বিশ্বাসঘাতিনী

বিশ্বাসঘাতিনী

ব্রিটানির এক প্রাসাদে বাস করত তরুণ এক ব্যারন। দেশের রাজা তাকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল ব্যারন। ব্যারনের স্ত্রী ছিল খুবই সুন্দরী। তবে তার মনটি সুন্দর ছিল না। সে তার স্বামীর সঙ্গে হেসে হেসে অনেক ভালোবাসার কথা বলত। কিন্তু আদপেই ব্যারনকে পছন্দ করত না সে। মহিলা তার হৃদয় উৎসর্গ করে রেখেছিল এক নাইটকে। সে শুধু ভাবত কবে স্বামীকে ছেড়ে নাইটের কাছে পাকাপোক্ত ভাবে চলে যাওয়া যাবে। নাইটকে বিয়ে করাই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য।

প্রতি হপ্তায় পালা করে তিনদিন ব্যারন প্রাসাদে অনুপস্থিত থাকত। তার স্ত্রী কিংবা কেউ জানত না সে কোথায় গেছে বা কী করছে। মহিলা খালি চিন্তা করত কীভাবে জানা যায় হপ্তায় তিনদিন তার স্বামী কোথায় যায়। একদিন স্বামীকে অনেক আদর টাদর করার পর সে জিজ্ঞেস করল, যদি সাহস দাও তো তোমাকে একটি অনুরোধ করতে চাই, মাই লর্ড।

হাসল ব্যারন। তুমি জানো তোমার অনুরোধ আমি ফেলতে পারব না। তো শুনি কী চাও তুমি।

প্রতি হপ্তায় তিনদিন তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় যেন চলে যাও। তোমাকে ছাড়া এ বিশাল প্রাসাদে আমার খুবই একা লাগে। তোমাকে অনুরোধ, আমাকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যেয়ো না।

মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল ব্যারন। ঠোঁট থেকে মুছে গেছে হাসি। কথা বলার সময় বিরক্তি প্রকাশ পেল কণ্ঠে।তোমার সঙ্গে সবসময় থাকতে পারলে তো ভালোই হত। কিন্তু তা সম্ভব নয়।

তাহলে তুমি কোথায় যাও এটুকু অন্তত বলল। তাতেও খানিকটা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারি। কিন্তু জবাব দিল না ব্যারন। তার স্ত্রী নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করেই যেতে লাগল। বালিশ ভিজিয়ে ফেলল চোখের জলে। কাঁদতে কাঁদতে বলল ব্যারন আসলে তাকে ভালোবাসে না। তাই বলতে চায় না সে কোথায় যায়। বৌকে ভালোবাসত ব্যারন। তার আকুল কান্নায় বিচলিত বোধ করল সে। শেষে বাধ্য হলো মুখ খুলতে। তবে আগে স্ত্রীকে কসম খাইয়ে নিল গভীর গোপন ব্যাপারটি যেন কেউ জানতে না পারে।

আমি আসলে এক ওয়্যারউলফ, বলল সে। তবে ঘটনাচক্রে আমি ওয়্যারউলফে পরিণত হয়েছি। তাতে আমার কোনও হাত ছিল না। প্রতি হপ্তায় তিনটি দিন আমাকে মায়া নেকড়ের রূপ ধরে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে হয়।

তুমি কীভাবে ওয়্যারউলফে পরিণত হও? জানতে চাইল স্ত্রী।

জঙ্গলে ঢুকে আমি পরনের সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলি। তারপর একটি বিশেষ জায়গায় ওগুলো লুকিয়ে রাখি যাতে পরে ওগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। তারপর নেকড়েতে রূপান্তর ঘটে আমার। তিনদিন পরে গায়ে পোশাক চড়াতেই আমি আবার মানুষ হয়ে যাই। মাই লর্ড, তুমি নেকড়ে হওয়ার সময় জামাকাপড় কোথায় লুকিয়ে রাখ? সতর্কতার সাথে প্রশ্ন করল ধূর্ত স্ত্রী।

সে কথা কাউকে বলা যাবে না। কারণ তিনদিন পার হয়ে গেলে আমি যদি জামাকাপড় পরতে না পারি, চিরদিনের জন্য নেকড়ে বনে যাব আমি। ওই পোশাক আবার না পরা পর্যন্ত নেকড়ে হয়েই থাকতে হবে আমাকে।

স্বামীর গোপন রহস্য জেনে খুশিতে বাগ বাগ মহিলা। তবে ওই মুহূর্ত থেকে সামান্যক্ষণের জন্যও সে শান্তি দিল না ব্যারনকে। বারবার একই প্রশ্ন করতে লাগল। বলল স্বামীর ভালোর জন্যই সে জানতে চায় ওয়্যারউলফে পরিণত হওয়ার সময় ব্যারন কোথায় লুকিয়ে রাখে পোশাক। ব্যারন স্ত্রীকে ভালোবাসত, বিশ্বাসও করত। শেষে বলল, জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা একটি চ্যাপল আছে। ওটার কাছে একটি ঝোঁপের আড়ালে রয়েছে ফাঁপা একখণ্ড পাথর। আমি ওই পাথরের ফাঁকে লুকিয়ে রাখি আমার জামা-কাপড়।

মহিলা স্বামীকে চুমু খেয়ে বলল, ব্যারন তাকে বিশ্বাস করে সবচেয়ে গোপন কথাটিও বলে দিয়েছে দেখে সে অভিভূত। সে কথা দিচ্ছে ব্যারনের গোপন রহস্য কোনদিন ফাস করবে না।

কিন্তু ব্যারন যে-ই একা একা প্রাসাদ থেকে রওনা হলো জঙ্গলের উদ্দেশে, তার স্ত্রী ছুটে গেল প্রেমিক নাইটের কাছে। তাকে খুলে বলল সব। অনুরোধ করল ভাঙা চ্যাপেলে গিয়ে ফাঁকা পাথর থেকে স্বামীর পোশাক নিয়ে আসতে। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে কাজটি করল নাইট। ব্যারনের স্ত্রী স্বামীর জামাকাপড় একটি সিন্দুকে লুকিয়ে রাখল।

তিনদিন পরে মায়ানেকড়েরূপী ব্যারন ফাঁপা পাথরের কাছে এসে দেখে তার জামাকাপড় গায়েব। বুঝতে পারল তার স্ত্রী তার সঙ্গে বেঈমানী করেছে। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। কারণ জঙ্গলের বাইরে গেলেই লোকের চোখে পড়লে তারা শিকারী কুকুর খেপিয়ে দেবে, ছুঁড়ে মারবে পাথর, মুগুরপেটা করবে। বনে লুকিয়ে না থাকলে তার জীবন সংশয় হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

কয়েক হপ্তা পার হয়ে গেল। বাড়ি ফিরল না ব্যারন। তার স্ত্রী খানিক চোখের জল ফেলল তবে চেঁচামেচি করল কয়েকগুণ বেশি। চিৎকার করে অভিযোগ করল তার স্বামী তাকে ফেলে রেখে গেছে। তারপর সে প্রেমিক নাইটকে বিয়ে করল। সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাওয়ায় দুজনেই সন্তুষ্ট।

এদিকে নেকড়ে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলে। বেঁচে থাকার জন্য প্রাণী হত্যা করে ক্ষুধা মেটায়। আর মনে মনে শুধু আফসোস করে কেন বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকে বিশ্বাস করে গোপন কথাগুলো বলতে গিয়েছিল।

এভাবে একটি বছর কেটে গেল। একদিন রাজা ওই জঙ্গলে এলেন শিকারে। শিকারী কুকুরের দল মাটিতে নেকড়ের পায়ের ছাপ দেখে তারস্বরে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিল। তাদেরকে ধরে রাখে কার সাধ্য। তারা নেকড়ের পিছু নিল। সারাটি দিন কুকুরগুলো ধাওয়া করল নেকড়েকে। রাজা তার পরিবারবর্গ নিয়ে ছুটলেন। কুকুরের পেছন পেছন। সন্ধ্যা নাগাদ, ক্রমাগত ধাওয়া খেয়ে ক্লান্ত, কাঁটার আঘাতে আহত এবং বিপর্যস্ত নেকড়ে একেবারে নেতিয়ে পড়ল। সে নিশ্চিত আজই মৃত্যু ঘটবে তার শিকারী কুকুরের হাতে। হঠাৎ রাজাকে দেখতে পেল সে। মনে পড়ল এই রাজা একসময় তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। শরীরে যতটুকু শক্তি ছিল, কুকুরগুলোর সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে, তাদের ধারাল দাঁত এবং থাবার আঘাত উপেক্ষা করে সে ছুটে গেল রাজার কাছে। একটা থাবা রাখল রাজার ঘোড়ার রেকাবে এবং রাজার পায়ের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। খ্যাকখ্যাক করতে করতে তেড়ে এল হাউণ্ড বাহিনী। রাজা চাবুক মেরে ওগুলোকে সরিয়ে দিলেন। ভৃত্যদের আদেশ দিলেন কুকুরগুলোকে বেঁধে রাখতে।

এই বেচারী বুনো জন্তুটি আমার কাছে দয়া ভিক্ষা চেয়েছে, বললেন রাজা। ওকে আমি দয়া করব। ওকে আমি ছেড়ে দেব। ও মুক্তভাবে জঙ্গলে চলাফেরা করুক। ঘোড়া নিয়ে ঘুরলেন তিনি। চললেন প্রাসাদে। কিন্তু নেকড়ে তাকে ছেড়ে গেল না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাজার ঘোড়ার পাশে হাঁটতে লাগল। এভাবে প্রাসাদের ফটক পর্যন্ত চলে এল সে। সবাই দৃশ্যটি দেখে আশ্চর্য।

নেকড়েটি আমার কাছে আশ্রয় চাইছে, বললেন রাজা। আমি ওকে আশ্রয় দেব। সে যতদিন ইচ্ছে আমার প্রাসাদে থাকতে পারবে।

তিনি সবাইকে বলে দিলেন কেউ যেন নেকড়েটির কোনও ক্ষতি করার চেষ্টা না করে। নেকড়ের জন্য প্রতিদিন তাজা মাংসের বন্দোবস্ত করা হলো। নেকড়ে থেকে গেল প্রাসাদে। সে প্রাসাদের কারও কোনও ক্ষতি করে না। সবার সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করে। আর রাজাকে অত্যন্ত ভক্তি করে। রাজা যেখানে যান, তাঁর সঙ্গী হয়। নেকড়ে। দিনের বেলাটা সে রাজার পাশে থাকে, রাতে রাজার পায়ের কাছে ঘুমায়। রাজা তার কুকুর বাহিনীর চেয়েও বেশি ভালোবাসেন এই নেকড়েটিকে।

কিছুদিন পরে রাজা তাঁর রাজ্যের সকল জমিদারকে দাওয়াত দিলেন দরবারে। জমিদারদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করলেন, পেটপুরে শাহী ভোজ খাওয়ালেন। এই জমিদারদের মধ্যে সেই নাইটও ছিল যে ব্যারনের স্ত্রীকে বিয়ে করেছিল। সে যখন তার সহকারীদের নিয়ে দরবারে ঢুকল, রাগে গরগর করে উঠল নেকড়ে, পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল নাইটের গায়ে। তাকে যেন গেঁথে ফেলল মাটির সঙ্গে। আশপাশের লোজন সাহায্যের জন্য এগিয়ে না এলে নেকড়ের কামড়ে সেদিন মারাই যেত নাইট। তারা বহু কষ্টে নেকড়ের কবল থেকে উদ্ধার করল নাইটকে।

রাজা এ দৃশ্য দেখে খুবই অবাক। কারণ এর আগে নেকড়েটিকে কারও ওপর হামলা করতে শোনেননি তিনি, দেখা দূরে থাক। তবে শুধু একবার নয়, অন্তত তিনবার নেকড়ে নাইটের ওপর হামলার চেষ্টা করল। নাইটের বন্ধুরা প্রতিবারই তাকে পিটিয়ে খেদাল। নাইট অথবা নেকড়ে, দুজনের যে কেউ মারাত্মক আহত হতে পারে আশংকা করে রাজা নাইট না যাওয়া পর্যন্ত নেকড়েকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখলেন। নাইট নেকড়েকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে দেখে মনে মনে স্বস্তি পেল। নেকড়েটি হঠাৎ তার উপর কেন এমন খেপে উঠল এর সদুত্তর না পেয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজের প্রাসাদে রওনা হলো সে।

এর কয়েক মাস পরের ঘটনা। রাজা আবার সেই জঙ্গলে শিকারে বেরিয়েছেন। তিনি রাতের বেলা জঙ্গলের ধারে, ব্যারনের প্রাসাদের অদূরে তাঁবু খাটালেন। ব্যারনের সাবেক স্ত্রী নিজের এবং তার নাইট স্বামীর জন্য রাজ-অনুগ্রহ পাবার আশায় পরদিন সকালে ঘোড়ায় চড়ে হাজির হলো রাজার তাঁবুতে। সে রাজার জন্য প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে এসেছে। কিন্তু রাজার কাছে আসামাত্র বিকট গর্জন ছেড়ে তার ওপর হামলে পড়ল নেকড়ে। ভয়ে আর্তনাদ ছাড়ল মহিলা। রাজা চট করে দাঁড়িয়ে গেলেন মহিলার সামনে। ফলে নেকড়ের হামলা ব্যর্থ হলো। রাজা না থাকলে মহিলার লোকজন তক্ষুণি মেরে ফেলত নেকড়েকে। রাজার ভয়ে কিছু বলল না।

রাজা নেকড়েকে জড়িয়ে রাখলেন দুহাতে যাতে সে ছুটে যেতে না পারে। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, এই মহিলা ব্যারনের স্ত্রী ছিল। ব্যারন ছিল আমার বন্ধু। সে হঠাৎ করে কোথায় গায়েব হয়ে গেছে কেউ জানে না। যে নাইটকে আমার নেকড়ে হামলা করেছিল সে এই মহিলার দ্বিতীয় স্বামী। সে এখন আমার বন্ধুর জমিদারি শাসন করছে।

রাজা মহিলা এবং নাইটকে রশি দিয়ে বেঁধে মাটির নিচে একটি ঘরে বন্দি করে রাখলেন। অন্ধকার, শীতল ওই ঘরে না খেয়ে থাকতে থাকতে ভয়ে, দুশ্চিন্তায় মহিলার প্রাণ যায় যায়। অবশেষে নিজের অপরাধ স্বীকার করল সে, বলল ব্যারনের জামাকাপড় কোথায় লুকিয়ে রেখেছে।

রাজা সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো নিয়ে আসার হুকুম দিলেন। নেকড়ের সামনে রাখা হলো কাপড়গুলো। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কী ঘটে দেখার জন্য। কিন্তু নেকড়ে শুধু জামাকাপড়ের দিকে তাকিয়েই রইল, নড়াচড়া করল না।

ও আসলে সাধারণ একটি নেকড়ে ছাড়া কিছু নয়, মন্তব্য করল এক পরিষদ। আমরা আমাদের ব্যারনকে কোনদিনই ফিরে পাব না। রাজা মুদৃ গলায় বললেন, এত লোকের সামনে নেকড়ে থেকে ব্যারনে রূপ নিতে ও লজ্জা পাচ্ছে। তিনি জামাকাপড়গুলো নিয়ে নিজের শোবার ঘরের দিকে কদম বাড়ালেন। পেছন পেছন চলল নেকড়ে। রাজা কাপড়গুলো বিছানার ওপর রেখে চলে এলেন। ভেতরে। নেকড়েকে রেখে বন্ধ করে দিলেন দরজা। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। দেখলেন বিছানায় শুয়ে আছে তরুণ ব্যারন। ঘুমাচ্ছে। রাজা তখন যে কী খুশি হলেন তা লিখে বোঝানো যাবে না।

ব্যারনের সাবেক স্ত্রী এবং নাইটকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন রাজা। ব্যারন ফিরে পেল নিজের প্রাসাদ এবং জমিদারি। তবে সে তার বেশিরভাগ সময় মানুষ অথবা নেকড়ের বেশে কাটিয়ে দিল রাজার দরবারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *