৩. অর্ঘ্য [১৯৮১-১৯৯১]

৩. অর্ঘ্য [১৯৮১-১৯৯১]

Let craft, ambition, spite,
Be quenched in Reasons night,
Till weakness turn to might,
Till what is dark be light,
Till what is wrong be right!

-Lewis Carroll

১০.

এ সময় আমার চাকরি নিয়ে একটু কুশতাকুশতি শুরু হয়েছিল আইএসআরও এবং ডিআরডিওর মধ্যে। আইএসআরও আমাকে ছেড়ে দিতে খানিকটা ইতস্তত করছিল, অন্যদিকে ডিআরডিও আমাকে নিয়ে নিতে চাইছিল। অনেকগুলো মাস কেটে গেল, আর অনেক পত্রবিনিময় হলো আইএসআরও এবং ডিআরডিওর মধ্যে। অন্যদিকে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্তে আসার জন্য অনেকবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো ডিফেন্স আরঅ্যান্ডডি এবং ডিপার্টমেন্ট অব স্পেসের সচিবালয়ের মধ্যে। ইতোমধ্যে অধ্যাপক রামান্না অবসর গ্রহণ করলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার দপ্তর থেকে। অধ্যাপক রামান্নার জায়গায় এলেন ড, ভিএস অরুণাচলম, তখন পর্যন্ত তিনি ছিলেন হায়দারাবাদে অবস্থিত ডিফেন্স মেটালার্জিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (ডিএমআর এল)-এর পরিচালক। ড. অরুণাচলম তার আত্মবিশ্বাসের জন্য পরিচিত ছিলেন, আর তিনি জটিলতা ও বৈজ্ঞানিক আমলাতন্ত্রের অতিসূক্ষ্ম তারতম্য খুব সামান্যই পরোয়া করতেন। ইতোমধ্যে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সেই সময়কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আর ভেঙ্কটরমন আমার ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণাগারের দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে অধ্যাপক ধাওয়ানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। অধ্যাপক ধাওয়ানকেও মনে হয়েছিল যেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটা নিস্পত্তিমূলক পদক্ষেপ নেবার অপেক্ষায় আছেন। অবশেষে সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে ডিআরডিএলের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো।

অধ্যাপক ধাওয়ান প্রায় সময়ই আইএসআরও সদরদপ্তরে আমার কামরায় আসতেন আর স্পেস লঞ্চ ভেহিকল প্রকল্প নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করতেন। এমন এক মহান বিজ্ঞানীর সঙ্গে কাজ করা, ছিল বিশাল এক সুবিধা। আমি আইএসআরও ছেড়ে যাবার আগে, অধ্যাপক ধাওয়ান আমাকে ২০০০ সাল নাগাদ ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির ওপর বক্তব্য দিতে বললেন। প্রায় গোটা ম্যানেজমেন্ট ও স্টাফ আমার বক্তব্য শোনার জন্য হাজির হয়েছিল, যেটা এক দিক থেকে ছিল ফেয়ারওয়েল মিটিং।

১৯৭৬ সালে আমার দেখা হয়েছিল ড. ভিএস অরুণাচলমের সাথে, এসএলভির ইনার্শিয়াল গাইডেন্স প্ল্যাটফর্মের জন্য অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয় ইনভেস্টমেন্ট কাস্টিংয়ের সাথে যুক্ত হয়ে যখন আমি ডিএমআরএলে গিয়েছিলাম সেই সময়। ড, অরুণাচলম ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো ইনভেস্টমেন্ট কাস্টিং করেছিলেন, তাও অবিশ্বাস্য সংক্ষিপ্ত সময়ে-মাত্র দুই মাসে। তার যৌবনদীপ্ত শক্তি আর উদ্যম আমাকে চমৎকৃত করেছিল। এই তরুণ ধাতুবিদ অতি অল্প সময়ের মধ্যে মেটাল-মেকিং বিজ্ঞানকে মেটাল-ফর্মিং টেকনোলজিতে এবং সেখান থেকে আর্ট অব অ্যালয় ডেভলপমেন্ট-এ উন্নীত করেছিলেন। লম্বা ও দেহের অধিকারী ড. অরুণাচলম ছিলেন বৈদ্যুতিক চার্জ দেওয়া একটা ডায়নামোর মতো। আমার কাছে তাকে মনে হতো শক্তিশালী আচরণের একজন অগতানুগতিক ধাচের বন্ধু ভাবাপন্ন ব্যক্তি। সেই সঙ্গে একজন অসাধারণ ওয়ার্কিং পার্টনার।

১৯৮২ সালের এপ্রিলে আমি ডিআরডিএলে গেলাম আমার কাজের জায়গার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য। ডিআরডিএলের তকালীন পরিচালক এমএল বানসাল আমাকে সবখানে ঘুরিয়ে দেখালেন আর গবেষণাগারের সিনিয়র বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ডিআরডিএল কাজ করছিল পাঁচটা স্টাফ প্রজেক্ট ও ষোলটি কমপিটেন্স বিল্ড-আপ প্রজেক্ট নিয়ে। এছাড়াও তারা বেশ কিছু টেকনোলজি ওরিয়েন্টেড কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত ছিল; এক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য ছিল, ভবিষ্যতে দেশীয় মিসাইল সিস্টেম উন্নয়নে অগ্রবর্তী সময় জিতে নেওয়া। আমি বিশেষ করে প্রভাবিত হলাম তাদের টুইন ৩০-টন লিকুইড প্রোপেল্যান্ট রকেট ইঞ্জিন তৈরির চেষ্টা দেখে।

এরই মধ্যে মাদ্রাজের আন্না বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করল। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আমি ডিগ্রি অর্জনের … পর ইতোমধ্যে প্রায় কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে। আন্না বিশ্ববিদ্যালয় রকেট বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমার প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেওয়ায় আমি আনন্দিত হলাম, কিন্তু আমাকে সবচেয়ে যা বেশি আনন্দ দিয়েছিল তা হলো একাডেমিক সার্কেলে আমাদের কর্মমূল্যের স্বীকৃতি। আমাকে উৎফুল্ল করে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হলো অধ্যাপক রাজা রামান্নার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে।

১৯৮২ সালের ১ জুন তারিখে আমি যোগদান করলাম ডিআরডিএলে। শীঘ্রই উপলব্ধি করলাম যে এই গবেষণাগার এখনও ডেভিল মিসাইল প্রজেক্টের উপসংহারেই তাড়িত হয়ে আছে। অনেক উৎকর্ষসম্পন্ন প্রফেশনাল তখনও হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বিজ্ঞানীর কাজের নাড়ি হঠাৎ ছিঁড়ে গেলে তার যেমন লাগে। ডিআরডিএলে সাধারণ মেজাজ আর কাজের ছন্দ আমার মনে পড়িয়ে দিয়েছিল স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ-এর কবিতা The Rime of the Ancient Mariner:

Day after day, day after day.
We stuck, nor breath, nor motion;
As idle as a painted ship.
Upon a painted ocean.

আমি দেখলাম আমার সিনিয়র সহকর্মীরা প্রায় সবাই মুখ থুবড়ে পড়া আশার যন্ত্রণা নিয়ে জীবনযাপন করছে। একটা ব্যাপক ধারণা ছিল যে, এই গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা প্রতারিত হয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের দ্বারা। আমার কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আশা ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টি জাগিয়ে তুলতে হলে ডেভিল কে অবশ্যই কবর দিতে হবে।

যখন প্রায় এক মাস পর তঙ্কালীন নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল ওএস ডসন ডিআরডিএল সফরে এলেন, তখন সেটাকে আমি দলে যুক্তি প্রতিষ্ঠার একটা সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করলাম। ট্যাকটিক্যাল কোর ভেহিকল (টিসিভি) প্রকল্প বেশ কিছুদিন ধরে আগুনের ওপর ঝুলছিল। সাধারণ সাবসিস্টেমসহ এটা ছিল সিঙ্গল কোর ভেহিকল। সামরিক বাহিনীর চাহিদা ছিল একটা কুইক রিঅ্যাকশন সারফেস টু-এয়ার মিসাইল, একটা অ্যান্টি-রেডিয়েশন এয়ার-টু-সারফেস মিসাইল যা নিক্ষেপ করা যাবে হেলিকপ্টার অথবা ফিক্সড উইং এয়ারক্র্যাফট থেকে। অ্যাডমিরাল ডসনের কাছে আমি জোরালভাবে কোর ভেহিকলের ভূমিকা তুলে ধরলাম। আমি শুধু এর কারিগরি জটিলতাই ব্যাখ্যা করলাম তা নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে এর সামর্থ্যও ব্যাখ্যা করলাম; এবং আমি হাইলাইট করলাম উৎপাদন পরিকল্পনা। আমার নতুন সহযোগীদের কাছে বার্তাটা ছিল স্পষ্ট ও পরিষ্কার এমন কোনো কিছু তৈরি কর না যা তুমি বিক্রি করতে পারবে না পরে, এবং শুধু একটা জিনিস তৈরি করেই জীবন খরচ কর না। মিসাইল নির্মাণ একটা বহুমাত্রিক ব্যাপার তুমি যদি একটা মাত্রাতেই থেকে যাও দীর্ঘকাল, তাহলে তুমি নিশ্চল হয়ে যাবে।

ডিআরডিএলে আমার প্রথম কয়েক মাস ছিল ব্যাপকভাবে মিথস্ক্রিয়ামূলক। আমি সেন্ট জোসেফ’স-এ পড়েছিলাম যে, একটা ইলেকট্রন একটা ক্ষুদ্র কণা কিংবা ঢেউ হিসাবেও মনে হতে পারে, এটা নির্ভর করে ওই ইলেকট্রনের দিকে তুমি কীভাবে তাকাচ্ছ তার ওপর। তুমি যদি একটা ক্ষুদ্র প্রশ্ন কর, ওটা তোমাকে একটা ক্ষুদ্র উত্তর দেবে; তুমি যদি ঢেউ প্রশ্ন কর, ওটা তোমাকে ঢেউ উত্তর দেবে। আমি শুধু আমাদের লক্ষ্যের কথাই বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করিনি, ওগুলোকে আমাদের কাজ ও আমাদের সত্ত্বার মধ্যে একটা পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া হিসাবেও দেখিয়েছি। এখনও আমার একটা মিটিঙে রোনাল্ড ফিশার থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার কথা মনে আছে, এক টুকরো চিনিতে যে মিষ্টতার স্বাদ আমরা পাই, তা চিনির সম্পদ নয় আবার আমাদের সম্পদও নয়। চিনির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়ায় আমরা মিষ্টতার অভিজ্ঞতা উৎপাদন করছি।

একটা ভার্টিক্যাল রাইজ-টার্ন স্ট্রেইট লাইন ক্লাইম্ব-ব্যালিস্টিক পথে একটা সারফেস-টু-সারফেস মিসাইলের ওপর অতিশয় চমৎকার কাজ করা হয়েছিল সেই সময়। আমি ডিআরডিএলের জনশক্তির দৃঢ় প্রত্যয় দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এরা তাদের পূর্ববর্তী প্রকল্পের ব্যর্থতা সত্ত্বেও সামনে এগিয়ে যেতে দৃঢ় ছিল। আমি পর্যালোচনার আয়োজন করেছিলাম এর বিভিন্ন সাবসিস্টেমের জন্য যথাযথ বৈশিষ্ট্য আলাদা করতে। ডিআরডিওর অনেক পুরনো কমরি মনে। আতংক সৃষ্টি করে আমি যেখানে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ পাওয়া যেতে পারে এমন সব স্থান থেকে লোকজনকে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করলাম, যেমন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ, টাটা ইন্সটিটিউট এর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ এবং আরও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমি অনুভব করেছিলাম, ডিআরডিএলের গুমোট কর্মকেন্দ্রগুলোয় তাজা বাতাসের প্রয়োজন। আমরা যদি জানলা পুরো খুলে দিই, তাহলে বৈজ্ঞানিক প্রতিভার আলো ভেতরে ঢুকতে শুরু করবে। আরও একবার কোলরিজের Ancient Mariner আমার মনে এল:

Swiftly, swiftly flew the ship,
Riding gently the oncoming tide.

১৯৮৩ সাল শুরুর দিকে কোনো এক সময়ে অধ্যাপক ধাওয়ান ভিজিটে এলেন। ডিআরডিএলে। প্রায় এক দশক আগে আমাকে দেওয়া তার উপদেশ আমি তাকেই স্মরণ করিয়ে দিলাম ও আপনার স্বপ্ন সত্যি হবার আগেই আপনাকে স্বপ্ন দেখতে হবে। কিছু লোক জীবনে যা চায় তার দিকে লাফিয়ে চলে; অন্যরা তাদের অদলবদল করে কিন্তু কখনও শুরু করতে পারে না কারণ তারা জানে তারা কী চায় এবং এও জানে না কীভাবে পেতে হবে। আইএসআরও ছিল ভাগ্যবান, কারণ অধ্যাপক সারাভাই ও অধ্যাপক ধাওয়ান তার হাল ধরেছিলেন। এমন নেতা যারা তাদের জীবনের চেয়ে মিশনকে বড়ো করে তুলেছিলেন, তারপর অনুপ্রাণিত করেছিলেন তাদের গোটা জনশক্তিকে। ডিআরডিএল অতটা ভাগ্যবান ছিল না। এই অসামান্য গবেষণাগার একটা অগ্রভাগ কর্তিত ভূমিকা রেখেছিল যা এর অস্তিত্বের অথবা বিপুল সামথ্যের প্রতিফলন ঘটাত না, এমনকি সাউথ ব্লকে এর প্রত্যাশাও পূরণ করত না। আমার প্রচণ্ড প্রফেশনাল, কিন্তু খানিকটা হতবুদ্ধি দল সম্পর্কে আমি অধ্যাপক ধাওয়ানকে জানিয়ে ছিলাম। অধ্যাপক ধাওয়ান তার উত্তরে স্বভাবসুলভ হাসি হেসেছিলেন, যেমন ইচ্ছা তেমন তার অর্থ করা যেত।

ডিআরডিএলে আরঅ্যান্ডডি-এর গতি সঞ্চারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলোর ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আমার ক্যারিয়ার জুড়ে আমি বৈজ্ঞানিক বিষয়ে খোলামেলা নীতি অনুসরণ করেছি। ম্যানেজমেন্ট রুদ্ধদ্বার আলোচনা ও গোপন বৈঠক করে যেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে, আমি খুব কাছ থেকে তার ক্ষয় দেখতে পেয়েছি। আমি এ ধরনের চেষ্টার বিরোধীতা করেছি সবসময়। সুতরাং প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছিলাম তা হলো সিনিয়র বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটা ফোরাম গঠন করা, যে ফোরামে যৌথ উদ্যোগ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হবে। এভাবে ডিআরডিএলের মধ্যেই একটা উঁচু পর্যায়ের বডি গঠন করা গেল, যাকে বলা হলো মিসাইল টেকনোলজি কমিটি। এর ফলে ম্যানেজমেন্টের গবেষণাগারের কর্মতৎপরতার মধ্যে টেনে আনা গেল মধ্য স্তরের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের।

অনেক দিনের বিতর্ক ও অনেক সপ্তাহের চিন্তাভাবনা শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ে পরিণত হলো দীর্ঘমেয়াদী গাইডেড মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম। কোথাও আমি পড়েছিলাম, কোথায় যাচ্ছ তা জান। দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো কাজ এ নয় কোথায় আছি তা জানা, আসল ব্যাপার হলো আমরা কোথায় যাচ্ছি। দেশীয় মিসাইল উৎপাদনের জন্য একটা স্পষ্ট ও সুনির্ধারিত মিসাইল কর্মসূচি তৈরি করতে আমার সভাপতিত্বে একটা কমিটি গঠিত হলো। এর সদস্য ছিলেন জেডপি মার্শাল, ভারত ডাইনামিকস লিমিটেডের তৎকালীন প্রধান, এনআর আয়ার, একে কাপুর ও কেএস ভেঙ্কটরমন। ক্যাবিনেট কমিটি ফর পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স (সিসিপিএ)-এর পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা একটা খসরা তৈরি করলাম। এই খসরা চূড়ান্ত করা হয়েছিল তিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর। আমরা খরচের হিসাব ধরেছিলাম প্রায় ৩৯০ কোটি রূপি, বারো বছর সময়কালের জন্য। ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম অধিকাংশ সময় আটকা পড়ে থাকে অর্থের অভাবে। আমরা অর্থ চেয়েছিলাম দুটো ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য একটা লো-লেভেল কুইক রিঅ্যাকশন ট্যাকটিক্যাল কোর ভেহিকল এবং একটা মিডিয়াম রেঞ্জ সারফেস-টু-সারফেস উইপন সিস্টেম। আমরা একটা মাল্টি-টার্গেট হ্যান্ডলিং ক্ষমতাসম্পন্ন মাঝারি পাল্লার সারফেস-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেছিলাম দ্বিতীয় পর্যায়ে। ডিআরডিএল পরিচিত ছিল ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালনের জন্য। আমরা প্রস্তাব করলাম ফায়ার-অ্যান্ড-ফরগেট ক্ষমতাসম্পন্ন একটা তৃতীয় প্রজন্মের ট্যাংকবিধ্বংসী গাইডেড মিসাইল তৈরি করার। এই প্রস্তাবে খুশি ছিল আমার সমস্ত সহকর্মী। তারা দেখতে পেল, নতুন উদ্যমে কর্মতৎপরতা শুরু করার এটা একটা সুযোগ। তবে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল রি-এন্ট্রি এক্সিপেরিমেন্ট লঞ্চ ভেহিকল (আরইএক্স)-এর স্বপ্ন পুনরুজ্জীবিত করা। আমার সহকর্মীদের পরামর্শ দিলাম তাপ-নিরোধক ডিজাইনে ব্যবহারের জন্য ডাটা তৈরির একটা টেকনোলজি ডেভলপমেন্ট প্রকল্প গ্রহণ করতে। ভবিষ্যতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল এই তাপনিরোধক।

.

সাউথ ব্লকে আমি পরিকল্পনা উপস্থাপনার একটা আয়োজন করলাম। এতে সভাপতিত্ব করলেন সেই সময়ের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আর ভেঙ্কটরমন এবং উপস্থিত ছিলেন তিন বাহিনীর প্রধানরা: জেনারেল কৃষ্ণ রাও, এয়ার চিফ মার্শাল দিলবাগ সিং এবং অ্যাডমিরাল ডসন। কেবিনেট সচিব কৃষ্ণ রাও সাহিব, প্রতিরক্ষা সচিব এসএম ঘোষ ও সচিব (ব্যয়) আর গণপতিও উপস্থিত ছিলেন। সবাইকেই মনে হচ্ছিল সব রকম সন্দেহে ভুগছেন আমাদের সামর্থ্য সম্পর্কে, চাহিদা অনুযায়ী প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর প্রাপ্তিসাধ্যতা ও সাধনযোগ্যতা সম্পর্কে, টিকে থাকার সক্ষমতা, সময়সূচি ও ব্যয় সম্পর্কে। ড. অরুণাচলম পুরো প্রশ্নোত্তর পর্বে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার পাশে। যদিও কয়েকজন আমাদের উচ্চাকাঙ্খী প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তবুও প্রত্যেকেই, এমনকি সন্দেহবাদীরাও ভারতের মিসাইল সিস্টেমের কল্পনায় উদ্দীপনা অনুভব করেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভেঙ্কটরমন প্রায় তিন ঘন্টা পর সন্ধ্যায় তার সঙ্গে আমাদের দেখা করতে বললেন।

মধ্যবর্তী সময়টা আমরা গাণিতিক বিন্যাস ও সংখ্যার রাশি সৃষ্টির কাজ করে কাটালাম। তারা যদি মাত্র ১০০ কোটি রুপি মঞ্জুর করে, তাহলে ওই অর্থ আমরা বন্টন করব কীভাবে? ধরা যাক, তারা আমাদের ২০০ কোটি রুপি দিল, তাহলে আমরা কী করব? প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে সন্ধ্যা বেলায় আমরা সাক্ষাৎ করলাম। আমার একটা অনুমান ছিল যে, যত অংকেরই হোক আমরা কিছু তহবিল পাব। কিন্তু তিনি যখন পরামর্শ দিলেন, মিসাইল তৈরি না করে আমরা একটা ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করব, তখন আমাদের কানকেও আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পরামর্শে আমরা একেবারে বোবাকালা হয়ে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ বিরতির পর ড. অরুণাচলম উত্তর দিলেন, আমরা পুনরায় চিন্তা করে আপনার সঙ্গে দেখা করার আর্জি জানাচ্ছি, স্যার!

আপনারা আগামীকাল সকালে আসুন দয়া করে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী উত্তর দিলেন।

অধ্যাপক সারাভাইয়ের প্রবল উৎসাহ ও স্বপ্নের কথা এতে মনে পড়ে গিয়েছিল। সেই রাতে, ড. অরুণাচলম ও আমি এক সঙ্গে মিলে আমাদের পরিকল্পনা আবার নতুন করে তৈরি করলাম।

আমাদের প্রস্তাবে কতকগুলো জরুরি বিষয় আমরা সম্প্রসারিত ও অন্তর্ভুক্ত করলাম। যোগ করলাম সব ধরনের পরিবর্তন, যেমন ডিজাইন, ফেব্রিকেশন, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, কোয়ালিফিকেশন, পরীক্ষামূলক ফ্লাইট, মূল্যনির্ধারণ, আপডেটিং, ইউজার ট্রায়াল, উৎপাদনশীলতা, মান, নির্ভরযোগ্যতা, আর আর্থিক সক্ষমতা। আমরা বিশদ করে দেখালাম ডিজাইন, ডেভলপমেন্ট ও উৎপাদন সহবর্তমানতার ধারণা, এবং ড্রয়িং-বোর্ড পর্যায় থেকেই ইন্সপেকশন এজেন্সি ও ইউজারের অংশগ্রহণের প্রস্তাব দিলাম। আমরা বহু বছরের উন্নয়মূলক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়ে আসার পর এখন স্টেট-অব-দ্য-আর্ট সিস্টেম অর্জনের জন্য একটা মেথোডোলজির পরামর্শও দিলাম। আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আমরা সমকালীন ক্ষেপণাস্ত্রই দিতে চাই, বাতিল হয়ে যাওয়া কোনো অস্ত্র নয়। খুব উত্তেজনাকর একটা চ্যালেঞ্জ আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমাদের এই পরিকল্পনার কাজটা শেষ করতে করতে সকাল হয়ে গেল। হঠাৎ নাশতার টেবিলে আমার মনে পড়ল, সন্ধ্যায় রামেশ্বরমে আমার ভাইঝি জামিলার বিয়ে আর আমার তাতে হাজির থাকার কথা। আমি ভাবলাম কোনো কিছু করার আর সময় নেই। দিনের আরও পরে যদি মাদ্রাজ ফ্লাইট ধরতেও পারি, সেখান থেকে রামেশ্বরমে পৌঁছাব কীভাবে? মাদ্রাজ ও মাদুরাইয়ের মধ্যে কোনো বিমান যোগাযোগ ছিল না, মাদুরাই থেকে রামেশ্বরমে যেতে হতো ট্রেনে। অপরাধের আর্দ্র ছায়া পড়ল আমার মনের ওপর। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, পরিবারের প্রতি আমার প্রতিশ্রুতি ও বাধ্যবাধকতা ভুলে যাওয়া কি সঙ্গত? জামিলা আমার কন্যারও অধিক। পেশাগত কারণে তার বিয়েতে থাকতে না পারার চিন্তাটা ছিল অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক। নাশতা শেষ করে সাক্ষাতের জন্য আমি বেরিয়ে গেলাম।

.

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভেঙ্কটরমনের সঙ্গে আমরা যখন সাক্ষাৎ করলাম আর আমাদের সংশোধিত প্রস্তাব দেখালাম, তখন দৃশ্যত তিনি আনন্দিত হলেন। মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের প্রস্তাব রাতারাতি পরিণত হয়েছিল একটা ইন্টিগ্রেটেড প্রোগ্রামের ব্লু-প্রিন্টে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর প্রতি আমার সম্মান রেখেই বলছি, আমি সত্যিই নিশ্চিত ছিলাম না যে তিনি আমাদের পুরো প্রস্তাব ক্লিয়ার করবেন কিনা। কিন্তু তিনি করলেন। আমি অকল্পনীয় আনন্দিত হলাম।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, সংকেত দিলেন মিটিং শেষ হয়ে গেছে। আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, যেহেতু আমি আপনাকে এখানে এনেছি, তাই আমি আশা করছিলাম এমন কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আসবেন আপনি। আপনার কাজ দেখে আমি আনন্দিত। ১৯৮২ সালে ডিআরডিএলের পরিচালক হিসাবে আমার নিয়োগ দানের রহস্য এক মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল। তাহলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভেঙ্কটরমন আমাকে নিয়ে এসেছেন এখানে। তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য মাথা ঝুঁকিয়ে আমি দরজার দিকে ঘুরলাম আর শুনতে পেলাম ড. অরুনাচলম এই সন্ধ্যায় রামেশ্বরমে অনুষ্ঠিতব্য জামিলার বিয়ের কথা বলছেন মন্ত্রীকে। বিষয়টা মন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করায় আমি বিস্মিত হলাম। সর্বময় ক্ষমতার সাউথ ব্লকে বসা তার মতো একজন ব্যক্তি বহু দূরের এক দ্বীপে একটা ছোট্ট বাড়িতে একটা বিয়ের ব্যাপারে কেন উদ্বিগ্ন হবেন?

ড. অরুণাচলমের প্রতি সবসময়ই আমার শ্রদ্ধা ছিল। আমি একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লাম যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মাদ্রাজ ও মাদুরাইয়ের মধ্যে গমণকারী বিমানবাহিনীর একটা হেলিকপ্টারে আমার মাদুরাই যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের নিয়মিত ফ্লাইটে আমি মাদ্রাজ পৌঁছে বিমান থেকে নামা মাত্রই ওই হেলিকপ্টার আমাকে সেখান থেকে তুলে নেবে মাদুরাইয়ে পৌঁছে দেবার জন্য। দিল্লি থেকে বিমানটি ছেড়ে যাবে এক ঘন্টার মধ্যেই। উ, অরুণাচলম আমাকে বললেন, এটা আপনি অর্জন করেছেন গত ছয় মাসের কঠোর পরিশ্রমের জন্য।

বিমানে মাদ্রাজের দিকে উড়ে যেতে যেতে আমার বোর্ডিং পাসের উল্টো দিকে আমি দ্রুত হাতে লিখলাম:

Who never climbed the weary league
Can such a foot explore
The purple territories
On Rameswarams shore?

দিল্লি থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানটি মাদ্রাজ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই এর খুব কাছে ল্যান্ড করল বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। পরবর্তী কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি হেলিকপ্টারে চড়ে মাদুরাইয়ের পথে উড়ে চললাম। এয়ার ফোর্স কমান্ডান্ট আমাকে রেলস্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন, সেখানে রামেশ্বরমগামী ট্রেনটা প্লাটফর্ম ছেড়ে যাবার উপক্রম করেছে তখন। জামিলার বিয়ের অনুষ্ঠানে ঠিক সময়েই আমি যোগ দিতে পেরেছিলাম সেদিন। পিতার ভালোবাসা দিয়ে আমার ভাইয়ের মেয়েকে আমি আশীর্বাদ করেছিলাম।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমাদের প্রস্তাব ক্যাবিনেটে উপস্থাপন করলেন আর আগাগোড়া খতিয়ে দেখলেন। আমাদের প্রস্তাবের ওপর সুপারিশ গৃহীত হলো এবং এই খাতে ৩৮৮ কোটি রুপি মঞ্জুর করা হলো, যেটা ছিল নজিরবিহীন। এভাবেই জন্ম নিয়েছিল ভারতের মর্যাদাশীল ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম, পরবর্তীতে সংক্ষেপে বলা হতো আইজিএমডিপি।

সরকারের মঞ্জুরি পত্র আমি যখন উপস্থাপন করলাম ডিআরডিএলের মিসাইল টেকনোলজি কমিটির সামনে, তখন সবাই যেন হর্ষে ফেটে পড়ল। প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল ভারতের আত্মনির্ভরতার মর্ম অনুসারে। এভাবেই সারফেস-টু-সারফেস উইপন সিস্টেমের নাম দেওয়া হয় পৃথী, ট্যাকটিক্যাল কোর ভেহিকলের নাম দেওয়া হয় ত্রিশূল। অন্যদিকে সারফেস-টু-এয়ার এরিয়া ডিফেন্স সিস্টেমের নাম হয় আকাশ এবং ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প নাগ। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন আরইএক্সের নাম দিয়েছিলাম অগ্নি। ড, অরুণাচলম এলেন ডিআরডিএলে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করলেন আইজিএমডিপি, ১৯৮৩ সালের ২৭ জুলাই। সেটা ছিল এক বিশাল ঘটনা। ডিআরডিএলের প্রতিটা কর্মী তাতে অংশ নিয়েছিল। ইন্ডিয়ান অ্যারোস্পেস রিসার্চের সাধারণ ব্যক্তিটাও আমন্ত্রিত হয়েছিল। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য গবেষণাগার ও প্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞানী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপকরা, সশস্ত্র বাহিনী, উৎপাদনকেন্দ্র ও ইন্সপেকশন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা, যারা এখন আমাদের কাজের অংশীদার হয়েছিলেন। সমস্ত আমন্ত্রিতদের জন্য একটা কক্ষের ব্যবস্থা করতে না পারায় আমরা তাদের মধ্যে যোগাযোগ নিশ্চিত করেছিলাম ক্লোজড-সার্কিট টিভি নেটওয়ার্ক বসিয়ে। আমার ক্যারিয়ারে এটা ছিল দ্বিতীয় সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। প্রথম দিনটি এসেছিল ১৯৮০ সালের ১৮ জুলাই, যেদিন এসএলভি-৩ পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করেছিল রোহিনী রকেট।

.

১১.

এ আইজিএমডিপির উৎক্ষেপণ ছিল ভারতের বিজ্ঞান-আকাশে এক উজ্জ্বল ঝলক। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিকে বিবেচনা করা হয়েছিল বিশ্বের নির্বাচিত কয়েকটি রাষ্ট্রের জমিদারি হিসাবে। জনগণ কৌতূহলী ছিল যে আমাদের প্রতিশ্রুতি আমরা কীভাবে রক্ষা করি, সেই সময়ে ভারতের পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটে। দেশে আইজিএমডিপির উজ্জ্বলতা ছিল বাস্তবিকই নজিরবিহীন। নির্ধারিত প্রকল্পগুলোও ছিল ভারতের আরঅ্যান্ডডি স্থাপনাগুলোর নমুনার বিচারে অসার কল্পনাপূর্ণ। আমি সম্পূর্ণ সচেতন ছিলাম যে, কর্মসূচির জন্য মঞ্জুরি পাওয়া যাবে কেবল দশ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ করতে পারলেও। চালিয়ে যেতে পারলে সেটা হবে একেবারেই আলাদা ব্যাপার। যত বেশি তোমার থাকবে, তত বেশি তোমাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এখন আমরা প্রয়োজনীয় অর্থ আর স্বাধীনতা পেয়েছি সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সুতরাং দলকে। আমার সামনের দিকে চালাতে হবে এবং আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।

ডিজাইন থেকে মোতায়েন পর্যন্ত এই ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বাস্তবায়নে কী প্রয়োজন হবে? বিপুল জনশক্তি ছিল সহজলভ্য; অর্থ মঞ্জুর হয়েছে; এবং কিছু অবকাঠামও বিদ্যমান। তাহলে অভাব কীসের? এই তিনটে গুরুত্বপূর্ণ ইনপুট ছাড়া একটা প্রকল্পের আর কী দরকার? আমার এসএলভি-৩ অভিজ্ঞতা থেকেই এর উত্তর আমার জানা ছিল। জটিল বিষয় হলো মিসাইল টেকনোলজির ওপর প্রভুত্ব অর্জন করতে হবে। বিদেশ থেকে আমি কিছুই আশা করিনি। টেকনোলজি হচ্ছে গ্রুপ অ্যাকটিভিটি আর আমাদের সেসব নেতা দরকার যারা তাদের হৃদয়-মন সঁপে দিতে পারবেন মিসাইল প্রগ্রামে, সেই সঙ্গে আরও শত শত প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীকে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন নিজেদের সঙ্গে। আমি জানতাম, অসংখ্য পরস্পরবিরোধীতা আর হাস্যকর নিয়মনীতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের, অংশগ্রহণকারী গবেষণাগারগুলোয় যা প্রভাব বিস্তার করে আছে। সরকারি খাতের ইউনিটগুলো মনে করে থাকে তাদের কর্মকুশলতা কখনও পরীক্ষিত হবে না, তাদের মধ্যে বিরাজমান এই মনোভাবের সঙ্গেও আমাদের মিথস্ক্রিয়া করতে হবে। পুরো সিস্টেমকে এর লোকবল, নিয়ম, অবকাঠামকে বর্ধন করা জানতে হবে। আমরা এমনকিছু অর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি যা আমাদের যৌথ জাতীয় সামর্থ্যের বাইরে, এবং আমার এই ব্যাপারে কোনো অলীক ধারণা নেই যে, সঙ্গতি ও সম্ভাবনার ভিত্তিতে আমার দল যতক্ষণ কাজ শুরু না করছে ততক্ষণ কিছুই অর্জিত হবে না।

ডিআরডিএলের সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল এখানে বিপুলসংখ্যক উঁচু প্রতিভাবান মানুষের সমাবেশ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের মধ্যে অনেকেরই অহংকার ও বিদ্রোহাত্মক মনোভাব ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আত্মবিচারের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হবার মতো যথেষ্ট পরিমাণ অভিজ্ঞতার অভাব ছিল তাদের। মোদ্দা কথা, তারা বেশ উৎসাহ সহকারে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অল্প কয়েকজনের নির্বাচিত কথার সঙ্গে একমত হতো। তারা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বাইরের বিজ্ঞানীদের কথা বিশ্বাস করত।

.

ডিআরডিএলে একজন চিত্তাকর্ষক ব্যক্তি ছিলেন এভি রঙ্গ রাও। তিনি ছিলেন অতিশয় স্পষ্টভাষী আর তার ছিল প্রভাবদায়ক ব্যক্তিত্ব। তিনি সাধারণত চেক কোটের সঙ্গে লাল নেকটাই আর ঢোলা ট্রাউজার পূরতেন। হায়দারাবাদের গরম আবহাওয়ার মধ্যেও তিনি এগুলো পরতেন, যেখানে এমনকি ফুল হাতা শার্ট আর জুতোও পরিত্যাজ্য বলে বিবেচিত হতো। তার মুখে ছিল ঘন শাদা দাড়ি আর দাঁতের ফাঁকে তামাকের পাইপ। এই গিফটেড মানুষটার চারপাশে দেখা যেত দেহজ্যোতির আভা।

আমি মানব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম পুনর্গঠিত করার ব্যাপারে রঙ্গ রাওয়ের সঙ্গে আলোচনা করলাম। রঙ্গ রাওয়ের অনেকগুলো মিটিং ছিল সেইসব বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যারা দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি উন্নয়নে আমাদের দর্শনের অংশীদার ছিল। তিনি তাদের কাছে আইজিএমডিপির বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করছিলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, গবেষণাগারকে একটা টেকনোলজি-ওরিয়েন্টেড স্ট্রাকচার হিসাবে পুনর্গঠিত করা হবে। প্রকল্পের জন্য দরকারি বিভিন্ন তৎপরতা পরিচালনার জন্য একটা মৌল কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। চার মাসেরও কম সময়ের মধ্যে চারশ বিজ্ঞানী মিসাইল কর্মসূচির কাজ শুরু করে দিলেন।

এ সময় আমার সামনে সবচেয়ে জরুরি কাজ ছিল স্বতন্ত্র মিসাইল প্রকল্প পরিচালনার জন্য প্রকল্প পরিচালক নির্বাচন করা। আমাদের বিপুলসংখ্যক প্রতিভাবান লোক ছিল বস্তুত, সম্পদের বাজার। প্রশ্ন হলো কাকে বেছে নেব একজন পরিকল্পনাকারী, একজন নিয়মের বশবর্তীহীন মানুষ, একজন একনায়ক কি একজন দলীয় মানুষ? আমাকে খুঁজে নিতে হবে সঠিক নেতাকে যে পরিষ্কারভাবে লক্ষ্যের ছবি কল্পনা করতে পারবে, এবং তার দলের সদস্যদের শক্তি প্রবাহিত করতে পারবে স্বপ্ন বাস্তবায়নে যারা কাজ করবে বিভিন্ন কর্মকেন্দ্রে তাদের ব্যক্তিগত লক্ষ্যে।

খুব কঠিন এক খেলা, কিছু নিয়ম আমি শিখেছিলাম দুই দশক আইএসআরওর হাই প্রায়োরিটি প্রকল্পসমূহে কাজ করার সময়। ভুল নির্বাচন কর্মসূচির গোটা ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিতে পারে। অনেক বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর সঙ্গে আমি চেয়েছিলাম এই পাঁচজন প্রকল্প পরিচালক প্রশিক্ষণ দেবেন অন্য পঁচিশজন প্রকল্প পরিচালককে ও আগামী দিনের দলনেতাদের।

আমার সিনিয়র সহকর্মীদের অনেকেই তাদের নাম উল্লেখ করাটা ঠিক হবে না, কারণ তা হবে শুধুই আমার কল্পনা-এই সময়টায় আমার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের চেষ্টা করেন। আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষের জন্য তাদের উৎকণ্ঠার বিষয়টি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু কোনো রকম নিবিড় যোগাযোগ এড়িয়ে যাই। বন্ধুর প্রতি আনুগত্যের কারণে কোনো ব্যক্তি এমনকিছু করতে পারে যাতে প্রতিষ্ঠানের কোনো ভালো স্বার্থ থাকবে না।

হয়তো আমার বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ ছিল সম্পর্কের দাবি থেকে পালিয়ে থাকার বাসনা। রকেট তৈরির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো কিছু বিশাল প্রতিবন্ধক বলে আমি মনে করি। আমি শুধু কামনা করতাম আমার জীবনধারায় সৎ থাকতে, আমার দেশে রকেট বিজ্ঞানকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে, আর স্বচ্ছ চেতনা নিয়ে অবসর গ্রহণ করতে। আমি কিছুটা সময় নিলাম এবং পাঁচটা প্রকল্প কারা পরিচালনা করতে পারবে তার সিদ্ধান্ত স্থির করতে প্রচুর ভাবলাম। সিদ্ধান্ত নেবার আগে অনেক বিজ্ঞানীর কর্মপন্থা পরীক্ষা করলাম। আমার মনে হয়, আমার কিছু পর্যবেক্ষণ তোমার চিত্তাকর্ষক মনে হবে। কোনো ব্যক্তির কর্মপন্থার মূল পরিচয় হলো কীভাবে সে পরিকল্পনা করে আর কাজ সংগঠন করে। কেউ সতর্ক পরিকল্পনাকারী, প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলার আগে সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করে সম্ভাব্য ভুলের দিকে, সে চেষ্টা করে অনিশ্চিত সম্ভাবনাগুলো কভার করতে। অন্য দিকে আছে হুড়োহুড়ি করার লোক, কোনো পরিকল্পনা ব্যতিরেকেই যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোনো আইডিয়ায় অনুপ্রাণিত হলেই সে সর্বদা প্রস্তুত হয়ে যায় কাজের জন্য। কোনো ব্যক্তির কর্মপন্থার আরেক পরিচয় হলো নিয়ন্ত্রণ শক্তি ও মনোযোগ উৎসর্গ করা থাকে এটা নিশ্চিত করতে যে সবকিছু নির্দিষ্ট পথে চলছে। এর আবার একদিকে আছে। টাইট কন্ট্রোলার, কঠোর প্রশাসক। নিয়ম-নীতি সেখানে পালন করা হয় ধর্মের মতো। এর বিপরীতে আছে স্বাধীনভাবে চলাচলকারীরা। আমলাতন্ত্রের ব্যাপারে তাদের ধৈর্য সামান্যই। তারা সহজ প্রতিনিধিত্ব করে আর চলাফেরার ব্যাপক স্বাধীনতা দেয় তাদের অধস্তনদের। আমি চেয়েছিলাম মধ্য পথের নেতাদের, সেসব নেতাদের যারা শ্বাসরুদ্ধকর ভিন্নমত বা কঠোর অনমনীয়তা ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

আমি তাদের চেয়েছিলাম যাদের সম্ভাবনা জাগানোর সামর্থ্য ছিল, ধৈর্যের সঙ্গে সকল সম্ভব বিকল্প বের করতে পারার সামর্থ্য ছিল, নতুন পরিস্থিতিতে পুরনো নীতি প্রয়োগের জ্ঞান ছিল; সামনে এগিয়ে যাবার দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ। দরকার ছিল আমার। আমি চেয়েছিলাম তারা নিজ নিজ ক্ষমতা ও কাজ অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন, ভালো কাজের প্রতিনিধিত্ব করবেন, জ্ঞানীদের শ্রদ্ধা করবেন। তারা বিভিন্ন বিষয়কে পরস্পর থেকে পৃথক করতে পারবেন, আর দায়িত্ব নেবেন সামনে চলার। সর্বোপরি, সাফল্য ও ব্যর্থতাকে সমানভাবে নিতে পারবেন।

.

পৃথ্বী প্রকল্পের জন্য আমি খুঁজে পেলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইএমই কোরের কর্নেল ভিজে সুন্দরমকে। তার ছিল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আর মেকানিক্যাল ভাইব্রেশনে তিনি বিশেষজ্ঞের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ডিআরডিএল-এ সুন্দরম ছিলেন স্ট্রাকচার গ্রুপের প্রধান। আমি তার মধ্যে খুঁজে পেলাম অনিশ্চিত ধারণা সমাধানে নতুন ধারার পরীক্ষানিরীক্ষায় প্রস্তুত একজন মানুষকে। টিম ওয়ার্কে তিনি ছিলেন একজন নিরীক্ষক ও উদ্ভাবক। কাজ পরিচালনার বিকল্প পন্থার মূল্যায়ন করার অনন্যসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। যদিও কোনো প্রকল্প নেতার কাছে লক্ষ্য পরিষ্কার হতে পারে এবং লক্ষ্য পূরণে তিনি যথার্থ নির্দেশ দিতেও পারেন, তা সত্ত্বেও তার অধস্তনরা সে উদ্যোগ প্রতিরোধ করতে পারে যদি লক্ষ্য সম্পর্কে তাদের কোনো বোধোদয় না ঘটে। তাই কার্যকর কর্ম নির্দেশনা দেবার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। আমি ভাবলাম পৃথ্বীর প্রকল্প পরিচালককে উৎপাদন সংস্থা ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আর এক্ষেত্রে সুন্দরমই হবে উপযুক্ত পছন্দ।

ত্রিশূল-এর জন্য আমি এমন এক ব্যক্তিকে খুঁজছিলাম যার শুধু ইলেকট্রনিক্স ও মিসাইল ওয়ারফেয়ারে বিপুল জ্ঞান আছে তাই নয়, যে তার দলের সঙ্গে বোঝাপড়া ও দলের সমর্থন আদায়ের জন্য জটিল বিষয়গুলো দলের কাছে পেশ করতে পারবে। এই কাজের উপযুক্ত লোক হিসাবে খুঁজে পেলাম কমোডর এসআর মোহনকে, ভারতীয় নৌবাহিনী থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল প্রতিরক্ষা আরঅ্যান্ডডিতে। যুক্তির দ্বারা মানুষের মনে প্রত্যয় উৎপাদনের অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তার।

অগ্নি আমার স্বপ্নের প্রকল্প। এ জন্য এমন একজনকে দরকার ছিল যে কি না প্রকল্প চালানোয় মাঝে মধ্যে আমার অযাচিত হস্তক্ষেপ সহ্য করে নেবে। আরএন আগরওয়াল ছিলেন সঠিক মানুষ। উজ্জ্বল অ্যাকাডেমিক রেকর্ডসহ তিনি ছিলেন এমআইটির একজন প্রাক্তন ছাত্র। তীক্ষ্ণ পেশাদার বিচারবুদ্ধি দিয়ে ডিআরডিএলের অ্যারোনটিক্যাল টেস্ট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।

প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে আকাশ ও নাগ সে সময় ভবিষ্যতের মিসাইল বলে বিবেচিত হয়েছিল; এগুলো তৈরির কর্মতৎপরতা আরও আধ-দশক পরে জোরাল হবে বলে আশা করা হতো তখন। তরুণ বয়সী প্রহ্লাদ ও এনআর আয়ারকে আমি নির্বাচন করলাম আকাশ ও নাগের জন্য। সুন্দরম ও মোহনের ডেপুটি হিসাবে নির্বাচন করলাম অপর দুই তরুণ ভিকে সরস্বৎ এবং একে কাপুরকে।

সেইসব দিনে ডিআরডিএলে কোনো ফোরাম ছিল না যেখানে সাধারণ জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা যেত কিংবা সিদ্ধান্তের ওপর বিতর্ক করা যেত। অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে বিজ্ঞানীরা মূলত আবেগপ্রবণ মানুষ। একবার যদি তারা হোঁচট খায়, তাহলে তাদের টেনে নেওয়া খুবই কঠিন। বাধাবিপত্তি আর হতাশা সবসময়ই আছে এবং যে কোনো পেশায় পূর্বানুক্রমিক অংশ হিসাবে তা থাকবেই, এমনকি বিজ্ঞানজগতেও। যা হোক আমি চাইনি আমার বিজ্ঞানীদের কাউকে একা একা নিরাশার মুখোমুখি পড়তে হোক। আমি এও নিশ্চিত করতে চেয়েছি যে, তাদের মন্দ অবস্থায় কোনো লক্ষ্য যেন তাদের নির্ধারণ করতে না হয়। এ ধরনের বিষয়গুলো এড়ানোর জন্য একটা সায়েন্স কাউন্সিল গঠন করা, হলো-এক রকম পঞ্চায়েত যেখানে সবাই একত্রে বসে সাধারণ সিদ্ধান্তগুলো নেবে। সমস্ত বিজ্ঞানী প্রতি তিন মাসে একবার এক সঙ্গে বসবে।

কাউন্সিলের প্রথম বৈঠক ছিল ঘটনাবহুল। একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী এমএন রাও সরাসরি একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন: কীসের ভিত্তিতে আপনি নির্বাচিত করেছেন এই পঞ্চপান্ডবকে? পঞ্চপান্ডব বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন প্রকল্প পরিচালকদের কথা। বস্তুত আমি এমন একটি প্রশ্নই আশা করছিলাম। আমি তাকে বলতে চেয়েছিলাম যে, আমি আবিষ্কার করেছি এই পঞ্চপান্ডব বিয়ে করেছে ইতিবাচক চিন্তার দ্রৌপদীকে। কিন্তু তার বদলে রাওকে আমি অপেক্ষা করে দেখতে বললাম। আমি তাদের নির্বাচন করেছিলাম দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচির দায়িত্ব গ্রহণ করতে, যেখানে নতুন নতুন ঝড় উঠবে প্রতিদিন।

প্রতিটা আগামীকাল, আমি রাওকে বললাম, সুযোগ বয়ে আনবে এইসব উদ্যমী মানুষদের কাছে আগরওয়ালদের কাছে, প্রহ্লাদদের কাছে, আয়ারদের কাছে, সরস্বদের কাছে তাদের লক্ষ্যের স্পষ্ট চিত্রটা তারা দেখতে পাবে তাতে করে, আর অঙ্গীকারে তারা অটল হবে।

কিসে তৈরি হয় একজন উৎপাদশীল নেতা? আমার মতে, একজন উৎপাদনশীল নেতাকে অবশ্যই কর্তৃত্ব পরিচালনায় হতে হবে উপযুক্ত। তাকে অবশ্যই প্রতিনিয়ত তার প্রতিষ্ঠানে নতুন রক্ত সঞ্চালন করতে হবে। তাকে অবশ্যই সমস্যা আর নতুন ধারণার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। তাকে অবশ্যই হতে হবে দলকে উদ্যমী করে তোলায় পারঙ্গম। যেখানে দরকার সেখানে প্রশংসা করতে হবে; প্রশংসা করতে হবে প্রকাশ্যে, কিন্তু সমালোচনা ব্যক্তিগতভাবে।

সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নগুলোর একটা এল একজন তরুণ বিজ্ঞানীর কাছ থেকে এই প্রকল্পের ভাগ্য যদি ডেভিল প্রকল্পের দিকে যায়, তাহলে তা আপনি ঠেকাবেন কীভাবে? আইজিএমডিপির পেছনে যে দর্শন আছে আমি আর কাছে সেটা ব্যাখ্যা করলাম-এটা শুরু হবে ডিজাইনে আর শেষ হবে মোতায়েনে। একেবারে ডিজাইন স্তর থেকে ইউজার এজেন্সি ও প্রডাকশন সেন্টারগুলোর অংশগ্রহণ এতে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সফলভাবে মিসাইল সিস্টেম স্থাপন না করা পর্যন্ত পেছনে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

.

যে সময়ে দলগঠন প্রক্রিয়া ও কর্ম সংগঠন চলছিল, সেই সময়ে আমি লক্ষ করলাম, আইজিএমডিপির চাহিদা পূরণের মতো পর্যাপ্ত স্থান ডিআরডিএলে নেই। নিকটবর্তী স্থানে কিছু স্থাপনা গড়তে হবে। ডেভিল প্রকল্পের মিসাইল স্থাপনার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল মাত্র ১২০ বর্গমিটার শেড। পাঁচটা মিসাইল যা খুব শীগগরিই এখানে পৌঁছাবে তা ইন্টিগ্রেট করার জায়গা কোথায়? এনভায়রনমেন্টাল টেস্ট ফ্যাসিলিটি এবং অ্যাভিওনিস ল্যাবরেটরি ছিল সমান ভাবেই গাদাগাদি করে ঠাশা আর দুর্বল যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত।

আমি নিকটবর্তী ইমারত কাঞ্চা এলাকা ঘুরে দেখলাম। কয়েক দশক আগে ডিআরডিএল এ জায়গায় ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছিল। ভূখন্ডটা একেবারে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে ছিল কোনো গাছপালা নেই-আর দাক্ষিণাত্যের ভূপ্রকৃতির বড়ো বড়ো বোল্ডার দেখা যায় মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যেন বিপুল পরিমাণ শক্তি আটকা পড়ে আছে এইসব পাথরের মধ্যে। মিসাইল প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টিগ্রেশন ও চেক-আউট স্থাপনার জন্য এ জায়গাটিকেই আমি নির্বাচন করলাম। পরবর্তী তিন বছরের জন্য এটাই হয়ে উঠল আমার মিশন।

সকল অগ্রবর্তী সুযোগসুবিধাসহ একটা উচ্চতর প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আমরা ছক করেছিলাম। একটা ইনার্শিয়াল ইন্সট্রুমেন্টেশন ল্যাবরেটরি, পূর্ণমাত্রার এনভায়রনমেন্টাল ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার (ইএমআই/ইএমসি) টেস্ট স্থাপন, একটা কম্পোজিট উৎপাদন কেন্দ্র, এবং একটা স্টেট-অব-দ্য-আর্ট মিসাইল ইন্টিগ্রেশন ও চেকআউট সেন্টার ইত্যাদি থাকবে তাতে। যে কোনো দিক থেকে এটা ছিল বিশালতর কাজ। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দরকার ছিল আলাদা ধরনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আর আত্মপ্রত্যয়। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইতোমধ্যেই স্থির করা হয়েছিল। এখন সেগুলোয় টেনে আনা দরকার ছিল বিভিন্ন সংস্থার লোকজনকে, যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। এ কাজ করার সবচেয়ে যোগ্য লোক ছিল কে? এমভি সূর্যকান্ত রাওয়ের মধ্যে এর সমস্ত গুণ আমি দেখেছিলাম। তারপর যেহেতু বিপুলসংখ্যক সংস্থা আরসিআই, তৈরিতে কাজ করবে, তাই পৌরহিত্য বিষয়ক

স্পর্শকাতরতা রক্ষার জন্য একজনকে প্রয়োজন হয়েছিল। এর দায়িত্ব দিলাম কৃষ্ণ মোহনকে। কাজকর্মে হুকুম তামিল করার চেয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ গ্রহণের উদ্দীপনা জাগাতে পারবে সে লোকজনের মধ্যে। প্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুযায়ী, আমরা আরসিআই নির্মাণ কাজের জন্য মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস (এমইএস) কে ডাকলাম। তারা বলল এ কাজ সম্পূর্ণ করতে পাঁচ বছর সময় লাগবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা হলো এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো বাইরের নির্মাণ কোম্পানিকে এই দায়িত্ব দেওয়া হবে। আমরা সার্ভে অব ইন্ডিয়া ও ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং এজেন্সির মধ্যে লিয়াজোঁ রক্ষা করলাম কন্ট্রর ম্যাপ তদন্ত এবং ইমারত কাঞ্চার আকাশ থেকে তোলা আলোকচিত্রের জন্য। এর উদ্দেশ্য ছিল স্থাপনার লোকেশন ও রাস্তার লেআউট প্রস্তুত করা। সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড পানি উত্তোলনের জন্য পাথরগুলোর মধ্যে কুড়িটা লোকেশন শনাক্ত করল। ৪০ এমভিএ পাওয়ার চালু ও প্রতিদিন ৫০ লাখ লিটার পানি উত্তোলনের অবকাঠাম নির্মাণের পরিকল্পনা স্থির করা হলো।

এই সময়েই কর্ণেল এসকে সালওয়ান আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন, অসীম শক্তির অধিকারী একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। নির্মাণ কাজের শেষ পর্যায়ে, বোল্ডারের মধ্যে প্রাচীন এক উপাসনাস্থল আবিষ্কার করলেন সালওয়ান। আমার মনে হয়েছিল এই স্থানটি ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট। এখন আমরা মিসাইল সিস্টেম ডিজাইনের কাজ শুরু করেছিলাম এবং অগ্রগতি হচ্ছিল দ্রুত। পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল মিসাইল ফ্লাইট পরীক্ষার জন্য একটা উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করা। অন্যদিকে এসএইচএআর অন্ধ্রপ্রদেশে স্থান অনুসন্ধানের কাজ করছিল। এ কাজ ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল রেখা বরাবর। শেষ পর্যন্ত এর সমাপ্তি ঘটল উড়িষ্যার বালাসোরে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল বরাবর একটা স্থান শনাক্ত করা হলো ন্যাশনাল টেস্ট রেঞ্জের জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ওই অঞ্চলে বসবাসকারী লোকদের স্থানান্তরকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া রাজনৈতিক বিতর্কের কর্কশ আবহাওয়ার ভেতর গিয়ে পড়ল গোটা প্রকল্প। অতঃপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, উড়িষ্যার বালাসোর জেলার চন্ডিপুরে অবস্থিত প্রুফ এক্সপেরিমেন্টাল এস্টাবলিশমেন্ট (পিএক্সই) সংলগ্ন স্থানে একটা মধ্যবর্তী অবকাঠাম নির্মাণ করা হবে। এই রেঞ্জ গঠনের জন্য ৩০ কোটি রুপি তহবিল গঠন করা হলো। এর নাম দেওয়া হলো ইন্টারিম টেস্ট রেঞ্জ (আইটিআর)। ইলেক্ট্র অপটিক্যাল ট্র্যাকিং ইস্ট্রমেন্ট, একটা ট্র্যাকিং টেলিস্কোপ সিস্টেম এবং একটা ইট্রুমেন্টেশন ট্র্যাকিং রাডার ইত্যাদির জন্য ড, এইচএস রামা রাও ও তার দল অভূতপূর্ব কাজ করেছিলেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরএস দেশওয়াল এবং মেজর জেনারেল কেএন সিং রেঞ্জ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও লঞ্চ প্যাড তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। চন্ডিপুর ছিল পাখিদের অপূর্ব এক অভয়ারণ্য। তাদের বিরক্ত না করে টেস্ট রেঞ্জ ডিজাইন করতে বললাম আমি প্রকৌশলীদের।

.

আরসিআই সৃষ্টি ছিল খুব সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক অভিজ্ঞতা। অভূতপূর্ব মিসাইল প্রযুক্তির এই কেন্দ্র নির্মাণ ছিল কাদা থেকে মৃৎশিল্পীর তৈরি মৃৎপাত্রের মতোই একটা ব্যাপার।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আর ভেঙ্কটরমন ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডিআরডিএল পরিদর্শনে এলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আইজিএমডিপির তৎপরতায় তার নিজের মূল্যাবধারণ করা। তিনি আমাদের পরামর্শ দিলেন, আমাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর তালিকা করতে, কোনো কিছুই যেন বাদ না পড়ে, এবং তাতে যেন আমাদের নিজেদের ইতিবাচক ভাবনা ও বিশ্বাস থাকে। আপনি তাই কল্পনা করবেন যা আপনি বাস্তব করবেন, আপনি তাই বিশ্বাস করবেন যা আপনি অর্জন করবেন, তিনি বললেন। ড. অরুণাচলম ও আমি দেখতে পেলাম, আইজিএমডিপির সামনে সম্ভাবনার এক অনন্ত দিগন্ত প্রসারিত হচ্ছে। দেশের সেরা প্রফেশনালরা আইজিএমডিপির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে দেখে আমরা উদ্দীপিত ও উৎসাহিত হয়েছিলাম। বিজয়ীর সঙ্গে সহযোগিতা করতে কে না চায়? বিশ্ব বুঝতে পেরেছিল আইজিএমডিপি জন্ম-বিজয়ী।

.

১২.

১৯৮৪ সালের মধ্যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে আমরা একটা মিটিং করছিলাম, এ সময় আমাদের কাছে খবর এল বোম্বাইতে ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মারা গেছেন ড. ব্রহ্ম প্রকাশ। মানসিকভাবে এটা ছিল আমার জন্য বিশাল ক্ষতি, কারণ আমার জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়টাতেই আমি তার অধীনে কাজ করার সুবিধা পেয়েছিলাম। তার সমবেদনা ও নম্রতা ছিল দৃষ্টান্তমূলক। এসএলভি-ই ১ ফ্লাইটের ব্যর্থতার দিন তার সস্নেহ স্পর্শের কথা আর তাতে আমার বেদনা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল।

অধ্যাপক সারাভাই যদি ভিএসএসসির স্রষ্টা হয়ে থাকেন, তাহলে ড. ব্রক্ষ প্রকাশ ছিলেন তার সম্পাদনকারী। তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে পুষ্টি জোগান দিয়েছিলেন, যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। আমার নেতৃত্বের দক্ষতাকে রূপ দিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ড. ব্রহ্ম প্রকাশ। বস্তুত তার সঙ্গে আমার কর্মসহযোগ ছিল আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। তার তা আমার আগ্রাসী মনোভাবকে স্বাভাবিক করে তুলতে সাহায্য করেছিল। নিজের প্রতিভা বা জ্ঞানের জন্য যে তিনি নতা দেখাতেন তা নয়, বরং তার অধীনে কর্মরতদের মর্যাদা জ্ঞাপনের জন্যই তিনি নম্র আচরণ করতেন। তার মধ্যে আরও ছিল শিশুসুলভ নির্দোষিতা, আর আমি সবসময়ই তাকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক সন্ত হিসাবে বিবেচনা করতাম।

ডিআরডিএলে নবজনের এই সময়টায় পি ব্যানার্জি, কেভি রামানা সাই ও তাদের দল একটা অ্যাটিচিউড কন্ট্রোল সিস্টেম ও একটা অন-বোর্ড কম্পিউটার প্রায় প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন। এই উদ্যোগের সাফল্য যে কোনো দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ কর্মসূচির জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কথায়, আমাদের একটা মিসাইল দরকার এই গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেম পরীক্ষা করার জন্য।

মস্তিষ্কে ঝড় তোলা অনেকগুলো সেশনের পর, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এই সিস্টেম পরীক্ষার জন্য একটা ডেভিল ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হবে উপস্থিতমত প্রাপ্ত উপাদান দিয়ে। একটা ডেভিল মিসাইলের বিভিন্ন অংশ আলাদা করা হলো, নানা প্রকার পরিবর্তন করা হলো তাতে, সম্প্রসারিত সাবসিস্টেম টেস্টিং সম্পন্ন করা হলো এবং মিসাইল চেকআউট সিস্টেম নতুন করে গঠন করা হলো। অস্থায়ী ব্যবস্থারূপে একটা লঞ্চার স্থাপন করে পরিবর্তিত ও সম্প্রসারিত রেঞ্জের ডেভিল ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হলো ১৯৮৪ সালের ২৬ জুন, উদ্দেশ্য ছিল প্রথম দেশীয় স্ট্র্যাপ-ডাউন ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম পরীক্ষা করা। সমস্ত চাহিদা পূরণ করল গাইডেন্স। ভারতের মিসাইল উন্নয়নের ইতিহাসে এটা ছিল প্রথম ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। বহুদিন ধরে অস্বীকার করে আসা একটা সুযোগ অবশেষে যথাযথ কাজে লাগাতে পারলেন ডিআরডিএলের মিসাইল বিজ্ঞানীরা! বার্তাটা ছিল স্পষ্ট ও পরিষ্কার। আমরা এটা করতে পেরেছি।

দিল্লিতে এ বার্তা পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আইজিএমডিপির অগ্রগতিকে প্রশংসা করলেন। পুরো প্রতিষ্ঠান উত্তেজনায় ভরে গিয়েছিল। ১৯৮৪ সালের ১৯ জুলাই শ্রীমতি গান্ধী ডিআরডিএল পরিদর্শন করতে এলেন।

.

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন বিপুল গর্ববোধসম্পন্ন একজন মানুষ নিজের সম্পর্কে, নিজের কাজের ব্যাপারে ও তার দেশকে নিয়ে। তাকে আমি ডিআরডিএলে অভ্যর্থনা জানানোর বিষয়টিকে একটা সম্মান হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম, যেহেতু আমার এক ধরনের নম্র মানসিকতার মধ্যেও তিনি নিজের কিছু গর্ব সঞ্চারিত করেছিলেন। তিনি খুব সচেতন ছিলেন যে, আশি কোটি মানুষের নেতা তিনি। তার হাতের প্রতিটা নড়াচড়া, প্রতিটা ইঙ্গিত, প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল আশাবাদিতার চিহ্ন। গাইডেড মিসাইলের ক্ষেত্রে আমাদের কাজের যে উচ্চমূল্য তিনি দিতেন, তাতে করে আমার নৈতিক শক্তি আরও জোরদার হয়েছিল।

যে এক ঘন্টা তিনি ছিলেন ডিআরডিএলে, সেই এক ঘন্টায় তিনি আইজিএমডিপির সবকিছু খুঁটিয়ে দেখলেন, ফ্লাইট সিস্টেম পরিকল্পনা থেকে বহুমুখী উন্নয়ন গবেষণাগার পর্যন্ত। পরিশেষে তিনি বক্তৃতা দিলেন। আমরা যেটা নিয়ে কাজ করছিলাম সেই ফ্লাইট সিস্টেমের শিডিউল চাইলেন তিনি। আপনারা পৃথ্বীর ফ্লাইট টেস্ট করবেন কবে? শ্রীমতি গান্ধী জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ১৯৮৭ সালের জুনে। তিনি দ্রুত বলে উঠলেন, ফ্লাইট শিডিউল এগিয়ে আনতে কী দরকার আমাকে বলুন। তিনি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ফলাফল দ্রুত পেতে চেয়েছিলেন। আপনাদের কাজের দ্রুতগতি হচ্ছে সমগ্র জাতির আশা, তিনি বললেন। তিনি আমাকে আরও বললেন যে, আইজিএমডিপির বৈশিষ্ট্য শুধু শিডিউলের ওপরই নয়, উৎকর্ষতা অনুসরণেও। আপনি যা অর্জন করলেন তা বিষয় নয়, আপনার কখনই পুরোপুরি আত্মতৃপ্ত হওয়া উচিৎ হবে না, বরং আরও উন্নতির পথ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। তিনি যোগ করলেন। এক মাসের মধ্যে নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এসবি চ্যাবনকে প্রকল্প পরিদর্শনে পাঠিয়ে তিনি তার সমর্থন ও আগ্রহ প্রকাশ করলেন। শ্রীমতি গান্ধীর মনোভাব শুধু যে প্রভাবদায়ক ছিল তাই নয়, বরং ফলপ্রসুও ছিল। আমাদের দেশে আজকের দিনে অ্যারোস্পেস গবেষণায় জড়িতরা জানে যে, আইজিএমডিপি আর উৎকর্ষতা সমার্থক।

আমাদের নিজেদের ম্যানেজমেন্ট টেকনিক আমরা আয়ত্ত করেছিলাম, এবং তা ছিল কার্যকর। এমন একটি টেকনিক ছিল প্রকল্প তৎপরতার ফলো-আপ। সম্ভাব্য সমাধানের প্রাযুক্তিক ও নিয়মানুগ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে এটা গঠিত হয়েছিল। আর সরব সমর্থনের পর একে কাজে লাগান হতো। অংশগ্রহণকারী কর্ম কেন্দ্রগুলোর তৃণমূল থেকে বিপুল পরিমাণ আইডিয়া এর ফলে পাওয়া গিয়েছিল। এই সফল কর্মসূচির যে কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনাগত কৌশল সম্পর্কে আপনি যদি আমাকে বলতে বলেন, তাহলে আমি এই ফলো-আপের কথাই বলব। বিভিন্ন গবেষণাগারে কৃত ডিজাইন, প্ল্যানিং ইত্যাদির ফলোআপের ভেতর দিয়ে, এবং ইন্সপেকশন এজেন্সি ও অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্যে দ্রুত অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিল। বস্তুত গাইডেড মিসাইল প্রোগ্রাম অফিসে কাজের ধারা ছিল? কোনো ওয়ার্ক সেন্টারে আপনার যদি একটা চিঠি পাঠাতে হয়, তাহলে ফ্যাক্স করুন; যদি আপনার টেলেক্স বা ফ্যাক্স পাঠাতে হয়, তাহলে ফোন করুন; আর যদি টেলিফোনে আলাপ করার প্রয়োজন হয়, তাহলে সরাসরি সেখানে গিয়ে কথা বলুন।

এই দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষমতা আলোয় এল যখন ড. অরুণাচলম আইজিএমডিপির একটা স্টাটাস সমীক্ষা চালালেন ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ডিআরডিও গবেষণাগারগুলোর বিশেষজ্ঞরা, আইএসআরও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদন সংস্থাগুলো একত্রিত হলো সাধিত অগ্রগতি খতিয়ে দেখার জন্য আর বাস্তবায়নের প্রথম বছরে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেগুলো জানতে। বড়ো সিদ্ধান্তগুলো যেমন ইমারত কাঞ্চায় স্থাপনা নির্মাণ ও পরীক্ষাস্থল প্রতিষ্ঠা এই সমীক্ষায় দানা বেঁধেছিল। জায়গাটির মূল নামটিকে মর্যাদা দিয়ে ইমারত কাঞ্চায় ভবিষ্যতের অবকাঠামোর নাম দেওয়া হয়েছিল রিসার্চ সেন্টার ইমারত (আরসিআই)।

রিভিউ বোর্ডে ছিলেন পুরনো পরিচিত ব্যক্তি টিএন সেশন। খুবই আনন্দের বিষয় ছিল সেটা। এসএলভি-৩ ও এখনকার এই সময়ে আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটা হৃদ্যতা! এবার প্রতিরক্ষা সচিব হিসাবে সেশন খোঁজখবর নিলেন শিডিউল ও আর্থিক প্রস্তাবনার টিকে থাকার নানা প্রসঙ্গে। এসব ছিল আরও নির্দিষ্ট। সেশন ছিলেন হাস্যরসিক মানুষ। তার বিরোধীদেরও তিনি হাস্যরস দিয়ে কোণঠাশা করে ফেলতেন। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু আর সুবিবেচক। আমার দল ভীষণ আনন্দিত হয়েছিল বিশেষ করে তার আইজিএমডিপিতে নিয়োজিত অগ্রবর্তী প্রযুক্তি বিষয়ে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে। কার্বন-কার্বন কম্পোজিটের দেশীয় উৎপাদন সম্পর্কে তার নির্ভেজাল কৌতূহলের কথা আমার আজও মনে পড়ে। আর আপনাদেরকে একটা গোপন কথা বলি-সেশন হলেন এ দুনিয়ার একমাত্র ব্যক্তি যিনি ৩১টি অক্ষর ও পাঁচটি শব্দে গঠিত আমার পুরো নাম ধরে আমাকে সম্বোধন করতেন-আবুল পাকির জয়নুলাবদিন আবদুল কালাম।

মিসাইল প্রোগ্রাম এগিয়ে চলছিল এবং ডিজাইন, উন্নয়ন ও উৎপাদনে তাতে শরিক হয়েছিল ১২টি অ্যাকাডেমিক ইন্সটিটিউট ও ডিআরডিওর ৩০টি গবেষণাগার, কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর), আইএসআরও এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান। বস্তুত, ৫০ জনেরও বেশি অধ্যাপক ও ১০০ জন গবেষক পন্ডিত নিজ নিজ ইন্সটিটিউটের গবেষণাগারে মিসাইল সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলেন। সেই এক বছরে অংশীদারিত্বের ভেতর দিয়ে অর্জিত কাজের উন্নত মান আমাকে এই আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল যে, দেশে যে কোনো উন্নয়ন কর্মকান্ড গ্রহণ করা যেতে পারে। এই সমীক্ষার চার মাস আগে, আমার মনে হয়। ১৯৮৪ সালের এপ্রিল-জুন মাসে, মিসাইল কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমরা ছয়জন শিক্ষাঙ্গনগুলো পরিদর্শন করে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ গ্রাজুয়েটদের তালিকা তৈরি করেছিলাম। আমরা অধ্যাপক ও উৎসাহী ছাত্রদের সামনে মিসাইল প্রোগ্রামের রূপরেখা তুলে ধরেছিলাম, প্রায় ৩৫০ জন ছাত্রের সামনে, এবং অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। সমীক্ষকদের আমি অবগত করলাম যে, প্রায় ৩০০ তরুণ প্রকৌশলী আমাদের গবেষণাগারগুলোয় যোগ দেবে বলে আমরা আশা করছি।

ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্যাল ল্যাবরেটরির তৎকালীন পরিচালক নোম নরসিমহা এই সমীক্ষার ব্যাপারটাকে প্রযুক্তির দৃঢ় এক প্রকাশ হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি সবুজ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, তাতে প্রমাণিত হয়েছিল লক্ষ্য পরিষ্কার থাকলে বড়ো বড়ো প্রাযুক্তিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তিকে সহজেই পাওয়া যায়।

অর্ঘ্য ভারত যখন শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে তার প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাল, তখন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষমতাসম্পন্ন পৃথিবীর ষষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত হলো সে। যখন আমরা এসএলভি-৩ উৎক্ষেপণ করেছিলাম, তখন আমরা ছিলাম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সামর্থ্য অর্জনকারী পঞ্চম দেশ। কোনো প্রযুক্তিগত কৃতিত্ব অর্জনকারী প্রথম বা দ্বিতীয় দেশ হব কখন আমরা?

আমি মনোযোগের সঙ্গে সমীক্ষায় সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সদস্যের কথা, মতামত ও সন্দেহ শুনলাম, আর শিক্ষা নিলাম তাদের যৌথ জ্ঞান ভান্ডার থেকে। সত্যিই এ ছিল আমার জন্য বিশাল এক শিক্ষা। আসলে বিদ্যালয়ে আমরা পড়তে, লিখতে, বলতে শিখি, কিন্তু শুনি না কখনও, আর পরিস্থিতি পরেও একই রকম থেকে যায়। ঐতিহ্যগতভাবেই ভারতীয় বিজ্ঞানীরা খুব ভালো বক্তা, কিন্তু শোনার মতো পর্যাপ্ত দক্ষতা তাদের নেই। মনোযোগী শ্রোতা হবার জন্য আমরা সংকল্প নিয়েছিলাম।

.

পূর্ববর্তী মাসের সমীক্ষা থেকে তৈরি করা অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। এমন সময় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হবার খবর ছড়িয়ে পড়ল। এর পরপরই এল সহিংসতা ও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার খবর। হায়দারাবাদ নগরীতে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল। আমরা পিইআরটি চার্ট গুটিয়ে রেখে একটা সিটি ম্যাপ মেলে ধরলাম টেবিলের ওপর। আমাদের সকল কর্মীকে কোন রাস্তা দিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে তা বের করার জন্য। এক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে গবেষণাগার পরিণত হলো জনমানবহীন ফাঁকা স্থানে। আমি একা বসে থাকলাম আমার অফিসে। শ্রীমতি গান্ধীর মৃত্যুতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা অত্যন্ত অশুভ লক্ষণযুক্ত হয়ে পড়েছিল। মাত্র তিন মাস আগে এখানে তার পরিদর্শনের কথা মনে পড়তেই আমার যন্ত্রণা আরও গম্ভীর হলো। মহান মানুষদের শেষ পরিণতি অমন ভয়ংকর হবে কেন? আমি স্মরণ করলাম কাউকে আমার বাবা বলেছিলেন, সাদা আর কালো সুতো যেমন এক সঙ্গে বুনন হয়ে থাকে কাপড়ে, তেমনি সূর্যের নিচে ভালো ও খারাপ মানুষ এক সঙ্গেই বসবাস করে। কালো বা শাদা সুতোর কোনো একটিও যদি ছিঁড়ে যায়, তাঁতী তাহলে খুঁজে দেখবে পুরো বস্ত্রটা, আর সে ততও পরীক্ষা করবে। গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় একটা প্রাণীকেও আমি দেখতে পেলাম না। আমি ছেঁড়া সুতোর তত নিয়েই চিন্তা করতে থাকলাম।

বিজ্ঞান মহলে শ্রীমতি গান্ধীর মৃত্যু ছিল বিশাল ক্ষতি। দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তিনি শক্তি জুগিয়েছিলেন। শ্রীমতি গান্ধীর হত্যার আঘাত কাটিয়ে ওঠা গেল ক্রমে ক্রমে, যদিও এর জন্য বলি হলো কয়েক হাজার জীবন আর সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হলো। তার পুত্র, রাজীব গান্ধী, ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন। তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট পেলেন মিসেস গান্ধীর পলিসি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম ছিল সেগুলোর একটা অংশ।

১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে, ইমারত কাঞ্চায় মিসাইল টেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার তৈরির সমস্ত গ্রাউন্ডওয়ার্ক সম্পূর্ণ হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ১৯৮৫ সালের ৩ অগাস্ট রিসার্চ সেন্টার ইমারত (আরসিআই)-এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন। অগ্রগতিতে তাকে খুব সন্তুষ্ট মনে হলো। তার মধ্যে ছিল শিশুসুলভ কৌতূহল। এক বছর আগে এখানে পরিদর্শনের সময় তার মায়ের যে স্থিরচিত্ততা ছিল, তার মধ্যেও তা দেখা গেল। তবে পার্থক্য ছিল এক জায়গায়। ম্যাডাম গান্ধী ছিলেন একজন টাস্কমাস্টার, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবহার করতেন তার ক্যারিসমা। তিনি ডিআরডিএল পরিবারকে বললেন যে, ভারতীয় বিজ্ঞানীদের যে কঠোর অবস্থা মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা তিনি উপলব্ধি করছেন। বিদেশে আরামদায়ক চাকরির সুযোগ না নিয়ে যারা মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন যে, দৈনন্দিন জীবনের দুঃশ্চিন্তাগুলো থেকে মুক্তি না পেলে কারো পক্ষে এ ধরনের কাজ গভীর মনোযোগের সঙ্গে করা সম্ভব নয়। তিনি আমাদের আশ্বাস দিলেন, বিজ্ঞানীদের জীবনযাত্রা স্বস্তিদায়ক করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হবে।

তার সফরের এক সপ্তাহের ভেতর, মার্কিন বিমান বাহিনীর আমন্ত্রণে ডু. অরুণাচলমের সঙ্গে আমি যুক্তরাষ্ট্রে গেলাম। ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্যাল ল্যাবরেটরির রোডম নরসিমহা ও এইচএএলের কেকে গণপতি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে আমাদের কাজ শেষ করার পর, নরগ্রপ করপোরেশন পরিদর্শনে লস এঞ্জেলেসে যাবার পথে আমরা সান ফ্রান্সিসকোতে অবতরণ করলাম। আমি এই সুযোগে আমার প্রিয় লেখক রবার্ট শুলার কর্তৃক নির্মিত ক্রিস্টাল ক্যাথেড্রাল দেখে নিলাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম পুরোপুরি কাঁচের, চার পয়েন্টের, তারকা আকৃতির স্থাপত্যের এই অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখে। একটা পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টের দূরত্ব ৪০০ ফিটেরও বেশি। একটা ফুটবল মাঠের মতো ১০০ ফিট লম্বা কাঁচের ছাদ মনে হলো যেন শূন্যে ভাসছে। এই ক্যাথেড্রাল নির্মিত হয়েছে শুলারের চেষ্টায় দাতাদের দেওয়া কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। খোদা সেই ব্যক্তির মাধ্যমে বিপুল কাজ করতে পারেন যে ব্যক্তি কৃতিত্বের ধার ধারে না। অহংকার অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। শুলার লেখেন, সাফল্য দিয়ে খোদা তোমাকে বিশ্বাস করার আগে, বড়ো পুরস্কার পাওয়ার মতো যথেষ্ট নিরহংকার প্রমাণ করতে হবে তোমার নিজেকে। শুলারের গির্জায় আমি খোদার কাছে প্রার্থনা করলাম, তিনি যেন আমাকে সাহায্য করেন ইমারত কাঞ্চায় একটা রিসার্চ সেন্টার স্থাপন করতে সেটাই হবে আমার ক্রিস্টাল ক্যাথেড্রাল।

.

১৩.

তরুণ প্রকৌশলীরা ডিআরডিএলের গতি বদলে দিল। আমাদের সবার জন্য এটা ছিল মূল্যবান অভিজ্ঞতা। এই তরুণ দলের মাধ্যমে এখন আমরা এমন অবস্থায় পৌঁছেছিলাম যাতে তৈরি করা সম্ভব রি-এন্ট্রি টেকনোলজি ও স্ট্রাকচার, একটা মিলিমেট্রিক ওয়েভ রাডার, একটা ফেজড অ্যারে রাডার, রকেট সিস্টেম আর এ ধরনের অন্যান্য ইকুইপমেন্ট। প্রথম যখন তরুণ বিজ্ঞানীদের এসব কাজের দায়িত্ব আমরা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, তারা তখন কিন্তু তাদের কাজের গুরুত্ব পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। যখন বুঝতে পারল তখন তাদের ওপর স্থাপিত বিশাল আস্থার ভারে তারা অস্বস্তি বোধ করল। আমার এখনও মনে আছে এক তরুণ আমাকে বলছে, আমাদের দলে নামজাদা কেউ নেই, আমরা একটা ব্রেক থ্র দিতে সমর্থ হবো কীভাবে? আমি তাকে বললাম, নামজাদা লোক হচ্ছে ক্ষুদ্র লোক যে কিনা শুধু বন্দুক চালাতে থাকে, সুতরাং চেষ্টা কর। তরুণ বৈজ্ঞানিকদের পরিবর্তিত হয় আর আগে মনে হওয়া অবাস্তব কাজ কীভাবে বাস্তব হয় তা লক্ষ্য করা সত্যিই চমকপ্রদ ছিল। তরুণদের দলের অংশ হয়ে অনেক বৃদ্ধ বিজ্ঞানী পুনঃযৌবন লাভ করেছিলেন।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, আসল সৌরভ, খাঁটি কৌতুক, কাজের অবিরাম উদ্দীপনা ইত্যাদি বিরাজ করে কাজ করার মধ্যেই। চারটে মূল ফ্যাক্টরে আমি প্রভাবিত ছিলাম, আর সাফল্যজনক ফলাফলের সঙ্গেও সেগুলো জড়িত ও লক্ষ্য স্থির করা, ইতিবাচক চিন্তা; দৃশ্যায়ন এবং বিশ্বাস।

এই পর্যায়ে আমরা লক্ষ্য স্থির করা বিষয়ক সবকিছুই সম্পন্ন করেছিলাম এবং এসব লক্ষ্য সম্পর্কে তরুণ বিজ্ঞানীদের মধ্যে উদ্যম জাগিয়ে তুলেছিলাম। আমি চাইতাম রিভিউ মিটিঙে তরুণ বিজ্ঞানীরা তাদের দলের কাজ তুলে ধরুক। সময় সিস্টেমের দৃশ্য কল্পনা করতে তাতে তাদের সাহায্য হতো। ক্রমেই আত্মবিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। তরুণ বিজ্ঞানীরা নিরেট টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল সিনিয়র সহকর্মীদের। সন্দেহ দেখা দিলে তা প্রমাণ করতে লাগল। তারা শীঘই ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হলো। আমি চেষ্টা করলাম, বৃদ্ধ বিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতা আর তরুণ বিজ্ঞানীদের দক্ষতার মিশ্রণে কাজের একটা জীবন্ত পরিবেশ বজায় থাকুক। তরুণ ও অভিজ্ঞদের মধ্যে এই নির্ভরশীলতা ডিআরডিএলে অত্যন্ত উৎপাদনশীল কর্ম সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিল।

.

মিসাইল প্রোগ্রামের প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো ১৯৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, শ্রীহরিকোটার টেস্ট রেঞ্জ থেকে এ দিন ছোঁড়া হলো ত্রিশূল। সলিড প্রোপেল্যান্ট রকেট মোটরের ইন-ফ্লাইট পারফরমেন্স পরীক্ষার জন্য এটা ছিল একটা ব্যালিস্টিক ফ্লাইট। ভূমি থেকে মিসাইল ট্র্যাক করতে ব্যবহৃত হয়েছিল দুটো সিব্যান্ড রাডার এবং ক্যালিডিও-থিওডোলাইট (কেটিএল)। পরীক্ষা সফল হলো। লঞ্চার, রকেট মোটর ও টেলিমেট্রি সিস্টেম কাজ করল পরিকল্পনা অনুযায়ী। তবে উইন্ড টানেল টেস্টিং-এর ভিত্তিতে অনুমিত হিসাবের তুলনায় অ্যারোডাইনামিক ড্রাগ অনেক বেশি হলো। টেকনোলজির ব্রেকথ্র বা অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধির দিক থেকে এই টেস্টের মূল্য বেশি ছিল না, কিন্তু এই টেস্টের আসল অর্জনটা হলো এই যে আমার ডিআরডিএল এর সহকর্মীদের মনে করিয়ে দেওয়া, রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো কঠিন চাহিদা পূরণ না করেও তারা মিসাইল উৎক্ষেপণ করতে পারে।

এর পরই সফলভাবে পরীক্ষামূলক উডডয়ন অনুষ্ঠিত হলো পাইলটবিহীন টার্গেট এয়ারক্র্যাফটের (পিটিএ)। ব্যাঙ্গালোর ভিত্তিক অ্যারোনটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এস্টাবলিশমেন্ট (এডিই)-এর ডিজাইন করা পিটিএর জন্য রকেট মোটর তৈরি করেছিল আমাদের প্রকৌশলীরা। মোটর টাইপ-অ্যাপ্রুভড় করেছিল ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)। মিসাইল হার্ডওয়ার উন্নতির দিকে এটা ছিল একটা ক্ষুদ্র কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ যা শুধু ক্রিয়ামূলকই নয় বরং ইউজার এজেন্সিগুলোর কাছেও গ্রহণযোগ্য। একটা বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান ডিআরডিএলের টেকনোলজি ইনপুট নিয়ে উৎপাদন করছিল নির্ভরযোগ্য উঁচু থ্রাস্ট-টু-ওয়েট রেশিও রকেট মোটর। একক গবেষণাগার প্রকল্প থেকে বহু গবেষণাগার কর্মসুচি আর সেখান থেকে ল্যাবরেটরি ইন্ডাস্ট্রির দিকে আমাদের কর্মপরিধি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছিল। চারটে আলাদা সংস্থার ওপর বেশ প্রভাব সৃষ্টি করেছিল পিটিএ। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি একটা মিলনকেন্দ্রে আর তাকিয়ে আছি ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার) এবং আইএসআরও থেকে আসা রাস্তাগুলোর দিকে। চতুর্থ রাস্তাটি ছিল ডিআরডিএল, মিসাইল প্রযুক্তিতে জাতির আত্মনির্ভরতার মহাসড়ক।

দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব আরও এক ধাপ বাড়িয়ে জয়েন্ট অ্যাডভান্সড টেকনোলজি প্রোগ্রামস শুরু করা হলো ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএস) ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আমার সবসময়ই প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে ইনপুট দিতে পারেন শিক্ষাবিদরা তাকে আমি মূল্য দিই। এসব প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানান হয়েছিল এবং ডিআরডিএলে তাদের অনুষদগুলো থেকে কোন বিশেষজ্ঞরা আসবেন তা আয়োজন করা হয়েছিল।

বিভিন্ন মিসাইল সিস্টেমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু অবদানের কথা বলা যাক এই অবসরে। পৃথ্বীর ডিজাইন করা হয়েছিল গাইডেড মিসাইল হিসাবে। সঠিকভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে ট্রাজেক্টরি-প্যারামিটারে সংযুক্ত করা লাগত মস্তিষ্ক অর্থাৎ অন-বোর্ড কম্পিউটার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল তরুণ প্রকৌশলী গ্রাজুয়েট, অধ্যাপক ঘোষালের তত্ত্বাবধানে, তৈরি করেছিল রোবাস্ট গাইডেন্স অ্যালগোরিদম। আইআইএস-এ স্নাতকোত্তর ছাত্ররা, অধ্যাপক আইজি শর্মার নেতৃত্বে, তৈরি করে দিল আকাশ-এর মাল্টি-টার্গেট অ্যাকুইজিশনের জন্য এয়ার ডিফেন্স সফটওয়ার। অগ্নির জন্য রি-এন্ট্রি ভেহিকল সিস্টেম ডিজাইন মেথডলজি তৈরি করে দিল আইআইটি মাদ্রাজ-এর তরুণদের একটা দল এবং ডিআরডিওর বিজ্ঞানীরা। ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভিগেশনাল ইলেকট্রনিক্স রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং ইউনিট নাগ-এর জন্য তৈরি করেছিল স্টেট-অব-দ্য-আর্ট সিগনাল প্রসেসিং অ্যালগোরিদম। সহযোগীদের সামান্য কয়েকটি উদাহরণ এগুলো। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অংশীদারিত্ব ব্যতিরেকে আমাদের পক্ষে অগ্রসর প্রযুক্তিগত লক্ষ্য অর্জন অত্যন্ত কঠিন হতো।

বিবেচনা করা যাক অগ্নি পেলোড় ব্রেকথ্রর উদাহরণটা। অগ্নি হচ্ছে টু-স্টেজ রকেট সিস্টেম। দেশে প্রথমবারের মতো তৈরি রি-এন্ট্রি টেকনোলজি এতে ব্যবহার করা হয়। এসএলভি-৩ থেকে বিক্ষিপ্ত একটা ফাস্ট-স্টেজ সলিড রকেট মোটরের দ্বারা এটা সামনে ঠেলে দেওয়া হয়, তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও গতি-সঞ্চারিত করা হয় পৃথ্বীর লিকুইড রকেট ইঞ্জিন দিয়ে। অগ্নির ক্ষেত্রে হাইপারসোনিক গতিতে পোলোড খালাস করা হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছিল একটা রি-এন্ট্রি ভেহিকল স্ট্রাকচারের ডিজাইন করা আর সেটা উৎপাদন করা। গাইডেন্স ইলেকট্রনিক্স-এ বোঝাই পেলোড স্থাপন করা হয় রি-এন্ট্রি ভেহিকল স্ট্রাকচারে, এর উদ্দেশ্য ভেতরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রেখে পেলোড রক্ষা করা যখন বাইরের আবরণের তাপমাত্রা ২৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়েও অনেক বেশি। অন-বোর্ড কম্পিউটারযুক্ত একটা ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম কাঙ্খিত লক্ষে গাইড করে নিয়ে যায় পেলোডকে। যে কোনো রি-এন্ট্রি মিসাইল সিস্টেমের ক্ষেত্রে কার্বন-কার্বন মোজ ওই রকম প্রচণ্ড তাপেও শক্তিশালী রাখার জন্য ত্রিমাত্রিক পারফর্ম মূল চাবিকাঠি। ডিআরডিওর চারটে গবেষণাগার ও সিএসআইআর এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছিল মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে অন্য দেশগুলো এ সাফল্য অর্জন করেছিল এক দশক গবেষণার পর!

অগ্নি পেলোড ডিজাইনে সংশ্লিষ্ট আরেকটা চ্যালেঞ্জ বিপুল গতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। বস্তুত, অগ্নি এটমসফেয়ারে পুনঃপ্রবেশ করতে পারত শব্দের গতির বারো বার (বিজ্ঞানে একে আমরা বলি ১২ ম্যাচ)। আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না যে, এই বিপুল গতিতে ধাবমান ভেহিকলকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। পরীক্ষা করার জন্য, ওই ধরনের গতি সঞ্চালনের উইন্ড টানেল আমাদের ছিল না। আমরা যদি আমেরিকার সাহায্য চাইতাম, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াত এমন যে, তাদের এক্সক্লসিভ সুবিধা হাতানোর উচ্চাভিলাষ করছি যেন আমরা। এমনকি তারা যদি সহযোগিতা করতেও চাইত, তাহলেও এ বাবদ এমন এক ভাড়া নির্ধারণ করত যা হতো আমাদের পুরো প্রকল্পের বাজেটের চেয়েও বেশি। এখন প্রশ্ন দাঁড়াল কীভাবে এই সিস্টেম আয়ত্ত করা যায়। আইআইএসের অধ্যাপক এসএম দেশপান্ডে খুঁজে বের করলেন চারজন উজ্জ্বল তরুণ বিজ্ঞানীকে যারা কাজ করছিল ফ্লুইড ডাইনামিক্স-এর ক্ষৈত্রে এবং ছয় মাসের মধ্যে কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডাইনামিক্স ফর হাইপারসোনিক রেজিস-এর জন্য একটা সফটওয়ার তৈরি করলেন, দুনিয়ায় যার দ্বিতীয়টি ছিল না।

.

আরেকটা অর্জন ছিল একটা মিসাইল ট্রাজেক্টরি সিমুলেশন সফটওয়ার। অনুকল্পনা নামে এটা তৈরি করেছিলেন আইআইএসের অধ্যাপক আইজি শর্মা। আকাশ গোত্রের উইপন সিস্টেমের মাল্টিটার্গেট অ্যাকুইজিশন সক্ষমতার জন্য। কোনো দেশই এ ধরনের সফটওয়ার আমাদের দিত না, ফলে দেশীয় ভাবেই আমরা এটা তৈরি করি।

বৈজ্ঞানিক প্রতিভার আরেক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন আইআইটি দিল্লির অধ্যাপক ভারতী ভাট। তিনি কাজ করছিলেন সলিড ফিজিক্স ল্যাবরেটরি (এসপিএল) এবং সেন্ট্রাল ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড (সিইএল)-এর সঙ্গে। আকাশএর সার্ভেইলেন্স, ট্র্যাকিং ও গাইডেন্সের জন্য মাল্টি-ফাংশন মাল্টি-টাস্কিং ৩-ডি ফেজড আর্মি রাডারে ব্যবহারের জন্য ফেরিট ফেজ শিফটার তৈরি করে এক্ষেত্রে তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর একচেটিয়া অধিকার খর্ব করে দিয়েছিলেন। আরসিআইতে আমার সহকর্মী ছিলেন বিকে মুখোপাধ্যায়, তার সঙ্গে কাজ করছিলেন খড়গপুরে অবস্থিত আইআইটির অধ্যাপক সারাফ। তিনি নাগ-এর সিকার হেডের জন্য একটা মিলিমেট্রিক ওয়েভ (এমএমডব্লিউ) অ্যান্টিনা তৈরি করে দিলেন মাত্র দুই বছরে, এটা ছিল একটা রেকর্ড। সেন্ট্রাল ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস রিসার্চ ইন্সটিটিউট (সিইইআরআই), পিলানি, এসপিএল ও আরসিআই সহযোগে একটা Impatt Diode তৈরি করেছিল বিদেশের ওপর প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য, যা ছিল যে কোনো এমএমডব্লিউ ডিভাইসের প্রাণ।

.

প্রকল্পের কাজ আনুভূমিকভাবে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজের মূল্যনির্ধারণ করাও বেশি বেশি করে সংকটজনক হয়ে উঠছিল। ডিআরডিওর রয়েছে একটা মূল্যনিৰ্ণায়কযুক্ত পলিসি। ৫০০ বিজ্ঞানীকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে, তাদের কাজের মূল্যায়ন করে অ্যানুয়াল কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট প্রস্তুত করতে হতো আমাকে। এসব রিপোর্ট সুপারিশের জন্য পেশ করা হতো বাইরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটা মূল্য-নিৰ্ণায়ক বোর্ডের কাছে। অনেক লোক আমার কাজের এই অংশটাকে দেখত কঠোর সমালোচনার দৃষ্টিতে। কারো পদোন্নতি না হলে তাকে আমি অপছন্দ করি বলে মনে করা হতো। অন্য সহকর্মীদের পদোন্নতিকে দেখা হতো এভাবে যে, ওই সহকর্মীরা আমার আনুকুল্য পেয়েছে। কাজ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমি সর্বদা চেষ্টা করেছি ন্যায়বিচারকের ভূমিকা পালন করার।

একজন বিচারককে ঠিকভাবে বুঝতে হলে, আপনাকে অবশ্যই পরিমাপ দন্ডের প্রহেলিকা বুঝতে হবে; একদিকে স্তূপাকার হয়ে উঠেছে আশা, অন্য দিকে আশঙ্কা। পাল্লা যখন এক দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন উজ্জ্বল আশাবাদ পরিণত হয় নীরব ত্রাসে।

কোনো ব্যক্তি যখন নিজের দিকে তাকায়, তখন যা সে খুঁজে পায় তার ভুল বিচারই করে অধিকাংশ সময়। নিজের অভিপ্রায়ই সে শুধু দেখতে পায়। অধিকাংশ লোকেরই রয়েছে সদুদ্দেশ্য, সুতরাং তারা মনে করে যে তারা যা করছে তা ভালো। কোনো ব্যক্তির পক্ষে নিজের কাজকর্মকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিচার করা খুব কঠিন, যা হতে পারে, আর প্রায়ই হয়, তার সৎ অভিপ্রায়ের প্রতি বিসদৃশ। অনেকেই তাদের কাজ করে সুবিধাজনক আচরণে আর আত্মতৃপ্তি নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে ফেরে। তারা কাজের মূল্যায়ন করে না, মূল্যায়ন করে শুধু তাদের অভিপ্রায়ের। এটা মনে করা হয় যে, যেহেতু কোনো ব্যক্তি যথাসময়ে তার কাজ শেষ করার উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করেছে, সুতরাং বিলম্ব যদি ঘটে তবে তা এমন কারণে ঘটেছে যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিলম্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্য তার ছিল না। কিন্তু তার ক্রিয়া বা নিষ্ক্রিয়তা যদি ওই বিলম্বের কারণ হয়, তাহলে কি উদ্দেশ্যমূলক নয়?

পেছনের দিকে ফিরে তাকালে, যখন আমি ছিলাম একজন তরুণ বিজ্ঞানী, তখন আমি যা ছিলাম তার চেয়ে আরও বেশি কিছু হতে চাইতাম। আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল বেশি অনুভব করা, বেশি শেখা, বেশি প্রকাশ করা। আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল বড়ো হয়ে ওঠা, উন্নতি করা, বিশুদ্ধ হওয়া, সম্প্রসারিত হওয়া। আমার ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে আমি কখনও বাইরের প্রভাব ব্যবহার করিনি। নিজের ভেতরেই নিজের সামর্থ্য খুঁজে পাবার বাসনা ছিল আমার। আমার গতিময়তার চাবিকাঠি হলো, কতদূর এসেছি তার চেয়ে কত দূর আরও আমাকে যেতে হবে তা মাথায় রাখা। সর্বোপরি, অমীমাংসিত সমস্যা, উচ্চাভিলাষী বিজয় ও অনিয়তাকার পরাজয়ের একটা মিশ্রণ ছাড়া জীবন আর কি?

সমস্যা হলো আমরা প্রায়শ জীবনের সঙ্গে কারবার করার বদলে জীবনকে বিশ্লেষণ করতে বসি। লোকেরা ব্যর্থতার জন্য নানারকম অজুহাত তৈরি করে, কিন্তু সেগুলো মোকাবেলা করে না আর সেগুলো জয় করার জন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে না-যাতে করে পরবর্তী সময়ে এসব পরিহার করা যায়। আমার বিশ্বাসটা হলো এমন: সমস্যা সংকটের ভেতর ফেলে দিয়ে খোদা আমাদের সুযোগ দেন বড়ো হয়ে ওঠার। সুতরাং আপনার আশা, স্বপ্ন ও লক্ষ্য যখন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই খুঁজে দেখুন, হয়তো একটা সুবর্ণ সুযোগ খুঁজে পাবেন ওরই ভেতর।

লোকজনকে তাদের কাজের ভেতর নিমগ্ন করে দেওয়া আর বিষণ্ণতার মোকাবেলা করা একজন নেতার জন্য সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ। আমি শক্তির ভারসাম্য আর পরিবর্তনে প্রতিরোধের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছি প্রতিষ্ঠানের ভেতর। একটা বিরোধী শক্তির ক্ষেত্রে পাচালো স্প্রিং হিসাবে পরিণত হওয়ার কথা কল্পনা করা যাক, এমন যে কিছু শক্তি পরিবর্তন সমর্থন করে আর অন্যরা প্রতিরোধ করে। সমর্থনকারী শক্তিকে বাড়িয়ে অথবা প্রতিরোধী শক্তিকে কমিয়ে পরিস্থিতিকে চালিত করা যেতে পারে কাঙ্খিত ফলাফলের দিকে কিন্তু অল্প সময়ের জন্য মাত্র, আর সেটাও একটা নির্দিষ্ট পরিসর পর্যন্ত। কিছু সময় অতিবাহিত হলে অনেক বেশি শক্তি নিয়ে প্রতিরোধী শক্তি ঠেলা দিতে শুরু করবে, যত জোরেই সেটা চেপে রাখা হোক না কেন। সুতরাং চাপ না দিয়ে প্রতিরোধ শক্তিকে এমনভাবে কমাতে হবে যাতে করে সমর্থনকারী শক্তি নিজেই বৃদ্ধি পাবে। এই উপায়ে পরিবর্তন আনতে ও রক্ষা করতে কম শক্তির প্রয়োজন হবে।

ওপরে শক্তির যে ফলাফলের কথা বলেছি, তা হলো মোটিভ। এই শক্তি ব্যক্তিমানুষের জাড্য এবং কাজের পরিবেশে তার আচরণের ভিত্তি গঠন করে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অধিকাংশ মানুষের ভেতরে রয়েছে বিপুল শক্তি, বেড়ে ওঠার ঝোঁক, প্রতিযোগিতা। সমস্যা হয়েছে কাজের পরিবেশের অভাব যা তাদের উদ্দীপ্ত করতে পারবে আর পূর্ণ অভিব্যক্তি দিতে পারবে তার অভীষ্টের দিকে। নেতারা উঁচু উৎপাদনশীতার স্তর সৃষ্টি করতে পারেন জব ডিজাইন আর যথার্থ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে। আর কঠোর কাজের স্বীকৃতি দিয়ে।

আমি এ ধরনের সহায়তামূলক পরিবেশ সৃষ্টির প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলাম ১৯৮৩ সালে আইজিএমডিপি উৎক্ষেপণের সময়। সেই সময়ে প্রকল্প ডিজাইন পর্যায়েই ছিল। কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে ফলাফল বেড়ে দাঁড়াল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ। এখন বহুমুখী প্রকল্প প্রবেশ করছিল ডেভলপমেন্ট ও ফ্লাইট-টেস্টিং স্তরে, যেসব বড়ো ও ছোটো মাইলস্টোনে পৌঁছান গিয়েছিল সেগুলোর কারণে কর্মসূচি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। আত্মভূতকরণের ভেতর দিয়ে তরুণ বিজ্ঞানীদের একটি দলের গড় বয়স নামিয়ে আনা হলো ৪২ থেকে ৩৩ বছরে। আমি অনুভব করলাম তখন দ্বিতীয়বার রিঅর্গানাইজেশনের সময় হয়েছে। কিন্তু সেটা করব কীভাবে? সে সময়ে সহজলভ্য মোটিভেশনাল ইনভেনটরি কাজে লাগালাম আমি-তিন ধরনের বোধশক্তি তার মূল ভিত্তি: এই প্রয়োজনীয়তা বোঝা যে লোকেরা কাজ করে তৃপ্ত হতে চায়, ফলাফল বোঝ যে জব ডিজাইন চলমান রয়েছে, এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির আচরণে ইতিবাচক শক্তি বৃদ্ধির ক্ষমতা বোঝ।

১৯৮৩ সালে রিঅর্গানাইজেশন করা হয়েছিল নবায়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে: খুব জটিল এ কাজ করেছিলেন এভি রঙ্গ রাও এবং কর্ণেল আর স্বামীনাথন। নতুন যোগদান করা তরুণ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে একজন মাত্র অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে আমরা একটা দল গঠন করেছিলাম আর তাদের চ্যালেঞ্জ তুলে দিয়েছিল। স্ট্র্যাপ-ডাউন ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম এবং একটা অন-বোর্ড কম্পিউটার ও প্রপালসন সিস্টেমে একটা র‍্যাম রকেট তৈরি করার। দেশে এই চেষ্টা ছিল এটাই প্রথম, আর যে ধরনের প্রযুক্তি এতে ব্যবহৃত হয়েছিল তা ছিল বিশ্বমানের। তরুণদের দলটি শুধু যে এই সিস্টেমের ডিজাইন তৈরি করল তাই নয়, তার সেটাকে অপারেশনাল ইকুইপমেন্টেও রূপদান করল। পরবর্তী সময়ে পৃথ্বী ও অগ্নিতে একই গাইডেন্স সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছিল আর ফল পাওয়া গিয়েছিল অসাধারণ। এই তরুণ দলের প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশ আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল।

.

পৃথ্বীর কাজের প্রায় শেষের দিকে নতুন বছর শুরু হলো-১৯৮৮। দেশে প্রথমবারের ন্যায় ব্যবহৃত হতে যাচ্ছিল গুচ্ছভুক্ত লিকুইড প্রোপেল্যান্ট (এলপি) রকেট ইঞ্জিন। সুযোগ ও নীতি নির্ধারণের মান সত্ত্বেও সুন্দরম ও আমি পৃথ্বীর দলটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করছিল সৃজনশীল আইডিয়ার ওপর, যা অনুপ্রবিষ্ট করা যাবে কর্মযোগ্য উৎপন্ন দ্রব্যে। ওয়াই জ্ঞানেশ্বর ও পি বেনুগোপালনের সঙ্গে সরস্বৎ এক্ষেত্রে বিশাল কাজ করেছিলেন। তাদের দলের ভেতর তারা সাফল্যের ও গর্বের বোধ সঞ্চারিত করেছিলেন। এই রকেট ইঞ্জিনের গুরুত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না পৃথ্বী প্রকল্পের কাছে এটা ছিল একটা জাতীয় অর্জন। যৌথ নেতৃত্বের অধীনে বিপুলসংখ্যক প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ দলের লক্ষ্য বুঝতে পেরেছিলেন আর নিজেদের তারা অঙ্গীকারবদ্ধ করেছিলেন। তাদের পুরো দল কাজ করত এক ধরনের আত্মনির্দেশনায়।

সুন্দরম ও সরস্বতের দক্ষ ও নিরাপদ হাতে ভেহিকল ডেভলপমেন্ট ছেড়ে দিয়ে আমি মিশনের সমালোচনাযোগ্য বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলাম। মিসাইল সাবলীলভাবে উত্তোলনের জন্য লঞ্চ রিলিজ মেকানিজম (এলআরএম) তৈরির সতর্ক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এক্সপ্লোসিভ বোল্টের যৌথ নির্মাণে ডিআরডিএল ও এক্সপ্লোসিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটরি (ইআরডিএল) ছিল বহু-কর্মকেন্দ্র সমন্বয়ের এক চমকপ্রদ উদাহরণ।

আকাশ ভ্রমণকালে নিচের ভূদৃশ্যের দিকে মুগ্ধ চোখে আমি তাকিয়ে থাকতাম। তা ছিল কী অপরূপ সুন্দর, কী বৈচিত্র্যময়, কী শান্তিপূর্ণ। সেই এক দূরত্ব থেকে, আমি অবাক হয়ে কল্পনা করতাম কোথায় সেই বাউন্ডারিগুলো যা আলাদা করে এক জেলাকে আরেক জেলা থেকে, এক স্টেটকে আরেক স্টেট থেকে, এক দেশকে আরেক দেশ থেকে। হতে পারে ওই রকম এক দুরত্ব আর বিচ্ছিন্নতার বোধ প্রয়োজন হয় আমাদের জীবনের সকল তৎপরতা মোকাবেলা করার জন্য।

বালাসোরে ইন্টারিম টেস্ট রেঞ্জ সম্পূর্ণ হতে তখনও আরও এক বছর বাকি ছিল, সুতরাং আমরা পৃথ্বী উৎক্ষেপণের জন্য এসএইচএআরে একটা বিশেষ স্থাপনা তৈরি করে নিয়েছিলাম। এতে ছিল একটা লঞ্চ প্যাড, ব্লক হাউজ, কন্ট্রোল কনসো আর মোবাইল টেলিমেট্রি স্টেশন। আমার পুরনো বন্ধু এমআর কুরুপের সঙ্গে এখানে আবার পুনর্মিলন ঘটল, তখন সে এসএইচএআর সেন্টারের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিল। পৃথ্বী উৎক্ষেপণ পর্যায়ে কুরুপের সঙ্গে কাজ করার বিষয়টা আমাকে বিশাল তৃপ্তি দিল। কুরুপ পৃথ্বীর জন্য কাজ করেছিল একজন দলীয় সদস্য হিসাবে। যে বাউন্ডারি রেখা ডিআরডিও এবং আইএসআরওকে, ডিআরডিএল এবং এসএইচএআরকে বিভক্ত করেছিল তা সে পুরোপুরি উপেক্ষা করেছিল। আমাদের সঙ্গে লঞ্চ প্যাডে প্রচুর সময় খরচ করত কুরুপ। সে আমাদের সহযোগিতা করেছিল রেঞ্জ টেস্টিং ও রেঞ্জ সেফটিতে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে আর সে প্রোপেল্যান্ট ফিলিঙে কাজ করেছিল প্রচুর উদ্যম নিয়ে। পৃথ্বী উৎক্ষেপণটাকে সে স্মরণীয় অভিজ্ঞতার রূপ দিয়েছিল।

উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৮৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ১১:২৩ ঘন্টায়। দেশের রকেট বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা ছিল এক মহাকাব্যিক ঘটনা। সারফেস-টু-সারফেস মিসাইল পৃথ্বী ১৫০ কিলোমিটার দূরে ১০০০ কেজি কনভেনশনাল ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম আর নির্ভুলতার পরিমাণ ৫০ মিটার সিইপি। তবে আসল কথা হলো, ভবিষ্যতের সকল গাইডেড মিসাইলের জন্য এটা ছিল বেসিক মডিউল। লং-রেঞ্জ সারফেস থেকে এটিকে রূপান্তরিত করা যায় এয়ার মিসাইল সিস্টেমে, এ ছাড়াও জাহাজেও মোতায়েন করা যেতে পারে।

মিসাইলের নির্ভুলতা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় এর সার্কুলার এরর ব্যাবল (সিইপি)-এ। এটা একটা বৃত্তের রেডিয়াস পরিমাপ করে যার মধ্যে নিক্ষিপ্ত মিসাইলের ৫০ শতাংশ সংঘৃষ্ট হবে। অন্য কথায়, কোনো মিসাইলের যদি ১ কিলোমিটার সিইপি থাকে (উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত ইরাকি স্কাড ক্ষেপণাস্ত্রের যেমনটা ছিল), তাহলে তার অর্থ হলো এগুলোর অর্ধেক সংঘৃষ্ট হবে লক্ষ্যস্থলের ১ কিলোমিটারের মধ্যে। ১ কিলোমিটার সিইপি ও কনভেনশনাল হাই-এক্সপ্লোসিভ ওয়ারহেড যুক্ত একটা মিসাইল দিয়ে স্বাভাবিকভাবে আশা করা যাবে না যে, সেটা স্থির সামরিক লক্ষ্যবস্তুসমূহ যেমন কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল ফ্যাসিলিটি বা এয়ার বেজ অচল বা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হবে। এটা শহরের মতো অনিশ্চিত লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর।

১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের মার্চের মধ্যে জার্মান V-2 মিসাইল বর্ষণ করা হয় লন্ডনে। ওইসব মিসাইলে যুক্ত ছিল কনভেনশনাল হাইএক্সপ্লোসিভ ওয়ারহেড ও বৃহদাকার ১৭ কিলোমিটারের সিইপি। লন্ডনে হানা ৫০০টি v.2 ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২১,০০০-এরও বেশি আর ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ২০০০০০।

এনপিটি নিয়ে পশ্চিমারা যখন কর্কশ সুরে চিৎকার করছিল, আমরা তখন ৫০ মিটারের একটা সিইপি তৈরির দিকে এগিয়ে চলেছি। পৃথ্বীর সকল পরীক্ষার পর, পারমাণবিক ওয়ারহেড ছাড়াই একটা সম্ভাব্য কৌশলগত আক্রমণের শীতল বাস্তবতা মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল সেইসব সমালোচকদের যারা একটা টেকনোলজি কন্সপিরেসি বিষয়ে ফিসফাস করছিল।

পৃথ্বী উৎক্ষেপণ বৈরী ভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশগুলোয় একটা শক-ওয়েভ সৃষ্টি করেছিল। পশ্চিমা ব্লক প্রথমে স্তম্ভিত ও পরে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ল। সাতটি রাষ্ট্র আমাদের ওপর প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিল, ভারতের পক্ষে একেবারে অসম্ভব করে তুলল এমনকি গাইডেড মিসাইলের সঙ্গে যোগ নেই এমন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনাও। গাইডেড মিসাইল ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসাবে ভারতের উত্থান বিশ্বের সব কটি উন্নত রাষ্ট্রের মেজাজ বিগড়ে দিয়েছিল।

.

১৪.

রকেট বিজ্ঞানে ভারতের মৌলিক সামর্থ্য আবারও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বেসামরিক স্পেস ইন্ডাস্ট্রি ও টিকে থাকার শক্তিসম্পন্ন মিসাইল ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতকে সেইসব গুটিকয় রাষ্ট্রের সারিতে উন্নীত করেছিল যারা নিজেদের বলে পরাশক্তি। বুদ্ধ ও গান্ধীর শিক্ষাকে অনুসরণ করেও কেন এবং কীভাবে ভারত মিসাইল পাওয়ারে পরিণত হলোএই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে ভবিষ্যৎ প্রজনের জন্য।

দুই শতাব্দীর নিপীড়ন, নির্যাতনও পারেনি ভারতীয় জনগণের সৃষ্টিশীলতা ও সামর্থ্যকে হত্যা করতে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের মাত্র এক দশকের মধ্যেই ইন্ডিয়ান স্পেস অ্যান্ড অ্যাটমিক এনার্জি প্রগ্রাম চালু করা হয়েছিল। এর লক্ষ ছিল শান্তিপূর্ণ ব্যবহার। মিসাইল ডেভলপমেন্টে বিনিয়োগের কোনো তহবিলও ছিল না, কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে তেমন তাগাদাও ছিল না। ১৯৬২ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতাই আমাদের বাধ্য করেছিল মিসাইল ডেভলপমেন্টের দিকে প্রথম পদক্ষেপ নিতে।

একটা পৃথীই কি যথেষ্ট? চার অথবা পাঁচটা মিসাইল সিস্টেমের দেশীয় উৎপাদন কি আমাদের যথেষ্ট শক্তিশালী করতে পারে? পারমাণবিক অস্ত্র কি আমাদের আরও শক্তিশালী করতে পারে? মিসাইল ও অ্যাটোমিক অস্ত্র আসলে একটা বৃহত্তর বস্তুরই দুটো অংশ। অগ্রসর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পৃথ্বী উৎপাদন আমাদের দেশের আত্মনির্ভরশীলতা তুলে ধরেছে। উঁচু প্রযুক্তি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা আর ব্যাপক অবকাঠামোর সমার্থক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসবের কোনোটিই পর্যাপ্ত ছিল না। কাজেই আমরা কি করতে পারতাম? প্রযুক্তি প্রদর্শনের প্রকল্প হিসাবে তৈরি করা অগ্নি কি এসবের উত্তর হতে পারত? যে মিসাইল তৈরি করতে দেশের সহজলভ্য সব উৎসগুলো কাজে লাগান হয়েছিল।

প্রায় এক দশক আগে আইএসআরও-তে আমরা আরইএক্স নিয়ে আলোচনা করার সময়ও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, একত্রে কর্মরত ভারতীয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের এই টেকনোলজিক্যাল ব্রেকথ্র অর্জনের সামর্থ্য রয়েছে। ভারত অতি নিশ্চিতভাবেই স্টেট-অব-দ্য-আর্ট টেকনোলজি অর্জন করতে পারে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আর এটা করার জন্য আমরা তিন স্তরের একটা কৌশল অবলম্বন করলাম-বহু প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ, কনসোর্টিয়াম মনোভাব, এবং প্রযুক্তির বলবৃদ্ধি। এই পাথরগুলো ঘষেই সৃষ্টি করা হয়েছিল অগ্নি।

৫০০-এরও বেশি বিজ্ঞানী নিয়ে অগ্নির দল গঠন করা হয়েছিল। এই বিপুল কর্মকান্ডের নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল অনেক প্রতিষ্ঠান। অগ্নি মিশনে ছিল দুটো মূল নিশানা-কাজ এবং কর্মী। প্রত্যেক সদস্য তার দলের অন্যান্য সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল ছিল নিজ লক্ষ্য পূরণের জন্য। পরস্পরবিরোধিতা বা বিভ্রান্তি ঘটা এমন অবস্থায় খুবই স্বাভাবিক। কিছু নেতা কাজ করিয়ে নেবার সময় কর্মীদের জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাও লালন করতেন, তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত পন্থায়। অন্যরা শুধু কাজ আদায়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতেন। তারা মানুষকে লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। কেউ কেউ কাজের প্রতি কম গুরুত্ব দেন, আর তাদের সঙ্গে কর্মরত লোকদের উষ্ণতা ও অনুমোদন প্রাপ্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু এই দল যা অর্জন করেছিল তা হলো মানব সম্পর্কের ও কর্মকুশলতার সম্ভব সর্বোচ্চ একীভবন।

সংশ্লিষ্টতা, অংশগ্রহণ ও অঙ্গীকার ছিল কর্মযোগের মূল কথা। দলের প্রত্যেক সদস্য কাজ করত এমনভাবে যেন নিজের পছন্দে কাজ করছে। অগ্নি উৎক্ষেপণের ব্যাপারটি আমাদের বিজ্ঞানীদের জন্য তো বটেই, এমনকি তাদের পরিবারগুলোর জন্যও ছিল বিশাল এক বাজি। ভিআর নাগরাজ ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইন্টিগ্রেশন দলের নেতা ছিলেন এমনই নিবেদিত প্রাণ প্রযুক্তিবিদ যে কাজের সময় খাওয়া এবং ঘুমের কথাও ভুলে যেতেন। তিনি আইটিআর-এ থাকাকালে তার ভগ্নিপতি মারা যান। তার পরিবার এই খবর নাগরাজের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছিল, যাতে করে তার কাজে কোনো বাধা না পড়ে।

অগ্নি উৎক্ষেপণের তারিখ নির্ধারিত ছিল ১৯৮৯ সালের ২০ এপ্রিল। এটা হতে যাচ্ছিল এক নজিরবিহীন মহড়া। মিসাইল উৎক্ষেপণের সঙ্গে জড়িত ছিল। ওয়াইড রেঞ্জিং নিরাপত্তার বিপদের আশঙ্কা, যার সঙ্গে স্পেস লঞ্চ ভেহিকলের কোনো মিল নেই। মিসাইল ট্রাজেক্টরি মনিটর করার জন্য কাজে লাগান হয়েছিল দুটো রাডার, তিনটে টেলিমেট্রি স্টেশন, একটা টেলিকমান্ড স্টেশন ও চারটে ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল ট্র্যাকিং ইস্ট্রমেন্ট। ভেহিকল ট্র্যাক করতে আরও নিযুক্ত করা হয়েছিল কার নিকোবর (আইএসটিআরএসি)-এ টেলিমেট্রি স্টেশন এবং এসএইচএআরের রাডারগুলো। ডাইনামিক সার্ভেইল্যান্স নিয়োগ করা হয়েছিল কন্ট্রোল সিস্টেম প্রেসার এবং বৈদ্যুতিক শক্তির দিকটা কভার করার জন্য যা ভেহিকলের মধ্যে মিসাইল ব্যাটারি থেকে প্রবাহিত হয়। ভোল্টেজে অথবা প্রেসারে অন্য কোনো গড়মিল লক্ষ্য করতে বিশেষভাবে ডিজাইন করা স্বয়ংক্রিয় চেকআউট সিস্টেম সংকেত দেবে Hold। ক্রটি মেরামতের পর ফ্লাইট অপারেশন পরিকল্পনা মাফিক চলবে। কাউন্টডাউন শুরু হবে টি-৩৬ ঘন্টায়। টি-৭.৫ মিনিট থেকে কাউন্টডাউন নিয়ন্ত্রিত হবে কম্পিউটারে।

.

উৎক্ষেপণের জন্য সকল প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে চলল শিডিউল অনুয়ায়ী। উৎক্ষেপণকালে নিকটবর্তী গ্রামবাসীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। এ বিষয়টা সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়ল, আর শুরু হয়ে গেল বিপুল বিতর্ক। ২০ এপ্রিল যখন এল, পুরো জাতির নজর তখন আমাদের ওপর।

ফ্লাইট ট্রায়াল বন্ধ করার জন্য বিদেশী চাপ এসেছিল কূটনৈতিক চ্যানেলের ভেতর দিয়ে, কিন্তু ভারত সরকার আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল পাথরের মতো। টি ১৪ সেকেন্ডের সময় কম্পিউটার সংকেত দিল Hold আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরও অসংখ্য Hold আসতে লাগল। উৎক্ষেপণ স্থগিত করতে হলো আমাদের অন বোর্ড পাওয়ার সাপ্লাই বদলানোর জন্য মিসাইল খুলে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল। এর মধ্যে পরিবারের একজনের মৃত্যুর খবর জানান হয়েছিল নাগরাজকে। ক্রন্দনরত নাগরাজ আমার সঙ্গে দেখা করলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি তিন দিনের মধ্যে ফিরে আসবেন। এইসব সাহসী মানুষদের কথা কোনো ইতিহাস গ্রন্থে কোনোদিন লেখা হবে না। কিন্তু এই রকম নীরব মানুষদের কঠোর পরিশ্রমেই দেশের উন্নতি হয়েছে। নাগরাজকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আমার দলের সবার সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করলাম যারা মানসিক আঘাত আর দুঃখে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। আমার এসএলভি-৩ এর অভিজ্ঞতার কথা তাদের বললাম। আমার লঞ্চ ভেহিকল পড়েছিল সমুদ্রে, কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে তা পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। আপনাদের মিসাইল তো আপনাদের চোখের সামনেই রয়েছে। প্রকৃত পক্ষে আপনারা কিছুই হারাননি, শুধু কয়েক সপ্তাহ আবার কাজ করতে হবে। তাদের অচলতাকে এটা আঁকুনি দিল এবং গোটা দল সাবসিস্টেমের সমস্যা সমাধানে ফিরে গেল।

সংবাদপত্র পিছু লেগে গেল দারুণভাবে। পাঠকের উদ্ভট কল্পনার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে ফ্লাইট স্থগিতের বিষয়টি তুলে ধরল। কার্টুনিস্ট সুধীর ধর স্কেচ আঁকলেন, একজন দোকানদার সেলসম্যানের কাছে একটা পণ্য ফেরত দিয়ে বলছে যে অগ্নির মতো এটাও চলবে না। আরেকজন কার্টুনিস্ট দেখালেন, অগ্নির একজন বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা করছেন যে উৎক্ষেপণ স্থগিতের কারণ প্রেস বাটন স্পর্শ করাই হয়নি। হিন্দুস্তান টাইমস দেখাল, একজন নেতা সাংবাদিকদের বলছেন, আতংকিত হবার কিছু নেই… এটা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ, অহিংস মিসাইল

পরবর্তী দশদিন ঘড়ির কাটা ধরে প্রতিটা মুহূর্তে বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর আমাদের বিজ্ঞানীরা মিসাইলটিকে ১৯৮৯ সালের ১ মে উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত করে ফেললেন। কিন্তু আবারও, টি-১০ সেকেন্ডে স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার চেকআউট পিরিয়ডের সময় একটা Hold সংকেত পাওয়া গেল। নিবিড় তদন্তে দেখা গেল, নিয়ন্ত্রণের অন্যতম অংশ এস১-টিভিসি ঠিকমতো কাজ করছে না। উৎক্ষেপণ আবারও স্থগিত করা হলো। এখন, এ ধরনের ঘটনা রকেট বিজ্ঞানে খুবই সাধারণ একটা বিষয় আর অন্যান্য দেশেও প্রায়ই ঘটে থাকে। কিন্তু প্রতীক্ষমান জাতির মেজাজ ছিল না আমাদের অসুবিধাগুলো বোঝার। হিন্দু পত্রিকায় মুদ্রিত কেশবের আঁকা একটা কানে দেখা গেল, একজন গ্রামবাসী কিছু কারেন্সি নোট গুনছে আর অপর একজনের কাছে মন্তব্য করছে: হ্যাঁ, এই হলো পরীক্ষা স্থলের নিকটবর্তী আমার কুটির থেকে সরে যাওয়ার খেসারত আরও কয়েকবার স্থগিতের ঘটনা ঘটলে নিজের জন্য একটা দালান তুলতে পারব…। আরেকজন কার্টুনিস্ট অগ্নিকে আখ্যা দিল আইডিবিএম-ইন্টারমিটেন্টলি ডিলেইড ব্যালিস্টিক মিসাইল। আমুলের কার্টুনে পরামর্শ দেওয়া হলো যে, অগ্নির যা করা দরকার তা হলো জ্বালানি হিসাবে তাদের বাটার ব্যবহার করা!

.

কিছুটা সময় আমি অবসর নিলাম, ডিআরডিএল-আরসিআইয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য আইটিআরে রেখে এলাম আমার দলকে। ১৯৮৯ সালের ৮ মে কর্ম ঘন্টা শেষ হওয়ার পর ডিআরডিএল-আরসিআইয়ের কর্মীরা জড়ো হয়েছিল। আমি বক্তৃতা দিলাম ২০০০-এরও বেশি ব্যক্তির জমায়েতে। অগ্নির মতো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম সুযোগ দেওয়া হয় খুব কমই। আমাদের বিশাল এক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বড়ো সুযোগের সঙ্গে সমানভাবে আসে বড়ো চ্যালেঞ্জও। আমাদের হাল ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয় আর আমরা সমস্যার কাছে মাথা নত করতে পারি না। দেশ আমাদের কাছে সফলতা আশা করে। এখন সাফল্যের জন্য লক্ষ্যস্থির করা যাক। আমার বক্তৃতা প্রায় শেষ করেছি, ঠিক তখন, আবিষ্কার করলাম আমার লোকদের আমি বলছি, আমি আপনাদের কাছে অঙ্গীকার করছি, এ মাস শেষ হবার আগেই সফলভাবে অগ্নি উৎক্ষেপণের পর আমরা ফিরে আসব।

দ্বিতীয় প্রচেষ্টার সময় যে অংশে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ অনুযায়ী কন্ট্রোল সিস্টেম নতুন করে ঘষেমেজে ঠিকঠাক করা হলো। এ কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল একটা ডিআরডিও-আইএসআরও দলের ওপর। তারা আইএমআরওর লিকুইড প্রোপেল্যান্ট সিস্টেম কমপ্লেক্স (এলপিএসসি)-এ ফাস্ট স্টেজ কন্ট্রোল সিস্টেম মেরামতির কাজ সম্পন্ন করল। বিপুল একাগ্রচিত্ততা ও ইচ্ছাশক্তির জোরে রেকর্ড সময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পূর্ণ করতে পারল তারা। এতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না যে শত শত বিজ্ঞানী ও কর্মী অবিরাম কাজ করে মাত্র ১০ দিনেই সিস্টেমটাকে প্রস্তুত করে ফেলল। এগারো তম দিনে পরিশোধিত কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়ে ত্রিবান্দ্রাম থেকে বিমান আকাশে উড়ল আর আইটিআরের কাছেই ল্যান্ড করল। কিন্তু এবার বাধা হয়ে উঠল শত্রুর মতো খারাপ আবহাওয়া। একটা ঘূর্ণীঝড়ের আশঙ্কা জোরদার হচ্ছিল। সমস্ত কর্মকেন্দ্র সংযুক্ত ছিল স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ও এইচএফ লিঙ্কের মাধ্যমে। দশ মিনিট বিরতিতে প্রবাহিত হতে শুরু করল আবহগত ডাটা।

শেষ পর্যন্ত উৎক্ষেপণের শিডিউল নির্ধারিত হলো ২২ মে ১৯৮৯। তার আগের রাতে ড. অরুণাচলম, জেনারেল কেএন সিং ও আমি একত্রে হাঁটছিলাম প্রতিরক্ষামন্ত্রী কেসি পন্তের সঙ্গে। উৎক্ষেপণ দেখতে তিনি আইটিআর-এ এসেছিলেন। রাতটা ছিল পূর্ণিমার, প্রচণ্ড জোয়ার ছিল সমুদ্রে এবং ঢেউ সগর্জনে আছড়ে পড়ছিল, যেন সেই মহাসর্বশক্তিমানের গৌরব ও ক্ষমতার গান গাইছিল। আমরা কি আগামীকাল অগ্নি উৎক্ষেপণে সফল হবো? এ প্রশ্ন ছিল আমাদের সবার মনেই, কিন্তু আমরা কেউই চন্দ্রালোকিত রাতের মোহিনী সৌন্দর্য্যের ঐন্দ্রজালিকা ভাঙতে চাইছিলাম না। দীর্ঘ। নীরবতার পর অবশেষে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কালাম! আগামীকাল অগ্নি উৎক্ষেপণের সাফল্যে কী রকম উৎসব করতে বলেন আপনি আমাকে? প্রশ্নটা ছিল সাধারণ, এর জবাব কী হতে পারে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে আমার মাথায় এল না। আমি কী চাই? আমার নেই কী? আর কী আছে যা আমাকে আরও সুখী করবে? আর তখনই আমি উত্তরটা খুঁজে পেলাম। আরসিআইতে লাগানোর জন্য আমাদের ১০০০০০ চারাগাছ প্রয়োজন, আমি বললাম। তার মুখ বন্ধুত্বের আভায় আলোকিত হয়ে উঠল। অগ্নির জন্য ধরিত্রী মাতার আশীর্বাদ কিনছেন আপনি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কেসি পন্ত সরস জবাব দিলেন। আগামীকাল আমরা সফল হবো, তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন।

পরদিন অগ্নি উৎক্ষিপ্ত হলো ০৭১৪ ঘন্টায়। উৎক্ষেপণটা ছিল নিখুঁত। একেবারে কেতাবি ট্রাজেক্টরি অনুসরণ করল মিসাইলটা। সমস্ত ফ্লাইট প্যারামিটার কাজ করল যথাযথ। ব্যাপারটা ছিল দুঃস্বপ্নময় ঘুম থেকে এক সুন্দর সকালে জেগে ওঠার মতো। পাঁচ বছর বিভিন্ন কেন্দ্রে অবিরাম কাজ করার পর অবশেষে আমরা লঞ্চ প্যাডে পৌঁছেছি। গত পাঁচ সপ্তাহে আমাদের বসবাস করতে হয়েছে ধারাবাহিক সংকটের ভেতর। সমস্ত ব্যাপারটা থামিয়ে দেওয়ার চাপ ছিল আমাদের ওপর সবখান থেকেই। সে চাপ আমরা সহ্য করেছিলাম। আর আমরা শেষ পর্যন্ত আমাদের কাজটা করতে পেরেছি। এটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম একটা মুহূর্ত। মিসাইলটার ৬০০ সেকেন্ড উড্ডয়ন এক মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের এতদিনের অবসাদ ধুয়ে দিল। আমাদের প্রচণ্ড শ্রমের বছরগুলোর কী বিস্ময়কর উত্থান। সেই রাতে আমার ডাইরিতে লিখেছিলাম:

Do not look at Agni
as an entity directed upward
to deter the ominous
or exhibit your might.
It is fire
in the heart of an Indian.
Do not even give it
the form of a missile
as it clings to the burning pride of this nation
and thus is bright.

প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী অগ্নির উৎক্ষেপণকে বললেন নিজস্ব উপায়ে। আমাদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষার অব্যাহত চেষ্টার এ এক বিশাল অর্জন। অগ্নির মাধ্যমে প্রদর্শিত প্রযুক্তি আমাদের জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য অগ্রসর প্রযুক্তির দেশীয় উন্নয়নের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন। আপনার প্রচেষ্টায় দেশ গর্বিত, তিনি আমাকে বললেন। প্রেসিডেন্ট ভেঙ্কটরমন অগ্নির সাফল্যে তার স্বপ্ন পূরণ দেখতে পেলেন। সিমলা থেকে তিনি তারবার্তা পাঠালেন, আপনার কঠিন পরিশ্রম, প্রতিভা আর আত্মোৎসর্গের এই হলো উপহার।

এই প্রযুক্তি মিশন সম্পর্কে ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক ভুল তথ্যের পর ভুল তথ্য। অগ্নি কখনই শুধুমাত্র পারমাণবিক অস্ত্র হিসাবে তৈরির উদ্দেশ্য ছিল না। দূর পাল্লার অপারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সামর্থ্য অর্জনটাও ছিল অন্যতম লক্ষ। সমকালীন রণকৌশলগত তত্ত্বের ক্ষেত্রে এটা আমাদের টেকসই অপারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারীও করেছিল।

১৪৯ অগ্নির টেস্ট ফায়ার বিশাল ক্রোধ সৃষ্টি করেছিল অনেকের মধ্যে। আমেরিকার একটা সুপরিচিত প্রতিরক্ষা জার্নালের প্রতিবেদনে তা প্রকাশিত হলো। যারা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে, বিশেষ করে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা, দ্বৈত-ব্যবহার উপযোগী ও মিসাইল সংশ্লিষ্ট সকল প্রযুক্তি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিলেন, সেই সঙ্গে বহুজাতিক সহযোগিতাও।

গ্যারি মিলহোলিন, একজন তথাকথিত মিসাইল ওয়ারহেড টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় দাবি করলেন যে ভারত পশ্চিম জার্মানির সাহায্য নিয়ে অগ্নি তৈরি করেছে। আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না যখন পড়লাম যে, জার্মান অ্যারোস্পেস রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্ট (ডিএলআর) তৈরি করেছে। অগ্নির গাইডেন্স সিস্টেম, ফাস্ট-স্টেজ রকেট, এবং একটা কম্পোজিট নোজ, আর অগ্নির অ্যারোডাইনামিক মডেল পরীক্ষা করা হয়েছিল ডিএলআরের উইন্ড টানেলে। ডিএলআরের পক্ষ থেকে এসব বক্তব্যের প্রতিবাদ আসতে বিলম্ব হলো না। বরং তারা অভিযোগ করল যে, আগ্নির গাইডেন্স ইলেকট্রনিকস সরবরাহ করেছে ফ্রান্স। মার্কিন সিনেটর জেফ বিঙ্গাম্যান এমনকি এত দূর পর্যন্ত বললেন যে, অগ্নির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু আমি চুরি করেছি ১৯৬২ সালে ওয়ালপস দ্বীপে আমার চার মাস অবস্থানকালে। তবে প্রকৃত যে কথাটি তিনি চেপে গেলেন তা হলো, ২৫ বছরেরও বেশি সময় আগে আমি যখন ওয়ালপস দ্বীপে ছিলাম তখনও পর্যন্ত অগ্নিতে যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে সে ধরনের প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রে ছিল না।

আজকের বিশ্বে প্রযুক্তিগত পশ্চৎপদতার সুযোগ নিয়ে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে অধীন করে। আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা কি এর সঙ্গে আপোস করতে পারি? এই হুমকির বিরুদ্ধে দেশের অবিচ্ছেদ্যতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের অপরিহার্য দায়িত্ব। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমাদের দেশের মুক্তি এনেছিলেন যে পূর্বপুরুষরা তাদের মহিমা কি আমরা উঁচুতে তুলে ধরব না? তাদের স্বপ্ন কেবল তখনই পরিপূর্ণ হবে যখন আমরা প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব।

অগ্নি উৎক্ষেপণ পর্যন্ত ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়েছিল আমাদের দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কঠোর প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালনের জন্য, আমাদের চারপাশের দেশগুলোর হাঙ্গামা থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রক্ষা করার জন্য, এবং বাইরের আক্রমণের উপযুক্ত জবাব দিতে। এখন অগ্নি তৈরি হওয়ায় ভারত এমন এক স্তরে উপনীত হলো যে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি সে প্রতিরোধ করার সক্ষমতা অর্জন করল।

আইজিএমডিপির পাঁচ বছরের কাজের পূর্ণতা ছিল অগ্নি। আমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে পৃথ্বী ও ত্রিশূল আগেই সংযোজিত হয়েছিল, নাগ ও আকাশ আমাদের নিয়ে যায় এমন স্তরে যেখানে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা খুবই সামান্য অথবা একেবারেই নেই। এই দুই মিসাইল সিস্টেম ছিল বিশাল প্রযুক্তিগত ব্রেকথ্র। এগুলোর ওপর আমাদের আরও দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন ছিল।

১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে বোম্বাইয়ের মহারাষ্ট্র একাডেমি অব সায়েন্সেস আমন্ত্রণ জানাল জওহরলাল নেহরু স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। একটা দেশীয় এয়ার-টু এয়ার মিসাইল, যেটার নাম দিয়েছিলাম অস্ত্র, তৈরি করার আমার পরিকল্পনা স্কুটননানুখ বিজ্ঞানীদের সামনে তুলে ধরার এ সুযোগ আমি কাজে লাগলাম। এই মিসাইলটি হবে ইন্ডিয়ান লাইট কমব্যাট এয়ারক্র্যাফটের (এলসি)-এর জোড়। আমি তাদের বললাম যে, নাগ মিসাইল সিস্টেমের জন্য ইমেজিং ইনফ্রা রেড (আইআইআর) এবং মিলিমেট্রিক ওয়েভ (এমএমডব্লিউ) রাডার টেকনোলজির ক্ষেত্রে আমাদের কাজ মিসাইল টেকনোলজিতে আন্তর্জাতিক ভ্যানগার্ডের আসনে বসিয়েছে আমাদের। রি-এন্ট্রি টেকনোলজি অর্জনের কার্বন-কার্বন ও অ্যাডভান্সড কম্পোজিট ম্যাটারিয়ালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিষয়ও আমি তাদের সামনে তুলে ধরলাম। অগ্নি ছিল একটা প্রযুক্তিগত প্রচেষ্টার ফলাফল যার শুরুটা করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, যখন দেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতার দীর্ঘ অসাড়তা ভেঙে বেরিয়ে আসার এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর অধস্থনতার মরা চামড়া ফেলে দেওয়ার।

১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে পৃথ্বীর দ্বিতীয় ফ্লাইটও সফল হলো। আজ বিশ্বের সেরা সারফেস-টু-সারফেস মিসাইল হিসাবে পৃথ্বী প্রমাণিত। এটা ২৫০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বহন করতে পারে ১০০০ কেজি ওয়ারহেড আর ৫০ মিটার রেডিয়াসের মধ্যে তা ডেলিভারি দিতে পারে। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পরিচালনার মাধ্যমে অসংখ্য ওয়ারহেডের ভার ও ডেলিভারির দূরত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি অনুযায়ী। সবদিক থেকে এটা শতভাগ দেশীয় ডিজাইন, পরিচালনা, মোতায়েন। প্রচুর সংখ্যায় এটা তৈরি করা সম্ভব, যেহতু বিডিএলের উৎপাদন সুবিধাও এটার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে। বহুগুণ। সেনাবহিনী এর গুরুত্ব দ্রুত ধরতে পেরেছিল। তারা সিসিপিএর কাছে আবেদন জানিয়েছিল পৃথ্বী ও ত্রিশূল মিসাইল সিস্টেমের প্লেসিং অর্ডারের জন্য, এটা ছিল এমন একটা ব্যাপার যা আগে আর কখনও ঘটেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *