৩. পড়াশোনা আর হবে না

আমি কিছু বুঝি আর না বুঝি এটা বুঝে গেছি যে আমার পড়াশোনা আর হবে না। এই অবস্থায় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির খরচ চালানো একেবারেই অসম্ভব। রাহির পড়াশোনাও হয়তো খুব বেশি দূর হবে না। তবুও, অন্তত এইচএসসি পরীক্ষাটা দেয়া উচিত। বাবা-মায়ের ঘরের ফার্নিচার আর টিভিটা বিক্রি করে দিলাম। আপাতত এই জিনিসগুলো কোনো কাজে দিচ্ছে না। রূপ অবশ্য টিভি দেখে, তবে ওকে কম্পিউটার ছেড়ে দিলেও হবে। পুরনো জিনিসের খুব একটা চাহিদা নেই, ফার্নিচারের কেমন দাম হতে পারে সে বিষয়েও কোনো আইডিয়া নেই। ঠকলাম কি না তাও জানি না। রাহির ফর্ম ফিলাপের পর মোটামুটিভাবে মাসখানেক চলার মতো টাকা হাতে রইল। এভাবে জিনিসপত্র বিক্রি করে করে আর কতদিন চলবে? আমি বুঝতে পারছি পড়াশোনা যতদূর করেছি তাতে কোনো চাকরি পাওয়া সম্ভব না। আমার কোনো কাজ করতে হবে কিন্তু কি কাজ করব বুঝি না। কোনো কাজ করার যোগ্যতাই তো আমার নেই।

রাফসান শিকদার
১৩ ডিসেম্বর, ২০১০

হাতে কিছু টাকা আসায় ঢাকা ছুটলাম। এই টাকায় আমার হিসেব করে চলার কথা। কিন্তু মনকে মানাতে পারলাম না। চলে গেলাম। মীরা আমার কাঁধে মাথা রাখল। আমার হাত দুটো চেপে ধরে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিশ্বাস কর বকুল, আমার সত্যিই মনে হলো সব ঠিক হয়ে যাবে। ওর কাছে এলে যে আমি এত শান্তি পাব তা আগে বুঝিনি। এত শান্তি ওর দুচোখে, ওর হাসিতে, ওর স্পর্শে! এত তীব্রভাবে কবে ভালোবাসলাম ওকে আমি?

রাফসান শিকদার
১৮ ডিসেম্বর, ২০১০

এই অংশটা পড়ে মীরার চোখে জল এসে গেল। ভাবতেও অবাক লাগছে ওই সময় রাফি তাকে এইভাবে ভালোবাসত, অথচ সে এক মুহূর্তের জন্য টের পায়নি!

পরের পাতা…

ইদানীং আমি মেজাজ ধরে রাখতে পারছি না নাকি আমার সঙ্গে বিরক্তিকর ঘটনাগুলো বেশি বেশি ঘটছে? আজ টগর এসেছিল বাসায়। আমার কাছে গাছ কিনতে চায়। কত বড় সাহস ওর-আমি ভেবেই পাচ্ছি না। আমি কি গাছ বিক্রি করতে চাইছি নাকি যে ও কিনবে? হাতি বিপদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে! আমার হয়েছে সেই দশা। সেদিন এতগুলো পেয়ারা কেনার উদ্দেশ্য আজ পরিষ্কার হয়ে গেল।

রাফসান শিকদার
২১ ডিসেম্বর, ২০১০

কেন যেন এবার শীতে আমার কোনো সবজির তেমন ভালো ফলন হচ্ছে না। কিছু সবজিগাছ মরে যাচ্ছে। কিছু পোকায় খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। আমি সম্ভবত ভেতর থেকে ভেঙে গেছি। গাছগুলোর ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারছি না হয়তো। গাছগুলো দেখে মনে হলো, ওদের মতোই আমি মীরারও যত্ন নিতে পারছি না এখন। এই সম্পর্কটারও কি তবে শেষমেশ গাছগুলোর মতোই অবস্থা হবে? এসব একদম ভাবতে পারি না আমি। কেন এসব ভাবনা আমার মাথায় আসে?

রাফসান শিকদার
২৫ ডিসেম্বর, ২০১০

ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতে করতে সব শেষ করে দিচ্ছি। আমি জানি এটা ঠিক হচ্ছে না। এসব না করে একটা কাজ জোগাড় করা দরকার। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা কথা মনে পড়ল। কার থেকে শুনেছিলাম মনে নেই তবে শুনেছি বিভিন্ন গার্মেন্টস আর ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রায় সময়েই শ্রমিকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থাকে। ভাবলাম গায়ে শক্তি তো কম নেই নিশ্চয়ই পারব। চেষ্টা করে দেখি পাওয়া যায় কি না।

আশপাশের বেশির ভাগ ফ্যাক্টরিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছিল কিন্তু আমি নাকি বিদেশি তাই এসব কাজ পারব না! প্রত্যেকে তাই বলল। হায় আল্লাহ! কেন এমন চেহারা দিলে যে চেহারার জন্য একটা কাজও জোটাতে পারি না? এই চেহারায় হয়তো শুধু মেয়ে জোটানো সহজ।

রাফসান শিকদার
২০ জানুয়ারি, ২০১১

আজকাল কিছু লিখতেও বড় ক্লান্তি লাগে! সুখের গল্প লেখায় বড় সুখ। কষ্টে গল্প লেখায় বড় কষ্ট। আমার জীবনের সুখের কোটা পূর্ণ হয়ে গেছে কিনা জানি না তবে কষ্টের কোটা এখনো অনেক বাকি এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই।

রাফসান শিকদার
২২ জানুয়ারি, ২০১১

***

কীরে বকুল, খবর কী তোর? অনেকদিন কথা হয় না। মন-মেজাজ এত খারাপ থাকে যে তোর কথাও মনে পড়ে না। আজ হঠাৎ করেই মনে পড়ল প্রায় তিন মাস ধরে লিখি না তোকে! আমার অবস্থা আর কী? চলছে একরকম। কোনো আয়ের ব্যবস্থা করতে পারিনি এখনো। তবে চেষ্টা করছি।

মীরার সঙ্গে সম্পর্কের এখন আরো অবনতি হয়েছে। মাঝেমাঝে ভয় হয় সম্পর্কটা টিকবে তো? ও এখন আমার ভালোবাসায় অন্ধ। কিন্তু এই অন্ধত্বের পর্দা যদি কখনো সরে যায়? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যাওয়াটাও তো অস্বাভাবিক না। তার ওপর এখন আর সম্পর্কটার সুস্থতা বজায় রাখতে পারছি না। আমাদের জন্য একটু দোয়া করিস। মীরা এখন আর আমার প্রেমিকা নেই, তারচেয়ে বেশি কিছু হয়ে গেছে।

আমাদের বাসায় সম্ভবত খুব দামি কোনো জিনিস ছিল না। আর থাকলে ন্যায্য দাম পাইনি। জিনিসপত্র বিক্রি করতে করতে সব শেষ। এখন শুধু রান্নার জিনিসপত্র আর বিছানা বালিশ আছে।

মজার ব্যাপার কি জানিস? এখন আর রূপ মুরগির জন্য কাঁদে না। যা দেই তা দিয়েই খেয়ে নেয়। ক্ষুধার যন্ত্রণা চিনে গেছে মেয়ে! ভাত পেলেই খুশি! আলহামদুলিল্লাহ।

রাফসান শিকদার
০৬ মার্চ, ২০১১

আজ আমরা অনেক আনন্দ করলাম। গ্যাস বিল দিতে পারিনি কয়েকমাস। আজ দেখি গ্যাসলাইন কেটে দিয়েছে। কী আর করা যাবে। না খেয়ে তো আর থাকতে পারব না। আমি আর রাহি নদীর মাটি তুলে আনলাম। সেই মাটি দিয়ে চুলা বানালাম। এর আগে একবার গ্রামে পিকনিক করার জন্য কাজিনরা সবাই মিলে মাটির চুলা বানিয়েছিলাম। সেই কারণেই মাটির চুলা কীভাবে বানাতে হয় সেই ধারণা ছিল। লাকড়ির ব্যবস্থা আমার বাগান থেকেই হয়ে গেল। সবকিছুতেই রূপ এত আনন্দ পেল! ওর ধারণা হলো আমরা বুঝি পিকনিক করছি। তবে চুলা শুকাতে একটু সময় লাগল। ততক্ষণে রূপ ক্ষুধায় কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল। ওকে গাছের পেয়ারা খেতে দেয়া হয়েছিল, সেটা ছুঁড়ে মেরেছে। এক জিনিস আর কত খাওয়া যায়? যাই হোক চুলা শুকালে রান্না বসালাম। ততক্ষণে রূপ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। রান্না হওয়ার পর যখন ওকে খেতে ডাকলাম, হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। মেনু মোটা চালের ভাত (মোটা চাল সস্তা বিধায়) আর গাছের মিষ্টি কুমড়ার নিরামিষ। তাতেই রূপ মহাখুশি, নিজ হাতেই ভাত খেল। রূপের এই পরিবর্তন, এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাওয়া… বাবা-মা থাকলে হয়তো কখনোই হতো না। সবকিছুরই ভালো খারাপ দুটো দিক থাকে। আমাদের অভাব দিনের ভালো দিক বোধহয় এটা।

রাফসান শিকদার
১৩ মার্চ, ২০১১

রোজ একটু একটু করে ডুবে যেতে থাকি অন্ধকারের অতল গহ্বরে…

জানি না এর শেষ কোথায় কিংবা
আদৌ কোনো শেষ আছে কি না!

রাফসান শিকদার
২২ মার্চ, ২০১১

বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। গ্যাসের মতোই বিল জমে গিয়েছিল অনেক। বিল দিতে গেলে না খেয়ে থাকতে হতো। শেষমেশ লাইন কেটে দিয়েছে। এটা ঢাকা শহর আর ওয়াসার পানি হলে হয়তো সেই লাইনও এতদিন কেটে দিত। যদিও ইলেক্ট্রিসিটি না থাকার কারণে মোটর চালিয়ে পানি তোলা সম্ভব হয় না। টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে সব কাজ করি। নতুন নতুন বাড়ি করার পর প্রায়ই এখানে দীর্ঘসময় ধরে ইলেক্ট্রিসিটি থাকত না। তখন পানির সমস্যা হয়েছিল বলেই বাবা এই টিউবওয়েল টা বসিয়েছিল। সমস্যা একটাই, প্রচণ্ড গরম। দিনের বেলা রূপ মাঝেমাঝে কান্নাকাটি করে। কিন্তু আমি বিচলিত হই না। এটাও একসময় তার অভ্যাস হয়ে যাবে। তবে রাতের বেলা সারারাত ওকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করি। এখন এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি ঘুমিয়ে থাকি আমার হাতে পাখা নড়তে থাকে।

রাফসান শিকদার
২৯ মার্চ, ২০১১

বেশকিছু গরমের সবজি বুনেছিলাম। করলা আর মিষ্টি কুমড়া ছাড়া তেমন কিছুই দু-একটার বেশি হয়নি। তবে কুমড়ার ফলন বেশ ভালো হয়েছে। প্রতিদিন কুমড়ার নিরামিষ খেয়েও আমাদের কুমড়া শেষ হচ্ছে না। মিষ্টি কুমড়া খেতে খেতে রূপ অবশ্যি বিরক্ত। মাঝেমাঝে ডিম ভুনা করলে ওর আনন্দ দেখার মতো হয়। আজ ডিম ভুনা করেছি। আজ আমার রূপের আনন্দ দেখার দিন।

রাফসান শিকদার
০৭ এপ্রিল, ২০১১

হে আল্লাহ, আমার জীবনের সব সুখের বিনিময়েও কি আমার মাকে ফেরত দেয়া যায় না?

রাফসান শিকদার
১১ এপ্রিল, ২০১১

রাহির এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় ওর কষ্ট হচ্ছে। রাত জেগে পড়ার অভ্যাস ছিল। সেই অভ্যাস বদলাতে হয়েছে। যে ছেলেকে কখনো বেলা ১০/১১ টার আগে ঘুম থেকে তোলা যেত না। সে এখন অনায়াসে ভোরবেলা উঠে পড়তে বসে। যতক্ষণ আলো থাকবে ততক্ষণের মধ্যে পড়াশোনা শেষ করতে হবে কি না। অভাবে আমার ভাইবোন দুটো যে শিক্ষাগুলো পেয়েছে তা হয়তো আমি ওদেরকে আরাম-আয়েশে রেখে সারাজীবনেও দিতে পারতাম না।

রাফসান শিকদার
১৮ এপ্রিল, ২০১১

পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি ঘরে আর কিছু বিক্রি করার মতো আছে কি না। কিন্তু পাচ্ছি না। গাছেও কোনো ফল নেই। দুদিন ধরে ভাত খাই না। শুধু মিষ্টি কুমড়ার নিরামিষ আর গাছের শসা খেয়ে বেঁচে আছি। চাল শেষের দিকে কিন্তু একটা টাকাও নেই আমার কাছে। তাই কম করে রান্না করেছিলাম। যাতে অন্তত একদিনের চালে দুদিন চলে আর এরমধ্যে কোনোমতে কিছু টাকা ম্যানেজ করতে পারি। রাহি যাতে টের না পায় তাই ও পরীক্ষা দিয়ে ফেরার আগেই রূপকে খাইয়ে দিয়েছি আর বলেছি আমি রূপের সঙ্গে খেয়ে নিয়েছি। বেচারা খেতে বসে বলল,

ভাইয়া কাল থেকে চাল আরেকটু বাড়িয়ে নিস। এত অল্প ভাতে ক্ষুধা মেটে না।

আমি রাহিকে বলতে পারি না কাল হয়তো ভাত খাওয়াতেই পারব না।

আমার শরীরে শক্তি নেই। মাথা কাজ করে না। শরীর কাঁপতে থাকে। পেট গুলিয়ে বমি আসে। একমুঠো ভাতের জন্য আমার ড্রাগ এডিক্টের মতো অবস্থা হয়েছে। ২৩ বছর বয়সে আমি প্রথমবার উপলব্ধি করলাম ভাতের চেয়ে বড় নেশা আমার আর নেই।

রাফসান শিকদার
২২ এপ্রিল, ২০১১

গত তিনদিন ধরে তুমি একবারও আমাকে ফোন করোনি রাফি।

কথা তো প্রতিদিনই হচ্ছে।

হ্যাঁ হচ্ছে। আমি ফোন দিচ্ছি বলে হচ্ছে। তুমি নিজ থেকে একবারও ফোন দাওনি।

আমাকে ফোন দেয়ার সুযোগ তো দাও না। তার আগেই তুমি ফোন করো।

বাহানা দিও না।

আচ্ছা এখন কী করতে হবে?

তোমার যা মন চায় তাই করো। তোমার আর ফিলিংস নেই আমার জন্য। আমি বলে বলে তো সেই ফিলিংস আনাতে পারব না।

ফিলিংসে ভরপুর কাউকে পেলে চলে যেতে পারো। আমি তোমাকে বেঁধে রাখিনি।

কী বললে তুমি?

ফিলিংসে ভরপুর কাউকে পেলে চলে যেতে পারো।

কনভার্সেশনের এই পর্যায়ে মীরা ফোন রেখে দিল। সম্ভবত কাঁদছে। আমাদের সম্পর্কটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে এই নিয়ে সারাক্ষণ ভয়ে থাকি আমি অথচ আজ নিজেই কি বাজে একটা কথা বলে ফেললাম। যদিও আমার এভাবে বলা ঠিক হয়নি, তবে কথাটা বাজে হলেও সত্যি। আমার ওকে আটকে রাখা উচিত না। আমার সঙ্গে ও ভালো নেই।

রাফসান শিকদার
২৩ এপ্রিল, ২০১১

আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিনটি সম্ভবত আজ গেল। এমন দিন যেন আমার শত্রুরও না আসে। চাল শেষ এটা রাহিকে জানানো হয়েছে তাই সে চুপ ছিল। কিন্তু রূপকে এসব বোঝানো যাচ্ছে না। সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছিল। সকাল থেকে না খাওয়া, দুপুরও পেরিয়ে গেছে। রূপ বারবার বলছিল, আমাকে ভাত দাও রাফি ভাইয়া, আমাকে ভাত দাও। আম্মু আমাকে প্রতিদিন ভাত দিত। আমি ওর এসব কথা সহ্য করতে পারছিলাম না। বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। যদি কিছু জোগাড় করতে না পারি তাহলে হাইওয়েতে গাড়ির তলায় মাথা দেব আজ। টাকা-পয়সা ধার করার মতোও কেউ নেই। দাদা-দাদি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের একটা গতি হত। কিন্তু চাচারা তো ফিরেও তাকায় না। একটা খোঁজও নেয় না পাছে টাকা চেয়ে বসি! হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবকিছু অসহ্য লাগছে। ঠিক তখন চোখে পড়ল নদীর পাড়ঘেঁষে খুব সুন্দর কলমি শাক গজিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি গিয়ে কাঁচি আনলাম। শাক কেটে আঁটি বেঁধে বাজারে নিয়ে গেলাম। কেউ কিনল না। বিকেলবেলা কেউ তেমন একটা বাজারে ঢোকে না। তাই রাস্তার ধারে বসলাম, অফিস থেকে ফেরার পথে কেউ যদি কেনে! ভাগ্য ভালো, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে শাকগুলো বিক্রি হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা চাল কিনে বাসায় ফেরার পথে আমাদের জন্যও কিছু শাক কেটে আনলাম। আজ মিষ্টি কুমড়ার নিরামিষের সঙ্গে নতুন আইটেম পেয়ে রূপ খুশি হলো। চার দিন পর ভাত খেয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, এই বুদ্ধিটা আমার মাথায় আগে এলে আমার ভাইবোনগুলোকে দুইবেলা না খাইয়ে রাখতে হতো না। বুদ্ধি করে চলতে পারলে সব সমস্যারই সমাধান আছে। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিতেই আমাদের জীবনধারণের জন্য সবকিছু সুনিপুণ হাতে গুছিয়ে রেখেছেন। আমরা মানুষেরা বুঝতে পারি না। একখণ্ড জমি থাকলে আমি ধানচাষ করতাম। পুকুর থাকলে মাছ চাষ করতাম। কোনোকিছুর অভাব থাকত না।

আরে তোকে লিখতে লিখতেই মাথায় একটা আইডিয়া এলো। জমি, পুকুর না থাকলেও তো আমার একটা উঠান আছে। আমি এতে মুরগি তো পালতে পারি। আমার বোনের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য যা অনেক মাস ধরে তাকে আমি খেতে দিতে পারি না। মুরগি পালা শুরু করতে মুরগির বাচ্চা কেনা এবং খাবার কেনা বাবদ কিছু টাকা লাগবে। এই টাকাটা জোগাড় করতে পারলেই আমি শুরু করে দেব ইনশাআল্লাহ।

শুরুতে লিখেছি আজকের দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খারাপের সঙ্গে সঙ্গে দিনটি বিশেষ শিক্ষণীয়ও ছিল বটে। অভাব আর পেটের ক্ষুধা মানুষকে যে শিক্ষা আর জেদের জোগান দেয় তা আর কেউ দিতে পারে না বলে আমার মনে হল।

রাফসান শিকদার
২৪ এপ্রিল, ২০১১

এই পর্যায়ে মীরা ডায়েরিটা বন্ধ করে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলল । নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছল। এরপর ড্রয়িংরুমে গেল। কিন্তু রূপ সেখানে নেই। সে রূপের ঘরে গেল। রূপ আগামীকাল স্কুলের জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছিল। মীরাকে দেখে বলল,

ভাবি ভাল হয়েছে এসেছো, আমার পড়া শেষ। এসো গল্প করি।

মীরা রূপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, মাথায় হাত বোলাল। তারপর আচমকাই রূপকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। হতভম্ব রূপ জিজ্ঞেস করল,

কী হয়েছে ভাবি?

মীরা রূপের কপালে চুমু খেল। তারপর বলল,

ভাইয়া ভাবি তোমাকে অনেক ভালোবাসে রূপ।

রূপ বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কী হচ্ছে। তবে মীরার কথার উত্তর দিল,

আমিও তোমাদেরকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু কী হয়েছে ভাবি? তুমি কাঁদছো কেন?

তেমন কিছু না। হঠাৎ ইমোশনাল হয়ে পড়লাম।

সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু কেন?

মীরা চোখের পানি মুছে হেসে বলল,

এমনি।

রূপ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মীরা আবার নিজের ঘরে গিয়ে ডায়েরি পড়া শুরু করল।

***

আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া, আমি একটা কাজ পেয়েছি। সাভারে একটা কম্পিউটারের দোকানে কাজ। তুই তো জানিস বকুল, আমি কম্পিউটারের কত কাজ জানি? সেইজন্যই কাজটা পেতে সুবিধা হলো। কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে রাহির এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। যেদিন ওর পরীক্ষা থাকে না সেদিন তো কোনো সমস্যাই নেই। কিন্তু যেদিন ওর পরীক্ষা থাকে সেদিন রূপকে কোথায় রেখে যাব-এটা নিয়ে একটা ঝামেলা লাগে। রাহি পাশের বাসায় রাখতে চায় যেটা আমার পছন্দ না। তবু একদিন উপায় না পেয়ে ওখানে রেখে যেতে হয়েছে। একদিন ধামরাইতে দাদার বাসায় রেখে গিয়েছি কিন্তু ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য কারণ ধামরাই এখান থেকে বেশ দূর। রূপকে রেখে এসে আমার কাজে যেতে যেতে দেরি হয়ে যায়। এরপর থেকে আমাদের কোনো কাজিন এসে রূপের কাছে থেকেছে। একবার এলো মীরা। সরি মীরা বললে তুই কনফিউজড হবি। শান্তনার কথা বলছি। একবার শান্তনা এলো। রাহির সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছে হয়তো। রূপ ওকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। আমি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। শান্তনা আমাকে ডেকে বলল,

আমাকে দেখে বিরক্ত হলি রাফি? একদিন কি আমি রূপের কাছে থাকতে পারি না? সবাই পারলে আমি কেন পারব না?

আমি বললাম,

যদি আমাকে বিরক্ত হতে দেখিস সেটা তোর দৃষ্টিভ্রম। রূপ তোর কাজিন। ও তোর কাছে থাকতেই পারে। আমি কেন বাধা দিতে যাব?

সত্যি বলছিস?

আমার দেরি হয় যাচ্ছে। রূপের খেয়াল রাখিস।

এ কথা বলে আমি বেরিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমার সব অনুভূতির মতই ঘৃণার অনুভূতিও কি কমে গেছে? নাহলে আজ কেন ওকে দেখে খুন করতে ইচ্ছে হলো না। আজ কেন ওর কাছে আমার বোনকে রেখে বেরিয়ে এলাম? ভাবতে ভাবতে একসময় আবিষ্কার করলাম, ঘৃণা কমেনি তবে কাউকে খুন করার চেয়ে নিজে সারভাইভ করাটা এই মুহূর্তে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

রাফসান শিকদার
 ০৫ মে, ২০১১

বকুল,

চাকরি পেয়েছি। মাস প্রায় গড়িয়ে গেল। কিছুদিন পর বেতনও পাব। খাওয়া পরার চিন্তা কমেছে। কিন্তু নতুন এক চিন্তা এসে মস্তিষ্কের ভেতর সংসার বাঁধতে শুরু করেছে। আমার ভবিষ্যৎ চিন্তা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার মীরা। আমার ভবিষ্যণ্টা যেমন হবার কথা ছিল তেমন হবে না এখন আর। বাবা-মা নেই, পড়াশোনা নেই, আয়-রোজগারও নিতান্তই সামান্য। ভবিষ্যতে বাড়তে পারে। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হলেও বাকিসব একই থাকবে। তার ওপর দুই ভাইবোনের দায়িত্ব। এই অবস্থায় এটা স্পষ্ট যে আমাদের সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে বলে এতদিন ভয় পেয়ে এসেছি, অথচ আজ উপলব্ধি করতে পারলাম এই সম্পর্ক আমার নিজেরই ভেঙে দেয়া উচিত। মীরা আমার জন্য বদ্ধপাগল-এ কথা যেমন সত্য, ও যখন বড় হবে এই পাগলামি থাকবে না-এ কথাও সত্য। তখন হয়তো ও আফসোস করবে। না করলেও ওকে আমি ভালো রাখতে পারব না। সব থেকে বড় কথা ওর ফ্যামিলি আমাকে মানবে না। মানার মতো অবস্থা আর নেই আমার। কিন্তু…আমি কি পারব ওকে ছাড়া থাকতে? নিশ্চয়ই পারব। বাবা-মাকে ছাড়া আছি না? ওকে। ছাড়া থাকা আরেকটু সহজ। পারতে হবে। যার তিনবেলা ঠিকমতো ভাত জোটে না, তার সবকিছু পারার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়।

রাফসান শিকদার
২২ মে, ২০১১

আবার একটা ভয়াবহ সময় এসে গেল। রাহি কাল জানিয়েছিল, চাল শেষের দিকে। এখন আমি কাজে চলে যাই। রাহি রান্না করে। কিন্তু বাজারের ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হবে। মাস শেষ হলে টাকা পাব। এ কদিন চলবে কীভাবে বুঝতে পারছিলাম না। আজ বাসায় ফিরে দেখি রূপ ক্ষুধায় কাঁদছে। দুই ভাইবোন সারাদিন শুধু শসা খেয়ে রয়েছে। পুরো বাগান ঘুরে দেখলাম কোনো ফল বা সবজি নেই। নদীর পাড়ে শাকও নেই এখন। আমি আর কোনো উপায় না দেখে বড় চাচাকে ফোন করে কিছু টাকা ধার চাইলাম। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন আগের টাকা শোধ না করা পর্যন্ত তিনি ধার দিতে পারবেন না। ১০ হাজার টাকা পান উনি। সেই টাকা না দিয়ে আমারও আবার চাওয়াটা উচিত হয়নি। ছোট চাচাকে ফোন করলাম। সে জানাল, মাসের শেষ এখন হাতে টাকা নেই। একশ টাকা দিতে পারবেন। গিয়ে নিয়ে আসতে। আমার কাছে ধামরাই যাওয়ার ভাড়া নেই তাই যাওয়া হলো না। ধামরাই তো দূরের কথা সাভার যাওয়ার ৫ টাকা বাসভাড়াই থাকে না। ব্যাংক টাউন থেকে প্রতিদিন সাভার হেঁটে গিয়ে চাকরি করি। তা ছাড়া একশ টাকা দিয়ে একদিনের বাজারও ঠিকমতো হবে না। আমি পুরো বাসায় আরেকটা চক্কর মারলাম। যদি কিছু পাওয়া যায়। ছাদে টব আর ড্রামের গাছ ছাড়া কিছুই আসলে নেই, যা বিক্রি করা যায়। তা ছাড়া গাছইবা কে কিনবে। তবুও আমি এলাকার যেসব বাড়িতে ছাদবাগান নেই তাদের দারোয়ান বা বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বললাম ছাদবাগান করতে চাইলে আমার গাছগুলো যাতে নেন। নার্সারির চেয়ে কম দামে দিয়ে দেব। তৎক্ষণাৎ কেউ কিছু জানাল না। বলল, পরে জানাবে। কিন্তু আমার তো তখনই টাকা দরকার!

বাসায় ফিরে দেখি রূপ পানি ওঠানোর মোটরের দিকে ইটের টুকরো ছুঁড়ে মারছে। এটা তার খেলা। তখন মনে পড়ল একবার আমাদের মোটর চুরি হয়ে গিয়েছিল সে কারণেই পরবর্তীতে বাবা মোটরটা ভেতরের দিকে লাগায়। এটা তো কোনো কাজে লাগছে না এখন। এটা বিক্রি করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে খুলে নিয়ে বিক্রি করলাম। অনেকদিন পর কিছু বিক্রি করে তিন হাজার টাকা পেলাম।

রাফসান শিকদার
২৪ মে, ২০১১

ফোনে বেশি করে টাকা ভরে মীরাকে ফোন করলাম। সবকিছু ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। কতদিন পর ওকে আমি ফোন করেছি নিজেও বলতে পারব না। এটুকুতেই মেয়েটা কত খুশি! ওর খুশি দেখে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাটা বলতে পারলাম না। অনেক রাত পর্যন্ত কথা বললাম। শুধু তাই না আমি আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম আসলে আমার কি করা উচিত? আমি কি একবার ওর সঙ্গে দেখা করব?

রাফসান শিকদার
০৩ জুন, ২০১১

আজ মীরার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা গিয়েছিলাম। অনেক শান্তি এই একটা মানুষের মাঝে। আমি যদি সপ্তাহে অন্তত একবার ওর সঙ্গে দেখা করতে পারতাম তাহলে আমার অনেক যন্ত্রণা কমে যেত। আমি অপলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ও জিজ্ঞেস করল,

এভাবে তাকিয়ে আছো যে?

তৃষ্ণা মেটাই। অনেক মাস পর দেখছি তো তোমাকে।

ভীষণ খুশি হলো মেয়েটা! কিন্তু আমার মনে ছিল, হয়তো এটাই তোমার সঙ্গে শেষ দেখা। মীরা যেহেতু আমার মনের কথাটা শুনল না তাই সে পুলকিত হলো।

দিনশেষে দুটি উপলব্ধি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

১। মীরাকে ছাড়া বাঁচা বড় কঠিন হবে।

২। মীরাকে পাওয়ার যোগ্যতা আমি হারিয়েছি।

রাফসান শিকদার
১২ জুন, ২০১১

রাহি এইচএসসি পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করেছে। ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া কত কষ্ট করে ছেলেটা পড়াশোনা করেছে। সেকেন্ড ইয়ারের পুরোটা সময় মা ছিলেন না। শেষদিকে তো বাবাও চলে গেলেন। আমিও তেমনভাবে গাইড করতে পারিনি। কিন্তু ওর রেজাল্ট রীতিমতো চমকে দিল। পড়াশোনার তল্লাতল্পি একেবারেই গুটিয়ে রেখেছে বলে আজ বললাম,

এবার পড়াশোনা শুরু কর আবার। কোচিং তো করাতে পারব না। নিজে নিজে পড়তে হবে।

রাহি সঙ্গে সঙ্গেই বলল,

আমি আর পড়াশোনা করব না ভাইয়া।

আমি চমকে বললাম,

কেন?

কাজ খুঁজছি।

আমি ওকে বোঝালাম,

তোর কাজ করতে হবে না। আমি যা বেতন পাচ্ছি তাতে তো আমাদের চলে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে একে একে গ্যাস ও ইলেক্ট্রিসিটি আনার ব্যবস্থাও করতে পারব। তোর আয় করার দরকার হবে না।

কিন্তু আমার পড়াশোনা করার মতো মন-মানসিকতা নেই ভাইয়া। এইচএসসি আমি কীভাবে দিয়েছি নিজেও জানি না। হয়তো একটা মিরাকলের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু এতদিনে বুঝে গেছি আমাদের জীবনে আচমকা বাবা মাকে হারানোই মিরাকল ছিল। এর চেয়ে বড় মিরাকল আর আসবে না।

এত ভেঙে পড়ছিস কেন? আমি তো আছি।

আমি আসলে প্রচণ্ড ডিপ্রেসড ভাইয়া। আমাকে দিয়ে পড়াশোনা কেন, কিছুই হবে না।

আচ্ছা না হলে নাই। তোকে কাজ খুঁজতে হবে না। তুই বাসায় থেকে রূপকে রাখবি, রান্না করবি। দুজন মিলে কাজ করলে রূপকে কে দেখবে।

রাহি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল,

 ভাইয়া মা কি আর কোনোদিন ফিরবে না?

রাফসান শিকদার
২৭ জুলাই, ২০১১

***

শেষ পর্যন্ত মীরাকে বলেই ফেললাম এই সম্পর্কটা আমাদের আর আগানো উচিত না। মুহূর্তেই মীরা পাগল হয়ে গেল। কান্নাকাটি করে একাকার অবস্থা। যতকিছুই বোঝাই না কেন সে কিছু বুঝতে নারাজ। বারবার একই কথা,

রাফি তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব, যা বলবে তাই করব। আমাকে ছেড়ো না।

বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করো মীরা। আমি তোমাকে শখে ছাড়ছি না। এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

ভবিষ্যৎ আছে। আমার বাসায় না মানলে আমি পালিয়ে যাব।

অসম্ভব। আমার বোন যদি কারো সঙ্গে পালিয়ে যায় আমি মনে হয় মরেই যাব। তাই অন্যকারো বোনকেও আমি ভাগিয়ে আনব না।

আচ্ছা পালাব না। আমি যেভাবে হোক ম্যানেজ করব।

তুমি কেন আমার সঙ্গে থাকতে চাচ্ছ মীরা? আমার সঙ্গে তো তুমি ভালো নেই।

খুব ভালো আছি। কে বলেছে ভালো নেই? আচ্ছা আমি তোমার বিষয়ে নানা ধরনের অভিযোগ করেছি বলেই তো এসব বলছো? আর কখনো কোনো অভিযোগ করব না। সপ্তাহে একবার ফোন না করলেও কিছু বলব না। আমার ফোন না ধরলেও কিছু বলব না। দেখা না করলেও কিছু বলব না।

মীরার কণ্ঠে আকুতি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

তুমি বুঝতে পারছ না মীরা!

আমি বুঝতে পারছি। তুমি বুঝতে পারছ না। তোমাকে আমি প্রোপোজ করিনি তুমি আমাকে করেছে। আমি প্রেম-ভালোবাসা বুঝতাম না। তুমি আমাকে বুঝিয়েছো। তুমি শিখিয়েছে। এখন কীভাবে আমাকে মাঝসমুদ্রে ফেলে চলে যাওয়ার কথা বলতে পারছো?

সব স্বীকার করছি। তোমার প্রত্যেকটা কথা সত্য। কিন্তু পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে। আমি যদি তখন আজকের পরিস্থিতিতে থাকতাম তাহলে কখনোই তোমাকে প্রেম বোঝাতে যেতাম না।

আমি কিছু জানি না। কিছু জানি না। কিছু জানি না।

মীরা উভ্রান্তের মতো আচরণ করছে। এত কান্না আমি আর নিতে পারছি না। কোনো উপায় না দেখে বললাম,

আচ্ছা এসব বাদ। আপাতত শান্ত হও।

আমি শান্ত হব না। আমি মরে যাব তবু শান্ত হব না।

কেন শান্ত হবে না? ভালোবাসি না তোমাকে?

মীরা শান্ত হলো বটে। কিন্তু আমি হলাম দিশেহারা। কূল-কিনারা খুঁজে না পাওয়া এক ব্যর্থ নাবিক।

.

আমার কথা শেষ হলে রাহি এসে বলল,

খুব ভুল করছিস কিন্তু ভাইয়া।

বুঝতে পারলাম ও আমার কথা শুনতে পেয়েছে। বললাম,

এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

ভালোবাসা এত হিসাব করে চলে?

তুই এত বড় বড় কথা বলিস না। আসছে ভালোবাসাবিদ।

আমার কেউ থাকলে আমি কখনোই এমন করতাম না।

নেই তো বেঁচে গেছিস। থাকলে বুঝতি। রাহি যা তো এখান থেকে।

আমি যাব না। একটা মেয়েকে তুই এভাবে কষ্ট দিবি? ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নাহয় তখন দেখা যাবে।

তখন কষ্ট আরো বেশি হবে। যে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই সেটা বয়ে বেড়ানো কোনো মানে হয় না। শুধু শুধু মায়া বাড়ানো।

এভাবে তোরা সুখী হবি ভাবছিস?

হব। মীরাও হবে। হা প্রথমে কষ্ট পাবে এরপর একদিন সয়ে যাবে। প্রতিদিন তিলে তিলে কষ্ট পাওয়ার থেকে একবারে কষ্ট পাওয়া ভালো। ও আমার সঙ্গে ভালো নেই।

খুব ভুল করছিস ভাইয়া। এই খারাপ সময়টাতে তোর উচিত ওকে আঁকড়ে ধরে থাকা।

সেটা স্বার্থপরতা।

রাহি আর কথা বাড়াল, চলে গেল। অর্থাৎ এই যুক্তির পর ওর আর কিছু বলার নেই।

রাফসান শিকদার
০৫ আগস্ট, ২০১১

মা কোথায় তুমি? আমার বিশ্বাস তুমি বেঁচে আছো। বেঁচেই যদি থাকো তো ফিরে আসো মা। প্লিজ ফিরে আসো। আমি আর পারছি না।

রাফসান শিকদার
১২ আগস্ট, ২০১১

মীরাকে আরো কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দেব। এ ছাড়া উপায় নেই আসলে। তার আগে শেষবারের মতো মীরাকে দেখতে ঢাকা গেলাম। আজ সারাদিন ছিলাম ওর কাছে। সবকিছু ওর ইচ্ছেমতো করেছি। আমাকে এত দীর্ঘ সময় কাছে পেয়ে ও খুব খুশি ছিল। চলে আসার আগে খোলা রাস্তাতেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম, শেষবারের মতো! এই সুযোগ তো আর কোনোদিন আসবে না। কোথায় আছি কীভাবে আছি, লোকে দেখলে কী ভাববে সেসব ভাবনার বাইরের কোনো জগতে ছিলাম তখন। যে জগতে বাকি জীবনের জন্য তখনকার অনুভূতি আর স্পর্শগুলোকে জমা করছিলাম, শেষবারের মতো!

রাফসান শিকদার
১৯ আগস্ট, ২০১১

প্রতিদিন রাত হলে মীরাকে ফোন করতে ইচ্ছে করে। এতদিনের অভ্যাস, এত সহজেই ছাড়া যায় না। আমি সিম খুলে রেখেছিলাম। প্রতিদিন ফোনটা হাতে নিই। তীব্র ইচ্ছে হয় সিম ঢুকিয়ে ওকে একটা ফোন করি। পরক্ষণেই মনে হয় কত কষ্টে এই কঠিন কাজটা করেছি। একটা ফোনেই আবার সব এলোমেলো হয়ে যাবে। সিমটা ভয়ানক বিপজ্জনক। তাই ওটাকে দু-টুকরো করে জানলা দিয়ে নদীতে ছুঁড়ে ফেললাম। ফোনটা বিক্রি করতে দিতে হবে। এটা থাকলে এই ইচ্ছে হতেই থাকবে। ফোন আমার জন্য জরুরি কিছু না।

রাফসান শিকদার
২৪ আগস্ট, ২০১১

এই কয়মাসে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। তার সঙ্গে মোবাইল বিক্রির টাকা ভরে গ্যাস আনার ব্যবস্থা করলাম। রাহির লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে অনেক কষ্ট হতো। যাক মোবাইল বিক্রির টাকাটা একটা ভালো কাজে লাগল।

রাফসান শিকদার
৩০ আগস্ট, ২০১১

আচ্ছা কেমন আছে মীরা? খুব কি ছটফট করছে? নাকি এতদিনে কিছুটা শান্ত হয়েছে?

হে আল্লাহ! ওর ভেতরের সব অস্থিরতা তুমি আমাকে দাও। আমার যদি বিন্দুমাত্র শান্তি থাকে সেটুকু তুমি ওকে দিয়ে দাও। ওকে তুমি ভালো রেখো।

রাফসান শিকদার
০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১

আমাদের গলির এক বাড়িওয়ালা আমার ছাদের গাছগুলো কিনে নিলেন। অভাবে পড়ে কতকিছু বিক্রি করলাম কিন্তু এই প্রথম কিছু বিক্রি করার সময় হারানোর তীব্র কষ্ট অনুভব করলাম। গাছগুলো আমার সন্তানের মতো ছিল। বেশির ভাগ ফলের গাছ ছোট কলম থেকে এতবড় করা। ফুলগাছগুলো বেশির ভাগ বীজ বা নার্সারি থেকে আনা পাঁচ-ছয় ইঞ্চি ছোট চারা থেকে করা। ভালো হয়েছে বিক্রি করে দিয়েছি। গাছের মেডিসিন, খাবার এটা সেটা কত খরচের ব্যাপার। তার ওপর এখন গাছের যত্ন নেয়ার মতো সময় আমার হাতে থাকে না। যেগুলো উঠানের মাটিতে করা সেগুলো তো রইলই। এগুলো যেহেতু টবে বা ড্রামের সীমিত মাটিতে করা তাই যত্ন না পেলে ধীরে ধীরে মরে যাবে। মরে যাওয়ার চেয়ে অন্যের বাড়ি আলোকিত করুক যেমনি করে মীরাও একদিন অন্যের বাড়ি আলোকিত করবে!

রাফসান শিকদার
১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১

***

কিছু মুরগির বাচ্চা কিনে এনেছিলাম। রূপের খুশি আর দেখে কে! এখন বাচ্চাগুলো বেশ বড় হয়েছে। রাহির গাছের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না থাকলেও মুরগির ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখা গেল। রূপ-রাহি দুজনেই মুরগির আদর যত্ন করে। চাইলে এখন এদেরকে খাওয়া যায় কিন্তু রূপ তাদের খেতে নারাজ। রাহি আবার খেতে আগ্রহী। সে নাকি খাওয়ার উদ্দেশ্যেই এতদিন লালনপালন করেছে। এই নিয়ে দুই ভাইবোনের নিত্য কলহ। তবে সেই কলহ আবার আমি বাড়িতে না থাকলে হয় না। আমাকে দেখলেই রাহি একটু ছোট হয়ে যায়, রূপ একটু বড় হয়ে যায়। আহারে মায়া!

রাফসান শিকদার
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১

মাঝেমাঝে আমি একটা কাজ করি। রাহির কাছ থেকে ওর মোবাইলটা ধার এনে আমার মেমোরি কার্ড ভরে মীরার সঙ্গে কল রেকর্ডিংগুলো শুনি। ওর কণ্ঠস্বর শুনলে পরম শান্তি মেলে। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই মনে হলো এটাও এক ধরনের স্বার্থপরতা। আমি জানি মীরার কাছে আমাদের কোনো কল রেকর্ডিং নেই। কারণ কলরেকর্ড করার অপশন ওর ফোনে নেই। ও মন চাইলেই আমাকে শুনতে পাচ্ছে না, অথচ আমি শুনছি। স্বার্থপর আমি। সঙ্গে সঙ্গে মেমোরি কার্ড খুলে যত্ন করে তুলে রাখলাম। আর কখনো শুনব না। ওকে যতটা কষ্ট দিয়েছি। তা আমাকেও ভোগ করতে হবে।

রাফসান শিকদার
০৪ অক্টোবর, ২০১১

আরে বকুল? অনেকদিন পর তোকে লিখছি। তোর দিনকালের খবর কী? এতদিন একা একা বোর হচ্ছিলি? আমি ব্যস্ততার কারণে এতদিন তোকে লিখতে পারিনি। দোকানে ওভারটাইমের কাজ করে ফিরতে দেরি হয়ে যেত। কোনোরকমে দুটো ভাত গিলে ঘুমিয়ে পড়তাম। রূপকেও সেভাবে সময় দিতে পারিনি। কিছু টাকা বাড়তি এসেছে অবশ্য। তবে ইচ্ছে করে যে করেছি তাও না। উপায় ছিল না বলেই করেছি। কিন্তু ব্যাপারটা ভালো। ব্যস্ততা যত বেশি মীরার স্মৃতির জ্বালাতন তত কম। আচ্ছা কেমন আছে মীরা? ওর কোনো খবর জানিস?

রাফসান শিকদার
০৯ এপ্রিল, ২০১২

টগর আমাকে প্রপোজ করেছে। ব্যাপারটা আগেই বুঝেছিলাম আর তাই সবসময় তাকে এভয়েড করে গেছি। অবশেষে বলেই ফেলল। একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। এই সুযোগে আমিও তাকে বোঝাতে পারলাম আমার পক্ষে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব না। সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল ঠিক তখন আমি তাকে মীরার কথাও বললাম। মীরাকে তীব্রভাবে ভালোবাসা সত্বেও দূরে সরে গেছি এ কথা শুনে সে কিছুটা আঁতকে উঠল বটে। আশা করছি এরপর থেকে সে আমাকে আর বিরক্ত করবে না।

রাফসান শিকদার
১৩ মে, ২০১২

সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ শুকরিয়া, তিনি আমার মাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। মায়ের কাছে জানতে পারলাম, তিনি অ্যাক্সিডেন্ট করে এতদিন কোমায় ছিলেন। যেহেতু বাবা-মায়ের বিয়ে নানাবাড়িতে মেনে নেয়নি তাই আমাদের কারো ফোন নাম্বার তাদের কাছে ছিল না। অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে মায়ের ফোনও পাওয়া যায়নি তাও তারা কেউ যোগাযোগ করতে পারেনি। মা সুস্থ হয়ে বাবার এবং আমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে রাহির নাম্বারে ফোন করলেন। আজ অনেকদিন পর এই প্রথম আমার মনে হলো আমি বেঁচে আছি। কিন্তু সেই অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হলো না যখন মা বাবার কথা জানতে চাইলেন। বাবার ফোন বন্ধ কেন জিজ্ঞেস করলেন। আমি কথা বলতে পারছিলাম না। মা আবার জিজ্ঞেস করলেন,

কথা বলছিস না কেন? তোর বাবার ফোন বন্ধ, তোর ফোন বন্ধ। একমাত্র রাহিকে পেলাম। সবাই মিলে ফোন বন্ধ করে রেখেছিস কেন?

আমি কোনোমতে বললাম,

মা তুমি ফিরে এসো। এরপর সব বলছি।

মা কিছু বুঝতে পারলেন কি না জানি না। সে হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন,

রাফি তোর বাবা কোথায়? কী হয়েছে তার? সুস্থ আছে তো?

রাহি বারবার ইশারা করছে যেন না বলি। ওদিকে মা বারবার জিজ্ঞেস করছে। সত্যিটা যত কষ্টেরই হোক না কেন বলতে তো হবেই। আমি নিঃশ্বাস আটকে বলে ফেললাম,

বাবা আর বেঁচে নেই মা।

মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। পাগলের মতো নানা প্রলাপ বকতে শুরু করলেন। আমার কঠিন মা এই প্রথম আমার সামনে কাঁদছে-অথচ কি অভাগা আমি কোনো সান্ত্বনাবাণী আমার জানা নেই। আমি আর কোনো কথাই বলতে পারলাম না। চুপচাপ মায়ের কান্না শুনতে লাগলাম। নিজেকে বড় অসহায় লাগল। এরচেয়ে কঠিন সময় সম্ভবত আমার জীবনে এর আগে আসেনি।

রাফসান শিকদার
৩০ জুন, ২০১২।

মায়ের কাছে বাংলাদেশে আসার মতো টাকা নেই। মামাদের টাকা-পয়সাতে মায়ের চিকিৎসা হয়েছে। তাদের পক্ষেও মায়ের আসার খরচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মা পাগল হয়ে গেছেন দেশে ছুটে আসবার জন্য। বাবা মাকে ছাড়া আমরা তিন ভাই-বোন কীভাবে বেঁচে আছি সেই চিন্তায় মা অস্থির। আরো বেশি অস্থির হয়েছেন রূপের জন্যে। রূপ মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় প্রথম কথাটাই বলেছে,

মা তুমি মরে যাওনি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি মরে গেছে। আর যে আসো না তাই। জানো মা? বাবা মরে গেছে। আমাদের কাছে আর আসে না। আমি কত কাঁদি তবুও আসে না। তোমার জন্যও কাদি। তুমি তো মরে যাওনি। তুমি চলে আসো না প্লিজ?

এমন কথা শুনলে কোনো মায়ের পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব না। আমার মাও ছিল না। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি বিক্রি করে মাকে দেশে আসার জন্য টাকা পাঠাব। এছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। বাবার অনেক শখের বাড়ি আমি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারই ভালোবাসার স্ত্রী-সন্তানদের এক করার জন্য। কেন নিয়েছি সেটাও নিশ্চয়ই তিনি জানেন। নিশ্চয়ই তিনি মনে কষ্ট পাবেন না।

রাফসান শিকদার
০২ জুলাই, ২০১২

খুব ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছি। বাড়ি বিক্রি করে মাকে টাকা পাঠিয়েছি। বাকি টাকা ব্যাংকে রেখেছি। আমরা আপাতত ধামরাইতে একটা বাসা ভাড়া করে সেখানে উঠেছি। প্রথমে ব্যাংক টাউনে বা সাভারে বাসা নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু খুঁজে দেখলাম ওসব এলাকায় বাসাভাড়া অনেক বেশি। তাই ধামরাইতে বাসা নিলাম। এখানে বাসাভাড়াও কম আবার আমার প্রতিদিন সাভারে কাজে যেতেও খুব একটা সুবিধা হবে না। মাত্র ঘণ্টাখানেকের রাস্তা।

ব্যাংক টাউনের বাড়ির উঠানে আমার কত বছর ধরে লালনপালন করে বড় করা গাছগুলো ফেলে আসতে হলো। রাহি-রূপের পালা মুরগিগুলো বিক্রি করে দিতে হলো। কিন্তু কোনো কিছুতেই আমাদের এখন কষ্ট হচ্ছে না। এখন আমাদের হৃদয়ভরা আনন্দ। আমরা আমাদের মাকে ফিরে পেয়েছি যে!

রাফসান শিকদার
২৭ জুলাই, ২০১২

***

আজ মা এসেছেন। রূপ-রাহি দুজন দুদিক থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। মাও কাঁদছিলেন। আমি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি কিন্তু হেসেছি। আজকে তো আসলে কান্নার দিন নয়, আজ আনন্দের দিন। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন আজ।

খুব ইচ্ছে করছিল আমিও মাকে একটু জড়িয়ে ধরি। কিন্তু বড় হয়ে গেছি তো, লজ্জা লাগছিল। মায়ের মন বোধহয় তা বুঝল। তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি যেতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

আমার সোনার ছেলে। কীভাবে তুই সব সামলেছিস বাবা! আমি হলে একদম পারতাম না।

চোখদুটো ভিজে এলো। কিন্তু লুকিয়ে ফেললাম।

রাফসান শিকদার
১৯ আগস্ট, ২০১২

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মায়ের মুখটা দেখি। প্রতিদিন বাসায় ফিরে মায়ের হাতের রান্না খাই। এত সুখ এখনো আমার জন্য বাকি ছিল ভাবতেও পারিনি। এখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে। বেঁচে থাকাতেও এখন দারুণ আনন্দ। শুধু যদি মীরাও থাকত তাহলে ষোলোকলা পূর্ণ হতো!

রাফসান শিকদার
২৬ আগস্ট, ২০১২

মা আমাকে অনেকবার বলে ফেলেছেন বাড়ি বিক্রির বাকী টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা শুরু করতে। কারণ আমার যে আয় তাতে বাসাভাড়া-সংসার সবকিছু চলে না। ওই টাকা থেকে খরচ করতে করতে দিনদিন টাকাগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে কোনো ব্যবসার আইডিয়া নেই। তাছাড়া ব্যবসা বুঝিও না। আমার মনে হয় ওই টাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনলে ভালো হবে। থাকার জায়গার চিন্তা না থাকলে শুধু খাওয়া জোটাতে পারলেই হবে। তবে আমার মা কঠিন জিনিস। আমি জানি তিনি চেষ্টা করলেই আমাকে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবেন। কিন্তু আমি কেন যেন সাহস পাই না, টাকাটা যদি মার যায়?

রাফসান শিকদার
০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

কেমন আছিস বকুল? অনেকদিন কথা বলতে পারিনি তোর সঙ্গে। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। মাসখানেক হলো ব্যবসা শুরু করেছি। এখনো সবকিছু সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারিনি। ব্যবসা তেমন বড়সড় কিছু না। সাভারে একটা কম্পিউটারের দোকান দিয়েছি। এই এক জিনিস ছাড়া তেমন নলেজ তো আমার নেই। তাছাড়া দোকানে কাজ করে করে দোকান চালানোর একটা ধারণা পেয়েছি। তাই ভাবলাম এই ব্যবসাই করা যাক। আমি ব্যবসা না করলে মা নাকি চাকরি করবেন। এই বয়সে মাকে আর কষ্ট দিতে চাই না। তাই আমিই সাহস করে শুরু করলাম।

আমি আর মা দুজন মিলে রাহিকে আবার পড়াশোনা করার জন্য রাজি করিয়েছি। মা চেষ্টা করছিলেন আমিও যাতে আমার বাকি পড়া শেষ করি। গ্র্যাজুয়েট হওয়াটা আর মাত্র দুবছরের ব্যাপার। যদি পারতাম তবে আবারও মীরার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। আবারও স্বপ্ন দেখতাম ওকে নিয়ে। আমি নিশ্চিত ও এখনো আমাকে ভুলতে পারেনি। কিন্তু ব্যবসা বা চাকরি করে আবার ঢাকা গিয়ে এসে পড়াশোনা করাটা আসলে আমার পক্ষে সম্ভব না। তুই ভাবতে পারিস মীরাকে ভালোবাসার জোরেই তো আমার পারা উচিত। কিন্তু বিশ্বাস কর এটা কেবলই আবেগের কথা। অত আবেগ যে আমার নেই। আমি একা মানুষ ছোট একটা ব্যবসা শুরু করেছি। ব্যবসা দাঁড় করাতে দিন রাত ১৪-১৫ ঘণ্টা সময় দিতে হচ্ছে। কর্মচারী দিয়ে পুরো ব্যবসা চালানোর মতো ক্ষমতা বা সামর্থ্য কোনোটাই আমার নেই। পড়াশোনা কখন করব বল তো? রাহি আমি দুজন মিলে ব্যবসা করব? রাহি তো ব্যবসার কিছুই বোঝে না, আগ্রহও নেই। শেষে দুজনের একজনেরও পড়াশোনা হবে না। ব্যবসাটাও হবে না। থাক না মীরা সারাজীবন অধরা হয়েই। কোনো মানুষেরই জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। মীরাও আমার জীবনের সেই অপূর্ণ স্বপ্ন!

রাফসান শিকদার
০৪ নভেম্বর, ২০১২

আজ ৭ নভেম্বর, মীরাকে ভালোবাসার তিন বছর। ভালোবাসার দিন বেশিই হবে। কিন্তু এই দিনে আমাদের প্রেম হয়েছিল। প্রথম বছর আমি এই দিনটি মনে রাখতে পারিনি বলে মীরা ভীষণ মন খারাপ করেছিল। তারিখ মনে রাখা আসলে আমার কর্ম নয়। তবে আজকের দিনটা কীভাবে যেন আমার মনে আছে। মীরা যদি জানতো তাহলে কি খুশি হতো?

আচ্ছা মীরার কি মনে আছে আজকের দিনটা? কিংবা আমাকে? হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়লে ওর কেমন লাগে? কষ্ট পায়? নাকি ছাড়াছাড়ির এক বছর তিন মাসে স্মৃতি কিছুটা ঝাপসা হয়েছে? আমার কোনো স্মৃতিই ঝাপসা করতে পারেনি এই এক বছর তিন মাস। প্রচণ্ড খরায় মাটি ফাটার মতো করে বুক ফাটায় এই স্মৃতি! কিন্তু আমি মনেপ্রাণে চাই মীরার স্মৃতি ঝাপসা হোক। বুক ফাটার কষ্ট ওর

হোক। তুলোর মতো কোমল মেয়েটা সইতে পারবে না।

রাফসান শিকদার
০৭ নভেম্বর, ২০১২

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *