্ব ও আমাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। আমাদের অন্তর্জগতে যে বিশ্ব রয়েছে সেটাই আমাদের কাছে বড় সত্য।

স্বাধীনতা কেউ এসে আমাদের উপহার দিয়ে যায়নি। সমগ্র জাতি যুগের পর যুগ সংগ্রাম করে এ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সুতরাং এ স্বাধীনতা রক্ষার দায় দায়িত্ব আমাদের সকলের। এদেশের প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নের চেয়ে বড় কোন মতাদর্শ নেই।

জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেয়ে বড় কোন ইসু আমাদের সামাজিক জীবনে থাকতে পারে না।

উন্নত ভারত গড়ে ছাত্র শিক্ষার্থীদের এখনই তৈরী হতে হবে। তাদের প্রতি আমার জোরালো আহবান, তোমাদের হৃদয়কে উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুনে প্রজ্জ্বলিত করো। বড় বড় স্বপ্ন দেখো, বৃহৎ চিন্তায় নিজেকে সমর্পণ কর।

এক শিক্ষককে একদিন বলতে শুনেছিলাম, আমাকে পাঁচ বছরের একটি শিশু দাও। সাত বছর শিক্ষা দেবার পরে কোন ঈশ্বর অথবা শয়তানের ক্ষমতা নেই–তাকে আদর্শচ্যুত করে। আমাদের সমস্ত শিক্ষকরা সেই গুরুর মত হতে পারবে?

আমাদের রাষ্ট্রপরিচালকদের সামনে দেশের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। জনগণের সার্বিক মঙ্গল সাধিত হয় এমন সিদ্ধান্তই তাদের নিতে হবে।

স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও বিজ্ঞানের আশীর্বাদ আমরা এখনও সফলভাবে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা দ্রুত পৌঁছে দেবার এখনই সময়।

বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চগুলো ইতিমধ্যে ভারতের আইটি সেক্টরকে সম্মানজনক স্বীকৃতি দিয়েছে। আজকে ভারত আইটি ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম শ্রেণীর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ। টেলিমেডিসিন, ই-গভর্নেন্স এবং টেলিএডুকেশন সারা দেশে চালু করার ক্ষেত্রে এই আইটি ক্ষেত্রকে ব্যবহার করতে হবে।

কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের একযোগে কাজ করে কৃষকদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের কৃষিজাত পণ্যের মান ও উৎপাদন বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বীতা সক্ষম করে তুলতে হবে। একই সংগে পণ্য বাজারজাত করণের ক্ষেত্রেও সচেতন হতে হবে যাতে কৃষকরা তাদের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পায়।

সর্ব শেষে পরমকরুণাময়ের কাছে আমার প্রার্থনা তিনি যেন আমার দেশের মানুষকে কর্মঠ করে তোলেন। তিনি যেন তাদের আরও অসংখ্য অগ্নি তৈরীর সক্ষমতা দেন যাতে তারা শয়তানের বিষদৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারে।

তার কাছে আমার অন্তিম প্রার্থনা, হে আল্লাহ! আমার জনগণকে তুমি সম্প্রীতির বন্ধনে পরস্পরের সংগে বেঁধে দাও। ভারতের একটা ধুলিকণা হয়ে আমাকে গর্ব করার সুযোগ দাও, যে ধুলিকণা আবার জেগে উঠবে। পূর্ণ স্বাধীনতায় আবার যে উড়ে বেড়াতে পারবে।

.

শেষকথা

আমার ব্যক্তিগত চিন্তা ও দর্শনের সার সংক্ষেপ এ বইয়ে তুলে ধরেছি। আমার মনে পড়ছে ইন্টারনেট থেকে একবার একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটি রূপক। মাতৃগর্ভে থাকা দুটি চরিত্র অহঙ্কার ও তেজস্বী আত্মার কথোপকথনে লেখা হয়েছে এ গল্পের কাহিনী।

তেজস্বী আত্মার নাম স্পিরিট আর অহঙ্কারের নাম ইগো। স্পিরিট ইগোকে বললো, আমি জানি একথা তোর বুঝতে কষ্ট হবে, কিন্তু তবু বলছি, শোন্‌– জন্মের পর কিন্তু আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু হবে।

ইগো বললো, বোকার মত কথা বলবি না। তোর চারপাশে চেয়ে দ্যাখ। এখানে যা দেখছিস এটাই জীবন, এটাই বাস্তবতা। কেন মিছেমিছি এই বাস্তবতার বাইরে ভাবতে যা? এই জীবন নিয়েই সুখী হ।

ইগোর কথায় স্পিরিট খানিকক্ষণের জন্য দমে গেল, কিন্তু বেশীক্ষণের জন্য নয়। স্পিরিট বললো, দ্যাখ ইগো, তুই রাগ করিস না। আমার মনে হচ্ছে আমাদের মা বলে কিছু একটা আছে।

ইগো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, মা! একথা তুই ভাবছিস কি করে? তুই কোনদিন মাকে দেখিসনি, মা কী জিনিস তাও জানিস না! তোর এই জীবন নিয়ে কেন সুখী হতে পারছিস না? এখানে তুই আর আমি ছাড়া কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। এটাই তোর বাস্তব জীবন।

ইগো, স্পিরিট মরিয়া হয়ে বলে, খেয়াল করে শোন। মাঝে মাঝে দুজনই কি একধরনের চাপ অনুভব করি না? আমাদের ব্যথা লাগে। আমার ধারণা এটা আমাদের জন্ম নেবার পূর্বলক্ষণ। আমার মনে হয় আমরা শীগগিরই কোন নতুন জীবনে পা রাখতে যাচ্ছি। তখন আমরা আলো দেখতে পাব।

ইগো বললো, তুই কোনদিন আলো কী জিনিস তা দেখিসনি। তাহলে কেমন করে জানলি আলো দেখবো? এই পার্শ্বচাপ আর অন্ধকার আমাদের জীবনের অংশ। এটা মেনে নে। স্পিরিট ইগোকে বিরক্ত করতে চাইল না। আবার কথা না বলেও পারলো না। সে বললো, ইগো, আমার ধারণা এই পার্শ্ব-চাপ শেষ হবার পর আমরা শুধু আলোই নয় আমাদের মাকেও দেখতে পাব।

ইগো বললো, তোর মাথা সত্যিই গ্যাছে।

এ গল্পের উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আমার দেশবাসীকে বলতে চাই তারা যেন স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছরের এই প্রাপ্তি নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বিভোর হয়ে না যায়। এ বই যখন লেখা প্রায় শেষ করে এনেছি তখন কেউ কেউ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। চেন্নাইয়ের প্রেসিডেন্সী কলেজের ১৫শ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রত্যেক জাতির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে এ বিষয়ে বক্তব্য দেবার পর জাতীয় উন্নয়ন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান, শিক্ষা লাভের উপায় বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে অসংখ্য প্রশ্ন করা হল। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হবার পর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ঠেলাঠেলি করে আমার সংগে করমর্দন করছিল। যখন আমি তাদের মধুর উপদ্রব থেকে মুক্তি নিয়ে বের হতে যাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম একটা ছেলে সবল হাতে ভীড় সরিয়ে দ্রুত আমার কাছে চলে এল এবং আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। চিরকুটটি আমি পকেটে রেখে দিলাম।

গাড়িতে বসে যেতে যেতে প্রেসিডেন্সী কলেজে জুলজিতে এমফিল পর্যায়ে অধ্যয়নরত টি, সরাভানানের চিঠিটা পড়লাম। তার চিঠি পড়ে আমি এত মানসিক শক্তি পেয়েছি যে চিঠিটা উল্লেখ না করে পারছি না। সরাভানান লিখেছে, প্রিয় স্যার, মহামহীরুহ বটবৃক্ষের শক্তি আর তার বীজের সুপ্ত দ্রুণবৃক্ষের শক্তি একই। এদিক থেকে আপনি এবং আমি এ দুজনের ক্ষমতাই সমান সমান। আমরা দুজনে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের মেধার বিকাশ ঘটাচ্ছি।

সামান্য কিছু বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বড় হয়ে ওঠে আর বেশীর ভাগ মারা যায়। প্রতিকূল পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে বড় হতে না পেরে মারা যায়। কিন্তু তাদের শক্তি শেষ হয় না। তারা মরে গিয়ে সার হয় এবং ভবিষ্যত বৃক্ষটির শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এভাবেই সে তার বিশালত্বের আকাক্ষার মাঝে বেঁচে থাকে। আপনি দেশের জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন এবং বহু বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমিকদের সহায়তা করেছেন। আপনি কি মনে করেন তাদের এই কর্মদক্ষতা ও পরিশ্রম বিফলে যাবে না? এক্ষেত্রে আপনি তাদের কাছ থেকে কত শতাংশ সাফল্য আশা করেন?

ওই দিনই সরাভানানকে একটি জবাব লিখলাম,

প্রিয় সরাভানান,

আমি বেশ কয়েকবার তোমার চিঠি ও প্রশ্নটি পড়েছি। আমি দীর্ঘ কুড়ি বছর আইএসআরওতে কাজ করেছি। রকেট তৈরী, লঞ্চ ভেইকল এবং মিসাইল তৈরীর ব্যাপারে আরও কুড়ি বছর ডিআরডিওতে কাজ করেছি। আমি জীবনে বহু সাফল্য দেখেছি। কিছু ব্যর্থতার সম্মুখীনও আমাকে হতে হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে সাফল্য অর্জনের জন্য আমি অনেক বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং টেকনিশিয়ানের সংগে কাজ করেছি। একতাবদ্ধ ওই দল ওই সাফল্য দেখেছে এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। আমারই এমন বহু শিক্ষানবীশ আজ জ্ঞানে ও মেধায় আমাকে ছাড়িয়ে গ্যাছে। এ আমার জন্য বড় আনন্দের।

সরাভানানের চিঠি আমাদের এক কঠিন দায়িত্বে ফেলে দিয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের বুঝতে হবে তাদের চেয়ে পরবর্তী প্রজন্ম অনেক বেশী মেধাবী ও এগিয়ে। তাদের এগিয়ে যাবার কোন বাধা সৃষ্টি করা নেতৃস্থানীয়দের জন্য শোভনীয় নয়। পরন্তু বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা যেন ব্যর্থ না হয় সে চেষ্টা করতে হবে। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদদের এই নতুন প্রজন্ম আকস্মিক ব্যর্থতায় যেন হতাশ না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও বড়দের।

আইডিতে আমাকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার শেষ প্রশ্নটি উল্লেখ করে আমি এ বইয়ের সমাপ্তি টানতে চাই। প্রশ্নটি ছিল, আপনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনি কী কী প্রার্থনা করেন?

উত্তরে আমার শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাক্ষিদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমি দোআ করতে লাগলাম, হে সর্বশক্তিমান, আমার দেশের মানুষের মনে সৃজনশীলতা ও কর্মস্পৃহা দাও যাতে তারা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারে।

বিভাজন ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে জনগণকে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমার দেশের ধর্মীয় নেতাদের সাহায্য কর।

আমাদের জননেতাদের মনে এই মন্ত্র গেঁথে দাও ব্যক্তির চেয়ে দেশ অনেক অনেক বড়।

হে আল্লাহ! আমার দেশের মানুষের কাজের ওপর রহমত বর্ষণ কর আর এ দেশকে উন্নত দেশে পরিণত কর।

আমার এ বার্তা চেন্নাই, পোরবন্দর, রাজকোট, জামশেদপুর, ভুবনেশ্বর, ডিঙ্গিগাল, অবু রোড, আনন্দ, উদিরপুর ও আরও বহু জায়গার প্রায় ৪০ হাজার স্কুল শিশুকে পৌঁছে দিয়েছি। আমি আগামী ২০০৪ সালের আগস্টের মধ্যে এ সংখ্যা ১ লাখে নিয়ে যেতে চাই।

যেদিন এদেশের হাজার হাজার তরুণের এ প্রার্থনাবাণী ভারতের আকাশে বাতার্সে ধ্বনিত হবে, সেদিনই আমরা ভারতবর্ষকে উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে পারবো।

.

যৌবনের গান
আমি আর আমার ভারতবর্ষ

ভারতের এক তরুণ নাগরিক হিসেবে
প্রযুক্তি, জ্ঞান আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ
আমি উপলব্ধি করি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য একটা অপরাধ।

আমি কাজ আর পরিশ্রম করব এক মহান লক্ষ্য নিয়ে,
ভারতকে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য
মূল্যায়ন পদ্ধতিযুক্ত অর্থনৈতিক শক্তি হবে যার ভিত্তি।

আমি কোটি কোটি নাগরিকের একজন,
এ লক্ষ্যই পারে কোটি মানুষের অন্তরে আলো জ্বালাতে।
এটা প্রবেশ করেছে আমার মধ্যে,
যে-কোনও শক্তির তুলনায় আলোকিত অন্তর
আকাশ-পাতাল-পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় শক্তি।

উন্নত ভারত–এ লক্ষ্য অর্জনে
জ্ঞানের প্রদ্বীপ আমি জ্বালিয়ে রাখব চিরদিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *