এক ইঞ্চির গরমিল (উপন্যাস)

এক ইঞ্চির গরমিল (উপন্যাস)

কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম ‘এসিজি’। বয়েসকালে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা করার সময় এই সংক্ষিপ্ত নামে বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু এখন এই নামে কেউ উল্লেখ করলে বেশ অস্বস্তি হয়। কলিংবেলের সঙ্গে-সঙ্গে সেই নামেই কেউ ডেকেছেন বাইরে থেকে ‘এসিজি স্যার আছেন?’

কলিংবেল সাতসকালে বেজে ওঠা মানেই অতিথি ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব—এসিজির প্রাক্তন ছাত্র। সময় পেলেই সে চলে আসে স্যারের এই শ্যামবাজারের ফ্ল্যাটে। এসিজির পাখির শখ নিয়ে নানারকম কৌতূহল দেখায়। সেইসঙ্গে খুন-জখম-রাহাজানি নিয়ে বিস্তর আলোচনা।

একটু আগেই ব্রেকফাস্ট শেষ করেছেন এসিজি। তারপর এককাপ কফি খেয়ে উইলস ফিলটার ধরিয়েছেন। সকাল-সন্ধের কাজের বউ ‘ললিতের মা’ বাথরুমে কাপড় কাচছে—এখান থেকে জল পড়ার শব্দ আর কাপড় আছড়ানোর শব্দ দিব্যি কানে আসছে।

দু-আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে দরজা খুলে দিয়েছেন অশোকচন্দ্র। আর সঙ্গে-সঙ্গেই শোনা গেছে অতিথির প্রশংসাবাণী : ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ—।’

খাঁটি দুধের সঙ্গে তুলনা করে এসিজিকে আজ পর্যন্ত কেউ প্রশংসা করেনি। সুতরাং অতিথিকে দেখে তিনি যতটা অবাক হয়েছিলেন, তার অদ্ভুত প্রশংসায় ঠিক ততটাই বেসামাল।

কিন্তু অতিথিকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হল না। ‘লালমহল’-এর রঙ্গলাল গোস্বামী—যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন এই কথা বলে : ‘আমি একজন স্বভাব-কবি/কবিতায় কথা বলা আমার হবি।’

গতবছর পুজোর সময় এসিজি রঘুপতি যাদবের সঙ্গে রঙ্গলালবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন—বাগবাজার গঙ্গার ঘাটের কাছে দু-মহলা বাড়ি ‘লালমহল’। সেখানে রঙ্গলালবাবুর দাদার একটা হারানো চুনি খুঁজে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আবার কী রহস্য দেখা দিল ‘লালমহল’-এ?

সে-কথা জিগ্যেস করতে আকর্ণবিস্তৃত হেসে রঙ্গলাল বললেন, ‘না, না, না—সেসব কিছু নয়/করতে এসেছি গভীর পরিচয়। আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি, এসিজি স্যার। শুনে আপনার গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছি।’

পাছে রঙ্গলাল আবার ‘খাঁটি দুগ্ধের’ উপমা দেন সেই আতঙ্কে অশোকচন্দ্র তড়িঘড়ি অতিথি-সৎকারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রঙ্গলালবাবুকে ড্রইংরুমের সোফায় বসতে বলে এসিজি ললিতের মা-কে অতিথির খবর দিতে গেলেন।

একটু পরে ফিরে এসে দেখেন রঙ্গলালবাবু ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর অবাক চোখে ঘরের প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখছেন। অশোকচন্দ্রকে দেখেই ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/অমর, আকবর এবং অ্যান্টনি।’

হাসি চাপতে পারলেন না এসিজি। কোনওরকমে হাসি থামিয়ে জানতে চাইলেন, ‘অমর, আকবর, অ্যান্টনির মানে?’

রঙ্গলাল সোফায় বসে বিনীতভাবে বললেন, ‘তিনটি বিচিত্র গুণের সমাহার। আসলে আমার উপমাগুলো একটু বেশি সিম্বলিক। কিন্তু জানেন তো, কবিতায় সিম্বলের ব্যবহার একটা আর্ট।’

অশোকচন্দ্র নতুন চোখে মানুষটাকে দেখছিলেন।

শ্যামলা রং। ডানহাতের তিন আঙুলে রুপো দিয়ে বাঁধানো তিনটে পাথরের আংটি। পরনে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। মাথায় তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুল। ছোট-ছোট উজ্জ্বল চোখ। কপালের বাঁ-দিকে একটা ছোট আঁচিল। নাকটা মাপে সামান্য বড়। দাঁড়ি-গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। আর ভদ্রলোকের শরীর ঘিরে পারফিউমের হালকা সুবাস।

অন্য কেউ এরকম প্রশংসা করলে ব্যাপারটাকে চাটুকারিতা বলা যেত। কিন্তু রঙ্গলালবাবুর সবকিছুই এমন স্বাভাবিক আর আন্তরিক যে, ওঁর মুখে এ-ধরনের কথা শুনলে বেশ মজা পাওয়া যায়। তা ছাড়া, একজন কবিকে বন্ধু হিসেবে পেলে মন্দ কী!

সোফায় বসে রঙ্গলালবাবুর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন এসিজি। সিগারেটের ধোঁয়ার রেখা ওঁর মাথার সাদা চুলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।

গল্পের মাঝেই আবার বেজে উঠল কলিংবেল। ঘণ্টির ছন্দ শুনেই অশোকচন্দ্র এবার চিনে নিতে পারলেন নতুন অতিথিকে। তাই রঙ্গলালের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘রঘুপতি যাদব—।’

‘হরি হে মাধব!’ পাদপূরণ করলেন রঙ্গলাল। তাঁর মুখে সামান্য আশঙ্কার ছাপ ফুটে উঠল।

দরজা খুলতেই দেখা গেল এসিজির অনুমান সঠিক। ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে—অনেকটা পড়া-না-পারা ছাত্রের মতো। ওর হাতে বেশ বড় মাপের সবুজ প্লাস্টিকের কভার দেওয়া একটা ফাইল। এই মুহূর্তে ওকে যতটা না ইন্সপেক্টর তার চেয়ে ঢের বেশি ছাত্র-ছাত্র দেখাচ্ছে।

‘আরে, এসো ইন্সপেক্টর সাহেব, এসো—এসো। মুখটা যেরকম বাংলার পঞ্চান্নর মতো করে রেখেছ তাতে মনে হচ্ছে পাখি নিয়ে সমস্যায় পড়েছ।’

মজা করে প্রাক্তন ছাত্র রঘুপতিকে আহ্বান জানালেন এসিজি।

রঘুপতি যাদব ঘরে ঢুকল। বয়েস চল্লিশের এপিঠে। ছোট করে ছাঁটা চুল। কাঁচাপাকা চওড়া গোঁফ। ফরসা মুখে সামান্য বসন্তের দাগ। হাতের শিরা এবং পেশি দুই-ই চোখে পড়ার মতো।

রঘুপতি চাপা গলায় গজগজ করে বলল, ‘আপ তো মজাক কর রহে, স্যার—লেকিন মেরা তো নিদ খরাব হো গই।’

‘কেন, কেন, ঘুম শিকেয় উঠল কেন?’ চোখ থেকে কার্বন ফ্রেমের চশমাটা খুলে অশোকচন্দ্র ঠাট্টার সুরেই প্রশ্ন করেছেন প্রাক্তন ছাত্রকে।

‘স্রেফ এক ইঞ্চির জন্যে—’ রুক্ষভাবে বলল রঘুপতি। তারপর যেন এই প্রথম দেখতে পেল রঙ্গলাল গোস্বামীকে।

রঙ্গলাল প্রায় বিগলিত হয়ে রঘুপতি যাদবকে আকর্ণবিস্তৃত হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘মনে পড়েছে মহললাল? আমি সেই রঙ্গলাল।’

রঘুপতি অসন্তুষ্ট চোখে তাকাল অশোকচন্দ্রের দিকে : ‘কী ব্যাপার, গুপ্তাসাব? আবার কি পান্না-চুনির প্রবলেম, নাকি হাস্যকবি সন্মেলন?’

‘রঘুপতি, রঘুপতি—’ ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলেন এসিজি। আদরের গলায় বললেন, ‘তোমার মেজাজটাকে একটু ডাউন করো, প্লিজ। কর্পূরের মতো ভোলাটাইল মেজাজ নিয়ে কখনও মিস্ট্রি সলভ করা যায়! নাও বোসো—একটু কফি-টফি খাও, তারপর তোমার এক ইঞ্চির গরমিল নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে।’

রঙ্গলাল গোস্বামী রঘুপতির আচরণে খানিকটা হকচকিয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন। অশোকচন্দ্রের ‘কফি-টফির’ প্রস্তাবে গলা বাড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘কফি আমার প্রিয় নয়/টফি হলেই ভালো হয়—।’

রঘুপতি সোফায় বসতে গিয়ে হেসে ফেলল, দেখল রঙ্গলালের দিকে। তারপর বলল, ‘আপনি এই বয়েসেও টফি খান?’

রঙ্গলাল লজ্জায় মুখ নিচু করে বললেন, ‘কী করব, ভালো লাগে। ভালো লাগার কি কোনও বয়েস আছে?’ তারপর রঘুপতিকে সৌজন্যের নমস্কার জানিয়ে, ‘আমি বাগবাজারের লালমহলের রঙ্গলাল গোস্বামী। স্যারের সঙ্গে গভীর পরিচয় করতে এসেছি—।’

এমনসময় দরজা ঠেলে ঢুকল বিশু। বছর বারো-তেরোর কিশোর। এসিজির কাছেই থাকে, ফাইফরমাশ খাটে। বিশুর হাতে পলিথিনের ক্যারিব্যাগ—তাতে ঠোঙা আর বাক্স।

এসিজি ওকে বললেন, ‘ললিতের মা-কে বল দুজন গেস্ট আছে। আর কফি তিনকাপ।’ তারপর রঙ্গলালকে লক্ষ করে, ‘সরি, রঙ্গলালবাবু, আজ আপনাকে টফি খাওয়াতে পারলাম না। আজ কফি দিয়ে কাজ চালান—অন্য আর-একদিন টফি খাওয়াব।’

এরপর রঘুপতির সঙ্গে রঙ্গলালের ‘গভীর’ পরিচয় করিয়ে দিলেন এসিজি।

সব শুনে রঙ্গলাল চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ফিজিক্সের লোক, লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর! এই কম্বিনেশান বড় সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর।’

এসিজি হেসে বললেন, ‘আবার অমর, আকবর, অ্যান্টনি—কী বলুন!’

রঘুপতি অবাক হয়ে তাকাল স্যারের দিকে ‘অমর, আকবর, অ্যান্টনি মানে? আপনি আজকাল হিন্দি পিকচার-টিকচার দেখছেন নাকি, গুপ্তাসাব?’

এসিজি আবার হাসলেন। চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসিয়ে নিয়ে বললেন, ‘ও এক মজার ব্যাপার—তোমাকে পরে বুঝিয়ে দেব। এবারে তোমার এক ইঞ্চির গরমিলের গল্পটা বলো—।’

অশোকচন্দ্র গুপ্ত নতুন একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। ওঁর চোখ বুজে এল। বোঝা গেল, ‘থিঙ্কিং মেশিন’ নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে।

সোফায় বসে ফাইলটা ঠিক পাশেই রেখেছিল রঘুপতি। সেটা হাতে তুলে নিয়ে খুলতে-খুলতে বলল, ‘গুপ্তাসাব, ব্যাপারটা ঠিক সুইসাইড নয়—তবে সুইসাইডের মতো—।’

এসিজি চোখ খুললেন। রঙ্গলাল গোস্বামীকে লক্ষ করে বললেন,

‘রঙ্গলালবাবু, এবার একটু খুন-জখমের গল্প শুনুন। আপনি কবি মানুষ, এসব গল্পে হয়তো বোর হয়ে যাবেন…তবু—।’

দু-হাত তুলে এসিজিকে থামিয়ে দিলেন রঙ্গলাল, খানিকটা সুর করে বললেন, ‘রঘুপতি যাদব এবং আপনি/ তৎসহ কিঞ্চিৎ খুন কিংবা খুনি/ সুগভীর পরিচয়ের অঙ্গ বলে মানি/ ইন্টারেস্ট তীব্র মম শুনিতে কাহিনি।’ স্বভাব-কবিতা শেষ করে বিনয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে আকর্ণবিস্তৃত হাসলেন রঙ্গলাল।

অশোকচন্দ্র পালটা হেসে রঘুপতিকে বললেন, ‘রঘুপতি, তুমি ননস্টপ তোমার কাহিনি বলে যাও। আমরা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনছি। খুঁটিনাটি কিচ্ছু বাদ দেবে না।’

রঘুপতি বলতে শুরু করল, ‘ওই যে বললাম, ব্যাপারটা ঠিক সুইসাইড নয়—সুইসাইডের মতো। কেসটা প্রথম এসেছিল মানিকতলা থানায়—সুইসাইডের কেস হিসেবে। ব্যাপারটা বেশ স্ট্রেট ফরোয়ার্ড ছিল। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ধুতি বেঁধে খুদকুশি। কিন্তু পরে দেখা গেল, সবকুছ ঠিকঠাক হ্যায়, লেকিন সিরফ এক ইঞ্চির গরমিল। আর সুইসাইড নোটেও থোড়াবহত গড়বড় আছে।’

এরপর রঘুপতি যাদব ওর জগাখিচুড়ি ভাষায় যা বলে গেল তা মোটামুটি এই। ব্যাপারটা হয়েছে দিন কুড়ি আগে, লালাবাগানে—মানিকতলা থানা এলাকায়। গুরুদাস কলেজের বাংলার অধ্যাপক ডক্টর রণতোষ দত্ত আত্মহত্যা করেছেন। ভদ্রলোকের বয়েস চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন মতো হবে। সুন্দর, লম্বা, সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান চেহারা ছিল—তবে কে জানে কেন বিয়ে-থা করেননি। দোতলা বাড়ির ছাদের একটা ঘরে দিনরাত বইপত্র নিয়ে ডুবে থাকতেন। সেই ঘরেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন—সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ধুতি বেঁধে। প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা ঠিকই ছিল, কিন্তু পরে একটা গরমিল দেখা দেয়। বাড়িতে আরও লোকজন থাকেন। একতলায় একঘর ভাড়াটে। আর দোতলায় থাকেন রণতোষবাবুর ভাই পরিতোষ দত্ত, ভাইয়ের স্ত্রী অন্তরা দত্ত আর ওঁদের একটা বছর চারেকের মেয়ে টুসি। বাড়ির মালিক পরিতোষ দত্ত আর রণতোষ দত্ত। ওঁদের বাবা বছর কুড়ি আগে মারা গেছেন। তবে এই ঘটনার পর এখন মালিক পরিতোষ দত্ত। পরিতোষবাবু স্টেটব্যাঙ্কের বউবাজার ব্রাঞ্চে চাকরি করেন—বেশ ভালো পোস্টেই। ভদ্রলোকের চাকরির রেকর্ড একদম পরিষ্কার—কোনও গন্ডগোল নেই।

‘রঘুপতি রঘুপতি—’ হাত তুলে রঘুপতিকে থামতে ইশারা করলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত : ‘তোমাকে তো বহুবার বলেছি, গায়ের জোরের লড়াইয়ে স্পিডটা একটা ফ্যাক্টর, বুদ্ধির লড়াইয়ে নয়। তুমি এত তাড়াহুড়ো করে গল্পটা বোলো না—গাড়ির স্পিড একটু স্লো করো। এবার বলো দেখি, রণতোষবাবুর সুইসাইডে গন্ডগোলটা কোথায়, আর সুইসাইড নোটের কেসটাই বা কী? তারপর পরিতোষবাবুর ক্যারেকটার সার্টিফিকেট শুনব।’

রঘুপতি যাদব ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘রণতোষ দত্তের বডিটা সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছিল। আর তাঁর বডির ঠিক নীচেই মেঝেতে উলটে পড়ে ছিল একটা চেয়ার। মানিকতলা থানার এ. এস. আই. মজুমদার কেসটা ইনভেস্টিগেট করছিলেন—প্রথমে তিনি ব্যাপারটা খেয়াল করেননি। পরে মাপজোখ করে পতা চলা কে হ্যাঙিং বডি আর ওই চেয়ারের মধ্যে এক ইঞ্চি মতো ফাঁক থেকে যাচ্ছে। লেকিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট একদম ও. কে.—ক্লিন সুইসাইড বাই হ্যাঙিং—মানে, সেরকম হলে যেরকম হয় আর কী। তবে স্টমাকে সামান্য একটু ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে।’

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে এসিজি প্রশ্ন করলেন, ‘রণতোষ দত্ত ধুতি পরতেন।’

‘হ্যাঁ—’

এমনসময় বিশু ট্রে-তে করে খাবার-দাবার আর কফি নিয়ে এসে টি-টেবিলে রাখল।

এসিজির অনুরোধে রঙ্গলাল আর রঘুপতি খেতে শুরু করল। এসিজি নিজে কফির কাপ তুলে নিলেন। কফিতে চুমুক দিয়ে মাথার সাদা চুলের গোছা ধরে টান মারলেন কয়েকবার।

রঘুপতি ফাইলের একটা পৃষ্ঠায় চোখ রেখে খেতে-খেতে জড়ানো গলায় বলল, ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যা বলছে তাতে সন্দেহ হওয়ার কোনও কারণ নেই। সিক্সথ সার্ভিকাল ভার্টিব্রা মেডালা, পন্স, আর মিডব্রেইনে গিয়ে হিট করেছে। নতিজা রেসপিরেশন আর কার্ডিয়াক ফাংশানের ভাইটাল কন্ট্রোল সেন্টার ড্যামেজ হয়ে ডেথ—।’

কফিতে বারতিনেক লম্বা চুমুক দিয়ে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘বুঝেছি। কিন্তু তুমি সুইসাইড নোটের কথা কী যেন বলছিলে—।’

ইতিমধ্যে খাওয়া শেষ করে কফি শুরু করেছে রঘুপতি। কফির কাপ টেবিলে রেখে ফাইল থেকে একটা চিরকুট বের করে এগিয়ে দিল এসিজির দিকে : ‘দেখিয়ে গুপ্তাসাব, ইয়ে রহা আপকা সুইসাইড নোট।’

কফি শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। তারপর প্রাক্তন ছাত্রের হাত থেকে চিরকুটটা নিয়ে ভালো করে দেখলেন। রণতোষ দত্তের লেখা সুইসাইড নোট। রুলটানা কাগজে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে লেখা।

‘কোনও ব্যক্তির আত্মার সর্বনাশ হওয়া কেমন ভয়ানক ও গুরুতর বিষয়, তাহা বলা অসাধ্য; কিন্তু ধিক ২! মনুষ্যেরা ঈশ্বরের নিয়ম জানিয়াও মনে করে, যদ্যপি আমরা পাপ করি, তথাপি তিনি দয়ালু হইয়া পরলোকে আমাদিগকে অবশ্য ভালো স্থান দিবেন।’

—ফুলমণি ও করুণার বিবরণ

এটাকে কি সুইসাইড নোট বলা যায়? সিগারেটে গভীর টান দিলেন এসিজি। এরকম পুরোনো ধাঁচের বাংলায় কি কেউ সুইসাইড নোট লেখে! তা ছাড়া, শেষে ওই ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ ব্যাপারটাই বা কী? এটা কোনও লেখা থেকে কোট করা হয়নি তো!

সেটা রঘুপতিকে জিগ্যেস করতেই ও বলে উঠল, ‘আমরা ইনভেস্টিগেট করে দেখেছি, স্যার। এটা পুরোনো একটা স্টোরি থেকে নেওয়া—ফুলমণি ও করুণার বিবরণ—রাইটারের নাম হানা ক্যাথেনিন ম্যালেন্স। বাংলার প্রফেসররা এসবের খোঁজখবর রাখেন।’

কাগজটা দেখতে-দেখতে মাথার সাদা চুলের গোছা ধরে টান মারলেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত! আনমনাভাবেই বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, রঘুপতি, সুইসাইড নোটটা যেন কেমন-কেমন। তা ছাড়া, কাগজটা কোনও বড় পৃষ্ঠা থেকে সাবধানে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। যদি রণতোষবাবু এই অদ্ভুত সুইসাইড নোটের ব্যবস্থা করে গিয়ে থাকেন, তা হলে বলতে হয়, তাঁর আত্মার সর্বনাশ হয়েছিল, তিনি কোনও একটা পাপ কাজ করে সেই অনুতাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্ত এখানে আর-একটা খটকা লাগছে : ‘যে-ভদ্রলোক অনায়াসে নিজের পাপ স্বীকার করেন তাঁর পক্ষে স্পষ্ট সুইসাইড নোট লিখতে অসুবিধে কোথায়!’

‘ঠিকই বলেছেন স্যার—’ গম্ভীরভাবে সায় দিল রঘুপতি যাদব, ‘ওই সুইসাইড নোট আর এক ইঞ্চির ব্যাপারটা নিয়ে আমরা থোড়াসা মুসিবতে পড়ে গেছি। রণতোষবাবু মহল্লায় বেশ পপুলার আদমি ছিলেন। তো এসব কী করে জানাজানি হয়ে গিয়ে লোকাল থানায় পাবলিকের প্রেসার এসেছে। তাতে এই কেস ঘুরেফিরে এখন আমার হাতে—।’

‘আর তুমি সেই রিলে রেসের লাঠিটা এখন আমার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছ!’ বলে হো-হো করে হেসে উঠলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।

রঘুপতি না হেসে সিরিয়াস মুখে বলল, ‘আপ জো ভি সমঝে, গুপ্তাসাব, এই কেস আপনাকে সেটল করতে হবে—নো আদার অলটারনেটিভ।’

এসিজি সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, ‘তা হলে চলো, স্পটে একবার যাওয়া যাক। জায়গাটা কোথায় যেন বললে, লালাবাগান?’

‘হ্যাঁ। আমি একবার ওখানে ঘুরে এসেছি। তার রিপোর্ট এই ফাইলেই আছে। য়ু ক্যান গো থ্রু ইট। এখন বলুন, আপনি কবে যেতে পারবেন—।’

ভুরু উঁচিয়ে চোখ কপালে তুললেন অশোকচন্দ্র কবে মানে! আজ—এখনই! তোমার কোনও অসুবিধে নেই তো?’

‘আমার অসুবিধে! এটাই এখন আমার সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট অ্যাসাইনমেন্ট। আপনি তা হলে রেডি হয়ে নিন, নীচে আমার গাড়ি আছে।’

রঙ্গলাল গোস্বামী এতক্ষণে মুখ খুললেন, এসিজিকে লক্ষ করে তিনি বললেন, ‘আপনার তদন্তরসে হব কি বঞ্চিত/লালাবাগানে রঙ্গলাল সঙ্গী অবাঞ্ছিত?’

রঙ্গলালের কাব্যের সুড়সুড়িতে এসিজি হেসে ফেললেন, বললেন, ‘ছি, ছি, কী যে বলেন! আপনি সঙ্গী হলে আমাদের দারুণ ভালো লাগবে।’

তৈরি হয়ে ওঁরা তিনজনে নেমে এলেন রাস্তায়। তারপর উঠে পড়লেন রঘুপতির নিয়ে আসা গাড়িতে।

কোনও-কোনও সৌন্দর্য এমন হয় যা পুরুষকে স্থবির করে দেয়। তার অন্তরে আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। সে সেই সৌন্দর্যের ঘনিষ্ঠ হতে চায়, তাকে অপলকে দেখতে চায়, স্পর্শ করতে চায়—তার মাঝেই সবরকম পাওয়া পূর্ণ হয়।

একতলার একফালি বারান্দায় মেয়েটিকে দেখার পর অশোকচন্দ্র গুপ্তের সেইরকমই মনে হল।

বয়েস সাতাশ/আটাশ, সুঠাম শরীর, ফরসা রং, মাথায় ঘন কালো চুল। নাকের ডানপাশে—ঠোঁটের কাছাকাছি একটা স্পষ্ট তিল। চোখের রং সামান্য কটা। শরীরে বাড়তি মেদের আভাস। সিঁথিতে সিঁদুরের কোনও রেখা নেই।

এসিজির পিছন থেকে রঘুপতি যাদব চাপা গলায় বলল, ‘সুমিতা নিয়োগী। রণতোষবাবুদের ভাড়াটে। ওঁর হাজব্যান্ড বছরতিনেক আগে কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। একটা বছর আটেকের লেড়কি আছে—নাম বকুল। এ ছাড়া শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন—।’

পুরোনো বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে অশোকচন্দ্র রঘুপতির চাপা গলার ধারাবিবরণী শুনছিলেন। ও সুমিতা নিয়োগী, তার শ্বশুর জলধর নিয়োগী, শাশুড়ি পারুল নিয়োগী সম্পর্কে টুকরো-টুকরো খবর বলছিল। অবশ্য তথ্যগুলো এতই সাদামাটা যে, সেগুলোকে ঠিক খবর বলা যায় না।

সুমিতার স্বামী শশধর নিউ আলিপুরে একটা প্রাইভেট ফার্মে স্টোর অফিসারের চাকরি করতেন। খুব সরল-সোজা মানুষ ছিলেন। সুমিতার সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে । সুমিতার বাপের বাড়ি বাগনান। সেখানকার অবস্থা তেমন একটা সচ্ছল নয়। শশধর প্রায়ই ওদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। অবশ্য বাবা-মাকে লুকিয়ে।

দোতলায় উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে এসিজি রঘুপতিকে জিগ্যেস করলেন, ‘এত হাঁড়ির খবর তুমি পেলে কোথা থেকে?’

রঘুপতি বলল, ‘সুমিতা নিয়োগীর সঙ্গে আলাদা কথা বলেছি। আর শশধরবাবুর দফতরে খোঁজ নিয়েছিলেন মানিকতলা থানার অফিসার মজুমদার।’

রঙ্গলাল গোস্বামী এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। তবে বেশ কৌতূহল নিয়ে চারপাশের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখছিলেন, আর কান পেতে এসিজি ও রঘুপতির কথাবার্তা শুনছিলেন। ওঁর মুখে একটা গোয়েন্দা-গোয়েন্দা ভাব ফুটে উঠেছিল।

দোতলায় পৌঁছতেই তিনি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জীর্ণ বাড়ির অজীর্ণ রোগ/বাড়ির গন্ধে মৃত্যুযোগ—।’

অশোকচন্দ্র একবার রঙ্গলালবাবুর দিকে শুধু দেখলেন, কিছু বললেন না। কিন্তু তাঁর মনে হল, রঙ্গলালবাবুর কথা বুঝি একেবারে মিথ্যে নয়। বাড়িটা যে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরোনো তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তা ছাড়া, বাড়িটায় ঢোকার পর থেকেই কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ তাঁর নাকে আসছে। গন্ধটার মধ্যে সাবান অথবা ডিটারজেন্টের গন্ধের ধরন আছে।

ওঁদের তিনজনকে প্রথম দেখতে পেলেন অন্তরা দত্ত। একটু মোটাসেটা গিন্নি-গিন্নি চেহারা। চোখে বুদ্ধির ছাপ। মহিলা বোধহয় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আর-একটা ঘরে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, তিনজন অতিথিকে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই রঘুপতি যাদবকে চিনতে পেরে মুখে একচিলতে সৌজন্যের হাসি ফুটিয়ে তুললেন।

‘মিসেস দত্ত, রণতোষবাবুর সুইসাইডের ব্যাপারে আমরা একটু বাতচিত করতে এসেছি। ইনি আমার স্যার, ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত। আর ইনি মিস্টার রঙ্গলাল গোস্বামী—পোয়েট।’

রঙ্গলালবাবু ঘাড় হেলিয়ে বিনীত হেসে বললেন, ‘পোয়েট নয়, ন্যাচারাল পোয়েট। মানে, স্বভাব-কবি।’

অন্তরা দত্ত শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে ওঁদের ভেতরে আসতে বললেন। ছিমছামভাবে সাজানো ছোট মাপের বসবার ঘরে ওঁদের বসিয়ে মিসেস দত্ত চলে গেলেন। তার কয়েক সেকেন্ড পরেই ঘরে এসে ঢুকলেন পরিতোষ দত্ত। লম্বা রোগাটে চেহারা। চোখে চশমা। রং মাঝারি। কপালে কয়েকটা ভাঁজ।

পরিতোষ দত্ত যে চেষ্টা করে বিরক্তির ভাব লুকিয়ে রেখেছেন সেটা বুঝতে এসিজির কোনও অসুবিধে হল না। পোশাক দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোক অফিসে বেরোচ্ছেন।

‘কী ব্যাপার, ইন্সপেক্টর যাদব, দাদার সুইসাইডের ইনভেস্টিগেশান এখনও শেষ হয়নি! আমি এখন অফিসে বেরোচ্ছি—।’

রঘুপতি যাদব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর চোয়ালের রেখা দেখে কিছুটা বিপদ আঁচ করেছিলেন অশোকচন্দ্র। তাঁর অনুমান মিথ্যে হল না।

পরিতোষ দত্তর চোখে সরাসরি তাকিয়ে রঘুপতি বলল, ‘আপনি আজ অফিসে যাচ্ছেন না, পরিতোষবাবু। আর আপনার বড়া ভাই সুইসাইড করেননি—মে বি ইট ওয়াজ মার্ডার।’

পরিতোষ দত্তর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল পলকে। আর তখনই দেখা গেল, দরজার পরদার পাশটিতে কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছেন অন্তরা দত্ত। ওঁর মুখেও এখন রক্তের অভাব।’

‘মার্ডার!’ পরিতোষবাবু ভীষণ চমকে গেলেন। হতবুদ্ধিভাবে তিনজনের দিকে পালা করে দেখলেন : ‘কেন, আপনারাই তো বললেন, ব্যাপারটা প্লেন সুইসাইড!’ একটু থেমে ইতস্তত করে তারপর : ‘তা ছাড়া, আমরা তো জানি, দাদা বেশ ক’দিন ধরে ডিপ্রেশানে ভুগছিল।’

‘আপনি এত এক্সাইটেড হয়ে পড়ছেন কেন জানি না, মিস্টার দত্ত—’ শক্ত গলায় বলল রঘুপতি, ‘ইনভেস্টিগেশান করার সময় আমাদের যা-যা মনে হয়েছে বলেছি। লেকিন কে আপনাকে বলল যে, ইনভেস্টিগেশান খতম হয়েছে!’ পরিতোষ দত্তর হাত ধরে একটা চেয়ারের দিকে এগিয়ে দিল রঘুপতি ‘আইয়ে, বয়েঠ যাইয়ে। আমার স্যার আপনার সঙ্গে থোড়াবহত বাতচিত করবেন।’

স্কুল ছুটির পরে জোর করে আটকে রাখা ছাত্রের মতো গোমড়া মুখ করে পরিতোষ দত্ত একটা চেয়ারে বসলেন। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলেন শুভ্রকেশ হুনুরের দিকে।

অশোকচন্দ্র শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। তারপর নিজের পরিচয় দিলেন, হেসে বললেন, ‘আমি এক হুনুর, এখানে হুনুরি, মানে, গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছি। ইন্সপেক্টর যাদব কলেজ-জীবনে আমার ছাত্র ছিল—।’

রঘুপতি বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘এখনও তাই।’

রঙ্গলাল গোস্বামীর সঙ্গেও পরিতোষ দত্তর পরিচয় করিয়ে দিলেন এসিজি। তারপর গলা তুলে বললেন, ‘মিসেস দত্ত, আপনি ভেতরে আসুন। আপনি এখানে এসে বসলে আমাদের কাজের কোনও অসুবিধে হবে না।’

অন্তরা দত্ত একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। তারপর কুণ্ঠিত পায়ে ঘরের ভেতরে এসে ঢুকলেন। ভদ্রমহিলার মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। পরনে সামান্য অগোছালো ছাপা শাড়ি। বোঝা যায়, রান্নাবান্নার কাজে সাময়িক ইস্তফা দিয়ে কৌতূহল মেটাতে চলে এসেছেন এ-ঘরে।

স্ত্রীকে দেখে পরিতোষ দত্ত যেন অকূল পাথারে খড়কুটো খুঁজে পেলেন। সাততাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো না, এনারা এখন বলছেন দাদা আত্মহত্যা করেনি, ব্যাপারটা খুনও হতে পারে…।’

অন্তরা দত্ত বেশ শান্ত গলায় বললেন, ‘খুন হোক আর আত্মহত্যা হোক, যে-মানুষ্টা চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না।’

এসিজি বেশ অবাক হয়ে অন্তরাকে দেখলেন। ওঁর চেহারার সঙ্গে এই ধীর স্থির মন্তব্য যেন একেবারেই বেমানান।

অন্তরা এসিজিকে লক্ষ করে বললেন, ‘আমাদের যা-যা বলার পুলিশকে বহুবার বলেছি। নতুন কিছু আর বলার নেই। তবু যদি কিছু আপনাদের জিগ্যেস করার থাকে তা হলে বলুন…।’

ক’দিন ধরে বেশ গুমোট চলছে। আকাশে মেঘ আছে, কখনও-কখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টিও পড়ছে। কিন্তু থার্মোমিটারের পারা তাতে নড়ছে বলে মনে হয় না।

ছোট্ট ঘরটার একজোড়া জানলা দিয়ে আকাশ দেখা না গেলেও তার চেহারা-চরিত্র স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছিল। ঘরের সিলিং ফ্যানের ব্লেডগুলো ক্রমাগত ঘুরপথে ছুটে-ছুটে এখন যেন হাঁফাচ্ছে। সেইসঙ্গে সামান্য ক্যাঁচকোঁচ শব্দও তুলছে।

এসিজি স্বামী-স্ত্রীকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখলেন।

পরিতোষ দত্ত বেশ সচকিত। সাপের ঝাঁপির ডালা আচমকা খুললে সাপ যেরকম সতর্ক হয়ে যায়। অথচ অন্তরা দত্ত অবিচলিত—অন্তত দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। একেই বোধহয় পরিভাষায় বলে ‘কুল-কাস্টমার।’

‘রণতোষবাবু আপনাদের সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করতেন?’ অন্তরাকে লক্ষ করে প্রথম প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন এসিজি।

‘হ্যাঁ। আমার হাতের রান্না দাদা খুব পছন্দ করতেন।’

‘মারা যাওয়ার আগে বেশ ক’দিন ধরে উনি ডিপ্রেশানে ভুগছিলেন শুনলাম। এর কারণ কিছু আঁচ করতে পারেন?’

পরিতোষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওঁকে বাধা দিয়ে অন্তরা বললেন, ‘সেরকম কিছু না। তবে দাদা ইদানীং পাপ, শাস্তি, মৃত্যু—এসব নিয়ে খুব পড়াশোনা করছিলেন…।’

অশোকচন্দ্র আড়চোখে রঘুপতির দিকে তাকালেন।

পরিতোষ দত্ত আলতো গলায় বললেন, ‘দাদা এমনিতে খুব ইমোশনাল ছিল। যে-কোনও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভীষণ সিরিয়াসলি ভাবত।’

‘উনি বিয়ে করেননি কেন?’

‘সংসারের নানান কর্তব্য করতে গিয়ে নিজের বিয়েটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি।’

পরিতোষ দত্তর উত্তর শুনে অশোকচন্দ্র গুপ্ত তেমন সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শাকের আড়ালে কোথায় যেন মাছের গন্ধ পেলেন। এও লক্ষ করলেন, অন্তরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছেন—চোখে শাসনের ভ্রূকুটি।

এসিজি মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। কার্বন ফ্রেমের চশমাটাকে নেড়েচেড়ে ঠিক করে বসালেন। তারপর অন্তরার থেকে সৌজন্য অনুমতি নিয়ে নতুন একটা উইলস ফিলটার ধরালেন।

ধোঁয়া ছেড়ে বহুক্ষণ ধরে পরিতোষ দত্তকে দেখলেন এসিজি। সহজে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এমন নার্ভাস মানুষ। রণতোষ দত্তর চেয়ে প্রায় আঠারো-বিশ বছরের ছোট। কিন্তু স্বাস্থ্যের হাল এমনই যে, ওঁর পক্ষে দাদার ওপরে শারীরিক জোর খাটানো অসম্ভব। যদি না কেউ ওঁকে সাহায্য করে থাকে। তা ছাড়া, এখানে আসার পথে রঘুপতি যা বলেছে তাতে মৃতদেহে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন ছিল না। শুধু পাকস্থলীতে সামান্য পরিমাণে ভ্যালিয়াম পাওয়া গেছে। রণতোষ দত্ত যদি সত্যি-সত্যিই খুন হয়ে থাকেন তা হলে তাঁকে বোধহয় আগে থেকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কাবু করে ফেলা হয়েছিল।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘রণতোষবাবুর সঙ্গে কারও কোনও প্রেম—মানে, অ্যাফেয়ার ছিল?’

‘এর সঙ্গে সুইসাইডের সম্পর্ক কী?’ হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে গিয়েই পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন পরিতোষ। তারপর চকিতে একবার তাকালেন অন্তরার দিকে।

অন্তরা চোখ নামিয়ে ফেলেছিলেন।

রঘুপতি অধৈর্য হয়ে বলল, ‘ইনভেস্টিগেশান আপ কর রহে হ্যায় ইয়া হম! স্যার যা জানতে চাইছেন তার সহি জবাব দিন—।’

রঙ্গলাল গোস্বামী কপালে ভাঁজ ফেলে সবাইকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। ওঁর মুখের গোয়েন্দা-গোয়েন্দা ভাবটা এখনও যায়নি।

একটু ইতস্তত করে অন্তরা দত্ত বললেন, ‘দাদার একটা—ইয়ে ব্যাপার ছিল। এটা প্লিজ পাঁচকান করবেন না—ওঁর সুনাম নষ্ট হবে।’ কিছুক্ষণ সময় নিলেন অন্তরা। তারপর : ‘বছরচারেক আগে দাদার সঙ্গে ওঁর এক ছাত্রীর একটা অ্যাফেয়ার হয়েছিল। ছাত্রীটি ম্যারেড ছিল—তাই একটু-একটু স্ক্যান্ডালও হয়েছিল। মেয়েটি পরে কলকাতার পাট চুকিয়ে ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়। তখন দাদা খুব শকড হয়েছিলেন—ডিপ্রেশানে ভুগেছিলেন। তারপর ধীরে-ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়…।’

এসিজি স্বামী-স্ত্রীকে লক্ষ করছিলেন।

কখনও কোনও শক পেলে তার জন্য চারবছর পর কেউ সুইসাইড করে না। তা হলে কি রঘুপতির ‘মার্ডার’ থিয়োরিটাই সত্যি!

এরপর আরও কিছুক্ষণ ওঁদের সঙ্গে কথা বলার পর এসিজি বললেন, ‘রঘুপতি, চলো, এবার আসল জায়গায় যাওয়া যাক। রণতোষবাবুর ঘরটা আমি ভালো করে একবার দেখতে চাই।’

দত্ত দম্পত্তির অনুমতি নিয়ে ওঁরা তিনজনে ছাদের দিকে রওনা হলেন।

অগোছালো বই আর কাগজপত্রের স্তূপের কথা বাদ দিলে বলতে হয় ঘরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো।

ছাদের দক্ষিণ কোণ ঘেঁষে ঘরটা দাঁড়িয়ে। ছাদে উঠে কোনাকুনি চলে যেতে হয় ছাদের অপর প্রান্তে। সেখানেই কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অকুস্থল। একুশ দিন আগে এখানেই ঘটে গেছে দুঃখের ঘটনা।

ঘরের সিলিং বেশ নিচু। সেখান থেকেই ঝুলছে চকোলেট রঙের সিলিং ফ্যান। ঘরের বাঁ-দিক ঘেঁষে মামুলি বিছানা। আর ডানদিকে লেখাপড়ার টেবিল আর একটা চেয়ার। ঘরের দু-দেওয়ালে ছোট মাপের একজোড়া করে জানলা।

বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকায় ঘরে কেমন একটা গুমোট ভাব ছিল। তা ছাড়া সর্বত্র ধুলো ছড়িয়ে আছে। রঘুপতি নাক সামান্য কুঁচকে টেবিলের দিকের জানলা দুটো খুলে দিল।

রঙ্গলালবাবু আলতো গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘এসিজি স্যার, আমি কি বিছানায় আসন গ্রহণ করতে পারি?’

এসিজি ঘরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। রঙ্গলালের প্রশ্নে সামান্য চমকে উঠে বললেন, হ্যাঁ, পারেন—এবং ওখানেই বসে থাকবেন, নইলে আমাদের কাজের অসুবিধা হবে। রঘুপতির দিকে তাকিয়ে : ‘ওটাই সেই চেয়ার?’

‘হ্যাঁ, গুপ্তাসাব—ওয়ান অ্যান্ড ওনলি চেয়ার।’

এ-কথা শুনে বৃদ্ধ হুনুর তৎপরভাবে চলে গেলেন চেয়ারটার কাছে। ওটা তুলে নিয়ে এসে রাখলেন সিলিং ফ্যানের ঠিক নীচে। তারপর জ্বলন্ত সিগারেট হাতেই উঠে পড়লেন চেয়ারের ওপরে।

মাথা তুলে সিলিং ফ্যানটাকে একবার দেখলেন এসিজি, তারপর হাত বাড়ালেন তার দিকে।

এসিজির হাত ফ্যানে পৌঁছে গেল, কিন্তু তার ডাউন রড পর্যন্ত পৌঁছল না—খানিকটা ফাঁক থেকে গেল।

রঘুপতি বলল, ‘রণতোষ দত্ত প্রায় আপনার মতোই লম্বা ছিলেন—পাঁচ-আট।’

ঘরের একমাত্র পাখা বন্ধ থাকায় ওঁরা তিনজনেই দরদর করে ঘামছিলেন। রঙ্গলালবাবু ডানহাতের চেটো নেড়ে নিজেকে বাতাস করার চেষ্টা করছিলেন।

এসিজি চেয়ার থেকে নেমে পড়ে রঘুপতিকে বললেন, ‘পাখাটা চালিয়ে দাও—।’

সিলিং ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। অশোকচন্দ্র তার নীচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মাথার ভেতরে নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর তাঁর নজর হেঁটে বেড়াচ্ছিল ঘরের সর্বত্র।

চারিদিকে শুধু বই আর বই। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাতা এবং কাগজপত্র। ঘরের একদিকের দেওয়ালে একটা বাংলা ও একটা ইংরেজি ক্যালেন্ডার। একটা খাটো টুলের ওপরে বসানো চোদ্দো ইঞ্চি সাদা-কালো টিভি। তার পাশেই মেঝেতে সাদা রঙের জলের জগ।

ঘরের ডানদিকের দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে একটা মাঝারি মাপের আয়না। তার নীচের তাকে চিরুনি, ক্রিম, পাউডার আর ওষুধপত্র। তার পাশে দেওয়ালের হুক থেকে ঝুলছে বেশ কয়েকটা ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি-লুঙ্গি।

অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এসিজি হাতের সিগারেট শেষ করলেন। তারপর আনমনাভাবে এগিয়ে গেলেন টেবিলের কাছে। টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে সিগারেটের টুকরোটা গুঁজে দিলেন।

মাথার চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে বৃদ্ধ হুনুর এবার বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করলেন।

তারই মাঝে রঘুপতিকে জিগ্যেস করলেন, ‘ওঁর কোনও ডায়েরি-টায়েরি পাওয়া যায়নি?’

‘না—।’ নির্লিপ্ত গলার জবার দিল রঘুপতি।

রণতোষ দত্ত মানুষটাকে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। রঘুপতির ফাইলে অধ্যাপক দত্তের ছবি দেখেছেন তিনি। নীচের বসবার ঘরে তাঁর দেওয়ালে-টাঙানো ফটোও দেখেছেন—ফটোয় ফুলের মালা দেওয়া। এখন ফুলের মালাটাকে গলার ফাঁস বলে মনে হচ্ছিল।

গাড়িতে করে এখানে আসার পথে রঘুপতির দেওয়া ধারাবিবরণী এসিজির মনে পড়ছিল।

ঘটনার দিন সকালে রণতোষবাবুর চা দিতে গিয়ে অন্তরা দত্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। তখন প্রায় আটটা বাজে। তিনি ছুটে এসে স্বামীকে দুর্ঘটনার কথা জানাতেই ব্যাপারটা রাষ্ট্র হয়। পরিতোষবাবু সঙ্গে-সঙ্গে মানিকতলা থানায় ফোন করে খবর দেন। ওঁদের এই বিপদের সময় একতলায় ভাড়াটেরাও পাশে এসে দাঁড়ান। বিশেষ করে সুমিতা তো পরিবারের একজন হয়ে প্রতিটি কাজে অন্তরাকে সাহায্য করেছেন।

রণতোষ দত্তর ব্যাপারটা যদি সত্যিই খুন হয় তা হলে কার-কার উদ্দেশ্য এবং সুযোগ থাকতে পারে সেটাই এসিজি মনে-মনে খতিয়ে দেখছিলেন। কিন্তু বারবারই তাঁর হিসেব হোঁচট খাচ্ছিল।

নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে গভীর টান দিলেন অশোকচন্দ্র। তাঁর মাথা—যাকে তিনি ‘থিঙ্কিং মেশিন’ বলেন—কি বিগড়ে গেল! সুইসাইড, না মার্ডার? খুন, না আত্মহত্যা?

হাতড়াতে-হাতড়াতে হঠাৎই কতকগুলো কাগজ খুঁজে পেলেন এসিজি। প্রথম কাগজটার মাথায় শিরোনাম লেখা : পাপ ও মৃত্যু।

তারপর পাতার পর পাতা শুধু বিভিন্ন লেখা থেকে উদ্ধৃতি টোকা রয়েছে। বিখ্যাত-বিখ্যাত মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে মন্তব্য—ছোট-বড়, ইংরেজি-বাংলা নানারকম। তারই মধ্যে জন মিলটনের লেখা একটা ইংরেজি লাইন দেখতে পেলেন এসিজি :

‘Death is the golden key that opens the palace of eternity.’

তার নীচে বাংলা তর্জমাও চোখে পড়ল ‘মৃত্যু হল সোনার চাবি—যা দিয়ে অনন্তের প্রাসাদের দরজা খুলে যায়।’

প্রায় প্রতি পৃষ্ঠাতেই রণতোষবাবুর হতে লেখা বেশ কিছু মন্তব্য এসিজি লক্ষ করলেন। একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় বড়-বড় হরফে লেখা : ‘মৃত্যু যদি স্বর্গ হয়, জীবন তা হলে নরক। আমি মানুষ বলেই আমার অন্তরে পাপ আছে।’

পৃষ্ঠাগুলো প্রথম থেকে পরপর দেখছিলেন অশোকচন্দ্র। সাধারণ রুলটানা দিস্তে কাগজে লেখা। প্রত্যেক পাতায় পৃষ্ঠার সংখ্যা বসানো।

সুইসাইড নোটটা যে একই ধরনের কাগজে লেখা সেটা এসিজির বেশ মনে ছিল। হঠাৎই একটা ব্যাপার লক্ষ করে তিনি চমকে উঠলেন। পাতাগুলোর মধ্যে দু-নম্বর পৃষ্ঠাটা নেই!

সাদা চুলের গোছায় আলতো করে টান মারলেন এসিজি। তাঁর থিঙ্কিং মেশিনের চাকা বনবন করে ঘুরতে শুরু করল।

মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য। রুলটানা কাগজ। বলপয়েন্ট পেন। সুইসাইড নোট। পাপ ও মৃত্যু।

রণতোষ দত্ত কি কোনও কারণে পাপবোধে কাবু হয়ে পড়েছিলেন? সেইজন্যেই পাপ ও মৃত্যু নিয়ে এতসব কথা ভাবছিলেন? নাকি তিনি নেহাতই পড়াশোনা বা গবেষণার তাগিদে মৃত্যু সম্পর্কে নানারকম মন্তব্য সংগ্রহ করছিলেন?

আনমনাভাবে সিগারেট টানতে-টানতে চেয়ারটার কাছে চলে এলেন বৃদ্ধ হুনুর। বিড়বিড় করে বললেন, ‘মৃত্যু যদি স্বর্গ হয়, জীবন তা হলে নরক…’ তারপর চেয়ারে বসে পড়লেন।

মৃত্যু সকলের অপছন্দের, অথচ মৃত্যু অনিবার্য। তাই মৃত্যুকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কতরকম মহিমাই না তার ওপরে আরোপ করেছেন দার্শনিক ও সাহিত্যিকরা! মৃত্যু হল সোনার চাবি! মৃত্যু হল স্বর্গ!

এসিজি মাথা নাড়লেন। না, মৃত্যু অতি জঘন্য, মৃত্যু অত্যন্ত কুৎসিত। বিশেষ করে অস্বাভাবিক মৃত্যু।

মাথা তুলে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেন এসিজি। তিনি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন, রণতোষ দত্তর কঠোর সুপুরুষ শরীরটা সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে। কোন এক অলৌকিক বাতাসে শরীরটা সামান্য দুলছে। তাঁর পায়ের চেটো অল্পের জন্য এসিজিকে স্পর্শ করছে না।

দরজায় শব্দ হতেই ঘোর ভাঙল এসিজির।

দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন পরিতোষ দত্ত। তাঁর চোখেমুখে অপ্রস্তুত বিব্রত ভাব। কিন্তু তার সঙ্গে সামান্য কৌতূহলও যে মিশে আছে, সেটা এসিজির নজর এড়াল না।

ঘরের চারপাশে ঝটিতি একপ্রস্থ নজর চালিয়ে নিয়ে পরিতোষ বললেন, ‘ভাবলাম… একবার… ইয়ে… দাদার ঘরটা ঘুরে আসি। আপনাদের ইনভেস্টিগেশানে…ইয়ে…ডিসটার্ব করলাম না তো?’

পরিতোষ দত্তর আচমকা হাজির হওয়াটা এসিজি তেমন পছন্দ করেননি। হাতের সিগারেটে একটা ছোট্ট টান দিয়ে পরিতোষবাবুর দিকে সরাসরি না তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ভাড়াটের সঙ্গে আপনাদের কেস চলছে?’

পরিতোষ দত্ত স্পষ্ট চমকে উঠলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমতা-আমতা করলেন, কোনও জবাব খুঁজে পেলেন না। তারপর একটু সামলে নিয়ে বললেন, ‘না, কেস ঠিক নয়…সবে উকিলের সঙ্গে একটু কথা-টথা বলেছি। আসলে আমাদের ঘরগুলো ভীষণ ছোট-ছোট। তা ছাড়া, অন্তরা…ইয়ে…আমার ওয়াইফ বলছিল একতলাটায় একটা সেলাইয়ের স্কুল খুলবে। ওর সেলাইয়ের হাত খুব ভালো…।’

এসিজি আপনমনেই হেসে ফেললেন। অঙ্কটা যে কত সহজ এবার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

পরিতোষকে লক্ষ করে তিনি বললেন, ‘আপনি যান, আপনার ওয়াইফকে গিয়ে বলুন, আমাদের কাজ হয়ে গেছে। এক্ষুনি আমরা নীচে নামছি।’

ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে পরিতোষ চলে গেলেন।

এসিজি এবার রঘুপতিকে লক্ষ করে প্রশ্ন করলেন, ‘কিছু আন্দাজ করতে পারলে, রঘুপতি?’

রঘুপতি যাদবের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। বোধহয় ও কিছু একটা ভাবছিল। অশোকচন্দ্রের প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল : ‘কী, স্যার?’

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন বৃদ্ধ হুনুর। হাতের ছোট হয়ে আসা সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে চলে গেলেন টেবিলের কাছে। সিগারেটের টুকরোটা গুঁজে দিলেন অ্যাশট্রেতে। তারপর হেসে বললেন, ‘আমাদের তদন্ত কেমন চলছে সেটা দেখার জন্যে অন্তরা দত্ত বোধহয় স্বামীকে পাঠিয়েছিলেন। আর দাদা মারা যাওয়ার পর পরিতোষবাবু বাড়ির মালিক হওয়ামাত্রই ভাড়াটেদের উচ্ছেদ করার জন্যে কেস করার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। সেটা কার পরামর্শে তা তো আন্দাজ করতেই পারছ—।’

‘সব বাড়িওয়ালাই তো টেনান্টের এগেইনস্টে কেস করে—’ রঘুপতি সাদামাঠা গলায় বলল।

এসিজি বিড়বিড় করে বললেন, ‘সেরকম হলে তো প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল ছিল। কিন্ত সুমিতা নিয়োগীকে দেখার পর আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটা বোধহয় ততটা প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল নয়—।’

রঙ্গলাল গোস্বামী ছোট্ট করে মন্তব্য করলেন, ‘একে তো যুবতী তায় এক্সট্রিম সুন্দরী/তাঁকে ঘিরে জমে উঠবে স্যারের হুনুরি।’

কথায়-কথায় জানা গেল, জলধর নিয়োগী দশ বছর হল চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। কিন্তু মানুষটিকে দেখে তা বোঝায় উপায় নেই। লম্বা, শক্ত কাঠামো। মাথায় টাক পড়েছে। তাকে ঘিরে কাঁচাপাকা চুল। দু-কানেও খানিকটা করে চুল। চোখে কালো ফ্রেমের সাধারণ চশমা। তবে চামড়ার ভাঁজ খুঁটিয়ে দেখলে বয়সের আঁচ করা যায়।

এসিজি জলধর নিয়োগীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। তাঁর ডানপাশে বসা রঙ্গলালবাবু ঘরের ছাদের দিকে মুখ তুলে আনমনাভাবে কিছু একটা আওড়াচ্ছিলেন। তাঁর চায়ের কাপ অনেকক্ষণ আগেই শেষ।

কথাবার্তার সময় সুমিতা দু-একবার ঘরে ঢুকেছিল। কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে ছিল অশোকচন্দ্রের দিকে। তারপর আবার চলে গেছে ঘর থেকে। ওর বছর দশেকের মেয়ে বকুল একবার চলে এসেছিল ‘দাদুর’ কাছে। সুমিতা ‘পড়া শেষ হয়নি এখনও—পড়তে চলো’ বলে স্নেহের ধমক দিয়ে ডেকে নিয়ে গেছে।

ঘরটা ছোট মাপের। চেহারায় নিম্ন মধ্যবিত্ত, মলিন। একপাশে ছাপা চাদরে ঢাকা বিছানা। তার পাশে ট্রাঙ্ক, আলনা, ঠাকুরের আসন। সেখান থেকেই বোধহয় হালকা ধূপের গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। জলধরবাবু বিছানায় বসেছেন। অশোকচন্দ্র আর রঙ্গলাল নড়বড়ে চেয়ারে। সামনে যথেষ্ট মেরামত করা একটা টেবিল।

জলধরবাবুর সঙ্গে সহজ-সরল গল্প জুড়ে দিয়েছিলেন অশোকচন্দ্র। সেই গল্প করতে-করতেই কীভাবে যেন অধ্যাপক রণতোষ দত্তর কথা এসে পড়েছিল।

‘দারুণ মানুষ ছিলেন। চাকরিজীবনে বহু লোক চরিয়েছি। লোক চিনি। অন্তরটা বড় পরিষ্কার ছিল।’ থেমে-থেমে স্মৃতিচারণের সুরে কথাগুলো বললেন জলধর নিয়োগী। ওঁর চোখ সামান্য ঘোলাটে লাগছিল। কথা থামিয়ে পরনের লুঙ্গি আর হাফহাতা সাদা ফতুয়া টেনেটুনে ঠিকঠাক করলেন। তারপর এসিজির দিকে তাকালেন।

স্থির চোখে মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে জলধরবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘এইরকম একটা মানুষ—হঠাৎ কেন সুইসাইড করল বলুন তো?’

এসিজি হাসলেন। মাথার পিছনে হাত চালিয়ে সাদা চুলোর গোছায় বারদুয়েক টান মেরে বললেন, ‘সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তো আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি—।’

‘বিরক্ত হওয়ার কী আছে।’ বৃদ্ধ মানুষটি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ‘কেউ সুইসাইড করলে তার তো একটা কারণ নিশ্চয়ই থাকবে। যদি না অবশ্য অন্য কিছু হয়। আপনার কী মনে হচ্ছে?’

সময় নিতে একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। তারপ লাইটার পকেটে রেখে ঠোঁটে সিগারেট নিয়েই বললেন, ‘মনে হওয়ার ব্যাপারটা এখনও ঝাপসা, মিস্টার নিয়োগী—।’

কিন্তু সতিই কি ঝাপসা? রণতোষ দত্ত মানুষটা কি একটু-একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে না? ছবিটা যখন পুরোপুরি স্পষ্ট হবে তখন বোঝা যাবে মানুষটা কেন মারা গেল, কীভাবে মারা গেল। সুইসাইড না মার্ডার?

গত দু-দিন ধরে রঘুপতি যাদবের দেওয়া কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখেছেন এসিজি। প্রতিটি কাগজের প্রতিটি অক্ষর মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। তারপরই মনে হয়েছে, বছর পঞ্চান্নর এক সুদর্শন অধ্যাপককে তিনি দেখতে পাচ্ছেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। অকৃতদার, কর্তব্যপরায়ণ, ভালোমানুষ। কিন্তু মানুষটার মুখটা এখনও অস্পষ্ট, আর চোখ দুটো ঝাপসা।

এসিজি রঘুপতিকে বলেছিলেন, তিনি বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে চান। রঘুপতি তাতে হেসে বলেছে, স্যার যত খুশি কথা বলুন, ওর আপত্তি নেই। ওর শুধু অঙ্কের উত্তর চাই।

অতএব তৃতীয় দিন সন্ধেবেলা অশোকচন্দ্র এসে হাজির হয়েছেন লালাবাগানের এই জীর্ণ বাড়িতে। সঙ্গে রঙ্গলাল গোস্বামী। রঙ্গলালবাবুর শখ হয়েছে এসিজির মতো ‘প্রতিভাবান’ গোয়েন্দার কার্যকলাপ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো পর্যবেক্ষণ করবেন। তাই পর্যবেক্ষণের এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি।

কিছুক্ষণ একমনে সিগারেটে টান দিলেন এসিজি। তারপর হঠাৎই বৃদ্ধ মানুষটিকে প্রশ্ন করলেন, ‘রণতোষবাবুর ভাই পরিতোষবাবু কীরকম লোক?’

বড় মাপের একটা নিশ্বাস ফেললেন জলধর নিয়োগী, তারপর বললেন, ‘এমনিতে বোধহয় তেমন খারাপ লোক নন। দোষের মধ্যে বউয়ের কথায় চলেন। দাদার সঙ্গে মাঝে-মধ্যে কথা কাটাকাটি হত।’

‘কী নিয়ে কথা কাটাকাটি হত?’ শান্ত গলায় জিগ্যেস করলেন অশোকচন্দ্র।

ঠোঁট ওলটালেন জলধর নিয়োগী : ‘ঠিক কী নিয়ে তা জানি না। তবে কথাবার্তার মধ্যে ব্যাঙ্ক, টাকাপয়সা, লোন—এসব শুনতাম।’

‘আপনাদের বাড়িভাড়ার টাকা কে নিত?’

‘প্রথম-প্রথম আমিই দিয়ে আসতাম। রণতোষবাবুর কাছে। বছর দশেক হল আমি গেঁটে বাতে ভুগি। তাই পরের দিকে খোকা—মানে, শশধর দিয়ে আসত—’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বৃদ্ধের বুক ঠেলে : ‘ও—ইয়ে—চলে যাওয়ার পর থেকে বউমা—মানে, সুমিতা দিয়ে আসে।’

‘কাকে? রণতোষবাবুকে?’

‘কখনও-কখনও বড়ভাইকে দিয়ে আসত। কখনও ছোটভাইকে। কখনও বা ছোটভাইয়ের বউকে—।’

‘বাড়িওয়ালা হিসেবে এঁরা কেমন?’

ফতুয়ার ভেতরে হাত চালিয়ে গায়ে হাত ঘষলেন জলধর, বললেন, ‘রণতোষবাবু তো দারুণ মানুষ ছিলেন। খোকা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের জন্যে কী না করেছেন! খোকার অফিসে দৌড়োদৌড়ি করা, ই এস আই অফিসে যাওয়া, এল আই সি, প্রভিডেন্ট ফান্ড—সব ব্যাপারে আমাদের হেল্প করেছেন। সেইজন্যেই তো সংসারটা ভেসে যায়নি। তা ছাড়া, খোকা মারা যাওয়ার পর বাড়িভাড়া সাড়ে চারশো থেকে তিনশো করে দিয়েছিলেন। আজকের যুগে এরকম ভাবা যায়?’

এসিজির কাছে রণতোষ দত্তর মুখটা একটু-একটু করে স্পষ্ট হচ্ছিল। তিনি আচমকা একটা অপ্রীতিকর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বৃদ্ধের দিকে : ‘যদি শোনেন পরিতোষবাবু ভাড়াটে উচ্ছেদ করার জন্যে কেস করার তোড়জোড় শুরু করেছেন, তা হলে আপনার কেমন লাগবে?’

‘অবাক লাগবে না। এটাই তো নিয়ম। পারুলকে বলেছি। সুমিতাকেও আমার সন্দেহের কথা বলেছি। দিনদশেক আগে পাড়ার মাদার ডেয়ারির দোকানে খবরটা পেলাম। যাকগে, যা হয় হবে…।’

এসিজি ভাগ্যনির্ভর বৃদ্ধকে দেখছিলেন। দেবতা, ধূপ আর ভাগ্য কখনও দুর্ঘটনাকে রুখতে পারে না।

রঙ্গলাল গোস্বামী বোধহয় অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। কারণ তিনি বারবার ঘড়ি দেখছিলেন। একফাঁকে এসিজির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘এনাকে নিয়ে অনেক হল, এবার ক্ষান্ত দিন/তেনাকে ডেকে করুন শুরু, জবানবন্দী নিন।’

অশোকচন্দ্র হাসি চেপে জলধরবাবুকে লক্ষ করে বললেন, ‘যদি আপনি অনুমতি দেন তা হলে আপনার বউমা সুমিতাদেবীর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’

জলধরবাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎই যেন চমকে উঠে বললেন, ‘ওহ, হ্যাঁ—হ্যাঁ। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি—।’

উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ট্রাঙ্কের ওপরে রাখা একটা তোবড়ানো সস্তা অ্যাশট্রে তুলে নিয়ে এলেন বৃদ্ধ। সেটা এসিজির সামনে টেবিলে নামিয়ে রেখে বিড়বিড় করে বললেন, ‘খোকা খুব সিগারেট খেত…।’

অভিনয় শেষ করে মঞ্চ ছেড়ে বৃদ্ধ অভিনেতা যেমন সহজ ছন্দে উইংসের দিকে এগিয়ে যায়, কথাটা বলে ঠিক সেইভাবে নিষ্ক্রান্ত হলেন জলধর নিয়োগী।

পাশের কোনও বাড়িতে সময়ের ঘণ্টা বাজছিল। অশোকচন্দ্র ঘণ্টা গুনলেন আটটা। তারপর সিগারেটের টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতেই সুমিতা এসে ঘরে ঢুকল।

পরনে ওর আটপৌরে ছাপা শাড়ি। কিন্তু সেও যেন কালি লেপে সূর্যদেবতাকে মলিন করার মিথ্যে চেষ্টা। সুমিতার রূপ উষ্ণ তরঙ্গের মতো ঘরের পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিল। এ যেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের অমোঘ ভ্রমণ। অশোকচন্দ্রের মনে পড়ে গেল জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের কথা।

‘আমাকে ডেকেছেন?’

আড়চোখে রঙ্গলালকে দেখলেন বৃদ্ধ হুনুর। স্বভাবকবি মানুষটি স্তব্ধ বিস্ময়ে অপলকে সুমিতাকে দেখছেন।

সুমিতা বিছানার এককোণে সঙ্কুচিতভাবে বসল।

অশোকচন্দ্র ইতস্তত করে আলতো স্বরে বললেন, ‘সবই তো জানেন। আপনাকে বিরক্ত করতে খুবই খারাপ লাগছে। রণতোষবাবুর ব্যাপারেই কয়েকটা কথা বলব…।’

‘বলুন—।’

‘আপনি ওঁকে কীরকম চিনতেন?’

‘ভালো করেই চিনতাম।’ সঙ্কোচহীন গলায় উত্তর দিল সুমিতা, ‘ওরকম ভালোমানুষ ক’জন হয়! উনি চলে যাওয়াতে আমাদের সবার খুব ক্ষতি হয়ে গেল।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামল সুমিতা। তারপর ভুরু কুঁচকে এসিজির দিকে তাকিয়ে হঠাৎই প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, ওঁর সুইসাইড নিয়ে এতদিন পর আবার খোঁজ করছেন কেন?’

অশোকচন্দ্র কী যেন ভাবলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে ব্যাপারটা সুইসাইড নয়, মার্ডার।’

সুমিতার ফরসা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখ চঞ্চল হয়ে ওকে উদভ্রান্তের মতো দেখাল।

‘খুন! অসম্ভব! রণতোষবাবু খুন হতেই পারেন না। ওঁর কোনও শত্রু ছিল না। দেবতার মতো মানুষ ছিলেন। ওঁকে প্রত্যেকে ভালোবাসত—।’

শেষ শব্দটা এসিজির কানে বাজল। দেবতার প্রতি মানুষের ভালোবাসা! সুমিতাকে সামান্য খোঁচা দেওয়ার জন্যই তিনি বললেন, ‘ভালোবাসলে কি আর খুন করা যায় না!’

সুমিতা মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, ‘হয়তো যায়। আপনি খুন-জখম-রাহাজানি অনেক দেখেছেন। আপনি ভালো জানবেন। তবে রণতোষবাবুর বেলায় এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’

সুমিতাকে একটু সহজ হওয়ার সময় দিয়ে এসিজি প্রশ্ন করলেন, ‘মাঝে-মাঝে বাড়িভাড়া দিতে যাওয়া ছাড়া আপনার সঙ্গে ওঁর আর কোনও কথা হত না?’

‘কেন হবে না! আমার—আমার হাজব্যান্ড মারা যাওয়ার পর উনি সব ব্যাপারে হেলপ করেছেন। বাবা কিংবা আমি ওসব পেরে উঠতাম না। সব জায়গায় অ্যাপ্লিকেশন লিখে দেওয়া, ফর্ম ফিল-আপ করা, দৌড়োদৌড়ি করা—সব রণতোষবাবু করেছেন। কোনওরকম ধকল আমাদের টের পেতে দেননি—’

‘একটা কথা আপনাকে জিগ্যেস করছি। কিন্তু একটা রিকোয়েস্ট আছে—এটা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করবেন না…।’

সুমিতা মুখে একবার হাত বুলিয়ে নিল। তারপর বলল, ‘আলোচনা করার আমার আমার কে-ইবা আছে! আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।’

‘শুনেছি বছর-চারেক আগে রণতোষবাবুর সঙ্গে তাঁর এক ছাত্রীর একটা অ্যাফেয়ার হয়েছিল। ব্যাপারটা নিয়ে একটু-আধটু স্ক্যান্ডালও হয়—’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর এসিজি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন?’

সুমিতা মুখ নিচু করল। ওর চোয়াল শক্ত হল। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘না, জানি না। তবে তার সঙ্গে রণতোষবাবুর সুইসাইডের সম্পর্ক কী?’

‘না, সেরকম কিছু নয়। আমার মনে হচ্ছিল উনি বোধহয় খুব আবেগপ্রবণ মানুষ।’

‘আবেগপ্রবণ হওয়াটা কি অপরাধ?’ এসিজির চোখে চোখ রেখে সরাসরি প্রশ্ন করল সুমিতা।

‘না, অপরাধ কেন হবে?’ হাসলেন অশোকচন্দ্র।

‘আসলে গন্ডগোলটা কোথায় জানেন?’ সপ্রতিভভাবে বলে উঠল সুমিতা, ‘কোনও একটা অ্যাফেয়ার হলেই পুরুষদের দোষটা সকলের আগে চোখে পড়ে। এ-ব্যাপারেও মনে হয়, রণতোষবাবুকে অনেকে দোষী ভাবছে, আর ছাত্রীটিকে নির্দোষ। কে জানে!’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমিতা : ‘যার-যার বিচার তার-তার কাছে…’

সুমিতা নিয়োগীকে এখন আর মোটেই অসহায় বিধবা মনে হচ্ছিল না। ওর সৌন্দর্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের একটা আভা ছড়িয়ে পড়ছিল। মেয়েটিকে ক্রমশই ভালো লাগছিল এসিজির।

আর কিছু বলে ওঠার আগেই ঘরে এসে ঢুকল বকুল। ফরসা রং, একমাথা কোঁকড়া চুল, কটা চোখ—একেবারে মায়ের মতো হয়েছে।

বকুল ঘরে ঢুকেই মায়ের কাছে গিয়ে বায়নার সুরে বলল, ‘আমার পড়া হয়ে গেছে। এখন ওই ম্যাজিকটা আলমারি থেকে বের করে দাও—।’

এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘কী ম্যাজিক, মা-মণি?’

বকুল চটপট জবাব দিল, ‘দুটো প্যাঁচ খাওয়া পেরেকের ম্যাজিক।’

এসিজি হেসে বললেন, ‘বুঝেছি। ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে নাড়াচাড়া করে পেরেক দুটোকে আলাদা করতে হয়, তাই না?’

‘হ্যাঁ—’ মাকে ছেড়ে এসিজির দিকে দু-পা এগিয়ে এল বকুল। চোখ বড় করে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কী করে জানলে?’

অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘আমি অনেক ম্যাজিক জানি। এখুনি তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাচ্ছি। তুমি আমাকে দু-গ্লাস জল এনে দাও।’

‘দু-গ্লাস জল কেন?’ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইল বকুল।

‘একগ্লাস খাব, আর-একগ্লাস জল দিয়ে ম্যাজিক দেখাব।’

‘আমি নিয়ে আসছি—’ বলে সুমিতা তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল জল নিয়ে আসতে।

দু-গ্লাস জল এসে পড়ল একটু পরেই। এসিজি একটা গ্লাস তুলে নিয়ে সেটার জল দ্বিতীয় গ্লাসে খানিকটা ঢেলে দিলেন। তাতে দ্বিতীয় গ্লাসটা কানায় কানায় ভরতি হল। তখন প্রথম গ্লাসের জল ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন তিনি। তারপর একটু দম নিয়ে সুমিতাকে বললেন, ‘একটা পুরোনো পোস্টকার্ড দিতে পারেন?’

সুমিতা একটা পোস্টকার্ড খুঁজে এনে দিল।

পোস্টকার্ডটা টইটম্বুর গ্লাসের ওপর চেপে বসিয়ে দিলেন এসিজি। তাতে গ্লাসের মুখটা ঢাকা পড়ে গেল। তখন পোস্টকার্ড সমেত জল ভরতি গ্লাসটাকে সাবধানে ধরে সেটাকে উলটে দিলেন। তারপর ধীরে-ধীরে নীচের হাতটা সরিয়ে নিলেন। পোস্টকার্ড ঢাকা দেওয়া গ্লাস-ভরতি জল দিব্যি স্থির হয়ে রইল।

এ-দৃশ্য দেখে বকুল খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল।

এসিজি গ্লাসটা আবার সাবধানে সোজা করে রেখে দিলেন টেবিলে।

বকুল এবার চলে এল এসিজির কাছে। আবদার করে বলল, ‘আমাকে এর সিক্রেটটা শিখিয়ে দাও—।’

এসিজি ওকে বুঝিয়ে বললেন, বাতাসের চাপ পোস্টকার্ডে চাপ দিয়ে একগ্লাস জলকে কীভাবে সহজে ধরে রাখতে পারে।

বকুল অবাক বিস্ময়ে বৃদ্ধের কথা শুনছিল।

ওকে বোঝানো শেষ করে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘আমি আরও অনেক ম্যাজিক জানি। তোমাকে সেগুলোর সিক্রেট শিখিয়ে দেব পরে।’

বকুলের গাল টিপে আদর করে অশোকচন্দ্র উঠে পড়লেন। সুমিতাকে বললেন, ‘চলি, মিসেস নিয়োগী। আমাকে হেলপ করার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।’

সুমিতা উঠে দাঁড়িয়েছিল। এসিজির কথায় ছোট্ট করে হেসে বলল, ‘আপনার সামান্য ক’টা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি—একে হেলপ বলে না।’

অশোকচন্দ্র কয়েক সেকেন্ড কী ভেবে বললেন, ‘আচ্ছা পরিতোষ দত্ত, অন্তরা দত্ত কেমন মানুষ বলুন তো—।’

সুমিতার মুখটা পালটে গেল। নিজেকে সামলে নিতে খানিকটা সময় নিল, তারপর চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘মানুষ? আচার-আচরণ দেখে তো মনে হয় না।’

বকুল শাড়ি ধরে ওকে বিরক্ত করছিল। সুমিতা আলতো ধমক দিয়ে মেয়েকে বলল, ‘ভেতরে যাও—।’

মেয়েটা একটা জলের গ্লাস আর ভিজে পোস্টকার্ড নিয়ে চলে গেল ভেতরে।

এসিজি একাগ্র ছাত্রের মতো সুমিতার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

সুমিতা বলল, ‘ভদ্রমহিলা তো প্রায়ই নোংরা ভাষায় চিৎকার করে ঝগড়া করেন। কখনও কাজের বউয়ের সঙ্গে, কখনও স্বামীর সঙ্গে, আর কখনও বা ভাসুরের সঙ্গেও ঝগড়া করতেন। অবশ্য এগুলোকে ঠিক ঝগড়া বলা যায় না, কারণ ব্যাপারগুলো সবসময়েই একতরফা হত। রণতোষবাবু এ নিয়ে আমার কাছে বারকয়েক আক্ষেপও করেছেন।’

‘পরিতোষবাবু স্ত্রীকে কখনও বারণ করতেন না?’

‘না, ওঁর পক্ষে বারণ করা সম্ভব নয়। সে-ক্ষমতা ওঁর নেই—।’

বিষণ্ণ হাসল সুমিতা : ‘ওঁদের সঙ্গে কথা বললেই আপনি সব বুঝতে

পারবেন।’ কী খেয়াল হতেই ও আরও বলল, ‘আপনি তো ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন—।’

‘হ্যাঁ, বলেছি…’ চিন্তিতভাবে জবাব দিলেন এসিজি, ‘আবারও বলব।’

রঙ্গলালবাবু অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিলেন কিছু একটা বলার জন্য। এখন সুযোগ পেয়ে বলে বসলেন, ‘রণতোষবাবু যদি সুইসাইড করে থাকেন তা হলে তার কারণ কিছু আন্দাজ করতে পারেন?’

সুমিতার মুখটা হঠাৎ পালটে গেল। মাথা নিচু করে চোখের কোণ টিপল কয়েকবার। যখন মুখ তুলল তখন ফরসা মুখ খানিকটা লালচে, থমথমে। একটু সময় নিয়ে ও বলল, ‘কী জানি, জানি না…’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আরও যোগ করল, ‘ওঁর কাছে যেটা যথেষ্ট কারণ বলে মনে হয়েছে সেটা হয়তো অন্য কারও কাছে কোনও কারণই নয়। সুইসাইডটা হয়তো সম্পূর্ণ অকারণে…।’

‘আর মার্ডার হলে?’ অশোকচন্দ্র জানতে চাইলেন।

‘তা হলেও একই কথা বলব। ওঁকে খুন করারও কোনও যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে না।’

একটু ভাবলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তারপর বললেন, ‘রাত বাড়ছে। এবার চলি, মিসেস নিয়োগী। পরে আবার দেখা হবে।’

রঙ্গলাল গোস্বামী সুমিতাকে নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, তা হলে এবার যাই। খুনির যেন দেখা পাই।’

ভাঙাচোরা আলো-আঁধারি অলিপথে পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন দু-জনে।

অশোকচন্দ্র গুপ্ত একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,

‘রঙ্গলালবাবু, খুনির দেখা পাওয়া খুব সহজ নয় বলে মনে হচ্ছে। আর-একদিন এসে অন্তরা দত্তর সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

রঙ্গলালবাবু হেসে জিগ্যেস করলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আইডিয়ার ওপরে বেস করে দু-লাইনের একটা ছোট্ট কবিতা শোনাব?’

এসিজি পালটা হেসে বললেন, ‘শোনান। আমি বারণ করলে কি আপনি ক্ষান্ত হবেন!’

গলাখাঁকারি দিয়ে রঙ্গলাল বললেন, ‘স্যার, আপনার কথার মানে অনেকটা এইরকম। সহজে খুনি ধরতে আমায় কহ যে/খুনি কখনও দেয় না ধরা সহজে।’

‘সাধু! সাধু!’ শান্তিনিকেতনী ঢঙে স্বভাব-কবিকে বাহবা দিলেন অশোকচন্দ্র।

জানলা দিয়ে বিকেলের আলো দেখা যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত ভাবছিলেন, এখনই যদি ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে তা হলে কেমন হয়। অথচ এখনও সন্ধে হতে অনেক দেরি।

রণতোষ দত্তর জীবনে অতর্কিতে সন্ধে নেমে এসেছে। সেই সন্ধের আঁধারে এসিজি পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন। অন্তরা দত্তের শেষ কথাটা তাঁকে ভাবিয়ে তুলছিল।

রঙ্গলাল গোস্বামীকে সঙ্গী করে বিকেল-বিকেল দত্তবাড়িতে চলে এসেছেন এসিজি। পরিতোষ দত্ত এখনও অফিস থেকে ফেরেননি। অন্তরার মেয়ে টুসি বোধহয় ভেতরে কোথাও রয়েছে। কলতলার দিক থেকে বাসন মাজার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।

অন্তরা চা-বিস্কুট দিয়ে এসিজি ও রঙ্গলালকে আপ্যায়ন করলেন। তারপর সন্দিহান সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে ওঁদের সামনে বসলেন।

চা শেষ করা পর্যন্ত অশোকচন্দ্র মামুলি কথাবার্তা বলছিলেন। তারপর শেষ চুমুক শেষ হতেই অন্তরার কাছ থেকে সৌজন্যের অনুমতি নিয়ে একটা উইলস ফিলটার ধরালেন। রণতোষবাবুর কথা তুলে প্রথম প্রশ্ন করলেন অশোকচন্দ্র, ‘ওঁর সুইসাইডের ব্যাপারটা আপনি প্রথম জানতে পারেন?’

অন্তরা সহজ স্বরে সপ্রতিভ জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। সকালবেলা চা দিতে গিয়েছিলাম। রোজ সকালে আমিই দাদাকে চা দিয়ে আসি। তো গিয়ে দেখি দরজা ভেজানো। দু-একবার ডাকাডাকি করে দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। আর তখনই সব দেখতে পেলাম—মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে যেন শিউরে উঠলেন অন্তরা। চাপা গলায় বললেন, ‘বীভৎস দৃশ্য!’

‘উনি মারা যাওয়াতে সবাই খুব শকড হয়েছেন। নীচের তলার জলধরবাবু, সুমিতা ওঁর কথা খুব বলছিলেন, খুব প্রশংসা করছিলেন।’

‘সে তো করবেই!’ বিরক্তভাবে উত্তর দিলেন অন্তরা, ‘ভাড়া না নিলে, বিনিপয়সায় পড়ালে লোকে প্রশংসা তো করবেই।’

এসিজি অবাক হলেন। সিগারেটে গভীর টান দিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘রণতোষবাবু বিনি পয়সায় কাকে পড়াতেন, বকুলকে?’

‘না, বকুলের মাকে—।’

খবরটা শুনে অশোকচন্দ্র যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সুমিতাকে পড়াতেন রণতোষবাবু! কই, সুমিতা নিয়োগী তো এ-কথা তাঁকে বলেননি!

‘সুমিতাকে কী পড়াতেন?’

‘বাংলা। ওর নাকি বাংলা নিয়ে পড়াশোনার খুব আগ্রহ। সত্যি-মিথ্যে ও-ই জানে।’

বোঝা গেল, সুমিতার ছাত্রী হওয়াটা অন্তরা মোটেই পছন্দ করেননি। বিশেষ করে পুরোনো এক ছাত্রীর সঙ্গে আবেগতাড়িত সম্পর্কের বিড়ম্বনার পর।

‘সুমিতা কোথায় পড়তেন? একতলায় নিজেদের ঘরে, নাকি রণতোষবাবুর ঘরে?’

‘কখনও নীচে, কখনও চিলেকোঠার ঘরে—’ নিস্পৃহভাবে বললেন অন্তরা, ‘তবে দাদা খুব ভদ্র, সংযমী মানুষ ছিলেন।’

‘আপনারা ছাড়া ছাদের ঘরে আর কে-কে যাতায়াত করত? সুমিতা দেবী?’

‘হ্যাঁ—’ একটু থেমে অন্তরা আরও বললেন, ‘ওর মেয়েটাও যখন-তখন যেত। বকুলকে দাদা খুব ভালোবাসতেন। কথায়-কথায় নানান গিফট দিতেন। আসলে দাদার ভেতরে কোথায় যেন একটা অভাববোধ ছিল—।’

কিছুক্ষণ চুপ করে কী ভাবলেন এসিজি। তারপর অন্তরার চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মিসেস দত্ত, দাদার ঘরে কখনও এমন কিছু আপনার চোখে পড়েছে যা আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে?’

ঠোঁটে দাঁত চেপে কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন অন্তরা, তারপর বললেন, ‘না, সেরকম কিছু দেখিনি।’

‘আগের দিন আপনি বলছিলেন আপনার দাদা ইদানীং পাপ, শাস্তি, মৃত্যু—এইসব নিয়ে ভাবছিলেন। এসব উনি কেন ভাবছিলেন আন্দাজ করতে পারেন?’

‘জানি না। দাদা এমনিতে খুব নীতিবাগীশ মানুষ ছিলেন। পাপ করার লোক উনি ছিলেন না। তবু কেন ওসব ভাবছিলেন কে জানে!’

এসিজি প্রশ্ন করার মতো আর কিছু ভেবে পেলেন না।

রঙ্গলাল গোস্বামীকে ইশারা করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, অন্তরাকে বললেন, ‘চলি—।’

অন্তরা দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। সামান্য উদ্বিগ্ন স্বরে জিগ্যেস করলেন, ‘ঠিক করে বলুন তো, মিস্টার গুপ্ত, ব্যাপারটা কী—সুইসাইড, না মার্ডার?’

অশোকচন্দ্র সিগারেটে শেষ টান দিয়ে হাসলেন, বললেন, ‘খুন হোক আর আত্মহত্যা হোক, যে-মানুষ্টা চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না।’

অন্তরা বুঝতে পারলেন এসিজি ওঁর বলা কথা ওঁকেই ফেরত দিলেন। ওঁর মুখে সামান্য লালচে আভা ফুটে উঠল।

অশোকচন্দ্র গুপ্ত আর রঙ্গলাল গোস্বামী বাইরের চাতালে বেরিয়ে এলেন। হাতের সিগারেটের টুকরোটা এককোণে রাখা আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিলেন এসিজি।

রঙ্গলাল গোস্বামী বললেন, ‘প্রশ্ন উত্তরের পালা শেষ হল, স্যার / এবারে বলুন সুইসাইড না মার্ডার।’

এসিজি বললেন, ‘এখন শুধু আর-একজনের সঙ্গে কথা বলা বাকি—।’

‘কে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন রঙ্গলাল।

‘বকুল—’ হেসে বললেন এসিজি।

দোতলা থেকেই ওঁরা বকুলের গলা পাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, ও ছুটতে-ছুটতে জীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে।

সিঁড়ির মুখে দুজনকে দেখেই ফুটফুটে মেয়েটা একগাল হেসে বলল, ‘তোমার জন্যে ওয়েট করছিলাম। এখন একটা ম্যাজিক দেখিয়ে তার সিক্রেটটা শিখিয়ে দাও—।’

এসিজি পালটা হেসে বললেন, ‘ছাদে চলো, তোমাকে আজ অনেকগুলো ম্যাজিক শিখিয়ে দেব। তবে একটা কন্ডিশান আছে—।’

‘কী কন্ডিশান?’ বকুল চোখ গোল-গোল করে প্রশ্ন করল।

‘ছাদে চলো, বলছি—।’

সরু সিঁড়ি বেয়ে ওরা তিনজন উঠে এলেন ছাদে।

একপাশে কয়েকটা ফুলগাছের টব। এলোমেলোভাবে টাঙানো নাইলনের দড়িতে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় ঝুলছে। বিকেলের রোদ মরে এসেছে, তবে একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। একটু দূরেই নিষ্পাপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অকুস্থল।

এসিজি ছাদের সুরকি ওঠা ময়লা মেঝেতে বসে পড়লেন। বকুলকে কাছে ডেকে বললেন, ‘আমি তোমাকে অনেক ম্যাজিকের সিক্রেট শিখিয়ে দেব। তবে এক্সচেঞ্জে তোমাকেও কিছু সিক্রেট বলতে হবে।’

‘কী সিক্রেট, বলো—।’

‘রণতোষ জেঠুর সুইসাইডের ব্যাপারে।’

চোখের পলকে বাচ্চা মেয়েটার মুখ পালটে গেল।

বোঝা গেল, এসিজির আন্দাজে ছোড়া ঢিল ঠিক জায়গায় লেগেছে। রঙ্গলালের মনে হয়, বকুল বোধহয় সত্যিই কোনও সিক্রেট জানে।

বকুলকে পিঠ চাপড়ে সাহস দিলেন এসিজি, বললেন, ‘বলো, কোনও ভয় নেই। আমরা কাউকে বলব না—।’

একটুক্ষণ কী যেন ভাবল বকুল। তারপর যান্ত্রিক স্বরে বলল, ‘রনো আঙ্কলের ঘর থেকে আমি শুধু একটা বাক্স নিয়ে এসেছি—।’

‘কীসের বাক্স?’ ভেতরে-ভেতরে সামান্য উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন এসিজি। চেষ্টা করে তাঁকে গলার স্বর স্বাভাবিক রাখতে হল।

‘মায়ের বাক্স—’ অম্লানবদনে এসিজির প্রশ্নের জবাব দিল বকুল।

‘মায়ের বাক্স তোমার আঙ্কলের ঘরে গেল কী করে?’ রঙ্গলালবাবু এবার সক্রিয় ভূমিকা নিলেন।

‘তা তো জানি না। বোধহয় মা নিজেই আঙ্কলকে দিয়েছে।’

‘তুমি ঘরের কোথায় বাক্সটা পেলে?’ এসিজি জানতে চাইলেন।

‘ফ্লোরে পড়ে ছিল—।’

‘বাক্সটা তুমি কবে নিয়ে এসেছে?’

‘যেদিন সকালে রনো আঙ্কল সুইসাইড করেছিল, সেদিন।’

‘রনো আঙ্কল তখন কী করছিল?’

‘ওপরদিকে…অল্প-অল্প দোল খাচ্ছিল…।’

‘মাই গড!’ শিউরে উঠে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন এসিজি।

রঙ্গলালবাবুও বেশ ঘাবড়ে গিয়ে অবাক চোখে বাচ্চা মেয়েটাকে দেখতে লাগলেন।

বকুলকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে যা জানা গেল তার সারমর্ম এই, সুযোগ পেলেই ও রনো আঙ্কলের ছাদের ঘরে চলে যেত। ঘটনার দিন সকালে ও একটা নতুন ওয়াটার বটল আঙ্কলকে দেখাতে গিয়েছিল। গিয়ে দ্যাখে, রণতোষবাবু সিলিং পাখা থেকে বিশ্রীভাবে ঝুলছেন। ও ভীষণ ভয় পেয়ে পালিয়ে চলে আসে মায়ের কাছে। মাকে ফিসফিস করে সব বলতেই মা ভয়ে কেঁদে ফ্যালে। তারপর ওকে চুপিচুপি একটা কাজ করতে বলে। কাজটা হল, রণতোষ দত্তর ঘর থেকে খুঁজে একটা কাঠের বাক্স নিয়ে আসা। বাক্সটা মায়ের। সবুজ রঙের ওপরে সাদা আলপনা দেওয়া। অনেকটা বাঁধানো বইয়ের মতো দেখতে। বাক্সের ভেতরে কী আছে বকুল জানে না। ও চুপিচুপি আবার চিলেকোঠার ঘরে ফিরে যায়। এদিক-ওদিক একটু নজর দিতেই দেখতে পায় মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে থাকা একটা চেয়ারের পাশে বাক্সটা পড়ে আছে। সেটা বগলদাবা করে ও একছুটে পালিয়ে আসে ওর মায়ের কাছে। মাকে বাক্সটা দিতেই মা সেটা আঁকড়ে ধরে ভীষণ কাঁদতে থাকে। খানিক পরে মা চুপিচুপি ওপরে চলে যায়। একটু পরেই আবার ফিরে আসে। এসে বকুলকে বলে গোটা ব্যাপারটা সিক্রেট রাখতে।

কথার শেষ দিকটায় বকুল বারবার দম নিচ্ছিল, সামান্য হাঁফাচ্ছিল যেন। বক্তব্য শেষ করে এবার ও ওর প্রথম আবদারে ফিরে গেল ‘এবার একটা ম্যাজিক দেখিয়ে তার সিক্রেটটা শিখিয়ে দাও—।’

এসিজি পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ছোট রুবিক কিউব বের করলেন। কিউবটার এক-একটা পিঠে নানারঙের রঙিন খোপ। অভ্যস্ত হাতে কিউবটাকে বারকয়েক মোচড় দিলেন তিনি। একটু পরেই দেখা গেল কিউবটার ছ’পিঠে তৈরি হয়ে গেছে সুন্দর রঙিন নকশা। সেটা বকুলকে দেখিয়ে এসিজি বললেন, ‘এটার নাম হল রুবিক কিউব। প্রমিস করছি, কাল তোমার জন্য এরকম একটা কিউব এনে দেব। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে। মায়ের বাক্সটা তোমাকে এক্ষুনি লুকিয়ে নিয়ে আসতে হবে। ওটা দেখেই আমি তোমাকে আবার ফেরত দিয়ে দেব। ঠিক পারবে তো?’

বেণী দুলিয়ে ঘাড় হেলাল বকুল ‘হ্যাঁ, পারব—’

কথা শেষ হতে-না-হতেই ছাদের সিঁড়ির দিকে ছুট লাগাল বকুল।

ছুটে চলে যাওয়া মেয়েটিকে দেখতে-দেখতে অশোকচন্দ্র আনমনাভাবে মন্তব্য করলেন, ‘দেখা যাক বাক্স-রহস্য থেকে রণতোষবাবুর মৃত্যু-রহস্য ভেদ করা যায় কি না।’

বিকেলের আলো মলিন হয়ে এসেছে। আকাশে দু-একটা পায়রা। রাস্তা দিয়ে ছুটে-চলা গাড়ির শব্দ হালকাভাবে কানে আসছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রণতোষ দত্তর ঘরটা এখন যেন অনেকে বেশি অর্থময়। রুবিক কিউবটা পকেটে রেখে চোখ থেকে কার্বন ফ্রেমের চশমা খুলে নিলেন এসিজি। পাঞ্জাবির কোণ দিয়ে কাচ দুটো মুছলেন। তারপর চশমাটা ঠিকঠাক করে নাকের ওপরে বসালেন। এখন কি সবকিছু আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে?’

ঠিক সেই মুহূর্তে হাঁপাতে-হাঁপাতে ছাদে ফিরে এল বকুল। হাতে বইয়ের মাপের একটা সবুজ কাঠের বাক্স।

বাক্সটা বৃদ্ধ হুনুরের হাতে দিয়েই মেয়েটা হাত বাড়াল তাঁর দিকে ‘তোমার রুবিক কিউবটা আমাকে একটু দাও, আমি একটু খেলি—।’

এসিজি হেসে কিউবটা পকেট থেকে বের করে বকুলের হাতে দিলেন, বললেন, ‘এই নাও। বাক্সটা আনার সময় তোমার মা দেখতে পায়নি তো?’

বকুল মাথা ঝাঁকাল : ‘না।’

এসিজি বললেন, ‘তুমি এবার নীচে চলে যাও। সন্ধে হয়ে আসছে—তোমার মা চিন্তা করবে। আমি যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাব।’

রুবিক কিউবটা হাতে নিয়ে বকুল লাফাতে-লাফাতে চলে গেল।

অশোকচন্দ্র রঙ্গলালবাবুকে বললেন, ‘আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন, রঙ্গলালবাবু। নীচে গিয়ে আপনি সুমিতা নিয়োগীকে ডেকে নিয়ে আসুন। জলধরবাবু বা ওঁর স্ত্রীর যেন জানতে না পারেন। বলবেন, খুব জরুরি ব্যাপার—আমি ওঁর সঙ্গে নিরিবিলি একটু কথা বলতে চাই।’

রঙ্গলালবাবু বিহ্বল চোখে অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বৃদ্ধের কথা শেষ হতেই ঠোঁট উলটে বললেন, ‘মিস্টিরিয়াস ব্যাপার-স্যাপার বুঝিতে না পারি/খুনি যেন চেনা কিন্তু চিনিতে না পারি।’ স্বভাব-কবিতা বলে রঙ্গলাল সুমিতাকে ডেকে নিয়ে আসতে চলে গেলেন।

সুমিতাকে নিয়ে রঙ্গলাল যখন ফিরে এলেন তখন সন্ধের ছায়া মন্থরভাবে নেমে এসেছে।

এসিজি বাক্সটা সুমিতাকে দেখিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এটা আপনার?’

অস্পষ্ট আলোতেও সুমিতা বাক্সটা চিনতে পারল, বলল, ‘হ্যাঁ—কিন্তু এটা আপনি কী করে পেলেন?’

‘বকুল নিয়ে এসেছে। ও আমাদের সব বলেছে—।’

সুমিতা আচমকা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

আকাশের কালচে নীল স্লেটে তখন সন্ধ্যাতারাই একমাত্র আলো।

সুমিতার কান্না-একটু স্তিমিত হয়ে এলে অশোকচন্দ্র প্রশ্ন করলেন, ‘বাক্সের ভেতরে কী আছে, মিসেস নিয়োগী?’

সুমিতা কান্না-প্লাবিত চোখে এসিজির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ছোটবেলার সব জিনিস। মা জমিয়ে রেখেছিল—বিয়ের সময় বাক্সটা আমাকে দিয়েছিল। ওতে আমার ছোটবেলার ফটো আছে, চুলের কাঁটা-ফিতে আছে, খেলার পুতুল আছে, হাতের লেখা আছে—দামি কিছুই নেই।’

‘বাক্সটা রণতোষবাবুকে আপনি দিয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ। উনি আমার ছোটবেলার ফটো, হাতের লেখা—এসব দেখতে চেয়েছিলেন।’

‘কেন?’

এই প্রশ্নে আবার অসহায়ের মতো কেঁদে ফেলল সুমিতা। অনেক কষ্টে অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘সবই আমাদের পোড়া কপাল। আমরা এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সবসময় একটা চোরা টান টের পেতাম—।’

‘সেইজন্যেই কি রণতোষবাবু ইদানীং অপরাধবোধে ভুগছিলেন?’

সুমিতা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। তা ছাড়া, আরও একটা ব্যাপার হয়েছিল।’

‘কী ব্যাপার?’

‘রনোদা…রনোদা…আমাকে পড়াতেন।’ ইতস্তত করে বলল সুমিতা।

‘জানি—’ আলতো করে বললেন এসিজি।

‘একদিন বাংলা উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে-করতে উনি রবীন্দ্রনাথের ”শেষের কবিতা” প্রসঙ্গে চলে এসেছিলেন। তারপর হঠাৎই কেমন বেসামাল হয়ে গিয়ে অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ”সুমিতা, কিছুদিন ধরে কেবলই মনে হচ্ছে তুমি আমার বন্যা, তুমিই আমার মিতা—” এ-কথা বলেই রনোদা আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন…’ সুমিতা মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল।

অশোকচন্দ্র ওকে কান্নার সময় দিয়ে অপেক্ষা করে রইলেন।

সুমিতা একটু পরে কান্না-ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি রনোদাকে শ্রদ্ধা করতাম, ভালোওবাসতাম। তাই ধৈর্য হারানোটা আমার খারাপ লাগেনি। কিন্তু তারপরই দেখলাম আক্ষেপে গ্লানিতে ”ছি-ছি” করে উনি একেবারে ভেঙে পড়লেন। বারবার বলতে লাগলেন, ”এ কী অন্যায় আমি করে বসলাম!” আমি যতই ওঁকে বোঝালাম যে এটা অন্যায় নয়, এমনকী কোনও দুর্ঘটনাও নয়। বরং যা স্বাভাবিক তাই-ই হয়েছে। কিন্তু রনোদা মানতে পারেননি। অপরাধবোধে একেবারে ডুবে গিয়েছিলেন। আমি অনেক করে বুঝিয়েও ওঁকে শান্ত করতে পারিনি। পাপ, শাস্তি, মৃত্যু—এসব নিয়ে লিখে-লিখে পাতার পর পাতা ভরতি করে ফেললেন। তারপর…।’

এসিজির মনে পড়ল, ‘পাপ ও মৃত্যু’ শিরোনামে এই লেখাগুলোই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন।

‘তারপর…’ আবার বলতে লাগল সুমিতা, ‘তারপর সেই ডিপ্রেশন থেকেই সুইসাইড করলেন।’

‘সুইসাইড কেমন করে বুঝলেন?’

আবছা অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সুমিতার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘রনোদার সুইসাইড নোটটা আমার কাছে আছে। বকুল ওই বাক্সটা নিয়ে আসার পর আমি চুপিচুপি রনোদার ঘরে আসি। দেখি সুইসাইড নোটটা রনোদার লেখার টেবিলে খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। তাতে লেখা, ”তোমাকে কখন ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। আর বুঝতে পারিনি বলেই বশ হারিয়ে ওই পাপে তোমাকে জড়িয়ে ফেলেছি। তারপর থেকে বারবার লজ্জায় আমি মরে গেছি। এবার সত্যি-সত্যি মরলাম।”

সুমিতা এবার হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল—সর্বস্বান্ত দিশেহারা মানুষ যেভাবে কাঁদে।

এসিজি কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিলেন।

অনেকক্ষণ পর সুমিতার কান্না থামল।

ও বলল, ”ওই সুইসাইড নোট পুলিশের হাতে গেলে রনোদাকে জড়িয়ে বাজে একটা স্ক্যান্ডাল হত। সেটা আমার পক্ষে সহ্য করা খুব কঠিন হত। আমি আমার চিন্তা করিনি—শুধু রনোদার কথাই ভেবেছিলাম…বিশ্বাস করুন…।’

‘সেইজন্যেই আসল সুইসাইড নোট সরিয়ে রণতোষবাবুর লেখা থেকে একটা পাতার খানিকটা ছিঁড়ে সুইসাইড নোট হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন?’

সুমিতার শরীর ফুলে-ফুলে উঠছিল। বড় করে শ্বাস টেনে ও বলল, ‘হ্যাঁ—রনোদার ওই ”পাপ ও মৃত্যু” নামে লেখার পাতা থেকে—আপনি হয়তো দেখেছেন…।’

অন্ধকারেই ঘাড় হেলালেন এসিজি।

ভারি গলায় সুমিতা বলল, ‘আমাকে যা-খুশি সাজা দিন, কিন্তু দেখবেন, দেবতার মতো ওই মানুষটার কোথাও যেন কালি না লাগে। উনি যে-ভুল করেছিলেন সেটা কোনও ভুলই নয়। কিন্তু ওঁর নীতিবাগিশ মন ভেতরে-ভেতরে ওঁর গলা টিপে ধরেছিল, ওঁকে কুরেকুরে খাচ্ছিল…।’

পাশের কোনও বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ শোনা গেল কয়েকবার।

এসিজি নরম গলায় বললেন, ‘এবারে নীচে চলুন। ব্যাপারটা যাতে ঠিকমতো মিটে যায় সেজন্যে ইন্সপেক্টর যাদবকে আমি রিকোয়েস্ট করব। আপনি সুইসাইড নোটটা আমাকে দিন।’

‘নীচে চলুন, দিচ্ছি—।’

তিনজন ছায়া-ছায়া মানুষ অকুস্থলের পাশ দিয়ে হেঁটে এল সিঁড়ির কাছে। অবসন্নভাবে সিঁড়ি নামতে লাগল।

একতলার কাছাকাছি এসে সুমিতা অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘অনেকবার ভেবেছি সুইসাইড নোটটা পুড়িয়ে ফেলব, কিন্তু পারিনি…ওঁর শেষ লেখা…।’ সুমিতা আবার কেঁদে ফেলল।

রঙ্গলালবাবু বললেন, মিসেস নিয়োগী, প্লিজ… জলধরবাবুরা শুনতে পাবেন।’

এসিজি বললেন, ‘আমরা আর ভেতরে ঢুকব না। আপনি শুধু বকুলকে একবার ডেকে দেবেন। আর…এই নিন আপনার বাক্স…।’

সুমিতা চোখ মুছতে-মুছতে বাক্সটা নিল। তারপর ওঁদের অলিপথে দাঁড় করিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।

একটু পরেই সুমিতা ফিরে এল, একটা ভাঁজ করা কাগজ তুলে দিল এসিজির হাতে। এসিজি সেটা না দেখেই পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল বকুল।

ওকে দেখে এসিজি বললেন, ‘মা-মণি, আমরা এবার গুডবাই—।’

‘আবার যেন দেখা পাই—’ সপ্রতিভভাবে বলল বকুল।

এসিজি অবাক চোখে রঙ্গলালবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘স্বভাব-কবিতা কি সংক্রামক ব্যাধি?’

রঙ্গলাল হাসলেন, কিছু বললেন না।

বকুল অশোকচন্দ্রের রুবিক কিউবটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘আমারটা কাল মনে করে আনবে কিন্তু—।’

এসিজি কিউবটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, ‘অবশ্যই—’ তারপর সুমিতাকে বললেন, ‘মিসেস নিয়োগী, আপনি কোনওরকম দুশ্চিন্তা করবেন না। আর আমরা কাল সন্ধেবেলা আসছি। তখন শুধু চায়ে চলবে না, চায়ের সঙ্গে টা-ও চাই।’

সুমিতা ভেজা চোখ মুছে হাসতে চেষ্টা করল, বলল, ‘আসবেন কিন্তু—।’

রঙ্গলালবাবুকে সঙ্গে নিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত রাস্তায় বেরিয়ে এলেন।

সন্ধ্যের কলকাতা গালে-ঠোঁটে রং লাগিয়ে যথারীতি চঞ্চল হয়ে পড়েছে। এসিজি নতুন একটা সিগারেট ধরাতেই রঙ্গলালবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘সবই তো বুঝলাম, স্যার, কিন্তু ওই এক ইঞ্চির গরমিলের ব্যাপারটা কী হল?’

এসিজি সিগারেটে জম্পেশ টান দিয়ে কুলকুল করে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘বুঝতে পারেননি! ব্যাপারটা তো খুব সোজা। চেয়ার পেতে তার ওপরে ওই কাঠের বাক্সটা রেখে তবেই সিলিং ফ্যানের ঠিকমতো নাগাল পেয়েছিলেন রণতোষবাবু। তারপর ওঁর পায়ের ছটফটানিতে চেয়ার, বাক্স দুটোই উলটে গিয়েছিল—।’

রঙ্গলালবাবু প্রশংসার উজ্জ্বল চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধ হুনুরের দিকে। তারপর সুর করে বললেন, ‘দেখে আপনার তীক্ষ্ন বুদ্ধি/হলেম আমি নিহতবুদ্ধি—।’

এসিজি চমকে রঙ্গলালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘নিহতবুদ্ধি মানে?’

রঙ্গলালবাবু বিনীত হেসে বললেন, ‘এই ওয়ার্ডটা আমার ইনভেনশান, স্যার। নিহতবুদ্ধি মানে হল সাঙ্ঘাতিক হতবুদ্ধি অবস্থা—।’

এসিজি আর হাসি চাপতে পারলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *