১. হাওয়াই মিঠাই বইটির অংশ

শিকদার সাহেবের দিনলিপি – মৌরি মরিয়ম

উৎসর্গ

আমাদের জীবনের পরিক্রমায় এমন কিছু মানুষ আসে, যারা সবসময় নিঃস্বার্থভাবে পাশে থাকেন। যারা আনন্দের সময় হাসির শব্দ বাড়ানোর সঙ্গী হন। বিপদের সময় ঢাল হন। অচেনা পথে বিপজ্জনক পথচারী চেনান। যারা নিজের কাজে আপনার মতামত নিয়ে আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ বুঝিয়ে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়ান। অনুপ্রেরণা জোগান আপনার প্রতিটি নতুন কাজে। তেমনই একজন প্রিয় বড় ভাই, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, লেখক সাদাত হোসাইন।

.

ভূমিকা

শিকদার সাহেবের দিনলিপি বইটি মূলত হাওয়াই মিঠাই বইটির একটি অংশ। হাওয়াই মিঠাইতে একটি ডায়েরির কথা উল্লেখ ছিল কিন্তু ডায়েরির ভেতর কী লেখা-তা পাঠক জানতে পারেনি। সেই ডায়েরিটি নিয়েই আবর্তিত হয়েছে এই বইটির গল্প।

বইটি লিখতে লিখতে এক পর্যায়ে আমার মনে হচ্ছিল। আমি একজন পুরুষ এবং আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমি লিপিবদ্ধ করছি। বইটি আসার কথা ছিল জুলাইতে। কিন্তু শিকদার সাহেবের জীবনের কঠিন সময়টা লিখতে গিয়ে তার হতাশা-বিষণ্ণতাগুলো এমনভাবে আমার ভেতর ঢুকে যায় যে আমি লেখায় অনেক পিছিয়ে পড়ি। সারা দিন-রাত আমার বিষণ্ণতায় কাটত, কিছুই ভালো লাগত না। অনেক মাস এভাবে কেটে যাওয়ার পর যে মুহূর্তে আমি বিষয়টি অনুধাবন করতে পারলাম তখন থেকে আবার নিজেকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে লেখা শেষ করি। পাঠকদের এতদিন অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করছি, হাওয়াই মিঠাই ভক্তদের এই বইটি কিছু বিশেষ অনুভূতি দিতে পারবে।

মৌরি মরিয়ম
খিলগাঁও, ঢাকা।

***

একটা চার বছর বয়সী বাচ্চাকে লিচু ছিলে খাওয়ালে কোন মহাকৰ্ম অনিষ্ট হবে মীরা বুঝতে পারে না। চার বছর বয়স নাকি নিজের হাতে লিচু ছিলে খাওয়ার। জন্য যথেষ্ট। বেশ কিন্তু যদি লিচুতে পোকা থাকে আর সেটা না বুঝে মেয়ে খেয়ে ফেলে? যদি বিচি গিলে ফেলে? রাফির সঙ্গে তার পাঁচ বছরের সংসার। এই পাঁচ বছরে তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কখনো সংকটজনক কোনো ঝগড়া হয়নি। কিন্তু তাদের একমাত্র মেয়ে হিমিকে নিয়ে ঝগড়া হয়েছে হাজারও বার। এই লিচু ছিলে খাওয়ানো নিয়ে এক চোট হয়ে গেল আজ সকালে। রাফি তার মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী করে বড় করতে চায়। খুবই ভালো কথা, মীরাও তা চায়। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে রাফি অতিরিক্ত করে ফেলে। হিমিকে নিজের হাতে খেতে হবে। মাছ বেছে দেয়া যাবে না, ভাত মেখে দেয়া যাবে না। অদ্ভুত কথা! নিজে নিজে মাছ খেতে গিয়ে যদি গলায় কাটা বিঁধে? এই চিন্তাগুলো কি রাফির মাথায় নেই? নাকি সব চিন্তা আল্লাহ কেবল তার মাথায় দিয়ে রেখেছে। অথচ মেয়েকে দেখো-কেমন বাবা অন্তপ্রাণ!

বৃষ্টি হওয়ার কারণে রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। যেখানে মীরা সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসে, সেখানে আজ ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল। তার মেজাজ খুবই খারাপ ছিল। অফিস থেকে ফিরে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল কারণ রাফি তখনো ফেরেনি। আসুক যখন ইচ্ছা। একেবারে অনির্দিষ্টকালের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দেবে।

.

মীরা ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলো। তার শাশুড়ি সালওয়া তখন ডাইনিংয়ে বসে রূপ ও হিমিকে পড়াচ্ছিলেন। রূপ মীরার একমাত্র ননদ, ক্লাস টেনে পড়ে। মীরা শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল,

মা চা খাবেন? বানাব?

সালওয়া চওড়া হাসি দিয়ে বললেন, বানাও।

রূপ বলল, ভাবি আমিও চা খাব।

ফুপির কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিমি বলল, মা আমিও চা খাব।

মীরা কিছু বলার আগেই সালওয়া বললেন, একি দাদু? বাচ্চারা চা খেলে কী হয় ভুলে গেছো?

হিমি দাঁতে জিভ কেটে বলল, এহহে দাদু এক্কেবারে ভুলেই গেছিলাম!

এরপর মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি চা খাব না মা। আমাকে আবার দিও না।

মীরা মুচকি হেসে চা বানাতে গেল। জয়েন্ট ফ্যামিলির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে। বাচ্চা লালন-পালন করা বা শাসন করার দায়িত্ব একা বাবা মায়ের ওপর থাকে না। দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুপু সবাই কোনো এক অদৃশ্য নিয়মেই নিজেদের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়। আর মীরা তো খুবই ভাগ্যবতী তার শাশুড়ির কারণে। এমন বুঝদার মানুষ হয় না। মীরার কাছে সে এক জাদুর বাক্স। সব সমস্যার সমাধান সেই জাদুর বাক্সটাতে রয়েছে!

মীরা শাশুড়ি ও রূপকে চা দিয়ে নিজের এবং দিয়ার চা নিয়ে দিয়ার ঘরে নক করল। গল্প করে কিছুটা সময় কাটুক। মীরার একমাত্র দেবর রাহি। রাহির স্ত্রী দিয়া। রাহি চা খায় না কিন্তু দিয়াকে কখনো চায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে হয় না। রাহির ফিরতে বেশ রাত হয় কিন্তু আজ আগেই ফিরেছে। ওকে ঘরে দেখে মীরা আর ভেতরে ঢুকল না। রাহি বলল,

ভাবি ভেতরে এসো।

মীরা হেসে বলল,

না না ভাইয়া, আমার কাজ আছে। দিয়ার চা দিতে এসেছিলাম।

দিয়া চা নিতে নিতে বলল,

ভাবি তুমি সারাদিন অফিস থেকে ফিরে কষ্ট করে চা বানাতে গেলে কেন? রাফি ভাইয়া এলেই আমি সবার জন্য চা করতাম।

তাতে কী? একজন করলেই তো হলো। রাফির বোধহয় দেরি হবে তাই করে ফেললাম।

চা দিয়ে মীরা বেরিয়ে এলো। শাশুড়ির কাছে একটু বসবে সেই উপায়ও নেই। ওকে পেলে রূপ হিমি দুজনেরই আহ্লাদ শুরু হয়ে যায়। কেউই ঠিকমতো পড়াশোনা করে না। অন্যদিন সন্ধ্যার পর তার সময়টাও রাফির সঙ্গেই কাটে। অথচ আজ রাফি নেই, অমনি সবকিছুতে বিষাদ শূন্যতা। সারাদিনের রাগ ভুলে রাফিকে ফোন করল। কিন্তু রাফি ফোন না ধরে কেটে দিল। ফোন কাটার সঙ্গে অটো সেভ করা ব্যস্ততার মেসেজটা এলো। মীরার খুব অভিমান হলো। আর ফোন দেবে না সে। এমনকি রাফি ফেরার পর একটি কথাও বলবে না আজ রাতে আর। বরং কিছু কাজ করে সময় কাটানো যাক। সালওয়া মীরার বাতিল করা জামাকাপড়গুলো চেয়েছিলেন। সবার বাতিল কাপড়গুলো একসঙ্গে গ্রামে পাঠিয়ে দেবেন। মীরা তার বাতিল জামাকাপড়গুলো পরিত্যক্ত ব্যাগে ভরে বাথরুমের ওপরের ফলস ছাদে রেখেছিল। সেগুলো নামিয়ে দেয়া একটা জরুরি কাজ। আলসেমি করে নামানো হচ্ছে না। রাফিকেও বলতে মনে থাকে না। পরমুহূর্তেই ভাবল, সে রাফিকে দিয়ে নিজের কোনো কাজ আর করাবে না। নিজের কাজ নিজেই করবে। এখন থেকে রাফির সঙ্গে লেনদেন কমিয়ে ফেলতে হবে। ওর ওপর এত নির্ভরশীল হলে চলবে না। চেয়ার টেনে নিয়ে তার ওপরে টুল দিয়ে মীরা ওপরে উঠল। কিন্তু বিধি বাম কাপড়ের ব্যাগটা টান দিতেই সেটার ধাক্কা লেগে একটা ছোট সাইজের চটের বস্তা পরে গেল নিচে। আর সেটার ভেতর থেকে কিছু একাডেমিক পরিত্যক্ত বইপত্র, ম্যাগাজিন বেরিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সারাঘর হলো। উফ রাফির কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? এসব কেজি দরে বিক্রি করে দিলেও তো পারে। ঘরের আবর্জনা সাফ হয়। এখন এক কাজ করতে গিয়ে আরেক কাজ বাড়ল। কাপড়ের ব্যাগটা নিচে ফেলে নেমে এলো মীরা। বইগুলো গোছাতে গোছাতে খেয়াল করল বইগুলো কম্পিউটার সাইন্সের! হঠাৎ মায়া হলো মীরার। আহারে রাফি পড়ালেখা ছাড়লেও কম্পিউটার সাইন্সের বই পড়েছে! পরম মমতায় বইগুলো গুছিয়ে রাখল মীরা। সঙ্গে কিছু ডায়েরিও ছিল। একটা ডায়েরি ওপর থেকে পড়ার সময়েই খুলে পড়েছে। সেই ডায়েরির খোলা পাতার লেখাটায় চোখ আটকে গেল মীরার। কোথাও কোথাও কালি ছড়িয়ে গেছে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা…

মীরা আমার কাছে মরে গেছে। কিন্তু নামটা পিছু ছাড়ছে না। জীবনের প্রথম একটা টিউশনি জুটল, ছাত্রীর নাম মীরা, তাই টিউশনিটা আর করা হলো না। এমনিতেও আমার দ্বারা টিউশনি হবে বলে মনে হয় না। রাস্তায় মেয়েরা হেঁটে যায়, একজন আরেকজনকে ডাক দেয় মীরা বলে। সেদিন দেখি, ইউনিভার্সিটির পাশে একটা নতুন টি স্টল হয়েছে, নাম মীরা টি স্টল। আজ রং নাম্বারে একটা কল এলো। সেই মেয়ের নামও মীরা। বেচারি মিষ্টিকণ্ঠী মেয়েটা কি না নামের জন্য প্রথমেই ধমক খেল। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কে সে বলল, আমি মীরা। আসলে দুটো শব্দ শুনে কণ্ঠটা ঠাওর করতে পারিনি। এক্স মীরা ভেবে বকে ফেলেছি। দুনিয়াতে এত মীরা কেন ভাই? নাকি সব মীরা এসে আমার কাছে মরে?

রাফসান শিকদার
১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

***

মাথা ঘুরতে লাগল মীরার। ফিরে গেল অতীতের সেই দিনগুলোতে। হঠাৎ করেই রং নাম্বারে রাফিকে খুঁজে পাওয়া। নাম এক হওয়ার কারণে প্রথমদিন তাকে এক্স গার্লফ্রেন্ড ভেবে বকে দিয়েছিল রাফি। তারপর আরো কত কি! সবকিছু সেভাবেই ফেলে রেখে ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখল। ডায়েরিটা প্রায় ভরা। অনেক কিছু লেখা। কিছু পাতায় হাবিজাবি আঁকিবুকি করা। রাফি কি কাউকে না বলতে পারা কথাগুলো লিখে রাখত? রাফির সঙ্গে ৫ বছরের সংসার তবু অনেক রহস্য ভেদ করতে পারেনি সে। আর তর সইছিল না। মাঝখান থেকে কিছু পড়তে ইচ্ছে করছিল না। সে প্রথম থেকে পড়া শুরু করল।

প্রথম পাতা…

আগের ডায়েরিটা শেষ হওয়াতে নতুন ডায়েরি নিলাম। আমার সব ডায়েরির মতো এই ডায়েরিটারও একটা নাম দেয়া প্রয়োজন। না হলে কথাবার্তা বলা সহজ হয় না। কিন্তু এই মুহূর্তে নাম ঠিক করতে পারছি না। অথচ অনেক কথা জমে গেছে!

রাফসান শিকদার
১৯ জানুয়ারি, ২০০৯

তোর নাম ঠিক করেছি বকুল। কি নাম পছন্দ হয়েছে তো? গেটের ধারের বকুল গাছে আজ প্রথম ফুল ফুটেছে। তা দেখে হঠাৎ মনে হলো তোর নাম বকুল রাখা উচিত। এখন মনে হচ্ছে এরচেয়ে উপযুক্ত আর কোনো নামই হতে পারে না। যাক নাম যখন রাখা হয়ে গেছে এখন থেকে অনেক কথা হবে। এখন সময় নেই। ক্যাম্পাসে যাচ্ছি। মন খারাপ করিস না, তোকেও নিয়ে যাব। তুই পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গেই থাকবি ২৪/৭। বোঝা গেল? নে এবার ব্যাগে ঢোক।

রাফসান শিকদার
২৪ জানুয়ারি, ২০০৯

পরের পাতা…

বকুল শোন, ডায়েরি শেষ হলে মনটাই খারাপ হয়ে যায়। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ বড়সড় দেখে নিলাম তোকে। যাতে দীর্ঘদিন সঙ্গে রাখতে পারি। তুই আমার জীবনে নতুন। অনেক কিছুই জানিস না আমার সম্পর্কে। কিছু কি আগেই জেনে নিতে চাস নাকি আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে জানতে চাস? আচ্ছা আস্তেধীরেই না হয় জানলি। এত তাড়া কিসের। তুই আমার জীবনে এমন একটা সময়ে এসেছিস যখন আমি মানসিকভাবে প্রচণ্ড এলোমেলো হয়ে আছি। কেন? মীরার জন্য। সে ফিরতে চায় আমার কাছে আবার, কিন্তু আমি চাই না। মীরাকে তো চিনিস না। ছোট করে পরিচয় দিয়ে নিই। ও আমার কাজিন। বয়সে আমরা সমান। আমি কয়েকদিনের বড়। কাজিনের সঙ্গে প্রেম? জঘন্য ব্যাপার না? কিন্তু কেমন করে যেন হয়ে গেল। মনে হতে লাগল ওকে না পেলে এই জীবনের কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু বলতে পারতাম না। মেয়েরা ছেলেদের থেকে একটু অ্যাডভান্স থাকে। মীরা আবার সেই অ্যাডভান্স মেয়েদের থেকে কয়েক ডিগ্রি অ্যাডভান্স। সে নিজেই বুঝে নিল। কয়েকদিন আমাকে খুব নাচাল এরপর ধরা দিল। আমার অন্তরে তখন এই গানটা বাজত, আমার কি সুখে যায় দিন রজনী কেউ জানে না। একদম রূপকথার মতো মীরা হাসলেই আমার বুকে জোছনা ঝরত, কাঁদলেই সেই বুক ভেঙে যেত, রাগ করলে নিশ্বাস থেমে যেত। মীরা চেয়েছে আমি দিইনি এমন কিছু দুনিয়াতে নেই। চল তোকে একটা উদাহরণ দিই, তখন সবে কলেজে উঠেছি। মীরা একবার আমার ওপর ভীষণ রাগ করল। কিছুতেই রাগ ভাঙে না। আমি বললাম,

কী করলে তোর রাগ ভাঙবে?

ও বলল,

পৌষের রাতে আমাদের পুকুরে বুক পর্যন্ত নেমে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবি। আমি জানালা থেকে একটু পর পর চেক করব।

আমি সত্যিই কাজটা করলাম। এবং মীরাও সারারাত চেক করল। ভোরবেলা আমাকে চলে যেতে বললে আমি চলে গেলাম। পরদিন শরীর কাঁপিয়ে জ্বর! খবর পেয়ে মীরা আমাকে দেখতে এলো। এসে সে কি কান্না! বারবার বলছিল,

কেন তুই সত্যি সত্যি সারারাত পুকুরে ডুবে থাকলি? আমি তো রাগ করে বলেছিলাম। তাই বলে সত্যিই করতে হবে? তুই কি পাগল?

এসব আবোলতাবোল বকুনির সঙ্গে একটা বিশেষ উপহার পেয়েছিলাম। ছোট একটা চুমু। কিন্তু অনুভূতিটা বড়! আমি এসব ব্যাপারে নাদান বাচ্চা হলেও ও ছিল প্রচণ্ড লেভেলের অ্যাডাল্ট!

কী ভাবছিস বকুল? সবকিছু অতীতকালে কেন বলছি? কারণ মীরা এখন আমার জন্য অতীত। বছর চারেক আগে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে। ছাড়াছাড়ি আমি নিজেই করেছি। অবাক হচ্ছিস? যে মেয়ের জন্য আমি এত পাগল তার সঙ্গে কেন ছাড়াছাড়ি করলাম? কারণটা আজ অবধি কাউকে বলিনি। তোকেই প্রথম বলছি, মন হালকা করতে হবে। না হয় শ্বাস নিতে পারি না। ও ডাবল টাইমিং করেছে। ওর এক্সের কথা আমি আগে থেকেই জানতাম। তা নিয়ে আমার মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু আমি থাকা অবস্থায় আরো একজনের সঙ্গে প্রেম করছে-এটা মানতে পারছিলাম না। আর সেই একজন আমারই বন্ধু শিবলি। শিবলি অবশ্য জানত না মীরার সঙ্গে আমার কিছু আছে। মীরাও জানত

শিবলি আমার বন্ধু। একই এলাকায় থাকলে যা হয়, সবারই সবার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে চেনাজানা থাকে। শিবলির মুখে ওদের রসায়নের গল্প শুনলাম। মীরা আমার কাছে মাফ চেয়েছিল। সে নাকি আমাকেই ভালোবাসত। শিবলির জন্য ওর ভালোবাসা নেই। তাহলে কেন এই সম্পর্ক সেই প্রশ্ন করায় মীরা আমাকে একটা যুক্তি ছিল, দে গট ইমোশনাল। আমার মন চাইছিল মীরাকে ওখানেই খুন করে ফেলি। কিন্তু পারলাম না। শুধু সম্পর্ক ছিন্ন করে আসলাম। জানি ভালোবাসা জীবনের সবকিছু নয়। কিন্তু এই ভালোবাসাই যে আমার জীবনের সবকিছু উল্টোপাল্টা করে দিয়েছিল? আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছিল এই ভালোবাসা। না না একে তো আর ভালোবাসা বলা চলে না। এটা ছিল মন্দবাসা।

রাফসান শিকদার
০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯

পরের পাতা…

বাবা-মায়ের ভালোবাসার গল্পটা কী সুন্দর! বাবা অফিস ট্যুরে তুরস্ক গেল। এক মাসের ট্যুর। সেখানে মায়ের সঙ্গে পরিচয় এবং ভালোবাসা। মায়ের পরিবার খুশি ছিলেন না এই বিয়েতে। কিন্তু তুর্কি মা আমার বাংলাদেশি বাবার মায়া ছাড়তে পারলেন না। বিয়ে করে নিলেন। ভিসাজনিত কারণে মা বাবার সঙ্গে তখনই বাংলাদেশে আসতে পারলেন না। পরবর্তীতে একা এলেন। এরপর টোনাটুনি সংসার বাঁধলেন। আমি এই জীবনে এদের মধ্যে যে ভালোবাসা দেখেছি তা আর কারো মধ্যে দেখিনি। কিংবা কে জানে সব বাবা-মায়ের ভালো বাসাই হয়তো এমনই মিষ্টি। দূর থেকে বোঝা যায় না। কাছ থেকে দেখলেই কেবল বোঝা যায়। অথচ তাদেরই ছেলে হয়ে আমার ভাগ্যে কী জুটল! মীরা ফিরে আসতে চায়। অনেক অনুনয়-বিনয় করছে। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের মিষ্টি ভালোবাসা দেখে বড় হওয়া আমি এমন ফাটল ধরা ভালোবাসা কেন যেন মেনে নিতে পারছি না। মীরার জন্য কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয় কিন্তু ওর প্রতি সেই শ্রদ্ধাটা আর বেঁচে নেই। ওকে গ্রহণ করলেও শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া একটা সম্পর্ক নড়বড় করবে না? একটা সুযোগ কি দেয়া উচিত? এতবার যখন মাফ চাইছে? তুই কি বলিস বকুল?

রাফসান শিকদার
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯

আজ ক্লাস শেষে তপনদের বাসায় গিয়েছিলাম একটা প্রজেক্ট ওয়ার্কের জন্য। তখন দেখি তপনের বোন ত্রিশা চোখ দিয়ে ইশারা করে। চায়ের কাপ দেয়ার ছুঁতোয় হাতে হাত লাগায়। কেমন কেমন করে হাসে। কী ভয়াবহ অবস্থা! এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে আগেও এমন করেছে কিন্তু সেভাবে খেয়াল করিনি। পিচ্চি একটা মেয়ে সবে ক্লাস টেনে পড়ে এখনই অশ্লীল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এ ধরনের মেয়েরা ভয়ংকর। এরপর থেকে আর তপনের বাসায় যাওয়া যাবে না।

রাফসান শিকদার
২২ মার্চ, ২০০৯

মীরাকে আরেকটা সুযোগ দিলাম। ভুল করলাম কি না জানি না। তবে সে যখন শোধরাতে চাইছে তাকে শোধরানোর সুযোগ দেয়া উচিত। তা না হলে হয়তো সে আরো খারাপ দিকে যাবে। তার প্রতি আমার রাগ ছাড়া আর কোনো অনুভূতি ছিল না। সময় গেলে নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে মাফ করে দিলাম। কিন্তু যখনই ও আমার হাতটা ধরল, মনে হলো, আজও ভালোবাসি।

রাফসান শিকদার
০৩ এপ্রিল, ২০০৯

***

পরের পাতা…

রূপ আধো আধো বোলে কথা বলতে শুরু করেছে। আমি বাড়িতে ঢুকলেই বাইয়া বাইয়া করে ছুটে আসে। আজ বাস থেকে নামার সময় বাসের আধভাঙা দরজার কোনা উঠে থাকা টিনে লেগে হাত কেটে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে পরিষ্কার করছিলাম। আমার হাতে রক্ত দেখে রূপ কেঁদে ফেলল। ও ভেবেছে ভয়াবহ কিছু হয়েছে। কি পাগল বোন আমার! মনে হয় ওর জন্য আমি পুরো দুনিয়া একপাশে রেখে দিতে পারব। কি অদ্ভুত অনুভূতি! ও দুনিয়াতে না এলে বুঝতাম না বোনের জন্য ভাইয়ের ভালোবাসা কেমন হয়!

রাফসান শিকদার
৬ মে, ২০০৯

ইট ওয়াজ আ গ্রেট ডে উইথ মীরা। সুন্দর কিছু মুহূর্ত। বাকি কথা পরে হবে। প্রচণ্ড ক্লান্ত। ঘুমাই চল।

রাফসান শিকদার
১৪ মে, ২০০৯

কি রে বকুল, রাগ করেছিস? এতদিন কথা বলিনি বলে? একদম সময় পাচ্ছি না। রে। পরীক্ষা চলছে। তার ওপর বাসায় এলে রূপ আর ছাড়তেই চায় না দেখিস তো। এক্সাম টা দিয়ে নিই। অনেক কথা বলব তোর সঙ্গে।

রাফসান শিকদার
০২ জুলাই, ২০০৯

আই ওয়াজ রং বকুল। ভেরি ভেরি রং। ভুল করে একটা খারাপ কাজ করলে মাফ করে দেয়া যায় কিন্তু খারাপ কাজ করাটা অভ্যাস হয়ে থাকলে তাকে মাফ করা যায় না। মীরা আসলে ভুল করেনি। ওর স্বভাবটাই অমন। একই ঘটনা আবার ঘটিয়েছে। একটা নয়, দুটো নয়। বহুপ্রেম ওর। আমাকে বলে, আমি ওর সিরিয়াস প্রেম আর বাকিরা টাইম পাস। বুঝি না, আমি ওর যুক্তি বুঝি না। এবার আমি বেশি সচেতন থাকার কারণেই কি না জানি না খুব দ্রুত ধরা পড়ে গেল ও। বিশ্বাসটা ভেঙে গুড়োগুড়ো করে দিয়েছে। ভেঙে গেছি আমি নিজেও। জানি না আমি কী করব তবে মীরাকে আমার জীবনে আর চাই না। কোনোভাবেই না। আমি এখন প্রচণ্ড ডিপ্রেসড কিন্তু আমি এই ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠব দেখিস তুই। একটা বহুগামী মেয়ের জন্য মুষড়ে পড়ে থাকার মানুষ না এই রাফি। অনেক অনেক স্ট্রং সে। বিশ্বাস না হয় তো দেখিস। কে বলল কাঁদছি? চোখে ছানি পড়েছে তোর? একদম কাঁদছি না আমি। উল্টোপাল্টা কথা বললে সারাজীবনের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দেব তোর সঙ্গে। কীসের প্রথম। প্রেম? ও ছিল আমার ভুল প্রেম।

রাফসান শিকদার
১৮ জুলাই, ২০০৯

মীরা এবার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে থতমত খেয়ে গেল। কারণ পুরো একটা পাতা জুড়ে একটা কঙ্কালের স্কেচ করা। শেষের দিকে লেখা…

কিরে বকুল, ভাবছিস কঙ্কাল এলো কোত্থেকে? মীরা আমার জন্য শুধু মরেইনি। মরে কঙ্কাল হয়ে গেছে। বারবার মীরার কথা জিজ্ঞেস করিস যে তাই ওর কঙ্কাল দেখালাম। আশা করি এরপর থেকে ওর কথা আর জিজ্ঞেস করবি না।

রাফসান শিকদার
২০ জুলাই, ২০০৯।

অনেকদিন পর তোকে লিখতে বসেছি। এতদিন লিখিনি বলে রাগ করেছিস? আমার আসলে এখন লিখতে ইচ্ছা করে না। কী যে ইচ্ছা করে তাও জানি না।

রাফসান শিকদার
০১ আগস্ট, ২০০৯

‘কেন আশা বেঁধে রাখি। কেন দ্বীপ জ্বেলে রাখি।
জানি আসবে না ফিরে আর তুমি…
তবু পথপানে চেয়ে থাকি! কেন আশা বেঁধে রাখি।’

মিতালী মুখার্জির এই গানটা শুনেছিস বকুল? গানটা সদ্য বিচ্ছেদ হওয়া সকল মানুষের প্রিয় গান। আমারও বেশ পছন্দ। তবে বিচ্ছেদ হওয়ার জন্য না, অনেক আগে থেকেই। আমার ক্ষেত্রে আমি চাই না সে ফিরে আসুক। তবু সে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু আমি তাকে চাই না আর। গত চার বছরে নিজেকে অনেকটা শক্ত করে নিয়েছিলাম। তারপর যে ও কীভাবে আমাকে গলাল বুঝতেই পারলাম না। কিন্তু পুনরায় একই ঘটনা। এরপর তো আর মাফ করা যায় না। আগের মতো নরম মানুষ তো নেই আমি। এবার আর অত কষ্ট হবে না দেখিস।

ও আমার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, বাসায় আসে, ফোন করে। বারবার একই অনুনয় বিনয়। আচ্ছা বল তো ও যে এতবার আমার কাছে ফিরতে চায়, প্রতিবারই আমি ওকে রিজেক্ট করি তবু ওর লজ্জা হয় না কেন? অবশ্য লজ্জা থাকলে তো এতগুলো ছেলের সঙ্গে একইসঙ্গে…মুখে অনেক বাজে কথা আসছে। কিন্তু তুই তো জানিস বাজে কথা বলি না আমি। তাই বললাম না। আমি শুধু চাই আমার ত্রিসীমানায় যেন ওই মেয়েটা আর না আসে।

রাফসান শিকদার
০৩ আগস্ট, ২০০৯

ছাদের গাছগুলো নিড়িয়ে দিচ্ছিলাম। দুটো নতুন গাছও লাগিয়েছি। শেষ গাছটা লাগানোর সময় পাশের ছাদ থেকে একজন বলে, কী গাছ? আমি তাকিয়ে দেখি পাশের ছাদে একটা মেয়ে দাঁড়ানো। বেশ সুন্দরী। একে আগে কখনো দেখিনি। কদিন আগে ওই বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। সম্ভবত এরাই এসেছে। আমি হাফ প্যান্ট পরা ছিলাম। তা দেখা স্বত্তেও মেয়ে কোন বিবেকে আমার সঙ্গে কথা বলে? আমি যদি পাশের ছাদে একটা হাফ প্যান্ট পড়া মেয়েকে গাছ লাগাতে দেখতাম তাহলে তো চোখ নামিয়ে চলে আসতাম। কথা বলার হলে পরে বলতাম। ধুর বকুল কিসের ছেলেমেয়ে? মেয়েরা কি মেয়েদের সামনে লজ্জা পায়? ছেলেদের সামনেই তো পায়। তেমনই ছেলেরাও ছেলেদের সামনে লজ্জা পায় না, মেয়েদের সামনেই পায়। তার উচিত ছিল বিষয়টা খেয়াল রাখা। যাই হোক আমি বললাম,

টগর গাছ।

সে বলল,

সত্যি? আমি কখনো টগর গাছ দেখিনি। টগর ফুল কেমন দেখতে?

আমি বললাম,

ফুটলে দেখবেন।

সে আরো কথাবার্তা চালাতে চাচ্ছিল কিন্তু আমি নিচে নেমে আসছিলাম তখন হঠাৎ সে আবার ডাকল,

শুনুন।

আমি দাঁড়ালাম। সে বলল,

আপনাকে আগেও কয়েকদিন দেখেছি। কিন্তু আপনি কী মনে করবেন ভেবে কথা বলিনি। কিছু মনে করেননি তো?

আমি বললাম,

না।

সে বলল,

আপনার ফোন নাম্বার টা দেয়া যাবে?

দেয়া যাবে না বলে নিচে নেমে এলাম আমি। তাকে আর কিছু বলারই সুযোগ দিলাম না। দেখিস না ভার্সিটির খাতির জমাতে আসা মেয়েগুলোকে কেমন পাত্তা না দিয়ে চলি? আমি এখন খুব সাবধান বকুল। কোনো মেয়েকে কোনো চিপা চাপা দিয়েও আর ঢুকতে দেব না আমার জীবনে। সে যেই হোক না কেন, যত সুন্দরীই হোক না কেন। জীবন একটাই। এক জীবনে বারবার ভাঙা যায় না।

রাফসান শিকদার
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

***

মীরা আমার কাছে মরে গেছে। কিন্তু নামটা পিছু ছাড়ছে না। জীবনের প্রথম একটা টিউশনি জুটল, ছাত্রীর নাম মীরা, তাই টিউশনিটা আর করা হলো না। এমনিতেও আমার দ্বারা টিউশনি হবে বলে মনে হয় না। রাস্তায় মেয়েরা হেঁটে যায়, একজন আরেকজনকে ডাক দেয় মীরা বলে। সেদিন দেখি, ইউনিভার্সিটির পাশে একটা নতুন টি স্টল হয়েছে, নাম মীরা টি স্টল। আজ বিকেলে রং নাম্বারে একটা কল এলো। সেই মেয়ের নামও মীরা। বেচারি মিষ্টিকণ্ঠী মেয়েটা কি না নামের জন্য প্রথমেই ধমক খেল। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কে সে বলল, আমি মীরা। আসলে দুটো শব্দ শুনে কণ্ঠটা ঠাওর করতে পারিনি। এক্স মীরা ভেবে বকে ফেলেছি। দুনিয়াতে এত মীরা কেন ভাই? নাকি সব মীরা এসে আমার কাছে মরে?

রাফসান শিকদার
১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

বকুল, তুই আসার পর একদিনও এমন হয়নি যে একইদিনে দুবার তোকে লিখতে বসেছি। আজই প্রথম। ঘটনা হয়েছে কী শোন, সন্ধ্যার রং নাম্বারের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে ইচ্ছে করছে আবার কথা বলি। না মানে মেয়েটার কণ্ঠ অসম্ভব সুন্দর। আমার ধারণা পৃথিবীর সবচেয়ে সুকণ্ঠি বালিকা সে। অন্তত আমি এরচেয়ে সুন্দর কণ্ঠস্বর আগে কখনো শুনিনি। টিজ করছিস কেন তুই? অন্যকিছুই না ভাই। শুধু কণ্ঠ শোনার জন্যই। তুই তো জানিসই মেয়েদের প্রতি আমার সেরকম আগ্রহ নেই। যখন থেকে ছেলে মেয়ে ব্যাপারগুলো বুঝতে শুরু করেছি, তখন থেকেই আমার সবটা জুড়ে ছিল কেবল বেঈমান মীরা। আর কোনো মেয়ে সম্পর্কে কোনো আগ্রহ তৈরি হওয়ার সুযোগই হয়নি। আর ও বেইমানি করার পর থেকে মেয়েদের প্রতি একটা ঘৃণামিশ্রিত ভয় কাজ করে। না হয় আগে-পিছে কম মেয়ে কি ঘোরে? সেজন্যই বলছি, বিশ্বাস কর কেবল ওই কণ্ঠটা শুনতেই আবার ফোন করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু একটা অজুহাত তো দরকার। হুট করেই তো আর ফোন করা যায় না। কী অজুহাত তৈরি করা যায় বল তো?

আচ্ছা শোন, একটা আইডিয়া এসেছে। মেয়েটা বলেছিল ওর ফোন থেকে কে ফোন করেছে ও জানে না তবে খোঁজ নেবে। কী খোঁজ পেল সেই অজুহাতেই তো কল করা যায়। আমাকে কে ফোন করেছিল সেটা আমি জানতে চাইতেই পারি। কী বলিস বকুল?

রাফসান শিকদার
১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

মীরার সঙ্গে কথা হচ্ছে। আমি ওকে বলেছিলাম ওর সুকণ্ঠ শুনবার জন্য মাঝে মাঝে কল করব। কিন্তু এখন আমি প্রতিদিনই কল করি। মীরাও করে। আরে না বকুল, ওই মীরা না। ছোট মীরার কথা বলছি। যা বাবা এই এক নাম যে আমাকে আর কত বিপদে ফেলবে! আচ্ছা শোন, যাতে তোর আর আমার মাঝে কোনো কনফিউশন না হয় সেজন্য একটা কাজ করি। বেইমানটার নাম যে মীরা সে কথা তুই ভুলে যা। ওর ভালো নাম যেহেতু শান্তনা, ওকে আমরা এখন থেকে শান্তনা ডাকব। আর সুকণ্ঠীকে ডাকব মীরা বলে।

দেখ বকুল, তুই কিন্তু প্রচুর টিজ করছিস। আমার কথা বলার একমাত্র জায়গা তুই। তুই এমন করলে কিন্তু মীরার কথা তোকে আর বলবই না।

রাফসান শিকদার
১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

আমাদের প্রচুর কথা হচ্ছে। প্রচুর মানে প্রচুর। এখন তুই টিজ করলেও আমি আপত্তি করব না। না মানে… মনে হয় আমি একটু একটু গলে যাচ্ছি। আমি বোকা মানুষদেরকে পছন্দ করি না। কিন্তু ও বোকা হওয়া সত্ত্বেও ওকে আমার ভালো লাগে। ওর বোকামোগুলো আসলে বুদ্ধিহীনতা নয়। ও সরল তাই বোকা বোকা কথা বলে ফেলে। আর ওর এই সরলতাই আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করছে। কিন্তু একেবারেই অচেনা বলে একটু ভয় হচ্ছে। এই সবকিছু যদি ভান হয়? ভান হলে খুব কষ্ট পাব। আরেকটা খুঁতখুঁতানিও আছে মনে। ও আমার থেকে ৫-৬ বছরের ছোট। পার্থক্যটা কি একটু বেশি হয়ে গেল না? ধুর বকুল, তুই বাবা মায়ের উদাহরণ টানছিস কেন? ওদের হিসাব আলাদা। আমার ভয় হচ্ছে। প্রথমবার দারুণভাবে ঠকার পর আমি কখনো কোনো মেয়েকে আমার জীবনে আসার সুযোগ দিই না। অথচ ওকে বলতে গেলে নিজেই ডেকে এনেছি। রং নাম্বারে কল আসতেই পারে তাই বলে তার সঙ্গে খাতির জমাতে হবে? না দেখে না শুনে না চিনে কীভাবে আমি গলতে শুরু করলাম নিজেও বুঝতে পারছি না। সামনে কি কোনো ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য?

রাফসান শিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

আজ সকালে মা জানতে চাইল বাগানে কোনো তরকারি আছে কি না। আমি বললাম আছে কিন্তু এখন থেকে আমার বাগানের তরকারি রান্না করলে কিনে নিতে হবে। মা তো অবাক! কিনতে হবে কেন? আমি বললাম, আমার ইদানীং একটু টাকা-পয়সার দরকার। কোনো বাড়তি আয় তো নেই। তুমি তরকারি কিনলে আমি ফলন বাড়াব। কৃষক হব। একটা আয়ের উৎস হবে। মা আমার কথায় হেসে কুটিকুটি হলেন। হাসতে হাসতে বললেন,

দিন-রাত এত ফোনে কথা বললে টাকা-পয়সার তো দরকার হবেই।

আমিও হেসে দিলাম। মা বললেন, কিন্তু আমার স্বামীর জায়গায় যে ফসল ফলাচ্ছিস। জায়গার ভাড়া দিবি? আমি বললাম,

এটা আমার বাপের জায়গা। ভাড়া কেন দেব?

মা আবার বললেন,

আচ্ছা বুঝলাম কিন্তু সেই তরকারি যখন রান্না হবে সেটাও তো তুই খাবি। তাহলে? আমি বললাম,

তুমি তোমার ছেলেমেয়েকে কী খাওয়াবে সেটা তোমার বিষয়। আমার বাগানেরটা না পেলে তো বাজার থেকে কিনতে তাই না? এত কষ্ট করে ফসল ফলাব তার কোনো দাম পাব না?

মা খুব হাসলেন। তারপর বললেন,

আচ্ছা এখন থেকে সব কিনে নেব। বাজার দরেই কিনব। এবার বল তো মেয়েটা কে?

আমি বললাম,

নিজেও জানি না। রং নাম্বারে পেয়েছি। এখন আর কিছুই বলতে চাই না। সব ঠিকঠাক থাকলে আমি নিজেই তোমাকে জানাব। মা-ও আর চাপাচাপি করলেন না।

বুঝলি বকুল, এখন থেকে আমি আর বেকার না। এখন থেকে আমি একজন গর্বিত কৃষক। আজ মা বাগান থেকে এক হালি টমেটো, এক আঁটি লাউশাক আর কিছু কাঁচামরিচ কিনেছেন। লক্ষ্মী মা আমার-বাজারদরের থেকে একটু বেশিই দিয়েছেন। এক হালি টমেটো শুনে হাসছিস কেন? আমার কাছে তো পাল্লা-বাটখারা নেই। তাই এভাবে মেপেছি। তোর আবার মেয়েদের মতো সবকিছুতেই হাসাহাসি। থাম তো এবার। শোন কাল আরো কিছু সবজি লাগাব। প্রচুর সবজি ফলাতে হবে। কৃষক রাফির বাগান ফলে-ফসলে ভরে যাবে দেখিস। সারারাত কথা বললেও ফোনের টাকা আর ফুরোবে না। কি দারুণ ব্যাপার।

রাফসান শিকদার
১০ অক্টোবর, ২০০৯

আজ ছুটির দিন। বাবা বাজারে গিয়েছিলেন। মা তাকে দিয়ে আমার জন্য একটা উপহার আনিয়েছেন। অনুমান কর তো জিনিসটা কী হতে পারে? আচ্ছা আমি বলছি, পাল্লা আর বাটখারা। যাতে আমি সবজি মাপতে পারি। ভাবা যায়? গতকালই সিদ্ধান্ত হলো যে সবজি বিক্রি করব। মাপার জিনিস নেই বলে হালিতে বিক্রি করলাম। আর আজই মাপার জিনিস রেডি! সাধেই কি আর বলি মা আমার বন্ধু। সত্যিই আমি কত ভাগ্যবান তাই না? আমি জিনিসটা পেয়ে হেসেছি, ধব্যবাদ দিয়েছি কিন্তু বোঝাতে পারিনি কতটা খুশি হয়েছি। বাবা মাকে কতটা ভালোবাসি তাও বোঝাতে পারি না কখনো। নিশ্চয়ই তারা বুঝে নেয়, তাই না? বিশেষ করে মা। মুখ দেখেই কীভাবে যেন সব বুঝে যায়!

রাফসান শিকদার
১১ অক্টোবর, ২০০৯

***

মীরা শুধু ছোটই না, সে শিশু। তাকে সবই বোঝানো লাগে। প্রেম, ভালোবাসা, গার্লফ্রেন্ড, প্রিয়তমা, আগডুম, বাগডুম। আল্লাহ জানে ভবিষ্যতে আর কি কি বোঝানো লাগে! কি লজ্জা! কি লজ্জা! ওর এত কৌতূহল যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে। যেন আমি সবজান্তা! অবশ্য আমার ভালোই লাগে। আমি যেহেতু কম কথার মানুষ সেহেতু ওই পক্ষ কথা বেশি বলাতে রসায়নটা জমে গেছে।

রাফসান শিকদার
১৫ অক্টোবর, ২০০৯

বকুল, মীরা যে এই রাফির জন্য পাগল হয়ে গেছে ব্যাপারটা কি ধরতে পেরেছিস? অবশ্য তুই তো আর আমাদের সব কথা শুনিস না। শুনলেই বুঝতে পারতি। তবে ও নিজে বুঝতে পেরেছে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। আমার খুব দেখা করতে ইচ্ছে করে। মীরারও করে কিন্তু ও এত ছোট মানুষ! বাসা থেকে বের হওয়াটা ওর জন্য বড় মুশকিলের কাজ। অবশ্য চাইলেই ও ছবি দেবে। ও খুব আগ্রহী আমাকে দেখার জন্য এবং ওকে দেখানোর জন্য। কিন্তু আমি ছবি দেখতে চাই না। সামনাসামনি দেখতে চাই। না একদমই দুশ্চিন্তা হয় না। ও দেখতে যেমনই হোক আমার তাতে কিছু যায় আসে না। শুধু মানুষটা সত্যি হলেই হলো। কোনো তথ্য মিথ্যা হলে আমি শেষ হয়ে যাব। একদম শেষ। প্রচণ্ডরকম বিশ্বাস করে ফেলেছি যে! কেন যেন মনে হয় ওর মধ্যে কোনো ভান নেই, কোনো নোংরামো নেই, নেই কোনো আড়াল। ও ঠিক যেমন, তেমনটাই প্রকাশ পেয়ে যায় ওর কথাবার্তায়, আচরণে।

রাফসান শিকদার
২২ অক্টোবর, ২০০৯

বকুল, এই মুহূর্তে আমার অবস্থা খুবই খারাপ। দুশ্চিন্তায় আমার শরীর কাঁপছে। প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলাম আজ। বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসার কথা। কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। ঘটনা হচ্ছে সন্ধ্যা থেকে মীরার ফোন বন্ধ পাচ্ছি। এখন প্রায় ভোর। সারারাত কতবার ফোন করেছি হিসাব নেই। দেখলি তো। আচ্ছা বল তো মীরার ফোন বন্ধ কেন? কী হতে পারে? ও কি ধরা পড়ে গেছে? আর কখনোই কি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারব না? কেন আমি ওর ঠিকানা টা নিলাম না। এখন যদি এই নাম্বার আর না খোলে তাহলে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করব কীভাবে! উফ দেয়ালের সঙ্গে মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে এখন আমার। এমনকি ভালোবাসার কথাও বলিনি! উচিত ছিল এতদিনে বলে দেয়া। তাহলে অন্তত এই আফসোসটা থাকত না। আল্লাহ একবার মীরাকে আবার পাইয়ে দাও। পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলব। আর একটা বার সুযোগ দাও।

রাফসান শিকদার
০৬ নভেম্বর, ২০০৯

মীরার কোনো বিপদ হয়নি। আসন্ন মডেল টেস্ট পরীক্ষার কারণে ওর বাবা ফোন নিয়ে গেছে। একেবারে এসএসসি পরীক্ষার পর ফোন দেবেন। মীরা অন্য কারো ফোন থেকে আমাকে কল করেছিল। আজই মীরাকে ভালোবাসার কথা বলে দিয়েছি বকুল। কথাটা শুনে ওর অবস্থা হয়েছে সাঁতার না জেনে অথৈ জলে পড়ে হাবুডুবু খাওয়ার মতো। আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি কি শুধু ভালোবাসি নাকি প্রেমও করতে চাই। বোঝ তাহলে অবস্থা। হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছি ভাই। তবে আমার অবস্থা জানলেও কেউ কেউ হাসতে পারে। চিনি না, জানি না, দেখিনি পর্যন্ত একটা মেয়েকে ভালোবেসে বসে আছি। জানি না এত হিসেব করে চলা এই আমার কী হলো! ছোট একটা মেয়ে শুধু কথা দিয়ে আমাকে পুরো এলোমেলো করে দিল। হঠাৎ হঠাৎ বুক ভার হয়ে আসে, প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা হয়, আমি কি আবারও কোনো ভুল করতে যাচ্ছি? অথচ ওর সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য কোনো জগতে চলে যাই। তখন কেবল মনে হয় এই মানুষটাকে অনেক কিছু শেখানোর আছে, জানানোর আছে, বোঝানোর আছে। অনেকটা পথ চলতে হবে তার সঙ্গে!

রাফসান শিকদার
০৭ নভেম্বর, ২০০৯

নতুন নতুন প্রেম হয়েছে, মীরাকে কী দেয়া যায় বল তো। আহা দেখা হয়নি, কিন্তু হবে তো। জানি তোর অভিজ্ঞতা নেই। আচ্ছা অভিজ্ঞতা নেই কেন রে বকুল? ডায়েরির সঙ্গে কি ডায়েরির প্রেম হতে পারে না? আচ্ছা দাঁড়া। এফ এম রেডিওতে একটা গান হচ্ছে। গানটা একটু শোন। সুন্দর না? গানটা আজই প্রথম শুনলাম। তুমি চাইলে বৃষ্টি, মেঘও ছিল রাজি। অপেক্ষা শুধু বর্ষণের… মনে হচ্ছে গানটা যেন আমার মনের কথা বলছে। যে কথাগুলো শুধুই মীরার জন্য। আপাতত এই গানটা কলার টিউন দিয়ে ওকে ডেডিকেট করি। আর দেখা হওয়ার সময়ে না হয় অন্যকোনো গিফট দেয়া যাবে। কী বলিস আইডিয়া ভালো না?

রাফসান শিকদার
১০ নভেম্বর, ২০০৯

***

নিজেকে আমি ভীষণরকম ধৈর্যবান বলেই ভাবতাম। কিন্তু আজ সেই ভাবনায় ফাটল ধরতে শুরু করেছে। কখন সকাল হবে তর সইছে না। কারণ সকালে ঢাকা যাব। কাল মীরার সঙ্গে প্রথম দেখা। ইচ্ছে করছে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে সকাল করে দিই। এটাও ইচ্ছা করছে যে রাতটাকে ভিডিওচিত্র বানিয়ে টাইমল্যাপসে দিয়ে এক মিনিটে সকাল করে দিই। কিন্তু হায়, আমি নাদান মানুষ আমার এত ক্ষমতা নেই। এমনকি আজ রাতে নিদ্রাক্ষমতাও হারিয়েছি!

রাফসান শিকদার
১১ নভেম্বর, ২০০৯

ভয়াবহ কুয়াশা পড়েছে। কুয়াশায় এক হাত সামনে কী তাও দেখা যাচ্ছে না। সারারাত এক মিনিটের জন্য চোখের পাতা এক করিনি। এক মিনিটও না। কিছুতেই ঘুম আসছিল না বলে সিনেমা দেখে সময় কাটিয়েছি। জানি না কেন। আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়লাম। ঝাড়ুদাররা এখনো রাস্তা ঝাড়ু দিতে নামেনি। দু-একটা কাক আর আমি ছাড়া অন্যকোনো প্রাণী রাস্তায় নেই। ভোরবেলা একচ্ছত্র রাজত্ব করা কুকুরগুলোও তখনো আশ্রয়স্থল থেকে বের হয়নি। আচ্ছা তবে কাক কেন বেরিয়েছে? ওদের কি শীতের অনুভূতি কম? রাতে বাসায় গিয়ে ইন্টারনেটে দেখতে হবে ব্যাপারটা। সকাল সাড়ে ছটার মতো বাজে হয়তো তখন ব্যাংক টাউন গেটে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছি। একটা বাসও নেই রাস্তায়। এটা খুব ছোট স্টপেজ। সরাসরি এখান থেকে কোনো বাস নেই। সাভার থেকে যেসব বাস ঢাকা যায় তারা কয়েক সেকেন্ডের জন্য এখানে দাঁড়ায়, তখনই উঠতে হয়। অনেক বাস এখানে দাঁড়ায়ও না। অন্যদিন এই সময়ের মধ্যে বেশকিছু বাস ছেড়ে দেয়। আজ সম্ভবত কুয়াশার জন্য দেরি করছিল। যাই হোক ৭টার দিকে বাস পাওয়া গেল। সকাল ৮টার মধ্যে আমি ফার্মগেট পৌঁছে গেলাম। মীরার সঙ্গে দেখা করার কথা ১১টায়। আমি নিজেও জানি না কেন এত তাড়াতাড়ি এলাম? আর ১১টা পর্যন্ত কীইবা করব?

টুকটুক করে হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, আমি কলাবাগান এসে গেছি। হয়তো নিজের অবচেতন মনেই আমি কলাবাগানের দিকে হাঁটা ধরেছি। কারণ কলাবাগান ফার্স্ট লেনে মীরা থাকে। আমি ফার্স্ট লেনে ঢুকলাম। ভাবতে লাগলাম, এই রোডে যেখানে আমি হাঁটছি সেখানে কখনো মীরা হেঁটেছে! এই বাতাসে হয়তোবা কখনো মীরারও চুল উড়েছে!

আমার কথা শুনে তুই হাসছিস বকুল? আচ্ছা যা স্বীকার করেই নিলাম আমি একটু বিচলিত বোধ করছি। প্রেমিকদের প্রথম প্রথম এরকম একটু হয়। তুই প্রেমে পড়লে তোরও হবে। শোন আজ আমি একটু চালাকি করেছি। কথা ছিল আমি কালো শার্ট পরে আসব। কিন্তু সাদা শার্ট পরে এসেছি। একটা হাফ লিটারের পানির বোতল রাখার কথা আমার হাতে। কিন্তু রাখব না। কারণ আমি মীরাকে আগে দেখতে চাই। বকছিস কেন? এটা তো খারাপ কিছু না। আমি তো পরে নিজের পরিচয় দেবই। আরে এটা ধোকা কীভাবে? বেশি বুঝিস তুই। এখন খুব মীরার লোক হয়ে গেছিস!

শোন বকুল, কলাবাগান লেকে বসে লিখছি। লেকের পানির কারণে প্রচুর শীত লাগছে এখানে। আর থাকা যাচ্ছে না। এবার একটু রোদে হাঁটব। দেখা হওয়ার পর কী হলো সেসব রাতে বলব। জানি তুইও উদগ্রীব হয়ে আছিস।

রাফসান শিকদার
১২ নভেম্বর, ২০০৯

এতটুকু পড়ে মীরা ডায়েরিটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। রাফি তো দেখা যাচ্ছে তারচেয়ে বেশি অস্থির ছিল প্রথম দেখা হওয়ার সময়। অথচ সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তা। খুব স্বাভাবিক লেগেছিল তাকে! মীরা বিস্ময় কাটিয়ে আবার ডায়েরিটা পড়া শুরু করল।

বকুল আমার জীবনে এত অদ্ভুত ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। ঘটেনি মানে ঘটেইনি। কারো জীবনে এধরনের ঘটনা ঘটতেও শুনিনি বা দেখিওনি। বললে তুই নাও বিশ্বাস করতে পারিস। না না কি বলছি, তুই তো আমার সব কথাই বিশ্বাস করিস তাই এটাও করবি। ঘটনা হচ্ছে মীরার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু আমি বলতে পারব না মীরার চেহারা কেমন! মানে আমি এতটাই আউলা হয়ে গেছি যে তোকে বুঝিয়ে বলতেই পারছি না। যখন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে তখন জানতাম না ওটা মীরা। এরপর যখন জানলাম কিছুতেই মনে করতে পারছি না যে ওর মুখটা কেমন! আমি জানি, বলতে গিয়ে প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলছি। মানে কোথা থেকে শুরু করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি যেমন আগে দেখব বলে প্ল্যানমতো কালো শার্ট পরিনি। সেও একই কারণে অন্য রঙ পরে এসেছিল। যেহেতু কারো বাহ্যিক অবয়ব সম্পর্কে কেউ কিছু জানতাম না তাই কেউই কাউকে চিনতে পারিনি।

মীরা বের হচ্ছে জানিয়েছে। তারপর অনেক সময় কেটে গেছে, আমি ওকে খুঁজে মরছি। সেই সময় এক মেয়ে এসে একটা আর্জেন্ট কল করার জন্য ফোন ধার চাইলো। আমি দিলাম। তার দিকে সেভাবে তাকাইনি কারণ আমার অস্থির দু চোখ হন্যে হয়ে মীরাকে খুঁজছিল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা ফোন ফেরত দিয়ে চলে গেল। মেয়েটা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর যখন আমি আমার ফোনের দিকে তাকাই তখন দেখি আমার নাম্বারে ডায়াল করা হয়েছে। তখনই বুঝতে পারলাম যে ওটা মীরা ছিল। আমি বলতে গেলে ভোঁ দৌড় দিলাম। কিন্তু ততক্ষণে মীরা গেটের ভেতর ঢুকে গেছে। মীরা আর বের হতে পারল না। এই আমার প্রথম দেখা!

রাফসান শিকদার
১২ নভেম্বর, ২০০৯

বকুল শোন, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম মীরা অনেক লম্বা। আমাকে সবসময় সবাই বলতো আমি লম্বা মানুষ খাটো মেয়ে পাব। পেলেও আপত্তি ছিল না। শান্তনা তো খাটোই ছিল। তাতে কী? কিন্তু মীরা আর আমার হাইটের এত পারফেক্ট ম্যাচিং কিভাবে সম্ভব হলো? নারে বকুল। বিশ্বাস কর দেখতে কেমন একদমই খেয়াল করিনি। ছেলে মানুষ মেয়েদের দিকে তাকাবে না এটা হয় না। আমিও অবশ্যই তাকাই কিন্তু তখন মীরাকে খোঁজার জন্য অস্থিরচিত্ত ছিলাম। অন্য কোনো দিকে খেয়াল করতে পারিনি। মীরাকে আবার দেখলে চিনব না এমন না, চিনব অবশ্যই। তবে বিস্তারিত বলতে পারছি না। সব মিলিয়ে সম্ভবত সুন্দর!

রাফসান শিকদার
১২ নভেম্বর, ২০০৯

কাল ছুটির দিন। দেখা করা তো অসম্ভব। ১৪ তারিখেও মীরার পরীক্ষা নেই। ১৫ তারিখে দেখা করতে হবে। আমি জানি না কীভাবে এই দুটো দিন আমার কাটবে। মীরাও নিশ্চয়ই একই রকম অস্থিরতায় দিন কাটাচ্ছে! ধুর ছাতা এমন সময় ওর ফোনটাও ওর কাছে নেই। মন চাইলে একটু কথাও বলতে পারি না। ওকে একটা ফোন কিনে দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু হাতে তো সেরকম টাকা নেই। কিভাবে কিনে দিই? একটা বুদ্ধি বাতলে দে না ভাই!

রাফসান শিকদার
১২ নভেম্বর, ২০০৯

***

নির্মলেন্দু গুণের মোনালিসা নামের একটা কবিতা আছে,

চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই
সদ্য রজঃস্বলা এক কিশোরীরে–
যে জানে না, কী কারণে হঠাৎ এমন
তীব্র তুমুল আনন্দ-কাতরতা
ছড়িয়ে পড়েছে তার নওল শরীরে।
মনুর ভাষায় গৌরী, এইটুকুনু মেয়ে
চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে–
দেখে তার অঙ্গজুড়ে ফুলের উৎসব।
মনে হয় ছড়িয়ে পড়েছে মর্ত্যে
নার্গিস আর বার্গিসের স্বর্গপুষ্পঘ্রাণ।
মাকে ডেকে মেয়েটি শুধায়–
‘আমার শরীরে ফুলের সৌরভ কেন?
মেয়েরা বুঝি ফুলের উদ্যান?’

মীরাকে দেখে তৎক্ষণাৎ আমার এই কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল। সদ্য কৈশোরে পা দেয়া এক পুষ্প সে। সাধারণত আমি স্কুল কলেজের মেয়েদের দিকে তাকাই না। তাই কৈশোরের সৌন্দর্য আমার সেভাবে জানা নেই। গল্প উপন্যাস-কবিতায় পড়া পর্যন্তই। আজ মীরাকে দেখলাম, আপাদমস্তক দেখলাম। ভালো চোখে দেখলাম, অসভ্য চোখে দেখলাম। দেখে জানলাম কৈশোরের সৌন্দর্য। ওর হাত ধরে বুঝলাম… এই ফুলকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, যেন ছিঁড়ে যাবে!

আজ আমি আবারও প্রেমে পড়েছি ওর চোখে তাকিয়ে। ওইটুকু সময়ের মধ্যে ওর চোখে কতবার ডুবেছি জানি না। ওই চোখ দুটো স্বচ্ছ, রিক্ত অবিন্যস্ত। যেন আমি যা কিছু লিখে দেব তাই হবে ওই দুটি চোখের ভাষা।

প্রথম প্রথম আমার ভেতরে ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি ছিল যে এত ছোট একটা মেয়ের সঙ্গে… কিন্তু দিনে দিনে আমার ভেতরকার অনুভূতিগুলো সেই অস্বস্তিকে হারিয়ে দিয়েছিল। আজ ওকে দেখে মনে হলো ওই অস্বস্তিটা ছিল এক অকারণ অস্বস্তি। প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কে কিছুটা বয়সের পার্থক্য থাকলে ক্ষতি নেই। বরং এই পার্থক্যটা কোত্থেকে আচানক এক দায়িত্ব এনে দিল। মনে হলো অনেক যত্নে রাখতে হবে এই নিষ্পাপ ফুলকে। আমার চোখের সামনে একদিন এই ফুল বড় হবে। আমিও বড় হব। তাই তখনো সে আমার কাছে ফুলই থাকবে। আজীবন যেন এই ফুলের যত্ন নিতে পারি। এই ফুল থেকে আমি একটা বাগান করে ফেলব! সৃষ্টিকর্তা আমাকে সাহায্য করুন। ওই চোখে নিমজ্জিত থাকতে চাই সহস্ৰকোটি বছর ধরে।

রাফসান শিকদার
১৫ নভেম্বর, ২০০৯

একটু আগে ৩ ঘণ্টা কথা বলেছি মীরার সঙ্গে। অনেকদিন পর। জানি না কী বলি কিন্তু সময় বয়ে যায়। এরপর দেখি তিন-চার ঘণ্টা কথা বলে ফেলেছি। দেখা করে আসার পর একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেই ঘোর কিছুটা কেটেছে। তবে সারাক্ষণ মাথায় কেবল মীরাই ঘুরছে। কথা কীভাবে বললাম? ও আচ্ছা তোকে তো বলা হয়নি বকুল, আমি মীরাকে একটা ফোন কিনে দিয়েছি। টাকা কোথায় পেলাম? আমার পিসির হেডফোনটা বিক্রি করে দিয়েছি। ওটা তো অত জরুরি কিছু না বল? তার চেয়ে জরুরি মীরার সঙ্গে কথা বলা। আবার টাকা জমিয়ে হেডফোন একটা কিনে ফেলব নাহয়। ঈদ আসলেই তো আবার সালামি পেয়ে বড়লোক হয়ে যাব।

রাফসান শিকদার
১৫ নভেম্বর, ২০০৯

একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। আজকাল আমার ক্ষুধা লাগে । ঘুম আসে না। দাড়ি কাটতে ইচ্ছা করে না। ক্যাম্পাসে যেতে ইচ্ছা করে । সারাক্ষণ ইচ্ছা করে কলাবাগানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। দাড়ির ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম মীরা বলেছে, ওর আমার দাড়ি ভালো লাগে তাই কাটতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু বাকিগুলো?

প্রেমে পড়ে কি আমি পাগল হয়ে গেলাম রে? আমি মানুষটা সুবিধার না। সহজে প্রেমে পড়ি না কিন্তু প্রেমে পড়লেই পাগল হয়ে যাই। শান্তনার জন্য কি কম পাগল ছিলাম? কী করিনি ওর জন্য? অসম্ভব কতকিছুই তো অবলীলায় করেছিলাম! প্রেমে পড়লে সাহস, শক্তি, সামর্থ্য, আত্মবিশ্বাস সবকিছুই কি বেড়ে যায়?

বকুল জানিস, আমার কেবলই ভয় হয়! ঘরপোড়া গরু তো! কিন্তু আমি জানি মীরা শান্তনার মতো না। নিশ্চয়ই ও আমাকে ঠকাবে না। ওর মতো নিষ্পাপ মানুষের পক্ষে কাউকে ঠকানো সম্ভব না। ওরা কেবল মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসতে জানে। তবুও কোন আশঙ্কায় হঠাৎ হঠাৎ বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করে ওঠে?

রাফসান শিকদার
১৬, নভেম্বর, ২০০৯

মীরাকে দেখলেই ঘাম ছুটিয়ে দেয়া এক প্রগাঢ় অনুভূতি বুকের মাঝে মাদল বাজাতে শুরু করে। সকল নিষেধ অগ্রাহ্য করে অনুভূতিরা আচ্ছন্ন করে রাখে দিনভর, রাতভর। ওর হাসি ওর দৃষ্টি সবকিছু ক্ষণে ক্ষণে পাগল করে তোলে। নিষিদ্ধ ভাবনারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পুনরায় নিজেকে দমিয়ে রাখি। ও যে কেবল পুষ্পকুঁড়ি। আগে তো ওকে প্রস্ফুটিত পুষ্প হতে হবে।

আজ মীরা আগেরদিনের মতো চুপচাপ ছিল না। বেশ কথা বলেছে। মজার ব্যাপার কি জানিস বকুল? আমি যতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, ততক্ষণ ও ভুলেও আমার দিকে তাকায় না। আমি চোখ সরাতেই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। ভালোবাসার মানুষকে প্রাণভরে দেখার মাঝে এক অন্যরকম সুখ আছে। তা থেকে ওকে বঞ্চিত করি কী করে বল তো? তাই আমি ইচ্ছে করেই বারবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমাকে দেখার সুযোগ করে দিই।

রাফসান শিকদার
১৯ নভেম্বর, ২০০৯

বকুল শোন, তোর সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে আমার। হ্যাঁ মীরার ব্যাপারেই। তোকে ওর কথাই বেশি বলা হয় কারণ ওর কথা আমি কাউকেই বলতে পারি না। রাহিকে অবশ্য বলেছি কেউ এসেছে আমার জীবনে। কিন্তু বিস্তারিত কিছুই বলতে পারিনি। একমাত্র তোর কাছেই ওর সব কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আলাপের বিষয়বস্তু হচ্ছে মীরার পাগলামি। এই মেয়ে তো ভয়াবহ রকমের পাগল হয়ে গেছে আমার জন্য। আমি যে ফোনটা দিয়েছি সেটা স্বাভাবিকভাবেই লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে। কথা ছিল প্রতি রাতে অল্প করে কথা হবে। লুকিয়ে লুকিয়ে আসলে খুব বেশি বলাও সম্ভব না। কিন্তু এই মেয়ে যা করছে! বাথরুমে লুকিয়ে কথা বলে, ছাদে লুকিয়ে কথা বলে। কোচিং-এ যাওয়ার সময় সারাপথ কথা বলতে বলতে যায়। কি না করে! তবু তার কথা বলা চাই! দুদিন পর পর দেখা করতে চায়। অসম্ভব মায়া জড়িয়ে হাত ধরে রাখে আমার। ভালোবাসার কথা মন খুলে বলে, যা কি না আমি কখনোই সেভাবে পারি না। আমি কাউকে সহজে ভালোবাসতেও পারি না। আবার ভালোবাসলে গলে পানি হয়ে যাই। তাই আমি পাগল হব-এটা স্বাভাবিক তাই বলে ওই পক্ষও এত পাগল হবে?

অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে জানিস? আমার ধারণা শান্তনা আমার সঙ্গে যত বেইমানিই করুক না কেন কখনো ভালোবেসেছিল। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভালোবেসেছিল। কিন্তু সেই ভালোবাসায় কোনো পাগলামি ছিল না। অন্ধত্ব ছিল না। কিন্তু এই মেয়েটা? এমন করেও মেয়েরা ভালোবাসতে জানে! জানলেও ও এমন করে ভালোবাসছে কেন আমাকে? আমি তো এমনিতেই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, এবার কি তবে বদ্ধপাগল হব?

রাফসান শিকদার
২১ নভেম্বর, ২০০৯

ডায়েরিটার এতটুকু পর্যন্ত পড়ে মীরার প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সে যেন টাইম মেশিনে করে ফিরে গেছে ১৪ বছর আগে। বুকের ভেতর নানারকম অনুভূতির জোয়ার ভাটা চলছে। এত ভালোবাসা! শুরুতেই এত ভালোবাসা ছিল তার জন্য রাফির? এত উতলা এত উত্তেজিত ছিল রাফি তাকে নিয়ে? অথচ তাকে কখনোই বুঝতে দেয়নি। একটা মানুষ এত চাপা স্বভাবের কী করে হয়? কেন হয়?

মীরা আবার ডায়েরিটা পড়া শুরু করল।

***

শেষ। আমি শেষ। আবারও আমি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলাম। সব মীরারাই কি অভিনয়ে পারদর্শী হয়? সব মীরারাই কি চরিত্রহীন হয়? এখনো ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে মীরা আমাকে সম্পূর্ণ মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে! যে মীরার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মেলাবার জন্য আমি কলাবাগানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি সে কলাবাগানে থাকেই না। সে থাকে নাখালপাড়া। এসব ছোটখাটো ব্যাপার না হয় ছেড়েই দিলাম। কারণ সে আরো অনেকগুলো বড় বড় মিথ্যে বলেছে। সে আমার নাম্বার কীভাবে পেয়েছে তা নিয়ে তো বিরাট এক মিথ্যে নাটক তৈরি করেছে। সে আমাকে বলেছিল তাদের বাসার কাজের মেয়ে নাকি বাড়িতে ফোন করতে গিয়ে একটা ডিজিট ভুল করে আমাকে ফোন করেছে!

অথচ আজ জানতে পারলাম সব মিথ্যে বলেছে। ও আসলে তপনদের বাসার বাড়িওয়ালার মেয়ে। তপনের বোন ত্রিশার বান্ধবী। ও তপনের ফোন থেকেই আমাদের সব বন্ধুদের নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দিয়েছে! শুভকে বানিয়েছে স্বামী, বাচ্চার বাবা। আর আমাকে বানিয়েছে প্রেমিক। দীপু আরিফের সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে।

অথচ এই মীরাকে আমি ছাগলের মতো বিশ্বাস করে বসে আছি। যেখানে তাকে ভালোবেসে আমি দিন-রাত এক করে ফেলছি, সেখানে তার জন্য আমি শুধুই মজা? এও কি সম্ভব ওই ছোট্ট নিষ্পাপ দেখতে মেয়েটার দ্বারা? এত বড় ধোকার শিকার হলাম আমি? এত বোকা আমি? এত বোকা?

রাফসান শিকদার
২২ নভেম্বর, ২০০৯

মীরার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না বলে ফোন বন্ধ করে রেখেছি। ও খুব কাঁদছিল। সবটা এক্সপ্লেইন করতে চেয়েছিল। কোনো সুযোগ দিইনি। আমার যে পরিমাণ রাগ উঠেছে তাতে ওর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে গেলে ভয়াবহ কিছু হতো। অনেক বাজে এবং কঠিন কথা বলে ফেলতাম যা হয়তো ও নিতেই পারত না। হায়রে রাফি এত বড় ছাগল তুই? এখনো ওই মেয়ে কী নিতে পারবে আর কী নিতে পারবে না সেই চিন্তা করিস? এখনো এত ভাবছিস? যে এত অভিনয় জানে, এত মিথ্যা জানে সে সবই নিতে পারবে।

রাফসান শিকদার
২২ নভেম্বর, ২০০৯

শুভ, আরিফ, দীপু তিনজনের ফোনেই মীরার নাম্বার থেকে কল গিয়েছিল। মীরার নাম্বার বলতে ওর নিজস্ব ফোন যেটা ছিল সেটা থেকে। আমি যেটা দিয়েছি সেটা না। তার মানে ঘটনা মাস দুয়েক আগের। কারণ মীরার ওই ফোন ওর বাবা দু মাস আগেই নিয়ে নিয়েছে। আমার বন্ধুরাও আমাকে দু মাস আগের কল হিস্ট্রিই দেখাল। তবে দীপু এবং আরিফের সঙ্গে খুব বেশি কথা হয়নি। বেশি কথা হয়েছে শুভর সঙ্গে। কেন যেন মনে হচ্ছে–এখানে বড় ধরনের কোনো ফাঁক রয়ে গেছে। যেটা আমি ধরতে পারছি না। আমার মন মস্তিষ্ক সবই বলে মীরা এমন হতেই পারে না। মিথ্যা বলতে পারে, তাই বলে একইসঙ্গে এতগুলো ছেলের সঙ্গে চক্কর চালাতে পারে না। নাকি এই ভাবনা আমার আরেক বোকামি?

রাফসান শিকদার
২৩ নভেম্বর, ২০০৯

নাহ পারছি না। শক্ত থাকতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে মীরাকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। আমি জানি কোনো একজনের জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। কাউকে ছাড়া কেউ মরে না। কিন্তু তবুও প্রতিমুহূর্তে আমার এ এক অসহ্য রকমের দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু ওর কাছে ফিরে যেতে পারছি না। অসহ্য লাগছে ওকে। না পারছি ফেলতে, না পারছি গিলতে! ফেলতে গেলে মনে হয় ওকে তো ভালোবাসি। গিলতে গেলে মনে হয় ওকে তো ঘৃণা করি।

কেউ যখন কাউকে একইসঙ্গে ভালোবাসে এবং ঘৃণা করে তখন তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এবং এটা দুনিয়ার সবচেয়ে বিশ্রী অনুভূতি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি শান্তনার ক্ষেত্রেও সম্পর্কের শেষদিকে আমার এই একই অনুভূতি ছিল। অনেক কষ্টে সেই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। কেন বিশ্রী এই অনুভূতিগুলো পুনরায় আমাকে তাড়া করছে?

রাফসান শিকদার
২৫ নভেম্বর, ২০০৯

আজ মা বাপের বাড়ি গেছে। সবার মায়ের বাপের বাড়ি যাওয়া আর আমার মায়ের বাপের বাড়ি যাওয়া কিন্তু এক না। আমার মায়ের বাপের বাড়ি তুরস্ক। নানা নাকি অসুস্থ। মাকে একবার দেখতে চায়। এমতাবস্থায় না গিয়ে পারা যায় না। যাওয়ার আগে মায়ের মন খুব খারাপ ছিল দুটো কারণে। প্রথমত, বাড়ি করার পর বাবার যতটুকু সেভিংস ছিল সব খরচ হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, বাবা বা আমাদের কাউকেই মায়ের সঙ্গে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার প্রাণপ্রিয় স্বামী, দু বছরের ছোট্ট কন্যা আর দুটো দামড়া ছেলেকে এখানেই রেখে যেতে হচ্ছে। হয়তো চিন্তা হচ্ছে আমরা ঠিকভাবে চলতে পারব কি না। মা আমাদের এমনভাবেই মানুষ করেছেন যে আমরা ঠিকঠাকই চলতে পারব। কোনো সমস্যাই হবে না। কিন্তু মায়ের চিন্তা দূর করতে পারব না।

আল্লাহর কাছে সারাদিন দুটি প্রার্থনা করে যাচ্ছি। এক, তিনি আমার মায়ের সব চিন্তা দূর করে দিক। নিরাপদে তিনি দেশে পৌঁছাক এবং নিরাপদে ফিরে আসুক।

দুই, আল্লাহ আমার বাবার মনটা ভালো করে দিক। হাসিখুশি মানুষটাকে জীবনে এই প্রথম মন খারাপ করতে দেখলাম। ২৩ বছরের সংসার জীবনে কখনোই একটি দিনের জন্যও আলাদা থাকেননি তাঁরা। আল্লাহ খুব দ্রুত দুজনকে দুজনার কাছে ফিরিয়ে দিক।

রাফসান শিকদার
২৬ নভেম্বর, ২০০৯

***

বাসায় মা নেই এমনটা এর আগে কদাচিৎ হয়েছে। তবে সেটা কয়েক ঘণ্টার জন্য। এরকম একাধারে মাকে ছাড়া থাকা তো কখনো হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম মাকে ছাড়া আমাদের কোনো সমস্যাই হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ভীষণ সমস্যা হচ্ছে। রান্নাবান্না আমি আর রাহি মিলে করে নিচ্ছি। বাবাও কখনো সাহায্য করছে। নিজেদের অন্যান্য কোনো কাজেই সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা একটা জায়গায় সেটা হচ্ছে-মাকে দেখতে পাচ্ছি না। মা বলে ডাকতে পারছি না। বাবা হুটহাট মায়ের নাম ধরে ডেকে ফেলছেন। আমরা অবশ্য শুনেও না শোনার ভান করি।

এই প্রথম মা দূরে গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি যতই আমাদের সব কাজ শেখান না কেন, আমরাও আসলে অন্য ছেলেমেয়েদের মতোই মাকে ছাড়া অচল!

রাফসান শিকদার
২৮ নভেম্বর, ২০০৯

আমি মীরাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না আবার আমার বন্ধুদেরকেও পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না। বিশেষ করে শুভকে একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না। মীরার বক্তব্য শোনা দরকার। দাগি আসামিকেও কিছু বলার সুযোগ দেয়া হয় কিন্তু আমি ওকে কিছু বলার সুযোগ দিইনি। কাজটা ঠিক হয়নি। আবার আরেকদিক থেকে ভাবতে গেলে ঠিক আছে। প্রচণ্ড রাগের মাথায় কারো সঙ্গে সিরিয়াস ব্যাপারে কথা বলা উচিত না। বললে হয়তো বাজে কিছু বলে ফেলতাম! অন্য কারো মেয়েকে বাজে কথা বলার আমি কে? তারচেয়ে এই নীরব শাস্তি ভালো। ৭ দিন হয়ে গেছে আমার ফোন বন্ধ ছিল। আজ ফোন করেছিলাম। ফোন ধরেই মীরার কান্নাকাটি শুরু। মেয়েরা এই একটা কাজ খুব ভালো পারে। এটা তাদের মোক্ষম অস্ত্র। অস্ত্র কাজে লেগেছে। কান্না শুনেই মায়া লাগল! অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার। মায়া ভয়ানক এক জাল। এই জালে আটকালে জীবদ্দশায় বের হবার সুযোগ মেলে না। নিজের ওপর বিরক্তির শেষ রইল না আমার।

যাই হোক, বিরক্তি নিয়েই ওর বক্তব্য শুনলাম। ঘটনা হচ্ছে মীরা নতুন ফোন পাওয়ার পর হঠাৎ একদিন ত্রিশা একটা কাগজে আমাদের ৪ বন্ধুর ফোন নাম্বার লিখে নিয়ে এসেছিল। সবাইকে ফোন করে মজা করবে বলে। প্রথমে নাকি আমাকে কল করেছিল। আমি ফোন ধরলাম না। এরপর ফোন করেছে শুভকে। শুভর সঙ্গে সেই থেকে ত্রিশার কথা শুরু। ওর সঙ্গে কথা জমে ওঠায় প্রায়ই নাকি ত্রিশা মীরার কাছে এসে ওকে ফোন করত। প্রথমদিন আমি যখন মীরাকে কলব্যাক করেছিলাম ততক্ষণে ত্রিশা চলে গেছে। আর মীরাও প্রথমে। বুঝে উঠতে পারেনি আমি আসলে কে! যখন বুঝলো ততক্ষণে নাকি আমার কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। একবার কথা বলেই নাকি আবার কথা বলার লোভে পড়ে গিয়েছিল। ওদিকে ত্রিশা মীরার বেস্টফ্রেন্ড, সে বারবার বলছিল যেন ধরা না খায়। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মীরা মিথ্যা বলেছিল। বক্তব্য অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। সত্যিই মনে হচ্ছে কিন্তু ভেজালটা হলো কণ্ঠস্বরের ব্যাপারটায়। এই একই কথা আমি মীরাকে বলেছিলাম। মীরাও এখন এই কথা আমাকে বলছে! এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। তাছাড়া আমার কণ্ঠস্বর এমন কোনো রসগোল্লাও না, আমি তা জানি।

এক পর্যায়ে আমি মীরাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও যে ত্রিশাকে যখন-তখন ওর ফোন ব্যবহার করতে দিত, ওই মেয়ে যদি কোনোদিন আমাকেই ফোন দিয়ে বসত তাহলে তো আমাদের সম্পর্কের কথা টের পেয়ে যেত।

এ কথা জিজ্ঞেস করতেই মীরা ফুঁসে উঠল, কেন আমাদের সম্পর্কের কথা ত্রিশা জানলে কি তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?

আচমকা আমি হাসি আটকাতে পারলাম না। তবে পরমুহূর্তেই সামলে নিলাম। যে মেয়ে আমাকে নিয়ে জেলাস ফিল করে সে নিশ্চয়ই আমাকে ভালোবাসে। এত সরল যে মেয়ে, সে মিথ্যা বললেও নাটক সাজাতে পারে না।

রাফসান শিকদার
২৯ নভেম্বর, ২০০৯

আসলেই আমি প্রেমে পড়ে ছাগল হয়ে গেছি। নাহলে এই ব্যাপারটা আমার মাথায় আরো আগে কেন এলো না! তপনদের বাসায় গেলেই ত্রিশা যে আমার পেছনে ছুক চুক করত-সেটা আমি কীভাবে ভুলে গেলাম? আজ হঠাৎ মনে পড়ল। আমি এখন নিশ্চিত মীরা যা বলেছে সত্যি বলেছে। দুজনের বয়স এক হলেও স্বভাব আলাদা। মীরাকে ত্রিশা হাটে নিয়ে ১৪ বার বেঁচে দিতে পারবে, মীরা টেরও পাবে না। যে মেয়ে চায়ের কাপ দেয়ার হুঁতোয় হাতে হাত লাগাতে পারে সে মেয়ে নির্দ্বিধায় এতগুলো ছেলের সঙ্গে কথা বলে যেতে পারে। আসল ঘটনা আমার বোঝা হয়ে গেল। একটা ক্ল যখন পেলাম তখন সত্যিটা প্রমাণ করতে আর সমস্যা হলো না। মীরার কিছু ভয়েস রেকর্ড করেছিলাম। দীপু আরিফকে শোনানোর পর ওরা বলল ওদের সঙ্গে যে কথা বলেছে তার গলা এটা নয়। কিন্তু শুভকে শোনানোর পর শুভ বলল, ওর সঙ্গে যার কথা হয়েছে এটা তারই গলা। সন্দেহটা তখনই হলো। কারণ দীপু আরিফ দুজনেই মিথ্যে বলবে তা হয় না। ওদেরকে একসঙ্গেও জিজ্ঞেস করিনি, আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করেছি। শুভকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, এখনো কথা হয় কি না, শুভ বলল হয়। তখন শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেলাম ওর মীরার সঙ্গে কথা হয়নি। কারণ মীরার ফোন তো ওর বাবা নিয়ে নিয়েছে পরীক্ষার আগেই। তার মানে মীরা সত্যি বলেছে। শুভ ত্রিশার সঙ্গে কথা বলত। ওদের হয়তো প্রেম হয়েছে আর সেটা আড়াল করতেই শুভ মিথ্যে বলছিল।

আমাদের মাঝে আজ যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা মীরার এই সরলতার জন্য হয়েছে। ওর সরলতা কমাতে হবে। মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা যে ঠিক না তা ওকে বোঝাতে হবে। ও যে নরম মেয়ে কোনো সহজ পদ্ধতিতে বোঝালে হবে না। কঠিন পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

রাফসান শিকদার
০২ ডিসেম্বর, ২০০৯

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *