১. উদ্‌গম [১৯৩১-১৯৬৩]

১. উদ্‌গম [১৯৩১-১৯৬৩]

এই পৃথিবী তার, ওই বিস্তীর্ণ ও সীমাহীন আকাশের তিনিই মালিক; তারই মধ্যে আছে মহাসাগর, আবার তিনি বিরাজ করেন ক্ষুদ্র জলাধারে।

অথর্ব বেদ
পরিচ্ছেদ ৪, স্তোত্র ১৬

.

পূর্বতন মাদ্রাজ রাজ্যের দ্বীপশহর রামেশ্বরমের একটি মধ্যবিত্ত তামিল পরিবারে আমার জন্ম। আমার বাবা, জয়নুলাবদিন, খুব বেশি দূর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতেন পারেননি। খুব বেশি ধনসম্পদও তার ছিল না। এসব অসুবিধা সত্ত্বেও তার ছিল বিপুল সহজাত জ্ঞান ও আত্মার খাঁটি বদান্যতা। আমার মা, আশিয়াম্মার। তার মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন এক আদর্শ সহধর্মীনি। মা প্রতিদিন যতজন লোককে খাওয়াতেন তাদের সঠিক সংখ্যা আমি মনে করতে পারব না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আমাদের পরিবারের মোট সদস্যের চেয়ে তাদের সংখ্যা হতো অনেক অনেক বেশি।

আদর্শ দম্পতি হিসাবে আমার মা-বাবার ছিল ব্যাপক মর্যাদা। আমার মা যে পরিবার থেকে এসেছিলেন সেই পরিবারটি ছিল অনেক বেশি সুখ্যাত, তার পূর্বপুরুষদের একজনকে বৃটিশরা বাহাদুর উপাধি প্রদান করেছিল।

অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চার মধ্যে আমি ছিলাম লম্বা ও সুদর্শন মা-বাবার অনুল্লেখ্য চেহারার খর্বকায় সন্তান। বংশানুক্রমিকভাবে আমাদের যে বাড়িটায় আমরা বাস করতাম সেটা নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯শ শতকের মধ্যভাগে। রামেশ্বরমের মস্ক স্ট্রিটে অবস্থিত ইট আর চুনাপাথরে তৈরি পাকা বাড়িটা ছিল যথেষ্ট বড়ো। আমার কঠোর আত্মসংযমী পিতা অনাবশ্যক আরামআয়েশ ও বিলাসিতা পরিহার করে চলতে অভ্যস্ত ছিলেন। তবে খাদ্য, ওষুধ অথবা বস্ত্রের মতো দরকারি সব বিষয় মেটানো হতো। বস্তুত, আমি বলব যে, আমার শৈশব ছিল নিরাপদ, আবেগ ও বিষয়গত দুদিক থেকেই।

রান্নাঘরের মেঝের ওপর বসে সাধারণত আমি মায়ের সঙ্গে আহার করতাম। আমার সামনে তিনি কলাপাতা রাখতেন, তার ওপর বেড়ে দিতেন ভাত এবং সুগন্ধী সাম্ভার, ঘরে তৈরি এক প্রকার আচার আর এক লোকমা টাটকা নারকেলের চাটনি।

রামেশ্বরম যে কারণে ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের কাছে অতি পবিত্র বলে গণ্য হতো সেই বিখ্যাত শিব মন্দিরটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বে। আমাদের এলাকাটি ছিল ব্যাপকভাবে মুসলমান অধ্যুষিত, তবে কিছু সংখ্যক হিন্দু পরিবারও ছিল, সম্প্রীতির সঙ্গে মুসলমান পড়শিদের সঙ্গে বসবাস করত তারা। আমাদের মহল্লায় অনেককালের পুরোনো একটা মসজিদও ছিল, সন্ধ্যাবেলার প্রার্থনার জন্য আমাকে সেখানে নিয়ে যেতেন বাবা। আরবীতে উচ্চারিত প্রার্থনার অর্থ সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না, কিন্তু আমার পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল যে তা স্রষ্টার কাছে পৌঁছাত। প্রার্থনার পর আমার বাবা কখন বেরিয়ে আসবেন তার অপেক্ষায় বাইরে বসে থাকত নানা ধর্মের লোকজন, তার জন্য অপেক্ষা করত তারা। তাদের অনেকে পানির পাত্র এগিয়ে দিত তার দিকে, বাবা সে সব পাত্রের পানিতে আঙুলের ডগা ডুবিয়ে দোয়া পড়তেন। এই পানি তখন তারা যে যার বাড়িতে নিয়ে যেত অসুস্থ লোকদের জন্য। সুস্থ হয়ে ওঠার পর লোকজন ধন্যবাদ জানাতে আসত আমাদের বাড়িতে সে কথাও আমার মনে পড়ে। আমার বাবা সবসময় হাসতেন আর তাদের বলতেন সর্বদয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে।

রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত, পক্ষী লক্ষ্মণা শাস্ত্রী, ছিলেন আমার বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই ব্যক্তিদ্বয় সম্পর্কে আমার শৈশবের প্রথম দিককার বর্ণাঢ্য স্মৃতিগুলোর একটা হচ্ছে, নিজ নিজ ঐতিহ্যগত দৃষ্টিকোণ থেকে তারা আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনায় মগ্ন থাকতেন। প্রশ্ন করার মতো বড়ো হয়ে ওঠার পর, বাবার কাছে আমি প্রার্থনার প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে জানতে চাই। বাবা আমাকে বলেন, প্রার্থনার মধ্যে রহস্যের কিছুই নেই। বরং লোকজনের মধ্যে পারস্পরিক আধ্যাত্মিক যোগাযোগ সম্ভব হয় প্রার্থনার মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, তুমি যখন প্রার্থনা করো, তখন তুমি তোমার দেহের সীমা অতিক্রম করে যাও, আর পরিণত হও মহাজগতের অংশে, যা ধনদৌলত, বয়স, জাতপাত কিংবা লোভের কোনো বিভাজন মানে না।

.

আমার বাবার সাধ্য ছিল জটিলতম আধ্যাত্মিক ধারণাগুলো সহজ ভাষায়, একেবারে সাদামাটা তামিলে বর্ণনা করার। একবার তিনি আমাকে বলেন, নিজের সময়ে, নিজের জায়গায়, প্রকৃতই নিজে যা, এবং যে স্তরে পৌঁছেছে-ভালো বা খারাপ-তাতে।চিরন্তন সত্ত্বার সমগ্রতার মধ্যে প্রতিটা মানুষই হচ্ছে নির্দিষ্ট উপাদান। সুতরাং অসুবিধা, ভোগান্তি আর সমস্যাসংকট নিয়ে উল্কণ্ঠা কেন? সমস্যা যখন আসবে তখন তোমার ভোগান্তির প্রাসঙ্গিকতা বোঝার চেষ্টা করো। দুঃখদুর্দশা সর্বদা অন্তদৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি করে।

তোমার কাছে যারা সাহায্য ও উপদেশ নিতে আসে তাদের কেন এ কথা বলো না? বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করি। তিনি আমার কাঁধে হাত রাখেন আর সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকান। কিছুক্ষণ তিনি কিছুই বলেন না, যেন তার কথা উপলব্ধি করার সামর্থ্য আমার আছে কিনা বিচার করছিলেন। তারপর তিনি নিচু, গভীর কণ্ঠস্বরে জবাব দিলেন। তার উত্তর অদ্ভুত এক শক্তি আর প্রবল আগ্রহে আমাকে পরিপূর্ণ করে তুলল:

মানুষ যখনই নিজেকে নিঃসঙ্গ দেখতে পায়, তখন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে সে সঙ্গি খুঁজতে শুরু করে। যখনই তারা কোনো সমস্যায় পড়ে, তখনই কাউকে খুঁজতে থাকে যে তাদের সাহায্য করতে পারবে। যখনই তারা কোনো কানাগলিতে পৌঁছায়। তখনই এমন কাউকে খুঁজতে থাকে যে তাদের। বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পারবে। প্রতিটা পৌনঃপুনিক মানসিক বা শারীরিক যন্ত্রণা, আকুল আকাঙ্ক্ষা, এবং কামনা খুঁজে পায় নিজের বিশেষ সাহায্যকারি। নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে যারা আমার কাছে আসে তাদের ক্ষেত্রে বলতে গেলে আমি একজন মধ্যগ, প্রার্থনার ভেতর দিয়ে অশুভ শক্তির হাত থেকে তাদের নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টার মধ্যে। এটা মোটেও সঠিক পথ নয় এবং এটা কখনও অনুসরণ করা উচিৎ নয়। ভাগ্যের ভীতিতাড়িত দৃশ্য এবং আমাদের আত্মতৃপ্তির শত্রুকে খুঁজে বের করতে যা আমাদের সমর্থ করে সেই দৃশ্যের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা মানুষকে অবশ্যই বুঝতে হবে।

আমার মনে পড়ে সূর্যোদয়ের আগে, নামাজ আদায়ের ভেতর দিয়ে আমার বাবা তার দিন শুরু করতেন ভোর ৪টায়। নামাজ শেষে তিনি পায়ে হেঁটে আমাদের ছোটো নারকেল বাগানে যেতেন, আমাদের বাড়ি থেকে বাগানটা ছিল প্রায় ৪ মাইল দূরে। এক সঙ্গে বাঁধা প্রায় এক ডজন নারকেল কাঁধে নিয়ে তিনি ফিরে আসতেন, এরপরই নাশতা খেতেন। বয়স ষাট বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এই ছিল তার রুটিন।

আমি সারা জীবন ধরে আমার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতের ভেতর দিয়ে চেষ্টা। করেছি বাবার সমকক্ষ হতে। যে মৌলিক সত্য বাবা আমার কাছে উন্মোচন করেছিলেন তা বোঝার জন্য আমি প্রবল চেষ্টা করেছি, আর এই বিশ্বাস অনুভব করেছি যে ঐশ্বরিক শক্তি বলে কোনো সত্ত্বা রয়েছে, যে সত্ত্বা মানুষকে বিভ্রম, দুর্দশা, বিষণ্ণতা ও ব্যর্থতা থেকে তুলে নিতে পারে এবং পথ প্রদর্শন করে মানুষকে তার প্রকৃত স্থানে নিয়ে যেতে পারে এবং একবার যদি কোনো ব্যক্তি তার আবেগ ও শরীরগত দাসত্বকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, তাহলেই সে পেয়ে যায় মুক্তি, সুখ ও মানসিক প্রশান্তির পথ।

আমার বাবা যখন রামেশ্বরম থেকে ধানুসকোডি (সেথুক্কারাই নামেও পরিচিত) পর্যন্ত ধর্মযাত্রা করে ফিরে আসার জন্য একটা কাঠের নৌকা তৈরি করার পরিকল্পনা নিলেন, তখন আমার বয়স প্রায় ছয় বছর। আহমেদ জালালুদ্দিন নামের এক আত্মীয়ের সহায়তা নিয়ে আমার বাবা নৌকাটি নির্মাণ করছিলেন সাগরতীরে। জালালুদ্দিন পরে আমার বোন জোহরাকে বিয়ে করেছিল। আমি লক্ষ করি নৌকাটি আকার নিচ্ছে। কাঠের আগুনের উত্তাপ দিয়ে পানিরোধক বেষ্টনী ও কাঠাম টেকসই করা হয়েছিল। আমার বাবার নৌকা নির্মাণের কাজ ভালোই এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু একদিন ঘন্টায় ১০০ মাইল গতিবেগের সাইক্লোন সেথুক্কারাইয়ের আরও কিছু জিনিসের সঙ্গে আমাদের নৌকাটিও উড়িয়ে নিয়ে গেল। যাত্রীবোঝাই ট্রেন নিয়ে ভেঙে পড়ল পাষান ব্রিজ। এ ঘটনার আগ পর্যন্ত আমি কেবল সমুদ্রের সৌন্দর্যই দেখেছিলাম, এখন এর অনিয়ন্ত্রণযোগ্য শক্তি একটা রহস্যের প্রকাশ হিসাবে দেখা দিল আমার কাছে।

.

নৌকাটির অসময়ে সমাপ্তি যতদিনে ঘটল, ততদিনে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে আহমেদ জালালুদ্দিন, বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও। সে আমার চেয়ে প্রায় ১৫ বছরের বড়ো ছিল আর আমাকে আজাদ নামে ডাকত। প্রতি সন্ধ্যায় এক সঙ্গে আমরা অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটতে বেরোতাম। মস্ক স্ট্রিট থেকে হাঁটতে আরম্ভ করে আমরা দ্বীপের বালুময় তীরের দিকে এগিয়ে যেতাম, ওই সময়টায়, জালালুদ্দিন ও আমি কথা বলতাম প্রধানত আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে। নানারকম তীর্থের কারণে ওই ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করার মতোই পরিবেশ ছিল রামেশ্বরমে। আমরা প্রথমে এসে থামতাম শিব মন্দিরে। এই মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে, দেশের দূরতম প্রান্ত থেকে আসা যে কোনো তীর্থযাত্রীর মতো আমরাও, অনুভব করতাম যেন আমাদের ভেতর দিয়ে শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে।

স্রষ্টা সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলত জালালুদ্দিন যেন স্রষ্টার সঙ্গে তার কাজের অংশীদারিত্ব ছিল। তার সমস্ত সন্দেহ সে স্রষ্টার কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করত যেন সে সব নিরসন করার জন্য স্রষ্টা খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি অপলকে তাকিয়ে থাকতাম জালালুদ্দিনের দিকে। তারপর তাকাতাম মন্দিরের চারপাশে জড়ো হওয়া তীর্থযাত্রীদের বিশাল ভিড়ের দিকে, তারা সমুদ্রে পূণ্যস্নান করছে, আচারঅনুষ্ঠান পালন করছে এবং প্রার্থনা উচ্চারণ করছে শ্রদ্ধার মনোভাব নিয়ে সেই একই অজ্ঞাতের উদ্দেশ্যে, যাকে আমরা নিরাকার সর্বশক্তিমান হিসাবে মান্য করি। আমি কখনও সন্দেহ করিনি যে আমাদের মসজিদের প্রার্থনা যেখানে পৌঁছায়, সেই একই গন্তব্যে পৌঁছায় মন্দিরের প্রার্থনাও। আমি শুধু বিস্ময়ে ভাবতাম যে স্রষ্টার সঙ্গে জালালুদ্দিনের অন্য আর কোনো বিশেষ যোগাযোগ আছে কিনা। জালালুদ্দিনের বিদ্যালয়ের লেখাপড়া ছিল সীমিত, প্রধানত তাদের পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে। হয়তো এ কারণেই আমার লেখাপড়া অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সে আমাকে সবসময় উৎসাহ জোগাত আর দারুণ আনন্দে উপভোগ করত আমার সাফল্য। নিজের ভাগ্য বিড়ম্বনার জন্য জালালুদ্দিনকে কখনও আফসোস করতে দেখিনি আমি। বরং জীবন তাকে যা দিয়েছে তাতেই পূর্ণ কৃতজ্ঞ ছিল সে সবসময়।

ঘটনাক্রমে যে সময়ের কথা আমি বলছি, সেই সময়ে সারা দ্বীপে সে ছিল। একমাত্র ব্যক্তি যে ইংরেজি লিখতে পারত। প্রয়োজন হলে যে-কোনো লোকের চিঠি লিখে দিত সে। আমার পরিবারে কিংবা প্রতিবেশিদের মধ্যেও জালালুদ্দিনের সমান। শিক্ষা ছিল না অথবা বাইরের দুনিয়ার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গেও কোনো যোগ ছিল না। কারো।

জালালউদ্দিন সবসময় আমাকে বলত শিক্ষিত লোকজন সম্পর্কে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্পর্কে, সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে, এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের অর্জনগুলো সম্পর্কে। আমাদের সংকীর্ণ পরিবেশের বাইরে একটা সাহসী, নতুন দুনিয়া সম্পর্কে সেই আমাকে সচেতন করে তুলেছিল।

আমার শৈশবের দীনহীন পরিবেশে বই ছিল এক দুর্লভ বস্তু। স্থানীয় অবস্থার তুলনায়, যাহোক, এসটিআর মানিকাম-এর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটা ছিল বেশ বড়ো। এই মানিকাম ছিল একজন সাবেক বিপ্লবী কিংবা উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী। যতটা পারি পড়ার জন্য সে আমাকে উৎসাহ যোগাত এবং প্রায়ই আমি বই ধার নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে যেতাম।

আরেক ব্যক্তি যে আমার শৈশবের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল সে হচ্ছে আমার প্রথম চাচাত ভাই শামসুদ্দিন। রামেশ্বরমে সে ছিল সংবাদপত্রের একমাত্র পরিবেশক। পাষান থেকে সকালের ট্রেনে রামেশ্বরম স্টেশনে এসে পৌঁছোত সংবাদপত্রগুলো। শামসুদ্দিনের সংবাদপত্র এজেন্সি ছিল একক ব্যক্তির একটা সংগঠন। রামেশ্বরম শহরের এক হাজার শিক্ষিত মানুষের পড়ার চাহিদা মেটাতে সে। এই সংবাদপত্রগুলো প্রধানত কেনা হতো জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চলমান অগ্রগতি সম্পর্কে টাটকা খবরাখবর জানার জন্য। এছাড়াও রাশিফল ইত্যাদি জানাও ছিল পাঠকের লক্ষ। বহুজাতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন কিছু পাঠক আলোচনা করত হিটলার, মহাত্মা গান্ধী ও জিন্নাহকে নিয়ে। সবকিছুই শেষ পর্যন্ত একটা বিষয়ের দিকেই ধাবিত হতো আর সেটা হলো উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে। পেরিয়ার ইভি রামস্বামীর আন্দোলনের বিপুল রাজনৈতিক প্রবাহ। দিনমনি ছিল সর্বাধিক বিক্রিত সংবাদপত্র। যেহেতু মুদ্রিত বিষয় পড়ার সামর্থ্য তখনও আমার হয়নি, তাই শামসুদ্দিন তার গ্রাহকদের কাছে সংবাদপত্রগুলো বিলি করার আগে সেগুলোয় প্রাকশিত ছবিতে নজর বুলিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট হতে হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে, তখন আমার বয়স আট বছর। কখনই আমি বুঝতে পারিনি এমন সব কারণে বাজারে হঠাৎ করেই বেড়ে গেল তেঁতুলবিচির চাহিদা। আমি তেঁতুলবিচি সংগ্রহ করে মস্ক স্ট্রিটের একটা দোকানে বিক্রি করতে থাকি। এক দিনের সংগ্রহে যে এক আনা দাম পেতাম তাতেই নিজেকে রাজকুমার মনে হতো। যুদ্ধ সম্পর্কে জালালুদ্দিন আমাকে গল্প শোনাত, পরে তার চিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাতাম আমি দিনমন্ত্রি সংবাদ-শিরোনামে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আমাদের এলাকা পুরোপুরিভাবে যুদ্ধের প্রভাবমুক্ত ছিল। কিন্তু খুব শীঘ্রই মিত্রবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হলো ভারত এবং জরুরি অবস্থার মতো একটা ঘোষণা দেওয়া হলো। রামেশ্বরম স্টেশনে ট্রেন না থামার অনিশ্চয়তা হিসাবে প্রথম ক্ষয়ক্ষতি দেখা দিল। সংবাদপত্রগুলো এখন বান্ডিল করে চলন্ত ট্রেন থেকে ছুঁড়ে দেওয়া হতো রামেশ্বরম ও ধানুসকোডির মধ্যবর্তী রামেশ্বরম রোডে। এর ফলে বান্ডিল ধরার কাজে একজন সাহায্যকারী খুঁজে নিতে বাধ্য হলো শামসুদ্দিন আর, যেন স্বাভাবিকভাবেই, আমাকেই নিয়োগ করা হলো ওই কাজে। এভাবে আমার প্রথম রোজগার অর্জনে সাহায্য করল শামসুদ্দিন। অর্ধশতাব্দী পর, এখনও আমি প্রথমবারের মতো নিজের অর্থ উপার্জনের সেই গর্ব অনুভব করি।

প্রতিটা শিশুই কিছু পরিমাণ বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। একটা নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক ও আবেগপূর্ণ পরিবেশে, আর নির্দিষ্ট পন্থায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় কর্তাপক্ষীয় ব্যক্তিদের দ্বারা। আমি বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছিলাম সততা ও আত্ম-শৃঙখল; মায়ের কাছ থেকে ধার্মিকতা ও গভীর দয়ালুতার বিশ্বাস। আমার মতো আমার তিন ভাই ও বোনও এসব পেয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। কিন্তু জালালুদ্দিন ও শামসুদ্দিনের সঙ্গে যে সময় আমি কাটিয়েছিলাম, সেই সময়ই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল আমার শৈশবের অনন্যতায়, এবং আমার পরবর্তী জীবনে সকল পার্থক্য রচনা করে দিয়েছিল।

শৈশবে আমার তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল-রামানাধা শাস্ত্রী, অরবিন্দন ও শিবপ্রকাশন। এরা ছিল গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। শিশু ছিলাম বলেই আমাদের ধর্মীয় পার্থক্য ও লালনপালন থেকে সৃষ্ট কোনো পার্থক্যই নিজেদের মধ্যে আমরা কেউই অনুভব করতাম না। বস্তুত রামানাধা শাস্ত্রী ছিল পক্ষী লক্ষ্মণ শাস্ত্রীর ছেলে, পক্ষী ছিলেন রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। পরে রামানাধা রামেশ্বরম মন্দিরের পৌরহিত্যের দায়িত্ব নিয়েছিল তার বাবার কাছ থেকে, সফররত তীর্থযাত্রীদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থার ব্যবসায় জড়িয়েছিল অরবিন্দন এবং শিবপ্রকাশন ক্যাটারিং কন্ট্রাক্টর হিসাবে কাজ নিয়েছিল সাউদার্ন রেলওয়েজে।

বার্ষিক শ্রীসীতারামকল্যাণম উৎসব চলাকালে আমাদের পরিবার মন্দির থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে প্রভুর প্রতীক নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে তৈরি পাটাতনযুক্ত নৌকার ব্যবস্থা করত, অনুষ্ঠানস্থলটি ছিল পুকুরের মাঝখানে আর ঐ জায়াগটিকে বলা হতো রামতীর্থ, জায়গাটা ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছেই। আমার মা ও দাদী রাতের বেলা বিছানায় আমাদের পরিবারের বাচ্চাদের রামায়ণ থেকে নানা কাহিনি এবং রসুলের জীবনের নানা গল্প শোনাতেন। রামেশ্বরম এলিমেন্টারি স্কুলে আমি যখন ফিফথ-স্টান্ডার্ড এর ছাত্র তখন একদিন নতুন এক শিক্ষক এলেন আমাদের ক্লাসে। আমি একটা টুপি পরতাম মাথায় যাতে করে বোঝা যেত আমি একজন মুসলিম এবং আমি সবসময় সামনের সারিতে রামানাধা শাস্ত্রীর পাশে বসতাম, সে একটা পৈতে পরত। মুসলিম এক বালকের সঙ্গে একজন হিন্দু পুরোহিতের পুত্র বসবে তা সহ্য করতে পারলেন না নতুন শিক্ষক। তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আমাদের সামাজিক মর্যাদা মোতাবেক আমাকে বলা হলো উঠে গিয়ে পেছনের বেঞ্চিতে বসতে। আমি খুব দুঃখ অনুভব করলাম, আর রামানাধা শাস্ত্রীও দুঃখ পেল। পেছনের সারিতে যখন আমি চলে গেলাম তখন সে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। পেছনের সারিতে আমি চলে যাবার সময় তার কান্নার দৃশ্য একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে রাখলো আমার মনের ওপর।

স্কুল শেষ হবার পর আমরা বাড়ি ফিরে গেলাম আর আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবামাকে এই ঘটনা সম্পর্কে বললাম। লক্ষ্মণা শাস্ত্রী ঐ শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন এবং আমাদের উপস্থিতিতে তাকে বললেন যে নির্দোষ শিশুদের অন্তরে সামাজিক অসাম্য ও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়ানো তার উচিৎ নয়। তিনি শিক্ষককে বললেন হয় ক্ষমা চাইতে নয়তো স্কুল ছেড়ে দিয়ে দ্বীপ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে। শিক্ষক শুধু তার ব্যবহারের জন্যেই দুঃখ প্রকাশ করলেন তা নয় লক্ষ্মণা শাস্ত্রীর সুদৃঢ় মনোভাব তার মনটাকে সংস্কারও করে দিলো।

সামগ্রিকভাবে রামেশ্বরমের ছোটো সমাজটি ছিল বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষদের নিয়ে গঠিত। যাই হোক, আমার বিজ্ঞান শিক্ষক শিবসুবামানিয়া আয়ার ছিলেন এক ধরনের বিদ্রোহী, যদিও তিনি নিজে ছিলেন গোড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের এবং তার স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল। সামাজিক বাধাগুলো ভেঙে ফেলার জন্য তিনি সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়েছিলেন যাতে করে বিভিন্ন স্তরের লোকজন সহজভাবে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে। তিনি আমার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতেন এবং বলতেন, কালাম, আমি তোমার উন্নতি চাই যাতে করে বড়ো শহরের উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তুমি অবস্থান করতে পারো।

একদিন তিনি আমাকে তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। তার স্ত্রী ধর্মীয়ভাবে পবিত্র তার রান্নাঘরে বসে খাওয়ার জন্য একজন মুসলমান বালককে নিমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে এই চিন্তায় আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। রান্নাঘরে তিনি আমাকে খাবার দিতে অস্বীকার করলেন। শিবসুব্রামানিয়া আয়ার মোটেও থমকে গেলেন না, স্ত্রীর প্রতি রাগও করলেন না, বরং তিনি আমাকে নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করলেন এবং খাবার খাওয়ার জন্য আমার পাশেই বসে পড়লেন। তার স্ত্রী রান্নাঘরের দরজার পেছন থেকে আমাদের লক্ষ্য করতে লাগলেন। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবলাম যেভাবে আমি ভাত খেলাম, পানি পান করলাম কিংবা খাবার পর মেঝে পরিষ্কার করলাম তার মধ্যে কোনো পার্থক্য তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন কিনা। তার বাড়ি থেকে চলে আসার সময় শিবসুব্রামানিয়া আয়ার আবারও তার সঙ্গে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন আমাকে পরের সপ্তাহান্তে। আমার ইতস্ততভাব লক্ষ করে তিনি আমাকে হতাশ হতে নিষেধ করে বললেন, একবার যদি তুমি প্রথা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নাও, তাহলে এ ধরনের সমস্যা তোমাকে মোকাবেলা করতে হবে। পরের সপ্তাহে আমি যখন তার বাড়িতে গেলাম, শিবসুব্রামানিয়া আয়ারের স্ত্রী আমাকে তার রান্নাঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন এবং নিজের হাতে আমাকে খাবার দিলেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল। আর ভারতের স্বাধীনতাও ছিল অত্যাসন্ন। ভারতীয়রা নিজেরাই নির্মাণ করবে নিজেদের ভারত, ঘোষণা দিলেন গান্ধীজী। এক অপরিমেয় আশাবাদে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল সারা দেশ। জেলা সদর রামনাথপুরম-এ গিয়ে লেখাপড়ার জন্য রামেশ্বরম ত্যাগ করার অনুমতি চাইলাম আমি বাবার কাছে।

.

যেন সশব্দে চিন্তা করছেন এমনভাবে তিনি বললেন, আবুল! আমি জানি বড়ো হবার জন্য তোমাকে দূরে যেতে হবে। সূর্যের নীচে কি সিগাল ওড়ে না, একাকী ও বাসাহীন? তোমার বিশাল আকাঙ্ক্ষার স্থানে পৌঁছানোর জন্য তোমার স্মৃতির দেশের প্রতি তোমার আকুল আকাক্ষা অবশ্যই তুমি ছাড়িয়ে যাবে, আমাদের ভালোবাসা তোমাকে বঁধবে না আর আমাদের প্রয়োজনও তোমাকে আটকে রাখবে না। কাহলিল জিবরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আমার দ্বিধাগ্রস্থ মাকে বললেন, তোমার সন্তান তোমার নয়। তারা জীবনের পুত্র ও কন্যা। তারা। তোমার ভেতর দিয়ে এসেছে কিন্তু তোমার থেকে আসেনি। তুমি তাকে হয়তো তোমার ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমার চিন্তা দিতে পার না। যেহেতু তাদের নিজস্ব চিন্তা আছে।

তিনি আমাকে ও আমার তিন ভাইকে মসজিদে নিয়ে গেলেন এবং পবিত্র কুরআন থেকে সুরা আল ফাতিহা পাঠ করলেন। রামেশ্বরম স্টেশনে ট্রেনে আমাকে তুলে দিয়ে তিনি বললেন, এই দ্বীপ হয়তো তোমার দেহের আবাস হতে পারে কিন্তু তোমার আত্মার নয়। তোমার আত্মা বাস করে আগামীর বাড়িতে যেখানে রামেশ্বরমের আমরা কেউই যেতে পারি না, এমনকি আমাদের স্বপ্নেও নয়। স্রষ্টা তোমার মঙ্গল করুন, আমার বাছা!

শামসুদ্দিন ও আহমেদ জালালুদ্দিন রামনাথপুরম পর্যন্ত আমার সঙ্গে এলো আমাকে শোয়ার্টজ হাই স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া এবং সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। রামনাথপুরম ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের একটা দুর্দান্ত শহর, কিন্তু রামেশ্বরমের বৈচিত্র্য এবং সুসঙ্গতি সেখানে ছিল অনুপস্থিত। আমি বাড়ির অভাব খুবই অনুভব করতাম আর রামেশ্বরমে যাবার প্রতিটা সুযোগই আঁকড়ে ধরতাম। রামনাথপুরমে শিক্ষা সুযোগের টান মোটেও জোরালো ছিল না অন্তত আমার মায়ের তৈরি দক্ষিণ ভারতীয় মিষ্টি পোলির আকর্ষণের চেয়ে। বস্তুত বারো প্রকার এই মিষ্টি তিনি তৈরি করতে পারতেন, যেসব উপাদান দিয়ে মা এই মিষ্টি তৈরি করতেন তার প্রত্যেকটার আলাদা সৌরভ বের করে আনার সামর্থ্য ছিল তার।

আমার গৃহকাতরতা সত্ত্বেও নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আমি দৃঢ়চিত্ত ছিলাম, কারণ আমি জানতাম বাবা আমার সাফল্য সম্পর্কে বিপুল আশা করেছিলেন। বাবা আমাকে কালেক্টর হিসাবে কল্পনা করেছিলেন এবং আমি ভেবেছিলাম বাবার স্বপ্ন বাস্তব করে তোলা আমার কর্তব্য, যদিও রামেশ্বরমের আরাম আয়েশ, নিরাপত্তা ও পরিচিত বলয়ের অভাব আমি দুর্দান্তভাবে অনুভব করছিলাম।

ইতিবাচক চিন্তাশক্তি সম্পর্কে জালালুদ্দিন আমার সঙ্গে কথা বলত এবং আমি প্রায়ই গৃহকাতরতা অথবা বিষণ্ণতা অনুভব করলে তার সেই কথাগুলো স্মরণ করতাম। যেমনটা সে বলেছিল তা করার জন্য আমি কঠিন চেষ্টা করতাম, তাতে আমার চিন্তা ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম, এবং তাতে আমার লক্ষ্যের ওপর প্রভাব পড়ত। ভাগ্যের ব্যাপার হলো, সেই লক্ষ্য আমাকে রামেশ্বরমে ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি, বরং আমাকে আরও অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমার শৈশবের বাড়ি থেকে।

.

২.

রামনাথপুরমে শোয়ার্টজ হাই স্কুলে আমি একটু গুছিয়ে নেবার পর আমার ভেতরের পনেরো-বছর-বয়স্ক মানুষটা আবার জেগে উঠল। আমার শিক্ষক, ইয়াজুরাই সলোমন, ছিলেন তরুণ মনের জন্য এক আদর্শ গাইড, যে মন তখনও জানে না তার সামনে কী রকম সম্ভাবনা আর বিকল্প ধারা পড়ে আছে। নিজের উষ্ণ ও খোলামেলা মনোভা দিয়ে ক্লাসে তিনি তার ছাত্রদের মনে স্বস্তি জাগিয়ে তুলতেন। তিনি বলতেন যে একজন খারাপ ছাত্র একজন দক্ষ শিক্ষকের কাছ থেকে যা শিখতে পারে তার চেয়ে একজন ভালো ছাত্র একজন খারাপ শিক্ষকের কাছ থেকে অনেক বেশি শিখতে পারে।

রামনাথপুরমে আমার অবস্থানকালে তার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল তা ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার সাহচর্যে আমি শিখেছিলাম যে, যে-কোনো ব্যক্তি তার নিজের জীবনের ঘটনাবলীর ওপর বিপুল প্রভাব খাটানোর অনুশীলন আয়ত্ব করতে পারে। ইয়াড়রাই সলোমন বলতেন, জীবনে সফল হতে হলে আর ফলাফল অর্জন করতে হলে, তোমাকে অবশ্যই তিনটে প্রবল শক্তি সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে আর সেগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে-আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস, আর প্রত্যাশা।

ইয়াড়রাই সলোমন, পরবর্তীকালে যিনি হয়েছিলেন একজন রেভারেন্ড, আমাকে শিখিয়েছিলেন যে কোনো কিছু ঘটুক বলে আমি যা চাই তার আগে আমাকে তা কামনা করতে হবে এবং আমাকে পূর্ণ নিশ্চিত থাকতে হবে যে তা ঘটবে। আমার নিজের জীবন থেকেই একটা উদাহরণ টানা যেতে পারে। একেবারে শৈশবকালে আমি মোহাবিষ্ট হতাম আকাশের রহস্যময়তায় ও পাখিদের উড্ডয়নে। আমি সারস ও সীগালের উড্ডয়ন লক্ষ্য করতাম আর ওড়ার জন্য আকুল হতাম। যদিও মফঃস্বলের বালক ছিলাম, তবুও আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে এক দিন আমিও আকাশে ভাসব। প্রকৃত পক্ষে আমি ছিলাম রামেশ্বরমের প্রথম শিশু যে আকাশে উড়েছিল।

ইয়াড়রাই সলোমন ছিলেন এক মহান শিক্ষক, কারণ সমস্ত বাচ্চাদের মধ্যে তাদের নিজেদের মূল্য সম্পর্কে একটা বোধ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সলোমন আমার আত্মশক্তি উঁচুতে তুলে দিয়েছিলেন আর আমাকে প্রভাবিত করেছিলেন, আমি তো ছিলাম সেই মা-বাবার সন্তান শিক্ষার সুবিধা থেকে যারা বঞ্চিত হয়েছিলেন, তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে যা ইচ্ছা করি তা হবার সামর্থ্য আমার আছে। মনে বিশ্বাস থাকলে, তোমার ভাগ্য তুমি পরিবর্তন করতে পারবে, তিনি বলতেন।

একদিন, আমি তখন ফোর্থ ফর্মে পড়ি, আমার গণিত শিক্ষক রামকৃষ্ণ আয়ার অন্য এক ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন। অন্যমনস্কতার কারণে আমি ওই শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ি আর পুরাতন প্রথা অনুযায়ী রামকৃষ্ণ আয়ার আমার ঘাড় চেপে ধরেন আর পুরো ক্লাসের সামনে আমাকে বেত মারেন। বেশ কয়েক মাস পর, যখন গণিতে আমি ফুল মার্ক পেয়েছি, সকালের অ্যাসেম্বলিতে গোটা স্কুলের সামনে ঘটনাটা বর্ণনা করে তিনি ব্যাখ্যা দিলেন। যাকেই আমি বেত মারি সেই মহান ব্যক্তিতে পরিণত হয়। আমার কথাটা মনে রেখ তোমরা, এই ছেলেটা তার স্কুল ও শিক্ষকদের জন্য গৌরব বয়ে আনবে। আগের যন্ত্রণা উপশম হয়েছিল তার এই প্রশংসায়!

শোয়ার্টজ-এ আমার লেখাপড়া যখন সম্পূর্ণ হলো, তখন আমি নিজের সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত আত্মবিশ্বাসী এক বালক। আরও পড়াশোনা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে এক সেকেন্ডও ভাবতে হয়নি। সেই সব দিনে আমাদের কাছে। পেশাগত শিক্ষার সম্ভাবনা বলতে কিছু ছিল না; উচ্চ শিক্ষা বলতে বোঝাত কলেজে পড়া। সবচেয়ে কাছের কলেজটি ছিল তিরুচ্চিরাঞ্চলিতে, সেকালে লেখা হতো ত্রিচিনোপলি, এবং সংক্ষেপে ত্রিচি।

.

১৯৫০ সালে আমি উপস্থিত হলাম ত্রিচির সেন্ট জোসেফ’স কলেজে, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে। পরীক্ষার গ্রেড অনুযায়ী আমি খুব একটা মেধাবী ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু রামেশ্বরমে আমার দুই বন্ধুকে ধন্যবাদ, আমি এক রকম ধৈর্যগুণ অর্জন করেছিলাম বাস্তবিক অর্থেই।

শোয়ার্টজ থেকে যখনই আমি রামেশ্বরমে ফিরে যেতাম, আমার বড়ো ভাই মুস্তাফা কামাল তখনই আমাকে তার কাজে একটু সাহায্য করার জন্য ডেকে নিত, রেলওয়ে স্টেশন রোডে একটা মুদি দোকান চালাত সে, আর আমার দায়িত্বে দোকান ছেড়ে দিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্য উধাও হয়ে যেত। আমি বিক্রি করতাম তেল, পেঁয়াজ, চাল এবং অন্যান্য দ্রব্য। আমি আবিষ্কার করলাম সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেশি বিক্রি হয়ে যায় সিগারেট ও বিড়ি। অবাক হয়ে ভাবতাম, গরীব মানুষেরা তাদের কঠোর পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ এভাবে বোয়া গিলে উড়িয়ে দেয় কেন। মুস্তাফাঁকে সাহায্য করতে না হলে আমার ছোটোভাই কাশিম মোহাম্মদের কিওস্কে বসতাম আমি। সেখানে বিক্রি করতাম সমুদ্র শঙ্খ দিয়ে তৈরি নানা প্রকার সৌখিন দ্রব্য।

সেন্ট জোসেফ’স-এ রেভারেন্ড ফাদার টিএন সেকুয়েইরার মতো একজন। শিক্ষককে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন, তাছাড়াও ছিলেন আমাদের হোস্টেল ওয়ার্ডেন। তিনতলা হোস্টেল ভবনে আমরা প্রায় একশ শিক্ষার্থী বসবাস করতাম। রেডারেন্ড ফাদার হাতে একটা বাইবেল নিয়ে প্রতি রাতে প্রত্যেকটি ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তার শক্তি ও ধৈর্য ছিল বিস্ময়কর। ছেলেদের প্রতিটা মুহূর্তের যত্ন নিতেন তিনি পরম কর্তব্যপরায়ণতার। সঙ্গে। দীপাবলীতে, তার নির্দেশে, হোস্টেলের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্রাদার ও উৎসবের। স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিটা কক্ষে গিয়ে ধর্মীয় স্নানের জন্য চমৎকার গিঙ্গেলি তেল বিতরণ করত।

সেন্ট জোসেফ’স ক্যাম্পাসে আমি চার বছর ছিলাম। আমার কামরায় আমি ছাড়া আরও দুজন থাকত। একজন ছিল শ্রীরঙ্গমের এক গোঁড়া আয়েঙ্গার আর অন্যজন কেরালার এক সিরিয়ান খৃস্টান। আমরা তিনজন একসঙ্গে দারুণ একটা সময়। কাটিয়েছিলাম। হোস্টেলে আমার তৃতীয় বর্ষ চলাকালে আমাকে নিরামিষ মেসের সচিব বানানো হলে আমরা রোববারের মধ্যাহ্নভোজে রেক্টর রেভারেন্ড ফাদার কালাথিলকে আমন্ত্রণ জানাই। আমাদের মেনুতে ছিল নানা রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার। ফলাফল ছিল অপ্রত্যাশিত, তবে রেভারেন্ড ফাদার আমাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি। রেভারেন্ড ফাদার কালাখিলের সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্ত আমরা উপভোগ করেছিলাম, তিনি শিশুসুলভ উফুল্লতা নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন আমাদের চপল কথাবার্তায়। আমাদের সবার জন্য সেটা ছিল এক স্মরণীয় ঘটনা।

সেন্ট জোসেফ’স-এ আমার শিক্ষকরা ছিলেন কাঞ্চি পরমাচার্যের খাঁটি অনুগামী। পরমাচার্য দান ক্রিয়া উপভোগ করতে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করতেন। ক্যাম্পাসে এক সঙ্গে হেঁটে বেড়ানো আমাদের গণিত শিক্ষক অধ্যাপক থোথাথ্রি আয়েঙ্গার ও অধ্যাপক সূর্যনারায়ণ শাস্ত্রীর বর্ণিল সুতি আজও আমার মনে প্রেরণা জোগায়।

সেন্ট জোসেফ’স-এ আমি যখন শেষ বর্ষে তখন ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ জন্মে। আমি মহান ধ্রুপদী সাহিত্যিকদের রচনা পড়তে শুরু করি, তলস্তয়, স্কুট ও হার্ডি ছিল আমার বিশেষ রকমের প্রিয়, তারপর আমি দর্শন বিষয়ক রচনাগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হই। ঠিক এই সময়টাতেই পদার্থবিদ্যার প্রতি সৃষ্টি হয় আমার বিপুল আগ্রহ।

সেন্ট জোসেফ’স-এ পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক চিন্না ডুরাই ও অধ্যাপক কৃষ্ণমূর্তি সাবঅ্যাটোমিক ফিজিক্স বিষয়ে পাঠ দিতেন। তার ফলে বস্তুর রেডিও অ্যাকটিভ ক্ষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় ও হাফ-লাইফ পিরিয়ডের ধারণার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। রামেশ্বরমে আমার বিজ্ঞান শিক্ষক শিবসুব্রামানিয়া আয়ার আমাকে কখনও শেখাননি যে অধিকাংশ সাবঅ্যাটোমিক বস্তু অস্থির এবং অন্য বস্তুর মধ্যে নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর সেগুলো বিভাজিত হয়ে যায়। এসব বিষয় আমি জানতে পারছিলাম প্রথমবারের মতো। কিন্তু যখন তিনি আমাকে অধ্যবসায়ের সঙ্গে কঠোরভাবে চেষ্টা করার শিক্ষা দিয়েছিলেন, যেহেতু সকল যৌগিক বস্তুতে ক্ষয় হচ্ছে সহজাত ব্যাপার, তখন কি আসলে তিনি একই বিষয়ে কথা বলছিলেন না? আমি ভাবি, কেন কিছু মানুষ মনে করে বিজ্ঞান মানুষকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় খোদার কাছ থেকে? আমি এটাকে যেভাবে দেখি তা হলো-বিজ্ঞানের পথ সর্বদা হৃদয়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। আমার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান হচ্ছে আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি ও আত্ম-উপলব্ধির পথ।

.

এমনকি বিজ্ঞানের যুক্তিবাদী চিন্তাধারাও রূপকথার বাসা হতে পারে। আমি সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক বইয়ের আগ্রহী পাঠক এবং মহাকাশের বস্তু সম্পর্কে পড়তে আনন্দ পাই। আমাকে স্পেস ফ্লাইটের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন প্রশ্ন করার সময় অনেক বন্ধু কখনও কখনও জ্যোতিষি বিদ্যার মধ্যে ঢুকে পড়েন। সততার সঙ্গে বললে বলতে হয়, আমাদের সৌরজগতে অবস্থিত দূরবর্তী গ্রহসমূহের প্রতি লোকদের বিপুল গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে তা আমি সত্যি কখনও বুঝতে পারিনি। শিল্প হিসাবে জ্যোতিষিবিদ্যার বিরুদ্ধে বলার আমার কিছুই নেই, কিন্তু বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে তাকে গ্রহণযোগ্য করতে চাইলে তা আমি বাতিল করে দেব। আমি জানি গ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জ এবং এমনকি উপগ্রহ সম্পর্কেও এইসব মিথ কীভাবে উদ্ভূত হয়েছিল। আর সেই মিথ অনুযায়ী লোকেরা বিশ্বাস করে যে এইসব বস্তু মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। আমি যেমনটা মনে করি, পৃথিবী হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিমান ও ক্ষমতাশালী গ্রহ। জন মিলটন এ বিষয়টা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার Paradise Lost কবিতায়:

…What if the Sun
Be center to the World, and other stars…
The planet earth, so steadfast though she seem,
In sensibly three different motions move?

এই গ্রহের যেখানেই তুমি যাও সেখানেই তুমি দেখতে পাবে গতি আর জীবন। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে অনড় বস্তু যেমন পাথর, ধাতু, কাঠ, মাটি ইত্যাদি সবকিছুই গতিময়তায় পূর্ণ, কারণ এসবের প্রতিটা নিউক্লিয়াসকে ঘিরে অবিরাম নেচে চলেছে ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াসের দ্বারা সেগুলোর ওপর আরোপিত অবরোধের প্রতি সাড়া দিতে এই গতি উৎপন্ন হয়, বৈদ্যুতিক শক্তির দ্বারা যা চেষ্টা করে যতদূর সম্ভব সেগুলোকে কাছাকাছি ধরে রাখতে। নির্দিষ্ট পরিমান শক্তি সম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তি মানুষের মতোই ইলেকট্রনও অবরোধ পছন্দ করে না। নিউক্লিয়াস যত শক্ত করে ইলেকট্রনকে ধরে রাখবে, ইলেকট্রনের ঘূর্ণনবেগও তত বেশি হবে? বস্তুত একটি অণুতে ইলেকট্রনের আটক অবস্থার ফলাফল থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার ঘুর্ণন গতির সৃষ্টি হতে পারে! এই উঁচু বেগমাত্রার কারণে এটমকে অনমনীয় অবস্থার মতো মনে হয়, ঠিক যেমন অতিদ্রুতগতিতে ঘূর্ণায়মান ফ্যানকে একটা চাকতির মতো মনে হয়। আরও জোরালোভাবে এটমের ওপর চাপ প্রয়োগ করা খুবই অসুবিধাজনক-এভাবে বস্তুসমূহ পরিচিত কঠিন অবয়ব পেয়ে থাকে। প্রতিটা কঠিন বস্তু, এভাবে, নিজের মধ্যে প্রচুর খালি জায়গা ধারণ করে এবং অনড় সমস্ত কিছু নিজের মধ্যে ধারণ করে বিপুল গতি। ব্যাপারটা এমন যেন আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটা মূহূর্তে পৃথিবীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শিবের নাচ।

.

যখন আমি সেন্ট জোসেফ’স-এ বি.এসসি. ডিগ্রি কোর্সে যোগ দেই, তখনও আমি উচ্চ শিক্ষার অন্য আর কোনো সুযোগ সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না। বিজ্ঞানের একজন ছাত্রের জন্য সহজলভ্য চাকরির সুযোগ সম্পর্কেও আমার কোনো তথ্য জানা ছিল না। একটা বি.এসসি. ডিগ্রি অর্জনের পরই কেবল আমি উপলব্ধি করি যে পদার্থবিদ্যা আমার বিষয় নয়। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে। অনেক আগেই আমি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যোগ দিতে পারতাম, ঠিক আমার ইন্টারমিডিয়েট কোর্স শেষ করার পর পরই। কখনও না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়াও ভালো, এই কথা আমি নিজেকে বললাম মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) ভর্তির আবেদন জমা দিয়ে। সেই সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল সমগ্র দক্ষিণ ভারতে কারিগরি শিক্ষার মনিরত্ন।

নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকায় আমার নাম উঠল, কিন্তু এই মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রায় এক হাজার রূপি প্রয়োজন, কিন্তু আমার বাবার পক্ষে অত টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। সেই সময় আমার বোন জোহরা আমার পাশে দাঁড়াল, নিজের সোনার বালা ও চেইন বন্ধক রেখে আমাকে সে টাকা জোগাড় করে দিল। আমার সামথ্যের প্রতি তার এই বিশ্বাস আর আমাকে শিক্ষিত মানুষ হিসাবে দেখতে চাওয়ার তার এই দৃঢ়তা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করল। নিজের উপার্জিত অর্থে বন্ধকি থেকে তার বালা ছাড়িয়ে আনার শপথ নিলাম আমি। সময়ের ওই পর্যায়ে টাকা উপার্জনের যে একটা মাত্র উপায় আমার সামনে ছিল তা হলো কঠিনভাবে পড়াশোনা করে একটা বৃত্তি অর্জন করা। আমি পুরো দমে সামনে এগিয়ে চললাম।

এমআইটিতে আমাকে সবচেয়ে বেশি মোহাবিষ্ট করেছিল দুটো অব্যবহৃত বিমান পোত। ফ্লাইং মেশিনের নানারকম সাবসিস্টেম প্রদর্শনের জন্য ও দুটো রাখা হয়েছিল। ওগুলোর প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করতাম আমি, আর অন্য শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার পরও দীর্ঘ সময় ওগুলোর নিকটে বসে থাকতাম, আকাশে মুক্তভাবে ওডার, পাখির মতো, মানুষের ইচ্ছায় মুগ্ধ। আমার প্রথম বর্ষ সম্পূর্ণ করার পর, যখন একটা বিশেষ শাখা বেছে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, আমি তাৎক্ষণিকভাবে নিজের জন্য পছন্দ করলাম অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এত দিনে লক্ষ্যটা আমার মনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল: আমি বিমান ওড়াতে চলেছি। এ ব্যাপারে আমি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলাম, আমার জেদের অভাব সত্ত্বেও, যা সম্ভবত এসেছিল আমার দারিদ্রের পটভূমি থেকে। এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমি বিশেষ চেষ্টা করি। এতে হতাশা ছিল, কিন্তু আমার বাবার উৎসাহব্যাঞ্জক কথা আমাকে স্থির রেখেছিল। যে অন্যদের জানে সে শিক্ষিত, কিন্তু জ্ঞানী হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে জানে। জ্ঞান ছাড়া শিক্ষা কোনো কাজে আসে না।

এমআইটিতে আমার কোর্সে তিনজন শিক্ষক আমার ভাবনাকে আকৃতি দিয়েছিলেন। তাদের সমন্বিত অবদান ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল যার ওপর পরে আমি আমার পেশাগত ক্যারিয়ার নির্মাণ করি। এই তিনজন শিক্ষক হলেন অধ্যাপক স্পন্ডার, অধ্যাপক কেএভি পান্ডালাই ও অধ্যাপক নরসিংহ রাও। তাদের প্রত্যেকেরই ছিল অত্যন্ত উঁচু ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাদের সবারই একটা বিষয় ছিল অভিন্ন ছাত্রদের মেধার ক্ষুধা মেটানোর সামর্থ্য।

.

অধ্যাপক স্পন্ডার আমাকে পড়াতেন টেকনিক্যাল অ্যারোডাইনামিক্স। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সমৃদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন অস্ট্রিয়ান ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে নাৎসিদের হাতে তিনি বন্দি হয়েছিলেন এবং একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটক থাকেন। বোধগম্য কারণেই জার্মানদের প্রতি তার মধ্যে বিরাগ সৃষ্টি হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, অ্যারোনটিক্যাল বিভাগের প্রধান ছিলেন একজন জার্মান, অধ্যাপক ওয়াল্টার রেপেনথিন। আরেকজন সুপরিচিত অধ্যাপক, ড. কুর্ট ট্যাংক, ছিলেন খ্যাতিমান অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার যিনি এক আসনবিশিষ্ট জার্মান ফাইটার বিমান Focke=Wulf Fw 190)-এর নকশা তৈরি করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেটি ছিল অনন্যসাধারণ জঙ্গি বিমান। ড. ট্যাংক পরে ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (এইচএএল)-এ যোগ দেন এবং ভারতের প্রথম জেট ফাইটার HF-24 Marut-এর নকশার দায়িত্ব পান।

এ অবস্থার মধ্যেও অধ্যাপক স্পন্ডার নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র রক্ষা করে চলেন। এবং উঁচু পেশাগত মান বজায় রাখেন। তিনি সবসময় ছিলেন শান্ত, উদ্যমী আর সম্পূর্ণ আত্ম-নিয়ন্ত্রিত। তিনি সর্বসাম্প্রতিক প্রযুক্তির সঙ্গে সংযোগ রেখে চলতেন এবং চাইতেন তার ছাত্ররাও তাই করুক। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়ার আগে আমি তার পরামর্শ নিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, নিজের ভবিষ্যৎ আশা নিয়ে কারো উদ্বিগ্ন হওয়া উচিৎ নয় কখনও। তার চেয়ে বরং পর্যাপ্ত ভিত্তি স্থাপন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক স্পন্ডার লক্ষ করতেন যে, শিক্ষা সুযোগ বা শিল্প অবকাঠামোর অভাব ভারতীয়দের কোনো সমস্যা নয়, তাদের সমস্যা ছিল শৃঙ্খলা ও তাদের পছন্দকে যুক্তিবাদী করে তোলার মধ্যে। পার্থক্য করতে না পারার ব্যর্থতা। অ্যারোনটিকস কেন? ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নয় কেন? কেন নয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং? সকল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীকে আমি নিজে বলব যে, যখন তারা নিজেদের বিশেষ ক্ষেত্রে পছন্দ করবে, তখন অপরিহার্য ভাবে বিবেচনা করতে হবে যে ওই পছন্দ তাদের ভেতরকার অনুভূতি ও উচ্চাকাঙ্খ প্রকাশ করছে কিনা।

অধ্যাপক কেএভি পান্ডালাই আমাকে শেখাতেন অ্যারোস্ট্রাকচার ডিজাইন ও বিশ্লেষণ। তিনি ছিলেন সদা উফুল, বন্ধু ভাবাপন্ন ও উদ্যমী শিক্ষক, প্রতি বছরের শিক্ষা কোর্সে তিনি নিয়ে আসতেন তরতাজা মনোভঙ্গি। অধ্যাপক পান্ডালাই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি আমাদের কাছে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গুপ্তবিষয় উন্মোচন করেছিলেন। এমনকি আজও আমি বিশ্বাস করি, অধ্যাপক পান্ডালাইয়ের শিক্ষা যারা পেয়েছে তারা সবাই একমত হবে যে তিনি ছিলেন মহান পন্ডিত ব্যক্তি, কিন্তু তার মধ্যে সামান্য পরিমাণ গর্বও পরিলক্ষিত হতো না। শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন পয়েন্টে তার সঙ্গে অমত পোষণ করার স্বাধীনতা ছিল তার ছাত্রদের।

অধ্যাপক নরসিংহ রাও গণিতবিদ, তিনি আমাদের পড়াতেন তাত্ত্বিক অ্যারোডাইনামিকস। আমি এখনও তার ফ্লুইড ডাইনামিকস শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি স্মরণ করতে পারি। তার ক্লাসগুলোয় হাজির হওয়ার পর, অন্য যে কোনো বিষয়ের তুলনায় আমি গাণিতিক পদার্থবিদ্যা বেশি পছন্দ করতে শুরু করলাম। প্রায়ই আমি অ্যারোনটিক্যাল ডিজাইন পর্যালোচনা করার জন্য একটা সার্জিক্যাল নাইফ বহন করি। অ্যারোডাইনামিক প্রবাহের সমীকরণ করতে প্রমাণাদি গ্রহণে অধ্যাপক রাওয়ের সদয় পরামর্শ যদি না পেতাম, তাহলে এই রূপক যন্ত্রটা আমি অর্জন করতে পারতাম না।

অ্যারোনটিকস একটা মোহনীয় বিষয়, এটা নিজের মধ্যে ধারণ করে আছে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি। স্বাধীনতা ও পলায়নের মধ্যে, গতি ও আন্দোলনের মধ্যে, ধ্বস ও প্রবাহের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে তা এই বিজ্ঞানের রহস্য। এই সত্য আমার সামনে উন্মোচন করেছিলেন আমার শিক্ষকরা। তাদের অমূল্য শিক্ষার ভেতর দিয়ে তারা আমার মধ্যে অ্যারোনটিকস সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের মেধা, চিন্তার স্বচ্ছতা আর বিশুদ্ধতার জন্য কামনা আমাকে। চালিত করেছিল চাপ প্রয়োগযোগ্য মধ্যম গতির ফুইড ডাইনামিকস-মোডস, শক ওয়েভ সৃষ্টি ও শক, ক্রমবর্ধমান গতিতে ফ্লো, সেপারেশন উদ্দীপ্ত করা, শক স্টল ও শক-ওয়েভ ড্রাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়াশোনার মধ্যে ঢুকে যেতে।

.

ধীরে ধীরে আমার মনে জায়গা নিল তথ্যের বিপুল ভান্ডার। এরোপ্লেনের কাঠামগত অবয়ব নতুন অর্থ নিতে লাগল-বাইপ্লেন, মনোপ্লেন, টেইললেস প্লেন, ক্যানার্ড। কনফিগারড প্লেন, ডেল্টা-উইং প্লেন, এ সমস্ত কিছু আমার জন্য ধারণ করতে আরম্ভ করল ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব। তিন শিক্ষক, স্ব স্ব ক্ষেত্রে তারা সবাই ছিলেন কর্তাব্যক্তি, আমাকে সাহায্য করেছিলেন একটা যৌগিক জ্ঞান সন্নিবিষ্ট করতে।

এমআইটিতে আমার তৃতীয় ও শেষ বছরটি ছিল উত্তরণের একটি বছর এবং আমার পরবর্তী জীবনের ওপর এর প্রভাব পড়েছিল। সেই সব দিনে, রাজনৈতিক আলোকবর্তিকার একটা নতুন আবহাওয়া ও শিল্প স্থাপনার চেষ্টা ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। স্রষ্টায় আমার বিশ্বাস পরীক্ষা করতে হয়েছিল আমাকে এবং দেখতে হয়েছিল যে সেটা বৈজ্ঞানিক চিন্তার ছাঁচে খাপ খায় কিনা। গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একটা বিশ্বাস ছিল জ্ঞানের প্রতি একমাত্র বৈধ অভিগমন। যদি তাই হয়, আমি ভেবেছিলাম, তাহলে বস্তুই একমাত্র বাস্তবতা আর আধ্যাত্মিক প্রপঞ্চ বস্তুর একটা প্রকাশ ছাড়া আর কি? সমস্ত নৈতিক মূল্য কি আপেক্ষিক, এবং সংবেদজ উপলব্ধি সত্য ও জ্ঞানের একমাত্র উত্স? এসব বিষয়ে আমি ভাবতাম, বৈজ্ঞানিক মেজাজ ও আমার নিজের আধ্যাত্মিক আগ্রহের প্রশ্ন আলাদা করার চেষ্টা চালাতাম। যে মূল্যবোধের ধারায় আমি রেড়ে উঠেছিলাম তা গভীরভাবে ছিল ধর্মীয়। আমি এই শিক্ষা পেয়েছিলাম যে আধ্যাত্মিক এলাকার মধ্যে আসল বাস্তবতা রয়েছে জড় বিশ্ব ছাড়িয়ে, এবং জ্ঞান আহরণ করা যায় কেবল অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

ইতোমধ্যে আমার কোর্সের কাজ যখন শেষ করে ফেলেছি, তখন আমাকে একটা প্রকল্পে কাজে লাগানো হলো আরও চারজন সহকর্মীর সঙ্গে মিলে একটা লোলেভেল অ্যাটাক এয়ারক্র্যাফটের নকশা করার জন্য। আমি অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন অংকন ও প্রস্তুতের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। বিমানের প্রপালসন, স্ট্রাকচার, কন্ট্রোল ও ইট্রুমেন্টেশন নকশার কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল আমার টিম মেটরা। একদিন আমার ডিজাইন শিক্ষক অধ্যাপক শ্রীনিবাসন, তখন এমআইটির পরিচালক, আমার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে হতাশাব্যাঞ্জক বলে ঘোষণা করলেন। বিলম্বের কারণ হিসাবে এক ডজন অজুহাত দিলাম আমি, কিন্তু তার কোনোটিই মনে ধরল না অধ্যাপক শ্রীনিবাসনের। আমি শেষ পর্যন্ত তার কাছে কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য এক মাসের সময় চাইলাম। অধ্যাপক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখ, আজ শুক্রবার বিকেল। আমি তোমাকে তিন দিন সময় দিচ্ছি। সোমবার সকালে যদি ড্রয়িং না পাই তাহলে তোমার বৃত্তি বন্ধ হয়ে যাবে। আমি একেবারে বোবা হয়ে গেলাম। বৃত্তিটা ছিল আমার লাইফলাইন, সেটা যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে একেবারে অসহায় হয়ে পড়ব। যেভাবে বলা হয়েছে সেই মতো কাজটা শেষ করা ছাড়া আর কোনো পথ দেখতে পেলাম না। সেই রাতে আমি ড্রয়িং বোর্ড নিয়েই পড়ে থাকলাম, বাদ দিয়ে গেলাম নৈশভোজ। পরবর্তী সকালে মাত্র এক ঘন্টার বিরতি দিলাম পরিষ্কার হয়ে সামান্য কিছু মুখে দেবার জন্য। রোববার সকালে, কাজ শেষ করে আনার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তখন, হঠাৎ করে কামরায় কারো উপস্থিতি অনুভব করলাম। একটু দূর থেকে আমাকে লক্ষ করছিলেন অধ্যাপক শ্রীনিবাসন। জিমখানা থেকে সরাসরি এসেছিলেন, তাই তার পরনে ছিল টেনিসের পোশাক। আমার অগ্রগতি দেখতে এসেছিলেন তিনি। আমার কাজ পরীক্ষা করার পর অধ্যাপক শ্রীনিবাসন সস্নেহে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর পিঠ চাপড়ে দিলেন। তিনি বললেন, আমি জানি তোমাকে কঠিন চাপের মধ্যে রাখছিলাম আর অসম্ভব এক ডেডলাইনের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ করতে বলছিলাম। এত চমৎকার পারফর্ম করবে তুমি তা আমি কখনও প্রত্যাশা করিনি।

প্রকল্প কালের বাকি সময়ে এমআইটি তামিল সংঘম (সাহিত্য সমাজ) আয়োজিত এক রচনা প্রতিযোগিতায় আমি অংশগ্রহণ করি। তামিল আমার মাতৃভাষা, এবং এর উত্স নিয়ে আমি গর্বিত, যার গতিপথ অনুসরণ করলে রামায়ণপর্ব কালের মহামনি অগস্ত্য পর্যন্ত পৌঁছান যাবে; এ ভাষায় রচিত সাহিত্য খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দির পুরনো। এই চমৎকার ভাষার আওতার বাইরে বিজ্ঞান থাকতে পারে না তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমি অতিশয় প্রত্যয়ী ছিলাম। আমি তামিলে একটা প্রবন্ধ লিখি আমাদের নিজস্ব বিমান তৈরি করা যাক শিরোনামে। প্রবন্ধটি দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং প্রতিযোগিতায় আমি। বিজয়ী হই। জনপ্রিয় তামিল সাপ্তাহিক আনন্দ বিকাতান-এর সম্পাদক দেবন এর কাছ থেকে আমি প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করি।

এমআইটি-তে আমার সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী স্মৃতি অধ্যাপক স্পন্ডারের সঙ্গে জড়িত। বিদায় অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে আমরা গ্রুপ ছবি ওঠাচ্ছিলাম। সামনে উপবিষ্ট অধ্যাপকদের রেখে সকল স্নাতক ছাত্র তিন সারিতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অধ্যাপক স্পন্ডার হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁজতে লাগলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তৃতীয় সারিতে। সামনের সারিতে এসে আমার পাশে বসো, তিনি বললেন। অধ্যাপক স্পন্ডারের আমন্ত্রণে আমি হতচকিত হয়ে পড়লাম। তুমি আমার সেরা ছাত্র এবং ভবিষ্যতে তোমার শিক্ষকদের বিপুল সুনাম বয়ে আনতে কঠোর পরিশ্রম তোমাকে সাহায্য করবে। প্রশংসায় বিহ্বল কিন্তু স্বীকৃতিতে সম্মানিত হয়ে ছবি তোলার জন্য আমি বসলাম অধ্যাপক স্পন্ডারের পাশে। ঈশ্বর তোমার আশা, তোমার বেঁচে থাকা, তোমার পথ প্রদর্শক হোন, আর তিনি ভবিষ্যতে তোমার চলার পথে আলো দিন, অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটি এভাবে আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।

এমআইটি থেকে ট্রেইনি হিসাবে আমি গেলাম ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (এইচএএল)-এ। সেখানে একটা দলের অংশ হিসাবে আমি ইঞ্জিন ওভারলিং-এর কাজ করতাম। বিমানের ইঞ্জিন ওভারহলিং বিষয়ে খোলা হাতের কাজ ছিল অত্যন্ত শিক্ষামূলক। ক্লাসরুমে শেখা কোনো নিয়ম যখন ফলবতী হয় বাস্তব অভিজ্ঞতায়, তখন তা থেকে সৃষ্টি হয় উত্তেজনার এক অদ্ভুত অনুভূতি যেন একদল অচেনা মানুষের মধ্যে পুরনো বন্ধুকে দেখতে পেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে তার দিকে দৌড়ানো। এইচএএলে পিস্টন আর টারবাইন ইঞ্জিন উভয়ের ওভারহলিং-এর কাজ করতাম আমি। গ্যাস ডাইনামিকস-এর আবছা ধারণা আর আফটার বানিং বিষয়ক নিয়মের বিভাজন প্রক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল আমার মনে। আমি রেডিয়াল ইঞ্জিন-কাম-ড্রাম পরিচালনার প্রশিক্ষণও পেয়েছিলাম।

আমি শিখেছিলাম ওয়্যার ও টিয়ারের জন্য একটা ক্র্যাংকশ্যাফট কীভাবে চেক করতে হয়; আর টুইস্টের জন্য ক্র্যাংকশ্যাফট ও একটা সংযোগ বড়ো। একটা সুপার-চার্জড় ইঞ্জিনে যুক্ত একটা ফিক্সড-পিচ ফ্যানের ক্রমাংকন করি আমি। প্রেসার ও এক্সিলারেশন-কাম-স্পিড কন্ট্রোল সিস্টেম খুলে দিই, এবং টার্বো-ইঞ্জিনের এয়ার স্টার্টার সাপ্লাই সিস্টেমস। প্রপেলার ইঞ্জিনের রিভার্সিং এবং ফেদারিং ও আন ফেদারিং বুঝতে পারা ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। এইচএএল-এর টেকনিশিয়ানদের বেটা (ব্লেড অ্যাঙ্গল কন্ট্রোল)-এর নিখুঁত শিল্প এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। বড়ো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না, তাদের ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার যার নির্দেশ দিচ্ছিল তার বাস্তবায়নও করছিল না তারা। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা খোলা হাতে কাজ করছিল এবং এটাই তাদের কাজ করার এক অনুভূতি জাগিয়েছিল।

এইচএএল থেকে একজন গ্রাজুয়েট অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে বেরিয়ে আসার পর কাজের দুটো বিকল্প সুযোগ ছিল আমার সামনে, দুটোই আকাশে ওড়ার আমার দীর্ঘ দিনের স্বপ্নের কাছাকাছি। একটা এয়ার ফোর্সে এবং অন্যটি ডাইরেক্টরেট অব টেকনিক্যাল ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড প্রডাকশন ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। দুটোতেই আমি আবেদন করলাম। প্রায় যুগপৎ দুটো জায়গা থেকেই ডাকা হলো সাক্ষাৎকারের জন্য। এয়ার ফোর্স রিক্রুটমেন্ট কর্তৃপক্ষ আমাকে ডেকে পাঠাল দেরাদুনে আর ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার) দিল্লিতে। করোমন্ডল উপকূলের বালকটি উত্তর ভারত অভিমুখী একটা ট্রেন ধরেছিল। আমার গন্তব্য ছিল ২০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। আর আমার মাতৃভূমির বিস্তীর্ণতা দেখার সুযোগও হলো আমার সেই প্রথম।

.

৩.

কম্পার্টমেন্টের জানলা দিয়ে আমি দেখতে লাগলাম দ্রুত ধাবমান পল্লী অঞ্চল। ক্ষেত-খামারে শাদা ধুতি ও পাগড়ি পরা পুরুষেরা, আর ধান ক্ষেতের সবুজ পটভূমিতে বর্ণবহুল পোশাক পরিহিতা নারীদের দেখে মনে হচ্ছিল চমৎকার তৈলচিত্রের দৃশ্যের মতো। জানলায় আমি বসে ছিলাম আঠার মতো। প্রায় সবখানেই লোকজন কোনো না কোনো কাজে লিপ্ত ছিল, আর তাতে ছিল ছন্দ ও শান্তিপূর্ণতা। পুরুষেরা তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গবাদি পশু, ঝর্ণা থেকে পানি আনছে নারীরা। কোনো কোনো সময় হয়তো একটা বাচ্চার আবির্ভাব ঘটছে আর সে হাত নাড়ছে ট্রেনের উদ্দেশ্যে।

ক্রমাগত উত্তরের দিকে যেতে যেতে যেভাবে ভূদৃশ্যের পরিবর্তন ঘটে তা বিস্ময়কর। গঙ্গা নদীর দুপাশে সমৃদ্ধ সমতল উর্বর ভূমি শিকার হয়েছে আগ্রাসন, ক্ষয়ক্ষতি ও পরিবর্তনের। প্রায় ১৫০০ খৃস্টপূর্বাব্দে উত্তরপশ্চিমের পর্বত পেরিয়ে এ অঞ্চলে এসেছিল গৌরবর্ণের আর্যরা। দশম শতাব্দীতে এসেছিল মুসলমানরা, পরে যারা স্থানীয় অধিবাসীদের ভেতর মিশে গিয়েছিল আর এ দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। এক সাম্রাজ্য হটিয়ে দিয়েছিল অন্য সাম্রাজ্যকে ধর্মীয় বিজয় অভিযান অব্যাহত ছিল। এই পুরো সময়ে কর্কটক্রান্তির দক্ষিণে ভারতের এই অংশ বেশির ভাগটাই থেকে গিয়েছিল অস্পষ্ট, বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বত শ্রেণির আড়ালে নিরাপদ। নর্মদা, তপ্তি, মহানদী, গোদাবরি ও কৃষ্ণ নদী ভারতীয় উপদ্বীপের জন্য নিরাপত্তা রক্ষার জাল বিছিয়েছিল। আমাকে দিল্লিতে নিয়ে যাবার জন্য ট্রেনটা অতিক্রম করে গেল এসবকিছু।

আমি এক সপ্তাহের যাত্রা বিরতি করলাম দিল্লিতে, মহান সুফী সাধক হযরত নিজামুদ্দিনের এই নগর। সেখানে ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এ ইন্টারভিউ দিলাম। আমার ইন্টারভিউ ভালোই হলো। রুটিন মাফিক কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল আমাকে, আর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার জ্ঞান সম্পর্কে কোনো প্রশ্নই তোলা হয়নি। তারপর আমি দেরাদুন গেলাম এয়ার ফোর্স সিলেকশন বোর্ডের সামনে আমার ইন্টারভিউ দিতে। সিলেকশন বোর্ডে মেধার চেয়ে ব্যক্তিত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলো বেশি। হয়তো তারা অনুসন্ধান করছিল শারীরিক যোগ্যতা আর স্পষ্ট আচরণ। আমি বেশ উত্তেজিত কিন্তু নার্ভাস হয়েছিলাম, দৃঢ়প্রত্যয়ী কিন্তু উদ্বিগ্ন ছিলাম। এয়ার ফোর্সে আটজন অফিসার নির্বাচন করার জন্য ২৫ জনের ব্যাচে আমি নবম স্থান পেলাম। আমি দারুন হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। বিমান বাহিনীতে যোগ দেবার সুযোগ আমার আঙলের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে তা উপলব্ধি করতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। সিলেকশন বোর্ড থেকে বেরিয়ে এসে একটা পাহাড় চূড়ায় দাঁড়ালাম আমি। অনেক নিচে একটা হ্রদ দেখা যাচ্ছিল। আমি জানতাম সামনের দিনগুলো আরও সংকটময় হবে। প্রশ্ন ছিল যার উত্তর দিতে হবে এবং কর্মপরিকল্পনা যা প্রস্তুত করতে হবে। আমি সোজা চলে গেলাম ঋষিকেশ।

.

আমি গঙ্গায় স্নান করে এর জলের পবিত্রতায় পরমানন্দ লাভ করলাম। তারপর পায়ে হেঁটে এলাম শিবানন্দ আশ্রমে, পাহাড়ের খানিকটা উঁচুতে সেটা অবস্থিত। ভেতরে ঢোকার সময় আমি প্রচণ্ড কম্পন অনুভব করলাম। বিপুল সংখ্যক সাধুকে দশাপ্রাপ্ত অবস্থায় উপবিষ্ট দেখলাম চারপাশে। বইতে পড়েছিলাম যে সাধুরা হচ্ছে আধ্যাত্মিক মানুষ যারা স্বজ্ঞালব্ধভাবে সবকিছু জানে। বিষণ্ণ মনে যে সন্দেহগুলো আমাকে জ্বালাতন করত তার জবাব খুঁজতাম আমি।

আমি সাক্ষাৎ করলাম স্বামী শিবানন্দের সঙ্গে। বুদ্ধের মতো দেখতে মানুষটা, পরে আছে তুষারধবল ধুতি আর কাঠের খড়ম। জলপাইয়ের মতো তার গায়ের রং এবং কালো চোখ। তার অপ্রতিরোধ্য এবং প্রায় শিশুসুলভ হাসি আর মহিমান্বিত ব্যবহারে আমি চমকিত হলাম। স্বামীজীর কাছে আমি নিজের পরিচয় দিলাম। আমার মুসলিম নাম তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না। আমি আর কিছু বলার আগেই তিনি আমার দুঃখের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমার দুঃখ তিনি কীভাবে জানলেন তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিলেন না আর আমিও জানতে চাইলাম না।

বিমান বাহিনীতে যোগদানের আমার ব্যর্থ চেষ্টার কথা তাকে বললাম। তিনি মৃদু হাসলেন, প্রায় তৎক্ষণাৎ মুছে দিলেন আমার সকল উদ্বিগ্নতা। তারপর তিনি মৃদু কিন্তু অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন,

আকাঙ্ক্ষা, যখন তার উদ্ভব ঘটে হৃদয় ও আত্মা থেকে, যখন তা বিশুদ্ধ ও প্রগাঢ়, তখন তাকে আচ্ছন্ন করে ভীষণ বিদ্যুৎচুম্বকীয় শক্তি। এই শক্তি প্রতি রাতে নিষ্কাষিত হয় ইথারে, মন যখন নিদ্রার স্তরে থাকে। প্রতি সকালে তা চেতন স্তরে ফিরে আসে মহাজাগতিক প্রবাহের নতুন শক্তি নিয়ে। যা কল্পনা করা হয়েছে তা নিশ্চিত ভাবেই প্রতীয়মান হবে। তুমি নির্ভর করতে পারো, যুবক, এই অনন্ত প্রতিশ্রুতির ওপর যেমন নিশ্চিতভাবে তুমি নির্ভর করতে পারো চিরন্তনভাবে অটুট সূর্যোদয়ের… এবং বসন্তের প্রতিশ্রুতির ওপর।

ছাত্র যখন তৈরি, তখন শিক্ষকের আগমন ঘটবে-কী সত্যি! এই তো এক শিক্ষক যিনি পথ দেখাচ্ছেন এক ছাত্রকে যে কিনা প্রায় বিপথে যেতে বসেছিল। তোমার নিয়তিকে গ্রহণ করো আর জীবনকে নিয়ে এগিয়ে চল। বিমান বাহিনীর পাইলট হওয়ার ভাগ্য নয় তোমার। তুমি কী হবে তার নিয়তি এখনও উন্মোচিত নয়, কিন্তু আগেই তা নির্দিষ্ট হয়ে আছে। এই ব্যর্থতার কথা ভুলে যাও, মনে করো তোমার নিয়তি নির্দিষ্ট পথে চলার জন্য এ ছিল অপরিহার্য। এর পরিবর্তে তোমার অস্তিত্বের আসল উদ্দেশ্য অনুসন্ধান কর। নিজেকে সমর্পন কর ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে, স্বামীজী বললেন।

আমি দিল্লিতে ফিরে এলাম এবং আমার ইন্টারভিউয়ের ফলাফল জানার জন্য ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এ খোঁজ নিলাম। জবাবে আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো নিয়োগপত্র। মাসিক ২৫০ রূপি মূল বেতনে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে পরদিন সেখানে আমি কাজে যোগদান করলাম। যদি এই আমার নিয়তি হয়ে থাকে, আমি ভাবলাম, তাহলে তাই হোক। শেষ পর্যন্ত, মানসিক শান্তিতে আমি পূর্ণ হলাম। বিমান বাহিনীতে ঢুকতে না-পারার ব্যর্থতায় আমার মনে আর কোনো তিক্ততা ছিল না। এসব ছিল ১৯৫৮ সালের ঘটনা।

ডাইরেক্টরেটে আমাকে নিয়োগ করা হলো টেকনিক্যাল সেন্টার (এভিয়েশন) এ। আমি যদি এরোপ্লেনে উড়তে নাই পারি, অন্তত সেগুলো ওড়াতে সাহায্য করতে পারব। ডাইরেক্টরেটে আমার প্রথম বছরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আর ভরদরাজনের সহযোগিতায় সুপারসনিক টার্গেট এয়ারক্রাফটের ওপর একটা নকশার কাজ করেছিলাম আমি। পরিচালক ড. নীলকান্তন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন আমার কাজের। বিমান রক্ষণাবেক্ষণের শপ-ফ্লোর এক্সপোজারের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠান হলো কানপুরে এয়ারক্র্যাফট অ্যান্ড আর্মামেন্ট টেস্টিং ইউনিট (এঅ্যান্ডএটিইউ)-এ। ওই সময় তারা Gnat Mk1 বিমানের ট্রপিক্যাল ইভ্যালুয়েশন এ জড়িত ছিল। এর অপারেশন সিস্টেমের মূল্যায়ন কাজে আমি অংশগ্রহণ করি।

এমনকি সেই সব দিনেও কানপুর ছিল ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। কোনো শিল্পনগরীতে বসবাসের সেটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। ঠান্ডা আবহাওয়া, জনমানুষের ভিড়, হৈ চৈ আর ধোয়া ইত্যাদি ছিল, তার সম্পূর্ণ বিপরীত রামেশ্বরমে যাতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। সবচেয়ে ঝামেলার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম সকালের নাশতা থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত ডাইনিং টেবিলে আলুর অবিরাম উপস্থিতিতে। আমার কাছে এটা ছিল এই নগরীতে একাকীত্বের অনুভূতির মতো। রাস্তায় যেসব লোকজন চোখে পড়ত তারা সবাই গ্রাম থেকে এসেছিল কারখানাগুলোয় কাজের সন্ধানে, পরিবারের সুরক্ষা আর তাদের মাটির গন্ধ ফেলে এসেছিল তারা পেছনে।

দিল্লিতে আমার প্রত্যাবর্তনে আমাকে জানান হলো যে একটা DART টার্গেটের নকশা গ্রহণ করা হয়েছে ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এ এবং ডিজাইন টিমে আমাকে রাখা হয়েছে। আমি এই কাজ শেষ করলাম দলের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মিলে। তারপর একটা Humall Centrifuge-এর প্রাথমিক নকশার কাজ নিলাম। পরে ভার্টিক্যাল টেকঅফ ও ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম-এর নকশা তৈরি ও উন্নয়নের কাজ করলাম। হট ককপিট-এর উন্নয়ন ও নির্মাণের কাজেও আমি সহযোগিতা করি। তিন বছর পেরিয়ে গেল। তারপর ব্যাঙ্গালোরে জন্ম নিল দ্য অ্যারোনটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এস্টাবলিশমেন্ট (এডিই) এবং নতুন এই প্রতিষ্ঠানে আমাকে বদলি করা হলো।

.

নগর হিসাবে ব্যাঙ্গালোর সরাসরি বিপরীত ছিল কানপুরের। বস্তুত, আমি অনুভব করি আমাদের দেশের একটা অতিপ্রাকৃত ধরনের পন্থা আছে তার জনগণের চরমসীমা বের করে আনার। আমার ধারণা, এর কারণ ভারতীয়রা অনেক শতাব্দীর অভিবাসনে সমৃদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন শাসকের প্রতি আনুগত্য আমাদের একক বশ্যতার ক্ষমতা হরণ করেছে। পরিবর্তে আমরা যুগপৎ একই সঙ্গে অর্জন করেছি সহমর্মিতা ও নিষ্ঠুরতা, সংবেদশীলতা ও নির্মমতা, গভীরতা ও তরলতার এক অনন্যসাধারণ সামর্থ্য। অনভিজ্ঞ দৃষ্টিতে আমরা বর্ণবহুল ও ছবিতুল্য বলে প্রতিভাত হতে পারি; কিন্তু সমালোচকের চোখে, আমাদের বিভিন্ন প্রভুর বাজে রকম নকল ছাড়া আর কিছু নয়। কানপুরে আমি দেখেছিলাম পান চিবানো ওয়াজিদ আলী শাহ-এর নকল, এবং ব্যাঙ্গালোরে এর বিপরীতে কুকুর নিয়ে হাঁটা সাহেবদের। এখানেও আমি ব্যাকুল হয়ে পড়লাম রামেশ্বরমের গভীরতা ও শান্ততার জন্য। পার্থিব ভারতীয়ের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের মধ্যে সম্পর্ক ক্ষয় হয়ে গেছে আমাদের নগরসমূহের বিভক্ত স্পর্শকাতরতার দ্বারা। আমার সন্ধ্যাগুলো আমি কাটাতাম ব্যাঙ্গালোরের শপিং রাজা আর বাগানগুলো আবিষ্কার করে।

প্রথম বছরে এডিইতে কাজের চাপ অনেক হালকা ছিল। প্রথমে আমার মধ্যে কাজের ধারা সঞ্চার করতে হয়েছিল, যে পর্যন্ত না ক্রমান্বয়ে ছন্দ সৃষ্টি হয়। গ্রাউন্ডহ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট বিষয়ক আমার প্রাথমিক অধ্যয়নের ভিত্তিতে একটা প্রকল্প দল গঠন করা হলো, একটা গ্রাউন্ড ইকুইপমেন্ট মেশিন (জিইএম) হিসাবে একটা দেশীয় হোভারক্র্যাফট প্রটোটাইপ-এর নকশা ও উন্নয়ন কাজের জন্য। সেটা ছিল একটা ক্ষুদে কর্মীদল। চারজন সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্টকে নিয়ে এডিইর পরিচালক ড. ওপি মেডিরাট্টা আমাকে দলের নেতৃত্ব দিতে বললেন। ইঞ্জিনিয়ারিং মডেল তৈরির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হয়েছিল আমাদের।

যে কোনো মানের দিক থেকে প্রকল্পটা ছিল আমাদের যৌথ সামর্থ্যের চেয়েও অনেক বড়ো। আমাদের কারোরই যন্ত্র তৈরির অভিজ্ঞতা ছিল না, ফ্লাইং মেশিন তৈরি তো দূরের কথা। কোনো ডিজাইন বা প্রতিরূপ ছিল না যার সাহায্য নিয়ে আমরা শুরু করতে পারি। আমরা শুধু জানতাম যে আমাদেরকে একটা বাতাসের চেয়ে ভারী ফ্লাইং মেশিন তৈরি করতে হবে। হোভারক্র্যাফট বিষয়ক যত কিছু লেখালেখি ছিল সব সংগ্রহ করে আমরা পড়ি, কিন্তু এ বিষয়ে খুব লেখালেখি ছিল না। এক্ষেত্রে যাদের জ্ঞান আছে এমন লোকদের পরামর্শ নেওয়ার চেষ্ট করি আমরা, কিন্তু তেমন কাউকেই খুঁজে পাই না। একদিন সীমিত তথ্য ও সূত্র নিয়ে কাজে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।

একটা ডানাবিহীন, হালকা, দ্রুতগতির মেশিন তৈরির এই প্রচণ্ড চেষ্টা খুলে দিলো আমার মনের জানালা। আমি খুব দ্রুত দেখতে পেয়েছিলাম একটা হোভারক্র্যাফট ও একটা এয়ারক্র্যাফট-এর মধ্যে প্রতীকি যোগসূত্র। সে যাই হোক, সাত বছর ধরে বাইসাইকেল ফিক্সিং করার পর প্রথমবারের মতো এরোপ্লেন তৈরি করতে পেরেছিলেন রাইট ভাইয়েরা! জিইএম প্রকল্পে উদ্ভাবনী দক্ষতা ও ক্রমোন্নতির বিশাল সুযোগ দেখতে পেয়েছিলাম আমি। ড্রইং বোর্ডের ওপর কয়েক মাস কাটানোর পর আমরা সরাসরি হার্ডওয়্যার কাজে আত্মনিয়োগ করি।

আমার মতো পটভূমির কোনো ব্যক্তির যে পটভূমি হচ্ছে পল্লী অঞ্চল কিংবা ক্ষুদে শহর, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বাবা-মায়ের সীমিত শিক্ষা, তো এ রকম একটি পটভূমির কোনো ব্যক্তির সবসময় যা বিপদ তা হলো সে একটা কোণে পশ্চাদপসরণ করবে এবং শুধু অস্তিত্বের জন্যই সেখানে সংগ্রাম করবে, যতক্ষণ না বড়ো কোনো ঘটনা তাকে চালিত করে আরও অধিক অনুকূল পরিবেশের মধ্যে। আমি জানতাম আমাকেই আমার নিজের সুযোগগুলো তৈরি করে নিতে হবে।

অংশের পর অংশ, সাবসিস্টেমের পর সাবসিস্টেম, স্তরের পর স্তর কাজ এগিয়ে চলল। এই প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে আমি শিখলাম যে, একবার যদি তোমার মন একটা নতুন সুরে প্রসারিত হয় তাহলে আর কখনও তা আগের মাত্রায় ফিরে যাবে না।

ঐ সময় ভিকে কৃষ্ণ মেনন ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। আমাদের ক্ষুদ্র প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত উৎসাহিত ছিলেন, এই বিষয়টিকে তিনি মনে করতেন ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উন্নয়ন কাজের সূচনা হিসাবে। ব্যাঙ্গালোরে যখনই তিনি আসতেন তখনই তিনি কিছুটা সময় বের করে নিতেন আমাদের প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য। আমাদের সামর্থ্যের ব্যাপারে তার আস্থা আমাদের ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল। অ্যাসেম্বলি শপে আমি প্রবেশ করতাম আমার অন্যান্য সমস্যা বাইরে রেখে, ঠিক আমার বাবা নামাজ পড়ার জন্য যেভাবে মসজিদে প্রবেশ করতেন, বাইরে রেখে আসতেন তার জুতো।

কিন্তু জিইএম সম্পর্কে কৃষ্ণ মেননের মতামত প্রত্যেকেই যে গ্রহণ করেছিল তা নয়। সহজলভ্য যন্ত্রাংশ দিয়ে আমাদের এই এক্সপেরিমেন্ট উৎফুল্ল করতে পারেনি আমাদের সিনিয়র সহকর্মীদের। এমনকি অনেকেই আমাদের বলতেন খামখেয়ালি উদ্ভাবকদের একটি দল যারা দৌড়াচ্ছে অসম্ভব এক স্বপ্নের পেছনে। navvie-দের নেতা হওয়ায় আমি ছিলাম নির্দিষ্টভাবে তাদের লক্ষ্যবস্তু। আমাকে গণ্য করা হয়েছিল একজন অমার্জিত পেঁয় লোক হিসাবে যে কিনা বিশ্বাস করে যে বাতাসে আরোহণ ছিল তার করায়ত্ত। আমাদের বিরুদ্ধ মতামতের ভার আমার চির-আশাবাদী মনকে আরও বেশি জোরালো করেছিল। এডিই-তে কয়েকজন সিনিয়র বিজ্ঞানীর মন্তব্যে আমার মনে পড়ত ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত রাইট ভাইদের নিয়ে লেখা জন ট্টোব্রিজ-এর বিখ্যাত স্যাটায়ার কবিতার কিছু অংশ:

…with thimble and thread
And wax and hammer, and buckles and screws,
And all such things as geniuses use;
Two bats for patterns, curious fellows!
A charcoal-Pot and a pair of bellows.

.

প্রকল্পটা যখন প্রায় এক বছর অতিক্রম করেছে, তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন এডিইতে তার একটা রুটিন পরিদর্শনে এলেন। আমি তাকে আমাদের অ্যাসেম্বলি শপে নিয়ে এলাম। ভেতরে একটা টেবিলের ওপর রাখ ছিল জিইএম মডেলটি। যুদ্ধের ময়দানের জন্য বাস্তবসম্মত একটা হোভারক্র্যাফট তৈরির এক বছরের অক্লান্ত চেষ্টার প্রতিফলন ঘটেছিল তাতে। মন্ত্রী একটার পর একটা প্রশ্ন করলেন আমাকে। আগামী বছরের মধ্যেই এই প্রটোটাইপ টেস্ট ফ্লাইটে যাবে তা নিশ্চিত হতে তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন। তিনি ড. মেডিরাট্টাকে বলেছিলেন, কালাম যে গ্যাজেট অধিকার করেছে তার সাহায্যে জিইএম ফ্লাইট সম্ভব।

হোভারক্র্যাফটের নামকরণ করা হয়েছিল নন্দী, শিবের বাহন সঁড়ের নামানুসারে। একটা প্রটোটাইপের ক্ষেত্রে, এর আকার, যোগ্যতা ও পূর্ণতা ছিল আমাদের প্রত্যাশার বাইরে, আমরা একটা অবকাঠাম পেয়েছিলাম। আমার সহকর্মীদের আমি বললাম, এই যে একটা ফ্লাইং মেশিন, এটা নির্মাণ করেছে একদল বাতিকগ্রস্ত ব্যক্তি নয় বরং দক্ষ প্রকৌশলীরা। এটার দিকে তাকিয়ে থেকো না। তাকিয়ে থাকার জন্য এটা তৈরি করা হয়নি, এটা তৈরি করা হয়েছে ওড়ার জন্য।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন নন্দীতে চড়ে আকাশ বিহার করলেন, তার সঙ্গে ছিল নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা। মন্ত্রীর দলে একজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিলেন, কয়েক হাজার ঘন্টা আকাশে ওড়ার রেকর্ড ছিল তার লগ বুকে। আমার মতো অনভিজ্ঞ এক বেসামরিক পাইলটের সঙ্গে ওড়ার সম্ভাব্য বিপদ থেকে মন্ত্রীকে রক্ষা করতে নিজেই ফ্লাইং মেশিনটা চালানোর প্রস্তাব দিলেন তিনি, আর ইশারা করলেন যন্ত্রটা থেকে আমাকে বেরিয়ে আসার জন্য। আমার তৈরি যন্ত্রটা ঠিকভাবে ওড়াতে পারার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম, সুতরাং আপত্তি জানিয়ে আমি মাথা নাড়লাম। এই শব্দহীন কথাবার্তা লক্ষ করে মেনন একটা হাসি দিয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেনের অপমানকর প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন এবং যন্ত্রটা চালানোর সংকেত দিলেন আমাকে। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন।

হোভারক্র্যাফট উন্নতির মূল সমস্যা সমাধান করা গেছে তা তুমি দেখিয়েছ। আরও শক্তিশালী একটা প্রাইম মুভার তৈরি কর আর তাতে দ্বিতীয়বার চড়ার জন্য আমাকে ডাক দিও, কৃষ্ণ মেনন আমাকে বললেন। সন্দেহবাদী গ্রুপ ক্যাপ্টেন (এখন এয়ার মার্শাল) গোলে পরবর্তীকালে আমার এক ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন।

নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রকল্প সম্পূর্ণ করলাম আমরা। আমাদের সঙ্গে ছিল একটা ওয়ার্কিং হোভারক্র্যাফট, প্রায় ৪০ মিমি এয়ার কুশন আর ৫৫০ কেজি লোড নিয়ে চলছিল সেটা, সেই সঙ্গে কড়তার ওজন। ড. মেডিরাট্টা দৃশ্যত এই সাফল্যে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এই সময়ে কৃষ্ণ মেননের মন্ত্রীত্ব শেষ হয়ে গেল, ফলে তার প্রতিশ্রুত দ্বিতীয়বার ফ্লাইং মেশিনে চড়তে পারলেন না। একটা দেশীয় হোভারক্র্যাফট সামরিক বাহিনীতে সংযোজন করার যে স্বপ্ন তার ছিল, সে স্বপ্ন অনেকেরই ছিল না। প্রকৃত পক্ষে, এমনকি আজও, হোভারক্র্যাফট আমদানি করতে হয় আমাদের মতোবিরোধের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। আমার জন্য এটা ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। যত দূর আমার ধারণা ছিল যে আকাশ পর্যন্ত হচ্ছে সীমা, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সীমা আরও নিকটের ব্যাপার। কিছু বাউন্ডারি আছে যা নির্দেশ দেয় জীবনকে এতটা ওজন তুমি তুলতে পার; এতটা দ্রুত তুমি শিখতে পার; এতটা পরিশ্রমের সঙ্গে তুমি কাজ করতে পার; এতটা দূর তুমি যেতে পার।

.

বাস্তবের মুখোমুখি হতে আমি অনিচ্ছুক ছিলাম। আমার হৃদয় মন আমি সঁপে দিয়েছিলাম নন্দীতে। আমি হতাশ হয়েছিলাম আর আমার মোহভঙ্গ ঘটেছিল। বিভ্রম ও অনিশ্চয়তার এই সময়টায় শৈশবের স্মৃতি ফিরে এসেছিল আমার কাছে আর সেগুলোর নতুন তাৎপর্য আবিষ্কার করেছিলাম আমি।

পক্ষী শাস্ত্রী বলতেন, সত্য অন্বেষণ করো, সত্য তোমাকে মুক্তি দেবে। বাইবেলে বলা হয়েছে, চাও এবং তুমি পাবে। একদিন ড. মেডিরাট্টা আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাদের হোভারক্র্যাফটের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। যখন বললাম যে ওড়ার মতো নিখুঁত অবস্থায় যন্ত্রটা রয়েছে, তিনি আমাকে বললেন আগামীকাল গুরুত্বপূর্ণ একজন দর্শনার্থীর জন্য প্রদর্শনের আয়োজন করতে। আমি যতদূর জানতাম, পরের সপ্তাহে কোনো ভিআইপির সফরসূচি ছিল না আমাদের গবেষণাগারে। যা হোক ড. মেডিরাট্টার নির্দেশ আমি পৌঁছে দিলাম আমার সহকর্মীদের কাছে আর আমরা নতুন এক আশার সঞ্চার অনুভব করলাম।

ড. মেডিরাট্টা পরদিন একজন দর্শনার্থীকে নিয়ে এলেন আমাদের হোভারক্র্যাফটের কাছে একজন লম্বা, সুদর্শন, দাড়িওয়ালা লোক। তিনি যন্ত্রটা সম্পর্কে আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তার চিন্তার স্বচ্ছতা ও বিষয়মুখিতায় আমি চমৎকৃত হলাম। আপনি কি আমাকে এই যন্ত্রে চড়াতে পারেন? তিনি জানতে চাইলেন। তার অনুরোধে আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠলাম আমি। শেষ পর্যন্ত, এই একজনকে পাওয়া গেল যিনি আমার কাজে আগ্রহী হলেন।

আমরা দশ মিনিট হোভারক্র্যাফটে চড়লাম, মাটি থেকে কয়েক সেন্টিমিটার ওপরে। আমরা ঠিক উড়ছিলাম না, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বাতাসে ভাসছিলাম। দর্শনার্থী আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন আমার নিজের সম্পর্কে, হোভারক্র্যাফটে চড়ানোর জন্য ধন্যবাদ দিলেন এবং চলে গেলেন। তবে যাবার আগে নিজের পরিচয় : দিয়ে গেলেন তিনি ছিলেন অধ্যাপক এমজিকে মেনন, টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর পরিচালক। এক সপ্তাহ পর, আমার কাছে একটা ফোন এল ইন্ডিয়ান কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ (ইনকপার) থেকে। রকেট ইঞ্জিনিয়ারের একটা পোস্টে আমাকে ইন্টারভিউ দিতে ডাকা হলো। সেই সময়ে আমি ইনকসপার সম্পর্কে যা জানতাম তা হলো, বোম্বাইতে (এখন মুম্বাই) টিআইএফআর-এর ট্যালেন্ট পুল নিয়ে গঠিত একটা কমিটি, ভারতে মহাকাশ গবেষণা সংগঠিত করার জন্য যার উদ্ভব।

ইন্টারভিউতে হাজির হতে আমি বোম্বাই গেলাম। ইন্টারভিউতে আমাকে যে সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে সে সবের ধরন সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। এ নিয়ে পড়াশোনা করার অথবা অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার মতো সময় ছিল না হতে। লক্ষ্মণা শাস্ত্রীর কণ্ঠে ভগবৎ গীতা প্রতিধ্বনিত হলো আমার কানে:

সকল প্রাণী দ্বিত্বের মোহ নিয়ে জন্মায়…. অভিভূত থাকে কামনা ও ঘৃণা থেকে উত্থিত দ্বিত্বের দ্বারা…. কিন্তু যাদের মধ্যে পাপ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যারা দ্বিত্বের প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত, তারা স্থিরচিত্তে আমার উপাসনা করে।

আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে বিজয়ী হওয়ার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে বিজয়ী হওয়ার দরকার নেই মনে করা। তুমি যখন স্বাভাবিক আর সন্দেহ মুক্ত থাকবে, তখনই তুমি ভালো ফলাফল করতে পারবে। ঘটনা যেভাবে ঘটবে সেভাবেই নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। যেন অধ্যাপক এমজিকে মেননের সফর কিংবা ইন্টারভিউতে হাজির হবার জন্য টেলিফোন ইত্যাদিতে আমার কিছু যায় আসে না, এটাই সর্বোত্তম মনোভাব হবে বলে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম।

আমার ইন্টারভিউ নিলেন ড. বিক্রম সারাভাই, তার সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক এমজিকে মেনন এবং তৎকালীন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি মি. শরাফ। কামরায় যখন আমি প্রবেশ করলাম, তখনই তাদের উষ্ণতা ও বন্ধুসুলভ মনোভাব আমি অনুভব করতে পারলাম। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে ড, সারাভাইয়ের উষ্ণতায় আমি চমৎকৃত হলাম। ইন্টারভিউ গ্রহণকারীরা সাধারণত যেমন অহংকার ও পৃষ্ঠপোষকসুলভ মনোভাব দেখিয়ে থাকে কোনো তরুণ ইন্টারভিউ প্রদানকারীর সঙ্গে তার কোনো চিহ্নই ছিল না সেখানে। ড, সারাভাইয়ের প্রশ্ন আমার বিদ্যমান জ্ঞান ও দক্ষতা খুঁড়ে তুলল না; বরং তারা ব্যস্ত ছিলেন যে সম্ভাবনা আমি ধারণ করি নিজের মধ্যে তা আবিষ্কার করায়। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে যেন আরও বড়ো কিছু সন্ধান করছিলেন। পুরো সাক্ষাৎকারের বিষয়টি আমার কাছে মনে হলো সত্যের সামগ্রিক এক মুহূর্ত, যার মধ্যে আমার স্বপ্ন বড়ো এক ব্যক্তির বড়ো এক স্বপ্নে আবৃত ছিল।

আমাকে পরামর্শ দেওয়া হলো কয়েক দিন থেকে যাবার জন্য। যাহোক, পরদিন সন্ধ্যায় আমাকে নির্বাচন করার কথা জানান হলো। রকেট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আমাকে আত্মভূত করা হবে ইনকসপারে। ঠিক এই রকম একটা ব্রেকথ্রর স্বপ্নই দেখে আমার মতো কোনো তরুণ।

ইনকাসপারে আমার কাজ শুরু হলো টিআইএফআর কম্পিউটার সেন্টারে পরিচিতিমূলক কোর্সে। এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এর পরিবেশ থেকে। লেবেল কোনো বিষয় ছিল না। নিজের পজিশন জাহির। করার কিংবা অন্যদের প্রতিকূলতার বস্তু হওয়ার প্রয়োজন ছিল না কারো।

১৯৬২ সালের দ্বিতীয়ার্ধের কোনো সময়ে ইনকসপার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, থুম্বায় একটা ইকুয়ারিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন স্থাপন করা হবে। থুম্বা ছিল কেরালা রাজ্যের অন্তর্গত ত্রিবান্দ্রাম (এখন থিরুভানাথাপুরাম)-এর নিকটবর্তী মৎস্যজীবীদের নিঝুম এক গ্রাম। আহমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির ড, চিটনিস এ জায়গাটিকে উপযুক্ত লোকেশন হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, কারণ এ জায়গাটি ছিল পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ইকুয়াটরের অত্যন্ত সন্নিকটে। ভারতে আধুনিক রকেট-ভিত্তিক। গবেষণার এই ছিল সূচনা। থুম্বায় নির্বাচিত স্থানটির অবস্থান ছিল রেললাইন ও সমুদ্র উপকূলের মাঝখানে, প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং মাপে প্রায় ৬০০ একর। এই এলাকার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল একটা বিশাল গির্জা, সেই জায়গাটাও অধিগ্রহণের দরকার ছিল। ব্যক্তিগত পক্ষের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ সবসময়ই অসুবিধাজনক। আর কালক্ষেপণের ব্যাপার, বিশেষ করে কেরালার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। এর ওপর আরও সমস্যা, ধর্মীয় স্থান অধিগ্রহণ। ত্রিবান্দ্রামের তৎকালীন কালেক্টর কে, মাধবন নায়ার দারুণ কৌশলে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলেন। রাইট রেভারেন্ড ড, ডেরেইরার আশীর্বাদ ও সহযোগিতা নিয়ে তিনি সমস্যার সমাধান বের করে দেন।

ড. ডেরেইরা ১৯৬২ সালে ছিলেন ত্রিবান্দ্রামের বিশপ। শীঘ্রই সেন্ট্রাল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট (সিপিডব্লিউডি)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরডি জন পুরো এলাকা রূপান্তরিত করে ফেললেন। সেন্ট মেরি ম্যাগডালিন গির্জাটি হলো থুম্বা স্পেস সেন্টারের প্রথম অফিস। প্রার্থনার কামরাটা ছিল আমার প্রথম গবেষণাগার, বিশপের কক্ষটা ছিল আমার ডিজাইন ও ড্রয়িং-এর অফিস। আজকের দিন পর্যন্তও গির্জাটাকে রাখা হয়েছে পূর্ণ মহিমায় এবং বর্তমানে এটাকে বানান হয়েছে ভারতীয় মহাকাশ জাদুঘর।

এসবের পরপরই আমাকে আমেরিকায় যেতে বলা হলো সফলভাবে রকেট উৎক্ষেপণ কলাকৌশল বিষয়ক ছয় মাসের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য, দ্য ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)-এর ওয়ার্ক সেন্টারে। দেশের বাইরে যাবার আগে আমি কয়েক দিনের অবকাশ নিয়ে রামেশ্বরমে গেলাম। আমার যে সুযোগ এসেছে তা শুনে আমার বাবা দারুণ খুশি হলেন। তিনি আমাকে মসজিদে নিয়ে গেলেন এবং শুকরানার জন্য বিশেষ নামাজ পড়লেন। আমি অনুভব করলাম স্রষ্টার ক্ষমতা আমার বাবার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আমার মধ্যে এবং আবার ফিরে যাচ্ছে স্রষ্টার কাছে; আমরা প্রার্থনার মধ্যে পুরোপুরি আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম।

প্রার্থনার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, আমার ধারণা, সৃষ্টিশীল আইডিয়ার প্রতি উদ্দীপনা জাগান। মনের ভেতরে রয়েছে সফল জীবনের জন্য প্রত্যাশিত সকল ক্ষমতা। চেতনায় উপস্থিত আছে আইডিয়া, যখন তা সুযোগ পায় বেড়ে ওঠার ও আকার নেওয়ার, তখন তা নিয়ে যেতে পারে সফলতায়। খোদা, আমাদের স্রষ্টা, বিপুল শক্তি ও সামর্থ্য জমা রেখেছেন আমাদের চেতনায় ও ব্যক্তিত্বে। প্রার্থনা আমাদের সাহায্য করে এসব শক্তি উৎসারিত করতে।

আহমেদ জালালুদ্দিন ও শামসুদ্দিন আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল বোম্বাই বিমান বন্দরে। বোম্বাইয়ের মতো বড়ো কোনো শহরে এটা ছিল তাদের প্রথম আগমন, ঠিক আমি নিজে যেমন প্রথমবারের মতো নিউ ইয়র্কের ন্যায় কোনো মেগা সিটিতে যাচ্ছি। জালালুদ্দিন ও শামসুদ্দিন ছিল আত্মনির্ভর, ইতিবাচক এবং আশাবাদী মানুষ। নিজেদের কাজ তারা নিয়েছিল সাফল্যের নিশ্চয়তাসহ। এই দুই ব্যক্তির কাছ থেকেই আমি আমার মনের সৃষ্টিশীল ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম। আমি আবেগ ধারণ করতে পারি না। আর বুঝতে পারি অশ্রুতে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। জালালুদ্দিন তখন বলল, আজাদ, আমরা সবসময় তোমাকে ভালোবেসেছি, আর আমরা তোমাকে বিশ্বাস করেছি। আমরা সবসময় তোমাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করব। আমার সামর্থ্যের প্রতি তাদের আস্থার এই বিশুদ্ধতা আমার শেষ প্রতিরোধ ভেঙে দেয়, আর আমার গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *