৩. দূরদর্শী শিক্ষাগুরু–দূরদর্শী বিজ্ঞানী

৩. দূরদর্শী শিক্ষাগুরু–দূরদর্শী বিজ্ঞানী

Whatever you can do or dream you can, begin it. Boldness has genius, power and magic in it. Begin it now.

–Goethe.

এদেশের ক্ষণজন্মা মহাত্মাদের এমন কিছু ক্ষমতা ছিল যা দিয়ে তারা সাধারণ জনগণের মধ্যে নিজেদের আদর্শ প্রতিস্থাপন করে মোহনীয় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে পারতেন। তাদের কাছে আপনার চেয়ে বড়, নিজের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশ ও জাতি। স্বপ্নকে তারা হাজারবার বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছেন।

২০০০ সালের ডিসেম্বরে আধিয়াপাকা রত্ন টি, তোতাদ্রি আয়েঙ্গারের জন্মশতবর্ষ পূর্তি উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। ১৯৫৪ সালে তিরুচিরাপল্লীর সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি। তরুণ ছাত্রবয়সে আমি অধ্যাপক টি. তোতাদ্রি আয়েঙ্গারকে দেখেছি। অনুপম আর ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মানুষটি প্রতিদিন কী দৃপ্ত পদক্ষেপে কলেজ চত্ত্বর দিয়ে হেঁটে যেতেন। বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসির ছাত্রছাত্রীদের গণিত ক্লাস নিতেন তোতাদি স্যার। ছাত্ররা পরম শ্রদ্ধা ও সমীহ নিয়ে তাদের গুরু হিসেবে তার দিকে চেয়ে থাকতো। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেনও তাই। তিনি যখন হাঁটতেন, মনে হতো তার চারপাশে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ঝলমল করে উঠতো। ক্যালকুলাস শ্রীনিবাস ছিলেন আমাদের গণিতের শিক্ষক। তিনি প্রায়ই অধ্যাপক তোতাদ্রি আয়েঙ্গারের কথা বলতেন গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে।

তিনি চাইতেন বিএসসি (সম্মান)র প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা যেন তোতাদ্রি স্যারের সংস্পর্শে আসে, তার ক্লাসে ঠিকমত উপস্থিত হয়। তার বেশ কয়েকটি ক্লাসে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, বিশেষ করে আধুনিক আলজেব্রা ও পরিসংখ্যানের ক্লাসগুলোতে।

আমরা যখন বিএসসি প্রথম বর্ষে তখন ক্যালকুলাস শ্রীনিবাস স্যার আমাদের ক্লাস থেকে শীর্ষস্থানীয় দশজন মেধাবী ছাত্রকে বেছে নিয়ে সেন্ট জোসেফ কলেজের গণিত ক্লাবের সদস্য করান। তাদের মধ্যে তোতাদ্রী বেশ কয়েকটি লেকচার দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, ওই সদস্যদের মধ্যে আমিও ছিলাম।

১৯৫২ সালের কোন একদিন প্রাচীন ভারতবর্ষের গনিতবিদ ও জ্যোতির্বিদদের বিষয়ে একটি লেকচার দিয়েছিলেন। তিনি কথা বলেছিলেন টানা একঘণ্টা। তার সে বক্তব্য আজও আমার কানে বাজে। আমার শিক্ষক তোতাদ্রির মত প্রাচীন ভারতের অসংখ্য গণিতবিদ ও তাদের কর্মশক্তির ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত চিন্তা চেতনা পাঠকের সংগে শেয়ার করা যাক–

৪৭৬ সালে কুসুমপুরে (বর্তমান পাটনা) আর্যভট্ট নামে একজন জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞের জন্ম হয়েছিল। তখনকার সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত গণিতের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ছিল অগাধ জ্ঞান। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি দুই খণ্ডে সমাপ্ত বই আর্যভট্টম লিখেছিলেন। এ বইয়ের বিষয় ছিল অ্যারিথমেটিক, অ্যালজেবরা, ত্রিকোণমিতি এবং অবশ্যই জ্যোতির্বিদ্যা। তিনি ত্রিভূজ ও বৃত্তের ক্ষেত্রফল সম্পর্কে ফর্মুলা দেন। এছাড়া গোলক ও পিরামিডের আয়তন ও ঘনত্ব পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এ বিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম বৃত্তের জ্যা ও ব্যাসের অনুপাত হিসেবে ৩,১৪১৬ সংখ্যাটি উদ্ভাবন করেন। এই মহান জ্যোতির্বিদের স্মরণে ভারত ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মত যে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পাঠিয়েছিল তার নাম দেওয়া হয় আর্যভট্ট।

রাজা হর্ষদত্তের শাসনামলে রাজস্থানের বিল্পমালায় ৫৯৮ সালে জন্মেছিলেন ব্রহ্মগুপ্ত নামের আরেক বিজ্ঞানী। তিরিশ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বই ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত।

তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি সাধন করেন। এছাড়া গণিত ও জ্যামিতিক্ষেত্রেও তার ছিল অগাধ জ্ঞান। গণিত শাস্ত্রের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। একই সংগে চতুর্ভুজ সংক্রান্ত জটিল জ্যামিতিক সমস্যারও সমাধান দেন তিনি।

ভাস্করাচার্য নামের আরেক ভারতীয় বিজ্ঞানী তার সময়ের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এখনকার কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বিজ্জলবাড়াতে ১৯১৪ সালে জন্মেছিলেন এই মহান পুরুষ। চারটি অধ্যায় সম্বলিত তার লেখা বিখ্যাত বই সিদ্ধান্তশিরোমনি! জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বীজগণিত ছিল তার অধীত বিষয়। ভাস্করাচার্যই হলেন সেই ভারতীয় বিজ্ঞানী যিনি আর্যভট্টর আবিষ্কারগুলোর ভিত্তিতে সর্বপ্রথম গণিতে জিরো বা শূন্য সংখ্যাটির ধারণা দেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আইএসআরওর দ্বিতীয় দফায় নির্মিত দুটি স্যাটেলাইটের নাম রাখা হয় ভাস্কর-১ ও ভাস্কর-২ (প্রথমটি নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৮১ সালে)।

এই তিন ভারতীয় গণিতজ্ঞের কথা মাথায় রেখেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, আমরা ভারতীয়দের কাছে বহুলাংশে ঋণী যারা আমাদের গুনতে শিখিয়েছে, যা ছাড়া আজকের এই বিশাল বিশাল জিনিসের আবিষ্কার কিছুতেই সম্ভব হতো না।

এদের পরে যার নাম আমার মনে আসছে তিনি উনবিংশ শতকের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সর্বস্বীকত বিজ্ঞানী শ্রীনিবাস রামানুজ। মাত্র ৩৩ বছরের আয় নিয়ে। জন্মেছিলেন রামানুজ (১৮৮৭-১৯২০) এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও ছিল না তার। তারপরেও শুধুমাত্র তার অবিচল আগ্রহ ও গণিতের প্রতি ভালোবাসা তাকে গণিত শাস্ত্রের গবেষণায় অমূল্য অবদান রাখতে সহায়তা করেছিল। তার বহু সূত্র আনুষ্ঠানিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের জন্য গণিতজ্ঞরা অক্লান্ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

রামানুজ এমন এক বিস্ময়কর মেধা যিনি কিনা ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জিএইচ হার্ডির মত পণ্ডিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটা মোটেই অতিরঞ্জিত বক্তব্য নয় যে জিএইচ হার্ডিই রামানুজকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা কেন আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আরেকটি রামানুজকে আবিষ্কার করতে পারছে না। ওহ আমার বন্ধুরা, তোমরা কেন তোমাদের স্ব স্ব ক্ষেত্র অন্তর দিয়ে আঁকড়ে ধরছে না আর কেন মহীরুহের মত আত্মপ্রকাশ করছে না?

কোন একজন গণিতজ্ঞ রামানুজের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি পূর্ণ সংখ্যাই রামানুজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার এ কথা মোটেই অতিরঞ্জিত ফাপা বক্তব্য নয়। অধ্যাপক হার্ডি একবার সর্বোচ্চ মাত্রা ১০০ ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞানীকে নম্বর দিয়েছিলেন। অধিকাংশই হার্ডির বিবেচনায় পেয়েছিলেন ৩০ নম্বর। শুধু রামানুজই পেয়েছিলেন ১০০র মধ্যে ৬০ নম্বর। হার্ডির মতে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা শাখার যেকোন ক্ষেত্রেই রামানুজ ১০০ শতাংশ উপযোগী। রামানুজ অথবা ভারতীয় ঐতিহ্যকে এত বড় সম্মান সম্ভবত আর কেউ দেয়নি।

রামানুজের পদচারণ ক্ষেত্র ছিল বিস্তীর্ণ ও বিশাল। মৌলিক সংখ্যা, জটিল জ্যামিতিক সিরিজ, কম্পিউটারের সংযোজনে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক গঠন উপাদানের একক বা মডিউলার ফাংশান, ম্যাজিক স্কোয়ার, উপবৃত্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে রামানুজের সূত্র অনুকরণ করা হয়।

আমি আশা করি আমাদের পণ্ডিত শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের শিক্ষকতার জীবন শেষ করে সরকারী উচ্চ পদে আসীন হলে তারা সেখানেও তাদের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবেন এবং স্ব স্ব বিষয়গুলোর অনুশীলন চালিয়ে যাবেন। এমনই একজন মানুষ অধ্যাপক এস, চন্দ্রশেখর। তিনি তার কাজের বাইরেও ভারতীয় ঐতিহ্যের গণিত চর্চা করেন। গণিত সন্দেহাতীতভাবেই বিশ্বজনীন। এখন আমাদের ঐতিহ্য অধ্যাপক সি, এস. শেষার্দি, অধ্যাপক জে. ভি. নারলিকর, অধ্যাপক এম. এস. নরসিমা, অধ্যাপক এস. আর. এস, বর্ধন, অধ্যাপক এম. এস, রঘুনাথ, অধ্যাপক নরেন্দ্র কর্মকার এবং অধ্যাপক অশোক সেনের মত জ্ঞানতাপসদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে।

স্যার সি, ভি, রমন কলকাতার একটি অফিসে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলন। কিন্তু তার হৃদয়ের মধ্যে যে আরেকজন বিজ্ঞানী সি. ভি. রমন ছিল তাকে তিনি বিশ্রাম নিতে দেননি। যেসব রহস্যময় সমস্যা ও প্রশ্ন তাকে আগ্রহী করেছে তিনি অসীম ধৈর্যের সংগে তা সমাধানের পথ খুঁজেছেন। সৌভাগ্যবশত তিনি মহান শিক্ষাবিদ স্বর্গীয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তিনি সি. ভি. রমনকে তার গবেষণা চালিয়ে যেতে অনিবার উৎসাহ যোগাতেন।

একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, স্যার সি, ভি. রমন যে আবিষ্কারের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন সেই রমন ইফেক্ট কিন্তু বিশাল ব্যায়বহুল কোন প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগার থেকে আসেনি। একই ঘটনা দেখেছি আমরা অধ্যাপক এস, চন্দ্রশেখরের বেলাতেও। তিনিও নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ব্ল্যাকহোল বিষয়ে কাজ করার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে তিনিও ব্যায়বহুল প্রযুক্তি ও গবেষণাগার ব্যবহার করেননি। কামেশ্বর সি, ওয়ালীর লেখা চন্দ্রশেখরের জীবনী গ্রন্থ চন্দ্রতে কিছু মজার তথ্য ও বিবৃতি পাওয়া যায়।

যেমন, বইটির এক জায়গায় বলা হয়েছে, চন্দ্র বড় হয়ে ছিলো এমন এক সময়ে যখন ভারতবর্ষ বিজ্ঞান, কলা ও সাহিত্যে এক স্বর্ণালী অবস্থানে ছিল, পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল। সে সময় জে. সি. বোস, সি. ভি. রমন, মেঘনাদ সাহা, শ্রীবাস রামানুজ এবং রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধীর মত বহু মহাত্মা তাদের বৈজ্ঞানিক ও সৃজনশীল সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে জাতীয় বীর হয়ে উঠেছিলেন।

তাদের সুবিশাল সাফল্যসমূহ তখন ভারতে সৃষ্টিশীলতার পরিবেশ তৈরী করেছিল। চন্দ্রশেখরই ওই সময়টাকে সম্ভবত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ভাষায়, ১৯১০ সালের আগের সেই আধুনিক যুগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন (ভারতীয়) বিজ্ঞানীও ছিলেন না। ১৯২০ ও ১৯২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এসে আমরা হঠাৎই পাঁচ ছয়জন বিশ্বখ্যাত (ভারতীয়) বিজ্ঞানীর সন্ধান পাই।

আমার আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনেই আমি ওই সময়কার উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের সংগে যুক্ত হয়েছিলাম। আমার সময়ে তরুণরা জেগে উঠেছিল জাতীয় বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে। বিজ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করাও তখন জাতীয় বিপ্লবের অংশ হয়ে উঠেছিল। ভারত সে সময় পরাধীন দেশ ছিল কিন্তু…. বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা তখন বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমরা তাদের চেয়ে কম নই।

এখানে আমি সি. ভি. রমনের একটি উদ্ধৃতি টানতে চাই। ১৯৬৯ সালে তরুণ স্নাতক ডিগ্রিধারীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার সামনে উপস্থিত তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলতে চাই যে তারা যেন আশাহত না হয়, তারা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে। সাহসের সাথে সাধনা করলে সফলতা তোমাদের সামনে এসে ধরা দেবে। আমি সমস্ত মতবিরোধের ভয়কে প্রত্যাখ্যান করে, সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বলতে চাই ভারতীয়দের মেধা যে কোন টিউটোনিক, নর্ডিক অথবা অ্যাংলো-স্যাক্সনের মেধার সমান। কিন্তু আমাদের যে জিনিসের অভাব রয়েছে সেটি হল সাহস।

আমাদের পরিচালিত শক্তির অভাব রয়েছে। আমি মনে করি, আমরা সুদীর্ঘ সময় ধরে হীনমন্যতায় ভুগে তাকে এখন এক বিশাল বিষবৃক্ষে পরিণত করেছি। আমার মনে হচ্ছে ভারতবর্ষকে যে বিষয়টি তিলে তিলে ধ্বংস করে ফেলছে তা হলো আমাদের পরাজয়প্রবণ নির্জীব শক্তি। এ মুহূর্তে আমাদের সবচে বেশী প্রয়োজন সাহসী ও তেজোদীপ্ত স্পৃহা। আমাদের প্রয়োজন এমন স্পৃহা যা সূর্যের নিচের এই ভোলা পৃথিবীর বুকে আমাদের নায্য অধিকারের জায়গায় আসীন করবে। প্রয়োজন এমন শক্তির যা আমাদের নিজেদেরকে চিনতে শেখাবে আর গৌরবময় এক সভ্যতার উত্তরসূরী হিসেবে এই গ্রহের নায্য ঠিকানায় আমাদের পৌঁছে দেবে। যদি সত্যিই আমরা সেই দুর্দমনীয় শক্তিকে জাগ্রত করতে পারি, তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের ঈপ্সিত গন্তব্যে পৌঁছবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

বিজ্ঞানের বাইরের অন্যান্য সম্মানজনক ক্ষেত্রের মহান ব্যক্তিত্বরাও একইভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।

খুব লক্ষনীয় ব্যাপার হলো সংগীত জগতের তিন সাধক, ত্যাগরাজা সায়গল, মাথুস্বামী দিক্ষিদার ও শ্যাম শাস্ত্রীগল ওই একই সময় দক্ষিণ ভারতের মাত্র ৫০ কিলোমিটার বৃত্তায়তনের এলাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। আমাদের খেয়াল করতে হবে ওই সময়ে ভারতে কলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভুবনবিখ্যাত কিছু পুরুষের জন্ম হয়েছিল যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি শক্তি যুগিয়েছেন।

এই নিকট সম্প্ৰতিতেও আমরা বড় বড় বিজ্ঞানীদের আবির্ভূত হতে দেখেছি।

বিশেষ করে তিনজন বিজ্ঞানীর জীবনী আমাকে সবচে বেশী টানে– ডক্টর ডি, এস, কোটারি, ডক্টর হোমি জে, ভাভা এবং ডক্টর বিক্রম সারাভাই। জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের নেতৃত্বপূর্ণ গুণাবলী সম্পর্কে জানতে আমি বহুবার আগ্রহী হয়েছি। এই তিন বিজ্ঞানী ভারতের তিনটি বিশাল প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছিলেন ডিআরডিও, ডিএই এবং আইএসআরও।

ডক্টর ডি.এস. কোটারি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত একজন সুবিখ্যাত পদার্থবিদ ও জ্যোতিবস্তুবিদ্যা বিশারদ। গ্রহের মত শীতল ঘনীভূত কোন কিছুর দিকে বেতার তরঙ্গকে চাপের মাধ্যমে নামিয়ে আনা বা আয়োনাইজেশন (lonization)র সূত্র আবিষ্কারের জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত।

ডি.এস, কোটারির এ থিওরিটি ছিল তার গুরু ড. মেঘনাদ সাহার আবিষ্কৃত নবযুগের সূচনাকারী তাপসংক্রান্ত আয়োনাইজেশন থিওরির এক পূরক সূত্র। ১৯৪৮ সালে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা নিযুক্ত হবার পর কোটারি ভারতের প্রতিরক্ষা কাজে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের রীতি চালু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতে তিনি প্রথম ডিফেন্স সায়েন্স সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন যাতে প্রতিরক্ষা বিভাগ সেখানে বৈদ্যুতিক বিষয়াদি, পারমাণবিক ওষুধপত্র ও ব্যালিস্টিক সায়েন্সের ওপর গবেষণা করতে পারে। তাকে একারণে ভারতের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ভারতীয় বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে তার সম্মানে একটি খালি চেয়ার রেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের ওপর গবেষণা করতেন ডক্টর ভাভা। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি মহাজাগতিক রশ্মি সম্পর্কিত গবেষণা করেন। ১৯৩৯ সালে ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত IIScতে স্যার সি. ভি. রমনের সংগে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করলেন। পরবর্তীতে তিনি গড়ে তোলেন টাটা ইন্সটিটিউট অব ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ। এখানকার গবেষণার মূল বিষয় ছিল গণিত ও পরমাণু বিজ্ঞান। ১৯৪৮ সালে তিনি গড়ে তোলেন অ্যাটোমিক অ্যানার্জি কমিশন। তার মূল লক্ষ্য অনুযায়ী আরও বেশ কয়েকটি পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হল যেখানে পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদন অথবা পারমাণবিক ওষুধপত্র আবিষ্কারের গবেষণা শুরু হল।

এই বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি কেন্দ্রের জন্ম দিল যেখানে পরমাণু বিজ্ঞানকেই মূল গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

এই তিনজনের মধ্যে বয়সে সবচে তরুণ ছিলেন ডক্টর সারাভাই। তিনি স্যার সি. ভি. রমনের সংগে পরীক্ষামূলক মহাজাগতিক রশ্মির ওপর গবেষণা করতেন। সারাভাই আহমেদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছেন ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি যেখানকার মূল গবেষণার বিষয় হলো স্পেস। ১৯৬৩ সালে বায়ু মণ্ডলীয় গবেষণার জন্য তার প্রতিষ্ঠিত থাম্বা ইকুয়েটরিয়াল রকেট লাঞ্চিং স্টেশন থেকে রকেট উৎক্ষেপন শুরু হয়। ডক্টর সারাভাই স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান স্যাটেলাইট রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা আইএসআরও। এ প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে এখন নভোযান ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করা হচ্ছে, অভিযানগুলো ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করা হচ্ছে।

এই তিন ভারতীয় বিজ্ঞানী সবাই ছিলেন পদার্থবিদ। তারা পদার্থবিদ্যার গবেষণাস্থল হিসেবে যে সকল প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন আজ সেগুলো প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, পারমাণবিক প্রযুক্তি ও স্পেস প্রযুক্তির গবেষণা মন্দির হিসেবে বিকশিত হয়েছে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা প্রতিষ্ঠানে এখন প্রায় ২ হাজার বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন।

একটি বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে যে এই তিন বিজ্ঞানী বুঝতে পেরেছিলেন বিজ্ঞান কীভাবে দেশের জন্য কাজ করে তা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বুঝতে হবে। তাদের বক্তব্য ছিল–

যে সকল প্রযুক্তি জনগণের জন্য দ্রুত উন্নয়ন বয়ে আনে সেগুলোর ব্যবহার প্রচলন করতে হবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়, তা সে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন। এদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হলো প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মৌলিক বিজ্ঞানই হল মুখ্য। আন্তরিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মূল্য বুঝতে হলে তাদের কাছ থেকে আমাদের নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে হবে।

১৯৬২ সালে ডক্টর সারাভাই এবং ডক্টর ভাভা বিষুবীয় অঞ্চলে স্পেস রিসার্চ স্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী একটি জায়গা খুঁজছিলেন।

বিষুবীয় এলাকার নিকটবর্তী হওয়ার কারণে কেরালার থাম্ব অঞ্চলটাকেই তাদের কাছে অবশেষে আয়োনেস্ফেরিক গবেষণার জন্য সবচে উপযোগী মনে হল। হাজার হাজার দরিদ্র জেলের বাস ছিল থাম্বা জেলায়। সেখানে ছিল সেন্ট ম্যারি ম্যাগডালেন্স চার্চ নামে সুন্দর একটি গীর্জা আর বিশপদের কোয়ার্টার। রিসার্চ সেন্টার গঠনের জন্য ওই জমি অধিগ্রহণ করতে কোন বেগ পেতে হয়নি।

ডক্টর সারাভাই প্রধান ধর্মযাজক ডক্টর পিটার বার্নার্ড পেরেইরার সংগে এক শনিবার দেখা করে জায়গাটি গবেষণাগারের জন্য ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলেন। বিশপ প্রশান্তভাবে হেসে সারাভাইকে পরের দিন আবার আসতে বললেন। রোববার সারাভাইকে সাথে নিয়ে বিশপ তার সাপ্তাহিক ভাষণে বললেন, শিশুরা, আমার সংগে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী রয়েছেন। তিনি তার বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের জন্য আমাদের এই গীর্জা ও আমার ভবনটি প্রার্থনা করছেন। বিজ্ঞান সত্যের অনুসন্ধান করে যা মানবজীবনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তোলে। আধ্যাত্মিক সাধনাই সর্বোত্তম ধর্ম। ধর্মোপদেশ দাতারা মানবাত্মার শান্তির জন্য করুণাময় ঈশ্বরের সাহায্য চান। আসল কথা হলো, বিক্রম সারাভাই যা করছেন এবং আমি যা করছি–এ দুটোই এক অর্থে সমপর্যায়ের। বিজ্ঞান ও ধর্মের মূল কাজ হলো মানুষের দেহমনের কল্যাণ বয়ে আনার জন্য ইশ্বরের সহায়তা প্রার্থনা। আমার শিশুরা, আমরা কি বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য পূরণের জন্য ঈশ্বরের এ ঘর তাদের হাতে হস্তান্তর করতে পারি?

খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতার পরে অগনিত শিশুর সম্মতিসূচক আমেন ধ্বনিতে গীর্জা কক্ষ যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।

১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ডক্টর বিক্রম সারাভাইয়ের সংগে কাজ করার দুর্লভ অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। তরুণ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তার অধীনে থিরুভানানথাপুরাম স্পেস স্টেশনে আমি কম্পোজিট টেকনোলজি, এক্সপ্লোসিভ সিস্টেম এবং রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং সিস্টেমের ওপর কাজ করেছি।

এ সময়টাতে তার নেতৃত্ব থেকে আমি এক দুর্লভ শক্তি সঞ্চয় করি। যদিও আমাদের দেশে তখন প্রযুক্তিগতভাবে শৈশবে নিজেদের নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের স্বপ্ন দেখছিলাম। তার স্বপ্ন ছিল ভারতের মাটি থেকে সানসিস্ক্রোনাস কক্ষপথে রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট এবং জিওসিংক্রানাস কক্ষপথে কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট পাঠাতে হবে। আজ জিএসএলভি (জিওসিষ্ক্রোনাস লাঞ্চ ভেইকল) উৎক্ষেপনের মাধ্যমে তার সে স্বপ্ন সফল হয়েছে।

এছাড়াও কক্ষপথে ইণ্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন আইআরএস ও ইনস্যাট সিস্টেম প্রতিস্থাপন করেছে যাতে সাধারণ মানুষও স্পেস বা মহাকাশযানের সুফল ভোগ করতে পারে।

ডক্টর সারাভাইয়ে স্পেস প্রোগ্রাম সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। অবশ্য এ বিষয়ে আমি আমার উইংস অব ফায়ার বইয়ে সংক্ষিপ্তাকারে লিখেছি।

ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট মহাযান এসএলভি-৩-এর ডিজাইন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার (ভিএসএসসি) থেকে। রকেট, তাপরোধক প্রক্রিয়া এবং গাইডেন্স সিস্টেমের প্রত্যেকটি পর্যায়ের ডিজাইন নির্বাচিত প্রকল্প নেতৃবৃন্দের হাতে দেওয়া হয়েছিল। এসএলভি-৩ এর চতুর্থ পর্যায়ের ডিজাইন প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলাম আমি। আমার প্রকল্পাধীন পর্যায়টি ছিল রকেটের ওপরের দিকের অংশ যেটি মহাযান রোহিনীকে কক্ষপথে চূড়ান্ত ভাবে প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা করবে। রকেটের এই অংশটি নির্মাণ করতে দরকার হয় সর্বাধুনিক শক্তিশালী ধাতব উপাদান যেটি প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন কিন্তু ওজনে হাল্কা। এটা সর্বোচ্চ পরিমাণ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জ্বালানীও বহন করার কাজ করে। ১৯৭০ সালে যখন আমি রকেটে এ অংশের ডিজাইনের কাজে ব্যস্ত, তখন খবর পেলাম ডক্টর সারাভাই ফরাসী স্পেস এজেন্সি সিএনইএসর চেয়ারম্যান হুবার্ট কিউরিয়েনকে সাথে নিয়ে থিরুভানানথাপুরাম পরিদর্শনে আসছেন।

কিউরিয়েনের টীমের কাছে চতুর্থ পর্যায়ের ডিজাইন সম্পর্কে আমাকে বলতে বলা হল। আমার ডিজাইন তাদের কাছে উপস্থাপনের পর জানলাম, ফ্রান্সের ডায়ামন্ট পি-৪ উৎক্ষেপন যানেও আমার ডিজাইনকৃত চতুর্থ পর্যায়টির মতো ডিজাইন ব্যবহৃত হচ্ছে।

সিএনইএস জানাল তাদের আমাদের চেয়ে দ্বিগুন ওজনের একটি অ্যাপোজি রকেট মটর এবং আমাদের ডিজাইনকৃত চতুর্থ অংশের মত একটি অংশ দরকার।

ওইদিনের বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল চতুর্থ অংশটি আবার এমনভাবে কনফিগার করতে হবে যাতে ওই অংশ ফরাসী রকেট ডায়ামন্ট পি-৪ এবং আমাদের এসএলভি-৩ উভয়টাতেই খাপ খায়। গল্পটা একারণে বললাম যে আমরা তখন মাত্র রকেটটির ডিজাইন পর্যায়ে, তারপরও ডক্টর সারাভাই পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।

ভারতীয় বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের ওপর কী অগাধ আস্থা ছিল তার। এসএলভি ৩র অন্যান্য অংশের ডিজাইনের আগে চতুর্থ অংশের ডিজাইন ডেভেলপ করা শুরু হল। আমাদের আত্মবিশ্বাস জেগে উঠলো এবং পূর্ণদ্যোমে কাজ এগুতে লাগল। দুটো পর্যবেক্ষক দল বেশ কয়েকবার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চতুর্থ অংশের কাজ ড্রইং বোর্ড থেকে ডেভেলপিং স্টেজে নেবার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৯৭১ সালে ডক্টর সারাভাই দেহত্যাগ করেন। ওই বছরই ফ্রান্স সরকার তাদের ডায়ামন্ট পি-৪ প্রকল্পও বাতিল ঘোষণা করে।

চতুর্থ পর্যায়ের ডিজাইন ডেভেলপ করার পর বেশ কয়েকবার তা পরীক্ষা করা হয় এবং আমরা সফল হই। ভারতে নির্মিত স্যাটেলাইটের মত আকৃতির স্যাটেলাইট ইউরোপীয়রা উৎক্ষেপনের চেষ্টা চালানোর সময় আমাদের এই চতুর্থ অংশটির প্রয়োজন পড়ে। ফ্রান্স সরকার এরিয়ান প্যাসেঞ্জার পেপোড় রকেট তাদের অ্যাপল নামক কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কক্ষপথে প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয় এবং আমাদের ডিজাইনকৃত এসএলভি-৩ এর চতুর্থ অংশ ওই রকেটের জন্য সর্বোচ্চ উপযোগী প্রমাণিত হয়। অবশেষে ১৯৮১ সালে আমার ডিজাইনকৃত চতুর্থ অংশটি অ্যারিয়ান রকেটে লাগিয়ে ফ্রেন্সগায়ানার কুরু থেকে উৎক্ষেপন করা হয়। অ্যাপল স্যাটেলাইট জিওস্টেশনারী কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করার পর এবং তা পৃথিবীর সংগে যোগাযোগ শুরু করার পর সবাই ডক্টর বিক্রম সারাভাইর ৭০ সালের দূরদৃষ্টি সম্পর্কে সজাগ হয়। অ্যাপলর সফলতা প্রমাণ করলো নিবেদিত প্রাণ বৈজ্ঞানিক পৃষ্ঠপোষকতা সমৃদ্ধ ইচ্ছা অবশ্যই একদিন তার লক্ষ্যে পৌঁছবে। অ্যাপোলোর এ সফলতা এ দেশের রকেট টেকনোলজির ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন হিসেবে আবির্ভূত হল।

ডক্টর সারাভাইর স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন যিনি তার নাম সতীশ ধাওয়ান। ১৯৭২ সালে প্রফেসর ধাওয়ান আইএসআরওর দায়িত্ব নেবার পর তিনি আইএসআরওকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলেন। তার তৈরী পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেইকল ভারতসহ অন্যান্য দেশের বহু স্যাটেলাইটকে বিভিন্ন কক্ষ পথে প্রতিস্থাপন করেছে। এই রকেটটি একই সংগে একাধিক স্যাটেলাইট প্রতিস্থাপনে সক্ষম।

১৯৭২ সালে এসএলভি-৩এর প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট রোহিনীকে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপনের দায়িত্ব পাই। স্যাটেলাইট ডিজাইন করা, ডেভেলপ করা থেকে শুরু করে উৎক্ষেপনের দায়িত্ব আমার ওপর দেওয়া হয়। সে সময় প্রফেসর ধাওয়ানের কাছ থেকে আমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনেক শিক্ষা অর্জন করেছিলাম।

সে সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম যখন একজন প্রজেক্ট ডিরেক্টরকে নিয়োগ করা হয় তখন আইএসআরওর চেয়ারম্যানসহ সমগ্র প্রতিষ্ঠানই তার সাফল্যের জন্য কাজ করে। অন্য প্রজেক্টগুলোতে কাজ করতে গিয়েও আমি এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। গত ৪০ বছর ধরে তিনটি বিভাগের দায়িত্বে থেকে বহু প্রজেক্ট ও প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আরেকটি বিষয় বুঝেছি, যদি তুমি প্রজেক্টকে নিজের চেয়ে বেশী মূল্যবান মনে কর তাহলে প্রজেক্ট লিডার হিসেবে অবশ্যই সফল তুমি হবে। যখন একজন প্রকল্প প্রধান প্রকল্পের চেয়ে নিজেকে বড় করে দেখে, তখনই প্রতিষ্ঠান সমস্যার সম্মুখীন হয়।

আমার মনে পড়ছে ১৯৮০ সালের কথা। সে বছর ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত আইএসআরও সদরদফতরে লঞ্চ ভেইকল প্রোগ্রামস সিস্টেমসর পরিচালনা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। প্রথমে আমরা লঞ্চ ভেইকল বা রকেটের কর্মক্ষমতা ও সম্ভাব্য ব্যায় নিয়ে আলোচনায় বসলাম।

১৯৮১ সালে আইএসআরর অন্যান্য সেন্টারগুলোর বিজ্ঞানীদের সহায়তা নিয়ে থিরুভানানথাপুরামে অবস্থিত ভিএসএসসির বিজ্ঞানীরা দুটি বিশাল ও ভারী গতি সঞ্চালক ওয়ালা পিএসএলভি কোর ভেইকলের কনফিগারেশন দাঁড় করায়।

পিএসএলভি উৎক্ষেপনের সময় সেটির ওজন দাঁড়ায় ৪শ টন। অধ্যাপক ধাওয়ান আরও সহজ ও হাল্কা কোন বিকল্প কনফিগারেশন চাচ্ছিলেন। আমি এবং আমার কয়েকজন সহকর্মী এ. শিবতনু পিল্লাই, এন, সুন্দররাজন এবং কে. পদ্মনভ মেননকে ওই বিকল্প মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আমাদের টিম এসএলভি-৩ রকেটের প্রথম অংশ ব্যবহার করে একটি নতুন ধরনের কোর ভেইকলের ডিজাইন করলো যাতে বেশ কয়েকটি অপশন ছিল। নতুন এ ডিজাইনে পিএসএলভির ওজন নেমে আসে ২৭৫ টনে। আমার অফিস রুম কাছাকাছি হওয়ায় অধ্যাপক ধাওয়ান প্রতিদিন একবার আমার রুমে আসতেন এবং সম্ভাব্য কনফিগারেশন চয়েস নিয়ে আলোচনা করতেন। গণিত ও সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিনি নিজেই গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, তথাপি ব্ল্যাক বোর্ডে নিজের আইডিয়া এঁকে দেখাতেন এবং তার সংগে আরও কী কী সংযোজন করা যায় তা আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন।

যাহোক, প্রফেসর ধাওয়ান পূর্বকৃত ও আমাদের ডিজাইনকৃত দুটি কনফিগারেশন আইএসআরওর বিশেষজ্ঞদের বিশেষ বৈঠকে উপস্থাপন করলেন। বিশেষজ্ঞরা দুটো কনফিগারেশনই গভীর মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন এবং অবশেষে পিএসএলভির কনফিগারেশন হিসেবে আমাদের করা ডিজাইনই গৃহীত হল।

 মূলত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় ওই ডিজাইন অনুকূল ছিল বলে আমাদের কনফিগারেশন গৃহীত হয়। প্রফেসর ধাওয়ান দূরদর্শী ছিলেন বলেই আগামী ৫০ বছরের সময়োপযোগী ওই কনফিগারেশন নির্মাণের জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি ও প্রফেসর নরসিমা ডেভেলপমেন্ট ইন ফ্লুইড মেকানিকস অ্যান্ড স্পেস টেকনোলজি নামে একটি বই লিখেছি। সে বইতে পিএসএলভির কনফিগারেশন নিয়ে লেখাসহ প্রফেসর ধাওয়ানর ১৫ বছর ধরে হাতে লেখা স্পেস প্রোফাইল প্রকাশ করেছি।

১৯৮২ সালের ৩১ মে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। প্রফেসর ধাওয়ান আইএসআরওর একটি কাউন্সিল মিটিং ডাকলেন ভবিষ্যত রকেট উৎক্ষেপন বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। সে মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন পরিচালকবৃন্দ। আমি আমাদের লঞ্চ ভেইকলের ব্যয়ভার ও কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বক্তব্য দিলাম।

আমার বক্তব্য শেষ হবার পর প্রফেসর ধাওয়ান কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই জানালেন, আমাকে ডিআরডিওর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার এই সিদ্ধান্ত আমার ক্যারিয়ারে ব্যাপক পরিবর্তন আনে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার অগ্রগতি হতে থাকে।

আজ আমরা যে স্বয়ংক্রিয় লঞ্চ ভেইকল বানাতে সক্ষম হয়েছি এবং যে পিএসএলভি অপারেশন সিস্টেম তৈরী করেছি তার প্রায় ৮০ শতাংশ কাজই করা হয়েছে ১৯৮০ সালে দেওয়া ধাওয়ানের ফর্মুলা অনুসরণ করে। শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি ও স্পেস প্রোফাইলের কারণে আইএসআরও সফল সংস্থা হিসেবে পরিচিত। এ পরিচিতির নেপথ্যেও ধাওয়ানের কৃতিত্ব রয়েছে।

এছাড়াও আইএসআরওর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন অধ্যাপক ইউ.আর. রাও এবং ডক্টর কে কস্তুরিরঙ্গন। অবসর নেবার পরও প্রফেসর ধাওান স্পেস কমিশনের সদস্য ছিলেন এবং তার হাতে গড়া এ সংস্থার জন্য কাজ করেছেন আমরণ। তার জীবদ্দশাতেই তিনি আইএআরওর বহু ভবিষ্যত প্রোগ্রামের দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

ডিআরডিওতে যোগ দিয়ে আমি ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপমেন্টের কাজ শুরু করি। আইজিএমডিপি (ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম)র কাজ করার সময় আমি আমাদের স্থানীয় ডিজাইনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এ ডিজাইনের আওতায় নির্মিত হয় ভূমি থেকে ভূমিতে উৎক্ষেপনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবী। যথার্থ নির্ভুলতা, নির্ভরযোগ্য-কার্যপরিচালনা ও নির্ভুলভাবে ক্ষেপণাস্ত্রের বঙ্কিম পথ অনুসরণের জন্য পৃথিবী ভুবন বিখ্যাত মিসাইল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অগ্নিতে এসএলভি-৩র প্রথম পর্যায়টি জুড়ে দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে আমার টিমের অনুমোদিত রেক্স (রিএন্ট্রি এক্সপেরিমেন্ট) প্রোগ্রামের ভিত্তিতে অগ্নি নির্মিত হয়। পৃথিবী ও অগ্নি দুটো ক্ষেপণাস্ত্রই আমাদের ডিআরডিওর প্রথম প্রোডাকশন।

এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে নির্মিত হয় ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ত্রিশুল ও আকাশ।

তৃতীয় পর্যায়ে আমরা বানিয়েছি নাগ মিসাইল যেটি বিশ্বের সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানে ভারত পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশের সংগে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার ক্ষমতা রাখে।

ডিআরডিওতে দায়িত্বপালনকালে এক সময় আমার মনে হল ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের আইজিএমডিপির বাইরে চিন্তা করতে হবে। আমার এ ধারণা আমি সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল নির্মানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। অনেক দেশের হাতেই এখন যেসব ক্রুজ মিসাইল রয়েছে তা শব্দের গতির চেয়ে ধীরগামী।

আমাদের এসোসিয়েশন রাশিয়ার অন্যতম ইনস্টিটিউট এনপিও মাসিনোন্ত্ৰোয়নিয়ার সংগে যৌথভাবে কাজ করে একটি সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের ডিজাইন করে। বন্ধুত্ব ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাশিয়ার সংগে আমাদের এ পার্টনারশীপ গড়ে ওঠে। আমি আমার সহকারীদের নিয়ে এনপিও মাসিনোস্ত্রোয়নিয়ার মহাপরিচালক ড. এইচএ ইয়েফ্রেমোভর সংগে দেখা করি। এরিমভ আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন। তিনি প্রায় সাত প্রকারের ক্রুজ মিসাইল নির্মাণ করেন এবং সেগুলো রাশিয়ার নৌবাহিনীতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। রাশিয়া ও ভারতের মধ্যকার মিসাইল প্রযুক্তি সংক্রান্ত যৌথ উদ্যোগ ১৯৯০ সালের একটি বিরাট ঘটনা যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এ উদ্যোগ আমার ও ইয়েফ্রেমোভের জন্য ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জও।

যখন আমি ইয়েফ্রেমোভের সংগে দেখা করি তখন আমার মনে হয় আমি যেন মহান বিজ্ঞানী ডক্টর সতীশ ধাওয়ান অথবা রকেট প্রযুক্তির পিতা ডক্টর ওয়ার্নার ভন ব্রাউনের সংগে কথা বলছি। ডক্টর ইয়েমোভ আমাকে তার টেকনোলজি সেন্টারে নিয়ে গেলেন। ওই সেন্টারে সাধারণত কোন বিদেশীকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তিনি সত্যিকার অর্থেই আমাকে তার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং তার ল্যাবরেটরিতেই ভারতীয় খাবারের আয়োজন করলেন। আমিও তাকে হায়দ্রাবাদের মিসাইল প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্র ইমারত পরিদর্শনের সুযোগ দিই। আমাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় হল।

আমরা আমাদের এ যৌথ প্রকল্পের নাম দিলাম ব্রাহমোস। আমাদের ব্ৰহ্মপুত্র নদ ও ওদের মস্কো নামের সংযোজন ঘটিয়ে এ নাম রাখা হল। শিবতনু পিল্লাই, রমানাথ, ভানুগোপাল এবং ভাইস অ্যাডমিরাল ভারত ভূষণ রুশ বিজ্ঞানীদের সংগে মিলিত হয়ে ভারত-রাশিয়ার যৌথ প্রোগ্রাম শুরু করেন। শিবতন পিল্লাইকে একই সংগে যৌথ প্রকল্পের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ও চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ও ডিআরডিওর ক্ষেপনাস্ত্র বিভাগের চীফ কন্ট্রোলার নিয়োগ করা হয়। যৌথ উদ্যোগ সফল করার জন্য সরকার তাকে যুগপভাবে দুটো বিভাগের দায়িত্ব দিয়েছিল। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ল্যাবরেটরি, ডিআরডিএলর অন্যতম বিজ্ঞানী ভানুগোপালকে যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হল।

ভারত-রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে দুদেশের অস্ত্রপ্রযুক্তির ডিজাইন, অগ্রগতি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত তৈরী হল। এ প্রজেক্টের জন্য দুটো দল নির্ধারিত হওয়ায় আমি খুব খুশি হলাম। ২০০১ সালের ১২ জুন ব্রাহমোস চন্ডিপুর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মত উৎক্ষেপন করা হয়। ২০০২ সালের ২৮ এপ্রিল আরও উন্নত প্রক্রিয়ায় সফল পরীক্ষা হল ব্রাহমোসের। ড. ইয়েফ্রেমোভ ও আমি এই ভেবে খুব স্বস্তি ও আনন্দ পেলাম যে এই যৌথ উদ্যোগ সফল হওয়ায় ভারত ও রাশিয়া দুই দেশই বুঝতে পারে এই উন্নত প্রযুক্তির মিসাইল দুদেশের বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করেছে এবং এটা বিশ্ববাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে। আমার স্বপ্ন ছিল তথাকথিত উন্নত বিশ্বে বাজারজাতকরনের এমন ধরনেরই একটি অস্ত্রপ্রযুক্তি আবিষ্কার করা। ব্ৰাহমোস আমার সে স্বপ্ন সফল করলো। যদিও তার নির্মাণপ্রক্রিয়া থেকে আমি দূরে ছিলাম। ব্রাহমোস নির্মাণ করেছে আমার দল। এতেই আমার শান্তি।

অ্যান আনফিনিশড ড্রিম নামে ভার্গেস কিউরিয়েনের লেখা একটি বই পড়েছিলাম। এতে তিনি বলেছেন, একটি ঘটনার কারণে আমাকে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী হতে হয়েছিল। একজন ব্রিটিশ দুগ্ধবিশেষজ্ঞ ভারতে উৎপাদিত দুধের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ভারতে উৎপাদিত দুধের চেয়ে লন্ডনের ব্যাকটেরিয়া মিশ্রিত পানি অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। তার ওই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে কিউরিয়েন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করণে আত্মনিয়োগ করেন এবং দশকের পর দশক ধরে তার নিরলস গবেষণার ফলস্বরূপ আজ ভারত পৃথিবীর প্রথম শ্রেণীর দুগ্ধ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

আনন্দ পরিদর্শনের সময় তার সংগে একটি দিন কাটানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তার প্রতিষ্ঠিত আমূল দুগ্ধ গবেষণাগার আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। দুধ থেকে সেখানে মাখন, ঘি আর আইসক্রিম তৈরী হচ্ছে আর বিশ্ববাজারে তা ছড়িয়ে পড়ছে।

কথা প্রসংগে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে দেশের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। তিনি বললেন, আমাদের এমন সব কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে যা দেশের তরুণ ও কষকশ্রেণীর প্রত্যক্ষ উপকারে আসে। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া আমরা কোনভাবেই সফল হতে পারব না। তাদের অংশগ্রহণ থাকলে আমরা কখনই ব্যর্থ হবো না।

বিজ্ঞানীদের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে হায়দ্রাবাদের ইন্দো-আমেরিকান ক্যান্সার সেন্টারে কর্মরত চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাকরলা সুব্বা রাওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ক্যান্সার কি আমাদের ওপর আরোপিত কোন চরম অভিশাপ?

রেডিওলজির অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সুব্বা রাও তার জবাবে হ্যাঁ এবং না দুটোই বললেন। হ্যাঁ একারণে যে জেনেটিকভাবেই আমাদের শরীরে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা ক্যান্সার আক্রান্ত হতে সহায়তা করে। আর না এজন্য যে আমরা ইতিমধ্যেই ক্যান্সার প্রতিরোধে সাংঘাতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছি।

আমরা সাইকো নিউরো ইমিউনোলজি (পিএনআই) নতুন একটি গবেষণা ক্ষেত্র তৈরী করেছি। মস্তিষ্ক কিভাবে শরীরের ইমিউন বা রোগ প্রতিরোধক শক্তি উৎপাদন করে এ প্রোগ্রামের আওতায় তার গবেষণা চলছে। ক্যান্সার, এইডস, সিফিলিসর মত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসজনিত রোগ থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে এ গবেষণা নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। সাইকো-নিউরো কার্ডিওলজি (পিএনসি) নামে আরেকটি গবেষণা চলছে যার মাধ্যমে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। কীভাবে মস্তিষ্ক রক্তচাপ সংশ্লিষ্ট সমস্যা তৈরী করে। রক্তকণিকা জমাট বেঁধে কীভাবে তা স্ট্রোকের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

.

আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তাদের নিরলস পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন জাতিকে মরণগ্রাসী রোগ থেকে মুক্তি দেবার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *