১৪. রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের পরে

১৪. রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের পরে

ফুলকে দেখো, কী অকৃপণভাবে সুগন্ধ আর মধু দান করে,
কিন্তু যখন তার কাজ শেষ হয়ে যায়, নিঃশব্দে ঝরে পড়ে যায়।

—ভগবদ্‌গীতা।

রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আমার খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। আমাদের এই সুন্দর দেশ ঘুরে ঘুরে প্রতিটি রাজ্যে গিয়ে কীভাবে মানুষ সেখানে বেঁচে থাকে, তাদের পরিবেশ এবং সমস্যা স্বচক্ষে দেখা আর তারা জীবনে কতটা সুখী তা উপলব্ধি করা ছিল প্রথম বছরে আমার অন্যতম লক্ষ্য। কেরল উপকূলের নিকটবর্তী লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জ একমাত্র স্থান যেখানে পরিদর্শনে যেতে পারিনি বলে আমি অনুতপ্ত। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব আকর্ষণ থাকে। সরলতা আর উষ্ণতার যে অন্তঃসলিলা প্রবাহিত হয় তা কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়।

অন্যরা এই ধরনের সফর কী চোখে দেখে তা জানা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ‘Outlook’ পত্রিকায় একটা প্রতিবেদন আমি উদ্ধৃত করছি-‘কালাম একজন সদা ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রপতি, যিনি দফতরে ১০ মাসের মেয়াদে ২১টি রাজ্য ইতিমধ্যে পরিদর্শন করেছেন। যা সম্ভবত ৫ বছরের মেয়াদকালে কোনও রাষ্ট্রপতি যা করে থাকেন তার চাইতেও বেশি। তিনি এই ধরনের ঝড়ের মতো ভ্রমণে যথেষ্টসংখ্যক এমনকী সংখ্যায় ১৫টি পর্যন্ত কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করেন, ব্যস্ত কর্মসূচিতে যাতে যথাসম্ভব সুস্থ থাকতে পারেন তার জন্য আগের দিন রাত্রে পৌঁছন…।’

রাষ্ট্রপতি মেয়াদকাল সমাপ্ত হলে পরে আমি দুটি ক্ষেত্রে সন্তুষ্টবোধ করেছিলাম। যখন আমি রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করি তখন ছাত্রমহলে একটা বিষণ্ণতা ও নৈরাশ্যবোধ কাজ করছিল। আমি তাঁদের কাছে গিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে বলতাম। চেষ্টা করতাম তাঁদের উৎসাহিত করতে। বলতাম, যুবসমাজের কারও ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা করার প্রয়োজন নেই, কারণ ভারত ভালভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। ভারতবর্ষের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের উন্নতি ঘটছে, তাঁদের বলেছিলাম। অবশ্যই এই উন্নয়নের হার সাম্প্রতিককালে বর্ধিত হয়েছে। আমার মেয়াদকাল শেষে যুবসমাজের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছিল। তাঁরা উন্নত ভারতে বাস করতে চেয়েছিলেন এবং তার জন্য তাঁরা কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন।

রাষ্ট্রপতির ব্যস্ততাপূর্ণ জীবনের বাইরে কীভাবে আমি মানিয়ে নেব ভেবে অনেকে আশ্চর্য হতেন। যদিও রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগে আমি সক্রিয়ভাবে লেখা, শিক্ষকতা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনুপ্রেরণা দান করা এবং সেমিনার ও বৈঠকে যোগদানে নিযুক্ত ছিলাম। এই রোজনামচায় ফিরে যাওয়াই আমার ইচ্ছে ছিল। আমার কাছে চেন্নাইয়ের আন্না বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদের ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বা আইআইআইটি (Indian Institute of Information Technology), পন্থনগরের জি বি পন্থনগর কৃষি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, অহমদাবাদ ও ইন্দোরের আইআইএম, খড়গপুর আইআইটি, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বা বিএইচইউ এবং আরও অনেক স্থানে শিক্ষকতার প্রস্তাব এসেছিল।

মনশ্চক্ষে দেখতে গেলে ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত আমার জীবনের লক্ষ্য আরও বর্ধিত হয়েছে। আমার শিক্ষকতা এবং গবেষণা এখন পন্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুসংজ্ঞায়িত হয়েছে। আমার লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা কীভাবে ভারতের দ্বিতীয় সবুজবিপ্লবে এক সঞ্চালক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াতে পারে। পন্থ বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের প্রথম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় গবেষণামূলক কৃষি উৎপাদনের জন্য বিস্তৃত ক্ষেত্র আছে। ভারতের প্রথম আইআইটি খড়গপুরে আমি সাম্মানিক অধ্যাপক বা ডিসটিংগুইশড প্রফেসর হিসেবে সামাজিক রূপান্তর ও নেতৃত্ব বিষয়ে অধ্যাপনা করেছিলাম। হায়দরাবাদের আইআইআইটি-তে আমি তথ্যপ্রযুক্তি এবং জ্ঞান উৎপাদিত বিষয়ে শিক্ষাদান শুরু করেছিলাম যা ইন্ডিয়া ২০২০ লক্ষ্যে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। বিএইচইউ এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রযুক্তি এবং গ্রামীণ অর্থনীতি রূপান্তর ঘটানোয় তার বহুমাত্রিক দিক বিষয়ে অধ্যাপনা করেছি। অহমদাবাদের আইআইএম এবং লেক্সিংটনে Gatton College of Business and Economics, USA-এ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ বিষয়ক একটি ইন্টার-অ্যাকটিভ কোর্স ম্যানেজমেন্টে স্নাতক ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ছাত্ররা ২০২০ সালের পূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিযোগিতামূলক দশ দফা রেখাচিত্র উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে নানা কৌশল এবং উন্নয়নের জন্য অভিনব ধারণাগুলি নিবেদন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ একদল ছাত্র PURA-কে সরাসরি বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বে প্রচেষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করছে।

বিদেশের অনেক আমন্ত্রণ পাই। এখনও, দফতর ত্যাগ করার পরেও আমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, রাজনৈতিক এবং শিল্পমহল থেকে, এ ছাড়া আমেরিকা যুক্তরাজ্য, ব্রিটেন, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ড, কোরিয়া, ইজরায়েল, কানাডা, ফিনল্যান্ড, নেপাল, আয়ারল্যান্ড, সংযুক্ত আরবশাহী, তাইওয়ান, রাশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে বিশেষ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সফর করেছি। সফরের সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শন করেছি, শিল্প এবং বিশ্ব যুব সম্মেলনে যোগদান করেছি, এক উন্নত ভারতের লক্ষ্য মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি এবং মূল্যভিত্তিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অন্য রাষ্ট্রের অংশীদারিত্বের গুরুত্ব ব্যক্ত করেছি। এখনও পর্যন্ত আমি ১,২০০-এর বেশি কার্যক্রমে যোগদান করে ১৫ লাখ মানুষের সঙ্গে, বিশেষত তরুণদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তাদের সঙ্গে তরুণ সমাজের স্বপ্ন আমি বণ্টন করে নিয়েছিলাম, তারা কীভাবে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উন্নয়নের মহান লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা সহযোগে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠতে চায়। এই প্রচেষ্টা এখন ওয়ার্ল্ড ভিশন ২০৩০-তে উন্নীত হয়েছে।

প্রতিটি ঘটনা আমার জীবনে নবদিগন্তের সূচনা করেছে। যখন আমি অতীতচারণ করি, তখন আত্মবিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করি ঘটনাগুলির দরুন যে পালাবদল ঘটেছিল সেখান থেকে আমি কী শিক্ষা পেয়েছিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগুলি যথেষ্ট জটিল ও ঘটনাগুলি কালানুক্রমিকভাবে একে অপরের থেকে একেবারে আলাদা। তা সত্ত্বেও, নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য আমি যে আকাঙ্ক্ষা বোধ করি তা সমস্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি। এইভাবে জীবন সমৃদ্ধ হয়।

একজন যা-কিছু করতে চায় তার সমস্ত কিছুর জন্য সময় বার করা খুব কঠিন। সত্যি কথা বলতে কী, আমার কার্যসূচিগুলো খুব জীবন্ত বলে মনে হয়। আগের তুলনায় আমার জীবন আরও কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছিল আর ভাবছিলাম নিজেকে কীভাবে আরও একটু জায়গা দেব। এই তো একদিন আগে আর কে প্রসাদ, যিনি আমার কর্মসূচি এবং কার্যক্রমসূচি দেখাশোনা করেন, তাঁকে ঠাট্টা করে বলছিলাম, কীভাবে শুক্রবার মহীশুর থেকে ফিরেই সোমবারের জন্য মোরাদাবাদ এবং রামপুরের কার্যক্রম নির্দিষ্ট করেছিল। গভীর রাত্রে গাড়িতে করে দিল্লি ফিরে আসার আগে ওখানে চারটে অনুষ্ঠানে যোগদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বুধবার প্যান আফ্রিকান ই-নেটওয়ার্কে একটা অভিভাষণ এবং তারপর বৃহস্পতিবার গুয়াহাটি, শুক্রবার রাতে দিল্লি ফিরে আবার শনিবার সকালে মন্ত্রণাসভার জন্য লখনউতে বিমানে গমন। সাম্প্রতিক মাস, যেমন মে মাসের তালিকাবদ্ধ অনুষ্ঠানসূচি নিম্নলিখিত। প্রতিদিনকার পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎকার যার সংখ্যা খুব-একটা সামান্য নয়, বাদ দেওয়া হয়েছে।

২০১২ সালের মে মাসের তালিকা:

১ মে, মঙ্গলবার

• বোকারো পরিদর্শন: বোকারো ইস্পাত কেন্দ্র পরিদর্শন, প্রযুক্তিবিদদের উদ্দেশে এবং চিন্ময় বিদ্যালয়ের উদ্দেশে অভিভাষণ প্রদান।

• ‘আমি কী দিতে পারি’ কার্যক্রমের উদ্বোধনে অংশগ্রহণ করব, রাঁচিতে।

৫ এবং ৬ মে, শনিবার ও রবিবার

• চেন্নাই, ত্রিচি এবং কারাইকুড়ি পরিদর্শন

৭ মে, সোমবার

•ছত্তিশগড় সরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৩০ জন ছাত্র এবং শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।

৯ মে, বুধবার

• মথুরায় ‘আমি কী দিতে পারি’ কার্যক্রম স্থাপন করার জন্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শন।

• বৃন্দাবনে বিধবাদের আশ্রম ‘পাগল বাবা আশ্রম’ পরিদর্শন।

১১ মে, শুক্রবার

• বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিভাগের প্রযুক্তি দিবস উদ্‌যাপনের উদ্বোধন।

১২ মে, শনিবার

• বেদান্ত হাসপাতালের উদ্বোধন এবং আজমগড়ের ছাত্রদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেওয়ার জন্য উত্তরপ্রদেশের আজমগড় পরিদর্শন।

১৫ মে, মঙ্গলবার

• জাতীয় সমবায় উন্নয়ন নিগমের সমবায়সমূহ ২০১২-এর আন্তর্জাতিক বর্ষের উদ্বোধন।

১৭-১৮ মে, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার

• সিএমআর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির স্নাতক দিবস উদ্‌যাপনে প্রধান অতিথি।

• মহীশূরের প্রতিরক্ষা খাদ্য গবেষণাগারে স্বর্ণজয়ন্তী বক্তৃতা।

• অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং-এ পরিদর্শন।

• জেএসএস বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন এবং ছাত্রদের উদ্দেশে অভিভাষণ প্রদান।

২১ মে, সোমবার

• মোরাদাবাদের তীর্থঙ্কর মহাবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি।

• রামপুর পরিদর্শন এবং রামপুর জেলার স্কুল ছাত্রদের অভিভাষণ প্রদান।

• সি এল গুপ্ত আই ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করা এবং ডাক্তার/কর্মীদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেওয়া।

• মোরাদাবাদ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি পরিদর্শন ও ছাত্রদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেওয়া।

২৩ মে, বুধবার

• আফ্রকীয় জাতির উদ্দেশে প্যান আফ্রিকীয় ই-নেটওয়ার্ক।

২৪ মে, বৃহস্পতিবার

• গুয়াহাটি পরিদর্শন এবং আইআইটি গুয়াহাটির বার্ষিক সমাবর্তনে অভিভাষণ প্রদান।

২৬ মে, শনিবার

লখনউ-এ হিন্দুস্তান টাইমস-এর হিন্দুস্থান উত্তরপ্রদেশ উন্নয়ন কনক্লেভে অভিভাষণ দান।

কর্মসম্পাদনের বৈচিত্র্যে, এতে যে-কেউ লক্ষ করতে পারবেন, প্রতিটি অভিভাষণে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা এবং বক্তৃতা তৈরি করাও একটা বিশেষ কাজ।

২৬ মে লখনউতে, উত্তরপ্রদেশের উন্নয়নের পরিকল্পনা উদ্ভাবনের জন্য মন্ত্রণাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। যথারীতি বক্তব্য উপস্থাপনার প্রস্তুতির জন্য বেশ কিছু সময় নিয়েছিলাম। আমি যে-যে বিষয়গুলো তুলে ধরতে চেয়েছিলাম সেগুলো ওখানে উপস্থিত বিশেষজ্ঞ এবং নতুন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে দেখে খুশি হয়েছিলাম। আটত্রিশ বছর বয়সি অখিলেশ যাদব দেশের কনিষ্ঠতম মুখ্যমন্ত্রী।

উত্তরপ্রদেশ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদে সহজাতভাবে সমৃদ্ধ। দেশের ১০০ মিলিয়ন তরুণদের মধ্যে, প্রতি পঞ্চম ব্যক্তি উত্তরপ্রদেশের অধিবাসী। আমার বিশেষজ্ঞ বন্ধুরা আমায় বলেছেন ২০১৬ সালের মধ্যে সারা বিশ্ব জুড়ে যে ১০০টা দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের সৃজন ঘটবে, তার মধ্যে শুধু এই রাজ্য থেকেই সরাসরি আটটি গড়ে উঠবে।

উত্তরপ্রদেশের অর্থনৈতিক রূপরেখা বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ অনুসারে এখানকার জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশ কৃষি এবং কৃষিজাত কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত এবং রাজ্যের উপার্জনের ৪৬ শতাংশ কৃষি থেকে অর্জিত হয়। একাদশতম পরিকল্পনা পর্বকালীন সময়ে রাজ্যে ৭.৩ শতাংশ মোট রাজ্য অন্তর্দেশীয় উৎপাদন বা জিএসডিপি (গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) নথিবদ্ধ করেছে, যা তার ৬.১ শতাংশ লক্ষ্যকে অতিক্রম করেছে। রাজ্যে ২.৩ লক্ষেরও বেশি ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা রয়েছে। বর্তমানে ওখানে ২.৫ লক্ষেরও বেশি বেকার যুবক-যুবতী রয়েছে যার মধ্যে ০.৭ লক্ষ সংখ্যক হল ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে।

এ-সমস্ত কিছু মনে রেখে আমার প্রেজেন্টেশন মূল্যসংযোজিত কর্মসংস্থান উদ্ভাবনার মাধ্যমে মাথাপিছু উপার্জন বর্তমান ২৬,০৫১ টাকা থেকে ১০০,০০০ টাকারও বেশি বৃদ্ধি করার উপায়, ১০০ শতাংশ হারে সাক্ষরতা প্রসার, শিশু মৃত্যু হার বা আইএমআর (ইনফান্ট মর্টালিটি রেট) ১০-এর নীচে নামিয়ে আনা এবং কুষ্ঠরোগ, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু এবং যক্ষ্মার মতো ব্যাধি রাজ্য থেকে নির্মূলীকরণ করার কথা বিবেচনা করেছিল।

২০০ মিলিয়ন মানুষকে সক্ষম করার এই লক্ষ্যগুলো কীভাবে সম্পাদন করা সম্ভব আমি তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলাম।

আমি যে পরামর্শগুলি দিয়েছিলাম তার মধ্যে একটি ছিল উত্তরপ্রদেশের এক কর্মদক্ষতার মানচিত্র তৈরি করা। অর্থাৎ এমন মানচিত্র তৈরি করা যা রাজ্যের প্রতিটি জেলার শিল্প, সংগীত, হস্তশিল্প, কৃষিজাত দ্রব্য এবং বিশেষ ধরনের রন্ধনপ্রণালী প্রভৃতির দিকগুলো দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা চিহ্নিত করবে।

প্রেজেন্টেশনে আরও অনেক নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা ছিল। আমার মনোবাসনা দ্রুত উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনক্ষম পরিকল্পনাসমগ্র রাষ্ট্রে প্রযুক্ত হোক যাতে প্রক্রিয়া পারস্পরিক এবং ফলভিত্তিক হয়।

আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে যে ১২৩ চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা ইন্দো-ইউ এস পারমাণবিক চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত তার সামরিক ও অসামরিক পারমাণবিক ব্যবস্থা পৃথক করতে রাজি হয় এবং তার যাবতীয় অসামরিক পারমাণবিক ব্যবস্থাগুলিকে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি বা IAEA (International Atomic Energy Agency)-র সুরক্ষা বন্দোবস্তের অধীনে নিয়ে আসে। এর পরিবর্তে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে ‘সম্পূর্ণ’ অসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতার লক্ষ্যে কাজ করতে সম্মত হয়। দীর্ঘমেয়াদি আলাপ-আলোচনার পর IAEA-র সঙ্গে সুরক্ষা বন্দোবস্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল জোট বা ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) সরকারকে ২০০৪ সালের ২২ জুলাই এক আস্থা ভোটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

এই আস্থা ভোটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল বাম দলগুলি যারা ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন জানাচ্ছিল। এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরতা বিষয়ে অংশীদার হতে তারা অসম্মত হয়। সমাজবাদী দলের সভাপতি মুলায়ম সিং যাদব এবং তাঁর পূর্বতন সহকারী অমর সিং পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে মানসিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন এবং সরকারকে সমর্থন বজায় রাখবেন কি না সে-বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। এই চুক্তি ভারতের পক্ষে অনুকূল হবে নাকি পশ্চিমের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক মুনাফা বিবেচনা করে করা হচ্ছে, সে-বিষয়ে তাঁদের মনে অনিশ্চয়তা ছিল। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মুলায়ম সিং যাদব এবং অমর সিং উভয়েই আমার সঙ্গে আমার ১০ রাজাজি মার্গ-এর বাড়িতে দেখা করতে এবং এই চুক্তি স্বাক্ষর করলে ভারতের পক্ষে ভাল ও খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁদের বলেছিলাম, ভারতবর্ষকে থোরিয়ামভিত্তিক পারমাণবিক রি-অ্যাক্টরে স্বনির্ভর হতে হবে। এর অর্থ, আমাদের উন্নয়নমূলক কার্যের জন্য পরিচ্ছন্ন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন। এই চুক্তি ইউরেনিয়ামের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বর্তমান অভাব অনেকটা মিটিয়ে দিতে সাহায্য করবে।

আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছিল ২০১১ সালের মার্চে, জাপানের ফুকোসিমায় সুনামি তাণ্ডবের পরে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র, বিশেষত তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে নির্মীয়মাণ পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শন। বিক্ষোভকারীরা স্থানীয় গ্রামবাসী, তাঁরা চাইছিলেন কুড়ানকুলামের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হোক এবং সেখানকার ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। এঁদের সমর্থন করছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলি বা এনজিও। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে ভারতের পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এবং এই নিয়ে অগ্রসর হওয়া কাঙ্ক্ষিত কি না সেই সম্পর্কে এক বিশদ বিস্তৃত পর্যালোচনা করেছিলাম। ইংরেজি ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে বিশ্লেষিত হয়েছিল ভারতের প্রয়োজনীয় উন্নয়নের জন্য কেন এই প্রযুক্তি এত জরুরি।

পাশাপাশি, আমি আমার টিম নিয়ে ২০০০ মেগাওয়াট থার্ড জেনারেশন প্লাস প্ল্যান্ট (third generation plus plant) পর্যবেক্ষণ করতে কুড়ানকুলাম গিয়েছিলাম। শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষা বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে এবং কীভাবে মানুষের আশঙ্কা সম্বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, বিশেষত আলোড়ন সৃষ্টিকারী ফুকোসিমা ঘটনার পর তা আমি উপলব্ধি করতে চেয়েছিলাম। আমি সারাদিন বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম এবং শক্তিকেন্দ্রের নানান ধরনের সুযোগসুবিধা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। সুরক্ষাব্যবস্থায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষা ব্যবস্থার চারটে মূল দিক আছে— গঠনগত অখণ্ড সুরক্ষাব্যবস্থা (Structural integrity safety), তাপীয় জলপ্রবাহ সুরক্ষা ব্যবস্থা (Thermal hydraulic safety), বিকিরণ সুরক্ষা ব্যবস্থা (Radiation safety), নিউট্রনিক সুরক্ষা ব্যবস্থা (Neutronic safety) এবং এই চারটে প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেছিল।

পরে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম শক্তিকেন্দ্রের আশপাশের গ্রামগুলোর জন্য একটা লাগোয়া বিশেষ PURA কমপ্লেক্স গড়ে ওঠা প্রয়োজন যা শিক্ষা, প্রশিক্ষণ সুযোগ এবং মূল্যসংযোজিত কর্মসংস্থানে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তা করবে।

এই বন্দোবস্তগুলি প্রয়োগ করা হয়েছে দেখে আমি আনন্দিত। সরকার ঘোষণা করেছেন যে, শক্তিকেন্দ্রের দ্বারা অর্জিত লভ্যাংশের ২ শতাংশ সমাজকল্যাণ, গ্রামীণ উত্তরণ এবং কুড়ানকুলাম অঞ্চলের বাসিন্দাদের আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির জন্য ব্যয় করা হবে। শক্তিকেন্দ্রের সম্পাদনকার্য শক্তিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা লক্ষ্য অর্জনের অংশ হয়ে উঠবে।

.

গত পাঁচ বছর আমার অসংখ্য বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করার, দেশ-বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এবং অধ্যয়নে নিত্যসঙ্গী হওয়া, সমাজের রূপান্তর সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাপকসংখ্যক ম্যানেজমেন্ট ছাত্রদের শিক্ষক হওয়া এবং তাৎপর্যপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি নিবেদন করার সৌভাগ্য হয়েছে। সর্বোপরি, আটটি রাজ্যে আপৎকালীন জরুরি ব্যবস্থাপন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জীবনরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করানোর অনুঘটন সম্ভব করেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *