৬. অন্য সকলের কাছ থেকে শিক্ষা

৬. অন্য সকলের কাছ থেকে শিক্ষা

“আমি যেন নিঃসহায় মানুষের রক্ষাকর্তা হতে পারি
সর্ব পর্যটকের জন্য পথের দিশারী হতে পারি;
যারা (জল) পার হতে চায়
তাদের সবার জন্য আমি যেন একটা সেতু, একটা নৌকা, একটা জাহাজ হতে পারি।”

-আচার্য শান্তিদেব
৮ম শতকের বৌদ্ধগুরু

সকল মানুষের মন কীভাবে মিলিত হয়ে সাফল্যকে প্রতিষ্ঠাদান করে তা আমায় মোহিত করে। এ খুব সহজ পন্থা নয়, আশানুরূপ সিদ্ধিলাভের ঘাটতির কারণ হিসেবে বলা চলে এতে নানা মতের সমাবেশ। রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নসাধন কালে দলবদ্ধভাবে আমাদের অনেক কাজ করতে হত। আমি কাজ করতে করতে মানুষের ভাবনাচিন্তার পদ্ধতিগুলো কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে এবং তাঁদের কাছ থেকে শিখতে শুরু করি। ইন্ডিয়া ২০২০কে স্পষ্টরূপে বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার পদ্ধতি এই অভ্যাসকে আরও জোরালো করেছিল। রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরবর্তীকালে অভিজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ মানুষের আদর্শ, মতামত এবং সমালোচনা থেকে লাভবান হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সব ধরনের মতামত ও জিজ্ঞাসা মানবোন্নয়নে পথপ্রদর্শনকারী জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের হাজার হাজার ঘটনার মধ্যে সামান্য কিছু ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, যা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত করেছে।

উপহার:

আমি অনেকবার এই ঘটনাটি বলেছি, তাই এখন খুব সংক্ষেপে বলব। আমি যখন ছোট তখন আমার বাবা জনাব আভুল পাকির জয়নুলাবেদিন আমায় এক শিক্ষা দিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতালাভের ঠিক পরবর্তী সময়ে। রামেশ্বরম দ্বীপে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল এবং আমার বাবা গ্রামপরিষদের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁকে এজন্য নির্বাচন করা হয়নি যে, তিনি কোনও বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ভুক্ত অথবা বিশেষ কোনও অর্থনৈতিক স্তরের মানুষ ছিলেন। তাঁকে তাঁর চরিত্রমাহাত্ম্যে ও একজন মহৎ মানুষ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল।

যেদিন বাবাকে সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল সেদিন এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি আসেন। আমি তখনও স্কুলে পড়ি, সেসময় জোরে জোরে আমার পড়া তৈরি করছিলাম, এমন সময় শুনলাম দরজায় কেউ করাঘাত করছে। রামেশ্বরমে তখন কেউ বাড়ির দরজা বন্ধ করত না। এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে বাবার খোঁজ করলেন। বাবা তখন সান্ধ্য নমাজ পড়তে গেছেন শুনে তিনি বললেন, বাবার জন্য তিনি কিছু নিয়ে এসেছেন, শুধালেন সেগুলো রেখে যাওয়া যাবে কি না। আমি তাঁকে সেগুলো খাটিয়ার ওপর রাখতে বলে আবার পড়ায় মন দিলাম।

বাবা নমাজ সেরে ফিরে, খাটিয়ার ওপর একটা রুপোর প্লেট এবং উপহারসামগ্রী পড়ে থাকতে দেখে আমায় জিজ্ঞেস করলেন। আমি তাঁকে জানালাম যে এক ভদ্রলোক এসে ওসব ওঁর জন্য রেখে গেছেন। মোড়ক খুলে দেখা গেল দামি কাপড়ের সঙ্গে কয়েকটা রুপোর কাপ, কিছু ফল এবং মিষ্টি রয়েছে। সেসব জিনিসপত্র দেখে বাবা দারুণ বিরক্ত হলেন ও রেগে গেলেন। সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে আমি বাবার খুব আদরের ছিলাম। বাবাকেও আমি ভীষণ ভালবাসতাম। সেদিন প্রথম আমি বাবাকে অত রেগে যেতে দেখলাম এবং সেবার প্রথম বাবার হাতে আচ্ছামতো পিটুনি খেলাম। আমি ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। পরে বাবা আমায় বুঝিয়েছিলেন কেন তিনি অত রেগে গেছিলেন, এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন কখনও কোনও উপহার ওঁর অনুমতি ছাড়া যেন গ্রহণ না করি। তিনি হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিলেন, ‘পরমেশ্বর যখন মানুষকে কোনও কাজে নিযুক্ত করেন তিনি তাঁর প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখেন, এর বাইরে যদি কেউ কিছু গ্রহণ করে সেটা অবৈধ।’

তিনি আমায় বলেছিলেন, উপহার নেওয়া ভাল অভ্যাস নয়। উপহারের সঙ্গে কোনও উদ্দেশ্য জড়িত থাকে যা খুব বিপজ্জনক। ঠিক যেমন বিষধর সাপকে স্পর্শ করা পরিবর্তে বিষদংশন সহ্য করা। আশি বছর বয়সেও এই শিক্ষা আজও আমার মনে দাগ কেটে রেখেছে। ঘটনাটা গভীরভাবে আমার মনে মুদ্রিত হয়ে আমার মূল্যবোধ গঠনে সাহায্য করেছিল। এখনও কেউ যদি আমায় কোনও উপহার দিতে চায় আমার শরীর আর মন শিউরে ওঠে।

পরবর্তীকালে আমি মনুস্মৃতি বা মনুর বিধান পড়েছি-যাকে হিন্দু ধর্মভাবনায় মূলসূত্র হিসেবে মান্য করা হয়। সেখানেও বলা হয়েছে উপহার গ্রহণ করলে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত ঐশ্বরিক শক্তি নির্বাপিত হয়ে যায়। মনু প্রতিটা ব্যক্তিকে উপহার গ্রহণের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। কারণ উপহার স্বীকার করলে গ্রহীতা দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হন। পরিবর্তে তিনি কোনও অনৈতিক বা অবৈধ কাজ করতে বাধ্য হন।

এক সযত্নলালিত মূল্যবোধ ব্যবস্থা

কয়েক মাস আগে, আমার বড় দাদা একদিন আমায় রামেশ্বরম থেকে ফোন করেছিলেন। তাঁর তখন পঁচানব্বই বছর বয়স। তিনি আমার সঙ্গে ফোনে বার্তালাপ শুরু করেছিলেন আমেরিকাবাসী আমার এক ভারতীয় বন্ধুর কথা দিয়ে— বন্ধুটি আমার দাদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আলাপচারিতার মধ্যে আমার বন্ধু দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাদের বাসগৃহটি কত পুরনো। উত্তরে দাদা জানিয়েছিলেন বাড়িটা একশো বছরেরও আগে আমার বাবা তৈরি করেছিলেন। আমার ছোট ভাই এবং উপার্জনশীল নাতিরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন পুরনো বাড়িটা ভেঙে ওই জায়গায় নতুন বাড়ি করার। আমার বন্ধুটি বলেছিলেন ওরকম ঐতিহাসিক স্থান ধ্বংস করা তাঁর মনঃপূত নয়। তাঁর ইচ্ছা কোনও অছির মাধ্যমে এমন একটা ব্যবস্থা করা যাতে বাসগৃহটা জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত হয়, পাশাপাশি আমার ভাই এবং তাঁর পরিবারের জন্য বিকল্প বসবাসের বন্দোবস্ত করা সম্ভব। দাদা আমায় ফোন করেছিলেন জানানোর জন্য যে, তিনি এই প্রস্তাবের বিরোধী— ‘আমি যে বাড়িতে বড় হয়েছি এবং ৯৫ বছর ধরে বাস করছি সে বাড়িতেই আমি থাকতে চাই। আমার যাবতীয় কিছু দিয়ে ওই জায়গাতেই একটা নতুন বাড়ি তৈরি করতে চাই— এ ছাড়া অন্য কোনও বন্দোবস্ত আমার পছন্দ নয়। তুমি তোমার বন্ধুকে সুন্দরভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে দিয়ো।’ দাদার কথায় আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম যে, একজন মানুষ যিনি নিজের শর্তে বাঁচবেন এবং কারও কাছ থেকে কোনও সাহায্য নেবেন না, যতই তা অর্থবহ হোক-না কেন— আমার কাছে এ এক পরমশিক্ষা এবং বড়দাদার মধ্যে আমি আমার বাবার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলাম। বাবা একশো তিন বছর বয়স অবধি বেঁচে ছিলেন এবং আমাদের মধ্যে এই ধরনের ঐতিহ্য বদ্ধমূল গেঁথে দিয়েছিলেন।

এক হজ তীর্থযাত্রা

ব্যস্ত একটা দিন। লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার, ফাইলপত্র পর্যালোচনা করার কাজকর্ম চলছিল। সেইসময় আমার দাদার নাতি মক্কা থেকে ফোন করল। ও আমার জীবনের অন্যতম এক মহান উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছিল। আমার পরিবারের তিনজন সদস্য এক স্মরণীয় আধ্যাত্মিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিন প্রজন্মের তিনজন সদস্য ছিলেন— নব্বই বছর বয়সি আমার দাদা, তাঁর মেয়ে এবং নাতি। এই তিনজন ২০০৫-এর ডিসেম্বর মাসে চেন্নাই থেকে হজ তীর্থ করতে যাত্রা করেছিলেন।

আমার দাদা যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়েছিলেন বলে এই পরিকল্পনাটা আমার হৃদয়ের খুব কাছের ছিল এবং তাঁর ধর্মবিশ্বাসই ছিল তাঁদের হজ তীর্থযাত্রায় পাঠানোর মূল চালিকাশক্তি। সৌদি আরবে আমাদের রাষ্ট্রদূত এই তীর্থযাত্রা সম্পর্কে জানতে পেরে আমায় রাষ্ট্রপতি ভবনে টেলিফোন করেছিলেন, এবং যে-কোনওরকম সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, রাষ্ট্রদূত মহাশয়, শুধু একটা অনুরোধ— আমার দাদার ইচ্ছে তিনি কোনও সরকারি সাহায্য ব্যতিরেকে একজন সাধারণ নাগরিকের মতো হজ তীর্থযাত্রায় যান। এ তাঁর ব্যক্তিগত মনোবাসনা। তীর্থযাত্রার জন্য হজ কমিটি যে সাধারণ পদ্ধতিতে যাত্রী নির্বাচন করেন আমার দাদা সে পদ্ধতির মাধ্যমেই নির্বাচিত হওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর নাতি নিজে গিয়ে নির্বাচন দপ্তরে দরখাস্ত জমা দিয়েছিলেন এবং কমিটির প্রচলিত যদৃচ্ছ নির্বাচন পদ্ধতিতে, ঈশ্বরের আশীর্বাদে তাঁদের বেছে নেওয়া হয়েছিল।

এই তীর্থযাত্রা নানা স্থানে, নানা ধর্মীয় অবশ্যকরণীয় কর্তব্যপালনের মধ্য দিয়ে পঞ্চাশ দিন ধরে চলেছিল।

দাদার সঙ্গে ওঁর কন্যা এবং নাতি ছিলেন, তীর্থযাত্রায় দাদাকে সাহায্য করার জন্য আমি ওঁদের দাদার সঙ্গে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু দাদা সব রকমের অসুবিধে আর অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হওয়ার জন্য বিশেষ প্রাণোচ্ছলতা এবং মানসিক জোর দেখিয়েছিলেন। তিনি শান্ত সমাহিতভাবে নাতিকে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে অনুমতি দিয়েছিলেন এবং তার নির্দেশ কোনও অদলবদল না করে মেনে চলেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তীর্থযাত্রার সময় ওঁর নাতি প্রচণ্ড জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দাদা ওই পরিস্থিতিতে সব দায়িত্বভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন, পরিবারের কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে যা তিনি সর্বদা করে থাকেন। মসজিদ দর্শন, খাওয়াদাওয়ার সমন্বয়সাধন, প্রয়োজন অনুসারে ডাক্তার তলবের দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। ওঁর নাতি আমায় বলেছিল জ্বরের ঘোরে যতটুকু মনে পড়ে রাত্রে দাদা ওর বিছানার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে অন্ততপক্ষে তিন ঘণ্টা ধরে প্রার্থনা করতেন। যখন নাতি সুস্থ হয়ে উঠল আবার তখন পূর্বেকার ছন্দে শান্তভাবে প্রার্থনায় ফিরে গেলেন।

ওঁর নাতি আমাকে শেষ ক’দিনে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল তা বুঝিয়ে বলেছিল। মিনায় তাঁবুতে দিনযাপন করে আরাফতের দিকে তাঁরা এগিয়েছিলেন, আরাফত এমন একটা জায়গা যেখানে ৫০ লক্ষ তীর্থযাত্রী একত্রিত হয়। আমি বেশ কল্পনা করতে পারি দাদা আকাশের দিকে দু’ হাত তুলে প্রার্থনা করছেন।

এরকম এক দিন, দাদার নাতি মূল মসজিদের ওপরের তলে প্রার্থনা সেরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছিল। তীর্থযাত্রীদের সিঁড়ি ব্যবহার করতে হত, কেননা দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য চলমান সিঁড়ি বা এসকেলেটর বন্ধ করে দেওয়া হত। যদিও ওই মারাত্মক ভিড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামা যথেষ্ট কষ্টকর ছিল। ফলে ভিড়ের চাপে নাতির দেওয়ালে পিষে যাওয়ার উপক্রম হল। ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ছটফট করছিল। হঠাৎ ওর মনে হতে লাগল চারদিকের বাতাসের রুদ্ধচাপ একটু যেন হালকা হয়ে গেল এবং ওর চারদিকটা ফাঁকা হয়ে গেল। আসলে ওকে শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে দেখে আফ্রিকা থেকে আগত এক তীর্থযাত্রী এগিয়ে এসেছিলেন। নিজের শক্তসমর্থ চেহারা দিয়ে উপচে পড়া ভিড় থেকে আড়াল করে নাতিকে বাঁচিয়েছিলেন। যখন তাঁরা নীচের তলায় পৌঁছলেন ধন্যবাদ জানানোর সুযোগটুকু না দিয়ে ওই তীর্থযাত্রী কোথাও উধাও হয়ে যান।

দ্বিতীয় ঘটনাটা আরও উৎসাহজনক। আরাফতে প্রার্থনা জানানো হলে ওঁরা মিনায় ফিরলেন। সমস্ত ৫০ লক্ষ তীর্থযাত্রীকে একই দিনে টানা ১৫ কিমি রাস্তা ফিরতে হয়। দাদারা যে গাড়িতে ফিরছিলেন তার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল। মরুভূমিতে তীব্র গরম অথচ আমার দাদা একবিন্দু জল বা খাবার গ্রহণ না করে সারা রাস্তা প্রার্থনা করছিলেন। প্রতি আধঘণ্টায় গাড়ি একটু একটু করে এগোচ্ছিল এবং তাঁরা টানা আট ঘণ্টা ধরে গাড়িতে ছিলেন। শেষপর্যন্ত গাড়ির চালক প্রস্তাব করল যেহেতু গন্তব্যস্থল আর আধঘণ্টাটাক পায়ে হাঁটার রাস্তা সুতরাং ওটুকু রাস্তা হেঁটে যাওয়াই ভাল। দাদার কাছে এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য বলে মনে হল। নাতি দাদার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল। যেতে যেতে রাস্তার একটা ফাটলের কাছে এসে তাঁরা আটকে গেলেন— এবার দাদাকে হুইলচেয়ার থেকে নেমে ফাটল পার হতে হবে। দু’জন তীর্থযাত্রী সমস্যা বুঝতে পেরে দাদাকে ইশারায় হুইলচেয়ারে বসে থাকতে বললেন। এমনকী তাঁর নাতি কিছু বলার আগেই দু’জন এসে হুইলচেয়ার দাদা-সহ তুলে ফাটলের ওপারে পার করে দিয়ে চলে গেলেন। এবারও তাঁরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার সুযোগটুকু পেলেন না।

মাঝদালিফা নামক এক জায়গায় তীর্থযাত্রীদের খোলা প্রাঙ্গণে রাত্রিযাপন করতে হয়েছিল। মরুভূমিতে শীতের রাত্রে, খোলা আকাশের নীচে মাটিতে শুধু মাদুর পেতে শুতে হয়েছিল। পরনের হালকা কাপড় শীতে যথেষ্ট আরামদায়ক ছিল না। ভোরবেলায় শৌচাগারের সামনে সুদীর্ঘ লাইন। যারা বচসা করে সুযোগ পেতে অপারগ তারা শান্ত হয়ে ধৈর্যসহকারে প্রতীক্ষা করছিল। এরকম একটা লাইনে একজন মহিলা প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় এক অল্পবয়সি মেয়ে এগিয়ে এসে ওঁর কাছে প্রার্থনা করল—শৌচাগারে ওকে আগে যেতে দেওয়া হোক, লাইনের আর সকলে ব্যাপারটা মহিলার সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিল। ভদ্রমহিলা সেই মেয়েটিকে যেতে দিলেন। একটু পরে আরও একজন বৃদ্ধা মহিলা এসে ওঁকে একই অনুরোধ জানালেন, ওখানে যারা উপস্থিত ছিল তারা প্রত্যেকেই ভাবছিল এতক্ষণ ধরে অপেক্ষায় থাকা ভদ্রমহিলা হয়তো দ্বিতীয়বার কাউকে সুযোগ দেবেন না। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে দ্বিতীয়বারও ভদ্রমহিলা ওই বৃদ্ধা মহিলাকে তৎক্ষণাৎ যেতে দিলেন। একথা এখানে মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা কিন্তু একে অপরের ভাষা জানেন না, আকারে ইঙ্গিতে তাঁরা মনের ভাব প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু এই ঘটনাংশ আমাদের শেখায় ছোট্ট ছোট্ট ব্যঞ্জনাপূর্ণ কাজ আমাদের জীবনকে মহৎ করে তোলে।

আমার দাদার মেয়ে নাজিমা এবং নাতি গুলাম কে মউনুদ্দিনের কথাবার্তা থেকে আমার এই উপলব্ধি হয়েছিল, যদি সুযোগ দেওয়া হয়, মানুষের প্রতি ভালবাসার অবারিত নদী বিভেদের সব চিহ্নকে মুছে ফেলতে পারে।

ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ’

আমি যখন ২০০৬-এ কোয়েম্বাটুর পরিদর্শনে গেছিলাম তখন ফিল্ড মার্শাল-এর কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটা টেলিফোন এসেছিল। যখন আমায় সংবাদ প্রেরণ করা হল আমি বলেছিলাম, ওয়েলিংটনে সেনাবাহিনীর হাসপাতালে আমি অবশ্যই ওঁর সঙ্গে দেখা করব। ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের কথা বলি—

১৯৯০-র নাগাদ একবার আমি যখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানে চড়ে যাচ্ছিলাম, আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক ছিলেন ফিল্ড মার্শাল এম এইচ এফ জে ‘স্যাম’ মানেকশ’। আমি নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম রক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে। তাঁকে এ কথা বলাতে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তিনি কি অতি সজ্জন ব্যক্তি?’ তাঁর পরের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার বয়স কত?’ উত্তরে জানালাম আমার বয়স উনসত্তর বছর। শুনে তিনি বললেন, ‘আপনি তো নেহাতই বাচ্চা!’ আমি কখনও ভাবিনি যে আমি ফিল্ড মার্শালকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বময় কর্তা হিসেবে পাব। যে মুহূর্তে আমি ওঁর ঘরে ঢুকলাম উনি সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। আমায় উনি কাছে বসতে বলে আমার হাত দুটি ধরে বললেন, ‘কী অসাধারণ রাষ্ট্রপতি আপনি, আমি যখন ক্ষমতায় নেই আপনি তখন একজন সৈনিককে সম্মানিত করছেন।’ আমায় দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, শয্যাশায়ী, তবুও তখনও তাঁর মনে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কার্যোপযোগিতা সম্বন্ধে ভাবনাচিন্তা বজায় আছে। তিনি বললেন যে, প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রতিপক্ষ এবং উদ্ভাবনী প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির কারণে সর্বদা শক্তিশালী করে রাখতে হবে। তিনি আমায় এক কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন করলেন, ‘কালাম আপনি কি বলতে পারেন আর এক দশকের মধ্যে বর্তমান অস্ত্রগুলি কি বরবাদ হয়ে যাবে এবং বৈদ্যুতিন আর সাইবার যুদ্ধপ্রযুক্তি তার জায়গা নেবে?’ ফিল্ড মার্শালের কাছ থেকে শোনা এই প্রশ্ন আমার মনে বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল এবং আমি যখন কোনও এক মহান আধ্যাত্মিক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পৃথিবী থেকে পারমাণবিক অস্ত্রসমূহ নির্মূল করা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলাম তখন আমার ভেতর থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এসেছিল। আমি যখন ফিল্ড মার্শালকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি আপনার জন্য কিছু করতে পারি?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি জানি না, কিন্তু একটা কথা আমি বলতে চাই— আমাদের দেশের ফিল্ড মার্শাল বা তার সম-পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দেশের কাছে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন হতে হবে।’ এই মন্তব্য আমার মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছিল।

দিল্লি আসামাত্রই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য বৈঠক ছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম ফিল্ড মার্শাল মানেকশ’ দেশের জন্য যে মহান কর্তব্য করেছিলেন তার প্রতি আমাদের উপযুক্ত সম্মান জানানো উচিত। ওইদিন সাক্ষাৎকারপ্রার্থী উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য রাত্রিকালীন ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর প্রধানদের কাছে আমি ফিল্ড মার্শাল মানেকশ’ এবং বিমানবাহিনী প্রধান অর্জুন সিং-এর উপযুক্ত সম্মানজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিলাম। তৎক্ষণাৎ আমার সচিব পি এম নায়ারকে ডেকে পাঠালাম। অতীতের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে নোট তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে বললাম। দেশের প্রতি তাঁর অবদানের প্রকৃতি বিবেচনা করে সরকার খুব সন্তুষ্টচিত্তে তাঁর বেতন পুনর্নির্ধারণ করলেন। আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম যে ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ’-এর জীবদ্দশায় এই স্বীকৃতি প্রদান সম্ভব হয়েছিল।

অদ্বিতীয় খুশবন্ত

খুশবন্ত সিং-এর সঙ্গে পরিচয় হওয়া আমার কাছে এক মস্ত অভিজ্ঞতা, উনি এখন নব্বই বছর পার করেছেন। আমি ওঁর লেখা কিছু বই পড়েছি এবং ‘হিন্দুস্থান টাইমস্’ সংবাদপত্রে ওঁর কলামের (Column)-এর একজন উৎসাহী পাঠক। অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন কেন আমি বিশেষ করে ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমার উত্তর ছিল আমি বই এবং তার লেখকদের পছন্দ করি। খুশবন্ত সিং একজন মহান লেখক এবং পঁচানব্বই বছর বয়সেও তিনি অবিরাম লিখে চলেছেন। তিনি ২০০৭ সালে তাঁর কলামে আমাকে নিয়ে লিখেছিলেন। আমি তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে দিচ্ছি। এতে ঈশ্বর সম্বন্ধে ওঁর এবং আমার যে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত হয়েছিল, সেগুলো আমার চিন্তানুযায়ী যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক ছিল।

‘আর কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের প্রজাতান্ত্রিক দেশের একাদশতম রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদকাল সমাপ্ত করে অবসরগ্রহণ করবেন। সর্বোচ্চ পদাধিকারী হিসেবে তিনি ছিলেন মুসলিম ধর্মের তৃতীয় ব্যক্তি। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের দাবির এটাই এক সুষ্ঠু প্রমাণ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে শিক্ষণীয়।

আমার কোনও ধারণা নেই অবসর গ্রহণের পর তিনি তাঁর গবেষণায় ফিরবেন, কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন, না সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করবেন। তিনি সত্তর বছর বয়স পার করেছেন। আমার একবার ওঁর সঙ্গে আধঘণ্টা কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। আমার গৃহে এসে তিনি আমায় সম্মানিত করেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রধান যখন সাধারণ একজন কেরানির সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখন তাঁর বিনম্রতাই প্রকাশ পায়।

আমাদের দু’জনের মধ্যে খুব সামান্যই মিল আছে। তিনি তামিল আর আমি তামিল ভাষায় মাত্র দুটো শব্দ জানি—ওয়ানাক্কাম আর আই-আই-য়ো। তিনি বিজ্ঞানসাধক হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত ধার্মিক। আমি একজন অজ্ঞেয়বাদী এবং বিশ্বাস করি বিজ্ঞান এবং ধর্ম একসঙ্গে পথ চলতে পারে না। একটা হল যুক্তিনির্ভর, আর একটা হল বিশ্বাসনির্ভর। ওঁর সঙ্গে কথা বলে এবং ওঁর লেখা পড়ে মনে হল মহাত্মা গাঁধীর মতোই এঁর ধর্মবিশ্বাস। বাপুর সব মতবাদ গ্রহণ করার অক্ষমতা সত্ত্বেও আমি নিজেকে গাঁধীবাদী বলি। কালামও বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব দেখেন না। যখন আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম যে তিনি কি “শেষ বিচারের দিন” এবং আমাদের সকলকে জীবনের পরে পুরস্কার অথবা শাস্তি নিতে হতে পারে এই বিষয়টি বিশ্বাস করেন, তিনি পাশ কাটানো উত্তর দিলেন, ‘স্বর্গ এবং নরক মনের মধ্যে থাকে…।’

সুতরাং ঈশ্বর সম্পর্কে কালামের মত তা হলে কী? আল্লাহ বনাম ঈশ্বর, খোদা বনাম ভগবান তো নয়। তাঁকে মসজিদ বা মন্দিরে খুঁজে পাওয়ার নয়। তাঁকে যুদ্ধ করে বা আত্মোৎসর্গে খুঁজে পাওয়া যায় না— যেমন আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মের মূল প্রচারকরা করে থাকেন। তাঁরা একে অপরের রক্তপাত করার পর ঈশ্বরসম কণ্ঠে বজ্র ঘোষণা ওঠে:

আলোক থেকে সহসা বজ্রনিনাদ গর্জিত হল

‘শোনো সবাই! আমি তোমাদের কারও নই!

প্রেম ছিল আমার ব্রত, আর তোমরা ঘৃণায় তা অপচয় করেছ,

আমার হর্ষকে হনন করে, জীবনকে শ্বাসরোধ করে।

জেনো: খোদা আর রাম

উভয়েই এক, ভালবাসায় তাঁরা প্রস্ফুটিত।’

কোনও যুক্তিবাদী ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধে কালামের দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনা করতে পারবেন না। কেউ ঈশ্বরকে দেখেন সত্যরূপে, কেউ প্রেমরূপে। কালামের কাছে ঈশ্বরত্ব হল সহানুভূতি…।’

আমি ওঁর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিলাম, কারণ আমি মনে করি খুশবন্তের মতো লেখকের আমার লেখা নিয়ে অতটা সময় ধরে পর্যালোচনা করা এবং ঈশ্বর, ধর্ম ও সৎ মানুষ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক গুণ সম্পর্কে আমার অভিমত নিবেদন করা আমার বিবেচনায় খুব বিরল সৌভাগ্য।

দানেই আমাদের প্রাপ্তি

অবশ্যই আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ ধনসম্পদে সৌভাগ্যবান। আমি এখানে এমন এক ব্যক্তির কথা বলব যিনি মুক্তহস্তে দান করেছেন এবং সারা বিশ্বে আনন্দ বিতরণ করেছেন। ২০০৭ সালে আমি শ্রীশ্রীশিবকুমার স্বামীগালুর শততম বার্ষিকী উদ্‌যাপন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার অনুরোধ নিয়ে সিদ্ধগঙ্গা মঠে এক ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ পেলাম। ওখানে পৌঁছে দেখলাম লক্ষ লক্ষ ভক্ত আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন স্বামীজিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য জমায়েত হয়েছে। মঞ্চে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও ধর্মগুরুও আসীন ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য রাখা হয়ে গেলে স্বামীজি এলেন। কোনও লিখিত বিবৃতি ছাড়াই ভক্তকুলের উদ্দেশে তাঁর আশিসবাণী তাত্ক্ষণিক বক্তৃতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন। আমি ওই দৃশ্য দেখে পরমবিস্মিত হয়েছিলাম। একশো বছর বয়সি ওই মহান নেতা ঋজু শরীরে, হাসিমুখে বক্তৃতা দিচ্ছেন এই দৃশ্য আমায় নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছিল কীভাবে তিনি নিজের শক্তি এবং উৎসাহ এত সুন্দরভাবে বজায় রেখেছেন। এর একমাত্র কারণ আমি মনে করি, তিনি মুক্ত হস্তে দান করেছেন। শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অগুনতি অনাথাশ্রম এবং প্রতিদিন হাজার হাজার দুঃস্থ মানুষকে খাদ্যদানের মাধ্যমে প্রভূত দান করেছেন। ওঁর অক্লান্ত সেবাব্রত এবং অশিক্ষা ও সামাজিক বৈষম্য বিলোপসাধনের প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে ওই অঞ্চলের অনেক মানুষকে উন্নীত করেছিল। আমি এটা লিখতে অনুপ্রাণিত হলাম—

আমি কী দিতে পারি?

হে আমার সহ-নাগরিক বন্ধু,

তুমি দিয়ে দেহমনে অশেষ আনন্দ পাও।

তোমার দেবার সবকিছু আছে।

যদি তোমার জ্ঞান থাকে, বণ্টন করো।

যদি তোমার সংস্থান থাকে, নিঃস্বকে দান করো।

হৃদয় আর মস্তিষ্ক ব্যবহার করে

পীড়িতের যন্ত্রণা দূর করো

ব্যথিত হৃদয়কে উৎফুল্ল করো,

দেবার বদলে পাবে অপার আনন্দ।

সর্বশক্তিমান তোমার সমস্ত কর্মোদ্যোগ আশীর্বাদ করবেন।

প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে ধ্যানধারণার আদানপ্রদান

ডিআরডিএল-এর অধিকর্তা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা, ক্যাবিনেটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি পদমর্যাদাকালে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে ধ্যানধারণা আদানপ্রদানের সৌভাগ্য আমার হয়েছে, যেমন-ড. সতীশ ধাওয়ান, ড. রাজা রামান্না, ড. ভি এস অরুণাচলম, আর ভেঙ্কটরামন, পি ভি নরসিংহ রাও, এইচ ডি দেবেগৌড়া, আই কে গুজরাল, অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং ড. মনমোহন সিং। এই যোগাযোগ ভীষণ অর্থবহ ছিল এবং আমার হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তা এবং ইসরো প্রধান ড. সতীশ ধাওয়ানের কাছ থেকে শিখেছিলাম কোনও জটিল লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে হলে সবসময় তার চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বলতেন কখনও কোনও সমস্যা যেন তোমার নিয়ামক না হয়। তুমি হবে সমস্যার পরিচালক। সমস্যাকে পরাজিত করো ও সাফল্য লাভ করো। কোনও জটিল কর্ম সম্পাদনে নিযুক্ত যাঁরা, তাঁদের কাছে এ এক মহৎ শিক্ষা। ড. রাজা রামান্না এবং ড. অরুণাচলম কোনও ব্যক্তির যোগ্যতা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে এবং জটিল কর্ম সম্পাদনের উপযুক্ত ব্যক্তি নিযুক্ত করার কুশলতা প্রদর্শন করেছিলেন। আর ভেঙ্কটরামন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষার জন্য ব্যাপকাকারে সশস্ত্র বহুগুণক ব্যবস্থার চাহিদা আন্দাজ করে এ কার্যক্রমে উত্তরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, যা আজকের দিনে বহুল পরিমাণে কাজে আসছে।

নরসিংহ রাও অসম্ভব স্বচ্ছ চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, দেশের উন্নয়নমূলক সমস্ত বিষয় তাঁর করায়ত্ত ছিল। একবার, তিনি যখন প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা কমিটির সভাপতিত্ব করছেন, তখন ASC (Army Supply Corps) জোগান এবং পরিবহণের মহানির্দেশক দুগ্ধজাত খামার-এর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব এবং পরিকল্পনার আধুনিকীকরণ বিষয়ে একটা প্রেজেন্টেশন করছিলেন। প্রেজেন্টেশন চলাকালীন মহানির্দেশক উল্লেখ করেছিলেন, মহিষের বদলে সে জায়গায় জার্সি গোরু আনতে চান। রাও তত্ক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন আমাদের দেশের পক্ষে মহিষ তুলনাহীন, কেননা এদের ক্রান্তীয় অঞ্চলে সস্তা খোরাক ও খাদ্যে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব— পরিবর্তে পাওয়া যায় উচ্চমাত্রার প্রোটিনযুক্ত দুধ। এ ধরনের দেশীয় লাভজনক সম্পদ দেশ হারাতে পারে না। এখান থেকে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, প্রস্তাব পুনরায় পর্যালোচিত হবে এবং সেনা দুগ্ধ খামার জরুরি সংশোধনীয় ক্রিয়া গ্রহণ করবে।

অন্য এক ক্ষেত্রে ১৯৯৫ সালে কোনও একসময় যখন আমি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আত্মনির্ভরশীলতার ওপর প্রতিবেদন পেশ করছিলাম, রাও চটজলদি পর্যবেক্ষণ করলেন যে আমরা এমন এক ব্যবস্থা রাখছিলাম যে, প্রতিরক্ষা ব্যয় যেন মোট অন্তর্দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) ৩ শতাংশে কম থাকে। তিনি বলেছিলেন এরকম কোনও সীমা নির্দিষ্ট করা উচিত নয়। বরং রাষ্ট্রের জন্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যা-কিছু অত্যাবশ্যকীয় তার ওপর কাজ করা উচিত। জিডিপি হয়তো ক্রমাগত পরিবর্তনশীল হবে, কিন্তু তার দরুন আমাদের ব্যয় বাড়বে-কমবে তা অভিপ্রেত নয়।

আরও একটা উদাহরণের কথা আমার মনে পড়ে— প্রযুক্তি প্রদর্শকের কার্যকলাপের অতিরিক্ত ডিআরডিও-কে অগ্নি উৎক্ষেপণ ব্যবস্থার লাগাতার অনুসন্ধান ব্যবস্থার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হত, যা সেনাবাহিনীতে যোগ করতে পারত। রাও অবিলম্বে প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এক পৃষ্ঠার প্রস্তাবনায় বিনা প্রশ্নে ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের কার্যক্রমের অনুমোদন দিয়েছিলেন। সময়মতো কার্যনির্বাহ এবং সেনাবাহিনীতে উৎক্ষেপণ অস্ত্র প্রেরণ করার জন্য প্রয়োজনভিত্তিক পরিচালন ব্যবস্থার নকশা গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, এই কার্যক্রম ড. মনমোহন সিং-এর অনুমোদন পেয়েছিল, সাধারণ নিয়মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পৌঁছনোর আগে যাঁর কাছে পৌঁছনোর কথা। পরে এই নথি কার্যনির্বাহের নিয়মশৃঙ্খলায় ভারত সরকারের সচিবদের কাছে পৌঁছেছিল। কোনও কার্যক্রমের ধারণা, অনুমোদন এবং প্রয়োগসাধনের এ এক বিপরীত কর্মপ্রণালীর উদাহরণ।

পরবর্তীকালে, ২০০৪ সালে আমার ড. সিং-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর সমগ্র অর্থনীতি সংক্রান্ত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বর্ধিত করেছিলেন, সাম্প্রতিককালে যা ৭ শতাংশ উচ্চতায় পৌঁছেছিল। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তিনি এক উষ্ণ এবং মানবিক স্পর্শ এনেছিলেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর মধ্যে আমি যে-কোনও সিদ্ধান্তগ্রহণে তৎপরতাবোধ লক্ষ করেছিলাম। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রথম করণীয় হিসেবে তিনি আমাকে পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পাদনকার্য দিলেন। সাধারণভাবে বলা যায়, জাতীয় কোনও সমস্যা নিয়ে নিজের কাজ করার ক্ষেত্রে বাজপেয়ী দ্বিধাহীন। আমি আগেই বলেছি, ২০০২ সালের অগস্ট মাসে লালকেল্লার প্রাকার থেকে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ভারতবর্ষ ২০২০ সালের মধ্যে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। ১৯৯৮ সালে এইচ ডি দেবেগৌড়া প্রথমবার ইন্ডিয়া ২০২০-কে জাতীয় কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

.

সৎ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ এক শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যক্তিদের সাক্ষাৎলাভে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *