রাত যখন বারোটা

রাত যখন বারোটা

ওরা চার বন্ধু। শুভ, রুবেন, দীপ আর মন্টু। বেড়াতে এসেছে মন্টুদের গ্রামের বাড়িতে। মন্টুদের বাড়িটা বিল। গ্রামের এক প্রান্তে। ওদের বাড়ির পরে খোলা খাস জমি। তারপর কবরস্থান। মন্টুদের গ্রামটাকে অজপাড়াগাঁই বলা যায়। এখানো বিদ্যুৎ আসেনি। রাত নয়টার মধ্যে সারা গা ঘুমে ঢলে পড়ে। শুভ, রুবেন এবং দীপ শহরের ছেলে। রাত বারোটা/একটার আগে বিছানায় যেতে মন চায় না। ওদের। গ্রামটা খুব নিস্তব্ধ বলে গা ছম ছম করতে থাকে। এই মুহূর্তে চার বন্ধু। মিলেছে চিলেকোঠার ঘরে। হারিকেন জ্বলছে। ফিসফাস কথা চলছে।

শুভ চিলোকোঠার ছোট জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে বাইরেটা একবার দেখল। ওই দ্যাখ, পুরনো গোরস্তানটা এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, মন্টু। চাঁদের আলোয় কেমন ভৌতিক লাগছে।

শুভর দেখাদেখি মন্টু, দীপ আর রুবেনও উঁকি দিল জানালায়।

পাথরের সমাধিগুলো লক্ষ্য করেছিস? বলল দীপ। চাঁদের আলোয় ধবধব করছে। কংকালের মত।

দাদু ওই গোরস্তান নিয়ে অনেক রোমহর্ষক গল্প বলেছে আমাকে, জানায়। মন্টু। দাদু আজতক আমাকে ওখানে যেতে দেয়নি।

শুভ মন্টুর দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। গোরস্তানকে এত ভয় কিসের? মাটির নিচে কতগুলো কংকাল বৈলতা অন্যকিছু নেই ওখানে। তোর কি ধারণা গোরস্তানে গেলে কংকালগুলো কবর থেকে উঠে এসে তোর ওপর হামলে পড়বে?

সবাই এ কথায় হেসে উঠল। চটে গেল মন্টু। ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে বলল, তোর যদি এতই সাহস তা হলে যা না একবার গোরস্তানে। রাত দুপুরে ঘুরে আয়। দেখব হিম্মত।

সবাই ঘুরে তাকাল শুভর দিকে। হারিকেনের আলোটা একটু উস্কে দিল শুভ। ছায়াময় অন্ধকারে ওর চোখজোড়া চকচক করছে। অদ্ভুত হাসি ফুটল ঠোঁটে। বলল, গোরস্তানে যাওয়া আমার জন্যে কোন ব্যাপারই না। কখন যেতে হবে বল।

পারলে আজ রাতেই যা। রাত ঠিক বারোটায়, রীতিমত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসে মন্টু।

দরকার নেই বাপু রাত বিরেতে গোরস্তানে যাবার, ভয় পেয়ে গেছে রুবেন। ও একটু ভীতু প্রকৃতির। শেষে দাদু জানলে কেলেংকারী হবে।

দাদুকে তোরা না জানালে উনি জানবেন কি করে? বলল শুভ।

তবে তুই যে সত্যি গোরস্তানে গিয়েছিস আমরা জানব কি করে? বলল মন্টু। আমরা প্রমাণ চাই।

কি প্রমাণ চাস? জিজ্ঞেস করল শুভ। একটা আস্ত কংকাল নিয়ে আসব?

আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, এতক্ষণে কথা বলল স্বল্পভাষী দীপ। গোরস্তানের মাঝখানে একটা বার্চ গাছ আছে। দেখতে পাচ্ছিস সবাই? এ গ্রামের মধ্যে ওটাই একমাত্র বার্চ গাছ। শুভ যদি ওই গাছের একটা ডাল ভেঙে নিয়ে আসতে পারে তাহলেই বুঝব ও গোরস্তানে গিয়েছিল।

বেশ তাই হবে, বলল শুভ।

তাহলে আজ রাত বারোটায়? বলল মন্টু।

রাত বারোটায়, মাথা ঝাঁকাল শুভ।

যাসনে, কাঁদো কাঁদো গলায় রুবেন বলল। দরকার কি বাপু এত রাতে গোরস্তানে যাবার?

চিন্তা করিস না, বলল শুভ। তোরা এখানেই থাকবি। আমি রাত দুপুরে যে গোরস্তানে যেতে ভয় পাই না তা প্রমাণ করে ছাড়ব।

.

রাত পৌনে বারোটার সময় জ্যাকেট গায়ে গলিয়ে মন্টুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল শুভ। অক্টোবরের শেষ। ঢাকায় এখনো শীত পড়েনি। কিন্তু এখানে হিম বাতাসে গায়ে কাঁপুনি উঠে গেল শুভর। গোরস্তানে যাবার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে, গির্জার পাশ দিয়ে। মন্টুদের গ্রামে খ্রীস্টানদের সংখ্যাই বেশি। আর গির্জাটা প্রায় দুশো বছরের পুরানো। …গির্জার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শুভ, হঠাৎ টাওয়ারের ঘড়িটা গম্ভীর আওয়াজে বাজতে শুরু করল। রাতের নিস্তব্ধতা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল ঘণ্টা ধ্বনির শব্দে। এক… দুই… তিন… একটানা বেজে চলল ঘণ্টা। ঢং ঢং ঢং। শুভ গুণল নয়… দশ… এগারো… বারো। থেমে গেল ঘণ্টা ধ্বনি। শুভর সমস্ত শরীর কেন জানি হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে উঠল। ঘণ্টাধ্বনি ওর স্নায়ুর ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে এখন মাঝরাত, ব্যাপারটা উপলব্ধি করার পর একটু একটু ভয় করছে ওর।

গির্জার পাথুরে দেয়ালের পাশ দিয়ে হন হন করে এগোল শুভ। দেয়ালের শেষ মাথায় লোহার ছোট একটা বেড়া, খ্রীষ্টানদের গোরস্তানটাকে ঘিরে রেখেছে চারপাশ থেকে। গেটের দিকে এগোচ্ছে শুভ, খসখস শব্দ হলো পেছনে। যেন কেউ বা কিছু দেয়ালে গা ঘষে ঘষে আসছে। এক মুহূর্তের জন্যে থেমে দাঁড়াল শুভ, দমাদম হাতুড়ি পিটছে বুকে। হৃৎপিণ্ডটা লাফ দিয়ে চলে এসেছে গলার কাছে। মুখ তুলে চাইল ও। দূরে, কালো আকাশের পটভূমিকায় দেখা গেল মন্টুদের প্রকাণ্ড বাড়িটা। মিটমিট আলো জ্বলছে চিলেকোঠার ঘরে। আবছা কয়েকটা ছায়া দেখা যাচ্ছে না জানালার ধারে? কে জানে মন্টুরা হয়তো দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। দেখার চেষ্টা করছে শুভ সত্যি গোরস্তানে যাচ্ছে কিনা। নাহ্, থেমে দাঁড়ালে চলবে না, সিদ্ধান্ত নিল শুভ, এগোতে হবে।

লোহার বেড়ার গেট বন্ধ। শুভও তাই ভেবেছিল। বন্ধ থাকবে গেট। গোরস্তানের গেট সন্ধ্যার পরপর বন্ধ করে দেয়া হয়। বেড়ার ঠাণ্ডা, লোহার গরাদে হাত রাখল শুভ। ভাবছে কি করা যায়। হঠাৎ কয়েক কদম পিছিয়ে এল ও। তারপর দৌড় দিল। একলাফে বেড়ার ওপাশে। গোরস্তানের ভেজা, নরম ঘাসে ল্যাণ্ড করল ও।

মিনিট খানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল শুভ। আশেপাশের পরিস্থিতি বুঝে নেয়ার। চেষ্টা করছে। হঠাৎ সবকিছু ওর কাছে কেমন অন্যরকম মনে হতে লাগল। গোরস্তানের বাইরেটা নিজাব, প্রাণহীন লাগছে। কিন্তু বেড়ার ভেতরে-অন্যরকম। চাঁদের আলোয় সমাধি স্তম্ভগুলো বিশাল দেখাচ্ছে। কোন কোনটি ওর চেয়েও লম্বা। যেন ঝুঁকে আছে ওর দিকে, ওগুলো ঠাণ্ডা, সাদা মার্বেল পাথর চাঁদের আলোয় চক চক করছে।

দুপাশে কবর, মাঝখানে রাস্তা।

রাস্তা বলতে ঘাসে ছাওয়া, এবড়ো থেবড়ো আল। হাঁটছে শুভ। হঠাৎ ছোট একটা পাথরে হোঁচট খেল। দাঁড়িয়ে পড়ল। খসখস শব্দ হলো পেছনে। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল ও। কিছু নেই। একটা বড় সমাধি স্তম্ভ, তাতে পাথরের মুখ খোদাই করা, যেন তাকিয়ে আছে শুভর দিকে। ঘাড়ের পেছনের সমস্ত চুল সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল, গায়ে কাঁপুনি উঠে গেল শুভর। এবার শীতে নয়, ভয়ে।

ছুটল শুভ। কবরগুলোর মাঝ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। লক্ষ্য গোরস্তানের মাঝখানের বার্চ গাছ। নিজেকে বোঝাতে চাইছে আসলে খামোকা ভয় পাচ্ছে ও। পেছনে কিছুই নেই। কিন্তু প্রতিটি পা ফেলার সময় খসখস শব্দটা হয়েই চলেছে। অনেক কষ্টে আবার ফিরে তাকাল শুভ। পাথুরে কবর ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। মৃতদের পাহারা দিচ্ছে নীরবে।

অনেকটা ছোটার পর বার্চ গাছটাকে দেখতে পেল শুভ। চাঁদের আলোয় ওটার সাদা ডালপালাগুলো যেন জ্বলছে। আর কয়েক পা এগুলেই গাছটাকে ছুঁতে পারবে সে, ভাবল শুভ, তারপর একটা ডাল ভেঙে নিয়ে সোজা বাড়ি।

হঠাৎ নিচু, গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল বাতাসে, আঁতকে উঠল শুভ। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এল হিম স্রোত। ওটা কিছু নয়, নিজেকে সান্ত্বনা দিল শুভ, স্রেফ প্যাচার ডাক। মুখ তুলে চাইল ও। মাথার ওপর একটা গাছের মগডালে প্যাচাটাকে খুঁজল। কিন্তু ওখানে কোন প্যাচা নেই। গাছটার মাথার ওপর দিয়ে কালো এক টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। আবার দৌড় শুরু করল শুভ। বার্চ গাছের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, এমন সময় ছোট একটা সমাধি স্তম্ভে পা ঠেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ও। নাকে বোটকা একটা গন্ধ ঝাঁপটা মারল। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল শুভ। চাঁদ আবার কালো মেঘের আড়ালে চলে গেছে। আরো অন্ধকার এবং ভৌতিক লাগল গোরস্তান। সামনে কিছু দেখাই যায় না।

সামনে হাত বাড়িয়ে, অন্ধের মত হোঁচট খেতে খেতে এগোল শুভ। এদিকটাতে অন্ধকার। কিছু ঠাহর করা মুশকিল। হঠাৎ ডান হাতে শক্ত, ঠাণ্ডা কি যেন ঠেকল। বাম হাতটাও বাড়িয়ে দিল শুভ। দুহাতে ধরল এবার ঠাণ্ডা, শক্ত জিনিসটাকে। বার্চের ডাল হবে হয়তো। মনে মনে বলল শুভ। তারপর হ্যাঁচকা টান দিল। বিকট শব্দে ভেঙে জিনিসটা চলে এল শুভর হাতে। হঠাৎ কেন জানি খুব ভয় লেগে উঠল শুভর। শক্ত ডালটা বগলে চেপে ঘুরে দাঁড়াল ও। ছুটতে শুরু করল।

কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না শুভ। ও এখন মনেপ্রাণে গোরস্তান থেকে বেরিয়ে পড়তে চাইছে। সেই চাপা গোঙানির আওয়াজ ক্রমে বেড়ে চলেছে, সেই সাথে খসখসে শব্দটাও। ওটা যেন পিছু নিয়েছে ওর। অশুভ আশঙ্কায় বুক ধড়ফড় করে শুভর। অন্ধের মত ছুটছে ও। বার দুই ডিগবাজি খেয়ে পড়ল। কিন্তু বগলের নিচে চেপে রাখা বার্চের ডাল ছাড়ল না কিছুতেই। বন্ধুদেরকে দেখাতে হবে সে চ্যালেঞ্জ জিতেছে।

হঠাত্র গির্জার প্রকাণ্ড কাঠামোটা চোখের সামনে ফুটে উঠল। ওই তো লোহার বেড়া দেখা যাচ্ছে। বেড়া পার হতে পারলে আর কে পায় শুভকে। পিছিয়ে আসতে শুরু করল ও, এক দৌড়ে বেড়া পার হবে।

হঠাৎ কে যেন পেছনে থেকে খামচে ধরল জ্যাকেট। চিৎকার করে উঠল শুভ। জ্যাকেট ধরে ঝাড়া দিল। তারপর তাড়া খাওয়া খরগোশের মত ছুটল বেড়া লক্ষ্য। করে। এক লাফে বেড়ার ওপাশে।

বাড়ি না পৌঁছা পর্যন্ত দৌড় থামল না শুভর। এক ধাক্কায় দরজা খুলল ও, ছুটল চিলেকোঠার ঘরের দিকে। বার্চের ডালটা যথারীতি চেপে ধরে আছে বগলের নিচে।

বন্ধুরা অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে চিলেকোঠার ঘরে। আমি পেরেছি, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শুভ। এই দ্যাখ তোদের বাজির জিনিস নিয়ে এসেছি। বার্চের ডালটা মাথার ওপর উঁচু করে ধরল ও।

হঠাৎ চুপ হয়ে গেল সবাই। মন্টু, রুবেন বা দীপ কেউ কোন কথা বলছে না। ভয়ে রক্ত সরে গেছে সবার মুখ থেকে, বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে শুভর মাথার দিকে। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে শুভও তাকাল সেদিকে। এবং জমে গেল ভয়ে।

শুভ দেখল সে বার্চের ডাল মনে করে যে জিনিসিটা নিয়ে এসেছে সেটা ডাল নয়… সে উঁচু করে ধরে আছে কংকালের একটা হাত… শুকনো, খটখটে হাড়ের আঙুলগুলো শুভর মাথার ওপর মৃদু হাওয়ায় দুলছে, যেন ওকে খামচে দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *