১. টুকরো মন্তব্য

পর্ব ১ : টুকরো মন্তব্য

এক

একটি রাষ্ট্র কোন গুণে মহান?

একটি রাষ্ট্র কীসে বা কোন গুণে মহান হয়, সেই আলোচনায় যাবার আগে আমি মানব বিবর্তনের গবেষণায় যে অগ্রগতি হয়েছে, তার কথা কিছু বলতে চাই। এই বিষয়টি বুঝতে চিরাচরিতভাবে দু’টি পথে এগোনো হয়। প্রথমটি হল পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে। মহেঞ্জো-দারো আর হরপ্পা বা পৃথিবীর অন্যত্র ওই ধরনের অন্যান্য খনন প্রক্রিয়ায় উঠে আসা প্রমাণগুলি এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বহু ধরনের সভ্যতার যাপনচিত্র, তাদের সংস্কৃতি এবং ব্যুত্পত্তির হদিশ দিয়েছে তারা।

দ্বিতীয় এবং সাম্প্রতিকতম পথটি চালিত হয়েছে মানব জিনোম বিষয়ে আমাদের উন্নততর জ্ঞানের সাহায্যে। মানুষের জিনের ক্রমের বৃহদাংশ সকল মানুষেই এক, স্বল্পাংশে শুধু দেখা যায় পার্থক্য। এই পার্থক্যর ফলেই মানুষের মধ্যে আমরা দেখতে পাই এত বৈচিত্র্য। দক্ষিণ আফ্রিকার অধ্যাপক ফিলিপ টোবিয়াস (১৯২৫-২০১২) ছিলেন জিনতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের এক পুরোধা পুরুষ, যিনি আমাদের এই কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসকে জানতে সাহায্য করেছেন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের গবেষণার নতুন পথ দেখিয়েছে তাঁর কর্মকাণ্ড।

২০০৫ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি (এনজিএস), ইন্টারন্যাশনাল বিজ়নেস মেশিনস (আইবিএম) এবং ওয়েট ফাউনডেশন (একটি মার্কিন সংস্থা যারা সমুদ্রের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধারের কাজে নিযুক্ত), সম্মিলিতভাবে ‘জিনিয়োগ্রাফিক প্রোজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে। এর লক্ষ্য, জিনগত নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়নের জন্য সারা বিশ্বের কয়েক লক্ষ মানুষের ডিএনএ-র নমুনা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে ইতিহাসে যত মানব অভিবাসন হয়েছে, তার একটি মানচিত্র নির্মাণ করা। মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর এম পিচাপ্পান এই প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে আমার আলোচনা আমার কাছে ছিল এক চিন্তা-উদ্রেককারী অভিজ্ঞতা।

ভবিষ্যতে কোনও একদিন হয়তো, ‘একটি রাষ্ট্র কোন গুণে মহান?’-এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ওই মানব জিনে-ই। আপাতত এইটুকু বলা যায় যে, দেশের জনসাধারণ রাষ্ট্রর থেকে মহান। তাঁদের মননশীল নেতৃত্ব, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অংশীদারির গৌরব, এবং তাঁদের দূরদৃষ্টি— এই সবকিছু মিলিয়ে তাঁরা তাঁদের রাষ্ট্রকে করে তোলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।

মহাত্মা গাঁধী, ড. নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা

কিছু বছর আগে আমার এক অনন্য অভিজ্ঞতা আমাকে দেখিয়ে দিল যে, এক বিপুল জনজাতিকে কীভাবে একটি মানুষ উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। দিল্লিতে হঠাৎ-ই আমার সুযোগ হল মহাত্মা গাঁধীর প্রপৌত্রী, শ্রীমতি সুমিত্রা গাঁধী কুলকার্নির সঙ্গে সাক্ষাতের। তিনি তাঁর পিতামহ, যাঁকে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁর বিষয়ে একটি ঘটনার কথা আমাকে শোনালেন।

গাঁধীজি প্রতি সন্ধ্যায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর প্রার্থনাসভাটি করতেন। প্রার্থনার শেষে হরিজন উন্নয়নের জন্য দান সংগ্রহ করা হত। তাঁর সহকারীরা প্রতিদিন তা গুনে রাখতেন এবং তাঁর রাতের আহারের আগে তাঁকে মোট অঙ্কটি জানিয়ে দেওয়া হত। পরের দিন ব্যাঙ্কের আধিকারিক এসে তা ব্যাঙ্কে নিয়ে যেতেন। একদিন আধিকারিকটি জানালেন যে, সংগৃহীত অর্থ এবং তাঁকে যে টাকা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কয়েক পয়সার গরমিল রয়েছে। পার্থক্যটি নেহাতই ক্ষুদ্র অঙ্কের। কিন্তু গাঁধীজি জোর দিয়ে বললেন যে, সংগৃহীত অর্থ যেহেতু গরিবদের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাই তার প্রতিটি পয়সার সঠিক হিসেব থাকা প্রয়োজন। এমনই ছিল গাঁধীজির নৈতিক সততার পথ। সেই পথেই তিনি সমগ্র দেশবাসীকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন মহত্ত্বের অভিমুখে। তাঁর উদাহরণ মেনে আমাদের প্রত্যেকের উচিত আমাদের চিন্তায় ও কাজে এই নৈতিক সততার অভ্যাস করা।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের একটি প্রাচীন ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় আমার ভ্রমণের একটি বৃত্তান্ত আমি এখানে বর্ণনা করব। একের পর এক স্টেশন পার হয়ে ট্রেনটি ঝিকঝিক করে এগোতে লাগল; আর অবিচারের বিরুদ্ধে সেই দেশে গাঁধীজির সংগ্রামের কথা আমার মনে পড়তে থাকল। আমি পিয়েটারমারিটসবার্গ স্টেশনে, যেখানে নামলাম, সেইখানেই গাঁধীজিকে তাঁর চামড়ার বর্ণের জন্য প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। দেখলাম, সেখানে তাঁকে স্মরণ করে একটি স্মৃতিফলক:

এই ফলকের কাছেই কোনও স্থানে

এম কে গাঁধীকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল

একটি প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে

৭ জুন ১৮৯৩ রাত্রে।

এই ঘটনা তাঁর জীবনের ধারাকে

পরিবর্তিত করে দিয়েছিল।

তিনি বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে

লড়াই শুরু করেন।

তাঁর সক্রিয় অহিংস্রতার

শুরু এই দিনটি থেকে।

সেখানে দাঁড়িয়ে আমার মন চলে গেল দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার দু’টি পূর্ব অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে। একটি হল রোবেন দ্বীপে, যেখানে ড. নেলসন ম্যান্ডেলাকে সাতাশ বছর একটা ছোট্ট কুঠুরিতে অন্তরিন করে রাখা হয়েছিল। অন্যটি ড. ম্যান্ডেলার বাড়িতে।

টেবল পর্বতের জন্য কেপ টাউন খুবই বিখ্যাত। এই পর্বতমালার তিনটি শিখর— টেবল পিক, ডেভিল পিক আর ফেক পিক। শিখরগুলি দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। সারাদিন ধূসর আর সাদা মেঘ এক একটি শিখরকে যেন আলিঙ্গন করে শিখরগুলির মধ্য দিয়ে উড়ে বেড়ায়। টেবল পিকটি সমুদ্রতটের সব থেকে কাছের শিখর। সেখান থেকে দশ মিনিটে আমি রোবেন দ্বীপে পৌঁছে যাই হেলিকপ্টারে। সমুদ্রর গর্জন বাদে সেই দ্বীপ একেবারে শান্ত, নিশ্চুপ। এইখানেই ব্যক্তির স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছিল।

বিস্মিত হতে হয় ড. ম্যান্ডেলার কুঠুরিটির পরিমাপ দেখে। এক ছ’ফুট দীর্ঘ মানুষের পক্ষে সাতাশ বছর ধরে ওই ক্ষুদ্র কুঠুরিতে শোয়া-থাকার কথা ভাবা যায় না। প্রতিদিন প্রখর সূর্যের আলোয় কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁকে নিকটবর্তী পাহাড়ে খনন কাজে নিয়ে যাওয়া হত। এই সময়েই তাঁর দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হয়। কিন্তু শারীরিকভাবে নির্যাতিত হলেও, তাঁর অন্তরাত্মা ছিল অজেয়। ওয়ার্ডেন শুয়ে পড়লে, তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে লিখে যেতেন তাঁর পাণ্ডুলিপি, যা পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয় একটি বিখ্যাত গ্রন্থের আকারে, Long Walk to Freedom.

জোহানেসবার্গে তাঁর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল আমার কাছে এক বিরাট ঘটনা। ছিয়াশি বছরের মানুষটি হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে কী অসাধারণ অভ্যর্থনা জানালেন। বিদায়ের সময়ে তিনি আমাকে এগিয়ে দিতে পোর্টিকো পর্যন্ত এলেন। তাঁর হাতের লাঠিটি তিনি পরিত্যাগ করে আমাকে ভর করে হাঁটলেন। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ড. ম্যান্ডেলা, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলনের মুখ্য ব্যক্তিরা কারা ছিলেন?’

তাঁর তাত্ক্ষণিক উত্তর, ‘অবশ্যই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন এম কে গাঁধী। ভারত আমাদের এম কে গাঁধীকে দিয়েছিল, আর দু’দশক পর আমরা ভারতকে ফিরিয়ে দিলাম মহাত্মা গাঁধীকে।’ ভারতের ঐতিহ্যই তো তাই। আমরা যে দেশেই গিয়েছি আমরা তাদের সাহায্য করেছি— অর্থনৈতিকভাবেই শুধু নয়, জ্ঞান, শ্রম, এবং সর্বোপরি মান ও সম্মান দিয়ে।

ড. ম্যান্ডেলা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি হলেন, তিনি তাঁর দেশবাসীকে, যারা তাঁর সঙ্গে অসদাচরণ করেছিল, সাতাশ বছর অন্তরিন করে রেখেছিল, তাদের তিনি দিলেন স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সমঅধিকার। সুপ্রিয় বন্ধুগণ, ২২০০ বছর আগে কবি-সন্ন্যাসী তিরুভাল্লুভারের লেখা তিরুক্কুরালের দু’টি চরণ, ড. ম্যান্ডেলার কাছে প্রাপ্ত শিক্ষার যেন প্রতিফলন:

এর অর্থ, যারা তোমার সঙ্গে অসদাচরণ করবে, তাদের সঙ্গে তুমি সু-আচরণ করো। রাজনৈতিক দুই নেতা, মহাত্মা গাঁধী এবং ড. নেলসন ম্যান্ডেলা, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ জনসংখ্যার যথাক্রমে, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের দেখানো পথে অন্য বহু রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে শামিল হয়েছে।

ইউরোপ

এবার আমরা ইউরোপের দিকে তাকাই এবং খুঁজে নিই শ্রেষ্ঠত্বের কোন পাঠ আমরা তাদের কাছ থেকে পেতে পারি।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে ইউরোপীয় সভ্যতার একটি অনন্য স্থান আছে। সেখানকার মানুষেরাই এই গ্রহকে প্রথম অন্বেষণ করে বেড়িয়েছে। তারাই শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী চিন্তাভাবনার জন্ম দিয়ে তাদের উন্নতিসাধন করেছে। কিন্তু অন্যদিকে এই ভূখণ্ডেই সেখানকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত হয়েছে শয়ে শয়ে বছর ধরে, যার মধ্যে আছে গত শতকের দু’টি বিশ্বযুদ্ধ।

এতত্সত্ত্বেও, তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) প্রতিষ্ঠা করল। লক্ষ্য, সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট সব রাষ্ট্রের মধ্যে সংযোগের উদাহরণ হয়ে আছে। তেমনই সম্ভবত, রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা নিষ্ক্রান্ত করেছে এবং ওই অঞ্চলে এক চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের নিদর্শন হয়ে আছে, এই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। পরস্পরের একান্ত নিজস্ব দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটি স্থিতিশীল শান্তির পরিবেশ রচনার এই ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইইউ যেন এক পথপ্রদর্শক। বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির উচিত ইইউ-র মতো আঞ্চলিক সহযোগিতাকে বৃদ্ধি করে এক উন্নততর স্থায়ী বিশ্বশান্তির পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা।

সিঙ্গাপুর

আবার অন্যদিকে আছে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর। এটি এমন একটি দেশ যার নিজস্ব কোনও প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, তার জনসাধারণ ছাড়া। এই জনসাধারণই তাঁদের জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশটিকে করে তুলেছেন অর্থনৈতিকভাবে এক উন্নত রাষ্ট্র। দেশের নেতৃবৃন্দের ভিতরেও জনগণের এই গুণগুলি বর্তমান। তাঁরা সততা ও আত্মনিয়োগের প্রতিমূর্তি। লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০। তাঁর মননশীল নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরকে তিনি করে তুলেছেন এক মহান বহুসংস্কৃতির সংহত রাষ্ট্র, যার লক্ষ্য ছিল একটিই— সিঙ্গাপুরই। তাঁর নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর হয়ে উঠল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক রাষ্ট্র, যার সংস্কৃতি তার নাগরিকদের করে তুলল তাঁদের দেশ সম্পর্কে গর্বিত এবং দেশের আইনকে মান্যতা দিয়ে তাঁরা নিজেদের যাপনকে করে তুললেন সুস্থির।

ইউনাইটেড স্টেটস অফ অ্যামেরিকা

জ্ঞানত মাত্র ২৫০ বছরের দেশ এই ইউনাইটেড স্টেটস অফ অ্যামেরিকা (ইউএস)। কিন্তু এদের থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। ধরা যাক, তাদের গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা অথবা প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক বা অন্যান্য প্রতিকূলতাকে যুঝে তাদের সমাধান করার ক্ষমতা। মার্কিন দৃষ্টিকোণ ও স্বপ্ন আজ তার দেশের জনগণের জন্যই বিশ্বময় একটি বহুল প্রচারিত ও আলোচিত ধারণা। সেখানে প্রত্যেক দেশবাসী চান অ্যামেরিকা বিশ্বে একনম্বর রাষ্ট্র হবে। এই ভাবধারাই ইউএস-কে প্রতিনিয়ত করে তুলছে উন্নত। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, শিল্প— সকল ক্ষেত্রেই তারা নেতৃত্ব প্রদানে এগিয়ে।

মহান নেতারা কীভাবে একটি মহান রাষ্ট্রের জন্ম দেন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই ইউএস। স্বপ্নদর্শী কিছু পুরুষ ও মহিলা একটি রাষ্ট্রকে দিয়েছেন তার দিশা এবং জুগিয়েছেন তার স্থায়িত্ব। থমাস জেফারসন এবং জর্জ ওয়াশিংটন ইউএস-কে দিয়েছিলেন তার শক্তপোক্ত গণতান্ত্রিক বুনিয়াদ। আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর জীবনকে বাজি রেখে উচ্ছেদ করলেন দাসপ্রথা। ড. ম্যান্ডেলা যদি মহাত্মা গাঁধীর পথ অনুসরণ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় জাতি-বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকেন, তো ইউএস-এ গাঁধীজির অনুপ্রেরণায়ই ওই একই পথে হেঁটেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারের মতো নেতৃবৃন্দ। এমনই সব মহান নেতারা তাঁদের কাজের মাধ্যমে তাঁদের দেশকে করে তুলেছিলেন মহিমান্বিত। তাঁদের হত্যাকাণ্ডর ঘটনাগুলি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সংগ্রামকে দৃঢ়তর করেছে।

ভারত

পরিশেষে আসা যাক ভারতের কথায়। ভারত ও ইউএস-এর মধ্যে কিছু মিল পাওয়া যায়, বহু পার্থক্য সত্ত্বেও। আবার অন্যদিকে, ভারতীয় সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন। তেমনই, ভারতে বিভিন্ন ভিনদেশের আগ্রাসন হয়েছে, তার আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য। ইউএস-এর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। কিন্তু, দুই রাষ্ট্রই আজ আধুনিক, বহুসংস্কৃতির, বহুধর্মের, বহুভাষার দুই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী পৃথিবীর বিভিন্ন রাজবংশ ভারতে তাদের শাসন কায়েম করে গিয়েছে । কিন্তু এই বিদেশি আক্রমণকারীরা ভারতবর্ষের ইথস বা যাকে বলা যায় মূল ধারণাকে তাদের মধ্যে আহরণ করে নিয়েছে। আর ভারত ভিন্ন সভ্যতার গুণগুলিকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করে নিয়েছে। সে বহু হিংস্রতা প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু আজ সে অহিংসার পুণ্যভূমি। একটি মানুষ তা তিনি সম্রাট অশোকই হোন বা মহাত্মা গাঁধীই হোন, তাঁদের মননশীল নেতৃত্ব আমাদের জাতীয় চরিত্রের উপর প্রভাব ফেলে।

বহুভাবেই ভারত আজ এক মহান রাষ্ট্র। যেসব রাষ্ট্রর কথা উল্লিখিত হল তাদের সঙ্গে সমপর্যায়ে উচ্চারিত হতে পারে তার নাম। সারা বিশ্ব তার প্রগাঢ় সমৃদ্ধশালী সভ্যতাকে শ্রদ্ধা করে। অনুপ্রাণিত করবার মতো বহু নেতা আজ বর্তমান। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন ও শিল্পে বহু মহান মানুষের জন্ম হয়েছে এই দেশে। কিন্তু একবিংশ শতকে ভারতকে সার্বিকভাবে এক মহান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এখনও কিছু পথ চলার বাকি আছে।

সেই শ্রেষ্ঠত্বের পথটি কিছু মৌলিকতার সাহায্যে শুরু হয়।

.

দুই : মূলের দিকে ফেরা

ভারতের বহু গ্রাম, নগর ও শহরের রাস্তায় আমি হেঁটে ঘুরেছি। প্রায় কুড়িটির মতো যে-সব দেশে আমি ভ্রমণ করেছি, সেখানেও আমি হেঁটেছি বেশ কিছু পথ। অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের একটি পার্থক্য হল, অন্য দেশের চাইতে আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি পদসঞ্চারণ করেন। আর একটি পার্থক্য হল, অন্য দেশের নাগরিক তাঁদের রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিজেরাই নেন। সেখানকার পুরদপ্তর অবশ্য নজর রাখেন যাতে আবর্জনা ফেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে, এবং যাতে সেগুলি নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করা হয়। ঘন বসতিপূর্ণ টোকিও বা হংকং-এর মতো শহরগুলিও পরিচ্ছন্নতায় অনেক এগিয়ে। কারণ, সেখানে আছে কঠোর আইন এবং আছে সকল বয়সের নাগরিকদের জন্য রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। কিন্তু ভারতে সে ব্যবস্থা নেই।

যেখানে পরিচ্ছন্নতা ও হাইজিন, টয়লেট ও স্যানিটেশন বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সেখানে আমরা কী করে আশা করতে পারি আমাদের দেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশগুলির অন্যতম হবে? এ এক বিরাটাকার সমস্যা। গ্রাম-গঞ্জে, নগরে এমনকি বড় বড় শহরগুলিতেও আমরা দেখি শৌচালয়ের অপর্যাপ্ততা। যেখানে শৌচালয় আছে, সেখানে সেগুলি অপরিষ্কার এবং সেগুলির কোনও দেখভালও হয় না। পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা একেবারেই সঠিক না হওয়ায় আশপাশ হয়ে থাকে দুর্গন্ধময় এবং পোকা-মাকড়ের জন্মস্থান।

আমরা প্রত্যেকেই এই সমস্যার বিশালত্ব এবং সাধারণ জনসাধারণের উপর তার প্রভাব বিষয়ে ওয়াকিবহাল। স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি, নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজ়েশন (এনজিও) এবং সাধারণ মানুষের সংযোগে এক উৎসর্গীকৃত কর্মোদ্যোগ গড়ে ওঠা। এর বিভিন্ন দিক আছে। যেমন, স্বাস্থ্য শিক্ষা, বিভিন্ন সংস্থাগুলির মধ্যে এক সংহত ক্রিয়াশীল সম্পর্ক স্থাপন যার ফলে গড়ে উঠবে সুযোগ সুবিধা, সাশ্রয়ী, এবং সর্বক্ষণের পর্যবেক্ষণ এবং উন্নতিসাধন।

কোনও রাষ্ট্রের উন্নতির মান বুঝতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হল সেখানকার স্যানিটারি ব্যবস্থা ও তার পরিকাঠামো। আমাদের পক্ষে কি সম্ভব শুধু এই বিষয়টির ভিত্তিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে ভারতকে তুলে ধরা? এই প্রশ্ন আমার মনে দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছে।

২০০৭ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল ওয়ার্ল্ড টয়লেট সামিট-এ বক্তৃতা দেবার। এই শিখর সম্মেলন প্রতি বছর সংঘটিত হয় ওয়ার্ল্ড টয়লেট অর্গানাইজ়েশনের তরফে। সেই বছর তা নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় ও বিদেশি প্রতিনিধিরা সেখানে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বের একচল্লিশটি দেশ অংশ নেয় সেই সম্মেলনে। সেখানে উঠে আসে নানান চিন্তাভাবনা। স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতির বিষয়ে নানা কৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা হয়, যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই ব্যবস্থার সুস্থ প্রয়োগ করে উন্নতি করা যায়। সেইখানেই আমি দীর্ঘ সময় ধরে এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ পাই। এইখানে সেই চিন্তাভাবনাগুলি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

কীরাপালায়াম অভিজ্ঞতা

২০০৪ সালের অগাস্টে আমি তামিলনাডুর কুডালুর জেলার কীরাপালায়াম পঞ্চায়েত পরিদর্শনের জন্য যাই। সেই পঞ্চায়েতের আধিকারিকরা আমায় জানান যে, সেখানকার ১১২৫টি বাসগৃহের প্রতিটিতেই শৌচালয়ের ব্যবস্থা আছে। একটি বিষয় আমাকে আগ্রহান্বিত করল। গ্রামের মহিলারা নিজেরাই ইট-চুন-সুরকির কাজ শিখে নিজ নিজ বাসগৃহে শৌচালয় নির্মাণ করেছেন। শুধু নিজেদের পঞ্চায়েত অঞ্চলেই এই নির্মাণ কাজ তাঁরা করেননি, পার্শ্ববর্তী গ্রামেও তাঁদের এই নির্মাণ দক্ষতার পরিচয় রেখে এসেছেন। এর ফলে কর্মসংস্থানের একটা পথ যেমন উন্মুক্ত হল, তেমনই গ্রামগুলিতে দেখা গেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রোগমুক্ত পরিবেশ।

ওই রাজ্যের রামানাথাপুরম জেলার থামারাইকুলম পঞ্চায়েতেও একই ফল পাওয়া গেল। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের বিভিন্ন গ্রামে, গঞ্জে, শহরে বিক্ষিপ্ত এমন কিছু উদাহরণ আমরা পাব। এমন একটি তথাকথিত ‘সরল’ সমাধান, যা সারা দেশেই প্রযোজ্য হতে পারে, তা কিন্তু আমাদের নজরের বাইরেই থেকে গিয়েছে এতকাল। ভারতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং ঘিঞ্জি বাসস্থানের কারণে আজ এই সমস্যা আকাশছোঁয়া চেহারা নিয়েছে। অতি দ্রুত আমাদের একটি সুসংহত ব্যবস্থার আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই সমস্যা মোকাবিলায়।

সমাধান

বাস্তবে কীরাপালায়াম আর থামারাইকুলম ভারতে সত্যই ব্যতিক্রমী উদাহরণ। সাধারণভাবে শৌচালয় আর স্যানিটেশনের ছবিটা আমাদের দেশে খুবই ভয়ানক। এবং তার জন্য অন্য কেউ না, আমরাই দায়ী। আমাদের আশপাশে তাকালে স্কুল, কলেজ, রেলস্টেশন এবং সাধারণ মানুষের যাতায়াতের স্থানগুলির টয়লেটের প্রাচীন চেহারা দেখে আমরা মনে করি, এর পরিবর্তন অসম্ভব। এই নিয়েই আমাদের থাকতে হবে হয়তো। এমনই বদ্ধ চিন্তাধারা আমাদের। কিন্তু, না, এমন ভাবে চলতে পারে না।

বিষয়টি নিয়ে সচেতনতার প্রচার চালানো এবং এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার সম্ভাব্য কর্মসূচির মধ্যেই রয়েছে এর সমাধান। এই কাজ আমাদের শুরু করতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আমাদের নিজেদের বাড়ি থেকে। আমাদের কর্তব্য ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যকর টয়লেটের প্রয়োজনীয়তা, তা বাড়িতে হোক, সাধারণ মানুষের যাতায়াতের স্থান হোক বা পরিবহণ সংশ্লিষ্ট স্থানেই হোক, সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। স্থানীয় নাগরিক গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে যারা এই বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করবে এবং কাজটিকে পর্যবেক্ষণে রেখে যথাসাধ্য সাহায্য করবে।

এই প্রসঙ্গে, আমি অন্ধ্রপ্রদেশের পেড্ডাপুরমের [Peddapuram] এম আর রাজুর কাজটির উল্লেখ করি। তিনি তাঁর গ্রামের নার্সারি ক্লাসের তিন বছরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এই ধরনের শিক্ষা দিচ্ছেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তিনি তাদের ভাল খাদ্যস্বভাব ও শৌচস্বভাবের অভ্যাস করাচ্ছেন। এমন শিক্ষা আমাদের প্রতিটি স্কুলে প্রয়োজন।

স্যানিটেশন ও পানীয় জলের এক সংহত মিশন

ভারতের নগর, শহর ও মেট্রো শহরগুলির সমস্যা হল শৌচকর্মের সুযোগ সুবিধার অভাব। গ্রামাঞ্চলে এই সুযোগ সুবিধার অভাবের সঙ্গে আছে শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের অভাব। বাস্তবিকই এ এক জাতীয় সমস্যা। কেউ যদি প্রকল্পগুলি এবং তাদের বরাদ্দের পরিমাণ দেখেন, কোনও সময়েই তা নিমিত্ত মনে হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন তা হলে তুলনামূলকভাবে কোনও উন্নতির চিহ্ন দেখা যায় না, যখন অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদাদি এতটা করেই ঢালা হচ্ছে প্রকল্পগুলিতে।

উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, ভারতের প্রতি জনের জন্য প্রতি বছর ৩৫০ টাকা বিনিয়োগ করা হয় জল সরবরাহের ক্ষেত্রে। এই পরিমাণ যদিও আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় কম, কিন্তু তা একবিংশ শতকের প্রথম দশকের তুলনায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সরবরাহ উপলব্ধও হচ্ছে অনেক বেশি মানুষের কাছে। গ্রামীণ স্যানিটেশন ব্যবস্থা যেখানে ১৯৮০ সালে ছিল প্রতি একশো জনে ১, সেখানে ২০০৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রতি শতকে ২১। উন্নত জল সরবরাহ ব্যবস্থা যেখানে ১৯৯০ সালে উপলব্ধ ছিল ৭২ প্রতি শতকে, তা ২০০৮-এ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৮৮ প্রতি শতক। আবার সঙ্গে সঙ্গে এও দেখা যায় যে, ভারতের মাত্র দু’টি শহরে আছে নিরবচ্ছিন্ন জল সরবরাহ ব্যবস্থা। আবার প্রতি একশো জন ভারতীয়র ভিতর প্রায় ৬৯ জনের কাছে এখনও উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা পৌঁছতে পারেনি।

সমস্যাটা হল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে জল সরবরাহ আর স্যানিটেশনের দায়িত্ব ভাগ করে নেয় বিভিন্ন মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় স্তরে আছে তিনটি মন্ত্রক: পানীয় জল ও স্যানিটেশন মন্ত্রক (গ্রামাঞ্চলের দায়িত্বে), বাসস্থান ও নগর দারিদ্র্য দূরীকরণ মন্ত্রক, এবং নগর উন্নয়ন মন্ত্রক (নগরাঞ্চলের দায়িত্বে)। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী জল সরবরাহ ও স্যানিটেশন রাজ্যের আওতায় পড়ে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলির শুধু পরামর্শ এবং সামান্য কিছু অর্থ বরাদ্দর ক্ষমতা আছে। ক্ষেত্রীয় যোজনা রাজ্যের অগ্রাধিকারে আসে। মূল বিষয়টি হল, বিভিন্ন সংস্থাগুলির মধ্যে একটি সুসংহত সহযোগ প্রয়োজন যাতে প্রকল্পগুলি যাদের উদ্দেশে রচিত তারা যেন তার পূর্ণ সুবিধা লাভ করতে পারে।

চলতি যে ব্যবস্থা রয়েছে, তার গুণাগুণ বিচারে একটি কার্যকরী মাপযন্ত্রের প্রয়োজন। ধরা যেতে পারে যে, যখন স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়, তখন জনসাধারণের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমার মতে, আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার উপলব্ধতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকবে তীব্র ডায়ারিয়ার কেসগুলির হ্রাস পাওয়া।

সামাজিক অংশগ্রহণ

সেই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করা উচিত যে, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা এবং তাকে সার্বিকভাবে কার্যকরী করার দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকারের উপর পড়ে না। পঞ্চায়েতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, এনজিও-গুলির এবং নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে এ ব্যাপারে। আমাদের সকলের উচিত এই বিষয়টিতে নজর দেওয়া, কারণ তবেই সকলের জন্য স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।

বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে মহাত্মা গাঁধী স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের উপর জোর দিতেন। স্যানিটেশন ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ছিল তাঁর অতি প্রিয় দু’টি বিষয়। পঞ্চায়েতের বিভিন্ন বিভাগের অংশগ্রহণ ছাড়া সার্বিক স্যানিটেশনের লক্ষ্যে পৌঁছনো অসম্ভব। যেহেতু তৃণমূল স্তরের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, তাই স্যানিটেশনের প্রচারে তারাই মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে।

মহিলাদের অংশগ্রহণও সমানভাবে অত্যন্ত জরুরি। স্বনির্ভর গোষ্ঠী, মহিলা সমক্ষ (মহিলাদের সম-অধিকারে শিক্ষা দান) এবং মহিলাদের গোষ্ঠীগুলিকে স্যানিটেশনের বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। দিতে হবে কিছু পারিতোষিক। আমি কীরাপালায়াম গ্রামে এ কাজ স্বচক্ষে দেখে এসেছি।

রেলের টয়লেট

আমাদের ট্রেনের টয়লেটগুলির যা দশা, তাদের বিষয়ে সত্বর দৃষ্টি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন। প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত যাতে মলমূত্র রেল লাইনে না পড়ে। যেহেতু আমাদের ট্রেনগুলির জন্য লক্ষ লক্ষ টয়লেটের প্রয়োজন, তাই টয়লেটগুলি যাতে সাশ্রয়ী হয় তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রেল দপ্তর এমন কামরা চালু করতে পারে বা চলতি কামরাগুলিকে পরিবর্তন করে নিতে পারে, যেখানে আধুনিক ইউরিনাল, টয়লেট, বেসিন এবং আবর্জনা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা থাকবে যাতে রেললাইন পরিচ্ছন্ন থাকে আর যাত্রীদের ট্রেন যাত্রা হয় আরামদায়ক ও সুখকর।

জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে রেল কর্তৃপক্ষ, গবেষক ও নির্মাণ সংস্থা বসে এই নতুন পরিকল্পনা আমাদের ট্রেনগুলিতে যাতে সত্বর চালু করা যায়, তা দেখা উচিত।

কেমনভাবে স্মরণীয় থাকা যায়?

আমি সাধারণভাবে মনে করি যে, বেশিরভাগ এনজিও-ই একটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। তারা সমাজকল্যাণে অংশ নিতে চায়। প্রত্যেক এনজিও-রই নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, ‘আমরা কোন কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকব?’ এই ক্ষেত্রে সুলভ ইন্টারন্যাশনাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে স্যানিটেশন, পাবলিক টয়লেট, পুনর্নবীকরণ ও বায়োগ্যাসের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রয়োগের কাজের জন্য। আমি সুলভ ইন্টারন্যাশনাল, অন্যান্য এনজিও এবং গ্রামোন্নয়ন সংস্থাগুলিকে অনুরোধ করব বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে এই কাজ করতে। এই ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কর্মোদ্যোগ এবং সেবার লক্ষ্যে স্থির থেকে এমন কাজের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। গ্রাম-রূপান্তরের কাজে তাই, তারা সাহায্য করতে পারে।

ধরা যাক, একটি গ্রামে কয়েক ঘণ্টার জন্য কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। এর ফলে কয়েকটি নালার সৃষ্টি হল। সেই নালা হয় ঝিলে বা পুকুরগুলিতে গিয়ে পড়বে, যেখানে সেই জল জমা থাকবে ভবিষ্যতের জন্য। নয়তো সেই নালার জল গিয়ে সমুদ্রে পড়বে, অথবা কোথাও না গিয়ে নিজে থেকেই শুকিয়ে যাবে। এ সবই নির্ভর করছে গ্রাম পঞ্চায়েত কেমনভাবে সেই জলের স্রোতের পথ নির্ধারণ করে দেয়, তার উপর। কোনও কোনও স্থানে রাস্তা নির্মিত হয় আশপাশের জমির থেকে উঁচুতে। ফলে, বৃষ্টির জলের যে অংশ রাস্তায় পড়ে, তা গড়িয়ে আশপাশের জমিতে চলে যায়। রাজস্থানের মাউন্ট আবুতে আমি এটা প্রত্যক্ষ করেছি।

আমার সুদীর্ঘ পাবলিক জীবনে আমি বহু এনজিও-র কাজের অগ্রগতি নিরীক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। বহু ক্ষেত্রে দেখেছি এক-পিট টয়লেটের মাধ্যমে স্যানিটেশন ব্যবস্থা করা হয়। যখনই ওই পিট পূর্ণ হয়ে যায়, সেটি আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। সুতরাং, আমাদের দেখতে হবে যে, এনজিও-গুলি বা সরকারি সংস্থা কাজের শেষে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেও যাতে কাজের মূল উদ্দেশ্যটি অব্যাহত থাকে। এটা করতে গেলে স্থানীয় মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজটি শিখিয়ে দিতে হবে, যাতে প্রকল্পটির সুফল গ্রামবাসীরা ভোগ করতে পারেন। এই প্রশিক্ষণের দায়িত্ব প্রাক্তন সেনানীদের দেওয়া যেতে পারে। কারণ, তাঁরা আসেন এক শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন থেকে এবং সারা দেশেই এঁদের দেখা মেলে।

জীবন এক অসাধারণ সুযোগ। মসৃণ পথে হাঁটায় কোনও চ্যালেঞ্জ নেই। নতুন নতুন পথ তৈরি করবে গ্রামের এনজিও-রা এবং সারা ভারত জুড়ে সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রামের সৃষ্টির জন্য চিরকাল তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বর্জ্য পরিচালনে ক্লোজড-লুপ ব্যবস্থা

গ্রামের স্যনিটেশন ব্যবস্থার বিষয় মনে এলে প্রথমেই যে কথাটি মাথায় আসে তা হল প্রত্যেক গৃহস্থালির জন্য পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থার সঙ্গে সঠিক সুযোগ সুবিধার আয়োজন। গ্রামের সার্বিক ধনসম্পদ বৃদ্ধির একটি উপায় এই সুযোগ সুবিধার জন্য পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা। যেমন, কোনও কোনও গ্রামে দেখা যায় সেখানকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর তৈরি ফাইবার গ্লাসের টয়লেট সরঞ্জাম সেখানে ব্যবহার হয়। তামিলনাডুর কীরাপালায়াম আর ভাল্লামে [Vallam] এবং গুজরাতের আহমেদাবাদে আমি গ্রামের মানুষের হাতে এই ধরনের টয়লেট সরঞ্জাম তৈরি হতে দেখেছি।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে, এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, গ্রামের সব টয়লেট সব সময়ে কাজ করছে কিনা। তার অর্থ, গ্রামের মানুষজনকে জল-কলের বা যাকে বলে প্লাম্বিং-এর কাজে প্রশিক্ষিত ব্যক্তির দ্বারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি রাখতে হবে। তৃতীয়ত, টয়লেটের জন্য সর্বক্ষণ জল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃতিতে জলসম্পদ হ্রাস পাওয়ার দরুন, টয়লেটে ব্যবহৃত জলকেই পুনর্বার ব্যবহারযোগ্য করে নিতে হবে। এবং প্রতি ঘরে ঘরে জল ধরে রাখার ব্যবস্থাও করতে হবে।

চতুর্থত, প্রত্যেক টয়লেটকে একটি কেন্দ্রীয় পয়ঃপ্রণালীর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এটি না করতে পারলে ঘরে ঘরে আদর্শ টয়লেট নির্মাণের প্রকল্প তার কাঙ্ক্ষিত ফল পাবে না। এইচ জি এস গিল নামে এক অনাবাসী ভারতীয়র তৈরি একটি মডেল আমার চোখে পড়ে পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুর জেলার কারোডি গ্রামে। তিনি যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন তাতে, প্রত্যেক টয়লেট একটি কেন্দ্রীয় পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে, বর্জ্যকে একটি ঢাকা নর্দমার মাধ্যমে নিয়ে গিয়ে ফেলে দূরস্থ একটি স্থানে। সেখানে সূর্যের আলোয় উন্মুক্ত একটি স্যুয়ারেজ ট্যাঙ্কে বর্জ্য থেকে জল পৃথকীকরণ করা হয়। এই জল শোধন করে চাষের কাজে ব্যবহার করা হয়। শ্রী গিল নজর রাখেন যাতে প্রতি ঘরের টয়লেট ঠিক মতো কাজ করে এবং কোনও প্রতিবন্ধকতা যাতে না থাকে। কেন্দ্রীয় পয়ঃপ্রণালীটিও যাতে আটকে না যায়, সেদিকেও নজর রাখেন এক দল প্রশিক্ষিত মানুষ। কেন্দ্রীয় ট্যাঙ্কটি কয়েক মাস অন্তর পরিষ্কার করা হয়। তার কঠিন বর্জ্য শোধন করে চাষে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হোশিয়ারপুরের অন্যান্য গ্রামেও তিনি তাঁর এই মডেল চালু করেছেন।

যে বিষয়টি আমি এখানে গুরুত্ব দিতে চাইছি তা হল, প্রতিটি গৃহস্থালিতে টয়লেটের ব্যবহার শুরু করানোটাই সব নয়। যা সব থেকে প্রয়োজনীয় তা হল, সঠিকভাবে বর্জ্য নিষ্কাশন এবং সেই বর্জ্যের সঠিক শোধন, যাতে পারিপার্শ্বিক থাকে নির্মল পরিচ্ছন্ন। একটি আদর্শ টয়লেট সাতটি চাহিদা পূরণ করে। আমাকে বলা হয়েছে দুই-পিটের টয়লেট এই সাতটি চাহিদা পূরণে আদর্শ। এই ব্যবস্থায় একটি পিট পরিপূর্ণ হয়ে গেলে, তা আর আগামী তিন বছর ব্যবহার করা হয় না। অন্য পিটটি তখন ব্যবহার করা হয়। এই তিন বছর প্রথম পিটের বর্জ্য জীবাণুমক্ত, পূতিগন্ধমুক্ত কঠিন সারে রূপান্তরিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে ওই সার ব্যবহার হয়।

এই বর্জ্য বাদে গ্রামে অন্য বর্জ্য আসে পশুপাখি, গাছপালা, রান্নাবান্না, কাপড়চোপড় কাচা, থালাবাটি ধোয়া এমন নানান দৈনন্দিন কাজ থেকে। এগুলি দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: বায়োডিগ্রেডেবল বা জৈবিকভাবে পচ্য আর নন-বায়োডিগ্রেডেবল বা জৈবিকভাবে অপচ্য। গৃহস্থালির কাজে সাধারণ জ্বালানির পরিবর্তে জৈবিকভাবে পচ্য আবর্জনা থেকে তৈরি গুল ব্যবহার করা যায়। কোনও গ্রামে মানুষ ও পশুর সংখ্যা যদি অত্যধিক হয়, তাহলে জৈবিকভাবে পচ্য আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।

স্যানিটেশন ও টয়লেট পরিকাঠামো মিশন

স্যানিটেশন প্রকল্পকে পুরোপুরি সফল করতে আমার তরফে এই পরামর্শগুলি রইল:

১। ভারতের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে টয়লেট ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিগত কারও ঘরে টয়লেট নির্মাণের থেকে জরুরি টয়লেট ব্যবস্থাকে সার্বিক পরিকাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা।

২। স্যানিটেশন ও টয়লেট ব্যবস্থার পরিকাঠামোর এই কর্মযজ্ঞে অনেকগুলি কাজ করতে হবে। প্রথমে একটি কেন্দ্রীয় ট্যাঙ্ক নির্মাণ করতে হবে। তারপর বর্জ্যকে সারে রূপান্তরিত করতে ও জলকে পুনর্ব্যবহারের জন্য একটি শোধন ব্যবস্থা করার সঙ্গে রাস্তা পর্যন্ত পাইপলাইনকে সম্প্রসারণ করে প্রতি ঘরের ও কমিউনিটি টয়লেট নির্মাণ করে মূল পাইপের সঙ্গে সংযোগ করে দিতে হবে। বর্জ্য জলের সব ক’টি নিকাশি পাইপ একটি আধারের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। সেই আধারে জলকে পুনর্নবীকরণ ও শোধন করার ব্যবস্থা থাকবে। এই মডেলটি নতুন যে পিইউআরএ বা ‘পুরা’ (প্রোভাইডিং আরবান ফেসিলিটিজ় টু রুরাল এরিয়াজ়) প্রকল্প, বা শহরের বস্তি এবং সাধারণের উপযোগ ব্যবস্থায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।

৩। যে টয়লেটগুলি নির্মিত হবে তা বিশ্বাসযোগ্য, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প জল ব্যবহারের উপযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ব্যক্তিগত টয়লেটগুলিতে পুনর্ব্যবহার্য জলের ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪। গ্রাম অঞ্চলে বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক টয়লেট ব্যবস্থায় ডেসিকেটিং ও কম্পোস্টিং মডেল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তার আগে বর্জ্যকে সম্পূর্ণ গন্ধমুক্ত করতে ও কম্পোস্টিং-এর ফলে উদ্‌গত সারকে যান্ত্রিক উপায়ে সরিয়ে ফেলার জন্য প্রয়োজন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে এগোনো।

৫। গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, স্বাস্থ্য, সমাজ কল্যাণ, কর্মসংস্থান, জলসম্পদের মতো মন্ত্রকগুলি নিজেদের মধ্যে একটি কার্যকরী সম্পর্ক তৈরি করে নিতে হবে।

৬। নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদেরকে তাঁদের গ্রামের জন্য টয়লেট নির্মাণের আদর্শ মডেলটি বিবেচনা করে, তার নির্মাণের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য নিজেদের প্রশিক্ষিত করে নিতে হবে। সঠিক প্রযুক্তি তাঁদেরই বেছে নিতে হবে। পরিচর্যার জন্য সকল রকম ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাঁদের গ্রামের টয়লেট ব্যবস্থা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে, ত্রুটিমুক্তভাবে ও নির্বিঘ্নে চলতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রতিটি টয়লেট— ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত— কেন্দ্রীয় পরিকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকে।

উপসংহার

২০২০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। সেই রূপান্তরের ভিত হচ্ছে স্যানিটেশন এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এই ব্যবস্থা সরাসরি প্রভাব ফেলবে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর। জন্ডিস এবং অন্যান্য জলবাহিত রোগ ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ হ্রাস পাবে। একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা রাখতে হবে যা খেয়াল করবে, স্যানিটশন প্রকল্পগুলির প্রয়োগের সঙ্গে স্বাস্থ্য পরিসেবার খরচ কমছে কিনা। সুতরাং এই স্যানিটেশন প্রকল্পকে একটি লাভজনক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করতে তাই প্রয়োজন স্যানিটেশন ও টয়লেট পরিকাঠামো নির্মাণের এই উদ্যোগ।

.

তিন : ভ্রমণ থেকে উপলব্ধ কিছু শিক্ষা

ছ’দশকের আমার পেশাদারি জীবনে আমি বহু সংগঠনে, বহু পদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, এবং আমাদের দেশের দৈর্ঘ্য প্রস্থ চষে বেড়িয়েছি। ২০০২ থেকে ২০০৭, আমি যখন রাষ্ট্রপতি পদে আসীন, আমি নিশ্চিত করেছিলাম যাতে আমি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে ভাব আদানপ্রদান করতে পারি। সেই সুযোগে তাঁদের কাছ থেকে কিছু শিখতেও পারি। ভারতবর্ষের হৃৎপিণ্ড রয়েছে তার এই গ্রামেই। ডাক্তার যেমন রুগির চিকিৎসা শুরু করেন তার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনে, তেমনই একশো কোটি মানুষের এই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগ করতে হবে দেশের ৬০০,০০০ গ্রামের কথা শুনে।

তুয়েনসাং, নাগাল্যান্ড, অক্টোবর ২০০৭

২০০৭ সালের অক্টোবরে হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তের শেষে অবস্থিত নাগাল্যান্ড ভ্রমণের কথা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। আয়তনে ক্ষুদ্র এই রাজ্য কিন্তু তার জীববৈচিত্র্য ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। তার জনসংখ্যা পঁচিশ লক্ষ যার বেশির ভাগই উপজাতি গোষ্ঠীর। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির রয়েছে বিবিধ উপভাষা এবং সংস্কৃতি। আমার অন্যতম ভ্রমণস্থান ছিল তুয়েনসাং। তুয়েনসাং সেখানকার সব থেকে বড় জেলা। ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় এর অবস্থানগত গুরুত্বও আছে। ওখানে থাকাকালীন ওই এলাকার উপজাতীয় পরিষদের একটি অধিবেশনে উপস্থিত হয়েছিলাম।

নাগাল্যান্ডের উপজাতি নেতারা সেখানকার রাজনৈতিক প্রতিনিধিই শুধু নন, তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতির রক্ষাকর্তাও বটে। তাঁরা প্রত্যেকেই হাজির হলেন তাঁদের রংবেরং-এর উজ্জ্বল ঐতিহ্যশালী পোশাকে। প্রত্যেকের হাতে এক গুচ্ছ কাগজ, তাতে হাতে লেখা তাঁদের আলোচ্য বিষয়গুলি। আমাকে জানানো হল যে, সাধারণত তাঁরা একটি বড় গাছের ছায়ায় বসে মিটিংটা করে থাকেন। কিন্তু যেহেতু ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁদের আজ অতিথি, তাই তাঁরা একটি বন্ধ ঘরে বসে মিটিংটা করতে রাজি হয়েছেন। তাঁরা আমাকে এবং পরে পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়ে অত্যন্ত পেশাদারি চলনে যে যাঁর জায়গায় গোল হয়ে বসে পড়লেন। অত্যন্ত গাম্ভীর্যময় পরিবেশে আলোচনা শুরু হল। সেদিনের আলোচ্যসূচিতে ছিল এই পরিষদের উদ্যোগে কেমনভাবে ফল ও সবজির চাষে উন্নতি এসেছে।

একজন বললেন, ‘এই প্রথম, চাহিদার থেকে অনেকগুণ বেশি ফলন হয়েছে।’

সকলে বাহবা জানালেন। আমারও ভাল লাগল ওখানকার গ্রামগুলির এই উজ্জ্বল সাফল্যে।

কিন্তু এক যুবক নেতা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শ্রদ্ধেয় সদস্যগণ, এটা সত্যিই আনন্দের যে, উৎপাদন ও মান দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে একটি অর্থনৈতিকভাবে কার্যকরী মডেল তৈরি করতে পারি।’

কোনায় বসা এক মহিলা সদস্য তাঁর একটি ভাবনার কথা তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের এখন রপ্তানির বাজার খুঁজতে হবে।’ তিনি জানালেন, ‘আমার একটি গোষ্ঠী আছে যারা আশপাশের গ্রামের ও শহরের চাহিদা কেমন, তার একটা সমীক্ষা করতে পারবে। এইভাবেই আমাদের নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।’ উপস্থিত সকলেই তাঁকে সমর্থন করলেন।

এরপর এক বয়োজ্যেষ্ঠ উপজাতীয় নেতা তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। অন্যরা তা মন দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনতে লাগলেন। তিনি বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি মহোদয় এবং আমার পরিষদীয় সদস্যবৃন্দ, আমাদের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হল, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বা শহরে যাবার ভাল রাস্তার বড় অভাব। পণ্য বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও যানের ব্যবস্থাও আমাদের নেই।’

এই সমস্যাটা নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক এক অতি আকর্ষক আলোচনা হল। নানান মতামতের আদানপ্রদানের পর স্থির হল যে, একটি সমবায় সমিতি গঠিত হবে। এই সমিতি অতিরিক্ত যে ফলন তা সদস্যদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে একটি শক্তপোক্ত পরিবহণ ব্যবস্থা তৈরি করে বিভিন্ন দুর্গম স্থানের দূরাবস্থিত বাজারে এমনকি নাগাল্যান্ডের সীমানার বাইরেও বিক্রির জন্য নিয়ে যাবে। এরপর, তাঁরা পর্যটন শিল্পে কীভাবে উন্নতি আনা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা করলেন। এই আলোচনার ভিত্তিতে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর জন্য একটি স্মারকলিপি প্রস্তুত করলেন। মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হল, পর্যটকদের বিভিন্ন দর্শনযোগ্য স্থানে যাবার সুবিধার্থে কয়েকটি হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হোক। অতিরিক্ত কৃষিপণ্য পরিবহণেও সাহায্য প্রার্থনা করা হয়।

নিকোবর দ্বীপ, জানুয়ারি ২০০৫

অগম্যতা বহু ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের উপজাতি অঞ্চলে এ ঘটনা আমি দেখেছি। সেই ভয়ঙ্কর সুনামির পরের মাসে, ২০০৫-এর জানুয়ারিতে আমি নিকোবর দ্বীপে কিছু উপজাতি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করি। আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করি, কেন তাঁরা সমুদ্রসম্পদকে তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কাজে লাগাচ্ছেন না।

আমি তাঁদের বলি, ‘এত সমুদ্রসম্পদ আপনাদের কাছে রয়েছে। প্রতিবেশী দেশের মত্স্যজীবীরা আমাদের সাগরের সম্পদ বেআইনিভাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আপনারা কেন এই জাতীয়সম্পদ নিজেরা ব্যবহার করছেন না?’

উপজাতি নেতারা কিছুটা ভেবে আমার কথার উত্তর দিলেন। তাঁদের সমবেত বক্তব্য ছিল যে, তাঁরা চিরাচরিত প্রথায় মাছ শিকার করতে জানেন। কিন্তু অতিরিক্ত মাছ কীভাবে তাঁদের নিজ নিজ গ্রামের বাইরের বাজারে নিয়ে গিয়ে বেচতে হবে, তার ধারণা নেই। মত্স্য প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তি বিষয়েও তাঁরা জানতে ইচ্ছুক। এই অজ্ঞানতাই তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

নিকোবর যাবার আগে নয়া দিল্লিতে আমাকে জানানো হয়েছিল যে, সুনামি বহু পিতামাতাকে কেড়ে নিয়ে তাঁদের সন্তানদের অনাথ করে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম সেই দ্বীপে কোনও অনাথ আশ্রমই নেই। আমি নেতাদের বললাম, ‘আন্দামানে গিয়ে আমি তিনটি অনাথ আশ্রম দেখেছি। নিকোবরে কোথায়?’

আমাকে বিস্মিত করে তাঁরা আমাকে জানালেন, ‘এখানে কোনও অনাথ আশ্রম নেই।’ এ যেন সুনামির পর কালো মেঘের কোলে রৌপ্যঝলক। এক বরিষ্ঠ অথচ কর্মঠ নেতা অনেক ভেবে আমায় বললেন, ‘যে সব ছেলেমেয়েদের পিতামাতা নেই তারা আমাদের ঘরের ছেলেমেয়ে হয়ে রয়েছে। আমাদের এখানে তাই অনাথ আশ্রমের প্রয়োজন নেই। আমাদের ঘরই তাদের ঘর। আসলে এই দ্বীপে আমরা একটি বৃহৎ পরিবার।’

কী অপরূপ রীতি। ভালবাসা, স্নেহ, অনুকম্পার এই যে সঞ্চারণ, তা সারা রাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্বে সংরক্ষিত ও লালিত হওয়ার প্রয়োজন। আমরা যখন উন্নতির কথা বলি, আমাদের চিন্তায় এই বিষয়টি রাখতে হবে অবশ্যই।

ওয়্যানাড, কেরালা, ফেব্রুয়ারি ২০১১

চলুন আপনাদের পশ্চিমে ১২০০ কিমি. দূরে কেরালায় নিয়ে যাই। ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে আমাকে একটি অনন্য শিক্ষা প্রকল্পের উদ্‌ঘাটনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ওয়্যানাড জেলা শিক্ষা দপ্তর। ওই দিনই জহর নবোদয় বিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্কুল পড়ুয়াদের সঙ্গে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। আমার কিছু সহকর্মীর সঙ্গে সকাল ৯.৩০ মিনিটে আমার ব্যাঙ্গালোরের পথে দিল্লি থেকে রওনা হওয়ার কথা ছিল। ব্যাঙ্গালোর থেকে কালিকাটের প্লেন ধরে ৩.৩০-এ সেখানে পৌঁছে গাড়িতে ওয়্যানাডের ৫টার অনুষ্ঠানে পৌঁছনোর কথা। যাত্রার প্রতিটি বিষয় নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত হয়েছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার কারণে যে-কোনও নিখুঁত পরিকল্পনাই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

দিল্লি বিমানবন্দরে আমরা ঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আমাদের জানানো হল যে, কিছু অনিবার্য কারণে ব্যাঙ্গালোরের প্লেন ছাড়তে দেরি হবে। প্রথমে, আমাদের মনে হয়েছিল যে, হয়তো কিছু মিনিটের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক কাটার পর, আরও এক ঘণ্টা, তারপর আরও-ও এক ঘণ্টা কেটে গেল। প্রতীক্ষালয়ে বসে আমরা আমাদের বক্তৃতাগুলি ঝালিয়ে নিলাম, বই পড়লাম। শেষে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছতে ৫.৩০টা বেজে গেল। আমাদের কালিকাটগামী সংযোগকারী প্লেন বহুক্ষণ আগেই স্বাভাবিকভাবে ছেড়ে চলে গিয়েছে । ওয়্যানাডের ছেলেমেয়েদের এবং অন্যান্যদের কথা চিন্তা করে আমি সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা জানালাম।

তাঁরা আমায় বললেন, ‘স্যার, আমরা কেউই এখান থেকে একটুও নড়ছি না। আপনার অপেক্ষায় প্রয়োজনে আমরা এখানে সারা রাত থাকব। আমরা জানি আপনি কখনওই আমাদের অসন্তুষ্ট করবেন না।’

আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম, এবং ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক ওয়্যানাড আমরা পৌঁছবই। বিভিন্ন উপায় আলোচনা করে ঠিক হল, গাড়ি নিয়ে কয়েকশো কিলোমিটার কেরালার ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গেলে ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাব। আমার ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছ’টা। যত তাড়াতাড়িই যাই মধ্যরাতের আগে আমরা ওয়্যানাড পৌঁছতে পারব না। আমি সেইভাবেই যাওয়া মনস্থ করলাম এবং সংগঠকদের তা জানিয়ে দিলাম।

শুরু হল আমার জীবনের দীর্ঘতম একনাগাড় পথযাত্রা। ১০০ কিমি.-র আগেই, ওই রাস্তাটি বাদে, মানবসভ্যতার সব চিহ্নই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল— শুধু পড়ে রইল সবুজ বনানী তার একান্ত নিজস্ব দৃশ্যাবলি ও শব্দগুচ্ছ নিয়ে। ওই চন্দ্রাভিষিক্ত রাত্রিতে আমাদের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখছিলাম গাছের লম্বা লম্বা ছায়াগুলি। মাঝে মাঝে আমাদের গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল হাতির পালের আওয়াজ। বনাঞ্চলের এই বিশাল সম্পদ যেন আমাদের সামগ্রিক জাতীয়সম্পদের এক সাক্ষ্য বহন করছে।

কোথাও না থেমে দীর্ঘ সাড়ে ছ’ঘণ্টার পথ অতিক্রম করার পর আমাদের স্বাগত জানাল একটি সাইনবোর্ড যাতে লেখা, ‘ওয়্যানাডে স্বাগত’। শহরে ঢোকা মাত্রই মোবাইল ফোনের যোগাযোগ আবারও পাওয়া গেল, আর রাতের আকাশের তারার প্রেক্ষিতে মানুষের তৈরি আলো ঝিলমিল করতে লাগল। আমরা সরাসরি চন্দ্রাগিরি প্রেক্ষাগৃহে চলে গেলাম প্রথমেই। সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে প্রথম অনুষ্ঠানটির।

বিপুল উল্লাস ধ্বনিতে আমাদের আপ্যায়ন জানাল প্রায় ২০০০ মানুষ, যা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। তাঁদের আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে দিল। এই গভীর রাত পর্যন্ত এতটা সময় তাঁরা কী কষ্টেই না কাটিয়েছেন। এ এক অনন্য দেশ— এই ভারতবর্ষ। তার মানুষেরাও অন্য দেশের তুলনায়, অতুলনীয়। যখন কোনও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তাঁর সামনে, দেশের যে-কোনও অংশে যে-কোনও ভারতীয় অকল্পনীয় কিছু করে দেখাতে পারেন। ওয়্যানাডের এই ঘটনা তারই একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন মাত্র।

ওই অনুষ্ঠানে জেলায় শিক্ষা প্রসারের জন্য অরিভিদম প্রকল্পের উদ্বোধন করলাম। অরিভিদম-এর অর্থ জ্ঞান ও তথ্যের এক স্থান। জ্ঞান একজন ব্যক্তিকে মহান করে তোলে। সুতরাং, কেরালার জন্য উৎকৃষ্ট নাগরিকের বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প। আঞ্চলিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থায় ডিজিটাল জ্ঞানের যে অভাব রয়েছে তার অভাব মেটাতে ছাত্র, শিক্ষক এবং সাধারণের মধ্যে শিক্ষা, জ্ঞান ও তথ্যের প্রসার ঘটানো এই প্রকল্পর লক্ষ্য। প্রিন্সিপ্যাল, হেডমাস্টার ও আধিকারিকদের মধ্যে ভিডিও-সম্মেলনের ব্যবস্থা, প্রতি স্কুলে ওয়েবসাইট নির্মাণ, এবং সাধারণ মানুষের জন্য একটি নেটওয়ার্ক সৃষ্টি, এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত।

সাধারণের কাছে জ্ঞানের ভাণ্ডার পৌঁছিয়ে দিতে এক অপূর্ব হাতিয়ার হল তথ্যপ্রযুক্তি আর কম্পিউটারের সঙ্গে উদ্ভাবনী পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগের যুক্তকরণ। ফেসবুকের মতো অ্যাপ্লিকেশন আজ কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে । সেই প্রযুক্তি আর সেই দর্শন নিয়েই আমরা কেন গ্রামের মানুষের কাছে এনে দিতে পারব না জ্ঞান আর তথ্যের ভাণ্ডার?

এই অনুষ্ঠান শেষে পূর্ণ উদ্যম নিয়ে পৌঁছে গেলাম জহর নবোদয় বিদ্যালয়ে ভোর ২.৩০ মিনিটে। সেখানে তখন জড়ো হয়েছে ওয়্যানাডের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। একটি অনুষ্ঠান বা মিটিং-এর জন্য সময়টি ছিল অ-সাধারণ। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল যে, তারা প্রত্যেকেই ছিল মনোযোগী। অনুষ্ঠান শেষে এক পড়ুয়া জানতে চাইল, ‘স্যার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কী করে অশিক্ষাকে দূর করতে পারে?’ আমি তাকে একটি দারুণ উদাহরণ দিলাম, যার পরিচয় আমি কিছু ঘণ্টা আগেই পেয়েছি: অরিভিদম।

ঊরি, ঊর্সা আর তাংধার, জম্মু ও কাশ্মীর, অক্টোবর ২০০৫

কেরালা থেকে যাওয়া যাক কাশ্মীরে। ২০০৫ সালের অক্টোবরে কাশ্মীর উপত্যকায় এক ভয়ানক ভূমিকম্প জীবন ও সম্পত্তির প্রভূত ক্ষতি করে। বিশালাকার সেই উদ্ধার আর পুনর্বাসনের কাজ কেমন চলছে তা দেখার জন্য আমি পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ঊরি, ঊর্সা আর তাংধারে গিয়েছিলাম।

সেখানকার স্থানীয় মানুষ যার সংখ্যাগরিষ্ঠই কৃষক, সরকারের প্রতিনিধি, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটি মিটিং-এ যোগ দিয়েছিলাম। মিটিং-এ আমি তার আগের দিন ওই তিনটি জায়গা পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে বললাম যে, আমার বিশেষ করে নজরে পড়েছে যে, সেখানে জীবনধারণের কোনও আয়োজন নেই। আমি স্থানীয়দের প্রশ্ন করলাম যে, কেন তাঁরা তাঁদের জমিতে ফল, বিশেষ করে কাশ্মীরের জগৎ-বিখ্যাত আপেল, ফলান না।

তাঁরা জানালেন, ‘স্যার, আমাদের কোনও জমি নেই। আমাদের সব জমি সেনাবাহিনীর হাতে।’

তাঁদের এই উত্তর আমাকে অবাক করে দিল। কিন্তু আমার সঙ্গে যেসব আধিকারিকরা ছিলেন তাঁরা একটু হতচকিত হয়ে পড়লেন। আমি রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী এবং সেনার বরিষ্ঠ অফিসারদের দিকে তাকালাম। একটা যেন অস্বস্তিকর নীরবতা চেপে বসেছে। আমি জানতাম আমাকেই এর উত্তর দিতে হবে। আমি বললাম, স্থানীয়দের এই অসুবিধা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। তাই কিছু জমি চিহ্নিত করে তা ফসল ফলানোর জন্য রাখতেই হবে— এবং তাতেই ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব। বাজারের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগ ব্যবস্থার বিষয়ের উপরও জোর দিলাম। ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেন তার সীমান্তবর্তী এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। বস্তুত, সকল সামাজিক অশান্তিকে প্রশমিত করার সব থেকে উত্তম পথ হল উন্নয়ন।

কিবিথু, অরুণাচল প্রদেশ, মার্চ ২০০৭

২০০৭ সালে, আমার রাষ্টপতি পদে থাকার শেষ বছর, সামরিক বাহিনীর প্রধান, জেনারাল জোগিন্দর যশবন্ত সিংহ অরুণাচল প্রদেশে ভারতের সঙ্গে চিনের সীমান্ত একবার ঘুরে আসার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। এই জেনারালটি, যাঁকে সকলে জেজে নামেই ডাকেন, হলেন একজন বহুদিনের সেনানী যাঁর ছিল অত্যন্ত দৃঢ় অথচ সকলকে অভিভূত করে রাখার মতো এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। আর ছিল তাঁর চিরহরিৎ হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। সুতরাং, তিনি যখন জোর দিয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন সীমান্তের সেনা জওয়ানদের সামনে বক্তব্য রাখতে, আমি তত্ক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম।

কিবিথু নামের একটি স্থানে আমরা পৌঁছলাম। এখানে মিলেছে চৈনিক আর ভারতীয় অঞ্চল। আমরা ছিলাম একটি উপত্যকায় যাকে ঘিরে পর্বতমালা আকাশকে ছুঁয়েছে। ওপারে দেখা যাচ্ছিল চিনা শিবির, আমাদের থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত। সেখানকার কিছু অনুসন্ধিত্সু সৈনিক জড়ো হয়ে দেখছিল আমাদের এখানে আসা নিয়ে এখানকার ব্যস্তসমস্ত কার্যকলাপ। আমি বিশাল হিমালয়ের প্রেক্ষাপটে তাকিয়ে দেখছিলাম আমাদের তরুণ সেনানীদের আর ওই অঞ্চলের কিছু স্থানীয় মানুষদের যাঁরা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। আমাদের সৈনিকদের ওই কঠিন পরিস্থিতির সাহসী মোকাবিলা, আমাকে মুগ্ধ করে দিল। আমরা যতই তাঁদের জন্য সবরকম ব্যবস্থা করি না কেন, হিমালয়ের যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন বাস্তব হল সেখানকার সব থেকে বড় প্রতিপক্ষ, পার্শ্ববর্তী দেশের সেনাদের থেকেও, সেখানকার কঠিন আবহাওয়া।

এরপর আমি স্থানীয়দের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। তাঁদের বেশিরভাগই উপজাতি সম্প্রদায়ের। তাঁদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর উল্লসিত চেহারা। কিন্তু তাঁদের দারিদ্র্য ও কঠিন জীবনকে তা ঢেকে দিতে পারল না। তাঁদের জীর্ণ শরীর, অতিরিক্ত কর্মে ক্লান্ত হাত দু’খানি বা দীর্ণ পোশাক জানিয়ে দিচ্ছিল তাঁদের অবস্থা। এই সব সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কোনও অতিরিক্ত সাহায্য ছাড়াই যে-পরিমাণ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেন তার তুলনা নেই। সেনার কাজে সাহায্যর জন্যও তাঁদের বহু অতিরিক্ত কাজ যেমন করতে হয়, তেমনই তাদের কিছু লজিস্টিক কাজেও সাহায্য করতে হয়। তাঁদের পাশ দিয়ে আমি যখন হেঁটে যাচ্ছি, আমার কানে এল এমন উপজাতীয় এলাকার অতি পরিচিত অভিবাদন: ‘জয় হিন্দ’।

এরপর আমি সংযুক্ত স্থলসেনা কমান্ডের উদ্দেশে বক্তৃতা দিলাম। আমি লক্ষ করলাম, ওই কঠিন পরিবেশ সত্ত্বেও, সাধারণ জওয়ান ও অফিসারদের তাঁদের কর্তব্যকর্মের প্রতি এক অদ্ভুত উদ্যম। লক্ষ করলাম যে-কোনও চ্যালেঞ্জ, তা আবহাওয়া হোক বা ওপারের হুমকিই হোক, তার জন্য তাঁরা চিরপ্রস্তুত। বক্তৃতার শেষে কয়েকজন তরুণ অফিসারের সঙ্গে আমার আলাপ হল।

আমি তাঁদের বললাম, ‘আপনারা রাষ্ট্রের ও তার মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দিনরাত কাজ করে চলেছেন— আপনাদের জন্য আমি গর্বিত। আপনাদের প্রত্যেকের বহু যত্নে পোষণ করা সব থেকে ঈপ্সিত স্বপ্নের কথা এবার আমাকে বলুন।’

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর, কয়েকটি হাত উঠে এল।

এক তরুণ অফিসার উঠে আমাকে একটা দুর্দান্ত স্যালুট ঠুকে বেশ উচ্চস্বরে বললেন, ‘স্যার, আমি যখনই চিনাদের হিমালয়ে আমাদের থেকে উঁচুতে দেখি, তখনই আমার মনে আসে আমার তাওয়াং যাওয়ার কথা। আমার সব থেকে বড় উচ্চাশা হল, আমি যেন চিনাদের যে-কোনও আগ্রাসন পরাস্ত করে দিতে পারি।’

আর একজন যোগ দিলেন, ‘স্যার, যে ৫০,০০০ বর্গ কিমি. আমাদের দেশের অংশ চিনাদের কবলে রয়েছে, তা উদ্ধার করে আনা হল আমার জীবনের অভিপ্রায়। আমি আমার শেষ নিশ্বাস দিয়ে তার জন্য লড়ে যাব।’

স্থানীয়রা করতালি দিয়ে স্বাগত জানিয়ে ক্রমাগত আওড়াতে লাগলেন, ‘জয় হিন্দ! জয় হিন্দ!’ আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম জওয়ান, অফিসার এবং স্থানীয়দের এই সুদৃঢ় মনোবল আর অটল সংকল্পের মানসিকতা দেখে। আমাদের এই সব অঞ্চলকে যেমন লালন করতে হবে, তেমনই এই স্পিরিটটা বা মানসিকতাটাকেও জিইয়ে রাখতে হবে।

ভাদারিয়া, রাজস্থান, মে ১৯৯৮

দেশের একেবারে পূর্ব থেকে ৩০০০ কিমি. ভারতের বুকের উপর দিয়ে পেরিয়ে, যাওয়া যাক পশ্চিমে। সেটা ছিল ১৫ মে, ১৯৯৮, ভারত, তার প্রতিরক্ষার মানকে সুউচ্চ স্তরে তুলে, সবে সাফল্যের সঙ্গে তার পাঁচটি আণবিক পরীক্ষা করেছে, ১১ মে ও ১৩ মে। সারা রাষ্ট্র উত্ফুল্ল। আমি এবং আমার বিজ্ঞানীদের দল যেখানে পরীক্ষাগুলি সংঘটিত হয়েছিল, সেই পোখরান থেকে ফিরছি। থর মরুভূমির অভ্যন্তরে অবস্থিত পোখরানে জীবনের প্রায় কোনও চিহ্নই নেই। মে মাসের ওই সময়টায় প্রচণ্ড গরম, তাপমাত্রা ৫০˚ সে. ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং মরুভূমির বালি যেন ফুটছে।

এঁকেবেঁকে মরুপথে ফেরার সময়ে আমরা পেলাম একটি ছোট গ্রাম— ভাদারিয়া। রাস্তায় জায়গাটির বোর্ড দেখে আমার এক সহকর্মী উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন যে, ওই জায়গার নাম তিনি আগে শুনেছেন। ওখানে নাকি একটি বিখ্যাত আশ্রম আছে। তাঁর অনুরোধে আমরা স্থির করলাম সামান্য ঘুরপথ হলেও আমরা ওই স্থানটিতে যাব।

ভাদারিয়া আসলে একটি ছোট হ্যামলেট বা যাকে পল্লি বলা যায়। আশ্রমটি খুঁজে পেতে তাই বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সেখানে আমরা যা দেখলাম তা বিশ্বাস করা কঠিন। একটি বিশাল জায়গা নিয়ে সবুজ বনানীতে ঢাকা মরুর মধ্যে এই স্থানটি। আশ্রমের প্রধান, বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ, আমাদের অভ্যর্থনা করে জানতে চাইলেন, আমরা তাঁর তৈরি গ্রন্থাগারটি দেখতে ইচ্ছুক কিনা। তিনি সিঁড়ি দিয়ে আমাদের একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে নিয়ে গেলেন। সেই কক্ষ দিয়েই ঢুকতে হয় গ্রন্থাগারটিতে।

ঘরটি অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ আমাদের জানালেন, ঘরটির পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যে, বাইরে যতই তাপ বৃদ্ধি পাক, গ্রন্থাগারের ভিতরটা থাকবে ঠান্ডা। বিভিন্ন বিষয়ের, বিভিন্ন ভাষার, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের উপর বই দেওয়াল জোড়া। কিছু ছিল বল্কলের উপর হাতে লেখা। বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ আমাদের কয়েকশো বছরের পুরনো বই দেখালেন। তিনি জানালেন যে, প্রাচীন ঐতিহ্যশালী জ্ঞানভাণ্ডারকে তাঁর আশ্রম বহু যুগ ধরে সংরক্ষণ করে আসছে।

তাঁর গ্রন্থাগারে বসে আমরা যখন তাঁর বইগুলিতে মশগুল, তিনি আমাদের সকলকে বড় বড় গেলাস ভর্তি দুধ এনে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাবা, এই মরুভূমিতে এমন চমকার টাটকা দুধ আপনি কোথায় পেলেন?’

তিনি হেসে আমাকে তাঁর সঙ্গে আসতে বললেন। আশ্রমের পিছনে একটি বিশাল গোশালায় তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে রয়েছে শয়ে শয়ে গোরু। তিনি বললেন, ‘কালাম, এই গোরুগুলি সব পরিত্যক্ত। দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় এদের মানুষ পরিত্যাগ করেছে। তাদের কাছে এই গোরুর কোনও মূল্য নেই। কিন্তু আপনার মতোই আমিও এক প্রযুক্তিবিদ।’ এই বলে তিনি হাসলেন। ‘আমি একটি বিশেষ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এই পরিত্যক্ত গোরুদের আবার সুস্থ সবল করে তুলেছি। তারা আবারও দুধ দিচ্ছে— যা আপনার হাতের গেলাসে আপনি ধরে আছেন।’

আমি মুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছিলাম, এমন এক মহিমান্বিত কর্মযজ্ঞ— এক মিশন। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কিন্তু বাবা, আপনি এদের খাদ্য কোথা থেকে জোগাড় করেন?’

তিনি আমাকে গাছের ছায়ায় একটি খাটিয়াতে বসতে বলে ভাদারিয়ার রূপান্তরের কাহিনি শোনালেন। তিনি বললেন, ‘বহু বছর আগে এই অঞ্চলের মানুষরা ছিলেন ভীষণ গরিব। তাঁরা নানা রকম নেশা করতেন সিগারেট, মদ থেকে, স্থানীয় আগাছা থেকে উৎপন্ন মাদক। জায়গাটা ছিল একেবারেই অনুর্বর, নিষ্ফলা। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব, অপুষ্টি ইত্যাদির মতো নানান সামাজিক সমস্যা ছিল। জলের জোগান ছিল অপ্রতুল, আর যতটুকু পাওয়া যেত তাও বিনা তত্ত্বাবধানে নষ্ট হত। এখন দেখুন আমরা গ্রামবাসীদের সহযোগিতা এবং সমর্থনে কী করে ফেলেছি। নেশা-মুক্তির শিবির খোলা হল এই আশ্রমের ভিতরেই। আজ ভাদারিয়ার আশপাশে প্রায় সত্তরটি গ্রামে তা চলছে। লক্ষ লক্ষ গাছ রোপণ করে স্থানীয়দের সহযোগিতায় আমরা ভাদারিয়া ও তার আশপাশ অঞ্চলে সবুজায়ন অভিযান করেছি। টিউবওয়েল বসানোর কাজের ফলে এই এলাকায় কৃষিকাজ শুরু হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে জল সংরক্ষণের কাজও শুরু হয়।

‘আশ্রম থেকে প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও বনৌষধি সম্পর্কে জ্ঞাতব্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচার করা হয়। গবাদি পশুর চিকিৎসাও হয়।’ বাবা এরপর বললেন, ‘কালাম জানেন, গ্রামবাসীরা এতটাই তৃপ্ত এই ব্যবস্থায় যে, এই গোশালার গোরুদের খাদ্য তাঁরাই জোগাড় করে আনেন। যখন গোরু দুধ দেওয়া শুরু করে আমি গ্রামের যাঁরা দুঃস্থ তাঁদের বিনাপয়সায় দুধ, মাখন দিই— আর দিই এই গ্রামে আসা অতিথিদের… যেমন আপনি, কালাম!’ বলে হেসে উঠলেন আর আমার গেলাসে ঢেলে দিলেন আরও দুধ।

‘পরিশেষে একটি প্রশ্ন আপনাকে করি, বাবা’, আমি বললাম। ‘এই বনৌষধির বিষয়ে বা গোরুদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজকর্মের বিষয়ে আপনি কোথা থেকে জানলেন?’

বাবার চোখ দু’টি মরুর আলোকোজ্জ্বল তেজের মতো জ্বলে উঠল। ভূগর্ভস্থ গ্রন্থাগারটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওইখান থেকে।’

ভাদারিয়া থর মরুভূমির মাঝে একটি ছোট্ট গ্রাম। কিন্তু সে সারা বিশ্বকে এক অমূল্য পাঠ শিখিয়েছে। সুসংহত উন্নয়নের এক আদর্শ নিদর্শন এই গ্রাম— যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্ঞানের প্রসার, স্বাস্থ্য পরিষেবা, গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণ, পশুখাদ্যের সুষম পরিচর্যা— এই সবকিছুই ঘটেছে মরু অঞ্চলে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরম্পরাগত জ্ঞানের এক অদ্ভুত মিলনে, এই অঞ্চলের জমি, সম্পদ, এমনকী মানুষের জীবনে এসেছে এক অত্যাশ্চর্য রূপান্তর। শ্রেষ্ঠত্বের পথে উত্তরণে এইটিই মৌলিক দিক, যা আমরা এই গ্রন্থে আলোচনা করছি। তা কেবল একটি রাষ্ট্রের নয় বা এক রাষ্ট্রগোষ্ঠীর বিষয় নয়, তা সমগ্র বিশ্বের মানব গোষ্ঠীর জন্য মূল্যবান।

.

চার : হাতে হাত

ভাদারিয়ার ক্ষেত্রে যা সত্য, তা যে-কোনও সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সত্য। সার্বিক বৃদ্ধি ও অগ্রগতির জন্য জীবনের বিবিধ দিকের একযোগে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন। যত ধরনের ব্যবস্থা কায়েম আছে তাদের সকলেরই অভিমুখ কিন্তু এক হওয়া চাই। এবং তাকে হতে হবে স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ। তবেই পাওয়া যাবে উন্নয়নের প্রতি স্থির লক্ষ্যে এক সুসংহত প্রয়াস। বিবিধ জটিল সমস্যা আমাদের রাষ্ট্রকে জর্জরিত করে রেখেছে। কিন্তু জাতীয় উন্নয়ন যেহেতু লক্ষ্যের মূলে তাই এই সমস্যাগুলি এক ধরনের নিরপেক্ষতায় যথাযথ সময়ের ভিতরে সমাধান হয়ে যায়। কীভাবে প্রতিটি ব্যবস্থার নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যের দিকে নিষ্ঠাভরে কাজ করা বাঞ্ছনীয়, তা আমি বুঝিয়ে বলছি।

১। রাজনৈতিক নেতা

রাষ্টের সামনে একটি লক্ষ্য স্থির করে উন্নয়নমূলক রাজনীতির মাধ্যমে নাগরিক সমাজের সামনে একটি দৃষ্টান্ত রাখার প্রয়োজন আছে রাজনৈতিক নেতাদের। রাজনৈতিক নেতাদের উচিত দেশের আইনব্যবস্থার উপর শ্রদ্ধাশীল হওয়া। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে যেন সেই আইন লঙ্ঘিত না হয়, সে দিকেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

২। আইনপ্রণেতা

আইনকে সরল করার প্রয়োজন এবং পুরনো অপ্রাসঙ্গিক অ্যাক্টগুলিকে একটা নির্ধারিত সময় অন্তর বাতিল করে দেওয়া। এমনই ব্যবস্থা হওয়া উচিত যেখানে বিচার হবে ন্যায্য এবং তাড়াতাড়ি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আইনবিষয়ক ধারণা দেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে তা প্রথাগতভাবে হোক বা অন্য উপায়ে— বিশেষ করে গ্রামের মানুষদের জন্য।

৩। নাগরিক

প্রত্যেক নাগরিকের অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। ন্যায্য সঠিক কারণে আইনব্যবস্থাকে কাজে লাগানো উচিত, নিজেদের তুচ্ছ কারণে নয়। এ ছাড়া, নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া যে-কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতার সঙ্গে তাঁদের সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেওয়া উন্নতির জন্য অনুকূল অবস্থা তৈরি করে দেয়।

৪। শাসনব্যবস্থা

সমাজের পরিবর্তন ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে শাসনব্যবস্থাকে হতে হবে সংবেদনশীল এবং অতিক্রিয়াশীল। প্রযুক্তি, যেমন ই-গভর্নেন্সের মতো ব্যবস্থা, তার সাহায্যে সিদ্ধান্তকে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কার্যকরী করতে হবে।

৫। পুলিশ

সুশীল নাগরিকের সামনে সার্বিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও বরাভয় জোগানো পুলিশের কর্তব্য। তাদের বিচার যেন বহিরাগত কোনও চাপের মুখে পরাজিত না হয়ে যায়। সত্যনিষ্ঠ আধিকারিকদের কর্তব্য সমাধা করতে যেন সব সময়ে একটা নিরাপত্তা দেওয়া হয়। পুলিশের কাজের ভিত্তিতে তাঁদের যথাযথ বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া উচিত।

৬। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ

উন্নতির যে কাজ তাতে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদকে হতে হবে সহযোগী। দ্রুত গতিতে উন্নয়নের জন্য চাই উদ্ভাবনী সমাধানসূত্র। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সমাজের সব স্তরের মানুষকে ওয়াকিবহাল করতে হবে যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হতে পারে দ্রুত।

৭। আইনজ্ঞ

আইন ব্যাবসা শুধুই একটি ব্যাবসা নয়— সমাজে সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার দায়ও তার। আইনের চর্চা করেন যাঁরা, তাঁদের উচিত, তাঁদের পেশাদারি নীতিজ্ঞান বজায় রেখে চলা। আইন স্কুলগুলিতে শিক্ষার্থী আইনজীবীদের ভিতরে এই মূল্যবোধ প্রোথিত করে দিতে হবে তাঁদের পেশাদারি জীবনের গোড়াতেই, যাতে তাঁরা যখন তাঁদের পেশায় বরিষ্ঠ হয়ে উঠবেন, নতুন প্রজন্মের কাছে তখন যেন তাঁরা রোল মডেল হয়ে ওঠেন।

৮। বিচারক

সত্যকে তুলে ধরতে অভিগ্রস্ত পক্ষের সামাজিক অধিষ্ঠান বিচার্য নয়। দ্রুততার সঙ্গে বিচার সমাপ্ত করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে আইন অপরাধের প্রতিবন্ধক, তেমন আইন, উত্তম রোল মডেল আর কম বয়সে নীতিজ্ঞান শিক্ষা, এইসবই অপরাধ হ্রাসে সাহায্য করে। অন্যদিকে, সময় মতো বিচার পেলে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের নিন্দুক প্রবৃত্তিও হ্রাস পাবে।

৯। সংবাদমাধ্যম

সদা সজাগ ও অতিক্রিয়াশীল থাকতে হবে সংবাদমাধ্যমকে। তবে তাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে উত্তেজনাকে ইন্ধন জোগাতে গিয়ে সত্যের অপলাপ না হয়ে যায় অথবা কোনও বিষয় পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে পড়ে।

১০। শিল্পী ও লেখক

ইতিহাস, সাহিত্যর মতো কলা বিষয়ে চর্চা করেন যাঁরা, তাঁরা সারা দেশের মনোজগৎকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, দেশের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে দেশের সম্ভাবনাময় গুণগুলিকে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরার কাজ ছাড়াও, তাঁদের উচিত নিজস্ব চিন্তাধারাকে প্রকাশ করা, গণতান্ত্রিক উপায়ে কোনও বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করা।

১১। নন-গভর্নমেন্টাল ও কল্যাণকারী সংগঠন

তাদের প্রবল উদ্দীপনাপূর্ণ দায়বদ্ধতার জন্য নন-গভর্নমেন্টাল সংগঠনগুলি খ্যাত এবং তাদের কর্মোদ্যোগ, নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে তারা দেশে দর্শনীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা সকলে, তা যে যা পেশাতেই যুক্ত থাকি না কেন, সংবিধানে নির্দিষ্ট যে আচরণবিধি আছে তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। বিচক্ষণতার সঙ্গে আমরা আমাদের প্রতিটি কাজ করব এবং আমাদের প্রতিটি কার্যাবলি সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকব। আমি একজন নাগরিক হিসেবে এ কথা সোচ্চারে উচ্চারণ করছি, কারণ আমি দেখেছি কম সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ আইনের সুফল পান না। যাঁদের উপর সুযোগ-সুবিধা বর্ষিত হয় তাঁদের উচিত যোগ্য সম্মান দিয়ে তার সদ্‌ব্যবহার করা। যাঁদের কাছে সেই সুযোগ সুবিধা নেই তাঁদের ক্লেশ দেবার জন্য তা ব্যবহার করা সমুচিত নয়। এবং অবশ্যই তা জাহির করার জন্য নয়। অধিকার আস্ফালনের জন্য নয়, তাকে সঠিক কাজে লাগানোটাই কর্তব্য। সৌজন্য ও সংযমের মতো গুণগুলি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে লালন করা প্রয়োজন।

গণতন্ত্রের যে তিনটি স্তম্ভ— আইনসভা, প্রশাসন ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা— তারা যত শীঘ্র বুঝবে যে, এক স্বাস্থ্যকর প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থায় একটির অন্য দু’টি ছাড়া কোনও অস্তিত্ব নেই, ততই মঙ্গল আমাদের পক্ষে। আমাদের চেষ্টা হবে নাগরিকদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে পোষণ করে এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যেখানে সত্যিকারের গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারবে। সেইটিই হবে এক স্বাস্থ্যকর পুনরুদীয়মান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযুক্ত পরামর্শ।

২০১৩ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার এক বক্তৃতার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। মেরিল্যান্ডে জগদ্‌গুরু শ্রীশিবরাত্রীস্বর (জেএসএস) প্রতিষ্ঠানে কিছু মানুষের সামনে ‘Evolving a World without War’ বিষয়ে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। বক্তৃতাশেষে আমি লক্ষ করলাম যে, মার্কিন শ্রোতারা আমাকে আমার বক্তব্যের উপর প্রশ্ন করলেন বা পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ভারতীয় শ্রোতারা আমায় যা প্রশ্ন করলেন, তা সাধারণ বিষয়ে, যা আমার বক্তব্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এর থেকে আমি এই বার্তাই দিতে চাইছি যে, বক্তার বক্তব্য অনুধাবন করার অভ্যাস করতে হবে আমাদের, এবং সেই মতো প্রশ্নগুলিকে সাজিয়ে নিতে হবে। তাহলেই সমগ্র আলোচনাটি ফলপ্রসূ হবে।

এই ঘটনা আমাকে একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটি রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কি নিজেদেরকে সঠিক প্রশ্ন করছি? প্রাসঙ্গিক সমস্যার বিষয় বলতে গিয়ে আমরা কি বিমূর্ত কিছু কথা বলে বসি? আমরা এমন সমাধানসূত্র দিই যা হয়তো পাঁচ বছর পর কাজে আসবে, কিন্তু এই মুহূর্তে কোনও সুবিধা হবে না। আমরা অন্তরিক্ষ অন্বেষণের কথা বলি অথচ পায়ের নীচের পথটি সারানোর কথা ভাবি না।

একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি এমন হওয়া উচিত যা হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এবং তার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশ্ন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার শক্তি থাকে জ্ঞানে। জ্ঞানের শক্তি প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির শক্তি লুকিয়ে থাকে উদ্ভাবনীতে। জ্ঞানের সমাজে, আমাদের সর্বক্ষণ উদ্ভাবন চালিয়ে যেতে হবে। উদ্ভাবন নতুন নতুন জ্ঞানের রাস্তা উন্মোচন করে দেয়। তার ফলে কল্পনার নতুন দিক খুলে যায়। ফলে আমাদের কল্পনাতে যুক্ত হয় নতুন নতুন পরত যা দৈনন্দিনতাকে করে তোলে অনেক অর্থবহ এবং সমৃদ্ধ, বিষয়ে এবং গুরুত্বে। মননশীলতা জন্ম দেয় উদ্ভাবনকে। এবং মননশীলতা আসে সুন্দর মন থেকে। সুন্দর মন পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় পাওয়া যাবে— মত্স্যজীবী পল্লিতে, বা কৃষকের ঘরে, ক্লাসরুমে বা ল্যাবরেটরিতে, শিল্পে বা আর-অ্যান্ড-ডি কেন্দ্রে। মননশীলতা দিয়ে আমরা সারাক্ষণ আমাদের চিন্তাভাবনাকে উন্নততর করে তুলতে পারি। আমাদের কাজে পরিবর্তন ও পরিশোধন এনে নতুন নতুন সমাধানে উপনীত হতে পারি। মননশীলতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সবাইকার মতোই কোনও কিছু নিরীক্ষা করে অন্যকিছু ভাবে তাকে চিন্তা করা। উদ্ভাবন ও মননশীলতা পরিশেষে শ্রেষ্ঠত্বের আবাদ করে— সুন্দর মন থেকে জন্ম হয় এক সুন্দর রাষ্ট্রের।

.

পাঁচ : একটি সুন্দর রাষ্ট্র

ধরুন এক ভ্রমণযাত্রী হিমালয়ের সুউচ্চ কোনও এক গিরিকন্দরে দাঁড়িয়ে তাঁর সম্মুখে উন্মীলিত সম্পূর্ণ দেশটিকে দেখছেন। তিনি কী দেখবেন? এক বৈচিত্র্যে ভরপুর ভূস্বর্গচিত্র তাঁর সামনে। সেখানে রয়েছে সব ধরনের গাছগাছালি, জীবজন্তু; নদ, নদী, নালা যারা গিয়ে পড়ছে ভূখণ্ডের তিন দিক ঘেরা সমুদ্রে; রয়েছে মরুভূমি, পাথুরে পর্বতমালা; শাল তরু এবং শত শত প্রজাতির গাছে ভরা ঘন জঙ্গল; এবং রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন ভাষার মানুষ যাঁদের সাহিত্য ভাণ্ডার এতটাই অসীম যে পণ্ডিতদের বহু জীবন লেগে যাবে তার অধ্যয়নে, আর তদুপরি আছে তাঁদের উষ্ণ আতিথেয়তা এবং নজরকাড়া স্বভাব। মূল ভূখণ্ডটিই সব নয়। বৈচিত্র্যপূর্ণ সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে বঙ্গোপসাগরে, মূল ভূখণ্ড থেকে ১৩০০ কিমি. দূরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে, আর আরব সাগরে মূল ভূখণ্ড থেকে ৪৫০ কিমি. দূরের লাক্ষাদ্বীপে।

এই অসীম সৌন্দর্যর সঙ্গে ভ্রমণযাত্রীর চোখে পড়বে অনেক কিছু অনভিপ্রেত বিষয়, যা সহজেই সংশোধন করে নেওয়া সম্ভব। যেমন, নদ-নদীর ক্রমবর্ধমান দূষণ; অরণ্যবিনাশ; পূতিগন্ধময় আবর্জনার মধ্যে স্যানিটেশন ব্যবস্থাহীন যত্রতত্র নগরায়ণ; অবহেলা ও বঞ্চনা; প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষার অভাব যা জনসংখ্যার বিরাট অংশকে গ্রাস করে রেখেছে, এমন বেশ কিছু বিষয়। সব থেকে নিকৃষ্ট যে বিষয়টি তাঁর চোখে পড়বে তা হল দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং বেকারত্ব। একটি সমাজকে অস্থির করে দেয় যে ক্রোধ ও হিংসা তা জন্ম নেয় এই পরিস্থিতিতেই। সমাজে স্থিতিশীলতা, শান্তির গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। এসবই নির্ভর করে জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা কতটা উপলব্ধ হচ্ছে তার উপর। এইসবের উপর প্রত্যেক মানুষের পূর্ণ অধিকার আছে। অধিকার আছে সম্ভ্রম নিয়ে ও সম্মানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঁচার। মূলত গণতন্ত্র হল এই সম্ভ্রম নিয়ে বাঁচা ও সম্মান আদায়ের জন্য ন্যায় ও ন্যায্য পথে এগোনোর সুযোগের প্রতুলতা। আমাদের সংবিধানের মূল বক্তব্যই তাই। একটি সত্যিকারের প্রাণিত গণতন্ত্রে জীবনযাপনকে সুখকর এবং আনন্দময় করে তোলে এইটিই।

এই ক্ষণে আমি সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের গণতন্ত্রের মসৃণ পথ চলা নির্ভর করছে আমাদের সকলে মিলে সমাজের সকলের মনের মিল ঘটানোতে। অন্যের চিন্তাধারা ও জীবনবোধের প্রতি যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা দেখা দিচ্ছে, যার প্রকাশ মানুষেরই বিরুদ্ধে আইনভাঙা হিংসা, তা যে প্রসঙ্গেই হোক, মেনে নেওয়া যায় না কোনওমতেই। আমাদের সকলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং সভ্য আচরণে দৈনন্দিন জীবনকে চালিত করতে হবে যাতে অন্যের অধিকার সুরক্ষিত হয়। এই আমাদের গণতান্ত্রিক নীতিবোধের ভিত। ভারতবর্ষকে এক সুন্দর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে এই মূল্যবোধই।

আলোকপ্রাপ্ত মানুষ

সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে কেমনভাবে আমরা আলোকপ্রাপ্ত মানুষে বিবর্তিত হতে পারি? এর উত্তর আছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট কাজের মধ্যে। সন্তানের বিভিন্ন বয়সে যখন তার পিতামাতা কোনও কাজের জন্য তাকে ক্ষমতা প্রদান করেন, সে ধীরে ধীরে এক দায়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত হয়। শিক্ষক তাঁর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় যখন ক্ষমতাবান হন, ভাল নীতিবোধ নিয়ে মানুষের প্রকাশ ঘটে। প্রযুক্তির ক্ষমতাবলে সাধারণ মানুষ তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রকাশের সুযোগ পায়। কোনও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক যখন তাঁর অধীনস্থদের ক্ষমতা দেন তখন আরও অনেক পরিচালকের সৃষ্টি হয় যাঁরা দেশের পরিবর্তন আনতে পারেন বিভিন্ন দিকে। বিভিন্ন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা এনে দিলে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি নিশ্চিত। প্রতিটি ধর্মকে যদি ক্ষমতা দেওয়া হয় যাতে তারা আধ্যাত্মিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তাহলে প্রতিজনের হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হবে সুখ ও শান্তি। এই ধরনের ক্ষমতায়নই পারে উত্তম মূল্যবোধ নিয়ে আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক তৈরি করতে।

আমি মনে করি আলোকপ্রাপ্ত মানবসমাজ তৈরি করতে প্রয়োজন তিনটি মূল উপাদান: নীতিজ্ঞানসম্পন্ন এক শিক্ষা ব্যবস্থা, দক্ষতার সুসংবদ্ধতা আর সামাজিক ছুঁতমার্গের বিলোপ।

১। উত্তম মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষা

মানুষের জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল তার শৈশব। তাদের পাঁচ থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত, বাড়ি, স্কুল ও সমাজ থেকে তারা যে শিক্ষা পায়, তা-ই তাদের সারা জীবনকে তৈরি করে দেয়। এই পর্যায়েই তাদের প্রয়োজন হয় এক উত্তম মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার, যাতে তারা আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে। এক প্রাচীন গ্রিক শিক্ষকের কথাগুলি মনে পড়ে যায়: ‘আমাকে সাত বছরের জন্য এক শিশু সন্তানকে দাও। তারপর ভগবান হোক বা শয়তান, নিয়ে যাক সেই শিশুকে। তাকে তারা আর পরিবর্তন করতে পারবে না।’ অভিভাবক ও শিক্ষক, এঁরা দু’জন মিলে স্থির করুন এক সুসংবদ্ধ লক্ষ্য: উত্তম মূল্যবোধের শিক্ষা— বাড়িতে এবং স্কুলে। ২৫,০০০ ঘণ্টার এই মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা থেকে যদি আমাদের সন্তানরা বঞ্চিত হয়, আমাদের এক সত্যনিষ্ঠ সমাজ স্থাপনের স্বপ্ন সার্থক হবে না। শিক্ষাই একটি স্বপ্নের রাষ্ট্র নির্মাণের মৌলিক উপাদান। আমাদের জনসংখ্যার এক বড় অংশ এই তরুণরা যাঁদের দক্ষতার উপর নির্ভর করেই আমাদের সমাজের যত প্রত্যাশা। ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণন একবার বলেছিলেন, ‘Education should be imparted with a view to the type of society that we wish to build. We are working for a modern democracy built on the values of human dignity and equality. These are only ideals; we should make them living forces. Our vision of the future should include these great principles.’ [‘কী ধরনের সমাজ আমরা গড়ে তুলতে চাই সেইটাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক রূপায়ণের নিয়ামক হওয়া আবশ্যক। মানবিক মর্যাদা ও সাম্যতার মূল্যবোধের উপর আমরা এক আধুনিক গণতন্ত্র গড়তে চলেছি। এ সবই শুধু তাত্ত্বিক স্তরে রয়েছে; তাকে বাস্তবে জীবন্ত করে তুলতে হবে। এই মহান তত্ত্বকে আমাদের ভবিষ্যতের লক্ষ্যে যুক্ত করতে হবে।’]

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি শিশুর নিজস্বতা ও মননশীলতাকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে হবে। পাঠ্যসূচিকে করে তুলতে হবে উদ্ভাবনী। পরীক্ষা পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনে মুখস্থ বিদ্যার বদলে মননশীলতা ও নতুন চিন্তা যাতে প্রশ্রয় পায়, তাই দেখতে হবে। শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রদানের কেন্দ্র না হয়ে স্কুলগুলিকে জ্ঞান ও দক্ষতার উন্মেষ কেন্দ্র হতে হবে।

আমার নিজের জীবনের কিছু ঘটনা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। সুদূর ১৯৪৩ সালে আমার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন শ্রীশিবসুব্রহ্মনিয়া আয়ার [Sivasubramania Iyer]। এই দারুণ মানুষটি আমাদের বিজ্ঞান ও অন্যান্য কিছু বিষয় পড়াতেন। পাখি কী করে ওড়ে, এই বিষয়ে তিনি একদিন আমাদের পড়াচ্ছিলেন। তিনি বললেন যে, পাখির শরীরের আকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে তারা ডানা ঝাপটায়, কীভাবে গতি নেয়, এবং তাদের লেজ কীভাবে দিক পরিবর্তনে সাহায্য করে, এ সবই তিনি খুব সুন্দরভাবে বোঝালেন। কিন্তু আমাদের মনশ্চক্ষুতে আমরা তা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। আমার মনে আছে, তখন বাজে দুপুর ৩.৩০। তিনি আমাদের নিয়ে চললেন রামেশ্বরম দ্বীপের সমুদ্রতটে। সেখানে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আমরা সামুদ্রিক পাখির ওড়া দেখলাম। আমরা দেখলাম তাদের ডানা ঝাপটানো, গতি নিয়ে উড়ে যাওয়া, এবং লেজের সাহায্যে দিকের পরিবর্তন করা। ওই দিনটিতেই আমি জেনে গেলাম আমি কী করব। আমি উড্ডয়ন বিজ্ঞানের অধ্যায়ন করব। আমার শিক্ষক, তাঁর জীবন ও তাঁর শিক্ষাপ্রদান পদ্ধতি আমাকে আমার পথ বেছে দিল। ওই ক্লাসেই আমি আমার জীবনের ব্রত ঠিক করে ফেললাম।

অন্য ঘটনাটি ঘটেছিল যখন আমি তিরুচিরাপল্লীর [Tiruchirappalli] সেন্ট জোসেফস কলেজে পড়ি। সেখানে পড়াতেন তোটাদ্রী আয়েঙ্গার [Totadri Iyengar] নামে এক বিখ্যাত অঙ্কের শিক্ষক। প্রজ্ঞা যেন বিচ্ছুরিত হত যখন তিনি পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন। তরুণ শিক্ষার্থীরা সকলে বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকত। আমার অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন অন্য একজন, যাঁকে সকলে ‘ক্যালকুলাস’ শ্রীনিবাসন নামে ডাকে। তিনিও অধ্যাপক আয়েঙ্গার সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আমার বিএসসি-র প্রথম বর্ষেই ক্যালকুলাস শ্রীনিবাসন কলেজের ম্যাথামেটিক্স ক্লাবে দশজন সদস্যর অন্যতম হিসেবে আমাকে নির্বাচন করলেন। এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার সবথেকে বড় লাভ হল, ক্লাবের সদস্যদের জন্য অধ্যাপক আয়েঙ্গারের বক্তৃতামালা শোনার সুযোগ। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, প্রথম দিনে অধ্যাপক আয়েঙ্গার তাঁর এক ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় প্রাচীন ভারতের অঙ্কশাস্ত্র আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের পণ্ডিতদের বিষয়ে বললেন। আমার এখনও কানে বাজে সেই বক্তৃতা, যেন গতকালই তা শুনেছি। আর্যভট্ট, ভাস্কর এবং আমাদের এখনকার সময়ের রামানুজম— অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুরোধা পুরুষ এবং অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষজনের কথা তাঁর কাছেই আমার প্রথম শোনা। এই দুই ঘটনা আমার শিক্ষা, জ্ঞান আহরণ ও মূল্যবোধের ভিত্তি হয়ে থেকে গিয়েছে।

তাঁর মতোই আমাদের স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের উচিত আত্মসমীক্ষা করা এবং বিচার করা যে তাঁরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে কতটা সাহায্য করছেন।

২। সংঘবদ্ধ দক্ষতা

আমাদের উচিত অর্থনৈতিক উন্নতিতে ও রাষ্ট্র গঠনে আমাদের সন্তানদের কর্মদক্ষতা প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া। মননশীলতা ও উদ্ভাবন এবং উদ্যোগী অধিনায়কত্বের জন্য যে গবেষণা বা অনুসন্ধিত্সার প্রয়োজন, তার সুযোগ করে দেওয়াও তার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সন্তানদের প্রয়োজন এই বিভিন্ন ধরনের দক্ষতাকে সুসংহত করে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা।

৩। সামাজিক ছুঁতমার্গের দূরীকরণ

আমাদের সন্তান, যারা ভবিষ্যতের নাগরিক, তাদের ভিতর মনের মিল এবং সাম্যবোধ সৃষ্টিতে শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সমাজে যে বিভিন্ন ধরনের ছুঁতমার্গ লক্ষ করা যায়, যেমন সামাজিক অবস্থান ও লিঙ্গ, বা অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষকদের কর্তব্য এমন ধরনের প্রভেদ তাঁদের ক্লাসঘর থেকে তথা শিক্ষার্থীদের মন থেকে দূর করে দেওয়া। কোনও পক্ষপাতিত্ব যেমন, সেই শিক্ষার্থী ছেলে না মেয়ে, ধনী না গরিব ঘর থেকে আসছে, অথবা কোন বিশেষ অঞ্চল থেকে আসছে বা কোন ধর্মের, এসব প্রশ্ন ছাড়াই যদি তাঁরা সকল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একরকম ব্যবহার করেন, তবেই ওই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব।

সুখী পরিবার

এক সুন্দর রাষ্ট্র নির্মাণের পরবর্তী পদক্ষেপ হল সুন্দর পরিবারের সৃষ্টি। আমি মনে করি একমাত্র সংযুক্ত সুখী পরিবারই পারে এক সুন্দর দেশের জন্ম দিতে। সুন্দর গৃহকোণের চারটি দিক আছে:

১। বই পড়ার অভ্যাস

পিতামাতা আর তাঁদের এক পুত্র আর এক কন্যা— অথবা দুই পুত্র আর দুই কন্যা— এই নিয়ে ধরা যাক একটি ছোট সংসার। পরিবারে পিতামাতা দু’জনেই উপার্জন করেন। আমি মনে করি এমন এক সংসারে নিদেনপক্ষে খান দশেক ভাল ভাল বইয়ের একটি সংগ্রহ আছে। রোজ সকালের জলখাবারের সময়ে অথবা রাতের আহারের সময়ে পিতামাতা যদি তাঁদের সন্তানদের বই পড়ে শোনান, তাহলে সন্তানদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস ঢুকে যাবে। নিজেদের মধ্যে এক সহজ যোগাযোগের স্বার্থে যে-কোনও একটি আহারের সময়ে অন্তত, সমগ্র পরিবারের একত্র হওয়া বাঞ্ছনীয়।

পিতামাতার কোনও একজনের উচিত আহারের সময়ে কোনও একটি বই থেকে কাহিনি বা আখ্যান পড়ে শোনানো, যেখানে আছে নীতি ও মূল্যবোধের কথা। সেই কাহিনি শুনে সন্তানরা তাদের মতামত জানাবে। এই অভ্যাস ছেলেমেয়েদেরও অনুপ্রাণিত করবে বই পড়ায়। নীতি ও মূল্যবোধের শিক্ষা তারা প্রয়োগ করবে তাদের জীবনে। কেউ কেউ স্কুলে তাদের বন্ধুদের ওই সব কাহিনির কথা বলবে। এবং এইভাবেই এক বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে সেই শিক্ষার উপকারিতা ছড়িয়ে পড়বে।

এই দৈনন্দিন পারিবারিক মিলনের ফলে সমাজ জুড়ে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তথ্য ও জ্ঞানের সঙ্গে নীতিবোধের সম্প্রসারণ ঘটবে। এই অভ্যাস থেকে যে সন্তানরা লাভবান হবে, তারা সকল সময়েই যে-কোনও কাজে হবে দায়িত্বশীল। সে দায়িত্ব তারা সুন্দরভাবে, নিষ্ঠাভরে ও আত্মসম্মানের সঙ্গে অতিবাহিত করবে।

২। মায়ের প্রসন্নতা

এক সুখী মা-ই যে কোনও সুখী পরিবারের ভিত। সংসারের সকলের পরিচর্যা ও লালন করেন যেহেতু তিনি, তাই তাঁর সুখসমৃদ্ধির দিকে খেয়াল রাখা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়— যেখানেই আমি তরুণদের সাক্ষাৎ পাই, আমি তাদের জোর দিই যাতে প্রতিদিন তারা একটি সময় বের করে তাদের মায়েদের প্রসন্ন রাখার চেষ্টা করে। তাদের একটা শপথবাক্য পাঠ করাই। সেটা অনেকটা এইরকম:

আজ থেকে আমি আমার মাকে সুখী রাখব।

আমার মা সুখে থাকলে, আমার পরিবার সুখে থাকবে।

আমার পরিবার সুখে থাকলে, সমাজ সুখে থাকবে।

সমাজ যদি সুখে থাকে, আমার রাজ্য সুখে থাকবে।

রাজ্য যদি সুখে থাকে, দেশ সুখে থাকবে।

৩। স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত পরিবার

এক স্বচ্ছ দুর্নীতিমুক্ত সমাজের অপেক্ষায় আজ সারা রাষ্ট্র। দুর্নীতি শুরু হয় কিছু পরিবারে, তাই ঘরের অভ্যন্তরেই তাকে বিনাশ করে দিতে হবে। প্রায় ২০ কোটি পরিবারের সমাজ আমাদের। তার এক তৃতীয়াংশ যদি আমরা মনে করি দুর্নীতিগ্রস্ত, তা হলে কমবেশি প্রায় ৬ কোটি পরিবার দুর্নীতির কবলে।

এর থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ আছে। আমি তরুণদের বলব, তারা যদি তাদের পরিবারে এই দুর্নীতি-ভাইরাসের সন্ধান পায়, তারা যেন তাদের পিতামাতাকে স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে এই পথ— যে পথে রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে— সেই পথ থেকে নিবৃত্ত করে। আমার বিবেক বলছে, কোনও আইন নয়, যুবকদের এই অভিযানই পারবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে।

৪। সবুজ গৃহকোণ

আবহাওয়ার পরিবর্তন আজ পৃথিবীর সবথেকে বড় সমস্যা। অরণ্যবিনাশ, শিল্পায়ন এবং পরিবহণ— আমাদের এই গ্রহের উষ্ণতার কারণ। পৃথিবী জুড়ে আজ যে ভয়াবহ বন্যা বা খরা, তার কারণ এই উষ্ণায়ন।

আমাদের প্রতিটি পরিবার যদি দায়িত্ব নেয়, এই পরিস্থিতি পালটে দেওয়া যায়। প্রত্যেক পরিবার অঙ্গীকার করুক, তারা অন্তত একটি গাছের পরিচর্যা ও লালন করবে। একটি পূর্ণ বয়সের ২০ কেজি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং ১৪ কেজি অক্সিজেন ত্যাগ করে। যদি প্রতিটি পরিবার একটি গাছ রোপণ করে তাকে পরিচর্যা করে, তবে ২০ কোটি গাছ থাকবে আমাদের, যা আবহাওয়া পরিবর্তনের সমস্যায় সাহায্য করবে অবশ্যই।

এক সুন্দর ভারত

আলোকপ্রাপ্ত মানুষজন আর সুখী পরিবার একসঙ্গে এক সুন্দর ভারত গড়ার কাজে বহু দূর যাবে। এক সুন্দর ভারতের বিবর্তনের বিষয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই বিবর্তনের সঙ্গে আছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে আহরিত মূল্যবোধ। বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যৎ বাণী বলছে যে, ২০২০ সালের মধ্যে ভারত সারা পৃথিবীতে এক গৌরবময় স্থান নিয়ে উঠে আসবে। ওই লক্ষ্য-বছরটিকে ধরে এবং গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক উন্নতির চেহারাটা দেখে, আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে প্রয়োজন একটি বিরাট ধাক্কার। ভবিষ্যতের প্রজন্মকে আমরা এমন এক প্রতিযোগিতামূলক রাষ্ট্র উপহার দেব যার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকবে-

১। এক সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, সুখী রাষ্ট্র।

২। গ্রাম-নগরের বিভাজন রেখা যে রাষ্ট্রে অতি সূক্ষ্ম।

৩। যে রাষ্ট্রে শক্তি ও উন্নতমানের জলের ন্যায়সংগত বিতরণ আছে।

৪। এমন রাষ্ট্র যেখানে কৃষি, শিল্প এবং অন্যান্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলি প্রযুক্তির সাহায্যে এক সুরে বেজে ওঠে, যাতে এক নিরবচ্ছিন্ন সম্পদসৃষ্টি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

৫। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে যে রাষ্ট্রের মেধাবী বিদ্যার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় না।

৬। সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেধার শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানীদের জ্ঞান লাভের আদর্শ গমনস্থান হয় যে রাষ্ট্র।

৭। যে রাষ্ট্রে সমগ্র জনগণের জন্য শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য পরিষেবা সহজলভ্য হয়।

৮। যে রাষ্ট্রের সরকার প্রযুক্তির ব্যবহারে তার শাসনকে করে তোলে সকলের কাছে গ্রহণীয়, স্বচ্ছ ও সহজে সংযোগকরণীয়, আর আইন যেখানে সরল হওয়ায় সরকার হয় দুর্নীতিমুক্ত।

৯। যে রাষ্ট্রে দারিদ্র্য সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত, অশিক্ষা এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিলুপ্তি ঘটেছে, আর সমাজের কোনও ব্যক্তিই যেখানে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন না।

১০। যে দেশ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাসযোগ্য স্থান, আর যে দেশ একশো কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *