২. শপথ

পর্ব ২ : শপথ

ছয়: যুবসমাজ

একজন শিক্ষক, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। সংসদ এবং বিভিন্ন বিধানসভাগুলিতে রাজনৈতিক নেতা ও সদস্যদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। স্কুলগুলিতে আমার দেখা হয়েছে পড়ুয়া ও শিক্ষকদের সঙ্গে। ডাক্তার ও প্যারামেডিকাল স্টাফদের সঙ্গে দেখা হয়েছে হাসপাতালগুলিতে। দেশের দূর দূর স্থানে আমি মিলিত হয়েছি উপজাতি নেতাদের সঙ্গে। আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানকার গোষ্ঠী বা তাঁদের পেশার কথা মাথায় রেখে আমি তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই শপথগুলি তাঁদের জীবনে প্রভাব ফেলে, অথবা খুব ক্ষুদ্রভাবে হলেও তাঁদের জীবনে পরিবর্তন এনে দেয়।

দৃষ্টান্তস্বরূপ, পূর্ববর্তী কোনও এক অধ্যায়ে আমি আমার ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেরালার ওয়্যানাড ভ্রমণের কথা লিখেছি। জহর নবোদয় বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সঙ্গে সেখানে আমার দেখা হয়েছিল ভোর ২.৩০-এর সময়ে। ওই সময়তেও তারা ছিল তরতাজা জীবনীশক্তিতে ভরপুর। তারা খুশি মনে আমার দেওয়া দশ দফার এই শপথটি পাঠ করেছিল:

১। আমার জীবনে একটি লক্ষ্য থাকবে যার জন্য আমি পরিশ্রম করব। আমি মনে করি লক্ষ্য ক্ষুদ্র হওয়া এক অপরাধ।

২। আমি নিষ্ঠার সঙ্গে আমার কাজ করব এবং সফলও হব সততার সঙ্গে।

৩। আমি আমার পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের ও বিশ্বের এক ভাল সদস্য হব।

৪। আমি সকল সময়ে সচেষ্ট থাকব কাউকে রক্ষা করতে বা তাঁর জীবনকে উন্নত করতে— তা তিনি যে-কোনও গোত্রের, বর্ণের, ভাষার, ধর্মের বা প্রদেশের হোন।

৫। আমি যেখানেই থাকি, যাই করি, আমি নিজেকে প্রশ্ন করব, ‘আমি কী দিতে পারি।’

৬। সময়ের গুরুত্ব আমি সকল সময়ে মনে রাখব। আমার মন্ত্র হবে: ‘আমার এই মুক্ত বিহঙ্গের সময়টিকে নষ্ট হতে দেব না।’

৭। আমি সকল সময়ে পরিচ্ছন্ন পৃথিবী আর পরিচ্ছন্ন শক্তির জন্য কাজ করব।

৮। রাষ্টের যুবসমাজের একজন হিসেবে নির্ভয়ে আমার সকল কাজে সাফল্য পেতে সচেষ্ট হব, এবং অন্যের সাফল্যে আনন্দ পাব।

৯। আমি আমার বিশ্বাসের মতোই তরতাজা এবং আমার সন্দেহর মতোই প্রাচীন। তাই বিশ্বাসের দীপশিখা আমার হৃদয়ে জ্বালিয়ে রাখি।

১০। জাতীয় পতাকা আমার হৃদয়ে সর্বক্ষণ উড্ডীন এবং আমার রাষ্ট্রের জন্য আমি নিয়ে আসব গৌরব।

একটি সমাজের, তার যুবজগতের স্বপ্ন, উদ্বেগ, ভাবনাচিন্তা, আশা আকাঙ্ক্ষার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত সকল সময়ে, কারণ ভবিষ্যত্টা তারাই নির্ধারণ করবে। ২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ হল কুড়ি বছরের নীচের জনগণ। আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, এই পৃথিবীর উপরনীচে সব থেকে শক্তিশালী সম্পদ হল প্রজ্বলিত যুবসমাজ। আমি নিশ্চিত যে, যুবশক্তিকে সঠিক পথে চালিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারলে মানবসমাজে রূপান্তর ঘটবে তার অগ্রগতি, নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা এবং সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি নিয়ে আসার জন্য।

পৃথিবীর সামনে যে মূল সমস্যাগুলি রয়েছে সেগুলি নিয়ে এবার আলোচনায় আসা যাক। দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী বাস করে দারিদ্র্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরাপদ পানীয় জল পাওয়া যায় না, ভাল শিক্ষার কথা তো বাদই দেওয়া হল। এই পরিস্থিতির সংস্কারে যুবসমাজ কীভাবে সাহায্য করতে পারে? একজন শিক্ষিত তার সারা জীবনে অন্তত পাঁচজনকে কী অক্ষর শিক্ষা করাতে পারে? জল সংরক্ষণের বার্তা যুবসমাজ কী প্রচার করতে পারে? চিরাচরিতের বাইরে তার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের পথ কী বের করতে পারে?

কিছু বছর আগে Lead India ২০০২ নামে একটি অভিযান শুরু করি আমি। এটি মূলত একটি যুবসমাজের অভিযান। আমার দশ দফা শপথের উপর ভিত্তি করে এটি তৈরি করি। কারণ, আমি মনে করি, শিক্ষা, পরিবেশ, সামাজিক ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে এবং গ্রাম-শহর বিভাজন কমিয়ে আনতে যুবসমাজই সক্ষম। নিজস্ব লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জাতীয় উন্নয়নেও ভাগ নেন। আমি আবারও বলি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য রেখে এগোনো এক অপরাধ। এক যুবক বা যুবতী নিজের জীবন বা পেশা গড়তে যে কাজ করেন তার সঙ্গেই তাঁর পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমগ্র মানবজাতির সেবায়ও নিয়োজিত থাকেন। প্রতিটিই অন্যের পরিপূরক।

আমার তৈরি এই শপথের পিছনে আছে কিছু তত্ত্ব, কিছু ছোট ছোট ঘটনা, এবং আছে বিভিন্ন ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চিন্তানায়কদের শিক্ষা। সেই প্রেক্ষিতের কাহিনিগুলি আপনাদের বলা যাক।

১। অন্যের জীবনকে রক্ষা কর বা তার উন্নতিসাধন কর

মহাত্মা গাঁধীর মা একবার তাঁকে বলেছিলেন: ‘পুত্র, তুমি যদি তোমার সারা জীবনে কোনও মানুষের জীবনকে রক্ষা করতে পার বা তাঁর জীবনে উন্নতি নিয়ে আসতে পার, তা হলে জেনো যে, তোমার মানবজীবন সার্থক। তুমি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য।’ এই পরামর্শ গাঁধীজির উপর গভীর প্রভাব ফেলে যা তাঁকে সারা জীবন মানবজাতির জন্য কাজ করে যেতে অনুপ্রাণিত করে।

২। ‘আমি’ শব্দটিকে নিজের দর্শন থেকে দূর কর

২০০৩-এ অরুণাচল প্রদেশ ভ্রমণের সময়ে আমি তাওয়াং-এ একটি ৪০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মনাস্ট্রিতে গিয়েছিলাম। সারাদিনই প্রায় সেখানে অতিবাহিত করি। ওই প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমি লক্ষ করলাম, সেখানকার আশপাশের গ্রামের মানুষদের ভিতর থেকে এক আশ্চর্যরকমের সুখানুভূতি নির্গত হচ্ছে। সেই মন্দিরের সব বয়সের ভিক্ষুদের মধ্যে দেখলাম এক প্রশান্তি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তাওয়াং বা আশপাশের গ্রামগুলিতে কী এমন বস্তু আছে যার জন্য এখানকার মানুষজনের মধ্যে এত শান্তি বিরাজ করে। মনাস্ট্রির প্রধানকে আমি এই প্রশ্নটা করলাম।

তিনি তাত্ক্ষণিক কোনও উত্তর দিলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি হেসে বললেন, ‘আপনি ভারতের রাষ্ট্রপতি। আমাদের এবং সারা দেশের সব কিছু সম্পর্কে আপনার জানা উচিত।’

আমি বললাম, ‘আপনি দয়া করে আপনার সুচিন্তিত বিশ্লেষণ আমাকে জানান। আমার খুব প্রয়োজন এটা জানার।’

আমাদের ঠিক পিছনেই বুদ্ধর হাস্যোজ্জ্বল প্রদীপ্ত স্বর্ণাভ মূর্তি। প্রধান ভিক্ষু প্রায় একশো যুব এবং প্রবীণ অভিজ্ঞ ভিক্ষুদের সেখানে জড়ো করলেন। তিনি এবং আমি তাঁদের মাঝে বসলাম। তিনি তাঁদের একটি ছোট বক্তৃতা দিলেন, যা আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

‘বর্তমান পৃথিবীতে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ হিংসাতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই মনাস্ট্রি এই বার্তাই প্রচার করে যে, যখনই তুমি “আমি”-কে তোমার মন থেকে সরিয়ে দিতে পারবে তখনই তোমার অহং-ও বিলুপ্ত হবে। তুমি যে মুহূর্তে তোমার আমিত্ব ত্যাগ করতে পারবে, তখনই অন্যের প্রতি তোমার ঘৃণা দূর হবে। যে মুহূর্তে ঘৃণা তোমার মন থেকে দূর হবে সেই ক্ষণেই হিংস্রতা অদৃশ্য হয়ে যাবে। হিংস্রতা দূর হলেই সেই জায়গায় শান্তি প্রস্ফুটিত হবে। এবং তখনই সমাজে শান্তি আর শুধু শান্তিই ফুটে উঠবে।’

এইভাবেই আমি জানতে পারলাম প্রশান্তিময় জীবনের সুন্দর সূত্রটি। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন কাজটি হল ‘আমি’-কে চিন্তার জগৎ থেকে সরিয়ে ফেলা। তাই আমাদের প্রাচীন দার্শনিক জ্ঞানীদের শিক্ষা আমাদের সন্তানদের মধ্যে প্রোথিত করতে হবে তাদের কম বয়স থেকেই।

৩। ক্ষমাশীলতা

আমার প্রশ্ন, ‘কীভাবে একটি প্রশান্তিময় সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ে ওঠে?’, তার উত্তরের একটি অংশ পেয়েছিলাম তাওয়াং-এ। কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যের অন্বেষণ আমার জারি ছিল। ওই বছরই তারপর বুলগেরিয়া ভ্রমণে গেলাম আমি।

দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের শেষে আমি সেখানকার বিখ্যাত রিলা মনাস্ট্রিতে গেলাম। দশম শতাব্দীতে বুলগেরীয় সন্ন্যাসী সন্ত ইভান রিল্‌স্কির ভক্তরা মিলে নির্মাণ করেছিলেন এই মনাস্ট্রি। ওই দেশের এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাবার পর ঊনবিংশ শতকে এটি সম্পূর্ণভাবে পুনর্নির্মিত করা হয়। বুলগেরীয়দের কাছে পবিত্র এই স্থানের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে আমার কৌতূহল ছিল। আমি সেখানকার যাজকদের সঙ্গে তাওয়াং-এর বার্তাটি বিষয়ে আলোচনা করলাম। তাঁরা আমার প্রশ্নের উত্তরের অন্য অংশটি জানালেন।

তাঁদের মূল বার্তাটি হল, ক্ষমাশীলতা, যা এক পবিত্র জীবনের ভিত্তি তৈরি করে।

৪। দানধ্যান এনে দেয় শান্তি ও সুখ

২০০৪ সালে তেমনই এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দর জন্মভিটায়। উত্তর কলকাতার ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে তাঁর পৈতৃক বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করে জনসাধারণের জন্য ওই বছর অক্টোবরে খুলে দেওয়া হয় প্রচুর আনন্দোত্সাহের সঙ্গে। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় উদ্বোধনের জন্য।

১৮৬৩ সালে ওই বাড়িতে স্বামীজি জন্মগ্রহণ করেন। ওই সময়ে বাড়িটির চার ধারে বাগান আর তার ওপারে ছিল একটি উন্মুক্ত স্থান। পরবর্তীকালে শহরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটিতে যাওয়ার রাস্তাটি সরু হতে শুরু করে এবং তা একটি গলিপথে পরিণত হয়। অষ্টাদশ শতকের বাড়িটির ভগ্নদশা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রামকৃষ্ণ মিশন সেটিকে অধিগ্রহণ করে পুনর্নির্মাণ করে একটি স্মারক সংগ্রহশালাতে পরিণত করে।

তার সঙ্গে পাশের জমিতে তৈরি হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক ও গবেষণা কেন্দ্র এবং একটি পাঠ্যবইয়ের গ্রন্থাগার।

উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্বামীজির শিষ্যদের আমি আমার তাওয়াং অভিজ্ঞতার কথা বললাম। তাঁরাও মনে করেন এটি একটি অপূর্ব বার্তা। এর সঙ্গে তাঁরা যোগ করলেন, কাউকে কোনও দান অর্পণ করলে বৃদ্ধি পায় সুখ শান্তি।

৫। ভাল কাজ এনে দেয় শুভ ক্রিয়া

একবার রাজস্থানের অজমেরে খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির বিখ্যাত দরগায় আমি গিয়েছিলাম। শুক্রবারের নামাজ পাঠের পর আমি এক সুফি জ্ঞানীজনের সঙ্গে আলোচনায় বসি। তিনি আমায় বলেন যে, সর্বশক্তিমানের সৃষ্ট এই মানুষ আজ এক শক্তিমান শয়তানের সম্মুখীন। সে মানুষকে মন্দ কাজে প্রলুব্ধ করছে। একমাত্র ভাল কাজই পারে ভাল চিন্তার জন্ম দিতে, এবং শুভ চিন্তাই সেই ক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে যা থেকে, সর্বশক্তিমানের নির্দেশে, বিচ্ছুরিত হয় প্রেম।

আমি যখন দশ বছরের বালক আমি প্রায়ই দেখতাম যে, আমাদের বাড়িতে তিনজন মানুষের আলোচনা হত। এঁরা হলেন পক্ষী লক্ষ্মণ শাস্ত্রীগাল [Pakshi Lakshmana Sastrigal], বিখ্যাত রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এবং একজন বৈদিক পণ্ডিত; রেভারেন্ড ফাদার বোদেল [Bodel], যিনি রামেশ্বরম দ্বীপের প্রথম চার্চটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; এবং আমার পিতা যিনি ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। এঁরা নিজেদের মধ্যে বসে দ্বীপটির সমস্যাগুলি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতেন এবং সমাধান সূত্র বের করে দিতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নিজেদের সহমর্মিতা দিয়ে সেতু রচনা করতেন।

যুবসমাজ কী ধরনের বিশ্ব নির্মাণে এগোবে— এই কথা চিন্তা করলেই ওই স্মৃতি আমার মনে আসে। মনের মিলন ও সম্প্রীতি হল ভারতের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি। আমি এই কথাই বলব যে, আমাদের যুবশক্তিকে বোঝাতে হবে যে, সমাজে বিচ্ছিন্নতাবাদকে অতিক্রম করতে হবে তাদের। সারা বিশ্বের ও আমাদের দেশের অগণিত সমস্যার বহু ক্ষেত্রেই সমাধান পাওয়া যাবে যদি এই পথে তারা এগোয়।

.

সাত : শিক্ষক

দেশের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ধরে দেড় কোটির বেশি স্কুলপড়ুয়ার সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটেছে। অরুণাচল প্রদেশ হোক, নাগাল্যান্ড হোক বা মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত বা কর্ণাটক হোক, অথবা জম্মু ও কাশ্মীর বা ভারতের অন্য যে-কোনও অংশ হোক— যুবকণ্ঠস্বরটি অনন্য এবং পরাক্রমী। তারা তাদের লক্ষ্যে দৃঢ় ও অচঞ্চল, এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে উদ্যোগী। তাদের সকলের স্বপ্ন, তারা বাস করবে এক সমৃদ্ধশালী ভারতে, এক সুখী ভারতে, এক শান্তির ভারতে, এবং এক নিরাপদ ভারতে। সমৃদ্ধি, সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তাকে মিলতে হবে এক বিন্দুতে, তবেই ভারত হবে এক আদর্শ উন্নত রাষ্ট্র। এবং আমাদের সন্তানদের স্বপ্ন ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে পারে যে চালকযন্ত্র তা হল শিক্ষকসমাজ। আমি যখনই কোনও শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের সমাবেশে ভাষণ দিতে যাই, আমি অনুভব করি যে আমি মিলিত হচ্ছি এমন একটি গোষ্ঠীর ছোট্ট এক অংশের সঙ্গে যারা ভারতের ভবিষ্যৎ গড়ার ভিত্তি তৈরি করবে। শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীর মনকে প্রজ্বলিত করে দেন। সরকারি হিসেবমতে দেশে সাড়ে ষাট লক্ষ স্কুলশিক্ষক আছেন। এঁরা প্রত্যেকেই এক একটি প্রজ্বলিত দীপ যা আলোকিত করে দেয় আরও বহুজনকে। ছেলেমেয়েরা গড়ে ২৫,০০০ ঘণ্টা অতিবাহিত করে তাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। সুতরাং শিক্ষকদের কাছে অনেকটাই সময় থাকে তাঁদের পড়ুয়াদের সামনে রোল মডেল হয়ে নিজেদের দাঁড় করাতে।

আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?

আমরা প্রত্যেকেই শিক্ষার বিভিন্ন স্তর পার হয়ে এসেছি। আমি কখনও কখনও ভাবি যে, ওই প্রতিটি স্তরে মানুষের চাহিদা সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়া আমরা কেমনভাবে প্রকাশ করি? শিশু প্রশ্ন করে, ‘আমার জন্য তুমি কী করতে পার?’ কিশোর বলে, ‘আমি নিজেই করে নিতে চাই।’ যুবক সোচ্চারে বলে ওঠে, ‘চল সকলে মিলে করি।’ নেতা বলেন, ‘আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’ শিক্ষকরা, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বা প্রধান, তাঁরা এক শিশুকে এক নেতায় রূপান্তর করে দিতে পারেন— ‘আমার জন্য তুমি কী করতে পার?’ থেকে ‘আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’-তে। এটি করতে গেলে তাঁদের দ্রষ্টা হতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে অনুপ্রেরণা দেবার ক্ষমতা। অধ্যক্ষদের এটাও দেখতে হবে যে, শিক্ষকরা যেন এমনভাবে শিক্ষা দেন যাতে শিক্ষার্থীদের ভিতরের শ্রেষ্ঠ গুণগুলি প্রকাশ পেতে পারে। এটি করতে গেলে অধ্যক্ষকে এক আদর্শ শিক্ষক হতে হবে।

আমি নিশ্চিত যে, শ্রেষ্ঠ মনন প্রকাশ পেতে পারে একমাত্র অধ্যক্ষ, শিক্ষক আর অভিভাবকের এক যৌথ প্রভাবে।

ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়

মানুষের মন এক অনন্য উপহার যেন। আপনার যদি অনুসন্ধিত্সা থাকে আর আপনি যদি চিন্তাশীল হন, তবেই আপনি, আমি যাকে বলি ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়, তাতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন। আপনার জীবনযাপনে যতই চড়াই-উতরাই থাক, এই কৌতূহল আর চিন্তাশক্তি আপনার সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। চিন্তাই প্রগতি। অ-চিন্তা একটা মানুষের জীবনে বা কোনও প্রতিষ্ঠানে বা দেশে এনে দেয় এক বদ্ধ অবস্থা। চিন্তাই জন্ম দেয় ক্রিয়াশীলতার। ক্রিয়া ছাড়া জ্ঞান অর্থহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। জ্ঞানের সঙ্গে ক্রিয়া নিয়ে আসে সমৃদ্ধি।

শিক্ষকদের উচিত তরুণ মনের লালন করে মানবজীবনের প্রতিটি দিকের অন্বেষণ করা। আকাশের দিকে তাকান। আমরা সেখানে একা নই। সারা ব্রহ্মাণ্ড আমাদের সাথি। যাঁরা স্বপ্ন দেখতে চান তাঁদেরই সে দেয় তার শ্রেষ্ঠ দান। সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের ক্ষেত্রে যেমন। তারাদের বিবর্তন সম্পর্কে তাঁর গাণিতিক বিশ্লেষণ, বৃহদাকার তারাদের এবং কৃষ্ণ গহ্বরগুলির বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়গুলি সম্পর্কে এখনকার চলতি বেশ কয়েকটি তাত্ত্বিক মডেল তৈরিতে সাহায্য করেছে। কেন কিছু তারা জ্বলজ্বল করে আর কেন কিছু মরে যায়, তাঁর সেই কৌতূহলী প্রশ্ন থেকেই শুরু তাঁর অনুসন্ধান। আজ Chandrasekhar Limit ব্যবহার করে আমরা গণনা করতে পারি সূর্য আর কতদিন তার আলো বিচ্ছুরণ করতে পারবে।

অথবা নেওয়া যাক স্যার সি ভি রমনের উদাহরণ। সমুদ্র আর আকাশের দিকে চেয়ে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, সমুদ্রকে কেন নীল হতে হল। এর থেকেই জন্ম হল Raman Effect-এর। তিনি দেখলেন সমুদ্রের নীল রং আলোর অণুর বিচ্ছুরণের ফলে হয়। সাধারণ মানুষ যেমন ভাবেন আকাশের প্রতিফলনের কারণে হয়— তা কিন্তু নয়। কিংবা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, যিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হল কীভাবে। তার থেকেই জন্ম হল সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2, যা ঘটিয়ে দিল নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যায় এক বিপ্লব।

ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ১৯৬০-এর দশকে। প্রোফেসর বিক্রম সারাভাই ভারতকে দেখালেন সম্পূর্ণ দেশজ অন্তরিক্ষ প্রকল্পের স্বপ্ন। তিনি বললেন, ভারতের উচিত নিজস্ব রকেট সিস্টেম এবং যোগাযোগ ও রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ নির্মাণ করে নিজস্ব কেন্দ্র থেকে তা উৎক্ষেপণ করা। তিনি যে স্বপ্নগুলি দেখেছিলেন আজ ভারতের কাছে সব কিছুই মজুত।

সকল শিক্ষককে অনুরোধ করতে চাই যে, তাঁরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের স্যার সি ভি রমন বা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন অথবা সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর বা বিক্রম সারাভাইর মতো মহান চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন যদি। আমি তাঁদের উদ্দেশে বলব যে, ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময় অবলোকন করে উপলব্ধি করুন যে, আপনার মধ্যে আছে সেই ক্ষমতা যা বিরাট বিরাট চিন্তাবিদের জন্ম দিতে পারে।

শুভ নীতিজ্ঞান যুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা

তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফস কলেজে ছাত্রাবস্থায় শোনা রেভারান্ড ফাদার কালাথিলের বক্তৃতাগুলি এখনও আমার স্মৃতিতে আছে। জেস্যুইট প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন প্রধান। প্রতি সোমবার তিনি একটি একঘণ্টার ক্লাস নিতেন। প্রাচীন এবং বর্তমান সময়ের আদর্শ কিছু মানুষ সম্পর্কে তিনি সেই ক্লাসে বলতেন। গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, সন্ত অগাস্টিন, কালিফা ওমর, মহাত্মা গাঁধী, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, এবং আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো মহান ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলতেন। তিনি আমাদের সভ্যতার ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু নীতিকাহিনিও বলতেন। মরাল সায়েন্স ক্লাসে ফাদার কালাথিল বুঝিয়ে দিতেন যে, কীভাবে অভিভাবকদের যত্ন, শিক্ষা আর ভাল বইয়ের সান্নিধ্যে এসে এই মহাপুরুষরা বিকশিত হয়েছিলেন।

১৯৫০-এর দশকে যখন আমি কলেজ ছাত্র, তখন শোনা সেই বক্তৃতা আজও ছ’টি দশক পার করে আমায় উদ্বুদ্ধ করে। আমি মনে করি, স্কুলে বা কলেজে প্রতি সপ্তাহে ভারতের সভ্যতার ঐতিহ্য বিষয়ে এক ঘণ্টার একটি বক্তৃতা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি প্রত্যেক ভাল শিক্ষকের। এর ফলে শিক্ষার্থীরা থাকবে এক শুভ নৈতিক যাপনে। এর থেকেই দেশের প্রতি, দশের প্রতি একটি ভালবাসা জন্ম নেবে। তরুণ বয়স থেকেই প্রতিটি নাগরিকের ভিতর প্রোথিত হয়ে যাবে নীতিজ্ঞান।

রাষ্ট্রনির্মাণের ক্ষমতা

সব থেকে মূল্যবান যে কর্মকাণ্ডে শিক্ষকরা নিজেদের যুক্ত করতে পারেন তা হল রাষ্ট্রনির্মাণের ক্ষমতা সৃষ্টি করা। শিক্ষার পরিমণ্ডলে কী ধরনের মানুষ আমরা হতে চাই? আমাদের সন্তানদের আমরা কোন কোন ক্ষমতা দিতে চাই? আমরা যদি তাদের কোনও ক্ষমতা দিতে আগ্রহী হই, তো আমাদের প্রশ্ন করতে হবে: কীসের জন্য সেই ক্ষমতা? আমরা আমাদের সন্তানদের দেব অর্থনীতির উন্নতি আনার আর রাষ্ট্র গড়ার ক্ষমতা। কোন ধরনের রাষ্ট্র ভারত গড়তে চায়?

ভারতকে ২০২০ সালের ভিতর এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে আমাদের লক্ষ্য। পাঁচটি ক্ষেত্র আছে যেখানে একযোগে উন্নয়ন করতে হবে: কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়া; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি; পরিকাঠামো উন্নয়ন যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নদী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক; এবং জটিল প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা।

এই লক্ষ্য পূরণে স্কুলগুলিতে আর তার পড়ুয়াদের ভিতর যে ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন সেগুলি হল: গবেষণা ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা; মননশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বিশেষ করে তথ্য হস্তান্তরে মননশীলতা; উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা; উদ্যোগী নেতৃত্বের ক্ষমতা; এবং নৈতিক নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা।

১। গবেষণা ও অনুসন্ধান

আমাদের আঙুলের গোড়ায় জ্ঞান ও তথ্যের যে ভাঁড়ার তার ব্যবস্থাপনা হবে একুশ শতকের অভিমুখ। আমাদের সন্তানদের দিতে হবে সেই ক্ষমতা যার সাহায্যে তারা জ্ঞান ও তথ্যের সাগর সাঁতরে পার হয়ে তার সঠিক প্রয়োগ করবে। প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা আজ সততই হতে পেরেছি জীবনভরের পড়ুয়া, যে পড়ুয়াদের প্রয়োজন হয় যে-কোনও নিরন্তর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতিতে।

২। মননশীলতা ও উদ্ভাবন এবং তথ্যের মননশীল হস্তান্তর

অন্যকে শিক্ষাদানে আমাদের নিজেদের শিক্ষা হয় সব থেকে ভাল। একুশ শতকে জ্ঞানের ব্যবস্থাপনা কোনও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতার বাইরে। যে তথ্য ভাণ্ডার থেকে কিছু আহরণ করা সম্ভব তার পরিমাণ এত বৃহৎ যে, তা কোনও ব্যক্তিবিশেষের আয়ত্তে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং তথ্যের ম্যানেজমেন্ট ব্যক্তির আওতা থেকে সরে গিয়ে তা এখন সমাজের আওতায় চলে গেছে। সকলে মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে কী করে তথ্যের পরিচালনা করা যায়, তা আমাদের শিখতে হবে। অর্থাৎ, নিজেদের শুধু শিক্ষিত করে তুললে হবে না, অন্যকেও শিক্ষিত করে তুলতে হবে।

৩। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার

আমাদের স্কুলগুলির প্রতিটি শিক্ষার্থীর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জানতে হবে, তার শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজনেই। স্কুলগুলির উচিত আধুনিক হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সুসজ্জিত থাকা। সেই রকম বাতাবরণ তৈরির প্রয়োজন আছে যাতে পড়ুয়ারা তাদের শিক্ষাগ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।

৪। উদ্যোগী নেতৃত্ব

উদ্যোগী নেতৃত্বের তিনটি দিক আছে। প্রথম, সমস্যার খোঁজ করে তাকে উন্নয়নের প্রেক্ষিতে সমাধান করে ফেলা। উদ্যোগপতি হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হল আমাদের চাহিদা কী তা বুঝে নেওয়া এবং তার সঙ্গে বুঝে নেওয়া যে, মানুষ হিসেবে সকলেরই চাহিদা একই ধরনের হয়। দ্বিতীয়, ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা। উদ্যোগপতি অন্যের থেকে ভিন্নভাবে কাজ করেন, সাহসী চিন্তা করেন, এবং তা সকল সময়েই হয় ঝুঁকিপূর্ণ। বৃহৎ লাভের জন্য কেমন ভাবে পরিকল্পিত ঝুঁকি নিতে হয়, তার শিক্ষা আমাদের সন্তানদের দিতে হবে। তৃতীয় অংশটি হল সঠিকভাবে কাজ করার সদিচ্ছা।

৫। নৈতিক নেতৃত্ব

নৈতিক নেতৃত্বের দু’টি বিষয় আছে। প্রথমত, বাধ্যকারী এবং শক্তিশালী স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা থাকতে হবে, যার লক্ষ্য হবে মানুষের কল্যাণ। অর্থাৎ, যে অবস্থায় আজ মানুষ আছে, ভবিষ্যতে তার থেকে উন্নত অবস্থায় তাকে তুলে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেখানে উদ্যোগী নেতৃত্ব চায় মানুষ সঠিক কাজ করার অভ্যাস করুক, সেখানে নৈতিক নেতৃত্ব সঠিক কাজ করার সদিচ্ছা তৈরি করে দেবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যকেও সেই সঠিক কাজ করার প্রেরণা দেবে।

যদি আমাদের স্কুলগুলি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি একুশ শতকের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে চায়, তা হলে শিক্ষা প্রদানকারীদের নিজেদের মধ্যে নৈতিক নেতৃত্বের চর্চা করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা সঞ্চারিত করতে হবে। স্কুলগুলির জন্য এবং স্কুলশিক্ষার বিষয়ে তাঁদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে পড়ুয়ারা অধ্যয়নের মাধ্যমে স্বশাসিত হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।

আমাদের সন্তানদের জন্য তেমনই এক শিক্ষার প্রয়োজন যা রাষ্ট্রকে দেবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একনিষ্ঠ নেতা, যারা ভারতকে এক সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, সুখী রাষ্ট্রে রূপান্তর করে দেবে।

এই পাঁচটি গুণ যদি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রোথিত করে দেন তাদের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা, তা হলে তাদের মধ্যে তৈরি হবে জীবনভর জ্ঞানার্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। অন্যের কাছে তা হবে এক দৃষ্টান্তও। অর্থাৎ, তারা হয়ে উঠবে আদর্শ শিক্ষার্থী। ক্লাসরুম ছাড়াও তারা শিক্ষা নেবে তাদের পারিপার্শ্বিক থেকে। আমি নিশ্চিত করে বিশ্বাস করি যে, প্রত্যেক শিক্ষকের লক্ষ্য হল তেমনই আদর্শ শিক্ষার্থী তৈরি করা। এই কথা মনে রেখে আমি একটি এগারো-দফার শপথ তৈরি করেছি যা আমি চাই সারা ভারতের সব শিক্ষক যেন মেনে চলেন:

১। সর্বাগ্রে, আমি শিক্ষাদানকে ভালবাসব। শিক্ষকতাই হবে আমার আত্মা।

২। আমি মনে করি যে, আমি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাই নয়, আমি গড়ে তুলব সেই সব প্রজ্বলিত মনের তরুণদের যারা পৃথিবীতে, পৃথিবীর উপরে ও পৃথিবীর নীচে সর্বশক্তিমান সম্পদ। আমি এই শিক্ষকতার মহান মিশনে থাকব সম্পূর্ণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও একনিষ্ঠ।

৩। আমি নিজেকে একজন মহান শিক্ষক হিসেবে দেখব কারণ, একজন সাধারণকে অসাধারণ স্তরে উন্নীত করে দিতে পারে আমার শিক্ষাদান।

৪। উদারতা ও স্নেহ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমার সকল কাজ চালিত করব। তাদের কাছে আমি হব একাধারে মাতা, ভগিনী, পিতা বা ভ্রাতা।

৫। আমি আমার জীবনকে এমনভাবে চালিত করব যে, আমার জীবনই হবে আমার শিক্ষার্থীদের কাছে এক বার্তা।

৬। আমার ছাত্রছাত্রীদের আমি উৎসাহিত করব যাতে তারা প্রশ্ন করে আর তাদের মধ্যে একটা অনুসন্ধিৎসার স্পৃহা জন্মায়, যাতে তারা মননশীল আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক হয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।

৭। আমার সকল ছাত্রছাত্রীকে আমি সমান চোখে দেখব এবং ধর্ম, বর্ণ বা ভাষার ভিত্তিতে তাদের পৃথকীকরণকে সমর্থন করব না।

৮। আমি আমার শিক্ষকতার ক্ষমতাকে সর্বক্ষণ বর্ধিত করার চেষ্টা করব যাতে আমি আমার শিক্ষার্থীদের দিতে পারি উৎকৃষ্ট শিক্ষা।

৯। আমার শিক্ষার্থীদের জন্য আমি অসম্ভব গর্বিত হব।

১০। আমি উপলব্ধি করি যে, সব ধরনের জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পে এক শিক্ষক হিসেবে আমার মূল্যবান যোগদান আছে।

১১। আমার সর্বক্ষণের প্রচেষ্টা থাকবে যাতে উৎকৃষ্ট চিন্তায় আমার মন ভরে থাকে এবং যাতে আমি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারি চিন্তায় ও কর্মে আভিজাত্য।

.

আট : কৃষক

কবি-সন্ত তীরুভাল্লুভারের ভিটে তামিলনাডু থেকে আমি এসেছি। প্রায় ২২০০ বছর আগে তিনি রচনা করেছিলেন ১৩০০ দ্বিপদী যাকে একত্রে বলা হয় তীরুক্কুরাল। এর মধ্যে দশটি দ্বিপদী কৃষকদের উদ্দেশে রচিত যেখানে তাঁদের পেশাকে উদ্‌যাপিত করা হয়েছে। তীরুক্কুরাল পাঠ করেই আমি বড় হয়েছি। আমাদের দেশের কৃষকদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। সর্বশেষ গণনা অনুযায়ী ভারতে রয়েছেন ১২ কোটি চাষকর্মী। প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মশক্তি আমাদের দেশে রয়েছে কৃষিতে, যা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি)-র ১৩.৭ শতাংশ।

তিনটি অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই, যা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে ভারতের কৃষিসমাজ আমাদের রাষ্ট্রকে মহান করে তুলে ধরতে পারে। একটি কাহিনি বিহারের, অন্যটি তামিলনাডুর আর তৃতীয়টি গুজরাতের।

দ্বিগুণ উৎপাদনশীলতা, বিহার

টেকনোলজি ইনফর্মেশন, ফোরকাস্টিং অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট কাউন্সিল (টিআইএফএসি) দল ২০০০ সালে বিহারের আরপি চ্যানেল ৫ আর মাঝোলি শাখানদী অঞ্চলে একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। পরবর্তী সময়ে কৃষকদের অনুরোধে তা সম্প্রসারিত হয় পালিগঞ্জ ও পাঁচটি অন্য শাখানদী অঞ্চলে। এই পরীক্ষাটি টিআইএফএসি পরিচালনা করলেও সঙ্গে ছিল কৃষকদের একটি সমবায় সমিতি, ভারতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা (আইএআরআই), এবং বিহারের পুসাতে অবস্থিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারে উৎপাদন হল দ্বিগুণ। এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে ছিল মাটির শ্রেণিগত চরিত্র নিরূপণ, মাটির চরিত্র অনুযায়ী সঠিক বীজের নির্বাচন, সময়মতো রোপণ, সার ও কীটনাশকের সঠিক নির্বাচন, জলের ব্যবস্থা এবং ফসল তোলার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রণালীর সঠিক প্রয়োগ। প্রতি হেক্টর জমিতে ২ টনের জায়গায় ৫.৮ টন ধান চাষ হল। গমের ক্ষেত্রে ০.৯ টনের পরিবর্তে ২.৬ টন প্রতি হেক্টর। বর্তমানে ধান ও গম চাষ হয় ২৫০০ হেক্টর জমিতে এবং সেখানে যুক্ত আছেন ৩০০০ জন কৃষক।

অন্যান্য রাজ্যেও এই সাফল্য কাহিনির পুনরাবৃত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।

প্রিসিশন চাষ পদ্ধতি, তামিলনাডু

প্রিসিশন চাষ বা কৃষি হল এক ধরনের প্রযুক্তি যা তামিলনাডুতে প্রয়োগ হয়েছে। কৃষির সঠিক কাজ, সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে করাই হল এই প্রযুক্তি। এর ফলে উচ্চ হারে উৎপাদন হয়েছে, কৃষক সরাসরি বাজারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছে, এবং সে এক উদ্যোগপতি হয়ে উঠতে পেরেছে। এই পদ্ধতি সর্বোত্তম রোপণ ঘনত্ব, সার এবং অন্যান্য প্রয়োগ বস্তুর চাহিদা, এবং ফলনের পরিমাণ আগে থেকে সঠিকভাবে নিরূপণ করে নিতে সাহায্য করে। স্থানীয় মাটি এবং আবহাওয়াকে ধর্তব্যে না রেখে কোনও ফসলে অবাঞ্ছিত পদ্ধতি প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে এই পদ্ধতি। অর্থাৎ, শ্রম, জল, সার ও কীটনাশক জাতীয় প্রয়োগ বস্তুর মাত্রা কমিয়ে উৎকৃষ্ট মানের ফসল পাওয়া যায়।

২০০৪-০৫ সালে তামিলনাডুর ধর্মাপুরি জেলায় প্রথম প্রিসিশন ফার্মিং প্রোজেক্ট চালু করা হয়। শুরুতে ১০০ হেক্টর জমিতে প্রয়োগ করা হয়, তারপর ২০০৫-০৬-তে ২০০ হেক্টর এবং ২০০৬-০৭-এ ১০০ হেক্টর জমিতে করা হয় এই পদ্ধতিতে চাষ। ড্রিপ পদ্ধতির সেচ স্থাপনের জন্য ৭৫,০০০ টাকা এবং ফসল ফলানোর জন্য ৪০,০০০ টাকা কৃষকদের দেওয়া হয়। তামিলনাডু এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে প্রথম ফসলটি তোলা হয়। পরবর্তী পাঁচটি ফসল কৃষকরা তোলেন তিন বছরে।

প্রথম বছর কৃষকরা গররাজি ছিলেন এই প্রকল্পটি গ্রহণ করতে। কারণ, ২০০২ সাল থেকে চলছিল লাগাতার খরা। কিন্তু ওই প্রথম ১০০ জন কৃষকের সাফল্য এবং বাজারে সেই ফসলের উচ্চ মূল্য দেখে কৃষকরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর থেকে প্রকল্পটিতে নাম নথিভুক্ত করতে শুরু করেন।

সালেম-এ কৃষক দিবস অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এক প্রিসিশন কৃষক অশ্রুসিক্ত চোখে জানান যে, তাঁর জীবনে তিনি প্রথম এত গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা যা সর্বমোট ১০০,০০০ টাকা হয় তা চর্মচক্ষুতে দেখেন শুধুমাত্র ওই পদ্ধতিতে চাষ করে। এই ঘটনার ফলে নীতিনির্ধারকরা, ব্যাঙ্ক আধিকারিকরা, বিমা সংস্থারা ভিড় করতে থাকেন। তার ফলে কৃষিসমাজে বহু আর্থিক সহায়তা আসতে থাকে। ন্যূনতম ১০০,০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি হেক্টরে মুনাফা হওয়ায় প্রত্যেক কৃষকই এক একটি প্রকল্পের মালিক হয়ে উঠলেন। উদাহরণস্বরূপ, কৃষক পি এম চিন্নাসামী এক হেক্টর জমিতে পনেরো মাসে ৫০০ টন বেগুন উৎপাদন করেন। অন্য শ’য়ে শ’য়ে বেগুন চাষিদের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন এক রিসোর্স কৃষক।

ওই পদ্ধতির প্রয়োগকারীরা পঁয়তাল্লিশটি ফসলের ফলন, রাজ্য এবং জাতীয় স্তরের গড়ের তুলনায় দ্বিগুণ করায় ওই রাজ্যে প্রিসিশন পদ্ধতিতে চাষ এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নয় শতাংশ কৃষির বৃদ্ধি, গুজরাত

গুজরাতের রাজ্য কৃষি মন্ত্রণালয় আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের কৃষি বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে একটি উচ্চ ফলনশীল কৃষি পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছে। সাধুবাদযোগ্য এই কাজের ফলে কৃষিতে রাজ্য ৯ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে নিরন্তর, যেখানে জাতীয় গড় ৩ শতাংশ। নানান বাধা যেমন, জলস্তর কমে যাওয়া, লবণাক্ততার কারণে মাটি ও জলের চরিত্র বদল, বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাত ও ২০০০ সাল থেকে বারবার খরার প্রকোপের মতো বিষয় সত্ত্বেও এই সাফল্য পেয়েছে গুজরাত।

কৃষি ক্ষেত্রে গুজরাতের এই ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি সারা দেশের জন্য শিক্ষণীয়। এর থেকে বেশ কয়েকটি পাঠ নেওয়া যায়। তার ভিতর গুরুত্বপূর্ণগুলি হল:

১। সঠিক সময়ে ভাল বীজ, সার ও কীটনাশক কৃষকদের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া।

২। শুধুমাত্র কৃষকদের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা যা বিদ্যুৎ পৌঁছিয়ে দেবে কম দামে।

৩। বর্ষার আগেই সব জলাশয় পলিমুক্ত করে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া।

৪। সমবায় সমিতি তৈরি করে সরকার অতিরিক্ত ফসল কিনে নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তা বিক্রি করা।

উপসংহার

দীর্ঘ কয়েক বছরে ভারতে এমন সাফল্য কাহিনি বহু আছে। জাতীয় স্তরে প্রয়োজন সেই কাহিনিগুলির বিস্তৃতভাবে পুনরাবৃত্তির। ভারতের প্রয়োজন দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের। যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে ফলনশীলতা বৃদ্ধি পাবে বেশি মাত্রায়। ওই ধরনের বিপ্লবই কৃষকের কর্মক্ষেত্রকে শস্য ফলানো থেকে প্রসারিত করে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সমবায়ের মাধ্যমে বাজারজাত করা পর্যন্ত বিস্তৃত করবে। এ কাজ করতে গিয়ে নজর দিতে হবে যেন পরিবেশ-মানুষ সংক্রান্ত উন্নয়নগুলি নিরন্তর চলতে থাকে। এই সব মাথায় রেখে আমি, আমাদের কৃষকদের জন্য আট-দফা শপথ রচনা করেছি:

১। কৃষি একটি অতি উত্তম কর্মযজ্ঞ। আমি কৃষিকাজ ভালবাসি।

২। জমি ও জল আমাদের মহত্তম সম্পদ। আমি তাদের রক্ষা ও সংরক্ষণ করব।

৩। ফলনের মানের উন্নতির জন্য আমি প্রযুক্তি আর উত্তম কৃষিপদ্ধতির ব্যবহার করব।

৪। কৃষিকে স্থায়ী নির্ভরযোগ্য করতে আমি জৈব চাষ করব।

৫। সন্তানরা আমাদের বিত্ত। সন্তানকে আমি শিক্ষা দেব যাতে কৃষি ফলন ও কৃষি পদ্ধতি বর্ধিত হয়।

৬। কৃষিবর্জ্যকে আমি জৈব জ্বালানি আর জৈব সারে রূপান্তরিত করব।

৭। আমি কৃষি, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি ঐকতান রচনাতে নিয়োজিত থাকব।

৮। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় কৃষিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে তুলব।

.

নয় : পঞ্চায়েতপ্রধান

ভারতের হৃত্পিণ্ড তার গ্রামে অবস্থিত, এ কথা আমি প্রায়ই বলে থাকি। প্রায় ৫,৪৩,০০০টি গ্রাম আছে আমাদের দেশে। জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বাস ওই গ্রামে। ফলে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে গ্রামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ভারতের স্থানীয় স্বশাসিত ব্যবস্থার ভিত্তি হল গ্রামের পঞ্চায়েত, যার সংখ্যা ২,৫০,০০০। পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রধানের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বিশাল গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে সরকারি দপ্তরের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলেন এই প্রধান। বিহারের মতো কিছু রাজ্যে, সরপঞ্চদের ক্ষমতা দেওয়া আছে বিভিন্ন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা তদারকের। আইনভঙ্গকারীদের শাস্তি প্রদান ও জরিমানা ধার্য করার ক্ষমতাও তাঁদের দেওয়া আছে আইনে। এক উন্নয়নশীল দেশ থেকে এক উন্নত দেশে পরিবর্তিত হওয়ার লক্ষ্যে আগামী দুই দশক ভারতের কাছে অত্যন্ত জরুরি। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে কিছু কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে আমার কিছু ভাবনা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

‘পুরা’ এবং স্ত্রীসমাজ

প্রোভাইডিং আরবান অ্যামেনিটিস ইন রুরাল এরিয়াজ় (পিইউআরএ বা ‘পুরা’) হল তেমনই একটি প্রকল্প যা আমার হৃদয়ের সব থেকে কাছের। বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে এমন এক গুচ্ছ গ্রামকে শনাক্ত করে চার ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা এর মূল লক্ষ্য:

১। সড়ক, পরিবহণ ও বিদ্যুৎ যোগাযোগ।

২। নির্ভরযোগ্য টেলিকম, ইন্টারনেট ও আইটি পরিষেবার মাধ্যমে বৈদ্যুতিন যোগাযোগ।

৩। উত্তম মানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দ্বারা জ্ঞানের যোগাযোগ।

৪। কৃষক এবং অন্যান্যদের তাঁদের পণ্যের সব থেকে উৎকৃষ্ট মূল্য পাওয়ার জন্য বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ।

আগামী পাঁচ বছরে সরকার মনস্থ করেছে ‘পুরা’ চালু করা হবে সারা দেশের ৫০০০টি গুচ্ছ-গ্রামে। তৃণমূল স্তরে গ্রামপ্রধানদের গোষ্ঠীবদ্ধ সক্রিয় সহযোগিতার উপর নির্ভর করছে এই উচ্চাশার প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ। উপরন্তু, মহিলাদের সহজাত যে সব গুণ যেমন, অন্যের প্রতি সমবেদনা, সহনশীলতা, অধ্যবসায়, সততা, সামাজিক বিষয়ে সংবেদনশীলতা, সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক অভিগমন ও কঠোর পরিশ্রম করার ক্ষমতা, তা এই মিশনকে ফলপ্রসূ করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা পেলে মহিলারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে দর্শনীয় কাজ করে দেখাতে পারেন।

তামিল মহাকবি সুব্রাহ্মনিয়া ভারতীর কথা মনে পড়ছে, যিনি ১৯১০ সালে, ভারতের নারীদের নিয়ে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। তার অনুবাদ এই রকম হবে:

She walks with raised head,

With her eyes looking straight.

She has her principles

Unafraid of anybody!

She has a lofty

And knowledge-based pride.

Such cultured women

Don’t falter from the chosen path.

She drives ignorance away.

She welcomes the bliss of life

With learned mind.

This is the dharma

Of the emerging woman.

‘পুরা’ এবং পঞ্চায়তপ্রধান

‘পুরা’-র বিষয়ে গ্রামীণ সমাজকে অবগত করে তাঁদের এই উন্নয়ন প্রকল্পে শামিল করতে পারেন পঞ্চায়তপ্রধান। সহযোগিতা করতে পারেন এইভাবে:

১। অশিক্ষা দূরীকরণ অভিযানে সাহায্য ও সহযোগিতা।

২। স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে কম্পিউটারের সাহায্যের বিষয়ে গ্রামীণ প্রশাসনকে ওয়াকিবহাল করা।

৩। গ্রামে সমবায় স্থাপন করে কেন্দ্রীয়ভাবে ন্যায্য মূল্যে পণ্য সংগ্রহ, মজুত, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা।

৪। পরিবার ও গোষ্ঠীর সুস্বাস্থ্যের জন্য উৎকৃষ্ট পুষ্টি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, নিরাপদ পানীয় জল এবং স্বাস্থ্য পরিসেবা জোগান দেওয়া।

৫। পণ, কন্যা ভ্রূণ হত্যা, শিশু বিবাহ, শিশুশ্রম, গার্হস্থ্য হিংসা এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির নির্যাতন ও হয়রানির মতো সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করা।

৬। ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা আর বিভিন্ন দক্ষতা উন্নতি প্রকল্প আয়োজন করে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে মহিলাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা।

৭। সৌরশক্তির সঠিক ব্যবহার, বর্জ্য পুনর্নবীকরণ এবং বৃষ্টির জল ধারণ করে জলসম্পদের ব্যবস্থাপনার মতো শক্তি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।

উপসংহার

ভারতকে উন্নত দেশে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাবে এই কাজে ব্রতী আছি। কৃষি, কৃষিজাত প্রক্রিয়াকরণ, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, রেশমশিল্প, ঔষধি গাছগাছালি চাষ ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাদের নানান সাফল্য কাহিনি আমাদের জানা। সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে অভিযানে মহিলারা নেতৃত্ব দেন। ২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে এক উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার একমাত্র লক্ষ্যকে সামনে রেখে যদি এই স্ত্রীসমাজ তৃণমূল স্তর থেকে নিরন্তর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে চলেন, তবে আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো কেউ আটকাতে পারবে না।

সময় হয়েছে মহিলা পঞ্চায়েতপ্রধানদের মননশীল নেতৃত্ব দেওয়ার। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, উদ্যোগপতি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির সাহায্যে তাঁরা নিজ নিজ গ্রামে ‘পুরা’ প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন। এটা করা সম্ভব গ্রামীণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাঁদের চালিত করে এই কাজে শামিল করা যায়। এটাই হবে মহিলা প্রধানদের মূল কাজ। তাঁদের জন্য আমার দশ-দফা শপথ:

১। আমি মনে করি ঈশ্বর আমাকে এক অনন্য সুযোগ দিয়েছেন আমার পঞ্চায়েতের মানুষজনকে সেবা করার।

২। আমার ব্রত হল মানুষের সহযোগিতায় পঞ্চায়েতকে সমৃদ্ধ করা।

৩। আমি নিশ্চিত করে বলছি যে, মানষের সঙ্গে সব বিষয়ে আমি সৎ আর স্বচ্ছ থাকব।

৪। আমি নিশ্চিত করব যে, আমার পঞ্চায়েতের মানুষ হবেন জুয়া আর নেশা মুক্ত।

৫। আমার পঞ্চায়েতকে আমি ১০০ শতাংশ, মহিলা সমেত, শিক্ষিত করে তুলব।

৬। আমার পঞ্চায়েতের মানুষকে আমি বোঝাব যাতে পুত্রসন্তান আর কন্যাসন্তানকে সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে দেখা হয়।

৭। আমি নিশ্চিত করব যাতে, আমার পঞ্চায়েতের সকল গৃহে স্যানিটেশন আর নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকে।

৮। আমি নিশ্চিত করব যাতে আমার পঞ্চায়েত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে এবং আমি বিশ্বাস করি পরিচ্ছন্নতা শুরু হয় নিজ গৃহে।

৯। আমার পঞ্চায়েতের যাবতীয় জলাধার আমি ব্যবহারযোগ্য করে দেব।

১০। আমার পঞ্চায়েতকে আমি এক আদর্শ পঞ্চায়েত করে তুলব।

.

দশ : স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী

সকলের জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছিয়ে দেওয়া ভারতের কাছে এক বিরাট উদ্বেগের বিষয়। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জনগণই একটি রাষ্ট্রকে মহান করে তুলতে পারে। সুস্বাস্থ্যের এক দেশ নির্মাণে হাসপাতাল, ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ২০১৫ সালের যে হিসেব তাতে ভারতে ওই বছর ৯,৫০,০০০ জন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। হিসেবমতো, সরকারি হাসপাতালে প্রতি ১১,৫০০ জনের জন্য একজন ডাক্তার। গড়ে প্রত্যেক সরকারি হাসপাতাল ৬১,০০০ জন মানুষকে পরিষেবা দেয়। ১৮৩৩ জন রুগির জন্য আছে একটি মাত্র শয্যার ব্যবস্থা। সুতরাং, তার স্বাস্থ্য পরিষেবার চিত্রকে উন্নত করতে ভারতকে পার হতে হবে বহু পথ।

আমার চোখে একুশ শতকের এক হাসপাতাল

সমগ্র চিকিৎসা পরিষেবা ব্যবস্থায় মাল্টি-স্পেশালিটি হাসপাতালগুলির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। আমার দৃষ্টিতে একুশ শতকের হাসপাতাল এমন হওয়া উচিত:

১। প্রত্যেক রুগির ভিতর বিশ্বাস জাগাতে হবে যে, তিনি নিরাময় হবেন। পরিতৃপ্তি আর আশা সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে হাস্যোজ্বল ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালের সুন্দর পরিবেশ।

২। প্রত্যেক রুগি কী বলছেন তা শুনতে হবে। রুগির যন্ত্রণার উপশম করাই হবে প্রত্যেক ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য প্যারামেডিকাল স্টাফের ব্রত। যে-কোনও স্থানে এবং যখন প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দল রুগিকে পরীক্ষা করে সত্বর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।

৩। হাসপাতাল গ্রিন হাউস ধারণার প্রয়োগে কমিয়ে আনবে বিদ্যুৎ আর জলের খরচ।

৪। হাসপাতাল ঘিরে থাকবে সবুজ গাছপালা আর মরশুমি ফুল।

৫। রুগিদের যাবতীয় পরীক্ষার রিপোর্ট একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে জমা থাকবে যাতে তা সহজলভ্য হয় এবং রুগি বা তাঁর আত্মীয়কে সময় ও শ্রম ব্যয় করে তা খুঁজতে না হয়।

৬। এমনভাবে হাসপাতালের ডিজ়াইন করতে হবে যাতে রুগিকে সময়মতো শুশ্রূষা করতে সহজেই স্থানান্তর করা যায়।

৭। হাসপাতালের সরঞ্জাম ও পরিবেশ রুগিদের দেবে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমক্ত পরিসেবা।

৮। হাসপাতাল এমন হবে যেখানে রুগি মনে করবেন যে, এই হাসপাতালই সব থেকে উৎকৃষ্ট স্থান যেখানে থেকে তিনি সব থেকে ভাল চিকিৎসা পাবেন।

৯। হাসপাতালকে হতে হবে সম্পূর্ণ আইটি নির্ভর যাতে, রুগির সঙ্গে ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালের প্রধানের সর্বক্ষণ কম্পিউটার-যোগাযোগ থাকবে। দেশের অন্য বড় হাসপাতালগুলির সঙ্গেও হাসপাতালটির যোগাযোগ থাকবে যাতে পরামর্শ ও মতামত নেওয়া যায়।

১০। প্রতিদিন একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত কনফারেন্সের ব্যবস্থা করবে হাসপাতালটি যাতে, রুগিদের ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র সব সমস্যাগুলি আলোচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

একুশ শতকের এমন রুগি-বন্ধু হাসপাতাল পরিকল্পনা করে গড়তে প্রয়োজন বিভিন্ন বিষয়ে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতে ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে থাকে পরিকল্পিত বৃদ্ধির সুযোগ। সাফল্যের চাবিকাঠি হল বিভিন্ন স্তরে মননশীল নেতৃত্ব।

মননশীল স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের কিছু বৈশিষ্ট্যাবলি

আমার জীবনে আমি তিনটি স্বপ্নকে দেখেছি প্রথমে লক্ষ্য হিসেবে, তারপরে ব্রত হিসেবে এবং শেষে বাস্তবায়িত হয়ে মূর্ত হতে: ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (আইএসআরও বা ‘ইসরো’)-র অন্তরিক্ষ প্রকল্প, ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও)-র ‘অগ্নি’ প্রকল্প, এবং প্রোভাইডিং আরবান অ্যামেনিটিস ইন রুরাল এরিয়াজ় বা ‘পুরা’ প্রকল্প। অবশ্য, এই তিনটি প্রকল্পই সাফল্য পেয়েছে নানান চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার মধ্য দিয়ে। এই তিনটি প্রকল্প থেকে আমি নেতৃত্ব সম্পর্কে যা শিখেছি তা হল:

১। নেতার চাই এক ধরনের বীক্ষণ।

২। নেতার প্রয়োজন তার লক্ষ্যকে বাস্তবে পরিণত করার আবেগ।

৩। নেতার থাকবে অনাক্রমণ পথে যাওয়ার ক্ষমতা।

৪। নেতাকে জানতে হবে কীভাবে সাফল্য এবং অসাফল্য— দুই-ই স্বীকার করে নিতে হয়।

৫। নেতার থাকবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।

৬। নেতার ব্যবস্থপনায় থাকবে আভিজাত্য।

৭। নেতার প্রতিটি কাজে থাকবে স্বচ্ছতা।

৮। নেতার কাজে এবং সাফল্যে থাকবে সততা।

একুশ শতকের জন্য ভারতের হাসপাতালগুলিকে প্রস্তুত করে একশো কোটির বেশি জনগণকে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য মননশীল নেতৃত্বের প্রয়োজন এই বৈশিষ্ট্যগুলি আয়ত্ত করা।

ছ’টি গুণ যা স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের থাকা আবশ্যিক

২০০৮ সালের নভেম্বরে কাঠমান্ডু ইউনিভার্সিটির চতুর্দশ সমাবর্তন ভাষণ দিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে বৌদ্ধনাথে কা-নিইং শেদ্রুব লিং বৌদ্ধ মঠে গিয়েছিলাম এবং সেখানকার প্রধান সন্ন্যাসী চোকিই নিইমা রিনপোচের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকও বটে। অভ্যর্থনার পর তিনি আমাকে তাঁর অধ্যয়ন কক্ষে নিয়ে গেলেন। এক তরুণের মতো তিনি দৌড়ে উঠে গেলেন ওই পাঁচতলা। আমি তাঁর পিছন পিছন কষ্টসাধ্য ধীর পায়ে উঠলাম।

তাঁর ঘরটি থেকে হিমালয় দৃশ্যমান। ঘরটিতে এক আধ্যাত্মিক বাতাবরণ উপস্থিত। আমাকে যা বিস্মিত করল তা হল যে, তাঁর গবেষক ছাত্ররা সব এসেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তাঁর সহ লেখক, ডেভিড আর শ্লিম, এমডি-র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যৌথভাবে তাঁরা একটি বই লিখেছেন, Medicine and Compassion: A Tibetan Lama’s Guidance for Caregivers নামে। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় হল, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের বৃদ্ধ, অসুস্থ বা অপারগ স্নেহের জনের বিধি বহির্ভূত সেবক হিসেবে কাজ করি। পেশাগত সেবক-সেবিকা নিয়োগ করলেও সেভাবে যত্ন দেওয়া যায় না।

Medicine and Compassion পাঠকের সঙ্গে সেবা দানের সত্যিকারের আদর্শের যোগ ঘটায়। বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা থেকে সেবার আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করে বাস্তবে তার প্রয়োগের কথা বলে এই বই। যাঁরা তাঁদের চিকিৎসা বা তাঁদের সেবকদের বিষয়ে অসন্তুষ্ট বা যে ব্যক্তি মৃত্যুর পথে অথবা যাঁদের অবস্থা সংকটজনক তাঁদের পরিবারের জন্য বাস্তবোচিত পরামর্শ রয়েছে এই বইতে। যাঁরা তাঁদের সহনশীলতা, সহমর্মিতা আর কার্যকারিতাকে নতুন উদ্যমে ফিরে পেতে চান তাঁদের জন্য এই বই এক প্রেরণা।

চোকিই আর আমার মধ্যে কিছু বইয়ের আদানপ্রদান হল। তিনি আমাকে যে বইগুলি দিলেন তার অন্যতম ছিল Medicine and Compassion। কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি আসার পথে বইটি আমি পড়লাম। আমার অসম্ভব ভাল লাগল। মূল যে বিষয়টি আমি বইটি থেকে আহরণ করলাম তা হল, ছ’টি গুণ প্রত্যেক চিকিৎসাশাস্ত্রের পেশার ব্যক্তির থাকা আবশ্যক। রিনপোচে আর শ্লিমের মতে, এই ছ’টি গুণ হল, উদারতা, বিশুদ্ধ ন্যায়বোধ, সহনশীলতা, অধ্যবসায়, সম্পূর্ণ মনঃসংযোগ এবং মেধা। সেবকের মধ্যে এই গুণগুলি থাকলে তবেই মুমূর্ষুর যত্ন নিতে পারবেন সেবক। সারা পৃথিবীর চিকিৎসাশাস্ত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিরা, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী, নার্স এবং প্যারামেডিকাল স্টাফদের জন্য এ যেন এক পথ নির্দেশিকা।

বিশ্বাসের শক্তি

আর একটি বই যা আমার অত্যন্ত প্রেরণাকারী মনে হয়েছে তা হল, The Biology of Belief: Unleashing the Power of Consciousness, Matter and Miracles. বইটির লেখক আমার বন্ধু ড. ব্রুস লিপটন আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বইটি নব্য জীববিজ্ঞানের এক নতুন রাস্তা খুলে দিয়ে আমাদের চিন্তা সম্পর্কের ধারণায় বিপ্লব এনে দিয়েছে। মনের এবং শরীরের পারস্পরিক ক্রিয়া এবং কোশ কেমনভাবে তথ্য গ্রহণ করে, এই বিষয়ে ড. লিপটন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা অবিশ্বাস্য নতুন আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, জিন এবং ডিএনএ আমাদের জৈবিক কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে না। পরিবর্তে ডিএনএ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু কোশবহিঃস্থ বার্তা দ্বারা। এই বার্তার মধ্যে আমাদের চিন্তাভাবনাও অন্তর্ভুক্ত। সহজ করে বললে, জিন এবং ডিএনএ-কে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বিশ্বাস, আমাদের প্রত্যয়।

এই বক্তব্যকেই তিনি প্রসারিত করে যুক্তি দিচ্ছেন যে, রোগ আর তার চিকিৎসার ভিত রয়েছে আমাদের চিন্তায় যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে কোশের। তিনি বলছেন, ‘এই বিশ্বাসের শক্তিকে ডাক্তাররা যেন ওষুধের রাসায়নিক বা অস্ত্রোপচারের ছুরির থেকে নিকৃষ্ট মনে না করেন।’

মহাত্মা গাঁধীও বলেছেন যে, আমাদের নিয়তিকে গড়ে তোলে আমাদের চিন্তা। ড. লিপটন তাঁকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন:

Your beliefs become your thoughts

Your thoughts become your words

Your words become your actions

Your actions become your habits

Your habits become your values

Your values become your destiny.

আমি সকল স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীকে বলব, তাঁরা যেন ড. লিপটনের বইটা পড়ে তার বার্তাটি উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে তাঁদের রুগিদের সেই প্রশিক্ষণ দেন যাতে রোগ থেকে নিরাময় হয়ে উঠতে তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসের শক্তিকে প্রয়োগ করতে পারেন।

মানুষ তাই-ই হয়ে ওঠেন যা তিনি চিন্তা করেন

এই প্রেক্ষিতে আমি আর একটি বইয়ের কথা বলব যেটি পড়ে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। বইটি হল মরিস গুডম্যানের লেখা The Miracle Man: An Inspiring True Story of the Human Spirit। তাঁর ছত্রিশ বছর বয়সে, ১৯৮১-র মার্চে, মরিস গুডম্যান যখন একটি প্লেন চালাচ্ছেন, তখন তাঁর ইঞ্জিনটি বিনা হুঁশিয়ারিতে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। রানওয়েতে কোনওভাবে প্লেনটাকে নামিয়ে আনতে চেষ্টা করলেও কিছু বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে উলটে গিয়ে সেটি মাটিতে আছড়ে পড়ে। দুর্ঘটনায় তিনি পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর শিরদাঁড়া চূর্ণ হয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় কশেরুকা দু’টি ভেঙে যায়। সাহায্য ছাড়া তিনি খাওয়াদাওয়া এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসও চালাতে পারতেন না। শুধু চোখের পাতা খোলা-বন্ধ করতে পারতেন। ডাক্তাররা বলে দিলেন, সারা জীবন তাঁকে অসাড়ত্ব নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।

এমন কথাই ডাক্তাররা ভেবেছিলেন, কিন্তু গুডম্যানের কাছে সে কথার কোনও গুরুত্ব ছিল না। তিনি নিজে কী ভাবছেন সেইটিই ছিল তাঁর কাছে বেশি জরুরি। তিনি কল্পনা করতেন যে, তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে হাসপাতাল থেকে পায়ে হেঁটে বেরোচ্ছেন। তিনি মনের সঙ্গে তাঁর ক্রীড়া চালিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁর বইতে তিনি লিখেছেন যে, একবার যদি মনকে তুমি তোমার সঙ্গে পেয়ে যাও, তোমার সবকিছু নিজের নিজের জায়গায় ফিরে আসবে। দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহের গভীর অনুশীলনের পর গুডম্যান একদিন যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই প্রথমবার শ্বাস গ্রহণ করতে সক্ষম হলেন। স্পিচ থেরাপিস্টের সঙ্গে বসে তিনি তাঁর প্রথম একটি শব্দ বলে উঠলেন: Mama: কয়েকমাস পর তাঁকে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হল। সেখানে তিনি নিজে হাতে খেতে শুরু করলেন এবং হাঁটতে শেখার চেষ্টা করতে থাকলেন। শারীরিক পরিচর্যায় তিনি তাঁর পেশিশক্তির বৃদ্ধি ঘটাতে থাকলেন এবং বাড়িয়ে তুলতে থাকলেন তাঁর মনোবল যতক্ষণ না তিনি নিজের ক্ষমতায় দাঁড়াতে পারছেন। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর তিনি কোনও সাহায্য ছাড়াই হাঁটতে সক্ষম হলেন।

ডাক্তারেরা দিশাহারা। ক্রিসমাসের আগেই গুডম্যান মনস্থির করেছেন হাসপাতাল থেকে হেঁটে বেরোবেন। এবং তিনি ঠিক তা-ই করে দেখালেন। পৃথিবীর জন্য তিনি যে বার্তা দিলেন তা হল, ‘মানুষ তাই-ই হয়ে ওঠেন যা তিনি চিন্তা করেন’। আমি আশা করি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীরা, এই কাহিনিগুলি মনে করবেন, যখন তাঁদের রুগিদের চিকিৎসা করবেন এবং শেখাবেন কেমনভাবে, শুধুমাত্র ওষুধে নয়, তাঁদের নিজ চিন্তার শক্তিতে নিরাময় হতে পারেন।

উপসংহার

আমি শেষ করতে চাই স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য দু’টি শপথ দিয়ে। প্রথমটি নার্সদের জন্য:

১। আমি আমার এই নার্সিং পেশাকে ভালবাসি। এটি একটি মহান ব্রত।

২। আমি মনে করি কারোর যন্ত্রণার উপশম করা একটি মহান, ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্রত।

৩। আমি সকল রুগিকে সমানভাবে যত্ন ও সহমর্মিতা দিয়ে সেবা করব।

৪। আমি অন্তত কুড়িজন গ্রাম্য রুগির বিশেষ সেবা যত্ন করব।

৫। আমি জীবনভর নার্সিং-এ শিক্ষা নিয়ে যাব।

৬। আমি সেই ব্রত নিয়ে চলব যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমার যত্ন তোমার যন্ত্রণাকে নিরাময় করে তোমার মুখে হাসি ফোটাক’।

দ্বিতীয়টি ডাক্তারদের জন্য:

১। আমি মনে করি চিকিত্সক পেশায় আমি ঈশ্বরপ্রদত্ত কাজ করে চলেছি।

২। আমার সময়ের কিছুটা আমি সেই সব রুগিদের চিকিৎসার জন্য দেব, যাঁদের সামর্থ্যের অভাব।

৩। আমি কোনও সময়েই আমার রুগিদের অপ্রয়োজনীয় রোগ নির্ণয়কারী পরীক্ষার যন্ত্রণা দেব না এবং পরামর্শ দেব একান্ত জরুরি পরীক্ষাগুলি করতে।

৪। গ্রামে গিয়ে আমি বছরে অন্তত কুড়িজন গ্রাম্য রুগির চিকিৎসা করব ন্যূনতম খরচে।

৫। আমার যাবতীয় রোগ নির্ণয়ে এবং চিকিৎসায় আমি উৎসাহ দেব উচ্চমানের দেশি সরঞ্জাম এবং অন্য সামগ্রীর ব্যবহারে।

৬। যদি আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাই আমি তাহলে নির্দিষ্ট গবেষণায় যাব যেমন এইচআইভি-র জন্য ভ্যাকসিন বা ডায়াবেটিস টাইপ ১ এবং টাইপ ২-এর স্থায়ী নিরাময়ের উপায়।

৭। আমি সেই ব্রত মেনে চলব যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমার মেধা যেন সকল পীড়িতের যন্ত্রণা নিরাময় করে হাসি ফোটায় তাঁদের মুখে।’

.

এগারো : সিভিল সার্ভেন্ট

ভারতের সিভিল সার্ভিসই সব থেকে উত্তম এবং সব থেকে নিকৃষ্ট সময়ে রাষ্ট্রকে চালনা করে নিয়ে যায়। ২০১০ সালের হিসেব মতো দেশে সিভিল সার্ভেন্টদের সংখ্যা ৫০,০০০। আমাদের এই বিশাল দেশের দৈনন্দিন শাসনব্যবস্থাকে তাঁরাই দেখাশুনা করেন। দেশের অস্থির সময়েও তাঁরাই দেশকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিয়ে যান।

মধ্য ১৯৯০ দশকে ভারতের Vision ২০২০-র পরিকল্পনা রচনার এক অভিজ্ঞতার কথা আমার মনে পড়ে যায়। আমাকে টিআইএফএসি-র সভাধ্যক্ষর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় যে, কাউন্সিল একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে যাতে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা যায়। ভারতের জিডিপি-র বৃদ্ধির হার যেখানে প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ শতাংশ ছিল, এই লক্ষ্য পূরণে সেখানে আমাদের ধরে নিতে হচ্ছিল নিরন্তর দশ বছরের বেশি সময় ধরে সেই বৃদ্ধির হার দশ শতাংশ রাখার কথা। কাউন্সিলের সকলের মনকে এই বিষয়টি প্রজ্বলিত করে দিল।

সেই সময়ে টিআইএফএসি-র সদস্যরা ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিব; ভারত সরকারের ন’জন সচিব; কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই), অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া (এএসএসওসিএইচএএম) এবং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)-র প্রধানরা; আইডিবিআই, আইসিআইসিআই এবং আইএফসিআই ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানরা; কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা; কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা; এবং ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডিএসটি)-র বিজ্ঞানীরা।

নানান তর্কবিতর্কের পর ৫০০-র কিছু বেশি সদস্য নিয়ে সতেরোটি কার্যনির্বাহী দল তৈরি করা হল। অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের ৫০০০ মানুষের সঙ্গে বৈঠক করলেন এঁরা। এই কমিটিগুলি দু’বছরের কিছু বেশি সময় কাজ করে পঁচিশটি রিপোর্ট প্রস্তুত করলেন যা তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার হাতে ২ অগাস্ট ১৯৯৬ তুলে দেওয়া হয়। কীভাবে বিভিন্ন সরকারি বিভাগ এবং সংস্থা যা ভারতের সিভিল সার্ভিসের শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কের সমন্বয়, একযোগে জাতীয় উন্নয়নে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করেন, এটি ছিল তার এক চিত্তাকর্ষক নিদর্শন।

ভারতের রাষ্ট্রপতি হবার আগে, স্যাটেলাইট লঞ্চিং ভেহিকল (এসএলভি) প্রকল্প এবং পরে ওই ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের নির্মাণ ও কার্যক্ষম করার সময়ে, আমি বেশ কিছু বরিষ্ঠ সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে চিন্তার আদানপ্রদান করেছিলাম। পরবর্তীকালে, আমি শ’য়ে শ’য়ে সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি, যখন আমি মুসৌরির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এ সিভিল সার্ভিস প্রোবেশনারদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছি। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন, রাষ্ট্রপতি ভবনে নতুন সিভিল সার্ভেন্টরা আমার সঙ্গে এসে দেখা করতেন। আমি তাঁদের পাঁচ-দফা শপথ (যার বিষয়ে আমি এই অধ্যায়ের শেষে আসব) পাঠ করাতাম। আমি ভারতের গ্রাম অঞ্চলে গেলে কোনও কোনও পরিচিত সিভিল সার্ভিস অফিসার মুসৌরি বা রাষ্ট্রপতি ভবনে আমার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বর্তমানে তাঁদের কর্মকাণ্ডের কথা বলতেন।

২০০৫-এ সংসদের উভয় কক্ষের উদ্দেশে আমার বক্তৃতায় সাংসদদের সঙ্গে যে কবিতাটি আমি ভাগ করে নিয়েছিলাম সেটি আমি এখানে বলতে চাই:

প্রিয় বন্ধু, আমরা এখন কোথায়?

সেই মহাসভায় যেখানে আমাদের ইতিহাস গড়া হয়।

ভারতের জনতার হৃদস্পন্দনের ডাক।

জনতা প্রশ্ন করে, জনতা প্রশ্ন করে:

হে! সাংসদরা, ভারত মাতার ভাস্কর,

আলোয় নিয়ে চল আমাদের, আমাদের জীবন সমৃদ্ধ কর।

তোমাদের সততার শ্রম, আমাদের আলোর দিশারী,

তোমরা যদি কঠোর শ্রম দাও, আমরা সমৃদ্ধ হব।

যেমন রাজা, তেমন জনতা,

মহান চিন্তার লালন কর, উঠে দাঁড়িয়ে কাজে লাগ,

সততার পাথেয় হোক তোমাদের দিশারী।

ঈশ্বরের কৃপায় তোমাদের শ্রীবৃদ্ধি হোক।

আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যতটা সাংসদদের হাতে, ততটাই তা আমাদের সিভিল সার্ভেন্টদের হাতে। আমি ভারতের সিভিল সার্ভেন্টদের জোর দিয়ে বলব তাঁরা যেন এই কবিতাটার মর্ম উপলব্ধি করে তা অন্তরে গ্রহণ করেন— তোমরা যদি কঠোর শ্রম দাও, আমরা সমৃদ্ধ হব।

মুসৌরিতে সংযোগ

২০১০ সালে আমি মুসৌরি গিয়েছিলাম। সেখানে পঁচাশিতম ফাউন্ডেশন ব্যাচ-এ সদ্য-যোগ দেওয়া সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে সংযোগ ঘটেছিল। প্রশিক্ষণের মধ্যবর্তী পর্যায়ের ট্রেনিদের উদ্দেশে আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। আমি তাঁদের মননশীল ও উদ্ভাবনী নেতৃত্ব এবং আরও ভাল এক পৃথিবীর উন্মেষের কথা বলেছিলাম। বক্তৃতা শেষে অংশগ্রহণকারীদের থেকে কিছু অনন্য প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেগুলি ছিল আমলাতন্ত্রের উচ্চতম পর্যায়ে প্রশাসনকে যে সুযোগ আর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তার উপর। আমি এই তরুণ অফিসারদের বলেছিলাম যে, কেমনভাবে তাঁরা মননশীল নেতৃত্ব দিয়ে জীবনের মহান সব কর্মযজ্ঞে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন, তার উপায় চিন্তা করুন। বক্তৃতার পর এক তরুণী অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ড. কালাম, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য আমলাতন্ত্র খ্যাত এবং সেই ভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। ফলে তার প্রেক্ষিতে আমি কীভাবে মননশীল ও উদ্ভাবনী হতে পারব?’ আর এক তরুণ অফিসার বললেন, ‘স্যার, এই মুহূর্তে, যখন আমরা আমাদের কর্মজীবনের শুরুতে রয়েছি, আমাদের ন্যায়বোধ প্রখর এবং সততায় আমরা দৃঢ়। আমরা সকলেই কঠোর পরিশ্রম করে পরিবর্তন আনতে চাই। কিন্তু এক দশক পর, আমাদের পারিপার্শ্বিক সত্ত্বেও আমরা কেমনভাবে ওই একই ন্যায়বোধ নিয়ে সমান উচ্ছ্বাসে কাজ করে যেতে পারব?’

এই প্রশ্নগুলির উত্তরে আমি বললাম যে, যে তরুণ অফিসাররা প্রশাসনে ঢুকছেন তাঁদের এক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য স্থির করে নিতে হবে, যাতে তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন। ওই লক্ষ্য তাঁদের সকল সময়ে উদ্বুদ্ধ করবে এবং সকল বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করবে। আমি তাঁদের বললাম যে, আমাদের রাষ্ট্রের তরুণ অফিসারদের মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা যখন কোনও কঠিন কর্মযজ্ঞে ঢুকবেন, তখন নানা সমস্যা আসবে। কিন্তু এই সমস্যাগুলি যেন আমাদের অধিনায়ক হয়ে না দাঁড়ায়; সমস্যাগুলিকে পরাস্ত করে আমাদের সাফল্য পেতে হবে।

আর এক তরুণ অফিসার বললেন, ‘ড. কালাম, আপনি বললেন যে, আমাদের কাজ করতে হবে সত্যনিষ্ঠা নিয়ে এবং সাফল্যও পেতে হবে সততার সঙ্গে। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং আমাদের বরিষ্ঠরা যাঁরা দুর্নীতিপরায়ণ তাঁরা তো কোনও এক সময়ে আমাদের ন্যায়-নীতিবোধের সঙ্গে আপোস করতে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করবেন। আমরা কীভাবে তার মোকাবিলা করব?’ এই প্রশ্নটি সম্পর্কে আমি চিন্তা করলাম। প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবসম্মত। প্রত্যুত্তরে আমি, আমার রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বললাম।

আমি ডিআরডিও-র সচিব, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং ভারত সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ছিলাম। এই প্রতিটি পদেই আমার দায়িত্বে ছিল বিরাট বিরাট কর্মযজ্ঞ যার মূলধনী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল বিশাল। কিন্তু কোনও সময়েই কোনও নেতা বা কোনও প্রশাসক আমার কাছে কোনও সুবিধে পাওয়ার আশায় আসেননি। আমি তরুণ অফিসারদের বললাম যে, তাঁরা তাঁদের নিজেদের এক ধরনের সততা তৈরি করে নিন যাতে যাঁরা নীতির সঙ্গে আপোসের কথা বলতে চান তাঁরা দূরেই থাকবেন। অবশ্যই, এরও কিছু সমস্যা থাকবে। কিন্তু অবশেষে, মানুষের মধ্যে যা শুভ তা সফল হবেই।

একশো কোটির প্রশাসন

পরিশেষে কিন্তু একজন সিভিল সার্ভেন্টের কাজ হল রাষ্ট্রকে ভাল প্রশাসন দেওয়া। প্রশাসনের বিচার হয় সে কতটা মানুষের চাহিদা সম্পর্কে ক্রিয়াশীল এবং সংবেদনশীল, তার ওপর এর থেকেই তাঁরা এক নৈতিকভাবে সুঠাম, বৌদ্ধিকভাবে উচ্চতর ও উন্নত মানের জীবনযাপন করতে সক্ষম হবেন। এ একমাত্র সম্ভব শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনে এবং তার সমৃদ্ধিতে। কীভাবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যায়?

আমি মনে করি এক সমাজভিত্তিক গ্রিড তৈরি করার প্রয়োজন আছে যাতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে জ্ঞানের গ্রিড, স্বাস্থ্য গ্রিড এবং ই-গভর্নেন্স গ্রিড যা ‘পুরা’ গ্রিড-এ এসে মিশবে। প্রথমটি নাগরিকদের গণতান্ত্রিক উপায়ে সঠিক জ্ঞানে বলীয়ান করে জ্ঞান-সমাজের বৃদ্ধি ঘটাবে। দ্বিতীয়টি নজর রাখবে যাতে সঠিক মানের স্বাস্থ্য পরিসেবা আর্তদের কাছে পৌঁছয়। এর দ্বারা তাঁদের জীবনের মান উন্নত হবে এবং ব্যক্তি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে যা রাষ্ট্রের উন্নয়নের গতিকে বৃদ্ধি করবে। তৃতীয়টি প্রশাসনিক কাজে আনবে স্বচ্ছতা এবং তা যেন তার মানে এবং পরিমাণে হ্রাস না হয়ে প্রত্যেকের কাছে সমানভাবে উপলব্ধ হয় তার খেয়াল রাখবে।

যদি এই গ্রিডগুলি একে অপরের পরিপূরক হয় এবং ‘পুরা’ গ্রিড, যা ভারতের ৬,০০,০০০ গ্রামকে যুক্ত করে রেখেছে, তার কার্যকারিতার মানকে উন্নত করে, তা হলে গ্রামগুলি হয়ে উঠবে অধিক ক্ষমতাবান। ক্ষমতাপ্রাপ্ত গ্রাম মানেই ভাল তত্পর প্রশাসন। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, সমাজভিত্তিক গ্রিড মডেলটি প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব। এবং তা ভারতকে ২০২০ সালের মধ্যে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিবর্তন করার আমাদের লক্ষ্যকে সাহায্য করবে।

শ্রী ভেঙ্কটেশাম বুরা, আইএএস, ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের (বর্তমানে তেলেঙ্গানা) মেডাক জেলার কালেকটর। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ ভাল আলাপ হয়েছিল যখন আমি অধ্যাপক এন বি সুদর্শন আচার্যর শুরু করা Lead India ২০০২ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল, সমাজ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের দূত হিসেবে তরুণদের প্রশিক্ষিত করা। প্রকল্পটির দর্শন ছিল, ব্যক্তির উন্মেষ আনে জাতির উন্নয়ন।

তাঁর কাজের ব্যাপারে এবং ভাল প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করায় সিভিল সার্ভিস অফিসারদের ভূমিকা সম্পর্কে আমি শ্রীবুরাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর প্রতিক্রিয়াগুলি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই এখানে:

APJ: আপনার জেলায় Lead India প্রকল্প কতটা যুবসমাজকে প্রভাবিত করেছে?

VB: আমি যখন মেডাক জেলার কালেকটর ছিলাম, আমি বুঝেছিলাম Lead India প্রকল্প মনোযোগ কাড়বে। আমি প্রকল্পটিকে বিপুলভাবে আমার সমর্থন দিই। এই জেলার ৫০,০০০-এর বেশি পড়ুয়ারা এই প্রকল্পটি থেকে অনেক কিছু নিজেদের ভিতর নিতে পেরেছিলেন। প্রকল্পটি তাঁদের অন্তরের অন্তঃস্থলে পৌঁছে তাঁদের জীবনদর্শনের পরিবর্তন এনেছে। নিজের বাড়িতে, ক্লাসে এবং খেলার মাঠে তাঁদের আচরণেই তা প্রকাশ পায়। প্রকল্পটি তাঁদের সুপ্ত ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলে তাঁদের ব্যক্তিত্বর এক সার্বিক উন্নতি ঘটিয়েছে।

APJ: আপনার সব থেকে বড় সমস্যা কী ছিল এবং তার সমাধান আপনি কীভাবে করলেন?

VB: এই জেলায় কিছু মানুষ অসম্ভব রকমের বঞ্চিত। যাঁরা অত্যন্ত অসুস্থ এবং শারীরিকভাবে অক্ষম তাঁদের রুজিরোজগারের ভীষণ সমস্যা। অনেকেই অনাহারে থাকেন। মানসিক জরাগ্রস্ত যাঁরা রাস্তায় থাকেন, তাঁরা সম্মানজনক কোনও শুশ্রূষা পান না। সমস্যাটা সাংঘাতিক এবং সাধারণ সরকারি কার্যক্রম ও পরিষেবা তাঁদের সমস্যাকে মোকাবিলা করতে অক্ষম। তাঁরা অযত্নে অবহেলায় থেকে যান।

বিভিন্ন এনজিও এবং জনগোষ্ঠীকে এই বিষয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলাম আমি। কয়েকটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সহায়তায় একটি প্রকল্প শুরু করা হল। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হল Assara। তার লক্ষ্য ছিল ওই সব আর্তদের বিশেষ করে বয়স্ক এবং যাঁরা মৃত্যুপথযাত্রী, তাঁদের দিনে অন্তত দু’টি আহারের ব্যবস্থা করা। প্রত্যেক গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠী সেই সব আর্তদের সন্ধান করে একজন বেকার মহিলাকে নিযুক্ত করল যিনি এঁদের দু’টি আহারের ব্যবস্থা করবেন। দ্রব্যসামগ্রীর যা প্রয়োজন তা দিলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং স্থানীয় মানুষ।

আর একটি প্রকল্প Ashray নামে শুরু করা হয় জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন এনজিও-গুলির সহযোগিতায়। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানসিক জরাগ্রস্ত গৃহহীনদের জন্য সম্মানীয় জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা। রাস্তা থেকে তুলে এনে তাঁদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করা হত। তাঁদের পুষ্টিকর খাদ্য ও ওষুধ দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হত।

নিউ ইয়র্কের একটি সংস্থা সোশাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইন্টারন্যাশনাল, মেডাক জেলাকে তার কাজের জন্য SA8000 সার্টিফিকেট প্রদান করে ২০০৭ সালে। নিরক্ষা সম্মত সামাজিক সার্টিফিকেট প্রদান প্রক্রিয়ায় এটি বিশ্বের প্রথম যা দেওয়া হয় শিল্পক্ষেত্রে সম্মানজনক কর্মস্থানের ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য। সমগ্র এশিয়াতে এটি প্রথম একটি সরকারি সংস্থা যা এই শংসাপত্র পেয়েছিল।

APJ: নাগরিকদের প্রতি আপনার কোনও পরামর্শ আছে যা তাঁদের আরও উত্তম পরিসেবা পেতে সাহায্য করবে?

VB: উত্তমরূপে কাজ করা কোনও গণতন্ত্রের জন্য তো বটেই, প্রশাসনের পক্ষেও অত্যন্ত জরুরি হল নাগরিকদের সচেতন থাকা এবং প্রশ্ন করা। আইনত প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে এক ভদ্রোচিত মানবজীবন যেখানে তার মৌলিক চাহিদা, খাদ্য, বস্ত্র আর বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকবে। আমাদের সকলে মিলে প্রচেষ্টা নিতে হবে যাতে ভারতকে সবথেকে উন্নত ও সুখী রাষ্ট্রসমূহের অন্যতম করে গড়ে তোলা যায়। গণতন্ত্রের সব ক’টি স্তম্ভের একযোগে কাজ করতে হবে এবং একে অপরকে টেক্কা দেবার চেষ্টাকে পরিহার করতে হবে। আমাদের মানুষজনই এই দেশ শাসন করছে, অন্য কোনও বিদেশি শক্তি আমাদের শাসন করছে না। সহযোগিতা, অংশগ্রহণ করা এবং দায়িত্ব নেওয়া হল এই সময়ের চাহিদা।

কিছু সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা

বন্ধুগণ, কিছু সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলব। এই অফিসারদের প্রত্যেককেই আমার মনে হয়েছে অত্যুজ্জ্বল নেতৃত্বের এক একজন উদাহরণস্বরূপ।

সি আর কৃষ্ণস্বামী রাও

১৯৮২-৮৩ সালে গাইডেড মিসাইল প্রকল্পের সময়ে আমি ছিলাম ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ল্যাবরেটরি (ডিআরডিএল)-এর অধিকর্তা। শ্রী সি আর কৃষ্ণস্বামী রাও সাহেব ছিলেন ক্যাবিনেট সচিব। ক্যাবিনেটকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটির বিষয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার আগে, একটি মিটিং হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন তদানীন্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী আর ভেঙ্কটরমন, রাও সাহেব এবং সামরিক বাহিনীর তিন উপ-প্রধান। আমাকেও ওই উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন মিটিংটিতে হাজির থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটির স্টাডি রিপোর্টটি পেশ করতে বলা হয়।

প্রচণ্ড সমালোচনা হল সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে। তাঁদের মত হল যে, ভারত যেহেতু আজ পর্যন্ত একটি ক্ষেপণাস্ত্রও সাফল্যের সঙ্গে নির্মাণ করতে পারেনি, তাই পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র বিকাশ ও নির্মাণ অনুমোদন করা যাবে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর তদানীন্তন উপদেষ্টা ড. ভি এস অরুণাচলম এবং আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এটি হবে এক ফ্ল্যাগশিপ প্রোজেক্ট। কিন্তু সদস্যরা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। এই সময়ে শ্রী কৃষ্ণস্বামী রাও সাহেব এমন একটি মন্তব্য করলেন যা আজও আমার কানে বাজে।

তিনি বললেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় স্যার, আমি সমস্ত আলোচনাটাই শুনেছি। আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই। সময় হয়েছে একটা সিদ্ধান্তে আসার এবং একটা সাহসের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নতুন পথে চলার। অতীত নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আমরা এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি যে, এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটির নেতৃত্বে যাঁরা, তাঁরা কর্মকাণ্ডটিতে মনেপ্রাণে নিয়োজিত এবং আবেগে ভরপুর। আমি মনে করি সব ক’টি ক্ষেপণাস্ত্রই একযোগে সুসংহতভাবে নির্মাণ করার প্রয়োজন আছে।’

এই মন্তব্যটি থেকেই শ্রী আর ভেঙ্কটরমন প্রকল্পটির নাম রাখলেন ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল প্রোগ্রাম। ওই মিটিং-এর দু’মাসের মধ্যেই প্রকল্পটি ক্যাবিনেট অনুমোদন দিয়ে দিল। আমি যাবতীয় প্রয়োজনীয় অর্থ, মানবসম্পদ এবং নতুন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা পেয়ে গেলাম। উৎপাদনের প্রয়োজনে কিছু জরুরি ব্যবস্থা স্থাপনার জন্যও অর্থ বরাদ্দ পেলাম। আজ সেই উৎপাদন সংস্থাটির ‘পৃথ্বী’, ‘অগ্নি’, ‘আকাশ’ এবং প্রথম সুপারসনিক ক্রুইস মিসাইল ‘ব্রহ-মোস’ নির্মাণের বরাতের অর্থমূল্য ৯৩ ট্রিলিয়ন টাকা। আমাদের আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের এমনই দূরদৃষ্টির ক্ষমতা।

প্রভাত কুমার

বন্ধুগণ, একটি রাষ্ট্রের জীবনে অনেকগুলি বাঁক আসে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বৃদ্ধির পথে প্রভাব ফেলে এইগুলি। একটি ঘটনার কথা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব, যেখানে দেখা যাবে ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারে কেমনভাবে এল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

১৯৯৮-৯৯-এর ওই সময়ে ক্যাবিনেট সচিব শ্রীপ্রভাত কুমারের সভাপতিত্বে সচিবদের মাসিক অধিবেশনে আমি অংশ নিতাম। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে মিটিংগুলির কার্যাবলি খেয়াল করতাম। আমি ভাবতাম সরকার কেন একচেটিয়া ভাবে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) নিজের হাতে রাখে। একদিন শ্রীপ্রভাত কুমার আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘মি. কালাম, আপনাকে আহ্বায়ক করে একটি দল তৈরি করে দিচ্ছি। ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহার কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, তার পথ বাতলাতে পারবেন?’

আমি বললাম, ‘ইন্টারনেট ব্যবহারের ঘনত্ব অত্যন্ত কম আমাদের দেশে। অনেক বেশি ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীর প্রয়োজন একে বৃদ্ধি করতে। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন অবশ্যই আছে, ইন্টারনেট যোগাযোগ ট্র্যাফিকের কারণে।’

শ্রীকুমার জানতে চাইলেন টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের সচিব আর আমি নিজেদের মধ্যে বসে এই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারি কিনা। সেন্টার ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রোবোটিক্স-এর তদানীন্তন অধিকর্তা অধ্যাপক এম বিদ্যাসাগরের সভাপতিত্বে আমরা দু’জনে একটি বিশেষ কমিটি তৈরি করে দিলাম। তিনি কমিটির আলোচনাগুলি আমাকে জানিয়ে যেতেন। তিনি আমাকে জানালেন যে, যদিও আইএসপি-র বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে সকলেই একমত, তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে কিন্তু সংশয় আছে।

আমি ঠিক করলাম যে, কমিটি একটি উপস্থাপনা তৈরি করবে যেখানে সকল স্টেকহোল্ডার তাঁদের উত্তর পেয়ে যাবেন। কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করলাম কমিটির মিটিংগুলিতে অংশ নিতে, যেমন, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর অধ্যাপক এন বালাকৃষ্ণান, যিনি তদানীন্তন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন, কারণ রেল এক বৃহৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। মিটিংগুলি আমি আহ্বান করতাম কাজের সময়ের পর যাতে সকলেই উপস্থিত থাকতে পারেন।

নিরাপত্তা বিষয়েই বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারীর আপত্তি ছিল। বিশেষজ্ঞরা জানালেন নিরাপত্তার জন্য বিশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যপক্ষ বললেন, তা করতে গেলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রশ্ন এসে যাবে। উলটোদিকে যুক্তি দেওয়া হল যে, যাঁরা প্রকৃত ব্যবহারকারী তাঁদের ভয়ের কোনও কারণ নেই; শুধু যাঁরা কুকর্মে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন তাঁদেরই গোপনীয়তা নিয়ে সমস্যা হবে। এই নিয়ে বিতর্ক চলল বেশ কিছু সময় ধরে। অবশেষে, সকল অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ঐক্যমতে সিদ্ধান্ত হল যে, আইএসপি খুলে দেওয়া হবে বেসরকারি ক্ষেত্রেও।

আমি শ্রীপ্রভাত কুমারকে কমিটির পরামর্শ জানিয়ে দিলাম। তিনি তত্ক্ষণাৎ পরামর্শগুলিকে কার্যে পরিণত করতে ক্যাবিনেটের অনুমোদন নিয়ে নিলেন। সেই আইএসপি খুলে দেওয়ায় আজ ভারতে ১২০০ ক্রিয়াশীল সার্ভিস প্রোভাইডার রয়েছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী ১২ কোটি ১০ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহাকারীকে তারা পরিষেবা দিচ্ছে। প্রতি বছর বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাই শুধু নন, এই সমগ্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের আইটি শিল্পরও উচিত শ্রীপ্রভাত কুমারের এই অবদানের জন্য তাঁকে স্মরণ করা।

সন্তোষ বাবু

২০০৯ সালে আমার আলাপ হয় ড. সন্তোষ বাবুর সঙ্গে। তিনি তখন ছিলেন ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন অফ তামিলনাডু (ইএলসিওটি)-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর তামিলনাডু ই-গভর্নেন্স এজেন্সি (টিএনইজিএ)-র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক। আমি গিয়েছিলাম হোসুর এফওএসটিইআরএ (ফস্টারিং টেকনোলজিস ইন রুরাল এরিয়াজ়)-এর ভার্চুয়াল বা কম্পিউটার যোগাযোগ কেন্দ্র এবং গ্রামীণ বাণিজ্য হাবের উদ্বোধনে। এটি একটি গ্রামীণ বিজ়নেস প্রোসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)। তিনি যখন কৃষ্ণগিরি জেলার কালেক্টার ছিলেন সেই সময়ে তিনি এই বিপিও-র চিন্তাধারাটির জন্ম দেন। তিনি আর তাঁর দল মিলে স্কুল-পালানোদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁর স্থাপিত বিপিও-তে নিয়োগ করতেন।

ড. বাবু জেলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষ করে স্কুল-পালানোর সংখ্যা প্রায় শূন্যতে এনে ফেলায়। তিনি এটি সম্ভব করতে পেরেছিলেন প্রযুক্তি, জনগোষ্ঠীর সহযোগ এবং সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সাহায্যে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর সফটওয়্যারে মজুত ডাটার সম্ভার দেখে। তিনি প্রতিটি স্কুল-পালানো শিশুর খুঁটিনাটি ধরে রেখেছিলেন তাঁর সফটওয়্যারে যা সহজেই পাওয়া যায় www.back2school.in এই ঠিকানায়। তাঁর পদ্ধতিতে প্রতিটি শিশুর পরিবারের চাহিদা কী তার উল্লেখ থেকেছে, যার ফলে জেলা প্রশাসন তত্ক্ষণাৎ সাহায্য করতে পেরেছে।

একটি উদাহরণ। নির্মলা নামের একটি মেয়ে বারবার স্কুল পালিয়েছে। জেলা প্রশাসন তা রদ করার আন্তরিক চেষ্টা করেও কোনও ফল হয়নি। খুঁটিনাটি খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, তার পরিবারের প্রয়োজন একটি রেশন কার্ড, একটি বাসস্থান আর তার মায়ের জন্য একটি চাকরি। জেলা প্রশাসন রেশন কার্ড, ইন্দিরা আবাস যোজনায় একটি বাসগৃহ এবং তার মায়ের জন্য একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দিল। কস্তুরবা গাঁধী বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে নির্মলাকে ভর্তি করে দেওয়া হল। কালেক্টার তার পরিবারের এই চাহিদাগুলি পূরণ করে দেবার পর নির্মলা নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করে দেয়।

যে জিনিসটি অনুধাবনযোগ্য তা হল, একটি শিশুর স্কুলে না যাওয়ার কারণটির খুঁটিনাটি অনুসন্ধান করেছেন ড. বাবু ও তাঁর দল। সমস্যাটিকে শনাক্ত করে তাকে নির্মূল করে বাচ্চাটির স্কুল যাওয়াকে মসৃণ করে দিয়েছেন। এইভাবেই, স্কুল-পালানোর হার কমে গিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি। এই দৃষ্টান্তটি দেখিয়ে দেয় কেমনভাবে একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার প্রযুক্তির সাহায্যে ও তাঁর নিজের কমিটমেন্ট ও প্যাশন দিয়ে কাজ করে সামাজিক জীবনযাপনে আনতে পারেন এক পরিবর্তন এবং এক সার্বিক সুখ।

স্বর্ণ সিংহ

ড. স্বর্ণ সিংহ পঞ্জাবের জলন্ধরের ডিভিশনাল কমিশনার ছিলেন ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অগাস্ট ২০০৭ পর্যন্ত। তিনি আর তাঁর স্ত্রী অমরজিৎ কৌর টেলিফিল্মের সাহায্যে রাজ্যের এক গম্ভীর সমস্যা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, সম্পর্কে সচেতন করার কাজ করেছেন। স্ত্রীর রচিত চিত্রনাট্য নিয়ে ড. সিংহ নির্মাণ করেছিলেন দু’ঘণ্টার ছবি Eh Tera Apmaan। চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছিল কেমনভাবে এক গ্রাম্য মহিলা নাতির মুখ দেখবে বলে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে নিয়ে এল অপরাধ।

এর পাশাপাশি ড. সিংহ অন্য ধরনের বাস্তবোচিত ব্যবস্থা নিতেন, যেমন কোনও কন্যাসন্তানের জন্ম হলে তিনি সেই গোষ্ঠীতে উৎসবের আয়োজন করতেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক দিনে যতগুলি কন্যাসন্তান জন্মাল সবাইকার একই নামকরণ করে দিতেন জেলার কালেক্টার। আবার, যে পরিবারে বা ক্লিনিকে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, সেই বাড়ি বা ক্লিনিকের সামনে গোষ্ঠীর মানুষদের একত্র করে আয়োজন করা হত শোকসভা। কোনও স্লোগান নয়, শুধু শান্তিপূর্ণ শোকসভা সেই সব বেআইনি কাজ যাঁরা করেছেন তাঁদের লজ্জিত করে দিত। গোষ্ঠীর সকলের কাছে তা ছিল এক কড়া বার্তা।

আমরা দেখি কেমনভাবে এক নিয়োজিত সিভিল সার্ভেন্ট ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়া সামাজিক এক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে কন্যাসন্তান সম্পর্কে ধারণার এক বিশাল পরিবর্তন এনে দিতে পারেন।

এম জি ভি কে ভানু

২০১১ সালের ২১ নভেম্বর, আমি আসামের জোরহাটে গিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ড টি সায়েন্স কংগ্রেসে ভাষণ দিতে। জোরহাটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর সি জৈনের আয়োজিত প্রশাসক ও পুলিশ আধিকারিকদের একটি সভায় আমি বক্তৃতা দিই। ‘আমি সততার সঙ্গে কাজ করব এবং সফল হব সততার সঙ্গে’ নামে একটি শপথ অংশগ্রহণকারীদের দিয়ে পাঠ করিয়েছিলাম। ‘সততার সঙ্গে কাজ করব’ অংশটি সকলে উচ্চস্বরে বললেন, কিন্তু সে স্বর নীচে নেমে গেল ‘সফল হব সততার সঙ্গে’ অংশটির সময়ে।

পরের দিন অবশ্য, আমি এক অত্যন্ত সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখতে পেলাম ওয়ার্ল্ড টি সায়েন্স কংগ্রেসে মুখ্যমন্ত্রী ও জোরহাট প্রশাসনের উপস্থিতিতে। টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আই এ এস অফিসার এম জি ভি কে ভানুকে দেখলাম আমার সামনে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে সূচনা ভাষণ দিতে।

তিনি তাঁর ভাষণে বললেন, ‘গতকাল, ড. কালাম সকল আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের, যার মধ্যে আমিও অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, একটি শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই ড. কালাম, যে, আমি আমার আইএএস জীবনের চব্বিশ বছর রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সততার সঙ্গে কাজ করেছি এবং সফলও হয়েছি সততার সঙ্গে। আমি এখন টি বোর্ডে আছি। আমি আসামের মুখ্যমন্ত্রীর সচিব ছিলাম। আমি ড. কালামকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমি আমার সকল কাজে এক ধরনের নীতিনিষ্ঠ দৃঢ়তা বজায় রাখার চেষ্টা করে গিয়েছি।’

তিনি আরও বললেন যে, তিনি সারা রাত চিন্তা করেছেন কোন কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে ভারতকে সর্ববৃহৎ চা উৎপাদক ও রপ্তানির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে চান।

এই অনন্য অভিজ্ঞতাটি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমার খুব ভাল লাগল। যদি ভারত সরকারের প্রত্যেক কার্যনির্বাহক এমন ভিশন ও মিশন নিয়ে কাজ করেন, আমি নিশ্চিত ২০২০ সালের আগেই আমরা এক উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে উঠব।

উপসংহার

প্রায় ২২০০ বছর আগে তাঁর যোগসূত্র-তে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছিলেন: ‘তুমি যখন কোনও মহান উদ্দেশ্যে, কোনও অসাধারণ প্রকল্পের জন্য অনুপ্রাণিত, তখন তোমার চিন্তা সব সীমাই ছিন্ন করে দেয়। তোমার মন সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে, তোমার বিবেক সবদিকে বিস্তার করে এবং তুমি এক নতুন, মহান, অপূর্ব জগতে নিজেকে খুঁজে পাও। সুপ্ত শক্তি, মেধা এবং প্রজ্ঞা জাগ্রত হয়, এবং নিজেকে তোমার স্বপ্নের থেকেও এক বৃহত্তর ব্যক্তি হিসেবে তুমি আবিষ্কার কর।’ এই অনুপ্রাণিত কথাগুলি মনে রেখে সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য আমার পাঁচ-দফা শপথ দিয়ে শেষ করা যাক:

১। আমি যে জায়গায় কাজ করতে যাব, আমি সেখানকার মানুষকে ১০০ শতাংশ শিক্ষিত করে তুলতে কাজ করব, এবং আমি নিশ্চিত করব যাতে একটি শিশুও স্কুল ছেড়ে চলে না যায়।

২। আমি নিশ্চিত করব যাতে মহিলাদের অবস্থা সমৃদ্ধ হয়, এবং আমি ছেলে আর মেয়ের মধ্যে সাম্য আনতে কাজ করব।

৩। আমি নিশ্চিত করব যাতে কেউ আমাকে দুর্নীতির পথে প্রলোভিত না করতে পারে।

৪। আমি জেলায় যতদিন কাজ করব আমি নিশ্চিত করব যাতে এক লক্ষ গাছ রোপণ হয় এবং তাদের পরিচর্যা করা হয়।

৫। যে জেলায় আমার নিয়োগ হবে, সেখানে যাতে সেই জেলার অন্তত পাঁচটি ‘পুরা’ কমপ্লেক্স কাজ করতে পারে আমি নিশ্চিত করব, এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষের যাতে কাজের সুযোগ হয়, তার জন্য গ্রামীণ সংস্থা তৈরি করে কাজ করব।

.

বারো : বিচারব্যবস্থাপক

যে রাষ্ট্র ন্যায়ের পথে স্থিত সেই রাষ্ট্রই মহান এক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আশা করতে পারে। সমাজে ন্যায়, সাম্য ও ন্যায্যবোধের প্রতিষ্ঠা করে, এক মহান দেশের ভিত্তি স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এক শক্তসমর্থ বিচারব্যবস্থা। সেই সঙ্গে, সময় মতো বিচার না হলে শুধু বিচারব্যবস্থা নয়, অস্বীকৃত হয় মহত্ত্বও। দুর্ভাগ্য এই যে, আদালতে মামলা পড়ে থাকা এবং নিষ্পত্তির জন্য অস্বাভাবিক দেরি হওয়া, এমন পরিস্থিতি ভারতের আইনব্যবস্থাকে পীড়িত করে রেখেছে বহুদিন ধরেই। ফলে, জাতীয় উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে যাচ্ছে। আইন ও বিচার মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ভারতের উচ্চতম, উচ্চ, জেলা আর নিম্ন আদালতগুলিতে ৩ কোটি মামলা নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে। তার ১০ শতাংশ দশ বছরের বেশি সময়ের জন্য পড়ে আছে।

এর কারণ অনেক: আদালতের সংখ্যা অপ্রতুল এবং জুডিশিয়াল অফিসারদের সংখ্যাও অপর্যাপ্ত (একটি হিসেবে, ৭০,০০০ বিচারপতির স্বল্পতার দরুন ভারতের আইনব্যবস্থা ভুগছে); বিশেষ ধরনের মামলা সামলানোর ক্ষমতা জুডিশিয়াল অফিসারদের নেই; মামলাকারী এবং তাঁদের উকিলরা দীর্ঘসূত্রতার পদ্ধতি অবলম্বন করে, যেমন প্রায়শই মুলতুবি নেওয়া এবং সময়মতো কাগজ নথি জমা না দেওয়া; এবং সব শেষে আছেন আদালতগুলির প্রশাসনিক স্টাফরা।

শক্তসমর্থ বিচারব্যবস্থা

এই সব সমস্যার সমাধান করার প্রয়াস নিয়ে সত্বর বিচারের ব্যবস্থা করে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উচিত জাতীয় উন্নয়নের চালকের দায়িত্ব নেওয়া। জমে থাকা মামলাগুলির নিষ্পত্তি করা যেতে পারে মানবিক দৃষ্টি, সেগুলির বয়সের বিচার, বিতণ্ডার সমাধানে বিকল্প উপায়, ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত, ই-বিচারব্যবস্থা, বিচারক, উকিল এবং জুডিশিয়াল অফিসারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাঁদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। আইনের নজরে যে সব মামলা এক ধরনের সেগুলি একত্রে একজন বিচারক বা বেঞ্চের কাছে পেশ করা যেতে পারে। যেমন, একই সরকারি দপ্তরের মামলাগুলি নিষ্পত্তির জন্য কোনও বিশেষ পদ্ধতির ব্যবস্থা। অহেতুক মুলতুবি না করে উকিলদের উচিত মামলা চালিয়ে যাওয়া। প্রতি মামলার নির্দিষ্ট সংখ্যার মুলতুবি বেঁধে দেওয়া থাকবে।

ই-বিচারব্যবস্থা মামলাকারীদের পীড়া লাঘবের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মামলা রুজু থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত সবকিছুই হবে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। এতে খুব সহজেই নথির সার্চিং, তার উদ্ধার, ঠিকভাবে সাজিয়ে নেওয়া, তথ্যের ও রেকর্ডের প্রক্রিয়াকরণ, এবং মামলার নিষ্পত্তিও হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে। স্বচ্ছতার শুরু হতে হবে ঘর থেকে। বিচারক, উকিল এবং অন্য সহযোগী স্টাফ ও মামলাকারী, সকলে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে হবে, এবং প্রত্যেককেই তাঁর কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকতে হবে।

দেশের উন্নতির বিশাল দায়িত্ব রয়েছে আদালতের উপর। বিচারব্যবস্থাকে গতিশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা নিয়ে এই কর্মকাণ্ডে শামিল হতে হবে।

আইন ও নীতি

আইনকে আলাদা করে না দেখে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বিভিন্ন ভাবনাচিন্তার পরিবর্তনের সঙ্গে আইনের সম্পর্ক বুঝতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে বিগত দুশো বছরে। কিছু জিনিস যা বিজ্ঞান ভেবেছিল হওয়া সম্ভব, তা হয়নি; আর কিছু জিনিস যা ভাবা হয়েছিল অসম্ভব, তা সম্ভব হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখের হবে যদি আমাদের সমাজে যে বিবর্তন ও বিপ্লব ঘটে চলেছে তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের আইন ও নীতি অক্ষম হয়।

যে দ্রুততার সঙ্গে অগ্রগতি হচ্ছে এবং যার প্রভাব সমগ্র মানবজাতি এবং সমাজের উপর পড়ছে, তার জন্য আইন, বিজ্ঞান ও নীতির সংহতভাবে এক পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং আইনজ্ঞকে একসঙ্গে বসে একটি পথরেখা তৈরি করতে হবে যাতে প্রযুক্তির সাহায্যে আমাদের আইনব্যবস্থা, এক ভারসাম্য বজায় রাখা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

মানুষের জিনোম প্রকল্পের উদাহরণটাই দেখা যাক, যার সম্পর্কে এই বইয়ে আগে উল্লেখ করেছি। সেই প্রসঙ্গে যে প্রশ্নগুলি মনে আসে সেগুলি হল: প্রকল্পের যে ফলাফল তার মালিকানা কার? ব্যক্তির জিনগত তথ্য কে আহরণ করতে পারবে, এবং তা কেমনভাবে ব্যবহার করা হবে? জিনগত তথ্যের মালিক কে, কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে? কেমনভাবে জিনগত পরীক্ষার বিশ্লেষণ এবং প্রবিধান করে সঠিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং উপযোগিতা নিরূপণ হবে? আইনের অন্য যে দিকগুলির পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন তা হল অন্তরিক্ষ সংক্রান্ত আইন আর সাইবার আইন।

বিজ্ঞানের সাধনা প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে বুঝতে সাহায্য করে এবং তা মানব সমাজে বাস্তবোচিত প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়। তেমনই, সমাজকে শাসনে রাখতে যে আইন রচিত হয়েছিল তা আইনত কাজ করে সমাজে আনে শৃঙ্খলা এবং সুস্থিতি। কিন্তু যে সব ব্যক্তি এই আইনের প্রয়োগ করেন তাঁদের কোন আইনে নিয়ন্ত্রণ করা হয়? সেই আইন কে রচনা করেন? আমার মনে হয় এই সব বিস্তৃতভাবে চলে আসে ‘নীতি’র এক্তিয়ারে। এই নীতির অনুশীলন নিয়ম এবং বিধির থেকে অনেক বেশি জরুরি। সব শেষে, প্রয়োজন হয় সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের রূপান্তর।

উপসংহার

হাজারও বছর ধরে ভারত রাজারাজড়া দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। প্রত্যেক শাসকই এক গুচ্ছ আইন রেখে যান। তেমনভাবেই, ভারতে নানান ধর্ম মানা হয়ে এসেছে এবং তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ আইন আছে। ব্রিটিশরা দু’শো বছরের উপর আমাদের শাসন করে দিয়ে গিয়েছে আইনের শাসন, যার ভিত্তি তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আইনি অভিজ্ঞতা। অনেকগুলি দশক ধরে আমরা তা-ই মেনে চলেছি। প্রতিটি আইনই আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

বর্তমানে, ভারত এমন এক অভাবনীয়তার মধ্য দিয়ে চলেছে যেখানে তথ্য সমাজ, শিল্প সমাজ ও কৃষি সমাজকে প্রভাবিত করছে জ্ঞান সমাজ, উদ্ভাবন ও মূল্যবোধের সহযোগে। এই পরিস্থিতি ধন্যবাদার্হ, কারণ এর সাহায্যেই ২০২০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে ভারত। বহু দেশেই শুধুই অর্থনৈতিক অগ্রগতি সামাজিক জীবনে সুখ আনতে পারেনি। এর অর্থ, অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্যে স্থির থেকে, আমাদের সভ্যতার ঐতিহ্য থেকে নীতিজ্ঞান আর মূল্যবোধকে আহরণ করে আমাদের সমাজের বিবর্তনে তা প্রোথিত করে দিতে হবে। ভারতের উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে মিল রেখে আইনব্যবস্থার বিবর্তন হতে হবে। এর থেকেই জন্ম নেবে সুখী, সমৃদ্ধ এবং নিরাপদ ভারত।

আমি শেষ করব ভারতের উঠতি আইনজীবী এবং আইনব্যবস্থার পেশাদারিদের জন্য শপথ দিয়ে:

১। আমি আমার অভিজাত আইন পেশাকে ভালবাসি।

২। আমি সকল সময়ে আমার সব মামলায় সত্য উদ্ঘাটনের জন্য কাজ করব।

৩। প্রত্যেকের কাছে আইনব্যবস্থা পৌঁছে দেবার জন্য আমি সচেষ্ট থাকব, তাঁর অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা ব্যতিরেকে।

৪। আমি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করব যাতে আমার প্রতিটি মামলা সত্বর শেষ হয়।

৫। আমি আইনের সাহায্যে প্রত্যেক মানুষের জীবনের সম্মান রাখতে সচেষ্ট থাকব।

৬। আমি আইনের সাহায্য নিয়ে কখনওই কোনও নিরীহকে অপরাধী সাব্যস্ত করব না।

৭। আমি আইনের সাহায্যে রাষ্ট্রকে দুর্নীতি ও আতঙ্কবাদ মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকব।

৮। আমি কোনও সময়েই আইনকে এমনভাবে ব্যবহার হতে দেব না যাতে মানবকল্যাণ এবং জাতীয় উন্নয়ন বিঘ্নিত হয়।

৯। আমার রাষ্ট্রই আমার জীবন, আমি আমার আইনি জ্ঞানের সাহায্যে তার সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখব।

.

তেরো : রাজনৈতিক নেতা

সব শেষে, মহান এক রাষ্ট্র গড়তে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে আমি বলতে চাই। একটি দেশের ভবিষ্যতের পরিবর্তন ঘটায় রাজনীতিকদের সিদ্ধান্ত, তাঁদের লক্ষ্য এবং তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম। এক অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া এক মহান রাষ্ট্র সম্ভব নয়। সুতরাং, আমাদের গভীর চিন্তার প্রয়োজন, কীভাবে এক মননশীল নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটানো যায়। এমন এক নেতৃত্ব যা হয়ে উঠবে নিজেই এক নিদর্শন আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের পথে এগিয়ে দিতে।

আমি এখানে স্মরণ করি আমার অভিজ্ঞতায় ভারতের ইতিহাসের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাকে।

শ্রেষ্ঠদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা

পি ভি নরসিংহ রাও ও অটল বিহারী বাজপেয়ী

১৯৯৬ সালের মে মাসের কোনও এক রাত্রি ৯টা বাজে তখন। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি থেকে আমাকে ফোনে বলা হল পি ভি নরসিংহ রাওর সঙ্গে সত্বর দেখা করতে। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার দু’দিন আগেই আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কালাম, আপনার দল নিয়ে আপনি এক আণবিক পরীক্ষার জন্য তৈরি থাকুন। আমি তিরুপতি যাচ্ছি। ওই পরীক্ষা আয়োজনের জন্য আমার অনুমতির অপেক্ষায় থাকবেন। ডিআরডিও-ডিএই (ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি)-এর দল যেন প্রস্তুত থাকে কর্মকাণ্ডটির জন্য।’ তাঁর মন্দির-শহরটিতে যাবার কারণ নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার জন্য প্রার্থনা।

যা ঘটল তা তাঁর আশার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। উড়িষ্যার চাঁদিপুরে মিসাইল রেঞ্জে আমি তখন ব্যস্ত। আমি ফোন পেলাম যে, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে আমি যেন হবু প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে সত্বর দেখা করি। আমি অবাক হয়ে গেলাম এই দেখে যে, রাও চাইছেন আমি বাজপেয়ীকে আমাদের আণবিক যোজনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে দিই, যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি মসৃণভাবে হস্তান্তরিত হয়। এই ঘটনা দেখিয়ে দিল এক দেশভক্ত কূটনীতিকের পরিণত চিন্তাধারা এবং পেশাগত অসাধারণত্ব, যিনি মনে করতেন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে।

১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে প্রথম যে কাজটি বাজপেয়ী আমাকে দিয়েছিলেন, সেটি হল, যত শীঘ্র সম্ভব আণবিক পরীক্ষাটার ব্যবস্থা করা। কঠিন এবং কঠোর সিদ্ধান্ত উভয় নেতাই নিয়েছেন সাহসের সঙ্গে, হয়তো-বা সেই সিদ্ধান্তগুলির ফলাফল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হয়েছে অসীম গুরুত্বের।

ইন্দিরা গাঁধী ও বিজু পট্টনায়ক

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপিং প্রোজেক্ট-টির অনুমোদন দিয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে। হায়দ্রাবাদের ডিআরডিএল-এর অধিকর্তা ছিলাম আমি যখন সেই ১৯৮৪ সালে তিনি প্রকল্পটির পর্যালোচনা করতে সেখানে গিয়েছিলেন। শ্রীমতী গাঁধীকে আমরা যখন প্রকল্পটির অগ্রগতি সম্পর্কে জানাচ্ছিলাম, তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ওই অধিবেশন কক্ষে রাখা পৃথিবীর একটি মানচিত্রর উপর। তিনি আমাদের থামতে বলে বললেন, ‘কালাম, মানচিত্রটার দিকে তাকান। মানচিত্রে পূর্বদিকের দূরত্বটা দেখুন। আপনার ল্যাবরেটরি কবে একটি মিসাইল উৎক্ষেপণ করতে পারবে যেটি ওই জায়গাটিতে (যেটি ভারতীয় সীমারেখার ৫০০০ কিমি. দূরে অবস্থিত) গিয়ে পড়বে?’

এই ঘটনা আমাকে আর একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৯৩ সালে ডিআরডিও-তে আমরা পরীক্ষামূলক মিসাইল উৎক্ষেপণের একটি যথাযোগ্য স্থানের খোঁজ করছিলাম। পশ্চিম ভারতে মরু অঞ্চলে আমাদের স্থান নির্বাচনের প্রচেষ্টা সম্ভব হল না নিরাপদ রেঞ্জ আর ভৌগোলিক-রাজনৈতিক কারণে। সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা পূর্ব তটরেখায় কোনও জনমানবহীন দ্বীপের সন্ধানে ছিলাম। নৌসেনার তরফে আমাদের যে হাইড্রোগ্রাফিক মানচিত্র দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বঙ্গোপসাগরে কয়েকটি দ্বীপ নজরে এল। এগুলি উড়িষ্যার ধামরার তটরেখার বাইরে। আমাদের রেঞ্জ দলের দুই সদস্য ড. এস কে সালওয়ান ও ড. ভি কে সারস্বত একটি নৌকা ভাড়া নিয়ে দ্বীপগুলির খোঁজে গেলেন। মানচিত্রে দ্বীপগুলি লং হুইলার, কোকোনাট হুইলার এবং স্মল হুইলার নামে চিহ্নিত ছিল। একটি ডিরেকশনাল কম্পাস নিয়ে তাঁরা যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু তাঁরা পথ হারিয়ে ওই হুইলার দ্বীপগুলিকে খুঁজে পেলেন না। ভাগ্যবশত তাঁরা কয়েকটি মাছ ধরার নৌকার সাক্ষাৎ পেলেন, এবং তাঁদের কাছ থেকে সঠিক নির্দেশ চাইলেন। মত্স্যজীবীরা হুইলার দ্বীপের কথা জানেন না, তবে চন্দ্রচূড় নামের একটি দ্বীপের কথা জানালেন। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন হুইলারের কোনও একটা দ্বীপ হয়তো হবে। চন্দ্রচূড় দ্বীপের সম্ভাব্য অবস্থান জেনে নিয়ে তাঁরা সেই দিকে এগোতে থাকলেন। এইভাবে তাঁরা চন্দ্রচূড়ে গিয়ে পৌঁছলেন। পরে নিশ্চিত হল যে, সেটি স্মল হুইলার দ্বীপ। দ্বীপটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আমাদের কাজের প্রয়োজনে ছিল যথার্থ।

এরপরের ধাপে, এই দ্বীপটিতে কাজের জন্য উড়িষ্যা সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। রাজ্য সরকারের আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে এগিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়কের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আবশ্যক হয়ে পড়ল। তাঁর দপ্তর থেকে সংকেত পাচ্ছিলাম যে, আমাদের অনুরোধ নাকচ হয়ে যাবে কয়েকটি কারণে। যাই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটি মিটিংয়ের ব্যবস্থা হল।

আমরা তাঁর দপ্তরে পৌঁছে দেখলাম ফাইলটি তাঁর সামনে রাখা। তিনি বললেন, ‘কালাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওখানকার পাঁচটি দ্বীপই আমি আপনাকে (ডিআরডিও)-কে বিনা ব্যয়ে দেব। কিন্তু আমি ফাইলে সই করব যদি আপনি একটা প্রতিজ্ঞা রাখেন।’

আমি চিন্তা করতে লাগলাম এই শক্তিশালী নেতাটি আমার কাছে কী চাইতে পারেন।

তিনি আমার হাতটি ধরে বললেন, ‘চিন যাবার একটি আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমি সেখানে যাব যদি আপনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, এমন একটি মিসাইল আপনারা নির্মাণ করবেন যা চিনে গিয়ে পৌঁছবে।’

‘স্যার, আমরা অবশ্যই সেই দিকে কাজ করব,’ আমি বললাম। তিনি ফাইলে সই করে দিলেন।

ইন্দিরা গাঁধী এবং বিজু পট্টনায়কদের মতো নেতাদের দূরদৃষ্টি দু’দশক পরে ২০১২ সালে সম্ভব করেছে আমাদের বিজ্ঞানীদের আণবিক-ক্ষমতাসম্পন্ন ‘অগ্নি ৫’ নির্মাণে, যার রেঞ্জ ৫০০০ কিমি.।

সাংসদদের প্রতি ডাক

আমি যখন ভারতের সাংসদদের দিকে তাকাই, আমি তাঁদের মধ্যে দেখতে পাই পি ভি নরসিংহ রাও ও অটলবিহারী বাজপেয়ী, ইন্দিরা গাঁধী ও বিজু পট্টনায়ক, বা ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, পণ্ডিত জহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, সর্দার বল্লভভাই পটেল, ড. বাবাসাহেব অম্বেদকর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং মহাত্মা গাঁধীর প্রতিশ্রুতি। তাঁরা ছিলেন ভারতের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃবর্গ। আজকের সাংসদদের আমি প্রশ্ন করতে চাই: আপনারাও কি হতে পারেন না দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সেই সব নেতা, যাঁরা রাষ্ট্রকে নিজের আগে স্থান দেবেন? আপনারা কি বিশ্বের দরবারে ভারতের মহান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতীয়মান করতে পারেন না? হ্যাঁ তা সম্ভব।

গত সাত দশক ধরে স্বাধীন ভারতের সেই সব মহান নেতাদের দূরদৃষ্টি ভারতকে একটি সন্তোষজনক স্থানে রাখতে পেরেছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের বহু গর্ব করার মতো অবদান আছে। কিন্ত সেই সাফল্য নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আগামী দশকগুলি ভারতের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবেন আজকের সাংসদ, বিধায়ক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাঁদের কাঁধে আজ এক বিরাট দায়িত্ব।

সময় বেঁধে জাতীয় কার্যক্রম রচনা করে এবং তার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের ভিতর এক বিশ্বাস তৈরি করতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। আমাদের সামনে আজ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ: অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে জোরদার করে বিশ্বময় যে আতঙ্কবাদ এবং যে নতুন ধরনের আইনশৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তার মোকাবিলা; অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি হওয়া; পৃথিবীর জীবাশ্ম-জ্বালানির দ্রুত হারে হ্রাস পাওয়া; যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের পরিকল্পনা রচনা; একশো কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের জোগান, অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।

এই সব জাতীয় সমস্যাগুলির প্রতি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের, দলমত নির্বিশেষে, নজর দেওয়া প্রয়োজন। যে-কোনও গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হল সংসদ, তাই সাংসদদেরই এই সমস্যাগুলির সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তাঁদের এই মিশন রাষ্ট্রের এক ভিশনের জন্ম দেবে। তাঁদের উপরই নির্ভর করছে জনগণের এক সমৃদ্ধশালী, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ। সুতরাং সাংসদদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংসদের প্রত্যেক সদস্যের উচিত তাঁরা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তার জন্য উঠে দাঁড়ানো। প্রত্যেক সাংসদের মধ্যে যেন যুবসমাজ এক মহান নেতা এবং তাঁদের রোল মডেল খুঁজে পান, এবং খুঁজে পান সেই নেতাকে যিনি রাজনীতি আর সমাজে নিয়ে আসবেন এক অত্যন্ত ক্রিয়াশীল পরিবর্তন।

এখানে আমি সরাসরি ভারতের সংসদের মাননীয় সদস্যদের উদ্দেশে বলতে চাই যে, আপনারা সঠিক নীতি ও আইন প্রণয়ন করে এবং সামাজিক রূপান্তরে সাহায্য করে একশো কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠাগুলিতে আপনাদের নাম উল্লেখ থাকার অপেক্ষায় আছে। ভারতকে এক উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে দিন, তার গরিমা হবে আপনার। বিশ্বকে আপনার পরিণত রাজনীতির পরিচয় দিন এবং দেখিয়ে দিন কীভাবে তাকে আপনি রাষ্ট্রের নিরন্তর উন্নয়নের কাজে লাগাবেন। এক অনুনাদশীল, সজাগ, নিরাপদ ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ার জন্য এগিয়ে আসুন। আমি নিশ্চিত এই ক্ষমতা আপনাদের আছে এবং তা সম্ভব হবে যদি আপনাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে।

উপসংহার

২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারির একটি ঘটনার কথা আমি এখানে বলতে চাই। মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে ‘সতপুরা শিক্ষণ প্রসারক মণ্ডল’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এই অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে আমি লাখ খানেক তরুণদের একটি সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলাম ‘আমি অনন্য’ এই বিষয়ে, সেখানে উপস্থিত ছিলেন বহু রাজনীতিক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ। ভাষণ শেষে অনেকগুলি প্রশ্নের মধ্যে এক তরুণ বালকের প্রশ্নটি ছিল তাত্পর্যের।

সে নিজেকে হারালী গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র বলে পরিচয় দিল। সে প্রশ্ন করল, ‘স্যার, আমাদের সংবাদমাধ্যমে এবং আমার বন্ধুরা সব সময়ে বলে যে, চিন ভারতের থেকে অনেক বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতি করেছে এবং তার অগ্রগতির হারও আমাদের থেকে বেশি। দয়া করে, স্যার, আপনি আমাদের বলুন কেন ভারত দ্রুত হারে অগ্রগতি করতে পারছে না। আপনি আমাদের বলুন, তার জন্য আমার মতো তরুণদের কী করতে হবে?’

বালকের এই প্রশ্ন সকলের সাদর অভিনন্দন পেল। এক লক্ষ তরুণ আমার কাছে উত্তর চায়। মঞ্চে উপবিষ্ট বন্ধুরাও আমার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে। কিছু পল চিন্তা করে আমি ছেলেটির নাম জানতে চাইলাম।

সে উত্তর দিল, ‘বিনীত।’

আমি বললাম, ‘বিনীত, তোমার রয়েছে এক শক্তিশালী মন এবং তুমি দেশকে ভালবাস। তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে পারি, একথা সত্য যে, চিনের অর্থনৈতিক উন্নতি ভারতের থেকে ভিন্ন ধরনের। কিন্তু চিনের সঙ্গে তফাত হল, ভারত এক সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ। তার জনগণ নেতাদের নির্বাচন করেন। গণতন্ত্রের কিছু চাপ, কিছু টান থাকে। কিন্তু আমাদের পাখা মেলে এগিয়ে যেতে হবে। ওই দীর্ঘসূত্রতা যা গণতন্ত্রের সহচর, তাকে দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে নেতৃত্বকেই। এখানে যত তরুণ আজ জমা হয়েছেন, তাঁদের আমি বলব, প্রিয় তরুণ সাথীরা, আমি আপনাদের দু’টি ব্যবস্থা— একটি পূর্ণ গণতন্ত্র, সঙ্গে দ্রুত উন্নয়ন, এবং অন্যটি চিনের মতো রাজনৈতিক ব্যবস্থা— এই দু’টি ব্যবস্থার মধ্যে আপনারা কোনটি বেছে নেবেন?’

হাত তুলে যখন আমি তাঁদের পছন্দ জানাতে বললাম, ৯৯ শতাংশ তরুণ হাত তুলে জানালেন, তাঁরা দ্রুত উন্নয়নের গণতন্ত্রে বাস করতে চান। এই বার্তাটি উচ্চস্বরে এবং স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল: ‘তরুণ সমাজ নিশ্চিত করে চায় নতুনভাবে আবিষ্কৃত হোক এক দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্র।’

আমি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আমাদের গণতন্ত্রকে পুনরাবিষ্কার করে আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের পথটিকে পালটে দেবার জন্য আহ্বান করব। আমি শেষ করব আমাদের সাংসদদের জন্য এই শপথ দিয়ে:

১। আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কারণ আমার নির্বাচন কেন্দ্র আমাকে নির্বাচিত করেছে তাঁদের নেতৃত্ব দেবার জন্য।

২। আমি উপলব্ধি করছি যে জনগণের নেতৃত্বের অর্থ আমার নির্বাচন কেন্দ্রতে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে হবে।

৩। আমার নির্বাচন কেন্দ্রের জন্য আমার লক্ষ্য হবে: ১০০ শতাংশ শিক্ষিত করে তোলা, সব জলাধারগুলিকে কার্যকরী করা, সকল প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রগুলিতে সত্ত্বর কাজ শুরু করা, এবং সর্বোপরি, এক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কেন্দ্র।

৪। আমি প্রশ্ন করব, ‘আমি কী দিতে পারি?’ এই প্রশ্ন আমাকে বিনয়ের সঙ্গে পরিসেবা দিতে বাধ্য করবে।

৫। আমি সততার সঙ্গে কাজ করব এবং সফল হব সততার সঙ্গে।

৬। আমি ২০ লক্ষ গাছ রোপণ করে নিশ্চিত করব আমার নির্বাচন কেন্দ্রতে সবুজ পরিবেশ।

৭। আমার মেধা সকল যন্ত্রণা দূর করুক।

৮। জাতীয় পতাকা আমার হৃদয়ে সর্বক্ষণ উড্ডয়নরত এবং আমি আমার রাষ্ট্রকে এনে দেব গরিমা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *