৩. অন্তিম কিছু ভা

পর্ব ৩ : অন্তিম কিছু ভাবনা

চোদ্দ : নেতৃত্বের গুরুত্ব

আমি সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে অনুরোধ করব এই শপথগুলি অনুধাবন করে সেগুলিকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে। তাহলেই আমরা সকল ক্ষেত্রেই মননশীল নেতৃত্ব পাব, যে নেতৃত্ব আমাদের রাষ্ট্রকে পথ দেখিয়ে সেই শ্রেষ্ঠত্বের দিকে নিয়ে যাবে। নেতৃত্বের গুরুত্বের বিষয়ে আমি বলে সেভাবে ঠিক বোঝাতে পারব না কারণ, তাদের একটিমাত্র লক্ষ্যই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়। ভারতের ইতিহাস থেকে কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নিয়ে আমরা দেখি কেমন ভাবে কয়েকজন নেতা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে এনেছিলেন আমূল পরিবর্তন।

স্বাধীনতা অভিযান

ভারতের স্বাধীনতা অভিযান রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, শিল্পকলা, বিচারব্যবস্থা, বিজ্ঞান এবং শিল্পের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন জন্ম দিয়েছে বেশ কয়েকজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, নিয়োজিত ও আবেগপ্রবণ নেতার। রাজনীতির ক্ষেত্রে বাল গঙ্গাধর টিলক ১৮৮০-র দশকে উচ্চারণ করলেন অগ্নিসম তাঁর সেই উক্তি, ‘স্বাধীনতা আমার জন্মগত অধিকার, এবং তা আমি আদায় করবই’, এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঞ্চার করলেন নতুন জীবন। জামশেদজি টাটা ভারতে লৌহশিল্পের সূত্রপাত করলেন, যদিও সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসকরা তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করেছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, আর বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির স্থাপনা করলেন পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য ১৯১৬ সালে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির রসায়নের অধ্যাপক আচার্য পি সি রায় ছিলেন ভারতে ফার্মাসিউটিকালের পুরোধা পুরুষ।

ভারতীয়-মার্কিনি অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট অধ্যাপক সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর, যিনি ১৯৮৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন, তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, কেমনভাবে ১৯২০ দশকে পাঁচ পাঁচজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ভারতে কাজ করছিলেন। এঁরা হলেন সি ভি রমন, জে সি বোস, শ্রীনিবাস রামানুজন, এস এন বোস এবং মেঘনাদ সাহা। চন্দ্রশেখর বলছেন, এটা এক সুখকর কাকতালীয় ঘটনা নয়। এঁরা প্রত্যেকেই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, ভারতীয় মেধা বিশ্বের যে-কোনও শ্রেষ্ঠ মেধার সমতুল। তিনি আরও বলেছেন, স্বাভিব্যক্তি এবং নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করার এক দুর্দমনীয় অভিপ্রায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে থাকে, তা সে রাজনীতিতেই হোক বা বিজ্ঞানে, এবং তা স্বাধীনতা অভিযানে প্রতীয়মান হয়েছে।

সাহিত্য জগতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কার পেলেন ১৯১৩ সালে। যে সময়ে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল দূর অস্ত্, সেই সময়ে তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর দেশবাসীকে স্বাধীনতার জন্য দৃঢ় বিশ্বাস ও আবেগ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছেন:

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,…

পিতঃ, ভারতেরে সেই স্বাধীনতার স্বর্গে করো জাগরিত

[Where the mind is without fear and the head is held high…

Into that heaven of freedom, my Father, let my country awake.]

সেই সময়েই, মহান তামিল কবি, জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী সুব্রাহ্মনিয়া ভারতী তাঁর দূরদৃষ্টিতে এক মহান ভারতকে দেখলেন, যেখানে স্ত্রীজাতি মুক্ত ও যেখানে শিক্ষার বিস্তার হয়েছে। ১৯১০ সালে তিনি স্বাধীনতার জয়গানের এক কবিতায় বললেন, ‘চল সবে উৎসবে মাতি, আমাদের আনন্দময় স্বাধীনতা এসে গিয়েছে।’ সংগীতের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতকে ত্যাগরাজা, মুথুস্বামী দীক্ষিতার এবং শ্যাম শাস্ত্রীর ত্রিমূর্তি কর্ণাটকি সংগীতকে সমৃদ্ধ করে তুললেন। পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতে নবজাগরণ নিয়ে এলেন।

এই সময়ে ভারত বেশ কয়েকজন অনুপ্রাণিত মহিলা নেত্রীকে পেয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের ভীমা বাঈ হোলকার, কিট্টুরের রানি চেন্নাম্মা, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, ঔধের বেগম হজরত মহল, আর বিংশ শতকে সরোজিনী নাইডু, কস্তুরবা গাঁধী এবং অ্যানি বেসন্তের মতো কয়েকটি নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়, তাঁদের অবদানের জন্য— যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক বা রাজনীতিতে।

সবশেষে বহু মহান নেতা যেমন পণ্ডিত জহরলাল নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বোস, সর্দার বল্লভভাই পটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং সি রাজাগোপালাচারি, মহাত্মা গাঁধীর অনুপ্রাণিত নেতৃত্বে স্বাধীনতা অভিযানের সামনের সারিতে থেকে ভারতকে এনে দেন তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতা।

বিক্রম সারাভাই: এক মহান দূরদ্রষ্টা

স্বাধীনতার পর ভারত বহু মহান নেতার দেখা পেয়েছে। এঁদের অনেকের সঙ্গেই কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বিমুগ্ধতা নিয়ে আমি স্মরণ করি তেমনই একজনকে— ড. বিক্রম সারাভাই। ইসরো-তে সাত বছর আমি তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। তাঁর এক-পৃষ্ঠার বিখ্যাত এক বক্তব্যে আমি দেখেছিলাম ভারতের অন্তরিক্ষ যোজনার উন্মেষ।

তাতে বলা হয়েছে: ‘তার বিশাল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভাণ্ডার ও যুবশক্তির আধার নিয়ে ভারতের নিজস্ব রকেট সিস্টেম সমূহ (স্যাটেলাইট লঞ্চিং ভেহিকল) নির্মাণ করা জরুরি, এবং তার সঙ্গে নির্মাণ করা উচিত তার নিজস্ব যোগাযোগ, রিমোট সেন্সিং এবং আবহবিদ্যাগত নভোযান, এবং নিজস্ব ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, যাতে উপগ্রহ যোগাযোগ, রিমোট সেন্সিং এবং আবহবিদ্যা ভারতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্তরিক্ষ প্রকল্পে যে কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়েছে তার সবই সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য।’

এই মহান নেতা যিনি ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করা আমার কাছে এক দুর্দান্ত শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। এই চার দশক পর যখন আমি সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্যটি ফিরে দেখি, আমি বিস্মিত হয়ে যাই তার অভীষ্ট ফল দেখে। আজ ভারত যে-কোনও উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান, যে-কোনও নভোযান তৈরি করতে সক্ষম, এবং তাদের উৎক্ষেপণ হয় ভারতীয় ভূমি থেকেই। চন্দ্রযান ও মঙ্গলযান উৎক্ষেপণ করেছে ভারত। অন্য গ্রহে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় চলছে। ভারত প্রমাণ করেছে নভোবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা কার্যকরী যোগাযোগ, সম্পদ ম্যাপিং, বিপর্যয়ের ভবিষ্যবাণী এবং তার ম্যানেজমেন্ট প্রদান করতে সক্ষম।

ড. সারাভাই ভারতের জন্য এমন এক পথের দিশা দেখিয়েছেন যা কেউ কোনওদিন ভাবতে পারেননি। আমি একটি বিশেষ ঘটনার কথা বলতে চাই যা তাঁর এই বৈশিষ্ট্যটিকে প্রকাশ করেছে। ১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে তিনি আর তাঁর দল মিলে অনেকগুলি বিকল্প জায়গা দেখে একটি জায়গা নির্বাচন করেন যেটি অন্তরিক্ষ গবেষণার জন্য প্রযুক্তিগতভাবে উপযোগী। উচ্চ বায়ুমণ্ডলে আয়নোস্ফেরিক ও ইলেক্ট্র্রোজেট গবেষণার জন্য আদর্শ যে চৌম্বক বিষুবরেখা, তার কাছেই অবস্থিত বলে নির্বাচিত হল কেরালার থুম্বা।

নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি বিশেষ স্থান খুঁজে পাওয়া ছিল ড. সারাভাইয়ের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথা অনুযায়ী কেরালা প্রশাসনের কাছে তিনি প্রথমে গেলেন। জায়গাটির এবং তটরেখার প্রোফাইল দেখে জানানো হল যে সেখানে হাজারো মত্স্যজীবীর বাস। সেখানে রয়েছে একটি প্রাচীন গির্জা, বিশপের বাড়ি ও একটি স্কুল। সুতরাং প্রশাসনের মনে হয়েছে জায়গাটি এই কাজে দেওয়াতে সমস্যা হবে। বিকল্প হিসেবে অন্য কোনও জায়গা ব্যবস্থা করে দিতে তাঁরা প্রস্তুত। জানানো হল যে, একজনের সঙ্গে দেখা করতে, যিনি এই ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন।

তিনি হচ্ছেন ওই অঞ্চলের বিশপ রেভারেন্ড ফাদার পিটার বার্নার্ড পেরেরা। আমার মনে আছে, এক শনিবার বিকেলে ড. সারাভাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সেই সাক্ষাৎটি হয়ে দাঁড়াল ঐতিহাসিক। আমরা অনেকেই ছিলাম প্রত্যক্ষদর্শী।

‘ওহে বিক্রম, তুমি তো বাচ্চাদের গৃহ, আমার গৃহ এবং ঈশ্বরের গৃহ চাইতে এসেছ,’ বললেন বিশপ। ‘সে কী করে সম্ভব?’

উভয়েরই একটি বিষয়ে মিল ছিল। কঠিন সময়েও তাঁরা দুজনেই হাসতে পারতেন। বিশপ, ড. সারাভাইকে রবিবার সকাল ৯টায় গির্জায় আসতে বললেন। ড. সারাভাই আর তাঁর দল তা-ই গেলেন। তাঁরা যখন গির্জায় পৌঁছলেন তখন প্রার্থনা চলছিল। প্রার্থনার শেষে বিশপ, ড. সারাভাইকে মঞ্চে ডেকে নিলেন।

‘প্রিয় সন্তানবৃন্দ, ইনি একজন বিজ্ঞানী, ড. বিক্রম সারাভাই,’ তিনি তাঁর শ্রোতাদের বললেন। ‘বিজ্ঞান কী করে? আমরা সকলেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আলো জ্বালাই, এমনকি এই গির্জায়ও। আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি এই মাইকের মাধ্যমে, যা প্রযুক্তির দান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে রুগিদের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হয়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির সাহায্যে মানবজীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং তার মান বৃদ্ধি করেছে। যাজক হিসেবে আমি কী করি? আপনাদের সুখ শান্তির জন্য প্রার্থনা করি। ছোট করে বলতে গেলে, বিক্রম আর আমি একই কাজ করি। বিজ্ঞান আর অধ্যাত্মবাদ উভয়ই সর্বশক্তিমানের কাছে মানবজাতির শারীরিক ও মানসিক সমৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। প্রিয় সন্তানেরা, বিক্রম বলছে এক বছরের মধ্যে তটরেখার কাছেই আমাদের এই ব্যবস্থার বিকল্প তৈরি করে দেবে। প্রিয় সন্তানেরা, আমরা কি আপনাদের আবাস, আমার আবাস, ঈশ্বরের আবাস বিজ্ঞানের এক মহান কর্মকাণ্ডের জন্য দিয়ে দিতে পারি?’

নিশ্চুপ স্তব্ধতা সব দিকে। তারপর সকলে, যাঁরা সেদিন গির্জায় সমবেত হয়েছিলেন, উঠে দাঁড়িয়ে একযোগে বলে উঠলেন, ‘আমেন।’

গির্জার জায়গায় আমরা তৈরি করলাম আমাদের ডিজ়াইন কেন্দ্র, যেখানে আমরা শুরু করলাম রকেট অ্যাসেমব্লির কাজ। বিশপের বাড়িটি হল আমাদের বিজ্ঞানীদের কর্মস্থান। সেইখানেই আমরা চালু করলাম থুম্বা ইকুয়েটোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন, যা পরবর্তী সময়ে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার হিসেবে স্থাপিত হয়। ওইখানে অন্তরিক্ষ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের সূত্রপাত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্পেস সেন্টারের স্থাপনা হতে লাগল। গির্জাটি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে হাজার হাজার মানুষ জানতে পারছেন ভারতের অন্তরিক্ষ গবেষণার অত্যন্ত ক্রিয়াশীল ইতিহাস। এর সঙ্গে তাঁরা জানতে পারছেন এক বিজ্ঞানী এবং এক অধ্যাত্মবাদী নেতা, এঁদের দু’জনের মহৎ চিন্তা-ভাবনার খবর। থুম্বার বাসিন্দারা বিকল্প স্থানে পেলেন তাঁদের নতুন স্কুলবাড়ি এবং আরাধনার স্থান।

এই ঘটনাটি যখনই স্মরণে আসে, আমি দেখি কেমন করে আলোকপ্রাপ্ত আধ্যাত্মিক জগতের এবং বিজ্ঞান জগতের নেতারা একযোগে মানবকল্যাণে কাজ করেন। থুম্বা ইকুয়েটোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন এবং পরবর্তীতে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের জন্ম দেশকে লঞ্চ ভেহিকল, অন্তরিক্ষ যান এবং অন্তরিক্ষ প্রয়োগ সংক্রান্ত দক্ষতা এনে দিল। এবং তার ফলে ভারতের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়ে এক অভাবনীয় স্তরে পৌঁছয়।

আজ আমাদের মধ্যে না আছেন ড. সারাভাই, না আছেন ফাদার পেরেরা, কিন্তু তাঁরা আমাকে ভগবদ্গীতার এই পঙ্ক্তিগুলি মনে করিয়ে দেন: ‘ফুলকে দেখ কেমন উদারভাবে সুগন্ধ ও মধু বিতরণ করছে। সে সকলকেই তা দিচ্ছে, দিচ্ছে তার ভালবাসা। কাজের শেষে সে চুপিসারে ঝরে যায়। ফুলের মতো হও— নানা গুণ সত্ত্বেও নিরভিমান।’ কী অসাধারণ এই বার্তা মানবজীবনের ধর্ম বিষয়ে।

অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান: সাফল্য ও অসাফল্য সমানভাবে স্বীকার করা

তিন দশক আগে, আমি যখন ইসরো-তে কাজ করছি, আমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা পেয়েছিলাম যা কোনও বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারবে না। ইসরো-র তদানীন্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান আমাকে একটি কাজ দিলেন। প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান এসএলভি-৩ নির্মাণ করে রোহিণী উপগ্রহকে কক্ষপথে পাঠাতে হবে। এটি ছিল সেই সময়ে সব থেকে উচ্চপ্রযুক্তির অন্তরিক্ষ যোজনা। সমগ্র অন্তরিক্ষ প্রযুক্তি সমাজ প্রস্তুত এই কর্মকাণ্ডের জন্য। হাজারও বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদ দিনরাত কাজ করে ১০ অগাস্ট ১৯৭৯-এ এসএলভি-৩-কে উৎক্ষেপণ করা গেল।

এসএলভি-৩ আকাশে উঠল ভোর বেলা। প্রথম পর্যায়টি আমরা পেরিয়ে গেলাম মসৃণভাবে। সবক’টি রকেট এবং সিস্টেমগুলি ঠিকঠাক কাজ করলেও প্রকল্পটি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারল না কারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ সিস্টেমটির কাজ ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কক্ষে ঢোকার পরিবর্তে রোহিণী গিয়ে ডুবল বঙ্গোপসাগরে। মিশনটি হল অসফল।

অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীহরিকোটায় সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপক ধাওয়ান আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করলেন যে, এই অসাফল্যর দায়ভার তাঁরই। কিন্তু আমি ছিলাম প্রোজেক্ট ডিরেক্টর এবং মিশন ডিরেক্টর। পরের বছর, ১৮ জুলাই ১৯৮০, এসএলভি-৩ উৎক্ষেপণ করে আমরা যখন সাফল্যের সঙ্গে রোহিণীকে কক্ষপথে নিক্ষিপ্ত করতে পারলাম, একটি সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। এইবার অধ্যাপক ধাওয়ান আমাকে সামনে ঠেলে দিয়ে সাফল্য কাহিনির অংশীদার করে সংবাদমাধ্যমের সামনে উপস্থিত করলেন।

এই ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা পেলাম তা হল, একজন সত্যিকারের নেতা সকল সময়ে সাফল্যের গৌরব যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের দেন, আর অসাফল্যের দায় নেন নিজে। একেই বলে নেতৃত্ব। ভারতের বিজ্ঞান জগতের সৌভাগ্য যে, তেমন নেতৃত্বই সে পেয়েছে। এবং তার ফল হয়েছে তার বহু কৃতিত্ব।

যে-সব তরুণরা আগামী দিনের নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। যে মহান পাঠটি আমরা পেলাম তা হল, সত্যিকারের নেতা তা তিনি রাজনীতি, প্রশাসন, বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প, বিচারব্যবস্থা বা মানব-সংক্রান্ত অন্য যে ক্ষেত্রেই হোক, তাঁর ভিতর মননশীলতা যেমন থাকবে তেমনই অসাফল্যকে স্বীকার করে নেওয়ার ক্ষমতাও থাকতে হবে, এবং সাফল্যের কৃতিত্ব তাঁর দলের সদস্যদের দিতে হবে।

ড. ব্রহ্ম প্রকাশ: ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্য

যে নেতা সম্পর্কে এবার বলতে চাই তিনি ধাতুতত্ত্ববিদ ড. ব্রহ্ম প্রকাশ, যিনি আণবিক বস্তু নিয়ে কাজের জন্য খ্যাত। আমি যখন এসএলভি-৩-এর প্রোজেক্ট ডিরেক্টর, ড. প্রকাশ তখন ছিলেন বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের অধিকর্তা। ভারতে অন্তরিক্ষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য তিনি অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি আমার মনে করতে ভাল লাগে, তা হল, যে মুহূর্তে এসএলভি-৩ প্রকল্পটি অনুমোদন পেল, বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের বিভিন্ন ল্যাবরেটরি এবং ইসরো-র বিভিন্ন কেন্দ্র, সঙ্গে স্পেস ডিপার্টমেন্ট, সকলে একত্রে একটি দল হিসেবে কাজ করতে থাকল লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদে। ১৯৭৩ থেকে ’৮০, এই সময়টায় বিশেষ করে, মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা, সঙ্গে অন্যান্য ছোট ছোট প্রকল্পের দাবির সঙ্গে যুঝতে হচ্ছিল। কিন্তু তিনি ব্যবস্থা করলেন যাতে যাবতীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত কাজ এসএলভি-৩ এবং তার উপগ্রহে নিয়োজিত হয়।

আমি বলেছি ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্যর জন্য ড. প্রকাশ বিখ্যাত। এর কয়েকটি উদাহরণ দিই। রোহিণী উপগ্রহকে অক্ষে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য এসএলভি-৩ প্রকল্পটিতে প্রথমবারের জন্য তিনি নিয়ে এলেন এক সুসংহত ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা। এসএলভি-৩ ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনা আমার টাস্ক টিম রচনা করার পর তিনি স্পেস সায়েন্টিফিক কমিটির প্রায় পনেরোটি চিন্তন বৈঠক করলেন তিন মাসে। বহু আলোচনার পর এই ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনাটি ড. প্রকাশ সই করে দেন, এবং তা হয়ে দাঁড়ায় সমগ্র সংস্থাটির নির্দেশাবলি। এটি ছিল জাতীয় দূরদৃষ্টিকে কর্মকাণ্ডের নানান যোজনার রূপে নিয়ে আসার শুরুও।

এই ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনার উদ্ভাবনের সময়ে আমি খেয়াল করলাম নানা ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী মতামত। বহু ব্যক্তি এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে নিজেদের ব্যক্তিসত্তাকে হারাবার ভয়ে, মিটিংগুলিতে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। কিন্তু ড. প্রকাশ তাঁর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সারাক্ষণ বজায় রাখতেন। মানুষের ক্রোধ, ভয় এবং সংস্কার, সব অদৃশ্য হয়ে যেত এই মানুষটির চিন্তার আভিজাত্যে।

আজ ইসরো-তে অন্তরিক্ষ যোজনাগুলি, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলি এবং উৎক্ষেপণ অভিযানগুলি এক সুসংহত ও সহযোগিতামূলক আবহে হচ্ছে। এই মহান মহাত্মাটির কাছে আমি শিখেছি যে, কোনও প্রকল্প শুরুর আগেই একটি প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান সঠিকভাবে প্রণয়ন করে তাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা আবশ্যক। সেই প্ল্যানে থাকবে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ, কেমনভাবে বিভিন্ন পর্যায় এগোতে হবে, কেমনভাবে আগে থেকেই আসন্ন কঠিন অবস্থার বিষয়ে সতর্ক হয়ে তা সমাধানের ব্যবস্থা করে নিতে হবে— যার মধ্যে সময়, কার্যকারিতা এবং সূচি হচ্ছে সব থেকে জরুরি। ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্য নিয়ে আসার জন্য তাঁকে সাধুবাদ।

ই শ্রীধরন: আবেগ নিয়ে লক্ষ্য পূরণ

‘মেট্রো মানব’ ই শ্রীধরন হলেন ইদানীংকালের এক নেতা যাঁকে ভারত পেয়েছে। নিজের ভিশনকে প্যাশন দিয়ে এক মিশনে রূপান্তর করে কোটি কোটি মানুষের জীবন পালটে দেওয়ার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত এই মানুষটি। প্রথমে কোঙ্কান রেলওয়ে এবং পরে দিল্লি মেট্রোর মাধ্যমে ভারতের সরকারি পরিবহণের চিত্রটিই তিনি পালটে দিয়েছেন।

বহু বাধা সত্ত্বেও কোঙ্কান রেলওয়ে প্রকল্পটি সাত বছরে শেষ হয়। তার পথের ৮২ কিমি. অংশে রয়েছে তিরানব্বইটি টানেল। নরম মাটি কেটে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। তার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ৭৬০ কিমি. এবং রয়েছে ১৫০টিরও বেশি ব্রিজ। এটি এমন এক সরকারি প্রকল্প যার জন্য অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ তেমন তাত্পর্যের নয়, এবং সময়সীমাও বৃদ্ধি না করেই সম্পন্ন করা হয়। এটি তাই এক বিরাট এবং অভূতপূর্ব কৃতিত্ব বলে মানা হয়।

দিল্লি মেট্রো রেল কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর করে দেওয়া হয় তাঁকে। ঘোষিত বাজেট ও সময় মেনেই সব ক’টি নির্দিষ্ট কাজ শেষ হয় তাঁর নেতৃত্বে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সময়ের আগেই শেষ হয় কাজ। তিনি তাঁর প্রকল্পের কাজ রাজনৈতিক চাপ এবং প্রভাব মুক্ত রাখার জন্য খ্যাত ছিলেন। তিনি তাঁর প্রকল্পের কাজকে দ্রুত শেষ করার জন্য রাজনৈতিক মহল থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতেন। তাঁর প্যাশন এবং ভিশন ভারতকে তার প্রথম সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থা দিয়েছিল। ১৫০টি স্টেশন এবং ২০০ কিমি. দৈর্ঘ্যের দিল্লি মেট্রো বিশ্বে দ্বাদশতম বৃহৎ মেট্রো ব্যবস্থা। ২৬ লক্ষ মানুষকে সে প্রতিদিন পরিসেবা দেয়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপুঞ্জ কার্বন ক্রেডিট দিয়ে শংসাপত্র দিয়েছে একে— বিশ্বের প্রথম মেট্রোরেল এবং রেললাইনভিত্তিক ব্যবস্থা যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকে হ্রাস করে শহরের দূষণের মাত্রাকে হ্রাস করেছে।

শ্রীধরণের দিল্লি মেট্রোর কাজ এতটাই সফল ছিল এবং ভারতের কাছে তার গুরুত্ব ছিল এতটাই যে ফ্রাঁস তাঁকে Chevalier de la Legion d’honneur (নাইট অফ দ্য লিজিওন অফ অনার) সম্মানে ২০০৫ সালে ভূষিত করে, এবং ভারত সরকার তাঁকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম নাগরিক সম্মান পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করে ২০০৮ সালে। তিনি ২০০৫ সালের শেষে অবসর নেবেন বলে ঘোষণা করেন, কিন্তু তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় দিল্লি মেট্রোর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। দিল্লি মেট্রোর সঙ্গে ষোলো বছরের কর্মজীবনের পর তিনি অবসর নেন ৩১ ডিসেম্বর ২০১১। অবসরের পর তিনি সামান্যই বিশ্রাম পেয়েছেন, কারণ তাঁকে কোচি, লখনউ, জয়পুর, বিশাখাপট্টনম এবং বিজয়ওয়াড়ার মেট্রোর কাজে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত করে নেওয়া হয়।

বিশ্ব নেতৃত্ব

এঁদের মতো নেতারাই ভারতকে শ্রেষ্ঠ করে তুলে ধরছেন এবং আগামীতেও তুলে ধরবেন। কিন্তু আমি প্রায়ই বলে থাকি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য রেখে এগোনো একটি অপরাধ। সুতরাং আমরা এক শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র গড়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি না। এটি একটিই পৃথিবী যা সমগ্র মানবসমাজ ভাগ করে নেয়, তাই আমাদের লক্ষ্য হবে একে এক মহান গ্রহে পরিবর্তন করা।

আমি এখানে এক দূরদ্রষ্টা আধ্যাত্মিক নেতা শ্রীঅরবিন্দর স্বপ্নের কথা বলতে চাই। তাঁর প্রথম স্বপ্নটি ছিল এক বৈপ্লবিক অভিযানে ভারতকে মুক্ত করা এবং সংযুক্ত করা। ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭-এ তা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় স্বপ্নটি ছিল এশিয়ার মানুষের পুনরুত্থান এবং মুক্তি। তার সঙ্গে, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে ভারতকে তার পুরনো মহান ভূমিকায় ফিরে যেতে হবে। তাঁর তৃতীয় স্বপ্ন ছিল, সমগ্র মানব জাতির জন্য সত্যনিষ্ঠ, উজ্জ্বল এবং অভিজাত জীবনের জন্য এক বিশ্বব্যাপী সংযুক্তিকরণে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন।

অন্য বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে হাতে হাত রেখে ভারতকে এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে। সকলকে নিয়ে একটি বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবে ন্যায়নিষ্ঠ, সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী পৃথিবী। আমি মনে করি তিনটি লক্ষ্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ:

১। এক আলোকোজ্জ্বল সমাজ: এক সমৃদ্ধিশালী শান্তিপূর্ণ বিশ্বের প্রয়োজনে মূল্যবোধ সম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি।

২। শক্তি ব্যবহারে স্বাধীনতা: এক পরিচ্ছন্ন বসুন্ধরা পাওয়ার যে স্বপ্ন আমরা প্রত্যেকেই পোষণ করি তাকে বাস্তবায়িত করা।

৩। বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের মঞ্চ: সকল রাষ্ট্রের দক্ষতাকে মিলিত করে সংকটপূর্ণ সমস্যাগুলির সমাধান করা, যেমন জলের অপর্যাপ্ততা, সকলের জন্য ভাল মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ক্ষমতার নির্মাণ।

আমাদের সত্যিকারের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য অভিযান এখনও শেষ হয়নি। সে কাহিনি আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। পৃথিবীর পরিবেশ আজ বিপজ্জনক, এবং ভারতের স্বাধীনতা, যা বহু যন্ত্রণা ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে এসেছিল, তাকে সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করতে হবে, তাকে শক্তিশালী করে প্রসারিত করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতার খোঁজ চলবে ক্রমাগত। কঠিন ও দ্রুত কাজের ভিতর দিয়ে সে খোঁজ চলবে এমনভাবে যাতে স্বাধীন ও নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের বিবর্তন ত্বরান্বিত হয়।

ভারত একটি তরুণ রাষ্ট্র এবং সে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে আমরা তাত্পর্যপূর্ণ এক রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন করতে পেরেছি। প্রাকৃতিক রোষ, কয়েকটি যুদ্ধ এবং সীমান্তপারের আতঙ্কবাদের মতো নানান পরীক্ষা এবং ক্লেশের মধ্যে দিয়েই ঘটেছে এই উন্নয়ন। এবং এসবই হয়েছে আমাদের জনসংখ্যা ও রাজনীতির সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই। এতসত্ত্বেও, সবুজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বনির্ভরতা এসেছে এবং আমাদের একশো কোটি মানুষের খাদ্য সংস্থান আমরা করতে পেরেছি। গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রের উন্নতির মাধ্যমে গড় আয়ুর বৃদ্ধি করতে পেরেছি আমরা। আমাদের শিল্প ভিত প্রসারিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পেয়েছে নতুন উদ্যম। উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তিতে, অন্তরিক্ষ, আণবিক শক্তি এবং প্রতিরক্ষা গবেষণায়।

কিন্তু কোনও রাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী সংযোগ আজ একান্তই বাস্তব এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব শান্তি আর সমগ্র মানবজাতির উন্নয়ন নিশ্চিত হলে এক নিরাপদ বিশ্বের সৃষ্টি হবে যেখানে সকল রাষ্ট্রই হবে লাভবান। দারিদ্র্য দূরীকরণ, শক্তির নিশ্চয়তা, পানীয় জলের লভ্যতা এবং পরিবেশ রক্ষা হল আজ মানবজাতির সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। বহু রাষ্ট্রকে ভুগতে হয় সীমান্ত পারের আতঙ্কবাদ এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য। এটি শুধু কোনও একটি দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা নয়— এ আজ সারা বিশ্বের সুখ শান্তিকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে।

সারা পৃথিবীতে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব, ক্রোধ ও হিংস্রতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে ঐতিহাসিক শত্রুতা, স্বৈরশাসন, অবিচার, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মের মৌলবাদ। এই সব মিলিয়ে আতঙ্কবাদের বিস্ফোরণ ঘটছে আজ সারা বিশ্বে। এক সুখ শান্তির পৃথিবী নির্মাণের প্রয়োজনে আমাদের যেতে হবে এই সবের মূলে যে সমস্যা, তার মোকাবিলায়। সেগুলি হল দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং বেকারত্ব।

শান্তির জন্য একটি সমাজের স্থায়িত্ব এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। এই স্থায়িত্ব নির্ভর করে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষার মতো মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির পূরণের উপর। অর্থনৈতিক অথবা সামাজিকভাবে যাঁরা নিম্নস্তরে বাস করেন তাঁদের, উচ্চস্তরে বাস করেন যাঁরা, তাঁদের দ্বারা শোষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অসাম্য কমিয়ে আনতে পারলেই এই শোষণ একভাবে দূর করা যায়। দারিদ্র্য দূর করা এবং সকল মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ নিশ্চিত করার মতো বিশ্বস্তরে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এর ফলেই যাঁদের আছে আর যাঁদের নেই, তাঁদের মধ্যের যে ফারাক, তা কমিয়ে আনা সম্ভব।

কেমনভাবে আমরা তা পারব? পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের উচিত এক সাহচর্য গড়ে তুলে সম্পদের এক বিশ্বব্যাপী ভাগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে সহ-অবস্থান ও সহ-উন্নয়ন দুই-ই চলতে পারে। আগামী কয়েক দশক শক্তি, পরিস্রুত জল ও পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে একটি বিশ্বব্যাপী সংকট থাকবে। বহ রাষ্ট্রকেই এগিয়ে এসে একযোগে একটি ভিশন তৈরি করতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্মের তরুণরা সুখে শান্তিতে বাস করতে পারেন। যখন কোনও রাষ্ট্রের সামনে নির্দিষ্ট মিশনের একটি ভিশন থাকে, তখন আতঙ্কবাদ ও হিংসার মতো সমস্যা নির্মূল হয়ে যায়।

.

পনেরো : ‘পুরা’-র গুরুত্ব

এক সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে যদি আমাকে একটি সুনির্দিষ্ট মিশনের কথা বলতে হয় যেটি বহুদূর যেতে সক্ষম, আমি সেই তৃণমূল স্তরের মিশনের কথা বলব যা আমার হৃদয়ের বড় কাছের— ‘পুরা’। এর সম্পর্কে আমি এই বইয়ে আগে ছুঁয়ে গিয়েছি, কিন্তু আমি এখানে তার সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা করতে চাই। কারণ, আমি মনে করি এই সময়ের চাহিদা পূরণে এটি আদর্শ। ভারত থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রে, এই প্রকল্প সকলকে নিয়ে বৃদ্ধি এবং সুসংহত উন্নয়ন আনতে সক্ষম।

‘পুরা’-র সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত

ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এক দেশে রূপান্তরিত হতে হলে তার ৬০০,০০০ গ্রামে উন্নয়ন সব থেকে জরুরি। তার অর্থ:

১। গ্রামগুলিকে নিজেদের মধ্যে এবং বড় বড় শহর ও মেট্রো শহরের সঙ্গে ভাল রাস্তা ও রেললাইনের মাধ্যমে যুক্ত থাকতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণ ও বহিরাগতদের জন্য অন্যান্য পরিকাঠামো যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য বন্দোবস্ত থাকতে হবে। একে আমরা বলতে পারি সরাসরি সংযোগ।

২। জ্ঞানের স্ফুরণের যুগে, স্থানীয় জ্ঞানের সংরক্ষণ করে তার ব্যাপ্তি আনতে হবে আধুনিক প্রাযুক্তিক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে। উৎকৃষ্ট শিক্ষার নাগাল পেতে হবে গ্রামগুলিকে, শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের কাছ থেকে তা তিনি যেখানেই থাকুন, পেতে হবে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবা, তেমনই জেনে নিতে হবে কৃষি, মাছচাষ, ফুলচাষ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো বিষয়ে সাহায্যর কথা। এর অর্থ গ্রামগুলির বৈদ্যুতিন সংযোগ থাকতে হবে।

৩। ভৌত সংযোগ এবং বৈদ্যুতিন সংযোগ থাকলেই জ্ঞানের সংযোগ ঘটে যাবে। এর ফলে উৎপাদন বাড়বে, অবসর সময়ের ব্যবহার বাড়বে, স্বাস্থ্য কল্যাণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে, উৎপাদনের বাজার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, এবং গুণগত মান সম্পর্কে বোধ এবং স্বচ্ছতা বাড়বে।

৪। এই তিন সংযোগ ঘটলেই রোজগার বৃদ্ধির ক্ষমতা বাড়বে।

সুতরাং, মিশন হিসেবে ‘পুরা’, গ্রামগুলিকে সমৃদ্ধশালী জ্ঞানের কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে দিতে পারে। গ্রামের মানুষকে করে দিতে পারে উদ্যোগপতি। হিসেব বলছে ভারতের জন্য ৭০০০ ‘পুরা’ কমপ্লেক্স প্রয়োজন তার ৬০০,০০০ গ্রামের জন্য যেখানে ৭০ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের বসবাস। সেইভাবে ৩০,০০০ পুরা কমপ্লেক্সের প্রয়োজন সারা বিশ্বের ৩ বিলিয়ন গ্রামীণ অঞ্চলকে এক অর্থনৈতিকভাবে উদ্যমী অঞ্চলে পরিণত করতে এবং সেই সঙ্গে স্থায়ী উন্নয়ন নিয়ে আসতে।

‘পুরা’ চালু করতে ভারত সরকার ১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে, জাতীয় স্তরে বিভিন্ন জেলায় কাজ শুরু করে দিয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ মডেলে। বেশ কয়েকটি কর্মক্ষম ‘পুরা’ চালু করেছে বেশ কিছু শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠান এবং তার সঙ্গে শিল্প মহল। তেমন কয়েকটি প্রকল্প হল তামিলনাডুতে পেরিয়ার ‘পুরা’, মহারাষ্ট্রে লোনি ওয়ারানা ভ্যালি ‘পুরা’ এবং চিত্রকূট ‘পুরা’ মধ্য প্রদেশে।

‘পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড

আমি এবার, “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’ নামের একটি অনন্য স্থায়ী উন্নয়নের ব্যাবসায়িক উদ্যোগ-চালিত মডেল উপস্থাপন করতে চাই। “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর মূল ভাবনাটা হল যে, পরবর্তী প্রজন্মের ‘পুরা’ উদ্যোগের ভাবনার মধ্যে রাখতে হবে যে, তাঁদের মানুষের জীবনধারণের ব্যবস্থাপক হয়েই শুধুমাত্র কাজ করলে হবে না, আরও কিছু করতে হবে। একটি ‘পুরা’ কমপ্লেক্সের গ্রামীণ জনসাধারণের সার্বিক, সুসংহত উন্নতি হল “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর লক্ষ্য। তার সঙ্গে আর একটি লক্ষ্য হল, স্থায়ী সামাজিক-ব্যাবসায়িক মডেলের মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্যোগপতিদের এক উল্লম্ব সংহত নেটওয়ার্ক রচনা করা, যাতে তাঁরা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করে পরস্পরের মূল্যমান বৃদ্ধি করেন। যার ফলে, সকল স্টেকহোল্ডারই হবেন লাভবান।

“পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এ দু’ধরনের উদ্যোগপতি আছে:

১। সম্পদ উদ্যোগপতি:  তাঁদের মূল দৃষ্টি হল চিরাচরিত প্রযুক্তি ও আধুনিক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা মারফত প্রাকৃতিক সম্পদ, ঐতিহ্যগত সম্পদ ও মানবসম্পদের, সঠিক আর্থিক মূল্যায়ন করে প্রত্যেক পরিবারের রোজগারের স্তরকে বৃদ্ধি করা। তাঁরা উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালীর মাধ্যমে এবং উৎপাদনকে বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে, সম্পদকে মূল্য শৃঙ্খলের উপরের দিকে টেনে তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করবেন। তাঁদের কাজের পরিণাম দেখা যাবে ওই গ্রামীণ কমপ্লেক্সের সামগ্রিক জিডিপি-র বৃদ্ধিতে।

২। সামাজিক উদ্যোগপতি:  অন্য শ্রেণিটি, সামাজিক উদ্যোগপতি, সম্পদ উদ্যোগপতিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন। মানব উন্নয়নের সূচক, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির বৃদ্ধির উপর তাঁদের নজর থাকবে। তাঁরা মানুষের বর্ধিত ক্রয় ক্ষমতাকে উত্তম জীবনে পরিণত করার উপর জোর দেবেন। তাঁদের কাজ পরোক্ষ ভাবে প্রতিফলিত হবে শিক্ষার মানের উন্নতিতে, শিশু ও মায়ের মৃত্যু হারের হ্রাসে, পুষ্টির বৃদ্ধিতে, উত্তম গার্হস্থ্যজীবনে, স্যানিটেশন, পরিস্রুত পানীয় জল এবং সঠিক মানের শক্তির ব্যবহারে। এর থেকেই জন্ম নেবে পরিবেশ সচেতনতা, এবং হ্রাস পাবে সামাজিক সংঘর্ষের হার।

“পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর উদ্যোগপতিরা স্থানীয় স্তরে সফল ‘পুরা’ উদ্যোগী, যাঁরা বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাও হতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে একযোগে কাজ করবেন। “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর উদ্যোগপতিরা সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলির সহযোগী হবেন। “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর এক ব্যাবসায়িক নেটওয়ার্ক তৈরি হতে হবে বিবিধ ধারার প্রাযুক্তিক ও ম্যানেজেরিয়াল প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়। সেইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন এন্টারপ্রাইজ়গুলি “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর সহযোগী হয়ে উঠতে পারে, ইক্যুইটি ইনভেস্টার হিসেবে, অথবা বাজারের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরির সাহায্যকারী হিসেবে, বা উত্তম কার্যপ্রণালী ও উৎপাদনের নানান চ্যালেঞ্জের উদ্ভাবনী সমাধান সমূহর জন্য প্রাযুক্তিক সহায়তা প্রদানকারী হিসেবে। এইভাবে সারা বিশ্বের এন্টারপ্রাইজ়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাবসায়িক সংস্থা নিজ নিজ দক্ষতাকে ভাগ করে, গ্রামীণ ও শহরতলি অঞ্চলের অব্যবহৃত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষের উন্নতি নিয়ে আসবে।

ইউজ়ার কমিউনিটি পিরামিড

প্রাকৃতিক সম্পদের হ্রাস প্রাপ্তি এবং জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে আজ মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি অর্থনৈতিক স্তরে স্থায়ী উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে হবে। কী সেই অনন্য উপায় যা স্থায়ী উন্নয়নকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করবে? স্থায়ী উন্নয়নের আমি একটি সুসংহত সমাধানের অনন্য মডেল প্রস্তাব করছি যার নাম দিয়েছি ‘ইউজ়ার কমিউনিটি পিরামিড’ (ইউসিপি)।

কাঠামোগতভাবে ইউসিপি তৈরি হয়েছে এইগুলির সংযোগে:

১। প্রাকৃতিক সম্পদ

স্থায়ী উন্নয়নের মূলে আছে প্রাকৃতিক সম্পদ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে এবং তাদের প্রয়োগে আমরা মানব উন্নতিতে প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে আসছি। কিন্তু সেই সঙ্গে, গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণে, বনানী ধ্বংসে এবং মাটি, জল ও বায়ুকে দূষিত করে আমরা পরিবেশকে দূষিত করেছি। আজ, প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে, আর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে যার ফল, বিশ্ব উষ্ণায়ন।

২। তথ্য ও যোগাযোগ

এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্যের সংগ্রহ, তথ্যের উৎপাদন, তার বিস্তার। প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ এবং পরিবেশের উন্নতির পরিকল্পনা করতে এটি সাহায্য করবে। বর্জ্য, দূষণ, শক্তি, চলন-গমন এবং জীববৈচিত্র্যের মতো বিবিধ ক্ষেত্রে স্থায়ী উন্নয়ন কেমনভাবে করা যায়, তা আধুনিক জিও-স্প্যাশিয়াল অ্যানালিটিকাল সরঞ্জামের সাহায্যে আমরা জানতে পারব।

৩। প্রযুক্তির একত্রীকরণ

প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির কারণে জল, শক্তি, পরিবেশ, দূষণ, বর্জ্য, জীববৈচিত্র্য এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো বিষয়গুলির ম্যানেজমেন্টে নতুন নতুন উৎপাদিত বস্তু ও ব্যবস্থার প্রয়োগ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখি গুজরাতে সৌর প্রযুক্তির সাহায্যে ৭০০ মেগা ওয়াটের প্রথম সৌর উদ্যান; ন্যানো-প্রযুক্তির সাহায্যে নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা; বা ন্যানো-প্যাকেজিং প্রযুক্তির সাহায্যে বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং-এর ব্যবস্থা। এই সবের একত্রীকরণ আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মানবজাতির অগ্রগতিতে একান্ত জরুরি।

৪। সমাজ ভিত্তিক ব্যাবসার মডেল

এক দিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থার অগ্রগতি হচ্ছে, আর অন্য দিকে বিবর্তিত হচ্ছে উদ্ভাবনী ব্যাবসার মডেল যা প্রযুক্তিকে পৌঁছিয়ে দেবে অন্তিম ইউজ়ার বা ব্যবহারকারীর কাছে। এর ফলে কৃষক, মত্স্যজীবী, প্রশিক্ষিত কর্মী এবং গ্রামে বাস করা মানুষজন হবেন ক্ষমতাবান ও সমৃদ্ধ।

৫। পিরামিডের তল

ইউসিপি-তে পিরামিডের একেবারে নীচের স্তরে আছেন ইউজ়াররা বা ব্যবহারকারীরা। তাঁরাই হলেন যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ এবং স্থায়ী উন্নয়নের লাভের অংশীদার। সবশেষে, যাবতীয় কাজের সুবিধা বা উপকার পাবেন তাঁরাই। প্রযুক্তি তাঁদের জীবনধারণের মানের উন্নতিতে সাহায্য করবে। এই কাজ বর্তমানের প্রাকৃতিক সম্পদকে এমনভাবে ব্যবহার করবে যাতে পরবর্তী প্রজন্মগুলি নিরন্তর ব্যবহার করতে পারে এই সম্পদ।

সমাজ ভিত্তিক উন্নতির রাডার

উন্নতির রাডার প্রস্তুত করার কারণ, ইউসিপি কেমনভাবে ইউজ়ারদের লাভবান করেছে, তা পর্যালোচনা ও নজরে রাখা। ন’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এইটি করতে হবে। সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে এই বিষয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়গুলি হল:

১। খাদ্য ও পুষ্টি

২। পানীয় ও কৃষিতে ব্যবহারযোগ্য জল অধিগত করার সুযোগ

৩। স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ

৪। রোজগার করার ক্ষমতা পাওয়া

৫। শিক্ষা ও দক্ষতা নির্মাণের সুযোগ পাওয়া

৬। উত্তম শক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পাওয়া

৭। সমাজ ভিত্তিক সংঘর্ষের অবস্থান

৮। অর্থনৈতিক সাহায্য প্রাপ্তি

৯। পরিচ্ছন্ন ও সবুজ পরিবেশ প্রাপ্তি

সমাজ ভিত্তিক উন্নতির রাডারের তিনটি লক্ষ্য থাকবে। প্রথমটি হল ওই ন’টি বিষয়ের বর্তমান অবস্থা নিরীক্ষণ করা। দ্বিতীয় লক্ষ্যটি হল মাঝামাঝি সময়ের টারগেট রেখে তৃতীয় একটি দীর্ঘ সময়ের লক্ষ্য স্থির করা। তবে তা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমায় বাঁধা রাখতে হবে।

‘পুরা’ ভাবনাটি যখন এইভাবে প্রয়োগ করা হবে, তখন বিশ্বব্যাপী ৩ বিলিয়ন গ্রামীণ জনসাধারণের জীবনের মান উন্নত হবে স্থায়ী উন্নয়নের প্রক্রিয়ায়। সব দিক থেকে উত্তম একটি সাম্যের সুন্দর পৃথিবী তৈরি হবে।

.

ষোলো : উপসংহার

এই বইয়ের ভূমিকায় ভুবনেশ্বর থেকে দিল্লির প্লেনে এক বিদেশি যাত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমি আমাদের জাতীয় চরিত্রের বিষয়ে সেই ঘটনাটি কী নির্দেশ করে, তা বলেছিলাম। তেমনই একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমি বইটি শেষ করি।

এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের একটি মিটিং সেরে আমি সিওল থেকে ২৯ নভেম্বর ২০১১-র রাত্রে একটি ননস্টপ উড়ানে দিল্লি ফিরছিলাম। পরের বছর সিওল নিউক্লিয়ার সিকিউরিটি সামিট সম্মেলনের আগে এই মিটিংটি আয়োজন করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি। এই মিটিং-এ এসেছিলেন বিভিন্ন দেশের আণবিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা। এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের লক্ষ্য ছিল সারা বিশ্বে যে ৫৩৯টি আণবিক শক্তি প্লান্টগুলি রয়েছে তাদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি নির্দেশাবলি প্রস্তুত করা। সেই সম্মেলনের বিষয়ে বিস্তারিত এখানে বলছি না, তবে এক জাপানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং প্রাক্তন কূটনীতিক শিনিচি কিতাওকা আমাকে এবং এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের যে ঘটনার কথা বলেছিলেন, সেইটি বলব।

অধ্যাপকটি বলছিলেন, তাঁর দেশে সেই বছর মার্চ মাসে ফুকুশিমা দাইচির যে আণবিক বিপর্যয়টি ঘটেছিল, তার কথা। ১১ মার্চ ২০১১ সালে তোহোকুতে ভূমিকম্পর জেরে যে সুনামিটি হয়, সেইটি ফুকুশিমা-১ আণবিক শক্তি কেন্দ্রের দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়। ভূমিকম্পর ঠিক পরেই চালু থাকা রিঅ্যাকটরগুলি আপনাআপনি তাদের নিরন্তরভাবে চলতে থাকা ফিশন বিক্রিয়াগুলি বন্ধ করে দেয়। রিঅ্যাকটরগুলিকে যে আপতকালীন জেনারেটরগুলি ঠান্ডা রাখে সেগুলিকে সুনামি ধ্বংস করে দেয়। ফলে, তিনটি নিউক্লিয়ার মেল্টডাউন ঘটে এবং রেডিওঅ্যাকটিভ বস্তু ছড়িয়ে পড়ে। এরপরের কয়েকদিন হাইড্রোজেন-বায়ুর রাসায়নিক বিক্রিয়াজনিত বেশ কিছু বিস্ফোরণ হয়।

তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের চের্নোবিলে ১৯৮৬ সালে ঘটে যাওয়া আণবিক বিপর্যয়ের পর ফুকুশিমা দুর্ঘটনাটির মতো এমন বিপর্যয় পৃথিবী আর দেখেনি। কিন্তু চের্নোবিলে যা ঘটেছিল তা ফুকুশিমাতে দেখা গেল না। একটিও রেডিয়েশন জনিত মৃত্যু ঘটেনি এখানে।

‘দু’টি জাপানি শহর ১৯৪৫ সালে আণবিক অস্ত্রের আক্রমণের শিকার হয়েছিল।’ বললেন অধ্যাপক কিতাওকা। ‘সেটি ছিল অত্যন্ত দুঃসহ এক ট্র্যাজেডি, কিন্তু জাপানি নাগরিকরা তা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে, মাত্র তিন দশকের মধ্যে জাপানকে বিশ্বের সব থেকে অগ্রণী শিল্পসমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। এখন, ফুকুশিমা শক্তি কেন্দ্রটির সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা, জাপানিরা, কখনওই এই সমস্যাকে আমাদের কর্তা হতে দেব না। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আমরা, জাপানিরা, নিজেরাই সমস্যাটির কর্তা হয়ে তাকে পরাস্ত করে সফল হব। এবং বিশ্ব দেখবে এক পরিচ্ছন্ন ও সবুজ আণবিক শক্তি চতুর্দিকে উদ্‌বোধিত হচ্ছে।’

একটি রাষ্ট্র তখনই শ্রেষ্ঠ হয় যখন সে কোনও গভীর চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে, নিজের ভিতরের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রের মানুষ এক হয়ে সমস্যাকে পরাস্ত করে তার উপর কর্তৃত্ব করে। জাপানের মতো এক মহান দেশের এইটিই জাতীয় চরিত্র।

ভারতকে এমন মহান দেশগুলির উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে। আমি যখন ভারতের কোনও পঞ্চায়েতে, গ্রামে বা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনে যাই, এক থেকে দু’ঘণ্টার ভিতরেই আমি বুঝে যাই সেই জায়গা ভাল নেতাদ্বারা ঠিকঠাক প্রশাসিত হচ্ছে কিনা। আমি এও বুঝতে পারি যে সেই জায়গার নাগরিকরা সমবেতভাবে তাদের নিজেদের বাড়ি, আশপাশ, গ্রাম বা শহরের দায়িত্ব নিচ্ছেন কিনা। দুর্ভাগ্যবশত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ নাগরিকদের ভিতর বা তাঁদের নির্বাচিত সরকারের সকল স্তরের প্রতিনিধিদের ভিতর এই স্পিরিটটা দেখতে পাওয়া যায় না।

বিশ্বে যদি ভারতকে তার গরিমার আসনে বসতে হয়, যা তার অবশ্যই প্রাপ্য, তা হলে এই চিন্তাধারার পরিবর্তন করতেই হবে। এ আমাদের সকলের একত্রিত দায়। আমি একান্তভাবে আশা করব এই বই, বিশেষ করে বিভিন্ন জগতের বিভিন্ন ধরনের মানুষের জন্য রচিত শপথগুলি ভারতের নাগরিকবৃন্দকে এই মহান দায়িত্ব নিতে সাহায্য করবে, এবং এক জাতীয় চরিত্র নির্মাণ করবে যাতে আমাদের রাষ্ট্র সারা বিশ্বকে শ্রেষ্ঠত্বের পথে নিয়ে যেতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *