৪. ধ্যান [১৯৯১-]

৪. ধ্যান [১৯৯১-]

আমরা সৃষ্টি ও ধ্বংস করি
এবং আবার সৃষ্টি করি
এমন আকৃতিতে যা কেউ জানে না।

–আল-ওয়াকিয়াহু
কুরআন ৫৬ : ৬১

১৫.

১৯৯০ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে, মিসাইল কর্মসূচির সাফল্য উদযাপন করল জাতি। উ. অরুণাচলমের সঙ্গে আমাকেও পদ্মবিভূষণ পুরস্কার দেওয়া হলো। আমার অপর দুই সহকর্মী, জেসি ভট্টাচার্য ও আরএন আগরওয়াল, ভূষিত হলেন পদ্মশ্রী পুরস্কারে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই প্রতিষ্ঠানের এতজন বিজ্ঞানীর নাম যুক্ত হয়েছিল পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায়। আমাকে এক দশক আগে দেওয়া পদ্মভূষণ পুরস্কারের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছিল আবার। আমি কম-বেশি আগের মতোই জীবন যাপন করছিলাম-দশ ফুট চওড়া ও বারো ফুট লম্বা একটা কামরায়, সেটা সজ্জিত ছিল প্রধানত বই, কাগজ আর কয়েকটা ভাড়া করা আসবাবপত্রে। একমাত্র পার্থক্য আগের কামরাটা ছিল ত্রিবান্দ্রামে আর এবারেরটা হায়দারাবাদে। মেস বেয়ারা সকালের নাশতার জন্য আমার ইডলি ও বাটারমিল্ক নিয়ে এল আর পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমাকে নীরব আভিনন্দন জানাল হাসি দিয়ে। আমার দেশবাসীর এই স্বীকৃতি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। প্রচুর অর্থ রোজগারের জন্য বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী প্রথম সুযোগেই এ দেশ ছেড়ে চলে যান বিদেশে। এটা সত্যি যে তারা অবশ্যই বিশাল আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন, কিন্তু দেশের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে কি তার তুলনা চলে?

আমি কিছু সময় একাকী নীরব ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়ি। রামেশ্বরমের বালু ও শখ, রামনাথপুরমে ইয়াড়রাই সলোমনের তত্ত্বাবধান, ত্রিচিতে রেভারেন্ড ফাদার, সেকুয়েইরার এবং মাদ্রাজে অধ্যাপক পান্ডালাইয়ের পথনির্দেশনা, ব্যাঙ্গালোরে ড. মেডিরাট্টার উৎসাহ, অধ্যাপক মেননের সঙ্গে হোভারক্রাফটে উডডয়ন, ভোর হবার আগে অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে তিলপাটত পরিদর্শন, এসএলভি-৩ ব্যর্থতার দিন ড, ব্ৰহ্ম প্রকাশের নিরাময়ী স্পর্শ, এসএলভি-৩ উৎক্ষেপণে জাতীয় বিজয়োল্লাস, ম্যাডাম গান্ধীর সপ্রশংস উপলব্ধিমূলক হাসি, ভিএসএসসিতে এসএলভি-৩ পরবর্তী ফুটন্ত অবস্থা, ডিআরডিওতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে ড. রামান্নার বিশ্বাস, আইজিএমডিপি, আরসিআই সৃষ্টি, পৃথ্বী, অগ্নি… স্মৃতির বন্যা ভেসে গেল আমার ওপর দিয়ে। এসব মানুষ এখন কোথায়? আমার বাবা, অধ্যাপক সারাভাই, ড, ব্রহ্ম প্রকাশ? আবার যদি তাদের সঙ্গে দেখা হতো আর আমার আনন্দ ভাগ করে নিতে পারতাম। আমি অনুভব করি, স্বর্গের পৈত্রিক শক্তি আর প্রকৃতির মাতৃক ও বৈশ্বিক শক্তি পিতামাতার মতো আমাকে আলিঙ্গন করে, যেন বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে তারা ফিরে পেয়েছে। আমার ডাইরিতে আমি দ্রুত হাতে লিখলাম:

Away! fond thoughts, and vex my soul no more!
Work claimed my wakeful nights, my busy
days Albeit brought memories of Rameswaram shore
Yet haunt my dreaming gaze!

এক পক্ষকাল পরে, আয়ার ও তার দল নাগ-এর মেইডেন ফ্লাইট চালিয়ে মিসাইল কর্মসূচিতে একটা পুরস্কার যোগ করলেন। পরদিনও তারা এ পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন, এভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের প্রথম অল-কম্পোজিট এয়ারফ্রেম ও প্রপালসন সিস্টেমের দুইবার পরীক্ষা। দেশীয় থার্মাল ব্যাটারির মূল্যও প্রমাণিত হয়েছিল এসব পরীক্ষায়।

ফায়ার-অ্যান্ড-ফরগেট সামর্থযুক্ত তৃতীয় প্রজন্মের ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল সিস্টেমের অধিকারী হবার মর্যাদা অর্জন করেছিল ভারত। তা ছিল দুনিয়ার যে কোনো স্টেট-অব-দ্য আর্ট প্রযুক্তির সমান। দেশীয় কম্পোজিট প্রযুক্তি বড়ো একটা মাইলস্টোন অতিক্রম করেছিল। নাগ-এর সাফল্যও নিশ্চিত করেছিল কনসোর্টিয়াম অভিগমনের ফলপ্রদতা, যা পরিচালনা করেছিল অগ্নির সফল নির্মাণ।

নাগে ব্যবহার করা হয় প্রধান দুটো প্রযুক্তি-একটা ইমেজিং ইনফ্রা রেড (আইআইআর) সিস্টেম এবং একটা মিলিমেট্রিক ওয়েভ (এমএমডব্লিউ) সিকার রাডার। প্রথমটার গাইডিং আই হিসাবে। দেশের একক কোনো গবেষণাগারের সামর্থ্য ছিল না এসব প্রচণ্ড অগ্রবর্তী সিস্টেম তৈরি করার। কিন্তু সাফল্য লাভের তাগিদ ছিল, যা থেকে ফল পাওয়া গিয়েছিল কার্যকর যৌথ প্রচেষ্টায়। চন্ডিগড়ের সেমি কণ্ডাক্টর কমপ্লেক্স তৈরি করেছিল চার্জ কাপড ডিভাইস (সিসিডি) বিন্যাস। দিল্লির সলিড ফিজিক্স ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিল মার্কারি ক্যাডমিয়াম টেলুরাইড (এমসিটি) ডিটেকটর। দিল্লির ডিফেন্স সেন্টার (ডিএসসি) জলস টমসন এফেক্টের ওপর ভিত্তি করে গড়ে দিয়েছিল একটা দেশীয় কুলিং সিস্টেম। দেরাদুনের ডিফেন্স ইলেকট্রনিকস ল্যাবরেটরি (ডিইএএল) উদ্ভাবন করেছিল ট্রান্সমিটার রিসিভার ফ্রন্ট এন্ড।

স্পেশাল গ্যালিয়াম আর্সেনাইড গান, স্কটকি ব্যারিয়ার মিক্সার ডিওড়স, অ্যান্টেনা সিস্টেমের জন্য কমপ্যাক্ট কমপ্যারাটর-এসব উচ্চতর প্রযুক্তি ডিভাইসের সবগুলোর ক্ষেত্রে ক্রয় নিষেধাজ্ঞা চাপান হয়েছিল ভারতের ওপর। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা দিয়ে কখনও উদ্ভাবনা দমন করা যায় না।

.

আমি ওই মাসেই মাদুরাই কামারাজ ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম তাদের সমাবর্তনে ভাষণ দিতে। যখন মাদুরাইতে পৌঁছলাম, তখন আমার হাই স্কুল শিক্ষক ইয়াড়রাই সলোমনের কথা জিজ্ঞেস করলাম, এতদিনে তিনি রেভারেন্ড হয়েছিলেন আর তার বয়স হয়েছিল আশি বছর। আমাকে বলা হলো যে, মাদুরাইয়ের এক শহরতলিতে তিনি বাস করেন। আমি ট্যাক্সি নিয়ে তার বাড়িতে গেলাম। রেভারেন্ড সলোমন জানতেন, ওই দিন আমি সমাবর্তন ভাষণ দেব। কিন্তু সেখানে যাবার কোনো উপায় ছিল না তার। ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে এক হৃদয়স্পর্শী পুনর্মিলন ঘটল। ড. পিসি আলেকজান্ডার, তামিল নাড়ুর গভর্ণর, তিনি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করছিলেন, এটা দেখে খুব আলোড়িত হলেন যে বৃদ্ধ শিক্ষক তার বহু দিন আগের ছাত্রকে ভুলে যাননি, তিনি তাকে মঞ্চে আসন নেবার অনুরোধ জানালেন।

প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা সমাবর্তন দিবস হচ্ছে শক্তির ফ্লাডগেট খুলে দেবার মতো ব্যাপার যা, প্রতিষ্ঠান সংস্থা ও শিল্পকারখানায় সজ্জিত হলে, জাতিগঠনে সহযোগিতা করে, আমি তরুণ গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে বললাম। আমি অনুভব করলাম, কোনো দিক থেকে আমি রেভারেন্ড সলোমনের কথারই প্রতিধ্বনি করছি, যা তিনি বলেছিলেন প্রায় অর্ধ-শতাব্দী আগে। বক্তৃতা শেষ হলে আমি মাথা নুইয়ে সম্মান জানালাম আমার শিক্ষককে। মহান স্বপ্নদ্রষ্টাদের বিশাল স্বপ্ন হয় সর্বদা সীমা অতিক্রান্ত, আমি রেভারেন্ড সলোমনকে বললাম। তুমি যে শুধু আমার লক্ষ্যেই পৌঁছেছ তাই নয়, কালাম! তুমি ওগুলোর দীপ্তিকেও ছাড়িয়ে গেছ, তিনি আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসা গলায় আমাকে বললেন।

পরের মাসে আমি ত্রিচিতে গেলাম আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগালাম সেন্ট জোসেফ কলেজ পরিদর্শনে। সেখানে রেভারেন্ড ফাদার সেকুয়েইরা, রেভারেন্ড ফাদার এরহার্ট, অধ্যাপক হোথাথরি আয়েঙ্গারকে খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আমার মনে হলো সেন্ট জোসেফ-এর প্রতিটা পাথরে তখনও যেন ওইসব মহান মানুষের জ্ঞানের ছাপ লেগে ছিল। সেন্ট জোসেফ-এ আমার স্মৃতির দিনগুলোর কথা আমি তরুণ ছাত্রদের কাছে বর্ণনা করলাম আর আমাকে যারা গড়ে তুলেছিলেন সেই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম।

আকাশ-এর টেস্ট ফায়ারিং দিয়ে আমরা উদযাপন করলাম জাতির চুয়াল্লিশতম স্বাধীনতা দিবস। প্রহ্লাদ ও তার দল কম্পোজিট মোডিফাইড ডাবল বেজ প্রোপেল্যান্টের ভিত্তিতে নতুন একটা সলিড প্রোপেল্যান্ট বুস্টার সিস্টেম তৈরি করেছিল। নজিরবিহীন উচ্চ শক্তিসম্পন্ন এই প্রোপেল্যান্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল দূরপাল্লার সারফেস-টু-এয়ার মিসাইলের নিশ্চয়তা বিধানে। আঘাতযোগ্য ক্ষেত্রে ভূমিভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষায় একটা জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছিল দেশ।

১৯৯০ সালের শেষ দিকে, বিশেষ এক সমাবর্তনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ডক্টর অব সায়েন্স উপাধিতে সম্মানিত করল। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষের সঙ্গে একই তালিকায় আমার নাম দেখে আমি কিছুটা হতবুদ্ধি হয়েছিলাম। একই সমাবর্তনে তাকেও সম্মানিত করা হয়। ম্যান্ডেলার মতো এক কিংবদন্তির সঙ্গে সাধারণ মিল আমার কী ছিল? হয়তো সেটা ছিল আমাদের মিশনে আমাদের নাছোড়বান্দা মনোভাব। আমার দেশে আমার অ্যাডভান্সিং রকেট বিজ্ঞানের মিশন ম্যান্ডেলার মিশনের সঙ্গে তুলনা করলে কিছুই ছিল না। কারণ ম্যান্ডেলার মিশন ছিল বিপুল গণমানবতার জন্য মর্যাদা অর্জনের মিশন। কিন্তু আমাদের আকাঙ্ক্ষার ব্যাকুলতার মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। দ্রুত কিন্তু কৃত্রিম আনন্দের পেছনে ছুটে বরং নিখাদ সাফল্য অর্জনের জন্য আরও বেশি নিবেদিত প্রাণ হও, তরুণ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আমার এই ছিল পরামর্শ।

মিসাইল কাউন্সিল ১৯৯১ সালকে ডিআরডিএল এবং আরসিআইয়ের জন্য প্রবর্তনার বছর হিসাবে ঘোষণা করল। আইজিএমডিপিতে আমরা যখন একটা ধারাবাহিক ইঞ্জিনিয়ারিং রুট পছন্দ করেছিলাম, তখন আমরা একটা রাফট্র্যাক নির্বাচন করেছিলাম। পৃথ্বী ও ত্রিশূল-এর উন্নয়নমূলক পরীক্ষা সম্পাদনের পর, আমাদের পছন্দ এখন গড়িয়েছে পরীক্ষার ওপর। এক বছরের মধ্যে ইউজার ট্রায়ালের জন্য আমার সহকর্মীদের আমি উদ্দীপ্ত করলাম। আমি জানতাম যে এটা কঠিন কাজ হবে। কিন্তু সেটা আমাদের নিরুৎসাহিত করবে না।

রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহন তার দায়িত্ব থেকে অবসর নিলেন, ত্রিশূলের দায়িত্ব  চাপল কাপুরের কাঁধে। মিসাইল কমান্ড গাইডেন্স মোহন যেভাবে বুঝতেন আমি সবসময়ই তার অনুরাগী ছিলাম। এই নাবিক-শিক্ষক-বিজ্ঞানী এই ক্ষেত্রে দেশের অন্য আর সব বিশেষজ্ঞকে ছাড়িয়ে যেতে পারতেন। আমিত্রিশূল বিষয়ক মিটিংগুলোয় কমান্ড লাইন অব সাইট (সিএলওএস) গাইডেন্স সিস্টেমের নানা ধরণ নিয়ে তার মূল্যবান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কথা চিরদিন মনে রাখব। একবার তিনি আমাকে একটা কবিতা দেখিয়েছিলেন, তাতে তিনি আইজিএমডিপি-এর প্রকল্প পরিচালকের প্রতি ঋণ স্বীকারের তুলে ধরেন। নিঃশ্বাস ছাড়বার এটা ছিল একটা ভালো উপায়:

Impossible timeframes,
PERT charts to boot
Are driving me almost crazy as a coot;
Presentations to MC add to ones woes,
If they solve anything, Heaven only knows.
Meetings on holidays, even at night,
The family is fed up, And all readz to fight.

My hands are itching
to tear my hair–
But alas! I havent any more to tear…

আমি তাকে বলেছিলাম, আমার সব সমস্যা আমি হস্তান্তর করেছি ডিআরডিএল, আরসিআই, আর অংশগ্রহণকারী অন্যন্য গবেষণাগারে কর্মরত আমার সেরা দলগুলোর কাছে। আর সেজন্যই আমার মাথাভর্তি চুল রয়ে গেছে।

১৯৯১ সালটা শুরু হলো অত্যন্ত অশুভ একটা লক্ষণ নিয়ে। ১৫ জানুয়ারি ১৯৯১ সালের রাতে ইরাক ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর মধ্যে শুরু হয়ে গেল উপসাগরীয় যুদ্ধ। এক ধাক্কায় গোটা জাতির কল্পনা দখল করে নিল রকেট ও মিসাইল। লোকজন কফি হাউজ ও চায়ের দোকানে স্কাড ও প্যাট্রিওট ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। শিশুরা মিসাইলের আকৃতির ঘুড়ি ওড়াতে লাগল, আর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে লাগল। পঙ্খী ও ত্রিশূল-এর সফল পরীক্ষা উপসাগরীয় যুদ্ধের উত্তেজনা থেকে একটি জাতিকে স্বস্তি দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। পৃথ্বী ও ত্রিশূল গাইডেন্স সিস্টেমের প্রগ্রামেবল ট্র্যাজেক্টরি ক্যাপাবিলিটি সম্পর্কে সংবাদপত্রের খবর ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। গোটা জাতি আমাদের ওয়ারহেড ক্যারিয়ার ও উপসাগরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত মিসাইলের মধ্যে তুলনা করতে লাগল। তারা আলোচনা করতে লাগল পৃথ্বী কি স্কার্ডের চেয়েও শক্তিশালী, আকাশ কি প্যাট্রিওটের মতো লক্ষ্যভেদী, ইত্যাদি। আমার কাছ থেকে হাঁ অথবা কেন নয়? শুনে তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত গর্বে ও আত্মতৃপ্তিতে।

মিত্রবাহিনী এগিয়ে ছিল প্রযুক্তির সর্বসাম্প্রতিক ব্যবহারের দিক দিয়ে। তাদের কৌশলগত অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হয়েছিল আশি ও নব্বই দশকের প্রযুক্তি অনুযায়ী। কিন্তু ইরাকের কাছে যেসব অস্ত্র ছিল সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল ষাট ও সত্তুর দশকের প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

এখন বলতেই হয়, আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে আধিপত্য অর্জন। চীনা যুদ্ধ বিষয়ক দার্শনিক সান জু ২০০০ বছর আগে বলে গেছেন, যুদ্ধে আসল বিষয় হচ্ছে শত্রুকে শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবে পরাস্ত করা, তার মনে পরাজয়ের বোধ ঢুকিয়ে দিতে পারলেই সে ভেঙে পড়বে, তার পতন ঘটবে, আসল কাজ হলো তার ইচ্ছাশক্তিকে ভেঙে দেওয়া। আজকের দিনে মনে হয় দার্শনিক সান বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধ কৌশলে প্রযুক্তির আধিপত্য কল্পনা করতে পেরেছিলেন। উপসাগরীয় যুদ্ধে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের সঙ্গে মিসাইল ফোর্স মিলিত হয়ে যে অবস্থাটা তৈরি করেছিল, সেটা মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিক এক্সপার্টদের জন্য ছিল এক মহাভোজ। এ ক্ষেত্রে মিসাইল, ইলেকট্রনিক ও ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার নিয়েছিল প্রধান ভূমিকা। এটা ছিল একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধ-নাটকের পর্দা উত্তোলন।

ভারতে, এমনকি আজকের দিনেও, অধিকাংশ মানুষ প্রযুক্তি বলতে বোঝে বোয়াচ্ছন্ন ইস্পাত কারখানা অথবা ঘড়ঘড়ে যন্ত্রপাতি। প্রযুক্তির এ এক অপর্যাপ্ত ধারণা। মধ্যযুগে হর্স কলার উদ্ভাবন বিশাল পরিবর্তন এনেছিল কৃষি পদ্ধতিতে। এর কয়েক শতাব্দি পর উদ্ভাবিত বেসমার ফার্নেরস প্রযুক্তির দিকে ছিল আরেক অগ্রগতি। আসলে কৌশল আর যন্ত্র মিলে তৈরি হয় প্রযুক্তি। আর এর ব্যবহার চলে সর্বক্ষেত্রে কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন তৈরিতে, মৎস্য উৎপাদনে, আগাছা উপড়ে ফেলতে, থিয়েটারে আলো জ্বালাতে, রোগীদের চিকিৎসা করতে, ইতিহাস শেখাতে, যুদ্ধে লড়াই করতে, এমনকি যুদ্ধ প্রতিরোধ করতেও।

উপসাগরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল মিত্রবাহিনীর প্রযুক্তিগত আধিপত্যের ভেতর দিয়ে। এরপর ডিআরডিএল এবং আরসিআইয়ের ৫০০ বিজ্ঞানী একত্রিত হলেন। নতুনভাবে উত্থিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে। আমি একটা প্রশ্ন রাখলাম ও অন্যান্য দেশের টেকনোলজি ও অস্ত্রশস্ত্র কি কার্যকর? আর যদি তাই হয়, তাহলে কি .. আমাদেরও সে সবের উদ্যোগ নেওয়া দরকার? আলোচনায় আরও অনেক গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। যেমন কার্যকর ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সাপোর্ট কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়? এলসির মতো সমানভাবে প্রয়োজনীয় সিস্টেমের সঙ্গে একই সময়ে কীভাবে মিসাইল উন্নয়ন কার্যক্রম চালান যাবে? আর অগ্রগতির জন্য প্রধান জায়গাগুলো কোথায়?

তিন ঘন্টার প্রাণবন্ত আলোচনা শেষে বিজ্ঞানীরা শপথ নিলেন বেশ কয়েকটি বিষয়ে। যেমন-পৃথ্বীর ডেলিভারি আরও নিখুঁত করে তুলতে সিইপি কমিয়ে আনা হবে, ত্রিশূল-এর গাইডেন্স আরও নিখুঁত করা হবে এবং বছরের শেষ নাগাদ অগ্নির সমস্ত কার্বন-কার্বন রি-এন্ট্রি কন্ট্রোল সারফেস তৈরি করা হবে। পরবর্তী সময়ে এসব শপথ পূরণ করা হয়েছিল। এ বছরেই নাগ পরীক্ষা করা হলো ভূগর্ভে। ত্রিশূল ছোঁড়ার পর সেটা সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র সাত মিটার ওপর দিয়ে ভেসে চলল, শব্দের গতির চেয়েও তিনগুণ বেশি গতিতে। এই পরীক্ষাটি ছিল একটা ব্রেকথ্র। দেশীয় শিপ-লঞ্চ অ্যান্টি সি-স্কিমার ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ঘটনা।

একই বছর বোম্বাইয়ের আইআইটি আমাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করল। এ উপলক্ষে অধ্যাপক বি নাগ আমার সম্পর্কে বর্ণনা করলেন যে, আমি একটা নিখাদ প্রযুক্তিগত ভিত্তি সৃষ্টির পেছনে এক অনুপ্রেরণা, যেখান থেকে ভারতের ভবিষ্যৎ মহাকাশ কর্মসূচি একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে। হয়তো অধ্যাপক নাগ কেবল ভদ্রতা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি যে ভারত আগামী শতাব্দীতে নিজের স্যাটেলাইট স্থাপন করতে পারবে। মহাকাশের ৩৬০০০ কিলোমিটার দূরে এবং নিজেরই লঞ্চ ভেহিকল-এর সাহায্যে। তাছাড়া মিসাইল পাওয়ারেও পরিণত হবে ভারত। আমাদের দেশ বিপুল প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

১৫ অক্টোবর আমার বয়স হলো ষাট বছর। আমি অবসরে যাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর কম সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুদের জন্য একটা স্কুল খোলার পরিকল্পনা করেছিলাম। আমার বন্ধু অধ্যাপক পি রামা রাও, যিনি ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পরিচালনা করছিলেন, আমার সঙ্গে মিলে স্কুলটা দেওয়ার জন্য লেগে গেলেন আর সেটার নামও ঠিক করে ফেললেনঃ রাও-কালাম স্কুল। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা আমরা বাস্তবে রূপ দিতে পারলাম না। কারণ ভারত সরকার আমাদের কাউকেই নিজ নিজ পদ থেকে অবসর দিল না।

এই সময়েই আমার স্মৃতিকথা, পর্যবেক্ষণ আর নির্দিষ্ট বিষয়ে অভিমত লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ভারতীয় তরুণদের সবচেয়ে বড়ো যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তা হলো, স্বচ্ছ ভবিষ্যৎ দর্শনের অভাব, নির্দেশনার অভাব। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই, আজকের এই আমাকে যারা গড়ে তুলেছিলেন তাদের কথা আর যে সব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আমি বড়ো হয়ে উঠেছিলাম সে সব কথা আমি লিখব। এর উদ্দেশ্য শুধু এই নয় যে কয়েকজন ব্যক্তির প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করব, কিংবা আমার জীবনের নির্দিষ্ট কিছু চিত্র তুলে ধরব বিশেষভাবে। আমি আসলে যা বলতে চেয়েছি তা হলো, জীবন সম্পর্কে কোনো মানুষেরই, সে যত দুরাবস্থায় থাকুক, কিংবা সুবিধাপ্রাপ্তহীন বা ক্ষুদ্র, কখনই হতাশ হওয়া উচিৎ নয়। সমস্যা হচ্ছে জীবনেরই একটা অংশ। ভোগান্তি হচ্ছে সাফল্যের সৌরভ। যেমন একজন বলেছেন:

God has not promised
Skies always blue,
Flower-strewn pathways
All our life through;
God has not promised
Sun without rain,
Joy without sorrow,
Peace without pain.

আমি এ কথা বলব না যে আমার জীবন অন্য কারও জন্য একটা রোল মডেল হতে পারে। কিন্তু আমার নিয়তি যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে গরিব শিশুরা হয়তো বা একটু সান্ত্বনা পেতে পারে। এতে হয়তো তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রেরণা পাবে। তারা যেখানেই যাক, তাদের সচেতন হতে হবে যে খোদা তাদের সঙ্গেই আছেন, আর তিনি যখন তাদের সঙ্গে আছেন তখন কে পারে তাদের বিরুদ্ধে যেতে?

But God has promised
Strength for the day,
Rest for the labour
Light for the way.

আমার পর্যবেক্ষণে আমি দেখেছি, অধিকাংশ ভারতীয় অনাবশ্যকভাবে দুর্দশা ভোগ করে আবেগ কীভাবে আয়ত্তে রাখতে হয় জানে না বলেই। মনস্তাত্ত্বিক সংকটেই তারা অবশ। পরবর্তী সর্বোত্তম বিকল্প, ওটাই একমাত্র কার্যকর সুযোগ বা সমাধান, এবং যে পর্যন্ত না সবকিছু ভালোর দিকে মোড় নেয় ইত্যাদি হচ্ছে। আমাদের নৈমিত্তিক আলাপচারিতায় ব্যবহৃত কথাবার্তা। এইসব নেতিবাচক, আত্মপরাজয়মূলক চিন্তাভাবনা কেন আমরা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি না? আমি অনেক সংগঠন আর অনেক মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি। তাদের অনেকের ছিল সীমাবদ্ধতা। আমার কথা মান্য করা ছাড়া তাদের যেন আত্মমূল্য প্রমাণের পথ ছিল না। ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ট্রাজেডি নিয়ে কেন লেখা হয় না? এবং সাংগঠনিক সাফল্যের পথ সম্পর্কে? প্রত্যেক ভারতীয়ের অন্তরের প্রচ্ছন্ন আগুনে ডানা গজাক, এবং এই মহান দেশের গৌরবে আকাশ আলোকিত হোক।

.

১৬.

প্রযুক্তি হচ্ছে দলগত তৎপরতা। বিজ্ঞানের সঙ্গে এখানেই এর অমিল। এটা ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে না, বরং এর ভিত্তি হচ্ছে অনেক মানুষের মিথস্ক্রিয়া। আমি মনে করি আইজিএমডিপির সবচেয়ে বড়ো সাফল্য এটা নয় যে রেকর্ড সময়ের মধ্যে দেশ স্টেট-অব-দ্য-আর্ট মিসাইল সিস্টেম অর্জন করেছে। বরং এর থেকে সৃষ্টি হয়েছে অসাধারণ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের কিছু দল। ভারতীয় রকেট বিজ্ঞানে আমার ব্যক্তিগত অর্জন সম্পর্কে কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, আমি তাহলে তরুণদের কাজের জন্য একটা চ্যালেঞ্জিং পরিবেশ সৃষ্টির কথাই বলব।

আকার নেবার একেবারে গোড়ার দিকে দলের অবস্থা থাকে শিশুর মতো। সজীবতা, উদ্যম, কৌতূহল আর আনন্দের আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ। শিশুদের ক্ষেত্রে এসব ইতিবাচক গুণ বিনষ্ট হতে পারে বাবা-মায়ের ভুল নির্দেশনার কারণে। দলের সাফল্যের জন্য অবশ্যই এমন পরিবেশ প্রয়োজন যেখানে উদ্ভাবনা প্রতিভা কাজে লাগানোর সুযোগ আছে। এমন অনেক বিষয় নিয়ে আমাকে লড়তে হয়েছে।  ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার), আইএসআরও, ডিআরডিও এবং অন্যান্য জায়গায় যেখানে আমি কাজ করেছি। কিন্তু সবসময় আমি নিশ্চিত করেছি, কাজের উপযুক্ত পরিবেশ আর উদ্ভাবন ও ঝুঁকি গ্রহণের সুযোগ যেন পায় আমার দল।

এসএলভি-৩ প্রকল্পের সময় প্রথম যখন আমরা প্রজেক্ট টিম সৃষ্টি করছিলাম, এবং পরে আইজিএমডিপিতে, তখন এসব দলের লোকেরা নিজেদের আবিষ্কার করে সংস্থার উচ্চাকাঙ্খর একেবারে সম্মুখ সারিতে। এসব দলে মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ সন্নিবিষ্ট করা হয়েছিল, ফলে তারা প্রচণ্ডভাবে দৃশ্যমান ও ভেদ্য হয়ে পড়েছিল। যৌথ গৌরব অর্জনে তাদের অবদান অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে বলে আশা করা হয়েছিল।

আমি সচেতন ছিলাম, সাপোর্ট সিস্টেমের যে কোনো ব্যর্থতা দলীয় কৌশলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কয়েকটি ঘটনায় ধৈর্য আর স্নায়ুশক্তি হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছিল প্রতিষ্ঠানের। অনিশ্চয়তা আর জটিলতার উচ্চমাত্রা প্রায়ই দলীয় তৎপরতায় জায়গা করে নিত, আর তা হতো একটা ফাঁদের মতো।

এসএলভি-৩ প্রকল্পের প্রথম বছরগুলোয়, প্রায়ই আমি শীর্ষ ব্যক্তিদের রায়দুর্বলতার মুখোমুখি হতাম, কারণ অগ্রগতি তখনও দৃশ্যমান হয়নি। অনেকেই ভাবত এসএলভি-৩ এর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে প্রতিষ্ঠান। ভাবত দল চলছে অপরীক্ষিতভাবে। এসব ভয় ছিল কাল্পনিক, পরে তা প্রমাণিত হয়। প্রতিষ্ঠানে অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন। যেমন ভিএসএসসিতে। তারা প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোয় আমাদের দায়িত্বশীলতা ও অঙ্গীকার উপেক্ষা করতেন। পুরো কার্যক্রমে এমন ধরনের লোকদের সঙ্গে কাজ করাটা ছিল সংকটজনক অংশ। আর কুশলী হাতে এটা করতেন ড, ব্ৰহ্ম প্রকাশ।

.

একটা প্রজেক্ট টিম হিসাবে আপনি যখন কাজ করবেন, তখন সাফল্যের ব্যাপারে আপনাকে একটা জটিল দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে। সেটা দরকার হয়ে উঠবে আপনার জন্য। সবসময়ই প্রত্যাশার সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলবে। আর প্রজেক্ট টিম খন্ডিত হয়েও যেতে পারে বাইরের সাব-কন্ট্রাক্টরদের ও প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার বিশেষজ্ঞ দপ্তরের টানাটানির মধ্যে। ভালো প্রজেক্ট টিম দ্রুত সেই ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে খুঁজে বের করতে পারে যার মাধ্যমে আলোচনা চালান যেতে পারে। তাদের চাহিদা নিয়ে এসব ব্যক্তিদের পক্ষে আলোচনা চালান নিশ্চয় প্রধান প্রত্যাশিত বিষয় হবে। পরিস্থিতি পরিবর্তন বা উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত আলোচনাও চলতে থাকবে, সে নিশ্চয়তা বিধান করাও জরুরি। অপ্রীতিকর সারপ্রাইজ বহিরাগতরা অপছন্দ করে। তেমন কিছু না ঘটার ব্যবস্থা নিতে হবে ভালো দলকে।

এসএলভি-৩ দল সৃষ্টি করছিল তাদের অভ্যন্তরীণ সাফল্যের ক্রাইটেরিয়া। আমরা আমাদের মান, প্রত্যাশা ও লক্ষ্য বোধগম্য করেছিলাম। সারাংশ করেছিলাম সফল হতে আমাদের কী প্রয়োজন, আর সাফল্যের পরিমাপ করব কীভাবে। যেমন আমাদের কাজ কীভাবে আমরা পূর্ণ করব, কে কী করবে, আর কীসের মান অনুসারে। সময়সীমা কী হবে, আর অন্যান্য সংস্থার প্রতি রেফারেন্সসহ দল কীভাবে যোগাযোগ করবে।

একটা দলের সাফল্যের ক্রাইটেরিয়ায় পৌঁছানোর প্রক্রিয়া হচ্ছে দক্ষতা। কারণ ভূগর্ভের নিচে বহুকিছু আছে। মাটির ওপর দল সাধারণভাবে কাজ করবে প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জন। কিন্তু আমি বারংবার দেখেছি, মানুষেরা কী চায় তা বোধগম্য করে তুলতে কতটা অপারগ-যতক্ষণ না তারা দেখে একটা কর্মকেন্দ্র কিছু করছে বা তারা চায় না তারা করুক। প্রকল্প দলের একজন সদস্যকে অবশ্যই কাজ করতে হবে গোয়েন্দার মতো। কীভাবে প্রকল্প সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, তাকে তা খুঁজে বের করতে হবে।

অন্য এক স্তরে প্রকল্প-দল ও কর্মকেন্দ্রের মধ্যে সম্পর্ক উৎসাহিত ও উন্নত করে তুলতে হবে আর এ দায়িত্ব প্রকল্প নেতার। পারস্পরিক নির্ভরতার ব্যাপারে উভয় পক্ষকে অবশ্যই পরিষ্কার থাকতে হবে, আর এটাও বুঝতে হবে যে উভয়ের ওপরই প্রকল্পের কাজের অংশ চাপান আছে। অন্য এক স্তরে এক পক্ষকে অপর পক্ষের সামর্থ মূল্যায়ন করতে হবে এবং কী করা দরকার তা নিয়ে পরিকল্পনার জন্য শক্তি ও দুর্বলতার জায়গাগুলো শনাক্ত করতে হবে। বস্তুত পুরো বিষয়টি হতে হবে কন্ট্রাকিং প্রক্রিয়ার মতো। আইজিএমডিপিতে শিবাথানু পিল্লাই ও তার দল তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত কৌশল পিএসিইর মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে স্মরণীয় কিছু কাজ করেছিলেন, যা কাজে লেগেছিল প্রোগ্রাম অ্যানালাইসিস, কন্ট্রোল ও ইভালুয়েশন ইত্যাদিতে। প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে ১টার মধ্যে তারা একটা নির্দিষ্ট কর্মকেন্দ্রে একটা প্রকল্প দলের সঙ্গে বসতেন আর তাদের ভেতরকার সাফল্যের মূল্যায়ন করতেন। সাফল্যের পথে পরিকল্পনা আর সাফল্য থেকে ভবিষ্যতের চিত্র যে উদ্দীপনা সঞ্চার করত তাতে অপ্রতিরোধ্য গতি পেত তারা, আর আমি সবসময় দেখতাম তার থেকে সৃষ্টি হচ্ছে কাক্ষিত বস্তু।

.

টেকনোলজি ম্যানেজমেন্টের ধারণার শিকড় ডেভলপমেন্ট ম্যানেজমেন্টের অনেক গভীরে প্রোথিত। এর উৎপত্তি ষাটের দশকের প্রথমভাগে। ম্যানেজমেন্ট ওরিয়েন্টেশনের ধরন মূলত দুটো: প্রাইমাল, যা ইকোনমিক কর্মীকে মূল্য দেয়, আর র‍্যাশনাল, যা মূল্য দেয় অর্গানাইজেশনাল কর্মীকে। আর এ ব্যাপারে আমার ধারণা হলো এমন ব্যক্তিকে নিয়ে যে হবে একজন টেকনোলজি পারসন। প্রাইমাল ম্যানেজমেন্ট ধারা মানুষকে স্বীকৃতি দেয় তাদের স্বাধীনতার জন্য, এবং র‍্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট স্বীকৃতি দেয় তাদের নির্ভরশীলতার জন্য। অন্য দিকে আমি মূল্য দিই মানুষের পরস্পর নির্ভরতাকে।

আব্রাহাম ম্যাসলো প্রথম ব্যক্তি যিনি সে-অ্যাকচুয়ালাইজেশনের নতুন মনস্তত্বকে একটা ধারণাগত পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। ইউরোপে রুডোল্ফ স্টেইনার ও রেগ রেভান্স এই ধারণাটিকে ব্যক্তির শিক্ষা ও সাংগঠনিক নবায়নের পদ্ধতিতে উন্নীত করেছিলেন। অ্যাংলো-জার্মান ম্যানেজমেন্ট ফিলোসফার ফিস শুমাখার প্রবর্তন করেছিলেন বৌদ্ধ অর্থনীতি এবং স্মল ইজ বিউটিফুল নামে বই লিখেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী তৃণমূল প্রযুক্তির গুণকীর্তন করেছেন আর সমগ্র তৎপরতার মাঝখানে রেখেছেন ব্যবহারকারীদের। জেআরডি টাটা প্রগতি চালিত অবকাঠাম সৃষ্টি করেন। ড. হোমি জাহাঙ্গির ভাভা ও অধ্যাপক বিক্রম সারাভাই প্রবাহ ও সমগ্রতার স্বাভাবিক নিয়মের পরিষ্কার বৈশিষ্ট্য নিয়ে চালু করেন উঁচু, প্রযুক্তিভিত্তিক আণবিক শক্তি ও মহাকাশ কর্মসূচি। ড. ভাভা ও অধ্যাপক সারাভাইয়ের উন্নয়নমূলক দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে ড, এমএস স্বামীনাথন ভারতে চালু করেন সবুজ বিপ্লব। ড, ভার্গিস কুরিয়েন ডেয়ারি শিল্পে এক বিপ্লবের ভেতর দিয়ে শুরু করেন শক্তিশালী সমবায় আন্দোলন। অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ গবেষণায় প্রতিষ্ঠা করেন। মিশন ম্যানেজমেন্টের ধারণা। আইডিয়া বাস্তবায়নের এ হলো সামান্য কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এভাবেই সারা পৃথিবীজুড়ে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে গবেষণা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবয়ব।

আইজিএমডিপিতে আমি অধ্যাপক সারাভাইয়ের ভবিষ্যৎ দর্শন আর অধ্যাপক ধাওয়ানের মিশন একীভবনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ভারতীয় গাইডেড মিসাইল তৈরিতে আমি যোগ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম লেটেন্সির প্রাকৃতিক নিয়ম, সম্পূর্ণ দেশীয় টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। বিষয়টা পরিষ্কার হবে একটা প্রতাঁকের মাধ্যমে তুলে ধরলে।

টেকনোলজি ম্যানেজমেন্টের বৃক্ষ সেখানেই শেকড় গাড়ে যেখানে রয়েছে প্রয়োজনীয়তা, নবায়ন, পরস্পরনির্ভরতা এবং স্বাভাবিক প্রবাহ। এর বেড়ে ওঠার ধরন মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য, যার অর্থ ঘটনা এগিয়ে যাবে ধীর পরিবর্তন ও আকস্মিক রূপান্তরের একটা সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে। প্রতিটা রূপান্তর থেকে সৃষ্টি হবে আরও জটিল কোনো স্তর কিংবা সে খুঁড়িয়ে দেবে আগের পর্যায়টিকে। ঝামেলাপূর্ণ হয়ে উঠলে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাৰে আধিপত্যকারী মডেল; এবং পরিবর্তনের ধারা চলতেই থাকবে।

টেকনোলজি ম্যানেজমেন্টের বৃক্ষ, যদি যত্ন করে লালন করা হয়, বয়ে আনে অ্যাডাপটিভ অবকাঠামোর ফল। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রযুক্তিগত ক্ষমতার আওতায় আনা যায় এর ফলে। তাছাড়া মানুষের মধ্যে কারিগরি দক্ষতা সঞ্চারিত করা সম্ভব হয়।

১৯৮০ সালে আইজিএমডিপি অনুমোদন করার সময় আমাদের পর্যাপ্ত টেকনোলজি বেজ ছিল না। সামান্য কিছু বিশেষায়িত বিভাগ ছিল, কিন্তু সেই এক্সপার্ট টেকনোলজি ব্যবহারের কর্তৃত্ব আমাদের ছিল না। কর্মসূচির বহু প্রকল্প পরিবেশ একটা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল, একই সঙ্গে পাঁচটা অ্যাডভান্সড মিসাইল সিস্টেম তৈরি করার ক্ষেত্রে। ঘটনাক্রমে আইজিএমডিপির অংশীদার ছিল ৭৮ টি, সেই সঙ্গে ৩৬টি প্রযুক্তি কেন্দ্র আর ৪১টি উৎপাদন কেন্দ্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সরকারি খাতের ওপর, অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির ওপর, বেসরকারি শিল্পকারখানার ওপর। আমাদের নির্দিষ্ট প্রয়োজন মেটাতে পারবে এমন ধরনের একটা মডেল আমরা তৈরি করেছিলাম কর্মসূচির ব্যবস্থাপনায়। মোট কথা, আমাদের দরকারি ব্যবস্থাপনা ও সমবায়ী উদ্যোগের সমন্বয় প্রতিভা বিকাশে ও ব্যবহারে কাজে লেগেছিল। যা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল, তা কাজে লেগেছিল আমাদের গবেষণাগারে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও বেসরকারি শিল্পকারখানায়।

আইজিএমডিপির টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট দর্শন মিসাইল তৈরির ক্ষেত্রে এক্সক্লসিভ কিছু নয়। এই সাফল্যের পেছনে ছিল জাতির অন্তরগত এক কামনা, যাতে করে দুনিয়া আর কখনও পেশীশক্তি বা টাকার জোরে পরিচালিত না হতে পারে সেই আকাঙ্ক্ষা। প্রকৃতপক্ষে এই দুটো ক্ষমতাই টেকনোলজির ওপর নির্ভরশীল। টেকনোলজি শুধু টেকনোলজিকেই সম্মান করে। এবং, আমি আগে যেমন উল্লেখ করেছি, টেকনোলজি বিজ্ঞানের মতো নয়, এটা দলগত তৎপরতা। ব্যক্তিবিশেষের বুদ্ধিমত্তা থেকে এটা জন্ম নেয় না, জন্ম নেয় পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া আর মুক্ত প্রভাব থেকে। আর সেটাই আমি করার চেষ্টা করেছিলাম, আইজিএমডিপিতে: ৭৮ টি একীভূত ভারতীয় পরিবার, যে পরিবার মিসাইল সিস্টেম তৈরি করতেও সক্ষম।

.

আমাদের বিজ্ঞানীদের জীবন ও সময় নিয়ে প্রচুর দার্শনিকতা আর বিস্ময়ের। সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু তারা কোথায় যেতে চেয়েছিলেন আর কীভাবে সেখানে পৌঁছেছিলেন সে সব কথা আবিষ্কার করা হয়েছে খুবই কম। আমার একটা ব্যক্তি হয়ে ওঠার পেছনে যে সংগ্রামের কাহিনি আছে, সম্ভবত তার খানিকটা আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরতে পেরেছি এই লেখায়। আমি আশা করি অন্তত কিছু সংখ্যক তরুণকেও এটা সাহায্য করবে আমাদের এই কর্তৃত্ববাদী সমাজে উঠে দাঁড়াতে। এই সমাজের বৈশিষ্ট্য এমনই যে মানুষের মনের মধ্যে সে প্রবিষ্ট করে স্কুল আকাঙ্ক্ষা পুরষ্কার, ধনসম্পদ, মর্যাদা, পদ, পদোন্নতি, অন্যদের দ্বারা। জীবনযাত্রা অনুমোদন, আনুষ্ঠানিক সম্মান, আর সব ধরনের স্ট্যাটাস সিম্বল।

এসব পদার্থ অর্জন করার জন্য তারা এটি শেখে আর নিজেদের পরিচিত করে রীতি, ঐতিহ্য, প্রটোকল ইত্যাদির সঙ্গে। আজকের তরুণদের অবশ্যই জীবনের এই সৰ আত্মপরাজয়ী পন্থা শেখা চলবে না। শুধু ভোগবিলাসের আর পুরস্কারের জন্য কাজ করার প্রবণতা অবশ্যই ছাড়তে হবে। আমি যখন ধনী, ক্ষমতাবান ও শিক্ষিত লোকদের দেখি একটু শান্তির জন্য সংগ্রাম করছে, তখন আমি স্মরণ করি আহমেদ জালালুদ্দিন ও ইয়াড়রাই সলোমনের মতো মানুষদের কথা। দৃশ্যত বস্তুগত কোনো ধনদৌলত ছাড়াই তারা কতটা সুখী ছিলেন!

On the cost of Coromandel
Where the earthy shells blow,
In the middle of the sands
Lived some really rich souls.
One cotton lungi and half a candle–
One old jug without a handle
These were all the worldly possessions
Of these kings in the middle of the sands,

কেমন করে তারা নিরাপত্তার অনুভূতি নিয়ে থাকতে পারতেন? আমার বিশ্বাস তারা নিজের ভেতরে শক্তিধারণ করতেন। অন্তরগত সংকেতের ওপর তারা নির্ভর করতেন বেশি, বাইরের সেই সব পদার্থের চেয়ে যার কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। আপনার অন্তরগত সংকেত সম্পর্কে আপনি কি সচেতন? আপনার আস্থা আছে তার প্রতি? আপনার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছেন আপনি? আমার কথা শুনুন, বাইরের চাপ যত বেশি আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন, যা সর্বক্ষণ আপনাকে নিজ উদ্দেশ্য সাধনে লাগানোর চেষ্টা করে, তত বেশি সুন্দর হবে আপনার জীবন, তত বেশি সুন্দর হবে আপনার সমাজ। প্রকৃতপক্ষে দৃঢ়, আত্মদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষে গোটা জাতি লাভবান হবে।

আপনার জীবনে আপনার নিজের ভেতরকার ক্ষমতা ব্যবহারের ইচ্ছা আপনাকে সাফল্য এনে দেবে। আপনার একক ব্যক্তিসত্ত্বা থেকে যখন আপনি। কোনো কাজ নির্দিষ্ট করতে পারবেন, কেবল তখনই আপনি হয়ে উঠবেন একজন পূর্ণ ব্যক্তি।

এই গ্রহের সবাইকেই তিনি পাঠিয়েছেন নিজের ভেতরকার সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগানোর জন্য, আর নিজেদের মতো করে শান্তিতে থাকার জন্য। আমার পথ আলাদা হতে পারে অনেক ক্ষেত্রে। জীবন একটা কঠিন খেলা। মানুষ হিসাবে নিজের জন্মের অধিকার ধারণ করেই আপনি এ খেলায় জিততে পারেন। আর এই অধিকার ধারণ করতে সকল চাপ উপেক্ষা করে আপনাকে সামাজিক ও বাইরের ঝুঁকি গ্রহণে ইছুক হতে হবে। শিবসুব্রামানিয়াম আয়ার তার সঙ্গে খাবার খেতে আমাকে যে তার রান্নাঘরে আমন্ত্রণ করেছিলেন তাকে আপনি কী বলবেন? আমার বোন জোহরা আমাকে প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে নিজের সোনার বালা ও চেইন বন্ধক রেখেছিল, তাকে কী বলবেন? অধ্যাপক স্পন্ডার গ্রুপ ফটো তুলতে আমাকে সামনের সারিতে তার পাশে বসিয়েছিলেন, তাকে কী বলবেন? একটা মোটর গ্যারেজে হোভারক্রাফট তৈরিকে কী বলবেন? তারপর সুধাকরের সাহস? উ. ব্রহ্ম প্রকাশের সমর্থন? নারায়ণনের ব্যবস্থাপনা? ভেঙ্কটরমনের ভবিষ্যৎ-দর্শন? অরুণাচলমের উদ্যোগ? এসবই হচ্ছে দৃঢ় অন্তরগত শক্তি ও উদ্যমের এক একটা উদাহরণ। পঁচিশ শতাব্দী আগে যেমনটা বলেছিলেন পিথাগোরাস, সমস্ত কিছুর ওপরে, নিজেকে শ্রদ্ধা কর।

.

আমি কোনো দার্শনিক নই। আমি প্রযুক্তির মানুষ। আমার সারাটা জীবন আমি খরচ করেছি রকেট বিজ্ঞান শেখার পেছনে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে আমার বোঝার সুযোগ হয়েছিল প্রচণ্ড জটিলতার মধ্যে পেশাগত জীবনের প্রপঞ্চ। যা আরও আগে বর্ণনা করেছি সেদিকে তাকালে আমার নিজের পর্যবেক্ষণ ও উপসংহার ডগমাটিক বলে প্রতীয়মান হয়। আমার সহকর্মীরা, সহযোগীরা, নেতারা; রকেট বিদ্যার জটিল বিজ্ঞান; টেকনোলজি ম্যানেজমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু; সমস্তই মনে হয় করা হয়েছে নেহাৎ কর্তব্য হিসাবেই। হতাশা এবং সুখ, সাফল্য ও ব্যর্থতা-আলাদাভাবে চিহ্নিত হয় বর্ণনায়, কালে ও স্থানে-সমস্তই মনে হয় মিলে গেছে এক সঙ্গে।

একটা বিমান থেকে আপনি নিচে তাকালে লোকজন, বাড়ি, পাথর মাঠ, গাছপালা ইত্যাদি সবকিছুই আপনার মনে হবে যেন একটা সমরূপ ল্যান্ডস্কেপ, একটা থেকে অন্যটাকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা খুব কঠিন হবে। আমার জীবনের যেটুকু আপনি পড়েছেন তা দূর থেকে দেখা ওই বার্ডস্-আই ভিউয়েরই অনুরূপ।

My worthiness is all my doubt
His merit-all my fear–
Contrasting which my quality
Does however-appear.

প্রথম অগ্নি উৎক্ষেপণের সঙ্গে শেষ হওয়া সময়ের এই গল্প-জীবন কিন্তু চলতেই থাকবে। এই বিশাল দেশ সকল ক্ষেত্রেই বিপুল সাফল্য অর্জন করতে পারবে, যদি আমরা ৯০ কোটি মানুষের ঐক্যবদ্ধ এক জাতির মতো সবকিছু ভাবি। আমার গল্প-জয়নুলাবদিনের পুত্রের গল্প, যে রামেশ্বরম দ্বীপের মস্ক স্ট্রিটে জীবন কাটিয়ে গেছেন একশ বছরের ওপর আর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন; এক বালকের গল্প যে তার ভাইকে খবরের কাগজ বিক্রি করতে সাহায্য করত; এক ছাত্রের গল্প যাকে তৈরি করেছিলেন শিবসুব্রামানিয়া আয়ার ও ইয়াড়রাই সলোমন; এক ছাত্রের গল্প যে শিক্ষা পেয়েছিল পান্ডালাইয়ের মতো শিক্ষকদের কাছে; একজন প্রকৌশলীর গল্প যাকে চিনতে পেরেছিলেন এমজিকে মেনন ও লালন করেছিলেন অধ্যাপক সারাভাই; একজন বিজ্ঞানীর গল্প যে ব্যর্থতা ও বাধাবিপত্তিতে পরীক্ষিত হয়েছিল; এক নেতার গল্প যাকে সমর্থন দিয়েছিল প্রতিভাদীপ্ত ও নিবেদিতপ্রাণ প্রফেশনালদের বিশাল একটি দল। এই গল্প শেষ হবে আমার সঙ্গেই, যেহেতু পার্থিব কিছুই আমার নেই। আমি কোনো কিছুরই মালিক নই, কিছুই সৃষ্টি করিনি, অধিকারী নই কোনো কিছুর-না পরিবার, না পুত্র-কন্যা।

I am a well in this great land
Looking at its millions of boys and girls
To draw from me
The inexhaustible divinity
And spread His grace everywhere
As does the water drawn from a well.

অন্যদের মাঝে নিজেকে একটা উদাহরণ হিসাবে আমি স্থাপন করতে চাই না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, কিছু পাঠক হয়তো অনুপ্রেরণা পাবেন আর পরম তৃপ্তির অভিজ্ঞতা পাবেন যা কেবল আত্মিক জীবনেই পাওয়া সম্ভব। খোদার দূরদর্শিতা ও সদয় তত্ত্বাবধান আপনার উত্তরাধিকার। আমার প্রপিতামহ আবুল, আমার পিতামহ পাকির, আমার পিতা জয়নুলাদিন-এর ব্লাডলাইন হয়তো শেষ হবে আবদুল কালামে এসে, কিন্তু খোদার মহিমা কখনও থামবে না, যেহেতু তা চিরন্তন।

.

উপসংহার

ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল এসএলভি-৩ ও অগ্নি প্রোগ্রামের সঙ্গে আমার গভীর সম্পৃক্ততা নিয়ে বিজড়িত এ বই। এমন সেই সম্পৃক্ততা যা আমাকে ১৯৯৮-এর মে মাসের পারমাণবিক পরীক্ষার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গেও জড়িত করেছে। তিনটি বৈজ্ঞানিক এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম-মহাকাশ, প্রতিরক্ষা গবেষণা ও আণবিক শক্তি। এসব এস্টাবলিশমেন্টে কাজ করার সময় আমি দেখেছি, আমাদের দেশের সেরা মানুষ আর সেরা উদ্ভাবনী মস্তিষ্ক দুষ্প্রাপ্য নয়। একটা ব্যাপার সবখানেই ছিল সাধারণ, আর সেটা হলো বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা মিশন চলাকালীন ব্যর্থতায় কখনও শংকিত হতেন না। ব্যর্থতার ভেতরে আছে আরও শিক্ষাগ্রহণের বীজ যা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আরও ভালো প্রযুক্তির দিকে, আরও উঁচু সাফল্যের দিকে। এইসব মানুষেরা ছিলেন মহান স্বপ্নদ্রষ্টাও এবং তাদের স্বপ্ন শেষপর্যন্ত সত্যি হয়েছিল আশ্চর্য সাফল্যের ভেতর দিয়ে। আমি অনুভব করি যে, এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত প্রযুক্তিগত শক্তি যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে এর তুলনা করা যেতে পারে দুনিয়ার যে কোনো স্থানের সেরা স্থাপনাগুলোর সঙ্গে। সর্বোপরি, আমার সুযোগ হয়েছিল দেশের মহান স্বপ্নদ্রষ্টাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার, বিশেষ করে অধ্যাপক বিক্রম সারাভাই, অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান ও ড. ব্রহ্ম প্রকাশ, যারা প্রত্যেকেই আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন প্রচণ্ডভাবে।

উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য একটা জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও দৃঢ় নিরাপত্তা দুটোই প্রয়োজন। আমাদের Self Reliance Mission in Defence System 1995– 2005 আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে একটা স্টেট-অব-দ্য-আর্ট প্রতিযোগিতামূলক উইপন সিস্টেম যোগান দেবে। Technology Vission-2020 পরিকল্পনা জাতির অর্থনৈতিক বিকাশ ও সমৃদ্ধির নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও স্কিমগুলোয় কাজে লাগান হবে। এই দুই পরিকল্পনা জাতির স্বপ্নকে মেলে ধরেছে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস আর প্রার্থনা করি যে, এই দুই পরিকল্পনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আমাদের দেশকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করবে এবং উন্নত দেশের মর্যাদাসম্পন্ন জাতিগুলোর মধ্যে আমাদের ন্যায্য স্থানটি করে নেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *