২. আমাদের একজন ‘রোলমডেল’ দাও

২. আমাদের একজন ‘রোলমডেল’ দাও

Men of ten become what they believe themselves to be. If I believe I can not do something, it wakes me inca pable of doing it. But when I believe I can, then I acquire the ability to do it even if I didnt have it in the beginning.

–Mahatma Gandhi

কেন বারবার বিশেষ করে তরুণ শিক্ষার্থীদের সংগে আমি দেখা করি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে ছাত্রজীবনে ফিরে যেতে হয়। রামেশ্বরম দ্বীপ থেকে আমি উঠে এসেছিলাম। তারপর কী সুদীর্ঘ যাত্রা! আমার পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকালে নিজের কাছেই তা অবিশ্বাস্য মনে হয়।

কিন্তু আমার আজকের এই অবস্থানের নেপথ্যে কী ছিল? কঠোর পরিশ্রম? উচ্চাকাক্ষা? কত উত্তরই তো আমার মনে আসে। তবে আমার মনে হয় এর নেপথ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আমার কর্মসাধনার মূল্য পরিমাপের মানসিকতা। মূল কথা হলো, ঈশ্বর তোমাকে যে এত ঐশ্বর্য দান করেছেন, তোমাকে অবশ্যই তার মূল্য বুঝতে হবে। যদি আমাদের তরুণ ছাত্র ছাত্রীরা বিশ্বাস না করে যে তারা আগামী দিনের উন্নত দেশ ভারতের গর্বিত নাগরিক তাহলে কি করে তারা আলোকিত নাগরিক হয়ে উঠবে?

উন্নত বিশ্বের অমিত ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদ অর্জনের পেছনে কিছুমাত্র রহস্য নেই। এর নেপথ্যের ঐতিহাসিক সত্য হলো জি-৮ বলে পরিচিত উন্নত দেশগুলোর মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম পরম্পরায় দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে কল্পনা করেছে যে তারা একদিন উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এ কারণেই আমাদের একজন রোলমডেল দাও আজ তারা তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সম্পদ ও প্রজ্ঞা লাভের আকাঙ্খ করা, জাগতিক ধনসম্পত্তি অর্জনের চেষ্টা করা ভুল– একথা আমি বিশ্বাস করি না। যদিও আমি খুব স্বল্প পরিমাণ সম্পদ নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি। তথাপি আমি সম্পদ অর্জনের প্রশংসা করি, কারণ এতে জাতির নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্জিত সম্পদ আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় সহায়তা করে। সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণেই সে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়। তুমি চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখবে প্রকৃতিও নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে কিছু দেয় না। বাগানে গেলে দেখবে, বসন্ত মৌসুমে সারা বাগান ফুলে ফুলে ভরে যায়। আসমানের দিকে তাকাও- দেখ, এ মহাবিশ্ব তোমার কল্পনার চেয়েও বড় অসীম বিশাল।

পৃথিবীতে যা কিছু আমরা দেখি– এর সবই শক্তির প্রতীক। শ্রী অরবিন্দর ভাষায়, এ মহাবিশ্বের অসংখ্য শক্তির মত আমরাও একটি শক্তি। বহু দার্শনিক বলেছেন, আত্মা ও দেহের সম্মিলনেই অস্তিত্বের সৃষ্টি। শক্তি ও বস্তু একে অপরের পরিপূরক। আমরা যদি যুক্তি বিশ্বাস করি তাহলে বুঝতে পারবো প্রজ্ঞা ও ধী শক্তির পাশাপাশি বস্তুগত সম্পদ লাভের আকাঙ্ক্ষা করা ভুল বা অপরাধ নয়, বরং জরুরী।

এজন্য এই দর্শনেই আমাদের বিশ্বাসী হতে হবে। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সম্পদ নিয়ে জীবনযাপনের ধারণাও ভুল নয়। মহাত্মা গান্ধীও এ ধরনের জীবন যাপন করতেন। সেটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। তুমিও চাইলে তাকে অনুসরণ করতে পার। তার মত জীবন যাপন করলে তুমিও সত্যিকার অভাব জিনিসটাকে উপলব্ধি করতে পারবে। তবে মনে রাখতে হবে ত্যাগের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে দারিদ্রকে বরণ করা আর সত্যিকার দারিদ্র্যে পতিত হওয়ার মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। এই বিষয়টিকে বোঝানোর জন্যই আমি বারবার স্কুল কলেজের তরুণ শিক্ষার্থী বন্ধুদের কাছে ছুটে যাই। তাদের স্বপ্নগুলো

জানার জন্য ছুটে যাই। তাদের বলতে যাই সুখ সমৃদ্ধি আর দারিদ্র্যমুক্ত স্বর্ণযুগের প্রত্যাশায় তাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। কাজ করতে হবে। তাদের বলতে চাই, তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা ও আনন্দের যে স্রোতধারা রয়েছে তা ছড়িয়ে দাও।

প্রথমবারের মত আমি ত্রিপুরার একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে প্রায় শপাঁচেক শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী জড়ো হয়েছিল। ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন ও উদ্যোগ বিষয়ক আমার বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর আমার কাছে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে একের পর এক বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আসতে লাগলো।

এ বিষয়ে একটু বলতে চাই। আমার প্রতি তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, আমরা কোত্থেকে অনুসরণযোগ্য একটি রোল মডেল বা আদর্শ পাব, আপনি কীভাবে সেই মডেল পাবেন?

আমরা এ বিষয়ে সচেতন থাকি বা নাই থাকি, ছোটবেলা থেকেই জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রমণের সময় আমরা কিন্তু কাউকে না কাউকে মনের মধ্যে আদর্শ ব্যক্তির মডেল হিসেবে দাঁড় করাই।

আমি তাদের প্রশ্নের জবাবে বললাম, যতক্ষণ তোমরা বড় হচ্ছে, এই ধরো ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত, তোমাদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রোল মডেল হবেন তোমাদের বাবা, মা এবং তোমাদের শিক্ষকরা। আমি মনে করি পিতামাতা ও শিক্ষক একটি শিশুর সর্বোত্তম পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন।

আমি শিশুদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে উপস্থিত অভিভাবক ও শিক্ষক শিক্ষিকার দিকে চাইলাম। শিশুদের প্রতি তাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু কথা বললাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি এই মানুষগুলোর মাধ্যমেই শিশু প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব। শৈশবে আমার নিজের পরিবারে বড় হয়ে উঠতে উঠতে আব্বা আম্মাকে দেখেছি তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আমাদেরও নামাজের জন্য উপদেশ দিতেন।

নিজেরা দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও আশে পাশের গরীব মানুষকে সাহায্য করতেন। আমার শিক্ষাগুরু শিবসুহ্মমানিয়া আয়ার আব্বাকে পরামর্শ দিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন। প্রত্যেক বাবা-মার উচিত তাদের সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে তারা ভবিষ্যতে কঠোর পরিশ্রমী এক একজন আলোকিত মানুষ হয়ে উঠতে পারে।

একজন শিক্ষক একটি শিশুর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানলাভের দরোজা। শিশুর ভেতরে সৃষ্টিশীলতা জাগ্রত করতে শিক্ষককে অনুসরণীয় মডেল হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে। আমার বিশ্বাস বাবা, মা ও শিক্ষক এই তিনজনই একটি শিশুর ত্রি-মাত্রিক রোল মডেল। আর একটু বৃহৎ পরিসরে বলতে চাইলে বলা যায়, এরা যদি সম্মিলিতভাবে শিশুদের মনে সাধনার বীজ বুনে দিতে পারেন তাহলে এই ভারতবর্ষ নিঃসন্দেহে এক নবজন্ম লাভ করবে। যেমন বলা হয়ে থাকে?

পিতামাতার অন্যপ্রান্তে বিদ্যালয় আর বিদ্যালয়ের অন্যপ্রান্তে বাড়ী–এই হলো শিশুর ঠিকানা। শিক্ষা এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ

আমাদের একজন রোলমডেল দাও থেকে না দেখে জাতীয় উন্নয়ন হিসেবে আমাদের দেখতে হবে। সঠিক শিক্ষা পেলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মসম্মান ও নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম হবে। কোন আইন প্রয়োগ করে এই গুণাবলী সৃষ্টি করা যাবে না। আমাদেরই পরিচর্যা করে তা সৃষ্টি করতে হবে।

আমার মূল বক্তব্য অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, তবে আমার এ জবাবে বাচ্চারা খুব সন্তুষ্ট হয়েছিল বলে মনে হল।

আরেকটি মেয়ে খুব সিরিয়াসভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, প্রতিদিনই আমরা খবরের কাগজে পড়ি অথবা মা-বাবাকে আতঙ্ককারীদের বিষয়ে আলোচনা করতে শুনি। এরা কারা? তারা কি আমাদের দেশেরই লোক?

তার এ প্রশ্নটি সত্যিই আমাকে বিদ্ধ করলো। আমি নিজেই এর উত্তর খুঁজছিলাম।

তারা আমাদেরই লোক। কখনও কখনও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শূন্যতার মাধ্যমে আমরাই তাদের সৃষ্টি করেছি। কোন প্রতিক্রিয়াশীল জাতি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার জন্য, সন্ত্রাসবাদীতার জন্য এদের ব্যবহার করছে। আমি এই ক্ষুদ্র বালিকার নিষ্ঠুর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উপস্থিত দর্শকদের দিকে, আমার পাশে বসা লোকদের দিকে, শিক্ষকদের দিকে এমন কি আকাশের দিকেও দৃষ্টির হাত বাড়ালাম। আমি বললাম, বাচ্চারা, এ মুহূর্তে আমার রামায়ন ও মহাভারত এ দুটি মহাকাব্যের কথা মনে পড়ছে। রামায়নে আমরা সত্যের পক্ষে ভগবান রামকে এবং মিথ্যা ও রিপুর পক্ষে রাজা রাবণকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে দেখেছি। এটা ছিল সুদীর্ঘ এক জীবন-মরণ যুদ্ধ। কিন্তু শেষমেশ রামেরই জয় হয়েছে। মহাভারতে আমরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা পাই। সেখানেও ধর্ম ও অধর্মের লড়াই। সেখানেও ধর্মের জয় হয়েছিল। যুদ্ধ হয়েছে অনেক, অগনিত, অসংখ্য কিন্তু শান্তির জয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের সময়ে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ভাল ও মন্দ দুটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে ভাল ও মন্দ স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উভয়ই জয়ী হয়েছে।

সর্বশক্তিমান ঈশ্বর উভয়কেই জ্ঞান ও সুচিন্তা দিয়ে সাহায্য করেছেন।

তামিল নাড়ুর ডিভিগুলে অবস্থিত সেন্ট মেরিস স্কুলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত আরেকটি জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে আমাকে বক্তব্য রাখতে হয়েছিল। আমার সংগে দেখা করতে আসা অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে দুশিক্ষার্থী একটি প্রশ্নের জবাবের জন্য ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দুজনের একজন বলে উঠলো, আমি আপনার অগ্নি সিরাগুগাল (উইংস অব ফায়ারের তামিল সংস্করণ) বইটি পড়েছি। সেখানে আপনি কেবলই স্বপ্ন দেখার জন্য বাণী দিয়েছেন। এত কিছু থাকতে বার বার স্বপ্ন কেন?

জবাবে আমি উপস্থিত সমবেত শিক্ষার্থীদের এই বাণীটি আবৃত্তি করতে বললাম,

Dream, Dream, Dream.
Dream transform in to thoughts
Thoughts result in action.

আমি বললাম, বন্ধুরা, যেখানে কোন স্বপ্ন নেই, সেখানে বৈপ্লবিক কোন চেতনাও নেই। আর যেখানে চেতনা নেই, সেখানে কোন ভাল কাজও সংঘটিত হতে পারে না।

এ কারণেই পিতামাতা ও শিক্ষকের প্রধান কর্তব্য হলো তাদের শিশু কিশোরদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা। স্বপ্নের পথ পাড়ি দিয়েই সাফল্য আসে যদিও সেই পথে রয়েছে নানা বাধা বিপত্তি আর সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা।

ওই দিনই আরেকটি ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার, পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী কে? তার প্রশ্ন শুনে আমি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম অগনিত প্রশ্নের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানের জন্ম ও তার ক্রমবিকাশ। সমগ্র বিজ্ঞানের ভিত্তিই হল প্রশ্ন। পিতামাতা ও শিক্ষকরাই ভালো জানেন যে শিশুরাই সীমাহীন প্রশ্নের উৎসমুখ। আর এ কারণে আমি সেই ছেলের প্রশ্নের জবাবে বললাম, শিশুরাই পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী। আমার জবাব শুনে তুমুল করতালি বর্ষণ শুরু হল। ছেলেমেয়েরা আমার এ ভিন্নধর্মী চিন্তার বিষয়টিতে ভারি আনন্দ পেয়েছিল। আমার জবাব শুনে অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাও হেসে ফেললেন।

আসাম সফরের সময় আমি তেজপুর পরিদর্শন করেছিলাম। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। সমাবর্তন শেষে আমি স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সংগে দেখা করতে গেলাম। আমার সামনে অসংখ্য শিশু কিশোরের জটলা। তাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া আমার সেদিনের বক্তব্যের প্রতিপাদ্য ছিল দুর্দর্ষণীয় শক্তি। বক্তব্য শেষ করতেই কচিকাঁচারা আমাকে অটোগ্রাফের জন্য ঘিরে ধরলো। অটোগ্রাফ দেওয়া শেষ হলে আমি আমাদের একজন রোলমডেল দাও দুটো প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। এর একটি হলো : সারা বছরের থৈ থৈ ব্রহ্মপুত্রের স্রোত কেন বিশুষ্ক জলহীন রাজস্থান ও তামিল নাড়ু তে গতি পরিবর্তনের মাধ্যমে পাঠানো হয় না?

একমাত্র শিশুরাই এ ধরনের অভিনব ধারণার জন্ম দিতে পারে। বড় হওয়ার পর মানুষ তাদের আইডিয়া বাস্তবায়নের পথে নানা অসম্ভাব্যতা আবিষ্কার করে। এটি এত শক্তিশালী ও তীব্র প্রশ্ন ছিল যে আমি পুরোপুরি ধাক্কা খেলাম। আমি নিশ্চিত যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। আমি ওই বাচ্চাটিকে কীভাবে বোঝাবো যে নদী হলো রাজ্য সরকারের সম্পত্তি এবং আমাদের সরকার ওই পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি বললাম, ইণ্ডিয়া ভিশন ২০২০ তোমাদের মত তরুণ কিশোরদের কাছে প্রত্যাশা করে তারা ২০২০ সালের মধ্যে রাজ্যগুলোর মধ্যে কৃত্রি করে এক নদীর সংগে আরেকটিকে সংযুক্ত করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি তরুণদের মধ্যে সর্বোচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মেধা রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আত্মকেন্দ্রীক নীতি ও নেতিবাচক পুঁজিবাদী চিন্তা পরিহারের শক্তি তরুণদের কাছে সবচে বেশী। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের সংগে রাজ্য সরকারগুলোর সমন্বয় প্রক্রিয়া তারাই উন্নত করতে পারে। আর অবশ্যই তারা তা করবেও।

আরেকজন ছাত্র আমাকে এমন একটি প্রশ্ন করেছিল যার জবাব দেবার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। সে বলেছিল, স্যার, বড় বড় নেতারা আমাদের কাছে আসেন না, আমাদের সংগে কথাও বলেন না। প্রধানমন্ত্রীজি প্রায়ই চেন্নাই, লক্ষ্ণৌ, আরও কত কত জায়গায় যান কিন্তু এখানে তো আসেন না। আমরা এখানে তাকে চাই, তার সংগে কথা বলতে চাই। আমি দেশনেতাদের সংগে তার যোগাযোগের স্পৃহা দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, দিল্লি পৌঁছে আমি নেতাদেরকে তোমার স্বপ্নের কথা বলবো। তোমার স্বপ্ন অবশ্যই সত্যি হবে।

দিল্লি ফিরে আমি সত্যি সত্যি প্রধানমন্ত্রীকে এ ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বিনীতভাবে বিষয়টি স্বীকার করে বললেন, আসলেই বাচ্চারা আমার সংগে কখনও কথা বলার সুযোগ পায় না। হয়তো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই তাদের সংগে আমার দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত সৃষ্টির স্বার্থে শিশুদের সংগে বেশী বেশী যোগাযোগ রাখার জন্য আমি প্রায়ই বিভিন্ন ক্ষেত্রের নেতৃবৃন্দকে পরামর্শ দিয়ে থাকি।

ঝাড়খণ্ড সংস্কার উদ্যোগী হওয়ার পর আমি বহুবার সেখানে সফর করেছি। যতবার আমি সেখানে গেছি ততবারই সেখানকার উন্নয়ন ধারা দেখে হতবাক হয়েছি। বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের উদ্যোগ দেখে ভেবেছি এবার সেখানে কত সম্পদের সদ্ব্যবহার হবে। বোকারোতে অবস্থিত রামকৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে একবার ৩ হাজার ছাত্রছাত্রীর মাঝে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের হাতে আঁকা পেইন্টিং, পুতুল, খেলনা সামগ্রীর প্রদর্শনী দেখে তাদের সৃজনশীলতায় অবাক হয়েছি। তাদের সংগে কথোপকথনের এক পর্যায়ে এক ছাত্র আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের এই ঝাড়খণ্ডের সবখানেই সবুজের সমারোহ। এখানে অরণ্য, নদী, পাহাড় সবই আছে। কিন্তু রাজস্থানে কেন মরুভূমি? তার এ প্রশ্ন আসামের সেই ছাত্রের প্রশ্নটির কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল। কেন ব্রহ্মপুত্রের পানি তামিলনাড় ও রাজস্থানে নেওয়া হচ্ছে না?

আমি বললাম, তোমরা জান, মাত্র ২০ বছর আগেও রাজস্থানে এখন যে চাষাবাদ হয় তাও হতো না। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী খাল খননের পর সেখানকার অনেক জায়গায় চাষাবাদ সম্ভব হয়েছে। মানুষের পক্ষেই একটি মরুভূমিকে উর্বর ভূমিতে পরিণত করা সম্ভব। আসামের ছাত্রদের যে কথা বলেছিলাম, এখানেও তার পুনরাবৃত্তি করলাম, ভারতের নদী সংযোগ বিষয়ক পরিকল্পনা আছে যাতে জলশূন্য এলাকায় পর্যাপ্ত পানি পৌঁছে দেওয়া যায়। তোমরা বড় হয়ে সরকারের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করবে।

একটি ছোট্ট সোনামণি গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে খুব সিরিয়াস এক্সপ্রেশন নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, আপনার বানানো অগি মিসাইল কি সাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আঘাত করতে পারবে?

তার এ কথায় আমি হোঁচট খেলাম। আমি বললাম, আমাদের এমন কোন শত্রু দেশ নেই যেখানে অগ্নি মিসাইল দিয়ে আঘাত করতে হবে। তাছাড়া আমেরিকা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। অগ্নি আমাদের শক্তির প্রতীক। অগ্নি শুধু এটুকু প্রমাণের জন্য যে ভারতের সব ধরনের ক্ষমতা রয়েছে।

কটক সফরের সময় আমি স্বর্গীয় বিচারপতি হরিহর মহাপাত্রর জন্মদিন উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। বিচারপতি রঙ্গনাথ মিশ্রর নিমন্ত্রণে মূলত সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে আমি মানবজীবনকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বিচারপতি হরিহর মহাপাত্র সেখানে মৃত্যুকে জয় করে যেন সবার মাঝে বেঁচে আছেন। ৯২ বছরের জীবনে কটকে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন-কটক চক্ষু হাসপাতাল, উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ক কয়েকটি

আমাদের একজন রোলমডেল দাও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে উড়িয়া ভাষায় আমার আত্মজীবনী প্রকাশ পেয়েছিল। আমার বক্তব্য শেষ হতেই কিশোর তরুণরা আমাকে ঘিরে ধরলো।

তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, স্যার কোন কোন বই আপনার প্রিয় যা আপনার মনন গঠনে সহায়তা করেছে?

আমি বললাম, আমার পড়া চারটি বই আমার আত্মার খুব কাছাকাছি। প্রথমটি হলো, নোবেল জয়ী লেখক ডক্টর অ্যালেন্সিস ক্যারেলের লেখা ম্যান দ্য আনোন। যেহেতু মন ও শরীর অবিচ্ছেদ্য বিষয় সেহেতু রোগীর চিকিৎসার জন্য মন ও শরীরের চিকিৎসা যুগপৎভাবে হওয়া উচিত। এ বইয়ে রোগীকে সারিয়ে তুলতে কীভাবে মন ও শরীরের চিকিৎসা করা দরকার তা নির্দেশ করা হয়েছে। একটিকে অবহেলা করে অপরটি সারিয়ে তোলা যায় না। যারা বড় হয়ে চিকিৎসক হবার স্বপ্ন দেখছে তাদের এটা পড়া উচিত। এটিপড়লে জানা যাবে মানবদেহ কোন যান্ত্রিক কাঠামো নয় বরং অত্যন্ত মেধাদীপ্ত উপায়ে নির্মিত ও স্পর্শকাতর ফিডব্যাক সিস্টেমে পরিচালিত একটি অর্গানিজম। দ্বিতীয় প্রিয় বইটি হল, তিরুভালুভারর লেখা থিরুকুরাল। এতে জীবনের অপূর্ব কিছু দিক নির্দেশনা রয়েছে। তৃতীয় বইটি হচ্ছে লিলিয়ান ইখলার ওয়াটসনের লেখা বই লাইট ফ্রম মেনি ল্যাম্পস্। আমাদের কীভাবে বাঁচতে হবে তার নির্দেশনা রয়েছে এ বইটিতে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে বইটি আমার অমূল্য পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। সর্বোপরি পবিত্র কোরান শরীফ আমার সার্বক্ষণিক সংগী।

গুজরাটের আনন্দতে শিশু সমাবেশে বক্তব্য দেবার পর চটপটে একটা ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের শত্রু কে? আমি তার প্রশ্নটি অন্য ছাত্র ছাত্রীদের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম এবং তাদের কাছে উত্তর জানতে চাইলাম। ওদের একজন উত্তর দিল, দারিদ্র্য।

আমার কল্পনার আলোকিত শিশুদের মত তারা কি সুন্দর প্রজ্ঞাময় জবাব দিয়ে দিল।

সেখানকার শেষ প্রশ্নটি চমকাবার মতই। অন্য আরেকটি শিশু দাঁড়িয়ে বললো, স্যার, পাকিস্তানি অস্ত্র কি ভারতের চেয়ে শক্তিশালী? আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম কেন তার মাথায় এ ধরনের চিন্তা এল? সে জানাল সংবাদমাধ্যমগুলোই তাকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। আমি বললাম, শক্তি সামর্থ্য প্রদর্শন করা আমাদের দেশের চরিত্রের এক অনুপম দিক। এটা হয়তো আমাদের জেনেটিক কারণেও হতে পারে। আমি তাকে বললাম, ভারত যেকোন ধরনের মিসাইল ও পারমাণবিক বোমার ডিজাইন করতে, তা উন্নত করতে ও প্রস্তুত করতে সক্ষম। সারাপৃথিবীতে এ ক্ষমতা মাত্র ৪টি দেশের আছে। আমি তাকে মন থেকে সমস্ত সন্দেহ ও উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলার জন্য বললাম। সে আমাকে খুব সুন্দর একটা বই উপহার দিয়েছিল।

আমি ভারতবর্ষের বহু স্কুল পরিদর্শন করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর মুখোমুখি হয়েছি। তারা আমাকে যে শত শত প্রশ্ন করেছিল তার থেকে বেছে বেছে মাত্র ১১টি প্রশ্নের কথা আমি উল্লেখ করলাম। এ প্রশ্নের মধ্যে তাদের সারল্য ফুটে উঠলেও পরিস্কারভাবে বোঝা যায় তারা একটি উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য কত শক্তিশালী কল্পনা হৃদয়ে লালন করছে।

তাদের সংগে আলাপচারিতায় আরেকটি বিষয় আমি বুঝতে পারছি বিজ্ঞান, শিল্প বাণিজ্য, ক্রীড়া, বিনোদন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য রোল মডেল এখন কী ভয়ানক জরুরী।

এখন একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা কি আমাদের সন্তানদের সামনে একজন রোল মডেল বা আদর্শ ব্যক্তিত্ব হাজির করতে পারব? যদি পারি তাহলে কীভাবে তা পারব?

নতুন সহস্রাব্দের সূচনালগ্ন জিন প্রযুক্তির সুসংবাদ বয়ে এনেছে। মানুষ যে বিশেষ ধরনের ৩০ হাজার জিন তার দেহে বহন করছে তা হাজার হাজার বছর আগে জন্ম নেওয়া প্রস্তর যুগের পূর্বপুরুষদের চরিত্র বহন করে।

লক্ষণ প্রকাশ পায় আমাদের সমৃদ্ধজীবন লাভের চেষ্টার মাধ্যমে। আমাদের পূর্বপুরুষদের মত আমরাও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য, একটি স্বচ্ছল জীবন অর্জনের জন্য লড়াই করে চলেছি।

বলা হয় প্রকৃতিই এত প্রয়োজন ও অভাবের সৃষ্টি করেছে। উৎপাদনের প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে, খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছে, নিঃশ্বাস নেবার প্রয়োজনীয়তা তৈরী করেছে। ইতিহাসে দেখা যায় ক্ষুধার জন্যই মানুষকে সবচেয়ে বেশী সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমরা হয়তো আমাদের পেছনের করুণ ইতিহাস ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস মনে রাখতেই হবে।

আমি তিন দশক ধরে ডক্টর বিক্রম সারাভাইর সাফল্য অর্জনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা দেখেছি। তার সংগে যারা কাজ করেছে তাদের সবারই স্বপ্ন ছিল বিক্রমকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার। আমরা তাকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করে কাজ করেছি। বিক্রম সারাভাইর কর্মস্পৃহা এত প্রখর ও শক্তিশালী ছিল যে মৃত্যুর বহু বছর পরেও তার ছাত্রছাত্রী তার স্বপ্নকে সফল করেছিল। তোমার জীবনের রোল আমাদের একজন রোলমডেল দাও মডেল হবে এমন কেউ যাকে তুমি সবচেয়ে বেশী ভালবাস ও যার কাজ তোমার সবচে বেশী ভাল লাগে– সে হতে পারে ক্রীড়াবিদ, শিক্ষক অথবা, যে কোনও সফল মানুষ।

সম্প্রতি একজন মূর্তিমান রোল মডেল ও জীবিত লিজেন্ড চরিত্রের সংগে আমার দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি ভারতের কীংবদন্তি শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর।

লতার বাবা স্বর্গীয় ওস্তাদ দীননাথ মুঙ্গেশকরের স্মরণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন তিনি। ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত লতাজি আমাকে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ৪৫০ শয্যার দীননাথ হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানানোয় আমি গর্ববোধ করেছিলাম। উদ্বোধনের কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালটি ঘুরে দেখেছি। দেখলাম হাসপাতালের প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবে। এ ঘটনা আমাকে মুগ্ধ করলো এজন্য যে অঢেল ঐশ্বর্য ও খ্যাতি পাওয়া সত্ত্বেও লতা মুঙ্গেশকর একজনের সহায়তায় দশজনের দুঃখ লাঘব হতে পারে। যুগ যুগ ধরে রেডিওতে তার গান শুনে অগনিত মানুষ আনন্দ উপভোগ করছে। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন সংঘাতের সময় তার অ্যায় মেরে বাতান কি লোগো গানটি পুরো জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। এমন আনন্দপূর্ণ উপায়ে লাখ লাখ মানুষকে খুব কম লোকই প্রভাবিত করতে পারে।

আদর্শ ব্যক্তিত্বরা বা (আমার ভাষায়) রোল মডেলরা আমাদেরকে ব্যক্তি হিসেবে দল হিসেবে এবং অবশ্যই জাতি হিসেবে কী করণীয় তার দিক নির্দেশনা দেন। সুবিশাল সাফল্যের ক্ষেত্রেও তারাই নেতৃত্ব দেন। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি সফলতার পথে আসতে পেরেছি বলে মনে হয়। কিন্তু এর সংগে অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনা করা ঠিক হবে না বা বলা যাবে না আমরা অমুক অমুক ক্ষেত্রে পিছিয়ে।

প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল আদ্যোপান্ত একটি জ্ঞান সম্ভারপূর্ণ সমাজ। গণিতবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, মহাকাশতত্ত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের অতুলনীয় নেতৃত্বের ইতিহাস রয়েছে। এই উচ্চ প্রযুক্তির যুগে সাধারণ শ্রমিকের কাজে আটকে না থেকে ভারতে এখনই এমন এক শিক্ষা বিপ্লব ঘটানো দরকার যাতে আবার আমরা জ্ঞানে ও মেধায় বিশেষ একটি সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *