অতৃপ্ত প্রেতাত্মা

অতৃপ্ত প্রেতাত্মা

আমি ডুবে যাচ্ছি! আমি ডুবে যাচ্ছি!

পানিতে ছিটকে পড়ার সাথে সাথে আতঙ্কিত হয়ে উঠল চেলসি এমারসন। মনে মনে আকুতি করে উঠল, আমি মরতে চাই না।

কিছুক্ষণ আগে, ন বছরের মেয়েটি তার বাবা-মার চল্লিশ ফুট লম্বা সেইল বোট সী ইয়ার ডেকে শুয়ে সূর্যস্নান করছিল। বোট নোঙর করা ছিল ওয়াকার্স বে তে, এটা বাহামার ছোট একটা দ্বীপ থেকে সিকি মাইল দূরে। চেলসি সাঁতার প্রায় জানেই না, ওর লাইফ জ্যাকেট পরে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ডেকে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল চেলসি। ঘুম ঘুম চোখে জেগে ওঠে ও, ভেষ্ট গায়ে চাপানোর বদলে হাতে ধরে রেখেছিল।

ইয়টের পেছনে, ডেকের ওপর হাঁটতে হাঁটতে কতগুলো পেলিক্যান পাখির উড়ে যাওয়া দেখছিল চেলসি। লক্ষ্য করেনি কোনদিকে যাচ্ছে। ডেকে গুটিয়ে রাখা রশিতে পা বেঁধে হোঁচট খায় ও, মাথাটা দারুণভাবে ঠুকে যায় ডেক ঘিরে রাখা রেইলিং-এ, প্রায় জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা হয় চেলসির। হাত থেকে খসে পড়ে লাইফ জ্যাকেট, টলতে টলতে কয়েক পা এগিয়েছিল চেলসি, তারপর রেইলিং থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যায় ক্যারিবিয়ানের নীল-সবুজ পানিতে।

পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডুবে গিয়েছিল চেলসি। বুঝতেই পারেনি কী ঘটছে। নাকে পানি ঢুকতে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল ও, বাঁচার তাগিদে পানিতে দ্রুত হাত চালাতে লাগল ওপরে ভেসে ওঠার জন্যে। পানির ওপরে ওঠো, নিজেকে নির্দেশ দিল চেলসি। বাতাস দরকার তোমায়। না হলে মরে যাবে। পা চালাও চেলসি, পানিতে লাথি মারো! ভুস করে ভেসে উঠল ও, মুখ হাঁ করে বাতাস টানতে লাগল হাঁপাতে হাঁপাতে। কিন্তু সাহায্যের জন্যে চিৎকার করার আগে আবার পানির নিচে ডুবে গেল চেলসি।

ভেসে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করল মেয়েটা, আতঙ্কে তালগোল পাকিয়ে গেল মাথা। পানিতে পড়লে কীভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে সে কথা একদম ভুলে গেল। শান্ত থাকতে পারছে না ও… চিৎ হয়ে শ্বাস বন্ধ করে থাকলে আপনা আপনি ভেসে উঠবে সারফেসে, এ কথা মনেই নেই। চেলসি শুধু বুঝতে পারছে ও পানির তলায় তলিয়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যু অবধারিত।

হঠাৎ করেই কোত্থেকে যেন শরীরে শক্তি ফিরে পেল চেলসি। জানে হাতে সময় কম। সাগরের সাথে যুদ্ধে হেরে যাবার আশংকাই বেশি। শেষ চেষ্টা করল ও। ওপরে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিল বাঁচাও! বাঁচাও! বলে। কিন্তু সে চিৎকারে জোর নেই। ইয়টে ঘুমিয়ে থাকা চেলসির বাবা-মার কানে পৌঁছুল না মেয়ের মরণ আর্তনাদ।

কেউ সাহায্য না করলে বাঁচতে পারবে না এতক্ষণে বুঝে গেছে চেলসি। আবার পানির নিচে তলিয়ে গেল ও, দম বন্ধ করে রইল। কিন্তু কতক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে থাকা যায়? ফুসফুসে যেন আগুন ধরে গেল। আর পারব না আমি। সব শেষ। এবার সত্যি মারা যাচ্ছি আমি। লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা বাদ দিল হতাশ চেলসি।

হঠাৎ, ভোজবাজির মতো কে যেন চেলসির টি-শার্ট ধরে টানতে লাগল, ওকে উপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পানিতে ভেসে ওঠার পরে বেদম কাশতে লাগল চেলসি। মুখ হাঁ করে বাতাস টানছে। ফুসফুসের আগুন নিভে গেল নিশ্বাস নিতে পেরে। ওহ্, থ্যাঙ্ক গুডনেস, কেউ আমাকে বাঁচিয়েছে। বিদ্বস্ত এবং প্রচণ্ড রকম দুর্বল চেলসি শুধু কোনোমতে বলতে পারল আমাকে ছেড়ে চলে যেয়ো না, তারপর ঘুরল ও। দেখবে কে তার রক্ষাকর্তা। যাকে দেখল তাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না চেলসির।

কোনো মানুষ নয়- ওটা একটা তামাটে রঙের জার্মান শেফার্ড কুকুর। টি শার্ট কামড়ে ধরেছিল কুকুরটা। ছেড়ে দিল। চেলসি পাগলের মতো ওটার পেছনের একটা পা চেপে ধরল। জোরে জোরে পা দিয়ে স্ট্রোক মেরে মেরে ধীরে ধীরে সাঁতার কাটতে শুরু করল কুকুর, চেলসিকে নিয়ে এগোল তীরের দিকে।

অগভীর পানিতে পৌঁছে কুকুরটাকে ছেড়ে দিল চেলসি, হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পড়ল তীরে, একটা পাথরের স্তূপের পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান ফিরল জার্মান শেফার্ডের জিভের স্পর্শে। ওর মুখ জিভ দিয়ে চাটছে কুকুরটা।

চেলসি জড়িয়ে ধরল কুকুরটার গলা। বারবার বলতে লাগল, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। প্রত্যুত্তরে লেজ নেড়ে সরে গেল কুকুর। তাকাল সী ইয়ার দিকে। উঁচু গলায় ডাকতে লাগল। চেলসি এখনো হাঁপাচ্ছে। বালুতে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকল ও। কুকুরটার ঘেউ ঘেউ থামার পরে উঠে বসল। দেখল চলে গেছে শেফার্ড। চারদিকে চোখ বুলাল ও। কোথাও চিহ্ন নেই ওর রক্ষাকর্তা কুকুরের।

এদিকে, সেইলবোটে, চেলসির বাবা-মা কেন এবং অ্যালেন ঘুম ভেঙে দেখলেন তাদের কন্যা লাপাত্তা। ডেকের ওপরে, নিচে মেয়েকে কোথাও না পেয়ে– তারা উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন, চেলসি! চেলসি! কোথায় তুমি?

হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন কেন। ষ্টার্নে চেলসির জ্যাকেট আছে শুধু। ও নেই।

মেয়ে আমার পানিতে পড়ে যায়নি তো! আঁতকে উঠলেন এলেন। তাঁরা এবার উন্মাদের মতো ডাকাডাকি শুরু করলেন মেয়ের নাম ধরে।

সাগর তীর বসে চেলসি শুনতে পেল ওদের ডাক। হাত উঁচু করে সে চেষ্টাতে শুরু করল, এই যে আমি এখানে!

ওই তো চেলসি! আনন্দে অ্যালেনের কেঁদে ফেলার জোগাড়। সাগর তীরে। ও গড। ও বেঁচে আছে!

লাফ মেরে নিজেদের ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বসলেন কেন ও অ্যালেন, দ্রুত বৈঠা মেরে এগোলেন তীরের দিকে। ভীত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁরা, তীরে পৌঁছেই।

চেলসি, কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন বাবা। তুমি ঠিক আছ তো?

কেঁদে ফেলল চেলসি। আমি ইয়ট থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যাই … ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে চলল ও।…ডুবে যাচ্ছিলাম… মনে হচ্ছিল মরে যাব… এমন সময় বিশালদেহী একটা কুকুর এসে আমাকে উদ্ধার করে। বলে হুহু করে কাঁদতে লাগল ও। অনেকক্ষণ কান্নার পরে বুকটা হালকা হলো চেলসির, কিভাবে রক্ষা পেয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিল।

ঘটনাটা অদ্ভুত, সোনা, বললেন অ্যালেন। চেলসি লক্ষ্য করল বাবা-মা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন। বোঝাই যায় চেলসির গল্প বিশ্বাস করেন নি তারা।

আমার কথা বিশ্বাস হয়নি তোমাদের, না? জিজ্ঞেস করল চেলসি।

তুমি সুস্থ আছ সেটাই যথেষ্ট, বললেন কেন।

কুকুরটাকে দেখেছ তোমরা? জানতে চাইল ছোট্ট মেয়েটি। ওর ডাক শুনেছ?

না সোনা, শুনিনি, জবাব দিলেন অ্যালেন।

ওটা বড় একটা জার্মান শেফার্ড, বলল চেলসি। কালো, গায়ে গাঢ় বাদামী দাগ। কই যে গেল কুকুরটা!

বোটে চলল, বললেন মা।

সেদিন দুপুরে চেলসি নিচের ডেকে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, শুনল বাবা-মা ওর সাগরে পড়ে যাবার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছেন।

আসলে কী ঘটেছিল বলে তোমার মনে হয়, কেন?

কোনো কুকুর যে ওকে উদ্ধার করেনি তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই, বললেন কেন। এদিকের উপকূলে অন্য কোনো বোট চোখে পড়েনি আমার। সাগর তীর খা খা করছে। যদিও দ্বীপের ওদিকটাতে একটা গ্রাম আছে। কিন্তু বালুতে আমি কোনো কুকুরের পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি।

ঢেউয়ের কারণে পায়ের ছাপ মুছে যেতে পারে।

যদি সত্যি কুকুরটা পানির ধারে গিয়ে থাকে, তাহলে। সাগর সৈকত খুবই দীর্ঘ এবং খালি। কুকুরটাকে আমাদের চোখে পড়া উচিত ছিল-যদি না ওটা পানিতে সাঁতরে যায়। আর কোনো কুকুরই অমন কাজ করবে না।

কুকুরই যদি না ছিল তাহলে চেলসিকে রক্ষা করল কে?

আমার ধারণা চেলসি আতঙ্কিত হয়ে কুকুরের কথা ভেবেছে। ভেবেছে একটা কুকুর তাকে উদ্ধার করেছে। আসলে সে নিজের চেষ্টায় তীরে এসে পৌঁছেছে।

আর সহ্য হলো না চেলসির। সে দৌড়ে উঠে এল ওপরের ডেকে। গলা ফাটিয়ে বলল, তোমরা কে কী ভাবছ তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি জানি আসলে কী ঘটেছে। একটা জার্মান শেফার্ড রক্ষা করেছে আমার জীবন!

.

প্রায় আধা মাইল দূরে, ওয়াকার্স বের অপর প্রান্তে, ১২ বছরের র‍্যাচেল কাজ সাঁতার কাটার জন্যে বেরিয়ে পড়ল ওদের ভাড়া করা বীচ হাউজ থেকে। ওর পায়ে ফ্লিপার মাস্ক আর স্মরকেল। ছুটি শেষ হবার আর মাত্র একদিন বাকি। তারপর ওরা ফিরে যাবে নিজেদের বাড়িতে। র‍্যাচেল ছুটির শেষ সময়টুকু যতটা সম্ভব সাগরে সাঁতার কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নাস্তা খেতে ব্যস্ত, র‍্যাচেল নেমে পড়ল সাগরে। ও খুব ভালো সাঁতার জানে। তীর থেকে পঁচাত্তর গজের মতো দূরে, একটা কোরাল রীফের দিকে এগিয়ে চলল ও। উপুড় হয়ে সাঁতার কাটছে র‍্যাচেল। চোখে পড়ল একটা ষ্টার ফিশ। ছয় ইঞ্চি লম্বা বাহু দিয়ে একটা চিংড়ি মাছ ধরে আছে ওটা। ষ্টার ফিশটাকে ভালো করে দেখার জন্যে গভীর দম নিয়ে পানির নিচে ডুব দিল র‍্যাচেল। ষ্টার ফিশের কাছে এসেছে, একটা ছায়া দেখতে পেল ও সাগর তলে। আতঁকে উঠল র‍্যাচেল। মাই গড! ওটা নির্ঘাৎ হাঙর। কিন্তু পরক্ষণে ভুল ভেঙে গেল ওর। ভালো করে তাকাতে দেখল হাঙর নয়, ওটা একটা কুকুর।

পানির ওপরে উঠে এল র‍্যাচেল, খুলে ফেলল মাস্ক। দেখল ওর কাছ থেকে ত্রিশ গজ দূরে তামাটে রঙের, গায়ে গাঢ় বাদামী ফুটকিঅলা একটা জার্মান শেফার্ড দ্রুতগতিতে সাঁতার কাটছে।

কুকুরটার পিছু পিছু সাঁতরাতে শুরু করল র‍্যাচেল। মনে পড়ে গেল বাবা-মাকে কথা দিয়েছে রীফ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না ও। তাই পানিতে মাথা তুলে থাকা একখণ্ড পাথরের ওপরে উঠে বসল র‍্যাচেল।

কুকুরটা যাচ্ছে কোথায়? অবাক হয়ে ভাবল ও। উজ্জ্বল সূর্যালোকে চোখ ঝলসে যায়। র‍্যাচেল কপালের ওপর হাত রেখে ভুরু কুঁচকে তাকাল দিগন্তরেখার দিকে। আর কোনো ডাইভার বা সাঁতারু চোখে পড়ল না। আধখানা চাঁদের মতো বে-র ওধারে একটা ইয়ট ছাড়া অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছে না র‍্যাচেল। লক্ষ্য করল একজন নারী আর একজন পুরুষ ইয়ট থেকে লাফিয়ে নামল একটা ডিঙিতে, তীরের দিকে এগোতে লাগল। ওখানে ছোট একটা মেয়ে ওদের দিকে হাত তুলে নাড়ছে। র‍্যাচেল অনুমান করল কুকুর এবং ওই মানুষগুলোর মধ্যে সম্ভবত কোনো সম্পর্ক নেই।

শিস দিল র‍্যাচেল। অ্যাই, কুকুর, এদিকে এসো। আবার শিস দিল ও, কিন্তু গতিপথ বদলাল না জার্মান শেফার্ড। একমনে সাঁতার কেটেই চলেছে।

হঠাৎ কুকুরটা ডেকে উঠল। পরপর তিনবার। খুশি খুশি গলা। যেন প্রভুকে বাড়ি ফিরে আসতে দেখেছে তার পোষা জানোয়ার। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল পানির নিচে।

কুকুরটা কই গেল? ওর কিছু হয়নি তো? কুকুরটার আবার দেখা মিলবে সে আশায় রইল র‍্যাচেল। কিন্তু এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট গেল, তবু দেখা নেই ওটার।

ওহ্, মাই গড! চিৎকার করে উঠল র‍্যাচেল। কুকুরটা নির্ঘাৎ ডুবে মরেছে!

পাথরখণ্ড থেকে লাফিয়ে পানিতে নেমে পড়ল ও, ফিরে এল তীরে। তারপর এক ছুটে বাড়িতে। মা! বাবা! আমি বিরাট একটা কুকুর দেখেছি-জার্মান শেফার্ড-সাগরে সাঁতার কাটছিল। তারপর হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল পানির নিচে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ওটাকে আর ভেসে উঠতে দেখলাম না। কুকুরটা ডুবেই গেল কি না! খোঁজ নিয়ে দেখব একবার?

দেখো। বললেন ওর বাবা। তবে জেট স্কি ব্যবহার কোরো।

কিছুক্ষণ পরে র‍্যাচেলের সঙ্গে বাবাও বেরিয়ে পড়লাম। যেখানে কুকুরটাকে শেষ মুহূর্তে দেখা গেছে, সে জায়গায় খোঁজাখুঁজি চালালেন। কিন্তু কোনো চিহ্ন নেই জার্মান শেফার্ডের। তীরে ফিরে এলেন ওরা। র‍্যাচেল অবাক হয়ে ভাবতে লাগল কুকুর সাগরে সাঁতার কাটতে যাবে কেন?

.

সেদিন সন্ধ্যায় দ্বীপের ওধারের শহুরেবাসীরা তাদের গ্রামের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি বীচ পার্টির আয়োজন করল। খোলা আকাশের নিচে তৈরি করা হলো উনুন, আগুনে ঝলসাতে লাগল শামুক আর মাছের কাবাব। একটি ব্যাণ্ড দল বাজাচ্ছে রেগে সঙ্গীত, আর সব বয়সের মানুষ বাজনার তালে তালে নাচছে।

ওই পার্টিতে চেলসির সাথে পরিচয় হলো র‍্যাচেলের। এক বাহামিয়ান মহিলা র‍্যাচেলের কালো চুলে চমৎকার বিনুনি করে দিয়েছিল। ওটা দেখে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল চেলসি।

তোমার চুলের বিনুনি খুব সুন্দর হয়েছে, চেলসি বলল র‍্যাচেলকে। বিশেষ করে রঙিন পুঁতির কারণে আরো বেশি ভালো লাগছে।

ধন্যবাদ, বলল র‍্যাচেল। বাহামায় আজকেই আমার শেষ রাত। তাই অন্যরকম একটু সাজলাম আর কি। এরপর মেয়ে দুটি গল্পে মেতে উঠল। কে কিভাবে ছুটি কাটিয়েছে, কী রকম মজা করেছে এসব আর কি।

চেলসি তার নতুন বন্ধুর কাছে গল্প করছে দ্বীপের কোন্ কোন্ জায়গায় সে ঘুরেছে, র‍্যাচেলের চোখ আটকে গেল একটা জার্মান শেফার্ডের ওপর-তামাটে রঙের, গায়ে বেগুনি দাগ-ভিড়ের মাঝখানে দ্রুত পায়ে হাঁটছে।

সাগরে যে কুকুরটাকে আজ দেখেছি ওটা কি সেটা? ভাবছে র‍্যাচেল। চেহারা তো সেরকমই মনে হচ্ছে। যাক, ওটা সুস্থ আছে জেনে ভালো লাগছে। যাই, ভালো করে দেখে আসি কুকুরটার কী অবস্থা।

একটু উঠব, চেলসি, বলল র‍্যাচেল, ওই কুকুরটাকে দেখে আসি।

র‍্যাচেলের চোখ অনুসরণ করে চেলসিও দেখতে পেল জার্মান শেফার্ডকে। আরে ওই তো সে-ই! সেই কুকুরটা!

কুকুরটাকে দেখেছ আগে?

হ্যাঁ। সে এক লম্বা গল্প। আজ সকালে ও-ই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। চলো তো যাই।

ছুটল ওরা। কুকুরটার পিছু নিল। ওটা একটা গলিতে বাঁক নিল। দাঁড়াল ঝকঝকে সবুজ রঙের একটা বাড়ির সামনে। বাড়িটির জানালাগুলো নীল। কুকুরটা এক লাফে সামনের বারান্দায় উঠল, শুয়ে পড়ল ওখানে।

সাবধানে কুকুরটার দিকে পা বাড়াল ওরা। লেজ নাড়ছে কুকুর। ওরা হাত বুলিয়ে দিল গায়ে। কিছু বলল না জার্মান শেফার্ড। চুপচাপ আদর খেতে লাগল। এটাই সেই কুকুর কি না ঠিক বুঝতে পারছি না, বলল চেলসি।

মানে?

চেলসি তখন গল্পটা খুলে বলল র‍্যাচেলকে। জানাল কীভাবে সেইল বোট থেকে পড়ে গিয়েছিল ও। ডুবে মারা যাচ্ছিল, একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর ওকে জামা ধরে টেনে তীরে পৌঁছে দেয়। তারপর অদৃশ্য হয়ে যায় ওটা।

আশ্চর্য তো! চেঁচিয়ে উঠল র‍্যাচেল। আমি ওই একই রকম তামাটে বর্ণের, গায়ে বাদামী ফুটকিঅলা একটা কুকুরকে দেখেছি। সাগরে সাঁতার কাটছিল। তারপর ঘেউ ঘেউ করতে করতে ওটা পানির নিচে চলে যায়। আর দেখিনি ওটাকে। জার্মান শেফার্ডকে ভালো করে দেখল র‍্যাচেল। তবে এটা সেই কুকুরটা নাও হতে পারে। এটাকে ওটার চেয়ে আকারে ছোট লাগছে দেখতে। আর গায়ের রঙও বেশি গাঢ়।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে লাফিয়ে উঠল দুই কিশোরী। লাফ মেরে সিধে হলো কুকুর, শুরু করে দিল ঘেউ ঘেউ। বিশাল শরীরের এক বাহামিয়ান মহিলা, মাথায় গোলাপ রঙের স্ট্র হ্যাট এবং একই রঙা ফুলতোলা কাপড় পরা, পা রাখল বারান্দায়।

হ্যালো, মেয়েরা, কুকুরটার দিকে ফিরল মহিলা, মিস মলি, তুমি কি এই সুন্দর মেয়েদুটিকে এখানে নিয়ে এসেছ?

একরকম তাই, বলল চেলসি ওর পিছু নিয়ে এসেছি আমরা। আজ সকালে পানিতে ডুবে মরার হাত থেকে একটা কুকুর প্রাণ বাঁচিয়েছে আমার। অনেকটা এটার মতো দেখতে।

র‍্যাচেল বলল, সকাল বেলায় সাগরে সাঁতার কাটার সময় আমিও এরকম একটা কুকুর দেখতে পাই। হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায় সে। ভেবেছিলাম ডুবে গেছে। আপনার কুকুরটাকেই বোধহয় দেখেছিলাম।

আচ্ছা! অবাক বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল মহিলার চোখ। ভারী অদ্ভুত তো! বারান্দায় বসতে বলল সে ওদেরকে। তোমাদের রহস্যের একটা সমাধান হয়তো দিতে পারব। তবে বিশ্বাস করা না করা তোমাদের ইচ্ছে।

কাঠের রকিং চেয়ারে বসল মহিলা। তার প্রকাণ্ড শরীরের ওজনে কাঁচক্যাচ করে আর্তনাদ ছাড়ল চেয়ার। আগে পরিচয় পর্বটা সেরে নিই। আমি জ্যানেল। তোমরা?

চেলসি ইমারসন।

র‍্যাচেল কাৎজ।

তাহলে, চেলসি, আজ সকালে তোমাকে একটা জার্মান শেফার্ড প্রাণ বাঁচিয়েছে আর র‍্যাচেল তুমি একই কুকুরকে দেখেছ সাগরে সাঁতার কাটতে? চেয়ারে দুলতে দুলতে প্রশ্ন করল মহিলা। তারপর আপন মনে বলল, সেদিন হয়তো এসে হাজির হয়েছে। হ্যাঁ, এতদিন পরে অবশেষে মুক্তি ঘটতে পারে তার।

আপনি কী বলছেন? জিজ্ঞেস করল র‍্যাচেল।

মেয়েরা, তোমাদেরকে আমি হতাশ করতে চাই না। তবে আজ সকালে তোমরা যে কুকুরটাকে দেখেছ সে মিস মলি নয়। মিস মলি বোধহয় পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র জার্মান শেফার্ড যে পানিকে ডরায়। অথচ সে এই ছোট্ট দ্বীপে বাস করছে যার চারদিকে সমুদ্র।

দোল খাওয়া বন্ধ করল জ্যানেল, চেয়ারটা টেনে নিয়ে এল মেয়েদের কাছে। ফিসফিস করে বলল, তোমরা যাকে দেখেছ, আমি নিশ্চিত, সে সেবা-ভূত সেবা।

ভূত? আঁতকে উঠল ওরা একসঙ্গে।

মিথ্যা বললে আমার কালো চুল সোনালি হয়ে যাবে। হ্যাঁ, দ্বীপের দূর প্রান্তে, সেবাকে সাগরে দেখা গেছে, দেখা গেছে সাগর-সৈকতেও। আর সেটা ১৮৮০ সালের শেষ দিক থেকেই দেখা যাচ্ছে। শুনবে সেই ঘটনা?

একসাথে মাথা ঝাঁকাল ওরা।

রিচমণ্ড নামে একটা জাহাজ কিউবা থেকে বারমুডা যাচ্ছিল। জনা কুড়ি ছিল তার যাত্রী, উইনচেষ্টার পরিবারসহ। এ পরিবারে ন্যান্সি আর পলি নামে স্কুলছাত্রী দুই বোন ছিল। বাবা-মার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছিল। আর ওদের সঙ্গী ছিল একটি জার্মান শেফার্ড। নাম সেবা। ওদের বাবা রপ্তানীর ব্যবসা করতেন। পরিবার নিয়ে বারমুডা যাচ্ছিলেন।

সুন্দর একটি দিনে যাত্রা শুরু হয় ওদের। দখিনা বাতাসের সাথে অনুকূল স্রোত পেয়ে তরতর করে এগিয়ে চলছিল জাহাজ। কিন্তু জাহাজের ক্রু কিংবা যাত্রীদের কেউই জানত না প্রায় ৫০০ মাইল দূর থেকে ভয়ঙ্কর গতিতে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড়। বাহামা চ্যানেল ধরে দ্রুত এগোচ্ছিল ঝড়টা। কিউবা থেকে রওনা হবার দিন দুই পরে অশান্ত হয়ে উঠল সাগর, আকাশের রঙ বদলে গেল হঠাৎ। এক বুড়ো নাবিক সুর করে বলতে লাগল, সকালে যদি থাকে আকাশ লাল, কপালে আছে অশেষ আকাল। রাতে যদি লাল হয় আকাশ, নাবিক পায় নিশ্চিত আশ্বাস। তো সে সকালে আকাশের রঙ লাল বর্ণই ছিল।

রিচমণ্ডের যাত্রীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হামলা করে বসল হারিকেন। সে কী প্রচণ্ড ঝড়! কুদ্ধ নেকড়ের মতো গর্জাচ্ছিল বাতাস। রাগী দানবের হাত হয়ে উঠেছিল যেন সাগরের ঢেউ, ভীষণ বেগে আছড়ে পড়ছিল জাহাজের গায়ে, ওটাকে নাকানি-চোবানি খাওয়াচ্ছিল ইচ্ছে মতো।

উইনচেষ্টার পরিবার তাদের কুকুরকে নিয়ে নিচের ডেকে আশ্রয় নিল। শুনতে পেল মাথার ওপর মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ছে মাস্তল। পাল-টাল কোথায় উড়ে গেল বাতাসের তোড়ে। জাহাজটার বাঁচা-মরা পুরোপুরি নির্ভর করছিল ঝড় থেমে যাবার ওপর।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভয়ঙ্কর ঝড় ইচ্ছেমতো খেলল রিচমকে নিয়ে। দ্বীপের অগভীর পানিতে মাথা উঁচিয়ে থাকা পাথরখণ্ডের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে জাহাজের মারাত্মক ক্ষতি হলো। মি: উইনচেষ্টার কাঠের টুকরোর সঙ্গে রশি দিয়ে মেয়েদেরকে বেঁধে ফেলতে লাগলেন। সাগরে পড়ে গেলেও যাতে ওরা ডুবে না। যায়। কিন্তু কাজটা শেষ করার আগেই প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে রীফের গায়ে। আছড়ে পড়ল জাহাজ, নারকেলের ভাঙা খোলের মতো দুটুকরো হয়ে গেল। কাঠের জাহাজ-এর কার্গো আর যাত্রীরা ধাক্কার চোটে ছিটকে পড়ে গেল ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে।

ন্যান্সি আর পলি আঁকড়ে ধরে রইল সেবাকে। কিন্তু পাহাড় সমান ঢেউ ছিনিয়ে নিয়ে গেল কুকুরটাকে ওদের কাছ থেকে। সেবা কাঠের ভাঙা টুকরোগুলো খুঁজছিল। দেখল একটা টুকরো ধরে তারস্বরে কাঁদছে ন্যান্সি। সাহায্য চাইছে আর্তস্বরে। টুকরোটা বারবার পিছলে যাচ্ছে হাত থেকে। শেষে হাল ছেড়ে দিল ও।

সেবা প্রাণপণে সাঁতরে পৌঁছে গেল ন্যান্সির কাছে। ন্যান্সি কুকুরটার পেছনের পা ধরে ফেলল। সেবা সাঁতার কেটে চলে এল তীরে, ওখানে পৌঁছে পরিশ্রমে আর ভয়ে নেতিয়ে পড়ল ন্যান্সি।

ঠিক এভাবেই কুকুরটা আমাকে বাঁচিয়েছে আজ সকালে, বলল চেলসি।

তো কী বলছিলাম? ওহ্, হ্যাঁ সেবার কথা। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সেবা। তবে কান খাড়া ছিল ওর। শুনতে পেল আরেকটা মেয়ের ক্ষীণ আর্তনাদ।

পলি? জিজ্ঞেস করল র‍্যাচেল।  

হ্যাঁ। ছোট্ট পলি ভাঙা মাস্তল আঁকড়ে ধরে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু তীব্র স্রোত ওকে মাঝ সাগরে টেনে নিয়ে। যাচ্ছিল। সেবা প্রবল ক্লান্তি সত্ত্বেও আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। পলিকে উদ্ধার করতে ছুটল।

এদিকে ন্যান্সি অপেক্ষা করছিল তার বোনের জন্যে। সেবাকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে দেখেছে সে। যেন জানত পলিকে উদ্ধার করে আনবেই সেবা কিন্তু হায় তা আর হলো না। সেবা বা পলি কেউই আর ফিরে এল না।

মাথা নাড়ল র‍্যাচেল। ইস, কী দুঃখজনক ঘটনা!

হ্যাঁ। সত্যি দুঃখজনক ঘটনা ছিল ওটা। ন্যান্সি বেচারীর কী দশা দেখো। বেচারী তার বাবা-মা, বোন এবং কুকুরটাকে হারিয়েছে। অন্যান্য যাত্রীদের লাশ ভেসে এসেছিল তীরে। তবে পলিকা সেবার লাশ খুঁজে পায়নি কেউ।

এর সাথে আমাদের কী সম্পর্ক? জানতে চাইল চেলসি।

সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ওই ভয়ংকর ঝড়ের পরে, ওয়াকার্স বে তে প্রতি বছর একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যেতে লাগল। জেলে, ট্যুরিষ্ট বা এরকম অনেকেই দেখল তামাটে রঙের, বাদামী ফুটকিঅলা একটা জার্মান শেফার্ড সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

সেবার ভূত? জিজ্ঞেস করল র‍্যাচেল।

হা, সেবার ভূত। আমাদের দ্বীপের অনেকের বিশ্বাস সেবা একটি অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। ছোট্ট পলির খোঁজে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেবে দেখ, একটা কুকুর তার মনিবের মেয়েকে এতই ভালোবাসত যে মৃত্যুর পরেও তাকে ভুলতে পারেনি।

ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও প্রশ্নটা করি- আপনার কি ধারণা সেবাই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে? প্রশ্ন করল চেলসি।

ধারণা? আমি নিশ্চিত ওটা সেবা ছিল।

আপনি বলেছিলেন সেদিন হয়তো এসে হাজির হয়েছে। হ্যাঁ, এতদিন পরে অবশেষে মুক্তি ঘটতে পারে। মানে কী এ কথার? জানতে চাইল র‍্যাচেল।

আমার ধারণা অতৃপ্ত প্রেতাত্মাদের অসম্পূর্ণ কিছু কাজ থাকে, ব্যাখ্যা করল জ্যানেল। সে কাজ শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পায় না তাদের আত্মা। সেবার আত্মাও অতৃপ্ত ছিল সে পলিকে রক্ষা করতে পারেনি বলে। একশ বছর ধরে তার আত্মা ঘুরে মরেছে অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করার জন্যে। তারপর চেলসির ঘটনাটা ঘটল। সে বোট থেকে পড়ে গেল। ডুবে মরতে যাচ্ছিল। সেবা এসে তাকে বাঁচাল। রক্ষা করল একটি বাচ্চা মেয়ের জীবন। আর পানিতে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন রইল না সেবার। তার আত্মা মুক্তি পেল এতদিন পরে।

কিন্তু কুকুরটাকে আমিও দেখেছি, বলল র‍্যাচেল। আর সেটা চেলসি উদ্ধার পাবার পরে।

আমার ধারণা তুমি যে সেবাকে দেখেছ সে ছিল ১০০ বছরের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সেবা। একটা কথা জিজ্ঞেস করি? অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে কি ঘেউ ঘেউ করেছিল কুকুরটা?

জ্বি, জবাব দিল র‍্যাচেল।

তার মানে পৃথিবীর কাছ থেকে চির বিদায় নিয়েছে সে, বলল জ্যানেল। আর কেউ কোনোদিন দেখতে পাবে না তাকে। তার আত্মা এখন বাস করছে শান্তিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *